বেরিয়ে এসে ক্লের প্যারিসের পোড়া পেট্রলভরা বাতাসে লম্বা দম নিয়ে বললেন, ‘বাঁচলাম। কিন্তু এখনো তো অনেক সময় বাকি। কোথায় যাই বলুন তো?’
দেশে থাকতে আমি ম্যালেরিয়ায় ভুগতুম। সব সময় সব কথা শুনতে পাইনে।
ক্লের বললেন, ঠিক ঠিক, মনে পড়েছে। সিনেমার কাছেই খোলা হাওয়ায় একটা রেস্তোরাঁ আছে। আপনার ডিনার হয়ে যায়নি তো?
বাঙালির বদ অভ্যাস আমারও আছে। ডিনার দেরিতে খাই। তবু ফাঁড়া কাটাবার জন্য বললুম, আমি ডিনার বড় একটা—’
বাধা দিয়ে ঢের বললেন, আমিও ঠিক তাই। মাত্র এক কোর্স খাই। সুপ না, পুডিং। রাত্রে বেশি খাওয়া ভারি খারাপ। অগস্টের প্যারিস ভয়ঙ্কর জায়গা।
ততক্ষণে ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে। প্যারিসের ট্যাক্সিওলারা ফুটপাথে মেয়েদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে গাহক কি না ঠিক ঠিক বুঝতে পারে।
জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলুম রবীন্দ্রনাথ কত বেদনা পেয়ে লিখেছিলেন:
‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ।’
নিশ্চয়ই ট্যাক্সি চড়ে গিয়েছিলেন, মিটার খারাপ ছিল এবং ভাড়াও আপন ট্যাক থেকে দিতে হয়েছিল। না হলে গানটার কোনো মানেই হয় না। পায়ে হেঁটে গেলে দু মাইল চলতে যা খর্চা, দু লক্ষ মাইল চলতেও তাই।
বাহারে রেস্তোরাঁ। কুঞ্জে কুঞ্জে টেবিল। টেবিলে টেবিলে ঘন সবুজ প্রদীপ। বাদ্যিবাজনা, শ্যাম্পেন, সুন্দরী, হীরের আংটি আর উজির-নাজির-কোটাল। আমার পরনে গ্রে ব্যাগ আর ব্লু ব্লেজার। মহা অস্বস্তি অনুভব করলুম।
ক্লের ওয়েটারকে বললেন, কিছু না, শুদু ‘অর দ্য ভর।
‘অর দ্য ভর’ এল। বিরাট বারকোষে ডজনখানেক ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য খোপেখখাপে সাজানো। সামোন মাছ, রাশান স্যালাদ, টুকরো টুকরো ফ্রাঙ্কফুর্টার, টোস্ট-সওয়ারকাভিয়ার, ইয়োগু (দই), চিংড়ি, স্টাক্ট অলিভ, সিরকার পেঁয়াজ—এককথায় আমাদের দেশের সাড়ে বত্রিশ ভাজা। তবে দাম হয়তো সাড়ে বত্রিশশ গুণেরও বেশি হতে পারে।
একেই বলে ‘এক কোর্স খাওয়া!’ কোথায় যেন পড়েছি মোতিলালজী সাদাসিদে কুটির বানাতে গিয়ে লাখ টাকার বেশি খর্চা করেছিলেন। তালিমটা নিশ্চয়ই প্যারিসের ‘এক কোর্স খাওয়া’ থেকে পেয়েছিলেন।
ওয়েটার শুধাল, ‘পানীয়?
ক্লের ঘাড় বাঁদিক কাত করে বললেন, ‘নো’, তারপর ডান দিকে কাত করে বললেন, ‘উয়ি’, ফের বাঁদিকে ‘নো’, ফের ডান দিকে ‘উয়ি’
আমার ‘দোলাতে দোলে মন’—ফাঁসি না কালাপানি? কালাপানি নয়, শেষ দোলা ডান দিকে নড়ল, অর্থাৎ লাল পানি।
ক্লের দু ফোঁটা ইংরাজিও জানেন। যে পানীয় অর্ডার দিলেন তার গুণকীর্তন করতে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘ইৎ ইজ নৎ এ দ্রীক বাৎ এ দ্ৰীম (স্বপ্ন) মসিয়য়া,
এ জিনিস ফ্রান্সের গৌরব, রসিকজনের,মোক্ষ, পাপীতাপীর জর্দন-জল।
নিশ্চয়ই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এক বাউলকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘যে জন ডুবলো সখী, তার কি আছে বাকি গো?
তারপর সেই এক কোর্স খাওয়া শেষ হতে না হতেই ওয়েটার এসে আমাদের বলল হঠাৎ এক চালান তাজা শুক্তি এসে পৌঁচেছে। সমস্ত রেস্তোরাঁয়, আমরাই যে সবচেয়ে দামি দামি ফিনসি খাদ্য খাবার জন্য এসেছি, এ তত্ত্বটা সে কী করে বুঝতে পেরেছিল; জানিনে। মৃদঙ্গের তাল পেলে নাচিয়ে বুড়িকে ঠেকানো যায় না, এ সত্যও আমি জানি, কাজেই ক্লের যখন ফরাসী শক্তির উচ্ছাস গেয়ে তার এক ডজন অর্ডার দিলেন, তখন আমি এইটুকু আশা আঁকড়ে ধরলুম যে, যদি কোনো শুক্তির ভেতর থেকে মুক্তো বেরে তবে তাই দিয়ে বিল শোধ করব।
ক্লের ঢেকুর তোলেননি। না জানি কত যুগ ধরে তপস্যা করার ফলে ফরাসী জাতি এক ডজন শুক্তি বিনা ঢেকুরে খেতে শিখেছে। ফরাসী সভ্যতাকে বারংবার নমস্কার।
প্রায় শেষ কপর্দক দিয়ে বিল শোধ করলুম।
সে রাত্রে সিনেমায়ও গিয়েছিলুম। পাঁচ সিকের সিটে বসে ‘অল কোয়াটের’ বন্দুককামানের শব্দের মাঝখানেও ক্লেরের ঘুমের শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম। নাক ডাকাটা বললুম না, গ্রাম্য শোনায় আর ফরাসী সভ্যতার দায় যতক্ষণ সে জাগ্রত আছে।
রাত এগারোটায় সিনেমা শেষে যখন বাইরে এসে দাঁড়ালুম, তখন ক্লের বললেন, ‘কোথায় যাই বলুন তো, আমার সর্বাঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।’
আমি বলতে যাচ্ছিলুম, নত্র দামের গিঞ্জেয়। সেই একমাত্র জায়গা যেখানে পয়সা খর্চা না করেও বসা যায়, কিন্তু চেপে গেলুম। বললুম, আমাকে এই বেলা মাফ করতে হচ্ছে মাদমোয়াজেল শাতিল্লো। কাল আমার মেলা কাজ, তাড়াতাড়ি না শুলে সকালে উঠতে পারব না।
ক্লের কী বললেন আমি শুনতে পাইনি। ভদ্রতার শেষরক্ষা করতে পারলুম না বলে একটু দুঃখ হল। ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দশমীর বিসর্জনের মতো দেবীপূজার শেষ অঙ্গ। এত খর্চার পর সব কিছু এটুকু বাধায় গেল ঠেকি?’ চাবুক কেনার পয়সা ছিল না বলে দামী ঘোড়াটাকে শুধু দানাপানিই খাওয়ালুম, জিনটা পর্যন্ত লাগানো গেল না!
বাস-ভাড়া দিয়ে দেখি আমার কাছে আছে তিনটে কফি, একখানা স্যানডুইচ, আর পাঁচটি সিগারেটের দাম।
আমার কপাল-বাসের টায়ার ফাটলো। আধ মাইল পথ হাঁটতে হবে।
প্যারিসের হোটেলগুলো বেশির ভাগ সংযমী মহল্লায় অবস্থিত। সংযমীর বর্ণনায় গীতা বলেছেন সর্বভূতের পক্ষে যাহা নিশা সংযমী তাহাতে জাগ্রত থাকেন। তারপর সংযমী সেই নিশাতে কী করেন তার বর্ণনা গীতাতে নেই। আমার ডাইনে-বাঁয়ে যে জনতরঙ্গ বয়ে চলেছে, তাদের চেহারা দেখে তো মনে হল না তারা পরমার্থের সন্ধানে চলেছেন। তবে হয়তো এঁরা অমৃতের সন্তান—অমৃতের সন্ধানে বেরিয়েছেন আর অমৃতের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক ঋষি বলেছেন, অমৃতাস্তি সুরালয়ে অথবা ‘বনিতাধরপল্লবেষু।’