—’ওসব কথা ছাড়ো।’–বাদশা গলায় জোর আনার চেষ্টা করেন। চুনিবেগম রান্নাবান্নার কিছু জানে না।
—’তাই বুঝি?’—মণিবেগম বিলোল কটাক্ষ হানেন। তারপর বলেন—’তা শিখে নিতে বলুননা সুলতান? আমি যদি গানবাজনা শিখি, তবে চুনিবেগমও রান্নাবান্না…’
‘আঃ! কি যে বলোনা! সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয় না।‘
—কেন হবে না? আমি যদি গাইতে পারি, তবে চুনিবেগমও রাঁধতে পারবে।
বাদশা মণিবেগমের শুধু মুণ্ডচ্ছেদ নয়, একেবারে কচুকাটা করেন। তবে সবটাই মনে-মনে। গরম হয়ে বলেন–দ্যাখো বেগম, দুপুরে খানাপিনার সময় এসব কথা কাটাকাটি আমার ভাল লাগেনা কিন্তু! বলি, নিজের জন্যও তো কিছু বেঁধেছ, না কি? তার থেকেই আমার খানার বন্দোবস্ত করো। দিবানিদ্রার সময় পার হতে গেল।
—অয় খোদা! কি যে বলেন! আমি আর এখন রাঁধি কোথায়? আমি তো শুধু গাই!
–তোবা, তোবা।–বাদশাহের পেটের আগুন তার চোখের তারায় ঝলসে ওঠে। নাঃ, এর চেয়ে দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়াও ভাল। ইস্পাহান প্রদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই একটা খিটিমিটি চলছে। এই ভরদুপুরেই বেরিয়ে পড়া যাক। পথের মাঝে দু-পাঁচটা সরাইখানা লুণ্ঠন করলেই খানার ব্যবস্থাটা হয়ে যাবে। ভাবতে-ভাবতেই বীররক্ত ছলকে ওঠায় এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়েন সম্রাট।
মণিবেগম কোন ব্যস্ততা দেখান না। গালে হাত দিয়ে চোখ বড়বড় করে বলেন—আরে, চললেন কোথায়?
এই ভর দুপুরে ‘দিগ্বিজয়ে’ বললে হাস্যকর শোনাবে, তাই বাদশাহের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় কোথায় আবার? মোতিমহলে!
—সে তো যাবেনই।’—মণিবেগমের গলায় বাদশাহের তলোয়ারের চেয়েও ধারালো ছুরি ব্যঙ্গের সুরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে।’–খাবেন এই বাঁদির মহলে, আর শোকেন চুনিবেগমের মোতিমহলে! তারপরেই গলার সুর পাল্টে তর্জনি তুলে কুমের সুরে বলে ওঠেন-বসুন! বসুন বলছি!’
সেই ধমক শুনে দিগ্বিজয়ী সুলতান অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখেন, পর্দার আড়ালে মণিবেগম অদৃশ্য, শুধু বেড়ালটা ধৈর্যের প্রতীক হয়ে পালোসের ওপর লেজ গুটিয়ে বসে তাকে যেন কিসের একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অল্পক্ষণ পরেই দেখা যায় বাদশা-বেগম তারিয়ে-তারিয়ে বাদশাহী খানা খেয়ে চলেছে, হাড়গোড় ছুঁড়ে দিচ্ছেন বেড়ালটার দিকে। আহারের প্রায় শেষভাগে হঠাৎ-ই স্বর্গীয় সুর ভেসে আসে। মোতিমহলে চুনিবেগম গান ধরেছেন। মণিবেগম বাদশাহের উসখুস ভাব লক্ষ করেন এবং সঙ্গে-সঙ্গেই তার পাতে হিন্দুস্থানের রাবড়ি ঢেলে দেন। ফলে, আহারের পর বাদশাহের আর নড়বার ক্ষমতা থাকে না। চুনিবেগমের গান শুনতে-শুনতে মণিবেগমের পাশে শুয়ে দিবানিদ্রার সুখ অনুভব করেন তিনি। ঘুম যখন ভাঙে, তখন চুনিবেগম থেমে গিয়েছেন, মণিবেগম সুর ধরেছেন। ‘ওহ্, অসহ্য’ বলে গটগট করে শিশমহল থেকে বেরিয়ে আসেন বাদশা, পেছনে মণিবেগম কটমট করে চেয়ে থাকেন।
সন্ধের পর দরবারের ঝামেলা মিটিয়ে মোতিমহলে এসে ঢোকেন সুলতান। সেখানে চুনিবেগম মুখ ভার করে বলেন-দুপুরে আজ এলেননা যে? কত করে গলা সাধলাম!
শুনে বাদশাহ মরমে মরে যান। চুনিবেগমের রঙও টকটকে ফর্সা, তবে মণিবেগমের মত গোলগাল চেহারা নয়। দোহারা গড়ন, মাথায় বেশ খানিকটা লম্বা, টিকালো নাক, পাতলা ঠোঁট, চঞ্চল দুই চোখ, রাজহংসী গ্রিবা। সেই গ্রিবা সামান্য বাঁকিয়ে রবাব বাজিয়ে যখন গান ধরেন চুনিবেগম, সে গান শুনেও সুখ, সে ভঙ্গি দেখেও যেন আর আশ মেটে না। হায়! দুপুরে আজ এই স্বর্গীয় সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাদশা। তিনি তো চলেই আসতেন, কিন্তু বাদ সাধল ওই হিন্দুস্থানের রাবড়ি। সুস্বাদু, যেন অমৃত! তবে খেলেই বড় ঘুম পায়।
–‘জানি, মণিবেগম আজ আপনাকে পেট পুরে খাইয়েছে।’—চুনিবেগমের পাতলা ঠোঁট অভিমানে কিঞ্চিৎ স্ফুরিত হল।
—না, না, তেমন কিছু … তবে শেষপাতে ওই রাবড়িটা…’ মুখ ফসকে বলেই ফেলেন বাদশা।
—ওসব খাবেন না। মণিবেগম ওতে সিদ্ধি মিশিয়ে রাখে।
–বলো কি?
—ঠিকই বলি। আপনি সরল মানুষ। গান-পাগল। ওসব মেয়েলি প্যাঁচ-পয়জার বুঝবেন না। মণিবেগমের বেড়ালটাকে দেখেননি? শুধু খায় আর ঘুমোয়। ওটাকে ওষুধ করেছে। আপনাকেও করার মতলবে আছে।
দিগ্বিজয়ী বাদশা এসব শুনে চমকে ওঠেন। উষ্ণীষ খুলে কেশবিরল মস্তকে দ্রুত আঙুল চালান। চুনিবেগম তো ঠিকই বলেছে! আজকাল প্রায়ই শিশমহলে খানাপিনার পর তার আর ওঠার অবস্থা থাকে না।
–‘তাহলে উপায়?’–বাদশা খুবই বিব্রত এবং অসহায় বোধ করেন।
—আমি আপনার জন্য সুর ও সুরা দুইই মজুত রেখেছি। এসব কি যথেষ্ট নয়?
বাদশা ধন্ধে পড়ে যান। সন্ধের পর থেকে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত এধ্ব খুবই ভাল, তবে মধ্যযামের পর খিদেয় ঘুম ভেঙে যায়। তখন চুনিবেগম কণ্ঠলগ্না হয়ে থাকলেও তার মণিবেগমের কথাই বেশি মনে পড়ে। ইচ্ছে হয়, বেগমের বেড়ালটি হয়ে রসুইখানায় সেঁধিয়ে যান।
গলা-খাঁকারি দেন সুলতান। তারপর বলেন—তুমি … ইয়ে … একটু রান্নাবান্না শেখোনা কেন?
আপনি কুম করলেই পারি। সেদিন রাত্রে আপনাকে মুগ্মসল্লম বেঁধে খাওয়ালুম না?
শুনে বাদশা কিঞ্চিৎ মুখবিকৃতি করলেন। সেই বিস্বাদ এখনও তার জিভে লেগে আছে। পরের দিনই মণিবেগমের মহলে গিয়ে জিভের স্বাদ ফেরাতে হয়েছিল তাকে। বাগে পেয়ে মণিবেগমও তাকে দু-ঘণ্টা ধরে কালোয়াতি শুনিয়ে দুরমুশ করে দিয়েছিলেন।