০০. আমার কথা
ষোলো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজে আমার অবস্থান। ঠাকুরদাদার বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়। বাবার জন্ম কোলকাতায়। আমার জন্ম শহরে হলেও পরবর্তীতে আমাদের বসবাস নদিয়ার চাকদহে। এখানেই আমার বেড়ে ওঠা, বয়ঃসন্ধি, এখনকার মধ্য যৌবন। এখানকার পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য এখনও গম্ভীরভাবে উচ্চারণ করেন, চক্ৰদহ। গঙ্গা সরে গিয়ে চক্রাকারে এক দহ উপহার দিয়ে গিয়েছিল বলেই আদতে জায়গাটির নাম হয়েছিল চক্ৰদহ। পরবর্তীতে মানুষের মুখের ভাষায় ক্রমশই তা বদলিয়ে চাকদহ, চাকদা হয়ে ওঠে। এটাই চাকদহ নামের আসল পুরাণ। তবে লোকশ্রুতি ধর্মাবহ টেনে অন্য কথা বলে। ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে গঙ্গা হলেন গিয়ে আবার দেবী। গঙ্গার উপাখ্যান বাল্মীকি লিখে গিয়েছেন। সেখানেই রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ সগর রাজার কথা আছে আর এই সগরের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ ভগীরথই নাকি গঙ্গাকে মর্তে এনেছিলেন,গল্প সেরকমই বলে। তা মর্ত্যে গঙ্গা আনয়নের সময় ভগীরথের রথের চাকায় আমার বাসভূমিতে গভীর খাতের সৃষ্টি হয়, তারপরে গঙ্গাজলে পূর্ণ হয়ে জমিটির নাম চক্ৰদহ হয়ে ওঠে। নামকরণ নিয়ে আরেক কিংবদন্তি বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। শ্রীকৃষ্ণনন্দন প্রদ্যুম্ন ছিলেন বীর যোদ্ধা। তিনি বহু যুদ্ধে বাবা কৃষ্ণকে সাহায্য করেছিলেন। পুরাণ মতে সমস্ত অসুরেরাই শ্রীকৃষ্ণের ছেলের হাতে মারা গিয়েছিল। সম্বরাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় তাঁর রথের চাকা পৃথিবী গ্রাস করে। স্বভাবতই আমার বসবাসের ভূখণ্ডটির নিস্তার নেই কোনও প্রদ্যুম্নের রথের চাকায় ডেবে এখানেও নাকি সুবিশাল দহ হয়। আর সেই দহ থেকেই এতদঞ্চলের নাম চক্ৰদহ হয়ে ওঠে। তবে পুরাণকল্প তো আবার কিছু ঐতিহাসিক সত্যে নিহিত, সেই সত্য নিয়েই বোধহয় তাই প্রাচীন দলিলে প্রদ্যুম্ননগরের। উল্লেখ রয়েছে।
সে যাই হোক, আমার বাসজমিটি আবার অখণ্ড নদিয়ারই অন্তর্গত। তাঁর কুষ্টিয়াতেই ফকির সাঁইয়ের আস্তানা। তাঁর আগে এ অবশ্য চৈতন্যদেবেরও জন্মভূমি। স্বভাবতই নদিয়া তাই বাউল-বোরেগীর দেশ। আবার চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মশাই এই নদিয়ার নবদ্বীপে বসেই মা কালীর রূপ ও তন্ত্র সাধনার সংকলন গ্রন্থটি পর্যন্ত রচনা করে ফেলেন। ফলত আমার নদিয়া বোরেগী-বাউল তান্ত্রিক গুরু ভৈরবী মায়েরও দেশ বটে। আর এর শেষ হাতায় একসময় সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে কৃষ্ণনগরের রাজার বদান্যতায় শোরগোল তুলে দেন। পারস্য থেকে আসা সুফি সাধনার ঘরানা বাংলার গুরু পীরের মহিমাকে বাড়িয়ে ধরে যে ফকির সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘাটাললা; দরবেশী ভাবপ্রবণতার ভাণ্ডার খুলে দিল, সেখানেও নদিয়া সংযুক্ত হল। লৌকিক ইসলাম বা দেল কোরানের মতাদর্শে বিকশিত হয়ে উঠল আমারই নদিয়া।
আঠারো শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের সময়সীমায় বাংলায়। লোকায়ত সাধনার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্র হিসেবে যেন উঠে এল এই নদিয়াই। ঘোষপাড়ায় গড়ে উঠল কর্তাভজা ধর্ম, কুষ্টিয়ায় লালনশাহী মত, বৃত্তিহুদতে সাহেবধনী ক্ষেত্র, ভাগা গ্রামে খুশি বিশ্বাসী স্রোত, মেহেরপুরে বলাহাড়ি সম্প্রদায়। সেই সঙ্গে চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর বাংলার বৃন্দাবনকেন্দ্রিক উচ্চকোটির বৈষ্ণবধর্মের বাইরে সহজিয়া কায়া সাধনার একটা স্রোত তো এই নদিয়ায় বহমান ছিলই। সময় পরিস্থিতির চাপে খণ্ড নদিয়াতেও উঠে এল কুষ্টিয়ার হেঁউড়িয়ার ধর্ম, ভীমপুর-আসাননগর দিয়ে তার বিস্তার শুরু হল। মেহেরপুরের বলরামভজার স্থান হল তেহট্ট পেরিয়ে মোনাকষার নিশ্চিতপুর। দেবগ্রামের ভাগায় খুশি বিশ্বাসের ধর্ম এখন মরা সোঁতা হলেও কল্যানীর ঘোষপাড়ার কর্তাভজা, চাপড়ার বৃত্তিহুদার সাহেবধনী তাঁর ছেউরিয়ার লালন ফকিরের স্রোত এখানে বেশ জায়মান। নিশ্চিতপুরের বলরামীরা হেজেমজে না গেলেও এঁদের ধর্মমতে মানুষের স্রোত ক্ষীণ। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ ও পাটুলি কাটোয়ার সহজিয়া স্রোতের জোয়ার নদিয়াতেও এখন রমরমা। সব মিলিয়ে নদিয়া দেহবাদী কায়া সাধনা, যুগল ভজনা নিয়ে বেশ মশগুল, আর এই পরিবেশের ভেতরই আমার ছোটবেলা থেকে মধ্য যৌবনের জীবন।
বেশ মনে আছে আমার কৈশোর বয়সে আমাদের বাড়ির নিকটস্থ হাজরাতলার ঝোপজঙ্গল পরিষ্কার করে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর আখড়া তৈরি করে নেওয়ার কথা প্রতি সন্ধ্যায় তাঁদের খোলের আওয়াজ ভেসে আসত আমার পড়ার ঘরে, আর সারা বৈশাখ মাস জুড়ে এই দুই কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কাকভোরে গেয়ে ফিরতেন প্রভাতী। রাই জাগানোর সেই সুর এখনও আমার কানে লেগে। বাড়ির কাছের সেই আখড়াবাড়ি আর নেই, বৈষ্ণবীকে সাপে কাটার পর বৈষ্ণব সেই যে কাউকে না বলে কয়ে গেলেন। আখড়াবাড়ি ছেড়ে আর ফিরে এলেন না। বৈষ্ণবীর নিথর দেহ ছুঁয়ে বৈষ্ণবের সেই কান্নার ধ্বনি আমি যেন আজও শুনতে পাই। খোলের আওয়াজ, কর্তালের শব্দ আজও যখন বৈষ্ণবদের আখড়াবাড়িতে পাই তখন আমার এই দুইজন সুজনের কথা মনে আসে। মাধুকরী করতে এসে কখন যেন এঁরা আমার ঠাকুরদাদা-ঠাকুমা হয়ে উঠেছিলেন। বৈষ্ণবী আমাকে গাল ছুঁয়ে আদর করতেন। তাঁর স্নেহাশিষে আমি আমার ঠাকুমাকে পেতাম, যিনি আমার জন্মের আগেই চলে গিয়েছিলেন।