.
পরদিন রিয়া আবার শুভময়ের অফিসে ফোন করলো,–কেমন আছেন জামাইবাবু।
–এই চলে যাচ্ছে।
রিয়া স্পষ্ট বুঝলো জামাইবাবুর কণ্ঠস্বরে আজ কেমন যেন বেসুর বাজছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে রিয়া কায়দামতো একুট টোকা দিতেই শুভময় গড়গড় করে তার মনের সব অভিমান আর ক্ষোভের কথা উগরে দিয়ে বললো,—রিয়া তুমি ঠিক বলেছিলে, পাঁচ বছর সংসার করলেও স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে পুরোপুরি চিনতে পারে না। আমি তো ভাবতেই পারছি না…….
রিয়া মনে মনে হাসে। এর মানে খেলাটা ভালই জমেছে। কিন্তু সে কথা না বলে রিয়া ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, কি আর করবেন বলুন জামাইবাবু, আজকের দিনে স্বামী স্ত্রী সকলেরই স্বাধীনতা আছে নিজের ইচ্ছেমতো চলা। সতী সাধ্বীর সে দিনতো আর নেই…
শুভময় হঠাৎ কোন কথা বলে না। সে আধুনিক যুগের শিক্ষিত যুবক। রিয়া যা বলেছে তা সে অস্বীকার করে কি করে তার অনুপস্থিতিতে রনিতা যদি তার কোন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গতা দূর করতে চায় তার কি করার আছে। কিন্তু তবু………
—জামাইবাবু আপনার মনের ভাবনা আমি টের পাচ্ছি, টেলিফোনের ওদিক থেকে রিয়া বলে,—গুলি মারুন ওসব চিন্তায়, আজ চলুন, ছুটির পর আমরা একটা নাটক দেখে আসি।
–নাটক!
—হ্যাঁ। একাডেমি অফ ফাইন আর্টস। বহুরূপী একটা দারুণ নতুন নাটক নামিয়েছে।
কিছুটা মনের দুঃখ ভুলতে কিছুটা অভিমানের জ্বালায় রাজি হলো শুভময়। অফিস ছুটির পর সেদিন সন্ধ্যায় শ্যালিকার সঙ্গে সে গেল এ্যাকাডেমিতে নাটক দেখতে। শো শেষ হবার পর রিয়ার অনুরোধে একটা হোটেলে ঢুকলো। রাতের খাওয়াটা সেখানেই সেরে শুভময় যখন নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলো তখন রাজ এগারটা।
রনিতা খাওয়ার টেবিলে রাতের খাবার সাজিয়ে বসেছিল। শুভময় গম্ভীর ভাবে খেয়ে এসেছি বলে জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো।
বিস্ফোরণটা ঘটলো পরদিন।
শুভময় অফিস থেকে ফিরে দেখলো ফ্ল্যাটের দরজায় ভেত্র থেকে লক নেই। শুধু ভেজান রয়েছে। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ফ্ল্যাটের ভেতরে আলো জ্বালানো হয়নি। শঙ্কিত মনে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়লো সামনের ডাইনিং স্পেসে ডাইনিং টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে রয়েছে রণিতা। উস্কোখুস্কো চেহারা। চোখের কোনে কালি।
–রণিতা! কি হয়েছে তোমার?
রণিতা কোন কথা বলে না। যেমনভাবে বসেছিল, তেমনভাবেই চুপচাপ বসে রইলো।
এবার সত্যিই দূর্ভাবনায় পড়লো শুভময়। হঠাৎ নজর পড়লো রনিতার হারে সামনে পড়ে রয়েছে একটা টুকরো কাগজ। উঁকি মারতেই বুঝলো সেটা একটা চিঠি। শুভময় চিঠিটা হাতে তুলে নিল। তাতে মেয়েলি ছাঁদে কয়েক লাইন লেখা?
“শুভ,
সত্যিই আর পারছিনা গো, তুমি কথা দিয়েছিলে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু কবে আসবে সেইদিন, যেদিন সব বাধা ভেঙে তুমি আমায় একেবারে আপন করে নেবে। আর দেরি কোর না লক্ষ্মীটি।
ইতি।
তোমার সেই একজন”
শুভময় অবাক হয়ে চিঠিটা টেবিলের ওর নামিয়ে রাখতেই রনিতা বললো,–তোমার শার্ট লন্ড্রিতে দেবার জন্য পকেট হাতড়াতেই চিঠিটা পেয়েছি। পড়ে ফেলার জন্য দুঃখিত। আজই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।
—কোথায় যাবে? শুভময় প্রশ্ন করে।
—আমার মতো মেয়েদের শেষ আশ্রয় তো একটাই। বাপের বাড়ি।
—আগামীকাল সকালে গেলে হোত না।
–না। যত শীঘ্র সম্ভব তোমায় আমি মুক্তি দিতে চাই। সুটকেশ আমি গুছিয়েই রেখেছি। শুধু তোমার ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় রনিতা। তার সত্যি সত্যি ঘরের ভেতরে ঢুকে সুটকেশটা নিয়ে শুভময়ের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায়।
.
—এ তুমি কি করলে রিয়া! এ ভাবে যে তুমি আমার সংসারটাকে ভেঙে দেবে আমি ভাবতে পারি নি। বলতে বলতে শুভময়ের দুচোখ অশ্রুতে ভরে উঠলো।
রিয়া স্পষ্টতই অস্বস্তিতে পড়েছে। এতটা সে ভাবতে পারে নি। হ্যাঁ, গত পরশু রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে জামাইবাবুর সঙ্গে হোটেল থেকে ফেরার পথে চিঠিটা সেই শুভময়ের অজান্তে তার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সূত্র ধরে ব্যাপারটা যে এতখানি গড়াবে…….
গতরাতেই তার দিদিভাই রনিতা জামাইবাবুর ফ্ল্যাট ছেড়ে তাদের বাড়িতে চলে এসেছে এবং অনবরত কেঁদে চলেছে। দিদি যে জামাইবাবুকে সত্যিই কতটা ভালবাসে তা রিয়ার চেয়ে বেশি আর কে জানে!
আর আজ জামাইবাবুও অফিসে না গিয়ে সোজা এসেছেন তার অফিসে।
দুজনের পাঁচ বছরের ভালবাসার মধ্যে এই দাম্পত্য কলহের পাঁচিলটাতো সেই তুলেছে। কিন্তু রিয়া তো সত্যি সত্যি চায়নি তার দিদি জামাইবাবুর মধ্যে এই সাতদিনের মধ্যেই এমন একটা বিচ্ছেদ নেমে আসুক। সে তো একটা খেলা খেলতে চেয়েছিল মাত্র। সেদিন তার জামাইবাবু এই শ্যালিকাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলছিল পাঁচ বছরে তাদের স্বামীর স্ত্রী মধ্যে যে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে তা ভাঙার সাধ্য কারুর নেই, বিয়ের পর একদিনের জন্যেও দাম্পত্য কলহ হয় নি তাদের মধ্যে। রিয়া চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল। সে চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকাল। আজ সাতদিন পূর্ণ হয়েছে। তার মানে এ খেলায় জিতে গেছে রিয়া।
এবার আবার জোড়া লাগাতে হবে।
.
দিন রাত্রে রিয়া ফোন করলো সরাসরি শুভময়ের ফ্ল্যাটে।
শুভময় সেদিন আর অফিস ফেরত ক্লাবে যায় নি। বলতে কি তার দেহমন সে রাত থেকেই অবসন্ন হয়ে রয়েছে, যে রাতে রনিতা তাকে ভুল বুঝে বাপের বাড়ি চলে গেছে।