বাঁশফুলের জাউ রাঁধা হল প্রথম অতুলদের বাড়িতে। তাদের গাছে প্রথম ফুল ফুটেছে প্রথম ফল তো তারাই খাবে একটু তেতোই লাগে বাঁশজাউ, চিনি বা গুড় দিলে পায়েস, নুন দিয়ে ঘাঁটলে জাউ, দুর্ভিক্ষের মরসুমে কেউ দামি জিনস খরচ করতে চায় না। কিন্তু হায় ছোটবউ, দুর্ভিক্ষর কাছে নুন-চিনি একদর।
—তোমরা শান্ত হও, শান্ত হও।
জেলা পরিষদ থেকে ফিরে এসে অতুল সকলকে বোঝাতে লাগল।
–সরকার আর দুর্ভিক্ষ হতে দেবে না, পি এল চার শো আশির গম এনে তোমাদের খাইয়েছে আর আজ পারবে না। স্বয়ং জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বলেছেন—তোমাদের কোনও ভয় নেই।
লোকে কিন্তু শুনে এই বলে হাসাহাসি করল যে, সরকার কী দুনম্বর, এমনি হাসানোর দিনে যাদের কাঁদানো অভ্যাস তারা কাদানোর দিনে হাসি এনে দেবে, ওরে বাদ দে, মাঠে বুনে দে ও কথা।
দেখতে-দেখতে বাঁশফুলের কাছে বিজ্ঞান, জেলা পরিষদ সব তুচ্ছ হয়ে যায়, অতুল নিজে বিশ্বাস করল না, কাঁচামাচা ধান কাটতে লাগিয়ে দিল পরেরদিন থেকে। উচ্চফলনশীল ধানের নিয়মই হচ্ছে একসঙ্গে সব পাকে না, কিন্তু কী আর করা, যদি
শুকনো ডাঙায় বান ডাকে, যদি ঝড়-শিলাবষ্টি এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দেয়, বলা যায় না, শোনা যাচ্ছে রাজস্থানে পঙ্গপাল ননেমে পড়েছে ঝকঝক।
ধান সব তোলা হয়ে গেল, ঝাড়াই-মাড়াই হয়ে গেল দুদিনে, আচ্ছা তবু কেন এত ভয়, ভয় যে কিছুতেই সরছে না।
চন্দ্রা জিজ্ঞেস করছে অতুলকে—হ্যাঁ গো, আমাদের এত ধান উঠল, খামার ভর্তি, তবু আমরা খেতে পাব না?
–শনির দৃষ্টিতে গণেশের মাথা উড়ে গেছল, আর এ তো তুচ্ছ….
—ঘুরে পাশ ফিরে শুল অতুল।
–শুনছ!
চন্দ্রা পিঠে খোঁচা দিচ্ছে।
—পিঠ ঘুরে শুলে ভাল লাগে না, এই-এই! শোনো না।
হঠাৎ অতুল বলল—এসময়ে আমাদের ওটা না হলেই ভাল হত।
–কীটা?
–বাচ্চাটা।
পিঠের ওপাশে একটা বৃহৎ দীর্ঘশ্বাস পড়ল, ভীষণ গুমরানো হয়ে গেল চন্দ্রা। যেমন করে লোকে ঘাসের ওপর ভিজে সাদা ধুতি মেলে তেমনি করে চন্দ্রা নিজেকে একেবারে ফ্যাকাশে করে সে-ও পাশ ফেরে।
এর ঠিক তিনদিনের দিন কী করে যেন অব্যর্থ ফলে গেল অতুলের চাওয়াটা। অতুল যেটা চাইল সেটাই পেয়ে গেল! ইস, অতুল, তুমি বড় ব্যথার জিনিসটা চাইলে হে!
ও ঠিক মন্দারবুড়ির ওষুধ খেয়েছে। আর টিকবে কি না সন্দেহ, রাত পেরোবে কিনা…তিন মাসের পোয়াতি, এক হাতচেটো একটা ল্যাললেলে জ্যান্তো আঁথালের মতো মাংসপিণ্ড, লিচি-পাকানো আটায় বেশি জল পড়ে গেলে যেন হয়।
চন্দ্রা আছাড় খেয়েও পেট নামিয়ে নিতে পারে, ও যা মেয়ে, ওকে বলাটা ঠিক হয়নি, বলে ফেলেই অতুল বুঝে গেছল একটা মহা ভুল করলাম।
এত রক্তপাত ঘটেছে যে চন্দ্রা বিছানায় মিলিয়েই গেছে, সাতটা ডাকলে একবার চিচি করে সাড়া দেয়। ওদিকে যত বাঁশফুল ফুটছে, ফুলে-ফুলে ছেয়ে যাচ্ছে, এদিকে তত চন্দ্রার অবস্থার অবনতি হচ্ছে।
বাড়ির প্রত্যেকেই কিন্তু এক-যুক্ত-এক সমান দুই-এর মতো ধরেই নিয়েছিল চন্দ্রা মরছেই, ও যত চিকিৎসে করুক আর যাই করুক, বাঁশফুল ফুটেছে অথচ চন্দ্রা মরবে না এ হতেই পারে না।
মারিকবুড়ো অতুলের বাবা, অতুলের ডাক্তার দেখানোর জেদ দেখে রেগে। বলল—হুঁ, এভাবেই তো দুর্ভিক্ষ আসে, ধান-চাল বেচে মানুষ এভাবেই সর্বস্বান্ত হতে হতে একদিন দেখবে সব ঘর ঝাটিয়ে এলে কোথাও এক দানা খুদ নেই।
তার মা বলল—তা হলে তোর শশুরকে ডেকে পাঠা, তার কাছে তো এখনও সাড়ে সাত হাজার টাকা পাওনা আছে, মেয়ের অসুখের সময়ও যদি না দেয় তবে আর কবে দিবে!
বাবা বলল—দ্যাখ এসময় যদি আদায় করতে পারিস, না হলে তো…
না হলে মানে মেয়ে মারা যাওয়ার পরও কি আর কেউ পণের টাকা শোধ দেয়।
চন্দ্রার বাবা দেখতে এল মেয়েকে, মেয়েকে দেখল, বাঁশফুল দেখল। বনবিহারীবাবুও অভিজ্ঞ সংসারী মানুষ সে-ও জানে বাঁশফুলের ইতিহাস এবং কার্যকারিতা। মেয়েরে বিয়েতে আমবাগান বাঁধা পড়েছে এখনও ছাড়াতে পারেনি, এখন বাকি সাড়ে সাত হাজার দিতে হলে তাকে তাদের একমাত্র আয়-উপায় পান বেরোজাটাও বাঁধা দিতে হবে। সে, চন্দ্রার বাবা, বুড়োমারিকের সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে যায়না বেয়াই, আমিও কোনও আশার মুখ দেখছি না।
শ্বশুরকে বাসে তুলে দিতে নিয়ে যাচ্ছে অতুল সাইকেলে চড়িয়ে। অতুল শ্বশুরকে বলল বাবা বলছিল আপনার কাছে যে টাকাটা আছে সেটা চাইতে, টাকাটা পেলে বি ডি রায়কে একবার দেখতাম।
—তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আরও খানিক গিয়ে অতুল আবার জিজ্ঞেস করলনা, মানে..আর তো একদম দেরি করা উচিত নয়, তা হলে কালকেই…
সাইকেলের পেছনে বসেছিল অতুলের শ্বশুর তার মুখটা ঠিক দেখা গেল না, কিন্তু সে অত্যন্ত নিরাসক্ত গলায় বলল—কোনও লাভ নেই, বুঝলে কোনও লাভ নেই, এ হল ভগবানের মার।
অতুল শক্ত হ্যান্ডেল ধরেছিল এবার হাত দুটো নিজে নিজেই আলগা হয়ে যায়, আলরাস্তায় পেছনে ডবল নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছে, যদি…বড্ড টাল খাচ্ছে শ্বশুরসমেত অতুল।
.
৩.
চন্দ্রা সেই রাতেই বাঁশের ধন্নাতেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। এখন বাঁশফুল নির্মূল হয়েছে, কচি বাঁশও বেরিয়েছে, বাঁশঝাড় আগের মতোই ঘন সবুজ বাঁশঝাড়ে পরিণত হয়েছে, মারিকবুড়ো বাঁশতলায় বসে জাল বুনছে আর বারোশো ছত্রিশ বোরোধানের পাখি তাড়াচ্ছে। কিন্তু বাঁশফুলের কুফল সম্পর্কে এখন আর হাতিহষ্কার কারও কোনও সন্দেহ নেই। দেখলে তো চেখের সামনে এমন সুন্দর বউটা…