নবকুমার কৃষ্ণাকে ছেড়ে নতুন সঙ্গিনী জুটিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণা সে সময় মেয়ে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছিলেন। আমাকে তার দুঃখের কথা, সংগ্রাম জানিয়েছিলেন তিনি।
বলেছিলেন, জানো তো প্রথম-প্রথম প্রোগ্রাম হত না। সে নষ্ট করে দিত। তখন এখনকার মানুষটি পাশে না দাঁড়ালে ভেসে যেতাম আমি।
জানি কৃষ্ণা এখন সহৃদয় এক মানুষের দেখা পেয়েছেন। যিনি তাঁকে ঘর দিয়েছেন, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণার এখন বড় দল। বেশ কয়েকজন গায়ক বাউল, বাজনদার নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান আখড়া-মচ্ছবে, অনুষ্ঠানে। রেডিও টিভিতে অনুষ্ঠানের ডাকও পান তিনি। তাঁর মানুষটা যদিও বাউল সমাজের কেউ না। তবু আমি বলব কৃষ্ণার বিপদে তিনি তো যোগ্য মানুষের মতো পাশে দাঁড়িয়েছেন। গানই এখন কৃষ্ণার সাধনা।
যদিও গল্প রটে। সে গল্প কী আশাকরি কাউকেই বলে বোঝাতে হবে না। কিন্তু আশ্চর্যের! কৃষ্ণার পাড়াতে তাঁর যথাযোগ্য সম্মান রয়েছে। যখন প্রথম যাই খোঁজে, জানতাম নবকুমারের সঙ্গিনী কৃষ্ণা। সেইমতো একে-তাকে বলতেই সকলে একবাক্যে বলেছিলেন কৃষ্ণা তাঁর সাথে আর থাকেন না।
কে কাকে ছেড়েছেন অন্য প্রশ্ন। কৃষ্ণা কখনো কোনওদিন নবকুমার সম্পর্কে খারাপ কথা আমাকে বলেননি। আবার নবকুমারও নন। প্রথম-প্রথম তাঁকে বোধহয় কেউ ভুল বুঝিয়ে ছিল। বাউলের আগ্রহী মানুষ জেনে শেষে তিনি অদ্যাবধি মধুর সম্পর্কই রেখে চলেছেন।
মীরা মা সেদিন চড়া সুরে আমার সঙ্গে কথা বললেও বলেছিলেন, নাও বেলপানাটা খেয়ে নাও আগে। যা গরম। শরীর জুড়োবে। খাও আগে। ওসব পরে হবে। নিজে হাতে আমাকে বাতাস করেছিলেন তিনি একেবারে হাসে মুখে। তখন কোথায় তাঁর রাগ। একেবারে বাড়ির মা মাসিমা মনে হচ্ছিল তাঁকে। তিনি কাকা গোঁসাইয়ের সাধন সঙ্গিনী ছিলেন। শুনেছি গোঁসাই ছিলেন সিদ্ধ সাধক। দেহ রাখার পর মীরা মা তাঁর আশ্রমের দায়ভার নিয়ে আছেন। ভক্ত-শিষ্য সকলের মা তিনি। আখড়া করেন অগ্রদ্বীপের মেলায় প্রতি বছর। তাঁর আখড়া ঘিরে বিশিষ্ট বাউলদের সব জমায়েত হয়। আশ্রমে তত্ত্বকথা শুনিয়ে, সাধনার গান গেয়ে তিনি বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিন কাটান। বাউলের প্রচার-খ্যাতি ব্যাভিচার এসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই একেবারে। ভাবে মজে থাকেন। সেজন্য তিনি বর্তমান বাউল সমাজের যোজন হাত দূরে। তাই তাঁর বিশ্বাস এখনও কাকা গোঁসাইয়ের ভাবধারার। বাউলের অবক্ষয়, অবনতি এসবে তাঁর কলরব সেই এখনও প্রাচীন পন্থাতেই পড়ে। মেয়েরা সাধন সঙ্গিনী হয়ে সাধকের অতলস্পর্শকেই শুধু ছোঁবে। গান করবে কী! তাঁর মুখেই নবাসনের নির্মলা মার কথা শুনেছিলাম। মীরাকে মনে হয়েছিল নির্মলা মা’র প্রজ্ঞা নিয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি মাটিয়ারীর বটের ছায়ায়।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু?
রেগে উঠলেন মা।
কতটুকু মানে। মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।
মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তাঁরা সাধন সঙ্গিনীই কেবল?
বেশ রেগে উঠলেন মা।
কে বলেছে আবোল তাবোল?
বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।
বলতে দিলেন না মা।
বললেন, তা বস্তু উর্ধগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস, দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধগামী হবে শুনি! যত আজেবাজে কথা।
জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনোপুত হচ্ছে না মা’র।
বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।
মা’কে বলতে পারলাম না আমি, তা নয় করল, করে সাধক সিদ্ধ হল, নাম রটল তাঁর। তাতে হল কী সঙ্গিনীর? সে তো আর সিদ্ধ আসন পেল না। সে যে কেবল সাধন সঙ্গিনী। বুঝলাম মীরা দাপুটে বলে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু সবাই তো আর মীরা মোহান্ত নন, বা মীরার বলা নির্মলা মা নন, তাহলে তাঁদের অবস্থান। কি? আর সেই অবস্থান চিহ্নিত করতেই এখন মেয়েরা সাধক নন গানের সঙ্গে বসবাস করছেন। গান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। বাউলের ধার ধারছেন না। অনেক দিনের বঞ্চনার ফলে এটা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মীরা মা এসব আঁচ থেকে দূরে গুরুমা, মা গোঁসাইয়ের জীবনধারণ করছেন তাই মেয়েদের অসহায়তা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। তাঁর ভাব সাধক বাউলের যথার্থ সঙ্গিনীর ভাব। নির্মলা মারও তাই হবে মীরা মার মুখে যতটা শুনেছি সেই ভিত্তিতেই বললাম।
একদিন বেশ ঠাণ্ডা মেজাজে পেয়েছিলাম নবকুমারকে। গরিফায় এক অনুষ্ঠানে গাইবার আগে কথা চলছিল।
বললেন, আমাদের শরীরে তো নিয়ত চন্দ্রের চলাচল। চন্দ্র হল শীতলতা।
কীসের? জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
কীসের আবার, সিদ্ধির।
কীভাবে আসবে এই সিদ্ধি? বললাম।
চন্দ্রতত্ত্বে আসবে তা। শরীরের মধ্যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে। যুগলে অমাবস্যাতে এই সাড়ে চব্বিশকে ধরতে-ঘঁতে–জানতে-বুঝতে হবে। তারপর জোয়ার নামবে।
আর কিছু বলতে চাইলেন না নবকুমার।
বললেন, একদিন আসেন। সেখানে হবে খোন। এই হাটে-মাঠে তত্ত্ব হয়? হয় না।
ইতিমধ্যে ডাক পড়ল তাঁর। বাজনদাররা উঠে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। নবকুমার পায়ে ঘুঙুর জোড়া বাঁধতে বসলেন।
আমাদের ঝম ঝম চন্দ্রের ওখানেই ইতি হয়ে গেল।
*****