০০. আমার কথা
ষোলো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজে আমার অবস্থান। ঠাকুরদাদার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। বাবার জন্ম কোলকাতায়। আমার জন্ম শহরে হলেও পরবর্তীতে আমাদের বসবাস নদিয়ার চাকদহে। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা, বয়ঃসন্ধি, এখনকার মধ্য যৌবন। এখানকার পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য এখনও গম্ভীরভাবে উচ্চারণ করেন, চক্ৰদহ। গঙ্গা সরে গিয়ে চক্রাকারে এক দহ উপহার দিয়ে গিয়েছিল বলেই আদতে জায়গাটির নাম হয়েছিল চক্ৰদহ। পরবর্তীতে মানুষের মুখের ভাষায় ক্রমশই তা বদলিয়ে চাকদহ, চাকদা হয়ে ওঠে। এটাই চাকদহ নামের আসল পুরাণ। তবে লোকশ্রুতি ধর্মাবহ টেনে অন্য কথা বলে। ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে গঙ্গা হলেন গিয়ে আবার দেবী। গঙ্গার উপাখ্যান বাল্মীকি লিখে গিয়েছেন। সেখানেই রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ সগর রাজার কথা আছে আর এই সগরের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ ভগীরথই নাকি গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন,গল্প সেরকমই বলে। তা মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের সময় ভগীরথের রথের চাকায় আমার বাসভূমিতে গভীর খাতের সৃষ্টি হয়, তারপরে গঙ্গাজলে পূর্ণ হয়ে জমিটির নাম চক্ৰদহ হয়ে ওঠে। নামকরণ নিয়ে আরেক কিংবদন্তি বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। শ্রীকৃষ্ণনন্দন প্রদ্যুম্ন ছিলেন বীর যোদ্ধা। তিনি বহু যুদ্ধে বাবা কৃষ্ণকে সাহায্য করেছিলেন। পুরাণ মতে সমস্ত অসুরেরাই শ্রীকৃষ্ণের ছেলের হাতে মারা গিয়েছিল। সম্বরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর রথের চাকা পৃথিবী গ্রাস করে। স্বভাবতই আমার বসবাসের ভূখণ্ডটির নিস্তার নেই কোনও প্রদ্যুম্নের রথের চাকায় ডেবে এখানেও নাকি সুবিশাল দহ হয়। আর সেই দহ থেকেই এতদঞ্চলের নাম চক্ৰদহ হয়ে ওঠে। তবে পুরাণকল্প তো আবার কিছু ঐতিহাসিক সত্যে নিহিত, সেই সত্য নিয়েই বোধহয় তাই প্রাচীন দলিলে প্রদ্যুম্ননগরের। উল্লেখ রয়েছে।
সে যাই হোক, আমার বাসজমিটি আবার অখণ্ড নদিয়ারই অন্তর্গত। তাঁর কুষ্টিয়াতেই ফকির সাঁইয়ের আস্তানা। তাঁর আগে এ অবশ্য চৈতন্যদেবেরও জন্মভূমি। স্বভাবতই নদিয়া তাই বাউল-বোরেগীর দেশ। আবার চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মশাই এই নদিয়ার নবদ্বীপে বসেই মা কালীর রূপ ও তন্ত্র সাধনার সংকলন গ্রন্থটি পর্যন্ত রচনা করে ফেলেন। ফলত আমার নদিয়া বোরেগী-বাউল তান্ত্রিক গুরু ভৈরবী মায়েরও দেশ বটে। আর এর শেষ হাতায় একসময় সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে কৃষ্ণনগরের রাজার বদান্যতায় শোরগোল তুলে দেন। পারস্য থেকে আসা সুফি সাধনার ঘরানা বাংলার গুরু পীরের মহিমাকে বাড়িয়ে ধরে যে ফকির সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘাটাললা; দরবেশী ভাবপ্রবণতার ভাণ্ডার খুলে দিল, সেখানেও নদিয়া সংযুক্ত হল। লৌকিক ইসলাম বা দেল কোরানের মতাদর্শে বিকশিত হয়ে উঠল আমারই নদিয়া।
আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সময়সীমায় বাংলায়। লোকায়ত সাধনার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্র হিসেবে যেন উঠে এল এই নদিয়াই। ঘোষপাড়ায় গড়ে উঠল কর্তাভজা ধর্ম, কুষ্টিয়ায় লালনশাহী মত, বৃত্তিহুদতে সাহেবধনী ক্ষেত্র, ভাগা গ্রামে খুশি বিশ্বাসী স্রোত, মেহেরপুরে বলাহাড়ি সম্প্রদায়। সেই সঙ্গে চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর বাংলার বৃন্দাবনকেন্দ্রিক উচ্চকোটির বৈষ্ণবধর্মের বাইরে সহজিয়া কায়া সাধনার একটা স্রোত তো এই নদিয়ায় বহমান ছিলই। সময় পরিস্থিতির চাপে খণ্ড নদিয়াতেও উঠে এল কুষ্টিয়ার হেঁউড়িয়ার ধর্ম, ভীমপুর-আসাননগর দিয়ে তার বিস্তার শুরু হল। মেহেরপুরের বলরামভজার স্থান হল তেহট্ট পেরিয়ে মোনাকষার নিশ্চিতপুর। দেবগ্রামের ভাগায় খুশি বিশ্বাসের ধর্ম এখন মরা সোঁতা হলেও কল্যানীর ঘোষপাড়ার কর্তাভজা, চাপড়ার বৃত্তিহুদার সাহেবধনী তাঁর ছেউরিয়ার লালন ফকিরের স্রোত এখানে বেশ জায়মান। নিশ্চিতপুরের বলরামীরা হেজেমজে না গেলেও এঁদের ধর্মমতে মানুষের স্রোত ক্ষীণ। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ ও পাটুলি কাটোয়ার সহজিয়া স্রোতের জোয়ার নদিয়াতেও এখন রমরমা। সব মিলিয়ে নদিয়া দেহবাদী কায়া সাধনা, যুগল ভজনা নিয়ে বেশ মশগুল, আর এই পরিবেশের ভেতরই আমার ছোটবেলা থেকে মধ্য যৌবনের জীবন।
বেশ মনে আছে আমার কৈশোর বয়সে আমাদের বাড়ির নিকটস্থ হাজরাতলার ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর আখড়া তৈরি করে নেওয়ার কথা প্রতি সন্ধ্যায় তাঁদের খোলের আওয়াজ ভেসে আসত আমার পড়ার ঘরে, আর সারা বৈশাখ মাস জুড়ে এই দুই কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কাকভোরে গেয়ে ফিরতেন প্রভাতী। রাই জাগানোর সেই সুর এখনও আমার কানে লেগে। বাড়ির কাছের সেই আখড়াবাড়ি আর নেই, বৈষ্ণবীকে সাপে কাটার পর বৈষ্ণব সেই যে কাউকে না বলে কয়ে গেলেন। আখড়াবাড়ি ছেড়ে আর ফিরে এলেন না। বৈষ্ণবীর নিথর দেহ ছুঁয়ে বৈষ্ণবের সেই কান্নার ধ্বনি আমি যেন আজও শুনতে পাই। খোলের আওয়াজ, কর্তালের শব্দ আজও যখন বৈষ্ণবদের আখড়াবাড়িতে পাই তখন আমার এই দুইজন সুজনের কথা মনে আসে। মাধুকরী করতে এসে কখন যেন এঁরা আমার ঠাকুরদাদা-ঠাকুমা হয়ে উঠেছিলেন। বৈষ্ণবী আমাকে গাল ছুঁয়ে আদর করতেন। তাঁর স্নেহাশিষে আমি আমার ঠাকুমাকে পেতাম, যিনি আমার জন্মের আগেই চলে গিয়েছিলেন।
বয়ঃসন্ধির সময় শরীরে আমার এসে ঢুকল বাড়ি থেকে শ্মশানে পালিয়ে যাওয়ার রোগ ভৈরবী মায়ের আস্তানায় সামনে আমার তখন অপার রহস্যের জগৎ। নিত্য নতুন হরেক কিসিমের সাধু দর্শন। তারপর একসময় গোটা পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রত্যন্ত শ্মশানই হয়ে উঠল আমার শ্বাস নেওয়ার জায়গা। তন্ত্র বোঝা, যুগল মিলন দেখা, শবের। ওপর বসে অঘোরী সাধুর নানা ক্রিয়াকরণের আমি সাক্ষ্মী। শাস্ত্রিক বিচক্ষণতার বাইরে প্রায় প্রান্তিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাজবৃত্তান্তই এক সময় বই হয়ে উঠল প্রকাশকের তৎপরতায়। বাজারে এল ‘ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায়’ বইখানি। সাড়া মিলল পাঠকের। তার আগে অবশ্য আমার ‘বাউল গানের কথকতা’ বেরিয়ে গেছে। আমাদের এখানকার সর্বমান্য পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’এ তার প্রশংসাধ্বনি বেজে উঠল বাউলের আখড়াবাড়িতে একতারা, খমক বেজে উঠবারই মতো। এরপর এল বাউল, তন্ত্র, সহজিয়া সাধনার যুগল মন্ত্রটি লেখার অনুরোধ। কেননা তখন আমার বাংলার বাউল-ফকির তান্ত্রিকগুরু-ভৈরবী মা-সাধু-বাউলানি ভৈরব-ফকিরানি-সহজিয়া-বৈষ্ণব-কায়াবাদী সাধক বৈষ্ণবী-অঘোরীদের সঙ্গে আখড়া শ্মশান বাসের এক যুগ অতিবাহিত। লিখে ফেললাম ‘দেহ সাধনায় যৌনতা’। এক বছরের মাথায় ফুরিয়ে গেল বই। বেরোলো দ্বিতীয় সংস্করণ। আমার মতো নতুন লেখকের কাছে এ যে কত আনন্দ ও সম্মানের। আমি উৎসাহ পেলাম। আমার সঙ্গে ২০১২ সালে দেখা করতে এলেন ফারহাদ মাজহার। ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে বসালাম বাউল গানের আসর। তারপরই আমার বৃত্তিহুদায়, নিশ্চিতপুর, দৈকিয়ারি, শালুনিতে ছোটাছুটি বাড়লো। লিখলাম কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলাহাড়ি, লালনশাহী ধর্মের ইতিবৃত্ত ‘নারী সাধনার ভাষা’। মনে খেদ কুষ্টিয়া তথা বাংলাদেশের পীর-ফকির-বাউলের আস্তানা দেখা হলো না। হলো না আমার একবারও বাংলাদেশ ভ্রমণ।
তবু আমি স্বপ্নে এখনও চলে যাই আমার ঠাকুরদাদার দেশে। ময়মনসিংহে পাগলাপন্থী সাধকদের ভদ্রাসন ঘুরে দেখি, নেত্রকোনায় বাউল উকিল মুনশির বাড়ি পৌঁছে যাই, মালজোড়া গানের কথাও মনে আসে যে আমার; আবদুস সাত্তার, জালালউদ্দীন খাঁয়ের স্মৃতিধন্য নেত্রকোনার মাটি স্পর্শ করি; ওখানে যে আমারও পূর্ব পুরুষের অস্তিত্ব লেগে! বড় আনন্দ হয় আমার চলে যাই রতিরাম দাস, করিম শাহ, লালন শাহ, শিতালং শাহ, পাগলা কানাই, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহের দেশে। সিলেট যেতে গেলেই মনে পড়ে হাসন রাজার কথা। আমি শাহ আবদুল করিমের কবরে গিয়ে বসি, রাধারমণের সমাধি মন্দিরে বসে বসে ভাবি এই গান ও ভাটির দেশ তো আমারও মাতামহের ভূমি, এখানে যে আমারও অস্তিত্ব নিয়ে অদেখা অথচ স্বপ্নে চেনা কালনী নদীর বুকে মেঘ ওঠে, বৃষ্টি নয়ে আমি ঝরি সিলেট নামের দেশে। সুনামগঞ্জের নোয়ারাই চলে যাই দুর্বিন শাহের বাড়ি। এভাবেই বাংলাদেশের গান ও বাউলের রাজত্বে আমি প্রবেশ করি।
যৌবনের একেবারে সন্ধিক্ষণে সদর্থক বাউল পাঠ শুরু হয় আমার। প্রথম যাই আমি ঘোষপাড়ার মেলায় বাউল গান শুনতে, সেবারই এ গানের মধ্যে আবিষ্কার করি কৈশোরে ফেলে আসা বৈষ্ণবীর গাওয়া কৃষ্ণময়তার প্রতীক। কৃষ্ণা দাসী যখন গান; মীরা মা যখন সুর ধরেন; সুমিত্রা দাসী মঞ্চে ওঠেন; ভাবি, তাঁদের গলা থেকে বৈষ্ণবীরই আওয়াজ বেরোচ্ছে। ষষ্ঠী খ্যাপা, নবকুমার, নটবর, দয়াল সরকার, নরোত্তম দাসের গলা বৈষ্ণবের সুর নিয়ে গমগম করে। মজলিশপুরের আখড়ায় বসে যখন প্রবৃদ্ধ শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য কথা বলেন তখন আমার বাড়ির কাছে পরিত্যক্ত হাজরাতলার ধূসর আখড়ার কবেকার সেই বৈষ্ণবের মুখ জ্বলজ্বল করে। আমি বেশ বুঝতে পারি কৈশোরে গড়ে ওঠা এই বৈষ্ণব–বৈষ্ণবীর সঙ্গে আমার সখ্য এখন আজীবনের। সেই স্নেহ সখ্য বুকে করে আমি পাক খাই নদিয়ায়। আসাননগরে গিয়ে সুবল দাস বৈরাগ্যের আখড়ায় বসি; তিনিই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান মুড়াগাছার সুমিত্রা দাসীর কাছে। বৈষ্ণবপাড়া, ঘূর্ণীর কালিদাসী অধিকারীর বয়স ও রূপে আবার বৈষ্ণবী ধরা দেন। আসাননগরে তুলিকা মণ্ডল, ভীমপুরের অনিল ক্ষ্যাপা, মাটিয়ারীর মীরা মোহন্ত–এভাবে গোটা নদিয়া চক্রাকারে ঘুরে বর্ধমান ফুঁড়ে উঠি বীরভূমে, হাটগোবিন্দপুরের সাধন দাস বৈরাগ্যের আখড়ায় সময় কাটে, এখানেই দেখা হয় আমার ওসাকার কানসাই ইউনিভার্সিটির দর্শনের ছাত্রী মাকি কাজুমির সঙ্গে। ১৯৯১ সালে সাধন দাস ভারত উৎসবে যখন জাপান সফররত তখনই ওঁর গান শুনে মাকি চলে আসেন এ দেশে। সাধন দাসের তত্ত্বাবধানে বাংলা শিখে এরপর সাধনায় ডুবে মাকি হয়ে ওঠেন বাংলারই বাউলানি। এক সময় পৌঁষমেলায় শান্তিনিকেতনের মূল মঞ্চে তিনি প্রবেশাধিকারই পাননি বিদেশিনী বলে। কিন্তু আজ তিনি বিশ্বের দরবারে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজেরই উজ্জ্বল প্রতিনিধি। ওসাকায়ও মাকি বাউল। চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই টানে প্রতি বছর জাপানি বাউলরা আসেন পশ্চিমবঙ্গে জয়দেবে কেঁদুলির মেলায়। সাধন দাস বৈরাগ্যের ‘মনের মানুষ’ আখড়া সাজে জাপানি বাউলদের সমাহারে। সাদা পোশাকে এঁরা সকলেই তখন বাংলার বাউল। হাটগোবিন্দ পুরের আখড়া তথা এখানকার বাউল সমাজে মাকি কাজুমি এখন মাকি মা; আশ্রম চালান, দীক্ষা দেন, তত্ত্বকথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গে নারী বাউল বা বাউলানির তিনি তো এখন উজ্জ্বল প্রতিনিধি।
মাকির বেড়ে দেওয়া ভাত খেয়ে হাটগোবিন্দপুর ছেড়ে আমি রওনা দিই বাঁকুড়ার নবাসনে। সেখানে নির্মলা মা দেখি আশ্রম সামলাচ্ছেন। তাঁর সাধনসঙ্গী হরিপদ গোঁসাই বাউল সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। হটযোগ ও প্রাণায়ামে দক্ষ এই বাউল প্যারিসে যান যুবক-যুবতীদের যোগ শেখাতে। শীতকালে নবাসনে উঠে আসে টুকরো প্যারিস। ফরাসি সহায়তায় হরিপদ গোঁসাইয়ের মাটির বাড়ির আখড়ায় পাকা ঘর ওঠে, স্যানিটারি পায়খানা, পাতকুয়ো, টিউবওয়েল। এসব দেখে কোথাও যেন আমি সাজুয্য খুঁজে পাই সাধন দাস বৈরাগ্যের আখড়াবাড়ির। ফরাসি-জাপানি সহায়তায় স্বচ্ছল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে বাউলের সংসার। নির্মলা মা আমাকে প্যারিস থেকে প্রকাশিত সিডি উপহার দেন। পৃথুল চেহারার পান-দোক্তা খাওয়া কালো দাঁতের, গেরুয়া বসন পরিহিতা হাসিখানা আজও যে আমার বুক কাঁপায়!
এদিকে নরম বীরভূম। আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালা দাসীর আস্তানাতে দুপুর দুপুর উঠি। ওঁর অশক্ত শরীরে মাধুকরী করে পাওয়া নানা সাইজের জড়ো করা চালের ভাত খেয়ে মরমে মরে যাই। আমি যদি না খাই তাহলে কাল হয়তো তাঁকে ভিক্ষাতে বের হতে হতো না, কিন্তু এ সমাজ এমনই অতিথি পরায়ন কোনও বারণই শোনে না। মহম্মদবাজারে চলে যাই গৌর ক্ষ্যাপার আস্তানায়। সাধনার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। আমি দেখে চমকে যাই মোটা থানের শাড়ি পরা এই মেয়েই আগে অভাবের তাড়নায় শরীর বেচতেন সিউড়ির লজে লজে। বাউলের নারীর এও এক রূপ। সাধন সঙ্গিনীর আগমন এই জায়গা থেকেই। অসহায়, নির্যাতিতা, স্বামীহারা। মেয়েদের গুরুপাঠই যে ভরসা। সেখানেও জায়গা নিরিখে অনেকেরই পূর্বতন অভিজ্ঞতাগুলো কাজ করে। তথাপি এ সমাজে গৌর ক্ষ্যাপার মতো সাধকেরা রয়েছেন। সাধনা, নির্মলারা খেয়ে-পড়ে সম্মানের সঙ্গে বাঁচেন। বাউল সাধনার এও এক দিক। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মেয়ে মানুষদের দেখা মেলে এখানে। কোথায় যেন এসে সাধনা ও যৌনতা এক হয়ে ওঠে। সাধন সঙ্গিনীর থাকা ও চলে চলে যাওয়া, সাধক বাউলের সঙ্গিনী বদলানোর তরঙ্গেও দুলতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজ। জয়দেবে বসে প্রখ্যাত বাউল পূর্ণচন্দ্র দাসের দিদি রাধারানি অভিযোগ করেন, কেউ তাঁকে আর গাইতে ডাকে না এখন; জানান বৃদ্ধ বয়সেও ওকে এখনও মাধুকরীতে বেরোতে হয়। গোপালনগরে গিয়ে আমি তাঁর হতশ্রী দশা দেখে আসি। ছোট ভাই চক্ৰধরের পোলিও রোগে দুটি পা পঙ্গু হয়ে যাওয়া ছেলে নিয়েই যে তাঁর সংসার। ওরই জন্য গান গাওয়া, মাধুকরী। পূণ্যর দিদির এই করুণ কাহিনী শুনে আমি আসি কেন্দুয়াতে ওদেরই ভাই লক্ষ্মণ দাস বাউলের বাড়ি। দেখি নবনী দাস বাউলের সমাধি। আমার সারা শরীরে তখন ঝড় ওঠে। আমি দেখি শান্তিনিকেতনের আশ্রমে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে গান শোনাচ্ছেন নবনী দাস বাউল!
আসি মুর্শিদাবাদ। থাকতে শুরু করি মজলিশপুরে শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্যেরই ওখানে। আলাপ হয় ওঁর শিষ্য বেলডাঙ্গার সোমেন বিশ্বাসের সঙ্গে,চলে যাই সাটুই। প্রখ্যাত বাউল মনোমোহন দাসের সমাধি বাড়িতে। সুলক্ষনার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। এভাবেই বাউল বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে আমার জীবন, ফাল্গুনে ঘোষপাড়া, চৈত্রে অগ্রদ্বীপ, শেষচৈত্রে পাথরচাপুড়ি, জৈষ্ঠ্যে আড়ংঘাটার যুগলকিশোর–বাৎসরিক মেলার সুবাদে আমার বাউল সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বেড়ে চলে। এইসব মেলায় আমি খুঁজে পাই সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলরামভজা, জাতবৈষ্ণব, পাটুলি স্রোতের সহজিয়া, রাধাবল্লভী, বৈরাগী, ন্যাড়া, সাঁই, আউল, দরবেশ, খুশি বিশ্বাসী, গৌরবাদী, মতুয়াপন্থীদের–যারা সকলেই বাউলের সমাজে ঢুকে পড়েছেন। সেই সমাজে, মেলায়, দিবসী, মচ্ছবে দেখা হয়ে যায় তান্ত্রিক ভৈরবী মা, অঘোরী সাধুদের সঙ্গেও। বুঝি লোকায়ত সাধকদের মধ্যে আড়াআড়ি নেই। বৈষ্ণবতীর্থ কেঁদুলি তাই পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের প্রধান আখড়া। বাৎসরিক সমাবেশে এখানে সবচেয়ে বড় বাউল সমাগম হয়। ফরাসি, জাপানিদের পাশাপাশি কুষ্টিয়া থেকেও সাধক বাউলেরা আসেন। সাধকদের পাশাপাশি পাকা প্রোফেশনাল পূর্ণচন্দ্র দাস, পবন দাসেরা পর্যন্ত এ সময় জয়দেবে গান করেন। থাকেন খয়েরবুনির সনাতন দাস বাউলের মতো প্রবীন সাধক বাউল; দেশবিদেশ ঘুরে উল্লেখযোগ্য সরকারী খেতাবও তাঁর ঝুলিতে; ঋত্বিক ঘটকের পুত্র ঋতবান তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র পর্যন্ত নির্মান করেন, এখনকার পাকা আরেক প্রোফেশনাল শিল্পী পার্বতী দাস বাউলও সনাতনের শিষ্যা। গৌর ক্ষ্যাপা সনাতনের মতো অতখানি উঁচু পর্যায়ে না পৌঁছলেও বাউল সমাজে ওরও যথেষ্ট সম্মান আছে। তিনিও বহুবার বিদেশ গেছেন। এখনকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র নির্মাতা ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়ও ওঁর ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরী করেছেন। তা এই গৌর ক্ষ্যাপাও মেলার জয়দেবে আকর্ষনের। বাঁকুড়ার সোনামুখীর বাউল সমাবেশ বৈষ্ণব সাধক মনোহর ক্ষ্যাপার প্রসিদ্ধিতে। একইভাবে বর্ধমানের অগ্রদ্বীপও বৈষ্ণব প্রসিদ্ধিতে জুড়ে। বীরভূমের কোটাসুরের আশ্রম ও মেলা নারায়নচাঁদ গোঁসাই ও তাঁর সাধন সঙ্গিনী ক্ষ্যাপা মা’র প্রসিদ্ধিতেই। বর্ধমানের দধিয়ার বোরেগীতলার মেলা, বেনালীপুরের মেলা, মালদহের রামকেলীর মেলা সবই কায়াবাদী বৈষ্ণব সহজিয়াদের মিলনক্ষেত্র। কিন্তু এগুলো সব এখন বাউল সমাবেশে পূর্ণ। আসলে বৈষ্ণব বাউল মিল-অমিলের ব্যাপার নয়, আসল ব্যাপারটি হল গিয়ে আরোপ সাধনার। অনুমানের পথ ছেড়ে বর্তমানের পথে, দেহভাণ্ডের মশগুল রসে নিমজ্জিত মানুষজনের মিলনক্ষেত্র হল গিয়ে এইসব গ্রাম বাংলার পুরনো মেলা, দিবসী, সাধু সমাগমের অনুষ্ঠান। আচরণবাদীদের সেই ভিড়ের আমিও তো একজন। আমি সাধক নই, সাধনসঙ্গে মিশে মিশে সাধকদেরই ‘মনের মানুষ’। সাধকেরা সব কৃপা করে, ভালোবেসে, স্নেহ দিয়ে আমাকে জায়গা দিয়েছেন তাঁদেরই আখড়াবাড়িতে। আমি সেখানেই থেকে দেখেছি সাধনস্রোতকে। গানে মজে প্রতীকী ভাষার আলোকসম্পাত খুঁজতে সখ্য বাড়িয়েছি এঁদের সঙ্গে। এঁরা দেহতত্ত্ব, সাধনরীতি, স্থলন, ব্যভিচার, সাধনের উচ্চদশা কখন কেমনভাবে যে খুলে দিয়েছেন আমার সম্মুখে নিজেরাও জানেন না।
সেইসব বৃত্তান্ত কোনওদিন লিখব এও আমি স্বপ্নে ভাবিনি। রক্তে লোকায়ত সাধনার বীজ থাকলেও লিখতাম তো কবিতা। এখনও লিখি না যে তাও নয়। তবে আমার গবেষণাকেন্দ্রিক নানা বিষয়ে লেখালেখির চাপে মূলত সে লেখা ‘দেশ’ পত্রিকা কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার মান্য কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী হলেন মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদার বংশের সন্তান। ওঁর বাড়িটি ছিল আমার আখড়া শশান বাদে সময় কাটানোর আরেক জায়গা। আমার কলেজে পড়ার বয়সে নৈহাটির সেই বনানী বাড়িতেই আমি তাবড় তাবড় সব কবিদের পেয়েছি। তাই সেই বৃত্তেও মেলামেশাটাও আমার সহজ হয়ে উঠেছে। একদিকে কবিতা লেখা, কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখা, কবিদের সঙ্গে সময় কাটানো অপরদিকে আমার সেই লুক্কায়িত জগতে মেলামেশা–এভাবেই কাটছিল দিন। কিন্তু একসময় লুকনো জগত্তার কথা জেনে ফেললেন ‘পত্রলেখা’র কর্ণধার গুনেন শীল। ডেকে পাঠালেন আমাকে। বাউলদের নিয়ে লিখবার কথা শুনে কলমে আমার আড়ষ্টতা, অথচ এ জগতের অজস্র গান আমার টেপ রেকর্ডারে বন্দী আর কথা নিয়ম করে আমার ডায়েরী লেখার খাতায়। প্রকাশক তাড়া দিচ্ছেন। লিখতে পারছি না আমি। সেই অস্বস্তির সময় গুরু আমাকে বললেন, তুমি লেখ এ জগতের কথা; বেষ্টিত আড়াল ভেঙে ভাবসাধনার আসল সত্যটুকু তুলে ধর।
গুরুর কৃপাতে আপনাআপনিই লেখা হয়ে উঠল। এক তীব্র নেশায় লিখে ফেললাম বই। প্রকাশকের ঘর থেকে ২০১১ সালের বইমেলায় বেরোলো বাউল গানের। কথকতা। আমি দেখলাম আমার মতো লেখকের বইও বিকোচ্ছে, সংবাদ পত্রে আলোচনা হচ্ছে। এরপর একের পর এক লিখতে শুরু করলাম লোকায়ত সাধকদের কথা। আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর তথাকথিত উচ্চকোটির সংস্কৃতির ভেতর এই যুগল সাধনা নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত ধারণা আছে। বহমান ধারণার ভেতর রয়েছে অবশ্য সাধনবৃত্তেরই কিছু ব্যভিচার ও যৌনবিকৃতি। যা দেখেছি, যেভাবে দেখেছি, বুঝেছি, রপ্ত করেছি সবই দিয়ে আমি আজও লিখে চলেছি প্রান্তিক এই সমাজ কাহিনী। শাস্ত্রবিধিকে উপেক্ষা করে আলাদা অধিষ্ঠানের এই জগৎ আমাকে শিখিয়েছে অল্পে তুষ্ট হয়ে বেঁচে থাকা। আখড়া-শ্মশানে আমার সেই সামান্য বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার খবর যে এ দেশ ছেড়ে প্রাণাধিক বাংলাদেশে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে এও তো আমি স্বপ্নে ভাবিনি।
আখড়া শ্মশানে থাকতে থাকতে কবে যেন তৈরি হয়ে গিয়েছে আমার একটা মাটির মন। তথাকথিত আমার উচ্চশিক্ষা ও উচ্চবৃত্তের সংস্কৃতির বাইরে আমি দাঁড়াতে চেয়েছি হয়তো বা নদিয়া-ময়মনসিংহের মরমিয়াবাদের বীজ আমার শরীরে ঢুকে পড়ার কারণে। এরকমই যে আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই শিক্ষিত হয়েও আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমার তীব্র অনীহা। যদিও বিশ শতকের প্রথমেই হাটগোবিন্দপুরে বাউলের আখড়ায় টেলিফোন, ক্রমে ক্রমে মোবাইল, ফেসবুকে পর্যন্ত বাউলের আইডি। বিশ্বজোড়া বাউল এখন, আধুনিক জীবনে অভ্যস্থ; নানা দেশ দেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর তাপ্পি মারা পোশাকে লেগে। তবে এতে আমি কিছু দোষ দেখি না। ধূলিতল অন্তরে রেখেও বিশ্ববোধের সঙ্গে লোকায়নের মেলবন্ধন ঘটানোটাই বুদ্ধিমানের। তাহলে আমাদের প্রাচীন শেকড়গুলো। ধরে রাখা সম্ভব। সেই সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজেও এসেছে কিছু শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষের সহায়তায়। এখানকার কিছু বাউল তাই তাঁদের দৈন্যতা ও মাটির জড়তা কাটিয়ে আধুনিক হতে পেরেছেন। তাছাড়া এখন লোকশিল্পীদের ভাতারও ব্যবস্থা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকার। সরকারী মেলা-অনুষ্ঠানে গান গেয়ে উপার্জনের পথে গিয়েছেন বাউল। সামান্য শ্রী ফিরেছে বাউলের জীবনে।
আমিও আমার জড়তা কাটিয়েছি অনেক। মোবাইল ব্যবহার করি। যদিও অনেক লেখকের মতো কম্পিউটারে বসে লিখতে পারি না। এখনও হাতে লিখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বছরখানেক হলো ফেসবুক ব্যবহার করি আমার বন্ধু ও প্রকাশকদের বকাবকিতে। আর এই ফেসবুকে এসে যেটা হল, আমার পূর্বপুরুষের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে গেল। আস্তে-ধীরে জানতে পারলাম এখানকারও কিছু মানুষ আমার বইপত্র পড়েছেন। আমার মতো সামান্য লেখকের বই কোলকাতা উজিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছেছে এতেই আমার আনন্দ।
সিলেটের বাসিন্দা লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ আমার অনীহার সেই ফেসবুকের দৌলতেই এখন প্রাণের বন্ধু। যদিও ওকে সামনাসামনি কখনো দেখিনি। ও একদিন আমাকে চমকিত করে বলে বসল, আমার বইগুলো ও পড়েছে এবং রেফারেন্সের কাজে লাগিয়েছে কিছু, আর সে আমাকে ‘বাউল গানের কথকতা’ বেরোবার পর হতে খুঁজছে। আমার তো তখন পিলে থমকে যাওয়ার জোগাড়। তা সেই সুমনই একদিন প্রস্তাব দিয়ে বসল বইয়ের। ওরই ব্যবস্থাপনায় বই করতে এগিয়ে এলেন ঢাকার উৎস প্রকাশনার কর্ণধার। আমি এত সম্মানিত ও বিস্মিত যে মোস্তফা সেলিম কোলকাতা এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। সুফিবাদ, মরমিবাদ, পুঁথি সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে রীতিমতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ এই মানুষটির সঙ্গে আমি সময় কাটিয়ে নিজেকেই ধন্য মনে করি। তিনিও এখন আমার বন্ধু। আমার আশা অন্যান্য প্রকাশকদের মতোই তাঁর সঙ্গে আমার প্রকাশক–লেখক সম্পর্ক কখনোই হবে না। চিরকালই আমার বন্ধু ভাগ্য ভালো। বন্ধুরাই সবসময়। এগিয়ে এসে আমাকে তুলে ধরেছেন, আমি শুধু ওদের সঙ্গে সেঁটে থাকতে চেয়েছি। এছাড়া আমার যে আর কোনও যোগ্যতা নেই।
‘পশ্চিমবঙ্গের বাউল’ অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে রমরম করে চলল। চক্ৰতীর্থে বসেই সে সংবাদ এলো। এরপর ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ছড়িয়ে পড়ল বই। বন্ধুরা জানাতে থাকলেন ফেসবুকে। ওখানকার মান্য সংবাদপত্র ও পত্রিকাতে আদৃত হল। বই। এর পাশাপাশি বহিবঙ্গ ত্রিপুরা থেকেও বের হল বই ‘বাউল বাউলানির দেহসাধনা’। স্রোত প্রকাশনার গোবিন্দ ধর যত্ন নিয়ে ছাপলেন বই। ত্রিপুরা থেকে অসম ছড়িয়ে পড়ল বই। সেখানকার বাঙালি পাঠকদের কাছ থেকেও খবর আসতে থাকলো। এইসব বার্তার ভেতরই আবার নতুন কাজ, নতুন বই, দুই বাংলার বাউল আখড়ার আখ্যান। বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অসম, পশ্চিমবঙ্গ–বাংলাভাষার পাঠকদের কাছে এভাবে যে ছড়িয়ে পড়ব কোনওদিন ভাবিনি। গুরুকৃপা না হলে এমন উজানে ভাঁটির নাও বাওয়া কখনো কি সম্ভব? তন্নো ধিয়ঃ প্রচোদ্দয়াৎ।
এবারের ছড়িয়ে পড়ার দায়িত্ব নিয়েছে বন্ধু অরুণাভ। ওদের আত্মজা পাবলিশার্স এর তৎপরতায় নতুন বই পাঠক আদৃত হলে দীর্ঘদিনের আমার এই ঘোরাফেরাটা আরও একটু পূর্ণতার দিকে যেতে পারে। সাঁইজি বলেন, ‘মুর্শিদ পথের দাঁড়া যাবে কোথায় তারে ছাড়া।’
০১.১ প্রতিপদে পূর্ণিমা যার তিন ধারাতে জনম তার
ঘোষপাড়া মেলার আগের রাত। মেলা শেষ পর্বের প্রস্তুতির আয়োজন সেরে ফেলেছে পুরোদমে। আখড়ায় বাউল ফকিরদের সমাবেশ। সাধুরা তাঁদের ডেরায় ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গল্পে মশগুল। হোমযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে দু’এক জায়গায়। আজ চাঁচর। এ রাতের চাঁদে পূর্ণিমার ঘোর লেগে। চতুর্দশীর আলো নিয়ে চাঁদ দাঁড়িয়ে পড়েছে সতীমার পুকুরের পাড়ে। এ ধারটা নির্জন। দু’একজন বৃদ্ধা ভিখারি রাতে শোবারও প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে বাঁধানো পাড়ে ময়লা ঘেঁড়া চাঁটাই পেতে। পুকুরের সিঁড়ির দিকটায় এগিয়ে গেলাম গানের আওয়াজ পেয়ে লোকজন তেমন নেই। অথচ এখানে এমনভাবে বসে কে গাইছেন এই গান! কাকে বা শোনাচ্ছেন! এগিয়ে গেলাম আমরা তিন বন্ধু। শীতের কামড় না থাকলেও ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। এ বছর দোল আগে। মাঝ ফেব্রুয়ারি বলে শীত তার লোটাকম্বল গুছিয়ে নেয়নি। ভাঁজ করা চলছে সবে। আমি গায়ের পাতলা চাদরটা কানে মাথায় জড়িয়ে নিলাম। আমার আবার চট করে ঠাণ্ডা লেগে যায়। গানের রেশ আমাদের কানে পুরোপুরি লেগে গিয়েছে। আমরা নিবিষ্ট মনে শুনছি। বৃদ্ধ এক ফকির একমনে গেয়ে চলেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পাননি এখনও। পুকুরের দিকে মুখ করে রয়েছেন বলে আমাদের তিনি দেখতেও পাচ্ছেন না। হাওয়ায় আমার দুই বন্ধুর চুল ফরফর করে উড়ছে। চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ছে হাওয়া। চাদর পুরোটা জড়ানো নয় বন্ধুদের শরীরে। উত্তরীয় করে গলাতে দোলানো। হাওয়া ঢুকে চাদর বেঁকেচুরে যাচ্ছে। উত্তরীয় যেন দোল খাচ্ছে রাধাকৃষ্ণের মতো। দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে শুরু করলে শরীরী সেই ভালোবাসার মধ্যে যেভাবে দু’জনের প্রত্যঙ্গ নড়ে; দোল খায়, ফকিরের পিঠে তারই ছায়া পড়েছে যেন। ভালোবাসায় মেতে উঠেছেন তিনি। এমনি তাঁর গায়কির আবিষ্টতা। তন্ময় হয়ে যাচ্ছি আমরা সব। আবীর ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছে না। সুজিত ফাঁকা নির্জনে এসেছে সিগারেটে গাঁজা ভরে টানবে বলে, টানা দূরের কথা গাঁজার প্যাকেটও পকেট থেকেই বের করে উঠতেই পারেনি। গান এভাবেই বিবশ করেছে ওদের, মশা কামড়াচ্ছে। মুখের চারধারে ঘুরঘুর করছে মশা। তবু আমারও বিরক্তবোধ নেই। ফকির যেন গানের গাঁজা খাইয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। গাইছেনঃ
পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে
তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর-দক্ষিণ
রবি শশি তার দুই কিনারে। বা
পের ঘরে রবির কিরণ
শশির ঘরে মার দর্শন
তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন
বাছাধন তাই চিনে নেরে।
কি করে চিনি চক্ররে
উদর ভরে আধ অক্ষরে
তোরা রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি
ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে।
শাহা শির আলির হৃদয়পুরে
কেনে রয়েছে ঘুমের ঘোরে
ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা
চেয়ে তোর নগরচাঁদ নগরের পরে।
ঘোর ভাঙল ফকিরের। পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলাম। তারে আর গান শোনানো হবে না। সে বলল মানুষ এসেছে গো। তুমি থোও। কথা কও ওদের সঙ্গে। গান শোনাও। আমি পিছন ফিরি দ্যাখলাম সত্যি। আপনারা সব এসি গিয়েছেন। বসেন খ্যাপারা সব। দুটো-একটা কতা কই। পরাণের কতা।
আমাদের তিনজনই ফকির বসার একটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে বসে পরলাম। আবীর সিগারেট ধরাল। সুজিত বের করে নিল গাঁজা। ফকির আর আমাদের দূরত্ব এখন এক সিঁড়ির। কিন্তু এই মানুষটাকেই এতক্ষণ আমরা ধরতে ছুঁতে পারছিলাম না। গানে তিনি আমাদের থেকে যোজন দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিলেন। এখন যেন খানিক ছুঁতে, ধরতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। আবীর কলকে ছাড়া গাঁজা টানে না। ওর নাকি সিগারেটে আমেজ হয়না। কলকে প্রস্তুত করে বার দুই টানার পর ও ফকিরের দিকে বাড়িয়ে ধরল সেটা। বলল, নেন আসেন।
কলকে প্রসন্ন বদনে কপালে ঠেকালেন ফকির। টানলেন। বার দুই টানার পর বললেন, ওধারে খেপী মা রয়েছেন। ওনারে একটু দিই, ডাকি? কী বলেন আপনারা।
কিছু বলার আগেই তিনি ডাকলেন–মা, মাগো, আসো দিকি এদিক পানে। বাবারা সব প্রসাদ করিছে।
মস্ত এক হাওয়া বইল এ সময়। আমরা দেখলাম হাওয়া ফুঁড়ে উঠে এলেন যিনি তাঁর সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। লাল শাড়ির আঁচলে তবু লেপ্টালেপ্টি খাচ্ছে হাওয়া। কপালের সিঁদুর জল লেগে মিয়ে গেছে যেন। হাত ভর্তি পলায় চাঁদ লেগে জলের চিকচিক।
মা এসে ছিলিম ধরলেন। কোনওদিকে তাকালেন না পর্যন্ত। কপালে ঠেকালেন। বললেন, ব্যোম শঙ্কর। বার তিনেক টেনে তিনি নেমে গেলেন সোজা। যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন সেখানেই চলে গেলেন তিনি। এ যেন সীতার পাতাল প্রবেশ।
ফকির বললেন, গরম ধরিসে মার সেই থেকে জলে।
আমি ভাবলাম, এই শেষ শীতেও মা-র শরীরে এত গরম।
বললেন, তারাপীঠ থেকে এসেছেন মা। সঙ্গে কালভৈরব। এসে থেকে জলে রয়েছেন তিনি। তন্ত্র করেন তো। তাই শরীরে এত তাপ মা’র। তারাপীঠ যাবেন। দেখবেন শ্মশানে মায়ের দাপট। প্রতি অমানিশায় ক্রিয়াকর্ম করেন তিনি আর কালভৈরব। ভৈরব এসে থেকেই যে কোথায় গায়েব হলেন!
হাওয়া দিচ্ছে। খেপী মা জলেই সেঁধিয়ে রয়েছেন। চুপ হলেন ফকির। চোখে বোধহয় রং লেগেছে। বেশ কিছু টান হয়ে গেছে তাঁর।
******
জিজ্ঞাসা করলাম–কাকে গান শোনাচ্ছিলেন?
–কাকে আবার! ফিক হেসে বললেন ফকির। আমার এ সময় মনে পড়ে গেল কবির কথা–’চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। / ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।’
আমি সত্যিই চাইছি ফকির তাঁর জ্যোৎস্না হাসির পরত ছুঁয়ে কিছু বলুন। অমন যার গান; ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোনো সব কথার কুচি, এমন ভাব যেন তিনিই পদকর্তা। এতখানি একাত্মতা! গানের সেই পরশ কথাতেও নিশ্চয়ই থাকবে। এ আমার বিশ্বাস। তবে অভিজ্ঞতার পর এরকম বিশ্বাস আমি সংগ্রহ করেছি।
জবাব দিলেন না ফকির।
তবে কি তিনি কথা বলতে চাইছেন না!
ভাবলাম আমি।
বললাম, ‘তালে আমাদের দেখার সাথে সাথে বললেন যে, ‘তারে আর গান শোনানো হবে না।‘ কাকে গান শোনাচ্ছিলেন আপনি? খেপী মা তো বললেন ডুব মেরেই থাকেন জলে। কুম্ভক করে। তবে শ্রোতাটা কে শুনি? কেউ তো নেই এখানে।
আবারও ফিক হাসলেন ফকির। চুপ মারলেন। বুঝলাম তিনি কিছুই বলবেন না।
বললাম, আমরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন পরাণের কতা কইবেন। কই কিছুই যে কইছেন না!
নীরবতা ভঙ্গ দিলেন ফকির।
বললেন, খ্যাপার যে আর তর সইছে না।
আবীর, সুজিত থম মেরেছে। বুঝলাম ধরেছে ওদের।
ফকির বললেন, আমি খ্যাপা চাঁদরে শোনাচ্ছিলাম গান। চাঁচরের চাঁদ কথা কইছে। ভাবলাম চাঁদরে চাঁদের কতাই শোনাই। তাই চিমটে বাজিয়ে গাইছিলাম আর কী।
চমকে গেলাম আমি।
বলেন কী ফকির! চাঁদকে শোনাচ্ছেন গান। আশ্চর্য!
বিস্ময়কে তিনিই ভাঙলেন।
বললেন, ভাবছেন নেশা ধরি গেছে আমার। তা খ্যাপা চাঁচরে তো চাঁদের নেশাই ধরে।
আমি চুপ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
ফকির বললেন, আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন।
আমি অবাক।
বলে চলেছেন তিনি–সকল মানুষই কথা কয় চাঁদের সঙ্গে। বুঝে, না-বুঝে, জেনে, না-জেনে কথা চলে চাঁদের সঙ্গে। খ্যাপা জানেন তো আপনে। এ লাইনে ঘোরাফেরা তো অনেকদিনের বলেই মনে হচ্ছে। চিমটেটা বাজাতে থাকলেন তিনি। আবার গান ধরলেনঃ
সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে
অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে
অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগ আজব-সম্ভব সম্ভোগ
জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ
গতি হয় অখণ্ড দেশে।
রবিশশী রয় বিমুখা
মাস অন্তে হয় একদিন দেখা
সেই যোগের যোগে লেখাজোখা
সাধলে সিদ্ধি হয় অনায়াসে।
দিবাকর নিশাকর সদাই
উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়
ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়
লালন রে তোর হয় না দিশে।
প্রথমেই বুঝেছিলাম বৃদ্ধ ফকির চাঁদ বলতে কী বোঝাতে চাইছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখেছি না জানার ভান করলেই বেশি জানা যায়। আমি যে তাঁর ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি এটা অভিজ্ঞ ফকির ধরে ফেলেছিলেন। এজন্যই আমাকে এ লাইনে অনেকদিনের কথা বলেছিলেন তিনি।
গানের ভেতর দিয়েই ফকির বলে দিয়েছেন, সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে। সত্যিই ভাবের এই আবেশ না থাকলে প্রতীকী কথকতার অন্তঃসার কিছুই ধরা যাবেনা, বোঝা যাবে না। আর তা না ধরতে পারলে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ও অধরা থেকে যাবে। পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই ডুবে যেতে হবে। শরীরের গহন অন্দরে, কলকজায় রয়েছে সেই পূর্ণিমার চাঁদ। পদকর্তা শাহ শির আলি তারই হদিশ দিতে চেয়েছেন পদটিতে।
ফকির যার জন্য বলেছিলেন আমাকে ‘আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না?’ তাঁর এই জিজ্ঞাসা মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা। দেহসাধক এর উত্তর পান দেহকে ধরে। তাঁর এই দেহ জানা, দেহ চেনার অন্তর্জগত তৈরি করে দেন গুরু। গুরু দেহের অবিকৃত প্রকৃতিগুলোকে খুলে ধরেন। দেহপ্রকৃতি তখন হাসে, জাগ্রত হয়, চাঁদও ধরতে পারে সেজন্যই সুফিসাধক জালালউদ্দিনের গানে আমরা পাই—’চিনগে মানুষ ধরে/ মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে। / কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় / পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে/ দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে–/ তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।’
প্রশ্ন হল আমাদের দেহ কীভাবে এই চাঁদকে খুঁজে পাবে? কীভাবে বা আমরা ধরব শাহ শির আলির চাঁদ। বৃদ্ধ ফকির তো সেই চাঁদ খুঁজে, চাঁদ ধরে দিব্যি বেশ চাঁদের সঙ্গে কথকতা কইছেন। গান শোনাচ্ছেন চাঁদকে। ভাবা যায়, আশ্চর্য!
তবে আমরাও ইচ্ছে করলে চাঁদকে অনায়াসে গান শোনাতে পারি। তাঁর জন্য আমাদের শরীরকে কেবল জাগ্রত করতে হবে যোগে। শরীরের ভেতর আমাদের চাঁদ আর সূর্য সদা বিরাজমান হয়ে দিব্যি আলো ছড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। তন্ত্রে মৎস্যসাধক তিনিই হতে পারেন, যিনি শরীরের গঙ্গা ও যমুনা নামে দুই মাছকে বেশ ভালোভাবে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিতে পারেন। কীভাবে খাবেন তন্ত্রসাধক শরীরের এই দুই কল্পিত মৎস্যকে?
‘গঙ্গা যমুনয়োর্মধ্যে মৎসৌ ঘৌ চরতঃ সদা/ তৌ মৎসৌ ভক্ষয়েদ যস্তু স ভবেন্মৎস্য সাধকঃ।।’ অর্থাৎ কিনা গঙ্গা যমুনার মধ্যে দুটো মাছ চরে বেড়াচ্ছে। গঙ্গাকে। সাধক বলছেন ইড়া, পিঙ্গলা হল যমুনা। রজ ও তম এই দুই মাছ তার মধ্য দিয়ে চলাচল করে। রজ=শ্বাস, তম=প্রশ্বাস। যে সাধক এই দুই মৎস্যকে ভক্ষণ করতে পারেন তিনি। মৎস্যসাধক বা মৎস্যাসী। কীভাবে এটা সম্ভবপর? এটা সম্ভবপর যোগক্রিয়ায়। প্রাণায়ামে রেচকেপূরকে। কুম্ভকে।
মৎস্য অবতারের গল্পে আছে মৎস্যের আবির্ভাবই হয়েছিল সপ্ত ঋষিকে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য। এক অসুর বেদ চুরি করে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। বেদও মৎস্য অবতার উদ্ধার করে আনেন।
সমুদ্রকে আমরা ধরতেই পারি মানবদেহ। সমুদ্রের তলদেশ হল মূলাধার। মূলাধার চক্র নীচস্থ অবস্থানেই থাকে শরীরে। শ্বাসবায়ু হল মৎস্য, অসুর হচ্ছে প্রশ্বাস বায়ু। এই অসুর কুলকুণ্ডলিনীকে মূলাধারের দিকে টেনে নামিয়ে আটকে রাখে। সপ্ত ঋষিকে আর বেদ চুরি করে এনে রাখার মতো করেই। শ্বাস মৎস্য অবতার সেজে মূলাধার থেকে সেই কুলকুণ্ডলিনী অর্থাৎ চক্ৰমধ্যস্থিত শক্তি বা জ্ঞানকে টেনে ওপরে তোলে। এইজন্য শ্বাসকে মৎস্য অবতার রূপে ভাবতে পারি। আর এই রূপকে, প্রতীকে শ্বাসকে ভাবলে প্রশ্বাসকে করতে হচ্ছে অসুর। তাহলে দাঁড়াল এইঃ শ্বাস/ প্রাণবায়ু/ মৎস্য, প্রশ্বাস/ অপান বায়ু/ অসুর।
সাধক যেমন আমাদের নাড়িকে নদীরূপের প্রতীকী অবয়ব দিয়েছেন তেমনই নাড়িকেই আবার আকাশ, মহাকাশের দ্যোতনাও দিয়েছেন। আর সেই দ্যোতনাকে সাথে নিলে ফকির কথিত চন্দ্র রয়েছে আমাদের শরীরের মধ্যেই। কীভাবে? চন্দ্রকে বাউল সাধক / দেহ সাধক / সহজিয়া সাধক বলেন ইড়া আর পিঙ্গলাকে সূর্য। বাউল অবশ্য সরাসরি চন্দ্রকে ইড়া বলেন না। চন্দ্র হল তাঁদের কাছে বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক। রেচক করার সময় শরীরের ভেতর টেনে নেওয়া বায়ু ডান নাক দিয়েই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পূরকে যা বাঁ নাকের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে টেনে আনা হয়। ডান নাক দিয়ে বায়ু রেচন করা হয় আবার বিপরীতক্রমে মানে শ্বাস ছেড়ে দেবার পর ডান নাকেই টেনে দুই নাকে রেখে কুম্ভক করে বাঁ নাক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় রেচক করেই।
মহাবিশ্বের সৃষ্টির স্তরকেও সাধক শরীরের মধ্যেই দেখেন। ছটি স্তরকে তাঁরা দুটি চক্র হিসাবে বর্ণনা করেন এবং প্রত্যেকটি চক্রে এক একজন নিয়ন্ত্রক দেবতা আছেন আর চক্ৰমধ্যে একটি বিশেষ গুণও বর্তমান বলে তাঁদের বক্তব্য। চক্রে চক্রে সাধক যখন সেই চেতনাকে অপর চক্রে ঠেলে তুলে উধ্বক্রমে শক্তিকে তুলতে তুলতে চক্র পার হয়ে যান তখন একেক চক্রকে তাঁরা বলে থাকেন মহাবিশ্বের স্তর। এই ছয় চক্রের শেষ দুই চক্রের মধ্যে কিন্তু চন্দ্র রয়েছেন। চন্দ্রই এই দুই চক্রের নিয়ন্ত্রক দেবতা। বিশুদ্ধ চক্র সাধকের কাছে মহাবিশ্বেরই তর্পলোক, তা সত্ত্ব গুণে আচ্ছন্ন আর নিয়ন্ত্রক দেবতা চন্দ্র। আজ্ঞা চক্র সত্যলোক, সত্ত্ব গুণ তার। নিয়ন্ত্রক দেবতা সেই চন্দ্রই। তাহলে এখানে এভাবে। দেখলেও কিন্তু দেখব শরীরের ভেতরই রয়েছে চন্দ্র। প্রসঙ্গত এখানে বাকি চার চক্রের কথাও বলে রাখি। মূলাধারে ভুবর্লোক, গুণ তম, নিয়ন্ত্রক দেবতা অগ্নি। স্বাধিষ্ঠানে স্বর্লোক, তমগুণ, অগ্নি দেবতা। মণিপুরে মহর্লোক, গুণ রজ, দেবতা সূর্য। অনাহতে জনর্লোক, রজ গুণ, সূর্য দেবতা।
মুদ্রা সাধকের তন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবেঃ ‘সহস্রারে মহাপদ্মে কর্ণিকা মুদ্রিতা চরেৎ। আত্মা তত্রৈব দেবেশিকেবলং পারদোপমম।।/ সূর্য কোটি প্রতীকাশং চন্দ্রকোটি সুশীলতম। অতীব কমনীয়ঞ্চ মহাকুণ্ডলিনী যুতম। যস্য জ্ঞানোদয় তত্র মুদ্রা সাধক উচ্যতে।।’ মানে হল মাথার উপরের অংশে সহস্রার মহাপদ্ম বর্তমান। তার কর্ণিকার মধ্যে পারদের মতোই ঢল ঢল সুনির্মল সাদা বর্ণ সব আছে। সেই বর্ণের এমনই জ্যোতি যে, চন্দ্ৰসূর্যের জ্যোতি থেকেও সে জ্যোতিস্মান। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন কুণ্ডলিনী আকারে মহাশক্তি। তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্মণ, তুরীয় তুরীয়াতীত আনন্দ সব। যার জোরেই শরীরের রাস্তাঘাট, গাছপালা সব প্রকট হয়ে পড়ছে। চাঁদকে কিন্তু মনের প্রতীক হিসাবেও ধরে থাকি আমরা। ধরার কারণ চন্দ্রের বিভিন্ন কলাতে মনের প্রভাব। মহিলাদের, বলা ভালো, সঙ্গিনীর রজঃপ্রবৃত্তির সময়কে বাউল সাধক অভিহিত করে ‘অমাবস্যা’ বলে। আমাদের এক সংস্কারও আছে–মাসিক বা রজঃপ্রবৃত্তির সময় বাড়ির মহিলারা ঠাকুর ঘরে ঢোকেন না। পুজো করেন না ওই সময়। বলেছি আমরা চাঁদকে মনের প্রতীক। চেক বিজ্ঞানীরা প্রমাণও করেছেন রজঃপ্রবাহের সময় মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি হয়। আর দেবার্চনা হল গিয়ে ধ্যানস্থ অবস্থার কাজ। ধ্যানে ভক্তিতে দেবতাকে ডাকার, অর্চনা করার নিয়ম। এই রজঃপ্রবাহের কালে যেহেতু মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি মাত্রাতে থাকে সেইজন্যই আসলে এই সংস্কার। এই যৌক্তিকতাকেই বোধহয় সংস্কারে গাথা হয়েছে। তবে তাও নয়। সংস্কার আগে তৈরি। প্রামাণিক নথি বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে বেশ পরে। তবে বোধহয় সংস্কার এ কারনেই গড়া–রজঃপ্রবাহের সময় বা চলাকালীন সেই স্রোতে যৌনাঙ্গ তথা চারপাশ অশুচি বা চটচটে হয়ে পড়ে। কাপড় জাতীয় বস্তু ব্যবহার করতে হয়। তখন তো আর টেনে নেবার মতো ন্যাপকিন জাতীয় কিছু ছিল না। তাই এই অপরিচ্ছন্ন দশাতে, ঘিন ঘিনে ভাবে ঠাকুরের কাছে যেতে যেন বাঁধো বাঁধো লাগে। সেই থেকেই এই বিধিকল্পের সংস্কার। চন্দ্রের প্রভাবে যে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে তা জ্যোতিষীরাও মানেন। সেজন্যই তাঁরা অস্থির মতি ব্যক্তিদের ‘মুন স্টোন’ ধারণ করার পরামর্শ দেন।
খেপী মা সেদিন আমাকে শিবের মাথার বাঁকা চাঁদকে বলেছিলেন সাধকের সিদ্ধির জাগৃতির স্বরূপ।
তা বাবা ফকির তো কোলো তার মতো। চাঁদ, ব্যোমভোলার মাথার চাঁদ কী। বাবা? কী মনে কর তুমি?
আমি চুপ।
মা বললেন, ওসব সাধনযোগ তুমি ছাড়ান দাও দিকি।
ফকির হাসছেন মিটমিট করে। কালভৈরব তখন মায়ের পাশে।
খেপী মা বললেন, শিবের চাঁদ সাধনে সিদ্ধি গো।
কীভাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
খেপী মা বললেন, চাঁদ শূন্যতা। শূন্যতা পরম। পরম হল গিয়ে শিব–বলেই মা ব্যোমভোলে ব্যোমভোলে বলে দু’বার চিৎকার তুললেন।
ভৈরবের ডেরায় তখন যজ্ঞের আগুন নিভে আসছে। ফকির চিমটে নিয়ে তৈরি। ভৈরবের কথামতো গান ধরলেন তিনি।
কালভৈরব বলতে লাগলেন–চন্দ্র হল ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। বাউল ফকিরও তা মানে। তাদেরও ব্রহ্মাণ্ড শরীর। আমাদেরও। সবার ব্রহ্মাণ্ড হল গিয়ে সেই শরীর। আমি-আমি আমি-আমি–বলতে লাগলেন ভৈরব।
থামেন দিকি।
খেপীর কথায় বাবা থামলেন।
মা বললেন, শরীরের আজ্ঞা চক্র ভেদ হলেই চন্দ্ৰজ্যোতি বের হয়। শিবের মাথার চাঁদ হল সেই জ্যোতি। শরীরই শিব বাবা।
ভৈরব বললেন, আজ্ঞা ভেদ হলে একে একে শক্তি উপরে উঠেই শিবত্ব লাভ। জীবত্ব থেকে মানুষ শিবত্ব লাভ করে। মানে হল মানুষই ভগবান।
বেষ্টিত ভক্ত-শিষ্য বলতে লাগলেন, কালভৈরব কী জয়। খেপী মা কী জয়। তারাপীঠ কী জয়। তারা মা কী জয়। জয় শঙ্কর।
খেপী মা বললেন, হারামজাদারা সব জয় দিলি,সিদ্ধ ফকিরের জয় দিলি না। বলেই বললেন, ফকির ফজর শাহ কী।
সমবেতভাবে জয়ধ্বনি উঠল–জয়।
গান ধরলেন ফকির। শোনা সেই গান। পুকুর ধারে যা গেয়েছিলেন ফকির।
*****
গানে স্পষ্টই বলা হয়েছে–’পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে/ তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ/ রবি শনি তার দুই কিনারে।’ পূর্ণিমার চাঁদ হল চন্দ্রকলার বৃদ্ধির পর একেবারে পূর্ণাঙ্গ অবস্থা। এই পূর্ণচন্দ্র হল বাউল মতের প্রেম। পূর্ণচন্দ্রের প্রতীককে বাউল প্রেমই বোঝেন। ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরার অর্থ প্রেমকে সাঙ্গ করা। যে প্রেম শরীরের মধ্যে রয়েছে। প্রেম এখানে কাঙ্খিত পরম ঠিকই কিন্তু সেই পরমকে পেতে, উপলব্ধি করতে শরীরের যোজন যোজন পথই অতিক্রম করতে হয় বাউলকে। Platonic Love এর কথা আমরা জানি। আবার শরীর ছাড়া প্রেম হয় না কিছুতেই; আমি তোমাকে ভালোবাসির অর্থ তোমার সত্ত্বাকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু এই সত্ত্বা তো শরীরের মধ্যস্থিত সত্ত্বা; রক্তমাংসের সত্ত্বা, তাই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকেও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চান অনেকে। বাউল এই দ্বিতীয় মতে থাকলেও তাঁদের। বিশ্বাস শরীরের পথঘাট, রজ-বীর্য পার হয়ে এই ভালোবাসা হল কাম-পথকে পেছনে। রেখে প্রেম-পথকে সামনে আনা। এই পথ সাধনার পথ। প্রকৃতি-পুরুষের / যুগল শরীরের সাধনপথ। বাউল বলে একে ‘রাগের ভজন’। ‘রাগ’ এখানে, এ পথে আত্মার মোহাবস্থা বা নিজের কামাবস্থা কাটিয়ে ফেলে নিজের জাগ্রত দেহকে গরীয়সী করে তোলা। দেহ করে তোলা ভাবদেহ। বাহ্যদেহকে নষ্ট করলেই দেহ হবে ভাবদেহ। তার জন্যই দেহসাধনা। বাউলের সাধনা বাউল মতে ‘রাগের ভজন’ যেমন, তেমনই, ‘রাগের কারণ’। তাঁরা নিজেকে অনেক সময় ‘রাগের মানুষ’ বলেও উল্লেখ করে থাকেন। যা ‘মনের মানুষের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।
গানে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরবার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ দিকে যেতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ বাউলের কাছে তিন নদীর নামান্তর। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীরূপী তিনি নাড়ি ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। শুধু বাউল সাধক নন, তন্ত্র তথা আমাদের যোগশাস্ত্র এই তিন নাড়িকে নদীনামের শিরোপা দিয়ে ‘ত্রিবেণী’ বা ‘ত্রিকূট’ বলে অভিহিত করেছে। বাউল অবশ্য ‘ত্রিকুট’ বলেন না। প্রধান চোদ্দ নামই আমাদের চোদ্দটি নদীর নামেই। চোদ্দ নাড়ি কী কী? ‘সুষুড়ো পিঙ্গলা চ গান্ধারী হস্তি জিত্বিকা। / কুহূঃ সরস্বতী পূষা শঙ্খিনী চ পয়স্বিনী। / বারুণ্যলয়ুষা চৈব বিশ্বোদরী যশস্বিনী। / এতাসু তিম্রো মুখ্যাঃ সুঃ পিঙ্গলেড়াসুষুমিকাঃ।।’ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী ও যশস্বিনী–এই চোদ্দটি নাড়ির মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না প্রধান। সাধক এই চোদ্দ নাড়িকে বলছেন পূণ্যনদী। তিনটি নাড়ির নদীনাম বলে ফেলেছি আমরা। বাকি এগারোটি নাড়ির নদী নাম হল–গান্ধারী = কাবেরী, হস্তিজিহ্বা = সিন্ধু, কুহু = নর্মদা, পূষা = তাম্রপর্ণী, শঙ্খিনী = তাপ্তী, পয়স্বিনী = গোদাবরী, বারুণী = চন্দ্রভাগা, অলম্বুষা = গোমতী, বিশ্বোদরী = বিতস্তা, যশস্বিনী = ইরাবতী। সাধক বলেন গঙ্গারূপা ইড়া, যমুনাস্বরূপা পিঙ্গলা আর সরস্বতীরূপিণী সুষুম্না। আজ্ঞাচক্রের উপরে ত্রিবেণী বা ত্রিকূট রূপের প্রতীকী স্থানে মিলিত হয়েছে। এই তিন নদীরূপী নাড়িতে সাধক যোগক্রিয়ায় বাহ্যস্নান সারেন প্রতিনিয়ত। এলাহাবাদের ত্রিবেণীতে স্নানে যে পূণ্য এই বাহ্যস্নানেও সাধকগণ একইরকম পূণ্যফল লাভ করে থাকেন। বাউল সাধকও তাই বিশ্বাস করেন। তন্ত্রমতে ইড়াকে চন্দ্রস্বরূপা, পিঙ্গলাকে সূর্যস্বরূপা এবং সুষুম্নাকে চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নিস্বরূপা হিসাবে দেখা হয়। আর এই তিন নাড়িতেই সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনটি গুণ বিরাজমান।
ফকিরের গাওয়া গানের মধ্যেও রয়েছে তারই যথার্থ সংকেত। পূর্ণিমার চাঁদ ধরার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ’ দিকে চেয়ে দেখতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ তিন নাড়িরূপী নদীর মিলনক্ষেত্র। সুষুম্না নাড়ি মূলাধার থেকে উৎপন্ন হয়ে একেবারে ব্রহ্মরন্ধ্র। পর্যন্ত গিয়েছে। ব্রহ্মরন্ধ্রে শরীরের শেষচক্র সহস্রারের স্থান। সুষুম্নার বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া আর পিঙ্গলা ডান দিকে। ত্রিবেণীর উত্তরদিক বলতে ইড়া এবং দক্ষিণ দিক বলতে সুষুম্নাকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পদকর্তা প্রতীকী ভাষাতে। ‘রবি শশি দুই কিনারে’ মানে হল ইড়াতে চন্দ্রের স্থান আর সুষুম্নাতে সূর্যের স্থান। যার কথা প্রতীকময়তার ইঙ্গিত আমরা কিছু আগে বলে নিয়েছি। পদকর্তা বলেছেন: ‘বাপের ঘরে রবির কিরণ/ শশির ঘরে মার দর্শন / তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন / বাছাধন তাই চিনে নেরে।’ বাপ–মা এখানে পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলদেহ। সাধক ও সাধন সঙ্গিনী। বাপকে সূর্যের প্রতীকে রাখা হয়েছে, মাকে চন্দ্রপ্রতীকে। কারণ ইড়াতে চন্দ্র আর পিঙ্গলাতে সূর্যের অবস্থান বলে। পদকর্তা বা সাধক এ নির্দেশ দিচ্ছেন শিষ্যকেই। সেজন্যই বলা হয়েছে গানে ‘তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন’। সৃজন হল যুগলসাধনের জন্য প্রাণোচ্ছ্বসিত সৃষ্টিবলয়। একত্র সাধনার ইঙ্গিত। বাছাধন’ বলে শিষ্যকে সে সাধনায় নামবার জন্যই বিধিকল্প বেঁধে দিয়েছেন গানে। যার জন্যই চক্রকে চেনার ইঙ্গিত–’কি করে চিনি চক্ররে’। কেন না চক্রের ভেতরেও তো চাঁদ আছে।
কীভাবে রয়েছে সেই চাঁদ? কোন্ অবস্থাতে শক্তির কলাকৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদ? সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। চাঁদ রয়েছে বিশুদ্ধ আর সহস্রার চক্রে। বিশুদ্ধ চক্রে শাকিনী শক্তির কল্পনা করে থাকেন দেহসাধক। তিনি কিন্তু আবার চন্দ্রের মতো শুক্লবর্ণা। আর এই চক্রতেই চন্দ্রমণ্ডলকেও কল্পনা করে বসেন সাধক। বিশুদ্ধ চক্রের পকে দ্বিদলের রূপ দেওয়া হয়েছে। এই দুটো দলই আবার চাঁদের মতোই শ্বেতবর্ণ। সহস্রারে কলঙ্করহিত শুদ্ধ চাঁদের অবস্থান। এই চক্রের সহস্রদল পদ্ম সম্পর্কে নানা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এই সহস্রার থেকেই আনন্দপ্রবাহ নির্গত হয় সাধকদের উদ্দেশ্যে: ‘সুধাধারাসারং নিরবধি বিমুঞ্চন্নতিতরাং / যতেঃ স্বাত্মজ্ঞানং দিশতি ভগবান নির্মলমতেঃ। / সমাস্তে সৰ্ব্বেশঃ সকল-সুখ-সন্তান-লহরী/ পরিবাহো হংসঃ পরম ইতি নাম্ন পরিচিতঃ।।’ যিনি নিরন্তর সাধকজনের প্রতি অমৃতধারা রূপ সারবস্তু বা চন্দ্র থেকে নিঃসৃত শুক্লবর্ণ অমৃতকিরণ অতিমাত্রায় বর্ষণ করতে করতেই স্বাত্মজ্ঞান (জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদ জ্ঞানকারক তারক ব্রহ্ম মন্ত্র) উপদেশ দিচ্ছেন। যা সকলের অধীশ্বর এবং সর্ব রকম সুখের বিস্তার স্বরূপ লহরীর নিঝর রূপ, সেই পরমহংস নামে পরিচিত ভগবান পরম শিব সহস্রদল পদ্মে অবস্থান করেন। সাধকগন তাঁর ধ্যানেই সদা নিমগ্ন থাকেন। আর এই পদ্মতেই চন্দ্রের অমানামে সেই প্রসিদ্ধা ষোড়শী কলা আছেন–’অত্রাস্তে শিশুসূৰ্য্য সোদরকলা চন্দ্রস্য সা ষোড়শী’। এই পদ্মতেই ইষ্টচৈতন্য স্বরূপের বিকাশ ঘটে। বোধদয় হয়। বলা হয় এর আকৃতি অর্ধচন্দ্রের মতো বক্র।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শরীরের মধ্যেই আমাদের চন্দ্রের বসবাস। যে চন্দ্র শরীরের সবকটি, বিশেষত প্রধান তিন নাড়ির সঙ্গে সর্বদাই ফিসফাস করছে। কথা বলছে। সেজন্যই ফকির আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন। ফকিরের সেই চাঁদের কথাবার্তা আমাদের শরীরের ভেতরে চলতে পারে কিন্তু প্রতিনিয়তই। তবে যোগক্রিয়াতে সেটা একমাত্র সম্ভবপর। গানে সেজন্যই চক্ৰচেনার কথা বলা হয়েছে। ‘যা উদর ভরে আধ অক্ষরে’ রয়েছে। অর্থাৎ কিনা শরীরের অভ্যন্তরে অচেনা অবস্থাতে রয়েছে। এজন্যই পদকর্তা বলেছেন-’কি করে চিনি চক্ররে’। বলেছেন–’তোরা। রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি/ ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে’। ‘রুহিনি’ কথার অর্থ কী? ‘রুহিনি’ হল আত্মা, নিজের ভেতরজাত অংশও বলতে পারি। তাকে চিনতেই ফাঁদ পাততে বলা হয়েছে ‘হৃদয়পুরে’।
বাউলের দৈগন্তিক প্রসারকে এভাবেও আমরা দেখতে চাইছি এখানে, গানের শঙ্খিনীমালার সৌন্দর্যে শরীরের মধ্যবর্তী ছায়ার অপরূপকে খুলে ফেলে তার থেকে চকিত বিপর্যয়ের ঢেউ নিয়ে উদ্দীপ্ত সমুদ্রে স্নান করতে চাইছি বারবার। যে স্নানে চাঁদের মর্মস্পর্শী পটভূমিকা রয়েছে। তার জন্যই ফকির গাইছেন–শাহা শির আলির হৃদয়পুরে। কেনে রয়েছ ঘুমের ঘোরে / ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা চেয়ে/ তোর নগরচাঁদ নগরের পরে। ‘হৃদয়পুর’ হল শরীরের সদর অন্দর। উপলব্ধর প্রতীকী সুগভীর গূঢ়ার্থ। ‘প্রেমের কক্ষ’ যুগল শরীরের মত্ততা। সাধকের মতো ভাবের প্রতিফলনের কুঠুরি। ‘নগর’ হল শরীর। ‘নগরের চাঁদ’ শরীরের চন্দ্ররূপী নাড়ির জাগরণ। যার ফলে সাধকের মনে সাধনা বহত্যা-বিস্তারী শক্তি ঘোরাফেরা করে। যে শক্তি; চাঁদ চিনতে পাড়ার এই কলাকৌশলই একদিন সাধককে সিদ্ধস্তরে ঠেলে দেবে।
ফকির আরেকটি গানও আমাদের শুনিয়েছিলেন। সে গানেও চাঁদের কথা রয়েছে। বহুশ্রুত লালনের পদ এটি। বহু বাউলই প্রতিনিয়ত এটা গেয়ে থাকেন। বাউল মোচ্ছব ও মেলাতে এলে এ গান শোনাই যায়। কতবার যে কতজনের মুখে শুনেছি এ গান। মনে আছে সোনামার আশ্রমে এক সন্ধ্যায় আমির চাঁদ ফকিরের মুখে শুনেছিলাম এ গান। চৈত্রের হাওয়ায় বালিউড়াতে তাঁর চুলদাড়ি নড়ছে। বাঁশের খুঁটিতে হেলান খেয়ে বয়স্ক মানুষটি গাইছেন–’সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে/ অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে’।
বাউলের কাছে অমাবস্যাই পূর্ণিমা হয়ে ওঠে। পদকর্তা তাই বলেছেন–‘পূর্ণিমা সে অমাবস্যে।‘ কীভাবে পূর্ণিমা অমাবস্যা হয়ে যাচ্ছে আর অমাবস্যাই হয়ে উঠছে পূর্ণিমা? পূর্ণিমার চাঁদ ‘পূর্ণচন্দ্র’ বাউলের হল প্রেম। এই প্রেম আসে চন্দ্ৰসাধনায়। গোপালের গানে ইঙ্গিতময়তার মধ্যে উঠে এসে চন্দ্ৰসাধনা–’চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে/ সময় গেলে শের পটকালে হবে না তাই আখেরেতে।।’ ‘চন্দ্রসাধন’ কী? চাঁদ নিয়ে উপাসনা? অবশ্যই তাই। বাউল চাঁদ খায়, চাঁদ মাখে। চাঁদের বেসাতি তৈরি করে বাউল। কীভাবে তা হয়? বাউলের ‘চন্দ্র’র নানারূপ আছে। চাঁদকে তারা প্রতীকময়তার ভেতর রেখে হেঁয়ালি তৈরি করেন শুধু। ‘চন্দ্র’ তাঁদের বাঁ নাক। পূর্ণচন্দ্র প্রেম, আবার ‘শুক্র’ বলতেও বাউল অনেক সময় চাঁদকে ইঙ্গিত করেন। চন্দ্র বলতে তাঁরা আবার সাধন লব্ধ আত্মজ্ঞানকেও সামনে রাখেন। ‘চারভূত’-ও বাউলের চন্দ্র। ‘চারিচন্দ্র’। মল, মূত্র, রজ, শুক্র। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পাঁচটি পঞ্চভূত। চারভূত তাঁদের ‘চারিচন্দ্র’। তবে ফকিররা কিন্তু চারভূত বলতে বৈদিক মতের পঞ্চভূতকে একেবারে মানেন না।
আমির চাঁদ ফকির বলেছিলেন, চারভূত হল গিয়ে আব, আতস, জল, আগুন, মাটি ও বাতাস।
ফজর শাহ জলকে জানিয়েছিলেন খাক বাত বলে।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাউল ফকিরে পার্থক্যটা কী?
বললেন, পার্থক্য কিছু নেই খ্যাপা। যা আছে সব তৈরি করা। মুর্শিদ আর কৃষ্ণ আলাদা নাকি খ্যাপা! সব এক। সব শরীরের উদরে রয়েছেন।
আমির চাঁদ বলেছিলেন, ফকিরিতে নানাবিধ সাধনা আছে। কোনটা করবা তুমি। যুগল আছে, পৃথক আছে, দমের সাধনা আছে। বস্তুরও আছে।
চারচন্দ্রের সাধনা ফকির করে? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
–করে, করে না। মানে, মানে না। সব আছে গো। আসল হল গিয়ে নিজেরে জানা। তা তুমি চার-পাঁচ যে চন্দ্রই বল বাপু নিজেরে না বুঝলে কিছুই হবে না। নবী কে গো?
–কে?
–নবী হল গিয়ে আমি নিজে।
ঘোষপাড়ার নবকুমার দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম চারচন্দ্রের কথা। নিত্যানন্দ বালা, নরোত্তম দাসকে বললে কিছুই বলেননি তাঁরা। নরোত্তম গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। যেটি শুনিয়েছিলাম আমার বেশ চেনা গান। প্রথমে গুনগুন করেই গাইছিলেন বাউল। শিষ্য (বাজনদার) একতারাতে সুর দিতেই গাইলেন। দরাজ গলায় বাউল বাড়ি (আখড়া) ম ম করতে থাকল চাঁদেরই গন্ধে।
দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার।
হলো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার।।
সূর্য-মামা মরে গেছে বুকে মেরে শূল,
বামুনপাড়ায় কায়েতবুড়ি মাথায় বইছে চুল।
আবার কামরূপেরে কাকা ম’ল,
কাশীধামে হাহাকার।
ময়রা-মামীর কুলের স্বামী বসে রয়েছে,
তার গর্ভেতে তিন জনার জন্ম হয়েছে।
আবার ভাদ্র-মাসের তেরোয় পৌষে
চড়ক-পূজার দিন এবার।।
বৃন্দাবনে বলছে বামী বোষ্টমী–
একাদশীর দিনে হবে জন্মাষ্টমী।
আবার রাজবাড়ীতে টাট্ট ঘোড়ার
সিং বেরিয়েছে দু’টো তার।।
গোঁসাই পোদয় কয় ভেবে এবার,
কথা শুনতে চমৎকার,
সাধক বিনে বুঝতে পারে
এমন সাধ্য কার।
কথা যে বুঝেছে, সেই মজেছে,
গিয়েছে সে বেদের পার।।
গান শেষে থামলেন বাউল। বললেন, লাইনে না এলে এর মানে জানা যাবে না। একটু ঘোরাফেরা করেন, ঠিক একদিন জেনে যাবেন। আমাকে আর শুধতে হবে না।
হাসলেন বাউল।
বললেন, দীক্ষা হয়েছে?
বললাম, না।
আগে চট করে দীক্ষাটা নিয়ে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন অনুরাগ আসবে।
নবকুমার দাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, চারচন্দ্র সম্বন্ধে আপনার অনুভূতি কী?
প্রথম প্রথম শুধু চারচন্দ্র কেন, নবকুমার আমার কোনও প্রশ্নেরই সেইভাবে জবাব দিতেন না। বিরক্ত প্রকাশ করতেন। ভাবখানা এমন এখানে না আসলেই পারেন। ওদিকে যখন অত যাতায়াত তাহলে ওখানে গিয়েই মেটান না কৌতুহলী জিজ্ঞাসা সব। তবে আমি রাগ করতাম না। বুঝতাম বিষয়টা হয়তো পছন্দ করছেন না নবকুমার। কিন্তু কোনওদিন এই বিষয়ে তিনি আমাকে কটু কথা বলেননি। বাউল সমাজে মিশে এটা বুঝেছি সেখানে তাঁদের ভেতরে নানা অরাজকতা থাকলেও তাঁরা বাইরের মানুষদের প্রাপ্য অতিথির সম্মান দেন।
দুপুরের ঠাঠাপোড়া রোদে মাটিয়ারী গিয়ে মহিলা বাউল বিশেষত কৃষ্ণা দাসীর সম্পর্কে; তাঁর গান বিষয়ে নানা কথা এলে মীরা মার উত্তেজিত সুর সব মনে আছে।
বলেছিলেন, মেয়েদের আখড়া ছাড়া, আশ্রম ছাড়া গান গাওয়া অপরাধ। এই সব মেয়েরা বাউল মতের কলঙ্ক।
বলেছিলাম, বাউল যদি অনুষ্ঠানে গাইতে পারে তাহলে মহিলা বাউলরা গাইতে পারবেন না কেন?
রেগে উঠেছিলেন তিনি।
বললেন, বাউল মতের বোঝ কী তুমি গান কি বাউলের পথ?
মীরা মা’কে বোঝাতে পারিনি গানই এখন বাউল-পথ। বাউলরাই তাই করে নিয়েছে। বাউল এখন আর নিভৃত সাধনার বিষয় নেই। আলো, প্রচারের জন্য সেও যা নয় তাই করে ফিরছে।
মা বললেন, মেয়েদের কাজ হল সাধুসঙ্গ করা। বাউলকে এগিয়ে দেওয়া বাউল মত কে, পথকে প্রতিষ্ঠা করা। ধরে রাখা।
বলে যাচ্ছেন মীরা মা–নবকুমার জাত বাউল। ও তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভুলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেকুঁদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।
খুবই ঝাঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি না। ভাবছি শুধু তাঁর বিশ্বাসের আসন টলাবে কে শুনি! কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তাঁরা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী! গান, প্রচার, বিদেশ যাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই, সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধক জীবন তো এখন ব্যাভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের তথাকথিত live together
নবকুমার কৃষ্ণাকে ছেড়ে নতুন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণা সে সময় মেয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। আমাকে তার দুঃখের কথা, সংগ্রাম জানিয়েছিলেন তিনি।
বলেছিলেন, জানো তো প্রথম-প্রথম প্রোগ্রাম হত না। সে নষ্ট করে দিত। তখন এখনকার মানুষটি পাশে না দাঁড়ালে ভেসে যেতাম আমি।
জানি কৃষ্ণা এখন সহৃদয় এক মানুষের দেখা পেয়েছেন। যিনি তাঁকে ঘর দিয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণার এখন বড় দল। বেশ কয়েকজন গায়ক বাউল, বাজনদার নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান আখড়া-মচ্ছবে, অনুষ্ঠানে। রেডিও টিভিতে অনুষ্ঠানের ডাকও পান তিনি। তাঁর মানুষটা যদিও বাউল সমাজের কেউ না। তবু আমি বলব কৃষ্ণার বিপদে তিনি তো যোগ্য মানুষের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। গানই এখন কৃষ্ণার সাধনা।
যদিও গল্প রটে। সে গল্প কী আশাকরি কাউকেই বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু আশ্চর্যের! কৃষ্ণার পাড়াতে তাঁর যথাযোগ্য সম্মান রয়েছে। যখন প্রথম যাই খোঁজে, জানতাম নবকুমারের সঙ্গিনী কৃষ্ণা। সেইমতো একে-তাকে বলতেই সকলে একবাক্যে বলেছিলেন কৃষ্ণা তাঁর সাথে আর থাকেন না।
কে কাকে ছেড়েছেন অন্য প্রশ্ন। কৃষ্ণা কখনো কোনওদিন নবকুমার সম্পর্কে খারাপ কথা আমাকে বলেননি। আবার নবকুমারও নন। প্রথম-প্রথম তাঁকে বোধহয় কেউ ভুল বুঝিয়ে ছিল। বাউলের আগ্রহী মানুষ জেনে শেষে তিনি অদ্যাবধি মধুর সম্পর্কই রেখে চলেছেন।
মীরা মা সেদিন চড়া সুরে আমার সঙ্গে কথা বললেও বলেছিলেন, নাও বেলপানাটা খেয়ে নাও আগে। যা গরম। শরীর জুড়োবে। খাও আগে। ওসব পরে হবে। নিজে হাতে আমাকে বাতাস করেছিলেন তিনি একেবারে হাসে মুখে। তখন কোথায় তাঁর রাগ। একেবারে বাড়ির মা মাসিমা মনে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি কাকা গোঁসাইয়ের সাধন সঙ্গিনী ছিলেন। শুনেছি গোঁসাই ছিলেন সিদ্ধ সাধক। দেহ রাখার পর মীরা মা তাঁর আশ্রমের দায়ভার নিয়ে আছেন। ভক্ত-শিষ্য সকলের মা তিনি। আখড়া করেন অগ্রদ্বীপের মেলায় প্রতি বছর। তাঁর আখড়া ঘিরে বিশিষ্ট বাউলদের সব জমায়েত হয়। আশ্রমে তত্ত্বকথা শুনিয়ে, সাধনার গান গেয়ে তিনি বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিন কাটান। বাউলের প্রচার-খ্যাতি ব্যাভিচার এসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই একেবারে। ভাবে মজে থাকেন। সেজন্য তিনি বর্তমান বাউল সমাজের যোজন হাত দূরে। তাই তাঁর বিশ্বাস এখনও কাকা গোঁসাইয়ের ভাবধারার। বাউলের অবক্ষয়, অবনতি এসবে তাঁর কলরব সেই এখনও প্রাচীন পন্থাতেই পড়ে। মেয়েরা সাধন সঙ্গিনী হয়ে সাধকের অতলস্পর্শকেই শুধু ছোঁবে। গান করবে কী! তাঁর মুখেই নবাসনের নির্মলা মার কথা শুনেছিলাম। মীরাকে মনে হয়েছিল নির্মলা মা’র প্রজ্ঞা নিয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি মাটিয়ারীর বটের ছায়ায়।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু?
রেগে উঠলেন মা।
কতটুকু মানে। মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।
মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তাঁরা সাধন সঙ্গিনীই কেবল?
বেশ রেগে উঠলেন মা।
কে বলেছে আবোল তাবোল?
বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।
বলতে দিলেন না মা।
বললেন, তা বস্তু উর্ধগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস, দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধগামী হবে শুনি! যত আজেবাজে কথা।
জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনোপুত হচ্ছে না মা’র।
বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।
মা’কে বলতে পারলাম না আমি, তা নয় করল, করে সাধক সিদ্ধ হল, নাম রটল তাঁর। তাতে হল কী সঙ্গিনীর? সে তো আর সিদ্ধ আসন পেল না। সে যে কেবল সাধন সঙ্গিনী। বুঝলাম মীরা দাপুটে বলে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু সবাই তো আর মীরা মোহান্ত নন, বা মীরার বলা নির্মলা মা নন, তাহলে তাঁদের অবস্থান। কি? আর সেই অবস্থান চিহ্নিত করতেই এখন মেয়েরা সাধক নন গানের সঙ্গে বসবাস করছেন। গান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। বাউলের ধার ধারছেন না। অনেক দিনের বঞ্চনার ফলে এটা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মীরা মা এসব আঁচ থেকে দূরে গুরুমা, মা গোঁসাইয়ের জীবনধারণ করছেন তাই মেয়েদের অসহায়তা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। তাঁর ভাব সাধক বাউলের যথার্থ সঙ্গিনীর ভাব। নির্মলা মারও তাই হবে মীরা মার মুখে যতটা শুনেছি সেই ভিত্তিতেই বললাম।
একদিন বেশ ঠাণ্ডা মেজাজে পেয়েছিলাম নবকুমারকে। গরিফায় এক অনুষ্ঠানে গাইবার আগে কথা চলছিল।
বললেন, আমাদের শরীরে তো নিয়ত চন্দ্রের চলাচল। চন্দ্র হল শীতলতা।
কীসের? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
কীসের আবার, সিদ্ধির।
কীভাবে আসবে এই সিদ্ধি? বললাম।
চন্দ্রতত্ত্বে আসবে তা। শরীরের মধ্যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে। যুগলে অমাবস্যাতে এই সাড়ে চব্বিশকে ধরতে-ঘঁতে–জানতে-বুঝতে হবে। তারপর জোয়ার নামবে।
আর কিছু বলতে চাইলেন না নবকুমার।
বললেন, একদিন আসেন। সেখানে হবে খোন। এই হাটে-মাঠে তত্ত্ব হয়? হয় না।
ইতিমধ্যে ডাক পড়ল তাঁর। বাজনদাররা উঠে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। নবকুমার পায়ে ঘুঙুর জোড়া বাঁধতে বসলেন।
আমাদের ঝম ঝম চন্দ্রের ওখানেই ইতি হয়ে গেল।
*****
রজঃপ্রবাহকে বাউল বলেন রজঃস্নান। এই স্নানের চারটি গালভরা নামও আছে। গরল, উন্মাদ, রোহিনী, বাণ। চার নামই স্পষ্ট করে রজঃযোগ চারদিন। প্রথমদিন গরল। মানে হল বিষ। সেই বিষকেই সাধক সুধা করে দেন। দ্বিতীয় দিন উন্মাদ। বাউল বলেন জোয়ার শুরু হল। একে তাঁরা অমাবস্যাও বলে থাকেন। ঘোর অমাবস্যার তৃতীয় দিন। রোহিণী। রোহিণী কিন্তু চাঁদ প্রতীকের সামঞ্জস্যতা রাখছে। চন্দ্ৰপত্নী হলেন রোহিণী। বাউলের চন্দ্রনাড়ি জাগছে আর চন্দ্রপত্নী তৃতীয় দিনে যোগ্য সঙ্গিনী হয়ে সাধককে সাহায্য করছেন। সাধক চতুর্থ দিনে বাণে সিদ্ধ হচ্ছেন। বাণ বলতে কিন্তু বাউল লিঙ্গকে চিহ্নিত করেন। এই বাণকে উৰ্দ্ধরেতা দেন সাধক। বীর্য নিম্নগতি পায় না। তবে এই চারটিকে রজঃস্নানের চারটি দিনের রজঃপাতের নাম হিসাবেই দেখেন তাঁরা। স্নাননাম যদিও অনেকে বলেন। এই বৈপরিত্য গুরু অভিহিতের ফল। গুরু যেমন বলে থাকেন সাধককে, সাধক বাউল সেভাবে, সে নামে চিহ্নিত অরে থাকেন। ‘চারিচন্দ্র’ বলতে অনেকে আবার মল, মূত্র, রজ, শুক্র না বলে বলেন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল। আদি হল আমিসত্ত্বা। নিজ হল নিজের মল-মূত্র। উন্মত্ত হল সঙ্গিনীর রজ। গরল হল গিয়ে শুক্র। বীর্যকেই তাঁরা অমৃত করে নেন, মানে বীর্যকে উধ্বপ্রবাহ দিয়ে ‘অধর মানুষ’, ‘অটল মানুষ’ হয়ে যান। অধর, অটল হল সিদ্ধ স্তরের দশা। স্কুল, প্রবর্ত, সাধক পেরিয়ে সিদ্ধ স্তরে তিনি ব্যক্তির উচ্ছ্বাস ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সহজ হয়ে ভক্ত শিষ্যদের সামনে নিমগ্নতার আততিকে তুলে ধরেন। মত বিনিময় করেন।
সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র হল করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিভে এক, কপালে দেড়। অষ্টম চন্দ্র বা অষ্টম ইন্দুর কথাও বলে থাকেন বাউল। ‘অষ্টম চন্দ্র’ হল মুখ এক, স্তন দুই, হাত দুই, বুক এক, নাভি এক, যোনি এক।
প্রশ্ন হল সংখ্যা চিহ্নিত এই প্রত্যঙ্গগুলোতে কী কাজ হয়ে থাকে? দেহ যখন দেহাতীত হয়ে ওঠে; বস্তুঙ্খলন থেকে উর্ধ্বে বিরাজ করে দেহ, রজঃবীজের নিয়ন্ত্রণ চলে এসে দেহ সংবৃত নির্জন হয়ে পড়ে যুগল মিলনে তখন সাধক ও সঙ্গিনীর এই সব প্রত্যঙ্গ মারফৎ স্বকীয় মৃত্যু ঘটে। এখানে চুম্বনে আত্মবিস্মৃত মগ্নতা আসসে। সাধক ও সঙ্গিনী ভুলে যান নিজস্বতা। সঙ্গমরত মানবশরীর সঙ্গমের ঊর্ধ্বে উঠে উপমেয়কেই যেন খুঁজে পায়। উপমেয় হল বাউল মতে, কামের মধ্য থেকে কামকে হেঁটে বাদ দিয়ে নিষ্কামী হওয়া। আর কামকে বাদ দেবার সাধনা গুরুই শেখান। সেজন্যই তা হল রপ্ত এক কৌশল। যে কৌশলে ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ ও ‘অষ্টম চন্দ্রের’ ব্যবহার অনিবার্য। এগুলো সবই সঙ্গমের। উপান্ত দশায় এসে গুরু নির্দেশিত সব পূর্ণচ্ছেদ। অমোঘ টানে বা আকর্ষণে প্রত্যঙ্গের ওসব স্থানে কখনও সংখ্যাচিহ্নিত চুম্বন, স্পর্শ ইত্যাদি কোনওভাবে সম্ভবপর নয়। এগুলোকে গুরুর সুমুদ্রিত স্বাক্ষর হিসাবেই শুধু দেখা ভালো। তবে ঊধ্বরেতা যথেষ্টই শরীর রপ্তের কাজ। কঠোর যোগসাধন না হলে তা হবে না। কী তন্ত্রে, কী বাউলে, দেহ সাধনায় সাধক সঙ্গমস্থ দশায় বীর্যকে উর্ধেরেতা দান করেন। তবে সন্ন্যাসী তো আর শরীর ছোঁন না, তাঁরা বলেন স্ত্রীসঙ্গে বিন্দুনাশ হয়। বিন্দুনাশ হলে আত্মক্ষয় ও সামর্থহীনতা আসে–’যদি সঙ্গং করোতেব বিন্দুস্তস্য বিনশ্যতি। আত্মক্ষয়ে বিন্দুহানাদসামর্থঞ্চ জায়তে।।‘ ‘পীত্বা মোহময়ীং প্রমোদমদিরামুন্মত্তীভূতং জগৎ’। ভর্তৃহরি এই কথা বলেছেন। বলেছেন মোহময়ী। প্রমোদরূপ মদিরা পান করে এই অনন্ত জগৎ উন্মত্ত হয়ে আছে। ‘ভগেন চৰ্ম্মকুণ্ডেন। দুর্গন্ধেন ব্রণেন চ। / খণ্ডিতং হি জগৎ সৰ্ব্বং সদেবাসুরমানুষ।।‘ এই আকর্ষণ থেকে। উদ্ধার পাবার পথ কী? অভ্যাস আর সংযম। সন্ন্যাসী তা রপ্ত করেন। তাঁরা ব্রহ্মবস্তু বলেন বীর্যকে। শরীরে তা আছে বলেই আনন্দ। যোগসাধনে বিন্দুধারণ না হলে উন্নতি সম্ভবপর। নয় কখনোই। ‘যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ।’ সতত বিন্দুধারণ করলে। যোগীগণের সিদ্ধি হয়। তাঁরা বলেন বীর্য সঞ্চিত হলে পরে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চয় হয়। এই শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন হয়। সাধক অনেক উপরে উঠতে পারেন। সংসার ছাড়ার কথা বলেন সন্ন্যাসী। অর্থাৎ সংসারের ‘সং’ ছেড়ে ‘সার’কে গ্রহণ করতে বলেন তাঁরা। দুরাশার অন্ধকারে না ডুবে অসার রূপে ‘সং’ না সেজে ‘সার’ হয়ে সংসারে আশার সুধা ভরার কথা বলে থাকেন তাঁরা। সংসারে সার প্রসার করতে বলেন তাঁরা। অর্থাৎ শরীরের যোগ শরীরের উপাদানকে শরীরে রেখে শরীরকে পাশব-বাসনা থেকে মুক্ত রাখেন তাঁরা।
যুগল সাধনে ‘সার’ গ্রহণ হয় ঠিকই কিন্তু সংসারের ‘সং’ কিছু থাকে ঠিক। সে অন্যত্র আলোচিত বিষয়। বাউল তাঁর শরীর সংবেদিতার মন্ত্র বলে থাকেন গানে। যেমন লালন বলেছেন–’না জেনে করণ কারণ কথায় কথায় কি হবে/ কথায় যদি ফলে কৃষি তবে বীজ কেন রোপে? / গুড় বললে কি মুখ মিঠা হয়/ দিন না জানতে আঁধার কি যায়/ তেমনি জেনো হরি বলায় হরি কি পাবে।
বাউলের পৃথিবী এই পাওয়ার প্রতীকী উত্তরাধিকারকে সবসময় ধরে রাখে গানে। গান তাই বাউলের সাধন অনুভূতির ভাষা। গান তাঁর যথাযোগ্য আলোরই বৈরাগ্য। সেদিকেই আমরা মুখ ফেরাব।
পদকর্তা বলেছেন : ‘অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগে আজব-সম্ভব সম্ভোগ / জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ / গতি হয় অখণ্ড দেশে।’
‘আজব-সম্ভব সম্ভোগ’ হল বাউলের কাম জয়ের সম্ভোগ। প্রেমে রূপান্তর হয় কাম তাঁদের ভাষায় ‘চন্দ্ৰসাধনা’ করলে। আর সিদ্ধিতে সাধকের স্থান হয় ‘অখণ্ড দেশে’। আর তার জন্যই সাধনভজন। গোপালের ‘চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে’ গানটির কথা বলেছিলাম আমরা। গোপাল বলছেন সেখানে চারটি চন্দ্র মন আর পবন চার জা’গাতে চারের আসন / আর আতস খাক বাদে মিলন চলন চারেতে / লাল জরদ সিয়া সফেদ চারটি রঙেতে। / চার মঞ্জিলে খেলছে তারা রয়েছে চার হিকমতে। / চার কুতুব আর ষোল প্রহরী একশ আট চন্দ্র তাইতে ধরি / রয়েছে সব সারি সারি ধরাধরিতে।।/ অদ্য হয়ে সাড়ে চব্বিশ হয় জাহেরাতে / সাড়ে চারকে সাধলে পাবি সিদ্ধি হবে চার যুগেতে।।’
চন্দ্রের কথা কিছু আগেও বলেছি আমরা। বাউলের চন্দ্রে আছে শরীরের বর্জ্য পদার্থ, বাঁ নাকের শ্বাস, বিভিন্ন দেহাঙ্গ, এমন কী নখ পর্যন্ত। এগুলোর সাহায্যেই তাঁরা চান্দ্র ঘটনাতে সামিল হন। ‘চান্দ্র ঘটনা’ হল সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহ। এই রজঃপ্রবাহের মধ্যেই চলে সাধনা। সাধনার সঙ্গী চার চন্দ্র–দুই বর্জ্য আর দুই শরীরের রজ-বীর্য। ‘মন আর পবন’ অর্থাৎ কিনা যুগল মনের একাত্মতা এবং যুগল বায়ু বাঁ শ্বাসের গুরু শেখানো রপ্তকৌশল। চার জায়গাতে চলে চারের আসন। চারটি জায়গা চারটি দিক–পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ আর চারের সাধন আদি, নিজ, উন্মত্ত, গরল–যা কিনা দুই বর্জ্য ও রজ বীর্যেরই মতান্তর। চার রঙ–জরদ, সফেদ, সিয়া, লাল–তা হলে রজের চারদিনে পরিবর্তিত রূপ। স্রোতধারার চারদিনে চার রঙ ধারণ করে রজ। মতান্তরে স্রোতধারা বা রজঃপ্রবাহের তিন দিনে দিন রঙের হয় সঙ্গিনীর রজ–সফেদ, সিয়া, লাল। চার কুতুব চারদিক। ‘ষোল জন প্রহরী’ হল–ষড়রিপু আর দু’ভাগের পাঁচ পাঁচ করে দশেন্দ্রিয়। ‘একশ আট চন্দ্র’–অষ্টম পাশের আট আর ছয় চক্রের পদ্ম পাপড়ির একত্র যোগফল। সেজন্য বলা রয়েছে রয়েছে সব সারি সারি। আমাদের শরীরকে স্থূল শরীর হিসাবে দেখে থাকেন প্রথমে বাউল সাধক। এই স্থূল দেহ ত্যাগ হলে আসে জ্যোর্তিদেহ। তারপর মানসদেহ ও নিমিত্ত দেহের প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞানেও কিন্তু এই তিন স্তরের উল্লেখ আমরা পাই। Astral body (জ্যোর্তিদেহ), Mentral body (মানসদেহ), Casual body (নিমিত্ত দেহ)। ছয়টি যে চক্র বললাম তা মানব শরীরে বর্তমান। ইংরাজিতে মানবদেহ বলা হচ্ছে হিউম্যান বিং। Human এর Hue রঙ বা Colour Being হল আলো বা light. Human Being faces oftco IGT colour menifextation in light সুতরাং এভাবে দেখলে দেহ রঙপেন্সিলের একটা বাক্স। তার আধারে ছটি চক্র। মূলাধার (Root), স্বাধিষ্ঠান (Abdomen), মণিপুর (Solar Plexus), অনাহত (Heart), বিশুদ্ধ (Throat), আজ্ঞা (Third Eye)। যেটা বোঝাতে চাইছি এই সব প্রতীকী কল্পনাতেও কিন্তু বিজ্ঞান রয়েছে। গাঠনিক সেই অভিধাকে মেনেই চক্ৰ কল্পিত প্রতীকী নামকে ধরে রেখেছে।
বাউল বলেন কারণবারি, রস বা রজ। যা দেহেরই অন্তর্গত পদার্থ বাউলের যে যুগলমিলন তা ঘটে কিন্তু জ্যোর্তিদেহে। বাউল যাকে প্রবর্ত স্তর বলেন আর কী। এই স্তরে তিনি শেখেন শ্বাসাদির কাজ, আসন। সাধক স্তরে যুগল দেহ বাউল মতের ‘ভাবদেহ’ হবার জন্য পাঠ গ্রহণ করে। এই হল মানস দেহ। সিদ্ধিস্তর বাউলের নিমিত্ত দেহ। বিজ্ঞানে, প্রাণে এই তিনাবস্থার উল্লেখ আছে কিন্তু। বাউলের যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র সাধনা তা যুগল মিলনে সসীমকে আসলে অসীম করে দেওয়া। তার জন্যই সাধক দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে দিয়ে অসীমের জন্য গোপন সংকেত রাখেন। সেই সংকেতের ইন্দ্রিয়গুলোর সাহায্য তিনি নেন। খোঁজাখুঁজি করেন লক্ষ্যস্থলটির জন্য। চতুর্দশ স্থল মঞ্জরীর কথা বলেন সাধক। বলেন শরীরের মধ্যে চোদ্দ কমল ফোটে কীভাবে ফোটে এই কমল? কপালে ভানু মঞ্জরী, চোখে রূপ মঞ্জরী, নাকে কস্তুরী মঞ্জরী, জিভে রস মঞ্জরী, কানে গুণ মঞ্জরী, গলায় ভূঙ্গ মঞ্জরী, দুই স্তনে রঙ্গ মঞ্জরী, নাভিতে লবঙ্গ মঞ্জরী, কোমরে কিঙ্কিণী। মঞ্জরী, লিঙ্গে রতি মঞ্জরী, উরুতে মোহন মঞ্জরী, পায়ে পদ্ম মঞ্জরী, হাতে বিলাস মঞ্জরী, হৃদয়ে প্রেম মঞ্জরী। সাধক বাউল সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে ও অষ্টম চন্দ্রে যে প্রত্যঙ্গগুলো স্পর্শ করেন সেখানে কিন্তু বৈষ্ণবীয় আধারের চোদ্দ মঞ্জরীই বর্তমান। সাধন-করনখে চুম্বন। করেন পুরুষ ও প্রকৃতি। অর্থাৎ কিনা তাঁরা বিলাস মঞ্জরীতে বিচরণ করেন তখন। যা কিছু চাওয়া-পাওয়া সব তাঁরা নষ্ট করে বসেন। পদনখে যখন চুম্বন চলে তখন থেকেই বর্ধিত শোভা উপরের দিকে উঠতে থাকে। পায়ে পদ্ম মঞ্জরী বর্তমান। শোভা খুলতে থাকে প্রতীকী এই পদ্মরূপে। গলাতে যখন চুম্বন চলে তখন যেন ভ্রমরের মতোই স্বর নিক্ষিপ্ত হয় (যাকে। কামশাস্ত্রে শীকার বলছে)। গলায় তাই ভৃঙ্গ মঞ্জরীর কল্পনা। অধরে বা ঠোটস্থ চুম্বনের অর্ধস্ফুট আওয়াজও ভৃঙ্গ মঞ্জরীতে আমরা রাখতে পারি। জিভের চুম্বনে লালা নির্গত হতে থাকে, মিশে যেতে থাকে তা এ-জিভে ও-জিভে। এখানে রস মঞ্জরীর অবস্থান। ললাটে চুম্বনকালে তেজ বা জ্যোতি নির্গত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে ব্রহ্মরন্ধ্র কিন্তু সহস্রার চক্রতেই বিরাজমান। একে ভানু মঞ্জরী হিসাবে প্রতীককল্প দিচ্ছেন সহজিয়া বৈষ্ণব। অষ্টম চন্দ্রের মুখে যদি চুম্বন চলে তাহলেও সেটাকে ভৃঙ্গ মঞ্জরীরে রাখতে পারি আমরা। কেননা মুখ থেকেই মধুর বচন নির্গত হয়। স্তনের চুম্বনে আমোদ বা আনন্দ লাভ হয়। একে বলা হচ্ছে রঙ্গ মঞ্জরী। হাতের চুম্বনেও বিলাস মঞ্জরীকে ভাবতে পারি। বুকের চুম্বনে প্রেম মঞ্জরীকে। বুকের ভেতরই তো মন বা হৃদয়ের সিংহাসনকে রাখি আমরা। নাভি চুম্বনে ফুল। আধার দিলে তা অবশ্যই লবঙ্গ মঞ্জরী। যোনি চুম্বনকে উরুর মোহন মঞ্জরীর প্রতীক হিসাবে কল্পনা করে নিতে পারি।
এখন প্রশ্ন এই সাড়ে ২৪টি স্থান স্পর্শ বা চুম্বন করা হয় কেন পুরোপুরি সম্ভোগ বা মিলনের আগে? করা হয় এই কারণেই, বাউল কামে থেকে নিষ্কামী হবার কথা বলে থাকেন। তাঁরা সঙ্গিনীর এই সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন বা স্পর্শ করে কামকে ভোঁতা করে। দেন। কাম তখন প্রেমের দিকে ধাবিত হয়। এমন তাঁদের সাধনার বিশ্বাস। অষ্টম চন্দ্রও স্পর্শ বা চুম্বন এ কারণেই হয় বা হয়ে থাকে। তা এই কার্যকরণ সাধক কি সঙ্গিনীকে করেন কেবল? নাকি সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র চুম্বন করে থাকেন? উত্তরে মতান্তরে আছে। তবে প্রবীন প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যের মতকে গুরুত্ব দিলে তা দাঁড়ায় সাধকই তা করেন। সঙ্গিনীকে সাধনার জন্য প্রস্তুত করে নেন সাধক।
নবকুমার আমাকে বলেছিলেন, সঙ্গিনীও সাধকের সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রকে জাগায়।
বললাম, অনেকে বলেন সাধক তা একা করেন।
বললেন, কখনও না। দুই গণ্ডে দু’বার যে তা ওই দুজনেরই না কি?
আমি তাঁকে আর বললাম না, দুই গণ্ডকে যদি গলার দু’ধারের স্পর্শ বলি তাহলে কি খুব ভুল ধরব? একথা তাঁকে আর বলা হয়নি। তার আগেই গান ধরলেন তিনি–
যদি হয় মহাভাবুক জেলে,
ধর্ম মাছ ধরতে পারে
ভাবের দ্বারে গুরু-ভাব-ভক্তি জাল।
বুঝলাম, চন্দ্র সাধনে আমার কথা তাঁর পছন্দ হয়নি। তাই যাদুবিন্দুর পদ গেয়ে আমার ভেতর যাতে গুরু-ভাব-ভক্তি–এসব আসে তারই ইঙ্গিত দিতে চাইছেন। নবকুমার।
*****
পদকর্তা গেয়েছেন: ‘রবিশশী রয় বিমুখা/ মাস অন্তে হয় একদিন দেখা/ সেই যোগের যোগে লেখাজোখা / সাধলে সিদ্ধি হয় অনায়াসে।‘
‘রবিশশী’ ইড়া-পিঙ্গলা নাড়ি। ‘মাস অন্তে একদিন দেখা’ রজঃপ্রবাহের দিন। ‘যোগের যোগ’ মহাযোগ। এই যোগে শরীর সাধনায় সিদ্ধির কথা বলছেন লালন।
‘দিবাকর নিশাকর সদাই/ উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়/ ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়/ লালন রে তোর হয় না দিশে।’
ইড়া আর পিঙ্গলা নাড়ি ‘উভয় অঙ্গ’ অর্থাৎ কিনা সাধক ও সাধন সঙ্গিনীর মধ্যে লুকিয়ে আছে। তা জাগানোই দেহসাধকের কাজ। সে কাজ বা সাধনায় সিদ্ধির করণকৌশলই লালনকে দিতে চাইছেন তাঁর গুরু সিরাজ সাঁই। গুরু সাধনার দিশা দিতে চাইছেন শিষ্যকে।
লালন এভাবেই তাঁর পদে গুরুকে অধিপতির সিংহাসন দিয়েছেন। শরীর সাধনাতে গুরুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। গুরু ছাড়া ও পথে সিদ্ধ হবার উপায় নেই কোনো। শুধু এ পথ কেন আধ্যাত্মবাদের পথে গুরুই দিশা। শিষ্যকে অজ্ঞানতার তিমির থেকে গুরুই উদ্ধার করেন। তাই সাধক ছুটে যান গুরুর কাছে। আমাদের শাস্ত্রও সেই নির্দেশ দিয়েছে–’মধুলব্ধো যথা ভৃঙ্গ পুষ্পৎ পুষ্পরং ব্রজেৎ / জ্ঞানলুব্ধস্তথা শিষ্যো গুরুব্বন্তরং ব্রজেৎ।।‘ ভ্রমর যেমন মধুর লোভে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ছুটে যায়, তেমনই জ্ঞানপিপাসু শিষ্য এক গুরু থেকে অপর গুরুর আশ্রয় গ্রহণ করবে।
পিতামাতাকে গুরু হিসাবে দেখা যায়, প্রথম গুরু হিসাবে তাঁদেরই স্থান দেওয়া হয়। বাউল বলেন যে তাঁদের প্রথম জন্ম পিতার বীর্য আর মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় গুরু মন্ত্রগুরু। বাউলও এমত মানেন। তন্ত্রে মন্ত্রযোগ নিকৃষ্ট শ্রেণীর হিসাবে দেখা হয়। বাউল তা মুখে না বললেও তাঁদের তৃতীয় জন্ম গুরুর হাতেই বলেই তাঁরা মনে করেন। কেননা গুরু নির্দেশিত পথেই দেহসাধনা চলে। তবে তন্ত্রে মন্ত্রযোগ নিকৃষ্ট শ্রেণীর হলেও তাঁর একটা বিশেষ স্থান আছে। বলা হয়েছে : ‘মনোহন্যত্র শিববাহন্যত্র শক্তিরণ্যত্র মারুতঃ। / ন সিধ্যন্তি বরারোহে কল্পকোটিশতৈরপি।’ মন্ত্র জপের সময়ে মন, পরম শিব, শক্তি এবং বায়ু পৃথক পৃথক স্থানে থাকলে অর্থাৎ এদের একত্র সংযোগ না হলে শতকল্পেও মন্ত্রসিদ্ধি আসে না। বলা হয়েছে: ‘মন্ত্ৰাৰ্থং মন্ত্ৰচৈতন্যং যোনিমুদ্রাং ন বেত্তি যঃ। / শতকোটিজপেনাপি তস্য বিদ্যা ন সিধ্যাতি।।’ মন্ত্ৰার্থ, মন্ত্র চৈতন্য, যোনিমুদ্রা না জেনে শতকোটি জপ করলেও মন্ত্রে সিদ্ধিলাভ হয় না। কেননা শরীরস্থ চক্রে যোনিমুদ্রাতে দেবদেবীর প্রতীকী রূপের কল্পনা রেখেই সাধক ধ্যানজপ করেন তাই সেগুলো সম্পর্কে সঠিক অভিহিত না থাকলে মন্ত্রজপে শরীর শক্তির জাগৃতি আসতে পারে না কিছুতেই। তন্ত্রসাধক বলেন তন্ত্র। ক্রিয়াকরণের যোগ। বাউল সাধক তা না বললেও এই সিদ্ধি ক্রিয়াকরণেরই সিদ্ধি। বলা হয় মন্ত্রের মধ্যে যে প্রাণশক্তি তা থাকে মণিপুর চক্রে–’মণিপুরে সদা চিন্তাং মন্ত্রাণাং প্রাণরূপকম্। মণিপুরে মন্ত্রের প্রাণরূপ সর্বদা কল্পনা করবে। মন্ত্রের প্রাণ জেনে ক্রিয়া না করলে মন্ত্রচৈতন্য কখনওই আসবে না। গুরুমন্ত্রকে সুষুম্নার মূলদেশে জীবরূপে চিন্তা করে মন্ত্র জপ করলে মন্ত্ৰার্থ ও মন্ত্রচৈতন্য আসে, তাই বলে থাকেন সাধক। ‘মূলমন্ত্র প্রাণবুদ্ধ্যা সুষুম্নমূলদেশকে। / মন্ত্ৰার্থং তস্য চৈতন্যং জীবং ধ্যাত্বা পুনঃ পুনঃ।।’
বাউলের চতুর্থ জন্ম হয় সিদ্ধিতে। আর সিদ্ধিতে ‘চন্দ্রসাধন’ অনিবার্য। বাউল তাঁর দেহতত্ত্বের গানে চন্দ্রসাধনের চাঁদের কথা বার বার বলে থাকেন।
মদন শাহের পদ:
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম তারে তোমরা বল কি।
ঘর আছে তার দুয়ার নাই মানুষ আছে বাক্য নাই
কে তাহাদের আহার দেয় কেবা দেয় সন্ধ্যাবাতি।
ছ’মাসে হয় জীবের স্থিতি ন’মাসে হয় গর্ভবতী
হয় এগারো মাসে তিনটি সন্তান
কোনটি করবে ফকিরি।
বত্রিশ বাহু সোল মাথা গর্ভে ছেলে কয় গো কথা
কেবা তাহার মাতা পিতা এই কথাটি জিজ্ঞাসি।
বলে মদন শা ফকিরে মায়ে ছুঁলে পুত্র মরে
এই চার কথার অর্থ বললে তারই হবে ফকিরি।
খ্যাপা মনোহরও চন্দ্রতত্ত্বের অনুপ্রেরণা নিয়েই এই ধরণের একটি পদ রচনা করেছিলেন জয়দেব-কেন্দুবিতে বসেই। গানের নীচে তারিখ রয়েছে ১৬-১-১৯৭০ সেই গানটিও আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখে নিই একবার।
খ্যাপা মনোহরের পদ:
চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী,
বাপের পেটে মায়ের জনম।
তারে তোমরা বলবে কী
চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী।
অমাবস্যায় একাদশী
বিধবা রহিল বসি
পূর্ণচন্দ্র কালশশী
নাম ধরে তার ডাকবে কী।
বাপের পেটে মায়ের জনম
তারে তোমরা বলবে কী।
প্রতিপদে পূর্ণিমা যার
(ক্ষ্যাপা) তিন ধারাতে জনম রে তার
গঙ্গা যমুনা সরস্বতী
বাপের দোহাই দিবে কী।
চাঁদ উঠেছে চাঁদের গায়ে
তোমরা ভেবে করবে কী,
বাপের পেটে মায়ের জনম
(ক্ষ্যাপা) তারে তোমরা বলবে কী!
দুটি পদের প্রথমেই দেখছি ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার কথা রয়েছে। অর্থাৎ কিনা গুরু-শিষ্যের মিলনের কথাই এগুলোতে সব প্রতিভাত আছে। গুরু শিষ্যকে নির্দেশ দিচ্ছেন, টানছেন যেন চুম্বকদণ্ডের মতো। শিষ্য সেই প্রতিধর্মের লৌহকণিকা। লেগে যাচ্ছেন গুরুর গায়ে। অর্থাৎ কিনা গুরুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন শিষ্য বাউল। সাধন এলাকার এই মার্গ নিয়ে তাই আমাদের ভাবনার কিছুই নেই। বাকসংযমের অনুধাবনীয় স্তরেই যেন আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন সাধক পদকর্তারা সব। মদন শাহের পদে এরপর রয়েছে ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জনম’। খ্যাপার পদে আছে আছে বাপের পেটে মায়ের জনম।
‘ঝি’ সন্তানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গুরু এখানে সন্তানের পদমর্যাদা পাচ্ছেন। গুরুর বেদবানী পালন করছেন শিষ্য। মানে হল গুরুকেই লালন করছেন তিনি। তাই গুরুর প্রতীকী রূপ পদে ‘ঝি’ বলেই। ‘ঝি’ প্রতিরূপ খ্যাপার গানে এসেছে ‘বাপ’ হয়ে। ‘বাপ’ গুরুতুল্য। বাপকে লালন করছেন মা। ‘মা’ বা মাতৃঅংশ বাউল সাধক নিজে। তিনি সাধনার দ্বারা যেন গুরুকে ধারণ করেই আছেন। তারই কথা বলেছেন পদকর্তারা। প্রতীকের সন্নিহিত আবেশ ভাঙ্গলে শিষ্যর গ্রন্থিমোচন হয়ে গুরুর আধারিত অংশ নিয়ে তিনি মাতৃভাবে প্রসাদ পেয়ে সন্তানস্বরূপ ধারণ করে থাকেন গুরুকেই। পদকর্তাদের এই অস্তিত্বরহস্য অনিবার্যের ইশারা। যা ভাষার প্রভাতী আলাপনের বীণাকে যেন বাজিয়ে ধরে।
মদন শাহের পদে তৃতীয় লাইনে রয়েছেঃ ‘ঘর আছে তার দুয়ার নাই মানুষ আছে বাক্য নাই/ কে তাহাদের আহার দেয় কেবা দেয় সন্ধ্যাবাতি।’ মদন শাহ ‘ঘর’ বলতে শরীর বুঝিয়েছেন। বাউল ভাষায় ঘর সব সময়ই স্ত্রীর প্রতিবিম্ব। বলেছেনঃ ‘ঘর আছে তার দুয়ার নেই’–দুয়ার হল দরজা। দরজা এখানে ইন্দ্রিয়দ্যোতক। আর দুয়ার নেই বলেই আলোচ্য ঘরে সন্ধ্যাবাতি দেবার দরকার নেই। ঘরই যখন অধিষ্ঠিত হয়নি, ইন্দ্রিয় তৈরি হয়নি, ক্রিয়াকৈবল্য শুরু হয়নি তখন আহারের প্রয়োজন হয়? আহার হল নাড়ির মতন। যার তরঙ্গে ওঠাপড়ার ঘর গড়ে ওঠে। আর তা তৈরি করতে পদকর্তা মদন তৈরি। এজন্য তিনি বলেছেন: ‘ছ’মাসে হয় জীবের স্থিতি ন’মাসে হয় গর্ভবতী / হয় এগারো মাসে তিনটি সন্তান/কোনটি করবে ফকিরি।
‘ছ’মাস ছটি রিপু। ‘ছ’মাসে জীবের স্থিতি–ছটি রিপু নিয়েই মানুষ থাকে তুঙ্গ তীব্রতায়। যার থেকে বেরোবার কথাই বলেন সাধক। ‘ছ’মাসের এক কন্যা’ও রিপুর ক্রিয়াত্মক কল্পনা। ন’মাসের গর্ভ–বাউল মতের নববিধা সেই ভক্তিরস। নটি চক্রের কথাও আমরা কিন্তু ভাবতে পারি। ‘এগার মাসের তিনটি সন্তান’–দশেন্দ্রিয় ও মনের সমন্বয়। এই সব একত্রিত করে এগুলো বশীভূত করে তবেই যেতে হবে সাধনা ও সংযমে। এর ফলে শ্রেষ্ঠ গুণ তিনটি সাধক শরীরে একত্রিত হবে। এই তিন গুণ হল জ্ঞান, বিবেক ও বৈরাগ্য।
শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য একবার আমাকে বলেছিলেন, দশেন্দ্রিয়, ষড়রিপু এগুলো সব হল গিয়ে বাবা চিনি খাওয়া রাক্ষুসি। শরীরের মধু সব খেয়ে নেয়। সাধনায় এদের আগে মারতে হবে বাবা।
‘বত্রিশ বাহু ষোল মাথা গর্ভে ছেলে কয় গো কথা/ কেবা তাহার মাতা পিতা এই কথাটি জিজ্ঞাসি। মদনের এই জিজ্ঞাসার উত্তর: ষোলমাথা = দশেন্দ্রিয় + ষড়রিপু। বত্রিশ বাহু = পঞ্চভুতের পাঁচ (ক্ষিতি,অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম) + পঞ্চগুণ বা স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তেতো, ঝাল) + দশেন্দ্রিয় (পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়–বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ, এবং পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়–চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক) + ছয় রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) + আট দ্বার (দুই কান, দুই চোখ, দুই নাক, মুখ, পায়ু) = চব্বিশ। এর সঙ্গে ব্রহ্ম বস্তু দেড় আর অর্ধাংশ রজ ও বীর্য নিয়ে দেহ হয় পঁচিশ। তার সঙ্গে সাত যোগে হয় বত্রিশ। এই সাত হল সাত সাগর। শরীরের সাতটি উপাদানকে বাউল সাধক অভিহিত করেন সাত সাগরের নামে।
মূত্র (লবনসাগর),বীর্য (ক্ষীরোদসাগর),মজ্জা (দধিসাগর),চর্ম (ঘৃতসাগর), জিভ (জলসাগর), রক্ত (সুরাসাগর), রজ (ইক্ষুসাগর)। এগুলোকে ‘সপ্তধাতু’, ‘সপ্ততালা’ও বলেন বাউল। সর্বমোট এই বত্রিশটি উপাদান যা দেহস্থ ক্রমপরিণামী স্তর–বাউল তাঁর সিদ্ধির পূর্ণতা বিকাশে সেগুলো পুনর্লব্ধ নৈঃসঙ্গ করে নিয়ে সিদ্ধির অভিজ্ঞানপত্র রচনা করেন। সাধকের আখ্যাপত্রকে দূরে ঠেলে দেহসাধনার সর্বশেষ সিংহাসনটি দখল করে। বসেন। এজন্যই মদন শাহ ‘বত্রিশ বাহু সোল মাথায় গর্ভস্থ ছেলেকে’ জানতে, বুঝতে, উপলব্ধি করতে বলেছেন। মদন শা বলেছেন: ‘মাকে ছুঁলে পুত্র মরে।’ ‘মা’ কে? সাধক বাউল। ‘ছেলে’ গুরু। ‘গুরু’র পরবর্তীতে ‘শিষ্য বা সাধক বাউল’ সে জায়গাটা নিচ্ছেন। সাধনার অতল প্রয়াণ ঘটছে এখানে। গুরুর যেন মৃত্যু হচ্ছে। গুরুরূপী ছেলে মরে গিয়ে শিষ্যরূপী মা জেগে উঠছেন। শিষ্য মাতৃস্থ অবয়ব নিয়ে আবারও পরবর্তীতে তাঁর শিষ্যদের পূর্বচ্ছবিতে গুরু হয়ে মৃত্যুলাভ করবেন। এই কথা যদি কেউ অনুধাবন করতে না পারেন। তবে ‘ফকিরি’ মানে সাধনা বৃথা।
*****
অগ্রদ্বীপে মীরা মোহান্তের আখড়ায় বসে শুনেছিলাম চাঁদের আরেক গান। ঘোষপাড়ার মেলা ঘেঁষে শেষাশেষি ফাল্গুনে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দোলপূর্ণিমার পরের একাদশী তিথিতে বসে অগ্রদ্বীপের মেলা। লোকে বলে ঘোষঠাকুরের মেলা। মেলার প্রথম দিন চিড়া-মচ্ছব চলে। দ্বিতীয় দিন অন্ন-মচ্ছব সেবার প্রথম উপস্থিত হয়েছি অন্ন-মচ্ছবের দিনে। গিয়ে দেখি ভাত আর তরকারি রান্না চলছে সমানে। গর্ত খুঁড়ে কলাপাতা পেতে ঢালা হচ্ছে তাতে ভাত তরকারি। সেই গরম ভাত পেটে পড়েছে বেলাবেলি। সন্ধ্যার আখড়া সাজেনি তখনও। ভক্ত-শিষ্য, বাউল সব এধার-ওধার ঘোরাফেরা করছে। নদীর ঠাণ্ডা উঠে আসছে হাওয়ায়। মীরা মা গল্পগাছা করছেন ভক্তদের সঙ্গে।
আমার কথা চলছিল কাঁঠালতলার রতন বাউলের সঙ্গে। বললেন প্রতিবার এ আখড়াতেই এসে ওঠেন। কথা চলতে চলতে চলে গেল চন্দ্রকথায়। একতারাটা তাঁর বসবার পাশেই ছিল কাত হয়ে শুয়ে। যেন সেও মচ্ছবের ভাত-তরকারি পেটে পুরে ঝিমুচ্ছে। তুলে নিলেন রতন। ঘুম ভাঙল একতারাটার। টুং টাং হতেই মীরা মা ফিরে বসলেন এদিকে। আলোচনা শ্লথ হয়ে ঘুরে বসল বাউলেরই গানে। রতন বাছার গাইলেনঃ
আমি চাঁদকে চিনলাম না আমার লগ্নেতে চাঁদ ছিল না
চাঁদের হাতি চাঁদের ঘোড়া চাঁদের গরু চাঁদের মেড়া চাঁদ জগৎজোড়া
সেথা চাঁদে চাঁদে লেনাদেনা চৈতন্যের কেনাবেচা।।
চাঁদের হাট চাঁদের বাজার চাঁদ পসারি হাজার হাজার
চাঁদের ওজনদার।।
সেথা লক্ষ লক্ষ ভাবের ভাবী অসংখ্য চাঁদ যায় জানা।
সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে কামগায়েত্রী কামবীজের কাছে
সাধক চাঁদ সাধে
ক্ষেপাচাঁদ গোঁসাই বলে সে চাঁদ আমার ভাগ্যে হল না।।
রতন বাউলের গানে আখড়া হয়ে উঠল চাঁদের হাট। ভক্ত-শিষ্য সমবেত হল সব। সেজে উঠল আখড়া। রাতের আখড়ায় গান শুরু হয়ে গেল রতনের গানে। মীরা মা। বললেন, আসর বন্দনার আর দরকার নেই। চন্দ্র বন্দনা হয়ে গেছে।
বাউল বললেন আমায়–অমাবস্যা তিথি আসছে গো সামনে। আজ দ্বাদশী তিথি চলছে।
আবার একতারা তুলে নিতেন বাউল। মাইক এল। এল নানা বাদ্যযন্ত্র। ডুবকিতে চাপর পড়ল। বোল উঠল খমকেও। গান শুরু করে দিলেন বাউল।
বললেন, আরেকখান চাঁদের গান গাই। বাবুরা সব এয়েছেন চন্দ্রকথা শুনতে। জানছেন। বুঝছেন। শুধোচ্ছেন সব। তা বাবুরা, দেখেন এবার চাঁদ কী কইছে। আপনাদেরও তো চাঁদপানা মুখ।
গৌরচন্দ্রিকা সেরে আবার গান ধরলেন বাউল। পরিচিত সেই গান। পূর্ণচন্দ্র দাসের কণ্ঠে বহুবার শোনা।
ও চাঁদ ফাঁকি দিয়ে ভোট নেবে, ভেবেছ আবার।
তোমায় চিনে গেছে সব ভোটার।
যেমন করেছ বোকামি, দেহ আক্কেল সেলামি,
বেলতলাতে বল ন্যাড়া যায় হে কতবার!
দেশের ভালো হবে বলে, মিলিয়া সকলে,
আদর অরে কল্লেম কমিশনার।
তার রাখলে খুব ধর্ম, করলে উচিত কর্ম
এমন ফিকির আঁটছ গলায় ছুরি দেবার।।
রইলে মনের মত হয়ে ডাকতেম সব সয়ে,
রাখতে পারলে কৈ তেমন পশার
কিসের অহঙ্কারে মত্ত, কদিন এই ইন্দ্রত্ব
তিন বছর বই আর তো, রবে না পাওয়ার।
তোমার নয় হে পিতৃশ্রাদ্ধ, সে করবে যে বরাদ্দ,
কড়া কথায় কারো নাই অধিকার।
যখন সাধারণের টাকা, সকলকে চাই ডাকা,
একলা হরির খুড়া কে তুমি তার।
তখন কাছা দিয়ে গলে, আমায় ভোট দাও বলে,
দ্বারস্থ হয়েছে সবার।
সেদিন গেছে চলে, এখন গেছ ভুলে,
দেখলে যেন চিনতে পার না আর।
করে গরবীকে পেষণ, শুষ্ককে শোষণ
সেই রক্তের ধনে তোমার এই কি ব্যবহার।
ওহে তিল কাঞ্চন হলে, অনায়াসে যায় চলে,
কর বৃষোৎসর্গ পরের ভাঁড়ারে।
আসরে দেখলাম চাঁদের আকর্ষণে এতক্ষণে জোয়ার নেমেছে। ভিড় বেড়েছে। আখড়া ছেড়ে মেলায় ঘুরে দেখি পিলপিল করছে মাথা।
বাউলের প্রথম গানে ‘চাঁদ’কে চিনতে পাড়ার কথাই বলা হয়েছে। বাউল বিশ্বাস করেন চন্দ্রময় মানুষের উপস্থিতি। তার শরীরে চাঁদ প্রতিনিয়ত খেলা করছে।
রতন বলেছিলেন, বাবুমশাই চাঁদ কী কেবল জলে খেলিছে, চাঁদ শরীরের জলকেও টানছে। উপরে তুলি দিচ্ছে।
আমি বুঝলাম রতন বীর্যর ঊর্ধ্বগতির কথাই বোঝাতে চাইছেন আমাকে।
এ গানে বাউল সাধকের আপশোস চাঁদ তার চেনা হল না। লগ্নে নেই চাঁদ। বাউলের নশ্বরতায় চাঁদ তাঁকে অমর, অনন্ত, অসীমের সন্ধান দেয়। সাধকের সাধনাকে চাঁদ সিদ্ধ গুণসম্পন্ন করে দেয়। বাউল তাই চন্দ্ৰসাধনাতে জোর দেন। গুরু সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রের কাজ দেখান। সাধক তা প্রতিস্থাপন করেন সঙ্গিনীর শরীরে। সেই চাঁদের অসিদ্ধি, বেদনা, তার জন্য হাহাকার, আর্তি ফুটে উঠেছে পদকর্তার গানে। দেহচিত্তপ্রাণমন সব ঢেলে চন্দ্র উপাসনা করতে শেখান গুরু। সাধক সেই উপাসনার আস্তরণটুকু সরাতে পারেননি এখনও। কারণ চাঁদ তার আয়ত্ত্বে নেই এখনও। চাঁদ আয়ত্ত্বে না এলে সাধকের সিদ্ধির জন্য সাধনা করা বৃথা। কীভাবে চাঁদ আয়ত্ত্বে আসবে? পদকর্তা বলছেন: চাঁদ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চাঁদের হাতি, ঘোড়া, গরু, মেড়া, চাঁদ জগৎজোড়া। হাট বাজার লেনাদেনা সবেতেই চাঁদ। পদকর্তা আসলে বোঝাতে চাইছেন চন্দ্রময় মানুষের উপস্থিতি। আমাদের নাড়ি, চক্রে চাঁদ কীভাবে তার স্পর্ধিত শাসন চালাচ্ছে। কীভাবে সাধককে চাঁদ নিয়ন্ত্রণ করছে সেসব আমরা বলেছি।
চাঁদ আসলেই এক প্রতীকী অবিচ্ছেদ্যতা। প্রকৃতি-পুরুষে। সাধক-সাধিকাতে। সাধক-সাধন সঙ্গিনীতে চাঁদ সদানন্দ ভাবের পরিবেশ তৈরি করে দেয় সাধক শরীরে।
দশমহাবিদ্যারূপে শক্তির যে নানা রূপ দেখি আমরা, সেখানে আদ্যাশক্তি হিসাবে কালী কৃষ্ণবর্ণা। দেশশক্তি হিসাবে তাঁর নাম তারা। এরূপে তিনি নীলবর্ণা। এই দুই রূপই কল্যানময়ী মাতৃরূপ। দু’জনেরই কপালে চন্দ্রকলা বর্তমান। দেশ ও কাল অনন্ত বলে মানলেও কালের উৎপত্তি ও লয় আছে। দেশেরও উৎপত্তি ও লয় আছে। চাঁদ সেই উৎপত্তি ও লয়কেও প্রতীকী অর্থে প্রকাশ করে। ওঠে ও ডুবে যায়। যদিও বিজ্ঞান বলছে চাঁদের রূপ দিনের আকাশেও থাকে সূর্যের তেজস্ক্রিয়তায় চাঁপা পড়ে। তাহলে এটাও তো ঠিক চন্দ্র ও সূর্য দেশ ও কালে সর্বশক্তিসম্পন্ন। তাদের উপস্থিতি মহাশূণ্যে সবসময়। শরীরকেও সেই প্রতীক দিয়ে বসেন সাধক। শরীরের নাড়ি তাই হয়ে ওঠে চন্দ্র ও সূর্য নাড়ি। চক্রে চক্রে বিরাজ করে চাঁদ। তার বলবীর্যকে আমরা দেখি সাধকের শরীরে। চাঁদ এভাবেই ভাবের মাত্রাকে বৈভব এনে দেয়। চাঁদে যান মানুষ। চন্দ্রকে আহ্বান করেন। আবিষ্কার করেন চাঁদে প্রাণের প্রহর কোন ছোটবেলাতে মা তো আকাশের চাঁদ দেখিয়েই শিশুকে বলেন–’আয় আয় চাঁদমামা টী দিয়ে যা। / চাঁদের কপালে চাঁদ টী দিয়ে যা।‘ আর ঠিক তখনই চাঁদমুখ শিশুর হাসি ফোটে মুখে চাঁদের বুড়ির চরকা কাটার গল্প এখনও এই কম্পিউটার, সিডির যুগেও ঠাকুমা-দিদিমার মুখে হাঁ করে শোনে বাচ্চারা। চাঁদকে তেমন করেই দৃশ্যত হাজির করেন বয়স্করা। তাঁদের বাত-বেদনার সঙ্গেও জড়িয়ে যায় চন্দ্র মহিমার কথা। পূর্ণিমা অমাবস্যাকে তারা ব্যথা প্রকটের কাল হিসাবেও চিহ্নিত করেন। এ সময় রসস্থ হয়ে ওঠে শরীর। তাই ব্যথা প্ৰকটে তারা ময়দা-আটা খান। ভাতকে বর্জন করেন। বাউলের ‘রস’ শুক্র-রজ বা বীর্য-রজ অমাবস্যার মহাযোগে ‘চারচন্দ্র’, ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’র প্রতীকে, ইশারায় ইন্দ্রিয়কে অচল করে দিয়ে, প্রবৃত্তিকে নিষ্কাম করে নিয়ে চন্দ্রের আধিপত্যকে চিহ্নিত করে। পদকর্তা বাউল তাই চন্দ্রপাঠের ইস্কুলে গিয়ে অকৃতকার্য হয়ে গেয়ে ফেরেন: ‘চাঁদ আমার ভাগ্যে’ হল না। এই অকৃতকার্য শিষ্যকে কৃতকার্য হবার প্রতীকী মন্ত্র। সাবধান বাণী। বাউল তাই বারবারই গেয়ে ফেরেন চাঁদের কথা চন্দ্র নিয়মের মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে লেখা হয় অজস্র গান। চন্দ্রবিধি, নিষেধাজ্ঞা, পালন, নির্দেশ, শিক্ষা, চর্চা, প্রচার, সাধনা সবই একাকার হয়ে যায় বাউলের এ সব গানে। তেমনই এক গান শুনেছিলাম চৈতন্য বাউল আশ্রমে।
গাইছিলেন বাউল:
চাঁদের বিবরণ জানে যে জন সুজন বলি তারে
চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে
চাঁদ প্রতিপদ হলে চলে যায় পাতালে দ্বিতীয়াতে মিলে পায়ের উপরে
থাকে তৃতীয়াতে পায়ের গোছোতে মিলে চতুর্থীতে হাঁটুর উপরে।।
পঞ্চমীতে তায় জানুর উপর রয় ষষ্ঠীতে কোমরেতে যায়
সপ্তমীতে স্থিতি নাভিতে বসতি অষ্টমীতে রয় বক্ষ মাঝারে
নবমী যোগেতে কণ্ঠ ‘পরে আসে দশমীতে ঠোঁটের উপরে
একাদশ যোগে থাকে নাসিকাতে মিলে দ্বাদশ চোখের ভিতরে
ত্রয়োদশী হলে যায় কপালে চতুর্দশীতে পূর্ণিমা যে
পূর্ণিমাতে রয় পূর্ণ মগজেতে আর্জান বলে ধন্য সাধুতে হরে।।
এই পদে দেহে চন্দ্র পরিক্রমার কথাই বলা হয়েছে। ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’ পরিক্রমা করেন সাধক সাধিকার শরীরে। সেই পরিক্রমারই বর্ণনা রয়েছে এই গানে। ‘চাঁদ অমাবস্যা হলে চলে যায় পাও-তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুল ভিতরে’। অমাবস্যা এখানে রজঃপ্রবৃত্তির কাল। যে কালে সাধক চন্দ্র পরিক্রমা শুরু করেন। সঙ্গিনীর পদনখে (পাও তলে দক্ষিণ কনিষ্ঠ আঙুলে ভিতরে), প্রতিপদে চাঁদ অবস্থান করে পাতালে। পাতাল’ এখানে অষ্টম চন্দ্রের যোনি। দ্বিতীয়াতে পায়ের উপরে। তৃতীয়াতে গেছে। চতুর্থীতে হাঁটু। চাঁদ এভাবে সঙ্গিনীর প্রত্যঙ্গ গুলোকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। চাঁদ হল চন্দ্র সাধক। যার চন্দ্ররূপী নাড়ি, চন্দ্র চক্র সব জেগে গেছে। সিদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হয়ে উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ। সাধকের প্রেমময়তা। জ্ঞান ও বোধিচর্চার গুরুকেন্দ্রিক ভাব-উপলব্ধি। আর্জান শাহের আরেকটি পদে পাই–’আগে পড়গা ইস্কুলে প্রথম যে স্বরে অ-এর স্বর যেও না ভুলে। / অ-এতে অন্ধকার ছিল স্বর বেয়ে আলো করিল/ একা চন্দ্র টলে গেল পক্ষ গেল মিলে।’ ‘চন্দ্র টলা’ মানে গুরু নির্দেশিত সাধনার ভিতটুক নড়ে যাওয়া। ‘টলা’ মানে হল শুক্র বা বীর্য স্খলিত হয়ে যাওয়া সাধিকার যোনির ভেতর। বাউল ‘অটল মানুষ’ হওয়ার কথা সব সময়ে বলে থাকেন। ‘অটল মানুষ’ হল ঈশ্বরতুল্য মানুষ। মূর্তিময়তায় সাধারণত বাউলের বিশ্বাস নেই। ‘ঈশ্বরতুল্য মানুষ’ হল ‘বস্তুরক্ষার মানুষ’। শুক্র সঞ্চয়ের মানুষ। শুক্রের অধগতি না আসা হল ‘অটল মানুষের’ সাধনলব্ধ ফল। সাধক বাউল দেহমিলনে সাধক শরীরকে উধ্বগতি দিয়ে বস্তুরক্ষা করে থাকেন। বাউল সাধনাতেও বস্তু বিসর্জন একেবারে নিষিদ্ধ। বাউল বলে রজঃপ্রকাশের তিনটি দিনে সঙ্গিনীর শরীরে কোনওরূপ কাম থাকে না। তার জন্যই সাধনে শুক্র স্খলিত হয় না। ‘প্রেমজন্ম’ হয়। সন্তান জন্ম হয় না। এই জন্ম সিদ্ধ সাধকের জন্ম। বাউল বলেন কামগায়ত্রী থাকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্রে।
জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠে একদিন অতি বৃদ্ধা বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিলেন, তা ছেলে তুমি আমি কেউ পুরুষ নই গো।
তাহলে আমরা সব কী? জিজ্ঞেসা করেছিলাম বৈষ্ণবীকে।
বৈষ্ণবী বলেছিলেন, কী আবার? কৃষ্ণের পৃথিবীর আমরা সব হলাম গিয়ে নারী। তা তুমি ছেলেই হও আর মেয়েই হওকৃষ্ণ একা বেটা ছেলে। জোয়ান মরদ। পুরুষ।
শ্রীনিবাস গোস্বামীও এই শ্ৰীপাঠে বসে একদিন বলেছিলেন, আমরা সব নারীবেশে চৈতন্য হয়ে কৃষ্ণের উপাসনা করি। চৈতন্য কেবল মহাপ্রভু নন। চৈতন্য আমাদের বিবেক, বৈরাগ্য আর জ্ঞান। এই তিনের বিকাশ হলেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের স্বরূপ নারীর।
–আপনি তো চৈতন্যদেবের রাধাভাবে উপাসনার কথা বলছেন?
–তা নয়। তা নয়। চৈতন্যদেবই আমাদের বুঝিয়েছিলেন রাধাভাবে উপাসনা করে শরীর থেকে কামের সব বীজমন্ত্র ঝেরে ফেলতে। তাই তো কামগায়ত্রী।
বাউলও সে কথা বলেন। সঙ্গিনীর শরীরে ‘সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র’কে তারা জাগিয়ে নিয়ে কামগায়ত্রী রচনা করেন। কামবীজকে ধ্বংস করে দেন এভাবে তারা।
.
বহুল প্রচারিত পদটিতে আমরা দেখেছি চাঁদকে ফাঁকি দিয়ে ভোট নেবার কথা বলছে অজ্ঞাত পদকর্তা। ভোট’ এখানে নির্বাচন ঠিকই। এই নির্বাচন সাধনার মৌলিক প্রত্যয়। যেখানে ফাঁকি দিয়ে আর ভোট নেওয়া যাবে না, মানে সাধনা চলবে না, কারণ ভোটার অর্থাৎ সাধক চিনে গেছেন চাঁদকে। চাঁদের চলিষ্ণুতা শরীরস্থ সাক্ষ্যে হাজির করে। দিতে জানেন সাধক। সাধনায় তাই চাঁদ চেনা জরুরি। সাধকরা এখন তা চিনে গেছেন। প্রথমে সাধক চাঁদকে আদর করে কমিশনার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু চাঁদ গুরুত্ব দেয়নি। ভোটারকে। চাঁদ অহংকারে মত্ত ছিল। পদকর্তা বলছেন–চাঁদের পাওয়ার তিন বছরের। তিন–তিনটে নাড়ি ঠিকই। কিন্তু এখানে ‘তিন’ সাধনার প্রথম তিনটে স্তর–স্থূল, প্রবর্ত, সাধক। এই তিন স্তরে চাঁদের ভূমিকা অনিবার্য। তার ‘পাওয়ার স্বীকার করেন দেহসাধক। চন্দ্র ঠিকঠাক সাড়া না দিলে সাধনা মোহাবস্থাতেই থেকে যাবে। সিদ্ধ দশাতে আর যাবে না। কখনও। তাই তিন বছর অর্থাৎ তিন স্তরের রঙ্গভূমিতে চাঁদের ইতিবাচকতা রয়েছে। সাধক বাউল যার জন্য তখন চাঁদের দৌরাত্ম সহ্য করেন। তারপর সিদ্ধদশাতে চাঁদ দিয়ে কাম বশীভূত করে নিয়ে তিনি চাঁদকেই চোখ রাঙান।
০১.২ দেহের খবর জান গে রে মন
চৈত্র-পূর্ণিমার চাঁদ নিয়ে কুলের পাটের মেলা সাজে। চাঁদ যেন এক চৈতন্য। যমুনা-খালে আদিগন্ত ছড়িয়ে যেয়ে যে যখন তার হাসি ছড়ায় আর বাতাস ফাঁকা ধানের মাঠে সরু খালের জলীয় হাওয়া তুলে এনে ধানকে বাজায়, তখন মনে হয় নদিয়ার জ্যান্ত গৌর হাসছেন আর তাঁর হাসিই খলবল বেজেবেজে যাচ্ছে ধানের মাঠে। এ মেলার ধারক-বাহক আমাদের গৌরই। চৈতন্য স্মৃতি-বিজরিত এ মেলা। কুলিয়ার পাটের মেলা। লোকে বলে কুলের পাটের মেলা। অনেকে আবার বলেন, অপরাধ ভঞ্জনের মেলা। কথিত: বিশিষ্ট তার্কিক দেবানন্দ গোস্বামীকে চৈতন্যদেব এখানেই তর্কযুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। তার্কিক হিসাবে যথেষ্ট সুনাম ছিল দেবানন্দের। এ বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট অহংকার তৈরি হয়েছিল মনে যে, তাঁকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করবার মতো কেউই নেই। নবদ্বীপের তাবড় তাবড় সব পণ্ডিত তাঁর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে একেবারে কুপোকাত হয়ে গিয়েছিলেন। এ-হেন তার্কিককে যখন চৈতন্যদেব পরাস্ত করেছিলেন, তখন অবশ্য চৈতন্যদেবের পরিচিতি বাংলা-বিহার-ওড়িশা ছড়িয়ে পড়েনি। সাধারণ এক শাস্ত্রজ্ঞ যুবকের কাছে পরাজিত হয়ে দেবানন্দের চোখ খুলে গিয়েছিল। তিনি নাকি চৈতন্যদেবের কাছে তখন তাঁর অহংকার জনিত সব অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছিলেন আর নদিয়ার গৌর তাঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেই মাহাত্মেই প্রচুর মানুষজন, সাধুগুরু, বৈষ্ণব-বাউল সব আসেন এখানে। যে যার অপরাধ স্বীকার করে নেন শ্রীপাঠের গৌরমূর্তির কাছে। নামকীর্তন চলে। বাউল। গানও হয়। তুলনায় নির্জন খালের ধার ফাঁকা থাকে। ওখানে বসে লোক হাওয়া খায়। দু’দণ্ড জুড়ায়।
আমরা দুই বন্ধু যে উদ্দেশ্যেই মাঝ-মেলায় গিয়ে বসলাম খালপাড়ে। মানুষজন কেউ নেই। মেলা তখন আমাদের গৌরচাঁদের ঝলক নিয়ে তার বিকিরণ ছড়াচ্ছে সমানে।
সবে বসেছি আমরা। শীতল জ্যোৎস্নায় চোখমুখ সব চকচক করছে, চুল উড়ছে। সুজিতের থলথলে পাজামায় হাওয়ার মাতন লেগেছে। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল।
হঠাই শুনি একতারার বোল উঠেছে খালধার থেকে ভেসে আসছে গান। তার রেশ কানে এসে লাগছে আমাদের। আমরা উঠে গান বরাবর এগিয়ে গেলাম। সুজিত বলল, যা সিগারেটটা শেষ করে যাচ্ছি।
গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা বাউলের পাশে। একমনে গেয়ে চলেছন তিনি। চেনা গান আমার। কতবার কতজনের মুখে যে শুনেছি জালালউদ্দিনের এই পদ। একেক শোনায় একেক আবেশ এনে দিয়েছে মনে। আজকে বাউল যেন মানুষের উচ্চ্যমন্য, অহংকারী সত্তা সব এক-এক করে খুলে সাজিয়ে রেখে দিচ্ছেন যমুনাখালের তাল তাল শক্ত কাদায়। মানুষের দ্বৈততা, তাঁর গ্রামীন ও নাগরিক যাপন সংক্রান্ত প্রচলন সব যেন বাউল খুলে ফেলছেন মানুষের আসল ব্যক্তিময়তায়। তেমনই আমার মনে হচ্ছে। ভাবছি, চৈতন্যের অন্তর্গত সত্তা এখনও এতখানি করতে পারে?
বাউল গাইছেন:
চিন্গে মানুষ ধরে
মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে।
কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় না।
পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে
দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে
তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।
মায়া সূতে জাল বুনিয়ে প্রেমের ঘেরে ভাব জাগায়ে
প্রাণেতে প্রাণ মিশাইয়া রহে জগত জুড়ে
নব রঙ্গে ফুল ফুটিলে ডোমর আসে উড়ে
ফুলের মধু দেখতে সাদা আপনি খেয়ে উদর ভরে।
সমুঝ দিয়ে দেখ চেয়ে পুরুষ নহে সবই মেয়ে।
থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ-বিচারে
একটি পুরুষ নিজ ছুরতে জগত মাঝে ঘুরে–
লক্ষ নারীর মন জোগাইয়া প্রেমের মরা আপনি মরে।
আমাদের দেখে বলে বসলেন, বসেন।
আমরা পর-পর বসে গেলাম খালপাড়ে। যমুনা থেকে তখন হাওয়া উঠছে সমানে। বাউলের চুলদাড়ি নড়ছে। আমাদের মুখে চকচক করছে চৈত্রের চাঁদ।
জিজ্ঞাসা করলাম, মেলা ছেড়ে এখানে একা বসে গাইছেন? কাউকে বুঝি আর শোনাতে ইচ্ছা জাগছে না?
বাউল বললেন, তা নয়। মেলা হল গিয়ে হাঁ কর্তা। সর্বক্ষণ গিলছে। ভাবলাম একা বসে কিছু সময় ত্রিবেণীরে গান শোনাই।
বললাম এখানে আপনি তিন নদী কোথায় পেলেন?
হাসলেন বাউল। মনে হল চৈত্র-চাঁদ হেসে উঠছে তার মুখে।
–তিন তো সদা সর্বদা আমরা ধরে রাখি কর্তা। তিন তো মাইনষের মইধ্যে খেলা করে। তিনখান নদী লইয়া মানুষ নাড়েচড়ে। কথা কয়। ও কর্তা, মাইনষের ত্রিবেণী তো মাইনষের অন্দরে খেলা করে।
বুঝলাম, বাউল তিনটি নদীস্বরূপা নাড়ির কথা বলছেন।
বললাম, তিন যদি মানুষের মধ্যেই থাকে তাহলে মজা যমুনা খালের প্রতীকে লাভ কী? নিজেকে গান শোনালেই তো হল।
–কর্তা, প্রেমরে কি আপনে দেখবার পারেন? পারেন না। মাইনষের মধ্যে দিয়া প্রেমরে দেখেন। প্রেম যে কর্তা তালে প্রতীক নিল? নিল না? কী কন?
আমি চুপ। বাউলের মুগ্ধতায় নিমজ্জিত হয়ে গেছি। বন্ধুদেরও যেন ত্রিবেণী স্নান হয়ে গেছে রাত নটার কাঁটায়।
বলে চলেছেন বাউল।
মজা যমুনাডারে পিঙ্গলা মনে কইরা যদি ভেতর শানাই, তা কর্তা মনে পড়ব হেইগার মইধ্যে সঞ্জলের স্রোত ছিল। এই যমুনার তো গঙ্গা, সরস্বতীর সঙ্গে মিলন-মিশন ছিল। ত্রিবেণীখান অ্যাহনো যদি দেখেন, তবে দ্যাখবেন সেই ভাব-ভালবাসার রেখাখান দেখা যায়। যমুনা তো আয়নামহলের ঘরডারে মনে করায়। মজা যমুন্না যে ফিসফিসাইয়া কয় দিন গেল, নাড়ি জাগব কবে? যমুনা যে বাড়বাড়ির কাছারি ঘরে হেইডার বিচার চায়। তাই তারে মনে লইয়া মজাডারে গান শুনাই। মানুষ জাগাই। ভেতর-মানুষের আওয়াজ খান শোনেন কর্তা।
একতারাটা টুং টুং করে বাজিয়ে ধরলেন বাউল। গাইতে থাকলেন।
মানুষ হয়ে মানুষ হয়ে কর গো যা মানুষের লীলা
ধরবি যদি সে মানুষে খুলে দে দেহের তালা
মানুষে মানুষ রয়েছে ধর গে মানুষ মানুষের আহে
মানুষে মানুষ পেয়েছে বৃন্দাবনে ব্রজবালা।।
লইলে মানুষের সঙ্গ উথলিবে প্রেমতরঙ্গ
সাক্ষ্মী আছে শ্রীগৌরাঙ্গ কৈলাসেতে পাগল ভোলা
পরমাত্মা রূপে এসে মানুষে মানুষ আছে মিশে
সাধনকল্পে পারি দিশে রবে না আর ত্রিতাপ জ্বালা
দ্বিদল পরে দেয় পাহারা বেদবিধি পার উলটা খেলা।
রাজা হয়েছে দিশেহারা হল না তার মানুষ ধরা
রাজেশ্বরী দিচ্ছে সাড়া যোগ দিতেছে যোগে চেলা।।
আমরা শুনলাম বাউলের মানুষ এসে সাড়া দিচ্ছে ফাঁকা এ ধারে। মেলার কলরবের মানুষ সব যমুনার ফুরফুরে হাওয়ায়, ধবধবে চাঁদে যেন মানুষের লীলায় মেতে উঠছে। না হলে গৌরের জ্যান্ত লীলায় এখনও এত মানুষের সমাগম হয়?
বাউল বললেন, একদিন চাঁদমারী আসেন। বিস্তর গান শোনাব মানুষের। আমার বসতির কাছ ঘেঁষে ইড়া নদী। পিঙ্গলায় তো বসে রইলেন। সরস্বতীটা দেখে আসেন পঁচিশে চৈত্র। ত্রিবেণী শ্মশানঘাটে গান আছে। আসবেন।
উঠে পড়লেন হরি বৈদ্য বাউল। খালপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেলেন দেবানন্দ গোস্বামী নামাঙ্কিত সৌধের ধার দিয়ে মানুষের স্রোতে।
তাঁকে আর দেখা গেল না। যমুনার ফুরফুরে হাওয়ায় মানুষের অন্তর্দীপ্তি খুঁজে ফেরা বাউলকে মানুষের ভিড়ই মিশিয়ে নিল চৈত্র-পূর্ণিমায়।
*****
‘মানুস-ধরে’ মানুষ চিনবার কথা বলেছেন হরি বৈদ্য বাউল। মানুষ ধরা হল গুরুর কাছে যাওয়া। গুরুর আসন বাউলের কাছে হৃদয় সিংহাসন। গুরুকে তারা পরমতত্ত্ব হিসাবেও ব্যাখ্যা করেন। মানবগুরুও বলে থাকেন বাউল। কেননা বাউলই মানুষ হলে ওঠেন গুরুর নির্দেশিকায়। গুরুই সাধক বাউলকে মানুষে পরিণত করে দেন। তারা মানুষকে ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, ‘রসের মানুষ’, ‘আলেখ মানুষ’ ইত্যাদি নানা অভিধায় ভূষিত করে থাকেন। মনের মানুষ তার কাছে আত্মস্বরূপ। নিজের ভেতর নিজের জ্যান্ত উপস্থিতি, নড়াচড়া, কথা বলা ইত্যাদি নানা ইন্দ্রিয়গত উপস্থিতিকে টের পাইয়ে বাউল গুরু সাধক বাউলকে ক্রমান্বয়ে ‘মনের মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’ ইত্যাদির নানা অভিজ্ঞানে পরিণত করান। গানে তাই বলা হয়েছে, মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে।
বাউলগুরু শিষ্যর মানুষ সত্তার বিকাশ দিয়েই মানুষ বানিয়ে দেন সাধক বাউলকে। তখনই এই মানুষের মধ্যে সেই মানুষে খেলা করে সেই মানুষ হল বাউলের নানা তকমাধারী সব মানুষ। গুরু তাঁকে সেই মানুষ’ তৈরি করান। বাউল সাধনায় গুরু তাই ঈশ্বরের মতো। গুরুই শিষ্যকে মানুষের স্থির নিবেশ দিয়ে সহজতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। গুরু বাউলের অশ্রুময় সত্তা যেন। অন্তরালের আবরণ খসিয়ে গুরুই বাউলকে অন্বেষণের উত্যাক্ষা, অন্তর্লোককে সামনে এনে হাজির করান। বাউল তার সব অসূয়া। কারুবাসনাগুলোকে মুছতে থাকেন গুরু নির্দেশিত সাধনাতে এসে। গুরু তার কাছে সমর্পণ। নিবেদন। গুরু তার বস্তুজগৎকে ভাবজগতের দিকে টেনে নিয়ে যান। গুরুতত্ত্বের গানে বাউল বারবারই সেকথা প্রকাশ করে ফেলেন। লালন সহ প্রাচীন পদকর্তাদের গানে গুরু তাই আত্মবিশ্লেষণে সবসময়ই সজীব হয়ে ওঠেন। গুরু, সাধক বাউলের ব্যার্থতা, জ্বালা, যন্ত্রণা, খরস্রোতকে অগ্নিময় কেন্দ্রাভিগ করে দেন। গুরুর প্রতি যার জন্য সাধক বাউলের আকুতি প্রাচীন, আধুনিক, নবীন সব পদকর্তাদের লেখায় ঝলসে ওঠে। লালনের বহুশ্রুত সেই গুরুবন্দনার গান বাউল আখড়াতে গেলে হামেশাই শোনা যায়। অনেক বাউলকেই দেখেছি আসর বন্দনা সারেন এ গান দিয়েই। গরিফার এ আসরে নবকুমার দা বাউলকে এ গান দিয়েই আসর বন্দনা করতে আমি শুনেছিলাম। মঞ্চে উঠে গুরুপ্রণাম করে বাউল সে আসরে ধরলেন বহুশ্রুত এই লালনের গান। নবকুমারের কণ্ঠ উন্মুক্ত অশ্রুভরা নিমগ্ন বেদনা নিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ল গরিফার মস্ত ফুটবল খেলারই মাঠে।
নবকুমার গাইতে লাগলেন গান। আসরে তার কাছাকাছি বসে আমি লক্ষ করলাম চোখে তার জল চিকচিক করছে। নবকুমার কাঁদছেন আর গাইছেন:
গুরু, দোহাই তোমার, মনকে আমার লও গো সুপথে।
তোমার দয়া বিনে তোমায় সাধবো কি মতে।।
তুমি যারে হও গো সদয়, সে তোমারে সাধনে পায়;
বিবাদী তার স্ববশে রয় তোমার কৃপাতে।।
যন্ত্রেতে যন্ত্রী যেমন, যেমন বাজায় বাজে তেমন।
তেমনি যন্ত্র আমার মন, বোল তোমার হাতে।।
জগাই মাধাই দস্যু ছিল, তারে গুরুর কৃপা হল।
অধীর লালন দোহাই দিল সেই আশাতে।।
গুরু শিষ্য-বাউলকে কীভাবে সহজ মানুষে পরিণত করান একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম নবকুমারকে।
বাউল বললেন, রিপু মারা শেখান গুরু রিপু মরলে দেহের ইঁদুর-বিড়াল দেহেই খেলে বেড়ায়। বিড়াল ইঁদুরখানাকে খেয়ে আত্মতৃপ্ত হয় না।
–বিড়াল কী? জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাউলকে।
বললেন, বিড়াল হল কাম। বিড়ালের যেমন আঁশ ছাড়া, মাছ ছাড়া রোচে না। তেমনই দেহের কামও ছকছক নোলা নিয়ে বসে থাকে কখন ইঁদুরখানাকে খাবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ইঁদুর কী?
–ইঁদুর হল সহজ ইন্দ্রিয়। জ্ঞানেন্দ্রিয় একখানা। আমাদের পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়গুলো সরলে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় সাড়া দেয়। কর্মেন্দ্রিয়গুলোই তো রিপু মারে। আর তখনই জ্ঞানের বিকাশ হয়। আর তা হলেই বিড়াল মাছ পর্যন্ত ছোঁয় না। সর্বদা কাশী যেতে চায়। শোনেননি নাকি সেই গান?
বাউল এবার সুর ধরলেন একতারায়। সঙ্গত দিলেন ঘরোয়া সান্ধ্য আসরে। গাইলেন না। গেয়ে উঠলেন তাঁরই শিষ্যসামন্তের একজন গুরুরই নির্দেশিকায়।
বিড়াল বলে মাছ খাব না, আঁশ ছোব না কাশী যাবো।
আবার বার মাসেই একাদশী, আমি বিশ্বনাথের প্রসাদ পাবো।
উঠি এক নেংটি ইঁদুর, ও তার কপালে টিপ মাথায় সিঁদুর
(বলে) আমি ঢাকাই শাড়ি পরে আবার মেজদার বৌদি হবো।
উঠি এক কোলা ব্যাঙ আবার বের করে সে লম্বা ঠ্যাং;
(বলে) আমি এক লাফেরে লঙ্কা গিয়ে, রাবণ মেরে রাজা হবো।
উঠি এক লাল পিপড়ে, সে বলে, আমি চলি কলে কৌশলে
আমি রেললাইনে মাথা দিয়ে বোম্বাই মেল আটকাবো।
আবার রাস্তা ধারের কেলে কুকুর, সে বলে, হব আমি কেষ্টঠাকুর
আমি কদম তলায় লেজ নাড়িয়ে শ্যামের বাঁশি কেড়ে নেবো।
নবকুমার বললেন, গুরুর সান্নিধ্যে এলেই দেহের বিড়াল মাছ ছোঁয় না। মাছ তো কাম। কাশী কাম মারার তীর্থক্ষেত্র। মহাদেব স্বরূপ তার অবস্থান। এই মানবদেহ। তার শুদ্ধতার জন্যই তো একাদশী করা। ইন্দ্রিয়গুলোকে মনে নিয়ে বোঝাপড়া সারা। সারতে গিয়ে নেংটি ইঁদুরখানা বেরোয়। ব্যাঙ বেরোয়। পিপড়ে আসে। এগুলো সব গিয়ে মদমত্ততাকে সামলায়। বাউল কী তার আর একা পারে? তখনই গুরু লাগে।
গুরুতত্ত্বের আরেক গান শুনেছিলাম নিত্যানন্দ বালার নতুনপল্লীর আখড়াতে বসে। নিত্যানন্দ সেদিন ছিলেন দারুণ মুডে। ভক্তশিষ্য পরিবেষ্টিত একেবারে। সবে সতীমার মেলা ভেঙেছে গতকাল। আজও সব বাউল যেয়ে উঠতে পারেননি আখড়া ছেড়ে। নিত্যানন্দর বাড়ির আখড়াতেও বাউল গমগম। সন্ধ্যার আসরে ক্রিয়াকরণের পর গেয়ে উঠলেন পাঞ্জু শাহের পদখানা।
গুরু-রূপে নয়ন দে রে মন
গুরু বিনে কেউ নাই তোর আপন।।
গুরু-রূপে অধর মানুষ দিবে তোরে দরশন।।
পিতার ভাণ্ডে কি রূপ ছিলি,
মায়ের গর্ভে কি রূপ হলি, মন,
পূর্ব-পরে নিরন্তরে গুরুরূপে নিরঞ্জন
রজবীজে মিলন কে করিল,
কোথায় আছে তার আসন,
ব্রহ্মাণ্ডের গড়ন গড়ে সে কোন্ জন।।
কোথায় ছিলি, কার বা সাথে ভাবে এলি, ওরে মন।
অধীর পাঞ্জ বলে, গুরু ধরে কর তার অন্বেষণ।।
নিত্যানন্দ বললেন, তা খ্যাপা আপনি মনের মানুষের কথা বলছিলেন না। সেদিন? আজ বলি দেহ না জাগলে চিনবেন কী করে তারে দেহ তো সাতে আবদ্ধ।
জিজ্ঞাসা করলাম। কী এই সাত?
বাউল বললেন, সাত সপ্তধাতু। যা দিয়ে স্থূল দেহ তৈরি। শুক্র-রজ, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, ত্বক–এই সাতে শরীর গঠিত। তাতে আবার পাঁচের সমন্বয়–ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই এগারোর আবাসভূমি শরীর। গুরু চেনান তারে।
–কীভাবে চেনান গুরু?
–সে বড়ো কঠিন কাজ। চক্ৰ চেনেন আপনে?
মাথা নেড়ে বললাম, না। সেভাবে তেমন জানি না। তবে নটা চক্রের কথা শুনেছি। বললেন, এত অল্পজ্ঞানে ‘মনের মানুষ বুঝবেন কী করে আপনি?
বললাম, সহজভাবে বলুন না। যদি ধরতে পারি।
–কী করে ধরবেন খ্যাপা? আগে গুরু ধরেন। তবে তো আপনে মানুষ ধরবেন। ইচ্ছা করে কিছু বললাম না। কেবল হাসলাম। আসলে আমার জানাটা কেবল নয়–নিত্যানন্দর জানাটা দিয়ে আমি জানতে চাইছি আজকের বাউল সমাজকে। তার পেশা গান। গানের জন্য দরবার করেন তিনি। এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান রীতিমতো গৃহী বাউল তিনি। ঘোষপাড়ার প্রায় সমস্ত বাউলই এখন তাই। তার মধ্যে দু’একজন কেবল সাধনভজন করেছেন কিছুটা। নবকুমার তাঁদের একজন। সাধন-সঙ্গিনী কৃষ্ণাকে নিয়ে বাউলপাঠ শুরু করেছিলেন। এখন নতুন সঙ্গিনী নিয়ে আছেন। তবে গায়ক বাউলরা তত্ত্বটাকে বেশ রপ্ত করেছেন। গান বেচে, তত্ত্ব বেচে, খানিকটা গুরুগিরি করে তারা পেট চালান। ভক্ত শিষ্য জোটান। তবে নিত্যানন্দ কথা বলেন সুন্দর। তার গানেরও সুনাম আছে বেশ। ডাক আসে দূর-দূরান্ত থেকে। ভক্ত-শিষ্যর সংখ্যাও তার কম নয়। রীতিমতো নবকুমারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে।
বাউল বললেন, গুরু তো রস-সাধনা শেখান। নরদেহকে গুরুই আমাদের নারায়ণ করে দেন। নররূপী নারায়ণ দেখেন, আমাদের দেহঘরে গুহ্যদেশে যে মূলাধারটি তা পৃথিবীর হদিশ দেয়। লিঙ্গের সন্ধিমূলে স্বাধিষ্ঠান জলের কথা বলে। নাভিমূলের মণিপুর শিখা ছড়ায়। হৃদয়ের অনাহত বায়ু ধরে। এই বায়ু পার করে। সহজ মানুষ করে।
কীভাবে করে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বললেন, গুরুবস্তু বায়ুক্রিয়াতেই ধরে রাখেন বাউল। নিজ শরীরে সঞ্চিত সব। গুরুতত্ত্ব শরীরের চক্রগুলোর ভেতর দিয়ে মাথায় ওঠে। উর্ধ্বে ওঠেন বাউল। পরমাত্মার দেখা পান। এ কী আর বলে বোঝানো যায় খ্যাপা নাম নেন, নাম নেন খ্যাপা। সব জানতে পারবেন।
বুঝলাম, নিত্যানন্দ আমাকে দীক্ষিত হতে বলছেন তাঁর কাছে। দলে টানতে চাইছেন আর কী। প্রান্তিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে এরা তো সবসময়ই টানতে চান। শিক্ষিত, অভিজাত এঁদের কাছে ঘুরঘুর করলে যে সমাজে তাঁদের দর বাড়ে। শিষ্য তৈরি হয় একটু বেশি।
বাউল বিন্দুসাধনের কথা বলেন। বিন্দুকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জড়সত্তা হিসাবেও আমরা। কিন্তু ভাবতে পারি। ‘শিবসংহিতা’তে আছে: ‘বিন্দুঃ শিবো রজঃ শক্তিরুভয়োর্মেলনাৎ স্বয়ম্। /স্বপ্ৰভূততানি জায়ন্তে স্বশক্ত্যা জড়রূপয়া।। অর্থাৎ বিন্দু হচ্ছে শিবস্বরূপ। রজ শক্তিস্বরূপ, দুইয়ের মিলনে জড়রূপী নিজের শক্তি বহুরূপে প্রকাশমান হয়। দেহকে ব্রহ্মাণ্ড বলেন বাউল। কারণ হচ্ছে দেহতে পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ–এই পাঁচটি উপাদান দেহের বাইরে ও ভেতরে একাত্ম হয়ে আছে। ক্ষিতিশ্চ বারি তেজশ্চ বায়ুরাকাশমেব চ। / স্থৈর্যং গতা ইমে পঞ্চ বাহ্যাভ্যন্তরে এব চ।।’ এখন প্রশ্ন হল, পঞ্চ উপাদান কীভাবে দেহস্থ অন্দরে-বাহিরে রয়েছে? পাঁচটি উপাদানের পাঁচটি করে গুণও বর্তমান। যেমন–পৃথিবী অস্থি, চর্ম, নাড়ি, লোম মাংস (‘অস্থি চর্ম তথা নাড়ী লোম মাংসস্তথৈবচ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা পৃথিব্যাঞ্চ ব্যবস্থিতাঃ।।’)। জল= মল, মূত্র, শুক্র, শ্লেষ্ম, শোণিত (‘মলমূত্রং তথা শুক্রং শ্লেষ্ম শোনিতমেব চ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা আপস্তত্র ব্যবস্থিতাঃ।।‘) তেজ = ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, মোহ ও ক্ষান্তি (‘ক্ষুধা তৃষ্ণা তথা নিদ্রা প্রমোহঃ ক্ষান্তিরেব চ। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তাস্তেজস্তত্র ব্যবস্থিত।।’)। বায়ু = বিরোধ, আক্ষেপণ, আকুঞ্চন, ধারণ ও তৃপ্তি (‘বিরোধক্ষেপনাকুঞ্চধারণং তর্পনং তথা। / এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা মারুতে চ ব্যবস্থিতাঃ।’) আকাশ = রাগ, দ্বেষ, মোহ, ভয়, লজ্জা (‘রাগো দ্বেষশ্চ মোহশ্চ ভয়ং লজ্জা তথৈব চ/ এতে পঞ্চগুণাঃ প্রোক্তা আকাশে চ ব্যবস্থিতা। ‘)। দেহে দশ বায়ুরও দশটি অবস্থান সূচক স্থানও বর্তমান। প্রাণ বায়ু হৃদয়ে থাকে। গুহ্যদেশে অপান বায়ু। নাভিদেশে সমান বায়ু, কণ্ঠে উদান বায়ু, সমস্ত শরীর জুড়ে ব্যান বায়ু। এছাড়া বাকি আরো পাঁচ বায়ু নাগ, কূর্ম, কৃকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয় থাকে সহস্র নাড়ির মধ্যে। দেহসাধক বলেন শরীরে সপ্তপাতাল আছে। যোগক্রিয়ায় সেসব স্থানে অনায়াসে বিচরণ করা যায় দেহসাধক বলেন পায়ের অধোভাগ অতল, ঊর্ধ্বভাগ বিতল (‘পাদাধস্তুবতলং বিদ্যাং তদৃধ্বং বিতলং তথা )। জানু দুটোতে সুতল এবং সন্ধিস্থলে তল (জানুনোঃ সুতলঞ্জৈব তলং চ সন্ধিরষ্ক্রকে।’) গুদমধ্যে তলাতল, লিঙ্গমূলে রসাতল(তলাতলং গুদ মধ্যে লিঙ্গমূলে রসাতলম। ) পায়ের অগ্রভাগে ও কোমরের কটির সংযোগস্থলে পাতাল (‘পাতালং কটিসন্ধৌ চ পাদাদৌ লক্ষয়ে বুধঃ।।’)। সাধক যোগে এই সাত পাতালকে দর্শন করে থাকেন। যাকে বিজ্ঞান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একেকটি স্তর বা উপাদান হিসাবে দেখছে। দেহসাধক এগুলোকে সব দেহ উপাদান হিসাবেও চিহ্নিত করেছেন। শরীরে সাতটি লোকের কথাও বলে থাকেন সাধক। নাভিদেশে ভূলোক আর হৃদয়ে ভূর্বলোকের অবস্থান। (‘ভূর্লোকো। নাভিদেশেতু ভুবলোকস্তথা হৃদি। ‘)। স্বর্লোক থাকে কণ্ঠদেশে, চোখে মহর্লোক। (‘স্বর্লোকঃ কণ্ঠদেশে তু মহর্লোকশ্চ চক্ষুষি।।’) চোখের উপরে দ্রুদ্বয়ে জনলোক বাউল সাধক এই সন্ধিস্থলকে আরশিনগর বলে থাকেন। আর ললাটে থাকে তপোলোক (‘জনলোকস্তদৃধ্বঞ্জ তপোলোকা ললাটকে।‘)। মস্তকে, সহস্রারে সত্যলোক। অনেকে একে মহাযোনিও বলে থাকেন (‘সত্যলোকো মহাযোনী ভূবনানি চতুর্দশ।‘) সহস্রারেই ব্রহ্মরন্ধ্রের অধিষ্ঠান। বিন্দুধারণ এখানেই সুসম্পন্ন হয়ে থাকে সাধকের। সপ্তলোক ও সপ্তপাতালের সমষ্টিকে দেহসাধক বলেন চতুর্দল ভুবন। বাউল সাধক আবার চোদ্দকে পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও চতুর্ভুজের যোগফল হিসাবে দেখেন। সপ্তপর্বতের কথাও বলে থাকেন। দেহসাধক। দেহের ত্রিকোনে থাকে মেরুপৰ্বত। উর্ধকোণে মন্দর পর্বত (‘ত্রিকোণে চ হিতো মেরুরূৰ্ব্বকোণে চ মন্দরঃ। ) কৈলাস বিষ্ণুস্তদূর্পে চ সপ্তৈতে কুলপর্বতাঃ।।উধ্বভাগে বিন্ধ্য ও বিষ্ণুপর্বত। শাক্তানন্দ তরঙ্গিনী’তে এই ছটি পর্বত আছে। মৎস্যপুরাণ ও বিষ্ণুপুরাণে সাতটি পর্বতের উল্লেখ পাই। তবে নামে কিছুটা পরিবর্তন আছে। মহেন্দ্র, মলয়, সহ্য, শক্তিমান, ঋক ও পরিবার–এই হল সপ্তপর্বত। শরীরস্থ সাতটি দ্বীপের কথাও বলেন সাধক। অস্থিতে জম্বুদ্বীপ, মাংসে থাকে কুশদ্বীপ (‘অস্থিস্থানে মহেশানি! জম্বুদ্বীপো ব্যবস্থিত। মাংসেষু চ কুশদ্বীপঃ ক্রৌঞ্চদ্বীপঃ শিরাসু চ।’) শিরাতে ক্রৌঞ্চদ্বীপের অবস্থান। রক্তে থাকে শাকদ্বীপ (‘শাকদ্বীপঃ স্থিতো রক্তে প্রাণিনাং সর্বসিন্ধযু।‘)। তার উপরে সন্ধিদেশে থাকে শাল্মলি দ্বীপ (‘তদূর্ধ্বং শাল্মলিদ্বীপঃ ক্ষশ্চ লোমসঞ্চয়ে। ‘)। লোমপূর্ণ স্থানে থাকে প্লক্ষদ্বীপ। আর নাভিতে থাকে পুষ্কর দ্বীপ(‘নাভৌ চ পুষ্করদ্বীপঃ সাগ্ৰাস্তদনস্তরম্।।’)। সাতটি সাগরও থাকে দেহে। মূত্রে লবণসাগর আর শুক্রে ক্ষীরোদসাগর (লবণোদস্তথা মূত্রে শুক্রে ক্ষীরোদসাগরঃ। ‘) মজ্জায় থাকে দধিসাগর, তার উপরে চর্মে ঘৃত সাগর ( ‘মজ্জা দধিসমুদ্রশ্চ তদূর্ধ্বং ঘৃতসাগরঃ।।)। বসা বা চর্বি / মেদে থাকে জলসাগর আর কোমরে / কটিদেশে বা রক্তে থাকে ইক্ষুসাগর (‘বসাপঃ সাগরঃ প্রোক্ত ইক্ষু স্যাৎ কটিশোণিতম্।।‘)। শোণিতে থাকে সুরাসাগর (শোণিতেষু সুরাসিন্ধঃ কথিতাঃ সপ্তসাগরাঃ।।)। সাধক এই সাত সাগরের কথা বলে থাকেন। বাউল সাধক দেহে সাত রসের কথা বলে থাকেন। আবার সাতদিনের যে রজঃধারার নাম করেন তাও অনেকটা সাগরস্থ সাতনামের ধারেপাশে চলে আসে। দেহসাধক দেহস্থ নবগ্রহের কথাও বলে থাকেন। নাদচক্রে সূর্য, বিন্দুচক্রে চাঁদ অবস্থিত (নাভিচক্রে স্থিতঃ সূর্যো বিন্দুচক্রে চ চন্দ্রমা’। ) চোখে মঙ্গলের স্থান আর হৃদয়ে বুধ (‘লোচনে মঙ্গলঃ প্রোক্তো হৃদি সোমসুতো।‘)। পেটে বৃহস্পতির স্থান, শুক্রে শুক্র (‘উদরে চ গুরুশৈচব শুক্রে শুক্ৰস্তথৈব চ।।’) নাভিতে শনি বিরাজমান, মুখে রাহু (‘নাভিচক্রে স্থিতো মন্দো মুখে রাহু স্থিতঃ সদা। ‘)। পায়ে ও নাভিতে কেতুর স্থান (‘পাদে নাভৌ চ কেতুশ্চ শরীরে গ্রহমন্ডল।’)। বাউল নববিধা ভক্তিরসের কথা বলে থাকেন। বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসও বাউলের নটার অন্তর্গত। সূর্য-চন্দ্রকে ইড়া-পিঙ্গলা স্বরূপও আমরা ভাবতে পারি। দেহে সপ্তপাতাল, সপ্তসাগর, সপ্তদ্বীপের কথা কিন্তু বাউল সাধকও বলেন। তন্ত্রসাধকের একার কল্পনা তা কখনওই নয়। চোদ্দ ভুবনের কথাও কিন্তু বাউল বলেন। এরকমই এক গান কেদুলি মেলাতে বিশ্বনাথ দাস বাউলের গলাতে শুনেছিলাম। সুধীরবাবার আখড়াতে বিশ্বনাথ সেবার এ গান গেয়েছিল। ভীমপুর-আসাননগরের লালন মেলাতেও বাংলাদেশের এক বাউলের মুখে রাধাশ্যামের এই পদ শুনেছিলাম। যথেষ্ঠ গুরু আধারিত এ গান। আগন্তক নিবেশ দিয়ে রূপময় বার্তা এ কখনওই নয়। এ গান শিক্ষা দীক্ষার প্রস্তুতি পর্বের জন্য বাউল সাধকের কাছে যেন ধ্রুপদী সঙ্গীত। যথেষ্ট ভাবগম্ভীর আধার দিয়ে গেয়েছিলেন সেদি এ গান বিশ্বনাথ। পদ্মাসনে বসে হাতে একতারা নিয়ে। তত্ত্বের নিবেশকে তিনি যেন ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিলেন বাউলের দরবারে।
গাইছিলেন বিশ্বনাথ:
আগে দেহের খবর জান গে রে মন,
তত্ত্ব না জেনে কি হয় সাধ।
দেহে সপ্ত স্বর্গ, সপ্ত পাতাল,–
চৌদ্দ ভুবন কার ভ্রমণ।।
এই দেহে হয় চব্বিশ তত্ত্ব,
গুরুবর্ত করে দেখলি না রে
হয়ে অহঙ্কারে মত্ত।
আছে চব্বিশের উপর তিন তত্ত্ব,
যাতে মত্ত হয় রসিকগণ।।
আরো আঠারো চিজে দেহ গঠন হয়েছে,
পিতার চার, আর মাতার চার
দেখ দেহে রয়েছে।
আরো গুরু যে তায় দশ দিয়েছে,
সে কথা কি নাই স্মরণ।।
বলি ওরে মন-কানা, তোর ভ্রম তো গেল না,
দেহের মধ্যে কে আপন-পর, তাও তো চিনলি না।
এবার যত্ন করে গুরুদ্বারে চক্ষে দিলি না রে জ্ঞানাজ্ঞান।।
এই দেহেতে আছে বাইশ মোকাম–
তার কার বা কোন স্থান,
দেখ না খুঁজে, কোথায় বিরাজে
তোর পরম গুরু আত্মারাম।
ক্ষ্যাপা রাধাশ্যাম তুই না জানিস তত্ত্ব-প্রমাণ–
গোঁসাই গুরু চাঁদের এই বচন।।
রাধাশ্যাম বলছেন দেহতত্ত্ব না জানলে বাউল সাধন কখনও কোনওভাবেই সার্থক আকার নিতে পারে না। কেননা মানবদেহতেই মূলতত্ত্বের বাস। দেহকে ঘিরে থাকে উপলব্ধ-সত্তা। বাউল বলেন আত্মা। আত্মা তাঁদের কাছে ভগবান স্বরূপ। বাউল তো কল্পিত মূর্তির ভগবানে বিশ্বাস রাখেন না সাধারণত বাউলের ভগবান আত্মা। এই প্রাণস্পন্দ যুগল দেহসাধনা থেকে উঠে আসা স্পন্দ। ‘ভগবান’ কথাটিই কিন্তু যথেষ্ট যুগল-দ্যোতক। ‘ভগ’ কথার অর্থরূপ গর্ত। ‘বাণ’ হল লিঙ্গ। বাউলও গুহ্যপ্রতীকে বাণকে লিঙ্গই বলেন। নতুন কোনো আলাদা অর্থের প্রতীকরূপ বাণকে তিনি দেখেন না। যা সচরাচর তারা করে থাকেন। তবে যেটা মনে হয় তাঁদের সব প্রতীককল্পেরই একটা সদর্থক ভাবনা থাকে। ভেবেচিন্তেই বাউল সমাজ প্রতীককল্পগুলোকে তৈরি করেছেন। এখানেও সদর্থক অর্থেই তাঁদের ভেতর ভাবনা কাজ করেছে। প্রতীককে তারা অনুভূতিদেশের আলো দিয়েছেন। দিয়েছেন রক্তশব্দ, সমুদ্রশব্দ সব। যার জন্য প্রতীক প্রাণবন্ত তরঙ্গ তুলছে বাউলেরই গানে। চন্দ্র তাঁদের এমনি এমনি কি বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক হয়ে উঠেছে? মোটেই না। ইড়া পিঙ্গলার তেজদীপ্তি নিয়েই তো তারা ডান-বামের শিরোপা ধরেছে। পূর্ণচন্দ্রকে বাউল প্রেম বলেন। প্রেমের ভেতরে তো চিরকালই নরম মাধুর্য এক জ্বলজ্বল করে, বাউল তাই পূর্ণচন্দ্রকে প্রেম প্রতীকে রেখেছেন। ক্ষীরকেও প্রেম নামেই অভিহিত করে থাকেন তারা। ক্ষীরের জমাট নরম মিষ্টতার সঙ্গে প্রেমের ভাষার উৎসার তো সঠিক অর্থেই যায়। নীর তাঁদের কাম বা রজ। আভিধানিক নীর তো জলসূচক। রজ উন্মোচিত আবরণ তাই সে নিয়েছে বাউল-প্রতীকে। তিন, ছয়, পাঁচ প্রতীকেও তো শরীরের কেন্দ্রগত সব মাংসময়তা আছে। দেহে সপ্তস্বর্গ, সপ্ত পাতালের কথা বলেছেন রাধাশ্যাম গানে। শরীরস্থ প্রলয়ঙ্কর শক্তি সব। সাধকগণ তাঁদের প্রতীকময়তার দেহেই জীবন্ত করে রেখেছে। দেহ ব্ৰহ্মাণ্ড। নিয়েই সহজিয়া তাই অন্তর্লোকের অনুসন্ধিৎসাকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন গুরুর সংযুক্ত আধারে। দেহকে বাউল ‘পরম পুরুষ’ হিসাবে দেখেন। দেহ আত্মোপলব্ধির একেকটি স্তর। গুরু নির্দেশিত সেই স্তর ভেদ করে সাধক আধ্যাত্মিক উপলব্ধিতে উপণীত হন। আধ্যাত্মিক এই বিকাশ বাউল সাধকের আত্মিক বিকাশ। যুগল সাধনে শরীরস্থ অস্থি চর্মময় আধারে তারা মহারসের আনন্দধারা উপলব্ধ করে থাকেন। বাউল ক্রিয়ামূলক আচরণে চক্রস্থ নাড়িকে সতেজ করে, ষড়রিপুকে দমন করে পঞ্চভূতকে, সপ্তপাতাল আর। সপ্তস্বর্গকে বিকশিত করে সঙ্গিনীর শরীরে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র ছুঁয়ে, অষ্টম ইন্দুকে প্রতিলব্ধ করে ‘অটল’ হয়ে ওঠেন।
অটল কী? একবার প্রবৃদ্ধ বাউল সাধক শশাঙ্কশেখরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললেন, বিন্দুধারী ব্ৰহ্ম গো। মনের মানুষ হওয়া তো ব্রহ্মকে ধরে থাকা। ব্রহ্ম আত্মা নাড়ির ধুকপুকানি।
তারাপীঠে আশ্বিণের শুক্লা চতুর্দশী তিথিতেই একবার দেখা হয়েছিল যোগমায়া ভৈরবীর সঙ্গে। সাধুসন্তের সমাগমের উজ্জ্বল এই লগ্নযোগে যজ্ঞ করতে তিনি পৌঁছেছেন। থাকেন আগ্রায়। তার ভৈরব বিশ্বেশ্বর নাকি স্বয়ং শিব। ভক্ত-শিষ্যর এমনই সব মতামত। আর মা আদ্যাশক্তি মহামায়া। তা মহামায়া আমাকে সেই বিকেলে বললেন এমন এক আশ্চর্য কথা, আমি তো শুনে হতবাক হয়ে গেলাম।
মা বললেন, শব্দতে আস্তরজ্ঞান থাকে। শব্দ তাই ব্রহ্ম। একা শব্দ হল প্রকৃতি। শব্দবন্ধ হল তার পুরুষ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রূপ। কালী কি?
জিজ্ঞাসা করলাম, কী মা?
–আস্তর ফাটা, দ্যাখ, কালী হল কামনাকেই বশীভূত করে নেওয়া।
–কীভাবে তা হয়?
–কালী তো রতিযোগের নারী ক্রিয়াশীল। তিন রতির এক রতি হল গিয়ে কালী। বিপরীত বিহার করছেন তিনি। শিব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। যেন মরে রয়েছে। যুগল সাধনায় নিষ্ক্রিয় শিবকে, পুরুষকে তো শক্তি জাগায়। তাই পুরুষ ব্রহ্মলাভের জন্য শক্তিরূপা কালীর কামনাকে হরণ করে নেন। নিণা কালী অর্থাৎ কামনা সগুণা হয়। আর তা হলেই সাধক অটল অমর হয়ে যায়।
মায়ের এই কথা শুনে আমার বাউলের অটল হবার কথা মনে পড়ে গেল। মা কে বললাম, মা এতে কী সাধক সহজ মানুষ হন?
বললেন, বাউল বলেন ও কথা। ঠিকই বলেন, সাধককে তো সহজ হতেই হবে। সহজ কী?
জিজ্ঞাসা করলেন মা।
বললাম কী মা? আপনি বলুন। আপনার কথা শুনতে চাই।
–সহজ হল সহস্রবার কাছে যাওয়া। কার কাছে যাবেন সাধক? যাবেন পরমা প্রকৃতির কাছে। তার কাছে গিয়ে নাড়িকে সহস্রবার জাগিয়ে নেবেন। সহজের সহস্র তখন চলে যাবে সহস্রার পদ্মে। এখানের ক্রিয়ায় সাধক অটল হবেন। রসিক হবেন। কারণ যে তিনি রস ধরেছেন।
বাউলও এই রস ধরেই কিন্তু রসিক হন। মনের মানুষ, সহজ মানুষ তার রসস্থ আলোকসম্পাত। সর্বোচ্চ দশা। নিভৃত ঘরে দ্বিদলের ক্রিয়া দ্বিদল প্রস্ফুটিত হয় আজ্ঞাচক্রে। এখানে তিন নাড়ির মিলনস্থল। বাউলের ত্রিবেণী। হৃদ্বয়ে এই দ্বিদল পদ্ম থাকে। বাউল কথিত তা আরশিনগর। সাধক বলেন শ্বেতবর্ণ পদ্ম এটি। এই সাদাকে পরমাত্মা স্বরূপ কল্পনা করতে পারি। কামনার নাশে ‘কালী’ মুছে ‘সাদা’ আসছে। দুই দ্বলে দুই বর্ণের কথা বলেন সাধক। ‘হ’ ও ‘ক্ষ’। ‘হ’ কে হৃদয়দ্যোতক আর ‘ক্ষ’কে ক্ষণ(শুভক্ষণ, শুভাগমন, ভাগ্যবান) হিসাবে কল্পনা করে নিলেই কিন্তু মনের মানুষের রেশটি যেন আরও স্পষ্ট হয়। হৃদয় দিয়েই উধ্বারেতার অনুভূতিকে ধরা ছোঁয়া যায়। ভাষা দিয়ে নয়। আর তা ভাগ্যবানের পক্ষেই সম্ভব। সবাই তো আর সেই স্তরে, মুহুর্তে, ক্ষণে যেতে পারেন না।
যোগমায়া মা বলেছিলেন, বীর্য হল কার্ত্তিক।
আমি চমকে গিয়েছিলাম শুনে। জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে মা বীর্য কার্তিক হলেন?
বললেন, তোর রূপ পরিষ্কার। কিন্তু তুই কালো হলেও কার্তিক হবি। বীর্য সবার কার্তিকের রূপের মতনই রূপময়। আর নারীর রজ হল লক্ষ্মী। রজঃস্রোতেই সাধক ঐশ্বর্য লাভ করেন। তার ঐশ্বর্য বীর্যের উদ্ভাস। বীর্যের সঙ্গে সাধকের সাক্ষাৎকার ঘটে ব্রহ্মরন্ধ্রে।
*****
রাধাশ্যাম গানে গুরুবর্তের কথাই বলেছেন: ‘এই দেহে হয় চব্বিশ তত্ত্ব/ গুরুবর্ত করে দেখলি না রে/ হয়ে অহঙ্কারে মত্ত।’
চব্বিশ তত্ত্ব হল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোমের পাঁচ। পঞ্চভূত। মিষ্টি, টক, লবনাক্ত, তেতো, ঝালের এই পঞ্চস্বাদ। চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক, পানি, বাক, পাদ, পায়ু উপস্থের দশ। দর্শেন্দ্রিয়। কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্যের ছয়। ষড় রিপু। অনিমা, মহিমা, লঘিমা, গরিমা, পতি, প্রকাম্য, ইশিত্ব, বশিত্বের আট। অষ্টসিদ্ধি। সর্বমোট চব্বিশ। দেহের এই চব্বিশ তত্ত্বের হদিশ গুরু দেন। গুরু সাধকের দেহ আধারিত বিজ্ঞান। শরীরের আকাশ,বাতাস, তেজ, জল, পৃথিবীর সন্ধান সাধককে দেন গুরু। ভাব, যোগ ও ক্রিয়াসংযোগে। রাধাশ্যাম তার কথাই বলেছেন পদটিতে। চব্বিশের তিন তত্ত্ব। রতিকল্প–ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। যাতে মত্ত হয় রসিকগণ। অর্থাৎ কিনা বাউল সাধক নিজে নাড়ির করণক্রিয়া বুঝে নেন, জেনে নেন গুরুর কাছে। তারপর তিনি রপ্ত করে ফেলেন। আর তখনই ‘আঠারো চিজ’কে জানতে হয়–’আরো আঠারো চিজে দেহ গঠন হয়েছে/ পিতার চার, আর মাতার চার/ দেখ দেহে রয়েছে। আর গুরু যে তায় দশ দিয়েছে, সে কথা কি নাই স্মরণ।।’
পিতার চার-হাড়, শিরা, শুক্র, মগজ। মাতার চার-মাংস, চামড়া, রক্ত, চুল। গুরুর দেওয়া দশ–দশেন্দ্রিয়। গুরুই তো ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধি প্রদান করে থাকেন সাধক বাউলকে। তাই গুরুবর্তের কথাতে তা মনে রাখতে বলা হচ্ছে। গুরুই তো সাধক বাউলকে জ্ঞানচক্ষু দেন। তাই গুরুর স্থান পিতামাতার পরই। বৈষ্ণবরা বলেন–’গুরু ত্যজি গোবিন্দ ভজে, / সেই পাপী নরকে মজে।’ শাস্ত্রে বলা হয়েছে–’ন চ বিদ্যা গুরোস্তুল্যং ন তীর্থং ন চ দেবতা / গুরোস্তুল্যং ন বৈ কোহপি যদৃষ্টং পরমংপদম।।/ ন মিত্রং ন চ পুত্রাশ্চ ন পিতা ন চ বান্ধবাঃ। ন স্বামী চ গুরোস্তুল্যং যদৃষ্টং পরমং পদম। একমপ্যক্ষরং যস্ত গুরুঃ শিষ্যে নিবেদয়েৎ। পৃথিব্যাং নাস্তি তদ্রব্যং যদ্দত্ত্বা চাণী ভবেৎ।’ কোনও বিদ্যা, কোনও তীর্থস্থান, কোনও দেবতা, কিছুই গুরুর তুল্য নয়। গুরুর মতো বন্ধু কেউ নেই। পিতা, পুত্র, স্বামী, বন্ধু কেউই গুরুতুল্য হতে পারেন না। গুরু শিষ্যকে যা প্রদান করেন (মন্ত্র, যোগ, ক্রিয়া ইত্যাদি) তার তুল্য বস্তু পৃথিবীতে নেই। বাউল সাধক তাই গুরুতত্ত্বেরই সাধনা করেন। তাঁদের মত, গুরুতত্ত্বের যে স্বরূপ তার তিন রূপ। প্রথম রূপ ভোক্তা। যিনি স্কুল শরীর ভোগ করেন। দ্বিতীয় রূপ পুরুষ আর তৃতীয় প্রকৃতি। পুরুষ আর প্রকৃতির যুগল সাধনাতেই অনির্বচনীয় স্তরে চলে যান সাধক। যা তাঁদের সহজ মানুষের স্তর। সমস্ত মানুষ। অভিধা শেষে গিয়ে সাধকের অতীন্দ্রিয় গুরুতত্ত্বে মেশে। বাউল তখনই গুরুরূপের স্বরূপ দেহতত্ত্বের, মানুষতত্ত্বের, সাধনতত্ত্বের গান রচনা করেন আর প্রদর্শিত পথে হাঁটেন। কুলের পাটের মেলায় হরি বৈদ্য বাউল পরম গুরুতত্ত্বের মানুষকেই তাই সামনে আনছিলেন একা বসে পূর্ণচন্দ্রের আভায়– ‘কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় না/পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে/দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে–তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।’
পদকর্তা বলছেন মানুষ দিয়ে মানুষ বানানোর কথা। দেহ সাধনায় মানুষ বানানো হয় যুগল ঘনসংবদ্ধতার গাঠনিক সৌকর্যকে নিয়েই। দুই ভাণ্ডের পানির কথা বলেছেন রাধাশ্যাম। দুই ভাণ্ড যুগল দেহ। পানি রজ-বীর্য। অষ্ট জিনিস কীভাবে তৈরি হয় দুই ভাণ্ডের পানিতে? তৈরি হয় সাধনের সময়। বাউল সাধনার সময় দিনক্ষণ আর তিথিতে মাপা। তাঁদের ক্রিয়াকরণ তিনদিনের। যখন সঙ্গিনীর শরীরে রজস্রোত বইতে থাকে সাধনার প্রথম দিনে তখন থাকে নিরবিচ্ছিন্ন কাম। এই কাম তাঁদের কাছে লীলাসূচক। তখন বাউল সাধক চারচন্দ্র ভেদে নামেন। মল, মূত্র, শুক্র, রজ সব শরীরে ফিরিয়ে নেন। এতে নাকি দেহে একটা পরিবর্তন আসে। অনেক বাউল সাধকই বলেন চারচন্দ্র ভেদের পরে শরীরে তারা অষ্টদল পদ্ম দেখতে পান ঘুমের ঘোরে, স্বপ্নেসেখানে। বিন্দু প্রতীকের কথাও তারা বলেন। আসলে যেটা মনে হয় একটা ধারণার কথা বলেন তারা। ভাবেন আর স্বপ্নময়তার আবেশে সেই ছবি ফুটে ওঠে। তবে তা একান্তই ঘুমঘোরে কিনা বলা শক্ত। কেননা অষ্টদলের পদ্মচক্র তো আমাদের শরীরে যোগসাধক কখনও কল্পনা করেন না। মূলাধার চতুৰ্দলবিশিষ্ট। স্বাধিষ্ঠান ষড়দল বিশিষ্ট। মণিপুর দশ দলের। অনাহত দ্বাদশ দলের। বিশুদ্ধ ষোড়শ দলের। আজ্ঞা দ্বিদলের। গুরুচক্র শতদলবিশিষ্ট। সহস্রার সহস্রদলবিশিষ্ট পদ্মচক্র। তাহলে অষ্টদলের কথা এল কীভাবে? গানেও কিন্তু অষ্টদল পদ্মের উল্লেখ পাই। মণি গোঁসাইয়ের গানে এর স্পষ্ট উল্লেখই আছে: ‘অষ্ট ক্রোশ গভীরের নিচে রূপের একটা গাছ রয়েছে। / একশত সাত ফুল ত্রিজগৎ তার গন্ধে আকুল/ ফুল ফুটে তার মাসে মাসে মধু খায় ভ্রমর ডালে বসে।।’
বাউল স্বাধিষ্ঠানকে অনেক সময়ই বাদ দেন দেখেছি। তাহলে দাঁড়ালো: অষ্টপদ্ম চক্র। সহস্রার আটে চলে এল। আর সহস্রারেই সাধক বিসর্গাকারের মণ্ডলবিশেষ দেখতে পান ধ্যানযোগে। এই বিসর্গাকারের তেজোময় মণ্ডলটিকে তারা বলেন বিন্দুসম। এখানে। পরম শিবের স্থান বলে তাঁদের বিশ্বাস। শিব শক্তিদ্যোতক। যোগকালে সমস্ত পদ্মচক্রের পাঁপড় ছিড়তে ছিড়তে সাধক ব্রহ্মরন্ধ্রের উপরে সেই বিন্দুরূপকে দেখেন। ‘বিন্দু’ এখানে উর্ধ্বারেতা সমত্ত ধরতে পারি। কেননা মূলাধারের শুক্র যোগক্রিয়াতে সহস্রারের ব্রহ্মরন্ধ্রে এসে জমা হয়। তখনই দিব্যজ্ঞান, নিরাকার শূণ্যতার দেখা পান সাধক। মায়াচ্ছাদিত পরমাত্মা থৈ থৈ করতে থাকে সাধক শরীরে। বিন্দু দেখাকে বাউল উধ্বারেতার ইঙ্গিত স্বরূপই দেখেন বোধহয়। আর তারা যেহেতু অষ্ট চক্রের কথা বলে থাকেন, সেই জন্যই অষ্টদল পদ্ম রূপ। অষ্ট জিনিসের কথা বলেছেন রাধাশ্যাম। অষ্টপাশ বাউলের-লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এগুলোর কর্মযোগকে তারা থামিয়ে দেন। সাধক অষ্ট সিদ্ধির কথা বলেন। তান্ত্রিক সাধনাতে এর উল্লেখ পাই। অণুর মতো যোগবলে ক্ষুদ্র হয়ে যেতে পারেন সাধক (অণিমা)। বড় হয়ে যান (মহিমা)। ইচ্ছামতো হাল্কা হতে পারেন। আবার (গরিমা)। যা ইচ্ছা লাভ করতে পারেন (প্রাপ্তি)। ইচ্ছামতো কোনো জিনিস পেতে পারেন (প্রকাশ্য)। কোনো কিছুর উপর প্রভূত্ব বিস্তার করতে পারেন (ইশিত্ব)। বশ করতে পারেন যাকে তাকে (বশিত্ব) বাউল সাধকের এই অষ্টসিদ্ধি নেই এটা হলফ করে বলতে পারি। তাঁদের আট আটপাশের বাঁধন কাটা। আর অষ্টদল পদ্ম ধারণাকল্প। বাস্তবিক এরকম পদ্মচক্র শরীরে কিন্তু নেই। যেটা মনে হয় অষ্টপাশ মুক্তি হওয়াই তাঁদের অষ্টবৃত্তির নাশস্বরূপ আটটি দলপদ্ম। নবরঙ্গে ফুল ফোটার কথা বলেছেন পদকর্তা। নবরঙ্গ নয়বিধা ভক্তিরস। এই রসে রাধাভাব আসে। শরীর প্রকৃতি হয়। রাধাশ্যাম তাই বলেছেন: ‘নব রঙ্গে ফুল ফুটিলে ডোমর আসে উড়ে/ ফুলের মধু দেখতে সাদা আপনি খেয়ে উদর ভরে। / সমুঝ দিয়ে দেখ চেয়ে পুরুষ নহে সবই মেয়ে। / থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ বিচারে’–এই ভেদ বিচার হল চারচন্দ্র ভেদ। তারপর সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শ। ভাবাশ্রয়। বাণক্রিয়া। তিন দিনের যোগে এই বৈতরণী পার হলে বাউল বলেন শরীরে ‘সহজ মানুষের’ উদয় হয়েছে। সহজ মানুষ হল প্রকৃতি-পুরুষের নিবিড় আনন্দময় অবস্থা। যেখানে প্রেম শৃঙ্গার। তিনদিনের রেচক–পূরক–কুম্ভকের ক্রিয়ায় নাড়ি পরিষ্কার হয়ে যায়। বায়ুর সাম্যতা থাকে শরীরে। সুষুম্নার পথ সহজ সরল হয়ে ওঠে। আর এই সুষুম্না দিয়েই। বাউল সাধক নীচস্থ বীর্যকে উপরে ঠেলে তুলে দিয়ে সঙ্গিনীর শরীরে নিবিড় অচঞ্চল হয়ে পড়েন। এই অবস্থাই বাউলের সহজ মানুষের বিলাসস্বরূপ। বাণ ক্রিয়ার কথা বলেছি আমরা। কুম্ভক শক্তির উপর এই ক্রিয়া নির্ভরশীল। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন ও সম্মোহন–এই পঞ্চবাণ-ক্রিয়া থাকে যুগল মিলনে। মদন হল ক্রিয়াযোগে রতিশক্তির উত্তেজক অবস্থা। মাদন হল সঙ্গিনীর দেহের বিভিন্ন উত্তেজক স্থানগুলোতে চুম্বনস্পর্শ দিয়ে উত্তেজনা জাগিয়ে দেওয়া। বাউল একে ‘হিল্লোল’ও বলেন। শোষণ হল সঙ্গিনীর শরীর। থেকে কামকে তুলে নেওয়া। স্তম্ভন যুগ্মদেহের স্থিরতা। সম্মোহন দেহের হিতাহিত শূন্যতা। মনের মানুষের বা সহজ মানুষের স্থিরকৃত ভূমি হল সম্মোহন। এখানে শরীর এলেই ওই বোধেন্দ্রিয় ক্রিয়া করে। রাধাশ্যাম বলেছেন: ‘থাকবে যদি পুরুষ হয়ে চল ভেদ-বিচারে/ একটি পুরুষ নিজে ছুরতে জগত মাঝে ঘুরে।’
পুরুষ এখানে বাউলবস্তু। কৃষ্ণধন। তার জন্যই লক্ষ নারীর মন জোগানোর কথা। ‘লক্ষ নারী’ সাধন শরীর। তাকে ঠিকমতো চালনা করলেই ‘প্রেমের মরা আপনি মরে।’ অর্থাৎ কিনা শরীর শূন্যতায় অখণ্ডতা দেখা দেয়। পরমাত্মা বিরাজ করে শুধু।
কুলের পাটের মেলায় বাউল হরি বৈদ্য রাজ খ্যাপার যে পদ শুনিয়েছিলেন সেখানেও বলা হয়েছে: ‘মানুষ হয়ে মানুষ হয়ে কর গে যা মানুষের লীলা/ ধরবি যদি সে মানুষে খুলে দেহের তালা।’ ‘বাউলের পরমতত্ত্ব’ সব দেহ ঘিরেই। চক্র ও তার সন্নিহিত পদ্ম; ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ি এগুলোকে আশ্রয় করেই তাঁদের তত্ত্ব বিরোচিত। তান্ত্রিক আচার, সহজিয়া বৈষ্ণব মতো সবই দেহকে শ্রীক্ষেত্র করে সামনে এগোনো। তার জন্যই পদকর্তা দেহের তালা খুলতে বলছেন। শরীরের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডকে উপলব্ধ করতে বলছেন। সাধনপদ চর্যাপদের ভাষাতেও দেহস্থ অন্দরকে ঠিকঠাক জানার কথাই লেখা হয়েছে–’ঘরে অচ্ছই বাহিরে পুচ্ছই/ পই দেকখই পড়িবেশী পুচ্ছই। / সরহ ভণই বঢ় জাণউ অপ্পা। / ণউ সো ধেঅণ ধারণা জপ্পা।।‘ ঘরের মধ্যেই পরমতত্ত্ব আছে। তুমি কেবল বৃথাই বাইরে তার জন্য একে-তাকে জিজ্ঞাসা করছ। তোমার প্রিয় ভেতরই আছে, তবু তুমি প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করছ সে কোথায় আছে। সরহ বলছেন, ওরে মূর্খ, আত্মতত্ত্বকে জান সত্য ধারণা নিয়ে। ধ্যান ধারণার দ্বারা দেহকে না জানলে কিছুই জানা যাবে না। এখানকার ‘তোমার প্রিয়’ সেই বাউল কথিত মনের মানুষই। দেহকে সাধক সহজ বৃন্দাবন মনে করে থাকেন। দেহ মথুরাও। এই দুই জায়গার আবেশ বাউল দু’জনের শরীরে মেখে সাধনাতে এগোন। জীবন্ত এক প্রতিভূ সব সময়ই তৈরি করতে চান বাউল। গৌরাঙ্গের রক্তমাংসের পরতও খুলে যায় তাঁদের দেহতত্ত্বের গানে। বৈষ্ণবীয় আধার এভাবে বাউলে ঢোকে। পদকর্তারা বৈষ্ণবীয় কবি চন্ডীদাসকেও তাঁদের অন্তর্ভূক্ত করে নেন। রামীকে তাঁদের সাধনগুরু সাজিয়ে নারীকে প্রতিনিধি স্থানীয় এক বিশেষ সিংহাসনই দেন। সহজিয়া-বৈষ্ণবরাও ‘মানুষ’, ‘সহজ মানুষ’ বলতে অন্তরস্থ সত্তাকে শ্রীকৃষ্ণ হিসাবে বোঝেন। এক্ষেত্রে চৈতন্যদেবই তাঁদের পথ দেখান। তার প্রতিমূর্তি, রাধাভাবের নিমগ্ন সাধনায় শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ওঠে পরমতত্ত্ব। মানুষ, সহজ মানুষ। তাঁদের অনেক পদেই মানুষের এই অভিজ্ঞানকে আমরা দেখে থাকি। যেমন-’মানুষ মানুষ ত্রিবিধ প্রকার মানুষ বাছিয়া লেহ। / সহজ মানুষ অযোনি মানুষ/ সংস্কারা মানুষ-দেহ।।‘ বা, ‘সব পরিজন লয়ে সঙ্কৰ্ষণ / সহজ মানুষ হইলা। / সহজ রূপেতে সহজ মানুস/আস্বাদে মানুষ লীলা। অথবা, ‘সহজ মানুষ কোথাও নাই। / খুঁজিলে তাহারে নিকটে পাই। / যোনিতে জনম তাহার নয়। / তাহার জনম রাগেতে হয়।‘ চৈতন্য পরবর্তী সহজিয়া বৈষ্ণবধর্ম বাউলের প্রাথমিক স্তরের পাঠশালার মধ্যে বেশ কিছুটা ঢুকে আছে। যতই দুদ্দু শাহ লিখুন না কেন: ‘বাউল বৈষ্ণবধর্ম এক নহে তো ভাই/ বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই। / বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব / পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ/ তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই। / বাউল মানুষ ভজে/ যেখানে নিত্য বিরাজে/ বস্তুর অমৃতে মজে/ নারী সঙ্গী তাই।‘ বাউলের ধর্ম মতে বৈষ্ণবধারা যেমন আছে তেমনই অদীক্ষিত সাধনাবর্জিত বাউলরাও আছেন। আছেন যুগলমতের উপাসকগণ। চিন্তামণির মত রয়েছে। মারিফত পন্থীরাও আছেন। দরবেশি ধারা প্রবেশ করেছে। চিস্তিরামত, তরিকপন্থী, সহজিয়া, পাবনাস্রোত, কচ্ছাধারী সম্প্রদায়, শরিয়ত তরিকতের মিলিত ভাবাদর্শ, মথুরানন্দের স্রোত এসে মিশেছে বাউল-ফকিরের সম্প্রদায়ে। অখিলপন্থী, কালাচাঁদী, তান্ত্রিক সাধন, সহজিয়া, শ্রীরূপের মতাদর্শীরাও বাউল আধারে একত্রে মিলেমিশে আছেন সব। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা দেখা যায় বাউলের দীক্ষাগুরু বৈষ্ণব, শিক্ষাগুরু বাউল। আবার উল্টোটাও আছে। শিক্ষায় আসন, যোগ, দেহচর্চা, মুদ্রার ব্যবহারিক প্রয়োগের কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। তবে তন্ত্রসাধকদের মতো তারা মুদ্রার অতখানি ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না। মুদ্রাকে বলা হয় কুণ্ডলিনী শক্তির চাবিকাঠি। কুণ্ডলিনী যোগের জন্য দশ ধরণের মুদ্রা ব্যবহার জানা প্রয়োজন। খেচরী হল প্রধান মুদ্রা। সিদ্ধাসনে বসে যোনিমুদ্রার সাহায্যে যোগীগুরু চোখ, নাক, কান, মুখ সব। আচ্ছন্ন করে দেন, যাতে বাইরের কোনো কু-প্রভাব দেহে এসে না পড়ে। গোরক্ষসংহিতাতে। সিদ্ধাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে: ‘যোনিস্থানকমংঘ্ৰিমূলঘটিতং কৃত্বা দৃঢ়ং বিন্যসেৎ / মেট্ৰেপাদথৈকমেব হৃদয়ে ধৃত্বা সমং বিগ্রহ। স্থানুঃ সংযমিতেন্দ্রিয়োহ চলদৃশা পশ্যন্ জবোরর/ চৈতন্যাখ্যকপাটভেদজনকং সিদ্ধাসনং প্রোচ্যতে। যোনিস্থানকে বাঁ পায়ের গোড়ালি দিয়ে চাপ দিয়ে মূলদেশ বা মলদ্বার অঞ্চলের সামান্য কিছু উপরে উঠে পড়ে। এরপরই কাকিনীমুদ্রায় সাধক প্রাণবায়ুকে গ্রহণ করেন। প্রাণের সঙ্গে যোগসাধনে অপান বায়ু আসে। তখনই দেহের ছয় চক্রের দরজা খোলে। সাধক এখানে মন্ত্র জপেন ‘হুং হংসং’। ‘হুং’ তেজরশ্মি বা সূর্যতেজ। এতে কুণ্ডলিনী শক্তিতে উত্তাপ ছড়ায়। ‘সং’ হল ইচ্ছা। মূলাধারচক্রে বায়ু থাকে চন্দ্রসূর্যরূপী। হুং তো জাগিয়ে দিল কুণ্ডলিনীকে। ‘স’ টেনে তোলে। সহস্রারে উঠে যায় বায়ু। তখন সাধকের মনে হয় সর্বত্র প্রসারিত, বিরাজিত তিনি। তখনই। আনন্দময় হয়ে ওঠেন তিনি। তন্ত্রশাস্ত্র একে বলছে শিব। সাংখ্যদর্শন নাম দিয়েছে পুরুষ। বৌদ্ধশাস্ত্র শূন্যতা। উপনিষদ বলছে ব্ৰহ্মণ। অশ্বিনীমুদ্রাতে যতক্ষণ না বায়ু সুষুম্নাতে আসছে ততক্ষণ এখানে অবস্থান করেন সাধক। ইড়া-পিঙ্গলাতে / চন্দ্র-সূর্যতে তখন বায়ুবেগ টেনে সুষুম্নাতে এলে তখন তলপেটের মাংসপেশি একবার বাঁয়ে একবার ডানে সরে যায়। এতে কুণ্ডলিনী জাগে। এর সঙ্গেই চলে যোনিমুদ্রাতে সিদ্ধাসনে প্রাণবায়ু গ্রহণ এবং প্রাণবায়ুর সঙ্গে অপান বায়ুর সমন্বয় সাধন। শক্তিচালান মুদ্রার প্রয়োজন হয়ে পড়ে সাধকের যোনিমুদ্রার আগে। অশ্বিনীতে তলপেটে নানা আওয়াজ হতে থাকে। কুম্ভকের সাহায্যে এখানে কুণ্ডলিনীকে সহস্রারে নিয়ে যাওয়া হয়। তন্ত্রগুরু দেখেন এখানে শিবের সঙ্গে শক্তির মিলন হচ্ছে। এই মিলনে তিনি আনন্দময় হয়ে ওঠেন। মহাবেধ মুদ্রাতে যোগী মনকে নিবিষ্ট করে নেন। এখানে চন্দ্র, সূর্য, তেজ বা অগ্নি সব একাকার হয়ে যায়। মানে হল ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নার ত্রিবেণীযোগাযোগী ভদ্রিকাকুম্ভক ও পদ্মাসন করতে থাকেন। পদ্মাসনে বসেই তলপেটকে সংকুচিত করেন তিনি। খেচরী মুদ্রাতে জিভকে বের করে। আনা হয় দুই ভুরুর মাঝখানে। এতখানি প্রসারিত হয় জিভ। এই স্থান বাউলের আরশিনগর। বাউলও আজ্ঞাচক্র ভেদ করেন। পরমাত্মারূপ তার জ্ব-পদ্মে। যুগল তিনি তা লাভ করেন। রাজ খ্যাপা তাই তার পদে বলেছেন: ‘পরমাত্মা রূপে এসে মানুষে মানুষ আছে মিশে সাধন কল্পে / পাবি দিশে রবে না আরে ত্রিতাপ জ্বালা / দ্বিদল পরে দেয় পাহারা বেদবিধি পার উল্টা খেলা।’
এই উল্টাখেলাতেই বাউল সাধক মনের মানুষকে বোঝেন, উপলব্ধি করেন। আর তার জন্যই তো বাউলের যত হাহাকার। এমনই এক হাহাকারের বহুশ্রুত গান শুনেছিলাম কৃষ্ণা দাসীর বাড়িতে বসেই। এক বিকেলে আমি আর চন্দ্রানী পৌঁছেছিলাম কৃষ্ণার ওখানে। তখন কৃষ্ণা সবে একতারা নিয়ে বসেছেন। পড়ে এসেছে বিকেল। কৃষ্ণা বললেন, কাল রেডিও সেন্টারে গাইতে হবে। ডাক এসেছে। তাই বসেছি।
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাদের দেখে বললেন, চা করি।
চন্দ্রানী বলল, ও সব পরে হবে। আগে গান শুনি।
কৃষ্ণা পুনরায় একতারা তুলে নিলেন হাতে গাইতে লাগলেন বহুশ্রুত সেই গান। কৃষ্ণা গাইছেন মন প্রাণ ঢেলে। সবে তখন নবকুমারের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার গানে যেন সেই সম্পর্কের তিক্ত-কষা যুক্তির জাগর হয়ে ফুটে উঠছে সব। তিনি গাইছেন:
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে–
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানল মরছি জ্বলে নিভাই কেমন করে
মরি হায় হায়রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায়রে–
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে–
তাইতে মোরা দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তার গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে–
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথার ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে।
বাউল বলেন মনের মানুষ দ্বিদলে অবস্থান করেন। দ্বিদল হল আজ্ঞাচক্রের স্থান। তারপর ষোড়শ দলে নেমে আসেন। ষোড়শ দল বিশুদ্ধচক্রের স্থান। সেখান থেকে দশমদলে নামেন তিনি। মণিপুরে। তারপর চতুৰ্দলে স্থিত হন। মূলাধার চক্রে। মূলাধারের এই সহজ মানুষকে সাধক বাউল উজানে ঠেলে নিয়ে দ্বিদলে স্বরূপকে উপলব্ধ করেন।
কৃষ্ণার গানে তার স্বরূপ নিয়েই নিভৃততম স্রস্ততা, শিহরণ, অনিশ্চয়টুকু ফুটে উঠেছে। আমাদের উপনিষদ বলছে, বাইরের সত্যকে খুঁজে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। নিজের মধ্যে ডুব দিলে পরমের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য থাকে না। ‘তৎ তৃম অসি’–তুমিই সেই। এই তুমি আনন্দ-স্বরূপ নিজেরই অন্তরাত্মা। দ্রষ্টা, দৃষ্টি এবং দ্রষ্টব্য। একই সরলরেখার জিনিস। চার অবস্থার কথা বলা হয়েছে উপনিষদে–জাগ্রত, সস্বপ্ন। নিদ্রা, স্বপ্নহীন নিদ্রা, তুরীয় অবস্থা। এই চার অবস্থাকে আমরা বাউল সাধনার চারটি স্তরের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেই পারি। জাগ্রত = স্থূল, স্বস্বপ্ন নিদ্রা = প্রবর্ত, স্বপ্নহীন নিদ্রা = সাধক, তুরীয় অবস্থা = সিদ্ধ। বাউলের অষ্টদল পদ্মের কথা আমরা কিন্তু উপনিষদে পাই। সেখানে বলা হয়েছে, অনাহত চক্রের নীচে অষ্টদল পদ্ম থাকে। এখানে ইষ্টদেবতার পূজা করতে হয়। বাউলের নিষ্ট ও ইষ্ট মনের মানুষ। তাই সাধক বাউল রজ পানের পর ঘুমঘোরে এই পদ্মেরই দেখা পান স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থাতে। এটা উপনিষদের দ্বিতীয় স্তর। বাউলেরও প্রবর্ত স্তর শিক্ষা-দীক্ষার শুরুর সময়ই তো চারচন্দ্র ভেদ করতে হয় তাকে। অষ্টদলে আট বৃত্তির কথাও বলছে উপনিষদ। পূর্ব দলে পূণ্যমতি, দক্ষিণ-পূর্বদলে নিদ্রা ও আলস্য, দক্ষিণ দলে কুরমতি, দক্ষিণ-পশ্চিম দলে পাপমতি, পশ্চিম দলে নীচতা, উত্তর-পশ্চিম দলে ক্রিয়ার ইচ্ছা, উত্তর-পূর্ব দলে বস্তুগ্রহণ। এই আট বৃত্তি কিন্তু মনের মানুষ লাভের জন্য যথেষ্টই সংযোগ সূচক।
মনের মানুষের জনপ্রিয় আরেক গান অনেক বাউলের মুখেই শুনতে পাওয়া যায়। ঘোষপাড়ার মেলায় সুমিত্রা দাসীর গলাতে সেই গানের কথা মনে এলে এখনও সেই উজ্জ্বলতার ঘোরকে কাটাতে পারি না আমি কিছু কিছু গান যেন গায়কেরই একান্ত হয়ে ওঠে। সুমিত্রার এই গানকে আমার মনে হয়েছিল একান্ত নিজস্ব গান। তার স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, সঙ্কটাপন্ন অর্থনীতি, পরিবার বিচ্ছিন্নতা–সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল যেন এ গান তার গাইবার জন্যই রচিত। যখন সুমিত্রাকে দেখেছিলাম, ঠিকানা চেয়েছিলাম পুনরায় যোগাযোগের তখন নিজস্ব কোনও আস্তানা ছিল না তার। মাধবপুর, মুড়াগাছা, অতঃপর বীরভূম, বর্ধমান কোথাও স্থিতু হতে পারেননি এই নারী। সঙ্গীহীন উদাত্ত সঙ্গীত নিয়ে কেবল গ্রাম বাংলা চষে ফেলছেন তিনি। অথচ স্বপ্ন ছিল সাধনভজন করবেন। সাধকের প্রতারণা তাকে মুখর ও জেদি করে কেবল ছেড়ে দিয়েছে গানের দরবারে। সুমিত্রার তাই ভেঙে পড়া বিচ্ছিন্ন নগরে রোষ, ক্ষোভ আর বিদ্বেষের আরশিনগর রয়েছে। পড়শি তার এখন নাকি কেবলই গান। এ সুমিত্রার নিজের কথা।
ঘোষপাড়ার মেলায় সেবার তিনি গাইলেন:
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
ও এক পড়শি বসত করে।
গ্রাম বেড়িয়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে–
আমি বাঞ্ছা করি দেখব তারি
আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে।
বলব কি সেই পড়শির কথা।
ও তার হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা নাই রে।
ও সে ক্ষণেক ভাসে শূণ্যের উপর
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।
পড়শি যদি আমায় ছুঁত
আমার যম-যাতনা যেত দূরে।
আবার সে আর লালন একখানে রয়
তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে।
ভিড়ের মাঝে সুমিত্রাকে খানিক নিভৃতে পেয়েছিলাম। বললেন, মচ্ছবের রান্নার পোড়াকাঠখানা দেখেছেন; দেখেন, আমার এখন তেমন দশা। সাধন পুড়েছে। ভজন নিয়ে তাই থাকি। ভজনই শান্তি, পাপ, প্রায়শ্চিত্ত। ভজন হল উত্রাই। তাই তিরবেগে ছুটতে ছুটতে আজ এখানে তো কাল ওখানে।
আমি সুমিত্রা চলে যাবার পর ভাবলাম, পড়শি তার এখন কেবল গান। তাকেই তিনি আজ্ঞাচক্রে দ্বিদলে স্থান দিয়েছেন। লালন যদি থাকতেন, সুমিত্রার এই ব্যথা কি বুঝতে পারতেন আজ। সুমিত্রার শরীরের অগাধ পানিতে একদিন বাউল-সাধক তরণী ভিড়িয়েছিলেন। তাতে স্কন্ধ-মাথাহীন পড়শি তিনি পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই আমার। তবে সুমিত্রা পড়শির সেই উপেক্ষিত ছোঁয়ায় জীবনের সর্বশেষ অধ্যায়টি খুঁজে পেয়েছেন এখন। যে অধ্যায়ে গানখানি তার সর্বস্বতা নিয়ে পড়ে আছে একেবারে স্বতঃসিদ্ধ অস্তিত্বের অন্যরকম এক আরশিনগর। যেখানে দাঁড়ালে পড়শির হাঁ হাঁ রব কেবলই শোনা যায়। পড়শি কেঁদে ফেরে বাউলের হাওয়ায় হাওয়ায়।
*****
কুলের পাটের মেলায় বেশ রাতের দিকে শুনলাম কাঁটাগঞ্জের বাউল অরুণ দাসের গান। ততক্ষণে ভিড় থিতু হয়ে বসেছে আসরে। ইতিউতি অনেকে চাটাই পেতে গা এলিয়ে দিয়েছে খানিক। অরুণ দাস গাইতে উঠছেন। প্রথম গানেই দেহতত্ত্বকে ছিঁড়েখুঁড়ে টেনে বের করতে থাকলেন। যন্ত্রীদের থামিয়ে বললেন, এই এত মানুষের মধ্যে মানুষ। করতে হবে নিরীক্ষণ। কী বলেন সব খ্যাপা? ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি! ডুবকিতে চাপড় দিল সঙ্গত শিল্পী। একতারা বাজিয়ে নিলেন। ধরলেন মানুষতত্ত্বের গান। কুলের পাট গমগম করতে থাকল সুর আর তালের মানুষে।
বাউল গাইলেন:
এবার আপনার খবর আপনি জান রে মন
মানুষ কোথায় আছে কর নিরীক্ষণ।
আমি আমি সবাই বলে আমি কে চেন গা আগে
তার কর গা অন্বেষণ।
এমন মানব জনম পাবি যদি
ধর গা হাড়িরামের ওই চরণ।
তারে খুঁজেও পাওয়া যায়
আপনি-হারা হলে পরে কোথায় পাওয়া যায়
আপনাকে আপনি হতেছ হারা
খুঁজে করগা তার অন্বেষণ।
এই দেহেতে চৌদ্দ কোঠা
যেমন শোলার পাখি কয়গো কথা
শতেক হাড়ে পিঁজরাটা গাঁথা–
হাওয়া বল্ ছাড়া এ কল রবে গো পড়ে।
শুধু খাঁচার কথা কবে না তোর।
সদানন্দ ভাবছে বসে কি করবি মন শেষে
ও তার কর গা অন্বেষণ
এমন মানব জনম পাবি যদি
ধর গা হাড়িরামের চরণ।
অরুণ বাউলের গানে নিজেকে চেনারই কথকতা রয়েছে। সেজন্যই দেহের চোদ্দ কোঠাকে শোলার পাখির কথা বলার উপমার সঙ্গে সামঞ্জস্য করা হয়েছে। চোদ্দ কোঠা চোদ্দ ভুবনে সামিল–দুই চোখ, দুই নাক, দুই কান, মুখ, মাজা, পায়ু, উপস্থ, বুক, স্তন, নাভি আর ব্রহ্মরন্ধ্র। চোদ্দকে দশেন্দ্রিয় আর চার ভূত মিলিয়েও দেখতে পারি আমরা। চোদ্দ ভূবনে দুই শরীরের প্রত্যঙ্গ রয়েছে সব। সাড়ে তিন কোটি নাড়ি আছে। আছে পঞ্চভূতেরও বাসস্থান। সাত ধাতুর উপাদান আছে। এই সমন্বয়ের ঐক্যতান তখনই একীভূত হয়, সাধনক্রিয়া শুরু হয়। অষ্টপাশ নাশ হয়। আর অষ্ট সিদ্ধির একটি কিন্তু লঘিমা। ইচ্ছামতন হাল্কা হবার ক্ষমতা। এতে শোলার পাখির কথা বলার প্রতীক রয়েছে। দেহের যোগক্রিয়াতে হাল্কা স্তরই শোলার পাখির কথা বলা। এই কথা বলতে হয় বায়ুযোগে। বায়ুই সাধককে। উজ্জীবিত করে রাখে। বায়ুর অভিষেক ঠিকঠাক শরীরে না হলে উপর্যায়ের উদ্ভাসিত বহুমাত্রিক শক্তিকে সাধক কখনই আয়ত্ত করে উঠতে পারবেন না। শরীর তৈরি করে বায়ু। বায়ু কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগায়। আজ্ঞাচক্রে কুলকুণ্ডলিনী উঠে এলে শ্বাসপ্রশ্বাস ক্রিয়া প্রায়
বন্ধ হয়ে যায়। কারণ এই অঞ্চল থেকেই শূন্যতা দ্যোতিত হয়। নিজস্ব স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বার। বোধ জাগে। এই শূন্যতা হল পূর্ণতা। সাধক তৈরি শক্তির শরীর নিয়ে তখন সেজে ওঠেন। ‘কুল’ সংস্কৃত ভাষাতে পরম চেতনার নামান্তর। এর আরও এক অর্থ রূপ বা আকৃতি। কুণ্ডলিনী শক্তির কাজ হল কুলকে বেঁধে ফেলা। আর তা হলেই রূপ তখন অরূপ হয়ে ওঠে। এই রূপ অধর মানুষের রূপ। যা সাধকই কেবল ধরতে পারেন। পদকর্তা সদানন্দ সেই মানুষের নিরীক্ষণের কথাই বলেছেন।
ছিন্নমস্তার উপাসক আলো সাধু একবার আমায় বলেছেন, আমাদের শরীরের তো একান্ন পীঠ আছে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে তা আছে?
বললেন, একান্ন পীঠ শরীরের একান্নটা স্তর।
–কী এই স্তর?
–ছয় চক্রের স্তর। এতে সাতটি করে তরঙ্গ আছে। ছয়কে সাত দিয়ে গুণ কর তুই। বিয়াল্লিশ হল। এই ছয়ে আরও তিন স্তর আছে। তাহলে যোগে নয় হয়। সর্বমোট একান্ন হল। সতীর একান্ন টুকরো দেহবিশ্ব রে। সমগ্র শক্তি। ইতিবাচক মানুষে একান্ন থাকে।
বাউলের ইতিবাচক মানুষ হল অনুভূতির মানুষ। সহজ মানুষ।
বাউল বললেন, মানুষের তিরোধান হয় মানুষ দিয়ে গো! বুঝলেন না খ্যাপারা সব স্থূল মানুষ না মরলে সিদ্ধ মানুষ হবে কীরূপে? কী কন খ্যাপা?
আমি দেখছি চৈত্ৰচাঁদে কুলের পাটে চৈতন্যমূর্তিতে মানুষের হাওয়া লাগছে যেন। থই থই মানুষের শ্বাসে চৈতন্য কি বন্ধ মন্দিরে ঘুমিয়ে আছেন মানুষের নিরবচ্ছিন্ন এই হাওয়ায়! অরুণ বাউলের গানে ও একতারায়।
০১.৩ ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী মধ্যে আছে মহা ঔষধি
পাঁচ পিড়ির আশ্রমে বসে আছি। বৈশাখের বিকেলবেলা। তবু তাত কমেনি সেইভাবে বাতাসে। ভক্তশিষ্য তেমন কেউ নেই। ফাঁকা, নিরিবিলি বসে আছি শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যের পাশে। পুঁইয়ের মাচার নধর লতাও সব নুয়ে পড়েছে তাপে। পেঁপের রং হলুদ হয়েছে। কিন্তু পাতা সব নেতিয়ে রয়েছে। কুয়োতলা থেকে জল তুলে বাউলানি ভিজিয়ে দিচ্ছেন আশ্রমের গাছের গোড়া। ডালপালাতেও ছিটে দিচ্ছেন।
শিবশঙ্কর বললেন, দেখেন খ্যাপা, গাছ-লতা সব কেমন হাসছে। জল হল গিয়ে খ্যাপা আশ্রয়। মানুষের, পশু-পাখির, গাছ-লতার। বাউল তো তাই জলসাধনা করে। জলের জন্যই তো তার আকুতি। প্রাণপাত। তাই তো নদীর ঘাটে যাওয়া খ্যাপা।
একতারা তুলে নিলেন বাউল। বললেন, জলের একখানা গান গাই খ্যাপা। বোঝেন খ্যাপা, জল কী করে, কীভাবে করে।
গাইতে থাকলেন বাউল চিরপরিচিত সেই গান। তার গানে পাঁচ পিড়িতে মানুষ ভিজছে যেন। শীতল হচ্ছে মন।
গাইছেন বাউল:
মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী
মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি।
যখন নদী হয় উতলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা
একজন কালা একজন ধলা একজনা লালমতী।
মেয়ের গুণ কে বলতে পারে কিঞ্চিৎ জানেন মহেশ্বরে
একজন শিরে একজন বুকে ধরেন পশুপতি
রসিক মেয়ে থাকে ঘরে ঘরের রসের জগৎ দেখে
তার সাক্ষী আছে গোপের মেয়ে গোকুলের সতী–
সতী হয়ে ধর্ম রাখে লয়ে উপপতি।
এবার মলে মেয়ে হব মহৎ সঙ্গ চেয়ে লব
দাস কমল বলে থাকবে না তার বংশে দিতে বাতি।।
মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী।
বাউল বললেন, মেয়ে হল খ্যাপা, ভবনদী। সাধক বাউল মেয়ে ধরেই পরপারে যান। মেয়ে রতি নিয়ে জন্মায় বলেই বাউল তার ধারা পায়। রজঃধারা কি পুরুষ শরীরে বয়? রতি হল অনুরাগ।
জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের অনুরাগ?
–প্রেমের, রাগের, ভাবের সে অনুরাগ শরীরে হয়। বাউল নদীর ভাবেই ভবনদী পার হয় নারী কী এমনি-এমনি নদী খ্যাপা? নদীর ভাবেই সাধকের মহাভাব হয়।
–রতিকে তো আপনারা রসও বলেন?
–রসই তো। তিন নদীর তিন ধারার রসে বাউল স্নান করে। হাবুডুবু খায়। পরে যারা যায় তারা ভবনদী থেকে মহাভাবখানা তুলে নেয়। সাধক তো নৌকা খ্যাপা। নদীর উজানে বায়।
আসাননগরে বসে বাঙালঝির মোজাম্মেল ফকিরের গলাতে শুনেছিলাম এমনই এক নৌকার গান। ধরা বিকেলে লালন মেলায় রং লাগেনি তখনো। দুই বাংলার একত্র হাওয়ায় মোজাম্মেলের কথা ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। তার পাশে বসে চুপ করে শুনছি আর ভাবছি বাউল-ফকিরদের প্রক্ষেপণগুলো এক হয়ে গিয়েছে কোথাও সহজিয়া প্রেরণায়। হাটে-মাঠে-গঞ্জে সহজিয়া প্রবচন এখনো এই অস্বাচ্ছন্দ্যের সুরে কী ভীষণ শরিক
সংগতির সুরকে একত্র করে রাখছে খসে পড়ছে সব ভেদাভেদের দেওয়াল।
মোজাম্মেল গাইছেন:
নৌকা বাইও সাবধান হইয়ারে মাঝি ভাই–
বাইও সাবধান হইয়া।
আল্লাহ নবীর নামরে মাঝি ভাই স্মরণ রাখিয়া।
তিন তক্তারি নৌকারে মাঝি ভাই মধ্যে জোড়া
বিপাকে পড়িলেরে মাঝি ভাই নৌকা যাবে মারা।
বাতাসে চালায় রে নৌকা আজবও গঠন
গলইয়ে ভরিয়া রে দিছে অমূল্য রতন।
শরীয়তের পাইকরে মাঝি ভাই মারিফতের নাও।
মায়া-নদী বাঁকেরে নৌকা উজান বাইয়া যাও।
গাবকালি লাগাইয়ারে নৌকা যত্ন করে বাও।
নুনা জলে খাইলেরে তক্তা ভাঙ্গিয়া পড়ে নাও।।
নায়ের মাঝে আছেন রে মাঝি ভাই নায়ের মহাজন।
এ করিম কয় না চিনিলে বিফলও জীবন।
ফকির বললেন, আল্লাহ নবীর নামে নৌকা, হেইয়া বাওয়াই কর্তা সারা জেবনের কাজ। আল্লাতালার প্রেরিত পুরুষ হইল গিয়া নবী। তিনিই তো বানাইছেন সাধের তরণীখানি। মাইনষের কাজ হইল হেইডা শুধু সুন্দরভাবে বাইয়া যাওয়া। হের লেইগ্যা তো সাধনা। তিন তক্তারি কাঠে বানাইতে কইছে মুর্শিদ নৌকারে। ববাঝেননি তিন তক্তারি কী?
বললাম, শরীরের তিনখানা নাড়ি।
–হ ঠিক কইছেন একেবারে কর্তা। নাড়ির বাতাসই তো চলায় নৌকা। নৌকা বাইতে হয় মায়া-নদীর বাঁকে-বাঁকে। তা কর্তা, মুর্শিদে মতি হইছে আপনের? নাম লইছেন? নাড়া বাঁধছেননি?
বললাম, না না। আমি হলাম জিজ্ঞাসু মানুষজন শুধু।
— এইডা কী কন্। আপনে অনুরাগী মানুষজন। নবীর নিকটে আইতে আইতেই দ্যাখবেন কর্তা, একদিন না একদিন আপনের অনুরাগ আইব। তখনই কর্তা মুর্শিদের দেখা পাওনের লাগি মন আনচান করব। এত উৎসুক্য আপনের। কর্তা দেহ গঠন করতে হইব না? সোনার গৌর আপনার দেহখান না হইলে তো পোকে খাইব। যমে শয়তানে টানাটানি করব। সময় আছে কর্তা, আপনের এই কাঁচা বয়সে মুর্শিদ ধইরা দেহখান গইড়া লন। তারপর ঘুরেন যত খুশি মেলায়-খেলায়। না হইলে কর্তা সব বৃথা যাইব। আল্লাহরে ডাকলে হইব না শুধু।
বাতাস বইছে। দুই বাংলার বাতাস এসে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে আর মোজাম্মেলকে। অদূরে বাংলাদেশের গাছগাছালির হাওয়া একত্রিত হয়ে নাচছে অখণ্ড বাংলায়। ফকির এবার তাঁর সাধের দোতারাটা হাতে তুলে নিলেন। গান ধরলেন:
শুধু কি আল্লা বলে ডাকলে তারে
পাবি ওরে মন-পাগলা
যে ভাবে আল্লাতালা বিষম লীলা ত্রিজগতে করছে খেলা।
কতজন জপে মালা তুলসী-তলা হা
তে ঝোলা মালার ঝোলা
আর কতজন হরি বলি মারে তালি
নেচে গেয়ে হয় মাতেলা।
কতজন হয় উদাসী তীর্থবাসী
মক্কাতে দিয়াছে মেলা।
কেউ বা মসজিদে বসে তার উদ্দেশে
সদায় করে আল্লা আল্লা।
স্বরূপের মানুষ মিশে স্বরূপ দেশে
বোবায় কালায় নিত্য লীলা
স্বরূপের ভাব না জেনে চামর কিনে
হচ্ছে কত গাজীর চেলা।
নিত্য সেবায় নিত্য লীলা চরণ মালা
ধরা দিবে অধর কালা
পা তাই করে হেলা ঘটল জ্বালা
কি হবে নিকাশের বেলা।
গান শুনতে শুনতে দেখি সন্ধ্যা মজেছে সবে। বাউল-ফকিরের জমায়েতে মেলা সরগরম হয়ে উঠছে। গুরু-মুর্শিদের দেশে আমি তখন খুঁজে ফিরছি বাউলকে। আমার দোরের কপাট তাঁর গানগুরু ও সঙ্গের অনুশাসনই কেবল খুলে দিতে পারে। হাওয়া বইছে। আসাননগরে। গুরুর দিগ্বলয়ে নেমে আসছে হাওয়া বাউলেরই সমাসীন আধারে, ছেড়ে আসা মোজাম্মেলের মুখও যেন ঝলসে উঠছে তার ভেতর।
পাঁচ পিড়িতে বসে শিবশঙ্কর গাইছিলেন তিনটি ধারার সঙ্গম স্থল ত্রিবেণীর গান। নারীকে বাউল নদীর প্রতীক দিয়েছেন। যোনি বা জননাঙ্গ হল নারী দেহের নদী। তাঁর স্রোতপ্রবাহ রজঃপ্রবৃত্তির সমাচ্ছন্নতা। বাউল সাধনা রস-রতির মিলন। সাধনমার্গে এই মিলন আত্মার সঙ্গে আত্মার। রজের সঙ্গে বীর্যের নয়। দুই আত্মা বা সাধন শরীরের একত্র মিলনে জন্ম হয় পরমাত্মার। বাউল বলেন তাঁদের সিদ্ধদশার করনকারণ তিনদিনের। সঙ্গিনীর শরীরে রজ-উদয়ের সময়কে তারা অমাবস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। ওই দিনে সঙ্গিনীর শরীরে তমগুণের বিকাশ ঘটে। তম হল তামসিক ভাব। অজ্ঞানতা। এই অজ্ঞানতা কামের বশীভূত দশা আসলে। সঙ্গিনীর এই কামের মত্ততাকে সাধক বাউল বলেন ‘জীবাচার’। জীবাচারের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চান তারা। তাই তারা বলেন প্রকৃতি বা সঙ্গিনীর অন্তর্নিহিত সত্তাই হল রজ। পুরুষের বীর্য বা বীজ। এর মিলনে তাঁরা বিশ্বাসী। তাই জন্যই তাঁদের দেহসাধনা। কেননা তাঁদের মিলন জীবাচারের কখনও নয়–জীবাচারের মিলনে রজবীজের মিলন ঘটে দেহের ভিতরে।
প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর একবার আমায় বলেছিলেন, পুরুষ পুরুষ তো নয়।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পুরুষ তাহলে কে?
বললেন, পুরুষ বীর্য। আর রজ হল নারী। যোনি-লিঙ্গ তাকে নারী-পুরুষ হিসাবে দেখে ঠিকই। আসলে নারী-পুরুষ কেউই তারা নয়, সবাই একেকজন হিজড়া।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী হিসাবে একথা বলছেন আপনি?
–দুই দেহেই বাবা রজ-বীর্য থাকে। তাহলে দাঁড়ায় কী না তাঁরা ছেলে, না মেয়ে। সাধনই বাবা হিজড়াকে নারী বা পুরুষের রূপে এনে দেয়।
–কীভাবে আনে?
–তোমার দেহের উর্ধ্বচক্রে বীহ আছে। নিম্নে রজ। স্রোতধারা যে বয় মৈথুনে, ঊধ্বচক্রের বীজ নীচে নামে। বীজ তখন রজ হয়। সাধক রজকে রজর সঙ্গে মিশায় না কখনও। আবারও উর্ধ্বে তুলে বীজ করে দেয়। এভাবে সাধক সিদ্ধ হয়। পুরুষ হয়। অটল হয়।
ঢিলাইচণ্ডীর তান্ত্রিক সাধু পরিতোষ বাবা একবার বলেছিলেন আমায়, তোর দেহে নারী আছে তুই জানিস? সবার দেহে নারী থাকে। পুরুষ থাকে।
কীভাবে থাকে তা বাবা? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললেন, নারী থাকে মূলাধারে। পুরুষ সহস্ৰারে। সাধক সিদ্ধ হলে সহস্রারে কুণ্ডলিনী উঠে যায়। এই শক্তি নারীশক্তি। মূলাধারের সুপ্ত কুণ্ডলিনী সহস্রারে এসে শক্তির সৃষ্টি করে রে। যখন তা সহস্রারে এল তখন সে পুরুষ হল। তাঁর আগে শক্তির নারীর বেশ। আমরা তাই তো বলি নারীশক্তি। পুরুষ শক্তি বলি কখনও?
আমি চুপ।
বাবা বলছেন, সাধনা শুরু হয় নারীতে-নারীতে। সাধক সিদ্ধ হল পুরুষ হয়ে। বীজ ধরে। আর সাধিকার নারীরূপ চিন্ময় হয়। এই যে দেখছিস কালী মা, মা, মাগো… এই মা মৃন্ময় মা চিন্ময় হয় ভৈরবীর শরীরে। জ্যান্ত শিব মা তৈরি করে নারী ছাড়া সাধন হয়? জীবনেও বউ ছাড়া তুই পুরুষ নোস। নারী, বউই তো পুরুষ করে। প্রাণ আনে তোর বউ তোকে সাহায্য করে তোর বউ তোকে পুরুষ করে দিয়ে সে নারী হয়ে ওঠে। তাই তো তাঁর মাতৃরূপ সেই তো আমার মা। মা না থাকলে শালা সব অন্ধকার রে।
মা মা বলে চিৎকার করছেন পরিতোষ বাবা। ঢিলাইচণ্ডীতে মায়ের আজ অমাবস্যার পুজো। বাবা সকাল থেকেই যোগাড়ে লেগেছেন তাঁর। ভক্তশিষ্য গমগম করছে আশ্রমে ভক্তিতে আর বাবার কথায় মাতোয়ারা হচ্ছে সবাই।
*****
শিবশঙ্কর বলেছেন: ‘মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী/ মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি।’
সঙ্গিনীকে এই রূপক পরিয়েছেন পদকর্তা সাধক। ত্রিবেণী বাউলের তিন রতি। তিনদিনের রজঃপ্রবাহকে বাউল তাই তিন নামেই চিহ্নিত করেছেন। কারুণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত, লাবণ্যামৃত। তিন ধারার এই নামও অর্থদ্যোতক। প্রথম ধারায় সঙ্গিনীর শরীরের কামস্রোতকে সাধক বাউল সদর্থক দিকে চালিত করেন।
ষষ্ঠীখ্যাপা একবার বলেছিলেন, বাউল কাম মারে। মানুষ কাম তোলে।
জীবাচারে আবদ্ধ যেহেতু মানুষ তাই তাঁরা কামকে উপভোগ করেন। আমাদের কামশাস্ত্র সেই কামোপভোগকে সুন্দর সব ধারাভাষ্যেই চালিত করেছে। আর তা করতে গিয়ে পুরুষ বিভাগ এসেছে—‘শশো বৃষোহশ্ব ইতি লিঙ্গতো নায়কবিশেষাঃ।’ পুরুষের লিঙ্গমাপ অনুসারে তাকে শশ, বৃষ ও অশ্ব–এই তিনভাগে ভাগ করা হয়। যেসব পুরুষের লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ছোট তাদের শশকের রূপ দেওয়া হচ্ছে। মধ্যম লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ বৃষ। আর দৈর্ঘ্যের দিক থেকে বারো আঙুল পরিমাপক যে লিঙ্গ ধারণের অধিকারী পুরুষ তিনি অশ্ব শ্রেণির বাৎস্যায়ন এখানে বোধহয় যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন লিঙ্গ পরিমাপক স্যাংখ্যিক হিসাব আনতে। শশ = ছয়, বৃষ = নয়, অশ্ব = বারো। আদতে শেষ দুটো যথেষ্ট রকম বাড়াবাড়ির। পর্ণগ্রাফি এই মাপকে অবশ্য গ্রহণ করে মনোরঞ্জন করছে। আপাতত। নীল ছবিতে তাই এখন ঠাঁই হয়েছে বাৎস্যায়নের বৃষ ও অশ্ব পুরুষের। নারীর তিনটি ভাগ হল–‘নায়িকা পুনমৃগী বড়বা হস্তিনী চেতি।’ নায়িকাও আবার পশুদের সঙ্গে উপমা অনুসারে তিন ধরণের হয়ে থাকে–মৃগী, বড়বা বা ঘোটকী, হস্তিনী। পুরুষের। লিঙ্গের দৈর্ঘ্য অনুসারে ভেদ-সূচিত তিন প্রকারের পুরুষ আর নারীর এই পরিমাপকে যোনির সেই ছয়, আট, বারো আঙুল মাপকেই সামনে আনা হয়েছে। চওড়াতে তাকে স্যাংখ্যিক পরিমাপকের আধার দেওয়া হয়েছে। মিলনে সুখদায়ক অনুভূতির জন্যই কামশাস্ত্রের নির্দেশিকা সব। সেজন্যই শশ শ্রেণীর পুরুষের সঙ্গে মৃগী, বৃষর সঙ্গে বড়বা, অশ্বর সঙ্গে হস্তিনীর মিলন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রেও শেষ দুই শ্রেণীর বিভাজনকে নীল ছবি পুরোপুরি গ্রহণ করেছে।
চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে কামশাস্ত্রে। মিলনের সময় আলিঙ্গনাদিকে চৌষট্টি প্রকার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে—‘আলিঙ্গন-চুম্বন-নখচ্ছেদ্য-দর্শনচ্ছেদ্য-সম্বেশন সৌকৃত-পুরুষায়িতৌ-পরিষ্টকানাদ্মষ্টানমষ্টধা।’ আলিঙ্গন, চুম্বন, নখ দিয়ে আঘাত করা, দাঁত দিয়ে উত্তেজনা জাগানো, অঙ্গমর্দন করা, উত্তেজিত অবস্থাতে সাড়া দেওয়া, মিলন, চূড়ান্ত পর্বের পর স্থিতাবস্থা–এই আট প্রকার ভেদের প্রত্যেকটির আট ভাগের উপবিভাগ করে চৌষট্টি কলার কথা বলা হয়েছে। তবে একথারও উল্লেখ আছে যে, মিলনে সব সময়ই যে চৌষট্টিটি দশার সূত্রপাত ঘটবে এরকম কোনো কারণ নেই। বিশেষণ হিসাবে বলা হয়েছে সপ্তপর্ণ অর্থাৎ কিনা ছাতিম গাছের প্রত্যেক পল্লবেই যে সাতটি করে পাতা থাকবে বা পূজা সবসময় যে পঞ্চাপচারে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা যেমন নেই তেমনই মিলনে যে সব সময় এই চৌষট্টিকলার প্রয়োগ ঘটবে এরও কোনো মানে নেই। পদাবলি আমাদের কিন্তু চৌষট্টি নায়িকার সন্ধান দিয়েছে। আবার আমরা চৌষট্টি রসের কীর্তনের সম্বন্ধেও কিন্তু অবহিত আছি। বৈষ্ণবীয় আচরণে চৌষট্টি প্রকার সেবারও উল্লেখ পাই। বৌদ্ধ-সহজিয়াতেও চৌষট্টি পাপড়ির পদ্মের কথা উল্লেখ আছে। আমাদের শরীরস্থ
যে সপ্তম পদ্মচক্র তাঁর দলকেও কিন্তু চৌষট্টিদল বিশিষ্ট হিসাবে দেখানো হয়েছে। বাউলও তাঁর গানে চৌষট্টির প্রতীককে সামনে এনেছেন। মানবদেহকে কোলকাতার সঙ্গে তুলনা করে পদকর্তা বলেছেন: ‘তাঁর বাইরে আলো ভিতরে আঁধার / মানবদেহ কলিকাতা অতি চমৎকার / চৌষট্টি গলির মাঝে ষোলোজন প্রহরী আছে / তিনশত ষাট নম্বরে হয় রাস্তা বাহাত্তর হাজার।’ চৌষট্টি গলি হল রক্তবাহী প্রধান ধমনী, তা সংখ্যারূপ। যেটা বলতে চাইছি তা হল: চৌষট্টির রূপক, প্রতীকী আবেগ-ইচ্ছা-অনুভূতি ব্যক্ত যে কুক্ষিগত আচরণ। তা অতি আবশ্যিক উপাচার। কখনও তা সুখদায়ক কামাচারের কখনও বা তা সাধিত অনুশাসনে আচ্ছন্ন দেহাচারের। আটটি ভাবের উল্লেখ আমরা পাই দেহসাধনায়–স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, মূৰ্ছা ও অশ্রু। অষ্টশক্তির কথাও বলে থাকেন সাধক। অণিমা, লঘিমা, ব্যাপ্তি, প্রকাম্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কামবসায়িত। অষ্টপাশের কথাও বলে থাকেন সাধক বাউল–ঘৃণা, লজ্জা, শঙ্কা, ভয়, জিগীষা, জাতি, কুল, মান। এই অষ্টরূপকে কিন্তু আমরা কামশাস্ত্রেও দেখে থাকি। সেখানে ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষ, স্তন, ওষ্ঠ ও মুখের মধ্যে চুম্বনের উল্লেখ আছে। চৌষট্টিকলার একটি রূপ নখচ্ছেদ্য। তাকেও আবার আটটি স্থানে রাখা হয়েছে–বগল,স্তন, গলদেশ, পৃষ্ঠদেশ, জঘন, কটির একদেশ, কটির পুরোভাগ, নিতম্ব–এই আট স্থানে নায়কের নখক্ষত সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। বাউল কিন্তু অষ্টম ইন্দু বা অষ্টম চন্দ্ৰস্পর্শের কথা বলে থাকেন। তাহলে এই আটের ব্যবহার দু’ধারায় আছে। সুখদায়ক কামাচারেও রয়েছে আটের বহুরূপী প্রতিফলন। আবার সাধনাচারের আট চেতনাসম্পৃক্ত এক অধ্যায়। এই চেতনা কামকে প্রেমে সমুজ্জ্বল ও ঋদ্ধ করে নিয়ে আত্মাকে সংগৃহীত পরমাত্মার সঙ্গেই মিলিয়ে দেওয়া। বাউল সাধনে এ যেন এক শৌর্য প্রদর্শন। তন্ত্র তথা সমস্ত যুগল দেহসাধনার সম্মিলিত চেতনা, আশা, উদ্বেগ, প্রেরণা, প্রতিজ্ঞা, প্রার্থনা–এগুলো সবই দাউ দাউ আদর্শের গহন শিখা।
শিবশঙ্কর গানে ‘ত্রিবেণী সংহতি’কে তিন রতির উর্ধ্বাঙ্গই দিয়েছেন। তিন রতি, তিন নদীরূপী স্রোতধারা, বাউল প্রতীকের ‘রূপ সায়রের তিনধারা’। প্রথম দিনের মিলনে বাউল বলেন গুণের মানুষ উঠে আসবে। এই গুণ তমগুণ। দ্বিতীয় দিনে রসের মানুষ। তৃতীয় দিনে সহজ মানুষ। বাউল বলেছেন: ‘যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা।’ কীভাবে হয় এই লীলাখেলা?
চৈতন্যচরিতামৃতে বাউলের তিন রতিকে তিন বাঞ্ছা হিসাবে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে: ‘তিন বাঞ্ছ পুণ্য করি রস আস্বাদন।।/ আলিঙ্গনে ভাব পুণ্য কান্তিতে চুম্বন। / সিঙ্গারে প্রেমরস বাঞ্ছিতপূরণ।।/ পিরিতি আনন্দময় চিন্ময় কেবল। / সেইভাবে বস হইয়া করে সম্বল।।/ নিজরূপে স্বয়ং রূপে এক রূপ হয়। / এক দেহ সে জানিহ নিশ্চয়/ নিজরূপে সঅং রূপ এক দেহ হয়। গোলোক বৃন্দাবন বলি অতএব কয়।’ বাউলের এই লীলাখেলাতে প্রথম চারচন্দ্র ভেদ করতে হয়। সঙ্গিনীর রজ গুরু যোগাড় করে রাখেন। তা সাধক বাউলকে পান করতে হয়। কেউ বলেন সঙ্গিনী নিজে তা পান করেন। আবার কেউ বলেন না, সঙ্গিনীর কাজ তা নয়। পান করে থাকেন কেবল সাধক বাউল, যথেষ্ট মতভেদ আছে এই ক্রিয়াকরণে। এই পান ক্রিয়াকে তাঁরা বলেন গ্রহণ। অর্থাৎ শরীরের জিনিস শরীরেতে ফিরিয়ে নেওয়া। এটাই তাঁদের ভেদ। চার চন্দ্রের একচন্দ্র ভেদ। তারপর মূত্র যতবার হবে তা নারকেল মালা বা পাত্রে ধরে আবার শরীরে ফিরিয়ে আনা। মল হাতের তালুতে ফেটে খাওয়া আর বাকিটা শরীরে মাখা। এই চারচন্দ্র ভেদকে বাউল ব্রহ্মচর্যদশা বলেন। এরপরই মিলন দশা আসে। তবে ব্রহ্মচর্যে কতদিন পর রসরতির মিলন হবে তা নিয়েও যথেষ্ট মত পার্থক্য আছে। কেউ এক মাস, ছ মাস, দশ বা বারো মাসের কালক্ষেপের কথা বলেন। তবে সেই অপেক্ষা-যোগ এখন এতখানি সময় পর্যন্ত মানা হয় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেননা বাউলকে তো এখন তাড়াতাড়ি সিদ্ধ স্তরে পৌঁছতে হবে। তবে না তাঁর পসার জমবে। ভক্তশিষ্য তৈরি হবে। খ্যাতি রটবে। যেটা মনে হয় চারচন্দ্র ভেদ একটা নিমিত্তকরণ। আসলে যে করণকার্য তা তো নাড়ির। ইড়া নাড়ির, পিঙ্গলা নাড়ির, সুষুম্না নাড়ির। শরীরের বাইরের বায়ুকে প্রথমে বাঁ নাক দিয়ে টেনে কিছুক্ষণ সেই বায়ু বাঁ নাকে রেখে তাকে আবার ডান নাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বায়ু যখন টেনে অভ্যন্তর পূরণ করা হয় তখন তা পূরক। এতে উদর জলপূর্ণ কলসির মতো বায়ু জমা থাকে তাই তা কুম্ভক আর যখন তা ডান নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হয় তখন তা রেচক। এই যোগশিক্ষাই বাউল সাধককে ক্রিয়াকরণে আসলে সাহায্য করে। মিলনে এর সাহায্যেই বাউল মূলাধারের শুক্রকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিতে পারেন। তাই চারচন্দ্র ভেদ না হয় হল কিন্তু শ্বাসক্রিয়া ঠিকঠাক না হলে শুধু চারচন্দ্র ভেদ, ব্রহ্মচর্যের দীক্ষার কি মূল্য আছে? আসল হল শরীর গঠন। তা ভেদে হয় ঠিক কিন্তু সেই ভেদ বায়ুভেদ বায়ুকেই বশ করেন সাধক। তবে বাউল ‘দমের কাজ’ করার কথা সব সময়ই বলেন।
শিবশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, দম হল দমন রিপুকে, রতিকে দমন।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দমই তো বাউল সিদ্ধির আসল কথা?
–তা ঠিক। তবে চন্দ্রভেদ অনেকটা মন্ত্রসিদ্ধির মতো। বাউলের জপ আর কী।
–বাউল তাহলে গুরুমন্ত্র জপেন?
–হ্যাঁ, আমাদের মন্ত্রজপ তো আছে।
–কী মন্ত্র?
–কৃষ্ণমন্ত্র।
বাউল তো মূর্তিতেই বিশ্বাস রাখেন না। সবই তাঁর জ্যান্ত তবে বাউল কৃষ্ণমন্ত্র। জপ করেন কেন? মজলিশপুরে বসে শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললেন, কৃষ্ণ অনুরাগ। প্রেমের অনুরাগ কৃষ্ণ। কামের বিরাগ কৃষ্ণ। শরীর কৃষ্ণ। ভাব কৃষ্ণ। দুইজনের মিলন কৃষ্ণ।
বললাম, সব তো কাম-গায়ত্রীর দিকেই যাচ্ছে?
–যাবেই তো। কাম হল ক্লীং। ক্লীং হল কৃষ্ণ। কামকৃষ্ণ। এই কামকৃষ্ণকে সাধক শুধু কৃষ্ণ করেন।
–কৃষ্ণ তাহলে কী? জিজ্ঞাসা করলাম।
–কৃষ্ণ হল আত্মাকে ত্যাগ করে পরমাত্মায় বিরাজ করা। কৃষ্ণ হল প্রাপ্তি। স্কুল শরীরের মৃত্যু কৃষ্ণপ্রাপ্তি। সিদ্ধ শরীরের দশা। কৃষ্ণলাভ।
গানে তিন দিনের লীলাখেলাকে তিন রঙ দিয়েছেন পদকর্তা–’একজন কালা একজন ধলা একজন লালমতী।‘ এই তিন রঙ প্রতীকী রজঃরং। ধারাস্রোতের যেমন নাম দিয়েছেন বাউল, তেমনই রজঃরঙের নামকরণ। তবে মতান্তরে চার রঙের কথা বলে থাকেন কোনো কোনো বাউল সাধক। ঢিলাইচণ্ডীর তান্ত্রিক সাধু বলেছিলেন নারী থাকে। মূলাধারে। পদকর্তা কমল বলেছেন: ‘মেয়ের গুণ কে বলতে পারে কিঞ্চিৎ জানেন মহেশ্বর / একজন শিরে একজন বুকে ধরেন পশুপতি।‘ মহেশ্বর এখানে শিবরূপী বাউল সাধক। ‘মেয়ের গুণ’ হল সাধনসঙ্গিনীর রজ নয়–তিন দিনের রজঃযোগ। সাধনক্রিয়া। কমল বলেছেন ‘মেয়ের গুণ’ শিরে ধরবার কথা। শির এখানে মস্তিষ্ক দ্যোতক হলেও আসলে তা সাধক শরীরের নবম পদ্মচক্র সহস্রার। ব্রহ্মরন্ধ্রের উপর মহাশূন্যে শ্বেতবর্ণের সহস্রদল পদ্মচক্রের কল্পনা করে থাকেন দেহসাধক। বলা হয় এখানে মাতৃকাবর্ণেরা আছে। এটি বৃহৎ শক্তিমণ্ডল হিসাবে কল্পনা করেন সাধক। কেননা মূলাধারের শুক্র প্রাণ-অপান বায়ুর সহযোগে প্রধানত তিন নাড়ির সাহায্যে ব্রহ্মরন্ধ্রে গিয়ে অবস্থান করে। এতে নাকি সাধক শরীরে তুরীয় দশার সৃষ্টি হয়। রজগুণেই মহাযোগক্রিয়ায় তা হয়ে থাকে। তাই পদকর্তা বলেছেন মেয়ের গুণ শিরে অধিষ্ঠান করবার কথা। মেয়ের গুণকে শিরে/ ব্রহ্মরন্ধ্রে ধারণ করার অর্থ সিদ্ধাসন লাভ। পরিতোষ বাবার মত নিলে সাধকের সিদ্ধ হয়ে ওঠা মেয়ের গুণ বুকে ধরার অর্থ দ্বাদশ পদ্মকে ধারণ। হৃদয়ে বন্ধুকপুষ্পসদৃশ বর্ণবিশিষ্ট দ্বাদশদলযুক্ত অনাহত চক্র আছে। এর বারোটি বৃত্তি মেয়ের গুণেই সাধক নাশ করতে পারেন। বৃত্তিগুলো: আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিকলতা, বিবেক, অহঙ্কার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক ও অনুতাপ। কীভাবে এইসব বৃত্তি নাশ হয়? কুলকুণ্ডলিনী জাগবার পর মণিপুরে এসে সেই শক্তিরূপী নারী বা এক্ষেত্রে পদকর্তা কথিত ‘মেয়ের গুণ’ যখন অনাহত পদ্মচক্রকে ফাটিয়ে বিশুদ্ধতে ঢুকতে যায় তখন এইসব বৃত্তি নাশ হয়। এগুলো সবই স্থূল শরীরের পাশ। অনাহতে এলে সাধক শরীরের স্থূলতা নষ্ট হতে থাকে না; একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। তাই সাধক তখন মেয়ের গুণে বুকে পশুপতিকে ধরেন। অর্থাৎ তাঁর পশুত্ব বৃত্তি সব নাশ হয়ে যায়। কমল বলেছেন–রসিক মেয়ে থাকে ঘরের রসে জগত দেখে। এই রস সহজসত্তার বিকাশ। বাউলের মনের মানুষের শিরোপা। তার সাক্ষী হিসাবে পদকর্তা ‘গোপের মেয়ে গোকুলের সতী’র কথা বলেছেন। কারণ দেহসাধনাতে রাধাও শক্তি বিশেষত আদ্যাশক্তি হিসাবে বন্দি হয়েছেন। দেহের বিভিন্ন পদ্মচক্রে তাঁর গুণশক্তিকে উপলব্ধ করে থাকেন বাউল সাধক। রাধা সঙ্গিনী যেমন ঠিকই, তেমনই রাধা সাধনশক্তির দ্যোতক বলেই সাধক শরীরেও অবস্থান করেন এভাবেই প্রতীকময়তাতে। তাই রাধারূপী শরীরই ‘সতী হয়ে ধর্ম রাখে লয়ে উপপতি। মেয়ে হবার বাসনা প্রকাশ করেছেন পদকর্তা–’এবার মলে মেয়ে হব মহৎ সঙ্গ চেয়ে লব/ দাস কমল বলে থাকবে না তাঁর বংশে দিতে বাতি।‘ মরা কিন্তু এখানে দেহসাধকের ‘জেন্তে মরা’। জীবাত্মার বিনাশ হয়ে পরমাত্মার প্রকাশ। বাউল সাধনা, বাউলের গান সেই আলোকেই প্রকাশিত হতে চায়। বারবার।
*****
চৈতন্য বাউল আশ্রমে বসে নরোত্তম দাসের মুখে শুনেছিলাম নদীর আরেক বিজয়দুন্দুভি। ভরা বর্ষার প্যাচপ্যাচে কাদা নিয়ে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলাম বাউল আশ্রমে। নরোত্তমের সঙ্গিনী পা ধোবার জল দিলেন প্রথমে। তখন চাঁদমারীর কাছে গঙ্গা ফুসছে। হরি বৈদ্য বাউল সে খবর দিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
নরোত্তম বললেন, আজ ‘তালে নদী পেরোনোর একখানি গাই গাই।’
হরি বৈদ্যই একতারায় সুর দিলেন।
বাউল গাইলেন:
শ্রীরূপ-নদীটি অতি চমৎকার।
তোরে বলি সার, হৃদে কর বিচার,
দেখে ভব-গর্ত হলি মত্ত,
আস্বাদন কি বুঝলি তাঁর।।
বিষম সে ত্রিপানি নদী,
ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী,
মধ্যে আছে মহা ঔষধি।
ওঠে ঘুরনো জল, যদি না থাকে গুরুবল,
তবে খুলবে মণিকোঠা, বাঁধবে ল্যাঠা,
সেখানে খুব খবরদার।।
নদীর ভিতর তলায় গরল-সুধা,
এক পাত্রেতে রহে সদা,
সুধা খেলে যায় ভব-ক্ষুধা।
গরল পান করে প্রাণেতে মরে,
ছুটে সেই উল্টো কল নেমেছে ঢল,
শিখতে হবে আপ্তসার।।
ত্রিপানিতে তিনটি ধারা,
নিধারাতে আছে ধরা,
ঠিক রেখ নয়নের তারা।
পলকে প্রলয়, হয়ে যাবি ক্ষয়,
স্থূলে মূলে সকল ভুলে
করতে হবে হাহাকার।।
বাঁকা নদীর পেছল ঘাটে
যেতে হবে নিষ্কপটে
সাধুবাক্য ধরে এঁটে।
তিনদিন বারুণী, তাইতে স্নান শুনি,
নাইলে সে মহাযোগে অনুরাগে,
কাম-কুম্ভীর কি করবে তার।।
রসিক ডুবুরি হলে,
ডুব দিয়ে সেই গভীর জলে,
অনায়াসে রত্নধন তোলে।
গোঁসাই গোবিন কয়,কুবীরচাঁদের জয়,
ভেবে গোপাল মূর্খ, পায় রে দুঃখ,
দিনে দেখে অন্ধকার।।
শ্রীরূপ-নদী নারীর শ্রী-মণ্ডিত বিভা নিয়েই গোবিন্দ গোঁসাইয়ের গানে যেন উঠে এসেছে। শ্রী এখানে নারীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নয়। শ্রী তার রজঃপ্রবাহের স্রোতধারার। এই শ্রীরূপ-নদীটিকে হৃদয় দিয়ে বিচার করার কথা বলা হয়েছে গানে। হৃদয় হল পূর্ণচন্দ্রের। হৃদয়। নারীর রজঃপ্রবৃত্তি হল বাউল সাধকের অমাবস্যা-যোগ। এই অমাবস্যা এই কারণেই, এ সময় সঙ্গিনীর শরীরে অন্ধকারময় কামের ঘনঘটা দেখা দেয়। আর তার ভেতরই পূর্ণচন্দ্রের উদয় হয়। পূর্ণচন্দ্র প্রেম। কামকে বাউল প্রেমে রূপান্তরিত করে নেন। অধর মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। সহস্রারে অটল রূপে বিরাজ করেন তিনি। তাঁর জন্যই শ্রী রূপ নদীতে অবগাহন। পদে বলা হয়েছে: ‘দেখে ভব-গর্ত হলি মত্ত/ আস্বাদন কি বুঝলি তার।’ ভব-গর্ত হল সঙ্গিনীর যোনি। ভব কথার অর্থ জন্ম বাঁ উৎপত্তি। সত্তা, স্থিতি, ইহলোক হিসাবেও ‘ভব’কে আমরা দেখতে পারি। রজঃস্রোতের উৎপত্তিকেই এখানে ভব-গর্ত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রজঃবীজকে বাউল সত্তা হিসাবে মানেন। জীবের স্থিতি রজঃপ্রবাহেই আসে। এর আস্বাদন না বোঝার কথাই বলা হয়েছে। কারণ ভবগর্তে নিরবচ্ছিন্ন কামাচার বাউল সাধকের উদ্দেশ্যে কখনও নয়। বাউল সাধনার মুখ্য বিষয় তিন দিনের ক্রিয়া ও শেষে বিশেষ ক্রিয়া। যোগ-মিলনের আগে দুই পর্ব আছে। নামগ্রহণ আর ভাবগ্রহণ প্রবীণ সাধক দয়াল খ্যাপা এ কথা বলেছিলেন আমাকে।
মদনমোহন আশ্রমে বসে দয়ালকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেহ মিলনের যোগক্রিয়ার কথা।
বললেন, প্রথমে গুরু নাম দেন। গুরুমন্ত্র জপতে জপতেই শরীর সেই মন্ত্রভাবকে টেনে নেয়। ভাব এলেই ক্রিয়াকরণ শুরু হয়। চারচন্দ্র তো আগে থেকেই নিয়ম করে পালন করতে হয়।
খুব জরুরি কি চারচন্দ্রের ক্রিয়া? জিজ্ঞাসা করলাম।
–অবশ্যই। চারচন্দ্র শরীরকে উপযোগী করে। দম ধরতে সাহায্য করে গিয়ে ওই চারচন্দ্র। এই আমার নিরোগ সুঠাম শরীর নিয়মিত চার চন্দ্র সাধনের ফল।
–আপনি কি এখনও এই ক্রিয়াযোগ করেন? মল, মূত্র শরীরে ফিরিয়ে নেন?
বললেন, এ বিষয়ে তো বলে বোঝানো যাবে না বাবা। গুরু শিষ্যকে শ্বাস নিয়ন্ত্রণ শেখান। এই ক্রিয়া আটবার, বত্রিশবার–এই করে করে রপ্ত করে নিতে হয়। রেচক, পূরক, কুম্ভক করতে হয়। কুম্ভক নাড়ি শোধন করে বাবা। বিন্দুকে স্থিরতা দেয় শরীরে।
গানে যে আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে বিন্দুধারণের স্থিরতা। বাউল সাধক বলে থাকেন কুম্ভক ক্রিয়াতে এই শক্তি অর্জিত হয়। বায়ুর সাম্যতা রাখে কুম্ভক ক্রিয়া। মূল-সাধনা বাউলের ধরে রাখে কুম্ভক ক্রিয়াই। প্রথমে যেটা করতে হয় শরীরের বাইরে বায়ুকে বাঁ নাকে টেনে নিতে হয়। প্রাণ বায়ু এতে শরীরের ভেতর প্রবেশ করে। এই জমা বায়ুকে ডান নাকে নিয়ে কিছু সময় রেখে দিয়ে তাকে আবার বাঁ নাকেই ত্যাগ করে দেন দেহসাধক। বাইরের বায়ুকে টেনে শরীরের অভ্যন্তরভাগ পূরণ করাই হল বাউলের পূরক। আর বায়ু যে এভাবে শরীরে ধারণ করে রাখা; শরীরকে বায়ু ভরিয়ে পূর্ণ করে রাখা। তা হল তাঁদের কুম্ভক। আবার বায়ুকে বাইরে বের করে দেওয়া বাউলের রেচক। মূলত দুই বায়ুর ক্রিয়া ইহা। সাধুসন্তরা বলেন প্রথমে ডান হাতের আঙুল দিয়ে ডান দিকের নাকে বায়ুকে রোধ করে ওঁ বা যার যার গুরুমন্ত্র ষোলো বার জপ করতে করতে বাঁ নাকের সাহায্যে বায়ুকে ভেতরে এনে কনিষ্ঠা ও অনামিকা আঙুল দিয়ে বাঁ নাকে রেখে বায়ুরোধে। ওঁ বা গুরুমন্ত্র চৌষট্টিবার জপ করতে করতে কুম্ভক করতে হবে। তারপর আঙুল ডান নাক থেকে তুলে মন্ত্র বত্রিশবার জপ করতে করতে ডান নাকে এনে বায়ু রেচক করতে হবে। এইভাবেই পুনরায় বিপরীতক্রমে অর্থাৎ শ্বাসত্যাগের পর এই ডান নাকের সাহায্যে মন্ত্র। জপ করতে করতে পূরক এবং দুই নাকে কুম্ভক, শেষে বাঁ নাকে রেচক করতে হবে। আবার প্রথমবারের মতো অবিকল দু নাকের সাহায্যে পূরক, কুম্ভক, রেচক করতে হবে। বাউল বলেন কুম্ভক শক্তির উপরই তাঁদের বাণক্রিয়া নির্ভর করে। দেহ মিলনের সময় মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহন–এই পঞ্চবাণের ক্রিয়ার কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। লালনের গানে আমরা পাই—’পঞ্চবাণের ছিলা কেটে/ প্রেম যজ স্বরূপের হাটে। সিরাজসাঁই বলে রে, লালন, / বৈদিক বাণে করিস নে রণ, / বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।।’
‘বৈদিক বাণ’ কী? দেহমিলনের সময় কামই কামের একান্ত পরিনাম। কামকে উপভোগ্য স্তরে নিয়ে যাবার জন্যই নরনারী নানা প্রত্যঙ্গে নানারূপ ক্রিয়াকরণে মেতে ওঠেন। কেননা কামকে তাঁরা চুড়ান্ত রূপে ভোগ করতে চান। তার জন্যই কামশাস্ত্রে যৌনমিলনের প্রস্তুতিস্বরূপ নানা আলিঙ্গন, চুম্বন, দেহে নখচিহ্নের স্মরণীক অধ্যায়, দন্তক্ষতের রূপকল্প, ভঙ্গি বা আসন, শীৎকার ধ্বনির নানা রূপের কৌশলক্রিয়ার কথা লেখা হয়েছে। যাতে কাম, সম্ভোগক্রিয়া একেবারে উত্তেজক অধ্যায়ে চলে আসে। নরনারী তৃপ্তি লাভ করেন। বাস্তবিক এই তৃপ্তি। রিপুর উত্তেজনা থেকেই এই আকর্ষণ, মিলন। যে মিলনে তৃপ্তির সাথে সন্তান জন্মেরো এক বিধিবদ্ধ অধ্যায় আছে। তাই বলা ভালো, এই কাম-প্রবর্তিত দেহ-মিলন এবং এতে সন্তান সৃষ্টিই হল বৈদিক বাণ। লালনের গানে এই বাণকৌশলের ইঙ্গিত রয়েছে। বাউল বলেন, বিশ্বাস রাখেন যে, এই পঞ্চবাণের যে ক্রিয়া তাতে রয়েছে কেবল চূড়ান্ত সম্ভোগক্রিয়ায় কামকে উপভোগ। এই কাম ভোগমূলক। লালনের পদে, গুরু সিরাজ সাঁই তাই লালনকে বলছেনেই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলতে হবে। দেহকে কামক্রিয়ার ভেতর না রেখে দেহকে ব্যবহার করতে হবে স্বরূপতত্ত্বকে জানার জন্য। তার জন্যই বাউল সাধক দেহ থেকে কামকে তুলে ফেলে প্রেমে রূপান্তরিত করে ফেলেন। ঠিক যেমন দুধ থেকে সর তুলে মাখন বা ঘি বানানো হয়। কীভাবে বাউল সাধক এই পঞ্চবাণের ছিলা কেটে ফেলেন?
পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরে কামের বাণকে আরো যেন শানিয়ে দেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায়, ললাটে বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বার এক, ললাটে দেড়। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তাঁরা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্না নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডানদিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু’দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষুম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদন বাণের সময় ইড়া নাড়িতে(বাঁ নাকে) শ্বাসগ্রহণ করে মদন বাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শ্বাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। দক্ষিণ বা ডান দিককে তাঁরা বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তাঁরা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। শোষণ বাণের সময় তাঁরা যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গ নালে উত্থিত শুক্রকে তাঁরা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা। স্থিরতা আসে। শ্বাসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউল সঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাঁদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তাঁরা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তাঁরা নানা। সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে যখন চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞাচক্রের দ্বিদলপদ্মে তাঁরা মনের মানুষকে উপলব্ধ করে থাকেন। এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির অচঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা। মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ। অষ্টমচন্দ্র স্পর্শ এগুলো কোনওটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়। প্রত্যঙ্গকে। প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনের সময়ই তা শুরু হয়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধন সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শ্বাসাদির চোখে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলন ক্রিয়ার সময় চার প্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনও কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তাঁর শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন(slight contact) বলে। সঙ্গী কোনও নির্জন স্তাহ্নে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেবার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের। সঙ্গে সঙ্গী যখন উধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধত অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দুহাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive rubbing embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে–চুম্বন, নখক্ষত, দক্ষত, প্রহণন ও শীক্কার। তবে কামশাস্ত্র কখনওই মিলনক্রিয়ার সময়, তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলন সময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে যখন পুরুষের শ্বাস বইতে থাকে। অর্থাৎ চন্দ্র বাঁ নাকে আর সঙ্গিনীর পিঙ্গলা নাড়িতে বাঁ নাকে শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘন্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তাঁরা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলিকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এই সময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম গায়ত্রী।
এই জপক্রিয়া কেন করা হয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম প্রবীন প্রাজ্ঞ সাধক দয়াল খ্যাপাকে।
বললেন, কাম-বীজ ও কাম-গায়ত্রী জপে সাধক সাধিকার শরীর রাধা-কৃষ্ণ হয়ে যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই মন্ত্র?
বললেন, কাম বীজ ক্লীং। ক্লীং কামদেবায় বিদ্বহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নো কৃষ্ণ প্রচোদ্দয়াৎ।
–এগুলো কী?
–সব হল কৃষ্ণবীজ। শরীরে কৃষ্ণ জাগানো।
রাধামন্ত্র জপের কথা একবার বলেছিলেন জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সদানন্দ বাবাজি।
বললেন, কৃষ্ণই চৈতন্য। তাঁর বীজমন্ত্র হল–ক্লীং কৃষ্ণচৈতন্য নমঃ। রাধা হলেই কৃষ্ণ মেলে। রাধার বীজমন্ত্র তাই জপতে হয় সবসময়।
কী এই মন্ত্র? জিজ্ঞাসা করলাম।
বললেন, ওঁ শ্রীং হ্রীং রীং রাধিকায়ে স্বাহা। আর রাধিকারও গায়ত্ৰীমন্ত্র আছে। হল–ক্লীং রাধিকায়ৈ বিদ্বহে প্রেমরূপায় ধীমহি তন্নো রাধে প্রচোদ্দয়াৎ।
এগুলো সব হল গিয়ে আসলে রক্ষামন্ত্র। ঢিলাইচণ্ডীর সাধু পরিতোষ বাবা একবার আমায় দক্ষিণাকালীর বীজমন্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
বললেন, ওঁ ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং দক্ষিণে কালিকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুং হুং হ্রীং হ্রীং স্বাহা। ক্রীং হল বুঝলি রক্ষা কর। দক্ষিণা কালী আমার মস্তক রক্ষা করো। ক্রীং ক্রীং ক্রীং–এই ত্রিবীজরূপিণী খড়গধারিণী কালিকা আমার ললাট, হুং হুং বীজদ্বয়রূপিনী নেত্রযুগল, হ্রীং হ্রীং বীজদ্বয়রূপিনী আমার কর্ণযুগল রক্ষা করুন। এরপর বলা হয় স্বাহা বাঁ ফটু স্বাহা। বুঝিস এর মানে?
বললাম, আপনি বলুন?
–স্বাহা হল প্রণাম করা। লুটিয়ে পড়া। ফটু হল সর্বাঙ্গে। মানে কালী সারা দেহে বিরাজমান হও। এ হল গিয়ে সাধনের শক্তি।
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব প্রেমোন্মত্ত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বুঝিয়েছিলেন, ‘তাকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।
তবে কীভাবে তাকে জানা যায়? ঠাকুর গেয়েছিলেন:
কে জানে কালী কেমন?
ষড়দর্শনে না পায় দরশন।।
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন।
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ।।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।।
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জানো কেমন।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন।।
প্রসাদ ভাষে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন।।
গান থামিয়ে ঠাকুর বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন, ‘দেখলে, কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন। আর বলছে, ষড়দর্শনে না পায় দরশন–পাণ্ডিত্যে তাকে পাওয়া যায় না।’
কালী শব্দটির যদি আমরা অর্থ করি তাহলে দাঁড়ায়: কালের সঙ্গে ঈ শক্তি যুক্ত হয়ে হয়েছেন কালী। ঈ হলেন ঈশ্বরী। কালী হচ্ছে আসলেই কালকে উপলব্ধ করার মহাশক্তি। কালীর যে রূপ শিবের বুকে পা দিয়ে জিভ বের করে থাকা, এর অর্থ হল কালী আদ্যাশক্তি হিসাবে পূজিতা। আদ্যাশক্তির অর্থ হল অদনময়ী। অদন মানে ভোগ। যা কিছু আমরা ভোগ করছি তা শুধু পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়েই ভোগ করছি না, করছি সর্বাঙ্গ দিয়ে। ঠাকুর বলেছেন ষড়দর্শনে কালীকে জানা যায় না। সাধনার মূল আধারই তো ষড়রিপুকে ত্যাগ করা। বাউলও তো তাই বলেন। বলেন ষড়রিপুকে মারার কথা। তাঁরও তো রয়েছে পঞ্চভূত। যা শরীরস্থ চক্রে জাগিয়ে রাখেন দেহসাধক। বাউলের যে পঞ্চবাণ তা তো রিপু দমনেরই। নিক্ষেপ। এটাই তাঁর অঙ্গীভূত সাধনা। গোবিন্দ গোঁসাই এর যে গান নরোত্তম বাউল। আমাকে শুনিয়েছিলেন সেখানে ‘বিষম সে ত্রিপাণি নদী’র কথা বলেছেন পদকর্তা। তা যেমন তিন নাড়ি তেমনই তিন গুণও। তিন রস হিসাবেও কিন্তু তাকে চিহ্নিত করতে পারি। বাউল বলেন তিনদিনের কারণ-রসে তিন শক্তির আধিপত্য থাকে। প্রথমদিনে ব্রহ্মার, দ্বিতীয় দিনে বিষ্ণুর, তৃতীয় দিনে মহেশ্বরের। বহু বাউল গানেই এই প্রতীকময়তাকে দেখতে পাই। পদকর্তা বলেছেন: ‘ত্রিকোণ যন্ত্র পাতালভেদী / মধ্যে আছে মহা ঔষধি।’ ত্রিকোণ যন্ত্র হল গিয়ে সঙ্গিনীর যোনির অবয়ব। মহাঔষধি রজঃধারা। এই জল নিয়েই বাউলের কারবার। তাই বলা হয়েছে— ‘ওঠে ঘুরনো জল যদি না থাকে গুরুবল/ তবে খুলবে মণিকোঠা বাঁধবে ল্যাঠা/ সেখানে খুব খবরদার।‘ জল ওঠার অর্থ–সঙ্গিনীর সত্তায় রজঃরূপের যখন পূর্ণপ্রকাশ হয় তখন রজঃবীজ মস্তক থেকে নেমে এসে রজঃদ্বারে প্রবাহিত হতে থাকে। এই স্রোতপ্রবাহকে, জলকে সাধক গুরুবলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। গুরু সেই রজঃস্রোতে সাঁতার কাটতে শেখান। কিন্তু তা করতে গিয়ে মূলাধারের শুক্রের যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, শুক্র নিম্নগামী হয়ে পড়ে তখন সাধন পথে বিপর্যয়। তাকেই ল্যাঠা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে গানে। নদীর ভিতর গরল-সুধা’র কথা বলেছেন পদকর্তা। যা আসলে প্রথম দিনের রজঃনাম হিসাবে চিহ্নিত। গরল পানের অর্থ হল গরল রসকে ওজে বা মিছরিতে পরিণত করে নেওয়া। গরল স্রোত থেকে কামকে তুলে প্রেমের জলধারাকে সাজিয়ে দেওয়া। আর এ ধারাকেই ‘উল্টো কল নেমেছে ঢল’ বলে চিহ্নিত করে দিয়েছেন গোবিন্দ গোঁসাই। তিন দিনের বারুণী স্নান’ হল–তিনদিনের রজঃযোগে অবগাহন। শাস্ত্রমতে চৈত্রমাসের কৃষ্ণ ত্রয়োদশী শতভিষা নক্ষত্র যুক্ত হলে এই শুভযোগ হয়। এই যোগে গঙ্গাস্নানে পূণ্য লাভ হয়ে থাকে বলে কথিত আছে। বাউলের এই যোগ অমাবস্যার তিথি পদকর্তা তাই বলেছেন: ‘তিন দিন বারুণী তাইতে স্নান শুনি / নাইলে সে মহাযোগে অনুরাগে / কাম-কুম্ভীর কি করবে তার।
ক্রিয়াযোগেই বাউল কামকে বশীভূত করে রাখেন। আলাপনের কথা আগেই বলেছি। ক্রিয়া শুরু হয় তা দিয়েই। এখানে চলে দৃষ্টিস্থাপন। তাঁরা একে ‘নেহার’ বলে থাকেন। স্থিরদৃষ্টি তাঁদের ‘আরোপ’। বহু বাউল গানে এর উল্লেখ আছে। এই অবস্থাতেই কুম্ভক শুরু করেন বাউল। কুম্ভকেই মিলন ক্রিয়ার মূল ভিত্তি। প্রাণ আর অপান বায়ুকে কুম্ভকের সাহায্যে মিলিয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বগত হতে যান বাউল সাধক। এই সাধনা তাঁদের দম সাধনা।
সাধন দাস বৈরাগ্য একবার আমাকে বলেছিলেন, বাউল জীবন দমে শুরু দমে শেষ।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দমক্রিয়া কি শুধু সঙ্গিনীর সঙ্গে দেহ মিলনের সময়ই করে থাকেন বাউল সাধক?
–তা কেন? দমেই তো শরীর গঠন। সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলন না হলেও সাধক কি শুক্র ক্ষয় করেন কখনও? করেন না। দমেতেই তো শুক্র উপরে ওঠে। বিন্দুবীজকে তো দমেতেই সাধক শরীরে রেখেছেন।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাহলে চার চন্দ্রের সাধনা কি বাউল সারা জীবন করে করেন।
–সেইভাবে চারচন্দ্র সকল সাধক হয়তো করেন না। তবে বীজকে তো উধ্বগতি দেন সকলেই। না হলে আর সহজ সাধনাটা হল কী করে?
গোবিন্দ গোঁসাই বলেছেন: ‘রসিক ডুবুরি হলে/ ডুব দিয়ে সেই গভীর জলে/ অনায়াসে রত্নধন তোলে।’ বাউলের রত্নধন স্থিতাবস্থা। অভ্যাস-প্রণালীতে অটল হয়ে যাওয়া। বাউল বলেন: ‘টলে বীজ, অটলে ঈশ্বর, / টলাটল ত্যজ্য করে ভজে সেই রসিক শেখর।‘ রস তাঁদের সাধনার মূলবস্তু। রসই তাঁদের অপ্রাকৃত দেহধারী ভাবের মানুষে পরিণত করে রাখে। দ্বিদল পদ্মে বাউল বলেন ভাবের মানুষের দেখা পান। সাধক আর সাধন সঙ্গিনীর দুই আত্মা যখন এক হয়ে ওঠে দমক্রিয়ায় তখনই আজ্ঞাচক্রে এই পদ্ম। ফোটে। বাউল বিকশিত হন মনের মানুষ বা ভাবের মানুষে।
*****
নিয়ামতপুরে প্রতি সাত-ই বৈশাখ খ্যাপাচাঁদের স্মরণ-উৎসব হয়। সেই উপলক্ষ্যে বাউল গানের আসরও বসে। এই আসরেই রামনগরের রসিক ভক্তিদাস বাউলের একখানি গান শুনেছিলাম যেখানে সেই নদীর দখলদারিকেই আয়ত্ব করতে চাইছেন বাউল সাধক।
বাউল গাইছিলেন:
নদী নদী হাতড়ায়ে বেড়াও অবোধ মন!
মিছে ভ্রমেতে কর ভ্রমণ।।
তোমার হৃদয়-রত্নাকরের মাঝে,
আছে অমূল্য রতন।।
দেহে থাকতে সহজ মানুষ, ধরতে না পারে যে জন।
তাঁর বৃথাই জন্ম, নরের অধম, বিধাতারই বিড়ম্বন।।
কাঞ্চন ত্যাজিয়ে কেবা কাচেতে করে যতন।
যেমন স্বর্গ ত্যাজে ইচ্ছা করি নরকে করে গমন।।
যে যা বলে তারই কথায় দৌড়ে বেড়ায় ত্রিভুবন।
তোমার ঘরের মধ্যে বিরাজ করে বিশ্বজয়ী সনাতন।।
কারুর কথা না শুনিবি, শুনবি স্বগুরুর বচন।
তবে ঘরে বসি দিবানিশি করবি তারে দরশন।।
ছাড়বি না পাইলে রসিক, প্রেমিক, সুজন মহাজন।
ও তোর যে দিনে চৈতন্য হবে, লক্ষ্য করবি নিত্যধন।।
নিতাই দাস বাউলে বলে, শুনশুন সাধুজন।
কেন আত্মতীর্থ ত্যাজ্য করে মিছে তীর্থ পর্যটন।।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে–’অন্তঃস্নানবিহীনস্য বহিঃস্নানেন কিং ফলম!’ অর্থাৎ অন্তস্নান বিহীন ব্যক্তির বাহ্যস্নানে কোনো ফল নেই। অন্তঃস্নান কীভাবে করা যায়? এই স্নান সম্পন্ন হয় গুরুর কৃপায়। গুরুই শিষ্যকে আত্মতীর্থ দর্শন করান। কোথায় রয়েছে এই তীর্থ? এই তীর্থ ভ্রদ্বয়ের মধ্যে অবস্থিত। আজ্ঞাপদ্মচক্র। দ্বিদলের পদ্ম। এই পদ্মের কর্ণিকাভ্যন্তরে শরচ্চন্দ্রের ন্যায় নির্মল শ্বেতবর্ণ ত্রিকোণমণ্ডল আছে। ত্রিকোণের তিন কোণে। সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনগুণ এবং ত্রিগুণান্বিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিন দেব আছেন। ত্রিকোণমণ্ডলের মধ্যে শুক্লবর্ণের চন্দ্ৰবীজ ঠং দীপ্তিমান হয়ে আছে। ত্রিকোণমণ্ডলের এক দিকে শ্বেতবর্ণ বিন্দু আছে। তাঁর পাশে চন্দ্ৰবীজ প্রতিপাদ্য বরাভয় শাসিত দ্বিভুজ দেববিশেষের কোলে জগন্নিধান-স্বরূপ শ্বেতবর্ণ দ্বিভুজ ত্রিনয়নের জ্ঞানদাতা শিব আছেন বলে সাধক কল্পনা করেন। তিনি এও কল্পনা করে থাকেন যে, দ্বাদশভূজা হাকিনী শক্তিরও বিকাশ এখানেই। আজ্ঞাচক্রের উপরেই ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না–এই তিন নাড়ির মিলন স্থান। এই স্থানের নাম ত্রিকূট বা ত্রিবেণী। ত্রিবেণীর উপরে সুষুম্না নাড়ির মুখের নীচে একটা অর্ধচন্দ্রাকার মণ্ডল আছে। অর্ধচন্দ্রের উপর তেজঃপুস্বরূপ একটি বিন্দু আছে। ওই বিন্দুর উপরে উধ্বাধোভাবে দণ্ডাকার নাদ আছে। এটি দেখতে অনেকটা দণ্ডায়মান তেজোরেখার মতন। এর উপরে শ্বেতবর্ণ একটি ত্রিকোণমণ্ডল অবস্থিত। তাঁর মধ্যে শক্তিরূপে শিবাকার হকারার্ধ্ব আছে। এখানেই বায়ুর ক্রিয়া শেষ হয়ে এসেছে। এই আজ্ঞাপদ্মকেই জ্ঞানপদ্ম বলা হয়ে থাকে। এর অধিষ্ঠাতা পরমাত্মা। ইচ্ছা তাঁর শক্তি। অষ্টশক্তির এক শক্তি। সাধক দেখেন এখানে প্রদীপ্তশিখারূপিণী আত্মজ্যোতি স্বর্ণরেণুর মতোই বিরাজমান। তিনি বলেন এই স্থানেই জ্যোতির্দর্শন হয়। যা হল সাধকের আত্মপ্রতিবিম্ব। এই পদ্মচক্রে ধ্যানে বসলে জ্যোতিঃদর্শন ঘটলে যোগের চরম ফল নির্বাণপ্রাপ্তি হয়।
সাধকে এই আত্মপ্রতিবিম্ব দর্শনই বাউল সাধকের কাছে রস-রতিকে উধ্বর্গত করে উচ্চস্থানে দ্বিদলপদ্মে নিয়ে যাওয়া। টল অটল নয়, একেবারেই সুটল হয়ে যাওয়া।
দয়াল খ্যাপা আমাকে বলেছিলেন, সাধক সাধনা করেন লিঙ্গ শাসনের। লিঙ্গতেই ব্রহ্মাণ্ড থাকে।
কী এই ব্রহ্মাণ্ড? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
বললেন, রজ আর বীর্য। রজ হল স্ত্রীলিঙ্গ। বীর্য হল পুংলিঙ্গ। লিঙ্গ শাসন হয় এই রস রতি দিয়েই। ত্রিবেণী পেরোতে হয়। নদীই হল সাধন। নদীই সাধককে ভবপারে নিয়ে যায়। এর জন্য সাধকের পাঁচতত্ত্ব রপ্ত করতে হয়।
–কী এই পাঁচটি তত্ত্ব?
–বিবেক,জ্ঞান, সংযম, বৈরাগ্য আর ভক্তি। নদী পারাপারে এ তো লাগেই।
গানে নদী হাতড়ে হাতড়ে বেরানোর কথা বলা হয়েছে। অবোধ ঘন নদীকেই কেবল খুঁজে চলেছে। কিন্তু পদকর্তা বলছেন নদী খুঁজতে গেলে আগে হৃদয় রত্নাকরের মাঝে, যে অমূল্য রতন আছে তাকে খুঁজতে হবে। প্রশ্ন হল–হৃদয় রত্নাকর বলতে পদকর্তা কী বোঝাতে চাইছেন?
‘হৃদয় রত্নাকর’ হল অনাহত পদ্মচক্র। হৃদয়ে দ্বাদশদলের পদ্ম একটি। এই পদ্মের কর্ণিকামধ্যে অরুণবর্ণ সূর্যমণ্ডল এবং ধূম্রবর্ণ ষট্কোণবিশিষ্ট বায়ুমণ্ডল আছে। তাঁর একদিকে ধূম্রবর্ণ বায়ুবীজ যং আছে। এই বায়ুবীজের মধ্যে চতুর্ভুজ বায়ুদেব কৃষ্ণসাধিরোহণে অধিষ্ঠিত। তাঁর কোলে বরাভয়-লসিতা ত্রিনেত্রা সর্বালঙ্কারভূষিতা মুণ্ডমালাধরা পীতবর্ণা কাকিনী শক্তি বিরাজিতা। সাধককে এই বায়ুবীজকে জাগরিত করতে হয়। বায়ুপথ ঠিকঠাক প্রসারিত না হলে, হাওয়া না খেললে, দম ঠিক না হলে কখনওই বাউল সাধক নদীপথকে শাণিত বা চালিত করতে পারেন না। ভেতর নদীতে অন্তস্নান না হলে বাউল তিন রতির রসে, বাঁকা নদীতে অবগাহন করবেন কী রূপে! বাঁকা নদী তো আসলেই স্ত্রী জননাঙ্গের প্রতীক। নদীর বেগ হল বাউলের কামনা। বাউল সাধক বলেন। তাঁদের সাধনা হল গিয়ে পরকীয়া সাধনা। পরকীয়ার অর্থ তাঁরা করেন কিন্তু নিষ্কাম সাধনা। স্বকীয়া তাঁদের স্বকামের নামান্তর। তাঁদের মত গৃহী লোকের পথ এটি। বাউল স্বকীয়া থেকেই পরকীয়াতে যায়। পরকীয়া সাধনে মনকে তাঁরা মৃত প্রতিপন্ন করেন। অচঞ্চল মনকে তাঁরা মৃত হিসাবেই ঘোষণা করে থাকেন–’য চঞ্চলতাহীনং তন্মনো মৃতমুচ্যতে।‘
গানে ‘হৃদ্যে-রত্নাকরের’ মাঝে অমূল্য রতন আছে বলার অর্থই হল বায়ুকে চেনা-জানা, তার সঙ্গে বসতি করার কথা বলা। কেননা শ্বাসের কাজ রপ্ত না হলে নদীরূপী নাড়িও জাগবে না। অন্তস্নানও হবে না। আর বাঁকা নদীর পেছল ঘাটে দম আটকে পড়ে থাকতে হবে।
প্রবৃদ্ধ সাধক শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একবার আমায় বলেছিলেন, বুঝলে বাবা, সাধকের হল–বায়ুর ঘর বায়ুর বাড়ি বায়ু নিয়ে নাড়িচাড়ি। এই নাড়াচাড়া না হলে সাধক সিদ্ধ হবেন কোন প্রকারে শুনি?
বললেন, বায়ু কী জানো বাবা?
বললাম, কী?
–বায়ু হল বীজাবস্থা। শুদ্ধ চৈতন্য বায়ু। বায়ু না হলে শক্তিতত্ত্ব আর শিবতত্ত্ব জাগবে কীভাবে? এই শক্তি কোথা থেকে আসে জানো বাবা?
জিজ্ঞাসা করলাম, কোথা থেকে?
–মায়া থেকে বাবা।
–মায়া তো পাশ বলেন আপনারা? জিজ্ঞাসা করলাম।
–মায়া তো পাশই বাবা। মায়া মুক্ত হলে আসে শুদ্ধ মায়া। আর এই শুদ্ধ মায়া থেকেই শক্তি ও শিব জাগরিত হয়। যুগল নেয় সত্তা। মায়া হল শরীরের সব সৎ বৃত্তি। অসৎ কী জানো বাবা?
বললাম, আপনার চোখে অসৎ কী? আমি যে অর্থে অসৎ বলব তা হয়তো আপনার সঙ্গে মিলবে না।
বললেন, তা তুমি যে অর্থেই বল অসৎ আসলেই হল অনস্তিত্ব মন। মায়া যে সৎ বৃত্তি তার কারণ মায়া অস্তিত্বের প্রকাশ। মায়াকে শুদ্ধ মায়াতে আনতে হবে। শরীরকে, মনকে অনস্তিত্বের জায়গায় আনতে হবে। তবে না আনন্দশক্তির আত্মপ্রকাশ আসবে। ঘর কী?
বললাম, কী?
বললেন, ঘর হল গিয়ে দেহক্রিয়া। মূলাধারের অস্থি, স্বাধিষ্ঠানের মেদ, মণিপুরের মাংস, অনাহতের রক্ত, বিশুদ্ধের ত্বক আর আজ্ঞার মজ্জা নিয়ে ঘর গঠিত। ঘরকে আগে ক্রিয়াশীল করতে হবে। গুরুই তো ঘরকে দেখায়, চেনায়, জানায়।
খ্যাপাচাঁদের উৎসবে বাউল গিয়েছিলেন–’কারুর কথা না শুনিবি, শুনবি স্বগুরুর বচন। / তবে ঘরে বসি দিবানিশি করবি তাঁরে দরশন।‘
বাউলের এই দেখা, অনস্তিত্বের স্বীকৃতি, অন্তরাত্মার ভেতর মনের মানুষের আনাগোনা নিয়েই বাউলের পথ চলা।
দয়াল খ্যাপা বলেছিলেন, পথ কেমন?
–কেমন সে পথ? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
–পথ হল আনুগত্য। সব উজাড় করে দিলে তারে, তবেই পথ মেলে।
–পথচারী কারা?
জিজ্ঞাসা করলাম, কারা?
–নাড়ি, হৃদয়–এরা হল সব পথচারী। তাদের গুনগুন না শুনলে তুমি পথ পাবা না কোনওকালে। পথ হল ভোমরা। সদানন্দ ভোমরা।
ষষ্ঠী খ্যাপা একবার আমাকে বলেছিলেন, বাউলের পথ হল একতারা। তা খ্যাপা জানো কী এই একতারা?
— কি? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললেন, একতারা হল একতানে নিজেরে বেঁধে ফেলা। গানে। মানে।
আমি সেই মনের প্রজ্জ্বলিত ধ্বনি নিয়েই ভাবছি, বাউলের গান কতখানি আজ বাজতে পারে প্রতীকী সেই একতারায়? আমাদের মনে এখন মনেরই কৈশোর বার্ধক্যে উপনীত হয়ে বসে আছে। বাউলের দাউ দাউ আদর্শেও তো ঘুণ ধরেছে।
০১.৪ ফুলের লাগি কতজন হল বিরাগী
রামপ্রসাদের ভিটে লাগোয়া গৌরিপদ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। গতকাল জেঠিয়ার এক অনুষ্ঠান সেরে এখানেই এসে উঠেছেন কানাই বাউল। বেলপাহাড়িতে থাকেন তিনি। সে এলাকা রাজনৈতিক চাপানউতরে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত। তবে ওসবের খবর রাখেন না তিনি। আর কতদিনই বা তিনি সেখানে থাকেন। বীরভূমের বেদনাশা বটআশ্রমে যতবারই, যে সময়ে আমি গিয়েছি তাঁর দেখা পেয়েছি। এটা তাঁর গুরুর আশ্রম। ছোটখাটো চেহারার বয়স্ক মানুষটি এখানে থাকলেই বোধহয় ভাবগত তৃষ্ণাকে কিছুটা হলেও নিবারণ। করতে পারেন। কতবার তাঁকে দেখেছি গুরুর সমাধি মাটিতে পড়ে-পড়ে কাঁদতে। তবে শুধু তিনি নন, এ সাধন মাটি গায়ে মাথায় মাখতে, এমন কী মুখে দিতেও আমি অনেক বাউল সাধককে দেখেছি। নামকরা বাউল থেকে অচেনা বাউল অনেকেই খ্যাপা বাবার এই সাধনস্থলকে সিদ্ধপীঠ বলেই মনে করেন। এখানে এসে দু’দণ্ড বসেন, হাসেন, কাঁদেন, গান করেন, অরূপের স্পর্শ অনুভব করেন। তবে সকলেই যে খ্যাপার শিষ্য তা কিন্তু নন।
কানাই বাউল জেঠিয়ায় গান সেরে গতকাল রাতেই গৌরিবাবুর বাড়িতে এসে উঠেছেন। আজ পার্শ্ববর্তী এক আসরে গাইবেন তিনি। হালিশহর শ্মশান লাগোয়া ছিন্নমস্তার আশ্রমে বসেছে সেই আসর। বিকেল নিভু নিভু বাতি জ্বালিয়ে নিয়েছ। গঙ্গায় জোয়ার লেগেছে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে জল খানিক আছড়ে যাচ্ছে পাড়ে। অন্তিম জীবনের কার্যও সমাধা হচ্ছে কান্না আর শোকে। হরিধ্বনি উঠছে।
আলো সাধুর সন্ধ্যা আরতির পর গান ধরলেন কানাই বাউল। বললেন আজ শুধু গুরুর গানই গাইবেন। অন্য কারও নয়। তাঁকে যেন অনুরোধ করা না হয়। কেননা আজই তাঁর গুরু ইহলোকের মায়া কাটিয়ে ভব সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন। আজ তাঁর গুরুদেবের তিরোভাব তিথি।
প্রথমে আসর বন্দনা করলেন তিনি। গুরুকে প্রণাম করে সুর ধরলেন
আনন্দে বল জয় গুরু জয়।
জয় জয় জয়, যম পরাজয়,
জয় জগন্নাথ, জয় কী জয়।
আনন্দে বল জয় গুরু জয়।
এরপর গান শুরু করলেন তিনি। ডুবকিতে চাপর পড়ল। দোতারা, খমকও সঙ্গত দিল সেই মতো। তাঁর চোখে ভক্তিরস আর গাঁজার আচ্ছন্নতা। অল্পবিস্তর মানুষ সেখানে। ভাবগম্ভীর পরিবেশ। আলো সাধু তন্ময় হয়ে কানাই বাউলের গান শুনছেন। রামপ্রসাদের। হাওয়া লেগে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর গান। বকুলতলা নিগমানন্দের আশ্রমে সন্ধ্যা আরতির ঘণ্টাধ্বনিও শোনা যাচ্ছে।
আমরা দুই বন্ধু গৌরীবাবুর পাশে বসে। ভাবছি, বাউলের গান কি চৈতন্য ডোবার গৌর মূর্তিতে কাঁপন ধরাচ্ছে? একটু আগেই দেখা গৌরের প্রসন্ন হাসি যেন এখন কানাই বাউলের জর্দার ছোপ লাগা দাঁতে লেগে। একমনে গেয়ে চলেছেন তিনি।
অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনিতে পারে
জলের গড়ন মণিকোঠা, মণির ভিতর জলের ছটা,
জলের দরজায় জলের চাবি খুলা,
সপ্ততালায় নব জলের খেলা, জলের মানুষ হৃদে ভৃগুপদ ধরে।
ওই জলে জল বিহরে, অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনতে পারে।
জলের স্বর্গ জলের মঞ্চ, জলে সপ্ত পাতাল স্থিত,
ওই জলের কল ঘর্ষণেতে, হর ব্রহ্মা বিষ্ণু হলেও মরে।
জলের জানালায় জলের খেল, জল চিনিলে ছাড়বে যমের জ্বালা,
সেই জলের এক বিন্দুতে শতকোটি ব্রহ্মাণ্ড সঞ্চারে।
জলের পর্বতে জলের অরণ্য, জলের বৃক্ষে জলের লতা ধন্য,
জলের ফুলে ভৃঙ্গরূপে, শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।
জানি শ্যাম কেমন জল, সে জলে ভাঙ্গিল বিধির বল,
জলের ভিতর স্বতঃ রজঃ তমঃ তিন হয়,
মূঢ় কামিনী কয় অবিশ্বাসে নয়, গুরুর চরণে যে জন দৃঢ় করে।
জলের এই কথকতা প্রথম শুনেছিলাম আমি অজয়ের পাড়ে বসে। তখন বাউল পাঠ পড়তে শুরু করেছি সবে বেশ মনে আছে এই কানাই বাউলই প্রথম আমাকে জলের প্রতীকীকলা খুলে ধরেছিলেন একেবারে সদর দরজা হাট করে। জল যে আমাদের শরীর বস্তুরই অংশভাগ–বীর্য-রজঃপ্রবাহ, কানাই বাউল তার প্রথম হদিশ দিয়েছিলেন।
এই গানের প্রথমেই বলা হয়েছে–’অনুগত বিনে তাঁরে কে চিনিতে পারে। কে এই তিনি? আমরা বলব এ তো জলের ধারার মতোই পরিষ্কার, তিনি হলেন শ্যাম। তাঁর বর্ণনাও তো এখানে আছে–’শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।‘ তারপরেই অবশ্য ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে–’না জানি শ্যাম কেমন জল’ বলে। আর এই না জানা থেকেই উঠে আসে বাউলের অভিজ্ঞান। তিনি কল্পমূর্তির শ্যামে বিশ্বাস রাখেন না। বাউল সাধক। মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী নন। সাধারণত কোনো বাউল আশ্রমে কিংবা আখড়ায় কোনও দেবদেবীর পূজা দেখা যায় না। বাউল কখনও কোনও মূর্তির সামনে মাথা নত করেন না। পুস্পাঞ্জলি পর্যন্ত দেন না। বাউলের পূজা বা সাধনা তা সব ওই মানুষকে নিয়েই। এ মানুষ হল অধর মানুষ। খ্যাপা বাবারই গান আছে–সে যে অধর মানুষ/ দেয় না ধরা/ ধরতে হয় এক কৌশলে। / (সে যে) সহজে আসে, সহজে যায়/ (মন) বসে আছে দ্বিদলে। বা, ‘সহজ মানুষ না হলে/ সহজ উপায় বুঝিবে সে কার বলে। / চল সহজে সোজা, ঘুচাও মনের গজা, / নইলে তুলতে নারবি, কর্ম ফেরের বোঝা, / ওহো গুরু মহাজন বলে। অথবা, ‘সহজের পথে চলে যাও/ থেকো না আঁধার ঘরে। / সহজেতে আসে সহজেতে যায়,/ (খ্যাপা) ধরিবে কেমন করে?’
একবার ঘোষপাড়ার মেলায় এক বৃদ্ধ বাউল আমায় বলেছিলেন, বাউল কথার অর্থ হল আসলে গিয়ে অন্বেষণ।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীসের সেই খোঁজ? কাকে খোঁজা? –কেন বাবা, নিজেকেই তো খোঁজা। হেঁড়াফাটা আমিকে একত্র করে দেখা কোথায় কোথায় ফেটেছে তার, রিপু করতে হবে না বাবা। তা করতে গেলে গুরু লাগবে। জ্ঞানতত্ত্ব লাগবে।
‘গুরু’ কথার অর্থও তো তাই। ‘গু’হল গিয়ে অন্ধকার আর ‘রু’ হল গিয়ে আলো। যে বা যিনি শিষ্যকে সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে ঠেলে তোলেন তিনিই তো আসলে গুরু।
আনন্দগোপাল দাস বাউলের একখানা গান আছে। বোলপুরের সুরিপাড়াতে থাকেন তিনি। কেঁদুলির মেলাতে বসেই তাঁর রচিত গানখানি শুনেছিলাম।
আমায় বল গুরু কানে কানে
আমি শুনে যাব মনে প্রাণে
গুরু স্থান দিও ওই শ্রীচরণে
আমি সহজতত্ত্ব জানতে চাই।
এই মানুষের এমনি কঠিন প্রাণ
সে গায় না গুণগান
তত্ত্ব জানবে গুরুর কাছে
তাঁরে করে না সন্ধান।
ও তাঁর কলিযুগের এই তো প্রমাণ
দাস আনন্দ বসে ভাবছে তাই।
বাউলের সেই ‘সহজতত্ত্ব’ জানা তো আসলে নিজেকেই জানা। এই আমি, দেহগত আমি, আত্মগত আমিকে সদগুরুর সাহায্যে জাগিয়ে তোলা। বাউল আসলেই এক জাগরণকলা। এই জাগরণই যে তাঁর গান। শরীরের সামগ্রিক দলিলসমূহ। বাউল তাই-ই লিখে রাখেন তাঁর দেহতত্ত্বের গানে। যে তত্ত্বের চারটি অনুপম যোগ বর্তমান–হঠযোগ, তন্ত্রযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ। আমাদের আলোচ্য খ্যাপা বাবা বা শ্রী শ্রী খ্যাপা মনোহর ঠাকুরের গানে এই চারটি ক্রিয়াকৈবল্যকে আমরা সব সময়েই দেখতে পাই। যে তিনটি গানের কথা আমরা বললাম বাউলের মানুষ বিকাশের পথটিকে ঋজু করতে, প্রশস্ত করতে-সেগুলো সবই আত্মদর্শনের গান। এক অর্থে এ তো সেই বৃদ্ধ বাউলের বলা অন্বেষণই। বাউলের সমস্ত গানকে, সাধনাকে আমরা তো এই অভিধাতেই রাখতে পারি। খ্যাপা বাবার এই গানগুলি জ্ঞানযোগের।
হঠযোগের কথা প্রায়শ বলে থাকেন বাউল। শিষ্যকে এই যোগ আর রেচক, পূরক, কুম্ভক করার উপদেশ আমি অনেক বাউল আশ্রমেই শুনেছি। এই ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু গানও আছে। যেমন–চণ্ডী গোঁসাইয়ের গান: ‘যদি রেচক পূরক কুম্ভক করবি ভাই তবে নাড়ির কপাট খুলা মায়া / শিখে নেগে আগে তাই।‘ নাড়ির এই কপাট খোলার মায়াই হল গিয়ে যোগ। চারপ্রকার যোগের কথা আমরা জানি। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, রাজযোগ, লয়যোগ। মন্ত্রযোগ সর্বপ্রকার সাধনের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে কথিত। ‘মন্ত্র জপান্মনোলয়ো মন্ত্রযোগঃ।‘ অর্থাৎ মন্ত্র জপ করতে করতে যে মনোলয় হয়ে থাকে, তাই মন্ত্রযোগ। তবে একে নিকৃষ্ট অভিধায় ভূষিত করলেও কিন্তু এও বলা হয়ে থাকে: ‘জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ, জপাৎ সিদ্ধিঃ ন সংশয়ঃ।‘ জপই সাধনায় সিদ্ধি এনে দিতে পারে। কালী, কৃষ্ণ, শিব যাই বলি না কেন আমরা এতে বাঁ এই ইষ্ট সাধনায় সিদ্ধি পেতে গেলে জপের ভূমিকা অনিবার্য। বাউলের ইষ্ট মানুষ। তাঁরই ভজনা বাঁ সাধনা সারাক্ষণ বাউলের সাধনা। সেই সাধনার জপ হল গিয়ে গান। বন্দনা। খ্যাপা বাবা নিজেই এ ধরণের বন্দনা গান অনেক লিখে গেছেন। যেমন-’অনুরাগে ভজরে মন,/ পাবি রাধার যুগলচরণ,/ রাধাকৃষ্ণ একাসনে/ ধ্যানে মগ্ন মদনমোহন।‘ বা, ‘আগে নিষ্ঠারতি করগে মনে, পরে করবিরে উপাসনা/মনের ভুল তোর থাকবে না রে দূরে দিবি রে রূপাসনা।‘ অথবা, ‘আমার নয়ন কোণে লুকিয়ে কালা / বাজাল কি মজার বাঁশি। / সুরে প্রাণটি আকুল করে, / ওলো কুল মজাল এই কি বাঁশি।।’ খ্যাপার এই সব গানকেই তন্ত্রযোগ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা যাকে মন্ত্রযোগ বলে জানি। বাউল ক্রিয়াকর্ম। তন্ত্রও তো তাই। শরীর আধারিত সব অধ্যায় এই সব লোকায়ত সাধনা। হঠযোগ হল গিয়ে একত্রে সংযোগ। বাউল সাধনে যা অপরিহার্য। গুরু–শিষ্যর। সাধক-সাধক সঙ্গিনীর। গুরু-শিষ্যর সংযোগের একটি বহুল প্রচারিত গানের কথা আমরা সকলেই জানি–’চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে। করবো কি? ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাঁরে তোমরা বলবে কি?’
এই চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা হল গুরু আর শিষ্যর মিলন। এই গানে ব্যবহৃত প্রথম চাঁদ হল গুরুচাঁদ। যিনি শিষ্যকে টানছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। গুরু এখানে যেন কল্পিত একটি বড়োসড়ো চুম্বকখণ্ড। এই চাঁদের গায়েই শিষ্যচাঁদ লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ শিষ্য হলেন। লৌহকণিকা। গুরু তাঁকে নানা প্রাকরণিক কৌশলে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করছেন। দু’জনের দেহই ঈশ্বরের অংশ হয়ে উঠছে যেন। পূর্ণচন্দ্র গুরু। তাঁর আকর্ষণে চন্দ্রাংশ বা শিষ্য মিলিত হচ্ছেন বা হবেন, এতে কারও কিছু করবার নেই। ক্রিয়াশীল এই নিয়ম। এখানে কোনো রকম ভাবনার অবকাশ থাকবার কথা নয়। শিষ্য এখানে নিজেকে মাতৃঅংশ বলে মনে করেছেন। তাই ‘ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। ঝি হল সন্তানতুল্য অভিধা। নিজেকে তিনি মাতৃভাবে প্রতিপন্ন করে গুরুকে সন্তানের আসনে বসাচ্ছেন।
‘হকার কীৰ্ত্তিতঃ সূৰ্য্যষ্ঠকারশ্চন্দ্র উচ্যতে। সূৰ্য্যচন্দ্রমসোর্যোগাদ্ধঠযোগো নিগদ্যতে।।‘ অর্থাৎ, হ শব্দে সূর্য ঠ শব্দে চন্দ্র, হঠ শব্দে চন্দ্র-সূর্যের একত্র সংযোগ। অপান বায়ুর নাম হল চন্দ্র আর প্রাণ বায়ুর নাম হল সূর্য। প্রাণ আর অপান বায়ুর একত্র সংযোগকেই শাস্ত্রে হঠযোগ বলেছে। যোগশাস্ত্রে এই দুই শরীরের বায়ু ত্যাগ-গ্রহণের মাধ্যমেই ক্রিয়াকর্মের কথা বলা হয়েছে।
সব সময়ে গুহ্য ভাষাতেই কথা বলে থাকেন বাউল। কারণ গুরুর নির্দেশ: ‘আপন সাধন কথা না কহিও যথা তথা/ আপনার আমিরে তুমি হইও সাবধান। বাউলের গানও তাই প্রহেলিকাতে ভরা। হঠযোগের চন্দ্র বাউলের সংকেতময়তার বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক। অর্থাৎ সেই ঘুরে ফিরে শ্বাসপ্রক্রিয়ারই কথা কিন্তু হল। জ্ঞানযোগ শরীর জাগৃতির গাণিতিক অধ্যায়ের পর উপলব্ধ বিশ্বাস। মানুষতত্ত্বের প্রতি পুরোপুরি আস্থা। খ্যাপা বাবার গানগুলো তো তাই-ই প্রমাণ করে। ভক্তিযোগ হল মহামিলনের পর। স্থিতাবস্থা। বাবার গানগুলোতে তারই প্রমাণ মেলে–’শ্বাসের মালা-জপরে ভোলা,/ যাবে। রে তোর ত্রিতাপ জ্বালা, / সদা শান্তি পাবি–প্রাণ জুড়াবি/ নয়নে নাচবে যে তোর নন্দলালা।‘ বা, ‘সে দেশে নাই যুবা বৃদ্ধ বালা, / রেবতীর পতি গুরু, নিজে স্বামী নিজে জরু, / পূর্ব দেশে ভূমি মরু, বিনা আগুনে জ্বলিছে আলা। / সে দেশের আলো, সেথা নাই শ্যাম চিকন কালা,/ ওই হাটের তরণি সুর বাঁধা অনাহত গলা।‘
কানাই বাউলের যে গানের কথা বলে আমরা শুরু করেছি তা খ্যাপা বাবার হঠযোগ পর্যায়ের গান বলেই চিহ্নিত রয়েছে। ভক্ত-শিষ্যরা বাবা গানগুলির এক সংকলনও প্রকাশ করে ফেলেছেন। নাম রেখেছেন ‘ক্ষ্যাপাগীতামৃতে আত্মতত্ত্বের সন্ধান’ (বাউল সংকলন)। তাতে কানাই বাউলের মুখে শোনা গানটি দেখি ওই পর্যায়ভুক্ত রয়েছে। আমরা এখন গানটির অন্তর্নিহিত অর্থের ভেতর প্রবেশ করি।
গানটির প্রথমেই যে কথাটি বলা হয়েছে তা হল অনুরাগ ছাড়া তাঁকে চিনতে না। পাড়ার কথা। এই অনুরাগ হল ভক্তি, প্রেম। প্রীতি, আসক্তি তো তাঁর আভিধানিক মানে। বাউল সাধক এর বাইরে বেরোতে চান। কানাই বাউল অজয়ের পাড়ে বসে যখন আমাকে এ গান শুনিয়ে ছিলেন তখন ভরা বর্ষার মাস আসতে শুরু করেছে সবে। তিনি বললেন, অজয়ের অনুরাগ হয়েছে গো। কৃষ্ণের হাওয়া লেগেছে গায়। তাই উতলা হয়ে উঠেছে। যারা শীত গ্রীষ্মের অজয় দেখেছেন কেব্ল তাঁরা ভরা বর্ষার সময় এর রূপ কল্পনায় আনতে পারবেন না। তার রূপ অনেকটা ওই বাউলের গানের মতোই–’জলের গড়ন মণিকোঠা, মণির ভিতর জলের ছটা / জলের দরজায় জলের চাবি খুলা। অজয় যেন তাঁর জলের চাবি খুলিয়ে এ সময় কানায় কানায় ভর্তি করে ফেলেছে জল। আর তা ওই অনুরাগের মতই। উপচে পড়ছে চারিধারে ডোবাচ্ছে। ভাসাচ্ছে। বাউল সাধক এই অনুরাগেই ডুবে মরছেন। যাকে চেনার কথা, জানার কথা, বোঝার কথাও বলা হয়েছে গানে, সে তো সেই সঙ্গীতে আস্থায়ী অন্তরা-সঞ্চারী-আভোগের মতোই এক পরিণতির প্রক্রিয়া। এই পরিণতি গুরুর নির্দেশে, দেখানো কায়কল্পে নিজের ভেতরকার শরীরী প্রতিসরণ। যাকে চিনবার কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে গানে। বাউল মূর্তিপুজায় বিশ্বাস করেন না এ তথ্যের কথা আমরা। বলেছিলাম। কিন্তু এ তথ্য সব সময় সর্ববিদভাবে সত্য নয়, অন্তত আজকের বাউল অভিধায়। মন্ত্রদীক্ষার সময় মালসাভোগ নিবেদনে অনেক বাউলের মুখেই শুনেছি আত্মগুরু এবং পঞ্চপ্রভুকে তা নিবেদন করা হয়। আত্মগুরু এখানে নিজের গুরুদেব বাঁ তাঁকে আমরা মনগুরু হিসাবেও দেখতে পারি। আর পঞ্চপ্রভু হলেন–গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর। এরা কেউই কিন্তু প্রতিকৃতি নন কেবল কল্পমূর্তির, এটাও যেমন ঠিক আবার একই রকমভাবে ঠিক বাউল আশ্রমে বা কিছু আখড়ায় সন্ধ্যা-আহ্নিকের কর্মে গোবিন্দ মূর্তির ফটো আমি সামনে রাখাও দেখেছি। এ যথেষ্টই বৈষ্ণবীয় আচার। ‘বাউল আর বৈষ্ণব এক নহে তো ভাই’ বলা হলেও অন্তত এক্ষেত্রে এখন অনেকাংশেই একাকার হয়ে গেছে। বাউলের মাধুকরী তো বৈষ্ণব আচারেরই অঙ্গ। তন্ত্রে পঞ্চ ‘ম’ কারে সাধনার নির্দেশ আছে। যে সাধনা সম্পূর্ণরূপে নাড়িকল্পের বৈষ্ণবীয় এক আচার যেটা দেহাচার নয় বলা ভালো হবে সংযমাচার সেগুলোকে বৈষ্ণবীয় আচরণে অনেকটা তন্ত্রের পঞ্চ ‘ম’ কারের মতোই ভিন্ন প্রতীকী অর্থে সাধনা করা হয়। আর এভাবেই তন্ত্র আর বৈষ্ণবীয় আচরণে মাংসসাধক, মুদ্রাসাধক, মৎস্যসাধক, মৈথুনসাধক, মদ্যসাধক আলাদা হয়ে পড়েন। বাউল পঞ্চ ‘ম’ কার নয় পঞ্চভূতে সিদ্ধির কথা বলেন। তাঁদের পঞ্চভূতের সঙ্গে আবার অঘোরী মতের পঞ্চ ‘ম’ কারে কিছুটা মিল রয়েছে। অঘোরী মতে মৃত্তিকা = মুদ্রা, জল = মৎস্য, অগ্নি = মদ, বায়ু = মাংস, মৈথুন = ব্যোম। তবে সাধক ভেদে এর প্রভেদ থাকতে পারে। যেটুকু বুঝেছি প্রতীকী অর্থময়তাতে এসব তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় পার্থক্য কেবল দৃষ্টিকোণের এর বেশি কিছুই নয়। বাউলের পঞ্চভূতে পরে আসছি। এই বিধিকল্প যথাযথ সময়েই পেশ করব। যেটা বলেছিলাম বাউলের অর্চনার কথা।
শিহালাই সহজিয়া সেবাশ্রম, যাকে পাঁচ পিড়ির আশ্রমও বলা হয়ে থাকে। কারণ হল সেখানে হরিদাস মহান্ত, তুলসীবাবা, রমেন দাস, চম্পক বালা, বৈদ্যনাথ দাস–এই পাঁচ বাউল সাধকের সমাধি আছে। এই পাঁচটি সমাধি পরে ধূপ দীপ জ্বালতে দেখেছি সন্ধ্যাকালে শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যকে। খ্যাপা মনোহরের বেদনাশা বটমূলে, খ্যাপার সমাধি মন্দিরেও ধূপ-প্রদীপ জ্বালানো হয় সন্ধ্যাবেলাতে।
লক্ষ্মণ দাস বাউলের আখড়াতেও রীতিমত ধূপ-দীপ-খোল-করতালে গোবিন্দের আরাধনা করা হয়ে থাকে। খেপামা, বেলহরি, দেশচাঁদপুর, তিকরবে, দৌমড়াও–এই আখড়াগুলো লোক মুখে শুনেছি প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য বহন করে যথেষ্ট। এখানেও স্বায়ংকর্মে ধূপ-দীপের উপাচার আছে। এসব তো বৈষ্ণবীয় আচারের আখড়ার সন্ধ্যা, চোদ্দ মাদলের সন্ধ্যার নানারূপ ছবিকে মনে করিয়ে দেয়। বেশ প্রাচীন আখড়াগুলোরই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে হালের গুলোর অবস্থা কী? ঘোষপাড়ার বাউল-বাউলানির বাড়িতে / আখড়ায় দেখেছি ঠাকুরের সিংহাসন পাতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে রাধাকৃষ্ণ বিরাজমান। কৃষ্ণা দাসীর বাড়িতে লক্ষ্মীর সিংহাসন আছে। তাঁর লক্ষ্মীবারের ব্রতকথা পাঠও স্বচক্ষে দেখা। তবে এরা কেউই তো আর সাধক বাউল নন। গানকে জীবিকা করে কিছু বাউল-আচরণ সঙ্গে করে এরা জীবন নির্বাহ করছেন মাত্র। মহিলা বাউলরাও তো এখন সেবাদাসী, চরণদাসীর ভূমিকা ছেড়ে কেবল গানকেই সাঙ্গ করেছেন। সাধন সঙ্গীকে ছেড়ে অনেকেই দল গড়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। কৃষ্ণা দাসী তাঁর বাউল সাধনের সঙ্গী নবকুমার দাসের সঙ্গ ছেড়ে সেই কবেই দল গড়ে নিয়েছেন নিজের মতো করে। মুড়াগাছার সুমিত্রা দাসী, কল্যাণী সীমান্তর লক্ষ্মীরানি বিশ্বাস, বীরভূম আহমদপুরের ফুলমালা দাসী এরা সবাই এখন গানকে জীবিকা করে নিয়েছেন। ফুলমালা তো ট্রেনে ট্রেনেও মাধুকরী করে বেড়ান। তবে মাটিয়ারীর মীরা মোহন্ত, নবাসনের নির্মলা মা এখনও পুরনো ধ্যান ধারণা পুষে রাখেন। মেয়েদের হাটে মাঠে গান গেয়ে বেড়ানো তাঁদের কাছে গর্হিত অপরাধ। মেয়েদের আখড়ায় বসে সাধনভজনের কালকে আমরা কিন্তু আজকে পরিস্থিতির চাপে অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছি। বাউল সংস্কৃতিতে মহিলাদের বিদ্রোহী সত্তা, সাধন সঙ্গিনী হয়ে কেবল না-থাকা–এই জেহাদ অনেকাংশেই ওই ফেমিনিজমের নামান্তর। দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা, অপমান, বঞ্চনা, অসম্মান থেকে তাঁরা বেড়িয়ে আসতে চাইছেন। সেই প্রক্রিয়াকরণও অনেকদিনই হল জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে। তাই বাউলের ক্ষেত্রে আচরণ নয়, গানই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে, উঠছে কেবল। ধস নামতে শুরু করে দিয়েছে বাউল সংস্কৃতিতে।
এবার আমরা আচরণে ফিরে যাব কানাই বাউলের গানকে সাঙ্গ করেই। বাউল বলছিলেন অনুরাগের কথা।
বললেন–অনুরাগে সায় মেলে।
জিজ্ঞাসা করলাম–কার সাড়া পেতে চাইছেন?
–কেন গো, নিজের অন্তরের সাড়া। সে সায় দিলেই তো আত্মার জাগৃতি হবে।
তবে বাউলের আত্মার ফর্দ অন্য। উপনিষদের ব্যাখ্যার সঙ্গে তা সচরাচর মিলবে না। সে সবে পরে আসছি। আগে কানাই বাউলের উপলব্ধির আসরে খানিক বসি। একতারা বাজাই।
সদাচারী বাউল বলতে যা বোঝায় কানাই বাউল তাই। মন্ত্র দীক্ষা তিনি নিয়েছিলেন খ্যাপাবাবার কাছে। ওখানেই তাঁর নাড়া বাঁধা। তবে ছেলে-মেয়ে নিয়ে তিনি এখন রীতিমতো সংসারী। মেয়েও গান গায়। জামাই বাউল-আসরে ক্যাসিও বাজায়। ছেলেটাও গাইতে পারে। কানাই বাউলের স্ত্রীকেও আশ্রমে সন্ধ্যাবেলায় সাধনার গান গাইতে দেখেছি। বলা ভালো তাঁর বাউলের সংসার। তাঁকে সদাচারী বলেছি এ কারণেই, কানাই বাউলের সেই শুদ্ধ আচরণ ধর্মকথায় তত্ত্বকথায় আবদ্ধ। বাউল সাধনাকে তিনি বহন করে আসছেন এভাবেই। প্রকৃত সাধকের সন্দর্ভ তাঁর নেই ঠিক কথা কিন্তু হৃদয় ও চৈতন্যের অভিমুখে সর্বদাই তিনি দাঁড়িয়ে অভিসারী ভাবনায়।
বললেন–এ জল তোমার শরীরের জল গো। জলের খেলায় সাধক মাতে। জলের মধ্যেই যে উল্টাস্রোতে নৌকাকে বাইতে হয়।
জানি তিনি যা বলেছেন, বোঝাতে চাইছেন তাঁর আকারগত রূপটি বাউলের কেবল অনুভূতির। গানের প্রতীকী আলোকসম্পাত তিনি জানেন ঠিকই, মরমে উপলব্ধি করতেও পারেন। কিন্তু জীবনের স্বতঃসিদ্ধ ধারায় তা কোনোভাবে আর হয়ে ওঠেনি। তবে শুধু তিনি কেন, এখানকার বাউলরা তো প্রায় সকলেই কেবল গানের শাণিত উচ্চারণের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বাউল যে সাধন কৌশল সেই সারবত্তা আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে। রয়ে যাচ্ছে তাঁর অনূদিত গান। এর কারণগত বিচার-বিশ্লেষণে আমরা কিন্তু বসিনি এখানে। এখানে যেটা বলতে চাইছি বাউল গানের ভেতরে যে মুদিতাক্ষ সৌন্দর্য, শরীরের সেই প্রবক্তাসুলভ আচরণ যা এখন বাউল ধরে রেখেছেন তাঁর তদগত ভাবনায়–সেই শরীরিণী কলাকৈবল্য কীভাবে আমাদের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বা সৃজনশৈলীর মধ্যে ক্রমাগত এক রূপকসর্বস্ব কথকতার জন্ম দিচ্ছে যার মধ্যে আমাদেরই ভাব সংস্কৃতির বিস্তৃত অধ্যায়গুলো সব পড়ে। আমরা এখানে তাকেই কেবল খুলে ধরতে চাইছি। যেটা বলতে চাইছি, বাউল গানের স্বভাব ন্যস্ত অরূপে যে ধরা-ছোঁয়ার অনূদিত শিল্পরূপ তাঁর বিচ্ছুরণ আমরা কেন আমাদের গভীরতর সন্ধিৎসার ভেতর রাখছি না? সেটিকে না রেখে বাউলের সাধনাগত অধ্যায়ের অবক্ষয়জনিত যে ধারাপাত তা নিয়ে ভাবছি। তবে এটাও ঠিক সাধনার প্রক্রিয়াগত যে পুঞ্জ আধার বাউল যদি তা এখন আর জীবনে, যাপনে ধারণ না করেন কেবল গানের আখরগুলোর ভেতর রসাস্বাদনের বস্তুপুঞ্জকে শুধু বিতরণ করেন অনুগত ভক্ত-শিষ্যর মধ্যে তবে সাধন সংস্কৃতির ধারাটি একদিন তত্ত্বধর্মী অগ্নিশিল্পে পরিণত হবে। রূপায়ণ আর হবে না।
কানাই বাউল জলের মণিকোঠায়, মণির ভেতর ছটায় যে ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাওয়া’র কথা বলেছেন সেটিকেই আগে আমরা প্রতিরূপে সাজাই। উল্টা স্রোত হল বিপরীতমুখীতা তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু কীসের এই বিপরীতমুখীতা? এই বিপরীতমুখীতা হল যুগল সাধনার গুরু-শেখানো পদ্ধতি। যে পদ্ধতিতে সাধকের বীর্যের স্থায়িত্ব রক্ষা করার পদ্ধতিটি গুরু নির্দেশিত পথে করানো হয়।
বাউলের আত্মা। উপনিষদে আত্মা কী? কীভাবে দেখানো হয়েছে তাকে? ‘স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ’–তিনিই আমার স্বরূপ। ‘ওঁ আত্মা বাঁ ইদমেক একাগ্র আসীৎ। আত্মা হল আমি নিজেকে এই আমি? আমি হল পঞ্চেন্দ্রিয়ের শরীর–বাক, নাসিকা, চক্ষু, শ্রোত্র ও মন। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই দেহ দ্বারা অধিগত থাকে। এজন্য এদের আধ্যাত্মিক বলা যেতে পারে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় আবার পঞ্চপ্রকৃতি বা পঞ্চভূতের সঙ্গেও যুক্ত। বাক = অগ্নি, নাসিকা = বায়ু, চক্ষু = আদিত্য, শ্রোত্র = দিক, মন = চন্দ্রমা। আত্মাকে আমরা জ্ঞানের ব্যাপ্তি হিসাবেও দেখতে পারি। ভারী সংজ্ঞায় আমরা যাচ্ছি না। আমরা বলছি আত্মা সৰ্ব্বজ্ঞ। আমার এই যে আদান প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত তার ক্রিয়া দু’প্রকারের। স্বরূপ পরিণাম আর বিরূপ পরিণাম। স্বরূপ পরিণাম কী? আপনার বাঁ নিজের সত্ত্বকে সত্ত্বরূপে, রজকে রজরূপে, তমকে তমরূপে অবস্থান করানো। এগুলো সবই হল ব্যক্তিসত্ত্বার আবরণ। যা নিজের স্বরূপকে বিস্মৃত করিয়ে রাখে। সত্ত্ব হল নিজের প্রকৃতি, স্বভাব, মন–এই তিনটি গুণকে ঠিকভাবে চিনে নেওয়া। রজ হল দর্শনজনিত গুণ আর তম তামসিক গুণ বা অজ্ঞানতাকে দূর করা। আবরণ তিনটি। যা নিজস্ব স্বরূপকে বিস্মৃত করে দেয়। মোহ-দরজা বন্ধ করে দেয়। সাধক এই তিন আবরণ খসিয়ে ফেলে। প্রথম আবরণ তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) যার কথা এতক্ষণ বললাম। দ্বিতীয় আবরণ ছয়টি স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিক্ত, ঝাল, কষা)। তৃতীয় আবরণ পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম)। তিন গুণ আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। পঞ্চভূত আমাদের দৈহিক গঠনকে ঠিক রাখে। ছয় স্বাদ আমাদের দেহের রাসায়নিক অবস্থাকে ঠিক করে দেয়। এভাবেই আমাদের মন ও দেহ এক সুতোয় বাঁধা পড়ে। তার সঙ্গে দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়) যুক্ত হয়ে কুণ্ডলিনী শক্তির উপর চব্বিশটি আবরণ সৃষ্টি করে। কুণ্ডলিনী হল চৈতন্যস্বরূপ। শক্তিরূপবলে শাস্ত্র তাকে চৈতন্যস্বরূপা করে নারীর অভিজ্ঞান দিয়েছে। এই কুণ্ডলিনী বাঁ চৈতন্যস্বরূপ / স্বরূপা যাই বলি না কেন তা যদি নিজের স্বচ্ছ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে তবেই গণ্ডগোল লাগে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে যায়। আর দৃষ্টি যদি সে অর্জন করে ফেলে তবে ব্যক্তিসত্ত্বা বাঁ আমিরই সব রকমভাবে জাগরণ ঘটে। আমরা স্বরূপ পরিণাম বুঝলাম। অরূপ পরিণামও একে বলতে পারি। আর বিরূপ পরিণাম কী? পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ আর সেই সময়ে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। পুরুষ হল আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা ধরছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলেই এক সংযোগ। যে যোগে প্রাণের সৃষ্টি হয়। বাউলের আত্মাও এই দেহগত প্রাণকে ঘিরে। কিন্তু তার অবস্থান বস্তুগত। কী এই বস্তু যা বাউলের আত্মাতে সামিল। দুদ্দু শাহর একটি গান আছে, তাতে বলা হয়েছে: বস্তুকেই আত্মা বলা হয়। আত্মা কোন অলৌকিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এতে স্পষ্ট হল না। আরেকটি গানে দুদ্দু বলেছেন: ‘যে বস্তু জীবনের কারণ/ তাই বাউল করে সাধন।‘ এই বস্তু শরীরের রজ-বীর্য। সাধক বাউল নিজেদের শরীরের অন্তঃস্থিত পদার্থকে সংরক্ষণ করেন। কানাই বাউলরা কেবল গানের তত্ত্বকথাকেই ব্যক্ত করেন ধর্ম কথায়। পালন করেন তা কেবল সাধক বাউলরা। তার সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। আরও একটি গানে দুদ্দু মেয়ের চরণ ধরেই সাধনার কথা জানিয়েছেন: ‘সাধন করো রে মন ধরে মেয়ের চরণ। বলেছেন–’পিতা শুধু বীর্যদাতা/ পালন ধারণ কর্তী মাতা/ সে বিনে মিছে কথা সাধন ভজন/ আগে মেয়ে রাজী হবে/ ভজনের রাহা পাবে/ কেশ ধরে পাড়ে নেবে দুদ্দুর বচন।‘
মনোহর খ্যাপার গানটিতে ‘জলের দরজায় জলের চাবি খুলা’ বলতে ইঙ্গিত করা হয়েছে সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনকেই। আর এই তিন দিনই সাধক বাউলকে ‘উল্টা স্রোতে নৌকা বাইতে হয়। বাউলরা বিশ্বাস করেন, মানেন শরীরের ভেতরই পরমেশ্বরের সিংহাসন পাতা। তাঁকে লাভ করাই সাধক জীবনের মোক্ষ। কীভাবে তা সম্ভব? গুরুর শেখানো দম ও শ্বাসের কাজে–হঠযোগে, কুম্ভকে, পূরকে, রেচকে বীর্যের নিম্নগতিকে তাঁরা রুদ্ধ করে দেন। ওপরে উঠিয়ে দিতে তাঁরা পারেন। বীর্য নারীর যোনিতে রমণের পর চিহ্নস্বরূপ লেগে থাকবে না। রীতিমত সেখানে যোনি পরীক্ষার নিয়ম। দুটো শব্দ বাউল ব্যবহার করেন। বিন্দুধারণ’ আর ‘বিন্দুপতন। তার মানে হল বীর্যের গতিবেগকে ওপরে উঠিয়ে নাওয়া হল বিন্দুধারণ। পতন হল বাউল বলেন–’যোনিতে পতন।‘ মানে রমণে বীর্যপাত হয়ে যাওয়া। এই মিলন হয় সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন। বাউল বলেন এই এর উৎকৃষ্ট সময়। এই তিন দিন তাঁরা কামকে এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ স্তরে, তাঁদের মতে প্রেমে রূপান্তরিত করেন। মেয়েদের রজঃপ্রবাহের তিন তিনটে দিন বাউলের ভাষায় ‘মহাযোগের সময়’। ঠিকঠাক উত্তীর্ণতায় বাউল সিদ্ধ স্তরে। পৌঁছান। তাঁরা বলেন নারী শরীরের মধ্যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্ম আছে। সে সব জেনে বুঝে তারপর হবে ‘জেন্তে মরা’ ‘জেন্তে মরা’ হল কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া।
আমাদের প্রশ্ন, নারী শরীরের মধ্যে যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্মের কথা বাউল বলেন তা শুধু নারী শরীর কেন পুরুষ তথা মানব শরীরেও বর্তমান। তবে বাউল সাধক শুধু নারী শরীরে থাকবার কথা বলছেন কেন? শরীরের নটা চক্রে এই সব পদ্মরূপের কল্পনা করা হয়েছে। কারণ হল পদ্ম কাদায়, পাঁকে জন্মায় কিন্তু নিজে সে পঙ্কিল হয় না। কাদার উপরে সুন্দর ফুল হিসাবে ফুটে থাকে। রামকৃষ্ণদেব আমাদের সংসারে পাঁকাল মাছের মতো থাকবার কথা বলেছেন। পাঁকাল মাছও পাঁকে জন্মায় অথচ গায়ে পাঁক থাকে না। এই কাদা বা পাঁক হল প্রতীকী অর্থে মায়া। এই মায়াকে ভেদ করে পদ্মফুল ফুটছে। পদু সূর্যের আলো পেলেই তার পাপড়ি খোলে। তেমনই আমাদের শরীরের পদ্মগুলো তাঁদের দল খোলে কুণ্ডলিনী শক্তি জেগে উঠলে। সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি পদ্মের উপর জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তবে দেখা যাবে পাপড়িগুলো সব মুড়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন মানুষকে হতে হবে এই জলের উপরে ফোটা পদ্মের মতো পদ্মের পাপড়ি যেমন গায়ে জল পড়লে গুটিয়ে যায় তেমনই ইন্দ্রিয়ের আচরণগুলোও বদ্ধ হয়ে যেতে পারে বিরূপ আচরণে। যার জন্যই যোগক্রিয়ায়, সংযমে তাকে জাগিয়ে রাখতে বলছেন সাধক। যোগীতন্ত্রগুলো আমাদের সেই পথেই নির্দেশিত করেছে বারবার। যোগীগুরু, তন্ত্রসাধকরা এই সব পদ্মে ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। মানে শরীর ক্রিয়ায় শরীরকে জাগান। উপাসনা করেন। তন্ত্র সাধনাতেও সঙ্গিনী অনিবার্য। ভৈরবের ভৈরবী অবশ্যই দরকার। তবে তাঁরা রমণের পূর্বে যোনি পূজা, বুক, ললাট, কণ্ঠ, লিঙ্গ ইত্যাদি প্রত্যঙ্গর পূজা সারেন। বাউল তা করেন না। তবে তাঁদের মতও তান্ত্রিক ক্রিয়াকর্মেরও মত সেই কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া। আমাদের প্রশ্ন, যে কোনো মিলনই, নারী-পুরুষের একত্র সম্ভোগই তো আনন্দের, উপভোগের শুধু লোকায়ত সাধনার মিলনে করণকৌশল যেটা তা হল যোনিতে বীর্যপাত ঠেকানো। বস্তুরক্ষা। বাউল নারীর শরীরে এই পদ্ম, ওই পদ্ম বলে সাধন সঙ্গিনীকে মনে হয় উচ্চাসনই দিতে চান। কিন্তু এটা তো ঠিক লালন ফকির, চণ্ডীদাস গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, পদ্মলোচন, দুদ্দু শাহ প্রভৃতি পদকর্তারা তাঁদের সব ক্রিয়াকরণের গানে নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছেন সে সম্মান বাস্তবে নারীর বা সাধন। সঙ্গিনীর এখন নেই। তার কারণ অবশ্যই পুরুষের, সঙ্গীর, সাধকের ব্যভিচার। না হলে আমাদের লোকায়ত সাধন আধার কিন্তু নারীকে যোগ্য আসনই দিয়েছিল। কী তন্ত্র, কী বৈষ্ণব, কী বাউল সাধনে। বাউল, সঙ্গিনীটিকে ‘রাধারানি’, ‘মনের মানুষী’ ইত্যাদি বিশেষণের মালা পরান ঠিকই যেমন তন্ত্রে ভৈরব সঙ্গিনীকে, ভৈরবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এই বিশেষণ, সম্বোধন, মান্যতা, যথাযোগ্য প্রাপ্য স্বীকৃতি সব ছিল এখনকার কারও রচনা নয়। বেশির ভাগটাই সাধক পদকর্তাদের।
খ্যাপা বলেছেন–’সপ্ততালায় নব জলের খেলা, জলের মানুষ হৃদে ভৃগুপদ ধরে।‘ সপ্তপ্তালা কী? আমরা বলব এ হল শরীরের প্রবেশ দ্বারের বা ভেতরের অংশবিশেষ। আমাদের শরীর শুক্র, শোণিত, মজ্জা, মেদ, মাংস, অস্থি ও ত্বক–এই সাতটি উপাদান দিয়ে তৈরি। যাকে সপ্তধাতুও বলা হয়ে থাকে। বাউল বলেছেন–’সপ্ততালা। অর্থাৎ সমগ্র শরীরে এই জলের খেলা চলছে। সাতটি উপাদানের শুক্রকে বাউল সাধক উর্ধ্বগতিতে নিয়ে যাচ্ছেন কেবল। শুধু বাউল সাধক কেন, তন্ত্র সাধকরাও এই বিধিকর্ম মানেন। পালন করেন। তান্ত্রিকরা বলেন তন্ত্র মন্ত্রমূলক নয়, ক্রিয়ামূলক। মন্ত্রের গুরুত্ব যা কেবল তন্ত্রে তা ক্রিয়াকরণের জন্যই। আমরা বলব বাউলও ক্রিয়ামূলক। মন্ত্রের গুরুত্ব যা কেবল তন্ত্রে তা ক্রিয়াকরণের জন্যই। তার মন্ত্র গানগুলোই। যেগুলো সব ক্রিয়াকর্মের আধারেই বিরচিত। এটা তো ঠিক ‘বাউল গান নয় কোনো’। ‘বাউল’ প্রকৃতপক্ষে দেহবাদী এক সাধনা। গান। তার উপাচার মাত্র। এর বেশি কিছুই নয়। বর্তমানে পরিবেশ পরিস্থিতিতে গানই মুখ্য হয়ে গেছে এই যা। বাউল বলছেন সমগ্র শরীরেই জলের খেলা চলছে। সাতটি উপাদানের শুক্রকে সাধক উধ্বগতিতে নিয়ে যাচ্ছেন কেবল। যাকে ‘সপ্ততালা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই শুক্র ঊর্ধ্বগতিতে উঠে গেলে, বিন্দুধারণ হলে, যোনিতে পতন না। ঘটলেই সাধকের সিদ্ধ স্তর। জলের মানুষ অর্থাৎ বস্তু বা বীর্যরক্ষাকারী মানুষ ‘ভৃগুপদ’লাভ করেন বা করবেন। সাধক সিদ্ধ স্তরে বিচরণ করবেন। ‘হৃদে ভৃগুপদ ধরে’র অর্থ হল হৃদয়ে পর্বতের উচ্চস্থান ধরে রাখা। মানে সাধনায় নির্বিকল্প লাভ করা।
শাস্ত্রে বলছে–’ন তপস্তপ ইত্যাহুর্ব্রহ্মচর্য্যঃ তপোত্তমম্। / উৰ্দ্ধরেতা ভবেদ্ যস্তু স দেবো ন তু মানুসঃ।।‘ ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ বীর্যধারণই সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট তপস্যা। যে ব্যক্তি এই তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে উৰ্দ্ধরেতা হয়েছেন, তিনিই মানুষ নামের প্রকৃত দেবতা। বাউল যাকে ‘বিন্দুধারণ’ বলেছেন। যোগও তাই বলছে–’যোগিনস্তস্য সিদ্ধিঃ স্যাৎ সততং বিন্দুধারণাৎ। সব সময় বিন্দুধারণ করলে যোগীগনের সিদ্ধিলাভ হয়। বীর্য সঞ্চিত হলে মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি সঞ্চিত হয়–এই মহতী শক্তির বলে একাগ্রতা সাধন সম্ভবপর হয়। সন্ন্যাসীর মূলমন্ত্র আসক্তিমোচন। তাই নারী আসক্তি তার থাকবে না একেবারে। সেখানের। দেহসাধনা একক ক্রিয়াকরণের। লোকায়ত দেহসাধনার মতো কখনও যুগলের নয়। লোকায়ত সাধকরা সম্ভোগ সুখ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না কিন্তু কখনও। শুধু ‘বিন্দুধারণ’ পদ্ধতিটিকে রপ্ত করেছেন। নারী আসক্তি তাঁদের রয়েছেই। যুগল সাধনার সৃষ্টিকল্পে আমাদের তাই মনে হয় বেশ বুঝেশুনে পরিকল্পিতরূপে এই ক্রিয়াকরণকে ভাবা হয়েছে। তবে এর পেছনে কারণ আছে। চর্যাপদের সময়কেই যদি আমরা মান্য দেহসাধনার নিদর্শন রূপে সামনে এনে দেখি, তবে দেখব সিদ্ধাচার্যরা সবাই কিন্তু গৃহী। বাউলরাও গৃহী। তাঁদের গৃহ হয়তো আখড়া অভিধার। তান্ত্রিকদের বরং সেই অর্থে গৃহ নেই। তবে এদেরও তো এখন ডেরা আছে। বাউল দেহসাধনা আখড়ায় সম্পন্ন হয়। তান্ত্রিক শরীরসাধনা। অমাবস্যাতে হয়। শ্মশানে ভৈরবীচক্র বসে। সন্ন্যাসীরা যুগলতত্ত্বের ধারেপাশে যান না। ত্যাগই তাঁদের প্রধান কর্ম। তাঁদের মতে ত্যাগের সাধনা না করলে ব্ৰহ্মচিন্তা নিস্ফল। কামিনী কাঞ্চন তাই সেখানে একেবারে নিষেধ। বিন্দুধারণ’ সেখানে কেবল বীর্যকে শুক্রকে উধ্বগমনে নিয়ে গিয়ে অতল আনন্দ লাভ করা।
বাউল ‘জলের জানলায় জলের খেলা’র কথা বলেছেন। বলেছেন–’ওই জলের কল ঘর্ষনেতে, হর ব্রহ্মা বিষ্ণু হলেও মরে।‘ দেহতাদের মরার কথা কেন? তাঁদের অমরত্বে আমরা তো বিশ্বাসী। কিন্তু বাউল তো আর দেবতা বিশ্বাস করেন না। তাই হর ব্রহ্মা বিষ্ণু তাঁদের কাছে শক্তিধর মানুষ। আসলে তো তাই-ই। শিবত্ব প্রাপ্তি কী? তা তো ওই শক্তিরই বিকাশ শরীরের ধৌতকণায়। তাই বাউল বলছেন হর ব্রহ্মা বিষ্ণুও যদি বিন্দুধারণ করতে না পারেন, বীর্যকে নিম্নগতি দিয়ে ফেলেন তবে তারাও পথভ্রষ্ট হবেন। সিদ্ধি আসবে না তাঁদের। যা মরারই নামান্তর। বলা হয়েছে–’জল চিনিলে ছাড়বে যমের জ্বালা’। ‘যম’ কী? যম হল যোগের আটটি অঙ্গের একটি রূপ। ‘যমশ্চ নিয়মশ্চৈব আসনঞ্চ তথৈব চ / প্রাণায়ামস্তথা গার্গি প্রত্যাহারশ্চ ধারণা/ ধ্যানং সমাধিরেনি যোগাঙ্গানি বরাননে।।‘ অর্থাৎ যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি–এই আটটি হল যোগের অঙ্গ যোগসাধন করতে হলে, স্বরূপ জ্ঞান লাভ করতে হলে, নিজেকে, আমিকে, আত্মাকে উপলব্ধ করতে হলে এই অষ্টযোগের অভ্যাস বিশেষ প্রয়োজনীয়। অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ এগুলোকে যম বলে। যখন মনের মধ্যে কোনো রূপ হিংসার ছায়া আসবে না। পরের দ্রব্য নেবার ইচ্ছা যখন চলে যাবে তখনই অস্তেয় সাধন হবে। শাস্ত্রে তো বীর্যধারণকে ব্রহ্মচর্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে সম্পর্কে তো আগেই বলেছি। অপরিগ্রহ হল অতিরিক্ত ভোগত্যাগ। খ্যাপা মনোহর এই গানে যমের জ্বালা ছেড়ে যাওয়া বলতে যোগের এই প্রথম ক্রিয়াকর্ম বলে সাধকের উদ্দীপিত ধ্রুপদী প্রতিসরণকেই দেখাতে চেয়েছেন। যে প্রতিসরণে অনুগত ছাড়া সিদ্ধি আসে না। এই অনুগত ভাব আসে জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য দ্বারা। এই অনুগত ভাব অর্জনে গুরুর সহায়তা অবশ্যই প্রয়োজন। সেই সহায়তাতেই ‘জলের এক বিন্দুতে শতকোটি ব্রহ্মাণ্ড সঞ্চারে’–অর্থাৎ বিন্দুধারণে শরীর হয়ে উঠেছে ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ। জলের এই ব্রহ্মাণ্ড প্রাপ্তিতে মানে সাধকের সিদ্ধ দশাতে ‘জলের পর্বতে জলের অরণ্য, জলের বৃক্ষে জলের লতা ধন্য হয়ে যাচ্ছে। যুগল মিলনের শরীরে চরমত্ব প্রাপ্তি ঘটছে। যার জন্যই ‘জলের ফুলে ভৃঙ্গরূপে, শ্যাম চরান হংস জলের সরোবরে।‘ ‘ভূঙ্গ’ হল ভ্রমর। বিন্দুধারণে সাধক শরীরে, যুগল শরীরে সিদ্ধির ভ্রমর গুনগুন করে যাচ্ছে আর জলের সেই সরোবরে শ্যাম হংস চরাচ্ছেন। হংস চরানো হল সম্ভোগ করছেন সাধক। সরোবর হল গিয়ে যোনি। রজঃপ্রবাহে সাধক বাউল সম্ভোগ অবস্থাতে বীর্যকে ঠেলে উপরে উঠিয়ে দিচ্ছেন। তিনি শ্যামরূপ হয়ে উঠছেন। ‘শ্যাম’ এখানে প্রেমের দ্যোতক। কামকে রূপান্তরিত করে নিচ্ছেন তিনি প্রেমে। এই শ্যামরূপ জলে ‘সত্বঃ রজঃ তমঃ তিন হয়।‘ মানে হল এই ত্রিবিধ গুণ আয়ত্তের ফলে ‘তিন’ অর্থাৎ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না এই তিন নাড়ি শরীরের আজ্ঞাচক্রের উপরে মিলিত হচ্ছে। যে স্থানে তা হয় তাঁকে বলা হয় ত্রিকূট। বাউল বলেন ‘ত্রিবেণী’। এই মিলনে ‘মূঢ় কামিনী কয়, অবিশ্বাসে নয়, গুরুর চরণ যে জল দৃঢ় করে।‘ সেই-ই এর প্রতিরূপ চিনতে পারে। মানে নিজেকে সিদ্ধ স্তরে নিয়ে যেতে পারে। বাউল গুরুর অনুগত হয়ে সেই পথেই যেতে চান। ‘মূঢ় কামিণী’ হল মোহাবিষ্ট জন, অজ্ঞানতার ফুল। কামিনী এখানে স্ত্রী দ্যোতক নয়। ফুলটি হল সেই শরীরের চক্রকলার চিহ্নিত প্রতীক। এই প্রতীকে ধ্যানে, যোগে তাঁকে চেনা যাবে। তিনি হলেন ‘দেহব্রহ্মাণ্ড।‘ অবিশ্বাসে তা হবে না। হবে গুরুর প্রদর্শিত পদে যে। পথ যথার্থ বাউলের পথে। খ্যাপা তাকেই নির্দেশিত করছেন গানে।
এবার যে গানটির কথা বলব তা শুনেছিলাম কেঁদুলির খ্যাপা বাবার আখড়ায়। তরুণ এক অচেনা বাউল গাইছিলেন সে গান। হাতে একতারা। সুদর্শন। গায়কিতেও ফুলের। রঙ লেগেছে যেন। কণ্ঠ থেকে ফুলেরই শোভা ঝরে পড়ছে।
এক বঁকে তিন ফুল ফুটেছে, লাল, নীল পীত জরদ সাদা,
এক ফুলে সুরসিক বসে, আর এক ফুলে রয় রাধা।
আ মরি কি ফুলের লীলা, ফুলের মাঝে নন্দলালা
ভাঁড় ভেঙে ননী খায় দু’বেলা, বাঁশী বাজায় রাধা রাধা।
সে ফুল আছে থির পবনে, রসিকে তার সন্ধান জানে,
বায়ু বরুণ নাই যেখানে, ফুলেই খায় ফলের মাথা।।
দীন খ্যাপা কয় ফুলের লাগি, কতজন হল বিরাগী,
কেউ বা হল দেশত্যাগী, কেউ পেলরে ফুলের সুধা।
এখন ‘এক বঁকে’ মানে হল গিয়ে নারীর যোনি। সেই বাউল অবশ্য আমাকে বেশ শুদ্ধ ভাষাতেই ‘এক বঁকে’র মানে বুঝিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এক বঁকে হল গিয়ে স্ত্রী জননাঙ্গ–বলেই আমাকে বলেছিলেন, এত আগ্রহ আপনার, আপাদের গুরুর আশ্রমে আসুন, সঙ্গ করুন সব জেনে-বুঝে যাবেন, এসব জানতে তো সাধুগুরুর সঙ্গ করতে হয়।
বললাম, খ্যাপা বাবার আশ্রম থেকে আপনি দীক্ষিত নন?
বললেন, না। এখানে তো কেবল মন্ত্রদীক্ষা দেওয়া হয়। তা আমার হয়েছে খ্যাপার আশ্রমেই। উনি তো নেই, দেহ রেখেছেন। ওর ছেলের কাছেই মন্ত্রদীক্ষা হয়েছিল আমার। এখানে নয়, রাধাকুঞ্জ আশ্রমে। তা শিক্ষাদীক্ষার পাঠ নেব ভাবছি।
জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় আপনার গুরুর আশ্রম?
বললেন, শিহালাই, এই বীরভূমেই। পাঁচ পিড়ির আশ্রমের নাম শোনেননি? ওখানেই এখন থাকি। শিবশঙ্কর দাস বৈরাগ্যের কাছে নাড়া বেঁধেছি।
ভাবলাম, শিক্ষাদীক্ষার পাঠ ছাড়াই এরা কীরকম গানের ভেতরকার তত্ত্বকথা, শরীর কথার পাঠ নিয়ে ফেলেছেন। কোনোদিনই কি সম্পন্ন হবে ওর শিক্ষাদীক্ষার পাঠ। শিবশঙ্কর দাস তো এখন প্রধানত গানজীবি। বউ-মেয়ে আছে। মেয়েটাও ক্লাস সেভেনে পড়ে তিনি শিক্ষাদীক্ষা দেন কী?
এ গানের মূল কথা, কায়া সাধন; এই বাউলও গড়ে নিয়েছেন ভাবসাধনে। যার বলেই তিনি আমাকে বোঝাতে চাইছেন। আকৃষ্ট করতে চাইছেন। সেই জন্যই তো গুরুর আশ্রমে যেতে বলছেন। অনুসন্ধিৎসু লোকজনকে যদি ভক্ত-শিষ্যরা গুরুর দরবারে নিয়ে যেতে পারেন তবেই তো গুরু তার প্রতি সদয় হবেন। মিলবে অনুষ্ঠানে তার গান গাইবার ছাড়পত্র, গুরু গাইবার আগেই। এই জন্যই তো এই বাউল পিছন ছাড়ছেন না আমার।
খ্যাপার এই গানের প্রথম শব্দ দুটোর প্রতীকী রহস্য ভেদ করে নিয়েছি আমরা। তা নারীর যোনিতে কীভাবে ফুটছে এই তিনরঙা ফুল? অনেক বাউলকে নারীর যোনিকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ও বলতে শুনেছি। বৃন্দাবনে যেমন রাধার রসধারা ঝরে, তেমনি নারীর যোনিতে রজঃপ্রবাহ ঘটে।
-তিন দিনের এই স্রোতধারা গো। তিন দিনে তিন রঙ ধরে। লাল হয় প্রথম দিন, দ্বিতীয়তে নীল, তৃতীয় দিনে সাদা রঙ তার।
অনেকে আবার চার রঙের কথাও বলেন। তিনদিন হল রজঃপ্রবাহের সূচনা দিন থেকে নিবৃত্তির দিন। প্রতিমাসেই এদিন, তিনদিন ঘুরে ফিরে আসে। এজন্য প্রচলিত এক কথাও আছে ‘মাসিক’। এ নিয়ে কমল দাসের একখানা গানও আছে–’মেয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী/ মাসে মাসে জোয়ার আসে ত্রিবেণী সংহতি। / যখন নদী হয় উথলা তিনজন মেয়ের লীলাখেলা/ একজন কালা একজন ধলা একজনা লালমতী।‘
দেহসাধক নারীর রজঃপ্রবাহের তিন দিনের ‘মহাযোগ’ এ শরীর যুগলের মিলনকে মনে করে থাকেন রাধাকৃষ্ণের যুগলতত্ত্ব। ত্রিগুণময়ী রাধা সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যার বিবৃতি আমরা ‘কথামৃত’তে পাই ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৫ তারিখে শ্যামপুকুর বাটির কথোপকথনে–’বৈষ্ণবশাস্ত্রে আছে কামরাধা, প্রেমরাধা, নিত্যরাধা। কামরাধা চন্দ্রাবলী। প্রেমরাধা বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। নিত্যরাধা নন্দঘোষ দেখেছিলেন গোপাল কোলে। … নিত্যরাধার স্বরূপ–যেখানে নেতি নেতি বিচার বন্ধ হয়ে যায়। নিত্য রাধাকৃষ্ণ, আর লীলা রাধাকৃষ্ণ। যেমন সূর্য আর রশ্মি। নিত্য সূর্যের স্বরূপ, লীলা রশ্মির স্বরূপ।‘
ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব যেটা বলতে চেয়েছেন তা হল শ্রীরাধাতত্ত্ব তিনটি স্তরের। চন্দ্রাবলী হলেন আমাদের কামনা-বাসনা, মান-অভিমানের প্রতীকী রূপ। কামধারা তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী। চন্দ্রাবলীকে কৃষ্ণের সখি না ধরে জ্যোৎস্নারূপও ধরে নিতে পারি। এই রূপ তেজস্ক্রিয়াকে পরিহার করছে। সূর্যের আলোর পরক্ষতা রয়েছে চাঁদের মধ্যে। চাঁদ সূর্যের আলোতে আলোকিত হয়েও কমনীয়তা বজায় রেখেছে। চাঁদ বাঁ চন্দ্রাবলী তাই প্রেমসংগ্রামের রূপ। সূর্যকে এখানে কাম হিসাবে ধরছি। কাম প্রেমে রূপান্তরিত হচ্ছে যেন। প্রেমরাধা কী? প্রেমরাধা হল নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক। যার কোনো চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, কেবল সমর্পণ আছে। চৈতন্য তো সেই ভাবরসেই কৃষ্ণের উপাসনা করেছিলেন।
চৈতন্য মঠের সদানন্দ বাবাজি একবার আমায় বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ। আমরা তার ভক্তরা স্ত্রী-স্বরূপা হয়েই তাঁকে ডাকছি,প্রেমরূপে সব সমর্পণ করছি।
জিজ্ঞেস করেছিলাম, শ্রীকৃষ্ণকে একমাত্র পুরুষ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন আপনি?
ফিক করে হাসলেন বাবাজি। অল্প দাড়ির গালে হাত বুলোলেন। বললেন, শ্রীকৃষ্ণ আমাদের পরমাত্মা। হৃদয়ের সচ্চিদানন্দ ঘন আনন্দও ধরতে পারে। এই আনন্দ পুরুষরূপ। তার বিকাশ, প্রকাশ, নারীরূপ। তাই তো মহাপ্রভু নারীরূপ ধরে সেই আনন্দকেই পেতে চেয়েছিলেন।
ঠাকুর বলেছিলেন ‘নিত্যরাধা নন্দঘোষ দেখেছিলেন গোপাল কোলে।‘ যেটা মনে হয় ঠাকুর এখানে ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের’কাহিনীতে আলো ফেলতে চেয়েছিলেন। সেখানেই আছে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আবহাওয়া অনুকূল, এর ভেতরেই নন্দের অনুরোধে যুবতী রাধা শিশু কৃষ্ণকে কোলে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। যেটা মনে হয় নিত্যরাধা বলতে রামকৃষ্ণদেব আসলে নিত্যস্বরূপা পরমা প্রকৃতির কথাই বলতে চেয়েছেন। সাধক নিত্যস্বরূপা পরমা প্রকৃতি বলতে কিন্তু কুণ্ডলিনীযোগকেই বোঝেন। এই যোগেই শরীরের। জানলা-দরজা সব খুলে যায়। শরীরে চৈতন্যের আলো প্রবেশ করে। চৈতন্য হল গিয়ে ‘সচ্চিদানন্দ’। সৎ + চিৎ + আনন্দ। জগৎ সৃষ্টির মূলে তিনটি অবস্থা বর্তমান। সৎ হল অপরিচ্ছন্ন জ্যোতি। সৃষ্টির আদি প্লাজমাও আমরা বলতেই পারি। চিৎ হল হৃদয়ের স্বচ্ছতা। আনন্দ হল পরমশূন্যতা। আবার আরেকভাবেও আমরা ভাবতেই পারি ‘সচ্চিদানন্দ’কে উল্টো দিক থেকে সাজিয়ে নিলে। আনন্দকে অপরিচ্ছন্ন জ্যোতি ধরতেই পারি, সৃষ্টির আদি প্লাজমা হল এটাই। পণ্ডিচেরি বসবাসের কালক্ষেপ সম্পর্কে শ্রীমা একবার বলেছিলেন–’হৃদয়ে যেন আনন্দের পূর্ণঘট বসানো থাকত সর্বদা। একটু এদিক ওদিক হলেই, উছলে পড়বে।‘ এই আনন্দই সৃষ্টিদ্যোতক। দুঃখের একপ্রকার আনন্দ থাকে। তাঁকে চিনতে জানতে-বুঝতে হবে। তবেই না সৃষ্টিক্রিয়ার নকশা বুনতে সুবিধা হবে। চিৎ এবার ধরছি ইদম ব্যতিত অহম বোধ। অর্থাৎ নিজের অহংকারকে বাদ রেখে, সরিয়ে রেখে জাগতিক উৎসের অহংকারকে সাথে রাখতে চাইছি। সৎকে ধরছি পরম শূন্যতা হিসাবে (supervoid))
বাবাজি আমায় বলেছিলেন, ভগবান, শ্রীকৃষ্ণ, লীলা করবার জন্যই দুটো হয়েছেন গো। তাই তো রাধাকৃষ্ণ লীলা। কৃষ্ণের অঙ্গ থেকেই রাধা বেরিয়েছেন।
–মানে আপনি বলতে চাইছেন আমাদের শরীরেরই দুটো রূপ।
–হ্যাঁ গো বাবা, ঠিক তাই।
আমার তখন মনে পড়ছে অর্ধনারীশ্বরের কথা।
বললেন, যা কিছু, যত কিছু তুমি দেখছ সবই পুরুষ প্রকৃতি যোগ।
বাউলও এ কথা বলে থাকেন। সনাতন খ্যাপাকে ঘোষপাড়ায় মেলায় ভক্ত শিষ্যদের বলতে শুনেছিলাম। ওকে ঘাটাসনি তোরা। ও যে স্বয়ং প্রকৃতি।
তন্ত্রসাধক খ্যাপা ব্রহ্মানন্দর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা চলার পর বলেছিলেন, প্রকৃতিরে কিছু জিজ্ঞাসা করবা না। প্রকৃতিরে আগে তুষ্ট কর। তিনি রুষ্ট হলি….
তখন দেখছি মানদা ভৈরবী স্থির হয়ে বসে জপে মগ্ন। ধ্যান ভাঙলে পর কথা প্রসঙ্গে বললেন,পুরুষের যোগে প্রকৃতি সব কাজ করছেন। দু’জনকে ছাড়া দু’জন অচল পয়সা। ফুটো কড়ি। শিবের উপর কালী কী?
–কী?
–পুরুষকে সংহার করছেন প্রকৃতি। প্রকৃতি জাগছেন। আওয়াজ তুলছেন।
আর রাধাকৃষ্ণ? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
ভৈরবী মা খ্যাপার দিকে একবার ফিরে বললেন, এ যে প্রেমে মজেছে গো। রাধাকৃষ্ণ হল গিয়ে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়। সংহার নেই। প্রেমের ঝাঁকুনি আছে কেবল। যা তোমার লেগেছে গো–বলেই হাসলেন ভৈরবী। তার হাসির বিকট শব্দে একাকার হয়ে গেল যেন সব–পুরুষ ও প্রকৃতি।
খ্যাপার গানে রয়েছে ‘এক বঁকে তিন ফুল ফুটেছে, লাল, নীল, পীত জরদ সাদা / এক ফুলে সুরসিক বসে, আর এক ফুলে রয় রাধা।‘ ফুল যে রজঃস্রাব তা এতক্ষণে আমরা বুঝে গেছি। ‘এক ফুলে সুরসিক বসে আছেন–সাধক মিলনে ব্যাপৃত আছেন। আর এক ফুলে রাধা’ আছেন–পরমা প্রকৃতি, সঙ্গিনী, রাধাস্বরূপিনী সেই নারী দেহ, যে দেহের রূপ-উপমায় সাধক বলছেন–’আর মরি কি ফুলের লীলা’। এই লীলারূপে অংশ নিচ্ছেন তো স্বয়ং সাধক। যার জন্যই ‘ফুলের মাঝে নন্দলালা’। যিনি ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন আর বাঁশি বাজিয়ে বলছেন–’রাধা রাধা’ বাঁশি হল গিয়ে নারী দেহ। ‘ভাঁড়’ ভাঙা হল যোনির ভেতর প্রবেশ। সাধনলিঙ্গ যোনির মধ্যে অবস্থান করছে। সাধক। ‘ভাঁড় ভেঙে ননী’ খাচ্ছেন। ননী’ হল কামকে প্রেমরূপে আস্বাদন করে নেওয়া। রাধা এখানে রামকৃষ্ণদেবের সেই ‘কামরাধা’ থেকে ‘প্রেমরাধা’তে পরিণত হচ্ছেন। খ্যাপা বলছেন–’সে ফুল আছে থির পবনে, রসিকে তার সন্ধান জানে, / বায়ু বরুণ নাই যেখানে, ফুলেই খায় ফলের মাথা।।‘
ফল কী? ফল হল দেহপ্রকৃতির নিয়ম। যে নিয়মে সন্তান হয় কিন্তু এখানে ফল হল গিয়ে সাধকের অন্বিষ্ট সেই রজঃপ্রবাহ। যাকে বশে এনে সাধক সেই সিদ্ধ স্তরে যেতে চাইছেন। যে স্তরে যাওয়ার আকুতি গানেতেই ধরা আছে–’দীন ক্ষ্যাপা কয় ফুলের লাগি, কতজন হল বিরাগী, কেউ বা হ’ল দেশত্যাগী, কেউ পেল রে ফুলের সুধা।।‘
‘দেশত্যাগী’ হওয়ার অর্থ হল সাধন-ভজন ছেড়ে দেওয়া। কারণ গুরু নির্দেশিত শ্বাস আর দমের কাজে যে বীর্যকে উধ্বগতি কিছুতেই দিতে পারেনি। এক বঁকে বা নারীর যোনিতে রজঃবীজে তা মিশে গেছে। সেজন্যই অকৃতকার্য হয়ে ‘দেশত্যাগী’ হওয়া। আর যিনি রজঃস্রোতের ভেতর ‘উল্টা স্রোতে’ নৌকা বাইতে পেরেছেন, ‘জেন্তে মরা’ হয়ে যেতে পেরেছেন তিনি বা সেই সাধক দেহপ্রকৃতির সুধাকণা লাভ করতে পেরেছেন। আর তা লাভের জন্যই তো বিরাগী হওয়া। অর্থাৎ কিনা বৈরাগ্য নেওয়া। এ বৈরাগ্য হল গিয়ে সাধন বৈরাগ্য।
এই পদের সামনে আমরা যদি একটু সম্মোহিত হয়ে বসি, তবে দেখব তার ভাষা কীভাবে অমূর্ত এক বিহ্বলতা দিচ্ছে। সেই ভাষা-শব্দের শিল্পময় সিঁড়িটিতে দাঁড়ালেই দেখতে পারব অপ্রতিম এক আনন্দ গ্রাস করছে আমাদের, যে আনন্দ শব্দ সংগীতের দার্শনিক প্রস্থানবিন্দুকে সরিয়ে ফেলে প্রতীকী যৌক্তিকতার প্রকরণকে তৈরি করছে খালি। যার ভাষা-আনন্দ কবিতার সার্বভৌম কলাকেই মূর্ত রাখছে বারবার। তাঁরই সংবেদী অংশীদার হতে চাইছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই আভরণ ভেদ করতে চাইছি আমরা।
মন্ত্রগুরুর আখড়াতে তরুণ অচেনা বাউল আরেকটি গানও গেয়েছিলেন সেদিন। ততক্ষণে তিনি অবশ্য চেনা হয়ে উঠেছেন। সুরুলের নিবাসী তিনি। নাম রাজেন দাস। তার পরিবারের তিনকূলে কেউ গান গাননি। তিনি কীর্তন গাইতেন। এখন বাউলে মজে সেখানেই নাড়া বেঁধেছেন। তবে খ্যাপার আশ্রমে তার বাবাও দীক্ষিত। সেই সুবাদেই তিনি হয়তো দীক্ষা নিয়েছিলেন। রাজেন দাস গাইলেন–
অকৈতব গাছের লতা পাতায় পাতায় গৌর জুড়া,
গৌর গোবিন্দ রসে, যুগল হয়ে রইছে খাড়া।।
ছয় গোঁসাই সদা শান্ত, করে পঞ্চভাবে উপাসনা,
কেউ বা হাসে, কেউ বা কাঁদে, কেউ হয়েছে জেন্তে মরা,
রূপ লাবণ্যে ভুবন আলো অমাবস্যার জ্যোতি জুড়া,
পেল তাই রসিক জনা প্রেম সাধনা, ছেড়ে দিলে জেঠা খুড়া।।
দীন খ্যাপা তুই ঘুচাবে ভুল ছেড়ে দে ওই গোলক ধাঁধা,
ডাক্ নিত্য রসে চাঁদ গৌরে, গদাধরের চরণ জড়া।।
‘অকৈতব গাছের লতা’ হল গিয়ে সেই দেহপ্রকৃতি। তাতে পুরুষ এসে যুক্ত হয়েছেন বাউল মতের যুগলভাবে। যে ভাবে পুরুষ ‘গৌর গোবিন্দ’। অকৈতব গাছের। লতাপাতা সমস্তই যুগল হয়ে ‘খাড়া’ হয়ে রয়েছে। পুরুষ ও প্রকৃতি মিলিত হয়ে পড়েছেন। বাউল মতে সাধক ও সাধন সঙ্গিনী। এই মহামিলনে, ‘মহাযোগে’ ‘ছয় গোঁসাই’ শান্ত হয়ে রয়েছেন। চলছে ‘পঞ্চভাবে উপাসনা’। সে যে যথার্থ বৈষ্ণবীয় আচার! বৈষ্ণব মতের ‘পঞ্চভাবে’ পূজা সারছেন ‘ছয় গোঁসাই’। আদতে কিন্তু তা মোটেই না। এখানে যা রয়েছে তা হল বাউলেরই যথার্থ দেহাচার।
পূজার্চনার সময় আমরা যে সমস্ত উপাচার ব্যবহার করে থাকি তা কিন্তু সবই পঞ্চভাবের সমাহার। বাউল একে ‘পঞ্চভূত’, ‘পঞ্চবাণ’ নানাভাবে ব্যবহার করে থাকেন। খ্যাপার গানেই আছে–’পরিপক্ক মুখমালা, ভাব বিভূতি ভোলা / আজ ভূবন মোহিনী পী ধায় গো। / ভাবেরি ঘরেতে রাই আঁখি পালটিয়া চায় / মারল মদন পঞ্চবান গো।‘ বা, ‘পাঁচটা ভুতের হাতে পড়ে মন/ লাগলো মস্ত গণ্ডগোল–/ জন ছয় রিপু আর ইচ্ছা জ্ঞানে / পাকায় যত হট্টগোল। / পঞ্চ ভূতের হাতে পড়ে মন / লাগালো মস্ত গণ্ডগোল।।‘
পঞ্চভূত আমরা জানি ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই পাঁচ ভূতকে ‘ব্যোমপঞ্চকং’ হিসাবে চিহ্নিত করছে তন্ত্র। ‘আকাশন্তু মহাকাশং পরাকাশং পরাৎপরম। / তত্ত্বাকাশং সূৰ্য্যাকাশং আকাশং পঞ্চলক্ষণ।।‘ আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ, সূৰ্য্যাকাশ–এই হল গিয়ে পঞ্চব্যোম। পৃথ্বী(ক্ষিতি), জল(অপ), অগ্নি(তেজ), বায়ু(মরুৎ), আকাশ(ব্যোম)–এই পঞ্চতত্ত্ব হল গিয়ে পঞ্চাকাশ। এই পঞ্চাকাশের বাসস্থান আমাদের শরীরের মধ্যে।
কোথায় কীভাবে রয়েছে এই পঞ্চাকাশ? শরীরের নীচের দিক থেকে উপরের দিকে আমাদের যে পাঁচটি চক্র আছে সেগুলো সবই পঞ্চভূতের উপাদান দ্বারা তৈরি। যেমন–মূলাধার চক্রে ক্ষিতির (পৃথ্বী) অবস্থান। স্বাধিষ্ঠান চক্রে রয়েছে অপ (জল)। মণিপুরে তেজ (অগ্নি)। অনাহত চক্রে মরুৎ (বায়ু)। বিশুদ্ধ চক্রে ব্যোমের (আকাশের) উপস্থিতি।
পূজায় দেবদেবীর উদ্দেশ্যে আমরা যে ফুল নিবেদন করি তা ব্যোম/ আকাশের প্রতীক। ধূপ মরুৎ / বায়ুর প্রতীক। প্রদীপ বা দীপ তেজ/ অগ্নির প্রতীক নিবেদিত নৈবেদ্য অপ/জলের প্রতীক। চন্দন, অগুরু ইত্যাদি সুগন্ধি যা লাগে পূজাকার্যে তা সবই ক্ষিতি/ পৃথিবীর প্রতীক।
তন্ত্রে যে পঞ্চ ‘ম’ কারের সাধনা তাও এই পাঁচটি তত্ত্বেরই প্রতীক। যেমন–মদ হল অগ্নি, মাংস বায়ু, মৎস্য জল, মুদ্রা পৃথ্বী, মৈথুন আকাশ। তবে ভিন্ন ভিন্ন সাধক প্রতীকাৰ্থের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করেছেন। করলেও এটুকু বলা যায় সবই ওই পাঁচটিকেই ইঙ্গিত করছে।
ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা বলেন তাঁরা যীশুর রক্তমাংস ভক্ষণ করেন। এর মানে কী? যে উৎসবে এটা করা হয় তার নাম ইউকারিষ্ট। এই উৎসবে রুটি মদ ইত্যাদি তাঁরা খান। রুটি হল মাংস, মদ রক্ত। এই রক্তমাংস। একবার নেতাজি বাজারের ছোট্ট চার্চে ফাদার পীটার গেমসের সঙ্গে কথা চলছিল। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলেন তিনি।
বললেন, যীশু কী?
বললাম, কী?
–তাঁর অবতারত্ব তো আসলে প্রতীকময়তাতেই ঢাকা।
–কী সেই প্রতীক? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
ফাদার বললেন, যীশু মহাপ্রকৃতি। যার মধ্যে আমরা বেঁচে আছি।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম ফাদারের এই প্রতীকময়তার ব্যাখ্যা শুনে।
খ্যাপার গানে পঞ্চভূত আমরা বুঝে নিয়েছি। শরীরের পাঁচটি উপাদান আমরা পেয়ে গেছি যা দিয়ে ধ্যানে, যোগে, ভক্তিতে, বিশ্বাসে উপাসনা করতে হয়। বাউলের সেই উপাসনা শরীর মন্দিরেই চলে। সহজিয়া সাধক শরীরকে মন্দির বলে থাকেন। দেহকে তীর্থক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করেন তাঁরা। দেহ আসলেই এক প্রতীককল্পের মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, গুরুদুয়ার–যা ভাবব তাই।
কীভাবে? ভাবনাকে ভাবে, কল্পনায় প্রসারিত করে নিতে হবে আমাদেরকে। ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে যদি শরীরকে কল্পনা করি, ভাবি তবে আমাদের মস্তিষ্ক সেই মন্দির মসজিদ গীর্জা গুরুদুয়ার ইত্যাদির প্রতীক। ধ্যান যোগীরা সাধারণত পদ্মাসনে বসেই করে থাকেন। এই অবস্থাতে বসলে প্রসারিত হাতদুটি মন্দির-মসজিদের খিলান। ভাজস্থ পা দুখানি ভিত্তিভূমি। নাভি হল তাঁর প্রবেশদ্বার। প্রশস্ত বুক সেই অধিষ্ঠানের স্থান। যেখানে প্রতীকে, অনুভবে তিনি বিরাজমান।
এই একই কথা আমাকে সরাটির মৌলবী সাহেব বলেছিলেন। আমার বন্ধু বাবলু শেখের সঙ্গে আমি সেই গ্রামের মসজিদ দেখতে গিয়েছিলাম।
বললাম, দেখতে এলাম আপনাদের মসজিদ।
বললেন, আমাদের এখানে কিছুই দেখার নেই বাবা। সমস্তই তো তাই। তোমাদের ঈশ্বরকেও কি দেখা যায়? যায় না। প্রতীকময়তায় ভেবে নিতে হয়। তুমি যদি ভাবতে পারো তাহলে তোমার শরীরও মসজিদ।
–কীভাবে?
তিনি তখন আমার শরীরী গঠনকে মসজিদ বানিয়ে দিলেন। বললেন, তোমার শরীররূপী মসজিদেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঠ হচ্ছে। রোজা চলছে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলেন কী মৌলবী সাহেব! কীভাবে সেখানে রোজা চলছে, নামাজ পাঠ হচ্ছে? বুঝলাম তিনিও কোনো প্রতীকময়তায় এর ব্যাখ্যা সারবেন।
মৌলবী সাহেব বললেন, রোজা হল গিয়ে রোজকার কাজ। রুটিন। তা ঠিকঠাক পালনই তো ধর্ম। নামাজ হচ্ছে তোমাদের নামসংকীর্তন। আমি বেশ চমকিয়েই গেলাম গ্রামীণ এক মসজিদ প্রধানের এই কথায়, বিশ্বাসে, ভাবনায়, প্রতীকময়তায়।
খ্যাপার গানের ‘পঞ্চভাবে উপাসনা’ নিয়ে আমরা বিস্তর সব প্রতীককল্পের আলোচনা চালালাম। এবার ‘ছয় গোঁসাই’ এ আসি। বাউল ‘ছয়’ শব্দের মানে করেন ষড়রিপু বা ষটযন্ত্র। আসলেই তাই। এটা তো হল ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য–এই ছয়টি ইন্দ্রিয়ের ছলনা বা শত্রু হতে দূরে থাকতে হয় সাধককে। অনেক সাধক এগুলোকে তন্ত্রের পঞ্চ ‘ম’ কারের মৎস্য প্রতীকের মধ্যে রাখেন। তাঁরা বলেন অহংকার, দম্ভ, মদ, পৈশূন্য, হিংসা, মাৎসর্য–এই ছয়টি মৎস্যকে বৈরাগ্যজালে আবদ্ধ করে রাখলে সাধক সত্ত্বগুণের অধিকারী মানুষ হয়ে ওঠেন। গানে এই ছয়টি ইন্দ্রিয় প্রতীককেই শান্ত রাখতে বলা হচ্ছে। খ্যাপা বলেছেন–’ছয় গোঁসাই সদা শান্ত, করে পঞ্চভাবে উপাসনা/ কেউ বা হাসে, কেউ বা কাঁদে, কেউ হয়েছে জেন্তে মরা/ রূপ লাবণ্যে ভুবন আলো অমাবস্যার জ্যোতি জুড়া/ পেল তাই রসিক জনা প্রেম সাধনা, ছেড়ে দিলে জেঠা খুড়া।।‘
বাউল ‘কাম’কে ‘অমাবস্যা’ বলে থাকেন। রজঃপ্রবৃত্তির সময়কেই তাঁরা ‘অমাবস্যা’ হিসাবে ধরে থাকেন। ইন্দ্রিয়গুলোকে নিষ্ক্রিয় করে নিচ্ছেন সাধক। যুগল সাধনায় কামেন্দ্রিয় অবশ হয়ে গিয়ে প্রেমে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। সাধক বাউল হয়ে। উঠেছেন ‘জেন্তে মরা’। আর তা তিনি হচ্ছেন অমাবস্যাতেই। মাহেন্দ্ৰযোগে। বাউল কথিত ‘মহাযোগে’ এই প্রেম সাধনা চলছে। এই সাধনার আলোকরশ্মি রসিকই কেবল নিতে জানেন। ‘রসিক’ হলেন সাধক বাউল। আর এই রসের চাঁদ গৌরে বলেই ডাকা যায়। সম্বোধন করা যায়। এই ডাক আত্মার জাগৃতি। বাউলের বস্তুরূপী ‘আত্মা’কে সাধক বাউল অমাবস্যাতেই ঊর্ধ্বগতি প্রদান করেন। সিদ্ধরূপে বিচরণ করে তিনি গদাধরের চরণ জড়াতে পারেন। ‘গদাধর’ হলেন গুরুর দ্যোতক। গুরুই তাঁকে সিদ্ধাসনে বসিয়ে দেন। তাই সাধক বাউল গদাধররূপী গুরুর পদযুগল জড়িয়ে ধরেন। এই প্রেম সাধনায় সাধক রসিক হতে পারেন। ‘রসিক’ এখানে সিদ্ধতা। সাধারণ স্তর থেকে উপরে ওঠা। আর প্রেম সাধনা ছেড়ে দিলে তিনি জেঠা খুড়ার নামান্তর। ‘জেঠা খুড়া’ হলেন অতি সাধারণজন। সাধনমার্গ থেকে দূরে থাকা লোক। এভাবেই এই গান আমাদেরকে প্রতীকদ্যোতক এক শিল্পভঙ্গির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যে প্রতীকের আকস্মিক অভিঘাতগুলো আমরা ছুঁয়ে ধরে দেখতে চাইছি। গৌণ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ভাষাকে কাব্যের অভিক্ষেপে দেখে নিতে চাইছি বারবার। কারণ তাঁর প্রতীক-প্রতিমা-রূপকে শিল্পরূপের নিরীক্ষণ কর্তাটি সব সময় দাঁড়িয়ে আছে। যাকে আমরা প্রান্তিক কারুকলার মধ্যে কখনও রেখে দিতে পারি না। তেমনই এক গান। কানাই বাউলের মুখে শুনেছিলাম সেই ছিন্নমস্তার আশ্রমে।
এ কোন কারিকর,গড়লে এ ঘর, একটা রূপের নিশান
নয় দরজা ষোলতালা, দ্বাদশে বাতি ঘোষণা।।
সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু, ষড়দলে দীনবন্ধু,
শতদলে প্রাণগোবিন্দ, দ্বিদলে রূপ সাধনা।।
এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা,
ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।।
আর কেউ বা শুনে, কেউ বা দেখে, কেউ করে ভাই প্রবঞ্চনা।
কেউ দেখে শুনে চুপটি করে, করে নিত্যলীলার রটনা।।
জরা মৃত্যুর নয় সে অধীন, প্রতি নব নব জানা,
কৈশরা কিশোরী রূপে, ক্ষ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।।
কানাই বাউল কথকতার ঢঙ্গে এ গানের ব্যাখ্যা করছিলেন সে আসরে। সেই ব্যাখ্যার সঙ্গে নিজস্ব চিন্তাধারাকে মিলিয়ে এ গানকে বুঝবার চেষ্টা করব আমরা। ঘর এখানে দেহভাণ্ড। বাউল বলেছিলেন, দেহবাড়ি, নারীদেহবাড়ি। আমরা বলব প্রবোধের বেড়া। যা ভাঙতে চাইছেন সাধক। ঘরের নয় দরজা হল শরীরে নয়টি প্রত্যঙ্গ। বাউল সাধক একে ‘নবদ্বার’ও বলে থাকেন। এই প্রত্যঙ্গগুলো হল দুই কান, দুই চোখ, দুই নাক, মুখবিবর, পায়ু ও উপস্থ। উপস্থ বললে সঠিক পরিষ্কার হল না। বলি জননেন্দ্রিয়, লিঙ্গ। যোনি। ‘ষোলতালা’ হল মোলটি আধার। যে আধারে লয়যোগ সাধন হয়। একে যোগী যাজ্ঞবল্ক বলেছেন ‘ষোড়শাধারং’। ‘পাদাঙ্গুষ্ঠী চ গুলফৌ চ / পায়ুমূলং তথা পশ্চাৎ দেহমধ্যঞ্চ মেট্ৰকং।।/ নাভিশ্চ হৃদয়ং গার্গি কণ্ঠকূপস্তথৈব চ। / তালুমূলঞ্চ নাসায়া মূলং চাক্ষুশ্চ মণ্ডলে। / ভ্ৰবোৰ্মধ্যং ললাটঞ্চ মূর্ধা চ মুনিপুঙ্গবে।’ অর্থাৎ ডান পায়ের আঙুল (দক্ষিণ পদাঙ্গুষ্ঠ), গোড়ালি (পাদগুল), গোপনীয় বা অপ্রকাশ্য অংশ (গুহ্যদেশ), পুংজননেন্দ্রিয় বা শিশ্ন (লিঙ্গমূল), নাভির গর্ত বা কুণ্ড (নাভিমণ্ডল), মন (হৃদয়), কণ্ঠনালীর নিচস্থ গর্ত (কণ্ঠকূপ), জিভের অগ্রভাগ (জিহ্বাগ্র), দন্তপংক্তি বা দাঁতের পাটি (দন্তাধার), টাকরা (তালুমূল), নাক বা নাকের ফুটো (নাসাগ্রভাগ), দুই ভুরুর মধ্যবর্তী স্থান বা অংশভাগ (ভ্রমধ্য), চোখ বা চোখের অংশভাগ (নেত্ৰাধার), কপাল (ললাট), মাথা বা মস্তক (মূর্ধ্বা), শিরোমধ্যস্থ বা মাথার ভেতরে অধোমুখের সহস্রদল পদ্ম(সহস্রার)। এই ষোলটি স্থানের ক্রিয়াবিশেষ অনুষ্ঠানে লয়যোগ হয়, লয়যোগ হল আমাদের মনকে যে কোনো পদার্থের উপর একত্র করে একতানে বেঁধে ফেলা। ‘দ্বাদশ বাতি’ হল শরীরের। মধ্যে অবস্থিত অনাহতচক্র। এর বারোটি পাপড়ি থাকে। এই দ্বাদশ দল হল–ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ। এগুলো সবই মাতৃকাবর্ণাত্মক। মায়ের ভাষা। আমাদের। বর্ণমালা। মাতৃকা হল শক্তিস্বরূপিণী। সেই আধারেও রাখতে পারি এই বারোটি পাপড়িকে। এর রঙ সিঁদুর বর্ণের। এর প্রত্যেক দলে একেকটি বৃত্তি রয়েছে আমাদের। এগুলো হল–আশা, চিন্তা, চেষ্টা, মমতা, দম্ভ, বিকলতা, বিবেক, অহংকার, লোলতা, কপটতা, বিতর্ক ও অনুতাপ। এই অনাহত চক্রে বা পদ্মের মধ্যে অরুণবর্ণের সূর্যমণ্ডল ও ধূম্রবর্ণের বায়ুমণ্ডল আছে। এই পদ্মে সাধক ধ্যানে বসলে অণিমাদি লাভ করেন। অনিমিত্ত ঘটনারাশি তাঁর চোখের সামনে ভাসে।
তাহলে আমরা বুঝতে পারছি এ গানে পদকর্তা নারীদেহের ভেতরকার সৌন্দর্যের জাগৃতি দিয়েছেন। তবে যেটা মনে হয় ‘ঘর’কে কানাই বাউল নারী দ্যোতকের রূপ দিলেও ভঙ্গির প্রতিচ্ছায়াতে এ গানের বর্ণিত ‘ঘর’ যুগল দেহের। যুগল সাধনার ব্রহ্মাণ্ড। খ্যাপা বলেছেন ‘সপ্ত তালায়, সপ্ত সিন্ধু’–’সপ্ততালার কথা আমরা এর আগেও খ্যাপার গান প্রসঙ্গে বলেছি। তবু প্রসঙ্গত এখানে আবারও বলি। আমাদের শরীরের বীর্য, রক্ত, মজ্জা, মেদ, মাংস, হাড়, চামড়া–এই সাতটি পদার্থকে ‘সপ্ততালা’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক। তারপরই বলেছেন ‘ষড়দলে দীনবন্ধু’–’ষড়দল’ হল ষড়রিপু। সেখানে ‘দীনবন্ধু’ রয়েছেন কীভাবে? যদি ভাবি ‘দীনবন্ধু’ সাধকেরই দীনতা খুব কি ভুল ভাবব আমরা? সেই দীনতা ‘ষড়দল’এ আটকে যাচ্ছে। ‘ষড়রিপু’কে পরিণামী মেজাজ দিতে চাইছেন তিনি। যার জন্যই ‘শতদলে প্রাণ গোবিন্দ’কে দেখতে পারছেন তিনি। ‘প্রাণগোবিন্দ’ হল সাধকের অপরিমেয়তা। তাঁরই দিব্যবানী শোনাতে চাইছেন তিনি পরবর্তী দু’লাইনে। ‘শতদল’ হল গিয়ে শরীরের গুরুচক্র। অষ্টম পদ্ম এটি। এই পদ্মের কর্ণিকাতে (বীজকোষে) ত্রিকোণমণ্ডল আছে। ত্রিকোণমণ্ডল তিনটি বর্ণ দ্বারা গঠিত। এই বর্ণগুলো হল–হল, ক্ষ। এই তিনটি শক্তিদ্যোতক। নটি চক্রেরই বিকাশ তো শক্তির অভিক্ষেপের জন্যই। যার জন্য একে শক্তিমণ্ডল বলে। অনেকে যোনিপীঠও বলে। যা প্রকৃতি দ্যোতক। নারীর জননাঙ্গ সৃষ্টির সন্নিবেশকেই প্রতীকী করে রাখে। সাধক বলেন তেজময় এই শক্তির মধ্যে কামকলা মূর্তি থাকে। সেই মূর্তিকেই তিনি দিব্য প্রেমের ইঙ্গিত দেন। গুরুপদ্ম বা চক্র শতদল পদ্মকে কেন বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে এই কারণেই, এই পদ্মেই। সাধক গুরুদেবের ধ্যানজপ করেন। এই ধ্যানে সাধক মনে করেন সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। দিব্যজ্ঞান স্ফুটমান হয়। এই দিব্যতা লাভ করার উদ্দেশ্যেই সাধক ‘দ্বিদলে রূপ সাধনা’ করেন। দ্বিদল হল আজ্ঞাপদ্ম। দুটো দলের বর্ণ হ এবং ক্ষ। এই পদ্মের বীজকোষে যে ত্রিকোণমণ্ডল আছে তাতে তিনটি গুণ বর্তমান–সত্ত্ব, রজ, তম। সাধক বলেন ত্রিগুণান্বিত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। এই জন্যই খ্যাপা গানকে সেই দ্বিদ্বলের দ্যোতনা দিয়েছেন। তাঁকে একটু আগে আমরা ‘দিব্যবাণী’ হিসাবে চিহ্নিত করে নিয়েছি। এই দিব্যবাণী হল–’এক ধারায় নয় তিন ধারানন, তিনগুণে তার তিন সাধনা/ ওই নব রসে রসিক বসে, স্বরূপ নিয়ে করে রূপ ঘোষণা।‘ ‘নবরস’ নটা চক্রেরই দ্যোতক। বাউল একে ‘নববিধা ভক্তি’ বলেন। নববিধা ভক্তি হল অলংকার শাস্ত্রের নয়টি রস–শৃঙ্গার, হাস্য, বরুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। কানাই বাউল আমাকে বলেছিলেন, নবরসে শরীরের নটি দ্বার খোলে গো।
এই নটি দ্বার–শরীরের নটি ছিদ্র। দুই চোখ, দুটি কান, দুই নাক, মুখ, যোনি লিঙ্গ। তা যদি খোলে ‘ঘর’ কে কানাই বাউল কথিত ‘নারীদেহ’ হিসাবে কীভাবে মেনে নেব? যার জন্যই তাঁকে যুগল দেহের প্রেম সাধনার (কাম সাধনার? !) দীর্ঘসূত্রতা দিয়েছিলাম। তা কিন্তু গানের শেষ লাইনে একেবারেই স্পষ্ট–কৈরা কিশোরী রূপে, খ্যাপা করেরে রূপের সাধনা।
খ্যাপা বাবার গানে রূপের এই রণন ফিরে ফিরে দেখব আমরা। সাধন পর্যায়ে বাউলের গানকে তিন ভাগে অনায়াসে ভাগ করতে পারি আমরা। ‘ক্ষ্যাপা গীতামৃত’ যতই চারটি ভাগের আত্মপক্ষ তৈরি করে নিক না কেন। এই তিনটি ভাগ পদকর্তাদের আত্মতত্ত্ব বা সাধকের দেহতত্ত্ব, সঙ্গিনীর দেহতত্ত্ব বা পরতত্ত্ব আর পরম তত্ত্ব। খ্যাপার গানের চৈতন্যতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব, রসতত্ত্ব তাঁকে বৈষ্ণব ভাবিত সাধক হিসাবেই চিহ্নিত করে। তাঁর গুরুদেব শ্রী শ্রী সদানন্দ দাসী (শ্রীশ্রী বুড়াবাবা) তাঁকে ‘খ্যাপা বাবা’র আখ্যাটি দিয়েছিলেন। মানভূম জেলার সোনাথলীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘই এখন ‘মনোহর সেবাশ্রম সংঘ’ নামে খ্যাত। খুব বেশীদিন যে তিনি দেহ রেখেছেন। তা নয়। ১৯৯৬ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন। প্রথম জীবনে তিনি সংসারী ছিলেন। পরবর্তীতে সংসারের মায়া ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। শ্রী শ্রী রাধারানি দেবী (শ্রীশ্রীমা) ছিলেন তাঁরই মন্ত্রশিষ্যা। খ্যাপা বাবার মন্ত্রশিষ্য অনেকেই। মনোহর সেবাশ্রম সংঘের সভাপতি শ্রীরাধানাথ দাস ঠাকুর আমাকে যে নামগুলো দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই নাম করা বাউল। সনাতন দাস, পূর্ণচন্দ্র দাস, বিশ্বনাথ দাস, বিশ্বনাথ দাস(সনাতন দাসের ছেলে), রাখালচন্দ্র দাস–এসব নামগুলো তিনিই আমাকে। জানিয়েছিলেন। খ্যাপার গান এই সব প্রতিষ্ঠিত বাউল গায়করা প্রায়শই গেয়ে থাকেন। কেঁদুলির মেলাতেই সরকারি বাউল মঞ্চে একবার পূর্ণচন্দ্রের কণ্ঠে শুনেছিলাম যে গান তা শ্রুত বাউল গান হিসাবে বিশেষ পরিচিত। পূর্ণচন্দ্র খ্যাপার কথা বলেই সেদিন গান শুরু করেছিলেন।
কাঁচা হাড়িতে রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)
কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে
শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)
রাখিতে নারিলি প্রেমজল।।
যদি হবি পাকা হাঁড়ি
চলে যাবি গুরুর বাড়ি,
প্রেমানলে দগ্ধ হবি।
রূপে করবে টলমল গো।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।
সদানন্দ ভেবে আউল
এই কথা যে বুঝেছে সেইত বাউল,
ধান কুটিলে হবে চাউল
(ক্ষ্যাপা) তুষ কুটিলে কিবা ফল।
রাখিতে নারিলি প্রেমজল (গো)।।
এই গানে কথিত ‘কাঁচা হাঁড়ি’ হল আমাদেরই স্থূল দেহ। এই স্থূল দেহকে প্রবর্ত স্তরে নিয়ে যেতে হলেই গুরুর কাছে যেতে হয়। গুরু শিক্ষা দেন স্থূল স্তর থেকেই। স্থূলকে মোটা হিসাবে না দেখে অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার নামান্তর ধরলেই বোধহয়। ভালো। গুরু এই অতীক্ষ্ণ বুদ্ধি বা অসূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাকেই প্রবর্তস্তরে নিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তাঁর জন্যই গানে গুরুর বাড়ি যেতে বলা হচ্ছে। ‘প্রেমজল’ নারীর বা সাধন সঙ্গিনীর রজঃস্রাব। সহজিয়া বলছেন ‘কাঁচাহাঁড়ি জলে দিলে তখনি যাইবে গলে/ শেষে লাগবে গণ্ডগোল (গো)।‘ এই ‘জল’ পুরুষ দ্যোতক বা পুরুষের কিংবা সাধকের বীর্যপাত। স্থূল দেহেই যদি বাউল সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরেন তাহলে তিনি বীর্যকে চূড়ান্ত মিলনের সময় উর্ধগতিতে উঠিয়ে নিতে পারবেন না। বীর্য ‘প্রেমজল’ এ মিশে যাবে। পথভ্রষ্ট হবেন সাধক। যাকে ‘গণ্ডগোল’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন সাধক খ্যাপা। তাঁর জন্যই গুরুর কাছে যাওয়া।
মজলিশপুরের প্রবীণ প্রাজ্ঞ বাউল শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য আমাকে বলেছিলেন, জীবনে চার বার জন্ম হয়।
–কী রকম ভাবে? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বলেছিলেন, প্রথম জন্ম মাতৃক্রোড়ে। পিতার বীর্য মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় জন্ম দেন দীক্ষাগুরু। মন্ত্রদীক্ষা হয় আমাদের। তৃতীয় জন্ম ক্রিয়াকরণের। গুরুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। চতুর্থ জন্ম হয় ভেকে।
ভেক হল সিদ্ধি। প্রচলিত ভাষায় ভেক নেওয়া হল ছদ্মবেশ। যেমন বলা হয়–ছিল চোর, বদমাশ এখন সাধুর ভেক নিয়েছে। হতভম্ব হয়ে যাওয়াকেও ভেক বলা হয়। কিন্তু শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্যের বলা ভেক হল বাউল সিদ্ধি সাধনার সর্বোচ্চ দশা।
‘পাকা হাঁড়ি’ হল বাউল কথিক ভেক। যার জন্য গুরুর কাছে যাওয়া। শিক্ষাপ্রণালী রপ্ত করা। সাধক হয়ে ওঠা। প্রেমানলে দগ্ধ হওয়া। প্রেমানল’ হল পুরুষ ও প্রকৃতির অচ্ছেদ্যতা। বাউল ভাষায় বললে, রজঃবীজ বা বীর্যকে উধ্বদিকে উল্টিয়ে দেওয়া। ‘উল্টোস্রোতে নৌকা বাওয়া’। এই বাহ্য অবস্থার রূপই ‘জেন্তে মরা’। অর্থাৎ কিনা সাধক ও সাধন সঙ্গিনী আত্মবিস্মৃত, চেতনাহীন হয়ে পড়বেন। দেহগত আকর্ষণ থাকবে না। তাঁদের। লালনের গানেই আছে তাঁর প্রকাশ–’জেন্তে-মরা প্রেম-সাধনা কি পারবি তোরা। যে প্রেমে কিশোর-কিশোরী হয়েছে হারা।।/ শোসায় শোষে না ছাড়ে বাণ, / ঘোর তুফানে বায় তরী উজান,/ ও তাঁর কাম-নদীতে চর পড়েছে/ প্রেম-নদীতে জল পোরা। এই অবস্থাই খ্যাপার গানে–’প্রেমানলে দগ্ধ হবি/রূপে করবে টলমল গো।‘ এই রূপ অরূপের প্রগাঢ় প্রস্বর যিনি বুঝেছেন তিনিই বাউল–’সদানন্দ ভেবে আউল / এই কথা যে বুঝেছে সেই তো বাউল।’ আউল হল গুহ্য সাধনার সম্প্রদায়। সহজিয়া কর্তাভজাও বলা যেতে পারে তাঁদের। অনেকে এঁদের বৈষ্ণব ভাবিত সম্প্রদায়ও বলে থাকেন। ‘সদানন্দ’ পদকর্তা নন। হৃদয়ের আনন্দধারা। রূপ বিকাশের মূর্ততা। ‘প্রেমানলে’ দগ্ধ। হওয়ার রূপ। এই রূপ প্রস্ফুটিত হবে ‘পাকা হাঁড়ি’ হলেই। না হলে তা কোনওভাবে সম্ভব। নয় একেবারে। তাঁর জন্যই বলেছেন খ্যাপা ধান কুটলে, খোসা ছাড়ালে চাল পাওয়া যাবে। ‘ধান’ এখানে ‘পাকা হাঁড়ি’র দ্যোতক। ‘চাল’ ‘প্রেমানলের’। ‘তুষ’ হল ‘কাঁচা হাঁড়ি’। যা ছাড়ালে শূলতার বিপর্যয়ই থাকবে জীবনে। তা ভেঙে প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ স্তরে কখনও আর ওঠা হবে না–’ধান কুটিলে হবে চাউল / (ক্ষ্যাপা) তুষ কুটিলে কিবা ফল। ফল’ এখানে অসিদ্ধতার প্রকাশ। বাউল সাধক সেই উচ্চমার্গে স্বচিহ্নিত শিল্পবস্তুর কথাই বলেছেন। এই বস্তুকে পিতৃবস্তু শুধু বলছি না। বলছি সাধকের গুরুর শিষ্যর প্রতি বেদবাণী। খ্যাপা গানে রূপকে, প্রতীকে তাঁরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এই ইঙ্গিতের অনাশ্রয়ী দুর্গ ভাঙতে পারলে অসাধারণ অভূতপূর্ব প্রতীকী ভাষার বা পারিভাষিক শব্দসূত্রের পরিণত এক বিস্তীর্ন। অধ্যায় দিতে পারেন। যার সংরক্ষণ, রসাস্বাদন প্রতিবন্ধকতা ভেঙে এগোলে তবেই সম্ভব।
জয়দেবের মেলাতে খ্যাপা বাবার আখড়ায় বেশ রাতের দিকেই গাইতে ওঠেন। বিশ্বনাথ দাস। এ-আখড়া ও-আখড়া ঘুরে তিনি এখানে আসেন। এসে বেদনাশা বটমূলে আগে প্রণাম সারেন। তারপর আসরে এসে বসেন। বার দুই এ দৃশ্য আমি দেখেছি। বিশ্বনাথ নামকরা বাউল সনাতন দাসের পুত্র। নিজেও যথেষ্ট নামকরা বাউল সমাজে। বার দুই বিদেশে গেছেন গানের সুবাদে। বিশ্বনাথ নিজেও পদ রচনা করেন। তাঁর পিতা সনাতন দাসকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিশ্বনাথের মুখেই শুনেছিলাম ওঁর কথা। তিনি অনেক পদ রচনা করেছেন। সে পদের বেশ কিছু শুনবার সৌভাগ্য আছে আমার। তবে তিনি যে বাউলতত্ত্ব বিষয়ে দু’দুইখানি বই রচনা করেছিলেন এ তথ্য আমি জানতাম না। বিশ্বনাথই আমাকে বলেছিলেন। সনাতন দাসের মন্ত্রদীক্ষা নাকি খ্যাপার কাছেই। সংঘের সভাপতি এ কথা একবার বলেছিলেন। বিশ্বনাথ দাসকে এ কথা আমার জিজ্ঞাসা করা হয়নি এবং তাঁর মন্ত্রদীক্ষা খ্যাপার আশ্রমে কিনা এও জানা হয়নি। বিশ্বনাথ দাসই আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁর বাবার আকাদেমি পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা। লালন পুরষ্কারও তিনি পেয়েছিলেন।
বিশ্বনাথের কণ্ঠে খ্যাপা বাবার যে গানটি একবার শুনেছিলাম সেটিও ছিল যথেষ্ট শ্রুত গান। অনেক বাউলরাই এই গানখানি গেয়ে থাকেন। পূর্ণদাসের গানখানাও তাই। বাংলা ব্যান্ড ‘ভূমি’ পর্যন্ত খ্যাপার ‘কাঁচা হাঁড়িতে…’ গানখানা রেকর্ড করেছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এরা এই গানখানা গেয়ে থাকে। তা সে রাতে বিশ্বনাথের কণ্ঠে খ্যাপার গানখানা যেন মহোজ্জ্বল আলোকসম্পাত রচনা করেছিল। খুবই একাগ্র মনে গাইছিলেন তিনি। অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিলেন যেন গানখানির প্রকৌশলে। দেহের আশ্চর্য সব অলব্ধ চারপাশ যেন তিনি কণ্ঠের অভিঘাতেই সামনে আনছিলেন। গাইছিলেন–
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে,
সুষুম্না এক নাড়ী আছে,
সহজ সরল তাঁরই কাছে
সপ্তাঙ্গ অষ্টাঙ্গ ভেদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।
চতুর্দল মূলাধারে
মণিপুর তার উপরে,
অনাহত বিশুদ্ধ পারে;
লক্ষ যোজন যাও না কেঁদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।।
চেতনে চৈতন্য যিনি,
কুণ্ডলীতে আছেন তিনি,
দ্বাদশ পবন বইছে সদাই;
(ক্ষ্যাপা) পূর্ণচন্দ্র প্রতিপদে।
ইড়া পিঙ্গলার মাঝে।।
দেহাত্মবাদী কায়া সাধনার মূল কথা হল শ্বাস আর দমের কাজ। যে শ্বাসপ্রশ্বাসে আমরা সাধারণ মানুষেরা জীবনধারণ করি, সেই শ্বাসপ্রশ্বাসকেই কাজে লাগিয়ে তাঁরা যৌন জীবনযাপনে বিশেষ প্রক্রিয়া গ্রহণ করে থাকেন, যে প্রক্রিয়ায় বীর্য-রজ একাকার হবে না কোনো সময়। সন্তান আসবে না। শ্বাসক্রিয়াই জন্মনিরোধক হিসাবে কাজ করবে। শ্বাসকে তাঁরা গুরু হিসাবে মানেন। বায়ু বা পবন বলতে তাঁরা শ্বাসক্রিয়াকে ধরেন। শ্বাস তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপন-বিভাব। যার দ্বারা শরীরকেই নির্জনতম সাধনার স্থান তাঁরা করে নিতে পারেন। শরীর তাঁদের কাছে সাধনার পূর্ণাঙ্গ দলিল। ভবা পাগলার গানের মধ্যেই রয়েছে দেহের তামসিক উপকরণ–’দেহ অট্টালিকা অতি মনোরম/ তাহাতে বসতি করে একটুখানি দম। / সতর্ক থাকিও তুমি খুব হুঁশিয়ার/ রক্ষই ভক্ষক কিন্তু খবরদার খবরদার।
খ্যাপার এই গান যেন শরীরে আপাতবিক্ষিপ্ত অধ্যায়গুলোকে পরপর সাজিয়েই ধরা। তিনি বলছেন–’ইড়া পিঙ্গলার মাঝে/ সুষুম্না এক নাড়ী আছে।‘ সুষুম্না আমাদের দেহে অবস্থান করছে মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলকে মাঝ বরাবর বিদীর্ণ করে একেবারে মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রকে ছুঁয়ে। সুষুম্নার বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া। পিঙ্গলা অবস্থান করছে ডানদিকে। সুতরাং ‘ইড়া পিঙ্গলার মাঝে সুষুম্না’র অবস্থান। খ্যাপা বলছেন–’সহজ সরল তাঁরই কাছে/ সপ্তাঙ্গ অষ্টাঙ্গ ভেদে।‘ ‘সপ্তাঙ্গ’ ‘অষ্টাঙ্গের’ প্রতীককলা কী? ‘সপ্তাঙ্গ’ শরীরের সাত ধাতু। অষ্টাঙ্গ হল অষ্টশক্তি। কী এই অষ্টশক্তি? এই অষ্টশক্তি হল অণিমা, মহিমা, লঘিমা, গরিমা, প্ৰাপতি, প্রকাশ্য, ইশিত্ব, বশিত্ব।
সাধক ধ্যানে অণুর মতো ক্ষুদ্র হবার ক্ষমতা অর্জন করেন তা হল অণিমা। ধ্যানযোগে তিনি বৃহৎ হবার ক্ষমতাও রাখেন যা মহিমা। ইচ্ছাকৃত হালকা হবার ক্ষমতা হল লঘিমা। ভারী হবার ক্ষমতা গরিমা। যা কিছু বা যা ইচ্ছা লাভ করার ক্ষমতা হল প্ৰাপতি। অনেক সাধক একে কামবসয়িতাও বলে থাকেন। ইচ্ছামতো যে কোনো জিনিস পাবার ক্ষমতা ইশিত্ব। আর ইচ্ছামত বশ করার ক্ষমতা হল গিয়ে বশিত্ব।
গৌতম বুদ্ধ আবার আকাক্ষা বিলোপের জন্য আটটি পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। শালুয়া বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু আমাকে বলেছিলেন, গৌতম বুদ্ধের এই আটটি পথের অভিধাকে তাঁরা বলে থাকেন অষ্টমার্গ।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী এই অষ্টমার্গ?
তিনি বললেন, ভগবান বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন সংসারে দুঃখ আছে। দুঃখের কারণও আছে। আর এই দুঃখের কারণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য তিনি আটটি পথের কথা বলেছিলেন তাই-ই অষ্টমার্গ।
বললাম, তন্ত্রক্রিয়াতেও আটটি মার্গ আছে।
বললেন, দেহসাধনার আটটি মার্গ এটা নয়।
আমি আর তাই বাউল সাধনার ‘অষ্টভাবে’রও কথা তাঁকে বললাম না।
সবে সন্ধ্যা হয়েছে। উপাসনা শুরুর আগে তিনি বললেন, আজ আর নয়। তোমাকে অষ্টমার্গটি বলে ছেড়ে দিচ্ছি। আমার সময় হয়েছে।
শরীরের তিনচক্রে আমাদের সাধকরা যে আটটি শক্তিমূর্তির কল্পনা করেন, সে কথাও সেদিন তাঁকে বলা গেল না।
ঘন্টা বাজা শুরু হয়েছে সবে। ভগবান বুদ্ধের সামনে সান্ধ্যজ্যোতি দপদপ করে জ্বলছে। বললেন, আমাদের অষ্টমার্গ হল–সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ সংকল্প, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবন, সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সমাধি। এ তোমাদেরও নয় কি?
সেদিন আর কথা হল না। বৌদ্ধবিহারের ঘণ্টা বাজতে থাকল জোরে জোরে।
খ্যাপা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন সাধক ছিলেন যেমন একাধারে, তেমনই তিনি তন্ত্রজ্ঞ পুরুষ ছিলেন। তাঁর গুরুর নির্দেশে তিনি ধরমপুরের ক্রোশজুড়ি সিদ্ধেশ্বরের মন্দিরে একমাস রাজযোগের ক্রিয়াকরণ করেছিলেন। এটিও একটি সহজি পন্থা। এই যোগ সংসারী লোকের পক্ষে করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই কোনো বইতেও বিস্তারিত এই যোগের ক্রিয়াকর্মের আলোচনা নেই। খ্যাপা মনোহর এক ভক্তের অনুরোধে অবশ্য রাজযোগে নিজের উপলব্ধির কথা ‘রাজযোগ সাধনা’ বইতে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধতন্ত্র-সাধনার সঙ্গে বাউল সাধনার কিছু মিলকরণ আছে। তান্ত্রিক বলেন কুণ্ডলিনী। বাউলও তাই বলেন। বৌদ্ধাচার্য আবার একে আহলাদিনীও বলে থাকেন। যে নামেই আমরা একে অভিহিত করি না কেন আসলে এ সবই হাওয়ার গতি। এই হাওয়া বাউলের শ্বাস। হাউড়ে গোঁসাই তা অনুধাবন করেই বোধহয় লিখেছিলেন–’মৃণাল হাওয়ার গতি, ত্রিগুণ ধারিণী শক্তি যথায় বসতি/ তারে জাগালে যোগনিদ্রা, সাধ্যধন বাধ্য হয়;/ তবে দ্বার পারাপার দম দামোদরে,/ উর্ধ্বেতে হইবে গতি দ্বিদল ‘পরে,/ তবে হবে দৃষ্ট প্রণব পুষ্ট, ঘুচবে কষ্ট তাই ভেবে।
আমাদের মণিপুর চক্র ও অনাহত চক্রে আটটি শক্তিমূর্তির কল্পনা করেন তন্ত্রসাধক। তন্ত্রের আটটি শক্তির কথা বলেছি। বাউলের অষ্টশক্তিও তাই তবে নামকরণে কিছু প্রভেদ আছে। তন্ত্রের অণিমা ও লঘিমা বাউল মতেও তাই। তবে বাকি ছটাতেও নামে পার্থক্য আছে একটিতে। ব্যাখ্যায় হেরফের আমরা সেরকম কিছু দেখি না। তন্ত্রের গরিমা বাউল মতে ব্যাপ্তি। ব্যাপার কিন্তু একই। গরিমার ইচ্ছামতো ভারী হবার সঙ্গে ব্যাপ্তির মিল আছে। তন্ত্রের আটটি মূর্তি হল–বাসিনী, কামেশ্বরী, মোদিনী, বিমলা, অরুণা, জয়িনী, সর্বশ্বরী, কালী বা কৌলিনী।
সাধক বলেন আটটি বিভিন্ন অক্ষরমণ্ডলের দেবী এরা। অ থেকে ঘ এই ষোলোটি অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন বাসিনী। পাঁচটি অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামেশ্বরী। পাঁচটি অক্ষর হল ক থেকে ঙ। আবার চ থেকে ঞ, এই পাঁচটি অক্ষরেরও অধিষ্ঠাত্রী দেবী মোদিনী। বিমলা (ট–ণ), অরুণা (ত–ন), জয়িনী (প–ম)। য থেকে ব, এই চার অক্ষরের অধিষ্ঠাত্রী হলেন সর্বেশ্বরী। শ থেকে ক্ষ, এই পাঁচ অক্ষরেরও অধিষ্ঠাত্রী হলেন কালী বা কৌলিনী।
খ্যাপা তন্ত্রসিদ্ধ হলেও যেহেতু এটা বাউল তত্ত্ব তাই অষ্টাঙ্গ ভেদকে তিনি বাউল মতেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন ‘চতুর্দল মূলাধারে’। মূলাধারে এই চতুর্দল পদ্মের বর্ণ চারটে হল–ব, শ, ষ, স।
বাউলের রজঃবীজের উধ্বগতি হল সাধকের কুণ্ডলিনীর গতিকে স্থূল জগৎ থেকে ক্রমশ সূক্ষ্ম জগতের দিকে নিয়ে যাওয়া। বাউল ভাষায় একে ‘প্রবর্ত’ বলা যেতে পারে। এই স্তরেই বাউল ‘বায়ু’র কাজ শেখেন।
তন্ত্রসাধক বলেন কুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতিতে শরীরের ভিতরস্থ বিভিন্ন এলাকার চরিত্র অনুযায়ী সেই অঞ্চলের দেবতা ও বৃত্তিগুলো সব নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। তাঁরা বলেন মূলাধারে ব্রহ্মা, সাবিত্রী, ডাকিনী, মাতৃকা–এইসব দেবদেবীর বসবাস। এগুলো সবই তাঁদের কাছে প্রতীককল্পের বৃত্তি। মূলাধারে দেবদেবী ও বৃত্তি কুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় উধ্ব অঞ্চলে। একে নদীর সঙ্গে আমরা তুলনা টানতে পারি। নদী যেমন প্রবল জোয়ারে তাঁর মধ্যকার সমস্ত আবর্জনা সরিয়ে ফেলে; সেগুলো বুকের থেকে, নসীর শরীর থেকে হারিয়ে যায়। পাড়ে এসে পড়ে। সাধকের বৃত্তিও একই ভাবে নষ্ট হয়। মাতৃকা হল শরীরের মধ্যস্থ পৃথ্বী অঞ্চল। যার বীজ সাধক বলেন লং। একে আমরা শব্দশক্তি হিসাবে ধরতে পারি। এই লং হল চৈতন্যের সেই অবস্থা সে অবস্থাতে সাধকের চৈতন্য শব্দের আকারে প্রকাশ পায়। আমরা প্রায়শই বাকসিদ্ধ সাধুর কথা বলে থাকি। মূলাধার পদে ধ্যানে, জপে সাধকের সেই বাকসিদ্ধতা আসে।
মূলাধার দেহের সর্বনিম্ন চক্র বা পদ্ম। কিন্তু বাউল সাধক মূলাধারকে স্বাধিষ্ঠান চক্র বা পদ্ম বলেন। বিশ্বনাথ দাস বাউল আমাকে মূলাধার বলতে সেই স্বাধিষ্ঠানই বুঝিয়েছিলেন।
গান শেষে প্রায় ভোর ভোর সময়, যখন প্রভাতী গাইবেন এক বাউল গায়ক তখন তাঁকে একটু নিভৃতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মূলাধার কী?
বললেন, আমাদের শরীরের মধ্যকার সেই জননেন্দ্রিয়। ষড়দলের রূপ তাঁর। মুলাধারেই রজঃবীজ থাকে। বাউল রজঃবীজকে উপরে উঠিয়ে দিতে পারেন।
বুঝলাম চক্রের যে পদ্ম-কল্পনার প্রকাশ তাই-ই হল তাঁদের রজঃপ্রকাশ। রজকে তাঁরা ফুল বলেন। ‘যোনিপদ্ম’ তান্ত্রিকরাও বলেন। বাউল ‘রাধাপদ্ম’ বলেন। রাধাপদ্মতেই তো রজঃবীজের প্রকোপ না ঘটানো–এটাই তো তাঁদের মূল সাধনা। সংস্কৃত শাস্ত্রে রজের আভিধানিক মানে হল ফুল।
খ্যাপাও বাউল মতো মেনেই মূলাধারকেই স্বাধিষ্ঠান বলেছেন। তাঁর প্রমাণ রয়েছে গানেই–’চতুর্দল মূলাধারে/ মণিপুর তাঁর উপরে।‘ তাহলে দাঁড়াল মূলাধারের পরই মণিপুর। তা যদি হয়, তাহলে স্পষ্ট স্বাধিষ্ঠানই এখানে মূলাধার। নয় কি? তবে তাঁর দল তিনি চতুর্দলই করেছেন। মনে হয় যেটা তিনি তন্ত্রসিদ্ধ বলেই দলকে আর বদলাতে চাননি।
কুণ্ডলিনী যখন মূলাধার ত্যাগ করে তখন যে প্রাণপ্রবাহ উপরের দিকে উঠে আসে তাঁর ধাক্কাতেই স্বাধিষ্ঠানের পাপড়ি ঘেঁড়ে। ফলে এর মুখও খুলে যায়। যা খুলে গেলে এখানকার শক্তিরূপের দেবদেবী বিষ্ণু, লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাকিনী, মাতৃকা এবং বৃত্তি সব কুণ্ডলিনীর সঙ্গে মিশে ভয়াবহ ভাবে ডুবে যায়। পৃথ্বীরূপী লং বীজ তখন জলতত্ত্বকে ধারণ করে বসে। হয় অপ, রং বীজ। মণিপুরের অগ্নিবীজ বায়ুবীজে মেশে। এখানে বিষ্ণুর রূপকল্পনা থাকে। বায়ু বীজ যং বীজে রূপান্তরিত হয়। অনাহত পার হয়ে উঠে আসে আজ্ঞাচক্রে। এই চক্র থেকেই শক্তি আরও উপরে উঠে প্রণব নাদ আরও সব সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম। পর্যায়ে গিয়ে মেশে। তারপর থাকে কেবল পরম চৈতন্যের শক্তি। যে শক্তি শিবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বলে থাকেন সাধক। শিব এখানে সর্বোচ্চ শক্তিতরঙ্গের প্রতীক। সাধকের জগদীশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা। তাঁকে প্রাপ্তি। উপলব্ধি। আমরা বলব সাধক এখানে এসে এই চরম পন্থায় যে নির্বাণ লাভ করে থাকেন সেই জ্ঞান পরমাত্মা। অর্থাৎ কিনা আমিকে, আমার শক্তিকে সর্ববিধভাবেই চেনা। খ্যাপা যার জন্যই বলেছেন–’লক্ষ যোজন যাও না। কেঁদে।‘ এই কান্না সিদ্ধ স্তরে পৌঁছানোর জন্যই প্রচেষ্টার অশ্রুপাত। সে স্তরে নিজের চেতনাকেই উপলব্ধ করা যায়–’চেতনে চৈতন্য যিনি/ কুণ্ডলীতে আছেন তিনি।‘ ‘দ্বাদশ পবন’ কী? এই ‘দ্বাদশ পবন’ হল গিয়ে শরীরের মূল বারোটি শিরার মধ্যে রক্তের যে একমুখী প্রবাহ। এই রক্তপ্রবাহ হৃৎপিণ্ড থেকে নির্গত হয়ে চৌষট্টিটি ধমনী পার হয়ে তিনশত ষাট শিরার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে উপশিরা ও স্নায়ুতে ছড়িয়ে যায়। যার জেরেই ‘পূর্ণচন্দ্র’ লাভ করা যায়। বাউলের ‘পূর্ণচন্দ্র’ হল গিয়ে প্রেম প্রেম এখানে সিদ্ধতা। সঙ্গিনীর শরীর ভ্রমণ করে, সেই শরীরকে নিগূঢ় বোধিচর্চা দিয়ে নিজের সর্বাত্মক ধাঁচটি বজায় রাখা। তাঁর জন্যই খ্যাপা গাইছেন–’দ্বাদশ পবন বইছে সদাই/ (ক্ষ্যাপা) পূর্ণচন্দ্র প্রতিপদে।‘ বাংলার দেহসাধনা এভাবেই দ্বৈততত্ত্বকে প্রকাশ করেছে গানে। খ্যাপা বাবার গানগুলোর মধ্যে আমরা তাঁরই প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি বার বার।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা,
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
কত শক্ত করে বেঁধেছে ঘর
কেউ গিরে তাঁর ঠিক দিয়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
(দেখ) সপ্ততালা এ ঘরখানি
নয় দরজা-তায় রেখেছে
মাপে কিন্তু চৌদ্দ পোয়া
তিন জনার এ ঘর গড়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন-আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।
এ ঘরে কি মজার সন্ধি
জলআগুনে–করেছে বন্দি।
বইছে উনপঞ্চাশ পবন,
জীবেরে ধরে রেখেছে
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।
ঘরে পঞ্চভূত আর ষড়রিপু
তায় এগার জন বসেছে
তাঁরা হাসায় কাঁদায় নাচায় গাওয়ায়
সুফল কুফল দুই রয়েছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।
(এ) ঘরে সুমতি কুমতি দুজন।
দিবারাতি বাস করেছে
তাঁরা ইচ্ছা জ্ঞানে ভাঙে গড়ে (ঘর)
ক্ষ্যাপা পূর্ণানন্দে প্রাণ সঁপেছে।
আমার ঘরের বাঁধন আঁটা
সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।
কত শক্ত করে বেঁধেছে ঘর,
কেউ কিরে তাঁর ঠিক দিয়েছে।।
খ্যাপার আশ্রমেই রাখাল দাস বাউলের মুখে শুনেছিলাম এ গান। সন্ধ্যার ক্রিয়াকর্মের পরে গান ধরেছিলেন রাখাল দাস। বেদনাশা বটের প্রদীপ তখন অজয়ের হাওয়ায় এদিক-ওদিক করে কাঁপছে। এরই মধ্যে রাখাল দাস গান ধরেছেন। একতারাতে সুর উঠেছে। আমার শরীরেও হাওয়া এসে লাগছে অজয়ের। গৌরীবাবু এই আশ্রম থেকেই দীক্ষিত। তিনিও ছিলেন সেদিন পাশে। আমি ধরে দাঁড়িয়ে আছি গৌরীবাবুর ছেলে সুজীবকেই। ও আমার বন্ধু। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির সুজীব। সন্ধ্যেবেলাতে একেবারেই দেখতে পায় না ও। আস্তে আস্তে ওর চোখের সব নাড়িগুলোই শুকিয়ে যাচ্ছে। আমিই ওকে ধরে আশ্রম থেকে বেদনাশা বটের কাছে নিয়ে এসেছি। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে আমরা দাঁড়িয়ে। গরমের ক্লান্তি অনেকখানি দূর করে দিচ্ছে অজয়ের হাওয়া। ফাঁকা নির্জন চারপাশ। সংক্রান্তির ভিড় এ সময় এলে কল্পনা করা যাবে না। আমি ভাবছি সুজীব তো এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ও কি রাখাল দাসের কথা অনুযায়ী নিজের ঘরের বাঁধনখানা দেখতে পাচ্ছে? এ বাঁধন আমাদের কাছে তো একেবারেই অনুভবের বাঁধন। সাধক বাউলের কাছে। ক্রিয়াকরণের উদ্দেশ্যে পথ নির্দেশিকার বাঁধন। শরীরকে জানা, বোঝার বাঁধন। গিঁট খুলে স্থূল শরীরকে প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ স্তরে নিয়ে যাওয়ার বাঁধন।
‘ঘর’ এখানে শরীর। ‘গিরে’ হল গিঁট। ‘সাড়ে তিন কোটি’ গিরে শরীরের মধ্যেকার সাড়ে তিন কোটি নাড়ি। যেগুলো সব শরীরকে বেঁধে রেখেছে। তাঁর জন্যই খ্যাপা বলছেন ‘আমার ঘরের বাঁধন আঁটা/ সাড়ে তিন কোটি গিরে রয়েছে।।’ ‘সার্ধলক্ষত্ৰয়ং নাড্যঃ সন্তি দেহান্তরে না।‘ লক্ষ নাড়ি দেহের অভ্যন্তরে রয়েছে। যা হল বাউলের ঘর। ঘরের সপ্ততালা শরীরের সাত ধাতুর একেকটি মৌল। যাকে তালা বা পর্যায় হিসাবে। দেখাচ্ছেন খ্যাপা। মৌলগুলোর কথা আমরা আগেও বলেছি। ‘নয় দরজা’ নখানা দরজা। সে সম্পর্কেও বলা রয়েছে আগে। ‘চৌদ্দ পোয়া’র পরিমাণ চৌদ্দটি গুরুত্বপূর্ণ সেই নাড়ি। ‘তিন জনার এ ঘর’–চোদ্দ নাড়ির মধ্যে প্রধানা তিন নাড়ি। ঘরের সন্ধি ‘জল আগুনে’র সন্ধি। ‘জল’ এখানে রজ। ‘অগ্নি’কে তেজ না ধরে বীর্যস্বরূপ হিসাবে দেখছি। উনপঞ্চাশ’ বায়ুর বিষয়ে আসছি। আগে বলি, শাস্ত্র সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ির নির্দেশ দিচ্ছে। খ্যাপা সাড়ে তিন কোটি বলছেন কেন? বলছেন, এ কারণেই ঘরের সামগ্রিক ব্যাপ্তি দিতে চাইছেন তিনি। কোটি হল অঙ্কের হিসাবে শেষ নির্ধারক। তাই খ্যাপা কোটিতে এসে ঠেকেছেন। ‘চোদ্দ পোয়া’কে গোটা শরীরের পরিমাপও বলতে পারি।
‘বায়ু’ যোগক্রিয়ায় অনিবার্য এক ব্যাপার। বাউল বলেন ‘দমের কাজ’। দম কথার অর্থ নিশ্বাস-প্রশ্বাসকে রোধ করা। গুরুর কথামতো তাঁরা প্রথমে শ্বাসক্রিয়া বা প্রাণায়াম রপ্ত করেন। পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে আছে–’তস্মিন সতি শ্বাসপ্রশ্বাসইয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়াম।‘ অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতি ভঙ্গ করে শাস্ত্রোক্ত নিয়মে অভ্যাস বা বিধৃত করার নাম হল প্রাণায়াম। প্রাণ বায়ু আর অপান বায়ু। দ্বয়ের সংযোগ। শ্বাসের এই যুগল ক্রিয়া শরীর সাধনার যুগল দেহের আনুরূপ্য আরও ঈষৎ রূপকেই যেন বিস্তার করে। ‘প্রাণাপানসমাযোগঃ প্রাণায়াম ইতীরিতঃ/ প্রাণায়াম ইতি প্রোক্তো রেচকপূরককুম্ভকৈঃ।।‘ প্রাণায়াম বলতে আমরা সাধারণত রেচক, পূরক, কুম্ভকের কথাই বুঝি। বাউলও এই তিন প্রাণায়ামের কথাই বলেন। চণ্ডী গোঁসাইয়ের গানেই আছে–’ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্নাতে/ রেচক পূরক কুম্ভক তাতে/ দেখিস যেন এক নাড়িতে/ ভাবিসনে তিন সেরে যাই।‘
গুরুর নির্দেশে শিক্ষানবীশ বাউল প্রথমে বাঁ নাকের সাহায্যে বাইরের বাতাসকে টেনে এনে শরীরের অভ্যন্তরে রেখে ধীরে ধীরে ডান নাক দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই যে বাইরের বাতাসে শরীরের অভ্যন্তর পূর্ণ হচ্ছে সেজন্য এর নাম পূরক। শরীরের ভেতরে এই যে বাতাস ধরে রাখা তা অনেকটা কলসিতে জল ভরে রাখার মতই। তাই এর নাম কুম্ভক। আর বাতাসকে যখন ডান নাক দিয়ে নিয়ে বাঁ নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে তখন তাঁর নাম রেচক। এই ক্রিয়া বাউলকে শিখতে হয়, এতে সমস্ত নাড়ি পরিশুদ্ধ হয়ে সুষুম্না দিয়ে সোজা উপরে উঠতে আরম্ভ করে। উর্ধ্বপথ এভাবেই তৈরি করে নিতে থাকেন শিক্ষানবীশ বাউল। এই উধ্বযোগেই বিন্দুধারণ শক্তি অর্জন করা যায়।
শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য বাউলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কতবার এই প্রাণায়াম করতে হয়?
তিনি দাঁতহীন গালের দুদিকে হাসিতে সেই গর্ত বুজিয়ে কিছু পর আমাকে বললেন, এই করণকৌশলের নানা নিয়ম আছে। গুরুর কাছে এসবই শিখতে হয়।
বললাম, আমাকে করণকৌশল জানতে হবে না। যদি বাধা থাকে বলতে। শুধু বলুন দিনে কতবার এই প্রাণায়াম করতে হয়?
তিনি আমাকে ভাসা ভাসা ভাবে তিন আসনের কথা বলে বললেন, এই সব প্রাণায়াম প্রথম-প্রথম আট, তারপর বাড়িয়ে ষোলোষোলোর পর দ্বিগুণ, এরপর আবারও দ্বিগুণ।
বুঝলাম আট, ষোলো, বত্রিশ তারপর একেবারে চৌষট্টিবার করতে হবে। বাউলের ভাষায় যে যতক্ষণ ‘দম’ রাখতে পারবে সে তত তাড়াতাড়ি সিদ্ধ স্তরে উঠে যাবে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে চরিত্র বিশ্লেষণের সুন্দর এক গল্প আছে। বাউলের এই দম ক্রিয়াটির সেখানে উল্লেখ আছে ‘দ’ এর প্রতীককল্পে। গল্পটি এরকম–প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে একবার দেবতা, মানুষ, অসুরেরা এসে বললেন, আপনি কিছু আমাদের নির্দেশ দেন। যা আমাদের কাজে লাগবে।
ব্রহ্মা দেবতা, মানুষ, অসুর–সবাইকেই বললেন কেবল ‘দ। বলে বললেন, কিছু বুঝলে তোমরা?
সকলেই ঘাড় নাড়লেন।
ব্রহ্মা প্রথমে দেবতাদের বললেন, কী বুঝেছ তোমরা সাংকেতিক এই ‘দ’ এর দ্বারা।
দেবতারা বললেন, আপনি ‘দ’ এর মাধ্যমে আমাদেরকে দমের কথা বোঝাতে চাইছেন।
তিনি বললেন, হ্যাঁ। তোমরা সব ঠিকই বুঝেছ।
দম হল এখানে বাউলের ‘বায়ু’র দ্যোতক নয়। দম হল সংযম। দেবতাদের যা একেবারেই ছিল না।
মানুষরা ‘দ’ এর মানে বুঝলেন দান। কারণ তাঁরা স্বভাবতই একটু লোভী প্রকৃতির। অসুরেরা ‘দ’ এর মানে বুঝলেন দয়া। যা তাঁদের একেবারেই ছিল না। যেটা এখানে বলতে চাইছি তা হল, প্রতীককল্পকেই দেহসাধনা বার বার চিহ্নিত করে। এই চিহ্ন মনের গ্রথিত পাণ্ডুলিপিকেই যেন ছেপে বের করা। মন তাঁর চিন্তাকে, ভাবনাকে, উপলব্ধিকে, বিশ্বাসকে যোগক্রিয়ায় ছেপে বের করে দিচ্ছে। এই ক্রিয়াকে সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে বায়ু খ্যাপা উনপঞ্চাশ বায়ুর কথা বলেছেন। এই বায়ুগুলো আমাদের শরীরের ভেতরই বিরাজমান। উনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান ও উদান, এই পাঁচ বায়ুই প্রধান। এই পাঁচটির মধ্যে আবার প্রাণ ও অপান এই দুই বায়ু প্রধান প্রাণ বায়ুতে শ্বাসক্রিয়া হয় ইড়া নাড়িতে। এই নাড়ি জ্ব-মধ্যে আজ্ঞাচক্রের বাঁ দিকে আসে মূলাধার থেকে। এসে সে মেরুদণ্ডকে জড়িয়ে ধরে। অপান বায়ুতে শ্বাসক্রিয়া হয় পিঙ্গলা নাড়িতে। পিঙ্গলা মূলাধারচক্রের বাঁ দিকে কিন্তু উধ্বমুখ বজায় রেখে আজ্ঞাচক্রকে ডান দিকে রাখে। শ্বাস যখন নেওয়া হয় অপান বায়ু প্রাণ বায়ুকে টেনে নীচের দিকে নামায়। শ্বাস যখন ছাড়া হয় তখন প্রাণবায়ু অপান বায়ুকে উপরের দিকে টেনে তোলে। এতেই সাধকের উধ্বযোগ রপ্ত হয় ভালো করে। উনপঞ্চাশ বায়ুর ভেতর এই প্রধান বায়ুদ্বয়ই সাধনক্রিয়ায় সাহায্য করে থাকে বেশিমাত্রায়।
‘সপ্ততালা’কে সাত ধাতুর সমষ্টি হিসাবে দেখেন বাউল। শরীরের সাতটি উপাদান মিশিয়ে এই সাতটি স্তর। কিন্তু আমার মনে হয় ‘সপ্ততালা’কে আজ্ঞাচক্রের উপরিভাগ হিসাবে দেখা ভালো। ছটি চক্র পেরিয়ে শক্তি উপরে উঠে যাচ্ছে সপ্ততালাতে। যেটা লালন চক্র। এখানে চৌষট্টিদল বিশিষ্ট পদ্ম আছে। বৃত্তি আছে বারোটা। শ্রদ্ধা, সন্তোষ, স্নেহ, দম, মান, অপরাধ, শোক, খেদ, অরতি, সন্ত্রম, উৰ্ম্মি ও ঔদ্ধতা। এরপরই শক্তি গুরুচক্র ছুঁয়ে সহস্রারে প্রবেশ করে। যেখানে গেলেই সাধকের নির্বাণপ্রাপ্তি, চিন্তামনি দর্শন, এই সব হয়। তাই আজ্ঞাচক্রের উপরে শক্তি ওঠা মানেই সপ্ততালায় প্রবেশ করা। নটা চক্রকে যদি শরীরের নটা ধাপ হিসাবে দেখি। আর সেটাই তো দেখা উচিত অন্তত বাউল সাধনে। শরীর তো সেখানে ঘরবাড়ির নামান্তর। হাসন রাজার একখানা গান আছে–’লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালো না আমার/ কী ঘর বান্ধিমু আমি শূন্যেরই মাঝার।‘ হাসনের এই বেদনাময় উপলব্ধি ধরেই বলি, খোদা এ ঘর বানিয়েছেন ঠিকই কিন্তু এ ঘরের তদারকি গুরু দেখানো পদ্ধতিতে ঠিকমতো না হলে তা সেই ‘ঘরবাড়ী ভালো না আমার’ই হবে। সাধকের কাছে এই অকৃতকার্যতা অনুতাপের। তাই তো বাউলের নানা গানে, আলোচিত খ্যাপার গানেও ‘ঘরবাড়ি ভালা’ রাখার নির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছেন সিদ্ধ বাউল। শিষ্যদের মঙ্গলের জন্যই তাঁদের এ সমস্ত করা।
শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য প্রাণায়াম চৌষট্টি বার করতে বলেছেন কেন? এই প্রশ্ন স্বভাবতই মনে আসতে পারে। বাউল তাঁর অনেক গানেই ‘চৌষট্টি গলির কথা বলেছেন। চৌষট্টি গলি রক্তবাহী প্রধান চৌষট্টিটি ধমনী। শ্বাসক্রিয়া এগুলোতে ঠিকমত ছড়ানোর জন্যই এই বিধি। আট বার প্রথমে করতে বলার নির্দেশ। যেটা মনে হয় ‘অষ্টশক্তি’কে জাগিয়ে দেবার জন্যই বোধহয় আটবার করতে বলা। ষোলবারের ব্যাখ্যা দিতে পারি এইভাবে–শরীরের ষোলোটি প্রধান ধমনী। চারটি হৃদপিণ্ডের আ বাঁকি বারোটি শরীরের অন্যপ্রান্তের। এখানেও শ্বাস ছড়ানো দরকার উর্ধ্বযোগের জন্য ঠিকমতো। বৈষ্ণব সাধকও প্রাণায়াম করেন। মহেশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সনাতন বাবাজি ষোলো বার প্রাণায়ামের বিধিকে ষোলো নাম আর বত্রিশ বার করাকে বত্রিশ অক্ষরের সদৃশ মানে তাঁকেই স্মরণ করা বলে আমাকে বলেছিলেন। এই ষোলো নাম–হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। তা বত্রিশ অক্ষরের হয়ে থাকে। প্রথম ধাপটি অর্ধাংশ আট বারের। একে আট বার করার সঙ্গে মেলাতে পারি আর নাম দু’বার সম্পূর্ণ জপলে চৌষট্টি হয়ে যাচ্ছে।
ঘরে পঞ্চভূত আর ষড়রিপুর কথা খ্যাপা বলেছেন। যার যোগফল এগারো জন সদস্যের। যারা ‘হাসায় কাঁদায় নাচায় গাওয়ায়’–অর্থাৎ কিনা এই পাঁচটি উপাদান। শরীরের পাঁচচক্রে জড়িয়ে গিয়ে সাধককে সিদ্ধিতে বা অকৃতকার্য হতে সাহায্য করে। ষড়রিপুর ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য। সাধককে তো কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের উপরে উঠতে হয়। পাঁচটি উপাদানের ক্ষিতি থাকে মূলাধারে, অপ স্বাধিষ্ঠানে, তেজ মণিপুরে, অনাহতে মরুৎ এবং বিশুদ্ধচক্রে ব্যোম অবস্থান করে। এই পাঁচ চক্রে পঞ্চভূতের এই ধ্যানে উধ্বগতির যোগ চলতে থাকে। আর এসব ঠিকমতো সাধক না করতে পারলেই কাঁদা হাসার প্রশ্ন। আর ঠিক হলে নাচা-গাওয়ার। অর্থাৎ কিনা সিদ্ধ স্তরে অগ্রগতির আনন্দ। ঘরে কুমতি সুমতির বাস। সুমতি হল সিদ্ধ মতি। যা অগ্রগতি ঘটাবে। আর কুমতি হল পশ্চাৎগমন। যা সাধককে ঠেলে নামাবে নীচে। এই নীচে নামানো হল কুমতি। মানে বীর্যের নিম্নগতি। ‘সুমতি ঊর্ধ্বারে’ অবস্থা। তাঁদের ঠিকমত চালনা না হলেই ঘর ভাঙাগড়ার প্রশ্ন। এই গড়া-ভাঙার ইচ্ছা সাধকেরই হাতে। গুরু তাঁকে পথ দেখান মাত্র। সঠিক পথে ‘পূর্ণানন্দে প্রাণ’ একীভূত হয়। এই আনন্দ সিদ্ধস্তরেরই ছায়ানুবাদ। খ্যাপা তাঁর কথাই বলতে চেয়েছেন পদে। যেখানে উন্মীলিত সৌন্দর্যের সুধাকনা আছে। স্তব্ধ, ছায়াচ্ছন্ন। হয়ে ভাবলেই তাঁর ছবি ফুটে উঠতে পারে মনে। বাউলের গান সেই ছবিরই প্রতিলিপি হাজির করতে চায় সব সময়, সকল সময়।
গানে কথিত পূৰ্ণানন্দকে আমরা ভাবতে পারি এভাবেও–নটি চক্রের শেষ চক্র সহস্রার। এই চক্রের ধ্যানেই সাধক পরমাত্মা বা মূলসত্তার স্বরূপ ধরতে পারেন। মূলাধারের আগত শক্তি সহস্রারে এসে মিলিত হয়ে সাধকের মধ্যে এক তেজোময় দীপ্তি ফুটে ওঠে। এই দুই চক্রের সংযোগে সাধক এই সৌন্দর্য্যের বা নিরাকার মহাশূন্যতার। শোভা উপভোগ করেন। এই শোভা উপভোগকেও আমরা পূর্নানন্দ হিসাবে দেখতে পারি। বায়ুসাধনা বা প্রাণায়াম বাউল সাধক যে বলছেন আট, ষোলো, বত্রিশ, চৌষট্টি বার করতে। এটাও চার গুণিতকে বেড়ে যাচ্ছে অঙ্কের হিসাবে। চৌষট্টির পর একশো আট বার। শশাঙ্ক দাস তা না বললেও, বেশি বার করার অর্থই উধ্বরে অবস্থাতে দ্রুত পারঙ্গমতা। তাই চৌষট্টির পর আর করা যাবে না এ কখনওই ঠিক না। নইমুদ্দীনের গানে আমরা তাঁরই উল্লেখ পাই–’এক দুই তিন হবে চারি তাহাতে দুই গুন করি/ চতুর্থ গুণ করলে পরে নির্বাস হয় ভারি।।/ সাধ্যমতি উর্ধ্বগতি তখন খেলিবে রূপের কাঞ্চন।।/ ও সে নইমের বচন তিন বীজে প্রাণায়াম/ অধঃলিঙ্গে উধ্বশৃঙ্গে কি লিঙ্গে মিলন/ কুম্ভক পুরা হবে সারা। বললাম তোরে বিবরণ।।‘
শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে দিঘরাতে প্রতিবারই বসে বাউল গানের আসর। একবার এই আসরেই ষষ্ঠী খ্যাপার গান শুনেছিলাম। নানা গানের মাঝে তিনি সেদিন একখানা খ্যাপার গানও গেয়েছিলেন। খ্যাপা মনোহরের গান তিনি আরও অনেক আসরেই গেয়েছিলেন। আমার বহুবার এই গানখানা তাঁর মুখে শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।
ষষ্ঠী খ্যাপা ভাবোন্মাদ থাকেন সব সময়। যত বারই কথা বলেছি তাঁর সঙ্গে সেরকমই আমার মনে হয়েছে। গেরুয়া পরেন না তিনি। নানা রঙের তালি লাগানো জোব্বা পরে মঞ্চে ওঠেন। তাঁর নাচ সাধারণত বাউল নাচের যে আঙ্গিক সেরকমটি একেবারে নয়। তাঁর নাচের কৌশল ভিন্নতর। মঞ্চে অনেকখানি জায়গা জুড়ে গোল ঘূর্ণাবর্তকে ভেঙেচুরে তিনি নাচেন। যা বাউলরা একেবারে করেন না।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মন্ত্রদীক্ষার মত কী আপনার?
বলেছিলেন, বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত আমি। এখনও গাঁয়ে-গাঁয়ে মাধুকরী করেই বেড়াই। তবে বাউল শিক্ষার জন্য তিনি অনেকেরই কাছে ঘাঁটি গেড়েছিলেন। বেশ কিছু নাম বলেছিলেন সে সময়।
দিঘরাতেই তাঁর বাড়ি। তাই এ আসরে রাত করেই তিনি মঞ্চে ওঠেন। বহিরাগত বাউলদের গাওয়া হয়ে গেলে। বলা ভালো, তাঁর টানেই এরা এখানে আসেন। মাঝরাতে তিনি সেবার ধরেছিলেন খ্যাপার গান। গানের মাঝে মাঝে কিছু প্রতীকের রূপকল্পকে সামনে আনছিলেন। শুনতে বেশ ভালোই লাগছিল। গাইছিলেন তিনি খ্যাপার গান। একতারাকে বাজিয়ে নিয়ে নাচে যেন সারা শরীরই বাজিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি।
শুনরে (তোরা) ক্ষ্যাপার কথা–
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট।
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যাথা।।
শুনরে তোরা খ্যাপার কথা।
চব্বিশের ছয় ছেড়ে দিয়ে…
এবার, যুক্তি কর যেথা সেথা।
বাহান্নর চার বাদ দিয়ে দেখ
(তোরা) পাবি নিজের মনের কথা।
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা।
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।
একশ আটের চব্বিশ বাদে
গণনাতে হয় চুরাশি
সাধক সিদ্ধ মহাপুরুষ
কথায় বলে একাই আসি
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা।।
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।
বিশ্বজুড়ে দেখনা ঘুরে
(আছে) চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের কথা।
অষ্টাদশে শ্রীমদ্ভাগবত
(ক্ষ্যাপা) গুরুশিষ্যের স্বার্থকতা–
শুনরে (তোরা) ক্ষ্যাপার কথা।
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ, ক্ষেপীর আট বল,
এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।
শুনরে (তারা) ক্ষ্যাপার কথা।।
যায় বাহান্ন তায় তিপান্ন
ওই দেখ আছে পঞ্চ, তত্ত্ব গাঁথা।
(ক্ষ্যাপা) সহস্র দল দেখবি হেথা–
শুনরে তোরা ক্ষ্যাপার কথা
ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।
তিনি বলেছিলেন, খ্যাপার চৌদ্দ হল গিয়ে আমাদের শরীরের দশ-দশটা ইন্দ্রিয় আর চারভূত। খেপীর আট অষ্টপাশ।
অষ্টপাশ বললেন তিনি–ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল, মান।
প্রচলিত এক প্রবাদের কথা আমরা সকলেই জানি–’লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়।‘ বাউলও তাই বিশ্বাস করেন। তান্ত্রিক সাধকদেরও এমতে পূর্ণ আস্থা আছে।
খ্যাপা ব্রহ্মানন্দ আমায় বলেছিলেন, আগে পাশমুক্তি। পাশমুক্তি না হলে সাধন হবে না।
অমাবস্যার রাতে নিঝুম গৌরনগর শ্মশানে যজ্ঞে বসবেন তিনি। কুণ্ড তৈরি করতে তখন ব্যস্ত। জিজ্ঞাসা করলাম, বাবা বুঝিয়ে বলুন। এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি আমার নানা জিজ্ঞাসা, কৌতুহলের উত্তর দিয়েছেন।
বললেন, পাশ হল বন্ধন। এই বন্ধনই তোমার স্বরূপকে বাউরে আসতে দিচ্ছে। লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষুধা, নিদ্রা, ভয়, ক্রোধ, কাম প্রভৃতি নানারকম পাশ আছে। তাঁর উর্ধ্বে যেতে হবে। ছিঁড়ে দিতে হবে বন্ধন।
বললাম, কীভাবে ছিঁড়বে এই বন্ধন?
শ্লোক আওড়ালেন বাবা: ‘পাশবদ্ধো ভবেৎ জীবঃ, পাশমুক্তঃ সদা শিবঃ।‘
হোমকুণ্ডে যন্ত্র আঁকছিলেন তখন বাবা। রেড়ির তেলে জ্বালানো প্রদীপের শিখা তখন কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে, বেঁকেচুরে আবার জ্বলছে সোজা হয়ে। হাওয়া থামলে স্থির হয়ে যাচ্ছে শিখা। তবে সেটা দু’এক মিনিটের জন্য। অদূরে গঙ্গার হাওয়ার আজ সেইভাবে নেই বিরাম কোনও শিখা কাঁপছে। সেই কাঁপা শিখার আলোতে দেখলাম বাবা একটি সোজা ত্রিভূজ এঁকে তার উপর উল্টানো ত্রিভূজ আঁকছেন। তাদের গায়ে সোজা-উল্টো অসংখ্য ত্রিভূজ।
আঁকতে আঁকতেই বললেন, মনে কর ভয়ের পাশ থেকে মুক্ত হতে হবে, তার জন্য অমানিশায় শবের উপর বসে একমনে ধ্যান করতে হবে। কাম জয় করতে ভৈরবী মা’র সঙ্গে সম্পূর্ণ উত্তেজিত অবস্থায় মৈথুনের ভেতরই জপে মগ্ন হতে হবে। আমার গুরুর গুরুদেব শ্মশানে মরা এলে তার মাথা ফাটানোর সময় চিতার সামনে এসে দাঁড়াতেন। খুলি ফাটলেই সেই রস তিনি নিয়ে রাখতেন পাত্রে। পরে ভাতের সঙ্গে মেখেমুখে খেতেন। ঘেন্না পেলে চলবে?
বাউলের অষ্টপাশের সঙ্গে তন্ত্রের অষ্টপাশে কিছু হেরফের আছে। কারণ বাউলকরণ, সাধন তন্ত্রসাধনের মতো অত ভয়াবহ ক্রিয়া কখনওই নয়। বিভৎস রস সেখানে বেশ কম।
খেপীর আট অষ্টপাশ সাধক ও সাধনসঙ্গিনীকেও পেরোতে হয়। ব্রহ্মানন্দ যে মরার মাথার খুলির রস খাবার কথা বলছিলেন অঘোরী সাধুরা তা খান। তন্ত্রক্রিয়া শ্মশানে করতে হয় কেন? একবার ব্রহ্মানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি। তিনি কিছু উত্তর দেননি। শুধু নিজের দেহকে বার বার দেখাচ্ছিলেন।
বললাম, দেহকে শ্মশানরূপ দিতে চাইছেন কি?
কিছু বললেন না তিনি।
তার ভৈরবী ছিলেন মানদা মা।
মা গলায় একটা স্নেহময়ী সুর নিয়ে বললেন, ঠিক ধরেছিস তুই।
বললেন, শ্মশান আসলে আমাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, মান, রাগ, দ্বেষ–এই সব থেকে মনকে বের করে আনা। মনকে ধুয়ে মুছে নির্জন ধূ ধূ করে দেওয়া। শ্মশানপুরীর রূপ দেওয়া। মনের কামনাকে পুড়িয়ে দাওয়াই হল শ্মশান। তন্ত্রক্রিয়া পাশমুক্তির সাধনা। তাই শ্মশানেই করতে হয় বেশিরভাগ ক্রিয়াকর্ম।
‘অষ্টপাশে’ বাউল ’জাত কুল’কে ধরেন। তান্ত্রিক তা ধরেন না। তাঁরা আবার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা–এভাবেও ‘অষ্টপাশ’ বলেন। তবে ব্যাপার কিন্তু ঘুরে ফিরে মনের কামনাকেই সংবেদন ও বোধের মাঝখান থেকে টেনে বের করে আনা বোঝায়। কী তন্ত্রে, কী বাউলে।
‘জাত কুল’ বাউল ‘অষ্টপাশে’ আনেন বোধহয় এই কারণেই, তথাকথিত যাতে তাঁরা বিশ্বাস রাখেন না বলেই। পাঞ্জু শাহের গানেই আমরা পাই–’জেতের বড়াই কী/ ইহকাল-পরকালে জেতে করে কী–/ আমার মন বলে অগ্নি জ্বেলে দিই জেতের মুখি।‘
পাঞ্জু ‘জেতের মুখি’ অগ্নি জ্বাললেও মূলত তফসিল পরিবার থেকেই তাঁরা আসেন বেশি। বর্ণহিন্দু, বৈষ্ণব ও মুসলমান পরিবার থেকেও বাউল উঠে আসেন। বৈষ্ণব পরিবার থেকে অনেকে আসেন বলেই বোধহয় বৈষ্ণবীয় আচরণ তাঁরা বাউল-আচরণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। মুসলমান পরিবার থেকে উঠে আসা বাউলরা তাঁদের গানে আরবি, উর্দু, মুসলমানি শব্দকে ব্যবহার করেন অকাতরে। তবে ফকিরি গানে এর আধিক্য বেশি দেখা যায়।
বিশ্বাস করেন বীর্য প্রকৃতি বা সৃষ্টির জড় উপাদান। তাই তা ভক্ষণ করাও উচিত। শিক্ষার্থে তাঁরা গুরুর নির্দেশে শরীরের জিনিস শরীরের মধ্যে ফিরিয়ে আনেন। সকালবেলাকার বিষ্ঠা থেকে খানিক তুলে মুখে দেন। বাকিটা ফেটিয়ে মাখনের মতো করে ফেলেন। তাতে বদ গন্ধ কমে। তা গায়ে-মুখে-চোখে-নাকে সর্বাঙ্গে মেখে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে স্নান করে পরিষ্কার হন। পেচ্ছাব/প্রস্রাব মাটির হাঁড়ি বা নারকেল মালাতে ধরে খেয়ে শরীরের মধ্যেই ফিরিয়ে নেন ফের। ‘অষ্টপাশ’ না ঘুচলে এ কখনও সম্ভব নয়। তবে এখনকার বাউল এই আচরণ কতটা পালন করেন যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাউল সাধনে গানই পুরনো সিদ্ধ স্তরের মানুষজনদের লেখা। এখনকার বাউল যে গান লেখেন তাতে চটকদারি কথাবার্তা যত থাকে সাধনতত্ত্বের কথা সেভাবে থাকে না। এরকম গান আমরা আকছার শুনতেও পাই। বাউল বলেন, শ্রোতারা এখন এসবই পছন্দ করেন। তাই আমরা লিখি, সুর করি, গাই। যার জন্য বাউল আসরে এখন ‘সাইকেলের মধ্যে চাকা দু’দিক ফাঁকা’, ‘বন্ধু আমার রসিয়া’, ‘এঁড়ে গরু বেড়া ভেঙে খেজুর গাছে চড়েছে’–এসব গানও শোনা যায়। তবে শখের বাউলরাই শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য এসব পরিবেশন করেন বেশি। যারা দশ-কুড়ি বছরের বেশি বাউল গান করছেন, গানকেই পেশা হিসাবে নিয়েছেন, হয়তো কিছু আচরণও পালন করছেন জীবনে, তাঁরা কিন্তু চট করে আসরে আজেবাজে গান গানই না একেবারে। গাইলেও আসর বুঝে গান।
খেপীর ‘অষ্টপাশের’ কথা বাউল বলেছেন। যা থেকে মুক্ত হয়ে না এলে সাধন সঙ্গিনী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। বাকি রইল খ্যাপার চোদ্দ। ‘দশ-দশটা ইন্দ্রিয় আর চারভূতের’ কথা ষষ্ঠী খ্যাপা বলেছিলেন। তবে গানের তালে তাঁকে আর ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেননি বোধহয়। না হয় গাইতে-গাইতে আবেশে, ভাবোন্মাদনায় ভুলেই গেছেন সেসব।
‘দশ-দশটা ইন্দ্রিয়’ কী? এই দশেন্দ্রিয়ের পাঁচটি হল জ্ঞানেন্দ্রিয়, বাকি পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। অর্থাৎ দশেন্দ্রিয়ের দুই ভাগ। পাঁচটি করে। জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো হল–চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক/চামড়া। কর্মেন্দ্রিয়–বাক, পাণি, পাদ, পায়ু, উপস্থ।
খ্যাপা বলছেন–’ক্ষ্যাপার চৌদ্দ ক্ষেপীর আট বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা।।‘ অর্থাৎ সাধক ও সাধন সঙ্গিনীর যুগল সাধনক্রিয়াতে কারও মাথা ব্যথা হবার কথা নয়। এ যে দু’জনের একত্র সাধনা। তাই এই সাধনক্রিয়া অপরের জানবার দরকার নেই। খ্যাপা জানুক তার এই ‘দশ দশটা ইন্দ্রিয়কে’। খেপীও চিনে নিক ‘অষ্টপাশ’কে তবেই সাধনা অগ্রগতির পথে যাবে।
তবে খ্যাপার ‘চৌদ্দ’কে আমরা মূলাধার পদ্ম কি ভাবতে পারি না? আর খেপীর আটকে যদি ‘অষ্টপাশ’ না ধরে ধরি সঙ্গিনীর আটটি প্রত্যঙ্গ–মুখ, দুই স্তন, দুই হাত, বুক, নাভি, যোনি। বাউল একে ‘অষ্টমচক্র’ও কিন্তু বলেন। আমার মনে হয় এই ভাবনাও আদতে খুব একটা ভুল হবে না।
কারণ, মূলাধারে চতুর্দশ পাপড়ির পদ্ম কল্পনা করে থাকেন সাধক। এই পদ্মে ধ্যানে,প্রাণায়ামে, শ্বাসক্রিয়ায় তিনি একেক চক্রের গাঁট খুলতে খুলতে বা পদ্মের পাপড়ি ছিড়তে ছিড়তে ক্রমশই উপরের দিকে ওঠেন আর তা উঠতে থাকলেই তো সেই বাউল কথিত জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও চারভূতকে পরাস্ত করে দিতে পারেন। আর এই চারভূত তো শরীরের চারটি চক্ৰতেই বিরাজ করে। মূলাধারেই পৃথ্বীমণ্ডল। স্বাধিষ্ঠানে বরুণমণ্ডল, মণিপুরে অগ্নিমণ্ডল, অনাহতে বায়ুমণ্ডল, বিশুদ্ধে আকাশমণ্ডল। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। যাঁদের রুদ্ধদ্বার খুলতে পারেন সাধক ধ্যানে, যোগে, ক্রিয়ায়।
‘অষ্টপাশ’কে আটটি প্রত্যঙ্গ ভাবার কারণ তন্ত্রমতে ভৈরব মৈথুনে বা ভৈরবী চক্রে ভৈরবীর এইসব প্রত্যঙ্গগুলোর পূজা সেরে নেন প্রথমে কামপাশ মুক্ত করেন সাধক বা তান্ত্রিক এভাবে। বাউলও যুগল আসনে সঙ্গিনীর তীর্থক্ষেত্র স্বরূপ মুক্ত শরীরে ভ্রমণ করেন। মোহ কাটান, কাম নিয়ন্ত্রণ করেন প্রত্যঙ্গগুলোতে প্রবেশ করে গুরু নির্দেশিত ‘শরীরই তীর্থক্ষেত্র এই ভাবনায়। তাহলে সঙ্গিনীর ‘অষ্টপাশ’কে আটটি প্রত্যঙ্গ ভাবতে দোষ কোথায়? বাউল ‘অষ্টপাশ’ খেপীকে আট দিয়ে খ্যাপার দশেন্দ্রিয়র সঙ্গে মিল দিতে চেয়েছেন। ১০+8= ‘চোদ্দ’ প্রতীককে ‘আট’ এ এনেছেন সেই ভেবেই। না হলে বাউল সঙ্গিনীকেও কিছু তো শ্বাসের কাজ শিখতেই হয় সাধককে সাহায্যার্থে। তা শিখতে শিখতেই তো মোহপাশ/ অষ্টপাশ কাটে। পাশমুক্তি হয়। তাই অষ্টপাশ ও দশেন্দ্রিয় আর চারভূতের ‘আট’ ‘চোদ্দ’কে এভাবেও প্রতীকীরূপ দিতে পারি। বাউল তা না মানলেও শরীরবিজ্ঞানকে কী করে অস্বীকার করব আমরা?
খ্যাপা ‘চব্বিশের ছয়’ ছেড়ে দিতে বলেছেন। ছয় বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। ষড়রিপু। কিন্তু চব্বিশ কী? চব্বিশ হল সেই ‘চোদ্দ’র মতই যোগফল। ষড়রিপুর ছয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় আর কর্মেন্দ্রিয় মিলিয়ে দশ, অষ্টপাশের আট। মোট চব্বিশ। এর থেকেই ছয় বাদ দিতে বলা হচ্ছে। তাহলেই নিজের মনের কথা পাওয়া যাবে। কীভাবে তা সম্ভব হবে? ষড়রিপুর ‘ছয়’ বাদ হলে জাগতিক জিনিসগুলো তো সব বাদ পড়ে যাচ্ছে। যা সাধনায় অনিবার্য। মনকে সেই স্তরে নিতে ষড়রিপু বর্জন প্রয়োজনীয়। তাই বাউল সাধক বলছেন সক্রিয় রিপুগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে নিতে।
‘চব্বিশ’কে আরেক রূপে কল্পনা করে নিতে পারি আমরা। জৈন ধর্মাবলম্বীরা চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন এই চব্বিশজনের বসবাস মানবদেহেই। কীভাবে? ছটি চক্র, ষট্যন্ত্র বা চক্রকে যারা অতিক্রম করতে পারবেন তারাই চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের দেখা পাবেন। এই মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞাচক্রকে অতিক্রম করে যাওয়াই হচ্ছে চব্বিশ। অতিক্রমে রয়েছে এক, সংসার সমুদ্র পার হবার বাসনা। দুই, সংসারের অপরিপূর্ণতা। তিন, পেরিয়ে যাওয়া। চার পূর্ণতা। এই চারকে সাঙ্গ করে ছয়কে দিয়ে গুণ দিলেই বেরোবে চব্বিশ। ৬x ৪=২৪।
একশ আটেরও চব্বিশ বাদ দিতে বলেছেন খ্যাপা। ‘একশো আট’ হল চক্র সমষ্টি। মূলাধারে চতুর্দল, স্বাধিষ্ঠানে ষড়দল, মণিপুরে দশদল, অনাহতে দ্বাদশ দল, বিশুদ্ধে ষোড়শদল, আজ্ঞায় দ্বিদল। যোগ করলে দাঁড়ায় একশো। (১৪+১৬+১০+১২+২৬+২) =১০০ আর অষ্টপাশের আট যদি নিই তাহলে সর্বমোট একশো আটই হয়। ১০০+৮=১০৮। চব্বিশ বাদ ধরি এইভাবে ১০+৪+৮=২৪। জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়ের দশ,চারভূতের চার, অষ্টপাশের আট। হল গিয়ে সর্বমোট চব্বিশ।
আবার গুরুচক্রে শতদল বিশিষ্ট পদ্ম থাকে। এইটি অষ্টম চক্র, তাহলে শতদল। আর অষ্টম চক্রের আট যোগেও একশো আটই হয়। ১০০+৮=১০৮। এই পদ্মে ধ্যানে বসলে সাধক গুরুর কৃপায় সর্বসিদ্ধি ও দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। এখানে ধ্যানে খ্যাপার গানের কথানুযায়ী সাধক সিদ্ধ মহাপুরুষ’ হন।
সাধক বলে থাকেন এটি একটি হংসপীঠ। গুরুপীঠও বলতে শুনেছি আমি অনেককে। গুরুপীঠ কেন? গুরুচক্রের মধ্যে যে শতদলবিশিষ্ট পদ্মের কল্পনা তার কর্ণিকায় ত্রিকোণমণ্ডল থাকে। তিনটি বর্গের তা–হল,ক্ষ। এই মণ্ডলকে যোনিপীঠ ও। শক্তিমণ্ডল বলে। ওই শক্তিমণ্ডলের মধ্যেই তেজোময় কামকলামূর্তির দেখা মেলে। তেজোময় জ্যোতিকে হংস স্বরূপিনী করে নিচ্ছেন সাধক। এই হংস শ্বেতবর্ণের। ধবধবে সাদা রঙের। শরীর জ্ঞানময়ের। পাখা দুটি আগম, নিগমের। পা দুটি শিবশক্তিময়, চক্ষুদ্বয় প্রণবস্বরূপ, নেত্র ও কণ্ঠ কামকলাময়। এই হংসই গুরুদেবের পাদপীঠ স্বরূপ। এই হংসের উপর গুরুবীজ ঐং আছে। বলা হয় গুরুদেব স্বয়ং এখানে অবস্থান করেন। তার বাঁ দিকে গুরুপত্নীও রয়েছেন।
হংস’র এই যে রূপকল্পনা তা মনে হয় শ্বাসবায়ুরই কল্পনা। আমাদের শ্বাস ও প্রশ্বাসে যে শব্দ হয় তার রূপ ‘হং’ ও ‘স’। এই ‘হং’ ও ‘স’ যদি সরলরেখায় হয় তাহলেই কুম্ভক হয়।
গানে খ্যাপা, ‘চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের কথা’ও বলছেন। চুরাশি সংখ্যার কথাও আছে। চুরাশি যোনি শরীরে চুরাশিটি আঙুল। ৮৪ লক্ষ বিভিন্ন যোনিতে জন্মের পর মানুষ জন্ম হয় বলে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে। একশো আট থেকে চব্বিশ বাদের এই হল প্রতীকময়তা। ‘চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ড’কে শরীরের প্রধান চোদ্দটি নদীরূপী নাড়িও ভাবা যেতে পারে। তার মধ্যে প্রধানা তিন নাড়ি ইড়া/গঙ্গা, পিঙ্গলা/যমুনা, সুষুম্না/সরস্বতী। সাধক বলেন ত্রিবেণী। এই তিন নদীরূপী নাড়িকে জাগিয়ে দিয়ে সাধক বাহ্য স্নান সারেন। আর এই স্নানে অর্থাৎ তিন নাড়িকে ঠিকমতো যোগক্রিয়ায় জাগাতে পারলে মহাশক্তির বিকাশ ঘটে। যা চার বেদ চোদ্দ শাস্ত্রের জ্ঞান হয়। ‘চোদ্দ ব্রহ্মাণ্ড’কে এই প্রতীকেও রাখতে পারি আমরা। কিন্তু সঠিক হিসাবে রাখতে গেলে চৌদ্দ ব্রহ্মাণ্ডকে ধরতে হবে শরীর। মদন শা ফকিরের গানেও তার প্রকাশ পাই–’জান গা কোথায় হাওয়ার স্থিতি। / ও তার চৌদ্দ পোয়া চৌদ্দ ভুবনে কে কোথায় করে বসতি।।’ চোদ্দ ভূবন–ও দেহভাণ্ড। ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপ তা। ‘চোদ্দ পোয়া’ও কিন্তু শরীরের গড়ন। মানে হল সাড়ে তিন হাত। আমরা সবাই মৃত্যুর পর সাড়ে তিন হাত জমির কথাই বলি। লোকায়ত গানেও তার প্রকাশ আছে। এটাও একটা প্রতীককল্প। বলি এই কারণেই, যার যার নিজের হাতের মাপে তার শরীর সাড়ে তিন হাতই। তাই ওটুকু জায়গা না হলে পোড়াতে, গোর দিতে, সমাধিস্থ করতে শরীরকেই আটানো যাবে না।
খ্যাপা বলেছেন–’যায় বাহান্ন তায় তিপান্ন/ ওই দেখ আছে পঞ্চতত্ত্ব গাঁথা।‘ কী এই সংখ্যা? বাহান্ন বা তিপান্ন হল–রস বহন করা বিভিন্ন নাড়ি। এই রস নারী শরীরের রজ। বাউল ‘তিপান্ন গলি’ বলতে গানে বোঝান সঙ্গিনীর/ নারীর শরীরের রূপকল্পকেই। ফিকিরচাঁদ সরকার ওরফে চাদমুদ্দিনের গানেও তার প্রকাশ পাই–’ঢাকা শহর ঢাকা যতক্ষণ/ ঢাকা খুলে দেখলে পরে থাকবে না তোর সাবেক মন।।/ ঢাকার কথা শোন তোরে বলি ঢাকার ভিতর আছে ঢাকা তিপান্ন গলি।‘ ‘পঞ্চ’ তো পঞ্চভূত। ‘পাঁচে পাঁচে পঁচিশ’ পঞ্চভূতকে পাঁচ দিয়ে গুণ। যেজন্য এই গুণ, শরীরের পাঁচচক্রে তাঁদের স্থান। সহস্রদল দেখার কথা বলেছেনে খ্যাপা শেষে। সহস্রদল সহস্রার চক্রের দ্যোতক। যা শরীরের নবম পদ্ম। সহস্রদল পদ্মের চারদিকে পঞ্চাশ দল বিরাজিত এবং এটি কুড়িটি স্তরে সাজানো। প্রত্যেক স্তরে পঞ্চাশ দলে পঞ্চাশটি মাতৃকাবর্ণ আছে। এই শক্তিমণ্ডলেই সাধক বলেন তেজপুঞ্জ আছে। যা বিন্দুস্বরূপ। এই বিন্দুই পরমশিব। এই বিন্দু প্রত্যক্ষ করাকে বলা হয় ব্রহ্মসাক্ষাৎকার। অর্থাৎ তিনি সমগ্রশক্তিকে জেনে নিজেই শিবস্বরূপ ব্ৰহ্ম হয়ে ওঠেন। সহস্রদলে ধ্যানে এসবের দর্শন হয়। জগদীশ্বরত্ব প্রাপ্তি এই পদ্মের ধ্যানেই।
গানে তাই বলা হচ্ছে সহস্রদল দেখবি হেথা। শরীর এভাবেই দ্যোতিত হচ্ছে। প্রতীকমান হচ্ছে, দ্বৈতাদ্বৈতের ভেতরে দাঁড়িয়ে শরীর সৃষ্টির হোমাগ্নিকেই জাগ্রত করছে। যেন। সাধক সেখানেই দেখে ফেলছেন আধ্যাত্মিক বিগ্রহ। খ্যাপা গানে তাঁরই হদিশ দিয়েছেন।
খ্যাপার সমসাময়িক পদকর্তারা হলেন নিতাই খ্যাপা, নবদ্বীপ গোঁসাই, ত্রিভঙ্গ গোঁসাই, রাধাশ্যাম দাস, গোপাল খ্যাপা, ঘনশ্যাম দাস। পরবর্তী পদকর্তারা হরিপদ গোঁসাই, হেমন্ত দাস, সনাতন দাস, লক্ষ্মণ দাস, মদন নাগ, সুধীর বাবা, সুধাময় দাস, ঠাকুর দাস। যেটা বলতে চাইছি বেশ কিছু সংকলনে এঁদের গান(সমসাময়িক, পরবর্তী) সংকলিত হয়েছে কিন্তু খ্যাপার গান বাউল কণ্ঠে শোনা ছাড়া কোথাওই কোনও গবেষকদেরই সংকলিত বাউল গানের গ্রন্থে গ্রথিত হয়নি। অথচ আশ্চর্যের, নামকরা। বাউলরাও সব গেয়ে থাকেন তার গান। এখানে তার সাতটি গানকে পূর্ণাঙ্গ পরিসর দিয়ে আমি গবেষকদেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলাম আরকি। যাতে পরবর্তীতে তার গানও সংকলন ভুক্ত হবার সময় কোনও ভাবে বাদ না পড়ে। তাহলে বাউল গানের মান্য পরিসর সেইভাবে গড়ে উঠবে না। তবে আশার বিষয় যেটা, খ্যাপা প্রতিষ্ঠিত সংঘ থেকেই তার রচিত ৫২৬ টি বাউল গানের সংকলন বেড়িয়েছে ২০০৫ সালে। যতদূর জানি সে বইও এখন পাওয়া যায় না কোনোভাবে। তার শিষ্যদের মধ্যেই যা কিছু ছড়িয়েছে। আমার শোনা গানগুলো এখন সবই সংকলিত। আমি রেকর্ডারে বাউলদের কণ্ঠে শোনা গানগুলো সব রেকর্ড করে রাখলেও এখানে উল্লেখের সময় সংকলন গ্রন্থেরই সাহায্য নিয়েছি। তার ছেলের মুখে একবার শুনেছিলাম বেদনাশা বট আশ্রমে মহোৎসব চলার সময় পূর্ণদাস এসেছিলেন খ্যাপার আশীর্বাদ নিতে। তখনও নাকি পূর্ণদাসের নাম হয়নি। নবনী দাসের হাত ধরে কলকাতাতে আসেননি তিনি। পূৰ্ণকে দেখা মাত্রই খ্যাপা ঠাকুর তার গলার মালা খুলে পূর্ণদাসের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোর জগৎ জোড়া নাম হবে।
পরে অবশ্য একবার পূর্ণদাসের স্ত্রী মঞ্জু দাসের মুখে শুনেছিলাম, ঠাকুরের সেই আশীর্বাদ কাজে লেগেছে।
মঞ্জু দাসী দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে একথা বলেছিলেন সেদিন। আমি মঞ্জু দাসের জবানীতে ঠাকুরের সেই মালা ছোঁড়ার দৃশ্য আর পূর্ণদাসের পরিতৃপ্ত হাসি মুখখানাই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। বেদনাশা বটের পাতা তখন সমানে উথাল পাতাল করছে অজয় নদের বুক থেকে উঠে আসা পাগলা হাওয়ায়।
০১.৫ জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে
দুপুরে অন্নভোগের পর সবে বন্ধ হয়েছে মন্দির। যুগলকিশোরের এখন বিশ্রামের সময়। সারাদিনে দর্শনার্থীর ভিড়ে তাঁরা চোখের পাতা এক করতে পারেননি। এত-এত মানুষের প্রার্থনা আর্তি সব শুনেছেন। এখন দু’দণ্ড জিরোচ্ছেন। ভক্তদের এরকমই সব বিশ্বাস। গোঁসাই বাবাজি বললেন, এত কতা কেনে? তোমাদেরও তো পেটে ভাত পড়েছে। এখন জিরোও দিকি। কতা থামান দাও তেনারা সবে শুয়েছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, কাদের কথা বলছেন বাবাজি?
গোঁসাই বাবাজি অবাক হলেন। সামান্য ভুরু কুঁচকোলেন। পাকা ভুরুর জঙ্গলে কৃষ্ণের হাওয়া খেলল যেন।
বললেন, বলেন কী কতা! আপনি খেলেন, খিলানে হেলান খেয়ে পা ছড়িয়ে বসলেন আর রাধামাধব জিরোলেই দোষ।
বুঝলাম, বাবাজি এতক্ষণ যুগলকিশোরের যাতে ঘুম, বিশ্রামে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যই ভক্ত-শিষ্যদের নীচু স্বরে কথা বলতে বলছেন। এতখানিই রক্তমাংসের মনে করছেন বাবাজি আরাধ্য রাধামাধবকে।
বেলুড় মঠেও দেখেছি সন্ন্যাসীরা বিবেকানন্দের ঘরে সারা দুপুর ফ্যান চালিয়ে রাখেন। রাতে খাটে মশারি টাঙিয়ে গ্লাসে পর্যন্ত জল ঢেকে রাখেন। রোজ সকালে চাদর, বালিশের ওয়াড় পাল্টে দেন। রামকৃষ্ণ, সারদা মা ও অন্যান্য জাগতিক মায়া কাটিয়ে চলে-যাওয়া সন্ন্যাসীদের ঘরেও একইভাবে ফ্যান-লাইট জ্বালিয়ে, চাদর-বিছানা বদলে খাবার, জল ঢেকে রাখা হয়। এতখানি রক্তমাংসের মনে করেন তাঁরা স্থূল দেহ ছেড়ে যাওয়া এইসব সাধক-সাধিকাদের।
শঙ্কর মহারাজের মুখে একবার শুনেছিলাম বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দিরের পার্শ্বস্থ মাঠের কাঁকর নাকি রোজ বিকেল-বিকেল একটা-একটা করে বেছে ফেলে দেওয়া হয়। কারণ এই মাঠেই রোজ ব্রহ্মমুহুর্তে ঠাকুর স্বশরীরে পায়চারি করেন। অনেক মহারাজই ঠাকুরকে ভোরবেলাকার আচ্ছন্ন সেই আভায় হাঁটতে দেখেছেন। ঠাকুর খালি পায়ে হাঁটেন। তাই ঠাকুরের পায়ে কাঁকরের আঘাতে যাতে কোনও ব্যথা না লাগে সন্ন্যাসীরা সেজন্য রোজ রোজ কাঁকর বাছেন মাঠের।
প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও যুগলকিশোরকে রক্তমাংসের মনে করেই ঠাকুরের বিশ্রামের সময় শোরগোলটা একটু কম করতে বলছেন।
আজ জৈষ্ঠ্য-সংক্রান্তি। যুগলের মেলার এই ভিড়ে, কলরবে যুগলকিশোর বা কতখানি বিশ্রাম পাবেন, নিশ্চিন্তে জিরোতে পারবেন খানিক-কে জানে!
দুপুরের রোদ নিস্তেজ হয়ে আসছে সবে। মেলা সাজ পরে নিচ্ছে। বাউল আখড়ায় একতারা-ডুবকি, ঘুঙুর-খমক সব এমন জোড়ায় রাখা হয়েছে যে, দেখে মনে হবে রাধাকৃষ্ণ যুগল হয়ে বসে। বাউলের রাখার ঢঙ কি তারই ইঙ্গিত করছে?
বিকেলে ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেলছে। জিলিপি-গজার ডাঁইয়েও রাধাকৃষ্ণ মাছি পাশাপাশি জোড়ায়-জোড়ায় বসে সব। আখড়ার দিকে হাঁটছি। দোসতিনার দিলীপ দাস বাউল কুশল সংবাদ নিলেন। বললেন, রাতের গানে নেমন্তন্ন। আসবেন কিন্তু খ্যাপা।
ঘাড় কাত করলাম। হাতে ধরা পাঁপড় ভাজাতেও দেখি শ্রীকৃষ্ণ মাছি। রজত বলল, রাধাটা বুঝলে আমার পাঁপড়ে বসে। সেই থেকে ও এসব নিয়ে পড়েছে। মাঝ দুপুরের পর নবদ্বীপের বাবাজিদের সঙ্গে বসেছিলাম। তাঁরাই বলছেন কৃষ্ণ সর্বত্রগামী। শরীরে, মনে, চারধারে কৃষ্ণ বিরাজমান। রাধা নিয়ে যুগল হয়ে আছে। রজত সেসবই এখন ইয়ার্কির ছলে জানান দিচ্ছে আমাকে।
আমরা নটবর দাসের আখড়াতে এসে পড়লাম। তখন সেইভাবে গান শুরু হয়নি। মেলা কমিটির মঞ্চেও গাইতে ওঠেনি বাউল। এ-কথা সে-কথার পর কথা গিয়ে পড়ল। যুগলতত্ত্বের উপর।
বাউল বললেন, বেশ শক্ত কথা। তার চে বরং যুগলের গানই গাই। কী কন খ্যাপা?
রজত, সুজিত ওরা সব বলল, হোক হোক।
নটবর একতারা তুলে নিলেন। গাইতে লাগলেন যুগলের গান।
সব আমরা তন্ময় হয়ে গেলাম বাউলের গানে।
নটবর দাস বাউল গাইতে থাকলেন। হৃষীকেশ গোঁসাইয়ের পদে, রাধাকৃষ্ণের যুগলে একেবারে ডুবে গেলেন নটবর।
কৃষ্ণপ্রেম কি সহজে মেলে।
অকৈতব প্রেম
জম্বুনদ-হেম,
উদয় হয় ভাগ্য-ফলে।।
সাধারণী কিছু নয়,
সমজ্ঞসা কিছু হয়,
সমর্থা প্রকৃত প্রেমের
হয় রে উদয়।
প্রেমে হয় না বিয়োগ,
সদাই থাকে যোগ,
মরে যায় বিয়োগ হ’লে।।
মা বাশুলীর পূর্ণ কৃপায়
যেমন দ্বিজ চণ্ডীদাস,
অপূর্ণ সম্পূর্ণ প্রেমে
মিটলো প্রেমের আশ;
প্রেমের রামী হয় গুরু,
কল্পতরু,
প্রেম-ভাণ্ডার দেয় খুলে।।
কৃষ্ণ প্রেম সুধাসিন্ধু
বিন্দুর কণা যদি পায়,
বিন্দুর প্রভাবে
চৌদ্দভুবন ডুবে যায়।
এ তো কইবার কথা নয়,
কে করিবে প্রত্যয়,
প্রেমের ভজন না জানিলে।।
এমন প্রেমেতে বিমুখ
ফেলে ভাবি আপ্তসুখ,
সুখে এবার বৈরী হ’লাম,
সুখের উপর দুখ।
ধরণীর কৃপায়
হৃষীকেশে কয়,
এই ছিল কি কপালে।
থামলেন বাউল। থেমে কৃষ্ণের ব্যাখ্যায় মাতোয়ারা হলেন। এরই মধ্যে দেখি যুগলের ভিড় উপচে পড়ছে। রাধাকৃষ্ণ একাকার হয়ে যাচ্ছে সব যুগলকিশোরের মেলায়।
*****
দুপুরবেলায় বাবাজি বললেন, তা বাবা রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ত্রিভঙ্গ কেন? কেন আমরা বলি ত্রিভঙ্গমুরারি?
কেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বাবাজি বললেন, আমাদের শরীরের তিনখানা গুণ নিয়ে তিনি যে ত্রিভঙ্গ হয়ে রয়েছেন। কী এই তিনখানা গুণ?
বললাম, কী?
বললেন, সত্ত্ব, রজ, তম গো।
বললাম, যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
–সত্ত্ব হল শরীরের নিত্যতা। স্থূল দেহ আমাদের। সবাইকার স্থূল শরীরে নিত্য জাগ্রত যে তিনি।
জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে জেগে আছেন তিনি?
–উপলব্ধিতে।
অস্তিত্বে কি তিনি কখনও তবে জেগে নেই?
হাসলেন, বাবাজি।
বললেন, আছে বাবা আছে।
–কীভাবে আছেন?
–রজ হয়ে।
ভাবলাম, বাবাজি প্রকৃতির গুণের কথা বলছেন। রজঃগুণ।
বললেন, রজ হল গিয়ে বাবা রাজসিক। আমাদের শরীরকে রাজসিক মায়ায় তিনি ধরে রাখেন। মায়া হল বন্ধন।
বললাম, অষ্টপাশের বন্ধন?
–অবশ্যই। কৃষ্ণকে শরীরের নিত্যতা মানলে আটপাশ তো থাকবে বাবা।
হাসলেন তিনি। বললেন, লীলা কী বাবা?
বললাম, খেলা।
চৈতন্যচরিতামৃত আওড়ালেন বাবা।
–কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু কৃষ্ণের স্বরূপ। তার জন্যই তো বললাম বাবা, কৃষ্ণের অস্তিত্ব শরীরের নিত্যতা। সেই নিত্যতা বুঝতে, জানতে, ধরতে নববিধা ভক্তিরস ছাড়া গতি নেই গো। এই নববিধা ভক্তি দিয়েই তো সাধক কৃষ্ণভজনা। করেন।
আরেক বাবাজি বললেন, কৃষ্ণকথা শুনে, গেয়ে, মনে রেখে, বন্দনা করে, সেবা করে, নিবেদন করে, পূজা করে, সখ্য তৈরি করে কৃষ্ণকে শরীরময় করে তোলা যায় বাবা।
–তম হল ভাব। মনের অন্ধকারকে দূর করে তামসিক ভাব আনা। এই ভাব এলে কৃষ্ণ হৃদয়ে, মনে, শরীরের সকল স্থানে আলো ফেলবে গো। তবেই তো কৃষ্ণের মাধুর্য বোঝা যাবে।
প্রেমানন্দ গোঁসাই বাবাজিও এ সময় এলেন। যোগ দিলেন।
বললেন, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃততেই আছে–আপন মাধুর্য হয়ে আপনার মন। আপনে আপনা চাহে করিতে আলিঙ্গন।
তবে কৃষ্ণের সদর্থক শরীরী উপমার কথা আমাকে সর্বপ্রথম কিন্তু শুনিয়েছিলেন জগদীশ পণ্ডিতের শ্রীপাঠের সদানন্দ বাবাজি।
সান্ধ্য কীর্তনের পর একদিন তার সঙ্গে কথা চলছিল।
বললেন, কৃষ্ণ হল গিয়ে আমি নিজে। কৃষ্ণ হল গিয়ে তোমার শরীর, আমার শরীর, সবার শরীর। কৃষ্ণ হল নাড়ি।
বললাম, শরীরের নাড়ির কথা বলছেন আপনি?
–হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ। ঠিক ধরেছ গো।
–আমাদের শরীরে তো সাড়ে তিন লক্ষ নাড়ি রয়েছে।
বাবাজি বললেন, ঠিক বলেছ তুমি। এই সাড়ে তিন লক্ষ নাড়িই হল গিয়ে কৃষ্ণ। আর তার ভেতর প্রধান আটটা নাড়ি হল রাধারই অষ্টসখি বাকি সব নাড়ি গোপিনী।
–তাহলে রাধার উপস্থিতি কি আমাদের শরীরে নেই?
বললেন, হ্যাঁ। ঠিক কথা বলেছ। রাধা ছাড়া কৃষ্ণ হবে কী করে? শরীরের প্রধান তিন নাড়িকে তো গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীর রূপ দেওয়া হয় যোগসাধনাতে। গঙ্গা ইড়া, যমুনা পিঙ্গলা, সুষুম্না সরস্বতী। কৃষ্ণমহিমায়। রাধা হল গিয়ে প্রধান। তিন নাড়ির মধ্যে সুষুম্নার কাজ বেশি। তা সুষুম্নকেও তুমি রাধা ধরতে পারো। পিঙ্গলা তো যমুনা। রাধা নিজেও তো এই নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কৃষ্ণলীলায়। যমুনার লীলাকে আমরা তো পিঙ্গলাতেও রূপ দিতে পারি। পারি না বাবা? কৃষ্ণ তো আসলে রূপকল্পনার দৈত্য?
–দৈত্য কেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
–কেন নয় বাবা! সে তো রাখে, সে মারে। নির্ধারক সে।
আমি বললাম, এই যে আপনি বললেন নাড়িগুলো সব কৃষ্ণ। তাহলে…
–তাহলে কি? নাড়িগুলো সব না জাগলে কৃষ্ণ জাগবে কী করে শুনি? যার নাড়ি যত বেশি জাগবে ধ্যানে,যোগে, ভক্তিতে তার তত বেশি সিদ্ধ দশা আসতে শুরু করে দেবে। সাধককে তো নির্ধারণ করবেন শরীরের সাড়ে তিন লক্ষ কৃষ্ণ। তিনিই রাখবেন। সিদ্ধস্তরে পৌঁছে দেবেন আবার তিনিই মারবেন। স্থূল দেহেই বসিয়ে রাখবেন।
বাবাজি সেদিনকার মতো উঠে যাবার পর আমি বসেই রইলাম নাটমন্দিরে। কৃষ্ণ ভজনার ঘন্টা সব তখন জোরে জোরে বাজতে লাগল। আমার সারা শরীরে গিয়েও যেন আলোড়ন তুলল ঘন্টাধ্বনি। একসময় থেমেও গেল। বৃদ্ধা বৈষ্ণবী গাইতে থাকলেন কানু-বন্দনার গীত।
*****
নটবর দাস বাউল যুগলের গানে যে কথা শুনিয়েছিলেন তা হল কৃষ্ণ সহজে না পাড়ার কথা। সদানন্দ বাবাজি যতই বলুন নাড়ি হয়ে কৃষ্ণ শরীরস্থ হয়েছেন বা প্রেমানন্দ গোঁসাই, নবদ্বীপের বাবাজিরা সব যাই বলুন না কেন–নববিধা ভক্তিরসকে রসস্থ করে কৃষ্ণ পাবার কথা যতই বলুন না কেন–বাউল কিন্তু বলছেন: ‘কৃষ্ণপ্রেম কি সহজে মেলে। অকৈতব প্রেম/ জন্ধুনদ–হেম/ উদয় হয় ভাগ্য-ফলে।।’
ভাগ্যফল বলতে কী বলতে চাইছেন বাউল?
এই ভাগ্যফল হল গিয়ে সাধন ভাগ্যফল।
বাউল তাঁর জীবন দিয়ে আসলে কৃষ্ণ পাবার সাধনা করেন। কৃষ্ণ তাঁর কাছে প্রকৃতি। কৃষ্ণ সঙ্গিনীর সাহায্যে প্রাপ্ত সুধাকণা। রস। কৃষ্ণ পাবার আকুতি তাই বাউলের সারা জীবনেরই আকুতি। দুদ্দু শাহের পদের ভেতরও আমরা সে কথাই পাই। এই পদও যুগল-মেলাতেই নটবরের গলাতেই শুনেছিলাম। মেলা কমিটির মঞ্চে নটবর দাস বাউল এ গান গেয়েছিলেন সেদিন। গাইতে গাইতে বললেন, খ্যাপা, খ্যাপারা সব মেলায় কৃষ্ণবস্তু নিয়ে বসে আছেন যে, তারে জানতে–চিনতে-বুঝতে হবে তো কী খ্যাপা?
নটবর আমার দিকে চোখ ফেরালেন। খমকে বোল তুলে নিলেন। গাইতে থাকলেন কৃষ্ণ খোঁজার, কৃষ্ণ জানার, কৃষ্ণ বোঝার, কৃষ্ণ সাধনের গান।
কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি
মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে-কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।
জীব দেহে শুক্ররূপে এ ব্রহ্মাণ্ড আছে ব্যেপে
কৃষ্ণ তারে কয় পুরুষ সেই হয় সেই রাধার গতি।
কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে
রসিকের করণ যে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।
আত্মতত্ত্ব জানে যে জন
কৃষ্ণ-সেতু চেনে সে জন
লালন সাঁইর বাণী রসিক ধনী বলে দুদ্দুর প্রতি।
হাটগোবিন্দপুরে একবার গেছি সাধন দাস বৈরাগ্যের খোঁজে। আশ্রমে ছিলেন না তিনি। কোথায় এন এক প্রোগ্রামে গিয়েছেন। শুনসান ফাঁকা আশ্রমে ঠিক গন্ধরাজ গাছতলায় বসে ছিলেন একখানা খাতা নিয়ে দয়াল সরকার। সাধনের আশ্রমে বহুদিন আছেন।
আমাকে বস্তে বললেন দয়াল। শীতলপাটিটা পরম যত্নে খুলে দিয়ে বললেন, বসেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী লিখছিলেন?
বললেন, কিছু না। গানের খাতাখান দেখছিলাম আর কী। কত গান যে মুখে মুখে লিখি আবার মুখেই হারিয়ে যায়!
খাতায় লেখেন না কেন?
সব সময় কি আর খাতা থাকে। মনের খাতায় লিখি। আবার মনের পাতাখানা ছিঁড়েছুঁড়ে কখন যে মনেই মিলিয়ে যায়।
দয়াল সরকারকে দেখে মনে হল যথার্থ কবিমানুষ। ভাব আর শব্দ যেন সবসময় তাঁকে ঘিরে রেখেছে। শব্দ দিয়ে গান নয় শুধু, আশ্চর্য সব কথকতা তৈরি করে দিতে পারেন দয়াল।
খাতাখানা একঝলক দেখতে চাইলাম। দেখালেন দয়াল। হাতের লেখা স্পষ্ট। গোটাগোটা।
বললেন কথাপ্রসঙ্গে–তাঁর কথা তিনিই লেখেন তিনিই আবার মুছে দেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কার কথা বলছেন আপনি?
–কেন গো। শরীরের কথা। শরীর দিয়ে শরীর লেখার কথা। বাউল তো তাই করে গো। শরীরই তাঁর গয়া-কাশী-বৃন্দাবন।
বললাম, শরীর মথুরা নয়?
বললেন, বুঝেছি। আপনে ঘুরিয়ে কৃষ্ণকথা জানতে চাইছেন।
–কৃষ্ণ কী আপনার চোখে?
–কী আবার! দেহ গো, দেহ। শরীরের এই ঘরখানাতে কৃষ্ণর বসবাস।
বললাম, নাড়িগুলোর কথা বলছেন আপনি?
–তা নয় গো, তা নয়। নাড়ি কৃষ্ণ নয়। রিপু কৃষ্ণ।
–ষড়রিপু? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বললেন, ছয় রিপু, দশ ইন্দ্রিয়, চার চন্দ্র, সাত দিনের রজঃধারা দিয়ে কৃষ্ণ গঠিত। সাধক রিপু দমন করে। ইন্দ্রিয়গুলোকে বশ করে। চারচন্দ্রকে বশীভূত করে। তবে না সঙ্গিনীর রজে, মহাযোগে তাঁর কৃষ্ণবস্তু রক্ষিত হয়।
–কৃষ্ণ তাহলে কেবল কৃষ্ণবস্তুই?
হাসলেন দয়াল।
বললেন, তা কেন। দেহ কৃষ্ণ। সাধনের দেহ। পিতার হাড়, মজ্জা, মগজ, মণি আর মাতার রক্ত, মাংস, চামড়া, চুল নিয়ে দেহ গঠিত। দেহেই তো ইন্দ্রিয়,রিপু থাকে নাকি? রজ-বীর্যও থাকে। দেহ দিয়ে দেহ রক্ষা করাই কৃষ্ণ পাওয়া।
আর কিছু বললেন না তিনি। হয়তো বলতে চাইলেন না আর। তাই গান ধরলেন। এখন বেশ বুঝিতে পারি বাউলের গুহ্যতা ভাঙতে আপত্তি থাকলে তখনই তিনি গান ধরেন। আবার অনেক সময় এটাও হয়, গুহ্যতা ভাঙবার মতো শিক্ষাবস্তু তাঁর নেই। তাই তখন মুখস্থ গানের আড়াল নেন বাউল আর হাসেন। এই হাসির অর্থ হল যার-তার কাছে সাধনকথা বলা যাবে না। কিন্তু তিনি যে সাধন কথা দূর অন্ত গানকথাও ঠিকঠাক বোঝাতে অপারগ–তাঁর জারিজুরি সব গেছে খুলে তা তিনি বুঝতে পারলেন না। শুধু হাসলেন আর হাসলেন। গায়ক বাউলরা এটাই বেশি করে থাকেন।
দয়ালের কথা আমি বলছি না। দয়াল সাধনস্তরের মানুষ। তাঁর মুখেই শুনেছি বহু। সাধকের সঙ্গ করেছেন তিনি। এক জায়গাতে তাঁর মন টেকে না। দীর্ঘদিন হল সাধনের আশ্রমে আছেন। আগে ছিলেন নবাসনে। হরিপদ গোঁসাইএর আখড়ায়।
সাধনের আশ্রমে গন্ধরাজ ফুটেছিল তখন। দয়ালের গানের আর ফুলের ভুর ভুর গন্ধ কেবল বাতাসে মিশে যাচ্ছে। ফাঁকা আশ্রমে দয়ালের গান যেন একাই ধরে রেখেছে। কৃষ্ণের কলরব।
দয়াল গাইছেন–
প্রেম সুখদ্বার কৃষ্ণ রসাকার রসনাতে তাঁর কর আস্বাদন
সে যে যোগাযোগ স্থলে মৃণাল পথে চলে
সহজ কমলে সুধা বরিষণ।।
সর্ব ঘটে বটে পটে পট্টস্থিতি
শক্তিতত্ত্বগুণে আনন্দ মুরতি।
শৃঙ্গার-আকার ধরে সাধ্য কার
ওই যে স্বরতি-সঞ্চার নবীন মদন।।
আদ্য সুখসাধ্য, বাদ্য কারুর নয়,
ইন্দু বিন্দুগতি সদা বিরাজয়।
জীবে নাহি জানে সাধু সন্ত চেনে,
রসপানে জানে তাঁরা অমৃত-সেবন।
মন আত্মা বপু যত রিপুচয়,
দেহেন্দ্রিয় সবাই তাহাতে মিশায়।
তাঁদের ব্রজ-প্রাপ্তি দেহ, তৃপ্ত হয় জীবন।।
কাম-প্রেম-রতি হবে এক ঠাঁই
সুখ-দুঃখ-আদি তথায় কিছু নাই,
নির্মল সে পথে হাউড়ে চায় যেতে
ওই শক্তি আত্মশক্তি হলে যায় দর্শন।।
ঘোষপাড়া মেলায় বেশ রাতের দিকে বাউল আখড়াগুলো সব জমজমাট। সাধুদের ওখানেও তেমন ভিড় নেই। আর বৈষ্ণবীরা সব মাছি তাড়াচ্ছেন। ভিড়ে, মানুষের ঘেঁষাঘেঁষিতে তখন আমার অস্বস্তি হচ্ছে বেশ। জিরোতে ফাঁকাতে এলাম। দেখি অতিবৃদ্ধা এক বৈষ্ণবী নিমগ্ন হয়ে বসে আছেন। বুঝলাম এ বয়সে সঙ্গী নেই আর তাঁর। গিয়ে বসলাম তাঁর একটু পাশে।
মাটিতে ঘাসের ’পরেই বসলাম আমি। তিনি টের পাননি। চোখ খোলা। ঘুমে যে ঢুলছেন না তা বেশ স্পষ্ট। সম্বিৎ ভাঙলে বললেন, ভাই এখানটাতে বসো। একেবারে মাটিতে কেন? ঠাকুমার ঘেঁড়া চাটাইটা ‘তালে আছে কী করতে? নাতি আমার মাটিতে বসবে তা কী হয়!
শতছিন্ন চাটাইতে আমি বসলাম।
বললেন, এখন আর ঘুম হয় না ভাই। তাই চেয়ে চেয়ে তাঁর অপেক্ষাতে থাকি। তবে তিনি সাত তাড়াতাড়ি না এলেই ভালো।
বললাম, না না। এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু আপনাকে টানবে না। বলতে নেই, আপনার বয়স হলেও দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ নন।
আমি তার কথা বলছি নে। বলছি ঘনশ্যামের কথা।
মানে! আমি চমকে গেলাম।
বৈষ্ণবী বললেন, একটা কথা আছে ভাই। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণই আশ। এই যে তিনি আসবেন। অপেক্ষা–এটাই তো জেবন। তিনি এলে, শ্যাম এলে তো আর আশা থাকবে না। না আসাটুকুই শ্যাম ভাই। এসব তুমি বুঝবা না। তা ভাই তোমার সাথে কেউ নেই কেন? রাধা ছাড়া কৃষ্ণ কি মানায় ভাই? সেজন কোথা?
তার কোনো খোঁজ পাইনি ঠাকুমা।
বৃদ্ধা হাসলেন।
বললেন, পাবা ভাই পাবা। তাড়া কিসের? প্রত্যেক কৃষ্ণর জন্য প্রত্যেক রাধা থাকে। খোঁজো খোঁজো। গরু খোঁজা করে ফেলো। দেখবা পাবা একদিন। কৃষ্ণ ছাড়া সে থাকবে ক্যামনে শুনি?
ঠাকুমা কৃষ্ণ কী? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
কী আবার ভাই! কৃষ্ণ হল গিয়ে আসলে সুর। অপেক্ষার সুর। তাঁকেই শুনতে হয়, ধরতে হয়, বুঝতে হয় দাদুভাই। বাঁশি কেন তাঁর হাতে?
কেন ঠাকুমা।
বাঁশিই তো সুর দাদু। বাঁশি বাজানো মানে আমাদের কামকে, ক্রোধকে, লোভকে, মোহকে, মাৎসর্যকে, মদকে বাজানো। এই দুইকে মন দিয়ে বাজাতে হবে দাদুভাই। তবেই না কৃষ্ণ বাজবে। বাঁশি বাজবে। বাঁশির সাতখান ফুটোর মানে হল। ষড়রিপুকে মন দিয়ে বাজানো। আর বাজাতে পারলেই কৃষ্ণ মিলবে। তাঁকে বাজাবা ভাই। তাহলে মানুষের ঊর্ধ্বে উঠবা। তোমার বাঁশিখান তোমাকেই তো বাজাতে হবে। তবেই না রাধা আসবে।
রাধা কী ঠাকুমা?
রাধা আগমন। অপেক্ষার শেষ। তাঁর জন্যই তো কানাইয়ের পথ চেয়ে বসে থাকা। এই তুমি যেমন আছো ভাই।
ঠাকুমা আপনার আশ্রম কোথায়?
হাসলেন তিনি।
বললেন, আশ্রম নেই ভাই। একখান বাড়ি আছে। পোড়া বাড়ি। তিনি চলে যাবার পর বাড়িটা বাজে। ষড়রিপু নিয়ে বাজে গো বাড়ি। বাড়ি ছেড়ে তাই ভাই পথে-পথে ঘুরি। যাও যাও, খোঁজো তারে। আমি খুঁজি আমার সেই ঘনশ্যামরে।
পার্শ্ববর্তী আখড়া থেকে তখন ভেসে আসছে কৃষ্ণ খোঁজার সেই অতি পরিচিত গান। আমি শুনতে শুনতে এগোচ্ছি আর ঘুরে তাকিয়ে দেখছি, এ কী! বৈষ্ণবী ঠাকুমা বসে নেই সেখানে। তবে গেলেন কোথায় তিনি এই মধ্যরাতে? কৃষ্ণ খুঁজতে কি!
আমি শুনতে পাচ্ছি বাউল গাইছেন–
এমন মন ব্যবসা ছেড় না ওগো সুখের ধানভানা
কর কৃষ্ণপ্রেমের ভান কুটো কোনোই কষ্ট থাকবে না
তোমার দেহ ঢাকশালে অনুরাগের ঢেঁকি বসালে
ভজন সাধন পাড়ুই দুটো দু দিকে দিলে
আবার নিষ্ঠা আঁশ কলাই লাগালে
ঢেঁকি চলবে ও সে টলবে না।।
রাগ দরদী দুইজন ভানুনী তাঁদের নাম কৃষ্ণ মোহিনী
তাঁদের একজন সদা গোপের মেয়ে একজন তেলেনী
তারা ধান ভানে ভালো জানে ভালো গায়ে তাঁদের উপাসনার গহনা।
রাগ বিবেকের মুষল আঘাতে বাসনা তোর
যাবে ছেড়ে পাহার দিতে দিতে
চাল উঠবে সেঁটে বিকার কেটে ঠিক যেন মিছরি দানা।
ঘরের বিদ্যাবুদ্ধি বেশ গিন্নি হবে শেঁকার দেউনী
শুদ্ধরতি শুদ্ধমতি কুলা চালুনী
এবার কাম কামনা ছেড়ে ঝেড়ে ঝুড়ে তুসকুঁড়ো চেলে লও না।
শ্রীগুরু সেই মহাজনের ধান তাতে হবিরে সাবধান
ষোল আনা বজায় রেখে করবি ব্যবধান।
লাভে লাভে কাল কাটাবি আসলে হারাইও না।।
গোঁসাই বলে অনন্ত ধান ভানতে পারবি না
তোর ঘটবে যন্ত্রণা
পাপ ঢেঁকি তোর মাথা নাড়ে গড়ে পড়ে না
দেখিস যেন বেহুঁশ হয়ে যাতে ঢেঁকি পড়ে না।
কৃষ্ণ দেখছি রূপকের আড়ালেই বারবার সাধকের শান্ত আত্মসমর্পনের আবেগ দিয়ে শরীরের জন্মদিন পালন করছে। চিত্রল-মুগ্ধতায় সদর্থক মিতায়ন নিয়ে এমন সব। প্রতীক নিবন্ধকে গানে সংগত আড়াল করে দিচ্ছে যে প্রতীকে বসে সদর্থক সাধনতত্ত্ব সব বারবার আলো ফেলছে।
কৃষ্ণের প্রেমকে ‘কৈতব’ নয় ‘অকৈতব’ প্রেম বলে অভিহিত করেছেন পদকর্তা। ছলনা, কপটতাহীন প্রেম। তাই অকৈতব। ‘জম্বুনাদ হেম’ও বলেছেন পদকর্তা কৃষ্ণপ্রেমকে। জন্ধুনদের শীতার্ত সাদা বরফ জমা রূপ-স্বরূপের সঙ্গে তুলনীয় কৃষ্ণপ্রেম। বোঝা যাচ্ছে। প্রেমকে বিম্বিত আরশি দিতে চাইছেন পদকর্তা হৃষীকেশ গোঁসাই।
যেটা এখানে বলতে হয়: ‘কৃষ্ণ’ শব্দের প্রতিবিম্বিত আধারেই কিন্তু ‘প্রেম’ শব্দটি বর্তমান। কৃষ্ণের যে স্বরূপ তা কিন্তু লীলারূপ। এই লীলা যোগীরা বিশ্বাস করেন শুরু হয় ভূলদেহে। ‘প্রেম’ কথাটি, শব্দটি যদি স্থূল অর্থে দেখি তবে তাঁর শব্দরূপের যে দুই সংখ্যার সমষ্টি ‘কৃষ্ণ’ কথাতেও তাই বর্তমান আছে। সুতরাং প্রেম আর কৃষ্ণকে সাংখ্যিক অনুপাতে আমরা পরস্পরের কাছে নিয়ে যেতে পারি। আমাদের স্কুল দেহ নাশ হয় যোগে। তা শুরু হলেই দেহ ছাড়খাড় হয়ে যায়। কুণ্ডলিনী জাগে। মূলাধার থেকে সহস্রারে সেই শক্তি মিশে যায়। নাড়িগুলো সব আনন্দিত হয়ে পড়ে। নাড়িগুলোকে গোপীর কথা বলেছেন বাবাজি। তা। যদি হয় নাড়িগুলোর জাগৃতি সব নৃত্যরত গোপিনী। রাধাও আছেন সেখানে। তাহলে দাঁড়ালো এই, গোপীদের সঙ্গে অর্থাৎ কিনা শরীরের নাড়িগুলোর সঙ্গে সাধকের যে বোঝাপড়া তাই কৃষ্ণের লীলা। স্থূল শরীর যোগে, সাধনায় নাশ হয়ে সূক্ষ্ম শরীর কৃষ্ণ হয়ে গিয়ে রাধা ও গোপী সহ নৃত্য করছেন, আনন্দ করছেন সাধক কৃষ্ণ। প্রেমময় জাগতিক আনন্দ এ নয়। এ আনন্দ সাধকের। কৃষ্ণ সাধকের দিব্যতা। বাউলও তাই-ই করছেন কিন্তু। ‘প্রকৃতি’কে কৃষ্ণ বলছেন তাঁরা। প্রকৃতিকে আমরা সঙ্গিনী, সাধিকা না ধরে যদি ধরি অপার অনন্ত শূন্যতা–তবে তাঁর রূপ তমোময়। এই তমসা উত্তীর্ণ জ্যোতি আহ্বান করছে। প্রকৃতির বর্ণচ্ছটাতে আমাদের নৃত্য করতে। অর্থাৎ কিনা আনন্দ করতে। নৃত্যকে, আনন্দকে ‘গোপী’ বললে গোপীর ‘গ’ হল প্রকৃতি। ‘পী’ হল ডাকা বা আহ্বান করা। আপ্যায়ন বললে ঐকতানটা যেন আরওই ঠিক থাকে। বৈষ্ণবরা তো রাধাকে মহাপ্রকৃতি বলেন। গোপীদের তাহলে ধরি বিশ্বপ্রকৃতি। যে গোপীরা সব শরীরের মধ্যেই অবস্থান করছেন। সাধকের শক্তির আধারে লীলা করছেন, আনন্দ করছেন, নৃত্যকলা প্রদর্শন করছেন। বলতে পারি বিশ্বপ্রকৃতিকে আহ্বান করছেন, ডাকছেন, ইশারা করছেন প্রকৃতি। বাউল সাধককেও ডাকছেন প্রকৃতি। মহাযোগে বৈষ্ণবীয় নামান্তরের মহাপ্রকৃতি বাউল সাধককে উর্দ্ধরেতা দান করে কৃষ্ণ করে দিচ্ছেন। কৃষ্ণকে শুদ্ধতা নয়–সিদ্ধতা হিসাবে দেখছি আমরা। বাউলের কৃষ্ণ বীর্য। বস্তুরক্ষা। ‘কৃষ্ণবস্তু’ বলেন তাঁরা কিন্তু বীর্যকে। রজ, প্রকৃতির প্রবাহ বা আনন্দ রাধাবিন্দু। ‘বিন্দুসাধন’ বলেন বাউল। বিস্কুধারণ আর পতন। ধারণ হল উর্ধ্বারেতা দান করে সিদ্ধতা। পতন-যোনিতে পতন। অকৃতকার্যতা তা আর কী।
গানে পদকর্তা রামীকে প্রেমের ‘গুরু’, ‘কল্পতরু’ বলেছেন। বলেছেন এই কারণে বাউলের সঙ্গিনী প্রকৃতি। তিনিই তো সাধককে কৃষ্ণবস্তু রক্ষা করার সাহায্য করে সিদ্ধাসনের ‘প্রেমভাণ্ডার’ খুলে দেন। পদকর্তা বলছেন–’মা বাশুলীর পূর্ণ কৃপায়/ যেমন দ্বিজ চণ্ডীদাস অপূর্ণ সম্পূর্ণ প্রেমে/ মিটলো প্রেমের আশ, / প্রেমের রামী হয় গুরু, / কল্পতরু/ প্রেম-ভাণ্ডার দেয় খুলে।
কৃষ্ণপ্রেমকে ‘সুধাসিন্ধু’ বলছেন পদকর্তা। সুধা হল জল। জল হল শুক্র বা মূত্র। এদের রস’ও বলেন বাউল। সঙ্গিনীর রজ’কে তাঁদের ‘রূপ’ বলতে শুনেছি। বাউল তো চারচন্দ্র ভেদ করেন। শুক্র, রজ, মল, মূত্রকে শরীরে ধারণ করে শরীরে ফিরিয়ে দেন। ‘শুক্র’কে তাঁরা ধারণ করেন। গানে নটবর সেকথাই বলেছিলেন–’কৃষ্ণপ্রেম সুধাসিন্ধু/ বিন্দুর কণা যদি পায়, / বিন্দুর প্রভাবে/ চৌদ্দভুবন ডুবে যায়। এ তো কইবার কথা নয়, কে করিবে প্রত্যয়,/ প্রেমের ভজন না জানিলে।।’
সাধকের বীর্য আর সঙ্গিনীর রজ এই দুই বস্তুকে বাউল দেহ গঠনের মুখ্য হিসাবে ধরেন। শুক্রের যে প্রাণকনা তা বাউলের কৃষ্ণবস্তু বা তাঁরা বলেন কৃষ্ণবিন্দু। সঙ্গিনীর রজর ডিম্বানু তাঁদের কাছে রাধাবিন্দু। এই দুইয়ের মিলিত যে প্রাণ বাউলের তা হল সুধাসিন্ধু। বাউল সাধনায় সন্তান সাধনপ্রনালীর অঙ্গ নয় মোটেই। যদিও এখন বাউল পুত্রকন্যা নিয়ে রীতিমত ঘর করেন। তবে সাধক বাউল সন্তানের জন্ম দেন না। অনেক বাউল সাধক-সাধিকা আছেন যারা সংসার ত্যাগ করে দীর্ঘদিন সাধনায় নিমগ্ন আছেন। যেমন মীরা মা-কাকা গোঁসাই, হরিপদ গোঁসাই–নির্মলা মা, সাধনা-গৌরখ্যাপা–এঁদের কথা আমরা জানি। তন্ত্রেও সন্তান জন্ম নিষিদ্ধ। তন্ত্রসাধক তাঁর সঙ্গিনীকে শরীরে বীর্যকে উর্ধ্বগতি দিয়ে প্রেমের দিব্যতায় ডুবে যান। তান্ত্রিক সাধুর যুক্তি ভৈরবীকে তাঁরা মা বলেন কারণ–মাতৃভাব আর রমণীভাব দুটোই আরোপিত ভাব। আসলে নারীর দুই রূপ। যেই রূপে ভাব আরোপ করা হয়, নারীর যে জননীরূপ, মাতৃভাব তাও যেমন আরোপিত তেমনি নারীর যে রমণী বা ভৈরবী হয়ে ওঠা তাও তো আরোপিত প্রকৃতিকে আমরা নারী। হিসাবে দেখি। আকাশকে পুরুষ। মানে হল আকাশের বিশালতা, ব্যাপ্তি প্রকৃতিকে ধরে রাখার জন্য। সাধক যে সঙ্গিনীকে ধরে রাখেন দেহ সাধনায় বা যুগল সাধনায় তাঁর কারণ তাঁরা সৃষ্টিপথকে প্রসারিত করেন। সৃষ্টি এখানে প্রাণ নয় কোনো প্রেমস্বরূপ প্রাণতরঙ্গ। সৃষ্টি হল শক্তির ব্যাপ্তি। বিশালতা। যোগীপুরুষ শরীরস্থ সমস্ত চক্রের শক্তিকে জাগিয়ে নিয়ে এই ব্যাপ্তি বা বিশালতাকে অনুভব করে থাকেন। প্রত্যেকটি চক্রে যোগী শক্তিরই আরাধনা করেন। মূলাধারে থাকে ডাকিনী শক্তি। ডাকিনী কথাটি তিব্বতী ঘেঁষা শব্দ। তিব্বতের ডাক শব্দ থেকে যোগশাস্ত্রে ডাকিনী শব্দটি এসেছে। তিব্বতে ডাকের অর্থ হল জ্ঞান। যোগশাস্ত্রে ডাকিনী হল জ্ঞানী রমণী। বলা হয় এই চক্রেই সাধকের মধ্যে প্রথম জ্ঞানের উদয় হয়। তাই এই চক্রে সাধক ডাকিনী শক্তির ধ্যানজপ, আরাধনা করে থাকেন। স্বাধিষ্ঠানে শক্তির নাম রাকিনী। অনেকে বলেন আবার কাকিনী। ডাকিনীও মতান্তরে শাকিনী। মণিপুরে থাকেন। শক্তিরূপিণী লাকিনী। অনাহতে কাকিনী। বিশুদ্ধে শাকিনী। বৌদ্ধরা বলেন এঁকে সুবেশা যোগিনী। কারণ এই চক্রে ধ্যানে যোগশক্তির মাত্রা অতিরিক্ত নাকি বেড়ে যায়। আজ্ঞাচরে হাঁকিনী। বৌদ্ধরা বলেন আবার, চিৎকারকারিণী যোগিনী। এখানেই নাকি শক্তির বিস্ফোরণ ঘটে সাধন শরীরে। সেজন্যই হাঁকিনী। সহস্রারে সন্ধিনী শক্তির বিকাশ। কারণ এই চক্রেই পরমের বা চিপিণী শক্তি বা সম্বিত জাগে পুরো মাত্রাতে সাধক শরীরে। সাধক নির্বাণত্ব লাভ করেন এখানে এসেই।
তন্ত্রেও এই শক্তিগুলোর আনাগোনার কথা বলে থাকেন দেহসাধক। বাউল সাধনের শক্তি এরূপ কল্পিত শক্তি নয়। যোগশক্তি অবশ্যই রেচকে, পূরকে, কুম্ভকে তাঁরা শরীরকে জাগান কৃষ্ণবস্তু রক্ষার তাগিদে। যোগশাস্ত্রে আটপ্রকার কুম্ভকের কথা উল্লেখ আছে তা কিন্তু তাঁরা করেন না। প্রয়োজনই নেই তাঁর। কেননা বাউলের পরম নিরাকার মহাশূন্যতার জ্যোতি কখনওই নয়, তাঁর পরম শরীরে কৃষ্ণবস্তু রক্ষা। নটবর দাস বাউল যুগলমেলায় মঞ্চে যে গান শুনিয়েছিলেন সে গানে স্পষ্টই বলা আছে–’কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে/ রসিকের করণ সে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।’ হৃষীকেশ গোঁসাইয়ের পদে বলা হচ্ছে–’বিন্দুর প্রভাবে/ চৌদ্দভুবন ডুবে যায়। চৌদ্দভুবন হল দুই চোখ, দুই কান, দুই নাক, মুখ, মাজা, লিঙ্গ, যোনি, বুক, স্তন, নাভি, ব্রহ্মরন্ধ্র। যা কিনা যুগলেরই প্রত্যঙ্গ সব। বিন্দুর প্রভাব’–বীর্যর ঊর্ধ্ব ধারা, যাতে দুই শরীর আর বাহ্য শরীর থাকেনা। স্কুল, প্রবর্ত, সাধক পেরিয়ে সিদ্ধ হয়ে ওঠে। আর এখান থেকেই তো প্রশ্ন ওঠে। প্রতিবাদ ওঠে। ঝড় ওঠে নারী বাউল সমাজে। তন্ত্রে ভৈরবীর কিন্তু অতখানি নগণ্য দশা নয়। কারণ সিদ্ধা ভৈরবী কিন্তু ছিলেন অনেকেই। যারা অষ্টসিদ্ধি রপ্ত করেছেন রীতিমত। তারাও তন্ত্র সাধকদের মতো অণিমা(ক্ষুদ্র হবার ক্ষমতা), মহিমা(বৃহৎ হবার ক্ষমতা), লঘিমা(হাল্কা হবার ক্ষমতা), গরিমা(ভারী হবার ক্ষমতা), প্ৰাপতি(যা ইচ্ছা লাভের ক্ষমতা), প্রকাম্য(যে কোনো জিনিস পাবার ক্ষমতা), ইশিত্ব(যে কোনো কিছুর ওপর নিজের প্রাধান্য স্থাপনের ক্ষমতা), বশিত্ব(বশ করার ক্ষমতা) অর্জন করতে পারেন। এরকম সাধিকা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে কম নেই কিন্তু। তাই ভৈরবীদের যথার্থ মর্যাদা আছে। যদিও সেই সাধনেও ধস নেমেছে এখন। স্বাভাবিকই। কারণ তন্ত্র করা, কিছুটা শক্তির সিদ্ধি পেয়ে ভক্তশিষ্য জোগাড় করে পেট চালানো একটা জীবিকাই হয়ে উঠেছে অনেকটা বাউলের কেবল গান গাওয়ারই মতো। বাউল আটপ্রকার কুম্ভক না করলেও হঠযোগ করেন। বৈষ্ণবরাও নানাবিধ প্রাণায়াম করে থাকেন। একবার চৈতন্য ডোবার প্রভু বলেছিলেন আমাকে, কৃষ্ণ তো প্রতিনিয়ত আমাদের শরীরে ঢোকেন আর বেড়িয়ে চলে যান।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কীভাবে কৃষ্ণ শরীরে ঢোকেন আর কীভাবে বা তিনি শরীর থেকে বেড়িয়ে চলে যান?
বললেন–যোগে, আসনে, প্রাণায়ামে। বায়ুগ্রহণ হল শরীরে কৃষ্ণের প্রবেশ আর ত্যাগে হল তাঁর বেড়িয়ে যাওয়া। জপ তো আসনে উপবিষ্ট হয়েই করতে হয়। জপে তো কৃষ্ণ ঢোকেন আর বেরোন। তাই কৃষ্ণ যাতে সব সময় শরীরে বিরাজ করেন তাঁর জন্যই তো সব সময় ধ্যানজপ।
যোগশাস্ত্রে আট প্রকার কুম্ভকের উল্লেখ আছে। ‘সহিতঃ সূৰ্য্যাভেদশ্চ উজ্জায়ী শীতলী তথা। / ভস্ত্রিকা ভ্রামরী মূৰ্ছা কেবলী চাষ্টকুম্ভিকা।।’ সহিত, সূৰ্য্যাভেদ, উজ্জায়ী, শীতলী, ভস্ত্রিকা, ভ্রামরী, মূৰ্ছা, কেবলী–এই আট প্রকার কুম্ভক। যোগীপুরুষই যা রপ্ত করেন। চক্র জাগাতে এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ। অনাহত চক্রে বায়ুবীজ লং অবস্থিত। দশ বায়ু আছে–‘প্রাণোহপানঃ সমানশ্চোদানব্যানৌ চ বায়বঃ/ নাগঃ কুম্মোহথ কুকরো দেবদত্তো ধনঞ্জয়ঃ।।‘ প্রাণ, অপান, সমান, উদান, ব্যান, নাগ, কুর্ম, কূকর, দেবদত্ত ও ধনঞ্জয়–এই হল দশ বায়ু। এর মধ্যে প্রধান পাঁচ বায়ু প্রাণ, অপান, গুহ্যদেশে; সমান নাভিমণ্ডলে; উদান কণ্ঠদেশে; ব্যান সমস্ত শরীরে অবস্থান করে। দশ বায়ুর দশটি গুণ বর্তমান। যার গুণগুলো ঠিকমতো জেনে নিতে পারলে সাধক শরীরের উপর ইচ্ছামত আধিপত্য স্থাপন। করতে পারেন। এতে সাধক শরীর সুস্থ ও নিরোগ থাকে।
প্রাণবায়ু খাবারকে পরিপাক করে; পানীয়কে স্বেদ ও মূত্ররূপে এবং রসকে। বীর্যরূপে, রজঃরূপে প্রতিস্থাপন করে দেয়। অপান বায়ু খাবার পরিপাকের জন্য অগ্নিপ্রজ্জোলন করে। গুহ্যে মল নিঃসারণ করে, উপছে মূত্র এবং অণ্ডকোষে বীর্য। তাছাড়া ঊরু, জানু, কটিদেশ ও জঙ্র কাজও সম্পন্ন করে থাকে। সমান বায়ু পরিপক্ক রসকে সমস্ত নাড়িতে চালিত করে; দেহের পুষ্টিসাধন করে। আমাদের প্রত্যঙ্গগুলোকে উন্নত করে উদান বায়ু। ব্যান বায়ু চোখ, কান, গলা ইত্যাদির কাজ সম্পন্ন করে। নাগবায়ু উদরের কাজ, কুর্মবায়ু সংকোচনের কাজ করে থাকে। খিদে-তৃষ্ণার তৈরি হয় কুকর বায়ুর কাজে। নিদ্রা হয় দেবদত্ত বায়ুতে। শোষনাদির কাজ করে থাকে ধনঞ্জয় বায়ু। সাধক এইসব বায়ুগুণকে আত্মস্থ করে নেন যোগক্রিয়ায়। তন্ত্রে এই বায়ু প্রয়োগ দরকার। বাউল সাধনায় এতখানি দরকার নেই। তাঁদের ক্রিয়াকল্পে হঠযোগ, রেচক, পূরক, কুম্ভক ইত্যাদিই যথেষ্ট।
যুগলের মেলায় কমিটির মঞ্চে নটবর দাস বাউল আমাকে বাউলের কৃষ্ণকে যেন প্রতীকী অনুষঙ্গের পরিধি বাড়াতে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বললেন, ‘খ্যাপারা সব কৃষ্ণবস্তু নিয়ে বসে আছেন।’
পুরাণ কাহিনী কিন্তু কৃষ্ণকে সেভাবেই উপস্থিত করে প্রাণময় করে রেখে দিয়েছে। পুরাণকারেরা কৃষ্ণকে যে সব অধিবিদ্যা দিয়ে বসেছেন সেগুলো কিন্তু সব আসলেই একেকটি স্মারক। যা তুলে দেওয়া যায় অনায়াসে মানুষের হাতে। আর এভাবেই। মানুষ ‘কৃষ্ণবস্তু’কে ইচ্ছে করলেই লাভ করতে পারেন। যেটা মনে হয় কৃষ্ণ হল আমাদের অন্তদৃষ্টি। সুসাৰ্থক প্রতীক সব কৃষ্ণকীভাবে?
কৃষ্ণকে সাধক শরীর আমরা ধরেছি আগেই। গোপীরা সব নাড়ি। কৃষ্ণ শরীরস্থ আত্মা বা অনুভব। যোগের প্রসারিত অঞ্চল সব। দেহস্থ নাড়িগুলো গোপী সেজে কৃষ্ণকে সবসময়ই বিরক্ত করেন। সাধকের বিরক্তি এতে। নাড়ি অর্থাৎ কিনা গোপীরা সব যোগক্রিয়াতে সাড়া দিচ্ছে না ঠিকমতো। চক্ৰস্থ শক্তিগুলোকে দেহসাধক একীভূত করে নিতে পারছেন না কিছুতেই। তাই তাঁদের শিক্ষা দেবার জন্য, উপদ্রব কমাবার জন্য কৃষ্ণ তাঁদের পাশমুক্তি দিয়ে বসলেন। এই পাশমুক্তি হল আবরণ উন্মোচন। বাসনার বস্ত্রকে সাধনার শরীর থেকে টেনে খুলে ফেলা। নাড়িগুলো যদি গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদেরই কাপড় সব টেনে খুলে একেবারে ন্যাংটা করে দিচ্ছেন। আবার নাড়িগুলো যদি প্রতীকী আবরণের গোপী হয়, তাহলে তো কৃষ্ণ তাঁদের সঙ্গে লীলাও করবেন না কী! কীভাবে করবেন সাধক কৃষ্ণ এই লীলা?
গোপীদের বশ করে নেবেন তিনি। বস্ত্র যদি বাসনা হয় তাহলে বাসনা মুক্ত শরীরে সর্বদাই চলবে নাড়িগুলোর ছন্দগত ক্রিয়াকরণের সব লীলা। এঁদের মধ্যে তো রাধাও বর্তমান ভেবে নিয়েছিলাম আমরা। দাঁড়াল এই–সাধক কৃষ্ণ মহিমায় মহিমান্বিত। হয়ে এভাবেই গোপীরূপী সব নাড়ি আর রাধারূপী সুষুম্নার সঙ্গে বিশেষ লীলা করে থাকেন। সুষুম্না হল প্রধানা নাড়ি। তাঁর দুই পাশে ইড়া, পিঙ্গলা। রাধার অষ্টসখিকেও নাড়ির প্রতীকী অবয়ব দিয়েছি আমরা। ইড়া, পিঙ্গলাও তাহলে এই অষ্টসখিরই অন্তর্গত।
কৃষ্ণের যে কালীয়দমন তাঁকে তো আমরা কুণ্ডলিনীর পাশ খোলাও অনায়াসে ধরতে পারি। শিবের গলার সাপকেও একই অভিধায় রাখতে পারি। ত্রিশূল দিয়ে দুর্গা। অসুরকে বধ করেছিলেন। ত্রিশূলের ‘ত্রি’ কে যদি আমাদের সত্ত্ব, রজ, তমগুণ সব ভাবি তাহলে ত্রিশূল দিয়ে দুর্গা অপান বায়ুকে বধ করেছিলেন। প্রাণায়াম, যোগে একে তো বশীভূত করা, পরাস্ত করা একান্তই জরুরি। অসুরকে তো অপান বায়ুর প্রতীকময়তা আমরা আগেও দিয়েছি। কুণ্ডলিনী তো সাপের মতই পেচিয়ে থাকে। সমুদ্রমন্থনের গল্পটি যদি এ প্রসঙ্গে আমরা মনে করি তাহলে দেখব সমুদ্রকে মন্থন করা হচ্ছে সাপ দিয়েই। বাসুকি যার নাম ছিল। সমুদ্রকে যদি সাধকের স্থূল দেহ মনে করি তবে তাঁকে মন্থন করা হচ্ছে। আমাদের শরীরের যেসব ইন্দ্রিয় তা যদি সাধক মন্থন করে নেন তবে সেই মন্থনেও হলাহল ও অমৃত দুই-ই তো উঠবে। অমৃত হল সিদ্ধির দিব্যতা বা জ্ঞান আর হলাহল বা বিষ হল বশীভূত সত্তা। যার মোহ সাধককে কাটাতে হয়। কুলকুণ্ডলিনীকে সর্প আকার দিয়েছি। যোগে তা জাগলে রস ক্ষরণ হতে থাকে সব, যা মদ্যর নামান্তর (‘সোমধারা ক্ষরে যাতু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে।‘) তাহলে দাঁড়াল এই–শরীররূপী সমুদ্রমন্থনেই। প্রতীককল্পের বিষ ও অমৃত উঠে আসছে সব। কুণ্ডলিনী বেঁকিয়েচুরিয়ে সর্পগতিতে হিস হিস ধ্বনিতে চক্ৰস্থ শক্তির দিব্যতা সাধক অমৃতস্বরূপ পান করছেন। আর তাঁর জন্যই তন্ত্রসাধক করছেন মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা, মৈথুনরূপী পঞ্চ ‘ম’ কারের সাধনা। বৈষ্ণবসাধকও ভিন্ন প্রতীকী অর্থে করেছেন একই সাধনা। বাউল সাধকও তাই করছেন। সকলেই ষড়রিপু, অষ্টপাশ, পঞ্চভূতকে নিয়ে দেহস্থ উপাচারে ব্রতী হচ্ছেন। আমরা সচ্চিদানন্দের কথা এর আগেও বলেছি। সৎকে নিউট্রন, চিৎকে প্রোটন ও আনন্দকে যদি ইলেক্ট্রন হিসাবে বিজ্ঞানের প্রতীকী অবয়ব পরিয়ে দেখি তাহলে দেখব এই সকল সৎ, চিৎ, আনন্দ শূন্যতার মধ্য থেকে বস্তুহীন প্রবাহে ধাক্কা খেতে খেতে পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা নিয়ে বিন্দু হিসাবে প্রতিভাত হচ্ছে। এই তিনভাগকে যদি ত্রিভঙ্গ হিসাবে ভাবি তাহলে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিখানির যে ত্রিভঙ্গ মুরতি নাম তাঁর প্রতীকী অর্থময়তাও স্পষ্ট হবে। তিনের যোগফলে ত্রিভঙ্গ যা কিনা ধাক্কায়, আঘাতে বেঁকেচুরে যাচ্ছে। ত্রিভঙ্গর মানেও তো তাই, তিন অংশে বাঁকা। তাহলে দাঁড়ালো এই–সৎ শূন্যতা/ নিউট্রন + চিৎ/ শক্তিপ্রবাহ প্রোটন+ আনন্দ ভাঙাচোরা বস্তুফেনা/ ইলেকট্রন। এই তিনের একত্র সমন্বয় ত্রিভঙ্গ। নটবর বাউলের বলা কৃষ্ণবস্তুকে কি প্রতীকী ভাবনার বিচ্ছুরণ দিয়ে একেবারের জন্যও এভাবে ভাবা যেতে পারে না।
গানে রীতিমতো প্রশ্ন তোলা হয়েছে যেন–’কোন কৃষ্ণ হয় জগৎপতি।‘ উত্তরও তাঁর সাজানো–’মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে-কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।‘
বাউল বলেন শরীর হল গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। এই বিশ্ব আমির স্বরূপকে নিয়ে সাকার হয়ে ওঠে বাউলের কাছে। আত্মতত্ত্ব ধরে থাকে আমি। হুল আমি যখন আস্তে আস্তে প্রবর্তস্তরে গিয়ে মেশে, গুরু হাল ধরেন। ত্রিকাল বিস্তৃত মহেশ্বরের মতোই গুরু আমির তীব্র মুহুর্তের এষণাকে জাগিয়ে দেন। বাউল তখন আমির স্বরূপকে চিনতে পারেন। আমি পঞ্চেন্দ্রিয় বাসনার থেকে মুক্ত হতে হতে, ষড়রিপুকে কম্পমান নক্ষত্রটুকুর আলোবিজ্ঞান পরাতে পরাতে, অষ্টপাশকে প্রসন্ন উন্মেষের কাছে নিয়ে যেতে যেতে ক্রমবর্ধমান আত্মসম্বিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর তখনই গুরু সাধক বাউলের আমিতে একশরীরী আকুলতার জন্ম দিতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। কীভাবে গুরু সাধক বাউলের আমিতে একশরীরী আকুলতার জন্ম দেন? সাধন দাস বৈরাগ্যকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বলেছিলাম, বাউলের আত্মতত্ত্বের বিকাশ কীভাবে হয়?
বললেন, সহচরীর ভাবনায়।
বললাম, দেহসঙ্গী কীভাবে বাউলকে আত্মতত্ত্বের বিকাশ দিতে পারে?
–দেহ কী শুধু শরীর? দেহ আনন্দস্বরূপ চৈতন্য। যার নারী নেই, পুরুষ নেই।
–একশরীরী মতবাদের কথা বলছেন আপনি?
— যুগল সাধনা তো এক শরীরেরই। এই সাধনায় নারীই ইষ্ট। আবার নারে অন্বিষ্ট। কখনও কখনও অনিষ্টও বটে নারী। নারী গুরু। নারীই দেহ দিয়ে দুই দেহের আত্মসম্বিতকে। এক করে দেন। চণ্ডীদাসকে রামী যেভাবে পার করেছিলেন। বিল্বমঙ্গলকে চিন্তামণি। পদ্মাবতী পার করে দিয়েছিলেন জয়দেবকে। বাউলকে পার করেন তাঁর রাধারানি। রাধারানি মোহ কাটান। আবার তিনিই মোহগ্রস্ত করে দেন। তিনি যে টানেন। কৃষ্ণ যেভাবে। টেনেছিলেন তাঁকে। যুগল সাধনায় এই টানাটানির খেলাতেই যখন দুই দেহ এক হয়ে ওঠে তখনই সাধক তাঁর আত্মতত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ডে শুক্রকে জমা করে অটল হয়ে যান। সাধনায় সিদ্ধ হন বাউল। রাধারানি তাঁকে পার করেন।
বলতে বলতে একতারা তুলে নিলেন সাধন। গাইতে লাগলেন। হাটগোবিন্দপুর আশ্রমে বিকেল যেন রাধা হয়ে আসন পাতল সাধনের গলা আর একতারায়।
ওই গোরা কি শুধুই গোরা।
আছে রাধা-রূপে রসান করা।।
তামাতে সোনা হল করিলে চিনে নেওয়া কি কঠিন বলে;
এমনি রাধার অঙ্গ,অঙ্গ পরশিলে তাইতো কালোরূপে গৌর রূপের পারা।
আহা মরি মরি, এ কি রে ভাব অন্য, অন্তরে কালো রূপ বাহিরে গৌরাঙ্গ;
গোরা পেয়েছিল ভালো ভাবিনীর সঙ্গ তাইতে রূপে রূপ ব্যেপে রেখেছে ধরা।।
গোরার ভাব বুঝিতে পারে কে এমন ছিল পুরুষ করল নারীর বেশ ধারণ,
গুরু অনুসারে কহিছে লালন, আছে শতদলে ভাব নিহারা।
নটবরের গানে আমরা কৃষ্ণকে প্রকৃতি হিসাবে পেয়েছিলাম। অর্থাৎ রাধা যেন। ধরে আছেন কৃষ্ণকে। চালিত করছেন। তাঁর সাধনাসম্পৃক্ত দেহ, দেহী সাধকের যুগলে সাধনবস্তুকে কৃষ্ণানুষঙ্গের পরিমণ্ডল দিচ্ছেন। পদকর্তা দুদ্দু বলছেন–’কৃষ্ণবস্তু নিগম ঘরে জীবদেহে বিরাজ করে/ রসিকের করণ সে কৃষ্ণ ধারণ করণ গম্ভীর অতি।‘ ‘কৃষ্ণ ধারণ’ বস্তুরক্ষা। আর এই বস্তুরক্ষা আত্মতত্ত্বকে না জানলে কখনও সম্ভব নয়। আত্মতত্ত্বতেই তো ইন্দ্রিয়ের আসক্তি নাশ হয়। কামেন্দ্রিয় প্রেমেন্দ্রিয়তে রূপ পায়। রূপের দরজা দিয়ে সোজা এগোলেই তখন প্রতিভাত হয় কৃষ্ণ, যিনি লালনের কথা অনুযায়ী রাধা-রূপে রসান করা।
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীকৃষ্ণজন্মখণ্ডে আছে–’কুম্ভকার বিনা-মৃত্তিকায় ঘট করিতে পারে না, স্বর্ণকার স্বর্ণ বিনা কুন্ডল গড়িতে পারে না। তেমনই আমি তোমা ব্যতীত সৃষ্টি করিতে পারি না। আমি যখন তোমা ব্যতিত থাকি, তখন লোকে আমাকে ‘কৃষ্ণ’ বলে, তোমার সহিত থাকিলে শ্রীকৃষ্ণ বলে…তুমি বিশ্বের মূল প্রকৃতি… এই বিশ্বের সমস্ত স্ত্রী তোমার কলাংশের অংশকলা যেমন দুগ্ধ ও ধবলতা, তেমনই যেখানে আমি, সেইখানে তুমি। আমি দীপ্তিমানদিগের মধ্যে সূর্য, তুমি সঙ্গে থাকিলে আমি দীপ্তিমান হই, তুমি না থাকিলে হই না।
দুদ্দু শাহের গানে যে ‘কৃষ্ণ প্রকৃতি’ সে কৃষ্ণ কৃষ্ণত্বের আমির ‘তোমা ব্যতীত’ থাকা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী। আবার সাধন দাস বাউলের গানে যে কৃষ্ণরূপ দেখি–’ওই গোরা কি শুধুই গোরা। / আছে রাধা-রূপে রসান করা। এই রস ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী ‘তোমার সহিত থাকিলে’র রসস্থ কৃষ্ণ।
রামকৃষ্ণদেব বলেছেন–’অনন্ত রাধার মায়া কহনে না যায়/ কোটি কৃষ্ণ কোটি রাম হয় যায় রয়।।‘ রাধার এই মায়াকে যদি কৃষ্ণ ও রামের রক্তমাংসে স্থাপনা করি তবে সাধনের গাওয়া লালনের গানটিই সামনে আসে–’এমনি রাধার অঙ্গ, অঙ্গ পরশিলে তাইতে কালো রূপে গৌর রূপের পারা।।‘ গৌর তো গৌরাঙ্গ স্বরূপ ঠিকই কিন্তু সেই গৌর ‘অনন্ত রাধার মায়া’ নিয়েই প্রতিভাত বাউলের কাছে। ‘রাধার মায়া’ বাউল সাধকের ‘রাধারানি’। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন–Radha was not of flesh and blood, Radha was froth in the ocean of love.’ রাধা রক্তমাংসের নয়, প্রেমসাগরের একটি বুদবুদ। বাউল সাধকের প্রেম দুদ্দু শাহের গানে বর্ণিত ‘আত্মতত্ত্ব’ জেনে ‘কৃষ্ণ-সেতু’ চিনে নেবার প্রেম। কৃষ্ণ-সেতু কৃষ্ণবস্তুর গৌরবী সমুজ্জ্বলতা। কৃষ্ণ মুখ্যত একটা প্রতীকী সাবয়ব নিয়ন্ত্রণের ধারা। যুগল সাধনায় এই নিয়ন্ত্রণ ইন্দ্রিয়ের সীমানাগুলোতে সচেতন অস্তিত্বের সহসা সঞ্চারণ যেন। অস্তিত্ব দেহসাধকের ‘আত্মতত্ত্ব’। যা কিনা ‘কৃষ্ণ সেতু’কে নির্ণয় করতে পারে। ঋগ্বেদে রাধা কথার অর্থ করা হয়েছে ধন বা ঐশ্বর্যের দেবী-রা-ধা, রয়িং বা রায়।
এই দেবীরূপ দেহস্থ চক্রের মধ্যস্থ বিভিন্ন শক্তির ভেতর দেহসাধক কল্পনা করেন। ডাকিনী, হাঁকিনী, লাকিনী ইত্যাদি নাম্নী শক্তিরূপের কথা আমরা বলেছি, যা কিনা চক্রপদ্মে অবস্থিত। ঋগ্বেদে রাধাকে যে ধন বা ঐশ্বর্যের দেবী বা অধিষ্ঠাত্রী হিসাবে দেখানো হয়েছে সেই ঐশ্বর্য কিন্তু দেহসাধক অনাহত পদ্মচক্রে ধ্যানে লাভ করে থাকেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাধাও পদ্মচক্রে অধিষ্ঠান করছে। নাড়ি জাগৃতিতে তাঁকে তো আমরা ইতিমধ্যে বিশিষ্টতার স্থান দিয়েই দিয়েছি। বাউল সাধক রাধাকে পদ্মচক্রে প্রতীকী করে রেখে কৃষ্ণকে জাগৃতি দিয়েছেন উৰ্দ্ধরেতাতে। কৃষ্ণ মদনমোহন কেন? কারণ তিনি কামকে মোহিত করে নিচ্ছেন। কামকে বশীভূত করে রাখছেন। আর এই কাম আসছে কোথা থেকে? আসছে কিন্তু সঙ্গিনীর শরীর থেকেই। তার জন্যই সাধক বাউল সঙ্গিনীর শরীরের কামকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পর্শে একেবারে ভোঁতা করে দেন। সঙ্গিনীর কামকে বাউল সাধক ভোঁতা করেন। তাহলে দাঁড়ালো, রাধাই মদনমোহন। কারণ রাধার কামকেই বাউল ভোঁতা করে দিচ্ছেন কিন্তু। বাউলের পদে রাধা যে পদ্মচক্রে শরীরস্থ হয়ে রয়েছেন যে কথা তো বললামই। তেমনই একখানি গান ফটিক গোঁসাইয়ের–’আমার দয়া, ও দয়া কর। বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই। / রাধে গো রাধে প্রেমময়ী, তুমি মৌন ভাবে মনমোহিনী/ তুমি চতুর্দলে কুণ্ডলিনী তুমি স্বাধিষ্ঠানে নারায়ণী/ তুমি দশম দলে কালরূপিনী তুমি হৃদকমলে কমলিনী/ রাধে আমায় দয়া কর হে, রাধে গো।।/ তুমি বিশুদ্ধাখ্যে পঞ্চাননী, দ্বিদলে আনন্দরূপিনী/ সহস্রারে ব্রজবিলাসিনী, রাধে আমায় দয়া কর হে, রাধে গো।।‘
দয়াল খ্যাপা সাধন দাসের আস্তানাতে বসে যে গান আমাকে শুনিয়েছিলেন সেখানেও রাধা কিন্তু শরীরের পদ্মচক্রেই রয়েছেন আর কৃষ্ণকে পদকর্তা রসাকার করেছেন। অর্থাৎ শুক্ররক্ষার চিহ্নস্বরূপ কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন সাধক রাধার শরীরস্থ পদ্মচক্রগুলোকে–’প্রেম সুখদ্বার কৃষ্ণ রসাকার রসনাতে তার কর আস্বাদন/ সে যে যোগাযোগ-স্থলে মৃণাল পথে চলে/ সহজ কমলে সুধা বরিষণ।
কৃষ্ণের চলাচলকে ‘মৃণাল পথ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন পদকর্তা হাউড়ে গোঁসাই। মৃণাল পদ্ম। তাহলে দেখা যাচ্ছে কৃষ্ণপথ পদ্মচক্রেরই পথ। কৃষ্ণবস্তুর রসনা আস্বাদন এই পথেই সম্ভবপর। ‘কৃষ্ণ রসাকার’ বলবার কারণ কৃষ্ণ হল শুক্রবস্তু। রজকেও বাউল রস বলেন। মূত্রও তাঁর কাছে রস। শরীরস্থ পদার্থ বাউল শরীরেই ফিরিয়ে নেন। তিন রস শরীরস্থ পদার্থই। বাউল সাধক শুক্ররস ব্রহ্মরতে উঠিয়ে নিতে পারেন। মূত্রও শিক্ষা দীক্ষার সময় পান করে শরীরে ফিরিয়ে নেন তিনি। তবে বাউল সঙ্গিনী রজ পান করেন বলে কোনোদিন শুনিনি। সঙ্গিনী মূত্র ও মলও শরীরে ফিরিয়ে নেন না। এ কার্য কেবল বাউল সাধকেরই। সঙ্গিনীর নয়। যুগল মিলনকে, সম্ভোগকে বাউল বলেন ‘অপ্রাকৃত মিলন’। তাঁদের মতো শরীরে শরীরে মিলন হয় না, মিলন হয় আত্মায় আত্মায়। আত্মার। সঙ্গেই আত্মার রমণ চলে। এভাবেই প্রাকৃত দেহ ভাবদেহ হয়ে ওঠে। এই দেহস্থ মিলনের অপার মহিমা কেবল রসিক হলেই জানা যায়। রসিক হল রসধারণকারী মানুষ। বীর্যরক্ষার মানুষ। কৃষ্ণ সাধনের মানুষ।
মৃণাল-পথে কৃষ্ণ-যোগাযোগ কীভাবে হয় বাউল সাধকের? সাধক বলেন অন্ত্রে বায়ুর প্রকোপ কমিয়ে এনে দেহকে সর্বপ্রথমে হালকা করতে হয়। দেহের মধ্যে বায়ু উনপঞ্চাশের প্রধান পাঁচটি নিয়ে সাধক শুরু করে দেন দেহসাধনা।
পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ বায়ুর(প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান) প্রধান দুই বায়ুর (প্রাণ, অপান) যে শ্বাসক্রিয়া তা চলে আবার শরীরের প্রধানা তিন নাড়িকে ঘিরেই। ইড়াতে চলতে থাকে প্রাণ বায়ুর ক্রিয়া। অপান বায়ুর ক্রিয়া হয় পিঙ্গলাতে। শ্বাস যখন নেওয়া হয় তখন প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে টেনে একেবারে নীচের দিকে নামিয়ে দেয়। শ্বাস ছাড়ার সময় প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে উপরে উঠিয়ে দেয়। শ্বাস উপরে ওঠাকে আমরা বলতে পারি চেতনার বিকাশ। প্রাণ বায়ু থাকে হৃদয়দেশে। অপান বায়ু গুহ্যদেশে। সাধক প্রাণ বায়ুকে ‘রা’ বলেন আর ‘ধা’ হল অপান বায়ু। দিনরাত আমাদের শরীরে দুই বায়ুর খেলা চলছে। সদানন্দ বাবাজি আমাকে বলেছিলেন, কৃষ্ণের লীলা হয় গো শরীরে। রাধার সঙ্গে খেলে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কৃষ্ণপ্রাপ্তি কীভাবে হয়?
বললেন, কৃষ্ণ হল গিয়ে আত্মসাক্ষাৎকার। তা হয় কুম্ভকে।
বললাম, কীভাবে হয় তা?
–তা বাবা এ তো বলে বোঝানো যাবে না। এ যেন করণক্রিয়া।
বাবাজি হাসলেন। আমি তাঁর হাসির রেখায় যেন দেখলাম আত্মসাক্ষাৎকারের প্রতিবিম্ব সব জড় হচ্ছে।
— শরীরে সব সময় রাধা নাম চলে।
শ্রীপাঠের বৃদ্ধা বৈষ্ণবী আমাকে বলেছিলেন।
–কীভাবে চলে?
–অভিমান, অভিসারে। এই অথর্ব শরীর এখনও অভিসারে যে বের হয়। তাঁর জন্যই তো অসুস্থতাতেও বেঁচে থাকা বাঁচার ইচ্ছা।
বৈষ্ণবীয় ‘অভিমান’ ‘অভিসার’কে আমরা যদি সংগ্রাম ধরি তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে আরও কীসের এই সংগ্রাম? না হয় সহজিয়া মত নিয়ে প্রেম সংগ্রামই আমরা ধরলাম।
সাধক বলেন জীবাত্মা বিস্তৃতপ্রায় হয়ে এলেই তবে পরমাত্মার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আসলে যেটা হয়, প্রাণ বায়ু অপান বায়ুকে কাছে টানে। ভাবি যদি প্রতীককল্পে তবে দাঁড়ায় এই : ‘রা’ টানছে ‘ধা’ কে। রাধাকে উল্টোলে হয় ধারা। অর্থাৎ অব্যাহত। এই টানাটানি সব সময় চলে। এই টানকে বৃদ্ধা বৈষ্ণবীর বিশ্বাসের বা প্রতীকী কল্পনার অভিমান, অভিসারও ধরা যেতেই পারে। টানার এই অভিমানে, অভিসারে যেটা হয় তা হল–এক সময় যোগে অপান বায়ুর পরাজয় ঘটে। প্রেম সংগ্রামে অপান বায়ু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। প্রাণ বায়ু বিজয় লাভ করে। অপান বায়ু না থাকায় তখন ক্রিয়া চালানোর ক্ষমতা থাকে না সাধকের। শ্বাস প্রশ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় দেহসাধকের। এই দশাকে সাধকরা বলেন কুম্ভক। কুম্ভকে জলপূর্ণ কলসির ন্যায় বায়ু ধারণ করে রাখা হয় শরীরে। সাধক এখানে শ্বাস প্রশ্বাসের ক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে কুম্ভকের মতই পূর্ণ হয়ে ওঠেন অতীন্দ্রিয় তরঙ্গে। সদানন্দ বাবাজি একেই বলছেন কৃষ্ণ। আত্মসাক্ষাৎকার। সাধক এই দশাকে হংস বলে থাকেন। হং হল শ্বাস, স হল প্রশ্বাস।
‘হংকারো নির্গমে প্রোক্তঃ সকারন্তু প্রবেশনে। / হংকারঃ শিবরূপেণ সকারঃ শক্তিরুচ্যতে।।’ শ্বাস পরিত্যাগ করে যদি আর গ্রহণ না করা হয় তবে তাঁকে মৃত্যু বলে। হং হল শিবস্বরূপ বা মৃত্যু। স হল গ্রহণ বা শক্তির স্বরূপ। ক্রিয়াযোগ বন্ধ মানেই সাধক জীবাত্মার খোলস ফেলে দিয়ে পরমাত্মাকে লাভ করে ফেললেন যোগবলে। না হলে শ্বাস প্রশ্বাসই তো জীবত্বের দশা। হংসই জীবের দশা। তা থেকে সরে এলে সাধক হয়ে ওঠেন। পরমহংস।
বাউল সাধকও শ্বাসক্রিয়াতেই ‘সহজ কমল’ লাভ করেন। তার সুধা অনুভব করতে পারেন। পদকর্তা তাই বলেছেন–’সর্ব ঘটে বটে পটে পট্ট স্থিতি / শক্তিতত্ত্ব গুণে আনন্দ মুরতি।‘ ‘সর্ব ঘট’ দেহের চক্ৰন্থ অধ্যায় সব। যে অধ্যায়তেই বায়ুক্রিয়ায় যুগল মিলনে ‘শৃঙ্গার আকার’ সাধারণ জনের না ধরতে পারার কথা বলা হয়েছে গানে। পদকর্তা বলেছেন ‘ইন্দু বিন্দু গতি সদা বিরাজয়। / জীবে নাহি জানে সাধুসন্ত চেনে/ রসপানে জানে তারা অমৃত-সেবন।’
ইন্দু হল চাঁদ। যার সাধনা ‘বি’র জন্যই সাধনা। বিন্দু শুক্র। বাউল বলেন বিন্দু সাধনায় আত্মশক্তির দর্শন হয়ে যায়। হাউড়ে গোঁসাইও সে কথা শুনিয়েছেন।
শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে আমরা দেখি শ্রীভগবান বলছেন–’রজোগুণসমুদ্ভবঃ এষঃ কামঃ এষঃ ক্রোধঃ মহাশনঃ মহাপাপমা ইহ এন বৈরিণম্ বিদ্ধি। রজগুণ থেকেই কাম উৎপন্ন হয়ে ক্রোধে পরিণত হয়। যাকে সব সময় শত্রু বলে জানবে। তৃষ্ণা ও আসক্তি থেকে আসে রজগুণ। রজগুণের এই আসক্তি থেকেই আসে কামনা। দেহসাধকের সাধনা কামনার কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে নেওয়া। আর তা হলেই কৃষ্ণপ্রাপ্তি। ‘আত্মশক্তির দর্শন’। অষ্টপাশ নাশ, ষড়রিপু দমন, চন্দ্ৰসাধন–এসবের মহদ্য দিয়ে কাম প্রেম হয়। ‘অষ্টপাশ’ কিন্তু প্রতীকী কৃষ্ণরূপ। এরকম ভাবতেই পারি আমরা। বাউল অষ্টমচন্দ্রের কথাও বলেন। সবই তাঁদের যদি কৃষ্ণবস্তু রক্ষার সাধনা হয় তাহলে তাঁদের ‘অষ্ট’তেও কিন্তু কৃষ্ণ বিরাজমান। কৃষ্ণ দেবকীর অষ্টম গর্ভেরই সন্তান। বাউলের কৃষ্ণ প্রতীকের বহিষ্কৃতি যেহেতু, তাই ‘প্রতীকের আট’ও সদর্থক অর্থেই কৃষ্ণসূচক। কৃষ্ণ আস্তিকতায় স্থৈর্য কৃষ্ণ চিত্তস্থৈর্যের ঈষৎ উচ্চাবচতা।
মনোহর খ্যাপার আশ্রমে একবার অজিত দাস বাউলের গলায় শুনেছিলাম এরকমই এক অতিক্রমের গান। গুরুপূর্ণিমা ছিল সেদিন। ভক্তশিষ্যরা অনেকেই এসেছিলেন। আশ্রমে থই থই করছে লোক। রোজকার ফাঁকা আশ্রম আর নেই। শ্রাবণের দু’এক পশলা লেগেছে হাওয়ায় বেশ কয়েকদিন ধরা বৃষ্টির পর এদিনই যেন মাঝ দুপুরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সন্ধ্যেয় বেদনাশা বটের পাতায় খিলখিলিয়ে উঠছে সিক্ত হাওয়া। ভরা অজয়েও যেন দোলা লেগেছে। বিকেলে ফুরফুর করে জলের স্রোত এসে লেগেছিল। আশ্রম বেষ্টনীর পাঁচিলে। হাওয়ায় জলের গন্ধ। রাধাকৃষ্ণের মতোই দুলে উঠছে বেদনাশার পাতা। জ্যোৎস্না পড়ে চিক চিক করছে জলে ভেজা পরিষ্কার পাতা। বাউল গাইছেন নিবিষ্ট মনে। ভক্তশিষ্য থ মেরে বসে আছেন গানের সামনে। এমনই পরিবেশের সম্মোহন। খ্যাপার গান গিয়ে ধাক্কা মারছে নির্জন আশ্রমের চরাচরে রাধাকৃষ্ণের শূন্য অখণ্ডতায়।
বাউল গাইছেন–
অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা-কৃষ্ণ দোলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
(ক্ষ্যাপা) সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন।
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে (ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিদলে,
অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা-কৃষ্ণ ঝুলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে
(ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিদলে
গোঁসাই পূৰ্ণানন্দ ভনে,
দোলার কথা কেই বা জানে।
গোলকপতি আপন মনে
(ক্ষ্যাপা), এক দোলায়, আজ দুজন দোলে।।
অকৈতব গাছের লতায় পাতায় রাধা কৃষ্ণ দোলে
পাতা নয়, শ্রীগোবিন্দ, লতা নয় সে প্রাণবন্ধু,
ইন্দু বিন্দু এক দোলায় দোলে।
(ক্ষ্যাপা) সেই অপ্রাকৃত মদনমোহন।
কৈতবেতে না যায় লিখন।।
(রাধা) শ্যাম দোলে
(ক্ষ্যাপা) ওই দ্বিতলে।।
‘অকৈতব গাছ’ এখানে ছলনা কপটতাহীন সাধক ও তাঁর সাধন সঙ্গিনীর যুগল শরীর। গাছের লতায় পাতায় রাধাকৃষ্ণ দুলছে। মনে হচ্ছে যুগল শরীরের সমস্ত প্রত্যঙ্গগুলোতে অপার্থিব হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কেননা দুই শরীর স্থূল দেহকে অতিক্রম করে চলে গেছে সাধনের সিদ্ধতায়। যার জন্য ইন্দু বিন্দু এক দোলাতে দুলে যাচ্ছে। ইন্দু হচ্ছে চাঁদ আর কি কৃষ্ণবস্তু। সাধক বাউল ইন্দুরই সহায়তায় বিন্দুধারণ করে জাগতিকতার উর্ধ্বে উঠে গেছেন, সাধন সঙ্গিনীর সঙ্গে তাঁর মিলন এখন রাধাকৃষ্ণেরই মিলন। রাধাকে প্রকৃতিও বলেন। প্রকৃতি হল তাঁর সঙ্গিনী প্রকৃতির সাহায্যে সাধক বাউল কৃষ্ণবস্তুকে নিগম করে নিয়েছেন। সাধক আর সঙ্গিনী দুলছেন দ্বিদলে। ভ্রদ্বয়ে আজ্ঞাচক্রে দ্বিদল পদ্মের অবস্থান। আজ্ঞাপদ্ম দুই দলের। বাউল সাধক হৃদ্বয়ের মিলনস্থলকে আরশিনগরও বলে থাকেন। বহুশ্রুত লালনের গানে আমরা এর উল্লেখ পাই–’আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে/ আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর/ ও এক পড়শি বসত করে।‘ বাউল বিশ্বাস রাখেন আজ্ঞাচক্রেই পড়শি বা উপাস্য থাকে। বাউলের উপাস্য হল বীর্য। যার সাধনক্রিয়ায় বাউল অটল হয়ে যান। বাউল কামকে ধ্বংস করেন। কামের বস্তুকে নিয়ন্ত্রণ করা সেজন্যই তাঁর প্রধান সাধনা। ভীষ্মর ইচ্ছামৃত্যুর মতো কামকে বাউল ইচ্ছাকামের মধ্য দিয়ে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে রাখেন বস্তু সাধনাতেই। ভীষ্মর যে শরশয্যা–এই শরশয্যাকে আমরা কল্পনা করতে পারি সংসারের সঙ্গে। সংসার শরশয্যা। অর্থাৎ সাধক সংসারের মায়ারিপুতে যাতে না বশীভূত হয়ে পড়েন তাঁরই প্রতীকীরূপ ভীষ্মর শরশয্যা। ভীষ্ম ত্যাগ তিতিক্ষার উর্ধ্বে উঠতে চেয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত করেছিলেন ব্রহ্মচর্য পালনের। মহানুভবতার পরিচয় দিতে গিয়েও ব্রহ্মচর্যের নাগপাশে তিনি আটকে থাকলেও তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল মায়া। শুধু কি মায়া? আড়ালে থেকেও রাজ্যের পুরোধা হবার বিশেষ বাসনা তাঁর কি একেবারেই ছিল না? ছিলই। না থাকলে তিনি ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। আর তা পারেননি বলেই ভীষ্ম শেষপর্যন্ত শরশয্যায় বিদ্ধ হয়ে পড়ে রইলেন গৃহ থেকে দূরে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে। ভীষ্মর এই শর যোজনার উপাখ্যান রিপু বশ্যতার উপাখ্যানই। যার থেকে সাধককে দূরে থাকতে হয়। বাউলের সাধনা শরীর থেকে কামের বন্ধন টেনে ছিঁড়ে কামকে নির্মূল করে দেওয়া। যার জন্যই তাঁর বস্তুরক্ষার প্রশ্ন। বাউলের সাধনাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যকে প্রসারিত করারই সাধনা। যদিও এ নিয়ে এখন প্রবল মতান্তর আছে। এক শ্ৰেণী বলছেন সাধক বাউলের যদি সন্তান না আসবে তবে আসল বাউল কী করে জন্মাবে? তবে বীর্য সাধনার মূল বিষয় নিয়ন্ত্রণেরই সাধনা। সৃষ্টির আদিবীজকে তাঁরা দেহ ব্রহ্মাণ্ডের সক্রিয় যোগশক্তির ভেতর ভ্রমণশীল বিচরণক্ষেত্র করে নিতে পারেন। এতেই তাঁদের সিদ্ধ স্তরের যে প্রবর্তনা তা প্রতিপন্ন হতে থাকে। আজ্ঞাচক্রে দ্বিদল যেমন থাকে তেমনই থাকে পদ্মের উপরে ইড়া,পিঙ্গলা, সুষুম্নার মিলনস্থল। বাউল একে ‘তিনরতি’ও বলে থাকেন। এই রতিকেই মতি দেন তাঁরা। আজ্ঞাপদ্মকে জ্ঞানপদ্মও বলে থাকেন সাধক। পরমাত্মা এর অধিষ্ঠাতা। জীবাত্মার বিনাশ হলে তবেই সাধক পরমাত্মার কাছাকাছি যেতে পারেন। বাউল সাধক অকৈতব মিলনে সেই স্তরে বিচরণ শুরু করে দেন। কেননা বিন্দুধারণে তাঁর উপাস্য, পড়শি বা কৃষ্ণবস্তু পরমাত্মার সংবর্ধনাকে গহন বৈভব দিয়ে দেয়। যার ফলে সিদ্ধ হয়ে ওঠেন সাধক। মদনমোহনও অপ্রাকৃত হয়ে এক দোলায় দুলতে থাকে। মদনমোহন কামজয়কারী মানুষ। অটল মানুষ। দ্বিদলে বা দ্বিতলে তখন রাধাকৃষ্ণ দোলে। অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষ এক হয়ে ওঠে। কে পুরুষ আর কে বা প্রকৃতি সেই বাহ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যে দশ অবতারের কথা বলে থাকি সেও কিন্তু আমাদের বাহ্যতা নাশেরই প্রতীকস্বরূপ।
মত্স্য হল আমাদের প্রথম অবতার। মৎস’র সঙ্গে জল সংযুক্ত। মানুষের জ্ঞান সমুদ্রকেই মৎস্য অবতার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল তখন। দ্বিতীয় অবতার কুর্ম উভচর প্রাণী। মানুষের মানসিক অবস্থাও অনেকটাই কুর্মের মতো। কুর্ম জলে ও ডাঙ্গায় দু’জায়গাতেই থাকতে পারে। সমুদ্রকে জ্ঞান স্বরূপ হিসাবে আমরা ভেবেছি। ডাঙাকে ব্যক্তিস্বরূপ হিসাবে ভাবি যদি তাহলে দাঁড়ায় মানুষ জ্ঞানসমুদ্র ও ব্যক্তিস্বরূপ থেকে অর্জিত চেতনার মধ্যে বিচরণ করতে পারে। তৃতীয় অবতার বরাহ। জলে থাকে না সে। ডাঙ্গা তার বাসযোগ্য জমি–তবে বরাহ প্রয়োজনে সাঁতারও দিতে পারে। মানুষ। ব্যক্তিস্বরূপকে জেনে চিনে বুঝে সেখানেই কেবল আবদ্ধ হয়ে থাকে না নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায়। তাই তাঁর জ্ঞানসমুদ্রও উথলে ওঠে। এর পরের অবতার নৃসিংহ। অর্থাৎ সিংহের মাথা, শরীরটা মানুষের। মানুষের ভেতর যে পশুচেতনাও মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠে এই অবতার তাকেই চিনতে সাহায্য করে প্রতীকী আলোকসম্পাতে। পঞ্চম অবতার বামন। ক্ষুদ্রতা, নীচতার প্রকাশকে যা চিহ্নিত করে। পরশুরাম পূর্ণ মানবসত্তার বিকাশপথটির। সূচনা। তাই রামের আগে পশুর বন্যতা লাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সপ্তম অবতার রাম। পশুত্বের মুক্ত চেতনা থেকে উদ্ভূত তাঁর রূপ। অষ্টম অবতার বলরাম। অর্থ হল হলধর। যা দাঁড়ায়, মানুষের সেই জ্ঞান সমুদ্রকেই আরও কর্ষণ। নবম অবতার বুদ্ধ। সংসারের মায়াপাশ ফেলে রেখে সাধনার নির্জন খুঁজে বোধি লাভ করার প্রতীককল্প। দশম অবতার কল্কি অর্থাৎ নিষ্কলঙ্ক হয়ে ওঠা। দশ অবতার এভাবেই আমাদের চেতনার পটভূমিকে তৈরি করে দেয়। যে চেতনার জোরেই বাউল সাধক অকৈতব গাছের লতায় পাতায় দুলতে পারেন। পুরুষ ও প্রকৃতির কম্পনকেও ঠিক রাখতে পারেন বিশ্বনৃত্যের একাত্মতায়।
বাউল সাধক পরমাত্মার স্বরূপ আস্বাদন করেন দু’জনের একত্র সাধনায়। বাউল বলেন নিজেকে নিজে আস্বাদন করা যায় না। সঙ্গিনীর ভেতর দিয়েই নিজেকে চেনা যায়। স্বরূপ বেড়িয়ে পড়ে তখন।
শশাঙ্কশেখরকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার, সঙ্গিনীর ভেতর দিয়ে কীভাবে নিজেকে চিনতে পারেন বাউল?
বললেন, শিক্ষা-দীক্ষাই তো বাউলকে সঙ্গিনীর ভেতর নিজেকে চিনতে সাহায্য করে।
–কীভাবে হয় শিক্ষা-দীক্ষা?
–সে অনেক কথা বাবা। ব্রহ্মচর্যের শুরু হয় শিক্ষা-দীক্ষায়। তখনই তিন রস শরীর থেকে ধরে শরীরে ঢুকিয়ে নিতে হয়। মূত্র যতবার হবে নারকেল মালাতে ধরে খেতে হবে।
–খেতে পারেন কি সবাই?
— না পারলে চলবে? ঘেন্নাকে মন থেকে না তুলতে পারলে কিছুই হবে না। পাশ, রিপু সব মূত্র গেলার মতোই খেতে হবে। খেতে খেতে মূত্রকে এক সময় মনে হবে অমৃতধারা। মল হবে মাখন। সঙ্গিনীর রজ হবে সদ্য দোয়ানো ঘন গরম দুধ।
–তারপর?
জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বাউল বললেন, তারপর ব্রহ্মচর্য ভাঙা যুগল সাধনায়। ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে আবার গড়েপিঠে নেওয়া। এ এত সহজ নয় বাবা। আসন আসন সিদ্ধাসন। শ্বাস ভেঙে শ্বাস নিয়ে শ্বাস ছেড়ে দু’জনকে দু’জনের মধ্যে গড়তে হয়। ভাঙতে গড়তেই রাধাকৃষ্ণের স্বরূপ বেড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা ঢলে এসেছে তখন। মজলিশপুরের আশ্রমে ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। যুগলের ঘন্টা ছড়িয়ে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়। অল্পলোয় ভেসে উঠছে রাধাকৃষ্ণের মুখ। শশাঙ্কশেখর তাঁকেই যেন উসকে তুলেছিলেন সেদিন। বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মানুষ তিনি। বাউলের ভাব পরে তিনিও একদিন মেতেছিলেন যুগল সাধনায়। আজ তাঁর ছেলে আছে আর আছে ছড়ানো ভক্তশিষ্য। দ্বিধারা স্রোত নিয়ে তিনি যেন একাই এই বৃদ্ধ বয়সে যুগল হয়ে বসে আছেন। সেদিন তাঁকে দেখে যেন তেমনই আমার মনে হচ্ছিল।
*****
যুগলকিশোরের মেলায় গোপাল দাস বাউলের মুখে শুনেছিলাম যে গান, তা শোনানোর আগে তিনি বলেছিলেন, কৃষ্ণের দরজায় এসেছেন আর নাড়া খাবেন না তা কী হয়!
–কীভাবে নাড়া খাব বলুন তো?
বাউল বললেন, কীভাবে আবার? সুরে নড়িয়ে দেব আমি। সুরে কৃষ্ণ শরীর ধারণ করবেন যে!তার বাঁশি যে সদর্থক বাঁশি। বাজলেই শরীর ধারণ বাঁশি আর কী বলুন, বাঁশি তো হল গিয়ে আমাদের মগ্ন চৈতন্য।
একতারা বাজাতে আরম্ভ করলেন বাউল। ভরদুপুরে তাঁর ভাত পেটে পড়েনি তখনও।
বললেন, কৃষ্ণকে খাইয়ে তবেই খেতে যাব আজ। যখন তুললেন ও কথা। আপনার সেবা হয়েছে তো?
ঘাড় নাড়লাম আমি। বাউল গাইতে লাগলেন।
কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানে, আমার মন যাবি রে ভ্রমণে
প্রাণ জুড়াবে মন্দ মন্দ আনন্দ সমীরণে।
সেথা নিত্য ফুটে পাঁচ রকমের ফুল
যার সৌরভে প্রাণ মুগ্ধ করে গৌরবে অতুল,
আত্মারামের আত্মা ব্যাকুল, করেছে যার আঘ্রাণে।।
সেই বাগানে আছে দুই মালি
তাঁদের মধ্যে একজন উড়ে একজন বাঙালি
তাঁরা বাগান ছিঁড়েখুঁড়ে নাড়েচারে গাছ বাড়ে তাঁদের যতনে।।
আছে সেই বাগানের চার দিকে বেড়া
আছে আশমানে খাড়া ও তার মেলে না গোড়া।
সেথা শিব ব্রহ্মা আছে খাড়া প্রবেশ করবার সন্ধানে।।
তাঁর মধ্যে সরসী, সুধাতুল্য জলরাশি
সেই স্বচ্ছ জলে সদা খেলে হংস আর হংসী।
কোটি জন্মের পিপাসা যার তার বিন্দু মাত্র জলপানে।।
সেই বাগানে ফলে মেওয়াফল, তাঁর কাছে তুচ্ছ চারি ফল
সে ফল যে পেয়েছে যে খেয়েছে হয়েছে পাগল।
তার জন্ম সফল কর্ম সফল, সেই ফলের নাম সেই জানে।।
বাগানের অতি মনোেহর শোভা মনোহরের মনোলোভা
সাধুমুখে শুনেছি তার নাম সুদর্লভা।
সেথা নাই রাত্রিদিবা প্রভা পায় আপন গুণে।।
গোঁসাই তাই ভাবছেন অন্তরে,
শোন অনন্ত রে সেই বাগান আছে কোটি জন্মের অন্তরে।
সেথা যাবি যদি স্বকাম নদী পার হবি তার কেমনে।।
‘কৃষ্ণ অনুরাগের বাগান’ দেহসাধকের স্থূল শরীর। গুরু প্রদর্শিত পথে সেই স্থূলতাই প্রবর্ত হয়ে উঠবে আর তখনই কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানকে টের পেতে শুরু করে দেবেন সাধক বাউল। প্রবর্ত ছাড়িয়ে সাধক স্তরে এলেই তিনি বাগানের ‘পাঁচ রকমের ফুলকে’ দেখতেও পাবেন। সাধক দেখবেন শরীরের পাঁচ চক্রপদে পাঁচ ফুল ফুটে গিয়ে শোভা ছড়াচ্ছে। সৌন্দর্য দান করছে। সেই শোভা, সৌন্দর্য সবই কৃষ্ণ অনুরাগের কারণেই। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পাঁচ ফুলের শোভা সাধক বুঝে যাবেন। তাঁর সৌরভে মুগ্ধও হবেন।
বলা হয়ে থাকে স্কুল সাধনার পরই জ্ঞানযোগ হয়ে থাকে। স্থূলতাকে অতিক্রম করার জন্যই মূর্তি, প্রতীক–লিঙ্গ বা শালগ্রাম, দেবদেবীর ছবি ইত্যাদির সাহায্য নেওয়া হয়ে থাকে। এর সঙ্গে সশব্দে মন্ত্র উচ্চারণ করার কথাও বলা হয়ে থাকে।
বাউলে এই সব উপাচার নেই। বাউল ভুল শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন যোগে। তন্ত্রসাধকের একই পথ। স্থূল শরীরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে যোগ, তাঁর নাম হল গিয়ে হঠযোগ। স্থূল শরীর সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে যুক্ত। স্থূল শরীরের ভেতরই তো থাকে শরীরের যাবতীয় সূক্ষ্মতা। সূক্ষ্ম স্তরে দেহের কোষগুলো সব তরবারির মতো খুলে যায়। সাধক বলেন সূক্ষ্ম শরীরে রয়েছে বুদ্ধি, ভাব, লোভ, কামনা, বাসনা ইত্যাদি। স্থূল শরীরের স্তর পেরোনোর পর যে সূক্ষ্ম শরীরের কথা বললাম সেখানের কোষগুলো পাঁচটি স্তরে সাজানো। এখানে পাঁচ চক্রের কল্পনাকে আমরা সামনে আনতেই পারি। পাঁচটি কোষ পার হবার পর ষষ্ঠে এসে পৌঁছলে সাধক বলে থাকেন নতুন জন্মান্তরে তিনি এসে পৌঁছেছেন। হঠযোগে এই স্তর পেরিয়ে আসেন সাধক। ষষ্ঠের জন্মান্তরের সঙ্গে ষটচক্রভেদের বোধহয় কোনো সম্বন্ধ আছে। তাই তন্ত্রে হঠযোগের বিধিব্যবস্থা। চক্রভেদ মানে একেকটি কোষকে অতিক্রম। বাউল সাধকও ষড়রিপু বা ষটচক্রকে ছয়েরই ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন। যেমন প্রচলিত এক গানের ভেতরও পাই সেই ছয়েরই ইঙ্গিত–’মন পাখি বিবাগী হয়ে ঘুরে মোর না/ ভবে আসা যাওয়ার কি যন্ত্রণা/ তাও কি জান না। / পাখির আছে দশ ইন্দ্রিয় / রিপু আছে ছয় জনা।’ হঠযোগে শরীরের মধ্যস্থ প্রাণ বায়ুকে টানে অপান বায়ু। প্রাণ বায়ু থাকে গিয়ে হৃদপিণ্ডে। সে অপান বায়ুকে ঠেলে তুলে দেয় হৃদপিণ্ডে। মূলাধার চক্র থেকে এসে অপান বায়ু মিশে যায় প্রাণে যোগশাস্ত্র হঠযোগের পদ্ধতিকে সাত ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। প্রথম ভাগ শোধন। ছটি বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে এখানে শরীর পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ভাগ দৃঢ়তা। এক্ষেত্রে আসন দ্বারা শক্তি সঞ্চয় করা হয়। তৃতীয় ভাগ হল গিয়ে স্থিরতা। বিভিন্ন মুদ্রা দ্বারা স্থৈর্য অর্জন করা আর কী। চতুর্থ ভাগ ধৈর্য। ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পঞ্চম ভাগ লাঘব। প্রাণায়ামে হাল্কাবোধ। ষষ্ঠ ভাগ ধ্যান। যা মনঃসংযোগেরই অংশবিশেষ। সপ্তম ভাগ হল গিয়ে নির্লিপ্ততা। বহির্বিশ্ব থেকে আত্মাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ষটচক্র দ্বারা দেহশুদ্ধির কথাও বলেন সাধক। এই শুদ্ধতা আসে। ধৌতিতে। অন্তর ধৌতি। বায়ুর সাহায্যে হৃদয় পরিষ্কার। দন্ত ধৌতি, দাঁত, জিভ, কান ইত্যাদি পরিষ্কারকরণ। হৃদ ধৌতি। কফ, পিত্ত, মল ইত্যাদির নিষ্কাশন। ধৌতির পর ষটকর্মে আসে বস্তিযোগীপুরুষ উৎকটাসনে বসে গিয়ে নাভি পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রাখেন। এতে সিক্ততা আসে। শুষ্কতা চলে যায় সব প্রাণায়ামে। বিশেষত কপালভাতিতে। তিন রকম কপালভাতি করে থাকেন দেহসাধক। শ্বাস নেওয়া ও শ্বাস ছাড়া, নাকদিয়ে জল নিয়ে মুখ দিয়ে বের করে দেওয়া, মুখ দিয়ে জল টেনে নাক দিয়ে বের করে দেওয়া। এরপর হঠযোগে বসেন সাধক। তন্ত্রসাধক এখানে আরও কিছু আসন সারেন। সেগুলো হল মুণ্ডাসন, চিতাসন আর শবাসন। মুণ্ডের সন্নিবেশ নিয়ে তৈরি আসন মুণ্ডাসন। চিতায় বসে চিতাসন আর শবের উপর বসে শবাসন। হঠযোগের পর মুদ্রার সাহায্য নেন দেহসাধক। এও এক ষটচক্রের দেহশুদ্ধি। অগ্নির দাহিকা, জলের সিক্ততা, বায়ুর প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারে মুদ্রাভঙ্গি। অশ্বিনী মুদ্রা, যোনি মুদ্রা, খেচরী মুদ্রা, মহাবোধ মুদ্রাতে ধ্যান করে তিনি কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগান। তারপর রেচক, পুরক, কুম্ভক প্রাণায়াম। বাউল সাধক এগুলো রপ্ত করেন। হঠযোগও করেন। তবে মুদ্রার ব্যবহার তাঁর ক্রিয়াকরণের অঙ্গিভূত নয়। ষটচক্রে এরপর লয় যোগ। আসন, কুম্ভক, মুদ্রা–এসবই কুণ্ডলিনীকে জাগরনের জন্য করে থাকেন দেহসাধক। বাউল সাধক শ্বাসক্রিয়াতে তাকে জাগান। কুণ্ডলিনী জেগে গেলে ইড়া ও পিঙ্গলার প্রভাবে শক্তি সুষুম্নাতে প্রবেশ করে ব্রহ্মরন্ধ্রে চলে যায়। বাউল। সাধক এই শক্তির সাহায্যেই শুক্রকে উধ্বগতিতে মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্রের উপরে অবস্থিত ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
গানে কৃষ্ণ অনুরাগের বাগানে দুজন মালির কথা বলা হয়েছে। এই দুইকে দুইভাবে দেখতে পারি আমরা। এক,ভক্তিকে বেড়া দিয়ে শাখা-উপশাখা সব ঘেঁটে জল সার ইত্যাদি দেওয়া। এ কাজে আগের দিনে উড়িয়াদের কদর ছিল। তাই এক মালিকে পদকর্তা উড়ে করে নিয়েছেন। দুই, দুইজন বলতে আমরা দু’প্রকার ধ্যানের কথাও বলতে পারি। সগুণ ধ্যান আর নিগুণ ধ্যান। সগুণ ধ্যান মূর্তি কল্পনা করে ধ্যান। বাউল তা করেন। না তা কিন্তু নয়। কেননা অনেক বাউলই বৈষ্ণব ভাবাপন্ন বাউল। শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্য বাউলের কথা কিছু আগেও বলেছিলাম। তিনি বৈষ্ণব ভাবাপন্ন বাউল ছিলেন। তিনি এই দু’প্রকার ধ্যানের কথা বলেছিলেন। নিষ্ঠুণ ধ্যান হল যে ধ্যানে মনকে ধাবিত করা হয় মহাশূন্যতার দিকে। আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য। সুতরাং ভক্তির বেড়া দিয়ে মালির যত্নে গাছ বাড়তে পারে আবার ধ্যানযোগেও তা সম্ভব। কেননা দুটো তো একেবারেই সংযুক্ত রূপ।
সুধাতুল্য জলরাশি সঙ্গিনীর রজ। হংস সাধক নিজেই। হংসী সাধিকার সম্বোধন। এই জলপান আসে বিন্দুধারণে। আর তা ধারণ করেই বাউল সাধক স্বকাম নদী পার হয়ে যান অনায়াসে। এই পারাপারে কৃষ্ণ যেন জল সীমানা ছাড়িয়ে সাধকের বস্তুজল ধারণ করে বসে থাকেন। জল হল রজপাত। প্রতীকী যমুনা ধরতেও পারি আমরা। রাধাকে বেশ আগে সুষুম্না চিহ্নিত করেছিলাম আমরা। রাধাকে শরীরস্থ সাধকের নাড়িতে স্থান দিলে যমুনা অর্থাৎ পিঙ্গলার লীলা থাকবে না তা কি হয়? শরীর যদি এক্ষেত্রে পূর্ব কথিত কৃষ্ণ হয়। বাউলের কৃষ্ণ শরীর ধারণেরই কৃষ্ণ। রক্ষাবস্তুর কৃষ্ণ। সঙ্গিনীর জলকে সিঞ্চন করেই তিনি কৃষ্ণ পান। সঙ্গিনী রাধারূপ। সম্বোধিত বাউলের ‘রাধারানি’। বৈষ্ণব সাধক আবার নিজেকেও রাধারানি ভাবেন। তা যদি ভাবেন তাহলেও কৃষ্ণ শরীরধারণ করে ভক্তিরসে রসস্থ হয়। বাউলের কৃষ্ণ যথার্থই শরীর ধারণের কৃষ্ণ।
ঘোষপাড়ার মেলায় প্রতিবছরই আমতলায় আখড়া করেন নবকুমার দাস বাউল। তাঁর ভক্ত শিষ্য,গুণমুগ্ধর সংখ্যা কম নয়। আখড়া একেবারে গমগম করতে থাকে। বেশ রাতেই এখানে গাইতে ওঠেন নবকুমার। সবাইকে গাইয়ে, তদারকি করে তাঁর গাইতে গাইতে একেবারে শেষ রাত। শেষে প্রভাতী গেয়ে তিনি নেমে পড়েন। এবছর প্রভাতী গাইবার আগে বললেন, দেখেন এখনই কীরকম গৌরের আধাপ্রকাশ্য, আধাগোপন আলো এসে গিয়েছে। এবার বোধহয় প্রভাতী গাইবার সুযোগ দেবেন না গৌর। গৌর যে আমার এমনই।
সমবেত ভক্তমণ্ডলী তখন ধ্বনি দিলেন–জয় গৌর, জয় গৌর।
গান ধরলেন বাউল। নবকুমারের গানে গৌর যেন ছড়িয়ে পড়তে লাগল সতী মায়ের মেলাতে।
এই গৌর লীলার বাজারে
অবাক যাই হেরে।
একটা সূচের ছিদ্র মজার কথা
পার করে গজবরে
একটা সোনা গাছেতে
জোড়া আম ধরে তাতে
আমের ভিতর জামের গাছ ভাই
জাম ধরে তাতে।
আছে তার তলে এক বাঁকা নদী–
হেম নামেতে প্রেম ঝরে
একটা সাপে-নেউলে
আর একটা ইঁদুর-বেড়ালে
এক যোগে বাস করে এরা
থাকে নির্মলে।
তাই দেখে এক মজায় হেসে
নিতাই গৌর রব করে।
একটা সর্পের মাথাতে
হংসের ডিম্ব দিয়েছে
তার ভিতরে চোদ্দ ভুবন
বাজার বসেছে।
(আবার) সেই বাজারের বেচাকেনা
হচ্ছে কেবল একদরে।
গোঁসাই হরি পোদোয় বলে
শোন রে মন কানা
তোর হাতে তুলে দিলাম রতন
যতন করলি না।
সে ধন অযতনে হারায়ে
(জগৎ) পড়েছে কর্ম ফেরে।
গৌর লীলার বাজার’ হল কৃষ্ণের বাজার কোথায় বসেছে সেই বাজার? বাজার বসেছে দেহচক্রে। স্থূলদেহে নয়, আত্মিক সত্ত্বায় এ বাজারে সমাগম ঘটছে সাধকের। যার জন্যই ‘সূচের ছিদ্র মজার কথা/ পার করে গজবরে।‘ ‘গজবর’ হল হাতি। হাতি কামমত্ততার প্রতীক। ছিদ্র অবশ্যই যোনিদ্বার। তার তীক্ষ্ণতার জন্য সূচের বিশেষণ পরানো হয়েছে। যুগল মিলনের সম্ভোগে কাম পেরিয়ে যাচ্ছে ওই ছিদ্রপথ দিয়ে। দেহ কামেন্দ্রিয়ের। প্রতিটি দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রেমেন্দ্রিয়ের সদর খুলে দিয়েছে। প্রকৃতির উপর মগ্ন পুরুষের সৌন্দর্য যেন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতি এখানে স্থির নিবেশ। যা সাধককে সাধন সঙ্গিনীই কেবল দিতে পারেন। আর সেই উৎসারণে শরীর সোনা গাছ হয়ে উঠেছে। সোনা হল আত্মপ্রতিচ্ছবি কৃষ্ণের। কৃষ্ণ প্রেমময় তাই তিনি জ্যান্ত। গৌরের প্রতিমূর্তি। শরীরস্থ ‘সোনা গাছে’ জোড়া আম ধরে আছে। কৃষ্ণ যুগলরূপের আধারকণা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পদকর্তা পদ্মলোচন(পোদো) বলছেন ‘আমের ভিতর জামের গাছ।’ ‘আম’ সোনা গাছের দ্যোতক। আম রক্ত-গৌরাঙ্গ জীবন্ত গৌর। ‘জাম’ কৃষ্ণের গাত্রবর্ণেরই প্রতীক। শরীর যুগল কৃষ্ণের ক্রমনির্মিতির অধ্যায়কে সংহত, মিতবাক তিমির দিয়ে দিয়েছে। তিমির প্রেমের অসূয়া কাটিয়ে নেবার অন্ধকার। যার জন্যই গাছ তলে ‘বাঁকা নদী’র বয়ে চলা। কৃষ্ণাঙ্গ শরীরের প্রকৃতির অনুষঙ্গ লাভ করা। নদী সঙ্গিনীর প্রতীককল্প। নদীতে ‘হেম নামেতে প্রেম ঝরে।’ ‘হেম’ স্বর্ণ বা স্বর্ণ অঙ্গ বিশিষ্ট গৌরাঙ্গেরই গাত্রবর্ণ। অর্থাৎ প্রকৃতি পুরুষের মিলনে শরীর জীবন্ত গৌরেরই শিরোপা আদায় করে নিয়েছে। এই মিলন এমনই এক ভাবের মিলন যে মিলনে শত্রর সহাবস্থান পরম মিত্রের। ‘সাপ-নেউলে’, ‘হঁদুর-বেড়াল’এর প্রতীককল্পে পদকর্তা তাঁরই ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাপের মাথাতে হাঁসের ডিমও সাধনার শুভ্র আবেগনিঝর কথা। হাঁসের ডিম(হংসের ডিম্ব) এখানে কামের আসক্তি থেকে বেরিয়ে পড়ে। নিরাসক্ত পূর্ণিমায় আত্ম-আবদ্ধ হয়ে থাকা। পূর্ণিমা যুগল প্রেমের অন্তর্লোকে বিহ্বল আদিঅন্তের কৃতাঞ্জলি। বাউলের জ্যোৎস্না, পূর্ণচন্দ্র প্রেম। সাপ তো কামাসক্তি। সেই কামের মাথাতে অর্থাৎ চূড়ান্ত মত্ততায় কামের পরতে যেন বিন্দু বিন্দু প্রবৃত্তির নিবেশ সরে গিয়ে হংসের ডিম্বর মতো ধবধবে জ্যোতি সর্বোচ্চ শান্ত, নির্মল, নিরাধার, নির্বিকার, নির্বিকল্প, দীপ্তিমান আত্মস্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। যোগশাস্ত্রও বলছে–’চিদাত্মা সৰ্ব্বদেহে জ্যোতিরূপেণ ব্যাপকঃ। / তজ্জ্যোতিশ্চক্ষুরগ্ৰেষু গুরুনেত্রেণ দৃশ্যতে।।’ চিদাত্মা জ্যোতিস্বরূপ সকল দেহতেই পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। গুরুনেত্র দ্বারা চোখের অগ্রভাগে তা দৃষ্ট হয়ে থাকে। পদকর্তা সেই গুরুনেত্র দিয়েই এই হংসের ডিম্বকে ‘সর্পের মাথাতে’ দেখেছেন। এই দেখা আত্মদর্শন। ‘আত্মদর্শনমাত্রেণ জীবন্মুক্তো ন সংশয়ঃ। আত্মদর্শন মাত্রে জীবদেহ মুক্ত হয়। পরমাত্মার দ্যুতি বের হয় শরীর থেকে।
হংস ডিম্ব কথাটির অন্তস্থ মানে আমরা কিন্তু আরেকভাবেও করতে পারি। হং’ শ্বাস পরিত্যাগ। যা একপ্রকার মৃত্যু। ‘স’ গ্রহণ। হংসই জীবাত্মা। হংস ইতি জীবাত্মানং। হংসের বিপরীত সোহংস হল সাধকের সাধনা। সোহংসা পরমাত্মা। যুগল মিলনে বাউল বলে থাকেন সেই রকমই এক উপলব্ধি আসে। এই উপলব্ধিকেও হংস ডিম্ব দ্যোতক। হিসাবে অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারি।
বাউল গাইছেন–’একটা সর্পের মাথাতে/ হংসের ডিম্ব দিয়েছে তাঁর ভিতরে চোদ্দ ভুবন/ বাজার বসেছে।’
চোদ্দ ভুবন দশেন্দ্রিয় ও চারভুতের সমষ্টি। যা দেহসাধনার দ্বান্দ্বিক সোপান। পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়র ক্রিয়াকরণ ও ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎকে চক্র ক্রিয়ায় জাগিয়ে নেওয়া। ‘চোদ্দ’কে শরীরের স্বমাপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে। দেহ আমাদের যার যার হাতের সাড়ে তিন হাত। আগে পোয়া ছিল মাপের একক। এক চার। তাহলে সাড়ে তিন হাত চৌদ্দ পোয়াও কিন্তু। বাউল গানে দেহপ্রসঙ্গ ‘চোদ্দ পোয়া’ও হিসাবে চিহ্নিত করে থাকেন। চোদ্দ ভুবন দেহের সামগ্রিক দীপ্র দীপ্তির ঘোষণা দেহের উজ্জীবতা। জাগরণ। তাঁর জন্যই বাজার বসা–’(আবার)সেই বাজারে বেচাকেনা হচ্ছে কেবল একদরে।’ ‘এক’ এখানে যুগল দেহের একত্র তন্ময়তা। বাউল এভাবে শব্দাবরণে দেহের বহিরঙ্গকে ভাঙন ধরান। দেহের আবরণ খসিয়ে, ক্ষইয়ে, তলিয়ে, শোষক–শোষিতের বিযুক্তকে আলাদা করে দিয়ে এমন এক অসভৃত দেহের আধার তৈরি করেন সেখানে দেহ দেহাতীত ভাবের। ধ্রুপদী সঙ্গীত গাইতে থাকে। বাউলের গান প্রতীকে, উপমায় তাঁরই আবেশনক্ষত্র নিয়ে মিটমিট করে জ্বলে বাউল আসরে।
ষষ্ঠী খ্যাপা একবার বলেছিলেন, ঘর হল গিয়ে গুরুপর্যায়। গুরুই ঘর খুলে দেন গো। গুরু হলেন গিয়ে চাবিকাঠি। তাঁর ইশারাতেই ঘর খোলে, সদর দেখা যায়। ভিতরবাড়ি, চমকায়।
–কীভাবে চমকায় ভিতরবাড়ি?
–কীভাবে আবার! শ্বাসে, দমে। গুরু শ্বাস চেনান। ঘরের চাবি খুলিয়ে রাধাশ্বাস, কৃষ্ণশ্বাস চেনান।
খ্যাপা গাইতে লাগলেন:
আমার ঘরের চাবি পরের হাতে
কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনা দেনা
আমি হলাম কর্মকানা না পাই দেখিতে।
রাজী হলে দারোয়ানী
দ্বার ছাড়িয়ে দেবেন তিনি
তারে বা কই চিনি শুনি বেড়াই কুপথে।
এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ-রতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না গো চিনিতে।
থামলেন খ্যাপা।
বললেন, বাউলের সোনা হল তাঁর গান। গানই তাঁর আঘাত। রাধাকৃষ্ণের আঘাত।
জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে গান রাধাকৃষ্ণের আঘাত?
–রাধা কী?
জিজ্ঞেস করলেন খ্যাপা।
বললাম, আপনিই বলুন না রাধা কী?
বললেন, বলব কী তোমায়। আমিই জানিনে কী তা। এই না জানাই রাধা।
–কীভাবে না-জানা রাধা হল শুনি?
–রাধা আয়ত্ব। রপ্ত। রাধা প্রকৃতির ছন্দ। কৃষ্ণরে কথা লিখতে সাহায্যে করে রাধা। ছন্দ দিয়েই তো কথা লিখতে হয়। না কি?
বাউলের জিজ্ঞাসার আমি কোনও উত্তর দিলাম না।
নিমতলার হাওয়াতে বসেই খ্যাপা বাউল গাইতে লাগলেন রাধার ছন্দ দিয়ে কৃষ্ণের কথা। চৈত্রের কচি নিমপাতারা তখন দুলতে থাকল রাধাকৃষ্ণের হাওয়ায় হাওয়ায়। খ্যাপার বাড়ির চারধারে ছড়িয়ে পড়ল গানের হাওয়া।
একতারার বোল তুলে খ্যাপা তখন ভাবে নিমগ্ন। গাইছেন:
কৃষ্ণের অধীন হওয়া মুখের কথা নয়।
কেবল রসিক অনুরাগীর কর্ম,
রাগের গুণে সুলভ হয়।
অনুরাগীর এই লক্ষণ–
ভাবে মগন তনু-মন;
বাতুলের প্রায় দরশন,
বোবা-ন্যাকার ভঙ্গী তায়।
তৃণাদপি সুনীচ জন,
সর্বত্র যার সম জ্ঞান,
কৃষ্ণময় যার নিয়ন,
তার ধ্যানে সদাই কৃষ্ণ রয়।।
ছিন্ন অষ্টপাশ যে জন,
কৃষ্ণ ভজনের যোগ্য সে জন,
সদা পূৰ্ণানন্দ তাঁর
দিন-রজনী সমান যায়।
অপ্রাকৃত গোবিন্দ কয়,
সদাচার-কদাচারে নয়,
কেবল গোপী-প্রেমে ঋণী হয়,
শ্রীভাগবতে ব্যাসদেবে কয়।।
গোপী-প্রেমের বলিহারি,
শঙ্কা, স্বজন পরিহারি,
কৃষ্ণ-সুখ লক্ষ্য করি
নিশিতে নিকুঞ্জে যায়।
কৃষ্ণ-প্রেম সুনির্মল,
যেন শুদ্ধ গঙ্গাজল,
তপ্ত ইক্ষু-চর্বণ-ফল
সেই প্রেমাস্বাদে উপজয়।।
যে জন বিষামৃতের বিষে মরে,
নিজে মরে পরকে মারে,
বহে জীবন মৃতাকারে,
হবে না তার গোপী-ভাব-উদয়।
শান্ত মধুর ভাব সিদ্ধ হলে,
ব্রজ-গোপীর দেহ মিলে,
রাগ বাড়ে তার তিলে তিলে,
অহি-শার্দুলেতে নাহি খায়।।
তীর্থযাত্রা পরিশ্রম,
সকলি মনের ভ্রম,
গোবিন্দ-ভজনের ক্রম
না সাধলে কি সাধন হয়।।
ঘটে ঘটে বিরাজকারী
চৈতন্য কৃষ্ণ নাম ধরি,
তার তত্ত্ব পাবে, নিলে–
মধুর রসের আশ্রয়।।
কৃষ্ণ শরীরস্থ উচ্চদশা। যে দশাতে কেবল রসিক অনুরাগীরাই পৌঁছে যেতে পারে। পদকর্তা বলেছেন–’রাগের গুণে সুলভ হয়।’ বাউল সাধকের প্রকৃতি-পুরুষের অন্তর্নিহিত সত্তা শুক্র ও রজ। রজ হল বীজ। বীর্য শক্তি। বীর্যসত্তাকে বাউল ঈশ্বর নামে অভিহিত করেন। বীর্য তাঁদের কৃষ্ণবস্তু। মূলাধারের সুপ্ত শুক্রকে বাউল সাধক ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নিতে পারেন চক্রস্থ সাধনায়। সঙ্গিনীর দেহে রজ থাকে সহস্রার চক্রে। যখন রজসত্তায় বিকাশ আসে তখন রজ নেমে আসে। সাধক অষ্টম ইন্দুকে স্পর্শ করে, ছুঁয়ে, ব্যবহার করে সঙ্গিনীর কামক্রিয়াকে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র দিয়ে ভোঁতা করে শুক্রকে ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠিয়ে নেন। মূলাধারের বীর্য ওঠে সহস্রারের ব্রহ্মরন্ধ্রে অপরপক্ষে সহস্রারের রজ প্রবৃত্তির নিয়ম নেমে আসে মূলাধারে। দুই শরীরের মিলন হয়। রজ-বীর্য মিলিত হয় না কখনও। বাউল বলেন সহজ মানুষের কথা। তাঁরা মনে করেন, বলেন, সঙ্গিনীর সত্তায় প্রকৃতি নিয়মে রজরূপী ঈশ্বর নেমে এসে ত্রিবেণীর স্রোতধারা বয়ে চলে। সাধক বাউল সেখানে। স্নান সারেন কেবল। রজরসে অবগাহন করেন। শুক্ৰবীজকে স্বাভাবিক রেখে দেন। কিন্তু সৃষ্টি ধারাকে তাঁরা নাশ করে মিথুনানন্দ উপভোগ করেন। তাঁরা বলেন পুরুষ-প্রকৃতির এই মিলনে দেহ বৃন্দাবন হয়ে ওঠে আর মিলন হয় রাধাকৃষ্ণের মিলন। এই মিলন সম্পূর্ণ কার্য সাপেক্ষ। পদকর্তা তাই বলেছেন–’ইহা রাগের গুণে সুলভ হয়। রাগ হল সহজ মানুষে পরিণত হওয়া। যার জন্যই অষ্টপাশ ছিন্ন। ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কূল, মান–এগুলোর ঊর্ধ্বে ওঠা। অষ্টভাব মনেতে নিয়ে আসা। এই ভাবগুলো হল–স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, অশ্রু, মূৰ্ছা। আর অণিমা, লঘিমা, ব্যাপ্তি, প্রকাশ্য, মহিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, কামবসায়িত–এই অষ্টশক্তিকেও জাগিয়ে নেওয়া। বাউল বলেন। আটপাশ আত্মচৈতন্যকে ডুবিয়ে রেখেছে গহিন জলে। তাকে আগে ভাসিয়ে তুলতে হবে। পাশ মুক্তির পর সব স্থূলতা কেটে যাবে।
শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একথা বলেছিলেন আমাকে। তবে তিনি তন্ত্রের কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, ক্ষুধা, তৃষ্ণা বলেননি অষ্টপাশে। তিনি বলেছিলেন কিন্তু ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘৃণা, ভয়, লজ্জা, মান, রাগ, দ্বেষ-এই অষ্টপাশের কথা। আসলে ব্যাপারগুলো সব প্রায় একই। তবে এগুলো বাবাজিদের কাছেই মূলত শুনেছি।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাউলকে, তা পাশমুক্তি হবে কী করে?
বললেন, ক্ষুধা জয় হল পেটের ক্ষুধাকে সাধনের অঙ্গভূত করে নেওয়া। তৃষ্ণাও তাই। সিদ্ধ স্তরে ওঠার জন্য আঁকুপাঁকু করা। ছটফটানি। এগুলো সবই ক্ষুধা-তৃষ্ণার ছটফটানি। মল-মূত্র খেয়ে-মেখে, রজও পান করে ঘেন্না জয়। ভয় হল মনকে একতানে বাঁধতে না পাড়ার অস্থিরতা। লজ্জা হল গুরুর সম্মুখেই সঙ্গিনীর সঙ্গে মিলনের বাঁধো বাঁধা ভাব। মান হল গিয়ে গুরুর কড়া কথার উর্ধ্বে ঢলে যাওয়া। রাগ হল রিপুনাশ। দ্বেষও তাই বাবা। এসব মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে হবে। অষ্টভাবের কথা বৈষ্ণবরাও বলে থাকেন। তাঁরা বলেন এগুলো হল সাত্ত্বিকভাব। এছাড়া তাঁরা আবার দৈন্য, গ্লানি, চাপল্য, বিষাদ, আবেগ, চিন্তা, হর্য, নিদ্রা, শঙ্কা, ত্রাস, শ্রম ইত্যাদি তেত্রিশটি ব্যাভিচারি ভাবের কথাও বলেন। এগুলো সব আসলে গিয়ে হল সেই ইন্দ্রিয় দমন। অষ্টশক্তি সব চক্রস্থ পন্থারই বিষয় আশয়।
গানে বলা হয়েছে বিষামৃতের বিষ, সদাচার, শঙ্কা–এগুলো কিন্তু সবই অষ্টপন্থার অনুসারী। বাউল বলেছেন–’শান্ত মধুর ভাব সিদ্ধ হলে/ ব্রজ গোপীর, দেহ মিলে, / রাগে বাড়ে তার তিলে তিলে, / অহি-শার্দুলেতে নাহি খায়।
শার্দুল হল কামমত্ততা। প্রেমভাবে কাম-আচ্ছন্ন আবহাওয়া সৃষ্টি করে।
খ্যাপা বলেছিলেন একথা।
কী সেই আচ্ছন্নতা? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
বললেন, শেকল ভাঙার আচ্ছন্নতা। কামের হাত পা মাথা সব কেটে দিলে আমাদের কাম তো বেদনাময় হয়ে যায়। কাম থেকে রক্ত ঝরে।
আমি চমকে উঠলাম খ্যাপার কথায়।
বলেন কী খ্যাপা! কাম থেকে রক্ত ঝরছে। মানুষটা এমন সব ভাষার খড়িমাটি দিয়ে আলপনা আঁকতে পারেন। যেন কবির গায়ের গন্ধ লেগে ওঁর জোব্বাজুব্বির গায়ে।
বললেন, গলগল গলগল সব রক্ত গো। কৃষ্ণরক্ত। রাধার ভাবধারা নিয়ে ছোপছোপ সব দাগ মনের অন্দরে লেগে। হিক্কা তুলতে তুলতে কাম মরে। কাপড় চোপড় পরে সাজগোজ করে কাম বেরিয়ে যায় কৃষ্ণপ্রেমের হাওয়া খেতে।
আমি দেখলাম খ্যাপার মুখের ছায়ায় কৃষ্ণের একতারা শুধু বেজে বেজে যাচ্ছে দিঘরার হাওয়ায়।
একতারা কৃষ্ণ সাজচ্ছে। পরে নিচ্ছে রাধার বেশ। যুগল হয়ে উঠছে বাউলের চিন্তায়, সাধনায়।
০২.১ বাউল আবদুল করিম বলে
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা কালনী নদী আর হাওরের আফাল একটা মানুষকে বাউল বানাতে পারে, এ খবরটা যখন আমি শুনি ঘোষপাড়ার বাউল দীনদয়ালের মুখে, তখনই শাহ আবদুল করিমের পূর্ণাঙ্গ খবর নিতে উঠে পড়ে লাগি। ততদিনে আবদুল করিম বাংলাদেশের মানুষদের কাছে কিংবদন্তির মর্যাদা পেয়ে টেয়ে একেবারে জীবনেরই প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন। অসুস্থ করিমের খবরও পেয়েছিলাম আখড়াবাড়িতে বসেই। ২০০৯ সাল, সেপ্টেম্বর মাসে আশ্বিনের ফোটা কাশের ভেতর দিয়ে এক ঢেউ খেলানো হাওয়া তুলে সাধক করিমের খবর এলো। ঘোষপাড়ার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় দিলেন গানের ভেতর দিয়েই। আখড়াবাড়ির গায়ে বয়ে চলা রূপ হারানো ত্রিবেণীর মূল সোঁতাটা তখন এখানে গঙ্গা নামেই খ্যাত। তার ভেতরও যেন কালনীর ঢেউ/ আফল তুলে আনলেন সাহেব কলোনির প্রবীন বাউল সাধক স্মরনজিৎ খ্যাপা। বেশ মনে আছে আমার, খ্যাপার একতারায় বোল উঠেছে; গলায় হাওরের আফল–’ভবসাগরের নাইয়া/ মিছা গৌরব করো রে/ পরান ধন লইয়া/ একদিন তোমার যাইতে হবে/ এই সমস্ত থইয়া রে/ পরান ধন লইয়া।‘ বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের উজালধল গ্রাম থেকে বাউল আবদুল করিমের দেহ রাখার খবর নদিয়ার ঘোষপাড়াতে পৌঁছলে এভাবেই এখানকার বাউল সমাজ তাঁকে বিদায় জানিয়েছিল। আমার আজও কল্পনা করতে ভালো লাগে। উজালধলের আখড়া বাড়িতে যখন করিমকে স্ত্রী ও সাধন সঙ্গিনী সরলার কবরের পাশে সমাহিত করা হচ্ছিল, তখনই বোধহয় ডুবকিতে চাপড় দিয়ে দীনদয়াল গাইছেন–’অকূল নদীর ঢেউ দেখে ডরাই/ অসময়ে ধরিলাম পাড়ি আকাশেতে বেলা নাই।।… আবদুল করিম দায়ে ঠেকেছে দরদি কে ভবে আছে রে/ দেও সংবাদ মুর্শিদের কাছে মরণকালে চরণ চাই।।’ শাহ আবদুল করিমের মরন সংবাদে আখড়াবাড়িতে এভাবেই গুরু মুর্শিদেরা বাউল সাধকের চরন বন্দনা করেছিলেন মুর্শিদ গুরুর কাছেই। কালনীর স্মৃতি, আফল, হাওরের কিংবদন্তি হয়ে ওঠা বাউলা করিম এভাবেই প্রথম বাসা বেঁধেছিলেন আমার মনে–’নিশিদিনে শয়নে-স্বপনে/ পরানে পরানে মিশিয়া/ এই আঁধার রাতে নেও যদি সাথে/ তুমি নিজে পথ দেখাইয়া।।‘ বাউল আবদুল করিম এভাবেই বোধহয় পথ দেখিয়েছিলেন আমায়, আরও আশ্চর্য যেটা, সেই সুনামগঞ্জ, হাওরের ছেলেই আমার বন্ধু সুমনকুমার দাশ করিমের সঙ্গে এক অর্থে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটিয়ে দিলেন গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই। সেটা ছিল শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবর্ষ স্মরণ অনুষ্ঠান। সিলেট শহরে ঘটা করে পালন হয়েছিল উৎসব। কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন শিল্পী ও সঙ্গীত সংগ্রাহক মৌসুমী ভৌমিক। অসম থেকে অধ্যাপক তপধীর ভট্টাচার্য। যদিও আমার কিন্তু সে উৎসবে যাওয়াই হয়নি। তথাপি আমি ছিলাম যেন সেই একেবারে উৎসবের মাঝখানে বসে–’আমি ফুল, বন্ধু ফুলের। ভ্রমরা/ কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া। / না আসিলে কালো ভ্রমর কে হবে যৌবনের দোসর/ সে বিনে মোর শূন্য বাসর আমি জিয়ন্তে মরা।’ সুমনের বই উদ্বোধন হচ্ছে ‘শাহ আবদুল করিম জীবন ও গান’, সাধু-গুরু-মরমিয়া-শিষ্যরা সব গাইছেন করিমের গান, বক্তব্য রাখছে সুমন। আমি ওঁর পাঠানো ছবি ও ভিডিও পেয়েই চলে যাচ্ছি সিলেট। ভাবছি, অনুষ্ঠান শেষে একবার গিয়ে বসব বাউল করিমের কবরে সুমনের সঙ্গেই হাঁটব ভাটি-সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবেড়িয়া; সাতটি জেলার চল্লিশটি উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত ভাটি অঞ্চল, অথচ এ বছরও তো ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চ… আমার যাওয়া হল না হাওর… দেখা হল না কালনীর আফাল… আবদুল করিমের কবর…কাজের কাজ যেটুকু হল–বাংলাদেশ থেকে একুশে গ্রন্থমেলায় বের হল আমার প্রথম বই ‘পশ্চিমবঙ্গের বাউল’। যার মূলে কিন্তু জড়িয়ে আছে আবার সুমনের বন্ধুত্ব আর বাউল আবদুল করিমেরই এক নিবিড় যোগাযোগ–’বন্ধু দরদিয়া রে/ আমি তোমায় চাই রে বন্ধু/ আর আমার দরদি নাই রে।‘
বাউল আবদুল করিমের গান আমি প্রথম অবশ্য শুনি ঘোষপাড়া নয়, সাহেব কলোনিতে স্মরণজিৎ খ্যাপার আখড়াবাড়িতে। খ্যাপা দুই মহতের পদ খুব পছন্দ করেন। এক, ভবা পাগলা। দুই, শাহ আবদুল করিম। ভবা পাগলা খ্যাপার মুখে নিজের লেখা গান শুনেই তাঁকে খ্যাপা উপাধিটি দিয়েছিলেন। মনসুরউদ্দিন তাঁর ‘হারামণি’তে পূর্ববঙ্গের সাটুরিয়া থানা এলাকার আমতা বেলেটি গ্রাম ভবার জন্মভূমি বলে উল্লেখ করলেও আদতে তাঁর জন্ম ঢাকার ধামরাই থানা এলাকার আমতা গ্রামে। ১৯৫০ সালে ভবা পাগলা পশ্চিমবঙ্গে এসে বর্ধমানের কালনায় কালী মন্দির ও আশ্রম স্থাপন করে মাতৃসাধনা শুরু করেন। কালনার মন্দির প্রতিষ্ঠার দিবসেই স্মরণজিৎ খ্যাপা গেয়ে ওঠেন–’মানুষ তোমার কোথায় অবস্থান/ আসো যাও নাই স্থিরতা অনুমান আর বর্তমান/ বুঝো না এই বারতা/ মানো না তুমি বিধাতা/ প্রকৃতি যে সেই তো মাতা কথাটি কী মূল্যবান।‘ এই গান শুনেই ভবা নিজের গলার মালা খুলে স্মরণজিৎ বাউলের গলায় পরিয়ে তাঁকে ‘খ্যাপা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
স্মরণজিৎ খ্যাপা সন্ধ্যায় চালপানি নিয়ে দৈন্য গানের আসরই শুরু করতেন আবার বাউল আবদুল করিমের পদ গেয়ে। গাইতেন–’দয়াল মুর্শিদ, তুমি বিনে/ কে আছে আমার? / তোমার নাম ভরসা করে অকুলে দিলাম সাঁতার। তাঁর বায়েদ শ্রীদাম ফকির এর পরই গেয়ে উঠতেন–… পড়িও না রিপুর ফাঁদে ভক্তি রেখো মুর্শিদপদে পড়বে না। কোনো বিপদে/ নিলে মুর্শিদ পদায়। আবদুল করিম মূঢ়মতি/ মুর্শিদ বিনে নাই তাঁর গতি/ কাঙাল জেনে দাসের প্রতি/ যদি মৌলার দয়া হয়।’ করিমের গানের পরই আসরে আসত ভবার গান।
খ্যাপা করিমের আরেকখানি জনপ্রিয় গানও গেয়ে থাকেন অনুষ্ঠানে গেলেই। একতারাতে সুর চড়িয়ে গাইতেন খ্যাপা–’আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী। এ গানের সঙ্গে জমজমাট বাঁশির সঙ্গত রাখেন শ্রীদাম ফকির। এবছর একুশে গ্রন্থমেলাতেই প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক সাইমন জাকারিয়ার শাহ আবদুল করিমের জীবনছায়া অবলম্বনে উপন্যাস ‘কুলহারা কলঙ্কিনী।
২০০৯ সালের মে মাসে তাঁর জীবদ্দশাতেই শাহ আবদুল করিম রচনা সমগ্র প্রকাশ পায় সিলেট থেকে কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমামের সম্পাদনায়। আর শুভেন্দুই ওঁর জন্মশতবর্ষ স্মরণ’ পুস্তিকাটিরও সম্পাদক ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের দু’জন লেখক এই স্মরণ পুস্তিকাতে লিখেছিলেন। আমার সৌভাগ্য আমি সেখানে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম।
ঘোষপাড়ার বাউলানি কৃষ্ণা দাসী গেলে পরেই আমাকে করিমের একখানি গান শোনাতেন–’কী জাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, দেওয়ানা বানাইছে। কৃষ্ণার তখন জুড়ি ভাঙেনি নবকুমার দাস বাউলের সঙ্গে। দুজনেই এক সঙ্গে গান করে বেড়ান তাঁরা। একসময় এই জুটি ছিল বাউল সমাজে চর্চা ও শ্রোতা মনোরঞ্জনের বিষয়। তারপরই জুড়িহীন কৃষ্ণার একাকী জীবন শুরু হয়। তবু কৃষ্ণা করিমকে ছাড়েননি। আসর মাত করেই গাইতেন–’আমার বুকে আগুন রে বন্ধু/ তোমার বুকে পানি/ দুই দেশে দুই দেশে দুই জনার বাস/ কে নিভাইব আগুনি রে/ আর আমার দরদি নাইরে।‘ এই গান গাইতে গেলে কৃষ্ণার গলায় হাহাকার খেলত, চোখ ছলছল করত। রংদোলে চাঁচরের রাতে তবু কৃষ্ণা দাসী বাউল আবদুল করিম দিয়েই আসর। জমাতেন সতী মায়ের মেলায়—’না জেনে করেছি কর্ম/ দোষ দিব আর কারে/ সর্পের গায়ে হাত দিয়াছি/ বিষে তনু ঝরে রে/ আর আমার দরদি নাই রে।‘
জনপ্রিয় বাউল পূর্ণদাসের দিদি হলেন রাধারানি দাসী। কৃষ্ণার মতো তাঁর গান জনসমাজে পৌঁছায়নি। কেঁদুলির মেলার এককোণে পড়ে থাকতেন প্রবীনা রাধারানি। কেউ একটু গাইতে দিলে নিজেকে উজাড় করে দিতেন। থাকতেন বোলপুরের ওঁড়িপাড়া ভাই চক্রধর বাউলের অথর্ব ছেলেটিকে নিয়ে। পরে অবশ্য তাঁর বাস গোপালনগরে গিয়ে ওঠে। রাধারানি ছিলেন গানের ভাণ্ডারী। দুঃখ এটাই, তাঁর কণ্ঠ ধরে রাখা যায়নি। হারিয়ে গেছে তাই অল্পশ্রুত অনেক মহতের পদ, লেখাজোখা না থাকার কারণেই। রাধারানি দাসীর মুখে শুনেছিলাম বাউল করিমের একখানি পদ–’মন পাগলা তুই লোক সমাজে, লুকি দিয়ে থাক। / মনমানুষ তোর মন মাঝে, আছে রে নির্বাক।‘
চন্দ্রাবতী রায় বর্মণ সিলেটের প্রবীণ লোকসঙ্গীত শিল্পী। জনপ্রিয় এই শিল্পী গত হয়েছেন ২০১৪ সালে। সেখানকার আরেক কিংবদন্তি সুষমা দাশ। সংগ্রাহক মৌসুমী ভৌমিক এই দুইজন প্রবীণ শিল্পীর গান সংগ্রহ করে এনে এখানে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। চন্দ্রাবতী রাধারমণের গানের একজন নামী শিল্পী হলেও করিমেরও বেশ কিছু গান। গেয়েছিলেন। সুষমা এখনও ভারী বার্ধক্য নিয়েও করিমের গান পরিবেশন করেন। এক সাক্ষাৎকারে সুমন প্রশ্ন রেখেছিল, ‘করিমের কোনও গান কি জানেন? বা কোন গানগুলো বেশি পছন্দ আপনার?’ চন্দ্রাবতী উত্তর করেছিলেন, ‘জানতাম না কেনে? করিম ভাইয়ের বেশ কতগুলো বেশ কতগুলো গান গাইছি। তাঁর ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘মন মজালে ওরে বাউলা গান’, ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইল কেমন দেখা যায়’–এসব গান বেশি গাই। করিম ভাইয়ের সঙ্গে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎও হইছে।
আমাদের ছোটবেলাতেও রেডিও, টিভিতে বাজত–’আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/ গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান ঘাটু গান গাইতাম।‘ এখনও এই গানটি আমাদের এখানকার লোকসংগীত শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। করিমের আরেকখানি গানও এখানে বেশ প্রচলিত–’আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া/ গান গাই আমার মনকে বোঝাই/ মন থাকে পাগলপারা।‘
গোরভাঙার নামকরা ফকির আরমান করিমের একখানি গান গেয়ে বেড়ান প্রায় আসরে–’মুর্শিদের প্রেম বাজারে কে যাবে রে আয়/ যেতে যদি হয় বিলম্বে নয়/ চল যাই সকালবেলায়।‘ তবে বাউল করিমের গুটিকতক দেহতত্ত্ব, সাধনতত্ত্বের গানই কেবল গেয়ে থাকেন পশ্চিমবঙ্গের বাউল ফকিরেরা। বাংলাদেশে করিমের অনেক শিষ্য-বায়েত আছেন। তাঁরাই ধরে রেখেছেন বাউল আবদুল করিমের গান ও সাধনা–’এই যে তোমার দেহভাণ্ড বন্ধ করো সকল রন্ধ্র/ অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র দেখবে হৃদাকাশে/ অনাহত দ্বাদশ দলে নয়ন যদি মেশে/ করিবে স্বদেশের চিন্তা রবে না আর এ বিদেশে।‘
সুমন কুমার দাশ আমার প্রাণের বন্ধু। বাংলাদেশে যাঁদের সঙ্গে আমার আত্মীক সম্পর্ক এখন, সমন তাঁদেরই অন্যতম। আমরা দু’জন দু’জনকে ‘বন্ধু’ সম্বোধনেই ডাকি। সিলেট থেকে সুমন ডাক দেয়, সেই ডাক নদিয়ায় এসে পৌঁছয়। অথচ কেউ কাউকে এখনও দেখিনি। সুমন কথা বললেই ওর ভাষা থেকে গানের গন্ধ বের হয়। শাহ আবদুল করিমের সঙ্গে গৃঢ় ও গভীর সখ্য ছিল আমার বন্ধুর। এই একটি বিষয়েই আমি কেবল বন্ধুকে ঈর্ষা করি। আবদুল করিমের জীবনীকার সে। ওর কথা ভেঙেই আমি কিংবদন্তিসম মরমিয়ার অন্তরমহলে প্রবেশ করি আর আশ্চর্য হই। জানতে পারি শুধু গান নয়, বাউল করিম ‘নিমাই সন্ন্যাস পালা’ খুব চমৎকার গাইতেন। তবে সে পালা শোনার সৌভাগ্য সুমনেরও হয়নি। করিম বলেছেন, বাউলগান এত বেশি আসরে গাইতে হয়, নিমাই সন্ন্যাস পালা গাওয়ার সুযোগ আর হয়ে ওঠে না। এ ছাড়া আগের তুলনায় হিন্দু ধর্মীয় পালাগানের আসরও তো ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
‘শাহ আবদুল করিম: তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান’ নামক একটি লেখাতে বন্ধু সুমন লিখেছে সাধক করিমের সহজাত দিকটির কথা। পড়ে সম্মোহিত হয়ে উঠি। এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বাউল করিমের এই মানসিকতাই প্রমাণ রাখে যে, একমাত্র গানই তাঁর বেঁচে থাকার শ্বাস। সাক্ষাৎকারে তিনি অবশ্য বারেবারেই বলেছেন সে কথা, ‘আমি তো কোনও কিছু পাওয়ার আশায় গান গাই না। আমার মনে গান চায় তাই গান গাই। গান গাই বলেই তো তুমি আমার কাছে এসেছ, তাই না?
বাউল করিমের এই জিজ্ঞাসারই উত্তর সুমন দিয়েছে নিজের লেখায়। জীবনের শেষ দিক। অনেকখানি খ্যাতি ও সম্মান নিয়ে শাহ আবদুল করিম তখন দেশের মানুষদের কাছে পরিচিত। বিদেশেও গেছেন প্রবাসী বাঙালিদের মরমিয়া সুর শোনাতে, বেড়িয়ে গিয়েছে তাঁর গানগ্রন্থগুলিও এক এক করে। কালনী নদী তাঁকে বাউল করেছে বলেই একটির গ্রন্থনাম ‘কালনীর ঢেউ’। এছাড়া ‘ভাটির চিঠি’, ‘ধল মেলা’, ‘গণ-সঙ্গীত’ও বেরিয়ে গেছে। প্রথমবার যুক্তরাজ্য সফর করেছে ১৯৬৮ সালে শিষ্য দুর্বিন শাহকে সঙ্গে করে। ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ, শেখ মুজিবুরের সঙ্গে বাংলা গড়ার স্বপ্নে সাড়াও দিয়েছেন–’দরদি, বাংলার নাও সাজাইয়া/ আমরা যাব বাইয়া। বাইতে বাইতে তরী এসেছে আপামর জনগনের ভেতর। গান, সাধনা, শিষ্য পরিবৃত্ত করিম আবার বাধাও পেয়েছেন। শরিয়ত সমাজের কাছে। মারফতি সমাজের আল্লা-ঈশ্বর না মেনে, বেদ-কোরান অস্বীকার করে সহজ মানুষ ভজা ধর্মে সাড়া দেওয়ার বাসনাতে বহুবারই নেমে এসেছে আক্রমণ। স্বাধীন বাংলাদেশে করিমও রেহাই পাননি। তাঁর স্ত্রী সরলা দেহ রাখলে গ্রামের ইমাম। জানাজা পড়াতে বাধা দিয়েছিলেন বাউল সাধক বলেই। কেননা করিমের বাউল সাধক বলেই। কেননা করিমের বাউল জীবন, সাধনা, গান–সবই নাকি বেশরা ও ইসলাম বিরোধী। লৌকিক ইসলামে বিশ্বাসী বাউল করিম দমে যাননি। নিজের বাড়িতেই স্ত্রীর কবর খুঁড়েছেন, শিষ্য আকবরকেও গুরু-মুর্শিদ করিম নিজেই জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছেন। আবার এই বাংলাদেশই দিয়েছে তাঁকে সম্মান; একুশে সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শাহ। আবদুল করিম। পেয়েছেন আমজনতার ভালোবাসা আর অসংখ্য পুরষ্কার। পূর্ববর্তী মহৎ লালন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণদের গানও তিনি কণ্ঠে ধারণ করেছেন; রেকর্ড করেছেন। বাদ পড়েননি সৈয়দ শাহনুর, দ্বিজদাস, আরকুম শাহ, শীতালং শাহদের মতো। আলু পরিচিত সাধক ও মহাজনও। গান গেয়েছেন, সাধনা করেছেন, বই বের করতে শেষ সম্বল নয় বিষে জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন। তবু সাধক, মহৎ মানুষের পাশে থাকতে চেয়েছেন, কেবল আত্মভোলা বাউল সাধক হতে চাননি শাহ আবদুল করিম–’মানুষই যদি না থাকে তাহলে দেহসাধনা করবে কে? দেহসাধনা করতে তো কেউ বাধাটাধা দিচ্ছে না, তবে বিপন্ন মানুষের কথা চিন্তা করতে হবে। গণমানুষের মুক্তি প্রয়োজন। তাই আমি বাউলগানের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরি। এই আঙ্গিকে গানও তো রয়েছে করিমের অসংখ্য। সেই করিমও শেষ জীবনে সংবর্ধনায় টাকা পেয়েছেন সোয়া তিন লাখ। করিম ভেবেছেন, সোয়া তিন হাজার। বলেছেন তখন, ‘এত টাকা! এই সোয়া তিন হাজার টাকা দিয়ে আমি কী করব?‘ আয়োজকরা বলেছেন ‘সোয়া তিন হাজার নয়, লাখ। করিম এই শুনে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে ছেলেকে বলেছেন, ‘চল বাড়ি যাই। সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলা নিয়া আমরা কিতা করমু? আমার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড়ো প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল।‘
সুমনের লেখা থেকে এ কাহিনী পড়ে আমি কেঁপে উঠি। মনে মনে ভাবি আমার বন্ধু এমন মানুষের সঙ্গ করেছে, সাক্ষাৎকার নিয়েছে, জীবনীগ্রন্থ লিখেছে। আমি সেই গ্রন্থ নিয়ে এই শেষ ফেব্রুয়ারিতেই শাহ আবদুল করিমের সখ্য বোধ করি। সুনামগঞ্জ, সিলেটের, ভাটি-হাওরের জল বাতাস লাগাই গায়ে। একতারা বাজিয়ে গাই–’মানুষ হয়ে তালাশ করলে মানুষ পায়/ নইলে মানুষ মিলে না রে বিফলে জনম যায়।‘
০২.২ দুর্বিন শাহ কয়
ফাজিলনগরে খেজমত ফকিরের ডেরায় সন্ধ্যা মজে যেতেই চেরাগ জ্বালা হয়ে গেছে তখন। হাত-পায়ের গোসল করে একে একে বায়েত সব এসে জুটছেন মুর্শেদের ডেরায়। সকলেই চেরাগ বাতি আগরবাতি জ্বালছেন সায়ং সন্ধ্যায়। খেজমত তখন তোড়জোর করছেন সাধন গানের, গুরু বন্দনার, ভারিক্কি চেহারার এক বায়েদ, মাথায়। তেল চুকচুকে বাবরি, গলায় পাথরের মালা, কজিতে তামা-স্টিল-কেরুয়া নানা জাতের বালা, সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরা, ওপরে ফকফকে ফতুয়া হাঁটু গেঁড়ে বসে খেজমতকে ভক্তি দিয়ে বললেন, ‘আলেখ’। মুর্শেদ বায়েদ এরপর সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘আলেখ’। মুর্শেদ আমার দিকে চেয়ে একবার তৃপ্তির হাসি দিলেন। খেজমতের ইশারায় বেজে উঠল। ডুবকি, খমক, একতারা। যুবক বায়েদ বেঁধে নিচ্ছে দোতারা। একতারায় পিড়িং পিড়িং করছে মাঝবয়সী এক বায়েত। একজন খোলবাদ্যে কটা চাঁটি মেরে নিল। খেজমত ফকির সুর ধরলেন হারমোনিয়ামের রীড চেপে। তারপরই গেয়ে উঠলেন–’নামাজ আমার হইল আদায়–/নামাজ আমি পড়তে পারলাম না/ দারুণ খান্নাসের দায়।’
ফকিরি গ্রাম গোরভাঙা ও তার আশেপাশের গ্রাম জুড়ে তখন রোজার মাস। মারফতি সাধকরা রোজা ও নামাজে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু শরিয়ত পন্থায় নামাজ রোজা তো আবশ্যক। মারফতি গ্রাম গোরভাঙায় এর বালাই না থাকলেও আশপাশের গ্রাম জুড়ে শরিয়তে বিশ্বাসী মানুষদের বাস। তবে এখানকার সিংহভাগ মানুষই বিপন্ন গরীব। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজের পর কর্মক্লান্ত হয়ে সংসারে ফেরে। পেটে খিদের আখ্যান। তাই ইচ্ছে থাকলেও তারা সবসময় নামাজ পড়ার অবসর-অবকাশ পায় না। যখন তারা বাড়ি ফেরে গোরভাঙার ফকিরি গ্রাম ধরে, অনেকেই শুনতে পায় খইবর-আরমান-গোলামরা তখন সাধন গান গাইছেন একেবারে তাঁদেরই যেন মনের কথায়–’ফজরের নামাজের কালে/ ছিলাম আমি ঘুমের ঘোরে/ জোহর গেল আইতে যাইতে/ আসর গেল কামের দায়।’
পাথরচাপড়ি হল ফকিরদের মক্কা। চোতমাসে দাতাবাবার উরস উৎসবে দুনিয়ার পীর ফকির এক হন। চারিধারে তখন পিরান-পাজামার গিজগিজ। পূজা, উৎসর্গ, সিন্নি, মানত, মোমবাতি–তারই মাঝে অবাঙালি ফকিরেরা গাইছেন কাওয়ালি, বাঙালি ফকিরেরা বসিয়েছেন মারফতি গানের আসর। গান হচ্ছে। মাইক্রোফোনেই ধ্বনিত হচ্ছে পীর-সুফী-ফকিরি পন্থার রীতি ও তরিকা–ঘুড়িষার নূর মহম্মদ ফকির গাইছেন–’মগরেবের নামাজের কালে/ গেলাম আমি গোয়াইল ঘরে/ হাওর থাকি আইল না গাই/ বাছুর আমার বান্ধা নায়।‘ পঞ্চাশ পেরোনো নূরের বাবা তোরাব আলি শাহ ফকিরি গান করতেন। হাওরের এ গান তোরাব পেয়েছিলেন খোদ পদকর্তার মুখ থেকেই। নূর মহম্মদ দৈন্যের ভঙ্গিমায় গানখানি আমাকে শোনানোর পর বললেন, ‘চোপর রাত জুড়ে গান হলে বাবা সারিন্দা বাজিয়ে গাইতেন এ গান।’ ডুবকির সঙ্গতে নূর এবার ভণিতায় চলে এলেন–’এসেয়ার নামাজের কালে/ বিবি বলেন চাউল ফুরাইছে/ ছাইলা মাইয়ার কান্দন শুইনা/ কান্দে পাগল দুর্বিন শায়।’
নূরের শেষ করাটায় রীতিমত আমার গায়ে কাঁটা দিল। খোদ পদকর্তা তাঁর আব্বাকে এ গান দিয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোরাব আলি কবে নাগাদ দিয়েছিলেন সিলেটের দুর্বিন টিলায়?’
নূর মহম্মদ বললেন, ‘আব্বার মুখে শুনেছিলাম দাতাবাবার উরসে দুর্বিন পাগল এসেছিলেন শেষ বয়সে। সঙ্গে তাঁর ছেলে আলম শরীফও ছিলেন। আমার তখন মেলায় আসার বয়স ছিল না।’
মাজারে তখন ভিড় বাড়ছে। ফকির চামর নেড়ে বলছেন, ‘আঁটকুড়ার পুত্র যদি হয় সত্য ভাবে/ নিধনের ধন হয় পীরের স্বভাবে। পীর বন্দনার এই ফাঁকে পাথরচাপড়িতে বসে আমি ভাবছি মারফতিদের নামাজ, রোজা, কোরান না মানার বাহাস-ঝগড়ায়, কত আসরে শুনেছি এই গান–’নামাজ আমার হইল না আদায়–’, কিন্তু আজ এমন একজন গাইলেন পাগল দুর্বিনের এই গান, যাঁর উত্তরাধিকারে মিশে আছে পদকর্তার পরম্পরা। তিনি নিজেই দিয়েছেন আবার তাঁর সাধন আখড়ারও পরিচয়–’সিলেট জেলার ভিতরে, পোষ্ট অফিস ছাতক বাজারে দুর্বিন টিলার উপরে, দুর্বিন শাহ হয় যার নাম।।’
দুর্বিন শাহ সুফিপন্থা ও মারফতি মতে বিশ্বাসী। সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নোয়ারাই গ্রামের তারামনটিলা তাঁর সাধন ক্ষেত্র। দেহতত্ত্বের অসংখ্য গান লিখেছেন তিনি। তত্ত্বগানে তিনি ছিলেন পূর্ববর্তী সাধক মরমীয়া আরকুম শাহ, শিতালং শাহ, জালাল উদ্দিনের অনুসারী। বিশেষত জালালউদ্দিনের গানের দেহঘরের নিমগ্ন প্রতীকগুলিই যেন দুর্বিন মূর্ত করেন তাঁর অতীন্দ্রিয় দশায়। এর পাশাপাশি বৈষ্ণবীয় পন্থার ভাবতত্ত্ব, রাধা কৃষ্ণলীলা, গোষ্ঠলীলাও আশ্চর্যভাবেই তাঁর গানের বিষয় হয়ে ওঠে। সাধক মহলে তিনি জ্ঞানের সাগর অভিধায় চিহ্নিত। কুষ্টিয়া ও হাওর–মরমিয়া সাধন ধারার দুই মতামত, আচরণ, ভেক, রীতিনীতি সবটাই বেশ আলাদা ধরণের। নদিয়া, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোরে গুরু ধরে বাউল সাধনার রীতি। সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ সহ গোটা হাওরেই সেটা মুর্শিদ এর দীক্ষা আধারিত। এ তো গেল স্থূল স্তরের তারিকা। প্রবর্তস্তরে নদিয়া তথা বাংলাদেশের লালনপন্থী বাউলেরা ভেক-খিলাফৎ নিয়ে থাকেন। তাঁরা সাদা পোশাক পরেন। বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে এই ভেক খিলাফতের কোনো ব্যাপার নেই। শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহরা তাই ভেক খিলাফত না নিয়েই মুর্শিদ, পীর এর কাছে দীক্ষা নিয়ে বাউল সাধনা করে গেছেন।
দুর্বিন শাহের সাধনশৈলী তাঁর গানের ভেতরই ধরা আছে। তিনি পুরোদস্তুর সংসারী মানুষ ছিলেন। তথাপি তিনি যেন ঘরছাড়া বাউল। আজমীর শরিফের খাদিম সৈয়দ আব্দুস সামাদ গুলজেদি ছিলেন তাঁর মুর্শিদ। ছেলেমেয়ে থাকলেও তিনি যে বাউল ধারার চারচন্দ্রভেদ, দমসাধনা, রজঃসাধনা সম্বন্ধে বিশ্বাসী এবং আচরণবাদী তা তাঁর গানগুলির ভেতরই স্পষ্ট চিহ্নিত। ১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’এর প্রথম খণ্ড প্রকাশ পায়। দ্বিতীয় খণ্ডও ওই একই সালে বের হয়। তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ সাল ১৯৬৮ সে বছরই তিনি শাহ আব্দুল করিমের সঙ্গে বিদেশ যাত্রা করেন। সেখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাধনতত্ত্বের গান পরিবেশিত হওয়ার পর তিনি প্রবাসীদের কাছ থেকেই জ্ঞানের সাগর উপাধিটি লাভ করেন। পরবর্তীতে গোটা বাংলাদেশই তাঁর নামের আগে বিশেষণ স্বরূপ উপাধিটি জুড়ে দেন। ১৯৬৮ সালেই ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’র চতুর্থ খণ্ডের প্রকাশ ঘটে। এরপর তিনিও মুক্তিযুদ্ধের শরিক হয়ে ওঠেন। জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। এক্ষেত্রে করিমের মতোই তাঁর প্রধান সহায় গান। তিনি বেশ কিছু দেশাত্মবোধক সঙ্গীতও রচনা করেন। ১৯৭২ সালে এইসব সংগ্রহ নিয়েই বের হয় বই ‘সোনার বাংলা সংগ্রাম গীতিকা’। এইসব গানের মূল বিষয়বস্তু হল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালেই সিলেটের ইউনাইটেড প্রেস থেকে বের হয় ছটি গানের সংকলন ‘পাক বঙ্গ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ গীতি’। ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক ঘটক তাঁর বিখ্যাত সিনেমা ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’তে দুর্বিন শাহের জনপ্রিয় সাধন সঙ্গীত নামাজ আমার হইল না আদায় ব্যবহার করেন। এটি গেয়েছিলেন ভাটির বিখ্যাত গায়ক রণেন রায়চৌধুরী। ১৯৭৭ সালে দুর্বিন টিলার নিজ বসত বাড়িতেই এই মরমিয়া সাধক দেহ রাখেন। বাউনের বিশিষ্ট তাত্ত্বিক আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন–’দুর্বিন শাহ কত গান রচনা করেছিলেন তার সঠিক হিসেব পাওয়া ভার। তবে তাঁর গানের একটা বড়ো অংশ ‘প্রেমসাগর পল্লীগীতি’ নামে মোট ছ’খণ্ডে বেড়িয়েছিল ১৯৫০ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে। সপ্তম খণ্ডের পাণ্ডুলিপি অসম্পূর্ণ থাকায় তা প্রকাশিত হয়নি। গবেষক আবদুল রহমান লিখেছেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই বাউল দুর্বিন শাহের গান নানাজনের কণ্ঠে শুনে আসছি। যেমন শুনতাম শাহ আবদুল করিমের গানও। আমাদের গ্রামের গানপিপাসু আলেক ভক্তগন প্রতি মাসে তিন চার দিন ঘরোয়া আসর করতেন। তখন বিভিন্ন পীর ফকির বাউল মহাজনের গান গাইতেন। প্রত্যেক আসরে দুর্বিন শাহের। দুই চারটি গান গাইতেন। যিনি গাইতেন তিনি ব্যতীত আর সবাই মুখ বন্ধ করে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ জিকির করতেন। কোনওপ্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়া গাইতেন। তখন গানকে বলা হতো কালাম। অনুসন্ধিৎসু টি এম আহমেদ কায়সার লিখেছেন দুর্বিন শাহের গায়কি নিয়ে।
তিনি বলছেন, ‘এমনকি উচ্চারণও স্পষ্ট হতো না সব সময়; গাইতেন কাশযুক্ত ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায়, কিন্তু তাতে কী হবে, ভক্তেরা কয়, আসরে আসরে কত নির্ঘুম রাত যে কাটিয়েছি দুর্বিন নেশায় এই গান শুধু তাঁর স্বকণ্ঠে শোনার জন্যে। এক অন্তর্মগ্ন মিনতি, আহা! কী যে এক বিষাদঘন মাধুর্য, যেন কান্না ঝরে পড়ত গানের ছত্রে ছত্রে। গানের বিশাল বিশাল আসর বসত তখন মাজারে, আখড়ায়, প্রত্যন্ত গ্রামে আবার কোনো কোনো গঞ্জেও। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে আসত গান শোনার জন্য। দুর্বিন শাহ’র কিছু গান একদা সারা বাংলাদেশ মাতিয়েছিল। অবশ্য তখনও বাউলা গানের কদর ছিল বেশ, বাউলরাও উপেক্ষিত ছিল না খুব একটা।
২০১০ সালে দুর্বিন শাহের প্রকাশিত–অপ্রকাশিত–অগ্রন্থিত ৩২ টি গান নিয়ে একটি সংকলন বের হয় সুমন কুমার দাশের সম্পাদনায়। সুমন সিলেটের ছেলে। আমারই বয়সী। গ্রাম ঘুরে ঘুরে লোকগান সংগ্রহ করে সে। ওর ব্যক্তিগত সংগ্রহে নানা ধারা উপধারার গান রয়েছে।
ভূমিকায় সুমন লিখছে, ‘আমি নিজে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি দুর্বিন শাহের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গানগুলো একত্রে গ্রন্থভুক্ত করার। তবে সংকলিত গানগুলোর বাইরে আরও কিছু গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময় গানের মঞ্চে তাৎক্ষণিক ভাবে রচিত অধিকাংশ গান সংরক্ষণের অভাবে শিল্পী নিজেই হারিয়ে ফেলেছেন। শিল্পীর অনুরাগী, ভাবশিষ্য ও ভক্তদের বদৌলতে হয়তো একদিন এসব গানও সংগৃহীত ও সংকলিত হবে। তখন হয়তো বা দুর্বিন শাহের গানের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে…।
২০১৪ সালে ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’র দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। এই সংস্করণে সুমন লিখছে, ‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’ গ্রন্থে পূর্ববর্তী সংস্করণের ৩২৭ টি গানের সঙ্গে আরও ২৮ টি অগ্রন্থিত গান মুদ্রিত হল। অগ্রন্থিত গানের মধ্যে ‘ভুলে পড়ে জগৎ ঘোরে, তার পিছনে আমিও ঘুরি’ ও ‘ফুলের মালা হল কী জ্বালা’ শীর্ষক দুটি গানের কোনো নামপদ পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে দুর্বিন শাহের গানের সংখ্যা ৩৫৫ তে দাঁড়ালো। এর বাইরে আরও কিছু গান হয়তো শিষ্য-অনুরাগীদের সংগ্রহে থাকতে পারে। তবে সে সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য বলেই আমাদের ধারণা। তবে বর্তমান সংস্করণ থেকে বইটির নতুন নামকরণ করা হয়েছে দুর্বিন শাহ সমগ্র।
এই সংকলনেই সুমন যোগ করেছে দুর্বিন শাহের জীবনপঞ্জী ও গ্রন্থপরিচয়। জুড়েছে আবুল আহসান, আবদুর রহমান ও আহমেদ কায়সারের লেখাগুলি।
সংকলনে গ্রথিত করবার সময় সুমন দুর্বিনের গানগুলো বলা চলে একেবারে সাধন বিন্যাসেই দিয়েছে। হামদ ও নাতে রাসুল, সৃষ্টিতত্ত্ব, আউলিয়া শানে, মুর্শিদ বর্ণনা, পারঘাটা, দেহতত্ত্ব, মারিফত তত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, কামতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, কারবালা স্মরণ, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, গোষ্ঠ–এই পনেরোটি সাধন আধারে রেখে সুমন দুর্বিনের পদাবলী সাজিয়েছে। আর ওঁর স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোকে রেখেছে সে বিবিধ হিসাবে।
বাউলের সাধন পদ্ধতি, আচরণ ও গায়নশৈলী বদলায় আসলে অঞ্চলের জল হাওয়ায়। নদিয়া বৈষ্ণব আচরণে ধন্য বলেই কুষ্টিয়ার সাধনা ও সুরে কীর্তনের প্রভাব।
ভাটির দেশের মরমিয়াদের সুরে ভাটিয়ালির প্রভাব থাকাটা তাই স্বাভাবিক। দুর্বিনের গান তাঁর ব্যাতিক্রম নয়। শরিয়ত মারফতের বিশ্লেষণ, দম-শ্বাসের দেহসাধনা, গুহ্যচর্চার গানের পাশাপাশি দুর্বিনের মুর্শিদ বন্দনার গানগুলির ভেতর যে আচরণবাদ তা বাউল পন্থারই যথার্থ তারিকা। যখন মেলায় খেলায় ঘোরাঘুরি শুরু করি, গুহ্য আচরণবাদে আকৃষ্ট হয়ে মরমিয়াদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করি তখন অনেকেই বলতেন আমায়, ‘আগে গুরু ধরেন গা, গুরু না ধরলি কোনও কিছু শুরুই হবে না নে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম খয়েরবুনির সনাতন দাসকেই, ‘গুরু কেন?‘
বলেছিলেন, ‘গুরু হলেন নিয়ন্ত্রণ।‘
বললাম, কীসের?
বললেন, শ্বাস প্রশ্বাসের। শরীরে নানা কাম যাতনার চক্র রে খ্যাপা। গুরু এর ঘোর কাটায়।
বিকেল যখন মজেছে। সনাতন একতারা তুলে নিয়ে গাইতে থাকলেন মুর্শেদ বন্দনারই গান। খয়েরবুনিতে সন্ধ্যা নামছে তখন হু হু করে। বাউলেরা এ সময় গুরু ভরসার দৈন্যগান করেন।
সনাতন গাইছেন, ‘মুর্শিদ নাম ভরসা করে অকূলে দিলাম সাঁতার।’
‘দুর্বিন শাহ সমগ্র’র ভেতর এই গানখানি নাড়াচাড়া করতে করতে খয়েরবুনির খ্যাপাকে বড় মনে পড়ছে। ওঁর গলাতেই আমি যে প্রথম শুনেছিলাম দুর্বিন শাহের পদ। কিছুকাল হল খ্যাপাও চলে গেছেন দুর্বিন শাহের দেশে।
০২.৩ দীন প্রশান্ত বলছে ডেকে
মাঝে মাঝেই ভাবি আউল-বাউল, ফ্যাকরা-ফকির, সাঁই-দরবেশ, ভৈরবী বৈষ্ণবী, সহজিয়া-মরমিয়াদের ভাবের রাজ্যে যদি কিছু সাধারণ অনুসন্ধিৎসু, ভূতে পাওয়া মানুষজনদের প্রবেশ না ঘটত তবে বাংলার দেহবাদী কায়া সাধনার নিরক্ষর, অল্প শিক্ষিত সাধক সম্প্রদায়ের সাধন ধারা, দেহতত্ত্ব ও সাধন নির্দেশের মধুস্রাবী সঙ্গীতের কী দশা হতো! সবই তো হারিয়ে যেত গ্রামের গহনে। ভাগ্যিস বাঙালি বিদ্বৎসমাজের কারও কারও গ্রাম ঘোরার বাতিক ছিল। আর ছিল পরিমণ্ডল ঢুড়ে এইসব সাধন সম্প্রদায়ের অনুসন্ধান করবার মতো একটা মন। যে মন উদাসীনের বিচিত্র ভুবনের ডাকে সারা দিয়ে পুথিপড়া লোক সংস্কৃতিচর্চার আড়াল ধসিয়ে সরাসরি বেড়িয়ে পড়তে পারে গ্রামদেশে এইসব উপাসক সম্প্রদায়ের সন্ধানে। বিদ্বৎসমাজ যাকে ‘লোকায়ত ধর্ম’ বা গৌন ধর্মের স্রোত বলে করেই পৃথক করে রেখেছে। তবে এ কাজটি বাঙালি করবার আগে করে গিয়েছিলেন এক বিদেশী। তিনি উইলসন সাহেব। ভারতীয় ধর্ম সম্প্রদায়গুলোকে তিনি ১৮ টি ভাগে ভাগ করে পথ প্রদর্শকের কাজটি করে দিয়ে গিয়েছিলেন ১৮৬২ সালে। এর আট বছর বাদে অক্ষয়কুমার দত্ত ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়কে এমন এক উপমুখ্য সম্প্রদায়ে ভাগ করে দেহবাদী কায়াসাধনার বৃত্তান্ত পেশ করলেন যেখান থেকে বেড়িয়ে আসলে গ্রাম্যভূমির লোকায়ত যাপনের হদিশ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি উৎসাহ দেখাল জমিদারী এলাকাভুক্ত কুষ্টিয়ার সাধক লালন ফকির সাঁইকে নিয়ে। সাঁইজি অবশ্য ঠাকুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে বেরোনো প্রবাসী পত্রিকার হারামণি বিভাগে ঠাই পাওয়ায় আগেই শরীরে থাকার সময়েই হরিনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়দের মতো বাঙালি বিদ্বজনের নজরে পড়েছেন। যেমন উইলসন সাহেবের কত আগে ১৮০২ সালে শ্রীরামপুরের মিশনারী উইলিয়াম কেরির নজরে পড়েছিল নদিয়ার কুষ্টিয়ার মতো আরেক এলাকা ঘোষপাড়া। যেখানকার কর্তাভজা ধর্ম ও ধর্মগুরু দুলাল চাঁদ ও সতী মা তাঁদের একেশ্বরবাদের কায়া সাধনা দিয়ে মিশনারীদের নজর কেড়েছিলেন। ধর্মান্তকরণের স্বার্থবুদ্ধি নিয়ে তাই কেরি, মার্শম্যানরা তখন ঘোষপাড়া যাতায়াত করছিলেন। তবে উইলসন সাহেবের কোনো স্বার্থবুদ্ধি ছিল না। Religious sects of the Hindus’ ছিল আদতে একটি অনুসন্ধিৎসার ফসল। ১৮৭০ সালে বেরোনো অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ও তেমনই এক মৌলিক গবেষণার নজির। এরপরই বলতে হয় ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর কথা। যিনি বীরভূমের বাউলদের আচরণবাদকে দেখেই ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করলেন বাংলার বাউল’ নিয়ে। বাউলিয়া তত্ত্ব বলা ভালো সেই প্রথম বিদ্বৎসমাজে উঠে এল। অক্ষয়কুমার দত্তের সমপর্যায়ের আরেক মানুষ হলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তিনিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। আর এরপর বাউল গবেষণা যার হাতে সর্বপ্রথম বৃহৎ আকারে আকরগ্রন্থ হিসাবে উঠে এল তিনি কুষ্টিয়ারই সন্তান উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেছিলেন ১৫০০ বাউল গান। কুষ্টিয়ার আরেক কৃতী, বাংলাদেশের প্রখ্যাত লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীও। বর্তমানে অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসাবে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন এ বঙ্গে শক্তিনাথ ঝা, সুধীর চক্রবর্তী। ওপার বাংলার আহমদ শরীফও বাউল তত্ত্ববিদ হিসাবে সমধিক পরিচিত। এ প্রসঙ্গে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও উল্লেখ্য। ঠিক যেমন এখানে ১৯৬৬ সালে বঙ্গীয় লোক সঙ্গীত রত্নাকর সম্পাদনা করে আশুতোষ ভট্টাচার্য এক অনন্য নজির গড়েছেন। এই। সমস্ত নজিরের পেছনেই রয়েহে আসলে উদাসী মন। না হলে ভাববাদী কায়া সাধনার এলাকাতে চলাফেরা করা বেশ শক্ত।
নিজের কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বয়ঃসন্ধির সময় পর্বে শুশান সম্পর্কে কৌতুহলী না হলে কোনওদিনই আমার ‘ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায় লেখা হতো। প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রশিল্পী। ঘর ছাড়লেন মনে উদাসীনের ওঠাপড়ায়। না হলে তন্ত্র বিষয়ে কালজয়ী গ্রন্থখানি লেখাই হতো না। সাধক নিগমানন্দ তাঁর সাধন উপলব্ধ জ্ঞানে লিখলেন ‘তান্ত্রিক গুরু’। পণ্ডিত প্রবর গোপীনাথ কবিরাজ বেনারসে সাধু মহাত্মাদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন বলেই লেখা হয়েছিল ‘সাধু দর্শন ও সৎ প্রসঙ্গ তাঁর তন্ত্র বিষয়ে তাত্ত্বিক গবেষণাও এখানে উল্লেখ্য। শক্তিনাথ ঝাঁ সেই কবেই আউলিয়া-বাউলিয়া সঙ্গে আখড়াবাসী হয়েছেন। বাউল ফকির সংঘের সভাপতিও তিনি। ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায় পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বাংলাদেশে ভাবান্দোলনের প্রাণপুরুষ ফারহাদ মাজহার। মাজহার নিজেও লালন ঘরানার সাধক। কুষ্টিয়ায় তাঁর আখড়া আছে। তাঁর ‘ভাবান্দোলন’ ও ‘সাঁইজির দৈন্যগান’ সহজিয়া দর্শনের প্রামাণিক আকর।
রাজশাহীতে জন্মেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র রায়। গ্রামে ছিল বৈরাগীপাড়া। মরমিয়া বাদের ছোঁয়া লাগল মনে তাঁর সেখান হতেই। এরপর এপার বাংলায় আসার পর সেই বৈরাগী ছোঁয়া আরও যেন পরিধি পেল। তিনি চলে এলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়ার ঘোষপাড়া, জয়দেবে, পাথরচাপুড়িতে, দুবরাজপুরে, বর্ধমানের বৈরাগীতলার মেলায় বাউল ফকিরদের সান্নিধ্যে। এসে পড়লেন দ্বন্দ্বে। যে দ্বন্দ্বে আমিও পড়েছিলাম ২০০০ সালে শুরুর সময় মেলায়-আখড়ার বৈষ্ণবীয় বহরে। বৈরাগীতলা, জয়দেব, সোনামুখী, রামকেলী সবই বৈষ্ণবীয় সাধকদের নামে জমায়েত। অথচ ভিড় বাউলদের। এই দ্বন্দ্বের ভেতরে সুধীর চক্রবর্তীও পড়েছিলেন। তাঁর প্রচারিত গ্রন্থ ‘বাউল ফকির কথা’তে বাউল আর বৈষ্ণব বিভাজন নিয়ে একখানি অধ্যায়ই আছে লালনশাহী মতের সাধক দুদ্দুশাহের বিভাজন রেখাকে নামিত করে। প্রশান্তচন্দ্রও দ্বন্দ্বে পড়ে যার উল্লেখ রেখেছনে—‘বাউল বৈষ্ণবধর্ম এক নহে তো ভাই/ বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই/ বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ/ তুলসীমালা অনুষ্ঠান সদাই/ বাউল মানুষ ভজে,যেখানে নিত্য বিরাজে/ বস্তুর অমৃত মজে, নারী সঙ্গী তাই।’ সহজিয়া বৈষ্ণবতায়ও নারী বা সাধন সঙ্গিনী অনিবার্য। এই সাধনধারাও বাউল মতের ‘বস্তুর’ই সাধনা। কায়াবাদী সাধকরা তো বস্তুহীন নন। শরীরের বর্জ্য ও রজ-বীর্য নিয়েই তো তাঁদের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদ। বাউলের সিংহভাগ সাধন সঙ্গীতও তো এই আচরিত পথ ও পন্থা নিয়েই। দুদ্দু শাহ তাঁর মধুস্রাবী গানে বাউলের গোপন ও গুহ্য আচরণবাদের অনেক কিছুই স্পষ্ট করেছেন। তাঁর গানে দেহকেন্দ্রিক আচরণের আধিক্যই বেশি। তিনি তন্ত্রাচারী ফকির বাউলের আচরণও গানে ব্যক্ত করেছেন আবার বাউল বৈষ্ণবের সাজুয্যের আচরণবাদকে পৃথক করতে নিদান হেঁকেছেন। তাঁর এই হাঁকাহাঁকিতে অবশ্য নদিয়া-রাঢ়ের বাউলেরা নেই। নদিয়া রাঢ় দুই ভূমিতেই বৈষ্ণবীয় আচরণবাদের দাপট। স্বভাবতই তা বাউলে মিশেছে। বাউলরা সাধন সঙ্গিনীকে ‘বোষ্টুমী’ বলেও ডাকাডাকি করছেন। লালন শাহের ‘চরণদাসী’ হওয়ার আশায় এ পথের মেয়েরাও তাই অনেক বাউল সাধকের কথকতায় ‘বৈষ্ণবী’ হয়ে উঠেছেন। অথচ বাউলের সাধন সঙ্গিনী ‘চরণদাসী’ হওয়ারই উপযোগী সাধনের গোপ্য ধারায়–নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা/ মায়েরে ভজিলে হয় তাঁর বাপের ঠিকানা। এই ঠিকানায় সন্ধানী মেয়েরা বাউলপথে ‘চরণদাসী’ হলেও সাজুয্যের বৈষ্ণবতায় ‘বোষ্টুমী’ হয়ে বসেছেন কোথাও কোথাও। লীনা চাকী এঁদের নিয়ে বিস্তারিত কাজ করেছেন। বাউল মেয়েদের মনের কথা জেনে লিখে ফেলেছেন ‘বাউলের চরণদাসী। বাউল বৈষ্ণবের সাজুয্য ধারায় কোথাও হয়েছেন আবার ‘বৈষ্ণব বাউল। এসব দ্বন্দ্বখেলায় সুধীর চক্রবর্তী যেমন পড়েছেন, পড়তে হয়েছে মরমিয়াবাদের সন্ধানী সকলকেই। প্রশান্ত চন্দ্র রায় সত্তর দশকে সেই দ্বন্দ্বমেলায় পড়েছিলেন। সালতামামির আখড়া মেলাতে ঘোরায় তিনি সুধীর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝাঁ-দের সমসাময়িক প্রশান্তচন্দ্র লিখেছেন, ‘মালা তিলক কষ্ঠীধারী বৈষ্ণবএর সাথে মানুষভজা বাউলের পার্থক্য এতটাই যে বাউলরা বস্তুবাদী, বস্তু অর্থে শুক্র, জীবন রস।
দীর্ঘ সতেরো বছর হল আমার সহজিয়াদের সঙ্গে ওঠাবসা। সহজিয়া বৈষ্ণবদের অনেক ধারা। পাটুলির স্রোত, বীরভদ্রের স্রোত, নিত্যানন্দের স্রোত, রূপকবিরাজী স্রোত। সব স্রোতেই কলমি পুঁথি আছে। আছে রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্বের কথা। কৃষ্ণ মানে ভগবান নন, মানুষ। কৃষ্ণ মানে যিনি কর্ষণ করতে পারেন। কৃষ্ণ হলেন ক্ষেত্রজ পুরুষ। যিনি বীজ বুনতে পারেন। বীজ মানেও কৃষ্ণ, অর্থাৎ বিন্দু বা বাউলের বস্তু। রাধা হলেন ক্ষেত্র অর্থাৎ কিনা সাধন সঙ্গিনী, বোষ্ট্রমী। বাউলের চরণদাসী। তাই সহজিয়া বৈষ্ণবরাও এক অর্থে বস্তুবাদী। চৈতন্য এই এলাকায় শরীরের চেতনসত্তা, চৈতন্যদেব নন। দুদ্দুশাহ বৈষ্ণবীয় গুপ্ত কড়চার কথা যে জানতেন তাঁর মস্ত প্রমাণ গানে সাধনতত্ত্বের ব্যবহার। দুদ্দু গুরু লালন সাঁইয়ের মতো নিরক্ষর ছিলেন না। তিনি পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরবি ফারসি ভাষা ও ইসলামি তত্ত্বের পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর গ্রাম হরিশপুরে বৈষ্ণব ধর্ম এবং সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা ছিল। লালন ঘরানার এই সাধকের গান পড়লেই তাঁর বিদ্যাচর্চা সহজেই অনুমেয়। দুদ্দুর গান ও রচিত গ্রন্থ ছিল। সেগুলো অমুদ্রিত থাকায় দুর্লভ। শক্তিনাথ ঝাঁ ২০১২ সালে দুদ্দুশাহের ২১৪টি গান অর্থ সংকেত সহ গ্রন্থনা করেছেন। এর অনেক আগেই বাংলা একাডেমী, ঢাকা থেকে প্রকাশ পেয়েছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় ‘বাউল গান ও দুদ্দু শাহ’ গ্রন্থখানিপ্রশান্তচন্দ্র রায় তাঁর সম্পাদিত ও সংকলিত গ্রন্থ ‘সহজিয়া সাধন সঙ্গীত’ এ দুদ্দুর গান রেখেছেন, তবে লালন ঘরানার আরেক মরমিয়া পাঞ্জু শাহের গান সংকলনভুক্ত হয়নি। পাঞ্জুর জীবিত কালেই তাঁর রচিত গান ও গ্রন্থ ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহহার প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালে। প্রশান্তচন্দ্র যে আখড়ায় নাড়া বেঁধেছিলেন সেই কেন্দুলি তমালতলার সুধীর বাবার ওখানে সন্ধেবেলার দৈন্যগানের আসরে সাঁইজি, দুদ্দু ও পাঞ্জুর গান হতো। লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনে থাকলেও গুরুকুলের পাঞ্জু শাহের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
প্রশান্তচন্দ্রের মূলত ওঠাবসা রাঢ়বঙ্গের বাউলের সঙ্গে। সুধীর খ্যাপার আখড়াই তাঁর মহাজনী পদ শোনা ও সংগ্রহের প্রধান জায়গা। এখানেই তাঁর রাঢ়ের বাউলদের সঙ্গে সান্নিধ্য। সে বিবরণ তিনি নিজেই দিয়েছেন তাঁর লেখা ‘বাউলগান ও ভাবসংগীত’ গ্রন্থখানিতে–’কেঁদুলি গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটতে শুরু করে। বোলপুরের ভাবসাগর বিশ্বনাথ দাস, বাঁকুড়া খয়েরবনীর সনাতন দাস, গৌর খ্যাপা, পবন। দাস, জয়দেব কেঁদুলির শান্তিরঞ্জন, বাঁকাশ্যাম দাস, লক্ষ্মণ দাস, তারকেশ্বর দাস, লক্ষ্মণ দাস(পূর্ণদাসের মেজোভাই), রাধারানি দাস(পূর্ণদাসের দিদি)। এঁদের সকলকেই তিনি তাঁর কর্মস্থল চিত্তরঞ্জনে গান শোনানোর জন্য নিয়ে গেছেন। তবে বোলপুরের প্রবীণ বাউল দেবীদাস, জয়দেবের তারক খ্যাপা, খ্যাতিমান শান্তদাস বাউল, রামপুরহাটের কানাই বাউলের অনুল্লেখ এখানে চোখে পড়ারই মতো। যেমন গৌরখ্যাপার সাধন সঙ্গিনী দুর্গা খেপী ও আহমেদপুরের ফুলমালা দাসীর কথা অনুল্লেখ রাখলে রাঢ়ের মরমিয়া সাধনার কথা অসম্পন্ন রয়ে যাবে। আর দু’জন সোনামুখী বাঁকুড়ার হরিপদ গোঁসাই ও নির্মলা মা।
প্রশান্ত রায় লিখেছেন, ‘বাউল তত্ত্ব দর্শন ও গানের কথা’ নিয়ে দুই বাংলার পণ্ডিত গবেষক অনেক গ্রন্থ লিখেছেন অনেক গবেষণাও হচ্ছে কিন্তু বিশেষ করে বাংলাদেশের গবেষকরা লালন ফকিরকে নিয়েই বেশি কাজ করেছেন, অবিভক্ত বাংলার বিশেষ করে রাঢ় বাংলায় যাদুবিন্দু, পদ্মলোচন, নিতাই খ্যাপা, রাধাশ্যাম দাস, মদন নাগ, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়(কণ্ঠমশাই), পীতম্বর দাস, হাউড়ে গোঁসাই, গোঁসাই প্রেমানন্দ, কোঠরে বাবা, গোঁসাই নরহরি প্রভৃতি অনেক মহাজনের গানের কথা বাংলাদেশের পণ্ডিত গবেষকদের পুস্তকে খুব একটা নজরে পড়ে না।
লালন ফকির সাঁই দুই বাংলাতেই পপুলার কালচার। তাই তাঁকে নিয়ে চর্বিত চর্বন চর্চা বেশি। বসন্তকুমার পালের প্রথম লালন জীবনী ‘মহাত্মা লালন ফকির’ ১৯৫৫ সালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকুল্যে বেরোনোর পর প্রামাণ্য লালনচর্চা বলতে সুধীর চক্রবর্তীর ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ ও শক্তিনাথ ঝাঁয়ের ‘ফকির লালন সাঁই দেশ কাল এবং শিল্প’ আর ওপার বাংলায় এ বিষয়ের পুরোধা আবুল আহসান চৌধুরী। তাঁর ‘কুষ্টিয়ার বাউল’ গ্রন্থখানিও মরমিয়া আলোচনায় প্রনিধানযোগ্য। লালনের পাশাপাশি
আবুল আহসান কাঙাল হরিনাথকে নিয়েও এখন কাজ করে চলেছেন। ঢাকা বাংলা। একাডেমীর সহ পরিচালক সাইমন জাকারিয়া লিখেছেন ‘উত্তর লালনচরিত’। তাঁর বাংলাদেশের কিংবদন্তি সাধক শাহ আবদুল করিমের জন্মশতবর্ষ পালন হল সিলেট শহরে। আয়োজকদের ডাকে সাড়া দিয়ে সংকলন স্মরণিকায় করিমের গান নিয়ে সে সময় লিখবার সুযোগ ঘটেছিল। রাঢ়ের আখড়ায় করিম প্রচলিত। প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনে তাঁর উপস্থিতি নেই। হাওর ভাটি অঞ্চল। সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুড়ে হাওরের বিস্তার। আর ভাটি পুরুষ করিম, দুর্বিন শাহ, হাসন রাজা, রাধারমণ, আরকুম শাহ, পাগলা কানাই, শিতালং শাহ, করিম শাহরা এপারের আখড়াবাড়িতে পরিচিত। রাঢ়ের কিংবদন্তি সনাতন দাস মঞ্চে উঠলেই দুর্বিন শাহ গাইবেন না এ হতে পারেনা। রাঢ়ের সাধুসঙ্গের উদাসীন প্রশান্তচন্দ্র কেন ভাটির সাধকদের গান সংকলনভুক্ত করলেন না এটা আশ্চর্যের। অথচ গ্রন্থটিতে দু’কলম ভূমিকা আছে ভাটিপুরুষ খালেদ চৌধুরী। প্রশান্তচন্দ্র ঠিকই লিখেছেন, রাঢ়ের সাধক বাউলদের পদ ওপারে কম প্রচলিত। এর প্রধান কারণ কিন্তু গ্রন্থনা। এ বঙ্গে একটি লালন সমগ্র নেই পপুলার কালচার হয়েও। কুবিরের গান অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করেছেন সুধীর চক্রবর্তী। শক্তিনাথ ঝাঁ সংগ্রহ করেছেন রাঢ়ের অনন্ত, গুরুচাঁদ, রাধাশ্যাম গোস্বামীদের গান। মুর্শিদাবাদের বাউলদের আচরনবাদ ধরা রয়েছে তাঁর ‘বস্তুবাদী বাউল’ গ্রন্থখানিতে। বর্ধমানের যাদুবিন্দু, কোটার অনুরাগী সাঁই, বৈরাগীতলার রাধাপদ গোস্বামী, মুর্শিদাবাদের মনমোহন দাস, শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য সহ উল্লেখ্য সাধক মহাজনদের পদও তিনি গ্রথিত করেছেন ‘বাউল ফকির পদাবলি’তে। বাংলাদেশের চিত্রটা কিন্তু এমন নয়। সেখানে শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, মছরু পাগলা, দ্বিজদাস, দীন শরৎ, আরকুম শাহ, পাগলা কানাইয়ের মতো উল্লেখ্য মহাজনদের সমগ্র বের হয়েছে। তাই সাধুগুরুর গান। সংগ্রহে ওপার বাংলা অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশে আমার ‘বাউলগানের কথকতা’, ‘দেহসাধনায় যৌনতা’ বইদুটি রমরমিয়ে চলার পর এবছর যখন একুশে গ্রন্থমেলায় ঢাকা থেকে বের হল পশ্চিমবঙ্গের বাউল তখনই যোগসূত্রের বহর আরও বেড়ে গেল। ওখানকার সুমনকুমার দাশ, সৈয়দা আঁখি হক, বঙ্গ রাখাল, পার্থ ঠাকুরের মতো আমার বয়সীরা মরমিয়াবাদ নিয়ে অকল্পনীয় সব কাজ করছেন। তাই বাংলাদেশে বাউলিয়া চর্চা এখন আর কোনও মতেই লালনচর্চাতে থেমে নেই। বরং এপার বাংলাতেই কাজের ঘাটতি রয়েছে।
রাঢ়ের প্রাচীন বাউল অনন্ত গোঁসাই। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর গ্রন্থে ওঁর পদ গ্রথিত করেন। এরপর শক্তিনাথ ঝাঁ। প্রশান্তচন্দ্র রায় অনন্ত গোঁসাই ও রাধাশ্যাম দাস–এই দুই রাঢ়ের বাউলের পদ সংকলিত করেছেন। রাঢ়ের সাধক বাউলদের মধ্যে অনন্ত গোঁসাইয়ের পর রাধেশ্যাম দাসের যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। তাঁর গুরু হলেন আহমদপুরের গুরুচাঁদ গোস্বামী। ফুলমালা দাসী আমাকে ওঁর আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাধেশ্যামের ‘অজ্ঞান তিমির হে গুরু নাশ করো জ্ঞান অঞ্জন নয়নে দাও’–এই গানখানি দিয়েই রাঢ়ের বর্তমান বাউলেরা আসর বন্দনা সারেন। নদিয়া, মুর্শিদাবাদেও রাঢ়ের এই দুই মহতের পদ গাওয়া হয়ে থাকে। অনন্ত গোঁসাইয়ের ছেলে হলেন অত্রুর গোঁসাই। নবনী দাসের বাবা। পূর্ণদাস, লক্ষ্মণ ও রাধারানি দাসী এই বংশধারারই বাউল। রাঢ়ের আরেক মহৎ যাদুবিন্দু। তাঁর গুরু নদিয়ার সাহেবধনী সম্প্রদায়ের কুবির গোঁসাই। বর্ধমানের পাঁচখালিতে যাদুবিন্দুর সমাধি আছে। ওর নাতি দেবেন গোঁসাইএর কাছ থেকে সুধীর চক্রবর্তী যাদুবিন্দুর গানের খাতা পেয়েছিলেন। প্রশান্তচন্দ্র যাদুবিন্দুর পদ রেখেছেন গ্রথিত সংকলনে।
পদ্মলোচন বা গোঁসাই পোদোও রাঢ়ের প্রাচীন বাউল। উপেন্দ্রনাথ, সুধীর চক্রবর্তী ওঁর গান সংগ্রহ করেছেন। রাঢ়ের আসরে অনিবার্য পদ্মলোচন। প্রশান্তচন্দ্র রাঢ়ভুক্ত আখড়ার মানুষ বলেই তাঁর গ্রন্থনায় পদ্মলোচনকে রেখেছেন।
বর্ধমানের নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের গান শুনে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব সমাধিস্থ হতেন একথা ‘কথামৃতে’ আছে। সুধীর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝাঁ কেউই এই মহতের গান গ্রথিত করেননি। প্রশান্তচন্দ্র রাঢ়ের আখড়া থেকে নীলকণ্ঠের গান সংগ্রহ করেছেন।
হাউড়ে গোঁসাইও নামি পদকর্তা। তন্ত্র, বেদপন্থা অবলম্বন করে শেষমেশ তিনি সনকানন্দ স্বামী। উপেন্দ্রনাথ তাঁর গান রেখেছেন। শক্তিনাথ, সুধীর চক্রবর্তী, প্রশান্তচন্দ্রও তাঁর গান গ্রথিত করেছেন।
হাওরের বিশিষ্ট মরমিয়া দীন শরৎ। বাংলাদেশে তাঁর গান নানাভাবে গ্রথিত হয়েছে। পার্থ ঠাকুরের ‘দীন শরৎ বলে’ গ্রন্থখানি এবারই একুশে গ্রন্থমেলাতে বের হয়েছে। সুমনকুমার দাশ এবছর বাংলাদেশের চোদ্দ মহতের একশোটি করে গান গ্রথিত করেছেন। দীন শরৎ তাঁর অন্তর্ভুক্ত। নদিয়া ও রাঢ়ে দীন শরতের গান যথেষ্টই চর্চিত। স্বভাবতই প্রশান্তচন্দ্রের সংকলনেও তাঁর জায়গা হয়েছে।
বিশ শতকে রাঢ়বঙ্গে সম্মাননীয় সাধক ও পদকর্তা সনাতন দাস। বাঁকুড়ার সোনামুখির খয়েরবুনি যাননি মরমিয়াবাদের অনুসন্ধিৎসুরা এ হতে পারেনা। পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট জনপ্রিয় তিনি। ১৯৯৯ সালে পেয়েছিলেন লালন পুরষ্কার। রেডিয়ো, দুরদর্শনে। নিয়মিত অনুষ্ঠান করেছেন। দেশ বিদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। বাদবাকি সময় খয়েরবুনির নিমগ্ন সাধক। ঋত্বিক ঘটকের ছেলে ঋতবান ওঁর ওপর তথ্যচিত্র নির্মান করেছেন। একুশ শতকের প্রচারের আলো মাখা পার্বতী দাস বাউল ওঁরই শিষ্য। ৯২ বছর বয়সে চলে গেছেন তিনি গতবছর। তাঁর এই চলে যাওয়াতে বাউল সাধনার একটি যুগের অবসানই হল বলা চলে। অনন্ত গোঁসাই থেকে সনাতন দাস–রাঢ়ের এই গুরুত্বপূর্ণ পরম্পরা। তমালতলার সুধীর বাবার আখড়ায় বসে প্রশান্তচন্দ্র রায় যার অনেকখানি অবলোকন। করেছেন। তাঁর একটুকরো ভূমিকাতে এবং দশ মহাজনের সংকলিত পদ সহ তিনশো। পদের তিনি গীতি নির্দেশও দিয়েছেন। সেসব এলাকায় বাউলের গুহ্য সাধনার বিষয়টি তিনি শুনে, বুঝে বলবারও চেষ্টা করেছেন দু’এক লাইনে। গুরুবস্তু, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, চাঁদের গায়ে চাঁদ এসব গোপন দেহতত্ব তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন বাউল সাধকদের কাছে। আর এখানে কিছুটা ফাঁক রয়ে গেছে। সেকথা নিজেই প্রশান্তচন্দ্র বলেছেন, ‘যেহেতু আমি তাঁদের সমাজের দীক্ষিত নই সে কারণে কিছু কিছু গোপনীয়তাও তাঁরা রক্ষা করেছেন।’
এই গোপনীয়তা মরমিয়াবাদের বৈশিষ্ট্য। সাধক কখনও শিষ্য বা বায়েদ ছাড়া দেহতত্ত্ব প্রকাশ করবেন না। তবে বায়েদ ও সাজা বাউল হরহর করে বলতে থাকেন। দেহতত্ত্ব। যার অনেকটাই ভুলে ভরা। অনুমান, লোকসাধনা বর্তমানের সাধনা। আমার গুরুকরণের আগে হেথাহোথা ঘুরছি ভেতর বাড়ির মানে জানতে। নবাসনের নির্মলা মা সার বলেছিলেন আমায়, ‘আগে সাধনে আয়, সব বলব তোরে।’ আমার গুরুজি বলেন, ‘সাধন বর্তমান। সাধন করে দেহতত্ত্ব বুঝতে হয়। দেহসাধনার অনুভূতি বাপ আমার, প্রমাণ। এটা অনুমানের ধর্ম নয়।’ আর এই বর্তমানে না এলে কিছু ভুলত্রুটি থাকে। যেমন অনেক বাউল গুরু আর বায়েদ বলেন ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ হল পুরুষ প্রকৃতি মিলন। প্রশান্তচন্দ্র ‘গীত নির্দেশ’ অংশে তাই-ই লিখেছেন। তবে লালনশাহী ঘরানা ও কুষ্টিয়া মতাদর্শে চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অর্থাৎ কিনা গুরু-শিষ্যের মিলন হচ্ছে। গুরু শিষ্যিকে নির্দেশ দিচ্ছেন, টানছেন যেন চুম্বকদণ্ডের মতো। শিষ্য সেই প্রতিধর্মের লৌহকনিকা। লেগে যাচ্ছেন গুরুর গায়ে। অর্থাৎ কিনা গুরুর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছেন শিষ্য বাউল। সাধন এলাকার এই মার্গ নিয়ে তাই আমাদের ভাবনার কিছু নেই–’চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আমরা ভেবে করব কি?’
প্রশান্তচন্দ্র গুরুমার্গকে অনুধাবন করে নিজে পদও লিখেছেন বেশ কিছু। বাউলের দেহতত্ত্ব ও মরমিয়াবাদের ভাব এসব গানের মূল বিষয়। তিনি বাউল স্বভাবী বলেই এসব গানে অনেক সাধন আধারই মিশেছে। আমার আপশোষ, এমন মানুষের সঙ্গে আলাপ হল না। তিনি চলে গেলেন সাঁইজির দেশে।
০২.৪ আপন সাধন কথা না কহিও যথাতথা
লোকধর্ম উদাত হওয়ার পেছনে যতই উদার মানবতাবাদের যোগসূত্রটা খুঁজে বের করা হোক না কেন, আদতে উচ্চবর্ণের ধর্মীয় কর্তৃত্বই নিম্নবর্গের মানুষদের শুধু। বর্ণগত নয়, ধর্মগত এই পৃথকীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ব্রাত্য, অন্ত্যজরা সমাজপতিদের সামাজিক নিষ্পেষণের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই একসময় নিজ জনগোষ্ঠীর কারও মধ্যেই নেতৃত্ব বা মুক্তির স্বপ্ন সত্য হওয়ার অলৌকিক শিখাটি খুঁজে পেয়েই তাঁকে লোকনায়ক বা গুরু বলে মেনে নিয়ে তাঁর দেখানো বিপরীত ধর্ম নির্দেশ ও কায়াবাদী আচার সর্বস্বতাকে আঁকড়ে সামাজিক মোকাবিলার দিকে চলতে গিয়েই একেকটি লোকধর্মের আকস্মিক সন্নিপাত ঘটিয়েছিল।
লোকধর্মে তাই ধর্মীয় উদারতন্ত্র ও সমন্বয়বাদের অভিজ্ঞান যত না রয়েছে, তাঁর থেকে বেশি মিলেছে গ্রামকেন্দ্রিক বাংলার অকুলীন, দরিদ্র, সাধারণ মানুষদের জোটবদ্ধতার মতামত।
শিক্ষিত বাঙালি উচ্চকোটির সংস্কৃতির ভেতর দাঁড়িয়ে এ পাড়ে কলকাতা ও পাড়ে ঢাকাকেই ধরে বসেছে কৃষ্টি ও সভ্যতার তীর্থজমি। এর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দু’দিকেরই বৃহত্তর বাংলায় সংস্কৃতি তাঁদের কাছে হয়ে উঠেছে ক্রমশই লোকায়ত আর অনাধুনিক। শহরে বাস করা শিক্ষিত বাঙালি লোকায়তের ব্যুৎপত্তিগত তাৎপর্যকেই আসলে ভুলে মেরেছে। জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া বিস্তীর্ণ যে সংস্কৃতি, সেটাই যে লোকায়ত অভিধার ঐতিহ্য বহন করে, এটা শহরে বাস করে নিত্য নতুন আধুনিক বস্তুবাদী প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে তাঁদের মাথার ভেতর থেকে একেবারেই বেড়িয়ে গেছে। ‘লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ–এই পারিভাষিক তাৎপর্য তাঁদের কাছে বৃহত্তর বাংলায় সাধরণ ঘেঁষা ব্যাপার। নয় কোনও শহরকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে তারা নিজেদের মতো করে তাই মূলধারা বানিয়ে তুলেছে। আর বাদবাকি যতটুকু, যা কিছু, সবই এখন লোকায়ত বাংলার সংস্কৃতি। শিক্ষিত বাঙালির নিজস্ব ইতিহাস চর্চার বহর ক্রমশই ঢাকা-কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়ির মতো ছোট হচ্ছে বলেই, তারা তাই শেকড় ভুলে গিয়ে স্বল্প পরিসরের সংস্কৃতিকেই প্রধান বলে দেগে দিয়ে নিজেদের বিদগ্ধ ও পণ্ডিতজন মেনে আধুনিক মননচর্চায় ব্রতী হয়েছে। তাদের সামনে পড়ে রয়েছে অবিদগ্ধ লোকায়ত জনের সংস্কৃতি। এই গরিমার ভেতরই বড় হচ্ছে, বৃহত্তর হচ্ছে শিক্ষিত বাঙালির বোধ ও বিবেক।
লোকধর্ম তথা লোকায়তজনের সংস্কৃতিকে ধরতে হলে তাই সংকীর্ণ বাঙালির নষ্ট জাতিসত্তার দরজার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলে হবে না কখনওই; আমাদের ঢুকতে হবে বৃহত্র বাংলার সেই বন্ধ হয়ে যাওয়া লোকায়তের দরজা দিয়েই।
*****
অজয় নদের দক্ষিণ পাড়ে যেদিন পাল রাজার ঢিবি আবিষ্কৃত হল, সেদিনই খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগেকার বাঙালির কৃষ্টি ও সভ্যতায় জুড়ে গেল অন্