বুড়োর গায়ে তখন থেকে কী ঝরঝর করে পড়ছে, টিয়ে তাড়ানো মানে খেতের মাঝে টাঙানো টিনের দড়ি ধরে দু-চারবার একটু নেড়ে দিতে হয়, টিনের ভেতরে একটা কাঠি আছে ধাক্কা লেগে অদ্ভুত শব্দ বেরোয়, মানুষ ছাড়া আর কেউ শব্দদূষণ সহ্য করতে পারে না, টিয়া পালায়। বুড়োর এই পাখি তাড়ানো, জাল সেলাই, ভেতরে-ভেতরে মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা, একসঙ্গে এত সব হচ্ছিল বলে অতুলের বাবা মারিকবুড়ো বাঁশফুলের রেণুর দিকে তাকায়নি। ঠিক তার মাথার ওপরে বাঁশের ডগায় নাকে তেলেঙ্গি নাকছাবির মতো একথোকা বাঁশফুল ঝুলছিল। বুড়োর পিঠে পিপড়ে চলছিল, ফেলতে গিয়ে হঠাৎ দেখল বাঁশফুলের রেণু, অনেক মানুষের গন্ধ শোঁকার অভ্যাস আছে, গন্ধ শুকল…প্রায় চল্লিশ বছর আগের একটা ভয়ঙ্কর চেনা জিনিসকে স্মৃতির গহন অন্ধকার থেকে তুলে আনা..অতুলের মা’র মৃত্যু হল তেরো বছর, মাত্র তেরো বছর মুখটা দেখেনি বলে সবচেয়ে বেশি বা বিশেষ-দেখা মানুষটাও কেমন আবছা হয়ে গেছে, এখন বুড়িকে দেখতে চাইলে তাকে বুড়ির ফোটোর কাছে যেতে হয়।
কিন্তু তবু বাঁশফুল চিনতে ভুল হল না মারিকবুড়োর, দশমাথা কার, রাবণ, এ কখনও কেউ ভুলবে, সীতা অযযাধ্যায় ফিরে এসে বিজনে রাজবালাদের সঙ্গে গল্প করতে করতেও অন্যমনস্কভাবে ধুলোয় দশটা মাথা এঁকে বসেছিল। মারিকবুড়োও বাঁশফুল ভোলেনি, সে জাল ফেলে আ-আ করে একটা অসম্ভব জোর ছাতি-বিদারক শব্দ করে দৌড়তে লাগল।
.
২.
মারিকবুড়ো লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল বাঁশফুলের থোকা।
বাড়ির সবাই তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে বেরোল, আর কাদেরও ঝাড়ে…এই শালা। বাঁশফুল, শালা বাঁশফুল…তা হলে কি শুধু তাদের সংসারেই…বাঁশফুল ফুটলে ধ্বংস অনিবার্য, দুর্ভিক্ষ মড়ক…প্রচণ্ড লণ্ডভণ্ড হতে লাগল অতুলদের সংসারে।
কে এমন কী পাপ করলে যে তার জন্য….
অতুলদের বাড়িতে পাপের একটা লিস্টও হয়ে গেল।
ঘোরতর পাপ ছাড়া তো এত বড় শাস্তি ধরণী দেয় না কাউকে!
চন্দ্রার অহঙ্কার বা দেমাকও এই লিস্টের অন্তর্ভুক্ত হল।
এবার যদি তার বসন্ত হয়, তার কী সুন্দর মুখ টোপাকুলের মতো গর্তে-গর্তে ভর্তি হয়ে যাবে, উঃ মা গো! আর শ্বশুরবাড়িতে যদি দুর্ভিক্ষ হয়, প্রখর রোদে তাকে যদি মাঠে ঘুঁটে-গোবড় কুড়োতে যেতে হয়।
আগের চেয়ে যত মানুষ বাড়ছে তত দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে, দীর্ঘশ্বাসে,দীর্ঘশ্বাসে যখন ছয়লাপ হয়ে যায়, যেমন জলকণা জমাট বাঁধলে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি, মেঘ বৃষ্টির মতো দীর্ঘশ্বাস আর পাপ—এও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসের পেছনে কোনওনা-কোনও পাপী-হাতের আক্রমণ থাকে, এভাবে হয়তো আগামী শতাব্দীতে বাঁশফুল ফোঁটার সময় আরও কমে আসবে, দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে, পাপ বাড়ছে, এদিকে বাঁশফুল ফোঁটার সময়ও তত কমে আসছে, চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের ব্যবধান ছিল সেটা কমে তিরিশ, হতে-হতে কুড়ি, পনেরো, দশ, তারপর হয়তো প্রতি বছরেই..না! অতুল চন্দ্রার দিকে এগোচ্ছিল মুখটা নিয়ে কিন্তু অসুস্থ লোকের গভীর কষ্টের আর্তনাদ করে বালিশে সেই জীর্ণ মুখটা গুঁজে দেয়।
দেখতে-দেখতে যখন অতুলদের বাড়ির সকলেই বাঁশফুলের ভয়ে ভীষণ আধখানা, তা অবশ্য মাত্র চারদিন ছিল, তারপর একদিন সকালে দেখা গেল অঞ্চলের সমস্ত বাঁশবন ফুলসম্ভারে সজ্জিত হয়ে সকলের নাড়ী শুকিয়ে দিয়েছে।
তেরোশো পাঁচ সালে বাঁশফুল ফুটেছিল, পাঁচ সালের ভয়ঙ্কর বন্যার ঠিক একটু আগে, তেরোশো উনপঞ্চাশে বাঁশফুল ফুটেছিল ঝড়বছর, আশ্বিনের প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের তার-একটু আগে, এবার, ফুটল তেরোশো সাতানব্বই বা উনিশশো নব্বই সালে। আমাদের আগের শতকের বাঁশফুলের খবর জানার উপায় নেই কিন্তু এই শতকের বাঁশফুল দু-দুবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সে অযথা-অযথা ফোটে না। বাঁশগাছই একমাত্র উদ্ভিদ যার ফুলের রহস্য এখনও কেউ ধরতে পারছে না, বাঁশগাছগুলো সব মরে যায়, ঝাড়তে ঝাড়, আর তাদের বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস সব শুষে নেয়—শস্যশ্যামল, নদী-জল,গোবৎসরা সব উলটে-উলটে পড়ে আছে নদীপাড়ে, চিল বসছে পুকুরের শুকনো পাঁকে, মরা পাকাল মাছ টেনে-টেনে বের করছে, শকুন উড়ছে আমবাগানের মাথায়, মারিকের পিসি দা দিয়ে বড় গেড়ি খুবলে বার করতে গেছল, সাপ বেরিয়ে পড়েছিল, তার পিসি সেই সাপের কামড়েই মারা যায়।
মারিকবুড়োও ভাবছিল অতুলের মা’র ওপর তারও কিছু কিছু নির্যাতনের পাপ থেকে গেছে। একবার গর্ভাবস্থায় তাকে দুডাং বসিয়ে দিয়েছিল, তা সে যেমন রি রিক বেলার সময়…কিন্তু যত যুক্তি থাক, ওটা পাপ। আচ্ছা, আজ তেরো বছর পর সেই পাপের ফলন এল। হতেও পারে, তারও তো কিছু পুণ্য ছিল, এতদিন তারই জোরে হয়তো..যাকগে আজ নিশ্চিন্তি, আজ সারা অঞ্চলের প্রত্যেকের বাঁশে ফুল ফুটেছে।
ফুল বললে একটা মায়াময়ী আকর্ষণ জাগে। কিন্তু বাঁশফুল বললে…যেন সেই ছবিটা-পার্বতীকাধে শিবের প্রলয়ঙ্কর নৃত্য, হাতিহষ্কা অঞ্চলের ছোট বড় একেবারে দুধের শিশুটি পর্যন্ত জেনে গেল একা মত্ত হাতি আসছে, পালা-পালা! যাগযজ্ঞ, খোলকীর্তন, শিব-শীতলার পুজোবলি তো হলই উপরন্তু ব্লকের মাধ্যমে নিউসেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এর কৃষিবিভাগে চিঠি লেখা হল :
মহাত্মন,
আমরা হাতিহষ্কা অঞ্চলের অন্তর্গত দাসপুর, জামালপুর, ঝরিয়া, ঋষা, জগন্নাথপুর, চাকতি ধানখণ্ডি প্রভৃতি আরও অসংখ্যা গ্রামের অধিবাসীবৃন্দ হইতেছি।