চাচা বললেন, আমি বাঙাল দেশের লোক। যা-তা নদী আমার চোখে চটক লাগাতে পারে না। তবু স্বীকার করি, রাইন নদী কিছু ফেলনা নয়। দুদিকে পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে রাইন সুন্দরী নেচে নেচে চলে যাবার সময় দুপাড়ে যেন দুখানা সবুজ শাড়ি শুকোবার জন্য বিছিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সে শাড়ি দুখানা আবার খাঁটি বেনারসী। হেথায় লাল ফুলের কেয়ারী হোথায় নীল সরোবরের ঝলমলানি, যেন পাকা হাতের জরির কাজ।
আর সেই শাড়ির উপর দিয়ে আমাদের ট্রাম যেন দুষ্টু ছেলেটার মতো কারো মানা না শুনে ছুটে চলেছে। মেঘলা দিনের আলো-ছায়া সবুজ শাড়িতে সাদাকালোর আল্পনা একে দিচ্ছে আর তার ভিতর চাপ রঙের ট্রামের আসা-যাওয়া সমস্ত ব্যাপারটা যেন বাস্তব বলে মনে হয় না। মনে হয় হঠাৎ কখন রাইন সুন্দরীর ধমকে দুষ্ট ছেলেগুলো পালাবে, আর সুন্দরী তার শাড়িখানা গুটিয়ে নিয়ে সবুজের লীলাখেলা ঘুচিয়ে দেবেন।
কিন্তু সবচেয়ে মুগ্ধ হলুম মোকামে পৌঁছে, ট্রাম থেকে নেমে সেখানে রাইনের দিকে তাকিয়ে দেখি রাইনের বুকের উপর ফুটে উঠেছে দুটি ছোট ছোট পল্লবঘন দ্বীপ। তার পেলব সৌন্দর্য আমার মনে যে তুলনাটি এনে দিল, নিতান্ত বেরসিকের মনেও সেই তুলনাটাই আসত। তাই সেটা আর বলছি না—সর্বজনগ্রাহ্য তুলনা রসিয়ে বলতে পারেন যিনি যথার্থ গুণী—শিপ্রাবল্লভ কালিদাস এ রকম একজোড়া দ্বীপ দেখতে পেলে মেঘদূতকে আর অলকায় পাঠাতেন না, এইখানেই শেষবর্ষণ করতে উপদেশ দিতেন।
লেডি-কিলার পুলিন সরকার কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সূয্যি রায়ের ধমক খেয়ে চুপ করে গেল।
চাচা বললেন, হাইস্টারবাখার রোট থেকে টাডেয়াস তীর্থ আধ মাইল দূরে। এই পথটুকু নির্মাণ করা হয়েছে জেরুজালেমের ‘ভিয়া ডলোরেসা’ বা ‘বেদনা-পথের অনুকরণে। খ্রীষ্টের প্রাণদণ্ডের আদেশ জেরুজালেমের যে-ঘরে হয় সেখান থেকে তার কাঁধে ভারি ক্রস চাপিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তাঁকে ক্রসের সঙ্গে পেরেক পুঁতে মারা হয়। এ পথটুকুর নাম ‘ভিয়া ডলোরসা।’ ক্যাথলিক মাত্রেরই আশা, জীবনে যেন অন্তত একবার সে ঐ পথ বেয়ে সভূমিতে উপস্থিত হতে পারে-যেখানে প্রভু যীশু সর্বযুগের বিশ্বমানবের সর্বপাপ স্কন্ধে নিয়ে কন্টকমুকুটশিরে আপন রক্তমোক্ষণ করে প্রায়শ্চিত্ত করেছেন।
কিন্তু জেরুজালেম যাওয়ার সৌভাগ্য বেশি ক্যাথলিকের হবে না বলেই তার অনুকরণে ক্যাথলিক জগতের সর্বত্র বেদনা-পথ’ বানান হয়। জেরুজালেমে এ পথের যেখানে শুরু তাকে বলা হয় প্রথম স্টেশন (পুণ্যভূমি) আর কুসভূমিতে চতুর্দশ স্টেশন। এখানে তারই অনুকরণে চৌদ্দটি স্টেশনের প্রথমটি হাইস্টারবাখার রোটের কাছে আর শেষটি টাডেয়াস তীর্থের গির্জার ভিতরে।
চাচা বললেন, হাইস্টারবাখার রোটে সেদিন রাইনল্যান্ডের বহু দূরের জায়গা থেকে বিস্তর লোক এসে জড়ো হয়েছে, এখান থেকে পায়ে হেঁটে টাডেয়াস তীর্থে যাবে বলে। ছোট রেস্তোরাঁখানাতে বসবার জায়গা নেই দেখে আমি গাছতলায় বসে পড়েছি—গ্রেটে আর তার মা কোনোগতিকে দুটো চেয়ার পেয়ে বেঁচে গেছে। হঠাৎ দেখি আমাদের পাদ্রীসায়েব গডেসবের্গের যাত্রীদলের তদারক করতে করতে আমার কাছে এসে হাজির। ভদ্রলোক একটু নার্ভাস টাইপের—অর্থাৎ সমস্তক্ষণ হন্তদন্ত, কিছু একটা উনিশ-বিশ হলেই কপাল দিয়ে ঘাম বেরিয়ে যায়।
ধপ করে আমার পাশে বসে পড়লেন। আমি খানিকক্ষণ বাদে জিজ্ঞেস করলুম, এই দুর্বল শরীর নিয়ে গ্রেটের তীর্থযাত্রায় বেরনো কি ঠিক হল?
পাত্রীসাহেবের মাথায় ঘাম দেখা দিল। রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন, ‘জানেন মা-মেরি। গ্রেটের মায়ের শেষ আশা যদি টাডেয়াসের দয়া হয় আর তার বর জোটে। ঐ তো একমাত্র পন্থা পুরোনো প্রেম ভোলবার। তা না হলে ও-মেয়ে তো বাঁচবে না। পাদ্রীসায়েব চোখ বন্ধ করে মা-মেরির স্মরণে উপাসনা করলেন, ‘ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী!
জিরিয়েজুরিয়ে আমরাও শেষটায় রওয়ানা দিলুম তীর্থের দিকে। লম্বা লাইনসকলের হাতে উপাসনাপুস্তিকা আর জপমালা। পাদ্রীসায়েব চেঁচিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন, ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী’—আর যাত্রীদল বারবার ঘুরে ফিরে সেই মন্ত্র উচ্চারণ করে সর্বশেষে ভক্তিভরে বলে, এই পাপীতাপীদের দয়া কর, আর দয়া কর যেদিন মরণের ছায়া আমাদের চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসবে।
তারপর আমরা এক-একটা করে সেই সব স্টেশন (পুণ্যভূমি) পেরোতে লাগলাম। কোনোটাতে পাদ্রীসায়েব চেঁচিয়ে বলেন, হে প্রভু, এখানে এসে ক্রসের ভার সইতে না পেরে তুমি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলে, আর সমস্ত তীর্থযাত্রী করুণকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘হে প্রভু, তোমার লুটিয়ে পড়াতেই আমাদের পরিত্রাণ হল। কোনো পুণ্যভূমির সামনে পাদ্রীসায়েব বলেন, এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা হল তোমার জননী মা-মেরির। দূর থেকে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছেন তোমার মৃত্যুদণ্ডাদেশ। এবার তিনি তোমার কাছে আসতে পেরেছেন কিন্তু কথা কইবার অনুমতি পাননি। তোমার দিকে তিনি তাকালেন—সে তাকানোতে কী পুঞ্জীভূত বেদনা, কী নিদারুণ আতুরতা!’ যাত্রীদল এককণ্ঠে বলে উঠল, মৃত্যুর চেয়েও ভালবাসা অসীম শক্তির আধার-স্টার্ক ভী ডেয়ার টোট ইট ভী লীবে। কোনো পুণ্যভূমিতে পাদ্রীসাহেব বলেন, এখানে তাপসী ভেরোনিকা তাকে বস্ত্রখণ্ড এগিয়ে দিলেন, যীশু মুখ মুছলেন, আর কাপড়ে তার মুখের ছবি ফুটে উঠল। যাত্রীদল বলে, আমাদের হৃদয়ের উপর, হে প্রভু, তুমি সেইরকম ছবি একে দাও।’