বাদশা-বেগম ঝমঝমাঝম – সৌমিত্ৰশংকর দাশগুপ্ত
শিশমহলে পা দিয়েই বাদশা প্রমাদ গুণলেন। বেলা দ্বিপ্রহর, খিদেয় পেট চুঁইছুঁই করছে। এ-সময়ে নাকে কোপ্তা কাবাবের গন্ধ এলেই তিনি খুশি হতেন, তার বদলে আতর আর গোলাপজলের খুশবুতে তার খালি পেট কেমন গুলিয়ে উঠল। এছাড়াও তাঁর কানে এল গগনভেদি সপ্তসুর যার সাতটি সুর সপ্তদিগন্তে ভেসে চলেছে, ‘সা’-এর সঙ্গে ‘রে’-এর কোন যোগাযোগ নেই, ‘গা’-এর সঙ্গে ‘মা’-এরও মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললেন দিগ্বিজয়ী বাদশা। হায়! সারা দুনিয়া জয় করে এসে শেষে কিনা নিজেরই মহলে খেয়ালি এক বেগমের পাল্লায় পড়ে তাকে অনাহারে মরতে হবে! স্ত্রী এমনই বিষম বস্তু!
মণিবেগম বাদশাকে দেখেই একমুখ হাসলেন। টকটকে ফর্সা রং, গালদুটি আপেলের মত, গোলগাল, নাদুসনুদুস চেহারা। দেখেই বোঝা যায়, ইনি খেতে এবং ঘুমোতে ভালবাসেন। বাদশা অবশ্য তার আরও একটি গুণের খবর রাখেন। বেগমের রান্নার হাত চমৎকার। শুধু খেতে নয়, খাওয়াতেও ভালবাসেন। সেজন্য খিদে পেলেই বাদশা মোতিমহল পার হয়ে শিশমহলে চলে আসেন। মোতিমহলে থাকেন তার আরেক বেগম। চুনিবেগম। তার কথা একটু পরে।
মণিবেগম বাদশাকে দেখে একমুখ হাসলেও বাদশার ভ্রূ কিন্তু কুঞ্চিত হয়েই রইল। সেভাবেই বললেন—’কি গাইছ?’
—ইমন, জনাব।
–ইমন! সে তত সন্ধের রাগ। এই বেলা দ্বিপ্রহরে…
মণিবেগম আবারও ছড়িয়ে হাসলেন। বললেন—জানি, মালিক। তবে ওস্তাদজি বলেন, দুপুরে সন্ধের অন্ধকার নামিয়ে আনতে পারলে তবেই না রেওয়াজের জোর।
বাদশা ভেতরে-ভেতরে ধৈর্য হারাচ্ছিলেন। তবে সময়টা দুপুর, পেটে খিদে এবং সামনে রন্ধনপটীয়সী বউ, তাই কোনক্রমে বাদশাহী মেজাজকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললেন—’গান গানই, ভোজবাজি তো নয়।‘
–‘ওস্তাদজি আমাকে সবসময় বিপরীতের চর্চা করতে বলেন। মণিবেগমের হাতে তানপুরা ঝংকার দিয়ে উঠল। বসন্তে গাইতে বলেন মল্লার, ভোরে দরবারি, রাতে মিঞা কে টোড়ি’…
-‘থামো, থামো।‘–খিদে এবং বেগমের বাক্যবাণে চোখে অন্ধকার দেখে দিগ্বিজয়ী বাদশা পারস্যের গালচের ওপর হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন।
মণিবেগম আবারও মিষ্টি হেসে বলেন—’আপনাকে একটু ইমনের বন্দিশ শোনাই, খোদাবন্দ?’
ওফ্! বউ বোকা হলে সেই পুরুষের কি যে ঝঞ্জাট! নাকি বোকা নয়, হিংসুটি! বাদশা কোমরবন্ধে হাত রাখলেন। তলোয়ারে হাত ছোঁয়ালে মেজাজ মুহূর্তে গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু হায়! বেগমমহলে কবে আর কোন পুরুষ তলোয়ার নিয়ে ঢুকেছে!
ওদিকে মণিবেগম গলা ঝেড়ে, কানে হাত চেপে, চোখ বুজে বিশাল হাঁ করে সুর ধরে ফেলেছেন। দিগভ্রষ্ট সেই সুর শুনে বাদশারও হাঁ ক্রমশ বড় হতে-হতে তিনি প্রায় খাবি খাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছেন। তবে বাদশাহী রক্ত বলে কথা! থেকে থেকেই ছলকে উঠতে চায়। বাদশা তাই প্রথমে তার গুরুগম্ভীর গলায় গলা-খাঁকারি দিলেন। তাতেও কোন কাজ হলনা দেখে তার মনে হল বেগমের গলাটা টিপে ধরেন। সেখানে পরতে-পরতে চর্বি জমে আছে দেখে মনে-মনেই হাত গুটিয়ে নিয়ে এবার কূটবুদ্ধির প্রয়োগ করেন। বলেন, কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ।
মন্ত্রের মত কাজ হয়। বেগম কুর্নিশ করে তানপুরা নামিয়ে রাখেন। এবং বাদশা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কাজের কথা পাড়েন।—আজ কি কি খানা পাকালে, বেগম?
প্রশ্ন শুনে বেগম বিস্ময়ে দুই চোখ বড় বড় করে বলেন—’অহ্ খোদা! আপনি মোতিমহল থেকে খানা সেরে আসেননি?’
বাদশার মাথায় বাদশাহী খুন চড়ে যায়। মনে-মনেই তিনি মণিবেগমের মুণ্ডচ্ছেদ করেন। এর বেশি আর কি-ই বা করতে পারেন? অথচ আজই দুপুরে দরবারে তিনি তিন-তিনটে দাগি চোরকে কোতল করার হুকুম দিয়ে এসেছেন। কিছু দূরে বেগমের পোষা বেড়ালটা লেজ গুটিয়ে পাপোষের ওপর বসে ছিল। খিদের চোটে বাদশা তার অভ্যস্ত কায়দায় দরবারি হুঙ্কার দিতে গিয়ে শোনেন, বেড়ালটা ভিজে ভিজে গলায় ডেকে ওঠে—ম্যাঁও!
প্রবল পরাক্রমশালী বাদশাও তাঁর দরবারি তর্জন-গর্জন ভুলে গিয়ে গোঁজ হয়ে অভিমানের সুরে বলেন—মোতিমহলে কবে আবার আমি খানা-পিনা করতে যাই?
সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে হেসে ওঠেন মণিবেগম। বাদশাও কোমরবন্ধে হাত রাখেন। আবারও তার খেয়াল হয় যে তলোয়ার নেই, বেগম তো দূরের কথা, বেগমের বেড়ালটাকেও কেটে ফেলবার সাধ্য তার নেই।
এবার থেকে অভ্যাসটা বদলে ফেলুন, জনাব! মণিবেগম হাসি-হাসি মুখে বলেন-শিশমহলে আসুন গানবাজনা শুনতে, আর খানা-পিনা সেরে আসুন মোতিমহলে।
উফ! অসহ্য! এই আওরত তো মোটেও বুরবাক নয়! বরং বাদশা যা সন্দেহ। করেছিলেন তাই। হিংসুটি!
কি কুক্ষণেই যে খোরাসান প্রদেশ জয় করতে গিয়ে চুনিবেগমকে নিকাহ্ করে এনেছিলেন বাদশা! নিকাহ যে গুনাহ্ হয়ে দাঁড়াবে একবারও যদি বুঝতেন!
ভাবতে-ভাবতেই আবারও উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তিনি। কিসের গুনাহ্? তারা পুরুষ-পরম্পরায় বাদশাহ। বিজিত প্রদেশের নারী-লুণ্ঠন বীরধর্মেরই অঙ্গ। তিনি চুনিবেগমের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অমন গান মণিবেগম সাত-জন্ম সাধনা করেও গাইতে পারবে না। তবুও তানপুরা নিয়ে ম্যা ম্যা করে চলেছে। অমন গানের তারিফ করবে ওর ওই পোষা বেড়াল। নাঃ, এই আওরত বুরবাকও বটে।