লোকচক্ষুর অগোচরে যাবারও যাদের স্থান নেই তাদের জন্য ভিজে কাঠের ধুয়ো আর মানের ঘরের কল খুলে দেওয়া।
তাই সর্ব অসহায় সর্ব বিপন্ন নরনারীর চোখের জল মুক্তার হার হয়ে দুলছে মামেরির গলায়, তারই নাম আভে মারিয়া মন্ত্র–ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী।
গোঁসাই ভাল কীর্তন গাইতে পারেন, সহজেই কাতর হয়ে পড়েন। বললেন, চাচা, আর না।
চাচা বললেন, মেয়েটিকে চিনতে পারলুম। কার্লকে এক্সরে করাতে গিয়ে ডাক্তারের ওয়েটিংরুমে মেয়েটির মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রমহিলা মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন একই উদ্দেশ্যে। এরও যক্ষ্মা। তবে কি নিরাময় হবার জন্য কাঁদছিল? কে জানে?
চাচা বললেন, তারপর একমাস হয়ে গিয়েছে, এমন সময় নাস্তিক উইলির সঙ্গে রাস্তায় দেখা। আমার গির্জা যাওয়া নিয়ে সে হামেশাই হাসি-মস্করা করত, কিন্তু ক্যাথলিক ধর্মের মূল তত্ত্ব তার অজানা ছিল না। উইলি ‘মুক্তপুরুষ’, কিন্তু আর পাঁচজনের জন্য যে ধর্মের প্রয়োজন সে কথা সে মানত। আমায় জিজ্ঞেস করল আমি য়ুভাস টাডেয়াসের তীর্থে যাবার সময় তার মাসিমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব কি না? আমি শুধাল মুডাস টাডেয়াস তীর্থ সাপ না ব্যাঙ তার কোন খবরই যখন আমার জানা নেই তখন সে তীর্থে আমার যাবার কোনো কথাই ওঠে না। শুনে উইলি যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘সে কি হে, টাডেয়াস তীর্থের নাম শোনননি, আর ক্যাথলিকদের সঙ্গে তোমার দহরমমহরম!’
তারপর উইলি আমায় সালঙ্কারে বুঝিয়ে দিল, রাইন নদীর ওপারে হাইস্টারৰাখার রোট। সেখান থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে টাডেয়াস তীর্থ। সে তীর্থের দেবতা বল, পীর বল, বড়কর্তা হচ্ছেন সেন্ট যুডাস টাডেয়াস। বড় জাগ্রত পীর। ভক্তিভরে ডাকলে পরীক্ষা তো নিশ্চিত পাস হবে, যথেষ্ট ভক্তি থাকলে জলপানিও পেতে পার। আর যদি মেয়েছেলে ঠাকুরকে ডাকে তবে সে নির্ঘাৎ বর পাবে–আশী বছরের বুড়ির পক্ষে বাইশ বছরের বর পাওয়াও নাকি ঠাকুরের কৃপায় সসি-বিয়ার (অর্থাৎ ডাল-ভাত)।
বুঝলুম ঠাকুর খাসা বন্দোবস্ত করেছেন। নদীর এ-পারের বন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছছাকরারা যাবে তার কাছে পরীক্ষা পাসের লোভে, মেয়েরা যাবে বরের লোভে দু’দলে তীর্থে দেখা হবে। তারপর কন্দর্প ঠাকুর তো রয়েছেনই টাডেয়াস ঠাকুরের সহকর্মী হয়ে স্বর্গের একসিকিউটিভ কমিটিতে। অর্থাৎ এ তীর্থে যেতে যে মেয়ে পশ্চাৎপদ নয় তার কপালে সপ্তপদী আছেই আছে।
উইলি পইপই করে বুঝিয়ে দিল, তীর্থ না করে ক্যাথলিক ধর্মের মূলতত্ত্বে কেউ কখনো প্রবেশ করতে পারেনি—উইলির নিজস্ব ভাষায় বলতে গেলে, ক্যাথলিক ধর্ম যে কতটা কুসংস্কারে নিমজ্জিত তা তীর্থে না গিয়ে বোঝা যায় না। যীশুর ক্রস নিয়ে মাতামাতি, পোপকে বাবাঠাকুর বলে কলুর বলদের মতো গুলি পরে তার চতুর্দিকে ঘোরা তীর্থযাত্রার কুসংস্কারের কাছে নস্যি।
তাহলে তো যেতে হয়।
পাড়ার পাদ্রীসায়েবকে যখন আমার সুমতির খবর দিলুম তখন তিনি কিছুমাত্র আশ্চর্য হলেন না। মনে হল, আমার যখন ধর্মে এত অচলা ভক্তি তখন যে আমি এমন জব্বর পরবটাতে গরহাজির থাকব না তা তিনি আগে থেকেই ধরে নিয়েছিলেন।
গডেসবের্গ থেকে আমরা জন তিরিশেক দল বেঁধে পাদ্রীসায়েবের নেতৃত্বে ট্রাম ধরে ব পৌঁছলুম। বেরোবার সময় কার্লের মা আমার হাতে তুলে দিলেন প্রেয়ার-বুক বা উপাসনা-পুস্তিকা, আর একগাছা রোজারি বা জপমালা। বন্ন পৌঁছে দেখি সেখানেই তীর্থের ঝামেলা লেগে গিয়েছে। এক গডেসবের্গেরই বিস্তর চেনা-অচেনা লোককে দেখতে পেলুম। এক আশী বছরের বুড়িকে দেখে আমি ভয়ে আঁৎকে উঠলুম-আমার বয়স তখন বাইশ। হয়তো উইলি ভুল বলেনি। পালাই পালাই করছি এমন সময় পাদ্রীসায়েব আমাকে জোর করে বসিয়ে দিলেন সেই যক্ষ্মারোগিণী আর তার মায়ের কাছে। মেয়েটির সঙ্গে আলাপও হল—ভুল বললুম, পরিচয় হল, কারণ সামান্যতম সৌজন্যের মৃদুহাস্য বা অভ্যর্থনা পর্যন্ত সে করল না।
উইলির মাসি ইতিমধ্যে না-পাত্তা। খবর নিয়ে শুনলুম, পীরের দর্গায় জ্বালাবার জন্য মোমবাতি কিনতে গিয়েছেন। সেকি কথা! বিলিতী পীরের খাসা ইলিকটিরি রয়েছে, মোমবাতির কী প্রয়োজন? আমাদের না হয় সাপের দেশ, বিজলি-বাতিও নেই—পিদিমমশাল না হলে পীরের অসুবিধা হয়। উইলি ঠিকই বলেছে, ধর্ম মাত্রই মোমবাতির আধাআলোর কুসংস্কারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পছন্দ করে, বিজলির কড়া আলোতে আত্মপ্রকাশ করতে চায় না।
মাসির আবার কড়া নজর। মোমবাতি কেনার ঠেলাঠেলিতেও আমার উপর চোখ রেখেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, গ্রেটের সঙ্গে কী করে পরিচয় হল। তারপর মাসি যা বললেন তার থেকে গ্রেটের কান্নার অর্থ পরিষ্কার হল। গোঁসাইয়ের পদাবলীতে খণ্ডিতা, প্রোষিতভর্তৃকা, বিলা নামের নানা নায়িকার পরিচয় আছে, এ বেচারী তার একটাতেও পড়ে না। এ মেয়ে বালবিধবার চেয়েও হতভাগিনী, এর বল্লভ হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়। পরে খবর পাওয়া গেল পয়সার লোভে অন্যত্র বিয়ে করার জন্য গ্রেটেকে সে বর্জন করেছে। বালবিধবার অন্তত এটুকু সান্ত্বনা থাকে, তার প্রেম অপমানিত হয়নি।
মাসি বললেন, কিন্তু আশ্চর্য, পুরো দু’বৎসর আমরা কেউ বুঝতে পারিনি গ্রেটের প্রাণে কতটা বেজেছে। মেয়েটা চিরকালই হাসি-তামাসা করে সময় কাটাত—দু’বছর তাতে কোনো হেরফের হল না। তারপর হল যক্ষ্মা। তখন বোঝা গেল, যে-আপেলের ভিতরে পোকা সে আপেলটারই বাইরের রঙের বাহার বেশি।