মহাশয়, আমাদের অঞ্চলের সমস্ত বাঁশঝাড়গুলিতে ফুল ফুটিয়া সাদা হইয়া গিয়াছে, ঝাড়ের বাঁশগুলি দেখিতে-দেখিতে শুকাইয়া মরুভূমিপ্রাপ্ত হইতেছে। এই দুষ্ট ফুলগুলি কেবল গাছগুলিকেই মারিয়া ক্ষান্ত হইতেছে না, চারিদিকে এক ভয়ঙ্কর ভয় ও ত্রাসের সৃষ্টি করিয়াছে।
মহাভারতের ভীষ্ম কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে বলেছিলেন বাঁশগাছে ফুল ফুটেছে কি না দেখো তো!
— পিতামহ, ফুল ফুটেছে।
–তা হলে আর কিছু করার নেই।
অধীনগণের বিনীত প্রার্থনা, আমাদের দরিদ্র গ্রামজীবনের অন্যতম সাথী এই বাঁশগুলিকে ফুল ফোঁটার হাত হইতে রক্ষা করিয়া এবং আমাদের ভয়-সন্ত্রাস দূর করিয়া স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সহায়তা করিয়া বাধিত করিবেন।
নিবেদন ইতি
কৃপাপ্রার্থী
হাতিহল্কা অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ।
নূরপুরের বাসনাবুড়ি অর্থাৎ ছোঁচার মা, অঞ্চলে সেই একমাত্র যে নিটে বাঁশফুল ফুটতে দেখল।
-তেরোশো পাঁচ সালে আমার তেখন কিশরি বয়স, মা’র সঙ্গে ধানরুয়া, তলাভাঙা শিখছি। হু, আমরা বাঁশচাল ভাজে খেয়েছিলুম গো, কী সোন্দর সরু সরু চাল, তবে বড্ড ভুয়া বেরায়, এক ঝড়া কুড়াই আনলে একপুয়া চাল। কিন্তু কী করব, তেখন যে আর কুথাও কিছু লাই।
ফোকলা মুখে হাসে বুড়ি—তু ভাগ্য বাঁশফুল ফুটেছিল, বাঁশচাল খেয়েই টিকে গেলাম।
—কিন্তু হ্যাঁ গো ছোঁচার মা, কদ্দিন পর আবার সব ঘুরে এল, বাঁশগাছ সব সেরে উঠল, আবার কচিপাত হল, মড়ক সরে গেল, দুর্ভিক্ষ সরে গেল, নদীর জল হল, কোকিলকবুত্র ডাকতে লাগল, তুলসীচারা রোল, পুকুরে মাছ হল, পদ্মফুল ফুটল…হ্যাঁ গো কদ্দিন পর আবার ঘ ঘুরাই পাইল পিখিবি, হা গো ছোঁচার মা!
—ঠিক মনে লাই রে…এক বছর, দেড় বছর, আড়াই…সঠিক মনে হচ্ছেনি, তবে আকাল বড় খারাপ বাপ, বড় খারাপ।
বুড়ির চোখ দিয়ে জল গড়ায়, বুড়ি হাঁপাতে থাকে।
এখন সাতানব্বই-এর আষাঢ় মাস চলছে এখনও ধানবোনা কি বীজতলা ফেলার মতোও মাঝারি বৃষ্টিটুকুও মাটি পায়নি। গায়ে গামছার বাতাস খেতে-খেতে প্রতিদিন সন্ধেবেলা সত্যি-সত্যি আর বৃষ্টিটিস্টি হবে না, না কি গো?
–আর বিস্টি!
–বাঁশের খোদ্দার পেলে?
—কে কিনবে, পাইকার এসেছিল সে বলছে, বাতা-জ্বালানির দামটুকু দিতে পারে, এ বাঁশ তো আর অন্য কোনও কাজে লাগবে না। ঝাড়পিছু দাম দিয়ে গেছে আড়াই শো টাকা।
অতুলদের সাত দুগুণে চোদ্দ শো, সাত অর্ধেক সাড়ে তিন, সাড়ে সতেরো শো, ব্যস বাঁশঝাড় উধাও, এমনি একদিন নিজের বুদ্ধিমতো নাইট্রোজেন মিশিয়ে মেটাসিড ছিটিয়েছিল অতুল কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।
—আরে শুনেছু অযবপুরে তিনজন মারা গেছে? একজন তো একেবারে জুয়ান, হঠাৎ…
—সে তো নাকি দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গেছে। —তা বল দিকি এতদিনের শক্ত দেওয়াল সে-ও আজ ধসে গেল।
যাবতীয় অভাব, যাবতীয় মৃত্যু বই বাঁশফুলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিশাল আকার ধারণ করে হাতিহায়।
পুরনো রেকর্ড বলছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে বাঁশফুল ফোটে, তেরো শো পাঁচ, উন পঞ্চাশ, সাতানব্বই। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করেছ সময়টা আগের চেয়ে কমেছে। আগের শতাব্দীর হিবে পাওয়া যায়নি, গেলে দেখা যেত যে সেব্যবধানটা ছিল ষাট-সত্তর বা তারও বেশি, এভাবেই হয়তো কমতে কমতে…
অঞ্চলের অন্দরমহলও এখন নানা রিহার্সেলে ব্যস্ত: ঘর সব ঝটিয়ে নিয়ে এলেও নাকি একমুঠো চাল থাকবেনি গো জেঠিমা, আটাও মিলবেনি একমুঠা, ছেপেনাকে কী করে বাঁচাব?
—টিপে টিপে চালা, আরও টিপেটিপে, সেই তো অনাহারে থাকতে হবে, অনাহারের চাইতে অর্ধাহার ভাল।
—হ্যাঁ গো ছোটপিসি, নাকি থইথই ব জল শুকিয়ে ঝামা ইটের মত শক্ত হয়ে যাবে? তা হলে আমাদের এই তালপুকুর?
ঘটিও ববেনি, দেখছু না কী হারে জল কমছে, কাল কাপড় কাচতে এসে দেখে গেছি বুড়া আশুদ মুড়ার কাছে জল, আর আজ পাথরের নীচে নেমে গেছে। অ্যাই, জলে কেউ ঢাপাসি করবিনি, এই একটু জলের জন্য হাহাকার পড়ে যাবে।
নদীতে জল থাকবে না, জলের জায়গায় শকুন মরা গোরু খাচ্ছে, নদীর বালি খুঁড়ে জল আনতে গিয়ে শকুন আর শকুনিদের ডানা ঝাঁপটানো, আনন্দ-বিলাস দেখে ভয়ে পালিয়ে আসছে পুরো হাতিহষ্কা অঞ্চলের কুলকামিনীরা!
মাঠে ঘাস নেই, কিন্তু নিটে ছাগল একটা বুড়ি গাই এখনও রয়ে মরেছে তিষ্টার মার। তিষ্টার জন্মানোর সময় ভীষণ পিপাসা বা তিষ্টে পেয়েছিল গোষ্টর বউয়ের, সেজন্য ছেলের নাম হয়ে গেল তিষ্টা। এখন একলার জান নয় অনেকের তিষ্টা নিবারণ করতে হবে তিস্টার মাকে। কিন্তু মাগো, আকাল হলে তো চাল-আটার আকাল, জলের আকাল হবে কেন? না রে বেটা, এ অন্য, এ হল ভগবানের দিবা আকাল, মানুষের দিবা হলে একটা দুটা কম পড়ে, এ হল তেনার দিবা, সবদিকটাই নিঙড়াই দেয়। বুড়া মরে গিয়ে ভালই বেঁচেছে, তাকে আর বাঁশফুল দেখে যেতে হলনি, তা তুমি আমাকে লও না গো তোমার কোলে তুলে, আমি যে আর বাঁশফুলের ভয়ে টিকতে পারছিনি।
বাশফুলের পায়েস বেঁধে খেতে হবে, তা হলে আর মড়ক-রোগ লাগবে না। কাগজে বেরোল। হয়তো কেউ আশ্বস্ত করার জন্য আন্দাজে বলেছে, তুব হাতিহষ্কার লোক শুনে বলল—কেন, বিজ্ঞানও হতে পারে, প্রকৃতির মধ্যেই থাকতে তার প্রতিষেধক। ফলে বাঁশতলা ঝাটিয়ে চাল কুড়নো প্রত্যেক সংসারের একটা নিয়মিত কাজ হয়ে গেল, যে যখন সময় পাচ্ছে ঝুড়ি আর ঝাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। বাঁশচালের ভালর দিক হল ওর খুব হালকা খোসা, সামান্য রোদে দিয়ে একটু ঘষে নিলেই ফরসা, বিজ্ঞানীরা নাকি বাঁশ চালের সঙ্গে ক্রশ করিয়ে সরাসরি চালগাছ তৈরির চেষ্টা করছ, এ-ও নাকি কাগজে বেরিয়েছিল। শুনে জায়ে-জায়ে টেপাটেপি হচ্ছে আর বলছে—সত্যি দিদি, চালগাছ হয়ে গেলে কী ভাল হয়, আমাদের আর তো রোদে গরমে ধানসেদ্ধ করতে হয় না, মাইরি দিদি, খেতে যাব আর ছুঁচে নিয়ে এসে সিদা হাঁড়িতে। কিন্তু নানা, বাঁশফুল কখনও ভাল স্বপ্ন দেয় না, সেই জন্মকাল থেকে আজ অবধি সে মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর ও প্রলয়ঙ্কর হিসেবেই চিহ্নিত।