উনিশ শতক বাউল শতক। বাংলার বাউল শিরোমনিরা সকলেই উনিশ শতকের সন্তান। আর বাউলমতের উদ্ভবের সঙ্গে জড়িয়ে যায় নদিয়ারই নাম। উনিশের কুষ্টিয়ার লালনপন্থার প্রচার ও প্রসারে বাঁধা ও বিপত্তির মাঝেই সাঁইজি তো বন্ধু পেয়েছিলেন কিছু। যারা তৎকালীন প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত। কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার, জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, মীর মোশারফ হোসেন’দের মতো শিক্ষিত আলোক প্রাপ্ত সমাজ সচেতনদের লালনের আখড়ায় যাতায়াত ছিল। আর ছিল শিলাইদহের কুঠিবাড়ির সংসর্গ। সত্যেন্দ্রনাথ–জ্ঞানদানন্দিনী–জ্যোতিরিন্দ্রনাথ–সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সেই আলাপ আলোচনার বিস্তার পায় রবীন্দ্রনাথের হাতে। সাঁইজি দেহ রাখার পরই আসলে লালনের সাধনক্ষেত্রের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ বাড়ে; বিশেষত রবীন্দ্রনাথ আরও আগ্রহী হন লালন ঘরানার ফকিরদের চোখের সামনে দেখে, গান শুনে, তাঁর জমিদারভুক্ত
যার সঙ্গীত সুলভ আচরণে আকৃষ্ট হয়েই ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা ‘ভারতী’তে জায়গা পায় সাঁইজির গান। ছাপা হয় কুষ্টিয়ার দুই গায়কের গান বিষয়ক প্রবন্ধ–’লালন ও গগন’। লালন দেহ রাখার পর হিতকারী পত্রিকার প্রতিবেদনই তাঁর দেহকেন্দ্রিক আচরণবাদের। সঙ্গীত সাধনা নিয়ে প্রথম আলো ফেলে। সেই আলো পর্যবেসিত হয় প্রামাণ্য ও বিকৃত লালন গবেষণায়। নদিয়ায় লালনের এই খ্যাতি ও কিংবদন্তির আগেও যে কোনো বাউল মুর্শেদের আবির্ভাব ঘটেনি তা কিন্তু নয়। ষোলো শতকের শেষ থেকে সতেরোর প্রথম ভাগেই হরিগুরু, বনচারী, অখিলচাঁদ, সেবাকমলিণীরা ছিলেন নদিয়ার বাউলধারার প্রবর্তক। সুতরাং বাংলার প্রাচীন বাউল সংস্কৃতির কেন্দ্র হল নদীয়া। সতেরোর মধ্যভাগেই বাংলার নিরক্ষর মুর্শেদের মরমিয়াবাদ ও সঙ্গীত বাংলার নানাস্থানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আঠারো শতকে বাউল মত প্রতিষ্ঠিত বিস্তৃত হতে থাকে। উনিশ শতকে আদৃত হয়। শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত অংশে। মান্য-অমান্যের ছায়া নিয়ে মুখর হয় বাংলার বাউলপন্থা। ব্যাপক বিস্তৃতির সুযোগে বিকৃত বিকৃত অনাচারের কিছু প্রাধান্য এল না তাও কিন্তু নয়। তবে সংস্কারপ্রবণ মুসলমান ও হিন্দুদের বাউল শত্রু হয়ে ওঠার মূল কারণ আপামর সাধারণের লোক আচরণের প্রতি ঝোঁক। যে কারণে মূলধর্মের সমাজপতি গুরুদেব সিংহাসন হারানোর ভয়। তারাই জোরকদমে লেগে পড়লেন সংস্কার ধর্মে। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য মৌলানা কেরামত আলী ও হাজী শরীয়তুল্লাহ বাংলার সর্বাঞ্চলেই সংস্কার আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন। নামকরণ পেয়েছে এইসব সংস্কার আন্দোলন। ওহাবি আন্দোলনের ফলে বাউল,মুর্শিদি চর্চা বিপন্ন হয়েছে যশোর কুষ্টিয়ায়। কুমারখালির দুর্গাপুর নিবাসী ওহাবি সংগঠক কাজী মিয়াজান নানা জায়গা থেকে লোক সংগ্রহ করে বাউল আখড়াগুলোতে শরিয়তের অনুশাসন মেনে চলার জন্য কড়া নির্দেশ পাঠাতেন। ফারায়জী আন্দোলন সংস্কারক হিসাবে হাজী শরীয়তুল্লাহ নন-ইসলামিক কার্যকলাপ দূর করার জন্য ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, ঢাকা, পাবনা, বরিশালে প্রচার চালান। তাঁর পুত্র পীর মোহসেনউদ্দীন বা দুদ্দুমিঞা মুসলমান বাউলদের ওপর রীতিমতো বলপ্রয়োগ করতেন। কেরামত আলীর সংগ্রামটা ছিল বিধর্মীয় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে। বাউল ধ্বংস করার আয়োজনে এইসব সংগঠকরাই সর্বপ্রথম বিশেষ ভূমিকা নেন। তারপর শুরু হয় মওলানা আব্দুল্লাহেল বাকী ও মওলানা আবদুল্লাহেল কাজী ভ্রাতৃদ্বয়ের হাদিস আন্দোলন। বাউলদের সংখ্যা ও ঐক্য নামে রীতিমত এরা বাহাস করতে থাকেন। যশোরের মুনসী। মোহম্মদ মেহেরুল্লাহও অশিক্ষিত, দরিদ্র মুসলমানদের বাউলধর্ম হতে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেন। মেহেরপুরের মুনসী শেখ জমিরুদ্দীন এই এলাকাতে পাদ্রিদের প্রচারের কাজেও বাঁধা সৃষ্টি করেন। মুনসী মেহেরুল্লাহ তাঁর বাউল বিরোধী কেতাব ‘মেহেরুল ইসলাম’ এ কিংবদন্তি বাউল গুরু পাগলা কানাইয়ের জানাজা অনুষ্ঠান নিয়ে টিপ্পনী কাটেন। তিনি বাউলদের ‘গণ্ড মুর্খ ভেদুয়া’ বলেছেন। তাঁদের সঙ্গীতকে ‘কাফেরী কালাম’ বলে দেগে দিয়েছেন। এ সময়ই বাউল-নেড়া-ফকিরদের বিরুদ্ধে তাঁদের শরিয়ত বিরোধী কার্যকলাপকে উদ্দেশ্য করে বেশ কিছু গ্রন্থ রচিত হয়। কুষ্টিয়া থেকে বের হয় ‘ভণ্ড ফকির, বশিরহাট থেকে ‘উচিৎ কথা’, যশোর থেকে ‘হেদায়েতল ফাছেকিন’। এই সব বইয়ের ভেতর বিশেষ উল্লেখযোগ্য মওয়ালা রেয়াজউদ্দীন আহমেদের ‘বাউল ধ্বংস ফাৎওয়া’। এরপরও বের হয় জাফর সাহেবের ‘বাতেল ফেরকা’, নাসিরুদ্দীন আহমদের ‘সমাজ সংস্কার’ সহ অসংখ্য বাউলপন্থার বিরুদ্ধে প্রকাশ। লালনের জীবদ্দশাতেই লালন বিরোধী আওয়াজ ওঠে। নেড়াদের বিরুদ্ধাচারণ নিয়ে প্রকাশ ঘটে ‘রদ্দে নাড়া’। লালনের দেহ রাখার পর কুষ্টিয়াতে মওলানা আফছারউদ্দীনরা ছেউড়িয়া আখড়ার বাউলদের ঝুঁটি কেটে আখড়া ছাড়া করেন। বিশ শতকেও লালন পপুলার কালচার হয়ে ওঠার পরও কুষ্টিয়াতে লালনের নামে শহর গড়তে বাধা আসে।
‘বাউল ধ্বংস ফাওয়া’-ই জানান দিচ্ছে তকালীন সময়ে ষাট-সত্তর লক্ষ বাউলের অস্তিত্ব। আন্দোলনে তা কমে এক লক্ষতে নেমেও আসে। শরিয়ত পন্থার জয় লোকধর্মের ওপর আঘাতে এভাবেই ঘোষিত হয়। উত্তরবঙ্গের নীলফামারিতে মাঝবাড়ি, মধ্যমা বাউল সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ শুরু হয়। মারফতি পন্থার এই নির্যাতন ও নিষ্পেষনই প্রমাণ করে এই ধর্মে শরিয়তিপস্থা কতখানি নাজেহাল হয়েছিল। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র। মারফতিপন্থায় তাই ইসলামিকরণ শুরু হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। বাংলাদেশ জন্মের পর বাউলপন্থা মর্যাদা লাভ করে। তথাপি মৌলবাদের হানায় এদের বিকাশ ও প্রকাশ সংকুচিত হচ্ছে না তা তো নয়।