লেখার অভ্যেস নেই তাই খাতা খুলে হাতের কলমটার উপর থুতনিটা ভর করে আধঘণ্টা বসে থেকেও কোনও ফল হল না। এত চট করে হবে না। হাতে আরও দশ দিন সময় আছে। ধীরে সুস্থে ভেবেচিন্তে লিখতে হবে। বিষফুল…। নামটা দুবার আপন মনে উচ্চারণ করলেন জগন্ময়বাবু। বিষফুল…! এই নামের লেখা লোকে না পড়ে পারবে না।
.
২.
আজ আর বাইনোকুলারের দরকার হল না। সকাল সাতটার সময় ঢিবিটার কাছে পৌঁছে রাস্তা থেকে খালি চোখেই জগন্ময়বাবু যে মৃত প্রাণীটা দেখতে পেলেন সেটা হল একটা খরগোশ। মরা সাপের কঙ্কাল আর মরা গিরিগিটিও এখনও রয়েছে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়লে হয়তো জায়গাটা পরিষ্কার করবে এসে ভগওয়ান বা ভগওয়ানের বাপ।
জগন্ময়বাবু হিসেব করতে চেষ্টা করলেন গাছটা কত দূর হবে রাস্তা থেকে। বিশ হাত? পঁচিশ হাত? তাঁর একটা অদম্য ইচ্ছে একটু এগিয়ে গিয়ে গাছটাকে আরেকটু ভাল করে দেখার। পাঁচ হাতের বেশি কাছে না গেলেই তো হল।
কিন্তু ওই ছোঁকরার অনুমান যদি ভুল হয়?
যদি সাত হাত, আট হাত দূর পর্যন্ত ফুলের প্রভাব পৌঁছায়।
জগন্ময়বাবু ঘাসের উপর দিয়ে তিন পা এগিয়ে আবার পেছিয়ে এলেন। সাপ, খরগোশ, গিরগিটি। শুয়োর। পোকামাকড়ের কথা ছেলেটি বলেনি। ফড়িং পিঁপড়ে মশামাছি–এ সবই কি এই গাছের বিষে মরে? না ছোট জিনিস রেহাই পায়? আর বড় জিনিস? তাঁর লেখার জন্য এগুলো। জানা দরকার। আজ ছেলেটিকে দেখছেন না। একবার তার বাড়ি যাবেন নাকি? একটা ইন্টারভিউ করবেন তাকে–যেমন অনেককে খবরের কাগজে করে?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই মনে হল–তাড়া নেই, সব হবে। ধীরে সুস্থে, ধীরে সুস্থে। হাতে আরও সাতদিন সময়।
এখানে জলটা ভাল, তাই খিদে হয় প্রচুর। ব্রেকফাস্টের কথা চিন্তা করতে করতে জগন্ময়বাবু বাড়ি ফিরলেন। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা বিশাল কম্পাউন্ড। দুটো কাঠের গেট, একটা পশ্চিমে, একটা উত্তরে।
উত্তরের গেটে–যেটা দিয়ে জগন্ময়বাবু এখন ঢুকলেন–এখনও একটা কাঠের ফলকে মূর সাহেবের নাম রয়েছে। গেট থেকে সোজা রাস্তা দিয়ে কটেজের সামনের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বড় বড় গাছগুলো, যেগুলোকে পবিত্রবাবু শিশু বললেন, সেগুলো কটেজের পিছনদিকে। এদিকে দক্ষিণে যে দুটো বড় গাছ রয়েছে সেগুলো শিশু নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু সেগুলোর নামও জগন্ময়বাবু জানেন না। এর মধ্যে যেটা দূরের গাছ, সেটার ডালপালাগুলো প্রায় সাদা আর বেশ ছড়ানো। গুঁড়িটা কালো হলে হয়তো আরও সহজে চোখে পড়ত, কিন্তু সাদা হওয়া সত্ত্বেও, খুব বেশি দূরে নয় বলে গুঁড়ির পাশের চেনা গাছটা জগন্ময়বাবুর দৃষ্টি এড়াল না।
সেই একই গাছ, একই বিচিত্র ফুল।
বিষফুল!
জগন্ময়বাবুর পেট থেকে খিদেটা ম্যাজিকের মতো উবে গেল।
এ গাছ কাল ওখানে ছিল না। জগন্ময়বাবু ওই সাদা গুঁড়িটা থেকে হাত দশেক দূরে বনোয়ারিকে দিয়ে ডেক চেয়ারটা আনিয়ে তাতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। তখন তাঁর কোনও কাজ ছিল না, কেবল শরৎকালের মিঠে রোদটা উপভোগ করা। তাঁর চোখ তখন চতুর্দিকে ঘুরছে, এমন কী সাদা গুঁড়িটার দিকেও। এটা মনে আছে, কারণ জগন্ময়বাবুর তখন মনে হয়েছিল গুঁড়িটার রঙের সঙ্গে ইউক্যালিপটাসের গায়ের রঙের মিল আছে। ওই আরেকটা গাছ ওঁর চেনা। ইউক্যালিপ–
ওটা কী?
একটা পাখি।
খয়েরি রং–মাথা থেকে ল্যাজের ডগা অবধি। শালিকের চেয়ে ছোট। পাখিটা মাটিতে খুঁটে খুঁটে কী জানি খাচ্ছে, আর মাঝে মাঝে খাওয়া থামিয়ে মাথা তুলে চিড়িক চিড়িক ডাকছে। ওই ফুলগাছটার হাত দশেকের মধ্যে। এবার দুটো ছোট্ট লাফ মেরে পাখিটা ফুলগাছটার দিকে আরও এগিয়ে গেল। জগন্ময়বাবু আর অপেক্ষা না করে সজোরে দুটো তালি মারলেন। পাখিটা তীক্ষ্ণ শিস দিতে দিতে উড়ে পালিয়ে গেল। জগন্ময়বাবু হাঁফ ছাড়লেন। কিন্তু গাছটা তো রয়ে গেল।
ওটার একটা ব্যবস্থা করা যায় না? সামনে রাস্তায় অনেক ঢেলা পড়ে আছে।
একটা ঢেলা হাতে তুলে নিয়ে জগন্ময়বাবু গাছটাকে তাক করে নিক্ষেপ করলেন। গাছটা থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। লেগেছে। কিন্তু কোনও ফল হবে কি একটা ঢিলে?
জগন্ময়বাবু অনুভব করলেন যে তাঁর মাথায় খুন চেপেছে। পর পর ত্রিশটা ঢেলা মারলেন গাছটার দিকে। কোনওদিন ক্রিকেট খেলেননি, তাই বোধহয় অর্ধেক ঢেলা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল; কিন্তু বাকিগুলো লাগল। গাছটা নুয়ে পড়েছে।
উয়ো ফির খাড়া হো যায়গা বাবু।
ভগওয়ান। গেটের বাইরে বই হাতে দাঁড়িয়ে দেখছে, মুখে মৃদু হাসি!
হোক্ গে খাড়া, বললেন জগন্ময়বাবু। কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত।
ভগওয়ান চলে গেল।
ঘটনাটা যে চৌকিদার আর মালিও দেখেছে সেটা বাংলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বুঝলেন জগন্ময়বাবু। বোঝাই যাচ্ছে দুটোই অকর্মার চেঁকি। তাঁকে একটু হেল্প করতে পারল না এগিয়ে এসে?
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে মনে হল যে চৌকিদার আর মালির এই যে নিস্পৃহ ভাব, তার জন্য হয়তো উনি নিজেই কিছুটা দায়ী। এখানে এসেই বোধহয় ওদের দুজনের হাতে কিছু আগাম বকশিশ গুঁজে দেওয়া উচিত ছিল। মালি তো স্টেশনে গিয়েছিল ওকে আনতে। মিসেস মুর টেলিগ্রামে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কুলির বদলে উনি মালির পিঠেই মাল চাপিয়েছিলেন। একটা সুটকেস, একটা বেডিং, একটা বড় কল-লাগানো ফ্লাস্ক। নিজের হাতে নিয়েছিলেন কেবল ছাতা আর বোনের দেওয়া এক হাঁড়ি মিষ্টি। বাংলোয় পৌঁছে উনি মালির জন্য দুটো টাকা বার করেও আবার পকেটে রেখে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন–যাবার দিন পুষিয়ে দেব; আগে দেখি না ব্যাটারা কীরকম কাজ করে।