- বইয়ের নামঃ লোটাকম্বল
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.০১ যাত্রা শুরু
প্রথম খণ্ড
অবতার বরিষ্ঠায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ
মাতাজী
পরমারাধ্যা
ব্রাজিকা মোক্ষত্রণার
শ্রীচরণকমলে
.
যাত্রা শুরু
এ আমার আত্মজীবনী নয় তবে আত্মজীবনীর মত করে লেখা অসংলগ্ন প্রলাপ। বস্তু আছে কি না জানি না তবে বাস্তব কিছু থাকতে পারে। পৃথিবীতে অনেকেই অনেক কিছু করতে আসে। আমার স্কুলের প্রধানশিক্ষক মশাই ক্লাসে এসে প্রায়ই বলতেন, ওরে এসেছিস যখন তখন দেয়ালে একটা। আঁচড় রেখে যা। স্বামী বিবেকানন্দ, যুগাবতার রামকৃষ্ণ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, হুড়হুড় করে একগাদা নাম উচ্চারণ করতে করতে রবীন্দ্রনাথে এসে স্তব্ধ হয়ে যেতেন। চোখ ছলছলে হয়ে উঠত। তারপর চটাক করে সেই চটকা ভেঙে শেষ বেঞ্চের কোণের দিকে বসে থাকা শম্ভু সাঁতরার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলতেন, অ্যায়, উঠে দাঁড়া। শম্ভ কলের পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াত। ইংরিজি কর, রামেরা দুই ভাই। শম্ভ বারকতক রাম নাম করে চেত্তা-খাওয়া ঘুড়ির মতো একপাশে কেতরে পড়ত। সেই বয়েসেই বুঝেছিলুম, ত্রেতায় রাম নামের যথেষ্ট পাওয়ার থাকলেও কলির শেষপাদে একেবারেই শক্তিহীন; কারণ এর পরেই হেডমাস্টারমশাই শম্ভুর পিঠে লিকলিকে বেত দিয়ে সপাসপ আঁচড় কাটতে শুরু করেছেন। এরপর ওই রাম তার যোগ্য ভ্রাতাকে নিয়ে ইংরিজি হবার জন্যে ঘুরে ঘুরে আমাদের সকলের কাছেই আসছে আর আমরা যথারীতি বেত্রাহত হয়ে আঁচড়-কাটা মহাপুরুষ না হয়ে আঁচড়-খাওয়া মানবসন্তান হয়ে নেতিয়ে নেতিয়ে পড়ছি। একটি প্রশ্ন এবং পর্যায়ক্রমে ক্লাসের বড়, ছোট, দামড়া ষাটজন মনুষ্যশাবককে পেটাতে পেটাতেই সময় কাবার হয়ে যেত। টেবলের ওপর বেত ফেলে দিয়ে হেডমাস্টারমশাই কোঁচার খোঁটে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে দিনের শেষ কথাটি বলতেন, তুমি যখন এসেছিলে, তখন তুমি কেঁদেছিলে জগৎ হেসেছিল, তুমি যখন যাবে হাসতে হাসতে যাবে, আর সারা জগৎ তোমার জন্য কাঁদবে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে দুটি বাতাসা বের করে তিনি মুখে ফেলতে-না-ফেলতেই স্কুলের দারোয়ান এসে বেত, ডাস্টার আর মোটা ডিকশনারিটা তুলে নিয়ে চলে যেত। কাঁধে চাদর ফেলে আমাদের প্রধানশিক্ষক উঁচু প্ল্যাটফর্ম থেকে সাবধানে নেমে আসতেন, তারপর আপন মনে আঁচড় কেটে যা আঁচড় কেটে যা বলতে বলতে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতেন। আমরা সদলে ডোরা কাটা জেব্রার মতো বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতুম দাগ রেখে যাওয়া ব্যাপারটা কত সহজ! কিছুই না, একটা বেত আর মনুষ্যরূপী গাধাদের কালো-সাদা পিঠ আর একটি প্রশ্ন। এই তিন মালকে মেলাতে পারলেই মহাপুরুষ। মার খেতে খেতে শম্ভু সত্যিই মহাপুরুষ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলে তার পিঠের আর কোনও সাড় নেই। মারলেও লাগে না। কানমলার চোটে ডান কান বাঁ কানের চেয়ে দু’সুতো লম্বা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে সাচ্চা সাধুর মতো সবসময় শালা বেরোচ্ছে।
পেটাই হতে হতে পেটাই হতে হতে, জলছাত তৈরি হয়। গোটা কুড়ি পাঠঠা মেয়েমানুষ জলের আরক ছিটোয়, পিচিক পিচিক করে খইনির থুতু ফেলে আর কাঠের মুগুর দিয়ে পেটাতে থাকে যদ্দিন না পেটাইয়ের কাঠ তড়াং তড়াং করে লাফিয়ে ওঠে। এইভাবে হিট প্রুফ, ওয়াটার প্রুফ ছাদ তৈরি হলেও অভিমানশূন্য মানুষ তৈরি হয় কি? কেরিয়ারও কি তৈরি হয়? হলে আমি সত্যিই মহামানব হয়ে যেতুম। ওটা আলাদা ব্যাপার। আমার সম্পর্কে একদিন একটি মন্তব্য শুনে বড় মুষড়ে পড়লুম। হাজারবার ধুলেও কয়লা সাদা হয় না। পেতল মাজলেও সোনা হয় না। মানুষ নিয়ে আসে। অদৃশ্য একটি পুঁটলি নিয়ে কুঁজো হয়ে অন্ধকার রাতে মাতৃজঠরে মুক্তোর পেটে স্বাতী নক্ষত্রের জলের মতো ঢুকে, ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তারপর একদিন অয়েলক্লথে ওঁয়া ওঁয়া করে গড়িয়ে পড়ে। গর্ভে মহাপুরুষ এলে মায়ের জ্যোতি বেড়ে যায়। শেষরাতে পিতা স্বপ্ন দেখেন, আষ্টেপৃষ্ঠে বটের ঝুরি জড়ানো ভগ্ন দেউল থেকে জ্যোতিষ্মন এক দেবশিশু বেরিয়ে এসে বলেন, আমি তোর কাছে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পিতার ঘুম ভেঙে যায়। স্বেদ, কম্প, পুলক প্রভৃতি দেখা দেয়। তিনি মাকে ঠেলা মারতে মারতে বলতে থাকেন, ওগো, শুনছ শুনছ, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। শেষের দিকে আনন্দে গলা ভেঙে আটরকম শব্দ বেরোতে থাকে। আগমন সংবাদ অকটেভে খেলে বেড়ায়। ঘুম-চোখে মা হয়তো জিজ্ঞেস করেন, কে আসছে গো? পিতা মশারির মধ্যে গাট হয়ে বসে ভাবাশ্রু বর্ষণ করতে করতে বলেন, যেসাস হতে পারেন, কৃষ্ণের অবতার হতে পারেন, স্বয়ং মহাদেব হতে পারেন। কে বলতে পারে, সময়ের ঘূর্ণনে দ্বিতীয় শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হচ্ছে কি না! ক্ষুদিরাম তোতা এইভাবেই গদাধরকে পেয়েছিলেন। জগন্নাথ পেয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যকে। মায়ের খাতির অমনি বেড়ে যায়। মহাপুরুষের ডিম্ব ধারণ করেছেন। অলৌকিক জ্যোতি দেখা দিয়েছে লৌকিক শরীরে। যৌথ পরিবারের ছাদে ভাদ্রের চাদি-ফাটা রোদে বসে বসে বড়ি কি কয়লার গুল আর দিতে হবে না। বাগানের পাঁচিলে থ্যাপাক থ্যাপাক করে ঘুঁটে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তলব করা হল। তাঁরা প্রত্যেকেই একবাক্যে ঘোষণা করলেন, এ বস্তুটির আবির্ভাব-মুহূর্তে ছোটবউদির চেহারায় কোনও অলৌকিক পরিবর্তন আসেনি। স্বপ্ন একটা দেখেছিল মনে হয়, বাবা পঞ্চানন ষাঁড়ের পিঠে চেপে আসছেন। পঞ্চাননতলার পঞ্চানন? সে দেবালয় ভেঙে কালের গর্ভে চলে গেছে। তা ছাড়া বাবা পঞ্চাননের তেমন দেবমর্যাদা ছিল না। পূজারি বেচারা গাঁজায় দম মেরে মেরে অকালেই দমহারা হয়ে পরপারে। মনে পড়েছে, তিন বছর বয়েসে ওকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে মাথা ন্যাড়া করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরেই পুঁয়ে পেয়ে ছেলে শুকোতে লাগল। সাত সমুদ্রের কডলিভার মালিশ করে করে মালিশ করে করে, রোদে ফেলে রাখা হত ধুতি চাপা দিয়ে। কী বরাত! যে বয়েসে শিশু কোলে কোলে, বুকে বুকে ত্যাত্যা, ব্যাব্যা করে বেড়াবে, গোলগাল মোটা মোটা হাতের কচি কচি আঙুল দিয়ে নাক খামচাবে, চশমা ধরে টানবে, সেই বয়েসেই অস্পৃশ্য মৎসগন্ধ হয়ে দাওয়ায় পড়ে রইল। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে কাছে এগোতে হত, এই যে আমার বাবুটা, এই যে আমার ব্যাবাটা। মুখে শিশুর স্বর্গীয় হাসি ছিল না। নাড়গোপালের মতো হামা ছিল না। কোমরের লাল ঘুনসিতে তামার ফুটো পয়সা কাপ হয়ে বসে ছিল না। সংসারের চাতালে এক দুঃস্বপ্নের আবির্ভাব। তিমিরে কডলিভার-মর্দিত তিমিশিশু। হাতে তার গুনচুঁচ। তবিল ফুটো করে সব সঞ্চয় লিক করিয়ে দিলে। এ মহাপুরুষ হল চৌবাচ্চার সেই বিখ্যাত ছেদা। যাঁর আগমনে সংসারটাই ড্যামেজ হয়ে গেল।
পুত্রের জন্মে পিতার ভূমিকা কী আমার জানা হল না। তবে মা আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে-থাকা। মাতুল বংশের অবদানে আমি যে একটি গেঁজে যাওয়া পদার্থ এ সত্যটি পাকেপ্রকারে নানাভাবে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা হয়েছিল। ওই যে তোমার কাঠামো, ওটা তোমার মামার দিকেই গেছে। বাপু। এ বংশে কারুর বত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি ছিল না। মিনিমাম ছত্রিশ, ম্যাক্সিমাম ছেচল্লিশ। হাতের কবজি কারুর অমন পাকাটির মতো ছিল না। ঘড়ি পরবে কী? পরতে হলে বাজুবন্ধ করে পরতে হবে। অমন সখীমার্কা চুল ওই বংশেরই পেটেন্ট করা জিনিস। বকের মতো লম্বা ঘাড়। ঘোড়ার মতো মুখ। ও মুখে আর ও মাথায় বাস্তব বুদ্ধি থাকতে পারে না। ইমোশন, সেন্টিমেন্ট, ক্রোধ এইসবই ভ্যাট ভ্যাট করছে। অহংকার, আলস্য, ঈর্ষা যাবতীয় তমোগুণে শরীর পাকতেড়ে। এরপর একটি ইংরেজি বাক্যে আমার চরিত্র সম্পূর্ণ, হি ইজ গুড ফর নাথিং। ওকে একটা নরম বিছানা আর গোটাকতক তুলতুলে বালিশ দাও, ঘুমিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিক। অগ্নিতে ঘৃতসংযোগের লোকের অভাব সংসারে হয় না। তারা কুটুস কুটুস করে বলতে লাগলেন, ওর মায়ের লিভারটা কমজুরি ছিল তাই গায়ে গত্তি লাগে না। ওর মায়ের সর্দিকাশির ধাত ছিল, টনসিল ছিল, তাই বারো মাসই হাঁচি কাশি সর্দি লেগেই আছে। এই যার স্বাস্থ তার জন্যে সংসার নয়, স্যানাটোরিয়ামই উপযুক্ত স্থান। মা ঊর্ধ্বলোকে পালিয়ে বেঁচেছেন, আমি পালাতে পারিনি। ফ্যাস্তা কলে পড়ে ফেঁসে গেছি। মায়ের জন্যে মাঝে মাঝে বড় কষ্ট হয়। রোজই একটা না একটা কারণে তাকে নামানো হয়, আর তার অপদার্থ সন্তানকে উপলক্ষ করে বাক্যবাণে এফেঁড়-ওফেঁড় করে আবার ওপর দিকে তুলে দেওয়া হয়।
আমার মরুভূমিতে মরূদ্যান ছিল না, ছিল মরীচিকা। সকলের মুখই কঠিন কঠোর। নিজের মুখ যতই বিষণ্ণ করি না কেন অন্যের মুখে স্নেহের নরম ছায়া নামে না। একটু ভালবাসা কোথায় পাওয়া যায়? গোকুলে নিশ্চয় কেউ বাড়ছে যে এই অধমকে ভালবাসবে। কল্পনায় সেই মুখটিকে পোস্টারের মতো বুকে সেঁটে একদিন খুব আবেগের গলায় গাইছি, বাঁকা ভুরু মাঝে আঁকা টিপখানি; কীভাবে জানি না, আমার সেই আবেগ চর্চা পিতৃদেবের কানে গিয়ে পৌঁছোল। তিনি রায় দিলেন, ছোকরা সঙ্গী খুঁজছে। হরমোন সিক্রিশনের এই তো বয়েস। তা বাপু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটি বাঁকা ভুরু খুঁজে নিলেই হয়।
কে বোঝাবে ও গান হর্মোন গাওয়ায়নি। চৈত্রের খাঁ খাঁ দুপুরে কাঠঠোকরা যখন সশব্দে নারকেল গাছ ফুটো করে, ঘুঘু যখন নির্জন বাগানে দুপুরকে উদাস করে তোলে, ঘাস-জ্বলা মাঠে গাভী যখন কষ্টের হাম্বাস্বরে বোঝাতে চায় বড় কষ্ট, বড় কষ্ট, তখন মনে একটু বিরহের সুর.আসতেই পারে। তাতে শরীরস্থ গ্ল্যান্ডের কোনও কারসাজি নেই। কথা শুনে মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। বিদ্যে যদুর হয়েছে তন্দুর ভাল। আর না। এবার ভাগ্যান্বেষণ। একটা কিছু হতে হবে। হয়ে দেখাতে হবে, আমিও হতে পারি।
আমি যা হতে পারি তার একটা ছবি বেশ ভালভাবেই আঁকা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার হতে পারব না, বড়ই দুর্বল। অঙ্কে মাথা নেই। যার সরল করো-র উত্তর বেরোয় ন’হাজার সাতশো সত্তর বাই আঠারোশো ছত্রিশ, তার দ্বারা ব্রিজ বানানো কি ড্যাম তৈরি অসম্ভব ব্যাপার। ও ওই চুল উলটে মিনমিনে গলায় সখী সংবাদ করুক। বড় ইচ্ছে ছিল ফ্যামিলিতে একজন ডাক্তার হোক। বিধানচন্দ্র কি নীলরতন না হোক আমাদের ভুজঙ্গভূষণের মতো হলেও চলত। রাতবিরেতে কারুর শরীর খারাপ কি আত্মীয়স্বজনের ডেলিভারি কেস। হায় ভগবান! সে গুড়ে বালি। যে-ছেলে রক্ত দেখলে অক্ত অক্ত করে লাফায়, রাস্তায় বলহরি শুনলে একলা ঘরে শুতে পারে না, ভূত দেখে, সে হবে ডাক্তার! ওর ওই চুল উলটে চোখ বড় বড় করে, রে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোরই ভাল। এর বেশি কিছু আশা করাই অন্যায়। আইনের জগতে রাসবিহারী, সেও কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়। মেটাল দেখলেই বোঝা যায় ধারালো কিছু হবে কি ভোতা কোদাল হবে। যে লোক দেখলে লাজুক হেসে তোতলাতে থাকে তার পক্ষে সেলসম্যান হওয়াই অসম্ভব, বাঘা ব্যারিস্টার তো বহু দূরের কথা। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ফোড়ন কাটলেন, ধাতু দৌর্বল্য। অভিভাবক মেনে নিলেন, হতে পারে, নরানাং মাতুলক্রম। টাইপ আর শর্টহ্যান্ড শিখতে বলো, মাস গেলে যা হোক তিন-চারশো হবে। ওইতেই বাঁকা ভুরু হবে, আঁকা টিপ হবে। আমাদের সব স্বপ্ন ওই ছোকরা ভেস্তে দিলে।
কী হতে পারব না যখন স্পষ্ট, কী হতে হবে তাও যখন নির্দিষ্ট, তখন একটা নতুন পথ বেছে নিতে হবে। দেখিয়ে দোব, কোন পথে কে চলে। পৃথিবীটা ভোদকা মানুষে ছেয়ে গেছে। চওড়া চওড়া বুক, মোটা মোটা কবজি, ভুড়ি, কলাগাছের মতো উরু, থামের মতো ঠ্যাং। এক একবারে পাহাড়প্রমাণ ভাত উড়ছে, পাঁঠার ঠ্যাং, ডবল ডিমের ওমলেট। ঢক ঢক করে জল খাওয়া, ঢেউ ঢেউ ঢেঁকুর তোলা, চ্যাকর চ্যাকর পান চিবোনো। সমস্ত ব্যাপারটাই লাউড, নয়েজি, অ্যান্ড ভালগার। আমার উক্তি নয়, আমার মাতুলের। কাঁধে লাল ভিজে গামছা, ঢাকের মতো পেটের তলায় লুঙ্গির কষি বাঁধা, বুকের পাটা দুটো থলথল করে ঝুলছে, মোটা মোটা চুলের কুঁড়ি পথ উঠে গেছে ওপর দিকে। ঘাম গড়াচ্ছে। নাকের ফুটো থেকে চুল ঝুলছে খান্ডার গোঁফের ওপর। থেকে থেকে থুথু ফেলছে হ্যাঁক থু। গামছায় ফেঁ ফোঁ করে নাক ঝাড়ছে। মেয়েকে ডাকছে পুঁটি পুঁটি। ছেলের নাম রেখেছে হুলো। একপাল ছেলেমেয়ে আর ধুমসি বউ নিয়ে বাঙালি কত্তার সংসার। চুলোচুলি, ঠ্যাঙাঠেঙি। এই হ্যাঁহ্য করে হাসছে, এই প্যানপ্যান করে কাঁদছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গালগলা ফুলিয়ে হাঁকছে, হুলো, হুলো, নস্যির ডিবেটা দিয়ে যা, মা’র কাছ থেকে পাঁচ আনা পয়সা নিয়ে আয়। জানলা খুলে প্রতিবেশীর প্রশ্ন, পুঁটির পেট ধরেছে? উত্তর, না, আম পড়ছে। প্রশ্ন, বায়ু আছে, বায়ু? উত্তর, আরে বায়ুতেই তো মেয়েটাকে খেলে। সিদ্ধান্ত, গাঁদালের ঝোল খাওয়াও।
সকালে বেশ করে তেল মেখে চান। পাট করে আঁচড়ানো চকচকে চুল। পেটের কাছে পাট করা কোঁচা। গায়ে কামিজ। সাদা কাপড়ের ব্যাগে টিফিন কৌটো। ভেতরে আধডজন রুটি, একদা কুমড়োর ঘাট। কত্তা চললেন অফিসে৷ দুগগা দুগগা। সবচেয়ে ছোটটা দোরগোড়া থেকে চেল্লাচ্ছে, বাবা, থিগিগর থিগিগর আছবে। এই কত্তাই বিয়ের ভোজে বসে চিৎকার ছাড়ছেন, মাছটা আর একবার ঘুরিয়ে দাও। দইয়ের মাথা, দইয়ের মাথা। লেডিগেনিটা আর একবার। মন্দিরে গিয়ে ঠ্যাং ঠ্যাং করে ঘণ্টা বাজিয়ে বিকট ডাক, মা, মা, জগদম্বে! বুউ উ উ বুম, ব্যোম, শিব শ্যাম্ভ। চোখ উলটে কয়েক সেকেন্ড দণ্ডায়মান। তারপর হনহন করে ছুটছেন পাঁচুর পেছনে বাঁশ দিতে।
মন ভেবে দেখ, তুই কি ওইরকম হতে চাস? মন বললে, না। তা হলে? মামার সঙ্গে নিজাম ফ্যামিলির এক আত্মীয়ের বাড়িতে গানের আসরে গিয়েছিলাম। মামার সে কী সুন্দর পোশাক! গলাবন্ধ সিল্কের ঝকঝকে কোট। পা-চাপা পাজামা। সোনার চেন ঝুলছে বুকপকেটের কাছে। চোখে রিমলেস চশমা, মিহি আতরের গন্ধ। চলার মধ্যেও একটা হালকা নাচের ছন্দ। নবাব। পরিবারের বিরাট গাড়ি চেপে আসরে যেতে যেতে মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দুটি মেরু, হয় রাজা না হয় মহারাজ। মহারাজ মানে সন্ন্যাসী। এর মাঝে যা কিছু সবই উঞ্ছবৃত্তি। ইয়া পুরু কার্পেট মোড়া বিশাল হলঘর। ঝাড়লণ্ঠনের ঝাড় দেখে মাথা ঘুরে যায়। বেনারসি কেটে জানলার পরদা হয়েছে। বাড়ি বললে ভুল হবে। প্যালেস। গৃহস্বামীর গায়ের রং চাপাফুলের মতো। পোশক রূপকথার মতো। আর সেই বাড়ির মহিলারা! স্বপ্ন দিয়ে তৈরি। একঝলক দু’ঝলকের দেখা। যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ডিমের মতো মুখ। খাড়া খাড়া নাক। পটলচেরা চোখ। দুধেআলতা রং ধনুকের মতো বাঁকা বাঁকা ভুরু। এমন পরিবেশ, এমন আদবকায়দা-নড়তেচড়তে ভয় লাগে। আমার মাতুলের এসব রপ্ত ছিল। গান ধরলেন যমুনা কা তীর। কিছুক্ষণের মধ্যে মনে হল, চাঁদের আলোয় তাজমহল তৈরি হচ্ছে। স্বয়ং সাজাহান বসে আছেন আরাম চেয়ারে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে ধীরে ধীরে নাচাচ্ছেন। নাগরার জরি তারের আগুনের মতো চমকে চমকে রিরি করে উঠছে। কফিনের ডালা খুলে মমতাজ আসছেন চাঁদের আলোর পোশাক পরে। সেদিন যমুনার তীর ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কেবলই মনে হয়েছিল, ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করলে মন্দ হয় না। এই শেরোয়ানি, এই আচকান, এই আতরদান, এই মলমল, মখমল, মেহেন্দির আলপনা আঁকা চাঁপার কলি আঙুল, সুরমা-টানা তীক্ষ্ণ চোখ, উর্দু শায়ের। মসজিদ উঠে গেছে আকাশের চাঁদোয়ায়, আজানের শব্দ। রোগনজুস থেকে ভেসে-আসা জাফরান আর আতরের গন্ধ। না, ধর্ম বদলালে কিছু হবে না। চালকলা বাঁধা বামুনের রক্তে রং ধরবে না। চ্যাটাই পেতে মেটে দাওয়ায় আড় হয়ে শুয়ে আমার বৃদ্ধ প্রপিতামহ চ্যাটাস চ্যাটাস করে মশা মারতেন আর প্রপিতামহীকে গালাগাল দিতেন। সকালে ফতুয়া পরে বগলে রংচটা ছাতা নিয়ে পাঠশালে গিয়ে বাঁদরদের শুভঙ্করী শেখাতেন। সকালের নাস্তা বেগুনপোড়া দিয়ে একবাটি মুড়ি। বড়াখানা আলোচালের পিন্ডি, কঁচকলা ভাতে, পপিতা সেদ্ধ, থানকুনি পাতার ঝোল, হিংচে শাক। তস্য পিতা উদুখলে চালভাজা গুঁড়ো করে ফোকলা মুখে ফকফক করে খেতেন। বুড়ি বুড়োকে গালাগাল দিয়ে বলতেন, মরবে এইবার পেছন পটকে। মাঝে মাঝেই পরিবারে চালু নানান চুটকির মধ্যে যেটি কানে আসে, খুব সূক্ষ্ম নয় স্থূল, যথা: পণ্ডিতং পণ্ডিতং মুখ কেন সিটকেতং? উত্তর, কেঁচায় পট্টতং। প্রশ্ন, যাও না কেন নদী? উত্তর, বাকি আছে। দধি। সেই রক্তে কি আর পারস্যের বুলবুল গান গাইতে পারে? তৈমুর কি চেঙ্গিজের সন্তান হলে দেখা যেত। এ তো অসি ধরা মেজাজ নয়। মসি ধরে চলে আসছে জীবিকার ধারা। গাড়ু হাতে মাঠ। ভেঙে প্রাতঃকৃত্য। কেঁতা বগলে শয়ন। দাঁতন মুখে প্রভাতে উত্থান।
রক্তে যদি গানের বীজ থাকত তা হলে একবার চেষ্টা করে দেখতুম। মামার মতো ক্ল্যাসিক্যাল মেজাজ নিয়ে রাজা মহারাজার বাড়িতে আসর মারতুম। সুরের পথ বেয়ে বেয়ে চলে যেতুম অতীতের ঐশ্বর্যে। মামার মতো ব্যাকব্রাশ করা চুল। ঘাড়ের কাছে বাবরি। আঙুলে হিরের আংটির ঝিলিক। চারপাশে সুন্দরী। দিনকতক মামার কাছে তালিম নিতে বসলুম। প্রথমেই গলা সাধা। ভূপালি, এ তানা যোবানা পরমা নানা করিয়ে। কেঠো সুর। অর্ধেক পরদা লাগে না। এ তানা যোবানা পরমা, একটু থমকেই সপাট তান, সারে গাপা ধাসা, গাপা গারে সা, হাঁটুতে এক চাপড়, এ তানা। যোবানা। সেই অঙ্কের ব্যাপার। ফাঁক, সম। তিন তালের তা ধিন ধিন তা, তা তিন তিন তা। লয় চলেছে টুকুস টুকুস। যে যেখান থেকে পেরেছে পৃথিবীটাকে জটিল করে রেখেছে। গলা শুনে গুরু বললেন, হচ্ছে, তবে নাকি সুর এসে যাচ্ছে দোক্তা বাঁড়ুজ্যের মতো। ভদ্রলোকের আসল নাম লোকে ভুলে গেছে। পানদোক্তা ঠেসে গান ধরেন, সোনে কা থালমে খা রাহি হ্যাঁয়, এ কালী কমলি সুঘারা। বানাও। চড়ার দিকেই যত গোলমাল। পাঠাকাটা গলা। তালে লয়ে মাস্টার। স্টক অনেক। শুধু গলা নিয়েই গণ্ডগোল। গলা কাটা গাইয়ে।
মামা বললেন, তোর ন্যাক আছে। থাকতেই হবে। আমাদের বংশের ব্লাড ঘুরছে শরীরে। তবে সাধতে হবে। বারো ঘণ্টা, তেরো ঘণ্টা। সারে, গাপা, ধাসা, ধাপা, গারে, গাসা। আর ওই নাকটাকে বাদ দিতে হবে। ওই তানা পরমা না না। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সামনে আধ হাত জিভ বের করে সিংহের মতো আ আ করবি। একগলা জলে দাঁড়িয়ে নাদ সাধনা করবি হুম, হুমমম। সংগীত মানে নাসিকাবাদ্য নয়, গলা বাজানো।
দাদু বললেন, দিনকতক আমার হাতে ছেড়ে দে। ধ্রুপদ দিয়ে গলার গাদা বের করে দিই, তারপর মোচড় দিয়ে মুচড়ে খেয়াল, ঠুংরি, গীত, গজল। মামা বলে ফেললেন, গলা হয়তো হবে, তবে জীবনে আর সুরে বলবে না। আপনার মতো বাজখাই হয়ে যাবে। বাস, লেগে গেল ঝটাপটি দু’জনে। জানিস আমি মণি মুকুজ্যের ছাত্র। আজ্ঞে হ্যাঁ অস্বীকার করছি না, তবে যেমন গুরু তেমন চেলা। গানের গ্রামার তিনি ভালই বুঝতেন, জানতেন, গাইতে পারতেন না। দাদু বললেন, অহংকার। অতি দর্পে হত লঙ্কা। আমার গলা আকাশের ব্রহ্মতালু স্পর্শ করে। আর তোর মিনমিনে গলা দু’হাত এগিয়ে ঝরা ফুলের মতো নেতিয়ে পড়ে।
মামার সঙ্গে দাদুর তেমন বনিবনা নেই। তেহাই মেরে কথা চলে। দাদু হলেন পুরুষসিংহ। মুখের চেয়ে হাত চলে বেশি। পাঠানদের মতো দশাসই চেহারা। জাপানি আপেলের মতো গায়ের রং। বাড়ির বাইরে আউটহাউসে থাকেন। স্বপাকে খান। তন্ত্রসাধনা করেন। রোজ চণ্ডীপাঠ। প্রতি বছর কালীপূজা। কোথা থেকে এক কাঁপালিক এসে পুজোয় বসেন। সেদিন একটু কারণবারি চলে। মায়ের মূর্তিও অসাধারণ। শিবের বুকে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন আধহাত জিভ বের করে। পূজারি আর তন্ত্রধারক দু’জনেরই পরনে রক্তাম্বর। গলায় গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল লাল টিপ। সব লাল। জবা লাল, মা লাল, চাঁদোয়া লাল। চোখ লাল। লালে লাল। সেই পুজো দেখতে গা ছমছম করে উঠত। বাইরের মিশকালো আকাশে বাজি উঠছে। দুমদাম শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপছে। মাতামহ পুজোর আসনে বসে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন হাঁড়িকাঠে গলাটা ফিট করে দিয়ে ঘপাং করে একটা কোপ মারলেই হয়। কপালে হোমের টিপ পরাতে পরাতে হাত কাঁপত। আমার গা কেঁপে উঠত। গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, মা, মা। উহ্য থেকে যেত, মেয়ের ছেলে মা, তাই লোভ সামলাতে হল, নয়তো ধড় মুন্ডু আলাদা করে ফেলে দিতুম তোমার পায়ে। লাভের মধ্যে প্রসাদ লুচি মাংস। মাংস আসত কালীঘাটের মন্দির থেকে। এক ঝটকায় কাটা ছাগশিশু।
মাতামহের স্নেহের কমতি ছিল না। কথায় কথায় বলতেন, তুই আমার সুদের সুদ। আদর করে নাম রেখেছিলেন পান্তুরানি। কেন রেখেছিলেন কে জানে! ভীষণ পান্তুয়া খেতে ভালবাসতেন সেই কারণেই বোধহয় পান্তুরানি। ছোট্ট ঘরে বিশাল এক সিন্দুক। সেই সিন্দুকেই যত স্থাবর সম্পত্তি। মাঝে মাঝে খুলতেন আর বন্ধ করতেন। খোলার সময় সন্দেহের চোখে চারপাশে তাকাতেন। বন্ধ করে নিশ্চিন্ত হতেন। কী যে রহস্য ছিল ওই বিশাল কাঠের বাক্সে! আর ছিল একটি তানপুরা।
মাতুলের তালিমে নানা ফ্যাচাং। এতই শাস্ত্রসম্মত ও আটকাঠ বাঁধা যে সুর থাকে তো তাল থাকে না, তাল থাকে তো লয় থাকে না। একঘর সুন্দর সুন্দরীর সামনে বিড়ম্বনার একশেষ। মাঝেমধ্যে কানমলা, গাট্টা, দাঁতখিচুনি। সুরের মধ্যে এত যে অসুর থাকে কে জানত! এমনিই তো বেশ গাওয়া যায়, জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো, সমাধি পরে মোর জ্বেলে দিয়ো। অভিমানে টসটসে মন, কান্নাকান্না গলা। কার জন্যে এই অভিমান বলা শক্ত। অবশ্যই অদৃশ্য কোনও রমণী। ইতিমধ্যে যে দু’-একজন রমণীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তারা কেউই যে আমার জীবনে দীপ জ্বালাবার জন্যে। জন্মায়নি, এ সত্যটি আবিষ্কার করা গেছে। রমণীরা একটু ডাকাবুকো ফচকে ঘোড়াদেরই পছন্দ করে। রসের কথাটথা বলবে। সাহস করে এমন কিছু করবে যা ভাবলেও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। তেমন ছেলের তো অভাব নেই। এমন রমণী কোথায় আছে যার কাছে জ্যামিতির একস্ট্রা করে দেখালে, মাই লাভ বলে গলা ধরে ঝুলে পড়বে! তা ছাড়া আমার পথ তো আলাদা। আমি তো সংসার করতে আসিনি। ত্যাগ করতে এসেছি। মনে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলে দোষ আমার নয়। ট্রেনিংয়ের অভাব। সাধনা তেমন হয়নি। কামার্ত সন্ন্যাসী গরম বালিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলেন, পুড়ে যা পুড়ে যা, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যা।
আমার মাতামহই ভাল। আমি আসর মারতে চাই না। সুর দিয়ে চরণ ছুঁতে চাই। যাঁকে ছুঁতে চাই তাঁর কাছ থেকে সামান্য সিদ্ধাই টিদ্ধাই পেতে চাই। যৎসামান্য, যাতে মানুষকে একটু ভয় পাইয়ে দেওয়া যায়। কারুর ক্ষতি করতে চাই না। একটু ভড়কে দিতে চাই। সেই ভাবটি চাই যাতে মনে হতে পারে, তোক না পোক। আগে শক্তি চাই। তারপর প্রেমিক হব। রমণীর নয়। জীবের। চোখদুটো হয়ে যাবে কাঁচের মতো। উদাস। উজ্জ্বল মুখ। বুকের মাঝখানটা সিঁদুরে লাল। যেমন ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের। সাধকের কী কী লক্ষণ হতে পারে সবই আমার জানা। বই পড়ে জেনেছি। আমেরিকার থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে স্বামী বিবেকানন্দ দাঁড়িয়ে আছেন। একমাথা চুল। চোখদুটো অদ্ভুত সুন্দর। যোগীর চোখ। দ্যুতি বেরোচ্ছে। বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টার্স বলে শুরু করে সব স্তব্ধ করে দিয়েছেন। অ্যা মঙ্ক ফ্রম দি ইস্ট। আঃ স্বামীজির মতো যদি হতে পারা যেত! ওইরকম স্বাস্থ্য, সাহস, বাগ্মিতা, মেধা। ব্রিটানিকার পাতায় একবার চোখ বুলিয়েই পুরোটা মুখস্থ হয়ে গেল। আর আমি! হাজার চেষ্টা করেও গ্লুকোজের স্ট্রাকচার মনে রাখতে পারি না। ডক্টর ব্যানার্জির কাছে ধমক খেয়ে মরি। রহস্যটা কী? সবই নাকি রেতর খেলা। বীর্য ধারণ করে ঊর্ধরেতা হতে হবে। মাতুলের আসরে মন বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্বামীজির বদলে জি বাদ দিয়ে যা থাকে সেইটি হবার সাধ জাগে প্রাণে। হাঁটুতে হাটু বেঁকিয়ে বসে থাকে উমা। তারও এ তানা যোবানা, আমারও এ তানা যোবানা। গলায় গলা মিলিয়ে কোরাসে, এ তানা, সারে গাপা ধাসা। গানের চেয়ে গায়িকার আকর্ষণ বড় বেশি। আমাকে সংসারে টেনে নামাবার জন্যেই যেন উমার এই মর্তে আগমন। ঠোঁট এত লাল হয়! গাল এত গোলাপি হয়! শরীরে এত বিদ্যুৎ থাকে! গায়ে গা ঠেকলেই সেই ব্যাংনাচানো সাহেবের ব্যাঙের মতো কেঁপে কেঁপে উঠতে হয়। রাতের স্বপ্নে উমা রাজকাপুরের নার্গিসের মতো ধোঁয়ার স্রোত ঠেলে এগিয়ে আসতে থাকে। আতঙ্কের চিৎকার, আর আর না। স্বপ্নের উমাকে থামায় কার পিতাব সাধ্য! প্রাতে বড়ই বিমর্ষ। স্বপ্নে স্বামীজি এলেন না পরিব্রাজক বেশে। রামকৃষ্ণ এলেন না সমাধিস্থ হয়ে। এসে গেল উমা। বাস্তবে এলেও না হয় বোঝা যেত। স্বামীজিকে উলটে রেখে ওমর খৈয়ামকে টেনে নামানো যেত। ও লাইনে লায়লা মজনু, হীর রনঝা কম্বিনেশন তো রয়েই গেছে। ইতিহাসের দিকে আর একটি জুটি ঠেলে দেওয়া যেত, উমা পিন্টু। এতক্ষণে আমার নাম প্রকাশ করা গেল। ভাল নামে দরকার নেই। পিন্টুই ভাল। বেশ পয়েন্টেড। ইন্টুর মতো।
পিতৃদেব নাস্তিক, মাতামহ আস্তিক। মায়ের বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা জানা নেই। নাস্তিকের আর আস্তিকের রক্তে আমি বোধহয় এক জগাখিচুড়ি। পিতাঠাকুর বললেন, যাচ্ছ কোথায়? বিশ্বরহস্য খানিক শুনে যাও। স্বর্গ নেই নরকও নেই মানিক। আছে কেবল কর্ম। এ জন্মে যদি ভাল করে তন-মন-ধন হয়ে জ্যামিতি করো তা হলে আসছে জন্মে ইউক্লিড। যদি পদার্থবিদ্যায় মন দাও, পরের জন্মে বাথটব থেকে লাফিয়ে উঠে রাজপথ ধরে রাজবাড়ির দিকে ছুটবে ইউরেকা ইউরেকা করে। মাতামহ বললেন, ওই দেখো দেয়ালে ঝুলছেন জগদম্বা। ও মাগি যা করাবে তাই করতে হবে।
এ সব খেপা মেয়ের খেলা
যার মায়ায় ত্রিভুবন বিহ্বলা
সে যে আপনি খেপা, কর্তা খেপা, খেপা দুটো চেলা ॥
কী রূপ কী গুণভঙ্গি, কী ভাব কিছুই না যায় বলা
যার নাম করিয়ে কপাল পোড়ে, কণ্ঠে বিষের জ্বালা ॥
উতারো তানপুরা। লাগাও সুর। আহা, যেন ওঁকার ধ্বনি উঠছে চরাচর ব্যাপ্ত করে। উঁহু, ওভাবে বসলে চলবে না। বসতে হবে হাঁটু গেড়ে বজ্রাসনে। এখন সকাল। ধরো ভায়রো, মা মা রবে মনসুখে মন ত্রিতন্ত্রী একবার বাজা রে। মা মা বলবে অনেকটা সেঁকুর তোলার মতো করে। তলপেট থেকে ঠেলে উঠবে হৃদয়ের দিকে। কুলকুণ্ডলিনী চমকে চমকে উঠবে। একবার যদি জেগে যায়, আর পায় কে? নাও ধরো, মা মা রবে মনসুখে। মামা ঠিকই বলেছিলেন। আবেগে, বীরভাবে, রাগে দাদুর গলা ছেড়ে যে-জিনিস মুক্তি পেল, তাতে সুর নেই, ভায়রো, ভৈরবী, ধানেশ্রী, পুরিয়া, বেহাগ সব মিলে মিশে একাকার। দরদর করে জল ঝরছে দু’চোখ বেয়ে। এত অশ্রু কেন? ও গলার সঙ্গে আমি পারব কেন? মাঝে মাঝে চিঁহি চিঁহি করে মা রব ছাড়ছি। মূলাধার চমকে চমকে উঠছে কই! দাদু পাছে হার্টফেল করেন এই ভেবে নিজের হার্টই ধড়ফড় করছে। খালি হাত আকাশে বাতাসে কিছু একটা খামচে ধরার চেষ্টা করছে। উত্তাল সমুদ্রে জাহাজের মাস্তুলের মতো তানপুরা দুলছে সামনে, পেছনে, ডাইনে, বাঁয়ে। রাস্তার দিকের জানলায় সারি সারি কুচোকাঁচার মুখ। পথে চ্যাংড়া ছেলেরা ঘেউ ঘেউ করছে। দাদু মন ত্রিতন্ত্রীকে বাজাবার চেষ্টা করছেন। মহরমের হাসান হোসেনের মতো বুকে চাপড় মারছেন। তানপুরার পঞ্চমের তারটা পটাস করে ছিঁড়তেই দাদুর ভাবসমাধি হল। সমাধি ভাঙতেই জানলার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল খিস্তি করলেন। মুখের সারি ভেংচি কেটে সরে গেল। জগদম্বার ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন, বেটি আজ খুব দিয়েছে। আমায় মাতিয়ে দে মা। আমি এমন করে মেতে যাই যেন এক মাতা হাতি!
চিঁ চিঁ করলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না, বুঝেছ পান্তুরানি। সিংহের মতো ডাকতে হবে। নাদ ছাড়তে হবে। নাদ ব্রহ্ম। চিঁ চিঁ করে মেয়েছেলেকে ডাকা চলে, ওগো, শুনছ? দ্যাকো তো আমার পিটের এখানটায় যেন কী একটা কামড়েছে? এট্ট চুলকে দাও। ওই বেটিকে পেতে হলে পুরুষকার চাই। আয় মা রণে, দেখি মা হারে কি পুত্র হারে! এই বসলুম আসনে। দেহ শুকিয়ে ঝরে যাক, কুছ পরোয়া নেই, তুমি সামনে এসে না-দাঁড়ানো পর্যন্ত উঠছি না। সাধন করনা চাহি রে মনুয়া, ভজন লাগল ন্যাজের মতো। নট নড়নচড়ন। ব্যস, বাবু ফিনিশ। মৃত-স্ত্রী পিতারা বড় বেপরোয়া হন। শাসন করার কেউ থাকে না তো সংসারে! মা থাকলে সম্ভব হত কি ওই সুড়ঙ্গে ঢোকা! নাও এবার বোঝে ঠ্যালা! গোলমাল শুনে পাশের বাড়ির প্রবীণ মানুষ আশুবাবু দৌড়ে এলেন, কী হয়েছে বাবা?
মিস্ত্রী: বাবু ঘুঁষা।
প্রবীণ মানুষদের যে-কোনও জিনিসই বুঝতে বেশ দেরি হয়, কিন্তু একবার বুঝলে আর রক্ষা নেই। কে ঢুকেছে বাবা? তোমার বাবা? আজ্ঞে হ্যাঁ। পাতকোর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাবধানে উঁকি মারলেন। দড়ি ঝুলছে, মানুষ নেই। কিছুতেই বুঝতে পারেন না ব্যাপারটা কী? পাতকের মাঝামাঝি জায়গায় সুড়ঙ্গ? কোথায় এমন আছে? ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান ব্যাবিলনেই ছিল। একে রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষণ। পাতকো বসাতেই ভিটেমাটি চাটি, মাঝে আবার সুড়ঙ্গ। কোন পাঁঠার কাজ? এমনভাবে তাকাতে লাগলেন যেন আমি এক রামছাগল! খুব বকাঝকা করে আশুবাবু সিদ্ধান্তে এলেন, তোমার বাবা প্রায়ই দুঃখ করেন, তুমি একটি অপদার্থ; এখন মনে হচ্ছে তোমার বাবা তোমার চেয়েও অপদার্থ। যাও, মা-টিকে তো খেয়েছ এখন বাবাটিও পাতাল প্রবেশ করলেন। নাও এবার গলায় কাছা নেবার ব্যবস্থা করো। আচ্ছা, দড়িটাকে একটু টেনে দেখলে হয় না?
কার সাহস হবে ওই দড়ি টেনে দেখার? আমার অত সাহস নেই। দড়ি ধরে টানলে যে-মানুষটি বেরোবেন তাকে আমি চিনি। আমি খ্যাকশেয়াল হলেও তিনি ব্যাঘ্র। সব জল্পনা কল্পনা থেমে গেল। ঝোলা দড়ি আরও খানিকটা ঝুলে গেল। ঝুলেছে ঝুলেছে বলে আশুবাবু কিঞ্চিৎ উল্লাস প্রকাশ করলেন। তোমার বাবা ব্যাক করছেন পিন্টু। অবশেষে একটি মুখ দেখা গেল। চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে সম্ভবত পিচ্ছিল পথে হড়কে হড়কে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। হাত নেড়ে বললেন, খিচো। সুড়ঙ্গ-মুক্ত পুরুষ মাঝামাবি: জায়গায় ঝুলতে ঝুলতে বললেন, ওয়ান্ডারফুল। এ গ্রেট ওয়র্ক অফ কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং।
ওপরে উঠে এলেন। হাতে একটা কী যেন রয়েছে। আশুবাবু উদগ্রীব, হ্যাঁগো, গুপ্তধন টুপ্তধন কিছু আছে নাকি? সংক্ষিপ্ত উত্তর, থাকলে আশ্চর্য হব না। আবার প্রশ্ন, হাতে ওটা কী? কচ্ছপের খোলা। বলো কী? তা হলে তো এ জায়গাটা দেখছি পীঠস্থান। কূর্মপীঠ। তা কতদূর গিয়েছিলে? মাইলখানেক হবে?
হাত তিনেক গিয়েছিলুম। আহা! এলিসের ওয়ান্ডারল্যান্ড। সোঁ সোঁ করে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসছে। ছোট একটা ছেলে পেলে দেখে নিতুম, শেষ কোথায়?
এইরকম একটি বাড়িতে রক্ত আমাশার মতো অসুখ। কার্বাইডের ড্রামে ভরতি জল। প্রায় শেষ করে ফেলেছি। একতলার পাতকোর থেকে টেনে টেনে জল ভরতে হবে ভাবলেই মাথা ঘুরে যাচ্ছে। খালি যখন করেছি ভরতে তো হবেই। আইন হল আইন। শুনেছি এই আইনের ঠ্যালায়। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই আধমরা হয়ে ছিলেন। সারা ভারত জুড়ে মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন চললেও, গঙ্গার তীরবর্তী এই ক্ষুদ্র জনপদের ভুতুড়ে বাড়িতে আইন অমান্যের সাহস কারুর ছিল না। দুঃখের দিনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্যে মনের দেয়ালে সারি সারি বীর, যোদ্ধা, মহাপুরুষদের ঝুলিয়ে রাখতে হয়। সামনে দাঁড়াও। চোখ বুজিয়ে বলল, শক্তি দাও, একটু স্পিরিট ধার দাও। রোমেলকে স্মরণ করি। এই অবস্থায় রোমেল না হলে উদ্ধারের আশা খুবই অল্প। শুয়ে শুয়ে মার খেতে হবে। সেই অনুচ্ছেদটি একবার ঝালিয়ে নিই। রোমেলের জীবনীর তেত্রিশ পাতায় নীচের দিকে আছে। ১৯১৪ সাল। আমি তখন কোথায়? ২২ অগাস্ট! ভোর পাঁচটা। স্থান, ফরাসি দেশ। গ্রামের নাম ব্লিইড। ফরাসিদের আক্রমণ করতে চলেছেন যুবক রোমেল। ধরা যাক, এখন আমার যা বয়েস, তখন তার সেই বয়েস। রোমেল যাবেন যুদ্ধে, আমি যাব ড্রামে জল ভরতে। দু’জনের শরীরের অবস্থাই সমান। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে রোমেল ঘোড়ার পিঠে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তার ওপর খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে পেট ছেড়েছে। শরীর ভেঙে আসছে। ঘোড়ার জিন থেকে পড়ে যাবার মতো অবস্থা হচ্ছে। তবু পড়ছেন না, কারণ তিনি রোমেল। রোমেল অসুস্থ হতে পারেন, কিন্তু মুখ চুন করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসতে পারেন না। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন ঘোড়ার পিঠে। জ্ঞান ফিরে এলেই বলছেন, নেভার মাইন্ড। জার্মান ভাষায় নেভার মাইন্ডের অনুবাদ জানা নেই। ইংরেজির মতো অতটা মোলায়েম হবে না। গাবদা গোবদা ভাষা। উচ্চারণে হাপরের মতো বাতাস বেরোবে। শব্দেই চাঙ্গা। ঠিক হোকনা-হোক আমারও একটা শব্দ চাই। রোমেল কুয়াশা ভেদ করে যুদ্ধের দিকে চলেছেন। আমি ধেড়ে বালতি হাতে ভাঙাভাঙা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামব। রোমেলের ফুডপয়জনিং, আমার পেটে মাতামহের খাদ্যতালিকার প্রলয় নাচন। ও নটরাজ, নটরাজ, প্রলয় নাচন নাচবে যখন। আলোচালের ফ্যানটাই মনে হয় প্রধান আসামি। নেভার মাইন্ড! গুটেনবার্গেন হ্যাফট হাফেভেন।
জল-ভরতি বালতির টানে উলটে ডিগবাজি খেয়ে পাতকোর মধ্যে পড়ে যাবার মতো হচ্ছে। হঠাৎ হোয়াইট নাইটের কথা মনে পড়ল। জলকে আমার দিকে আকর্ষণ না করে, জল যদি আমাকে জলের দিকে আকর্ষণ করত তা হলে বাপারটা অনেক সহজ হত। মাঝে মাঝে পৃথিবীটাকে ঘুরিয়ে নিতে পারলে বেশ হয়। আপসাইড ডাউন। আমি জল না তুলে জল যদি আমাকে তুলত! তেমন একটা শরীর পেলে দেখিয়ে দিতুম। এক বালতি তুলেই মনে হল, রোমেল যে-ধাতুতে তৈরি ছিলেন আমি সে ধাতুতে তৈরি হইনি। ব্যর্থ চেষ্টা। হেলে কখনও কেউটে হতে পারে না।
চৌবাচ্চার পাড়ে বসে একটু দম নিচ্ছি আর ভাবছি আর একটা ঘটনার কথা। বেশিদিন আগের নয়। দুপুরে পইতের মধ্যাহ্নভোজনে পঙক্তিতে বসেছি। পাশেই পিতাঠাকুর। আমরা একটু বেশি খাতিরের নিমন্ত্রিত। তাই আহার চলেছে কলাপাতা মাটির গেলাসে নয়। কাঁসার থালা, ধুম্বো কাঁসার গেলাস। তীষণ তেষ্টা। জলের গেলাস এত ভারী, যতবার চেষ্টা করি তুলতে আর পারি না। আঙুলে লেগে আছে তেল ঘি। মাটি থেকে সামান্য ওঠে আর ঠকাস করে পড়ে যায়। ভেবেছিলুম কেউ দেখছেন না। গৃহস্বামীর চোখ এড়াল না। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, দাঁড়াও, আমি তুলে ধরি, তুমি খা। পিতাঠাকুরও দেখছিলেন আড়চোখে। তিনি বললেন, খবরদার, নো সাহায্য। নিজে তুলতে পারে খাবে, না হলে খাবে না। আচ্ছা, আমি তা হলে একটা হালকা গেলাসে জল এনে দিই। আজ্ঞে না। সমস্যাকে সহজ করে দেবার কোনও অধিকারই আপনার নেই। জীবন যখন যে-ভার কাঁধে চাপিয়ে দেবে সে ভার বইবার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই বয়েসে ওই গেলাস তোলা উচিত। দিস ইজ এ ডিসগ্রেস। আহা! হাতে ঘি লেগে আছে যে! থাক না। সো হোয়াট! এই তো আমি তুলছি। আমার গেলাসটা তিনি বারকতক তুললেন আর নামালেন। এক, দুই, তিন। গৃহস্বামীকে বললেন, কিছু বলার আছে? বলার আর কী থাকতে পারে? অত ঝামেলা জানলে কে আর সাধ করে এগিয়ে আসত! তিনি এমন একটা মুখ করে চলে গেলেন, যেন, আপনার পাঠা আপনি বুঝুন! আমার কী?
আমি সেই পাঁঠা, রোমেল হবার ব্যর্থ চেষ্টায় পেট খামচে বসে আছি। দোতলার বারান্দা থেকে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন, কী হল কী তোমার? ওখানে লাট খাচ্ছ?
জীবনীকার লিখছেন, রোমেল মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন কিন্তু কখনও ঊর্ধ্বতনের কাছে গিয়ে নাকে কাঁদতেন না, আমার মাথা ঘুরছে, পেট ব্যথা করছে। সুতরাং উত্তর, না কিছু হয়নি তো!
তবে কি জৈন ধর্ম অবলম্বন করেছ? মশাকে রক্ত খিলাচ্ছ?
তেড়েফুঁড়ে উঠতে গিয়ে লাট খেয়ে পড়ে গেলুম। চেতনায় ভাসতে ভাসতে মনে হল মচকাব তবু ভাঙব না। তারপর আর কিছু মনে রইল না। কঠোর মানুষ যখন কোমল হন তখন একেবারে কুসুমের মতো হয়ে যান। সে প্রমাণ এ সংসারে মাঝেমধ্যে পাওয়া যায়।
পরের দৃশ্যে নিজেকে দোতলার বিছানায় আবিষ্কার করলুম। ঘরে দুই বিশাল ছায়া। পিতাঠাকুর আর মাতামহ। দু’জনে একটু ঝগড়ার ভাবেই রয়েছেন মনে হল। দাদু বলছেন, তোমাদের নিয়মটা বাপু বুঝি না, হোমিওপ্যাথি দিয়ে শুরু, বিভূতিতে শেষ। ওই করে আমার মেয়েটাকে মারলে।
আমি মারলুম না আপনার কবরেজে মারল?
কবিরাজে মারে না হরিশঙ্কর, একেবারে শেষের সময় প্রদীপ যখন নিবুনিবু তখন ডাক্তার গুডিভ এলেও কিছু করতে পারতেন না।
আপনি মাননীয়, আপনার সঙ্গে আমি তর্ক করতে চাই না। আপনি বসুন, আমি শ্যামবল্লভকে কল দিয়ে আসি।
আমার মনে হয় নগেন কবিরাজই ভাল হত। নাড়িতে একবার আঙুল রেখেই ধরে ফেলত বায়ু, পিত্ত কি কফ! কোন নাড়ি অতি প্রবলা। এ ব্যাপারে অবশ্য কথা বলা মানেই অনধিকার চর্চা। তোমার পাঁঠা, তুমি ন্যাজেই কাটো আর মুড়োতেই কাটো কিছু বলার নেই। তবে মেয়ের ছেলে তো, একটিমাত্র নাতি। মড়ার মতো পড়ে থেকে দু’জনের বাক্যালাপ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, জামাই আর শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক কখনওই মধুর হয় না। এক ধরনের শত্রুতা থেকেই যায়। সুযোগ পেলেই ঠুসঠাস। এ পক্ষ ও পক্ষকে একটু আঘাত করতে পারলেই বড় খুশি। অপদস্থ মাতামহকে পাশে রেখে পিতৃদেব হোমিওপ্যাথকে কল দিতে ছুটলেন।
ঘর খালি হতেই দাদু বললেন নিজের মনেই, বড় একরোখা। কারুর কথাই শুনতে চায় না। অনেকটা আমার মতোই। তেটিয়া স্বভাবের। আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে কপালে আঙুল রেখে ইড়িরবিড়ির করে নাড়াতে লাগলেন। চোখ পিটপিট করে দেখলুম ঠোঁট নড়ছে। বীজমন্ত্র চলেছে। কালীনামের গণ্ডি পড়ছে চারপাশে। জগদম্বা বলে ভীষণ এক হুংকার ছাড়লেন। চোখ খুলে গেল।
কী রে ব্যাটা?
পেট ছেড়েছে দাদু। তিন দিনে তিন জামবাটি আনোচালের ফ্যান খেয়েছি। আধসের ছোলা, এপো চিনেবাদাম। মাতামহ হা হয়ে গেলেন। সর্বনাশ! ভাগলপুরী ধূম্বো গাইয়ের খোরাক যে রে বাপ! তা একেবারে আলোতে গেলি কেন? সেদ্ধ দিয়ে শুরু করলে কী হত!
গণেশের মায়ের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। বিধবা মানুষ। একবেলা আলোচালের ভাত খান, আলু কঁচকলা পেঁপে ভাতে দিয়ে। সেদ্ধর ফ্যান পাচ্ছি কোথায়!
দাঁড়া, ও ব্যামোর ওষুধ আমার কাছে আছে। শরীর গরম হয়ে গেছে। শীতল করতে হবে। ভাল গাওয়া আছে! রান্নাঘরে ঘিয়ের টিন ছিল। ঘি তেল মোটামুটি ভালই চলে এ বাড়িতে। ভোগী আর যোগী দু’তরফেরই ঘৃত বিধি। ভোগেও ঘি, যোগেও ঘি। এক চামচে কাঁচা গব্যঘৃতের সঙ্গে একটু কাশীর চিনি মেড়ে দাদু আমার মুখে ফেলে দিলেন। মাতামহের ওপর অপার আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে সেই অপূর্ব দাওয়াই গিলে ফেললুম। সন্দেহ রইল, মরে না যাই। শুনেছি ব্যাসিলাই ডিসেন্ট্রি বড় সাংঘাতিক অসুখ। পাহাড়ে পর্বতে বহু বড় বড় সাধু ওইতে দেহত্যাগ করেছেন। খুবই অপমানজনক মৃত্যু। ব্রহ্মতালু ফেটে শ্রীশ্রী আটলক্ষ বাবার মহাসমাধি নয়।
.
প্রবীণ হোমিওপ্যাথ যখন এলেন তখন আমাদের ঘি-পর্ব শেষ হয়ে গেছে। আমরা তখন হরিদ্বারে কালীকমলির ধর্মশালায় সবে গিয়ে পৌঁছেছি। পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গার হর হর শব্দে দু’জনেই বিভোর। স্টেশন থেকে বেরোলেই চৌমাথায় মহাদেবের মূর্তি। ঘটি ধরা একটি হাত মাথার ওপরে তোলা। অবিরাম জল পড়ছে হুড়মুড় করে। সেই পাথরের শিবই দাদুর চোখে আসল শিব। থাকেন আর আহা আহা করে ওঠেন। হ্যারা হ্যারা শব্দে জল পড়ছে।
ডাক্তারবাবু ছোটখাটো খুরথুরে মানুষ। ভারী উজ্জ্বল চেহারা। নিজের হাতেই হাজারখানেক ওষুধ, তাই বয়েস হার মেনেছে যেন। একযুগ আগে যে-চেহারা ছিল এখনও তাই বজায় আছে। একটুও টসকায়নি। কুচকুচে কালো চুল। ধবধবে শরীর। ধবধবে সাদা ধুতি, সিল্কটুইলের শার্ট। উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখ। হাতে ওষুধের বাক্স। গলায় বুক পরীক্ষা করার যন্ত্র। ছেলেবেলায় খোকাবাবু বলতেন, এখনও তাই। খোকার এদিকে গোঁফ বেরিয়ে বসে আছে, বাবা হবার হাঁকডাক চলেছে রক্ত নদীর ধারায় ধারায়। শিরশিরিয়ে যৌবন এসেছে। চাহনি তেরছা হয়েছে।
কী হয়েছে খোকাবাবু?
সারা বছরের আমার অসুখবিসুখের একটি নির্ঘণ্ট পিতাঠাকুর করেই রেখেছেন। সিজন শুরু হয় অক্টোবরে। শিশির এল, শিউলি এল, টনসিল তেউড়ে উঠে ঘুংরি কাশি। নভেম্বরে সর্দি জমে শ্বাসকষ্ট, ঘুসঘুসে জ্বর। ডিসেম্বরে হাঁপানি। সারারাত গলায় অর্গান বাজছে, খণ্ডন ভব বন্ধন গ। জানুয়ারি জকারান্ত শব্দ সুতরাং জ্বর হবেই। কেঁপে কেঁপে আসবে ঘাম দিয়ে ছাড়বে। এইভাবেই ঋতুর রথচক্রে ব্যাধিচক্র বাঁধা। আমাকে আর উত্তর দিতে হল না। উত্তর দিলেন অভিভাবক।
পাতকোতলায় দাঁত চিরকুটে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, মনে হয় হিস্টিরিয়া।
ফ্যামিলিতে হিস্টিরিয়ার হিস্ট্রি আছে নাকি?
এ বংশে নেই, যদি থাকে মাতুল বংশে।
মাতামহ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, কী বললে হরিশঙ্কর? গঙ্গানারায়ণ মুকুজ্যের বংশে হিস্টিরিয়া? নিজেদের দিকটা ভাল করে খুঁজে দেখো। মনে পড়ে তোমার মেজো ভাই কালাজ্বরে ফৌত হয়ে গেল।
আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় জিওগ্রাফি। আসামের জঙ্গল থেকে ধরিয়ে এসেছিল। আপনি গেলে আপনারও হত।
তা হলে তোমার বড় ভাই কেন দোতলার বারান্দা থেকে লাফ মেরে অণ্ডকোষ ফেটে মারা গেল?
আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় সাইকোলজি। অত বড় ব্যাবসা পুড়ে ছাই হয়ে গেলে আপনি মনুমেন্ট থেকে লাফ মারতেন।
তা হলে, তোমার মাথার সামনের দিকের চুল উঠে গিয়ে টাক বেরিয়ে পড়ছে কেন? এই বয়েসেও আমার চুল দেখো।
আজ্ঞে, ওটা হিস্ট্রি নয় ব্যাড মেনটেনেন্স। ম্যানেজমেন্টের ব্যাপার। যত্ন আর তদারকির অভাব।
সাধুদের জটা দেখেছ? তারা চুলের কি যত্ন করে হরিশঙ্কর?
আপনি অন্য লাইনে চলে যাচ্ছেন। তা হলে বলতে হয় আপনারা সকলে অকালপক্ক কেন?
অকালপক্ক? হাসালে। পঁয়ষট্টিতে চুল পাকবে না? চুলের বাবা পাকবে।
তা হলে ওই দেখুন, আমার পিতাঠাকুরের ছবি। কুচকুচ করছে একমাথা কালো চুল।
ওটা কলপ হরিশঙ্কর। গোঁফজোড়া দেখেছ? পেকে ফটফট করছে।
ডাক্তারবাবু মৃদু হেসে বললেন, আপনারা কী আরম্ভ করলেন দু’জনে। শুনুন শুনুন, হিস্টিরিয়া হল মেয়েদের অসুখ। কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন!
পিতৃদেব অম্লান মুখে বললেন, ওকে আমি পুরুষ বলে মনে করি না, মহিলা, এফিমিনেট স্বভাবের। চুল আঁচড়াচ্ছে তো আঁচড়াচ্ছেই, গালে রুমাল ঘষছে তো ঘষছেই। ভাল করে গোফ পর্যন্ত বেরোল না। মাতুল বংশের দিকে চলে গেছে। চুলের বাহার দেখেছেন। খোঁপা বাঁধলেই হয়।
দাদু বললেন, ওহে হরিশঙ্কর, একতরফা খুব তো বলে যাচ্ছ, ফঁকা মাঠে হারোয়া লাঠি ঘুরিয়েই চলেছ। আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। গোঁফজোড়া দেখেছ। দেউড়ির দরোয়ানকেও। হার মানায়।
আপনার কথা আলাদা। আমি বলেছি মাতুল বংশ।
মাতামহ ছাড়া মাতুল আসে কোথা থেকে বৃন্দাবনচন্দ্র।
আমার নাম হরিশঙ্কর। নাম বিকৃত করা আপনার এক বদ স্বভাব। শাস্ত্র বলছে, নরানাং মাতুলক্রম, মাতামহক্রম নয়। ধর্মের পথে আছেন যখন একটু শাস্ত্রটাস্ত্র উলটে দেখলে লাভ বই লোকসান হবে না।
ডাক্তারবাবু এবার বেশ সশব্দে হাসলেন, স্ত্রীবিয়োগ হলে মানুষের মস্তিষ্ক যে বিকৃত হয়, আপনারাই তার প্রমাণ।
তার মানে? দু’জনেই প্রতিবাদ করে উঠলেন। আমরা পাগল?
পাগল বললে ভুল হবে, সামান্য ছিটগ্রস্ত। সামান্য বিষয় নিয়ে যেভাবে কচলাকচলি করছেন। দু’জনে?
দাদু বললেন, প্রতিবাদ করো হরিশঙ্কর, প্রতিবাদ।
আই প্রোটেস্ট, কে বলেছে স্ত্রীবিয়োগ হলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। আপনার হ্যাঁনিম্যান সায়েব? মুখুজ্যেমশাই, আপনি কত বছর উইডোয়ার?
তা হবে, বছর তিরিশ তো হবেই।
আমার হাফ, প্রায় পনেরো বছর। আমার কী ইনস্যানিটি আপনি দেখলেন?
দাদু ভালমানুষের মতো মুখ করে বললেন, কিছুই না, যা ছিল তাই আছে।
তার মানে? পিতাঠাকুর আবার তেড়ে উঠলেন।
ডাক্তারবাবু ওঁদের দু’জনকে অগ্রাহ্য করে এবার আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বাপু?
সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি, উনি এইভাবেই কথা বলেন। রোগীদের মনে হয় বয়স বাড়ে না। যতটা সম্ভব চাপা গলায় বললুম, রক্ত আমাশা।
রক্ত আমাশা? পিতৃদেবের কান এদিকেও ছিল, লাফিয়ে উঠলেন, হরিগিরির ডালবড়া। বাজার থেকে মারা কাঁচা পয়সা পকেটে গজগজ করছে, ডালবড়া চলছে, ফুলুরি চলছে, কচুরি ঘুগনি চলছে, পেটের আর দোষ কী! নাও এবার তিনমাস বিছানায় লটকে পড়ে থাকো। পিতার হোটেলে। দাদু সঙ্গে সঙ্গে যোগ করলেন, শখের প্রাণ গড়ের মাঠ।
ডাক্তারবাবু শান্ত গলায় বললেন, আহা, আপনারা অত উতলা হচ্ছেন কেন? আমাকে যখন আনলেন, একটু দেখতে দিন। তা বাবা, কী খেয়েছিলে? কোনও গুরুপাক কিছু?
দাদু চোখ টিপলেন। অর্থাৎ ফ্যানের কথাটা গোপন রাখ।
আজ্ঞে না, তেমন তো কিছু খাইনি।
পিতৃদেব সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, মিথ্যে কথা। কার্য না থাকলে কারণ থাকে না। কিছু না খেলে কিছু হয় না। একে লিভার নেই, তার ওপর গোটা চল্লিশ ডালবড়া, তার ওপর কনস্টিপেশন, যাবে কোথায়? বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোর–।
তুমি তখন থেকে অত ডালবড়ার দিকে ঝুঁকে আছ কেন বলো তো? মাতামহের প্রশ্ন।
আমি যে ওর উইকনেস জানি। আপনার যেমন ছোলার ডাল আর লুচি ওর তেমনি ডালবড়া।
এটা তুমি ঠিক বলেছ হরিশঙ্কর। চাপ চাপ ছোলার ডাল, আর গোটা চল্লিশ ফুলকো ফুলকো লুচি আর শেষে তোমার হাতের ঘি-চপচপ হালুয়া। আহা, ওটা তুমি যা বানাও না! খেতে খেতে মনে হয় কে যেন পটাপট পটাপট কাথবার্টসন হার্পারের বাড়ির জুতো হাঁকড়াচ্ছে গালে। অনেকদিন হয়নি, একদিন হয়ে যাক।
আড়চোখে একবার দেখে নিলুম, পিতাঠাকুরের মুখ নিমেষে প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। স্বভাব অনেকটা শিবঠাকুরের মতো। অল্পেই তুষ্ট। মাতামহ এই মুহূর্তে খুবই মনের মানুষ। মোহনভোগ বস্তুটিতে বাবা সিদ্ধিলাভ করেছেন। বড়ে গোলাম আলি যেমন মালকোষ রাগে। সুজি শুকনো কড়ায় কতক্ষণ নাড়তে হবে, কখন, কতটা ঘি দিতে হবে, প্লাস্টারের মশলার যেমন ভাগ আছে, এতটা বালিতে এতটা সিমেন্ট, সেইরকম চার কাপ সুজিতে এক কাপ চিনি, ফোর ইজ টু ওয়ান। জলের মাপ আরও সাংঘাতিক, একটু এদিক-ওদিক হলেই মোহনভোগ হয়ে যাবে লেই। মোগলাই ব্যাপার। ময়ূর সিংহাসনে বসে বাদশাহরা খেতেন সুর্মা-টানা চোখে।
পিতাঠাকুর মহোৎসাহে বললেন, হলেই হয়। আজই হতে পারে। রাতে আমার মনে হয় রোগীর পথ্য হবে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা চারখানা লুচি আর একটু নুন। কী বলেন ডাক্তারবাবু?
ডাক্তারবাবু বললেন, হতে পারে, তবে রুগিকে তো এখনও ঠিকমতো দেখাই হল না।
আমি মনে মনে বলছি, হে ডাক্তারবাবু, বাগড়া দেবেন না। দাদু বললেন, এর আর অত দেখার কী আছে! ইয়ংম্যান পেটটা একটু ছেড়েছে। তা ছাড়ক না। এক ডোজ অ্যাকোনাইট থ্রি এক্স দিলেই তো মিটে যায়।
অ্যাকোনাইট থ্রি এক্স দোব কেন? মার্কসলও তো দিতে পারি।
পিতাঠাকুর বললেন, হোয়াই নট মার্ককর!
মাতামহ বললেন, হোয়াই নট
নাম! ডাক্তারবাবু খুটুস করে ওষুধের ব্যাগ বন্ধ করে বললেন, আমি উঠি। রোগের চেয়েও আপনারা মারাত্মক। চিকিৎসা আপনারাই করুন।
কুছ পরোয়া নেহি। মাতামহ উল্লাসে ফেটে পড়লেন। বেশ শুট জলে ফুটিয়ে, তোকমারি দিয়ে মেড়ে, চিনি সহযোগে প্রাতে সেবন করিয়ে দোব। মধ্যাহ্নে পেট সিলমোহরকরা লেফাফা।
তোকমারি? সে তো ফোঁড়া ফাটায়! আপনি ভুল করছেন। পিতার সংশয়।
ভুল করব কেন, ওই তো সাদা সাদা হড়হড়ে, ভু ভু… আটকে গেলেন। স্মৃতি কমছে। বয়েস হচ্ছে।
ইসবগুল, ইসবগুল। ডাক্তারবাবু ভীষণ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আসল বস্তুটির নাম বলে দিলেন। তা দিতে পারেন, ভালই হবে। এমনিই লুজ আরও লুজ হয়ে যাবে।
তুমি ডাক্তারির কি জানো না। হতে পারে।
তবে আপনিও যে খুব বেশি জানেন, এমন প্রমাণ পাওয়া গেল না।
দাদুর মুখে অদ্ভুত এক ধরনের হাসি খেলে গেল। তিনি ডাক্তারি থেকে সরে আধ্যাত্মিক লাইনে চলে গেলেন। আচ্ছা ডাক্তার, তুমি তো সব তীর্থ ঘুরে এসেছ, কৈলাস, মানস, অমরনাথ, গঙ্গোত্রী। বেশ, বলো দেখি স্বয়ম্ভু পূষন কাকে বলে?
ডাক্তারবাবু বললেন, পারব না মুকুজ্যেমশাই! শাস্ত্রজ্ঞানে আপনার জুড়ি নেই। আমি জানি, নাক্স, ইপিকাক, অ্যালো, জেলসিমিয়াম। আমি ঘুরি দেশ দেখার ধান্দায়। আপনি খোঁজেন ভারতাত্মা, আমি খুঁজি মানবাত্মা।
হাঃ হাঃ তাই বলো। তা হলে দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ কাকে বলে তাও নিশ্চয় জানো না!
আজ্ঞে না।
সেই শঙ্খ গভীর রাতে আপনি বাজতে থাকে। সাধকের ইড়া পিঙ্গলায় তখন ওঁকারধ্বনি ওঠে।
ডাক্তারবাবু ব্যাগটা টেবিলের ওপর রেখে বসতে বসতে বললেন, তা হলে অ্যাকোনাইট থ্রি এক্সই দিয়ে যাই।
দাদু বললেন, দেবেই তো, দেবেই তো। ও ছাড়া আর কোনও ওষুধই নেই। দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের মতো আমার মুখ দিয়ে বেটি ঠিক ওষুধের নামটি বের করে দিয়েছে। জানো তো সিদ্ধপুরুষের বাক্যে বজ্রপাত হয়। ত্রেতায় হত, দ্বাপরে হত। মহাকলিতে সব গেছে। এক ডোজ ওষুধ দাও না। ডাক্তার যাতে কুলকুণ্ডলিনীটা খুলে যায়।
মাতামহ প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তারবাবু এক পুরিয়া ওষুধ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে আমার জিভে উজাড় করে দিলেন। দাদু বললেন, এক একটা গুলি এক একটা বীজমন্ত্রের মতো পেটে পড়ে দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিক। ডাক্তার, তোমাকে নয়, তোমার বিশ্বাসকে আমি ভক্তি করি। এবার যখন পাহাড়ে যাবে আমার জন্যে একটু শিলাতু আর এক ডেলা মৃগনাভি আনবে।
আচ্ছা মনে থাকবে, বলে ডাক্তারবাবু চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরের বাইরে প্রায় চলে গেছেন, দাদু তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, ডাক্তার, ডাক্তার আহারের বিধানটা দিয়ে গেলে না?
সকালে উপবাস। মিছরির জল চলতে পারে। রাতে টাকা সাইজের চারখানা লুচি, নুন দিয়ে লুচি। ভাজার আগে ঘিয়ে কয়েক কুচি আদা ভেজে নেবেন। অত ভজঘট করবে কে?
পিতাঠাকুর হাঁটুতে তাল ঠুকে বললেন, কেন আমি!
আপনার অফিস?
অফিস আগে না ছেলে আগে ডাক্তার!
শ্যামবল্লভ মৃদু হেসে চলে যেতেই মাতামহ বললেন, দাঁত থাকতে লোকে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। কী, এখন তোমার মনে হচ্ছে না হরিশঙ্কর, স্ত্রী বেঁচে থাকলে কত সুখে থাকতে পারতে?
আজ্ঞে না, সুখ আমার জীবনে নেই। আমি জন্মেছি বেঁচে থাকার মাশুল দিতে। ওর মা বছর তিনেক সুস্থ ছিল, তারপরই তো শয্যাশায়ী। সারাজীবন আপনি ঘি খেয়ে, দুধে কাঁঠালের ক্ষীর খেয়ে, তীর্থ আর মহাপুরুষ করেই কাটিয়ে গেলেন। ছেলেমেয়ের কথা যদি একটু ভাবতেন?
বলো কী হরিশঙ্কর? হরিশঙ্কর ঠিকই বলে, কারুর পরোয়া করে না। আপনার মেয়ের মতো অত ক্ষীণ স্বাস্থ্যের মহিলার সংসারধর্ম করতে আসাটাই অন্যায় হয়েছিল। আমাকে অনাথ করে, স্মৃতিটুকু ফেলে রেখে চলে গেল ড্যাং ড্যাং করে। স্বার্থপর, সেলফিশ, এসকেপিস্ট। ওপরে গিয়ে একবার দেখা হলে আমি গায়ে গায়ে শোধ তুলব। নাঃ, ওপর বলে তো কিছু নেই! সবই এখানে। সবই এখানে। হিয়ার, হিয়ার অ্যান্ড হিয়ার। চোখে জল। দু’জনের চোখেই জল।
১.০২ কৌপীনবন্ত: খলু ভাগ্যবন্ত
কোমরের কাছ থেকে ছোট্ট একটুকরো কাপড় বের করে পিতৃদেব চোখ মুছলেন। আড়চোখে আমাকে একবার দেখে নিলেন। উঃ, পিতা হবার কী জ্বালা! আমার মতো সৌভাগ্যবান ক’জন আছে। জন্মেই মরুভূমি। ধরে বেঁধে রাখার মতো কেউ কোথাও নেই। পরিস্থিতি লম্বা আঙুল তুলে দিকনির্দেশ করছে, পিন্টু, লোটাকম্বল। কৌপীনবন্তং খলু ভাগ্যবন্তং। জয় শিবশঙ্কু, উখার দে মকান, লাগা দে তম্ভ। চিতপাত হয়ে শুয়ে আছে, আর এক গৌতমবুদ্ধ। মানুষের কী কষ্ট। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি। মানুষ জেরবার হয়ে গেল। এ থাকে তো ও যায়, ও থাকে তো এ যায়। কী যে কেলোর কীর্তি চারদিকে। প্রবীণরা এসে মাঝে মাঝেই শুনিয়ে যান, হরিশঙ্কর, তোমরা শুনলে না তখন, এই ভূতের বাড়িতে এসে ঢুকলে! অত বড় সংসার, একে একে সবাই চলে গেল। এখন বংশে বাতি দেবার মতো কেউ থাকে কি না দেখো! হরিশঙ্কর তখন বুক ফুলিয়ে বলেন, কেউ না থাকে আমি থাকব। সেই ছাত্রজীবনে বাংলার শিক্ষক আমাদের চাঁদসদাগর পড়াতেন, হাতে লাঠি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে আছেন সদাগর, সব গেছে তবু নতি স্বীকার করব না।
মাতামহ অনেকটা টর্পেডোর ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে পড়ে জামাইয়ের দিকে এগিয়ে এলেন। ধরাধরা গলায় বললেন, হরিশঙ্কর, আমার এই জিভ, আমার এই নোলায় একটু হেঁকা দিতে পারো! সামনে জিভ ঝুলছে লকলক করে।
পিতা বললেন, ওটাকে আপনি ভেতরে গুটিয়ে রাখুন। হেঁকা দেবার ব্যবস্থা আমি করছি। তার আগে হিসেবটা লিখে নিই।
দাদু চেয়ারে বসে গান ধরলেন, এখনও কি ব্রহ্মময়ী, হয়নি মা তোর মনের মতো।
পিতা ক্যাশবাক্স খুলে সেই বিখ্যাত হিসেবের খাতাটি খুললেন। যার পাতায় পাতায় প্রতিদিনের হিসেব লেখা। পাইপয়সার এদিক-ওদিক হবার উপায় নেই। প্রতিদিনের হিসেব মেলাতে গিয়ে একটি কথা লিখতেই হবে, শর্ট, এত পয়সা। পাশে একটি জিজ্ঞাসার চিহ্ন। বড়ই সন্দেহ। কেন শর্ট? কে মেরেছে? আমি নয় তো! মিথ্যে বলব না, দু-এক দিন মেরেছি। বেশ নরম করে ভাজা বোকাদার দোকানের ডিমের ওমলেট বড়ই সুস্বাদু! মনের ওপর এখনও যে তেমন সংযম আসেনি। একটু-আধটু এদিকে-সেদিকে পা ফেলে। কিন্তু সে তো মাঝেমধ্যে। তা হলে রোজ শর্ট হয় কী করে! কে জানে? এদিকে শুনি হিসেবের কড়ি বাঘে খায় না।
ডাক্তারবাবুকে দু’টাকা ভিজিট দিয়েছেন। সকালে নর্দমা সাফ করার লোক এসেছিল, তাকে এক সিকি। ভিখিরি এসেছিল, দু’পয়সা। ওয়েস্ট নট ওয়ান্ট নট। চুলচেরা ব্যাপার। আমি যদি সত্যি বুদ্ধদেব হতুম, তা হলে কবে বোধিবৃক্ষের তলায় গিয়ে বসতুম। রোজ এইসব ছোটখাটো অপমান। বাজার থেকে পয়সা মেরেছি। অসুখে পড়ে ডাক্তার খরচ করিয়েছি। অহংকারে লাগে। আবার মহাপুরুষরা বলছেন, অহংকার কী রে ব্যাটা!
পাঁড়ে ন করসী বাদ-বিবাদঁ। যা দেহী বিন সবদ না স্বাদঁ
অণ্ড ব্রহ্মাণ্ড খণ্ড ভি মাটি। মাটি নবনিধি কায়া।
আরে পাঁড়েজি তর্কাতর্কি মাত করো। এই দেহে শব্দ নেই, স্বাদ নেই, স্রেফ মাটি রে ভাই। অণ্ড, ব্ৰহ্মাণ্ড, খণ্ড সবই মাটি। ওই যে আমার পিতৃদেব টাকা টাকা করছেন, ওঁর কানের কাছে আমি যদি নাকি সুরে দু’কলি গেয়ে উঠি;
মন রে রতন কাগজ কা পুতলা।
লাগে ঝুঁদ বিনসি জাই ছিল মৈ গরব করৈ ক্যা ইতনা ॥
মন রে, ধনরত্ন সব কাগজের খেলনা। বুদবুদ এই উঠছে এই মিলিয়ে যাচ্ছে। এত গর্ব কীসের!
আর কিছু না পারি বেশ দু-চারটে শ্লোক, দোহা টোহা মুখস্থ করে, পিপুল-পাকা অবস্থায় পৌঁছে গেছি। নাকে রসকলি করে সামনে পুঁথি খুলে কথকতায় বসলেই হয়। গলায় গাঁদাফুলের মালা, সামনে মরা, আধমরা, বড়ি খোঁপা, পানদোক্তা-খাওয়া হরেক মেজাজের একপাল বিধবা।
মাতামহ বেশ তারিফের গলায় বললেন, বড় ভাল অভ্যাস হরিশঙ্কর! মরো আর বাঁচো রোজ হিসেবটি লিখে যাবে। নিজেকে সংযত রাখার এর চেয়ে ভাল রাস্তা আর কিছুই নেই। ওড়ার আগেই ডানাটি কেটে ফেলল। খাতার দিকে তাকাও আর শামুকের মতো গুটিয়ে যাও। মহাত্মা গান্ধী শুনেছি। রোজ হিসেব লিখতেন। সাধে স্বাধীনতা আনতে পেরেছিলেন! ইংরেজ বললে, বাবা, বড় সাংঘাতিক লোক। কাপড় হাঁটুর উপর তুলেছে। আরও ওপরে তোলার আগেই সরে পড়ো।
আপনার সব ভাল, মাঝেমধ্যে এই যে একটু গ্রাম্য হয়ে পড়েন, তখনই পিত্তি চটে যায়। হচ্ছে হিসেবের কথা, চলে গেলেন মহাত্মা গান্ধীতে। উত্তর পশ্চিম জ্ঞানের বড়ই অভাব।
তুমি ঠিক বলেছ হরিশঙ্কর। আমার মুখটা একটু আলগা। এক-একটা কথা ফস করে মুখ দিয়ে যেই বেরোয়, চমকে চমকে উঠি। রিভলভারের গুলির মত বেরোবার সময় ধাক্কা দিয়ে যায়। তখন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করি, ওরে তোর মুখ না পেছন? অ্যাই, অ্যাই দেখো, যেই বললুম অমনি ধাক্কা খেলুম। উপমাটা তেমন সুবিধের হল না। মুখকে যার সঙ্গে তুলনা করলুম, সে জায়গাটা খুব সভ্য নয়।
কে আপনাকে ব্যাখ্যা করতে বলেছে?
কেউ বলেনি। তোমাকে দেখালুম আমি একেবারে গবেট নই। বোধবুদ্ধি আছে, কেবল অভ্যাসটা নেই। ঢলকো ছিপির মতো! কী, রাগ করছ নাকি? রেগে গেলে তোমার আবার জ্ঞান থাকে না। ভুলেই যাবে, আমি তোমার শ্বশুরমশাই। এখুনি বলবে, আপনি তা হলে আসুন। আমার লুচি-হালুয়া বন্ধ হয়ে যাবে। বেটির সামনে আসনে মন আর কিছুতেই স্থির হবে না। হরু পাগলের মতো গাইতে হবে,
থেকে থেকে যেন মাগো লুচির গন্ধ পাই
কোথা তোর রাঙা চরণ, ভাসছে চোখে মণ্ডামেঠাই।
থেকে থেকে যেন মাগো লুচির গন্ধ পাই।
খাতা ক্যাশবাক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চাবিটি লাগাতে ভুল হল না। দাদুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহারাদি তা হলে আজ এখানেই হোক।
গান থেমে গেল। লাজুক লাজুক মুখে বললেন, স্বপাকে ভাতেভাত খাই, এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। ওরে কাঙাল ভাত খাবি? না, হাত ধুয়ে বসে আছি। তা, কী কী পদ হবে হরিশঙ্কর?
ধরুন খুব সরু চালের ভাত। তার ওপর পরিমাণ মতো গব্য ঘৃত।
আহা, আহা!
পালং শাক পোস্ত দিয়ে ভাজা।
বড়ি আর মুলো পড়বে?
পড়বে।
তোফা তোফা।
সোনামুগের ডাল।
বলো কী?
পাকা রুইমাছের কালিয়া।
কেয়া বাত কেয়া বাত।
একটু চাটনি আর দই।
সর্বাঙ্গসুন্দর।
কিন্তু কে করবে?
কে করবে? হ্যাঁ তাও তো বটে, কে করবে? এ তো শ্মশানভূমি। চারদিক হাহা করছে, খাঁখাঁ। তা হলে বললে কেন?
স্বপ্ন দেখালুম মুকুজ্যেমশাই। দিবা স্বপ্ন।
তা হলে কী হবে?
জগাখিচুড়ি। চালে, ডালে, লাউ উঁটায়, আলুতে, পটলে এক মহা সম্মেলন। কী, দুঃখ হচ্ছে?
কিছুমাত্র না। দুঃখু কীসের? মূলং তরোঃ কেবলমাশয়ন্তঃ, পানিদ্বয়ং ভোমামন্ত্রয়ন্ত কামিব শ্রীমপি কুৎসয়ন্তঃ, কৌপীনবন্তঃ খলু ভাগ্যবন্ত। বুঝলে হরিশঙ্কর।
হ্যাঁ, বুঝলুম বই কী। হীনবল ভারতীয়ের ভাগ্যের সঙ্গে সহজ রফা। পুরুষকারের অভাব। ওর সঙ্গে যোগ করুন তৃণাদপি সুনীচেন, তরুরোহপি সহিষ্ণুনা, নেংটি পরে লটকে বেড়াই, মুখে কেবল কথার বড়াই। যা বলেছি তাই হবে। নো ট্রাকস্টার অ্যান্ড হাকস্টার উইথ ফেট।
তুমি কথায় কথায় বড় ইংরেজি বলো সায়েববাচ্চার মতো। ওই ভাষাটা আমি আবার তেমন বুঝি না।
এ হল তাদের ভাষা যারা কর্মযোগে বিশ্বাস করে। যারা লেংচে চলে না। মার্চ করে।
সবই বুঝলুম হরিশঙ্কর, তবে কি নাতিটার পেট ভাল নেই, এতগুলো পদ রাঁধবে, আর আমরা খেলিয়ে খেলিয়ে খাব, সেটা কি ঠিক হবে?
ওর জন্যে আমি বেলের মোরব্বা তৈরি করব।
আহা বড় ভাল জিনিস! আমাকেও দিয়ো কিঞ্চিৎ, না কোরো বঞ্চিত। তা হলে এখন একটু চা হোক। চিনির বদলে আমাকে গুড় দিলেও চলবে।
কেন, চিনির অভাব আছে নাকি? আপনার মেয়ে নেই, ঠিক আছে। নেই তো নেই, আমি তো আছি!
অ্যাঁ, তুমি এত বড় কথা বললে? আমার পুত্র-পুত্রবধূ যে কখনও এমন কথা বলতে পারলে না। পায়ের নীচে এখনও তা হলে জমি আছে! হরিশঙ্কর, জমি তা হলে আছে?
আলবাত আছে। আপনার মেয়েকে আমি শ্রদ্ধা করি। আজ নেই বলে বলছি না, থাকলেও বলতুম। সে ছিল দেবী। আপনি তার কিসুই জানেন না। আনইয়ুজুয়াল ডটার অফ নট সো ওয়ার্দি এ ফাদার।
একটু বাংলা করে বলো হরিশঙ্কর। শুনতে বড় ভাল লাগছে। চোখে জল এসে যাচ্ছে।
বাংলা করলে শুনতে আর তেমন ভাল লাগবে না।
তা হলে ইংরিজিই থাক।
হ্যাঁ, সেই ভাল, হোয়ার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস দেয়ার।
উঃ, সব ভাল ভাল কথাই তুমি ম্লেচ্ছ ভাষায় বলছ, আচ্ছা তোমার সংস্কৃত আসে না?
আসে, তবে ইংরিজির মতো নয়। ইংরিজিতে বেশ মোলায়েম করে গালাগাল দেওয়া যায়।
তুমি কি তা হলে এতক্ষণ গালাগাল দিচ্ছিলে?
কুচো নিমকি আর চা দিয়ে স্টার্ট করা যাক। কী বলেন?
ওঃ ফাসক্লাস! কালোজিরে দেওয়া?
হ্যাঁ পূর্ণাঙ্গ জিনিস।
নাতিটা ডালবড়া।
পিতৃদেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। দাদু আমার দিকে তাকিয়ে ছেলেমানুষের মতো হেসে বললেন, কী বুঝছ পাস্তুরানি?
বেশ জমেছে।
এরকম জামাই তুমি ভূ-ভারতে পাবে না। আনন্দ, আনন্দ। আজ যেন আনন্দের হিল্লোল বইছে! বেটি কোন দিন যে কী করে দেয়! এই কাদাচ্ছে, এই হাসাচ্ছে! এই রাজবেশ, এই কৌপীন। এই মহাভোজ, এই উপবাস।
তবে সেই সে পরমানন্দ
যে জন পরমানন্দময়ীরে জানে
সে জন না যায় তীর্থ পর্যটনে।
খুব জোর গান ধরেছিলেন। বিভোর ভাব। গায়ে হাফহাতা পাঞ্জাবি। পইতেটি সামান্য বেরিয়ে আছে।
দরজায় পিতৃদেবের মুখ দেখা গেল, স্টপ স্টপ, পরমানন্দময়ী হরিমটর ছাড়া আর কিছুর ব্যবস্থা রাখেন না, উঠে পড়ুন। এখন আর মিউজিক নয়, মাসলসের খেলা চলবে। বাটনা বাটতে পারেন?
ভাবজগৎ থেকে দমাস করে বাস্তবজগতে আছাড় খেয়ে মাতামহ কেমন যেন হয়ে গেলেন। তবু হাসি-হাসি মুখে বললেন, ওই শিলে ফেলে নোড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে তারপর গড়াগড়ি করে। মাখামাখির ব্যাপার তো! জীবজগতে অহরহ যা চলছে? আহা, জাতা ঘুরতে দেখে কবীর দাস একদিন কেঁদে ফেলেছিলেন। তার দুটো ফাটার মধ্যে পড়লে কেউ কি অক্ষত থাকবে রে ভাই,
চলতি চক্তি দেখিকে দিয়া কবীরা রোয়
দুই পট ভিতর আয়কে সবিত গয়ান কোয়।
এ আপনার জাঁতাকলে জীবজগত নয়। হলুদের কথা হচ্ছে। চলে আসুন। চা ছাকতে পারেন?
তা আর পারব না! কিন্তু তুমি যে বললে সেই কালোজিরে দেওয়া কুচো নিমকির কথা! ভুলে গেলে নাকি?
আপনার ওই পরমানন্দময়ীর জগৎ ছেড়ে বেরোতে পারলেই সর্বপ্রকার জীবানন্দ পাবেন।
তুমি বড় নাস্তিক হে হরিশঙ্কর, কিছুতেই তোমার বিশ্বাস আসে না!
আমি কালাপাহাড়; বলে পিতাঠাকুর অদৃশ্য হলেন। মাতামহ গেলেন চা ছাঁকতে।
সেই কুচো নিমকি আছে আলমারিতে। আংটায় ঝুলছে সাত লিভারের থান্ডার লক। বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিনি। পিতার অফিসের বন্ধুর স্ত্রী এক জার আমের মোরব্বা করে পাঠিয়েছিলেন। ফিনকি ফিনকি করে কাটা, কিসমিস টিসমিস দেওয়া বড় সুস্বাদু বস্তু। রাতে একটু চাখার পর স্বভাবটা কেমন যেন বেড়ালের মতো হয়ে গেল। হেঁক ছোঁক করে মরি। কোনও কাজেই মন বসে না। ঘুরি ফিরি আমের মোরব্বা। সেই কথামৃতের কথা: ঘুরছে ফিরছে, রান্না করছে, চুল বাঁধছে, মন পড়ে আছে উপপতির দিকে। দুপুরের দিকে একবারই একটু নিয়েছিলুম। বেশি না, চামচে দু’-এক। ধরা পড়লুম রাতে। মোরব্বার ওপর তখন বিদিগিচ্ছিরি রুটি আর কুমড়োর ছক্কা চেপে বসেছে। মোরব্বার জারে কোথায় একটা কী চিহ্নফিহ্ন করা ছিল। খুলতেই তিনি স্থানচ্যুত হবেন। জাগতিক দিক থেকে ব্যাপারটা খুবই সামান্য; কিন্তু নৈতিক দিক থেকে অসামান্য।
তুমি নিয়েছ?
যথারীতি উত্তর, আজ্ঞে না তো।
আজ্ঞে না-তো-ও-ও!
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটুখানি। এই এতটুকু।
মুখ যতদূর সম্ভব কাচুমাচু। সামনে আয়না থাকলে ছিঁচকে চোরের মতোই দেখাত। মাথায় বাবরি, অথচ চোর। সেই পাড়ার প্রসন্নদার মতো। গগলস পরে অফিসের টাইপরাইটার চুরি করেছিল। সুট আর ঝকঝকে জুতো, চোখে রঙিন চশমা, এদিকে কোমরে কাছি বাঁধা। শ্রীঘরে চলেছে বড় রাস্তা দিয়ে। সামনে পেছনে দুই সেপাই চলেছে হেলেদুলে, খইনি মলতে মলতে। একই তো ব্যাপার। বললে, কাঁপতেন চুরি করে মরেছে। পিতৃদেব বলবেন, ব্যাটার মাথায় চাচরঅ চিকুরঅ এদিকে মোরব্বা চুরি করে মরেছে। কদমছাট কি ন্যাড়া চোরে সহ্য হয়। ননিচোরা কৃষ্ণকে দেবতা বলে রেসপেক্ট করা চলে, বস্ত্রহরণ, বাঁশি বাজন, রাধাভিসার, ক্ষমণীয় অপরাধ কারণ তিনি এক গীতাতেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে চিতপাত করে দিয়েছেন। তুমি বাছা কী করেছ! কিন্তু কেমন করে। ধরলেন?
কী করে ধরলুম! আমি শার্লক হোমসের বাবা। ঢাকনাটা শেষ প্যাঁচে এনেও আমি আরও একটু চাপ দিয়ে মোক্ষম বাঁধনে বেঁধেছিলুম। যাতে খোলার সময় বেশ একটু বেগ পেতে হয়। লক্ষ করেছিলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ কোস্তাকুস্তি করেই খুলতে হয়েছিল।
হোমস বলছেন, অপরাধী অপরাধের জায়গায় সূত্র রেখে যাবেই। তুমি কী করলে, ঢাকনাটা লাগালে তোমার ক্ষীণজীবী শরীরের দুর্বল হাতে। পার্ফেক্ট ক্রিমিন্যাল পৃথিবীতে আজও জন্মায়নি। পিন্টু। পার্ফেক্ট সাধু কিন্তু জন্মেছেন; কারণ সতের পথ সোজা। ঈশ্বরের দিকে যেতে চাইলে তিনি হাত ধরে টেনে নেন। স্বর্গে জায়গা পাওয়া সহজ, নরক গুলজার, সেখানে লাইন দিতে হয়। তা হলে! সেই লোভ, যে-লোভ তোমাকে ভ্রষ্ট করেছে, সেই লোভের কাছে এই আহুতি।
যজ্ঞে আহুতি দেবার ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে পিতৃদেব পুত্রের সামনে নতজানু। সময় মধ্যরাত। বাইরে বসন্তের উতলা বাতাস। সিংহমশাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে কাঁচি দিয়ে ভুলোর ন্যাজ ছাটা হচ্ছে। আর্ত চিৎকারে আকাশ বিদীর্ণ। আর্য ঋষির মতো তিনি বলছেন, পিন্টুর লোভ প্রজ্জ্বলিত হও, মোরব্বাকে দহন করে চিরকালের জন্যে প্রশমিত হও।
সামনে থেকে সরে যাবার উপায় নেই। পায়ের গোছ চেপে ধরে আছেন। খেতে হবে, পুরোটাই তোমাকে খেতে হবে। খেয়ে অসুস্থ হলে আমি বিধান রায়কে ডেকে আনব। হেলা চরিত্র চাই না, চাই খাড়া, স্ট্রেট লাইক পাইন নিড়ল।
সে স্মৃতি কি ভোলা যায়! ওয়াটার্লর যুদ্ধের মতো। মাতালের অত্যাচারে ভুলো শেষ। তবু এখনও কুকুর কঁদলে মোরব্বার কথা মনে পড়ে। চরিত্রও পালটেছে। লোভ আছে, অভিমানে চাপা। খেতে হলে নিজের রোজগারে, নয়তো আকাশবৃত্তি। মাতামহ বলেন, অজগরবৃত্তি। হা করে পড়ে থাকবি। মুখের সামনে এলে গিলে খাবি, আবার চোখ উলটে পড়ে থাকবি।
ঠ্যান করে কী একটা পড়ল ওপাশে। পিতাঠাকুরের কিঞ্চিৎ উত্তেজিত গলা শোনা গেল, যাঃ, সব ফেললেন তো। নিন সরুন। খুব হয়েছে। এত কম সাধারণ বুদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! পৃথিবীর সব ধেড়ে ধেড়ে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী লোপাট হয়ে গেল। ধূর্ত শৃগাল কিন্তু ঠিক আছে।
মাতামহের অসহায় গলা, কেটলির ঢাকনাটা যে ফট করে খুলে যাবে, বুঝতে পারিনি হরিশঙ্কর!
ধীরে ধীরে উঠে গেলুম। তখন থেকে বড়ই অপদস্থ হচ্ছেন। যে-মানুষটির পাল্লায় পড়েছেন তাকে চেনা অত সহজ নয়। চা-পাতা সমেত একগাদা লিকার মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। কেটলি থেকে চা কার অভ্যাস না থাকলে ঢাকনা এইভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা করবে।
আমি একটু সাহায্য করতে পারি?
চায়ের কাপে চিনি গুলতে গুলতে পিতা বললেন, তুমি? তুমি যে উঠে এত দূর আসতে পেরেছ, এই তো যথেষ্ট। ব্র্যাভো ব্র্যাভো বলে হাততালি দেওয়া উচিত। তুমি তো সামান্যেই কাতর!
একটু আগের তিরস্কার ভুলে মাতামহ আমার পক্ষ নিলেন, পেটের অসুখে মানুষ বড় দুর্বল হয়ে পড়ে হরিশঙ্কর। তা ছাড়া ও তো এমনিই একটু কাহিল।
তবে শুনবেন? চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে পিতা চললেন অন্যের বীরত্বের কাহিনিতে। বীরের সংখ্যা তত কম নয়। কৃতি পুরুষেরও ছড়াছড়ি। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচণ্ড যড়যন্ত্র চলেছে আমাকে আরও আরও হেয় করার জন্যে। কেউ ট্রাইপস পাচ্ছে, কেউ র্যাংলার হচ্ছে, কেউ ছ’টা লেটার পেয়ে আজীবন স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে নিচ্ছে, কেউ এফ আর সি এস হয়ে এসে ক্যাচক্যাচ মানুষ কাটছে, বড়দিদার মতো গুনছুঁচ দিয়ে পেট সেলাই করছে, কেউ এভারেস্টের মাথায় উঠে পতাকা জাপটে ধরে স্টাইলে ছবি তুলছে।
দাদু ফড়ড় করে চায়ে চুমুক দিতেই পিতৃদেবের ভুরু কুঁচকে গেল। পদার্থবিদ্যায় পড়েছিলুম, এভরি অ্যাকশন হ্যাঁজ ইকোয়াল, অ্যান্ড অপোসিট রিঅ্যাকশন। ফড়ড় মানেই এক ধরনের গ্রাম্যতা। চিনের চা, পরিবেশন করতে হবে জাপানি কায়দায়, খেতে হবে বিলিতি প্রথায়। এতটুকু শব্দ হবে না। চুক করে টেনে নিয়ে, সুড়ত করে গিলে ফেলা। গলকম্বল উঠল আর নামল। ইতিমধ্যে মাতামহ আর একটি দুর্ধর্ষ চুমুক মেরেছেন, ফড়ফড় ফড়াক করে। ভুরুতে এবার একাধিক ভাজ। মাতামহের চোখে পড়েছে। ধরতে পারলেন না ব্যাপারটা কী! অতি সরল প্রশ্ন, কী, মাথা ধবছে হবিশঙ্কর?
আজ্ঞে না, মাথা আমার ধরে না, অম্বল আমার হয় না। আমি শুধু ভাবছি, মানুষ কীরকম খাল কেটে কুমির আনে, ঝাড় কেটে বাঁশ আনে।
তা যা বলেছ? খাল বেয়ে অবশ্য মাছও আসে, রুই, কাতলা, মৃগেল। তোমার কুমির কোন দিক দিয়ে এল হরিশঙ্কর?
এবার বেশ খেলানো চুমকি। একতলা, তিনতলা।
পিতৃদেব বললেন, সামনের দরজা দিয়েই এল।
সে কুমির এখন কোথায়? মাতামহ নিমকি চিবোতে চিবোত প্রশ্ন করলেন।
আমার সামনে।
কী জানি বাবা, আমাকে বলছ না তো!
হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। চা খাচ্ছেন বেনারসের বিধবাদের মতো। চা খেতে অত শব্দ করেন– কেন?
মাতামহ হাঁ হয়ে গেলেন। হাতের নিমকি হাতে, চায়ের কাপ প্লেটে। ছেলেমানুষ বকুনি খেলে যেরকম মুখ হয় ঠিক সেই মুখে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে কাপের দিকে আর হাত বাড়াচ্ছেন না। খেতে গেলে আবার যদি শব্দ হয়।
এই দেখুন আমার চুমুক। এক চুমুক চা টেনে নিলেন। কোনও শব্দ হল?
মাতামহ ঘাড় নাড়লেন নিঃশব্দে।
নিন, কাপ ওঠান, চেষ্টা করুন। এমন কিছু শক্ত নয়।
মাতামহ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। হাত আর কাপের দিকে এগোবার সাহস পাচ্ছে না।
কী হল? চেষ্টা করুন। যা দশে শেখেননি, তা ষাটে শিখুন।
আমি আর চা খেতে চাই না হরিশঙ্কর।
চোখের কোণদুটো ছলছলে। আলগা মুঠো থেকে মেঝেতে নিমকি খসে পড়ল। এতক্ষণ নিমকি নিমকি করে লাফাচ্ছিলেন। সেই নিমকির ওপরও আর তেমন টান নেই। সব ছেড়ে উঠে পড়লেন। প্লেটে নিমকি, আধ কাপ চা।
পিতা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় চললেন?
যাই, কোথাও তো যেতে হবে। বেলা বেড়ে যাচ্ছে।
বসুন। বেশ আদেশের সুর।
কখন কী অসভ্যতা করে ফেলি হরিশঙ্কর! তোমার মতো লেখাপড়া শিখিনি, তেমন সহবতও জানি না। রেলের মাল গুদামের বড়বাবু ছিলুম এককালে, পয়সাও অনেক কামিয়েছি; কিন্তু তোমার সামনে বসার মতো সভ্যতা তো আমাকে কেউ শেখায়নি হরিশঙ্কর। ছেলে বলে, ওল্ড ফুল, তুমিও
তো আমার আর এক ছেলে, তোমার মুখেও সেই এক কথা,
যাবদ্বিত্তোপার্জন শক্ত-স্তাবন্নিজপরিবারো রক্তঃ।
পশ্চাদ্ধাবতি জর্জরদেহে, বার্তাং পৃচ্ছতি কোছপি ন গেহে ॥
যতদিন রোজগার ছিল, বোলবোলা ছিল, ততদিন রাজনারায়ণের খুব খাতির ছিল হে। এখন গতায়ু বৃদ্ধ, জরা এসে চেপে ধরেছে, এখন কে কার! ভুলেও কেউ একবার জিজ্ঞেস করে না, বুড়ো কেমন আছ?
অঙ্গং গলিতং পলিতং মুণ্ডং দশনবিহীনং জাতং তুণ্ডম
বৃদ্ধা যাতি গৃহীত্বা দণ্ডং
বৃদ্ধ না কুত্র যাতি। পিতা হাত ধরে চেপে বসালেন। বসুন। অত অভিমান কীসের? সংসারে আপনার অভিমানের কে তোয়াক্কা করে! শঙ্করাচার্য পড়ে ঠোঁট ফোলাচ্ছেন? সাধনমার্গের দুটো পথ, জানেন তো? নেতি নেতি। ইতি ইতি। চায়ে চুমুক দিলে শব্দ হয়, অতএব চায়ে চুমুক দেব না, নেতির পথ। এমনভাবে চুমুক দেব শব্দ হবে না, এ হল ইতির পথ। নিন, স্টার্ট চুমুক, ওয়ান, টু, থ্রি।
মাতামহ উবু হয়ে বসে ছোট্ট একটু চুমুক ছাড়লেন ভয়ে ভয়ে। কী হরিশঙ্কর, কী বুঝলে?
পারফেক্ট। যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
মাঝারি ধরনের আর একটি চুমুক মেরে বললেন, এইবার?
শাবাশ!
নিমকির দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে টেনে নিলেন। মুখে নিমকি পড়লে যে একটু মুচমুচ শব্দ হবে।
মুচমুচ অ্যালাউ করা যায়, কারণ ওটা বস্তুর ধর্ম, কিন্তু তারপর যদি চ্যাকোর চ্যাকোর শব্দ হয় তখনই হবে অভ্যাস দোষ।
তা হলে থাক বাবা। দরকার নেই খেয়ে।
না না, ইতিবাচক সাধনা। খেয়ে প্রমাণ করতে হবে সিদ্ধপুরুষ।
মাতামহের ট্রেনিংপর্ব চলেছে। আমাকে উপলক্ষ করে সেই বীরত্বের কাহিনি ধামাচাপা রইল। সরে পড়াই ভাল। পিতার চোখ পড়ল এতক্ষণে, তুমি তা হলে কীভাবে সাহায্য করবে?
যেভাবে বলবেন!
যেভাবে বলব? বেশ, তা হলে একটা কর্মতালিকা তৈরি করা যাক। মুখুজ্যেমশাই হলুদ আর সরষে বাটার চেষ্টা করবেন আর যে-কোনও একটা পদ রাঁধবেন।
রান্না কি আমার আসবে হরিশঙ্কর?
বেঁধে প্রমাণ করতে হবে আপনি মহিলা নন, পুরুষ।
সে আবার কী কথা?
পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় রাঁধিয়েই হল পুরুষ, গঞ্জালেস, আবু বকর, স্টুয়ার্টলয়েড, আমাদের হালুইকর বিচিত্রবীর্য। সব পুরুষ। রান্নার জগতে মেয়েছেলের স্থান নেই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি বাছবে চাল। তোমার ওই রমণীমোহন চাচর চিকুরে ওই মেয়েলি কর্মটিই ভাল মানাবে।
আহা, তুমি আবার ওকে নিয়ে পড়লে।
পড়ব না! চুল ছাড়া ওর আর আছে কী? ভেবেছে চুল দিয়ে নারীচিত্ত জয় করবে! কৃষ্ণের হাতে শুধু বাঁশি ছিল না, সুদর্শন চক্রও ছিল। বুকের পাটা চাই। হাতের গুলি চাই। এই দেখো, তোমার সামনে তোমার পিতা, তোমার মাতামহ। সব ছেচল্লিশ ইঞ্চি।
সব ভুলে পিতার পাশে দাঁড়িয়ে সিমুলিয়ার ব্যায়ামবীরের মতো মাতামহ হাতের গুলি দেখাতে লাগলেন।
১.০৩ ছায়া, মায়া, কায়া
রান্নাঘরে এক ডেকচি জলের মতো ঝোলের তলদেশে ছাল-ছাড়ানো আস্ত একটা মাগুর কাঁচকলার বালিশ মাথায় দিয়ে শেষ শয্যায় শুয়ে আছে। জমাট অশ্রুবিন্দুর মতো গুটি পাঁচেক মরিচ শোকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর একটি পাত্রে শ্রাদ্ধের পিণ্ডের মতো অতি পুরনো চালের এক ড্যালা ভাত। পিতাঠাকুর পেটরোগা ছেলের আহার প্রস্তুত করে রেখে, চোগাচাপকান চাপিয়ে অফিসে চলে গেছেন। খাখা বাড়ি। পৃথিবীর চাকা ঘুরছে। এখানে মুহূর্ত যেন স্থির। কিছুই করার নেই। মোটা মোটা ভারী ভারী বই আছে। দেয়ালে দেয়ালে জ্ঞানভাণ্ডার ঝুলছে ঝুলের আবরণে। পণ্ডিত হতে চাইলে হওয়া যায়। মগজে গোবর। দাঁতের জোর থাকলে ইঁদুরের মতো চিবোনো যেত। সেও তো পোকা খেয়ে ভাঙা, আধভাঙা হয়ে বসে আছে। প্রায়ই পিতার সামনে হাঁ করে দাঁড়াতে হয়। ভাগ্য ভাল, তার সঁতও তেমন সুবিধের নয়। আমার গেছে যত্ন না নিয়ে, তার গেছে অতি যত্নে। যখনই সময় পান শক্ত বুরুশে ইঞ্চিখানেক পেস্ট নিয়ে খসর খসর করে ঘষতে থাকেন। ঘর্ষণে পাথর খয়ে যায়, দাঁতের এনামেল তো কা কথা।
বিজয়দা বলেছিলেন, সাইকেল শিখতে চাস? তা হলে সাইকেল হাঁটাতে শেখ।
বিজয়দা একটা মোটা খাতা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ট্যাক্স আদায় করতেন, আর আমি তার পেছন পেছন বিশাল ভারী এক র্যালে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে পায়ের খিল খুলে মরি। মাঝে মাঝে। লগবগে হয়ে নর্দমায় পড়ে যাবার মতো হয়। প্যাডেলের খোঁচা খেয়ে পায়ের ছালচামড়া উঠে যায়। মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, এতে আমার কী লাভ হচ্ছে! বিজয়দার মতে, এ হল জোড়ে হাঁটা। অনেকটা বিয়ের মতো। গাঁটছড়া বেঁধে সাত পা হাঁটলেই বোঝা যায়, যার সঙ্গে ঘর করতে চলেছ, তার ধাতটি কেমন! তিনি কোন দিকে টাল খান, চলন কেমন? জোড়ে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় আরও কিছুটা বুঝে গেলে। সঙ্গে সঙ্গে তোমার ব্যালে এসে গেল। বুঝে গেলে, কীভাবে চড়তে হবে, চালাতে হবে। দু’চাকার সাইকেল আর স্ত্রীজাতি একই জিনিস। নাড়াচাড়া না করলে, দূর থেকে ধাত কি স্বভাব বোঝা যায় না। চালাতে জানলে চলবে, নয়তো ফেলে দেবে নালায়।
পিতারও সেই এক কথা। এ জীবনটা বইয়ের ধুলোটুলো ঝেড়ে নাও, নেড়েচেড়ে দেখে যাও, আসছেবার ভেতরে ঢুকতে পারবে। মানুষের মতো চেহারা হলেই মানুষ হয় না। জন্ম হল অঙ্কের। ব্যাপার, ফ্রিকোয়েন্সির ব্যাপার। এককোষী প্রাণী থেকে বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করে বহুঁকোষী। প্রাণী, ভেড়া, ছাগল, গাধা, ঘোড়া, বাঁদর, প্রথম মানুষ জনম। দেহ আকৃতি মানুষের মতো, ভেতরটা গাধা-বাঁদর কম্বিনেশন। গাধা যুক্ত নর ইজ ইকোয়াল টু গানর। গাবানর। সেই গল্পের মতো, মনুষ্যচর্মাবৃত একটি গর্দভ, লাস্ট বেঞ্চে বসে পেনসিল চিবোচ্ছে। দিনের অর্ধেক কেটে গেল নিলডাউন হয়ে হাতে থান ইট নিয়ে। এইবার জন্মে যাও। জন্মাতে জন্মাতে জন্মাতে নিউটন কি। রাসেল, র্যাফেল কি রোদেনস্টাইন। লাখখাবার জন্মালে তবেই আকৃতি আর প্রকৃতি দুটোতেই মানুষ। হবে। তার আগে নয়। দু’জন পাশাপাশি বসে আছে, ট্রেনে কি ট্রামে। দু’জনই মানুষের মতো। দেখতে। হলে হবে কী? একটু নাড়াচাড়া করে দেখলেই বেরিয়ে পড়বে, একজন মানুষ আর একজন কোটপ্যান্ট পরা বনমানুষ।
সোম থেকে শনি, বইয়ের ধুলো ঝাড়ার ক্যালেন্ডার তৈরিই আছে। রবিবার যেন লিপ ইয়ার। কাজের ওপর কাজ। সারা বাড়িতে গোটা চোদ্দো মোগলাই আলমারি। তার মাথা আছে, তলা আছে, দেয়ালের দিকে পিছন করা পৃষ্ঠদেশ আছে। চেয়ারের ওপর টুল ফিট করে মাথা সাফ করো। টুলের চারটে পায়াই স্ট্যান্ড-অ্যাট-ইজের ভঙ্গিতে ছেতরে থাকে। চেয়ারে তিনি কোনওক্রমে খাড়া হবেন। সবসময়েই ভয়, সীমানা ছেড়ে যে-কোনও একদিকে ঝুলে না পড়েন। জয় তারা বলে সেই মনুমেন্টে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রাখে কেষ্ট মারে কে, মারে কেষ্ট রাখে কে! হাতে একটি ঝাড়ন। ঝাড়ো ধুলো। প্রথম ঝাঁপটাতেই নাকে কিছু ঢুকবে। সঙ্গে সঙ্গে গোটাতকত হাচি গেট-খোলা কুকুরের মতো তেড়ে বেরিয়ে আসবে। স্বর্গের কাছাকাছি জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই বিপুল হাঁচির বেগে টুলচ্যুত হয়ে দেবতার মর্তে পপাত হবার সম্ভাবনা যোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা হবে। পিতা তখন হয়তো এমরি পেপার ঘষে পোর্টম্যানের মরচে তুলছেন। কমলালেবু রং পালটে এবার নীল রং হবে। নিত্যনতুন রূপে সংসারকে সাজাতে হবে। নয়তো জীবনরসে ভাটা পড়বে। মাই ডিয়ার স্যার, স্ট্যাগনেশন ইজ ডেথ। শূন্যে তাকিয়ে পিতা বললেন, নাক টিপে, নাক টিপে।
সময় সময় নাকে রুমাল বেঁধে রঘু ডাকাতের বাচ্চা হয়ে ধুলো ঝাড়া চলে। সে বড় অসুবিধের। ডাকাতি আর ডাস্টিং, ডকারান্ত হলেও আকাশ পাতাল প্রভেদ, এক নয়। মাথা সাফাইয়ের পর তলা সাফ। সারা সপ্তাহের মালমশলা তলদেশে তরিবাদি করে জমিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁটু গেড়ে বসে, ঘাড় হেঁট করে, খাটো ঝাটা দিয়ে টেনে টেনে বের করো। ইঁদুরের ডাইনিংরুম। শালপাতার ঠোঙা, পাউরুটির খোল, ভঁটার ছিবড়ে, মাছের কাটা, যখন যা পেরেছে, টেনে টেনে নিয়ে গেছে। ভোজের পর বিয়েবাড়ির বাইরের আঁস্তাকুড়ের অবস্থা। তকতকে পরিষ্কার চাই। মনে রাখবে, ক্লিনলিনেস ইজ নেক্সট টু গডলিনেস। দেয়াল আর আলমারির মাঝখানের অংশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাঘা বাঘা এক্সপ্লোরারদেরও অজানা, ডার্কেস্ট আফ্রিকা। মানচিত্রে স্থান নেই। ঝুল, মাকড়সা, আরশোলা। ড্রাকুলা, এমনকী ভ্যাম্পায়ার বেরোলেও অবাক হবার কিছু নেই।
সব শেষ, ভেতর। মাল নামাও, ঝাড়ো, আবার মাল তোলো৷ ওঠ বোস। বোস ওঠ। তখনই ভাবনা আসে, সংসার এক বিচিত্র পুতুলখেলা। কিছু বই, কিছু বাক্সপ্যাটরা, কৌটোকাটা, ন্যাকড়াচোপড়া, গোটাকতক শাল, আলোয়ান, জাম্পার, মাফলার, পুলওভার। সব নিয়ে ন্যাজেগোবরে। একবার এদিকে রাখছে, ওদিকে রাখছে। হিয়া কামাল হুয়া, হুয়া কা মাল হিয়া। তালা, চাবি, হিসেবের খাতা, ক্যাশবাক্স। রাবিশের হিসেব সামলাতে চুল পড়ে মাথায় মসৃণ টাক।
ভব পান্থবাসে এসে
কেঁদে কেঁদে হেসে হেসে
ভুগে ভুগে কেশে কেশে
দেশে দেশে ভেসে ভেসে
জীবনটা যে এত হিসেবের, আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না। সবসময়েই যেন যুদ্ধ চলেছে। একটু তালে ভুল হলেই ছিটকে চলে গেলে। আর ফেরার পথ নেই। শুধু এগিয়ে চলল, এগিয়ে চলো। কোথায়? আর কোনও জবাব নেই। থাকলেও, খুব হেঁয়ালির উত্তর। কেন? জীবনের লক্ষ্যে। কে যে কীসের লক্ষ্যে পৌঁছোচ্ছে। সবাই যেন সুকুমার রায়ের সেই লড়াই-খ্যাপা। কখনও যায় সামনে তেড়ে, কখনও যায় পাছে। উৎসাহেতে গরম হয়ে তিড়িং বিড়িং নাচে। মাতামহের কাছ থেকে পিতাঠাকুর একটি কথা শিখেছেন, ভোগ একপ্রকার রোগ বিশেষ। উঠতে বসতে এখন সেই নয়া বিধানের প্রয়োগ। ওই এক ব্ৰহ্মাস্ত্রে সব চাওয়া-পাওয়া ওঠাবসা খারিজ।
কেউ এসে বললেন, আহা ছেলেটার শরীর বড় খারাপ, একটু মেটের ঝোল, সঙ্গে একটি গুর্দা। দিতে পারলে গত্তি লাগত। সঙ্গে সঙ্গে খারিজ, ভোগ একপ্রকার রোগ বিশেষ। একটা করে নরম পাকের শাঁখ সন্দেশ? সঙ্গে সঙ্গে সেই এক খারিজ মন্ত্র। এর ওপর কোথা থেকে পাড়ায় এক মেনিদা নামক ভদ্রলোক এসেছেন! এসব মানুষের খবর পিতার বীর ভাণ্ডারে আসবেই। তিনি দশমাইল পথ হেঁটে অফিসে যান, হেঁটে ফিরে আসেন। অভাব নয়, স্বভাব। সব অসুখই তার প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সারে। সর্দি-জ্বর! নাসে, মাসে, বাসে। তিনি প্রথম দুটি রেখে মাঝের মাংস দাওয়াইটি বাতিল করে দিয়েছেন। এ বেলা একটু সরষের তেল দু’নাকে সাঁ করে টেনে নাও, মেরে দাও এক গেলাস জল। ও বেলাও তাই। নাস আর উপবাস। তারপর ছোট্ট একটি গালাগাল সহ উপসংহার, সর্দিজ্বরের বাবা সারবে শালা। পেটের গোলমাল? তলপেটে মৃত্তিকার প্রলেপ। প্রথমে উলঙ্গ। দ্বিতীয় ধাপে, মাটি ফাইন করে মেড়ে সেরটাক তলপেটে চাপিয়ে চুপ করে শুয়ে থাকো। শুকোতে শুকোতে একসময় ঝরতে থাকবে। পেটে তিনবার চাটি মেরে উঠে পড়ো। এই সর্বনেশে মানুষটি আমার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। চেহারা শুষ্কং কাষ্ঠং। মানুষের পক্ষে এর চেয়ে রোগা হওয়া সম্ভব নয়। এই বস্তুটির সঙ্গে একজন স্ত্রীজাতি আছেন। তার তৈরি প্রায় আধ ডজনের মতো ভবিষ্যতের স্ত্রী-পুং মেনি আছে। আমার বন্ধু সুখেন একটু অকালে পেকেছে। নরনারীর যৌন জীবন নিয়ে তার নিত্যনতুন আলোকপাতে আমরা সময় সময় বেসামাল হয়ে পড়ি। সে বলে পুং মেনি আর স্ত্রী মেনির ঘর্ষণে রাতে ওঁদের উত্তরের ঘরে আগুন জ্বলে। কাঠে কাঠে ঘষা লাগলে কী হয় রে ব্যাটা? দুটোই তো চকমকি? ডজন কমপ্লিট করে রিটায়ার করবে। সে যাই হোক। কে কী করবে, তা নিয়ে সুখেনের মাথাব্যথা থাকলেও আমার নেই। সেদিন গভীর রাতে মেনিদা বাড়ি ফিরে শোবার ঘরের জানলার গরাদে হাত আলুলায়িত করে মিসেস মেনিকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছেন। গলা প্রেমরসে টসটসে। ঘুমচোখে স্বামীর মুখ দেখে স্ত্রী বুবু করে অজ্ঞান। মুখে গাজলা। ছোট্ট পাড়া। তা ছাড়া যে-পাড়ায় সুখেনের মতো প্রতিভা, সে পাড়ায় এমন একটা ঘটনা, কাগজে ছাপা না হলেও, ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় না।
এই ক’দিন একটু বিশ্রাম পাওয়া গেল। শরীর ঢকঢকে হয়ে আছে। সবসময় ঘুম পাচ্ছে। মনের দেয়ালে আরাম হারাম হায় বাণীটি সবসময় ঝোলানো থাকলেও, শুলে উঠতে ইচ্ছে করে না, বসলে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। বেশ ঘুমঘুম চোখে, হাই তুলে তুলে দিন কাটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আকাশ, গাছের পাতা, পাখি, রাস্তায় মানুষের স্রোত দেখে দেখে ক্রমশই দার্শনিক হয়ে উঠছি। আমি চাই না মাগো রাজা হতে। উঠতে গেলে হাত পা কাপে। বেশ আছি মা এলিয়ে বসে!
দোতলার বারান্দা। জানলার কাছে বেঞ্চ পাতা। দেয়ালে পিঠ। ঠ্যাং দুটো সোজা ছড়ানো। পায়ের পাতার ওপর পাতা। বাঁ পাশে টেবিল। টেবিলের ওপর বাঁ হাত আলগোছা ঝুলছে। এক বিঘত দূরে একটি বই, রজেটস থেসারস। একটি ইংরেজি কাগজ। কর্মখালির বিজ্ঞাপনের পাতায় এখানে-ওখানে লাল পেনসিলের ঢ্যাঁড়া মারা। কর্মস্থলে যাবার আগে দুটি নির্দেশ আমার জন্যে রেখে গেছেন। থেসারস মুখস্থ করে যাও। ওই বিদ্যেটি তো ভালই জানা আছে। অঙ্কের মগজ থাক আর না-থাক। ইংরেজিটা যদি ভাল করে রপ্ত করতে পারো, তা হলে কোনওমতে দু’বেলা দুটো অন্ন হয়তো জুটবে। পিতার হোটেল চিরকাল ভোলা থাকবে না রে দামড়া। দ্বিতীয় নির্দেশ, ঢ্যাঁড়ামারা জায়গায় চিঠি ছেড়ে যাও। বলা যায় না লাগলেও লেগে যেতে পারে। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো ভাই, মিলিলেও মিলিতে পারে পরশপাথর। দুটো কাজই বেশি এগোয়নি। আকাশে মেঘের ফর্মেশনে হিমালয়। শরীরে তাগত এলেই, একদিন উড়বে সাধের ময়না। মাটির চেয়ে আকাশ কত উদার! এখানে কচু, ঘেঁচু, মুলো, ময়লা, আবর্জনা, গোঁফ, দাড়ি, ঘামের গন্ধ, তিরস্কার। ওপরে, ট্রপোস্ফিয়ার, আয়নোস্ফিয়ার, ইথার, ওজোন, মেঘ, পাখি, মহাওঙ্কারধ্বনি। নীচে ভাগাভাগি, মারামারি, পাঁচিল তোলাতুলি, পার্টিশন, ডিক্রি। অস্থির পঞ্চম অবস্থা।
রাস্তার দিকেই চোখ ছিল। একটা গাড়ি আসছে। আমাদের বাড়ির সামনেই থামল। এই ভূতমহলে, অসময়ে, বিনা নোটিশে কার আগমন রে বাবা! দরজা খুলে সামনের আসন থেকে যিনি নামলেন, তার চেহারা ডবলডিমের ওমলেটের মতো। সাদা জিনের প্যান্ট, হাফহাতা সাদা জামা, মাথায় একটা শোলার টুপি। মুখ দেখা যাচ্ছে না। সামনে ভুড়ি ঠেলে আছে আধ হাত। জল-ভরা বেলুনের মতো থিরিথিরি নাচছে। বাড়ির ঠিকানা দেখে হুংকার ছাড়লেন, হ্যাঁ, এই তো সাতান্ন নম্বর। ঠিক এসেছি। নেমে আয়।
নেমে আয় বলামাত্রই আমি পা গুটিয়ে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছি। কে নামে, কে নামে! পেছনের আসন থেকে একটা পা ঝুলে পড়ল। সুন্দর মনোহর লেডিজ স্লিপার। ফুলফুল শাড়ির প্রান্ত। সর্বনাশ! মহিলা। একজন নয়, ওয়ান আফটার এনাদার, দু’জন। বুড়ি নয়, যুবতী। খেল খতম, পয়সা হজম। নির্জন বাড়িতে বেঞ্চে বসে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হবার বারোটা বেজে গেল। বুকের মধ্যে ভয় হামাগুড়ি দিতে শুরু করেছে। কী করে সামলাব এই অপ্সরাদের। জিভ উলটে টাগরায় গিয়ে ঠেকেছে। মেয়ে দেখলেই আমি অবশ হয়ে পড়ি। খাটের তলায় কি জালার কোণে ঢুকে লুকোতে ইচ্ছে করে। আমি তো সুখেন নই।
সদরের কড়া নড়ে উঠল। মাথায় টুপি থাকায় ভদ্রলোক আমাকে দেখতে পাননি। টুপির কার্নিসে দৃষ্টি ঠোক্কর খেয়েছে। মেয়েদুটি ওপরে চোখ ঘুরিয়েই আমাকে দেখে ফেলেছে। আমার ছাগলদাড়ি, শীর্ণ ঘোড়ার মতো মুখ, দুটো ড্যাব ড্যাবা নির্বোধের মতো চোখ, বকের মতো গলা। এমন ভজুয়া-মার্কা চেহারা আর দুটি নেই।
সদর খুলে সামনে দাঁড়াতে হল। ভদ্রলোক টুপি খুলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি? হরিবাবুর ছেলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বাবা কোথায়?
অফিসে।
জানতে আমরা আসব?
আজ্ঞে না।
একটা চিঠি পাওনি তোমরা?
না তো!
তা হলে জানো না আমরা কে?
আজ্ঞে না।
না জানাই স্বাভাবিক।
চৌকাঠের এপারে আমাকে সাসপেন্সে রেখে ভদ্রলোক ড্রাইভার আর মেয়েদের বললেন, এই সামান উতারো। মেয়ে দুটির নজর আর আমার ওপর নেই। একবারই চোখে চোখে ঠোকাঠুকি হয়েছিল। এমন কিছু দর্শনীয় বস্তু নয়। অনেকটা রামছাগলের মতো। চারটের বদলে দুটো কেঠো কেঠো লিকলিকে পা। বরং বাড়িটা দর্শনীয়। নাম্বার ওয়ান নাম্বার টু-কে চোখ উলটে বললে, দেখেছিস মুকু, বাড়িটা কী ভীষণ পুরনো। ঘাড়ে ভেঙে পড়বে না তো!
যাক, একজনের নাম জানা গেল মুকু। পরক্ষণেই জানা গেল আর একজনের নাম, কনক। ভদ্রলোক ভেতরে থেকে একটা সুটকেস বের করে বললেন, দাঁড়িয়ে থেকো না কনক। সাহায্য করো, সাহায্য করো।
মুকু ছোট, কনক বড়। মুকু খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললে, দিদি, এ যেন স্বর্গের সিঁড়ি রে। দু’জনেরই হাতে মালপত্র। আমার ভাগে পড়েছে সুন্দর একটি বেতের বাস্কেট। জীবনে এমন বস্তু দেখিনি, দেখবও না। সর্ব অঙ্গে কারুকাজ। পিতার ভাষায় বলতে হয়, আহা, একটা ওয়ার্ক অফ আর্ট। নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে, মন খারাপ করে ঘণ্টাখানেক বসে থাকো। অনুশোচনায় অন্তশুদ্ধি হয়।
দোতলার বারান্দায় মালপত্তর এসে জমল। বেশি কিছু না, গোটা তিনেক সুটকেস, একটা বেডরোল, বিশাল একটা স্টিল ট্রাঙ্ক। ওপরে আনতে ভদ্রলোক আর গাড়ির ড্রাইভার হিমশিম খেয়ে গেলেন। রিয়েল মাল যদি কিছু থাকে তো ওর মধ্যেই আছে। আরও গোটা দুই বেতের বাস্কেট আর হাতব্যাগ। দুই বোন, একবার এদিকে ফিরছে, একবার ওদিকে ঝুঁকছে। একবার এটা তুলছে, ওটা নামাচ্ছে। চুলের বেণি চাবুকের মতো, গোরুর ন্যাজের মতো সপাসপ ডাইনে বাঁয়ে দোল খাচ্ছে। কথায় বলে, আহা, তিনি যেন ঘর আলো করে বসে আছেন! সত্যিই তাই। দুই বোন যেখানে যাচ্ছে, যেদিকে ছুটছে সেই দিকটাই আলো হয়ে যাচ্ছে। অমাবস্যা আর পূর্ণিমার একই সঙ্গে আবির্ভাব। স্বামী ঘুটঘুটানন্দের হাত ধরে দুই ফুটফুটান। এখন বেশ গলা ছেড়েই গাওয়া যায়, আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো কে দেখবি আয়।
অস্পষ্ট একটা পরিচয় পাওয়া গেল। মেজ জ্যাঠাইমার বোনের স্বামী। বহুকাল আগে একবার এসেছিলেন। থাকতেন রেঙ্গুনে। আইনজীবী ছিলেন। তখন আমাদের সংসার জমজমাট। সুন্দরী। সুন্দরী বউ। পিসিমাদের আসাযাওয়া। অতিথি অভ্যাগত। গানবাজনা। পায়ে পায়ে ঘুরছে সাদা সাদা কাবলি বেড়াল। হাজার টাকার ঝাড়বাতি জ্বলছে। বাড়িটাও তখন এত জরাজীর্ণ হয়ে যায়নি। তারপর অদৃশ্য মৃত্যু এল কালো ওড়না গায়ে দিয়ে। আমরা তখন গভীর ঘুমে। ফুঁ দিয়ে একটি একটি করে বাতি নিবিয়ে দিয়ে গেল। সব মৃত্যুই শেষ রাতে। অদ্ভুত অদৃষ্ট লিপি। অসুখ, মৃত্যু, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বোঝার মতো বড় তখনও হইনি। খুব ছোট গাছ। ঝড় বইছে ওপরে। ডালপালা নড়ছে। শব্দ শুনছি। গায়ে লাগছে না। ভোরে উঠে দেখি দীপ নিবে গেছে। ফিকে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে। পাকিয়ে। যে ছিল সে আর নেই। শূন্য ঘর। শূন্য শয্যা। এ কেমন যাওয়া! কেউ তেমন সহজ করে বলতেই পারে না। কেন যাওয়া, কেনই বা তবে আসা। শিশুকে বোঝানো হত, তিনি গেছেন, দূরে, আসবেন, তবে দেরি হবে। এই নাও, তোমার ছবির বই, খেলনা, এয়ারগান। ভুলে যাও, ভুলে থাকো। মেতে থাকো। সংসারে অনেক কাজ, অনেক আশা। খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে খোলা ছাদে। রাতে যার মাথার ওপর থমকে থাকে তারা-চমকানো আকাশ। সেই সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে। সন্ধেবেলা রোজই গা ছমছম করে উঠত। মনে হত আজও সে আসবে নাকি! ভোরে উঠে দেখব আমাদের আর একজন কেউ নেই। সেই চলে যাওয়া আর ফিরে না-আসার অভিমান মনের সুরটাই চিরকালের জন্যে এমনভাবে বেঁধে দিয়ে গেছে, এখনও ঠোঁট ফোলে। মনে হয় তারা আছেন যাঁরা নেই। নির্জন দুপুরে এ বয়েসের সংলাপ:
যারা ছিল একদিন; কথা দিয়ে, চলে গেছে যারা;
যাদের আগমবার্তা মিছে বলে বুঝেছি নিশ্চয়;
স্বয়ম্ভ সংগীতে আজ তাদের চপল পরিচয়
আকস্মিক দুরাশায় থেকে থেকে করিবে ইশারা ॥
কিছুই তো মনে নেই সেদিনের কথা। শীতের সকালে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। অস্বচ্ছ পরদার আড়ালে পড়ে আছে জীবনের ফেলে আসা দিন। কে হাত ধরেছিল; কে কোলে নিয়েছিল, কে চুমু খেয়েছিল আদর করে! সবই অস্পষ্ট, ভাসা ভাসা। কল্পনা করা যায়, জোর করে কিছু বলা যায় না। আজ জ্যাঠাইমাও নেই, জ্যাঠামশাইও নেই। কিছু আগে পরে দু’জনেই চলে গেছেন।
টেবিলের ওপর টুপি নামিয়ে রেখেছেন। মাথার চুলে কমান্ডার কাট। চোখদুটো মাংসর চাপে ছোট ঘোট। মুখ গোলাকার। দুটি চিবুক তৈরি হয়েছে। বেল্টের চাপে পেট ফাটোফাটো। মানুষের মন কত খারাপ দিকে ছোটে! হঠাৎ মনে হল, এইরকম ভদ্রলোকের কেমন করে এমন সুন্দর দুটি মেয়ে হল? অবাক কাণ্ড! জন্ম রহস্যটা যদি জানা যেত! মনকে এক ধমক, ব্যাটা! পড়াশোনা চুলোয় গেল, যা জানলে কাজ হয় তা জানা হল না। জন্ম-রহস্য!
দু’পাশে দুটো পা ছড়িয়ে ভদ্রলোক বসেছেন। মাথার চুলে কুচুর কুচুর হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, আমি তা হলে গিয়ে তোমার মেসো হলুম।
যা হয় একটা কিছু হলেই হল। একটা ব্যাপার লক্ষ করে বেশ অবাক হচ্ছি। সেটা হল আমার শরীর। এতক্ষণের দুর্বলতা, কিছু না করার ইচ্ছে, আলস্য, সব হাওয়া। শরীরে যেন বেশ বল এসে। গেছে। কামিনী আর কাঞ্চন, এর চেয়ে ভাল টনিক আর কী আছে! আমার কথা নয়, নির্মল পাগলার। খুব জ্ঞানী মানুষ। গোটাকতক বিষয়ে এম এ সব ক’টাতেই ফার্স্টক্লাস। পড়ে পড়ে পাগল। জমিদারের ছেলে। নেই নেই করে এখনও বেশ আছে। বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন। মালকোঁচা মারা ধুতি। শার্টের ওপর গেঞ্জি। ধুতির ওপর আন্ডারওয়ার। লোকে যা করে তিনি তার উলটোটাই করবেন। নির্মলদার গল্প, বাহাত্তর বছরের বুড়ো, খাবিখাওয়া অবস্থা। উঠোনে কেত্তন-পার্টি রেডি। খোলের ওপর হাত নিসপিস করছে। বুড়ি ঘর থেকে কেঁদে উঠলেই কপাক কপাক করে খোল বেজে উঠবে। বুড়োর চোখ গেল দরজার দিকে। রকে বসে মানদা বাসন মাজছে কোমর দুলিয়ে। বেশ উঁশা যৌবন। বুড়ো থপাক করে খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল। আরে করো কী করো কী?
বড় অশ্লীল!
নির্মলদা বলবেন, চপ শালা। সারা পৃথিবীতে মানুষের শরীরে মাদল বাজছে। কামের জন্যেই come. পুড়ে ছাই হলে তবেই calm, ওসব সাধুগিরি আমার কাছে ফলাতে আসিসনি। নির্মলদার রণহুংকার:
I storm and I roar, and I fall in a rage,
and, missing my whore, I bugger my page.
কী জানি বাবা, কীসে কী হয়। আমার এই ভাবনা পিতাঠাকুর কোনওক্রমে জানতে পারলে হতাশায় আত্মহত্যা করবেন। উঃ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! কেন যে ছেলেরা পিতার হাতছাড়া হয়ে যায়! বড় ভাবনার কথা!
একটু গরম জল হলে…মেসোমশাই কিন্তু কিন্তু গলায় বললেন।
চা? আমার প্রশ্ন! একটু চা করে এঁদের সেবা করতে পারলে ভাবব, তবু একটা কাজের কাজ হল।
না, চা আমরা কেউই খাই না। তোমার নামটা কী বাবা? ভুলে গেছি, অনেকদিন আগে একবারই তো এসেছিলুম, তখন তুমি এতটুকু।
আমার নাম পিন্টু। গরম জল কী করবেন?
স্নান করতে হবে। নতুন জায়গা, ঠান্ডা জল গায়ে ঢালতে চাই না।
খুবই চিন্তার কথা। প্রাইমাস স্টোভে চায়ের জল গরম হতে পারে, তিনজনের স্নানের জল গরম করতে হলে উনুন ধরাতে হবে। সে এক ভয়ংকর ব্যাপার।
একটু বসুন তা হলে, উনুন ধরাই।
তুমি ধরাবে কেন? কনক! মেয়েকে ডাকলেন।
দু’বোন কিছু দূরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। কীভাবে কী করবে বুঝতেই পারছিল না। শূন্য বাড়ি। কোনও মহিলা নেই। প্রায় ধর্মশালার মতোই।
আসি, বলে কনক জানলার ধার থেকে সরে এল।
তুমি সব দেখেশুনে নাও। তোমাদের দু’বোনকেই সব করতে হবে বাপু। আসার পথে বাজার দেখে এলুম, আমি কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে আসি।
সবই বাড়িতে আছে। আপনাকে আর বাজারে যেতে হবে না। ডিম আছে, তরিতরকারি আছে, চাল, ডাল সব আছে।
তা হলেও!
তা হলে আবার কী?
বেশ, যা আছে তাইতেই হোক। তোমার বাবা আসুন, তারপর যা-হয় হবে। কনক, তুমি ওদিক। সামলাও, মুকু, তুমি এদিকে সব খুলেটুলে ফেলো। আগে স্নান, তারপর কাপড়টাপড় ছেড়ে রান্না। সামান্য কিছু করলেই হবে। বেশি বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।
আমাদের রান্নাঘর আর এক মহলে। দুটি মহল বারান্দা দিয়ে জোড়া। বারান্দার বাঁক ঘুরতে ঘুরতে কনক বললে, বাঃ, তোমাদের বাড়ির এদিকটা তো ভারী সুন্দর। ওদিকটা শহর, এদিকটা গ্রাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ, গাছপালা রয়েছে তো। একটু এগোলেই গঙ্গা।
আমাকে অত ভক্তি করে আজ্ঞে বলতে হবে না। আমি তোমার দিদি নই।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আবার সেই আজ্ঞে?
কী করি বলুন, কীরকম একটা অভ্যাস হয়ে গেছে।
আবার বলুন! আমার সঙ্গে খবরদার আপনি আজ্ঞে করবে না। নীচেটায় পাতকো বুঝি? বারান্দার ভাঙা রেলিং ধরে সামান্য ঝুঁকতেই আ-হা আহা করে হাতের ওপরদিকটা ধরে আমি টেনে নিলুম, ভাঙা, ভাঙা, পড়ে যেতে পারেন।
কোথায় ভাঙা?
এই যে রেলিং। সারা বাড়িটাই তো ভেঙেচুরে খলখলে।
একটু সারাওটারাও না কেন? এমন সুন্দর বাড়ি! কত বড় বলো তো।
টুকটাক সারাই বাবা নিজের হাতেই করেন। বিরাট ব্যাপার তো, একা ঠিক সামলাতে পারেন না। আর আমি তো একটা অপদার্থ।
তুমি কী করবে? মিস্ত্রি লাগালেই তো হয়!
বাবা বলেন, সেলফ হেলপ ইজ বেস্ট হেলপ।
পিতাঠাকুর রান্নাঘরটিকে সকালেই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রেখে গেছেন। কথায় কথায় বলেন, এ হল পুরুষের কিচেন, মেয়েদের হেঁশেল নয়। আঁস্তাকুড় আর আঁতুড় এই হল বাঙালির দুই বৈশিষ্ট্য। রান্নাঘরের সামনে বারান্দা পুব দিকে কিছু প্রশস্ত। সেই অংশে গুছিয়ে রাখা কয়লা আর ঘুঁটে। ওই যে নীচের বাগানে পড়ে আছে কয়লার রঙে কালো একটি পাথর, পাশেই সদ্যোজাত সন্তানের মতো গড়াগড়ি যাচ্ছে একটি হামানদিস্তের হাতল। কয়লা আগে ওইখানে আসবে। ঘণ্টাখানেকের পরিশ্রমে টুকরো টুকরো হয়ে, ভারে ভারে ওপরে উঠবে।
কনক বললে, বাঃ ভারী পরিষ্কার তো! কে এমন সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে? তুমি?
না, ফাদার।
বাব্বাঃ, মেয়েছেলেও হার মেনে যাবে!
মনে মনে ভাবলুম মেয়েছেলে? মেয়েছেলে সম্পর্কে পিতার ধারণার কথা জানলে মেয়েছেলে হয়ে জন্মাবার সাধ চিরকালের মতো ঘুচে যাবে।
আমি তা হলে লেগে পড়ি, কী বলে?
শাড়ির আঁচল কোমরে জড়িয়ে কনক কয়লার গাদার সামনে উবু হয়ে বসল। শাড়িটা মনে হয় বেশ দামি। কয়লার গুঁড়োয় ময়লা হয়ে যাবার সম্ভাবনা। এ কার্যটি তো রোজ সকালে আমাকেই করতে হয়। আমিই কেন হাত লাগাই না! এর নামই বোধহয় দুর্বলতা! কোনও গুফো লোক যদি এই মুহূর্তে কয়লার গাদায় বসতেন আমার মন কি এমন আকুলি-বিকুলি করত!
সরুন, আমি উনুন সাজিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই।
কেন?
শাড়িতে কালি লেগে যাবে যে!
বাঃ, লজ্জা তো বেশ কেটে এসেছে! জিভ তো আর তেমন জড়িয়ে যাচ্ছে না। কেমন মিঠি মিঠি বাত বেরোচ্ছে! এর নামই কি অ্যাটাচমেন্ট! পিতা যেমন মাঝেমধ্যে জগৎ-সংসারের দিকে তাকিয়ে হুংকার ছাড়েন, ছায়া, মায়া, কায়া।
কয়লা তোলার, নিয়ে যাবার অনেক সাজসরঞ্জাম আছে। পিতার উদ্ভাবন। হাত না ঠেকালেও চলে। যেমন মিনি বেলচা। ছোট বালতি। কয়লার গাদায় বেলচা চালাতেই এঁকেবেঁকে কিলিবিলি করে লাল মতো যে প্রাণীটি বেরিয়ে এল, সেটি একটি মধ্যম মাপের দাঁড়াটাড়াঅলা তেঁতুলে বিছে। গেঁটে গেঁটে শরীর।
মা গো, বলে কনক স্প্রিং-এর ইঁদুরের মতো লাফিয়ে সরে গেল। আমার তো তেমন সাহস নেই। ভিতুই বলা চলে। কনকের শরীরের আড়াল থেকে সেই রসহীন শুষ্ক প্রাণীটিকে একবার দেখে। নিলুম। চালচলন আমার মতোই উদ্দেশ্যহীন। নিতান্ত ভীরু ব্যক্তিও বাহবার লোভে বড় কাজ করে ফেলে। আমার উক্তি নয়, স্বামী বিবেকানন্দের। ভাগ্যিস পা দিয়ে ঘেঁতো করার চেষ্টা করিনি। বেলচা দিয়ে এক ঘা লাগাতেই তিনি কেতরে কেতরে আবার কয়লার গাদায় গিয়ে ঢুকলেন।
কনক বললে, এইবার কী হবে?
বীরের উক্তি, কী আবার হবে? পাশ থেকে কয়লা নিয়ে উনুন ধরাব।
যদি কামড়ায়?
ওষুধ আছে। কেরোসিন তেলে কয়লা ঘষে লাগিয়ে দোব। কিছুক্ষণ জ্বলবে, তারপর সব ঠান্ডা।
তোমাদের বাড়িতে আর কী কী আছে?
আর এক রকম বিছে আছে, তার নাম কঁকড়া বিছে। নীচের বাগানে গোটাকতক পোষা সাপ আছে। বড় বড় পাঞ্জামাপের মাকড়সা আছে। টনখানেক আরশোলা আছে। ইঁদুর আর ছুঁচোর অভাব নেই। সন্ধেবেলা বেশ বড় সাইজের একটা চামচিকি বেড়াতে আসে। মাঝরাতে চিলেকোঠায় বসে। ডাকে একজোড়া প্যাচা।
মহীশুরের টানাটানা চোখ, পাঞ্জাবের খাড়া নাক আর কুলু আপেলের রঙে রাঙানো গাল নিয়ে কনক অবাক হয়ে চেয়ে রইল। নাকের ডগায় ছাঁট-হিরে ঘাম।
১.০৪ Nothing begins and nothing ends
উনুনে আগুন পড়েছে। ধোঁয়া বের করার একটা কেরামতি আমার পিতাঠাকুরের উদ্ভাবনী মাথা থেকে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর, ডিসপোজালে এখানে-ওখানে নানারকমের জিনিস বিক্রি হত। সেই পড়তি মালের আড়ত থেকে হরেকরকমের জিনিস কেনার একটা নেশা চেপে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন। অনেক কিছুই এসেছিল, কাজেও লেগেছিল। সবচেয়ে কাজে লেগেছে জাহাজের একটা চিমনি। ঠ্যালাগাড়িতে লোড হয়ে সেই বস্তু যখন পাড়ায় ঢুকল, হাতি দেখার মতো ভিড় জমে গেল। কী তার বাহার! কালোর ওপর লালের ডোরা। ঠ্যালায় চেপে চিমনি চলেছে, পেছন পেছন চলেছে একপাল কুচোকাঁচা। হইহই ব্যাপার।
প্রতিবেশী রকে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আজ দেখছি পেল্লায় জিনিস পেয়ে গেছ হরিশঙ্কর! ওটা কী?
দেখতেই পাচ্ছেন, জাহাজের চিমনি।
এবার তা হলে একটি মাস্তুল জোগাড় করে চাঁদ সদাগরের মতো ভেসে পড়ো জলে। মিস্ত্রিকে হুকুম হল, ফিট করে রান্নাঘরের ছাদে। দেখেই তার চক্ষুস্থির। ছাদ এ লোড নিতে পারবে না বাবু। ঘর নেমে আসবে। তুমি লোডের কী বোঝো হে। যা বলছি তাই করো, রোজ বুঝে নিয়ে সরে পড়ো। মিস্ত্রি বললে, এর ফঁদটা একবার দেখেছেন বাবু? ছাদের অতটা খাবলে তুলে নিলে, ছাদের আর থাকে কী? সবটাই তো চিমনি হয়ে গেল। বর্ষায় তো বান ডাকবে ঘরে। তা ঠিক, বলে ভাবতে বসলেন। চিমনি কিছুদিন পড়ে রইল আড় হয়ে একজোড়া দোয়েল এসে সংসাব পেতে বসল। বাচ্চাকাচ্চাও হল গুটিকয়েক। সকাল সন্ধেয় খুব গান শোনা গেল বছর খানেক। অবশেষে সেই চিমনি ছটকাটে সরু হয়ে দেয়াল ফুড়ে সোজা উঠে গেল আকাশে। আস্ত একটা পাঠাকে কাবাব বানানো যায় এমন একটি কড়া উপুড় হল উনুনের মুখে। কড়া যেদিন এল সেদিনও প্রতিবেশী বললেন, যাক, এতদিনে তা হলে পেলে। এইবার চিমনি ফিট করে ভেসে পড়ো সাত সমুদ্রের জলে।
চিমনি দিয়ে যেদিন ভলকে ভলকে ধোঁয়া উঠল আকাশে, সেদিন কী আনন্দ! জমিদারবাবু যেন পায়রা ওড়াচ্ছেন! ব্র্যাভো, ব্রাভো, হোয়াট এ গ্র্যান্ড সাকসেস! প্রতিবেশীরা দেখতে এলেন জনে জনে। একটা কল বানিয়েছ বটে হরিশঙ্কর, তোমার মাথা আছে! ব্যান্ডেজ করা ডান হাত তুলে। অভিনন্দনের প্রত্যুত্তর জানাচ্ছেন আহত হরিশঙ্কর হাসিমুখে। চিমনি ছাদে ওঠার আগে মোক্ষম একটি লাথি ঝেড়ে গেছে পিতার ডান হাতে।
সেই কড়া এখন আমাদের প্রায় কাত করে ফেলেছে। ভলভল করে ধোঁয়া উঠছে। কড়া বিদ্রোহ করে বসে আছে। টানা হ্যাঁচড়া চলেছে খুব। কনকের চুল ছুঁড়ে ধোঁয়া উঠছে। অবশেষে তিনি ঘাড়ে চাপলেন। চোখ লাল, জলে ভরা। কনক বলল, বাব্বাঃ, চোখে এখন সরষেফুল দেখছি।
কন্নকের চালচলন দেখে মনে হচ্ছে মনটা বেশ সাদা। খুব একটা অহংকার টহংকার আছে বলে মনে হয় না। সুখেনের থিয়োরিই ঠিক। যারা সুন্দর, তাদের সবকিছুই সুন্দর। বিপদ কটা-সুন্দরীদের নিয়ে। দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। ঠোঁট সবসময় উলটেই আছে, আমার ভাই দুধটুধ ভাল লাগে na। মা যখন রাতে শোবার আগে দুধ নিয়ে সাধাসাধি করে আমার কান্না পায়। যাদের দুধ জোটে না, তারা বেশ আছে! সুখেন বলে, মেলামেশা করতেই যদি হয় তো সাতপুরুষে বড়লোকের সঙ্গে মিশতে পারিস, একপুরুষে দেখলেই সাত হাত দূরে ছিটকে পালাবি।
আঁচলে চোখ মুছে কনক বললে, এইবার তোমার কোথায় কী আছে দেখিয়ে দাও। বেশি ঝামেলার দরকার নেই। শরীর আর বইছে না গো! একটু শুতে পারলে ভাল হয়।
আমি একটু-আধটু রাঁধতে পারি। যদি আপত্তি না থাকে!
থাক আর বেঁধে দরকার নেই। তোমার কেরামতি পরে দেখা যাবে।
মাছ ছাড়া সবই আছে। সুব্যবস্থার শেষ নেই। ফর্দ করে বাজার হয়। তেল, নুন, মশলাপাতি সারা মাসের মতো মজুত। লেবেল-আঁটা ঝকঝকে টিনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাকে পাশাপাশি ক্যাটালগ মিলিয়ে অবস্থান করছে। লাইব্রেরির বইয়ের মত। ঝালের দিকে ঝাল, মিষ্টির দিকে মিষ্টি। চিনি, মোটা, মাঝারি, মিহি দানার, ভেলি, কাশীর চিনি। লাইন দিয়ে চলেছে ডালের কৌটো। এমন মানুষকে দেখিয়েই লোকে বলে, বিয়ে হলে তোমার বউ বড় সুখে থাকবে হে। আর কী হবে! সবই তো শেষ হয়ে গেছে। মা তোতা আর ফিরে আসবে না। কনককে দেখে মনটা কেমন যেন করে উঠছে। স্বপ্নে পুরনো ঘটনা মানুষ দৃশ্য দেখা দিয়ে ভেসে চলে যায়। মায়ের চেহারা আমার মনে নেই। যাঁরা দেখেছেন তাদের বর্ণনা থেকে একটা সাদৃশ্য তৈরি হয়েছে কল্পনায়। আমার মা বোধহয় কনকের মতোই দেখতে ছিলেন। পাতলা পাতলা পায়ের চেটো, ছিপছিপে গড়ন, কোমর-ছাপানো চুল। আমি অবশ্য ভোলামামার মতো আমার মা এসেছেন, আমার মা এসেছেন বলে চিৎকার করব না। ভোলামামার এই পাড়াতেই বাস। মাছের ভেড়ি আছে। রোজ রাত বারোটার সময় মদ খেয়ে বাড়ি ফেরেন। মামি রোজই ঝাটাপেটা করেন। এক এক ঘা ঝাটা পড়ছে পিঠে, মামা চিৎকার করছে, আমার মা এসেছে, মা। মায়েরা যেমন ছেলেকে মুখপোড়া বলে, মামিও তেমনি মামাকে মুখপোচ্ছা। বলেন, ঠিক ওই সময়টিতে। পাড়ার গিন্নিবান্নিরা সেই স্ত্রীলোকটিকে সোহাগ করে বলেন, আহা তোমার কী ভাগ্য মা, রোজই ঝেটিয়ে স্বামীকে ঘরে তুলতে হয়। তবে এই গ্রীষ্মের দুপুরে কোনও এক রমণীর চলনে বলনে অতীতের দিন ফিরে এসেছে মনে করে মন যদি সুখী হতে চায়, তোক না!
এই হল তোমার গিয়ে আলু। কনক হিসেব মেলাচ্ছে। পটল, কুমড়ো, তেঁড়স, ঝিঙে, করলা, বরবটি, পেঁপে, কাঁচকলা, মোচা, ঘোড়, কিছুই দেখছি বাকি নেই। ও বাবা, ডুমুরও রয়েছে দেখছি। তুমি কী খাবে?
আমার যে-খানা পাকানো আছে সে খানা দেখলে কনক ঘাবড়ে যাবে। যেমন তার বর্ণ, তেমনি তার গন্ধ।
আমার আছে রুগির ঝোল আর গলা ভাত। সবে পেটের অসুখ থেকে উঠেছি তো!
তা হলে আমিও ঝোল ভাত করে ছেড়ে দিই।
ডিম আছে।
না ডিম চলবে না গো। বাবার আবার অনেক বায়নাক্কা। ডিম খেলে মানুষের পেট গরম হয়। পেট গরম হলে মাথা গরম হয়। ডিম না খেয়ে বাবার মাথা যে কত ঠান্ডা হয়েছে দু-এক দিনের মধ্যেই টের পাবে। যাক উনুন ধরতে ধরতে চানটা সেরে ফেলা যাক। তোমাদের চানের ঘর?
নীচে। চৌবাচ্চায় জল আছে। পাতকো থেকে টাটকা তুলে নেওয়া যায়।
তা হলে আমিই আগে যাই।
মুকু বেড়াতে বেড়াতে এপাশে চলে এসেছে। এরই মধ্যে চুলটুল খুলে ফেলেছে। হাতে একটা চিরুনি। পেছনটা রুপো বাঁধানো। চুলের ডগা ধরে খেচাত খেচাত করে বারকতক আঁচড়ে বললে, বাড়িটা বেশ নির্জন, না রে দিদি?
জন্তুজানোয়ারও আছে। রাত আসুক দেখতে পাবি।
ওপাশ থেকে ডাক ভেসে এল, মুকু, মুকু, আমার সুটকেসের চাবি কোথায়, মুকু, আমার সুটকেসের চাবি কোথায়?
আসি, বলে মুকু চলে গেল। এরা দু’বোনই কেউ ডাকলে আসি বলে উত্তর দেয়। গলার স্বরও বেশ মিষ্টি।
আর কী কী ভাল ভাল জিনিস স্বভাবে লুকিয়ে আছে কে জানে? আমার পিতাঠাকুর প্রথমে মুগ্ধ হবেন, তারপর আমার স্বভাবের খুঁত বের করে, এই উৎকৃষ্ট উদাহরণের পাশে ফেলে আমাকে নীচে নামাতে নামাতে মনুষ্যাধম জন্তু বলে, তলায় একটি রেখা টেনে দেবেন।
পেছন মহল ছেড়ে বার মহলে এসে দেখা গেল এলাহি ব্যাপার। বিশাল ট্রাঙ্কের ডালা খোলা। তার মধ্যে শুধু বই আর বই। জামা, কাপড়, জুতো, ছাতা, লাঠি, চশমা, তোয়ালে, গামছা, ধরাশায়ী। সৈনিকের মতো চারপাশে ছড়ানো। একটা সুটকেস মুখ ভার করে পড়ে আছে একপাশে। তার সামনে থেবড়ে বসে আছে মুকু।
মেসোমশাই হাঁটুতে চাপড় মারতে মারতে বললেন, তুমি আজকাল ভীষণ কেয়ারলেস হয়ে যাচ্ছ মুকু। আমার বেশ মনে আছে তোমাকে আমি চাবিটা দিয়েছি। দেবার সময় এ কথাও বলেছি, দেখো হারিয়ো না যেন।
মুকু খুব ধীর গলায় বললে, সব চাবিই ঠিক রইল, আর ওটাই হারিয়ে গেল?
এ কথার মানে? তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমি মিথ্যে কথা বলছি! তোমাকে না দিয়ে বলছি দিয়েছি। আমি তোমার চোখে এত হীন, এত নীচ! তা হলে তো আমার আর বেঁচে থাকা চলে না। আমার আত্মহত্যাই করা উচিত। তোমার মা ঠিকই বলে, মেয়েরা কখনও আপনার হয় না।
মুকুর মুখ চুন। কনক কিছু বলব বলব করেও বলার সাহস পাচ্ছে না। মেসোমশাই টেবিলের ওপর থেকে টুপিটা তুলে নিলেন। মনে হয় টুপি পরেই আত্মহত্যা করবেন। যেতে হলে সেজেগুঁজেই যাওয়া ভাল। আমাদের পাড়ার গবা গামছা পরে গলায় দড়ি দিয়েছিল। মহিলারা। দেখতে ছুটলেন। ফিরে আসতে আসতে বললেন, মুখপোড়া ভারী অসভ্য। কুমুদবাবু ফুলশয্যার পোশাকে গলায় মালাটালা পরে কলকাতার ভাল হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে বিষ খেয়ে মারা গেলেন। নীল চিঠির কাগজে লিখে গেলেন, চিন্তামণি, আমার এই দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো। ইতি, কুমুদের লাশ। কে এই রমণী! সবাই বললে, ফিমের হিরোইন।
টুপিটা তুলতেই কনক কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের গলায় বললে, ওই তো আপনার। চাবি।
মেলোমশায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। রিঙে লাগানো ছোট দুটি চাবি। মুকু ফোঁস করল। কপাল ক্রমশ হাঁটুর দিকে ভাঙছে। পিঠ নুয়ে পড়ছে। ফুলে ফুলে উঠছে। মেসোমশাই বললেন, বয়েস বাড়ছে, বয়েস। কিচ্ছু করার নেই। এজলাসে উঠে বাদী বিবাদী নাম ভুল হয়ে যায়। ছ’বার কোঁত পেড়ে আজকাল শিবস্তোত্র পড়তে হয়। বাতে ধরেছে। তবু কান্না! কনক, আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নাও। বলো, টু আর ইজ হিউম্যান, টু ফরগিভ ডিভাইন।
কনক মুকুর পিঠে হাত রেখে বললে, কী হচ্ছে কী? শুধু শুধু কাঁদছিস কেন?
দিদির কথায় ফল উলটো হল। মুকু হাপরের মতো ফুলতে লাগল আর সাপের মতো হিসহিস।
বাড়ি ভরে গেছে মেয়েলি জিনিসপত্রে। লম্বা লম্বা শাড়ি নেমে গেছে দোতলা থেকে একতলায়। তারে ঝুলছে সায়া, ব্লাউজ। বারান্দায় হিল-তোলা জুতোচুল বাঁধার ফিতে, মাথার কাটা, সেফটিপিন, মাথায় মাখার তেল, সাবান। সারা বাড়িতে একটা মেয়েলি গন্ধ। জানি না বাবা, পিতাঠাকুর ফিরে এসে কী মূর্তি ধরবেন। একটা নয়, দু-দুটো মেয়ে। ছোট হলে কথা ছিল না, বেশ বড়সড়। অতিথিরা খাওয়াদাওয়া সেরে দক্ষিণের ঘরে একটু কাত হয়েছেন। দীর্ঘ ট্রেনভ্রমণের ক্লান্তি কাবু করে ফেলেছে। মেসোমশাইয়ের নাক ডাকছে মিঠে সুরে। যতটুকু জানা গেল, এঁরা মাসখানেক থাকবেন। মুকু বি এ পরীক্ষা দেবে, কনকের হবে চিকিৎসা। টনসিলে বেচারা বড়ই ভুগছে। কনক বি এ পাশ করে বসে আছে। আরও পড়বে না বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, এই নিয়ে দোটানা চলছে। পড়লে ফিলজফি নিয়ে এম এ করবে। অসম্ভব ভাল রাঁধে। এত সুন্দর ঝোল বেঁধেছিল, মুখে লেগে আছে এখনও। ওই সেই সংগীতের মতো। পিতা রান্নার থিয়োরি খুব ভালই জানেন, প্র্যাকটিক্যালে কনকের কাছে গোহারান হারবেন।
আমিও শুয়ে পড়েছি। আরাম হারাম হ্যাঁয় নোটিশটি আপাতত উলটে রেখেছি মনের দেয়ালে। যেখানে শুয়ে আছি, সেখান থেকে কনক আর মুকুর পা দেখা যাচ্ছে। মেসোমশাইয়ের ভুড়িটি ওঠানামা করছে নিশ্বাসের তালে তালে। নির্জন দুপুরে আড় হয়ে শুয়ে শুয়ে যুবকের যুবতীর সুডৌল পদযুগল দর্শন সম্পর্কে শাস্ত্রের কী সাবধান বাণী আছে জানি না। চোখ যদি অনবরতই ওদিকে চলে যেতে চায় তা হলে আমি কী করতে পারি। বিল্বমঙ্গল হয়ে যাব? রে চক্ষু, এই কাটার খোঁচায় দিলুম তোর বারোটা বাজিয়ে। সে মনের জোর আমার নেই। বাঁ দিকের দেয়ালে ক্যালেন্ডারে কেষ্টঠাকুর বসে আছেন কদমতলায় নধর একটি গাভীর গলা জড়িয়ে। সেদিকে তাকাতে কী হয়! দ্বারকা মথুরা হয়ে সোজা কুরুক্ষেত্রে চলে যাও না কেন! সেখান থেকে ঠেলে ওঠো মহাপ্রস্থানের পথে। মন যার লোভী সে হবে সন্ন্যাসী! কুঁজোর চিত হয়ে শোবার শখ। একবার করে ক্যালেন্ডারের দিকে ঘাড় ঘোরাচ্ছি, ঘাড় অটোম্যাটিক ঘুরে যাচ্ছে উলটো দিকে। লাল মেঝের ওপর দিয়ে চিনি-লোভী পিঁপড়ের মতো দৃষ্টি গুটিগুটি গিয়ে ঠেকছে সঠিক স্থানে। পা। পা থেকেই কি পাপ শব্দ এসেছে। ভাষাতত্ত্ববিদরা বলতে পারেন। সায়ার সামান্য অংশ, শাড়ির পাড়। চিত্ত বড় চঞ্চল হয়ে উঠছে। যে নিজেকেই নিজে সামলাতে পারে না, সে সামলাবে জগৎ! এই বড় বড় চোখে তাকিয়ে। কামিনীকাঞ্চনাসক্ত তাবৎ মানবকুলকে স্তম্ভিত করে ফেলবে! দ্বিতীয় বিবেকানন্দ হয়ে পৃথিবী কাঁপাবে! কুলকুণ্ডলিনী জেগেছে ঠিকই তবে তিনি সহস্রারে না উঠে নীচের দিকে নেমে বসে আছেন। ভিমরুলের চাকে খোঁচা। এই তো গত পরশু দিনই পড়লুম, শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন কামিনীকাঞ্চন ভোগ। যে-ঘরে আচার, তেঁতুল আর জলের জালা, সে ঘরে বিকারের রোগী থাকলে মুশকিল। আমি কি বিকারের রোগী! তিন দিন আগে আমাশার রোগী। আজ দেখছি বিকারের রোগী! মনের কোনও উন্নতি হয়নি। অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। আহা, ছি ছি।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় সুখেন চিৎকার করছে, পিন্টু, পিন্টু। একটা গলা করেছে বটে। যেমন ষাঁড়ের মতো চেহারা, তেমনি গলা। স্কুলে পণ্ডিতমশাই সুখেনের নাম রেখেছিলেন, সুখেন ষণ্ড। দিবাস্বপ্ন চটকে গেল। মেসোমশাই ধড়ফড় করে উঠে বসে বললেন, কে, কে? উঠবেনই তো। গলা শুনে মরা মানুষও উঠে বসবে। জানলার ধারে গিয়ে বলছি, দাঁড়া দাঁড়া, মেসোমশাই। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে মেঘগর্জনের সুরে বললেন, অসভ্যের মতো চেঁচাচ্ছ কেন, রাসকেল! মেরে মুখ ছিঁড়ে দোব। সুখেন কেমন যেন হয়ে গেল। এই ধরনের আকাশবাণীর জন্যে প্রস্তুত ছিল না! এ আবার কে রে বাবা! বোঝে ঠ্যালা! বাবারও যেমন বাবা থাকে, যাঁড়ের ওপরেও ষাঁড় থাকে।
আমাকে প্রশ্ন করলেন, ছেলেটি কে? তোমার বন্ধু?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ইডিয়েট।
কনক আর মুকু দু’জনেই উঠে এসেছে চোখ রগড়াতে রগড়াতে। পৃথিবীর সমস্ত পিতাই যেন ষড়যন্ত্র করে বসে আছেন৷ বজ্রের মতো কঠোর। দাদু না হওয়া পর্যন্ত কোমল হব না। স্রেফ চাবকে যাও। মেয়েদের এক ধমক লাগালেন, ওখানে কী, ওখানে। যাও ভেতরে যাও। জানোয়ার দেখোনি?
ধমক দিয়ে ভালই করেছেন। আমার সমর্থন আছে। সুখেনের সামনে সুন্দরীদের না বেরোনোই উচিত। যেমন করেই হোক সুখেন ভাব জমাবে। উভয়পক্ষ ক্রমশই জমাট হয়ে উঠবে। অন্য কেউ আর পাত্তা পাবে না।
সুখেন বলে, তোমরা যে যাই বলল, আমার জন্ম মেয়েদের জন্যেই। খেদিই হোক, বঁচিই হোক, অপ্সরাই হোক, সব আমার। বেশ হয়েছে ব্যাটা। চেঁচা গাঁক গাঁক করে।
নীচে নেমে দরজা খুলতেই সুখেন বললে, লোকটা কে রে?
মেসোমশাই।
রাস্তায় দেখা হোক, একদিন পেছন থেকে কাছা খুলে দিয়ে পালাব।
খুলে দেখ না! জজসাহেব। ঘানি ঘুরিয়ে ছেড়ে দেবেন।
মেয়েদুটো কে রে? নিচু ফিসফিসে গলায় সুখেন জানতে চাইল।
মেসোমশাইয়ের মেয়ে।
সুখেন সামান্য দমে গেল। সুর পালটে বললে, জজসাহেবের মেজাজ এইরকম না হলে মানায় না। কত মারাত্মক মারাত্মক আসামিকে ফাঁসিতে লটকাতে হয় বল? চল, ওপরে চল, প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নিই।
তুমি যাও ডালে ডালে। তোমাকে আমি চিনি না! মাতামহের গান, থেকে থেকে যেন মাগো লুচির গন্ধ পাই। আর একটু ভয় না দেখালে সুখেন ঠেলেঠুলে ওপরে উঠে পড়বে, তারপর ব্যাপার কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে? আকাশপ্রদীপ হয়ে বসে থাকবে। যেমন করেই হোক সুখেনকে ঠেকাতে হবে।
প্রণাম করার চেষ্টা আর কোরো না। ভীষণ রাগী মানুষ। আইনের কোন ধারায় ফেলে দেবেন জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এই তো সকালে যখন এলেন, পেছন পেছন পুলিশের দুটো গাড়ি এল। এরই মধ্যে বড় দারোগা তিন বার সেলাম বাজিয়ে গেলেন। এই রকে বোসো। এখন মাসখানেক আর এ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষার চেষ্টা কোরো না।
সুখেন মন খারাপ করে রকে বসে পড়ল। বাইরে গ্রীষ্মের দাবদাহ। বেলা পড়ে এসেছে। পথে লম্বা লম্বা ছায়া। উত্তাপ কিন্তু এতটুকু কমেনি। ঢোকার গলিতে এই রকটি বেশ ঠান্ডা। ভেতর বাড়ি থেকে লম্বা একটা নর্দমা এই পথেই বাইরে চলে গেছে। একটু-আধটু গন্ধ নাকে এলেও গ্রীষ্মের দুপুর কাটাবার বড় ভাল জায়গা। বসে বসে প্রাণের কথা মনের কথা বলো নিশ্চিন্ত আরামে। সুখে বললে, দেশলাইটা আন না একবার।
দেশলাই? তুই এখানে সিগারেট খাবি নাকি?
কেন, কী হয়েছে?
আমাকে বাড়িছাড়া করতে চাস? সিগারেটের গন্ধ ওপরে উঠবে, তারপর আমার কী হবে?
তুই দেখছি ভয়ে ভয়েই মরলি। মায়ের আঁচল-ধরা ছেলে দেখেছি, বাপের এমন কাছা-ধরা ছেলে দেখিনি! তোর ওই মেয়েলি মিনমিনে স্বভাবটা ছাড়া পৃথিবীটা অনেক অনেক বড়। পুরুষ হয়ে জন্মেছিস সবরকমের অভিজ্ঞতা না হলে পরে ওই বেচারার মতো পড়ে পড়ে মার খাবি সারাজীবন। তোর বাবাই তোর মাথাটি খেয়েছেন। মা-মরা ছেলে মা-মরা ছেলে বলে আগলে আগলে এমন একটি বস্তু তৈরি করেছেন, এরপর শাড়ি পরিয়ে কপালে টিপ এঁকে কারুর পুত্রবধূ করে সাত পাকে ঘুরিয়ে না দেন।
তোর মতো এঁচড়ে পেকে লাভ নেই।
তুমি আর এঁচড়টি নেই ভাই। মেঘে মেঘে মন্দ বেলা হয়নি। তুমি একটা খাজা কাঁঠাল। খবর পেয়েছি, বেশ সিঙ্কিং সিঙ্কিং ড্রিঙ্কিং ওয়াটার হচ্ছে।
তার মানে?
মানে? তুই আজকাল রেগুলার ওই পোডড়া মন্দিরটায় যাস কেন?
কোন পোড়ো মন্দির?
কিছুই যেন জানিস না, না? বিন্দুবালার শীতলাতলায়?
সাধন ভজন করতে।
এত দেবদেবী থাকতে মা শীতলা! কস্মিনকালে তুই কোনও শীতলাসিদ্ধ মহাপুরুষের নাম ইতিহাসে পেয়েছিস? কালী, তারা, শিব, দুর্গা, শোনা গেছে। তা, মা শীতলা তো সামনে বসে আছেন। গাধার পিঠে, ঝাটা হাতে, তুমি ব্যাটা পেছন দিকে বিন্দুবালার দাওয়ায় গিয়ে ওঠো কেন? ওখানে তোমার কী মধু আছে?
কোনও মধুই নেই।
মারব ব্যাটা এক থাপ্পড়। ছায়া আর মায়ার নাম শুনেছিস?
বিন্দুবালার ভাইয়ের মেয়ে। কেন কী হয়েছে? কেউ কোথাও নেই তাই পিসির কাছে মানুষ হচ্ছে। তাতে খারাপ কী হয়েছে?
ওদের কিছুই খারাপ হয়নি, হয়েছে তোর। তুই এবার দয়ে পড়ে মজবি। মজবি কী, রিপোর্ট বলছে মজে গেছিস।
সেকী রে? ছায়া তো পিসির মতো গেরুয়া ধারণ করে সন্ন্যাসিনী হয়েছে। আর মায়া? অতি সাদাসিধে ভাল মেয়ে।
ঘুঘু তুমি ভিটে দেখেছ, এইবার ফঁদ দেখবে। সে ফাঁদে পড়লে তোমার পিতারও ক্ষমতা নেই টেনে বের করেন। ওই মা শীতলার গাধা হয়ে দাওয়ায় বাঁধা থাকবে।
আরে রাখ!
নাবালক ছেলে, বাড়ি বসে হেঁশেল ঠেলিস, মেয়েরা যে কী কল বুঝবে সেদিন, যেদিন ছায়া, মায়া আর বিন্দুবালা একসঙ্গে চেপে ধরবে।
জানিস, আমি মেয়েদের পায়ের দিকে ছাড়া আর কোনও দিকে তাকাই না?
পা বেয়েই সুড়সুড় করে পিঁপড়ে ওপর দিকে ওঠে। ব্যাধ কাঠির ডগায় আঠা মাখিয়ে পাখি ধরে, জানিস তো?
সুখেন খুব খানিকটা জ্ঞান দান করে উঠে পড়ল। নতুন নেশা ধরেছে, সিগারেট। এখানে বসে অন্যান্য দিন গোটা তিনেক কেঁকা হয়ে যেত। ছাদে উঠে উত্তর দিকের আলসেতে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়িতে টোপ ফেলার চেষ্টা হত। অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চলছে। আমার জন্যেই বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। সুখেন ব্যায়াম করে ভাগবে, কান ধরে নিলডাউন হব আমি। মেয়েটিও কম যায় না। মা আরও সাংঘাতিক। সেই যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, মেয়েদের ঢং বেশ বুঝতে পারতুম। তাদের কথা, সুর নকল করতুম। কড়ে রাঁড়ি বাপকে উত্তর দিচ্ছে যা-ই। বারান্দায় মাগিরা ডাকছে, ‘ও তোপসে মাছওলা’। নষ্ট মেয়ে বুঝতে পারতুম। বিধবা সেজে সিঁথে কেটেছে আর খুব অনুরাগের সঙ্গে গায়ে তেল মাখছে। লজ্জা কম, বসবার রকমই আলাদা। আমিও আজকাল বুঝতে পারি ঠাকুর। ঈশ্বরকে চিনতে পারি না, হয়তো পারব একদিন, আর একটু ঝড়ঝাঁপটা খাই, মেয়েছেলের ব্যাপারস্যাপার বেশ ভালই বুঝি। উত্তরের ওই বাড়িটি বড় সুবিধের নয়। ওদিককার ছাতে পিতাঠাকুরের চন্দ্রমল্লিকার চাষ আবাদ। গোটা পঞ্চাশ টব বসানো আছে। তিনি ও তল্লাটে যান ছাতা মাথায় দিয়ে। তারস্বরে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে। কুহকিনীর হাত থেকে যেন শেক্সপিয়ারই রক্ষা করবেন, ক্যানস্ট দাও নট মিনস্টার টু এ মাইন্ড ডিজিজড। প্লাক ফ্রম দি মেমারি এ রুটেড সরো। একবার নিচু হয়ে বসতে পারলে শেক্সপিয়রের ছুটি। তখন গাছেদের সঙ্গে নানা সমস্যার আলোচনা। সবই তাদের জগতের। নাঃ তোমাকে আর বাড়তে দিলে না মানু। বুরুশ দিয়ে পাতার পিঠ থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি কালো পোকা ঝাড়েন আর বলেন, ব্লাডি বাগারস।
Nothing begins, and nothing ends.
That is not paid with moan.
For we are born in other’s pain
and perish in our own.
মাথায় মাথায় তিনটে ম্যাগনাম সাইজের বউ। গতর যেন ফেটে পড়ছে। তেমনই বেশবাস। সখি আমায় ধরো ধরো। মালা পরো পরো। পুরুষ একজন। কদাচিৎ তাঁকে দেখা যায়। ঘাড়ে শাঁস বের করা চুলের ছাঁট। ঠোঁটদুটো পুরুপুরু। সিল্কের পাঞ্জাবি। দিশি ধুতি। তিনি যেন সবসময় এলিয়েই আছেন। মুখ সদাসর্বদাই হাসিতে তুবড়ে তাবড়ে আলুর পুতুল। সুখেন ঠিক জলেই চার করেছে। মাছের নাম জবা। বেশ খেলিয়ে মাছ। আমার তাতে কাঁচকলা। বেল পাকিলে কাকের কী? তবে এটাও ঠিক, এদিকে এত বড় একটা ছাত পড়ে থাকতে আমারই বা কী দরকার ঘেঁষটে ঘেঁষটে ওই উত্তরে যাবার? বিকেলে রোদ পড়ে এলে ঝারি নিয়ে ফুলগাছে জল দেওয়া আমার একটা ডিউটি। মাথা নিচু করে সেই কর্মটি সমাধা করে সরে পড়লেই হয়! তা হলে অত বারেবারে, আড়ে আড়ে তাকানো কেন? এ আবার কেমনতর ব্রহ্মচারী! ওই জবাসুন্দরীর জন্যে পিতাকে একদিন নির্ভেজাল মিথ্যে বলেছি। গাছে এসেছে ফুল। তার নাম স্নোবল। চুলে আয়েশ করে চিরুনি চালাতে চালাতে জবা নিজে থেকেই বললে, কী সুন্দর হয়েছে! ব্যস, আর যায় কোথায়? মনের সাঁকো নড়ে ঝপাত করে জলে। ফুলের ব্যাখ্যানা হল পনেরো মিনিট। জবা হেসে হেসে, চোখ বড় বড় করে, ছোট ছোট করে, মাথার ওপর হাত ঘুরিয়ে চুল বাঁধতে বাঁধতে, খোঁপা করতে করতে শুনে গেল। যেন কতই মনোযোগী চন্দ্রমল্লিকার ছাত্রী! লাল ব্লাউজ আর হাত তোলাতুলির শোভা দেখতে দেখতে কুপোকাত। কোথায় ব্রহ্ম, কোথায় আদি অনন্ত! স্রোতের মুখে কুটো। সেয়ানা মন মাঝেমধ্যে খোঁচা মারছে, অ্যায়, কী হচ্ছে! আর একটা মন সঙ্গে সঙ্গে ধমকে উঠছে, চোপ। একে বলে সৌন্দর্যের শিল্পীসুলভ কদর। নারীর সৌন্দর্য। কালিদাস বড়, না লোমপাদ মুনি বড়? র্যাফেল, দাভিনচি, না স্বামী অঘোরানন্দ! ঈশ্বর তা হলে মহিলাদের সৃষ্টি করেছিলেন কেন?
বাসশ্চিত্ৰং মধু নয়নয়োর্বিভ্রমাদেশ দক্ষং
পুষ্পেদ্ভেদং সহকিশলয়ৈর্ভুষণানাং বিকল্পান্।
লাক্ষারাগং চরণকমলন্যাসযোগ্যঞ্চ
কী বর্ণনা! আমার পিতাও তো এই রচনায় মুগ্ধ, বিমুগ্ধ, তড়িতাহত। কালিদাস, দি গ্রেট পোয়েট বলে আত্মহারা হয়ে যান। রূপ বর্ণনা মহৎ, রূপ দর্শন লাম্পট্য, এ যুক্তি কি জজে মানবে? তুই মনের আনন্দে তারিয়ে তারিয়ে জবাকে দেখ।
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা পবিম্বাধরোষ্ঠী মধ্যে ক্ষ্যামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা নিম্ননাভিঃ শ্রোণীভারাদলসগমনা স্তোকনা স্তনাভ্যাং খেয়োদাত, বৃষকাষ্ঠ অধরপণ্ডিতও এই অংশটি আবৃত্তি করতে করতে রসে হাবুডুবু রাজভোগের মতো হয়ে যেতেন। কই ফণিবাবুকে কি কেউ এমন করে দেখে কাব্য করবেন,
নধরকান্তি ঘটোৎকচং
তিন তিসি লোটাগদানং।
সগুমফ গোলাকারং
টাকান্বিত তিন্তিড়িবৃক্ষং ॥
সেই জবাসুন্দরীকে সম্মোহিত হয়ে একটি স্নোবল উপহার দিয়ে ফেলেছিলুম। জীবনে প্রথম এবং আপাতত শেষ পাপকার্য। গভীর রাতে চোখ বুজলেই জবাসুন্দরীর রক্তরাঙা উন্নত ব্লাউজ। সূর্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চোখ বুজলেই জবাকুসুমসঙ্কাশং, ঠিক সেই অবস্থা। অনুশোচনায় মরি আর কী? এ কী অধঃপতন। জবাকে কুসুম দেবার এত মালী ছিল যে আমার মতো কৃশকায় খেকুরে ছাদমালীকে আর মনেই রইল না। সেই ঘটনা থেকে বুঝেছিলুম, আমি একটি বোকাপাঁঠা। হয় বৃষকাষ্ঠ, না হয় কাঠিয়াবাবা হবার জন্যে জন্মেছি।
সুখেন একটা ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়ে গেল। অনেকদিন হয়ে গেল, মায়া এক শিশি কালি চেয়েছিল। মেয়েটি খুব সুন্দর ছবি আঁকে। হাতের লেখা যেন ছাপার অক্ষর। যখন কাজ করে পাশে বসে দেখতে বড় ভাল লাগে। কেমন করে আঁকছে, রং করছে, লিখছে। পরনে কনট্রোলের লালপাড় সাদা শাড়ি, গেরুয়া ব্লাউজ। পিঠে ছড়ানো রুক্ষ চুল। কেমন একটা শিল্পী শিল্পী চেহারা। সুখেনের সবেতেই পাপ। আমার কেউ কোথাও নেই। ছায়া মায়া তো আমার বোনের মতো। ছায়া আমার চেয়ে বয়েসে ঢের বড়। মুখে বড় বড় বসন্তের দাগ। গেরুয়া নিয়েছে। তার সঙ্গে কারুর কোনও প্রেম, ভালবাসা, বিয়ে হতে পারে? সুখেন শুধু একটা কথাই জানে, যন্তর। ওর বাবার উচিত ছেলের শ’খানেক বিয়ে দিয়ে একটা আড়তে এক বছর বন্ধ করে রাখা। আমার পিতা যেমন রাত বারোটার সময় গলায় ডান্ডা পুরে এক জার মোরব্বা খাইয়েছিলেন জোর করে।
মায়াকে আজ এক দোয়াত কালো কালি দিয়ে আসতেই হবে। দেবার মতো আমার আর কী আছে? পিতার ধনে পোদ্দারি। নানা জিনিস তৈরি তার হবি। লেখার কালি তৈরি তার মধ্যে একটি। বড় কঠিন কাজ। সবচেয়ে দুরূহ কেরামতি হল কালো কালি তৈরি। এতটুকু তলানি পড়বে না, ঝরনা কলমের মুখ দিয়ে সূক্ষ্ম ধারায় বেরোতে থাকবে অবিরাম। বিলিতি কালির কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে, স্টিফেনস সক্রিপ, কুইঙ্ক, ওয়াটারম্যান, সোয়ান। সারি সারি বোতল, মুখে ফেঁদল আর বিভিন্ন ঘনত্বের ফিল্টার পেপার। সারাদিন চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে পরিশ্রুত কালি। নির্জন নিঃস্তব্ধ ঘরে কান পাতলে শোনা যাবে বিলুপতনের শব্দ, টুপ টুপ। এমন সব উপমা মাঝে মাঝে মনে আসে যা কালিদাসের পিতাও ভাবতে পারবেন না। বিশাল পালঙ্কে সময় শুয়ে আছে। ডান হাত ঝুলে আছে পালঙ্কের পাশে। তলায় একটি পাত্র। ধমনী চিরে গেছে ধারালো অস্ত্রে। রক্তের বিন্দু পড়ছে ফেঁটা ফোঁটা। পাণ্ডুর হয়ে আসছে শরীর। দিন যায় দিন যায়। গ্রিক পদ্ধতিতে সময়ের আত্মহত্যা। এর নাম কালি-ঘর। মাটির গামলায় বেদানার ভোলা আর হরীতকী পচছে। তাকে তাকে অসংখ্য শিশি। কোনও কোনও শিশি মৃত্যুর মতো নীল, খুনির মতো লাল। চিনির দানার মতো শুভ্র জরানো এক ধরনের পদার্থ, অকজ্যালিক অ্যাসিড। বাদামি ট্যানিক অ্যাসিড। ঝুলের আবরণে হরেক শিশি বসে আছে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। ঘরটা তেমন আলোকিত নয়। শীতের শেষ দ্বিপ্রহরে ঢুকলে মনে হবে প্রেতাত্মা নৃত্য করে চলেছে নূপুর পায়ে।
মায়ার জন্যে কালি আমাকে চুরি করতে হবে। এ শিশি থেকে একটু, ও শিশি থেকে একটু। এ চুরিতে নীতির প্রশ্ন নেই। অর্থ নয়, অলংকার নয়, সামান্য তরল পদার্থ। বিদ্যার্জনের প্রয়োজনে লাগবে। তা ছাড়া একটা গর্বও আছে। আমার পিতা কী না পারেন? আমি সামান্য হলেও তিনি অসামান্য। কত কী পারেন, যা কেউ পারে না।
শিশিতে কালি ঢালাচালি চলছে, কনক এসে ঘরে ঢুকল। নীচে কী করছিলে এতক্ষণ? এঁদো স্যাঁতস্যাঁতে গলিতে?
ওই যে আমার এক বন্ধু এসেছিল, সুখেন।
বেশ দেখতে ছেলেটিকে। কেমন সুন্দর স্বাস্থ্য। তোমার যদি ওইরকম হত। একটু চেপে খাওয়াদাওয়া করো না! দুধ, ঘি, মাখন। সকালে তোমার খাওয়া দেখলুম তো! পাখির আহার!
হুম!
স্বাস্থ্য তুলে কথা বললে উত্তর এক অক্ষরেই হওয়া উচিত। শরীর ছাড়া পৃথিবীতে আর যেন কিছুই নেই। এ যেন গো-হাটায় গোরু বিক্রি। নধর গাভীটির দিকে সবাই দৌড়োবে। দাম উঠবে চড়চড় করে। শাস্ত্র বলছেন, দেহটা কিছুই নয়। আসল হল আত্মা। সে বাবা এমন জিনিস, আগুনে পোড়ে না, জলে গলে না, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কাটা যায় না। নাও, কী করবে করো। মেয়েদের। কথাবার্তাই যেন কেমন কেমন। চুল-ওলটানো ফচকে ছোঁড়া দেখে চোখ ট্যারা হয়ে গেল। কী? না, শরীর! সাতটা বাঘে রুল অফ থ্রি-র হিসেবে রোজ এক ঘণ্টা করে খেলে তিন দিনে সুখেন ফুরোবে। আর আমাকে? বাঘ দেখেও দেখবে না। এক যদি কোনও এয়োস্ত্রী বাঘ কাটোয়ার ভঁটা ভেবে একটু। চিবিয়ে দেখে। তাতে হয়েছেটা কী! সুখেনের ভেতর দেখো, আর আমার ভেতর দেখো! শ্রীচৈতন্যদেবের চেহারা কি গোয়বাগানের ব্যায়ামবীরের মতো ছিল! শ্রীরামকৃষ্ণ পেটরোগা ছিলেন। সারদা মা কাঁচকলার ঝোল ভাত বেঁধে খাওয়াতেন। বুদ্ধদেব কি রোজ গুপেগুড়ার মতো। মুগুর ভাজতেন। পুণ্যের শরীর একরকম, পাপের শরীর আর একরকম। মেয়েরা বোঝে না কেন?
কনক উবু হয়ে আমার গা ঘেঁষে বসল। বসল তো ভারী বয়েই গেল। আমি তো আর সুখেন নই যে ভেতরটা জল থেকে তোলা মাছের মতো ছটফট করবে। আমি তো আগমার্কা ঘি। কোনও ভেজাল নেই। খুব বেসামাল হয়ে পড়লে, একবার শুধু বলব, মা বিপত্তারিণী, রক্ষা করো। গেল, গেল বুঝি সব রসাতলে। কনক ফিসফিস করে বললে, কী হচ্ছে কী এসব? সারি সারি বোতল।!
কালি ফিল্টার হচ্ছে।
কী হবে এত বোতল বোতল কালি?
লেখা হবে।
বাব্বা, মহাভারত লেখা হয়ে যাবে যে! আমার কলমে একটু ভরে দেবে? দেখি কেমন কালি!
এ জিনিস বাজারে মিলবে না। ঝুল কালো। নিবে আটকায় না। যে-কাগজে লিখবে সে কাগজে ভাগ্যের লিখনের মতো চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
বাঃ, পাক্কা সেলসম্যান ভাস্করবাবুর মতো কথা বলতে পারছি। একটুও আটকাচ্ছে না। পিতার ইচ্ছে কালি যদি কালীর মতো দাঁড়িয়ে যায় মহাদেবের বুকে, মহাদেব মানে বাঘমার্কা সাদা কাগজ, আর লজ্জায় যদি জিভটি না বেরোয়, তা হলে নেমে পড়বেন ব্যবসায়। নামও ঠিক, ইলিসিয়াম ইঙ্ক। আমি হব সেলসম্যান। দোকানে দোকানে অফিসে অফিসে ঘুরব। লেখার কালি দিয়ে শুরু করে, স্ট্যাম্প প্যাড় ইঙ্ক, মার্কিং ইঙ্ক, শেষ হবে ছাপার কালিতে।
কনকের সোনার কলমে কালি ভরা হল। এমন কলম আমি জীবনে দেখিনি। নাম লেখা আছে। পার্কার। এঁরা বেশ বড়লোক। চালচলন, সঙ্গের জিনিসপত্র, চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় মেসোমশাই লক্ষ্মী এবং সরস্বতী দুই দেবীরই কৃপা লাভ করেছেন।
মাটির যে-গামলাটায় বেদানার খোলা আর হরীতকী পচছিল সেটা হঠাৎ নড়ে উঠল। কনক বললে, ওই দেখো জ্যান্ত কালি। ভুড়ভুড় করছে।
ও অমন হয়, ফার্মেন্টেশন হচ্ছে তো। নিজের জ্ঞান জাহির করতে পেরে বেশ গর্ব হল। গামলা থেকে কী একটা লাফিয়ে উঠে আবার গবাত করে গামলাতেই পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। কনক বললে, ওই দেখো কালির ন্যাজ বেরিয়েছে।
দু’জনেই গামলার দিকে ঝুঁকে পড়লুম। কালির আবার ন্যাজ কী রে বাবা! পিতা চেয়েছিলেন বিলিতি কোয়ালিটি। তিনি তো ন্যাজ চাননি। ফিল্টার করলে লাল বাদ যাবে কি! বাঁদরকে ফিল্টার করলে মানুষ হবে? ডারউইন সায়েব বেঁচে থাকলে একটা বেয়ারিং চিঠি লিখতুম।
আমিও তো আর এক পণ্ডিত। অনেক ভেবেচিন্তে বললুম, এটা হল সেই ব্যাপার বুঝলে কনক, জলে বিচিলি ভিজিয়ে রাখলে দিনকতক পরে ছোট ছোট সাদা সাদা ন্যালবেলে পোকা হয়, মাছের খাদ্য। কেমন হয় তো?
কী জানি, হয়তো হয়।
কী জানি মানে? আমি নিজে করে দেখেছি। আমার একটা গোল্ডফিশ ছিল। বেড়ালে খেয়ে না ফেললে আজ কত বড় হত। বেদানা কাবুলে জন্মায়, হরীতকী সাধুদের আহার। কাবুলিদের চেহারা দেখেছ? সাত ফুট বাই পাঁচ ফুট। সেই বেদানার খোলা পচে যে পোকা হবে তার আকার আকৃতি একটু বড়সড়ই হবে। এ তো কমন সেন।
আমার থিসিসও শেষ হল আর সেই কাবুলিপোকা তিড়িং করে এক লাফ মেরে, পড়বি তো পড় কনকের কোলে।
ওরে বাব্বা, খেজুর, বলে কনক উলটে পড়ল। সেই পা! পা থেকেই পাপ। পরিপূর্ণ তিনটি বোতল সুন্দরীর পদাঘাতে তিন গুন্ডার মতো তিন দিকে ছিটকে গেল। একেই বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। পিতৃদেবকে রাতে কী কৈফিয়ত দোব?
১.০৫ মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল
পণ্ডিতের ঘরেই মূর্খ জন্মায়। আবার মূর্খরাই পণ্ডিত হয়। সেই তিন পণ্ডিতের গবেষণার গল্প। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে চাষার কোদালে একটি তালের আঁটি উঠেছে। জটাজুটধারী। কী বস্তু কে জানে? কোনও দেবতাটেবতা নয় তো! তিন পণ্ডিত এলেন। টিকি নেড়ে, নস্যি নিয়ে, একজন বললেন, এ বস্তুটি হল শকুনের বাত্সা। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত দু’জন পণ্ডিত কখনও একমত হতে পারেননি। দ্বিতীয় পণ্ডিত বললেন, তুমি কসু জানো, এটা বাদুড়ের বাস। তৃতীয় পণ্ডিত বললেন, প্রণাম করো, ইনি হলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মাথা। চাষা ব্যাটা কোদালের কোপে ধড় থেকে নামিয়ে এনেছে। কুম্মাণ্ডকে নিয়ে চলো কোতোয়ালের কাছে, বিচার হবে। কারুর সর্বনাশের রাস্তা খোলা হলে। পণ্ডিতরা সঙ্গে সঙ্গে একমত। আহা ব্যাটা শূলে চড়বে। হাকিম শূলে প্রায় চড়িয়েই ফেলেছিলেন। হাকিমের স্ত্রী বললেন, আরে ওটা তো তালের আঁটি। আমাকে দাও, ভেঙে ফোঁপলটা খেয়ে ফেলি।
গামলার প্রাণীটি যে একটি নেংটি ইঁদুর দুই পণ্ডিতে বুঝে উঠতে পারিনি। কনকের কোল থেকে মেঝের ওপর তার পলায়নের রেখা টেনে জলচৌকির নীচে গিয়ে ঢুকেছে। আর তাকে পায় কে? এদিকে তিন বোতল কালির স্রোত মেঝের ঢাল বেয়ে নর্দমার দিকে গড়িয়ে চলে গেছে। নীল, কালো, নীলকালো, সব মিলেমিশে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মতো একাকার। মাঝখানে আমি এক শ্রীরামকৃষ্ণ হাত ঊর্ধ্বাকাশে তুলে সমাধিস্থ। কনক এক মহামায়া, ভূমিশয্যায় আড়কাত হয়ে হেসে কুটোপুটি। দরজায় উঁকি মারছে আর এক মহাশক্তি মুকু। কে যেন বলেছিলেন, নারী নরকের দ্বার। আমার মাতামহ। মাতামহী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন হয়তো বলেছেন, স্বর্গদ্বার। শৃগাল অনেক লম্ফঝম্ফর পর নাগাল না পেয়ে বলেছিল, দ্রাক্ষাফল টক। মাতামহী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে সরে পড়ার পর সেই স্বর্গদ্বার হয়ে গেল নরকের দ্বার। আমার তেমন কোনও বন্ধন নেই, প্রায় নাঙ্গাবাবা, আমি ভেবেচিন্তেই বলছি, বাক্যটির মধ্যে কিঞ্চিৎ সত্য আছে। আমি যদি সরাইকেল্লার মহারাজা হতুম, তা হলে মায়ার কাছে যেতুম গজমোতির হার নিয়ে ঘোড়ায় চেপে। এক শিশি কালি তো সেই গজমোতির হার। কনট্রোলের শাড়ি পরা রাজকুমারীর মনে সামান্য আঁচড় কাটার চেষ্টা। মানুষের অভাব বেড়েছে, স্বভাব কিছুই পালটায়নি। তপস্যা করলেও বেড়াল বেড়ালই থেকে যাবে। উপনিষদ কত আগেই বলে রেখেছেন, নান্যঃপন্থা। আদি রিপুকে মালসায় ফেলে গন্ধকের আগুনে পোড়ালেও কিছু হবে না।
ছেঁড়া কাপড় দিয়ে নিংড়ে নিংড়ে ওই কালিকে যতটা সম্ভব বোতলে ফিরিয়ে আনতে হবে। তা হলে রাতে এই সুন্দরীদের সামনে আমার নাজেহাল অবস্থা হবে। বারেবারে শুনতে হবে তিন চরণ কবিতা,
Sons dangle their fathers with a rope, creation kills the creator,
even the Almighty Lord.
কার লেখা কে জানে, বারেবারে শুনে শুনে কান পচে গেছে। ঘরের নর্দমার ছোট্ট মুখে একটি গোল কাঠ গোঁজা। সেখানে তৈরি হয়েছে কালির আরব সাগর। এমন এক পাপ ছড়িয়েছে যাকে আর সহজে চাপা দেওয়া যাবে না। নর্দমা চুঁইয়ে ওপাশে সিঁড়ির দেয়াল দাগরাজি করবেই। এতক্ষণে করেও ফেলেছে। কতরকমের রসিকতা আছে! মুকু বললে, আহা আমার বড় ইচ্ছে করছে ওই কালি পুকুরে একটা কাগজের নৌকা ভাসাই। কনক বললে, থাক, বুড়ি বয়েসে আর ছেলেখেলার দরকার নেই। বাবা কোথায় রে?
বাথরুমে?
কনক বললে, এসো, দু’জনে মিলে যতটা পারি তুলি।
তুমি আবার হাতে কালি মুখে কালি করবে কেন?
আমার অপকর্ম আমাকেই সামলাতে হবে।
এতক্ষণ আমরা কেউই লক্ষ করিনি, কেমন সহজে তুমি-তে নেমে এসেছি! পাশাপাশি বসে কালি ভোলা হচ্ছে। বোতলের পাপ বোতলেই ফিরে যাচ্ছে একাকার হয়ে। ঘরে একটি মাত্র ছোট জানলা। তেমন আলো বাতাস আসে না। বেশ গরম হচ্ছে। এই প্রথম টের পেলুম, বেদান্তেও যা লেখা নেই, নারীদের শরীর থেকে অদ্ভুত একটা গরম হলকা বেরোয়। দীর্ঘ রৌদ্রদগ্ধ মাটিতে প্রথম বৃষ্টি পড়লে যেমন একটা সুবাস ছড়ায়, তেমনি একটা গন্ধও আছে। ওদিকে আমার মন যাবার কথা নয় তবু যাচ্ছে। এমনও মনে হচ্ছে, হে প্রভু, রোজই যেন একবার করে বোতল ওলটায় এইভাবে। আমার মনটা যেন কেমন কেমন করছে। গলায় চিকচিক করছে ছিলে কাটা সোনার হার। হাতের চুড়িতে রিনিঝিনি শব্দ। নাকছাবির পাথর এক একবার চমকে উঠছে। খেকুরে মনের পোড়া শ্মশানে। বসে, বিসমিল্লা খাঁ সানাইয়ে ধরেছেন পুরিয়া ধানেশ্রী। বৈশাখী সন্ধ্যায় ফুলওয়ালি হেঁকে চলেছে। বেলফুল। তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে। সুখেন ঠিকই বলে গেল, পৃথিবী বিশাল। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। পুরানা কাগজ বলে থলে কাঁধে হেঁকে বেড়ালে সের সের কাগজ মিলবে, লোহালক্কড়, শিশিবোতল, ভাঙা কাঁচ মিলবে। মন মিলবে না, স্নেহ ভালবাসা মিলবে না। যে পায়, সে পায়। এসব ভেসে ভেসে কোথায় চলে যাবে! ঘর থাকবে, বৈশাখ থাকবে, সন্ধ্যার নম্র অন্ধকার থাকবে, মানুষ থাকবে না। মেয়াদ এক মাস। তারে ঝোলা শাড়ি সরে যাবে, ফিতে, কাটা, চিরুনি, সাবান, তেলের সুবাস, চুড়ির শব্দ, সব, সব মিলিয়ে যাবে। আবার সেই শূন্য বাড়ি, শেষ বেলার ছায়া, দূরে বহু দূরে কোনও মায়ের চিৎকার– পিন্টু ঘরে আয়।
এই ঠোঁট-ফোলানো ন্যাকামির জন্যেই ছেলেটার কিছু হবে না। কাব্য করেই কেবল মোলো। কেউ বলেনি, নিজেকেই নিজের তিরস্কার। একটা দিনও পার হল না, মনেই মথুরা তৈরি করে নটঘট অবস্থা। একে কয়লার গোলায় চাকরি করে দাও। বোঝা মাথায় বাড়ি বাড়ি ঘুরলেই রস মরে পুরুষ হবে। আর্মিতে পাঠাও। প্যারেড করে জীবন যন্ত্রণা জুড়োবে। কালি বোতলে তোলো, মেঝে থেকে তুলে মেঝেতে নিংড়োচ্ছ কেন? স্বপ্ন দেখছ নাকি?
তাই তো! কনকের কথায় চমক ভাঙল। কোন কল্পনাজগতে ভাসছিল মন!
সন্ধে হয়ে আসছে। মায়াকে কালির শিশিটা দিয়ে আসতেই হবে। প্রায় সাত দিন হয়ে গেল, দেখা সাক্ষাৎ নেই। সুখেন যাই বলুক বিন্দুবালার গাধা হয়েও সুখ আছে। যে-সংসারে পুরুষ নেই সে সংসারে মেয়েদের স্বাধীনতার চেহারাই আলাদা। ভাল সারযুক্ত মাটিতে উপযুক্ত আবহাওয়ার ফুল যদি ফুটতে পায় সে ফুলের চেহারাই আলাদা। চেনাকেও অচেনা মনে হয়। মনে আছে। কালিম্পঙে গিয়ে গন্ধরাজ দেখে অবাক। কী ফুল? কী ফুল? মহা বিরক্ত হয়ে একজন বললেন, গর্দভ গন্ধরাজ চেনো না। এদিকে গন্ধরাজ পুরোটা ফোটেই না।
যেন কন্বমুনির আশ্রম। হরিণ ছাড়া সবই আছে। ছিটে বেড়া। গাব ভ্যারেন্ডার ঝোঁপ। সারি সারি কলকে, টগর, করবী। উঠোনের মাঝখানে তেলচুকচুকে পাতা, কাঁঠাল গাছ। তলায় বাঁধা হাবলা-গোবলা একটি ছাগশিশু, লোটা লোটা কান। পেছন দিকে একটা ডোবামতো আছে। বর্ষায় ভেসে উঠোন পর্যন্ত চলে আসে। মাটির উঠোনে একটা চৌকি পাতা আছে। মেঘশূন্য চাঁদিনি রাতে ব্যাপারটা ভীষণ জমে ওঠে। কাঁঠাল গাছের মাথার ওপর চাঁদ ওঠে। তারাদের জলসা। দক্ষিণের হৃদয় বিদারক বাতাস। ধূপধুনোর গন্ধ। ঘণ্টাধ্বনি। রাতচরা পাখির কটাস কটাস বন্ধন খোলা ডাক। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত মায়ার পোড়-খাওয়া মুখ। বিন্দুবালার সাধনজগতের কথাবার্তা। ভিজে কাপড়ে ছায়ার চলে যাওয়া। কেমন করে বৈরাগ্য আসে প্রভু! জলে জাল ফেলে জেলে বসে আছে জলে।
সারাদিন রোদে পড়ে থেকে ডোবার জল এখন বাষ্প ছাড়ছে। গাছপালার পেছনটা নীল-নীল ধোঁয়া-ধোঁয়া। মায়াবিনীর আঁচল উড়ছে। ছাগলটা চোখ বুজিয়ে কাঁঠাল পাতা চিবোচ্ছে। বেতার গায়ে একটি নীল শাড়ি শুকোচ্ছে। মায়া ঘরের সামনের দাওয়ায় বসে, উরুতে ফেলে প্রদীপের সলতে পাকাচ্ছে। গোটা কুড়ি হয়ে গেছে। আর ক’টা হবে কে জানে! দৃশ্যটি দর্শনীয় হলেও উটকো পুরুষের দেখা উচিত হবে কি না বুঝতে পারা যাচ্ছে না। শাস্ত্র এ সম্পর্কে নীরব। অথচ প্রদীপের জন্যেই সলতে। সলতের জন্মস্থান মহিলাদেরই কলিকাণ্ড সদৃশ জঙ্ঘার তৈলাক্ত মসৃণ দেহভাগে। প্রদীপ না জ্বললে ধর্ম হয় না। সলতে না হলে প্রদীপ জ্বলে না। যুবতীর উরু না হলে সলতে হয় না। আমাদের মেনিদা যদি ঠ্যাং বের করে সলতে পাকাতে বসেন, তা হলে এক পাকেই তো চিৎকার উঠবে। কঁচি আন, ব্লেড আন। লোম রোল হয়ে সলতে সেঁটে আছে জেঁকের মতো। পরিণত পরিণতি লোমফোঁড়া।
তা হলেও, মায়া একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অতটা অনাবৃত করার প্রয়োজন ছিল না। বাড়িতে কোনও পুরুষ না থাকলে মেয়েদের সাহস বড় বেড়ে যায়! এ যেন মশা মারতে কামান দাগা। দলমাদল সামনে পড়ে আছে। কোথাও এতটুকু মরচে নেই। যাহা অন্তঃপুরে থাকে তাহা কি এত বিস্ময়কর ভাবে শুভ্র হইয়া থাকে! বালক, প্রশ্নের উত্তর তোমার চক্ষুর সম্মুখেই প্রসারিত। লুকাইয়া, লম্পট জমিদারপুত্রের ন্যায় দেখিয়ো না। মহাবীরের মতো হুপ করিয়া লাফাইয়া সামনে গিয়া পড়ো। পাপ পুণ্য হইয়া যাইবে। শৃগাল সিংহের বলপ্রাপ্ত হইবে। বলদা, মোক্ষদা, মায়া, অষ্টপাশ ছিন্ন করিয়া দেবকার্য করিতেছে। তুমি বহুবার পাঠ করিয়াছ, দেবকার্য লজ্জা, ঘৃণা, ভয় তিন থাকিতে নয়।
বয়স্ক পুরুষদের দেখেছি অন্তঃপুরে ঢোকার সময় গলায় এক ধরনের শব্দ করেন, যা কাশিও নয়, চাপা হাঁচিও নয়। ছোট মাছের কাঁটা গলায় বিধে গেলে আমরা ওইরকম শব্দ করি। সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা সচেতন হয়ে বক্ষদেশে আঁচল তুলে দেন। কাপড় গুছিয়ে নেন। ব্যতিক্রম স্থূলাঙ্গী মহিলারা। মেদ বিপরীত লিঙ্গিদের কেমন যেন উদম, উদাস করে রাখে।
গলার শব্দে মায়া সচেতন হল না। চেনা মানুষ আর ছাগলে তেমন উনিশ-বিশ নেই বলেই মনে হয়। সলতে পাক খেয়ে উপদখণ্ডের ছায়ায়, সুন্দরী এ কী করলে বলে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছে। মুখ হয়ে উঠেছে মেঘৈমেদুরম্বরং-এর মতো। একেই কি বলে, কশ্চিৎ কান্তাবিরহগুরুণা!
আমি এলুম।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
রামগডুরের ছানার মতো, রামলীলার প্যান্ট পরা, খড়ের সোঁটা ন্যাজ ওঁচানো হনুমানের মতো, অশোককাননে নির্বাসিতা সীতার সামনে শিশি হাতে দণ্ডবৎ। বসতে বলছে না। অভিমান হয়েছে। হাম্বীর রাগে মাতুলের শেখানো সেই সংগীতের দু’চরণ গাইব নাকি, জানি না মানিনী, তড়াক, সম-এ এসে পড়লুম, কেন এ অভিমান, ফাঁক। তেটে ধিন ধিন তা, কৎ ধাগেনাগে, ধাগেনাগে, ধেরে কেটে, মেরে ধরে। জানি না মানিনী।
বসতে পারো।
বসতে তো পারি। বসার লোভে প্রাণ মৎস্যাশী হুলোর মতো ছোঁক ঘেঁক করছে। উচিত হবে কি। মায়া যে বিধাতার উদ্যানের প্রথম আপেলে এখনও কামড় লাগায়নি। যে-ভঙ্গিতে ছিল সেই ভঙ্গিতেই বসে আছে। তা ছাড়া এমন একটি কর্ম করে বসল যাতে হৃদয় হোঁচট খায়। এক ফোঁটা তেল দিয়ে মসৃণ ত্বককে মেজে ঘষে পলতে-বিলাসী করে ফেলার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভয়ে ভয়ে যতটা সম্ভব দূরে বসলুম। বসতে-না বসতেই কাঁঠালতলার ছাগলটা ব্যাঅ্যা করে ডেকে জানিয়ে দিলে, তুমিও এক বলির পাঁটা। ব্যাটা জ্ঞানপাপী হাজার বার পড়েছিস, পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ কাঁদে। পৃথিবীটা যদি আমাদের দু’জনের হত, তা হলে কথা ছিল না। হঠাৎ যদি সন্ন্যাসিনী পিসি ডোবার ধার থেকে চ্যালা কাঠ হাতে তেড়ে আসেন। মানুষের মুখে পাপের ছায়া ইংরেজি সিক্সও ক্লক শেডের মতো ঘনিয়ে আসে। বোঝা যায় সুবোধ বালক মনে মনে পাঁয়তাড়া কষছে।
এই যে তোমার কালি।
ফেলে দাও।
শুধু শুধু রাগ করছ। জানো আমার কী হয়েছিল! অসুখে কাত হয়ে বিছানায় পড়েছিলুম তিন দিন। একবার খবর নিয়েছিলে?
তোমার খবর নেবার উপায় আমার আছে? তুমি না এলে জানব কী করে?
তা অবশ্য ঠিক। মা কোথায়?
ছেলে কম সেয়ানা নয়। মা শব্দটি এমন মিঠে করে উচ্চারণ করলুম, যেন আমার মা। দেখতে না পেয়ে গলা শুকিয়ে গেছে! ওঁয়া ওঁয়া করে উঠল বলে! আসলে ভয়ে মরছি। এ বাড়ির শাসন, অনুশাসন কোনওটাই তেমন জানা নেই। মায়া বললে, পিসিমা আর দিদি হালিশহর গেছে, ফিরতে রাত হবে।
ভেতরে ব্যাং লাফাল। একা। আমরা দু’জন। মনের কোণে কে যেন হালুম করে উঠল। আমি নই। আমি যে পবিত্র গঙ্গার জল। পাপ ধোয়া তুলসী পাতা। মায়ার সলতে পাকানো শেষ হয়ে গেল। পা ঢেকে বললে, তোমার মুখটা খুব শুকিয়ে গেছে। আমার কাছে দিন কতক থাকলে দুধ খাইয়ে মোটা করে দিতুম।
কীসের দুধ?
ফস করে বেরিয়ে গেছে। জিভ কাটলুম। মায়া কিছুই মনে করেনি। এ হল চরিত্রের ওপর সুখেনের প্রভাব! পিতা ঠিকই বলেন, সঙ্গদোষেই ভুজঙ্গ! প্রশ্নটা তেমন নিরীহ নয়।
[ওহে বর্ণচোরা আম! বেশি অশ্লীলতা করলে কান ধরে উপন্যাস থেকে বার করে দোব। বেশ পেকেছ। মনটাকে মানুষ করো। অবাক হবার কিছু নেই। এ কণ্ঠস্বর আমার। রাশ আলগা হয়েছে ভেবে কাটা ঘুড়ির মতো চেত্তা খেয়ো না, টানতে কতক্ষণ। জীবন একটা আধার। ধরলে অমৃত ধরা যায়, আবার বিষপাত্র হয়ে মৃত্যুকেও ডেকে আনা যায়। তুমি অমৃতের পুত্র হবে, না পুতনার স্তন! মনে মনে তিনবার বীজমন্ত্র জপ করে নাও। জিহ্বা শুদ্ধ হোক।
Truth never come where lust
and fame and greed
of gain reside. No man who
thinks of woman
As his wife can ever perfect be
Nor he who owns however little
nor he
Whom anger chains can ever pass
through Maya’s gates
so give these up, Sannyasm bold
Say Om Sat Om.
সন্ন্যাসীর গীত তোমাকে শুনিয়ে দিলুম। এই মায়া, আর ওই মায়ায় বিশেষ তফাত নেই। তা হলে আরও শোনো, আমেরিকায় তাহার প্রলোভন কম হয় নাই। কাহার? স্বামী বিবেকানন্দের। তুমি অবশ্য তাহার একগাছা কেশেরও যোগ্য নহ। একে জগদব্যাপী প্রতিষ্ঠা; তাহাতে সর্বদাই পরমাসুন্দরী উচ্চবংশীয়া সুশিক্ষিত মহিলাগণ আসিয়া আলাপ ও সেবা করিতেন। তাঁহার এত মোহিনী শক্তি যে, তাহাদের মধ্যে অনেকে তাহাকে বিবাহ করিতে চাহিতেন। একজন অতি ধনাচ্যের কন্যা সত্য সত্য একদিন আসিয়া তাহাকে বলিয়াছিলেন, স্বামী! আমার সর্বস্ব ও আমাকে আপনাকে সমর্পণ করিলাম। স্বামী তদুত্তরে বলিলেন, ‘ভদ্রে! আমি সন্ন্যাসী। আমার বিবাহ করিতে নাই। সকল স্ত্রীলোক আমার মাতৃস্বরূপা!’ তুই হলে কী করতিস ব্যাটা! তেত্রিশটা বউ নিয়ে লোটাকম্বল ফেলে, ন্যাজেগোবরে হয়ে বসে থাকতিস স্বামী পিনখাড়ানন্দ।]
মায়ার লম্বা ডান হাত আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। সরু সরু আঙুল। ওপর হাতে লাল সুতো দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা। ওই সর্বনেশে হাত আমার আমসির মতো গাল টিপতে আসছে। ওম তৎসৎ, ওম তৎসৎ! দু’আঙুল দিয়ে নীচে থেকে টিপে ধরেছে। আহা! আমার গালে যদি একটু মানুষের মতো মাংস থাকত! তত্ত্বজ্ঞান না, বৈরাগ্য নয়, পোয়াটাক মাংস দু’গালে।
তোমাকে আমি খাঁটি গোরুর দুধের সিন্নি খাইয়ে খাইয়ে ইয়া মোটা করে দিতুম। আহা রে! শাসনে শাসনে ছেলেটা আমার শুকিয়ে গেল।
চুলের ঝুটি ধরে কোলের দিকে টানছে। ওম তৎসৎ, ওম তৎসৎ। প্ল্যাটফর্ম এগিয়ে আসার মতো কোল এগিয়ে আসছে। মায়ার দরজা পার করে দাও প্রভু।
বাঘিনি বাঘ নিয়ে খেলে
সিংহ নতজানু বিশেষ সময়ে
শৃগালের হাহা হাসি
হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, ক্যা হুয়া, কেয়া হুয়া ॥
আমি জানি, এখন কী হবে! মায়ার আবেগ বড় সাংঘাতিক! বারকয়েক ওই আটচালায় তার প্রমাণ মিলে গেছে। অপত্যস্নেহে কোলে ফেলে তাল চটকান চটকাতে থাকবে। সারাশরীর কাঁপতে থাকবে। দেহের অনাবৃত অংশ ঘর্মাক্ত হবে। কেবল বলবে, দুষ্টু দুষ্টু, চটকে শেষ করে দেব। সুখেন, বাঁচা। দৈহিক নয়, বড় নৈতিক যন্ত্রণা। আমার ধর্ম গেল। সতীত্ব গেল। ধ্যার মূর্খ। শাক্ত থেকে বৈষ্ণব হয়ে যা, মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল, বোল হরি বোল, বোল হরি বোল ॥
রূপসির কালো ওড়নার মতো সন্ধ্যা ঘিরে আসছে। লোম উসকোখুসকো দুটো কুকুরের মতো মায়া আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। খুব একচোট হয়ে গেল। কী থেকে যে কী হয়ে যায়! মনের কাঁধে পা ঝুলিয়ে আর একটা কী বসে আছে! সে যে দৃষ্টি এড়ায়, পালিয়ে বেড়ায়, যায় না তারে ধরা।
মায়া ঘর থেকে একটা আধ-ভাঙা টিনের বাক্স নিয়ে এল। সাজের সাজসরঞ্জাম। দাঁড়া-ভাঙা চিরুনি। চুল বাঁধার ফিতে। সোনালি টিপ, কাঁচপোকার ডানা কাটা। চিরুনি হাতে নিয়ে মায়া আমার সামনে মাটিতে দু’হাঁটু ফেলে খাড়া হয়ে বসে, বুকের দিকে মাথাটা টেনে নিয়ে ঘাড়ের দিকের চুলে চিরুনি চালাতে লাগল।
চুল নয় তো, জটেবুড়ির জটা। কী করে রেখেছ মাথাটা। দেখি মাথা তোলো।
সামনে ঝুঁকিয়ে, পেছনে হেলিয়ে, পাশে ফিরিয়ে মায়া আমার চুল ঠিক করতে লাগল। গোল হাতে বাঁধা তাবিজের লাল সুতো সাপের মতো ঝুলছে। মাঝে মাঝে ছোবল মেরে যাচ্ছে। একটু বাসি তেলের গন্ধ, জলের গন্ধ, বুকের গন্ধ। সন্ধ্যা আসে ঘিরে। পাতায় বাতাস লেগেছে। পৃথিবীরও একটা মোহিনী আঁচল আছে। অদৃশ্য সব ফঁকফোকর থেকে সুখ নেমে আসে। মহাকাশের মহা অন্ধকারে মাথা তুলে আছে নির্জন পর্বতশ্রেণি। ফাটল চুঁইয়ে বেরিয়ে আসছে জলবিন্দু, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর মতো। জমে উঠছে টোপা টোপা মুক্তোর দানার মতো। সূর্যের আলোয় অশ্রু হয়ে উঠবে হীরকের হাসি। সবই অলক্ষে। কখন কোথায় কী হয়ে চলেছে এই বিরাট বিশ্বে কে আর নজর রাখছে।
মায়া কোল থেকে আঁচল তুলে নিয়ে তেলতেলে মুখটা মুছিয়ে দিতে দিতে বললে, তুমি অনেক দেরিতে বুড়ো হবে। আমি মরে যাবার অনেক পরে তুমি মরবে। এখনও একবারে কচি আছ। দেখি একটা কাঁচপোকার টিপ পরালে কেমন দেখায়?
ছোট্ট কৌটোয় ধুনোর আঠা। সেই আঠায় ঠেকিয়ে একটি টিপ ভুরুর মাঝখানে প্রথম আঙুলের চাপ দিয়ে পরাতে পরাতে বললে, তুমি আমার কে বলো তো!
এ বড় শক্ত প্রশ্ন! এই পৃথিবীতে কে যে কার। যার কেহ নাই, তুমি আছ তার। এই তো হালফিল যে ঘটনা ঘটে গেল পাড়ায়! হারু আর হারুর মা হারুর বাবাকে ঘাড় ধরে বাড়ির বার করে দিলে। বুড়ো ভাল দেখে না, কানে ভাল শোনে না। ঘষা কাঁচের ডাটি-ভাঙা চশমা চোখে। নাকের কাছে তুলো জড়ানো। বুড়ো কয়লার দোকানের পেছনে পড়ে রইল এক মাস। উঠতে পারে না, চলতে পারে না। দু’হাতে সেবা করে গেল কে? মেয়ে স্কুলের কর্মচারী মেনকাদি। বিয়ে করলে যে-কোনও রাজপুত্তুরকে বিয়ে করতে পারতেন। জীবন কাটাচ্ছেন আতুরের সেবায়। এক মাস সকাল বিকেল মেনকাদি জল, দুধবার্লি, কাঁথাকম্বল জোগালেন। বুড়ো দ্বিতীয়পক্ষের বউ প্রথমপক্ষের ছেলেকে রেখে একদিন শেষরাতে চলে গেলেন মহাযাত্রায়। কেউ এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। মেনকাদি কেঁদে ভাসালেন। তবে? মায়া আমার কে? আমি মায়ার কে? কোথাও কোনও অদৃশ্য লিপিতে কি ভাগ্যবিধাতা লিখে রেখেছেন?
একটা ভাঙা আয়নায় পাকা বউয়ের মতো মুখ দেখতে দেখতে মায়া বললে, তোমার বাবার। তৈরি ব্রনর কোনও ওষুধ আছে?
বোরোফ্যাক্স আছে।
কাল একটু এনো তো।
ভাবতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কার ওষুধ কোন গালে এসে লাগবে? যদি একবার জানাজানি হয়ে যায়! ন্যাড়া করে মাথায় ঘোল ঢেলে, গাধার পিঠে উলটো করে বসিয়ে, ঢাক ঢোল ফেস্টুন সহকারে নগর প্রদক্ষিণ করাবেন।
কই বললে না তো তুমি আমার কে?
তুমি আমার ভৈরবী।
সে আবার কী?
আমার একটা পরিকল্পনা আছে মায়া। একদিন শেষরাতে তুমি আর আমি গৃহত্যাগ করব। আমার এই বড় বড় চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। পরনে রক্তাম্বর। এক হাতে চিমটে, আর এক হাতে ত্রিশূল। পাশে তুমি আমার ভৈরবী। রুক্ষ, এলো চুল। লাল শাড়ি। কপালে এতখানি গোল সিঁদুরের টিপ। যেতে যেতে যেতে যেতে, কোনও এক মহাশ্মশানের পাশে দু’জনে ধুনি জ্বালিয়ে বসব। একটু একটু করে মহামায়াকে জয় করে সিদ্ধ সাধক হয়ে বসব। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু সব আমাদের পায়ের তলায়।
তার মানে বউ!
ঠিক বউ নয়। সে কীরকম এক ধরনের ব্যাপার, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি নিজে বুঝে, তোমাকে বুঝিয়ে দেব।
ওসব সাধুটাধু হতে পারব না বাপু। আমার ভীষণ মাছের লোভ। চুনোমাছ বেশ সরষেবাটা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে গরগরে ঝাল তৈরি করে একথালা গরমগরম ভাত। তারপর একখিলি পান। ডুরে শাড়ি। ও গেরুয়া মেরুয়া সব ভণ্ডামি। চটকলে অনেক লোক নেবে শুনলুম। চেষ্টা করে দেখো না। তা হলে বেশ পালানো যায়!
কী বলে রে? আমি কার ছেলে? কত বড় আমাদের বংশ। ইচ্ছে করলে আমি কী না হতে পারি! ওকালত, কালোয়াত। ইচ্ছে করি না তাই! নাবালিকা। লঘুগুরু-জ্ঞানশূন্য।
উঠে পড়ি বাবা! সন্ধেটন্ধে দিতে হবে।
টিনের বাক্স হাতে মায়া ঘরের দিকে চলেছে। আঁচল লুটোচ্ছে মাটিতে। শাড়ি একটু উঁচু করে পরা। কত পাপ যে করেছি! লুকিয়ে লুকিয়ে বিদ্যাসুন্দর পড়েছি। তাকাতে গিয়ে যে সেই লাইনটাই মনে আসছে,
নিবিড় বিপুল চারু যুগল নিতম্ব।
কাম-পারাবার-পার-সার-অবলম্ব ॥
মন্দ মন্দ গমনে যদ্যপি বাঁকা চায়।
মনোভাব পরাভব লইয়া পলায় ॥
বাড়ি ফিরতেই কনক বললে, তুমি তো আচ্ছা। কথা আটকে গেল। তোমার কপালে ওটা কী?
মরেছে। সেই কাঁচপোকার টিপ। বৈষ্ণব পদাবলির সেই দৃশ্য। অভিসার শেষে রাধা ফিরছেন কুঞ্জ হতে। অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি। কপাল থেকে চট করে টিপটা খুলে নিয়ে পাকা অভিনেতার মতো বললুম, কিছু লেগেছিল বোধহয়! ভাগ্যিস সময়টা সন্ধে। নয়তো ধরা পড়ে যেতুম।
মেসোমশাই ডাকছেন, কনক, কনক। সন্ধে হল।
আসি বাবা। কনক যেতে যেতে বললে, তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে এসো। প্রার্থনায় বসতে হবে।
সে আবার কী? সে তো বহুকাল আগের কথা! অস্পষ্ট স্মৃতি। সকালে হাত জোড় করিয়ে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে এক নারীমূর্তি আমাকে প্রার্থনা করাচ্ছেন,
সকালে উঠিয়া আমি মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।৷
তিনি হয়তো আমার মা ছিলেন কিংবা জ্যাঠাইমা। এই ছাড়া-গোরুকে কে আবার গোয়ালে তুলতে চায়! সাঁঝাল দিতে চায়। সব তো চুকেবুকে গেছে। আমার মনে যে বড় বেদনা! আমার যে কেউ কোথাও নেই। আমি ঈশ্বরকেই চাই, তবে পুরুষের বেশে নয়। নারীর বেশে। যত মত তত পথ। তুমি আমার প্রেমিকা হয়ে এসো।
তোমার দিন কি এইভাবেই কাটে পিন্টু! মেসোমশাই সামনে দাঁড়িয়ে। তুমি কি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছ?
আজ্ঞে না! এই একটু লাইন চেঞ্জের সময় তো!
তার মানে? তুমি রেলগাড়ি, না কলকাতার ট্রামগাড়ি! দুপুরবেলা বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইহল্লা করছ। সন্ধে উতরে যাবার পর বাড়ি ফিরছ!হরিদা সারাদিন অফিসে থাকেন। ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে হচ্ছে!
ডাক্তারবাবু বিকেলে আমাকে একটু বেড়াতেই বলেছেন।
ফাজিল ছেলেদের মতো মুখে মুখে তর্ক কোরো না। যাও ঠাকুরঘরে যাও।
প্রদীপের শিখা স্থির। ডগার দিক মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। গরদের কাপড় পরে মেসোমশাই আসনে বসেছেন। ধূপের ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। পেছনে আমরা তিনজন। সামনে পেতলের ওঁ-এর মধ্যে রাধাকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে আছেন। পটে মা লক্ষ্মী। মায়ের হাতে লাগানো সিদুরের দাগ এখনও লেগে আছে। নিস্তব্ধ। দূরে, বহুদূরে কোনও মন্দিরে আরতির ঘণ্টা বাজছে। প্রদীপের শিখা মাঝে মাঝে ফটফট করে উঠছে।
হঠাৎ আমরা সংগীতে ভেঙে পড়লুম, ভবসাগর তারণ কারণ হে, গুরুদেব দয়া করো দীন জনে। সুর ঢেউয়ের মতো একবার করে উঠছে, একবার করে পড়ছে। মন বলছে, ঈশ্বর, মেসোটি যেন রাতে ভিমরুলের চাকে খোঁচা না মারেন!
১.০৬ বিবাদে বিষাদে প্রমাদে প্রবাসে
আপনার প্রথম চিঠি আমি পেয়েছি। কিন্তু আপনার দ্বিতীয় চিঠি, যে-চিঠিতে আপনি দিন, তারিখ লিখে জানিয়েছেন বলছেন, সে চিঠি আমি পাইনি। দেখুন পোস্ট করেছেন কি না!
কী বলছেন আপনি হরিদা? আমি নিজে হাতে লাল ডাকবাক্সের ঠোঁটে টুক করে গলিয়ে দিলুম, কোর্টে যাবার পথে। আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। আইনের ব্যাবসা করি। মক্কেল চরিয়ে খাই।
আপনি তো গোড়াতেই গলদ করে বসে আছেন বিনয়দা। যেসব ডাকবাক্স পথের ধারে ষাঁড়ের মতো বসে আছে, তাদের স্বভাব আপনার জানা নেই। কিছু গলায় রাখে, কিছু পেটে। চিঠি ফেলতে হলে কঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ফেলতে হবে। সে চিঠি এখনও আপনার আটকে আছে। লেটারবক্স ডাইজেস্ট করতে পারেনি।
হতে পারে। পৃথিবীকে আমি আর বিশ্বাস করি না। এর অনেক মুখ। জাস্ট লাইক এ কারবাঙ্কল। তবে ডাকবাক্সে আমি আর জীবনে হাত ঢোকাব না। সে চিঠি যাক আর না-যাক।
অদ্ভুত প্রতিজ্ঞা। কারণটা কী?
সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার। ডাকবিভাগের ইতিহাসে লেখা থাকবে।
কনক চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকছিল। তার গলা দিয়ে কুঁক করে একটা শব্দ বেরোল। যেন পাতিহাঁস একবার ডেকেই পেছন উলটে জলে গলা ডোবাল। সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিতে পেরেছে। এই যা রক্ষে। দুই অভিভাবকই ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছেন। দু’জনেই মনে হয় সমান ধাতের মানুষ। একই ধাতুতে তৈরি। টাকার এ পিঠ আর ও পিঠ। কনক আমার পিতাঠাকুরের সামনে খুব কায়দা করে চায়ের কাপ রেখে বললে, আপনার চা মেসোমশাই। দুধ কম, চিনিও কম।
দ্যাটস ফাইন। তুমি কী করে জানলে, আমি দুটোই কম পছন্দ করি?
আমি যে জেনে নিয়েছি আগেই।
তোমার সব দিকে এত নজর?
সবে আধঘণ্টাও পেরিয়েছে কি না সন্দেহ। পিতা অফিস থেকে ফিরেছেন। এর মধ্যেই কনকের নজরে অভিভূত। মেয়েদের এই একটা সুবিধে। সহজেই মন জয় করে নিতে পারে। পিতা এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন সন্ধিপুজোর মুহূর্তে ধূপধুনোর ধোঁয়ার পাতলা আবরণের আড়ালে দেবী দুর্গাকে দেখছেন ভক্তের চাহনিতে। স্তোত্রটি পড়ে ফেললেই হয়, নমস্তে সিদ্ধসেনানী, আর্যে। মন্দরবাসিনী, কুমারী, কালী, কপালী, খগখেটকধারিণী।’ উপায় থাকলে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পৃথিবীটাকে বাকি জীবনের জন্যে একবার দেখে নিতুম। ন্যাজে খেলানো কাকে বলে! মুকুর প্রশংসা তো আগেই এক পক্কড় হয়ে গেছে। গার্গী মৈত্রেয়ীর সমপর্যায়ে উঠে পড়ার টেবিলে গ্যাট হয়ে বসে, গনর গনর করে কী একটা মুখস্থ করছে। এলো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর। সুখেন হলে নেচে নেচে গাইত, এলো চুলে গৌরী আমার শাঁখা সিঁদুর পরেছে।
বাবা, তোমার গরম জল কি এখন আনব?
গরম জল? আচ্ছা নিয়ে আয়।
আমার পিতার হঠাৎ খেয়াল হল কনকের পিতার এই অসময়ে গরম জল আবার কী হবে? প্রশ্ন করলেন, গরম জল কী হবে? চান করবেন?
না না। গরম জল খাব।
কেন চা?
চা আমার চলে না। যৌবনে বিশ কাপ, পঁচিশ কাপ ডেলি খেয়েছি। লিভার পাকতেড়ে মেরে গেছে। রোজ সন্ধের দিকে অম্বল। ডা. রায়ের প্রেসক্রিপশন– গরম জল।
চায়ে লিভার খারাপ করে এ থিয়োরি আপনি কোথায় পেলেন?
প্র্যাকটিক্যাল করে সিদ্ধান্তে এসেছি।
আপনার লিভার তো মশাই ডাক্তারের বাবার ক্ষমতা নেই খুঁজে বের করে। সাত-আট লেয়ার চর্বির তলায় যেভাবে চাপা পড়ে আছে! ওটাকে ওভাবে বাড়তে দিলেন কেন? উত্তরপ্রদেশ বড় করুন। কাজে লাগবে। মগজটাই তো সব। অবশ্য ভারতবর্ষের জিওগ্রাফিতে মধ্যপ্রদেশই বড়।
এ কি আর ইচ্ছে করে করেছি দাদা! মেড বাই অম্বল। আপনি কিন্তু চেহারাটাকে বেশ ফিট রেখেছেন!
রাখার কৌশল আছে। জানতে হয়। সবকিছুই সাধনার ব্যাপার। আছেন তো এক মাস। আপনাকে একটা চেহারা দেখাব।
ওসব ব্যায়ামবীরদের কথা আমাকে বলবেন না। এনাফ অফ দেম। ফ্যাশানেবল স্ত্রী আর মাসলম্যান, দে আর গুড ফর নাথিং।
আরে না মশাই, ওসব দেহধর ফেহধরদের আমিও জানি। তেল মেখে আলোর সামনে দাঁড়িয়ে পেশি নাচানো ছাড়া তারা আর কিছু জানে না। আপনাকে একটা সিস্টেম দেখাব। আমাদের ন্যাশন্যাল ফুটের মতো ঝনঝনে।
ন্যাশন্যাল ফুট কী জিনিস? কাঁঠাল? যা আমরা এতকাল ধরে পরস্পর পরস্পরের মাথায় ভেঙে আসছি। যা চিরকাল গাছেই থেকে গেল আর আমরা গোঁফে তেল দিয়ে দিয়ে তেল ফুরিয়ে। ফেললুম।
মন্দ বলেননি। কাঁঠালের জাতীয় ফল হবার সব গুণই আছে। তবে আমি জাতীয় ফল করে রেখেছি আমড়াকে। আদর্শ বাঙালি চরিত্র। আঁটি চর্মসার। দাঁতে ঠেকান, বাপ বলে লাফিয়ে উঠতে হবে। ওই যে বসে আছে। তাকিয়ে দেখুন। নিশ্চিন্ত আরামে। হাত পা এলিয়ে। চোখের দৃষ্টি দেখুন। উদাস, নিরালম্ব। যেন এন্ড অফ দি ওয়ার্লডে পৌঁছে গেছে। গান ধরলেই হয়, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল। ওই হল দিশি আমড়া।
ওর সিস্টেম কি খুব ভাল?
কনক কাঁচের গেলাসে গরম জল এনে সামনের টেবিলে রেখে চলে যেতে যেতে আমার দিকে তাকাল। এক ফুটের গরম জল দেখলেই বোঝা যায়। বুজকুড়ি ভাসছে। অনেকটা মায়ার গালের যুবতী ব্রণের মতো। মেয়েদের গালে ব্রণ এলেই বুঝতে হবে আম গাছে মুকুল এসেছে। মউ মউ সুবাস। ভ্রমরের ভ্যানর ভ্যানর। তোমার মুখে জুতো। কেন? কে তুমি? আমি তোমার সাত্ত্বিক মন। এত তুলোধানা হয়েও তোর শিক্ষা হয় না রে! মন ছুটছে মায়াপুর।
কাআ তরুবর পঞ্চবি ডাল
চঞ্চল চীত্র পইঠো কাল ॥
তোর দেহ থেকে পাঁচটা ডাল পাঁচ পাশে হাত বাড়িয়ে উদম নৃত্য করছে, মনের অঙ্গনে ঢুকে বসে আছে মহাকাল। মন তুই কৃষ্ণ কথা বল, কৃষ্ণ কথা বল।
ওর সিস্টেম? পিতা চায়ে চুমুক দিয়ে এমন একটা মুখ করলেন যেন পৃথিবীর বাইরে অন্ধকার মহাশূন্যে ভেলায় চেপে বেড়াতে বেরিয়েছেন। দু’হাতে কাপডিশ। কাপ ডিশ থেকে ইঞ্চিখানেক ওপরে ঝুলছে। আবার বললেন, অনেকটা ঘুমঘোরে, ওর সিস্টেম? আহারে অনাহার, শ্রমে বিশ্রাম, চিন্তায় নিশ্চিন্তা, দর্শনে অদর্শন, ভাবে বিভাব, উনি এক শাপভ্রষ্ট মহাপুরুষ। দয়া করে পাটকাঠি সদৃশ এক দেহাধারে ধরা পড়েছেন। একদিন মট করে ভাঙবেন আর উড়ে চলে যাবেন। আমি যার কথা বলছি তিনি এ পাড়ায় থাকেন, নাম মেনিবাবু। জীবনে একবারও অসুস্থ হননি। শরীর কঞ্চির মতো। মন ধারালো তলোয়ারের মতো। বায়ুর বেগে চলেন। তড়িৎ বেগে কথা বলেন। খাদ্য? চা আর জর্দাপান। কী আপনি লিভার লিভার করছেন? জেনে রাখুন শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়।
মেসোমশাই গরম জল খেতে লাগলেন। পিতা উঠে পড়লেন চেয়ার ঠেলে। বসবার সময় কোথায়? কথায় কথায় বলেন, আই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড অ্যান্ড স্টেয়ার। রান্নামহল থেকে হাঁক এল, চলে এসো। অন্যদিন হলে এই ডাকে আমার ময়দা মাখা শুরু হবার কথা। দু’কৌটো ময়দা, মাঝে গাব্ব তৈরি করে দু’চামচে ভাদুয়া, একটু নুন। নাও ঠেসে যাও। ঠাসতে ঠাসতে হাতের কবজি, কাধ টনটন করতে থাকবে। ততক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না হুকুম হয়, স্টপ।
ভেতরের দরজার পাশে কনক চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, এখন কী হবে?
একের পর এক নাটকের অঙ্ক হয়ে চলেছে সেই উত্তীর্ণ সন্ধ্যা থেকে। পরদা পড়ছে আর উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ছড়ানো-ছেটানো জিনিস দেখে বললেন, একী, এয়াররেড হয়ে গেছে নাকি? কনক, মুকু আর মেসোমশাইকে সামনে দেখে বললেন, আপনারা আবার কে? চেনাচিনি হয়ে যাবার পর হাওয়া মোটামুটি ধীরেই বইছিল। আবার ঝড় বইতে শুরু করেছে।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বেশ উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, দুপুরে অতিথিদের কী ব্যবস্থা করেছিলে? কিছু জুটেছিল?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সবই তো ছিল। ওঁরাই সব তৈরিটৈরি করে নিলেন।
তা হলে রাতের ব্যবস্থা করা যাক। ওঁরা কী আহারাদি করবেন জানতে পারলে ভাল হত।
অন্ধকার থেকে কনক সাহস করে এগিয়ে এল। পিতা যেন আশার আলো দেখতে পেলেন, এই যে কাঞ্চন, তোমরা রাতে কী খাবে?
উত্তর দেবার আগে কনক নামটা সংশোধন করাবার জন্যে বললে, আজ্ঞে আমি কনক।
ও হ্যাঁ, তুমি কনক। কনক কাঞ্চন।
আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, কাঞ্চন সাধারণত ছেলেদেরই নাম হয়।
দ্যাট আই নো। কনক মানে কী?
সোনা।
কাঞ্চন মানে কী?
সোনা।
তা হলে? আমার ভুলটা দেখলে কোথায়? আমি ওকে স্বর্ণ বলে ডাকতে পারি, সোনা বলে ডাকতে পারি। একই মানে। রোজ সকালে কয়েক পাতা করে অমরকোষটা মুখস্থ করো। তাতে তোমার ওই বোকা-বোকা ভাবটা কিঞ্চিৎ কেটে যাবে।
উঃ, কী থেকে কী হয়ে গেল! দু’জনেই অপ্রস্তুত। গাধার মতো দাঁড়িয়ে ঘা চাটছি। কনকের কিন্তু সাহস কম নয়। পরিস্থিতি একটু থিতোতেই প্রশ্ন করল, আপনারা রাতে কী খান জানতে পারলেই ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সব তৈরি হয়ে যাবে। আমরা যে কদিন আছি, আপনাকে আর রান্নাবান্না নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
খুব ভাল কথা। আমি কিন্তু তা হতে দেব না। আমার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা চলে যাবার পর বিপদে পড়ে যাব।
আপনি কী বলছেন মেসোমশাই। জ্ঞানী মানুষের কখনও অভ্যাসের দাস হওয়া উচিত নয়।
উঃ, শাবাশ। ভয়ে চোখ আর দম দুটোই বন্ধ। বোমের পলতেয় আগুন পড়েছে। দেখতে পাচ্ছি ফিচির ফিচির ফুলকি ছাড়তে ছাড়তে এগোচ্ছে। ফাটল বলে। মৃদু হাসির শব্দে চোখ খুলে গেল। বোমা ফাটল না। কনকের মেসোমশাই হাসছেন। মেয়েদের কী মহিমা রে! আগুনে আগুন নেই। তাপে তাপ নেই। জলে জল নেই। আমার মায়া! বিকেলে যখন চটকাঁচটকি করছিল, শরীরে উত্তাপ দেখে মনে হয়েছিল, ম্যালেরিয়া। তুমি কাপছ। তোমার জ্বর। কুইনিন খাও।
আজ্ঞে না গর্দভ। মেয়েদের আর বেড়ালের তাপ একটু বেশিই হয়। বুড়ি হয়ে বৃন্দাবনে গেলে তবেই এ জ্বর ছাড়বে।
আবার সেই মায়া? মায়ায় মজেছে মন। ভালই গাও, মজল আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীল কমলে। শ্যামামাকে আর কষ্ট দিয়ো না। মন টোল খেয়েছে, টাল খেয়েছে। শ্যামা কেটে মায়া। বসাও।
পিতা বললেন, হেরে গেলুম তোমার কাছে।
এ যেন নিমাইয়ের কাছে রঘুনাথ শিরোমণির হার। হারতেই হবে। অতবড় একটা কাবুলিকে ছোট্ট মেয়ে মিনি নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছিল। মুঠো মুঠো কিসমিস, আখরোট, মনাক্কা, খুবানি। ঝুলি থেকে বেরোচ্ছে তত বেরোচ্ছেই। কনক হাসতে হাসতে বললে, এতে হারজিতের কিছু নেই। মেসোমশাই, মেয়েদের কাজ মেয়েরাই করবে।
তা ঠিক, তা ঠিক। পিতা মাথা নাড়লেন।
কনক কথাটা এমন করুণ করুণ মুখে বললে, যেন কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে। পায়ে। পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কেই যদি এই কুকুর আর প্রভুর ভাবটা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তা হলে আর কোনও সমস্যা থাকে না। ন্যাজ নেড়ে নেড়ে ঘুরে যাও।
রাতে তা হলে লুচিই হোক।
তাই হোক, মেসোমশাই। এক হাতে কাঁচের গেলাস, আর এক হাতে তাসের মতো ধরা দুটো বড় নোট।
আপনার তো আবার অম্বল হয়েছে? আই ডোন্ট কেয়ার। সোডিবাইকার্ব ইজ দেয়ার।
তা হলে লুচি হোক, রাতটা নিরামিষেই চলুক, চিনে ঘাস দিয়ে দুধের পায়েস, একটু গোলাপের আতর। মারভ্যালাস!
গেলাসটা মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, মেসোমশাই দু’বার গলা ঝেড়ে বললেন, হরিদা, সবার আগে একটা কাজ সেরে নেওয়া যাক, এই দুটো আপাতত আপনার কাছে রাখুন।
মেসোমশাই হাসি-হাসি মুখে গুটিগুটি এগোচ্ছেন। পিতার মুখ ক্রমশই কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এইবার বোমা ফাটবে।
হোয়াট!
বাতাসের ধাক্কায় মেসোমশাই দুলে উঠলেন। এত জোরে হোয়াট বেরোবে কে আর ভেবেছিল?
আপনি আমাকে টাকা দেখাতে এসেছেন? এত অহংকার! অহংকারং বিমূঢ়াত্মা।
ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন হরিদা! এতে আপনি অহংকারের কী দেখলেন?
সেই বোধটুকু থাকলে আপনি ওভাবে টাকার পেখম মেলে বাইজি বাড়ির বাবুর মতো এগিয়ে আসতেন না। আপনি আমার অভিমানে ধাক্কা মেরেছেন। ভাবতেই পারলেন না যে আপনি আমার আত্মীয়। আপনি ক্ষুদ্র, আপনি বীভৎস। আপনার সভ্যতার ঝুলি থেকে হুলো বেরিয়ে পড়েছে।
পিতা ধাপে ধাপে চড়ছেন, মেসোমশাইয়ের কপালের কোচ একটি একটি করে বাড়ছে। প্রতিবাদের জন্যে ঠোঁট নড়ছে, শব্দ বেরোবার ফাঁক মিলছে না। সিনেমা হলের দরজা দিয়ে যখন গলগল করে তোক বেরোতে থাকে তখন ঢোকার লোকেরা একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে গা বাঁচিয়ে। যত জোরে হোয়াট দিয়ে শুরু করেছিলেন ততোধিক জোরে একটি হাঁচি দিয়ে মেসোমশাই-নিধন পর্ব শেষ হল।
মেসোমশাই বললেন, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন। আমি টাকা দেখাবার জন্যে টাকা দেখাইনি। এই বাজারে তিনজন এক মাস এবেলা ওবেলা খাবে তার একটা খরচ আছে তো! আমি সেই ভেবেই শেয়ার করতে চেয়েছিলুম। আপনি আমার পয়েন্টটা না বুঝেই বেশ কিছু কটু কথা হুড়হুড় করে বলে গেলেন, আপনার যেমন সেন্টিমেন্টে লাগল, আমার তেমনি লাগল প্রেস্টিজে। এ এক ধরনের অপমান।
দুই যোদ্ধার মাঝে কনক এসে দাঁড়াল। এ মেয়ে অ্যানি বেসান্ত কি হেলেন কেলারের দ্বিতীয় সংস্করণ। লেডি উইথ দি ল্যাম্প। কনক বললে, ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। মেসোমশাই, আপনি শান্ত হন। বাবা, আপনি একটু কাঁচা কাজ করে ফেলেছেন।
সমর্থন পেয়ে পিতা আবার লাফিয়ে উঠলেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি জিনিসটার কুৎসিত দিকটা ঠিক ধরতে পেরেছ। এটা তো হোটেল নয়, সরাইখানা নয়, পাঞ্জাবির পকেট থেকে কড়কড়ে নোট বের করে নাকের ডগায় ছুঁড়ে দেবেন, এই নিন। এক মাস কেন? আপনারা এখানে এক বছর থাকুন অতিথি হয়ে। আমার কে আছে বিনয়দা। রাজ্যপাট ভেঙে গেছে, সভাসদরা বিদায় নিয়েছে। আপনারা এসেছেন এই তো আমার সৌভাগ্য। বহুদিন পরে গাছের ডালে পাখি এসে বসেছে। কতকগুলো নোংরা কাগজ নেড়ে সুর কেটে দেবেন না। আমার অনুরোধ।
গলা যেন একটু ধরাধরা। এই যে সব থাকা আর না-থাকা, আমি আছি, তোমরা নেই, এইসব বিচ্ছেদের ব্যাপারট্যাপার সংসারী মানুষকে বড় বিচলিত করে। একটু বেদান্তের দিকে সরতে পারলেই বগল বাজিয়ে ঘোরা যায়, ‘এই সংসার ধোঁকার টাটি, খাই দাই আর মজা লুটি।’ জগৎ সব ভুল, স্বপ্নবৎ। আমিতেই মেরেছে। আমির বোধেই, তোমার বোধ। নীচে আগুন জ্বলছে, হাঁড়িতে ডাল, ভাত, আলু, পটল সব টগবগ করছে। লাফাচ্ছে, আর বলছে, ‘আমি আছি’, আমি ধিন ধিনা লাফাচ্ছি। শরীর সেই হাঁড়ি, মনবুদ্ধি জল, ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলি ডাল, ভাত, আলু, পটল, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার। অহং যেন তাদের অভিমান, আমি ফুটছি, ফাটছি। সচ্চিদানন্দ, তুমিই সেই অগ্নি। আহা, জগৎজোড়া কাবাবের কারখানা। থুড়ে থুড়ে কিমা। প্রশ্ন, কিমাং কিম করোতি। আসল জ্ঞান কি ব্যাকরণে আছে? আসল জ্ঞান কি গণিতে আছে? পাঁজিতে অনেক জলের কথা লেখা আছে। নিংড়োলে এক ফোঁটাও বেরোবে না। আসল জ্ঞান ফুটে ওঠে। প্রথমে একটু জ্বরজ্বর, কোমর ব্যথা, তারপর কপালে একটি গুটি, গলায় দুটি, পিঠে তিনটি! ব্যাপার কী? পক্স। ফক্সের সংসারে পক্সের মতো এইভাবেই গুটিকয়েক মানুষের মনে ব্ৰহ্মজ্ঞানের গুটি বেরোয়। বাকি সব অহংয়ের কচকচি। বয়েসফয়েস কিছুই নয়। ধ্রুব, প্রহ্লাদ, সব কঁচা বয়সেই যোগী।
পিতার শেষ কথায় পরিস্থিতি শীতল হয়ে এল। মৃত্যু, বিচ্ছেদ, শূন্যতা প্রৌঢ় মানুষদের সহজেই কাবু করে ফেলে। যুবকদের সমস্যা অনেক কম। এই যেমন আমি। কনকরা চলে যাবার পর দিন তিনেক মন হুহু করবে বাউল আর ভাটিয়ালি গানের মতো। বাথরুমে জল পড়ার ঝরঝর শব্দের সঙ্গে, মন মাঝি তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারলাম না মিলিয়ে, ছলছলে চোখে নাঙ্গা হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা। তাতে কনকেরও কিছু এসে যাবে না, আমারও কাঁচকলা। দশ বছর পরে দেখা যাবে কনক মা হয়ে মেয়ে কোলে কোনও এক্স ওয়াই জেডের ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব। দুঃখ হবে মায়ার কিছু হলো না, মায়ার কথা যখন-তখন ভাবা উচিত নয়। মায়া আমার মাঝরাতের মালকোষ, ভোররাতের যোগিয়া।
মেসোমশাই এগিয়ে এসে পিতার হাত ধরে বললেন, ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট। যা হয়ে গেল, তা হচ্ছে প্রিন্সিপিল-এর লড়াই।
হাত-ধরা অবস্থাতেই পিতা বললেন, আজ্ঞে না, একে বলে অহংয়ের ঠোকাঠুকি। কেউ কারুর কাছে ছোট হব না। অহংয়ের বাষ্পে দৃষ্টি আচ্ছন্ন, বিচারবুদ্ধি ঘোলাটে। মোটরবাইক কীভাবে স্টার্ট নেয় দেখেছেন?
দেখলেও খেয়াল করিনি।
পিতা হাত মুক্ত করে নিলেন। দু’হাতে মোটরসাইকেলের হাতল। সামনে শরীর একটু ঝুঁকে আছে। বাঁ পা স্টার্টারে। ফার্স্ট ফিক, সেকেন্ড, থার্ড কিক। ভটভট, ভটভট। একেই বলে অহংয়ের। লাথি।
মেসোমশাই, কনক দু’জনেই হেসে উঠলেন। যাক বাবা, আবহাওয়া ময়ান দেওয়া ময়দার মতো মোলায়েম হয়ে গেল। দুই ব্যাঘ্র চলে গেলেন বারমহলে। ছায়াছায়া বারান্দায় কনককে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। বুলবুল গান গায় নার্গিস বনে। বিচিলি রঙের শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। ধারালো চেহারা। চকচকে কালো চুল। চোখে আলো পড়লে নীল সাগরে ভেসে থাকা কালো মণি ঝলসে ঝলসে উঠছে।
কনক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, তোমার একজন বোন থাকলে বেশ হত।
তুমি তো আছ।
আমি আর কদিন বলো?
তা ঠিক। যদিন আছ তদিনই বাড়ি জমজমাট। তারপর সংসার চলবে শেষবেলার জলের চাকার। মতো। চাষার ক্লান্ত হাতে চাকা জলে নামছে, ঘুরে ঘুরে, ধীরে ধীরে উঠছে। সরষে-খেতে জল পড়ছে ছিড়িক ছিড়িক করে।
থাক আর কাব্য করতে হবে না। এখন লুচি, ছোলার ডাল, আলুর দম। ঘড়ির কাটা কোথায় গেছে দেখেছ!
ডাক উঠল, পিন্টু, পিন্টু। এক মিনিট দেরি করার উপায় নেই। আজ্ঞে বলে ক্যানেডিয়ান ইঞ্জিনের মতো দৌড়োতে হবে। দুই পিতাই আবার চেয়ারস্থ। বেশ ভাব হয়ে গেছে দু’জনের। প্রসঙ্গটা কী জানি না। মেসোমশাই খুব কাকুতিমিনতি করছেন, ওসব হাঙ্গামার দরকার নেই হরিদা। খাদ্যতালিকা যা তৈরি করেছেন যথেষ্ট।
এ ব্যাপারে আপনার কথা বলার কোনও অধিকার নেই বিনয়দা। আপনি আমার সম্মানিত অতিথি। আমাদের বংশের একটা ধারা আছে। . বংশই নেই তো বংশের ধারা! শেষ বাতিটি কে জ্বালাবে! আমি তো আজ আছি কাল নেই। গুরু পেলেই বৃন্দাবন। তখন তো অনেক কথাই ফিরিয়ে নিতে হবে, যেমন দুষ্ট গোরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই ভাল। পিতা বললেন, একটা কাজ করতে পারবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কেন পারব না!
পরেশের দোকানে গরম রসগোল্লা কটার সময়ে নামে?
রাত বারোটা নাগাদ।
তুমি ঘোড়ার ডিম জানো।
আমি সেইরকমই শুনেছি।
কার কাছে?
কে যেন বলছিল। ওই পেটের গোলমাল হয়েছিল। রাত বারোটায় গিয়ে পরপর তিন দিন ছ’টা করে রসগোল্লা খেয়ে সেরে উঠেছে।
সে তোমার কোনও গেঁজেল বন্ধু। আমি জানতুম, তোমার দ্বারা চুলের কেয়ারি ছাড়া অন্য আর কিছু হবার উপায় নেই। আমিই যাচ্ছি। কতক্ষণ লাগবে? যেতে তিন মিনিট, আসতে তিন মিনিট।
আমি তো যাব না বলিনি!
তবে যাও। বলে এসো রাত দশটার সময় এক সের গরম রসগোল্লা চাই। সবচেয়ে বড় সাইজের যেটা সেইটা।
মেসোমশাই আর একবার মৃদু গলায় বললেন, কেন হাঙ্গামা করছেন হরিদা?
এটা আমাদের ব্যাপার বিনয়দা। যাও, তুমি আবার তানানানা করছ কেন?
গরম হাওয়া পেলে বেলুন ফুস করে ঠেলে আকাশে ওঠে। রাস্তায় পা রেখে মনে হল আমারও সেই অবস্থা। বাড়ির দিকে তাকিয়ে ফিরে ফিরে দেখছি। খোলা জানলায় আলো ফটফট করছে। মানুষের ছায়া নড়ছে দেয়ালে। বাইরে থেকে দেখলে মনেই হবে না, গরাদহীন উন্মাদ আশ্রম! পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে যেন বললেন, কী দেখছ হে ঘুরে ঘুরে? আমাদের পাড়ার বিধুজ্যাঠা। পাটের দালাল। বেশ ভোগীর চেহারা। বগলে একটা ব্যাগ। চোখে সোনালি চশমা।
বাড়ি দেখছি জ্যাঠামশাই।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বিশ্বরূপ শেষরাতে গৃহত্যাগ করছেন, জানলায় দাঁড়িয়ে আছে বিষ্ণুপ্রিয়া। হরি ফিরেছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
একবার মনে করিয়ে দিয়ে তো! আমি যা বলেছিলুম সেটার কী হল? রবিবার আমি অবশ্য একবার দেখা করার চেষ্টা করব।
পরেশদা ছানায় আঁক দিচ্ছেন। পরনে সেই গামছা, গোলগলা আধময়লা গেঞ্জি। রসে-ডোবা চমচমের মতো চেহারা। নীচের দিকটা তাকিয়ার মতো, ওপরদিকটা মাথার বালিশের মতো। তার ওপর একটা তিন নম্বর ফুটবল। দুটো বারকোশের মাঝখানে কাপড় জড়ানো ছানার নাদা। ছাদে উঠে পরেশদার লেফটরাইট চলছে। এক একবার চাপ পড়ছে আর সাদা সাদা জল বেরিয়ে আসছে। পরেশদা দিন দিন কী হচ্ছে! সত্যিই এর নাম ‘টনিক ময়রা। মিষ্টির দোকানে কাজ করতে পারলে, মাসখানেকের মধ্যেই মুটিয়ে যেতুম। নধরকান্তি একটি বটব্যাল।
পরেশদা, গরম রসগোল্লা কখন নামবে?
ছানার ওপর নাচতে নাচতে বললেন, ওই তো রস জ্বাল হচ্ছে। এইবার পড়বে।
দশটা নাগাদ?
এসো, দেখা যাবে।
এক সের বুক করে গেলুম। সবচেয়ে বড়টা।
বুক পেট জানি না। নামলেই নিয়ে যেয়ো।
রাত ক্রমশই রসগোল্লার মতো রসস্থ হয়ে উঠছে। সাত নম্বর বাড়িতে গানের আসর বসেছে। তবলায় চটি পড়ছে। পানবিড়ির দোকানে রেডিয়ো বাজছে। ফটফট করে আলো। বোকাদা ডিম ভেঙে সকালকে সুপ্রভাত করেছিলেন। এখনও ভেঙে চলেছেন। বিদায়রজনী হবে রাত বারোটায়। ইংরেজি মতে তখন নতুন দিন শুরু হয়ে গেছে। জবাদের বাড়ির সেই সদাহাস্যমুখ বাবুটি হাতে একগাদা প্যাকেট ঝুলিয়ে নেচে নেচে চলেছেন, রাত হল, রাত হল, দ্বার খোলো প্রমদা।
গরম রসগোল্লা রেডি হচ্ছে। রাত দশটা নাগাদ পাওয়া যেতে পারে।
দেখেছ, তোমার ইনফর্মেশন কত ভুল! এই ভুল ইনফর্মেশনের জন্যে অতবড় হিটলারের পতন হল। ইংরেজের রাজত্বে সূর্য ডুবে গেল। সত্য শ্রবণে নেই সত্য দর্শনে।
হুড়মাড় দুদ্দাড় করে কনক উত্তরমহল থেকে দক্ষিণমহলে ছিটকে এল। হাতে একটা খুন্তি। সমস্বরে প্রশ্ন, কী হল, কী হল?
কোনওরকমে দম ফেলে কনক বললে, আরশোলা, অসংখ্য আরশোলা। ঝাকে ঝাকে উড়ে আসছে।
পিতা মেসোমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, নাপচিয়াল ফাঁইট, বুঝলেন বিনয়দা! এখন দরকার ঝাটা ট্রিটমেন্ট। এ রোগের দাওয়াই হল ঝাটা পেটা। চলো পিন্টু।
কনকের চেয়ে আমার কিছু বেশি সাহস নেই। মাতুলক্রমঃ। সেই ঘটনাটি মনে পড়লে এখনও, আমার হাসি গুমরে গুমরে ওঠে। কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহে বসেছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর। সময় সকাল। মাতুল ধরেছেন গুর্জরী টোড়ি। আলাপ জমে উঠেছে। দুটো তানপুরা দু’পাশ থেকে মিঞাও মিঞাও করছে। তবলচির হাত উসখুস করছে তবলায়। গানের মুখ এলেই তেরে কেটে করে লাফিয়ে পড়বেন। ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে ফিরর করে কী একটা উড়ে গেল। সুর বোধহয় পক্ষ বিস্তার করেছে। সুর নয় আরশোলা। পেছনের সাদা পরদায় বসে তাল খুঁজছে। কে জানত, মাতুলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করছে। আরশোলা যাঁহাতক উড়েছে দ্বিতীয় চক্করে, তবলা, তবলচি, মাইক্রোফোন, হারমোনিয়ম, গাইয়ে সব একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে স্টেজ থেকে সামনের সারির দর্শকদের ঘাড়ে। গানের মুখ সবে ধরেছিলেন অব মেরে নইয়া। নইয়া পাড়ে ভেড়ার আগেই ডুবে গেল। হইহই ব্যাপার। বেনারসের ওস্তাদ চিৎকার করছেন, কেয়া হুয়া ওস্তাদজি? ওস্তাদজি, তবলচি তখন হামা দিচ্ছেন সামনের প্যাসেজে।
রান্নাঘরের আকাশে লাল বিমানবহর। সপাসপ ঝাটা চলছে। ডাইনে বাঁয়ে। মাঝেমধ্যে দু’-এক ঘা পরস্পরের পিঠেও পড়ছে। পিতা বলছেন, নেভার মাইন্ড, নেভার মাইন্ড। এক একবার চাপস মারছেন। কখনও বলছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে কিছু বড় সাইজের টিকটিকি ইমপোর্ট করতে হবে। কখনও বলছেন, ছাতাওয়ালা গলির পিংলিংকে খবর দেবেন। এ জিনিস মেরে শেষ করা যাবে না, খেয়ে শেষ করতে হবে।
প্রেমোন্মাদ শেষ আরশোলাটিকে ঝাটায় চেপে ধরে পিতা হাঁকলেন, কনক, অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।
১.০৭ সারমন অন দি মাউন্ট
আমাদের নোনা-ধরা দেয়ালের যে-জায়গাটায় দক্ষিণ আমেরিকার মানচিত্র তৈরি হয়েছে সেখানে একটা আদ্যিকালের বদমেজাজি ঘড়ি ঝুলছে। পেন্ডুলামের চেহারাটা হেডমাস্টারের মতো। গুরুগম্ভীর মুখে দুলছে তো দুলছেই। ছন্দটা এইরকম: নো, নো, আই ওন্ট টলারেট। বাজনার সুর রসকষহীন। দুপুর রোদে হাঁকছে যেন, শিল কাটাও। বাজা-র এক মিনিট আগে জানান দেয়, খাড়াক।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিতাঠাকুর চুলে টাকপড়া বুরুশ চালাতে চালাতে বললেন, ক্লক স্ট্রাইকস টেন। যাও, রসগোল্লা।
ক্লক স্ট্রাইকস বললে কেমন একটা রহস্যের দরজা খুলে যায়। মধ্যরাতে ঘড়ি বাজে, কবর খুলে বাদুড় ওড়ে। চশমার খাপ থেকে দশটা টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন। স্নান সেরেছেন। বেশ তাজা দেখাচ্ছে। ছাদের ঘরে ব্যায়াম হয়েছে। ঠাকুরঘরে বসা হয়েছে। ধর্মের জন্যে নয়, একাগ্রতার জন্য। সব কাজ সারা। এইবার রাত বাড়বে, পড়া চলবে, পাতার পর পাতা। টেবিলের একধারে বইয়ের পাহাড়। কী নেই। উপন্যাস, দর্শন, গণিত, ভূবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা, কৃষিবিজ্ঞান। স্বল্পং স্তথা আয়ু বহবশ্চ বিঘ্ন। শিশির ভাদুড়ীর মতো হাত পা নেড়ে বলেন, জ্ঞান অর্জন করে যাও, জ্ঞান অর্জন। করে যাও। এক জীবনে সব হবে না। যতটা পারা যায়, যতটা পারা যায়।
টাকাটি হাতে তুলে দিয়ে বললেন, কড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। একটি একটি করে হাঁড়িতে তুলবে যখন, দেখবে। চোখ বুজিয়ে থেকো না। চোখ বুজিয়ে ঈশ্বরদর্শন হয়, জগৎদর্শন হয় না। টাটকা আর বাসি মিশিয়ে ছেড়ে দেবে। এ বড় শক্ত ঠাই, গুরু শিষ্যে দেখা নাই।
বিশাল উনুনে ঢাউস কড়ায় রস ফুটছে। রসে টাবুরটুবুর করছে রাশি রাশি রসগোল্লা। শর্করার গন্ধমাখা ফিনফিনে ধোঁয়া উঠছে বাঁশের বাতার দিকে। কড়ার সামনে নৌকোর হালের মতো কাঠের হাতা নিয়ে টুলে বসে আছেন পরেশদা। চোখের চেহারা দেখেই মালুম হচ্ছে দু’-চার ছিলিম চেপে গেছে। যমরাজ বসে আছেন গাট হয়ে। তপ্ত কটাহে জীবজগৎ হাবুডুবু। ভিয়েন দেখলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়। রসে ডু ডুবিয়ে তুলে দেখে ময়রা। এক সুতো। দু’সুতো। পাঁচ সুতায় পাকা পাক। পঞ্চেন্দ্রিয় চুর হলে জীব মুক্তি পায়। সর্বং খন্বিদং ব্রহ্ম।
পরেশদা, এক সের বড় রসগোল্লা।
অপেক্ষা করো, হয়ে এসেছে।
বাঁশের খোটায় হুক লাগানো। সেই হুকে সোনপাপড়ির সুতো লাগিয়ে আর এক ভীমভবানী টানাটানি চালিয়েছে। এও আর এক খেলা। যত টানবে তত খাস্তা হবে। ততই মজবে ভাল। মাঞ্জামারা সোনপাপড়ি। রসের চাঁচর সঁতে কাটবে নাগর। নাগর শব্দটা তেমন ভাল নয়। এসব কথা কেন মনে আসছে! বালযোগী সাবধান। ক্ষুরস্যধারা।
পরেশদা হাঁক মারলেন, নিতাই, নিতাই।
ইজের-পরা নিতাই দোকানের গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এল। একসেরি হাঁড়ি আন একটা।
ভিজে হাঁড়ি জল শুষছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় ফিসফিস শব্দ ছেড়ে গেল, বড় তৃষ্ণা, বড় তৃষ্ণা। ওজন টোজনের প্রয়োজন হল না। বড় রসগোল্লা ক’টায় এক সের হয় পরেশদার জানা।
ছোট্ট বিড়ের ওপর হাঁড়ি। মুখে শালপাতার আবরণ। পাটের দড়ি দিয়ে কায়দা করে বাঁধা। হাঁড়ি ঝুলছে ডান হাতে। ফাউ চাইলে একটা মুগের নাড়ু মিলত। লোভ জয় করে ফেলেছি। চরিত্রের কী শক্তি! ওদিকে সারি সারি পাঁচপো মাপের হাঁড়ি লাইন দিয়ে বসেছে। দুধে টইটম্বুর, সাজা দিয়ে ফেলে রেখেছে। কাল সকালে জমে দই হবে।
রাতের রাস্তায় নোক চলাচল কমে এসেছে। মধুবাবুর সাইকেল মেরামতের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। রকে একটা কালো কুকুর শুয়ে শুয়ে গা চাটছে। বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা। কুকুরটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, একটা ডন মেরে রাস্তায় নেমে এল। ভয়ের কিছু নেই। কে চোর, কে সাধু, চেনার ক্ষমতা কুকুরের মতো আর কোনও প্রাণীর নেই। সাধে কুকুর পাণ্ডবদের মহাপ্রস্থানের পথের সঙ্গী হয়েছিল?
আমি চলেছি। পেছন পেছন কুকুর চলেছে ফোঁস ফোঁস করতে করতে। চলতেই হবে, আমি যে ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। মহাপ্রস্থান করার সময় তোকে নিয়ে যাব রে ভুলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে একটু সন্দেহ হল। ভুলো আমার সাত্ত্বিক চরিত্রকে অনুসরণ করে আসছে বলে মনে হচ্ছে না তো! ডান হাতে ঝোলানো হাঁড়িটা শুঁকতে শুঁকতে আসছে।
এতে রসগোল্লা আছে মানু। মাংস নেই। গরম রসগোল্লা।
ভুলো রাসকেলের এই মতলব ছিল কে জানত! সামনের দু’পা তুলে মারল টান। হাত ছেড়ে হাঁড়ি পড়ল রাস্তায়। ভটাস করে একটা শব্দ। ঘটাকাশ আর চিদাকাশ এক হয়ে বন্ধনমুক্ত জীবের মতো সাদা সাদা রসগোল্লা। আমরা চললুম পিন্টু, ভুলোর মুখ দিয়েই স্বর্গদ্বারে পৌঁছোব, তোমার পিতৃদেবকে বলে দিয়ো। উপবাসী শয়তান কাবাব জ্ঞানেই রসগোল্লা খেতে লাগল। ন্যাজটি কিন্তু নাড়তে ভোলেনি। শয়তান হলেও কুকুর তো! অন্ধকার রাস্তা। দোকানপাট সব বন্ধ। নর্দমার ধার থেকে আর একটি ছায়ামূর্তি প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল। এইবার প্রেতের হাসি। খিলখিলে শব্দ। এ সেই মণিপাগলি। কুকুরটা একটা চাপা গর্জন ছাড়ল। আনন্দমঠের দুর্ভিক্ষের দৃশ্য। পাগলি উবু হয়ে বসে রসগোল্লা খাচ্ছে। প্রায় উলঙ্গ।
মণি কত বড় বাড়ির মেয়ে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে কীভাবে পাগল হয়ে গেল! একসময় কী সুন্দর চেহারা ছিল। ভাল ফুল তো ফোঁটার উপায় নেই। মানুষ এসে ছিড়বেই৷ মণিকে যারা শেষ করে গেল, তারা এখন কোন ফুলে গিয়ে বসেছে কে জানে। ডাসা ডাসা ভোমরা উড়ছে। যৌবনের পরাগ ঝরে ঝরে পড়ছে। ভাগ্যিস মেয়েছেলে হইনি। ভাদ্র মাসে ভুলোরা শেষ করে দিত। হে ভারত ভুলিয়ো না তোমার নারীজাতির আদর্শ।
মণিপাগলিকে দেখে মনের জোর বেড়ে গেল। রসগোল্লার বদলে বকুনি খাবার জন্যে আমি এখন প্রস্তুত। প্রমাণ সহ পিতার সামনে উপস্থিত হতে হবে। প্রমাণ ছাড়া তিনি কিছু বিশ্বাস করেন না। ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না, সুতরাং তিনি নাস্তি। মাটির হাঁড়ির একটা টুকরো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিলুম। ভুলোর একটা টুকরো নিতে পারলে ভাল হত।
মণি গান ধরেছে, হরে কৃষ্ণ, হরে রাম, পেটের ছেলের বড় দাম।
শূন্য হাতে ফিরতে দেখে পিতা বললেন, কী এখনও নামেনি নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ নেমেছে। আনতে আনতে কুকুরে ছিনিয়ে নিলে। এই যে ভাঙা হাঁড়ির টুকরো। ভুলো আর মণিপাগলি ভাগাভাগি করে খেয়েছে। নির্ভীক স্বীকারোক্তি। বুক ফুলিয়ে সত্যভাষণ। জর্জ ওয়াশিংটন তো তাই করেছিলেন। পিতার শখের গাছ তলোয়ারের এক কোপে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, পিতা, এই অপকর্ম আমি করিয়াছি।
মেসোমশাই মেয়েকে পড়াচ্ছিলেন। মুখ তুলে বললেন, ভগবানের ইচ্ছে নেই হরিদা। আপনি চেষ্টা করলে হবে কী?
ভগবান ফগবান আমি মানি না বিনয়দা। যখন যেমন, মানুষের ইচ্ছে ভগবানের ইচ্ছে বলে চালানো হয়। আমি পুরুষকারে বিশ্বাস করি। ট্রাই অ্যান্ড ট্রাই! গরম রসগোল্লা আমি খাওয়াবই আর ওকে দিয়েই আনাব।
আপনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না? কী আশ্চর্য! তার ইচ্ছেতেই তো জগৎ চলছে। জীব আসছে যাচ্ছে। গাছের পাতা নড়ছে। ফুল ফুটছে। পাখি ডাকছে। যেখানে যা দরকার তাই দিয়ে পৃথিবী সাজিয়েছেন। এ এক অনন্ত লীলা! আপনার আমার বোঝার ক্ষমতা নেই। মওঃ শরতরং নান্য কিঞ্চি অস্তি ধনঞ্জয়! ময়ি সর্ব ইদং পোতং সূত্রে মণি-গণা ইব।
মেয়ের বই দেখে আমাকে আর সংস্কৃট আওড়াবেন না। আমি সার বুঝেছি, ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাৎ ঈশ্বর আমার সামনে এসে দাঁড়ালেও আমি আগে আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চাইব। যাচাই করে নেব ইমপোস্টার কি না? আমি মনুর সন্তান মানুষ। আমার সেই পিতার পিতা তস্য। পিতা, প্রি-ইনফাইনাইট পিতা বলে গেছেন, যৎ কর্ম কুর্বতোহস্য স্যাৎ পরিতোমোহন্তরাত্মনঃ। তৎ প্রযত্নেন কুর্বিত বিপরীতন্তু বর্জয়েৎ। যে কাজ করলে অন্তরাত্মার তৃপ্তি হয় আমি সেই কাজই করব। ওসব গড উইশ ফুইশ আমি বুঝি না।
আগে তো আপনি এইরকম ঘোরতর নাস্তিক ছিলেন না। কী করে এরকম হয়ে গেলেন?
ঈশ্বর হলেন ধনীর বিলাসিতা, দরিদ্রদের দুর্বলতা। এই সংসারে একের পর এক যখন মৃত্যু নামছে, একটা করে প্রাণ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে, তখন মাঝরাতে, নির্জন ছাতে, তারাভরা। আকাশের দিকে তাকিয়ে, জলভরা চোখে দিনের পর দিন বলেছি, প্রভু, আর না, আর না, এনাফ। অফ ইট, এবার ক্ষান্ত হও। একেবারে শ্মশান করে দিয়ো না। আপনার ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব ঈশ্বর উল্কায় জ্বলেছেন, তারায় মিটমিট করেছেন, অ্যান্ড নাথিং মোর। ভীরুর কল্পনায় তার মন্দির। ওয়ান্ট, ডেস্ট্রাকশন, ডেস্টিচিউশন, মিউটিলেশন, রেপ, র্যামপেজ, ডিভাস্টেশন, আপনার ঈশ্বরের পৃথিবীর নিত্য ঘটনা। হার্ড লিকার। চিনি দিলেও মিষ্টি হবে না। এই নাও দশটা টাকা। এইবার মাথায় করে আনবে। দেখি এইবার ঈশ্বরের কেমন ক্ষমতা! দ্যাট নন-এগজিস্ট্যান্ট অলমাইটি লর্ড, আই চ্যালেঞ্জ ইয়োর অথরিটি।
পরেশদার ভিয়েন নেমে গেছে। দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছেন। বাচ্চা ছেলেটা ঘ্যাসর ঘ্যাসর করে পিঠের ঘামাচি চুলকে দিচ্ছে। ছেলেটাকে দেখে বড় কষ্ট হয়। কে যে কী করার জন্যে জন্মায়! কীভাবে বিকিয়ে যায়! এই ভবের হাটে অনবরত চলছে বেচা-কেনা। কে কোন রাতে নিজের তাগিদে জন্ম দিয়ে সরে পড়েছে। এখন তুমি ভুগে মরো। নির্মলদা ঠিকই বলেন, তোমার আনন্দ আর একজনের দুঃখ। প্রাণ রাখিতে সদাই যে প্রাণান্ত। জন্মিতে কে চাইত যদি আগে সেটা জানত। ভোরে উঠেই ঘুমটি নষ্ট, তার পরেতে যে সব কষ্ট, বর্ণিতে অক্ষম আমি সে সব বৃত্তান্ত।
আয়েশে পরেশদার চোখ বুজে এসেছে। ছেলেটি তার গ্রাম্য ভাষায় বললে, খদ্দের এসেছে গো।
আসুক গে তুই শালা চুলকো।
আমার গলা না শুনলে আয়েশ কাটবে না। পরেশদা, এক সের গরম রসগোল্লা।
পরেশদা ঘাড় তুলে চিনলেন, আরে সেই ঘোড়াটা আবার এসেছে। কী হল? এই তো নিয়ে গেলে।
ছোঁড়া শব্দটা শুনে পা থেকে মাথা অবদি জ্বলে গেল। ব্যাটার পয়সা হয়েছে। পয়সা হলে কী হবে কালচার নেই। না, রাগলে চলবে না। গীতা বলছেন, বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ। গীতাকে তো আবার ব্যঙ্গ করেছেন ডি এল রায়। গীতার জোরে সচ্ছে ঘুষি, সচ্ছে কানুটিটে, গীতার জোরে পেটে না খাই, সয়ে যাচ্ছে পিঠে। নানা ভাবের ধাক্কায় পৃথিবীর পথ খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন হয়ে পড়ছে।
বেশ ঝরঝরে গলায় বলতে হল, দেরি হবে নাকি!
বাবা, তুমি যে দেখছি ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ?
হ্যাঁ, তাড়া আছে। আমার কাজ আছে।
ব্যাজার মুখে পরেশদা দোকানে ঢুকলেন। বিচিত্র স্বভাবের মানুষ। আগেও দেখেছি দোকানে কোনও নিম্নশ্রেণির মহিলা এলে, অন্য খদ্দের ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রসালাপ করবেন। স্বামীজি কেমন করে বললেন, মানুষই ঈশ্বর। বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর। কী দৃষ্টি লাভ করলে পরেশকে ঈশ্বর ভাবা যায়! পরেশ ঈশ্বর, মণিপাগলি ঈশ্বর। আমিও ঈশ্বর। ঈশ্বরে ঈশ্বরে ছয়লাপ। পৃথিবী গিজগিজ করছে রে বাবা!
এবার আর কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না। মাথায় না চাপালেও, প্রায় বুকের কাছে গরম হুঁড়ি চেপে ধরে গুটিগুটি এগোতে থাকি। কৃষ্ণকোলে নন্দলালা যমুনা পার হচ্ছেন। আর কোনওদিন রাস্তার কুকুরকে সোহাগ করে বলতে যাব না, মানু আমার, মাংস নয়, রসগোল্লা। অন্ধকারে ভোস করে একটা শব্দ হল। ইনি আবার কে? আমাদের পাড়ার সেই বিখ্যাত ষাঁড়টি। যার আতঙ্কে যুবতী গোরুরা রাস্তা হাঁটে ভয়ে ভয়ে। যে থানার বড় দারোগাকে শিঙে ঝুলিয়ে রেখে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। খ্যাতিমান পুরুষ এখন প্রাণায়াম করছেন। কুলকুণ্ডলিনী ধ্যানস্থ। ইড়া পিঙ্গলায় মহেশ্বরের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাবার মতো গাভী সুন্দরীরা এখন গোয়ালে জাবর কাটছে। প্রকৃতিতে বড় কামপ্রভাব। পজেটিভ আর নেগেটিভ এক হবার জন্যে সদাই ছটফটর করছে। তাতে তোর কী রে শালা। এ যে রামকৃষ্ণের গলা। তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।
আমাদের বাড়িতে মধ্যরাতে সন্ধ্যা নামে। সব নিদ্ৰাজয়ী মহাযোগী। কোন বাড়িতে রাত বারোটার সময় কর্তা হাঁকেন, চা চাপাও তো! পিতৃদেব গর্ব করে বলেন, আমি হলুম নকটারন্যাল বার্ড। কালপ্যাচা। কেন এমন হয়েছে জানেন, একের পর এক রুগির পাশে বসে রাতের পর রাত জেগে জেগে আমার বায়োলজিক্যাল ক্লক ঘুরে গেছে। পৃথিবী যখন ঘুমোয় আমি তখন জাগি। সেন্টিন্যাল অফ দি নাইট। নাইটজার। পিতার স্টকে কত যে ভাল ভাল শব্দ আছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে সারাজীবন এমন পিতার পাশে থেকে সেবা করে যেতুম।
হাতে হাঁড়ি দেখে পিতা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন, এসেছে এসেছে। পেরেছে পেরেছে। আপনার ঈশ্বর পরাজিত হয়েছেন বিনয়দা। মেসোমশাই মুখ তুলে তাকালেন। সহজে হারতে চান না। মৃদু হেসে বললেন, বিচার হবে শেষের সে দিনে, যেদিন আমরা মৃত্যুর মুখোমুখি হব। মৃত্যু একটা ন্যাচারাল প্রসেস। ওখানে ঈশ্বর নেই। আছে কাল। ইজ থেকে ওয়াজ।
Under the wide and starry sky,
Dig the grave and let me lie.
Glad did I live and gladly die,
And I laid me down with a will.
জলের বিম্ব জলেতে মিলায় অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত মরতে মরতে একেবারে মরণটারে মারত ॥
ব্যস! মেসোমশাই কুপোকাত। ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত সব একেবারে পাঞ্চ করে ছেড়েছেন। ভোলাময়রা আর হরুঠাকুরের ধুন্ধুমার লড়াই। ভুরভুরে ঘিয়ের গন্ধ নাকে আসছে। মুকু চেয়ারে নেই। রান্নাঘরে গেছে দিদিকে সাহায্য করতে। হঠাৎ মাতামহকে মনে পড়ল। এই মুহূর্তে কী করছেন কে জানে? বাগানের একপাশে নারকেল গাছের তলায় ছোট্ট একানে ঘর। বিশাল এক সিন্দুক। একটু পরেই আমরা লুচি খাব। তিনি কী খেলেন? মাতুলের সংসারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। অভিমানে দূরে সরে আছেন। কিছু প্রশ্ন করলেই হা হা হাসি, গৃহীভুত্বা বনী ভবেৎ, বার্ধক্যে মুনিবৃত্তীনাম।
মুকু গোটাকতক আসন হাতে বড়ঘরে ঢুকল। হলঘরই বলা চলে। শুনেছি একসময় এই ঘরে বড় বড় আসর বসত। রাত ভোর হয়ে যেত গানে গানে। বড় বড় সব ওস্তাদ আসতেন। মাতুল তখন কিশোর। সেই কিশোর বয়সেই তাক লাগিয়ে দিতেন। মুকু হাতের ইশারায় ডাকল।
সেই সন্ধে থেকে এক নাগাড়ে পড়ে পড়ে চোখদুটো ফুলে উঠেছে। কোন দিকে মুখ করে খেতে বসতে হয় জানো?
দক্ষিণ ছাড়া, যে-কোনও দিকেই মুখ করে বসা যায়। দাও আমি পেতে দিচ্ছি। মুকু তিনটে আসন এনেছে। দুটো আসন পেতে দিলুম।
তোমারটা পাতলে না?
আমি পরে তোমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসব।
খেতে বসে পিতৃদেব নানা ফ্যাচাং বের করেন। কনক সামলাতে পারবে না। তা ছাড়া অপরিচিত মেসোমশাইয়ের সামনে বসে তারই মেয়ের ভেজে ভেজে দেওয়া ফুলকো লুচি খেতে লজ্জায় মরে যাব। রান্নাঘরে উনুনের আগুনের আভায় কনককে একেবারে বউমার মতো দেখাচ্ছে। ওবেলা একটু আড়ষ্ট ছিল। এবেলা সব পুরোমাত্রায় দখলে এসে গেছে। মাঝে মাঝে ডিক্টেটারের মতো মুকুকে হুকুম চালাচ্ছে।
একটা নকল কাশি দূর থেকে এগিয়ে আসছে। পিতা আসছেন। কনকের একেবারে পেছনে পঁড়িয়ে সিঁথি দেখছিলুম। কেন দেখছিলুম তা বলতে পারব না। ভাল লাগছিল। সম্মানজনক দূরত্বে সরে গেলুম। যতই শিশুর মতো নিষ্পাপ মুখ করি না কেন, পিতার চক্ষুবীক্ষণে মনের ফেঁসো ধরা পড়বেই। মন রে তুই শোয়াপোকা।
তালতলার চটি পটাস পটাস শব্দ করছে। কনকের কিছু দূরে এসে শব্দ থেমে গেল। পিড়েতে পেছন ঠেকিয়ে কনক বসে আছে উবু হয়ে। ইয়া এক খোঁপা ঘাড়ের কাছে লটকে আছে। সামনে অ্যালুমিনিয়ামের কড়ায় আধা-ঘিয়ে লুচি ফুলছে ফোঁস করে।
পিতা তারিফ করলেন, বাঃ বেশ ফুলছে। একেবারে নিখুঁত, নিটোল হয়ে। আচ্ছা এবার তুমি ওঠো। তোমার কাজ শেষ। এবার আমাদের শুরু।
কনক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, তার মানে?
তার মানে, তোমরা এইবার খেতে বসবে, আমরা পিতাপুত্রে পরিবেশন করব।
এ আবার কোন দেশি নিয়ম!
তোমরা অতিথি। অতিথিসেবার পর গৃহস্থ আহারে বসবে, এই হল নিয়ম।
নিয়ম শাস্ত্রেই থাক। আপনারা খেতে বসুন। মেয়েলি শাস্ত্র আলাদা।
কনক কথা বলছে আর লুচি ভেজে চলেছে। মেসোমশাইকে বেশ কায়দায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েরা কেমন সহজেই শাসক হতে পারে! ভয়ডর কিছুই নেই। সাধে পরের বাড়ি গিয়ে সহজে আঁকিয়ে বসে? ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোয়।
পিতা বললেন, কথা তা হলে শুনবে না!
না, মেসোমশাইয়ের বাড়িতে এসেছি। অতিথিফতিতি আবার কী? যদ্দিন আছি, এ মহলে আপনার প্রবেশ নিষেধ।
ঠ্যাং করে কড়াতে ঝুঁজরিতে একটা শব্দ হল। পিতার চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। বহু দূর থেকে যেন তাকিয়ে আছেন। দীর্ঘ জলযাত্রার পর নাবিক যে-দৃষ্টিতে তমাল তটরেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্থির অচঞ্চল। চটির শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। এ কি জয়? এ কি পরাজয়? পরাজয় মাঝে মাঝে ভাল।
কনক এবার আমার দিকে তাকাল। একটা চোখ আধ-বোজা। কড়ার ভাপ এসে লাগছে। এ এক মারাত্মক চাহুনি। একে আমার একটু কবিকবি ভাব। থেকে থেকে আকাশে কালিদাসকে দেখি। ছাদে উঠে ডানা মেলে উড়ে যেতে চাই। বিরহী যক্ষের মতো জানলা দিয়ে উত্তরের শ্যামবৃক্ষরাজির দিকে তাকিয়ে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার দিকে এমন ধারালো মুখ যদি আধ-বোজা চোখে তাকায়, তা হলে কী হয়? নাও ভেসে যায় নদীর জলে।
কনক বললে, তুমি বসছ না কেন?
আমার কি লুচি চলবে?
ওমা সেকী কথা!
দেখলে না, সকালের খাদ্য।
তোমার তো পেট সেরে গেছে।
অত্যাচারে যদি বেড়ে যায়?
ঘোড়ার ডিম হবে। গরম লুচিতে পেট ভাল হয়।
তা হলে, তোমাদের সঙ্গে বসব।
রাত হয়েছে বেশ। তোমার খিদে পায়নি?
না না, খিদে পাবে কেন?
খিদে পেয়ে পেয়ে মরে মরে এখন আর খিদে কাকে বলে ভুলেই গেছি। কনক তো আর জীবনের সব ঘটনা জানে না। মরা গাছে ফল শুকিয়ে পাকে। রং থাকে স্বাদ থাকে না।
মুকু পরিবেশন করছে। শাড়ির আঁচল ঝুলে ঝুলে পড়ছিল। মেসোমশাই বললেন, কতদিন বলেছি, আঁচল কোমরে জড়াবে।
মুকু বাঁ হাতে কোনওরকমে আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে নিল। মুকুর চুল বেশ কেঁকড়ানো কোকড়ানো। দু’জনের আহার বেশ জোরকদমে চলেছে। অম্বুলের রুগি হলে কী হবে, মেসোমশাই বেশ ভালই টানছেন। এক এক গ্রাসে, এক একখানা লুচি উড়ে যাচ্ছে।
দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছি। দু’বোন আমাকে কোনও কাজই করতে দেবে না। পিতা পাত থেকে মুখ তুলে বললেন, কী বুঝলে তা হলে?
বোকার মতো তাকিয়ে রইলুম ঘুমঘুম চোখে। কোন বোঝার কথা বলছেন?
একটি নধর পটল আঙুল দিয়ে ফুটো করতে করতে বললেন, সেই ছাগলের ঘটনা মনে আছে। নিশ্চয়ই।
ওরে বাবা, খুব মনে আছে। অনেকটা এই ভুলোর মতোই ব্যাপার। পিতাপুত্রে বাজার সেরে ফেরা হচ্ছে। আমার হাতে বিশাল দুটো কপি। চারপাশে লতাপাতা ঝুলছে। পথের পাশে একটা ছাগল শুয়ে ছিল। হঠাৎ মনে হল কপির পাতা তো কাজে লাগবে না। আহা কৃষ্ণের জীব খাইয়ে যাই। কপিসমেত পাতা মুখের সামনে ধরলুম। নে, খা, পাতা খা। ছাগলটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আচমকা এক টান মেরে কপিদুটো হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মার দৌড়। দু’জনেই ছুটছি ছাগলের পেছনে। হইহই রইরই ব্যাপার। ছাগল এক খানা টপকাবার জন্যে মারলে লাফ। কপি ছিঁড়ে পড়ল নর্দমায়। পাতা-মুখে ছাগল পালাল ওপারে। রাস্তার লোকের সে কী আনন্দ! মানুষ বোকা বনে গেলে তার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে! পিতার চোখমুখ রাগে লাল। বাড়ি ফিরে বললেন, ছাগলটাকে চিনতে পারলে? ভালমানুষের মতো বললুম, আজ্ঞে না।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। দেখতে পাবে।
সামান্য দুটি কথা; কিন্তু কী অসম্ভব জ্বালা। শুনেছি, শয়তানের মুখ নাকি ছাগলের মতোই।
মুগের ডালের তারিফ করতে করতে পিতা বললেন, তোমার জন্যে আমি এক সেট ‘সারমন অন দি মাউন্ট’ তৈরি করে দিয়ে যাব। প্রথম সারমন হল, সবসময় ভাববে আমি মানুষ নই, একটা গাধা। পৃথিবীর অন্য সমস্ত জীবজন্তুর বুদ্ধি আমার চেয়ে ঢের বেশি।
মেসোমশাই ভরাট মুখে বললেন, সেই লেটারবক্সের ঘটনার পর আমিও নিজেকে তাই মনে করি।
পিতা কুচুরমুচুর করে লুচি খেতে খেতে বললেন, গ্রেট গাধাজ থিঙ্ক অ্যালাইক। হ্যাঁ, আপনার কী হয়েছিল?
সেই লেটারবক্স। তখন তো বলা হল না। কোর্টে যাবার পথে একদিন একটা চিঠি পোস্ট করার ছিল। এই অবদি শুনেই কনক কুঁক কুঁক করে হেসে উঠল। মেসোমশাই মেয়েকে সমর্থন করলেন, হাসিরই কথা। ভাবলে আমার নিজেরই এখনও হাসি পায়। চিরকাল শুনে আসছি চিঠি ঠিকভাবে না ফেললে লেটারবক্সের টাগরায় আটকে থাকে। তাই হাঁটু ভেঙে ডান পাশে কাত হয়ে হাতটাকে যতদূর পারা যায় ততদূর ঠেলে দিলাম ভেতরে। প্রায় কাধ পর্যন্ত ঢুকে গেল। চিঠিটা টুক করে ছেড়ে দিলুম। এইবার যত হাত টানি, হাত আর বেরোয় না। লেটারবক্সের জিভ আছে। আপনি কি তা জানেন হরিদা?
খুব জানি। লেটারবক্সও প্রাণী। সে থিয়োরি আমি আপনাকে পরে বলব।
যতবার হাত টানি মুখের সেই ফ্যালফ্যাল ফ্ল্যাপে কোটের ওপর হাতটা আটকে যায়। হাত আর বেরোয় না। তেমন জোরে টানতেও সাহস হচ্ছে না। কোট তো ছিড়বেই। সেই সঙ্গে একখানা। মাংসও যাবে। ইতিমধ্যে দু’-একজন এসে গেছেন চিঠি ফেলতে। তারা কেবলই জিজ্ঞেস করেন, কী। হল আপনার? আপনি কি নিজেকে পোস্ট করতে চাইছেন? তা হলে চিঠির বাক্সে নয়, পার্সেলের বাক্সে গিয়ে পড়ুন, হয়তো ধরে যাবে। লজ্জায় বলতেও পারছি না, আটকে গেছি। শেষে বলতেই হল, দাদা হাত টেনে ধরেছে। হইহই ব্যাপার। ঠিকুর রোদে বেলা বারোটা পর্যন্ত সেইভাবে ঝুলে রইলুম। মজা দেখার জন্যে শহরের ছেলেবুড়ো সব ভেঙে পড়ল। এজলাসে মামলা মুলতুবি রইল। জায়গাটার নামই হয়ে গেল, উকিলমারি। সেই থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি, ডাকবাক্সে আর কখনও হাত ঢোকাব না।
চিঠিটা নিশ্চয়ই একটু ক্ষতিকারক ছিল!
তা একটু ছিল। উকিলের চিঠি তো! কারুর সর্বনাশ, কারুর পোষ মাস।
সেই কারণেই লেটারবক্স হাত কামড়ে ধরেছিল। মরামাছ প্রতিশোধ নেয় জানেন কি?
কীরকম?
এই তো কয়েকদিন আগে সঁাত আর মাড়ির ফাঁকে আড়াআড়ি ঢুকে গেল কাটা। কিছুতেই বেরোয় না। আঙুলে ধরা যায় না। কাঠি দিয়ে খোঁচানো যায় না। জিভ দিয়ে ঠেলা যায় না। মাড়িতে পুঁতে গেল। ধারালো একটি খোঁচা বেরিয়ে রইল। সারাদিন কসরত। শেষে ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে ফেঁড়ে বার করতে হল। মানুষ অপঘাতে মরলে ভূত হয়। মাছও তাই। মরে মেরে গেল।
ওটা জাস্ট একটা দুর্ঘটনা।
তা হলে শুনুন, দেয়াল কীভাবে প্রতিশোধ নেয়। পেরেক পুঁতছেন। ইয়া গজাল। হাতুড়ি পড়ছে টাই উঁই। কে বলেছে দেয়ালের প্রাণ নেই! যার কান আছে, তার প্রাণও আছে। হাতুড়ির সঙ্গে ইশারায় কথা হয়ে গেল। ব্যস, পরের ঘায়ে বুড়ো আঙুলের মাথাটা ছেতরে গেল। পৃথিবী কি সহজ জায়গা মশাই! এখানে কী আছে আর কী নেই! কী হয় আর কী হয় না, বলা ভারী শক্ত।
একটি রসগোল্লা মুখে পুরলেন। এ হেঃ প্রায় ঠান্ডা হয়ে এসেছে। গরম রসগোল্লা দোকানের সামনে উবু হয়ে বসে খেতে হয়। নিন নিন, টপাটপ মুখে পুরুন। তা হলে তোমার দর্দ বাড়বে। হিন্দিতে দর্দ মানে যন্ত্রণা।
ঘড়ি খাড়াড়াক করে উঠল। সাড়ে এগারোটা বাজবে। তিনমাথার মোড়ে কুকুর মড়াকান্না শুরু করেছে। মাঝরাত এগিয়ে আসছে। এইবার ভূত বেরোবে। আমাদের চিলের ছাতে পাচা ডাকবে চা চাঁ করে।
রান্নাঘরে তিনজন পাশাপাশি খেতে বসেছি। মেয়েদের খেতে বসার ধরনটাই আলাদা। একটা হাঁটু খাড়া থাকবে, আর একটা পাতা থাকবে জমিতে। তার ওপর থাকবে একটা হাত। ঠোঁটদুটো অল্প ফাঁক। খাবার ঢুকবে একটু একটু করে। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না বোঝার উপায় থাকবে না। যে গতিতে খাওয়া চলেছে, শেষ হতে রাত দুটো বাজবে। কনক নিজের পাত থেকে একটা পটল আমার পাতে তুলে দিল। তুলে দিয়েই খেয়াল হল, এ মা তোমার পাতটা এঁটো করে দিলুম যে।
আনন্দে সারাশরীর শিরশির করে উঠল। কত কাছাকাছি চলে এসেছি। দুটো মহাদেশ যেন এক হচ্ছে। আমার একটা সেই মাছি-মার্কা হাসি আছে। দাঁত বের করা, গালে টোল ধরানো। সেই সাপের হাসি যে বেদেয় চেনে। মুখটাকে গাটাপার্চারের মতো করে বললুম, তাতে কী হয়েছে! তুমি খেলে না কেন?
নতুন পটল। সুন্দর খেতে। তুমি একটা বেশি খাও। রান্না কেমন হয়েছে?
উঃ। ওয়ান্ডারফুল। কার কাছে শিখলে এমন রান্না।
মায়ের কাছে।
সব শেষ হতে বারোটা বেজে গেল। উত্তর মহলের আলো নিবে গেল। কনক বললে, মুকু, তুই কি এখন আবার পড়তে বসবি?
আর শরীর বইছে না।
আজ তা হলে শুয়ে পড়।
ছাতে ধুপধাপ আওয়াজ হচ্ছে। পিতৃদেব পদচারণা করছেন। হজমের জন্যে যা অবশ্য করণীয়। বৃষ্টি পড়লে ছাতা মাথায় দিয়েও করতে হবে। আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও সূর্য পূর্ব দিকে ঠিকই ওঠে। কোনও নড়চড় নেই।
১.০৮ যামিনী জাগহি যোগী
পিতৃদেব অনেকক্ষণ কান খাড়া করে বসে আছেন। সামনে একটা মোটা বই আধাআধি জায়গায় খোলা। চাপা আলো সামনে ছড়িয়ে পড়েছে। মশারির মধ্যে শুয়ে শুয়ে দেখছি। ঘুম চটে গেছে। সহজে কি আর আসবে। হঠাৎ মশারির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী ডাকছে বলো তো? মনে হচ্ছে দুটো কোলা ব্যাং মুখোমুখি বসে গলা সাধছে! এখন তো বর্ষাকাল নয়। ব্যাং আসবে কোথা থেকে?
আজ্ঞে ব্যাং নয়। মেসোমশাইয়ের নাক। দুটো ফুটো দু’রকম শব্দ ছাড়ছে। আর মাঝে মাঝে গলাটা আমতা আমতা করে উঠছে।
রাত বারোটার পর পিতৃদেব একটু নরম হয়ে যান। তখন একটু রসিকতা টসিকতা চলে। রোদ উঠলেই স্বভাবের জলাশয় উত্তপ্ত হতে থাকে। সূর্য যখন মধ্যগগনে মেজাজও তখন সপ্তমে। মেজাজেরও উদয় অস্ত আছে। আসলে এই ঘরে এই সময় তো মায়ের শোবার কথা। নীল শাড়ি, চুড়ির শব্দ। চুলে চিরুনি চালাবার গাঢ় ঘন শব্দ। যেন বটের পাতায় হাওয়া লেগেছে। আমার মা হলেও পিতার স্ত্রী তো! দু’জনের সঙ্গে দু’রকম সম্পর্ক। রিভারসিবল সোয়েটারের মতো। দু’জনের কাছে দুরকম রং! সেই জায়গায় কে শুয়ে আছে। তারই গর্ভজাত এক অষ্টাবক্র মুনি। দেহেও মর্কট, মনেও মর্কট। সন্ন্যাস নিলে, নিজেই নিজের নাম রাখব স্বামী মর্কটানন্দ।
এ নাক কি শুলেই ডাকবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দুপুরেও সমানে ডেকে গেছে।
তার মানে মিউজিক্যাল নোজ। আমাদের ফ্যামিলিতে কারুর কখনও নাক ডাকেনি। ডাকের বহর দেখে মনে হচ্ছে অ্যাফ্রিকান নোজ। মেয়েদুটো ঘুমোচ্ছে কী করে! এ যে ঘরের পাশে ঘোড়ার আস্তাবল।
পিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। সমস্যায় সলিলোকি। শেক্সপিয়ার চালু করে দিয়ে গেছেন। ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন, রিভলভারে যদি সাইলেন্সার ফিট করা যায়, নাকে কেন যাবে না! নিশ্চয়ই যাবে। ওটা যদি গোল হয়, এটা হবে তিনকোনা।
রাতে চারপাশ শান্ত বলেই ডাকের জোর দুপুরের চেয়ে অন্তত একশো গুণ বেশি মনে হচ্ছে। একেবারে ষাঁড়ের ডাক। ঘঘারতর আক্রোশ। দাতে দাঁত চেপে নাক শব্দ করছে গাঁ গাঁ। বিরাট লরির ইঞ্জিন খাড়াই বেয়ে ওঠার সময় এইরকম পরিত্রাহী শব্দ ছাড়ে। আর একটি উপসর্গ যোগ হয়েছে যা দুপুরে ছিল না। নিজের ডাকে নিজেই চমকে উঠে সাড়া দিচ্ছেন, কে কে? চারবার কে বলে আবার নিচু পরদা থেকে নাক ধাপে ধাপে ওপরে উঠছে। সত্যিই আতঙ্কের বিষয়।
পিতার সলিলোকি, নাক কেন ডাকে? নাক ডাকে, না গলা ডাকে? বর্ষাকালে ব্যাং ডাকে। সে হল পুরুষের ডাক। পুরুষ ডাকছে প্রকৃতিকে। সে তো নাক নয়, গলার খেলা। দেখি বুক অব নলেজ কী বলছে।
রাত দুটো। মানুষের ঘুম চলে গেলে মাথা কত দিকে খেলতে চায়। বইয়ের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বুক অব নলেজ খুঁজছেন। হঠাৎ মাথাটা বাঁ পাশে হেলে গেল। যেন কোনও কিছুর ঝাঁপটা লাগল। চট করে বসে পড়লেন। গুঁড়িগুড়ি এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে। হাত বাড়িয়ে আলো নেবালেন। বই বন্ধ করলেন ধপাস করে। একই কায়দায় ফিরে এলেন বিছানায়, মশারির ভেতরে। ফিসফিস করে বললেন, এসে গেছে।
ঘরে সুইশ সুইশ করে ডানার শব্দ হচ্ছে। সেই বিশাল চামচিকিটা। চক্কর দিয়ে উড়তেই থাকবে, উড়তেই থাকবে। পিতার মহামান্য অতিথি। আজ আমাদের বাড়ি-ভরতি অতিথি, মেঘের মতো নাসিকা গর্জন, তাই তেমন গা ছমছম করছে না। নয়তো এই মধ্যরাতে, অন্যান্য দিন, দুটি প্রাণীর চোখের সামনে ডানা-মেলা অন্ধকার যখন লাট খেতে থাকে তখন কেমন যেন মনে হয়। That hor rible black scaffold dressed. That stapled block God sink the rest!
রঙ্গমঞ্চে লাট-খাওয়া চামচিকির প্রবেশ, পিতার গুঁড়িগুড়ি বিছানায় এসে ঢোকা, কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস বলা, এসেছে, এসেছে। ঘাড়ের কাছে গরম নিশ্বাস। অন্ধকারে অন্ধকারের তরঙ্গ তুলে পক্ষযুক্ত অন্ধকারের অন্ধকার রেখা টেনে চলা, জগতের গর্ভমোচন করে অতিজাগতিকের রহস্যমুক্তির মতো বিমূর্ত কোনও অনুভূতি। শরীর কেমন শিথিল হয়ে আসে। পিতা বলতে থাকেন, এ সোল, এ সোল। মহৎ কোনও আত্মা। আমাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। কার আত্মা! আমাদের যত মৃত পূর্বপুরুষ! আত্মার তলে ঈশ্বরের চাকিতে তিনকোনা পরোটার আকৃতি ধারণ করে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে! শিক্ষিত মানুষের এমন বিশ্বাস আসে কী করে? পরপর তিন দিন না এলেই বুঝবে বিপদ আসছে। একটা হাত মাথার বালিশে রেখে কাত হয়ে পিতা ঘরের অন্ধকারের দিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বোধিবৃক্ষের তলায় উপবিষ্ট বুদ্ধকে শিষ্য পোত্থাপদ জিজ্ঞেস করলেন, প্রভু, এই জগৎ কি অনন্তকালের নয়? কোনও উত্তর নেই? প্রভু, জগৎ কি সসীম? বুদ্ধ নিরুত্তর। জগৎ কি তবে অসীম? এ প্রশ্নেরও কোনও জবাব নেই। প্রভু, আত্মা আর দেহ কি এক? এরও কোনও উত্তর নেই। তা হলে কি পৃথক? বুদ্ধ বললেন, এসব প্রশ্ন অর্থহীন। ধর্মের সঙ্গে কোনও যোগ নেই। এর উত্তর জানা-না-জানায় প্রশ্নকারীর কোনও লাভ নেই। মূল কথা হল, দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ আর মার্গ। আত্মা চামচিকি, না চামচিকি আত্মা এ নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চিত্তবৃত্তির নিরোধ সাধন করে ঘুমিয়ে পড়ো। মেসোমশাই আচমকা কে কে করে উঠলেন।
পিতা বললেন, কানের পাশে এই তূর্যনাদ চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। ঠেলে তুলতে হবে।
সেটা খুব অভদ্রতা হবে।
এই, এই হল বাঙালি মেন্টালিটি। নোলক-নাড়া বউদের স্বভাব। সঁতে দাঁত চেপে সহ্য করব আর পুকুরঘাটে গিয়ে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করব। ইয়োররাপের রীতিটা কী জানো? সোজা মুখের ওপর বলা, ইউ আর এ নুইসেন্স। আমার একটা হাই উঠল। খুবই অনুচিত কাজ। তবে আবেগ তো! বেগ চাপা যায় না।
পিতা বললেন, ইউ আর এ নুইসেন্স বুঝলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এইটা হল ইয়োরোপিয়ান অ্যাপ্রোচ।
হাইটা চাপতে পারলাম না। চেষ্টা করেছিলুম। ছপ্পর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
তোমাকে বলিনি। হাইয়ের পাংচুয়েশানে আগের কথার জের টানলুম। তোমাকে ডিরোজিওর জীবনের একটা গল্প বলি। জানো তো তিনি কে ছিলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হিন্দু কলেজে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। ডিরোজিও দেখছেন। হঠাৎ একটা ছেলে এসে সামনে আড়াল করে দাঁড়াল। যেমন তোমরা করো আর কী? ডিরোজিও বললেন, মাই বয়, ইউ আর নট ট্রানসপেরেন্ট। একেই বলে ইংলিশ অ্যাপ্রোচ। অভদ্র না হয়েও কাজের কথাটি বলে ফেলা।
কিন্তু যিনি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন তাঁকে আপনি কী বলবেন? না ট্র্যানসপেরেন্ট, না ওপেক, ডেড।
দেখবে তা হলে! ব্যাপারটাকে কতদূর ফানি করে তোলা যায়! দেখো তা হলে।
বিছানা ছেড়ে নেমে পড়লেন। চামচিকি উড়ে চলে গেছে শেষ চক্কর মেরে। আলো জ্বলে উঠল। মেঝেতে শতরঞ্জি পড়ল। কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘটনা কোন দিকে যাবে। কী করতে চলেছেন। নিচু হয়ে খাটের তলা থেকে বাঁয়া তবলা টেনে বের করলেন।
হাঁটুতে ধীরে ধীরে চাপড় মারলেন বারকতক। তাল বোঝার চেষ্টা করছেন। নাকের ডাকেরও তাল আছে! দেখি কোন তালে ভেড়ে! তবলায় চাটি পড়ল। নেহাত বাগানঘেরা ভুতুড়ে বাড়ি! তা না হলে প্রতিবেশীরা ডান্ডা নিয়ে তেড়ে আসত। তবলা বোল ভাঙছে। বাঃ নাক দেখছি ঝাঁপতালে চলেছে।
মিনিট দশেক হয়ে গেল, তবলা উদ্দাম বেজে চলেছে, ধা ধা, ধা, ধিনতা তা। ধাগে নাগে বাগে পেলে, ধিক্কার দিয়ে যা। ভুরুকুটি, মুকুটি, ভিরকুটি, ফেঁসে যা, ধসে যা, ধা, ধা, ধিনতা,কৎ। যেনাক ডাকে, সে কানে শুনতে পায় না। আর মেয়েরা একবার ঘুমোলে মৃত। বেহুলার কথা মনে নেই! লক্ষ্মীন্দর ঠ্যালা মারছে আর বলছে, উঠ উঠ বেহুলা/সায়াবেনের ঝি। তোরে খাইল কালনিদ্রা/ মোরে খাইল কী! আমাদের মেনিদা তো প্রায়ই সদর দরজার একটা পাল্লা কাঁধে করে রাতে গৃহপ্রবেশ করেন। শ্রীমতী মেনির এমনই ঘুম। দেয়ালে পাল্লা ঠেসিয়ে রেখে একটু দম নিয়ে স্ত্রীর নাক টিপে ধরেন। একটু হাঁসফাস করে চোখ মেলে তাকিয়ে শ্রীমতী বলেন, ভেঙেছ! একেই বলে, ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়। সবই মিস বড় মেনির কাছে শোনা। মাঝে মাঝে দুপুরে আসে পড়তে। এমন নিঃক্ষত্রীয় বঙ্গললনা সচরাচর চোখে পড়ে না। শব্দটা সুখেনের আবিষ্কার। যে-শরীরে যৌবন ফেঁড়ে ফেলার মতো ধার নেই সুখেনের ভাষায় তেমন শরীর হল নিঃক্ষত্রীয়। থিয়েটারে ছেলেরা মেয়ে সাজে। মেয়েরা যদি ছেলে সাজতে চায় সবার আগে মিস মেনির ডাক পড়বে। সব সমতল। ও তলে অতল নেই। সুখেনের কৃপায় জ্ঞানভাণ্ডার যেরকম সমৃদ্ধ হয়েছে, পরিচয় পেলে। পিতা হতভম্ব হয়ে যাবেন। এ যে পিতার পিতা, বৃদ্ধ পিতা।
তবলা থেমে গেল। সাবেক কালের লম্বা লম্বা গরাদ লাগানো খোলা খাড়া জানলায় রাতের আকাশ লেগে আছে। অন্ধকার যেন পাতলা চাঁদরের মতো থিরথির কাঁপছে। ফ্যাকাসে চাঁদ অভিসার শেষ করে ওই পথেই যেতে যেতে উঁকি মেরে দেখছে। ঘরের মেঝেতে লম্বা হয়ে তারাদের ছায়া পড়েছে, চার পাশ কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। মোহনিশা সব সো অনিহারা। দেখছি স্বপ্ন অনেক প্রকারা ॥ এহি জগ যামিনী জাগহি যোগী। পরমারথ পরপঞ্চ বিয়োগী। এই মোহরাত্রি। ভোগী জীব স্বপ্নে নিদ্রিত। কনক, মুকু, মেসোমশাই। আর এই যে আমরা পরমার্থনুসন্ধায়ী বিবেকী যোগী দু’জন সংসার নিশায় জেগে বসে আছি। রাতের রেলগাড়ি চলেছে, চাঁদের পাহাড়ের পাশ দিয়ে তারাদের যাত্রী নিয়ে। থ্যাঙ্কস ফাদার। আপনার জন্যেই এই নিশিযাপন। অসীমের রহস্য সন্ধান।
হাঁটুর ওপর হাত রেখে পিতা তাকিয়ে আছেন উন্মনা হয়ে। সারাশরীরে চাঁদের আলো। ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। না ফিরেই বললেন, ঘুমোলে নাকি?
আজ্ঞে না।
কী হবে ঘুমিয়ে! নেমে এসো। দেখি তুমি কেমন গান শিখেছ?
মিলিটারি ডিসপোজালে কেনা খাকি মশারির ঘেরাটোপ ছেড়ে নেমে এলুম। মেঝেতে রুপোর স্রোত বইছে। ভাণ্ডারে তালে গাইবার মত দুটো গানই আছে। তাই তোক। তুলসীদাসকে মনে পড়ছে। অযোধ্যার পাহাড়। রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। ধরে ফেলি তা হলে, রামনাম সুখদায়ী, সাচ্চা মনসে ভজ রাঘব তো, একদিন মুক্তি পাই। গান বেশ জমে উঠল। সুরের মায়াজাল তৈরি করবার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে। মাতুলের মতো কাজ অলংকার বসাতে না পারলেও চোখের সামনে রামচন্দ্রকে দেখতে পাচ্ছি। কাঁধে ধনুর্বাণ, নন্দলাল বসুর আঁকা টানাটানা চোখ। অযোধ্যার বিশাল প্রাসাদ। সিংহাসনে বৃদ্ধ দশরথ। চামর হাতে দু’পাশে দুই সুন্দরী। অযোধ্যার রাতের বাজার। মশালের আলো। দোকানে দোকানে ঝিলিক মারছে হিরে, চুনি, পান্নার হার। কী শান্তি! কী আনন্দ! রামনাম সুখদায়ী। রাম নাম হ্যাঁয় অমৃতধারা। রাম বিনা কোই নেহি হামারা। ভাবের ঘোরে হড়কে গিয়ে মাঝে মাঝে তাল কাটছে। উত্তেজনায় লয় বেড়ে যাচ্ছে। প্রবল বেগে তবলা বাজাতে বাজাতে পিতা থেকে থেকে হুঁ হুঁ করে উঠছেন। ফাঁক চলে গেছে সমে। সম চলে এসেছে ফাঁকে। মরিয়া, তেরিয়া, খেপে গেছি। সবে সাইকেল চালাতে শিখে রাস্তায় নামার মতো। বেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। লয় বাড়ছে, মাথা দুলছে। লাঠালাঠি ব্যাপার।
খুটুস করে কনকদের ঘরের দরজা খুলে গেল। রাম ভুলে চোখ চলে গেল ঘরের দিকে। কায়দা। করে তিন তেহাই মেরে কালোয়াতের কালোয়াতি শেষ হল। কনক অবাক হয়ে গেছে। রাতের এখন কোন প্রহর! চাঁদের আলো আরও ম্লান হয়ে এসেছে। বৃষ্টিভেজা প্রেয়সীর ওষ্ঠের মতো। পিতাপুত্র সেই আলোতে বসে আছি বিবর্ণ ছবির মতো।
কনক এগিয়ে এসে বললে, মেসোমশাই, কখন উঠলেন?
তিড়িং করে তবলায় চাটি মেরে বললেন, শুতেই যাইনি, তো ওঠা! নাও ধরো ধরো। মন্দ হচ্ছে না। ঘষামাজা করলে হতে পারে।
আমারও তর সইছে না। গলায় সুর এসেছে। সামনে কনক এসেছে। চার পাশে দুধ-গোলা অন্ধকার। মলিন উত্তরীয় জড়িয়ে পৃথিবী চেয়ে আছে পুবের দিকে। আর তো কিছু জানা নেই। ভয়রোই চলুক। জাগিয়ে রঘুনাথ কুবর। পঞ্ছি বন বোলে। আহা সুর যা লাগছে! আকাশের গায়ে সিঁদুরে রং ধরার মতো।
কনক পা মুড়ে বসে পড়েছে। মেসোমশাইয়ের নাসিকা গর্জন থেমে গেছে। এরকম ভীষণ উৎপাতে কে ঘুমোবে! পুরো পরিবার জেগে উঠেছে। ঝাঁপসা পাখি উড়ছে। কুমার রঘুনাথকে জাগাবার জন্যে গাইয়ের কী ব্যাকুলতা! রহস্যময়ী রাত চলে গেল। অচেনা পৃথিবী আবার চেনা হয়ে, উঠছে। স্পষ্ট প্রত্যক্ষ।
চোখদুটো জ্বালাজ্বালা করছে। কনক কাপড়জামা ছেড়ে প্রাইমাস স্টোভে চায়ের জল চাপিয়েছে। মেসোমশাই ঠাকুরঘরে ধ্যানস্থ। পিতা দাঁতে কড়া বুরুশ ঘষছেন। স্টোভের শব্দের সঙ্গে বুরুশের শব্দ মিশে বেশ একটা ঐকতান তৈরি হয়েছে। সকালের গায়ে যেন শিরিষ কাগজ ঘষা হচ্ছে।
মেসোমশাই ঘরের বাইরে এসে ধ্যান-ভাঙা চোখে জগৎসংসারের দিকে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থেকে বললেন, হরিদা, আপনাদের এখানে কোথাও খাঁটি দুধ পাওয়া যায় না। খাঁটি দুধ!
পিতা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, এ বাজারে খাঁটি কিছু আছে কি? খাটাল আছে, গোরু আছে, বাঁট থেকে সাদা জলও বেরোবে: তবে সে দুধে সরও পড়বে না, গোঁপে ঘিয়ের স্বাদও পাবেন না।
সেই ছেলেবেলা থেকেই সকালে দুধ খাওয়া অভ্যাস, যদি অনুমতি করেন একরার চেষ্টা করে। দেখি।
কটার সময় খাওয়া অভ্যাস?
এই আটটা নাগাদ।
তার আগেই পাবেন। বালতি হাতে রামখেলোয়ান এল বলে।
তা হলে এই এক মাসের জন্যে দুধ একটু বাড়িয়ে দেবার আজ্ঞা করুন।
করলুম। তবে চাদির চাকতি ছোঁড়া চলবে না।
ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন। সুটকেসে নোট গজগজ করছে, খরচ করার সুযোগ মিলছে না। কনক চায়ের কাপ হাতে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললে, বাব্বাঃ, কখন দাঁত মাজতে বসেছেন মেসোমশাই! এবার উঠুন। চা এসে গেছে।
ব্রাশ হাতে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পিতা বললেন, সকালের চা আমি যে গেলাসে খাই মা। ওইটুকু মধুপরি কাপে কি সানাবে?
খালি পেটে এক গেলাস চা?
ও বাপকো বেটি! লিভারাতঙ্কে ভুগছ! চা আমার লিভারকে কাবু করতে পারবে না। তুমি কিচ্ছু ভেবো না। মেসোমশাই এবার দ্বিতীয় ফাঁকড়া বের করলেন, আপনাদের সকালের বাজারটা একবার দেখে এলে হত না। গামছায় হাত মুছতে মুছতে পিতা বললেন, আপনি মশাই মহা ছটফটে লোক। শান্ত হয়ে একটু বসুন তো! বাজারে গিয়ে গোত্তা খেয়ে কী হবে? এ কি আপনি মধুপুরে চেঞ্জে এসেছেন? ড্যাঞ্চিবাবু হয়ে বাজারে ঘুরবেন? তিন দিনের বাজার বাড়িতে ঠাসা। আগে খেয়ে শেষ করুন।
আমি যে মাছ কিনতে বড় ভালবাসি।
সে সুযোগ রোববারে পাবেন।
পড়ার টেবিল থেকে মুকু ডাকল, বাবা।
পিতৃদেবের ভুরু ক্রমশই কুঁচকে উঠছে।
মেসোমশাই চলে গেলেন। পিতা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তুমি বাজার থেকে দেখেশুনে একটু মাছ আনতে পারবে?
কেন পারব না?
তা হলে নেমে পড়ো। তোমার মেকআপ টেকআপ নিয়ে নাও।
কথায় একটু হুল থাকবেই। বসরাই গোলাপেও কাটা থাকে। মাতুল একটি মুখে ঘষার ক্রিম উপহার দিয়েছিলেন। সেই বস্তুটি একদিন মাখতে দেখে, কী অট্টহাসি! ওহে লালিমা পাল পুং, বঙ্গের বীর সন্তান, চুলে পমেটম, গালে রংচং, পকেট ঢনটন, মুখে মিহিমিহি বুলি, চায়ের কাপে তুফান তুলি, বেড়াবি আর কতকাল। সেই দর্শনের দর্শনী আজও দিতে হচ্ছে।
হরি আছ? হরিশঙ্কর?
বেশ ভারী গলা। সিঁড়ি ভেঙে উঠছেন আর হক মারছেন। এত সকালে কার আগমন? বিধুজ্যাঠা। গায়ে আসাম সিল্কের পাঞ্জাবি। চওড়াপাড় দিশি ধুতি। কপালে লাল চন্দনের টিপ। তার মাঝে একটি চাল আটকে আছে। চুলে অ্যায়সা তেল ঢেলেছেন কপালের দুপাশে গড়াচ্ছে। মাতুল দেখলেই বলতেন, কলুর বলদ। সাতসকালে কারুর শুভাগমন কোনওকালেই তিনি ভাল চোখে দেখেন না।
বিধুজ্যাঠা আর একবার হাঁক পাড়লেন, হরি আছ? হরিশঙ্কর? আমাকে সামনে দেখে বললেন, ও তুমি! বাবা উঠেছেন?
কথায় আছে, তিন তিসি, লোটা গর্দান, দোনো হায় শয়তানকা নিশান। এই মানুষটি সেই লক্ষণাক্রান্ত। চোখে আবার ফ্যান্সি চশমা! আমার পেছনে দাঁড়িয়ে পিতা বললেন, আসুন। হঠাৎ এই সকালে!
এক সার বাঁধানো দাঁত মেলে বিধুজ্যাঠা বললেন, বাধ্য হলুম আসতে। তুমি যেরকম ন্যাজে খেলছ!
তার মানে?
তুমি যেন আকাশ থেকে পড়লে হে!
হ্যাঁ, আকাশ থেকেই পড়লুম। আপনার ন্যাজ আছে সে স্বীকারোক্তি এক ধরনের আত্মপ্রকাশ। মেনে নিতে রাজি আছি। তবে সে সোঁটা ন্যাজ নিয়ে আমি কোন দুঃখে খেলতে যাব।
রেগো না, রেগো না। ভেতরে চলল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা চলে না! ব্যাপারটা যখন দেনাপাওনার।
বিধুজ্যাঠা প্রায় ঠেলেঠুলেই ঘরে ঢুকে এলেন। একটা জ্বলন্ত উনুন যেন পাশ দিয়ে চলে গেল, এত উত্তাপ! চেয়ারে যেন নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন। নিজের ডান পা-টাকেই বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর এমনভাবে রাখলেন যেন বন্দুক ঘোরাচ্ছেন! পিতাও প্রায় সেইভাবেই চেয়ারে বসলেন। এঁদের শরীরে এখন খোঁচা মারলে রক্ত বেরোবে বলে মনে হয় না। রেলগাড়ির স্টিম বেরোবে ফাঁস করে।
পিতা বললেন, কীসের দেনাপাওনা! কীসের দেনাপাওনা! আমার কাছে কেউ এক কপর্দকও পায় না।
পায় পায়, হরিশঙ্কর। নেবার সময় লোকে খুব কাঁদুনি গায়, দেবার সময় তিড়িং তিড়িং লাফায়।
শুনুন, শুনুন, আমি আপনাকে হাড়েহাড়ে চিনি। জীবনে আপনার ত্রিসীমানা মাড়াইনি, মাড়াবার ইচ্ছেও নেই। না খেয়ে মরব সেও ভি আচ্ছা, তবু আপনার মতো এক দালালের কাছে কখনও টাকা ধার করতে যাব না, বুঝলেন? আর তা ছাড়া বাপমায়ের আশীর্বাদে আমি ভিখিরি নই। নিজের ম্যাও নিজেই সামলাতে পারি। তার জন্যে দালালের দরজায় যেতে হবে না।
হরিশঙ্কর, অহংকার ভাল, তবে কী জানো, তোমার মেজদা, যার মেরে তোমার এই বোলচাল, তার শেষের দিনে এই বিধুশৰ্মাই তো ম্যাও ধরেছিল। তোমার মেজবউদি যখন মরোমরো, তুমি তো তখন উড়ছ। বাড়িতে আসর বসাচ্ছ, রাজ এস্টেট থেকে ওস্তাদ আনাচ্ছ, বাড়িতে রেখে বিরিয়ানি ওড়াচ্ছ, আর ওদিকে তোমার মেজদা দু’বেলা আমার কাছে এসে হাত পাতছে।
গেট আউট, ইমিজিয়েটলি গেট আউট। লায়ার, শয়তান, রোগ।
পিতা ঘুষি পাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে সবেগে উঠতে গেলেন। গেঞ্জি গলে মোটা পইতে ঝুলে ছিল। উত্তেজনার অবসরে পইতে যথাস্থলে চেয়ারের কোনায় জড়িয়ে বসেছিল। পিতা উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার উঠল, পইতে ছিঁড়ে দু’টুকরো হল, চেয়ার টাল খেয়ে সশব্দে উলটে পড়ল বইয়ের র্যাকের ওপর, র্যাক থেকে দুদ্দাড় করে বই পড়ল, বইয়ের ধাক্কায় চায়ের গেলাস ছিটকে গেল কোনার দিকে। সব ঘটে গেল পরপর, অনেকটা জন্ম বিবাহ মৃত্যুর অর্ডারে।
মেসোমশাই, মুকু, কনক তিনজনেই ছুটে এসেছেন। পিতা পইতে ছিঁড়ে রণক্ষেত্রে দণ্ডায়মান। প্রতিপক্ষ চেয়ারেই বসে আছেন পায়ের ওপর পা তুলে। মৃদু মৃদু হাসছেন। আমার সেই শয়তানের গল্পটি মনে পড়ল। ঈশ্বর বললেন, শয়তান, লোকে বলে তুমি খারাপ ছাড়া ভাল কিছু কখনও করো না। কেন বলো তো? শয়তান বললে, প্রভু আমার ভাগ্য। দু’জনে ছদ্মবেশে এক মুদির দোকানে বসে কথা বলছিলেন। শয়তান গুড়ের নাগরি থেকে আঙুলে এক ফোঁটা গুড় নিয়ে দোকানের বাঁশের খোঁটায় একটি টিপ পরিয়ে দিয়ে বললে, প্রভু, এটা কি কোনও অপকর্ম? ভগবান বললেন, না, এ আর কী এমন অপকর্ম। তবে দেখুন! দু’জনেই স্থানত্যাগ করলেন। এদিকে সেই গুড়ের টানে সারি সারি পিঁপড়ে খোঁটা বেয়ে উঠতে লাগল। পিঁপড়ের লোভে তেড়ে এল গোদা টিকটিকি। টিকটিকি ধরতে এল বেড়াল। বেড়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে এল রাস্তার কুকুর। নিমেষে লন্ডভন্ড, লঙ্কাকাণ্ড।
মেসোমশাই মেয়েদের এক এক টানে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে দুম করে ডান পা ফেলে ঘরে ঢুকলেন। ড্রয়ারের ওপর পাশাপাশি রাখা কাঁচের ফুলদানি চিন করে বেজে উঠল। চাপা হুংকারে বললেন, কী হয়েছে হরিদা?
নানা জিনিসের যুগপৎ পতনের শব্দে বিভ্রান্তিতে পিতা তৃষ্ণীষ্কৃত হয়েছিলেন। মেসোমশাইয়ের প্রশ্নে ঘোর কেটে গেল। বাজারের পাশে একটা লোক বসে বসে ভেলকি দেখাচ্ছিল, লাগ ভেলকি, লাগ ভেলকি। হঠাৎ টাগরায় জিভ জড়িয়ে লোকটির সমাধি হয়ে গেল। সবাই ধন্য ধন্য করছে। কিছুক্ষণ পরে সেই ভাবটি যেই কেটে গেল, লোকটি অমনি লাগ ভেলকি, লাগ ভেলকি বলে চিৎকার শুরু করে দিল। পিতা সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে উঠলেন, গেট আউট গেট আউট, ইউ স্কাউন্ড্রেল।
মেসোমশাই অগ্রপশ্চাৎ কিছুই শোনেননিঃ কিন্তু বীরভাবের একটা স্পর্শদোষ আছে। মালকোচা মারা ধুতিপরিহিত মেসোমশাই বিধুজ্যাঠার চোখের সামনে তিড়বিড় করে নাচতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, গেট আউট, গেট আউট, ইউ স্কাউড্রেল।
আমাদের তিনজনের এতক্ষণ কোনও ভূমিকা ছিল না। লম্ফঝম্প শুরু হওয়ায় আমরা তিনজনে সমস্বরে চিৎকার করতে লাগলুম, বাবা কাঁচ, মেসোমশাই কাঁচ। বাবাতে, মেসোমশাইতে এমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সন্দেহ হচ্ছে, কে কার বাবা, কে কার মেসোমশাই! সাবধানবাণী কেউই গ্রাহ্য করছেন না। এদিকে মেঝেতে লেবুর কোয়ার মতো ফালাফালা কাঁচ পড়ে আছে। একবার পায়ে ফুটলে হয়! আমাদের সুখেন একবার বৃন্দাবনকে খুব ধাঁধায় ফেলে দিয়েছিল। বৃন্দাবনের বাবা বৃন্দাবনের মাসিকে দ্বিতীয় পক্ষ করে আনলেন। সুখেন বোকাসোকা বৃন্দাবনকে বুঝিয়ে দিলে, তোর বাবাকে আর ভুলেও বাবা বলে ডাকিনি। ভীষণ রেগে যাবেন। অপমান করা হবে। তিনবার ফেল করেছিস, এইবার তা হলে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। মেসোমশাই বলবি। মাসির বর মেসো হয় জানিস তো! পরের দিন সকালে দেখা গেল, বৃন্দাবন উদম হয়ে বাইরের রকে বসে আছে। কী হল রে বৃন্দাবন? কী বলব মাইরি, রাতে খাবারটাবার সব বাড়া হয়েছে, যেই ডাকলুম, মেসোমশাই, খাবেন আসুন, এতদিনের বাবা মাইরি জুতো হাতে তেড়ে এলেন। শরীরের অবস্থা দেখ, মেসোতে আর মাসিতে মিলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দিয়েছে রে! সব কেড়ে নিয়ে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। বাবা মাইরি সত্যিই মেসো হয়ে গেছে।
বিধুজ্যাঠা এমনভাবে বসে আছেন, যেন কুচিপুডি নৃত্য দেখছেন। প্রোগ্রাম শেষ হলে হাততালি দেবেন। কাঁচ পরিষ্কার করে নাচের নিরাপদ জমি তৈরি করার জন্যে কনক ঝাটা আনছিল। খেয়াল করেনি। সেই রাতের আরশোলা-পেটানো ঝাটা। একটা আধমরা প্যান্তাখাঁচা মাল কাঠির মধ্যে ঘাপটি মেরে ছিল। মেঝেতে নিচু হয়ে বোল কাটা জোড়া জোড়া পা বাঁচিয়ে যেই এক টান মেরেছে, আরশোলা ক্যাতরাতে ক্যাতরাতে হাত বেয়ে একেবারে সেই মোম আশ্রয়ে ঢুকে পড়ল যেখানে বিবাহের আগে কোনও পুরুষের হাতের প্রবেশ নিষেধ। কনক ঝাটা ফেলে মেঝেতে কুমড়ো গড়াগড়ি। ওদিকে কুচিপুডি, এদিকে হিন্দি সিনেমার সুঁই নাচ। শেম শেম বলতে ইচ্ছে করছে। বিধুজ্যাঠা ছাড়া সকলেরই অবস্থা মত্ত মৃদঙ্গের মতো। খ্যাচাখাই খ্যাচাখাই করে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বেজেই চলেছে। গেট আউট বললেও কেউ যদি গেড়ে বসে থাকে, তা হলে তাকে চ্যাংদোলা করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসতে হয়।
মেসোমশাইয়ের হঠাৎ বোধহয় আদালতের কথা মনে পড়ল, বাজখাই গলায় চেঁচাতে লাগলেন, পুলিশ পুলিশ। ওদিকে সাহসী মুকু বক্ষলগ্ন আরশোলা সমেত কনককে বাইরে টেনে নিয়ে গেছে, সেদিক থেকে নানা রকমের কাতর চিৎকার ভেসে আসছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমার ভীষণ সাহস। আরশোলা ফারশোলায় আর কোনও ভয় নেই। হাত ঢুকিয়ে খপাত করে ধরেই ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দোব। অসাধারণ বীরত্ব। সেভিয়ার অফ ম্যানকাইন্ড, উওম্যানকাইন্ড। আহা, মানিক আমার। একটা উটকো লোক এসে পিতাকে অপমান করছে, সন্তান হয়ে গায়ে লাগছে না, রুখে দাঁড়াবার সাহস হচ্ছে না, মজা দেখছ, এরই মধ্যে আবার আরশোলা উদ্ধারের শখ। এই শোন, রোজই তো কথামৃত পড়িস, তা হলে মন অত চুলবুল করছে কেন রে! সন্ন্যাসী স্ত্রীলোকের চিত্রপট পর্যন্ত দেখবে না। সন্ন্যাসীর পক্ষে স্ত্রীলোক, থুথু ফেলে থুথু খাওয়া। স্ত্রীলোকদের সঙ্গে সন্ন্যাসী বসে বসে কথা কবে না–হাজার ভক্ত হলেও জিতেন্দ্রিয় হলেও আলাপ করবে না।আরে সে তো পড়েছি। আরশোলা ঢুকেছে যে!
বিধুজ্যাঠা পায়ের ওপর থেকে পা নামিয়ে বললেন, সামান্য ক’টা টাকার জন্যে এত নাচানাচি, ভাঙাভাঙি!
যোলোকলা পূর্ণ হল। দরজার সামনে মাতামহ। কয়েকদিন অদর্শনের পর আজ উপস্থিত। বুকের কাছে দু’হাতে ধরা একটি বিশাল ঠোঙা। কাগজ ফুড়ে তেল ফুটে উঠেছে। তার মানে রসদ সহ অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। মুড়ি আর তেলেভাজা। পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ চালাবার ইচ্ছে ছিল। ঘরের লন্ডভন্ড কাণ্ড অবস্থা দেখে বললেন, কী ব্যাপার! বেড়াল ঢুকেছে নাকি? বেড়ালও চোর, তবে তার জন্যে আবার পুলিশ কেন?
আজ্ঞে বেড়াল নয়, বিধুজ্যাঠা।
মাতামহ টর্পেডোর মতো সামনে ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, তারপর দু’পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আরে আরে, এটা যে দেখছি সেই সিন্ধুঘোটক জুট মার্চেন্টটা। আঁটকুড়োর ব্যাটা? তুই এখানে সাতসকালে কী করছিস! ফুটবল খেলছিস। ব্যাটার মুখ দেখলেও অযাত্রা।
ক্রোধে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠলেও পিতার শালীনতা জ্ঞান নষ্ট হয়নি। মাতামহকে বললেন, এ আপনি কী বলছেন? আঁটকুড়োর ব্যাটা? আরও অনেক ভাল ভাল গালাগাল আছে, যেমন পিগ, রাসকেল, সান অফ এ বিচ, হতচ্ছাড়া, জানোয়ার। সেসব ছেড়ে আপনি চলে গেলেন বস্তির ল্যাঙ্গোয়েজে। ওই আপনার দোষ। মুখের ফিল্টার নষ্ট হয়ে গেছে।
মাতামহ একগুঁয়ে ছাত্রর মতো বললেন, যা বলেছি, বেশ বলেছি। তুমি ওকে কতটা চেনেনা হরিশঙ্কর? ও একটা চিট। দ্যাটস রাইট। হি ইজ এ চিট। শুধু তাই নয়, ওই আগেরটাও। তুমি ওর জন্মবৃত্তান্ত জানো? ওর মা ছিল নন্দলালের রক্ষিতা। সমাজের যে শাসন নেই, তাই আজ সিল্ক চড়িয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। চুলে আবার পমেটম। তুই কোন সাহসে আমাদের সামনে চেয়ারে পা তুলে বসে আছিস? ওঠ। উঠে দাঁড়া। কান ধরে উঠে দাঁড়া।
মাতামহকে দেখে বিধুবাবু একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এখন যেন জোকের মুখে নুনের ছিটে পড়ল। বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সামান্য ক’টা টাকার জন্যে তা হলে কোর্ট কাছারিই করতে হচ্ছে।
আবার টাকা! কীসের টাকা? কার টাকা? পিতা তেড়ে আসতে চাইছেন। হাতের মুঠো আবার পাকিয়ে উঠেছে। আমরা আবার কোরাসা ধরেছি, বাবা কাঁচ, মেসোমশাই কাঁচ।
১.০৯ Dark idolatry of self
টাকার কথা আসছে কেন হরিশঙ্কর? তুমি কি এই দালালটার কাছে টাকা ধার করেছিলে?
মাতামহ ব্যাপারটা বুঝতে চাইলেন। রঙ্গমঞ্চে আপাতত চরিত্ররা স্থির। চেয়ার পা উলটে পড়ে আছে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত অশ্বের মতো। থানইটের মতো কিছু কেতাব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। উত্তেজনায় মেসোমশাইয়ের ভুঁড়ি ইঞ্চিখানেক চুপসে যাওয়ায় কাপড়ের কষি আলগা হয়ে গেছে। টাইট করে বাঁধার চেষ্টা করছেন। কনক আর একটা ঝাড়ু এনে উবু হয়ে বসে কাঁচের কোয়া ঠেলে ঠেলে এক জায়গায় জড়ো করছে। পিঠের দিকে খোলা অংশে শাড়ির আঁচল লাগলে আরশোলা ভেবে চমকে চমকে উঠছে। মুকু চেষ্টা করছে বইয়ের র্যাকটাকে সোজা করার। বিধুজ্যাঠা শাসিয়েটাসিয়ে, কোর্টকাছারির ভয় দেখিয়ে পালিয়েছেন। মাতামহ বুকের কাছে ঠোঙাটি তখনও ধরে আছেন। অনেকক্ষণ লোভ সামলেছেন। আর পারলেন না। বেশ বড় সাইজের একটি বেগুনি বের করে সযত্নে দাতে কাটলেন। মুচুড় করে শব্দ হল।
মুকু ভূপাতিত চেয়ারটিকে খাড়া করেছে। পিতা সাবধানে পেছনে সরে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। এতক্ষণ সব বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। আবার হিসেবজ্ঞান ফিরে আসছে। মাতামহ। বিধুবাবুর বসে যাওয়া চেয়ারে বসলেন না। অপবিত্র হয়ে গেছে। পাশের আর একটা চেয়ারে বসলেন। মুখে বেগুনি, মাকালীর লাল জিভের মতো সামনে লকলক করছে।
মেসোমশাই কোমরের কষি কোনওমতে বাগে আনতে পেরেছেন। আর একটা চেয়ারে বসে তারও ওই একই প্রশ্ন, কী টাকা টাকা করছিল ওই স্কাউড্রেলটা!
মাতামহ বেশ সন্দেহের চোখে প্রশ্নকারীর দিকে তাকালেন। চোখ ঘুরে গেল কনক আর মুকুর ওপর দিয়েও। এরা আবার কারা? সংসারটা বেশ শ্মশানের মতো হয়ে ছিল! হঠাৎ শ্মশান জাগাতে এ কাদের আগমন? প্রশ্ন করলেন, আপনাকে তো ঠিক চিনলুম না? সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি হরিশঙ্করের শ্বশুরমশাই।
কী ট্রেনিং! মুকু আর কনক সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে হেঁট হয়ে গড়াগড় তিনজনকে প্রণাম করে ঘরের মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। নৃত্যের একটা ছন্দ চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে। মেসোমশাই বললেন, আমার মেয়ে।
মাতামহ একটা হাত বুকের কাছে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে সাপের ফণার মতো তুলে ধরে বললেন, সে তো বুঝলুম, কিন্তু আমিটা কে?
পিতা বললেন, এঁকে আপনি আগে হয়তো দেখেননি, মেজদার ভায়রাভাই। পণ্ডিত মানুষ। ডাকসাইটে উকিল।
মাতামহ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কী, চলবে? বেগুনি, আলুর চপ, আলুর বড়া বা ফুলুরি?
আজ্ঞে, সবই তো সুস্বাদু, মুখরোচক। তবে আমি যে আবার অম্বলের রুগি!
মাতামহ হা হা করে হেসে বললেন, পুরুষমানুষের অম্বল? হরিশঙ্কর, শুনেছ? পুরুষমানুষের অম্বল! ও তো মেয়েদের অসুখ গো! অম্বল, মাথাধরা, গেঁটে বাত, বাধক। গরম তেলেভাজা না, খেলে তোমার ও ব্যামো সারবে না বাপু! সুখদা মোক্ষদা মা, আমার দিকে এসো তো!
কনক আর মুকু এগিয়ে গেল। যাক, দু’জনের আর একজোড়া নতুন নাম হল। মাতামহ ঠোঙাটি কনকের হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, বাঃ, বেশ মেয়েটি তো? একেবারে দুর্গাপ্রতিমা! আমার নাতিটার বিয়ে দিয়ে দিলে হয়। এই ভস্মলোচনের সংসারে একটি অন্নপূর্ণার বড় প্রয়োজন। মাতা চ পার্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ। বান্ধবা শিবভক্তাচ স্বদেশোভুবনয়ম।
ঠোঙাটা বুকের কাছে ধরে, মাথাটাকে তার ওপর গুঁজে, মুকুর পা মাড়িয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে মাতা অন্নপূর্ণা ঘর ছেড়ে পালালেন। এই লাজুক লাজুক প্রস্তাবে বাচ্চা মহাদেবটিকেও কামরাঙার মতো মুখ করে, দেয়ালে পিঠ ঘষে ঘষে গুটিগুটি সরে পড়তে হল।
রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়াতেই কনক বললে, যাও! তোমার সঙ্গে কথা বলব না।
আমার তো আবার সবেতেই পাকামো! এই আহ্লাদে আটখানা, এই আবার বিষাদে ফুটিফাটা। এখন ভেতরটা নেত্য করছে।
কনক বসে বসে ঠোঙা থেকে তেলেভাজা বের করছে। চট করে আঁচলটা মাথায় তুলে দিলুম। মন ধমকে উঠেছিল, কী গ্রাম্য রসিকতা! হৃদয় শোনেনি, হাত বশে থাকেনি।
আর মা অন্নপূর্ণা! তিনি কপাত করে আমার হাত চেপে ধরে কটাস করে আঙুল কামড়ে দিলেন। মোস্ট আন-অন্নপূর্ণাসুলভ কর্ম। দৃশ্যটি মুকু দেখে ফেললেন এবং মৃদু হেসে বুঝিয়ে দিলেন, বেশ হচ্ছে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে, কোনও মেয়ে যদি কটাস করে আঙুলের মাথা কামড়ে দেয় তা হলে তার কী অর্থ! সুখেন? না সুখেন নয়। আরও পবিত্র কেউ। যে এর ভেতরের রোমান্সটা চটকে বের করে দিয়ে বিশ্রী একটা দেহের স্বাদ ঢুকিয়ে দেবে না। মায়া? না, মায়াও নয়। তা হলে মাতামহকেই জিজ্ঞেস করব। প্রাণের কথা বলার মতো এমন প্রাণ আর কোথায় পাব!
মাছ আনা মাথায় উঠেছে। বসার ঘরে তিন সংসারী আলোচনায় বসেছেন। ব্যাপারটা যেমন আকস্মিক তেমনই কদর্য। পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত জায়গা। একদিকে যেমন ভাল, আর একদিকে তেমনই খারাপ।
কী বলছে ব্যাটা? তোমার মেজদা টাকা ধার নিয়েছিল? মাতামহ আলুর চপ খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন।
কোনও ডকুমেন্ট আছে? মেসোমশাইয়ের প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন।
ওর আস্তিনে কী আছে ওই জানে। মাঝে মাঝে কেবল তড়পে যাচ্ছে। আমার পরামর্শ ছাড়া মেজদা জীবনে কোনও কাজ করেনি। সে এই লোফারটার কাছে টাকা ধার করতে যাবে, আমি বিশ্বাস করি না। অসম্ভব। ইমপসিবল। আর টাকা তাকে ধার করতে হবে কেন? তার কোনও অভাব ছিল? সে তো ধার দিয়েই ফতুর। ওই রাসকেল আমাকে বলে গেল, মেজদার মেরে আমি বড়লোক! ছি ছি কানে যেন গরম সিসে ঢেলে দিয়ে গেল। মেজদা যা রেখে গেছে, আমি কাকে দোব? দোবটা কাকে? কেউ তো নেই। মেজদার বংশই তো লোপাট হয়ে গেছে। আমি কি পার্সেল তার ওপরে পাঠাব!
মাতামহ বললেন, মেজকত্তা একটু খরচে ছিল। দানধ্যানও ছিল প্রচুর। তুমি সে তুলনায় বেশ হিসেবি।
এই রে, মরেছে রে! আমার মাতামহের এই এক যা দোষ! মনে যা এল, দুম করে বলে ফেললেন। মা ব্রয়াত সত্যমপ্রিয়ম। কে কার কথা শোনে! এইজন্যে যে অপ্রিয় হতে হয়, তা বোঝেন না। পিতা কঠিন মুখে তাকালেন, সংসারী মানুষকে একটু হিসেবিই হতে হয়। দিয়তাম, ভুজ্যতাম করলে আপনার ছেলেটির মতো অবস্থা হবে। আয় একশো, ব্যয় হাজার, পাঁচজনের কাছে হাত পেতে বেড়াও। বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। ব্যাটা যেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। রোজ মোগলাই খানা চাই। কানে আতর চাই। একপা হাঁটার ক্ষমতা নেই, গাড়ি চাই, সেবাদাসী চাই। বউয়ের কী তোয়াজ। ব্যাটা যেন বিল্বমঙ্গল! পরশুদিন একটা শাড়ি এল, দাম শুনলে চক্ষু চড়কগাছ, দুশো টাকা!
বেহিসেবি হওয়া যেমন ভাল নয়, আবার আপনার মতো ওয়ানপাইস ফাদারমাদার হওয়াটাও ঠিক নয়।
আরে দুর, আমার পাইসই নেই তো ফাদারমাদার। তোমার যেমন কথা!
মেসোমশাই উসখুস করছিলেন। আলোচনা লাইন চেঞ্জ করে অজ্ঞাত দিকে চলেছে। পারিবারিক গোপনীয়তা বেরিয়ে আসছে। খক করে একবার কেশে চূড়ান্ত রায় দিলেন, হোয়েন দেয়ার ইজ নো ডকুমেন্ট, দেয়ার ইজ নো ক্লেম। যিনি ধার নিয়েছেন তিনি আর জীবিত নেই। একটা মানহানির মামলা ঠুকে দিন।
মাতামহ মহাউল্লাসে বললেন, এই তো আইন আমাদের পাশে, আমাদের কাত করে যাবে এক ব্যাটা দালাল! ঠুকে দাও, ঠুকে দাও। আমার জামাইকে আমি রিপ্রেজেন্ট করব।
কত টাকা দাবি করছে? মেসোমশাই আর একটু গভীরে যেতে চাইলেন।
পাঁচ হাজার। বলছে খেপে খেপে দিয়েছে। মেজদা মুদিখানায় কিছু ধার রেখে গিয়েছিল, হাজারখানেকের মতো। ভয়ে আমাকে বলেনি। সাধুখাঁ খাতা দেখাতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি, অফকোর্স উইথ এ প্রেয়ার, মেজদা, এবার তুমি যেখানেই জন্মাও, লম্বা হাত খাটো করার মতো এমন ভাই তোমার পাশে থাকবে না। তুমি সেই স্বভাব নিয়ে এসো, যে স্বভাব বলে, কাট ইয়োর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইয়োর ক্লথ।
মাতামহ বললেন, মুদিখানার হাজার তুমি না দিলেও পারতে। ওরা তিন টাকাকে তিরিশ টাকা করে রাখে। ওসব হল বানানো খাতা।
তা বললে কি চলে? ও আপনি পারেন, আমি পারি না, আমার শাস্ত্র আলাদা। আর একটা ধার ছিল, অতি সামান্য। জানতেও পারতুম না, যদি না মেজদা স্বপ্নে এসে বলে যেতেন।
কীরকম? কীরকম? মাতামহ একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। পরকালের গন্ধ পেয়েছেন।
ভোররাতে মেজদা এলেন।
নিশ্চয়ই ট্রেন লেট ছিল। আমি এতকাল রেলকোম্পানির মালবাবু ছিলুম। লেট না থাকলে কোনও ট্রেন শেষরাতে হাওড়ায় ইন করে না।
আপনি ছিলেন মালবাবু, কথা বলছেন জলপাইবাবুর মতো।
অর্থ?
সুকুমার রায়। জল পাই আর জলপাই এক করে পাগল করে মেরেছিল। হচ্ছে স্বপ্নের কথা চলে গেলেন অন্য লাইনে, রেললাইনে।
বয়েস হরিশঙ্কর। বয়েস। বয়েসে বাতুল। তুমি বলো, বলো। লঙ্কা চিবিয়ে ফেলেছি। ব্লটিং পেপারে একটু চিটেগুড় পেলে জিভে সেঁটে ধরতুম।
কাশীর চিনি মিলতে পারে। চিটেগুড় পাবেন গুলিখোরদের আখড়ায়।
কনক চা নিয়ে এল না, এল মুকু। লজ্জা হয়েছে। বিয়ের কথায় মেয়েরা কেমন যেন মেদুর হয়ে যায়। আরে বোকা, ও তো মাতামহর ঠাট্টা। বৃদ্ধদের ওই তো রীতি। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই একেবারে ফুলশয্যার ছবি আঁকা। লাল মেঝে। বাঘথাবা খাট। নীল কামুক মশারি। ফলাও সাদা চাদর। বিলাসী বালিশ। রজনীগন্ধার ছড়ি। যুঁইয়ের মালা বাজু বেয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে মাতোয়ালা। ইন্দ্রিয়ে সুবাসের সুড়সুড়ি। ফরাসডাঙার ধুতি আর গরদের পাঞ্জাবি পরে প্যাঙা বসে আছে গ্যাট হয়ে। বত্রিশ ইঞ্চি বুকের ছাতি বেড়ে ছেচল্লিশ ইঞ্চি একটি প্রেমের তাকিয়াকে ধরবে বলে। আর পাকা মেয়েরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সেই কঁচা অর্ঘ্যটিকে ভেতর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যাও না যাও, ওই যে বসে আছেন ঠুটো জগন্নাথ, জগন্নাথ স্বামী রসানন্দো রাধাসরসবপুরালিঙ্গনসুখখা। বৃদ্ধের চোখে হারিয়ে যাওয়া সেই অতীত রাতের ছবি। পাকা পেয়ারার মতো দিদিমার বদলে ঘরে একটা কাঠের সিন্দুক। কতদিন দেখেছি, মাতামহ সিন্দুকের গায়ে হাত বুলোত বুলোতে বলছেন, হ্যাঁগা, শেষপারানির কড়িটি তুমি রেখেছ তো!
যাক, চা এসে গেছে, বলে মাতামহ চায়ে একটা চওড়া চুমুক চালিয়ে বাপস বলে কাপ নামিয়ে রাখলেন। ঝালের জিভে গরম চা উত্তপ্ত শাবলের মতো ঢুকেছে। ভয়াবহ মুখে ফেলে আসা আলোচনার টুকরো তুলে নিলেন, শেষরাতে মেজকত্তা এলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ! তিনি এলেন উত্তরের দরজা দিয়ে।
হ্যাঁ, ওই দিকেই যে হিমালয়! নো কমেন্টস। এটা জিওগ্রাফির ক্লাস নয়। দিস ইজ প্যারাসাইকোলজি। বাবা, কতরকমের প্যারা আছে গো! প্যারাটাইফয়েড, প্যারাচুট, প্যারালিসিস, প্যারাগ্রাফ, প্যারামর্শ।
প্যারামর্শটা কী?
পরামর্শকে একটু বাঁকা পথে চালালেই প্যারামর্শ। উকিলরা যা দেয় তা হল প্যারামর্শ। ওই প্যারামর্শর ঠেলাতেই সারাজীবন কোর্টের খোঁটায় কলুর বলদের মতো ঘুরেই চলেছি, মামলার তেলে আমার উকিল বন্ধুবিহারী দিন দিন চকচকে হচ্ছে। মাগের গতর দেখলে সুন্দরবনের কেঁদোর জিভে জল আসবে।
মাগ ছাড়া অন্য শব্দ মাথায় এল না?
আহা, ওই যার চেহারা তাকে আমি কেমন করে রমণী বলি? একটা মানানসই শব্দ বলতে হবে তো? তুমি সবেতেই যদি চটে যাও তা হলে তো বোবা হয়েই থাকতে হয়। তা হলে তুমি রামকৃষ্ণের ওপর রাগো, রামপ্রসাদের ওপর রাগো। আমি তো তাও মাগি বলিনি! রামপ্রসাদ বলে আমার কোষ্ঠী, শুদ্ধ সেই তারাবেশে। মাগি জানে না যে মন কপাটে খিল দিয়েছি কত কষে।
আপনি অফুল।
নিশ্চয়ই কোনও বিলিতি ফুল। কুন্দ, কমল, বকুল, বেল, যুঁই, জবা, ঘেঁটুর দলে নয়। বুঝেছি খুব বিরক্ত হচ্ছ। কী করি বলো, সারাদিন কথা বলার লোক পাই না। ছেলে ওল্ডফুল বলে মুখ বেঁকিয়ে সরে পড়ে। দেখেশুনে পুত্রবধূ নিয়ে এলুম। ছেলে সরে পড়ল ফুসলে নিয়ে। বড়লোকের মেয়ে, ছেলে শ্বশুরের সেরেস্তায় বন্ধক পড়ে গেল। বউ বললে, ওঠো তো ওঠো বোসো তত বোসো। সঙ্গী আমার কেউ নেই হরিশঙ্কর। দেয়াল, বেটির ছবি, দোরগোড়ার নারকোল গাছ, গোটাকতক কাক, আর আমার এই সুদের সুদ নাতি। মেরে তাড়াবে তাড়াও। তোমারই রকে গিয়ে বসব। লোকে বলবে জামাই শ্বশুরকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে। জানো, গত তিনদিন আমার পেটে দানাপানি পড়েনি। কেউ একবার জিজ্ঞেস করেনি, বুড়ো, তুমি কিছু খেয়েছ? দোতলায় মোগলাই, একতলায় হরিমটর। মাতামহ চোখ রগড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে উঁহু করে হাত সরালেন, বাপস জ্বলে গেল, আঙুলে আলুর চপের লঙ্কা লেগে ছিল।
পিতার প্রশ্ন, দানাপানি জোটেনি কেন?
আর বলল কেন? সে আর এক দুঃখের কথা। এখন সই করতে গেলে হাত কাঁপে। যতবার টাকা তোলার ফর্মে সই করি, পোস্টমাস্টার বলে সই মিলছে না। সাক্ষী ধরে আনুন। শেষে জিজ্ঞেস করলুম, মশাই আমি তা হলে কোন শালা? সইয়ের আমি, না আমার সই!
আজ থেকে আপনি আমার এখানে খাবেন। যদ্দিন আমি বেঁচে থাকব। তবে একটা অনুরোধ, যতদূর সম্ভব হুগলি জেলার ওই গ্রাম্য শব্দগুলো ব্যবহার না করার চেষ্টা করবেন। শুনলেই আমার পিত্তি চটে যায়। মনে থাকবে?
মাতামহ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লেন। গালে জলের রেখা। দুঃখ আর লঙ্কা নিংড়ে বের করেছে।
মেসোমশাই বললেন, আমারও একটা প্রতিবাদ আছে। উনি একটু আগে উকিলদেরও একহাত নিয়েছেন। বলেছেন আমরা মক্কেলকে যা দিই তা হল প্যারাম। মক্কেল মেরে, তেল বের করে আমাদের চেকনাই। হাইলি অবজেকশনেবল।
মাতামহ জল-ভরা চোখে হেসে উঠলেন। কানন দেবীও এমনটি পারবেন না। অনেকটা রোদ আর বৃষ্টির মতো। হাসতে হাসতে বললেন, তোমাকে বলিনি গো। তুমি তো আমাদের ঘরের উকিল। ঘরকা মুরগি ডাল বরাব্বর। অনেকদিন আগে বিভক্তির শ্লোক মুখস্থ করেছিলুম, প্র, পরা, অপ, সম, নি, অভি, দুর, বি৷ হরিশঙ্করের প্যারার সঙ্গে মেলাতে গিয়েই কথায় কথা বাড়ে, টাকায় বাড়ে সুদ। ও কিছু না। তোমাকে আমি কিছু বলিনি।
মুরগি বলাটা মনে হয় উপযুক্ত হল না, যতই হোক হিন্দুর ছেলে!
পিতার মুখ দেখে মনে হল ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন। কথার জালে ক্রমশই এমন জড়িয়ে পড়ছেন কীভাবে যে কেটে বেরিয়ে আসবেন ভগবানই জানেন। আঙুল তুলে মাতামহকে বললেন, আপনি অনেকটা গেঞ্জির মতো। কোনা ধরে টান দিলেই হল, ফড়ফড়, ফড়ফড় খুলেই চলেছেন। ওর জন্যে আমি যেমন এক নব-সারমন-অন-দি মাউন্ট তৈরি করছি, আপনার জন্যও সেইরকম একটা তৈরি করতে হবে।
ওই একটাতেই হবে হরিশঙ্কর। আবার নতুন করে খাটবে কেন?
খাটতেই হবে। দু’জনের দু’রকম নেচার। আপনার জন্যে পয়লা উপদেশ হবে, কম কথা বেশি। আহার। খাবার না দেখলে ঠোঁট ফাঁক হবে না।
আঃ, চমৎকার চমৎকার! তুমি আমাদের হিন্দু যিশু, তোমাকে শিশুর মতো কোলে তুলে আমার ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে। প্রেমদাতা নিতাই বলে গৌরহরি, হরিবোল। হরি হরয়ে নমঃ কৃষ্ণ-যাদবায় নমঃ। যাদবায় মাধবায় কেশবায় নমঃ। মাতামহ মাথা নেড়ে নেড়ে সুর করে গাইতে লাগলেন। পিতা তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, অ্যাবসলিউটলি ব্যাড টেস্ট। নাম। নিয়ে ব্যঙ্গ।
গান থেমে গেল। সরল মুখে মাতামহ বললেন, কেন, শাক্ত কি মাঝে মাঝে বৈষ্ণব হতে পারে না?
কেন পারবে না? সব ধর্মেরই শেষে মৃত্যু। তা বলে আপনি আমার নাম নিয়ে সুর করে হরি হরায় নমঃ, হরি হরয়ে নমঃ করবেন? অত্যন্ত কুরুচির পরিচয়।
আরে এ হরি সে হরি নয়। ইনি সেই লোকনাথং ত্রিলোকেশং পীতাম্বরধরং হরিম। তুমি তো শুধু হরি নও, হরি আর শঙ্কর একসঙ্গে পাটিসাপটা হয়ে বসে আছ। রেগে আছ তো, তাই বুদ্ধিবৈকল্য। হয়েছে। না বাবা, তোমার সামনে আর বসব না। কী বলতে কী বলে ফেলব!
মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। কোলের ওপর থেকে গোটাকতক মুড়ি মেঝেতে ছিটকে পড়ল। ভয়ে ভয়ে মুড়ির দানা ক’টা মেঝে থেকে নিচু হয়ে তুলতে তুলতে বললেন, তোমার কোনও কথাই শোনা হল না।
আপনিই তো সব ভন্ডুল করে দিলেন।
আচ্ছা বেশ, আমি যদি এখন একটাও কথা না বলে চুপ করে লক্ষ্মীছেলের মতো বসি!
চেষ্টা করে দেখুন।
মাতামহ চেয়ারে বসে মেঝে থেকে কুড়োনো মুড়ির একটা দানা মুখে পুরলেন। কার সামনে কী কাজ। পিতার নজর সর্বত্র, আরে ছিঃ ছিঃ। আপনি ওই মেঝের মুড়ি দাতে কাটছেন, ছি ছি ছিঃ। দেশে এত বড় দুর্ভিক্ষ চলেছে জানতুম না তো! কদিন না খেয়ে আছেন?
মেঝেটা তো বেশ পরিষ্কার হরিশঙ্কর।
আরে একটু আগেই ওখানে বিধু নেচে গেছে। যান, মুখ ধুয়ে আসুন। আপনাকে দেখছি এবার কোমরে ঘুনসি বেঁধে, দড়ি দিয়ে খাটের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হবে, দামড়া গোপালের মতো। দ্বিতীয় শৈশব শুরু হয়ে গেছে।
একদিন তোমারও হবে। না, না, হবে না, হবে না। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
স্তম্ভিত ঘরে মাতামহ মুখ ধুয়ে ফিরে এলেন। চেয়ারে বসলেন ধীরে ধীরে, যেন শব্দ না হয়। শুভ্র ব্যাকব্রাশ করা চুলে জল হাত বুলিয়েছেন। ধবধবে সাদা ভুরু জলে ভিজে ভিজে। তপঃক্লিষ্ট মুখ অদ্ভুত প্রসন্ন। কেঁচার খোঁটে মুখ মুছতে মুছতে বহু দূর থেকে বললেন, নাও শুরু করো।
কথা বলার ধরনে বেশ বোঝা যায়, দেহ ঘরে, মন উড়ে চলে গেছে বহু দূরে। আমাদের ছাতে বহুকাল ধরে এক খণ্ড কাঠ পড়ে আছে। জলে ভেজে, রোদে পোড়ে, শীতে শুকোয়, হিম খায়, বসন্তের বাতাস পায়। এর নাম নাকি সিজনিং। কাঠ ধীরে ধীরে লোহা হয়ে উঠছে। মাতামহকে। দেখলে, আমার সেই কাঠের টুকরোটার কথা মনে পড়ে। Seasoned Sailor returns from the Seven Seas/ His eyes speak of Cyclones/ Hairs bleached white.
পিতা শুরু করলেন, রাত প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে। ভোরের মেটে আলোয় মেজদা উত্তরের দরজা খুলে এলেন। গায়ে সাদা উত্তরীয়। আমার মাথার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেজদা তুমি? মুখে অপূর্ব হাসি। মানুষের মুখে অমন হাসি দেখা যায় না। স্বর্গীয় হাসি। তুমি কেমন আছ মেজদা? বললেন, সে তোমাকে বোঝাতে পারব না হরি। না থেকেও থাকার আনন্দ। এলে বুঝতে পারবে। সে এক মহাসম্মেলন। তুমি কি আবার আসবে? মেজদা বললেন, আপাতত নয়। তোমাকে একটা কথা বলার জন্যে আজ এলুম। ওই যে কেবল মুচি, যাবার দু-তিন দিন আগে ওকে দিয়ে আমার চটির স্ট্র্যাপটা সেলাই করিয়েছিলুম। পয়সা দিয়ে যেতে পারিনি। বড় ভাল মানুষ। কোনওদিন চাইবে না। তুমি সকালেই গিয়ে দেনাটা শোধ করে এসো। আলমারিতে আমার চশমার খাপে স্যাময় লেদারের তলায় টাকা আছে। পুরোটাই দিয়ে দিয়ো।
আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেজদা নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে গেল। ফুটো দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়লে যেমন হয়, সেইরকম একটা রুপোলি রেখা ক্রমশ গুটোতে গুটোতে বহু দূরে চলে গেল। সারাঘরে সুন্দর গন্ধ। আমি একজন কেমিস্ট। অমন গন্ধ পৃথিবীর কোনও আতরে খুঁজে পাইনি। জানি না ব্রহ্মকমলের কেমন গন্ধ!
মাতামহের চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে। মেসোমশাই বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার। মুখ দেখে মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। সামনে ঝুঁকে পড়ে মাতামহ বললেন, তারপর কী হল!
আলমারি খুললুম। চশমার খাপ। সত্যিই টাকা রয়েছে। একটা দশটাকার নোট। সকাল হল। কেবলকে জিজ্ঞেস করলুম। সাধুসন্ত মানুষ। কিছুতেই স্বীকার করবে না। শেষে বললে, হ্যাঁ, মেজবাবু জুতো সারিয়েছিলেন। তবে সে পয়সা আমি আর কিছুতেই নিতে পারব না। স্বপ্নের কথা বলতেই কেঁদে আকুল। একজোড়া সোয়েডের নিউকাট দেখিয়ে বললে, ওই দেখুন, মেজকত্তার জুতো। তৈরি হল, পরা আর হল না। এই তো মানুষের জীবন! টাকা কী হবে? সেই টাকা দশটা ফ্রেমে বাঁধাই করে দোকানে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেই মেজদা বিধুর কাছে টাকা ধার করেছেন আমাকে। বিশ্বাস করতে হবে?
মেসোমশাই বললেন, একটা মানহানির মামলা ঠুকে দিই। আর দেরি নয়। ফার্স্ট, থানায় একটা ডায়েরি করে আসতে হবে।
না। মামলা-মকর্দমা নয়। আমি টাকাটা ওর নাকের ডগায় ছুঁড়ে ফেলে দোব।
সেকী? মাতামহ আর মেসোমশাই দুজনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলেন।
পাঁচ হাজার টাকার চেয়ে আমার কাছে আমার ইজ্জত অনেক মূল্যবান। ওর জন্যে, ওর জন্যেই আমি ওই জোচ্চোরটা যা চায় তাই দোব।
পিতা দূর থেকে আমাকে বারকতক আঙুলের খোঁচা মারলেন।
মেসোমশাই বললেন, এর মধ্যে ও আসছে কী করে?
ভবিষ্যতে কেউ যেন না বলতে পারে, তোমার বাবা চোর ছিল, জোচ্চর ছিল, চরিত্রহীন ছিল। দেয়ালে যখন ঝুলব, তখন দেবতার মতো ঝুলব। পৃথিবীর আদর্শ পিতাদের তিল তিল নিয়ে আমি হব তিলোত্তম। কোনওদিন ওর মনে যেন এই ক্ষোভ দেখা না দেয়, আমার পিতা যা বলতেন তা করতেন না। হি ওয়াজ এ বান্ডল অফ প্যারাডক্স। দেবদেবীতে আমার বিশ্বাস নেই, দেবচরিত্রে আমার বিশ্বাস আছে। আমার চরিত্রই আমার গর্ব। সেই গর্বের ছোঁয়া লাগবে আমার 91698 1691 All over the land they will be telling of Dugald Stewart. Mothers will teach their children to be men by him. High will his name be with the teller of few teles. There are things greater than death. Dugald Stewart-এর জায়গায় হরিশঙ্কর। পাঁচ হাজার টাকা নাথিং বাট স্ক্র্যাপ অফ পেপারস।
শুনুন, শুনুন হরিদা, সেন্টিমেন্ট ভাল, সেন্টিমেন্টাল হওয়া ভাল নয়। রামকৃষ্ণ বলেছেন, ফোঁস করবে। সেটি ছেড়েছ কী মরেছ। চরিত্র এক জিনিস, দুর্বলতা আর এক জিনিস। ভীরুতা কি ভাল? মেসোমশাই বেশ গম্ভীর মুখে বললেন।
ভয়? যে ঈশ্বরকে ভয় করে না, যে শয়তানকে ভয় পায় না, জীবনের সিংহদুয়ারে যে একা প্রহরীর মতো সারাজীবন খাড়া তার অভিধানে ভয় শব্দের স্থান নেই বিনয়দা।
আছে আছে, সাবকনসাসে’ লুকিয়ে আছে বদনামের ভয়, চরিত্রহননের ভয়। It is the dark idolatry of Self/Which, when our thoughts and actions once are donel Demands that man should weep, and bleed, and groan/Seek not glories that are in heaven.
বেশ, এর ও উত্তর আছে, We have no wings, we cannot soar. But we have feet to scale and climb. দেখতে দোষ কী, কতটা ওঠা যায়, হায়ার, স্টিল হায়ার।
চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে মাতামহ বললেন, বেশ জমেছে হে? তবে বাংলায় হলে খুলত ভাল।
মাতামহের তারিফে বিশেষ কেউ কান দিলেন না। এজলাসে দুই বাঘা উকিল যেন সমানে সমানে লড়ছেন। আসামি হল মানুষের চরিত্র। পিতা বললেন, তা হলে একটা ঘটনা শুনুন।
আবার ঘটনা? মাতামহ টানটান হয়ে বসলেন।
দেরাদুন থেকে ট্রেনে ফিরছি। আমি ওপরের বাঙ্কে। ওপরের বিপরীত বাঙ্কে আমার এক বন্ধু। তার নীচে একটি ছেলে। একেবারে নীচের বাঙ্কে একজন বাঙালি মহিলা। মহিলার বিপরীতে হ্যাটকোট পরা এক প্রৌঢ় মানুষ। আমার নীচের বাঙ্ক খালি।
মাতামহ বললেন, সব গুলিয়ে গেল। তোমরা কে যে কোথায়?
আপনার আর বুঝে কাজ নেই। মডেল তৈরি করে না দেখালে আপনি বুঝতে পারবেন না। সে ইনটেলিজেন্স আপনার নেই। আমারও সে সময় নেই।
কে কোথায় আছ বুঝতে পারলে ভাল হত।
থাক। যা বুঝলেন তাইতেই সন্তুষ্ট থাকুন। ট্রেন চলছে। প্রৌঢ় ভদ্রলোক হলেন কিশোরটির পিতা।
কেমন করে জানলে? মাতামহের বাগড়া।
পিতার ধমক, আবার আপনি কিন্তু শর্ত ভেঙে পূর্বের অবস্থায় ফিরে চলেছেন।
মাতামহ অপরাধীর মুখে বললেন, স্বভাব যায় না মলে।
ট্রেন চলেছে। বিপরীত বাঙ্কে শুয়ে থাকা আমার বন্ধু কেমন যেন উসখুস করছে।
প্রথমে কারণটা বুঝতে পারিনি। আমার বাঙ্ক থেকে আমি ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছি, আর সেই মহিলাকে দেখতে পাচ্ছি। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। মহিলা বসে আছেন জড়োসড়ো হয়ে। আমার বন্ধু হঠাৎ তড়াক করে বাঙ্ক থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। নেমেই সেই সায়েবি পোশাক পরা লোকটির কলার চেপে ধরল, রাসকেল। খুবই অশ্লীল ব্যাপার। আমার নজরে পড়ার কথা নয়, বন্ধুর নজরে পড়েছে, লোকটা হল একজিবিশনিস্ট।
সে আবার কী? মাতামহ জানতে চাইলেন।
সে একটা অসুখ, এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
ছোঁয়াচে?
মানসিক ব্যাধি। মহিলা বাঙালি। আমাদের বললেন, আপনারা দয়া করে আমার পাশে বসুন। কলকাতা পর্যন্ত যাব। একা ভীষণ ভয় করছে।
তোমরা চেন টেনে লোকটাকে নামিয়ে দিলে না কেন? আইন আছে, পাগল, ছাগল, ছোঁয়াচে রোগী, কেরোসিন, বারুদ, মাতাল, ট্রেনে ট্রাভেল করতে পারবে না। ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দাও।
মাতামহ এমনভাবে বললেন, যেন ট্রেন চলছে, ঘটনা ঘটছে।
পিতা আবার শুরু করলেন, আমরা ওপর থেকে নীচে নেমে এসে সেই মহিলার দু’পাশে বসলুম। কথায় কথায় জানা গেল, মহিলার স্বামী দেরাদুনে সম্প্রতি মারা গেছেন। ফিরে চলেছেন। কলকাতায় নতুন জীবন শুরু করতে। বিবাহিত জীবন মোমবাতির মতো গলে গলে নিবে গেছে। চার বছরেই সব শেষ। মানুষ কী জীব দেখুন। লালসার জিভ লকলক করে বেরিয়ে এলেই হল। চেক-ভালভ বলে কিছু নেই। এরাই আবার গর্ব করে বলে, অমৃতস্য পুত্রা।
মাতামহর প্রতিবাদ, একটা মানুষ দেখে সব মানুষকে গালাগাল দিয়ো না। গরলের পুত্র একটা-দুটো, অমৃতের পুত্ৰই বেশি। তা ছাড়া তুমি তো বললে, লোকটা অসুস্থ! কী যেন অসুখ। বললে? ও রোগের নাম বাপের জন্মে শুনিনি।
না শোনাই ভাল? কিছু অসুখ আছে যার ওষুধ হল লাঠি। লাঠৌষধি। ব্রায়োনিয়া নয়, অ্যাকোনাইট নয়, পটপটি নয়। লালসার দাওয়াই হল শাশুড়ি-ছ্যাঁকা। জিভটি টেনে বের করো, আর খুন্তিকে লাল করে পুড়িয়ে ছ্যাঁকা।
তুমি আমাকে বলছ না তো হরিশঙ্কর? পান্তুয়া দেখলে যে আমার নোলা সকসক করে ওঠে।
এ নোলা সে নোলা নয়। এ হল নোলকের নোলা। প্রস্টেট থেকে বেরিয়ে এসে কুলকুণ্ডলিনীতে সুড়সুড়ি দেয়। মানুষ তখন সারমেয়ের মতো জিভ বার করে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে থাকে। অমৃতের পুত্র উদম হয়ে হেঁচকি তোলে। সময় নেই, অসময় নেই, স্থান কাল-পাত্রের বিচার নেই। আমার পাখিই ভাল, আমার পাখিই ভাল। সূক্ষ্ম আহার, সূক্ষ্ম বিয়োগ, দুটি ডিম। একটু তা। লাল-ঠোঁট বাচ্চা। পালকের বাহার। অনন্ত আকাশ। গান, শুধু গান। দ্বিপদ প্রাণী যখন চতুষ্পদ হয়ে যায় তখন ব্যাপারটা এত ভালগার হয়ে দাঁড়ায়? আমাদের ভোলা ষাঁড় অনেক অনেক ডিগনিফায়েড।
মেসোমশাই সামান্য অধৈর্য হয়ে বললেন, এখনও কিন্তু উপসংহারে এলেন না।
ও হ্যাঁ। ঠিকই তো। মানুষের ব্যবহারে বড় বিচলিত হয়ে পড়েছিলুম। যা বোঝাবার জন্যে এই গল্পের অবতারণা, তা হল, সেই হ্যাটকোটধারী পশুমানবটি কুপেতে আর বসতে পারলেন না, বাইরের প্যাসেজে দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেক রাতে বাথরুমে যাবার পথে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে পিতা-পুত্রকে মুখোমুখি দেখলুম। ছেলে বাপকে জিজ্ঞেস করছে, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান ফাদার?
গলায় অভিমান, অভিযোগ। ফাদার ফাম্বল করছে। ইউ হ্যাভ ডান সাম রং। হোয়াই, হোয়াই? হোয়াই? হোয়াই? গলা ভেঙে এসেছে কান্নায়। আমি চাই না, আমি চাই না আমার পুত্র, জীবিত আমি মৃত আমির সামনে পঁড়িয়ে অভিযোগের আঙুল তুলে বলে, কেন, কেন তুমি এমন কাজ করতে গেলে? আমার চরিত্রের অর্কিড হাউসে ও ঝুলতে থাকবে হিমালয়ের সৌন্দর্য নিয়ে। সেই কারণেই আমি বিধুকে পাঁচ হাজার টাকা দোব।
সেকী? মেসোমশাই, মাতামহ, দুজনেই আবার চিৎকার করে উঠলেন। এ যেন সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা বলে চিৎকার করে ওঠা।
সেকী টেকি নয়, ডিসিশন ইজ ডিসিশন।
মাতামহ বললেন, হরিশঙ্কর, তোমারও ওই লাঠৌষধি। বিধুকে তুমি টাকা দিয়ে দেখো!
মেসোমশাই বললেন, এ হল আইনের অবমাননা। লোকটাকে আমি জালিয়াতি কেসে ফেলে যাবজ্জীবন করে ছাড়ব ভেবেছিলুম। আপনি বাদ সাধলেন। কিল খেয়ে কিল হজম করে পুত্রবধূর৷৷ কয়েকদিন পরেই আপনি শ্বশুর হবেন, আপনার এ কী ভীরুতা।
মাতামহ বললেন, ও হবে শ্বশুর? শ্বশুর হলুম আমি। এ জিনিস দ্বিতীয় আর পাবে না। মেয়ে নেই আমার জামাই আছে। আর তার ঘাড়ে বসে লুচি চলছে, মালপো চলছে। দু’বার তীর্থভ্রমণও হয়ে গেছে।
মেসোমশাই চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, বাথরুমে বসে ঠান্ডা মাথায় আর একবার চিন্তা করুন হরিদা।
চিন্তা? পিতা হাসলেন। পাঁচ হাজার টাকা আমাকে বেঁধে ফেলার আগেই লোহা গরম থাকতে থাকতেই হাতুড়ি মারব। মন বড় দুর্বল। আমি ক্যাশবাক্স খুলব, এখুনি টাকা বের করব, এখুনি দিয়ে আসব। কে জানে? মন বড় দুর্বল। মন বড় অপলকা। পিতা ক্যাশবাক্সর দিকে এগোতে লাগলেন। তা না হলে রক্ষক ভক্ষক হয়ে যায়?
তার মানে? পইতের চাবিটি হাতে ধরে পিতা ঘাড় ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বললেন, ওই যে আমার ট্রেনের বন্ধু!
১.১০ নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম
দিন যেন ঝলসে যাচ্ছে। চনমনে রোদ। চারপাশ ঝনঝন করছে। সামনে গঙ্গা। জোয়ারে ভারভরন্ত। সারাশরীরে ঢেউয়ের কুচুরমুচুর। একটু আগে একটা স্টিমার চলে গেছে। তলপেটে চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে। বড় ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে ঘাট পর্যন্ত চলে এসেছে। পইঠেতে জলের ধাক্কা লেগে লপাত লপাত শব্দ হচ্ছে। শ্মশানের কাঠকয়লা তালে তালে নাচছে- এই ছিল এই নেই সুরে। নৌকো ভেড়ার বাঁশের সাঁকো তলিয়ে গেছে জলের তলায়। নৌকো বাঁধার খোঁটাটি শুধু জেগে আছে দূরে। একপাশে পতিত মাঝির বৃদ্ধ নৌকো দুলে দুলে উঠছে। ঝুলনের মেলায় সেই প্রৌঢ়া নর্তকীর কোমর দুলিয়ে নাচার মতো। যে নাচ দেখতে গিয়ে তাঁবুর ভেতরেই শশাঙ্ককাকার কানমলা খেয়েছিলুম। বাইরের পোস্টারে মাকড়সা কন্যার জাল বোনার কথা সাড়ম্বরে লেখা ছিল। ভেতরে যে ঘাঘরা নাচের আয়োজন কেমন করে জানব। সুখেন হয়তো জানত! তা না হলে ঢুকবে কেন? কন্যাটন্যার। মর্ম সেই বয়েসে সুখেনের চেয়ে ভাল কে আর জানত। প্রথমে প্যান্ট পরা চোয়াড়ে মার্কা একটা লোক কাঠের পাটাতনের ওপর দাঁড়িয়ে খুব খানিক অসভ্যতা করে, সিক সিক দু’বার সিটি মারতেই ততোধিক অসভ্য সেই মহিলা পেছনের ঘেঁড়া চটের পরদা ঠেলে বেরিয়ে এল। মুখে খড়ি, ঠোঁট লাল। বুকদুটো ঠেলে বেরিয়ে আছে। সুখেনের মতো অ্যানাটমিই বা কে জানে? ফিসফিস করে বললে, ফক্স। শুরু হল অশালীন ক্রিয়াকলাপ। ভদ্ররুচির কোনও মানুষের সেসব দেখা উচিত নয়। উঠে পালাবার উপায় নেই। সুখেন চেপে ধরে রেখেছে। আমাদের পাশে লুঙ্গি পরা সব লোক বসেছে। মদের গন্ধ, রসুনের গন্ধ, তেলের গন্ধ, বিড়ির গন্ধ। মঞ্চের লোকটা মাঝে মাঝে সেই মহিলার বিশাল পাছায় পটাস পটাস চাপড় মারছে, আর সকলে হায় হায় করে উঠছে। বুকফাটা আর্তনাদ। মানুষের কখন কী যে কেমনভাবে ফেটে যায়! চিতায় বেলের মতো ফটাস করে মাথা ফাটে। দুঃখে বুক ফাটে। এ আবার কী ফাটা! আমার পাশের লোকটা কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলল, মাগির রস আছে। রসগোল্লার রস হয়। এ আবার কী রস বাবা! কিন্তু শশাঙ্ককাকার মতো প্রবীণ মানুষ কী জন্যে ওই রসমঞ্জরীর কাছে গিয়েছিলেন? জবাব নেই।
এমন মজা, সেই থেকে কিছু দুললেই কান সুড়সুড় করে ওঠে, আর সেই মেয়েমানুষটির কথা মনে পড়ে। আহা, এ যেন ভক্ত প্রহ্লাদ, ক বললেই কৃষ্ণের কথা ভেবে হাপুস। কিন্তু দূরে ঘাট-মাঝি চট পেতে ক্যাশব্যাক্স নিয়ে বসে আছেন। গঙ্গার ধারে সারাদিন বসে থেকে থেকে, নৌকোর পারাপার দেখে দেখে কেমন যেন দার্শনিকের মতো মুখ। বসে আছেন তো বসেই আছেন। ইনি যেন সিদ্ধার্থের সেই ঘাট-মাঝি। হেরম্যান হেসের ওই বইটা কতবার যে পড়েছি। যতই পড়ো বাবা! জীবন অনেকটা চুনো মাছের মতো। আঁশটে গন্ধ কি সহজে যেতে চায়। ছাঁকা তেলে কড়কড়ে করে ভাজা না হলে!
পশ্চিমে রোদ ঝুলছে। জল থেকে মাঝে মাঝে হিরের আঙুল বেরিয়ে এসে চোখে খোঁচা মেরে যাচ্ছে। বাঁ পাশে বিশাল একটা বাগানবাড়ির জলটুঙি অতীত গৌরব হারিয়ে, আধ-ভাঙা হয়ে জলের ওপর ঝুঁকে আছে। ছেলেবেলায় ওখানে সুন্দরীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। চুল উড়ছে, শাড়ির আঁচল উড়ছে। সময় উড়ছে, টাকা উড়ছে, পাখি উড়ছে। যাহা যায়, তাহা যায়। ডাকলেও আর আসে না। ফাটা রেকর্ড বাজতেই থাকে, শূন্য এ বুকে পাখি মোর, আয় ফিরে আয়, ফিরে আয়।
মাতামহ পাশে বসে আছেন গুম হয়ে। কনকের হাতের রান্না খেয়ে সেই দুপুর থেকে স্তব্ধ হয়ে আছেন। নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছেন বুঝি? খাবার সময় ছাড়া ঠোঁট ফাঁক করবেন না। জল থেকে রোদের ঝিলিক উঠে মুখে লেগেছে। তপ্ত কাঞ্চনের বর্ণ হয়েছে। মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি, যদি কিছু কথা বলেন।
ভস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী দেখছিস? কতদিন হয়ে গেল এই পৃথিবীতে এসেছি। জীবন যেন আর ফুরোতেই চায় না। যে শেষে যায় সে বড় কষ্ট পায়। একে একে হাত ধরে নৌকোয় তুলে দিয়ে, চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকো। দিন যায়, দিন যায়, সে আর আসে না।
কে দাদু?
মৃত্যু রে বোকা, মৃত্যু।
মৃত্যুর কথা আসছে কেন? সব বুড়োরই এক রোগ।
ওই জলটুঙিটার দিকে তাকিয়ে দেখ।
সেই তখন থেকেই তো দেখছি।
ওইটার মতোই আমি জীর্ণ আর প্রাচীন। হুহু করে জল বয়ে চলেছে। পোস্তা ভাঙছে আর ভাঙছে। একদিন ধস করে ধসে পড়ে যাবে। ওর আর কী কদর আছে বল? আমার মতোই। ভেঙে এসেছে। ভাঙল বলে।
এ তুলনার কোনও মানে হয় না। জড় পদার্থের সঙ্গে সজীব পদার্থ বিজ্ঞান মানবে না।
রাখ তোর বিজ্ঞান। জড়ে আর বৃদ্ধের জীবনে বিশেষ তফাত নেই রে! দেহে সে শক্তি নেই, মনে সে জোর নেই, উপার্জনের ক্ষমতা নেই। বেঁচে থাকার অধিকার কোথায়? এ পৃথিবী হয় ভোগীর না হয় যোগীর। আমি যে কোনওটাই নই।
বাবা আপনাকে বকেন বলে মনে দুঃখু হয়েছে?
তোমার বাবা? ও তো মানুষ নয় দেবল। তুই চিনতে পারিস না?
না।
তা পারবি কেন। পিতা সূর্যসমং জ্যোতিঃ মাতা সমুদ্রসমং সরঃ। পিতা পৃথিবৈঃ বর্ষীয়ান্ মাতুর্মাত্রা ন বিদ্যতে ॥ বুঝলে কিছু? ও আমার পাগলা ছেলে। এই কড়া কথা, এই নরম কথা, এই দূর দূর করছে, এই আবার কোলে তুলে নিচ্ছে। ওর নখের যোগ্য হতে পারলে তোমার জীবন তরে যাবে।
একটু একগুঁয়ে।
গোঁ না থাকলে পুরুষকে মানায় না। গন্ডারের মতো গো চাই। একেবারে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে বেরিয়ে যেতে হবে। পৃথিবী কি তোমার সহজ জায়গা ভেবেছ? ওর তেজ তো তোমরা কিছুই দেখোনি। সে আমরা দেখেছি। সবাই বলত আপনার জামাই নয় তো আগ্নেয়গিরি। ওর সেই বিয়ের রাতের ঘটনাটা! একেবারে প্রথম রাতে বেড়াল কাটার মতো। এখনও মনে পড়লে একা একা কুঁই। কুঁই করে হাসি।
কী দাদু?
হ্যাঁ রে শালা, বাপের বিয়ের ঘটনা শোনার খুব শখ। আচ্ছা শুনে রাখ, তোরই হয়তো কাজে লাগবে। বাপকো বেটা হতে হবে তো। তোর বিয়েও তো লাগল বলে!
হ্যাঁ, তাই তো? ও পথে বাড়াস নে তুই পা।
তুই বাড়াবি কেন রে শালা, আমরাই বাড়িয়ে দোব।
আমি সারাজীবন ব্রহ্মচারী থাকব ভীষ্মের মতো।
আমরা বেঁচে থাকতে তুমি ধর্মের ষাঁড় হয়ে ঘুরবে ভেবেছ? ষণ্ড আর ভণ্ড এক জিনিস। পাত্রী উজিয়ে এসে ঘরে বসে আছে। একেবারে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। চোখদুটো দেখেছিস, যেন মা দুর্গা। হাতের রান্না দেখেছিস? আমি খাব কী, আমাকেই খেয়ে ফেললে। কাপড়ের কষি কোথায় নেমেছে দেখেছিস? মেয়েটিকে বড় পছন্দ হয়েছে আমার। মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। ছোটটা তেমন নয়। একটু গুমোরে।
এতই যখন পছন্দ তখন করে ফেলুন।
হ্যাঁ রে শালা, তোর মতো বয়েসে আমাদের কালে দশ-বিশটা বিয়ে করে ফেলত তেমন-তেমন পুরুষ। কী সব দাপট ছিল তাদের। বিয়ের নামে তোর মতো এমন কোঁচার খোট মুখে পুরে ছাগলের মতো চিবোত না। বংশবৃদ্ধি করার সময় কারুর মুখের দিকে তাকাত না। পাশের ঘরে মা তালপাতার চ্যাটাইয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে। মাথার কাছে এনামেলের চটা-ওঠা বাটিতে সর-পড়া বার্লি। ডেওপিঁপড়ে বিড়বিড় করছে। পাশের ঘরে পতিতপাবন মাগ জাপটে পড়ে আছে। মৃত্যু এসে দু’জানলাতেই উঁকি মারলে। ওরে ব্যাটাচ্ছেলে, গর্ভধারিণীকে নিয়ে চললুম। তখন তোর বীজ যিনি গর্ভে ধারণ করছেন, খাতায় তার নামও লেখা আছে। গর্ভধারিণী হয়ে ওই খাট থেকে চ্যাটাইয়ে একদিন নামতেই হবে, তখন দেখা যাবে। দৃকপাত নেই। সব শালা চার্বাকের ব্যাটা। বললে, অঙ্গনালিঙ্গনাদি জন্যং সুখম এব পরুষার্থঃ। যাবজ্জীবং সুখং জীবেৎ নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ। কী ভয় দেখাও মৃত্যু! বড় বউ, মেজ বউ, সেজ বউ। বড় ছেলে, মেজ ছেলে, ছেলের পর ছেলে। রোলকল করে রাতে ঘরে তুলতে হয়। মুথো ঘাসের বংশ। শিকড়ে বাকড়ে জড়িয়ে মুকুজ্যে বংশ কুঁড়োজালি তৈরি করে বসে আছি। টান মারলে মাটিসুদ্ধ উপড়ে চলে আসবে। কী ভয় মরণে। ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ। ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ। এক বাপ মরলে আরও একশো বাপ রয়ে গেল। যমরাজ তুমি কত নেবে? ধিনতাকের ব্যাটা তিনতাক, আমি দিতে থাকি তুই নিতে থাক।
পালের ভারে কাত হয়ে তীব্র বেগে নৌকো ঘাটে এসে ভিড়ল। দু’জন মাঝি লগির ঠেকনা দিয়ে সানবাঁধানো সিঁড়িতে নৌকোর মাথা ঠোকা অদ্ভুত কায়দায় বাঁচিয়ে দিল। নিত্য করে করে এমন অভ্যস্ত হয়েছে, টাল খায় না, ফসকায় না, পেটে খোঁচা লেগে ভুঁড়ি ফঁসে না। নৌকোর মাঝখানে সাইকেল নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাহনের ওপর বাহন। বেশ মজা। তিনি ঠেলেঠুলে আগে নামতে চাইছিলেন। পারলেন না। ছইয়ের ভেতর থেকে ডুরে শাড়ি পরা বেশ পাঠঠা চেহারার এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। পানের রসে পুরুপুরু ঠোঁটদুটি বেশ লাল। শরীরের ঊর্ধ্বভাগে অদ্ভুত এক ঝাঁকুনি দিয়ে কোমরে শাড়ির আঁচল জড়াতে জড়াতে কাঁচ-ভাঙা গলায় বললেন, যাচ্ছেন কোথায়? মাছের ঝুড়ি না নামলে নামবেন কী করে? যাঁরা শেষে নামবেন বলে উদাস উদাস মুখে বসেছিলেন, মহিলা তাদের মাথার ওপর দিয়ে টপকাতে টপকাতে গলুইয়ের পাশ দিয়ে টাল খেতে খেতে, মাঝিদের কোমর জাপটাতে জাপটাতে সামনে চলে এলেন। কে একজন বলে উঠলেন, গন্ধ। মহিলা ঘাড় ঘুরিয়ে ফোঁস করে উঠল, তোমার বউয়ের গায়ে কীসের গন্ধ? গোলাপের?
রসিক ছোকরা উত্তর দিল, বউ নেই গো আমার।
ঝুড়িটা মাথায় চাপিয়ে কোমর দুলিয়ে মেয়ে উত্তর দিলে, তা হলে রাতের বেলা লণ্ঠন জ্বেলে পাড়ায় এসো, চাঁদা মাছ পাবে।
এনকোর, এনকোর! গরবিনি মাছ নিয়ে, হেলে দুলে, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে উঠে এল। ওপারের যাত্রীরা এপারে পারানির কড়ি ফেলে। এপারের যাত্রীরা ওপারে। মহিলাকে কিছুই দিতে হল না। তিরছি নজরিয়াকি বাণ মেরে, ঘাটমাঝিকে কাত করে দিয়ে সরে পড়ল। পৃথিবীতে আদিরসের বড় ছড়াছড়ি। মৎসগন্ধা হলেও যৌবনে ডগমগে। আর যায় কোথায়? পৃথিবী ছেড়ে কথা কইবে? ঝুলনের মেলায় আধবুড়ি ঘাঘরা পরে মুখে রং মেখে নাচছে। সমঝদার খোঁচা মেরে বলছে, রস অছি। পরেশ মাঝরাতে ঘেঁটে গামছা পরে ছানার তালের ওপর নাচছে। জবা মাথার ওপর হাত তুলে চুল আঁচড়াচ্ছে। ফুলগাছের টবের আড়ালে বসে শিকারের চোখ অজগরের নিশ্বাসের টানে গুটিগুটি এগিয়ে চলেছে। আগুনে পতঙ্গের আত্মাহুতি। ও থাক। ও যেখানে লেখা আছে সেইখানেই থাক, দুঃখং সর্বং অনুস্মৃত্য কামভোগান্নিবর্তয়েৎ, অজং সর্বং অনুস্মৃত্য জাতং নৈব তু পশ্যতি। পাগলা জগৎ দুঃখময়। এই দুঃখের পৃথিবীতে সকাম হয়ে মরিসনি। সবই অজ। কিছুই নেই। তবে তুই ব্যাটা দামড়া ছাগল আঠাঅলা বটপাতা দেখে ব্যা ব্যা করে ছুটিস কেন? ডুরে শাড়ির ফাঁদ দেখলি। আর খোঁপা মাথায় মাছের ঝুড়িটা দেখতে পেলি না। চিদানন্দ সাগরে মাছ খেলছিল, টোপ ফেলে, বঁড়শি গেঁথে, আঁশ চুবড়িতে লাদাই করেছে। দশ টাকা সের, দশ টাকা সের।
শেষ যাত্রী নেমে গেল। পাটাতনে লগি রাখার শব্দ হল। শিকলে বাঁধা নোঙর ঝপাং করে জলে পড়ল। মাতামহ বললেন, নে উঠে পড়। কখন ছাড়বে কে জানে?– ঢেউয়ের তালে তালে নৌকো দোল খাচ্ছে। আই অ্যাম হেলপলেস, আই অ্যাম হেলপলেস। পাপীর মাথা নড়ছে। পুণ্যাত্মার মাথা নড়ছে। জজসাহেবের মাথা নড়ছে, আসামির মাথা নড়ছে। আমার কাঁধে হাতের ভর রেখে মাতামহ উইকেটকিপারের ভঙ্গিতে টাল খেতে খেতে নৌকোয় উঠলেন।
ঘটের মাথায় কঁঠালি কলার মতো নাতি আর মাতামহ নৌকোর মাঝখানে পাল টাঙাবার বাঁশের পাশে গাট হয়ে বসেছি। এ সময় এপার থেকে ওপারে কে আর যাবে! এখন সব ফেরার সময়। কলকারখানায় ছুটির সময়। মাতামহ জোরে জোরে দু’বার নিশ্বাস নিয়ে বললেন, জলের কেমন মিষ্টি গন্ধ দেখেছিস? ভেতরটা যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। আসছে বার জন্মে মাঝি হব। মাঝিরা খুব তাড়াতাড়ি ঈশ্বরকে পায়। মরে স্বর্গে যায়। তুই কী হবি?
আমি গভীর জলের মাছ হব।
খুব ভাল ইচ্ছে। কারুর বাপের ক্ষমতা নেই ধরে। মাঝে মাঝে শুধু ঘাই মেরে যাবি। তবে এ জন্মের সংস্কারে আসছে বার তুই লেংটি আর চিমটে নিয়ে জন্মাবি। এই পথের মাঝখানে বসে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না রে, চল গলুইয়ের ওপর গিয়ে বসি।
যদি টাল খেয়ে পড়ে যাই!
ঠিক মামার ধাতটি পেয়েছিস। ভয়েই আধমরা। পুরুষমানুষকে একটু ডাকাবুকো হতে হয়। আমার শরীরে কত জায়গায় কাটার দাগ আছে জানিস? এই দেখ।
সামনে একটা ঠ্যাং ছড়িয়ে দিলেন। গুলি থেকে উরু পর্যন্ত বড় ছোট নানা ধরনের দাগ।
দাদু, আপনি কি যুদ্ধে গিয়েছিলেন?
দুর ব্যাটা। যুদ্ধ কি থেমেছে নাকি? এখনও চলছে। এই দাগটা কীসের জানিস?
উরুর মাঝখানে বেশ বড় মাপের গভীর এক ক্ষতচিহ্ন।
এই দাগটা বেনারসের স্মৃতিচিহ্ন। বিশ্বনাথের গলিতে ষাঁড়ের লড়াই। যাঁড়ে ষাঁড়ে নয়। ষাঁড়েতে আর আমাতে। সেই চাঁদবদনিকে বাঁচাতে গিয়ে এই অবস্থা। তুই হলে?
কোন চাঁদবদনি দাদু? আপনার প্রেমিকা?
জিভের ডগাটা সামনে একটু বের করে বললেন, তুই চাঁদবদনি বলিসনি। তোর গুরুজন, দিদিমা। সবে বিয়ে হয়েছে। মনের যমুনায় তখন প্রেমের ঢেউ। রেল কোম্পানির ‘পাসে’ ভারত-ভ্রমণ হচ্ছে। তখনও তো পুরনো হয়নি বউ। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনি গোছের অবস্থা। আর তোর কানে কানে বলি, প্রথম যৌবনে সেই মেয়েমানুষটিকে দেখলে তুইও ভিরমি যেতিস। টকটক করছে গায়ের রং। তেমনি চেহারা। যেন উড়িষ্যার মন্দিরের খোদাই করা পাথরের মূর্তি।
ছবি দেখেছি দাদু।
ধুস, ও ছবিতে সে চেহারাই নেই। ঘি আর মালাই খাইয়ে খাইয়ে কুমড়োপটাশ করে দিয়েছি। তোকে আর একটা কথা বলে রাখি, সোহাগ ভাল অতি সোহাগ ভাল নয়। আদরের জিনিস তাড়াতাড়ি সরে পড়ে।
তারপর সেই ষাঁড়ের লড়াই?
হ্যাঁ, ষাঁড়ে ষাঁড়ে লড়াই। বিশ্বনাথের গলি, একটা গাভী, দুটো ষাঁড়।
নিজেকে ষাঁড় বলুন ক্ষতি নেই, দিদিমাকে গাভী বলাটা উচিত হচ্ছে?
তুই তো তার ভুড়ি দেখিসনি। দেখলে তুইও তাই বলতিস। আমি আদর করে নাম রেখেছিলুম ভগবতী। ঘর অন্ধকার করে যখন ঘুমোত, দুর থেকে নিশ্বাসের শব্দ শুনলে মনে হত, মাঝরাতে গোয়ালে এসেছি। যা যা শালা, নিজের বউকে আমি যা খুশি বলতে পারি। তোর বউকে তো বলিনি!
সকালে বাবা আপনাকে যে সারমন দিলেন ভুলে গেলেন। এই এত কথা বলছেন? অভ্যাসটা থেকে যাবে, রাতে বকুনি খাবেন।
রাতে তোর বাপের চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনতে যাচ্ছে কে? নিজের মসনদে গিয়ে একগুলি আফিং খেয়ে বেটির পায়ের তলায় পেছন উলটে পড়ব।
কনক যখন জিজ্ঞেস করল, রাতে কী খাবেন? তখন লম্বা এক ফিরিস্তি ছাড়লেন কেন?
তুই বুঝিস না কেন? এক বেলা খেতেই আমার লজ্জা করে। জামাই আমার বলেছে বলে দু’বেলাই খেতে হবে। আমি কি তোর তেমন হ্যাংলা দাদু?
কনক রাগ করবে।
রাগ করবে কেন?
বাঃ, রান্না নষ্ট হবে না?
তাও তো ঠিক। নাতবউকে তো রাগানো চলবে না।
কেন বউ বউ করছেন? ব্যারিস্টারের মেয়ে। সকালে ফট করে যখন বললেন মেসোমশাইয়ের মুখটা কীরকম গামলার মতো হয়েছিল, দেখেছিলেন?
রাখ তোর ব্যারিস্টার। এমন সোনারাদ ছেলে পাবে কোথায়?
দু’আঙুলে আমার গাল টিপে দিলেন। নৌকো দুলে উঠল। টকটকে লাল পাড় শাড়ি পড়া এক বর্ষীয়ান মহিলা নৌকোয় ডান পা রেখে সঙ্গের ছেলেটিকে বলছেন, বিষ্ণু, আমাকে ঠেলে তোল। দেখিস যেন দেবে যাসনি।
বিষ্ণু বললে, মা জননী, তুমিও একটু চেষ্টা করো।
আমি কি আর চেষ্টা করছি না বাবা, এ তো আর সানবাঁধানো পইঠে নয়, নৌকো যে ভর সইতে পারছে না। বিষ্ণু ঠেলছে আর বলছে, হেঁইও মারি হেঁইও, আউর ঘোড়া হেঁইও, বয়লট ফাটে হেঁইও।
মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। পালের খোঁটা ধরে টাল সামলে, সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আসুন মা, আমার হাত ধরে উঠুন।
শাঁখা পরা, গোল, টকটকে একটা হাত দাদুর হাতে ধরাতে ধরাতে সেই মা বললেন, বিষ্ণু, আর ভাবনা নেই, আমার বড়ছেলে এসে গেছে।
কপালে এতখানি গোল সিঁদুরের টিপ পড়ন্ত বেলার সুর্যের মতো টকটক করছে। গলায় গোটা গোটা রুদ্রাক্ষের মালা। এক এক আঙুলে ঝিলিক মারছে এক এক রকম পাথরের আংটি। দিদিমা বেঁচে থাকলে মনে হয় এইরকমই দেখতে হতেন। চোখদুটো ভারী অদ্ভুত। নীলার মতো। যার দিকেই তাকাচ্ছেন দৃষ্টি যেন তাকে ছুঁড়ে চলে যাচ্ছে। সামলেসুমলে বসতে হয়। অস্বস্তি হয়। মনে হয় উলঙ্গ হয়ে যাচ্ছি।
মহিলা পালের খোটা ধরে দাঁড়াতেই মাতামহ হাঁসের মতো পেছন উলটে পায়ের কাছে প্রণামে। নামলেন। গাঙের জল ছলকে উঠল, মা, মা, জগদম্বে, সর্বমঙ্গলা, মঙ্গল্যে, মা, মা।
ওরে পা ছাড়, ওঠ পাগল ওঠ, নৌকো দুলছে, পড়ে যাব বাবা। এইখানটাতেই বসি। ছইয়ের ভিতরে গিয়ে কাজ নেই। বিষ্ণু বললে, পড়ন্ত বেলার রোদ লাগবে গো।
ওরে মুখপোড়া, বেলা যার পড়ে এসেছে তাকে একটু দিনের আলোয় থাকতে দে। ঘরে ঘরে আলো দেখে লাগে ভাল, মোর হৃদি গেহ অন্ধকারে কালো। হ্যাঁগো বড়ছেলে, তোমার গান আসে?
কথা বলতে বলতে মহিলা আসনপিড়ি করে নৌকোর মাঝখানে বসলেন। আহা! একেই বলে। মায়ের কোল। তেমন মানুষ হলে বলত, মা জননী আমার এক কাঠা জায়গা নিয়ে চারপাশ আলো। করে বসেছেন। টুক করে আমিও একটি প্রণাম সেরে নিলুম। দুহাতে আমার মাথাটি আঁকিয়ে দিয়ে বললেন, ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলে বড় কষ্ট রে! এটি বুঝি তোমার নাতি? মেয়ের মেয়ে?
মাতামহ বসে পড়েছেন। তুমি কী করে বুঝলে মা?
ও আমি বুঝতে পারি। কী করে পারি তা বলতে পারব না। সবই গুরুর কৃপা। এই ছেলেটি পৃথিবীতে স্নেহ ছাড়া সবই পাবে। মরুভূমিতে হাঁটতে হবে, কঁটাগাছ চিবোতে হবে উটের মতো। তোমার জীবন বাবা খুব সুখের হবে না। তবে ঘাবড়ে যেয়ো না। শত দুঃখ শত জ্বালা আসিবে আসুক। জীবন হল কাঁচের ফানুস। আলো যদি জ্বালাতে পারো অন্ধকারে চাঁদের মতো দেখাবে। ধারা নৈবপতন্তি চাকমুখে মেঘস্য কিং দূষণম/ ষৎ পূর্বং বিধিনা ললাট লিখিত তন্ মার্জিতুং কঃ ক্ষমঃ? চাতকের মুখে যদি জল না পড়ে তাতে মেঘের কী দোষ বলো? বিধি তোমার ললাটে যা। লিখেছেন, কার ক্ষমতা আছে তা মুছে দেয়? তবু পথ আছে। বিপদি মহতাং ধৈর্য।
নৌকোর নোঙর উঠল। বাতাস লেগে পাল ফুলে উঠেছে। একপাশে কাত হয়ে জলে ফেনা কেটে কেটে নৌকো সবেগে ছুটেছে। বড় বড় ঢেউ উঠছে হিসহিস করে। নৌকোর ধাক্কা লেগে ঢেউ। ভেঙে পড়ছে টুকরো টুকরো কাঁচের মতো। গায়ে জলের কণা এসে লাগছে। ভয়ে বুক কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাতামহ উন্মুখ হয়ে বসে আছেন। চোখদুটো জ্বলছে। মনের মতো সঙ্গ পেয়ে গেছেন। এ আর এক চাতক। না চাইতেই জল পেয়ে গেছেন।
মহিলা আমার মাথার পেছনে একটা হাত রাখলেন। কী ভারী হাত! এ হাতে জগৎকে দাবিয়ে রাখা যায়। বললেন, কী রে ভয় করছে? পরান মাঝি হাল ধরেছে, ভয় কীসের বোকা! তুই না পুরুষমানুষ! তুই বলবি, হরিফে জোশিশে দরিয়া নহি খুদাদারি-এ সাহিল। উদ্বেল সমুদ্রের শত্রু আমি নই, আমি তটের দম্ভ। আমি পুরুষ। কীরকম পুরুষ? জানতুম পর নিসার করতা হুঁ। মৈ নহি। জানতা দুআ ক্যা হৈ। তোমার পায়ে নিজেকে ফেলে দিয়েছি, প্রার্থনা ফ্রার্থনা জানি না।
মাতামহ বললেন, একী? এ তো দেখছি উর্দু! তুমি উর্দু শিখলে কোথা থেকে?
হঠাৎ নৌকো চরকিপাক খেয়ে গেল, মোচার ভোলার মতো। মাঝিদের হইহই, পালের দড়ি ছিঁড়ে গেছে, সামাল সামাল। সামনের দিকে যাঁরা বসে ছিলেন তারা চিৎকার জুড়লেন, গেল গেল। নৌকোর দুলুনি দেখে প্রথম থেকেই আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হচ্ছিল। সাধিকা মাথায় হাত রেখে চেপে ধরেছিলেন। এখন মনে হল জলে ডুবে মরার আগে একবার বাথরুমে যেতে পারলে ভাল হয়। খোলসা হয়ে মরার আর এক আনন্দ। মাতামহ তারা তারা বলে চিৎকার শুরু করলেন। দড়ি-ছেঁড়া পাল ছিটকে বেরিয়ে গেছে। নাগালের বাইরে পতপত করে উড়ছে। মাঝে মাঝে হ্যাঁচকা। টান মেরে যাত্রীসমেত নৌকো উলটে দেবার চেষ্টা করছে। হালমাঝি যেন লড়াই করছে। হাত আর পা দুটোই চলছে। এত ভয়েও সে দৃশ্য দেখে মনে হল, একেই বলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জার লড়াই। মাতামহ এরই মাঝে ফিসফিস করে বললেন, পইতে থেকে সিন্দুকের চাবিটা খুলে নে। নামতে নামতে একেবারে নীচে নামবি, দেখবি একটা ছোট্ট বালিশ। বালিশটা তোর। বাকি সব ফেলে দিবি।
ডুবলে, আমরা দু’জনেই তো ডুবব। চাবি নিয়ে করবটা কী?
তুই তো সাঁতার জানিস।
সে সাঁতারে এ নদী সাঁতরানো যাবে না।
সাধিকার কিন্তু কোনও ভাবান্তর নেই। মুখ দেখলে মনে হবে বেশ মজা পাচ্ছেন। বিষ্ণুও বসে আছে গাট হয়ে। নিমীলিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। ঠিক মনে হল পেতলের চোখ। সে দৃষ্টি একমাত্র স্বপ্নেই হয়তো দেখা যায়। আমাকে বললেন, তোকে দুটো জিনিস শিখিয়ে দিই।
এখন শেখাবেন? সে শিক্ষা কি আর কাজে লাগানো যাবে? একমাত্র সাঁতার ছাড়া আর কোনও শিক্ষাই এখন কাজে লাগবে না।
কথার ফাঁকেই নৌকো আর একবার বাঁই করে ঘুরে গেল। যাঁরা আরও বেশিদিন বাঁচতে চান তারা সেই ঘূর্ণায়মান পদ্মপত্রে বসে পতনোম্মুখ জলবিন্দুর মতো হায় হায় করে উঠলেন। মাঝিরা পালের দড়িটাকে ধরবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ভূত না হলে অত বড় হাত পাবে কোথায়? সাধিকা ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলেন, বাঃ, বেশ মজা তো! নাগরদোলায় চেপেছি রে বিষ্ণু।
দেরিতে হলেও বিষ্ণু এবার ভয় পেয়েছে। সে বলল, মা, তুমি একটা কিছু করো।
আমি কী করব? আমি কি ভগবান? তোরা বড় চিৎকার করছিস। মরবি তো মানুষের মতো মর। এমন করছিস যেন ঘোড়ার আস্তাবলে আগুন লেগেছে। বড়ছেলে?
মাতামহ ফ্যাকাসে মুখে শুকনো গলায় বললেন, বলো মা।
দড়িটাকে চেপে ধরো না বাবা।
আমি কি পারব মা? আমার যে বয়েস হয়েছে।
তা হলে হাওয়া কমুক। এমন ঝোড়ো বাতাস এল কোথা থেকে! তোমরা একটু স্থির হও, মনে স্থির, দেহে স্থির। সেই পেতলের চোখদুটি অর্ধনিমীলিত হয়ে রইল কিছুক্ষণ। হালের মাঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আর পারছে না যেন সামাল দিতে। হঠাৎ বাতাস পড়ে গেল। নদীর জল সম্পূর্ণ স্থির। বহু টাকা উড়িয়ে বড়বাবুর দাপট যেমন কমে আসে, পালের ফটফটানিও সহসা থেমে গিয়ে নেতিয়ে পড়ল। ঘরের ছেলে ঘরে এসো বাবা। মাঝিরা দড়িটা আবার যথাস্থানে বেঁধে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার সতীমাইকি জয়।
নৌকোর মুখ কিন্তু ঘুরে গেছে। যে-পার থেকে ছেড়েছে সেই পারের দিকেই মুখ। সতীমা চোখ খুললেন। হাসিহাসি মুখে তাকিয়েছিলুম। তিনি উদাস কণ্ঠে বললেন, বিষ্ণু, ছেলেটা মারা গেল বাবা।
সেকী মা? এই তো দেখে এলে, হাসছে, দুধ খাচ্ছে।
নাঃ, বাতাস বড় জোরে বইছিল। প্রদীপ নিবে গেল। মাঝি, তোরা বাবা নৌকোর মুখ আর যোরাসনি। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চল।
মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, কে মারা গেল মা?
আমার এক ভক্তের ছেলে। এই নিয়ে তিনটি গেল। সবাই কি আর মা হতে পারে? হয় ছেলে মরে, নয়তো মা মরে। আমি কী করব? তোমরা সব পাপ করবে, পাপের বোঝা নিয়ে আসবে। ফল ভুগতে হবে না!
তোমার কে মা বুঝবে লীলে। তুমি কী নিলে কী ফিরিয়ে দিলে ।
নৌকো কোনাকুনি পাড়ি মেরে যে-ঘাটে ভিড়ল, সেটা পারঘাটা নয়। চৈতন্যঘাট। ইতিহাসের কোনও এক কালে এই ঘাটে শ্রীচৈতন্য নৌকো থেকে নেমেছিলেন। সময় সময়ের নদী দিয়ে বয়ে চলেছে। ঘাট পড়ে আছে আধভাঙা হয়ে জলধারার পাশে। ক্ষয়া ক্ষয়া পাথরে কালচে সবুজ শ্যাওলার পুরু আস্তরণ।
বিষ্ণু আগে নামল। বিষ্ণুর কাঁধে ভর রেখে তিনি সাবধানে নামলেন। ঘাট বেশ পিছল। মাতামহও নেশাগ্রস্তের মতো পেছন পেছন চলেছেন। মন পড়ে আছে সাধিকার দিকে। নৌকোর দুলুনিতে তাই বোধহয় টালমাটাল হচ্ছেন না। আমাকেও নামতে হল। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় চলেছি, কেন চলেছি জানি না। পিছলে পা হড়কাচ্ছে। পড়ে না যাই।
প্রভু যেমন পেছনে ন্যাজ নাড়তে নাড়তে আসা কুকুরের দিকে ‘কী রে কেন আসছিস’ দৃষ্টিতে তাকান, সেইভাবে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন। হাতে বিস্কুট নেই, তবু সেই ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললেন, কী রে কোথায় চললি তোরা?
মা, একটু কৃপা। একটু কৃপা দিয়ে যাও মা। মাতামহ জমিদারের পেছনে হাতকচলানো নায়েবের মতো সামনে কুঁজো হয়ে সিঁড়ি ভাঙছেন। মাঝে মাঝে পিছলে যাবার মতো হচ্ছেন। কৃপাটুপার কথা আমার কিছু মনে হচ্ছে না। আমি কেবল ভাবছি বাতাস উঠল কেন? বাতাস পড়ল কেন? এ কি শক্তি? না কোনও স্বাভাবিক ঘটনা। কে মরল! সে খবরও কি বাতাসে ভেসে এল! নৌকো তীর ছেড়ে চলে গেল।
মা মহাদেবের বুকে দাঁড়ানো জগদম্বার মতো দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, কৃপা কি ভিক্ষে করে পাওয়া যায় বাবা? এ কি ছেলের হাতে মোয়া যে তুমি খাবে ভোগা দিয়ে! আধার প্রস্তুত কর। যন্ত্রটাকে বেঁধে নে তবে তো সুরে বাজবে।
সিঁড়ির দু’ধাপ নীচে আমি উদোবন্ধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্যাচালো মন। সহজে যেন বিশ্বাস আসতে চায় না। নাস্তিকের রক্ত শরীরে বইছে। আমার ঘোড়ার মতো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ডাকলেন, এদিকে উঠে আয়। তোকে কানে কানে দুটো কথা বলে যাই।
নিশ্বাসে গোলাপের গন্ধ। কানে কোঁদল ফিট করে তপ্ত সিসের মতো গুটিকতক কথা তিনি ঢেলে দিলেন, তুই কখনও কাউকে ভালবাসার চেষ্টা করবি না, তা হলে তার মৃত্যু হবে। কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করবি না, সে পালিয়ে যাবে। সুখে থাকার চেষ্টা করলে অসুখে পড়বি। নিজেকে খুব কষ্টে রাখবি তা হলেই তোর সুখ হবে। তুই হলি শনি। নীলাঞ্জন-সমাভাসং রবিপুত্রং যমাগ্রজম। ছায়ায়া গর্ভসস্তৃতং তং নমামি শনৈশ্চরম ॥ ওই তোর পথ, ওই দেখ। ধুধু প্রান্তর। ধুলো উড়ছে। সাদা উত্তরীয় উড়িয়ে তুই চলেছিস, চলেছিস, ছায়া নেই, মায়া নেই, কায়া নেই, মমতা নেই, কনককান্তি নেই।
কী হল কে জানে? চোখের সামনে যেন মরীচিকা দেখছি। নদী অদৃশ্য। জনপদ লুপ্ত। সব যেন ভোজবাজি হয়ে গেল। সত্যিই ধুলো-ওড়া, রোদ-জ্বলা প্রান্তর। দূরে বহু দূরে আমি আমাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ ভয়ে আমার চিৎকার, এ তুমি কী করে দিলে? উত্তর এল দূর থেকে, ভয় পাসনি খোকা, আবার দেখা হবে, আবার, আবার।
১.১১ কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া
হিস্টিরিয়া, হিস্টিরিয়া, নাকের সামনে জুতোটা ধরুন। হ্যাঁ হ্যাঁ জুতোর গন্ধেই জ্ঞান আসবে। আমার মাসিমার মূৰ্ছা রোগ আছে। যেই ভিরমি যায় মেসো অমনি নাকের কাছে কঁচা চামড়ার জুতো ধরেন। ব্লটিং পেপারে শুকনো লঙ্কা গোল করে পাকিয়ে আগুন ধরিয়ে সিগারেটের মতো ধরতে পারলে আরও তাড়াতাড়ি কাজ হত।
আচ্ছন্ন ভাব কেটে আসছে। যে-কল্পজগতে সহসা ঢলে গিয়েছিলুম সেই জগৎ থেকে ধীরে ধীরে ফিরে আসছি। সেই ঘাট, সেই নদী, সেই ঢেউ, সেই শব্দ। আকাশের রংটাই যা কেবল পালটে গেছে। অন্ধকারের আয়োজন চলেছে। একটি-দুটি তারা ইতিউতি চোখ খুলব কি খুলব না করছে। কে একজন গলাজলে দাঁড়িয়ে অস্ত-আকাশের দিকে মুখ করে স্থির হয়ে আছে।
মাতামহ বলছেন, কেন হিস্টিরিয়া হিস্টিরিয়া করছেন। এ অন্য ব্যাপার।
আমার কানের কাছে মুখ এনে বলতে শুরু করলেন, হরি ওম তৎসৎ, হরি ওম তৎসৎ।
এতক্ষণে নিজের অবস্থা টের পেলুম। শ্যাওলা-ধরা ঘাটের পইঠেতে থেবড়ে বসে আছি। পাশে মাতামহ। তার বুকের ওপর আমার মাথা। তিনি দু’হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। পিটপিট করে তাকালে সামনে ঝুঁকে থাকা এক ভদ্রলোককে দেখতে পাচ্ছি। হাঁটুর ওপর দুটো হাত। পেছন দিকটা তোলা উনুনের মতো ঠেলে আছে। দু’ভাগ করে আঁচড়ানো চুল। চোখে রিমলেস চশমা। গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি। এতক্ষণ তিনিই জুতো শোকাবার পরামর্শ দিচ্ছিলেন। ভদ্রলোক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, অন্য ব্যাপার মানে? গাঁজা নাকি?
আরে না মশাই। গাঁজা হবে কেন?
তা হলে? অন্য ব্যাপার মানেটা কী?
মাতামহ রেগে গিয়ে বললেন, আচ্ছা নেইআঁকুড়ে দাদা তো? অন্য ব্যাপার, মানে অন্য ব্যাপার।
ও, ভাল করতে গেলে মন্দ হয়। বিপদে পড়েছেন দেখে ওপর থেকে নীচে নেমে এলুম, এখন মেজাজ দেখানো হচ্ছে? এক্ষুনি ভাবছিলুম একটা চামচে এনে দাঁতি লাগা ছাড়াবার ব্যবস্থা করব। এক গেলাস খাঁটি গোরুর দুধ খাওয়াব, এইমাত্র দোয়া হল। ঠিক আছে, আমার কী? নিজের ম্যাও নিজেই সামলান।
দুধের নামে মাতামহ নরম হয়ে গেলেন। বললেন, ও আপনি বুঝি এই বাড়িতেই থাকেন?
হ্যাঁ, এই ঘাটও আমাদের। পশ্চিমে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলুম, দেখলুম ছেলেটা মাথা ঘুরে পড়ে গেল। থাকতে পারলুম না নেমে এলুম। পরোপকারে আমার পিতৃদেব দেউলে হয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। তস্যাঁতস্য পিতা উমেদারের জ্বালায় খুন করে জেলে। যাবজ্জীবন কাটিয়েছিলেন। সেই রক্তের ধারাই তো আমার শরীরে বইছে।
মাতামহ ঘাটের ওপর ঠেলে ওঠা তিনতলা বাড়ির দিকে ঘাড় তুলে তাকালেন। আমিও পিটপিট করে একপলক তাকিয়ে নিলুম। ভাঙাভাঙা হলেও বিশাল বাড়ি। একটা পাশ প্রায় ধসে পড়েছে। বটের ঝুরি নেমেছে। একসময় সাদা রং ছিল। এখানে-ওখানে ছাপকা ছাপকা সেই স্মৃতিচিহ্ন মরা হাতি লাখটাকার কথা ঘোষণা করছে। মাতামহ বললেন, মনে কিছু করবেন না, বয়েসে মেজাজ তিরিক্ষি। কী হয়েছে তা হলে বলি, এ হল ঈশ্বরাবেশ।
আমি ফিসফিস করে বললুম, দাদু।
কানে মোচড় দিয়ে তানপুরার তার নামানোর মতো আমার কণ্ঠ নামিয়ে দিলেন। বোঝাতে চাইলেন, চুপ, লোকটাকে একটু খেলাই।
ভদ্রলোক বললেন, ঈশ্বরাবেশ মানে?
আমার এই নাতিটি ক্ষণজন্মা পুরুষ। মাঝে মাঝেই সমাধিস্থ হয়ে যায়। ঈশ্বরানুভূতিতে শরীর স্থির। দেহ এ জগতে চেতনা অন্য জগতে। তখন দর্শনটর্শন হয়। একথা তো সকলকে বলা যায় না!
অ্যাঁ, তাই নাকি? বলেন কী? সমাধি তো মশাই ঠাকুর রামকৃষ্ণের হত। তিনি কি আবার ফিরে এলেন নাকি? গীতা অবশ্য বলেছেন, যদা যদা হি ধর্মস্য; কিন্তু এঁর চেহারায় তো তেমন চেকনাই নেই। গেঁজেল দুধ না পেলে যেমন হয় অনেকটা সেইরকম। কী জানি বাবা!
অ্যায়? ওই জন্যেই অবিশ্বাসীদের কিছু বলতে নেই। কাঠিয়াবাবার নাম শুনেছেন?
আজ্ঞে না। গাঠিয়ার নাম শুনেছি। গুজরাটিরা আদাকুচি দিয়ে খায়।
তিনি ছিলেন যোগী, তান্ত্রিক। ছ’ফুট লম্বা। কাঠির মতো চেহারা। আসনে বসে হাত বাড়িয়ে গাছ থেকে নেবু পেড়ে আনতেন।
এই উদীয়মান মহাপুরুষেরও কি সেইরকম কোনও শক্তি আছে?
থাকলেও দেখায় না। হরি ওম তৎসৎ।
আমি আর আড় হয়ে শ্যাওলা গঙ্গামাটি মাখামাখি ঘাটে শুয়ে থাকতে পারছিলুম না। মশায় সর্ব শরীর ছিঁড়ে দিচ্ছে। ঘোর কেটে গেছে। পুরো ব্যাপারটাকেই এখন স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। ওম তৎসৎ বলামাত্রই তড়াক করে দাঁড়িয়ে পড়লুম। ভদ্রলোক ওরে ব্বাবারে বলে তিরবেগে দৌড়োলেন। মহাপুরুষের ভয়ে মানুষ এমন তিরবেগে দৌড়োতে পারেন, জানা ছিল না। যেন বাঘ দেখেছেন।
মাতামহ বললেন, যাঃ সব মাটি করে দিলি। দু’গেলাস খাঁটি গোরুর দুধ হাতছাড়া হয়ে গেল। সবে দোয়া হয়েছে। এখনও গরম। ফ্যানা উঠছে।
এইভাবে ধাপ্পা মেরে দুধ খাবেন! এক গেলাস দুধ তো আপনি বাড়িতেই পেতে পারেন। চলুন। খাইয়ে দেব।
আরে ধুস, সে দুধ আর এ দুধ! পকেটে আফিমের গুলি৷ টুক করে মুখে ফেলে, এক গেলাস ফ্যানাফ্যানা দুধ চোঁচোঁ মেরে দাও। যত রাত বাড়ছে তত মৌতাত বাড়ছে। অন্যায়টা কী হত! সত্যিই তো তোর সমাধি হয়েছিল। আমি লক্ষণ মিলিয়েই বলছি। সমাধির তুই কী বুঝিস?
সমাধি না হাতি। ভবিষ্যতের ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম। সতীমা যা বলে গেলেন, তাই যদি সত্যি হয়?
ধর্মের লাইনে অনেক বুজরুকি আছে। সহজে ওসব বিশ্বাস করিসনি। তোকে বিভূতি দেখিয়ে গেলেন। যাঁরা কথায় কথায় বিভূতি দেখান, তারা হলেন প্রথম স্তরের সাধু।
কীসে কী, সে পরে ভাবা যাবে, বাড়ি গিয়ে কী বলবেন তাই ভাবুন। কাল সকালেই তো ধুনুরি আসবে।
মাতামহ দুর্ভাবনায় আবার উবু হয়ে বসে পড়লেন। ঘুসুরি থেকে আমাদের তুলে আনার কথা। কাল সকালেই পিতার প্রিয় ধুনুরি গফুর মিঞা আসবে। তোশক তৈরি হবে। তিন অতিথির শুতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে। তুলো এল না। মিঞা সায়েবকে ফিরে যেতে হবে। যেদিন যা হবার কথা, সেদিন তা না হলে পিতৃদেব তুলোধোনা করে ছেড়ে দেবেন। নদী তরতর করে বেশ চলছে, বাধা। পেলেই উদ্দাম, ক্ষিপ্ত।
মাতামহ বললেন, কী আছে, সত্যি কথাই বলব। এমন ঘটনা তো সহজে ঘটে না।
উনি বিশ্বাস করবেন না।
ওর বাপ করবে।
হ্যাঁ, তখন বুঝবেন ঠ্যালা। ঈশ্বর সিদ্ধে প্রমাণাভাবাৎ বলে যখন ঠেসে ধরবেন তখন আমার পিতামহ অয়েল পেন্টিংয়ে যেমন বসে আছেন তেমনি বসে থাকবেন। বাঁচাতে আসবেন না।
তা হলে আমি পালাই। তোমার বাবাকে তুমিই সামলাও। আমার তো জামাই।
তা তো বটেই। একে বলে সুবিধেবাদী। আমাকে বাঘের মুখে ঠেলে দিয়ে নিজে গিয়ে বসবেন বেটির কাছে।
তা যা বলেছিস! মাতামহ উঠে দাঁড়ালেন। ওই সাধিকার মতো শক্তি থাকলে আকাশে হাত বাড়িয়ে মেঘ থেকে পাঁজা তুলো ধরে আনতুম। বৃথাই সাধনা। রাতটা ভাগাভাগি করে বকুনি খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাক।
আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণ বারকতক চমকে উঠল। এক চাকলা মেঘ জমেছে। লক্ষণ ভাল না। বেশি রাতে বৃষ্টি নামতে পারে। মাইলখানেক হাঁটতে হবে। একটা দোকানে গরম শিঙাড়া ভাজছে। সেদিকে তাকিয়ে মাতামহ বললেন, তুলোর পয়সার কিছু সদ্ব্যবহার করে গেলে হয়! কীরকম হাবুডুবু খাচ্ছে দেখেছিস। একেবারে গরম গরম। এক এক কামড়ে হা হা করতে হবে। তোর বেশ দুর্বল দুর্বল লাগছে না? একটু চা না খেলে এতটা হাঁটতে পারবি?
বৃদ্ধর খুব লোভ হয়েছে। তুলোর পয়সা এদিক-ওদিক করা আর ব্যাঙ্কের ক্যাশ ভাঙা একই অপরাধ। বুকপকেটে নিজস্ব একটি টাকা মজুত আছে। মায়া সিনেমা দেখতে চেয়েছিল। অন্ধকার ঘরে দু’জনে পাশাপাশি বসে চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে নদের নিমাই দেখব। কতদিনের পরিকল্পনা আমাদের। সেই টাকাতেই এখন শিঙাড়া হোক।
শিঙাড়া আর চা খেতে খেতেই আকাশ বেশ ঘোর হয়ে এল। যে ক’টা তারা চোখ মেলেছিল তাদের চোখ বুজে এল। পা চালা পা চালা বলে মাতামহ দৈত্যের মতো হাঁটতে শুরু করলেন। বৃদ্ধ হলেও তিনি আমার চেয়ে যুবক। পেছন পেছন আমি চলেছি নেচে নেচে।
বাড়ির সদরে পা রাখতেই দমকা হাওয়া শুরু হল। ভৈরব আসছে তেড়ে। দোর ভাঙার শব্দ হচ্ছে। দুই বোনে মনে হয় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জানলা দরজা একটা-আধটা নয় তো! উত্তর থেকে দক্ষিণে ঘুরে আসতে আসতেই একটা-না-একটা দিক ভেসে যাবেই। সদর খোলা ছিল। গলিতে কাদের একটা ছাড়া-গোর ঢুকে বসে আছে। ভোস ভেঁস করে জাবর কাটছে।
প্রথমেই কনকের সঙ্গে দেখা হল। একগাদা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বুকের কাছে ধরে ঘরে ঢুকছে। আমি আগেই উঠে এসেছি ওপরে। মাতামহ এখনও নীচে। গোরুর বাঁট পরীক্ষা করছেন। যে-দুধ ছেড়ে এসেছেন ওঁর ধারণা সেই দুধ বাড়ি বয়ে এসেছে। সাধিকার সঙ্গ বিফলে যাবার নয়। এখন থেকে অলৌকিক ব্যাপারস্যাপার ঘটতেই থাকবে।
কনক হাসিমুখে বললে, যাক বাবা, এসে গেছ। আকাশ যা হয়েছে। ভেঙে পড়ল বলে।
হুস করে প্রবল একটা হাওয়া এল। রান্নাঘরের সামনের বারান্দা থেকে কয়লা তোলার খালি গামলাটা গড়াতে গড়াতে উনুনের দিকে চলে গেল।
ধরো ধরো, বলে কনক কাপড়জামার বোঝা ধরিয়ে দিয়ে দুদ্দাড় করে রান্নাঘরের দিকে দৌড়োল। গেল গেল সব গেল। কী গেল কে জানে? হয়তো কিছু নামিয়ে এসেছিল। রান্নার এখন খুব তরিবাদি চলছে তো! মরাগাঙে বান এসেছে। আমি এদিকে লক্ষ্মণ ফল ধরে হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। প্রকৃতিতে প্রলয় নাচন, মনেও তাই। এ তুমি কী ধরালে প্রভু! বড় গরম লাগছে। গরম কী রে গাধা! ধুর, বৃষ্টির শীতল বাতাস ভলকে ভলকে বয়ে আসছে। এক এক ঝাঁপটায় পেয়ারাগাছের ডাল ঝড়াস ঝড়াস করে বারান্দার টিনের চালে আছড়ে পড়ছে।
এ যে শাড়ি! সকালে কনকের শরীরে পেঁচিয়ে ছিল। এ যে ব্লাউজ! এখনও শরীরের ঘ্রাণ লেগে আছে। এ যে সেই, যা আরও তলায় থাকে। হে জগদম্বে! ভেতরে ভিসুভিয়াস ভসর ভর করছে।
মাতামহ ওপরে উঠে এসেছেন। পেছন থেকে বললেন, কী হে, আবার সেই সমাধি নাকি?
আজ্ঞে না।
তা হলে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছ কেন? ওই তো পায়রার মতো বুক! নীলমণি হলে কে দেখবে!
পাপীর মন। কী যেন একটা চাপা দিতে চাইছে। আলিঙ্গনাবস্থায় গুরুজনের কাছে ধরা পড়ে গেছি নাকি? চোরের মন, সবসময় বোঁচকার দিকে। ঝড়ের ঝাঁপটা চলছে রান্নাঘরের দিকে তেড়ে। একহাতে মাথা আর মুখ আড়াল করে দেয়ালে কাধ ঘেঁষে ঘেঁষে কনক এদিকে এসে বললে, দাও। তুমি ঘরে ঢুকে গেলে না কেন?
মাতামহ সাধক মানুষ। মনে সবসময় সুবাতাস বইছে। আমার মতো কুবাতাসে পাড়ি দিয়ে হাবুডুবু খেয়ে মরেন না। গ্রাহ্যই করলেন না কী ঘটে গেল অন্তঃপুরে। একগাল হেসে বললেন, কিস্যু নেই। ব্যাটা শুকনো হয়ে শুয়ে আছে।
ঢুকে পড়ুন ঢুকে পড়ুন, বলতে বলতে ঝড়ের ঝাঁপটার সঙ্গে কনক আমাদের নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। বারান্দায় চটাপট চটাপট বৃষ্টি পড়ছে। টিনের চালে টুং-টাং শব্দ হচ্ছে। মনে হয় শিল পড়ছে। মাতামহ বললেন, অকৃতজ্ঞ দুনিয়া, শোবে এক জায়গায় দুধ দেবে আর এক জায়গায়।
কাপড় কোঁচাতে কেঁচাতে কনক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে, সে আবার কী?
ওই যে গোরুটা। নীচে শুয়ে আছে। দুধটুকু দিয়ে এসেছে মালিককে।
থাকলে কী করতেন?
একবার চেষ্টা করে দেখতুম।
পটাং পটাং করে শিল পড়ছে। ন্যাপথলিনের বলের মতো বারান্দার মেঝেতে লাফালাফি করছে। শিল পড়ছে শিল। আধ-কোচানো কাপড় মেঝেতে ফেলে রেখে কনক ছুটল। দু’জনে নিচু হয়ে হয়ে শিল কুড়োচ্ছি আর মুখে পুরছি। বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগছে। এক-একটা শিল পড়ে পিংপং বলের মতো লাফিয়ে উঠছে। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
এই যে এই একটা। এই আর একটা। এটা কত বড়! তুমি নাও, তুমি নাও।
বয়েস, পরিবেশ ভুলে, দু’জনে ভীষণ ব্যস্ত। পেছনে পেছন ঠেকে যাচ্ছে। মাথায় মাথা ঠুকে যাচ্ছে। বাতাসের আর্দ্রতায় কনকের সুন্দর মুখ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। টাটকা-ফোঁটা ভিজে গন্ধরাজের মতো। এবার কিন্তু সত্যিই আমি ভালবেসে ফেলব। তারপর যা থাকে বরাতে। কিন্তু ওই সাধিকা যে বলে গেলেন, কখনও কাউকে ভালবাসার চেষ্টা কোরো না, কাউকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা কোরো না। সে চেষ্টা তো আমি একবারও করিনি মা। আমার মতো বোকচৈতন পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকেই তো ভালবেসে বেকুব হতে পারে। তাতে কার কী যায় আসে! মূর্খরা ভালবেসে মরে। চালাকে কাজ গুছোয়।
মেসোমশাই এতক্ষণ ভেতরের ঘরে মুকুকে নিয়ে বোধহয় ব্যস্ত ছিলেন। কখন পেছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন আমরা কেউই লক্ষ করিনি। বেশ রাগরাগ গলায় বললেন, কনক, তুমি কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছ। একেই তোমার সেপটিক টনসিল, হঠাৎ ঠান্ডা লেগে গেলে তোমার আর কী বলল, বিপদে পড়ব আমি।
কনক উঠে দাঁড়াল। বারান্দার আলোটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। ঝোড়ো বাতাসে তার দুলে উঠলে আলো কাপে। নিবেও যেতে পারে। কনকের ধারালো চোখে কেমন যেন একটা ছায়া নেমে এল। আমি জানি অভিমান কাকে বলে। মন কীভাবে টসটসে হয়ে ওঠে। দরজা খুলে মানুষ কীভাবে জগতের বাইরে ছিটকে চলে যায়। আমার পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে কনক ভেতরে চলে গেল। পেছনের দিকে গোড়ালির কাছে লেসের কাজ করা সায়ার অংশ ভিজে গেছে। সে যুগের ঋষিরা কত সাধারণ কথা কেমন অসাধারণ করে যুগের এপারে ওভার বাউন্ডারি করে দিয়ে চলে গেছেন। প্রথম বয়সে মেয়েরা পিতার সম্পত্তি, তারপরই স্বামীর। মেসোমশাই মানুষটি তেমন সহজ সরল নন। অহংকারের পুরিয়া।
মাতামহ চেয়ারে চুপ করে বসে আছেন। ইচ্ছে থাকলেও নিজের ডেরায় ফিরে যাবার উপায় নেই। বেশ ঝেপে বৃষ্টি এসেছে। মেসোমশাই আবার ভেতরের ঘরে চলে গেছেন। মুকুকে পড়াতে। বসেছেন। মেয়েকে প্রেমাদ রায়চাঁদ করে ছাড়বেন। কনক বকুনির ধাক্কা সামলে উঠেছে। আমার। মতো ওর ঠোঁট বেশিক্ষণ ফুলে থাকে না। সহজেই সামলে নিতে পারে। মেয়েদের তা না হলে তো চলবে না। প্রথম জীবনে পিতাকে সামলাও, শেষ আর মধ্যজীবনে স্বামীকে খেলাও। মাছ ধরার মতো। সুতো ছাড়ো আর সুতো টানো। আমার আর কতটুকু জ্ঞান। চার পাশে যা দেখছি আর কী! মেয়েছেলে যদি খেলোয়াড় না হয় তার অশেষ দুর্গতি। ওই জবা, জবার মা, মা কি না সঠিক বলতে পারব না, জবার মাসি, মাসিই হবে, দু’জনকে প্রায় একই রকম দেখতে, ওদের মতো হলে সুখের শেষ নেই। সুখেন সব জানে। নিজেও মাঝে মাঝে দেখি তো। এই তো সেদিন! দুপুরবেলা বাড়িতে বোধহয় দুই মাতব্বরের কেউই ছিল না, যে ছেলেটাকে ওরা পিসতুতো ভাই বলে এতকাল চালিয়ে আসছে, সেই ষণ্ডামার্কাটা জবাকে পাঁজাকোলা করে বারান্দায় গোল হয়ে ঘুরছিল। কী খেলা কে জানে? সে জিনিস সিনেমা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। দুপুরবেলা সব কাজ ফেলে এক মদ্দা সোমত্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে মরছে। নাও বোঝে ঠ্যালা। কে বাবা সেই উপদেশ মনে রাখছে, ওরে দাগ রেখে যা, দাগ রেখে যা। উলটো বুঝলি রাম! তাবৎ মানুষ চরিত্র দাগবাজ করে পস্তে মরছে। মেসোমশাই কি আর সাধে গোঁফ পাকিয়ে তেড়ে এসেছিলেন! কনক হয়তো আমাকে গ্রাহ্যই করে না। কিন্তু আমার চালচলন তো দেখতে হবে। ফোঁস করে ছোবল মেরে দিলে কে সামলাবে। মানুষ তো আর ঢোঁড়া সাপ নয়। খড়ম মার্কা কেউটে। মেয়ে আমার নীলবর্ণ হয়ে যাবে। ভালবাসার ছোবল আর বাঘের কামড় কোনওটাই কম যায় না। আঠারো ঘা।
জানলা ফাঁক করে কনক এতক্ষণ বৃষ্টি দেখছিল। গাছপালা সব জবুথবু হয়ে ভিজছে! একদল দৌড়বীরের মতো বৃষ্টি রাস্তার ওপর দিয়ে ধর ধর করে দৌড়েই চলেছে। ছোটার যেন শেষ নেই। পাল্লা বন্ধ করে কনক মাতামহর কাছে সরে এসে বললে, কী, চা খেতে ইচ্ছে করছে?
মাতামহ সুবোধ বালকের মতো মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।
পাঁপড়ভাজা।
মেসোমশাই যে-ঘরে বসে মুকুর সঙ্গে তর্কশাস্ত্র নিয়ে ধস্তাধস্তি করছেন সেই ঘরের দিকে উঁকি মেরে ভয়ে ভয়ে বললেন, বুডোর খাইখাই দেখে তোমার বাবা যদি রেগে যান!
কনক হেসে বললে, বা রে, রেগে যাবেন কেন?
আমতা আমতা করে মাতামহ বললেন, তা ছাড়া জামাইটা বাইরে এই দুর্যোগে কোথায় এখন ভিজছে কে জানে? আমরা বেকারের দল মজা করে চা-পাঁপড় খাব, আর সে বেচারা ভিজে জাব হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি আসবে। সেটা কি ভাল দেখাবে নাতনি!
নীচে একটা হ্যাটহুট শব্দ শোনা গেল। যাক পিতৃদেব বেশি না ভাবিয়েই ফিরে এসেছেন। প্রকৃতির কাছে হেরে যাবার মানুষ তিনি নন। মাঝে মাঝে গর্ব করে বলেন, আমি একটা ট্যাঙ্ক। এমন কোনও শক্তি নেই আমাকে থামিয়ে রাখতে পারে।
পিতার গলা আবার শোনা গেল, দুধ খাবে একজন, আর গোবরে মাখামাখি হবে আর একজন। ব্যাটা, এটা তোমার মামার বাড়ি?
মাতামহ আনন্দে আটখানা, ঠিক বলেছে, ঠিক বলেছে। চলো চলো আমরা যাই। গোবরকুণ্ড থেকে উদ্ধার করে আনি।
সামান্য গোলমাল, তাইতেই মেসোমশাই বিরক্ত। তুমি পড়ো তুমি পড়ো, বলতে বলতে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা মানুষ বটে! যাই বলো বাবা, বেশ স্বার্থপর! কনক কিন্তু একেবারে অন্যরকম। দু’জনের তফাত একেবারে উত্তরমেরু দক্ষিণমেরু। কনক নীচে নেমে গেল। আমরা দুজনে সিঁড়ির মাথায় বৃষ্টিধৌত বীরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে স্থির দণ্ডায়মান।
মারাত্মক কিছু একটা সিঁড়ির দু’পাশের দেয়ালে ঠকাস ঠাস করে ধাক্কা খেতে খেতে ওপরে উঠছে। পিতা কি শেষে বর্ম শিরস্ত্রাণ পরে ফিরে এলেন! কিছুই বিশ্বাস নেই। সব পারেন। ধনুকের মতো কী একটা ঘাড়ে করে উঠছেন। পেছনে কনক। একেবারে বাধ্য মেয়ে। মেসোমশাইয়ের চেয়ে আমার পিতার সঙ্গে যেন বেশি মানিয়েছে।
মাতামহ বললেন, বাঃ বাঃ, বেশ মানিয়েছে হে। মহাভারতের পাতা থেকে যেন গাণ্ডীব ধারণ করে উঠে এলে! বস্তুটা কী গো! কোথাও হরধনু ভঙ্গের কমপিটিশন হচ্ছিল নাকি আজ?
একটা দিক কনকের কাঁধে। জিনিসটাকে ধীরে ধীরে দেয়ালে ঠেসিয়ে রেখে পিতা কনকের পিঠে দু’বার তারিফের চাপড় মেরে বললেন, তুমিই হলে রিয়েল কর্মী। আর এঁরা হলেন মহামান্য দর্শক। ন্যাজ নাড়েন শিকার ধরেন না। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? হরধনু ভঙ্গ! তা হলে তো একটি সীতাও আসত বুড়ো রামচন্দ্রের পেছন পেছন।
মাতামহ গ্রাহ্যই করলেন না। গীতার মহাপুরুষ। আক্রমণ অনাক্রমণে স্থির, অচঞ্চল। তিনি সেই যন্ত্রের ছিলেতে আঙুলের টুসকি মারলেন। ব্যাঙাও ব্যাঙাও করে শব্দ হল। বাঃ যন্ত্রটি বেশ তো! দক্ষিণ ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে জমবে ভাল। ইল্লেহেহে কুড়হুহু।
আপনার সংগীতের সঙ্গেও মানাবে ভাল। তবে বাজাতে পারবেন না। এ চালাতে হলে ষাঁড়ের ডালনা খেতে হবে বছর দুই।
মাতামহ বললেন, তোব তোবা, তা হলে আনলে কেন?
কনক বললে, মেসোমশাই, এটা তুলোধোনা যন্ত্র না?
আঃ ঠিক ধরেছ। ভেরি ইনটেলিজেন্ট, ভেরি ইনটেলিজেন্ট। তোমার মতো একজন কেউ আমার পাশে থাকলে সংসারে ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতুম।
পিতা ঘরে ঢুকলেন। হাতে একটা হাফ মুগুর। ওইটা দিয়ে তাতে আঘাত করলে ব্যাঙাও ব্যাঙাও করে শব্দ হয়। ছটফট ছটফট করে চার পাশে তুলো লাফাতে থাকে। শৈশবে বাড়ির বিশাল ছাতে ধুনুরি এসে বসলে আমাদের উত্তেজনা বেড়ে যেত। মুগুরটাকে অনেকটা মিনারের মাথার মতো দেখতে। কনক হাত থেকে নিয়ে ঘরের এক পাশে সাবধানে রেখে দিল। এই প্রথম চিন্তাটা মনে। উঁকি দিয়ে গেল, কনক যদি আমার মা হয়ে এই সংসারে বেশ আঁকিয়ে বসে, তা হলে কেমন হয়? মন্দ কী? বয়েসে একটু ছোট হবে। তা হলেও, মা ছোট হলেও মা। ছেলে হিসেবে আমি একটু বেমানান হয়ে যাব। এই যা সমস্যা! ট্রেনের টিকিট চেকার সেই সুখেনকে ধরেছিল। হাফ টিকিটে ওপরের বাঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে বোম্বাই যাচ্ছিল। চাঁদরের বাইরে পা বেরিয়ে পড়েছে। চেকারের হাতে টিকিট,নজর পায়ের দিকে, এতনা মোটা গোড়, এতনা লম্বা বাল, হাফ টিকিট? সুখেনের দাদা বলছেন, মোটা হুয়া তো কেয়া হুয়া, গোদ হুয়া সাহাব। লোকে হয়তো বলবে, আহা মেয়েটার কী ভাগ্য, একেবারে রাজহাঁসের মতো ছেলে নিয়ে চলেছে। ধেড়ে গলায় যখন ম্যা ম্যা করে ডাকে তখন প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যায়? কেন যে এসব চিন্তা আসছে। বড় পাপ ঢুকেছে মনে। হিংসে, অভিমান, লোভ, কামনা, সব মিলেমিশে মন নয় তো, জগাখিচুড়ি।
মাতামহ বললেন, হঠাৎ তুমি এই যন্ত্রটা কিনতে গেলে কেন হরিশঙ্কর! ভাল দেখে একটা তানপুরা কিনলেই পারতে!
ভিজে জামা খুলতে খুলতে পিতা বললেন, তাতে তো আর তুলো ধোনা যেত না!
তুমি তুলো ধুনবে? সব ছেড়ে তোমার এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কেন?
সংসারে সবকিছু শেখা দরকার। সেলফ হেলপ। পরমুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকব কেন? নিজের কাজ নিজে করে নোব। সংসারের সাশ্রয়।
এটাও কি তুমি ডিসপোজাল থেকে কিনলে?
আজ্ঞে না। দেখি কী তুলো আনলেন? ভিজে যায়নি তো!
মাতামহ মাথা নিচু করলেন। এইবার সেই মুহূর্ত এসেছে। জীবন-মরণ সমস্যা। আমতা আমতা করে বললেন, তুলে আনা হয়নি হরিশঙ্কর।
কেন? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? দিবানিদ্রা?
না না, সে এক অলৌকিক ব্যাপার।
তার মানে? তুলো উড়ে গেছে?
না না, সে এক মহা অলৌকিক ব্যাপার।
আপনাদের সবেতেই দেখছি অলৌকিক ব্যাপার! থাকেন লৌকিক জগতে, কাজকারবার সব অলৌকিক জগতে! মজা তো মন্দ নয়। আপনারা আমার সব প্ল্যান বানচাল করে দিলেন। বললেই পারতেন, পারব না।
কনক বললে, মেসোমশাই, এখন আর মেজাজ খারাপ করবেন না। পাঁপড়ভাজা আর চা খান, তুলোর চিন্তা পরে করা যাবে।
তুমি বলছ বটে, তবে আমার সমস্ত পরিকল্পনা একেবারে ভেস্তে গেল।
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। এই ঝড়ের রাতে কার আবার অভিসার! দরজা খোলা। আর বন্ধের শব্দ। এই বাড়িতেই কেউ এলেন। গাড়ি চেপে কার আগমন? সুরেলা গলা উচ্চগ্রামে খেলে গেল, পিন্টু, পিন্টু।
মাতুল এসেছেন। আরে বাপ রে! মহামান্য অতিথি। তটস্থ হয়ে থাকতে হবে। পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। আসুন আসুন। অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে কাছা কেঁচা খুলে যাবার মতো অবস্থা। সেই পরিচিত সুবাস সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। সেই পরিচিত জুতোর শব্দ। সেই ফিনফিনে শৌখিন মানুষটি এবার দৃশ্যমান। আর একটু ফরসা হলে মনে হত ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সাহেব। আলো পড়ে বুকের একসার হিরে-বসানো বোম জলতরঙ্গের মতো হাসছে। কখনও এটা কখনও ওটা। মাতুলের পেছনে আর এক ভদ্রলোক। যে-কোনও বিয়েবাড়িতে এমন কাঠামোর মানুষ প্রায়ই দেখা যায়। হৃষ্টপুষ্ট। লাগাম ছাড়লেই ফচকেমিতে ভেসে যাবেন। সমস্ত মহিলাই এঁর বউদি। চিরন্তন ঠাকুরপো। ঝুলনতলার নাচের তাবুতে লোকটি কনুইয়ের খোঁচা মেরে বলেছিল, মাগির রস আছে। মহিলারা এই মানুষটিকে অবশ্যই বলবেন, মিনসের রস আছে। গা থেকে সেই পরিচিত গন্ধ বেরোচ্ছে। পুরুষালি ঘাম, সিগারেট আর সেন্ট। ব্যাকব্রাশ চুল। যৌবনের ব্রণ মুখে দু-চারটে ক্ষত রেখে চলে গেছে। এমন মানবের সঙ্গে মেশার আগে মহিলাদের খতিয়ে দেখা উচিত, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়! অকারণে মুখে যে-হাসি লেগে আছে, সে হাসি দেখলেই পিতা বলতেন, উজবুকের মতো হাসছ কেন বলো তো? পৃথিবীটা কি এতই আনন্দের জায়গা।
মাতুল আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন, সব ঠিক আছে তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আবহাওয়া অনুকূল না প্রতিকূল?
আলেকজান্ডার সেই পুরুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না! তুমি কীরকম ব্যবহার প্রত্যাশা করো? মাতুলের প্রশ্নের উত্তর আমাকে আর দিতে হল না। পিতা পেছন থেকে আলেকজান্ডারের কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন করলেন, তুমি কীরকম আবহাওয়া চাও?
মাতুল পুরুর মতোই বীর দর্পে বললেন, মৃদু এবং মোলায়েম। ময়েন দেওয়া লুচির মতো।
তৈরি করে নাও।
এসে যখন পড়েছি, অনুমতি পেলেই হাত লাগাব। বেতলব দে তো মজা উস-র্মে সিবা মিলতা হৈ। বোহগদা জিস-কো নহ হো খু-এ সবাল, আচ্ছা হৈ। না চাইতেই যদি দেন তো তার স্বাদই আলাদা; সেই তো শ্রেষ্ঠ ভিখারি, হাতপাতার অভ্যেস হয়নি যার।
আহা গালিব দিয়ে শুরু করলে! সব মাটি করে দিলে। বেশ একটা রাগ-রাগ ভাব আসছিল। তোমাকেও ফায়ার করার ইচ্ছে হচ্ছিল।
আমাকে? আমার অপরাধ?
তোমার অপরাধ? তোমার উপেক্ষা। এই ঝড়ের রাতে পারিবারিক হাড়ি খুলে পচাই বের করতে চাই না। আজ হল শ্যাম্পেন নাইট। তুমি স্রেফ তরে গেলে গালিবের জন্যে, তরে গেলে এই ভদ্রলোকের জন্যে।
ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। প্রতাপ রায়। আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। অসাধারণ ভাল তবলা বাজায়।
প্রতাপ রায়ের কাণ্ডজ্ঞান আছে। প্রণামটি চট করে সেরে নিল। মাতুল সাধারণত কারুর কাছে। মাথা নিচু করেন না। তবে ভগিনীপতির কাছে অহংকার খাটো করার অভ্যাস বজায় রেখেছেন।
পিতা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হঠাৎ এলে কেন? তুমি তো সহজে আসো না। তোমার জগৎ তো আলাদা। এ কি তোমার মতিভ্রম!
মাতুল বললেন, ধরেছেন ঠিক। পৃথিবীকে আপনি যতটা চেনেন, আর কেউ ততটা চেনে না। আপনারই কথা, ধোঁয়া দেখলেই বুঝবে আগুন। আমরা এসেছি আপনাদের দুজনকে ধরতে।–
হঠাৎ। নিশ্চয়ই স্বার্থ আছে।
অবশ্যই।
টাকাপয়সার ব্যাপার?
অবশ্যই।
তা হলে পরিবেশ বিষিয়ে ওঠার আগে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক।
প্রতাপ রায় ঠিক তালে ছিলেন। কনককে দেখেই বললেন, এক গেলাস জল খাওয়াবে ভাই।
সুন্দরীরা বড় তৃষ্ণার্ত করে তোলে বুঝি!
১.১২ রতনে রতন চেনে, ভালুক চেনে শাঁকালু
পাঁপড়ভাজা আমি খাই না। ও আপনি নিয়ে যান। চিরকালের নাক-তোলা মাতুল, হাত নেড়ে, মাথা নেড়ে ভয়ংকর এক ভঙ্গি করলেন। যোড়শীর বদলে বৃদ্ধা তেড়ে এলে মানুষ এমন ছিটকে যেতে পারে। বর্ষার রাতে মুচমুচে পাঁপড়ে এমন বিতৃষ্ণা বড়ই বেমানান। কনক হকচকিয়ে গেছে। মাতুল আবার আপনি বলে বয়েস আর ব্যবধান দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পিতা বললেন, ও হ্যাঁ, তুমি তো আবার চপকাটলেট ছাড়া অন্য কোনও মধ্যবিত্ত খানা পছন্দ করো না। পোস্ত, বড়ি, মুড়ি, পাঁপড়।
আজ্ঞে না, তা কেন? পোস্ত দিয়ে পরোটা আমি ভীষণ ভালবাসি। পাঁপড় কেমন যেন বুড়োটে খাবার।
তাই নাকি? তা হলে তুমি বিস্কুট খাও, কটেজ ক্রিম।
বিস্কুট তো রুগিরা খায়।
ও, রুগিরা খায়!
পিতা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছেন। শ্যালক একের পর এক ফাঁকড়া বের করছেন। সামান্য খাওয়া নিয়েও মানুষের সংসারে কত ফ্যাচাং। এ ব্যাপারে মাতামহ আমার সোনারচাঁদ ছেলে। কোনও বায়নাক্কা নেই। একেবারে কোণের দিকে একটা বেতের চেয়ারে বসে আপন মনে একা একা পাঁপড়। চিবোচ্ছেন। যেন এ জগতের মানুষই নন। মা ছোট্ট ছেলেকে ধামিতে মুড়িমুড়কি দিয়ে বসিয়ে দিয়ে গেছেন যেন! শিশু ভোলানাথ খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, পাখি দেখছে, হাত নাড়ছে। চোখে কেবল মোটা করে কাজল আঁকা নেই, কপালে ধেবড়ানো টিপ নেই। কনকও ভীষণ বিপদে পড়েছে। এক পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে?
পিতা বললেন, তা হলে তুমি কেক খাও।
না না, কেক দাতে বড় জড়িয়ে যায়, জিবে বিচ্ছিরি একটা কোটিং পড়ে যায়।
তাই নাকি? তুমি টুথব্রাশ দিয়ে খাও। আমি তোমাকে নতুন টুথব্রাশ দিচ্ছি। এক কামড় করে খাও আর ব্রাশ দিয়ে ঘষে দাও।
সেটা একটা পাগলামো হবে।
পাগল তো পাগলামি করবেই। সেইটাই তো তার স্বভাব! বেশ, তুমি তা হলে ওমলেট খাও। কনক, তুমি ওমলেট করে নিয়ে এসো তো!
মাতুল বললেন, হ্যাঁ ওমলেট চলতে পারে, তবে পেঁয়াজ ছাড়া। আর মাখন দিয়ে নরম করে ভাজা।
কনক পাঁপড় নিয়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছে, প্রতাপ রায় বললেন, আমাকে দিয়ে যাও। আমার খোলটা অনেক বড়।
কনক পাঁপড়ের ডিশটা প্রতাপ রায়ের সামনে কোনওরকমে নামিয়ে রেখে পালিয়ে বাঁচল। মেয়েরা মানুষ পড়তে পারে। চোখের ভাষা, মুখের মুচকি হাসি। বহু যুগের অ্যানিম্যাল ইন্সটিংক্ট। প্রতাপ রায় যেন রেডিয়ো ট্রান্সমিটার। যখন যেখানেই থাকুন না কেন, লাগাতার বিপ বিপ করার জন্যেই জন্মেছেন। আমাদের ভোমলা পাগলা। ডাকলেই বলবে, কী করতে হবে? ওই মেয়েটাকে চুমু খেতে হবে। সন্ধ্যা শিশি হাতে কেরোসিন তেল আনতে যাচ্ছে, ভোমলা দৌড়োল পেছন পেছন। ভোমলার পেছন পেছন দৌড়োলুম আমরা, ওরে, না-রে, না-রে, তোকে রুটি খাবার জন্যে ডেকেছিলুম। তিন দিন উপোস করে আছিস।
পিতা বললেন, তোমার স্বভাবের সাত খুন মাপ হয়ে যায়, তোমার একটি মাত্র গুণের জন্যে। সে হল তোমার সংগীত। তোমার বড়লোকি চালের জন্যে যখনই ঘৃণা করতে ইচ্ছে করে তখনই কানে ভেসে আসে তোমার সুর, কৈসে গুজার গই হায় জওয়ানি। সেই ছেলে, সেই এতটুকু ছেলে, স্কুলে আমার কোলে বসে গান গেয়েছিলে বাগেশ্রীতে, কোলে তুলে নে মা কালী। তাবড় তাবড় গুণী সেদিন কাত হয়ে গিয়েছিল। সময়, সময়! সময় কীভাবে চলে যায়। ব্রিজের ওপর দিয়ে যেন মেল। ট্রেন ছুটছে।
মেসোমশাই ওঘরে বাঘের মতো চিৎকার করে উঠলেন, মূর্খ! সেই সকাল থেকে চেষ্টা করছি, কিছুতেই তোমার মাথায় ঢুকছে না, শি অ্যাস, শি গোট। কোতের পজিটিভিজমের সারকথা কী? চিন্তাধারা পরপর তিনটি ক্রম পার হয়ে এগিয়েছে। কী কী? আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক। বলো, বারবার বলো। মুকু ঘুম-জড়ানো গলায় বলতে লাগল, আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক।
মাতুল এতক্ষণে জিজ্ঞেস করলেন, এঁরা কারা?
এঁরা হলেন মেজদার ভায়রাভাই আর তার দুই মেয়ে।
ও, এঁরাই তো সেই রেঙ্গুনে ছিলেন। ইভ্যাকুয়েশানের সময় আরাকানের জঙ্গলে স্ত্রী মারা গেলেন? আচ্ছা সব বড় বড় হয়ে গেছে। উনি আর বিবাহ করেননি?
কোনও সেনসিবল মানুষ দ্বিতীয় পক্ষ গ্রহণ করে? তোমার বাবা, আমি, ওই ভদ্রলোক। ইচ্ছে করলে আমরা আবার সংসারে ঢুকতে পারতুম। স্রেফ তোমাদের মুখ চেয়ে আমাদের এই স্যাক্রিফাইস। তোমরা এর দাম দিতে পারবে?
কেন পারব না?
ওই তো তার প্রমাণ। তোমার বৃদ্ধ পিতা গত তিন দিন অনাহারে ছিলেন। তুমি জানতে? তোমার স্ত্রী জানত?
অনাহারে থাকাটা ওনার একটা বিলাসিতা। কৃচ্ছসাধন। হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ। মনে রেখো, তোমাদেরও দিন আসবে। সব, সব শোধ করে দিয়ে যেতে হবে।
কনক ওমলেট নিয়ে এল। বেশ একটা খিদেখিদে গন্ধ বেরোচ্ছে। প্রতাপ রায় হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিতে নিতে বললেন, উমার ভূমিকায় সুন্দর মানাবে। পরদায় একেবারে নিউ ফেস। ফেটে যাবে বুঝলে? একেবারে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।
কনক অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে আবার কী রে বাবা! প্রতাপ রায় নতুন এক চাল ছেড়েছেন। ভেতরে বেগ এসেছে। মনের চালে শৃগালের হাহাকার। কনক, কনক। কোন মানুষ যে কখন কীভাবে পাগল হয়ে যাবে, কেউ জানে না। নিজেরও জানা নেই। ঘোড়ার মতো নাক ঘেঁদা করে লাগাম পরিয়ে রাখতে পারলে ভাল হয়। চার পা তুলে কখন যে চি-হি-হি করে উঠবে
মাতুল বললেন, তোর চোখ আছে প্রতাপ। বাংলা স্ক্রিনে নতুন নায়িকার বড় অভাব। এইসময় বাজারে ছাড়তে পারলে একেবারে ক্যান্টার হয়ে যাবে।
পিতা বললেন, তোমাদের আলোচনা কোন পথে চলেছে? পরদাফরদা কী বলছ? সিনেমা নাকি?
ধরেছেন ঠিক।
মাতামহ অন্ধকার কোণে স্প্রিংয়ের মানুষের মতো মোড়া থেকে ছিটকে উঠলেন, তোমাকে আমি ত্যাজ্যপুস্তুর করব। তোমার বায়োস্কোপ করা আমি ঘুচিয়ে দোব। এই কাপ্তেনটি কে? হাতি-ছাড়া বিশ্বকর্মা! মুখ দেখলে মনে হয় রামবাগানের আড়কাঠি।
মাতামহ বাঘের মতো এগিয়ে এসেছেন। পাঁপড়ের তেলহাত মাথার চুলে বুলিয়েছেন। আলো পড়ে পাকা চুল জরির মতো চিকচিক করছে। মেসোমশাই মুকুকে চড়া গলায় দর্শন বোঝাচ্ছেন, যদি ভূতমাত্রের হিতসাধন ধর্ম হয়, তবে একজনের হিতসাধন ধর্ম আবার একজনের হিতসাধন অপেক্ষা দশজনের তুল্য হিতসাধন অবশ্য দশগুণ ধর্ম। গুড অফ দি গ্রেটেস্ট নাম্বার। বাপস, বাংলা বটে। মুকু পরীক্ষার আগেই শুকিয়ে মরে যাবে। এরই মধ্যে কেমন যেন বাসি ফুলের মতো চেহারা হয়ে গেছে। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে ‘মিল’, ‘মিল’, ‘বেনথাম’, ‘বেনথাম’ বলে কেত পাড়ে।
মাতামহের আক্রমণে প্রতাপ রায়ের মুখের সেই অদ্ভুত হাসি মিলিয়ে গেল না। ওমলেট চিবোতে চিবোতে নির্বিকার মুখে বললেন, জ্যাঠামশাই, কেন যে আপনি আমাকে দেখতে পারেন না! সেদিন আপনি আমাকে খড়ম তুলে তাড়া করলেন। আপনার রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে।
ওহে ছোকরা, ভুল আমার হচ্ছে না। তুমি সর্পই, মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না। ঘাটের মড়া। মাতুল বেশ চড়া গলায় বললেন, বাবা! বয়েসের চেয়ে আপনি বেশি বাতুল হয়ে পড়েছেন। আনকালচার্ড ফুল।
ঘরে যেন গ্রেনেড ফাটল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ধোঁয়ায় চারপাশ আচ্ছন্ন। চতুর্দিকে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। দেয়ালে ঘড়ি চলছে ঠাস ঠাস শব্দে। মুকুদের পরীক্ষার পড়াও থেমে গেছে। হাত স্থির। হাঁটু স্থির। মুহূর্ত প্রস্তরীভূত। বসাকদের বাগানবাড়িতে দেখেছিলুম, পেছন দিকের বাগানে জঙ্গলের মধ্যে একগাদা স্ট্যাচু। নগ্ন রমণী, স্নানরতা রমণী। দাড়িঅলা নগ্ন এক বৃদ্ধ ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গিতে স্থির। বছরের পর বছর রোদে আর জলে পড়ে থেকে মৃতের মতো বিবর্ণ। ভূতের মতো ভীতিপ্রদ। ঘরটাকেও এই মুহূর্তে বসাকদের পেছনের বাগানের মতো মনে হচ্ছে।
পিতৃদেব ধীরে ধীরে চায়ের কাপ টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। এত ধীরে যে সামান্যতম শব্দও হল না। নৈঃশব্দ্যের মহড়া চলেছে। মাথা পিঠের দিকে সামান্য হেলে আছে। ফলে চিবুক সামনের দিকে সমকোণের চেয়ে একটু উঁচু। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। ঝাউয়ের শাখায় একঝলক সমুদ্রের বাতাসের মতো। এতটুকু শব্দ না করে চেয়ারটাকে দুহাতে পেছনে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাতুলের থেকে বেশ সম্মানজনক দূরত্বে সরে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। ঘরে যেন চিতাবাঘ ঘুরছে।
চালচলনে এইবার সামান্য গতি লক্ষ করা গেল। বুকের কাছে হাত জোড় করে বললেন, আচ্ছা, তোমরা তা হলে এবার এসো।
মাতুল সাহস করে বললেন, তাড়িয়ে দিচ্ছেন?
অফকোর্স। আমাদের সামনে বসার তোমার কোনও অধিকার নেই। তুমি হলে বড়লোকের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে। এ বাড়িতে তুমি আর কখনও না এলে আমি যারপরনাই সুখী হব।
হঠাৎ আপনার এই ভাবান্তর?
আমার আচরণের জবাবদিহি আপনার কাছে করতে আমি বাধ্য নই। আপনারা আসতে পারেন।
আপনি হঠাৎ এত রেগে গেলেন কেন?
হঠাৎ! সেই বেদের যুগ হলে তোমার মতো ইয়ার এতক্ষণে ভস্ম হয়ে যেত। গুরুজনদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তাই তো তুমি শেখোনি। উনি আলকালচার্ড ফুল, তুমি কী? তুমি হলে কালচারড মাঙ্কি। ক্লিয়ার আউট। ইমিজিয়েটলি ক্লিয়ার আউট।
উনি কেমন মানুষ আপনি কিছুই জানেন না। না জেনে নিজের অপরাধের বোঝা বাড়াচ্ছেন। হি ইজ ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। কঞ্জুষ দি গ্রেট, মাছির পিছন টিপে গুড় বের করেন।
শোনো শোনো, সক্রেটিস দি গ্রেট, উনি কেমন মানুষ আমাকে চেনাতে এসো না।
মাতামহ একচাকলা হাসি ছাড়লেন। সরতে সরতে কখন পিতার পাশে সরে এসেছেন। মুখ দেখলে মনে হবে ফোর্টের র্যামপার্টে বুক ঠুকে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশেই বীর গোলন্দাজ।
মেসোমশাই এতক্ষণে পাঠশালা থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করেছেন। বোধহয় মনে হয়েছে ‘হোয়েন রোম বার্নস, নিরো ফিডলস’ গোছের ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। মানুষটি একটু একবগ্ন হলেও গোষ্ঠীপতি হবার গুণ আছে। সেই বিধুজ্যাঠাকে কেমন তেড়ে গেলেন। আইনের রাজা। কিছুই তো তেমন জানা ছিল না। এইমাত্র পিতার কাছে আরও কিছু অতিরিক্ত পরিচয় পাওয়া গেল। জীবন একেবারে বেড অফ রোজেস ছিল না। রেঙ্গুন থেকে ভারতের হাঁটাপথে আরাকানের জঙ্গলে স্ত্রীকে হারিয়েছেন। এতক্ষণে বুঝেছি কেন একটু একবগ্না। কাপড় দুভাজ করে লুঙ্গির মতো পরেছেন। ভুড়ি বেড়েছে, সেই মাপে গেঞ্জি ছোট হয়েছে। কষির ওপর পেটের অংশ টুকি করছে। মাঝখানে সিথি করে কুচিকুচি চুল পেতে আঁচড়ানো। দুপুরে ছোটমেয়ে পিতাকে আদর করে সাজিয়ে দিয়েছে। অকৃতজ্ঞ পিতারা সেসব কথা লেখাপড়ার সময় বেমালুম ভুলে যান। মুকু বেচারার সেই সন্ধে থেকে আড়ং ধোলাই হচ্ছে।
মেসোমশাই রঙ্গমঞ্চে এবার নতুন ধরনের খেলা দেখালেন। কোনও কথা নেই। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে, ফোলাফোলা মুখে, থপথপ করতে করতে সেই রণাঙ্গন ভেদ করে উত্তরে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে বেশ তেড়ে গলা ঝাড়লেন। টিনের চাল ঝনঝন করে উঠল। এবার রিটার্ন জার্নি। উলটো রথ। সেইভাবেই তাকাতে তাকাতে ফিরে চললেন। ঘরের মাঝখান থেকেই উচ্চকণ্ঠে মেয়েকে বললেন, যতক্ষণ তোমার আয়ত্ত না হচ্ছে আজ ততক্ষণ চালাতে হবে। সে রাত একটা হোক, দুটো হোক, ভোর হোক। লাল মেঝের কালো বর্ডার বরাবর এসে বললেন, বেদান্ত বলছেন, স্বয়ে যথা দৃষ্টে, স্বপ্নে যেমন দেখা যায়, গন্ধর্ব নগরং যথা, মায়ায় দেখা দেয় গন্ধর্ব নগর। চৌকাঠে পা রেখে টাল খেতে খেতে বললেন, তথা বিশ্ব ইদং দৃষ্টং বেদান্তে বিচক্ষণেঃ। বৈদান্তিকের দৃষ্টিতে বিশ্বও তদ্রুপ। তদ্রুপ শব্দটা ইচ্ছে করেই মনে হয় অত জোরে বললেন। অনেকটা বিদ্রুপের মতো শোনাল।
মেসোমশাইয়ের আসা আর যাওয়াটা এত সুন্দর হল, লেডি ম্যাকবেথের ঘুমের ঘোরে হাঁটার মতো। আমাদের অধ্যাপক প্ল্যাটফর্মে চোখ বুজিয়ে সুব্লাড, সুব্লাড করে হাঁটতে হাঁটতে একদিন হিসাবের ভুলে দমাস করে পড়ে গিয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডের মানুষ। পড়ে গিয়ে ব্লাডি বলেছিলেন দাঁত কিড়মিড় করে। দরজাটা ভেজাতে ভেজাতে মেসোমশাই বললেন, প্রয়োজন হলে ডাকবেন হরিদা।
প্রতাপ রায় বললেন, যাঃ বাবা।
মাতুল উঠে দাঁড়ালেন, কোলের ওপর থেকে কেঁচা পাটে পাটে, ধাপে ধাপে মেঝেতে নেমে এল। ভীষণ অপমানিত হয়েছেন। দুর্দান্ত রাগী মানুষ। এমন বেকায়দায় পড়েছেন রাগতেও পারছেন না। ফরসা মুখ জবাফুলের মতো টকটকে লাল। কেঁচা ঝেড়ে হাতে ধরে বললেন, বেশ আমি চলে যাচ্ছি। আপনার নির্দেশ মনে থাকবে।
প্রতাপ রায় বললেন, বাড়ি মর্টগেজের ব্যাপারটা তা হলে কী হবে? মিনিমাম দু’লাখ নিয়ে ফ্লোরে নামতে হবে।
সে হবে। এখন জামাইয়ের তোয়াজে আছেন। বাড়িতে তো ফিরতেই হবে। মর্টগেজ ডিড তৈরিই আছে, ধরে সই করিয়ে নোব। বাড়ি বাঁধা রেখে তো আর দু’লাখ হবে না। সীমার গয়না বেচে কয়েকদিন কাজ চালাই।
মাতামহ আর্তনাদ করে উঠলেন, ওকে তোমরা ধরো। ওকে বাঁচাও। ফতুর হয়ে যাবে। সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে। আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
পিতা বললেন, উতলা হবেন না। ভাগ্যকে ধরে রাখা যায় না। It is all a chequer-board of nights and days/where destiny with men for pieces plays. উতলা হবেন না। শুধু দেখে যান।
মাতুল রাগ-রাগ গলায় বললেন, ফিমের কিছুই যখন বোঝেন না, তখন মন্তব্য না করাই ভাল। আমি পুডোভকিন হব, আমি গদার হব, আমি আইজেনস্টাইন হব। হয়ে দেখাব।
মাতামহ বললেন, এসব কী বলছে গো? আমরা ছেলেদের তো বলতুম, বিদ্যাসাগর হও, বিবেকানন্দ হও, রবীন্দ্রনাথ হও। এরা আবার কারা?
পিতা বললেন, জানো যখন কিছুই বুঝি না, তখন দয়া করে বোঝাতে এলে কেন? তুমি হয়তো আবদুল করিম হতে পারতে, গোলাম আলি হতে পারতে। একেবারে দ্বিতীয় হতে না পারলেও কাছাকাছি যেতে পারতে। তোমার ভাগ্য। ভাগ্যের ঘোড়া ছুটল বেরাস্তায়। বয়েস হয়েছে, যা ভাল বোঝে তাই করো।
আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই করব। শুধু নাম নয় অর্থও। সাত দিন হাউসফুল হলে সব টাকা উঠে আসবে। চোদ্দো দিনে টাকা ডবল, আটাশ দিনে চার ডবল।
ব্যস ব্যস, তাই করো। সেই চটে শুয়ে মুটে রাজার গল্প। সেই ফেরিঅলার গল্প। মনে নেই দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে সব ভেঙে চুরমার করেছিল। আমি তোমার কথা নয়, কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
ওল্ড জেনারেশন আর নিউ জেনারেশনে এই হল তফাত। টাকা সিন্দুকে রাখলে বাড়ে না। ছাতা পড়ে যায়। টাকা বাড়ে ব্যবসায়ে খাটালে। কোনও নন-বেঙ্গলি ব্যাবসার নামে এমন আঁতকে ওঠে না।
বাঙালির ব্যাবসা আমার জানা আছে। তোমার এটা ব্যাবসা নয়, ফাটকা।
রাজকাপুরের নাম শুনেছেন? জেমিনি গণেশনের নাম শুনেছেন?
প্রতাপ রায় বললেন, উত্তেজনায় তুই নাম গোলমাল করে ফেলেছিস। শিবাজি গণেশন। জেমিনি স্টুডিয়োর নাম। চন্দ্রলেখা করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছিল।
চন্দ্রলেখা? তুমি চন্দ্রলেখা করবে? চন্দ্রলেখা?
কথায় কথায় পিতা কিঞ্চিৎ শান্তভাব ধারণ করছিলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ফেটে পড়লেন বলে। ভিসুভিয়াসের মুখ দিয়ে লাভ বেরোয়। পিতার মুখ দিয়ে লাভার বদলে চন্দ্রলেখা বেরোচ্ছে ছিটকে ছিটকে। কেউ না জানুক, আমি জানি কারণটা। এক ঢিলে দু’পাখি মারা হচ্ছে। চারদিকে তখন চন্দ্রলেখার খুব প্রচার। সাংঘাতিক, ফ্যাবুলাস, সার্কাস, সোর্ডফাইট। কে জানত ওর মধ্যে আরও সব উঁচু উঁচু ব্যাপার আছে। আমার কথাতেই পিতা সপুত্র সেই ছবি দেখতে গেলেন। সবচেয়ে দামি আসনে দু’জনে পাশাপাশি বসে আছি। অন্ধকার ঘরে পিতা কখনও হরীতকীর টুকরো, কখনও যোয়ান, কখনও পাতলা কাগজে মোড়া লজেন্স এগিয়ে দিচ্ছেন। জিভ নানা রসে একেবারে চুর হয়ে আছে আরকের মতো। কষা থেকে মিষ্টি, মিষ্টি থেকে ঝাল, ঝাল থেকে মিষ্টি। পিতার ওপাশে একত্সর যুবতী। আমার পাশে মধ্যবয়সি একসার গোঁত্তামারা ভদ্রলোক। অবশেষে বই শুরু হল হাতির তোলা শুড়ের জল ছিটোনো দিয়ে। প্রথমটায় অত বোঝা যায়নি। বেশ চলছিল রাজারাজড়ার ব্যাপার। হঠাৎ শুরু হল ঢাকের ওপর যুবতীর নৃত্য। দক্ষিণী শরীর। যেমন নিতম্ব, তেমনি বক্ষ। চোখ ঠিকরে কোটর ছেড়ে পরদায় গিয়ে ঠোক্কর মারছে। নীচে সামনের সারির দর্শকরা নেচে নেচে উঠছে। দু-একজন চেয়ার ভেঙে পড়েও গেল। পিতা বললেন, হরি। পেছনের দর্শকরা বললেন, চপ। নর্তকীরা হঠাৎ পেছন দিকে চেত্তা খেয়ে পড়তে লাগলেন। জীবনে অমন কুচ যুগ’ দেখিনি। কাঁচুলি ফেটে ফ্যাটাস করে বেরিয়ে না পড়ে। পিতা বললেন, হরেন্ডাস। পেছনের দর্শক বললেন, চোপ। এরপর মেয়েদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে ছেলেরা, ছেলেদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে মেয়েরা চলে যেতে লাগল। মত্তপ্রমত্ত অবস্থা। এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া। চন্দ্রলেখার কেরামতি দেখে রাজা কামার্ত হয়ে, হাউমাউ করে তেড়ে এলেন। পিতা বললেন, গেট আপ। হাত ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে প্যাসেজ পার করে হলের বাইরে নিয়ে গিয়ে ফেললেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে স্রেফ দুটি কথা, আরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ, তোমার এই টেস্ট হয়েছে। মাই গড! ঠিক সেইসময় পাশ দিয়ে বোকাবোকা চেহারার এক ভদ্রলোক কাছাকোঁচা সামলাতে সামলাতে যাচ্ছিলেন, থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কী করেচে, নাক খুঁটেছে? শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে ঝাঁকুনি মেরে পিতা বললেন, বাক আপ। ধড়ফড় করে সামনে এগোতে এগোতে ভদ্রলোক বললেন, বাবা রে। পিতা হেসে উঠলেন। শেষ লজেন্সটি হাতে দিয়ে বললেন, তোমার দোষ নেই। যেমন শুনেছ তেমনি করেছ। এসব ছবি কক্ষনও দেখবে না। এসব হল নেগেটিভ পিকচার্স। ব্রেনওয়াশের জন্যে তৈরি। ক্যাপিটালিস্টদের চাল। নৈতিক ব্যাকবোন ভেঙে দিয়ে কল্পজগতের সরীসৃপ করে রাখার ষড়যন্ত্র। আর ইউ এ হিউম্যান ফডার ফর দেয়ার ক্যান? পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে একটা বাস চলে গেল ধুলো উড়িয়ে। নাকে চাপা নাকে চাপা বলে পিতা পকেটে রুমাল খুঁজতে লাগলেন। আঁধি উঠেছে আঁধি। সেই চন্দ্রলেখার নাম শুনে পিতা তো লাফাঁকেনই।
প্রতাপ রায় বললেন, চন্দ্রলেখা ভেরি সাকসেসফুল ছবি। বক্স অফিস স্ম্যাশ করে দিয়েছে। ভেরি সিম্পল ফর্মুলা। একটু বীররস, একটু রোমান্স, আর একটু সেক্স। (শেষ কথাটি বলার সময় ঠোঁটদুটো ছুঁচোর মতো সামনে উলটে এল, বাঁ চোখ ছোট হয়ে শর্টসার্কিট বাতির মতো তিড়িক করে লাফিয়ে উঠল।) সব একসঙ্গে তাল করে চিটেগুড় দিয়ে মেখে ফুরফুরে অম্বরী তামাক।
পিতা বললেন, তোমার ভূমিকাটা কী? তখন থেকে ফড়ফড় করছ! তোমার মুখ দেখলে এলিস ইন দি ওয়ান্ডারল্যান্ডের সেই চেশায়ার ক্যাটের কথা মনে পড়ছে, এ গ্রিন উইদাউট এ ফেস। কোনও কোনও প্রাণী শাঁকালু দেখলে ওইভাবে হাসে। তোমার এই বোকা সেন্টিমেন্টাল বন্ধুর টাকাকে শাঁকালু ভেবে হাসিটা মুখে পার্মানেন্ট হয়ে গেল নাকি?
পিতার কাঁধের পাশ থেকে মাতামহ বললেন, ওটা হল ফেউয়ের হাসি।
প্রতাপ রায়ের অসম্ভব সহ্যশক্তি। এতটুকু না রেগে বললেন, বড় বড় গাইয়েদের সঙ্গে তাল। মেরে ফিরি তাই হাসিটা মুখে লেগেই থাকে। এই ছবি করার ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনও ভূমিকাই নেই। পিতৃদেব কিছু টাকা, একটা বাড়ি, বিলিতি একটা গাড়ি রেখে গেছেন, বিয়েথা করিনি, ওস্তাদ মেরে বেড়াই, সেই টাকারই কিছু শ্রাদ্ধ হবে। শাঁকালু আমি দেখিনি, শাঁকালু দেখেছে আপনার শ্যালক।
পিতা এবং মাতামহ দু’জনেই একেবারে থ হয়ে গেলেন। এও সম্ভব। জগতে তোক চেনা ভার মুখ দেখে। মাতুল বললেন, প্রতাপ, তুই শেষে আমাকে ভাল্লুক ভাবলি?
ওঁরা যে আমাকে ভাল্লুক ভেবেছিলেন?
পিতা বললেন, এমন একটা প্রতিভা ভুলপথে চলে নষ্ট হয়ে যাবে, তুমি বারণ করতে পারছ না?
করেছিলুম। শুনবে না। ব্যাপারটা জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে। হতে চেয়েছিল মিউজিক ডিরেক্টর। ল্যাং মেরে দিয়েছে। সেই থেকে গোঁ চেপেছে, নিজে ছবি করবে, সেই ছবির মিউজিক ডিরেক্টর হবে। নৌশাদ ফৌশাদ সব তলিয়ে যাবে।
পিতা হা হা করে প্রাণখোলা হাসি হেসে চেয়ারে বসলেন। আরে, বোসো বোসো। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ছে হে।
মাতুল ইতস্তত করছেন। উঠে যখন পড়েছেন তখন বসা কি আর উচিত হবে। হাসি শুনে দর্শন ছেড়ে মেসোমশাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে?
আপাতত। বিনয়দা আসুন। অনেকক্ষণ কচলাকচলি করেছেন। মেয়েটাকে এবার একটু রেস্ট দিন। মাতুলের দিকে তাকিয়ে সামান্য বিরক্তির গলায় বললেন, কী হল তোমার? বসতে বললুম না?
বসার সাহস পাচ্ছি না।
সেকী? তুমি চন্দ্রলেখা করে ঢাকের ওপর মেয়েছেলে নাচাবে, তোমার সাহস নেই?
মেসোমশাই চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঢাকের ওপর কেন? লাল মেঝেতে কিংবা কার্পেটের ওপর নাচালে ক্ষতি কী? ঢাকের ওপর থেকে দুম করে পড়ে গেলে কী হবে?
আরে মশাই, এ ঢাক সে ঢাক নয়, জয়ঢাক। শ্রাদ্ধের সঙ্গে তিলকাঞ্চন।
মাতুল বসে পড়লেন। আমতা আমতা করে বললেন, কই আমি তো চন্দ্রলেখার কথা বলিনি। আমি এমন একটা ছবি করব, যে-ছবি মানুষের চোখের জল টেনে বের করে আনবে। শিল্পীর বঞ্চিত জীবন। প্রতিভা আছে সুযোগ নেই। গোটা আঠারো গান থাকবে। সব রাগরাগিণীর ওপর। দরবারি, বাগেশ্রী, মালকোষ, দেশ। সব কম্পোজ করা হয়ে গেছে।
শেষ দৃশ্যে নায়কের টিবি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ধরেছেন ঠিক। দরবারির ওপর বেস করে গান। তেমনি বাণী!
হৃদয়বিদারক?
আজ্ঞে হ্যাঁ। এ জীবনে আর কোনও প্রয়োজন নাই। এক এক লাইন গাইছে, আর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
কাশছে, এক ঝলক রক্ত উঠছে, আর দরবারিতে এ জীবন, এ জীবন করছে। তাই তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ, একেবারে অবিকল।
মাথায় আর কিছু এল না?
কেন?
দুঃখ, মৃত্যু, প্রেম, এ ছাড়া কিছু ভাবা যায় না? কেন, টকি অফ টকিজ কি মানময়ী গার্লস স্কুলের মতো একটা বই করা যায় না।
ওসব এখন চলবে না। মানুষের মনের ভেতর উঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোতে হবে। মানুষ এখন কাঁদতে চায়। বেদনায় জন্ম নেবে যন্ত্রণার শতদল, জীবনের ইতিহাস লেখা হবে রক্তের অক্ষরে, জীবনের মূল্য শুধু অশ্রুজল, তৃণশীর্ষে শিশিরের ক্ষণস্থায়ী বিন্দু।
ও, তোমার তো আর্টস ছিল। সবেতেই তাই এলিয়ে পড়ো। জীবনে চোখের জল তো আর ফেলতে হল না। তাই চোখের জল নিয়ে কাব্য করতে পারছ। তবে হ্যাঁ, যে-লাইনে নাক গলাতে চলেছ তার শেষটা অবশ্য অশ্রুজলেরই কাব্য। তুমি তো সাহিত্যের ছাত্র ছিলে, পড়েছ কি না জানি না, ভার্জিল থেকে দুটো লাইন বলি, Human deeds have their tears and morality touches the heart.
আমি তা হলে কী করব?
প্রথমে তুমি তোমার পিতার কাছে ক্ষমা চাইবে। তারপর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, আমাকে শুভবুদ্ধি দাও।
আমার অপরাধ?
সেকী? তোমার অপরাধ, তুমি জানো না? প্রথম অপরাধ, পিতাকে অপমান।
মাতুল সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনারা দেখছি এজলাস বসিয়ে ফেলেছেন।
তা বলতে পারো। পাশে জজসাহেবও বসে আছেন, বিনয়দা। তোমার দ্বিতীয় অপরাধের বিচার এখন হবে না, হবে পরে। সেটা হল বুদ্ধিবৈকল্য।
মাতামহ বললেন, ক্ষমা চাইতে হবে না। ও তো ছেলেবেলা থেকেই এইভাবে কথা বলে। মা-মরা ছেলে।
পিতা বললেন, জানি জানি, ও তো আমার কাছেই মানুষ। আজই না হয় আতর-মাখা ওস্তাদ হয়েছে। অতীত সহজে ভুলতে পারে বলেই বর্তমানে মানুষের তুড়িলাফ। অতীতের সব ছবি আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। হয়তো বয়েস বাড়ছে বলেই। বর্ষার রাত। ওর দিদি ডিম দিয়ে খিচুড়ি বেঁধেছে। অনেক রাত হয়ে গেছে। ওই টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। চাদর মুড়ি দিয়ে এই বাবু তখন ঘুমে কাদা। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমি। বিছানা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে আসনে বসিয়েছি। মাথা ঢুলে পড়ছে। আমি ধরে আছি, ওর দিদি একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছে। এক এক চামচে তুলছে, ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে পাখির ঠোঁটে পুরে দিচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। এমনকী ওর দিদির নাকের নাকছাবির হিরের ঝিলিকটি পর্যন্ত চোখের সামনে খেলে যাচ্ছে। কী অদ্ভুত মিল দুজনের মুখের। আমি ওকে দেখছি, ওর দিদির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমরা তিনজন একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়েছি। ভোরে আমার এসরাজের সঙ্গে গলা সেধেছে। সে মিলন আর সে বিচ্ছেদ কোথায়? সেই রাত, সেই দিন, মাস, বৎসর কোথায়?
বোহ ফিরাক অওর বোহ্ বিসাল কহাঁ ॥
বোহ্ শব ও রোজ ও মাহ্ ও সাল কহাঁ ॥
মাতুল চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, আমি ক্ষমা চাইছি।
মাথা নিচু করে প্রণাম করতেই পিতা পিঠে হাত রেখে বললেন, বড় রোগা হয়ে গেছ। সে যত্ন আর কোথায় পাবে? আমিও একটু কাব্য করে বলি, যারা ছিল তারা আর নেই, যারা পড়ে আছে, তারাও তো থাকবে না চিরদিন, কিছুটা পথ এগিয়ে দিতে পারি, তারপর তুমি একা। তোমার শাস্তি, আমাদের গান শোনাও। আজ হল গজলের রাত। কী বিনয়দা, অসুবিধে হবে না তো?
কিছুমাত্র না। সেই সকাল থেকে পড়িয়ে পড়িয়ে নিজেকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে। টিয়াপাখি।
হ্যাঁ, ওই আধিভৌতিক, আধিদৈবিক কিছুক্ষণ জিরেন পাক।
প্রতাপ রায় বললেন, কিন্তু সেই গল্পটা?
ও, সেই গল্প! তুমি ঠিক মনে রেখেছ দেখছি! সেই ক্যানাডিয়ান ইঞ্জিনের গল্প। পিতা হাসতে লাগলেন। আমি ফরাস বিছোতে শুরু করলুম। আসর বসবে।
১.১৩ প্রেমের তিন পর্ব
পারস্যের গালিচা। কে কিনেছিলেন জানি না। তবে রবিবার রবিবার এই বস্তু জীবন বের করে ছেড়ে দেয়। মানুষের চেয়েও যত্নে থাকে। নরম বুরুশ দিয়ে বুনোন বরাবর ঝাড়ো আর গোল করে গুটিয়ে রাখো। ব্রাশ অ্যান্ড রোল, রোল অ্যান্ড ব্রাশ। আবার খোলা মুখ দিয়ে ইঁদুর না ঢোকে। দুটো মাথায়। কাপড় জড়াও।
ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ সেই গালচে পড়েছে। বুকে লতাপাতার কারুকার্য। পাড় বসানো। নরম দুব্বো ঘাসের মতো জমি। কনক খুব সাহায্য করেছে। টানা হ্যাঁচড়ায় খোঁপা ভেঙে গেছে। পিঠের ওপর দুলছে সাপের কুণ্ডলীর মতো। আমার ওসব দেখা উচিত নয়। তবু নজর চলে যাচ্ছে। বয়েসের দোষ। বগলের কাছে ব্লাউজ টাকার মতো গোল হয়ে ঘামে ভিজে উঠেছে। হালকা নীল ওই জায়গাটা গাঢ় নীল হয়েছে। আবহাওয়া যত শীতলই হোক ওই জায়গাটা ঘামবেই। কঁধ আর ওপর বাহুর সন্ধিস্থল পায়রার বুকের মতো গরম। তোমার তাতে কী? কার্পেট পাতছ পাতো, অন্যদিকে নজর যাচ্ছে কেন? মিটমিটে শয়তান।
হামা দিয়ে বসেছিলুম। কনক সামনে ঝুঁকে কার্পেট সমান করতে করতে পিছু হটছিল, ঘাড়ে এসে উলটে পড়ল। রেগে গেছে। আচমকা এমন ঘটনা ঘটলে সবাই রাগবে। আমিও রেগে যেতুম। আমার পিঠের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পেছনে চিতপাত। পা জোড়া এখনও আমার পিঠে। মোমের মতো মসৃণ গোড়ালি দু’চোখের কোণে ঝিলিক মারছে। নিতম্বের ঘর্ষণে পিঠ গরম হয়ে উঠেছে। চোখে শাড়ির নিম্নাংশের ঝাঁপটায় জল এসে গেছে। ব্যাপারটা বিশ্রী হলেও মধুর। মানুষের মাথায় ছাদ ভেঙে পড়ে, যুবতী ভেঙে পড়ার ঘটনা খুব কম কোষ্ঠীতেই লেখা থাকে। কনক যদি মাতুলের ছবিতে নায়িকা হয় আমি নির্ঘাত আত্মহত্যা করব।
পিঠ থেকে পা তুলে নিয়ে কনক বললে, কী যে তখন থেকে বেড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরছ। পইতেতে পা লেগেছে?
কী জানি? খেয়াল করিনি।
ইস পাপ হয়ে গেল। দাঁড়াও একটা প্রণাম করি।
প্রণাম? পাগল নাকি?
ওপাশের ঘরে চেয়ার সরাবার শব্দ হল। চট করে উঠে দাঁড়ালুম। দু’জনকে কার্পেটে এইভাবে গড়াতে দেখলে, এ বাড়িতে আমার দানাপানি বন্ধ হয়ে যাবে। এলোমেলো শাড়ি গুছিয়ে নিয়ে কনকও উঠে দাঁড়াল। কনকের পাপ হবে কেন? পাপে আমি নিজেই মজে গেছি। কদিন থেকেই নিজেকে লক্ষ করছি, পুণ্যের চেয়ে পাপের আকর্ষণ হাজার গুণ বেশি। দেবতা হবার বাসনা তলিয়ে গেছে। অসুর হতে চাই। আমায় দাও মা অসুর করে, কাজ নেই আমার দেবতা হয়ে। স্বর্গপুরীর হর্মে নাকি দেদার হুরি বসত করে/সেথায় নাকি অঢেল সুরার ঊর্মিমুখর ঝরনা ঝরে/পুণ্যবানের কাম্যভূমির মর্ম যদি এমনতর/দোষ কী তবে বরণ করার আগেই এদের মর্ত পরে? এসো খৈয়াম এসো। তোমাকে নিয়ে কোনও মরূদ্যানে পালাই। মধ্যবিত্ত বাঙালির সংসার বড় একঘেয়ে। Those who have gone before us, O Cupbearer, are sleeping in the dust of Self-pride. অহংকারের অট্টালিকায় নির্বাসিতের হাহাকার। বেশ বলেছিস ব্যাটা।
দেয়ালে আমার মাতৃদেবীর ছবি সন্ধের ঝোড়ো বাতাসে একটু হেলে গিয়েছিল। পায়ের আঙুলের ওপর ভর রেখে শরীর উঁচু করে কনক ছবিটাকে সোজা করছিল, এমন সময় মাতুলের প্রবেশ। আমার চেয়ে অন্তত হাতখানেক বেশি লম্বা। পদক্ষেপের আগে আগে কোঁচা চলেছে লাথি খেতে খেতে। কনকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কনক?
কনকের গোড়ালি মাটি স্পর্শ করল। ছবি নিয়ে বেচারা তন্ময় ছিল। আমি সাহায্য করলে ব্যাপারটা নিমেষে হয়ে যেত। ইচ্ছে করেই করিনি। স্বার্থ ছিল। বেশ লাগছিল দেখতে। কেমন ডিঙি মেরে মেরে হুকের নাগাল পেতে চাইছিল। দীর্ঘকাল এ বাড়িতে শুধু পুরুষেরই রাজত্ব ছিল। সকাল সন্ধে মিলিটারি মার্চ করছে। আদেশ ছিটকোচ্ছে ছিটেগুলির মতো। অ্যাটেনশন। অ্যাবাউট টার্ন। ফরোয়ার্ড মার্চ। সেই কঠোরে কোমলের স্পর্শ লেগেছে। ফুটিফাটা জমিতে বৃষ্টি নেমেছে।
কনক হাসিহাসি মুখে ফিরে তাকাল, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার নাম কনক।
তুমি গান জানো? মাতুল কার্পেটে প্রমথেশ বড়ুয়ার মতো পায়চারি করতে করতে প্রশ্ন করলেন। গুনগুন করে গানের সুরও ভাঁজছেন। মেজাজ আসছে। আসতেই হবে। এ ঘরে কম গান হয়েছে? বড় বড় আসর বসেছে, রাতের পর রাত। এ ঘরের দেয়ালও গান গাইতে পারে।
কনক হাসিহাসি মুখেই বললে, অল্পস্বল্প।
সুর ভাজতে ভাজতে মাতুলের প্রশ্ন, নাচ আসে?
আজ্ঞে না।
আসা উচিত ছিল। তোমার বিউটিফুল নাচের ফিগার।
আমার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে সুর ভাজতে ভঁজতে বললেন, কী রে! তোর রেওয়াজ টেওয়াজ কেমন হচ্ছে?
একেবারেই না।
তুই আমার নাম ডোবাবি ব্যাটা। আজ আমার সঙ্গে বোস। গানে গলা দিবি।
কোঁচায় লাথি মারতে মারতে, কার্পেটের ওপর দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে মায়ের ছবির সামনে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। চিত্রার্পিত পুত্তলিবৎ। পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে কাঁচ মুছলেন। মৃতের সঙ্গে জীবিতের ভাষাহীন আলাপন চলেছে। কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন, আজ তোমাকে গান শোনাব।
আমাদের দিকে যখন ফিরে তাকালেন, তখন অন্যভাব। মুখে বিষণ্ণতার প্রলেপ। রিমলেস চশমার আড়ালে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। একটু যেন জল চিকচিক করছে।
যন্ত্র বের করো যন্ত্র বের করে বলে পিতা সদলে কুচকাওয়াজ করে ঘরে ঢুকলেন। হাতে দু’ফালি কাপড়। নিশানের মতো পতপত উড়ছে। একই সঙ্গে চামেলি আর বকুলের সুবাস। আতর ঢেলেছেন। বাতাস এখনও ভিজেভিজে। পাতা নড়লে এখনও জলের ফোঁটা ঝরছে। সেই বাতাস ফুলের গন্ধে কতদূর যে পৌঁছিয়ে গেল। কালিদাসের কালে। ওয়াজেদ আলির লক্ষ্মৌতে। সাজাহানের দিল্লিতে। ওমর খৈয়ামের পারস্যে। কাল কোথা থেকে কোথায় চলে গিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগল। চরিত্রদের চেহারাও যেন পালটে গেছে। মাতামহকে মনে হচ্ছে পুত্রের হাতে বন্দি সাজাহান। পেছন পেছন মুকু আসছে জাহানারার মতো। মাতামহর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সব ভুলে গেছেন। সিনেমা, বাড়ি বন্ধক, গয়না বিক্রি, উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও আর মনে লেগে নেই। এখনই হয়তো অহীন্দ্র চৌধুরীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকবেন, না, আমি আর সম্রাট হয়ে বসতে চাই না। আমার সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এ সাম্রাজ্য তুমি ভোগ করো পুত্র। এ মণিমুক্তো মুকুট তোমার! আর মার্জনা? ঔরংজীব, ঔরংজীব। না সেসব মনে করব না। ঔরংজীব! তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করলাম।
জাহানারার সকাল থেকেই সর্দি হয়েছে। ফুচুত করে হাঁচি হল। মুকু ঘাড় হেঁট করে হাঁচে। হাঁচার পর আরও কিছুক্ষণ নিচু হয়ে থেকে মুখ তুলে অপাঙ্গে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বড় লজ্জার কাজ করে ফেলেছে। হেঁচে ফেলেছে। নবাব ওয়াজেদ আলির মতো পিতা মধ্যমণি হয়ে বসেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন, অ্যাকোনাইট থার্টি। মাতামহ বললেন, মাঝরাতে এক ডোজ ডালকামেরা। প্রতাপ রায় কোঁচা সামলে বসতে বসতে বললেন, কিস্যু না, স্রেফ গরম জলে একটা পাতিলেবু কষকষে করে নিংড়ে একটু নুন দিয়ে খেয়ে নাও। মাতুল বললেন, কষা মাংস আর ফুলকো লুচি। মাতামহ বললেন, আদা দিয়ে গরম চা। মেসোমশাই বললেন, ভোরবেলা ঠান্ডা জলে স্নান। মুকু ধীরে ধীরে দরজার দিকে সরতে আরম্ভ করেছিল। টুক করে চৌকাঠ টপকে বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেখান থেকে ফুচুত করে আর একটি হাঁচির শব্দ ভেসে এল।
কনক আর আমি যন্ত্রপাতি বের করছিলুম। হারমোনিয়ম, বায়াতবলা। পিতা বললেন, এসরাজটাও নামাও। অনেকদিন বাজানো হয়নি। ছড়টড় কী অবস্থায় আছে, কে জানে?
হারমোনিয়মটা বেজায় ভারী। দু’জনে ধরাধরি করে এনে কার্পেটের মাঝখানে ধপাস করে ফেললুম। প্রতাপ রায় উঠব উঠব করছিলেন। কোঁচায় কাছায় জড়াজড়ি হয়ে গেছে বলে রক্ষা পেয়ে গেল কনক। নয়তো তেড়ে এসে সরো সরো বলে আমাকে একপাশে চিতপাত করে দিয়ে কনকের সঙ্গে একটু দহরম-মহরম করার চেষ্টা করতেন।
পিতা খোল থেকে এসরাজ বের করে নরম একটুকরো ন্যাকড়া দিয়ে ধুলো পরিষ্কার করতে লাগলেন। আমাকে বললেন, ওহে রজনটা বের করো।
মাতুল হারমোনিয়মের রিডের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে এপাশ থেকে ওপাশে বারকতক আঙুল চালালেন। অনামিকায় আংটির পাথর ঝিলিক মেরে গেল। সুরের গমকে ঘরের বাতাস চমকে। চমকে উঠল। এসরাজে ছড় টেনে অষ্টকুটি একটা শব্দ বের করে পিতা বললেন, বহত্ আচ্ছা। তোমার মেজাজ এসে গেছে।
প্রতাপ রায় তবলায় তড়াং করে একটা চাঁটি মারলেন। মেরেই বললেন, অ্যাঃ, ঢ্যা ঢ্যা করছে। কতদিন হাত পড়েনি? হাতুড়ি কই, হাতুড়ি?
এই রে, তবলা ঠোকার সেই ছোট্ট হাতুড়ি যে প্রায়ই হারিয়ে যায়। খুঁজে পাওয়াই যে মুশকিল। পিতা অধৈর্য হয়ে বললেন, কী হল, পেলে না? পাবে না জানি। এ বাড়িতে কোনও একটা সিস্টেম নেই। না পাও কয়লা-ভাঙা হাতুড়িটাই আনন।
যন্ত্রপাতির বাক্স থেকে সেই সুদৃশ্য হাতুড়ি অবশেষে বেরোল। এসরাজের ছড়ে রজন ঘষতে ঘষতে পিতা বললেন, কোথায় ছিল?
আজ্ঞে, আপনারই যন্ত্রপাতির বাক্সে।
প্রতাপ রায় তবলা ঠুকতে ঠুকতে বললেন, পাউডার আছে?
এ বাড়িতে পাউডারের পাট নেই। তবে ফ্রেঞ্চচক আছে। সে বস্তু যে-জায়গায় আছে তার নাগাল পেতে হলে চেয়ার চাই। কনক বললে, পাউডার? আমি এনে দিচ্ছি। খুব বাঁচিয়েছে। টঙে চড়ে আলমারির মাথা থেকে চক নামাতে হলে আসর মাথায় উঠত।
প্রচুর ঠোকাঠুকি করে তবলা সুরে বাঁধা হল। মাতুল বলতে লাগলেন, গাঁট্টায় মারো, গাঁট্টায় মারো। উঁহু ডান দিকটা এক পরদা নেমে আছে।
মাতুলের সাংঘাতিক কান। তার চেয়েও সাংঘাতিক কান পিতার। হাতে পাউডার ঢেলে তবলার গাবে প্রতাপ রায় ভাল করে মাখালেন। ওপর দিকে দু’হাত তুলে জয় নিতাইয়ের ভঙ্গিতে নিজের তালুতে বেশ করে ঘষলেন। মাতুল হারমোনিয়মে একটা সাপটা তাল বাজিয়ে সুরের মুখটি সবে ধরতে যাচ্ছেন, পিতা উঁহু উঁহু করে উঠলেন। মাতুলের ভুরু কোঁচকাল।
সুরটা দাও, সুর, যন্ত্রটা বেঁধে নিই।
তিন সপ্তক এসরাজ বাঁধার কাণ্ডকারখানা আমার দেখা আছে। এর চেয়ে ভীতিপ্রদ ব্যাপার আর কিছু নেই। শ্রোতাদের ধৈর্যের পরীক্ষা। তারে টুসকি মেরে মেরে, কানে মোচড় দিয়ে দিয়ে প্রতিটি পরদাকে সুরে ভেড়াতে হবে। মাতুল উসখুস করছেন। আঙুল মাঝে মাঝে টেপা সুরের বাইরে গিয়ে খেলে আসছে। গানের মুখ লিক করে বেরিয়ে পড়ছে। পিতা অমনি উঁহু করে ছটফটে মাতুলকে বশে আনছেন।
এইভাবে চললে রাত দুটোর আগে গানে আসা যাবে না। তরফের কান সহজে ঘুরতে চাইছে না। মটমট শব্দ করে সুরে পা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। পিতা ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, গেল গেল।
মাতুল শেষকালে সাহস করে বললেন, আমার ভীষণ গান পেয়েছে। আর চেপে রাখতে পারছি না।
পিতা বললেন, আর একটু ধৈর্য ধরো, আর একটু, প্লিজ। এক মেটে বেঁধে ছেড়ে দিচ্ছি।
এসরাজ কাঁধে উঠল। মাতুল ইমনে আলাপ ধরলেন। নিখাদ থেকে কোমল ঋষভ হয়ে যখন সুরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন মনে হচ্ছে যেন অচেনা রাস্তা খুলে যাচ্ছে। কড়ি মধ্যম ছুঁয়ে যখন ওপরে উঠছেন সুর যেন আকাশের ব্রহ্মতালু স্পর্শ করছে। রাগিণীর বিরহী রূপ সুরের দু’-চার চলনেই স্পষ্ট। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি নীল শাড়ি পরা কনক। বাকি সব অবলুপ্ত। রাজকাপুরের ছবির ধোঁয়া ভেদ করে নার্গিস যেন বেরিয়ে আসছে। মৈঘৈম্মেদুরম্বরং বনভুবঃ শ্যামাস্তমালদ্মৈর্নক্তং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহংপ্রাপয়।
মাতুলকে পিতার এসরাজ জবরদস্ত অনুসরণ করেছে। দু’জনেই দু’জনকে বাহবা দিচ্ছেন। প্রতাপ রায়ের আঙুল তবলার ওপর ছটফট করছে। এখনও গানের মুখ আসেনি। বোল ফোঁটাতে পারছেন না। ঝট করে গানের মুখ এসে গেল। একেবারে সাচ্চা গজল,
সব কহাঁ কুছ লালা বগুল সেঁ নুমায়াঁ হো গয়ী।
খাক মেঁ ক্যা সুরতেঁ হোগি কি পিনহাঁ হো গয়ী।
সব তো পাওয়া হল না। কিছু ফুল, কিছু পুষ্পবল্লরী, এতে আর কতটুকু প্রকাশ। মাটির যে আসল সৌন্দর্য সে তো সব লুকিয়েই রইল। সব কহাঁ কুছ লালা বগুল মে।
মাতুল-গর্বে বুক দশহাত হয়ে উঠছে। কী গাওয়াই গাইছেন। দুমড়ে মুচড়ে নিংড়ে হৃদয়ের আবেগ উজাড় করে দিচ্ছেন। এসব মানুষের কী দরকার কাউকে পরোয়া করে চলার? দুই বোন পাশাপাশি বসেছে। কনকের রাতের রান্না মাথায় উঠেছে। মেসোমশাই মাঝে মাঝে আহা আহা করে উঠছেন। মেসোর আহা শুনে মাতামহ হুহু করে এক ধরনের হাসি হাসছেন, যার অর্থ দেখো, ছেলে আমার কোন কোটির মানুষ! ঈশ্বরকোটির জীব।
হো গয়ী বলে মাতুল দুরূহ একটা কাজ সবে শেষ করেছেন এমন সময় সিঁড়িতে হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে গলা শোনা গেল, সিলিপ করে পড়ে গেলুম যে রে বাপ। গাইয়ে, বাজিয়ে, তবলচি কেউ না শুনতে পান, আমার কানে এসেছে। অচেনা গলা। আসর ছেড়ে ওঠার আগেই তিনি দরজার সামনে চলে এসেছেন। জবা এসেছে? জবা?
আরে, এ যে সেই জবাদের বাড়ির ধেড়ে বাবুটি। মনে হয় জবার স্টেপ ফাদার। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ, যার হেড সুখেন, এখনও পরিচয় বের করতে পারেনি। চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, জবা এসেছে? জবা?
মাতুল গান বন্ধ করলেন, হারমোনিয়মে সুরের শেষ টানটি মেলায়নি। তবলার শেষ চাটি মাঝ-বাতাসে পাখির মতো উড়ছে। এসরাজ নিখাদে এসে ন্যাজ গুটিয়েছে। পিতা এসরাজটিকে কোলের ছেলের মতো সাবধানে কার্পেটে শুইয়ে রেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এই অসুর? কী চাইছেন?
মুখে সেই কদাকার কাঁঠাল-কোয়া হাসি। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, জবা আছে? জবা?
মাতামহ পালটা প্রশ্ন করলেন, কেন? রক্ষেকালী পুজো আছে নাকি আজ? এই রাতে জবাফুল পাবেন কোথায়? পিতা এসরাজ তুলে নিতে নিতে বললেন, চোখের জলে পুজো করুন, চোখের জলে পুজো বেস্ট পুজো। ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে না পেরে আর একটু পরিষ্কার করে বললেন, সেই দুপুর থেকে জবাকে পাওয়া যাচ্ছে না, এত রাত হল, সে কি এখানে এসেছে?
পিতার এসরাজ আবার স্কন্ধচ্যুত হল। শূন্যে ছড়ি ঘুরিয়ে অর্কেস্ট্রার কনডাক্টরের মতো ভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন, ইনি কী চাইছেন বলো তো?
প্রতাপ রায় বাঁয়ায় গফা গফা আওয়াজ করে প্রশ্ন করলেন, কে জবা?
ভদ্রলোক বললেন, সেই জবা যাকে ওই ছেলেটি মাঝে মাঝে ছাত থেকে ফুল ছুঁড়ে দেয়।
অ্যায় মরেছে। ব্যাটা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলে। এইবার কোথাকার জল কোথায় গড়ায় দেখো। কপালে আজ এই লেখা ছিল ঈশ্বর। পিতার হাত থেকে ছড়ি খসে পড়ল, কী বললেন? আমার ছেলে জবাকে চন্দ্রমল্লিকা ছুঁড়ে মারে? আপনি এতদিন আমাকে বলেননি কেন? ঘুমোচ্ছিলেন, থানায় ডায়েরি করেননি কেন?
মেসোমশাই বললেন, উঁহু, ডায়েরির স্টেজে এখনও আসেনি। যতক্ষণ না শ্লীলতাহানি হচ্ছে, ইনডিসেন্ট জেসচার হচ্ছে ততক্ষণ পানিশেবল অফেন্স হচ্ছে না। এ কেস ফেল করবে। যত বড় বাঘা ব্যারিস্টারই হোক না কেন আসামি খালাস পেয়ে যাবে। তারপর দেখতে হবে যাকে ফুল ছুঁড়ে মেরেছে সে সাবালিকা না নাবালিকা? সাবালিকা হলে তার কনসেন্ট ছিল কি না? যদি প্রতিবাদ করে থাকে তা হলে সে প্রতিবাদের সাক্ষী কে? তা ছাড়া ফুল যে ছুঁড়ে মেরেছে বলছেন তার কোনও সাক্ষী আছে? প্রমাণ কী ফুল ছুঁড়ে মেরেছে? কেস ডিসমিস্ট। আসামি বেকসুর খালাস। আসামি এখন অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে। হাজার দশেক টাকা অবশ্যই পেয়ে যাবে।
মাতুল বললেন, মামলা যখন খারিজ হয়ে গেছে তখন আবার গান ধরা যেতে পারে?
পিতা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফলস অ্যালিগেশন। নাও ধরো।
ভদ্রলোক বললেন, আজ্ঞে, আমি মামলা করতে আসিনি। আপনার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেই। তবে আজকাল ভাবভালবাসার যুগ পড়েছে তো, তাই ভাবলুম জবা যদি এখানে এসে থাকে। এত বড় বাড়ি, শুনেছিলুম একটিও মেয়েমানুষ নেই, উঠতি বয়েসের মেয়ে, উঠতি বয়েসের ছেলে, ঝড়বাদল হচ্ছে। বলা তো যায় না, কী থেকে কী হয়ে যায়। যদি একবার হয়ে যায়।
মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়ে যায়?
আজ্ঞে এই জোড়কলম আর কী।
মাতামহ বললেন, হরিশঙ্কর, অশ্লীল কথা বলছে, অনুমতি দাও। জুতোজাড়া এখনও প্রায় নতুন আছে। পিতা বললেন, দাঁড়ান দাঁড়ান, অ্যাকশন তো আমিও নিতে পারি; তার আগে অভিযোক্তাকে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শপথ করো, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না, যাহা সত্য তাহাই বলিব।
প্রশ্ন: জবা কে?
একটি মেয়ে।
কোথায় থাকে?
যেদিকে চন্দ্রমল্লিকার টব, সেই ছাদের দিকের লাগোয়া বাড়িতে।
আই সি, যে বাড়ির মেয়েরা অন্তর্বাস পরে পুরুষদের সামনে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়, আপনি সেই বাড়ির নিনকম-পুপ। আজ্ঞে, আপনি আসতে পারেন। ফুল ছুঁড়েছে? সে তো নরম জিনিস। ইট ছোঁড়া উচিত ছিল। থান ইট, আধলা ইট।
ভদ্রলোক বললেন, শুনেছি আপনি রাগী মানুষ। রাগী হলেও পরোপকারী, দয়ালু, শিক্ষিত, আদর্শবান। বিপদে পড়ে এসেছিলুম আপনার কাছে। আমার দাদা পাঞ্জাবে বড় চাকরি করতেন, বউদিরা সেখানেই ছিলেন, তাই বাঙালির হালচালের সঙ্গে মেলে না।
প্রতাপ রায় প্রশ্ন করলেন, বউদিরা মানে?
আজ্ঞে দুই বিবাহ।
অ্যাঁ বলেন কী, দু’দুটো বউ।
বলেন কেন, আর সামলাতে পারছি না।
প্রতাপ রায় কাবাবের গন্ধ পেয়েছেন। সাগ্রহে বললেন, বসুন, বসুন।
ভদ্রলোক এতক্ষণ কদমতলায় কেষ্টঠাকুরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। কার্পেটের একপাশে বসলেন। সাবান আর পাউডারের বোদা গন্ধ বেরোচ্ছে গা থেকে। মাথার চুলে ফুলেল তেল। প্রতাপ রায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে সামলাতে হচ্ছে কেন?
আজ বছর পাঁচেক হল, দাদা নিরুদ্দেশ। মনে হয় বেঁচে নেই। আত্মহত্যা করেছেন।
মেসোমশাই টাস টাস করে টুসকি মেরে কনক আর মুকুকে দরজার সামনে থেকে ওপাশে সরে যেতে বললেন। খারাপ খারাপ কথা হচ্ছে, মেয়ে বখে যাবে। মাতামহ বলে উঠলেন, বলেন কী, এক ঢিলে দু’পাখি। দু-দুটো বউ বিধবা!
বউদিরা অবশ্য বিধবার সাজপোশাক পরেন না। মাছ, মাংস, ডিম সবই চলে। দাদা মারা গেছেন সে প্রমাণ তো নেই। যা হবে সেই বারো বছর পরে।
পিতা প্রশ্ন করলেন, আপনার কী করা হয়?
পোস্তার বাজারে মশলার পাইকার।
মাতামহ অমনি বলে উঠলেন, ও, ব্যাটা গন্ধবেনে।
মাতুল ক্ষমা চাইলেন, কিছু মনে করবেন না, ব্যাটা বলাটা ওনার মুদ্রাদোষ।
প্রতাপ রায় বললেন, আপনার কি মনে হচ্ছে জবা পালিয়েছে?
মাতামহ বললেন, অমন বাপের মেয়ে পালাবেই। দ্রৌপদীর মতো পঞ্চস্বামী গ্রহণ না করে থামবে না। তারপর বস্ত্রহরণ। পিতা বললেন, বড় অসংলগ্ন কথা হচ্ছে। জবা পালাক ক্ষতি নেই। প্রেমের তিন পর্ব। প্রথম পর্বে বুদ্ধিবৈকল্য। কাঁচে কাঞ্চন ভ্রম। দ্বিতীয় পর্বে দ্বিত্ব। তৃতীয় পর্বে। যথাস্থানে দ্বিরাগমন ও খেল খতম। সবই হল অপসৃষ্টির উত্তাপ। যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায় ততই ভাল। আপনি তার খোঁজে এখানে এলেন কেন?
আপনার ছেলের সঙ্গে ছাতে-ছাতে একটু কথা চালাচালি হত তো। তা ছাড়া এই চিঠিটা হঠাৎ হাতে এসে গেল।
চিঠি? সভাসদরা সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ চিঠি। মনে হয় আপনার ছেলের লেখা।
মেসোমশাই বললেন, মনে থাকে যেন হ্যান্ডরাইটিং এক্সপার্ট কল করা হবে।
আমি তো মামলা করতে আসিনি। জবার সন্ধানে এসেছি।
পিতা বললেন, ঠিক আছে, আগে হস্তাক্ষর মেলানো হোক, তারপর কী লিখেছে দেখা যাবে। কনক!
পিতার ডাকে কনক দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
এর যে-কোনও একটা হাতের লেখা নিয়ে এসো তো।
কনক একটু ইতস্তত করে সরে গেল। আমি যেন বন্দি আসামি। সাক্ষ্য, প্রমাণ সব একে একে হাজির করা হবে। আমার তাতে কোনও হাত থাকবে না। একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জবাকে এক-আধটা ফুল এ ছাত থেকে ও ছাতে পাচার করেছি ঠিকই কিন্তু চিঠি তো আমি লিখিনি। চিঠি লিখব কেন? আমি তো জানি যত দানাই ছড়াই জবা তো তেমন পায়রা নয় যে উড়ে আসবে। ওর দানা আলাদা। মটরদানা, কাঁকনিদানা, কোনও দানাতেই ও পাখি বশ মানবে না। মাতুল কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, কী কাণ্ড বাধিয়েছিস। ব্যাটা ওমর খৈয়ামের চেলা।
বেশ লজ্জা লজ্জা করছে। ভয় তেমন লাগছে না। কী আর হবে? পিতা যদি বাড়ি থেকে লাথি মেরে বের করে দেন, লোটাকম্বল নিয়ে সরে পড়ব। কোথায় সরব জানি না। তবে এত বড় পৃথিবী, কোথাও কি একটা ডেরা জুটবে না।
কনক খুঁজে খুঁজে আমার ডায়েরিটা নিয়ে এসেছে। মরেছে। ওতে যেসব মনের কথা লেখা আছে, সেসব পড়লে সশ্রম কারাদণ্ডের পরিবর্তে জজসাহেব ফাঁসির হুকুম দেবেন। অনেক আধ্যাত্মিক চিন্তাও আছে। বরাতে কোন পাতাটা বেরিয়ে পড়বে কে জানে! জয় ঠাকুর।
ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পিতা মাঝামাঝি একটা জায়গা খুলে আলোর সামনে মেলে ধরলেন। নীরব, নিথর, নিস্পন্দ প্রদীপ শিখা। কোন পাতাটা খুলেছেন। হে ভগবান, যে- পাতায় মায়া আছে,
যে-পাতায় কনক আছে, সেইসব পাতা যেন দুম করে বের করে দিয়ো না। কী কুক্ষণেই যে ডায়েরি। লেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ভেবেছিলুম মহাপুরুষেরা ডায়েরি লেখেন, তা হলে ডায়েরি লিখলে। মহাপুরুষ হয়। লজিক।
পিতা মুখ তুলে বললেন, বাপস, কী সব লিখেছে?
প্রতাপ রায় বললেন, খারাপ কথা?
না না, অতি উচ্চমার্গের কথা। লিখছে, জীবনে পাওয়ার চেয়ে না-পাওয়াটাই বড়। পেলে হারাবার ভয় থাকে, যা পাইনি তা তো কোনওদিন হারাবে না। সোজা চলে যাও, কিছু ধরার চেষ্টা। কোরো না, কিছু তুলে নেবার চেষ্টা কোরো না। রিক্ত হবার সাধনা ক’জন করে। সকলেই তো দেহি দেহি করছে। সত্য একটাই, সব ছাড়োয়ে, সব পাওয়ে।
জবার কাকা উসখুস করে বললেন, হাতের লেখা কি মিলছে?
চিঠিটাই পেলুম না, তো হাতের লেখা মেলানো!
এই যে স্যার।
এতক্ষণে কাগজটা নজরে এল। এ সেই চিঠি। সুখেন ব্যাটা সেদিন দুপুরে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল। দেখেছ কাণ্ড! একটু বেশ জমিয়ে লেখ তো পিন্টু। বেশ একটু আবেগ দিয়ে মারাত্মক করে লেখ তো। বড় ফসকে ফসকে পালাচ্ছে। প্রথম লাইনেই মেরে দে, লেখ, আর কতকাল থাকব। বসে, পরান খুলে বঁধু আমার! রাসকেল একবারও আমাকে বললে না মেয়েটা কে? বন্ধুকৃত্য করতে গিয়ে আজ অবস্থা দেখো। অপরাধ স্বীকার করে নিলে সাজা কমে যায়। সেই পথেই এগিয়ে দেখি।
মেলাতে হবে না, ওটা আমারই হাতের লেখা। তবে অন্যের হয়ে লেখা। হাতের লেখা আমার হলেও লেখক অন্য।
ভদ্রলোক বললেন, আজ্ঞে, হাইকোর্ট দেখাতে চাইছে? একটু চাপ দিলেই বেরিয়ে পড়বে জবা কোথায়।
মেসোমশাই ধমকের গলায় বললেন, চুপ করুন, চিঠির শেষে কার নাম আছে দেখুন তো হরিদা?
পিতা পাতা উলটে বললেন, ইতি তোমার সুখাদ্য।
প্রতাপ রায় বললেন, বাবা, একেবারে খাদ্যখাদক সম্পর্ক।
মেসোমশাই বললেন, কাকে সম্বোধন করা হয়েছে?
পিতা ভাল করে দেখে বললেন, আমার শ্যামা মায়ের চরণতল।
প্রতাপ রায় বললেন, একেবারে ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ, কাম। বহত আচ্ছা।
মেসোমশাই বললেন, এ চিঠি কিছু প্রমাণ করে না। ইট মে বি এনিথিং। কয়েক লাইন পড়ুন তো হরিদা। পিতা চিঠিটা মাতুলের হাতে দিয়ে বললেন, আমি পারব না, তুমি পড়ো।
ভদ্রলোক বললেন, বেশ পাকা পাকা কথা লেখা আছে। ইচ্ছে করলে আমি চেপে ধরে জবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে পারি। দুঃখু নেই। পাত্র হিসেবে ছেলেটি তো খারাপ নয়।
কথা শুনে সকলেই নির্বাক। বলে কী রে! পোস্তার কারবারি। সেই ছড়া নাকি, শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে তোমার নাকি ছেলের বিয়ে। মাতুল চিঠিটা শুরু করার আগেই প্রতাপ রায় ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পকেট থেকে সিগারেট লাইটার বের করে দপ করে আগুন ধরিয়ে দিলেন। চিঠি পুড়ছে, মাতুল চিৎকার করছেন, আগুন লেগে যাবে, ওরে আগুন লেগে যাবে।
ভদ্রলোক চিৎকার করছেন, আমার চিঠি, আমার চিঠি।
প্রতাপ রায় জ্বলন্ত চিঠিটা কার্পেটের পাশের মেঝেতে ফেলে দিয়ে খুব সহজ গলায় বললেন, এবার আপনি আসতে পারেন। জবা এখানে নেই। ভোরবেলা গাছে খোঁজ করবেন।
মাতামহ বললেন, আর একটা কথা বলেছ কী চ্যাংদোলা করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসব।
মাতুল বললেন, উনি যা বলেন তাই করেন। তন্ত্রসাধক।
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। মাতামহের দিকে ভক্তি গদগদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, বাবা, একটু আশীর্বাদ করুন। মাতামহ হাত তুলে বললেন, করলুম।
আশীর্বাদ করুন যেন এই অপমানের উপযুক্ত প্রতিশোধ নিতে পারি।
অ্যাঁ সেকী?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের ছেলে ছাত টপকে ফুল ফেলবে, চিঠি ফেলবে, আইবুড়ো মেয়ে অদৃশ্য। হয়ে যাবে, দেশে আইন বলে তো একটা কিছু আছে। মেয়ে যদি না ফেরে আমি থানায় যাব। তখন। যা হয় টানা হ্যাঁচড়া হবে। মেসোমশাই বললেন, আমি আছি।
পিতা খুব গম্ভীর গলায় বললেন, আপনারা একে ডিফেন্ড করবেন না। আমার ছেলে অপরাধী। শুধু অপরাধী নয়। চরিত্রহীন, লম্পট। হি ইজ এ সাফারার। বয়েসের অসুখে ভুগছে। শেম! শেম!
১.১৪ খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়
সব স্থির। সমস্ত মুখ গম্ভীর। এমনকী প্রতাপ রায়ের মুখ থেকেও সেই বিচিত্র হাসি অদৃশ্য হয়েছে। মাতামহ মাথা নিচু করে হাতের আঙুল নিয়ে পুর-মুঠ খেলছেন। এসরাজ একপাশে অভিমানী স্ত্রীর মতো পাশ ফিরে শুয়ে আছে। হারমোনিয়ম বেলো খোলা, সুরহারা। বাঁয়া আর তবলা মাথা ঠোকাঠুকি করে ফাটকের দুই রাতজাগা আসামির মতো নিজেদের ভাগ্য নিয়ে যেন বড়ই বিব্রত। দুই উরুতে হাত রেখে পিতা এত সোজা হয়ে বসেছেন, মনে হচ্ছে অমরনাথের তুষারলিঙ্গ। মাতুল ওপর-ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট চেপে বসে আছেন। বোঝাই যায় সুর বেরিয়ে আসতে চাইছে, কোনওরকমে চেপে রেখেছেন। নিজেকে মনে হচ্ছে ইঁদুরকলে পড়ে গেছি। কেউ-না-কেউ এইবার তুলে নিয়ে বাইরে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আসবে। এক ঝক কালো কালো কাক, ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে তেড়ে আসবে। প্রাণভয়ে ন্যাজ তুলে শুরু হবে আমার দৌড়োদৌড়ি।
প্যাঁচ ঘুরিয়ে এসরাজের ছড়ির ছড় আলগা করতে করতে পিতা বললেন, আর কী রইল? কিছুই রইল না।
মাতামহ মাথা তুলে প্রশ্ন করলেন, তার মানে?
মানে অতি সহজ। চরিত্র গেল তো আর কী রইল? কিছুই রইল না।
ছড়িটা শূন্যে তুলে দেখাতে লাগলেন, এই হল মাথা, লম্বা লম্বা চুল, দুটো লিকলিকে হাত, কঞ্চির মতো বাঁকা বাঁকা দুটো পা, এই ধনুকের মতো পিঠ। এই দুর্বল স্ত্রীর কীসের জোরে জগতের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত?
ছাত্রের মতো সমস্বরে সকলের জবাব, চরিত্র, চরিত্র।
উত্তেজনায় পিতা উঠে দাঁড়ালেন, রাইট ইউ আর। সেই চরিত্রটাই যার থ্রেডবেয়ার হয়ে গেল, তার আর রইল কী! প্রবৃত্তির ড্যাঙোস মাথায় পড়বে। ঘা খেতে খেতে, ঘা খেতে খেতে ও তো কেঁচো হয়ে যাবে। হি ইজ মাই লস্ট সন। আমি এখন পৃথিবীর শেষ সীমায় এসে অন্ধকারে পথ খুঁজছি৷ ইস, ইস, এই ছেলে যখন পিতার নাম বলবে লেট হরিশঙ্কর, আমি তো তখন কবরেও ঘৃণায় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে উঠব।
মাতামহ উদাস গলায় প্রশ্ন করলেন, লেট বলছ কেন? তুমি তো প্রেজেন্ট।
আমি সিদ্ধান্ত করেছি, আই উইল কমিট স্যুসাইড।
সভাসদরা সমস্বরে বললেন, সেকী? আত্মহত্যা।
ইয়েস আত্মহত্যা! দুষ্ট গোরুর চেয়ে, শূন্য গোয়াল ভাল।
মাতামহ বললেন, দুষ্ট গোরু তো ও, তুমি কেন গোয়াল শূন্য করে চলে যাবে? এ আবার কেমন বিচার? অঙ্ক আর ইংরেজিতে তুমি মাস্টার, আইনে তুমি একেবারে গবেট।
প্রতাপ রায় বললেন, একে বলে ট্র্যানসফারড এপিথেট। পিতা চড়াক করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক বলেছ। যে-চড় ওর গালে মারা উচিত ছিল, সেই চড় আমি নিজের গালে মারব। সেলফ ইমমলেশন। ওই উঠোনে কাঠের পিড়েতে বসব। গায়ে ঢালব একটিন কেরোসিন, তারপর একটি দেশলাই কাঠি। যতক্ষণ গলা দিয়ে স্বর বেরোবে, ততক্ষণ বলতে থাকব, তোমার লেলিহান কামনায় আমি পুড়ছি, তোমার লেলিহান কামনায় তোমার পিতা পুড়ছে।
মাতামহ বললেন, আমরা তখন কোথায় থাকব?
কাছাকাছিই থাকবেন।
তুমি পুড়বে আমরা দেখব! কী তোমার বুদ্ধি হরিশঙ্কর। হিন্দুস্থানিরা তোমাকে বুদ্ধ বলবে। এ কি সতীদাহনাকি! আমরা চট, কম্বল, বালি এনে তার ওপর, তার ওপর চাপাব। দমকল ডেকে আনব। তারপর হরিশঙ্কর, পুলিশ এসে তোমাকে ধরবে। কোমরে কাছি বেঁধে টানতে টানতে হাজতে। তোমার হাইপার অ্যাটিচিউড বেরিয়ে যাবে।
প্রতাপ রায় বললেন, হাইপার অ্যাটিচিউড নয়, ট্রানসফারড এপিথেট।
পিতা বললেন, আপনারা কি আমার সঙ্গে তামাশা করছেন? অ্যাম আই এ লাফিং স্টক? ভুলে যাবেন না সেই প্রবাদ, খুঁটে পোড়ে গোবর হাসে। তমসা এগিয়ে আসছে, তামাশা বেরিয়ে যাবে।
যতবারই আমি কিছু বলতে চাইছি মাতুল আমাকে চেপে চেপে ধরছেন। ফিসফিস করে বলছেন, একটাও কথা নয়, উত্তাপ বেরিয়ে যাক। গ্রহ আগে শান্ত থোক।
মেসোমশাই বললেন, পেশেন্স হরিদা, পেশেন্স। অপরাধীকে ডিফেন্ড করার সুযোগ দিন। এটা একটা ফাঁদ হতে পারে।
প্রতাপ রায় বললেন, ভাগনে, চিঠির রহস্যটা কী!
মাতামহ বললেন, তোমার পিতৃদেবকে সত্যি কথা বলে শান্ত করো। আমি জানি, তুমি আমাদের সে ছেলে নও।
আমার বন্ধু সুখেন।
মেসোমশাই বললেন, সে তোমার বন্ধু নয়, শত্রু।
মাতুল বললেন, নো ইন্টারাপশন। হি ইজ কামিং আউট।
মাতামহ বললেন, ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোচ্ছে।
আমার বন্ধু সুখেন আমাকে বলেছিল একটা চিঠি লিখে দে। তোর বাংলাটা ভাল আসে। লেখাটা আমি চিঠি হিসেবে লিখিনি, লিখেছিলুম সাহিত্য হিসেবে।
মাতুল বললেন, বেলেলেটারস আর কী!
মাতামহ বললেন, তার মানে এলেবেলে।
সুখেন বলেছিল একটা মেয়েকে লেখার কথা। আমি লিখেছি প্রকৃতিকে। সত্তাকে ভেঙে দু’খণ্ড করেছি, পুরুষ আর প্রকৃতি। বৈষ্ণবের মধুরভাব আর কী? প্রকৃতিভাবে উপাসনা। আমিই কৃষ্ণ, আমিই রাধা। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ। রূপ দেখি আপনার/কৃষ্ণের হয় চমৎকার/আস্বাদিতে মনে উঠে কাম ॥ এ চিঠিতে যে নায়ক সেই নায়িকা। সেই বেদনা, যার লাগি কান্দে প্রাণ তারে পাব কীসে।
পিতা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না।
আজ্ঞে না, দুরাত্মা নই, আসল আত্মা। আত্মাকে দু’টুকরো করেছি ভেঙে। একটা পুরুষ আর একটা প্রকৃতি। দু’জানলা দিয়ে দু’জনে উঁকি মারছে। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি…
মাতুল বললেন, অ্যাঁ, বলিস কী? খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। প্রতাপ, ধরো ধরো।
পাখি নয়, প্রতাপ রায় তবলা ধরলেন। মাতুল ধরলেন,
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
ক্যামনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনো বেড়ি…
নে ধর, ধর। গলা দে না ব্যাটা,
ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম তাহার পায়।
মাতামহ উঠে দাঁড়িয়ে বাউলের মতো নাচতে আরম্ভ করেছেন। বারেবারে বলছেন, আহা, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি। পিতা বসে পড়েছেন। ছড়ির ছড় টান করতে করতে বলছেন, থেমো না, থেমে না, চালিয়ে যাও। এসরাজ সুরে ককিয়ে উঠল,
ধরতে পারলে মনো বেড়ি
দিতাম তাহার পায়ে।
আট কুঠারি নয় দরজা আঁটা
মধ্যে মধ্যে ঝালকা কাটা
উপরে আছে সদর কোঠা
আয়না মহল তায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, বলে মাতুল যখন সুরে উঠছেন, ভেতর কেঁপে যাচ্ছে। মাতামহ নৃত্য করছেন, হাসি পাচ্ছে না। চোখে তাঁর ভাবাশ্রু। গানের ফাঁকে ফাঁকে মন বলে উঠছে, বেরিয়ে পড় পিন্টু। চার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে পড়। অচিন পাখি ধরতে। কামিনী কাঞ্চনের দাসত্ব, অস্থিমজ্জার দাবি, সব পাশ কাটিয়ে, সেই অনন্তের মুখোমুখি দাঁড়া।
গান থামল, মেসোমশাই বললেন, ছেলে আপনার ব্যারিস্টার হবে। পরিস্থিতি কেমন বদলে দিলে দেখলেন? ভেতরটা কেমন তুলতুলে হয়ে গেল দেখছ হরিদা? কেমন যেন আনচান করছে।
মাতুল বললেন, কার ভাগনে দেখতে হবে তো।
পিতা বললেন, সেইজন্যেই তো ভয় পাই। জালালুদ্দিন রুমির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?
হ্যাঁ শুনেছি।
তা হলে তার একটা গল্প শোনো। গল্প নয়, রূপক। রাজার বাজপাখি একদিন এক ভাঙা আস্তানায় উড়ে এসে বসল। সেখানে গোটাকতক প্যাচা বাস করত। বাজ বললে, তোমরা কি এই জায়গাটাকে খুব উন্নত বলে মনে করো? আমার স্থান কোথায় জানো কি? রাজার হাতের কবজির ওপরে। বুদ্ধিমান পাচারা চিৎকার করে অন্য পাচাঁদের সতর্ক করে দিলে, সাবধান। ওকে বিশ্বাস কোরো না। ওর ছলে ভুলো না। আমাদের আস্তানা দখলের তালে এসেছে। তুমি হলে সেই রাজকীয় বাজ। আমার এই প্যাচাটিকে কোটর-ছাড়া কোরো না।
মাতুল বললেন, আমার নাকটা সামনের দিকে সামান্য বাঁকা বলে বাজ বলছেন? তা বলুন। কিন্তু ওকে প্যাঁচা বলছেন?
আপত্তি কীসের? রুমি কী বলছেন শোনো, only Sweet-voiced birds are imprisoned/Owls are not kept in cages. যারা মেয়েছেলের সোনার খাঁচায় ঝোঁটন পাখি হয়ে বারান্দায় দোল খায়, তাদের গায়ে মুতো কাঁথার গন্ধ। তাদের মন শ্যাওলা-ধরা উঠোনের মতো। মানুষ যদি পুঁটলির মতো সংসারের চাতালে পড়ে থাকে তা হলে তার কী হবে? নৌকোর পাটাতনে নিদ্রিত মানুষের মতো অবস্থা হবে। এক দুলুনিতেই ছিটকে পড়বে অগাধ জলে। Seek a Pearl/brother/within a shell/And seek skill from among the men of words.
মাতুল বললেন, আমি কি তা হলে কিছুই না?
তুমি তোমার ক্ষেত্রে বিরাট। তবে কী জানো, তোমার লাইনে কিছু পাপ সহজাত। সুর, সুরা আর সুন্দরী। তুমি ধরবে। তোমার লিভার শুকোবে। তোমার কণ্ঠ হারাবে। শেষে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরবে। তোমার ভাগনের হাতে গার্ডল অফ ভেনাস আছে। জানো কি?
প্রতাপ রায় বললেন, গার্ডল অফ ভেনাস? ভাগনে আমাদের শিল্পী হবে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে অভিনয়ের লাইনে যাবে। দুর্গাদাস, নির্মলেন্দু, প্রমথেশ, দানিবাবু কি গিরিশ ঘোষ বলছি না, তাঁদের কাঠামোই আলাদা ছিল। এর একটা কীরকম প্রেমিক-প্রেমিক, গার্ডল অফ ভেনাস-ভেনাস চেহারা। ব্যর্থ প্রেমিকের ভূমিকায় ফাটিয়ে ছেড়ে দেবে। মেকআপ পর্যন্ত লাগবে না। আমাদের ছবিতে একজোড়া নতুন হিরো-হিরোইন লাগালে মন্দ হয় না। বই তো এমনিতেই ফ্লপ করবে, তবুলাখখানেক টাকা বাঁচবে।
অক্ষয় ওর হাত দেখে আমার কানে কানে বলেছিল, হরিদা, খুব সাবধান, শুক্রবন্ধনী ছিঁড়ে ঝলঝলে হয়ে ঝুলছে, সরু সরু, লম্বা লম্বা, গাইনোকোলজিস্টদের মতো হাতের আঙুল, শুক্রের ক্ষেত্র ঢিবির মতো উঁচু, তাতে আবার জাল চিহ্ন, এ ছেলে ডন জোয়ান হবে। প্রমোদ আর প্রমদা, এই হবে ওর জীবনের পারস্যুট। চুলের কেয়ারি, সাজপোশাকের বাহার আর চাঁদনি রাতের বেড়ালের স্বভাব।
মাতামহ বললেন, সে আবার কী?
ফাল্গুন আসুক বুঝতে পারবেন। মাঝরাতে চাঁদের আলোয় পাঁচিলে বসে হুলো ডাকছে বুকফাটা গলায় মিঞাও, মিঞাও।
কাকে ডাকবে হরিশঙ্কর? সুখে ডালে বসি, ডাকিছ পাখিরে, ডাকিছ কি সেই পরমপিতারে?
আজ্ঞে না, হুলোর জীবনে পিতা নেই, মাতা নেই, পরমপিতা নেই, আছে শুধু প্রমদা। বালস্তাবক্রীড়াসক্ত-স্তরুণস্তাবৎ তরুণীরক্তঃ।
মাতামহ বললেন, কী যে বলো তুমি? এ হুলো সে হুলো নয়। আজ এর সমাধি হয়েছিল, সে খবর রাখো কি?
পিতা বললেন, সমাধি আর লো প্রেশারের একই লক্ষণ। ওকে নিয়ে আমি চেঞ্জে যাব।
যাক, তা হলে তোমার রাগ পড়েছে।
হ্যাঁ, একে বলে সেকেন্ড থট। কোনও কিছু করার আগে দু’বার চিন্তা করা উচিত। আমি সরে গেলে ও আরও চিঠি লিখবে। প্রেমের বন্যা বইয়ে দেবে। প্রেমের ডিসেন্ট্রি ডায়েরিয়ায় জীবনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
তা যা বলেছ। ব্যাটা যেন ডিসপেপটিক শ্রীকৃষ্ণ। ফুয়ে তেমন জোর নেই তাই বাঁশি ছেড়ে কলম ধরেছে। তুমি হবে ওর বেলপোড়া।
আজ্ঞে হ্যাঁ, বেলপোড়াই হব। বাঁশি তবু বাজে, হুলোরা ডাকে, কলম বড় সাংঘাতিক জিনিস। নিঃশব্দ প্রাণঘাতিকা। বাঁশি শুনে গোপীরা বলত, কেষ্ট মুখপোড়া ছটফট করছে, কলমের খোঁচায় তেড়ে আসে মশলার কারবারিরা। চিঠিটা পুড়ে গেল, তা না হলে ভাষাটা ভাল করে অ্যানালিসিস করা যেত। বোঝা যেত কতদূর এগিয়েছে আর কতদূর এগোবে।
প্রতাপ রায় বললেন, কী লিখেছিলে ভাগনে?
মেসোমশাই বললেন, সে কি আর মনে আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, মনে আছে। ও তো চোরাই মাল।
মাতুল বললেন, সে কী? প্রেমেও প্লেজিয়ারিজম। কোথা থেকে ঝেড়েছ?
আজ্ঞে খালিল জিব্রান থেকে। আমার সুখে তুমিই অসুখ। কেন? সে প্রশ্নের জবাব শুনে তোমার হৃদয় কি টলবে? যাকে ভালবাসি, যাকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই, যার জন্যে আমার দিবসের শ্রম, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, রাতের অনিদ্রা, সে যদি হৃদয়টি অন্যকে দান করে দিয়ে বসে থাকে তা হলে। সুখের আর কিছু থাকে কি? আমি ধীরে ধীরে বাতির মতো গলে যাচ্ছি। বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছি আতরের সুবাসের মতো। কী আর অবশিষ্ট রইল আমার? এ দিন কবে শেষ হবে! এ রাত কখন ভোর হবে!
মাতুল বললেন, দারুণ লিখেছিস তো। আমার আবার একটু গাইতে ইচ্ছে করছে।
হারমোনিয়মে ভাঙা কাঁচের মতো সুরে চুরমার চুরমার বেজে উঠল। একেবারে চড়া পরদায় গান ধরলেন।
থি বো ইক শখসকে তসব্বর সে।
অব. বো রানাই এ খয়াল কহাঁ।
দু-চার পাক খেয়ে বাংলা করলেন, একজনের রূপের কল্পনায় আমি মশগুল ছিলাম। মনে এখন আর সে নেশা খুঁজে পাই না কেন?
তেরি ফুরসত কে মুকাবিল ওই উমর।
বর্ককো পাব হিনা বাঁধতে হেঁ ।।
হায় রে জীবন, বিদ্যুতের পায়ে মেহেদি আঁকার মোকাবেলাতেই তো ফুরিয়ে যাবি!
বাইরে আবার উতলা বাতাস বইতে শুরু করেছে। মনে হয় আবার বৃষ্টি হবে। প্রতাপ রায় বললেন, এবার ওঠো। অনেক দূর যেতে হবে।
হারমোনিয়মের বেলো আঁটতে আঁটতে মাতুল বললেন, কতদূরে আর যাবে, মৃত্যুর চেয়ে দূরে তো আর যেতে পারবে না ভাই। নজর ঘেঁ হেঁ হমারি জাদএ রাহে ফনা গালিব। কি য়ে শিরোজা হৈ, আলমকে অজজাএ পৃরিশাঁকা। আমার দৃষ্টিতে মৃত্যুর পথই ধরা পড়ে, গালিব। নিয়মহারা সংসারে মৃত্যুই তো একমাত্র শৃঙ্খলা, প্রতাপ।
এসরাজে শেমিজ পরিয়ে পিতা নিজেই হুকে ঝোলাতে গেলেন। আমাকে আর কোনও আদেশ হল না। খুব রেগে আছেন। মেসোমশাই বেশ নিশ্চেষ্ট হয়ে দেয়ালে পিঠ দিয়ে আরামে বসে আছেন। প্রতাপ রায় হাতে ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে বললেন, আপনি আইনজ্ঞ?
মাতামহ উত্তর দিলেন, আরে বাপ রে বিরাট ব্যারিস্টার। ইনি উঠে দাঁড়ালে জজসাহেবরা ভয়ে কাঁপেন। মেসোমশাই ওজন বাড়াবার জন্যে মুখটাকে আরও গম্ভীর করলেন। মাতুল কানে কানে বললেন, তুই একটা কবজ ধারণ কর। সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।
প্রতাপ রায় বললেন, ওঃ ভগবান আপনাকে পাইয়ে দিলেন। এখানে ক’দিন আছেন?
মেসোমশাই অকারণে কেশে, ব্যক্তিত্বের কুচকাওয়াজ তুলে বললেন, কিছুদিন আছি। ছোট মেয়ের পরীক্ষা, বড় মেয়েটাকে একবার বড় ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাব।
কী হয়েছে?
মনে হয় সেপটিক টনসিল। প্রায়ই ভোগে।
তাই নাকি? কাকে দেখাবেন ঠিক করেছেন?
নাঃ।
আমার এক বন্ধু বড় ডাক্তার, এফ আর সি এস। বলেন তো ঠিক করে দিতে পারি। এক পয়সা লাগবে না। আমার বাড়ির নীচেই চেম্বার।
মেসোমশাই সোজা হয়ে বসে বললেন, তা হলে তো খুবই ভাল হয়। আপনাকে ঈশ্বরই মনে হয় পাইয়ে দিলেন।
দু’জনে কোরাসে বললেন, ভগবানের অসীম কৃপা!
মাতামহ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভগবান কখন কী যে করেন!
এসরাজকে ফাঁসিতে লটকাতে লটকাতে পিতা বললেন, হি ইজ দি রিয়েল কালপ্রিট।
প্রতাপ রায় বললেন, আমি আপনার কাছে কিছু আইনের পরামর্শ নিতে চাই।
অবশ্য, অবশ্য।
কলকাতায় আপনি কেস করতে পারবেন না?
কেন পারব না। তেমন জটিল কিছু হলে অবশ্যই করব। সহজ হলে জুনিয়ার দিয়ে করানোই ভাল, খরচ কম হয়।
প্রতাপ রায় বললেন, ফি ইজ নো প্রবলেম।
দ্যাট আই নো, দ্যাট আই নো!
কাল দুপুরের দিকে একবার আসব? আপনাদের দু’জনকেই একবার নিয়ে যাব। লিগ্যাল এগজামিনেশন, মেডিক্যাল চেক আপ একসঙ্গে হয়ে যাবে।
পিতা এসরাজ ঝুলিয়ে ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছিলেন, মেসোমশাই ডাকলেন, হরিদা, আপনি কী বলেন?
অতি উত্তম প্রস্তাব। তা ছাড়া গাড়ি আছে, যাওয়া-আসার অসুবিধে হবে না।
মেসোমশাই প্রতাপ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেন সেটল্ড?
মাতুল উঠে দাঁড়িয়ে কাছাকোঁচা ঝেড়েঝুড়ে পাট পাট করে নিলেন। সিনেমা টিনেমার কথা মনে হয় ভুলেই গেছেন। মুখে একটা অদ্ভুত প্রেমিক ভাব। কোথায়, কই রে তোরা, বলে ভেতর বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
কাদের খুঁজছেন? সময় তো সব নিয়ে চলে গেছে! কাল ভুল হয়ে গেছে? দিদিকে খুঁজছেন নাকি? তিনি তো মৃত্যুপারের জগতে? একটি ছবি কেবল দেয়ালে ঝুলছে। মুকু ফোলাফোলা মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে বেশ আয়েশ করে একটি হাই তুলছিল। ছোট্ট, এতটুকু এতটুকু এক সার দাঁত লাল একটি জিভ হাইয়ের আকর্ষণে ভেতর দিকে এলিয়ে পড়ছে। মাতুল টুস টুস করে দু’বার টুসকি বাজিয়ে নিজেই একটি বিশাল আকারের হাই তুললেন ইমন কল্যাণে। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই কত রকম রাগিণীতে হাই তুলতে পারিস?
চেষ্টা করে দেখিনি তো?
কনক আলু ভাজছিল। থালায় গোল গোল আলুভাজা। তেল মরছে পিটির পিটির শব্দে। টুক করে দু’খণ্ড মুখে ফেলেই হা হা করতে লাগলেন। ভীষণ গরম। কোনওরকমে সামলে নিয়ে বললেন, এটা রাগিণী নয়, রাগ, রাগভৈরব।
কনক তাড়াতাড়ি বললে, ডিশে করে দোব? খাবেন আলুভাজা?
কনকের নাকটা ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার গান আজ আর শোনা হল না। আর একদিন হবে। এর সঙ্গে একদিন আমাদের বাড়িতে এসো না?
পাঞ্জাবির পকেটে হাত পুরে এতটুকু একটা সেন্টের শিশি বের করে কনকের হাতে দিয়ে বললেন, বিলিতি। জুনো। তোমার সৌরভ বাড়ক।
কনক ভ্যাবাচ্যাকা। লাল একটা লঙ্কা হাতে তুলে নিয়ে, গোলাপ ফুলের মতো নাকের কাছে ধরে ঘোরাতে ঘোরাতে মাতুল ফিরে চললেন। সাজাহান যেন তাজমহল দেখে গোলাপ ফুল শুঁকতে শুঁকতে খাসমহলে ফিরে চলেছেন। বারমহলে ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, বুড়ো দেখেছিস?
কীরকম বুড়ো?
একেবারে থুথুরে বুড়ো। বিছানায় কাপড়েচোপড়ে হয়ে পড়ে আছে।
আজ্ঞে না।
জীবনের কোনও কিছু তেমন করে গায়ে মাখবি না। মাখামাখি করে, কাপড়েচোপড়ে, ন্যাজেগোবরে হয়ে পড়ে থাকবি না। লাইফ ইজ এ গেম। হারজিত দুই-ই আছে। দুঃখ আছে। সুখ আছে। আমাদের দুটো পা, একটা সুখের, একটা দুঃখের। দুটো চোখ, এক চোখে হাসি, এক চোখে জল। গলা কিন্তু একটাই, কখনও ফুলের মালা, কখনও জুতোর মালা। কাটা আর ফুল, ফুল আর কাটা। গো অন মেরিলি ভাগনে। ইউ গো ইয়োর ওয়ে, আই গো মাই ওন। শিমুলের বীজ ফাটা দেখেছিস?
আজ্ঞে না।
কী দেখেছিস? কুনো ব্যাং? সরু সরু তুলোর পাখায় ভর করে ছোট ছোট বীজ উড়ে আসছে। আমাদের কর্মফল। ফুঁ দিয়ে দিয়ে উড়িয়ে দে, উড়িয়ে দে। ব্রাশ অ্যাসাইড, লাভ অ্যান্ড হেট/মি বিসাইড মি/ লাফটার আফটার/ হলটার, ফলটার/ রাইজ টু দি অলটার/ নান টু লুক আফটার দিই।
ভরাট গলায় ইংরেজি গান শুনিয়ে মাথায় গোটাকতক টুসকি মেরে মাতুল নেমে গেলেন নীচে। গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ হল। শব্দ মিলিয়ে গেল দূর থেকে দূরে। বেশ রাত হয়েছে। চারপাশ কেমন যেন সিমসিম করছে। অশরীরীরা নেমে আসছে রাতের জলসায়। মানুষের নাচঘর ঝিমিয়ে এল?
বিরাট কার্পেটে মাতামহ মাথা নিচু করে মাঝখানে একা বসে আছেন। মাথা মৃদু মৃদু দুলছে। ঠোঁটে সেই বাঁকা হাসি। যে-হাসির অর্থ দেখেছি অনেক, দেখছি অনেক, দেখব অনেক। পক্ষহীন শোনো বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার।
খুব মৃদু স্বরে বললেন, তোমার সেই সারমনের খাতায় লিখে নাও, নাচালে নাচব না। হুঁশ নিয়ে মানহুশ হব। আরও লিখে নাও, প্রেমের ডিসেন্ট্রিতে পিতার বেলপোড়া। কিন্তু আমি এখন যাই কোথা?
মাতামহকে আর তেমন সাহস করে বলতে পারছি না, কেন? এখানেই থাকবেন? আমার নিজের আসনই টলে গেছে। কনক এসে হাঁটু গেড়ে বসল। মাতামহের মুখের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে বলল, কী, খাওয়াদাওয়া হবে? রাত তো অনেক হল?
মাতামহ সেইভাবেই দুলতে দুলতে বললেন, কে কী অবস্থায় আছে?
কনককে আর উত্তর দিতে হল না। মেসোমশাই মেঘ গর্জনের গলায় ডাকলেন, কনক, তুমি এদিকে চলে এসো। কনক করুণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে উঠে গেল। মেসোমশাইয়ের এই ডাকের অর্থ আমি বুঝি। ঘৃণা-মেশানো ডাক। মেয়েকে বলছেন চলে এসো। সন্দেহজনক চরিত্রের ছেলের কাছাকাছি থেকো না। দাগ লেগে যাবে। যৌবন বড় ছোঁয়াচে। বসন্তের টিকে হয়, যৌবন ব্যাধির যে কোনও প্রতিষেধক নেই।
মাতামহ মুখ তুলে তাকালেন। সর্ববোদ্ধার সেই হাসিটি আরও জোরদার হয়েছে। মাথা নড়ছে। কী বুঝলে, কী বুঝলে না? পাথরের মতো মুখ করে খাওয়া শেষ হল। রাত জানে না, কী হবে, কী হবে না। দিনের আলোয় বোঝা যাবে, আমি প্যাঁচা না অন্য কোনও পাখি। আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছাড়াছাড়া, টুপটাপ। গাছপালার গন্ধ ভেসে আসছে। অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, দূর কোণে আমি দাঁড়িয়ে আছি, নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছি। মাটি তোলার শব্দ হচ্ছে ঝুপঝাঁপ৷ সতীমার চেহারা ভাসছে চোখের সামনে। চোখদুটো যেন পেতলের।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে কনক পাশে এসে দাঁড়াল ভয়ে ভয়ে। এত দুঃখেও হাসি পেল। এ যেন শ্রীরাধার অভিসার। চরিত্রহীন কেষ্ট বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে। হাতে বাঁশির বদলে ব্রাশ। তার ওপর আধ ইঞ্চি টুথপেস্ট।
বুকের কাছে ব্লাউজের ভেতর থেকে খানচারেক ডায়েরির পাতা বের করে কনক আমার বাঁ হাতে গুঁজে দিয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। একটাও কথা বললে না। বোঝাই গেল পিতার নিষেধ। ছেলে বখে গেছে। পাশের বাড়ির আইবুড়ো মেয়েকে প্রেমপত্র লিখেছে। খলিফাঁদের দেশ হলে ব্যাটাকে শূলে চাপানো হত। শুধু শূল নয়, গরম শূল।
উত্তর মহল অন্ধকারে ডুবে গেছে। সংসার নিস্তব্ধ। যে-ঘরে আসর বসেছিল, সেই ঘরেই মাতামহর বিছানা পড়েছে। পদ্মাসনে খাড়া বসে আছেন। রাত বাড়ছে। এইবার বেটির সঙ্গে যত মনের কথা প্রাণের কথা হবে। মশারিতে ঢোকার সময় আমার মাথায় হাত রেখে মন্ত্র জপ করে। দিয়ে বলেছেন, কোনও ভয় নেই। মেঘ আসে মেঘ কেটে যায়। সূর্য চাপা পড়ে গেছে দেখে ভেবো না যেন সূর্য আর উঠবে না। রাত আসে দিন হবে বলে।
পিতা ঘরের দরজা বন্ধ করে দ্রুত পায়চারি শুরু করলেন। মশারির ভেতর মটকা মেরে পড়ে আছি। ডায়েরির যে-পাতায় মায়া আর কনক সম্পর্কে আমার জ্ঞানগর্ভ কথা লেখা ছিল কনক বুদ্ধি করে সেই ক’খানির পাতা ছিঁড়ে রেখেছিল। নইলে কী যে হত! সেসব যা কথা, যে-কোনও পিতা পড়লেই পুত্রকে দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে পা থেকে জুতো খুলে প্রহার। ব্যাটার ডস্টয়েভস্কি হবার শখ হয়েছে। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।
সবচেয়ে অপমানের মেসোমশাইয়ের ব্যবহার। আমার যেন লেপ্রসি হয়েছে। মেয়ের ছোঁয়াচ লাগলে গলে গলে অঙ্গ খসে যাবে। প্রেম কি লেপ্রসি! বয়স্ক মানুষরা বিবাহ বোঝেন, প্রেম বোঝেন না কেন? এই মাঝরাতে একবার গলা ছেড়ে ধরব নাকি? বেশ একটু খেপু-খেপু ভাব আসছে ভাঙ ভাঙ কারার মতো।
তুণ্ডে তাণ্ডবিনীং রতিং
বিতনুতে তাবলীলব্ধয়ে
কর্ণক্রোড় কড়বিমনী ঘটয়তে
কর্ণাৱঁদেভ্য স্পৃহাং।
চেতঃপ্রাঙ্গণ-সঙ্গিনী বিজয়তে
সৰ্বেন্দ্ৰিয়াণাং কৃতিম
নো জানে জনিতা কিয়দ্ভিরম্তৈঃ
কৃষ্ণেতিবর্ণদ্বয়ী ॥
মশারির ভিতর গাট হয়ে বসে কীর্তনীয়া প্রেমদাস বাবাজির মতো ধরব নাকি, তুণ্ডে তাণ্ডবিনীং!
পিতা মশারির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মশারির পাশ তুলে প্রথমে টেনে নিলেন পাশবালিশ। মাথার বালিশ ধরে টানছেন, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম, কী হল, শোবেন না?
এক্সকিউজ মি। তোমার পাশে শুতে আমার গা রি রি করছে, ভেতরটা ছি ছি করছে। দেহের খবর জানি না, তোমার মন অপবিত্র হয়ে গেছে। তুমি শুধু অপবিত্র নও, তুমি ভণ্ড। তোমার পঞ্চেন্দ্রিয় নৃত্য করছে থই থই, তাতা থই থই।
বালিশ ধরে এক টান মারলেন। তলায় ছিল দু’সেলের ছোট্ট একটা টর্চলাইট। ঠিকরে পড়ল মেঝেতে। পিতা বললেন, যাঃ ফিনিশ।
১.১৫ Inside my brain a dull tom-tom begins
কোয়ারেনটাইন চলেছে। পুত্র ইনফেকশাস ডিজিজে আক্রান্ত। আমগাছে মুকুল ধরেছে। প্রেমের মুকুল। গন্ধে চারপাশ ম ম করছে। ভ্রমর উড়ছে ভ্যানভ্যান করে। কোণের ঘরে আশ্রয় মিলেছে। বড় ঘরের, পিতার বাঘথাবা পালঙ্ক থেকে বিতাড়িত। এ ঘরটা মন্দ নয়, তবে একটু একপেশে। মাঝরাতে ভয়ভয় করে। এ বাড়িতে শরীরীর চেয়ে অশরীরী বেশি। রাতবিরেতে তাদের আনাগোনার প্রমাণ মেলে নানাভাবে। ছাতে পদশব্দে, জনপ্ৰাণীহীন একতলার অন্ধকার সাম্রাজ্যে ফিসফিস শলাপরামর্শে। মাঝরাতে বাড়িটা আমাদের হাতের বাইরে চলে যায়। আর তখনই মনে হয় পৃথিবীতে আমি বড় একা। তখনই মনে হয় পৃথিবীর কী-ই বা জানি। পৃথিবীর বাইরেটা তো সম্পূর্ণ অজানা! ভাবতে বেশ ভাল লাগে! জ্ঞানীরা বলেন, ভেবে কী হবে, কাজ করে যাও। কীরকম কাজ! যে কাজে কর্মফল নেই। He, to whom the eternal world speaketh, is relieved of much questioning.
অনেকক্ষণ সকাল হয়েছে। আকাশ আমার মনের মতোই ঘোলাটে। ঘরের বাইরে একবার বেরিয়েছিলুম। হাওয়া তেমন সুবিধের মনে হল না। কনক আড়চোখে তাকিয়ে সরে গেল। মুকু তো তেমন কথাই বলে না। মুখ খুললে বিদ্যে লিক করে বেরিয়ে যেতে পারে। মেসোমশাই ব্রাশ ছেড়ে নিম দাঁতন ধরেছেন। বারান্দায় মুখ ঝুলিয়ে চিবোচ্ছিলেন, আর থুথু করে নীচের বাগানে ছিটোচ্ছিলেন। পিতা অসম্ভব রকমের গম্ভীর মুখে হাতে একটা হাতুড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন। বেশ কঠিন কোনও কাজ শুরু করার মতলব। আমি জানি, আগেও দেখেছি, মন তখন তোলপাড় করে তখন বিচিত্র কোনও কাজ নিয়ে ভীষণ মেতে ওঠেন। একে বলে, কাজের বাঁধন দিয়ে মন-তুরঙ্গকে বশে রাখা।
এক কাপ চা জুটেছে। অন্য কোনও কাজের ফরমাশ এদিকে আসছে না। অন্যদিন এতক্ষণে হরেক রকম কর্তব্যকর্ম ঘাড়ে চেপে বসত। আজ একেবারে স্বামী মুক্তানন্দ হয়ে চৌকিতে পা তুলে বসে থাকার সুযোগ মিলে গেছে। জানি না, কোথাকার জল কোথায় গড়াবে। মন বলছে, খেলা বেশ ভালই জমবে। কেমন উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে এসে গেল। নাও এখন ম্যাও সামলাও। সুখেনের সঙ্গে একবার দেখা হোক, ব্যাটার পিন্ডি চটকাব।
মাতামহ ভোর না-হতেই চলে গেছেন। যাবার সময় বলে গেছেন, তেমন ঝামেলা দেখলে চলে আসিস। আমার খুপরিতে দু’জনে মজা করে থাকব। একটা খাবার যা আবিষ্কার করেছি! একেবারে পাহাড়িবাবার ফর্মুলা। একদিন খেলে তিনদিন আর হাঁ করতে হবে না। লাউ সেদ্ধ করে, গুড় আর একটু গাওয়া ঘি দিয়ে চটকে, এক ড্যালা মেরে দাও। কে কার পরোয়া করে না বলে বললেন, কে কার পরোটা ভাজে! পেট নিয়েই তো মানুষ নাকাল। পেটটাকে ম্যাকাডামাইজ করতে পারলে কার দাসত্ব! হু কেয়ারস হুম। তোমার চোখ তুমি রাঙিয়েই রাখো, আমি শিস দিয়ে যাই ডালে বসে। পাখি হয়ে ডাক দিতে থাকি পরমপিতাকে। মনে হচ্ছে একেবারে একা লড়তে হবে না। পক্ষে মাতামহ আর মাতুলকে পাব।
হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে। কিছু একটা ভাঙা হচ্ছে। তুলো ধোনার যন্ত্র পড়ে রইল তুলোর অভাবে, তাই কি পিতা দেয়াল ভাঙার দিকে চলে গেলেন সব ছেড়ে। ভাঙার মতো দেয়াল এ বাড়িতে অনেক। আমার ওপর রেগে গিয়ে বাড়িটাকে অংশে অংশে ভেঙে মাঠময়দান করে তাঁবুর ব্যবস্থা হবে নাকি? বলা যায় না, কোন পরিকল্পনায় কী কাজ শুরু হল! কার ক্রোধ কখন কীভাবে কীসের ওপর যে গিয়ে পড়বে। আমাদের বিখ্যাত মেনিদা একবার মেয়ের ওপর রেগে হাঁটাপথে হরিদ্বার চলে গিয়েছিলেন। মাসখানেক বেপাত্তা। ফিরে এলেন ন্যাড়া হয়ে। গয়ায় নিজের নামে নিজেই পিণ্ড উৎসর্গ করে। বললেন, আমি আর বেঁচে নেই, আমাকে কারুর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যার যা খুশি করে যাও। পাড়ায় পেছনে লাগার মানুষের তো অভাব নেই। তারা সস্ত্রীক মেনিদাকে রাস্তায়। দেখলেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দাদা ইনি কি আপনার বিধবা স্ত্রী! বিয়েটা কি বিদ্যাসাগর মশাই দিয়ে গিয়েছিলেন?
মেসোমশাইয়ের গলা ভেসে এল, হরিদা, আজ বেরোবেন না? ছুটি নাকি?
না, ছুটি হবে কেন?
তা হলে সাতসকালে বাথরুমের দেয়াল ভাঙতে বসলেন?
কাজটা অনেকদিন পড়ে আছে। করব করব করে করা হচ্ছে না। খানিকটা এগিয়ে রাখি। রবিবার এসে গেল।
কী করতে চাইছেন?
পুরনো প্লাস্টার ঝরিয়ে ফেলব। শিলে গুঁড়ো করে অ্যাগ্রিগেট বের করব।
সে আবার কী?
আপনারা যাকে বালি বলেন, কনস্ট্রাকশনের ভাষায় তার নাম অ্যাগ্রিগেট।
সেকী মশাই! পুরনো প্লাস্টার গুঁড়ো করে আবার প্লাস্টার করবেন? ধরবে? ঝরে পড়ে যাবে। আমার লাইফে শুনিনি। পণ্ডশ্রম হবে।
ওর বাপ ধরবে। ধরাতে জানলেই ধরবে।
কিছু বালি কিনলেই তো হয়।
সে তো সবাই করে। তাতে আর নতুনত্ব কী আছে! সবসময় নতুন কিছুর অন্বেষণ করুন। সামথিং নিউ। সামথিং নিউ।
ঠাঁই, ঠাস, ধাঁই, ধাস। হাতুড়ির শব্দ উঠল। ঝড়াস ঝড়াস প্লাস্টার খসছে। বাথরুমের বারোটা বেজে গেল। আর তো একপাশে বসে থাকা যায় না। এসব অদ্ভুত কাজের একমাত্র দোসর আমি। এগোতেই হয়। এগিয়ে গিয়ে বলতে হয়, কী করতে হবে বলুন?
দরজার কাছে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে বললুম, কোনও সাহায্যে লাগতে পারি?
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, ও, নো নো। গো, অ্যান্ড রাইট ইয়োর লেটার্স। লাভ লেটার্স। সংসারে যুবতীর অভাব নেই। যুবকের কর্তব্য করে যাও। বোতল বোতল কালি আছে। দিস্তে দিস্তে কাগজ আছে। কোকিলের ডাকে সাড়া দাও। কাননে বসন্ত এসেছে, বসন্ত।
ধাই ধাস, ঠাই ঠাস। হাতুড়ির শব্দ শুরু হল। আবার কোণের ঘরে প্রত্যাবর্তন। চেনা মানুষ অচেনা হয়ে গেলে, নিকট দূর হয়ে গেলে বড় দুঃখ হয়। বেশ জোরে মনের মতো কয়েক চরণ কবিতা আবৃত্তি করলে কী হয়। বেশ জুতসই কয়েক লাইন:
Among the windings
of the violins
And the ariettes
of cracked cornets
Inside my brain a
dull tom-tom begins
Absurdly hammering
a prelude of its own
Capricious monotone
That is at least one
definite false note.
রাস্তায় হইহই উঠেছে। ভাল্লুক টাল্লুক বেরোলে এরকম হতে পারে। সাতসকালে ভাল্লুক আসবে কোথা থেকে। চিৎকার, চেঁচামেচি। বারান্দার দিকে কনক দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সরে গেল। বয়েই গেল। তুমি আজ আছ কাল নেই। তোমার ভালবাসা, ঘৃণা কোনও কিছুরই পরোয়া করি না।
রাস্তায় প্রবল উত্তেজনা। সবাই একমুখো দৌড়াচ্ছে আর বলছে, ধরেচে, ধরেছে। কী ধরেছে রে বাবা! চোর না ডাকাত! বারান্দায় আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দীনু ডাকলে, শিগগির নেমে আয়।
নীচে নামতেই যাঁড়ের গলায় চিৎকার করে উঠল, শালা চিকের আড়াল থেকে বেনারসি বাইজিদের মতো মুখ বের করে রাস্তা দেখছিস, এদিকে কী হয়েছে জানিস?
আস্তে বল, আস্তে। কী হয়েছে? আস্তে!
শালা, সুখেনকে ধরে ধোলাই দিচ্ছে।
কী করেছিল?
জবাকে নিয়ে মাসির বাড়ি লুকিয়ে বসে ছিল। সকালে দুর্গাপুর পালাবে বলে যেই বেরিয়েছে, ক্যাচ, কট, কট।
তা আমরা কী করব? আমাদের কী করার আছে?
তার মানে? প্রেমের যূপকাষ্ঠে একটা ছেলেকে বলি দেওয়া হচ্ছে, একজন রিয়েল প্রেমিক, আমাদের কিছু করার নেই! দুনিয়ার প্রেমিক এক হও। আমরা শুধু প্রেমের কথা বলি। ও করে দেখিয়ে দিলে। আমরা থিয়োরিটিক্যাল, ও প্র্যাকটিক্যাল। কাল কালীঘাটে গিয়ে জবাকে বিয়ে করে এসেছে। কপালে পাঁঠার রক্তের মতো এখনও এতটা সিঁদুর লেগে আছে। সেই প্রেমিককে পাঁঠাবলি দেবে, আর আমরা প্রেমের সাপোর্টার হয়ে চুপ করে বসে থাকব! চলবে না, চলবে না।
ভাগ্য ভাল, ওপরে হাতুড়ি চলছে, নয়তো দীনুর এই গলা ওপরের কানে গিয়ে আর এক নতুন ঝামেলা তৈরি করত। দীনু তো জানে না সুখেনের কলকাঠি কে নেড়েছিল। সুখেনের আগেই তো আমি বলি হয়ে গেছি। দীনুপাঠা সে খবর রাখে! সারাজীবন চেঁচিয়েই মোলো।
আমি গেলে আর এক কাণ্ড হবে।
তুই ভীষণ স্বার্থপর। তোদের ফ্যামিলিটাই স্বার্থপরের ফ্যামিলি।
হ্যাঁ রে, তাই তো বলবি। জানিস আমার কী হয়েছে?
দীনুকে অল্প কথায় ঘটনার আভাস দিতেই দীনু লাফিয়ে উঠল, শালা, কামাল করে দিয়েছিস। সাধে বলে, পেন ইজ মাইটিয়ার দ্যান সোর্ড। এক কলমের খোঁচায় টসকে দিয়েছিস। কী লিখেছিলিস মাইরি। জবা তো তা হলে তোরই বউ রে। মেয়েটা মাইরি…।
দীনু একটা চোখ অ্যায়সা বোজাল, মনে হল সারাজীবনের মতো দেড়চোখো হয়ে গেছে। দীনু চোখ খুলে বললে, এ অপমান, আমাদের সকলের অপমান। কেমন করে পকেটে পুরি, একটা কিছু তো করতেই হয়।
কী করতে চায় ওরা সুখেনকে নিয়ে?
আরে জবার সেই কাকাটা, জানিস তো কী জিনিস! সেই মাল, আর সুখেনের দাদা, দুটো পয়মালে মিলে প্রথমে সুখেনের মাথার অর্ধেকটা কামাবে, তারপর এক গালে চুন আর এক গালে কালি মাখাবে, মাখিয়ে ইজের পরিয়ে পেছনে ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে পাড়ায় পাড়ায়। ঘোরাবে। আর হ্যাঁ, একগাদা ছেঁড়া জুতো জোগাড় করেছে। মালা করে গলায় ঝোলাবে। দেশে ব্যর্থ প্রেমিকের তো অভাব নেই। প্রেমে সাকসেস দেখলে জ্বলে পুড়ে মরে। সেই মালেরা জুটেছে। তারাই মদত দিচ্ছে।
কী করা যায় বল তো? রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে।
আর একটা সিক্রেট খবর আছে। সুখেনের দাদা। মালকে চিনিস?
দেখেছি, তবে তুই কোন চেনার কথা বলছিস কে জানে!
দীনু আবার দেড়চোখো হয়ে বললে, মেয়েছেলে আছে।
তার মানে? মেয়েছেলে তো থাকবেই। বিয়ে তো লোকে মেয়েছেলেকেই করে।
তোর মাথা। এ মেয়েছেলে সে মেয়েছেলে নয়। যে-মেয়েছেলে বাজারে থাকে। বুঝলে চাঁদু। যারা নিজেরা পাপ করে তারাই সবচেয়ে বড় মর্যাল গার্জেন হবার চেষ্টা করে। সব গেল সব গেল। বলে তারাই সবচেয়ে বেশি চেল্লামিল্লি করে। আমার কী মনে হয় জানিস, ব্যাটা জবাকে হাতাবার। তালে আছে।
কী করে?
খুব সোজা। রক্ষকই ভক্ষক হয়ে বসবে। ইতিহাস পড়ে দেখ, প্রেমিকরা চিরকাল ফ্যা ফ্যা করে বেড়ায়। কিন্তু লম্পটদের কখনও মেয়ের অভাব হয় না। মেয়েরা মাইরি লম্পটদেরই ভালবাসে।
তুই বড় শালা আর মাইরি বলিস। ভদ্রসমাজে মিশবি কী করে?
রাখ তোর ভদ্রসমাজ! ওই তো ভদ্রসমাজের ব্যাপার। সুখেনের চে খারাপ ছেলের সঙ্গে জবার বিয়ে দেবে সেও ভি আচ্ছা, তবু একটা ছেলে যেচে একটা মেয়েকে বিয়ে করলে গাধার পিঠে চড়াবে। এই তোর ভদ্রসমাজ। এর চেয়ে বিলাসপুরের আদিবাসীরা ঢের ভাল। সুখেনটাকে কী করে তা হলে বাঁচানো যায়?
ব্যাটা পালাল যখন আরও দূরে পালাতে পারল না?
মনে হয় ঝড়বৃষ্টির জন্যে আটকে গিয়েছিল।
আমাদের দলে কাকে কাকে পাবি?
বুঝতে পারছি না। সুখেনেরও তো রাইভ্যাল ছিল অনেক। জবার পেছনে ক’টা ঘুরছিল কে। জানে? তবে শিবুদাকে আমাদের দলে পাবই।
কী করে বুঝলি?
এ পাড়ায় শিবুদাই একমাত্র সাকসেসফুল প্রেমিক। থিয়েটারের মেয়েকে বিয়ে করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এলেবেলে বিয়ে নয়, একটা ফলও হয়েছে। তা ছাড়া লড়িয়ে মানুষ। একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই সব শালা ঠান্ডা।
আবার শালা?
শালাদের শালা বলব না তো কি ভগিনীপতি বলব! তুই শালা আচ্ছা এক নীতিবাগীশ হয়েছিস। এরপর বলবি, গোরু গলিতে বাথরুম করে গেছে।
ওপরে হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল। মেসোমশাই আর কনক দু’জনেরই গলা একসঙ্গে পাওয়া গেল, কী হল, কী হল?
দীনু বললে, তোদের কিছু একটা ড্যামেজ হয়ে গেল। ভূত ছেড়ে যাবার সময় এইরকম শব্দ হয়।
মেসোমশাই বলছেন, লেগেছে আপনার? খুব লেগেছে! কেন যে সাতসকালে ওটার পেছনে লাগতে গেলেন। বেশ তো ছিল।
দীনু বললে, তোদের বোধহয় ছাদ ভেঙে পড়ল।
দাঁড়া আমি দেখে আসি।
হাতুড়িহীন পিতা কুঠারহীন পরশুরামের মতো উত্তরের বারান্দায় ছোট একটা মোড়ায় ডান পা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে স্থির হয়ে বসে আছেন। চুন আর বালির প্রলেপ ভেদ করে কুঁচফলের মতো অনবরতই নতুন নতুন রক্তের দানা ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে। মুখে যন্ত্রণার কোনও রেখা নেই। টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার মতো পায়ে রক্ত ফুটে ওঠার শোভা দেখছেন।
মেসোমশাই উদ্বেগ-মাখানো গলায় বলছেন, কিছু তো একটা করতে হয় হরিদা। বালিতে চুনেতে রক্তে মাখামাখি।
হ্যাঁ, কিছু তো একটা করবই। তবে যতটা বেরোবার, আগে বেরিয়ে যাক। আপনারা ব্যস্ত হবেন না। এরকম দুর্ঘটনা আমার প্রায়ই হয়। একে বলে প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড।
দীনু আমার পেছন পেছন ওপরে উঠে এসেছে। একমাথা কোকড়ানো কোঁকড়ানো চুল। ফরসা টকটকে রং। বুক-খোলা টি শার্ট। এতখানি চওড়া বুক। এ পাড়ার সবচেয়ে শিক্ষিত পরিবারের ছেলে। কিছুকাল পিতার কাছে অঙ্ক বুঝে নিতে আসত। লেটারফেটার নিয়ে পাশ করেছে। এখন সি এ পড়ছে। পাশ করেই নিজেদের ফার্মে বসে পড়বে।
দীনু পায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললে, পিন্টু, শিগগির গরম জল আর বোরিক তুলে নিয়ে আয়।
পিতা হাসিহাসি মুখে বললেন, আরে, দীনু যে, কেমন আছ?
আমি তো ভাল আছি কাকাবাবু, আপনি এ কী কাণ্ড করেছেন?
তোমার বাবা কেমন আছেন?
চিঠি দিয়েছেন। ভালই আছেন।
তিনি এখন কোথায়?
লন্ডনে।
আই সি।
আমি ডক্টর সেনকে ডেকে আনি।
প্রয়োজন হবে না। মাইনর ব্যাপার। লেট মি ব্লিড। সবকিছুরই একটা শেষ আছে। অত বড় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও একসময় শেষ হয়েছিল।
তা হয়েছিল, কিন্তু আহতদের এখনও ফেলে রাখা হয়নি। পিন্টু, তুই ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি ড্রেসিংটা করে রাখি।
তুই পারবি?
পারব না মানে? রেডক্রসের ট্রেনিং নিয়ে রেখেছি কী জন্যে! তুই ডাক্তারবাবুকে একেবারে ধরে নিয়ে আয়। বলবি এ টি এস নিয়ে আসতে।
পিতা বললেন, ডাক্তার, এ টি এস কিছুই লাগবে না। এমন একটা মারাত্মক কিছু হয়নি। সামান্য একটু বরইজ, একটু ব্লিডিং।
এখন আপনি আমাদের হাতে। আমাদের মতে চলতে হবে। পিন্টু তুই চলে যা।
সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে শুনলাম দীনু কনককে বলছে, দিদি, গরম জল বসিয়েছেন?
রাস্তায় বেরিয়ে মনে হল, পাড়া আজ বিশেষভাবে জেগে উঠেছে। পাড়ায় সাড়া পড়ে গেছে। মোহনদার সেলুনের সামনে বিশাল ভিড়। সুখেনের মাথা কামানো হচ্ছে। সমাজের চোখ লাল হয়েছে, পেট গরম হয়েছে। কোথা থেকে একদল দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ নীতির হাতিয়ার নিয়ে নিরস্ত্র একটি ছেলেকে চেপে ধরেছে। বাধা দেবার কেউ নেই। সুখেন কী এমন অন্যায় করেছে! এমনি সব নাকে কেঁদে অস্থির, মেয়ে বড় হয়েছে, পাত্র জুটছে না, জুটলেও কাড়ি টাকা চাইছে, আর পাত্র যখন নিজে যেচে এসে মাথা মুড়োতে চাইছে, তখন সব বেঁকে বসছেন। মানুষ এক আজব চিজ।
দু-চারজন রুগি বসে আছেন চেম্বারে। ডাক্তারবাবু এক অল্পবয়সি মহিলার বুকে স্টেথিস্কোপ চেপে ধরে বলছেন, জোরে জোরে নিশ্বাস নাও, আরও জোরে, হাঁ করে। হাঁ করে নিয়ে ভস করে ছাড়ো। টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে এক তিরিক্ষি চেহারার ভদ্রলোক ক্রমাগত বলে চলেছেন, ছ’টা ক্যাপসুল পড়ে গেল ডাক্তারবাবু, এখনও ভসভসে ভাবটা যে গেল না।
ডাক্তারবাবু নির্বিকার। বুক থেকে পিঠে চলে গেছেন। মহিলা হাপরের মতো ভসভস করে চলেছেন। পিঠ পরীক্ষা করতে করতেই চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। মুচকি হাসি খেলে গেল মুখে। স্টেথিস্কোপ তুলে নিয়ে সোজা হয়ে বসে বললেন, কী সংবাদ বিদুর?
তিরিক্ষি ভদ্রলোক মরিয়া হয়ে বললেন, ভসভসে ডাক্তারবাবু।
আরে দুর মশাই। আপনার ভসভসের নিকুচি করেছে। রোজ মাংসর স্টু খাওয়াচ্ছেন?
আপনি তো বলেই খালাস। অত পয়সা কোথায়?
তা হলে ভসভসেই হবে। কারও বাবার ক্ষমতা নেই জিয়ার্ডিয়ার রুগিকে হাই প্রোটিন ছাড়া ভাল করে।
ভদ্রলোক বললেন, ডাক্তারবাবুদের এই এক দোষ, বড়লোক, গরিবলোক আলাদা করতে পারেন না। সব যেন সমান। মুড়িমিছরির এক দর।
বড়লোকের অসুখ বাধিয়ে গরিব গরিব করে চেল্লালে আমি কী করব? ভগবানের দরবারে নালিশ পেশ করুন। ওই হলদে ট্যাবলেট তিরিশটা খাওয়ান। শাকপাতা একদম চলবে না।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কী খবর?
একবার যেতে হবে ডাক্তারবাবু। বাবার পায়ে প্লাস্টার ভেঙে পড়েছে।
প্লাস্টার করতে হবে?
আজ্ঞে না, কেটেকুটে গেছে। এ টি এস দিতে হবে।
তোমার বাবার চিকিৎসা করতে সাহস হয় না। আমার জ্ঞান বেরিয়ে পড়বে। উনি হলেন ডাক্তারের ডাক্তার। চলো, দেখি কী করা যায়!
কোঁত পেড়ে চেয়ার থেকে নিজেকে ঠেলে তুললেন। বয়েসের ভার, মেদের ভার। মেয়েরা মিউমিউ করে বললেন, বেরিয়ে যাচ্ছেন! আমরা অনেকক্ষণ বসে আছি।
আরও একটু বসুন। সবুরে ম্যাওয়া ফলে। ওষুধের গন্ধে অসুখ অর্ধেক ভাল হয়ে যাবে।
রিকশার তিনের চার ভাগে ডাক্তারবাবু। একের চার ভাগে আমি। ঈশ্বরের কী সুন্দর ব্যালেন্স। মানুষের শরীরেও জোয়ার-ভাটা। এদিক ফোলে তো ওদিক চোপসায়। রিকশাঅলা টানতে পারছে না। লোড তো কম নয়। ডাক্তারবাবু নস্যি নিতে নিতে বললেন, তোমার বাবার একটা বিয়ে দাও। বেশ রণচণ্ডী-মার্কা একটা মেয়ের সঙ্গে। মা ছাড়া এ মানুষকে সামলাবে কে? এই নিয়ে ক’বার হল? এই হাত উড়ে যাচ্ছে, এই পা উড়ে যাচ্ছে। সেই বেলাটাটা বেরিয়েছে?
আজ্ঞে না মনে হয়।
বুঝবে ঠ্যালা পরে। ওই কাঁটা এখন ব্লাডস্ট্রিমে ঘুরছে। সোজা যেদিন হার্টে গিয়ে ঢুকবে সেদিন ফিনিশ।
উনি বলেন, সে হজম হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, হজমা হজম। তবে বলা যায় না, ওঁর রক্ত তো সবসময় ফুটছে। কাঁটা হয়তো ভেপার হয়ে নাক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
ওদিকে মনে হয় সুখেনকে নিয়ে প্রসেশন বেরিয়ে পড়েছে। মোহনদার সেলুনের সামনে ক্যানেস্তারা বাজছে মহরমের বোলে। এসব কাজে লোকের অভাব হয় না। কারও সর্বনাশ করার চেয়ে উৎসাহের কাজ আর কী আছে!
ওদিককার জটলার দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে বলো তো? আজ কি কোনও পুজোপার্বণ আছে? ছট পুজোটুজো!
আজ্ঞে না। সুখেনের মাথা ন্যাড়া করা হচ্ছে।
ও, মানসিক ছিল!
মানসিক নয়। কাল রাতে জবা বলে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে।
ও, ট্রাইব্যাল ম্যারেজ।
না, রাক্ষস বিবাহ।
খেয়ে ফেলেছে।
খাবে কেন? সুখেন আমাদের চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে। জবাকে হরণ করে নিয়ে কাল রাতে কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করেছিল, আজ সকালে ধরা পড়েছে। এখন মেয়ের কাকা আর ছেলের দাদা দুজনে মিলে ধরে ন্যাড়া করে, মুখে চুনকালি মাখিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরাবে।
জবা কোন বাড়ির মেয়ে বলো তো?
ওই তো যার বাবার দু’বার বিয়ে, অনেকদিন হল নিরুদ্দেশ।
ও, বিশুবাবুর মেয়ে। আরে সে মেয়েটার তো খুব খারাপ একটা অসুখ আছে গো! ছেলেটা রামছাগল।
পায়ের ধপাস ধপাস শব্দ করে ডাক্তারবাবু সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন। দীনু পাকা ডাক্তারের মতো কাজ করেছে। ওই কড়কড়ে বালি আর চুন একটু একটু করে ক্ষতস্থান থেকে ছাড়িয়েছে। পায়ের অবস্থা দেখে গা শিরশির করে ওঠে। নুনছাল গুটিয়ে পাকিয়ে গেছে। সাদা দগদগে। ঘামের মতো বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরোচ্ছে। কনক পাকা নার্সের মতো দীনু ডাক্তারের হুকুম তামিল করছে। আমি কোথায় প্রভু! এই এক্সপার্টদের জগতে আমি এক কুণ্ড। কিছুই পারি না, কিছুই জানি না। তফাত যাও তফাত যাও বলে সবাই হড়হড় করে এগিয়ে চলেছে। দীনুতে কনকেতে যেরকম মাখামাখি, ‘ব্রেড অ্যান্ড বাটার’ অবস্থা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে শুভযোগ মেসোমশাইয়ের দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। কনকের বাবাও বিলেত-ফেরত, দীনুর বাবাও বিলেত-মারা মানুষ। দুই বেয়াইয়ে জমবে ভাল। মিথ্যে বলে লাভ নেই। দু’জনকে পাশাপাশি দারুণ মানিয়েছে। দীনু একটা জামাইয়ের। মতো জামাই। কনক একটা বউয়ের মতো বউ। গন্ধর্ব আর কিন্নরী। চোখের সামনে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। না, আমার মনে কোনও ক্ষোভ নেই। আমি নিজে ঈশ্বরের দরবারে প্রার্থনা জানাচ্ছি, নকের যেন দীনুর সঙ্গেই বিয়ে হয়। আজ হোক, কাল হোক, ছমাস পরে তোক, যেন হয়। মেসোমশাই কাঁচা ছেলে নন। দু’মেয়ের বাপ। জামাই চেনেন।
ডাক্তারবাবু দীনুকে ভালই চেনেন। বললেন, বাঃ তুমি তো আমার কাজ অনেকটা এগিয়েই রেখেছ। সি এ না হয়ে ডাক্তার হলেই তো পারতে।
মেসোমশাই বললেন, তুমি বুঝি সি এ পড়ছ? খুব ভাল লাইন। যেমন রেসপেক্টবল তেমনই রিওয়ার্ডিং।
এই তো, এই তো মাছে টোপ গিলেছে। ঈশ্বর আমার কথা শুনেছেন। ডাক্তারবাবু পিতার পায়ের সামনে মোড়ায় বসলেন। বসে বললেন, বাঃ, এই তো বেশ জট পাকিয়েছেন। বালিতে, চুনেতে, চামড়াতে, রক্ততে একেবারে ক্যাডাভারাস কাণ্ড।
ডাক্তারি ব্যাগটা বেশ প্রাচীন হয়েছে। চামড়ায় কোচ ধরেছে। যৌবনের বাঁধুনি নেই। মেঝের ওপর পড়ে আছে থেকে। নিচু হয়ে একটা সার্জিক্যাল কাচি বের করতে করতে ডাক্তারবাবু বললেন, হরিবাবু, আপনি হলেন আমাদের পরীক্ষা। অঙ্কে যেমন কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট, রুগিদের মধ্যে সেইরকম আপনি। একেবারে জটিল জলতরঙ্গ। কী কায়দায় এমন করলেন? পা দিয়ে পিলার ভাঙছিলেন, নৃসিংহ অবতারের খোঁজে?
পিতা মৃদু মৃদু হাসছেন। মুখে একটু গর্বের ভাব। হেঁ হেঁ বাবা করেছি একটা কাণ্ড। আমার কী! আমি তো পা ছড়িয়ে বসে আছি। ম্যাও সামলান আপনি। কাঁচি দিয়ে কুট কুট করে চামড়া কাটছেন। গা শিরশির করছে। দীনুর কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। পাশেই হেলেন কেলার। তিনিও নির্বিকার।
ক্যানেস্তারা বাদ্য বাড়ির সামনে এসে পড়েছে। ইস, সুখেন চলেছে। একগালে চুন, একগালে কালি। ডাক্তারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কলির কেষ্ট চলেছে হে। শ্রীরাধিকা কি সঙ্গেই আছেন?
পিতা মুখ তুলে তাকালেন। নীরব প্রশ্নে জানতে চান, কী হচ্ছে রাস্তায়। রাধাকৃষ্ণ আবার কোথা থেকে এলেন। দীনু তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। আমি এক্ষুনি আসছি, বলে, তিরবেগে দৌড়োল সিঁড়ির দিকে।
ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুলে ছোট্ট করাত ঘষতে ঘষতে ডাক্তারবাবু বললেন, আজকালকার ছেলেপুলে যা হয়েছে, শান্তিতে আর সংসার করা যাবে না হরিবাবু। ছেলে থাকলেও মুশকিল, মেয়ে থাকলেও মুশকিল।
উত্তরে পিতা একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, বলা হল না। রাস্তায় ঘুসোঘুসির শব্দ হচ্ছে। কে কাকে ধরে প্রচণ্ড পেটাচ্ছে।
সিরিঞ্জের নিডলটি হাতে ঢোকাতে ঢোকাতে ডাক্তারবাবু বললেন, দীনুকে বিশ্বাস নেই। গিয়েই মনে হয় মারামারি শুরু করেছে।
পিতা লাফিয়ে উঠলেন, অ্যাঁ, বলেন কী! দীনু মারামারি করছে।
ডাক্তারবাবু বলছেন, করেন কী, করেন কী! নিডল ভেঙে যাবে।
.
দীনু ধরাধধড় ঘুসি চালাচ্ছে। যে ব্যাটা নেচে নেচে টিন পেটাচ্ছিল সে টিন ফেলে দৌড় মেরেছে। সুখেনের দাদাটা একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জবার কাকা, সেই পালের গোদাটা হাতের আস্তিন গুটিয়ে দূর থেকে একবার করে ঘুসি তুলছে আর বলছে, হু আর ইউ? হু আর ইউ?
দীনুর শুধু হাত নয়, পা-ও চলছে সমানে। পিতার ওপর-বাহুতে এ টি এস সামান্যই ঢুকেছে। ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি নিডলটা বের করে নিয়েছেন। নইলে ভেঙে ঢুকে যেত। রক্তের স্রোতে বেলকাঁটা ঘুরছে, সঙ্গে দোসর জুটত ভাঙা উঁচ। রাস্তার দিকে জানলায় দাঁড়িয়ে উত্তেজনায় পিতা পা ঠুকছেন, আর একসময়ের কৃতী ছাত্র দীনুকে উৎসাহ দিচ্ছেন, শাবাশ! শাবাশ! চালিয়ে যাও। মেরে ফ্ল্যাট করে দাও। সব বাড়ির জানলাতেই সারি সারি মুখ।
পিতৃদেবের একপাশে মেসোমশাই আর একপাশে ডাক্তারবাবু, হাতে ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। দুই বোন আর এক জানলায় পাশাপাশি। আমি ফাঁকেফোকরে চোখ রেখেছি। দীনুর বীরত্ব যত বাড়ছে আমার ভেতরটা তত হুহু করে জ্বলছে। শামুকের মতো বীরত্বের ডান্ডা বেয়ে দীনু ওপরে উঠছে। হিরো, সুপার হিরো, সুপ্রিম হিরো, ক্রমশই ঝান্ডা উঁচু হচ্ছে আর আমি ক্রমশই ঠান্ডা হয়ে আসছি। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি কনকের মুখের দিকে। চোখ ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। কনকের মনের দেয়ালে দীনুর বীরত্বের গজাল পেরেক এক এক ঘুসিতে ইঞ্চি ইঞ্চি করে ঢুকছে। সাধে বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!
বৃত্তাকার একটা জায়গায় চুনকালি মাখা, আধ-মাথা কামানো, ছেঁড়া প্যান্ট পরা সুখেন আমাদের ‘ফক্স সাহেবে’র মতো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে ফক্স সাহেব এখনও এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। বেঁটেখাটো মানুষ। মাথায় শোলার টুপি। পরনে ঢোলা কোটপ্যান্ট। প্যান্টের তলা ছিঁড়েখুঁড়ে ঝুলঝুলে। পায়ে গোড়ালি খয়ে যাওয়া তালিমারা বুট জুতো। মুখে চুন আর কালি। প্রেমের নয়, জীবিকার। পেছনে এক হাফপ্যান্ট পরা কিশোরের মাথায় বিশাল কাঠের সিন্দুক। সাহেব চলেছে হুপ হাপ শব্দ করতে করতে। ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখায়। কোনওদিন দেখা হয়নি।
দীনু তাল ঠুকে বললে, আর কে আছিস চলে আয়।
পিতৃদেব বললেন, আমারও ইচ্ছে করছে গোটাকতক ঘুসি হাঁকড়ে আসি।
ডাক্তারবাবু বললেন, ব্যাপারটা কী তা জানা আছে?
অনুমান করতে পারি, এ ফর্ম অফ সোশ্যাল র্যাগিং।
কেন, সে খবর রাখেন? পুলিশ কেসে পড়ে যাবেন যে!
কেন?
ওই ছেলেটা কাল একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছিল। আজ ধরা পড়েছে। সেই অপরাধের উচিত শাস্তি চলেছে। এর মধ্যে দীনুর নাক গলাবার কোনও প্রয়োজন ছিল না।
আই সি! আমাদের পাশের বাড়ির সেই মেয়েটি। বেশ, ছেলেটাকে ধরে পুলিশে দিক। দেশে আইন আছে, আদালত আছে। কতকগুলো অর্বাচীন ইডিয়েটস হাতে আইন তুলে নেবে, আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাধার মতো দেখব! সে তো হতে পারে না। সভ্য মানুষ সভ্য উপায়ে বিচার করবে। আমরা জঙ্গলে বাস করছি না। আমরা একদল হনুমান নই? কিল হিম। কিল দ্যাট বাস্টার্ড।
জবার কাকা আধলা একটা ইট তুলে দীনুর দিকে এগিয়ে আসছিল। আহত পা নিয়ে পিঅ দুদ্দাড় করে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন। মেসোমশাই চেপে ধরলেন, করছেন কী? আপনার সে বয়েস আছে?
পিতা রুখে দাঁড়ালেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে বয়েস আবার কীসের বাধা?
অন্যায় বলছেন কেন? ওরা যা করছে ঠিকই করছে, এগজাম্পল ইজ বেটার দ্যান প্রিসেপ্ট।
একে এগজাম্পল বলে না। এ হল চরম অসভ্যতা। মনুষ্যত্বের অবমাননা। আই মাস্ট রেজিস্টার মাই প্রোটেস্ট উইথ এ ব্লো।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনার পায়ের অবস্থা খুব ভাল নয় হরিবাবু। তা ছাড়া এই উটকো ঝামেলায় আপনার মতো মানুষের জড়িয়ে পড়াটা ঠিক নয়।
এসকেপিস্ট। ইউ আর অল এসকেপিস্ট। মধ্যবিত্তের মিন মেন্টালিটিতে ভুগছেন।
দীনু হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, পালাচ্ছিস কেন শালারা? পালাচ্ছিস কেন?
পিতা বললেন, ইস, ইস, শালাটা না বললেই পারত।
উত্তেজনার ছোঁয়া কনকের মনেও লেগেছে। জানলার ধার থেকে রিলে করলে, সব ব্যাটা পালাচ্ছে। মেসোমশাই বললেন, দিজ জানলাজ, অফুল উইনডোজ, ভদ্রবাড়িতে জানলা থাকা উচিত নয়। ভেতরে যাও। তোমরা ভেতরে যাও।
ডাক্তারবাবু বললেন, চেম্বারে রুগি বসিয়ে এসেছি। বি সেনসিব। আমাকে আমার কাজটা সেরে নিতে দিন।
পিতা হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন ফুঁড়ে নিন।
বসুন। মাথা ঘুরে যেতে পারে।
আমার সে মাথা নয় ডাক্তার। অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই আমার তিন-তিনটে দাঁত তুলিয়েছি।
নীচে থেকে দীনু বীরের মতো হাঁক ছাড়ল, পিন্টু, নেমে আয়।
সুখেন আমাদের গলিতে এসে বসেছে। সারাশরীর থিরথির করে কাঁপছে। দু’চোখে দু’রঙের জল গড়াচ্ছে। চুন-মাখানো গালে মুক্তোর দানা, আলকাতরা-মাখানো গালে কয়লার রস। দীনু এক ধমক লাগিয়ে বললে, তুই আমাদের একবারও বললি না কেন ইডিয়েট? আমরা দলবল নিয়ে রেডি থাকতুম। এবার তুই পাড়ায় মুখ দেখাবি কী করে?
পিতৃদেব নীচে নেমে এলেন। প্রথমে ডাক্তারবাবু, সবশেষে মেসোমশাই। ডাক্তারবাবু যেন পালিয়ে বাঁচলেন। পিতা সুখেনকে ভাল করে দেখে বললেন, তুমি তো চক্রবর্তী বাড়ির ছেলে?
উত্তর দিল দীনু, আজ্ঞে হ্যাঁ।
তুমিই তো ট্র্যাপিজের খেলা দেখাও ব্যায়াম সমিতিতে?
দীনু বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ।
তোমার এই দুর্মতি হল কেন? দেশে কি মেয়ের অভাব!
সুখেন ধরাধরা গলায় বললে, কাকাবাবু, আমার একলার দোষ নয়। জবা বললে, কলিতেও আর একবার অহল্যা উদ্ধার হোক। দুটো মা আর একটা কাকাতে মিলে আমার জীবন শেষ করে দিলে।
এই বাজারে একটি বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করার চেষ্টা অহল্যা উদ্ধারের চেয়েও মহৎ কাজ। জজেও মানবে। কী বলেন বিনয়দা?
মেসোমশাই হিসেবির হাসি হাসলেন। স্বাভাবিক। মাথায় মাথায় যাঁর দুই মেয়ে তাঁকে এই ব্যাপারে রায় দিতে হলে অবশ্যই অনেক ভাবতে হবে। বলা যায় না, আবার কোনও রামচন্দ্র যদি এদিকে হঠাৎ পা বাড়ান, তা হলে জয় রাম না বলে ছিছি রামই বলতে হবে।
পিতা সুখেনকে বললেন, তোমার দাদা হঠাৎ ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে তোমাকে নিয়ে বাঁদর নাচ করল কেন?
সে কাকাবাবু এক নোংরা ব্যাপার। দাদাকে তো আপনি চেনেন না। অতি নোংরা মানুষ। বউদিকে তো প্রায় ত্যাগই করেছে। নিত্য কিল, চড়, ঘুসি, লাথি। বাইরে আসা যাওয়া আছে। রেস আছে। নেশা আছে। আর আছে, আমাকে ফাঁকি দিয়ে বিষয়সম্পত্তি একা গ্রাস করার ইচ্ছে। জবার কাকার হাতে কালোবাজারির পয়সা। বাড়িটা তাকে বেচতে পারলে, দু’তরফেরই লাভ। এর ফুর্তি, ওর সম্পত্তি। রতনে রতন চিনেছে।
আই সি। জবার বয়েস কত? সাবালিকা?
কুড়ি-একুশ তো হবেই।
বহত আচ্ছা! তবে তো কোনও ভয়ই নেই। কী বলেন বিনয়দা?
হ্যাঁ, আইন বলে, সাবালিকা স্বেচ্ছায় তার পছন্দমতো ছেলেকে বিয়ে করতে পারে।
তা হলে, আমরা লড়ে যাই। গেট রেডি ফর এ লিগ্যাল ফাঁইট। দীনুর অ্যাগেনস্টে ওরা ফৌজদারি করবেই। পয়সা আছে, ছেড়ে কথা বলবে না। সুখেনকেও ফাসাবার চেষ্টা করবে।
মেসোমশাই হু হু করে হেসে বললেন, আপনি একটা লিগ্যাল এড সোসাইটি খুলুন হরিদা। যেভাবে হুড়হুড় করে কে আসছে, আমি এখানেই পার্মানেন্টলি থেকে যাই।
কথার মধ্যে ব্যঙ্গের ছোঁয়াটুকু পিতা ধরতে পারলেন না। উত্তেজনায় মেতে আছেন। আমাকে বললেন, টারপেন্টাইনের বোতল আর একফালি ন্যাকড়া নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, আমার বাটলারের ক্ষুরটাও নিয়ে এসো। মাথাটা পুরো চেঁচে দিই।
মেসোমশাই ওপরে উঠতে উঠতে বললেন, কখন কী নিয়ে যে মেতে ওঠেন আপনি! নিজের পা-টা আগে সামলান। নিজের ছেলেটাকে আগে মানুষ করুন।
তার মানে? পিতা ফোঁস করে উঠলেন, ও কি অমানুষ হয়ে আছে?
মানুষ বলতে যা বোঝায় তা কি হয়েছে? যদি মনে করেন হয়েছে, আমার কিছু বলার নেই।
মানুষ বলতে আপনি কী বোঝেন?
এডুকেশন। এম এ করুক। পি আর এস, পি এইচ ডি করুক। বড় ডাক্তার, কি ইঞ্জিনিয়ার হোক। সারাদিন বাড়ি বসে আছে, ফস্টিনস্টি করছে। বড় বড় কথা বলছে। এটা কি মানুষ হবার লক্ষণ!
বিনয়দা, মানুষ বলতে আপনি বোঝেন তোতাপাখি, আমি বুঝি মানুষ। চরিত্রে, আচারে, আচরণে, সংস্কৃতিতে, সহবতে একটা পরিপূর্ণ মানুষ ইউনিভার্সিটির দরজা গলে বেরোয় না, বেরোয়। পরিবারের ফার্নেস থেকে। একদিন ইংরিজি নিয়ে ওর মুখোমুখি বসবেন নাকি? বসবেন সাহিত্য আর সংস্কৃতি নিয়ে? ধর্ম নিয়ে একদিন একটু আলোচনা হোক না। পরীক্ষা করুন না ওর ধৈর্য, সংযম, লোভ, সহিষ্ণুতা।
ওতে জাগতিক কিছু হয় না হরিদা। ছাপ চাই, ছাপা নামের পেছনে এত বড় একটা ন্যাজ চাই, ন্যাজ। আপনার ছেলে আপনার কাছে হিরের টুকরো হতে পারে, জগতের বিচারে কয়লা।
মেসোমশাই দুমদুম করে ওপরে উঠে গেলেন, সিনেমার ব্যারিস্টারের ভঙ্গিতে। হঠাৎ আমার বয়েস যেন বিশ বছর বেড়ে গেল। এতসব গুণের কোনও ঘনঘটাই আমার নেই। আমি মহাপুরুষ? কাপুরুষ বললে শোভা পায়। ধৈর্য? ছুঁচে সুতো পরাবার সময়েই ধৈর্য বোঝা যায়। সহিষ্ণুতা? একটার বেশি দুটো কাজের কথায় যার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে, সে হল সহিষ্ণু? সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় যে বেতো ঘোড়ার মতো আর্তনাদ করে সে হল সহিষ্ণু? আমার লজ্জা বাড়াবার। জন্যে কেন এসব বললেন? মেসোমশাই ঠিকই বলেছেন আমার দ্বিভুজে এমন কোনও হাতিয়ার নেই যা দিয়ে জগতের সঙ্গে লড়তে পারি। ময়লা পইতেতে চাবি বেঁধে, হাতে শালগ্রাম নিয়ে বাড়ি বাড়ি পুরুতগিরি করে যাকে দূর ভবিষ্যতে পেট চালাতে হবে, তার জন্যে পিতার এত গর্ব মানায় না। লোকে বলবে, লাভ ইজ ব্লাইন্ড। অহংকারী মানুষটি বড় অপমান করে গেলেন। ন্যাজ নেই বলে এত অসম্মান?
তারপিন দিয়ে সুখেনের মুখের আলকাতরা তোলা হল ন্যাকড়া দিয়ে ঘষে ঘষে। মাথা তেল চুকচুকে করে কামানো। বেশ সাধু সাধু দেখাচ্ছে। ব্যাপার অনেক দূর গড়াবে। দীনু এক সেট প্যান্ট, জামা আর টুপি এনে দিয়েছে। বাথরুমে ঢুকে সুখেন চান করে নিয়েছে। রাস্তায় বেরোতে লজ্জা পাচ্ছে। মানুষের ভুলতে সময় তো লাগবেই। রাত ছাড়া এ প্যাচার আর রাস্তায় বেরোবার উপায় নেই। কাকে ঠোকরাবে।
সুখেন বললে, আমি আজই দুর্গাপুর চলে যাব।
দীনু বললে, মামার বাড়ি। তোর বউয়ের কী হবে?
এক রাতের বউ ভাই। তাকে আর পাব কোথায়? চিরাগ কাহা, রোশনি কাঁহা। তাকে বোধহয় উলঙ্গ করে ঘরে চাবি দিয়ে রেখেছে।
সেকী রে!
আরে ওটা একটা পাপের বাড়ি।
সুযোগ পেলেই তাল বুঝে পাখি দেখবি উড়ে আসবে তোর খাঁচায়। সবুরে ম্যাওয়া ফলে রাজা।
কোনও পরিখাই খুব প্রশস্ত নয় এবং কোনও দেয়ালই খুব উঁচু নয়। ভালবাসা যদি থাকে, দু’জনে এসে মিলবেই। কোনও ঝড়ই খুব ভয়ংকর নয় এবং কোনও রাত্রিই খুব অন্ধকার নয়। ভালবাসা যদি থাকে, দু’জনে পরস্পরকে দেখবেই। যেমন ভাবেই হোক জ্যোৎস্না আসবে, তারার আলো ঝরবে, যেমন ভাবেই হোক মোমবাতি, আলো বা একটি লণ্ঠন জ্বলবেই।
কার কবিতা রে? পরে আমাকে লিখে দিস তো। বাঁধিয়ে রেখে দোব। আমার জন্যেই লেখা মনে
যে-গাড়ায় পড়েছিস, সেই গাড়া থেকে আগে ঠেলে ওঠ। মাথায় সেই কোকড়ানো চুল আবার ফিরে আসুক, তারপর আবার প্রেমের গর্তে পা দিবি। ব্যাটা ন্যাজ কাটা শেয়াল।
প্রেম হল ফলন্ত গাছের ফুলের মতো। গাছ যতদিন না মরছে ততদিন ঋতুতে ঋতুতে ফুল ফুটবেই।
এখনও তোর কাব্য আসছে রে দামড়া! নাঃ তুই রিয়েল প্রেমের ধাতুতে তৈরি। বোস, মোটরবাইকটা বের করে আনি। তোকে এ পাড়া থেকে পগারপার করে দিয়ে আসি।
দীনু বীরদর্পে বেরিয়ে গেল। সুখেন প্রেমের ধাতুতে তৈরি হলে, দীনু বীরের ধাতুতে। সুখেন ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললে, ইস, কী করে দিয়েছে মাইরি। সুযোগ পেলে এর বদলা একদিন আমি নেবই।
একা ভাল কাজ করা যায় সুখেন, অন্যায় কাজে দল চাই। একা তুই মঠ, মন্দির, মিশন করতে পারিস, পরনের কাপড় খুলে দান করে দিতে পারিস, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার করতে পারবি না। রোজ কত অন্যায়ই তো মানুষ করছে, কোথায় তার প্রতিকার! সৎ কাজের চেয়ে পৃথিবী জুড়ে অসৎ কাজের পরিমাণ হাজার গুণ বেশি।
যা যা, বুড়োদের মতো ভিজেভিজে কথা আর বলিসনি তো! তুই ব্যাটা একেবারে বুড়ো হয়ে গেছিস। কাকাবাবু এখনও তোর চেয়ে ইয়ং আছেন।
দীনুর মোটরসাইকেল বাড়ির সামনে এসে থামল। এরই মধ্যে পোশাক পালটে এসেছে। ছোকরার শরীরে রাজপুত্তুরের রক্ত বইছে। তা না হলে এমন ‘লেডি-কিলারের’ মতো চেহারা হয়? পুলিশ কি পাড়ার লোক দীনুর টিকিও ছুঁতে পারবে না। দীনুর বাবার যা ইনফ্লুয়েন্স। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ওঠাবসা করেন। আমাদের অনেক ক্ষতি অনেকে করতে পারে। বাঁচাবার কেউ নেই।
সুখেনকে পেছনে বসিয়ে দীনু সশব্দে পাড়া কাপিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ন্যাড়াকে বেলতলায় ছেড়ে দিয়ে আসি।
সুখেনের ছেঁড়া ঝুলঝুলে প্যান্ট, কালিঝুলি মাখা জামা, ফেলে যাওয়া উৎকণ্ঠার মতো গলিতে পড়ে রইল। ওই সাজ এবার তোমাকে না পরিয়ে ছাড়ে। প্রেমের কাঁঠাল কোথায় পাকছে মানিক। শীতলাতলার আটচালায়। মায়ার সঙ্গে আর বেশি মাখামাখি করতে যেয়ো না। ওখানে ভোদার নজর পড়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী বড় প্রবল হে।
সিঁড়ির মাথায় পিতৃদেব। প্রশ্ন করলেন, ওরা কোথায় গেল?
কিছু বলে গেল না তো।
একবার জিজ্ঞেস করলে না! তোমার কি মনে হয় চ্যাপ্টার ক্লোজড হয়ে গেল?
আজ্ঞে না। এই তো সবে শুরু।
দ্যাটস রাইট। এই তো বুদ্ধি পাকছে। কে বলে, তুমি আমার পুঁয়ে পাওয়া ছেলে? আশঙ্কা নিয়ে বাঁচতে শেখো। বিপদের ঢেউ কেটে কেটে চালাও তোমার জীবনের জাহাজ। ছেঁড়াখোঁড়া ওগুলো কী?
সুখেনের জামাপ্যান্ট।
ফেলো না, ছাতে নিয়ে চলো।
কী করবেন?
কাকতাড়ুয়া তৈরি করব। প্রেমের কাকতাড়ুয়া। ও পাশের ছাতে, যে-পাশে গাছের টব, হতচ্ছাড়াদের বাড়ি, সেই ছাতে থাকবে কাকতাড়ুয়া। একে কী বলে জানো?
আজ্ঞে স্কেয়ার ক্রো।
তোমার মাথা। একে বলে সাইকোলজিক্যাল টর্চার। ওরা ঘুরবে ফিরবে আর দেখবে। ক্রমশই মেন্টালি সিক হয়ে পড়বে। ম্যাকবেথের ভোজসভায় ব্যাঙ্কোর ভূত। রাজার আসন দখল করে বসে আছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে না, পাচ্ছে খুনি ম্যাকবেথ। চিৎকার করে বলছে, তুমি মাথা নাড়তে পারো না, তুমি কথা বলতে পারো না, তোমাকে আবার ভয় কীসের! পরমুহূর্তেই আর্তনাদ, ঈশ্বর, মর্গ থেকে যদি মৃতদেহ বেরিয়ে আসে, যাদের কবরে রেখে এসেছি তারা যদি কফিনের ডালা খুলে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে, old mouments, shall be the maws of kites. তোমার কেমন লেগেছিল কাল?
কী লাগার কথা বলছেন?
যখন বালিশটালিশ বের করতে করতে বললুম, তোমার সঙ্গে এক বিছানায় শুতে আমার ঘেন্না করছে।
খুব খারাপ।
মনটা কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যায়নি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
দেহ ঠিক রইল, মনটা কুঁচকে এতটুকু হয়ে গেল। কী ভীষণ যন্ত্রণা, তাই না? একে বলে সাইকোলজিক্যাল টর্চার। মানুষকে সংযত রাখার জন্যে মনের মধ্যে ভূত ঢোকাতে হয়। তা না হলে শয়তান বাড়তে বাড়তে দেবতাকে গ্রাস করে ফেলে। রান্না মনে আছে, না ক’দিনের সুখে ভুলে বসে আছ
না, মনে আছে।
তা হলে চলে এসো ওপরে। পুরনো অভ্যাস আজ আবার ঝালাই হবে।
উত্তরের বারান্দার একপাশে কনক উদাস মুখে বাগানের গাছপালার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কীসের যেন প্রত্যাশা! গ্রহান্তরের কোনও জীব এসে নামবে বাগানের কোণে। বড়ঘরে মেসোমশাই পায়চারি করছেন। পিতৃদেবের হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হচ্ছে। সামান্য খোঁড়াতে হচ্ছে।
মেসোমশাই বললেন, হরিদা, আপনার হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কোনও কারণ খুঁজে পেলুম না।
কারণ দেখিয়ে কোনও কাজ করার অভ্যাস আমার কোনওকালে ছিল না, আজও নেই। আমাদের রান্না আমরাই করে নোব, যেমন করে আসছি এতকাল।
কেন, বলনে তো!
আবার কেন? কোনও কেন নেই। সিদ্ধান্ত ইজ সিদ্ধান্ত।
তার মানে আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলছেন।
তা তো বলিনি। কনক কথা কাটাকাটি শুনে ঘরে এসেছে। ছলছলে চোখে বললে, আপনি কেন এত রেগে গেলেন মেসোমশাই। এই তো কালই বললেন, তোমার মতো মেয়ে পাশে থাকলে সংসারে ফুল ফুটিয়ে ছেড়ে দিতুম।
হ্যাঁ বলেছিলুম। যে-আকাশের দিকে তাকিয়ে আমরা সূর্যের প্রত্যাশা করি, সে আকাশেও হঠাৎ মেঘ আসে, সূর্য ঢাকা পড়ে যায়, দিনে ছাতল ধরে। আশা আর প্রত্যাশার মাঝখানে অনিশ্চয়তার বিশাল ব্যবধান। অনেক বাধা দিতে চাইলেও দেওয়া যায় না, নিতে চাইলেও নেওয়া যায় না। সাইকোলজিক্যাল ম্যানের এই হল ট্র্যাজেডি। মনের বিশুদ্ধ নীল আকাশে অহংকারের মিশকালো মেঘ।
মেসোমশাই বললেন, আপনি ভয়ংকর ইমোশানাল। সামান্যকে অসামান্য করে তুলে নাটক। করতে চান।
কী বললেন, ইমোশান! এই চেয়ারের ইমোশান নেই, ওই টেবিলের নেই, দেয়ালের নেই। ইমোশান আছে বলেই আমরা মানুষ। ইমোশানই আমাদের মোশান। আবেগই আমাদের প্রাণ। বিশাল এই রঙ্গমঞ্চে সারাজীবন আমি নাটক করে যাব।
তা হলে তাই করুন। আপনার ছেলে সম্পর্কে এমন কিছু অন্যায় বলিনি। যা দেখছি হিতৈষী হিসেবে তাই বলেছি। পুত্রস্নেহে আপনি অন্ধ হয়ে আছেন। আপনি ওর মঙ্গল চান, না অমঙ্গল চান?
আপনি যেভাবে চান, আমি সেভাবে চাই না। আমি ক্রীতদাস তৈরি করতে চাই না। আমি চাই মানুষ। পরিপূর্ণ একটি মানুষ। তর্ক করে লাভ নেই। তর্কে বিবেকানন্দ আসবেন, রবীন্দ্রনাথ আসবেন। আপনাদের শিক্ষার মূল নড়ে যাবে। চুপ করে থাকাই ভাল। কাল পর্যন্ত আপনি আমার আত্মীয় ছিলেন, আজ আপনি একজন শিক্ষাগর্বী মদগর্বী ব্যারিস্টার। অনেক টাকা, অনেক ক্ষমতা, অনেক উচ্চাশা। আমরা রিক্ত ফকির। আদর্শ নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টাই আমার যৎসামান্য। বিলাসিতা।
কী আপনার আদর্শ? গাছ তৈরিটা আদর্শ না আগাছা গজিয়ে তোলা আদর্শ?
কনক এগিয়ে এসে বললে, আপনাদের এই কথা কাটাকাটি আমার একদম ভাল লাগছে না।
বাবা, আপনি চুপ করুন না। মুকুকে পড়াতে বসুন। বই খুলে বসে আছে অনেকক্ষণ।
মেয়ের কথায় মেসোমশাই সরে গেলেন। কনক শান্ত নরম গলায় জিজ্ঞেস করলে, একটু চা খাবেন মেসোমশাই?
চা? হ্যাঁ, তা খেলে হয়। না থাক।
কনক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। চোখ ছলছল করে উঠছে। একটু ধরাধরা গলায় বললে, আপনারা বড় নিষ্ঠুর।
নিষ্ঠুর কেন? নিষ্ঠুরতার কী দেখলে?
আমরা কী সুন্দর ছিলুম, কী বিচ্ছিরি হয়ে গেলুম। বাইরে কী একটা ঝামেলা হল, আমাদের ভেতরটা সব ওলটপালট হয়ে গেল।
পিতা শব্দ করে হাসলেন, জীবন মানেই ঝোড়ো হাওয়া কনক, জীবন মানেই ঝড়। করার কিছু নেই।
সকাল থেকেই সংসারের চাতালে চড়া নাটক চলেছে। হাত নড়ছে, মাথা দুলছে, চোখ ছলছল হচ্ছে। দেয়ালের দিকে মুখ করে, অদৃশ্য কোনও শ্রোতাকে পিতা বললেন,
When the wind works, against us in the dark
come out, come out
It costs no inward struggle not to go.
বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। শব্দ শুনে পিতা বললেন, পুলিশ এল। গেট রেডি। শোনো তোমাকে বলে যাই, জেলখানার খাবার আমার গলা দিয়ে গলবে না, তুমি আমাকে রোজ একটু দুধ আর পাউরুটি দিয়ে আসবে। পারবে না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। কেন পারব না? কিন্তু আপনাকে ছাড়িয়ে আনার কী হবে?
তোমার মাতামহের সাহায্য নিয়ো। তিনিই আমার রিয়েল ফ্রেন্ড। দুজনেই আমরা ঘরপোড়া। গোরু।
গাড়ির দরজা বন্ধ হল। এইবার জোড়া জোড়া বুটের শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে পুলিশের দল উঠে আসবে। আমাদের অপরাধটা কী? পুলিশ আসবে কেন?
সিঁড়িতে খুড়স খুডুস করে জুতোর শব্দ হচ্ছে। পুলিশ তো এমন ভদ্রভাবে আসে না। এ যেন পাঁচির ছাগল ছাড়া পেয়ে ওপরে উঠে আসছে। খোলা দরজার সামনে প্রতাপ রায়। আমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, নাটকের মহড়া চলছে নাকি?
পিতা বললেন, কী ব্যাপার, তুমি?
চলে এলুম। ওই কিছু লিগ্যাল পরামর্শ, তা ছাড়া মেডিকেল চেকআপ। বিষয় বিষ! বিষয় বিষ! প্রতাপ রায়ের গলা শুনে মেসোমশাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হাল-ভাঙা নাবিক যেন তীর দেখতে পেয়েছেন। কোস্ট অ্যাহয় কোস্ট অ্যাহয় বলে চিৎকার করে উঠলেন।
প্রতাপ রায় উদ্ভাসিত মুখে বললেন, কিছু আগেই এসে পড়লুম দুটো কারণে। কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ কোনটা কী লাগে জানা নেই, আমার ওখানে বসেই যদি দেখেন বড় বাধিত হই। তা ছাড়া কোনও কাজের দায়িত্ব নিলে, যতক্ষণ সেটা করতে না পারছি, ততক্ষণ ভেতরটা এত ছটফট করে, খেয়ে নেয়ে শুয়ে স্বস্তি পাই না। ওই মেডিকেল চেকআপ! আমার বন্ধু বললে, বেলাবেলি পেশেন্টকে নিয়ে আয়।
মেসোমশাই একমুখ হেসে বললেন, কর্তব্যপরায়ণ মানুষের লক্ষণ। এ এক দুর্লভ লক্ষণ। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
আপনি আমাকে তুমিই বলবেন। আমি আপনার ছেলের বয়সি। চেহারাটাই যা একটু মোটাসোটা হয়ে গেছে।
মোটাসোটাই তো ভাল। বেশ ম্যানলি। পুরুষের চেহারা ফিনফিনে হলে মানায় না। মানুষ হবে হেলদি, ওয়েলদি অ্যান্ড ওয়াইজ।
ঘুঘুক ঘুঘুক করে হেসে প্রতাপ রায় বললেন, তা হলে চলুন।
কিন্তু বাবা খাওয়াদাওয়া যে হয়নি এখনও!
খাওয়াদাওয়া! ওটা একটা কথা হল! আপনারা যাচ্ছেন কলকাতার বিখ্যাত রায়বাড়িতে। যে-পরিবার অতিথি সৎকারে ইতিহাস তৈরি করে রেখে গেছে। যার পিতাকে জনৈক নিমন্ত্রিত, তবে রে শালা বলে, পঙক্তি থেকে উঠে খড়ম নিয়ে তাড়া করেছিলেন।
কেন গো!
এত খাইয়েছেন যে আর হাঁ করতে পারছেন না, সেই অবস্থায় জোর করে পাতে গোটাকতক একেবারে গাছপাকা ল্যাংড়া আম ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আপনি মেসোমশাই সেই বাড়িতে যাচ্ছেন।
পিতৃদেব এতক্ষণ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি লেখাপড়া কতদূর করেছ প্রতাপ?
প্রতাপ রায় আমতা আমতা করে বললেন, স্কটিশে পড়তুম। ফোর্থ ইয়ারে বাবা মারা গেলেন। বিষয়সম্পত্তির চাপ এসে গেল। তাই ছেড়ে দিতে হল।
এমনভাবে, ‘ছেড়ে দিতে হল’, বললেন যেন খাঁচা খুলে পাখি ছাড়লেন।
পিতা বললেন, এটা তুমি আজ কী পরে এসেছ?
কেন? চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি।
মেয়েদের অন্তর্বাসে এই ধরনের কাজ দেখা যায় বটে।
তা যা বলেন।
এতে কিন্তু তোমাকে তেমন ম্যানলি ম্যানলি দেখাচ্ছে না। কীরকম যেন লোফার লোফার দেখাচ্ছে।
মেসোমশাই বললেন, রহিস আদমিরা এইরকম পাঞ্জাবিই পরেন। চমৎকার মানিয়েছে।
ওঃ, তা হবে।
পিতা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। মেসোমশাই বললেন, হরিদা, আমি তা হলে মেয়েদের নিয়ে একবার ঘুরে আসি। রথ দেখা, কলা বেচা দুই-ই হবে।
অ্যাজ ইউ লাইক।
কনক চাপা সুরে বললে, এঁদের খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা না করেই চলে যাব?
আমরা যখন আসিনি তখন এঁরা কী করতেন? এঁদের বেঁধে খাওয়াবার জন্যে তো আমরা আসিনি।
পিতার কথায় কনক কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। বড়দের জগৎ স্বার্থের চাকায় ঘোরে। রাধে, তুমি কি তা জানতে না!
সেজেগুজে তৈরি হয়ে, কনক পিতৃদেবের সামনে ছলছলে চোখে এসে দাঁড়াল, মেসোমশাই, কী করব বলুন, আমি তা হলে আসছি।
পিতা মাথায় হাত রেখে বললেন, হ্যাঁ মা, সেরে এসো।
মুকুকে নিয়ে মেসোমশাই এসে দাঁড়ালেন, হরিদা, ঘুরে আসছি।
হ্যাঁ, আসুন।
প্রতাপ রায় দূর থেকে হেঁকে বললেন, আমরা আসছি।
অতি ক্ষীণ গলায় পিতা বললেন, এসো।
শুনতে পেল কি পেল না, কেউ বিশেষ গ্রাহ্য করল না। গাড়ির দরজা বন্ধ হল। ইঞ্জিনের শব্দ দূর থেকে দূরে মিলিয়ে গেল। বারান্দার রেলিংয়ে ভর রেখে, রোদ ঝলমলে গাছপালার দিকে তাকিয়ে পিতা বললেন, কী বুঝলে?
আজ্ঞে?
কী বুঝলে? আপনার জন সতত আপন/পর কি কখনও আপন হয়।
আপনার সেই গান!
ইয়েস। আমার সেই ইন্টারন্যাল মিউজিক। একলা চলো রে!
দখিনা বাতাস হু হু করে বয়ে এল। এলোপাতা খসে পড়ল গাছ থেকে। তারে কনকের নীল শাড়ি আমার অভিমানে ফুলে উঠল।
১.১৬ সিন্নি দেখেই এগোই কেঁতকা দেখে পেছোই
খাঁখাঁ দুপুর। খাঁখাঁ বাড়ি। বাগানের গাছে আবার ঘুঘু ডাকছে। নির্জন দুপুরের কারিগর। মনে হয় যেন স্যাকরার হাতুড়ি পিটছে! কনক চাল, ডাল, তরিতরকারি সবই বের করেছিল। রান্নার সময় পায়নি। প্রতাপ রায় তুলে নিয়ে গেছে। বড়লোকের সাতমহলা বাড়ি। জলসাঘর, ঝাড়লণ্ঠন, দাসদাসী। আস্তাবল, ওয়েলার ঘোড়া। তেলরঙে আঁকা পূর্বপুরুষদের ছবি। কার্পেটের ওপর আলতো পায়ে কনক ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। ভেতরটা কেমন যেন করছে। একেই বলে হিংসে।
পিতৃদেবের বেশ জ্বর এসে গেছে পায়ের তাড়সে। ইজিচেয়ারে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছেন। কোলের ওপর গণিতের বই। পাশের টেবিলে খাতা আর পেনসিল। গল্পের বই পড়তে চান না। তাতে মন নাকি এলিয়ে পড়ে। বুদ্ধিবৃত্তি উপন্যাসের খোটা বেয়ে লতিয়ে উঠতে থাকে। মন হবে বটবৃক্ষের মতো। শিকড় নেমে যাবে বিজ্ঞানে, দর্শনে, তর্কশাস্ত্রে, চিকিৎসাবিদ্যায়। শাখাপ্রশাখায় বিশাল মহীরুহ। আসুক বাতাস, আসুক ঝড়, অচল অটল, ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ। তলায় শীতল ছায়া। পারো তো একটুখানি উদারতার বেদি বাঁধিয়ে দাও। বাট্রান্ড রাসেলের খুব আত্মহত্যার ইচ্ছে হত। গণিতে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিলেন। যখনই মনে হত এইবার ঝুলে পড়ি তখনই বসে যেতেন অঙ্ক নিয়ে। গণিত থেকে চলে গেলেন দর্শনে। পিতৃদেব গণিত নিয়ে পড়েছেন, মাঝে মাঝে দর্শনের দিকে ঝুঁকেছেন, মৃত্যু সম্পর্কে অসীম কৌতুকের ভাব। কারুর মৃত্যুতে কখনও আহা আহা করতে শুনিনি। আহার নিদ্রার মতোই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। পেয়াদা এসে খাজনা নিয়ে গেল। মেনিদার মা মারা গেলেন। বুড়ির জন্যে ছেলে ফাঁসোর ফোঁসর করে অস্থির। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে এসে কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। পিতা বললেন, সদ্য-বিধবার মতো অমন হাপুস হুপুস করছেন কেন? বয়েসে মানুষ তো মরবেই! আপনার ইনটেলেক্ট তো তেমন খোলেনি। তেরাত্তির কঁদবেন, চতুর্থ রাতেই তো হেসে হেসে জর্দাপান খাবেন! পৃথিবীতে সে মৃত্যু কোথায়, যার শোকে মানুষ সারাজীবন মুহ্যমান থাকবে! Death borders upon our birth, and our cradle stands in the grave.
জ্বর মনে হয় বেশ তেড়েই আসছে। মাঝে মাঝে আড়মোড়া ভাঙছেন। চোখ বেশ জবাফুলের মতো লাল হয়ে উঠছে। মুখের চেহারা শুকনো শুকনো। ফটিফাইভ। এ পরিবারের অ্যাভারেজ পরমায়ু নাকি পঁয়তাল্লিশ। সেই বয়েস যেই পেরোবে জল ঝেড়ে বইঠা তুলে পাটাতনে তুলে রাখো। মনকে বলো, যা আছে সব চটপট তাড়াতাড়ি সেরে নাও। এখন আমার সময় হল, যাবার দুয়ার খোলো। সেপটিক ফিভার। সেরকম কিছু হবে না তো! আমার মনের অত জোর নেই। মচকাব না, একেবারে মট করে ভেঙে যাব।
শোনো!
ভয়ে ভয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
জ্বর বেশ আঁকিয়ে আসছে। বুঝলে!
আজ্ঞে হ্যাঁ।
পা-টাও বেশ টাটিয়ে উঠেছে।
সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবুকে একবার ডেকে আনি।
কোনও প্রয়োজন নেই। ডোন্ট বি নার্ভাস। বোসো না, দাঁড়িয়ে কেন? হ্যাঁ, যা বলছিলুম। বয়েস বাড়ছে, বুঝেছ?
আজ্ঞে না।
অ্যাঁ সেকী, বয়েস বাড়ছে, তুমি বুঝতে পারছ না! তুমি কি ভাবো, সময় স্ট্যাটিক। তোমার মা কত বছর হল মারা গেছেন জানো? চোদ্দো বছর হয়ে গেল। লং ফোর্টিন ইয়ার্স। তখন আমার। বয়েস ধরো পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ হবে। নাউ আই অ্যাম ফিফটি। পঞ্চাশ বছর! হাফ এ সেঞ্চুরি মাই সন। পঞ্চাশটা বছর দুঃখে সুখে পার করে দিলুম। কী বলছ তুমি! অ্যান্ড লাস্ট ফোর্টিন ইয়ার্স আই। অ্যাম অ্যালোন। এ লোন ফাঁইটার। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়নি। আই কেয়ার এ ফিগ ফর দেম। পৃথিবীকেও আমি থোড়াই কেয়ার করি। জন্মের দরজা দিয়ে স্টেজে ঢুকেছি মৃত্যুর দরজা দিয়ে নাচতে নাচতে বেরিয়ে যাব। যতদিন শক্তি আছে ততদিন অভিনয়।
Wavering between the
profit and the loss
In this brief transit
Where the dreams
cross
The dream crossed
twilight between birth
and dying.
না হে, বয়েস বাড়লেও স্মৃতিটা এখনও আছে। তোমার মনে পড়ে?
আজ্ঞে কী মনে পড়ে? পড়া?
না না পড়া নয়, তোমার মায়ের কথা?
খুব অল্প। অস্পষ্ট। একটা-দুটো ঘটনা।
তুমি ‘লাকি’। ভেরি, ভেরি ‘লাকি’।
আজ্ঞে মায়ের মৃত্যু তো ছেলের পক্ষে দুর্ভাগ্যের ঘটনা। আপনি আমাকে ‘লাকি’ বলছেন?
অফকোর্স। যে বয়েসে তোমার মা মারা গেছেন, সে বয়েসে তোমার স্মৃতি তৈরি হয়নি, অজ্ঞান শিশু। কিন্তু আমি! আমার কথাটা একবার ভাবো। হাজার হাজার টুকরো টুকরো স্মৃতি বহুবর্ণ পাথরের মতো মজা নদীর বুকে বিছিয়ে পড়ে আছে। দিন নেই, রাত নেই, আমি একবার এটা তুলি তো ওটা ফেলি, ওটা ফেলি তো এটা তুলি। নো, আই শুড নট বি উইক, আই শুড নট বি এ সেন্টিমেন্টাল ফুল The dream crossed twilight between birth and dying.
আপনার জ্বর খুব বেড়েছে। বিছানা করে দিই শুয়ে পড়ুন একটু।
ছেলেমানুষ! আমি একশো তিন জ্বরে অফিস করেছি। জ্বর একটা বার্নিং প্রসেস। ভেতরের সমস্ত বিষ পুড়িয়ে দিচ্ছে। অত সহজে শুয়ে পড়লে চলে।
The hurt is not enough:
I long for weight
and strength
To feel the earth
as rough To all my length.
তুমি ভাবছ আমি জ্বরের ঘোরে ভুল বকছি! তা হলে এসো, চেয়ারটা আমার কাছে নিয়ে এসো, বসে বসে দেখো আমি স্টেপ বাই স্টেপ কী কঠিন একটা অঙ্ক করছি।
না না, আমি ভুল বকার কথা বলিনি।
দেন ইট ইজ অলরাইট। তা হলে জেনে রাখো, শরীরকে কখনও বেশি প্রশ্রয় দেবে না। শরীর হল কুকুর। নাই দিয়েছ কী মাথায় উঠে বসবে। সবসময় পায়ের তলায় রাখবে। বেচাল দেখলেই লাথি। এ টাইমলি কিক। একটু চা করতে পারবে?
কেন পারব না?
ক’টা বাজল?
তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে।
তা হলে চারটে নাগাদ বসিয়ো। কেন জানি না, আজ সব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। জানবে, অতীত যখন মনে এসে ভিড় করে, তখন বুঝতে হবে বয়েস বাড়ছে। দেয়ালে ওই বড় আয়নাটা দেখেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব সুন্দর। বেলজিয়ান গ্লাস।
শুধু সুন্দর নয়। ওটা তোমার মায়ের। ওই কাঁচে তোমার মায়ের মুখ লেগে আছে। আমরা দু’জনেই প্রায় মাথায় মাথায় ছিলুম। সেম হাইট। আচ্ছা, তুমি তোমার মায়ের মুখটা পেলে, স্বভাবও পেলে, রংটা কেন পেলে না বলো তো!
আজ্ঞে, তা তো জানি না।
আমি জানি। আমি তোমার রং কালচে করে দিয়েছি। শুধু মা সুন্দরী হলে হয় না, পিতাকেও সুন্দর হতে হবে। আগেকার দিনের জমিদারদের সন্তান কন্দর্পকান্তি কেন হত জানো? অনেক খুঁজে খুঁজে, দেখে দেখে সেরা সুন্দরীদের সঙ্গে ছেলেদের বিয়ে দিতেন। বংশ দেখতেন। ফুটফুটে ছেলে, ফুটফুটে মেয়ে হত। নিষ্ঠা চাই। বুঝলে? হিউম্যান ব্রিডিংও একটা আর্ট। গ্রিক আর রোমানদের দিকে তাকিয়ে দেখো। ইজিপশিয়ানদের কথা ভাবো। ক্লিওপেট্রার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তবে? তবে কেন অত ছটফট করো!
আজ্ঞে করি না তো।
না কখনও করবে না। কোনও টিয়া কি কাককে বিয়ে করে! বউ কথা কও কি হাঁড়িচাচার জন্যে পাগল হয়? ময়ূর কি বকের পেছনে দৌড়োয়? ঘুঘু কি গোলাপায়রাকে লাভ লেটার্স লেখে?
আজ্ঞে না।
মেনটেন ইয়োর ব্রিড। তোমার মায়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া উচিত হয়নি। শি ওয়াজ এ প্যারাগন অফ বিউটি। আর আমি! এ লিটল বিট অফ এ সিমপ্যাঞ্জি। আমার সবকিছু কোর্স। স্কিন, হেয়ার, কমপ্লেকশন।
আজ্ঞে না, ইউ আর সো ম্যাসকুলাইন!
ও, ডোন্ট ফ্ল্যাটার মি। ম্যাসকুলাইন! দ্যাট ইজ মাই সাধনা। যৌবনে পিটে পিটে শরীরটাকে তৈরি করেছিলুম। তোমার মায়ের সঙ্গে কোনও সুন্দর পুরুষের বিয়ে হলে, তুমি কত সুন্দর হতে পারতে! তুমি আমার দিকে অ্যাকিউজিং ফিঙ্গার তুলে বলতে পারো, কেন আপনি আমার সর্বনাশ করলেন, কেন আপনি আমাকে পৃথিবীতে আনলেন, আমি কন্দর্প হয়ে আসতে পারতুম!
আজ্ঞে, আমি তা কখনও বলব না।
তোমার বলা উচিত। তুমি বলতে পারো। আই ওন্ট মাইন্ড। আই হ্যাভ ডেস্ট্রয়েড এ পসিবিলিটি। একটা ভাল পুট কাঁচা হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। তোমার জীবনী অন্যভাবে লেখা হতে পারত!
আমি ভাগ্যকে বিশ্বাস করি।
হ্যাঁ করবেই তো! তুমি যে দুর্বল। তাইমুর কি চেঙ্গিজ ভাগ্যকে বিশ্বাস করতেন না। নেলসন কি নেপোলিয়ান ভাগ্যকে বিশ্বাস করতেন না। তোমার রক্তে হোয়াইট ব্লাড কর্পাসল রেড ব্লাড সেলের চেয়ে অনেক বেশি। তুমি অ্যানিমিক। ভাল করে খাওয়াদাওয়া করো, ভাগ্য পালাবে। জীবন সম্পর্কে একটা পজিটিভ অ্যাটিচিউড আসবে। নির্জীব থেকে সজীব হয়ে উঠবে। ক্লীব থেকে জীব। তোমার রক্তে কিছু লোহার প্রয়োজন। ইউ নিড সাম মিনারেলস।
যাই, এইবার চা করে আনি।
হ্যাঁ, যাও, নাও ইট ইজ টাইম ফর টি।
উত্তর মহল আজ অসম্ভব ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। নির্জন দেয়ালে মাঝে মাঝে টিকটিকি টকাস টকাস শব্দ করে দরজা খোলাতে চাইছে। লম্বা লম্বা শাড়ি ঝুলছে। শুকিয়ে গেছে। হাওয়া দিলেই প্রাণ পেয়ে নড়াচড়া করছে। ছাতে ওঠার সিঁড়ির একপাশে কনকের, মুকুর ছাড়া জামাকাপড় তালগোল পাকানো পড়ে আছে। দু’জোড়া হাইহিল জুতো সিঁড়ি ভাঙার জন্যে যেন প্রস্তুত হয়ে আছে। ওয়ান, টু, থ্রি বললেই টকাস টকাস করে এগোতে থাকবে। রান্নাঘরের কুলুঙ্গিতে এক টুকরো কাগজ রোল করা। কীসের ক্যাশমেমো? কনকের হাতের লেখা, ‘পিন্টু, তুমি কিছু মনে কোরো না। বাবার ভয়ে দূরে দূরে থাকছি। মেয়েদের একটু অভিনয় করে চলতে হয়, নইলে তলিয়ে যেতে হয়। মেয়ে হলে বুঝতে।’ কখন লিখল! মনে আবার ভাঙন ধরাতে চাইছে।
চা নিয়ে এসে দেখলুম, পিতা জ্বরে হাঁসফাস করছেন। দেয়াল আয়নার দিকে দৃষ্টি স্থির। দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। হাত বাড়িয়ে চা নিলেন।
কী, খুব যন্ত্রণা হচ্ছে আপনার?
শরীরে নয়, মনে। জীবনে ছোটখাটো দু-একটা ভুল করে ফেলেছি। My thoughtless youth was winged with vain desirers/My manhood, long misled by wandering fires. আর তো শৈশবে ফিরে যাওয়া যাবে না, আর তো যৌবনে ফিরে আসবে না। Where is the Life we have lost in living?/where is the wisdom we have lost in Knowledge?/where is the knowledge we have lost in information?
চায়ে চুমুক দিলেন। যা কোনওদিন হয় না, আজ হাত কাঁপছে। চোখ আরও রক্তবর্ণ। উচ্চ চাপ মনে হয় বেড়েছে। এত আবেগই বা কোথায় ছিল? বাঁধভাঙা নদীর প্রবল স্রোতধারায় বেরিয়ে আসছে।
ওই যে আয়নাটা দেখছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ওই আয়নায় আমার যৌবন ধরা আছে, তোমার কৈশোর আছে, তোমার মায়ের ছায়া আছে। তা হলে শোনো একদিনের কথা বলি। তাড়া আছে?
আজ্ঞে না।
তা হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মতো পা ইকছ কেন? বোসো। তোমার বয়েস তখন তিন কি চার। ভীষণ জ্বর। তিন কি চার। উঠছে নামছে। সকালে এক পুরিয়া ওষুধ দিয়ে ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে অফিসে গেলুম। কাজে মন বসছে না। ছটফট করছি। ল্যাবরেটরিতে অ্যানালিসিসে একটা স্যাম্পল চড়িয়েছি। অন্যমনস্ক, ইথারের বোতলে আগুন ধরে গেল। পুড়তে পুড়তে বেঁচে গেলুম। আমার অ্যাসিস্টেন্ট অন্নদা বললে, আজ আপনার কী হয়েছে বলুন তো? আমি বললুম, তুমি কিছুক্ষণ সামলাও, আমি একবার চট করে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ছেলেটার খুব জ্বর দেখে এসেছি। ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি। সাড়াশব্দ নেই। নিস্তব্ধ বাড়ি। ঘরে ঢুকে দেখি, তোমার মা ওই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সবে চান সেরেছে। ভিজে চুল কোমর ছাপিয়ে পায়ের কাছে চামরের মতো দুলছে। চাঁপাফুল রঙের শাড়ি পরেছে। গালে গোলাপি আভা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে সিঁদুরের টিপ পরছে। আর তুমি খাটে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। আয়নায় আমাকে দেখে ঘুরে দাঁড়াল, আঙুল কপালের টিপে, তুমি? হ্যাঁ আমি। খোকা কেমন আছে? হেসে বললে, জ্বর ছেড়ে গেছে। Time, you old gipsy man/Will you not stay/Put up your caravan/Just for one day/Just for one day?
আপনার চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল। টাটকা আর এক কাপ করে দিই।
নাঃ, মুখে আর ভাল লাগছে না কিছু। বিস্বাদ হয়ে গেছে। ওই কোটের পকেট থেকে আমাকে বড় রুমালটা দাও। মাথায় একটা ফেট্টি বাঁধি। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
শুয়ে পড়ুন। একটু টিপে দিই।
দুর পাগল। সেবা নিলে মানুষ দুর্বল হয়ে যায়। He who was living is now dead/We who were living are now dying/With a little patience. তুমি বরং ওই রেকর্ডটা একবার চাপাও তো।
কোনটা বলুন?
ওই যে, তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই বারে বারে।
কোণের দিকে ছোট্ট একটা টেবিলে আদ্যিকালের চোঙা-লাগানো গ্রামোফোন। হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে রেকর্ড চাপাতে হয়। ঘুঘু আর ডাকছে না। বাইরের কার্নিসে গোটাকতক বুড়ো পায়রা বাতের ব্যথায় অনবরত কোত পেড়ে চলেছে। গান বেজে উঠল। পিনটা পালটানো উচিত ছিল। পিতা চোখ বুজে গান শুনছেন। গান একসময় থেমে গেল। তবু চোখ খুলছেন না। মাথার কাছে এগিয়ে গেলুম। জ্বরে বেহুশ মতো হয়ে গেছেন। এখান থেকে হলঘরে মায়ের ছবিটা স্পষ্ট দেখা যায়। পশ্চিমের একচিলতে রোদ পড়েছে। জ্বলজ্বল করছে। আয়নাটাও কেমন যেন গভীর আকাশের চেহারা নিয়েছে। মেসোমশাইদের ঘরের খাটের চাঁদরের একটা অংশ আয়নায় ভেসে আছে। আয়নার জগৎ একেবারে নির্জন নয়। বাতাসে চাদর নড়লে ছায়াও নড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে বহু দূর থেকে কেউ যেন আঁচল উড়িয়ে আসছে। ভারী অদ্ভুত লাগছে। বিরাট বড় একটা দায়িত্ব পেয়ে গেছি। বিশাল শক্তিশালী এই মানুষটি আজ কত অসহায়! অদৃশ্য বন্ধনের কত আকর্ষণ। ফেলে যাব কোথায়! সন্ন্যাস কি মুখের কথা! সব ছাড়োয়ে বললেই কি সব ছাড়া যায়!
মাথার নীচে ছোট একটা বালিশ লাগাতে গেলুম। চমকে উঠলেন। ক’টা বাজল?
প্রায় সাড়ে চারটে।
রোদ পড়ে এসেছে। ছাতের গাছে একটু করে জল দিতে হবে।
রোদের ঝঝ কমুক, এখন দিলে শুকিয়ে যাবে।
হ্যাঁ, সন্ধের মুখে দিয়ো। আমার পা-টা বেশ টাটিয়েছে। ওঁরা ফিরেছেন?
আজ্ঞে না।
সকালে আমি একটু বেশি ইমোশানাল হয়ে পড়েছিলুম। তোমাকে কেউ আক্রমণ করলে আমার অ্যানিম্যাল ইনস্টিংক্ট প্রখর হয়ে ওঠে।
The world turns and the world changes
But one thing does not change
In all of my years, one thing does not change
However you disguise it, this thing does not change
The perpetual struggle of good and evil.
দেবতা আর অসুরের মাঝখানে পাতলা কাগজের ডায়াফ্রাম। একটু এদিক-ওদিক হলেই ফরদাফাঁই। নাঃ, সংযত হতে হবে। কী করব? তুমি যে আমার সন্তান। তোমার মধ্যে যে আমার বিশালের ছায়া আছে। আমাকে শেক্সপিয়ারের কমপ্লিট ওয়ার্কসটা একবার দাও তো।
বই না পড়ে, একটু শুয়ে পড়ুন না। শরীর খারাপ হলে রেস্ট নিতে হয়।
তুমি আমাকে শুইয়ে দিতে চাইছ কেন? তাতে তোমার কী লাভ?
বাপ রে? সিন্নি দেখে এগিয়েছিলুম, কেতকা দেখে আবার পেছিয়ে এলুম। দুর্গ জয় করা কি অত সহজ কাজ। মনোদুর্গে বসবাস, আলোছায়া খেলে অধরাকে ধরা কি সহজ? পিতার সঙ্গে আমার একদিন কবির লড়াই হলে বেশ হয়। দেখি কার স্টকে কত কবিতা আছে?
বোদ মিলিয়ে গেল রাতের ছায়ায়। বেগুনি রঙের আলোয় পৃথিবী বড় বিষণ্ণ। ফুলগাছের টবে জল দিচ্ছি। দু’-এক ফোঁটা ছাদে পড়লেই সোঁ সোঁ করে টেনে নিচ্ছে। মিট্টিকা আতরের মতো গন্ধ বেরোচ্ছে। কাকের দল যেদিকে উড়ে গেল বাসায়, সেদিক থেকে বাদুড় উড়ে আসছে। পেছনে ধপ করে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ হল। বেশ ভারী। পেছন ফিরে তাকাতেই চমকে উঠতে হল। খুনি আততায়ীর মতো এ কে?
জটেবুড়ির মতো চেহারা। জট-পাকানো লাল লাল চুল চারপাশে উড়ছে। মুখ লাল টকটকে। চোখদুটো ছাদের আবছা বেগুনি আলোয় পাথরের মতো জ্বলছে। পোশাকও অদ্ভুত। লাল একটা ঘাগরা। ঘাগরা নয় সায়া। তার ওপর হলদে রঙের একটা ব্লাউজ। কোথা থেকে এল? আকাশ থেকে পড়ল নাকি? সতীমার ক্ষুদ্র সংস্করণ? সামনের দিকে দৌড়ে পালাবার উপায় নেই। ছাদের বাইরে চলে যেতে হবে। মূর্তির গলায় শব্দ বেরোল,
পিন্টুদা?
কে, জবা?
হ্যাঁ, চিনতে পারছ না?
তুমি কোথা থেকে এলে? কীভাবে এলে?
তোমাদের ছাদের আলসে টপকে।
আমাদের ছাত অবদি এলে কী করে?
আমাদের বাড়ির কার্নিসে নেমে তোমাদের বাড়ির কার্নিসে পা রাখলুম।
ভয়ে আমার চোখ বুজে এল। গা শিরশির করে উঠল। যদি একবার পড়ে যেত, নির্ঘাত মৃত্যু।
তুমি এভাবে আসতে গেলে কেন?
আমার শাড়ি খুলে নিয়ে ঘরে শেল বন্ধ করে রেখেছিল। এ সব হল আমার মাসিটার কাজ।
মাসি মানে?
ওই হল, ছোট মা। তুমি আর কথা বাড়িও না। তোমার সামনে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার লজ্জা করছে। চট করে একটা শাড়ি এনে দাও।
শাড়ি পাব কোথায়?
তোমাদের বাড়িতে দু-দুটো মেয়ে, শাড়ি পাব কোথায়? যাও শিগগির নিয়ে এসো। এখুনি খোঁজপাত শুরু হবে।
নীচের তারে কনকের শাড়ি ঝুলছিল। যা হয় তবে, এখন দিয়ে তো দিই। কনককে বোঝালে। নিশ্চয়ই বুঝবে। জবার হাতে শাড়িটা দিতেই বলল, এত দামি কাপড় না আনলেই পারতে।
শাড়িটা পরতে পরতে বললে, তোমাদের পেছন দিকের দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে যাব।
কোথায় যাবে?
আমার জায়গায়।
সেটা আবার কোথায়?
বিয়ের পর মেয়েদের জায়গা কোথায় জানো না!
জবা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে চলল। জোরে চেঁচাতেও পারছি না। পেছন পেছন নামতে নামতে ফিসফিস করে বললুম, সুখেন নেই। দীনু তাকে কোথায় যেন নিয়ে গেছে।
যাক, আমি ঠিক খুঁজে বের করব।
তোমার চেহারাটা একটু ঠিক করে নিলে হত না।
সময় নেই, উপায়ও নেই। আমি চুপিচুপি নেমে বেরিয়ে যাচ্ছি, তোমাকে আর আসতে হবে না। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবে আমি কিছু জানি না।
তোমাকে আবার ধরে ফেলবে।
কারুর বাপের ক্ষমতা নেই।
জবা পায়ে পায়ে নীচে নেমে গেল। ভাগ্য ভাল, পিতৃদেব জ্বরে ইজিচেয়ারশায়ী। উঃ, সুখেনের বরাতটা তো খুব ভাল! এত প্রেম! দু’জনে এক সুরে বাঁধা! এমন তত বড় একটা দেখা যায় না। জলের ঝারিটা আনতে গিয়ে কানে এল, জবাদের বাড়িতে এক মহিলা খ্যানখ্যানে গলায় চিৎকার করছে, জবা, জবা। পালাও জবা, পালাও।
কোলের ওপর শেক্সপিয়ার, চেয়ারে পিতা আচ্ছন্ন। মাথায় ফেট্টি, চোখ বন্ধ। বাড়িতে বয়স্ক কেউ থাকলে একটু সাহস পাওয়া যেত। ঘরে ঘুটুর ঘুটুর করছি, চোখ না খুলেই পিতা বললেন, রাতে আমার উপবাস। তুমি যা হয় একটা কিছু নিজের মতো করে নাও। ওঁরা তো এখনও ফিরলেন না!
না, বেশ দেরি হচ্ছে।
মুখ থেকে কথা সরতে-নাসরতেই বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। প্রতাপ রায় এলেন। দু’জনে কথা বলতে বলতে ওপরে উঠছেন। মেসোমশাইকে বেশ খুশিখুশি দেখাচ্ছে। ভোজনতৃপ্ত চেহারা। ঘরে ঢুকে কিছু একটা বলতে গিয়ে পিতার অবস্থা দেখে থেমে গেলেন। কী হল? শরীর। খুব খারাপ হয়েছে?
চোখ না খুলে পিতা বললেন, আপনার কাজ হল?
প্রশ্ন প্রশ্নে চাপা পড়ে গেল। এ বেশ ভাল কৌশল। যে-প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না পালটা প্রশ্ন করে পাশ কাটিয়ে যাই। কনক আর মুকু কোথায় গেল? তাদের দেখছি না তো!
হ্যাঁ, কাজ হয়েছে। প্রতাপের মতো ছেলে হয় না। হরিদা, আপনার অনুমতি চাইছি।
অনুমতির প্রয়োজন নেই। ম্যাটার অফ কনভিনিয়েন্স। আপনি যেতে পারেন।
যাবার কথাই জিজ্ঞেস করছি কী করে বুঝলেন।
কমন সেন্স বিনয়দা, কমন সেন্স।
প্রতাপের বাড়িটা বিশাল, জনপ্রাণী নেই।
লেখাপড়ার সুবিধে হবে।
ঠিক বলেছেন, তা ছাড়া…
নীচের তলাতেই ডাক্তারের চেম্বার।
ঠিক বলেছেন, তা ছাড়া…
প্রতাপের বিষয় সম্পত্তির মামলা এমন জড়ভট্টি হয়ে আছে, জট ছাড়াতে হলে কাছেই থাকা দরকার।
ঠিক বলেছেন, তা ছাড়া…
কলকাতায় থাকলে পরীক্ষা দেবার সুবিধে অনেক।
ঠিক বলেছেন, তা ছাড়া প্রতাপের এক কাকা দর্শনের অধ্যাপক। কাছাকাছি থাকলে আমার চেয়ে ভাল কোচিং পাবে।
এই মুহূর্তে আপনি চলে যান। আর একটুও দেরি করবেন না।
আপনি চোখ খুলছেন না কেন?
কোনও কোনও সময় চোখ বুজিয়ে থাকলে পৃথিবীকে কম কর্কশ মনে হয়।
প্রতাপ রায় বললেন, আপনাকে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছে। চলুন না একবার স্পেশালিস্ট দেখিয়ে দিই।
তেমন স্পেশাল কিছু হয়নি প্রতাপ। ধন্যবাদ।
মেসোমশাইয়ের চেয়ে প্রতাপ রায়ের উৎসাহ যেন বেশি। মেসোমশাই বিক্ষিপ্ত সমস্ত জিনিস গোছগাছ করে সুটকেসে ভরতে লাগলেন। মেয়েদের শাড়ির হিসেব রাখেন না, তাই জানতেও পারলেন না একখানা শাড়ি নেই। আশ্চর্য, মেয়ে দুটোকে কেন রেখে এলেন?
মেসোমশাইয়ের সেই প্রথম দিনের বেশ। হাতে শোলার টুপি।
হরিদা, আমি তা হলে আসছি। মেয়েদুটো থিয়েটার দেখতে গেছে। অনেকদিনের শখ কলকাতার থিয়েটার দেখবে। যাবার আগে দেখা করে যাব। দিনকতক আপনার অসুবিধে করে গেলুম।
অসুবিধে হলে যাবার আগেও আসতে পারেন।
নাঃ অসুবিধে আর কী? প্রাসাদতুল্য বাড়ি। দাসদাসী। আচ্ছা আসি।
দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন, আগে পরে। প্রতাপ রায়ের এত উৎসাহ কীসের! পিতা এতক্ষণে চোখ খুললেন।
কী বুঝলে?
আমাকে আর বুঝতে হল না। মাতামহ আসছেন গাইতে গাইতে, রিপুর বশে চললেম আগে, ভাবলেম না কী হবে পাছে।
১.১৭ আপনার চেয়ে পর ভাল, পরের চেয়ে বন ভাল
গান গাইতেন, আপনার জন সতত আপন, পর কি কখনও হয় রে আপন। কনকের বাবা যেভাবে চলে গেছেন, নিতান্ত স্বার্থপর না হলে এভাবে কেউ যেতে পারে না। কুইক মার্চ অ্যান্ড এগজিট। জীবনে বড়সড় হতে গেলে নিজের কথাই ভাবতে হয়, অন্যের কথা ভাবতে গেলে চলে না। ভেবেছ। কী মরেছ। কে কার?
মাতামহ দরজার আড়াল থেকে ঘরে উঁকি মেরে বললেন, একী, এমন রাখাল রাজার বেশ কেন? মাথায় ফেট্টি। তুমি কি রাখালভাবে সাধনা করছ নাকি?
পিতা চোখ আধ-খোলা করে বললেন, ব্রেকডাউন। একশো তিনটিন হবে। ডান পা-টা ড্যামেজ করে ফেলেছি।
মাতামহ পিতার সামনে চেয়ার টেনে এনে সোজা হয়ে বসে বললেন, তোমার মঙ্গল কিঞ্চিৎ কুপিত। প্রায়ই রক্তপাত হচ্ছে। ফ্রন্টিয়ারে যুদ্ধ করতে গেলেও ঘনঘন এতবার আহত হতে হয় না। তোমার এই কাটা সৈনিকের অবস্থা দেখতে ভাল লাগে না। তুমি হলে আমাদের পুরুষসিংহ। সিংহ যদি গর্জন না করে বেড়ালের মতো মিউ মিউ করে, বড় মন খারাপ হয়ে যায়।
সংসারে চিরকালই আমি এক কাটা-সৈনিক। মাঝেমধ্যে তেড়েফুঁড়ে উঠি, সঙ্গে সঙ্গে ড্যাঙোস খেয়ে চিতপাত হয়ে পড়ি।
তোমাকে ড্যাঙোস মারে এমন পুরুষ মাতৃগর্ভে জন্মায়নি।
আমি তো আছি। নিজেই নিজেকে মেরে ফ্ল্যাট করে দিচ্ছি।
হরিদা আছেন? হরিদা?
অপরিচিত কণ্ঠস্বর। মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। খদ্দরের খাটো ধুতি। একমাথা আধ-পাকা চুল চারপাশে ঝকড়া কঁকড়া হয়ে ঝুলছে। ধুলোমাখা দুটো খালি পা। অন্তত ফুট ছয়েক লম্বা। তেমনি বিশাল চেহারা। বুকের সবক’টা বোতাম খোলা। ভেতরে আবার গেঞ্জি নেই। বুকে একটাও লোম নেই। মসৃণ, তেলা। কোমলে কঠোরে মেশানো অদ্ভুত এক চেহারা।
হ্যাঁ, আছেন। আপনি আসুন।
কে, অক্ষয় নাকি? পিতা ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন।
হ্যাঁ, আমি অক্ষয়। কী ব্যাপার আজ অফিসে গেলেন না?
এই যে পা খোঁড়া করে বসে আছি।
আমার মন বলছিল একটা কিছু হয়েছে। অকারণে বসে থাকার মানুষ আপনি নন।
তুমি ওই চেয়ারটায় বসে পড়ো। আমার শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?
না, আপনার মুখে ওঁর কথা আমি শুনেছি। আজ দর্শন হল। একটু পায়ের ধুলো নিই। শুনেছি আপনি অনেক দূর এগিয়েছেন।
মাতামহ পদযুগল কাপড়ের আড়ালে লুকোতে লুকোতে বললেন, না, না, প্রণাম কেন? আবার প্রণাম কেন?
তা বললে হয়, প্রণম্যকে প্রণাম করতেই হবে। অক্ষয়বাবু সামনে ঝুঁকে পড়ে চিকের আড়াল থেকে পা খুঁজে বের করার কসরত দেখাতে লাগলেন। মাতামহ ইজ্জত-যেতে বসা রমণীর মতো মুখভঙ্গি করে বসেই রইলেন।
পিতা বললেন, ধুলো নেবার মতো পা হল তোমার অক্ষয়। যেখান দিয়ে চলেছ সেইখানেই টন টন পদরেণু ঝরে ঝরে পড়ছে।
অক্ষয়বাবু খাড়া হয়ে বললেন, আমি ঝেড়ে দিচ্ছি হরিদা। একটা ঝাডুটাড়ু দিন।
আরে বোসো বোসো। আমি ধুলোর কথা বলেছি। ধুলো ঝাড়ার কথা বলিনি।
আপনার বাড়িতে লোকজন নেই, সারা শহরের ধুলো টেনে এনেছি, দিন না পরিষ্কার করে দিই।
মাতামহ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, বাড়িতে এখন অনেক লোক। আমাদের সংসার ভরে উঠেছে।
পিতা বললেন, ভরে উঠেছিল, আবার খালি হয়ে গেছে।
সেকী? সব হাওয়া!
আজ্ঞে হ্যাঁ। তারা চলে গেছেন। আরও ভাল বাড়ি, আরও ভাল ব্যবস্থা। আরও সুখসুবিধে। যাক বাবা, বাঁচা গেছে। আর তা হলে জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হবে না। আরে আমাদের পুরুষের সংসারে ওসব মানায় নাকি? আমরা নিজেদের মতো খাবদাব আর সানকি বাজাব। এ ক’দিন যেন আমাদের আক্কেল দাঁত উঠেছিল। তা হলে ঝেড়েই দাও।
না না, কোনও প্রয়োজন নেই, তুমি বোসো, আরাম করো। নিশ্চয় হেঁটে হেঁটে এসেছ!
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার আছে চরণবাবুর জুড়িগাড়ি। তা হলে বাইরে গিয়ে একটু নেচে আসি। যা ঝরার ঝরে যাক।
কোনও দরকার নেই, তুমি শান্ত হয়ে বোসো।
অক্ষয়বাবু বসলেন। বসে বললেন, আমি আরও এলুম, একটা সুখবর আছে। আপনার প্রোমোশনের সেই অর্ডারটা আজ এসে গেছে।
বলো কী? ল্যাং তা হলে মারতে পারল না।
নাঃ ফেল করল। আপনাকে আমি বলেছিলুম, অ্যাস্ট্রোলজিক্যলি আপনার এই প্রমোশন কারুর আটকাবার ক্ষমতা নেই। আপনার ব্যাড ডেজ চলে গেল। এইবার ভাগ্যের রথ গড়গড়িয়ে চলবে।
মাতামহের ঘুমঘুম ভাব কেটে গেল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ও, তুমি এনার কথাই বলেছিলে। বিরাট জ্যোতিষী। মর্গে গিয়ে মৃতদেহের হাত দেখে দেখে জ্যোতিষের সত্য অসত্য মেলান।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস নেই, তবে অক্ষয়ের অধ্যবসায়ে আমার গভীর বিশ্বাস। দেখা যাক ও এই বুজরুকিকে বিজ্ঞানের স্তরে নিয়ে যেতে পারে কি না। মর্গে তোমার সেই ভূত দর্শনের ঘটনাটা ভাবো অক্ষয়?
মাতামহ আরও সোজা হয়ে বসে বললেন, অ্যাঁ, ভূতের হাত? ইনি ভূতের হাত দেখেছেন?
ভূতের হাত নয়, ভূতের হাতে পড়েছিলেন।
আমার খুব শুনতে ইচ্ছে করছে।
এসেছে যখন শুনবেন, তার আগে একটু জলযোগ করে নিক। খাইয়ে মানুষ। সারা মাসই তো ওকে নেমন্তন্ন খেয়ে খেয়ে বেড়াতে হয়। ও হল কলকাতার এক নম্বর প্রোফেশনাল খাইয়ে। বড় বড় বাড়ির রেজিস্টারে ওর নাম আছে।
উঃ, একেই বলে ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়। আমরা সারাবছর হাপিত্যেশ করে বসে থাকি, আর ইনি রোজ ভোজ মেরে বেড়ান। ভোজরাজ। কিন্তু ভূতের ব্যাপারটা সন্ধের মুখে সেরে নেওয়াই ভাল। বেশি রাতে ওসব আলোচনা না করাই উচিত। ছোটরা ভয় পেতে পারে।
আমরা তো সবাই বুড়ো দামড়া, ভয় পাবার মতো তো কেউ নেই। এক আপনি যদি ভয় পান তা হলে আলাদা কথা।
আমি একটু ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি। তোমার মতো অবিশ্বাসী নই। বাগানের একপাশে পড়ে থাকি। বুঝলে কিনা?
আপনি তো তন্ত্রসাধক! আপনার আবার ভয় কীসের?
তা-আ ঠিক। মাতামহ আবার মাথা নিচু করলেন।
পিতা বললেন, নাও, এঁদের একটু জলযোগের ব্যবস্থা করো। আমি তো বেএক্তিয়ার হয়ে পড়েছি। তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না।
থাক না হরিদাজলযোগের জন্যে ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? পরে আর একদিন হবে। অক্ষয়বাবু খুঁতখুঁত করে উঠলেন।
আমার ডিকশনরিতে পরে বলে কোনও কথা নেই। আমি জানি, নাও অর নেভার। ওর ট্রেনিংও সেইভাবেই হয়েছে। তুমি কিন্তু কিন্তু কোরো না।
মাতামহ বললেন, আমি সাহায্য করছি। আমরা সব অন্য জাতের মানুষ, কী বলল হরিশঙ্কর! আমরা হলুম গিয়ে অর্ধনারীশ্বর। বাড়িতে মেয়েরা নেই তো কী হয়েছে। আমরা হলুম গিয়ে মেয়েদের বাবা। গর্ভধারণ ছাড়া সবই পারি।
উঃ, আবার আপনার মুখ আলগা হয়েছে। সেদিন কী সারমন দিলুম?
গর্ভধারণ তো খারাপ কথা নয়। একেবারে শুদ্ধ সংস্কৃত।
শব্দটা খারাপ নয়, ভাবটা ভালগার।
তা হলে ওটা তুমি কেটে দাও।
বলা কথা আর ছোঁড়া পাথর আর ওলটানো দুধ হাতের বাইরে চলে যায়।
পিতার মনে হয় জ্বরের দাপট একটু কমেছে। সেই ঝিমুনি ভাবটা আর নেই। অনর্গল কথা বলছেন।
মাতামহ উঠে এলেন। মুখে সেই অনাবিল হাসিটি লেগে আছে। শুভ্র একটি রাজহংস। জীবনের কোনও কিছুই গায়ে মাখলেন না। একবার করে পালক ঝাড়েন আর সব ছিটকে পড়ে যায়। ফিসফিস করে বললেন, আসার সময় দেখে এলুম ওই মোড়ের দোকানে গরম গরম হিঙের কচুরি ভাজছে। এই ফুলোফুলো, লাল লাল।
আপনি যা ভাবছেন আমিও তাই ভাবছি। কচুরি, ঘুগনি, আর চা।
উঃ, তুই আমার নাতির মতো নাতি। তুলসী তোকে রেখে গেছে আমার জন্যে আর ওই দুর্দান্ত ছেলেটার জন্যে। পা-টাকে অমন ক্ষতবিক্ষত করল কী করে?
বাথরুমের দেয়াল ঝরাচ্ছিলেন, পায়ে প্লাসটারের চাঙড় ভেঙে পড়েছে।
নাঃ তুলসী ওকে ভুলতে পারেনি।
তার মানে?
সে তুই বুঝতে পারবি না। এই পৃথিবীর চারপাশে আর একটা জগৎ ঘুরপাক খাচ্ছে। ডাক্তারখানায় যেমন রুগিরা মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে থাকে সেইরকম মৃত আত্মারা সেইখানে বসে আছে। ওখানের আলোটা কেমন জানিস?
না।
বিদ্যুৎ চমকালে যেমন নীল আলোলা হয় সবসময় সেইরকম নীল আলো স্থির হয়ে আছে।
কী করে জানলেন?
আমার মনে হয়। তা হলে কচুরি আর ঘুগনি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
মোড়ের মাথায় দিনুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কী রে, সুখেন কোথায়?
খুব নিরাপদ জায়গায়। আচ্ছা, চুল বেরোতে ক’মাস সময় লাগে রে?
রাখ তোর চুল। জবা ছাত টপকে আমাদের বাড়ির খিড়কি দিয়ে সেই ন্যাড়ার সন্ধানে ছুটেছে।
অ্যাঁ, বলিস কী? পৃথিবীটা হঠাৎ পালটে গেল নাকি! যাই জবাকে খুঁজে বের করি। কেউ জানে?
না, কাউকে বলিনি।
দিনু আবার দৌড়োল। আমাদের গ্রেট দিন।
কচুরি আর ঘুগনি খেয়ে অক্ষয়বাবু একটু ধাতস্থ হলেন। এতটা পথ হেঁটে এসেছেন, বেশ খিদে পেয়েছিল মনে হয়। চায়ের কাপটা সামনে রাখতেই পকেট থেকে খানিকটা তুলো বের করে চায়ে ভেজাতে লাগলেন।
মাতামহ জিজ্ঞেস করলেন, চায়ে তো বিস্কুট ভিজিয়ে খায়, তুলোও খাওয়া যায় নাকি?
আজ্ঞে না, আসার পথে হোঁচট খেয়ে ডানপায়ের বুড়ো আঙুলের নখটা কৌটোর ঢাকা খোলার মতো হয়ে গেছে। চায়ে তুলো ভিজিয়ে একটু বেঁধে রাখি।
এটা কী ধরনের চিকিৎসা?
আজ্ঞে আসুরিক। মানুষ যখন জঙ্গলে থাকত, পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করত, তখন তাদের অনেক দাওয়াই জানা ছিল।
তখন কি চা ছিল?
না, চা-চিকিৎসা আমার আবিষ্কার। চা খেলে পেট মরে যায়, লিভার শুকিয়ে যায়, তা হলে ঘা কেন শুকোবে না, জীবাণু কেন মরবে না? কাটাছেঁড়ায় চা আমার দাওয়াই।
চা-টা যে নোংরা হয়ে গেল।
না, না, নোংরা আবার কী? নোংরা, পরিষ্কার সবই আমাদের মনের বিকার। ওঃ কত বড় সাধক আপনি! ভূত দেখেছেন, ভৌতিক চিকিৎসায় উপকার পেয়েছেন, ভগবান দেখেছেন?
আজ্ঞে না।
দেখবেন দেখবেন। কেউ আটকাতে পারবে না। ঠাকুর বলেছিলেন, যখন গঙ্গার জল আর নর্দমার জল এক মনে হবে তখন বুঝবে ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে। আপনার তো তাই হয়েছে। আপনি প্রকৃত ভাগ্যবান।
আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন?
হ্যাঁ, তাও তো বটে। আমি তো বড় একটা কাউকে আপনি বলি না। আপনিটা তুমি নিজের গুণেই আদায় করে নিলে।
পিতা চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন, অক্ষয়ের সাহস কত জানেন? তোমার সেই ঘটনাটা বলো না।
কোনটা হরিদা?
সেই বালির ব্রিজে মুণ্ডু কাটা মানুষ।
উঃ, সে ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।
কীরকম, কীরকম? মাতামহ উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে পড়লেন।
অক্ষয়বাবু বেশ আয়েশ করে বসে গল্প শুরু করলেন। আমি তখন উত্তরপাড়ায় থাকি। বউদির ভীষণ অসুখ। ডাক্তারবাবু এমন এক ওষুধ দিলেন যা কলকাতা ছাড়া পাওয়া যাবে না। রাত হয়ে গেছে। ওষুধ না পড়লে রুগির রাত কাটবে কি না সন্দেহ। বেরিয়ে পড়লুম সাইকেল নিয়ে। কোথাও না পাই শ্যামবাজারের রাইমারে পাবই। শীত পড়েছে জাঁকিয়ে! অমাবস্যা তিথি। যাবার সময় দেখে গেলুম গঙ্গা থেকে হিলহিল করে কুয়াশা উঠছে। ওষুধ পেয়ে গেলুম। ফেরার পথে টালার কাছে টায়ার পাংচার হয়ে গেল। সারাতে সারাতে বেজে গেল রাত দশটা। ফের যখন ব্রিজে উঠলুম তখন মাঝরাত। গঙ্গা অদৃশ্য। ব্রিজ পড়ে আছে নরকে যাবার একফালি রাস্তার মতন। কুয়াশায় ভেসে আছে। মনে হচ্ছে কুরে কুরে রাস্তা বের করতে হবে। সে দৃশ্য ভাবা যায় না। দু’হাত দূরেও দৃষ্টি চলে না। ব্রিজের মাঝামাঝি এসেছি। বাঁ পাশে তাকিয়ে দেখি লোহার গার্ডারে ঠেসান দিয়ে কে যেন বসে আছে। কে রে বাবা! এই শীতের রাত। থিকথিকে কুয়াশা। আত্মহত্যা করতে চায় নাকি! ব্রিজ হল আত্মহত্যার জায়গা। সাইকেল থেকে নেমে পড়লুম। ফুটপাথে ঠেসিয়ে রেখে কাছে গিয়ে। ডাকছি, ও মশাই শুনছেন, ও মশাই শুনছেন? কোনও উত্তর নেই? কাঁধে হাত দিয়ে বললুম, ও মশাই! যেই না নাড়া দিয়েছি, কাঁধ থেকে মুভুটা খুলে ঠাস করে গড়িয়ে পড়ল। কী সর্বনাশ! আমার তো খালি পা। এতক্ষণ পায়ে নরম নরম রবারের মতো কী লাগছিল। ভাল করে তাকিয়ে দেখি আলকাতরার মতো জমাট রক্ত। আর ঠিক সেই সময় একটা স্টিমার গম্ভীর সুরে ভোঁ দিয়ে উঠল। কুয়াশার সাদা চাদর কেঁপে গেল। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে চট করে রাস্তা থেকে মুন্ডুটা তুলে নিয়ে আবার কাঁধে ফিট করে দিলুম। চেহারা দেখে মনে হল বেশ মানিড ম্যান। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মনে হল পিঠে কে যেন হাত রাখল। চমকে উঠেছি। পুলিশ নাকি! কেউ কোথাও নেই। অথচ পিঠে হাত রেখেছিল কেউ! ফিসফিস করে কানের কাছে কে বললে, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও। ঝড়ের বেগে সাইকেল চালালুম। পড়ি কি মরি। বাড়ি ঢুকছি, ভাইপো ভাইঝিরা কেঁদে উঠল। বউদি মারা গেলেন।
পিতা মাতামহের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন শুনলেন? আপনি হলে কী করতেন?
মাতামহ ভয়ে জমে পাথর হয়ে গেছেন। নীচের ঠোঁট থিরথির করে কাঁপছে। চোখদুটো প্রায় উলটে গেছে।
পিতা বললেন, একটা ঠোঙা ফুলিয়ে কানের কাছে ফট করে ফাটাও। শক ট্রিটমেন্ট।
অক্ষয়বাবু বললেন, শকে শাক্যং সমাচরেৎ। ভীষণ ভিতু মানুষ।
না না, অন্য ব্যাপারে তেমন ভয় নেই। আগে খুব বাঘের ভয় ছিল। আমাদের সঙ্গে একবার জামতাড়া বেড়াতে গিয়ে রাতে বাঘের স্বপ্ন দেখে মশারিফশারি ছিঁড়ে এমন কাণ্ড করেছিলেন! সে আর এক কাহিনি। পরে তারাপীঠে শ্মশান জাগাতে গিয়ে ভূতের ভয় ধরিয়ে এসেছেন। ভ্রষ্ট তান্ত্রিক। মাঝরাতে ভূতে নাকি আঁচড়ে দিয়েছিল। আঁচড় দেখেই বুঝেছিলাম, খাকশেয়ালের কাজ। সঙ্গে সঙ্গে পাস্তুরে নিয়ে গিয়ে তলপেটে চব্বিশটা।
ফ্যাট করে ঠোঙা ফাটার শব্দ হতেই মাতামহ সংবিৎ ফিরে পেয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। অক্ষয়বাবু বললেন, তা হলে মর্গের গল্পটা না বলাই ভাল। কী বলেন হরিদা!
হ্যাঁ, না বলাই ভাল। সে তো আরও সাংঘাতিক।
মাতামহ বললেন, আমি কিন্তু ভয় পাইনি হরিশঙ্কর। তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। আমি একটা অন্য জগতে চলে গিয়েছিলুম। তুমি যার কাঁধে মুন্ডু ফিট করেছিলে, সে আমার শ্যালক প্রতীপ।
অ্যাঁ, বলেন কী! একই সঙ্গে দু’জনের বিস্ময় প্রকাশ।
হ্যাঁ গো, তোমাদের মনে নেই, সেই পদ্মিনী মামলার কথা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, পদ্মিনী মামলা! মনে পড়েছে। বছরের পর বছর চলেছিল। এতদিন আপনি চেপে ছিলেন কেন?
সে যে বড় লজ্জার কথা ছিল।
হ্যাঁ, তা ছিল, লাস্ট, গ্রিড।
হ্যাঁ, একেবারে চটকাঁচটকি ব্যাপার। অক্ষয়বাবু ফোড়ন কাটলেন।
মাতামহ বললেন, প্রতীপ আজ বেঁচে থাকলে কত বড় গাইয়ে হত জানো? ওর মতন অমন ঠুংরি খুব কম গাইয়েই গাইতে পারত। একেবারে আবদুল করিম কেটে বসানো। আমি তোমার ভয়ে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলুম।
আমার ভয়ে? অক্ষয়বাবু ভুরু কোচকালেন।
হ্যাঁ, খুব বাঁচা বেঁচে গেছ। মনে আছে, মৃতের পাশে একটা ইঞ্জেকশনের অ্যামপুলস্ পড়ে ছিল। সেটা তো তা হলে তোমার পকেট থেকেই পড়েছিল।
পিতা বললেন, যদুর মনে পড়ছে, সেটা তো ছিল মরফিয়া। তুমি কি রাইমার থেকে মরফিয়া কিনেছিলে?
কতদিন আগের কথা, আর কি মনে আছে! হতে পারে মরফিয়া। বউদির মাথায় হেমারেজ হচ্ছিল, এইটুকু মনে আছে।
মাতামহ বললেন, সেইসময় আমি পরপর চোদ্দোদিন টানা সাক্ষী দিয়েছিলুম। আসামিরা সব ওই অ্যামপুলসের জোরে একে একে খালাস পেয়ে গেল। প্রতীপ মরফিয়া নিত না। আসামিরাও নয়। তা হলে মরফিয়া এল কোথা থেকে? খুনির পকেট থেকে। আর তুমিই সেই খুনি। তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজ পাওয়া গেল।
অক্ষয়বাবু শুকনো মুখে বললেন, আপনি কি আমাকে এতদিন পরে সেই খুনি ভাবলেন নাকি? মাতামহ হেসে বললেন, কী, ভয় পেয়েছ তো!
তা একটু পেয়েছি।
দেখলে তো, ভূতের ভয় ছাড়াও, অন্য ভয় আছে। প্রতীপও নেই, পদ্মিনীও নেই। যে খুন। করেছিল, সে এখনও বেঁচে আছে চন্দননগরে। সারাগায়ে শ্বেতী। প্রতীপের প্রেতাত্মা গায়ে হাত বুলিয়ে সাদা করে দিয়েছে। পদ্মিনী পুড়ে মারা গেছে।
পরের খবর কাগজে আর বেরোয়নি। পৃথিবীর আদালত থেকে মামলা গিয়ে উঠেছিল ভগবানের আদালতে। একেই বলে, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।
মাতামহ বললেন, জীবনে আমি বহু পাপী দেখেছি। মানুষের আদালতে পার পেয়ে গেলেও ঈশ্বরের আদালতে অন্যভাবে সাজা পেয়েছে। আশু রেল কোম্পানির ক্যাশ ভেঙেছিল। অনেক টাকা। জেলে গেল তার অ্যাসিসটেন্ট প্রভাত। বউটা গলায় দড়ি দিলে। দিন যায়। আশুর একমাত্র ছেলে। খুব বড় ঘরে বিয়ে দিলে। ছ’মাসের মাথায় বাস অ্যাকসিডেন্টে ছেলেটা মারা গেল। দিন যায়। আশুর চোখদুটো গেল। চুরি-টাকার বাড়ি নিলাম হয়ে গেল। তাই বলি, পাপ করার আগে ঈশ্বরের কথা একবার ভেবো। সে চোখকে তো ফাঁকি দিতে পারবে না।
পিতা ব্যান্ডেজ বাঁধা পা-টা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, এই দেখুন আমার ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট।
অক্ষয়বাবু বললেন, কী ক্রাইম করেছিলেন?
সামান্য অহংকার, একছিটে প্রত্যাশাভঙ্গের ক্রোধ, একটু ঘোলাটে বুদ্ধি, সব মিলে ঘণ্টা কয়েকের পশু। খুব লপচপানি, ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে পানিশমেন্ট। হাতে হাতে গীতার ফল প্রাপ্তি।
ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাঘুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশা প্রণশ্যতি ॥
মাতামহ মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, হে হেঃ ব্বাবা, পথে এসো ম্যান। খুব তো পুরুষকার পুরুষকার করতে, আমি কতদিন বলেছি, কারুর কাছে কিছু আশা কোরো না। না পেলেই মন খারাপ, মন খারাপ থেকে অভিমান, অভিমান থেকে রাগ। রাগ হল লাল লোহা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পশুকে জাগিয়ে তোলে। অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধং পরিগ্রহম্।
থাক থাক আর গীতা নয়। ও অনেক শুনেছি। মুখে আওড়ে কাঁচকলা হয়। মনকে বশে আনতে হবে।
এই তো, এই তো। তুমি ঘুরে গেছ। এইবার সাধনা। রত্নাকর থেকে বাল্মীকি।
রত্নাকর বাল্মীকি হয়। মিটমিটে মধ্যবিত্ত বাঙালি বাঙালিই থেকে যায়।
অক্ষয়বাবু বললেন, সবই হল গ্রহের প্রভাব। যে যা হবে, সে তা হবে। আগে থেকেই ঠিক করা আছে। সাধু সাধু হবে। চোর চোর হবে।
ওটা আবার তোমার লাইন। আমি বিশ্বাস করি না। ম্যান ইজ এ ক্রিচার অফ সারকামস্ট্যানসেস। তবে কালকের একটা ব্যাপারে আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি।
কীরকম, কীরকম? মাতামহ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
কাল আমি একটা স্বপ্ন দেখলুম। আমি যেন মাঝরাতে খোলা ছাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আকাশটা খুব কাছে নেমে এসেছে।
আহা, কী ভাল স্বপ্ন। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
দাঁড়ান দাঁড়ান। সবটা আগে শুনুন। আকাশটা খুব কাছে নেমে এসেছে। ধকধক করে তারা জ্বলছে। আমি বলছি, আরে ওই তো কালপুরুষ। যেই বলেছি কালপুরুষ, অমনি কালপুরুষ ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অবাক হয়ে ভাবছি, এ আবার কী! কালপুরুষ অমনি হুহু করে নীচের দিকে নামতে লাগল। আলো, আলো। চারপাশ যেন ঝলসে যাচ্ছে। নেমে এল ছাতে। সঙ্গে সেই কুকুরটাও আছে। লোমে হিলহিল করছে আগুন। আমি ভয়ে বলছি, একী একী, আকাশ ছেড়ো না। কালপুরুষ ধনুকে তির জুড়ল। মারবে নাকি! বলতে না-বলতেই তির ছেড়ে দিল। এত আলো, মনে হল সারা পৃথিবী জ্বলে উঠেছে। পেট্রলে আগুন লাগার মতো আমি দপ করে জ্বলে উঠে এক খণ্ড পোড়া কাঠের মতো হয়ে গেলুম। সব দেখতে পাচ্ছি, সব বুঝতে পারছি। নিজেই নিজের সৎকার দেখছি। কালপুরুষ রকেটের মতো আকাশে উঠে গেল। আকাশ সরে গেল। চারপাশে থকথকে অন্ধকার। ছাদে সেই পোড়া কাঠ। হাওয়া লেগে ছাই হচ্ছে, আর পিটপিট শব্দ করছে।
মাতামহ পিতার পিঠে হাত রেখে বললেন, তোমার হয়ে গেছে। তুমি পেয়ে গেছ। তোমার আর দেরি নেই। দীক্ষাটা নিয়ে ফেলল। এখন গেরুয়া পরার দরকার নেই। সবসময় সঙ্গে একটা গেরুয়া রুমাল রাখো। সন্ন্যাসাশ্রমে তোমার নাম হোক, স্বামী হরিহরানন্দ। এই বাড়িটাকে আমরা আশ্রম বানাব। পাঁজিতে তোমার নাম তুলে দোব।
আহা উত্তেজিত হবেন না। কী স্বপ্নের কী ব্যাখ্যা! কাল রাতে ওই স্বপ্ন, আজ সকালে আহত, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। দুটোর মধ্যে কেমন যেন যোগসাজস খুঁজে পাচ্ছি। অক্ষয়, তুমি এর কী মানে করবে?
আজ্ঞে, আমি তো তেমন স্বপ্নতত্ত্ব জানি না। তবে, মনে হয়, আপনার এই প্রমোশনের সঙ্গে ওর কোনও যোগ আছে।
মাতামহ মানতে পারলেন না। আরে, না হে না, একেবারে আধ্যাত্মিক স্বপ্ন। নক্ষত্র জ্যোতিতে পুড়ে ছাই হয়ে হরিশঙ্কর নবীন জন্ম লাভ করে ঊর্ধ্বে আরোহণ করছে। এসব স্বপ্নের অর্থ তোমরা কী বুঝবে! আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব? হয়তো বলতে পারবে, জ্যোতিষ ট্যোতিষ করো তো।
অক্ষয়বাবু বললেন, বলুন, জ্ঞান থাকলে বলব।
এই বাড়িটা, বুঝলে অক্ষয়, এই বাড়িটায় একটা কিছু আছে। সংসারটা একেবারে ছারখার হয়ে গেল। এই দুটো সলতে কেবল টিমটিম করে জ্বলছে। নাতিটা তো একটা বদ্ধ পাগল। এই বয়েসের ছেলে, একটা সিগারেট খায় না, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেশে না, যাত্রা থিয়েটার দেখে না, আবার বেদবেদান্ত পড়ে। ব্যাটা মহাপুরুষ না কাপুরুষ বোঝা দায়। আমার কী মনে হয় জানো?
কী মনে হয়?
মাতামহ পিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, কুলকুচো করে এসো। কতদিন বলেছি, চা খাবার পর মুখ ধোবে। দাঁত ভাল থাকবে। শেষ বয়েসেও দোলের দিন মঠ আর ফুটকড়াই খেতে পারবে।
আপনিও তো চা খেলেন?
আমি? এই দেখো! মাতামহ পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে আস্ত দু’পাটি দাঁত বের করে দেখালেন। মাতামহ যেন নিজের হাতের তালুতেই পড়ে পড়ে খিলখিল করে হাসছেন।
এই যদি আপনার অবস্থা হয় তা হলে আমার আর নিয়ম মানার প্রয়োজন নেই। পা নিয়ে নড়তে পারছি না। আতুরে নিয়ম নাস্তি।
মাতামহ আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, আমার কী মনে হয় জানো, এই বাড়ির উত্তরের ওই বাগানে কোথাও একটা হাড় পোঁতা আছে।
শ্রোতারা সমস্বরে বললেন, হাড়?
হ্যাঁ, হাড়। সেই হাড়টা মাটি খুঁড়ে তুললে দেখা যাবে, সরু সরু কালো কালো লোম বেরিয়েছে।
শ্রোতারা বললেন, সে আবার কী?
মাতামহ বড় বড় চোখ করে বললেন, তোমরা এসবের কতটুকু জানো। দু’কলম ইংরেজি পড়ে সব পণ্ডিত হয়ে গেছ। নিশির ডাক শুনেছ?
ডাক শুনিনি, তবে আছে শুনেছি।
আমাদের শশাঙ্ক সাড়া দিয়ে চোখের সামনে মারা গেল। আড়াই প্রহর রাতে গুণিন এসে বাড়ির সামনে দাঁড়াল, হাতে একটা মুখ-খোলা ডাব। শশাঙ্ক, শশাঙ্ক, তিনবার ডাকল, শশাঙ্ক আছ! শশাঙ্ক ঘুমের ঘোরে উত্তর দিল, কে, যাই। ব্যস কপ করে ডাবের মুখে চাপা পড়ে গেল। শশাঙ্কর প্রাণবায়ু চলে এল ডাবের জলে। সেই জল খেয়ে বেঁচে উঠল মণি চাটুজ্জে। আজও বুড়ো বেঁচে আছে। তেজপক্ষের বউটা সংসার ছারখার করে দিলে। প্রথম পক্ষের বড় ছেলেটার সঙ্গে, সে আমি বলতে পারব না, তুমি আবার বকাবকি করবে।
বুঝতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি। সবসময় সবকথা বলার দরকার করে না। কবিদের মতে ব্যঞ্জনায় মেরে দিতে হয়।
তা হলে দেখো, তোমার ট্রেনিংয়ে কীরকম তৈরি হয়েছি। রেলের মালবাবু থেকে কবি কালিদাস। যাক যে কথা বলছিলুম, তুমিই তো শিখিয়েছ, বেশি লাইন চেঞ্জ করা খুব খারাপ। মেন লাইন ধরে থাকতে হয়। মাঝরাতে পৃথিবীর চেহারা কীরকম দাঁড়ায় জানো? তোমার স্বপ্নের মতো। মাপার উপায় নেই, তা হলে সত্যি সত্যিই দেখতে পেতে, আকাশ অনেকটা নীচে নেমে আসে। তারাদের চোখ ড্যাবড্যাবা হয়ে ওঠে। গাছ চুল এলো করে দেয়। গর্তে আগুন জ্বলে, নদীর জল রক্তগোলা হয়ে যায়, কবরে কবরে মৃতদেহ উঠে বসে। এ সব আমার দেখা। তারাপীঠের মহাশ্মশানে বসে দেখেছি।
আপনি দেখছি, আর এক মিলটন।
ও, সেই অন্ধ মহাকবি। অন্ধ না হলে মনের চোখ খোলে না। আচ্ছা, তোমার সেই হ্যাঁমিলটন সায়েবকে মনে আছে! রোজ কলকাতা থেকে প্লেনে চেপে দিঘার সমুদ্রে চান করতে যেতেন।
আবার লাইন চেঞ্জ করছেন।
মিলটনের নাম শুনে হঠাৎ মনে পড়ল, তাই জিজ্ঞেস করলুম। এই যে তুলসী, তুলসী আমার মেয়ে, তুলসী কেন মারা গেল?
পিতা বললেন, ওসব অসুখের এখনও কোনও চিকিৎসা বেরোয়নি।
ও তোমাদের কথা। আমি জানি, তুলসী কেন মারা গেল। মনে আছে, ওর তারে-মেলা শাড়ির আঁচলের খানিকটা কেটে নিয়ে গেল। তোমরা সন্দেহ করলে হাবুর মাকে। তুল