বাদশা সবই খুলে বললেন। তাঁর পিতৃ-পিতামহ পাঁচ-সাতজন বেগম নিয়ে দাপটে ঘরকন্না করেছেন, আর মাত্র দুটিকে নিয়েই তার হিমসিম অবস্থা। কালে কালে হল কি?
দরবেশ বললেন—বিষয়টা আপনার পূর্বপুরুষদের আমলেও খুব সহজ ছিল না। বেগম হল দিল্লিকা লাচ্ছু, যো খায়া ও হি পস্তায়া।
বাদশা চিন্তিতভাবে বললেন—তাহলে উপায়?
দরবেশ বললেন—আমাকে দিন তিনেক সময় দিন।
—বেশ। আপনি তবে আমার অতিথিশালায় থাকুন। খানাপিনা করুন, গোলাপজলের ফোয়ারায় আমার বাছা বাছা নর্তকীদের নৃত্য-গীত উপভোগ করুন।
—আমি দরবেশ। বিলাসব্যসনের ধার ধারি না। আপনার দারোয়ানের ঘরটিই আমার বিশেষ পছন্দ। আপনি ওখানেই আমার থাকার বন্দোবস্ত করুন।
অতঃপর দরবেশ রয়ে গেলেন দারোয়ানের ঘরে, আর বাদশাও দোনামোনা করে আবারও যাতায়াত শুরু করলেন শিশমহলে আর মোতিমহলে।
কিন্তু দুই মহলই নীরব। সেই রাত্রের তুমুল ঝগড়ার পর দুই শিবিরেই যেন গোরস্থানের শান্তি। চুনিবেগমের তার-ছেঁড়া রবাবে আর সুর ওঠেনা, মণিবেগমও বেসুরে সঙ্গীতচর্চা করেন না। রান্নাবান্না বাবুর্চিকে দিয়েই করান হয়, বলা বাহুল্য বাদশাহের সেসব মুখে রোচে না।
তারপর, রাত্রে শুয়ে দুই বেগমেরই ফিচির-ফিচির কান্না শুনতে হয়। বাদশা ‘কি হল কি হল’ করলে মণিবেগম ফোপাতে-ফোপাতে বলেন—কি আবার হবে? আমি নাকি তালকানি, পেঁচানি—ডাইনিটা কি বলল শুনলেন তো? অনুরূপভাবে চুনিবেগমও বলেন—আমি নাকি শয়তানী, হিংসুটি-মিথ্যেবাদি, পাজিটা কি বলল শুনলেন তো?
জেরবার হয়ে তিদিন পর্যন্ত কোনক্রমে ধৈর্য বজায় রেখে অবশেষে বাদশা দরবেশকে ডেকে পাঠান। দরবেশ সব শুনে বলেন—আরও তিনদিন দেখুন।
সেই তিনদিনেও অবস্থার কোন ইতরবিশেষ হয় না। শুধু দুই বেগমেরই চোখের জল শুকিয়ে গিয়ে শরীর-মুখ-চোখ কেমন কাঠ কাঠ হয়ে যায়। রাত্রে শিশমহলে শুতে গেলে মণিবেগম গুম হয়ে বলেন–আজ আমার কাছে যে? পথ ভুলে? আবার মোতিমহলে গেলে চুনিবেগম ভুরু টান করে বলেন—কাল যদি ওখানে, তবে আজ রাতে কেন এখানে?
ছ-দিনের মাথায় দরবেশ বলেন—এবার আমি দুই বেগমের সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলতে চাই।
বাদশা সেইমতই ব্যবস্থা করেন। আধঘণ্টা পর ফিরে এসে দরবেশ বলেন—হল না।
-কি হল না?
—আমার এই বাঁকানো লাঠিটি মন্ত্রপূত। এটি ছোঁয়ালেই আপনার চুনি হয়ে যেতেন মণিবেগম, আর মণি হয়ে যেতে চুনি।
-বলেন কি?
—কিন্তু চুনিবেগম বললেন, ওই ধুমসী হতে আমার বয়ে গেছে। দিন-রাত শুধু রাঁধবাড় আর খাও। ও কি মানুষের জীবন?
—আর মণি?
–বললেন, গান-টান আমার ভালই লাগে না। নেহাত বাদশার মন রাখতে একটু-আধটু গাই। বেঁধে-বেড়ে পুরুষকে খাওয়াতে কত সুখ!
—তাহলে উপায়?
–কাল বলব।
পরের দিন আবার দরবেশকে বেগমদের মহলে পাঠিয়ে বাদশা অধীর প্রতীক্ষা করতে থাকেন।
ফিরে এসে দরবেশ বলেন–ব্যবস্থা হয়ে গেল।
—কিরকম, কিরকম?–বাদশার আগ্রহ আর ধরে না।
–সপ্তাহে তিনদিন, শনি, রবি, সোম মোতিমহলে চুনিবেগম গানও গাইবেন আবার বেঁধেও খাওয়াবেন।
—চুনি করবে রান্না! আর সেই রান্না খেতে হবে আমাকে! এক-দু-দিন নয়, তিন-তিনটে দিন! মারা পড়ব দরবেশ।
-বিচলিত হবেন না। আমার এই যাদুদণ্ডটি ওঁর হাতে দুইয়ে দিয়ে এসেছি। ওই তিনদিন চুনিবেগমের হাতে আপনি অমৃতের স্বাদ পাবেন।
—আর মণি?
—মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি ওঁর গলায় সুর বিরাজ করবে। গানও শোনাবেন, বেঁধেও খাওয়াবেন।
–বলেন কি!
–জুম্মাবারে সংযম পালন করবেন। তবে সাবধান, দিন ভুল করবেননা, যেন। তাহলেই যাদুর খেল খতম।
—দাঁড়ান, দাঁড়ান, ঝালিয়ে নিই। সোম, মঙ্গল, বুধ চুনি … না না, কি যেন বললেন, শনি, রবি সোম মণি … না না … মণি তো নয়, চুনি …।
বাদশা চোখ বুজে কর গুণে দিনের হিসাব করতে থাকেন। ধাতস্থ হয়ে চোখ খুলেই দেখেন, আরেঃ! কোথায় সেই দরবেশ।
এরপর সেই বাদশা দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে আরও নানা দেশ জয় করেন। তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে বিজিত দেশের বহু রাজকন্যা তাকে দেহ-মন দুইই সমর্পণ করতে চান। বাদশা তাঁদের প্রত্যেককেই মিষ্ট হাস্যে আপ্যায়িত করে বলেন-তা হয়না সুন্দরী! ঘরে আমার দুই বেগম। শনি-রবি-সোম, আর মঙ্গল বুধ-বেস্পতি। সুন্দরীরা মনঃক্ষুণ্ণ হলেও বাদশার কথাকে রসিকতা ভেবে করতালি দিয়ে হেসে উঠে বলেন-বাঃ বাঃ, আপনার দুই বেগমেরই ভারি অদ্ভুত নাম তো!