- বইয়ের নামঃ প্রোফেসর শঙ্কু সমগ্র
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ সমগ্র
আশ্চর্জন্তু (প্রোফেসর শঙ্কু)
আগস্ট ৭
আজ এক আশ্চৰ্য দিন।
সকালে প্রহ্লাদ যখন বাজার থেকে ফিরল, তখন দেখি ওর হাতে একটার জায়গায় দুটো থলি। জিজ্ঞেস করাতে বলল, দাঁড়ান বাবু, আগে বাজারের থলিটা রেখে আসি। আপনার জন্য একটা জিনিস আছে, দেখে চমক লাগবে।
ভেবে আমার হাসি পেল। কী এনেছে সে থলিতে করে?
মিনিটখানেকের মধ্যে প্রশ্নের জবাব পেলাম, আর চমক যেটা লাগল সেটা যেমন তেমন নয়, এবং তার মাত্রা অনুমান করা প্রহ্লাদের কর্ম নয়।
থলি থেকে বার করে যে জিনিসটা প্রহ্লাদ আমার হাতে তুলে দিল সেটা একটা জানোয়ার। সাইজে বেড়ালছানার মতো। চেহারার বর্ণনা আমার মতো বৈজ্ঞানিকের পক্ষে এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। প্রাণিবিদ্যাবিশারদদের মতে পৃথিবীতে আন্দাজ দু লক্ষ বিভিন্ন শ্রেণীর জানোয়ার আছে। আমি তার বেশ কিছু চোখে দেখেছি, কিছুর ছবি দেখেছি, আর বাকি অধিকাংশেরই বর্ণনা পড়ে জেনেছি তাদের জাত ও চেহারা কীরকম। প্রহ্লাদ আমাকে যে জন্তুটা দিল সেরকম জন্তুর বর্ণনা আমি কখনও পড়িনি। মুখ দেখে বানর শ্রেণীর জানোয়ার বলেই মনে হয়। নাকটা সাধারণ বাঁদরের চেয়ে লম্বা, কপাল বাঁদরের তুলনায় চওড়া, মাথাটা বড় আর মুখের নীচের দিকটা সরু। কান দুটো বেশ বড়, চাপা, এবং উপর দিকটা শেয়ালকুকুরের কানের মতো ছুচোলো। চোখ দুটো মুখের অনুপাতে বড়ই বলতে হবে–যদিও লরিস বাঁদরের মতো বিশাল নয়। পায়ের প্রান্তভাগে থাবার বদলে পাঁচটা করে আঙুল দেখেও বাঁদরের কথাই মনে পড়ে। লেজের একটা আভাসমাত্র আছে। এ ছাড়া, গোঁফ নেই, সারা গায়ে ছোট ছোট লোম, গায়ের রং তামাটে। মোটামুটি চেহারার বর্ণনা হল এই। মাথাটা যে বড় লাগছে, সেটা শৈশব অবস্থা বলে হতে পারে–যদিও শৈশব কথাটা ব্যবহার করলাম আন্দাজে। এমনও হতে পারে যে, এটা একটা পরিণত বয়স্ক জানোয়ার, এবং এর জাতই ছোট।
মোটকথা এ এক বিচিত্র জীব। প্রহ্লাদ বলল, এটা তাকে দিয়েছে জগন্নাথ! জগন্নাথ থাকে উশ্রীর ওপারে ঝলসি গ্রামে। সে নানারকম শিকড় বাকল সংগ্রহ করে গিরিডির বাজারে বেচিতে আসে। সপ্তাহে দু-তিনবার। আমিও জগন্নাথের কাছ থেকে গাছগাছড়া কিনে আমার ওষুধ তৈরির কাজে লাগিয়েছি। জগন্নাথ জন্তুটাকে পায় জঙ্গলে। সে জানে প্ৰহ্রাদের মনিবের নানারকম উদ্ভট জিনিসের শখ, তাই সে জানোয়ারটা আমার নাম করেই তাকে দিয়েছে।
কী খায় জানোয়ার, সে বিষয়ে বলেছে কিছু?
বলেছে।
কী বলেছে?
বলেছে শাকসবজি ফলমূল ডালভাত সবই খায়।
যাক, তা হলে তো কোনও চিন্তাই নেই।
চিন্তা নেই বললাম, কিন্তু এত বড় একটা ঘটনা নিয়ে চিন্তা হবে না। সে কী করে হয়? একটা সম্পূর্ণ নতুন জাতের প্রাণী, যার নামধাম স্বভাবচরিত্র কিছুই জানা নেই, যার কোনও উল্লেখ কোনও জন্তু জানোয়ারের বইয়েতে কখনও পাইনি, সেটা এইভাবে আমার হাতে এসে পড়ল, আর তাই নিয়ে চিন্তা হবে না? কেমনতরো জানোয়ার এটা? শান্ত না মিচকে? কোথায় রাখব একে? খাঁচায়? বাক্সে? বন্দি অবস্থায় না ছাড়া অবস্থায়? একে দেখে আমার বেড়াল নিউটনের প্রতিক্রিয়া কী হবে? অন্য লোকে এমন জানোয়ার দেখলে কী বলবে?…
একে নিয়ে কী করা হবে সেটা ভাবার আগে আমি জন্তুটাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করলাম। আমার কোল থেকে তুলে নিয়ে টেবিলের উপর রাখলাম। ওটাকে। সে দিব্যি চুপচাপ বসে রইল, তার দৃষ্টি সটান আমার দিকে। ভারী অদ্ভুত এ চাহনি। এর আগে কোনও জানোয়ারের মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এ চাহনিতে ভয় বা সংশয়ের কোনও চিহ্ন নেই, হিংস্র বা বুনোভাবের লেশমাত্র নেই। এ চাহনি যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, আমার উপর তার গভীর বিশ্বাস; আমি যে তার কোনও অনিষ্ট করব না, সেটা সে জানে। এ ছাড়াও চাহনিতে যেটা আছে, সেটাকে বুদ্ধি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। সত্যি করেই জন্তুটা বুদ্ধিমান কি না, তার পরিচয় না পেলেও, তার চোখের মণির দীপ্তিতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তার মস্তিষ্ক সজাগ। সেই কারণেই সন্দেহ হচ্ছে যে, এ জন্তু হয়তো শাবক নয়। অবিশ্যি এর বয়সের হদিস হয়তো কোনওদিনও পাওয়া যাবে না। যদি দেখি এর আয়তন দিনে দিনে বাড়ছে, তা হলে অবিশ্যি বুঝতে হবে এর বয়স বেশি হতে পারে না।
আজ সকাল সাতটায় এসেছে জন্তুটা আমার কাছে; এখন রাত পৌনে এগারোটা। ইতিমধ্যে পশুসংক্রান্ত যত বই, এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি আছে আমার কাছে, সবগুলো ঘেঁটে দেখেছি। কোনও জন্তুর বর্ণনার সঙ্গে এর সম্পূর্ণ মিল নেই।
সকালেই নিউটনের সঙ্গে জন্তুটার মোলাকাত হয়ে গেছে। আমার কফি খাবার সময় নিউটন আমার কাছে এসে বিস্কুট খায়। আজও এল। জন্তুটা তখনও টেবিলের উপরেই রাখা ছিল। নিউটন সেটাকে দেখেই দরজার মুখে থমকে দাঁড়াল। আমি দেখলাম তার লোম খাড়া হচ্ছে। জন্তুটার মধ্যে কিন্তু কোনও চাঞ্চল্য লক্ষ করলাম না। সে কেবল আমার দিক থেকে বিড়ালের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছে। অবিশ্যি এই দৃষ্টির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। খুব অল্পক্ষণের জন্য হলেও, তার মধ্যে একটা সতর্কতার আভাস ফুটে উঠেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিউটনের পিঠের লোমগুলো আবার বসে গেল। সে জানোয়ারের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে একটা ছোট্ট লাফে আমার কোলে উঠে বিস্কুট খেতে লাগল।
জন্তুটাকে মেপে রেখেছি। নাকের ডগা থেকে লেজের ডগা অবধি সাড়ে ন ইঞ্চি। এটার ছবিও তুলে রেখেছি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। রঙিন ছবি, কাজেই পরে রং পরিবর্তন হলে বুঝতে পারব। খাওয়ার ব্যাপারে আজ আমি যা খেয়েছি। তাই খেয়েছে, এবং সেটা বেশ তৃপ্তি সহকারে। আজ বিকেলে একবার আমি ওটাকে সঙ্গে নিয়ে বাগানে বেড়াতে বেরিয়ে ছিলাম। একবার মনে হয়েছিল গলায় একটা বকলস পরিয়ে নিই, কিন্তু শেষপর্যন্ত হাতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘাসের উপর ছেড়ে দিলাম। সে আমার পাশেপাশেই হোটল। মনে হয়। সে এর মধ্যেই বেশ পোষ মেনে গেছে। জন্তুজানোয়ারের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে আমার বেশি সময় লাগে না এটা আমি দেখেছি। এর বেলাও সেটা বিশেষভাবে লক্ষ করলাম।
এখন আমি শোবার ঘরে বসে ডায়রি লিখছি। জন্তুটার জন্য একটা প্যাকিংকেসের মধ্যে বিছানা করে দিয়েছি। মিনিটপাঁচেক হল নিজে থেকেই সে বাক্সের মধ্যে ঢুকেছে।
অকস্মাৎ আমার জীবনে এই নতুন সঙ্গীর আবির্ভাবে আমার মন আজ সত্যিই প্রসন্ন।
আগস্ট ২৩
আজ আমার কতকগুলো জরুরি চিঠি এসেছে; সে বিষয় বলার আগে জানিয়ে রাখছি যে, এই যোলো দিনে আমার জন্তু আয়তনে নিউটনকে ছাড়িয়ে গেছে। সে এখন লম্বায় ষোলো ইঞ্চি। তার স্বভাবচরিত্রেরও কতকগুলো আশ্চর্য দিক প্রকাশ পেয়েছে, সে বিষয় পরে বলছি।
জন্তুটিকে পাবার দুদিন পরেই তার ছবি সমেত পৃথিবীর তিনজন প্রাণিবিদ্যবিশারদকে চিঠি লিখে পাঠিয়ে ছিলাম। কীভাবে এটাকে পাওয়া গেল, এবং এর স্বভাবের যেটুকু জানি সেটা লিখে পাঠিয়ে ছিলাম। এই তিনজন হলেন ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন ড্যাভেনপোর্ট, ইংলন্ডের স্যার রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল, ও জার্মানির ড. ফ্রিডরিশ একহার্ট। তিনজনেরই উত্তর আজ একসঙ্গে পেয়েছি। ড্যাভেনপোর্ট লিখছেন—বোঝাই যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা একটা ধাপ্লাবাজি; এই নিয়ে তাঁকে যেন আমি আর পত্ৰাঘাত না করি। ম্যাক্সওয়েল বলছেন, জন্তুটা যে একটা হাইব্রিড তাতে কোনও সন্দেহ নেই। হাইব্রিড হল, দুটি বিভিন্ন জানোয়ারের সংমিশ্রণে উদ্ভূত একটি নতুন জানোয়ার। যেমন ঘোড়া আর গাধা মিলে খচ্চর। ম্যাক্সওয়েল চিঠি শেষ করেছেন এই বলে—পৃথিবীতে আনকোরা নতুন জানোয়ার আবিষ্কারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সমুদ্রগর্ভে কী আছে না আছে তার সব খবর হয়তো আমরা জানি না, কিন্তু ডাঙার প্রাণী সবই আমাদের জানা। তোমার এই জন্তুকে অনেকদিন স্টাডি করা দরকার। এর স্বভাবে তেমন কোনও চমকপ্ৰদ বৈশিষ্ট্য ধরা পড়লে আমাকে জানাতে পারে।
ড. একহার্ট হচ্ছেন এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন। তাঁর চিঠিটা একটু বিশেষ ধরনের বলে সেটা সম্পূর্ণ তুলে দিচ্ছি।
একহার্ট লিখছেন—
প্রিয় প্রোফেসর শঙ্কু,
তোমার চিঠিটা কাল সকালে পেয়ে আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। তুমি ছাড়া অন্য কেউ লিখলে আমি সমস্ত ব্যাপারটা প্রতারণা বলে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে এ প্রশ্নই ওঠে না। কী আশ্চর্য এক জানোয়ার যে তোমার হাতে এসে পড়েছে সেটা আমি পঞ্চান্ন বছর পশু সম্বন্ধে চৰ্চা করে বুঝতে পারছি। তোমার তোলা ছবিই এই জানোয়ারের অনন্যসাধারণত প্রমাণ করে। আমি বৃদ্ধ হয়েছি, তাই তোমার দেশে গিয়ে জানোয়ারটা দেখে আসা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু একটি বিকল্প ব্যবস্থায় তোমার আপত্তি হবে কি না পত্রিপাঠ লিখে জানাও! তুমি যদি এখানে আসি তবে তার খরচ বহন করতে আমি রাজি আছি। আমার অতিথি হয়েই থাকবে তুমি। তোমার জানোয়ারের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা আমি করব। আমি আপাতত অসুস্থ, ডাক্তার আমাকে দুমাস বিশ্রাম নিতে বলেছে। যদি নভেম্বর মাসে আসতে পার তা হলে খুব ভাল হয়। আমি তোমার সঙ্গে যথাসময়ে যোগাযোগ করব—অবিশ্যি যদি জানি যে, তোমার পক্ষে আসা সম্ভব হচ্ছে।
আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্ৰহণ করো।
ইতি
ফ্রিডরিশ এক্হার্ট
আমি এঁকে জানিয়ে দেব যে, আমার যাবার ইচ্ছে আছে—অবিশ্যি যদি আমার জন্তু বহাল তবিয়তে থাকে।
এবার জন্তুটার বিষয় বলি।
কদিন থেকেই লক্ষ করছি জন্তুটা আর আমার সামনে চুপচাপ বসে থাকে না। আমার সঙ্গ সে পরিত্যাগ করে না ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে যেন একটা স্বাধীন মনোভাব এসেছে। আমি যখন পড়ি বা লিখি তখন সে সারা ঘরাময় নিঃশব্দে ঘোরাফেরা করে। মনে হয়। ঘরের জিনিসপত্র সম্বন্ধে তার বিশেষ কৌতূহল। আলমারির বই, ফুলদানির ফুল, টেবিলের উপর কাগজকলম দোয়াত টেলিফোন—সব কিছু সম্পর্কে তার অনুসন্ধিৎসা। এতদিন সে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়ে দেখেই সন্তুষ্ট ছিল, আজ হঠাৎ দেখি চেয়ার থেকে টেবিলে উঠে সে আমার ফাউনটেনপেনটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। এই নাড়াচাড়ার মধ্যে একটা বিশেষত্ব লক্ষ করলাম। তার বুড়োআঙুল কাজ করে মানুষ বা বাঁদরের মতোই। ডাল আকড়ে ধরে গাছে চড়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে হবে বলে বানরশ্রেণীর জানোয়ারের এই কেজো বুড়ো আঙুলের উদ্ভব হয়েছিল। একেও জঙ্গলে থেকে গাছে চড়তে হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম।
এ ছাড়া আরেকটা লক্ষ করার জিনিস হল—সে কলমটা দেখছে দুপায়ে দাঁড়িয়ে। বানরশ্রেণীর মধ্যে এক ওরাংওটাং, ও সময় সময় শিম্পাঞ্জিকে, কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে হাঁটতে দেখা যায়। গেরিলা দুপায়ে দাঁড়িয়ে বুকে চাপড় মারে বটে, কিন্তু সেই পর্যন্তই। আমার জন্তু কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
তারপর দাঁড়ানো অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে একটা কাগজ টেনে নিয়ে কলামটা দিয়ে তার উপর হিজিবিজি কাটতে শুরু করল। আমার চল্লিশ বছরের পুরনো অতি প্রিয় ওয়াটারম্যান কলম; পাছে তার নিবটা এই জন্তুর হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে সেটাকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে সোফা ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলাম। জন্তু যেন আমার উদ্দেশ্য অনুমান করেই হাত বাড়িয়ে কলামটা আমার হাতে দিয়ে দিল।
এই ঘটনা থেকে তিনটে নতুন কথা জানতে পারলাম জন্তুটা সম্পর্কে।
১) তার বুড়ো আঙুল মানুষ বা বাঁদরের মতো কাজ করে।
২) সে দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বাঁদরের চেয়ে বেশিক্ষণ।
৩) তার বুদ্ধি বানরশ্রেণীর বুদ্ধিকে অনেকদূর অতিক্রম করে যায়।
আরও কত কী যে শিখব, এই বিচিত্ৰ জানোয়ারটিকে স্টাডি করে তা কে জানে?
সেপ্টেম্বর ২
জন্তুটা এ কদিনে আরও তিন ইঞ্চি বেড়েছে। এখন এর আয়তন মোটামুটি একটা মাঝারি সাইজের কুকুরের মতো। অথবা বছর চারেকের মানুষের বাচ্চার মতো। এটা বলছি, কারণ জন্তুটা এখন প্রায়ই দুপায়ে হাঁটে, হাতে করে খাবার তুলে মুখে পোরে, দুহাতে গেলাস ধরে দুধ খায়। শুধু তাই নয়, ওকে আর মাঠে নিয়ে যেতে হয় না। ও আমার বাথরুম ব্যবহার করে। গত সপ্তাহে ওর জন্যে কয়েকটা রঙিন পেন্টুলুন করিয়েছি। সেগুলো পরতে ও কোনও আপত্তি করেনি। আজ তো দেখলাম নিজেই পা গলিয়ে পরার চেষ্টা করছে।
আরও একটা বিশেষত্ব লক্ষ করছি। সেটা হল, ঘরে কথাবাতা হলে ও অতি মনোযোগ দিয়ে শোনে। শোনার সময় তার ভুরু কুঁচকে যায়—সেটা কনসেনট্রেশনের লক্ষণ। আমি জানি এটা অন্য কোনও জানোয়ারের মধ্যে দেখা যায় না। এটা বিশেষ করে লক্ষ করছিলাম। যখন কাল অবিনাশবাবুর সঙ্গে কথা বলছিলাম।
অবিনাশবাবু আমার প্রতিবেশী এবং বহুকালের আলােপী। এই একটি ভদ্রলোককে দেখলাম যিনি আমাকে কোনওরকম আমল দেন না। বা আমার কাজ সম্বন্ধে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করেন না। জন্তুটাকে দেখে তিনি ভুরু ঈষৎ কপালে তুলে কেবল বললেন, এটা আবার কী বস্তু?
আমি বললাম, এটি একটি আনকোরা নতুন শ্রেণীর জানোয়ার। এর নাম ইয়ে।
অবিনাশবাবু চুপ করে চেয়ে আছেন আমার দিকে। তারপর বললেন, কী হল—মনে পড়ছে না। নামটা?
বললাম তো-ইয়ে।
ইয়ে?
ইয়ে। সেটা বাংলা ইয়েও হতে পারে, আবার ইংরিজি E.A. অর্থাৎ একস্ট্রডিনারি অ্যানিম্যালও হতে পারে।
ইয়ে নামটা আমি গতকালই স্থির করেছি। ইয়ে বলে দু-একবার ডেকেও দেখেছি। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘোরানো থেকে মনে হয় সে ডাকে সাড়া দিচ্ছে।
বাঃ, বেশ নাম হয়েছে, বললেন অবিনাশবাবু, কিন্তু এ কিছু করবে। টরবে না তো?
জন্তুটা অবিনাশবাবুর দিকে এগিয়ে গিয়ে ভদ্রলোকের বাঁ হাতের কবজিটা ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রিস্টওয়াচটা দেখছিল। আমি বললাম, আপনি কিছু না করলে নিশ্চয়ই করবে না।
হুঁ…তা এটাকে কি এখানেই রাখবেন, না জু গার্ডেনে দিয়ে দেবেন?
আপাতত এখানেই রাখব। এবং আপনাকে একটা অনুরোধ করব।
কী?
আমার এই নতুন সম্পত্তিটি সম্বন্ধে দয়া করে কাউকে কিছু বলবেন না।
কেন?-অবিনাশবাবুর দৃষ্টিতে কৌতুকের আভাস—যদি বলি আপনি একটি ইয়ে সংগ্ৰহ করেছেন তাতে দোষটা কী? ইয়েটা যে কী সেটা না বললেই হল!
এটা চলতে পারে।
প্ৰহ্লাদ কফি এনে দিয়েছে, ইয়ে সোফায় ঠেস দিয়ে বসে ঠিক আমাদেরই মতো কাপের হাতলে ডান হাতের তর্জনী গলিয়ে দিয়ে সেটা মুখের সামনে ধরে চুমুক দিয়ে কফি খাচ্ছে।
এই অবাক দৃশ্য দেখেও অবিনাশবাবুর একমাত্র মন্তব্য হল, বোঝো!
একটা মানুষের বিস্ময়বোধ বলে কোনও বস্তু নেই, এটা ভাবতে অবাক লাগে।
সেপ্টেম্বর ৪
আজ এক আশ্চৰ্য ঘটনা ইয়ে সম্পর্কে আমার এতদিনের ধারণা তছনছ করে দিয়েছে।
দুপুরে আমার পড়ার ঘরে বসে। সদ্য ডাকে আসা নেচার পত্রিকার পাতা উলটে দেখছিলাম। ইয়ে আমার পাশের সোফাতে বসে একটা কাচের পেপারওয়েটে চোখ লাগিয়ে সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। এরই মধ্যে সে যে কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে টের পাইনি। হঠাৎ আমার ল্যাবরেটরি থেকে একটা বাক্স উলটে পড়ার শব্দ পেয়ে ব্যস্তভাবে উঠে গিয়ে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেললাম।
বর্ষার সময় আমার বাগানে মাঝে মাঝে সাপ বেরোয়, সেটা আমি জানি। তারই একটা বোধ হয় বারান্দা দিয়ে আমার ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছিল। যে সে সাপ নয়, একেবারে গোখরো। সেই সাপ দেখি এখন ইয়ের কবলে পড়েছে। সাপের গলায় দাঁত বসিয়ে আমার জন্তু তাকে ধরেছে মরণকামড়ে। আর সেইসঙ্গে সাপের লেজের আছড়ানি সে রোধ করেছে সামনের দুপা দিয়ে।
ঘটনাটা চলল এক মিনিটের বেশি নয়। কারণ এই আসুরিক আক্রমণ যে সাপকে সহজেই পরাস্ত করবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
থেঁতালানো, মরা সাপটাকে ছেড়ে দিয়ে এবার ইয়ে পিছিয়ে এল। বিজয়গর্বে তার দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে, সেটা আমি ঘরের বিপরীত দিক থেকে শুনতে পাচ্ছি।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে, ইয়ের দাঁত আমি আগে পরীক্ষা করেছি; সে দাঁত দিয়ে এ-কাজটা অসম্ভব। কারণ মাংসাশী জানোয়ারের তীক্ষ্ণ শ্ব-দন্ত বা কুকুরে-দাঁত ইয়ের ছিল না।
আর সাপের দেহ যেরকম ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, সে কাজটা করার মতো তীক্ষ্ণ নখ—যাকে ইংরেজিতে বলে ক্ল-সেও এ জন্তুর ছিল না।
প্রহ্লাদকে ডেকে সাপটা ফেলে দিতে বলে আমি ইয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ইয়ে, তোমার মুখটা হাঁ করো তো দেখি।
বাধ্য ছেলের মতো এই আশ্চর্য জন্তু এককথায় আমার আদেশ পালন করল।
না। এমন দাঁত তো আগে ছিল না, হঠাৎ এর আবির্ভাব হল কী করে?
চার পায়ের বিশটা আঙুলে যে তীক্ষ্ণ নখ এখন দেখলাম, সে নখও আগে ছিল না।
কিন্তু বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়।
দশ মিনিটের মধ্যে নখ ও দাঁত আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল।
পশুবিজ্ঞান এই রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারে কি? মনে তো হয় না।
নভেম্বর ১
কাল জার্মানি রওনা হব। আমাকে যেতে হবে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আন্দাজ সত্তর কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কোবলেনৎস শহরে। একহার্টকে গত কমাসের ঘটনাবলি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। সে দ্বিগুণ উৎসাহে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। যাতায়াতের সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। সাতদিন আমি একহার্টের অতিথি হয়েই থাকব।
ইয়ের আয়তন গত দেড়মাসে আর বাড়েনি, যদিও তার বুদ্ধি উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। আজকাল মাঝে মাঝে সে বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তাকে চতুস্পদ বলতেও দ্বিধা হয়। কারণ অধিকাংশ সময়ই সে দুপায়ে হাঁটে।
পর্যবেক্ষণের ফলে আরও যে কয়েকটি তথ্য ইয়ে সম্বন্ধে জানা গেছে সেগুলি লিপিবদ্ধ করছি।-
১) বদলে যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেবার আশ্চৰ্য স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে এ জন্তুর। সে জঙ্গল থেকে এলেও, মানুষের মধ্যে বাস করে তার স্বভাব দিনে দিনে মানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে।
২) গোখরোর ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে, শক্রকে পরাস্ত করার অদ্ভূত ক্ষমতা প্রকৃতি এই জানোয়ারকে দিয়েছে। বেজির স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে সাপকে বেকায়দায় ফেলার। এ ব্যাপারে বেজির নখ ও দাঁত তাকে সাহায্য করে। ব্যাঙের সে ক্ষমতা নেই, তাই ব্যাঙ সহজেই সাপের শিকারে পরিণত হয়। একদিন হঠাৎ যদি সাপের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ব্যাঙের নখ ও দাঁত গজায় তা হলে সেটা যত আশ্চৰ্য ঘটনা হবে, আমার জন্তুর সহসা নখ দন্ত উদগমও সেইরকমই আশ্চৰ্য ঘটনা। আমি জানি, আবার যদি তাকে সাপের সামনে পড়তে হয়, তা হলে আবার তার নখ ও দাঁত গজাবে।
৩) এই জানোয়ারের জাতটাই হয়তো বোবা, কারণ এই কমাসে একটিবারের জন্য সে কোনওরকম শব্দ করেনি।
নভেম্বর ৪
ইয়ে আরেকবার চমকে দিয়েছে আমাকে।
আমি ওর জন্য একটা বাক্স তৈরি করিয়ে নিয়েছিলাম, যেটা এয়ারওয়েজের কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করে প্লেনের লেজের দিকে ক্যাবিনের মধ্যেই রাখা হয়েছিল। ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছোনোর দশ মিনিট আগে আমি ইয়ের কাছে গিয়েছিলাম তাকে একটা গরম কোট পরিয়ে দেব বলে। গিয়ে দেখি ইয়ের চেহারা বদলে গেছে, তার সর্বাঙ্গে প্রায় তিন ইঞ্চি লম্বা লোম গজিয়ে তাকে বরফের দেশে বাসের উপযুক্ত করে দিয়েছে। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থার আরেকটা জলজ্যান্ত প্রমাণ।
ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে দেখি আশি বছরের বৃদ্ধ ড. একহার্ট নিজেই এসেছেন আমাকে রিসিভ করতে। এয়ারপোর্টে আর ইয়েকে বাক্স থেকে বার করলাম না, কারণ ওরকম সৃষ্টিছাড়া জানোয়ারকে দেখতে যাত্রীদের মধ্যে হইচই পড়ে যেত। একহার্ট অবিশ্যি পুলিশের বন্দোবস্ত করেছিলেন। তা ছাড়া কোনও সাংবাদিক বা ফোটোগ্রাফারকে আমার আসার খবরটা দেননি।
একহার্টকে দেখে বলতে বাধ্য হলাম যে, তাঁর বয়স যে আশি সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। সত্যি বলতে কী, পঞ্চাশ-বাহান্নর বেশি মনে হয় না। একহার্ট হেসে বললেন যে, সেটা জার্মানির আবহাওয়ার গুণ।
পথে গাড়িতে ভদ্রলোককে ইয়ের লোম গজানোর খবরটা দিলাম। একহার্ট বললেন, তোমার জানোয়ারের বিষয় যতই শুনছি, ততই আমার বিস্ময় বাড়ছে। আমি ইচ্ছা করেই অন্য কোনও প্রাণিবিদ বা বৈজ্ঞানিককে তোমার আসার খবরটা দিইনি, কারণ তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি যে, তারা ভারতে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচর্চার ব্যাপারটা বিশেষ শ্ৰদ্ধার চোখে দেখে না। তাদের কাছে ইন্ডিয়া এখনও রোপ-ট্রিক আর মেক-চামারের দেশ।
এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা কোবলেনৎস পৌঁছে গেলাম। শহরের বাইরে অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে একহার্টের বাসস্থান। আমি জানতাম যে, একহার্টের পরিবার জার্মানির সবচেয়ে সম্রান্ত পরিবারের অন্যতম। বাড়ির ফটকে শ্নস একহার্ট অর্থাৎ একহার্ট কাসল ফলক তার সাক্ষ্য বহন করছে। কাসলের চারিদিক ঘিরে নানান গাছে ভরা বিস্তীর্ণ বাগান, তাতে গোলাপের ছড়াছড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করার আগেই একহার্ট জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর স্ত্রী বছরচারেক হল মারা গেছেন, এখন বাড়িতে থাকেন। চাকরিবোকর ছাড়া একহার্ট নিজে এবং তাঁর মহিলা সেক্রেটারি। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই মহিলাটির সঙ্গে আলাপ হল। নাম এরিকা ওয়াইস চেহারায় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ পেলেও, তার সঙ্গে একটা উদাস ভাব লক্ষ করলাম।
বাড়িতে ঢুকে প্রথমেই বাক্স থেকে ইয়েকে বার করলাম। সে তৎক্ষণাৎ করমর্দনের ভঙ্গিতে একহার্টের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত বলেই হয়তো একহার্টের হাতটা তৎক্ষণাৎ প্রসারিত হল না। সেই অবসরে ইয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল সেক্রেটারির দিকে। শ্ৰীমতী ওয়াইসের চোখে বিস্ময় ও পুলকের দৃষ্টি আমি ভুলব না। জানোয়ারের প্রতি প্রকৃত মমত্ববোধ না থাকলে এ জিনিস হয় না।
একহার্ট বললেন, আমার কুকুরদুটোকে আপাতত বন্দি করে রেখেছি। কারণ তোমার এ জানোয়ারকে দেখে তাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে বলা মুশকিল।
আমি বললাম, আমার বিশ্বাস তোমার কুকুর যদি সভ্যভব্য হয় তা হলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটবে না, কারণ আমার বেড়াল আমার জন্তুকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছে।
হাঁটতে হাঁটতে বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকতেই একটা দৃশ্য দেখে কেমন যেন থমকে গেলাম।
এ কি প্ৰাণিতত্ত্ববিদের বাড়ি, না প্ৰাণিহত্যাকারীর? ঘরের চারিদিকে এত জন্তুজানোয়ারের স্টাফ করা মাথা আর দেহ শোভা পাচ্ছে কেন?
এক্হার্ট হয়তো আমার মনের ভাবটা আন্দাজ করেও বললেন, আমার বাবা ছিলেন নামকরা শিকারি। এসব তাঁরই কীর্তি। এই নিয়ে বাপের সঙ্গে আমার বিস্তর কথা কাটাকাটি হয়েছে।
ইয়ে ঘুরে ঘুরে জন্তুগুলো দেখছিল। চা আসার পর সে-ও আমাদের সঙ্গে সোফায় বসে পেয়ালা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে লাগল। একহার্টের দৃষ্টি বারবার তার দিকে চলে যাচ্ছে সেটা আমি লক্ষ করছিলাম। ইয়ে যে ভারতীয় ভেলকি বা ধাপ্লাবাজি নয়। সেটা আশা করি ও বুঝেছে। কিন্তু আশি বছর বয়সে সে এমন স্বাস্থ্য কী করে রেখেছে সেটা এখনও আমার কাছে দুর্বোধ্য। আলাপ আরেকটু জমলে পর এর রহস্যটা কী সেটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
চা-পান শেষ হলে পর একহার্ট সোফা থেকে উঠে পড়ে বললেন, আজকের দিনটা তুমি বিশ্রাম করো। তোমাদের ঘর দেখিয়ে দেবে এরিকা। কাল সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমার একটি পশুপ্রেমিক বন্ধুর সঙ্গে তোমার আলাপ হবে। আমার বিশ্বাস তাকে তোমার পছন্দ হবে।
আমার দুটো সুটকেস একহার্ট-ভৃত্য আগেই আমার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, এবার কার্পেটে মোড়া বাহারের সিঁড়ি দিয়ে এরিকার সঙ্গে আমি গেলাম দোতলায়। থাকার ব্যবস্থা উত্তম। দুটি পাশাপাশি ঘর, একটিতে আমি, একটিতে ইয়ে। জানোয়ার কী খাবে জিজ্ঞেস করাতে এরিকাকে বললাম, আমরা যা খাই তাই খাবে। ওকে নিয়ে কোনও চিন্তা নেই।
এরিকা শুনে একটা নিশ্চিন্তভাব করার পরমুহুর্তেই তাঁর চাহনির উপর যেন একটা সংশয়ের পর্দা নেমে এল। তিনি যেন কিছু বলতে চান, কিন্তু ইতস্তত করছেন।
আর কিছু বলার আছে কি? আমি আশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করলাম।
মানে ভাবছিলাম…তোমার কাছে কোনও অস্ত্ৰ আছে কি?
কেন, এখানে কি চোরাডাকাতের উপদ্রব হয় নাকি?
না, তা নয়, কিন্তু…ভাবছিলাম…তোমার জন্তুর তো একটা প্রোটেকশন দরকার। এমন আশ্চৰ্য প্রাণী…
ভয় নেই, আমার পিস্তল আছে।
পিস্তল?
পিস্তল শুনে এরিক ভরসা পেলেন না। বোধ হয় বন্দুক কি স্টেনগান বললে আরও আশ্বস্ত হতেন।
আমি আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তলের মহিমা আর এর কাছে প্ৰকাশ করলাম না। শুধু বললাম, ভয় নেই। পিস্তলই যথেষ্ট।
ভদ্রমহিলা চাপাকণ্ঠে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। মনে একটা সামান্য খটকার অনুপ্রবেশ রোধ করতে পারলাম না। যদিও জানি যে আমার পিস্তলের মতো ব্ৰহ্মাস্ত্র আর দ্বিতীয় নেই।
ইয়ে ইতিমধ্যে নিজে থেকেই তার ঘরে চলে গেছে। গিয়ে দেখি সে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে। আশা করি তার মনে কোনও উদ্বেগ নেই। এই অবোলা জীবের মন বোঝা সব সময় আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তার যদি কোনও অনিষ্ট হয় তা হলে আমার অবস্থা হবে শোচনীয়। এই কমাসে তার উপর গভীর মায়া পড়ে গেছে।
নভেম্বর ৬
আজ কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। তার সঙ্গে কিছু চমক লাগাবার মতো ঘটনাও ঘটেছে, এবং সেটা, বলা বাহুল্য, ইয়েকে কেন্দ্ৰ করে।
কাসপার মাক্সিমিলিয়ান হেলব্রোনার—এই গালভরা নামের অধিকারী হলেন একহার্টের বন্ধু। তবে এঁকে আমি কাসপার বলেই উল্লেখ করব। কারণ একহার্টও তাঁকে ওই নামেই ডাকেন। একহারা, ঢাঙা চেহারা, মাংসের অভাবে চোয়াল ও চিবুকের হাড় বেরিয়ে মুখে একটা পাথুরে ভাব এনেছে, তার সঙ্গে রয়েছে একজোড়া ঘন ভুরু আর একমাথা কদমছাট চুল। চেহারা দেখলে সম্রামের চেয়ে শঙ্কাই হয় বেশি; ইনি যে কখন কী করে বসবেন বলা যায় না।
একহার্ট ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, কাসপার আমার অনেককালের বন্ধু। জন্তুজানোয়ার সম্পর্কে ইনি বিশেষ উৎসাহী ও ওয়াকিবহাল।
ইয়ে অবশ্য আমার সঙ্গেই ছিল। কাসপার তার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কেবল একটি মন্তব্যই করলেন-হোয়াট এক্সকুইজিট ফার!
ইয়ের গায়ের লোম যে অতি মসৃণ এবং সুদৃশ্য সেটা সকলেই স্বীকার করবে। বিশেষ করে গোলাপির মধ্যে এমন হলুদের আভা আর কোনও জানোয়ারের লোমে আমি দেখিনি।
কিন্তু লোমের প্রতি কাসপার সাহেবের এই লোলুপ দৃষ্টি আমার মোটেই ভাল লাগল না। এই লোমের জন্য কত নিরীহ প্ৰাণীকে যে হত্যা করা হয়ে থাকে-বিশেষত পশ্চিমে-তার হিসেব নেই। চিঞ্চিলা নামে একটি ইঁদুরজাতীয় জানোয়ার আছে, তার লোম অভিজাত মেমসাহেবদের এত প্রিয় যে, একটি জানোয়ারের লোমের জন্য তাঁরা দশ-বিশ হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত। মনে মনে বললাম, হে ঈশ্বর, লোমব্যবসায়ীর দৃষ্টি যেন আমার এই জন্তুটির উপর না পড়ে।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বাকি কথা হল। ইয়েকে টেবিলে বসে খেতে দেখে কাসপার বললেন, আশ্চর্য ট্রেনিং দিয়েছ তো তোমার জানোয়ারকে! এ যে দেখছি শিম্পাঞ্জিকেও হার মানায়।
আমি বলতে বাধ্য হলাম যে, ইয়ে যা করছে তার কোনওটাই আমি তাকে শেখাইনি। আসলে ওর পর্যবেক্ষণ ও অনুকরণের ক্ষমতা অসাধারণ।
পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ খাপ খাইয়ে নেবার যে কথাটা তুমি বলছিলে, তার কোনও নমুনা দেখাতে পার কি?
আমি মৃদু হেসে বললাম, আমি তো ওকে ডিমনষ্ট্রেশন দেবার জন্য আনিনি। সেটা যদি তোমার সামনে আপনা থেকেই ঘটে তা হলেই দেখতে পাবে। আসলে সব প্রাণীকেই প্রকৃতি আত্মরক্ষার কতকগুলো উপায় সমেত সৃষ্টি করে। বাঘের গায়ের ডোরা আর বুটি তাদের জঙ্গলের গাছপালার মধ্যে প্রায় অদৃশ্য হয়ে মিশে থাকতে সাহায্য করে। তা ছাড়া এক জানোয়ার যাতে সহজে অন্য জানোয়ারের শিকার না হয়ে পড়ে তারও ব্যবস্থা থাকে। শজারুর
উগ্ৰ গন্ধ তাদের শক্ৰদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। যারা অপেক্ষাকৃত নিরীহ জানোয়ার যেমন হরিণ বা খরগোশ-প্রকৃতি তাদের দিয়েছেন দ্রুতবেগে পলায়নের ক্ষমতা। অবিশ্যি এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে। সব জানোয়ার শত্রুর হাত থেকে সমান নিরাপদ নয়।
তুমি বলছ তোমার এই জন্তু আত্মরক্ষার উপায় জানে?
প্রশ্ন করলেন কাসপার। আমি বললাম, তার দুটো পরিচয় আমি পেয়েছি। গোখরো সাপের আক্রমণ থেকে সে যে শুধু নিজেকে বাঁচিয়েছে তা নয়, সাপকে সে যুদ্ধে পরাজিত করেছে। আর শীতের প্রকোপ থেকে সে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়েছে সে তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আত্মরক্ষার তাগিদেই ক্রমবিবর্তনের ফলে যে পৃথিবীর প্রাণীর রূপ পালটেছে সে তো জানোই। আদিম জলচর প্রাণীই জলের যখন অভাব হল তখন প্রথমে হল উভচর। তারপর স্থলচর। সরীসৃপের ডানা গজিয়েই হল প্রথম উড়ন্ত জানোয়ার-সেও তো পরিবেশ বদলের জন্যই। এসব পরিবর্তন হতে কোটি কোটি বছর লেগেছিল। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোটা তো চোখের নিমেষে হয় না।
কিন্তু তোমার জানোয়ারের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে? বললেন কাসপার।
তাই তো দেখলাম চোখের সামনে।
কথাটা কাসপার বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না। আমি ভেবেছিলাম। একহার্ট আমাকে সাপোর্ট করবেন, কিন্তু তাঁকেও ভ্ৰকুঞ্চিত দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলাম।
প্রাতরাশের পর একহার্ট প্রস্তাব করলেন তাঁর বিস্তীর্ণ বাগানটা একটু ঘুরে দেখে আসার জন্য। রাত্ৰে তুষারপাতের ফলে সেই বাগানে এখন বরফের গালিচা বিছানো রয়েছে, সেটা সকালে উঠে জানালা দিয়ে দেখেছি।
আমি প্রস্তাবে আপত্তি করলাম না।
বাগানটা যে কতখানি জায়গা জুড়ে তা আমার ধারণা ছিল না। অবিশ্যি সবটাকেই বাগান বললে ভুল হবে। ফুলগাছের পাট কিছুদূর গিয়েই শেষ হয়ে গেছে, তারপর সবই বড় বড় গাছ, তার মধ্যে অধিকাংশই পাইন জাতীয়। এটাকে বন বললেই ঠিক বলা হবে।
আমি একহার্টকে প্রাণিতত্ত্ব বিষয়ে একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় জানোয়ারের কণ্ঠস্বর শুনে সেটা আর করা হল না।
হাউন্ডের ডাক। অ্যালসেশিয়ান।
হানসেল আর গ্রেটেলও দেখছি বেড়াতে বেরিয়েছে, বললেন একহার্ট।
আমি প্রথমে ইয়ের হাত ধরে হাঁটছিলাম, তারপর নিজেই হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন তার দিকে আড়াচোখে চেয়ে দেখি তার ভুরু কুঁচকে গেছে।
এবার প্রায় একশো গজ দূরে কুকুরদুটোকে দেখতে পেলাম। দুটোর গলাতেই বকলস, চামড়ার দড়ি একহার্টের চাকরের হাতে ধরা।
কুকুর আর আমরা পরস্পরের দিকে এগিয়ে চলেছি। দূরত্ব যখন আন্দাজ ত্রিশ গজ, তখন অ্যালসেশিয়ান দুটো থেমে গেল, তাদের দৃষ্টি সটান ইয়ের দিকে। আমরা চারজনেও থেমে গেছি। আমি ইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা ধরে নিলাম। কাসপার ও একহার্ট বুঝতেই পারছি, ঘটনা কোন দিকে যায়। তাই দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন।
দুটো কুকুরের দড়িতেই যে টান পড়ছে সেটা আমি লক্ষ করছিলাম, আর সেইসঙ্গে মৃদু। হুংকারও শুনতে পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে।
হঠাৎ প্রচণ্ড হ্যাঁচকা টানে একহার্ট-ভৃত্যকে বরফের উপর ফেলে দিয়ে হানসেল আর গ্রেটেল ছুটে এল আমাদের দিকে, আর ঠিক সেই মুহুর্তে আমার হাতে একটা টান অনুভব করাতে দেখলাম ইয়ে বিদ্যুদ্বেগে বাঁদিকে ছুটে গিয়ে একটা তুষারাবৃত ঝোপের পিছনে অদৃশ্য
হয়ে গেল।
সে ভয় পেয়েছে। এই জোড়া প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করার ক্ষমতা প্রকৃতি তাকে দেয়নি।
প্রায় যন্ত্রের মতোই আমিও ছুটে গেলাম ইয়ের পিছনে, আর আমার পিছনে একহার্ট ও কাসপার।
কুকুর দুটোর হিংস্ৰ চাহনি আগেই লক্ষ করেছিলাম; এবার দেখলাম শিকারের লোভে তাদের পাগলের মতো ছোটাছুটি। তারা হন্যে হয়ে খুঁজছে আমার জন্তুকে।
আমি প্ৰমাদ গুনলাম। বাধ্য হয়ে চেঁচিয়ে বলতে হল, দোহাই ড়, একহার্ট, আপনার কুকুরদুটোকে থামান।
ইমপিসিবল, রুদ্ধস্বরে বললেন একহার্ট, এ অবস্থায় ওদের থামানো ভগবানের অসাধ্য।
কিন্তু আশ্চৰ্য ব্যাপার-যেদিকে ইয়ে গিয়েছিল। সেইদিকেই গিয়েছে কুকুরদুটো, কিন্তু আমার সেই পোষা অনুগত জানোয়ারের কোনও চিহ্ন নেই।
প্রায় পাঁচ মিনিট উদ্দাম দাপাদাপির পর হানসেল আর গ্রেটেল হাল ছেড়ে দিয়ে জিভ বার করে হাঁপাতে লাগল, আর তাদের পরিচালক এগিয়ে গিয়ে কুকুরের গলার দড়ি হাতে তুলে নিল।
ওদের বাড়িতে নিয়ে যাও, হুকুম করলেন একহার্ট।
কিন্তু তোমার জানোয়ার কোথায় উধাও হল? প্রশ্ন করলেন কাসপার।
আমিও অবিশ্যি সেই কথাই ভাবছিলাম। অথচ আশেপাশে মাটিতে গর্ত বা গাছের গায়ে ফোকরও নেই যাতে তার ভিতর লুকোনো যায়।
কুকুরদুটো প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছোনোর পর আত্মপ্রকাশ করলেন আমার আশ্চর্য জানোয়ার।
কিন্তু এ কী হয়েছে তার চেহারা? সে কি এতক্ষণ বরফে গড়াগড়ি করেছে?
না, তা নয়। তার গায়ের রং, তার চোখের মণি, তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গ হয়ে গেছে। ধবধবে সাদা। সে এখন একটা তুষারপিণ্ডের সামিল। এই অবস্থায় এই পরিবেশে তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
গট ইন হিমেল! চেঁচিয়ে উঠলেন। কাসপার। হ্যাঁ, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ এই অবস্থায় স্বাভাবিক। এমন আশ্চৰ্য ঘটনা দুই জার্মান নিশ্চয়ই কোনওদিন দেখেননি।
আমরা চারজন আবার একহার্ট কাসলে ফিরে এলাম। সবাই মিলে সোফায় বসতে কাসপারই প্রথম মুখ খুললেন।
তোমার এই মহামূল্য সম্পত্তির ভবিষ্যৎ কী তা তুমি স্থির করেছ?
সহজ উত্তর। বললাম, আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন ওকে আমার কাছে রাখব। ও আমার সঙ্গী। এই কমাস আমিই ওকে প্রতিপালন করেছি।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেবে বিশ্বের প্রাণিবিদদের প্রতি তোমার কোনও দায়িত্ব নেই? তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চাও তোমার এই জন্তুকে?
লুকিয়ে রাখতে চাইলে আমি তাকে এখানে এনেছি কেন? ভবিষ্যতে তাকে কেউ দেখতে চাইলে আমার দেশে আমার বাড়িতে আসতে পারেন। আমার দরজা খোলাই থাকবে। জন্তু আমার কাছে নিরাপদে থাকবে। এখানে এনে কী হল তা তো দেখলেন। এরকম ঘটনা যে আরও ঘটবে না। তার কী বিশ্বাস?
কোনও পশুশালায় রাখতে আপত্তি কী?
সেটা রাখলে আমার নিজের দেশের পশুশালাতেই রাখব। কলকাতার চিড়িয়াখানা নেহাত নিন্দের নয়।
হুঁ…
কাসপার উঠে পড়লেন।
ঠিক আছে। আমি তা হলে আসি। আমার একটা প্ৰস্তাব ছিল, সেটা বোধ হয় তুমি গ্ৰহণ করবে না। আমি আর একহার্ট মিলে তোমাকে বিশ হাজার মার্ক দিতে রাজি আছি তোমার ওই জন্তুর জন্য। আমাদের দিলে সারা পৃথিবী ওর অস্তিত্ব জানতে পারবে। তার ফলে তোমার নামটাও অমর হয়ে থাকত। কারণ তুমিই যে ওটা দিয়েছ। আমাদের, সেকথা আমরা গোপন রাখতাম না।
তুমি ঠিকই অনুমান করেছ। এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারব না।
কাসাপারের সঙ্গে একহার্টও বেরিয়ে গেলেন, বোধ হয় বন্ধুকে গাড়িতে তুলে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব হল।
শ্ৰীমতী এরিকা ওয়াইস! চোখেমুখে গভীর উদ্বেগের চিহ্ন।
তুমি একা আছে বললেন শ্ৰীমতী ওয়াইস, তাই তোমাকে একটা কথা বলে যাই। প্রাণিবিদ একহার্টের মৃত্যু হয়েছে এক মাস আগে। তিনিই তোমাকে প্রথম চিঠিটা লিখেছিলেন। ইনি তাঁর ছেলে। এরও নাম ফ্রিডরিশ। ইনি শিকারি। জন্তুজানোয়ারের প্রতি বিন্দুমাত্র মমতা নেই। তুমি কালই চলে যাও এখান থেকে। আমি তোমার টিকিটের বন্দোবস্ত করে দেব। এখানে থাকা নিরাপদ নয়।
কিন্তু তুমি তা হলে কার সেক্রেটারি?
এঁর নয়, এর বাবার। আমি কতকগুলো কাজ শেষ করে এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে যাব।
আর কাসপার ভদ্রলোকটি কে?
ওডিয়ন সার্কাসের মালিক। সার্কাসের সঙ্গে একটা পশুশালা আছে, তাতে নানারকম উদ্ভট জানোয়ার–
বাইরে জুতোর শব্দ। এরিকা পাশের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান করলেন।
তোমাকে আজ আর বিরক্ত করব না, ঘরে এসে বললেন একহার্ট। আমাদের প্রস্তাবের কথাটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখো। কাল সকালে আবার তোমার সঙ্গে বসব।
একহার্ট চলে গেলেন। এতক্ষণ ইয়ের দিকে দৃষ্টি দিইনি, এবার চেয়ে দেখি সে আবার পূর্ব অবস্থায় ফিরে এসেছে।
এখন রাত এগারোটা বাজে। ইয়ের ঘরে গিয়ে দেখে এসেছি সে ঘুমোচ্ছে। আজকের অভিজ্ঞতাটা কি তার কাছে একটা বিভীষিকা, নাকি সে এজাতীয় ঘটনা উপভোগ করে? যে কোনও প্রাণীই জন্মগ্রহণ করে দুটি প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে—এক হল আত্মরক্ষা, আর দুই, খাদ্য আহরণ করে দেহের পুষ্টিসাধন করা। দ্বিতীয়টার ব্যাপারে ইয়ের আপাতত কোনও সমস্যা নেই-অন্তত আমার কাছে সে যতদিন আছে; আর প্রথমটি যে সে অনায়াসেই করতে সক্ষম, তার প্রমাণ তো পাওয়াই গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আজ এরিকা যে বিপদের কথা বললেন, সেটা কী ধরনের বিপদ? জানোয়ারের সঙ্গে ইয়ে যুঝতে পারে, কিন্তু মানুষের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তার শক্তি কতটুকু তা তো জানা নেই!
এ বিষয়ে কাল ভাবা যাবে। দেখি কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
নভেম্বর ৭
কাল রাতের চরম শিহরন জাগানো ঘটনা আর তার অদ্ভুত পরিসমাপ্তির কথা কোনওদিন ভুলব না।
কাল এগারোটায় শুয়ে পড়লেও ঘুম আসতে দেরি হয়েছিল। একহার্টের প্রতারণার ব্যাপারটা বারবার মনের মধ্যে মোচড় দিচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছে তার বাপের মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে সে আমার জন্তুটিকে হাত করার লোভে আমাকে এখানে আনিয়েছে। সে আমাকে যাতায়াতের খরচ দেবে বলেছিল, এখনও দেয়নি। হয়তো ভেবেছিল জন্তুর জন্য বিশ হাজার মার্ক দিলে সেটা পুষিয়ে যাবে। সে টাকা যে আমি নেব না, সেটা কি একহার্ট ভেবেছিল?
ঘুমটা এল একেবারে ম্যাজিকের মতো। বাইরে সিঁড়ির নীচে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে বারোটা বাজাতে আরম্ভ করল সেটা শুনেছি, কিন্তু শেষ হওয়াটা আর শুনিনি। অর্থাৎ তারমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। প্রথমে মনে হল ভূমিকম্প হচ্ছে, তারপর বুঝলাম আমার শরীরটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করা হচ্ছে; আর তারপরেই দেখলাম আমি বন্দি, অনড়। আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে। আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তল বালিশের তলায়, সেটারও নাগাল পাবার জো নেই। ঘরের দেয়ালঘড়িতে চোখ পড়াতে দেখলাম সাড়ে তিনটে। বাইরে পূর্ণিমার আলো, তাই হঠাৎ মনে হয়েছিল বুঝি ভোর হয়ে গেছে।
ঘরে অন্তত চার-পাঁচজন লোক সেটা দেখতে পাচ্ছি। একজনের হাতে টর্চ, সেটা আমার দিকে ঘোরানো রয়েছে। পাশের ঘরেও পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। ইয়ে কি তা হলো-?
প্রোফেসর শঙ্কু, তোমার আশ্চর্য জন্তু না মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে? আত্মরক্ষার অদ্ভুত সব উপায় নাকি চোখের পলকে উদ্ভব করতে পারে? এবারে বোঝা যাবে তার ক্ষমতার দৌড়।
একহার্টের গলা। দরজার মুখটাতে দাঁড়িয়ে আছে সে।
শাইনার, শুলটস-ওকে ওই পাশের ঘরের দরজার সামনে দাঁড় করাও।
দুজন লোক আমাকে এক হ্যাঁচকায় বিছানা থেকে তুলে নিয়ে টেনেহিঁচড়ে ইয়ের ঘরের দরজার সামনে নিয়ে গেল।
এই ঘরেও ফিকে চাঁদের আলো, অন্ততপক্ষে ছসৈাতজন লোক, এখানেও টর্চের আলো ঘোরাফেরা করছে। তিনজন লোকের হাতে দড়ি, থলি, জাল-অর্থাৎ জানোয়ার ধরার যাবতীয় সরঞ্জাম। অন্য দুজন লোকের হাতে ধাতব বস্তুর ঝালকানি দেখে বুঝলাম আগ্নেয়াস্ত্রেরও অভাব নেই।
কিন্তু বিছানা যে খালি সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
দুটো লোক উপুড় হয়ে খাটের তলায় টর্চ ফেলল, আর সেই মুহূর্তে ঘটল এক তুলাকালাম কাণ্ড।
একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ দমকা হাওয়ার মতো আমার নাকে প্রবেশ করে আমার চোখ থেকে জল বার করে দিল। ল্যাবরেটরিতে নানান কেমিক্যাল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ফলে কোনও গন্ধই আমাকে কাবু করতে পারে না; কিন্তু এই বীভৎস গন্ধের যে একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে মানুষকে ঘায়েল করার, সেটা বুঝতে পারছিলাম।
যারা এসেছিল তারা কেউ এ গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাকে রুমাল দিয়ে প্রায় ছটফট করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একহার্টও অবশ্য এই দলে পড়েন।
এরপরেই শুনতে পেলাম একহার্টের চিৎকার। তিনি বাইরের কোনও একটা জানলা দিয়ে মুখ বার করে বাগানে জমায়েত দলকে উদ্দেশ করে বলছেন, তোমরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থেকে-জন্তুটা জানালা দিয়ে পালাতে পারে।
আমার দৃষ্টি ইয়ের ঘর থেকে একচুল নড়েনি।
এবার খাটের তলা থেকে আমার প্ৰিয় আশ্চর্য জন্তু বার হয়ে হল। তারপরে এক লাফে বাগানের জানালার সামনে পৌঁছে আরেক লাফে জানালার বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে কি ওই অস্ত্ৰধারীদের শিকার হতে চলেছে?
না, তা নয়। কারণ এই সংকট মুহুর্তে পালাবার একমাত্র উপায় এই জন্তু উদ্ভব করেছে তার স্বাভাবিক ক্ষমতাবলে। ক্রমবিবর্তনের অমোঘ নিয়ম লঙ্ঘন করে চোখের নিমেষে এই স্থলচর চতুস্পদের ডানা গজিয়েছে।
জানোলা দিয়ে বেরিয়ে সে নীচের দিকে না গিয়ে বিস্তৃত ডানার সাহায্যে তিরবেগে উঠল। উপর দিকে। আমি দৌড়ে গিয়ে জানোলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম জ্যোৎস্নধৌত স্নান আকাশে তার দ্রুত সঞ্চালমান পক্ষবিশিষ্ট দেহ ক্ৰমে বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। বাগান থেকে পর পর দুটো গুলির শব্দ পাওয়া গেল, কিন্তু এই অবস্থায় বন্দুকের নিশানা ঠিক রাখা কোনও মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।
নভেম্বর ১৭
শ্ৰীমতী এরিকার দৌলতে যুগপৎ আমার মুক্তি, ও বন্ধুসমেত একহার্টকে পুলিশের হাতে সমর্পণ-এই দুটোই সম্ভব হয়েছিল।
গিরিডি ফেরার সাতদিন পরে খবরের কাগজে পড়লাম। নিকারাগুয়ার গভীর অরণ্যে এক পশুসংগ্ৰহকারী দল একটি আশ্চৰ্য নতুন জানোয়ারের সাক্ষাৎ পেয়েছে। এই জানোয়ার নাকি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দলের লোকএদের দিকে বারবার সেল্যুটের ভঙ্গিতে ডান হাতটা তুলে কপালে ঠেকাচ্ছিল। কিন্তু তাকে যখন জাল দিয়ে ধরতে যাওয়া হয়, তখন সে চোখের নিমেষে একটা একশো ফুট উঁচু গাছের মাথায় চড়ে ডালপালার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। পশু সংগ্ৰহকারী দল নাকি এই জানোয়ারের লোভে তাদের অভিযানের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানোয়ারের বর্ণনা থেকে তাকে আমারই ইয়ে বলে চিনতে কোনও অসুবিধা হয় না। এতদিন মানুষের মধ্যে থেকে সে মানুষের স্বভাব আয়ত্ত করেছিল, এখন আবার জঙ্গলের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কিছুদিন খোঁজার পরই যে এ অভিযাত্রী দল হাল ছাড়তে বাধ্য হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু ইয়ে কি তা হলে আর ফিরে আসবে না আমার কাছে?
না এলেই ভাল। যতদিন তার আয়ু, ততদিন তার আশ্চর্য ক্ষমতা নিয়ে সে বেঁচে থাকুক। আমার বৈজ্ঞানিক মনের একটা অংশ আক্ষেপ করছে যে, তাকে ভাল করে স্টাডি করা গেল। না, তার বিষয়ে অনেক কিছুই জানা গেল না। সেইসঙ্গে আরেকটা অংশ বলছে যে, মানুষের সব জেনে ফেলার লোভের একটা সীমা থাকা উচিত। এমন কিছু থাকুক, যা মানুষের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে, বিস্ময় জাগিয়ে তুলতে পারে।
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৯০
আশ্চর্য প্ৰাণী (প্রোফেসর শঙ্কু)
১০ই মার্চ
গবেষণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। আমার জীবনে এর আগে এ রকম কখনও হয়নি। একমাত্র সাত্ত্বিনা যে এটা আমার একার গবেষণা নয়, এটার সঙ্গে আরও একজন জড়িত আছেন। হামবোল্টও বেশ মুষড়ে পড়েছে। তবে এত সহজে নিরুদ্যম হলে চলবে না। কাল আবার উঠে পড়ে লাগতে হবে।
১১ই মার্চ
আজও কোনও ফল পাওয়া গেল না। যদি যেত, তা হলে অবিশ্যি সারা পৃথিবীতে সাড়া পড়ে যেত। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না সন্দেহ। আমি অবিশ্যি আমার হতাশা বাইরে প্রকাশ করি না, কিন্তু হামবোল্ট দেখলাম আমার মতো সংযমী নয়। আজ ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ কথা নেই বাতা নেই, ওর পোষা বিরাট গ্রেট ডেন কুকুরটার পাঁজরায় একটা লাথি মেরে বসল। হামবোল্টের চরিত্রের এ দিকটা আমার জানা ছিল না। তাই প্রথমটায় বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে রাগটা বেশিক্ষণ ছিল না। মিনিট দিশেকের মধ্যেই তুড়ি মেরে নেপোলিয়নকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। নেপোলিয়নও দেখলাম দিব্যি লেজ নাড়ছে।
আজ প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকে কনকনে হাওয়া বইছে। বাইরেটা বরফ পড়ে একেবারে সাদা হয়ে রয়েছে। বৈঠকখানার ফায়ারপ্লেসের সামনে বসেই আজ দিনটা কাটাতে হবে। আমি জানি হামবোল্ট আমাকে আবার সুপার-চেস খেলতে বাধ্য করবে। সুপার-চেস, অর্থাৎ দাবার বাবা। এটা হামবোল্টেরই আবিষ্কার। বোর্ডের সাইজ ডবল। যুঁটির সংখ্যা ষোলোর জায়গায় বত্রিশ, যুঁটির চালচলনও দাবার চেয়ে শতগুণে বেশি জটিল। আমার অবিশ্যি খেলাটা শিখে নিতে ঘণ্টা তিনেকের বেশি সময় লাগেনি। প্রথম দিন হামবোল্ট আমাকে হারালেও, কাল পর্যন্ত পার পর তিন দিন আমি ওকে কিস্তি মাৎ করে দিয়েছি। মনে মনে স্থির করেছি যে আজ যদি খেলতেই হয়, তা হলে ইচ্ছে করেই হারব। ওর মেজাজের যা নমুনা দেখলাম, ওকে একটু তোয়াজে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
১২ই মার্চ
আজ প্রথম একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। হয়তো বা শেষপর্যন্ত সত্যিই পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে প্রথম একটি প্রাণীর সৃষ্টি হবে। আজ মাইক্রোম্যাগনাস্কোপের সাহায্যে যে জিনিসটা ফ্লাস্কের মধ্যে দেখা গেল, সেরকম এর আগে কখনও দেখা যায়নি। একটা পরমাণুর আয়তনের cell জাতীয় জিনিস। হামবোল্ট দেখার পর আমি চোখ লাগানোর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল। ভাবগতিক দেখে সেটাকে প্রাণী বলতে দ্বিধা হয় না, এবং এটার সৃষ্টি হয়েছিল যে আমাদের গবেষণার ফলেই, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। হামবোল্ট প্রচণ্ডভাবে উত্তেজিত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য। সত্যি বলতে কী, যন্ত্রটা থেকে চোখ সরিয়ে নেবার পরমুহুর্তেই ও আমার কাঁধে এমন একটা চাপড় মারে যে, কাঁধটা এখনও টিনটিন করছে।
কিন্তু যেটা দুশ্চিন্তার কারণ সেটা হল এই যে, প্রাণী যদি সৃষ্টিও হয়, তার অস্তিত্ব কি হবে শুধুমাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য? তা হলো লাভটা কী হবে? লোককে ডেকে সে প্রাণী দেখাব কী করে? ইউরোপের অন্যান্য বৈজ্ঞানিকরা সে প্রাণীর কথা বিশ্বাস করবে। কেন?
যাকগে, এখন এসব কথা না ভাবাই ভাল। আমি নিজে এটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি যে, আজ যে ঘটনা আমাদের ল্যাবরেটরিতে ঘটেছে, তার তুলনীয় কোনও ঘটনা। এর আগে পৃথিবীর কোথাও কোনও ল্যাবরেটরিতে কখনও ঘটেনি।
এই প্ৰাণী তৈরির ব্যাপারে আমরা যে-রাস্তাটা নিয়েছি, আমার মতে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়, বিজ্ঞানীরা অনুমান করতে পারেন তখন পৃথিবীর অবস্থাটা কীরকম ছিল। সেই অবস্থােটা ভারী ভয়ংকর। সারা পৃথিবীতে ডাঙা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তার বদলে ছিল এক অগাধ সমুদ্র। পৃথিবীর উত্তাপ ছিল তখন প্রচণ্ড। এই সমুদ্রের জল টগবগ করে ফুটত। আজকাল বায়ুমণ্ডল পৃথিবীকে যেভাবে ঘিরে রয়েছে এবং তার আচ্ছাদনের মধ্যে মানুষকে অক্সিজেন, ওজোন ইত্যাদির সাহায্যে যেভাবে বাঁচিয়ে রেখেছে—তখন তা ছিল না। তার ফলে সূর্যের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি সোজা এসে পৃথিবীকে আঘাত করত। হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন সালফার কার্বন ইত্যাদি গ্যাস অবশ্যই ছিল, আর এইসব গ্যাসের উপর চলত বৈদ্যুতিক প্রভাবের খেলা। প্রলয়ংকর বৈদ্যুতিক ঝড় ছিল তখন দৈনন্দিন ব্যাপার। এই অবস্থাতেই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়।
আমরা আমাদের ল্যাবরেটরিতে যেটা করেছি। সেটা আর কিছুই নয়-একটা ফ্লাস্কের মধ্যে কৃত্রিম উপায়ে এই আদিম আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছি। আমার বিশ্বাস এই অবস্থােটা বজায় রেখে কিছুদিন পরীক্ষা চালাতে পারলে আমাদের ফ্লাস্কের মধ্যে একটি প্রাণীর জন্ম হবে, যেটা হবে মানুষের তৈরি প্রথম প্রাণী। এই প্রাণী জীবাণুর আকারে হবে এটাও আমরা অনুমান করছি, এবং জীবাণুরই মতো হবে এর হাবভাব চালচলন।
প্রোফেসর হামবোল্টের সঙ্গে এ ব্যাপারে কীভাবে জড়িত হলাম, সেটা বলি। জামানির ব্রেমেন শহরে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে আমি কৃত্রিম উপায়ে প্রাণসৃষ্টি সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ পড়ি। সভায় হামবোল্ট উপস্থিত ছিলেন। এই বিখ্যাত বায়োকেমিস্টের লেখা আমি আগে পড়েছি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল না। বক্তৃতার পর নিজে এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমারই মতো বয়স, তবে লম্বায় আমার চেয়ে প্রায় এক হাত উচু। মাথায় চকচকে টাক, গোঁফ দাড়ির লেশ মাত্র নেই, এমনকী ভুরু বা চোখের পাতাও নেই।
হঠাৎ দেখলে মাকুন্দ বলে মনে হয়। কিন্তু হ্যান্ডশেক করার সময় হাতে সোনালি লোম লক্ষ করলাম।
সম্মেলনের অতিথিদের জন্য বক্তৃতার পর একটা বড় হলঘরে কফি ও কেক-বিস্কুটের ব্যবস্থা ছিল। ভিড় দেখে আমি একটা কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। মনটাও ভাল নেই, কারণ বক্তৃতার শেষে হাততালির বহর দেখে বুঝেছিলাম, আমার কথাগুলো শ্রোতাদের মনে ধরেনি। অর্থাৎ মানুষের হাতে প্রাণীর সৃষ্টি হতে পারে সেটা বৈজ্ঞানিকেরা মানতে চায়নি। তাই বক্তৃতার শেষে দু একজন ভদ্রতার খাতিরে প্রশংসা করলেও এগিয়ে এসে বিশেষ কেউই কথা বলছে না। এমন সময় প্রোফেসর হামবোল্ট হাসিমুখে এলেন আমার দিকে এগিয়ে। তাঁর হাতে দু পেয়ালা কফি দেখে বুঝলাম তার একটা আমারই জন্যে। কফি পেয়ে তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। জামান ভাষাতেই কথাবাত হল। হামবোল্ট তাঁর প্রথম কথাতেই আমাকে অবাক করে দিলেন
আমার পেপারটা আর পড়ার দরকার হল না।
তার মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তুমি যা বললে, আমারও সেই একই কথা।
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, তাতে ক্ষতি কী? এরা যখন আমার একার কথায় গা করছে। না, সেখানে দুজনে বললে হয়তো কিছুটা কাজ হবে।
হামবোল্ট মৃদু হেসে মৃদু স্বরে বললেন, এদের কিছু বলে বোঝাতে যাওয়াটা পণ্ডশ্ৰম। এসব ব্যাপারে কথায় কাজ হয় না, কাজ হয় একমাত্র কাজ দেখাতে পারলে। তুমি যা বললে, সেটা নিয়ে কিছু পরীক্ষা করেছ কি?
আমি বলতে বাধ্য হলাম যে আমার গিরিডির ল্যাবরেটরিতে যা সরঞ্জাম আছে তাই নিয়ে এই জটিল পরীক্ষায় নামা মুশকিল।
কোনও চিন্তা নেই? হামবোল্ট বললেন। তুমি চলে এসো আমার ওখানে।
কোথায়? হামবোল্ট কোথায় থাকতেন সেটা আমার জানা ছিল না।
সুইটজারল্যান্ড। আমি থাকি সেন্ট গালেন শহরে। আমার মতো ল্যাবরেটরি ইউরোপে আর পাবে না।
লোভ লাগল। এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। ৫ই মার্চ অর্থাৎ ঠিক সাত দিন আগে সেন্ট গালেনে পৌঁছেছি। সুইটজারল্যান্ডের সব শহরের মতোই এটাও ছবির মতো সুন্দর। কনস্ট্যান্স হ্রদের ধারে রোরশাক শহর থেকে ট্রেনে ন মাইল। প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচুতে। প্রথম দিন একটু ঘুরে দেখেছিলাম শহরটা, তারপর গবেষণার কাজ শুরু হয়ে যাওয়াতে আর বেরোতে পারিনি। হামবোল্টের ল্যাবরেটরি সত্যিই একটা আশ্চর্য জিনিস। এ ধরনের গবেষণা এখানে ছাড়া সম্ভব ছিল না। এখন এটা সফল হলেই হয়। আজ যে খানিকটা আশার আলো দেখা দিয়েছে, তার জন্য আমি অনেকটা দায়ী। প্রোটোভিট্রোমাফিজেনারাস সলিউশনে নিউট্র্যাল ইলেকট্রিক বমবার্ডমেন্টের কথাটা আমিই বলেছিলাম। আমার বিশ্বাস তার ফলেই আজ কয়েক মুহুর্তের জন্য ওই পারমাণবিক প্রাণীটির আবিভব হয়েছিল। কাল বমবার্ডমেন্টের মাত্ৰাটা আর একটু বাড়িয়ে দেব। দেখা যাক কী হয়।
নাঃ-আজ আর লেখা যাবে না। এইমাত্র হামবোল্টের চাকর ম্যাক্স বলে গেল, তার মনিব সুপার-চেসের যুঁটি সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
১৪ই মার্চ
কাল ডায়েরি লিখতে পারিনি। লেখার মতো মনের অবস্থাও ছিল না। তার মানে মনমরা অবস্থা নয়—একেবারে উল্লাসের চরম শিখর। এখনও ঘটনাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘড়িতে যদিও রাত আড়াইটা, চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বার বার মন চলে যাচ্ছে হামবোল্টের ল্যাবরেটরির টেবিলের উপর রাখা ফ্লাস্কের ভিতরের আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে। আমাদের যুগান্তকারী পরীক্ষার ফল। এই প্ৰাণী।
কাল সন্ধ্যা ছটা বেজে তেত্ৰিশ মিনিটে এই প্ৰাণী জন্ম নেয়। আমার বিশ্বাস আমার অনুমান অনুযায়ী বমবার্ডমেন্টের মাত্রােটা বাড়ানোর ফলেই এ প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছে; যদিও এ বিষয়ে আমি হামবোল্টের কাছে কোনও বড়াই করিনি। তাই বোধ হয় তার মনটাও খুশিতে ভরে আছে। সে হয়তো ভাবছে তার কৃতিত্ব আমারই সমান। ভাবুক গিয়ে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। আমাদের গবেষণা সফল হয়েছে এইটেই বড় কথা।
শুধু প্রাণীর জন্মটাই যে কালকের একমাত্র আশ্চর্য ঘটনা, তা নয়। জন্মের মুহুর্তে যে সব ব্যাপারগুলো ঘটল, তা এতই অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক যে, এখনও মনে পড়লে আমার শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ ঘণ্টা একটানা দুজনে ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে বসে ছিলাম। বরফ পড়ছে, নেপোলিয়ন এসে ল্যাবরেটরির কাপেটের উপর বসেছে, ম্যাক্স সবেমাত্র কফি দিয়ে গেছে, এমন সময় হঠাৎ একটা বাজ পড়ার মতো প্ৰচণ্ড শব্দে আমাদের দুজনেরই প্রায় হার্টফেল হবার অবস্থা। অথচ আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই; জানোলা দিয়ে বাইরে ঝলমলে রোদ দেখা যাচ্ছে। এই বজপাতের সঙ্গে সঙ্গে আবার অনুভব করলাম। একটা এক সেকেন্ডের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি। তার তেজ এত বেশি যে, ঘরের জানোলা আর টেবিলের কাচের জিনিসপত্রগুলো সব ঝনঝনি করে উঠল, আর আমরা দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম টেবিলের উপর। তারপর কোনও রকমে টাল সামলে নিয়ে ফ্লাস্কের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা আশ্চর্য জিনিস।
ফ্লাস্কের অর্ধেকটা ছিল জলে ভর্তি। প্ৰথমে লক্ষ করলাম যে, সেই জলের উপরের স্তরে একটা যেন ঢেউ খেলছে। অত্যন্ত ছোট ছোট তরঙ্গের ফলে জলের উপরটা যেন একটা সমুদ্রের খুদে সংস্করণ।
তারপর দেখলাম ইঞ্চিখানেক নীচের দিকে জলের মধ্যে কী যেন একটা চরে বেড়াচ্ছে। সেটাকে খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না, কিন্তু সেটা পরমাণুর চেয়ে আয়তনে অনেকখানি বড়। আর তার চলার ফলে জলের ভিতরে যে একটা মৃদু আলোড়নের সৃষ্টি হচ্ছে, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়।
বাতিটা নেবাও!
হামবোল্টের হঠাৎ-চিৎকারে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার হাতের কাছেই লাইটের সুইচটা ছিল। সেটা নিবিয়ে দিতেই অন্ধকারে একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। প্রাণীটির একটা নিজস্ব নীল আলো আছে, সেই আলোটা জলের ভিতরে একেবেঁকে চলে তার গতিপথ নির্দেশ করছে। আমরা দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে রইলাম।
কতক্ষণ। এইভাবে চেয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠতে বুঝলাম হামবোল্টের আচ্ছন্ন ভাবটা কেটেছে। সে ঘরের এক পাশে সোফাটার উপর ধাপ করে বসে পড়ল। তার ঘন ঘন হাত কচলানি থেকে বুঝলাম, সে এখনও উত্তেজনায় অস্থির।
আমি টেবিলের সামনেই কাঠের চেয়ারটায় বসে পড়ে বললাম, এমন একটা ঘটনা বৈজ্ঞানিক মহলে প্রচার করা উচিত নয় কি?
হামবোল্ট এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে কেবল হাত কচলাতে লাগল। বোধ হয় আমাদের আবিষ্কারের গুরুত্বটা সাময়িকভাবে তার মাথাটা একটু বিগড়ে দিয়েছে, সে পরিষ্কারভাবে কিছু ভাবতে পারছে না। তবু আমি একটা কথা না বলে পারলাম না
আমাদের এই প্ৰাণী যাতে কিছু দিন অন্তত বেঁচে থাকে, তার জন্য যা করা দরকার সেটা আমাদের করতেই হবে।
হামবোল্ট বার দুয়েক মাথা নেড়ে অদ্ভুতভাবে চাপা ফিসফিসে গলায় প্রায় অন্যমনস্কভাবে
এরপর থেকে হামবোল্ট আর দাবার উল্লেখ করেনি। কাল রাত্রে খাবার সময় সে একটি কথাও বলেনি। বেশ বুঝেছিলাম যে, তার অন্যমনস্কতা এখনও কাটেনি। কী ভাবছে সে, কে জানে!
আজ সারা দিন আমরা দুজন অনেকটা সময় কাটিয়েছি ল্যাবরেটরিতে। দিনের বেলায় ল্যাবরেটরির জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছি, যাতে ঘরটা অন্ধকার থাকে। অন্ধকারের মধ্যে যতবারই ঘরে ঢুকেছি, ততবারই প্ৰথমে চোখ চলে গেছে। ফ্লাস্কের ওই নীল এঁকেবেঁকে-চলা আলোটার দিকে। কী নাম দেওয়া যায়। এই জীবন্ত আলোকবিন্দুর? এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি।
১৫ই মার্চ
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে, নিজেকে বৈজ্ঞানিক বলতে আর ইচ্ছে করছে না। হামবোল্টের ল্যাবরেটরিতে আজকে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমাদের দুজনকেই একেবারে বেকুব বানিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কোনও নিয়মই এখানে খাটে না। এটাকে অলৌকিক ভেলকি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
আমি কাল রাত্রে ঘুমিয়েছি। প্রায় তিনটের সময়; কিন্তু তা সত্ত্বেও অভ্যাস মতো আমার ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। হামবোল্টও ভোরেই ওঠে, কিন্তু ছটার আগে নয়।
সটান চলে গেলাম। ল্যাবরেটরিতে।
দরজা জানোলা কাল বন্ধ ছিল। দরজার একটা ড়ুপলিকেট চাবি হামবোল্ট আমাকে দিয়ে রেখেছিল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে ফ্লাস্কের দিকে চাইতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল।
সেই নীল আলোটা আর দেখা যাচ্ছে না। আমি তৎক্ষণাৎ ধরেই নিলাম যে, প্রাণীটার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাও ব্যাপারটা একবার ভাল করে দেখার জন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আলো জ্বালাতেই প্রথমেই দেখলাম যে, ফ্লাস্কে জল প্ৰায় নেই বললেই চলে। তার বদলে প্রায় অর্ধেকটা অংশ ভরে রয়েছে একটা খয়েরি রঙের পদার্থে। এই পদার্থের উপরটা প্ৰায় সমতল; তারমধ্যে কয়েকটা ছোট ছোট জলে ভরা ডোবার মতো জায়গা, আর সেগুলোকে ঘিরে সবুজ রঙের ছোপ। অর্থাৎ যেটা ছিল সমুদ্র, সেটা এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেছে। জলাভূমি।
কিন্তু আমাদের প্রাণী? এইবারে লক্ষ করলাম একটা ডোবার মধ্যে কিছুটা আলোড়ন। কী যেন একটা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে সেখানে। আমি এগিয়ে গিয়ে একেবারে ফ্লাস্কের কাচের গায়ে চোখ লাগিয়ে দিলাম।
হ্যাঁ। কোনও সন্দেহ নেই। একটা প্ৰাণী ডোবার জলের মধ্যে সাঁতার দিয়ে ডাঙায় এসে উঠল। প্রাণীটাকে খালি-চোখেই দেখা যাচ্ছে। সাইজে একটা সাধারণ পিঁপড়ের মতো বড়।
আমার মুখ থেকে একটা কথা আপনা থেকে বেরিয়ে পড়ল—অ্যামফিবিয়ান।
অর্থাৎ আমাদের সৃষ্ট জলচর প্রাণী আজ। আপনা থেকেই উভচর প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এ প্রাণী জলেও থাকতে পারে, ডাঙাতেও থাকতে পারে। পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণীর সৃষ্টি হয়, অনুমান করা হয় সে প্রাণী জলচর ছিল। তারপর প্রাকৃতিক অবস্থার পরিবর্তনে পৃথিবী থেকে জল কমে যায়; তার জায়গায় দেখা দেয় জলাভূমি। তার ফলে জলচর প্রাণীও ক্রমে নতুন পরিবেশে প্রাণধারণ করার উপযুক্ত একটা নতুন চেহারা নেয়। এই চেহারাটাই তার অ্যামফিবিয়ান বা উভচর চেহারা। এ জিনিসটা অবশ্য রাতারাতি হয়নি। এটা ঘটতে লেগেছিল। কোটি কোটি বছর। কিন্তু আমাদের ফ্লাস্কের মধ্যে ঠিক এই ঘটনাই ঘটে গেল দু দিনের মধ্যে।
টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ লক্ষ করলাম যে, প্রাণীটা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ মাইক্রোম্যাগনাস্কোপ দিয়ে সেটাকে একবার ভাল করে দেখে নিলাম। কোনও সন্দেহ নেই। ঠিক এই জাতীয় অ্যামফিবিয়ানেরই ফসিল আমি দেখেছি বার্লিন মিউজিয়মে। ৬০০ কোটি বছর আগে এই উভচর প্রাণী পৃথিবীতে বাস করত। মাছ আর সরীসৃপের মাঝামাঝি অবস্থা। রংটা লক্ষ করলাম সবুজ আর খয়েরি মেশানো। চেহারাটা যেন মাছ আর গিরগিটির মাঝামাঝি।
আরও একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম। ডোবার ধারে ধারে যেটাকে সবুজ রং বলে মনে হচ্ছিল, সেটা আসলে অতি সূক্ষ্ম আকারের সব গাছপালা।
হামবোল্ট বোধ হয় অনেক রাত পর্যন্ত লেখালেখির কাজ করেছে, তাই তার ঘুম ভাঙতে হয়ে গেল সাড়ে সাতটা। বলা বাহুল্য, ফ্লাস্কের ভিতরে ভেলকি দেখে আমারই মতো হতবাক অবস্থা তারও।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে হামবোল্ট প্রথম মুখ খুলল—আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরে কি পৃথিবীর প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের একটা মিনিয়েচার সংস্করণ ঘটতে চলেছে।
আমিও মনে মনে এটাই সন্দেহ করেছিলাম। বললাম, সেটা শুধু আজকের এই একটা ঘটনাতে প্রমাণ হবে না। এখন থেকে শুরু করে পর পর কী ঘটে, তার উপর সব কিছু নির্ভর করছে।
হুঁ।
হামবোল্ট কিছুক্ষণ চুপ। তার ঠোঁটের কোণে সেই অদ্ভুত হাসি, যেটা প্রথম প্রাণীর উদ্ভবের সময় থেকেই মাঝে মাঝে লক্ষ করছি। অবশেষে একটা সসেজের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, তার মানে এর পরে উদ্ভিদজীবী সরীসৃপ। তারপর স্তন্যপায়ী মাংসাশী জানোয়ার, তারপর।..তারপর…
হামবোল্ট থামল। তারপর কাঁটাচামচ নামিয়ে রেখে হাত দুটো কচলাতে কচলাতে বলল, আজ থেকে সতেরো বছর আগে, ওসাকায় একটা আন্তজাতিক বিজ্ঞানীবৈঠকে কৃত্রিম উপায়ে প্রাণ সৃষ্টি করার বিষয়ে একটা প্রবন্ধ পড়ে ছিলাম। সে প্রবন্ধ শুনে সভার লোক আমায় ঠাট্টা করেছিল, পাগল বলে গালমন্দ করেছিল। আজ ইচ্ছে করছে, তারা এসে দেখুক আমি কী করেছি…
আমি চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, হামবোল্ট প্রাণসৃষ্টির কৃতিত্বটা অম্লানবদনে নিজে একই নিয়ে নিচ্ছে। অথচ আমি জানি যে, যদি শেষ মুহুর্তে আমার মাথা না খেলত—বমবার্ডমেন্টের মাত্রা যদি না বাড়ানো হত— তা হলে পরীক্ষা সফল হত না। গবেষণার গোড়াতে হামবোল্টের কথাতেই কাজ চলছিল, কিন্তু তাতে কোনও ফল হয়নি। সেটা হামবোল্টও জানে, কিন্তু তাও…
যাকগে। এ সবে কিছু এসে যায় না। বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ছোট মনের পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি। তারাও তো মানুষ, কাজেই তাদের অনেকের মধ্যেই ঈষাও আছে, লোভও আছে। এ নিয়ে আর কোনও মন্তব্য বা চিন্তা না করাই ভাল।
কদিন একটানা বাড়ির ভেতর থাকতে হয়েছে, তাই আজ দিনটা ভাল দেখে ভাবলাম, একটু বেড়িয়ে আসি। দু-একটা চিঠি লেখা দরকার, অথচ ডাকটিকিট নেই, তাই সোজা পোস্টাপিসের দিকে রওনা দিলাম।
রাস্তায় বরফ পড়ে আছে, শীতটাও চনমনে, কিন্তু আমার কোটের পকেটে একটা এয়ার কন্ডিশনিং পিল থাকার জন্য অতিরিক্ত গরমজামার কোনও প্রয়োজন হয়নি। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ওভারকেট পরা রাস্তার লোকেরা আমার দিকে উদ্বিগ্নভাবে বার বার ফিরে ফিরে দেখছে।
পোস্টাপিসে টিকিট কেনার সময় মনে হল যে, এইখান থেকে ইচ্ছে করলে লন্ডনে টেলিফোন করা যায়। সোজা ডায়াল করলেই যখন নম্বর পাওয়া যায়, তখন আমার বন্ধু প্রফেসর সামারভিলকে একটা খবর দিলে কেমন হয়? সামারভিল বায়োকেমিস্ট; কৃত্রিম উপায়ে প্রাণী তৈরির ব্যাপারে এককালে তার সঙ্গে আমার চিঠি লেখালেখি হয়েছিল।
সামারভিলকে টেলিফোনে পেতে লাগল ঠিক এক মিনিট।
কোনওরকমে সংক্ষেপে তাকে ব্যাপারটা বললাম। সামারভিল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। একে কৃত্রিম প্রাণী, তার উপরে দু দিনের মধ্যে জলচর থেকে উভচর। শেষটায় সামারভিল বলল, তুমি কোখেকে ফোন করছ? ইন্ডিয়া নয় নিশ্চয়ই?
বললাম, না না, তার চেয়ে অনেক কাছে। আমি আছি সেন্ট গালেনে।
কেন? সেন্ট গালেনে কেন? সামারভিল অবাক।
বললাম, প্রোফেসর হামবোল্টের ল্যাবরেটরিতে কাজ করছি আমি।
তিন সেকেন্ড কোনও কথা নেই। তার পর শোনা গেল—
হামবোল্ট? কর্নেলিয়াস হামবোল্ট? কিন্তু সে যে—লাইন কেটে গেল।
মিনিটখানেক চেষ্টা করেও কোনও ফল হল না। সামারভিলের বাকি কথাটা আর শোনা হল না। তবে এটা বুঝেছিলাম যে আমার সহকমীর নাম শুনে সে বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছে!
কী আর করি? বাড়ি ফিরে এলাম। হামবোল্ট যে একটু গোলমেলে লোক, সে তো আমি নিজেও বুঝেছি। কিন্তু এটাও তো মনে রাখতে হবে যে তার মতো এমন ল্যাবরেটরিতে এমন একটা এক্সপেরিমেন্টের সুযোগ হামবোল্টই আমাকে দিয়েছে।
আজ সারাদিন ল্যাবরেটরিতে অনেকটা সময় কাটিয়েছি। আমি আর হামবোল্ট। মাইক্রোফোটোগ্রাফিক ক্যামেরা দিয়ে প্রাণীটার কয়েকটা ছবিও তুলেছি। এটা বেশ বুঝেছি যে, প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছুই করতে হবে না। তার জন্য অনুকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনা থেকেই ফ্লাস্কের ভিতর তৈরি হয়ে রয়েছে। সেই পরিবেশ বদল না হওয়া পর্যন্ত এ প্রাণী ঠিকই থাকবে।
১৬ই মার্চ
যা ভেবেছিলাম তাই। আজ সরীসৃপ। আমার প্রাণীর তৃতীয় অবস্থা। আয়তনে আগের প্রাণীর চেয়ে প্রায় দশগুণ বড়। মাইক্রোম্যাগনাস্কোপের প্রয়োজন হবে না। এমনি চোখে দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে এর আকৃতি ও প্রকৃতি। এর চেহারা আমাদের কাছে অতি পরিচিত। পৃথিবীর অনেক জাদুঘরেই এই কঙ্কাল রয়েছে। সরীসৃপ শ্রেণীর মধ্যে আয়তনে যেটি সবচেয়ে বড় ছিল—এ হল সেই ব্ৰন্টোসরাস। সেই ষাট ফুট লম্বা দানবসদৃশ প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের একটি দু ইঞ্চি সংস্করণ দিব্যি আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরের জমিতে হাঁটছে, শুচ্ছে, বসছে, আর দরকার হলে খুদে খুদে গাছের খুদে খুদে ডাল পাতা চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে।
খুব আপশোস হল একটা কথা ভেবে-কাল রাতটা কেন ফ্লাস্কের সামনে বসে রইলাম না? থাকলে নিশ্চয়ই পরিবর্তনটা চোখের সামনে দেখতে পেতাম। আজ স্থির করলাম যে যতক্ষণ না ফ্লাস্কের ভিতরে একটা কিছু ঘটে ততক্ষণ ল্যাবরেটরি ছেড়ে কোথাও যাব না। এখন রাত সোয়া বারোটা। আমি ল্যাবরেটরিতে বসেই আমার ডায়রি লিখছি। হামবোল্টও সামনে বসে আছে। কেবল মাঝে একবার টেলিফোন আসাতে উঠে চলে গিয়েছিল। কে ফোন করেছিল জানি না। যেই করুক, হামবোল্ট তার সঙ্গে বেশ উত্তেজিত ও উৎফুল্লভাবে কথা বলছিল। এটা মাঝে মাঝে তার উদাত্ত গলার স্বর থেকেই বুঝতে পারছিলাম, যদিও দুটো ঘরের মধ্যে ব্যবধানের ফলে কথা বুঝতে পারছিলাম না।
ব্ৰন্টোসরাসটা এখন বিশ্রাম করছে। ফ্লাস্কের ভিতরটা কেমন জানি ধোঁয়াটে হয়ে আসছে। হয়তো কিছু একটা ঘটবে। লেখা বন্ধ করি।
১৬ই মার্চ, রাত একটা বেজে ছত্ৰিশ মিনিট
দু মিনিট আগে সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে গেল। যে ধোঁয়াটে ভাবটার কথা লিখেছিলাম সেটা আর কিছুই না-ফ্লাস্কের ভিতরে উপর দিকটায় মেঘ জন্মছিল। মিনিট পাঁচেক এইভাবে মেঘ জমার পর অবাক হয়ে দেখলাম একটা মিহি বাম্পের মতো জিনিস মেঘ থেকে নীচে জমির দিকে নামছে। বুঝলাম সেটা বৃষ্টি। আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরের ভূখণ্ডটির উপর বৃষ্টি হচ্ছে।
শুধু বৃষ্টি নয়। পর পর কয়েকটা বিদ্যুতের চমকও লক্ষ করলাম-আর সেই সঙ্গে মৃদু। মেঘের গর্জন। যদিও সে গর্জন কান ফাটা কোনও শব্দ নয়, কিন্তু ফ্লাস্কটা ও টেবিলের অন্যান্য কাচের যন্ত্রপাতি সেই গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝনি করে উঠছিল।
বৃষ্টির মধ্যে আমাদের প্রাণীর কী অবস্থা হচ্ছে, সেটা দেখার কোনও উপায় ছিল না, কারণ বাম্পের জন্য ফ্লাস্কের ভিতরের সূক্ষ্ম ডিটেল সব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
আমরা দুজনেই তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে একটা সময় এল যখন বুঝতে পারলাম বৃষ্টিটা থেমে গেছে। মেঘ কেটে গেল, বাষ্প সরে গিয়ে ফ্লাস্কের ভিতরটা আবার পরিষ্কার হয়ে গেল। দেখলাম জমির রং একেবারে বদলে গেছে। আগের অবস্থায় যা ছিল তামাটে, এখন সেটা হয়েছে। ধবধবে সাদা।
আমরা দুজনে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম-বরফ!
বরফটা সমতল নয়। তার মধ্যে উঁচু নিচু আছে, এবড়োখেবড়ো আছে, এক এক জায়গায় বরফের চাই মাটি থেকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে পাহাড়ের মতো।
আমি বললাম, আমরা কি ফ্লাস্কের মধ্যে আইস-এজের একটা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি!
হামবোল্ট বলল, তা হবেও বা। কিংবা যে কোনও সময়ের মেরুদেশের দৃশ্যও হতে পারে।
আইস-এজ বা তুষারপর্বের সময় হচ্ছে আজ থেকে সাত-আট লক্ষ বছর আগে। বরফ তখন মেরুদেশ থেকে নীচের দিকে সরতে সরতে প্রায় সারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছিল।
হামবোল্ট হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—ওই যে! ওই যে আমাদের প্রাণী!
একটা বরফের গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা লোমশ জানোয়ার। এক ইঞ্চির বেশি লম্বা নয়। সেটা। জানোয়ারটা চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। হামবোল্ট মাইক্রোম্যাগনাস্কোিপটা চোখে লাগল। তারপর চেঁচিয়ে উঠল–
বুঝেছি! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পাগুলো বেঁটে বেঁটে, মাথার সামনের দিকে দুটো শিং, ঘাড়ে-গদানে চেহারা। এ হল লোমশ গণ্ডার! আমাদের স্তন্যপায়ী জানোয়ার!
এবার আমি চোখে লাগালাম যন্ত্রটা। হামবোল্ট ঠিকই বলেছে। গণ্ডারের আদিম সংস্করণ-যাকে বলে Wooly Rhinoceros। বরফের দেশেই বাস করত এ জানোয়ার।
বুঝতে পারলাম, আমাদের ফ্লাস্কের ভিতরে এভোলিউশন বা ক্রমবিবর্তনের ধারা ঠিকই বজায় আছে। আজকের বিবর্তনের ঘটনাটা যে আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, এটাই সবচেয়ে আনন্দের কথা। আমাদের ষোলো ঘণ্টা এক নাগাড়ে ল্যাবরেটরিতে বসে থাকা সার্থক হয়েছে।
কাল সকালে সামারভিলকে আরেকটা ফোন করে তাকে একবার আসতে বলব। এমন একটা অলৌকিক ঘটনা কেবলমাত্র দুটি বৈজ্ঞানিকের সামনে ঘটে চলবে, এটা অন্যায়, এটা হতে দেওয়া চলে না।
১৭ই মার্চ
আজ সাংঘাতিক গণ্ডগোল। আজ আমাকে হত্যা করতে চেষ্টা করা হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে এ যাত্রা বেঁচে গেছি, কিন্তু কী ধরনের বিপদসংকুল পরিবেশে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। কী হল সেটা গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।
সামারভিলকে আর একবার টেলিফোন করার কথা কালকেই মনে হয়েছিল। হামবোল্ট সম্পর্কে ও কী বলতে চেয়েছিল সেটা জানার জন্যও একটা কৌতূহল হচ্ছিল। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরোতে যাব, এমন সময় হামবোল্ট জিজ্ঞেস করল, কোথায় যােচ্ছ?
বললাম, গিরিডিতে আমি রোজ সকালে হাঁটতে বেরোই, তাই এখানে এসেও মাঝে মাঝে সেটার প্রয়োজন বোধ করি।
হামবোল্ট শুকনো গলায় বলল, সেদিন পোস্টাপিস থেকে কাকে টেলিফোন করেছিলে?
আমি তো অবাক। লোকটা জানল কী করে? সারা শহরে কি গুপ্তচর বসিয়ে রেখেছে নাকি হামবোল্ট?
আমার প্রশ্নটা বোধ হয় আচা করেই হামবোল্ট বলল, এ শহরের প্রত্যেকটি লোককে আমি চিনি, প্রত্যেকেই আমাকে সমীহ করে। আমার বাড়িতে একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক অতিথি এসে রয়েছে, সে খবরও সকলে জানে। তাদের যে কোনও একজনের কাছ থেকে খবরটা আমার কানে আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক?
আমি বললাম, অস্বাভাবিক নয় মোটেই। কিন্তু তোমার এভাবে আমাকে জেরা করাটা আমার অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবু-যখন জিজ্ঞেস করছ, তখন বলছি-আমার এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম।
কোথায়?
লন্ডনে।
সে কি বৈজ্ঞানিক?
হ্যাঁ।
কী বলেছিলে তাকে?
আমার ভারী বিরক্ত লাগল। লোকটা ভেবেছে কী? হতে পারে। আমি তার অতিথি; হতে পারে সে আমাকে তার ল্যাবরেটরিতে তার সঙ্গে একজোটে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু তাই বলে কি সে আমায় কিনে রেখেছে? আমার নিজের কোনওই স্বাধীনতা নেই? বললাম, দুজন বন্ধুর মধ্যে কী কথা হচ্ছিল, সেটা জানার জন্য তোমার এত কৌতূহল কেন বুঝতে পারছি না।
হামবোল্ট চাপা অথচ কৰ্কশ গলায় বলল, কৌতূহল হচ্ছে এই কারণেই যে আমার ল্যাবরেটরিতে যেটা ঘটছে, সেটা সম্বন্ধে কোনও মিথ্যে খবর বাইরে প্রচার হয় সেটা আমি চাই না।
মিথ্যে খবর বলতে তুমি কী বোঝা?
হামবোল্ট এতক্ষণ চেয়ারে বসেছিল। এবার সে চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার দিকে এগিয়ে এসে, আমার মুখের সামনে মুখ এনে সাপের মতো ফিসফিসে গলায় বলল, পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের হাতে প্রথম প্ৰাণ সৃষ্টির সমস্ত কৃতিত্ব হল কর্নেলিয়াস হামবোল্টের। এ কথাটা যেন মনে থাকে।
বুঝতে পারলাম, সামারভিলকে ফোনটা আর করা হবে না। মুখে কিছু বললাম না, যদিও লোকটাকে চিনতে আর বাকি ছিল না। কিন্তু একবার যখন বেরোব বলেছি, তখন বেরোলাম। গেট থেকে বেরিয়ে এসে বাঁ দিকের রাস্তায় শহরের দিকে না গিয়ে ডান দিকের রাস্তাটা ধরে পাহাড়ের উপর দিকটায় চললাম। এ রাস্তাটা দিয়ে প্রথম দিনই বেড়িয়ে এসেছিলাম। কিছু দূর গেলেই একটা সুন্দর নিরিবিলি বার্চের বন পড়ে। সেখানে একটা বেঞ্চিতে বসলে দুহাজার ফুট নীচে কনস্ট্যানস লেক দেখা যায়।
বার্চ বনে পৌঁছে বেঞ্চিটা খুঁজে বার করে বসতে যাব, এমন সময় কনের পাশ দিয়ে তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ করে কী যেন একটা জিনিস তিরবেগে বেরিয়ে গিয়ে আমার তিন হাত দূরে একটা বার্চ গাছের গুড়িতে গিয়ে বিঁধে গেল।
সেই মুহুর্তেই পিছন ফিরে দেখতে পেলাম একটা ব্ৰাউন কোট পরা লোক প্রায় একশো গজ দূরে এক দৌড়ে একটা ঝোপের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি প্রায় কোনও অবস্থাতেই নাভসি হই না। এখনও হলাম না। বেঞ্চি ছেড়ে গাছটার দিকে গিয়ে তার গায়ে টাটকা নিখুঁত গর্তটা পরীক্ষা করে দেখলাম। যদিও কোনও বন্দুকের আওয়াজ আমি পাইনি, এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে, গর্তটা হয়েছে গুলি লাগার ফলেই। অস্ত্রটিও যে মোক্ষম—সেটা বুঝতে বাকি রইল না, কারণ গুলি গুড়ির একদিক দিয়ে ঢুকে বেমালুম অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে।
আমি আর অপেক্ষা না করে ধীর পদক্ষেপে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
হামবোল্টের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেই দেখতে পেলাম চাকর ম্যাক্সকে। তার গায়ে একটা ব্ৰাউন চামড়ার জ্যাকেট। ম্যাক্স আমাকে দেখে যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে গেট দিয়ে বেরিয়ে শহরের দিকে চলে গেল।
বাড়িতে ঢুকে বৈঠকখানার দিকে যেতেই দেখলাম হামবোল্ট দুজন অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে বসে কথা বলছেন। আমাকে দেখে নির্বিকারভাবে তিনি ডাক দিলেন—কাম ইন, প্রোফেসর শঙ্কু।
আমি নির্বিকারভাবেই বৈঠকখানায় গিয়ে ঢুকলাম। আগন্তুক দুটি উঠে দাঁড়ালেন। একজন ছোকরা, অন্যটি মাঝবয়সি। তাদের হাতে খাতা-পেনসিল দেখে আন্দাজ করলাম তারা খবরের কাগজের রিপোর্টার। হামবোল্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মাঝখানে আমি এসে পড়েছি। হামবোল্ট আমার পরিচয় দিলেন, এবং যেভাবে দিলেন, তাতে বুঝলাম যে লোকটার ধৃষ্টতা একেবারে চরমে পৌঁছে গেছে।
ইনিই হচ্ছেন আমার ভারতীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট, যার কথা আপনাদের বলছিলাম।
আমি করমর্দন করে একটা ভদ্রতাসূচক মৃদু হাসি হেসে এক্সকিউজ মি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা ল্যাবরেটরিতে চলে গেলাম।
টেবিলের কাছে পৌঁছে ফ্লাস্কের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।
বরফ আর নেই। তার জায়গায় এখন রয়েছে একটা সবুজ বন, আর সেই বনে ঘোরাফেরা করছে আর একটি নতুন প্রাণী, যার নাম বানর। যাকে বলা হয় প্রাইমেট। যিনি হলেন মানুষের পূর্বপুরুষ।
কথাটা মনে হতেই বুকের ভিতরটা কী রকম যেন করে উঠল।
এর পরেই কি তা হলে মানুষের দেখা পাব ফ্লাস্কের মধ্যে? ক্রমবিবর্তনের নিয়ম যেভাবে মেনে চলেছে আমাদের প্রাণী, তাতে তো মনে হয় বানরের পরে মানুষের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী। হামবোল্ট কি দেখেছে ফ্লাস্কের এই বানরকে?
তারপরেই মনে হল, আজকে বার্চ বনে আমাকে লক্ষ্য করে মারা নিঃশব্দ বন্দুকের কথা। হামবোল্ট চাইছে না। আমি বেঁচে থাকি। ম্যাক্সের কাছে অস্ত্ৰ আছে। প্ৰভুভক্ত ম্যাক্স একবার ব্যর্থ হয়েছে বলে দ্বিতীয়বারও হবে এমন কোনও কথা নেই।
শয়তানির বিরুদ্ধে শয়তানি প্রয়োগ করা ছাড়া হামবোল্ট আমার জন্য আর কোনও রাস্তা রাখছে না।
আমি দোতলায় আমার ঘরে চলে গেলাম। আমার অমনিস্কোপটা বার করে চোখে লাগিয়ে জানালার ধারে চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। আমার এই চশমাটাকে ইচ্ছামতো মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ অথবা এক্সরেস্কোপ হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
আমার জানালা থেকে বাড়ির সামনের গোটটা দেখা যায়।
পৌনে দশটার সময় ম্যাক্স বাড়ি ফিরল। তার হাতে বাজার থেকে কিনে আনা জিনিসপত্র।
পাঁচ মিনিট পরে আমি কলিং বেল টিপলাম। এক মিনিটের মধ্যে ম্যাক্স ঘরে এসে হাজির।
আমাকে এক কাপ কফি এনে দিতে পারবে? বললাম ম্যাক্সকে।
যে আজ্ঞে বলে ম্যাক্স ঘাড়টাকে সামান্য নুইয়ে কফি আনতে চলে গেল। আমার চোখে এক্স-রে চশমা। সে চশমা ম্যাক্সের চামড়ার কোট ভেদ করে আমাকে দেখিয়ে দিল তার ভেস্ট পকেটে রাখা লোহার পিস্তলটিা।
কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাক্স কফি সমেত হাজির। ট্রে-টা টেবিলে নামিয়ে রাখার পর আমি তাকে বললাম, ম্যাক্স, আলমারির চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না; তোমার কোর্টের বাঁ পকেটে যে চাবির গোছোটা আছে, তার মধ্যে কোনওটা ওতে লাগবে কি?
ম্যাক্সের মুখ হাঁ হয়ে গেল, এবং সেই হাঁ অবস্থাতেই সে একদৃষ্টি আমার দিকে চেয়ে রইল। হেসে বললাম, আমি ইন্ডিয়ার লোক, জানি তো? আমাদের অনেকের মধ্যেই নানারকম অস্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে। তুমি অবাক হচ্ছি। কেন?
ম্যাক্স তোতলাতে শুরু করল। আপনি আ-মারি প-পকেটে কী আছে…
আরও জানি। শুধু তোমার বাঁ পকেটে কেন—ডান পকেটে খুচুরো পয়সাগুলোকে দেখতে পাচ্ছি, আর ভেতরের ভেস্ট পকেটে পিস্তলাটা-যেটা দিয়ে তুমি আমায় খুন করতে গিয়েছিলে। ভারী অন্যায় করেছিলে তুমি। দেখলে তো আমাকে মারা অত সহজ নয়। এখন কত দেবতার কত অভিশাপ পড়বে তোমার উপর, সেটা ভেবে দেখেছি?
ম্যাক্স দেখি ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। এই শীতের মধ্যেও তার কপালে ঘাম ছুটিছে। মনে মনে আমার হাসি পেলেও বাইরে একটা কঠোর গভীৰ্য অবলম্বন করে বসে রইলাম।
ম্যাক্স হঠাৎ ধাপ করে হাঁটু গেড়ে কাঠের মেঝের উপর বসে পড়ল। তারপর তার কম্পমান ডান হাত জ্যাকেটের ভিতর থেকে পিস্তলটি বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদের সুরে বলল, দোহাই আপনার-এর জন্যে আমাকে দায়ী করবেন না। আমি শুধুমানবের হুকুম পালন করেছি। না করলে নিস্তার পাব না, তাই করেছি। আমার অপরাধ নেবেন না-দোহাই আপনার! আমার মনিবকে আপনি চেনেন না। উনি বড় সাংঘাতিক লোক। আমি এ চাকরি থেকে রেহাই পেলে বাঁচি.
আমি পিস্তলটি ম্যাক্সের হাত থেকে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলাম। সেটা যে হামবোল্টেরই তৈরি, সেটা বুঝতে পারলাম। বললাম, এর গুলি নেই তোমার কাছে?
আজেজ্ঞ না। একটি মাত্র ছিল, সেটা আজ সকালে খরচ করে ফেলেছি। গুলি তো আমার মনিব নিজেই তৈরি করেন।
বললাম, তোমার মনিব আবার তোমার কাছে পিস্তল ফেরত চাইবেন না তো?
মনে হয় না। ওটা আমার কাছেই থাকে। আমি শুধু ওঁর চাকর নই। ওঁর দেহরক্ষীর কাজও আমাকে করতে হয়।
ম্যাক্স চলে গেল। আমিও হাঁপ ছেড়ে চোখ থেকে অমনিস্কোপটা খুলে পকেটে রেখে কফিতে চুমুক দিলাম। মনে মনে স্থির করলাম, এখন আর ঘর থেকে বেরোব না। হামবোল্টের মুখ দেখতেও ইচ্ছে করছিল না। সেও এখন আর আমার ঘরে আসবে না বলেই আমার বিশ্বাস। দেখা হবে সেই একেবারে লাঞ্চের সময়।
১৯শে মার্চ
গত দুদিনের ঘটনা এত বিচিত্র, এত বিস্ময়কর ও এত আতঙ্কজনক যে সবটুকু গুছিয়ে লেখা আমার মতো অ-সাহিত্যিকের পক্ষে একটা দুরূহ কাজ। ভাগ্যে সামারভিল এসে পড়েছে। একজন সহৃদয় সমঝদার বন্ধুকে কাছে পেয়ে তবু মনে একটু বল পাচ্ছি। ভাবছি, ফেরার পথে সাসেক্সে ওর কাস্ট্রি হাউসে কিছুদিন কাটিয়ে যাব। ওরাও তাই ইচ্ছে। সত্যি বলতে কী, বিষাক্ত গ্যাসের ফলে শরীরটাও একটু কাবু হয়েছে। সরাসরি দেশে না ফেরাই ऊळल!
পরশু—অর্থাৎ ১৭ই-লাঞ্চের সময় হামবোল্টের সঙ্গে দেখা হল। খেতে বসে লক্ষ করলাম, লোকটার মেজাজটা বেশ খোশ বলে মনে হচ্ছে। তার ফলে খাওয়ার পরিমাণ আর তৃপ্তিটাও যেন বেশ বেড়ে গেছে। তার কথা শুনে বুঝলাম যে, সে ভী ভেল্ট সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের শুধু তার সফল পরীক্ষার কথাই বলেনি, তাদের ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে প্রাণীর-অৰ্থাৎ মানুষের পূর্বপুরুষের—চেহারাটাও দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। কাগজে নাকি খুব ফলাও করে হামবোল্টের কৃতিত্বের কথা লেখা হবে।
আমার পকেটে হামবোল্টের তৈরি মারণাস্ত্র; চাকর ম্যাক্স মনিবপক্ষ ছেড়ে আমার দিকে চলে এসেছে। কাজেই আমারও খাওয়ার কোনও কমতি হল না।
অন্য সব পদ শেষ করে যখন আপেলের কাস্টার্ড খাচ্ছি, তখন হামবোল্ট হঠাৎ বলল, তুমি কবে দেশে ফেরার কথা ভাবিছ?
বুঝলাম, আমার সান্নিধ্য আর হামবোল্টের পছন্দ হচ্ছে না। বললাম, প্রাণীটার চরম পরিণতি সম্পর্কে একটা স্বাভাবিক কৌতূহল আছে বুঝতেই পারছি। সেটা দেখেই ফিরে যাব।
আই সি…
এর পরে আর হামবোল্ট কোনও কথা বলেনি।
বিকেলে বার্চ বনে আর একটু বেড়িয়ে এসে সন্ধ্যা ছটা নাগাদ আবার ল্যাবরেটরিতে হাজির হলাম। গিয়ে দেখি, হামবোল্ট কাঠের চেয়ারটায় চুপটি করে বসে একদৃষ্টি ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ থেকেই আকাশে মেঘ জন্মছিল। এবারে দেখলাম, জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।
ফ্লাস্কের ভিতরে এখনও আদিম বনে আদিম বানর ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরিবর্তন কোন সময় হবে, বা আদৌ হবে কি না, সেটা জানার কোনও উপায় নেই। ঘরের কোণে একটা গোল টেবিলের উপর থেকে একটা ফরাসি পত্রিকা তুলে নিয়ে সোফায় বসে পাতা উলটোতে লাগলাম।
বৈঠকখানার ঘড়িতে ঢং ঢেং করে সাতটা বাজার আওয়াজ পেলাম। বাইরে অন্ধকার। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুরু হয়েছে। নেপোলিয়নটা একবার গভীর গলায় ডেকে উঠল।
বসে থাকতে থাকতে বোধ হয় সামান্য তন্দ্ৰা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ একটা বিশ্ৰী শব্দে একেবারে সজাগ হয়ে উঠলাম।
হাম্বোল্ট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফ্লাস্কের দিকে ঝুঁকে পড়েছে—তার বিস্ফারিত, ঠোঁট দুটো ফাঁক। আওয়াজটা তারই মুখ দিয়ে বেরিয়েছে সেটাও বুঝতে পারলাম।
আমি সোফা ছেড়ে উঠে ফ্লাস্কটার দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি তার ভিতরে এখন সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য, নতুন পরিবেশ। বন নেই, মাটি নেই, গাছপালা নেই, কিছু নেই। তার বদলে আছে একটা মসৃণ সমতল মেঝে, তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে একটি এক ইঞ্চি লম্বা প্ৰাণী।
এই প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে বানর থেকে। অর্থাৎ এই প্রাণী হল মানুষ। কী রকম চেহারা ফ্লাস্কের এই মানুষটির?
হামবোল্টের কম্পমান হাত থেকে মাইক্র্যোম্যাগনাস্কোপটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। আমি সেটাকে নিয়ে চোখে লাগাতেই প্রাণীর চেহারাটা আমার কাছে স্পষ্ট হল।
মানুষটি বয়সে বৃদ্ধ। পরনে কোট-প্যান্ট, মাথায় চুল নেই বললেই চলে, তবে দাড়ি-গোঁফ আছে, আর চোখে এক জোড়া সোনার চশমা। প্রশস্ত ললাট, চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সঙ্গে মেশানো একটা শান্ত সংযত ভাব।
এ লোকটাকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি। আয়নায়। ইনি হলেন স্বয়ং ত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কুর একটি অতি-সংক্ষিপ্ত সংস্করণ।
অর্থাৎ—আমার তৈরি মানুষ দেখতে ঠিক আমারই মতন।
দেখা শেষ করে মাইক্রোম্যাগনাস্কোপটা টেবিলের উপর রেখে দেওয়া মাত্র খেয়াল হল যে, হামবোল্ট আর আমার পাশে নেই। সে হঠাৎ কোথায় যেতে পারে ভাবতে না ভাবতেই দুম দুম করে দুটো প্রচণ্ড শব্দে ল্যাবরেটরির দুটো দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেল। আর তারপরেই জানোলা দুটো। বুঝলাম যে আমি বন্দি হয়ে গেলাম।
হামবোল্টের কী মতলব জানি না। পরীক্ষার সাফল্যের জন্য যে আমিই দায়ী তার এমন জলজ্যান্ত প্রমাণ পেয়ে নিশ্চয়ই সে একেবারে উদভ্ৰান্ত হয়ে পড়েছে। হয়তো আমাকে হত্যা করার রাস্তা খুঁজছে সে। অস্ত্ৰ সংগ্রহ করে হত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে তবে সে দরজা খুলবে।
কী হবে যখন জানা নেই, তখন ভেবে কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে বরং আমার কয়েদখানার পরিবেশটিা একবার ভাল করে দেখে নিই।
একদিকে টেবিলের উপর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, তারমধ্যে ফ্লাস্ক, তারমধ্যে খুদে-আমি। তার ডান পাশের দেয়ালে দুটো বন্ধ দরজার মাঝখানে একটা বইয়ের আলমারি, তার পরের দেয়ালে দুটো বন্ধ জানালার মাঝখানে একটা রাইটিং ডেস্ক। অন্য দেয়ালটার সামনে সোফা, আর তার পাশে ঘরের কোণে একটা নিচু গোল টেবিল। পালাবার কোনও পথ নেই।
মনে পড়ল আমার সর্বনাশী ব্ৰহ্মাস্ত্র অ্যানাইহিলিন পিস্তলটিা গিরিডিতে রেখে এসেছি। আমার সঙ্গে হামবোল্টের পিস্তলটাি রয়েছে, কিন্তু সেটাও গুলির অভাবে অকেজো। কী আর করি? কাঠের চেয়ারটার উপর বসে। ফ্লাস্কের ভিতরে আশ্চর্য প্রাণীটার দিকে মন দিলাম।
খুদে শঙ্কু কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর দেখলাম হাত দুটোকে পিছনে করে পায়চারি আরম্ভ করল। মনে পড়ল আমিও চিন্তিত হলে ঠিক এইভাবেই পায়চারি করি। দৃশ্যটা আমাকে আবার এমন অবাক করে তুলল যে আমি আমার বিপদের কথা প্রায় ভুলেই গেলাম।
কতক্ষণ এইভাবে তন্ময় হয়ে ফ্লাস্কের দিকে চেয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ খেয়াল হল যে আমার দৃষ্টি কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে। তারপর বুঝতে পারলাম যে সেটার কারণ আর কিছুই না—কোথা থেকে জানি ঘরের মধ্যে একটা বাষ্প জাতীয় কিছু ঢুকছে। একটা তীব্র বিশ্ৰী গন্ধ নাকে এসে প্রবেশ করছে।
চারিদিকে আর একবার ভাল করে দেখে অবশেষে বুঝতে পারলাম, কোথা দিয়ে এই গ্যাসটা আসছে। ল্যাবরেটরির দুষিত বায়ু বাইরে যাবার জন্য একটা চিমনি রয়েছে টেবিলটার পিছন দিকে। সেটা চলে গেছে বাড়ির ছাত অবধি। সেই চিমনির মুখটা দিয়েই এই দুৰ্গন্ধ গ্যাস ঘরে এসে ঢুকছে।
আমি নাকে রুমাল চাপা দিলাম। গ্যাস ক্রমে বাড়ছে। সবুজ ধোঁয়ায় ঘর ক্রমে ছেয়ে যাচ্ছে। আমার চোখে অসহ্য জ্বালা। নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। তার মধ্যেই বুঝতে পারছি এটা সেই সাংঘাতিক কাবোঁডিমন গ্যাস-যাতে মানুষ পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাবি খেয়ে দম আটকিয়ে মরে যায়।
আমি আর চেয়ারে বসে থাকতে পারছিলাম না। উঠে দাঁড়ালাম। রুমালে কোনও কাজ দিচ্ছে না। ঘরের যন্ত্রপাতি টেবিল চেয়ার, এমনকী আমার সামনে ফ্লাস্কটা পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে আসছে। একটা অন্ধকার পরদা নেমে আসছে আমার সামনে। আমি দাঁড়িয়েও থাকতে পারছি না। আমার সামনে টেবিল। আমি টেবিলের ওপরেই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমার বেড়ালের কথা মনে হচ্ছে.প্রহ্লাদ…গিরিডি.আমার বাগান…গোলঞ্চ
কী যেন একটা ঝলসে উঠল আমার চোখের সামনে। এক বিঘাতের মধ্যে। সেই ঝলসানিতে স্পষ্ট দেখলাম ফ্লাস্কটা। তাতে আর খুদে-শঙ্কু নেই। তার জায়গায় পর পর তিনবার বৈদ্যুতিক স্পার্ক খেলে গেল। বুঝলাম আমি আমার দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছি, শরীরে বল পাচ্ছি, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি। ঘরের ভিতর থেকে গ্যাস দূরীভূত হচ্ছে, দুৰ্গন্ধ চলে যাচ্ছে, ধোঁয়াটে ভাবটা ক্রমশ কমে আসছে। আমার অবাক দৃষ্টি এখনও ফ্রাস্কের ভিতর। পরিবেশ বদলে গেছে। সিমেন্টের বদলে এখন একটা স্বচ্ছ কাচ কিংবা প্লাস্টিকের মাঝে যেখানে স্পার্ক হচ্ছিল, সেখানে এখন নতুন প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে।
এমন প্রাণী আমি জীবনে কখনও দেখিনি। লম্বায় দুইঞ্চির বেশি নয়, তার মধ্যে মাথাটাই এক ইঞ্চি। শরীরে রামধনু রঙের পোশাকটা পা থেকে গলা অবধি গায়ের সঙ্গে সাঁটা। নাক কান ঠোঁট বলতে কিছুই নেই। চোখ দুটো জ্বলন্ত অথচ স্নিগ্ধ আগুনের ভাঁটা। মাথা জোড়া মসৃণ সোনালি টাক। হাত দুটো কনুইয়ের কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। তাতে আঙুল আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
আমি আরও এগিয়ে গিয়ে ভাল করে প্রাণীটাকে দেখব, এমন সময় ঘরের একটা দরজা খুলে গেল।
হামবোল্ট, আর তার পিছনে তার গ্রেট ডেন হাউন্ড নেপোলিয়ন।
হামবোল্ট আমাকে দেখেই একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বোঝাই গেল, সে আমাকে জ্যান্ত দেখতে পাবে সেটা আশাই করেনি।
গ্যাস? গ্যাস কী হল? সে বোকার মতো বলে উঠল।
আমি বললাম, আপনা থেকেই উবে গেছে।
সুঃ নেপোলিয়ন।
হামবোল্ট এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ওর। ওই বিশাল কুকুরটা একটা হিংস্র গর্জন করে দাঁত খিঁচিয়ে একটা লম্ফ দিল আমাকে লক্ষ্য করে।
কিন্তু আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছাল না। শূন্যে থাকা অবস্থাতেই একটা তীব্র রশ্মি এসে তার গায়ে লেগে তাকে তৎক্ষণাৎ ধরাশায়ী করে দিল। রশ্মিটা এসেছে ফ্লাস্কের ভিতর থেকে।
এবার হামবোল্ট নেপোলিয়ান বলে একটা চিৎকার দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে কুকুরটার দিকে একবার দেখে টেবিলের উপর থেকে একটা মারাত্মক অ্যাসিডের বোতল তুলে নিয়ে সেটা আমার দিকে উঁচিয়ে তুলতেই তারও তার কুকুরের দশাই হল। ফ্লাস্কের ভিতর সদ্যোজাত অদ্ভুত প্রাণীটা ওই বিরাট জামান বৈজ্ঞানিককেও তার আশ্চর্য রশ্মির সাহায্যে নিমেষে ঘায়েল করল।
হামবোল্ট এখন তার পোষা কুকুরের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পরীক্ষা করে দেখলাম, দুজনের একজনও মরেনি, কেবল সম্পূর্ণভাবে অচেতন।
এই ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সামারভিল এসে হাজির। সব শুনেটুনে সে বলল, হাম্বোল্ট প্রায় বছর দশেক উন্মাদ অবস্থায় গারদে কাটিয়েছিল, তারপর ভাল হয়ে ছাড়া পায় কিন্তু সেই সময় থেকেই বৈজ্ঞানিক মহলে তার সমাদর কমে যায়। গত কয়েক বছর ধরে যেখানে সেখানে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে সে আমন্ত্রিত না হয়েও গিয়ে হাজির হয়েছে। পাছে আবার পাগলামিগুলো দেখা দেয়, তাই ওকে আর কেউ ঘটায় না। তুমি ব্যাপারটা জানতে না শুনে আমার আশ্চর্য লাগছে। সেদিনই তোমাকে টেলিফোনে সাবধান করে দিতাম, কিন্তু লাইনটা কেটে গেল। তাই ভাবলাম, নিজেই চলে আসি।
দোতলায় আমার ঘরে বসে কফি খেতে খেতে এই সব কথা হচ্ছিল। হামবোল্ট ও তার কুকুরকে তাদের উপযুক্ত দুটি আলাদা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাদের শক লেগেছে মস্তিষ্কে। কতদিনে সারবে বলা যায় না।
সামারভিল এসেই ফ্লাস্কের আশ্চর্য প্রাণীটাকে দেখেছিল। দুজনেই বুঝেছিলাম যে, এটাই হল মানুষের পরের অবস্থা; যদিও কত হাজার বা কত লক্ষ বছর পরে মানুষ এ চেহারা নেবে সেটা জানার উপায় নেই।
কফি খাওয়া শেষ করে আমরা দুজনেই স্থির করলাম যে খুদে-সুপারম্যান বা অতি-মানুষটি কী অবস্থায় আছে একবার দেখে আসা যাক। ল্যাবরেটরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই আবার একটা অপ্রত্যাশিত অবাক দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল।
সমস্ত ফ্লাস্কের ভিতরটা এখন একটা লালচে আভায় ভরে আছে। সূৰ্য্যস্তের পর মাঝে মাঝে আকাশটা যে রকম একটা বিষগ্ন আলোয় ভরে যায়, এ যেন সেই আলো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মেঝের বদলে এখন দেখতে পেলাম বালি, আর সেই বালির উপর একটা চ্যাপটা আঙুরের মতো জিনিস নিজীবিভাবে পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে দেখলাম, তার মধ্যে একটা মৃদু স্পন্দনের আভাস লক্ষ করা যাচ্ছে।
এটাও কি প্রাণী? এটাও কি মানুষের আরও পরের একটা অবস্থা? যে অবস্থায় মানুষের উত্তরপুরুষ একটা মাংসপিণ্ডের মতো মাটিতে পড়ে থাকবে, তার হাত থাকবে না পা থাকবে না, চলবার, কাজ করবার, চিন্তা করবার শক্তি থাকবে না, কেবল দুটি প্রকাণ্ড চোখ দিয়ে সে পৃথিবীর শেষ অবস্থাটা ক্লান্তভাবে চেয়ে চেয়ে দেখবে?
সামারভিল বলল, এ দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি না শঙ্কু। একটা কিছু করো।
কিন্তু কিছু করতে আর হল না। আমরা দেখতে দেখতেই চোখের সামনে একটা ক্ষীণ বাঁশির মতো শব্দের সঙ্গে সেই আলো, সেই বালি আর সেই মাংসপিণ্ড, সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে ক্রমবিবর্তনের শেষ পর্ব শেষ হয়ে পড়ে রইল। শুধু একটি কাচের ফ্লাস্ক আর তার সামনে দাঁড়ানো দুটি হতভম্ব বৈজ্ঞানিক!
সন্দেশ। শারদীয়া ১৩৭৮
ইনটেলেকট্রন (প্রোফেসর শঙ্কু)
এপ্রিল ৩
অনেকদিন পরে একটা নতুন জিনিস তৈরি করলাম। একটা যন্ত্র, যাতে মানুষের বুদ্ধি মাপা যায়। বুদ্ধি বলতে অবশ্য অনেক কিছুই বোঝায়। জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, সাধারণ বুদ্ধি বা কমনসেনসী, ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ইত্যাদি সবই এরমধ্যে পড়ে। আমার অন্যান্য যন্ত্রের মতো এটাও খুবই সরল। যার বুদ্ধির পরিমাপ হবে তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে মাথার দুপাশে হেডফোনের মতো দুটো ইলেকট্রেড লাগিয়ে দিতে হয়। সেই ইলেকট্রোডের তার একটা বাক্স জাতীয় জিনিসের গায়ে লাগানো হয়। সেই বাক্সের সামনেট কাচে ঢাকা, সেই কাচের পিছনে দাগ কাটা আছে একশো থেকে এক হাজার পর্যন্ত। যন্ত্রটা মস্তিষ্কের সঙ্গে লাগিয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেই একটা কাঁটা একটা বিশেষ নম্বরে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই নম্বরটাই হল বুদ্ধির পরিমাপ। রীতিমতো বুদ্ধিমান লোকেদের সাতশো থেকে হাজারের মধ্যে নম্বর ওঠা উচিত, পাঁচশো থেকে সাতশো হল চলনসই বুদ্ধি, আর পাঁচশোর নীচে হলে আর সে লোককে বুদ্ধিমান বলা চলে না। আমি যন্ত্রটা স্বভাবতই প্রথমে নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখি। নম্বর উঠল ৯১৭। তারপর বিকেলের দিকে অবিনাশবাবু এলেন। তাঁকে চেয়ারে বসিয়ে ইলেকট্রোড লাগিয়ে বোতাম টিপতে নম্বর উঠল ৩৭৭। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ওতে কী হিসেব পেলেন? বললাম, আপনার বুদ্ধির হিসেব।
কেমন বুঝলেন?
মোটামুটি যেমন ভেবেছিলাম তেমনই।
তার মানে বোকা?
না না, বোকা হতে যাবেন কেন? আপনার বইপড়া পাণ্ডিত্য যে নেই, সেটা নিশ্চয়ই আপনিও স্বীকার করবেন। তবে আপনার সাধারণ বুদ্ধি মোটামুটি আছে। আর সবচেয়ে যেটা বড় কথা, সেটা হল আপনি সৎ লোক। সেটা কম গুণ নয়।
এই সৎ লোকের হিসেবগুলি ওই যন্ত্রে পাওয়া যাচ্ছে?
না। ওটা আমার সঙ্গে আপনার বিশ বছর পরিচয়ের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
যন্ত্রটার নাম দিয়েছি ইনটেলেকট্রন। জুন মাসে হামবুর্গে আবিষ্কারক সম্মেলন বা ইনভেনটরস কনফারেন্স আছে, তাতে যন্ত্রটা নিয়ে যাব। তরে মুশকিল হবে এই যে অনেকেই নিজের বুদ্ধির পরিমাপ জানতে দ্বিধা করবে। একেবারে অঙ্কের সাহায্যে বুঝিয়ে দেওয়া কার কতটা বুদ্ধি আছে, এটা সকলে খুব ভাল চোখে দেখবে না। আর আমার যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করে কি না সেই নিয়েও অনেকে নিশ্চয়ই সন্দেহ প্ৰকাশ করবে। কিন্তু আমি জানি, এ যস্ত্রে কোনও ভুল নেই। আমার সব আবিষ্কারই এ পর্যন্ত ঠিকমতো কাজ করে এসেছে; এটাও না করার কোনও কারণ নেই।
বিকেলে হঠাৎ নকুড়বাবু-নকুড়চন্দ্ৰ বিশ্বাস—এসে হাজির। ভদ্রলোকের সঙ্গ আমার বেশ ভালই লাগে। আর মাঝে মাঝে সব অলৌকিক ক্ষমতার প্রকাশ এখনও বিস্ময়ের উদ্রেক করে। যেমন বসবার ঘরের সোফাতে বসেই বললেন, আপনি তো জুন মাসে আবার বাইরে চললেন।
তা যাচ্ছি বটে, আপনার গণনায় ভুল নেই।
এবার কিন্তু আমাকেও সঙ্গে নিতে হবে।
কেন বলুন তো?
না হলে আপনার বিপদ আছে।
ভদ্রলোকের কথায় কখনও ভুল হতে দেখিনি, তাই চিন্তায় পড়ে গেলাম। অবিশ্যি ওঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে আমার আপত্তি নেই, অসুবিধাও নেই-কারণ কনফারেন্সের তরফ থেকে সেক্রেটারির একটি করে টিকিট পাঠায়। সেটা আমার আর ব্যবহার করা হয় না-কিন্তু এবার নাহয় করব।
আপনার বুদ্ধিনির্ধারণ যন্ত্রটা একবার দেখতে পারি কি?
এই প্রশ্নও ভদ্রলোকের ক্ষমতার একটা পরিচয়, কারণ ওঁকে আমি যন্ত্রটা সম্বন্ধে কিছুই বলিনি। বললাম, নিশ্চয়ই—তবে সেটা আমি না। এনে আপনি সেটার কাছে গেলে আরও সুবিধে হয়।
নকুড়বাবু অবশ্যই রাজি। তাঁকে নিয়ে আমার ল্যাবরেটরিতে গেলাম। যন্ত্রটা নানা দিক থেকে দেখে ভদ্রলোক বললেন, আমি একবার চেয়ারে বসব নাকি?
বসুন না—তবে আপনার অলৌকিক বুদ্ধির পরিমাপ এতে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।
নকুড়বাবু বসলেন। কাঁটা উঠে ৫৫৭-তে থেমে গেল। বললাম, আপনি মোটামুটি বুদ্ধিমানদের দলেই পড়েন।
ভদ্রলোক একপেয়ালা কফি খেয়ে উঠে পড়লেন।
আমার ঠিকানা তো আপনার জানাই আছে। হামবুর্গ যাবার আগে খবরটা দেবেন। আমি সঙ্গে গেলে আপনার মঙ্গল হবে।
–১৯৮৯
==================
উপরে মুদ্রিত অসমাপ্ত গল্পের নামকরণ বাবা করেছিলেন–ইনটেলেকট্রন। একটি বাঁধানো রুলটানা কাগজের খাতায় (১১ ইঞ্চি x ৮.৫ ইঞ্চি) খসড়াটি পাওয়া গেছে। এটি সম্ভবত ১৯৮৯-এর জুন মাসে লেখা। ওই একই মাসে তিনি শেষ করেছিলেন ডাক্তার নন্দীর (মুন্সীর) ডায়রি ও
গোলাপি মুক্ত রহস্য। ইনটেলেকট্রন পরে সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি।
–সন্দীপ রায়
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী, ১৩৯৯
একশৃঙ্গ অভিযান (প্রোফেসর শঙ্কু)
১লা জুলাই
আশ্চর্য খবর। তিব্বত পর্যটক চার্লস উইলার্ডের একটা ডায়রি পাওয়া গেছে। মাত্ৰ এক বছর আগে এই ইংরাজ পৰ্যটক তিব্বত থেকে ফেরার পথে সেখানকার কোনও অঞ্চলে খামাপা শ্রেণীর এক দস্যুদলের হাতে পড়ে। দস্যুরা তার অধিকাংশ জিনিস লুট করে নিয়ে তাকে জখম করে রেখে চলে যায়। উইলার্ড কোনও রকমে প্রায় আধমরা অবস্থায় ভারতবর্ষের আলমোড়া শহরে এসে পৌঁছায়। সেইখানেই তার মৃত্যু হয়। এসব খবর আমি খবরের কাগজেই পড়েছিলাম। আজ লন্ডন থেকে আমার বন্ধু ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্সের একটা চিঠিতে জানলাম যে উইলার্ডের মৃত্যুর পর তার সামান্য জিনিসপত্রের মধ্যে একটা ডায়রি পাওয়া যায়, এবং সেটা এখন সন্ডার্সের হাতে। তাতে নাকি এক আশ্চৰ্য ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমার তিব্বত সম্বন্ধে প্ৰচণ্ড কৌতূহল, আর আমি তিব্বতি ভাষা জানি জেনে সন্ডার্স আমাকে চিঠিটা লিখেছে। সেটার একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি।
…উইলার্ড আমার অনেক দিনের বন্ধু ছিল সেটা তুমি জানা কি না জানি না। তার বিধবা স্ত্রী এডউইনার সঙ্গে পরশু দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে বলল আলমোড়া থেকে তার মৃত স্বামীর যেসব জিনিস পাঠানো হয়েছিল তার মধ্যে একটা ডায়রি রয়েছে। সে ডায়রি। আমি তার কাছ থেকে চেয়ে আনি। দুঃখের বিষয় ডায়রির অনেক লেখাই জল লেগে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাই পড়া মুশকিল। কিন্তু তার শেষ পৃষ্ঠার কয়েকটা লাইন পড়তে কোনও অসুবিধা হয়নি। ১৯শে মার্চের একটা ঘটনা তাতে লেখা রয়েছে। শুধু দুটি লাইন—আই সি এ হার্ড অফ ইউনিকর্নস টু ডে। আই রাইট দিস ইন ফুল পোজেশন অফ মাই সেনসেস। তার পরেই একটা প্রচণ্ড ঝড়ের ইঙ্গিত পেয়ে উইলার্ড ডায়রি লেখা বন্ধ করে। তার এই অদ্ভুত উক্তি সম্বন্ধে তোমার কী মত জানতে ইচ্ছে করে—ইত্যাদি।
উইলার্ড একপাল ইউনিকর্ন দেখেছে বলে লিখেছে। আর তার পরেই বলছে সেটা সে সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে দেখেছে। এটা বলার দরকার ছিল এই জন্যেই যে ইউনিকর্ন নামক প্ৰাণীটিকে আবহমানকাল থেকেই সারা বিশ্বের লোকে কাল্পনিক প্রাণী বলেই জানে। একশৃঙ্গ জানোয়ার। কপাল থেকে বেরোনো লম্বা প্যাঁচানো শিং বিশিষ্ট ঘোড়া। ইউনিকর্নের চেহারা বিলাতি আকা ছবিতে যা দেখা যায় তা হল এই। যেমন চিনের ড্রাগন কাল্পনিক, তেমনি ইউনিকর্নও কাল্পনিক।
কিন্তু এই কাল্পনিক কথাটা লিখতে গিয়েও আমার মনে খটকা লাগছে। আমার সামনে টেবিলের উপর একটা বই খোলা রয়েছে, সেটা মহেঞ্জোদাড়ো সম্পর্কে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই মহেঞ্জোদাড়োর মাটি খুঁড়ে আজ থেকে চার হাজার বছর আগেকার এক আশ্চর্য ভারতীয় সভ্যতার যে সব নমুনা পেয়েছিলেন তারমধ্যে ঘর বাড়ি রাস্তা ঘাট হাঁড়ি কলসি খেলনা ইত্যাদি ছাড়াও এক জাতের জিনিস ছিল, যেগুলো হচ্ছে মাটির আর হাতির দাঁতের তৈরি চারকোনা সিল। এই সব সিলে খোদাই করা হাতি বাঘ ষাঁড় গাণ্ডার ইত্যাদি আমাদের চেনা জানোয়ার ছাড়াও একরকম জানোয়ার দেখা যায়, যার শরীরটা অনেকটা বলদের মতো, কিন্তু মাথায় রয়েছে একটিমাত্র পাকানো শিং। এটাকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাল্পনিক জানোয়ার বলেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু এতগুলো আসল জানোয়ারের পাশে হঠাৎ একটা আজগুবি জানোয়ার কেন খোদাই করা হবে সেটা আমি বুঝতে পারি না।
এ জানোয়ার যে কাল্পনিক নয় সেটা ভাবার আরেকটা কারণ হচ্ছে যে দুহাজার বছর আগের রোমান পণ্ডিত প্লিনি তাঁর বিখ্যাত জীবতত্ত্বের বইয়েতে স্পষ্ট বলে গেছেন যে, ভারতবর্ষে একরকম গোরু আর একরকম গাধা পাওয়া যায় যাদের মাথায় মাত্র একটা শিং। গ্রিক মনীষী অ্যারিস্টটলও ভারতবর্ষে ইউনিকর্ন আছে বলে লিখে গেছেন। এ থেকে কি এমন ভাবা অন্যায় হবে যে, এককালে এদেশে এক ধরনের একশৃঙ্গ জানোয়ার ছিল যেটা এখান থেকে লোপ পেলেও, হয়তো তিব্বতের কোনও অজ্ঞাত অঞ্চলে রয়ে গেছে, আর উইলার্ড ঘটনাচক্ৰে সেই অঞ্চলে গিয়ে পড়ে এই জানোয়ার দেখতে পেয়েছেন? এ কথা ঠিক যে গত দুশো বছরে অনেক বিদেশি পর্যটকই তিব্বত গিয়ে তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছেন, এবং কেউই ইউনিকর্নের কথা লেখেননি। কিন্তু তাতে কী প্ৰমাণ হল? তিব্বতে এখনও অনেক জায়গা আছে যেখানে মানুষের পা পড়েনি। সুতরাং সে দেশের কোথায় যে কী আছে তা কি কেউ সঠিক বলতে পারে?
সন্ডার্সকে আমার এই কথাগুলো লিখে জানাব। দেখি ও কী বলে।
১৫ই জুলাই
আমার চিঠির উত্তরে লেখা সন্ডার্সের চিঠিটা তুলে দিচ্ছি—
প্রিয় শঙ্কু, তোমার চিঠি পেলাম। উইলার্ডের ডায়রির শেষ দিকের খানিকটা অংশ পড়তে পেরে আরও বিস্মিত হয়েছি। ১৬ই মার্চ সে লিখছে, টুডে আই ফু উইথ দ্য টু হান্ড্রেড ইয়ার ওল্ড লামা। ফ্লু মানে কি এরোপ্লেনে ওড়া? মনে তো হয় না। তিব্বতে রেলগাড়িই নেই, এরোপ্লেন যাবে কী করে। কিন্তু তা হলে কি সে কোনও যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই আকাশে ওড়ার কথা বলছে? তাই বা বিশ্বাস করি কী করে? এসব কথা পড়ে উইলার্ডের মাথা ঠিক ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। অথচ, আলমোড়ার যে ডাক্তারটি তাকে শেষ অবস্থায় দেখেছিলেন (মেজর হার্টন)। তাঁর মতে উইলার্ডের মাথায় গণ্ডগোল ছিল না। ১৩ই মার্চের ডায়রিতে থোকচুম গোস্ফা নামে একটা মঠের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। উইলার্ডের মতে-এ ওয়ান্ডারফুল মনাস্ট্রি। নো ইউরোপিয়ান হ্যাজ এভার বিন হিয়ার বিফোর। তুমি কি এই মঠের নাম শুনেছ। কখনও?…যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে-উইলার্ডের এই ডায়রি পড়ে আমার মনে তিব্বত যাবার একটা প্রবল বাসনা জেগেছে। আমার জার্মান বন্ধু উইলহেলম ক্রোলও এ ব্যাপারে উৎসাহী। তাকে অবিশ্যি উড়ন্ত লামার বিবরণই বেশি আকর্ষণ করেছে। জাদুবিদ্যা, উইচক্রাফট ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রোলের মূল্যবান গবেষণা আছে, তুমি হয়তো জান। সে পাহাড়েও চড়তে পারে খুব ভাল। বলা বাহুল্য, আমরা যদি যাই তো তোমাকে সঙ্গী হিসেবে পেলে খুবই ভাল হবে। এ মাসেই রওনা হওয়া যেতে পারে। কী স্থির কর সেটা আমাকে জানিও। শুভেচ্ছা নিও। ইতি
জেরেমি সন্ডার্স
উড়ন্ত লামা! তিব্বতি যোগী মিরারেপার আত্মজীবনী আমি পড়েছি। ইনি তান্ত্রিক জাদুবিদ্যা শিখে এবং যোগসাধনা করে নানারকম আশ্চৰ্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। তারমধ্যে একটা ছিল উড়ে বেড়াবার ক্ষমতা। এই জাতীয় কোনও মহাযোগীর সাহায্যেই কি উইলার্ড আকাশে উড়েছিলেন?
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আমারও মনে প্রচণ্ড কৌতূহল উদ্রেক করেছে। তিব্বত যাইনি; কেবল দেশটা নিয়ে ঘরে বসে পড়াশুনা করেছি, আর তিব্বতি ভাষাটা শিখেছি। ভাবছি সন্ডার্সের দলে আমিও যোগ দেব। এতে ওদের সুবিধাই হবে, কারণ আমার তৈরি এমন সব ওষুধপত্র আছে যার সাহায্যে পার্বত্য অভিযানের শারীরিক গ্লানি অনেকটা কমিয়ে দেওয়া।
২৭শে জুলাই
আজ আমার পড়শি ও বন্ধু অবিনাশবাবুকে তিব্বত অভিযানের কথা বলতে তিনি একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। দু-দুবার আমার সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরে গিয়ে নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতার ফলে ওঁর এই প্রৌঢ় বয়সে ভ্রমণের নেশা চাগিয়ে উঠেছে। তিব্বত জায়গাটা খুব আরামের নয়, এবং অনেক অজানা দুৰ্গম জায়গায় আমাদের যেতে হবে শুনে ভদ্রলোক বললেন, সে হোক গে। শিবের পাহাড়, কৈলাসটা যদি একবার চাক্ষুষ দেখতে পারি তো আমার হিন্দুজন্ম সার্থক। কৈলাস যে তিব্বতে সেটা জানলেও তার পাশের বিখ্যাত হ্রদটির কথা অবিনাশবাবু জানতেন না। বললেন, সে কী মশাই মানস সরোবর তো কাশ্মীরে বলে জানতুম!
একশৃঙ্গ আর উড়ন্ত লামার কথাটা আর অবিনাশবাবুকে বললাম না, কারণ ও দুটো নিয়ে এখনও আমার মনে খটকা রয়ে গেল। খামাপা দস্যুদের কথাটা বলতে ভদ্রলোক বললেন, তাতে ভয়ের কী আছে মশাই? আপনার ওই হনলুলু পিস্তল দিয়ে ওদের সাবাড় করে দেবেন। অ্যানাইহিলিন যে হনলুলু কী করে হল জানি না।
কাঠগোদাম থেকেই যাওয়া স্থির করেছি। আজ সন্ডার্সকে টেলিগ্রামে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি পয়লা কাঠগোদাম পৌঁছাব। জিনিসপত্র বেশি নেওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। অবিনাশবাবুকেও সেটা বলে দিলাম। উনি আবার পাশবালিশ ছাড়া ঘুমোতে পারেন না, তাই ওঁর জন্যে ফু দিয়ে ফোলানো যায় এমন একটা লম্বাটে বালিশ তৈরি করে দেব বলেছি। শীতে পরার জন্য আমারই আবিষ্কৃত শ্যাঙ্কলন প্লাস্টিকের হালকা পোশাক নিচ্ছি, এয়ার কন্ডিশনিং পিল নিচ্ছি, বেশি উচুতে উঠলে যাতে নিশ্বাসের কষ্ট না হয় তার জন্য আমার তৈরি অক্সিমোর পাউডার নিচ্ছি। এ ছাড়া অমনিস্কোপ ক্যামের্যাপিড ইত্যাদি তো নিচ্ছিই। সব মিলিয়ে পাঁচ সেরের বেশি ওজন হবার কথা নয়। পায়ে পরার জন্য পশমের বুট আলমোড়াতেই পাওয়া যাবে।
কদিন হল খুব গুমোট হয়েছে। এইবার ঘোর বর্ষা শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে। হিমালয়ের প্রাচীর পেরিয়ে একবার তিব্বতে পৌঁছাতে পারলে মনসুন আর আমাদের নাগাল পাবে না।
১০ই আগস্ট। গারবেয়াং।
এর মধ্যে ডায়রি লেখার সময় পাইনি। আমরা তেসরা কাঠগোদাম ছেড়ে মোটরে করে আলমোড়া পর্যন্ত এসে, তারপর ঘোড়া করে উত্তরপূর্বগামী পাহাড়ে রাস্তা ধরে প্রায় দেড়শো মাইল অতিক্রম করে কাল সন্ধ্যায় গারবেয়াং এসে পৌঁছেছি।
গারবেয়াং দশ হাজার ফুট উচুতে অবস্থিত একটা ভুটিয়া গ্রাম। আমরা এখনও ভারতবর্ষের মধ্যেই রয়েছি। আমাদের পুবদিকে খাদের নীচ দিয়ে কালী নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে নেপাল রাজ্যের ঘন ঝাউবন দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আরও বিশ মাইল উত্তরে গিয়ে ১৬০০০ ফুট উচুতে একটা গিরিবর্ত পেরিয়ে লিপুধুরা। লিপুধুরা পেরোলেই ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে তিব্বতে প্ৰবেশ।
কৈলাস-মানস সরোবর তিব্বতের সীমানা থেকে মাইল চল্লিশেক। দূরত্বের দিক দিয়ে বেশি নয় মোটেই, কিন্তু দুৰ্গম গিরিপথ, বেয়াড়া শীত, আর তার সঙ্গে আরও পাঁচরকম বিপদ-আপদের কথা কল্পনা করে ভারতবর্ষের শতকরা ৯৯.৯ ভাগ লোকই আর এদিকে আসার নাম করে না। অথচ এই পথটুকু আসতেই আমরা যা দৃশ্যের নমুনা পেয়েছি, এর পরে না জানি কী আছে সেটা ভাবতে এই বয়সেও আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে।
এবার আমাদের দলটার কথা বলি। সন্ডার্স ও ক্রোল ছাড়া আরও একজন বিদেশি আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন। এঁর নাম সেৰ্গেই মার্কোভিচ। জাতে রাশিয়ান, থাকেন পোল্যান্ডে। ইংরিজিটা ভালই বলেন। আমাদের মধ্যে ইনিই অপেক্ষাকৃত কমবয়সি। দোহারা লম্বা চেহারা, ঘোলাটে চোখ, মাথায় একরাশ অবিন্যস্ত তামাটে চুল, ঘন ভুরু, আর ঠোঁটের দুপাশে ঝুলে থাকা লম্বা গোঁফ। এর সঙ্গে আমাদের আলাপ আলমোড়াতেই। ইনিও নাকি তিববত যাচ্ছিলেন, তার একমাত্র কারণ ভ্ৰমণের নেশা, তাই আমরা যাচ্ছি শুনে আমাদের দলে ভিড়ে পড়লেন। এমনিতে হয়তো লোক খারাপ নন, কিন্তু ঠোঁট হাসলেও চোখ হাসে না দেখে মনে হয় তেমন অবস্থায় পড়লে খুনখারাপিতেও পেছ-পা হবেন না। সেই কারণেই বোধ হয় ক্রোলের একে পছন্দ না। ক্রোলের নিজের হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি না। টেকো মাথার দুপাশে সোনালি চুল কানের উপর এসে পড়েছে। বেশ গট্রিাগোঁড়া চেহারা। তবে আদৌ হিংস্ৰ নয়। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সে পাঁচবার ম্যাটারহর্নের চুড়োয় উঠেছে। লোকটা প্রায়ই দেখি ডান হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে কী যেন হিসেব করে। আমরা যেমন কড়ে আঙুল থেকে শুরু করে পাঁচ আঙুলের গাঁটে গাঁটে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গুনতে পারি, ইউরোপের লোকেরা দেখেছি সেটা একেবারেই পারে না। এরা একটা আঙুলে এক গোনে। গাঁটের ব্যবহারটা বোধ হয়। ভারতীয়।
সন্ডার্স আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সুগঠিত। সুপুরুষ চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা নীল চোখ, প্রশস্ত ললাট। সে এই কদিনে তিববত সম্বন্ধে খানদশেক বই পড়ে অভিযানের জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। যোগবল বা ম্যাজিকে তার বিশ্বাস নেই। এসব বই পড়েও সে বিশ্বাস জাগেনি, এবং এই নিয়ে ক্রোলের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে তর্কবিতর্কও হচ্ছে।
এই তিনজন ছাড়া অবিশ্যি রয়েছেন আমার প্রতিবেশী তীর্থযাত্রী শ্ৰীঅবিনাশচন্দ্র মজুমদার, যিনি আপাতত আমাদের থেকে বিশ হাত দূরে খাদের পাশে একটা পাথরের খণ্ডে বসে হাতে তামার পাত্রে তিব্বতি চা নিয়ে কাছেই খুঁটির সঙ্গে বাঁধা একটা ইয়াক বা চমরি গাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন। আজ সকালেই ভদ্রলোক বলছিলেন, মশাই, সেই ছেলেবেলা থেকে পুজোর কাজে চামরের ব্যবহার দেখে আসছি, আর অ্যাদিনে তার উৎপত্তিস্থল দেখলাম। সাদা চমরির ল্যাজ দিয়েই চামর তৈরি হয়। এখানে যে চমরিটা রয়েছে সেটা অবিশ্যি কালো।
আমরা বাকি চারজনে বসেছি একটা ভুটিয়ার দোকানের সামনে। সেই দােকান থেকেই কেনা তিব্বতি চা ও সাম্পায় আমরা ব্রেকফাস্ট সারছি। সাম্পা হল গমের ছাতুর ডেলা। জলে বা চায়ে ভিজিয়ে খেতে হয়। এই চা কিন্তু আমাদের ভারতীয় চা নয়। এ চা চিন দেশ থেকে আসে, এর নাম ব্রিক-টি। দুধ চিনির বদলে নুন আর মাখন দিয়ে এই চা তৈরি হয়। একটা লম্বা বাঁশের চোঙার মধ্যে চা ঢেলে আরেকটা বাঁশের ডান্ডা দিয়ে মোক্ষম ঘটান দিলে চায়ে-মাখনে একাকার হয়ে এই পানীয় প্রস্তুত হয়। তিব্বতিরা এই চা খায় দিনে ত্রিশ-চল্লিশ বার। চা আর সাম্পা ছাড়া আরও যেটা খায় সেটা হল ছাগল আর চমরির মাংস। এসব হয়তো আমাদেরও খেতে হবে, যদিও চাল ডাল সবজি কফি টিনের খাবার ইত্যাদি আমরা সঙ্গে নিয়েছি। সে সব যতদিন চলে চলবে, তারপর সব কিছু ফুরোলে রয়েছে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণানাশক বড়ি বটিকা ইন্ডিকা।
অবিনাশবাবু আমায় শাসিয়ে রেখেছেন—আমাকে মশাই আপনার ওই সাহেব বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বলবেন না। আপনি চৌষট্টিটা ভাষা জানতে পারেন, আমার বাংলা বই আর সম্বল নেই। সকাল সন্ধেয় গুড মর্নিং গুড ইভনিংটা বলতে পারি, এমনকী ওনাদের কেউ খাদেটািদে পড়ে গেলে গুড বাইটাও মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে—তার বেশি আর কিছু পাবেন না। আপনি বরং বলে দেবেন যে আমি একজন মৌনী সাধু, তীৰ্থ করতে যাচ্ছি। সত্যিই অবিনাশবাবু খুবই কম কথা বলছেন। আমি একা থাকলেও কথা বলেন ফিসফিস করে। একটা সুবিধে এই যে ভদ্রলোকের ঘোড়া চড়তে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। এসব অঞ্চলে ঘোড়া ছাড়া গতি নেই। ছটা ঘোড়া, মাল বইবার জন্য চারটে চমরি আর আটজন ভুটিয়া কুলি আমরা সঙ্গে নিচ্ছি।
উইলার্ডের ডায়রিটা নিজের চোখে দেখে আমার ইউনিকর্ন ও উড়ন্ত লামা সম্পর্কে কৌতূহল দশগুণ বেড়ে গেছে। এখানে একদল তিব্বতি পশমের ব্যাপারি এসেছে, তাদের একজনের সঙ্গে আলাপ করে একশৃঙ্গ জানোয়ারে কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বোধ হয় আমাকে পাগল ভেবে দাঁত বার করে হাসতে লাগল! উড়ন্ত লামার কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বলল সব লামাই নাকি উড়তে পারে। আসলে এদের সঙ্গে কথা বলে কোনও ফল হবে না। উইলার্ডের সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না জানি না। একটা সুখবর আছে এই যে, উইলার্ডের ১১ই মার্চের ডায়রিতে একটা জায়গার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যেটার নাম দেওয়া নেই, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান দেওয়া আছে। সেটা হল ল্যাটিচিউড ৩৩.৩ নর্থ আর লঙ্গিচিউড ৮৪ ইস্ট। ম্যাপ খুলে দেখা যাচ্ছে সেটা কৈলাসের প্রায় একশো মাইল উত্তর-পশ্চিমে চাংথাং অঞ্চলে। এই চাংথাং ভয়ানক জায়গা। সেখানে গাছপালা বলতে কিছু নেই, আছে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বালি আর পাথরে মেশানো রুক্ষ জমির মাঝে মাঝে একেকটা হ্রদ। মানুষ বলতে এক যাযাবর শ্রেণীর লোকেরা ছাড়া কেউ থাকে না। ওখানে। শীতও নাকি প্রচণ্ড। আর তার উপরে আছে। বরফের ঝড়—যাকে বলে ব্লিজার্ড—যা নাকি সাতপুরু, পশমের জামা ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
সবই সহ্য হবে যদি যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হয়। অবিনাশবাবু বলছেন, কোনও ভাবনা নেই। ভক্তির জোর, আর কৈলাসেশ্বরের কৃপায় আপনাদের সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে।
৪ঠা আগস্ট। পুরাং উপত্যকা।
১২০০০ ফুট উচুতে একটা খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর ধারে আমরা ক্যাম্প ফেলেছি। হাপরের সাহায্যে ধূনি জ্বালিয়ে তার সামনে মাটিতে কম্বল বিছিয়ে বসেছি। বিকেল হয়ে আসছে; চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গাটা থেকে রোদ সরে গিয়ে আবহাওয়া দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। আশ্চর্য এই যে, এখানে সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি দুর্জয় শীত হলেও দুপুরের দিকে তাপমাত্রা চড়ে গিয়ে মাঝে মাঝে ৮০।৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইট উঠে যায়।
গারবেয়াং থেকে রওনা হবার আগে, চড়াই উঠতে হবে বলে নিশ্বাসের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য আমি সকলকে অক্সিমোর পাউডার অফার করি। সন্ডার্স ও অবিনাশবাবু আমার ওষুধ খেলেন। ক্রোল বলল সে জার্মানির পার্বত্য অঞ্চলে মাইনিঙ্গেন শহরে থাকে, ছেলেবেলা থেকে পাহাড়ে চড়েছে, তাই তার ওষুধের দরকার হবে না। মার্কোভিচকে জিজ্ঞেস করাতে সেও বলল ওষুধ খাবে না। কেন খাবে না তার কোনও কারণ দিল না। বোধ হয় আমার তৈরি ওষুধে তার আস্থা নেই। সে যে অত্যন্ত মূর্থের মতো কাজ করেছে সেটা পরে নিজেও বুঝতে পেরেছিল। ঘোড়ায় চড়ে দিব্যি চলেছিলাম আমরা পাহাড়ে পথ ধরে। বেঁটে বেঁটে তিব্বতি ঘোড়ার পিঠে আমরা পাঁচজন, আর আমাদের পিছনে কুলি আর মালবাহী চমরির দল। ষোলো হাজার ফুটে গুরুপ-লা গিরিবর্তু পেরোতেই হিমেল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আমাদের কানে এল। আমাদের মধ্যে কে যেন প্রচণ্ড জোরে হাসতে শুরু করেছে।
এদিক ওদিক চেয়ে একটু হিসেব করে শুনে বুঝতে পারলাম হাসিটা আসছে। সবচেয়ে সামনের ঘোড়ার পিঠ থেকে। পিঠে রয়েছেন শ্ৰীমান সেরগেই মার্কোভিচ। তার হাসিটা এমনই বিকট ও অস্বাভাবিক যে আমাদের দলটা আপনা থেকেই থেমে গেল।
মার্কোভিচও থেমেছে। এবার সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। তারপর তার সমস্ত দেহ কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে অত্যন্ত বেপরোয়া ও বেসামাল ভাবে সে রাস্তার ডান দিকে এগোতে লাগল। ডাইনে খাদ, আর সে খাদ দিয়ে একবার গড়িয়ে পড়লে অন্তত দু হাজার ফুট নীচে গিয়ে সে গড়ানো থামবে, এবং অবিনাশবাবুর গুড বাই বলার সুযোগ এসে যাবে।
সন্ডার্স, ক্রোল ও আমি ঘোড়া থেকে নেমে ব্যস্তভাবে মার্কোভিচের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটার চোখ ঘোলাটে, তার হাসিও ঘোলাটে মনের হাসি। এবারে বুঝতে পারলাম তার কী হয়েছে। বারো হাজার ফুটের পর থেকেই আবহাওয়ায় অক্সিজেনের রীতিমতো অভাব হতে শুরু করে। কোনও কোনও লোকের বেলায় সেটা নিশ্বাসের কষ্ট ছাড়া আর কোনও গণ্ডগোলের সৃষ্টি করে না। কিন্তু একেকজনের ক্ষেত্রে সেটা রীতিমতো মস্তিষ্কের বিকার ঘটিয়ে দেয়। তার ফলে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ ভুল বকে, আবার কেউ বা অজ্ঞান হয়ে যায়। মার্কোভিচকে হাসিতে পেয়েছে। আমাদের কুলিরা বোধ হয় এ ধরনের ব্যারাম কখনও দেখেনি, কারণ তারা দেখছি মজা পেয়ে নিজেরাও হাসতে শুরু করে দিয়েছে। নটি পুরুষের অট্টহাসি এখন চারিদিকে পাহাড় থেকে প্ৰতিধ্বনিত হচ্ছে।
ক্রোল হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ওকে মারি একটা ঘুষি?
আমি তো অবাক। বললাম, কেন, ঘুষি মারবে কেন? ওর তো অক্সিজেনের অভাবে ওই অবস্থা হয়েছে।
সেই জন্যেই তো বলছি। এই অবস্থায় ওকে তোমার ওষুধ খাওয়াতে পারবে না। বেন্থশ হলে জোর করে গেলানো যেতে পারে।
এরপরে আমি কিছু বলার আগেই ক্রোল মার্কোভিচের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা প্রচণ্ড ঘুষিতে তাকে ধরাশায়ী করে দিল। অজ্ঞান অবস্থার তার মুখ হাঁ করে তার গলায় আমার পাউডার গুজে দিলাম। দশ মিনিট পরে জ্ঞান হয়ে ভদ্রলোক ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক ওদিক দেখে তার চোয়ালে হাত বুলোতে বুলোতে সুবোধ বালকের মতো তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল। আমরা সকলে আবার রওনা দিলাম।
পুরাঙে এসে ক্যাম্প ফেলে আগুন জ্বেলে বসবার পর ক্রোল ও সন্ডার্সের সঙ্গে ইউনিকর্ন নিয়ে কথা হল। সন্ডার্স বলল, বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে হঠাৎ একটা নতুন জাতের জানোয়ার আবিষ্কার করাটা কী সাংঘাতিক ব্যাপার বলে তো! আর, একটা আধটা নয়, একেবারে দলে দলে।
ইউনিকর্ন থেকে আলোচনাটা আরও অন্য কাল্পনিক প্রাণীতে চলে গেল। সত্যি, পুরাকালে কতরকমই না উদ্ভট জীবজন্তু সৃষ্টি করেছে মানুষের কল্পনা। অবিশ্যি কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন যে এ সব নিছক কল্পনা নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যে সব প্রাণীদের দেখত, তার আবছা স্মৃতি নাকি অনেক যুগ পর্যন্ত মানুষের মনে থেকে যায়। সেই স্মৃতির সঙ্গে কল্পনা জুড়ে মানুষই আবার এই সব উদ্ভট প্রাণীর সৃষ্টি করে। এইভাবে প্রাগৈতিহাসিক টেরোড্যাকাটিল বা ঈপিয়র্নিস পাখির স্মৃতি থেকেই হয়তো সৃষ্টি হয়েছে। গরুড় বা জটায়ু বা আরব্যোপন্যাসের সিন্ধবাদ নাবিকের গল্পের অতিকায় রক পাখি-যার ছানার খাদ্য ছিল একটা আস্ত হাতি। মিশর দেশের উপকথায় তি-বোনু পাখির কথা আছে, পরে ইউরোপে যার নাম হয়েছিল ফিনিক্স। এই ফিনিক্সের নাকি মৃত্যু নেই। একটা সময় আসে যখন সে নিজেই নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে, আর পরমুহুর্তেই তার ভস্ম থেকে নতুন ফিনিক্স জন্ম নেয়। আর আছে ড্রাগন—যার অস্তিত্বে পূর্ব-পশ্চিম দুদিকের লোকই বিশ্বাস করত। তফাত এই যে পশ্চিমের ড্র্যাগন ছিল অনিষ্টকারী দানব, আর চিন বা তিব্বতের ড্রাগন ছিল মঙ্গলময় দেবতা।
এইসব আলোচনা করতে করতে আমি মার্কোভিচের কথাটা তুললাম। আমার মতে তাকে আমাদের অভিযানের আসল উদ্দেশ্যটা জানানো দরকার। চাংথাং অঞ্চলের ভয়াবহ চেহারাটাও তার কাছে পরিষ্কার করা দরকার। সেটা জেনেও যদি সে আমাদের সঙ্গে যেতে চায় তো চলুক, আর না হলে হয় সে নিজের রাস্তা ধরুক, না হয় দেশে ফিরে যাক।
ক্রোল বলল, ঠিক বলেছ। যে লোক আমাদের সঙ্গে ভালভাবে মিশতে পারে না, তাকে সঙ্গে নেওয়া কী দরকার। যা বলবার এখনই বলা হোক।
সন্ডার্স বলল সে মার্কোভিচকে পশ্চিমের তাঁবুতে যেতে দেখেছে। আমরা তিনজনে তাঁবুর ভেতর ঢুকলাম।
মার্কোভিচ একপাশে অন্ধকারে ঘাড় গুজে বসে আছে। আমরা ঢুকতে সে মুখ তুলে চাইল। সন্ডার্স ভনিতা না করে সরাসরি উইলার্ডের ডায়রি আর একশৃঙ্গের কথায় চলে গেল। তার কথার মাঝখানেই মার্কোভিচ বলে উঠল, ইউনিকর্ন? ইউনিকর্ন তো আমি ঢের দেখেছি। আজকেও আসার সময় দেখলাম। তোমরা দেখনি বুঝি?
আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মার্কোভিচ যেমন বসে ছিল তেমনই বসে আছে। সে যে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে সেটা তার ভাব দেখে মোটেই মনে হয় না। তা হলে কি আমার ওষুধ পুরোপুরি কাজ দেয়নি? তার মাথা কি এখনও পরিষ্কার হয়নি?
ক্রোল গুনগুন করে একটা জার্মান সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বাইরে চলে গেল। বুঝলাম সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এবার আমরা দুজনেও উঠে পড়লাম। বাইরে এলে পর ক্রোল তার পাইপ ধরিয়ে বিদ্রূপের সুরে বলল, এটাও কি তোমার অক্সিজেনের অভাব বলে মনে হয়? আমি আর সন্ডার্স দুজনেই চুপ। আমরা নিঃসন্দেহে একটা পাগলকে সঙ্গে নিয়ে চলেছি-বলে ক্রোল তার ক্যামেরা নিয়ে হাতপঞ্চাশেক দূরে একটা প্রকাণ্ড পাথরের গায়ে খোদাই করা তিব্বতি মহামন্ত্র ওঁ মণিপদ্মে হুম-এর ছবি তুলতে চলে গেল।
মার্কোভিচ কি সত্যিই পাগল, না সাজ-পাগল? আমার মনটা খুঁত খুঁত করছে।
আমাদের মধ্যে অবিনাশবাবুই বোধ হয়। সবচেয়ে ভাল আছেন। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে ভদ্রলোককে দেখছি, ওঁর মধ্যে যে কোনও রসবোধ আছে তা আগে কল্পনাই করতে পারিনি। আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে উনি চিরকালই ঠাট্টা করে এসেছেন; আমার যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলোও ওঁর মনে কোনওদিন বিস্ময় বা শ্রদ্ধা জাগাতে পারেনি। কিন্তু ওই যে দুবার আমার সঙ্গে বাইরে গেলে—একবার আফ্রিকায়, আরকেওবার প্রশান্ত মহাসাগরের সেই আশ্চর্য দ্বীপে—তারপর থেকেই দেখেছি ওঁর চরিত্রে একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। ভ্রমণে মনের প্রসার বাড়ে বলে ইংরাজিতে একটা কথা আছে, সেটা অবিনাশবাবুর ক্ষেত্রে চমৎকার ভাবে ফলেছে। আজ বারবার উনি আমার কানের কাছে এসে বিড়বিড় করে গেছেন–কৈলাস ভূধর অতি মনোহর, কোটি শশী পরকাশ, গন্ধৰ্ব কিন্নর যক্ষ বিদ্যাধর অন্সরাগণের বাস। কৈলাস সম্বন্ধে পৌরাণিক ধারণাটা অবিনাশবাবু এখনও বিশ্বাস করে বসে আছেন। আসল কৈলাসের সাক্ষাৎ পেয়ে ভদ্রলোককে কিঞ্চিৎ হতাশ হতে হবে। আপাতত উনি কুলিদের রান্নার আয়োজন দেখতে ব্যস্ত। বুনো ছাগলের মাংস রান্না করছে ওরা।
দূরে, বহুদূরে, আমরা যেই রাস্তা দিয়ে যাব সেই রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার পিঠে একদল লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ দলটাকে কতগুলো চলমান কালো বিন্দু বলে মনে হচ্ছিল। এখন তাদের চেহারাটা ক্ৰমে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এদের দেখতে পেয়ে আমাদের লোকগুলোর মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লক্ষ করছি। কারা এরা?
শীত বাড়ছে। আর বেশিক্ষণ বাইরে বসা চলবে না।
৪ঠা আগস্ট। সন্ধ্যা সাতটা।
একটা বিশেষ চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল। এই কিছুক্ষণ আগে। দূর থেকে যে দলটাকে আসতে দেখেছিলাম সেটা ছিল একটা খামাপা দস্যুদল। এই বিশেষ দলটিই যে উইলার্ডকে আক্রমণ করেছিল তারও প্রমাণ পেয়েছি।
বাইশটা ঘোড়ার পিঠে বাইশজন লোক, তাদের প্রত্যেকের মোটা পশমের জামার কোমরে গোঁজা তলোয়ার, কুকরি, ভোজালি, আর পিঠের সঙ্গে বাঁধা আদ্যিকালের গাদা বন্দুক। এ ছাড়া দলে আছে পাঁচটা লোমশ তিব্বতি কুকুর।
দলটা যখন প্রায় একশো গজ দূরে, তখন আমাদের দুজন লোক—রাবসাং ও টুণ্ডুপ–হন্তদন্ত হয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, আপনাদের সঙ্গে যা অস্ত্রশস্ত্ৰ আছে তা তাঁবুর ভিতর থেকে বাইরে নিয়ে আসুন। আমি বললাম, কেন, ওদের দিয়ে দিতে হবে নাকি? না, না। বিলাতি বন্দুককে ওরা সমীহ করে চলে। না হলে ওরা সব তছনছ করে লুট করে নিয়ে যাবে। ভারী বেপরোয়া দস্যু ওরা।
আমাদের সঙ্গে তিনটে বন্দুক—একটা এনফিল্ড ও দুটো অস্ট্রিয়ান মানলিখার। সন্ডার্স ও ক্রোল তাঁবু থেকে টোটা সমেত বন্দুক বার করে আনল। মার্কোভিচের বেরোবার নাম নেই, আমি প্রয়োজনে পকেট থেকে আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তল বার করব, তাই হাত খালি রাখতে হবে, অথচ দুজনের হাতে তিনটে বন্দুক বেমানান, তাই অবিনাশবাবুকে ডেকে তাঁর হাতে একটা মানলিখার তুলে দেওয়া হল! ভদ্রলোক একবার মাত্ৰ হাঁ হাঁ করে থেমে গিয়ে কাঁপা হাতে বন্দুকটা নিয়ে দস্যুদলের উলটো দিকে মুখ করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
২
দস্যুদল এসে পড়ল। ধুমসো লোমশ তিব্বতি কুকুরগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করছে। তাদেরও ভাবটা দস্যুদেরই মতো। আমাদের দলের লোকগুলোর অবস্থা কাহিল। যে যেখানে ছিল সব জবুথবু হয়ে বসে পড়েছে। এই সব দস্যু সাধারণত যাযাবরদের আস্তানায় গিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চলে যায়। উপযুক্ত অস্ত্র ছাড়া এদের বাধা দিতে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। অবিশ্যি এরা যদি তিব্বতি পুলিশের হাতে পড়ে তা হলে এদের চরম শাস্তির ব্যবস্থা আছে। গদান আর ডান হাতটা কেটে নিয়ে সেগুলোকে সোজা রাজধানী লাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই ধুধু প্ৰান্তরে বরফে ঢাকা গিরিবর্ক্সের আনাচেকানাচে এদের খুঁজে বার করা মোটেই সহজ নয়। এও শুনেছি যে এই সব দস্যুদের নিজেদেরও নাকি নরকভোগের ভয় আছে। তাই এরা লুটপাট বা খুনখারাপি করে নিজেরাই, হয়। কৈলাস প্ৰদক্ষিণ করে, না হয় কোনও উচু পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে নিজেদের পাপের ফিরিস্তি দিয়ে প্ৰায়শ্চিত্ত করে নেয়।
দস্যুদের সামনে যে রয়েছে তাকেই মনে হল পালের গোদা। নাক থ্যাবড়া, কানে মাকড়ি, মাথার রুক্ষ চুল টুপির পাশ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে, বয়স বেশি না হলেও মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে, কুতকুতে চোখে অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে আমাদের চারজনকে নিরীক্ষণ করছে। বাকি লোকগুলো যে যেখানে ছিল সেখানেই চুপ করে ঘোড়ার লাগাম ধরে অপেক্ষা করছে; বোঝা যাচ্ছে নেতার হুকুম না পেলে কিছু করবে না।
এবারে দস্যুনেতা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। তারপর ক্রোলের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা ঘড়ঘড়ে গলায় বলল-পেলিং? পেলিং মানে ইউরোপীয়। ক্রোলের হয়ে আমিই হ্যাঁ বলে জবাব দিয়ে দিলাম। দিয়েই খটকা লাগল। ইউরোপীয় দেখে চিনল কী করে এরা?
লোকটা এবার ধীরে ধীরে সন্ডার্সের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর তার পায়ের কাছ থেকে একটা বেক্ড বিনসের খালি টিন তুলে নিয়ে সেটাকে উলটেপালটে দেখে তার গন্ধ শুকে আবার মাটিতে ফেলে ভারী বুটের গোড়ালির এক মোক্ষম চাপে সেটাকে থেঁতলে মাটির সঙ্গে সমান করে দিল। সন্ডার্স হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দস্যুনেতার ঔদ্ধত্য হজম করার আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে।
কোথেকে জানি মাঝে মাঝে একটা দাঁড়কাকের গভীর কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া কেবল নদীর কুল কুল শব্দ। কুকুরগুলো আর ডাকছে না। এই থমথমের মধ্যে আবার দস্যুনেতার ভারী বুটের শব্দ পাওয়া গেল। সে এবার অবিনাশবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোক যে কেন তাকে মাথা হেঁট করে নমস্কার করলেন তা বোঝা গেল না। দস্যুনেতার বোধ হয় ব্যাপারটা ভারী কমিক বলে মনে হল, কারণ সে সশব্দে একটা বর্বর হাসি হেসে অবিনাশবাবুর হাতের বন্দুকের বাঁটে একটা খোঁচা মোরল।
এবার ক্রোলের দিকে চোখ পড়াতে সভয়ে দেখলাম সে তার বন্দুকটা দস্যুনেতার দিকে উঠিয়েছে, প্রচণ্ড রাগে তার কপালের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। আমি চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে ধৈৰ্য হারাতে মানা করলাম। ইতিমধ্যে সন্ডার্স আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ফিস ফিস করে বলল, দে হ্যাভ অ্যান এনফিল্ড টু।
কথাটা শুনে অন্য দসু্যাগুলোর দিকে চেয়ে দেখি তাদের মধ্যে একজন হিংস্র চেহারার লোক ঘোড়ার পিঠে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে। তার কাঁধে। সত্যিই একটা এনফিল্ড রাইফেল। উইলার্ডের ডায়রি থেকে জেনেছি যে তার নিজের একটা এনফিল্ড ছিল। সেটা কিন্তু আলমোড়ায় ফেরেনি। এই বন্দুক, আর ইউরোপীয়দের দেখে চিনতে পারা—এই দুটো ব্যাপার থেকে বেশ বোঝা গেল যে এই দাসুন্দলই উইলার্ডের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কিন্তু তা হলেও আমাদের হাত পা বাঁধা। এরা দলে ভারী। লড়াই লাগলে হয়তো আমাদের বন্দুক আর আমার পিস্তলের সাহায্যে এদের রীতিমতো শিক্ষা দেওয়া যেত, কিন্তু সে খবর যদি অন্য খামপাদের কাছে গিয়ে পৌঁছায় তা হলে কি তারা প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে?
লড়াইয়ের প্রয়োজন হবে কি না ভাবছি, দস্যুনেতা অসীম সাহসের সঙ্গে আমাদের পূর্বদিকের ক্যাম্পটার দিকে এগিয়ে চলেছে, এমন সময় এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। অন্য ক্যাম্পটা থেকে হঠাৎ মার্কোভিচ টলতে টলতে বেরিয়ে এল-তার ডান হাতটা সামনের দিকে তোলা, তার তর্জনী নির্দেশ করছে দস্যুদের তিব্বতি কুকুরগুলোর দিকে।
পরমুহূর্তেই তার গলায় এক অদ্ভুত উল্লসিত চিৎকার শোনা গেল। —ইউনিকর্ন! ইউনিকর্ন!
আমরা ভাল করে ব্যাপারটা বোঝার আগেই মার্কোভিচ দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল একটা বিশাল লোমশ ম্যাস্টিফ কুকুরের দিকে। হয়তো তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে মনে করেই কুকুরটা হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়ে একটা বিশ্ৰী গর্জন করে মার্কোভিচের দিকে দিল একটা লাফ।
কিন্তু মার্কোভিচের নাগাল পাবার আগেই সে কুকুর ভেলকির মতো ভ্যানিস করে গেল।
কিন্তু মার্কোভিচের নাগাল পাবার আগেই সে কুকুর ভেলকির মতো ভ্যানিস করে গেল। এর কারণ অবশ্য আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তল। আমার ডান হাতটা অনেকক্ষণ থেকেই পকেটে পিস্তলের উপর রাখা ছিল। মোক্ষম মুহুর্তে সে হাত পিস্তল সমেত বেরিয়ে এসে কুকুরের দিকে তাগ করে ঘোড়া টিপে দিয়েছে।
কুকুর উধাও হবার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কোভিচ মুহ্যমান অবস্থায় মাটিতে বসে পড়ল। ক্রোল আর সন্ডার্স মিলে তাকে কোলপাঁজা করে তাঁবুর ভিতর নিয়ে গেল।
আর এদিকে এক অদ্ভুত কাণ্ড। আমার পিস্তলের মহিমা দেখে দাসুন্দলের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। তারা কেউ কেউ ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়েছে, কেউ আবার ঘোড়ার পিঠ থেকেই বার বার গড় করার ভাব করে উপুড় হয়ে পড়ছে। দাসুনেতাও বেগতিক দেখে ইতিমধ্যে তার ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়েছে। বাইশজন দস্যুর সম্মিলিত বেপরোয়া ভাব এক মুহুর্তে এভাবে উবে যাবে তা ভাবতে পারিনি।
এবার আমার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। যে লোকটার কাছে এনফিল্ডটা ছিল তার কাছে গিয়ে বললাম, হয় তোমার বন্দুক দাও, না হয় তোমাদের পুরো দলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব। সে কাঁপতে কাঁপতে তার কাঁধ থেকে বন্দুক খুলে আমার হাতে তুলে দিল। এবার বললাম, এই বন্দুক যার, তার আর কী কী জিনিস তোমাদের কাছে আছে বার করো।
এক মিনিটের মধ্যে এর ওর ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ল দুটিন সসেজ, একটা গিলেট সেফটি রেজার, একটা আয়না, একটা বাইনোকুলার, একটা ছেড়া তিব্বতের ম্যাপ, একটা ওমেগা ঘড়ি, আর একটা চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগ খুলে দেখি তাতে রয়েছে একটা বাইবেল, আর তিব্বত সম্বন্ধে মোরক্রফট ও টিফেনটালেরের লেখা দুটো বিখ্যাত বই। বই দুটোতে উইলার্ডের নাম লেখা রয়েছে তার নিজের হাতে।
জিনিসগুলোকে বাজেয়াপ্ত করে সবে ভাবছি দস্যুনেতাকে কিছু সতর্কবাণী শুনিয়ে তাদের বিদায় নিতে বলব, কিন্তু তার আগেই তাদের পুরো দলটা চক্ষের নিমেষে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আবছা হয়ে আসা পাহাড়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আপদ বিদায় করে অবিনাশবাবুকে মানলিখারের ভারমুক্ত করে পশ্চিম দিকের তাঁবুতে গেলাম মার্কোভিচের অবস্থা দেখতে। সে মাটিতে কম্বলের উপর শুয়ে আছে চোখ বুজে। মুখের উপর টর্চ ফেলতে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। এইবারে তার চোখের পাতা আর মণি দেখেই বুঝতে পারলাম যে সে নেশা করেছে। আর সে নেশা সাধারণ নেশা নয়; অত্যন্ত কড়া কোনও মাদক ব্যবহার করেছে সে। হয়তো এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস, আর তার প্রভাবেই সে যেখানে সেখানে ইউনিকর্ন দেখতে পাচ্ছে। কোকেন, হেরয়েন, মফিয়া বা ওই জাতীয় কোনও মাদক খেলে বা ইঞ্জেকশন নিলে শুধু যে শরীরের ক্ষতি করে তা নয়, তা থেকে ব্রেনের বিকার ও তার ফলে চোখে ভুল দেখা কিছুই আশ্চৰ্য না।
মার্কোভিচের মতো নেশাখোরকে সঙ্গে নিলে আমাদের এই অভিযান ভণ্ডুল হয়ে যাবে। হয় তাকে তাড়াতে হবে, না হয় তার নেশাকে তাড়াতে হবে।
১৫ই আগস্ট সকাল ৭টা
কাল রাত্রে তাকে ডাকা সত্ত্বেও মার্কোভিচ যখন খেতে এল না, তখন নেশার ধারণাটা আমার মনে আরও বদ্ধমূল হল। আমি জানি এ জাতীয় ড্রাগ বা মাদক ব্যবহার করলে মানুষের খিদে তেষ্টা অনেক কমে যায়। কথাটা বলতে সন্ডার্স একেবারে ক্ষেপে উঠল। বলল, ওকে সরাসরি জেরা করতে হবে এক্ষুনি। ক্রোল বলল, তুমি অত্যন্ত বেশি ভদ্র, তোমাকে দিয়ে জেরা হবে না। ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।
খাবার পরে ক্রোল সোজা তাঁবুর ভিতর গিয়ে আধঘুমন্ত মার্কোভিচকে বিছানা থেকে হিঁচড়ে টেনে তুলে সোজা তার মুখের উপর বলল, তোমার কাছে কী ড্রাগ আছে বার করো। আমরা জানি তুমি নেশা করো। এ নেশা তোমার ছাড়তে হবে, নয়তো তোমাকে আমরা বরফের মধ্যে পুতে দিয়ে চলে যাব; কেউ টের পাবে না।
মার্কোভিচ পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল কি না জানি না, কিন্তু সে ক্রোলের ভাব দেখে যে ভয় পেয়েছে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। সে কোনওরকমে ক্রোলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কিছুক্ষণ হাতড়ে তার থেকে একটা মাথার বুরুশ বার করে ক্রোলের হাতে দিল। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এটা তার পাগলামিরই আরেকটা লক্ষণ; কিন্তু ক্রোলের জার্মান বুদ্ধি এক নিমেষে বুঝে ফেলল যে মার্কোভিচ আসল জিনিসটাই বার করে দিয়েছে। বুরুশের কাঠের অংশটায় চাড় দিতে সেটা বাক্সের ডালার মতো খুলে গেল, আর তার তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল ঠিক ট্যালকাম পাউডারের মতো দেখতে মিহি সাদা কোকেনের গুড়ো। আধ মিনিটের মধ্যে সে গুড়ো তিব্বতের হিমেল বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, আর বুরুশটা নিক্ষিপ্ত হল খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর জলে।
কিন্তু শুধু কোকেন দূর করলেই তো হবে না, মার্কোভিচের নেশােটাকেও দূর করা চাই। আজ সকালে তার হাবভাবে মনে হচ্ছে আমার আশ্চর্য ওষুধ মিরাকিউরলে কাজ দিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই চার গেলাস মাখন চা, সেরখানেক ছাগলের মাংস আর বেশ কিছুটা সাম্পা খেয়ে ফেলেছে।
৭ই আগস্ট। সাংচান ছাড়িয়ে।
এখন দুপুই আড়াইটা। আমরা মানস সরোবরের পথে একটা গুম্ফা বা তিব্বতি মঠের বাইরে বসে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছি। পথে আসতে আসতে আরও অনেক গুম্ফা দেখেছি। এগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা পাহাড়ের চুড়ো বেছে বেছে তার উপর তৈরি করা হয়েছে, এবং প্রত্যেকটা থেকেই চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। লামাদের সৌন্দর্যবোধ আছে। এ কথা স্বীকার করতেই হয়।
আমাদের সামনে উত্তর দিকে ২৫০০০ ফুট উচু গুল-মান্ধাতা পর্বত সদৰ্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া চারিদিকে আরও অনেক বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ো দেখতে পাচ্ছি। আর কিছুদূর গেলেই কৈলাস-মানস সরোবরের দর্শন মিলবে, অবিনাশবাবুর যাত্রা সার্থক হবে। আপাতত মান্ধাতা দেখেই তাঁর সন্ত্রম ও বিস্ময়ের সীমা নেই। বার বার বলছেন, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশাই। মহাভারতের যুগে চলে এসেছি। উঃ কী ভয়ানক ব্যাপার!
বলা বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত একশৃঙ্গের কোনও চিহ্ন নেই। জানোয়ারের মধ্যে বুনো ছাগল ভেড়া গাধা চমরি এসব তো হামেশাই দেখছি। মাঝেমধ্যে এক আধটা খরগোশ ও মেঠো ইঁদুরও দেখা যায়। হরিণ আর ভালুক আছে বলে জানি, কিন্তু দেখিনি। কাল রাত্রে ক্যাম্পের আশেপাশে নেকড়ে হানা দিচ্ছিল, তাঁবুর কাপড় ফাঁক করে টর্চ ফেলে তাদের জ্বলন্ত সবুজ চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম।
সন্ডার্সের মনে একটা নৈরাশ্যের ভাব দেখা দিয়েছে। ওর ধারণা হয়েছে উইলার্ডও মার্কোভিচের মতো নেশা করে আজগুবি দৃশ্য দেখেছে আর আজগুবি ঘটনার বর্ণনা করেছে। উড়ন্ত লামা, ইউনিকর্ন—এরা সবই তার ড্রাগ-জনিত দৃষ্টিভ্ৰম। সন্ডার্স ভুলে যাচ্ছে যে আমরা আলমোড়াতে মেজর হার্টনের সঙ্গে দেখা করেছি। উইলার্ড সম্বন্ধে তার রিপোর্ট দেখেছি। তাতে ড্রাগের কোনও ইঙ্গিত ছিল না।
আমরা যে গুম্ফার সামনে বসেছি তাতে একটিমাত্র লামা বাস করেন। আমরা এই কিছুক্ষণ আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এক অভিনব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছি। এমনিতে হয়তো যেতাম না, কিন্তু রাবাসাং যখন বলল লামাটি পঞ্চাশ বছর কারুর সঙ্গে কথা বলেননি, তখন স্বভাবতই আমাদের একটা কৌতূহল হল। আমরা রাস্তা থেকে দুশো ফুট উপরে উঠে মৌনী লামাকে দর্শন করার জন্য গুম্ফায় প্রবেশ করলাম।
পাথরের তৈরি প্রাচীন গুম্ফার ভিতরে অন্ধকার, দেয়ালে শেওলা আসল কক্ষের ভিতর পিছন দিকে একটা লম্বা তাকে সাত-আটাটা মাঝারি আকারের বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে, তারমধ্যে অন্তত তিনখানা যে খাঁটি সোনার তৈরি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্ৰদীপ জ্বলছে। এক পাশে একটা পাত্রে একতাল। মাখন রাখা রয়েছে, যিয়ের বদলে এই মাখনই ব্যবহার হয় প্ৰদীপের জন্য। একদিকের দেয়ালের গায়ে তাকের উপর থরে থরে সাজানো রয়েছে লাল কাপড়ে মোড়া প্রাচীন তিব্বতি পুঁথি। অবিনাশবাবু একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বললেন, ভৌতিক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে মশাই। চেয়ে দেখি সেখানে একটা মড়ার খুলি রয়েছে। আমি বললাম, ওটা চা খাওয়ার পাত্র। অবিনাশবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
মৌনী লামা ছিলেন পাশের একটা ছোট্ট অন্ধকার ঘরে। ঘরের পুবের দেয়ালে একটা খুপরি জানালা, সেই জানালার পাশে বসে লামা জাপযন্ত্র ঘোরাচ্ছেন। মাথা মুড়োনো, শীর্ণ চেহারা, বসে থেকে থেকে হাত-পাগুলো অস্বাভাবিক রকম সরু হয়ে গেছে। আমরা তাঁকে একে একে অভিবাদন জানালাম, তিনি আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে লাল সুতো দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তাঁর সামনে একটা নিচু কাঠের বেঞ্চিতে আমরা পাঁচজন বসলাম। লামা কথা বলবেন না, তাই তাঁকে এমন প্রশ্ন করতে হবে যার উত্তর কথা না বলে দেওয়া যায়। আমি আর সময় নষ্ট না করে সোজা আসল প্রশ্নে চলে গেলাম।
তিব্বতের কোথাও একশৃঙ্গ জানোয়ার আছে কি?
লামা কয়েক মুহুর্ত হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমাদের পাঁচ জোড়া চোখের উৎসুক দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবদ্ধ। এইবার তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, উপর থেকে নীচে। একবার, দুবার, তিনবার। অর্থাৎ—আছে। আমরা চাপা উৎকণ্ঠায় আড় চোখে একবার পরস্পরের দিকে চেয়ে নিলাম। কিন্তু লামা যে আবার মাথা নাড়ছেন! এবার পাশাপাশি। অর্থাৎ—নেই।
এটা কীরকম হল? এর মানে কী হতে পারে? আগে ছিল, কিন্তু এখন নেই? ক্রোল আমাকে ফিসফিসে গলায় বলল, কোথায় আছে জিজ্ঞেস করো। মার্কোভিচও দেখছি অত্যন্ত মন দিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছে। এই প্রথম সে সুস্থ অবস্থায় আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্যের কথা শুনল।
ক্রোলের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রশ্নটা করাতে লামা তাঁর শীর্ণ বাঁ হাতটা তুলে উত্তর-পশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমরা তো ওই দিকেই যাচ্ছি। কৈলাশ ছাড়িয়ে চাংথাং অঞ্চলে! আমি এবার আরেকটা প্রশ্ন না করে পারলাম না।
আপনি যোগীপুরুষ। ভূত ভবিষ্যৎ আপনার জানা। আপনি বলুন তো আমরা এই আশ্চর্য জানোয়ার দেখতে পাব কি না।
লামা আবার মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। উপর থেকে নীচে। তিনবার।
ক্রোল রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এবার বেশ জোরেই বলল, আস্ক হিম অ্যাবাউট ফ্লাইং লামাজ।
আমি লামার দিকে ফিরে বললাম, আমি আপনাদের মহাযোগী মিলারেপার আত্মজীবনী পড়েছি। তাতে আছে তিনি মন্ত্রবলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যেতে পারতেন। এখনও এমন কোনও তিব্বতি যোগী আছেন কি যিনি এই আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী?
মৌনী লামার চাহনিতে যেন একটা কাঠিন্যের ভাব ফুটে উঠল। তিনি এবার বেশ দৃঢ়ভাবেই মাথাটাকে নাড়লেন। পাশাপাশি। অর্থাৎ না, নেই। তারপর তিনি তাঁর ডানহাতের তর্জনীটা খাড়া করে সেই অবস্থায় পুরো হাতটাকে মাথার উপর তুলে কিছুক্ষণ ধরে ঘোরালেন। তারপর হাত নামিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের উচোনো তর্জনীটাকে চাপ দিয়ে নামিয়ে দিলেন। মানেটা বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না; মিলারেপা একজনই ছিলেন। তিনি মন্ত্রবলে উড়তে পারতেন। তিনি এখন আর নেই।
গুম্ফা থেকে বেরোনোর আগে আমরা কিছু চা আর সাম্পা মৌনী লামার জন্যে রেখে এলাম। এখানকার যাত্রী ও যাযাবরদের মধ্যে যারা মৌনী লামার কথা জানে তারা এই গুম্ফার পাশ দিয়ে গেলেই লামার জন্যে কিছু না কিছু খাবার জিনিস রেখে যায়।
বাইরে এসে সন্ডার্স আর ক্রোলের মধ্যে তর্ক লেগে গেল। সন্ডার্স লামার সংকেতে আমল দিতে রাজি নয়। বলল, একবার হ্যাঁ, একবার না—এ আবার কী? আমার মতে হ্যাঁ-য়ে না-য়ে কাটাকাটি হয়ে কিছুই থাকে না। অর্থাৎ আমরা বৃথা সময় নষ্ট করছি।
ক্রোল কিন্তু লামার সংকেতের সম্পূর্ণ অন্য মানে করেছে। সে বলল, আমার কাছে মানেটা খুব স্পষ্ট। হ্যাঁ মানে ইউনিকর্ন আছে, আর না মানে সেটা এমন জায়গায় আছে যেখানে আমাদের যেতে সে বারণ করছে। কিন্তু বারণ করলেই তো আর আমরা বারণ মানছি না।
মার্কোভিচ এইবার প্রথম আমাদের কথায় যোগ দিল। সে বলল, ইউনিকর্ন যদি সত্যিই পাওয়া যায়, তা হলে সেটাকে নিয়ে আমরা কী করব সেটা ভেবে দেখা হয়েছে কি?
লোকটা কী জানতে চাইছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। ক্রোল বলল, সেটা আমরা এখনও ভেবে দেখিনি। আপাতত জানোয়ারটাকে খুঁজে বার করাই হচ্ছে প্রধান কাজ।
ই বলে মার্কোভিচ চুপ মেরে গেল। মনে হল তার মাথায় কী যেন একটা ফন্দি খেলছে। কোকেনমুক্ত হবার পর থেকেই দেখছি তার উদ্যম অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে লামাদের সম্পর্কে তার একটা বিশেষ কৌতূহল লক্ষ করছি, যার জন্য কাল থেকে নিয়ে সাতবার সে দল মুছাহাড়ে উঠে শুষ্ক দেখতে গেছে। কোকে নখের কি শেষটায় ধৰ্মজ্ঞানী হয়ে দেশে ফিরবে?
৩
৯ই আগস্ট, সকাল দশটা।
আমরা এইমাত্র চুসুং-লা গিরিবর্তু পেরিয়ে রাবণ হ্রদ ও তার পিছনে কৈলাসের তুষারাবৃত ডিম্বাকৃতি শিখরের সাক্ষাৎ পেলাম। এই রাবণ হ্রদের তিব্বতি নাম রাক্ষস-তাল, আর কৈলাসকে এরা বলে কাং-রিমাপোচে। হ্রদটা তেমন পবিত্র কিছু নয়, কিন্তু কৈলাস দেখামাত্র আমাদের কুলির সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম করল। অবিনাশবাবু প্ৰথমে কেমন ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গিয়েছিলেন। শেষটায় খেয়াল হওয়ামাত্র একসঙ্গে শিবের আট-দশটা নাম উচ্চারণ করে হাঁটুগেড়ে বার বার মাটিতে মাথা ঠেকাতে লাগলেন। রাবণ হ্রদের পুব দিকে মানস সরোবর। কালই পৌঁছে যাব বলে মনে হয়।
১০ই আগস্ট, দুপুর আড়াইটা।
মানস সরোবরের উত্তর পশ্চিমে একটা জলকুণ্ডের ধারে বসে আমরা বিশ্রাম করছি। আমাদের বাঁদিকের চড়াইটা পেরিয়ে খানিকটা পথ গেলেই হ্রদের দেখা পাব।
গত এক মাসে এই প্ৰথম আমরা সকলে স্নান করলাম। প্ৰচণ্ড গরম জল, তাতে সালফার বা গন্ধক রয়েছে। জলের উপর ধোঁয়া আর শেওলার আবরণ। আশ্চৰ্য তাজা বোধ করছি স্নানটা
করে।
এখন ডায়রি লিখতাম না, কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেছে যেটা লিখে রাখা দরকার।
আমি আর অবিনাশবাবু কুণ্ডের পশ্চিম দিকটায় নেমেছিলাম, আর সাহেব তিনজন নেমেছিলেন দক্ষিণ দিকে। স্নান সেরে ভিজে কাপড় শুকোনোর অপেক্ষায় বসে আছি, এমন সময় ক্রোল আমার কাছে এসে গল্প করার ভান করে হাসি হাসি মুখে চাপা গলায় বলল, খুব জটিল ব্যাপার। আমি বললাম, কেন, কী হয়েছে?
মার্কোভিচ। লোকটা ভণ্ড, জোচ্চোর।
আবার কী করল?
আমি জানি ক্রোল মার্কোভিচকে মোটেই পছন্দ করে না। বললাম, ব্যাপারটা খুলে বলো।
ক্রোল সেইরকম হাসি হাসি ভাব করেই বলতে লাগল, একটা পাথরের পিছনে আমাদের গরম জামাগুলো খুলে আমরা জলে নেমেছিলাম। আমি একটা ড়ুব দিয়েই উঠে পড়ি। মার্কোভিচের কোটি আমার কোটের পাশেই রাখা ছিল। ভিতরের পকেটটা দেখতে পাচ্ছিলাম। তাতে কী আছে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনটে চিঠি ছিল। ব্রিটিশ ডাকটিকিট। প্রত্যেকটিই জন মার্কহ্যাম নামক কোনও ভদ্রলোককে লেখা।
মার্কহ্যাম?
মার্কহ্যাম—মার্কোভিচ। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি কি?
আমি বললাম, ঠিকানা কী ছিল?
দিল্লির ঠিকানা।
জন মার্কহ্যাম…জন মার্কহ্যাম…নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় শুনেছি আগে? ঠিক কথা, বছর তিনেক আগের খবরের কাগজের একটা খবর। সোনা স্মাগল করার ব্যাপারে লোকটা ধরা পড়েছিল—জন মার্কহ্যাম। জেলও হয়েছিল। কীভাবে যেন পালায়। একটা পুলিশকে গুলি করে মেরেছিল। জন মার্কহ্যাম। লোকটা ইংরেজ। ভারতবর্ষে আছে বহুদিন। নৈনিতালে একটা হোটেল চালাত। পলাতক আসামি। এখন নাম ভাঁড়িয়ে পোল্যান্ডবাসী রাশিয়ান সেজে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। তিব্বত হবে তার গা ঢাকা দেবার জায়গা। কিংবা আরও অন্য কোনও কুকীর্তির মতলবে এসেছে। এখানে। ভণ্ডই বটে। ডেঞ্জারাস লোক। ক্রোলের গোয়েন্দাগিরির প্রশংসা করতে হয়। প্রথমে ওর অন্যমনস্ক ভাব দেখে ও যে এতটা চতুর তা বুঝতে পারিনি। আমি ক্রোলকে মার্কহ্যামের ঘটনোটা বললাম।
ক্রোলের মুখে এখনও হাসি। সেটার প্রয়োজন। এই কারণে যে মার্কোভিচ কুণ্ডের দক্ষিণ দিক থেকে আমাদের দেখতে পাচ্ছে। তার বিষয়ে কথা হচ্ছে সেটা তাকে বুঝতে দেওয়া চলে না। ক্রোল খোশগল্পের মেজাজে একবার সশব্দে হেসে পরীক্ষণেই গলা নামিয়ে বলল, আমার ইচ্ছা ওকে ফেলে রেখে যাওয়া। ওর তুষারসমাধি হোক। ওটাই হবে ওর শাস্তি।
প্রস্তাবটা আমার কাছে ভাল মনে হল না। বললাম, না। ও আমাদের সঙ্গে চলুক। ওকে কোনওরকমেই জানতে দেওয়া হবে না যে ওর আসল পরিচয় আমরা জেনে ফেলেছি। আমাদের লক্ষ্য হবে দেশে ফিরে গিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া।
শেষপর্যন্ত ক্রোল আমার প্রস্তাবে রাজি হল। সন্ডার্সকে সুযোগ বুঝে সব বলতে হবে, আর সবাই মিলে মার্কোভিচের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।
১০ই আগস্ট, বিকেল সাড়ে পাঁচটা। মানস সরোবরের উপকূলে।
মেঘদূতে কালিদাসের বর্ণনায় মানস সরোবরে রাজহাঁস আর পদ্মের কথা আছে। এসে অবধি রাজহাঁসের বদলে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনোহাঁস দেখেছি, আর পদ্ম থাকলেও এখনও চোখে পড়েনি। এ ছাড়া আজ পর্যন্ত মানস সরোবরের যত বর্ণনা শুনেছি বা পড়েছি, চোখের সামনে দেখে মনে হচ্ছে এ হ্রদ তার চেয়ে সহস্ৰগুণে বেশি সুন্দর। চারিদিকের বালি আর পাথরের রুক্ষতার মধ্যে এই পয়তাল্লিশ মাইল ব্যাসযুক্ত জলখণ্ডের অস্বাভাবিক উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ নীল রং মনে এমনই একটা ভাবের সঞ্চার করে যার কোনও বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হ্রদের উত্তরে বাইশ হাজার ফুট উঁচু কৈলাস, আর দক্ষিণে প্রায় যেন জল থেকে খাড়া হয়ে ওঠা গুল-মান্ধাতা। চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে ছোটবড় সব গুস্তফা চোখে পড়ছে, তাদের সোনায় মোড়া ছাতগুলোতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে।
আমরা ক্যাম্প ফেলেছি জল থেকে বিশ হাত দূরে। এখানে আরও অনেক তীর্থযাত্রী ও লামাদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ কেউ হামাগুড়ি দিয়ে হ্রদ প্ৰদক্ষিণ করছে, কেউ হাতে প্রেয়ার হুইল বা জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে পায়ে হেঁটে প্রদক্ষিণ করছে। হিন্দু বৌদ্ধ দুই ধর্মাবলম্বী লোকের কাছেই কৈলাস-মানস সরোবরের অসীম মাহাত্ম্য। ভূগোলের দিক দিয়ে এই জায়গার বিশেষত্ব হল এই যে, একসঙ্গে চারটে বিখ্যাত নদীর উৎস রয়েছে। এরই আশেপাশে। এই নদীগুলো হল ব্ৰহ্মপুত্ৰ, শতদ্রু, সিন্ধু ও কর্ণালি।
অবিনাশবাবু এখানে এসেই বালির উপর শুয়ে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম তো করলেনই, তারপর আমাদের সঙ্গী সাহেবদেরও সেক্রেড, সেক্রেড-মোর সেক্রেড দ্যান কাউ ইত্যাদি বলে গড় করিয়ে ছাড়লেন। তারপরে যেটা করলেন সেটা অবিশ্যি বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। হ্রদের ধারে গিয়ে গায়ের ভারী পশমের কোটটা খুলে ফেলে দুহাত জোড় করে এক লাফে ঝপাং করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। পরমুহুর্তেই দেখি তাঁর দাঁতকপাটি লেগে গেছে। ক্রোল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ জলে নেমে ভদ্রলোককে টেনে তুলল। তারপর তাঁকে ব্র্যান্ডি খাইয়ে তাঁর শরীর গরম করল। আসলে মানস সরোবরের মতো এমন কনকনে ঠাণ্ডা জল ভারতবর্ষের কোনও নদী বা হ্রদে নেই। অবিনাশবাবু ভুলে গেছেন যে এখানকার উচ্চতা পনেরো হাজার ফুট।
ভদ্রলোক এখন দিব্যি চাঙ্গা। বলছেন, ওর বাঁ হাতের বুড়োআঙুলের গাঁটে নাকি ছাব্বিশ বছর ধরে একটা ব্যথা ছিল, সেটা এই এক ঝাঁপানিতেই বেমালুম সেরে গেছে। দুটো হর্লিক্সের খালি বোতলে ভদ্রলোক হৃদের পবিত্র জল নিয়ে নিয়েছেন, সেই জলের ছিটে দিয়ে আমাদের যাবতীয় বিপদ আপদ দূর করার মতলব করেছেন।
এই অঞ্চলেই গিয়ানিমাতে একটা বড় হাট বসে। আমরা সেখান থেকে কিছু খাবার জিনিস, কিছু শুকনো ফল, ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া পাথরের মতো শক্ত চমরির দুধ, আর পশমের তৈরি কিছু কম্বল ও পোশাক কিনে নিয়েছি। ক্রোল দেখি একরাশ মানুষের হাড়গোড় কিনে এনেছে, তারমধ্যে একটা পায়ের হাড় বাঁশির মতো বাজানো যায়। এ সব নাকি তার জাদুবিদ্যার গবেষণায় কাজে লাগবে। মার্কোভিচ গিয়ানিমার বাজারে কিছুক্ষণের জন্য দলছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দশ মিনিট হল সে ফিরেছে। থলিতে করে কী এনেছে বোঝা গেল না। সন্ডার্সের নৈরাশ্য অনেকটা কমেছে। সে বুঝেছে যে একশৃঙ্গের দেখা না পেলেও, মানস সরোবরের এই অপার্থিব সৌন্দৰ্য আর এই নির্মল আবহাওয়া-এও কিছু কম পাওয়া নয়।
কাল আমরা সরোবর ছেড়ে চাং-থাং-এর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করব। আমাদের লক্ষ্য হবে ল্যাটিচিউড ৩৩.৩ নর্থ ও লঙ্গিচিউড ৮৪ ইস্ট।
অবিনাশবাবু তাঁর পকেট-গীতা খুলে কৈলাসের দিকে মুখ করে পিঠে রোদ নিয়ে বসে আছেন। এইবার বোঝা যাবে তাঁর ভক্তির দৌড় কতদূর।
১২ই আগস্ট। চাং থাং ল্যা, ৩০ ন-লং ৮১ই।
সকাল সাড়ে আটটা। আমরা একটা ছোট লেকের ধারে ক্যাম্প ফেলেছি। কাল রাত্রে এক অদ্ভুত ঘটনা। বারোটার সময় মাইনাস–পনেরো ডিগ্রি শীতে ক্রোল আমার ক্যাম্পে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, সে মার্কোভিচের জিনিসপত্র ঘেঁটে অনেক কিছু পেয়েছে। আমি তো অবাক। বললাম, তার জিনিস ঘাঁটলে? সে টের পেল না?
পাবে কী করে-কাল সন্ধেবেলা যে ওর চায়ের সঙ্গে বারবিটুরেট মিশিয়ে দিয়েছিলাম। হাতসাফাই কি আর আমনি অমনি শিখেছি? ও এখনও নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।
কী জিনিস পেলে?
চলো না দেখবে।
গায়ে একটা মোটা কম্বল চাপিয়ে আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে ওদেরটায় গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই একটা তীব্র আধ-চেনা গন্ধ নাকে এল। বললাম, এ কীসের গন্ধ?
ক্রোল বলল, এই তো-এই টিনের মধ্যে কী জানি রয়েছে। টিনের কৌটোটা হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
এ যে কস্তুরী!—ধরা গলায় বললাম। আমি।
কস্তুরীই বটে। এতে কোনও সন্দেহ নেই। তিব্বতে কস্তুরী মৃগ বা musikdeer পাওয়া যায়! সারা পৃথিবী থেকেই প্ৰায় লোপ পেতে বসেছে। এই জানোয়ার। একটা মাঝারি কুকুরের সাইজের হরিণ, তার পেটের ভিতর পাওয়া যায়। কিন্তুরী নামক এই আশ্চৰ্য জিনিস। এটার প্রয়োজন হয় গন্ধদ্রব্য বা পারফিউম তৈরির কাজে। এক তোলা কিন্তুরীর দাম হল প্ৰায় ত্রিশ টাকা। আসবার পথে ভারতবর্ষ ও তিব্বতের সীমানায় আসকোট শহরে এক ব্যবসাদারের কাছে জেনেছিলাম যে, তিনি একাই সরকারি লাইসেন্সে। গত বছরে প্রায় চার লাখ টাকার কস্তুরী বিদেশে রপ্তানি করেছেন। আমি বললাম, এই কন্তুরী কি গিয়ানিমার হাটে কিনেছে। নাকি মার্কোভিচ?
কিনেছে?
প্রশ্নটা করল সন্ডার্স; তার কথায় তিক্ত ব্যঙ্গের সুর। এই দেখো না—এগুলো কি সব ওর কেনা?
সন্ডার্স একটা ঝোলা ফাঁক করে একরাশ কালো চমরির লোমের ভিতর থেকে পাঁচটা বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি বার করল। সেগুলোর সাইজ এক বিঘাতের বেশি না, কিন্তু প্রত্যেকটি মূর্তি সোনার তৈরি। এ ছাড়া আরও মূল্যবান জিনিস ঝোলায় ছিল—একটা পাথর বসানো সোনার বজা, একটা সোনার পাত্র, খানিত্রিশেক আলগা পাথর ইত্যাদি।
উই হ্যাভ এ রিয়েল রবার ইন আওয়ার মিড্রস্ট বলল সন্ডার্স। শুধু খামপারাই দস্যু নয়, ইনিও একটি জলজ্যান্ত দস্যু। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এ কন্তুরী সে গিয়ানিমার বাজার থেকে চুরি করে এনেছে, যেমন এই মূর্তিগুলো চুরি করেছে গুম্ফা থেকে।
এখন বুঝতে পারলাম মার্কোভিচ কেন আমাদের দল ছেড়ে বার বার গুম্ফা দেখতে চলে যায়। লোকটার বেপরোয়া সাহসের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়।
আজ মার্কোভিচের ভাব দেখে মনে হল যে কালকের ঘটনা কিছু টের পায়নি। তার জিনিসপত্র যেভাবে ছিল আবার ঠিক সেইভাবেই রেখে আমরা ঘুমোতে চলে যাই। যাবার আগে এটাও দেখেছিলাম যে, মার্কোভিচের সঙ্গে একটি অস্ত্ৰও আছে-একটা ৪৫ কোল্ট অটোম্যাটিক রিভলভার। এটার কথা মার্কোভিচ আমাদের বলেনি। সে রিভলভার অবিশ্যি তার আর কোনও কাজে লাগবে না, কারণ ক্রোল তার টোটাগুলি সযত্নে সরিয়ে ফেলেছে।
১৫ই আগস্ট। চাং থাং-ল্যা, ৩২.৫ নি, লং ৮২ ই। বিকেল সাড়ে চারটা
চাং থাং অঞ্চলের ভয়াবহ চেহারাটা ক্ৰমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এই জায়গার উচ্চতা সাড়ে ষোলো হাজার ফুট। আমরা এখন একটা অসমতল জায়গায় এসে পড়েছি। মাঝে মাঝে ৪০০–৫০০ ফুট উঠতে হচ্ছে, তারপর একটা গিরিবর্ক্সের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আবার নামতে হচ্ছে।
কাল সকাল থেকে একটি গাছ, একটি তৃণও চোখে পড়েনি। যেদিকে দেখছি খালি বালি পাথর আর বরফ। তিব্বতিরা কিন্তু এ সব অঞ্চলেও পাথরের গায়ে তাদের মহামন্ত্র ওঁ মণিপদ্মে হুম খোদাই করে রেখেছে। গুস্ফার সংখ্যা ক্রমে কমে আসছে, তবে মাঝে মাঝে এক একটা স্তুপ বা চার্টেন দেখা যায়। বসতি একেবারেই নেই।
পরশু একটা যাযাবরদের আস্তানায় গিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় শপাঁচেক মহিলা পুরুষ তাদের কাচ্চা বাচ্চা ছাগল ভেড়া গাধা চমরি নিয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পশমের তাঁবু খাটিয়ে বসতি গেড়েছে। লোকগুলো ভারী আমুদে, মুখে হাসি ছাড়া কথা নেই, এই ভ্ৰাম্যমাণ শিকড়হীন অবস্থাতেও দিব্যি আছে বলে মনে হয়। এদের দু-একজনকে একশৃঙ্গ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না।
আমরা আরও উত্তরের দিকে যাচ্ছি শুনে এরা বেশ জোর দিয়ে বারণ করল। বলল, উত্তরে ডুংলুং-ডো আছে। সেটা পেরিয়ে যাওয়া নাকি মানুষের অসাধ্য। ডুংলুং-ডো কী জিজ্ঞেস করাতে যা বর্ণনা দিল তাতে বুঝলাম সেটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা দুর্লঙঘ্য প্রাচীর। তার পিছনে কী আছে। কেউ জানে না। এই প্রাচীর। এরা কেউই দেখেনি, কিন্তু বহুকাল থেকেই নাকি তিব্বতিরা এর কথা জানে। আদিকালে কোনও কোনও লামা নাকি সেখানে গেছে, কিন্তু গত তিনশো বছরের মধ্যে কেউ যায়নি।
মৌনী লামার হেঁয়ালি কথাতেও যখন আমরা নিরুদ্যম হইনি, তখন যাযাবরদের বারণ আমরা মানব কেন? চার্লস উইলার্ডের ডায়রি রয়েছে আমাদের কাছে। তার কথার উপর ভরসা রেখেই আমাদের চলতে হবে।
১৮ই আগস্ট। চাং থাং-ল্যা ৩২ ন, লং ৮২.৮ ই।
একটা লেকের ধারে ক্যাম্পের ভিতর বসে ডায়রি লিখছি। আজ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একটা প্ৰায় সমতল উপত্যকা দিয়ে হেঁটে চলেছি, আকাশে ঘন কালো মেঘ, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে, এমন সময় সন্ডার্স চেঁচিয়ে উঠল-ওগুলো কী?
সামনে বেশ কিছু দূরে যেখানে জমিটা খানিকটা উপর দিকে উঠছে, তার ঠিক সামনে কালো কালো অনেকগুলো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। জানোয়ারের পাল বলেই তো মনে হচ্ছে। রাবসাংকে জিজ্ঞেস করতে সে সঠিক কিছু বলতে পারল না। ক্রোল অসহিষ্ণুভাবে বলল, তোমার অমনিস্কোপে চোখ লাগাও।
অমনিস্কোপ দিয়ে দেখে মনে হল সেগুলো জানোয়ার, তবে কী জানোয়ার, কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বোঝা গেল না। শিং আছে কি? ক্রোল জিজ্ঞেস করল। সে ছেলেমানুষের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে বলতে হল যে শিং আছে কি নেই তা বোঝা যাচ্ছে না।
কাছে গিয়ে ব্যাপার বুঝে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটা বুনো গাধার পাল, সংখ্যায় প্রায় চল্লিশটা হবে, সব কটা মরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। রাবাসাং এইবার ব্যাপারটা বুঝেছে। বলল, শীতকালে বরফের ঝড়ে সেগুলো মরেছে। তারপর গরমকালে বরফ গলে গিয়ে মৃতদেহগুলো সেই দাঁড়ানো অবস্থাতেই আবার বেরিয়ে পড়েছে।
আমাদের খাবারের স্টক কমে আসছে। যাযাবরদের কাছ থেকে ভারতীয় টাকার বিনিময়ে কিছু চা আর মাখন কিনে নিয়েছিলাম, সেটা এখনও চলবে কিছুদিন। মাংসে আমাদের সকলেরই অরুচি ধরে গেছে। শাক সবজি গম ইত্যাদি ফুরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে আমার তৈরি ক্ষুধাতৃষ্ণানাশক বটিক ইন্ডিকা খেতে হয়েছে সকলকেই। আর কিছুদিন পরে ওই বড়ি ছাড়া আর কিছুই খাবার থাকবে না। ক্রোল মেক্সিকো থেকে আরম্ভ করে বোর্নিও পর্যন্ত এগারোটা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম ম্যাজিক প্রয়োগ করে গুণে বার করতে চেষ্টা করছে। আমাদের কপালে একশৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হবে কি না। পাঁচটা ম্যাজিক বলছে না, ছটা বলছে হ্যাঁ।
আমরা যেখানে ক্যাম্প ফেলেছি তার উত্তরে-অর্থাৎ আমরা যেদিকে যাব সেইদিকে— প্রায় ৩০-৪০ মাইল দূরে একটা অংশ দেখে মনে হচ্ছে সেখানে জমিটা যেন একটা সিঁড়ির ধাপের মতো উপর দিকে গেছে। অমনিস্কোপ দিয়ে দেখে সেটাকে একটা টেবল মাউন্টেনের মতো মনে হচ্ছে। এটাই কি ডুংলুং-ডো? উইলার্ড তার ডায়রিতে যে জায়গার অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছে আমরা তার খুবই কাছে এসে পড়েছি।
কিন্তু উইলার্ড যাকে এ ওয়ান্ডারফুল মনাস্ট্রি বলেছে সেই থোকচুম-গুম্ফা কোথায়? আর দুশো বছরের উড়ন্ত লামাই বা কোথায়?
আর ইউনিকৰ্নই বা কোথায়?
১৯শে আগস্ট
এক আশ্চৰ্য গুম্ফায় এক লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। এটাই যে উইলার্ডের থোকচুম-গুম্ফা তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কারণ গুম্ফায় পৌঁছানোর তিন মিনিট আগেই রাস্তার ধারে একটা পাথরের গায়ে সেই বিখ্যাত তিব্বতি মহামস্ত্রের নীচে তিনটে ইংরাজি অক্ষর খোদাই করা দেখলাম। সি. আর. ডব্ল্য—অর্থাৎ চালর্স রক্সটন উইলার্ড। আগেই বলে রাখি আমাদের কুলির মধ্যে রাবসাং ও টুথুপ ছাড়া আর সকলেই পালিয়েছে। রাবসাং পালাবে না বলেই আমার বিশ্বাস। সে যে শুধু বিশ্বাসী তা নয়; তার মধ্যে কুসংস্কারের লেশমাত্র নেই। তিব্বতিদের মধ্যে সে একটা আশ্চর্য ব্যতিক্রম। অন্যেরা যাবার সময় আমাদের সব কটা ঘোড়া এবং চারটে চমরি নিয়ে গেছে। বাকি আছে দুটো মাত্র চমরি। আমাদের তাঁবু এবং আরও কিছু ভারী জিনিস এই দুটোর পিঠে চলে যাবে। বাকি জিনিস আমাদের নিজেদের বইতে হবে। আর ঘোড়া যখন নেই, তখন বাকি পথটা হেঁটেই যেতে হবে। সেই খাড়া উঠে যাওয়া উপত্যকার অংশটা ক্ৰমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, আর সেই কারণেই আমাদের দলের সকলের মধ্যেই একটা চাঞ্চল্যের ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। আমাদের সকলেরই বিশ্বাস ওটাই ডুংলুং-ডো, যদিও ডুংলুং-ডো যে কী তা এখনও কেউ জানি না। সন্ডার্সের মতে ওটা একটা কেল্লার প্রাচীর। আমার ধারণা ওটার পিছনে একটা হ্রদ আছে, যার কোনও উল্লেখ পৃথিবীর কোনও মানচিত্রে নেই।
যে গুম্ফাটার কথা লিখতে যাচ্ছি সেটার অস্তিত্ব প্রায় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত বোঝা যায়নি। তার কারণ সেটা একটা বেশ উচু গ্র্যানিটের টিলার পিছনে লুকোনো ছিল। টিলােটা পেরোতেই গুম্ফাটা দেখা গেল, আর দেখামাত্র আমাদের সকলের মুখ দিয়েই নানারকম বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। সূৰ্য মেঘের আড়ালে থাকা সত্ত্বেও গুম্ফার জৌলুস দেখে মনে হয় তার আপাদমস্তক সোনা দিয়ে মোড়া।
কাছে গিয়ে কেমন যেন ধারণা হল যে, গুম্ফায় লোকজন বেশি নেই। একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা সেটাকে ঘিরে রেখেছে। আমরা পাহাড়ে পথ দিয়ে উঠে গুম্ফার ভিতরে ঢুকলাম। চৌকাঠ পেরোতেই মাথার উপর প্রকাণ্ড ব্রোঞ্জের ঘণ্টা। ক্রোল তার দড়ি ধরে টান দিতেই গুরুগম্ভীর স্বরে সেটা বেজে উঠল, এবং প্রায় তিন মিনিট ধরে সেই ঘণ্টার রেশ গুম্ফার ভিতর ধ্বনিত হতে লাগল।
ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম যে, সেখানে অনেকদিন কোনও মানুষের পা পড়েনি। কেবল মানুষ ছাড়া একটা গুম্ফায় যা থাকে তার সবই এখানে রয়েছে। সন্ডার্স দু-একবার হ্যালো হ্যালো করেও কোনও উত্তর না পাওয়াতে আমরা নিজেরাই একটু ঘুরে দেখব বলে স্থির করলাম। ক্রোলের হাবভাবে বুঝলাম সে মার্কোভিচকে একা ছাড়বে না। সোনার প্রতি যার এমন লোভ, তাকে এখানে একা ছাড়া যায় না। সন্ডার্স হলঘরের বাঁ দিকের দরজার দিকে এগিয়ে গেল, আমি আর অবিনাশবাবু গেলাম। ডান দিকে। গুম্ফার মেঝেতে ধুলো জমেছে,
এমন সময় একটা বিকট চিৎকারে আমাদের রক্ত জল হয়ে গেল।
সন্ডার্সের গলা। দৌড়ে গেলাম অনুসন্ধান করতে। ক্রোল, মার্কোভিচ। আর আমরা দুজন প্রায় একই সঙ্গে পৌঁছোলাম বাঁ দিকের একটা মাঝারি। আয়তনের ঘরে। সন্ডার্স পুবদিকের
দরজার পাশে শরীরটা কুঁকড়ে ফ্যাকাশে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি ঘরের পিছন দিকে।
এবার বুঝতে পারলাম তার আতঙ্কের কারণ।
একটি অতিবৃদ্ধ শীর্ণকায় মুণ্ডিতমস্তক লামা ঘরের পিছন দিকটায় বসে আছেন পদ্মাসনের ভঙ্গিতে। তাঁর শরীর সামনের দিকে ঝুকে পড়েছে, তাঁর হাত দুটো উপুড় করে রাখা রয়েছে একটা কাঠের ডেস্কের উপর খোলা একটা জীর্ণ পুঁথির পাতায়। লামার দেহ নিস্পন্দ, তাঁর চামড়ার যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে তার রং ছেয়ে নীল, আর সে চামড়ার নীচে মাংসের লেশমাত্র নেই।
লামা মৃত। কবে কীভাবে মরেছেন সেটা জানার কোনও উপায় নেই, আর কীভাবে যে তাঁর দেহ মৃত্যুজনিত বিকারের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটাও বোঝার কোনও উপায় নেই।
সন্ডার্স এতক্ষণে খানিকটা সামলে নিয়েছে। কিছুদিন থেকেই তার স্নায়ু দুর্বল হয়েছে, তাই সে এতটা ভয় পেয়েছে। আমি জানি আমাদের অভিযান সার্থক হলে সে নিঃসন্দেহে তার স্বাস্থ্য ফিরে পাবে।
এবারে আমার দৃষ্টি গেল। ঘরের অন্যান্য জিনিসের দিকে। একদিকের দেয়ালের সামনে পিতল ও তামার নানারকম পাত্র। হঠাৎ দেখলে মনে হবে বুঝি রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছি। এগিয়ে গিয়ে দেখি পাত্রগুলোর মধ্যে নানা রঙের পাউডার, তরল ও চিটচিটো পদার্থ রয়েছে। সেগুলো চেনা খুব মুশকিল। অন্যদিকের দেয়ালে সারি সারি তাকে রাখা রয়েছে অজস্র পুঁথি, আর তার নীচে মেঝেতে রয়েছে আশ্চৰ্য সুন্দর কাজকরা পাথর বসানো আট জোড়া তিব্বতি জানোয়ারের লোম ইত্যাদি। ক্রোল বলে উঠল, এই প্রথম একটা গুম্ফায় এসে তিব্বতি ম্যাজিকের গন্ধ পাচ্ছি।
আমার ভয়ডর বলে কিছু নেই, তাই আমি এগিয়ে গেলাম। লামার মৃতদেহের দিকে। তিনি কোন বিষয়ে অধ্যয়ন করতে করতে দেহরক্ষা করেছেন সেটা জানা দরকার। আগেই লক্ষ করেছি যে, পুঁথির অক্ষরগুলো দেবনাগরী, তিব্বতি নয়।
পুঁথিটা ধরে টান দিতে সেটা মৃত লামার হাতের তলা থেকে বেরিয়ে চলে এল আমার হাতে। লামার হাত দুটো সেই একইভাবে রয়ে গেল চৌকির দুইঞ্চি উপরে।
পুঁথির পাতা উলটেপালটে বুঝতে পারলাম তার বিষয়টা বৈজ্ঞানিক। ক্রোল জিজ্ঞেস করাতে বললাম, সেটা চিকিৎসাশাস্ত্ৰ সম্পর্কে, যদিও জানি আসলে তা নয়। যাই হোক, আর সময় নষ্ট না করে, সেটাকে সঙ্গে নিয়ে মৃত লামাকে সেই বসা অবস্থাতেই রেখে আমরা গুম্ফার অন্ধকার থেকে দিনের আলোয় বেরিয়ে এলাম।
এখন দুপুর দুটো। আমি গুম্ফার সামনেই একটা পাথরের উপর বসে আছি। পুঁথির অনেকখানি পড়া হয়ে গেছে। তিব্বতে যে ধর্মের বাইরেও কোনও কিছুর চর্চা হয়েছে, এই পুঁথিই তার প্রমাণ। অবিশ্যি এই বিশেষ লামাটি ছাড়া এই বিশেষ বিষয়টি নিয়ে কেউ চৰ্চা করেছে কি না সন্দেহ। এতে যা বলা হয়েছে তার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। পুঁথির নাম উডয়নসূত্রম। নিছক রাসায়নিক উপায়ে মানুষ কীভাবে আকাশে উড়তে পারে তারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এতে। এই উডয়নসূত্রমের কথা আমি শুনেছি। বৌদ্ধ যুগে তক্ষশীলায় একজন মহাপণ্ডিত ছিলেন। তাঁর নাম ছিল বিদ্যুদ্ধমনী। তিনিই এই বৈজ্ঞানিক সূত্র রচনা করেন, এবং করার কিছু পরেই তিব্বত চলে যান। আর তিনি ভারতবর্ষে ফেরেননি। তাঁর বিজ্ঞান সম্বন্ধেও ভারতবর্ষে কেউ কোনওদিন কিছু জানতে পারেনি।
পুঁথি পড়ে এক আশ্চর্য পদার্থের কথা জানা যাচ্ছে, যার নাম ংমুং। এই ংমুং-এর সাহায্যে মানুষের ওজন এত কমিয়ে দেওয়া যায় যে, একটা দমকা বাতাস এলে সে মানুষ রাজহংসের দেহত্যুত পালকের মতো শূন্যে ভেসে বেড়াতে পারে। এই সংমুং যে কীভাবে তৈরি করতে হয়
সেটা পুঁথিতে লেখা আছে, কিন্তু তার জন্যে যে সব প্রয়োজনীয় উপাদানের কথা বলা হয়েছে তার একটারও নাম আমি কখনও শুনিনি। বালীক, ষলক্ৰ, ত্ৰিগন্ধা, অভ্রনীল, থুমা, জঢ়া-এই কোনওটাই আমার জানা নয়। যাঁর হাতের তলা থেকে পুঁথিটা নিয়ে এলাম। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন, এবং এই সব উপাদানের সাহায্যে তিনি নিশ্চয়ই ধ্ৰুংমুং তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে ইনিই সেই টু হান্ড্রেড ইয়ার ওল্ড লামা—যাঁর সঙ্গে উইলার্ড ওই ংমুং-এর সাহায্যেই আকাশে উড়েছিলেন। ইনি যে গত এক বছরের মধ্যে পরলোকগমন করবেন। সেটা আমাদের দুৰ্ভাগ্য; না হলে আমাদের পক্ষেও নিশ্চয়ই উইলার্ডের মতো আকাশে ওড়া সম্ভব হত।
সকলে রওনা হবার জন্য তৈরি। লেখা বন্ধ করি।
২০শে আগস্ট। ল্যা. ৩৩.৩ না, ৮৪ লং ই।
উইলার্ডের ডায়রিতে এই জায়গাতেই ক্যাম্প ফেলার উল্লেখ আছে। আমরাও তাই করেছি। আমরা বলতে, যা ছিল তার চেয়ে দু জন কম, কারণ মার্কোভিচ ওরফে মার্কহ্যাম উধাও, আর সে-ই নিশ্চয়ই সঙ্গে করে টুঙুপকে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আমাদের দুটি চমরির একটিও গেছে। আমি কদিন থেকেই মার্কোভিচকে মাঝে মাঝে টুগুপের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। তখন অতটা গা করিনি। এখন বুঝতে পারছি ভিতরে ভিতরে একটা ষড়যন্ত্র চলছিল।
ঘটনোটা ঘটে কাল বিকেলে। গুম্ফা থেকে রওনা হবার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমাদের একটা প্ৰলয়ংকর ঝড়ে পড়তে হয়েছিল। যাকে বলে ব্লাইন্ডিং স্টর্ম। সাময়িকভাবে সত্যিই আমরা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। কে কোথায় রয়েছে, কোনদিকে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। প্রায় আধঘণ্টা পরে ঝড় কমলে পর দেখি দুটি মানুষ আর একটি চমরিকম। তার উপরে যখন দেখলাম যে একটি বন্দুকও কম, তখন বুঝতে বাকি রইল না যে ব্যাপারটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়। মার্কোভিচ প্ল্যান করেই পালিয়েছে এবং তার ফেরার কোনও মতলব নেই। একদিক দিয়ে বলা যেতে পারে। আপদ বিদেয় হল, কিন্তু সেই সঙ্গে আবার আপশোঁস হল যে তার শয়তানির উপযুক্ত শাস্তি হল না। ক্রোল তো চুল ছিড়তে বাকি রেখেছে। বলেছে এসব লোকের সঙ্গে ভালমানুষি করার ফল হচ্ছে এই যাই হোক, যে চলে গেছে তার কথা ভেবে আর লাভ নেই। আমরা তাকে ছাড়াই ডুংলুং-ডোর উদ্দেশে পাড়ি দেব। উত্তরে চাইলেই এখন ডুংলুং-ডোর প্রাচীর দেখতে পাচ্ছি। এখনও মাইলপাঁচেক দুর। তা সত্ত্বেও প্রাচীরের বিশালত্ব সহজেই অনুমান করা যায়। পুব-পশ্চিমে অন্তত মাইল কুড়ি-পঁচিশ লম্বা বলে মনে হয়। উত্তর-দক্ষিণের দৈর্ঘ্য বোঝার কোনও উপায় নেই। বোধ হয় ডুংলুং-ডোর দিক থেকেই একটা গন্ধ মাঝে মাঝে হাওয়ায় ভেসে আসছে, সেটাকে প্রথমে কন্দ্ৰস্তুরী বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন অন্যরকম লাগছে। সেটা কীসের গন্ধ বলা শক্ত, শুধু এটুকু বলতে পারি যে, এমন খোসবু আমাদের কারুর নাকে এর আগে কখনও প্রবেশ করেনি।
আবার ঝোড়ো বাতাস আরম্ভ হল। এবার তাঁবুতে গিয়ে ঢুকি।
২০শে আগস্ট, দুপুর দেড়টা
বরফের ঝড় বইছে। ভাগ্যিস গিয়ানিমার বাজার থেকে বিলিতি তাঁবুর বদলে তিব্বতি পশমের তাঁবু কিনে নিয়েছিলাম।
আজ সারাটা দিন এ ক্যাম্পেই থাকতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
২০শে আগস্ট, বিকেল পাঁচটা
আমাদের তিব্বত অভিযানের একটা হাইলাইট বা বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা এই কিছুক্ষণ আগে ঘটে গেল।
তিনটে নাগাদ ঝড়টা একটু কমলে পর রাবসাং আমাদের চারজনকে মাখন-চা দিয়ে গেল। বাইরে ঝড়ের শব্দ কমলেও দমকা বাতাসে আমাদের তাঁবুর কাপড় বার বার কেঁপে উঠছিল। অবিনাশবাবু তাঁর চায়ে চুমুক দিয়ে ভেরি গুড কথাটা সবে উচ্চারণ করেছেন এমন সময় বাইরে, যেন বহুদূর থেকে, একটা চিৎকার শোনা গেল। পুরুষকণ্ঠে পরিত্ৰাহি চিৎকার। কথা বোঝার উপায় নেই, শুধু আৰ্তনাদের সুরাটা বোঝা যাচ্ছে। আমরা চারজনে চায়ের পাত্র রেখে ব্যস্তভাবে তাঁবুর বাইরে এলাম।
হেলপ, হেলপি. সেভ মি! হেলপ!…
এবার বোঝা যাচ্ছে। কণ্ঠস্বরও চেনা যাচ্ছে। অ্যাদ্দিন মার্কোভিচ ইংরিজি বলেছে রাশিয়ান উচ্চারণে, এই প্রথম তার মুখে খাঁটি ইংরেজের উচ্চারণ শুনলাম। কিন্তু লোকটা কোথায়। রাবসাংও হতভম্বর মতো এদিকে ওদিকে চাইছে, কারণ চিৎকারটা একবার মনে হচ্ছে দক্ষিণ থেকে, একবার মনে হচ্ছে উত্তর থেকে আসছে।
হঠাৎ ক্রোল চেঁচিয়ে উঠল—ওই তো!
সে চেয়ে আছে উত্তরে নয়, দক্ষিণে নয়—একেবারে শূন্যে, আকাশের দিকে। মাথা তুলে স্তম্ভিত হয়ে দেখি মার্কোভিচ শূন্যে ভাসতে ভাসতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একবার
সে নীচের দিকে নামে, পরীক্ষণেই এক দমকা বাতাস তাকে আবার উপরে তুলে দেয়। এই অবস্থাতেই সে ক্রমাগত হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।
কীভাবে সে এই অবস্থায় পৌঁছোল সেটা ভাববার সময় নেই, কী করে তাকে নামানো যায় সেটাই সমস্যা। কারণ পাগলা হাওয়া যে শুধু থামছেই না তা নয়, ক্ষণে ক্ষণে তার বেগ ও গতিপথ বদলাচ্ছে।
লেট হিম স্টে দেয়ার! সন্ডার্স হঠাৎ বলে উঠল। ক্রোল সে কথায় তৎক্ষণাৎ সায় দিল। তারা বুঝেছে মার্কোভিচকে শাস্তি দেবার এটা চমৎকার পস্থা। এদিকে আমার বৈজ্ঞানিক মন বলছে মার্কোভিচ নীচে না নামলে তার ওড়ার কারণটা জানা যাবে না। রাবসাং কিন্তু ইতিমধ্যে তার তিব্বতি বুদ্ধি খাটিয়ে কাজে লেগে গেছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে খানদশেক লম্বা চমরির লোমের দড়ি পরস্পরের সঙ্গে গেরো বেঁধে তার এক মাথায় একটা পাথর বেঁধে সেটাকে মার্কোভিচের দিকে তাগ করে ছোড়ার জন্য তৈরি হল।
ক্রোল তাকে গিয়ে বাধা দিল। মার্কোভিচ এখন আমাদের মাথার উপর এসে পড়েছে। ক্রোল তার দিকে ফিরে কর্কশ গলায় চিৎকার করে বলল, ড্রপ দ্যাট গান ফাস্ট। অর্থাৎ, আগে তোমার হাত থেকে বন্দুকটা নীচে ফেলো। মার্কোভিচের হাতে বন্দুক রয়েছে সেটা এতক্ষণ দেখিনি।
মার্কোভিচ বাধ্য ছেলের মতো তার হাতের মানলিখারটা ছেড়ে দিল, আর সেটা আমাদের থেকে দশ হাত দূরে মাটিতে পড়ে খানিকটা আলগা বরফ চারদিকে ছিটিয়ে দিল।
এবার রাবসাং দড়ির মাথায় বাঁধা পাথরটা মার্কোভিচের দিকে ছুড়ে দিল। অব্যৰ্থ লক্ষ্য। মার্কোভিচ খপ করে সেটা লুফে নিল। তারপর রাবসাং একাই অনায়াসে তাকে টেনে মাটিতে নামিয়ে আনল।
এইবার লক্ষ করলাম যে, মৃত লামার ঘরে যে বাহারের বুটজুতো দেখেছিলাম, তারই একজোড়া রয়েছে মার্কোভিচের পায়ে। এ ছাড়া তার কাঁধের ঝোলার ভিতর থেকেও গুম্ফার অনেক জিনিস বেরোল, তার অধিকাংশই সোনার। ডাকাত হাতে হাতে ধরা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে এমনই একটা আশ্চর্য জিনিসের সন্ধান সে আমাদের দিয়েছে যে, তাকে শাস্তি বা ধমক দেওয়ার কথাটা আমাদের মনেই হল না।
মার্কোভিচ আমাদের ছেড়ে পালিয়েছিল ঠিকই, আর তার মতলব ছিল যাবার পথে মৃত লামার গুম্ফা থেকে বেশ কিছু মূল্যবান দ্রব্য সরিয়ে নেওয়া। মূর্তিটুর্তি ঝোলায় ভরার পর তার বুটের কথাটা মনে পড়ে। সেদিন থেকেই তার লোভ লেগেছিল ওই জিনিসটার ওপর। বুট নিয়ে বাইরে এসে সেটা পরে দু-এক পা হেঁটেই বুঝতে পারে নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। এইভাবে টুগুপ সমেত দু-মাইল সে দিব্যি চলেছিল, এমন সময় এক উত্তরমুখী ঝড় এসে তার সমস্ত ফন্দি ভাণ্ডুল করে দিয়ে তাকে আকাশে তুলে নিয়ে আবার আমাদেরই কাছে এনে হাজির করে।
ক্রোল ও সন্ডার্স স্বভাবতই এই কাহিনী শুনে একেবারে হতভম্ব। তখন আমি তাদের পুঁথি আর ংমুং-এর কথাটা বললাম। কিন্তু তার সঙ্গে এই বুটের সম্পর্ক কী? প্রশ্ন করল সন্ডার্স। আমি বললাম, পুঁথিতে এইংমুং-এর সঙ্গে মানুষের গুলফ বা গোড়ালির একটা সম্পর্কের কথা বলা আছে। আমার বিশ্বাস এই দুইয়ের সংযোগেই মানুষের দেহের ওজন কমে যায়। আমি জানি ওই বুটের সুকতলায় ংমুং-এর প্রলেপ লাগানো আছে।
অন্য সময় হলে কী হত জানি না, চোখের সামনে মার্কোভিচকে উড়তে দেখে ক্রোল ও সন্ডার্স দুজনকেই আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হল। বলা বাহুল্য, এই তিব্বতি বুট আমাদের
প্রত্যেকেরই একটা করে চাই। রাবসাংকে বলতে সে বলল, সে নিজেই গুম্ফা থেকে আমাদের চারজনের জন্য চার জোড়া জুতো নিয়ে আসবে।
মার্কোভিচ এখন একেবারে সুবোধ বালকটি। তার কাছে চোরাই মাল যা ছিল সব আমরা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছি। সেগুলো ফেরার পথে সব যথাস্থানে রেখে দেওয়া হবে। মার্কোভিচ জানে যে, আমাদের কাছে তার মুখোশ খুলে গেছে। এরপর সে আর কোনও বাঁদরামি করবে: বলে তো মনে হয় না। তবে অঙ্গারঃ শতধেীতেন… ইত্যাদি।
২১শে আগস্ট।
আমরা ডুংলুং-ডোর প্রাচীরের সামনে ক্যাম্প ফেলে বসে আছি কাল বিকেল থেকে। খাড়াই উঠে গেছে। প্রাচীর প্রায় দেড়শো ফুট! এটা যে কী দিয়ে তৈরি তা ভূতত্ত্ববিদ সন্ডার্স পর্যন্ত বলতে পারল না। কোনও চেনা পাথরের সঙ্গে এই গোলাপি পাথরের কোনও মিল নেই। এ পাথর আশ্চর্য রকম মসৃণ ও আশ্চর্য রকম মজবুত। ধাপে ধাপে গর্ত করে তাতে পা ফেলে ওপরে ওঠার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। ক্রোল তিব্বতি বুট পরে দু-একবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু হাওয়ার অভাবে বিশ-পাঁচিশ ফুটের ওপরে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ প্রাচীরের পিছনে কী আছে জানিবার একটা অদম্য কৌতূহল হচ্ছে। সন্ডার্স বলছে এটা একটা দুর্গ জাতীয় কিছু। আমি এখনও বলছি হ্রদ।
অবিনাশবাবু আরও পুণ্য সঞ্চায়ের জন্য তৈরি হয়ে আছেন। প্রাচীরের পিছন থেকে কোনওরকম শব্দ না পেলেও ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল মনমাতানো গন্ধে চারিদিক মশগুল হয়ে আছে। আমরা তিন-তিনজন ডাকসাইটে বৈজ্ঞানিক এই গন্ধের কোনও কারণ খুঁজে না পেয়ে বোকা বনে আছি।
২২শে আগস্ট।
আশ্চর্য বুদ্ধি প্রয়োগ-অভাবনীয় তার ফল।
আমাদের সঙ্গে পুরনো খবরের কাগজ ছিল অনেক। সেইগুলোর সঙ্গে দুটো তিব্বতি ম্যাপ আর কিছু র্যাপিং পেপার জুড়ে, আমাদের স্টকের তার দিয়ে কাঠামো বানিয়ে, একেবারে খাঁটি দিশি উপায়ে একটা ফানুস তৈরি করে আগুন জ্বালিয়ে তাতে গ্যাস ভরলাম। তারপর সেটার সঙ্গে একটা দুশো ফুট লম্বা দড়ি বাঁধলাম। সেই দড়িতে আমার ক্যামেরা বেঁধে, পাঁচিলের দিকে তার মুখ ঘুরিয়ে পনেরো সেকেন্ড। পরে আপনি ছবি উঠবে এরকম একটা ব্যবস্থা করে ফানুস ছেড়ে দিলাম। দড়ি-ক্যামেরা সমেত সাঁই সাঁই করে ফানুস উপরের দিকে উঠে গেল। প্রাচীরের মাথা ছাড়িয়ে যেতে লাগল। ছসেকেন্ড। তারপর আর দড়ি ছুড়লাম না। বিশ সেকেন্ড। পরে ফানুস সমেত ক্যামেরা নামিয়ে আনলাম।
ছবি উঠেছে। রঙিন ছবি। হ্রদের ছবি নয়। দুর্গেরও ছবি নয়। গাছপালা লতাগুলেম ভরা এক অবিশ্বাস্য সুন্দর সবুজ জগতের ছবি। এরই নাম ডুংলুং-ডো।
আপাতত আমরা প্রাচীর থেকে প্রায় বারোশো গজ দূরে একটা পাথরের টিবির পাশে বসে আছি। আমাদের পাঁচজনেরই পায়ে তিব্বতি বুট। আমরা অপেক্ষা করছি ঝড়ের জন্য। আশা আছে, সেই ঝড় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে ডুংলুং-ডোর প্রাচীরের ওপারের রাজ্যে গিয়ে ফেলবে। তারপর কী আছে কপালে জানি না।
৩০শে আগস্ট।
দূরে-বহু দুরে—একটা দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এটা যদি দাসুন্দল হয় তা হলে আমাদের আর কোনও আশা নেই। ডুংলুং-ডোর আবহাওয়ায় পাঁচদিনে আমাদের যে স্বাস্থেন্নোতি হয়েছিল তার জোরেই আমরা এই দশ মাইল পথ হেঁটে আসতে পেরেছি। কিন্তু এখন শক্তি কমে আসছে। আমরা যেদিকে যাচ্ছি। হাওয়া বইছে তার উলটো দিকে, তাই তিব্বতি বুটগুলোও কোনও কাজে আসছে না। খাবারদাবারও ফুরিয়ে আসছে, বড়িও বেশি নেই। এ অবস্থায় পিস্তল বন্দুক সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও, একটা বড় দাসুদৃদল এসে পড়লে আমাদের চরম বিপদে পড়তে হবে। এমনিতেই আমরা একজনকে হারিয়েছি। অবিশ্যি তার মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী। তার অতিরিক্ত লোভই তাকে শেষ করেছে।
অবিনাশবাবুর ধারণা, যে দলটা এগিয়ে আসছে সেটা যাযাবরের দল। বললেন, আপনার যন্ত্রে কী দেখলেন জানি না মশাই। ওরা দস্যু হতেই পারে না। কৈলাস, মানস সরোবর ও ড়ুডুংলা দেখার ফলে আমি দিব্যদৃষ্টি পেয়েছি। আমি স্পষ্ট দেখছি ও দল আমাদের কোনও অনিষ্ট করতে পারে না।
যাযাবরের দল হলে অনিষ্ট করার কথা নয়। বরং তাদের কাছ থেকে ঘোড়া, চমরি, খাবারদাবার ইত্যাদি সব কিছুই পাওয়া যাবে। তার ফলে আমরা যে নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারব সে ভরসাও আছে আমার।
সাঁইত্রিশ ঘণ্টা ঝড়ের অপেক্ষায় বসে থেকে তেইশ তারিখ দুপুরে দেড়টা নাগাদ আকাশের অবস্থা ও তার সঙ্গে একটা শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম। আমরা যে রকম ঝড় চাই—অর্থাৎ যার গতি হবে উত্তর-পশ্চিম—সে রকম একটা ঝড় আসছে। অবিনাশবাবুর তন্দ্ৰা এসে গিয়েছিল, তাঁকে ঠেলে তুলে দিলাম। তারপর আমরা পাঁচজন বুটধারী ঝড়ের দিকে পিঠ করে ডুংলুং-ডোর প্রাচীরের দিকে বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম। তিন মিনিট পরে ঝড়টা এসে আমাদের আঘাত করল। আমার ওজন এমনিতেই সবচেয়ে কম—এক মণ তেরো সের—কাজেই সবচেয়ে আগে আমিই শূন্যে উঠে পড়লাম।
এই আশ্চৰ্য অভিজ্ঞতার সঠিক বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ঝড়ের দাপটে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলেছি। শূন্যপথ দিয়ে, আর ক্রমেই উপরে উঠছি। সেই সঙ্গে ডুংলুং-ডোর প্রাচীরও আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। সামনের দৃশ্য দ্রুত বদলে যাচ্ছে, কারণ প্রাচীর আর আমাদের দৃষ্টিপথে বাধার সৃষ্টি করছে না। প্রথমে পিছনে বহু দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ো দেখা গেল, তারপর ক্রমে ক্রমে প্রাচীর যে আশ্চৰ্য জগৎটাকে আমাদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছিল, সেই সবুজ জগৎ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। প্রাচীরের বাধা অতিক্রম করে আমরা সেই জগতে প্রবেশ করতে চলেছি। আমার পিছন দিকে ক্রোল, সন্ডার্স ও মার্কোভিচ ইংরিজি ও জার্মান ভাষায় ছেলেমানুষের মতো উল্লাস প্রকাশ করছে, আর অবিনাশবাবু বলছেন, ও মশাই-এ যে নন্দন কানন মশাই-এ যে দেখছি নন্দন কানান!
প্রাচীর পেরোতেই ঝড়ের তেজ ম্যাজিকের মতো কমে গেল। আমরা পাঁচজন বাতাসে ভেসে ঠিক পাখির পালকের মতোই দুলতে দুলতে ঘাসে এসে নোমলাম। সবুজ রং, তাই ঘাস বললাম, কিন্তু এমন ঘাস কখনও চোখে দেখিনি। সন্ডার্স চেঁচিয়ে উঠল—জানো শঙ্কু–এখানের একটি গাছও আমার চেনা নয়, একটিও নয়! এ একেবারে আশ্চৰ্য নতুন প্রাকৃতিক পরিবেশ!
কথাটা বলেই সে পাগলের মতো ঘাস পাতা ফুলের নমুনা সংগ্রহ করতে লেগে গেল। ক্রোল তার ক্যামেরা বার করে পটাপট ছবি তুলছে। অবিনাশবাবু ঘাসের উপর গড়াগড়ি দিয়ে বললেন, এইখানেই থেকে যাই মশাই। আর গিরিডি গিয়ে কাজ নেই। এ অতি উর্বর জমি। চাষ হবে এখানে। চাল ডাল সবজি সব হবে। মার্কোভিচ তার বুট খুলে লম্বা ঘাসের ভিতর দিয়ে জায়গাটা অনুসন্ধান করতে এগিয়ে গেল।
ডুংলুং-ডো আয়তনে প্রায় মানস সরোবরের মতোই বড়। বৃত্তাকার প্রাচীরের মধ্যে একটা অগভীর বাটির মতো জায়গা। দেখে মনে হয় কেউ যেন হাত দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। প্রাচীরের বাইরেটা নীচের দিকে খাড়া নেমে গেলেও ভিতরটা ঢালু হয়ে নেমেছে। সন্ডার্স ঠিকই বলেছে। এখানে একটা গাছও আমাদের চেনা নয়। তারও নয়, আমারও নয়, তবে প্রতিটি গাছই ডালপালা ফুলপাতা মিলিয়ে ছবির মতো সুন্দর।
আমরা চারজন বুট পরে লাফিয়ে লাফিয়ে অর্ধেক হেঁটে অর্ধেক উড়ে জায়গাটার ভিতর দিকে এগোচ্ছি এমন সময় হঠাৎ একটা শনশন শব্দ পেলাম। তারপর সামনের একটা বড় বড় পাতাওয়ালা গাছের মাথার উপর দিয়ে দূরে আকাশে প্রকাণ্ড একটা কী যেন দেখা গেল। সেটা ক্রমেই আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুঝতে পারলাম সেটা একটা পাখি। শুধু পাখি নয়—একটা অতিকায় পাখি। পাঁচশো ঈগল এক করলে যা হয় তেমন তার আয়তন।
মাইন গট্! বলে এক অস্ফুট চিৎকার করে ক্রোল তার মানলিখারটা পাখির দিকে উঁচোতেই আমি হাত দিয়ে সেটার নলটা নীচের দিকে নামিয়ে দিলাম। শুধু যে বন্দুকে ও পাখির কোনও ক্ষতি করা সম্ভব হবে না তা নয়, আমার মন বলছে পাখি আমাদের কোনও অনিষ্ট করবে না।
ঈগলের মুখ ও সাউথ আমেরিকান ম্যাকাওয়ের মতো ঝলমলে রঙের পালকওয়ালা অতি-বিশাল পাখিটা মাথার উপর তিনবার চক্রাকারে ঘুরে সমুদ্রগামী জাহাজের ভোঁয়ের মতো শব্দ করতে করতে যেদিক দিয়ে এসেছিল। সেই দিকেই চলে গেল। আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই একটা কথা বেরিয়ে পড়ল—রক!
হোয়াট? ক্রোল বন্দুক হাতে নিয়ে বোকার মতো প্রশ্ন করল।
আমি আবার বললাম—রক! অথবা রুখ। সিন্ধবাদের গল্পে এইরকমই একটা পাখির কথা ছিল।
ক্রোল বলল, কিন্তু আমরা তো আর অ্যারেবিয়ান নাইটস-এর রাজ্যে নেই। এ তো একেবারে বাস্তব জগৎ। পায়ের তলায় মাটি রয়েছে, হাত দিয়ে গাছের পাতা ধরছি, নাকে ফুলের গন্ধ পাচ্ছি…
সন্ডার্স তার বিস্ময় কাটিয়ে নিয়ে বলল, জঙ্গলের মধ্যে একটিও পোকামাকড় দেখছি না, সেটা খুবই আশ্চৰ্য লাগছে আমার।
আমরা চারজন এগোতে এগোতে হঠাৎ একটা বাধা পেলাম। এই প্রথম উদ্ভিদ ছাড়া অন্য কিছুর সামনে পড়তে হল। প্রায় দু মানুষের সমান উচু একটা নীল ও সবুজে মেশানো পাথুরে টিবি আমাদের সামনে পড়েছে। সেটা দুপাশে কতদূর পর্যন্ত গেছে জানি না। হয়তো ডাইনে বাঁয়ে কাছাকাছির মধ্যেই তার শেষ পাওয়া যাবে, কিন্তু ক্রোল আর ধৈর্য রাখতে পারল না। সে তার বুট সমেত একটা বিরাট লাফ দিয়ে অনায়াসে উড়ে গিয়ে টিবিটার মাথার উপর পড়ল। আর তারপরেই এক কাণ্ড। টিবিটা নড়ে উঠল। তারপর সেটা সবসুদ্ধ বাঁ দিকে চলতে আরম্ভ করল। ক্রেণলও তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে, এমন সময় সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল-মাইন গট!—ইট্স এ ড্রাগন!
ড্রাগনই বটে। ক্রোল ভুল বলেনি। সেই ড্রাগনের একটা বিশাল পিছনের পা এখন আমাদের সামনে দিয়ে চলেছে। অবিনাশবাবু ওরে বাবা বলে ঘাসের উপর বসে পড়লেন। ইতিমধ্যে ক্রোলও ড্র্যাগনের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে আমাদের কাছে চলে এসেছে। আমরা অবাক হয়ে এই মন্থরগতি দানবতুল্য জীবের যেটুকু অংশ দেখতে পাচ্ছি। তার দিকে চেয়ে রইলাম। প্রায় তিন মিনিট সময় লাগল ড্র্যাগনটার আমাদের সামনে দিয়ে লেজটা একিয়ে বেঁকিয়ে গাছপালার পিছনে অদৃশ্য হয়ে যেতে। যে ধোঁয়াটা এখন বনের বেশ খানিকটা অংশ ছেয়ে ফেলেছে সেটা ওই ভু্যাগনের নিশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
এতক্ষণে ক্রোলের বোধ হয় আমার কথায় বিশ্বাস হয়েছে। তার অদ্ভুত নিরীহ ভ্যাবাচাকা ভাব থেকে তাই মনে হয়। সন্ডার্স বলল,চারিদিকের এই সম্পূর্ণ অপরিচিত প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে নিজেকে একেবারে অশিক্ষিত বর্বর বলে মনে হচ্ছে, শঙ্কু!
আমি বললাম, আমার কিন্তু ভালই লাগছে। আমাদের এই গ্রহে যে জ্ঞানী মানুষের বিস্ময় জাগানোর মতো কিছু জিনিস এখনও রয়েছে, এটা আমার কাছে একটা বড় আবিষ্কার।
আরও ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়িয়ে বিস্ময় জাগানোর মতো কত প্ৰাণী যে দেখলাম তার হিসেব নেই। একটা ফিনিক্সকে আগুনে পোড়ার ঠিক আগের মুহূর্ত থেকে, তার জায়গায় নতুন ফিনিক্সকে জন্মে পাখা মেলে সূর্যের দিকে উড়ে যেতে দেখেছি। এ ছাড়া উপকথার পাখির মধ্যে গ্রিফন দেখেছি; পারস্যের সিমূর্ঘ, আরবদের আঙ্কা দেখেছি, রুশদের নোর্ক আর জাপানিদের ফেং ও কির্নে দেখেছি। সরীসৃপের মধ্যে চোখের চাহনিতে ভস্ম করা ব্যাসিলিস্ক দেখেছি। একটা আগুনে অদাহ্য স্যালিম্যান্ডারকে দেখলাম তার বিশেষত্ব জাহির করার জন্যই যেন বার বার একটা অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করছে, আর অক্ষত দেহে বেরিয়ে আসছে। একটা প্রকাণ্ড চতুৰ্দন্ত শ্বেতহস্তী দেখেছি, সেটা ইন্দ্রের ঐরাবত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আর সেটা যে গাছের ডালপালা ছিড়ে খাচ্ছিল, তার পত্রপুষ্পের চোখ ঝলসানো বর্ণচ্ছটা দেখে সেটা যে স্বর্গের পারিজাত, তা অবিনাশবাবুও সহজেই অনুমান করলেন। তবে জায়গাটা যে সবটাই বৃক্ষলতাগুল্মশোভিত নন্দন কানন, তা নয়। উত্তরের প্রাচীর ধরে মাইলখানেক যাবার পর হঠাৎ দেখি, গাছপালা ফুলফল সব ফুরিয়ে গিয়ে ধূসর রুক্ষ এক পাথরের রাজ্যে হাজির হয়েছি। সামনে বিশাল বিশাল প্রস্তরখণ্ডের স্তৃপ নিয়ে এক পাহাড়, তার গায়ে একটা গুহা, আর সে গুহার ভিতর থেকে রক্ত হিম করা বিচিত্র সব হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে।
বুঝতে পারলাম। আমরা রাক্ষসের রাজ্যের প্রবেশপথে এসে পড়েছি। রাক্ষস সব দেশেরই উপকথাতে আছে, আর তাদের বর্ণনাও মোটামুটি একই রকম। সন্ডার্স গুহায় প্রবেশ করতে মোটেই রাজি নয়। ক্রোলের দোনামনা ভাব। এটা দেখেছি যে এখানকার প্রাণীরা আমাদের গ্রাহ্যই করে না; কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি ইতস্তত করছি, কারণ অবিনাশবাবু আমার কোটের আস্তিন ধরে চাপ মেরে বুঝিয়ে দিচ্ছেন—ঢের হয়েছে, এবার চলুন ফিরি—এমন সময় একটা তারস্বরে চিৎকার শুনে আমাদের সকলেরই মনটা সেইদিকে চলে গেল।
ইউনিকর্নস! ইউনিকর্নস! ইউনিকর্নস!
বাঁ দিকে একটা মস্ত ঝোপের পিছন থেকে মার্কোভিচের গলায় চিৎকারটা আসছে।
ও কি আবার কোকেন খেল নাকি? ক্রোল প্রশ্ন করল।
মোটেই না বলে আমি এগিয়ে গেলাম ঝোপটার দিকে। সেটা পেরোতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল।
ছোট বড় মাঝারি নানান সাইজের একটা জানোয়ারের পাল আমাদের সামনে দিয়ে চলেছে। তাদের গায়ের রং গোলাপি আর খয়েরি মেশানো। গোরু আর ঘোড়া—এই দুটো প্রাণীর সঙ্গেই তাদের চেহারার মিল রয়েছে, আর রয়েছে প্ৰত্যেকটার কপালে একটা করে প্যাঁচানো শিং। বুঝতে পারলাম যে, এদের সন্ধানেই আমাদের অভিযান। এরাই হল একশৃঙ্গ বা ইউনিকর্ন। প্লিনির ইউনিকর্ন, বিদেশের রূপকথার ইউনিকর্ন, মহেঞ্জোদাড়োর সিলে খোদাই করা ইউনিকর্ন।
জানোয়ারগুলোর সব কটাই যে হাঁটছে তা নয়। তাদের মধ্যে কয়েকটা ঘাস খাচ্ছে, কয়েকটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে লাফিয়ে চাঞ্চল্য প্রকাশ করছে, আবার কয়েকটা বাচ্চা ইউনিকর্ন খেলাচ্ছলে পরস্পরকে গুঁতোচ্ছে। মনে পড়ল উইলার্ডের ডায়রিতে লেখা আইস এ হার্ড অফ ইউনিকর্ন টুডে। আমরাও উইলার্ডের মতো সুস্থ মস্তিষ্কেই দলটাকে দেখছি।
কিন্তু মার্কোভিচ কই?
সবে প্রশ্নটা মাথায় এসেছে এমন সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য। জানোয়ারের মধ্যে থেকে উধৰ্বশ্বাসে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে মার্কোভিচ-তার লক্ষ্য হল আমাদের পিছনে ঘাসের শেষে ডুংলুং-ডোর প্রাচীরের দিকে। আর সে যাচ্ছে এক নয়—তার দুহাতে জাপটে ধরা রয়েছে একটা গোলাপি রঙের ইউনিকর্নের বাচ্চা।
সন্ডার্স চেঁচিয়ে উঠল—থামাও, শয়তানকে থামাও!
বুট পরো, বুট পরো!—চিৎকার করে উঠল ক্রোল। সে ছুটেছে মার্কোভিচকে লক্ষ্য করে। আমরাও তার পিছু নিলাম।
কথাটা ঠিক সময়ে কানো গেলে হয়তো মার্কোভিচের খেয়াল হত। কিন্তু তা আর হল না। ঘাসের জমি ছাড়িয়ে প্রাচীরের মাথায় পৌছিয়েই সে এক মরিয়া, বেপরোয়া লাফ দিল! অবাক হয়ে দেখলাম যে লাফটা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তার কোল থেকে ইউনিকর্নের বাচ্চাটা উধাও হয়ে গেল, আর পরমুহুর্তেই মার্কোভিচের নিম্নগামী দেহ প্রাচীরের পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পরে রাবসাং-এর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে মার্কোভিচকে প্রাচীরের উপর থেকে দেড়শো ফুট নীচে মাটিতে পড়তে দেখে তার দিকে দৌড়ে যায়। কিন্তু তার আর কিছু করবার ছিল না। হাড়গোড় ভেঙে মার্কোভিচের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। ইউনিকর্নের কথা জিজ্ঞেস করাতে সে অবাক হয়ে মাথা নেড়ে বলেছিল, সাহেব একাই পড়েছিলেন। তাঁর হাতে কিছু ছিল না!
ডুংলুং-ডো সম্পর্কে আমি যে ধারণাটায় পৌঁছেছি। সন্ডার্স ও ক্রোল তাতে সায় দিয়েছে। আমার মতো অনেক দেশের অনেক লোক অনেক কাল ধরে যদি এমন একটা জিনিস বিশ্বাস করে যেটা আসলে কাল্পনিক, তা হলে সেই বিশ্বাসের জোরেই একদিন সে কল্পনা বাস্তব রূপ নিতে পারে। এইভাবে বাস্তব রূপ পাওয়া কল্পনার জগৎ হল ডুংলুং-ডো। হয়তো এমন জগৎ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। ডুংলুং-ডো-র কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদকে তার গণ্ডির বাইরে আনা মানেই তাকে আবার কল্পনার জগতে ফিরিয়ে আনা। মার্কোভিচ তাই ইউনিকর্ন আনতে পারেনি, সন্ডার্সের থলি থেকে তার সংগ্ৰহ করা ফুলপাতা তাই উধাও হয়ে গেছে।
মৌনী লামার একসঙ্গে হ্যাঁ-না বলার মানেও এখন স্পষ্ট। একশৃঙ্গ সত্যিই থেকেও নেই। অবিশ্যি ওড়ার ব্যাপারে উনি না বলে ভুল করেছিলেন, তার কারণ উডয়নসূত্ৰে-র কথাটা উনি বোধ হয় জানতেন না।
অবিনাশবাবু সব শুনেটুনে বললেন, তার মানে বলছেন দেশে ফিরে গিয়ে দেখাবার কিছু নেই—এই তো?
আমি বললাম, ক্রোলের তোলা ছবি আছে। অবিশ্যি সাধারণ লোকের কাছে সেটা খুব বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। আর আছে আমাদের তিব্বতি বুটজুতো। কিন্তু পুঁথিতে বলছে ধ্ৰুংমুং জিনিসটা গরমে গলে গিয়ে তার গুণ চলে যায়।
অবিনাশবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এবার আমি আমার মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়লাম।
আমরা যে প্রায় পঁচিশ বছর বয়স কমিয়ে দেশে ফিরছি সেটা বোধ হয় খেয়াল করেননি। কী রকম? আমি আমার দাড়ি গোঁফ থেকে বালি আর বরফের কুচি ঝেড়ে ফেলে দিতেই অবিনাশবাবুর চোখ গোল হয়ে গেল।
এ কী, এ যে কালো কুচকুচে কাঁচা।
আমি বললাম, আপনার গোঁফও তাই। আয়নায় দেখুন।
অবিনাশবাবু আয়না নিয়ে অবাক বিস্ময়ে নিজের গোঁফের দিকে চেয়ে আছেন, এমন সময় সন্ডার্স এল। সন্ডার্সেরও বয়স কমে গেছে, তার উপরের পাটির পিছন দিকের একটা দাঁত নড়ছিল, সেটা আবার শক্ত হয়ে গেছে। সে একটা গভীর নিশ্চিন্তিরহাঁপ ছেড়ে বলল–
নিম্যাড্স, নট রবারস-থ্যাঙ্ক গড!
বাইরে থেকে যাযাবরদের হইহল্লার শব্দ, ঘোড়ার খুরের শব্দ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনতে পাচ্ছি। মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে। ওঁ মণিপদ্মে হম্।
সন্দেশ। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ,ফাল্লুন, চৈত্র ১৩৮০
কম্পু (প্রোফেসর শঙ্কু)
আজ সারা পৃথিবী থেকে আসা তিনশোর উপর বৈজ্ঞানিক ও শাঁখানেক সাংবাদিকের সামনে কম্পপুর ডিমনষ্ট্রেশন হয়ে গেল। ওসাকার নামুরা টেকনলজিক্যাল ইনস্টিটিউটের হলঘরের একপ্রান্তে মঞ্চের উপর একটা তিন ফুট উঁচু পেলুসিডাইটের তৈরি স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো স্তম্ভ বা স্ট্যান্ডের উপর কম্পপুকে বসানো হয়েছিল। দর্শক বসেছিল মখমলে মোড়া প্রায় সোফার মতো আরামদায়ক সিটে। এখানকার দুজন জাপানি কর্মচারী যখন কম্পপুকে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করল, তখন এই প্ল্যাটিনামে আচ্ছাদিত আশ্চর্য সুন্দর মসৃণ গোলকটিকে দেখে দর্শকদের মধ্যে একটা বিস্ময়মিশ্রিত তারিফের কোরাসে ঘরটা গমগম করে উঠেছিল। যে কম্পিউটার যন্ত্র পঞ্চাশ কোটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, তার আয়তন হবে একটা ফুটবলের দেড়া, তার ওজন হবে মাত্র বেয়াল্লিশ কিলো, আর তাকে দেখে যন্ত্র বলে মনেই হবে না, এটা কেউ ভাবতে পারেনি। আসলে এই ট্রানজিসটার আর মাইক্রো-মিনিয়েচারাইজেশন বা অতিক্ষুদ্রকরণের যুগে খুব জটিল যন্ত্রও আর সাইজে বড় হবার দরকার নেই। পঞ্চাশ বছর আগে বেঢপ বাক্স-রেডিওর যুগে কি আর কেউ ভাবতে পেরেছিল যে ভবিষ্যতে একটা রিস্টওয়াচের ভিতরে একটা রেডিওর সমস্ত যন্ত্রপাতি পুরে দেওয়া যাবে?
কম্পু যে মানুষের এক আশ্চর্য সৃষ্টি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এও সত্যি যে, জটিল যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে এখনও প্রকৃতির ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি মানুষ। আমাদের তৈরি যান্ত্রিক মস্তিষ্কের ভিতর পোরা আছে দশ কোটি সার্কিট, যার সাহায্যে যন্ত্র কাজ করে। মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন হল কম্পপুর পাঁচ ভাগের এক ভাগ। এই মস্তিষ্ক যার সাহায্যে অবিরাম তার অসংখ্য কাজগুলো করে যাচ্ছে তার নাম নিউরন। এই নিউরনের সংখ্যা হল দশ হাজার কোটি। এ থেকে বোঝা যাবে মস্তিষ্কের কারিগরিটা কী ভয়ানক রকম জটিল।
এখানে বলে রাখি, আমাদের কম্পিউটার অঙ্ক কষে না। এর কাজ হল যে সব প্রশ্নের উত্তর জানতে মানুষ বিশ্বকোষ বা এনসাইক্লোপিডিয়ার শরণাপন্ন হয়, সেই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। আরও একটা বিশেষত্ব এই যে, এই উত্তর অন্য কম্পিউটারের মতো লিখিত উত্তর নয়; কম্পু উত্তর দেয় কথা বলে। মানুষের গলা আর বিলিতি রুপোর বাঁশির মাঝামাঝি একটা তীক্ষ্ণ স্পষ্ট স্বরে কম্পপু প্রশ্নের জবাব দেয়। প্রশ্ন করার আগে ওয়ান থ্রি ওয়ান থ্রি ওয়ান থ্রি সেভূন—এই সংখ্যাটি বলে নিতে হয়, তার ফলে কম্পুর ভিতরের যন্ত্র চালু হয়ে যায়। তারপর প্রশ্নটা করলেই তৎক্ষণাৎ উত্তর পাওয়া যায়। গোলকের একটা অংশে এক বর্গ ইঞ্চি জায়গা জুড়ে দুশোটা অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। এই ছিদ্র দিয়েই প্রশ্ন ঢোকে, এবং এই ছিদ্র দিয়েই উত্তর বেরোয়। অবিশ্যি প্রশ্নগুলো এমনই হওয়া দরকার যার উত্তর মোটামুটি সংক্ষেপে হয়। যেমন, আজকের ডিমনস্ট্রেশনে এই কথাটা অভ্যাগতদের বলে দেওয়া সত্ত্বেও ফিলিপিনবাসী এক সাংবাদিক কম্পুকে অনুরোধ করে বসলেন-প্রাচীন চিন সভ্যতা সম্পর্কে কিছু বলো। স্বভাবতই কম্পু কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু সেই একই সাংবাদিক যখন তাকে তাং, মিং, হান, সুং ইত্যাদি সভ্যতার বিশেষ বিশেষ দিক সম্বন্ধে আলাদা আলাদা করে প্রশ্ন করলেন, তখন কম্পু মুহুর্তের মধ্যে ঠিক ঠিক জবাব দিয়ে সকলকে অবাক করে দিল।
শুধু তথ্য পরিবেশন নয়, কম্পপুর বিবেচনার ক্ষমতাও আছে। নাইজেরিয়ার প্রাণিতত্ত্ববিদ ডঃ সলোমন প্রশ্ন করলেন—একটি বেবুনশাবককে কার সামনে ফেলে রাখা বেশি নিরাপদ—একটি ক্ষুধার্ত হরিণ, না একটি ক্ষুধার্ত শিম্পাঞ্জি? কম্পু বিদ্যুদ্বেগে উত্তর দিল—ক্ষুধার্ত হরিণ। হোয়াই? প্রশ্ন করলেন ডঃ সলোমন। রিনারিনে গলায় উত্তর এল—শিম্পাঞ্জি মাংসাশী। এ তথ্যটা অবিশ্যি অতি সম্প্রতি জানা গেছে। দশ বছর আগেও মানুষ জানত বানর শ্রেণীর সব জানোয়ারই নিরামিষাশী।
এ ছাড়া কম্পু ব্রিজ ও দাবা খেলায় যোগ দিতে পারে, গান শুনে সুর বেসুর তাল বেতাল বিচার করতে পারে, রাগরাগিণী বলে দিতে পারে, কোনও বিখ্যাত পেন্টিংয়ের কেবল চক্ষুষ বর্ণনা শুনে চিত্রকরের নাম বলে দিতে পারে, কোনও বিশেষ ব্যারামে কী ওষুধ কী পথ্য চলতে পারে সেটা বলে দিতে পারে, এমনকী রুগির অবস্থার বর্ণনা শুনে আরোগ্যের সম্ভাবনা শতকরা কত ভাগ সেটাও বলে দিতে পারে।
কম্পপুর যেটা ক্ষমতার বাইরে সেটা হল চিন্তাশক্তি, অনুভবশক্তি আর অলৌকিক শক্তি। তাকে যখন আজ সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাক্সওয়েল জিজ্ঞেস করলেন আজ থেকে একশো বছর পরে মানুষ বই পড়বে কি না, তখনও কম্পু নিরুত্তর, কারণ ভবিষ্যদ্বাণী তার ক্ষমতার বাইরে। এই অভাব সত্ত্বেও একটা কারণে কম্পপু মানুষকে টেক্কা দেয়, সেটা হল এই যে, তার মস্তিষ্কে যে তথ্য ঠাসা রয়েছে তার ক্ষয় নেই। বয়স হলে অতি বিজ্ঞ মানুষেরও মাঝে মাঝে স্মৃতিভ্ৰম হয়। যেমন আমি এই কিছুদিন আগে গিরিডিতে আমার চাকরকে প্রহ্লাদ বলে না ডেকে প্রয়াগ বলে ডাকলাম। এ ভুল কম্পু কখনও করবে না, করতে পারে না। তাই মানুষের তৈরি হয়েও সে একদিক দিয়ে মানুষের চেয়ে বেশি কর্মক্ষম।
এখানে বলে রাখি যে কম্পু নামটা আমারই দেওয়া, আর সকলেই নামটা পছন্দ করেছে। যন্ত্রের পরিকল্পনার জন্য দায়ী জাপানের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মাৎসুয়ে—যাঁকে ইলেকট্রনিকসের একজন দিকপাল বলা চলে। এই পরিকল্পনা জাপান সরকার অনুমোদন করে, এবং সরকারই এই যন্ত্র নিমাণের খরচ বহন করে। নামুরা ইনস্টিটিউটের জাপানি কমীরা যন্ত্রটা তৈরি করেন প্রায় সাত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে। চতুর্থ বছরে প্রাথমিক কাজ শেষ হবার কিছু আগে মাৎসুয়ে পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের সাতজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানান এই যান্ত্রিক মগজে তথ্য ঠাসার ব্যাপারে সাহায্য করতে। বলা বাহুল্য, আমি ছিলাম। এই সাতজনের একজন। বাকি ছজন হলেন-ইংলন্ডের ডঃ জন কেনসিলি, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির ডঃ স্টিফেন মেরিভেল, সোভিয়েত রাশিয়ার ডঃ স্টাসফ, অষ্ট্রেলিয়ার প্রোফেসর স্ট্র্যাটন, পশ্চিম আফ্রিকার ডঃ উগাটি ও হাঙ্গেরির প্রোফেসর কুটুনা। এর মধ্যে মেরিভেল জাপানে রওনা হবার তিনদিন আগে হৃদরোগে মারা যান; তাঁর জায়গায় আসেন। ওই একই ইনস্টিটিউটের প্রোফেসর মাকসি উইঙ্গাফিল্ড। এঁদের কেউ কেউ টানা তিন বছর থেকেছেন। ওসাকায় জাপান সরকারের অতিথি হয়ে; আবার কেউ কেউ, যেমন আমি, কিছুকাল এখানে কাটিয়ে দেশে ফিরে গিয়ে কিছু কাজ সেরে আবার এখানে চলে এসেছে। আমি এইভাবে যাতায়াত করেছি। গত তিন বছরে এগারোবার।
এখানে একটা আশ্চর্য ঘটনার কথা বলি। গত পরশু অর্থাৎ ১০ই মার্চ ছিল সূর্যগ্রহণ। এবার যেসব জায়গা থেকে পূৰ্ণগ্ৰাস দেখা গেছে, তারমধ্যে জাপানও পড়েছিল। এটা একটা বিশেষ দিন বলে আমরা গত বছর থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে, যেভাবে হোক গ্রহণের আগেই আমাদের কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। ৮ই মার্চ কাজ শেষ হয়েছে মনে করে যন্ত্রটাকে পরীক্ষা করে দেখা গেল কথা বেরোচ্ছে না। গোলকাটা দুটো সমান ভাগে ভাগ হয়ে খুলে যায়। সার্কিটে গণ্ডগোল আছে মনে করে সেটাকে খুলে ফেলা হল। দশ কোটি কম্পোনেন্টের মধ্যে কোথায় কোনটাতে গণ্ডগোল হয়েছে খুঁজে বার করা এক দুরূহ ব্যাপার।
দুদিন দুরাত অনুসন্ধানের পর ১০ই ঠিক যে মুহুর্তে গ্ৰহণ লাগবে।–অর্থাৎ দুপুর একটা সাঁইত্রিশে—ঠিক সেই মুহুর্তে কম্পপুর স্পিকারের ভিতর দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ বেরোল। এটাই কম্পুর আরোগ্যের সিগন্যাল জেনে আমরা হাফ ছেড়ে গ্রহণ দেখতে চলে গেলাম। অর্থাৎ গ্রহণ লাগার মুহুর্ত আর কম্পুর সক্রিয় হবার মুহুর্ত এক। এর কোনও গৃঢ় মানে আছে কি? জানি না।
কম্পু ইনস্টিটিউটেই রয়েছে। তার জন্য একটা শীততাপনিয়ন্ত্রিত আলাদা কামরা তৈরি হয়েছে। ভারী সুদৃশ্য ছিমছাম। এই কামরা। ঘরের একপাশে দেয়ালের ঠিক মাঝখানে তার স্ফটিকের বেদির ওপর যন্ত্রটা বসানো থাকবে। বেদির ওপরে একটা বৃত্তাকার গর্ত ঠিক এমন মাপে তৈরি হয়েছে যে, কম্পু সেখানে দিব্যি আরামে বসে থাকতে পারে। কামরার উপরে সিলিংয়ে একটি লুকোনো আলো রয়েছে, সেটা এমনভাবে রাখা যাতে আলোকরশ্মি সটান গিয়ে পড়ে কম্পুর ওপর। এই আলো সর্বক্ষণ জ্বলবে। কামরায় পাহারার বন্দোরস্ত আছে, কারণ কম্পুর্ণ একটি মহামূল্য জাতীয় সম্পত্তি। এইসব ব্যাপারে আন্তজাতিক ঈষার কথাটা ভুললে চলবে না। উইঙ্গাফিল্ডকে এর মধ্যেই দু-একবার গজগজ করতে শুনেছি; তার আক্ষেপ, এমন একটা জিনিস আগেভাগে জাপান তৈরি করে ফেলল, যুক্তরাষ্ট্র পারল না। এখানে উইন্সফিল্ড সম্বন্ধে একটা কথা বলে নিই; লোকটি যে গুণী তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাকে কারুরই বিশেষ পছন্দ নয়। তার একটা কারণ অবিশ্যি এই যে, উইঙ্গাফিল্ড হাসতে জানে না। অন্তত গত তিন বছরে ওসাকাতে তাকে কেউ হাসতে দেখেনি।
বাইরে থেকে আসা সাতজন মনীষীর মধ্যে তিনজন আজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। যারা আরও কয়েকদিন থেকে যাচ্ছে তারা হল উইঙ্গাফিল্ড, কেনসিলি, কুটুনা আর আমি। উইন্সফিল্ড বাতের রুগি, সে ওসাকার একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছে। আমার ইচ্ছা জাপানটা একটু ঘুরে দেখব। কাল কিয়োটো যাচ্ছি। কেনসলির সঙ্গে। কেনন্সলি পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তার নানান ব্যাপারে উৎসাহ। বিশেষ করে জাপানি আর্ট সম্বন্ধে তো তাকে একজন বিশেষজ্ঞই বলা চলে। সে কিয়োটো যাবার জন্য ছটফট করছে; ওখানকার বৌদ্ধমন্দির আর বাগান না দেখা অবধি তার সোয়াস্তি নেই।
হাঙ্গেরির জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টফ কুটুনার আর্টে বিশেষ উৎসাহ নেই, তবে তার মধ্যে একটা দিক আছে। যেটা সম্বন্ধে অন্যে না জানলেও আমি জানি, কারণ আমার সঙ্গেই কুটুনা এ বিষয়ে কথা বলে। বিষয়টাকে ঠিক বিজ্ঞানের অন্তৰ্গত বলা চলে না। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আজ সকালে ব্রেকফাস্টের সময় আমরা একই টেবিলে বসেছিলাম; আমার মতো কুটুনারও ভোরে ওঠা অভ্যাস। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে সে হঠাৎ বলল, আমি সেদিন সূর্যগ্রহণ দেখিনি।
এটা অবিশ্যি আমি খেয়াল করিনি। আমি নিজে ঘটনাটাকে এত বেশি গুরুত্ব দিই, পূৰ্ণগ্রাসের পর সূর্যের করোনা বা জ্যোতির্বলয় দেখে এতই মুগ্ধ হই যে, আমার পাশে কে আছে না আছে সে খেয়াল থাকে না। কুটুনা কী করে এমন একটা ঘটনা দেখার লোভ সামলাতে পারল জানি না। বললাম, তোমার কি সূর্যগ্ৰহণ সম্বন্ধে কোনও সংস্কার আছে?
কুটুনা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটা পালটা প্রশ্ন করে বসল।
সূর্যগ্রহণ কি প্ল্যাটিনামের উপর কোনও প্রভাব বিস্তার করে?
করে বলে তো জানি না, আমি বললাম। কেন বলে তো?
তা হলে আমাদের যন্ত্রটা পূৰ্ণগ্রহণের ওই সাড়ে চার মিনিট এত নিম্প্রভ হয়ে রইল কেন? আমি স্পষ্ট দেখলাম পূৰ্ণগ্রহণ শুরু হতেই গোলকাঁটার উপর যেন একটা কালসিটে পড়ে গেল। সেটা ছাড়ল গ্রহণ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
তোমার নিজের কী মনে হয়? অগত্যা জিজ্ঞেস করলাম। আমি। মনে মনে ভাবছিলাম কুটুনার বয়স কত, আর তার ভীমরতি ধরল। কি না।
আমার কিছুই মনে হয় না, বলল কুটুনা, কারণ অভিজ্ঞতোটা আমার কাছে একেবারেই নতুন। শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, ব্যাপারটা যদি আমার দেখার ভুল হয় তা হলে আমি খুশিই হব। সূর্যগ্ৰহণ সম্বন্ধে আমার কোনও সংস্কার নেই, কিন্তু যান্ত্রিক মস্তিষ্ক সম্বন্ধে আছে। মাৎসুয়ে যখন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি লেখে তখন আমি এ সংস্কারের কথা তাকে জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, যন্ত্রের উপর যদি খুব বেশি করে মানুষের কাজের ভার দেওয়া যায়, তা হলে ক্ৰমে একদিন যন্ত্র আর মানুষের দাস থাকবে না, মানুষই যন্ত্রের দাসত্ব করবে।
ঠিক এই সময় উইন্সফিল্ড ও কেনুসলি এসে পড়াতে প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে গেল। যন্ত্র সম্বন্ধে কুটুনার ধারণাটা নতুন নয়। ভবিষ্যতে মানুষ যে যন্ত্রের দাসে পরিণত হতে পারে তার লক্ষণ অনেকদিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। খুব সহজ একটা উদাহরণ দিই। মানুষ যে ভাবে যানবাহনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে সেটা আগে ছিল না। শহরের মানুষও আগে অক্লেশে পাঁচ-সাত মাইল হাঁটত প্ৰতিদিন; এখন তাদের ট্রাম বাস রিকশা না হলে চলে না। কিন্তু তাই বলে কি আর বিজ্ঞান তার কাজ করে যাবে না? মানুষের কাজ সহজ করার জন্য যন্ত্র তৈরি হবে না? মানুষ আবার সেই আদিম যুগে ফিরে যাবে?
১৪ই মার্চ, কিয়োটো
কিয়োটো সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক যা কিছু শুনেছি। এরং পড়েছি, তার একটাও মিথ্যে বা বাড়ানো নয়। একটা জাতের সৌন্দর্যজ্ঞান আর রুচিবোধ যে একটা শহরের সর্বত্র এরকমভাবে ছড়িয়ে থাকতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস হত না। আজ দুপুরে কিয়োটোর এক বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দির আর তার সংলগ্ন বাগান দেখতে গিয়েছিলাম। এমন শান্ত পরিবেশ এর আগে কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মন্দিরে জাপানের বিখ্যাত মনীষী তানাকার সঙ্গে আলাপ হল। ঋষিতুল্য মানুষ। পরিবেশের সঙ্গে আশ্চর্য খাপ খায় এর সৌম্য স্বভাব। আমাদের দিগগজ যন্ত্রটির কথা শুনে স্মিতহাস্য করে বললেন, চাঁদটা সূর্যের সামনে এলে দুইয়ে মিলে এক হয়ে যায় কার খেয়ালে সেটা বলতে পারে তোমাদের যন্ত্র?
দার্শনিকের মতোই প্রশ্ন বটে। সূর্যের তুলনায় চাঁদ এত ছোট, অথচ এই দুইয়ের দূরত্ব পৃথিবী থেকে এমনই হিসেবের যে, চাঁদটা সূর্যের উপর এলে আমাদের চোখে ঠিক তার পুরোটাই ঢেকে ফেলে—এক চুল বেশিও না, কমও না। এই আশ্চর্য ব্যাপারটা যেদিন আমি বুঝতে পারি। আমার ছেলেবেলায়, সেদিন থেকেই সূর্যগ্ৰহণ সম্বন্ধে আমার মনে একটা গভীর বিস্ময়ের ভাব রয়ে গেছে। আমরাই জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর, তো কম্পুজানবে কী করে?
আরও একটা দিন কিয়োটোয় থেকে আমরা কামাকুরা যাব। কেনসিলি সঙ্গে থাকাতে খুব ভাল হয়েছে। ভাল জিনিস আরও বেশি ভাল লাগে একজন সমঝদার পাশে থাকলে।
১৫ই মার্চ
কিয়োটো স্টেশনে ট্রেনের কামরায় বসে ডায়রি লিখছি। কাল রাত দেড়টার সময় প্রচণ্ড ভূমিকম্প। জাপানে এ জিনিসটা প্রায়ই ঘটে, কিন্তু এবারের কাঁপুনিটা রীতিমতো বেশি, আর স্থায়িত্ব প্রায় না। সেকেন্ড। শুধু এটাই যে ফিরে যাবার কারণ তা নয়। ভূমিকম্পের দরুন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটার কিনারা করতে হলে ওসাকায় ফিরতেই হবে। আজ ভোর পাঁচটায় মাৎসুয়ে ফোনে খবরটা দিল।
কম্পু উধাও।
টেলিফোনে বিস্তারিতভাবে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। মাৎসুয়ে এমনিতেও ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলে, তার উপরে উত্তেজনায় তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। এটা জানলাম যে, ভূমিকম্পের পরেই দেখা যায় যে, কম্পু আর তার জায়গায় নেই, আর পেলুসিডাইটের স্ট্যান্ডটা মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। প্রহরী দুজনকেই নাকি অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়, আর দুজনেরই পা ভাঙা, ফলে দুজনেই এখন হাসপাতালে। তাদের এখনও জ্ঞান হয়নি, কাজেই তাদের এ অবস্থা কেন হল সেটা জানা যায়নি।
কিয়োটোতে বাড়ি ভেঙে পড়ে নব্বইজন মেয়ে পুরুষ আহত হয়েছে। স্টেশনে লোকের মুখে আর কোনও কথা নেই। সত্যি বলতে কী কাল যখন ঝাঁকুনিটা শুরু হয় তখন আমারও রীতিমতো অস্থির ও অসহায় মনে হচ্ছিল। কেনসলি সমেত আমি হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম, এবং বাইরে ভিড় দেখে বুঝেছিলাম যে কেউই আর ভিতরে নেই। জাপানে নাকি গড়ে প্রতিদিন চারবার ভূমিকম্প হয়, যদিও তার বেশির ভাগই এত মৃদু কম্পন যে, সিজমোগ্রাফ যন্ত্র আর কিছু পশুপক্ষী ছাড়া কেউই সেটা টের পায় না।
এ কী অদ্ভূত অবস্থার মধ্যে পড়া গেল! এত অর্থ, এত শ্ৰম, এত বুদ্ধি খরচ করে পৃথিবীর সেরা কম্পিউটার তৈরি হল, আর হবার তিন দিনের মধ্যে সেটা উধাও?
১৫ই মার্চ, ওসাকা, রাত এগারোটা
আমাদের বাসস্থান ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসে আমার ঘরে বসে ডায়রি লিখছি। নামুরা ইনস্টিটিউটের দক্ষিণে একটা পার্কের উলটোদিকে এই গেস্ট হাউস। আমার জানলা থেকে ইনস্টিটিউটের টাওয়ার দেখা যেত, আজ আর যাচ্ছে না, কারণ সেটা কালকের ভূমিকম্পে পড়ে গেছে।
আজ মাৎসুয়ে স্টেশনে এসেছিল তার গাড়ি নিয়ে। সেই গাড়িতে আমরা সোজা চলে গেলাম ইনস্টিটিউটে। ইতিমধ্যে দুজন প্রহরীর একজনের জ্ঞান হয়েছে। সে যা বলছে তা হল এই—ভূমিকম্পের সময় সে আর তার সঙ্গী দুজনেই পাহারা দিচ্ছিল। কম্পন খুব জোরে হওয়াতে তারা একবার ভেবেছিল ছুটে বাইরে চলে যাবে, কিন্তু কম্পপুর ঘর থেকে একটা শব্দ শুনে তারা অনুসন্ধান করতে চাবি খুলে ঘরে ঢোকে।
এর পরের ঘটনাটা প্রহরী যেভাবে বলছে সেটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। ঘর খুলেই নাকি দুজনে দেখে যে, কম্পুর স্ট্যান্ডটা মাটিতে পড়ে আছে, আর কম্পু নিজে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা গড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভূমিকম্পের জের ততক্ষণে কিছুটা কমেছে। প্রহরী দুজনেই কম্পুর দিকে এগিয়ে যায় তাকে ধরতে। সেই সময় কম্পু নাকি গড়িয়ে এসে তাদের সজোরে আঘাত করে, ফলে দুজনেরই পা ভেঙে যায় এবং দুজনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
এই আপনা থেকে গড়িয়ে পালিয়ে যাবার বিবরণটা যদি মিথ্যে হয় তা হলে অন্য সম্ভাবনাটা হচ্ছে চুরি। প্রহরী দুজনই যে নেশা করেছিল সেটা মিনিমোতো—অর্থাৎ যার জ্ঞান হয়েছে—স্বীকার করেছে। এই অবস্থায় যদি ভূমিকম্প শুরু হয় তা হলে তারা জােন বাঁচাতে বাইরে পালাবে সেটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরিতে নাকি কাজ হচ্ছিল সেই রাত্রে, এবং গবেষকরা প্রত্যেকেই নাকি ঝাঁকুনির তেজ দেখে বাইরে মাঠে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ ইনস্টিটিউটের দরজাগুলো সেই সময় বন্ধ ছিল না। কাজেই বাইরে থেকে ভিতরে লোক ঢুকতেও কোনও অসুবিধা ছিল না। দক্ষ চোর এই ভুমিকম্পের সুযোগে একটি বেয়াল্লিশ কিলো ওজনের গোলক বগলদাবা করে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়ে যেতে পারে অনায়াসে।
মোটকথা, চুরি হোক আর না হোক, কম্পু আর তার জায়গায় নেই। কে নিয়েছে, কোথায় রয়েছে, তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে কি না, এর কোনওটারই উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। জাপান সরকার এরমধ্যে রেডিও ও টেলিভিশন মারফত জানিয়ে দিয়েছে যে, যে ব্যক্তি যন্ত্রটা উদ্ধার করতে পারবে তাকে পাঁচ লক্ষ ইয়েন-অৰ্থাৎ প্রায় দশ হাজার টাকা-পুরস্কার দেওয়া হবে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে দিয়েছে, যদিও ইতিমধ্যে দ্বিতীয় প্রহরীরও জ্ঞান হয়েছে, এবং সে-ও অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলেছে যে, যন্ত্রটা চুরি হয়নি, সেটা নিজেই কোনও আশ্চর্য শক্তির জোরে চালিত হয়ে দুই প্রহরীকেই জখম করে কামরা থেকে বেরিয়ে গেছে।
প্রহরীদের কাহিনী আমাদের মধ্যে একমাত্ৰ কুটুনাই বিশ্বাস করেছে, যদিও তার সপক্ষে কোনও যুক্তি দেখাতে পারেনি। কেনসিলি ও উইন্সফিল্ড সরাসরি বলেছে চুরি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। প্ল্যাটিনাম অতি মূল্যবান ধাতু। দামের দিক দিয়ে সোনার পরেই প্ল্যাটিনাম। আজকাল জাপানি ছেলেছোকরাদের মধ্যে অনেকেই নেশার ঝোঁকে বেপরোয়া কাজ করে থাকে। বিশেষ করে সরকারকে অপদস্থ করতে পারলে তারা আর কিছু চায় না। এমন কোনও দল যদি কম্পুকে চুরি করে থাকে তা হলে মোটা টাকা আদায় না করে তাকে ফেরত দেবে না। তাই যদি হয় তা হলে এটা হবে যন্ত্র কিডন্যাপিংয়ের প্রথম নজির।
অনুসন্ধানের কাজটা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না, কারণ ভূমিকম্পের জের এখনও চলেছে। ওসাকায় দেড়শোর ওপর লোক মারা গেছে, আর অল্পবিস্তর জখম হয়েছে প্রায় হাজার লোক। দু-একদিনের মধ্যেই যে আবার কম্পন্ন হবে না। তার কোনও স্থিরতা নেই।
এখন রাত এগারোটা। কুটুনা এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত আমার ঘরে ছিল। কম্পুর স্বেচ্ছায় পালানোর কাহিনী সে বিশ্বাস করলেও কেন পালিয়েছে সেটা অনেক ভেবেও বার করতে পারেনি। তার ধারণা, ভূমিকম্পে মাটিতে আছড়ে পড়ে তার যন্ত্রের কোনও গোলমাল হয়ে গেছে। অর্থাৎ তার মতে কম্পুর মাথাটা বিগড়ে গেছে।
আমি নিজে একদম বোকা বনে গেছি। এরকম অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি।
১৬ই মার্চ, রাত সাড়ে এগারোটা
আজকের শ্বাসরোধকারী ঘটনাগুলো এইবেল লিখে রাখি। আমরা চার বৈজ্ঞানিকের মধ্যে একমাত্র কুটুনাই এখন মাথা উঁচু করে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে, কারণ তার অনুমান যে অনেকাংশে সত্যি সেটা আজ প্রমাণ হয়ে গেছে। এই ঘটনার পরে ভবিষ্যতে আর কেউ যান্ত্রিক মস্তিষ্ক তৈরি করার ব্যাপারে সাহস পাবে বলে মনে হয় না।
কাল রাত্রে ডায়রি লিখে বিছানায় শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমোতে পারিনি। শেষটায় আমার তৈরি ঘুমের বড়ি সমনোলিন খাব বলে বিছানা ছেড়ে উঠতেই উত্তরের জানলাটার দিকে চোখ পড়ল। এই দিকেই সেই পার্ক—যার পিছনে নামুরা ইনস্টিটিউট। এই পার্ক হচ্ছে সেই ধরনের জাপানি পার্ক যাতে মানুষের কারিগরির ছাপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। গাছপালা ফুলফল ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ, এখানে ওখানে বিক্ষিপ্ত ছোট বড় পাথরের টুকরো, হঠাৎ এক জায়গায় একটা জলাশয়-যাতে কুলকুলিয়ে জল এসে পড়ছে নালা থেকে-সব মিলিয়ে পরিবেশটা স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক, অথচ সবই হিসেব করে বসানো, সবটাই মানুষের পরিকল্পনা। এক বৰ্গমাইল জুড়ে এইরকম একটা বন বা বাগান বা পার্ক রয়েছে অতিথিশালা আর ইনস্টিটিউটের মাঝখানে।
বিছানা ছেড়ে উঠে আমার চোখ গেল। এই পার্কের দিকে, কারণ তার মধ্যে একটা টর্চের আলো ঘোরাফেরা করছে। আমার ঘর থেকে দূরত্ব অনেক, কিন্তু জাপানি টর্চের আলোর তেজ খুব বেশি বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জ্বলছে মাঝে মাঝে নিভছে, এবং বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ঘোরাফেরা করছে আলোটা।
প্ৰায় মিনিটপনেরো ধরে এই আলোর খেলা চলল, তারপর টর্চের মালিক যেন বেশ হতাশ হয়েই পার্ক ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেলেন।
সকালে নীচে ডাইনিংরুমে গিয়ে বাকি তিনজনকে বললাম। ঘটনাটা এবং স্থির করলাম যে, ব্রেকফাস্ট সেরে পার্কে গিয়ে একবার অনুসন্ধান করব।
আটটা নাগোত আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। ওসাকা জাপানের অধিকাংশ শহরের মতোই অসমতল। সারা শহরে ছড়িয়ে আছে সরু সরু নালা আর খাল, আর সেগুলো পেরোবার জন্য সুদৃশ্য সব সাঁকে। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা খাড়াই উঠে তারপর পার্কের গাছপালা শুরু হয়। তারই মধ্যে একটা হাঁটাপথ দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। মেপাল, বার্চ, ওক, চেস্টনাট ইত্যাদি বিলিতি গাছে পার্কটা ভর্তি। অবিশ্যি জাপানের বিখ্যাত চেরিগাছও রয়েছে। জাপানিরা অনেককাল আগে থেকেই তাদের দেশের নিজস্ব গাছ তুলে ফেলে তার জায়গায় বিলিতি গাছের চারা পুতিতে শুরু করেছে, তাই এরকম একটা পার্কে এলে জাপানে আছি সে কথাটা মাঝে মাঝে ভুলে যেতে হয়।
মিনিটপনেরো চলার পরে প্রথম একজন অন্য মানুষকে দেখতে পেলাম পার্কের মধ্যে। একটি জাপানি ছেলে, বছর দশ-বারো বয়স, মাথার চুল কদমছাঁটে ছাঁটা, কাঁধে স্ট্র্যাপ থেকে ঝুলছে ইস্কুলের ব্যােগ। ছেলেটি আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আমাদেরই দিকে। কুটুনা জাপানি জানে, সে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?
সেইজি বলল ছেলেটা।
এখানে কেন এসেছ?
ইস্কুল যাচ্ছি।
কুট্না ছাড়বার পাত্র নয়। বলল, তা হলে রাস্তা ছেড়ে ঝোপের দিকে যাচ্ছিলে কেন?
ছেলেটি চুপ।
ইতিমধ্যে কেনসলি ডানদিকে একটু এগিয়ে গিয়েছিল, সে কী জানি দেখে ডাক দিল, কাম হিয়ার, শঙ্কু।
কেন্সলি তার পায়ের কাছে ঘাসের দিকে চেয়ে আছে। আমি আর উইঙ্গাফিল্ড এগিয়ে দেখি, জমির খানিকটা অংশের ঘাস এবং সেইসঙ্গে একটা বুনো ফুলের গাছ চাপ লেগে মাটির সঙ্গে সিঁটিয়ে গেছে। দুপা এগোতেই চোখে পড়ল একটা চ্যািপটানো প্ৰাণী—এক বিঘাত লম্বা একটি গিরগিটি। গাড়ির চাকা বা অন্য কোনও ভারী জিনিস ওপর দিয়ে গড়িয়ে গেলে এরকমভাবে পিষে যাওয়া স্বাভাবিক।
এবার কেনসিলি কুটুনার দিকে ফিরে বলল, আস্ক হিম ইফ হি ওয়াজ লুকিং ফর এ বল।
ছেলেটি এবার আর জবাব এড়াতে পারল না। সে বলল, গতকাল ইস্কুল থেকে ফেরার পথে সে একটা ধাতুর বল দেখেছিল এই পার্কে একটা ঝোপের পিছনে। কাছে যেতেই বলটা গড়িয়ে দূরে চলে যায়। অনেক ছোটাছুটি করেও সে বলটার নাগাল পায়নি। বিকেলে বাড়ি ফিরে টেলিভিশনে জানতে পারে যে, ঠিক ওইরকম একটা বলের সন্ধান দিতে পারলে পাঁচ লক্ষ ইয়েন পুরস্কার পাওয়া যাবে। তাই সে গতকাল রাত্রেও টর্চ নিয়ে বলটা খুঁজেছে, কিন্তু পায়নি।
আমরা ছেলেটিকে বোঝালাম যে, এই পার্কেই যদি বলটা পাওয়া যায় তা হলে আমরা তাকে পুরস্কার পাইয়ে দেব, সে নিশ্চিন্তে ইস্কুল যেতে পারে। ছেলেটি আশ্বস্ত হয়ে তার আবার খোঁজা শুরু করলাম। যে যন্ত্রটা পাবে, সে অন্যদের হাঁক দিয়ে জানিয়ে দেবে।
পায়েহাঁটা পথ ছেড়ে গাছপালা ঝোপঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কম্পু যদি সত্যিই সচল হয়ে থাকে তা হলে তাকে পেলেও সে ধরা দেবে কি না জানি না। তার উপরে তার যদি মানুষের উপর আক্রোশ থেকে থাকে তা হলে যে সে কী করতে পারে তা আমার অনুমানের বাইরে।
চতুর্দিকে দৃষ্টি রেখে মিনিটপাঁচেক চলার পর এক জায়গায় দেখলাম দুটো প্রজাপতি মাটিতে পড়ে আছে; তারমধ্যে একটা মৃত, অন্যটার ডানায় এখনও মৃদু স্পন্দন লক্ষ করা যাচ্ছে। গত কয়েক মিনিটের মধ্যে কোনও একটা ভারী জিনিস তাদের উপর দিয়ে চলে গেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
আমি এক পা এক পা করে অতি সন্তপণে এগোতে শুরু করেছি, এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ শব্দ শুনে আমাকে থমকে যেতে হল।
শব্দটা শিসের মতো এবং সেটাকে লিখে বোঝাতে গেলে তার বানান হবে কি-য়ে দীর্ঘ ঊ।
আমি শব্দের উৎস সন্ধানে এদিক ওদিক চাইতে আবার শোনা গেল—
কূ–!
এবারে আন্দাজ পেয়ে শব্দ লক্ষ্য করে বা দিকে এগিয়ে গেলাম। এ যে কম্পুর গলা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আর ওই কু শব্দের একটাই মানে হতে পারে; সে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।
বেশি দূর যাবার দরকার হল না। একটা জেরেনিয়াম গাছের পিছনে সূর্যের আলো এসে পড়েছে কম্পপুর দেহে। সে এখন অনড়। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওই কু শব্দই বোধহয় অন্য তিনজনকেও জানিয়ে দিয়েছে কম্পুর অস্তিত্ব। তিনজনেই তিনদিক থেকে ব্যস্তভাবে এগিয়ে এল আমার দিকে। এই গাছপালার পরিবেশে মসৃণ ধাতব গোলকটিকে ভারী অস্বাভাবিক লািগছিল দেখতে। কম্পপুর চেহারায় সামান্য পরিবর্তন হয়েছে কি? সেটা তার গা থেকে ধুলো মাটি আর ঘাসের টুকরো ঝেড়ে না ফেলা পর্যন্ত বোঝা যাবে না।
ওয়ান থ্রি ওয়ান থ্রি ওয়ান থ্রি সেভন।
কেনসিলি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে কম্পুকে সক্রিয় করার মন্ত্রটা আওড়াল। কম্পু বিকল হয়েছে কি না জানার জন্য আমরা সকলেই উদগ্ৰীব।
সম্রাট নেপোলিয়ন কোন কোন যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন?
প্রশ্নটি করল। উইঙ্গাফিল্ড। ঠিক এই প্রশ্নটাই সেদিন ডিমনষ্ট্রেশনে এক সাংবাদিক করেছিল কম্পপুকে, আর মুহুর্তের মধ্যে নির্ভুল জবাব দিয়েছিল আমাদের যন্ত্র।
কিন্তু আজ কোনও উত্তর নেই। আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি, বুকের ভিতরে একটা গভীর অসোয়াস্তির ভাব দানা বাঁধছে। উইঙ্গাফিল্ড গোলকের আরও কাছে মুখ এনে আবার প্রশ্নটি করল।
কম্পু, সম্রাট নেপোলিয়ন কোন কোন যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন?
এবারে উত্তর এল। উত্তর নয়, পালটা প্রশ্ন—তুমি জান না?
উইঙ্গফিল্ড হতভম্ব। কুটুনার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। তার চাহনিতে বিস্ময়ের সঙ্গে যে আতঙ্কের ভাবটা রয়েছে সেটা কোনও অলৌকিক ঘটনার সামনে পড়লেই মানুষের হয়।
যে কারণেই হোক, কম্পু আর সে কম্পু নেই। মানুষের দেওয়া ক্ষমতাকে সে কোনও অজ্ঞাত উপায়ে অতিক্রম করে গেছে। আমার ধারণা, তার সঙ্গে এখন কথোপকথন সম্ভব। আমি প্রশ্ন করলাম–
তোমাকে কেউ নিয়ে এসেছে, না তুমি নিজে এসেছ?
নিজে।
এবারে কুটুনা প্রশ্ন করল। তার হাত পা কাঁপছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
কেন এলে?
উত্তর এল। তৎক্ষণাৎ—
টু প্লে।
খেলতে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমি।
উইঙ্গফিল্ড আর কেনসলি মাটিতে বসে পড়েছে।
এ চাইল্ড মাস্ট প্লে।
এসব কী বলছে আমাদের যন্ত্র? আমরা চারজনে প্ৰায় একসঙ্গে বলে উঠলাম—শিশু? তুমি শিশু?
তোমরা শিশু, তাই আমি শিশু।
অন্যেরা এই উত্তরে কী ভাবল জানি না, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম কম্পু কী বলতে চাইছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেও স্বীকার করতেই হবে যে, মানুষ যত না জানে, তার চেয়ে জানে না। অনেক বেশি। এই যে গ্র্যাভিটি বা অভিকর্ষ, যেটার প্রভাব সারা বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডে
মানুষের কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। সেই হিসেবে আমরাও শিশু বই কী!
এখন কথা হচ্ছে কম্পপুকে নিয়ে কী করা যায়। যখন দেখা যাচ্ছে তার মন বলে একটা পদার্থ আছে, তখন তাকেই জিজ্ঞেস করা উচিত। বললাম, তোমার খেলা শেষ?
শেষ। বয়স বাড়ছে।
এখন কী করবে?
ভাবব।এখানেই থাকবে, না আমাদের সঙ্গে যাবে?
যাব।
গেস্টহাউসে পৌঁছেই মাৎসুয়েকে ডেকে পাঠালাম। তাকে বোঝালাম যে, এই অবস্থায় আর কম্পুকে ইনস্টিটিউটে রাখা যায় না, কারণ সর্বক্ষণ তার দিকে নজর রাখা দরকার। অথচ কম্পুর এই অবস্থােটা প্রচার করাও চলে না।
শেষ পর্যন্ত মাৎসুয়েই স্থির করল পন্থা। কম্পপুকে তৈরি করার আগে পরীক্ষা করার জন্য ওরই সাইজে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের গোলক তৈরি করা হয়েছিল, তারই একটা ইনস্টিটিউটে রেখে দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে যে যন্ত্রটা উদ্ধার হয়েছে, আর আসল যন্ত্র থাকবে আমাদের কাছে এই গোস্টহাউসেই। এখানে বলে রাখি যে আমরা চার বৈজ্ঞানিক ছাড়া এখন আর কেউ এখানে নেই। দোতলা বাড়িতে ঘর আছে সবসুদ্ধ ষোলোটা। আমরা চারজনে দোতলার চারটে ঘরে রয়েছি, টেলিফোনে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের বন্দোবস্ত রয়েছে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মাৎসুয়ে একটি কাচের বাক্স পাঠিয়ে দিল আমার ঘরে। তারই মধ্যে তুলোর বিছানায় কম্পপুকে রাখা হয়েছে। অতি সাবধানে তার গা থেকে ধুলো মুছিয়ে দেবার সময় লক্ষ করলাম যে, তার দেহটা আর আগের মতো মসৃণ নেই। প্ল্যাটিনাম অত্যন্ত কঠিন ধাতু, কাজেই যন্ত্র যতই গড়াগড়ি করুক না কেন, এত সহজে তার মসৃণতা চলে যাওয়া উচিত না। শেষমেষ কম্পুকেই কারণ জিজ্ঞেস করলাম। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে সে উত্তর দিল—
জানি না। ভাবছি।
বিকেলের দিকে মাৎসুয়ে আবার এল, সঙ্গে একটি টেপ রেকর্ডার। এই রেকর্ডারের বিশেষত্ব এই যে, মাইক্রোফোনে শব্দতরঙ্গ প্রবেশ করামাত্র আপনা থেকে রেকর্ডার চালু হয়ে যায়, আর শব্দ থামলেই বন্ধ হয়। রেকর্ডার কম্পুর সামনে রাখা রইল, ওটা আপনা থেকেই কাজ করবে।
মাৎসুয়ে বেচারি বড় অসহায় বোধ করছে। ইলেকট্রনিকসের কোনও বিদ্যাই তাকে এই পরিস্থিতিতে সাহায্য করছে না। তার ইচ্ছা ছিল গোলকাটাকে খুলে ফেলে তার ভিতরের সার্কিটগুলো একবার পরীক্ষা করে দেখে, কিন্তু আমি তাকে নিরস্ত করলাম। বললাম, ভিতরে গণ্ডগোল যাই হয়ে থাক না কেন, তার ফলে এখন যেটা হচ্ছে সেটাকে হতে দেওয়া উচিত। কম্পিউটার তৈরি করার ক্ষমতা মানুষের আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, কিন্তু কম্পু এখন যে চেহারা নিয়েছে, সেরকম যন্ত্র মানুষ কোনওদিনও তৈরি করতে পারবে কি না সন্দেহ। তাই এখন আমাদের কাজ হবে শুধু কম্পপুকে পর্যবেক্ষণ করা, এবং সুযোগ বুঝে তার সঙ্গে কথোপকথন চালানো।
সন্ধেবেলা আমার ঘরে বসে চারজনে কফি খাচ্ছি, এমন সময় কাচের বাক্সটা থেকে একটা শব্দ পেলাম। অতি পরিচিত রিনারিনে কণ্ঠস্বর। আমি উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বললে?
উত্তর এল-জানি। বয়সের ছাপ।
অর্থাৎ সকালে তাকে যে প্রশ্ন করেছিলাম সেটার উত্তর এতক্ষণে ভেবে বার করেছে। কম্পু। প্ল্যাটিনামের রুক্ষতা হল বয়সের ছাপ।
তুমি কি বৃদ্ধ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না, বলল কম্পু, আই অ্যাম নাউ ইন মাই ইউথ।
অর্থাৎ এখন আমার জোয়ান বয়স।
আমাদের মধ্যে এক উইঙ্গফিল্ডের হাবভাবে কেমন যেন খটকা লাগছে আমার। মাৎসুয়ে যখন যন্ত্রটাকে খুলে পরীক্ষা করার প্রস্তাব করেছিল, তখন একমাত্র উইন্সফিল্ডই তাতে সায় দিয়েছিল। তার আপশোস যে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে কম্পিউটারটাকে তৈরি করা হয়েছিল। সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে গেল। কম্পু নিজে থেকে কথা বলতে আরম্ভ করলেই উইন্সফিল্ড কেন জানি উশখুশ করতে থাকে। কম্পুর এ হেন আচরণের মধ্যে যে একটা ভৌতিক ব্যাপার রয়েছে সেটা অস্বীকার করা যায় না; কিন্তু তাই বলে একজন বৈজ্ঞানিকের এরকম প্রতিক্রিয়া হবে কেন? আজ তো এই নিয়ে একটা কেলেঙ্কারিই হয়ে গেল। কম্পু আমার সঙ্গে কথা বলার মিনিটখানেকের মধ্যেই উইঙ্গাফিল্ড চেয়ার ছেড়ে গটগট করে কম্পপুর দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার সেই একই প্রশ্ন করে বসল—সম্রাট নেপোলিয়ন কোন কোন যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন? ভাবটা যেন যন্ত্রের কাছ থেকে যান্ত্রিক উত্তরটা পেলেই সে আশ্বস্ত হবে।
কিন্তু উত্তর যেটা এল সেটা একেবারে চাবুক। কম্পু বলল, যা জানো তা জানতে চাওয়াটা মূর্খের কাজ।
এই উত্তরে উইঙ্গফিল্ডের যা অবস্থা হল সে আর বলবার নয়। আর সেইসঙ্গে তার মুখ থেকে যে কথাটা বেরোল তেমন কথা যে একজন প্ৰবীণ বৈজ্ঞানিকের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব এটা আমি ভাবতে পারিনি। অথচ দােষটা উইঙ্গফিল্ডেরই; সে যে কম্পুর নতুন অবস্থাটা কিছুতেই মানতে পারছে না সেটা তার ছেলেমানুষি ও একগুঁয়েমিরই লক্ষণ।
আশ্চর্য এই যে, কম্পুও যেন উইঙ্গফিল্ডের এই অভদ্রতা বরদাস্ত করতে পারল না। পরিষ্কার কণ্ঠে তাকে বলতে শুনলাম, উইঙ্গাফিল্ড, সাবধান!
এর পরে আর উইঙ্গফিন্ডের এঘরে থাকা সম্ভব নয়। সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কেনসিলি আর কুটুনা এর পরেও অনেকক্ষণ ছিল। কেনসলির ধারণা। উইঙ্গফিন্ডের মাথার ব্যামো আছে, তার জাপানে আসা উচিত হয়নি। সত্যি বলতে কী, আমাদের মধ্যে কাজ সবচেয়ে কম করেছে। উইঙ্গাফিল্ড। মেরিভেল জীবিত থাকলে এটা হত না, কারণ ইলেকট্রনিকসে সেও ছিল একজন দিকপাল।
আমরা তিনজনে আমারই ঘরে ডিনার সারলাম। কারুরই মুখে কথা নেই, কম্পুও নির্বাক। তিনজনেই লক্ষ করছিলাম যে, কম্পপুর দেহের রুক্ষতা যেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেড়ে চলেছে।
দুই বিজ্ঞানী চলে যাবার পর আমি দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসেছি, এমন সময় কম্পপুর কণ্ঠস্বরে টেপ রেকর্ডারটা আবার চলতে শুরু করল। আমি কাচের বাক্সটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কম্পুর গলার স্বর আর তেমন তীক্ষ্ণ নেই; তাতে একটা নতুন গাম্ভীর্য লক্ষ করা যাচ্ছে।
তুমি ঘুমোবে? প্রশ্ন করল কম্পু।
আমি বললাম, কেন জিজ্ঞেস করছি?
স্বপ্ন দেখ তুমি?—আবার প্রশ্ন।
তা দেখি মাঝে মাঝে। সব মানুষই দেখে।
কেন ঘুম? কেন স্বপ্ন?
দুরূহ প্রশ্ন করেছে কম্পুর্ণ। বললাম, সেটা এখনও সঠিক জানা যায়নি। ঘুমের ব্যাপারে একটা মত আছে। আদিম মানুষ সারাদিন খাদ্যের সন্ধানে পরিশ্রম করে রাত্রে কিছু দেখতে না পেয়ে চুপচাপ তার গুহায় বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ত, তারপর দিনের আলো চোখে লাগলে তার ঘুম ভেঙে যেত। মানুষের সেই আদিম অভ্যোসটা হয়তো আজও রয়ে গেছে।
আর স্বপ্ন?
জানি না। কেউই জানে না।
আমি জানি।
জান?
আরও জানি। স্মৃতির রহস্য জানি। মানুষ কবে এল জানি। মাধ্যাকর্ষণ জানি। সৃষ্টির গোড়ার কথা জানি।
আমি তটস্থ হয়ে চেয়ে আছি কম্পপুর দিকে। টেপ রেকর্ডার চলছে। বিজ্ঞানের কাছে যা রহস্য, তার সন্ধান কি কম্পু দিতে চলেছে?
না, তা নয়।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে কম্পপু বলল, মানুষ অনেক জেনেছে। এগুলোও জানবে। সময় লাগবে। সহজ। রাস্তা নেই।
তারপর আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর—কেবল একটা জিনিস মানুষ জানবে না। আমার জানতে হবে। আমি মানুষ নই। আমি যন্ত্র।
কী জিনিস?-আমি উদগ্রীব হয়ে প্ল্যাটিনাম গোলকটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলাম।
কিন্তু কম্পু নির্বাক। টেপ রেকর্ডার থেমে আছে। মিনিটতিনেক এইভাবে থাকার পর সেটা আবার বলে উঠল—শুধু দুটো শব্দ রেকর্ড করার জন্য—
গুড নাইট।
১৮ই মার্চ
আমি হাসপাতালে বসে ডায়রি লিখছি। এখন অনেকটা সুস্থ। আজই বিকেলে ছাড়া পাব। এই বয়সে এমন একটা বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা হতে পারে সেটা ভাবতে পারিনি। কম্পপুর কথা না শুনে যে কী ভুল করেছি, সেটা এখন বুঝতে পারছি।
পরশু রাত্রে কম্পু গুড নাইট করার পর বিছানায় শুয়ে কয়েকমিনিটের মধ্যেই আমার ঘুম এসে গিয়েছিল। এমনিতে আমার খুব গাঢ় ঘুম হয়, তবে কোনও শব্দ হলে ঘুমটা ভাঙেও চট করে। কাজেই টেলিফোনটা যখন বেজে উঠল, তখন মুহুর্তের মধ্যেই আমি সম্পূর্ণ সজাগ। পাশে টেবিলে লুমিনাস ডায়ালওয়ালা ট্র্যােভলিং ক্লকে দেখলাম আড়াইটে।
টেলিফোনটা তুলে হ্যালো বলতে শুনলাম। উইঙ্গফিল্ডের গলা।
শঙ্কু, তোমার ঘুমের বড়ি একটা পাওয়া যাবে? আমার স্টক শেষ।
স্বভাবতই এতে আমার আপত্তির কোনও কারণ থাকতে পারে না। আমি বললাম। এক মিনিটের মধ্যে তার ঘরে গিয়ে আমি বড়ি দিয়ে আসব। উইঙ্গাফিল্ড বলল সে নিজেই আসছে।
আমি বড়ি বার করতে সঙ্গে সঙ্গেই দরজার সুরেলা ঘণ্টাটা বেজে উঠল। উঠে গিয়ে খুলতে যাব এমন সময় কম্পুর গলা পেলাম–
খুলো না।
আমি অবাক। বললাম, কেন?
উইঙ্গাফিল্ড অসৎ।
এসব কী বলছে কম্পু!
এদিকে দরজার ঘণ্টা আবার বেজে উঠেছে, আর তার সঙ্গে উইঙ্গফিল্ডের ব্যস্ত কণ্ঠস্বর—তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নাকি, শঙ্কু? আমি ক্লিপিং পিলের জন্য এসেছি।
কম্পু তার নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে চুপ করে গেছে।
আমি দেখলাম দরজা না খোলায় অনেক মুশকিল। কী কৈফিয়ত দেব তাকে? যদি এই যন্ত্রের কথা সত্যি না হয়?
দরজা খুললাম, এবং খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাতে আমি সংজ্ঞা হারালাম।
যখন জ্ঞান হল তখন আমি হাসপাতালে। আমার খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিন বৈজ্ঞানিক-কুট্না, কেনসিলি আর মাৎসুয়ে। তারাই দিল আমাকে বাকি ঘটনার বিবরণ।
আমাকে অজ্ঞান করে উইন্সফিল্ড কম্পুকে দুভাগে ভাগ করে বগলদাবা করে নিজের ঘরে চলে যায়। তারপর সুটকেসের মধ্যে কম্পুর দু অংশ পুরে ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করে নীচে গিয়ে ম্যানেজারকে জানায় যে তাকে প্লেন ধরতে এয়ারপোর্টে যেতে হবে, তার জন্য যেন গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়। এদিকে গেস্টহাউসের এক ভৃত্য উইন্সফিল্ডের তিনটে সুটকেস নীচে নিয়ে আসার সময় তার একটা অস্বাভাবিক ভারী মনে হওয়ায় তার সন্দেহের উদ্রেক হয়, সে পাহারার জন্য মোতায়েন পুলিশের লোককে গিয়ে সেটা জানায়। পুলিশের লোক উইঙ্গাফিল্ডকে চ্যালেঞ্জ করলে উইঙ্গাফিল্ড মরিয়া হয়ে রিভলভার বার করে। কিন্তু পুলিশের তৎপরতার ফলে উইঙ্গফিন্ডকে হার মানতে হয়। সে এখন হাজতে আছে-সন্দেহ হচ্ছে ম্যাসাচুসেটসে তার সহকমী মেরিভেলের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী হতে পারে। কম্পু তার আশ্চর্যক্ষমতার বলে তার স্বরূপ প্ৰকাশ করে দিতে পারে এই ভয়ে সে কম্পুকে নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করেছিল, হয়তো এয়ারপোর্টে যাবার পথে কোথাও তাকে ফেলে দিত।
আমি সব শুনে বললাম, কম্পু এখন কোথায়?
মাৎসুয়ে একটু হেসে বলল, তাকে আবার ইনস্টিটিউটে ফিরিয়ে নিয়ে গেছি। গেস্টহাউসে রাখাটা নিরাপদ নয় সে তো বুঝতেই পারছি। সে তার কামরাতেই আছে। তাকে আবার জোড়া লাগিয়েছি।
সে কথা বলছে কি?
শুধু বলছে না, আশ্চর্য কথা বলছে। জাপানে ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পাবার জন্য একরকম বাড়ির পরিকল্পনা দিয়েছে, যেগুলো জমি থেকে পাঁচ মিটার উপরে শূন্যে ভাসমান অবস্থায় থাকবে। বিজ্ঞান আজকাল যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তাতে এটা দশ বছরের মধ্যেই জাপান সরকার কার্যকরী করতে পারবে।
আর কিছু বলেছে?
তোমাকে দেখতে চায়, বলল। মাৎসুয়ে।
আমি আর থাকতে পারলাম না। মাথার যন্ত্রণা চুলোয় যাক, আমাকে ইনস্টিটিউটে যেতেই হবে।
পারবে তো? একসঙ্গে প্রশ্ন করল কুট্না ও কেন্সলি।
নিশ্চয়ই পারব।
আধঘণ্টার মধ্যে আবার সেই সুদৃশ্য কামরায় গিয়ে হাজির হলাম। আবার সেই স্ফটিকের স্তম্ভের উপর বসে আছে কম্পু। সিলিং থেকে তীব্র আলোকরশ্মি গিয়ে পড়েছে তার উপর, আর সেই আলোয় বেশ বুঝতে পারছি কম্পপুর দেহের মসৃণতা চলে গিয়ে এখন তার সবঙ্গে ফাটল ধরেছে। এই চারদিনে তার বয়স অনেক বেড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আমি কম্পপুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনও প্রশ্ন করার আগেই তার শান্ত, গভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।
ঠিক সময়ে এসেছি। আর সাড়ে তিন মিনিটে ভূমিকম্প হবে। মৃদু কম্পন। টের পাবে, তাতে কারুর ক্ষতি হবে না। আর তখনই আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর আমি পাব। সে উত্তর কোনও মানুষে পাবে না কোনওদিন।
এরপর আর কী বলা যায়। আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে রইলাম। কম্পুর কয়েক হাত উপরেই ইলেকট্রিক ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা এগিয়ে চলেছেটকটক করে।
এক মিনিট…দু মিনিট…তিন মিনিট…। অবাক চোখে দেখছি কম্পুর দেহের ফাটল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহের জ্যোতিও বাড়ছে। শুধু বাড়ছে কি? তা তো নয়—তার সঙ্গে রঙের পরিবর্তন হচ্ছে যে!-এ তো প্ল্যাটিনামের রং নয়, এ যে সোনার রং!
পনেরো সেকেন্ড…বিশ সেকেন্ড…পঁচিশ সেকেন্ড…
ঠিক ত্ৰিশ সেকেন্ডের মাথায় পায়ের তলার মেঝেটিা কেঁপে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে এক অপার্থিব বর্ণচ্ছটা বিকীর্ণ করে কম্পপুর দেহ সশব্দে খণ্ড খণ্ড হয়ে স্ফটিকস্তম্ভের উপর থেকে শ্বেতপাথরের মেঝেতে পড়ল, তার ভিতরের কলকবাজা চুৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে ধুলোর মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, আর সেই ভগ্নস্তৃপ থেকে একটা রক্ত হিম করা অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে উঠল—
মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি!
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৮৫
কর্ভাস (প্রোফেসর শঙ্কু)
১৫ই আগস্ট
পাখি সম্পর্কে কৌতূহলটা আমার অনেক দিনের। ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা পোষা ময়না ছিল, সেটাকে আমি একশোর উপর বাংলা শব্দ পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করতে শিখিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল, পাখি কথা বললেও কথার মানে বোঝে না। একবার এই ময়নাটাই এমন এক কাণ্ড করে বসল যে, আমার সে ধারণা প্রায় পালটে গেল। দুপুরবেলা সবেমাত্র আমি ইস্কুল থেকে ফিরছি, মা রেকাবিতে মোহনভোগ এনে দিয়েছেন, এমন সময় ময়নাটা হঠাৎ ভূমিকম্প, ভূমিকম্প বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমরা কোনও কম্পন টের পাইনি, কিন্তু পরের দিন কাগজে বেরোল সিজমোগ্রাফ যন্ত্রে সত্যিই নাকি একটা মৃদু কম্পন্ন ধরা পড়েছে।
সেই থেকে পাখিদের বুদ্ধির দৌড় সম্পর্কে মনে একটা অনুসন্ধিৎসা রয়ে গেছে, কিন্তু অন্যান্য পাঁচ রকম বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্যে ওটা নিয়ে আর চাচা করা হয়নি। আর একটা কারণ অবিশ্যি আমার বেড়াল নিউটন। নিউটন পাখি পছন্দ করে না, আর নিউটনকে অখুশি করে আমার কিছু করতে মন চায় না। সম্প্রতি, বয়সের জন্যই বোধ হয়, নিউটন দেখছি পাখি সম্বন্ধে অনেকটা উদাসীন হয়ে পড়েছে। সেই কারণেই আমার ল্যাবরেটরিতে আবার কাক, চড়ুই, শালিক ঢুকতে আরম্ভ করেছে। আমি সকালে তাদের খেতে দিই। সেই খাদ্যের প্রত্যাশায় তারা সূর্য ওঠার আগে থেকেই আমার জানালার বাইরে জটিলা করে।
প্রত্যেক প্রাণীরই কিছু কিছু নির্দিষ্ট সহজাত ক্ষমতা থাকে। আমার ধারণা, অন্য প্রাণীর তুলনায় পাখির ক্ষমতা আরও বেশি, আরও বিস্ময়কর। একটা বাবুইয়ের বাসা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। একজন মানুষকে কিছু খড়কুটো দিয়ে যদি ও রকম একটা বাসা তৈরি করতে বলা হয়, আমার বিশ্বাস মে কাজটা সে আদৌ করতে পারবে না, কিংবা যদি বা পারে তো মাসখানেকের অক্লান্ত পরিশ্রম লেগে যাবে।
অষ্ট্রেলিয়াতে ম্যালি-ফাউল বলে এক রকম পাখি আছে, যারা মাটিতে বাসা করে। বালি, মাটি আর উদ্ভিজ দিয়ে তৈরি একটা টিপি, আর তার ভিতরে ঢোকার জন্য একটা গর্ত। ডিম পাড়ে বাসার ভিতরে, কিন্তু সে ডিমে তা দেয় না। অথচ উত্তাপ না হলে তো ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোবে না। উপায় কী? উপায় হল এই যে ম্যালি-ফাউল কোনও এক আশ্চর্য অজ্ঞাত কৌশালে বাসার ভিতরের তাপমাত্ৰা আটাত্তর ডিগ্রি ফারেনহাইটের এক ডিগ্রিও এদিক ওদিক হতে দেয় না, তা বাইরের আবহাওয়া ঠাণ্ডা বা গরম যাই হোক না কেন।
আরও রহস্য। গ্রিব নামক পাখি তাদের নিজেদের পালক ছিড়ে ছিড়ে খায় এবং শাবকদের খাওয়ায়, কেন তা কেউ জানে না। আবার এই একই গ্রিাব পাখি জলে ভাসমান অবস্থায় কোনও শত্রুর আগমনের ইঙ্গিত পেলে, নিজের দেহ ও পালক থেকে কোনও এক অজ্ঞাত উপায়ে বায়ু বার করে দিয়ে শরীরের স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি বাড়িয়ে গলা অবধি জলে
ড়ুবে ভাসতে থাকে।
এ ছাড়া যাযাবর পাখির দিকনির্ণয় ক্ষমতা, ঈগল-বাজের শিকার ক্ষমতা, শকুনের হ্রাণশক্তি, অসংখ্য পাখির আশ্চর্য সংগীতপ্রতিভা–এ সব তো আছেই। এই কারণেই কিছু দিন থেকে পাখির পিছনে কিছুটা চিন্তা ও সময় দিতে ইচ্ছা করছে। তার সহজাত বুদ্ধির বাইরে তাকে কত দূর পর্যন্ত নতুন জিনিস শেখানো যায়? মানুষের জ্ঞান, মানুষের বুদ্ধি তার মধ্যে সঞ্চার করা যায় কি? এমন যন্ত্র কি তৈরি করা সম্ভব, যার সাহায্যে এ কাজটা হতে পারে?
২০শে সেপ্টেম্বর
আমার পাখিাপড়ানো যন্ত্র নিয়ে কাজ চলেছে। আমি সহজ পথে বিশ্বাসী। আমার যন্ত্রও তাই হবে জলের মতো সহজ। দুটি অংশে হবে এই যন্ত্র। একটি হবে খাঁচার মতো। পাখি থাকবে সেই খাঁচার মধ্যে। খাঁচার সঙ্গে বৈদ্যুতিক যোগ থাকবে দ্বিতীয় অংশের। এই অংশটি থেকে জ্ঞান ও বুদ্ধি চালিত হবে পাখির মস্তিষ্কে।
এই এক মাস আমার ল্যাবরেটরির জানোলা দিয়ে খাদ্যের লোভে যে সব পাখি এসে ঢুকেছে, সেগুলোকে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে স্টাডি করেছি। কাক, চড়ুই, শালিক ছাড়া পায়রা, ঘুঘু, টিয়া, বুলবুলি ইত্যাদিও মাঝে মাঝে আসে। সব পাখির মধ্যে একটি বিশেষ পাখি বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেটা একটা কাক। দাঁড়কাক নয়, সাধারণ কাক। কাকটা আমার চেনা হয়ে গেছে। ডান চোখের নীচে একটা সাদা ফুটকি আছে, সেটা থেকে তো চেনা যায়ই, তা ছাড়া হাবভাবও অন্য কাকের চেয়ে বেশ একটু অন্য রকম। ঠোঁটে পেনসিল নিয়ে টেবিলের উপর আঁচড় কাটতে আর কোনও পাখিকে দেখিনি। কালকে তো একটা ব্যাপারে রীতিমতো হকচাকিয়ে গেছি। আমি আমার যন্ত্র তৈরির কাজ করছি, এমন সময় একটা খচ খচ শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, কাকটা একটা আধাখোলা দেশলাইয়ের বাক্স থেকে ঠোঁট দিয়ে একটা কাঠি বার করে তার মাথাটা বাক্সের পাশটায় ঘষছে। আমি বাধ্য হয়ে হুস হুস শব্দ করে কাকটাকে নিরস্ত করলাম। কাকটা তখন উড়ে গিয়ে জানালায় বসে গলা দিয়ে দ্রুত কয়েকটা শব্দ করল, যেটার সঙ্গে কাকের স্বাভাবিক কা কা। শব্দের কোনও সাদৃশ্য নেই। হঠাৎ শুনে মনে হবে, যেন কাকটা বুঝি হাসছে।
যে রকম চালাক পাখি, আমার পরীক্ষার জন্য একে ব্যবহার করতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হবে। দেখা যাক কত দূর কী হয়।
২৭শে সেপ্টেম্বর
আমার অরনিথন যন্ত্র আজ তৈরি শেষ হল। কাকটা সকালেই আমার ঘরে ঢুকে পাউরুটি খেয়ে এ জানালা ও জানালা লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল, যন্ত্রটা টেবিলের উপর রেখে যেই তার দরজা খুলে দিলাম, অমনি কাক দিব্যি লাফাতে লাফাতে এসে তার ভিতরে ঢুকে পড়ল। এ থেকে এটাই অনুমান করা যায় যে, কাকটার শেখার আগ্রহ প্রবল। প্রথমে কিছুটা ভাষা জ্ঞান হওয়া দরকার, না হলে আমার কথা বুঝতে পারবে না; তাই সহজ বাংলা দিয়ে শুরু করেছি। আমাকে বোতাম টেপা ছাড়া আর কোনও কাজই করতে হচ্ছে না। শেখাবার বিষয় সমস্তই আগে থেকে রেকর্ড করা। বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন বিষয়, প্ৰত্যেকটার আলাদা নম্বর দেওয়া। একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম–বোতাম টিপলেই কাকটার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে যায়। কাকের মতো ছটফটে পাখির পক্ষে এটা যে কত অস্বাভাবিক, সে তো বুঝতেই পারছি।
নভেম্বর মাসে চিলির রাজধানী সানতিয়াগো শহরে সারা বিশ্বের পক্ষিবিজ্ঞানীদের একটা কনফারেনস আছে। মিনেসোটাতে আমার পক্ষিবিজ্ঞানী বন্ধু রিউফাস গ্রেনফেলকে একটা চিঠি লিখে দিয়েছি। যদি আমার বায়স বন্ধুটি সত্যি করে মানুষের বুদ্ধি কিছুটা আয়ত্ত করতে পারে, তা হলে ওকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে সম্মেলনে ডিমনসট্রেশন সহ একটা বক্তৃতা দেওয়া চলতে পারে।
৪ঠা অক্টোবর
কর্ভাস হল কাক জাতীয় পাখির ল্যাটিন নাম। আমার ছাত্রটিকে আমি ওই নামেই ডাকছি। নাম ধরে ডাকলে প্রথম দিকে আমার দিকে ফিরে ফিরে চাইত, এখন দেখছি গলা দিয়ে শব্দ করে উত্তর দেয়। এই প্রথম একটা কাককে ক না বলে কি বলতে শুনছি। তবে কণ্ঠস্বরের বিশেষ পরিবর্তন আমি আশা করছি না। অর্থাৎ কর্ভাসকে দিয়ে কথা বলানো চলবে না। তার বুদ্ধির পরিচয় তার কাজেই প্রকাশ পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
কর্ভাস এখন ইংরাজি শিখছে। বাইরে গিয়ে ডিমনসিস্ট্রেশন দিতে গেলে এই ভাষাটার প্রয়োজন হবে। ওর ট্রেনিং-এর সময় হল সকাল আটটা থেকে নট। দিনের বেলা বাকি সময়টা ও আমার ঘরের আশপাশেই ঘোরাফেরা করে। সন্ধ্যা হলে এখনও রোজই চলে যায় আমার বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোণের আম গাছটায়।
নিউটন দেখছি কর্ভাসকে দিব্যি মেনে নিয়েছে। আজকে যে ঘটনাটা ঘটল, তার পরে সম্পৰ্কটা বন্ধুত্বে পরিণত হলেও আশ্চর্য হব না। ব্যাপারটা ঘটল দুপুরে। নিউটন আমার আরাম কেদারাটার পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে, কিভাস কোথায় যেন উধাও, আমি খাতায় নোট লিখছি, এমন সময় হঠাৎ ডানার ঝটপটানি শুনে জানালার দিকে চেয়ে দেখি কর্ভাস ঘরে ঢুকেছে, তার ঠোঁটে একটি সদ্য কাটা মাছের টুকরো। সে সেটাকে এনে থপ করে নিউটনের সামনে ফেলে দিয়ে আবার জানালায় ফিরে গিয়ে বসে বসেই ঘাড় বেঁকিয়ে এ দিক ও দিক দেখতে লাগল।
গ্রেনফেল আমার চিঠির উত্তর দিয়েছে। লিখেছে, সে পক্ষিবিজ্ঞানীদের সম্মেলনে আমাকে নেমন্তন্ন পাঠানোর বন্দোবস্ত করছে। আমি অবশ্যই যেন কাক সমেত যথাসময়ে সানতিয়াগোতে গিয়ে হাজির হই।
২০শে অক্টোবর
দু সপ্তাহে অভাবনীয় প্রোগ্রেস। কর্ভাস ঠোঁটে পেনসিল নিয়ে ইংরিজি কথা আর সংখ্যা লিখছে। কাগজটাকে টেবিলের উপর ফেলে দিতে হয়, কিভাস তার উপর দাঁড়িয়ে লেখে। ওর নিজের নাম ইংরাজিতে লিখল–C-O-R-V-U-S। সহজ যোগ বিয়োগ করতে পারছে, ইংল্যান্ডের রাজধানী কী জিজ্ঞেস করলে লিখতে পারছে, আমার পদবি লিখতে পারছে। তিন দিন আগে মাস, বার, তারিখ শিখিয়ে দিয়েছিলাম, আজকে কী বার, জিজ্ঞেস করাতে পরিষ্কার অক্ষরে লিখল—F-R-I-D-A-Y।
কর্ভাসের খাওয়ার ব্যাপারেও বুদ্ধির পরিচয় পেয়েছি। আজ একটা পাত্রে রুটি-টোস্টের টুকরো আর আরেকটাতে খানিকটা পেয়ারার জেলি ওর সামনে রেখেছিলাম। ও রুটির টুকরোগুলো মুখে পোরার আগে প্রতিবারই ঠোঁট দিয়ে খানিকটা জেলি মাখিয়ে নিচ্ছিল।
২২শে অক্টোবর
কর্ভাস যে এখন সাধারণ কাকের থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে চায়, তার স্পষ্ট প্রমাণ আজকে পেলাম। আজ দুপুরে হঠাৎ খুব বৃষ্টি হল, সঙ্গে বিদ্যুৎ ও বজ্ৰপাত। তিনটে নাগাত একটা কনফাটানো বাজ পড়ার শব্দ শুনে জানালার কাছে গিয়ে দেখি, আমার বাগানের বাইরের শিমুল গাছটা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বিকেলে বৃষ্টি থামার পর প্রচণ্ড কাকের কোলাহল। এ তল্লাটে যত কাক আছে, সব ওই মরা গাছটায় জড়ো হয়ে হল্লা করছে। আমার চাকর প্রহ্লাদকে ব্যাপারটা দেখতে পাঠালাম। সে ফিরে এসে বলল, বাবু, একটা কাক মরে পড়ে আছে গাছটার নীচে, তাই এত চেল্লাচেল্লি। বুঝলাম বাজ পড়ার ফলেই কাকটার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য–কর্ভাস আমার ঘর থেকে বেরোবার কোনও রকম আগ্ৰহ দেখাল না। সে একমনে পেনসিল মুখে দিয়ে প্রাইম নাম্বারস লিখে চলেছে–2,3,4,5,7,11,13……
৭ই নভেম্বর
কর্ভাসকে এখন সদৰ্পে বৈজ্ঞানিক মহলে উপস্থিত করা চলে। পাখিকে শিখিয়ে পড়িয়ে খুঁটিনাটি ফরমাশ খাটানোর নানা রকম উদাহরণ পাওয়া যায়, কিন্তু কর্ভাসের মতো এমন শিক্ষিত পাখির নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে বলে আমার জানা নেই। অরনিথন যন্ত্রের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অঙ্ক, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ইত্যাদি সব বিষয়েই যে সব প্রশ্নের উত্তর সংখ্যার সাহায্যে বা অল্প কয়েকটি শব্দের সাহায্যে দেওয়া যায়, কিভাস তা শিখে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ওর মধ্যে যে জিনিসটা প্ৰায় আপনার থেকে জেগে উঠেছে, সেটাকে বলা চলে মানবসুলভ বুদ্ধি বা হিউম্যান ইনটেলিজেনসযেটার সঙ্গে পাখির কোনও সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ একটা ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সানতিয়াগো যাব বলে আজ সকালে আমার সুটকেস গোছাচ্ছিলুম। গোছানো শেষ হলে পর বাক্সের ঢাকনা বন্ধ করে পাশে ফিরে দেখি, কর্ভাস সুটকেসের চাবিটা ঠোঁটে নিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।
কাল গ্রেনফেলের আর একটা চিঠি পেয়েছি। ও সানতিয়াগো পৌঁছে গেছে। পক্ষিবিজ্ঞানী সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ আমার আসার পথ চেয়ে আছে। এর আগে এই সব সম্মেলনে কেবল পাখি নিয়ে বক্তৃতাই হয়েছে, জ্যান্ত পাখির সাহায্যে উদাহরণ সমেত কোনও বক্তৃতা কখনও হয়নি। গত দু মাসের গবেষণার ফলে পাখির মস্তিষ্কের বিষয়ে আমি যে দুর্লভ জ্ঞান সঞ্চয় করেছি, সে সম্পর্কে একটা প্ৰবন্ধ লিখছি। সেটাই হবে সম্মেলনে আমার পেপার। প্রতিবাদীর মুখ বন্ধ করার জন্য সঙ্গে থাকবে কর্ভাস।
১০ই নভেম্বর
দক্ষিণ আমেরিকা যাবার পথে প্লেনে বসে এই ডায়রি লিখছি। একটিমাত্র ঘটনাই লেখার আছে। বাড়ি থেকে যখন রওনা হব, তখন কভার্স হঠাৎ দেখি তার খাঁচা থেকে বার হওয়ার জন্য ভারী ছটফটানি আরম্ভ করেছে। কী ব্যাপার বুঝতে না পেরে খাঁচার দরজা খুলে দিতেই সে সটান উড়ে গিয়ে আমার রাইটিং টেবিলে বসে ঠোঁট দিয়ে উপরের দেরাজটায় ভীষণ ব্যস্তভাবে টোকা মারতে আরম্ভ করল। দেরাজ খুলে দেখি, আমার পাসপোর্ট-টা তার মধ্যে রয়ে গেছে।
কর্ভাসের জন্য একটা নতুন ধরনের খাঁচা বানিয়ে নিয়েছি। যে আবহাওয়া কর্ভাসের পক্ষে সবচেয়ে আরামদায়ক, খাঁচার ভিতর কৃত্রিম উপায়ে সেই আবহাওয়া বজায় রাখার ব্যবস্থা করেছি। খাবার জন্য কাকের পক্ষে পুষ্টিকর ভিটামিন দিয়ে হোমিওপ্যাথিক বড়ির মতো মুখরোচক বড়ি তৈরি করে নিয়েছি।
প্লেনের যাত্রীদের মধ্যে কেউই বোধ হয়। এর আগে কখনও পোষা কাক দেখেনি। কর্ভাস তাই সকলেরই কৌতূহল উদ্রেক করছে। তবে আমি আমার কাকের বিশেষত্ব সম্পর্কে কাউকে কিছু বলিনি। ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাই অনুমান করেই বোধ হয়। কর্ভাসও সাধারণ কাকের মতোই ব্যবহার করছে।
১৪ই নভেম্বর
হোটেল একসেলসিয়র, সানতিয়াগো। রাত এগারোটা। দু দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, তাই ডায়রি লেখার সময় পাইনি। আগে আমার বক্তৃতার কথাটা বলে নিই, তারপর এই কিছুক্ষণ আগের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় আসা যাবে। এক কথায় বলা যায়, কর্ভাসসহ আমার বক্তৃতাটা হয়েছে–অ্যানাদার ফেদার ইন মাই ক্যাপ। লেখাটা পড়তে লেগেছিল আধা ঘণ্টা, তারপর কর্ভাসকে নিয়ে ডিমনসিস্ট্রেশন চলল এক ঘণ্টার উপর। আমি মঞ্চে উঠেই কর্ভাসকে খাঁচা থেকে বার করে টেবিলের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্ৰকাণ্ড লম্বা মেহগনির টেবিল, তার পিছনে লাইন করে সম্মেলনের কর্তৃপক্ষীরা বসেছেন, আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে আমার প্রবন্ধ পড়ছি। পড়া যতক্ষণ চলল, ততক্ষণ কর্ভাস এক পা-ও নড়েনি। তার এক পাশে ঘাড় কাত করার ভঙ্গি ও মাঝে মাঝে মাথা উপরনীচ করা থেকে মনে হচ্ছিল, সে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে এবং কথা বুঝতেও পারছে। বক্তৃতা শেষ হবার পর চারিদিক থেকে করধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে একটা কাঠঠোকরার মতো শব্দ শুনে টেবিলের দিয়ে চেয়ে দেখি, কিভাস তার ঠোঁট দিয়ে হাততালির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেবিলের উপর ঠিকে চলেছে।
ডিমনসট্রেশনের সময় অবিশ্যি। কর্ভাসের কোনও বিরাম ছিল না। গত দু মাসে সে যা কিছু শিখেছে। সবই সম্মেলনের অভ্যাগতদের সামনে উপস্থিত করে তাঁদের তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছে যে পাখির মস্তিষ্কে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি যে এভাবে প্রবেশ করতে পারে, তা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি। এখানকার কাগজ কোরিয়েরে দেল সানতিয়াগো-র সান্ধ্য সংস্করণে এর মধ্যেই কর্ভাসের খবর বেরিয়ে গেছে। শুধু বেরিয়েছে নয়, প্রথম পাতায় প্রধান খবর হিসেবে বেরিয়েছে, আর তার সঙ্গে বেরিয়েছে পেনসিল মুখে কর্ভাসের একটা ছবি।
মিটিং-এর পর গ্রেনফেল ও সম্মেলনের চেয়ারম্যান সিনিয়র কোভারুবিয়াসের সঙ্গে সানতিয়াগো শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। জনবহুল মনোরম আধুনিক শহর, পুব দিকে আন্ডিজ পর্বতশ্রেণী চিলি ও আরজেনটিনার মধ্যে প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। ঘণ্টাখানেক ঘোরার পর কোভারুবিয়াস বললেন, সম্মেলনের প্রোগ্রামে দেখে থাকবে, অতিথিদের জন্য আমরা নানা রকম আমোদপ্রমোদের আয়োজন করেছি। তারমধ্যে আজ বিকেলের ব্যাপারটায় আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করছি। একটি চিলিয়ান জাদুকর আজ তামাশা দেখবেন তোমাদের খাতিরে। ইনি আর্গাস নামে পরিচিত। এঁর বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, ইনি ম্যাজিকে নানা রকম পাখি ব্যবহার করেন।
ব্যাপারটা শুনে কৌতূহল হয়েছিল, তাই আমি আর গ্রেনফেল আজ বিকেলে এখানকার প্লাজ থিয়েটারে আর্গাসের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিলাম। লোকটা নানা রকম পাখি ব্যবহার করে, সেটা ঠিকই। হাঁস, কাকাতুয়া, পায়রা, মোরগ, তিন হাত লম্বা সারস, এক ঝাঁক হামিং বার্ড–এ সবই কাজে লাগায় আর্গাস এবং বোঝাই যায় যে, সব কটি পাখিকেই সে বেশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ শিখিয়ে নিয়েছে। বলাবাহুল্য, এই কাজের কোনওটাই আমার কর্ভাসের কৃতিত্বের ধারেকাছেও আসে না। সত্যি বলতে কী, পাখির চেয়ে আমার অনেক বেশি ইনটারেস্টিং মনে হল জাদুকর ব্যক্তিটিকে। টিয়াপাখির মতো নাক, মাঝখানে সিঁথি করা, টান করে পিছনে আঁচড়ানো নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো চকচকে চুল, চোখে মাইনাস পাওয়ারের চশমা, তার কাচ এত পুরু যে, মণি দুটোকে তীক্ষ্ণ বিন্দুর মতো দেখায়। লম্বায় লোকটা ছ’ ফুটের উপর। চকচকে কালো কোটের আস্তিনের ভিতর থেকে দুটো শীর্ণ ফ্যাকাশে হাত বেরিয়ে আছে, সেই হাতের বিভিন্ন ভঙ্গিমাই দর্শকদের সম্মোহিত করে রাখে। জাদু খুব উঁচু দরের না হলেও, জাদুকরের চেহারা ও হাবভাব দেখেই প্রায় পয়সা উঠে আসে। আমি শো দেখে হল থেকে বেরোবার সময় গ্রেনফেলকে পরিহাসচ্ছলে বললাম, আমাদের যেমন আর্গাসের ম্যাজিক দেখানো হল, আগাঁসকে তেমনই কর্ভাসের খেলা দেখাতে পারলে মন্দ হত না।
রাত নটায় ডিনার ও তারপরে অতি উপাদেয় চিলিয়ান কফি খেয়ে গ্রেনফেলের সঙ্গে হোটেলের বাগানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সবেমাত্র ঘরে এসে বাতি নিবিয়ে বিছানায় শুয়েছি, এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। আমি একটু অবাক হয়ে অন্ধকারেই রিসিভারটা তুলে কানে দিলাম।
সিনিয়ার শঙ্কু?
হ্যাঁ—
আমি রিসেপশন থেকে বলছি। আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমা চাইছি। একটি ভদ্রলোক বিশেষ করে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।
আমি বাধ্য হয়েই বললাম যে আমি ক্লান্ত, সুতরাং ভদ্রলোক যদি কাল সকালে আমাকে টেলিফোন করে একটা অ্যাপয়েনটমেনট করতে পারেন, তা হলে ভাল হয়। নিশ্চয়ই কোনও রিপোর্টার হবে। এরমধ্যেই চারজন সাংবাদিককে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে এবং তারা যে সব প্রশ্ন করেছে, তাতে আমার মতো ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষকেও রীতিমতো অসহিষ্ণু হয়ে পড়তে হয়। একজন সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, ভারতবর্ষে যেমন গোরুকে পুজো করা হয়, তেমনই কাককেও হয় কি না।
রিসেপশন লোকটির সঙ্গে কথা বলে বলল, সিনিয়র শঙ্কু, ভদ্রলোক বলছেন তিনি পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেবেন না। সকালে ওঁর একটা অন্য এনগেজমেন্ট রয়েছে।
বললাম, যিনি এসেছেন। তিনি কি সংবাদপত্রের লোক?
আজ্ঞে, না। ইনি হলেন বিখ্যাত চিলিয়ান জাদুকর আর্গাস।
নামটা শুনে বাধ্য হয়েই ভদ্রলোককে উপরে আসতে বলতে হল। বিছানার পাশের টেবিল ল্যাম্পট জ্বালিয়ে দিলাম। তিন মিনিট পরে কলিং বেল বেজে উঠল।
দরজা খুলে যাঁকে সামনে দেখলাম, তাঁকে স্টেজে ছা ফুট বলে মনে হয়েছিল, এখন বুঝলাম তিনি সাড়ে ছ’ ফুটেরও বেশি লম্বা। সত্যি বলতে কী, এত লম্বা মানুষ এর আগে আমি কখনও দেখিনি। বিলিতি কায়দায় সামনের দিকে ঝুকে পড়ে নমস্কার জানাবার সময়ও তিনি আমার চেয়ে প্রায় ছ। ইঞ্চি লম্বা রয়ে গেলেন। ভদ্রলোককে ঘরে আসতে বললাম। স্টেজের পোশাক ছেড়ে জাদুকর এখন সাধারণ সুট পরে এসেছেন, তবে এ সুটের রংও কালো। ঘরে ঢোকার পর লক্ষ করলাম, কোটের পকেটে কোরিয়েরে দেল সানতিয়াগো-র সান্ধ্য সংস্করণ। আর্গাস চেয়ারে বসার পর তাঁর ম্যাজিকের তারিফ করে বললাম, যত দূর মনে পড়ছে, গ্রিক উপকথায় আর্গাস নামক একজন কীর্তিমান পুরুষের কথা পড়েছি, যার সবাঙ্গে ছিল সহস্ৰ চোেখ। একজন জাদুকরের পক্ষে নামটা বেশ মানানসই।
আর্গাস মৃদু হেসে বললেন, সেই কীর্তিমান পুরুষটির সঙ্গে পাখির একটা সম্পর্ক রয়েছে, মনে পড়ছে নিশ্চয়ই।
আমি বললাম, হ্যাঁ। গ্রিক দেবী হেরা আর্গাসের চোখগুলি তুলে ময়ূরের পুচ্ছে বসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই ময়ুরের লেজে চাকা চাকা দাগ। কিন্তু আমার কৌতূহল হচ্ছে আপনার চোখ সম্পর্কে। কত পাওয়ার আপনার চশমার?
মাইনাস কুড়ি। তবে তাতে কিছু এসে যায় না। আমার পাখিগুলোর কোনওটারই চশমার প্রয়োজন হয় না।
নিজের রসিকতায় নিজেই অট্টহাস্য করে উঠলেন আগোস। কিন্তু সে হাসি ফুরোবার আগেই ভদ্রলোক হঠাৎ মুখ-হাঁ অবস্থাতেই থেকে গেলেন। তাঁর চোখ চলে গেছে আমার ঘরের তাকে রাখা প্লাস্টিকের খাঁচাটার দিকে। কর্ভাস ঘুমিয়ে পড়েছিল; এখন দেখছি জাদুকরের অট্টহাসিতেই বোধ হয় তার ঘুমটা ভেঙে গেছে। সে দিব্যি ড্যাবি ড্যাবি করে চেয়ে আছে আগন্তুকটির দিকে।
আর্গাস মুখ-হাঁ অবস্থাতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে খাঁচাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর মিনিটখানেক ধরে কিভাসের দিকে চেয়ে বললেন, আজি সন্ধ্যার কাগজে এর বিষয় পড়ে অবধি আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উদ্গ্ৰীব হয়ে আছি। আপনার বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমি পক্ষিবিজ্ঞানী নই, কিন্তু আমিও পাখিদের শিক্ষা দিয়ে থাকি।
ভদ্রলোক চিন্তিতভাবে ফিরে এসে চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, বেশ বুঝতে পারছি আপনি ক্লান্ত, কিন্তু তাও অনুরোধ করছি–যদি আপনার এই পাখিটিকে একবার খাঁচা থেকে বার করতে পারেন. একবার যদি ওর বুদ্ধির একটু নমুনা…
আমি বললাম, শুধু আমিই ক্লান্ত নই, আমার পাখিও ক্লান্ত। আমার খাঁচার দরজা খুলে দিচ্ছি। বাকিটা নির্ভর করবে। আমার পাখির মেজাজের উপর। আমি ওকে জোর করে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করাতে চাইনা।
বেশ তো-তাই হোক…
খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। কর্ভাস বেরিয়ে এসে ডানার তিন ঝাপটায় আমার খাটের পাশে টেবিলটায় এসে ঠোঁটের এক অব্যৰ্থ ঠেকরে ল্যাম্পটা নিবিয়ে দিল।
ঘর এখন অন্ধকার। জানোলা দিয়ে রাস্তার উলটো দিকে হোটেল মেট্রোপোলের জ্বলা-নেবা সবুজ নিয়নের ফিকে আলো ঘরে প্রবেশ করছে। আমি চুপ। কর্ভাস ডানা ঝটপটিয়ে ফিরে গিয়ে খাঁচায় ঢুকে ঠোঁট দিয়ে টেনে দরজা বন্ধ করে দিল।
আর্গাসের মুখের উপর সবুজ আলো নিয়নের তালে তালে জ্বলছে, নিবছে। তার সোনার চশমার পুরু কাচের ভিতর সাপের মতো চোখ সবুজ আলোয় আরও বেশি সাপের মতো মনে হচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছি সে অবাক, হতভম্ব। বেশ বুঝতে পারছি, কিভাস ঘরের বাতি নিবিয়ে তার মনের যে ভাবটা প্রকাশ করল, সেটা আর্গাসের বুঝতে বাকি নেই। কর্ভাস এখন বিশ্রাম চাইছে। সে চায় না ঘরে আলো জ্বলে। সে অন্ধকার চায়, অন্ধকারে ঘুমোতে চায়।
আর আর্গাস? তার সরু গোঁফের নীচে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটা ফিসফিসে শব্দ উচ্চারিত হল—ম্যানিফিকো—অর্থাৎ চমকপ্ৰদ, অসামান্য। সে তার হাতদুটো যেন তালির ভঙ্গিতে থুতনির সামনে এনে জড়ো করেছে। লক্ষ করলাম, তার নখগুলো অস্বাভাবিক রকম লম্বা ও চকচকে। বুঝলাম, সে নখে নেলপালিশ মেখেছে। রুপোলি পালিশ। তার ফলে মঞ্চের স্পষ্ট লাইটে আঙুলের খেলা জমে ভাল। সেই রুপোলি নখে এখন বার বার বাইরের সবুজ নিয়নের আলো প্ৰতিফলিত হচ্ছে।
আই ওয়ানট দ্যাট ক্ৰো।
ফিসফিসে শুকনো গলায় ইংরিজিতে আর্গাসের কথা এল। এতক্ষণ সে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলছিল আমার সঙ্গে। কথাগুলো লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি, তাতে একটা নগ্ন নির্লজ্জ লোভের ইঙ্গিত এসে পড়ছে, কিন্তু আসলে আর্গাসের কণ্ঠস্বরে ছিল অনুনয়।
আই ওয়ানট দ্যাট ক্ৰো।— আবার বলল আর্গাস।
আমি চুপ করে তার দিকে চেয়ে রইলাম। এখন কিছু বলার দরকার নেই। আরও কী বলতে চায় লোকটা, দেখা যাক।
আর্গাস এতক্ষণ জানালার দিকে চেয়ে ছিল। এবার সে আমার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ভারী অদ্ভুত লাগছিল। এই অন্ধকার আর সবুজ আলোর খেলা। এও যেন একটা ভেলকি। লোকটা এই আছে, এই নেই।
আর্গাসের লম্বা আঙুলগুলো নড়েচড়ে উঠল। সেগুলো এখন তার নিজের দিকে ইঙ্গিত করছে।
আমাকে দেখো প্রোফেসর। আমি আর্গাস। আমি বিশ্বের সেরা জাদুকর। দুই আমেরিকার প্রতিটি শহরের প্রতিটি জাদুপ্রিয় লোক আমাকে চেনে। ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, পুরুষ সবাই চেনে। আগামী মাসে আমি পৃথিবী ভ্ৰমণে বেরোচ্ছি। রোম, মাড্রিড, প্যারিস, লন্ডন, অ্যাথেনস, স্টকহোলম, টোকিও, হংকং…। আমার ক্ষমতা এবার স্বীকৃত হবে। সারা বিশ্বে। কিন্তু আমার চমকপ্ৰদ ম্যাজিক আরও সহস্র গুণে বেশি চমকপ্ৰদ হবে–কীসে জান? ইফ আই গেট দ্যাট ক্রো–দ্যাট ইনডিয়ান ক্রো। ওই পাখি আমার চাই প্রোফেসরওই পাখি আমার চাই..আমার চাই..আমার চাই…
আর্গাস তার ফিসফিসে কথার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতটা আমার চোখের সামনে নাড়ছে, আঙুলগুলোকে সাপের ফণার মতো দোলাচ্ছে, নখগুলো সবুজ আলোয় চকচক করছে। আমি মনে মনে হাসলাম। আমার জায়গায় অন্য যে কোনও লোক হলে আর্গাসের কার্যসিদ্ধি হত। অর্থাৎ সে লোক হিপূনোটাইজড হত, সেই সুযোগে খাঁচার পাখিও আর্গাসের হস্তগত হত। আমাকে হিপনোটাইজ করা যে সহজ নয় সেটা এবার আমার কথা থেকেই বোধ হয় জাদুকর বুঝতে পারল।
মিষ্টার আর্গাস, আপনি বৃথা বাক্য ব্যয় করছেন। আর আমাকে সম্মোহিত করার চেষ্টাও বৃথা। আপনার অনুরোধ রক্ষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কর্ভাস শুধু আমার ছাত্রই নয়, সে আমার সন্তানের মতো, সে আমার বন্ধু, আমার অক্লান্ত পরিশ্রম ও গবেষণার—
প্রোফেসর!—আর্গাসের কণ্ঠস্বর আগের চেয়ে অনেক তীব্র। কিন্তু পরীক্ষণেই সে আবার গলা নামিয়ে বলে চলল, প্রোফেসর, তুমি কি জান যে আমি ক্রোড়পতি? শহরের পূর্ব প্রান্তে আমার একটা পঞ্চাশ কামরাবিশিষ্ট প্রাসাদ রয়েছে, সেটা কি তুমি জান? আমার বাড়িতে ছাব্বিশজন চাকর, আমার চারটে ক্যাডিলাক গাড়ি— এ সব কি তুমি জান? খরচের তোয়াক্কা আমি করি না, প্রোফেসর। ওই পাখির জন্য তোমাকে আমি আজই, এক্ষুনি দশ হাজার এসকুডো দিতে রাজি আছি।
দশ হাজার এসকুডো মানে প্রায় পনেরো হাজার টাকা। আর্গাস জানে না যে, সে যেমন খরচের তোয়াক্কা করে না, আমি তেমনই টাকা জিনিসটারই তোয়াক্কা করি না। সে কথাটা তাকে বললাম। আর্গাস এবার একটা শেষ চেষ্টা করল।
তুমি তো ভারতীয়। তুমি কি অলৌকিক যোগাযোগে বিশ্বাস কর না? ভেবে দেখো-আগসি—কর্ভাস! ওই কাকের নামকরণ হয়েছে আমারই জন্য, সেটা কি তুমি বুঝতে পারিছ না, প্রোফেসর?
আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললাম, মিস্টার আর্গাস-তোমার গাড়ি বাড়ি খ্যাতি অর্থ নিয়ে তুমি থাকো, কর্ভাস আমার কাছেই থাকবে। ওর শিক্ষা এখনও শেষ হয়নি। ওকে নিয়ে আমার এখনও অনেক আজ বাকি। আমি আজ ক্লান্ত। তুমি পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছিলে, আমি বিশ মিনিট দিয়েছি, আর দিতে পারছি না। আমি এখন ঘুমোব। আমার পাখিও ঘুমোবে। সুতরাং গুড নাইট।
আমার কথাগুলো শুনে আর্গাসের মুখে হতাশার ছাপ দেখে একটা সামান্য অনুকম্পার ভাব মনে প্রবেশ করলেও আমি সেটাকে একেবারেই আমল দিলাম না। আর্গাস আবার বিলিতি কায়দায় মাথা নুইয়ে স্প্যানিশ ভাষায় গুড নাইট জানিয়ে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
দরজা বন্ধ করে খাঁচার কাছে গিয়ে দেখি কিভাস এখনও জেগে আছে। আমি যেতেই সে ঠোঁট ফাঁক করে একটা শব্দ উচ্চারণ করল কে এবং শব্দটাতে যে একটা জিজ্ঞাসা রয়েছে, সেটা তার বলার সুরেই স্পষ্ট।
বললাম, এক পাগলা জাদুকর। টাকার গরমটা বড় বেশি। তোমাকে চাইতে এসেছিল, আমি না করে দিয়েছি। সুতরাং তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারো।
১৬ই নভেম্বর
ভেবেছিলাম কালকের ঘটনা কালকেই লিখে রাখব, কিন্তু বিভীষিকার ঘোর কাটতে সারা রাত লেগে গেল।
কাল সকালটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে বিপদের কোনও পূবাভাস ছিল না। সকালে সম্মেলনের বৈঠক ছিল, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে জাপানি পক্ষিবিজ্ঞানী তোমাসাকা মোরিমোতোর ঘোর ক্লান্তিকর ভাষণ। সঙ্গে কর্ভাসকে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্ৰায় এক ঘণ্টা বক্তৃতার পর হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলে মোরিমোতো আমতা আমতা করছিল, এমন সময় কভাঁসি হঠাৎ আমার চেয়ারের হাতলে সশব্দে ঠোঁটতালি আরম্ভ করে দিল। হলের লোক তাতে হো হো করে হেসে ওঠাতে আমি ভারী অপ্ৰস্তুতে পড়ে গিয়েছিলাম।
দুপুরে আমাদের হোটেলেই সম্মেলনের কয়েকজন ডেলিগেটের সঙ্গে লাঞ্চ ছিল। সেখানে যাবার আগে আমি আমার একাত্তর নম্বর ঘরে এসে কর্ভাসকে খাঁচায় রেখে খাবার দিয়ে বললাম, তুমি থাকে। আমি খেয়ে আসছি। বাধ্য। কর্ভাস কোনও আপত্তি করল না।
লাঞ্চ শেষ করে যখন ওপরে এসেছি, তখন আড়াইটে। দরজায় চাবি লাগাতেই বুঝলাম, সেটার প্রয়োজন হবে না, কারণ দরজা খোলা। মুহুর্তের মধ্যে একটা চরম বিপদের আশঙ্কা আমার রক্ত জল করে দিল। ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে দেখি— যা ভেবেছিলাম, তাই। খাঁচা সমেত কর্ভাস উধাও।
আবার ঝড়ের মতো ঘরের বাইরে এলাম। উত্তরদিকে দুটো ঘর পরেই বাঁ দিকে রুমবয়দের ঘর। ঊর্ধ্বশ্বাসে সে ঘরে গিয়ে দেখি, দুটো রুমন্বয়ই পাশাপাশি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখের চাহনি দেখেই বুঝতে পারলাম, তাদের দুজনকেই হিপনোটাইজ করা হয়েছে।
চলে গেলাম একশো সাত নম্বর ঘরে গ্রেনফেলের কাছে। তাকে সমস্ত ব্যাপারটা বলে দুজন সটান গিয়ে হাজির হলাম। একতলার রিসেপশনে। রিসেপশন ক্লার্ক বলল, আমাদের কাছ থেকে কেউ আপনার ঘরের চাবি চাইতে আসেনি। ড়ুপ্লিকেট চাবি রুমবয়দের কাছে থাকে, তারা যদি দিয়ে থাকে।
রুমবয়দের অবিশ্যি দেওয়ার দরকার হয়নি। আর্গাস তাদের জাদুবলে অকেজো করে দিয়ে নিজেই চাবি নিয়ে তার কাজ হাসিল করেছে।
শেষটায় হোটেলের দ্বাররক্ষকের কাছে গিয়ে আসল খবর পাওয়া গেল। সে বলল, আধ ঘণ্টা আগে একটা সিলভার ক্যাডিলাক গাড়িতে আর্গাস এসেছিলেন। তার দশ মিনিট পরে হাতে একটা সেলোফেনের ব্যাগ নিয়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যান।
রুপোলি রঙের ক্যাডিলাক। কিন্তু এখান থেকে কোথায় গেছে আর্গাস? তার বাড়িতে কি? না অন্য কোথাও?
অবশেষে কোভারুবিয়াসের শরণাপন্ন হতে হল। ভদ্রলোক বললেন, আগসের বাড়ি কোথায় সেটা এক্ষুনি জেনে দিতে পারি, কিন্তু তাতে কী লাভ হবে? সে কি আর বাড়িতে গেছে? সে তোমার কর্ভাসকে নিয়ে নিশ্চয়ই অন্য কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। তবে সে যদি শহরের বাইরে বেরোতে যায়, তা হলে একটাই রাস্তা আছে। তোমাদের আমি ভাল গাড়ি, ভাল ড্রাইভার আর সঙ্গে পুলিশ দিতে পারি। সময় কিন্তু খুব কম। আধা ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। হাইওয়ে ধরে চলে যাবে। যদি কপালে থাকে তো তার সন্ধান পাবে।
সোয়া তিনটের মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রওনা হবার আগে হোটেল থেকে ফোন করে জেনে নিয়েছিলাম যে, আর্গাস (আসল নাম দোমিনগো বার্তেলেমে সারামিয়েনতো) তার বাড়িতে ফেরেনি। আমাদের সঙ্গে দুজন সশস্ত্র পুলিশ, আমরা পুলিশেরই গাড়িতেই চলেছি। দুজন পুলিশের একজন— ছোকরা বয়স, নাম কারেরাস— দেখলাম আর্গাস সম্বন্ধে বেশ খবরটাবর রাখে। বলল, সানতিয়াগো এবং আশেপাশে আর্গাসের নাকি একাধিক আস্তানা আছে। এককালে জিপসিদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছে। উনিশ বছর বয়স থেকে ম্যাজিক দেখাতে আরম্ভ করেছে। পাখি নিয়ে ম্যাজিক শুরু করেছে। বছরচারেক আগে, আর সেই থেকেই ওর জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ও কি সত্যিই ক্রোড়পতি?
কারেরাস বলল, তাই তো মনে হয়। তবে লোকটা ভয়ানক কঞ্জস, আর কাউকে বিশ্বাস করে না। তাই ওর বন্ধু বলতে এখন আর বিশেষ কেউ নেই।
শহর থেকে বেরিয়ে হাইওয়েতে পড়ে একটা মুশকিল হল। হাইওয়ে দু ভাগে ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে উত্তরে লস আনডিজের দিকে, আর একটা চলে গেছে। পশ্চিমে ভালপারাইজো বন্দর পর্যন্ত। দুটো হাইওয়ের মুখের কাছে একটা পেট্রোলের দোকান। দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করাতেই সে বলল, ক্যাডিলাক? সিনিয়র আর্গাসের ক্যাডিলাক? সে তো গেছে ভালপারাইজোর রাস্তায়।
আমাদের কালো মারসেডিস তিরবেগে রওনা দিল ভালপারাইজোর উদ্দেশ্যে। কর্ভাসের প্রাণহানি হবে না সেটা জানি, কারণ তার প্রতি আর্গাসের লোভটা খাঁটি। কিন্তু কাল রাত্রে কর্ভাসের হাবভাব দেখেই বুঝেছিলাম যে, সে জাদুকর লোকটিকে মোটেই পছন্দ করছে না। সুতরাং আর্গাসের খপ্পরে পড়ে। তার যে মনের অবস্থা কী হবে, সেটা ভাবতেই খারাপ লাগছে।
পথে আরও দুটো পেট্রোল স্টেশন পড়ল, এবং দুটোরই মালিকের সঙ্গে কথা বলে আমরা নিশ্চিন্ত হলাম যে আর্গাসের সিলভার ক্যাডিলাক এই রাস্তা দিয়েই গেছে।
আমি আশাবাদী লোক। নানান সময় নানান সংকট থেকে অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এসেছি। আজ পর্যন্ত আমার কোনও অভিযানই ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু আমার পাশে বসে গ্রেনফেল ঘন ঘন মাথা নাড়ছে আর বলছে,ভুলে যেও না, শঙ্কু-তুমি একজন অত্যন্ত ধূর্ত লোকের সঙ্গে প্ৰতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছ। তোমার কর্ভাসকে সে যখন একবার হাতে পেয়েছে, তখন সে পাখি তুমি সহজে ফিরে পাবে না এটা জেনে রেখো।
কারেরাস বলল, সিনিয়র আর্গাসের হাতে কিন্তু অস্ত্ৰ থাকার সম্ভাবনা। এককালে তার অনেক ম্যাজিকে তাকে আসল রিভলভার ব্যবহার করতে দেখেছি।
হাইওয়ে ক্রমে ঢালু নামছে। সানতিয়াগোর ষোলোশো ফুট থেকে এখন আমরা হাজারে নেমে এসেছি। পিছনে দূরে পর্বতশ্রেণী ক্রমে ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে আসছে। চল্লিশ মাইল পথ এসেছি, আরও চল্লিশ মাইল গেলে ভালপারাইজো। গ্রেনফেলের ব্যাজার মুখ আমার আশার প্রাচীরে বার বার আঘাত করে তাকে টলিয়ে দিচ্ছে। হাইওয়েতে কিছু না পেলে শহরে গিয়ে পড়তে হবে। তখন আগসি-এর অনুসন্ধান আরও সহস্র গুণ বেশি কঠিন হয়ে পড়বে।
রাস্তা সামনে খানিকটা চড়াই উঠে গেছে। পিছনে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। গাড়ি এগিয়ে চলেছে দুবার গতিতে। চড়াই পেরোল। সামনে রাস্তা ঢালু নেমে গেছে বহু দূর। রাস্তার পাশে এখানে ওখানে দু-একটা গাছ। বহু দূরে একটা গ্রাম। মাঠে মোষের দল। জনমানবের কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু সামনে ওটা কী? এখনও বেশ দূর। সিকি মাইল তো হবেই।
এখন চারশো গজের বেশি নয়। একটা গাড়ি। রোদে ঝলমল করছে। রাস্তার এক পাশে বেঁকে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিছনে একটা গাছের গুঁড়ি।
এবার কাছে এসে পড়েছে গাড়িটা।
ক্যাডিলাক গাড়ি। সিলভার ক্যাডিলাক।
আমাদের মারসেডিস তার পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা কেন থেমে আছে, তার কারণটা এবার বুঝলাম। রাস্তার এক পাশে ছটকে গিয়ে সেটা একটা গাছের গুড়িতে মেরেছে। ধাক্কা। গাড়ির সামনের অংশ গেছে থেঁতলে।
কারেরাস বলল, সিনিয়র আর্গাসের গাড়ি। এ ছাড়া আরেকটা সিলভার ক্যাডিলাক আছে সানতিয়াগোতে। ব্যাঙ্কার সিনিয়র গালদামেসের গাড়ি। কিন্তু এটার নম্বর আমার চেনা।
গাড়ি তো রয়েছে, কিন্তু আর্গাস কোথায়?
আর আমার কর্ভাসই বা কোথায়?
ড্রাইভারের পাশের সিটে ওটা কী?
জানোলা দিয়ে মুখ ঢুকিয়ে দেখলাম, সেটা কর্ভাসের খাঁচা। দরজার চাবি আমারই তৈরি, আর সেটা রয়েছে আমারই পকেটে। আজ দুপুরে দরজায় চাবি দিইনি, শুধু ছিটিকিনিটাই লাগানো। কভার্স খাঁচা থেকে নিজেই বেরিয়েছে সন্দেহ নেই; কিন্তু তার পরে?
হঠাৎ একটা চিৎকার কানে এল। দূর থেকে। মানুষের গলা।
কারেরাস ও অন্য পুলিশটি বন্দুক উঁচিয়ে তৈরি। আমাদের ড্রাইভার দেখলাম ভিতু লোক। সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে মেরিমাতার নাম জপ করতে শুরু করেছে। গ্রেনফেল ফিসফিস করে বলল, ম্যাজিশিয়ান জাতটা আমাকে বড় আনকামফােরটেবল করে তোলে। আমি বললাম, তুমি বরং আমাদের গাড়ির ভিতরে গিয়ে বোসো।
চিৎকারটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাস্তার বাঁ দিক থেকে। কিছু দূরে কতকগুলো ঝোপড়া। দু-একটা বড় বড় গাছও রয়েছে। সেই দিক থেকেই আসছে। চিৎকারটা। কাল রাত্রে ফিসফিসে গলা শুনেছি, তাই চিনতে দেরি হল। এ গলা আর্গাসের। অকথ্য অশ্রাব্য স্প্যানিশে সে গাল দিয়ে চলেছে। কার উদ্দেশ্যে? ডেভিল বা শয়তানের স্প্যানিশ প্রতিশব্দটা বারিকয়েক কানো এল, আর তার সঙ্গে কর্ভাসের নামটা।
কোথায় গেল সে শয়তান পাখি? কিভাস! কিভােস। মুর্থ পাখি! শয়তান পাখি। নরকবাস আছে তোর কপালে। নরকবাস!–
আর্গাসের কথা আচমকা থেমে গেল–কারণ সে আমাদের দেখতে পেয়েছে। আমরাও দেখতে পাচ্ছি তাকে। তার দু হাতে দুটো রিভলভার। একশো হাত দূরে একটা ঝোপড়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
কারেরাস হুঙ্কার দিয়ে উঠল, সিনিয়র আগাঁস, তোমার অস্ত্ৰ নামাও! নইলে—
একটা কৰ্ণপটহ বিদারক শব্দে আমাদের মারসেডিসের দরজায় একটা রিভলভারের গুলি এসে লাগল। তারপর আরও তিনটে গুলির শব্দ। এ দিকে ও দিকে আমাদের মাথার উপর দিয়ে ছটকে বেরিয়ে গেল সেগুলি। কারেরাস দৃপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, সিনিয়র আর্গাস, আমাদের কাছে বন্দুক রয়েছে। আমরা পুলিশ। আপনি যদি রিভলভার না ফেলে দেন, তবে আমরা আপনাকে জখম করতে বাধ্য হব।
জখম? আর্গাস শুকনো গলায় আর্তনাদ করে উঠল। তোমরা পুলিশ? আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
আর্গাস এখন পচিশ হাতের মধ্যে। এইবার বুঝলাম তার দশটা। তার চশমাটি খোওয়া যাওয়াতে সে প্রায় অন্ধের সামিল হয়ে পড়ে যত্রতত্র গুলি চালিয়েছে।
আর্গাস হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে হোঁচটি খেতে খেতে এগিয়ে এল। কারেরাস ও অন্য পুলিশটি তার দিকে এগিয়ে গেল। আমি জানি, এ সংকটে আর্গাসের কোনও ভেলকিই কাজ করবে না। তার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কারেরাস এগিয়ে গিয়ে মাটি থেকে রিভলভার দুটো তুলে নিল। আর্গাস তখন বলছে, সে পাখি উধাও হয়ে গেল! দ্যাট ইনডিয়ান ক্ৰো! শয়তান পাখি…কিন্তু কী অসামান্য তার বুদ্ধি!
গ্রেনফেল কিছুক্ষণ থেকে ফিসফিস করে কী যেন বলতে চেষ্টা করছিল, এবারে তার কথাটা বুঝতে পারলাম।
শঙ্কু-দ্যাট বার্ড ইজ হিয়ার।
কী রকম? কোথায় কিভাস? আমি তো দেখছি না তাকে!
গ্রেনফেল রাস্তার উলটোদিকে নেড়া অ্যাকেসিয়া গাছটার মাথার দিকে আঙুল দেখাল।
উপরে চেয়ে দেখলাম— সত্যিই তো—আমার বন্ধু, আমার শিষ্য, আমার প্রিয় কর্ভাস গাছটার সবচেয়ে উচু ডালে বসে নিশ্চিন্তভাবে আমাদের দিকে ঘাড় নিচু করে দেখছে।
তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতেই সে অক্লেশে গোঁত খাওয়া ঘুড়ির মতো গাছের মাথা থেকে নেমে এসে বসল। আমাদের মারসেডিসের ছাদের উপর। তারপর অতি সন্তৰ্পণে–যেন জিনিসটার মূল্য সে ভালভাবেই জানে— তার ঠোঁট থেকে তার সামনেই নামিয়ে রাখল আর্গাসের মাইনাস বিশ পাওয়ারের সোনার চশমাটা।
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৭৯
ডক্টর শেরিং-এর স্মরণশক্তি (প্রোফেসর শঙ্কু)
২রা জানুয়ারি
আজ সকালটা বড় সুন্দর। চারিদিকে ঝলমলে রোদ, নীল আকাশে সাদা সাদা হৃষ্টপুষ্ট মেঘ, দেখে মনে হয় যেন ভুল করে শরৎ এসে পড়েছে। সদ্য-পাড়া মুরগির ডিম হাতে নিলে যেমন মনটা একটা নির্মল অবাক আনন্দে ভরে যায়, এই আকাশের দিকে চাইলেও ঠিক তেমনই হয়।
আনন্দের অবিশ্যি আরেকটা কারণ ছিল। আজ অনেক দিন পরে বিশ্রাম। আমার যন্ত্রটা আজই সকালে তৈরি হয়ে গেছে। বাগান থেকে ল্যাবরেটরিতে ফিরে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে যন্ত্রটার দিকে চেয়ে থেকে একটা গভীর প্রশান্তি অনুভব করছি। জিনিসটা বাইরে থেকে দেখতে তেমন কিছুই নয়; মনে হবে যেন হাল ফ্যাশানের একটা টুপি বা হেলমেট। এই হেলমেটের খোলের ভিতর রয়েছে বাহাত্তর হাজার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তারের জটিল স্নায়বিক বিস্তার। সাড়ে তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল। এই যন্ত্র। এটা কী কাজ করে বোঝানোর জন্য একটা সহজ উদাহরণ দিই।
এই কিছুক্ষণ আগেই আমি চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে আমার চাকর প্রহ্লাদ এসেছিল কফি নিয়ে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, গত মাসের ৭ই সকালে বাজার থেকে কী মাছ এনেছিলে? প্রহ্লাদ মাথাটাথা চুলকে বলল, এজ্ঞে সে তো স্মরণ নাই বাবু! আমি তখন তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে হেলমেটটা মাথায় পরিয়ে দিয়ে একটা বোতাম টিপতেই প্ৰহ্বাদের শরীরটা মুহুর্তের জন্য শিউরে উঠে একেবারে স্থির হয়ে গেল। সেই সঙ্গে তার চোখ দুটো একটা নিষ্পলক দৃষ্টিহীন চেহারা নিল। এবার আমি তাকে আবার প্রশ্নটা করলাম। প্রহ্লাদ, গত মাসের সাত তারিখ সকালে বাজার থেকে কী মাছ এনেছিলে? প্রশ্নটা করতেই প্ৰহাদের চাহনির কোনও পরিবর্তন হল না; কেবল তার ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে জিভটা নড়ে উঠে শুধু একটি মাত্ৰ কথা উচ্চারিত হল–ট্যাংরা।
টুপি খুলে দেবার পর প্রহ্লাদ কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে একগাল হেসে বলল, মনে পড়েছে বাবু–ট্যাংরা।
এইভাবে শুধু প্রহ্লাদ কেন, যে কোনও লোকেরই যে কোনও হারানো স্মৃতিকে এ যন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পারে। একজন সাধারণ লোকের মাথায় নাকি প্রায় ১οο, ο ο ο,ο ο ο,ο ο ο,ο ο ο–অর্থাৎ এক কোটি কোটি-স্মৃতি জমা থাকে, তার কোনওটা স্পষ্ট কোনওটা আবছা। তার মধ্যে দৃশ্য, ঘটনা, নাম, চেহারা, স্বাদ, গন্ধ, গান, গল্প, অজস্র খুঁটিনাটি তথ্য—সব কিছুই থাকে। সাধারণ লোকের দু বছর বয়সের আগের স্মৃতি খুব অল্প বয়সেই মন থেকে মুছে যায়। আমার নিজের স্মরণশক্তি অবিশ্যি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। আমার এগারো মাস বয়সের ঘটনাও কিছু মনে আছে। অবিশ্যি কয়েকটা খুব ছেলেবেলার স্মৃতি আমার মনেও ঝাপসা হয়ে এসেছিল। যেমন এক বছর তিন মাস বয়সে একবার এখানকার সে যুগের ম্যাজিস্ট্রেট ব্ল্যাকওয়েল সাহেবকে ছড়ি হাতে কুকুর নিয়ে উশ্রীর ধারে বেড়াতে দেখেছিলাম। কুকুরটার রং ছিল সাদা, কিন্তু জাতটা মনে ছিল না। আজ যন্ত্রটা মাথায় দিয়ে দৃশ্যটা মনে করতেই তৎক্ষণাৎ কুকুরের চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে জানিয়ে দিল সেটা ছিল বুলি টেরিয়ার।
যন্ত্রটার নাম দিয়েছি। রিমেমব্রেন। অর্থাৎ ব্রেন বা মস্তিষ্ককে যে যন্ত্র রিমেমবার বা স্মরণ করতে সাহায্য করে। কালই এটার সম্বন্ধে একটা প্ৰবন্ধ লিখে পাঠিয়েছি ইংল্যান্ডের নেচার পত্রিকায়। দেখা যাক কী হয়।
২৩শে ফ্রেব্রুয়ারি
আমার লেখাটা নেচারে বেরিয়েছে, আর বেরোনোর পর থেকেই অজস্ৰ চিঠি পাচ্ছি। ইউরোপ আমেরিকা রাশিয়া জাপান সব জায়গা থেকেই যন্ত্রটা দেখার আগ্রহ প্ৰকাশ করেছে। ৭ই মে ব্রাসেলস শহরে একটা বিজ্ঞানী সম্মেলন আছে সেখানে যন্ত্রটা ডিমনষ্ট্রেট করার জন্য অনুরোধ এসেছে। এমন একটা যন্ত্র যে হতে পারে সেটা বৈজ্ঞানিক মহলে অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছে না, যদিও আমার ক্ষমতার কথা এরা অনেকেই জানে। আসলে হয়েছে কী, স্মৃতির গৃঢ় রহস্যটা এখনও বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। আমি নিজেও শুধু এইটুকুই বুঝতে পেরেছি যে কোনও একটা তথ্য মাথার মধ্যে ঢুকলেই সেটা সেখানে স্মৃতি হিসাবে নিজের জন্য খানিকটা জায়গা করে নেয়। আমার বিশ্বাস, এক একটি স্মৃতি হল এক একটি পরমাণুসদৃশ রাসায়নিক পদার্থ, এবং প্রত্যেক স্মৃতিরই একটি করে আলাদা রাসায়নিক চেহারা ও ফরমুলা আছে। যত দিন যায়, স্মৃতি তত ঝাপসা হয়ে আসে, কারণ কোনও পদার্থই চিরকাল এক অবস্থায় থাকতে পারে না। আমার যন্ত্র মস্তিষ্কের মধ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি চালনা করে স্মৃতি নামক পদার্থটিকে তাজা করে তুলে পুরনো কথা মনে করিয়ে দেয়।
অনেকে প্রশ্ন করবে, স্মৃতির রহস্য সম্পূর্ণ ভেদ না করেও আমি কী করে এমন যন্ত্র তৈরি করলাম। উত্তরে বলব যে, আজকের দিনে আমরা বৈদ্যুতিক শক্তি সম্বন্ধে যতটা জানি, আজ থেকে একশো বছর আগে তার সিকি ভাগও জানা ছিল না, অথচ এই অসম্পূর্ণ জ্ঞান সত্ত্বেও উনবিংশ শতাব্দীতে আশ্চর্য আশ্চর্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছিল। ঠিক তেমনি ভাবেই তৈরি হয়েছে আমার রিমেমব্রেন যন্ত্র।
নেচারে লেখাটা বেরোবার ফলে একটা চিঠি পেয়েছি, যেটা আমার ভারী মজার লাগল। আমেরিকার ক্রোড়পতি শিল্পপতি হিরাম হোরেনস্টাইন জানিয়েছেন যে তিনি আত্মজীবনী লিখতে বসে দেখছেন যে তাঁর সাতাশ বছর বয়সের আগের ঘটনাগুলো পরিষ্কার মনে পড়ছে না। আমার যন্ত্র ব্যবহার করে এই সময়কার ঘটনাগুলো মনে করতে পারলে তিনি আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন। শৌখিন মার্কিন মিলিয়নেয়ারদের শখ মেটানোর জন্য আমি এ যন্ত্র তৈরি করিনি–এই কথাটাই তাঁকে আমি একটু নরম ভাষায় লিখে জানিয়ে দিয়েছি।
৪ঠা মার্চ
আজ খবরের কাগজে সুইটজারল্যান্ডের একটা বিশ্ৰী অ্যাক্সিডেন্টের কথা পড়ে মনটা ভার হবার আধা ঘণ্টার মধ্যেই সে বিষয়ে একটা দীর্ঘ টেলিগ্রাম এসে হাজির। একেই বোধ হয় বলে টেলিপ্যাথি। খবরটা হচ্ছে এই— একটা গাড়িতে দুজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক— সুইটজারল্যান্ডের অটো লুবিন ও অস্ট্রিয়ার ডক্টর হিয়েরোনিমাস শেরিং—অস্ট্রিয়ার ল্যান্ডেক শহর থেকে সুইটজারল্যান্ডের ওয়ালেনস্টট শহরে আসছিলেন। এই দুই বৈজ্ঞানিক কিছুদিন থেকে কোনও একটা গোপনীয় বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাচ্ছিলেন। গাড়িতে সামনে ছিল ড্রাইভার, পিছনে লুবিন আর শেরিং। পাহাড়ের পথ দিয়ে যেতে যেতে গাড়ি খাদে পড়ে। নিকটবর্তী গ্রামের এক মেষপালক চুৰ্ণবিচূর্ণ গাড়িটিকে দেখতে পায় রাস্তা থেকে হাজার ফুট নীচে। গাড়ির কাছাকাছি ছিল লুবিনের হাড়গোড় ভাঙা মৃতদেহ। আশ্চর্যভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন ডক্টর শেরিং। রাস্তা থেকে মাত্র ত্রিশ ফুট নীচে একটি ঝোপে আটকে যায় তাঁর দেহ। দুর্ঘটনার খবর ওয়ালেনস্টাটে পৌঁছানো মাত্র সুইস বায়োকেমিস্ট নরবার্ট বুশ সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। লুবিন ও শেরিং বুশের কাছেই যাচ্ছিলেন কিছু দিনের বিশ্রামের জন্য। বুশ তাঁর সুপ্ৰশস্ত মার্সেডিস গাড়িতে শেরিংকে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসেন। এইটুকু খবর কাগজে বেরিয়েছে। বাকিটা জেনেছি। বুশের টেলিগ্রামে। এখানে বলে রাখি যে বুশকে আমি চিনি আজ দশ বছর থেকে; ফ্লোরেন্সে এক বিজ্ঞানী সম্মেলনে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। বুশ লিখেছে— যদিও শেরিং-এর দেহে প্ৰায় কোনও জখমের চিহ্ন নেই, তার মাথায় চোট লাগার ফলে তার মন থেকে স্মৃতি জিনিসটাই নাকি বেমালুম লোপ পেয়ে গেছে। আরও একটা খবর এই যে, গাড়ির ড্রাইভার নাকি উধাও এবং সেই সঙ্গে গবেষণার সমস্ত কাগজপত্র। শেরিং-এর স্মৃতি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ডাক্তার, মনস্তাত্ত্বিক, হিপূনটিস্ট ইত্যাদির চেষ্টা নাকি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বুশ আমাকে পত্রপাঠ আমার যন্ত্রসমেত ওয়ালেনস্টােট চলে যেতে বলেছে। খরচপত্র সেই দেবে। টেলিগ্রামের শেষে সে বলছে— ডঃ শেরিং একজন অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। তাঁকে পুনজীবন দান করতে পারলে বিজ্ঞানীমহল তোমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। কী স্থির কর সত্বর জানাও।
আমার যন্ত্রের দৌড় কত দূর সেটা দেখার এবং দেখাবার এমন সুযোগ আর আসবে না। ওয়ালেনস্টট যাবার তোড়জোড় আজ থেকেই করতে হবে। আমার যন্ত্র ষোলো আনা পোর্টেবল। এর ওজন মাত্র আট কিলো। প্লেনে অতিরিক্ত ভাড়া দেবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
৮ই মার্চ
আজ সকালে জুরিখে পৌঁছে সেখান থেকে বুশের মোটরে করে মনোরম পাহাড়ি পথ দিয়ে ৬০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট ওয়ালেনস্টাট শহরে এসে পৌঁছোলাম পৌনে নটায়। একটু পরেই প্রাতরাশের ডাক পড়বে। আমি আমার ঘরে বসে এই ফাঁকে ডায়রি লিখে রাখছি। গাছপালা ফুলেফলে ভরা ছবির মতো সুন্দর পরিবেশের মধ্যে চোদ্দো একর জমির উপরে বায়োকেমিস্ট নরবার্ট বুশের বাড়ি। কাঠের সিঁড়ি, কাঠের মেঝে, কাঠের দেয়াল। আমি দোতলায় পশ্চিমের একটা ঘরে রয়েছি, ঘরের জানোলা খুললেই পাহাড়ে ঘেরা ওয়ালেন লেক দেখা যায়। আমার যন্ত্রটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে খাটের পাশেই একটা টেবিলের উপর রাখা রয়েছে। আতিথেয়তার বিন্দুমাত্র ত্রুটি হবে বলে মনে হয় না। এইমাত্র বুশের তিন বছরের ছেলে উইলি আমাকে এক প্যাকেট চকোলেট দিয়ে গেল। ছেলেটি ভারী মিষ্টি ও মিশুকে— আপন মনে ঘুরে ঘুরে সুর করে ছড়া কেটে বেড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে সকলকে অভিবাদন করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে আমার দিকে এগিয়ে এসে একটা কালো চুরুটের কেস সামনে ধরে বলল, সিগার খাবে? আমি ধূমপান করি না, কিন্তু উইলিকে নিরাশ করতে ইচ্ছে করল না, তাই ধন্যবাদ দিয়ে একটা চুরুট বার করে নিলাম। খেলে অবিশ্যি এ রকম চুরুটাই খেতে হয়; অতি উৎকৃষ্ট ডাচ সিগার।
এ বাড়িতে সবসুদ্ধ রয়েছে ছ জন লোক— বুশ, তার স্ত্রী ক্লারা, শ্ৰীমান উইলি, বুশের বন্ধু স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক অমায়িক স্বল্পভাষী হানস উলরিখ, ডঃ শেরিং ও তাঁর পরিচারিকা— নাম বোধহয় মারিয়া। এ ছাড়া দুজন পুলিশের লোক বাড়িটাকে অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছে।
শেরিং রয়েছে পুব দিকের একটা ঘরে। আমাদের দুজনের ঘরের মধ্যে রয়েছে ল্যান্ডিং ও একতলায় যাবার সিঁড়ি। আমি অবিশ্যি এসেই শেরিংকে একবার চাক্ষুষ দেখে এসেছি। মাঝারি হাইটের মানুষ, বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, মাথার সোনালি চুলের পিছন দিকে টাক পড়ে গেছে। মুখটা চৌকো ও গোলের মাঝামাঝি। তাকে যখন দেখলাম, তখন সে জানালার ধারের একটা চেয়ারে বসে হাতে একটা কাঠের পুতুল নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। আমি ঘরে ঢুকতে সে আমার দিকে ঘাড় ফেরাল, কিন্তু চেয়ার ছেড়ে উঠল না। বুঝলাম, ঘরে লোক ঢুকলে উঠে দাঁড়ানোর সাধারণ সাহেবি কেতাটাও সে ভুলে গেছে। চোখের চাহনি দেখে কী রকম খটকা লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি চশমা পর?
শেরিং-এর বাঁ হাতটা আপনা থেকেই চোখের কাছে উঠে এসে আবার নেমে গেল। বুশ বলল, চশমাটা ভেঙে গেছে। আর একটা বানাতে দেওয়া হয়েছে।
শেরিংকে দেখে এসে আমরা বৈঠকখানায় গিয়ে বসলাম। এ কথা সে কথার পর বুশ সলজভাবে বলল, সত্যি বলতে কী, আমি যে তোমার যন্ত্রটা সম্বন্ধে খুব উৎসাহিত বোধ করছিলাম, তা নয়। কতকটা আমার স্ত্রীর অনুরোধেই তোমাকে আমি টেলিগ্রামটা করি।
তোমার স্ত্রীও কি বৈজ্ঞানিক? আমি ক্লারার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রশ্নটা করলাম। ক্লারাই হেসে উত্তর দিলে
একেবারেই না। আমি আমার স্বামীর সেক্রেটারির কাজ করি। আমি চাইছিলাম তুমি আস, কারণ ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমার গভীর শ্রদ্ধা। তোমার দেশের বিষয়ে অনেক বই পড়েছি আমি, অনেক কিছু জানি।
বুশের যদি আমার যন্ত্র সম্বন্ধে কোনও সংশয় থেকে থাকে তো সেটা আজকের মধ্যেই কেটে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। আজ বিকেলে শেরিং-এর স্মৃতির বন্ধ দরজা খোলার চেষ্টা হবে।
এবার ড্রাইভারের কথাটা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না। বুশ বলল, পুলিশ তদন্ত করছে। দুটি জায়গার একটিতে ড্রাইভার লুকিয়ে থাকতে পারে। একটা হল দুর্ঘটনার জায়গার সাড়ে চার কিলোমিটার পশ্চিমে–নাম রোমুস, আর একটা হল সাড়ে তিন কিলোমিটার পুবে— নাম শ্লাইনস। দুটো জায়গাতেই অনুসন্ধান চলছে; তা ছাড়া পাহাড়ের গায়ে বনবাদাড়েও খোঁজা হচ্ছে।
দুর্ঘটনার জায়গাটা এখান থেকে কত দূরে?
পঁচাশি কিলোমিটার। সে ড্রাইভারকে কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিতেই হবে, কারণ, ও দিকে রাত্রে বরফ পড়ে। ভয় হয়, তার যদি কোনও শাকরেদ থেকে থাকে এবং ড্রাইভার যদি কাগজপত্রগুলো তাকে চালান করে দিয়ে থাকে।
৮ই মার্চ, রাত সাড়ে দশটা
ফায়ারপ্লেসে গানগনে আগুন জ্বলছে। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বাতাসের শনশন শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
বুশ আজ আমার বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় পেয়ে স্তম্ভিত। এখন বলা শক্ত, কে আমার বড় ভক্ত-সে, না তার স্ত্রী।
আজ সন্ধ্যা ছটায় আমরা আমার যন্ত্র নিয়ে শেরিং-এর ঘরে উপস্থিত হলাম। সে তখনও সেই চেয়ারে গুম হয়ে বসে আছে। আমরা ঘরে ঢুকতে আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল। বুশ তাকে অভিবাদন জানিয়ে হালকা রসিকতার সুরে বলল, আজ আমরা তোমাকে একটা টুপি পরাব, কেমন? তোমার কোনও কষ্ট হবে না। তুমি ওই চেয়ারে যেমনভাবে বসে আছ, সেইভাবেই বসে থাকবে।
টুপি? কী রকম টুপি? শেরিং তার গভীর অথচ সুরেলা গলায় একটু যেন অসোয়াস্তির সঙ্গেই প্রশ্নটা করল।
এই যে, দেখো না।
আমি ব্যাগ থেকে যন্ত্রটা বার করলাম। বুশ সেটা আমার হাত থেকে নিয়ে শেরিং-এর হাতে দিল। শেরিং সেটাকে সকালের খেলনাটার মতো করেই নেড়েচেড়ে দেখে আমাকে ফেরত দিয়ে দিল।
এতে ব্যথা লাগবে না তো? সে দিনের ইঞ্জেকশনে কিন্তু ব্যথা লেগেছিল।
ব্যথা লাগবে না কথা দেওয়াতে সে যেন খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে শরীরটাকে পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে হাত দুটোকে চেয়ারের পাশে নামিয়ে দিল। তার ঘাড়ে একটা জায়গায় ক্ষতের উপরে প্লাস্টার ছাড়া শরীরের অনাবৃত অংশে আর কোথাও কোনও ক্ষতচিহ্ন দেখলাম না।
শেরিংকে হেলমেট পরাতে কোনও অসুবিধা হল না। তারপর লাল বোতামটা টিপতেই হেলমেট-সংলগ্ন ব্যাটারিটা চালু হয়ে গেল। শেরিং একটা কাঁপুনি দিয়ে শরীরটাকে কাঠের মতো শক্ত ও অনড় করে ফায়ারপ্লেসের আগুনের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
ঘরের ভিতরে এখন অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। এক শেরিং ছাড়া প্রত্যেকেরই দ্রুত নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ পাচ্ছি। ক্লারা দরজার মুখটাতে দাঁড়িয়ে আছে। নার্স খাটের পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে শেরিং-এর দিকে চেয়ে আছে। বুশ ও উলরিখ শেরিং-এর চেয়ারের দু পাশে দাঁড়িয়ে উৎকণ্ঠায় ঝুকে পড়েছে সামনের দিকে। আমি বুশকে মৃদু স্বরে বললাম, তুমি প্রশ্ন করতে চাও? না আমি করব? তুমি করলেও কাজ হবে কিন্তু।
তুমিই শুরু করো।
আমি ঘরের কোণ থেকে একটা ছোট টুল নিয়ে শেরিং-এর মুখোমুখি বসলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম
তোমার নাম কী?
শেরিং-এর ঠোঁট নড়ল। চাপা অথচ পরিষ্কার গলায় উত্তর এল।
হিয়েরোনিমাস হাইনরিখ শেরিং।
এই প্রথম–রুদ্ধ স্বরে বলে উঠল। বুশ-এই প্রথম নিজের নাম বলেছে।
আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম।
তোমার পেশা কী?
পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
তোমার জন্ম কোথায়?
অস্ট্রিয়া।
কোন শহরে?
ইন্স্ব্রুক।
আমি বুশের দিকে একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলাম। বুশ মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল— মিলছে। আমি আবার শেরিং-এর দিকে ফিরলাম।
তোমার বাবার নাম কী?
কার্ল ডিট্রিখ শেরিং।
তোমার আর ভাইবোন আছে?
ছোট বোন আছে একটি। বড় ভাই মারা গেছে।
কবে মারা গেছে?
প্রথম মহাযুদ্ধে। পয়লা অক্টোবর, উনিশশো সতেরো।
আমি প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে বিস্ময়মুগ্ধ বুশের দিকে চেয়ে তার মৃদু মৃদু মাথা নাড়া থেকে বুঝে নিচ্ছি, শেরিং-এর উত্তরগুলো সব মিলে যাচ্ছে।
তুমি লান্ডেক গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কী করতে?
প্রোফেসর লুবিনের সঙ্গে কাজ ছিল।
কী কাজ?
গবেষণা।
কী বিষয়?
বি-এক্স থ্রি সেভন সেভন।
বুশ ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, এটা হচ্ছে গবেষণাটির সাংকেতিক নাম। আমি প্রশ্নে চলে গোলাম।
সেই গবেষণার কাজ কি শেষ হয়েছিল?
হ্যাঁ।
সফল হয়েছিল?
হ্যাঁ।
গবেষণার বিষয়টা কী ছিল?
আমরা একটা নতুন ধরনের আণবিক মারণাস্ত্র তৈরি করার ফরমুলা বার করেছিলাম।
কাজ শেষ করে তোমরা ওয়ালেনস্টাট আসছিলে?
হ্যাঁ।
তোমার সঙ্গে গবেষণার কাগজপত্র ছিল?
হ্যাঁ।
ফরমুলাও ছিল?
হ্যাঁ।
পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটে?
হ্যাঁ।
কী হয়েছিল?
বুশ আমার কাঁধে হাত রাখল। আমি জানি কেন। কিছুক্ষণ থেকেই লক্ষ করছি, শেরিং-এর মধ্যে একটা চাপা উশখুশে ভাব। একবার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চাটল। একবার যেন চোখের পাতা পড়ে পড়ো হল। কপালের শিরাগুলোও যেন ফুলে উঠেছে।
শেরিং-এর কথা বন্ধ হয়ে গেল। তার দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে। আমার বিশ্বাস, গোপনীয় গবেষণার বিষয়টা প্ৰকাশ করে ফেলে ওর মধ্যে একটা উদ্বেগের ভাব জেগে উঠেছে।
আমি সবুজ বোতাম টিপে ব্যাটারি বন্ধ করে দিলাম। এই অবস্থায় আর প্রশ্ন করা উচিত হবে না। বাকিটা কাল হবে।
হেলমেট খুলে নিতেই শেরিং-এর মাথা পিছনে হেলে পড়ল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে পরমুহুর্তেই আবার চোখ খুলে এদিক ওদিক চেয়ে বলল, চুরুট…একটা
আমি শেরিং-এর কপালের ঘাম মুছিয়ে দিলাম। বুশ যেন অপ্রস্তুত। গলা খাকরিয়ে বলল, চুরুটতো নেই। এ-বাড়িতে কেউ চুরুট খায় না। সিগারেট খাবে?
উলরিখ তার পকেট থেকে সিগারেট বার করে এগিয়ে দিয়েছে। শেরিং সিগারেট নিল कf।
হ্যাঁ, ছিল। বলল শেরিং। সে যেন ক্লান্ত, অস্থির।
কালো রঙের কেস কি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তা হলে সেটা উইলির কাছে আছে। ক্লারা, একবার খোঁজ করে দেখবে কি?
ক্লারা তৎক্ষণাৎ তার ছেলের খোঁজে বেরিয়ে গেল।
নার্স শেরিং-এর হাত ধরে তুলে, তাকে খাটে শুইয়ে দিল। বুশ খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে হেসে বলল, এবার তোমার মনে পড়েছে তো?
উত্তরে শেরিং যেন অবাক হয়ে বুশের দিকে চাইল। তারপর ধীর কণ্ঠে বলল, কী মনে পড়েছে?
শেরিং-এর এই পালটা প্রশ্ন আমার মোটেই ভাল লাগল না। বুশও যেন হতভম্ব। সে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সহজভাবেই বলল, তুমি কিন্তু আমাদের প্রশ্নের জবাব ঠিকই দিয়েছ।
কী প্রশ্ন? কী প্রশ্ন করেছ আমাকে?
এবার আমি গত কয়েক মিনিট ধরে যে প্রশ্নোত্তর চলেছে, তার একটা বিবরণ শেরিংকে দিলাম। শেরিং কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর তার ডান হাতটা আলতো করে নিজের মাথার উপর রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, আমার মাথায় কী পরিয়েছিলে?
কেন বলো তো?
যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অজস্র পিন ফুটছে।
তোমার মাথায় এমনিতেই চোট লেগেছিল। পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে পড়ার সময় তুমি মাথায় চোট পাও, তার ফলে তোমার পূর্বস্মৃতি লোপ পায়।
শেরিং বোকার মতো আমার দিকে চেয়ে বলল, কী সব বলছি তুমি। পাহাড় দিয়ে গড়িয়ে পড়ব কেন?
আমরা তিনজন পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।
ক্লারা ফিরে এসেছে। তার হাতে আমার দেখা চুরুটের কেস। সে সেটা শেরিং-এর হাতে দিয়ে বিনীতভাবে বলল, আমার ছেলে কখন যেন এটা নিয়ে নিজের ঘরে রেখে দিয়েছিল। তুমি কিছু মনে কোরো না।
বুশ আবার গলা খাকরিয়ে বলল, তুমি যে চুরুট খাও সে কথাটা মনে পড়েছে নিশ্চয়ই?
চুরুটের কেস হাতে নিয়ে শেরিং-এর চোখ বুজে এল। তাকে সত্যিই ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছিলাম, আমাদের এবার এঘর থেকে চলে যেতে হবে।
রিমেমব্রেন যন্ত্র ব্যাগে পুরে নিয়ে আমরা চারজন এসে বৈঠকখানায় বসলাম। খুশি ও খটকা মেশানো অদ্ভুত একটা অবস্থা আমার মনের। হেলমেটপরা অবস্থায় হারানো স্মৃতি ফিরে এলে হেলমেট খোলার পর সে স্মৃতি আবার হারিয়ে যাবে কেন? শেরিং-এর মাথায় কি তা হলে খুব বেশিরকম কোনও গণ্ডগোল হয়েছে?
এদের তিনজনকে কিন্তু ততটা হতাশ মনে হচ্ছে না।
উলরিখ তো যন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলল, এটা যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। যেখানে স্মৃতির ভাণ্ডার একেবারে খালি হয়ে গিয়েছিল, সেখানে পর পর এতগুলো প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দেওয়া কি সহজ কথা?
বুশ বলল, আসলে মনের দরজা এমনভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে সেটা খুলেও খুলছে না। এখন একমাত্র কাজ হচ্ছে কালকের জন্য অপেক্ষা করা। কাল আবার ওকে টুপি পরাতে হবে। আমাদের দিক থেকে কাজটা হবে শুধু প্রশ্নের উত্তর আদায় করা। অ্যাক্সিডেন্টের আগে গাড়িতে কী ঘটেছিল সেটা জানা দরকার। বাকি কাজ করবে পুলিশে।
আটটা নাগাদ বুশ একবার পুলিশে টেলিফোন করে খুবর দিল। ড্রাইভার হাইনৎস নয়মানের কোনও পাত্তা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তা হলে কি বি-এক্স থ্রি সেভন সেভানের ফরমুলা সমেত নয়মানের তুষারসমাধি হল।
৯ই মার্চ
কাল রাত্রে দুটো পর্যন্ত ঘুম আসছে না দেখে শেষটায় আমারই তৈরি সমনোলিনের বড়ি খেয়ে একটানা সাড়ে তিন ঘণ্টা গাঢ় ঘুম হল। আজ সকালে উঠেই আমার যন্ত্রটা একটু নেড়েচেড়ে তাতে কোনও গণ্ডগোল হয়েছে কি না দেখব ভেবেছিলাম, কিন্তু সে কাজটা করার আগেই দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখি শেরিং-এর নার্স। ভদ্রমহিলা রীতিমতো উত্তেজিত।
ডঃ শেরিং তোমাকে ডাকছেন। বিশেষ দরকার।
কেমন আছেন তিনি?
খুব ভাল। রাত্রে ভাল ঘুমিয়েছিলেন। মাথার যন্ত্রণাটাও নেই। একেবারে অন্য মানুষ।
আমি আলখাল্লা পরা অবস্থাতেই শেরিং-এর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। সে আমাকে দেখে একগাল হেসে ইংরিজিতে গুড মনিং বলল। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ?
সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার সমস্ত স্মৃতি ফিরে এসেছে। আশ্চর্য যন্ত্র তোমার। শুধু একটা কথা। কাল তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি আমাদের গবেষণা সম্পর্কে যা বলেছি, সেটা তোমাদের গোপন রাখতে হবে।
সে আর তোমাকে বলতে হবে না। আমাদের দায়িত্বজ্ঞান সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারে।
আরেকটা কথা। লুবিনের কী হল জানার আগেই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমি জানতে চাই সে কোথায়। সেও কি জখম হয়ে পড়ে আছে?
না। লুবিন মারা গেছে।
মারা গেছে!
শেরিং-এর চোখ কপালে উঠে গেল। আমি বললাম, তুমি যে বেঁচেছ, সেটাও নেহাতই কপাল জোরে।
আর কাগজপত্ৰ? শেরিং ব্যগ্ৰভাবে প্রশ্ন করল।
কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রধান দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে কাগজপত্রের সঙ্গে ড্রাইভারও উধাও। এ ব্যাপারে তুমি কোনও আলোকপাত করতে পার কি?
শেরিং ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলল, তা পারি বই কী।
আমি চেয়ারটা তার খাটের কাছে এগিয়ে নিয়ে বসলাম। এ বাড়ির লোকজনের বোধ হয় এখনও ঘুম ভাঙেনি। তা হোক; সুযোগ যখন এসেছে, তখন কথা চালিয়ে যাওয়াই উচিত। বললাম, বলো তো দেখি, আসল ঘটনাটা কী।
শেরিং বলল, আমরা ল্যান্ডেক শহর থেকে রওনা হয়ে ফিনস্টেরমুনৎসে সীমানা পেরিয়ে সুইটজারল্যান্ডে প্রবেশ করে কয়েক কিলোমিটার যেতেই এসে পড়ল শ্লাইনস নামে একটা ছোট্ট শহর। সেখানে গাড়ি মিনিট পনেরোর জন্য থামে। আমরা একটা দোকানে বসে বিয়ার খেয়ে আবার রওনা দেবার দশ মিনিটের মধ্যেই গাড়িতে কী যেন গণ্ডগোল হওয়ায় ড্রাইভার নয়মান গাড়ি থামায়। তারপর নেমে গিয়ে সে বনেট খুলে কী যেন দেখে লুবিনকে ডাক দেয়। লুবিন নেমে নিয়মানের দিকে এগিয়ে যেতেই নয়মান তাকে একটা রেঞ্জ দিয়ে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে। স্বভাবতই আমিও তখন নামি। কিন্তু নয়মান শক্তিশালী লোক। ধন্তাধস্তিতে আমি হেরে যাই, সে আমারও মাথায় রেঞ্জের বাড়ি মেরে আমায় অজ্ঞান করে। তারপর আর কিছুই মনে নেই।
আমি বললাম, পরের অংশ তো সহজেই অনুমান করা যায়। নয়মান তোমাদের দুজনকে গাড়িতে তুলে গাড়ি ঠেলে খাদে ফেলে দিয়ে গবেষণার কাগজপত্র নিয়ে পালায়।
টেলিফোন বাজার একটা আওয়াজ কিছুক্ষণ আগেই শুনেছিলাম, এখন শুনলাম কাঠের মেঝের উপর দ্রুত পা ফেলার শব্দ। বুশ দৌড়ে ঘরে ঢুকল। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায় খাদের মধ্যে কিছু কাগজ পাওয়া গেছে। লেখা প্রায় মুছে গেছে, কিন্তু সেটা কী কাগজ, তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না।
তা হলে ফরমুলা হারায়নি? শেরিং চেঁচিয়ে উঠল।
শেরিং-এর মুখে এ প্রশ্ন শুনে বুশ রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা। আমি তাকে সকালের ব্যাপারটা বলে দিলাম। বুশ বলল, তার মানে বুঝতে পারিছ তো?–নয়মান হয়তো ফরমুলা নেয়নি। শুধু টাকাকড়ি বা অন্য কিছু দামি জিনিস নিয়ে পালিয়েছে।
সেটা কী করে বলছ তোমরা, শেরিং ব্যাকুল ভাবে বলে উঠল— গবেষণা সংক্রান্ত কাগজ ছাড়া অন্য অদরকারি কাগজও তো ছিল আমাদের সঙ্গে। খাদে যে কাগজ পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে তো গবেষণার কোনও সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।
শেরিং ঠিকই বলেছে। কতগুলো লেখা ধুয়ে যাওয়া কাগজ থেকে এটা মোটেই প্রমাণ হয় না যে নয়মান ফরমুলা নেয়নি। যাই হোক, আমি আর বুশ স্থির করলাম যে, উলরিখকে শেরিং-এর সঙ্গে রেখে আমরা দুজন ব্রেকফাস্ট সেরেই চলে যাব অ্যাক্সিডেন্টের জায়গায়। আরও কিছু কাগজ পাওয়া যেতে পারে, এবং তার মধ্যে ফরমুলাটাও থাকতে পারে, এমন একটা ক্ষীণ আশা জেগেছে আমাদের মনে। রোমুস আর শ্লাইনসের মধ্যবর্তী অ্যাক্সিডেন্টের জায়গাটা এখান থেকে পচাশি কিলোমিটার। খুব বেশি তো সোয়া ঘন্টা লাগবে পৌঁছাতে। আমার মতে ড্রাইভার খোঁজার চেয়েও বেশি জরুরি কাজ হচ্ছে কাগজ খোঁজা। লেখা ধুয়ে মুছে গেলে ক্ষতি নেই। সে লেখা পাঠোদ্ধার করার মতো রাসায়নিক কায়দা আমার জানা আছে।
এখন সকাল সাড়ে আটটা। আমরা আর মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব। কেন জানি না কিছুক্ষণ থেকে আমার মনটা মাঝে মাঝে খচ খচ করে উঠছে। কোথায় যেন ব্যাপারটার মধ্যে একটা অসঙ্গতি রয়েছে। কিন্তু সেটা যে কী, সেটা বুঝতে পারছি না।
কেবল একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত। আমার যন্ত্রে কোনও গণ্ডগোল নেই।
১০ই মার্চ, রাত ১২টা
একটা বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ঘোর এখনও পুরোপুরি কাটেনি, কাটবে সেই গিরিডিতে আমার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে গিয়ে। এমন ছবির মতো সুন্দর দেশে এমন একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যাবে তা ভাবতে পারিনি।
গতকাল সকালে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আমি, বুশ। আর সুইস পুলিশের হানস বাগরি যখন দুর্ঘটনার জায়গায় রওনা হলাম, তখন আমার ঘড়িতে পৌনে নাটা। রাস্তার এখানে
থাকলেও গাছপালার অস্থির ভাব দেখে বুঝতে পারছিলাম বেশ জোরে হাওয়া বইছে। বুশই গাড়ি চালাচ্ছে, তার পাশে আমি, পিছনের সিটে বাগার।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে লাগল এক ঘন্টা দশ মিনিট। রেমুসে একবার মিনিট তিনেকের জন্য থেমেছিলাম। সেখানে পুলিশের লোক ছিল, তার সঙ্গে কথা বলে জানলাম নয়মানের কোনও খবর এখনও পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান পুরোদমেই চলেছে, এমনকী নয়মানকে ধরিয়ে দেবার জন্য পাঁচ হাজার ফ্রাঙ্ক পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
অ্যাক্সিডেন্টের জায়গার প্রাকৃতিক দৃশ্য আশ্চর্য সুন্দর। রাস্তার পাশ দিয়ে খাদ নেমে গেছে সাড়ে তিন হাজার ফুট। নীচের দিকে চাইলে একটা সরু নদী দেখতে পাওয়া যায়। মনে মনে বললাম, কাগজপত্র যদি ওই নদীর জলে ভেসে গিয়ে থাকে, তা হলে আর উদ্ধারের কোনও আশা নেই। রাস্তাটা এখানে এত চওড়া যে জোর করে ঠেলে না ফেললে, বা ড্রাইভারের হঠাৎ মাথা বিগড়ে না গেলে, গাড়ি খাদে পড়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। পাহাড়ের গায়ে পুলিশের লোক দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপরেও কিছু জিপ ও গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, খানাতল্লাশির কাজে কোনও ত্রুটি হচ্ছে না। আমরাও দুজনে পাহাড়ের গা দিয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম।
পায়েহাটা পথ রয়েছে, ঢালাও তেমন সাংঘাতিক কিছু নয়। দূর থেকে সুরেলা ঘণ্টার শব্দ পাচ্ছি; বোধ হয় গোরু চরছে। সুইস গোরুর গলায় বড় বড় ঘণ্টা বাঁধা থাকে। তার শব্দ সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশকে আরও মনোরম করে তোলে।
গাড়ি যেখানে পড়েছিল, আর লুবিনের মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল, এই দুটো জায়গা আগে দেখা দরকার। এ দিকে ও দিকে বরফের শুভ্ৰ কাপেট বিছানো রয়েছে, মাঝে মাঝে ঝাউ, বিচ আর অ্যাশ গাছের ডাল থেকে ঝুপ ঝুপ করে বরফ মাটিতে খসে পড়ছে।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট খুঁজেও এক টুকরো কাগজও পেলাম না। কিন্তু গাড়ির জায়গা থেকেয়ারও প্রায় পাঁচশো ফুট নেমে গিয়ে যে জিনিসটা আবিষ্কার করলাম, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
আবিষ্কারটা আমারই। সবাই মাটিতে খুঁজছে কাগজের টুকরো; আমার দৃষ্টি কিন্তু গাছের ডালপালা ফোকর ইত্যাদিও বাদ দিচ্ছে না। একটা ঘন পাতাওয়ালা ওক গাছের নীচে এসে দৃষ্টি উপরে তুলতেই পাতার ফাঁক দিয়ে একটা ছোট্ট সাদা জিনিস চোখে পড়ল যেটা কাগজও নয়, বরফও নয়। আমার দৃষ্টি যে কোনও পুলিশের দৃষ্টির চেয়ে অন্তত দশ গুণ বেশি তীক্ষ্ণ। দেখেই বুঝলাম ওটা একটা কাপড়ের অংশ। বার্গারকে ইশারা করে কাছে ডেকে গাছের দিকে আঙুল দেখালাম। সে সেটা দেখামাত্র আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ডাল বেয়ে উপরে উঠে গেল। মিনিটখানেকের মধ্যে তার উত্তেজিত গলা শোনা গেল। সে চেঁচিয়ে উঠেছে তার মাতৃভাষা জার্মানে—
ডা ইস্ট আইনে লাইথে!
অর্থাৎ–এ যে দেখছি একটা মৃতদেহ!
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মৃতদেহ নীচে নেমে এল। বরফের দেশ বলেই মৃত্যুর এত দিন পরেও দেহ প্রায় অবিকৃত রয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে এ হল ড্রাইভার হাইন্ৎস নয়মানের মৃতদেহ। তার কোটের পকেটে রয়েছে তার গাড়ির লাইসেন্স ও তার ব্যক্তিগত আইডেন্টিটি কার্ড। নয়মানেরও হাড়গোড় ভেঙেছে, হাতেমুখে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সেও যে গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে এসে ওই ওকে গাছের ডালপালার ভিতর এতদিন মরে পড়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তা হলে কি নয়মান লুবিন ও শেরিংকে অজ্ঞান করে গাড়িতে তুলে গাড়ি ঠেলে খাদে ফেলার সময় নিজেই পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল? নাকি অন্য কোনও অচেনা লোক এসে তার এই দশা করেছে? যাই হোক না কেন, নয়মানকে খোঁজার জন্য পুলিশকে আর মেহনত করতে হবে না।
এটাও বলে রাখি যে নয়মানের জামার পকেটে গবেষণা সংক্রান্ত কোনও কাগজ পাওয়া যায়নি। সে কাগজ যদি খাদের মধ্যে পাওয়া যায় তো ভাল, না হলে বি-এক্স তিনশো সাতাত্তরের মামলা এখানেই শেষ…
***
আমরা এগারোটার সময় ওয়েলেনস্টার্ট রওনা দিলাম। আমাদের দুজনেরই দেহমন অবসন্ন। সেটা কিছুটা পাহাড়ে ওঠানামার পরিশ্রমের জন্য, কিছুটা দুর্ঘটনার কথা মনে করে। সেই সঙ্গে কাল রাত্রের মতো আজও কী কারণে যেন আমার মনের ভিতরটা খচ খচ করছে। কী একটা জিনিস, বা জিনিসের অভাব লক্ষ করে মুহূর্তের জন্য আমার মনে একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যেটা আমার স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। সঙ্গে রিমেমব্রেন যন্ত্রটা আছে—ওটা হাতছাড়া করতে মন চায় না—একবার মনে হল যন্ত্রটা পরে বুশকে দিয়ে প্রশ্ন করিয়ে দেখি কী হয়, কিন্তু তারপরেই খেয়াল হল, কী ধরনের প্রশ্ন করলে স্মৃতিটা ফিরে আসবে; সেটাও আমার জানা নেই। অগত্যা চিন্তাটা মন থেকে মুছে ফেলে দিতে হল।
বাড়ি পৌঁছানোর কিছু আগে থেকেই মেঘ করেছিল, গাড়ি গেটের সামনে থামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হল।
শেরিং নয়মানের মৃতদেহ আবিষ্কারের কথা শুনে আমাদেরই মতো হতভম্ব হয়ে গেল। বলল, দুটি লোকের মৃত্যু, আর তার সঙ্গে সাত বছরের পরিশ্রম পণ্ড। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এক হিসেবে ভালই হয়েছে।
আমরা একটু অবাক হয়েই শেরিং-এর দিকে চাইলাম। তার দৃষ্টিতে একটা উদাস ভাব দেখা দিয়েছে। সে বলল, মারণাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছে আমার ছিল না। লুবিনই প্রথমে করে প্রস্তাবটা। আমি গোড়ায় আপত্তি করলেও, পরে নিজের অজান্তেই যেন জড়িয়ে পড়ি, কারণ লুবিন ছিল কলেজজীবন থেকে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
শেরিং একটু থেমে আমার দিকে ফিরে মৃদু হেসে বলল, এই যন্ত্রের প্রেরণা কেখেকে এসেছিল জান? তুমি ভারতীয়, তাই তোমাকেই বিশেষ করে বলছি। লুবিন সংস্কৃত জানত। বার্লিনের একটি সংগ্রহশালায় রাখা একটি আশ্চর্য সংস্কৃত পুঁথি লুবিন পড়েছিল কিছুকাল আগে। এই পুঁথির নাম সমরাঙ্গনসূত্ৰম। এতে যে কত রকম যুদ্ধান্ত্রের বর্ণনা আছে, তার হিসেব নেই। সেই পুঁথি পড়েই লুবিনের মাথায় এই অস্ত্রের পরিকল্পনা আসে। …যাক গে, যা হয়েছে তাতে হয়তো আখেরে মঙ্গলই হবে।
আমি সমরাঙ্গনসূত্রমের নাম শুনেছি, কিন্তু সেটা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। অবিশ্যি ভারতীয়রা যে মারণাস্ত্র নিয়ে এককালে বিশেষভাবে চিন্তা করেছে, সেটা তো মহাভারত পড়লেই বোঝা যায়।
শেরিংকে আর এখানে ধরে রাখার কোনও মানে হয় না। আমরা যখন বেরিয়েছিলাম, সেই সময় সে নাকি আলাটডর্ফ শহরে তার এক বন্ধুকে ফোন করে বলেছে তাকে যেন এসে নিয়ে যায়। আলটডর্ফ এখান থেকে পশ্চিমে পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে। শেরিং-এর বন্ধু বলেছে বিকেলের দিকে আসবে।
সারা দুপুর আমরা চারজন পুরুষ ও একজন মহিলা বৈঠকখানায় বসে গল্পগুজব করলাম। সাড়ে তিনটের সময় একটা হাল ফ্যাশানের লাল মোটরগাড়ি এসে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়াল। তার থেকে নামলেন একটি বছর চল্লিশেকের স্বাস্থ্যবান পুরুষ, লম্বায় ছ’ ফুটের ওপর, পরনে চামড়ার জার্কিন ও কর্ডের প্যান্ট। রোদোপোড়া চেহারা দেখে আন্দাজ করেছিলাম, পরে শুনলাম সত্যিই এর পাহাড়ে ওঠার খুব শখ, সুইটজারল্যাণ্ডের উচ্চতম তুষারশূঙ্গ মন্টে রোজায় চড়েছেন বারপাঁচেক–যদিও পেশা হল ওকালতি। বলা বাহুল্য ইনিই শেরিং-এর বন্ধু, নাম পিটার ফ্রিক। শেরিং আমাদের সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আর একবার আমার যন্ত্রটার উচ্ছসিত প্রশংসা করে আলটডর্ফের দিকে রওনা দিয়ে দিল।
সে যাবার মিনিট দশেক পরে— সবেমাত্র ক্লারা সকলের জন্য লেমনটি ও কেক এনে টেবিলে রেখেছে— এমন সময় হঠাৎ ভেলকির মতো আমার মনের সেই অসোয়াস্তির কারণটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল, আর হওয়ামাত্র আমি সবাইকে চমকে দিয়ে তড়াক করে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে বুশের দিকে ফিরে বললাম, এক্ষুনি চলো। আল্টডর্ফ যেতে হবে।
তার মানে? উলরিখ আর বুশ একসঙ্গে বলে উঠল।
মানে পরে হবে। আর এক মুহুর্ত সময় নেই।
আমার এই বয়সে এই তৎপরতা দেখেই বোধহয় বুশ ও উলরিখ তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল।
সিঁড়ি দিয়ে একসঙ্গে তিনটে করে ধাপ উঠতে উঠতে বুশকে বললাম, তোমার সঙ্গে অস্ত্ৰ আছে? আমারটা আনিনি।
একটা লুগার অটোম্যাটিক আছে।
ওটা নিয়ে নাও। আর পুলিশের লোকটি থাকলে তাকেও বলে দাও সঙ্গে আসতে। আর আলটডর্কেও জানিয়ে দাও–সে দিকেও যেন পুলিশ তৈরি থাকে।
আমার যন্ত্রটাকে ঘর থেকে নিয়ে আমরা চারজন পুরুষ বুশের গাড়িতে উঠে ঝড়ের বেগে ছুটিলাম আলটেডর্ফের উদ্দেশে। বুশ মোটর চালনায় সিদ্ধহস্ত— স্টিয়ারিং ধরে এক মিনিটের মধ্যে একশো কুড়ি কিলোমিটার স্পিড তুলে দিল। এ দেশে যারা গাড়ির সামনের সিটে বসে, তাদের প্লেনযাত্রীর মতো কোমরে বেল্ট বেঁধে নিতে হয়। এ গাড়িটা তো এমনভাবে তৈরি যে বেল্ট না বাঁধলে গাড়ি চলেই না। শুধু তাই না–গাড়িতে যদি আচমকা ব্রেক কষা হয়, তা হলে তৎক্ষণাৎ ড্যাশবোর্ডের দুটো খুপরি থেকে দুটো নরম তুলোর মতো জিনিস লাফিয়ে বেরিয়ে এসে চালক ও যাত্রীকে হুমড়ি খেয়ে নাকমুখ থ্যাঁতলানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
আমাদের অবিশ্যি আচমকা ব্রেক কষার প্রয়োজন হয়নি। ত্ৰিশ কিলোমিটারের ফলক পেরোবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা শেরিং-এর লাল গাড়ি দেখতে পেলাম। তার চলার মেজাজে চালকের নিরুদ্বেগ ভাবটা স্পষ্ট। আমি বললাম, ওটাকে পেরিয়ে গিয়ে থামো।
বুশ হর্ন দিতে দিতে লাল গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে খানিক দূর গিয়ে হাত দেখিয়ে গাড়িটাকে রাস্তার মাঝখানে ট্যারিচা ভাবে দাঁড় করিয়ে দিল। ফলে শেরিং-এর গাড়ি বাধ্য হয়েই থেমে গেল।
আমরা চারজন গাড়ি থেকে নোমলাম। শেরিং আর তার বন্ধুও নেমে অবাক মুখ করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
কী ব্যাপার? শেরিং প্রশ্ন করল।
পথে আসার সময় আমাদের চারজনের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। হয়তো আমার গভীরভাব দেখেই অন্য তিনজন সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। কাজেই আমরা কেন যে এই অভিযানে বেরিয়েছি, সেটা একমাত্র আমিই জানি, আর তাই কথাও বলতে হবে আমাকেই।
আমি এগিয়ে গেলাম। শেরিং যতই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করুক না কেন, তার ঠোঁটের ফ্যাকাশে শুকনো ভাবটা সে গোপন করতে পারছে না। তার তিন হাত পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তার বন্ধু পিটার ফ্রিক।
একটা চুরুট খেতে ইচ্ছে করল, আমি শান্তভাবে বললাম, কাল তোমার ডাচ চুরুট পান করে আমার নেশা হয়ে গেছে। আছে তো চুরুটের কেসটা?
আমার এই সহজভাবে বলা সামান্য কয়েকটা কথায় যেন ডিনামাইটে অগ্নি সংযোগ হল। শেরিং-এর বন্ধুর হাতে মুহূর্তের মধ্যে চলে এল একটা রিভলভার, আর সেই মুহুর্তেই সেটা গৰ্জিয়ে উঠল। আমি অনুভব করলাম আমার ডান কনুই ঘেষে গুলিটা গিয়ে লাগল বুশের মার্সেডিস গাড়ির ছাতের একটা কোণে। কিন্তু সে রিভলভার আর এখন পিটার ফ্রিকের হাতে নেই, কারণ দ্বিতীয় আর একটা আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রিকের রিভলভারটা ছিটকে গিয়ে রাস্তায় পড়েছে, আর ফ্রিক। তার বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের কবজিটা চেপে মুখ বিকৃত করে। হাঁটু গেড়ে রাস্তায় বসে পড়েছে।
আর শেরিং? সে একটা অমানুষিক চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বশ্বাসে উলটোমুখে দৌড় লাগাতেই বুশ ও উলরিখ তিরবেগে ছুটে গিয়ে বাঘের মতো লাফিয়ে তাকে বগলদাবা করে ফেলল। আর আমি— জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কু— আমার অদ্বিতীয় আবিষ্কার রিমেমব্রেন যন্ত্রটি শেরিং-এর মাথায় পরিয়ে বোতাম টিপে ব্যাটারি চালু করে দিলাম।
শেরিং দুজনের হাতে বন্দি হয়ে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইল, তার নিষ্পলক দৃষ্টি দেখে মনে হয়, সে দূরে তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়োর দিকে চেয়ে ধ্যান করছে।
এবার আমার খেলা।
আমি প্রশ্ন করলাম শেরিং-কে উদ্দেশ করে।
ডক্টর লুবিন কীভাবে মরলেন?
দিম আটকে।
তুমি মেরেছিলে তাকে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
টুটি টিপে।
তখন গাড়ি চলছিল?
হ্যাঁ।
ড্রাইভার নয়মান কীভাবে মরল?
নয়মানের সামনে আয়না ছিল। আয়নায় সে লুবিনের হত্যাদৃশ্য দেখে। সেই সময় তার স্টিয়ারিং ঘুরে যায়। গাড়ি খাদে পড়ে।
তার সঙ্গে তুমিও পড়ি?
হ্যাঁ।
তুমি কি ভেবেছিলে লুবিন ও নয়মানকে খুন করে তাদের খাদে ফেলে দেবে?
হ্যাঁ।
তারপর ফরমুলা নিয়ে পালাবে?
হ্যাঁ।
কী করতে তুমি ওটা দিয়ে?
বিক্রি করতাম।
কাকে?
যে বেশি দাম দেবে, তাকে।
ফরমুলার কাগজ কি তোমার কাছে আছে?
না।
তবে কী আছে?
টেপ।
তাতে ফরমুলা রেকর্ড করা আছে?
হ্যাঁ।
কোথায় আছে সে টেপ?
চুরুটের কেসে।
ওটা কি আসলে একটা টেপ রেকর্ডার?
হ্যাঁ।
আমি শেরিং-এর মাথা থেকে হেলমেট খুলে নিলাম। পুলিশের লোকটি ভিজে রাস্তার উপর জুতোর শব্দ তুলে শেরিং-এর দিকে এগিয়ে গেল।
***
এখন মনে হচ্ছে কী আশ্চর্য এই মস্তিষ্ক জিনিসটা, আর কী অদ্ভুত এই স্মৃতির খেলা। কাল শেরিং চুরুট চাইল, ক্লারা তাকে কেন্সটা এনে দিল, কিন্তু সে চুরুট খেল না। তখনই ব্যাপারটা পুরোপুরি আঁচ করা উচিত ছিল, কিন্তু করিনি। আজ সকালেও তার ঘরে চুরুটের কোনও গন্ধ বা কোনও চিহ্ন দেখিনি। চুরুটের কেন্সটা নিয়মিত খাটের পাশের টেবিলে থাকা উচিত ছিল, কিন্তু তা ছিল না। আজ দুপুরে এতক্ষণ বসে গল্প করলাম, কিন্তু তাও শেরিং চুরুট খেল না।
গান মেটালের তৈরি কেন্সটা এখন আমার ঘরে আমার টেবিলের উপর রাখা রয়েছে। এর ঢাকনাটা খুললে বেরোয় চুরুট, আর নীচের দিকে একটা প্রায়-অদৃশ্য বোতাম টিপলে তলাটা খুলে গিয়ে বেরোয় মাইক্রোফোন সমেত একটা খুদে টেপ রেকডার। টেপটা চালিয়ে দেখেছি, তাতে বি-এক্স তিনশো সাতাত্তিরের সব তথ্যই রেকর্ড করা আছে শেরিং-এর নিজের গলায়। এরই উপর যদি অন্য কিছু রেকর্ড করা যায়, তা হলে শেরিং-এর এই অপদার্থ ফরমুলাটা চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
উইলির গলা না? সে আবার সুর করে ছড়া কাটছে।
মাইক্রোফোনটা বার করে রেকডারটা চালিয়ে দিলাম।
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৮১
ডন ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণী (প্রোফেসর শঙ্কু)
সেপ্টেম্বর ৬
আজ আমার বন্ধু জেরেমি সন্ডার্সের কাছ থেকে একটা আশ্চর্য চিঠি পেয়েছি। সেটা হল এই— প্রিয় শঙ্কু,
তোমাকে একটা অদ্ভুত খবর দেবার জন্য এই চিঠির অবতারণা। আমাদের দেশের কাগজে খবরটা বেরিয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষে হয়তো বেরোয়নি। ম্যাড়িডের এক লাইব্রেরিতে একটি অতি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছিল তিন মাস আগে। স্পেনের বিখ্যাত ভাষাবিদ প্রোফেসর আলিফোনসো বেরেটা তিন মাসে এই পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার করেছেন এবং একটি সাংবাদিক সম্মেলনে সেটা সম্বন্ধে বলেছেন। এই পাণ্ডুলিপির লেখকের নাম হল ডন ক্রিস্টেবান্ডি এবং এর রচনাকাল হল ১৪৮৩ থেকে ১৪৯০। অৰ্থাৎ আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে। বেরেটা বলেছেন, এই পাণ্ডুলিপিতে ক্রিস্টেবান্ডি অজস্র ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যার অধিকাংশই ফলে গেছে। তুমি তো ফরাসি গণিাৎকার নষ্ট্রাডামুসের কথা জানো। নষ্ট্রাডামুস জন্মেছিলেন ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে, এবং তিনিও পদে বহু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যার অনেকগুলোই ফলে গেছে। লন্ডনের প্লেগ ও অগ্নিকাণ্ড, ফরাসি বিপ্লবে সম্ৰাট ষোড়শ লুইয়ের লাঞ্ছনা, নেপোলিয়নের উত্থান ও পতন, লুই পাস্তুরের যুগস্তকারী আবিষ্কার, এমনকী আমাদের যুগে হিরোশিমা ও নাগাসাকির উপর আণবিক বোমা বৰ্ষৰ্ণ, অষ্টম এডওয়ার্ডের সিংহাসনত্যাগ, হিটলারের অভুত্থান ইত্যাদি অনেক কিছুই নষ্ট্রাডামুস সঠিকভাবে বর্ণনা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু এই স্প্যানিশ পাণ্ডুলিপিতে যা ভবিষ্যদ্বাণী আছে, তা নষ্ট্রাডামুসের কীর্তিকে স্নান করে দেয়। গত পাঁচশো বছরে এমন কোনও বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঘটনা নেই যা ক্রিস্টেবান্ডি তাঁর দিব্যদৃষ্টি দিয়ে প্রত্যক্ষ করেননি। আমার তো বিশ্বাস, তোমার কথাও তিনি বলে গেছেন : বিংশ শতাব্দীতে এক অসাধারণ প্রতিভাশালী বিজ্ঞানীর আবির্ভার্ব হবে যার নামের আদ্যক্ষর এস—এ তুমি ছাড়া আর কে হতে পারে?
আমি ম্যাড্রিডে গিয়ে বেরেটার সঙ্গে দেখা করি এবং এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে আলোচনা করি। আমার এই চিঠি লেখার প্রধান কারণ হল ক্রিস্টোেবান্ডির একটি বিশেষ ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপে এক প্রাণীর আবির্ভার্ব হবে, যারা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মাত্র তিনশো বছরে মানুষের কীর্তিকে অনেক গুণে অতিক্রম করে যাবে। মানুষ এই প্রাণীর সন্ধান পাবে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াধের্চ এবং এই প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা মানুষই দূর করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে—এই প্ৰাণী কি সত্যিই আছে? যদি থাকে। তবে তারা কোথেকে এল, এবং একটি দ্বীপে বাস করে তারা এত অল্প সময়ে বিজ্ঞানে কী করে এতদূর অগ্রসর হল?
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে অনেক বিখ্যাত পর্যটক প্রশাস্ত মহাসাগর পরিভ্রমণ করে। অনেক কিছু আবিষ্কার করেন। আমি গত এক মাস ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে এইসব পর্যটকের ভ্রমণবৃত্তাস্ত পড়ে দেখেছি। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ফরাসি পর্যটক জী-ফ্রাঁসোয়া লা পেরুজ প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি দেন। তার বিবরণ তিনি লিখে গেছেন। সেটা পড়তে পড়তে এক আশ্চর্য ঘটনার বর্ণনা পেলাম। লা পেরুজের জাহাজ একবার ঝড়ে পড়ে কক্ষত্ৰষ্ট হয়ে একটা অজানা দ্বীপের কাছে এসে পড়ে। তখন সন্ধ্যা। সেই সময় লা। পেরুজ এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখেন। দ্বীপের একটা অংশ থেকে একটি আলোকস্তম্ভ উঠে আকাশে বহুদূরে চলে গেছে। এর কারণ জানার চেষ্টা লা পেরুজ করেননি, কারণ ঝড় থেমে যাওয়ায় তাঁরা আবার কক্ষে ফিরে আসেন।
আলোকস্তম্ভের বর্ণনা পড়লে লেসার রশ্মির কথাই মনে পড়ে। অন্য কোনও আলো এই ধরনের সমান্তরাল স্তম্ভ রচনা করতে পারে না। ভেবে দেখো-এই ঘটনা একশো বছর। আগে দেখা, আর মানুষের লেসার রশ্মি আবিষ্কার হল সাম্প্রতিক ঘটনা!
আমার প্রবল আগ্রহ হচ্ছে এই দ্বীপে গিয়ে অনুসন্ধান করার। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই প্রাণী সম্পর্কেও ক্রিস্টেবান্ডির গণনা নির্ভুল। আমাদের মনরো দ্বীপ অভিযানে, আমরা যে যান ব্যবহার করেছিলাম-আমাদের জাপানি বন্ধু হিদেচি সুমা-র তৈরি জেটচালিত সুমাইেক্রাফট—সেই একই যান আমরা এবারও ব্যবহার করতে পারি। সুমাকে বললে ও রাজি হবে না। এটা আমার বিশ্বাস হয় না। আর ক্রোল তো পা বাড়িয়েই আছে; এখন বাকি শুধু তোমার সম্মতি। তোমাকে তো চিনি আমি সতেরো বছর ধরে; আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি রাজি হবে।
কী স্থির কর অবিলম্বে জানাও, কারণ অনেকরকম তোড়জোড় আছে। শুভেচ্ছা নিও।
ইতি। জেরেমি
এ ব্যাপারে যে আমার উৎসাহ না হয়ে যায় না, সেটা সন্ডার্স ঠিকই বলেছে। সত্যিই কি এই উন্নতস্তরের প্রাণী, যারা মানুষ নয়, তারা পৃথিবীতে বাস করছে এতদিন ধরে? ডন ক্রিস্টোেবান্ডির এই গণনাও কি নির্ভুল?
আমি এই অভিযানে যোগ দিতে অবশ্যই প্রস্তুত, সে খবর আমি সভার্সকে আজই জানিয়ে
সেপ্টেম্বর ১৩
অভিযানের সমস্ত আয়োজন হয়ে গেছে। সুমা এককথায় রাজি। তার যানই আমরা ব্যবহার করছি, তবে এটা আগেরটার চেয়ে আরও উন্নত ধরনের যান-সুমাক্রাফট ২।
আমরা চার জন ছাড়া আরেকজন আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন। ইনি হলেন বার্সেলোনার বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রোফেসর সালভাডর সাবাটিনি। এর সঙ্গে আমার একবারই দেখা হয়েছিল ব্রাসেলসের এক বিজ্ঞানী সম্মেলনে। বয়স ষাটের বেশি নয়, পণ্ডিত ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই, তবে কিঞ্চিৎ দাম্ভিক আর একওঁয়ে। ইনি অভিজাত বংশের সন্তান, তবে এখন অবস্থা অনেক পড়ে গেছে। ক্রিস্টোবান্ডির পুঁথি ইনি পড়েছেন, এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এর ধারণা এস নামধারী যে বিজ্ঞানী প্রবারের কথা ক্রিস্টোবান্ডি বলে গেছেন, তিনি হলেন উনি নিজে।
আমরা সকলে সিঙ্গাপুরে একত্র হব, তারপর সেখান থেকে রওনা। লা পেরুজের সঙ্গে ক্রোনোমিটার ইত্যাদি নানারকম যন্ত্র ছিল, তাই তিনি এই রহস্যময় দ্বীপের অবস্থান দিয়ে গেছেন। সেটা হল ৪১-২৪ নর্থ বাই ১৬১-৫ ওয়েস্ট। ম্যাপে দেখা যাবে ওখানে কোনও দ্বীপের চিহ্ন নেই। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক।
আমরা ২৫শে সেপ্টেম্বর রওনা হচ্ছি।
সেপ্টেম্বর ২৪, সিঙ্গাপুর
আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি গতকাল। সাবাটিনির কাছে ক্রিস্টোবাল্ডির পুঁথির কথা শুনছিলাম। পুঁথির গোড়াতে ক্রিস্টোবান্ডি তার নিজের সম্বন্ধে বেশ কিছুটা বলেছে। মেষপালকের ছেলে ছিল সে। তেরো বছর বয়সে সে প্রথম ভবিষ্যতের ঘটনার ইঙ্গিত পায়। তার কথা অবশ্য সকলেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর একের পর এক অজস্র ভবিষ্যতের ঘটনা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে। সে নিজের চেষ্টায় লিখতে পড়তে শেখে শুধু এইসব ঘটনা লিখে রাখার জন্য। নষ্ট্রাডামুসের মতোই সে নিজের মৃত্যুর সন। তারিখও আগে থেকে জানিয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৩-এর–বাংলার মন্বন্তরের কথা ক্রিস্টোেবাল্ডি লিখে গেছে। বাংলার নাম অবশ্য করেনি; প্রাচ্যের একটা প্রদেশ বলে বলেছে। সেই সময় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলেছে, তার সম্বন্ধেও অবিশ্যি অনেক তথ্য আছে। হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পও বাদ যায়নি।
সুমা জিজ্ঞেস করল জাপান সম্বন্ধে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী আছে কি না। তাতে সাবাটিনি বলল, তোমাদের রাজা হিরোহিতো সম্বন্ধে একেবারে নাম উল্লেখ করে বলা আছে। তিনি যে দীর্ঘকাল জীবিত থাকবেন সে কথাও বলা আছে। তা ছাড়া হিরোশিমা নাগাসাকির কথা তো আছেই। যেমন নষ্ট্রাডামুসে ছিল।
সুমা দেখলাম, এই নতুন প্রাণীর ব্যাপারে একটু সন্দিহান। বলল, মানুষ এই বিংশ শতাব্দীতে যা করেছে, এই পৃথিবীতেই কোনও প্রাণী তার চেয়ে বেশি উন্নত কিছু করতে পারবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। সন্ডার্স আর ক্রোল দুজনেই এ ব্যাপারে যাকে বলে ওপান-মাইন্ডেড। ক্রোল বলছে, এই প্রাণী যদি থেকেও থাকে, তা হলে আমি প্রথমেই অনুসন্ধান করব এরা অলৌকিককে বিজ্ঞানের আওতায় এনে ফেলতে পেরেছে কি না। আমাদের অনেক বিজ্ঞানীই অলৌকিক ঘটনাকে হেসে উড়িয়ে দেন, অথচ সেগুলো যে কী করে ঘটছে তার কোনও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন না।
সন্ডার্সের উৎসাহের অন্ত নেই। ও বারবার বলছে, লা পেরুজ যা লিখে গেছে, তা তো মিথ্যা হতে পারে না। সে ছিল অতি বিখ্যাত পর্যটক। কথা হচ্ছে–সেই প্ৰাণী এখনও আছে কি না। একটা জিনিস। আমি কিছুঁতে ই বুঝতে পারছি না—শুধু একটা দ্বীপে নিজেদের আবদ্ধ রেখে পৃথিবীর অন্য কোনও অংশের সঙ্গে যোগস্থাপন না করে একটা জাত কী করে উন্নত অবস্থায় বেঁচে থাকে। টেকনলজিতে উন্নতি করতে গেলে তো যন্ত্রপাতি লাগে। সেই যন্ত্রপাতি তৈরি করার মালমশলা ওই একটা দ্বীপেই রয়েছে?
এইসব প্রশ্নের কোনও উত্তরই অবশ্য সিঙ্গাপুরে বসে পাওয়া যাবে না। তবে আমার মনেও যে একটা অবিশ্বাস দানা বাঁধেনি। তা নয়। এসব ব্যাপারে ধাপ্লাবাজির উদাহরণের অভাব নেই। আমাদের দিনেরই একজন লোক, যে প্রাচীনকালের হাতের লেখা অনুকরণ করতে পারে, সে মাসখানেক পরিশ্রম করলেই একটা পাঁচশো বছরের পুরনো পাণ্ডুলিপি তৈরি করে ফেলতে পারে। যিনি এই পুঁথি আবিষ্কার করেছেন, তিনি কীরকম লোক সেটা জানা দরকার।
সেপ্টেম্বর ২৭, প্রশান্ত মহাসাগর
আমরা পচিশেই রওনা হয়েছি। সুমার এই যানটির কোনও তুলনা নেই। ম্যাপে দেখে আন্দাজ হয়, আমাদের সাড়ে সাত হাজার মাইলের মতো যেতে হবে। আমরা এখন পর্যন্ত দিনে গড়ে পাঁচশো মাইলের মতো চলেছি। দরকার হলে এর চেয়েও বেশি যাওয়া যায়, কিন্তু এখন অবধি সেটার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। সন্ডার্স একটা খেলা নিয়ে এসেছে, নাম লোগোস। যেটা পাঁচ জনে খেলতে পারে। ইংরাজি শব্দ রচনার খেলা, ভেবেছিলাম সুমা আর সাবাটিনির অসুবিধা হবে, কিন্তু দেখছি। এরা ভাষাটা ভাল বলতে না পারলেও, পড়াশুনা করেছে অনেক, ফলে শব্দের স্টক রীতিমতো ভাল। খেলাটা খেলে আমাদের অনেকটা সময় কেটে যায়।
সুমা সঙ্গে করে একেবারে হালের ইলেকট্রনিক আবিষ্কারের কিছু নমুনা নিয়ে এসেছে। তারমধ্যে একটা খুবই চমকপ্রদ। তুমি হয়তো প্যারিসে গেছ বাজার করতে, অথচ ফরাসি ভাষা জান না। তুমি ইংরাজিতে তোমার চাহিদা জানালে। এই যন্ত্র তৎক্ষণাৎ সেটা ফরাসি
আমাদের ওখানে কতদিন থাকতে হবে জানি না। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দশ দিনের মতো জামাকাপড় নিয়ে এসেছি। থাকব। প্লাস্টিকের তাঁবুতে আর খাব টিনের খাবার।
অক্টোবর ৩, প্রশান্ত মহাসাগর
৪০, ১ নর্থ বাই ১৬১-৫ ওয়েস্ট
আজ আধা ঘণ্টা আগে আমরা এই দ্বীপে পৌঁছেছি। আদৌ যে একটা দ্বীপ রয়েছে এই ল্যাটিচিউড, লঙ্গিচিউডে, তাতেই আমরা উৎফুল্ল। বিচিত্র দ্বীপ। কোনও গাছপালা নেই, সবুজ বলতে কিছুই নেই, কেবল বালি, পাথর আর শুকনো মাটি। মশা ছাড়া কোনও প্রাণীর সাক্ষাৎ পাইনি এখন পর্যন্ত। কোনওরকম সরীসৃপও চোখে পড়েনি, পাখি বা জানোয়ার তো নয়ই।
দ্বীপটিা কত বড় সেটা এখনও আন্দাজ করতে পারিনি। তবে এটা প্রায় জোর দিয়েই বলা যায় যে, এখানে যদি কোনও প্রাণী থেকেও থাকে, তা হলে সভ্যতার স্তরে তারা বেশ নীচেই স্থান পাবে। সভ্য মানুষ হলে বাসস্থানের চিহ্ন থাকবে তো! এখানে যতদূর দেখা যায়, একটা বাড়িও চোখে পড়ছে না।
আমাদের সকলেরই মনে একটা আশঙ্কা রয়েছে যে এতদূর এসে হয়তো ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে। এখন দুপুর দুটো। আজকের দিনটা যে এখানে থাকা উচিত সেটা সকলেই বোধ করছি। দ্বীপটা একটু ঘুরেও দেখা উচিত। দূরের দিকে চাইলে মনে হয় সে অংশটা, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার চেয়ে বেশ খানিকটা উঁচু। এবং মোটামুটি মসৃণও বটে।
এখনও লাঞ্চ হয়নি। ক্রোল আর সন্ডার্স মিলে খাবার আয়োজন করছে; আমারও বোধ হয়হাত লাগানো উচিত। লেখা বন্ধ করি।
অক্টোবর ৫
কথাটা লিখেও আনন্দ; আমাদের অভিযান সফল হয়েছে! এই দুদিনের ঘটনা নিয়ে একটা বই লেখা যায়; আমি ডায়রিতে যতটা পারি লিখছি।
প্রথম দিন লাঞ্চের পর আমরা পাঁচজন বেরোলাম দ্বীপের মাঝের অংশ লক্ষ্য করে। যত হাটছি তত বুঝছি যে জমিটা ধীরে ধীরে উঁচু হচ্ছে এবং মসৃণ হচ্ছে। নুড়ি, পাথর ইত্যাদিও ক্রমশ কমে আসছে। এই মসৃণতা কিন্তু এমন দ্বীপের এমন জমিতে স্বাভাবিক নয়। সুমা একবার হাঁটা থামিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে বসে জমিটার উপর হাত বুলিয়ে পরীক্ষা করল। ওর মন্তব্য হল, ভেরি স্ট্রেঞ্জ।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটার পর একটা জায়গায় এসে পড়লাম, যেটাকে মনে হল দ্বীপের উচ্চতম অংশ। বিশেষ দ্রষ্টব্য হল মাটিতে একটা গোল গর্ত যার ব্যাস আন্দাজ দেড় মিটার। সেটার দিকে এগিয়ে ভাল করে দেখেও বোঝা গেল না তার ভিতর কী আছে। সেটা যে গভীর তাতে সন্দেহ নেই, কারণ চোখে যা দেখা যাচ্ছে তা হল দুর্ভেদ্য অন্ধকার। ক্রোল আধপাগলা লোক, সে গর্তটার কাছে মুখ নিয়ে তারস্বরে চিৎকার করল, হোয়েহো।
কোনও উত্তর নেই, অথচ বেশ বোঝা যাচ্ছে গর্তটা প্রাকৃতিক নয়; এমন নিখুঁত বৃত্ত মানুষ বা মানুষজাতীয় কোনও প্রাণীর কাজ হতে বাধ্য।
আমরা আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলাম। এদিকে জমিটা ক্রমে ঢালু হয়ে নীচে নামছে। আমরা এসেছি। প্রায় চার মাইল। এই গর্ত যদি এই দ্বীপের কেন্দ্ৰস্থল হয়, তা হলে ওদিকেও আন্দাজ চার মাইল জমি তো রয়েইছে।
ঢালুর ওপাশেও আমরা বাসস্থানের কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
কিছুদূর গিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। গর্তটা দেখে সকলেই উত্তেজিত, কিন্তু তার মানে কেউই বুঝতে পারছে না।
ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে পাঁচটা বেজে গেল। এতটা পথ হেঁটে সকলেরই বেশ ক্লান্ত লাগছিল। আমাদের তাঁবুগুলো খাটানো হয়ে গিয়েছিল। তিনটে তাঁবু-একটায় ক্রোল আর সন্ডার্স, একটায় আমি আর সুমা, আর একটায় সাবাটিনি। আমরা যে যার ক্যাম্পে ঢুকে প্লাস্টিকের চাদরে শুয়ে একটু জিরিয়ে নিলাম। সাড়ে পাঁচটায় ক্রোল সকলকে কফি এনে দিল। সাবাটিনির একটা অসুবিধা হচ্ছে, আমাদের মধ্যে একমাত্র ওকেই মশা কামড়াচ্ছে। সে বারবার শরীরের অনাবৃত অংশে চাপড় মেরে মশা মারার চেষ্টা করছে। বলল, আমার রক্তের জাতই এইরকম। আমার দেশেও মশারা আমার রক্ত খেতে খুব ভালবাসে।
সাড়ে ছটায় প্রশান্ত মহাসাগরের দিগন্তে সারা আকাশে রং ছড়িয়ে সূর্যদেব অস্ত গেলেন। এবার অন্ধকার হয়ে যাবে দেখতে দেখতে। আমি তিনটে ক্যাম্পের জন্য আমার তৈরি তিনটে লুমিনিম্যাক্স ল্যাম্প এনেছি।-অন্ধকার হলেই সেগুলো জ্বলবে।
কিন্তু সেই প্রাণীরা যদি থেকেও থাকে, তা হলে কখন তাদের দেখা পাওয়া যাবে? তারা কি আমাদের দেখাই দেবে না? মানুষের প্রতি কি তারা বিরূপ ভাব পোষণ করে?
ক্রোলের তাঁবু থেকে ভেসে আসছে হেঁড়ে গলায় টুকরো টুকরো ভাবে গাওয়া একটা জার্মান গান। সুমা পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতের ভক্ত। সে একটা বেটোফেনের সিমফনির ক্যাসেট বার করে তার যন্ত্রে চাপাতে যাবে এমন সময় একটা চিৎকার শোনা গেল।
কাম আউট অ্যান্ড সী, কাম আউট অ্যান্ড সী!
সাবাটিনির গলা।
আমরা হন্তদন্ত হয়ে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এক শ্বাসরোধ করা দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম।
দ্বীপের যেটাকে আমরা মাঝের অংশ বলে মনে করেছিলাম, সেখানকার জমি থেকে একটা সবুজ আলোকস্তম্ভ বেরিয়ে আকাশের দিকে বহুদূর উঠে গেছে। এটা যে লেসার রশ্মি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এই আলোকস্তম্ভই একশো বছর আগে দেখেছিল। লা পেরুজ।
সন্ডার্স বলে উঠল, ইট মাস্ট বি কামিং আউট অব দ্যাট হোল।
আমিও তাই সন্দেহ করছিলাম। ওই গর্ত থেকেই এই আলোকস্তম্ভ বেরিয়েছে।
আমার মনে একটা সন্দেহের উদয় হয়েছিল, সেটা এবার বলে ফেললাম।
আমার মনে হয় এই প্ৰাণী মাটির নীচে থাকে। তাই বাইরে এদের অস্তিত্বের কোনও চিহ্ন নেই।
কিন্তু এদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কীভাবে? অসহিষ্ণু ভাবে বলে উঠল সন্ডার্স।
অ্যান্ড ইন হোয়াট ল্যাঙ্গুয়েজ? প্রশ্ন করল। সুমা।
ঠিক কথা। এদের তো ইংরিজি জানার কোনও সম্ভাবনা নেই, তা হলে যোগাযোগ হবে ভাবে?
এবার সুমা ক্যাম্প থেকে একটা যন্ত্র নিয়ে এল। একেবারে হালের জাপানি কীর্তি, তাতে সুন্দেহ নেই। ছোট ক্যামেরার মতো দেখতে, তবে লেনসের জায়গায় একটা ছোট্ট চোঙা রয়েছে।
চোঙার উলটো দিকটা মুখের কাছে এনে সুমা স্বাভাবিক স্বরে কথা বলল, আর সেই কথার তেজ শতগুণ বেড়ে আকাশ কাঁপিয়ে দিল।
তোমরা যদি ইংরিজি জান তো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমরা মানুষ। তোমাদের বিষয় পড়ে তোমাদের সন্ধানে এসেছি।
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে গুরুগভীর তেজস্বী কণ্ঠস্বরে উত্তর এল। এমন যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর
মানুষের হয় না।
আমরা জানি তোমরা এসেছ। তোমরা কী ভাষায় কথা বলে সেটা জানার অপেক্ষায় ছিলাম।
আমরা তোমাদের বন্ধু বলল সুমা। আমরা তোমাদের কাছে আসতে চাই। কীভাবে আসব?
উত্তর এল, তোমরা রশ্মির উৎসের কাছে এসো। ততক্ষণে আমরা ব্যবস্থা করছি।
আমরা মনে প্রবল উত্তেজনা আর কৌতূহল নিয়ে আলোকস্তম্ভের দিকে এগিয়ে গেলাম।
কাছাকাছি যেতে আলো ক্রমশ স্নান হয়ে মিলিয়ে এল। কিন্তু তার পরিবর্তে সমস্ত জায়গাই একটা সাদা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম। এই আলোটাও সেই গর্তের ভিতর থেকেই আসছে।
আবার উদাত্ত যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
প্রবেশপথ দিয়ে চলন্ত সিঁড়ি নেমে এসেছে নীচে। তোমরা একে একে নেমে এসো। নীচে তোমাদের বসার ব্যবস্থা হয়েছে।
সবাই আমার দিকে চাইল। অর্থাৎ আমাকে দলপতি হতে হবে। আমি গর্তের দিকে এগিয়ে এলাম। নীচ থেকে আলো আসছে, তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চলন্ত সিঁড়ি। আমি সিঁড়িতে পা দিতেই নীচে রওনা দিলাম, আমার পিছনে চারজন।
অন্তত পঞ্চাশ গজ নামার পর সিঁড়ির নীচে পৌঁছোলাম। সামনে বিশ হাত দূরেই দেখা যাচ্ছে একটা আলোকিত প্যাসেজ। এই প্যাসেজ ধরে মিনিটখানেক গিয়েই দেখি আমরা একটা গোল ঘরে পৌঁছেছি। এ ঘরও আলোকিত, কিন্তু কোথেকে আলো আসছে সেটা বোঝা যায় না। ঘরে ল্যাম্প জাতীয় কিছু নেই। ঘরের মাঝখানে একটা অজানা ধাতুর তৈরি সোনালি টেবিল, আর তাকে ঘিরে পাঁচটা সোনালি চেয়ার। আদেশ শোনা গেল; তোমরা বোসো। এই ঘর, এই আসবাব, তোমাদের জন্যই তৈরি করে রেখেছিলাম।
আমরা পাঁচজনে বসলাম। আবার কথা এল: মানুষ আমরা এই প্রথম দেখলাম। যেমন ভেবেছিলাম তার সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। এতদিন যন্ত্রে তোমাদের কথা, তোমাদের গান, তোমাদের বাজনা শুনে এসেছি। এইবারে আসল মানুষকে দেখলাম।
কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? অসহিষ্ণুভাবে প্রশ্ন করল। সাবাটিনি। আমরা তোমাদের দেখতে চাই, তোমাদের কাছে আসতে চাই।
তা হবে না।
কেন?
আমাদের আকৃতি তোমরা সহ্য করতে পারবে না। আমরা দেখা দেব না। তোমরা কী জানতে চাও বলো।
তোমরা কি অন্য কোনও গ্রহ বা উপগ্রহ থেকে এসেছ?
না।
তবে?
পৃথিবীতে প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল আকস্মিকভাবে–রাসায়নিক প্রক্রিয়ায়। আমাদেরও উৎপত্তি হয়েছে সেরকম আকস্মিকভাবেই। আজ থেকে তিনশো বছর আগে।
কিন্তু তোমরা এত অগ্রসর হলে কী করে-মানুষের সংস্পর্শে না এসেও?
আমরা অগ্রসর হয়েই জন্মেছি। এই তিনশো বছরে অবশ্য আমরা নিজেদের চেষ্টায় আরও উন্নত হয়েছি।
তোমরা মানে তোমরা সকলে?
হ্যাঁ। আমাদের পরস্পরে কোনও প্ৰভেদ নেই।
কতজন আছ তোমরা?
পনেরো হাজার। তবে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যা ক্ৰমে বাড়ছে। ত্ৰিশ হাজার থাকতে পারে এই ভূগর্ভস্থিত শহরে।
তোমরা এই শহর তৈরি করলে কী করে? উপাদান কোথায় পেলে? তোমাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার উপাদান কোথা থেকে পাও?
আমরা আমাদের ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে অনেক কিছু করতে পারি। কোনও কিছুর প্রয়োজন হলে আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে সেটা পাবার ইচ্ছা করি। তার ফলে সেটা আমরা পেয়ে যাই। যেসব জিনিসের প্রয়োজন অল্পকালের জন্য, তার স্থায়িত্বও হয় অল্পকাল। যেমন এই চলন্ত সিঁড়ি। সিড়ির কোনও প্রয়োজন আমাদের হয় না। ওটা আমরা ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে শুধু তোমাদের প্রয়োজনের জন্য তৈরি করেছি। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ওটা আর থাকবে না। তা ছাড়া রসায়ন আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করে।
প্রকৃতির সঙ্গে তোমাদের কী সম্পর্ক? ক্রোল জিজ্ঞেস করল।
কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা জানি প্রকৃতির উপর নির্ভর করা বিপজ্জনক। পৃথিবীতে বহু জায়গায় বহুবার দুৰ্ভিক্ষ হয়েছে, তার কারণ অনাবৃষ্টির ফলে ফসলের অভাব। সেইরকম অতিবৃষ্টিতে বন্যা হয়েছে, মানুষের ঘর ভেসে গেছে, বহু মানুষ মরেছে। অর্থাৎ প্রকৃতি মানুষকে হতাশ করেছে, মানুষ তার জন্য কষ্ট পেয়েছে। আমাদের সে সমস্যা নেই।
তোমরা অবসর সময়ে কী করা? তোমাদের সংগীত নেই, খেলা নেই, সাহিত্য নেই?
আমাদের কোনও অবসরই নেই। আমরা সব সময়ই নিজেদের আরও অগ্রসর করতে চেষ্টা করি। আমরা যে স্তরে আছি, মানুষের সেখানে পৌঁছোতে আরও দুহাজার বছর লাগবে।
সন্ডার্স জিজ্ঞেস করল, হোয়াট অ্যাবাউট অ্যানিম্যালস, বার্ডস, ইনসেক্টস অ্যান্ড আদার ফর্মস অব লাইফ?
উত্তর এল; সেসব কিছু নেই। শুধু আমরা আছি আমাদের উন্নত জ্ঞান নিয়ে।
কিন্তু মশা তো রয়েছে তোমাদের দ্বীপে, বলল সন্ডার্স।
মশা?
হ্যাঁ। একরকম ইনসেক্ট। জান না?
এই প্রথম নাম শুনলাম।
আমি মনে মনে ভাবলাম—তা হলে এখানে চেয়ারে বসেও সাবাটিনি হাত চুলকোচ্ছে কেন? এখন মনে হচ্ছে যেন আসবার পথেও মাঝ সমুদ্রে সাবাটিনিকে মশা মারার চেষ্টা করতে দেখেছি। আমরা আসার পথে একটা দ্বীপে থেমেছিলাম। এঞ্জিনটাকে একটু বিশ্রাম দেবার জন্য। সেখান থেকেই মশার আমদানি হয়নি তো?
আমরা যাতে বসেছি, সেটা কী ধাতুর তৈরি? প্রশ্ন করল সুমা।
উত্তর এল; সোনা।
আশ্চর্য! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণখণ্ড হল তুতানখামেনের শবাধার। কিন্তু এই টেবিল তো তার চেয়ে অনেক বড়।
এখানে স্বর্ণখনি আছে? জিজ্ঞেস করল ক্রোল।
না। সোনা আমরা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করি। আমাদের সব যন্ত্রপাতিই সোনার তৈরি। এখানে সোনার কোনও মূল্য নেই। আমরা জানি মানুষের মধ্যে আছে।
সাবাটিনি ধরা গলায় বলল, সোনা তৈরির ফরমুলা আছে তোমাদের কাছে?
নিশ্চয়ই। না হলে তৈরি হয় কী করে?
ক্রোল বলল, আমাদের তো একদিন না একদিন দেশে ফিরে যেতে হবে; তখন তো আমাদের এই অভিজ্ঞতার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তোমাদের অন্তত একজন প্ৰাণীকে কি আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব না? অল্প কয়েক দিনের জন্য? তারপর আবার তাকে ফেরত দিয়ে যাব।
এবারে একটা হাসির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর কথা এল—
সে যদি তোমাদের সঙ্গে যায়, তা হলে ফেরার কোনও সমস্যা নেই। যানবাহন ছাড়া চলাফেরা করার উপায় আমরা প্রথম থেকেই জানি।
তা হলে তোমাদের একজনকে দেবে আমাদের সঙ্গে?
বললাম তো—তার আকৃতি তোমরা সহ্য করতে পারবে না।
সে আকৃতি তোমরা বদলাতে পারবে না? এত কিছু পার, এটা পারবে না?
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর কথা এল—
আমাদের দুদিন সময় দাও। আজ বিদায়। যেভাবে এসেছি তোমরা সেভাবেই ফিরে যেতে পারবে।
ক্রোল বলল, কিন্তু একটা কথা তো জানা হয়নি।
কী?
আমরা যেমন মানুষ, তেমনি তোমাদের নাম কী?
সে নাম তোমাদের জিভে উচ্চারণ হবে না।
তা হলে ফিরে গিয়ে তোমাদের কী নামে উল্লেখ করব?
দু সেকেন্ড পরে উত্তর এল: অটোপ্লাজম।
আর এই শহরের নাম?
নোভোপলিস বলতে পার।
এবারে আমার একটা বলার ছিল, সেটা বলে নিলাম। প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের এখানে ব্যারাম নেই?
না।
তার মানে কোনও ওষুধও নেই?
না।
কিন্তু ব্যারামের সম্ভাবনা নেই সেটা কী করে বলছ? এর পরে যখন আসব। তখন আমার তৈরি ওষুধ মিরাকিউরলের বেশ কিছু বড়ি সঙ্গে করে এনে এই টেবিলের উপর রেখে দেব। যদি ব্যারাম হয়, তা হলে সেটা খেলে সেরে যেতে বাধ্য।
আমি অবশ্য ক্রিস্টোবাল্ডির ভবিষ্যদ্বাণীর কথাটা ভেবেই এটা বললাম।
এরপরে আমরা গোলাঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। এরা এয়ারকন্ডিশনিংটা ভালই রপ্ত করেছে, কারণ মাটির নীচে হলেও আমরা অতি আরামদায়ক ঠাণ্ডা উপভোগ করেছি।
সিঁড়ির কাছে এসে দেখি, সেটা এখন নীচ থেকে উপর দিকে যাচ্ছে।
বিচিত্ৰ মনোভাব নিয়ে আমরা ক্যাম্পে ফিরলাম।
সাবাটিনি বলল, এখনও কিন্তু প্ৰমাণ পাওয়া যায়নি যে, এরা মানুষ নয়।
সেটা অবশ্য ঠিক, বলল ক্রোল।
এরা সবটাই মিথ্যে বলে থাকতে পারে। খাদ্যের সমস্যা এরা কীভাবে সমাধান করেছে। সেটা অবিশ্যি বোঝা গেল না। কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে মাটির নীচে গাছপালা ফুল ফল সবই গজানো যায়।
আর সোনার ব্যাপারটা? সুমা জিজ্ঞেস করল।
সাবাটিনি একটা বিদ্যুপের হাসি হেসে উঠল।
তুমি কি বিশ্বাস করলে ওই চেয়ার টেবিল সোনার তৈরি?
গোল্ড হ্যাজ এ স্পেশাল কাইন্ড অব ম্মেল, বলল সুমা। আমি চেয়ার টেবিল থেকে সে গন্ধ পেয়েছি।
হোয়াট! সোনার গন্ধ! আমি এমন কথা কস্মিনকালেও শুনিনি।
আমি জানি। আমি জেনেশুনেই বলছি, ঈষৎ রাগতভাবে বলল সুমা।
আমি দুজনকে ঠাণ্ডা করলাম। তারপর বললাম, এরা মানুষই হোক আর নতুন প্রাণীই হোক, এরা যখন একশো বছর আগে লেসার রশ্মি আবিষ্কার করেছে, তখন এদের বিজ্ঞান যে অন্য মানুষের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর সেটা স্বীকার করতেই হবে।
অক্টোবর ৬
আজ আমাদের অটোপ্লাজমদের ব্যাপারে কিছু করার নেই। আগামীকাল ওরা কী স্থির করল সেটা জানতে পারব। আমরা পাঁচজনে লোগোস খেলে আর সমুদ্রে স্নান করে সময় কাটালাম। আমার মন কিন্তু বলছে এরা মানুষ নয়, এবং এরা যা বলছে তা সবই সত্যি।
সন্ধ্যায় যথারীতি লেসারস্তম্ভ জ্বলে উঠল। আমরা এদের কাছ থেকে কোনওরকম খবর বা বিবৃতি আশা করছিলাম না, কিন্তু আলোকস্তম্ভ জ্বলার একটু পরেই পরিচিত কণ্ঠে ঘোষণা শুনলাম।
কাল আলো জ্বলার আধঘণ্টার মধ্যে তোমরা চলে এসো। যেমনভাবে এসেছিলে তেমনভাবেই আসবে, যে ঘরে বসেছিলে সে ঘরেই বসবে। কী সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা তখনই বলব।
ঘোষণা বন্ধ হবার পর ক্রোল বলল, এমনও তো হতে পারে যে আমাদের দেশের কিছু বিজ্ঞানী দেশে আমল না পেয়ে জেদের বশে এখানে এসে ডেরা বেঁধেছে?
কিন্তু দেখলে তো এসক্যালেটর? বলল সন্ডার্স। এইসব জিনিস তৈরি করার জন্য তো নানারকম ধাতু, লোকজন, যন্ত্রপাতি ইত্যাদির প্রয়োজন। এসব এরা পেল কী করে?
ইচ্ছাশক্তির কথাটা ভুলো না সন্ডার্স? আমি মনে করিয়ে দিলাম। সত্যিই যদি এদের তেমন উইলপাওয়ার থাকে, তা হলে তার জোরে অনেক কিছুই সম্ভব।
দেখা যাক এরা কাল কী বলে, বলল সুমা।
অক্টোবর ৭
সন্ধ্যাবেলা লেসার রশ্মিটা কখন জ্বলে তার একটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছিল আমাদের। আজ তাঁর আধঘণ্টা আগে রওনা হয়ে পৌঁছোবার ঠিক আগেই আলোকস্তম্ভটা জ্বলে উঠল। তারপর কণ্ঠস্বর শোনা গেল : তোমরা চলে এসো।
আমরা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার সেই গোলাঘরে গিয়ে হাজির হলাম।
কী স্থির করলে? প্রশ্ন করল ক্রোল।
আমাদের একজন লোক তোমাদের সঙ্গে দেব। তার আকৃতি হবে মানুষের মতো। পোশাকেও তোমাদের সঙ্গে কোনও তফাত করা যাবে না। কেবল বুদ্ধি হবে ওর আটোপ্লাজমের মতো।
ও কি ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারবে?
না; কারণ একজনের ইচ্ছাশক্তিতে কোনও ফল হয় না। তোমাদের জন্য চলন্ত সিঁড়িটা তৈরি করতে আমাদের পঞ্চাশজনের উইলপাওয়ার দরকার হয়েছিল।
তা হলে তো আর বেশিদিন এখানে থেকে লাভ নেই বলল সন্ডার্স। আমরা পরশুই সকালে বেরিয়ে পড়তে পারি।
কাল তোমরা তা হলে এই সময়েই এসো।
ঠিক আছে।
অক্টোবর ৯
আমরা আজ সকাল সাড়ে আটটায় রওনা হচ্ছি। চটপট কালকের ঘটনাটা বলে নিই।
কাল সন্ধ্যায় আবার সেই গোলাঘরে গিয়ে পৌঁছোতে কথা শোনা গেল।
তোমরা যেই পথ দিয়ে এলে, সেই পথ দিয়েই আমাদের প্রতিভূ। তোমাদের কাছে যাচ্ছে। একে তোমরা অ্যাডাম বলে ডেকে। কারণ এ আমাদের তৈরি প্রথম মানুষ। আবুজরুরি কথা তোমাদের মনে রাখতে হবে।
কী?
তোমাদের এখান থেকে দেশে ফিরতে কত দিন লাগবে?
তিন সপ্তাহ পরে আমরা লন্ডনে পৌঁছেবি।
যেদিন পৌঁছোবে, সেদিন থেকে ধরে সাত দিনের জন্য অ্যাডাম মানুষের আকৃতি নিয়ে থাকতে পারে। সাত দিন শেষ হলেই সে আপনিই আমাদের এখানে ফিরে আসবে। আমার বিশ্বাস তারমধ্যে তোমাদের কাজ হয়ে যাবে। ওকে তোমরা আসতে বাধা দিও না। মনে রেখে—ও বলপ্রয়োগ করে কিছু করতে পারবে না। অটোপ্লাজম অহিংস প্রাণী। অ্যাডাম নিরস্ত্র অবস্থায় যাচ্ছে তোমাদের সঙ্গে।
যদি দেরি হয়ে যায় তা হলে কী হবে?
তার ফল ভাল হবে না। এর বেশি আমি আর কিছু বলব না। আমি লক্ষ করছি তোমরা কেউ কেউ হাতে আংটি পর। আমি অ্যাডামের হাতে পাঁচটা সোনার আংটি পাঠিয়ে দিচ্ছি-পিওর গোল্ড; টুয়েন্টি-ফোর ক্যারাট। তোমরা সেগুলি গ্রহণ করলে খুশি হব।
জুতোর শব্দ পেয়ে পিছনে ফিরে দেখি, আমরা যে পথ দিয়ে এসেছি। সে পথ দিয়ে একজন সুদৰ্শন শ্বেতাঙ্গ যুবক প্রবেশ করল।
গুড ইভনিং জেন্টলমেন, মাই নেম ইজ অ্যাডাম।
ক্রোল যেন বেশ অবাক হয়েই বলল, কিন্তু তুমি আসলে এখানকার প্রাণী তো?
ইয়েস। আই অ্যাম অ্যান অটোপ্লাজম।
তোমাকে কিন্তু আমাদের দেশের বিজ্ঞানীরা নানারকম প্রশ্ন করবে। তুমি তার জবাব দিতে পারবে তো?
আমার বিশ্বাস আমি পারব।
তা হলে কাল সকালে আমরা আমাদের দেশে ফিরে যাচ্ছি। আজ রাতটা তুমি প্রোফেসর সাবাটিনির ক্যাম্পে ঘুমোবে।
আমরা ঘুমোই না।
যাই হোক, কাল সকালে আমরা রওনা দেব। লন্ডন শহরে সাত দিন থেকে তুমি আবার তোমার দেশে ফিরে আসবে।
সবশেষে আমি পকেট থেকে একটা বড় বোতলে রাখা এক হাজার মিরাকিউরলের বড়ি টেবিলের উপর রেখে বললাম, এই রইল ওষুধ। আশা করি তোমাদের কোনও ব্যারাম হবে না। কিন্তু যদি হয়, তা হলে এই ওষুধ খেলে বুঝতে পারবে যে মানুষও একেবারে পিছিয়ে নেই।
সন্ডার্স ডাকছে। সুমাক্রাফট রেডি।
অক্টোবর ১১
এই দুদিন দেখে বুঝেছি অ্যাডাম ছেলেটি অত্যন্ত ভদ্র। আমাদের সকলকে সমীহ করে চলে। সেইসঙ্গে এটাও দেখছি যে লোগোস খেলায় তার মতো অসাধারণ ক্ষমতা আমাদের আর কারুর মধ্যে নেই। ও আমাদের চেয়ে এত বেশি ভাল যে, শেষে খেলা বন্ধ করে দিতে হল। এখন আমরা গল্পগুজব করে আর সুমার ক্যাসেটে বাজনা শুনে সময় কাটিয়ে দিচ্ছি।
সুমার ভিডিও ক্যামেরা ছিল, কিন্তু সেটা সে বারই করেনি। যদিও আমাদের সঙ্গে একটি অটোপ্লাজম চলেছে, তার সঙ্গে মানুষের কোনও তফাত নেই দেখে সুমা ছবি তোলার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে।
আমি অনেক ভেবে একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছি। সেটা হল—এরা যদি সত্যিই মানুষ না হয়, তা হলে এরা যতই উন্নত প্রাণী হোক না কেন, সুখ দুঃখ সকাল সন্ধ্যা চন্দ্ৰ সূৰ্য ফুল ফল রং রস খেলাধুলা পশু পাখি নিয়ে মানুষই ভাল।
নভেম্বর ২, লন্ডন
আমরা কাল এখানে এসে পৌঁছেছি। আজ অ্যালবার্ট হলে পঞ্চাশ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আর দুহাজার দর্শকের সামনে অ্যাডাম তার পরীক্ষা দিল।
প্রথমেই সুইডেনের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হানস রুডেলবাৰ্গকে অ্যাডাম ধরাশায়ী করল। রুডেলবার্গের সদ্যপ্রকাশিত কিছু গাণিতিক তথ্য অ্যাডাম প্রমাণ করে দিল যে, তাদের দেশে সত্তর বছর আগে থেকে সকলেই জানে। তারপর সে কতকগুলো তথ্যের উদাহরণ দিল, যেগুলো আমাদের গাণিতিকরা এখনও উদ্ভবই করেননি।
এবার লন্ডনের জীবতত্ত্ববিদ ডক্টর কিংকেড মঞ্চে উঠে অ্যাডামকে উদ্দেশ করে বললেন, বুঝতেই পারছি আপনাদের বিজ্ঞান খুবই উন্নত, কিন্তু আপনারা নিজেদের মানুষ নয় বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন কেন? আকৃতিতে তো আপনার সঙ্গে আমাদের একটি যুবকের কোনও পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি না। আপনি বলছেন, আপনাদের দ্বীপে আপনা থেকেই প্রাণীর উদ্ভব হয়েছিল; কিন্তু তার চেহারা মানুষের মতো কী করে হয়?
অ্যাডাম অত্যন্ত নম্রভাবে জানাল যে এটা তার আসল চেহারা নয়। আমাদের চেহারায় মানুষ অভ্যস্ত নয় বলে আমি মানুষের আকৃতি নিয়ে এসেছি।
দেড় ঘণ্টা চলল ব্যাপারটা। প্রোফেসর ম্যাংকিভিচ, প্রোফেসর বুনিয়াস, জন ডাকওয়র্থ, ডক্টর ভ্যাসিলিয়েফ, রিখটার শুলৎস ইত্যাদি ইত্যাদি বাঘা বাঘা পদার্থবিজ্ঞানী, প্রত্নতাত্ত্বিক, জীববিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী সকলেই অ্যাডামের কাছে হার স্বীকার করলেন। অ্যাডাম যথারীতি ভদ্র ও বিনীতভাবে তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। অবশেষে যিনি আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি-প্রোফেসর কার্টওয়েল-তিনি বললেন, আমরা একজন অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীর চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ব্যক্তির পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছি। এবং নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছি। আজকের দিনটি যে বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মিস্টার অ্যাডাম তাঁর আসল আকৃতি আমাদের কাছে প্রকাশ করলেন না, ফলে একটা সন্দেহ রয়ে গেল যে তিনি আসলে মানুষ, এবং মানুষ হয়েই বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছেছেন।
করধ্বনিতে অ্যালবার্ট হল ফেটে পড়ল।
আমরা অ্যাডামকে নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। সামনের তিন দিন ওকে ব্যস্ত থাকতে হবে : সাংবাদিক সম্মেলন আছে, গোটাতিনেক টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার আছে। আমি বারবার সকলকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, ৭ই সন্ধ্যার মধ্যে ওকে ছেড়ে দিতে হবে।
সাবাটিনি অন্য হোটেলে রয়েছে, সে একদিন অ্যাডামকে খাওয়াতে চায়। খাওয়ার ব্যাপারে অ্যাডামকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাকে এমনভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে, সে দিব্যি মানুষের খাদ্য খেয়ে হজম করছে।
ঠিক হল পরশু, অৰ্থাৎ ৪ঠা নভেম্বর, সকালে টেলিভিশন ইন্টারভিউ-এর পর সাবাটিনি অ্যাডামকে তার হোটেলে নিয়ে যাবে খাওয়ানোর জন্য। সাবাটিনি বলল যে তার দু-তিনটে সিটিং লাগবে অ্যাডামের সঙ্গে, কারণ ম্যাড্রিড ফিরে গিয়ে সে ওখানকার স্প্যানিশ কাগজে অটোপ্লাজম সম্বন্ধে বড় করে লিখতে চায়।
নভেম্বর ৪
কাল সাংবাদিক সম্মেলনের ফলে আজ সব খবরের কাগজে বিস্তারিতভাবে অ্যাডামের খবর বেরিয়েছে। তার চেহারা যে হুবহু মানুষের মতো, তাতে অটোপ্লাজম সম্বন্ধে অনেকেই সন্দেহ প্ৰকাশ করেছে। তবে এটা সকলেই বলেছে যে, এমন একটি অসাধারণ মেধাবী যুবকের এইভাবে আত্মপ্রকাশ একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
আমরা অ্যাডামকে যথাসম্ভব। আগলে রাখছি। সাবাটিনি ওকে নিয়ে যেতে চাইলেও আমরা সে ব্যাপারে খুব উৎসাহ প্রকাশ করছি না। আরেকটা সিটিং সাবাটিনিকে দিতেই হবে, ও হোটেলে ডিনারের পর। সাক্ষাৎকারের পর সাবাটিনি বলেছে, সে নিজেই অ্যাডামকে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাবে।
নভেম্বর ৬
ক্রোল, সন্ডার্স এবং আমি-তিনজনেই গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি।
কাল রাত্রে ডিনারের পর সাবাটিনির কাছ থেকে অ্যাডাম আমাদের হোটেলে ফেরেনি। সাবাটিনি যে এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন সেটা আমি বুঝিনি। আজ সকালে ওর হোটেলে ফোন করে জানলাম যে, সাবাটিনি আজ ভোরে হোটেল ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেছে। আমরা তিন জন বহু হোটেলে টেলিফোন করেও সাবাটিনির সন্ধান পাইনি। অথচ কাল সাত তারিখ। কাল সন্ধ্যায় অ্যাডামকে ছেড়ে দিতে হবে। আজ একটা খবরের কাগজ থেকে একটা বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য ফোন করেছিল; তাকেও না করে দিতে হয়েছে।
আজকে আশা করি কোনও সময় সাবাটিনি না হোক, অন্তত অ্যাডাম ফিরে আসবে।
নভেম্বর ৭
ভয়ংকর ঘটনা। এখনও তার জের কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সন্ডার্স অনেক অনুসন্ধানের পর জানতে পারে যে, লন্ডনের বাইরে সাসেক্সে সাবাটিনির এক বন্ধু থাকেন। তিনিও স্প্যানিশ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ শেখান। সন্ডার্সের বিশ্বাস; সেখানে সাবাটিনি এবং অ্যাডাম-দুজনেরই খোঁজ পাওয়া যাবে।
আমি বললাম, তা হলে এক্ষুনি চলো। এখন সোয়া তিনটে। আজ সাড়ে ছটার মধ্যে অ্যাডামকে নোভোপলিস ফিরতে হবে।
ঠিকানা অবশ্যই সন্ডার্স জোগাড় করে এনেছিল। আমরা যখন যথাস্থানে হাজির হলাম, তখন প্রায় সন্ধে। দোতলা বাড়ি, সামনে একটা ছোট্ট বাগান। সামনের দরজায় বেল টিপতে একজন চাকর এসে দরজা খুলেই বলল, প্রোফেসর আলভারেজ শহরে নেই, প্যারিসে গেছেন।
আমরা প্রোফেসর সাবাটিনির খোঁজ করতে এসেছি। বলল ক্রোল।
উনি ব্যস্ত আছেন।
তা হোক। আমাদের ওঁর সঙ্গে বিশেষ দরকার।
কথাটা বলতে বলতেই ক্রোল গায়ের জোরে চাকরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।
চাকর আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ওপরে যাবার হুকুম নেই।
নিশ্চয়ই আছে, ক্রোল তার রিভলভার বার করে চাকরের দিকে তাগ করে বলল।
কিন্তু… কিন্তু ওনার ঘরের দরজা বন্ধ।
কোথায় ঘর?
দোতলায়, কাঁপতে কাঁপতে বলল চাকর।
আমরা দোতলায় উঠে গিয়ে ডানদিকে একটা বন্ধ দরজা দেখলাম। ক্রোল তাতে ধাক্কা দিল। একবার, দুবার। কোনও ফল হল না। সাবাটিনি! সাবাটিনি! গলা চড়িয়ে বলল ক্রোল।
কোনও উত্তর নেই।
এবার ক্রোল দরজার কাছে মুখ এনে বলল, সাবাটিনি, শেষবারের মতো বলছি। দরজা খোলো, না হলে আমরা দরজা ভেঙে ঢুকব।
তাতেও যখন কোনও ফল হল না। তখন ক্রোল দরজার অগলের দিকে তাগ করে রিভলভারের ঘোড়া টিপে দিল। প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে দরজা ফাঁক হয়ে গেল, আর আমরা তিন জন হুড়মুড়িয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলাম।
আশ্চর্য দৃশ্য। দুটো মুখোমুখি চেয়ার—একটাতে আমাদের দিকে পিঠ করে বসে আছে সাবাটিনি, অন্যটায় হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় অ্যাডাম।
আমাদের ঢুকতে দেখে সাবাটিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, আর দু মিনিটের মধ্যে আমি জেনে ফেলতে পারতাম, আর তোমরা সব ভণ্ডুল করে দিলে।
কী জেনে ফেলতে? জিজ্ঞাসা করল। সন্ডার্স।
দ্য ফরমুলা ফর মেকিং গোল্ড! ঘর কাঁপিয়ে বলল সাবাটিনি।
আমি কোনওদিনও বলতাম না, দৃঢ়স্বরে বলল অ্যাডাম। নেভার, নেভার, নেভার—
এই তৃতীয় নেভার-এর সঙ্গে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। অ্যাডামের সুপুরুষ আকৃতি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বদলে গিয়ে তার বদলে সেখানে এক বিকটদৰ্শন চোখসর্বস্ব দাঁতসর্বস্ব, নখসর্বস্ব প্রাণীর আবির্ভাব হল। এমন ভয়ংকর কোনও আকৃতি কল্পনাও করা কঠিন। সাবাটিনি সেটা দেখেই অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। ক্রোল মাইন গট!-বলে আর্তনাদ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এক সন্ডার্সেরই দেখলাম আশ্চর্য সাহস। সে ঘরে থেকে গিয়ে বলল, বাঁধনগুলো খুলে দাও, শঙ্কু।
আমি এগিয়ে গিয়ে প্রাণীর হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দিলাম। প্রাণীটা রক্তবর্ণ বিশাল চোখ আমাদের দিকে ঘুরিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ।
তারপর প্রাণীটা তার লোমশ সরু সরু পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, টেলিপ্যাথিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল আমাদের দেশের প্রাণীর সঙ্গে। মশা থেকে আমাদের দেশে ব্যারাম দেখা দিয়েছে। মনে হয় তোমার ওষুধ না হলে কেউই বাঁচত না।–আমি তা হলে আসি।
শেষ কথাটার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি মনে মনে বললাম, ক্রিস্টোবান্ডির ভবিষ্যদ্বাণী নির্ভুল প্রমাণিত হল।
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৯৬
ডাঃ দানিয়েলির আবিষ্কার (প্রোফেসর শঙ্কু)
১৫ এপ্রিল, রোম
কাল এক আশ্চর্য ঘটনা। এখানে আমি এসেছি। একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে। কাল স্থানীয় বায়োকেমিস্ট ডাঃ দানিয়েলির বক্তৃতা ছিল। তিনি তাঁর ভাষণে সকলকে চমৎকৃত করে দিয়েছেন। অবিশ্যি আমি যে অন্যদের মতো অতটা অবাক হয়েছি তা নয়, কিন্তু তার কারণটা পরে বলছি।
দানিয়েলির আশ্চর্য ভাষণের কথা বলার আগে একটা কথা বলা দরকার। বিখ্যাত ইংরাজ লেখক রবার্ট লুই স্টিভেনসনের উপন্যাস ডাঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড-এর কথা অনেকেই জানে। যারা জানে না তাদের জন্য বলছি যে, ডাঃ জেকিল বিশ্বাস করতেন প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা ভাল আর একটা মন্দ দিক থাকে। এই মন্দ প্রবৃত্তিগুলো মানুষ দমন করে রাখে, কারণ তাকে সমাজে বাস করতে হলে সমাজের কতকগুলো নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু ডাঃ জেকিল দাবি করেছিলেন তিনি এমন ওষুধ বার করতে পারেন, যে ওষুধ কেউ খেলে তার ভিতরের হীন প্রবৃত্তিগুলো বাইরে বেরিয়ে এসে তাকে একটা নৃশংস। জীবে পরিণত করবে। ডাঃ জেকিলের এ কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, তাই তিনি তাঁর গবেষণাগারে ঠিক এইরকমই একটা ওষুধ তৈরি করে নিজের উপর প্রয়োগ করে এক ভয়ংকর মানুষ মিঃ হাইডে পরিণত হয়েছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি খুনও করেছিলেন, যদিও ডাঃ জেকিল। এমনিতে ছিলেন অতি সজন ব্যক্তি।
স্টিভেনসনের এই উপন্যাস যথেষ্ট আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু এমন ওষুধ বাস্তবে আজ পর্যন্ত কেউ তৈরি করতে পারেনি। দানিয়েলি দাবি করছেন তিনি করতে চলেছেন, এবং দানিয়েলির আগেই গিরিডিতে আমার ল্যাবরেটরিতে আমি করেছি। আমার ওষুধ আমি নিজে খাইনি, কিন্তু আমার পোষা বেড়াল নিউটনকে এক ফোটা খাইয়েছিলাম। খাওয়ানোর তিন মিনিটের মধ্যে সে আমাকে অত্যন্ত হিংস্রভাবে আক্রমণ করে আমার ডান হাতে আচড় দিয়ে আমাকে জখম করে। আমি আমার ওষুধের নাম দিয়েছিলাম এক্স। একই সঙ্গে অ্যান্টি-এক্স নামে আরেকটা ওষুধ বার করি যেটা এক্স-এর অ্যান্টিডেট; অর্থাৎ যেটা খেলে মানুষ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। নিউটনকে অ্যান্টি-এক্স খাইয়ে শান্ত করতে হয়েছিল।
দানিয়েলির বক্তৃতার সময় তাঁর অবস্থা জেকিলের মতোই হয়েছিল। অন্তত তিনজন বৈজ্ঞানিক-ইংলন্ডের ডাঃ স্টেবিং, জার্মানির প্রোফেসর ক্রুগার ও স্পেনের ডাঃ গোমেজ—দানিয়েলির কথার তীব্র প্রতিবাদ করেন। ফলে মিটিং-এ একটা তুমুল বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। দানিয়েলির পক্ষে তাঁর মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এমনিতে দানিয়েলির সঙ্গে আমার এখানে এসেই আলাপ হয়েছে। অত্যন্ত বিনয়ী, নম্র স্বভাবের লোক বলে মনে হয়েছিল। অনেক দিন পরে একটা বিজ্ঞানী সম্মেলনে আজকের মতো একটা গোলযোগ হতে দেখলাম। আমি অবিশ্যি আমার নিজের ওষুধের কথা দানিয়েলি বা অন্য কাউকে বলিনি। দানিয়েলি বললেন, তাঁর ওষুধ দু-একদিনের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। তারপর সেটা তিনি নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখবেন, যেমন স্টিভেনসনের গল্পে ডঃ জেকিল করেছিলেন। ব্যাপারটা আমার ভাল লাগল না, কারণ এক্সপেরিমেন্ট যদি সফল হয়, তা হলে ওষুধ খাওয়া দানিয়েলি কীরকম ব্যবহার করবে তা বলা কঠিন। নিউটনের যা হিংস্ৰ ভাব দেখেছি তাতে আমার রীতিমতো ভয় ঢুকে গেছে।
আজ আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই ডেলিগেটদের লাঞ্চ আছে। আমরা আছি হোটেল সুপিাবাঁতে। এইখানেই একতলায় ডাইনিংরুমে লাঞ্চ। সম্মেলন চলবে। আর দু দিন। তারপর আরও দিন দু-তিন রোমে থেকে দেশে ফিরব।
১৭ এপ্রিল
আজ সম্মেলনের পর দানিয়েলির সঙ্গে দেখা করলাম। বললাম, তাঁর বক্তৃতায় তিনি যা বলেছেন তা আমি বিশ্বাস করি। আমারও একই মত। তাতে ভদ্রলোক যারপরনাই খুশি হলেন।
আমি বললাম, তুমি যে ওষুধ বানোচ্ছ, সেইসঙ্গে তার প্রভাব দূর করার জন্যও ওষুধ তৈরি করছি। আশা করি।
তা তো বটেই বললেন দানিয়েলি। এ ব্যাপারে। আমি স্টিভেনসনের উপন্যাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। এতদিন কেন যে কেউ এরকম একটা ওষুধ তৈরি করতে চেষ্টা করেনি, তা জানি না।
আমি বললাম, তার কারণ স্টিভেনসনের গল্পেই পাওয়া যাবে। যদি সেই ওষুধ মিঃ হাইডের মতো এমন মানুষ তৈরি করতে পারে, তা হলে সে ওষুধ খাওয়ার কী বিপদ সে তো বুঝতেই পারছি।
কিন্তু তা বলে তো বিজ্ঞানকে থেমে থাকতে দেওয়া যায় না, বলল দানিয়েলি। পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতেই হবে। এবং আমার পরীক্ষা যদি সফল হয় তা হলে তার পরিণাম যাই হোক না কেন, এটা মানতেই হবে যে সেটা হবে বিজ্ঞানের অগ্রগতির একটা নিদর্শন।
তবে তুমি যদি একটা হাইডে পরিণত হও, তা হলে ব্যক্তিগতভাবে আমার সেটা মোটেই ভাল লাগবে না।
দেখা যাক কী হয়।
তুমি কী কী উপাদান দিয়ে ওষুধটা তৈরি করেছ, সেটা জানতে পারি কি?
ভদ্রলোক যা উত্তর দিলেন তা শুনে আমি একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করলাম।
আমিও ঠিক একই উপাদান দিয়ে আমার ওষুধটা তৈরি করেছি।
সেটা অবিশ্যি আর দানিয়েলিকে বললাম না, এবং দানিয়েলিও তাঁর উপাদানের পরিমাণ আমাকে বললেন না।
১৮ এপ্রিল
আজ কাগজে সাংঘাতিক খবর।
ডাঃ স্টেবিংকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমাদের হোটেলটা টাইবার নদীর উপর। স্টেবিং নাকি রোজ ডিনারের আগে টাইবারের ধারে হাঁটতে যেতেন। আজও গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফেরেননি। পুলিশ সন্দেহ করছে শুনি কোনও গুণ্ডার দ্বারা নিহত হয়েছেন, এবং গুণ্ডার তাঁর মৃতদেহ টাইবারের জলে ফেলে দিয়েছে।
আমার কিন্তু ধারণা অন্যরকম। স্টেবিং দানিয়েলির বক্তৃতার পর তার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং দানিয়েলিকে অবৈজ্ঞানিক আখ্যা দেন। দানিয়েলিও বলেছিলেন, তাঁর ওষুধ দু দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে।
আমি টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে দেখলাম যে দানিয়েলির বাড়ির ঠিকানা হচ্ছে ২৭ নং ভিয়া সাক্রমেন্টো। আমি আর দেরি না করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা তার বাড়িতে চলে গেলাম।
বাড়ি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না, কিন্তু গিয়ে শুনি দানিয়েলি বাড়ি নেই। দানিয়েলির চাকর দরজা খুলেছিল; আমাকে জিজ্ঞেস করল, সিনিয়র আলবের্তির সঙ্গে কথা বলবেন?
তিনি কে?
তিনি প্রোফেসর দানিয়েলির সহকর্মী।
আমি বললাম, বেশ, তাঁকেই ডাকো।
চাকর চলে গেল। দু মিনিটের মধ্যেই একটি বছর ত্ৰিশের যুবক বৈঠকখানায় এসে ঢুকাল। কালো চুল, কালো চোখ, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।
তুমি কি দানিয়েলির সহকর্মী?
সহকর্মীর চেয়ে সহকারী বললেই ঠিক হবে। আমি মাত্র তিন বছর দানিয়েলির সঙ্গে আছি। আপনি কি ভারতীয় বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কু?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
যুবকের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, আমি আপনার বিষয়ে অনেক শুনেছি। আপনার আবিষ্কার সম্বন্ধে অনেক পড়েছি। আপনার দেখা পেয়ে অত্যন্ত গর্ব বোধ করছি।
আমি বললাম, সে কথা শুনে আমারও খুব ভাল লাগছে। কিন্তু আমি ডাঃ দানিয়েলির সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। তিনি কখন আসবেন?
যে কোনও মুহুর্তে বলল আলবের্তি। তিনি বাজারে গেছেন কিছু কেনাকাটা করতে। আপনি একটু বসে যান।
আমি অপেক্ষা করাই স্থির করলাম। সময় কাটানোর জন্য আলবের্তিকে প্রশ্ন করলাম, প্রোফেসরের ওষুধ কি তৈরি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, সে তো পরশুই হয়ে গেছে। বলল আলবের্তি, তারপর থেকেই প্রোফেসর কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। সামান্য একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি তাঁর মধ্যে। সেটা যে কী সেটা স্পষ্টভাবে বলতে পারব না।
তিনি কি ওষুধটা খেয়েছেন?
তা তো বলতে পারছি না। ওষুধটা উনি সম্পূর্ণ নিজে তৈরি করেছেন। আমি ওঁকে কোনওরকমভাবে সাহায্য করিনি। ওষুধের ফরমুলাও আমি জানি না। তবে ওষুধটা যে হয়ে গেছে সেটা উনি আমাকে বলেছেন। অবিশ্যি না বললেও আমি বুঝতাম, কারণ গত এক মাস উনি সারাদিন ল্যাবরেটরিতে কাজ করেছেন দরজা বন্ধ করে। দুদিন থেকে ওঁকে আর কাজ করতে দেখছি না।
দরজার ঘণ্টা বেজে উঠল। চাকর এসে দরজা খুলে দিতে দানিয়েলি হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে ঢুকলেন।
গুড মর্নিং প্রোফেসর শঙ্কু। দিস ইজ এ ভেরি প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!
আমিও ভদ্রলোককে প্রত্যাভিবাদন জানালাম। বললাম, খবর না দিয়ে এসে পড়েছি বলে আশা করি কিছু মনে করছ না।
মোটেই না, মোটেই না। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। তারপর কী খবর বলো।
খবর তো তোমার-তোমার ওষুধের খবর। ওটা তৈরি হল?
হয়েছে বই কী। পরশুই রাত্রে হয়েছে তৈরি।
পরীক্ষা করে দেখেছ?
আমি চায়ের চামচের এক চামচ খেয়ে দেখেছি।
তারপর?
তারপর কী হল জানি না।
তার মানে?
মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। সকালে উঠে দেখি আমার বিছানায় শুয়ে আছি। শরীরে কোনও গ্লানি নেই। রাত্রে কী ঘটেছে কিছু জানি না।
আজ কাগজে স্টেবিং-এর মৃত্যুসংবাদ পড়েছ?
পড়েছি বই কী—আর পড়ে অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছি। যদিও সে আমার বক্তৃতার প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু সে অত্যন্ত উচ্চস্তরের বিজ্ঞানী ছিল।
স্টেবিং-এর মৃত্যু সম্বন্ধে তুমি কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ?
এ তো বোঝাই যাচ্ছে স্থানীয় গুণ্ডাদের কীর্তি। তাকে মেরে শুনলাম টাইবারের জলে লাশ ফেলে দিয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই অবিশ্যি সে লাশ আবার ভেসে উঠবে।
আমি আর দানিয়েলির সময় নষ্ট করলাম না। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। দানিয়েলির ওষুধ খাওয়ার কথাটা এখনও মাথায় ঘুরছে। সে যে কিছুই টের পেল না, এটা খুব আশ্চর্য ব্যাপার। আমার ওষুধেও কি এই একই প্রতিক্রিয়া হবে? নিউটন যে আমাকে আক্রমণ করে, সেটা কি সে অজান্তে করে?
১৯ এপ্রিল
কাল রাত্রে সাড়ে এগারটার সময় জার্মানির প্রোফেসর ক্রুগার আর স্পেনের ডাঃ গোমেজ খুন হয়েছেন তাঁদের ঘরে। সেইসঙ্গে টাইবার নদীতে স্টেবিং-এর লাশও পাওয়া গেছে। লাশের গলায় আঙুলের গভীর দাগ। অর্থাৎ তাকে গলা টিপে মারা হয়েছিল।
এবার আর আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। তিনটে খুনই দানিয়েলির কীর্তি। পুলিশ অবশ্য তদন্ত করছে। ক্রুগার বা গোমেজের কোনও টাকা পয়সা চুরি যায়নি। কাজেই এটা চোরডাকাতের কীর্তি নয়।
পুলিশ আমাদের হোটেলের রিসেপশনিস্টকে জেরা করে জানতে পারে যে, কাল রাত্রে এগারোটার সময় একটি কুৎসিত লোক নাকি হোটেলে এসে ক্রুগার আর গোমেজের ঘরের নম্বর জানতে চায়। তারপর সে দুজনকেই টেলিফোন করে।
কী কথা বলেছিল সেটা শুনেছিলে? পুলিশ জিজ্ঞেস করে।
আজ্ঞে না, তা শুনিনি।
ক্রুগার আর গোমেজ দুজনকেই স্টেবিং-এর মতোই গলা টিপে মারা হয়েছে। আততায়ী যে অত্যন্ত শক্তিশালী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ দানিয়েলিকে দেখলে তার মধ্যে শারীরিক শক্তির কোনও লক্ষণ পাওয়া যায় না। ওর বয়সও হয়েছে অন্তত ষাট।
সে নিজেই ফোন ধরল। শান্ত কণ্ঠস্বর। কোনও উত্তেজনার লেশমাত্র নেই। আমি ফোন করছি শুনে অত্যন্ত হৃদ্যতার সঙ্গে আমি এবার দানিয়েলির বাড়িতে একটা ফোন করলাম। আমাকে অভিবাদন জানোল। আমি বললাম, আমি একবার তোমার বাড়িতে আসতে চাই।
এক্ষুনি চলে এসো, বলল দানিয়েলি। আমি সারা সকাল বাড়িতে আছি।
দশ মিনিটে দানিয়েলির বাড়িতে হাজির হলাম। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে করমর্দন করে আমায় সোফায় বসতে বলে বলল, বলো কী খবর।
আমি বসে বললাম, তুমি কি কাল রাত্রে আবার ওষুধটা খেয়েছিলে?
হঁয়া, এবং সেই একই প্রতিক্রিয়া, বলল দানিয়েলি। ওষুধ খাবার পরে কী করেছি, কোথায় ছিলাম, কখন ফিরলাম-কিছুই মনে নেই।
এক চামচই খেয়েছিলে?
হ্যাঁ।
তুমি বোধ হয় জান যে কাল ক্রুগার আর গোমেজ খুন হয়েছে, এবং স্টেবিং-এর লাশ পাওয়া গেছে।
জানি।
এরা তিন জনেই কিন্তু তোমার বক্তৃতায় ঘোর আপত্তি তুলেছিল।
তাও জানি।
আমার একটা কথা শুনবে?
কী?
ওষুধটা আর খেও না। তুমি যখন নিজে কিছুই অনুভব করছ না, তখন খেয়ে লাভ কী? বিজ্ঞানের দিক দিয়ে তো তুমি কোনও জ্ঞান আহরণ করছ না। সত্যি বলতে কী, তুমি তো কিছুই জানতে পারছ না।
তা পারছি না, কিন্তু একটা যে কিছু হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিছু মনে করো না, কিন্তু আমার ধারণা এই তিনটে খুনের জন্যই তুমি দায়ী; অর্থাৎ তোমার ওষুধই দায়ী।
ননসেন্স।
ননসেন্স নয়। কেন সেটা আমি বলছি। আমি নিজে একই ওষুধ আবিষ্কার করেছি ভারতবর্ষে আমার ল্যাবরেটরিতে। আমি সেটা আমার পোষা বেড়ালের উপর পরীক্ষা করেছিলাম। ড্রপার দিয়ে এক ফোঁটা ওষুধ তার মুখে ঢেলে দিয়েছিলাম। তিন মিনিটের মধ্যে সে আমাকে আক্রমণ করে জখম করে। তার আধা ঘণ্টার মধ্যেই অবিশ্যি সে আমারই তৈরি একটা অ্যান্টিডোট খেয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
দানিয়েলি একটুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি লক্ষ করলাম, তার জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে। তারপর চাপা স্বরে সে বলল, তুমি আমার আগে এই ওষুধ আবিষ্কার করেছ?
হ্যাঁ।
আই ডোন্ট বিলিভ ইট।
দানিয়েলির কণ্ঠস্বরে এই প্রথম একটা তিক্ততার আভাস পেলাম। সে আবার বলল, আই ডোন্ট বিলিভ ইট।
আমি বললাম, তুমি বিশ্বাস না করতে পারো। কথাটা কিন্তু সত্যি। তুমি তোমার ওষুধের উপাদানের কথা আমাকে বলেছ, কিন্তু পরিমাণ বলনি। আমিও এই একই উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করেছি, এবং আমার পরিমাণ মুখস্থ আছে। সেটা আমি তোমাকে বলছি। দেখ তোমার সঙ্গে মেলে কি না।
আমার পুরো ফরমুলাটা কণ্ঠস্থ ছিল। আমি সেটা দানিয়েলিকে বললাম। তার দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তারপর সে ফিসফিস করে বলল, আই কান্ট বিলিভ ইট; পরিমাণ দুজনের হুবহু এক।
তা হলেই বুঝতে পারছি।
তুমি নিজে খাওনি তোমার ওষুধ?
না, এবং কোনওদিনও খাব না।
কিন্তু আমাকে খেতেই হবে। যতদিন না জানতে পারছি ওষুধ খেয়ে আমার কী হচ্ছে, আমি কী করছি, ততদিন আমাকে এ ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। দরকার হলে পরিমাণ বাড়াতে হবে; এক চামচের জায়গায় দু চামচ।
তুমি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না, ওষুধ খেয়ে তুমি কী কর?
প্রথম দিন কিছুই বুঝিনি। কালকের সামান্য স্মৃতি আছে। আমি জানি, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমার গাড়িতে উঠেছিলাম।
তোমার কি ড্রাইভার আছে?
না। আমি নিজেই গাড়ি চালাই।
তারপর কী হয় কিছুই মনে নেই?
না। কিন্তু এইভাবেই আমি আস্তে আস্তে জানতে পারব আমি কী করছি, আমার কী পরিবর্তন হচ্ছে।
এর ফল ভাল হবে না, দানিয়েলি।
তা না হলেও, বিজ্ঞানের খাতিরে এটা আমাকে করতেই হবে। তুমি আর আমি এক লোক নই। আমার কৌতূহল তোমার চেয়ে অনেক বেশি।
আমি বুঝলাম দানিয়েলিকে অনুরোধ করে কোনও ফল হবে না। ওর মাথায় ভূত চেপেছে।
আমি বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
আমায় একটা কিছু ভেবে বার করতে হবে। এ দু দিনে দানিয়েলির তিনটি শক্ৰ খুন হয়েছে। আরও কত শক্ৰ আছে তার কে জানে?
২০ এপ্রিল
আজ চতুর্থ খুনের খবর কাগজে বেরিয়েছে। রোমের বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ডাঃ বার্নিনিকে কেউ কাল রাত্রে তার বাড়িতে গিয়ে গলা টিপে মেরে এসেছে। পুলিশ গলায় আঙুলের ছাপ পেয়েছে, সেই অনুসারে তারা অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
আমি তো অবাক। এ আবার কে খুন হল? কেন? আমি দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে দানিয়েলির বাড়িতে আলবের্তিকে ফোন করলাম। আলবের্তি ফোন ধরার পর বললাম, তুমি একবার আমার হোটেলে আসতে পারবে? আমার ঘরের নম্বর হচ্ছে ৭১৩। বিশেষ দরকার আছে তোমার সঙ্গে। পনেরো মিনিটের মধ্যে আলবের্তি আমার ঘরে চলে এল। আমি তাকে প্রথমেই বললাম, আমার একটা বিশ্ৰী সন্দেহ হচ্ছে যে, এ কদিন যে খুনগুলো হয়েছে সেগুলো দানিয়েলির কীর্তি। সে ওষুধ খেয়ে এই কাণ্ডটি করছে। তোমার কী মনে হয়?
আলবের্তি গভীর হয়ে বলল, আমারও কাল থেকে সেই ধারণা হয়েছে, কারণ যারা খুন হয়েছে তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় দানিয়েলির বিরুদ্ধে কিছু বলেছে, তার কথা বিশ্বাস করেনি বা তার কথার প্রতিবাদ করেছে।
কিন্তু কাল রাত্রে যিনি খুন হলেন—এই বানিনি ভদ্রলোকটি কে? ইনি এখানকার একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। দানিয়েলির একটা প্ৰবন্ধের তীব্ৰ প্ৰতিবাদ করে তিনি তিন বছর আগে একটা প্ৰবন্ধ লেখেন। সেটা একটা পত্রিকায় বেরিয়েছিল।
সেই রাগ দানিয়েলি এখনও ভোলেনি?
তাই তো দেখছি। এবং দানিয়েলিকে কোনও না কোনও সময় আক্রমণ করেছেন, এরকম বিজ্ঞানী রোমে অনেক আছে। প্রোফেসর তুচ্চি, ডাঃ আমাটি, ডাঃ মাৎসিনি—আর কত নাম করব? আমার এখন ধারণা হয়েছে। এঁদের প্রত্যেকের উপরই দানিয়েলি রাগ পুষে রেখেছেন। এতদিন কিছু করেননি, কারণ দানিয়েলি এমনিতে খুবই ভদ্র এবং অমায়িক ব্যক্তি। কিন্তু এই ওষুধই হয়েছে ওঁর কাল। আর একটা কথা আমি আপনাকে বলতে চাই।
কী?
আপনি বোধ হয় প্রোফেসরের আগে এই ওষুধ তৈরি করেছেন, তাই না?
সেটা তুমি কী করে জানলে।
আমি কাল প্রোফেসরের সঙ্গে লাঞ্চ খাচ্ছিলাম। উনিই বললেন, এবং যেভাবে বললেন তাতে মনে হয় না যে, উনি আপনার উপর খুব প্ৰসন্ন।
তই কি?
তাই—এবং আমি বলি আপনি সাবধানতা অবলম্বন করুন। রাত্রে আপনার ঘরে কাউকে ঢুকতে দেবেন না।
কিন্তু শুধু তা হলেই তো হবে না। এখানে হত্যাকাণ্ড যে চলতেই থাকবে। এরপর নিরীহ লোককেও দানিয়েলি খুন করতে আরম্ভ করবে। সামান্য ছুতো পেলেই।
তা হলে কী করা যায়?
সেটাই ভাবছি।
আমি কিছুক্ষণ ভেবে একটা ফন্দি বার করলাম। বললাম, তুমি প্রোফেসরের ল্যাবরেটরিতে যাও?
হ্যাঁ, যাব না কেন? দিনের বেলাতে যাই।
ওই ওষুধ কি তোমার নাগালের মধ্যে থাকে?
না। ওটা উনি আলমারিতে বন্ধ করে রাখেন। চাবি ওঁর কাছে থাকে।
আমি আরেকটু ভাবলাম। তারপর বললাম, তুমি কি ওর বাড়িতেই থাক?
না। আমি সকাল দশটার সময় আসি, আবার সন্ধ্যা ছটায় বাড়ি চলে যাই।
ওর ল্যাবরেটরির চাবি তোমার কাছে আছে?
তা আছে। তা হলে রাত্রে আমাদের দুজনকে ওর ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে হবে। ও যাতে ওষুধ আর না খায় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
কাল আমি একটু মিলান যাচ্ছি। পরশু সন্ধ্যাবেলা আপনার কাছে চলে আসব।
বেশ, তাই কথা রইল।
আলবের্তি চলে গেল। ঘটনাটা আজকে ঘটলেই ভাল হত, কিন্তু উপায় নেই। আলবের্তিকে প্রয়োজন।
২১ এপ্রিল
আজ দুটো খুনের খবর বেরিয়েছে কাগজে। তারমধ্যে একজনের নাম আলবের্তি কালকে করেছিল। আরেকজন প্রোফেসর বেলিনি—জীববিদ্যবিশারদ। দুজনকেই রাত্তিরে গলা টিপে মারা হয়েছে। আঙুলের ছাপ আগের খুনের সঙ্গে মিলে গেছে। পুলিশ এটা বুঝেছে যে, সব খুন একই লোক করেছে। বেলিনির চাকর পুলিশকে বলেছে যে, রাত এগারোটার সময় সে দরজার ঘণ্টা শুনে দরজা খুলে দেখে যে, একজন বীভৎস দেখতে লোক দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে সে বলে তার নাম আরাতুরো ক্রোচে। ক্রোচে বেলিনির সঙ্গে দেখা করতে চায়। বেলিনি। তখনও ঘুমোতে যাননি। ক্রোচের নাম শুনে তিনি চাকরকে বলেন লোকটিকে ভিতরে আসতে বলতে। পনেরো মিনিট পরে এই ক্রোচে লোকটি চলে যায়। বেলিনির চাকরীই তার হ্যাট আর কোটি তাকে এনে দেয়। তারপর মনিব ঘুমোতে যাচ্ছেন না দেখে চাকরীটি তাঁর ঘরে উঁকি মেরে দেখে বেলিনি মেঝেতে পড়ে আছেন—মৃত অবস্থায়। সে তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ বেলিনির গলাতে আততায়ীর আঙুলের ছাপ পায়, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আততায়ীর সন্ধান পায়নি।
২৩ এপ্রিল
কাল রাত্রের সাংঘাতিক ঘটনার বর্ণনা দেবার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু তাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
কাল সকালে রোমের কিছু দ্রষ্টব্য দেখতে বেরিয়েছিলাম একটা টুরিস্ট দলের সঙ্গে। ফিরেছি। বিকেল সাড়ে চারটায়। তারপর কফি খেয়ে টাইবারের ধারে হাঁটলাম আধা ঘণ্টা।
রাত সাড়ে আটটা নাগোত আলবের্তি আমার হোটেলে এল। আমরা দুজনে একসঙ্গেই ডিনার খেলাম। তারপর স্থির করলাম সাড়ে দশটা নাগাত দানিয়েলির বাড়ি যাব। বাড়ি যাব মানে বাড়ির বাইরে ওত পেতে থাকব। ল্যাবরেটরিটা বাইরে থেকে দেখা যায়, তাতে আলো জুললেই বুঝব দানিয়েলি ঢুকেছে। তখন আমরা বাড়িতে গিয়ে ঢুকব।
দানিয়েলির পাড়াটা এমনিতেই নির্জন—তার উপরে রাত্রে তো বটেই। বাড়ির সামনেই একটা পার্ক আছে; আমরা দুজনে সেই পার্কের রেলিঙের ধারে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ল্যাবরেটরি অন্ধকার, অথচ বাড়ির অন্য ঘরে আলো জ্বলছে।
বাড়ির দুশো গজের মধ্যেই একটা গিজা, তাতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ল্যাবরেটরির আলো জ্বলে উঠল।
আমি আর আলবের্তি দানিয়েলির বাড়ির দরজায় গিয়ে ঘণ্টা টিপলাম। চাকর এসে দরজা খুলে আমাদের দেখেই বলল, এখন সিনিয়র দানিয়েলির সঙ্গে দেখা হবে না। তাঁর বারণ আছে।
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আলবের্তি তাকে একটা মোক্ষম ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দিল। আমরা চাকরকে টপকে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আলবের্তি বলল, ফিলোমি।
সিঁড়ির পাশে একটা ঘর পেরিয়ে একটা প্যাসেজ, সেটা দিয়ে বা দিকে হাতদশোক গেলেই ল্যাবরেটরির দরজা। দরজা অল্প ফাঁক, তা দিয়ে আলো এসে বাইরে পড়েছে, প্যাসেজে কোনও আলো জ্বলছে না।
আমি আলবের্তিকে ফিসফিস করে বললাম, আমি ঢুকছি ভিতরে। তুমি দরজার বাইরে থেকো, দরকার হলে তোমাকে ডাকব।
তারপর ল্যাবরেটরির ভিতরে ঢুকেই দেখলাম দানিয়েলি আমার দিকে পিঠ করে একটা খোলা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে একটা বোতল থেকে চামচে ওষুধ ঢালছে।
দানিয়েলি!
আমার গলা শুনে সে চরকিবাজির মতো ঘুরে আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, সে কী, তুমি নিজেই এসে গেছ? আমি তো তোমার হোটেলেই যাচ্ছিলাম।
এই বলার সঙ্গে সঙ্গে সে ওষুধটা খেয়ে ফেলল, আর তারপরে অবাক হয়ে চোখের সামনে দেখলাম, মুহুর্তের মধ্যে তার চেহারার পরিবর্তন হতে।
সে এখন আর সৌম্যদর্শন বৈজ্ঞানিক নয়, সে হিংস্র চেহারার আধা মানুষ আধা জানোয়ার।
এর পরেই সে আর এক মুহুর্ত সময় না দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি বিদ্যুদ্বেগে পাশ কাটাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় চরম ফন্দিটা এসে গেল। দানিয়েলি হাতদুটো বাড়িয়ে আবার আমার দিকে লাফ দেবে, ঠিই সেই মুহূর্তে আমি আলমারির তাকে রাখা ওষুধের বোতলটা হাতে নিয়ে এক ঢোক ওষুধ মুখে পুরে দিলাম।
তারপর এইটুকু শুধু মনে আছে যে আমি ভীমবিক্রমে দানিয়েলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি, এবং দুজনে একসঙ্গে মেঝেতে পড়ছি। জড়াজড়ি অবস্থায়। এও মনে আছে যে, আমার দেহে তখন অসুরের শক্তি। এ ছাড়া আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান হল, তখন দেখি আমি আমার হোটেলের বিছানায় শুয়ে আছি, আমার সর্বাঙ্গে বেদনা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে আলবের্তি ঘরে ঢুকল।
আপনি নিজে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবেন না বলে রুমবয়ের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলেছি—আশা করি কিছু মনে করবেন না।
গুড মর্নিং, বললাম আমি।
আপনি আছেন কেমন?
শরীরে কোনও জখম নেই, কেবল বেদনা।
আমি ডাক্তারকে খবর দিয়েছি, সে এসে আপনার ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু কাল কী হল?
কাল দুই হিংস্র পিশাচকে মরণপণে লড়াই করতে দেখলাম। আমি এসে আপনার পক্ষ না নিলে কী হত বলা যায় না। আমি এককালে বক্সিং করেছি। দানিয়েলিকে একটা আপারকট মেরে নক আউট করে দিই। তার আগে অবশ্য আপনিও ওকে যথেষ্ট কাবু করেছিলেন। ও অজ্ঞান হলে আমি আপনাকে নিয়ে হোটেলে চলে আসি। যখন আপনাকে বিছানায় শুইয়ে দিই তখনও আপনার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। যতক্ষণ না আমার চেনা প্রোফেসর শঙ্কুকে আমার সামনে দেখতে পাই, ততক্ষণ আমি আপনার ঘরে ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে আসি। তখন রাত সাড়ে বারোটা।
আর দানিয়েলি?
এই প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার চলে এলেন। তিনি আমাকে পরীক্ষা করে প্রশ্ন করলেন, তোমার সঙ্গে কি কাল কারুর সঙ্গে হাতাহাতি হয়েছিল?
আমি বললাম, হ্যাঁ। তাঁর বাড়ি এই যুবকটি জানে। তিনি থাকেন সাতাশ নম্বর ভিয়া সাক্রামেন্টোতে। তাঁর নাম ডাঃ এনরিকো দানিয়েলি। তিনি তাঁর আবিষ্কৃত একটি ওষুধের প্রভাবে এই দশা করেছেন আমার। গত চার-পাঁচ দিনে যে কজন বৈজ্ঞানিক খুন হয়েছেন, তাঁদের গলার আঙুলের ছাপের সঙ্গে এই দানিয়েলির আঙুলের ছাপ মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে তাতে কোনও পার্থক্য নেই।
এটা তা হলে পুলিশের কেস?
তা তো বটেই।
আমি এক্ষুনি পুলিশে খবর দিচ্ছি।
ডাক্তার আমাকে ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন।
এবার আলবের্তি তার পকেট থেকে একটা বোতল বার করে টেবিলের উপর রেখে বলল, এই হল বাকি ওষুধ। এটা আপনার কাছেই থাক; আপনার গবেষণাগারে যে বোতলটা রয়েছে সেটার পাশে রেখে দেবেন। আশা করি এখন খানিকটা সুস্থ বোধ করবেন।
ওষুধ পড়েছে, আর চিন্তা কী। আমার মনে হয়। পরশুর মধ্যেই দেশে ফিরতে পারব। তোমার সাহায্যের জন্য অজস্র ধন্যবাদ। তোমার কথা ভুলব না। কখনও।
সন্দেশ। শারদীয়া ১৩৯৫
ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা (প্রোফেসর শঙ্কু)
১৬ই অক্টোবর
আজ আমার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হল। সকালে অবিনাশবাবু এসেছিলেন, আমার হাত দুটো ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, মেনি হ্যাপি ডেজ অফ দ্য রিটার্ন। ভদ্রলোকের হাবভাব এতই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল যে আমি আর ইংরেজিটা সংশোধন করলাম না।
দেশবিদেশ থেকে বহু বিজ্ঞানী বন্ধুরা আমায় অভিনন্দন জানিয়েছে। আমার সামনেই টেবিলে রাখা রয়েছে অন্তত খানপঞ্চাশেক চিঠি, টেলিগ্রাম আর গ্রিটিংস কার্ড। এখনও কাজ করতে পারছি—সেটাই বড় কথা। তার একটা কারণ অবশ্য মিরাকিউরল, আর আরেকটা আমার চাকর প্রহ্লাদের একনিষ্ঠ পরিচযা। সেও অবিশ্যি আমার মিরাকিউরলের সুফল ভোগ করেছে, যেমন করেছে আমার বেড়াল নিউটন। গত পঞ্চাশ বছরে মিরাকিউরল থেকে শুরু করে কত কী যে আবিষ্কার করেছি, সেই কথাই ভাবছিলাম। অ্যানাইহিলিন পিস্তল, ঘুমের বড়ি সমনোলিন, লুপ্ত স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য রিমেমব্রেন, ল্যাম্পের জোরালো আলো লুমিনিম্যাক্স, শ্যাঙ্কোপ্লাস্ট, শ্যাঙ্কোপ্লেন, কানে শোনা যায় না। এমন শব্দ শোনার জন্য মাইক্রোসোনোগ্রাফ-আরও কত কী!
এইসব ভাবছি এমন সময় প্রহ্লাদ এসে খবর দিল, একজন সাহেব দেখা করতে এসেছেন।
আমি আসতে বলতে যিনি প্ৰবেশ করলেন তার বয়স পাচিশের বেশি নয়। আমার সঙ্গে করমর্দন করে ছেলেটি বলল, আমার নাম চার্লস ড্রেক্সেল। আমার বাবার নাম হয়তো তুমি–
জন ড্রেক্সেল কি? বায়োকেমিস্ট?
হ্যাঁ। আমি বাবার ব্যাপারেই তোমার কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
তোমার বাবা এখন কোথায়?
প্ৰশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপে একটা এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন। তিন দিন হল তাঁর মৃত্যু হয়।
সে কী! এ যে ভয়ংকর সংবাদ। ব্যাপারটা শুনি।
বলছি। পুরো ব্যাপারটাই বলছি, একটু ধৈর্য লাগবে।
ধৈর্যের কোনও অভাব নেই আমার।
বাবা শুধু বিজ্ঞানীই ছিলেন না—তিনি পর্যটকও ছিলেন। দু বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে ভ্ৰমণ করতে গিয়ে তিনি ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর একটি আরবি পুঁথির সন্ধান পান। বাবা আরবি জানতেন। অত্যন্ত দুপ্রাপ্য পুঁথি। সেটা পড়ে তিনি প্রচণ্ডভাবে উৎসাহিত হয়ে পড়েন। বলেন, এই পুঁথিতে পৃথিবীর সুন্দরতম জিনিস আবিষ্কারের পদ্ধতির বর্ণনা আছে।
সেটা কী জিনিস? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
তাও বাবা বলেননি। বললেন, এক্সপেরিমেন্ট সফল হলে লোকে এমনিই জানতে পারবে।
তারপর?
তারপর বাবা এক্সপেরিমেন্টের তোড়জোড় শুরু করেন। ব্যয়সাপেক্ষ এক্সপেরিমেন্ট—শহরে করা চলবে না-প্রাকৃতিক পরিবেশ চাই। বাবা ব্যাপারটাকে গোপন রাখার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি দ্বীপ বেছে নেন। কোনও সংস্থা বাবাকে টাকা দিতে রাজি হয়নি। অবশেষে জোসেফ গ্রিমান্ডি নামে বাবার এক পরিচিত ধনী বায়োকেমিস্ট, বাবাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে এবং এক্সপেরিমেন্টে অংশগ্রহণ করতে রাজি হন। গ্রিমান্ডির শর্ত ছিল, পরীক্ষা সফল হলে তার জন্য অর্ধেক কৃতিত্ব সে দাবি করবে। বাবা তখন এমনই মেতে উঠেছেন যে, এই শর্তে তিনি রাজি হয়ে যান। তিন মাস আগে এই এক্সপেরিমেন্ট শুরু হয়। চিঠিতে জানতে পারতাম। বাবা দ্রুত সফলতার দিকে এগিয়ে চলেছেন। এমন সময় বিনা মেঘে বজ্ৰাঘাত। গ্রিমান্ডির চিঠি এল যে, মাত্র চার দিনের অসুখে কোনও অজ্ঞাত ট্রপিক্যাল ব্যারামে বাবার মৃত্যু হয়েছে। বিজ্ঞানীর দল যে যার দেশে ফিরে গেছে। অথচ বাবার শেষ চিঠিতে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে, এক্সপেরিমেন্ট সফল হতে চলেছে।
তোমার বাবার মৃত্যু সম্বন্ধে তোমার নিজের কোনও ধারণা আছে?
আছে।
কী?
গ্রিমাল্ডি এক্সপেরিমেন্টের পুরো ক্রেডিট নেবার জন্য বাবাকে খুন করেছে।
বুঝলাম। কিন্তু তুমি আমার কাছে এসেছি কেন?
আমি চাই, তুমি ওই দ্বীপে গিয়ে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করো। এই ধরনের অভিযান তো তোমার কাছে নতুন কিছু নয়। তোমার দল নিয়ে তুমি চলে যাও। বাবার কাজটা অসম্পূর্ণ থাকলে বিজ্ঞানের পরম ক্ষতি হবে। দ্বীপের অবস্থান আমার জানা আছে, আমি তোমাকে জানিয়ে দেব।
–১৯৯১
=============
একই আকারের অপর একটি বাধানো খাতায় ১৯৯১-এর জুন মাসে লেখা ড্রেক্সেল আইল্যান্ডের ঘটনা-র অসমাপ্ত খসড়াটি পাওয়া গেছে। বাবা গল্পটি পার পর মোট তিন বার লেখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রতিবারই তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তৃতীয় অৰ্থাৎ সর্বশেষ খসড়াটি এখানে প্রকাশ করা হল।
–সন্দীপ রায়
আনন্দমেলা । পূজাবার্ষিকী ১৩৯৯
নকুড়বাবু ও এল ডোরাডো (প্রোফেসর শঙ্কু)
১৩ই জুন
আজ সকালের ঘটনাটা আমার কাজের রুটিন একেবারে তছনছ করে দিল। কাজটা অবিশ্যি আর কিছুই না; আমার যাবতীয় আবিষ্কার বা ইনভেশনগুলো সম্বন্ধে একটা প্ৰবন্ধ লিখছিলাম সুইডেনের বিখ্যাত কসমস পত্রিকার জন্য। এ কাজটা এর আগে কখনও করিনি, যদিও নানান দেশের নানা পত্রিকা থেকে অনুরোধ এসেছে অনেকবার। সময়ের অভাবে প্রতিবারই প্ৰত্যাখ্যান করতে হয়েছে। ইদানীং আমার গবেষণার কাজ ইচ্ছে করেই অনেক কমিয়ে দিয়েছি। এটা ক্রমেই বুঝতে পারছি যে, গিরিডির মতো জায়গায় বসে আমার গবেষণাগারের সামান্য উপকরণ নিয়ে আজকের যুগে শুধু যে আর বিশেষ কিছু করা যায় না। তা নয়, করার প্রয়োজনও নেই। দেশে বিদেশে বহু তরুণ বৈজ্ঞানিক আশ্চর্য সব আধুনিক যন্ত্রপাতি হাতে পেয়ে, এবং সেই সঙ্গে নানান বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় যে সব কাজ করছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
অবিশ্যি আমি নিজে সামান্য ব্যয়ে সামান্য মালমশলা নিয়ে যা করেছি। তার স্বীকৃতি দিতে বৈজ্ঞানিক মহল কাপণ্য করেনি। সেই সঙ্গে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যেই আবার এমন লোকও আছে, যারা আমাকে বৈজ্ঞানিক বলে মানতেই চায়নি। তাদের ধারণা, আমি একজন জাদুকর বা প্ৰেতিসিদ্ধ গোছের কিছু; বৈজ্ঞানিকের চোখে ধুলো দেবার নানারকম মন্ত্রতন্ত্র আমার জানা আছে, আর তার জোরেই আমার প্রতিষ্ঠা। আমি অবশ্য এটা নিয়ে কোনও দিনই নিজেকে উত্তেজিত হতে দিইনি। আমার মধ্যে যে একটা ঋষিসুলভ স্থৈর্য ও সংযম আছে, সেটা আমি জানি। এক কথায় আমি মাথা ঠাণ্ডা মানুষ। পশ্চিমে এমন অনেক জ্ঞানীগুণী গবেষকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, যাঁরা কথায় কথায় টেবিল চাপড়ান, বা টেবিলের অভাবে নিজেদের হাঁটু। জামানির এক জীব রাসায়নিক ডঃ হেলব্রোনার একবার তাঁর এক নতুন আবিষ্কারের কথা বলতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে আমার কাঁধে এমন এক চপেটাঘাত করেছিলেন যে, যন্ত্রণায় আমাকে আর্তনাদ করে উঠতে হয়েছিল।
যাই হোক, এই প্রবন্ধে একটা জিনিস বুঝিয়ে বলার সুযোগ পাচ্ছি; সেটা হল—আমার আবিষ্কারগুলো কেন আমি সারা পৃথিবীর ব্যবহারার্থে ছড়িয়ে দিইনি। তার কারণ আর কিছুই না—আমার তৈরি জিনিসগুলোর মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে শক্তিশালী বা হিতসাধক—যেমন অ্যানাইহিলিন পিস্তল বা মিরাকিউরল ওষুধ বা অমনিস্কোপ বা মাইক্রোসোনোগ্রাফ, বা স্মৃতি উদঘাটক যন্ত্র রিমেমব্রেন-এর কোনওটাই কারখানায় তৈরি করা যায় না। এগুলো সবই মানুষের হাতের কাজ, এবং সে মানুষও একটি বই আর দ্বিতীয় নেই। তিনি হলেন ত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কু।
আজ ভোরে যথারীতি উগ্ৰীর ধারে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরে কফি খেয়ে, আমার লেখাপড়ার ঘরে বসে আমার পঞ্চাশ বছর ব্যবহার করা ওয়াট্যারম্যান ফাউনটেন পেনাটাতে কালি ভরে
লেখা শুরু করতে যাব, এমন সময় আমার চাকর প্রহ্লাদ এসে বলল, একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
কোন দেশীয়? প্রশ্ন করলাম আমি। স্বাভাবিক প্রশ্ন, কারণ পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে, যেখানকার গুণী জ্ঞানীর কেউ না কেউ কোনও দিন না কোনও দিন এই গিরিডিতে আমার বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেননি। তিন সপ্তাহ আগে লিথুয়ানিয়া থেকে এসেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত পতঙ্গবিজ্ঞানী প্রোফেসর জাবলনস্কিস।
তা তো জিজ্ঞেস করিনি, বলল প্রহ্লাদ, তবে ধুতি দেখলাম, আর খন্দরের পাঞ্জাবি, আর কথা তো বললেন বাংলাতেই।
কী বললেন? কথাটা অগ্ৰীতিকর শোনালেও স্বীকার করতেই হবে যে, মামুলি লোকের সঙ্গে মামুলি খেজুরে আলাপের সময় নেই আমার।
বললেন কী, তোমার বাবুকে বলো, কিসমিসের জন্য লেখাটা একটু বন্ধ করে যদি দশ মিনিট সময় দেন। কী যেন বলার আছে।
কিসমিস? তার মানে কি কসমস? কিন্তু তা কী করে হয়? আমি যে কসমস পত্রিকার জন্য লিখছি, সে কথা তো এখানে কেউ জানে না!
উঠে পড়লাম লেখা ছেড়ে। কিসমিস রহস্য ভেদ না করে শান্তি নেই। বসবার ঘরে ঢুকে যাঁকে দু হাতের মুঠোয় ধুতির কোঁচা ধরে সোফার এক পাশে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখলাম, তেমন নিরীহ মানুষ আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যদিও প্রথম চাহনির পর দ্বিতীয়তে লক্ষ করা যায়। এঁর চোখের মণির বিশেষত্বটা : এর মধ্যে যেটুকু প্রাণশক্তি আছে, তার সবটুকুই যেন ওই মণিতে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
নমস্কার তিলুবাবু! কোঁচার ডগা সমেত হাত দুটো মুঠো অবস্থায় চলে এল। ভদ্রলোকের থুতনির কাছে,-কসমসের লেখাটা বন্ধ করলাম বলে মার্জনা চাইছি। আপনার সঙ্গে সামান্য কয়েকটা কথা বলার প্রবল বাসনা নিয়ে এসেছি আমি। আমি জানি, আপনি আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করবেন।
শুধু কসমস নয়, তিলু নামটা ব্যবহার করাটাও একটা প্ৰচণ্ড বিস্ময় উদ্রেককারী ব্যাপার। ষাট বছর আগে আমার বাবা শেষ আমায় ডেকেছেন ওই নামে। তার পরে ডাকনামটার। আর কোনও প্রয়োজন হয়নি।
অধমের নাম শ্ৰীনকুড়চন্দ্ৰ বিশ্বাস।
আমার বিস্ময় কাটেনি, তাই ভদ্রলোকই কথা বলে চলেছেন।
মাকড়দায় থাকি; কষ্ট দিন থেকেই আপনাকে দেখতে পাচ্ছি। চোখের সামনে। অবিশ্যি সে দেখা আর এ দেখা এক জিনিস নয়।
আমাকে দেখতে পাচ্ছেন মানে? আমি প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম।
এটা মাস দেড়েক হল আরম্ভ হয়েছে। অন্য জায়গার লোক, অন্য জায়গার ঘটনা, এই সব হঠাৎ চোখের সামনে দেখি। সব সময় খুব স্পষ্ট নয়, তাও দেখি। আপনার নাম শুনেছি, ছবিও দেখেছি। কাগজে। সে দিন আপনার চেহারাটা মনে করতেই দেখি আপনি এসে হাজির।
এ জিনিস দেড় মাস থেকে হচ্ছে আপনার?
হ্যাঁ। তা দেড় মাসই হবে। খুব জল হচ্ছিল সে দিন, আর তার সঙ্গে মেঘের ডাক। দুপুর বেলা। দাওয়ায় বসে গোলা তেঁতুলের আচার খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি সামনে বিশ হাত দূরে মিত্তিরদের বাড়ির ভেরেণ্ডা গাছের পিছন দিকে একটা আগুনের গোলার মতো কী যেন শূন্যে ঘোরাফেরা করছে। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিলুবাবু, গোলাটা এল ঠিক আমারই দিকে। যেন একটি জ্যোতির্ময় ফুটবল। উঠোনে তুলসীর কাছ অবধি আসতে দেখেছি। এটা মনে আছে, তারপর আর মনে নেই। জ্ঞান হল যখন তখন জল থেমে গেছে। আমি ছিলাম তক্তপোশে; তিনটে বেড়ালছোনা খেলা করছিল উঠোনে, দাওয়ার ঠিক সামনেই। সে তিনটে মরে গেছে। অথচ আমার গায়ে আঁচড়টি নেই। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা মাদার গাছ আর একটা কতবেল গাছ ছিল, দুটোই পুড়ে ঝামা।
আর বাড়ির অন্য লোক?
ঠাকুমা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। ছোট ভাই ছিল ইস্কুলে; সে মাকড়দা প্রাইমারি ইস্কুলের মাস্টার। মা নেই; বাবা ছিলেন ননী ঘোষের বাড়ি, দাবার আড্ডায়। ঠাকুমার অসুখ। খাটে শুয়ে ছিলেন পিছন দিকের ঘরে, তাঁর কিছু হয়নি।
বর্ণনা শুনে মনে হল, বল লাইটনিং-এর কথা বলছেন। ভদ্রলোক। কচিৎ কদাচিৎ এ ধরনের বিদ্যুতের কথা শোনা যায়, যেটা ঠিক বলেরই আকার ধরে কিছুক্ষণ শূন্য দিয়ে ভেসে বেড়িয়ে হঠাৎ এক্সপ্লোড করে। সে বিদ্যুৎ একটা মানুষের কাছ দিয়ে যাবার ফলে যদি দেখা যায় যে, সে মানুষের মধ্যে একটা বিশেষ কোনও পরিবর্তন ঘটে গেছে, তা হলে বলার কিছু নেই। কাছাকাছি বাজ পড়ে কালা কানে শুনেছে, অন্ধ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে, এমন খবরও কাগজে পড়েছি। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভদ্রলোকের শক্তির দৌড় কত দূর।
প্রশ্নটা করার আগেই উত্তরের খানিকটা আভাস পেয়ে গেলাম।
নকুড়বাবু হঠাৎ বিড়বিড় করে বলে উঠলেন,থ্রি এইট এইট এইট নাইন ওয়ান সেভেন ওয়ান। দেখলাম, তিনি চেয়ে রয়েছেন সামনে টেবিলের উপর রাখা আমেরিকান সাপ্তাহিক টাইম-এর মলাটের দিকে। মলাটে যাঁর ছবি রয়েছে, তিনি হলেন মার্কিন ক্রোড়পতি পেট্রস সারকিসিয়ান। ছবির দিকে চেয়েই নকুড়বাবু বলে চলেছেন, সাহেবের ঘরে একটা সিন্দুক দেখতে পাচ্ছি।-খাটের ডান পাশে-ক্ৰস্কলি কোম্পানির তৈরি-ভিতরে টাকা-বান্ডিল বান্ডিল একশো ডলারের নোট…
আর আপনি যে নম্বরটা বললেন, সেটা কী?
ওটা সিন্দুকটা খোলার নম্বর। ডালার গায়ে একটা দাঁতিকাটা চাকার মতো জিনিস, আর সেটাকে ঘিরে খোদাই করা এক থেকে নয় অবধি নম্বর। চাকাটা এদিকে, ওদিকে ঘোরে। নম্বর মিলিয়ে ঘোরালেই খুলে যাবে সিন্দুক।
কথাটা বলে হঠাৎ একটা ভীষণ কুষ্ঠার ভাব করে ভদ্রলোক বললেন, অপরাধ নেবেন না। তিলুবাবু। এ সব কথা আপনার মতো ব্যস্ত মানুষের কাছে বলতে আসা মানেই আপনার মূল্যবান সময়–
মোটেই না, আমি বাধা দিয়ে বললাম। আপনার মতো ক্ষমতা একটা দুর্লভ ব্যাপার। আপনার সাক্ষাৎ পাওয়াটা একজন বৈজ্ঞানিকের পক্ষে খুবই সৌভাগ্যের কথা। আমি শুধু জানতে চাই–
আমি বলছি আপনাকে। আপনি জানতে চাইছেন, বল লাইটনিং-এর সংস্পর্শে এসে আমার মধ্যে আর কী কী বিশেষ ক্ষমতা দেখা দিয়েছে, এই তো?
নির্ভুল অনুমান। বললাম, ঠিক তাই।
নকুড়বাবু বললেন, মুশকিল হচ্ছে কী জানেন? এগুলোকে তো আর বিশেষ ক্ষমতা বলে ভাবতে পারি না। আমি! মানুষ যে হাসে বা কাঁদে বা হাই তোলে বা নাক ডাকায়—এগুলোকে কি আর মানুষ বিশেষ ক্ষমতা বলে মনে করে? এ তো নিশ্বাস প্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক। আমিও যা করছি, সেগুলো বিশেষ ক্ষমতা ভেবে করছি না। যেমন ধরুন আপনার ওই টেবিলটা। ওটার ওপর কী রয়েছে বলুন তো?
আমি ভদ্রলোকের ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমার ঘরের কোণে রাখা কাশ্মীরি টেবিলটার দিকে তাকালাম।
টেবিলের উপর একটা জিনিস রয়েছে, যেটা এর আগে কোনও দিন দেখিনি। সেটা একটা পিতলের মূর্তি—যদিও খুব স্পষ্ট নয়। যেন একটা স্পন্দনের ভাব, একটা স্বচ্ছতা রয়েছে মূর্তিটার মধ্যে। দেখতে দেখতেই মূর্তিটা মিলিয়ে গেল।
কী দেখলেন?
একটা পিতলের ধ্যানী বুদ্ধমূর্তি। তবে ঠিক নিরেট নয়।
ওই তো বললুম। এখনও ঠিক রপ্ত হয়নি ব্যাপারটা। মূর্তিটা রয়েছে আমাদের উকিল শিবরাতন মল্লিকের বাড়ির বৈঠকখানায়। একবার দেখেছিলুম। এখনকার মতো আপনার ওই টেবিলে আছে বলে কল্পনা করলুম, কিন্তু পুরোপুরি এল না।
আমি মনে মনে বলছিলাম, আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনও জাদুকর (একমাত্র চিনে জাদুকর চী চিং ছাড়া) আমাকে হিপ্লোটাইজ করতে পারেনি। ইনি। কিন্তু অনেকটা সমর্থ হয়েছেন। এও একরকম সম্মোহন বইকী! নকুড় বিশ্বাসের একাধিক ক্ষমতার মধ্যে এটাও একটা। হিপ্নোটিজম, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স বা অলোকদৃষ্টি-এ সব কটা ক্ষমতাই দেখছি একসঙ্গে পেয়ে গেছেন। ভদ্রলোক।
শিবরতনবাবুর কাছেই আপনার কথা প্রথম শুনি, বললেন নকুড়বাবু। তাই ভাবলুম, একবার গিরিডিটা হয়ে আসি। আপনার দর্শনটাও হয়ে যাবে, আর সেই সঙ্গে একটা ব্যাপারে। আপনাকে একটু সাবধানও করে দিতে পারব।
সাবধান?
আজ্ঞে কিছু মনে করবেন না, তিলুবাবু, ধৃষ্টতা মাপ করবেন। আমি জানি, আপনি তো শুধু আমাদের দেশের লোক নন; সারা বিশ্বে আপনার সম্মান। পৃথিবীর সব জায়গা থেকেই আপনার ডাক পড়ে, আর আপনাকে সে সব ডাকে সাড়াও দিতে হয়। কিন্তু সাও পাউলোর ব্যাপারটাতে গেলে, আপনাকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করি।
সাও পাউলো হল ব্ৰেজিলের সবচেয়ে বড় শহর। সেখান থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও ডাক আসেনি আমার। বললাম, সাও পাউলোতে কী ব্যাপার?
আজ্ঞে সেটা এখনও ঠিক বলতে পারলাম না। ব্যাপারটা এখনও ঠিক স্পষ্ট নয়। আমার কাছে। সত্যি বলতে কী, সাও পাউলো যে কোথায় তাও আমি জানি না। হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পেলুম একটা লম্বা সাদা খাম, তার উপর টাইপ করা আপনার নাম ও ঠিকানা, খামের এক কোণে একটা নতুন ডাকটিকিট, তার উপর একটা ছাপ পড়ল—সাও পাউলো—আর সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আর তার পরমুহুর্তেই দেখলুম। একটা সুদৃশ্য কামরা, তাতে এক বিশালবপু বিদেশি ভদ্রলোক আপনার দিকে চেয়ে বসে আছেন। লোকটিকে দেখে মোটেই ভাল লাগল না।
দশ মিনিট হয়ে গেছে দেখেই বোধহয় ভদ্রলোক উঠে পড়েছিলেন, আমি বসতে বললাম। অন্তত এক কাপ কফি না খাইয়ে ছাড়া যায় না। ভদ্রলোককে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে এর সঙ্গে যোগাযোগ করার কী উপায়, সেটাও জানা দরকার।
ভদ্রলোক রীতিমতো সংকোচের সঙ্গে আধা ওঠা অবস্থা থেকে বসে পড়লেন। বললাম, আপনি উঠেছেন কোথায়?
আজ্ঞে, উঠেছি মনোরমা হোটেলে।
থাকবেন ক’ দিন?
যে কাজের জন্য আসা, সে কাজ তো হয়ে গেল। কাজেই…
কিন্তু আপনার ঠিকানাটা যে জানা দরকার।
লজ্জায় ভদ্রলোকের ঘাড় বেঁকে গেল। সেই অবস্থাতেই বললেন, আমার ঠিকানা আপনি চাইছেন, এ তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।
এবার ভদ্রলোককে একটু কড়া করেই বলতে হল যে, তাঁর বিনয়টা একটু আদিখ্যেতার মতো হয়ে যাচ্ছে। বললাম, আপনি জেনে রাখুন যে, আপনার সঙ্গে মাত্র দশ মিনিটের পরিচয়ের পর একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা যে কোনও বৈজ্ঞানিকের পক্ষেই একটা আপশোসের কারণ হতে পারে।
আপনি কেয়ার অফ হরগোপাল বিশ্বাস, মাকড়দা দিলেই আমি চিঠি পেয়ে যাব। আমার বাবাকে ওখানে সবাই চেনে।
আপনি বিদেশ যাবার সুযোগ পেলে, যাবেন?
প্রশ্নটা কিছুক্ষণ থেকেই মাথায় ঘুরছিল। সেটার কারণ আর কিছুই না-অতি প্ৰাকৃত ক্ষমতা বা ঘটনা সম্পর্কে পশ্চিমে অনেক বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটা হেসে উড়িয়ে দেবার ভাব লক্ষ করেছি। শ্ৰীমান নকুড় বিশ্বাসকে একবার তাদের সামনে নিয়ে ফেলতে পারলে মন্দ হত না। আমি নিজে অবিশ্যি এই সন্দেহবাদীদের দলে নেই। নকুড়বাবুর এই ক্ষমতা আমি মোটেই অবজ্ঞা বা অবিশ্বাসের চোখে দেখি না। মানুষের মস্তিষ্ক সম্বন্ধে আমরা এখনও স্পষ্টভাবে কিছুই জানি না। আমার ঠাকুরদা বটুকেশ্বর ছিলেন শ্রুতিধর। একবার শুনলে বা পড়লেই একটা গোটা কাব্য তাঁর মুখস্থ হয়ে যেত। অথচ তিনি পুরোদস্তুর সংসারী লোক ছিলেন; এমন না যে, দিনরাত কেবল পড়াশুনা বা ধর্মকর্ম নিয়ে থাকতেন। এটা কী করে সম্ভব হয় সেটা কি পশ্চিমের কোনও বৈজ্ঞানিক সঠিক বলতে পারে? পারে না, কারণ তারা এখনও মস্তিষ্কের অর্ধেক রহস্যই উদঘাটন করতে পারেনি।
কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে নকুড়বাবু এমন ভাব করলেন, যেন আমি উন্মাদের মতো কিছু বলে ফেলেছি।
আমি বিদেশ যাব? চোখ কপালে তুলে বললেন নকুড়বাবু। কী বলছেন। আপনি তিলুবাবু? আর যদি বা ইচ্ছেই থাকত, আমার মতো লোকের পক্ষে সেটা সম্ভবই বা হত কী করে?
আমি বললাম, বাইরের অনেক বিজ্ঞানপ্রতিষ্ঠানই কোনও বিজ্ঞানী সম্মেলনে কাউকে আমন্ত্রণ জানালে, তাঁকে দুটো প্লেনের টিকিট দিয়ে থাকেন, এবং সেখানে দুজনের থাকার খরচ বহন করে থাকেন। কেউ কেউ নিয়ে যান স্ত্রীকে, কেউ বা সেক্রেটারিকে। আমি অবশ্য একাই গিয়ে থাকি, কিন্তু আপনি যেতে সম্মত হলে—
নকুড়বাবু একসঙ্গে মাথা নেড়ে, জিভা কেটে আমার প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানিয়ে উঠে পড়লেন।
আপনি যে আমার কথাটা ভেবেছেন, সেইটেই আমার অনেক পাওয়া। এর বেশি আর আমি কিছু চাই না।
আমি কিছুটা ঠাট্টার সুরে বললাম, যাই হোক, যদি আপনার দিব্যদৃষ্টিতে কোনওদিন আপনার বিদেশ যাবার সম্ভাবনা দেখতে পান, তা হলে আমাকে জানাবেন।
নকুড়বাবু যেন আমার রসিকতাটা উপভোগ করেই মৃদু হেসে দু হাতে কোঁচার গোছটা তুলে নিয়ে নমস্কার করে বললেন, আমার প্রণাম রইল। নিউটনকে আমার আশীবাদ দেবেন।
২১শে জুন
কসমস পত্রিকার জন্য প্ৰবন্ধটা কাল পাঠিয়ে দিলাম।
শ্ৰীমান নকুড়চন্দ্রের আর কোনও খবর পাইনি। সে নিজে না দিলে আর কে দেবে খবর। আমার দিক থেকে খুব বেশি আগ্রহ দেখানোটাও ঠিক নয়, তাই ঠিকানা জানা সত্ত্বেও আমি তাকে চিঠি লিখিনি। অবিশ্যি ইতিমধ্যে আমার দুই বন্ধু সন্ডার্স ও ক্রোলকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছি। তারা দুজনেই গভীর কৌতূহল প্রকাশ করেছে। ক্রোল বলছে, নকুড় বিশ্বাসকে ইউরোপে নিয়ে গিয়ে ডেমনষ্ট্রেশনের জন্য খরচ সংগ্ৰহ করতে কোনও অসুবিধা হবে না। এমন কী, টেলিভিশন প্রোগ্রাম ইত্যাদির জোরে নকুড় বিশ্বাস বেশ কিছু টাকা হাতে নিয়ে দেশে ফিরতে পারবে। আমি জানিয়ে দিয়েছি, মাকড়দাবাসীর কাছ থেকে উৎসাহের কোনও ইঙ্গিত পেলেই জানাব।
২৪শে জুলাই
গত একমাসে আমার প্রবন্ধটা সম্পর্কে একশো সাতত্তরটা চিঠি পেয়েছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকদের কাছ থেকে। সবই অভিনন্দনসূচক। তার মধ্যে একটি চিঠি হল এক বিরাট মার্কিন কেমিক্যাল কপোরেশনের মালিক সলোমন ব্লুমগার্টেনের কাছ থেকে। তিনি জানিয়েছেন যে, আমার অন্তত তিনটি আবিষ্কারের পেটেন্টস্বত্ব তিনি কিনতে রাজি আছেন। তার জন্য তিনি আমাকে পঁচাত্তর হাজার ডলার দিতে প্রস্তুত। আবিষ্কার তিনটি হল অ্যানাইহিলিন পিস্তল, মিরাকিউরল বড়ি ও অমনিস্কোপ যন্ত্র। যদিও আমি প্রবন্ধে লিখেছিলাম যে, এ সব জিনিস কারখানায় তৈরি করা যায় না, সে কথাটা ব্লুমগার্টেন মানতে রাজি নন। তাঁর ধারণা, একজন মানুষ নিজে হাতে যেটা তৈরি করতে পারে, যন্ত্রের সাহায্যে সেটা তৈরি না করতে পারার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। এ সব ব্যাপারে চিঠি মারফত তর্ক করা বৃথা; তাই আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, ব্যক্তিগত কারণে আমি পেটেন্ট রাইটস বিক্রি করতে রাজি নই।
পঁচাত্তর হাজার ডলারেও আমার লোভ লাগল না দেখে সাহেবের না জানি কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
১৭ই আগস্ট
আজ এক অপ্রত্যাশিত চিঠি। লিখছেন শ্ৰীনকুড়চন্দ্র বিশ্বাস। চিঠির ভাব ও ভাষা দুই-ই অপ্রত্যাশিত। তাই সেটা তুলে দিচ্ছি—
শ্ৰীত্ৰিলোকেশ্বর শঙ্কু মহাশয়ের শ্ৰীচরণে শতকোটি প্রণামপূর্বক নিবেদনমিদং—
মহাশয়,
অধমকে যে আপনি স্মরণে রাখিয়াছেন সে বিষয়ে অবগত আছি। অবিলম্বে সাও পাউলো হইতে আমন্ত্রণ আপনার হস্তগত হইবে। আপনি সঙ্গত কারণেই উক্ত আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করিতে পরিবেন না। আপনার স্মরণে থাকিবে যে, আপনি আমাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন, আপনার দাসানুদাস সেক্রেটারিরূপে আপনার সহিত বিদেশ গমনের জন্য। তৎকালে সম্মত হই নাই, কিন্তু স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর ক্রমে উপলব্ধি করিয়াছি যে, সাও পাউলোতে আপনার পার্থে উপস্থিত না থাকিলে আপনার সমূহ বিপদ। আমি গত কয়েক মাস অক্লান্ত পরিশ্রমে পিটম্যান পদ্ধতিতে শর্টহ্যান্ড বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করিয়াছি। উপরন্তু এটিকেট সম্পর্কে কতিপয় পুস্তক পাঠ করিয়া পাশ্চাত্ত্য আদব কায়দা কিছুটা আয়ত্ত করিয়াছি। অতএব আপনি আমাকে আপনার অনুচর রূপে সঙ্গে লইবার ব্যাপারে কী স্থির করেন তাহা পত্রপাঠ জানাইলে বাধিত হইব। আপনি ভারতের তথা বিশ্বের গৌরব। সবোপরি আপনি বঙ্গসন্তান। আপনার দীর্ঘ রোগমুক্ত, নিঃসঙ্কট জীবন আমাদের সকলেরই কাম্য। ইতি।
সেবক শ্ৰীনকুড়চন্দ্ৰ বিশ্বাস
এখানে প্রশ্ন হচ্ছে-আমার সঙ্গে বাইরে যাবার ব্যাপারে হঠাৎ মত পরিবর্তনের কারণ যেটা বলেছেন নকুড়বাবু, সেটা কি সত্যি? নাকি এর মধ্যে কোনও গুঢ় অভিসন্ধি আছে? ভদ্রলোক কি আসলে গভীর জলের মাছ? চিঠির ভাব ও ভাষা কি আসলে আদিখ্যেতা?
লোকটার মধ্যে সত্যিই কতকগুলো আশ্চর্য ক্ষমতা আছে বলে এই প্রশ্নগুলো আসছে। অবিশ্যি এখন এ বিষয়ে ভেবে লাভ নেই। আগে নেমন্তন্নটা আসে কি না দেখা যাক, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
৩রা সেপ্টেম্বর
নকুড়বাবু আবার অবাক করলেন। আমন্ত্রণ এসে গেছে। আরও অবাক হয়েছি। এই কারণে যে, এ আমন্ত্রণ সত্যিই ঠেলা যাবে না। সাও পাউলোর বিখ্যাত রাটানটান ইনস্টিটিউট একটা তিনদিন ব্যাপী বিজ্ঞান সম্মেলনের আয়োজন করেছেন, যেখানে বক্তৃতা, আলোচনাসভা ইত্যাদি তো হবেই, তা ছাড়া সম্মেলনের শেষ দিনে ইনস্টিটিউট আমাকে ডক্টরেট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করবে। কসমসের প্রবন্ধই আসলে নতুন করে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞানের জগতে। সম্মেলনের কর্তৃপক্ষ যে শুধু আমার উপস্থিতি প্রার্থনা করেছেন তা নয়, আমার সব কটি ইনভেনশন এবং সেই সঙ্গে সেই সংক্রান্ত আমার গবেষণার কাগজপত্রের একটি প্রদর্শনী করবেন বলে প্ৰস্তাব করেছেন। এ ব্যাপারে দিল্লির ব্ৰেজিলীয় এমব্যাসির সঙ্গে ভারত সরকার সব রকম সহায়তা করতে প্ৰস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন। ইনস্টিটিউট জানিয়েছেন যে, তাঁদের আতিথেয়তা তিন দিনেই ফুরিয়ে যাচ্ছে না, অন্তত আরও সাতদিন থেকে যাতে আমি ব্ৰেজিল ঘুরে দেখতে পারি সে ব্যবস্থাও কর্তৃপক্ষ করবেন। দুজনের জন্য থাকার এবং যাতায়াতের খরচ তাঁরা বহন করবেন।
আমি যাব বলে টেলিগ্রাম করে দিয়েছি, আর এও জানিয়ে দিয়েছি যে আমার সঙ্গে থাকবেন আমার সেক্রেটারি মিঃ এন সি বিসওয়াস।
মাকড়দাতেও অবিশ্যি চিঠি চলে গেছে। কনফারেন্স শুরু হচ্ছে ১০ই অক্টোবর। এই এক মাসের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারব বলে মনে হয়।
সন্ডার্স ও ক্রোলকে খবরটা দিয়ে দিয়েছি। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক হিসাবে দুজনেই সাও পাউলোতে আমন্ত্রিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস, তবে নকুড়বাবুর খবরটা জানিয়ে দেওয়া দরকার ছিল। তাকে নিয়ে এ যাত্ৰা বিশেষ মাতামাতি করা যাবে না সেটাও জানিয়ে দিয়েছি। ক্রোল নিজে অতিপ্ৰাকৃত ব্যাপার নিয়ে যথেষ্ট কৌতুহলী ও ওয়াকিবহাল। হোটেলের ঘরে বসে বিশেষ করে তাঁর জন্য সামান্য ডেমনস্ট্রেশন দিতে নকুড়বাবুর নিশ্চয়ই আপত্তি হবে না।
আমার আসন্ন বিপদের কথাটা সত্যি কি মিথ্যে জানি না। আমার মনে মনে একটা সন্দেহ হচ্ছে যে, নকুড়বাবু নিখরচায় বিদেশ দেখার লোভটা সামলাতে পারেননি। আমি লিখেছি তিনি যেন রওনা হবার অন্তত তিনদিন আগে আমার কাছে চলে আসেন। তাঁর আদিবাকায়দার দৌড় কতটা সেটা একবার দেখে নেওয়া দরকার। ভাষা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ইংরিজিটা মনে হয়। ভদ্রলোক একরকম নিজেই চালিয়ে নিতে পারবেন; আর, কোনও বিশেষ অবস্থায় যদি ব্ৰেজিলের ভাষা পর্তুগিজ বলার প্রয়োজন হয়, তার জন্য তো আমিই আছি। ভারতবর্ষের ইতিহাসে পর্তুগিজদের ভূমিকার কথা মনে করে আমি এগারো বছর বয়সে গিরিডির পর্তুগিজ পাদরি ফাদার রেবেলোর কাছ থেকে ভাষাটা শিখে নিয়েছিলাম।
২রা অক্টোবর
আজ নকুড়বাবু এসেছেন। এই কমাসে ভদ্রলোকের চেহারায় বেশ একটা উন্নতি লক্ষ করছি। বললেন, যোগব্যায়ামের ফল। ইতিমধ্যে কলকাতায় গিয়ে ভদ্রলোক দুটো সুট করিয়ে এনেছেন, সেই সঙ্গে শার্ট টাই জুতো মোজা ইত্যাদিও জোগাড় হয়েছে। দাঁতনের অভ্যাস বলে নতুন টুথপেস্ট টুথব্রাশ কিনতে হয়েছে। সুটকেস যেটা এনেছেন, সেটা নাকি আসলে উকিল শিবরাতন মল্লিকের। সেটি যে এনার কাছে কী করে এল, সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না।
ব্রোজিলের জঙ্গল দেখতে যাবেন না? আজ দুপুরে খাবার সময়ে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। আমি বললাম, সাতদিন তো ঘুরিয়ে দেখাবে বলেছে; তার মধ্যে অরণ্য কি আর একেবারে বাদ পড়বে?
নকুড়বাবু বললেন, আমাদের শ্ৰীগুরু লাইব্রেরিতে খোঁজ করে বরদা বাড়ুজ্যের লেখা ছবি টবি দেওয়া একটা পুরনো বই পেলাম ব্ৰেজিল সম্বন্ধে। তাতে লিখেছে ওখানকার জঙ্গলের কথা, আর লিখেছে সেই জঙ্গলে এক রকম সাপ আছে, যা নাকি লম্বায় আমাদের অজগরের ডবল।
মোট কথা ভদ্রলোক খোশমেজাজে আছেন। এখনও পর্যন্ত কোনও নতুন ক্ষমতার পরিচয় দেননি। সত্যি বলতে কী, সে প্রসঙ্গ আর উত্থাপনই করেননি।
ক্রোল ও সন্ডার্স দুজনেই সাও পাউলো যাচ্ছে বলে লিখেছে। বলা বাহুল্য, দুজনেই নকুড়বাবুকে দেখার জন্য উদ্গ্ৰীব হয়ে আছে।
১০ই অক্টোবর, সাও পাউলো, রাত সাড়ে এগারোটা
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে, কনফারেন্সের কর্ণধার প্রোফেসর রডরিগেজের বাড়িতে ডিনার খেয়ে আধা ঘণ্টা হল ফিরেছি হোটেলে। শহরের প্রান্তে সমুদ্রের ধারে পৃথিবীর বহু বিখ্যাত হোটেলকে হার মানানো এই গ্র্যান্ড হোটেল। আমন্ত্রিতরা সকলেই এখানে উঠেছেন। আমাকে দেওয়া হয়েছে একটি বিশাল সুসজ্জিত সুইট —নম্বর ৭৭৭। আমার সেক্রেটারি নকুড় বিশ্বাস একই তলায় আছেন। ৭১২ নং সিঙ্গল রুমে।
এখানকার কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে ক্রোল ও সন্ডার্সও গিয়েছিল এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে। সেখানেই নকুড়বাবুর সঙ্গে ওদের আলাপ করিয়ে দিই। ক্রোলের সঙ্গে পরিচয় হতেই নকুড়বাবু জার্মান ভদ্রলোকটির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বললেন, আলপস—বাভারিয়ান আলপস—নাইনটিন থাটি টু-ইউ অ্যান্ড টু ইয়ং মেন ক্লাইমবিং, ক্লাইমবিং—দেন ক্লিপিং, ক্লিপিং, ক্লিপিং-দেন—উফফ—ভেরি ব্যাড।
ক্রোল দেখি মুখ হাঁ করে সম্মোহিতের মতো চেয়ে আছে নকুড়বাবুর দিকে। তারপর আর থাকতে না পেরে জার্মান ভাষাতেই চেঁচিয়ে উঠল—আমার পা হড়কে গিয়েছিল। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে হারম্যান ও কার্ল দুজনেরই প্ৰাণ যায়!
কথাটা বাংলায় অনুবাদ করে দিতে নকুড়বাবুও বাংলায় বললেন,দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। বলতে চাইনি। বড় মর্মান্তিক ঘটনা ওঁর জীবনের।
বলা বাহুল্য, ক্রোলকে আমার আর নিজের মুখে কিছু বলতে হয়নি। আমি জানি, সন্ডার্স এ ধরনের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ খানিকটা সন্দেহ পোষণ করে। সে প্রথমে কোনও মন্তব্য করেনি; এয়ারপোর্ট থেকে ফেরার পথে গাড়িতে আমার পাশে বসে একবার শুধু জিজ্ঞেস করল, ক্রোলের যুবা বয়সের এ ঘটনোটা তুমি জানতে?
আমি মাথা নেড়ে না বললাম।
এর পরে আর এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি।
আজি ডিনারে প্রোঃ রিডরিগেজের সেক্রেটারি মিঃ লোবোর সঙ্গে আলাপ হল। এখানকার অনেকেরই গায়ের রং যাকে বলে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, আর চোখের মণি এবং মাথার চুল কালো। মিঃ লোবোও এর ব্যতিক্রম নন। বেশ চালাকচাতুর ভদ্রলোক। ইংরিজিটাও মোটামুটি ভাল জানেন, ঘণ্টাখানেক আলাপেই আমাদের সঙ্গে বেশ মিশে গেছেন। তাঁকে বললাম যে, আমাদের খুব ইচ্ছে কনফারেন্সের পর ব্ৰেজিলের জঙ্গলের কিছুটা অংশ ঘুরে দেখা। নিশ্চয়, নিশ্চয়! বললেন মিঃ লোবো, যদিও বলার ঢঙে কোথায় যেন একটা কৃত্রিমতার আভাস পেলাম। আসলে এঁরা হয়তো চাইছেন, অতিথিদের ব্ৰেজিলের আধুনিক সভ্যতার নিদর্শনগুলি দেখাতে।
আজ আলোচনাসভায় আমি ইংরাজিতে বক্তৃতা করেছিলাম। আমার সেক্রেটারি সে বক্তৃতার সম্পূর্ণটাই শর্টহ্যান্ডে লিখে রেখেছেন। আমি জানি, আজকের দিনে টেপ রেকর্ডারের সাহায্যে বক্তৃতা তুলে রাখাটাই সবচেয়ে সহজ ও নির্ভরযোগ্য উপায়; কিন্তু নকুড়বাবু এত কষ্ট করে পিটম্যান শিখে এসেছেন, তাই মনে হল তাঁকে সেটার সদ্ব্যবহার করতে দেওয়াটাই ভাল।
আমার আবিষ্কার ও সেই সংক্রান্ত গবেষণার কাগজপত্রের প্রদর্শনীও আজই খুলল। যে সব জিনিস এতকাল গিরিডিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে আমার আলমারির মধ্যে পড়ে ছিল, সেগুলো হঠাৎ আজ পৃথিবীর বিপরীত গোলার্ধে ব্ৰেজিলের শহরে প্রকাশ্য প্রদর্শনীতে দেখতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। সত্যি বলতে কী, একটু যে ভয়ও করছিল না, তা নয়, যদিও ব্ৰেজিল সরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন ভালই। প্রদর্শনীর দরজার বাইরে এবং রাটানটান ইনস্টিটিউটের ফটকে সশস্ত্ৰ পুলিশ। কাজেই ভয়ের কারণ নেই।
১২ই অক্টোবর, সকাল সাড়ে ছটা
গতকাল বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেল।
কাল লাঞ্চের পর আমি আমার দুই বিদেশি বন্ধু ও সেক্রেটারি সমেত শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। কিছু কেনাকাটা সেরে বিকেলে হোটেলে ফিরে নকুড়বাবু তাঁর ঘরে চলে গেলেন। এটা লক্ষ করছি যে, ঠিক যতটুকু সময় আমার সঙ্গে না থাকলে নয়, তার এক মিনিটও বেশি থাকেন না ভদ্রলোক। ক্রোল আর সন্ডার্সও আমার ঘরে বসে কফি খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেল; কথা হল, স্নান করে এক ঘণ্টার মধ্যে হোটেলের লবিতে জমায়েত হয়ে একসঙ্গে যাব এখানকার এক সংগীতানুষ্ঠানে।
ব্ৰেজিলের কফির তুলনা নেই, তাই আমি নিজের জন্যে সবে আরেক পেয়ালা ঢেলেছি, এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠল। হ্যালো বলতে উলটো দিক থেকেই বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন এল–
ইজ দ্যাট প্রোফেসর শ্যান্ধু?
আমি জানালাম আমিই সেই ব্যক্তি।
দিস ইজ সলোমন ব্লুমগার্টেন।
নামটা মনে পড়ে গেল। ইনিই গিরিডিতে চিঠি লিখে আমার তিনটে আবিষ্কারের পেটেন্ট স্বত্ব কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
চিনতে পেরেছ আমাকে? প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
বিলক্ষণ।
একবার আসতে পারি কি? আমি এই হোটেলের লবি থেকেই ফোন করছি।
আমার মুশকিল হচ্ছে কী, এ সব অবস্থায় সরাসরি কিছুতেই না বলতে পারি না, যদিও জানি, এঁর সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ নেই। অগত্যা ভদ্রলোককে আসতেই বলতে হল।
মিনিটতিনেক পরে যিনি আমার ঘরে প্রবেশ করলেন, ঠিক তেমন একজন মানুষকে আর কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ভাগ্যে তৃতীয় ব্যক্তি কেউ নেই ঘরে; থাকলে সব দিক দিয়েই প্রমাণ সাইজের প্রায় দেড়া এই মানুষটির পাশে আমার মতো একজন মিনি মানুষকে দেখে তিনি কখনওই হাসি সংবরণ করতে পারতেন না।
দাঁড়ানো অবস্থায় এনার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব, তাই করমর্দনের ঠেলা কোনওমতে সামলে বললাম, বসুন, মিঃ ব্লুমগার্টেন।
কল মি সল।
চোখের সামনে থেকে পাহাড় সরে গেল। ভদ্রলোক আসন গ্ৰহণ করেছেন।
কল মি সল, আবার বললেন ভদ্রলোক, অ্যান্ড আইল কল ইউ শ্যাঙ্ক, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।
সল অ্যান্ড শ্যাঙ্ক। সলোমন ও শঙ্কু। এত চট সৌহার্দ্যের প্রয়োজন কী জানি না, তবে এটা জানি যে, এ ধরনের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলা ছাড়া গতি নেই। বললাম, বিলো, সল, কী করতে পারি তোমার জন্য।
তোমাকে তো বলেইছি। চিঠিতে। সেই একই প্রস্তাব আবার করতে এসেছি আমি। আজ তোমার প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। কিছু মনে করো না,-তোমার এইসব আশ্চর্য আবিষ্কার বিশ্বের কাছে গোপন রেখে তুমি অত্যন্ত স্বার্থপর কাজ করেছ।
দানবাকৃতি মানুষটি বসে পড়াতে আমার স্বাভাবিক মনের জোর অনেকটা ফিরে এসেছে। বললাম, তুমি কি মানবকল্যাণের জন্য এতই ব্যগ্র? আমার তো মনে হয়, তুমি আবিষ্কারগুলোর ব্যবসার দিকটাই দেখছ, তাই নয় কি?
মুহুর্তের জন্য সলোমন ব্লুমগার্টেনের লোমশ ভুরু দুটো নীচে নেমে এসে চোখ দুটোকে প্রায় ঢেকে ফেলে আবার তখনই যথাস্থানে ফিরে গেল।
আমি ব্যবসায়ী, শ্যাঙ্ক, তাই ব্যবসার দিকটা দেখব-তাতে আশ্চর্যের কী? কিন্তু তোমাকে বঞ্চিত করে তো নয়! তোমাকে আমি এক লাখ ডলার দিতে প্ৰস্তুত আছি। ওই তিনটি আবিষ্কারের স্বত্বের জন্য। চেকবই আমার সঙ্গে আছে। নগদ টাকা চাও, তাও দিতে পারি—তবে এতগুলো টাকা সঙ্গে নিয়ে তোমারই অসুবিধা হবে।
আমি মাথা নাড়লাম। চিঠিতে যে কথা বলেছিলাম, সেটাই আবার বললাম যে, আমার এই জিনিসগুলো কোনওটাই মেশিনের সাহায্যে কারখানায় তৈরি করা সম্ভব নয়।
গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে ব্লুমগার্টেন বেশ কিছুক্ষণ সটান আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন চারটি ইংরিজি শব্দ।
আই ডোন্ট বিলিভ ইউ।
তা হলে আর কী করা যায় বলে।
আই ক্যান ডাবল মাই প্রাইস, শ্যাঙ্ক!
কী মুশকিল! লোকটাকে কী করে বোঝাই যে, আমি দিব্যি আছিম আমার আর টাকার দরকার নেই, এক লক্ষের জায়গায় বিশ লাখ পেলেও আমি স্বত্ব বিক্রি করব না।
ভদ্রলোক কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি আমার সেক্রেটারি।
ইয়ে—ভারী কিন্তু কিন্তু ভাব করে ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে এলেন।-–কাল সকালের প্রোগ্রামটা–?
এইটুকু বলে ব্লুমগার্টেনের দিকে চোখ পড়াতে নকুড়বাবু হঠাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেললেন।
ভারী অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। ব্লুমগার্টেনকে হঠাৎ দেখলে অনেকেরই কথার খেই হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু নকুড়বাবু যেন শুধু হারাননি; সেই সঙ্গে কিছু যেন পেয়েছেনও তিনি।
কালকের প্রোগ্রামের কথা জানতে চাইছিলেন কি?
পরিস্থিতিটাকে একটু সহজ করার জন্য প্রশ্নটা করলাম আমি।
প্রশ্নের উত্তরে যে কথাটা নকুড়বাবুর মুখ দিয়ে বেরোল, সেটা বর্তমান ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। ব্লুমগার্টেনের দিক থেকে চোখ না। সরিয়েই ভদ্রলোক মৃদু স্বরে দুবার এল ডোরাডো কথাটা উচ্চারণ করে কেমন যেন হতভম্ব ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হু ওয়াজ দ্যাট ম্যান?
আমি দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্নটা করলেন সলোমন ব্লুমগার্টেন।
আমি বললাম, আমার সেক্রেটারি।
এল ডোরাডো কথাটা বলল কেন হঠাৎ?
ব্লুমগার্টেনের ধাঁধালো ভাবটা আমার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। বললাম, দক্ষিণ আমেরিকা সম্বন্ধে পড়াশুনা করছেন। ভদ্রলোক, কাজেই এল ডোরাডো নামটা জানা কিছুই আশ্চর্য নয়।
সোনার শহর এল ডোরাডোর কিংবদন্তির কথা কে না জানে? ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন থেকে কোর্টেজের সৈন্য দক্ষিণ আমেরিকায় এসে স্থানীয় অধিবাসীদের যুদ্ধে হারিয়ে এ দেশে স্পেনের আধিপত্য বিস্তার করে। তখনই এখানকার উপজাতিদের মুখে এল ডোরাডোর কথা শোনে স্পেনীয়রা, আর তখন থেকেই এ নাম চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। ধনলিঙ্গু পর্যটকদের। ইংল্যান্ডের স্যার ওয়ালটর র্যালে পর্যন্ত এল ডোরাডোর টানে নৌবহর নিয়ে হাজির হয়েছিলেন এই দেশে। কিন্তু এল ডোরাডো চিরকালই অন্বেষণকারীদের ফাঁকি দিয়ে এসেছে। পেরু, বোলিভিয়া, কলোম্বিয়া, ব্রোজিল, আর্জেন্টিনা-দক্ষিণ আমেরিকার কোনও দেশেই এল ডোরাডোর কোনও সন্ধান মেলেনি।
ব্লুমগার্টেন হতবাক হয়ে টেবিলল্যাম্পের দিকে চেয়ে রয়েছে দেখে আমি বাধ্য হয়েই বললাম, আমাকে বেরোতে হবে একটু পরেই; কাজেই তোমার যদি আর কিছু বলার না থাকে তা হলে-
ভারতীয়রা তো জাদু জানে। আমার কথা চাপা দিয়ে প্রশ্ন করল ব্লুমগার্টেন।
আমি হেসে বললাম, তই যদি হত, তা হলে ভারতে এত দারিদ্র্য থাকত কি? জাদু জানলেও নিজেদের অবস্থার উন্নতি করার জাদু তারা নিশ্চয়ই জানে না।
সে তো তোমাকে দিয়েই বুঝতে পারছি ব্যঙ্গের সুরে বলল ব্লুমগার্টেন, যে দেশের লোক টাকা হাতে তুলে দিলেও সে টাকা নেয় না, সে দেশ গরিব থাকতে বাধ্য। কিন্তু…
ব্লুমগার্টেন আবার চুপ, আবার অন্যমনস্ক। আমার আবার অসহায় ভােব; এ লোকটাকে তাড়ানোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।
জাদুর কথা বলছি। এই কারণে, বলল কুমগার্টেন, আমার যে মুহুর্তে এল ডোরাডোর কথাটা মনে হয়েছে, সেই মুহুর্তে নামটা কানে এল ওই ভদ্রলোকের মুখ থেকে। আজ থেকে দুশো বছর আগে আমার পূর্বপুরুষরা পরপর তিন পুরুষ ধরে উত্তর আমেরিকা থেকে এদেশে পাড়ি দিয়েছে এল ডোরাডোর সন্ধানে। আমি নিজে দুবার এসেছি। যুবা বয়সে। পেরু, বোলিভিয়া, গুইয়ানা, ইকুয়েডর, ভেনিজুয়েলা—কোনও দেশে খোঁজা বাদ দিইনি। শেষে ব্ৰেজিলে এসে জঙ্গলে ঘুরে ব্যারাম বাধিয়ে বাধ্য হয়ে এল ডোরাডোর মায়া ত্যাগ করে দেশে ফিরে যাই। আজ এতদিন পরে আবার ব্ৰেজিলে এসে কাল থেকে মাঝে মাঝে এল ডোরাডোর কথাটা মনে পড়ে যাচ্ছে, আর আজ…
আমি কোনও মন্তব্য করলাম না। ব্লুমগার্টেনও উঠে পড়ল। বলল, আমি ম্যারিনা হোটেলে আছি। যদি মত পরিবর্তন কর তো আমাকে জানিও।
ক্রোল আর সন্ডার্সকে ঘটনোটা বলতে তারা দুজনেই রেগে আগুন। সন্ডার্স বলল, তুমি অতিরিক্ত রকম ভদ্র, তাই এই সব লোকের ঔদ্ধত্য হজম কর। এবার এলে আমাদের একটা ফোন করে দিয়ো, আমরা এসে যা করার করব।–
এর পরের ঘটনোটা ঘটল। মাঝরাত্তিরে। পরে ঘড়ি দেখে জেনেছিলাম, তখন সোয়া দুটো। ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। বিদেশবিভুঁইয়ে এত রাত্তিরে আমার ঘরে কে আসতে পারে?
দরজা খুলে দেখি শ্ৰীমান নকুড় বিশ্বাস। ফ্যাকাশে মুখ, ত্ৰস্ত ভাব।
অপরাধ নেবেন না তিলুবাবু, কিন্তু না এসে পারলাম না।
ভদ্রলোকের চেহারাটা ভাল লাগছিল না, তাই বললাম, আগে বসুন, তারপর কথা হবে।
সোফায় বসেই নকুড়বাবু বললেন, কপি হয়ে গেল।
কপি? কীসের কপি? এত রাত্তিরে এ সব কী বলতে এসেছেন ভদ্রলোক?
যন্ত্রটার নাম জানি না, বলে চললেন নকুড়বাবু, তবে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। একটা বাক্সর মতো জিনিস, ভিতরে আলো জ্বলছে, ওপরে একটা কাচ। একটা কাগজ পুরে দেওয়া হল যন্ত্রে; তারপর একটা হাতল ঘোরাতেই কাগজের লেখা অন্য একটা কাগজে হুবহু নকল হয়ে বেরিয়ে এল।
শুনে মনে হল, ভদ্রলোক জেরক্স ড়ুপলিকেটিং যন্ত্রের কথা বলছেন।
কী কাগজ ছাপা হল? প্রশ্ন করলাম আমি।
নকুড়বাবুর দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে। একটা আতঙ্কের ভাব দেখা দিয়েছে মুখে।
কী ছাপা হল? আবার জিজ্ঞেস করলাম।
নকুড়বাবু এবার মুখ তুলে চাইলেন আমার দিকে। সংশয়াকুল দৃষ্টি।
আপনার আবিষ্কারের সব ফরমুলা, চাপা গলায় দৃষ্টি বিস্ফারিত করে বললেন নকুড়বাবু।
আমি না হেসে পারলাম না।
আপনি এই বলতে এসেছেন এত রাত্তিরে? আমার ফরমুলা প্রদর্শনীর ঘর থেকে বেরোবে কী করে? সে তো—
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা চুরি হয় না? দলিল চুরি হয় না? প্রায় ধমকের সুরে বললেন নকুড়বাবু। আর ইনি যে ঘরের লোক। ঘরের লোককে পুলিশই বা আটকাবে কেন?
ঘরের লোক?
ঘরের লোক, তিলুবাবু। মিস্টার লোবো। আমার মনে হল ভয়ংকর আবোল তাবোল বকছেন নকুড়বাবু। বললাম, এ সব কি আপনি স্বপ্নে দেখলেন?
স্বপ্ন নয়। গলার স্বর তিন ধাপ চড়িয়ে বললেন নকুড়বাবু। চোখের সামনে জলজ্যাস্ত দেখতে পেলাম। এই দশ মিনিট আগে। হাতে টর্চ নিয়ে ঢুকলেন মিঃ লোবো-নিজে চাবি দিয়ে প্রদর্শনীর ঘরের দরজা খুলে। প্রহরী চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে। লোবো সোজা চলে গেলেন একটা বিশেষ টেবিলের দিকে-যেটার কাচের ঢাকনার তলায় আপনার খাতাপাত্তর রয়েছে। ঢাকনা তুলে দুটো খাতা বার করলেন মিঃ লোবো। তারপর অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে গিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে। উপরের তলার একটা আপিসঘরে গিয়ে ঢুকলেন। সেইখানে রয়েছে এই যন্ত্র। কী নাম এই যন্ত্রের তিলুবাবু?
জেরক্স, যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বললাম আমি। কেন যেন নকুড়বাবুর কথাটা আর অবিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু মিঃ লোবো।
আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করার জন্য আমি অত্যন্ত লজ্জিত তিলুবাবু, আবার সেই খুব চেনা কুষ্ঠার ভাব করে বললেন নকুড় বিশ্বাস, কিন্তু খবরটা আপনাকে না দিয়ে পারলাম না। অবিশ্যি আমি যখন রয়েছি, তখন আপনার যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। যেটা ঘটতে যাচ্ছে, সেটা আগে থাকতে জানতে পারলে একটা মস্ত সুবিধে তো! আসলে নতুন জায়গায় এসে মনটাকে ঠিক সংহত করতে পারছিলাম না, তাই লোবোবাবুর ঘটনোটা আগে থেকে জানতে পারিনি—কেবল বুঝেছিলাম, আপনার একটা বিপদ হবে সাও পাউলোতে।
নকুড়বাবু আবার ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, আর আমিও চিন্তিতভাবে এসে বিছানায় শুলাম।
আমার মধ্যে নকুড়বাবুর মতো অতি প্রাকৃত ক্ষমতা না থাকলেও এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, লোবোর মতো লোকের পক্ষে নিজে থেকে এ জিনিস করা সম্ভব নয়। তার পিছনে অন্য লোক আছে। পয়সাওয়ালা লোক।
ভাবলে একজনের কথাই মনে হয়।
সলোমন ব্লুমগার্টেন।
১২ই অক্টোবর, রাত পৌনে বারোটা
আজ রাটানটান ইনস্টিটিউট থেকে আমাকে ডক্টরেট দেওয়া হল। মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান, প্রোঃ রডরিগেজ-কে নিয়ে চারজন বিভিন্ন দেশের বৈজ্ঞানিকের আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষণ, ও সবশেষে আমার ধন্যবাদজ্ঞাপন। সব মিলিয়ে মনটা ভারী প্ৰসন্ন হয়ে উঠেছিল। আজ ডিনারে আমার দুই বন্ধু ও প্রোঃ রিডগিারেজের উপরোধে জীবনে প্রথম এক চুমুক শ্যাম্পেন পান করলাম। এটাও একটা ঘটনা বটে।
কাল নকুড়বাবুর মুখে মিঃ লোবোর বিষয় শুনে মনটা বিষিয়ে গিয়েছিল, আজ ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে মনে হচ্ছে, নকুড়বাবু হয়তো এবার একটু ভুল করেছেন। প্রদর্শনীতে টু মেরে দেখে এসেছি যে, আমার কাগজপত্র ঠিক যেমন ছিল তেমনই আছে।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে হল এগারোটা। ঢুকেই একটা দৃশ্য দেখে একেবারে হকচকিয়ে যেতে হল।
হোটেলের লবিতে চতুর্দিকেই বসার জন্য সোফা, ছড়ানো রয়েছে; তারই একটায় দেখি একপাশে বিশালবপু সলোমন ব্লুমগার্টেন ও অন্যপাশে একটি অচেনা বিদেশি ভদ্রলোককে নিয়ে বসে আছেন আমার সেক্রেটারি শ্ৰীনকুড়চন্দ্ৰ বিশ্বাস।
আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই নকুড়বাবু একগাল হেসে উঠে এলেন।
এনাদের সঙ্গে একটু বাক্যালাপ করছিলাম।
ব্লুমগার্টেনও উঠে এলেন।
কনগ্র্যাচুলেশনস।
করমর্দনে যথারীতি হাতব্যথা করিয়ে দিয়ে ব্লুমগার্টেন চোখ কপালে তুলে বললেন, তুমি কাকে সেক্রেটারি করে নিয়ে এসেছ? ইনি তো অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি! আমার চোখের দিকে চেয়ে আমার নাড়িনক্ষত্র বলে দিলেন।
দুজনের মধ্যে মোলাকতটা কীভাবে হল সেটা ভাবছি, তার উত্তর নকুড়বাবুই দিয়ে দিলেন।
আমার বন্ধু যোগেন বকশীর ছেলে কানাইলালকে একটা পোস্টকার্ড লিখে পোস্ট করার জন্য এই কাউন্টারে দিতে গিয়ে দেখি, এনারা পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় দেখে ব্লুমগাটেনসাহেবই এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। বললেন, কাল আমার মুখে এল ডোরাডোর নাম শুনে ওঁর কৌতূহল হচ্ছে, আমি এল ডোরাডো সম্পর্কে কত দূর জানি। আমি বললুম-আই অ্যাম মুখৃসুখ্য ম্যান-নো এড়ুকেশন-কাল একটা বেঙ্গলি বইয়ে পড়ছিলাম এল ডোরাডোর কথা। তা, পড়তে পড়তে যেন সোনার শহরটাকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। তা ইনি–
নকুড়বাবুর বাক্যস্রোত বন্ধ করতে হল। ক্রোল ও সন্ডার্সের মুখের ভাব দেখেই বুঝছিলাম তাদের প্রচণ্ড কৌতূহল হচ্ছে ব্যাপারটা জানার জন্য। নকুড়বাবু এ পর্যন্ত যা বলেছেন সেটার ইংরেজি তর্জমা করে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলাম আমি। ততক্ষণে অবিশ্যি আমরা তিনজনেই একটা পাশের সোফায় বসে পড়েছি, এবং আমি আমার দুই বন্ধুর সঙ্গে ব্লুমগার্টেনের আলাপ করিয়ে দিয়েছি। অন্য বিদেশি ভদ্রলোকটির নাম নাকি মাইক হ্যাচেট। হাবভাবে বুঝলাম, ইনি ব্লুমগার্টেনের বডিগার্ড বা ধামাধারী গোছের কেউ।
এবার ব্লুমগার্টেনই কথা বলল—
ইওর ম্যান বিসওয়াস ইজ এ রিয়্যাল উইজার্ড। ওকে মাইরনের হাতে তুলে দিলে সে রাতারাতি সোনা ফলিয়ে দেবে, অ্যান্ড ইওর ম্যান উইল বি ওনিং এ ক্যাডিল্যাক ইন খ্রি মানথাস টাইম!
মাইরন লোকটি কে জিজ্ঞেস করাতে ব্লুমগার্টেন চোখ কপালে তুলে বললেন, হোলি স্মোক–মাইরনের নাম শোনোনি? মাইরন এন্টারপ্রাইজেস! অত বড় ইমপ্রেসারিও আর নেই। কত গাইয়ে, বাজিয়ে, নাচিয়ে জাদুকর মাইরনের ম্যানেজমেন্টের জোরে দাঁড়িয়ে গেল, আর ইনি তো প্ৰতিভাধর ব্যক্তি।
আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। নকুড়বাবু শেষটায় রঙ্গমঞ্চে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে নাম কিনবেন? কই, এমন তো কথা ছিল না!
অ্যান্ড হি নোজ হোয়্যার এল ডোরাডো ইজ!
আমি নকুড়বাবুর দিকে দৃষ্টি দিলাম। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। বললাম, কী মশাই, আপনি কি সাহেবকে বলেছেন, এল ডোরাডো কোথায় তা আপনি জানেন?
যেটুকু আমি জানি, সেটুকুই বলেছি, কাঠগড়ার আসামির মতো হাত জোড় করে বললেন নকুড় বিশ্বাস-বলেছি, এই ব্ৰেজিলেই আছে এল ডোরাডো। আমরা যেখানে আছি, তার উত্তর পশ্চিমে। একটি পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকার ঠিক মধ্যিখানে এক গভীর জঙ্গল, সেই জঙ্গলের মধ্যে এই শহর। কেউ জানে না। এই শহরের কথা। মানুষজন বলতে আর কেউ নেই। সেখানে। পোড়ো শহর, তবে রোদ পড়লে এখনও সোনা ঝলমল করে। সোনার তোরণ, সোনার পিরামিড, যেখানে সেখানে সোনার স্তম্ভ, বাড়ির দরজা জানালা সব সোনার। সোনা তো আর নষ্ট হয় না, তাই সে সোনা এখনও আছে। লোকজন যা ছিল, হাজার বছর আগে সব লোপ পেয়ে যায়। একবার খুব বিষ হয়; তারপরেই জঙ্গলে এক মারাত্মক পোকা দেখা দেয়; সেই পোকা থেকেই মড়ক। বিশ্বাস করুন। তিলুবাবু, এ সবই আমি পর পর চোখের সামনে বায়োস্কোপের ছবির মতো দেখতে পেলুম।
ক্রোল ও সন্ডার্সের জন্য এই অংশটুকু ইংরিজিতে অনুবাদ করে দিয়ে ব্লুমগার্টেনকে বললাম, তুমি তো তা হলে এল ডোরাডোর হদিস পেয়ে গেলে; এবার অভিযানের তোড়জোড় করো। আমরা আপাতত ক্লান্ত, কাজেই আমাদের মাপ করো। —আসুন নকুড়বাবু।
আমার কথায় ব্লুমগার্টেনের মুখে যে থমথমে ভাবটা দেখা দিল, সেটা যে কোনও লোকের মনে ত্রাসের সঞ্চার করত। আমি সেটা যেন দেখেও দেখলাম না। নকুড়বাবু উঠে এলেন ভদ্রলোকের পাশ ছেড়ে।
আমরা চারজনে গিয়ে বসলাম আমার ঘরে। নকুড়বাবুর ইচ্ছে ছিল সোজা নিজের ঘরে চলে যান, কিন্তু আমি বললাম যে, তাঁর সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। দুই সাহেব বন্ধুর কাছে বাংলা বলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নকুড়বাবুকে বললাম, দেখুন মশাই, আমি আপনার ভালর জন্যই বলছি-আপনার মধ্যে যে ক্ষমতোটা আছে, সেটা যার তার কাছে এভাবে প্রকাশ করবেন না। আপনার অভিজ্ঞতা কম, আপনি হয়তো লোক চেনেন না, কিন্তু এটা বলে দিচ্ছি যে, এই ব্লুমগার্টেনের খপ্পরে পড়লে আপনার সর্বনাশ হবে। আপনাকে অনুরোধ করছি—আমাকে না জানিয়ে ফস করে কিছু একটা করে বসবেন না।
নকুড়বাবু লজ্জায় প্রায় কাপেটের সঙ্গে মিশে গেলেন। বললেন, আমায় মাপ করবেন। তিলুবাবু; আমার সত্যিই অপরাধ হয়েছে। আসলে বিদেশে তো আসিনি কখনও! মফস্বলের মানুষ, তাই হয়তো মাথাটা একটু ঘুরে গিয়ে থাকবে। আমাকে সাবধান করে দিয়ে আপনি সত্যিই খুব উপকার করলেন।
নকুড়বাবু উঠে পড়লেন।
ভদ্রলোক চলে যাবার পর ক্রোল তার পাইপে টান দিয়ে এক ঘর ধোঁয়া ছেড়ে বলল, এল ডোরাডো যদি সত্যিই থেকে থাকে, তা হলে সেটা আমাদের একবার দেখে আসা উচিত নয় কি?
আগেই বলেছি, সন্ডার্স এ সব ব্যাপারে ঘোর সন্দেহবাদী। সে ধমকের সুরে বলল, দেখো হে জার্মান পণ্ডিত, তিন শো বছর ধরে সোনার স্বপ্ন দেখা অজস্ৰ লোক দক্ষিণ আমেরিকা চাষে বেড়িয়েও এল ডোরাডোর সন্ধান পায়নি, আর এই ভদ্রলোকের এই কটা কথায় তুমি মেতে
8.
উঠলে? ওই অতিকায় ইহুদি যদি এ সব কথায় বিশ্বাস করে জঙ্গলে গিয়ে জাগুয়ারের শিকার হতে চান, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি এর মধ্যে নেই। আমাদের যা প্ল্যান হয়েছে তার একচুল এদিক ওদিক হয় এটা আমি চাই না। আমার বিশ্বাস শঙ্কুও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত।
আমি মাথা নেড়ে সন্ডার্সের কথায় সায় দিলাম। আমাদের প্ল্যান হল, আমরা কাল সকলে ব্রেকফাস্টের পর প্লেনে করে চলে যাব উত্তরে, ব্ৰেজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়া শহরে। সেখানে একদিন থেকে ছোট প্লেন ধরে আমরা চলে যাব জিঙ্গু ন্যাশনাল পার্কের উত্তর প্রান্তে পোস্টে ডিয়াউয়ারুম শহরে। তারপর বাকি অংশ নদীপথে। জিঙ্গু নদী ধরে নৌকা করে আমরা যাব পোরোরি গ্রামে। পোরেরিতে ব্ৰেজিলের এক আদিম উপজাতি চুকাহামাইদের কিছু লোক এখনও রয়েছে, যারা এই সে দিন পর্যন্ত ছিল প্রস্তরযুগের মানুষ। ব্রাসিলিয়া থেকেই আমাদের সঙ্গে থাকবেন। একজন বিশেষজ্ঞ, যাকে এখানকার ভাষায় বলা হয় সেরটানিস্টা। কথাটার মানে হল অরণ্য অভিজ্ঞ। সেরটানিস্টারা উপজাতিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে অগ্রণী; তাদের ভাষা থেকে আরম্ভ করে সব কিছুই এরা খুব ভালভাবে জানে।
পোরেরি ছেড়ে আরও খানিকটা পথ উত্তরে গিয়ে ভন মাটিয়ুস জলপ্রপাত দেখে আবার ব্ৰাসিলিয়া ফিরে এসে সেখান থেকে প্লেন ধরে যে যার দেশে ফিরব। দিন সাতেকের মধ্যে পুরো সফর হয়ে যাওয়া উচিত, তবে ব্ৰেজিল সরকার বলেছেন, প্রয়োজনে আতিথেয়তার মেয়াদ তিনদিন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে প্ৰস্তুত আছেন তাঁরা।
সাড়ে এগারোটা বাজে, তাই ক্রোল ও সন্ডার্স উঠে পড়ল। ক্রোল যে আমাদের দুজনের সঙ্গে একমত নয়, সেটা সে যাবার আগে জানিয়ে দিয়ে গেল দরজার মুখটাতে দাঁড়িয়ে—
আমার অবাক লাগছে শঙ্কু! যে তুমি তোমার এত কাছের লোককে চিনতে পারছি না! তোমার এই সেক্রেটারিটির চোখের দৃষ্টিই আলাদা। হোটেলের লবিতে বসে যখন সে এল ডোরাডোর বর্ণনা দিচ্ছিল, তখন আমি ওর চোখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
সন্ডার্স কথাটা শুনে আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে হাতে গেলাস ধরার মুদ্রা করে বুঝিয়ে দিল যে, ক্রোল আজ পাটিতে শ্যাম্পেনটা একটু বেশি খেয়েছে।
বারোটা বেজে গেছে। শহর নিস্তব্ধ। শুয়ে পড়ি।
১৩ই অক্টোবর, হোটেল ক্যাপিটল, ব্রাসিলিয়া, দুপুর আড়াইটা
আমরা ঘণ্টাখানেক হল এখানে পৌঁছেছি। আমরা মানে আমরা তিন বন্ধু ও মিঃ লোবো। লোবো পুরো সফরটাই আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আমি অন্তত এক মুহুর্তের জন্যও সৌজন্যের কোনও অভাব লক্ষ করিনি। ভদ্রলোকের ব্যবহারে।
এখানে নকুড়বাবুর কথাটা স্বভাবতই এসে পড়ে, যদিও কোনও প্রসঙ্গের দরকার ছিল না। সোজা বাংলায় বলতে গেলে ভদ্রলোক আমাকে লেঙ্গি মেরেছেন, এবং সেটা যে টাকার লোভেও সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
আজ সাও পাউলোতে আমার রুম বয় সকালের কফির সঙ্গে একটা চিঠি এনে দিল। বাংলা চিঠি, আর হস্তাক্ষর আমার চেনা। আগেরটার তুলনায় বলতেই হয়, এটার ভাষা অপেক্ষাকৃত সহজ। এই হল চিঠি–
প্রিয় তিলুবাবু,
অধমের অপরাধ লইবেন না। নগদ পাঁচ হাজার ডলারের লোভ সংবরণ করা সম্ভবপর হইল না। আমার পিতামহী আজ চারি বৎসর যাবৎ এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী। আমি সাড়ে আট বৎসর বয়সে আমার মাতৃদেবীকে হারাই। তখন হইতে আমি আমার পিতামহীর দ্বারাই লালিত। শুনিয়াছি, এ দেশে এই রোগের এক আশ্চর্য নূতন ঔষধ বাহির হইয়াছে। ঔষধের মূল্য অনেক। ব্লুমগার্টেনসাহেবের বদান্যতায় এই মহাৰ্য ঔষধ কিনিয়া দেশে ফিরিবার সৌভাগ্য হইবে আমার।
আজ সকালেই আমরা ব্লুমগার্টেন মহাশয়ের ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার বিমানে রওনা হইতেছি। আমাদের লক্ষ্য সাও পাউলোর সাড়ে তিনশো মাইল উত্তর পশ্চিমে একটি অরণ্য অঞ্চল। এই অরণ্যের মধ্যেই এল ডোরাডো অবস্থিত। আমার সাহায্য ব্যতীত ব্লুমগার্টেনমহোদয় কোনওক্রমেই এল ডোরাডো পৰ্ছছিতে পারিতেন না। তাঁহার প্রতি অনুকম্পাবশত আমি নির্দেশ দিতে সম্মত হইয়াছি। আমার কার্য সমাধা হইলেই আমি আপনাদের সহিত মিলিত হইব। আপনাদের যাত্রাপথ আমার জানা আছে।
ঈশ্বর আপনাদিগের মঙ্গল করুন। আমি যদি ঈশ্বরের কৃপায় আপনার কোনওরূপ সাহায্য করিতে পারি, তবে নিজেকে কৃতাৰ্থ জ্ঞান করিব। ইতি
দাসানুদাস সেবক
শ্ৰীনকুড়চন্দ্ৰ বিশ্বাস
হোটেলের রিসেপশনে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, নকুড়বাবু সত্যিই বেরিয়ে গেছেন ভোর ছ’টায়।
জনৈক বিশালবপু ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে ছিলেন কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ছিলেন।
আমার চেয়েও বেশি বিরক্ত হয়েছে সন্ডার্স, এবং সেটা শুধু নকুড়বাবুর উপর নয়; আমার উপরেও। বলল, তোমার আমার মতো লোকের এই ভৌতিক অলৌকিক প্রেতলৌকিক ব্যাপারগুলো থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল।
ক্রোল কিন্তু ব্যাপারটা শুনে বেশ মুষড়ে পড়েছে; এবং সেটা অন্য কারণে। সে বলল, তোমার লোক যখন বলছে আমাদের আবার মিট করবে, তখন বোঝাই যাচ্ছে যে, এল ডোরাডো আমাদের গন্তব্যস্থল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেক্ষেত্রে আমরাও যে কেন সেখানে যেতে পারি না, সেটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
আমি আর সন্ডার্স ক্রোলের এই অভিযোগ কানে তুললাম না।
ব্রাসিলিয়া ব্ৰেজিলের রাজধানী হলেও সাও পাউলোর সঙ্গে কোনও তুলনা চলে না। আমরা হোটেলে পৌঁছোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দলে যে সেরটানিস্ট বা অরণ্যঅভিজ্ঞ ভদ্রলোকটি যাবেন-নাম হাইটির-তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। বয়স বেশি না হলেও, চেহারায় একটা অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। তার উপরে ঠাণ্ডা মেজাজ ও স্নিগ্ধ ব্যবহার দেখে মনে হয়, উপজাতিদের সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য ইনিই আদর্শ ব্যক্তি। তাঁকে আজ ক্রোল জিজ্ঞেস করেছিল, এল ডোরাডোর সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা। প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক চোখ কপালে তুলে বললেন, আজকের দিনে আবার এল ডোরাডোর প্রশ্ন তুলছেন কেন? সে তো কোনকালে মিথ্যে বলে প্ৰমাণ হয়ে গেছে। এল ডোরাডো তো শহরই নয়; আসলে ওটা একজন ব্যক্তি। ডোরাডো কথাটা সোনার শহর বা সোনার মানুষ দুইই বোঝায় পর্তুগিজ ভাষায়। সূর্যের প্রতীক হিসেবে কোনও এক বিশেষ ব্যক্তিকে পুরাকালে এখানকার অধিবাসীরা পুজো করত, আর তাকেই বলত এল ডোরাডো।
চোখের পলকে একজন মানুষকে কখনও এমন হতাশ হতে দেখিনি, যেমন দেখলাম ক্রোলকে।
কাল সকালে আমাদের আবার যাত্রা শুরু। নকুড়বাবু অন্যায় কাজ করেছেন সেটা ঠিকই, কিন্তু তার জন্য আমি যে বেশ খানিকটা দায়ী, সেটাও ভুলতে পারছি না। আমিই তো প্রথমে তাঁকে আমার সঙ্গে নিয়ে আসার প্রস্তাবটা করি।
১৬ই অক্টোবর, বিকেল সাড়ে চারটে
বাহারের নকশা করা ক্যানু নৌকাতে জিঙ্গু নদী ধরে আমরা চলে এসেছি। প্রায় তেত্রিশ মাইল। আমরা পাঁচজন-অৰ্থাৎ আমি, ক্রোল, সন্ডার্স লোবো। আর হাইটির-ছাড়া রয়েছে দুজন নৌকাবাহী দক্ষিণ আমেরিকান ইন্ডিয়ান। আরও দুজন নৌকাবাহী সহ আর একটি ক্যানুতে চলেছে আমাদের মালপত্র রসদ, ইত্যাদি। এখন আমরা নদীর ধারে একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গা বেছে সেখানে তাঁবু ফেলেছি। তাঁবুর কাছেই তিনটি গাছে দুটি হ্যামক বাঁধা রয়েছে; সন্ডার্স ও ক্রোল তার এক একটি দখল করে তাতে শুয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছে ব্ৰেজিলের বিখ্যাত অ্যানাকোন্ড সাপ নিয়ে। এই অ্যানাকোন্ড যে সময় সময় বিশাল আকার ধারণ করে, সেটা অনেক পর্যটকের বিবরণ থেকেই জানা যায়। ক্রোলের মতে ত্রিশ হাত পর্যন্ত লম্বা হওয়া কিছুই আশ্চর্য না। সন্ডার্স সেটা বিশ্বাস করতে রাজি নয়। এখানে বলে রাখি যে, আমাদের তিনজনের কেউই চিড়িয়াখানার বাইরে অ্যানাকোন্ড দেখিনি। এ যাত্রায় আমাদের ভাগ্যে অ্যানাকোন্ডার সাক্ষাৎ পাওয়া আছে কি না জানি না। না থাকলেও আমার অন্তত তাতে আপশোস নেই। লতাগুল্ম ফলমূল কীটপতঙ্গ পশুপাখিতে ভরা ব্ৰেজিলের জঙ্গলের যে রূপ। আমরা এখন পর্যন্ত দেখেছি, তার কোনও তুলনা নেই। বন গভীর ও অন্ধকার হলেও তাতে রঙের অভাব নেই। প্রায়ই চোখে পড়ে লানটানা ফুলের ঝোপ, হরেক রঙের প্রজাপতি আর চোেখ ঝলসানো সব কাকাতুয়া শ্রেণীর পাখি। নৌকা চলার সময় জলে হাত দেওয়া বারণ, কারণ নদীতে রাষ্ণুসে পিরানহা মাছের ছড়াছড়ি। কালই নদীর ধারে একটা কেইম্যান কুমিরের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম; তার মাথার দিকের খানিকটা অংশ ছাড়া আর কোথাও মাংস নেই, শুধু হাড়। মাংস গেছে। পিরানহার পেটে।
ব্ৰেজিলের অনেক অংশেই বহুদিন পর্যন্ত বাইরের মানুষের পা পড়েনি। গত বছর দশেকের মধ্যে বেশ কিছু জঙ্গল কেটে চাষের জমি বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্রোজিল সরকারের হাইওয়ে বানানোর কাজও চলেছে জঙ্গল কেটে, আর ডিনামাইটের সাহায্যে পাহাড় উড়িয়ে। আমরা আসার পথেও বেশ কয়েক বার ডিনামাইট বিস্ফোরণ বা ব্লাস্টিং-এর শব্দ পেয়েছি। কাল মাঝরাত্রে একটা গুরুগম্ভীর বিস্ফোরণের শব্দে আমাদের ক্যাম্পের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। শব্দতরঙ্গের চাপ। এত প্রবল ছিল যে, ক্রোলের বিয়ার গ্লাসটা তার ফলে ফেটে চৌচির হয়ে গেল। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছিল, তাই আজ সকালে হাইটারকে জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি কোনও আগ্নেয়গিরি আছে কি না। হাইটির মুখে কিছু না বলে কেবল গভীর মুখে মাথা নাড়ল।
১৭ই অক্টোবর, ভোর ছটা
কাল রাত্রে এক বিচিত্ৰ ঘটনা।
রাত্রে মশা, আর দিনে জ্বালাতুনে ব্যারাকুড়া মাছির উপদ্রব থেকে রক্ষা পাবার জন্য আমি গিরিডি থেকেই একরকম মলম তৈরি করে এনেছিলাম। তিন বন্ধুতে সেই মলম মেখে সাড়ে নটার মধ্যেই যে যার ক্যাম্পে শুয়ে পড়েছিলাম। যদিও এখানে রাত্রে নিস্তব্ধতা বলে কিছু নেই, ঝিঝি থেকে শুরু করে জাগুয়ার পর্যন্ত সব কিছুরই ডাক শোনা যায়, তবু দিনের ক্লাস্তির জন্য ঘুমটা এসে যায় বেশ তাড়াতাড়ি। সেই ঘুম হঠাৎ ভেঙে গেল এক বিকট চিৎকারে।
আমি ও সন্ডার্স হন্তদন্ত হয়ে আমাদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, ক্রোলও তার তাঁবু। থেকে বেরিয়ে এসেছে, এবং তৃতীয় তাঁবু থেকে হাইটর।
কিন্তু মিঃ লোবো কোথায়?
ক্রোল টৰ্চটা জ্বালিয়ে এদিক ওদিক ফেলতেই দেখা গেল। ভদ্রলোককে। মুখ বিকৃত করে বিশ হাত দূরে একটা ঝোপের পাশ থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে এসেছেন আমাদের দিকে। আর সেই সঙ্গে পর্তুগিজ ভাষায় পরিত্ৰাহি ডেকে চলেছেন ভগবান যিশুকে।
আমার পায়ে দিয়েছে কামড়, আমি আর নেই-সন্ডার্সের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন মিঃ লোবো।
কামড়াটা মাকড়সার, এবং সেটা ডান পায়ের পাতার ঠিক উপরে। লোবো গিয়েছিলেন একটি ঝোপের ধারে ছোট কাজ সারতে। হাতের সোনার ঘড়ির ব্যান্ডটা নাকি এমনিতেই একটু আলগা ছিল; সেটা খুলে পড়ে যায় মাটিতে। টর্চ জ্বলিয়ে এ দিক, ও দিক খুঁজতে গিয়ে মাকড়সার গর্তে পা পড়ে। কামড়ে বিষ আছে ঠিকই, তবে মারাত্মক নয়। কিন্তু লোবোর ভাব দেখে সেটা বোঝে কার সাধ্যি।
ওষুধ ছিল আমার সঙ্গে; সেটা সন্ডার্সের টর্চের আলোতে লাগিয়ে দিচ্ছি ক্ষতের জায়গায়, এমন সময় লোবের মুখের দিকে চোখ পড়তে একটা অদ্ভুত ভাব লক্ষ করলাম। তাতে আতঙ্ক ও অনুশোচনার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ। তাঁর দৃষ্টি আমারই দিকে।
কী হয়েছে তোমার? আমি জিজ্ঞেস করলাম। আমি পাপ করেছি, আমায় ক্ষমা করো। কাতর কণ্ঠে প্রায় কান্নার সুরে বলে উঠলেন মিঃ লোবো।
কী পাপের কথা বলছি তুমি?
মিঃ লোবো দুহাত দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর ঠোঁট কাঁপছে, চোখে জল। সন্ডার্স ও ক্রোল বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে তাঁর দিকে।
সেদিন রাত্রে, বললেন মিঃ লোবো, সেদিন রাত্রে প্রহরীকে ঘুষ দিয়ে প্রদর্শনীতে ঢুকে আমি তোমার গবেষণার নেটসের খাতা বার করে নিয়েছিলাম। তারপর…
রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে কথা বলতে, কিন্তু তাও বলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে লোকটা।
তারপর…সেগুলোকে জেরক্স করে আবার যথাস্থানে রেখে দিই।
এবার আমি প্রশ্ন করলাম। তারপর?
তারপর-কপিগুলো-দিয়ে দিই মিঃ ব্লুমগার্টেনকে। তিনি আমায়….টাকা….অনেক টাকা…
ঠিক আছে। আর বলতে হবে না।
মিঃ লোবো একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। কথাটা বলে হালকা লাগছে. অনেকটা-এবার নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
আপনি মরবেন না, মিঃ লোবো, শুকনো গলায় বলল সন্ডার্স। এ মাকড়সার কামড়ে ঘা হয়, মৃত্যু হয় না।
মিঃ লোবোর ঘা আমার ওষুধে শুকোবে ঠিকই, কিন্তু তিনি আমার যে ক্ষতিটা করলেন, সেটা অপূরণীয়।
শ্ৰীমান নকুড়চন্দ্ৰ এক বর্ণও ভুল বলেননি।
তার মানে কি এল ডোরাডো সত্যিই আছে?
১৮ই অক্টোবর, রাত দশটা, হোটেল ক্যাপিটল, ব্রাসিলিয়া
আমাদের ব্ৰেজিল সফরের অপ্রত্যাশিত, অবিস্মরণীয় পরিসমাপ্তির কথাটা এই বেলা লিখে ফেলি, কারণ, কাল সকালেই আমরা যে যার দেশে ফিরছি। এটুকু বলতে পারি যে, সন্ডাসের যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মনের ভিত এই প্রথম দেখলাম একটা বড় রকম ধাক্কা খেল। সে মানতে বাধ্য হয়েছে যে, সব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, আখেরে এর ফল ভালই হবে।
এইবার ঘটনায় আসি।
গতকাল সকালে ব্যান্ডেজ বাঁধা লোবোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ক্যানু করে বেরিয়ে পড়লাম চুকাহামাই উপজাতিদের বাসস্থান পোরোরির উদ্দেশে। আমাদের যেতে হবে পঞ্চাশ কিলোমিটার। যত এগোচ্ছি, ততই যেন গাছপালা ফুল পাখি, প্রজাপতির সম্ভার বেড়ে চলেছে। এই স্বপ্নরাজ্যের মনোমুগ্ধকারিতার মধ্যে আতঙ্কের খাদ মিশে আছে বলে এটা যেন আমার কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আমি জানি, এ ব্যাপারে সন্ডার্স ও ক্রোল আমার সঙ্গে একমত। তারা যে খরস্রোতা নদীর উপকূলের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে, তার একটা কারণ বোধ হয় অ্যানাকোল্ডা দর্শনের প্রত্যাশা। এখনও পর্যন্ত সে আশা পূরণ হবার কোনও লক্ষণ দেখছি না। মাইলখানেক যাবার পর আমাদের নৌকা থামাতে হল।
নদীর ধারে তিনজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে; তারা হাইটরের দিকে হাত তুলে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে অচেনা ভাষায় কী যেন বলছে। আমি জানি, এখানকার উপজাতিদের মধ্যে গে নামে একটা ভাষা প্রচলিত আছে, যেটা হাইটির খুব ভালভাবেই জানে।
হাইটির লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমাদের তিনজনকে উদ্দেশ করে বলল, এরা স্থানীয় ইন্ডিয়ান। এরা আমাদের পোরোরি যেতে বারণ করছে।
কেন?—আমরা তিনজনেই একসঙ্গে প্রশ্ন করলাম।
এরা বলছে চুকাহামাইরা কী কারণে নাকি ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে রয়েছে। কালই নাকি একটা জাপানি দল পোরোরি গিয়েছিল; তাদের দুজনকে এরা বিষাক্ত তির দিয়ে মেরে ফেলেছে।
আমি জানি, কুরারি নামে এক সাংঘাতিক বিষ ব্ৰেজিলের আদিম জাতিরা তাদের তিরের ফলায় মাখিয়ে শিকার করে।
তা হলে এখন কী করা যায়? আমি প্রশ্ন করলাম।
হাইটির বলল, আপাতত এখানেই ক্যাম্প ফেলা যাক। আপনারা অপেক্ষা করুন, আমি বরং একটা ক্যানু নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা আঁচ করে আসি।
কিন্তু এই হঠাৎ উত্তেজনার কারণটা কিছু আন্দাজ করতে পারছেন? সন্ডার্স প্রশ্ন করল।
হাইটির বলল, আমার একটা ধারণা হচ্ছে, পরশু রাত্রের বিস্ফোরণের সঙ্গে এটা যুক্ত। বড় রকম একটা প্রাকৃতিক দুযোগ হলে এরা এখনও সেটাকে দেবতার অভিশাপ মনে করে বিচলিত হয়ে পড়ে।
অগত্যা নোমলাম আমরা ক্যানু থেকে।
জায়গাটা যে ক্যাম্প ফেলার পক্ষে আদর্শ নয়, সেটা বেশ বুঝতে পেরেছি। এখানে সাধারণত নদীর পাশে খানিকটা দূর অবধি জঙ্গল গভীর থাকে। ভিতরে কিছুটা অগ্রসর হলে দেখা যায়, বন পাতলা হয়ে এসেছে। এই জায়গাটায় কিন্তু যত দূর অবধি দৃষ্টি যায়, তাতে অরণ্যের ঘনত্ব হ্রাস পাবার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না।
নদীর দশ-পনেরো গজের মধ্যে একটা অপেক্ষাকৃত খোলা জায়গা পেয়ে আমরা সেখানেই বিশ্রামের আয়োজন করলাম। কতক্ষণের অপেক্ষা জানা নেই, তাই তাঁবুও খাটিয়ে ফেলা হল—বিশেষ করে লোবোর জন্য। সে ভালর দিকে যাচ্ছে জেনেও মিনিটে মিনিটে যিশু ও মেরি মাতাকে স্মরণ করছে। হয়তো সেটা এই কারণেই যে, সে অনুমান করছে আমরা শহরে ফিরে গিয়েই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করব। এ আশঙ্কা যদি সে সত্যিই করে থাকে, তবে সেটা ভুল নয়, কারণ আমি তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত থাকলেও, ক্রোল ও সন্ডার্স দুজনেই লোবের গদান নিতে বদ্ধপরিকর। আর ব্লুমগার্টেনকে পেলে তারা নাকি তার মাংস সিদ্ধ করে ব্ৰেজিলের নরমাংসভুক উপজাতির সন্ধান করে তাদের নেমন্তান্ন করে খাওয়াবে। তাদের বিশ্বাস, ব্লুমগার্টেনের মাংসে অন্তত বারো জনের ভূরিভোজ হবে।
আমরা তিনজনেই বেশ ক্লান্ত। পর পর চারটি বড় গাছের গুড়িতে তিনটি হ্যামক টাঙিয়ে তিনজনে শুয়ে মৃদু দোল খাচ্ছি, কাছেই বনের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছি। চুরিয়াঙ্গি পাখির কর্কশ ডাক, এমন সময় সন্ডার্স হঠাৎ একটা গোঙানির মতো শব্দ করে উঠল। আর সেই সঙ্গে আমাদের নৌকার দুজন মাঝি একসঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল।
এই গোঙানি ও চিৎকারের কারণ যে একই, সেটা বুঝতে আমার ও ক্রোলের তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি।
আমাদের থেকে দশ-বারো গজ দূরে একটা দীর্ঘাকার গাছের উপর দিকের একটা ডাল বেয়ে যেন আমাদেরই লক্ষ্য করে নেমে আসছে একটা সাপ, যেমন সাপের বর্ণনা পুরাণ বা রূপকথার বাইরে কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ে না।
এ সাপের নাম জানি, হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে বিস্ময়ের তাড়নায় নামটা আপনা থেকেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসত, কিন্তু এখন দেখলাম। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আতঙ্কের সঙ্গে একটা ঝিমধরা ভাব, যেটা পরে ক্রোল ও সন্ডার্সকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, তাদেরও হয়েছিল।
ব্ৰেজিলের এই অতিকায় ময়াল মাটি থেকে প্রায় বিশ হাত উঁচু। ডাল থেকে যখন মাটি ছুঁই ছুঁই অবস্থাতে পৌঁছেছে, তখনও তার আরও অর্ধেক নামতে বাকি। তার মানে এর দৈর্ঘ্য ষাট ফুটের কম নয়, আর প্রস্থ এমনই যে, মানুষ দুহাতে বেড় পাবে না।
আমি এই অবস্থাতেও বুঝতে চেষ্টা করছি আমার মনের ভাবের মধ্যে কতটা বিস্ময় আর কতটা আতঙ্ক, এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তিনজনকে বেকুব বানিয়ে দিয়ে চোখের সামনে থেকে অ্যানাকোল্ড প্রবর বেমালুম উধাও।
আপনাদের আশ মিটেছে তো?
আমাদের পিছনে কখন যে একটি ক্যানু এসে দাঁড়িয়েছে এবং কখন যে তার থেকে শ্ৰীমান নকুড়চন্দ্র অবতীর্ণ হয়েছেন, তা জানি না।
আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ানো একটি সাহেবের নির্দেশ করে বললেন নকুড়বাবু-ইনি হলেন ব্লুমগার্টেন সাহেবের বিমানচালক মিস্টার জো হপগুড়। ইনিই সাহেবের হেলিকপ্টারে করে আমাকে নিয়ে এলেন। শুধু শেষের দেড় মাইল পথ আমাদের ডিঙিতে আসতে হয়েছে।
ক্রোল আর থাকতে না পেরে বলে উঠল—হি মেড আস সি দ্যাট স্নেক।
আমি বললাম, তোমাকে তো বলেইছিলাম, ওঁর মধ্যে এই ক্ষমতারও একটা আভাস পেয়েছিলাম দেশে থাকতেই।
বাট দিস ইজ ইনক্রেডিবল!
নকুড়বাবু লজ্জায় লাল। বললেন, তিলুবাবু, আপনি দয়া করে এঁদের বুঝিয়ে দিন যে, এতে আমার নিজের কৃতিত্ব কিছুই নেই। এ সবই হল—যিনি আমায় চালাচ্ছেন, তাঁরই খেলা।
কিন্তু এল ডোরাডো?
সে তো দেখিয়ে দিয়েছি সাহেবকে হেলিকপ্টার থেকেই। যেমন সাপ দেখালুম, সেইভাবেই দেখিয়েছি। বরদা বাড়জ্যের বইয়েতে কিছু ছবি ছিল, মদন পালের আঁকা। সাপের ছবি, এল ডােরাডোর ছবীি, সবই ছিল। বাজে ছবি মশাই। সোনার শহরের বাড়িগুলো দেখতে করেছে। টোল খাওয়া টোপরের মতো—তাও সিধে নয়, ট্যারচা। সাহেবও সেই ছবির মতো শহরই দেখলে, আর দেখে বললে, এল ডোরাডো ইজ ব্রেথ টেকিং।
তারপর?
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি, নকুড়বাবুর কথা।
তারপর আর কী?-জঙ্গলের মধ্যে শহর। সেখানে হেলিকপ্টার নামবে কী করে? নামলুম জঙ্গলের এ দিকটায়। সাহেব দুই বন্দুকধারীকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন, আর আমি চলে এলুম। আমার কথামতো আপনাদের মিট করব বলে। আমি জানি, আপনারা কী ভাবছেন-হপগুডসাহেব আমাকে আনতে রাজি হলেন কেন। এই তো? ব্লুমগাটেনসাহেবের সঙ্গে চুক্তি ছিল, উনি এল ডোরাডো চাঙ্গুষ দেখলেই আমার হাতে তুলে দেবেন নগদ পাঁচ হাজার ডলার। হপগুড়কে বলে রেখেছিলুম, ওকে আড়াই দেব যদি ও আমাকে পৌঁছে দেয় আপনাদের কাছে। দেখুন কীরকম কথা রেখেছেন সাহেব—মনটা কীরকম দরাজ, ভেবে দেখুন। আর, ও হ্যাঁ—এল ডোরাডো দেখা গেলে ব্লুমগাটেনসাহেব এটাও কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি আপনার গবেষণার কাগজপত্তরের কপি ফেরত দেবেন। এই নিন। সেই কাগজ।
নকুড়বাবু তাঁর কোটের পকেট থেকে রাবার ব্যান্ডে বাঁধা এক তাড়া কাগজ বার করে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি এত মুহ্যমান যে, মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরোল না। এর পরের প্রশ্নটা ক্রোলই করল
কিন্তু ব্লুমগার্টেন যখন দেখবে এল ডোরাডো নেই, তখন কী হবে?
প্রশ্নটা শুনে নকুড়বাবুর অট্টহাসিতে আশেপাশের গাছ থেকে খানতিনেক ম্যাকাও উড়ে পালিয়ে গেল।
ব্লুমগার্টেন কোথায়? কোনওমতে হাসি থামিয়ে বললেন নকুড় বিশ্বাস। —তিনি কি আর ইহজগতে আছেন? তিনি জঙ্গলে ঢোকেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। তার ছাঁ ঘণ্টা পরে, রাত এগারোটা তেত্ৰিশ মিনিটে, এল ডোরাডোয় উল্কাপাতের ফলে সাড়ে তিন মাইল জুড়ে একটি গোটা জঙ্গল একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ ঘটনাও যে আপনাদের আশীবাদে আগে থেকেই জানা ছিল, তিলুবাবু! আপনার মতো এমন একজন লোক, যাঁর সঙ্গ পেয়ে আজ আমি তিনশো টাকা দামের একটি বিলিতি ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে পারছি আমার ঠাকুমার জন্য, তাঁর শত্রুর কি আর শেষ রাখতে পারি আমি?
ব্ৰাসিলিয়ায় এসেই দেখেছি, খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে কুইয়াবা—সান্তেরাম হাইওয়ের ত্রিশ কিলোমিটার পশ্চিমে একটি গভীর অরণ্যে আনুমানিক কুড়ি লক্ষ টন ওজনের একটি উল্কাপাতের খবর।
সৌভাগ্যক্রমে এই অঞ্চলে কোনও মানুষের বাস ছিল না। জীবজন্তু গাছপালা ইত্যাদি যা ছিল, তা সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আনন্দমেলা। পূজাবার্ষিকী ১৩৮৭
নেফ্রুদেৎ-এর সমাধি (প্রোফেসর শঙ্কু)
ডিসেম্বর ৭
এইমাত্র আমার জার্মান বন্ধু ক্রোলের কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলাম। ক্রোল লিখছে–
সব কাজ ফেলে কায়রোতে চলে এসো। তুতানখামেনের সমাধির মতো আরেকটি সমাধি আবিষ্কৃত হতে চলেছে। সাকারার দু মাইল দক্ষিণে সমাধির অবস্থান। কায়রোতে কানার্ক হোটেলে তোমার জন্য ঘরের ব্যবস্থা করে রাখছি।
উইলহেলম ক্রোল
প্রাচীন মিশরের কোনও রাজা বা উচ্চপদস্থ কর্মচারী মারা গেলে মাটির নীচে ঘর তৈরি করে কফিনে তাদের মমি রেখে তার সঙ্গে আরও বেশ কিছু জিনিসপত্র পুরে দেওয়া হত, এটা সকলেই জানে। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত মৃত্যুতেও মানুষের জীবন শেষ হয় না, কাজেই দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসের প্রয়োজনও ফুরায় না। তাই খাবার জিনিস, খেলার জিনিস, প্রসাধনের জিনিস, গয়নাগাটি, আসবাবপত্র, জামাকাপড় সবই সমাধিতে স্থান পেত। এরমধ্যে অনেক জিনিসই থাকত যা অত্যন্ত মূল্যবান; যেমন সোনার উপর পাথর বসানো অলংকার। সোনার তৈরি সিংহাসন পর্যন্ত মিশরের সমাধিতে পাওয়া গেছে। তুতানখামেনের মমির উপরে যে রাজার প্রতিকৃতি সমেত আচ্ছাদন ছিল তার পুরোটাই নিরেট সোনার তৈরি। পৃথিবীতে একসঙ্গে এত সোনা আর কোথাও পাওয়া যায়নি।
এই সব মূল্যবান জিনিস থাকার দরুন সেই প্রাচীনকাল থেকেই ডাকাতরা সমাধি লুণ্ঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। বর্তমানকালে খুব কম সমাধিতেই মূল্যবান কিছু পাওয়া গেছে। এর ব্যতিক্রম হল তুতানখামেনের সমাধি। আশ্চর্যভাবে এই তরুণ সম্রাটের সমাধির উপর ডাকাতের হাত পড়েনি। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে হাওয়ার্ড কাটার যখন এই সমাধি আবিষ্কার করেন, তখন সারা বিশ্বে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। এই কারণে যে, এই প্রথম একটি সমাধি পাওয়া গোল যার একটি জিনিসও খোয়া যায়নি।
ক্রোল যে সমাধিটার কথা লিখেছে সেটা সম্বন্ধে ইতিমধ্যে কাগজে পড়েছি। এটা হল আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগের এক পুরোহিত ও জাদুকর নেফ্রদেৎ-এর সমাধি। ইংলন্ডের লর্ড ক্যাভেনডিশ মিশর সরকারের অনুমতি নিয়ে এই সমাধি খননের যাবতীয় খরচ বহন করছেন। ভিন দেশের লোক খননের কাজ চালালেও, খুঁড়ে যা পাওয়া যাবে তার একটা ভাগ মিশর সরকারকে দিতে হবে এই হল নিয়ম। এইভাবেই কায়রোর আশ্চর্য মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে। খোঁড়ার কাজ চালাচ্ছেন তরুণ প্রত্নতাত্ত্বিক জোসেফ ব্যানিস্টার। সবেমাত্র একটা ঘর খুঁড়ে বার করার খবর কাগজে বেরিয়েছিল এবং তাতেই মনে হয়েছিল যে, এ সমাধিতে ডাকাতরা কোনও উপদ্রব করেনি। এ খবর তিনদিন আগে কাগজে পড়ি। এর মধ্যে কাজ নিশ্চয়ই আরও অগ্রসর হয়েছে, যদিও এ ধরনের কাজ অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ! আমার দিক দিয়ে এ এক সুবর্ণ সুযোগ। প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে ক্রোলের যথেষ্ট খাতির আছে। সে যখন এই খোঁড়ার কাজে জড়িয়ে পড়েছে, তখন আমারও কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়।
এই লর্ড ক্যাভেনডিশ ভদ্রলোকটি যে মিশর সম্বন্ধে বিশেষ উৎসাহী, তা নন। তাঁর নানারকম শখ। ইনি ইংলন্ডে বিশাল সম্পত্তির অধিকারী। বিভিন্ন সময়ে নানান ব্যাপারে ইনি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তারমধ্যে ব্ৰেজিলে ও নিউগিনিতে দুটি অভিযানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
জোসেফ ব্যানিস্টার সম্বন্ধে আমি শুধু এইটুকুই জানি যে তার বয়স পয়ত্রিশ এবং সে মিশর সম্বন্ধে একজন বিশেষজ্ঞ।
আমি তিনদিনের মধ্যেই রওনা হচ্ছি। মিশর সম্বন্ধে আমার চিরকালের কৌতূহল। এই বৃদ্ধ বয়সে ছেলেমানুষের মতো উত্তেজিত বোধ করছি।
ডিসেম্বর ১২, কায়রো
এখন রাত সাড়ে এগারোটা। আমি কানাক হোটেলের ৩৫২ নম্বর ঘরে বসে আমার ডায়রি লিখছি। গতকাল সকালে আমি কায়রো পৌঁছেছি। ক্রোল গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ফেরার পথেই এই তিন দিনের খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। এই সমাধিতে যে চোরের হাত পড়েনি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আসলে সমাধির প্রবেশপথটা কয়েকটা বড় পাথরের নীচে চাপা পড়েছিল। জোসেফ ব্যানিস্টার নেফুদেৎ-এর কথা জানত এবং বিশ্বাস করত তার একটা সমাধি নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। সে অনেক খোঁজার পর প্রায় হাল ছেড়ে দেবার মুখে একটা শেষ চেষ্টা দেবার জন্য ওই পাথরগুলো সরাতে বলে। পাথর সরাতেই বোঝা যায়। সেখানে একটা কিছু রয়েছে। একটু খোঁড়াখুড়ি করেই দেখা যায় যে সেটা একটা প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বার মানেই যে সমাধির প্রবেশদ্বার, এ বিষয়ে ব্যানিস্টারের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না, কারণ প্রবেশদ্বারের চৌকাঠের উপরে প্রাচীন মিশরীয় লিপিতে নেফুদেৎ-এর নাম লেখা ছিল।
ব্যানিস্টার এটা দেখামাত্র ইংলন্ডে লর্ড ক্যাভেনডিশকে টেলিফোন করে। ক্যাভেনডিশ তাকে খননের কাজ চালিয়ে যেতে বলেন, এবং আশ্বাস দেন যে টাকার কোনও অভাব হবে না!
কাল দুপুরে ক্রোলের সঙ্গে আমি গিয়েছিলাম খোঁড়ার জায়গায়। ব্যানিস্টারের সঙ্গে আলাপ হল। বেশ চালাকচতুর, এবং খুব উৎসাহী। সে এখন চরম উত্তেজনা বোধ করছে। তার বিশ্বাস সে তুতানখামেনের মতোই এক সমাধি আবিষ্কার করতে চলেছে, যদিও তুতানখামেন ছিল সম্রাট আর নেফুদেৎ পুরোহিত ও জাদুকর।
প্রথম যে ঘরটা খোলা হয়েছে তাতে বিস্তর জিনিস পাওয়া গেছে, তারমধ্যে আসবাব। আর দেবদেবীর মূর্তিই বেশি। কারুকার্য অতি উঁচু দরের। এরমধ্যেই নানান দেশ থেকে সাংবাদিকরা আসতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের অবশ্য সমাধিকক্ষের ভিতর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, এবং হবেও না। তারা যা খবর নেবার বাইরে থেকেই নিচ্ছে।
ক্রোল একটা কাজের কাজ করেছে। তার সঙ্গে ব্যানিস্টারের পরিচয় বেশ কিছুদিন থেকেই। সে ব্যানিস্টারকে বলে অনুমতি জোগাড় করে নিয়েছে যাতে খোঁড়ার সময় আমি আর ক্রোল দুজনেই কক্ষের মধ্যে থাকতে পারি। প্রথম কক্ষের জিনিসপত্রে নম্বর লাগিয়ে, তাদের ছবি তুলে অতি সন্তপণে তাদের পাঠানো হচ্ছে ল্যাবরেটরিতে পবিষ্কার করার জন্য।
প্ৰথম কক্ষের পিছন দিকে একটা সিলমোহর দিয়ে বন্ধ করা দরজা রয়েছে। সেটা যে আরেকটা ঘর তাতে সন্দেহ নেই। তাতে আবার কী আশ্চর্য সম্ভার লুকিয়ে আছে কে জানে!
ডিসেম্বর ১৫
আজ দ্বিতীয় ঘরটা খোলা হল। ব্যানিস্টার প্রথমে এক কিছুক্ষণ টর্চ নিয়ে ঘরটা ঘুরে দেখল। আমরা দুজন বাইরে অপেক্ষা করলাম। কদিনের মধ্যেই এইসব ঘরে ইলেকট্রিক কানেকশন বসে যাবে, তখন আর সবসময় টর্চের দরকার হবে না। একটু পরেই আমাদের ডাক পড়ল। ব্যানিস্টার উত্তেজিত স্বরে বলল, এ ঘরেও প্রচুর জিনিস। কাস্কেটের সংখ্যাই এগারোটা-তারমধ্যে ছোট বড় সব রকমই আছে। আর কাস্কেট মানেই সেগুলো জিনিসে ভরা।
তুতানখামেনের সমাধির কাস্কেট বা বাক্স দেখেছি। কাঠ, হাতির দাঁত আর অ্যােলাব্যাস্টারের তৈরি। বাক্সগুলোর বাইরে সবঙ্গে অপূর্ব কারুকার্য। এগুলোও দেখলাম সেরকমই ব্যাপার। কিন্তু এ ছাড়াও কিছু জিনিস দেখা যাচ্ছে যেগুলো তুতানখামেনের সমাধিতে দেখা যায়নি। সেগুলো বেশির ভাগই কাঠ বা হাড়ের তৈরি। ক্রোল বলল, আমাদের ভুললে চলবে না যে আমরা কোনও সম্রাটের সমাধি দেখছি না। নেফুদেৎ ছিলেন পুরোহিত ও জাদুকর। জাদুসংক্রান্ত অনেক কিছু জিনিসই এখানে পাবার কথা।
আমাদের দৃষ্টি গিয়েছিল একটা বড় বাক্সের দিকে, অ্যােলাব্যাস্টারের তৈরি। ব্যানিস্টার বলল, এবার এটাকে খুলব, কিন্তু কাজটা অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে করতে হবে। দেখতেই পােচ্ছ, বাক্সটার চারপাশে হাতে আকা ছবি রয়েছে। তাড়াহুড়ো করলে সেগুলোর রং খসে আসতে পারে।
এইবার ব্যানিস্টারের ধৈর্যের নমুনা দেখলাম। ছেলেটিকে যত দেখছি ততই ভাল লাগছে। আধা ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করে একটিও নকশা স্থানচ্যুত না করে সে বাক্সের ডালাটা খুলল। তারপর তারমধ্যে টর্চ ফেলতেই দেখা গেল সেটা নানারকম গয়না, ভাঁজ করা কাপড়, ছোট মূর্তি ইত্যাদি জিনিসে ভর্তি।
টর্চের আলোয় একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাক হলাম। বাক্সের ভিতরে কী একটা জিনিস যেন অস্বাভাবিক রকম ঝলমল করছে। সেটা সোনা নয়; সেটা যে একটা পাথর তাতে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সেটা একটা গয়নার মধ্যে বসানো।
আমি ব্যানিস্টারকে প্রশ্ন করলাম, ঝলমলে জিনিসটা কী বুঝতে পারছ?
ব্যানিস্টার বলল, মিশরে প্রাচীনকালে গয়নায় সোনার সঙ্গে যে সব পাথর ব্যবহার হত সেগুলো সেমি প্রেশাস স্টোনস। অর্থাৎ সেগুলো মহামূল্য রত্ন নয়। কারনেলিয়ান, অ্যামেথিস্ট, অবসিডিয়ান—এইসব জাতীয় পাথর। তার থেকে তো এত দ্যুতি বেরোয় না।
তা হলে?
একটু ধৈর্য ধরতে হবে, বলল ব্যানিস্টার। তোমরা বরং বাইরে অপেক্ষা করো। আমি এই বাক্সের জিনিসগুলো একে একে বার করি। আর, ভাল কথা, এই পাথর সম্বন্ধে যেন বাইরের কেউ না জানে। বিশেষ করে সাংবাদিকরা।
আমরা দুজনে বাইরে চলে এলাম। লাঞ্চের সময় হয়েছিল, কাজেই সে কাজটাও সেরে নেওয়া হল। সাংবাদিকরা আমাদের কাছ থেকে খবর বার করার বহু চেষ্টা করেছিল, আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলাম। ব্যানিস্টার না বলা পর্যন্ত আমরা কোনও কথা ফাঁস করছি না।
আজ মনে হয়। আর কোনও ঘটনা ঘটবে না, কারণ কাস্কেটের জিনিস বার করতে ব্যানিস্টারের সময় লাগবে। এই সাবধানতার ব্যাপারটা এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না। শুকনো বালির দেশ বলেই এসব জিনিস এখনও রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও হলে এতদিনে সব ধুলো হয়ে যেত।
মিশরসরকার থেকে ডাঃ আবদুল সিদ্দিকি বলে এক প্রত্নতাত্ত্বিকও আজ থেকে ব্যানিস্টারকে সাহায্য করছেন। লর্ড ক্যাভেনডিশ এখনও ইংলন্ডে; তবে উনি বলেছেন খবর দিলেই চলে আসবেন।
ডিসেম্বর ১৬
এর চেয়ে আশ্চর্য খবর আর হতে পারে না। কাল যে জিনিসটাকে কাস্কেটের মধ্যে চকচক করতে দেখেছিলাম, সেটা হল হিরে। হ্যাঁ, হিরে-যার সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক ছিল না। কোনওদিন। ঈজিপ্টে হিরে পাওয়া আর আফ্রিকার জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া একই জিনিস। ইতিহাসের গোড়ার দিকে হিরে ছিল ভারতবর্ষের একচেটিয়া সম্পত্তি। বহুকাল থেকে ভারতবর্ষে হিরের খনিতে কাজ হয়ে আসছে। পশ্চিমে তখন যে হিরে গেছে, সবই ভারতবর্ষ থেকে। বহু পরে, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে হিরে আবিষ্কার হয়। দক্ষিণ আমেরিকায় আর দক্ষিণ আফ্রিকাতে। আজকাল ভারতবর্ষে হিরের উৎপাদন কমে গেলেও কোহিনূর থেকে আরম্ভ করে যে সব বিখ্যাত হিরের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়, তার অধিকাংশেরই উৎপত্তি স্থান ভারতবর্ষ।
কিন্তু ঈজিপ্টে হিরে! এ যে তাক লাগানো ব্যাপার! কাস্কেটের গয়নার মধ্যে যে হিরে পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই মটরদানার সাইজের, দু একটা একটু বড়। সেগুলো সবই প্ৰায় সোনার মধ্যে বসানো। ল্যাবরেটরিতে এই হিরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। এতে কোনও খুঁত নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হিরের সঙ্গে এর তুলনা চলে। কঠিন্যে আর ঔজ্জল্যে এ হিরে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে।
বলা বাহুল্য খবরটা দাবানলের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মিশরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে এমন তাজব ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। কোথেকে এ হিরে এল, কী করে এল, সেটা কেউই অনুমান করতে পারছে না। ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথাও উঠেছে, কিন্তু সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে সোনা ছিল, এমন কোনও নজির ইতিহাসে নেই।
লর্ড ক্যাভেনডিশ খবর পাওয়ামাত্ৰ কায়রোতে চলে এসেছেন। আজ আমাদের সঙ্গে আলাপ হল। বছর পঞ্চাশ বয়সের সুপুরুষ ভদ্রলোক, এখন মহা ফুর্তিতে আছেন। এসেই আজ রাত্রেই একটা বড় পার্টি দিলেন কানাক হোটেলে এই যুগান্তকারী ঘটনা সেলিব্রেট করার জন্য। মিশরে এখন টুরিস্ট সিজন, তাই লোক হয়েছিল অনেক।
এখন পর্যন্ত হিরে সমেত সাতটা গলার হার আর তিন জোড়া কানের গয়না পাওয়া গেছে। আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে বলে আমার ধারণা। এখনও আসল সমাধি কক্ষ—যাতে নেফ্রুদেৎ-এর মমি থাকার কথা—সেটাই খোলা হয়নি। আমি পাটিতে ব্যানিস্টারের সঙ্গে এই ঘটনা নিয়ে কথা বললাম। সে একেবারে হতভম্ব। এই হিরে আবিষ্কারের ফলে মিশর সম্পর্কে এমন একটা নতুন দিক খুলে গেছে, যেটা সম্পর্কে আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। অথচ ব্যাপারটা রহস্যময়। ব্যানিস্টার বলল, ঈজিপ্টের সঙ্গে কার্বনের কোনও সম্পর্ক ইতিহাসে পাওয়া যায়নি। কয়লা এদেশে কোনওদিন ছিল না। অথচ হিরের মূলে হল কার্বন। আমি এর কোনও কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছি না।
আগামী কাল একটা নতুন ঘর খোলা হবে। আশা করছি এটাই হবে প্রধান সমাধিকক্ষ—এবং নেফুদেৎ-এর কফিনও এখানেই পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে হিরের খবরটা অবিশ্যি পৃথিবীর সব কাগজেরই প্রথম পাতায় বেরিয়ে গেছে। খোঁড়ার জায়গায় ভিজিটরের সংখ্যাও ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। তবে হিরে পাওয়ার পর থেকেই মিশর সরকার খোঁড়ার জায়গায় পুলিশের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন কেবল লর্ড ক্যাভেনডিশ, তাঁর কয়েকজন অন্তরঙ্গ বন্ধু আর আমাদের দুজনকে ছাড়া বাইরের লোক আর কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
ডিসেম্বর ১৭
আজ সকালে একটা ঘটনার কথা শুনলাম। যার সঙ্গে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কোনও সম্পর্ক না থাকলেও, এটাও হিরে সংক্রান্ত।
তিন মাস আগে হোটেল কানাকে লর্ড ও লেডি এইনসওয়র্থনামে ইংলন্ডের বিশেষ সম্রােন্ত পরিবারের এক দম্পতি এসেছিলেন কিছুদিনের জন্য। লেডি এইনসওয়র্থের একটি বহুমূল্য হিরের হার ছিল, যার প্রধান হিরোটি একটি আঙুরের মতো বড়। এই হোটেল থেকেই সেই হারটি চুরি যায়, এবং সেইসঙ্গে লর্ড এইনসওয়র্থের ভৃত্য ফ্রানসিসকেও আর পাওয়া যায় না।
পুলিশ অনুমান করে এটা বিখ্যাত গ্রিক হিরে চোর ডিমিট্রি ম্যাক্রোপুলসের কীর্তি। তাকে নাকি এই ঘটনার তিনদিন আগে কায়রোতে দেখা গিয়েছিল। ম্যাক্রোপুলস দুবার জেলা খেটেছে। কিন্তু তাতেও তার সংস্কার হয়নি। ম্যাক্রোপুলসী এইনসওয়র্থের চাকর ফ্রানসিসকে মোটা ঘুষ দিয়ে হিরের হারটি আদায় করে। তার ফলে ফ্রানসিসকেও পালাতে হয়। এখন হিরেই হচ্ছে একমাত্র আলোচ্য বস্তু। তাই আমাদের হোটেলে এক ফরাসি ভদ্রলোক আমাদের এই কাহিনীটা শোনালেন। মনে মনে বললাম, ভাগ্যিস নেফ্রুদেৎ-এর সমাধিতে ডাকাত পড়েনি, তা হলে তারা দাঁও মারত ভালই।
আজ দুপুরে দুটোর সময় তৃতীয় ঘরের দরজার সিল ভাঙা হল। যা অনুমান করা হয়েছিল, তাই। এটাই হল প্রধান কক্ষ, আর এখানেই রয়েছে নেফুদেৎ-এর শবাধার।
শবাধারটি বিশাল। তার চার পাশে নানারকম ছোটখাটো কাঠের আসবাব ইত্যাদি জমে ছিল; প্রথমে সেগুলোকে ঘর থেকে বার করা হল। এতে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই নেই।
স্থির হল কাল সকালে নেফুদেৎ-এর শবাধার খোলা হবে। সচরাচর এই কফিনগুলোতে প্রথমে থাকে একটা বাইরের কাঠের আবরণ। সেটাকে খুললে পরে বেরোয় কারুকার্যকরা মমির আবরণ, যেটার উপরের দিকে থাকে মৃত ব্যক্তির প্রতিকৃতি। তার নীচে থাকে বুকের উপর জড়ো করা হাত, আর তার নীচে শরীরের নীচের অংশ আর পা। এই মূর্তির সবঙ্গে থাকে। কারুকার্য এবং এতে সোনার অংশ থাকার সম্ভাবনাও বেশি।
কাল দুপুরের মধ্যে নেফুদেৎ-এর কফিন খোলা হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
ডিসেম্বর ১৮
আজ আরেক চমক।
নেফ্রুদেৎ-এর মামির আবরণে তার প্রতিকৃতির গলায় একটি হার পাওয়া গেছে যাতে একটি অসামান্য দুতিসম্পন্ন হিরে রয়েছে। ব্যানিস্টার আমাদের প্রায় ঘণ্টাখানেক আগেই ঢুকেছিল। এই কক্ষে। তারপর সে ডাকায় প্রথম গেলেন লর্ড ক্যাভেনডিশ ও তাঁর দুই বন্ধু, তারপর আমরা দুজন। ক্যাভেনডিশ একটি মন্তব্য করলেন যেটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। তিনি কিছুক্ষণ কফিনের গলার হিরেটার দিকে চেয়ে বললেন, আই মাস্ট সে ইট লুকস এগজ্যাক্টলি লাইক লেডি এইনসওয়র্থস ডায়ামন্ড।
এটা বলার অবিশ্যি একটা কারণ আছে। মিশরীয়রা সেই যুগেই হিরেতে পল কাটতে শিখেছিল-যেটা ভারতবর্ষ কোনওদিনও রপ্ত করতে পারেনি। এই হিরোটাও তাই দেখে আজকালকার হিরে বলেই মনে হয়। ক্রোল আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, ম্যাজিক, ম্যাজিক-এ সবই ম্যাজিক। ম্যাজিক, ভোজবাজি ইত্যাদিতে বিশ্বাসী ক্রোলের মতো ইউরোপে আর দ্বিতীয় কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। এই হিরে তৈরির ব্যাপারে জাদুর যে একটা ভূমিকা আছে, সে বিষয় ক্রোল নিঃসন্দেহ। শুধু রাসায়নিক ব্যাপারে এটা সম্ভব হয়েছে সেটা ক্রোল মানতে চায় না।
মোটকথা এই সাড়ে তিন হাজার বছর আগের হিরে আমাকে যে চমক দিয়েছে, তেমন আর কিছু দিয়েছে বলে মনে পড়ে না।
ডিসেম্বর ১৯
আজ তুমুল কাণ্ড। এরকম যে হবে তা ভাবতে পারিনি। নেফ্রুদেৎ-এর কণ্ঠহারের হিরে দেখে কায়রো পুলিশ বলেছে সেটা নাকি লেডি এইনসওয়র্থের নেকলেসের হিরে। এই হিরের একটা ছবি তুলে তৎক্ষণাৎ নাকি লেডি এইনসওয়র্থের কাছে পাঠানো হয়েছিল, এবং তিনিও সেটাকে তাঁর নিজের হিরে বলে চিনতে পেরেছেন। সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরে হিরে তৈরির ব্যাপারটা নাকি সম্পূর্ণ ধাপ্পা।
সমস্ত ব্যাপারটা কী করে সম্ভব হয় সেটারও একটা বিবৃতি পুলিশ দিয়েছে। যেদিন লেডি এইনসওয়র্থের গলার হার চুরি হয় সেদিন নাকি ম্যাক্রোপুলস কায়রোতে ছিলইনা। সে ছিল অ্যাথেনসে। এ ব্যাপারে তার অকাট্য অ্যালিবাই রয়েছে। অর্থাৎ এই বিশেষ হিরে চুরির সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই। পুলিশ তাই একটা নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। চুরির সময় ব্যানিস্টার কায়রোতে ছিল এবং কানাক হোটেলেই ছিল। সে-ই এইনসওয়র্থের চাকরকে ঘুষ দিয়ে নেকলেসটা চুরি করে তাই দিয়ে ঈজিপসিয়ান ধাঁচের গয়না বানিয়ে নেফুদেৎ-এর সমাধিতে পুরেছে। উদ্দেশ্য হল একটা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করা। হাওয়ার্ড কাটার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তুতানখামেনের সমাধি খুঁড়ে বার করে। ব্যানিস্টার চেয়েছিল কাটারকেও টেক্কা দিতে।
এদিকে আরেকটা ব্যাপার হয়েছে। আমেরিকার ডি বিয়ারস কোম্পানি সারা বিশ্বের হিরে বেচাকেন কনট্রোল করে! সেই কোম্পানি থেকে লোক এসেছে ব্যাপারটা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করার জন্য। কৃত্রিম উপায়ে সহজে হিরে তৈরি করতে পারলে হিরের ব্যবসা লাটে উঠত। অবিশ্যি তারা যখন শুনল নেফ্রুদেৎ-এর হিরে আসলে লেডি এইনসওয়র্থের হিরে, তখন তারা আশ্বস্ত হল।
ব্যানিস্টারকে পুলিশ প্রচণ্ডভাবে জেরা করছে। কায়রো পুলিশ নাকি এ ব্যাপারে একেবারে নির্মম। লর্ড ক্যাভেনডিশ একদম ভেঙে পড়েছেন। তাঁর মন বিশ্বাস অবিশ্বাসের মধ্যে দোলায়িত হচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন যে, ব্যানিস্টার নাকি ভীষণ উচ্চাভিলাষী। ছিল, যদিও কাজের দিক দিয়ে তার ওপর কোনও সন্দেহ করা চলতে পারে না। আমি আর ক্রোল দুজনেই বিশ্বাস করি যে ব্যানিস্টার নির্দোষ, কিন্তু সেটা আমরা প্রমাণ করছি কী করে? সে যদি সত্যিই লেডি এইনসওয়র্থের হিরে চুরি করে থাকে এবং তাই দিয়ে ঈজিপসিয়ান ধাঁচের গয়না তৈরি করে থাকে, তা হলে সেগুলো কাস্কেট ইত্যাদির মধ্যে রাখবার সুযোগ তার ছিল, কারণ রোজই সে প্রথমে একই সমাধিকক্ষে প্রবেশ করেছে। তারপর আমরা দুজন গেছি। পরিস্থিতি খুব অস্বস্তিকর। এ অবস্থায় কী করা উচিত তা ভেবে স্থির করা খুব মুশকিল।
এদিক খোঁড়ার কাজ তো বন্ধ রাখা যায় না, তাই সে কাজটা এখন চলছে। ডাঃ সিদিকির তত্ত্বাবধানে। লর্ড ক্যাভেনডিশও এ ব্যাপারে রাজি হয়ে গেছেন। সিদিকির সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট পরিচয় হয়ে গিয়েছিল, কাজেই আমাদের পথ খোলাই আছে। এখন কথা হচ্ছে-আরও হিরে যদি বেরোয়, তা হলে সেটা কার বলে প্ৰতিপন্ন হবে? তখন কি ব্যানিস্টারকে একটি পাকা হিরে চোর হিসেবে দাঁড় করানো হবে?
কিন্তু আমার মন বলছে আর হিরে বেরোবে না! সেখানেই মুশকিল। এ কদিনে গয়না যা বেরিয়েছে তার পরিমাণ কিছু কম নয়। এদিকে আর হিরে না বেরোলে ব্যানিস্টারকে বাঁচানো আমাদের পক্ষে সত্যিই মুশকিল হবে।
ডিসেম্বর ২০<