যাত্রীদল ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে আর প্রতি পুণ্যভূমির সামনে সবাই হাঁটুগেড়ে প্রার্থনা করে। পাদ্রীসায়েব পুণ্যভূমির স্মরণে চিৎকার করে তার বর্ণনা পড়েন, যাত্রীদল নকণ্ঠে সেই ঘটনাকে প্রতীক করে প্রাণের ভিতর তার গভীর অর্থ ভরে নেবার চেষ্টা করে।
বনের ভিতর ঢুকলুম। দুদিকে উঁচু পাইন গাছ ঠায় দাঁড়িয়ে। আমরা যেন মহাভাগ্যবান নাগরিকদল চলেছি রাজরাজেন্দ্র দর্শনে, আর এরা হতভাগ্যের দল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পল্লব দুলিয়ে কপালে করাঘাত করছে, না এরা চামরব্যজন করে আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে? প্রার্থনার মৃদু গুঞ্জরণ মিশে গিয়েছে পাইন পল্লবের মর্মরের সঙ্গে, আর জমে-ওঠা শুকনো পইন পাতার গন্ধ মিশে গিয়েছে যাত্রীদলের হাতের ধূপাধারের গন্ধের সঙ্গে।
খ্রীষ্ট আর মা-মেরির বেদনাকে কেন্দ্র করে এই যাত্রীদল—বিশ্বসংসারের তাবৎ ক্যাথলিক—আপন দুঃখ কষ্টের সান্ত্বনা খোঁজে, দুর্বলতার আশ্রয় খোঁজে, আপন নির্ভরের সন্ধান করে। রাধার বিরহবেদনায় বৈষ্ণব সাধু ভগবানকে না-পাওয়ার হাহাকার শুনতে পায়, সুফী সাধকের কান্নার গানও উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে প্রিয়াবিরহের বেদনাকে কেন্দ্র করে।
চাচা বললেন, ‘গ্রেটের দিকে আমি মাত্র একবার তাকিয়েছিলুম অতি কষ্টে, সাহস সঞ্চয় করে। দেখি, সে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছে, তার মা তার হাত ধরে তাকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তার দু’চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
চাচা বললেন, আমার ভক্তি কম। তাই বোধ হয় আড়নয়নে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছিলুম দুপুরবেলাকার সাদা মেঘ অপরাহের শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন কালো কালো ওভারকোট পরতে আরম্ভ করেছে। দশম কি একাদশ পুণ্যভূমির সামনে হঠাৎ জোর হাওয়া বইতে আরম্ভ করল আর সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টিজনে যাকে বলে বিকেনব্ৰুখ’ অর্থাৎ মেঘ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ল। ছাতা-বরসাতি অল্প লোকেই সঙ্গে এনেছিল—এবারে প্রাণ যায় আর কি! ভাগ্যিস সেখান থেকেই তীর্থযাত্রীদের জন্য যে-সব রেস্তোরাঁ তার প্রথমটা অতি কাছে পড়েছিল। তবু রেস্তোরাঁতে গিয়ে যখন ঢুকলুম তখন আমাদের অধিকাংশই জবুথবু। পাদ্রীসায়েব গ্রেটেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন দুখানা বরসাতি দিয়ে। তার মা ছাতা ধরেছিলেন আর পাদ্রীসায়েব গ্রেটেকে বুকের ভিতরে যেন খুঁজে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন। পাত্রীদের শরীর তাগড়া–যীশু খ্রীষ্টের এত বড় গির্জা যখন তাদের কাধের উপর থেকে পড়ে ভেঙে যায়নি তখন গ্রেটে তো তার কাছে চরকাকাটা বুড়ির সুতো।
‘রথ দেখা আর কলাবেচা’ না কচু! তাতে হয় ধর্ম আর অর্থ। কিন্তু যদি বলা হত রথ দেখা আর প্রিয়ার কণ্ঠালিঙ্গন’ তাহলে হয় ধর্ম আর কাম, আর তাতেই আছে আসল মোক্ষ। রেস্তোরাঁয় ঢুকে তত্ত্বটা মালুম হল।
রেস্তোরাঁ এতই বিশাল যে সেটাকে নৃত্যশালা বলাই উচিত। দেখি শখানেক ছোঁড়াছুঁড়ি, বুড়োবুড়ি ধেইধেই করে নাচছে, বিয়ারের ফোয়ারা বইছে আর শ্যাম্পেনে শ্যাম্পেনে ছয়লাপ। আর সবাই তখন এমনই মৌজে যে আমাদের দল ভিজে কাকের মতো ঢুকতেই চিৎকার করে সবাই অভিনন্দন জানাল। ধাক্কাধাক্কি ঠাসাঠাসি করে আমাদের জন্য জায়গা করে দেওয়া হল, গায়ে পড়ে আমাদের জন্য পানীয় কেনা হল, আহা, আমরা যেন সব ল লস্ট ব্রাদার্স-বহুদিনের হারিয়ে-যাওয়া ফিরে-পাওয়া ভাই।
এতে চটবার কী আছে, বল? ধর্মকর্ম করতে গেলেই যে মুখ গুমশা করে সব কিছু করতে হবে সে কথা লেখে ধর্মবিধির কোন ধারায়? এমনকি আদালতেও দেখোনি যেখানে খুনের মোকদ্দমা হচ্ছে সেখানেও জজ-ব্যারিস্টাররা ঠাট্টামস্করা করেন?
গ্রেটের মা, গ্রেটে, পাদ্রীসায়েব আর আমি একখানা টেবিল পেয়ে গেলুম জানলার কাছে। বাইরে তখন বৃষ্টি আর ঝড়, আর জানলার খড়খড়ানি থেকে বুঝতে পারছি ঝড় বেড়েই যাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোতে দেখলুম রাস্তা জনমানবহীন, এক হাঁটু জল জমে গিয়েছে।
তাতে কার কী এসে যায়? গান-ফুর্তি তো চলছে। ট্রি, ট্রি, ট্রিঙ্ক ব্রুডারলাইন পিয়ো, পিয়ো বঁধুয়া, পিয়ো আরবার’ শতকণ্ঠে গান উঠছে, পিয়ো পিয়ো বঁধুয়া। এরা সব গান গাইতে পারে ভালো—গির্জেয় এদের ধর্মসঙ্গীত গাওয়ার অভ্যাস আছে। যে শিবলিঙ্গ পুজোর জন্য দেবতা হন তাকে দিয়ে মশারির পেরেক ঠকলে তিনি কি আর গোসা করে বাড়িঘরদোর পুড়িয়ে দেন? রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, আমাদেরই বাগানের ফুল ‘কেহ দেয় দেবতারে, কেহ প্রিয়জনে। দুজনকে দিতেও তিনি আপত্তি করতেন না নিশ্চয়ই।
পাদ্রীসায়েব আমাকে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে যেতে লাগলেন। আমাদের তিনমাসের পরিচয়ের মধ্যে একদিন একবারের তরেও তিনি ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল দেখাননি। আজ এই শরাবখানায় হঠাৎ যে কেন তার জ্ঞানতৃষ্ণা বেড়ে গেল বুঝতে পারলুম। দরদী মানুষ, গ্রেটের মন ভোলাবার জন্য সব কিছু করতেই রাজি আছেন। আমিও কলকাতাতে যে হাতি-ট্যাক্সি পাওয়া যায় এবং তার ভাড়া দিতে হয় হাতিকে কলা খাইয়ে, সেকথা বলতে ভুললুম না। বোধ করি গ্রেটেও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার সম্মান রাখার জন্য দুএকবার হেসেছিল। একবার আমায় জিজ্ঞেসও করল আমি বুদ্ধদেব সম্বন্ধে কী কী পড়েছি। আমি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলুম সে কিছু পড়েছে কিনা। ততক্ষণে তার মন আবার অন্য কোন দিকে চলে গিয়েছে। দু’বার জিজ্ঞেস করার পর শুধু বলল ‘ই’। বুঝলুম হতভাগিনী শান্তির সন্ধানে অনেক দুয়ারেই মাথা কুটেছে।