—আজও আপনার জন্য আফগানি কাবাব বানিয়ে রেখেছি।—চুনিবেগম মধুর হেসে বললেন।
সর্বনাশ! সে আবার কেমন চিজ? বাদশা প্রমাদ গুণলেন। মুখে অবশ্য বললেন–বেশ তো, বেশ তো! তবে তার আগে তোমার গান শুনি।
চুনিবেগম রবাবে ঝংকার তুলে গান ধরলেন। অপূর্ব সেই সঙ্গীতসুধা উপভোগ করতে করতে বাদশা ঠোঁটে তুলে নিলেন সুরার পাত্র। এইভাবে রাত্রির প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হল, দেউড়িতে বাজল ঘণ্টা, আর শিশমহল থেকে মণিবেগমের বাঁদি এসে পর্দার আড়াল থেকে বলল—জাহাপনা, খানা তৈয়ার।
বাদশা কলে-পড়া ইঁদুরের মত চুনিবেগমের দিকে তাকালেন। বেগম যন্ত্রে ঝংকার দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন—বলো গিয়ে আজ সুলতান আমার এখানেই থাকেন।
এ-কথা শুনে বাদশাহের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার অবস্থা হল। সুরার প্রভাব একটু একটু করে কেটে এখন ক্ষুধার বেশ উদ্রেক ঘটছে। মাঝ রাতে এই ক্ষুধা দাবানলের আকার নেবে। বাদশা ভাবলেন, যা থাকে নসিবে, চুনিবেগম আফগানি কাবাব আনতে পর্দার আড়ালে অদৃশ্য হলেই তিনিও এই মোতিমহল থেকে অন্তর্হিত হবেন।
চুনিবেগম অবশ্য ওঠার কোন লক্ষণই দেখালেন না। সুরেলা গলায় বাঁদিকে কুম করলেন। তার মানে, বাঁদিই খাবার সাজাবে। এটিও বাদশার একেবারেই না পস। মণিবেগমের এসব কাজে বড় পরিপাটি। ইনি কিন্তু গতর নাড়াবেন না। রবাব কোলে তুলে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন—একটু সময় লাগবে। ততক্ষণ আপনাকে একটা ইরানি গজল শোনাই?
বাদশা আবারও উষ্ণীষ খুলে ফেললেন। বিননি করে ঘাম হচ্ছে। আধপেটা খেয়ে রাত কাটাতে হবে। তার ওপর চুনিবেগমের আর একটি বদভ্যাস আছে। আহারের পর সে পোষাক পাল্টায়, বাঁদিকে দিয়ে প্রসাধন সারে। ততক্ষণ পর্যন্ত বাদশাকে জেগে বসে থাকতে হয়।
চুনিবেগম চোখ বুজে পারস্যের গজল ধরেছেন, আর বাদশাও সেই ফাঁকে, পালানর পথ খুঁজছেন, এমন সময় একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। পর্দা সরিয়ে মোতিমহলে এসে দাঁড়ালেন শিশমহলের মণিবেগম। আর সুরের রাজ্যে অসুরের প্রবেশের জন্যই কিনা কে জানে, রবাবের তার গেল হঠাৎ-ই ছিঁড়ে এবং বাধা পেয়ে চোখ খুলে চুনিবেগম দেখলেন, তারই মহলের দরজায় দাঁড়িয়ে স্বয়ং মণিবেগম!
ঘোর বিপদ বুঝে বাদশা গলা-খাকারি দিয়ে বললেন—তোমার ওখানেই যাচ্ছিলাম … তবে … ইয়ে … মানে, পারস্যের গজল … তা তুমিও একটু শুনে যাও না?
মণিবেগম বাদশার কথায় ভ্রূক্ষেপও করলেন না। সোজাসুজি চুনিবেগমের দিকে তর্জনী তুলে কুমের সুরে বললেন—চুনি, ওঁকে ছেড়ে দাও।
রবারে তার ছিঁড়ে যাওয়ায় এমনিতেই চুনিবেগমের মেজাজ ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর মণিবেগমের খবর্দারিতে সুরেলা গলা তারসপ্তকে চড়িয়ে ভীষণ ব্বিক্তির সঙ্গে বললেন—ওরে আমার কে রে! বললেই হল, ছেড়ে দাও!
মণিবেগমের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল। তিনিও রণরঙ্গিনী মূর্তি ধরে সুরার পাত্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ভয়ংকর স্বরে বললেন—এসব ছাইপাঁশ গিলিয়ে বাদশার খিদের বারোটা বাজাচ্ছিস—তোর লজ্জা করেনা রাক্ষুসী?
চুনিবেগমও এক লাফে উঠে কোমরে ওড়না জড়িয়ে তেড়ে গিয়ে বললেন—আর তুমি যে রাবড়িতে সিদ্ধি মিশিয়ে সুলতানকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছ বলি, ভেবেছটা কি?
—বেশ করি। আমার মহলে সুলতান নিশ্চিন্তে ঘুমান।
—আহা! মরে যাই! আর আমিই বুঝি ওকে রাতে জাগিয়ে রাখি?
—সে তো ওঁর চোখের কোণে কালি দেখলেই বোঝা যায়। আমি সিদ্ধি মেশাই? তুই বিষ মেশাস। তোর ওই মদে বিষ মেশান থাকে।
—সেই বিষ পান করতেও সুলতান সকাল-সন্ধে আমার মহলে আসাই পছন্দ করেন। আর উপায়ই বা কি? ভেবেছ আমাকে টক্কর মারতে ওই হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে সুলতানের মন ভোলাবে? শয়তানি, হিংসুটি!
—শুনছেন, জাঁহাপনা শুনছে? মুখপুড়ি, ডাইনি!
–শুনছেন, জাঁহাপনা শুনছেন? আপনি কিন্তু আজ আমার এখানেই খেয়ে যাবেন।
–কক্ষনো না। সুলতান, একবার সাহস করে উঠে আসু তো? আমি আপনার জন্য কাশ্মীরী কোর্মা বানিয়ে রেখেছি।
—ওসব সুলতান মুখেও তোলেন না। আমি বানিয়েছি আফগানি কাবাব।
—সুলতান, খবর্দার ওর কথায় বিশ্বাস করবেন না। ও রান্নার কি জানে? বাবুর্চিকে দিয়ে রাঁধিয়ে নিজের বলে চালাচ্ছে। পাজি, মিথ্যেবাদি।
—তুমিই বা গানের কি জান? তালকানি, পেঁচানি!
—আমি না থাকলে সুলতান না খেয়ে মরতেন।
—তোমার ওই গান শুনে একদিন এমনিই মরবেন।
—তুই থাম।
—আমি কেন থামব? এটা আমার মহল।
—চো-ও-প!
—চোপরাও!
বলা বাহুল্য, সেদিন রাত্রে বাদশাহের আর আহার হলই না। চুনিবেগমের আফগানি কাবাব ছুঁচো আর ইঁদুরে খেল, মণিবেগমের কাশ্মীরী কোর্মাও গেল বেড়ালের পেটে। বিরক্ত হয়ে রাতটা বারমহলে কাটিয়ে পরের দিন সকালে আবার দরবারে এসে বসলেন তিনি। ক্লান্ত, চিন্তিত। আজও যে কি থেকে কি হবে!
এই সময় দ্বাররক্ষী এসে খবর দিল, একজন দরবেশ বাদশাহের সঙ্গে দেখা করতে চান। বাদশা তাকে হাতের মুদ্রায় হাঁকিয়ে দেবার ইঙ্গিত করতে রক্ষী বলল যে, দরবেশ নাকি তন্ত্রমন্ত্র জানেন, তিনি স্বপ্নে আদেশ পেয়েছেন বাদশা বড় মনোকষ্টে আছে, সেই কষ্টের যেন নিবৃত্তি হয়।
একথা শুনে বাদশার মনে কিঞ্চিৎ বিশ্বাস জন্মাল। তিনি দরবেশকে হাজির করার হুকুম দিলেন। দরবেশ একজন বৃদ্ধ। আলখাল্লা-পরা বৈশিষ্ট্যহীন চেহারা, হাতে একটি বাঁকানো লাঠি। তিনি এসেই বাদশাকে দরবার ফাঁকা করার অনুরোধ জানালেন। বাদশা সেই অনুরোধ রাখতেই দরবেশ বললেন—গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। দেখি, আল্লার ইচ্ছেয় যদি বিহিত করতে পারি।