- বইয়ের নামঃ সত্যজিৎ রায় গল্প
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অক্ষয়বাবুর শিক্ষা
অক্ষয়বাবু ছেলের হাত থেকে লেখাটা ফেরত নিলেন।
কী রে–এটাও চলবে না?
ছেলে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলনা, চলবে না। এটা অক্ষয়বাবুর পাঁচ নম্বর গল্প যেটা ছেলে নাকচ করে দিল।
অক্ষয়বাবুর ছেলের নাম অঞ্জন। তার বয়স চোদ্দ। অতি বুদ্ধিমান ছেলে, ক্লাসে সে সব সময় ফাস্ট হয়, পড়ার বাইরে তার নানা বিষয়ে কৌতূহল। অক্ষয়বাবু নিজে লেখক নন; তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের একজন মধ্যপদস্থ কর্মচারী। তবে তাঁর বহুঁকালের শখ হোটদের জন্য গল্প লেখার। অঞ্জন যখন আরও ছোট ছিল, তখন অক্ষয়বাবু তাকে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প বলেছেন। তখন ছেলের ভালই লাগত, কিন্তু এখন সে সেয়ানা হয়েছে, সহজে সে খুশি হবার পাত্র নয়।
তা হলে এটা ফুলঝুরি-তে পাঠাব না বলছিস?
পাঠাতে পারো। সম্পাদকের পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপবেন। তবে আমাকে এ গল্প তুমি তিন-চার বছর আগে বলেছ। আমার কাছে এতে নতুন কিছু নেই।
তা হলেও পাঠিয়ে দেখি না!
দেখো–কিন্তু তার আগে আমি লেখাটা কপি করে দেব। তোমার হাতের লেখা পড়া যায় না।
ছোটদের জন্য ফুলঝুরি মাসিক পত্রিকা বছরখানেক হল বেরোতে আরম্ভ করেছে, আর এর মধ্যেই ছেলেমেয়েদের মন কেড়ে নিয়েছে। অক্ষয়বাবু শুনেছেন কাগজটার নাকি ৭৫,০০০ কপি ছাপা হয়, আর একটাও বাজারে পড়ে থাকে না। প্রেসের যন্ত্রপাতি নাকি সদ্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। সম্পাদকের নাম সুনির্মল সেন। তিনি নাকি সব লেখা নিজে পড়েন, এবং যা বাছাই করেন তা একেবারে ফার্স্ট ক্লাস। ছেলেদের পত্রিকা তো সব সময়ই ছিল, এখনও আছে। তা হলে ফুলঝুরি-তে লেখা ছাপানোর জন্য অক্ষয়বাবু এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন? তার কারণ তিনি খবর নিয়ে জেনেছেন যে, ফুলঝুরি একটা গল্পের জন্য পাঁচশো টাকা দেয়। অক্ষয়বাবুর রোজগার তো অঢেল নয়, তাই মাঝে মাঝে এই বাড়তি আয়টা হলে মন্দ কী?
অঞ্জন গল্পটা বাবার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে তার পরিষ্কার হাতের লেখায় কপি করে দিল।
.
গল্প পাঠানোর এক মাসের মধ্যে অক্ষয়বাবুফুলঝুরি আপিস থেকে চিঠি পেলেন। চার লাইনের চিঠি, সম্পাদক মশাই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, অক্ষয়বাবুর গল্পটি মনোনীত হয়নি। কারণ-টারণ কিছু নেই; একেবারে ছাঁচে ঢালা বাতিল করা চিঠি–যাকে ইংরিজিতে বলে রিজেকশন স্লিপ।
অক্ষয়বাবু চিঠিটা নিয়ে ছেলের কাছে গেলেন। অঞ্জন সবে খেলার মাঠ থেকে ফিরেছে; পড়াশুনার মতোই খেলাতেও তার প্রচণ্ড উৎসাহ।
তুই ঠিকই বলেছিলি, বললেন অক্ষয়বাবু। গল্পটা ফুলঝুরি নিল না।
তাই বুঝি?
আমার দ্বারা কি তা হলে এ জিনিস হবে না?
গল্প কেন নেয়নি সেটা বলেছে?
নাথিং। এই তো চিঠি।
অঞ্জন চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলল, তুমি সুনির্মলবাবুর সঙ্গে দেখা করে ওঁকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমার মনে হয় উনি খুব ভাল লোক। আমি ফুলঝুরিকে দুটো চিঠি লিখেছি, উনি দুটোই ছেপেছেন।
কথাটা ঠিক। অঞ্জন তার প্রথম চিঠিটা লিখেছিল ধাঁধাগুলো একটু বেশি সহজ হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়ে। ফুলঝুরিতে চিঠির জন্য আলাদা পাতা থাকে। সেখানে অঞ্জনের চিঠি বেরোয়, আর তারপর থেকে ধাঁধাগুলোও অঞ্জনের মনের মতো হয়।
দ্বিতীয় চিঠিটা অঞ্জন লেখে ফুলঝুরিতে ছাপা একটা গল্প সম্বন্ধে। অঞ্জন বলে গল্পটার সঙ্গে একটা বিদেশি গল্পের আশ্চর্য মিল দেখা যাচ্ছে। এ চিঠিও ছাপা হয়, আর সেইসঙ্গে, গল্পের লেখকের চিঠিও বেরোয়। তিনি স্বীকার করেছেন যে গল্পটা একটা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা, আর সে কথাটা উল্লেখ না করার জন্য তিনি মার্জনা চেয়েছেন।
অক্ষয়বাবু ছেলের কথায় স্থির করলেন তিনি সোজা গিয়ে সুনির্মলবাবুর সঙ্গে কথা বলবেন।
শরৎ বোস রোডে ফুলঝুরির আপিস। পত্রিকা থেকে ঠিকানা নিয়ে এক শনিবার বিকেলে অক্ষয়বাবু সোজা গিয়ে হাজির হলেন সম্পাদকের ঘরে। ছোটদের পত্রিকার দপ্তর যে এত ছিমছাম হতে পারে সেটা অক্ষয়বাবু ভাবতে পারেননি। সুনির্মল সেনের চেহারাও আপিসের সঙ্গে মানানসই। বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর, ফরসা রঙ, চোখদুটো বেশ জ্বলজ্বলে।
বসুন। সুনির্মলবাবু তাঁর উলটোদিকের হালফ্যাশানের চেয়ারটার দিকে হাত দেখালেন।
অক্ষয়বাবু বসলেন।
আপনার পরিচয়টা–?
অক্ষয়বাবু নিজের নাম বললেন, এবং সেইসঙ্গে বললেন যে তিনি সম্প্রতি অপরাধ নামে একটি ছোটগল্প ফুলঝুরিতে পাঠিয়েছিলেন, সেটা মনোনীত হয়নি বলে তাঁকে জানানো হয়েছে।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, বললেন সুনির্মলবাবু।
কিন্তু গল্পটা কী কারণে বাতিল হল সেটা যদি বলেন, তা হলে ভবিষ্যতে সুবিধা হতে পারে।
সুনির্মলবাবু সামনে ঝুঁকে দু হাতের কনুই টেবিলের উপর রেখে বললেন, দেখুন অক্ষয়বাবু, আপনার মুশকিল হচ্ছে কি, আপনি যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের মন জানেন, তার কোনও পরিচয় আপনার গল্পে নেই। আমার কাছে সেকালের বাঁধানো সন্দেশ-মৌচাক আছে; তাতে যেরকম গল্প বেরোত, আপনার গল্প সেই ধাঁচের। আজকের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে, অনেক বেশি জানে, অনেক বেশি স্মার্ট। আমি পাঁচ বছর ইস্কুল মাস্টারি করেছি; তখন আমি এইসব ছেলেমেয়েদের খুব ভাল করে স্টাডি করেছি। তাদের মনের মতো গল্প যদি লিখতে পারেন তা হলে তা নিশ্চয়ই আমাদের কাগজে স্থান পাবে। অল্প-বিস্তর ত্রুটি থাকলে ক্ষতি নেই; সেটা আমি শুধরে দিতে পারি। সম্পাদকের এ অধিকারটা আছে, জানেন বোধহয়?
জানি, মাথা হেঁট করে বললেন অক্ষয়বাবু।
এর পরে আর কিছু বলার নেই, তাই অক্ষয়বাবু উঠে পড়লেন। বাড়ি ফিরে ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস বললেন, ফুলঝুরিতে কার গল্প তোর ভাল লাগে রে?
অঞ্জন একটু ভেবে বলল, দুজন আছে–সৈকত ব্যানার্জি আর পুলকেশ দে।
অক্ষয়বাবু ছেলের বইয়ের তাক থেকে একগোছা ফুলঝুরি নিয়ে গিয়ে নিজের খাটের পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর সাতদিন ধরে তিনি রাত্রে খাওয়ার পর এই দুই লেখকের একগুচ্ছ গল্প পড়ে ফেললেন। এদের গল্পের মেজাজ যে তাঁর নিজের গল্পের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এদের বিষয়ও আলাদা, ভাষাও আলাদা।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন যে, তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। প্রথমে তাঁর নিজের ছেলেকে আরও ভাল করে চিনতে হবে। অঞ্জনকে তিনি চোখের সামনে বড় হতে দেখেছেন, তার সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করেছেন, কিন্তু সত্যি কি ছেলের মনের খুব কাছে পৌঁছতে পেরেছেন? অক্ষয়বাবু মিনিটখানেক চিন্তা করেই বুঝলেন তিনি শুধু পারেননি নয়, সে চেষ্টাই করেননি। ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হয় এটা জেনেই তিনি খুশি; ছেলে কী দেখে, কী শোনে, কী পড়ে, কী ভাবে–এসব তিনি কোনওদিন জানতে চেষ্টা করেননি।
ছমাস অক্ষয়বাবু কোনও গল্প লিখলেন না। সেই সময়টাতে ছেলেকে আরও ভাল করে চিনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। অঞ্জন আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিশোরদের জন্য লেখা বহু ইংরিজি বই কিনে পড়ে ফেলেছে। কম্পিউটারের সব খবর তার কাছে আছে, সৌরজগতের গ্রহগুলোর স্যাটিলাইট সম্বন্ধে যা জানা গেছে, সব সে জানে। খেলার ব্যাপারেও অঞ্জনের সমান উৎসাহ। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট ফুটবল টেনিস ব্যাডমিন্টন ইত্যাদির খেলোয়াড়দের নাম তার মুখস্থ। অক্ষয়বাবু খবরের কাগজের খেলাধুলোর পাতাটার দিকেই দেখেন না।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন এবার থেকে বেশ খানিকটা সময় দিয়ে তাঁকে তাঁর ছেলের জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। গল্পের প্লট ভাবা তিনি অবিশ্যি এখনও থামাননি। কারণ ফুলঝুরিতে তাঁর গল্প ছেপে বেরিয়েছে–এ স্বপ্ন তিনি এখনও দেখেন। একটা গল্পের আইডিয়া মাথায় এলেই তিনি ছেলেকে শোনান।
কেমন হয়েছে বল তো।
একটু একটু করে ইমপ্রুভ করছে, বলে অঞ্জন।
অক্ষয়বাবু যে ক্রমশ তাঁর ছেলের মনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন সেটা মাঝে মাঝে তাঁর কথায় প্রকাশ পায়। যেমন, একদিন তিনি রাত্রে খাবার টেবিলে বসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বেকার, লেন্ডন, ম্যাকেনরো–এই তিনজনের মধ্যে তোর মতে কে শ্রেষ্ঠ?
ম্যাকেনরো, বলল অঞ্জন, তারপর বেকার, তারপর লেন্ডন।
আরেকদিন অক্ষয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ফ্যাক্স কাকে বলে জানিস?
জানি।
কী বল তো?
ফ্যাক্সের সাহায্যে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গা থেকে যে-কোনও জায়গায় একটা কাগজে কিছু। লিখে বা এঁকে পাঠালে সেটা এক সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে যায়।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন ছেলেকে নতুন কোনও জ্ঞান তিনি দিতে পারবেন না। তিনি যা জানেন, ছেলে তার চেয়ে বেশি জানে। তবে এটা ঠিক যে তিনি ছেলেকে এখন আগের চেয়ে ঢের বেশি ভাল করে চেনেন।
তা হলে কি আবার গল্প লেখা শুরু করা যায়?
তিনি কথাটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। অঞ্জন বলল, লেখো না। অবিশ্যি ছাপার মালিক হলেন সুনির্মলবাবু। গল্প ভাল হলে উনি নিশ্চয়ই ছাপবেন।
এবার না ছাপলে কিন্তু মরমে মরে যাব। বললেন অক্ষয়বাবু। অন্তত একবার সূচিপত্রে আমার নামটা দেখতে চাই।
অঞ্জন কিছু মন্তব্য করল না। দিন সাতেক মাথা খাটিয়ে অক্ষয়বাবু ডানপিটে নামে একটা গল্প লিখে ফেললেন। তারপর সেটা ছেলেকে পড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হয়েছে?
অঞ্জন বলল, পাঠিয়ে দাও। আমি কপি করে দিচ্ছি।
পরদিন লেখাটা পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফুলঝুরির আপিসে গিয়ে সেটা নিজের হাতে দিয়ে এলেন অক্ষয়বাবু।
পনেরো দিনের মধ্যে সুনির্মল সেনের চিঠি এল। ডানপিটে মনোনীত হয়েছে। আগামী কার্তিকের ফুলঝুরিতে ছাপা হবে।
অক্ষয়বাবু সগর্বে চিঠিটা ছেলেকে দেখালেন। অঞ্জন বলল, ভেরি গুড।
এটা ভাদ্র মাস, তাই আরও দুমাস অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে নতুন উদ্যমে অক্ষয়বাবু আরও গল্পের প্লট ভাবতে লাগলেন। এখন তিনি চাবিকাঠি হাতে পেয়ে গেছেন, তাই ছেলেকে শোনানোর আর কোনও প্রয়োজন নেই।
এই দু মাসটাকে অক্ষয়বাবুর দু বছর বলে মনে হল। অবশেষে কার্তিক মাসের দোসরা অঞ্জনের নামে খয়েরি খামে এল নতুন ফুলঝুরি। ছেলে তখন পাড়ার মাঠে খেলতে গেছে। অক্ষয়বাবু সবে আপিস থেকে ফিরেছেন। তিনি আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে খাম থেকে পত্রিকাটা বার করলেন।
প্রথমেই দেখলেন সূচিপত্র।
হ্যাঁ–ডানপিটে রয়েছে তেরোর পাতায়।
সেই পাতায় কাগজটা খুলে অক্ষয়বাবু দেখলেন পাতার উপর দিকে ফুলঝুরির আর্টিস্ট মুকুল গোস্বামীর কাজ–গল্পের নাম, লেখকের নাম, আর গল্পের একটা ঘটনার ছবি।
ছাপার অক্ষরে তাঁর লেখা দেখতে অক্ষয়বাবুর অদ্ভুত লাগছিল। তিনি দশ মিনিটে গল্পটা পড়ে ফেলে বেশ একটু অবাক হলেন। তিনি যা লিখেছেন তার বারো আনাই আছে, কিন্তু নতুন যে চার আনা অংশ–সেটা একেবারে মোক্ষম। তাতে গল্প অনেক গুণে ভাল হয়ে গেছে। সুনির্মল সেনের বাহাদুরি আছে।
এই কথাটা ভদ্রলোককে না জানিয়ে পারবেন না অক্ষয়বাবু।
পত্রিকাটা আবার খামের মধ্যে পুরে ছেলের পড়ার টেবিলের উপর রেখে একটা ট্যাক্সি নিয়ে অক্ষয়বাবু সোজা চলে গেলেন ফুলঝুরির আপিসে।
আবার সেই ছিমছাম ঘর, সেই হালফ্যাশানের চেয়ার।
এবার খুশি তো? জিজ্ঞেস করলেন সুনির্মল সেন।
তা তো বটেই, বললেন অক্ষয়বাবু। কিন্তু আমার আসার কারণ হচ্ছে আপনাকে ধন্যবাদ জানান। আপনার নিপুণ হাতের ছোঁয়া যে গল্পকে আরও কত বেশি ভাল করে দিয়েছে তা বলতে পারব না।
সুনির্মলবাবু ভুরু কুঁচকে তাঁর পাশের তাক থেকে একটা বক্স ফাইল টেনে এনে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর তার থেকে একটা পাণ্ডুলিপি বার করে অক্ষয়বাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন।
আমার ছোঁয়া কোথায় আছে বার করুন তো দেখি।
অক্ষয়বাবু পাণ্ডুলিপির প্রত্যেক পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন কোথাও কোনও কাটাকুটি নেই।
ওটা আপনারই হাতের লেখা তো? জিজ্ঞেস করলেন সুনির্মলবাবু। ওটাই আপনি পাঠিয়েছিলেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ–এটাই পাঠিয়েছিলাম। তবে হাতের লেখা আমার নয়।
তবে কার?
অক্ষয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমার ছেলের।
শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৭
অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু
টিপু ভূগোলের বইটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে দেখল। সাতচল্লিশ মিনিট পড়া হয়ে গেছে একটানা। এখন তিনটে বেজে তেরো মিনিট। এবার যদি ও একটু ঘুরে আসে তা হলে ক্ষতি কী? ঠিক এমনি সময় তো
সেদিন লোকটা এসেছিল। সে তো বলেছিল টিপুর দুঃখের কারণ হলে তবে আবার আসবে। তা হলে? কারণ তো হয়েছে। বেশ ভাল রকমই হয়েছে। যাবে নাকি একবার বাইরে?
নাঃ। মা বারান্দায় বেরিয়েছেন কীসের জন্য জানি। হুস করে একটা কাগ তাড়ালেন এক্ষুনি। তারপর ক্যাঁচ শব্দটায় মনে হল বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বোধহয় রোদ পোয়াচ্ছেন। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
লোকটার কথা মনে পড়ছে টিপুর। এমন লোক টিপু কোনওদিন দেখেনি। ভীষণ বেঁটে, গোঁফদাড়ি নেই, কিন্তু বাচ্চা নয়। বাচ্চাদের এমন গম্ভীর গলা হয় না। তা হলে লোকটা বুড়ো কী? সেটাও টিপু বুঝতে পারেনি। চামড়া কুঁচকোয়নি কোথাও। গায়ের রঙ চন্দনের সঙ্গে গোলাপি মেশালে যেমন হয় তেমনই। টিপু মনে মনে ওকে গোলাপীবাবু বলেই ডাকে। লোকটার আসল নাম টিপু জানে না। জানতে চেয়েছিল, কিন্তু লোকটা বলল, কী হবে জেনে? আমার নাম উচ্চারণ করতে তোমার জিভ জড়িয়ে যাবে।
টিপু বেশ রেগে গিয়েছিল। কেন, জড়িয়ে যাবে কেন? আমি প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বলতে পারি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলতে পারি, এমনকী ফ্লকসিনসিনিহিলিপিলিফিকেশন বলতে পারি, আর তোমার নাম বলতে পারব না? তাতে লোকটা বলল, একটা জিভে আমার নাম উচ্চারণ হবে না।
তোমার বুঝি একটার বেশি জিভ আছে? জিজ্ঞেস করেছিল টিপু।
বাংলা বলতে একটার বেশি দরকার হয় না।
বাড়ির পিছনে যে নেড়া শিরীষ গাছটা আছে, তারই নীচে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। এদিকটা বড় একটা কেউ আসে না। শিরীষ গাছটার পিছনে খোলা মাঠ, তারও পিছনে ধান খেত, আর তারও অনেক, অনেক পিছনে পাহাড়ের সারি। কদিন আগেই টিপু এদিকটায় এসে একটা ঝোঁপের ধারে একটা বেজিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল। আজ হাতে কিছু পাঁউরুটির টুকরো নিয়ে এসেছিল ঝোঁপটার ধারে ছড়িয়ে দেবার জন্য, যদি তার লোভে বেজিটা আবার দেখা দেয়। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল গাছতলায় দাঁড়ানো লোকটার দিকে। চোখাচুখি হতেই লোকটা ফিক করে হেসে বলল, হ্যালো।
সাহেব নাকি? সাহেব হলে কথা বলে বেশিদূর এগোনো যাবে না, তাই টিপু কিছুক্ষণ কিছু না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার লোকটাই ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, তোমার কোনও দুঃখ আছে?
দুঃখ?
দুঃখ।
টিপু তো অবাক! এমন প্রশ্ন তাকে কেউ কোনওদিন করেনি। সে বলল, কই না তো। দুঃখ তো নেই।
ঠিক বলছ?
বা রে, ঠিক বলব না কেন?
তোমার তো দুঃখ থাকার কথা। হিসেব করে তো তাই বেরোলো।
কীরকম দুঃখ? ভেবেছিলাম বেজিটাকে দেখতে পাব, কিন্তু পাচ্ছি না। সেরকম দুঃখ?
উঁহু উঁহু। যে-দুঃখে কানের পিছনটা নীল হয়ে যায়, হাতের তেলো শুকিয়ে যায়, সেরকম দুঃখ।
মানে ভীষণ দুঃখ?
হ্যাঁ।
না, সেরকম দুঃখ নেই।
লোকটা এবার নিজে দুঃখ ভাব করে মাথা নেড়ে বলল, নাঃ, তা হলে এখনও মুক্তি নেই।
মুক্তি?
মুক্তি। ফ্রিডম।
ফ্রিডম মানে মুক্তি সেটা আমি জানি, বলল টিপু। আমার দুঃখ হলে বুঝি তোমার মুক্তি হবে?
লোকটা টিপুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তোমার বয়স সাড়ে দশ?
হ্যাঁ, বলল টিপু।
আর নাম শ্রীমান তর্পণ চৌধুরী?
হ্যাঁ।
তা হলে কোনও ভুল নেই।
লোকটা যে ওর বিষয়ে এত খবর পেল কোত্থেকে, সেটা টিপু বুঝতে পারল না। টিপু বলল, শুধু আমার দুঃখ হলেই তোমার মুক্তি? আর কারুর দুঃখে নয়?
দুঃখে মুক্তি নয়, দুঃখ দূর করলে তবে মুক্তি।
কিন্তু দুঃখ তো অনেকের আছে। আমাদের বাড়িতে নিকুঞ্জ ভিখিরি এসে একতারা বাজিয়ে গান গায়। সে বলে তার তিন কুলে কেউ নেই। তার তো খুব দুঃখ।
তাতে হবে না, লোকটা মাথা নেড়ে বলল। তর্পণ চৌধুরী, বয়স সাড়ে দশ–এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে?
বোধহয় না।
তবে তোমাকেই চাই।
এবার টিপু একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারল না।
তুমি কীসের থেকে মুক্তির কথা বলছ? তুমি তো দিব্যি চলেফিরে বেড়াচ্ছ।
এটা আমার দেশ নয়। এখানে তো আমায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
কেন?
অত জানার কী দরকার তোমার?
বা রে, একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হল, আর তার বিষয় জানতে ইচ্ছা করবে না? তুমি কোথায় থাকো, কী করো, কী নাম তোমার, আর কে কে চেনে তোমাকে সব জানতে ইচ্ছা করছে আমার।
অত জানলে জিঞ্জিরিয়া হবে।
লোকটা আসলে জিঞ্জিরিয়া বলেনি; বলেছিল একটা ভীষণ কঠিন কথা যেটা টিপু চেষ্টা করলেও উচ্চারণ করতে পারবে না। তবে খুব সহজ করে বললে সেটা জিঞ্জিরিয়াই হয়। না জানি কী ব্যারামের কথা বলছে, তাই টিপু আর ঘাঁটাল না। কার কথা মনে হচ্ছে লোকটাকে দেখে? রামখেল তিলক সিং? না কি ঘ্যাঁঘাসুরের সেই একহাত লম্বা লোকটা, যার সঙ্গে মানিকের দেখা হয়েছিল? নাকি স্নো হোয়াইটের সেই সাতটা বামুনের একটা বামুন? টিপু রূপকথার পোকা। তার দাদু প্রতিবারই পুজোয় কলকাতা থেকে আসার সময় তার জন্য তিন-চারখানা করে রূপকথার বই এনে দেন। টিপুর মনটা সে সব পড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী ছত্রিশ পাহাড় পেরিয়ে কোথায় যেন উড়ে চলে যায়। সে নিজেই হয়ে যায় রাজপুত্তুর–তার মাথায় মুক্তো বসানো পাগড়ি, আর কোমরে হিরে বসানো তলোয়ার। কোনওদিন চলেছে গজমোতির হার আনতে, কোনওদিন ড্রাগনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।
গুড বাই।
সে কী, লোকটা যে চলল।
কোথায় থাকো তুমি, বললে না?
লোকটা তার প্রশ্নে কান না দিয়ে শুধু বলল, তোমার দুঃখ হলে তখন আবার দেখা হবে।
কিন্তু তোমায় খবর দেব কী করে?
ততক্ষণে লোকটা এক লাফে একটা দেড় মানুষ উঁচু কুলগাছ টপকে হাইজাম্পে ওয়র্লড রেকর্ড করে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এটা প্রায় দেড়মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকে লোকটা আর আসেনি। কিন্তু এখন তো আসা দরকার, কারণ টিপুর সত্যিই দুঃখের কারণ হয়েছে। আর সেই কারণ হল তাদের ইস্কুলের নতুন অঙ্কের মাস্টার নরহরিবাবু।
নতুন মাস্টারমশাইকে টিপুর এমনিতেই ভাল লাগেনি। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে কিছু বলার আগে প্রায় দুমিনিট খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সারা ক্লাসের ছাত্রদের উপর যেভাবে চোখ বোলালেন তাতে মনে হয় যেন আগে সকলকে ভস্ম করে তারপর পড়াতে শুরু করবেন। তালগাছের হুসুর মুসুরের মতো এমন ঝাঁটা গোঁফ যে সত্যি-মানুষের হয় সেটা টিপু জানতই না। তার ওপর ওরকম মুখে-হাঁড়িধা গলার আওয়াজ। ক্লাসের কেউই তো কালা নয়, তা হলে অত হুমকিয়ে কথা বলার দরকার কী?
আসল গোলমালটা হল দুদিন পরে, বিষুদবারে। দিনটা ছিল মেঘলা, তার উপর পৌষ মাসের শীত। টিফিনের সময় টিপু ক্লাস থেকে না বেরিয়ে নিজের ডেস্কে বসে পড়ছিল ডালিমকুমারের গল্প। কে জানত ঠিক সেই সময়ই অঙ্কের স্যার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাবেন, আর তাকে দেখতে পেয়েই ক্লাসে ঢুকে আসবেন?
ওটা কী বই, তর্পণ?
স্যারের স্মরণশক্তি যে সাংঘাতিক সেটা বলতেই হবে, কারণ দুদিনেই সব ছাত্রদের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে।
টিপুর বুকটা দুরদুর করলেও, টিফিনে গল্পের বই পড়াটা দোষের নয় মনে করে সে বলল, ঠাকুরমার ঝুলি, স্যার।
কই দেখি।
টিপু বইটা দিয়ে দিল স্যারের হাতে। স্যার মিনিট খানেক ধরে সেটা উলটেপালটে দেখে বললেন, হাঁউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ, হিরের গাছে মোতির পাখি, শামুকের পেটে রাজপুত্তুর–এসব কী পড়া হচ্ছে শুনি? যত আজগুবি ধাপ্পাবাজি! এসব পড়লে অঙ্ক মাথায় ঢুকবে কেমন করে, অ্যাঁ?
এ গল্প, স্যার, টিপু কোনওরকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বার করে বলল।
গল্প? গল্পর তো একটা মাথামুণ্ডু থাকবে, না কি যেমন-তেমন একটা লিখলেই হল?
টিপু অত সহজে হার মানতে চাইছিল না। বলল, রামায়ণেও তো আছে হনুমান জাম্বুমান, আর মহাভারতে বক রাক্ষস আর হিড়িম্বা রাক্ষসী আর আরও কত কী।
জ্যাঠামো কোরো না, দাঁত খিঁচিয়ে বললেন নরহরি স্যার। ওসব হল মুনিঋষিদের লেখা, দুহাজার বছর আগে। সে তো গণেশ ঠাকুরেরও–মানুষের গায়ে হাতির মাথা, আর মা দুর্গার দশটা হাত। ও জিনিস আর তোমার এ মনগড়া গাঁজাখুরি গল্প এক জিনিস নয়। তোমরা এখন পড়বে মনীষীদের জীবনী, ভাল ভাল ভ্রমণ কাহিনী, আবিষ্কারের কথা, মানুষ কী করে ছোট থেকে বড় হয়েছে সেইসব কথা। তোমাদের বয়সে বাস্তব কথার দাম হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তোমরা হলে বিংশ শতাব্দীর ছেলে। আদ্যিকালে পল্লীগ্রামে যে জিনিস চলত সে জিনিস আজ শহরে চলবে কী করে? এসব পড়তে হলে পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় গিয়ে বসতে হবে, আর দুলে দুলে কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া মুখস্থ করতে হবে। সে সব পারবে তুমি?
টিপু চুপ করে রইল। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কথা শুনতে হবে, সেটা ও ভাবতে পারেনি।
ক্লাসে আর কে কে এসব বই পড়ে? অঙ্ক স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
সত্যি বলতে কি, আর কেউই প্রায় পড়ে না। শীতল একবার টিপুর কাছ থেকে হিন্দুস্থানী উপকঞ্চ ধার নিয়ে গিয়েছিল, পরদিনই ফেরত দিয়ে বলল, ধুস, এর চেয়ে অরণ্যদেব ঢের ভাল।
আর কেউ পড়ে না স্যার, বলল টিপু।
হুঁ।…তোমার বাবার নাম কী?
তারানাথ চৌধুরী।
কোথায় থাকো তোমরা?
স্টেশন রোড। পাঁচ নম্বর।
হুঁ।
বইটা ঠক করে ডেস্কের উপর ফেলে দিয়ে অঙ্ক স্যার চলে গেলেন।
ইস্কুলের পর টিপু সোজা বাড়ি ফিরল না। স্কুলের পুব দিকে ঘোষদের আমবাগানটা ছাড়িয়ে বিষ্ণুরাম দাসের বাড়ির বাইরে বাঁধা সাদা ঘোড়াটার দিকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে রইল জামরুল গাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিষ্ণুরামবাবুর বিড়ির কারখানা আছে। ঘোড়ায় চড়ে কারখানায় যান। বয়স পঞ্চাশের উপর, কিন্তু এখনও মজবুত শরীর।
টিপু প্রায়ই এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে দেখে, কিন্তু আজ আর কিছু ভাল লাগছিল না। তার মন বলছে অঙ্ক স্যার তার গল্পের বই পড়া বন্ধ করার মতলব করছেন। গল্পের বই না পড়ে সে থাকবে কী করে? সারা বছরের একটা দিনও তার গল্পের বই পড়া বন্ধ থাকে না, আর সবচেয়ে ভাল লাগে ওইসব বইগুলো, যেগুলোকে অঙ্ক স্যার বললেন আজগুবি আর গাঁজাখুরি। কই, ও তো এসব বই পড়েও অঙ্কেতে কোনওদিন খারাপ করেনি! গত পরীক্ষায় পঞ্চাশে চুয়াল্লিশ পেয়েছিল। আর আগের অঙ্কের স্যার ভূদেববাবুর কাছে তো অঙ্কের জন্য কোনওদিন ধমক খেতে হয়নি!
শীতকালের দিন ছোট বলে এমনিতেই টিপু এবার বাড়ি ফিরবে ভাবছিল, এমন সময় একটা ব্যাপার দেখে ঝট করে গাছের আড়ালে গা-ঢাকা দিতে হল।
অঙ্ক স্যার নরহরিবাবু বই ছাতা বগলে এদিকেই আসছেন।
তা হলে কি ওঁর বাড়ি এইদিকেই? বিষ্ণুরামবাবুর বাড়ির পরে আরও গোটা পাঁচেক বাড়ি আছে অবিশ্যি এ রাস্তায়। তারপরেই হামলাটুনির মাঠ। ওই মাঠের পুব দিকে এককালে রেশমের কুঠি ছিল। হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন তার ম্যানেজার। ভয়ংকর কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। বত্রিশ বছর ম্যানেজারি করে কুঠির পাশেই তাঁর বাংলোতে মারা যান। তাঁর নামেই ওই মাঠের নাম হয়ে গেছে হামলাটুনির মাঠ।
আলো পড়ে আসা পৌষ মাসের বিকেলে জামরুল গাছের আড়াল থেকে ও দেখছে নরহরি স্যারকে। ভারী অবাক লাগছে তাঁর হাবভাব দেখে। স্যার এখন বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ছুঁচোলো করে চুক চুক করে ঘোড়ার কাঁধে হাত বুলোচ্ছেন।
এমন সময় খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দ হল, আর বিষ্ণুরামবাবু নিজেই চুরুট হাতে বেরিয়ে এলেন।
নমস্কার।
ঘোড়ার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে অঙ্ক স্যার বিষ্ণুরামবাবুর দিকে ফিরলেন। বিষ্ণুরামবাবুও নমস্কার করে বললেন, এক হাত হবে নাকি?
সেইজন্যেই তো আসা, বললেন অঙ্ক স্যার। তার মানে অঙ্ক স্যার দাবা খেলেন। বিষ্ণুরামবাবু যে খেলেন সেটা টিপু জানে। অঙ্ক স্যার এবার বললেন, দিব্যি ঘোড়াটি আপনার পেলেন কোত্থেকে?
কলকাতা। শোভাবাজারের দ্বারিক মিত্তিরের ছিল ঘোড়াটা। ওঁর কাছ থেকেই কেনা। রেসের মাঠে ছুটেছে এককালে। নাম ছিল পেগাসাস।
পেগাসাস? নামটা যেন চেনা চেনা মনে হল টিপুর, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না।
পেগাসাস বললেন অঙ্ক স্যার। কিম্ভুত নাম তো মশাই!
ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার ওইরকমই নাম হয়। হ্যাপি বার্থডে, শোভান আল্লা, ফরগেট-মি-নট…
আপনি চড়েন এ ঘোড়া?
চড়ি বইকী। তালেবর ঘোড়া। একটি দিনের জন্যও বিগডোয়নি৷
অঙ্ক স্যার চেয়ে আছেন ঘোড়াটার দিকে। বললেন, আমি এককালে খুব চড়িছি ঘোড়া।
বটে?
তখন আমরা শেরপুরে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যেতেন। আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। সুযোগ পেলেই চড়তুম। ওঃ, সে কি আজকের কথা!
চড়ে দেখবেন এটা?
চড়ব?
চড়ুন না!
টিপু অবাক হয়ে দেখল অঙ্ক স্যার হাত থেকে বই ছাতা দাওয়ায় নামিয়ে রেখে ঘঘাড়ার দড়িটা খুলে এক ঝটকায় সেটার পিঠে চড়ে বসলেন। তারপর বাঁ পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পাশে দুবার চাপ দিতেই সেটা খট খট করে চলতে আরম্ভ করল।
দেখবেন, বেশিদূর যাবেন না, বললেন বিষ্ণুরামবাবু।
আপনি খুঁটি সাজান গিয়ে, বললেন অঙ্ক স্যার, আমি খানিকদূর গিয়েই ঘুরে আসছি।
টিপু আর থামল না। আজ একটা দিন গেল বটে!
কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
তখন সন্ধ্যা সাতটা। টিপু পরের দিনের পড়া শেষ করে সবে ভাবছে এবার গল্পের বইটা খুলবে কিনা, এমন সময় বাবা ডাক দিলেন নীচে থেকে।
টিপু নীচে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখে নরহরি স্যার বসে আছেন বাবার সঙ্গে। টিপুর রক্ত হিম হয়ে গেল। বাবা বললেন, তোমার দাদুর দেওয়া যে বইগুলো রয়েছে সেগুলো ইনি একবার দেখতে চাইছেন। যাও তো, নিয়ে এসো গিয়ে।
টিপু নিয়ে এল। সাতাশখানা বই। তিন খেপে আনতে হল।
অঙ্ক স্যার ঝাড়া দশ মিনিট ধরে বইগুলো দেখলেন। মাঝে মাবো মাথা নাড়েন আর হু করে একটা শব্দ করেন। তারপর বইগুলো রেখে দিয়ে বললেন–দেখুন মিস্টার চৌধুরী, আমি যেটা বলছি সেটা আমার অনেকদিনের চিন্তা-গবেষণার ফল। ফেয়ারি টেইল বলুন আর রূপকথাই বলুন আর উপকথাই বলুন, এর ফল হচ্ছে একই–ছেলেমেয়েদের মনে কুসংস্কারের বীজ বপন করা। শিশুমনকে যা বোঝাবেন তাই তারা বুঝবে। সেখানে আমাদের বড়দের দায়িত্বটা কতখানি সেটা একবার ভেবে দেখুন! আমরা কি তাদের বোঝাব, বোয়াল মাছের পেটে থাকে মানুষের প্রাণ?–যেখানে আসল কথাটা হচ্ছে। যে প্রাণ থাকে মানুষের হৃৎপিণ্ডে–তার বাইরে কোথাও থাকতে পারে না, থাকা সম্ভব নয়।
বাবা পুরোপুরি কথাটা মানছেন কিনা সেটা টিপু বুঝতে না পারলেও, এটা সে জানে যে, ইস্কুলের মাস্টারদের কথা যে মেনে চলতে হয়, এটা তিনি বিশ্বাস করেন। ছেলেবয়সটা মেনে চলারই বয়স, টিপু, একথা বাবা অনেকবার বলেছেন। বিশেষ করে গুরুজনদের কথা মানতেই হবে। নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করার বয়সও আছে একটা, কিন্তু সেটা পড়াশুনো শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর। তখন তোমাকে কেউ বলবে না এটা করো, ওটা করো। বা বললেও, সেখানে তোমার নিজের মতটা দেবার অধিকার আছে। কিন্তু সেটা এখন নয়।
আপনার বাড়িতে অন্য ধরনের শিশুপাঠ্য বই নেই? জিজ্ঞেস করলেন নরহরি স্যার।
আছে বইকী,বললেন বাবা। আমার বুক শেলফেই আছে। আমার ইস্কুলে প্রাইজ পাওয়া বই। টিপু তুই দেখিসনি?
সব পড়া হয়ে গেছে বাবা, বলল টিপু।
সবগুলো?
সবগুলো। বিদ্যাসাগরের জীবনী, সুরেশ বিশ্বাসের জীবনী, ক্যাপ্টেন স্কটের দক্ষিণ মেরু অভিযান, মাঙ্গো পার্কের আফ্রিকা ভ্রমণ, ইস্পাতের কথা, আকাশযানের কথা… প্রাইজ আর কটাই বা পেয়েছ বাবা?
তা বেশ তো, বললেন বাবা। নতুন বই এনে দেওয়া যাবেখন।
আপনি এখানে তীর্থঙ্কর বুক স্টলে বললে ওরা কলকাতা থেকে আনিয়ে দেবে বই, বললেন অঙ্ক স্যার, সেইসবই তুমি পড়বে এবার থেকে, তর্পণ। এগুলো বন্ধ।
এগুলো বন্ধ। ওই দুটো কথায় যেন এক মুহূর্তে পৃথিবীটা টিপুর চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল।–এগুলো বন্ধ!
আর বন্ধ যাতে হয় তার জন্য বাবাও অঙ্ক স্যারের থেকে নিয়ে বইগুলো তাঁর আলমারির তাকে ভরে ফেলে চাবিবন্ধ করে দিলেন।
মা অবিশ্যি ব্যাপারটা শুনে বেশ খানিকক্ষণ গজর গজর করেছিলেন। খাবার সময় একবার তো বলে ফেললেন, যে লোক এমন কথা বলতে পারে তাকে মাস্টার করে রাখা কেন বাপু?
বাবা পরপর তিনবার উঁহু বলে মা-কে থামিয়ে দিলেন।–তুমি বুঝছ না। উনি যা বলছেন টিপুর ভালর জন্যই বলছেন।
ছাই বলছেন। তারপর টিপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই ভাবিসনে রে। আমি বলব তোকে গল্প। তোর দিদিমার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি ছেলেবেলায়। সব তো আর ভুলিনি।
টিপু কিছু বলল না। মুশকিল হচ্ছে কি, মার কাছে টিপু এককালে অনেক গল্পই শুনেছে। তার বাইরে মা আর কিছু জানেন বলে মনে হয় না। আর জানলেও, বই পড়ার মজা মুখে শোনা গল্পে নেই। বইয়ে ডুবে যাওয়া একটা আলাদা ব্যাপার। সেখানে শুধু গল্প আর তুমি–মাঝখানে কেউ নেই। সেটা মা-কে বোঝাবে কী করে?
আরও দুদিন গেল টিপুর বুঝতে যে, এবার সত্যি-সত্যিই সে দুঃখ পাচ্ছে। গোলাপীবাবু যে দুঃখের কথা বলেছিলেন, এটা সেই দুঃখ। এবার এক উনিই যদি কিছু করতে পারেন।
আজ রবিবার। বাবা ঘুমোছেন। মা বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে সেলাই-এর কল চালাচ্ছেন। এখন। বেজেছে সাড়ে তিনটে। এখন একবার পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। লোকটা যে কেন বলে গেল না সে কোথায় থাকে! সে না এলে টিপু সটান তার বাড়িতে চলে যেতে পারত।
টিপু পা টিপে টিপে একতলায় নেমে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
চারদিকে রোদ ঝলমল করছে, কিন্তু তাও বেশ শীত শীত ভাব। দূরে ধানখেতে সোনালি রঙ ধরে আছে পাহাড়ের লাইন অবধি। একটা ঘুঘু ডেকে চলেছে একটানা, আর চিড়িক চিড়িক শব্দটা নিশ্চয়ই ওই শিরীষ গাছের বাসিন্দা কোনও একটা কাঠবেড়ালি করছে।
হ্যালো।
আরে! কী আশ্চর্য! কখন যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায়, সেটা টিপু দেখতেই পায়নি!
তোমার কানের পিছনে নীল রঙ, হাতের তেলো খসখসে, বুঝতেই পারছি তোমার দুঃখের কারণ ঘটেছে।
তা ঘটেছে বইকী!
লোকটা এগিয়ে আসছে টিপুর দিকে। আবার সেই পোশাক। আবার মাথার চুলগুলো ফ্যূৎ করে ঝুঁটির মতো উড়ছে বাতাসে।
কী ঘটেছে সেটা বলতে হবে তো, নইলে আমি কিংকর্তব্যমতিত্ব।
টিপুর হাসি পেলেও, লোকটাকে শুধরোবার চেষ্টা না করে অঙ্ক স্যারের পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলে ফেলল। বলতে বলতে চোখে জল এসে গেলেও মনের জোরে নিজেকে সামলে নিল টিপু।
হুঁ, বলে লোকটা ষোলোবার ধীরে ধীরে মাথা উপর-নীচ করল। টিপু ভেবেছিল আর থামবেই না; আর সেইসঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে, লোকটা হয়তো কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। যদি না পায় তা হলে যে কী দশা হবে সেটা ভেবে টিপুর আবার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকটা মাথা নাড়া থামিয়ে আবার হু বলাতে টিপুর ধড়ে প্রাণ এল।
তুমি কিছু করতে পারবে কী? টিপু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
ভেবে দেখতে হবে। পাকস্থলীটা খাটাতে হবে।
পাকস্থলী? কেন, তোমরা মাথা খাটাও না বুঝি?
লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, তোমার এই নরহরি স্যারকে কাল দেখলাম না মাঠে ঘোড়া চড়তে?
কোন মাঠে? হামলাটুনির মাঠে?
যে মাঠে ভাঙা বাড়িটা আছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি কি সেইখানেই থাকো?
ওই ভাঙা বাড়িটার পিছনেই আমার ট্রিডিঙ্গিপিডিটা রয়েছে।
টিপু কথাটা ঠিক করে শোনেনি নিশ্চয়ই। তবে শুনলেও সেটা যে তার জিভ দিয়ে কিছুতেই বেরোত সেটা সে জানে।
লোকটা এখনও আছে, আর আবার মাথাটা উপর-নীচ করতে আরম্ভ করেছে।
এবার একত্রিশবার নাড়াবার পর মাথা থামিয়ে লোকটা বলল, আজ ফুল মুন। তুমি যদি ব্যাপারটা দেখতে চাও, তা হলে চাঁদ যখন মাঠের মাঝখানের খেজুর গাছটার ঠিক মাথায় আসবে তখন মাঠে এসে যেও। আড়ালে থেকো; কেউ যেন দেখে না ফেলে। তারপর দেখা যাক কী করা যায়!
টিপুর হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে তাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিল।
তুমি অঙ্ক স্যারকে মেরে-টেরে ফেলবে না তো?
এই প্রথম লোকটাকে হো হো করে হাসতে দেখল টিপু, আর সেইসঙ্গে দেখল লোকটার মুখের ভিতর একটার উপর আরেকটা জিভ। আর দেখল যে, লোকটার দাঁত বলে কিছু নেই।
মেরে ফেলব?–লোকটা কোনওরকমে হাসি থামাল।–উঁহু। আমরা কাউকে মারি-টারি না। একজনকে চিমটি কাটার কথা ভেবেছিলাম বলেই তো আমার নির্বাসন প্রথম ছক কেটে বেরোলো পৃথিবীর নাম, সেখানে হবে নির্বাসন; তারপর ছক কেটে বেরোলো এই শহরের নাম; তারপর তোমার নাম। তোমার দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েই মুক্তি।
ঠিক আছে, তা হলে–
লোকটা সেদিনের মতোই টিপুর কথা শেষ হবার আগেই কুলগাছের উপর দিয়ে হাই জাম্প করে হাওয়া।
.
টিপুর শরীরের ভিতরে সেই যে মিহি কাঁপুনি শুরু হল সেটা রইল রাত অবধি। আশ্চর্য কপাল, আজ মা বাবা দুজনেই রাত্রে নেমন্তন্ন খেতে যাবেন সুশীলবাবুদের বাড়ি। সুশীলবাবুর নাতির মুখে ভাত। টিপুরও নেমন্তন্ন ছিল, কিন্তু সামনে পরীক্ষা, তাই মা নিজেই বললেন, তোর আর গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে বসে পড়াশুনা কর।
সাড়ে সাতটায় বাবা বেরিয়ে গেলেন। টিপু পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে পুব দিকটা হলদে হতে শুরু করেছে দেখে বেরিয়ে পড়ল।
ইস্কুলের পিছনের শর্টকাটটা দিয়ে বিষ্ণুরামবাবুদের বাড়ি পৌঁছতে লাগল মিনিট দশেক। ঘোড়াটা নেই। টিপুর ধারণা, ওটা বাড়ির পিছন দিকে আস্তাবলে থাকে। সামনের বৈঠকখানার জানলা দিয়ে আলো রাস্তায় এসে পড়েছে, ঘরের ভিতর চুরুটের ধোঁয়া।
কিস্তি।
অঙ্ক স্যারের গলা। দাবা খেলছেন বিষ্ণরামবাবুর সঙ্গে। তা হলে কি আজ ঘোড়া চড়বেন না? সেটা জানার কোনও উপায় নেই। লোকটা কি বলেছে হামলাটুনির মাঠে যেতে। টিপু যা থাকে কপালে করে সেইদিকেই রওনা দিল।
ওই যে পূর্ণিমার চাঁদ। এখনও সোনালি, রুপোলি হবে আরও পরে। নেড়া খেজুর গাছটার মাথায় পৌঁছতে এখনও মিনিট দশেক দেরি। ফুটফুটে জ্যোৎস্না যাকে বলে সেটা হতে আরও সময় লাগবে, তবে একটা ফিকে আলো চারদিক ছেয়ে আছে। তাতে গাছপালা ঝোঁপঝাড় সবই বোঝা যাচ্ছে। ওই যে দূরে ভাঙা কুঠিবাড়ি। ওর পিছনে কোথায় থাকে নোকটা?
টিপু একটা ঝোঁপের পিছনে গিয়ে অপেক্ষা করার জন্য তৈরি হল। তার প্যান্টের পকেটে খবরের কাগজে মোড়া একটুকরো পাটালি গুড়। টিপু তার খানিকটা মুখে পুরে চিবোতে লাগল। শেয়াল ডাকছে দূরের বন থেকে। আকাশ দিয়ে যে কালো জিনিসটা উড়ে গেল সেটা নিশ্চয়ই পেঁচা। গরম কোটের উপর একটা খয়েরি চাদর জড়িয়ে নিয়েছে টিপু। তাতে গা ঢাকা দেওয়ার সুবিধে হবে, শীতটাও বাগে আসবে।
আটটা বাজার যে শব্দটা এল দূর থেকে, সেটা নিশ্চয়ই বিষ্ণুরামবাবুদের ঘড়ির শব্দ।
আর তারপরেই টিপু শুনতে পেল–খটমট-খটমট-খটমট-খটমট…
ঘোড়া আসছে।
টিপু ঝোঁপের পাশ দিয়ে মাথাটা বার করে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মোড়ের দিকে।
হ্যাঁ, ঘোড়া তো বটেই, আর তার পিঠে নরহরি স্যার।
কিন্তু ঠিক এই সময় ঘটে গেল একটা সাংঘাতিক দুর্ঘটনা। একটা মশা কিছুক্ষণ থেকেই টিপুর কানের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল, টিপু হাত চালিয়ে চালিয়ে সেটাকে যথাসম্ভব দূরে রাখতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু হঠাৎ সেটা সুড়ুৎ করে ঢুকল গিয়ে তার নাকের ভিতর।
দুআঙুল দিয়ে নাক টিপে যে হাঁচি চাপা যায় সেটা টিপু আগে পরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু এখন নাক টিপলে মশাটা আর বেরোবে না মনে করে সে হাঁচিটা আসতে দিল, আর তার শব্দটা খোলা মাঠের শীতের রাতের থমথমে ভাবটাকে একেবারে খানখান করে দিল।
ঘোড়া থেমে গেছে।
ঘোড়ার পিঠ থেকে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল টিপুর উপর।
তর্পণ!
টিপুর হাত পা অবশ হয়ে গেছে। সে যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ছি ছি ছি! এইভাবে সমস্ত ব্যাপারটা ভেস্তে দেওয়াতে লোকটা না জানি কী মনে করছে!
ঘোড়াটা এগিয়ে আসছিল তারই দিকে, পিঠে অঙ্ক স্যার, কিন্তু এমন সময় স্যারকে প্রায় পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে ঘোড়াটা সামনের পা দুটো তুলে একটা আকাশচেরা চিহিহি ডাক ছেড়ে এক লাফে রাস্তা থেকে মাঠে গিয়ে পড়ল।
আর তারপরেই টিপুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল, দেখে যে ঘোড়া আর মাটিতে নেই।
ঘোড়ার দুদিকে দুটো ডানা। সেই ডানায় ঢেউ তুলে ঘোড়া আকাশে উড়তে লেগেছে, অঙ্ক স্যার উপুড় হয়ে ঘোড়ার পিঠ জাপটে ধরে আছেন, তাঁর জ্বলন্ত টর্চ হাত থেকে পড়ে গেছে রাস্তায়। চাঁদ এখন খেজুরগাছের মাথায়, জ্যোৎস্না এখন ফুটফুটে, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে অঙ্ক স্যারকে পিঠে নিয়ে বিষ্ণুরাম দাসের ঘোড়া আকাশভরা তারার দিকে উড়তে উড়তে ক্রমশই ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছে।
পেগাসাস!
ধাঁ করে টিপুর মনে পড়ে গেল।
গ্রিসের উপকথা। রাক্ষসী মেডুসা–তার মাথায় চুলের বদলে হাজার বিষাক্ত সাপ, তাকে দেখলে মানুষ পাথর হয়ে যায়–তরোয়াল দিয়ে তার মাথা কেটে ফেলল বীর পারসিয়ুস, আর মেডুসার রক্ত থেকে জন্ম নিল পক্ষিরাজ পেগাসাস।
তুমি বাড়ি যাও, তর্পণ।
পাশে দাঁড়িয়ে সেই অদ্ভুত লোটা, চাঁদের আলো তার মাথার সোনালি ঝুঁটিতে।–এভরিথিং ইজ অল রাইট।
.
তিনদিন হাসপাতালে ছিলেন অঙ্ক স্যার। শরীরে কোনও জখম নেই, খালি মাঝে মাঝে শিউরে ওঠেন, জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না।
চারদিনের দিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে অঙ্ক স্যার টিপুদের বাড়িতে এলেন। বাবার সঙ্গে কী কথা হল সেটা টিপু জানে না। অঙ্ক স্যার চলে যাবার পরেই বাবা টিপুকে ডাকলেন।
ইয়ে, তোর বইগুলো নিয়ে যা আমার আলমারি থেকে। উনি বললেন ওসব গল্পে ওঁর আপত্তি নেই।
সেই লোকটাকে আর দেখেনি টিপু। তার খোঁজে একদিন গিয়েছিল কুঠিবাড়ির পিছনটায়। পথে যেতে দেখেছে বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়া যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু কুঠিবাড়ির পিছনে কিছু নেই।
শুধু একটা গিরগিটি দেখতে পেয়েছিল টিপু, যেটার রঙ একদম গোলাপী।
সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৯
অতিথি
মন্টু কদিন থেকেই শুনেছে তার মা-বাবার মধ্যে কথা হচ্ছে দাদুকে নিয়ে। মন্টুর ছোটদাদু, মা-র ছোটমামা।
দাদুর চিঠিটা যখন আসে তখন মন্টু বাড়ি ছিল। মা চিঠি পড়ে প্রথমে আপন মনে বললেন, বোঝে ব্যাপার। তারপর বাবাকে ডেকে বললেন, ওগো শুনছ?
বাবা বারান্দায় বসে মুচির জুতো মেরামত করা দেখছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, বলো।
মা চিঠি হাতে বেরিয়ে এসে বললেন, মামা আসছেন।
মামা?
আমার ছোটমামা গো।
বাবার ঘাড় ঘুরে ভুরু কপালে উঠে গেল।
বলো কী! তিনি বেঁচে আছেন?
এই তো চিঠি। মামার যে চিঠি লেখার মতো বিদ্যে আছে সেটাই তো জানতাম না।
বাবা আরাম কেদারার হাতল থেকে চশমাটা তুলে পরে নিয়ে মা-র দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কই, দেখি।
এক পাতার চিঠিটা পড়ে বাবাও বললেন, বোঝো।
মা ততক্ষণে মোড়ায় বসে পড়েছেন।
একটা খটকা লেগেছে দুজনেরই সেটা বেশ বুঝতে পারছে মন্টু। বাবাই প্রশ্নটা করলেন।
আমাদের ঠিকানা পেলেন কোথায় বলো তো? আর ওঁর ভাগনির সঙ্গে যে সুরেশ বোস বলে একজনের বিয়ে হয়েছে, আর তারা যে এই মামুদপুরে থাকে সেটাই বা জানলেন কী করে?
মা একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে বললেন, শেতলমামা আছেন তো। তাঁর কাছেই জেনেছেন হয়তো।
শেতলমামা?
আঃ, তোমার আবার কিছু মনে থাকে না। মামাদের পড়শি ছিলেন নীলকণ্ঠপুরে। কত যাতায়াত ছিল আমাদের বাড়িতে। তুমিও তো দেখেছ। বাজি ফেলে ছাপান্নটা রাজভোগ খেলেন আমাদের বিয়েতে, সেই নিয়ে কত হাসাহাসি।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
ছোটমামার সঙ্গে তো খুব মিতালি ছিল। গোড়ার দিকে মামা যে চিঠি দিতেন সে তো শুনেছি শেতলমামাকেই।
এ বাড়িতেও তো এসেছেন না শীতলবাবু?
বাঃ, আসেননি? রাণুর বিয়েতেই তো এলেন।
ঠিক ঠিক। কিন্তু তোমার ছোটমামা তো শুনেছিলাম সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।
তাই তো জানতাম। তিনি আবার হঠাৎ আমার এখানে আসছেন কেন সেটা তো বুঝলাম না।
বাবা একটু ভেবে বললেন, অবিশ্যি আসতেই যদি হয়তো তোমার কাছে ছাড়া আর কার কাছে আসবেন বলো। তোমার বাপ মা বড় মামা বড় মামী সব পরলোকে। বড় মামার ছেলে কানাডা, মেয়ে সিঙ্গাপুর। তুমি ছাড়া তার আর আছে কে?
তা তো বুঝলাম, কিন্তু যে লোকটাকে প্রায় চোখেই দেখিনি তাকে মামা বলে চিনব কী করে? মামা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যান তখন আমার বয়স দু বছর, আর ওনার ষোলো কি সতেরো।
ওঁর ছবি একখানা আছে না তোমার সেই পুরনো অ্যালবামে? তোমার যা কথা! সে চেহারা আর এখনকার চেহারা! তখন মামার বয়স পনেরো আর এখন ষাট।
সত্যি, খুব মুশকিলে পড়া গেল।
ঘর তো একখানা বাড়তি আছেই, বিনুর ঘর। কিন্তু কী খায় না খায় কিছু জানা নেই…
খাবে আবার কী? আমরা যা খাব তাই খাবে!
আমরা যা খাব মানে কী? যদি সাধু হয়ে থাকে তা হলে তো নিরামিষ খাবে। সে তো আরও ঝক্কি। পাঁচ রকম পদের কমে হবে না তার।
চিঠির ভাষা দেখে তো সাধু বলে মনে হয় না। দিব্যি আমাদেরই মতো লেখা। ইংরিজিতে তারিখ লিখেছে, ইংরিজি কথা ব্যবহার করেছে। এই তো–আনেসেসারি।
নিজের ঠিকানা তো দেয়নি।
তা দেয়নি।
আর সোমবারই আসছেন বলে লিখেছেন।
মা-বাবা দুজনেই খুব ভাবনায় পড়েছেন বলে মনে হল মন্টুর। সত্যি, যে মামাকে কেউ কোনওদিন চোখেই দেখেনি তাকে তো মামা বলে মনে করাই মুশকিল।
মন্টু এই দাদুর কথা বড় জোর একবার কি দুবার শুনেছে। ইস্কুলে পড়া শেষ হবার আগেই দাদু বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপর এই পঁয়তাল্লিশ বছরের গোড়ার কয়েকটা বছরের পর তার আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। মা বলতেন তিনি নিশ্চয়ই মরে গেছেন। মন্টুর দু-একবার মনে হয়েছে দাদু যদি হঠাৎ একদিন ফিরে আসেন তা হলে বেশ হয়। কিন্তু তারপরই মনে হয়েছে–সেরকম কেবল গল্পেই শোনা যায়। তাও গল্পে ঘর-পালানো লোক অনেকদিন পরে ফিরে এলে তাকে চেনবার লোক থাকে। এখানে তাও নেই। দাদু এল কি দাদু সেজে অন্য লোক এল তাও বলার জো নেই।
দাদু অবিশ্যি লিখেছেন বেশিদিন থাকবেন না–দিন দশেক। বাংলাদেশের ছোট মফঃস্বল শহরেই দাদুর ছেলেবেলা কেটেছে। সেই বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছে হয়েছে দাদুর। নিজের দেশ নীলকণ্ঠপুরে তো যাওয়া যায় না, কারণ এখন আর সেখানে কেউ নেই। তাই মামুদপুরেই আসতে চান। তাও এখানে একজন ভাগনি আছে তো। মন্টুর বাবা এখানে ওকালতি করেন। মন্টুর দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সে থাকে রিশড়ায়। দাদা কানপুরে হস্টেলে থেকে পড়ে আই আই টিতে।
রবিবারের মধ্যে মা সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। দোতলার পশ্চিমের ঘরের খাটে নতুন বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, দাদুর জন্য সাবান ভোয়ালে গামছা, সবই এসে গেল। ট্রেন আসবে সকালে, দাদু নিজেই সুরেশ বোসের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে আসবেন। তারপর যা থাকে কপালে। বাবা আজই সকালে বলেছেন, মামা হোক আর না হোক, লোকটা যদি সভ্যভব্য মিশুকে হয় তা হলে একরকম চলে যাবে। না হলে এই দশটা দিন হুজ্জতের একশেষ।
ভাল্লাগেনা বাপু, বললেন মা, সাপ না ব্যাঙ না বিচ্ছু কিছু জানা নেই, এখন সামলাও ঝক্কি। ঠিকানাও দিল না লোকটা; তা হলে না হয় কোনও একটা ছুতোয় না করে দেওয়া যেত। এ যেন একেবারে পণ করে ঘাড়ে এসে চাপা।
মন্টুর মনের ভাব কিন্তু অন্যরকম। তাদের বাড়িতে অনেকদিন কেউ এসে থাকেনি। এখন তার গ্রীষ্মের ছুটি; সারাটা দিন সে বাড়িতেই থাকে। খেলার সাথীর অভাব নেই–সিধু, অনীশ, রথীন, ছোটকা–কিন্তু বাড়িতে একজন বাড়তি লোকের মজাটা আলাদা। সারাক্ষণ শুধু মা আর বাবাকে দেখতে কি ভাল লাগে? আর দাদু-কি-দাদু-নয় মজাটাও কি কম? এ যেন একটা রহস্য অ্যাডভেঞ্চার। যদি দাদু না হয়, যদি কোনও বদ মতলবে দুষ্টু লোক আসে, আর সেটা যদি মন্টু ধরে দিতে পারে, তা হলে দারুণ ব্যাপার হবে।
সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে সদর দরজার বাইরে ঘোরাঘুরি করার পর সোয়া এগারোটার সময় মন্টু দেখল একটা সাইকেল রিকশা আসছে তাদের বাড়ির দিকে। গাড়িতে একজন লোক, তার হাতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি, আর পায়ের কাছে একটা চামড়ার সুটকেস। লোকটা সুটকেসের উপর একটা পা তুলে দিয়েছে।
ইনি সাধু নন। অন্তত সাধুর মতো পোশাক পরেন না। ধুতি-পাঞ্জাবিও নয়, প্যান্ট-সার্ট। মা বলেছিলেন বয়স ষাটের উপর, কিন্তু বেশি বুড়িয়ে যাননি। মাথার চুলও বেশি পাকেনি। চোখে। চশমা আছে, তবে পাওয়ার খুব বেশি নয়।
রিকশাকে ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে বাক্স মাটিতে নামিয়ে রেখে ভদ্রলোক মন্টুর দিকে ফিরে দেখে বললেন, তুমি কে?
দাড়িগোঁফ নেই, নাকটা চোখা, চোখ দুটো ছোট হলেও উজ্জ্বল।
মন্টু সুটকেসটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমার নাম সাত্যকি বোস।
অর্জুনের সারথি, না সুরেশ বোসের পুত্র? এই ভারী সুটকেস বইতে পারবে তুমি? ওতে বই আছে কিন্তু।
পারব।
তবে চলো।
ভিতরের বারান্দায় উঠতে মা এগিয়ে এসে প্রণাম করলেন ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক মিষ্টির হাঁড়িটা মা-র হাতে দিয়ে বললেন–
তোমার নাম সুহাসিনী তো?
হ্যাঁ। তোমার স্বামী তো উকিল। সে বোধহয় কাজে বেরিয়েছে?
হ্যাঁ। এইভাবে এসে পড়লাম…খুব কিন্তু-কিন্তু বোধ করছিলাম, জানো, কিন্তু শেষে মনে হল দিন দশেক হয়তো এই বুড়োকে বরদাস্ত করতে তোমাদের খুব অসুবিধে হবে না। তা ছাড়া শীতলদা তোমাদের এত প্রশংসা করলেন। কিন্তু বুঝতে তো পারি, আমি যে সত্যি তোমার মামা তার তো কোনও প্রমাণ নেই। কাজেই সেদিক দিয়ে আমি কিছু দাবিও করব না। একজন বুড়ো মানুষকে আশ্রয় দিলে কটা দিনের জন্য–এইটেই ভেবে নিতে হবে তোমাদের।
মন্টু লক্ষ করছিল যে মা মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছেন ভদ্রলোকের দিকে। এবার বললেন, আপনি চানটান করবেন তো?
খুব বেশি যদি অসুবিধে না হয়–
না না, অসুবিধে কেন? মন্টু, এঁকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দাও চানের ঘরটা। আর, ইয়ে, আপনি কী খানটান সে তো জানা নেই, তাই…।
আমি সর্বভুক। যা দেবে তাই খুশি মনে খাব। কথাটা বাড়িয়ে বলছি না।
তুমি ইস্কুলে পড়? দোতলায় উঠতে উঠতে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন মন্টুকে।
হ্যাঁ। সত্যভামা হাই স্কুল। ক্লাস সেভেন।
মন্টু একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারল না।
আপনি বুঝি সাধু নন?
সাধু?
মা বলছিলেন আপনি সাধু হয়ে গেছেন।
ও হো হো! সাধুটাধু তো অনেককালের কথা ভাই। যখন প্রথম বাড়ি থেকে বেরোই তখন গেলাম হরিদ্বার। বাড়িতে ভাল লাগত না, তাই বেরিয়ে পড়লাম। একজন সাধুর কাছে গিয়ে ছিলাম বটে কিছুদিন। হৃষীকেশে। তারপর সেখানেও আর ভাল লাগল না, তাই বেরিয়ে পড়লাম। তারপর সাধু-টাধুর কাছে আর যাইনি।
দুপুরে খাবার যা ছিল সেটা ভদ্রলোক সত্যিই বেশ খুশি মনে চেঁছেপুঁছে খেলেন। আমিষে কোনও আপত্তি নেই; মাছ ডিম দুই-ই খেলেন। মন্টুর মনে হল মা একটু নিশ্চিন্ত হয়েছেন। মন্টুর যদিও ভদ্রলোককে দাদু বলতে ইচ্ছে করছিল, সে লক্ষ করল মা একবারও মামা বললেন না।
যখন দই-এর প্লেটটা পাতে তুলছেন ভদ্রলোক, তখন যেন কতকটা কথা বলার জন্যই মা বললেন, বাংলা রান্না অনেকদিন খাওয়া হয়নি বোধহয়?
ভদ্রলোক হেসে বললেন, গত দুদিনে কলকাতায় খেয়েছি; তার আগে কতদিন খাইনি বললে বিশ্বাস করবে না।
মা আর কিছু বললেন না। মন্টুর ইচ্ছে হচ্ছিল যে জিজ্ঞেস করে-বাংলা রান্না খাননি কেন? কোথায় ছিলেন আপনি এতদিন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর জিজ্ঞেস করল না। ভদ্রলোক যদি ধাপ্পাবাজ হয়ে থাকেন তা হলে তাকে গুল মারার সুযোগ দেওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়। উনি নিজে যদি বলতে চান তো বলুন।
কিন্তু উনি নিজেও কিছু বললেন না। চল্লিশ বছরের উপর যে লোক নিরুদ্দেশ ছিল তার তো অনেক কিছুই বলার থাকা উচিত, তা হলে এ লোক এত চুপচাপ কেন?
বাবার গাড়ির আওয়াজ যখন পেল মন্টু তখন সে দোতলায়। সে দেখেছে ভদ্রলোক তখন হাতে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছেন। তার আগে মন্টু আধ ঘন্টা কাটিয়েছে ভদ্রলোকের সঙ্গে। সে ঘরের বাইরে ঘুরঘুর করছে দেখে ভদ্রলোক নিজেই তাকে ডাকেন।
ওহে অর্জুনের সারথি।
মন্টু গিয়ে ঢোকে ভদ্রলোকের ঘরে।
এসো আমার কাছে বললেন ভদ্রলোক, তোমাকে কিছু জিনিস দেখাই।
মন্টু খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
এটা কী? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
একটা তামার পয়সা।
কোথাকার?
মন্টু পয়সার গায়ে লেখাটা পড়তে চেষ্টা করে পারল না।
এটাকে বলে লেপটা। গ্রিস দেশের পয়সা। আর এটা?
এটাও মন্টু বলতে পারল না।
এটা তুর্কির পয়সা। এক কুরু। আর এটা রুমানিয়ার পয়সা। একে বলে বনি। এটা ইরাকের–ফিল।
এ ছাড়া আরও দশ দেশের দশ রকম পয়সা মন্টুকে দেখালেন ভদ্রলোক। তার একটাও মন্টু আগে কখনও দেখেওনি, তার নামও শোনেনি।
এগুলো সব তোমার জন্য।
মন্টু অবাক। ভদ্রলোক বলেন কী! অনীশের কাকাও পয়সা জমান। উনি মন্টুকে বুঝিয়েছেন যারা এ কাজটা করে তাদের বলে নিউমিসম্যাটিস্টস। কিন্তু অনীশের কাকার মোটেই এতরকম পয়সা। নেই সেটা মন্টু জানে।
আমি তো জানতাম যেখানে যাচ্ছি সেখানে আমার একজন নাতি আছে; তার জন্য এনেছি এসব পয়সা।
মন্টু মহা ফুর্তিতে পয়সাগুলো নিয়ে নীচে নেমে এল মা-কে দেখাতে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে বাবার গলা পেয়ে সে থেমে গেল। এই লোকটার বিষয় কথা বলছেন বাবা।
…দশ দিনটা বাড়াবাড়ি। ওকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের মনে সন্দেহ আছে। অতিরিক্ত খাতির না করলে ভদ্রলোক আপনিই মানে মানে বিদায় নেবেন। আর কোনওরকম রিস্ক নেওয়ার কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। আজ সুধীরের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেও অ্যাডভাইস দিল। আলমারি-টালমারি সব ভাল করে বন্ধ করে রাখবে। মন্টু তো সব সময়। পাহারা দেবে না। তার বন্ধুবান্ধব আছে, খেলাধুলো আছে। আমি কাজে বেরিয়ে যাব। বাড়িতে। তুমি আর সদাশিব। সদাশিব কাজ না থাকলেই ঘুমোয়। তুমিও যে দুপুরে ঘুমোও না তা তো নয়।
একটা কথা তোমায় বলি, বললেন মন্টুর মা।
কী?
এনার সঙ্গে কিন্তু মায়ের আদল আছে।
তোমার তাই মনে হল?
সেই রকম টিকোলো নাক, চোখের চাহনিও যেন সেইরকম।
আহা, আমি তো বলছি না ইনি তোমার মামা নন। কিন্তু মামা লোকটি কেমন তা তো কিছুই জানি না আমরা। লেখাপড়া করেননি, কোনও ডিসিপ্লিন নেই, ছন্নছাড়া জীবন…। আমার মোটেই। ভাল লাগছে না ব্যাপারটা।
বাবার কথা থামলে পর মন্টু ঘরে ঢুকল। এই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই মন্টুর ভদ্রলোককে বেশ ভাল লেগে গেছে। বাবার কথাগুলো সে পছন্দ করেনি। হয়তো পয়সাগুলো দেখলে বাবার মনটা ভদ্রলোকের প্রতি একটু নরম হবে।
এই কয়েন উনি দিলেন?
মন্টু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
উনি কি এসব জায়গায় গেছেন বলে বললেন নাকি?
না, তা বলেননি।
তাও ভাল। এ জিনিস কলকাতায় কিনতে পাওয়া যায়। চৌরঙ্গিতে দোকান আছে।
সাড়ে চারটে নাগাদ দোতলা থেকে নেমে এলেন ভদ্রলোক। তারপরেই বাবার সঙ্গে আলাপ হল।
আপনার ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে, বললেন ভদ্রলোক।
হ্যাঁ, ও তাই বলছিল।
মায়ের মতো বাবাও ঘন ঘন দৃষ্টি দিচ্ছেন ভদ্রলোকের দিকে।
আমি দেখেছি কম বয়সী ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব চট করে ভাব হয়ে যায়। ভবঘুরেদের বোধহয় ওরাই সবচেয়ে ভাল বোঝে।
আপনি বুঝি সারাজীবনই ঘুরেছেন?
তা ঘুরেছি। এক জায়গায় বসে থাকা ধাতে ছিল না আমার।
আমরা আবার গুছোনো জীবনটাই বুঝি। উদ্দেশ্যহারা ভাবে ঘোরাঘুরি আমাদের পোয় না। রোজগার আছে, সংসারের দায়িত্ব আছে, সন্তানপালন আছে। আপনি তো বিয়ে করেননি?
না।
ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, সুহাসিনীর বোধহয় মনে নেই; ওর এক প্রমাতামহ–আমার এক দাদু–তাঁরও ঠিক এই প্রবৃত্তি ছিল। উনি তেরো বছর বয়সে ঘরছাড়া হন। আমি তো অল্পদিনের জন্য হলেও ফিরেছি। উনি আর একেবারেই ফেরেননি।
মন্টু দেখল বাবা মার দিকে ফিরলেন।
এটা জানতে তুমি?
জানলেও এখন আর মনে নেই, বললেন মা।
বিকেলে চা খাবার পর এক ব্যাপার হল। মন্টুর বন্ধুরা কদিন থেকেই শুনছে যে সোমবার তার এক দাদু আসবে যাকে দাদু বলে চেনার কোনও উপায় নেই। তারা ভারী কৌতূহলী হয়ে এল সেই দাদুকে দেখতে। চার-পাঁচটি দশ বারো বছরের ছেলেকে একসঙ্গে দেখে দাদুও খুব খুশি। সবাইকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন লাঠি হাতে নিয়ে মিত্তিরদের বাড়ি পেরিয়ে মাঠটার একধারে কদম গাছটার তলায় বসে দাদু বললেন, তুয়ারেগ কাদের বলে জানো? সকলেই মাথা নেড়ে না বলল। দাদু বললেন, সাহারা মরুভূমি জানো তো?–সেই সাহারায় তুয়ারেগ বলে একরকম যাযাবর জাতি বাস করে। দরকার হলে তারা দস্যুবৃত্তি করে। সেই তুয়ারেগের কবলে পড়ে একজন লোক কী ভাবে রক্ষা পেয়েছিল বুদ্ধির জোরে সে গল্প বলি তোমাদের।
দাদুর গল্প ছেলের দল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলে। মন্টু পরে মা-কে বলেছিল, এমন গল্প, ঠিক মনে হয় সব কিছু চোখের সামনে দেখছি।
বাবা কাছেই ছিলেন, বললেন, গল্পের বই পড়ার বাতিক আছে বুঝি ভদ্রলোকের? কোনও এক ইংরিজি পত্রিকায় এ ধরনের একটা গল্প পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।
মন্টু বলেছিল ভদ্রলোকের সুটকেসে বই আছে সেটা সে জানে, তবে গল্পের বই কি না জানে না।
তিনদিন তিন রাত চলে এই ভাবে। বাড়ির কোনও কিছু চুরি হল না, ভদ্রলোক কোনও উৎপাত করলেন না, যা দেওয়া হল তাই তৃপ্তি করে খেলেন, কোনও বাড়তি আবদার করলেন না, কোনও বিষয়ে অভিযোগ করলেন না। এ কদিনে বাবার বেশ কয়েকজন উকিল বন্ধু এসেছে মন্টুদের বাড়িতে। এমনিতে বেশি আসে-টাসে না; মন্টু জানে তারা এই দাদু-কি-দাদু-নয় বুড়োকেই দেখতে এসেছে। মা বাবাকে দেখে মনে হয় তারা মোটামুটি বুড়োকে মেনেই নিয়েছেন। বাবাকে তো একদিন বলতেই শুনেছে মন্টু–লোকটা সাদাসিধে এটা বলতেই হবে। বেশি গায়ে পড়ার চেয়ে এই ভাল, তবে এরকম মানুষের বেঁচে থেকে কী লাভ জানি না। আসলে বাড়ি ছেড়ে পালানোর মানে বোঝো তো?–দায়িত্ব এড়ানো। এঁরা পরাশ্রয়ী জীব। সারা জীবনটাই হয়তো এর-ওর ঘাড়ে ভর করে কাটিয়েছে।
মন্টু একবার ছোটদাদু বলে ডেকে ফেলেছিল ভদ্রলোককে, তাতে তিনি শুধু মৃদু হেসে তার দিকে চেয়েছিলেন, কিছু বলেননি। মা কিন্তু মামা বলে ডাকেননি একবারও। মন্টু সে কথা বলাতে মা বলেছেন, তাতে ভদ্রলোক খুব একটা দুঃখ পাচ্ছেন বলে তো মনে হয় না। আর মামা যে ডাকব, তারপর যদি বেরোয় মামা নন, তা হলে কী অপ্রস্তুতের ব্যাপার বল তো।
চারদিনের দিন ভদ্রলোক বললেন আজ একটু বেরোবেন।–নীলকণ্ঠপুর বাস যায় না?
বাবা বললেন তা যায়। বাজার থেকে এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর বাস ছাড়ে।
তা হলে ভাবছি জন্মস্থানটা একবার দেখে আসব। ফিরতে অবিশ্যি বিকেল হয়ে যাবে।
খেয়ে যাবেন তো? প্রশ্ন করলেন মন্টুর মা।
নাঃ। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াই ভাল। ওখানেই হোটেলে কোথাও খেয়ে নেব। ওর জন্য। চিন্তা কোরো না।
নটার মধ্যেই ভদ্রলোক বেরিয়ে পড়লেন।
দুপুরে মন্টু আর লোভ সামলাতে পারল না। ভদ্রলোকের ঘর খালি। ওঁর সুটকেসটায় কী বই আছে সেটা দেখার শখ অনেকদিন থেকেই। বাবা নেই, মা একতলায় বিশ্রাম করছেন; মন্টু গিয়ে ঢুকল ভদ্রলোকের ঘরে।
সুটকেসে তালা নেই। চুরির ভয়টা নেই ভদ্রলোকের সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
মন্টু সুটকেসের ডালাটা তুলল।
কিন্তু কোথায় বই? বই তো নেই, খাতা। খান ত্রিশেক নানারকমের খাতা, তার মধ্যে দশবারোটা বাঁধিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু খাতা খুলল মন্টু। পরিষ্কার ঝকঝকে বাংলা হাতের লেখা, পড়তে কোনও অসুবিধে নেই।
মন্টু খাটের উপর উঠল খাতাটা নিয়ে।
আর পরমুহূর্তেই নেমে আসতে হল।
তার অজান্তে মা উপরে উঠে এসেছেন।
ও ঘরে কী হচ্ছে মন্টু? ওনার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছ বুঝি?
মন্টু সুবোধ বালকের মতো খাট থেকে নেমে এসে সুটকেসে খাতাটা রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
যাও, নিজের ঘরে যাও। পরের জিনিস ঘাঁটতে নেই। নিজের বই পড়ো গিয়ে যাও।
ছটার একটু পরেই ফিরে এলেন ভদ্রলোক।
রাত্তিরে খাবার সময় মন্টুর মা বাবাকে বেশ খানিকটা অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন তিনি কালই ফিরে যাচ্ছেন।
তোমাদের আতিথেয়তার তুলনা নেই, কিন্তু আমার পক্ষে এক জায়গায় বেশিদিন থাকা পোষায় না।
বাবা-মা যে খবরটা শুনে অখুশি নন এটা মন্টু জানে, যদিও তার নিজের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। বাবা বললেন, আপনি কি কলকাতায় যাবেন এখান থেকে?
হ্যাঁ, তবে সেও বেশিদিনের জন্য নয়। সেখান থেকে অন্য কোথাও পাড়ি দেব। কারুর গলগ্রহ হয়ে থেকে অভ্যেস নেই। আমি সেই বাড়ি ছাড়ার পর থেকেই স্বাধীন।
মা বললেন, গলগ্রহ বলছেন কেন, আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।
খানিকটা যে হচ্ছিল সেটা মন্টু জানে, কারণ সে এর মধ্যে একদিন বাবাকে বলতে শুনেছে যে এই মাগ্যির বাজারে একজন বাড়তি লোকের পিছনে খরচ অনেক।
এবার মন্টু আর বাবা দুজনেই গেল ভদ্রলোককে স্টেশনে পৌঁছাতে, বাড়ির গাড়িতে করে। মন্টু জানে যে ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন অবধি বাবার মনে সন্দেহ আছে যিনি এসে রইলেন এতদিন, তিনি সত্যি করেই মন্টুর দাদু কি না।
.
সাতদিন পর আরেক বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন মন্টুদের বাড়িতে। ইনি মন্টুর মায়ের শেতলমামা। এঁকে এর আগে একবারই দেখেছে মন্টু, দিদির বিয়েতে।
সে কী, শেতলমামা, হঠাৎ কী মনে করে?
একটা কর্তব্য সারতে এসেছি রে। একটা নয়, দুটো। নইলে এই বুড়ো বয়সে আজকের দিনে এমনি এমনি কেউ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে পাড়ি দেয়? দুপুরে খাব কিন্তু।
নিশ্চয়ই খাবেন। কী খেতে মন চায় বলুন। এখানে সব পাওয়া যায়, কলকাতার মতো নয়।
দাঁড়া দাঁড়া, আগে কাজগুলো সারি।
কাঁধে ঝোলানো থলি থেকে ভদ্রলোক একটা বই বার করলেন।
এ বইয়ের নাম শুনিসনি তো?
মা বইটা হাতে নিয়ে বললেন, কই, না তো।
পুলিন তোদের বলেনি সেটা জানি।
পুলিন?
তোর ছোটমামা! যে লোক কাটিয়ে গেল এখানে পাঁচটা দিন তার নামটাও জানিস নি? এ তারই লেখা বই।
তাঁর বই?
তোরা কোন্ রাজ্যে থাকিস? সেদিন কাগজেও তো নাম বেরিয়েছে। এমন আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যে কটা আছে?
কিন্তু এই নাম তো—
নাম তো ছদ্মনাম। সারা পৃথিবী ঘুরেছে চল্লিশ বছর ধরে, অথচ এতটুকু দম্ভ নেই।
সারা পৃথিবী–?
পুলিন রায়ের মতো অত বড় ভূপর্যটক ভারতবর্ষে আর হয়নি। আর সব নিজের রোজগারে ঘঘারা। খালাসিগিরি থেকে শুরু করে কুলিগিরি, কাঠের মজুরি, খবরের কাগজ বিক্রি, দোকানদারি, লরির ড্রাইভারি–কোনও কাজ সে বাদ দেয়নি। তার অভিজ্ঞতার কাছে গল্প হার মেনে যায়। সে বাঘের কবলে পড়েছে, সাপের ছোবল খেয়েছে, সাহারায় দস্যুদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে, জাহাজডুবি থেকে সাঁতরে উঠেছে ম্যাডাগাস্কারের ডাঙায়। থার্টি নাইনে সে ভারতবর্ষ ছেড়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে বলে বাপের বাড়ির মায়া একবার কাটাতে পারলে সারা পৃথিবীটাই হয়ে যায় নিজের ঘর। সাদা কালো ছোট বড় জংলি সভ্য সব এক হয়ে যায়।
কিন্তু–এসব আমাদের বললেন না কেন?
তোদের মতো ঘরকুনো কূপমণ্ডুক কি এসব কথা বিশ্বাস করত? সে আসল কি নকল তাই তোরা ঠিক করতে পারিসনি, তাকে মামা বলে ডাকতে পারিসনি, আর এত কথা সে বলতে যাবে তোদের?
ইস্–আ বার ডেকে আনা যায় না মামাকে?
উঁহু। পাখি উড়ে গেছে। বললে বলিদ্বীপটা দেখা হয়নি, সেখানে যাবার চেষ্টা করবে। এই বইটা তোদের দিয়ে গেছে। তোদের ঠিক দেয়নি, দিয়েছে দাদুকে। বললে ওর মনটা এখনও কাঁচা, ওতেই ছাপটা পড়বে ভাল। তবে ওর আসল পাগলামোর কথাটা বলিনি এখনও। ওকে পই পই করে বললাম যে আর কটা দিন থেকে যাও, এ বই নিঘাত পুরস্কার পাবে, অ্যাকাডেমি দশ হাজার টাকা দিচ্ছে আজকাল। সে কিছুতেই শুনলে না। বললে টাকা যদি আসে তো মামুদপুরে আমার ভাগনিকে দিয়ে দিয়ো, সে খুব যত্ন নিয়েছে আমার। শুধু মুখে বলা না, কাগজে লিখে দিলে।–এই নে সেই টাকা।
মা শেতলমামার হাত থেকে কামটা নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললেন, বোঝে ব্যাপার।
রচনাকাল আষাঢ় ১৩৮৮ (১৯,২০/৭/৮১) সরাসরি আরো বানো বইতে। প্রথম সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৮১
অনাথবাবুর ভয়
অনাথবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ ট্রেনের কামরায়। আমি যাচ্ছিলাম রঘুনাথপুর, হাওয়াবদলের জন্য। কলকাতায় খবরের কাগজের আপিসে চাকরি করি। গত কমাস ধরে কাজের চাপে দমবন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। তা ছাড়া আমার লেখার শখ, দু-একটা গল্পের প্লটও মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু এত কাজের মধ্যে কি আর লেখার ফুরসত জোটে? তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে দশদিনের পাওয়া ছুটি আর দিস্তেখানেক কাগজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এত জায়গা থাকতে রঘুনাথপুর কেন তারও অবিশ্যি একটা কারণ আছে। ওখানে বিনা-খরচায় থাকার একটা ব্যবস্থা জুটে গেছে। আমার কলেজের সহপাঠী বীরেন বিশ্বাসের পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। রঘুনাথপুরে। কফি হাউসে বসে, ছুটিতে কোথায় যাওয়া যায়, এই আলোচনাপ্রসঙ্গে বীরেন খুব খুশি হয়ে ওর বাড়িটা অফার করে বলল, আমিও যেতুম, কিন্তু আমার এদিকে ঝামেলা, বুঝতেই তো পারছিস। তবে তোর কোনওই অসুবিধা হবে না। আমাদের পঞ্চাশ বছরের পুরনো চাকর ভরদ্বাজ রয়েছে ও বাড়িতে। ও-ই তোর দেখাশুনো করবে। তুই চলে যা।
গাড়িতে যাত্রী ছিল অনেক। আমার বেঞ্চিতে আমারই পাশে বসে ছিলেন অনাথবন্ধু মিত্র। বেঁটেখাটো মানুষটি, বছর পঞ্চাশেক আন্দাজ বয়স। মাঝখানে টেরিকাটা কাঁচাপাকা চুল, চোখের চাহনি তীক্ষ্ণ, আর ঠোঁটের কোণে এমন একটা ভাব যেন মনের আনাচে কানাচে সদাই কোনও মজার চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও একটা বিশেষত্ব লক্ষ করলাম; ভদ্রলোককে হঠাৎ দেখলে মনে হবে তিনি যেন পঞ্চাশ বছরের পুরনো কোনও নাটকের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সেজেগুঁজে তৈরি হয়ে এসেছেন। ওরকম কোট, ও ধরনের শার্টের কলার, ওই চশমা, আর বিশেষ করে ওই বুট জুতো–এসব আর আজকালকার দিনে কেউ পরে না।
অনাথবাবুর সঙ্গে আলাপ করে জানলাম তিনিও রঘুনাথপুর যাচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞেস করাতে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। কিংবা এও হতে পারে যে, ট্রেনের শব্দের জন্য তিনি আমার প্রশ্ন শুনতে পাননি।
বীরেনের পৈতৃক ভিটেটি দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল। বেশ বাড়ি। সামনে একফালি জমি–তাতে সবজি ও ফুলগাছ দুই-ই হয়েছে। কাছাকাছির মধ্যে অন্য কোনও বাড়িও নেই, কাজেই পড়শির উৎপাত থেকেও রক্ষা।
আমি আমার থাকার জন্য ভরদ্বাজের আপত্তি সত্ত্বেও ছাতের চিলেকোঠাটি বেছে নিলাম। আলো, বাতাস এবং নির্জনতা, তিনটেই অপর্যাপ্ত পাওয়া যাবে ওখানে। ঘর দখল করে জিনিসপত্র গোছাবার সময় দেখি আমার দাড়ি কামানোর খুর আনতে ভুলে গিয়েছি। ভরদ্বাজ শুনে বলল, তাতে আর কী হয়েছে খোকাবাবু। এই তো কুণ্ডুবাবুর দোকান, পাঁচ মিনিটের পথ। সেখানে গেলেই পাবেখন বিলেড।
বিকেল চারটে নাগাদ চাটা খেয়ে কুণ্ডুবাবুর দোকানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি সেটি একটি ভাল আড্ডার জায়গা। দোকানের ভিতর দুটি বেঞ্চিতে বসে পাঁচ-সাতটি প্রৌঢ় ভদ্রলোক রীতিমতো গল্প জমিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন বেশ উত্তেজিত ভাবে বলছেন, আরে বাপু, এ তো আর শোনা কথা নয়! এ আমার নিজের চোখে দেখা। আর তিরিশ বছর হয়ে গেল বলেই কি সব মন থেকে মুছে গেল? এসব স্মৃতি অত সহজে ভোলবার নয়, আর বিশেষ করে যখন হলধর দত্ত ছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তার মৃত্যুর জন্য আমি যে কিছু অংশে দায়ী, সে বিশ্বাস আমার আজও যায়নি।
আমি এক প্যাকেট সেভন-ও-ক্লক কিনে আরও দু-একটা অবান্তর জিনিসের খোঁজ করতে লাগলাম। ভদ্রলোক বলে চললেন, ভেবে দেখুন, আমারই বন্ধু আমারই সঙ্গে মাত্র দশ টাকা বাজি ধরে রাত কাটাতে গেল ওই উত্তর-পশ্চিমের ঘরটাতে। পরদিন ফেরে না, ফেরে না, ফেরে না–শেষটায় আমি, জিতেন বক্সি, হরিচরণ সা, আর আরও তিন-চারজন কে ছিল ঠিক মনে নেই–গেলুম হালদার বাড়িতে হলধরের খোঁজ করতে। গিয়ে দেখি বাবু ওই ঘরের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে মরে কাঠ হয়ে আছে, তাঁর চোখ চাওয়া, দৃষ্টি কড়িকাঠের দিকে। আর সেই দৃষ্টিতে ভয়ের যে নমুনা দেখলুম, তাতে ভূত ছাড়া আর কী ভাবব বলুন? গায়ে কোনও ক্ষতচিহ্ন নেই, বাঘের আঁচড় নেই, সাপের ছোবল নেই, কিচ্ছু নেই। আপনারই বলুন এখন কী বলবেন।
আরও মিনিট পাঁচেক দোকানে থেকে আলোচনার বিষয়টি সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হল। ব্যাপারটা এই রঘুনাথপুরের দক্ষিণপ্রান্তে হালদারবাড়ি বলে একটি দুশো বছরের পুরনো ভগ্নপ্রায় জমিদারি প্রাসাদ আছে। সেই প্রাসাদে বিশেষ করে তার দোতলার উত্তর-পশ্চিম কোণের একটি ঘরে না কি অনেককালের পুরনো একটি ভূতের আনাগোনা আছে। অবশ্য সেই ত্রিশ বছর আগে ভবতোষ মজুমদারের বন্ধু হলধর দত্তের মৃত্যুর পর আজ অবধি নাকি কেউ সে বাড়িতে রাত কাটায়নি। কিন্তু তাও রঘুনাথপুরের বাসিন্দারা ভূতের অস্তিত্ব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বেশ একটা রোমাঞ্চ অনুভব করে। আর বিশ্বাস করার কারণও আছে যথেষ্ট। একে তো হলধর দত্তের রহস্যজনক মৃত্যু, তার উপর এমনিতেই হালদারবংশের ইতিহাসে নাকি খুনখারাপি, আত্মহত্যা ইত্যাদির অনেক নজির পাওয়া যায়।
মনে মনে হালদারবাড়ি সম্পর্কে বেশ খানিকটা কৌতূহল নিয়ে দোকানের বাইরে এসেই দেখি। আমার ট্রেনের আলাপি অনাথবন্ধু মিত্র মশাই হাসি-হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় দেখে বললেন, শুনছিলেন ওদের কথাবার্তা?
বললাম, তা কিছুটা শুনেছি।
বিশ্বাস হয়?
কী? ভূত?
হ্যাঁ?
ব্যাপার কী জানেন–ভূতের বাড়ির কথা তো অনেকই শুনলাম, কিন্তু সেসব বাড়িতে থেকে নিজের চোখে ভূত দেখেছে এমন লোক তো কই আজ অবধি একটিও মিট করলাম না। তাই ঠিক–
অনাথবাবু একটু হেসে বললেন, একবার দেখে আসবেন নাকি?
কী?
বাড়িটা।
দেখে আসব মানে–
বাইরে থেকে আর কি। বেশিদূর তো নয়। বড়জোর মাইলখানেক। এই রাস্তা দিয়ে সোজা গিয়ে জোড়াশিবের মন্দির ছাড়িয়ে ডানহাতি রাস্তায় ঘুরে পোয়াটাক পথ।
ভদ্রলোককে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল। আর তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গিয়ে কী করব? তাই চললাম তাঁর সঙ্গে।
হালদারদের বাড়িটা দূর থেকে দেখা যায় না, কারণ বাড়ির চারপাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল। তবে বাড়ির গেটের মাথাটা দেখা যেতে থাকে পৌঁছনোর প্রায় দশ মিনিট আগে থেকেই। বিরাট ফটক, মাথার উপর ভগ্নপ্রায় নহবতখানা। ফটকের ভিতর দিয়ে বেশ খানিকদূর রাস্তা গিয়ে তবে সদর দালান। দু-তিনটে মূর্তি আর ফোয়ারার ভগ্নাবশেষ দেখে বুঝলাম যে বাড়ির আর ফটকের মাঝখানের এই জায়গাটা আগে বাগান ছিল। বাড়িটি অদ্ভুত। কারুকার্যের কোনও বাহার নেই তার কোনও জায়গায়। কেমন যেন একটা বেঢপ চৌকো-চৌকো ভাব। বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে তার শেওলাবৃত দেয়ালে।
মিনিটখানেক চেয়ে থাকার পর অনাথবাবু বললেন, আমি যতদূর জানি, রোদ থাকতে ভূত বেরোয়। তারপর আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বললেন, একবার চট করে সেই ঘরটা দেখে এলে হত না?
সেই উত্তর-পশ্চিমের ঘর? যে ঘরে–
হ্যাঁ। যে ঘরে হলধর দত্তের মৃত্যু হয়েছিল।
ভদ্রলোকের তো এসব ব্যাপারে দেখছি একটু বাড়াবাড়ি রকমের আগ্রহ!
অনাথবাবু বোধহয় আমার মনের ভাবটা আঁচ করতে পেরেই বললেন, খুব আশ্চর্য লাগছে, না? আসলে কী জানেন? আপনাকে বলতে দ্বিধা নেই–আমার রঘুনাথপুর আসার একমাত্র কারণই হল ওই বাড়িটা।
বটে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ওটা যে ভূতের বাড়ি, আমি কলকাতায় থাকতে সে খবরটা পেয়ে ওই ভূতটিকে দেখব বলে এখানে এসেছি। আপনি সেদিন ট্রেনে আমার আসার কারণটা জানতে চাইলেন। আমি উত্তর না দিয়ে অভদ্রতা করলাম বটে, কিন্তু মনে মনে স্থির করেছিলাম যে, উপযুক্ত সময় এলে–অর্থাৎ আপনি কীরকম লোক সেটা আরেকটু জেনে নিয়ে, আসল কারণটা নিজে থেকেই বলব।
কিন্তু তাই বলে ভূতের পিছনে ধাওয়া করে একেবারে কলকাতা ছেড়ে–
বলছি, বলছি। ব্যস্ত হবেন না। আমার কাজটা সম্বন্ধেই তো বলা হয়নি এখনও আপনাকে। আসলে আমি ভূত সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। আজ পঁচিশ বছর ধরে এ ব্যাপার নিয়ে বিস্তর রিসার্চ করেছি। শুধু ভূত কেন ভূত, প্রেত, পিশাচ, ডাকিনী, যোগিনী, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ, ভুডুইজম ইত্যাদি যা কিছু আছে তার সম্বন্ধে বইয়ে যা লেখে তার প্রায় সবই পড়ে ফেলেছি। সাতটা ভাষা শিখতে হয়েছে এসব বই পড়ার জন্য। পরলোকতত্ত্ব নিয়ে লন্ডনের প্রফেসার নর্টনের সঙ্গে আজ তিন বছর ধরে চিঠি লেখালেখি করছি। আমার লেখা প্রবন্ধ বিলেতের সব নামকরা কাগজে বেরিয়েছে। আপনার কাছে বড়াই করে কী লাভ, তবে এটুকু বলতে পারি যে, এদেশে এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী লোক বোধহয় আর নেই।
ভদ্রলোকের কথা শুনে তিনি যে মিথ্যে বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন এটা আমার একবারও মনে হয় না। বরং তাঁর সম্বন্ধে খুব সহজেই একটা বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠল।
অনাথবাবু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ভারতবর্ষের অন্তত তিনশো ভূতের বাড়িতে আমি রাত কাটিয়েছি।
বলেন কী?
হ্যাঁ। আর সেসব কীরকম জায়গায় জানেন? এই ধরুন জব্বলপুর, কার্সিয়াং, চেরাপুঞ্জি, কাঁথি, কাটোয়া, যোধপুর, আজিমগঞ্জ, হাজারিবাগ, সিউড়ি, বারাসাত, আর কত চাই? ছাপ্পান্নোটা ডাকবাংলো আর কম করে ত্রিশটা নীলকুঠিতে আমি রাত্রিযাপন করেছি। এ ছাড়া কলকাতা এবং তার কাছাকাছির মধ্যে অন্তত পঞ্চাশখানা বাড়ি তো আছেই। কিন্তু–
অনাথবাবু হঠাৎ থেমে গেলেন। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললেন, ভূত আমায় ফাঁকি দিয়েছে। হয়তো, ভূতকে যারা চায় না, ভূত তাদের কাছেই আসে। আমি বারবার হতাশ হয়েছি। মাদ্রাজে ত্রিচিনপল্লীতে দেড়শো বছরের পুরনো একটা সাহেবদের পরিত্যক্ত ক্লাব বাড়িতে ভূত একবার। কাছাকাছি এসেছিল। কীরকম জানেন? অন্ধকার ঘর, একফোঁটা বাতাস নেই, যতবারই মোমবাতি ধরাব বলে দেশলাই জ্বালাচ্ছি, ততবারই কে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। শেষটায় তেরোটা কাঠি নষ্ট করার। পর বাতি জ্বলল, এবং আলোর সঙ্গে সঙ্গেই ভূতবাবাজি সেই যে গেলেন আর এলেন না। একবার। কলকাতার ঝামাপুকুরের এক হানাবাড়িতেও একটা ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার মাথায় তো এত চুল দেখছেন? অথচ, এই বাড়ির একটা অন্ধকার ঘরে ভূতের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে মাঝরাত্তির নাগাদ হঠাৎ ব্রহ্মতালুর কাছটায় একটা মশার কামড় খেলাম। কী ব্যাপার? অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখি একটি চুলও নেই! একেবারে মসৃণ মাথাজোড়া টাক! এ কি আমারই মাথা,
অন্য কারুর মাথায় হাত দিয়ে নিজের মাথা বলে মনে করেছি? কিন্তু মশার কামড়টা তো আমিই খেলাম। টর্চটা জ্বেলে আয়নায় দেখি টাকের কোনও চিহ্নমাত্র নেই। আমার যে-চুল সে-চুলই রয়েছে আমার মাথায়। ব্যস, এই দুটি ছাড়া আর কোনও ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা এত চেষ্টা সত্ত্বেও আমার হয়নি। তাই ভূত দেখার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছিলুম, এমন সময় একটা পুরনো বাঁধানো প্রবাসীতে রঘুনাথপুরের এই বাড়িটার একটা উল্লেখ পেলাম। তাই ঠিক করলাম একটা শেষ চেষ্টা দিয়ে আসব।
অনাথবাবুর কথা শুনতে শুনতে কখন যে বাড়ির সদর দরজায় এসে পড়েছি সে খেয়াল ছিল না। ভদ্রলোক তাঁর ট্যাঁকঘড়িটা দেখে বললেন, আজ পাঁচটা একত্রিশে সূর্যাস্ত। এখন সোয়া পাঁচটা। চলুন, রোদ থাকতে থাকতে একবার ঘরটা দেখে আসি।
ভূতের নেশাটা বোধহয় সংক্রামক, কারণ আমি অনাথবাবুর প্রস্তাবে কোনও আপত্তি করলাম না। বরঞ্চ বাড়ির ভিতরটা, আর বিশেষ করে দোতলার ওই ঘরটা দেখবার জন্য বেশ একটা আগ্রহ হচ্ছিল।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকে দেখি বিরাট উঠোন ও নাটমন্দির। একশো-দেড়শো বছরে কত উৎসব, কত অনুষ্ঠান, কত পূজা-পার্বণ, যাত্রা, কথকতা এইখানে হয়েছে, তার কোনও চিহ্ন আজ নেই।
উঠোনের তিনদিকে বারান্দা। আমাদের ডাইনে বারান্দার যে অংশ, তাতে একটি ভাঙা পালকি পড়ে আছে, এবং পালকিটি ছাড়িয়ে হাত দশেক গিয়েই দোতলায় যাবার সিঁড়ি।
সিঁড়িটা এমনই অন্ধকার যে, উঠবার সময় অনাথবাবুকে তাঁর কোটের পকেট থেকে একটি টর্চ বার করে জ্বালাতে হল। প্রায়-অদৃশ্য মাকড়সার জালের ব্যুহ ভেদ করে কোনওরকমে দোতলায় পৌঁছনো গেল। মনে মনে বললাম, এ বাড়িতে ভূত থাকা অস্বাভাবিক নয়!
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হিসাব করে দেখলাম বাঁ দিক দিয়ে সোজা চলে গেলে ওই যে ঘর, ওটাই হল উত্তর-পশ্চিমের ঘর। অনাথবাবু বললেন, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চলুন এগোই।
এখানে বলে রাখি, বারান্দায় কেবল একটি জিনিস ছিল–সেটি একটি ঘড়ি। যাকে বলে গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। কিন্তু তার অবস্থা খুবই শোচনীয় কাঁচ নেই, বড় কাঁটাটিও উধাও, পেন্ডুলামটি ভেঙে কাত হয়ে পড়ে আছে।
উত্তর-পশ্চিমের ঘরের দরজাটি ভেজানো ছিল। অনাথবাবু যখন তাঁর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে সন্তর্পণে ঠেলে দরজাটি খুলছিলেন, তখন বিনা কারণেই আমার গা-টা ছমছম করছিল।
কিন্তু ঘরের ভিতর ঢুকে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করলাম না। দেখে মনে হয় এককালে বৈঠকখানা ছিল। ঘরের মাঝখানে একটা বিরাট টেবিল, তার কেবল পায়া চারখানাই রয়েছে, উপরের তক্তাটা নেই। টেবিলের পাশে জানলার দিকে একটি আরাম কেদারা। অবিশ্যি এখন আর সেটি আরামদায়ক হবে কিনা সন্দেহ, কারণ তার একটি হাতল ও বসবার জায়গায় বেতের খানিকটা অংশ লোপ পেয়েছে।
উপরের দিকে চেয়ে দেখি ছাত থেকে ঝুলছে একটি টানাপাখার ভগ্নাংশ। অর্থাৎ তার দড়ি নেই, কাঠের ডান্ডাটা ভাঙা এবং ঝালরের অর্ধেকটা ঘেঁড়া।
এ ছাড়া ঘরে আছে একটি খাঁজকাটা বন্দুক রাখার তাক, একটি নলবিহীন গড়গড়া, আর দুখানা সাধারণ হাতলভাঙা চেয়ার।
অনাথবাবু কিছুক্ষণ একেবারে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। মনে হল খুব মনোযোগ দিয়ে কী একটা অনুভব করার চেষ্টা করলেন। প্রায় মিনিটখানেক পরে বললেন, একটা গন্ধ পাচ্ছেন?
কী গন্ধ?
মাদ্রাজি ধূপ, মাছের তেল, আর মভাপোড়ার গন্ধ মেশানো একটা গন্ধ?
আমি বার দু-এক বেশ জোরে জোরে শ্বাস টানলাম। অনেকদিনের বন্ধ ঘর খুললে যে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বেরোয়, সে গন্ধ ছাড়া আর কোনও গন্ধই পেলাম না। তাই বললাম, কই, ঠিক বুঝতে পারছি না তো।
অনাথবাবু আরও একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বাঁ হাতের তেলোতে ডান হাত দিয়ে একটা ঘুষি মেরে বললেন, বহুত আচ্ছা! এ গন্ধ আমার চেনা গন্ধ। এ বাড়িতে ভূত অবশ্যম্ভাবী। তবে বাবাজি দেখা দেবেন কি না দেবেন সেটা কাল রাত্রের আগে বোঝা যাবে না। চলুন।
অনাথবাবু স্থির করে ফেললেন যে, পরদিনই তাঁকে এ ঘরে রাত্রিবাস করতে হবে। ফেরার পথে বললেন, আজ থাকলুম না কারণ কাল অমাবস্যা-ভূতের পক্ষে সবচেয়ে প্রশস্ত তিথি। তা ছাড়া দু-একটি জিনিস সঙ্গে রাখা দরকার। সেগুলো বাড়িতে রয়ে গেছে, কাল নিয়ে আসব। আজ সার্ভেটা করে গেলুম আর কি।
ভদ্রলোক আমায় বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে বিদায় নেবার সময় গলাটা একটু নামিয়ে বললেন, আর কাউকে আমার এই প্ল্যানের কথা বলবেন না যেন। এদের কথাবার্তা তো শুনলুম আজকে যা ভয় আর যা প্রেজুডিস এদের, জানলে পরে হয়তো বাধাটাধা দিয়ে আমার প্ল্যানটাই ভেস্তে দেবে। আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা। আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে বললুম না বলে কিছু মনে করবেন না। এসব ব্যাপার, বুঝলেন কিনা, একা না হলে ঠিক জুতসই হয় না।
.
পরদিন দুপুরে কাগজকলম নিয়ে বসলেও লেখা খুব বেশিদূর এগোলো না। মন পড়ে রয়েছে হালদারবাড়ির ওই উত্তর-পশ্চিমের ঘরটায়। আর রাত্রে অনাথবাবুর কী অভিজ্ঞতা হবে সেই নিয়ে একটা অশান্তি আর উদ্বেগ রয়েছে মনের মধ্যে।
বিকেলে অনাথবাবুকে হালদারবাড়ির ফটক অবধি পৌঁছে দিলাম। ভদ্রলোকের গায়ে আজ একটা কালো গলাবন্ধ কোট, কাঁধে জলের ফ্লাস্ক আর হাতে সেই কালকের তিন সেলের টর্চ। ফটক দিয়ে ঢুকবার আগে কোটের দুপকেটে দুহাত ঢুকিয়ে দুটো বোতল বার করে আমায় দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন–এটিতে রয়েছে আমার নিজের ফরমুলায় তৈরি তেল-শরীরের অনাবৃত অংশে মেখে নিলে আর মশা কামড়াবে না। আর এই দ্বিতীয়টিতে হল কারবলিক অ্যাসিড, ঘরের আশেপাশে ছড়িয়ে দিলে সাপের উৎপাত থেকে নিশ্চিন্ত। এই বলে বোতল দুটো পকেটে পুরে, টর্চটা মাথায় ঠেকিয়ে আমায় একটা সেলাম ঠুকে ভদ্রলোক বুটজুতো খটখটিয়ে হালদারবাড়ির দিকে চলে গেলেন।
.
রাত্রে ভাল ঘুম হল না।
ভোর হতে না হতে ভরদ্বাজকে বললাম আমার থার্মস ফ্লাস্কে দুজনের মতো চা ভরে দিতে। চা এলে পর ফ্লাস্কটি নিয়ে আবার হালদারবাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম।
হালদারবাড়ির ফটকের কাছে পৌঁছে দেখি চারিদিকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। অনাথবাবুর নাম ধরে ডাকব, না সটান দোতলায় যাব তাই ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ শুনতে পেলাম–ও মশাই, এই যে এদিকে।
এবার দেখতে পেলাম অনাথবাবুকে–প্রাসাদের পুবদিকের জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে মোটেই মনে হয় না যে, রাত্রে তাঁর কোনও ভয়াবহ বা অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমার কাছে এসে হাসতে হাসতে হাতে একটা নিমের ডাল দেখিয়ে বললেন, আর বলবেন না মশাই! আধঘণ্টা বনেবাদাড়ে ঘুরছি এই নিমডালের খোঁজে। আমার আবার দাঁতনের অভ্যেস কিনা।
ফস করে রাত্রের কথাটা জিজ্ঞেস করতে কেমন বাধো বাধো ঠেকল। বললাম, চা এনেছি। এখানেই খাবেন, না বাড়ি যাবেন?
চলুন না, ওই ফোয়ারার পাশটায় বসে খাওয়া যাক।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তিসূচক আঃশব্দ করে আমার দিকে ফিরে মুচকি হেসে অনাথবাবু বললেন, খুব কৌতূহল হচ্ছে, না?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, হ্যাঁ, মানে, তা একটু–
বেশ। তবে বলছি শুনুন। গোড়াতেই বলে রাখি–এক্সপিডিশন হাইলি সাকসেসফুল। আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে।অনাথবাবু এক মগ চা শেষ করে দ্বিতীয় মগ ঢেলে তাঁর কথা শুরু করলেন :
আপনি যখন আমায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন তখন পাঁচটা। আমি বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে এই আশপাশটা একটু সার্ভে করে নিলুম। অনেক সময় ভূতের চেয়ে জ্যান্ত মানুষ বা জানোয়ার থেকে উপদ্রবের আশঙ্কা বেশি থাকে। যাই হোক, দেখলুম কাছাকাছির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু নেই।
বাড়িতে ঢুকে একতলার ঘরগুলোর মধ্যে যেগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোও একবার দেখে নিলুম। জিনিসপত্তর তো আর অ্যাদ্দিন ধরে বিশেষ পড়ে থাকার কথা নয়। একটা ঘরে কিছু আবর্জনা, আর আরেকটার কড়িকাঠে গুটি চারেক ঝুলন্ত বাদুড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। বাদুড়গুলো আমায় দেখেও নড়ল না। আমিও তাদের ডিসটার্ব করলুম না।
সাড়ে ছটা নাগাদ দোতলার ওই আসল ঘরটিতে ঢুকে রাত কাটানোর আয়োজন শুরু করলুম। একটা ঝাড়ন এনেছিলুম, তাই দিয়ে প্রথমে আরামকেদারাটিকে ঝেডেপুঁছে সাফ করলুম। কদ্দিনের ধুলো জমেছিল তাতে কে জানে?
ঘরের মধ্যে একটা গুমোট ভাব ছিল, তাই জানলাটা খুলে দিলুম। ভূতবাবাজি যদি সশরীরে আসতে চান তাই বারান্দার দরজাটাও ভোলা রাখলুম। তারপর টর্চ ও ফ্লাস্কটা মেঝেতে রেখে ওই বেতঘেঁড়া আরামকেদারাতেই শুয়ে পড়লুম। অসোয়াস্তি হচ্ছিল বেশ, কিন্তু এর চেয়েও আরও অনেক বেয়াড়া অবস্থায় বহুবার রাত কাটিয়েছি, তাই কিছু মাইন্ড করলুম না।
আশ্বিন মাস, সাড়ে পাঁচটায় সূর্য ডুবেছে। দেখতে দেখতে অন্ধকারটা বেশ জমাট বেঁধে উঠল। আর সেইসঙ্গে সেই গন্ধটাও ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি এমনিতে খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, সহজে বড় একটা একসাইটেড হই না, কিন্তু কাল যেন ভিতরে ভিতরে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলুম।
সময়টা ঠিক বলতে পারি না, তবে আন্দাজে মনে হয় নটা কি সাড়ে নটা নাগাদ জানলা দিয়ে একটা জোনাকি ঘরে ঢুকেছিল। সেটা মিনিটখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার জানলা দিয়েই বেরিয়ে গেল।
তারপর কখন যে শেয়াল, ঝিঁঝির ডাক থেমে গেছে, আর কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল। নেই।
ঘুমটা ভাঙল একটা শব্দে। ঘড়ির শব্দ। ঢং ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। মিঠে অথচ বেশ জোর আওয়াজ। জাত ঘড়ির আওয়াজ, আর সেটা আসছে বাইরের বারান্দা থেকে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমটা ছুটে গিয়ে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে আরও দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। এক–আমি আরামকেদারায় সত্যিই খুব আরামে শুয়ে আছি। ছেঁড়াটা তো নেইই, বরং উলটে আমার পিঠের তলায় কে যেন একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে গেছে। আর দুই–আমার মাথার উপর একটি চমৎকার ঝালর সমেত আস্ত নতুন টানাপাখা, তা থেকে একটি নতুন দড়ি দেয়ালের ফুটো দিয়ে বারান্দায় চলে গেছে, এবং কে জানি সে দড়িতে টান দিয়ে পাখাঁটি দুলিয়ে আমায় চমৎকার বাতাস করছে।
আমি অবাক হয়ে এইসব দেখছি আর উপভোগ করছি, এমন সময় খেয়াল হল অমাবস্যার রাত্তিরে কী করে জানি ঘরটা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তারপর নাকে এল একটা চমৎকার গন্ধ। পাশ ফিরে দেখি কে জানি একটা আলবোলা রেখে গেছে, আর তার থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে। একেবারে সেরা অম্বুরী তামাকের গন্ধ।
অনাথবাবু একটু থামলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে হেসে বললেন, বেশ মনোরম পরিবেশ নয় কি?
আমি বললাম, শুনে তো ভালই লাগছে। আপনার রাতটা তা হলে মোটামুটি আরামেই কেটেছে?
আমার প্রশ্ন শুনে অনাথবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বললাম, তা হলে কি সত্যি আপনার কোনও ভয়ের কারণ ঘটেনি? ভূত কি আপনি দেখেননি?
অনাথবাবু আবার আমার দিকে চাইলেন। এবার কিন্তু আর ঠোঁটের কোণে সে হাসিটা নেই। ধরা গলায় ভদ্রলোকের প্রশ্ন এল, পরশু যখন আপনি ঘরটায় গেলেন, তখন কড়িকাঠের দিকটা ভাল করে লক্ষ করেছিলেন কি?
আমি বললাম, তেমন ভাল করে দেখিনি বোধহয়। কেন বলুন তো?
অনাথবাবু বললেন, ওখানে একটা বিশেষ ব্যাপার রয়েছে, সেটা না দেখলে বাকি ঘটনাটা বোঝাতে পারব না। চলুন।
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনাথবাবু কেবল একটি কথা বললেন: আমার আর ভূতের পিছনে ধাওয়া করতে হবে না সীতেশবাবু। কোনওদিনও না। সে শখ মিটে গেছে।
বারান্দা দিয়ে যাবার পথে ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম সেরকমই ভাঙা অবস্থা।
ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে অনাথবাবু বললেন, চলুন।
দরজাটা ভেজানো ছিল। আমি হাত দিয়ে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। তারপর দুপা এগিয়ে মেঝের দিকে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত শরীরে একটা বিস্ময় ও আতঙ্কের শিহরণ খেলে গেল।
বুট জুতো পরা ও কে পড়ে আছে মেঝেতে?
আর বারান্দার দিক থেকে কার অট্টহাসি হালদারবাড়ির আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার রক্ত জল করে আমায় জ্ঞানবুদ্ধি-চিন্তা সব লোপ পাইয়ে দিচ্ছে? তা হলে কি?
আর কিছু মনে নেই আমার।
যখন জ্ঞান হল, দেখি ভরদ্বাজ আমার খাটের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন ভবতোষ মজুমদার। আমার চোখ খুলতে দেখে ভবতোষবাবু বললেন, ভাগ্যে সিধুচরণ আপনাকে দেখেছিল ও বাড়িতে ঢুকতে, নইলে যে কী দশা হত আপনার জানি না। ওখানে গেসলেন কোন আক্কেলে?
আমি বললাম, অনাথবাবু যে রাত্রে—
ভবতোষবাবু বাধা দিয়ে বললেন, আর অনাথবাবু! কাল যে অতগুলো কথা বললুম সে সব বোধহয় কিছুই বিশ্বাস করেননি ভদ্রলোক। ভাগ্যে আপনিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে রাত কাটাতে যাননি ও বাড়িতে। দেখলেন তো ওঁর অবস্থা। হলধরের যা হয়েছিল, এঁরও ঠিক তাই। মরে একেবারে কাঠ, আর চোখ ঠিক সেইভাবে চাওয়া, সেই দৃষ্টি, সেই কড়িকাঠের দিকে।..
আমি মনে মনে বললাম, না, মরে কাঠ নয়। মরে কী হয়েছেন অনাথবাবু তা আমি জানি। কালও সকালে গেলে দেখতে পাব তাঁকে–গায়ে কালো কোট, পায়ে বুট জুতো–হালদারবাড়ির পুব দিকের জঙ্গল থেকে নিমের দাঁতন হাতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছেন।
সন্দেশ, অগ্রহায়ণ ১৩৬৯
অনুকূল
এর একটা নাম আছে তো? নিকুঞ্জবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে বইকী!
কী বলে ডাকব?
অনুকূল।
চৌরঙ্গিতে রোবট সাপ্লাই এজেন্সির দোকানটা খুলেছে মাস ছয়েক হল। নিকুঞ্জবাবুর অনেকদিনের শখ একটা যান্ত্রিক চাকর রাখেন। ইদানীং ব্যবসায় বেশ ভাল আয় হয়েছে, তাই শখটা মিটিয়ে নেবার জন্য এসেছেন।
নিকুঞ্জবাবু রোবটটার দিকে চাইলেন। এটা হচ্ছে যাকে বলে অ্যান্ড্রয়েড, অর্থাৎ যদিও যান্ত্রিক, তাও চেহারার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চেহারার কোনও তফাত নেই। দিব্যি সুশ্রী দেখতে, বয়স মনে হয় বাইশ-তেইশের বেশি নয়।
কী ধরনের কাজ করবে এই রোবট? জিজ্ঞেস করলেন নিকুঞ্জবাবু। ডেস্কের উলটো দিকের ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, সাধারণ চাকর যা পারে, ও তার সবই পারবে। কেবল রান্নাটা জানে না। তা ছাড়া, ঘর ঝাড়পোঁছ করা, বিছানা পাতা, কাপড় কাঁচা, চা দেওয়া, দরজা-জানলা খোলা বা বন্ধ করা–সবই পারবে। তবে হ্যাঁ–ও যা কাজ করবে সবই বাড়িতে। ওকে দিয়ে বাজার করানো চলবে না, বা পান-সিগারেট আনাতে পারবেন না। আর ইয়ে–ওকে কিন্তু তুমি বলে সম্বোধন করবেন। তুইটা ও পছন্দ করে না।
এমনি মেজাজ-টেজাজ ভাল তো?
খুব ভাল। সে-দিক দিয়ে ট্রাবল আসবে যদি আপনি কোনও কারণে ওর গায়ে হাত তোলেন। আমাদের রোবটরা ওটা একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না।
সেটার অবিশ্যি কোনও সম্ভাবনা নেই; কিন্তু ধরুন, যদি কেউ ওকে একটা চড় মারল, তা হলে কী হবে?
তা হলে ও তার প্রতিশোধ নেবে।
কীভাবে?
ওর ডান হাতের তর্জনীর সাহায্যে ও হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শক দিতে পারে।
তাতে মৃত্যু হতে পারে?
তা পারে বইকী! আর আইন এ-ব্যাপারে কিছু করতে পারে না, কারণ রক্ত-মাংসের মানুষকে যে শাস্তি দেওয়া চলে, যান্ত্রিক মানুষকে তা চলে না। তবে এটা বলতে পারি যে, এখনও পর্যন্ত এরকম কোনও কেস হয়নি।
রাত্তিরে কি ও ঘুমোয়?
না। রোবটরা ঘুমোয় না।
তা হলে এতটা সময় কী করে?
চুপ করে বসে থাকে। রোবটের ধৈর্যের অভাব নেই।
ওর কি মন বলে কোনও বস্তু আছে?
ওরা এমন অনেক কিছু বুঝতে পারে, যা সাধারণ মানুষ পারে না। এ গুণটা সব রোবটের যে সমান পরিমাণে থাকে তা নয়; এটা খানিকটা লাকের ব্যাপার। এ গুণটা সময়ে প্রকাশ পায়।
নিকুঞ্জবাবু রোবটটার দিকে ফিরে বললেন, অনুকূল, আমার বাড়িতে কাজ করতে তোমার আপত্তি নেই তো?
কেন থাকবে? ষোলো আনা মানুষের মতো গলায় বলল অনুকূল। তার পরনে একটা নীল ডোরা কাটা শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট, বাঁ পাশে টেরি আর পাট করে আঁচড়ানো চুল, গায়ের রঙ বেশ ফরসা, দাঁতগুলো ঝকঝকে আর ঠোঁটের কোণে সবসময়ই যেন একটা হালকা হাসি লেগে আছে। চেহারা দেখে মনে বেশ ভরসা আসে।
তা হলে চলো।
নিকুঞ্জবাবুর মারুতি ভ্যান দোকানের বাইরেই অপেক্ষা করছিল, অনুকূলের জন্য চেকটা দিয়ে রসিদ নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। তিনি লক্ষ করলেন যে, ভৃত্যের হাঁটাচলা দেখেও সে যে যান্ত্রিক মানুষ, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই।
নিকুঞ্জবাবু বাড়ি করেছেন সল্ট লেকে। বিয়ে করেননি, তবে বন্ধুবান্ধব কয়েকজন আছে, তারা সন্ধ্যাবেলা আসে তাস খেলতে। তাদের আগে থেকেই বলা ছিল যে, বাড়িতে একটি যান্ত্রিক চাকর আসছে। কেনার আগে অবিশ্যি নিকুঞ্জবাবু খোঁজ নিয়ে নিয়েছিলেন। এই ক মাসে কলকাতার বেশ কিছু উপরের মহলের বাড়িতে রোবট-ভৃত্য বহাল হয়েছে। মানসুখানি, গিরিজা বোস, পঙ্কজ দত্তরায়, মিঃ ছাবরিয়া–সকলেই বললেন তাঁরা খুব স্যাটিসফাইড, এবং তাঁদের চাকর কোনও ট্রাবল দিচ্ছে না। মুখ। খুলতে না খুলতেই ফরমাশ পালন করে আমার জীবনলাল, বললেন মানসুখানি। আমার তো মনে হয় ও শুধু যন্ত্র নয়, ওর মাথার মধ্যে মগজ আছে আর বুকের মধ্যে কলিজা আছে।
সাতদিনের মধ্যে নিকুঞ্জবাবুরও সেই একই ধারণা হল। আশ্চর্য পরিপাটি কাজ করে অনুকূল। শুধু তা-ই নয়, কাজের পারম্পর্যটাও সে বোঝে। বাবু স্নানের জল চাইলে সেটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সাবান তোয়ালে যথাস্থানে রেখে বাবু কী কাপড় পরবেন, কী জুতো পরবেন স্নান করে এসে, সেটাও পরিপাটি করে ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রেখে দেয়। আর সব ব্যাপারেই সে এত ভব্য যে তাকে তুমি ছেড়ে তুই বলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
নিকুঞ্জবাবুর বন্ধুদের অনুকূলকে মেনে নিতে একটু সময় লেগেছিল–বিশেষত বিনয় পাকড়াশি নিজের বাড়ির চাকরদের তুই বলে এমন অভ্যস্ত যে, অনুকূলকেও একদিন তুই বলে ফেলেছিলেন। তাতে অনুকূল গম্ভীর ভাবে বলে, আমাকে তুই বললে কিন্তু তাকেও আমি তুই বলব।
এর পর থেকে বিনয়বাবু আর কোনওদিন এ-ভুলটা করেননি।
নিকুঞ্জবাবুর সঙ্গে অনুকূলের একটা বেশ সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠল। অনুকূল বেশির ভাগ কাজই হুকুম দেবার আগেই করে ফেলে। এটা অবিশ্যি নিকুঞ্জবাবুর বেশ আশ্চর্য বলে মনে হয়, কিন্তু রোবট সাপ্লাই এজেন্সির মিঃ ভৌমিক বলেছিলেন যে, তাঁদের কোনও কোনও রোবটের মস্তিষ্ক বলে একটা পদার্থ আছে, চিন্তাশক্তি আছে। অনুকূল নিশ্চয়ই সেই শ্রেণীর রোবটের মধ্যেই পড়ে গেছে। ঘুমোনোর ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিকুঞ্জবাবু ভৌমিকের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। যে এতটাই মানুষের মতো, সে সারারাত জেগে বসে থাকবে, এও কি সম্ভব? ব্যাপারটা যাচাই করতে তিনি একদিন মাঝরাত্তিরে চুপিসারে অনুকূলের ঘরে উঁকি দিতেই অনুকূল বলে উঠল, বাবু, আপনার কি কোনও দরকার আছে? নিকুঞ্জবাবু অপ্রস্তুত হয়ে না বলে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।
অনুকুলের সঙ্গে কাজের কথা ছাড়াও অন্য কথা বলে দেখেছেন নিকুঞ্জবাবু। তিনি দেখে আশ্চর্য হয়েছেন অনুকূলের জ্ঞানের পরিধিটা কত বিস্তীর্ণ। খেলাধূলা বায়স্কোপ থিয়েটার নাটক নভেল, সব কিছু নিয়েই কথা বলতে পারে অনুকূল। আর সত্যি বলতে কি, অনুকূল এসব বিষয় যত জানে, নিকুঞ্জবাবু তার অর্ধেকও জানেন না। বাহাদুরি বলতে হবে এই রোবট প্রস্তুতকারকদের। কত কী জ্ঞান পুরতে হয়েছে ওই যন্ত্রের মধ্যে।
কিন্তু সুসময়েরও শেষ আছে।
অনুকূল আসার এক বছরের মধ্যে নিকুঞ্জবাবু তাঁর ব্যবসায়ে কতকগুলো বেচাল চেলে তাঁর আর্থিক অবস্থার বেশ কিছুটা অবনতি করে ফেললেন। অনুকুলের জন্য মাসে তাঁর ভাড়া লাগে দুহাজার টাকা। সে-টাকা এখনও তিনি নিয়মিত দিয়ে আসছেন, কিন্তু কতদিন পারবেন সেটাই হল প্রশ্ন। এবার একটু বেশি হিসেব করে চলতে হবে নিকুঞ্জবাবুকে। রোবট এজেন্সির নিয়ম হচ্ছে যে, এক মাসের ভাড়া বাকি পড়লেই তারা রোবটকে ফেরত নিয়ে নেবে।
কিন্তু হিসেবে গণ্ডগোল করে দিল একটা ব্যাপার।
ঠিক এই সময় নিকুঞ্জবাবুর সেজোকাকা এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, চন্দননগরে একা-একা আর ভাল লাগছে না, তাই ভাবলুম তোর সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যাই।
নিকুঞ্জবাবুর এই সেজোকাকা–নাম নিবারণ বাঁড়ুজ্যে–মাঝে-মাঝে ভাইপোর কাছে এসে কটা দিন থেকে যান। নিকুঞ্জবাবুর বাবা অনেকদিন আগেই মারা গেছেন, তিন কাকার মধ্যে একমাত্র ইনিই অবশিষ্ট। খিটখিটে মেজাজের মানুষ, শোনা যায় ওকালতি করে অনেক পয়সা করেছেন, তবে বাইরের হালচালে তা বোঝার কোনও উপায় নেই। আসলে ভদ্রলোক বেজায় কঞ্জুষ।
কাকা, এসেই যখন পড়েছেন তখন থাকবেন বইকী, বললেন নিকুঞ্জবাবু, কিন্তু একটা ব্যাপার। গোড়াতেই আপনাকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। আমার একটি যান্ত্রিক চাকর হয়েছে। আজকাল কলকাতায় কয়েকটা রোবট কোম্পানি হয়েছে জানেন তো?
তা তো জানি, বলেন নিবারণ বাঁড়ুজ্যে, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছি বটে! কিন্তু চাকরের জাতটা কী শুনি। আমার আবার ওদিকে একটু কড়াকড়ি জানোই তো। এ কি রান্নাও করে নাকি?
না না না, আশ্বাস দিলেন নিকুঞ্জবাবু। রান্নার জন্য আমার সেই পুরনো বৈকুণ্ঠই আছে। কাজেই আপনার কোনও ভাবনা নেই। আর ইয়ে, এই চাকরের নাম অনুকূল, আর একে তুমি বলে সম্বোধন করতে হয়। তুইটা ও পছন্দ করে না।
পছন্দ করে না?
না।
ওর পছন্দ-অপছন্দ মেনে চলতে হবে বুঝি আমাকে?
শুধু আপনাকে না, সকলকেই। তবে ওর কাজে কোনও ত্রুটি পাবেন না।
তা তুই এই ফ্যাসাদের মধ্যে আবার যেতে গেলি কেন?
বললাম তো–ও কাজ খুব ভাল করে।
তা হলে একবার ডাক তোর চাকরকে; আলাপটা অন্তত সেরে নিই।
নিকুঞ্জবাবু ডাক দিতেই অনুকূল এসে দাঁড়াল। ইনি আমার সেজোকাকা, বললেন নিকুঞ্জবাবু, এখন আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবেন।
যে আজ্ঞে।
ও বাবা, এ তো দেখি পরিষ্কার বাংলা বলে, বললেন নিবারণ বাঁড়জ্যে। তা বাপু দাও তো দেখি আমার জন্য একটু গরম জল করে। চান করব। বাদলা করে হঠাৎ কেমন জানি একটু ঠাণ্ডা পড়েছে, তবে আমার আবার দু বেলা স্নান না করলে চলে না–সারা বছর।
যে আজ্ঞে।
অনুকূল ঘর থেকে চলে গেল আজ্ঞাপালন করতে।
নিবারণবাবু এলেন বটে, কিন্তু নিকুঞ্জবাবুর অবস্থার কোনও উন্নতি হল না। মাঝখান থেকে সান্ধ্য আড্ডাটি ভেঙে গেল। একে তো খুডোর সামনে জুয়াখেলা চলে না, তার উপর নিকুঞ্জবাবুর সে সংস্থানও নেই।
এদিকে কাকা কতদিন থাকবেন তা জানা নেই। তিনি মর্জিমাফিক আসেন, মর্জিমাফিক চলে যান। এবার তাঁর হাবভাবে মনে হয় না তিনি সহজে এখান থেকে নড়ছেন। তার একটা কারণ এই যে, অনুকূল সম্বন্ধে তাঁর একটা অদ্ভুত মনোভাব গড়ে উঠেছে। তিনি এই যান্ত্রিক ভৃত্যটি সম্পর্কে যুগপৎ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ অনুভব করছেন। চাকর যে ভাল কাজ করে, সেটা তিনি কোনওমতেই অস্বীকার করতে পারেন না, কিন্তু চাকরের প্রতি ব্যবহারে এতটা সতর্কতা অবলম্বন করাটাও তিনি মোটেই বরদাস্ত করতে পারছেন না। একদিন ভাইপোকে বলেই ফেললেন, নিকুঞ্জ, তোর এই চাকরকে নিয়ে কিন্তু মাঝে-মাঝে আমার খুব মুশকিল হচ্ছে।
কেন কাকা? নিকুঞ্জবাবু ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন।
সেদিন সকালে গীতার একটা শ্লোক আওড়াচ্ছিলাম, ও ব্যাটা আমার ভুল ধরে দিলে। ভুল যদি হয়েই থাকে, সেটা সংশোধন করা কি চাকরের কাজ? ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? ইচ্ছা করছিল ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিই, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম।
ওই থাপ্পড়টা কখনও মারবেন না কাকা–ওতে ফল খুব গুরুতর হতে পারে। ওর ওপর হাত তোলা একেবারে বারণ। আপনি তার চেয়ে বরং ও কাছাকাছি থাকলে গীতা-টিতা আওড়াবেন না। সবচেয়ে ভাল হয় একেবারে চুপ থাকলে।
নিবারণবাবু গজগজ করতে লাগলেন।
এদিকে নিকুঞ্জবাবুর অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। অনুকূলের জন্য মাসে দু হাজার করে দিতে এখন ওঁর বেশ কষ্টই হচ্ছে। একদিন অনুকূলকে ডেকে কথাটা বলেই ফেললেন।
অনুকূল, আমার ব্যবসায় বড় মন্দা চলেছে।
সে আমি জানি।
তা তো জানো, কিন্তু তোমাকে আমি আর কদ্দিন রাখতে পারব জানি না। অথচ তোমার উপর আমার একটা মায়া পড়ে গেছে।
আমাকে একটু ভাবতে দিন এই নিয়ে।
কী নিয়ে?
আপনার অবস্থার যদি কিছু উন্নতি করা যায়।
সে কি তুমি ভেবে কিছু করতে পারবে? ব্যবসাটা তো আর তোমার লাইনের ব্যাপার নয়।
তবু দেখি না ভেবে কিছু করা যায় কি না।
তা দেখো। কিন্তু সেরকম বুঝলে তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে আসতে হবে। এই কথাটা তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম।
যে আজ্ঞে।
দুমাস কেটে গেল। আজ আষাঢ় মাসের রবিবার। নিকুঞ্জবাবু বুঝতে পারছেন, টেনেটুনে আর দুটো মাস তিনি অনুকুলের ভাড়া দিতে পারবেন। তারপর তাঁকে মানুষ চাকরের খোঁজ করতে হবে। সত্যি বলতে কি, খোঁজ তিনি এখনই আরম্ভ করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা তাঁর মোটেই ভাল লাগছে না। তার উপর আবার সকাল থেকে বৃষ্টি, তাই মেজাজ আরও খারাপ।
খবরের কাগজটা পাশে রেখে অনুকূলকে ডাকতে যাবেন এক পেয়ালা চায়ের জন্য, এমন সময় অনুকূল নিজেই এসে হাজির।
কী অনুকূল, কী ব্যাপার?
আজ্ঞে, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
কী হল?
নিবারণবাবু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষার গান করছিলেন, এমন সময় কথার ভুল করে ফেলেন। আমি ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলাম, বাধ্য হয়ে ওঁকে সংশোধন করতে হয়। তাতে উনি আমার উপর খেপে গিয়ে আমাকে একটা চড় মারেন। ফলে আমাকে প্রতিশোধ নিতে হয়।
প্রতিশোধ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটা হাইভোল্টেজ শক ওঁকে দিতে হয় ওঁর নাভিতে।
তার মানে–?
উনি আর বেঁচে নেই। অবিশ্যি যেই সময় আমি শল্টা দিই, সেই সময় কাছেই একটা জোরে বাজ পড়েছিল।
হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম।
কাজেই মৃত্যুর আসল কারণটা কী, সেটা আপনার বলার দরকার নেই।
কিন্তু—
আপনি চিন্তা করবেন না। এতে আপনার মঙ্গলই হবে।
আর হলও তাই। এই ঘটনার দুদিন পরেই উকিল ভাস্কর বোস নিকুঞ্জবাবুকে ফোন করে জানালেন যে, নিবারণবাবু তাঁর সম্পত্তি উইল করে রেখে গিয়েছেন তাঁর ভাইপোর নামে। সম্পত্তির পরিমাণ হল সাড়ে এগারো লক্ষ টাকা।
আনন্দমেলা, অগ্রহায়ণ ১৩৯৩ (২৪ ডিসেম্বর ১৯৮৬)
অপদার্থ
অপদার্থ কথাটা অনেক লোক সম্বন্ধে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আমাদের চাকর নবকেষ্ট। নব, তুই একটা অপদার্থ–এই কথাটা ছেলেবেলায় মার মুখে অনেকবার শুনেছি। নব কিন্তু কাজ ভালই করত; দোষের মধ্যে সে ছিল বেজায় ঘুমকাতুরে। দিনের বেলা প্রায়ই একটু টেনে ঘুম। দেওয়ার ফলে বিকেলে চায়ের জলটা চড়াতে চারটের জায়গায় হয়ে যেত সাড়ে চারটে। কাজেই মা যে। তাকে অপবাদটা দিতেন সেটা ছিল রাগের কথা।
কিন্তু সেজোকাকার বেলায় অপদার্থ কথাটা যেরকম লাগসই ছিল সেরকম আর কারুর বেলায় হয়েছে। বলে আমার জানা নেই। সেজোকাকা মানে যাঁর ভালনাম ক্ষেত্রমোহন সেন, ডাকনাম ক্ষেতু। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই। বাবাই বড়, তারপর মেজো সেজো সোনা আর ছোট। পাঁচের মধ্যে সেজো বাদে আর সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। বাবা ছিলেন নামকরা উকিল। মেজো সম্মানিত অধ্যাপক, সংস্কৃত আর ইতিহাসে ডবল এম. এ। সোনা ব্যবসা করে কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তুলেছিলেন, আর ছোট কালোয়াতি গানে বড়বড় মুসলমান ওস্তাদের বাহবা আর ছত্রিশটা সোনা-রুপোর মেডেল পেয়েছিলেন ধনী সমঝদারদের কাছ থেকে।
আর সেজোকাকা?
তাঁকে নিয়েই এই গল্প, তাই তাঁর কথাটা এককথায় বলা যাবে না।
সেজোকাকার জন্মের মুহূর্তে নাকি ভূমিকম্প হয়েছিল। অনেকের মতে সেই কারণে নাকি তাঁর ঘিলুতে জট পাকিয়ে যায়, আর তাই তাঁর এই দশা। হাম আর চিকেন পক্স একবার না একবার প্রায় সব শিশুদেরই হয়। সেজোকাকার এই দুটো তো হয়েই ছিল, সেইসঙ্গে কোনও-না-কোনও সময় হয়েছিল। হুপিং কাশি, ডিপথিরিয়া, ডেঙ্গু, একজিমা, আসল বসন্ত। শিশু বয়সে সাতবার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে নীল হয়ে সেজোকাকা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সাত বছরে সেজোকাকার তোতলামো দেখা দেয়; সাড়ে নয়ে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তোতলামো সেরে যায়। এই পতনের ফলে সেজোকাকার গোঁড়ালি ভেঙে যায়। ডাক্তার বিশ্বাস সেটাকে ঠিকমতো জোড়া দিতে না পারায় সেজোকাকাকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত। এই খোঁড়ানোর জন্য তাঁর আর খেলাধুলা করা সম্ভব হয়নি। হাতের টিপের অভাবে ক্যারম, আর মাথা খেলে না বলে তাসপাশাও হয়নি।
সেজোকাকা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পর পর তিনবার এফ. এ. পরীক্ষায় ফেল হবার পর ওঁর বাবা, মানে আমার ঠাকুরদাদা, নিজেই ওঁর পড়াশুনো বন্ধ করে দেন। বলেন, ক্ষেতু, তুই যখন একেবারেই অপদার্থ, তখন তোর এডুকেশনের পেছনে খরচ করা মানে টাক জলে দেওয়া। তবে গলগ্রহ হয়ে থাকতে দেওয়াও তো চলে না! তুই আজ থেকে ভোম্বলের সঙ্গে বাজারে যাবি। শাকসজি মাছ মাংস চিনে নিবি। তারপর থেকে সংসারের বাজারটা তুই-ই করবি। ডোম্বল কাকা হলেন বাবার এক দূরসম্পর্কের ভাই; আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছেন, মানুষ হয়েছেন।
সেজোকাকা বেশ কিছুদিন বাজারে গেলেন ভোম্বলকাকার সঙ্গে। তারপর একদিন–সেদিন বাড়িতে লোক খাবে–ঠাকুরদা সেজোকাকার পকেটে দুটো দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, দেখি তুই কেমন জিনিসপত্তর চিনেছিস। আজ বাজারের ভার তোর ওপর।
সেজোকাকাকে দিয়ে বাজার আর হল না, কারণ কাকার পাঞ্জাবির পকেটে ফুটো, নোট দুখানা বাজারে পৌঁছনোর আগেই পথে কোথায় গলে পড়েছে। এর পর থেকে কে আর কাকাকে ট্রাস্ট করবে?
আমার প্রথম স্মৃতিতে সেজোকাকার বয়স তেত্রিশ আর আমার তিন। কালীপুজোর দিন সন্ধ্যাবেলা। ঘটনাটা মনে আছে কেন, সেটা আরেকটু বললেই বোঝা যাবে। সেজোকাকা বারান্দার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, আর আমি তাঁর পিঠে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছি। পাশের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা জ্বলন্ত উড়নতুবড়ি এসে বারান্দার তক্তপোশের উপর পড়তেই সর্বনাশ বলে সেজোকাকা সটান উঠে দাঁড়ালেন। তার ফলে আমি পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম শান বাঁধানো মেঝেতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। সেদিন অবিশ্যি সেজোকাকাকে ভয়ংকর সব কথা শুনতে হয়েছিল বাড়ির প্রায় সকলের কাছ থেকেই। আমার কিন্তু একটু দুঃখ হয়েছিল কাকার জন্য। কেউ তাঁকে গ্রাহ্য করে না, এমনকী মানুষের মধ্যেই ধরে না, তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাকার উপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। মাঝারি হাইট, মাঝারি রঙ, মুখে সবসময়ই একটা খুশি আর দুঃখ মেশানো ভাব–মনে হত সব মানুষেরই বুদ্ধি হবে, সব মানুষই করিৎকর্মা হবে, তার কী মানে? শহরভর্তি এত লোকের মধ্যে একটা লোক যদি সেজোকাকার মতো হয় তাতে দোষ কী?
আমি তাই ফাঁক পেলেই তাঁর একতলার কোণের ঘরটায় গিয়ে সেজোকাকার সঙ্গে বসে গল্প করতাম। কদিন গিয়েই এটা বুঝেছিলাম যে সেজোকাকাকে গল্প বলতে বলে কোনও লাভ নেই, কারণ তাঁর কোনও গল্পই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে না।
তারপর কী হল সেজোকাকা?
তারপর? হুঁ…তারপর… দাঁড়া, তারপর…তারপর…তারপর…
গলার স্বর তারপর তারপর বলতে বলতে ক্রমে দম ফুরানো হারমোনিয়ামের মতো ক্ষীণ হয়ে আসে। সেজোকাকা গল্প থেকে গুনগুন বেসুরো গানে চলে যান, শেষটায় গানও ফুরিয়ে গিয়ে কাকার মাথাটা ঘুমে ঢুলতে থাকে। বুঝতে পারি গল্পের বাকি অংশ মনে করার মেহনত কাকার পোষাচ্ছে না। তাঁকে সেই অবস্থায় রেখেই আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, সেজোকাকা আর ডাকেনও না।
আমার যখন বছর বারো বয়স তখন একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি একটা মোটা বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন আয়ুর্বেদের বই।
বললাম, ও বই পড়ে কী হবে সেজোকাকা?
কাকা একটু ভেবে গম্ভীর ভাবে বললেন, এটাও তো একটা ব্যারাম, তাই না?
কোনটা?
এই যে আমার দ্বারা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু মনে থাকে না, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না–এটা নিশ্চয়ই একটা রোগ?
কী আর বলব? বললাম, তা তো হতেই পারে, সেজোকাকা।
তা হলে এর চিকিৎসা হবে না কেন?
বললাম, তুমি নিজেই চিকিৎসা করবে নাকি?
আমি জানতাম যে সেজোকাকার এই অপদার্থতার জন্য তাঁকে ডাক্তার দেখানোর কথা কেউ কোনওদিন ভাবেনি। সত্যি বলতে কি, ওঁর ছেলেবেলার সেই একগাদা ব্যারামের পর ওঁর আর বিশেষ কোনও অসুখটসুখ করেনি। স্বাস্থ্যটা ওঁর মোটামুটি ভালই ছিল।
সেজোকাকা বলে চললেন, চকবাজারে ফুটপাথে বইটা পড়ে ছিল, দশ আনা দিয়ে কিনে এনেছি। বোধহয় কাজে দেবে। মনে হচ্ছে আমার ব্যারামের জন্যও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা আছে।
দুদিন বাদে তখন বর্ষাকাল বিকেলে সেজোকাকার ঘরে গিয়ে দেখি উনি বেরোবার তোড়জোড় করছেন। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গলায় জড়ানো সুতির চাদর আর হাতে ছাতা। বললেন, ভটচাপাড়ায় ভাঙা শিবমন্দিরটার পিছনে একটা গাছ আছে খবর পেয়েছি। তার শিকড় আমার চাই। ওইটে পেলেই ব্যস্ নিশ্চিন্তি।
সেজোকাকা বেরিয়ে পড়লেন। আকাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে, তেমন তেমন বৃষ্টি নামলে কাকার প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
আমি ঘণ্টাখানেক নীচে ঘুরঘুর করে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলাম। দক্ষিণের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তা দেখা যায়। বৃষ্টি নামল না। সন্ধে যখন হব হব, তখন দেখি সেজোকাকা ফিরছেন। দুড়দাড় করে নীচে নেমে সদর দরজার মুখে কাকার সঙ্গে দেখা।
পেলে শিকড়?
না রে! ভুল হয়ে গেল। একটা টর্চ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জায়গাটা জংলা আর বেজায় অন্ধকার।
কিন্তু ওটা কী?
কাকার কথার মধ্যেই চোখ পড়েছে আমার। খদ্দরের পাঞ্জাবির বুকে লাল রঙের ছোপ।
তাই তো, এটা তো খেয়াল করিনি এতক্ষণ!
পাঞ্জাবি খুলতেই বেরোল একটা জোঁক। ভীম যেমন দুর্যোধনের বুকের রক্ত খেয়েছিল, তেমনই ইনি সেজোকাকার বুকের রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল, টোকা দিতেই টপ করে মাটিতে পড়ে গেল।
কিন্তু একটা জোঁকে আর সেজোকাকার কী হবে? কাঁধ, কনুই, কোমর, পায়ের গুল। হাঁটু, গোঁড়ালি–সব জায়গা মিলিয়ে চোদ্দটা জোঁক বেরোল কাকার গা থেকে। পাঁচ-ছ আউন্স রক্ত যে তাঁর আজ খোয়া গেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, তার আয়ুর্বেদ চর্চাও এই একটি ঘটনাই দিল বন্ধ করে।
.
পড়াশুনায় আমি ছিলাম রীতিমতো ভাল। আমাদের এফ, এ, এনট্রান্সের যুগ শেষ হয়ে ম্যাট্রিক চলছে। পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড হয়ে বিজ্ঞান পড়ব বলে চলে এলাম কলকাতায়। হোস্টেলে থেকেই এম. এসসি পর্যন্ত পড়ে পদার্থবিজ্ঞানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে চলে যাই আমেরিকায়। শেষ পর্যন্ত গবেষক হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি হয়। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ও গবেষণার কাজ আমি একসঙ্গে চালাতে থাকি।
বাইরে থাকার ফলে সেজোকাকার সঙ্গে যোগসূত্র ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। একবার–তখন আমি সবে অধ্যাপনা শুরু করেছি–মার চিঠিতে এক অদ্ভুত খবর পেলাম। সেজোকাকা নাকি ফিল্মে অভিনয়ের। সুযোগ পেয়েছেন। এখানে বলি যে সেজোকাকার সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের চেহারার একটা সাদৃশ্য ছিল। দেহের গঠন মোটেই এক নয়–সেজোকাকা ছিলেন পাঁচ ফুট ছ ইঞ্চি–তবে নাক চোখ মুখের সাদৃশ্য সকলের চোখেই ধড়া পড়ত। পরমহংসদেব সম্বন্ধে একটা ফিল্ম তোলা হবে এবং তাতে বিবেকানন্দের ভূমিকা আছে খবর পেয়ে সেজোকাকা নাকি সরাসরি প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করে অভিনয় করার ইচ্ছে। প্রকাশ করেন। চেহারায় মিলের জন্য পার্টটা পেতে নাকি তাঁর কোনও অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু হপ্তাখানেক বাদেই আর একটা চিঠিতে জানলাম কাকা নাকি ছবি থেকে বাদ হয়ে গেছেন। হবেন নাই বা কেন? ঘর বন্ধ করে প্রাণপণে পার্ট মুখস্থ করা সত্ত্বেও, এক নম্বর দৃশ্যে রামকৃষ্ণের কথার উত্তরে। বিবেকানন্দের মুখ থেকে যদি তিন নম্বর দৃশ্যের উত্তর বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আর তাঁকে দিয়ে কীভাবে কাজ চলে? অর্থাৎ ফিল্ম অভিনেতা হিসেবেও তিনি যে অপদার্থ, সেটা সেজোকাকা প্রমাণ করে দিয়েছেন।
আমার যখন আটচল্লিশ বছর বয়স তখন শিকাগোতেই আমার ছোট ভাইয়ের একটা চিঠিতে জানি যে, সেজোকাকা এক সাধুবাবার শিষ্য হয়ে কোয়েটের চলে গেছেন।
গত বছর ডিসেম্বরের গোড়ায় আমার ছোটকাকার মেয়ে কাকলির বিয়েতে আমাকে কলকাতায় আসতে হয়। সঙ্গে আমার স্ত্রী আর আমার দুই মেয়ে তারা দুজনেই পুরোপুরি আমেরিকায় মানুষ। ইতিমধ্যে সেজোকাকার কোনও খবর পাইনি। তাই কলকাতায় এসে যখন শুনলাম উনি শহরেই আছেন এবং বহাল তবিয়তে আছেন, তখন স্বভাবতই তাঁকে একবার দেখার জন্য মনটা উৎসুক হয়ে উঠল। আমার বয়স তখন ষাট। তাই সোজা হিসেবে সেজোকাকার নব্বই। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, ইতিমধ্যেই প্রবাসেই কাকার দেহান্ত ঘটেছে।
শুনলাম ফার্ন রোডে তাঁর ভাগ্নে, অর্থাৎ আমার ছোট পিসিমার ছেলে ডাক্তার রণেশ গুপ্তর বাড়িতে এসে তিনি উঠেছে মাস তিনেক হল। আরও শুনলাম যে, ধর্মকর্ম ব্যাপারটা মোটেই তাঁর ধাতে সয়নি। দশ বছরেও ইডলিদোসায় অভ্যাস হয়নি। রোজ আধপেটা খেয়ে ওজন নাকি প্রায় ত্রিশ কিলো কমে গেছে। আমি এসেছি শুনে তিনি তাঁর ডাক্তার ভাগ্নেকে বলেছেন, ঝন্টুকে বলিস একবার যেন এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।
এক রবিবার সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির হলাম ফার্ন রোডে। লোডশেডিং চলছে, দোতলার একটি ঘরে টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে খাটের উপর বসে আছেন সেজোকাকা। একটা মটকার চাদরের উপর গলায় প্যাঁচ দিয়ে জড়ানো সবুজ মাফলার।
কাকাকে দেখলে চেনা যায় বটেই, এবং বলতেই হবে বয়সের পক্ষে রীতিমতো মজবুত চেহারা। মাথার চুল সব পাকা ঠিকই, কিন্তু এখনও যে চুল আছে সেটাই বড় কথা। আমায় দেখে হাসিতে মুখ ফাঁক হওয়াতে অরিজিন্যাল দাঁতও চোখে পড়ল ডজনখানেক, আর যখন কথা বেরোল তখন দেখলাম গলার স্বর ক্ষীণ হলেও কথায় বেশ তেজ আছে। এ তেজ কাকার মধ্যে আগে দেখিনি কখনও। তিনি যে সকলের বয়োজ্যেষ্ঠ, তাঁকে আর কারুর কাছে মাথা নোয়াতে হয় না, এই বোধ হয়তো তাঁর মেজাজে একটা ভারিক্কি ভাব এনে দিয়েছে।
কী রে ঝন্টু, বললেন সেজোকাকা, মার্কিন মুলুকে গিয়ে কী করা হচ্ছে শুনি?
আমার কাজের কথাটা যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে বললাম।
পদার্থবিজ্ঞান? গবেষণা? বললেন সেজোকাকা। লোকে মান্যি করে?
আমার সাতাত্তর বছরের পিসিমা গলা সপ্তমে চড়িয়ে আমার বিনয়কে ফুঙ্কারে উড়িয়ে দিয়ে জানিয়ে দিলেন আমার খ্যাতির কথা।
বটে? বললেন সেজোকাকা। নোবেল প্রাইজ পেয়েছিস কিনা সেটা বল আগে।
হালকা হেসে মাথা নাড়লাম।
তবে আর কীসের বড়াই? ছ্যা ছ্যা ছ্যা–একেবারে অপদার্থ!
আমি এই গুঁতোর ঠেলা সামলাতে না সামলাতে সেজোকাকার বাক্যস্রোত আমাকে নাকানিচোবানি খাইয়ে দিল।
তুই তো যাহোক ভিন মুলুকে পালিয়ে বাঁচলি, আমি ভাবলুম কলকাতায় গিয়ে একটু সোয়াস্তি মিলবে। জীবনের শেষ কটা দিন তবু আপনজনের সান্নিধ্যে কাটবে–তা এসব কী হচ্ছে বল তো? শকুনির ঠোকরে তো হাড় পাঁজরা বার করে দিয়েছে শহরটার। দিনে দশ ঘণ্টা বিজলি নেই। শ্বাস টানলে ধোঁয়া-ধুলোয় প্রাণ অতিষ্ঠ। জিনিসপত্তরের যা দর, উদরের সাধ মিটিয়ে ভালমন্দ যে একটু খাব তারও জো নেই।দূর দূর দূর–অপদার্থ, অপদার্থ।
সেদিন বুঝলাম যে, সেজোকাকার উপর থেকে আমার পুরনো টানটা এখনও যায়নি, কারণ তাঁর কথাগুলো শুনে আমার মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হল আমরা বোধহয় অ্যাদ্দিন ভুল করে এসেছি, উলটো ভেবে এসেছি; আসলে কাকা দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, আমরা সুদ্ধ দুনিয়াটাই অপদার্থ।
কিন্তু কথাটা যে ঠিক নয় সেটা সেজোকাকাই প্রমাণ করে দিলেন কয়েক দিনের মধ্যে।
এক সকালে ছোট পিসিমার বাড়ি থেকে ফোন এল যে, সেজোকাকা ভোর রাত্রে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছেন। আর যাওয়ার দিনটাও মোক্ষম বেছেছেন কাকা, কারণ সেদিনই সন্ধ্যায় গোধূলি লগ্নে আমার ভাগ্নির বিয়ে।
চক্মকি, ১৩৯০
অভিরাম
তোমার নাম কী?
অভিরাম সাউ, বাবু।
তোমার বাড়ি কোথায়?
উলুইপুর গাঁয়ে বাবু। উড়িষ্যা।
বাড়িতে আছে কে?
আমার দাদা আছে, বউদি আছে, দুই ভাইপো আছে।
তোমার বাড়ি যেতে হয় না?
কালে ভদ্রে বাবু। আমি তো সংসার করিনি। ধানজমি আছে কিছু, দাদাই দেখে।
তুমি বাড়ি গেলে বদলি দিয়ে যাবে তো?
নিশ্চয়ই। তবে সে দরকার আমার হবে না বাবু। হলে, বদলি দিয়ে যাব নিশ্চয়ই।
বদলির কথা কেন উঠল সেটা বলছি তোমায়, আমার সন্ধেবেলা একা থাকতে ভয় হয়। আমার ভূতের ভয় আছে। আমি রান্নার লোক যাকে পেয়েছি, সে ঠিকে; সন্ধেবেলা বেঁধে দিয়ে চলে যাবে। তখন আমার কাছে আরেকজন লোক থাকা চাই।
সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না বাবু, ও হয়ে যাবে। আমার নিজের মনে কোনও ভূতের ভয় নেই।
ঠিক আছে, অভিরাম।
লোকটিকে বেশ ভালই লাগল শঙ্করবাবুর। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স, বেশ হাসিখুশি, চালাক চতুর চেহারা। স্টেটব্যাকের কর্মচারী শঙ্করবাবু এই সাতদিন হল বদলি হয়ে পশ্চিম বাংলা আর উড়িষ্যার বর্ডারে এই ছোট শহর কাঞ্চনতলায় এসেছেন। নিজে একা মানুষ। দুখানা ঘরসমেত একতলা একটি ছোট বাড়ি পেয়েছেন। তাতে তার চলে যাবে। তবে বাড়ির পরিবেশ নিরিবিলি, তাই একজন চাকর সবসময় থাকা দরকার। শঙ্করবাবুর ভূতের ভয়টা একটা খাঁটি ভয়। অনেক বছর ধরে, অনেক চেষ্টা করেও সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
অভিরামকে শঙ্করবাবুর দিনে দিনে বেশি ভাল লাগতে লাগল। এমনি কাজ তো ভাল করেই, খাটতেও পারে। আর সন্ধেবেলা সে সত্যি করে শঙ্করবাবুকে সঙ্গ দেয়।
আরেকটা জিনিস শঙ্করবাবুকে অবাক করে, সেটা হল অভিরামের গল্পের স্টক। সে বলে যে, সব গল্প সে ছেলেবেলায় তার দিদিমার মুখে শুনেছে। উড়িষ্যার অফুরন্ত রূপকথা আর উপকথা। অভিরাম ভূতের গল্প বলার মন্ত্রণাও শঙ্করবাবুকে দিয়েছে। কিন্তু শঙ্করবাবু তাতে আমল দেননি।
আমি কিন্তু অনেক ভূতের গল্প জানি বাবু, অভিরাম বলল।
তা হোক, ও জিনিসটা তুমি বাদ দাও।
তা বেশ বাবু, তাই হোক। তবে যদি কোনওদিন মনে হয় ভূতের ভয় কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন তো আমায় বলবেন, তখন আমি আপনাকে ভূতের গল্প শোনাব। দেখবেন কেমন মজাদার গল্প।
তুমি নিজে ভূত মানো, অভিরাম?
আমার আর মানা না মানার কী আছে বাবু। ভূত থাকলে আছে, না থাকলে নেই, ব্যস্ফুরিয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, ভূত মানেই যে খারাপ লোক হবে এটা আমি মানি না। ভাল ভূত হলে ক্ষেতি কী?
কথা আর বেশি আগালো না।
এই ঘটনার তিন মাস পরে এক বর্ষাকালের সকালে অভিরাম শঙ্করবাবুর কাছে এসে বলল, বাবু, দাদার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। বেশি বর্ষা হবার ফলে আমাদের ফসলের খুব ক্ষেতি হয়েছে। দাদা একা সামলাতে পারছেন না। আমাকে তিন-চারদিনের জন্য যেতে দিতে পারবেন বাবু?
শঙ্করবাবু এই অবস্থায় না করতে পারলেন না। কিন্তু তুমি যে যাবে, লোক দিয়ে যাবে তো?
নিশ্চয়ই। খুব ভাল লোক দেব। তবে সে বোধ হয় আমার মতো কথা বলতে পারবে না।
তা হোক। সন্ধেবেলাটা আমাকে একটু সঙ্গ দিতে পারলেই হল।
তা খুব পারবে। আপনি যতক্ষণ না শুতে যাবেন ততক্ষণ ও আপনার কাছে থাকবে।
অভিরাম চলে গেল। তিনদিন পরে শঙ্করবাবু এক পোস্টকার্ড পেলেন তার ভৃত্যের কাছ থেকে। খবর ভাল নয়। আরও তিনদিন লাগবে সামাল দিতে, তারপর অভিরাম ফিরবে। শঙ্করবাবু কী আর করেন। এদিকে বদলি চাকরটিকে তাঁর বিশেষ পছন্দ নয়। মুখটা যেন বড় বেশি গোমড়া। যদিও কাজ করে ভালই।
পরদিন সকালে রেডিওতে খবর শুনে শঙ্করবাবু স্তম্ভিত। তাঁর চাকরের গাঁ এবং তার চারপাশে বেশ অনেকখানি এলাকা জুড়ে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির ফলে হাজার হাজার লোক মারা গেছে, এবং আরও অনেক বেশি লোক গৃহহীন।
শঙ্করবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। এ অবস্থায় কী করা উচিত তা তিনি স্থির করতে পারলেন। চিঠি লিখে লাভ নেই। অভিরামও যে লিখবে এমন কোনও ভরসা নেই।
অভিরামের বদলি নিতাইও এ ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারল না। রাত দশটা পর্যন্ত বাবুকে সঙ্গ দিয়ে নিতাই উঠে পড়ল।
শঙ্করবাবু একা তাঁর শোয়ার ঘরে প্রবেশ করলেন। বিছানায় শুয়ে বুঝলেন যে, তাঁর ঘুম আসার সম্ভাবনা কম। অভিরামের অভাব তিনি তীব্রভাবে অনুভব করছেন।
ক্রমে রাত নিঝুম হয়ে এল। একটানা ঝিঁঝি ডেকে চলেছে। এবার তার সঙ্গে শেয়ালের ডাক যোগ হল, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া!
হুয়া আবার কেয়া, শঙ্করবাবুর মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভূতের ভয়ে এর মধ্যেই তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
ওটা কী?
পায়ের শব্দ না?
শঙ্করবাবু বুঝলেন; তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
বাবু!
সেকী! এ যে অভিরামের গলা!
অভিরাম নাকি? চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন শঙ্করবাবু।
হাঁ বাবু! আমি এসেছি, ফিরে এসেছি!
আমার ধড়ে প্রাণ এল অভিরাম, দাঁড়া, দরজা খুলি।
না বাবু, খুলবেননি।
মানে?
খুলে কিছু দেখতে পাবেননি।
সে কী!
আমি অভিরাম বাবু, কিন্তু আসল অভিরাম নই। আমি অভিরামের ভূত। আমায় বন্যায় টেনে নিয়ে গেছে, আমি আর বেঁচে নেই।
কোনও উত্তর নেই শঙ্করবাবুর দিক থেকে।
কী বাবু? শুনলেন আমার কথা?
তবু কোনও উত্তর নেই। বাবু!
আবার ডাক এল বাইরের অন্ধকার থেকে।
এবার কথা এল বাড়ির ভিতর থেকে।
তোকে কীভাবে দেখতে পাব?
শুধু একটা ব্যাপার হলে পাবেন।
কী?
আপনিও যদি ভূত হন।
তা সে আর তোকে বলছি কী! তুই ভূত হয়েছিস শুনেই তো আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে। আমার দেহ ওই পড়ে আছে খাটের উপর, দৃষ্টি ঘরের ছাতের উপর, দেহে প্রাণ নেই।
তবে চলে আসুন বাবু!
এই এলুম বলে! আমাকে গল্প শোনাতে পারবি, ভূতের গল্প? কারণ, এখন আর ভয় নেই। বাকি মরণটা গল্প শুনে কাটিয়ে দেব, কী বলিস?
যা বলেছেন বাবু, যা বলেছেন!
সন্দেশ, শ্রাবণ ১৩৯৮
অসমঞ্জবাবুর কুকুর
হাসিমারায় বন্ধুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে অসমঞ্জবাবুর একটা অনেকদিনের শখ মিটল।
ভবানীপুরের মোহিনীমোহন রোডে দেড়খানা ঘর নিয়ে থাকেন অসমঞ্জবাবু। লাজপত রায় পোস্টঅফিসের রেজিষ্ট্রি বিভাগে কাজ করেন তিনি; কাজের জায়গা তাঁর বাড়ি থেকে সাত মিনিটের হাঁটা পথ, তাই ট্রামবাসের ঝক্কি পোয়াতে হয় না। এমনিতে দিব্যি চলে যায়, কারণ যেসব মানুষ জীবনে কী হল না কী পেল না এই ভেবেই মুখ বেজার করে বসে থাকে, অসমঞ্জবাবু তাদের দলে পড়েন না। তিনি অল্পেই সন্তুষ্ট। মাসে দুটো হিন্দি ছবি, একটা বাঙলা যাত্রা বা থিয়েটার, হপ্তায়। দুদিন মাছ আর চার প্যাকেট উইলস সিগারেট হলেই তাঁর চলে যায়। তবে তিনি একা মানুষ, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনও বিশেষ নেই, তাই অনেক সময় মনে হয়েছে একটা কুকুর থাকলে বেশ হত। তাঁর বাড়ির দুটো বাড়ি পশ্চিমে তালুকদারদের যে বিশাল অ্যালসেশিয়ানটা আছে, সে রকম। কুকুর না হলেও চলে; এমনি একটা সাধারণ কুকুর, যেটা তাঁকে সকাল সন্ধে সঙ্গ দেবে, তাঁর তক্তপোষের পাশে মেঝেতে গা এলিয়ে পড়ে থাকবে, তিনি আপিস থেকে ফিরলে পরে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করবে, তাঁর আদেশ মেনে তার বুদ্ধি আর আনুগত্যের পরিচয় দেবে। কুকুরকে তিনি ইংরিজিতে আদেশ করবেন এটাও অসমঞ্জবাবুর একটা শখ। স্ট্যান্ড-আপ সিট ডাউন শেক হ্যান্ড, এসব বললে যদি কুকুর মানে তা হলে বেশ হবে। কুকুর জাতটাকে সাহেবের জাত বলে ভাবতে অসমঞ্জবাবুর বেশ ভাল লাগে, আর উনি হবেন সেই সাহেবের মালিক–মানে হিজ মাস্টার আর কী।
মেঘলা দিন, সকাল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে, অসমঞ্জবাবু ছাতা ছাড়াই হাসিমারার বাজারে গিয়েছিলেন কমলালেবু কিনতে। বাজারের এক প্রান্তে একটা বেঁটে কুলগাছের পাশে বেতের টোকা মাথায় ভুটানি লোকটাকে দেখতে পেলেন তিনি। তিন আঙুলে একটা জ্বলন্ত চুটা ধরে পা ছাড়িয়ে মাটিতে বসে তাঁরই দিকে চেয়ে কেন যে মিটিমিটি হাসছে লোকটা সেটা বুঝতে না পারলেও, কৌতূহলবশে তিনি লোকটার দিকে এগিয়ে গেলেন। ভিখিরি কি? পোশাক দেখে সেটা মনে হওয়া আশ্চর্য নয়; প্যান্ট আর গায়ের জামাটার অন্তত পাঁচ জায়গায় প্পি লক্ষ করলেন অসমঞ্জবাবু। কিন্তু ভিক্ষের পাত্র বা ঝুলি বলে কিছু নেই; তার বদলে আছে একটা জুতোর বাক্স, সেই বাক্স থেকে উঁকি মারছে একটা বাদামি রঙের কুকুরছানা।
গুড মর্নিং!–চোখ বন্ধ করা হাসি হেসে বলল ভুটানি। উত্তরে অসমঞ্জবাবুও গুড মর্নিং না বলে পারলেন না।
বাই ডগ? ডগ বাই? ভেরি গুড ডগ।
কুকুরছানাটাকে বাক্স থেকে বার করে মাটিতে রেখেছে ভুটানি। ভেরি চীপ। ভেরি গুড। হ্যাপি ডগ।
কুকুরছানাটা গা ঝাড়া দিল, বোধ হয় পিঠে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দরুন। তারপর অসমঞ্জবাবুর দিকে চেয়ে তার দেড় ইঞ্চি লম্বা ল্যাজটা বার কয়েক নেড়ে দিল। বেশ কুকুর তো!
অসমঞ্জবাবু এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার সামনে বসে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে। কুকুরটা দু পা এগিয়ে এসে তার ছোট্ট জিভটা বার করে, অসমঞ্জবাবুর বুড়ো আঙুলের ডগাটায় একটা মৃদু চাটা দিয়ে দিল। বেশ কুকুর। যাকে বলে ফ্রেন্ডলি।
কেতনা দাম? হাউ মাচ?
টেন রুপিজ।
সাড়ে সাতে রফা হল। অসমঞ্জবাবু জুতোর বাক্স সমেত কুকুরছানাটাকে নিয়ে বগলদাবা করে বাড়িমুখো হলেন। কমলালেবুর কথাটা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন।
.
হাসিমারা স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারী বিজয় রাহা তাঁর বন্ধুর এই শখটার কথা জানতেন না। তাই তাঁর হাতে জুতোর বাক্স এবং বাক্সের মধ্যে কুকুরছানা দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন বইকী; কিন্তু দামটা শুনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, নেড়ি কুত্তাই যদি কেনার ছিল তা সে এখান থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কী ভাই? এ জিনিস তোমার ভবানীপুরে পেতে না?
না, ভবানীপুরে পেতেন না। অসমঞ্জবাবু সেটা জানেন। তাঁর বাড়ির সামনে রাস্তায় অনেক সময় অনেক কুকুরছানা দেখেছেন তিনি। তারা কখনও তাঁকে দেখে লেজ নাড়েনি বা প্রথম আলাপেই তাঁর বুড়ো আঙুল চেটে দেয়নি। বিজয় যাই বলুক–এ কুকুরের একটা বিশেষত্ব আছে। তবে নেড়ি কুত্তা জেনে অসমঞ্জবাবু খানিকটা আক্ষেপ প্রকাশ করাতে বিজয়বাবু তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন যে জাত কুকুরের ঝক্কি পোয়ানো অসমঞ্জবাবুর পক্ষে সম্ভব হত না।–তোর কোনও আইডিয়া আছে একটা জাত কুকুরের কত ঝামেলা? মাসে মাসে ডাক্তারের খরচায় তোর অর্ধেক মাইনে বেরিয়ে যেত। এ কুকুরকে নিয়ে তোর কোনও চিন্তা নেই। আর এর জন্য কোনও স্পেশাল ডায়েটেরও দরকার নেই। তুই যা খাস তাই খাবে। তবে মাছটা দিসনি, ওটা বেড়ালের খাদ্য। কুকুর মাছের কাঁটা ম্যানেজ করতে পারে না।
কলকাতায় ফিরে এসে অসমঞ্জবাবুর খেয়াল হল যে কুকুরটার একটা নাম দেওয়া হয়নি। সাহেবি নাম ভাবতে গিয়ে প্রথমে টম ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ছিল না, তারপর ছানাটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মাথায় এল যে রঙটা যখন ব্রাউন, তখন ব্রাউনি নামটা হয়তো বেমানান হবে না। ব্রাউনি নামে একটা বিলিতি ক্যামেরা তাঁর এক খুড়তুতো ভাইয়ের ছিল। কাজেই নামটা সাহেবি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আশ্চর্য নামটা মনে পড়া মাত্র ব্রাউনি বলে ডাকতেই ছানাটা ঘরের কোণে রাখা বেঁটে মোড়াটার উপর থেকে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে তাঁর দিকে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে এল। অসমঞ্জবাবু বললেন, সিট ডাউন, আর অমনি ব্রাউনি তার পিছনের পা দুটো ভাঁজ করে থপ করে বসে পড়ে তাঁর দিকে চেয়ে একটা ছোট্ট হাই তুলল।
অসমঞ্জবাবু এক মুহূর্তের জন্য যেন চোখের সামনে দেখতে পেলেন যে ব্রাউনি ডগ-শোতে বুদ্ধিমান কুকুর হিসেবে প্রথম পুরস্কার পাচ্ছে।
সুবিধে এই যে চাকর বিপিনেরও কুকুরটাকে পছন্দ হয়ে গেছে, ফলে দিনের বেলায় যে সময়টুকু তিনি বাইরে থাকেন, সে সময়ে ব্রাউনির দিকে নজর রাখার কাজটা বিপিন খুশি হয়েই করে। অসমঞ্জবাবু তাকে সাবধান করে দিয়েছেন যেন ব্রাউনিকে আজেবাজে কিছু খেতে না দেয়। আর দেখিস রাস্তায়-টাস্তায় না বেরোয়। আজকালকার ড্রাইভারগুলো চোখে ঠুলি দিয়ে গাড়ি চালায়। অবিশ্যি বিপিনকে ফরমাশ দিয়েও অসমঞ্জবাবুর সোয়াস্তি নেই; রোজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এসে ব্রাউনির লাঙ্গুলসঞ্চালন না দেখা পর্যন্ত তাঁর উৎকণ্ঠা যায় না।
.
ঘটনাটা ঘটল হাসিমারা থেকে ফেরার তিনমাস পরে। বারটা ছিল শনি, তারিখ বাইশে নভেম্বর। অসমঞ্জবাবু আপিস থেকে ফিরে তাঁর ঘরে ঢুকে সার্টটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে তক্তপোষ ছাড়া তাঁর একমাত্র আসবাব একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে বসতেই সেটার একটা পঙ্গু পায়া তাঁর সামান্য ভারও সইতে না পেরে কাজে ইস্তফা দিল, আর তার ফলে চোখের পলকে অসমঞ্জবাবু চেয়ার সমেত সশব্দে মেঝের সংস্পর্শে এসে গেলেন। এতে তাঁর চোট লাগল ঠিকই, এমনকী চেয়ারের পায়ার মতো তাঁর ডানহাতের কনুইটাও বাতিল হয়ে যাবে কি না সে চিন্তাটাও তাঁর মনে উদয় হয়েছিল, কিন্তু একটা অপ্রত্যাশিত শব্দ তাঁকে তাঁর যন্ত্রণার কথা ভুলিয়ে দিল।
শব্দটা এসেছে তক্তপোষের উপর থেকে। হাসির শব্দ, বোধহয় যাকে বলে খিলখিল হাসি, আর সেটার উৎস হচ্ছে নিঃসন্দেহে তাঁর কুকুর ব্রাউনি, কারণ ব্রাউনিই বসে আছে তক্তপোষের উপর, আর ব্রাউনিরই ঠোঁটের কোণে এখনও লেগে আছে হাসির রেশ।
অসমঞ্জবাবুর সাধারণ জ্ঞানের মাত্রাটা যদি আর সামান্যও বেশি হত তা হলে তিনি জানতেন যে কুকুর কখনও হাসে না। আর এই জ্ঞানের সঙ্গে যদি তাঁর কল্পনাশক্তিও খানিকটা বেশি হত, তা হলে আজকের এই ঘটনা তাঁর নাওয়া-খাওয়া, রাতের ঘুম সব বন্ধ করে দিত। এই দুটোরই অভাবে অসমঞ্জবাবু যেটা করলেন সেটা হল, তিন দিন আগে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা পুরনো বইয়ের দোকান থেকে আড়াই টাকা দিয়ে কেনা অল অ্যাবাউট ডগস বইটা হাতে নিয়ে বসলেন। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সেটা উলটেপালটে দেখলেন যে তাতে কুকুরের হাসির কোনও উল্লেখ নেই।
অথচ ব্রাউনি যে হেসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। শুধু হাসেনি, হাসির কারূণে হেসেছে। অসমঞ্জবাবুর স্পষ্ট মনে আছে, তাঁর যখন বছর পাঁচেক বয়স তখন নরেন ডাক্তার একবার তাঁদের চন্দননগরের বাড়িতে রুগি দেখতে এসে চেয়ার ভেঙে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছিলেন, আর তাই দেখে অসমঞ্জবাবু হাসিতে ফেটে পড়ায় বাবার কাছে কানমলা খেয়েছিলেন।
অসমঞ্জবাবু হাতের বইটা বন্ধ করে ব্রাউনির দিকে চাইলেন। চোখাচোখি হতেই বালিশের উপর সামনের পা দুটো ভর করে দাঁড়িয়ে ব্রাউনি তার তিন মাসে দেড় ইঞ্চি বেড়ে যাওয়া লেজটা নেড়ে দিল। তার মুখে এখন হাসির কোনও চিহ্ন নেই। অকারণে হাসাটা পাগলের লক্ষণ; অসমঞ্জবাবু ভেবে আশ্বস্ত হলেন যে ব্রাউনি ম্যাড ডগ নয়।
.
এর পর সাতদিনের মধ্যে ব্রাউনি আরও দুবার হাসার কারণে হাসল। প্রথমবারের ব্যাপারটা ঘটল রাত্রে। তখন রাত সাড়ে নটা। ব্রাউনির শোবার জন্য অসমঞ্জবাবু সবে তার তক্তপোষের পাশে মেঝেতে একটা চাদর পেতে দিয়েছেন, এমন সময় ফর ফর শব্দ করে দেওয়ালে একটা আরশোলা উড়ে এসে বসল। অসমঞ্জবাবু তাঁর এক পাটি চটি নিয়ে সেটাকে তাগ করে মারতে গিয়ে বেমক্কা এক চাপড় মেরে বসলেন দেওয়ালে টাঙানো আয়নাটায়, আর তার ফলে–সেটা পেরেক থেকে খসে মাটিতে পড়ে ভেঙে চৌচির। এবারে ব্রাউনির খিলখিলে হাসি তাঁকে ভাঙা আয়নার জন্য আপসোস করতে দিল না।
দ্বিতীয়বারের হাসিটা অবশ্য খিলখিল নয়; সেটা যাকে বলে ফিক করে হাসা। অসমঞ্জবাবু এবারে বেশ ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ ঘটনা বলতে কিছুই ঘটেনি। তবু ব্রাউনি হাসল কেন? উত্তর জোগাল বিপিন। চা এনে ঘরে ঢুকে মনিবের দিকে চেয়ে সেও ফিক করে হেসে বলল, আপনার কানের পাশে সাবান লেগে রয়েছে বাবু। আসলে আয়নার অভাবে জানলার আর্শিতে দাড়ি কামিয়েছেন অসমঞ্জবাবু; চাকরের কথায় দুদিকের জুলফিতেই হাত বুলিয়ে দেখলেন বেশ খানিকটা করে শেভিং সোপ লেগে রয়েছে।
এই সামান্য কারণেও যে ব্রাউনি হেসেছে তাতে অসমঞ্জবাবুর বেশ অবাক লাগল। তিনি দেখলেন যে পোস্টাপিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার ব্রাউনির কৌতুকভরা দৃষ্টি আর হাসির ফিক শব্দটা মনে পড়েছে। অল অ্যাবাউট ডগস-এ কুকুরের হাসির কথা না থাকলেও, কুকুরের এনসাইক্লোপিডিয়া গোছের একটা বই জোগাড় করতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই এ বিষয় কিছু জানতে পারতেন।
ভবানীপুরের চারটে বইয়ের দোকান, আর তারপর নিউ মার্কেটের সবকটা বইয়ের দোকান খুঁজেও যখন তিনি ওই জাতীয় কোনও এনসাইক্লোপিডিয়া পেলেন না, তখন মনে হল রজনী চাটুজ্যের কাছে গেলে কেমন হয়? তাঁর পাড়াতেই থাকেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রজনী চাটুজ্যে। কী বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন ভদ্রলোক সেটা অসমঞ্জবাবু জানেন না, কিন্তু তাঁর বৈঠকখানাটি যে ভারী ভারী বইয়ে ঠাসা সেটা তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই দেখা যায়।
এক রবিবার সকালে দুগা বলে রজনী চাটুজ্যের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন অসমঞ্জবাবু। দূর থেকে ভদ্রলোককে দেখেছেন অনেকবার, কিন্তু তাঁর গলার স্বর যে এত ভারী, আর ভুরু যে এত ঘন সেটা জানা ছিল না। রাগি মানুষ হলেও দরজা থেকে ফিরিয়ে দেননি, তাই খানিকটা ভরসা পেয়ে অসমঞ্জবাবু অধ্যাপকের মুখোমুখি সোফাটায় বসে একবার ছোট্ট করে কেশে গলাটা ঝেড়ে নিলেন। রজনীবাবু হাতের ইংরিজি পত্রিকাটি চোখের সামনে থেকে সরিয়ে তাঁর দিকে দৃষ্টি দিলেন।
আপনাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?
আজ্ঞে আমি এ পাড়াতেই থাকি।
অ।… কী ব্যাপার?
আপনার বাড়িতে একটা কুকুর দেখেছি, তাই…
তাই কী? আছে তো কুকুর। একটা কেন, দুটো আছে।
ও। আমারও আছে।
আপনারও আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটা।
বুঝলাম।–তা আপনি কি কুকুর-পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে আসছেন?
অসমঞ্জবাবু সরল মানুষ, তাই শ্লেষটা ধরতে পারলেন না। বললেন, আজ্ঞে না। একটা জিনিসের খোঁজ করতে আপনার কাছে এসেছি।
কী জিনিস?
আপনার কাছে কি কুকুরের এনইক্লোপিডিয়া আছে?
না, নেই।…ও জিনিসটার দরকার হচ্ছে কেন?
না, মানে–আমার কুকুর হাসে। তাই জানতে চাইছিলাম কুকুরের হাসিটা স্বাভাবিক কিনা। আপনার কুকুরও হাসে কি?
রজনীবাবুর দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে আটটা বাজতে যতটা সময় লাগল, ততক্ষণ একটানা তিনি অসমঞ্জবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, কখন হাসে আপনার কুকুর? রাত্তিরে কি?
হ্যাঁ, তা রাত্তিরেও…
রাত্তিরে আপনি করকম নেশা করেন? শুধু গাঁজায় তো হয় না এ জিনিস। তার সঙ্গে ভাঙ, চরস, আফিং–এসবও চলে কি?
অসমঞ্জবাবু বিনীতভাবে জানালেন যে একমাত্র ধূমপান ছাড়া তাঁর আর কোনও নেশা নেই, আর সেটাও তিনি কুকুর আসার পর থেকে হপ্তায় চার প্যাকেট থেকে তিন প্যাকেটে নামিয়েছেন, কারণ খরচে কুলোয় না।
তাও বলছেন আপনার কুকুর হাসে?
আমি দেখেছি হাসতে। শুনেছি। আওয়াজ করে হাসে।
শুনুন–।
রজনী চাটুজ্যে হাতের পত্রিকাটা বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে অসমঞ্জবাবুর দিকে তাকিয়ে একেবারে ষোলো আনা অধ্যাপকের মেজাজে বলেন, আপনার একটি তথ্য বোধহয় জানা নেই; সেটা জেনে রাখুন। ঈশ্বরের সৃষ্ট যত প্রাণী আছে জগতে, তার মধ্যে মানুষ ছাড়া আর কেউ হাসে না, হাসতে জানে না, হাসতে পারে না। এটাই হচ্ছে মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে প্রধান পার্থক্য। কেন এমন হল সেটা জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ সেটা জানি না। শুনেছি ডলফিন নামে শুশুক জাতীয় একরকম প্রাণীর নাকি রসবোধ আছে, তারা হাসলেও হাসতে পারে, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও প্রাণী হাসে না। মানুষ যে কেন হাসে সেটার কোনও স্পষ্ট কারণ জানা নেই। বাঘা বাঘা দার্শনিকরা অনেক ভেবে এর কারণ নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁদের মতের মিল হয়নি।–বুঝেছেন?
অসমঞ্জবাবু বুঝলেন, আর এও বুঝলেন যে এবার তাঁকে উঠতে হবে, কারণ রজনী চাটুজ্যের দৃষ্টি কথা শেষ করেই চলে গেছে তাঁর হাতের পত্রিকার দিকে।
.
ডাঃ সুখময় ভৌমিক–যাঁকে কেউ কেউ ভৌ-ডাক্তার বলেন কলকাতার একজন নামকরা কুকুরের ডাক্তার। সাধারণ লোকে তাঁর কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও একজন কুকুরের ডাক্তার সেটা করবে না এই বিশ্বাসে অসমঞ্জবাবু খোঁজ খবর নিয়ে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গোখেল রোডে ভৌমিকের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন। গত চার মাসে সতেরো বার হেসেছে ব্রাউনি। এটা অসমঞ্জবাবু লক্ষ করেছেন যে মজার কথা শুনলে ব্রাউনি হাসে না, কেবল মজার ঘটনা দেখলেই হাসে। যেমন বোম্বাগড়ের রাজা শুনে ব্রাউনির মুখে কোনও পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু আধসেদ্ধ আলুর দমের আলু যখন অসমঞ্জবাবুর আঙুলের চাপে পিছলে ছিটকে দইয়ের মধ্যে পড়ল, আর সেই দইয়ের ছিটে যখন অসমঞ্জবাবুর নাকের ডগায় লাগল, তখন ব্রাউনির প্রায় বিষম লাগার জোগাড়। রজনী চাটুজ্যে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রাণী-টানি বলে তো তাঁকে বিস্তর জ্ঞান দিলেন, কিন্তু অসমঞ্জবাবুর চোখের সামনে যে অধ্যাপকের কথা মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে তার কী হবে?
এই সব ভেবে-টেবে বিশ টাকা ফি জেনেও অসমঞ্জবাবু গেলেন ভৌ-ডাক্তারের কাছে। কুকুরের হাসির কথা শোনার আগেই তার চেহারা দেখে ডাক্তারের চোখ কপালে উঠল।
অনেক মংগ্রেল দেখিচি মশাই, কিন্তু এমনটি তো দেখিনি।
ডাক্তার দুহাতে ব্রাউনিকে তুলে তাঁর টেবিলের উপর দাঁড় করালেন। ব্রাউনি তার পায়ের সামনে পিতলের পেপারওয়েটটাকে একবার শুকে নিল।
কী খাওয়াচ্ছেন একে?
আজ্ঞে আমি যা খাই তাই খায়। জাত কুকুর তো নয়, কাজেই অতটা…
ভৌমিক ভুরু কুঁচকোলেন। ভারী মনোযোগ আর কৌতূহলের সঙ্গে দেখছেন তিনি ব্রাউনিকে।
জাত কুকুর দেখলে অবিশ্যি আমরা বুঝি, বললেন ভৌমিক, তবে সারা বিশ্বের সব জাত কুকুর যে আমাদের চেনা সেকথা জোর দিয়ে বলি কী করে বলুন। এটার চেহারা দেখে ফস করে দোআঁশলা বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। আপনি একে ডাল ভাত খাওয়াবেন না, আমি একটা খাবারের তালিকা করে দিচ্ছি।
অসমঞ্জবাবু এবার আসল কথায় যাবার একটা চেষ্টা দিলেন।
ইয়ে, আমার কুকুরের একটা বিশেষত্ব আছে, যার জন্য আপনার কাছে আসা।
কী বলুন তো?
কুকুরটা হাসে।
হাসে?
হ্যাঁ–মানে, মানুষের মতো করে হাসে।
বলেন কী! কই দেখি হাসান তো দেখি।
এইখানেই মুশকিলে পড়ে গেলেন অসমঞ্জবাবু। এমনিতেই তিনি বেশ লাজুক মানুষ, কাজেই সাকাসের ক্লাউনের মতো হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি করে তিনি ব্রাউনিকে হাসাবেন এমন ক্ষমতা তাঁর নেই। আর ঠিক এই মুহূর্তে এই ডাক্তারের ঘরে কোনও হাস্যকর ঘটনা ঘটবে এটাও আশা করা যায় না। তাঁকে তাই বাধ্য হয়ে বলতে হল অত সহজে ফরমাইশি হাসি হাসে না তাঁর কুকুর, কেবল কোনও হাসির ঘটনা দেখলেই হাসে।
এর পরে ডাঃ ভৌমিক আর বেশি সময় দিলেন না অসমঞ্জবাবুকে। বললেন, আপনার কুকুরের চেহারাতেই যথেষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে; তার সঙ্গে আবার হাসিটাসি জুড়ে দিয়ে আরও বেশি অসাধারণ করে তুলবেন না। তেইশ বছর কুকুরের ডাক্তারির অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আপনাকে কুকুর কাঁদে, কুকুর ভয় পায়, কুকুর রাগ ঘৃণা বিরক্তি হিংসে এ সবই প্রকাশ করে, এমন কী কুকুর স্বপ্নও দেখে; কিন্তু কুকুর হাসে না।
এই ঘটনার পর অসমঞ্জবাবু ঠিক করলেন যে আর কোনওদিন কাউকে কুকুরের হাসির কথা বলবেন না। প্রমাণ দেবার উপায় যখন নেই, তখন বলে কেবল নিজেই অপ্রস্তুত হওয়া। কেউ নাই বা জানুক, তিনি তো জানেন। ব্রাউনি তাঁরই কুকুর, তাঁরই সম্পত্তি। তাঁদের দুজনের এই জগতে বাইরের লোককে টেনে আনার কী দরকার?
কিন্তু মানুষে যা ভাবে সব সময় তো তা হয় না। ব্রাউনির হাসিও একদিন বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ পেয়ে গেল।
বেশ কিছুদিন থেকেই অসমঞ্জবাবু অভ্যাস করে নিয়েছিলেন কাজ থেকে ফিরে এসে ব্রাউনিকে নিয়ে ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকটায় একটা চক্কর মেরে আসা। একদিন এপ্রিল মাসের একটা বিকেলে বেড়ানোর সময় হঠাৎ আচমকা এল তুমুল ঝড়। আকাশের দিকে চেয়ে অসমঞ্জবাবু বুঝলেন এখন বাড়ি ফেরা মুশকিল, কারণ বৃষ্টিরও আর বেশি দেরি নেই। তিনি ব্রাউনিকে নিয়ে মেমোরিয়ালের দক্ষিণ দিকে কালো ঘোড়সওয়ার মাথায় করা শ্বেতপাথরের তোরণটার নীচে আশ্রয় নিলেন।
বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে, চারদিকে লোকজন পরিত্রাহি ছুটছে ছাউনি লক্ষ্য করে, এমন সময় সাদা প্যান্ট আর বুশ শার্ট পরা একটি মাঝবয়সী ফরসা মোটা বেঁটে ভদ্রলোক তাঁদের হাত থেকে হাত পনেরো দূরে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে তার হাতের ছাতাটা খুলে মাথায় দিতেই ঝড়ের দাপটে সেটা হড়াৎ শব্দ করে উলটে গিয়ে অকেজো হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, এই দৃশ্য দেখে অসমঞ্জবাবুরই হাসি পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি হাসবার আগেই ব্রাউনির অট্টহাস্য ঝড়ের শব্দকে ছাপিয়ে পৌঁছে গেল সেই অপ্রস্তুত ভদ্রলোকের কানে। ভদ্রলোক ছাতাটা আবার সোজা করার ব্যর্থ চেষ্টা বন্ধ করে অবাক বিস্ময়ে ব্রাউনির দিকে চাইলেন। এদিকে ব্রাউনির এখন কুটিপাটি অবস্থা, অসমঞ্জবাবু তার মুখের উপর হাত চেপে হাসি থামানোর চেষ্টায় বিফল হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
হতভম্ব ভদ্রলোক ভূত দেখার ভাব করে এগিয়ে এলেন অসমঞ্জবাবুর দিকে। ব্রাউনির হাসির তেজ খানিকটা কমেছে, কিন্তু তাও একজন লোকের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
লাফিং ডগ।
ভদ্রলোকের মুখে রা নেই দেখে অসমঞ্জবাবুই বললেন কথাটা।
লা-ফিং ড-গ! বহুদূরের পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনির মতো ফিরে এল কথাটা ভদ্রলোকের মুখ থেকে। হাউ এক্সট্রর্ডিনারি!
অসমঞ্জবাবু দেখেই বুঝেছিলেন যে ভদ্রলোক বাঙালি নন; হয়তো গুজরাটি বা পারসি হবে। কোনও প্রশ্ন যদি করেন ভদ্রলোক তা হলে ইংরিজিতে করবেন, আর অসমঞ্জবাবুকেও জবাব দিতে হবে ইংরিজিতেই।
বৃষ্টিটা বেড়েছে। ভদ্রলোক অসমঞ্জবাবুর পাশেই আশ্রয় নিলেন ঘোড়সওয়ারের নীচে, এবং যে দশ মিনিট ধরে বৃষ্টিটা চলল তার মধ্যে ব্রাউনি সম্বন্ধে যা কিছু সব তথ্য জেনে নিলেন। সেই সঙ্গে অসমঞ্জবাবুর নিজের ঠিকানাটাও দিতে হল। ভদ্রলোক বললেন তাঁর নাম পিলু পোচকানওয়ালা। তিনি কুকুর সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তাঁর এক ড্যালমেশিয়ান নাকি দুবার ডগ-শোতে প্রাইজ পেয়েছে, এমন কী তিনি কুকুর সম্বন্ধে কাগজে লিখেটিখেও থাকেন। বলা বাহুল্য, তাঁর জীবনে আজকের মতো তাক লাগানো ঘটনা আর ঘটেনি, ভবিষ্যতে আর ঘটবে না। তিনি মনে করেন এ বিষয়ে একটা কিছু করা দরকার, কারণ অসমঞ্জবাবু নিজে নাকি বুঝতে পারছেন না তিনি কী আশ্চর্য সম্পদের অধিকারী।
বৃষ্টি থামার পরে চৌরঙ্গির এডওয়ার্ড কোর্টে তাঁর বাসস্থানে ফেরার পথে পোচকানওয়ালা যে মিনিবাসের ধাক্কা খেয়ে কোমর ভাঙলেন, তার জন্য ব্রাউনিকে খানিকটা দায়ী করা চলে, কারণ লাফিং ডগের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকার ফলে ভদ্রলোক রাস্তা পেরোবার সময় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেননি। আড়াই মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে পোচকানওয়ালা হাওয়া বদলের জন্য যান নৈনিতাল। সেখানে একমাস থেকে কলকাতায় ফিরে এসে সেইদিনই সন্ধ্যায় বেঙ্গল ক্লাবে গিয়ে তিনি তাঁর বন্ধু মিঃ বালাপুরিয়া ও মিঃ বিসোয়াসকে লাফিং ডগের ঘটনাটা বললেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাটা পৌঁছে গেল ক্লাবের সাতাশজন সদস্য ও তিনটি বেয়ারার কানে, এবং পরদিন দুপুরের মধ্যে এই ত্রিশজন মারফত ঘটনাটা জেনে গেল কমপক্ষে হাজার কলকাতাবাসী।
এই সাড়ে তিন মাসে ব্রাউনি আর হাসেনি। তার একটা কারণ হয়তো এই যে, হাসির ঘটনা কোনও ঘটেনি। তাতে অবিশ্যি অসমঞ্জবাবু কোনও উদ্বেগ বোধ করেননি। কুকুরের হাসি ভাঙিয়ে খাবার কোনও অভিপ্রায় তাঁর কোনওদিন ছিল না। এই সাড়ে তিন মাসে তিনি বেশ ভালভাবেই বুঝেছেন যে ব্রাউনি এসে তাঁর নিঃসঙ্গতা সম্পূর্ণ দূর করে দিয়েছে। সত্যি বলতে কী, কোনও মানুষের প্রতি অসমঞ্জবাবু কোনওদিন এতটা মমতা বোধ করেননি।
পোচকানওয়ালার দৌলতে যারা লাফিং ডগের খবরটা পেলেন তাদের মধ্যে ছিলেন স্টেটসম্যান পত্রিকার একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি সেই কাগজের এক সাংবাদিক রজত চৌধুরীকে ডেকে অসমঞ্জবাবুর সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব করলেন। অসমঞ্জবাবু যে লাজপত রায় পোস্টাপিসের কেরানি সে খবরটা পোচকানওয়ালার জবানিতেই রটে গিয়েছিল।
অসমঞ্জবাবু অবিশ্যি তাঁর বাড়িতে সাংবাদিকদের আগমনের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর বিস্ময় খানিকটা কাটল যখন রজত চৌধুরী পোচকানওয়ালার উল্লেখ করলেন। অসমঞ্জবাবু ভদ্রলোককে ঘরে এনে নতুন পায়া লাগানো চেয়ারটায় বসিয়ে নিজে খাটে বসলেন। সেই সাতান্ন সালে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ-এর পর এই তাঁর প্রথম ইন্টারভিউ। ব্রাউনি ঘরের এক কোণে পিছন ফরে দাঁড়িয়ে দেওয়ালের গায়ে একটা পিঁপড়ের সারির গতিবিধি লক্ষ করছিল, তার মনিবকে খাটে বসতে দেখে সে এক লাফে তাঁর পাশে গিয়ে হাজির হল।
রজত চৌধুরীকে টেপ রেকর্ডারের চাবি টিপতে দেখে অসমঞ্জবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল সাংবাদিককে একটা কথা জানানো দরকার। তিনি বললেন, ইয়ে আমার কুকুর আগে হাসত ঠিকই, কন্তু ইদানীং বেশ কয়েকমাস আর হাসেনি; কাজেই আপনি ওর হাসি চাক্ষুষ দেখতে চাইলে আপনাকে হতাশ হতে হবে।
আজকালকার অনেক সাংবাদিকদের মতোই রজত চৌধুরী একটা বেশ চনমনে দাঁওমারা ভাব বোধ করেছিলেন এই সাক্ষাৎকারের শুরুতে। কথাটা শুনে তিনি খানিকটা হতাশ হলেও মনের ভাবটা যথাসম্ভব আড়াল করে বললেন, ঠিক আছে। তবু কতকগুলো ডিটেলস্ আমি জেনে নিই। যেমন প্রথম হচ্ছে, আপনার কুকুরের নাম কী?
এগোনো মাইকটার দিকে গলা বাড়িয়ে অসমঞ্জবাবু বললেন, ব্রাউনি।
ব্রাউনি…। এটা রজত চৌধুরীর দৃষ্টি এড়াল না যে নামটা উচ্চারণ হতেই কুকুরের লেজটা দুলে উঠেছে।
ওর বয়স কত? দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন রজত চৌধুরী।
এক বছর এক মাস।
আচ্ছা–আপনি এটাকে পে-প্পে-প্পেলেন কোথায়?
এটা আগেও হয়েছে। অনেক হোমরা-চোমরার সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েও রজত চৌধুরীর জিভের এই দোষটি তাকে আচমকা অপ্রস্তুত করে ফেলেছে। এখানেও তাই হতে পারত, কিন্তু ফল হল উলটো। এই তোতলামো ব্রাউনির বৈশিষ্ট্যপ্রকাশে আশ্চর্যভাবে সাহায্য করল। পোচকানওয়ালার পরে রজত চৌধুরী হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি নিজের কানে শুনলেন কুকুরের মুখে মানুষের হাসি।
পরের রবিবার সকালে গ্র্যান্ড হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দুশো সাতষট্টি নম্বর কামরায় বসে আমেরিকায় সিনসিনাটি শহরের অধিবাসী উইলিয়াম পি. মুডি কফি খেতে খেতে স্টেটসম্যান পত্রিকায় লাফিং ডগ-এর বিবরণ পড়ে হোটেলের অপারেটরকে ফোন করে বললেন টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের মিস্টার ন্যানডির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। এই ন্যানডি ছোঁকরাটি যে কলকাতার রাস্তাঘাট ভালই চেনে তার প্রমাণ মুডি সাহেব গত দুদিনে পেয়েছেন। স্টেটসম্যানে লাফিং ডগ-এর মালিকের নাম ঠিকানা বেরিয়েছে। মুডি সাহেবের তাঁর সঙ্গে দেখা করা একান্ত দরকার।
অসমঞ্জবাবু স্টেটসম্যান পড়েন না। তা ছাড়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি যে কবে বেরোবে সেটা রজত চৌধুরী বলে যাননি; দিনটা জানা থাকলে হয়তো তিনি কাগজের খোঁজ করতেন। তাঁকে খবরটা বলল জগুবাবুর বাজারে তাঁর পাড়ার জয়দেব দত্ত।
আপনি তো মশাই আচ্ছা লোক, বললেন জয়দেববাবু, এমন একটা তাজ্জব জিনিস ঘরে নিয়ে বসে আছেন এক বচ্ছর যাবৎ, আর কথাটা ঘুণাক্ষরেও জানাননি। আজ বেলা করে যাব একবারটি আপনার ওখানে। দেখে আসব আপনার কুকুর।
অসমঞ্জবাবু প্রমাদ গুনলেন। উৎপাতের সমূহ সম্ভাবনা। সত্যি বলতে কী, আপিসের বাইরে মানুষের সঙ্গ তাঁর মোটেই ভাল লাগে না। কোনওদিনই লাগত না–ব্রাউনি আসার পরে তো নয়ই। অথচ কলকাতার লোকেরা যা হুজুগে; এমন একটা খবর পড়ে কি আর তারা এই আশ্চর্য কুকুরটি দেখার লোভ সামলাতে পারবে?
অসমঞ্জবাবু দ্বিধা না করে বাড়ি ফিরে দশ মিনিটের মধ্যে ব্রাউনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর জীবনে প্রথম একটি ট্যাক্সি ডেকে তাতে চেপে সোজা চলে গেলেন বালিগঞ্জ রেলের স্টেশনে। সেখান থেকে চাপলেন ক্যানিং-এর ট্রেনে। পথে তালিত বলে একটা স্টেশনে গাড়ি থামলে পর জায়গাটাকে বেশ নিরিবিলি মনে হওয়ায় ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। সারা দুপুর বাঁশবন আমবনের ছায়া-শীতল পরিবেশে ঘুরে ভারী আরাম বোধ হল। ব্রাউনিকে দেখে মনে হল তারও ভাল লাগছে। তার ঠোঁটের কোণে যে হাসিটা আজ দেখলেন অসমঞ্জবাবু, সেটা একেবারে নতুন হাসি। এটা হল প্রসন্নতার হাসি, আরামের হাসি, মেজাজখুশ হাসি। অল অ্যাবাউট ডগ বইতে অসমঞ্জবাবু পড়েছিলেন যে কুকুরের এক বছর নাকি মানুষের সাত বছরের সামিল। কিন্তু এক বছরের ব্রাউনির হাবভাব দেখে তাঁর মনে হচ্ছে এই কুকুরটির মনের বয়স সাতের চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
বাড়ি ফিরতে হল প্রায় সাতটা। বিপিন দরজা খুলতে অসমঞ্জবাবু জিজ্ঞেস করলেন, হারে, কেউ এসেছিল? বিপিন জানাল সারাদিনে অন্তত চল্লিশবার তাকে কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলতে হয়েছে। অসমঞ্জবাবু মনে মনে নিজের বুদ্ধির তারিফ করলেন।
বিপিনকে চা করতে বলে গায়ের জামাটা খুলে আলনায় রাখতেই কড়া নাড়ার শব্দ হল। ধুত্তেরি বলে দরজা খুলে সামনে সাহেব দেখেই অসমঞ্জবাবু বলে ফেললেন, রং নাম্বার। তারপর সাহেবের পাশে চশমা পরা এক বাঙালি যুবককে দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন, কাকে চাই?
বোধহয় আপনাকে, বললেন ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের শ্যামল নন্দী। আপনার পিছনে যে কুকুরটাকে দেখছি সেটার সঙ্গে আজকের কাগজের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে। ভেতরে আসতে পারি?
অসমঞ্জবাবু অগত্যা দুজনকে তাঁর ঘরে এনে বসালেন। সাহেব বসলেন চেয়ারে, নন্দী মোড়াতে আর অসমঞ্জবাবু নিজে বসলেন খাটে। ব্রাউনির যেন কেমন একটা ইতস্তত ভাব; সে ঘরে না ঢুকে চৌকাঠের ঠিক বাইরে রয়ে গেল। তার কারণ বোধহয় এই যে, এর আগে সে এই ঘরে কখনও একসঙ্গে তিনজন পুরুষকে দেখেনি।
ব্রাউনি! ব্রাউনি! ব্রাউনি!
ঘাড় নিচু, চোখ সঙ্কুচিত এবং ঠোঁট ছুঁচলো করে সাহেব হাসি হাসি মুখে ব্রাউনির দিকে চেয়ে মিহি গলায় তার নাম ধরে ডাকছে। ব্রাউনিও একদৃষ্টে সাহেবকে পর্যবেক্ষণ করছে।
স্বভাবতই অসমঞ্জবাবুর মনে প্রশ্ন জেগেছিল–এঁরা কারা? সে প্রশ্নের উত্তর দিলেন শ্যামল নন্দী। সাহেব মার্কিন মুলুকের একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি, ভারতবর্ষে এসেছেন পুরনো রোলস রয়েস গাড়ির সন্ধানে। সকালে ব্রাউনির বিষয়ে খবরের কাগজে পড়ে তাকে একবার দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। সাহেব ঠিকানা খুঁজে বার করতে পারবেন না বলে শ্যামল নন্দী তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
অসমঞ্জবাবু লক্ষ করলেন সাহেব এবার নাম ধরে ডাকা ছেড়ে চেয়ার থেকে নেমে এসে নানারকম মুখভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গি করতে আরম্ভ করেছেন। অর্থাৎ কুকুরকে হাসানোর চেষ্টা চলেছে।
মিনিট তিনেক এইভাবে সংবাজি চালাবার পর সাহেব হাল ছেড়ে অসমঞ্জবাবুর দিকে ফিরে। বললেন, ইজ হিঁ সিঁক্?
অসমঞ্জবাবু জানালেন তাঁর কুকুরের কোনও ব্যারাম হয়েছে বলে তিনি জানেন না।
ডাঁজ হিঁ রিঁয়েলি ল্যাঁফ?
মার্কিনি ইংরিজি পাছে অসমঞ্জবাবু না বোঝেন তাই শ্যামল নন্দী অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিলেন সাহেব জানতে চাইছেন কুকুরটা সত্যিই হাসে কি না।
অসমঞ্জবাবুর অন্তরের ভিতর থেকে একটা বিরক্তির ভাব বাইরে ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করছিল। সেটাকে মনের জোরে দাবিয়ে রেখে বললেন, সব সময় হাসে না। যেমন সব মানুষও হাসতে বললেই হাসে না।
এবার দোভাষীর অনুবাদ শুনে সাহেবের মুখে লালের ছোপ পড়ল। তারপর তিনি জানালেন যে প্রমাণ না পেলে তিনি কুকুরের পিছনে খরচ করতে রাজি নন, কারণ দেশে ফিরে অপ্রস্তুতে পড়তে চান না তিনি। তিনি আরও জানালেন তাঁর বাড়িতে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে চীন থেকে পেরু পর্যন্ত পৃথিবীর এমন কোনও দেশ নেই যেখানকার কোনও না কোনও আশ্চর্য জিনিস নেই। একটি প্যারট আছে তাঁর কাছে, যেটা ল্যাটিন ভাষা ছাড়া কথা বলে না। –এই লাফিং ডগটি কেনার জন্য আমি সঙ্গে চেক বই নিয়ে এসেছিলাম।
থাটা বলে সাহেব তাঁর বুক পকেট থেকে সড়াৎ করে একটি নীল বই করে দেখালেন। অসমঞ্জবাবু আড় চোখে দেখলেন, তার মলাটে লেখা সিটি ব্যাঙ্ক অব নিউ ইয়র্ক।
আপনার ভোল পালটে যেত মশাই, বললেন শ্যামল নন্দী, আপনার কুকুরকে হাসাবার যদি কোনও উপায় জানা থাকে তা হলে সেইটি এবার ছাড়ন। ইনি বিশ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজি আছেন ওই কুকুরের জন্য। মানে টাকার হিসেবে দেড় লাখ।
বাইবেলে লিখেছে ঈশ্বর সাতদিনে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছিলেন। মানুষ কিন্তু কল্পনার সাহায্যে সাত সেকেন্ডেই এ কাজটা করতে পারে। শ্যামল নন্দীর কথা শোনামাত্র অসমঞ্জবাবু যে জগৎটা চোখের সামনে দেখতে পেলেন, সেখানে তিনি একটি পেল্লায় ছিমছাম ঘরে বার্ড কোম্পানির বড় সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে আরাম কেদারায় বসে আছেন, আর বাইরের বাগান থেকে ভেসে আসছে। হাসনাহানা ফুলের গন্ধ। দুঃখের বিষয় তাঁর এই ছবি বুদ্বুদের মতো ফুড়ৎ হয়ে গেল একটা শব্দে।
ব্রাউনি হাসছে।
এ হাসি আগের কোনও হাসির মতো নয়; এ একেবারে নতুন হাসি।
বাঁট হিঁ ইঁজ ল্যাফিং।
মুডি সাহেব কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েছেন, আর দুই চোখ দিয়ে গিলছেন এই দৃশ্য। জানোয়ার হলে তাঁর কানটাও যে খাড়া হয়ে উঠত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই অসমঞ্জবাবুর।
এবার কম্পিত হস্তে মুডি সাহেব তাঁর পকেট থেকে আবার বার করলেন তাঁর চেক বই। আর সেই সঙ্গে একটি সোনার পাকার কলম।
ব্রাউনি কিন্তু হেসে চলেছে। অসমঞ্জবাবুর মনে খটকা, কারণ তিনি এ হাসির মানে বুঝতে পারছেন না। কেউ তোতলায়নি, কেউ হোঁচট খায়নি, কারুর ছাতা উলটে যায়নি, চটির আঘাতে কোনও আয়না দেয়াল থেকে খসে পড়েনি–তা হলে কেন হাসছে ব্রাউনি?
আপনার কপাল ভাল, বললেন শ্যামল নন্দী। তবে আমার কিন্তু একটা কমিশন পাওয়া উচিত, কী বলেন–হেঃ হেঃ।
মুডি সাহেব মেঝে থেকে উঠে চেয়ারে বসে চেক বই খুললেন। অ্যাঁস্ক হিঁম হাঁউ হিঁ স্পেঁলস্ হিঁজ নেম।
সাহেব আপনার নামের বানান জিজ্ঞেস করছেন, বললেন দোভাষী শ্যামল নন্দী।
অসমঞ্জবাবু কথাটার উত্তর দিলেন না, কারণ তিনি হঠাৎ আলো দেখতে পেয়েছেন। আর সেই আলো তাঁর মনে গভীর বিস্ময় জাগিয়েছে। নামের বানানের বদলে তিনি বললেন, সাহেবকে বলুন কুকুর কেন হাসছে সেটা জানলে তিনি আর টাকার কথা তুলতেন না।
আপনি আমাকেই বলুন না, শুকনো গলায় কড়া সুরে বললেন শ্যামল নন্দী। ঘটনার গতি তাঁর মোটেই মনঃপূত হচ্ছে না। মিশন ফেল করলে সাহেবের ধাতানি আছে তাঁর কপালে এটা তিনি জানেন।
ব্রাউনির হাসি থেমেছে। অসমঞ্জবাবু তাকে কোলে তুলে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বললেন, সাহেব ভাবছেন টাকা দিলে দুনিয়ার সব কিছু কেনা যায়, তাই শুনে কুকুর হাসছে।
বটে? আপনার কুকুর বুঝি দার্শনিক?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তার মানে আপনি কুকুর বেচবেন না?
আজ্ঞে না।
শ্যামল নন্দী অবিশ্যি তাঁর অনুবাদে কুকুরের মনের ভাবের কথা কিছুই বললেন না, শুধু জানিয়ে দিলেন যে কুকুরের মালিক কুকুর বেচবেন না। কথাটা শুনে কলম, চেকবই পকেটে পুরে প্যান্টের হাঁটু থেকে অসমঞ্জবাবুর মেঝের ধুলো হাত দিয়ে ঝেড়ে ঘর থেকে বেরোনোর সময় সাহেব শুধু মাথা নেড়ে বলে গেলেন, হিঁ মাস্ট বিঁ ক্রেঁজি।
বাইরে মার্কিন গাড়িটার আওয়াজ যখন মিলিয়ে এল তখন অসমঞ্জবাবু ব্রাউনিকে তাঁর কোল থেকে নামিয়ে খাটের উপর রেখে তার দিকে চেয়ে বললেন, তোর হাসির কারণটা ঠিক বলিনি রে, ব্রাউনি?
ব্রাউনি ছোট্ট করে হেসে দিল—ফিক্।
অর্থাৎ ঠিক।
সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৫
আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিন
১.
রাজামশাই একদিন নাসিরুদ্দিনকে ডেকে বললেন, বনে গিয়ে ভাল্লুক মেরে আনো।
নাসিরুদ্দিন রাজার আদেশ অমান্য করে কী করে? অগত্যা তাকে যেতেই হল।
বন থেকে ফেরার পর একজন তাকে জিজ্ঞেস করলে, কেমন হল শিকার, মোল্লাসাহেব?
চমৎকার, বললে নাসিরুদ্দিন।
কটা ভাল্লুক মারলেন?
একটিও না।
বটে? কটাকে ধাওয়া করলেন?
একটিও না।
সে কী। কটা দেখলেন?
একটিও না।
তা হলে চমৎকারটা হল কী করে?
ভাল্লুক শিকার করতে গিয়ে সে জানোয়ারের দেখা না পাওয়ার চেয়ে চমৎকার আর কী হতে পারে?
.
২.
এক পড়শি এসেছে নাসিরুদ্দিনের কাছে এক আর্জি নিয়ে।
মোল্লাসাহেব, আপনার গাধাটা যদি কিছুদিনের জন্য ধার দেন তো বড় উপকার হয়।
মাফ করবেন, বললে নাসিরুদ্দিন, ওটা আরেকজনকে ধার দিয়েছি।
কথাটা বলামাত্র বাড়ির পিছন থেকে গাধা ডেকে উঠে তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে দিল।
সে কী মোল্লাসাহেব, ওটা আপনারই গাধার ডাক শুনলাম না?
নাসিরুদ্দিন মহারাগে লোকটার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সময় বললে, আমার কথার চেয়ে আমার গাধার ডাককে যে বেশি বিশ্বাস করে, তাকে কোনওমতেই গাধা ধার দেওয়া চলে না।
.
৩.
এক বেকুবের শখ হয়েছে সে পণ্ডিত হবে। সে মনে মনে ভাবলে মোল্লার তো নামডাক আছে পণ্ডিত হিসেবে, তার কাছেই যাওয়া যাক, যদি কিছু শেখা যায়।
অনেকখানি পথ পাহাড় ভেঙে উঠে সে খুঁজে পেলে নাসিরুদ্দিনের বাসস্থান। ঢোকবার আগে জানলা দিয়ে দেখলে মোল্লাসাহেব ঘরের এককোণে ধুনুচির সামনে বসে নিজের দু হাতের তেলো মুখের সামনে ধরে তাতে ফুঁ দিচ্ছে।
ঘরে ঢুকে বেকুব প্রথমেই হাতে ফুঁ দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে। ফুঁ দিয়ে হাত গরম করছিলাম, বলে নাসিরুদ্দিন চুপ করলে। বেকুব ভাবলে, একটা জিনিস তো জানা গেল। আর কিছু জানা যাবে কি?
কিছুক্ষণ পরে নাসিরুদ্দিনের গিন্নি দুবাটি গরম দুধ এনে কর্তা আর অতিথির সামনে রাখলেন। নাসিরুদ্দিন তক্ষুনি দুধে ফুঁ দিতে শুরু করলে।
এবার বেকুব সম্ভ্রমের সঙ্গে শুধোলে, হে গুরু, এবারে ফুঁ দেবার কারণটা কী?
দুধ ঠাণ্ডা করা, বললে নাসিরুদ্দিন।
বেকুব বিদায় নিলেন। যে লোক বলে ফুঁ দিয়ে জিনিস গরম হয়, আবার ঠাণ্ডাও হয়, তার কাছ থেকে জ্ঞানলাভের কোনও আশা আছে কি?
.
৪.
মোল্লা এখন কাজি, সে আদালতে বসে। একদিন এক বুড়ি তার কাছে এসে বললে, আমি বড়ই গরিব। আমার ছেলেকে নিয়ে বড় ফ্যাসাদে পড়েছি কাজিসাহেব। সে মুঠো মুঠো চিনি খায়, তাকে আর চিনি জুগিয়ে কুল পাচ্ছি না। আপনি হুকুম দিয়ে তার চিনি খাওয়া বন্ধ করুন। সে আমার কথা শোনে না।
মোল্লা একটু ভেবে বললে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এক হপ্তা পরে এসো, আমি একটু বিবেচনা করে তারপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।
বুড়ি হুকুমমতো এক হপ্তা পরে আবার এসে হাজির! মোল্লা তাকে দেখে মাথা নাড়লে।–এ বড় জটিল মামলা। আরও এক হপ্তা সময় দিতে হবে আমাকে।
আরও সাতদিন পরেও সেই একই কথা। অবশেষে ঠিক এক মাস পরে মোল্লা বুড়িকে বললে, কই, ডাকো তোমার ছেলেকে।
ছেলেটি আসতেই মোল্লা তাকে হুঙ্কার দিয়ে বললে, দিনে আধ ছটাকের বেশি চিনি খাওয়া চলবে। যাও।
বুড়ি মোল্লাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললে, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল, কাজিসাহেব।
বলো।
এই নিয়ে চারবার ডাকলেন কেন আমাকে? এর অনেক আগেই তো আপনি এ হুকুম দিতে পারতেন।
তোমার ছেলেকে হুকুম দেবার আগে আমার নিজের চিনি খাওয়ার অভ্যেস কমাতে হবে তো! বললে নাসিরুদ্দিন।
.
৫.
রাস্তার কয়েকটি ছোঁকরা ফন্দি করেছে তারা মোল্লাসাহেবের জুতোজোড়া হাত করবে। একটা লম্বা গাছের দিকে দেখিয়ে তারা মোল্লাসাহেবকে বললে, ওই যে গাছ দেখছেন, ওটায় চড়ার সাধ্যি কারুর নেই।
আমার আছে, বলে মোল্লাসাহেব জুতোজাড়া পা থেকে না খুলেই গাছটায় চড়তে শুরু করলেন। বেগতিক দেখে ছেলেরা চেঁচিয়ে বলল, ও মোল্লাসাহেব, ওই গাছে আপনার জুতো কোনও কাজে লাগবে কি?
মোল্লাসাহেব গাছের উপর থেকে জবাব দিলেন, গাছের মাথায় যে রাস্তা নেই তা কে বলতে পারে?
.
৬.
নাসিরুদ্দিন বাজারে গিয়ে এক নিলামদারের হাতে তার গাধাটিকে তুলে দিলে। সেটাকে দিয়ে আর কাজ চলে না, তাই একটা নতুন গাধা কেনা দরকার।
আর পাঁচরকম জিনিস পাচার হয়ে যাবার পর গাধা যখন নিলামে উঠল, নাসিরুদ্দিন তখন কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে। নিলামদার হাঁক দিলে, এবার দেখুন এই অসামান্য, অতুলনীয় গাধা। পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা কে দেবেন এর জন্য? মাত্র পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা!
এক চাষা হাত তুললে। দর এত কম দেখে মোল্লাসাহেব নিজেই হেঁকে বসলেন, ছয় স্বর্ণমুদ্রা।
ওদিকে অন্য লোকেও ডাকতে শুরু করেছে, আর নিলামদারও গাধার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দর যত বাড়ে ততই বাড়ে গুণের ফিরিস্তি।
চাষা ও মোল্লাসাহেবের মধ্যে ডাকাডাকিতে গাধার দাম চড়ে চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রায় পৌঁছে শেষটায় মোল্লাসাহেবেরই জিত হল। গাধার আসল দাম ছিল বিশ স্বর্ণমুদ্রা, অর্থাৎ লোকসান হল দ্বিগুণ।
কিন্তু তাতে কী এসে গেল? যে গাধার এত গুণ, বললে মোল্লাসাহেব, তার জন্য চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রা তো জলের দর।
.
৭.
নাসিরুদ্দিন মওকা বুঝে একজনের সবজির বাগানে গিয়ে হাতের সামনে যা পায় থলেতে ভরতে শুরু করেছে।
এদিকে মালিক এসে পড়েছেন। কাণ্ড দেখে তিনি হন্তদন্ত নাসিরুদ্দিনের দিকে ছুটে এসে বললেন, ব্যাপারটা কী?
নাসিরুদ্দিন বললে, ঝড়ে উড়িয়ে এনে ফেলেছে আমায় এখানে।
আর খেতের সবজিগুলোকে উপড়ে ফেলল কে?
ওড়ার পথে ওগুলিকে খামচে ধরে তবে তো রক্ষা পেলাম।
আর সবজিগুলো থলের মধ্যে গেল কী করে?
সেই প্রশ্নই তো আমাকেও চিন্তায় ফেলেছিল, এমন সময় আপনি এসে পড়লেন।
.
৮.
মোল্লাগিন্নি মাঝরাত্তিরে নাসিরুদ্দিনের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? চশমা পরে ঘুমোচ্ছ কেন?
মোল্লা নতুন চশমা নিয়েছে। খাপ্পা হয়ে বললে, চোখে চালশে পড়েছে, চশমা ছাড়া স্বপ্ন দেখব কী করে?
.
৯.
থলেতে একঝুড়ি ডিম লুকিয়ে নিয়ে নাসিরুদ্দিন চলেছে ভিনদেশে। সীমানায় পৌঁছতে শুল্ক বিভাগের লোক তাকে ধরলে। নাসিরুদ্দিন জানে ডিম চালান নিষিদ্ধ।
মিথ্যে বললে মৃত্যুদণ্ড বললে শুল্ক বিভাগের লোক। তোমার থলেতে কী আছে বলো।
প্রথম অবস্থার কিছু মুরগি, বললে মোল্লাসাহেব।
হুম–সমস্যার কথা। মুরগি চালান নিষিদ্ধ কিনা খোঁজ নিতে হবে, তারপর ব্যাপারটার মীমাংসা হবে। ততদিন এ থলি রইল আমাদের জিম্মায়। ভয় নেই, তোমার মুরগিকে উপোস রাখব না আমরা।
কিন্তু আমার মুরগির জাত যে একটু আলাদা, বললে নাসিরুদ্দিন।
কীরকম।
আপনারা তো শুনেছেন অবহেলার দরুন মুরগির অকাল বার্ধক্য আসে।
তা শুনেছি বটে!
আমার মুরগিকে ফেলে রাখলে সেগুলো অকালে শিশু হয়ে যায়!
শিশু মানে?
একেবারে শিশু, বললে নাসিরুদ্দিন, যাকে বলে ডিম।
.
১০.
মোল্লা মসজিদে গিয়ে বসেছে, তার জোব্বাটা কিঞ্চিৎ খাটো দেখে তার পিছনের লোক সেটাকে টেনে খানিকটা নামিয়ে দিলে। মোল্লা তৎক্ষণাৎ তার সামনের লোকের জোব্বাটা ধরে নীচের দিকে দিলে এক টান। তাতে লোকটি পিছন ফিরে চোখ রাঙিয়ে বললে, এটা কী হচ্ছে?
মোল্লা বললে, এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আমার পিছনের লোক।
.
১১.
কারও মৃত্যু হলে শোক জানানোর জন্য কালো পোশাক পরে মোল্লার দেশের লোকেরা। মোল্লাকে সেই পোশাকে হাঁটতে দেখে একজন জিজ্ঞেস করলে, কেউ মরল নাকি, মোল্লাসাহেব?
সাবধানের মার নেই, বললে মোল্লাসাহেব, কোথায় কখন কে মরছে তা কি কেউ বলতে পারে?
.
১২.
নাসিরুদ্দিন রাজাকে একটা সুখবর দেবে, তাই অনেক কসরৎ করে রাজসভায় গিয়ে হাজির হয়েছে। রাজা খবর শুনে খুশি হয়ে বললেন, কী বকশিশ চাও বলো।
পঞ্চাশ ঘা চাবুক, বললে নাসিরুদ্দিন।
রাজা অবাক! তবে নাসিরুদ্দিন যে মশকরা করছে না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যায়। হুকুম হল পঞ্চাশ ঘা চাবুকের।
পঁচিশ ঘায়ের পর নাসিরুদ্দিন বললে, থামো!
চাবুক থামল। বাকি পঁচিশ ঘা পাবে আমার অংশীদার, বললে নাসিরুদ্দিন। রাজপেয়াদা আমার সঙ্গে কড়ার করেছিল সুখবর পেয়ে রাজা বকশিশ দিলে তার অর্ধেক তাকে দিতে হবে।
সন্দেশ, মাঘ ১৩৮৭
আমি ভূত
আমি ভূত। আজ থেকে ঠিক সাড়ে তিন বছর আগে আমি জ্যান্ত ছিলাম। সেই সময় এই দেওঘরের এই বাড়িতেই আগুনে পুড়ে আমার জ্যান্ত অবস্থার শেষ হয়। এই বাড়ির নাম লিলি ভিলা। আমি এখানে এসেছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছুটি কাটাতে। একদিন স্টোভে চা করতে গিয়ে স্টোভ ফেটে আমার কাপড়ে আগুন ধরে যায়। আমার মুখেও আগুন লেগেছিল এইটুকু আমার মনে আছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। তারপর থেকে আমি এই বাড়িরই বাসিন্দা হয়ে গেছি। আমার চেহারা এখন কীরকম তা আমি নিজে জানি না, কারণ আয়নায় ভূতের ছায়া পড়ে না। জলেও যে পড়ে না সেটা বাঁড়ুজ্যেদের পুকুরে পরখ করে দেখেছি। খুব যে আহামরি চেহারা নয় সেটা বুঝেছি একটা ঘটনা থেকে। লিলি ভিলায় দু বছর আগে একটা পরিবার ছুটি কাটাতে এসেছিল। সেই পরিবারের কর্তা একদিন আমার মুখোমুখি পড়ে গিয়ে চোখ কপালে তুলে ভিরমি গিয়েছিলেন। দোষটা আমারই; ভূত দেখা দেবে কি অদৃশ্য থাকবে সেটা ভূতের মর্জির উপরই নির্ভর করে। আমি অদৃশ্য থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অন্যমনস্কতার ফলে ভুল করে দেখা দিয়ে ফেলেছিলাম। এই ঘটনার পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আগুনে পুড়ে শরীর আর মুখের যে অবস্থা হয়েছিল, ভূত হয়েও সেই অবস্থাটাই রয়ে গেছে।
এই ভিরমি দেবার ঘটনার পর থেকেই এ বাড়িতে আর কেউ আসে না, কারণ হানাবাড়ি বলে এটার একটা বদনাম রটে গেছে। আমার পক্ষে এটা লোকসান, কারণ বাড়িতে জ্যান্ত লোকজন থাকলে আমার বেশ ভালই লাগে। না হলে তো সেই একা একা দিন কাটানো। ভূত এ তল্লাটে আরও অনেক আছে, কিন্তু এ বাড়িতে তো নেই, কারণ এখানে আর কেউ কখনও অপঘাতে মরেনি। শহরের অন্য জায়গায় যে ভূত আছে তাদের সকলকে আমার পছন্দ নয়। কয়েকজন তো রীতিমতো মন্দ। যেমন নস্করদা, বা। ভীম নস্করের ভূত। ওর মতো কুচক্রী ফন্দিবাজ ভূত দুনিয়ায় দুটো হয় না। এই দেওঘরে কিছুদিন আগে লক্ষ্মণ ত্রিপাঠী বলে এক পোস্টমাস্টার ছিলেন। লক্ষ্মণের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল স্টেট ব্যাঙ্কের কর্মচারী কান্তিভাই দুবের। এক সন্ধ্যায় লক্ষ্মণ ত্রিপাঠী পোস্টাপিস থেকে বাড়ি ফিরছেন; শাবাবুদের বাড়ি পেরিয়ে মাঠটার কাছে আসতেই ভীম নস্করের ভূত করল কি, ঝপ করে একটা তেঁতুল গাছ থেকে নেমে ত্রিপাঠী মশাইয়ের ঘাড়টা মটকে দিল। তারপর সে কী হই-হুল্লোড়!–থানা দারোগা কোর্ট কাঁচারি মামলা মকদ্দমা, সব শেষে ফাঁসি পর্যন্ত। কার ফাঁসি? লক্ষ্মণ ত্রিপাঠীর দুশমন কান্তিভাই দুবের। যে-খুনটা করল ভীম নস্করের ভূত, ঘটনাচক্রে সেই খুনের জন্য দায়ী হল কান্তিভাই দুবে। এই উদোর বোঝা যে বুধোর ঘাড়ে চাপবে সেটা জেনেশুনেই নস্করের ভূত করেছিল কাণ্ডটা। আমি বাধা দিয়ে নস্করদাকে বললাম যে তুমি কাজটা ভাল করোনি। ভূত হয়েছ বলেই যে জ্যান্ত মানুষের অপকার। করতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই। তুমি তোমার রাজ্যে তোমার ধান্দা নিয়ে থাকো, আর জ্যান্তরা থাকুক তাদের ধান্দা নিয়ে। দুই জগতে ঠোকাঠুকি হলেই যত অনাসৃষ্টি।
আমি নিজে সজ্ঞানে কোনও জ্যান্ত মানুষের অনিষ্ট করতে যাইনি। বিশেষ করে যেদিন থেকে বুঝেছি যে আমার চেহারাটা মানুষের মনে আতঙ্ক জাগায়, সেদিন থেকে আমি একদম সাবধান। লিলি ভিলার পিছনে আম কাঁঠাল বনের একপাশে একটা পুরনো ভাঙা মালির ঘর আছে, সেইখানেই আমি পড়ে থাকি বেশির ভাগটা সময়। অবিশ্যি লিলি ভিলা এখন অনেকদিন থেকেই খালি; কিন্তু কাছেই চৌধুরী বাড়ি থেকে ছেলেরা এখানে লুকোচুরি খেলতে আসে। আশ্চর্য, এই ছেলেগুলোর একদম ভূতের ভয় নেই। কিংবা হয়তো ভূত আছে জেনেই তারা এখানে আসে। যাই হোক, সেই সময়টা আমাকে একদম অদৃশ্য থাকতে হয়। বড়রাই যদি আমাকে দেখে ভিরমি যায়, তা হলে ছোটদের কী অবস্থা হবে ভাবো তো! না; ওসবের মধ্যে আমি নেই।
তবে এটাও ঠিক যে, ভূতদেরও একা-একা লাগে। আমারই একটা গলতির জন্য লিলি ভিলা এখন। হানাবাড়ি। তাই এখানে কেউ এসে থাকতে চায় না; আর আমিও জ্যান্ত মানুষের গলার আওয়াজ, তাদের চলাফেরা কাজকর্ম হাসি-তামাশার শব্দ কিছুই পাই না। তাই মনটা এক-একসময় হু হু করে ওঠে। জ্যান্তরা যদি জানত যে ভূতরা তাদের সান্নিধ্য কত পছন্দ করে, তা হলে কি তারা ভূতকে এত ভয় পেত? কখনওই না।
কিন্তু লিলি ভিলাতেও শেষ পর্যন্ত লোক এসে হাজির হল। একদিন সকালে একটা সাইকেল রিকশার হর্ন শুনে ঘর থেকে গলা বাড়িয়ে দেখি রিকশা থেকে মাল নামছে। কজন লোক? দুজন। একজন বাবু, আর একটি চাকর। তাই সই। বেশি লোকের দরকার নেই আমার। নাই-মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।
ভূতরা দূর থেকেই খুব স্পষ্ট দেখতে পায়, তাই বলছি–বাবুটির বয়স বছর পঞ্চাশের কাছাকাছি, বেঁটে, মাথায় টাক, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, ঘন ভুরু, আর ভ্রুকুটি করা চোখ। বাড়িতে ঢুকেই চাকরটিকে বাবু বললেন, সব দেখেশুনে বুঝে নাও। আধঘণ্টার মধ্যে আমার চা চাই। তারপর আমি কাজে বসব।
এই কথাগুলো অবিশ্যি আমি মালির ঘর থেকেই শুনতে পেলাম। আমরা যেমন দেখি বেশি, তেমনই শুনিও বেশি। আমাদের চোখ কান দুটোই যেন দুরবিনের মতো কাজ করে।
চাকর আধঘণ্টার মধ্যেই বাবুকে চা বিস্কুট এনে দিল। বাবু তখন বাগানের দিকের ঘরটায় তাঁর বাক্স খুলে জিনিসপত্র বার করে গুছিয়ে রাখছেন। জানালার সামনে একটা টেবিল-চেয়ার। তার উপর দোয়াত কলম কাগজ সব রাখা হয়েছে।
ইনি তা হলে লেখক। খুব নামকরা লেখক কি?
হ্যাঁ, তাই।
ভদ্রলোক আসার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেওঘরের জনা আষ্টেক বাঙালি এসে হাজির হল লিলি ভিলাতে। তখনই জানলাম ভদ্রলোকের নাম নারায়ণ শর্মা। আসল নাম না ছদ্ম তা জানি না, তবে এই নামেই সকলে তাঁকে ডাকে। বাঙালির দল নারায়ণবাবুকে দেওঘরে পেয়ে কৃতার্থ। এতবড় একজন কাউকে তো সবসময় পাওয়া যায় না। তাই, যদি ভদ্রলোকের আপত্তি না থাকে, তা হলে এখানকার সকলে তাঁকে একদিন সংবর্ধনা জানাতে ইচ্ছুক।
নারায়ণ শর্মা লোকটি দেখলাম বেশ কড়া। বললেন, এখানে নিরিবিলিতে কাজ করতে পারব বলে কলকাতা ছেড়ে এলাম, আর আসামাত্র আপনারা এসে সংবর্ধনার জন্য পীড়াপীড়ি করছেন?
একথায় অবিশ্যি সকলেই একটা কাঁচুমাচু ভাব করলেন। তাতে আবার নারায়ণ শর্মা নিজেই নরম হয়ে বললেন, বেশ, আমাকে দিন পাঁচেক একটু নির্বাটে কাজ করতে দিন, তারপর হবেখন সংবর্ধনা। বেশি বিব্রত করলে কিন্তু আমি আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে কলকাতা ফিরে যাব।
এই সময় ঘোষ বাড়ির কর্তা নিতাইবাবু হঠাৎ একটা প্রশ্ন করে বসলেন যেটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। তিনি বললেন, এখানে এত বাড়ি থাকতে আপনি লিলি ভিলায় এসে উঠলেন কেন?
নারায়ণবাবুর মুখে এই প্রথম হাসির রেখা ফুটে উঠল। তিনি বললেন, হানাবাড়ি বলে বলছেন তো? তা, ভূত যদি আসে তা হলে তো ভালই, একজন সঙ্গী পাওয়া যাবে।
আপনি বোধহয় আমাদের কথাটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না, বললেন হারু তালুকদার। কলকাতার এক ডাক্তার এখানে সপরিবারে এসেছিলেন। ভদ্রলোক নিজের চোখে দেখেছিলেন ভূত। আর সে নাকি বীভৎস ব্যাপার। প্রায় পনেরো মিনিট পরে জ্ঞান ফেরে ভদ্রলোকের। এখানে ভাল ডাকবাংলো আছে; ম্যানেজার আপনার খুব ভক্ত। বললে উনি নিজে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনি লিলি ভিলা ছাড়ুন।
এইবার নারায়ণ শর্মা একটা অদ্ভুত কথা বললেন।
আপনারা বোধহয় জানেন না যে, প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধে আমি যতটা জানি ততটা খুব কম লোকেই জানে। আমার এখানকার লেখার বিষয়ও হচ্ছে ওই প্রেততত্ত্ব। সেই ডাক্তারের অবস্থায় আমাকে কোনওদিন পড়তে হবে না এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। তিনি ভূতের বিরুদ্ধে কোনও প্রিকশন নেননি, কোনও ব্যবস্থা করেননি; আমি সেটা নেব এবং করব। ভূত আমার কিছু করতে পারবে না। আপনারা সদুদ্দেশ্য নিয়েই উপদেশ দিতে এসেছেন তা জানি, কিন্তু আমি এই লিলি ভিলাতে থেকেই কাজ করতে চাই। এ বাড়িতে আমি ছেলে বয়সে এসেছি। তখনকার অনেক স্মৃতি আমার এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ভূতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথাটা আমি এই প্রথম শুনলাম। কথাটা ভাল লাগল না। আর প্রেততত্ত্ব? ভূত নিয়েও তত্ত্ব হয় নাকি? এসব কী বলছেন নারায়ণ শর্মা?
অবিশ্যি এখন এসব ভেবে কোনও লাভ নেই। রাতটা আসুক; আপনা থেকেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে বলে আমার বিশ্বাস।
তবে এই ব্যবস্থার কথাটা শুনে অবধি আমার মন বলছিল যে খবরটা একবার–অন্তত মজা দেখার জন্যও–ভীম নস্করকে জানানো উচিত। সে জ্যান্ত মানুষের ঘাড় মটকাবার কায়দা রপ্ত করেছে; না জানি সে এ খবর শুনে কী বলবে!
বেলা যতই বাড়তে লাগল ততই আমার ছটফটানিও বেড়ে চলল। শেষটায় আর না পেরে অদৃশ্য অবস্থায় মল্লিকদের দুশো বছরের পুরনো পোড়ো বাড়িটায় গিয়ে নস্করদার নাম ধরে ডাক দিলাম। সে দোতলার পুবদিকের ছাত ভাঙা ঘরটা থেকে হাওয়ায় ভেসে নীচে এসে বেশ কড়া সুরেই বলল, এই অসময়ে কেন?
আমি তাকে নারায়ণ শর্মার কথাটা বললাম। শুনে নস্করদা প্রচণ্ড কুটি করে বলল, বটে? বলি, ব্যবস্থা কি সে একাই করতে পারে? আমরা পারি না?
কী ব্যবস্থা করবে?ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। আমি বুঝেছিলাম যে নস্করদার মাথায় ফন্দি খেলছে।
নস্করদা বলল, কেন? বেঁচে থাকতে বত্রিশ বছর ধরে ব্যায়াম করেছিলুম–ডন বৈঠক মুগুর ডামবেল চেস্ট-এক্সপান্ডার কিছুই বাদ দিইনি। নারায়ণ ছোঁকরার ঘাড় মটকাবার শক্তি কি আমার নেই?
ব্যায়াম যে সে করত সেটা ভীম নস্করকে দেখলেই বোঝা যায়। সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল; তাতে তার দেহের কোনও বিকার ঘটেনি; তাই এখনও হাত পা নাড়লে শরীরে মাংসপেশি ঢেউ খেলে যায়। আমি বললাম, তা হলে?
আমি জানি যে আমার হৃৎপিণ্ড থাকলে তা এখন ধুকপুক করত।
তা হলে আর কিছুই না, বলল নস্করদা। আজ রাত বারোটায় নারায়ণ শর্মার আয়ু শেষ। ভূতের সঙ্গে চালাকি করলে আর যেই করুক, ভূত কখনও ক্ষমা করবে না।
বাকি দিনটা যে কীভাবে কাটল তা আমিই জানি। এদিকে নারায়ণ শর্মা সারাদিন তাঁর ঘরে বসে লিখেছেন। বিকেলে সূর্য ডোবার বেশ কিছু আগে ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে উত্তরের রাস্তাটা ধরে বেশ খানিক হেঁটে আকাশে সন্ধেতারাটা বেরোবার কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ি ফিরলেন। আজ অমাবস্যা, তাই চাঁদ নেই।
আমি আমার ডেরা থেকে সবই লক্ষ করে যাচ্ছি। এবার নারায়ণ শর্মাকে দেখলাম একটা অদ্ভুত জিনিস করতে। সুটকেস খুলে একটা থলে বার করে তার থেকে একটা গুঁড়ো জিনিসের এক মুঠো নিয়ে একটা ধুনুচির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে তাতে আগুন দিয়ে ধুনুচিটা ঘরের দরজার চৌকাঠের বাইরে রেখে দিলেন। সেই ধুনুচি থেকে গলগল করে ধোঁয়া উঠতে লাগল, আর দক্ষিণের হাওয়া সেই ধোঁয়াকে সোজা এনে ফেলল আমার ডেরায়।
বাপ্ রে–এ কী ব্যবস্থা! ভূতেরা কোনও গন্ধ পায় না, কিন্তু এ গন্ধ দেখছি নাকের মধ্যে দিয়ে একেবারে ব্রহ্মতালুতে পৌঁছে গেছে। এ কী সর্বনাশ! এ অবস্থায় নস্করদাও এই বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না।
আর সত্যিই তাই হল। মাঝরাত্তির নাগাদ আমার ঘরের পিছনের পাঁচিলের ওদিক থেকে চাপা গোঙানি শুনলাম–সুধন্য! ও সুধন্য!
সুধন্য আমার নাম।
বাইরে বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে ঘাসের উপর নাক টিপে বসে আছে ভীম নস্কর। নাকিসুরেই কথা বলল সে
একুশ বছর হল গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে আমার, আর এই প্রথম জ্যান্ত লোকের কাছে হার মানতে হল। মানুষ যে এত কল করতে পারে সে তো আমার জানা ছিল না।
ও লোকটা পড়াশুনা করে, নস্করদা। ও অনেক কিছু জানে।
ও হো হো!–এমন একটা লোকের ঘাড় মটকাতে পারলে কী সুখ হত বল দিকিনি।
সে যে আর হবার নয় সে তো বুঝতেই পারছ।
তা পারছি। আজ আসি। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা হল বটে!
নস্করদা চলে গেল, আর আমিও নিজের ঘরে ফিরে এলাম। আর তার পরেই বুঝতে পারলাম যে আমার ঘুম পাচ্ছে। ভূতের চোখে ঘুম–এ যে অভাবনীয়, অবিশ্বাস্য ব্যাপার! কিন্তু তা হলে কী হবে–ওই ধোঁয়াতে এমন জিনিস আছে যে, ভূতকেও ঘুম পাড়ায়। অথচ রাতই হল ভূতের চরে বেড়াবার সময়।
আমি আর থাকতে পারলাম না। একটা ঝিমধরা অবস্থায় ঘরের মেঝেতে শুয়ে পড়লাম।
.
ঘুম ভাঙল একটা গলার শব্দে। সময়টা সকাল।
আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। বসেই সামনে তাকিয়ে চক্ষুস্থির। ইনি যে নারায়ণ শর্মা সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু এঁর এমন দশা হল কী করে?
নারায়ণ শৰ্মাই আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন।
চাকরটা ঘুম থেকে ওঠেনি দেখে স্টোভ জ্বালিয়ে চা করতে গেসলুম। স্টোভটা বাস্ট করে। ওরা বোধ হয় ওদিকে আমার মৃতদেহের সৎকারের ব্যবস্থা করছে। আমি একটা ডেরা খুঁজছিলুম, তখন এ ঘরটা দেখতে পাই। এখানে আরেকজনের ঠাঁই হবে কি?
আমি অত্যন্ত খুশি হয়ে বললাম, নিশ্চয়ই হবে।
যাক–দুই মুখ-পোড়ায় জমবে ভাল!
সন্দেশ, আষাঢ় ১৩৯২
আর এক দফা মোল্লা নাসিরুদ্দিন
১.
নাসিরুদ্দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, পাশে ফুলে ফলে ভরা বাগিচা দেখে তার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। প্রকৃতির শোভাও উপভোগ করা হবে, শর্টকাটও হবে।
কিছুদূর যেতে না যেতেই নাসিরুদ্দিন এক গর্তের মধ্যে পড়ল, আর পড়তেই তার মনে এক চিন্তার উদয় হল।
ভাগ্যে পথ ছেড়ে বনে ঢুকেছিলাম, ভাবলে নাসিরুদ্দিন। এই মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশেই যদি এমন বিপদ লুকিয়ে থাকে, তা হলে না-জানি ধুলোকাদায় ভরা রাস্তায় কত নাজেহাল হতে হত!
.
২.
মোগ্লাগিন্নি একটা শব্দ পেয়ে ছুটে গেছে তার স্বামীর ঘরে।
কী হল? কীসের শব্দ?
আমার জোব্বাটা মাটিতে পড়ে গে, বললে মোল্লাসাহেব।
তাতেই এত শব্দ?
আমি ছিলাম জোব্বার ভেতর।
.
৩.
নাসিরুদ্দিন একদিন রাজসভায় হাজির হল মাথায় এক বিশাল বাহারের পাগড়ি নিয়ে। তার মতলব সে রাজাকে পাগড়িটা বিক্রি করবে।
তোমার ওই আশ্চর্য পাগড়িটা কত মূল্যে খরিদ করলে মোল্লাসাহেব? রাজা প্রশ্ন করলেন।
সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, শাহেন শা!
এক উজির মোল্লার মতলব আঁচ করে রাজার কানে ফিসফিস করে বললে, মুগ্ধ না হলে কেউ ওই পাগড়ির জন্য অত দাম দিতে পারে না, জাঁহাপনা।
রাজা মোল্লাকে বললেন, অত দাম কেন? একটা পাগড়ির জন্য এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা যে অবিশ্বাস্য।
মূল্যের কারণ আর কিছুই না, জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, আমি জানি দুনিয়ায় কেবল একজন বাদশাই আছেন যিনি এই পাগড়ি খরিদ করতে পারেন।
তোষামোদে খুশি হয়ে রাজা তৎক্ষণাৎ মোল্লাকে দুহাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবার ব্যবস্থা করে নিজে পাগড়িটা কিনে নিলেন।
মোল্লা পরে সেই উজিরকে বললে, আপনি পাগড়ির মূল্য জানতে পারেন, কিন্তু আমি জানি রাজাদের দুর্বলতা কোথায়।
.
৪.
বোগদাদের খালিফের প্রাসাদে ভোজ হবে, তিন হাজার হোমরা-চোমরার নেমন্তন্ন হয়েছে। ঘটনাচক্রে নাসিরুদ্দিনও সেই দলে পড়ে গেছে।
খালিফের বাড়িতে ভোজ, চাট্টিখানি কথা নয়! অতিথি সৎকারে খালিফের জুড়ি দুনিয়ায় নেই। তেমনি তাঁর বাবুর্চিটিও একটি প্রবাদপুরুষ। তার রান্নার যেমনি স্বাদ, তেমনি গন্ধ, তেমনি চেহারা।
সব খাদ্যের শেষে বিরাট পাত্রে এল একেকটি আস্ত ময়ূর। দেখে মনে হবে ময়ূর বুঝি জ্যান্ত, যদিও আসলে সেগুলো রোস্ট করা। ডানা, ঠোঁট, পুচ্ছ সবই আছে, আর সবকিছুই তৈরি রঙবেরঙের উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য দিয়ে।
নিমন্ত্রিতেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে আছে রন্ধনশিল্পের এই অপূর্ব নিদর্শনের দিকে, কেউই যেন আর খাবার কথা ভাবছে না।
নাসিরুদ্দিনের খিদে এখনও মেটেনি। সে কিছুক্ষণ ব্যাপার-স্যাপার দেখে আর থাকতে না পেরে বলে উঠল, এই বিচিত্র প্রাণীটি আমাদের ভক্ষণ করার আগে আমাদেরই এটিকে ভক্ষণ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না কি?
.
৫.
নাসিরুদ্দিন একটি সরাইখানার তত্ত্বাবধায়কের কাজে বহাল হন্মেছে। একদিন সেখানে স্বয়ং সম্রাট সদলবলে এসে বললেন, তিনি ডিমভাজা খাবেন।
খাওয়া শেষ করে শাহেন শা নাসিরুদ্দিনকে বললেন, এবার শিকারে যাব। বলল কত দিতে হবে তোমাদের?
জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন, ডিমভাজার জন্য লাগবে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা। সম্রাটের চোখ কপালে উঠল। ডিম কি এখানে এতই দুষ্প্রাপ্য? তিনি প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে না জাঁহাপনা, বললে নাসিরুদ্দিন। ডিম দুষ্প্রাপ্য নয়। দুষ্প্রাপ্য সম্রাটের মতো খদ্দের।
সন্দে, আষাঢ় ১৩৮১
.
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প গ্রন্থাকারে প্রকাশকালে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ভূমিকা–
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের নামে অনেক গল্প প্রায় হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানান দেশে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের মতে এইসব গল্পের জন্ম তুরস্কদেশে, কারণ সেখানে এখনো প্রতি বছর মোল্লা নাসিরুদ্দিনের জন্মোৎসব পালন করা হয়।
মোল্লা নাসিরুদ্দিন যে ঠিক কেমন লোক ছিলেন সেটা তার গল্প পড়ে বোঝা মুশকিল। এক এক সময় তাকে মনে হয় বোকা, আবার এক এক সময় মনে হয় ভারী বিজ্ঞ। তোমাদের কী মনে হয় সেটা তোমরাই বুঝে নিও।
আর্যশেখরের জন্ম ও মৃত্যু
অনেকের মতে আর্যশেখর ছিলেন যাকে ইংরাজিতে বলে চাইল্ড প্রডিজি। তাঁর যখন দশ বছর বয়স তখন একদিন স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম পাতায় নীচের দিকে এক লাইন লেখা তাঁর চোখে পড়ল–সান রাইজেজ টুডে অ্যাট সিক্স থার্টিন এ এম। আর্যশেখর কাগজ হাতে নিয়ে পিতা সৌম্যশেখরের কাছে উপস্থিত হলেন।
বাবা।
কী রে?
কাগজে এটা কী লিখেছে।
কী লিখেছে?
ছটা বেজে তেরো মিনিটে সূর্য উঠবে।
তা তো লিখবেই। সেই সময়ই তো সূর্য উঠেছে।
তুমি ঘড়ি দেখেছিলে?
ঘড়ি দেখতে হয় না।
কেন?
জানাই থাকে।
কী করে?
বিজ্ঞানের ব্যাপার। অ্যাস্ট্রনমি।
আর যদি ঠিক সময় না ওঠে।
ঘড়ি ভুল।
যদি ভুল না হয়?
তা হলে আর কী। তা হলে প্রলয়।
সেদিন থেকে আর্যশেখরের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার সূত্রপাত। এর দুবছর পরে আবার আরেকটি প্রশ্ন নিয়ে আর্যশেখরকে পিতার কাছে যেতে হল।
বাবা।
হুঁ।
চাঁদ আর সূর্য কি এক সাইজ?
দূর বোকা।
তা হলে?
সূর্য ঢের বড়।
কত বড়?
লক্ষ লক্ষ গুণ।
তা হলে এক সাইজ মনে হয় কেন?
সূর্য অনেক দূরে, তাই।
ঠিক যতখানি দূর হলে এক সাইজ মনে হয়, তত দূরে?
হুঁ।
কী করে হল?
জানি নে বাপু। আমি তো আর সৃষ্টিকর্তা বিধাতা নই।
এখানে বলা দরকার, সৌম্যশেখর বৈজ্ঞানিক নন। তাঁর পেশা ওকালতি। বাপের সঙ্গে কথা বলে আর্যশেখর বুঝলেন চন্দ্র-সূর্যের আয়তন আপাতদৃষ্টিতে এক হওয়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। তাঁর মনে এই আকস্মিকতা প্রচণ্ড বিস্ময় উৎপাদন করল। পাঠ্যপুস্তকের কথা ভুলে গিয়ে তিনি বাপের আলমারি খুলে দশ খণ্ডে সমাপ্ত হার্মওসয়ার্থ পপুলার সায়েন্স থেকে গ্রহ নক্ষত্র সম্বন্ধে পড়তে আরম্ভ করলেন। বলা বাহুল্য, এ কাজে তাঁকে ঘন ঘন অভিধানের সাহায্য নিতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে নিরুদ্যম হননি, কারণ কল্পনাপ্রবণতার সঙ্গে একাগ্রতার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে।
তাঁর চতুর্দশ জন্মতিথিতে আর্যশেখর পিতার টেবিলের দেরাজ খুলে তিনখানা অব্যবহৃত ডায়রি বার করে তার মধ্যে সবচেয়ে যেটি বড় তার প্রথম পাতায় লিখলেন–আমার মতে সৌরজগতের অন্য কোনও গ্রহে প্রাণী থাকলেও তা মানুষের মতো কখনওই হতে পারে না, কারণ এমন চাঁদ আর এমন সূর্য অন্য কোনও গ্রহে নেই। যদি থাকত, তা হলে আমাদের মতো মানুষ সেখানে থাকত। কারণ আমার মতে চন্দ্ৰসূর্য আছে বলেই মানুষ মানুষ।
এর পরের বছর আর্যশেখর হঠাৎ একদিন খেলাচ্ছলে মুখে মুখে দুরূহ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে শুরু করলেন। যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ তো আছেই, তা ছাড়া আরও আছে যা একেবারে উচ্চমান গণিতের পর্যায়ে পড়ে। যেমন আকাশে ঘূর্ণায়মান চিল দেখে তার গতির মাত্রা, মাটি থেকে তার উচ্চতা এবং তার বৃত্তপথের পরিধি নির্ণয় করে ফেললেন আর্যশেখর। গৃহশিক্ষক মণিলাল মজুমদার ছাত্রের এই অকস্মিক ব্যুৎপত্তিতে অপ্রস্তুত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। সৌম্যশেখরও ছেলের এই কাণ্ডে যুগপৎ বিস্মিত ও পুলকিত হলেন। তাঁর এবং তাঁর কয়েকটি বন্ধু ও মক্কেলের উদ্যোগে ক্রমে শহরের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞদের দৃষ্টি আর্যশেখরের প্রতিভার দিকে আকৃষ্ট হল। প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিতের অধ্যাপক জীবনানন্দ ধর নিজে এসে সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে আর্যশেখরকে নানারকম ভাবে পরীক্ষা করে তাঁকে দীর্ঘ প্রশংসাপত্র লিখে দিয়ে গেলেন। তিনি লিখলেন, মুখে মুখে গণিতের সমস্যা সমাধানে উত্তরকালে আর্যশেখর সোমেশ বসুকে অতিক্রম করে গেলে আমি আশ্চর্য হব না। আমি এই অলৌকিক প্রতিভাসম্পন্ন বালকের দীর্ঘজীবন কামনা করি।
অতিরিক্ত আয়ের একটা সম্ভাবনা সামনে পড়লে অনেক অর্থবান ব্যক্তিও সহজে সেটাকে উপেক্ষা করতে পারে না। সৌম্যশেখরের অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, সুতরাং পুত্রের অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে আয়ের পথটা কিঞ্চিৎ সুগম করে নেবার পরিকল্পনা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। তবে ছেলেকে না জানিয়ে কিছু করার ইচ্ছা তাঁর ছিল না, তিনি আর্যশেখরকে ডেকে পাঠালেন।
ইয়ে, একটা কথা ভাবছিলাম বাবা।
কী?
আমার তো জানিসই–মানে, আজকাল যা দিন পড়েছে–সেই অনুপাতে তো খুব একটা ইয়ে হচ্ছে –মোটামুটি চলে যায় আর কি। তা তোর যখন এমন একটা ইয়ে দেখা যাচ্ছে, সবাই বাহবা দিচ্ছে, মানে এও তো ধর গিয়ে একটা ম্যাজিক! তা সেটা যদি আর পাঁচজনকে দেখাবার সুযোগ দেওয়া যায়–মানে বেশ ভাল একটা জায়গাটায়গা দেখে ভাল ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা…
বলতে বলতে এবং সেইসঙ্গে ছেলের ক্ষুব্ধ বিস্মিত ভাব দেখে সৌম্যশেখর নিজেই লজ্জা বোধ করলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য কথা থামিয়ে তারপর সুর পরিবর্তন করে বললেন, তোর যদি আপত্তি থাকে।
তা হলে কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
তামাশা আর প্রতিভা এক জিনিস নয় বাবা। পিতার ব্যবহারে আর্যশেখরের মনে নতুন প্রশ্নের উদয় হল। এমন প্রতিভাবান পুত্রের এমন হীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন বাবা হয় কী করে? পিতাপুত্রের চরিত্রের এই বৈপরীত্যই কি স্বাভাবিক, না এটা একটা ব্যতিক্রম?
আর ব্যতিক্রমই যদি হয়, তা হলে তার বৈজ্ঞানিক কারণ কী? আর্যশেখরের অবসরের অভাব ছিল না, কারণ তাঁর গাণিতিক প্রতিভা প্রকাশ পাবার কিছুদিনের মধ্যেই সৌম্যশেখর তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। এই অবসরে আর্যশেখর হেরিডিটি ও প্রজনন সম্পর্কে গম্ভীরভাবে অধ্যয়ন আরম্ভ করে দিলেন। অচিরেই তিনি জীবনের মাহাত্ম উপলব্ধি করলেন। মানুষের শরীরে কয়েকটি পরমাণুর মধ্যে তার নিজের এবং তার ঊর্ধ্বতম ও অধস্তন পুরুষ পরম্পরার আকৃতি ও প্রকৃতির নির্দেশ লুকিয়ে রয়েছে। কী আশ্চর্য!
আর্যশেখর আরেকবার বাপের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
বাবা, আমাদের বংশলতিকা নেই?
বংশলতিকা? কেন?
আছে?
থাকলেও তা উইয়ে খেয়েছে। কেন, তুই কি জাতিস্মর-টাতিস্মর হলি বলে মনে হচ্ছে?
না, ভাবছিলাম, আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ প্রতিভাবান ছিলেন কিনা। তোমার আর ঠাকুরদাদার কথা তো জানি। তার আগে?
সাতপুরুষের মধ্যে কেউ ছিলেন না, এ গ্যারান্টি দিতে পারি। তার আগের কথা জানি না।
ঘরে ফিরে এসে আর্যশেখর চিন্তা শুরু করলেন। বাপের দিকে সাতপুরুষের মধ্যে কেউ নেই। মাতৃকুলেও তথৈবচবরং সেখানে সম্ভাবনা আরও কম। গুণের দিক দিয়ে নীহারিকা দেবী অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর মহিলা। তিনি এখনও তাঁকে খোকা বলে সম্বোধন করেন বলে আর্যশেখর পারতপক্ষে তাঁর কাছে। ঘেঁষেন না।
হেরিডিটির প্রভাব অনিশ্চিত। পরিবেশ? এনভায়রনমেন্ট? তেত্রিশ নম্বর পটুয়াটোলা লেন কি সেদিক দিয়ে খুব প্রশস্ত বলা চলে? বোধহয় না। তা হলে?
কিন্তু শুধুমাত্র হিসেব দিয়েই কি সত্যিকার কিছু প্রমাণ হয়? বাবার বাবা তার বাবা করে বংশলতিকা জিনিসটাকে তো টেনে একেবারে সৃষ্টির আদিতে নিয়ে যাওয়া যায়। জিনের প্রভাব কি তখন থেকেই প্রবাহিত হয়ে আসছে না? কে জানে আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ কে বা কেমন ছিলেন! এমনও তো হতে পারে তিনি আলতামিরার গুহায় দেয়ালে বাইসনের ছবি এঁকেছিলেন। এইসব আদিম গুহা চিত্রকরদের জিনিয়াসের পর্যায়ে ফেলা যায় না? অথবা হরপ্পা মহেনজোদরোর মতো শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন যাঁরা তাঁদের? অথবা বেদ উপনিষদের রচয়িতাদের? এঁদের মধ্যে কেউ যদি আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ হয়ে থাকেন তা হলে আর চিন্তার কোনও কারণ থাকে না। কিন্তু তবু তাঁর মনটা খচখচ করতে লাগল। সৌম্যশেখরের মতো কল্পনা-বিমুখ বৈষয়িক-চিন্তাসর্বস্ব স্থূল ব্যক্তি যে তাঁর জন্মদাতা হতে পারেন, এর কোনও বৈজ্ঞানিক সমর্থন তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
ভাবতে ভাবতে সহসা একটি সম্ভাবনা এসে তাঁর মনে দুরমুশের মতো আঘাত করল।
তিনি যদি জারজ সন্তান হয়ে থাকেন? যদি সৌম্যশেখরের ঔরসে তাঁর জন্ম না হয়ে থাকে?
কথাটা মনে হতেই আর্যশেখর বুঝলেন, এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র তাঁর বাবাই দিতে পারেন এবং সে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। সত্যান্বেষণের খাতিরে পুত্র পিতাকে প্রশ্ন করবে, এটা আর্যশেখরের কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হল।
নশো চব্বিশ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ ল ডাইজেস্টে নিমগ্ন সৌম্যশেখর পুত্রের প্রশ্ন প্রথমবার অনুধাবন করতে পারলেন না।
যমজ সন্তান? কার কথা বলছিস?
যমজ নয়, জারজ। আমি জানতে চাই আমি জারজ সন্তান কিনা।
একথায় সৌম্যশেখরের ওষ্ঠদ্বয় বিভক্ত হল। তারপর তাতে কম্পনের আভাস দেখা দিল। তারপর সে কম্পন তাঁর সমস্ত দেহে সঞ্চারিত হল। তারপর তাঁর কম্পমান ডান হাত কাছে আর কিছু না পেয়ে একটি ভারী কাঁচের পেপারওয়েট তুলে আর্যশেখরের দিকে নিক্ষেপ করল। আর্যশেখর আনাদ করে রক্তাক্ত মস্তকে ভূলুণ্ঠিত হলেন।
আরোগ্যলাভের পর বোঝা গেল আর্যশেখরের অলৌকিক গাণিতিক প্রতিভাটি নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল।
.
আর্যশেখরের যখন উনিশ বছর বয়স, তখন একদিন সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে একটি শিরীষ গাছের নীচে উপবিষ্ট অবস্থায় বৃক্ষস্থিত কোনও পক্ষীর বিষ্ঠা তাঁর বাম স্কন্ধে এসে পড়ায় তিনি সহসা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলেন। যথারীতি তিনি এ বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাঁর ধারণা ছিল নিউটনের আপেলের ঘটনাটা বুঝি কিংবদন্তি। প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের নিজের লেখায় সে ঘটনার উল্লেখ দেখে তাঁর ধারণার পরিবন হল। তাইকো ব্রাহি গ্যালিলিও থেকে শুরু করে কোপারনিকাস, কেপলর, লাইবনিৎস-এর রাস্তা দিয়ে ক্রমে আর্যশেখর আইনস্টাইনে পৌঁছে গেলেন। আর্যশেখরের বিদ্যায় আইনস্টাইন জীর্ণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু পাঠ্য-অপাঠ্য বোধ্যদুর্বোধ্য সবরকম পুস্তকই আদ্যোপান্ত পাঠ করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল আর্যশেখরের। অবিশ্যি বর্তমান ক্ষেত্রে তাঁর পড়ার আগ্রহের একটা কারণ ছিল এই যে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে কিনা। আইনস্টাইন পড়ে এইটুকু তিনি বুঝলেন যে মাধ্যাকর্ষণ কী তা জানা গেলেও মাধ্যাকর্ষণ কেন, তা এখনও জানা যায়নি। তিনি স্থির করলেন, এই কের অম্বেষণই হবে আপাতত তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
।সেইদিনই আর্যশেখর স্থির করলেন যে, তিনি যাবতীয় তুচ্ছ ঘটনার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। অনেক আবিষ্কারের পশ্চাতেই যে নিউটনের আপেলের মতো একটি করে তুচ্ছ ঘটনা রয়েছে, এটা তাঁর জানা ছিল।
দুঃখের বিষয়, প্রায় তিন মাস ধরে সহস্রাধিক তুচ্ছ ঘটনা লক্ষ করেও তিনি তাদের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেলেন না, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক আগেই হয়ে যায়নি। অগত্যা আর্যশেখরকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হল। উপলব্ধির আদিতে ধ্যান–এই বিশ্বাসে তিনি তাঁর বাড়ির তিনতলার ছাতে চিলেকোঠায় গিয়ে ধ্যানস্থ হতে মনস্থ করলেন।
প্রথম দিনই–সেদিন ছিল রবিবার, ছাতে উঠে চিলেকোঠার তক্তপোশে বসে চক্ষু মুদ্রিত করার অব্যবহিত পূর্বে জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির ছাতে একটি তুচ্ছ ঘটনা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রতিবেশী ফণীন্দ্রনাথ বসাকের সপ্তদশ বর্ষীয়া কন্যা ডলি বাহু উত্তোলন করে ধৌতবস্ত্র রজ্জুতে আলম্বিত করছে। এই দৃশ্যে মুহূর্তের মধ্যে আর্যশেখরের মন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত এক আশ্চর্য নতুন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
সাতদিনের মধ্যে ফুলস্ক্যাপ কাগজের একশো তেত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি প্রবন্ধে তিনি তাঁর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করলেন। বর্তমান সংক্ষিপ্ত জবানিতে তার বিস্তারিত বিবরণ সম্ভব নয়, তবে তাঁর মূল বক্তব্য ছিল এই। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব নিম্নগামী। মাধ্যাকর্ষণের মতো জীবনবিরোধী শক্তি সত্ত্বেও প্রাণ সৃষ্টি হল কী করে? তার কারণ সূর্য। কিন্তু সূর্যের প্রভাব চিরস্থায়ী নয়, পার্থিব মাধ্যাকর্ষণের নৈকট্য ও অবিরাম প্রভাব ক্রমে সূর্যের প্রভাবকে পরাভূত করে। ফলে প্রথমে জরার প্রকোপ এবং শেষে মৃত্যু এসে প্রাণশক্তিকে গ্রাস করে। শুধু যে জড়পদার্থেই এই দুই প্রভাবের পরস্পর বিরোধ দেখা যায় তা নয়; মানুষের কাজে, চিন্তায়, হৃদয়াবেগে, মানুষে মানুষে সম্পর্কে–সবকিছুতেই এটা বর্তমান। মানুষের যত হীন প্রবৃত্তি, সমাজের যত অনাচার অবিচার দুঃখ দারিদ্র যুদ্ধবিগ্রহ, সবই মাধ্যাকর্ষণজনিত। আর যা কিছু সুন্দর ও সতেজ, যা কিছু উন্নত, যা কিছু মঙ্গলকর, সবই সূর্যের প্রভাবে। মাধ্যাকর্ষণ আছে বলেই কোনওদিন পৃথিবীর কলঙ্ক দূর হবে না। অনেকদিন আগেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত–কিন্তু সূর্য তা হতে দেয়নি। ধ্বংসের পাশে সৃষ্টির কাজ চলে এসেছে আবহমান কাল থেকে।
প্রবন্ধটি শেষ করে আর্যশেখর চিলেকোঠা থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে সূর্যের উদ্দেশে, তারপর প্রতিবেশী ডলির উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। ঠিক সেই সময় চাকর ভরদ্বাজ এসে বলল তাঁর বাপ নীচে ডাকছেন।
সৌম্যশেখর কদিন থেকেই ছেলে সম্পর্কে চিন্তা করছিলেন। স্ত্রী নীহারিকার মৃত্যু হয়েছে গত বছর। ছেলের একটা হিল্লে দেখে যেতে পারলেন না বলে মৃত্যুশয্যায় তিনি আক্ষেপ করেছিলেন।
হাতের কাগজ পাকিয়ে নিয়ে আর্যশেখর বাপের সামনে এসে দাঁড়ালেন
তুই কী হচ্ছিস বল তো? সাপ না ব্যাঙ না বিচ্ছু?
সেটা আমার জিনের স্বরূপ না বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে না।
কীসের স্বরূপ?
জিন।
তোর তো অর্ধেক কথার মানেই বুঝি না।
সবাই তো সবকিছু বোঝে না। আমি কি ওকালতির কিছু বুঝি?
আমার ওকালতির জোরে খাচ্ছ সেটা বোঝো তো? তবে তোমার যা বয়স তাতে বসে বসে বাপের পয়সায় খাওয়াটায় কোনও বাহাদুরি নেই। কাজেই ওসব জিনফিন বলতে এসো না আমার কাছে। তুমি ছাতের ঘরে বসে যাই করো না কেন, এটা জেনে রেখো যে, আর পাঁচটা বাউণ্ডুলে বখাটে বেকারের সঙ্গে তোমার কোনও প্রভেদ নেই। আর এক বছর সময় দিলাম। তার মধ্যে যা তোক একটা চাকরি দেখে নেবে। ডিগ্রি-ফিগ্রি যখন হল না তখন বেশি কিছু আশা করি না আমি। তবে স্বাবলম্বী তোমায় হতে হবে। তারপর অন্য কাজ।
অন্য কী কাজ?
বংশবৃদ্ধির কথাটাও তো ভাবতে হবে। না কি তুমি বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ। করবে না?
না। কেন, সেটা জানতে পারি? প্রথমত, আমার প্রজনন ক্ষমতা সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। সৌম্যশেখরের বিষম লাগল। আর্যশেখর তাঁকে প্রকৃতিস্থ হবার সময় দিলেন। দ্বিতীয়ত, আমার জীবনের মধ্যাহ্নে যখন সূর্যের প্রভাব সবচেয়ে প্রবল, তখন আমার কাজ ও চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটে এটা আমি চাই না।
তুই কি কোনও ধর্মে-টর্মে দীক্ষা নিয়েছিস নাকি?
তা বলতে পারো।
কী ধর্ম?
সেটা আমার ব্যক্তিগত ধর্ম। নামকরণ এখনও হয়নি।
মুহূর্তকালের জন্য সৌমশেখরের আশা হয়েছিল যে, তিনি বুঝি পুত্রের রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে। এখন বুঝলেন, সেটা ঠিক না। কিছুক্ষণ তিনি ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। বিশেষ করে তার চোখের দিকে দৃষ্টিতে পাগল হবার কোনও লক্ষণ আছে কি? সৌম্যশেখরের প্রপিতামহ শেষজীবনে উন্মাদ হয়ে এক মহাষ্টমীর দিন উলঙ্গ অবস্থায় গ্রামসুদ্ধ লোকের সামনে পূজামণ্ডপে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর্যশেখরকে এ ঘটনা তিনি কখনও বলেননি। সৌম্যশেখরের মনে পুত্র সম্বন্ধে একটা স্নিগ্ধ করুণার ভাব জেগে উঠল। হাজার হোক একমাত্র ছেলে, সবেধন নীলমণি। যা করছে করুক–বেঁচে থাকলেই হল। আর মাথাটা খারাপ না হলেই হল!
ঠিক আছে। তুমি এসোখন।
আর্যশেখর প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ইংরাজিতে–কারণ এ জাতীয় লেখার কদর কোনও বাঙালি পাঠক করবে একথা তিনি বিশ্বাস করেননি। এবার তিনি সৌম্যশেখরের পুরনো রেমিংটনের সাহায্যে অপটু হাতে অনেক পরিশ্রমে প্রবন্ধটির চার কপি টাইপ করলেন। শেষ হলে পর তিনি অনুভব করলেন, তাঁর হাত-পা কোমর-পিঠে টান ধরে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া একটানা ঘরের মধ্যে থেকে-থেকে দমও প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে।
আর্যশেখর হাত থেকে নেমে এলেন। গোলদিঘির ধারে একটু হেঁটে আসবেন মনে করে বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখলেন, গেরুয়া পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত শ্মশ্রুগুলম্বাকেশবিশিষ্ট একটি শ্বেতাঙ্গ যুবক তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে দেখছে।
আর্যশেখরকে দেখে যুবক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মহাবোধি সোসাইটির অবস্থানটা তাঁর জানা আছে কিনা। আর্যশেখর বললেন, চলো তোমায় আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি ওদিকেই যাচ্ছি।
যাবার পথে আর্যশেখর যুবকের পরিচয় পেলেন। তাঁর নাম বব গুডম্যান। নিবাস টোলিডো ওহায়ো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো ত্যাগ করে ভারতবর্ষে এসেছেন প্রেম ও আলোর সন্ধানে।
আর্যশেখরের ছেলেটিকে ভাল লাগল। সেইদিনই রাত্রে তাঁকে তাঁর প্রবন্ধটি পড়তে দিলেন। বললেন, তুমিই প্রথম আমার এ লেখা পড়ছ। তোমার মন্তব্য জানার আগ্রহ রইল।
.
পরদিন সকালে গুডম্যান ফুলস্ক্যাপের তাড়া ঝোলায় নিয়ে চিনাবাদাম খেতে খেতে এসে বললেন–ইটস্ গ্রেট, গ্রেট। ইয়্যা–ইউ গট সামথিং দেয়ার–ইয়্যা।
আর্যশেখর চাপা গলায় তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়ার পর গুডম্যান বললেন, কিন্তু তোমার লেখায় এত পেসিমিজম কেন? মাধ্যাকর্ষণকে পরাস্ত করার কত উপায় তো তোমার দেশেই রয়েছে। তুমি লেভিটেশনের কথা জানো না? তোমাদের দেশের যোগী পুরুষদের কথা তুমি জানো না?
গুডম্যান এবার তাঁর ঝোলা থেকে একটি কাগজের মোড়ক বার করে আর্যশেখরের হাতে দিলেন। মোড়ক খুলে দেখা গেল তাতে রয়েছে একটি চারচৌকো চিনির ডেলা। অন্তত দেখলে তাকে চিনি বলেই মনে হয়। গুডম্যান বললেন, এটা সুগার কিউবই বটে, কিন্তু এর মধ্যে এককণা অ্যাসিড রয়েছে। মাধ্যাকর্ষণকে জব্দ করার মতো এমন জিনিস আর নেই। তুমি খেয়ে দেখো। নানান প্রতিক্রিয়া হবে–ভয়। পেয়ো না। আমার মনে হয় এটা খেলে পর তোমার মন থেকে পেসিমিজম দূর হয়ে যাবে।
গুডম্যান প্রদত্ত মোড়কটি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে আর্যশেখর সটান চলে গেলেন তিনতলার ছাতে। আশ্বিনের অপরাহে স্নিগ্ধ পড়ন্ত রোদে মাদুরে বাবু হয়ে বসে তিনি চিনির ডেলাটি মুখে পুরে চিবোতে আরম্ভ করলেন।
কয়েক ঘণ্টা কিছুই হল না। তারপর এক সময়ে আর্যশেখর অনুভব করলেন তিনি সূর্যের দিকে উখিত হচ্ছেন। এক অনির্বচনীয় মাদকতায় তাঁর দেহমন আচ্ছন্ন হল। নীচের দিকে চেয়ে দেখলেন ধূলি-ধূধূসর। কলকাতা শহরকে তেহেরানের গালিচার মতো বর্ণাঢ্য ও মনোরম দেখাচ্ছে। মাথার উপরের আকাশ সর্পিল। গতিবিশিষ্ট অজস্র বিচিত্র বর্ণখণ্ডে সমাকীর্ণ। আর্যশেখর বুঝলেন সেগুলো ঘুড়ি, কিন্তু এমন ঘুড়ি তিনি কখনও দেখেননি। একটি বর্ণখণ্ড তাঁর দিকে এগিয়ে এল। আর্যশেখর পরম আত্মীয়তাবোধে বাহু সম্প্রসারিত করে সেই বর্ণখণ্ডের দিকে নিজেকে নিক্ষেপ করলেন। তারপর তাঁর আর কিছু মনে নেই।
ডাক্তার বাগচির নির্দেশমতো ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে মিহিজাম যাবার আগে আর্যশেখর একজন পেশাদার টাইপিস্টকে দিয়ে তাঁর মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত প্রবন্ধটি পঞ্চাশ কপি টাইপ করিয়ে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের বাছাই করা বিজ্ঞানী ও মনীষীদের পাঠালেন। এই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজনের উত্তর মিহিজাম যাবার ঠিক আগের দিন আর্যশেখরের হস্তগত হল। ইংল্যান্ডের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত পদার্থবিদ প্রফেসার কারমাইকেল প্রবন্ধের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে লিখেছেন–আই ফাউড ইট মোস্ট ইন্ট্রিগিং।
মিহিজাম পর্বের ঘটনা সংক্ষিপ্ত, সুতরাং তার বিবরণও সংক্ষিপ্ত হতে বাধ্য।
১৯শে অক্টোবর–অর্থাৎ মিহিজাম পৌঁছবার পরের দিন আর্যশেখর ডায়রিতে লিখলেন–পাখি পাখি পাখি পাখি। পাখি ইজ পাখি। মোস্ট ইন্ট্রিগিং; সূর্যের সবচেয়ে কাছে যায় কোন প্রাণী? পাখি। ও বার্ড, হাউ ইয়োর ফ্লাইট ক্লাউটস মাধ্যাকর্ষণ!
২রা নভেম্বর চাকর ভরদ্বাজ দেখল আর্যশেখর কোত্থেকে জানি একটা বাবুইয়ের বাসা নিয়ে এসে বিছানার উপর পা ছড়িয়ে বসে গভীর মনোযোগে বাসার বুনন-পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
পরের দিন আর্যশেখর নিজেই খড়কুটো সংগ্রহ করে এনে নিজের হাতে একটি বাবুইয়ের বাসা তৈরি করতে শুরু করলেন। সেদিন রাত্রে তাঁর ডায়রিতে লেখা হল–
ম্যানস হাইয়েস্ট অ্যাচিভমেন্ট উড বি টু রাইজ টু দ্য লেভেল অফ বার্ডস।
১৩ই নভেম্বর বাবুর ফেরার দেরি দেখে ভরদ্বাজ তাঁকে খুঁজতে বেরোলো। আধঘণ্টা খোঁজার পর আর্যশেখরকে সে পেল অজ্ঞান অবস্থায় ধানখেতের পাশে একটি বাবলা গাছের নীচে। গাছে একটি কাঁটার সঙ্গে বাঁধা তৈরি বাবুইয়ের বাসা।
স্থানীয় ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, সানস্ট্রোক। সৌম্যশেখর কলকাতা থেকে চলে এলেন। তিনদিন ঘোর বিকারের পর পিতা ও ভৃত্যের সামনে আর্যশেখরের মৃত্যু হল।
শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার ঠিক আগে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন আর্যশেখর–মাগো!
শারদীয়া অমৃত ১৩৭৫
ইহুদির কবচ
১.
প্রাচ্যের পুরাতত্ত্ব সম্পর্কে আমার বিশিষ্ট বন্ধু ওয়র্ড মর্টিমারের জ্ঞান ছিল অসামান্য। সে এ বিষয়ে বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছিল, মিশরের ভ্যালি অফ দ্য কিংস-এ খননকার্য তদারকের সময় একটানা দু বছর থিবিসের একটি সমাধিগৃহে বাস করেছিল, আর যে কাজটা করে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগিয়েছিল, সেটা হল ফাইলিতে হোরাসের মন্দিরের একটি ভিতরের ঘরে ক্লিওপ্যাট্রার মমি আবিষ্কার। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে যে লোক এত কিছু করতে পেরেছে, তার ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল হতে বাধ্য, সেটা প্রায় সকলেই বিশ্বাস করত। তাই মর্টিমার যখন বেলমোর স্ট্রিট মিউজিয়মের তত্ত্বাবধায়কের কাজটা পেল, তখন কেউই বিশেষ অবাক হয়নি। এই পদ যিনি পাবেন, তিনি সেইসঙ্গে ওরিয়েন্টাল কলেজের অধ্যাপকের পদেও অধিষ্ঠিত হবেন, এবং তার ফলে তাঁর মাসিক রোজগার যা হবে, তাতে সচ্ছল জীবনযাত্রার সঙ্গে গবেষণার কাজও চালানো যায়।
শুধু একটা কারণেই ওয়র্ড মর্টিমার কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করছিল। সেটা হল, যে-তত্ত্বাবধায়কের স্থান সে দখল করেছিল, তাঁর অতুল খ্যাতি। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ, এবং খ্যাতি সারা ইউরোপ জোড়া। দেশ-বিদেশ থেকে তরুণ ছাত্ররা আসত তাঁর বক্তৃতা শুনতে। তা ছাড়া মিউজিয়মের মহামূল্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য তিনি যে ব্যবস্থা করেছিলেন, সকলেই একবাক্যে তার প্রশংসা করত। ফলে পঞ্চান্ন বছর বয়সে তিনি হঠাৎ এমন একটি চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে সকলেই বেশ অবাক হয়েছিল। ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাড্রিয়াস স্বভাবতই তাঁর মেয়েকে নিয়ে মিউজিয়ম-সংলগ্ন তাঁর বাসস্থান ত্যাগ করে চলে যান, আর তাঁর ঘরগুলি দখল করে আমার অকৃতদার বন্ধু ওয়র্ড মর্টিমার। চাকরিটা পাবার কয়েকদিনের মধ্যেই মর্টিমারকে চিঠি লিখে অভিনন্দন জানালেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। যেদিন প্রথম এই দুজনের পরিচয় হয় পরস্পরের সঙ্গে, সেদিন আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। অ্যাড্রিয়াস সেদিন তাঁর সংগ্রহশালার আশ্চর্য জিনিসগুলি আমাদের দেখালেন। প্রোফেসরের সুন্দরী মেয়ে এবং উইলসন নামে একটি যুবক (বোঝাই যাচ্ছিল। ইনি অধ্যাপক-দুহিতার পাণিপ্রার্থী) আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সংগ্রহশালায় সবসুদ্ধ পনেরোটি ঘর; তার মধ্যে ব্যাবিলন ও সিরিয়ার সভ্যতা সংক্রান্ত দুটি, আর সংগ্রহশালার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত প্রাচীন মিশরীয় ও ইহুদি সভ্যতা সংক্রান্ত একটি ঘরই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস এমনিতে চুপচাপ মানুষ, কিন্তু তাঁর সংগ্রহের প্রিয় জিনিসগুলি দেখাবার সময় তাঁর শ্মশুগুহীন শুকনো মুখখানা উৎসাহে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পুরাতত্ত্বের এই মহামূল্য নিদর্শনগুলির উপর থেকে তাঁর হাত যেন আর সরতে চায় না। বেশ বোঝা যায় সেগুলি তাঁর গর্বের বস্তু, এবং সেগুলি অন্যের আওতায় চলে যাওয়াটা যেন তাঁর পক্ষে এক মর্মান্তিক ঘটনা।
তাঁর সংগ্রহশালার মমিগুলি, তাঁর প্রাচীন পুঁথির সম্ভার, তাঁর স্ক্যারাবের সংগ্রহ, ইহুদি সভ্যতার যাবতীয় নিদর্শন, আর টাইটাস কর্তৃক রোম শহরে আনা বিখ্যাত সপ্তপ্রদীপের অবিকল প্রতিরূপ (আসলটি টাইবার নদীগর্ভে নিমজ্জিত)–এ সবই একের পর এক আমাদের দেখালেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। তারপর তিনি হলঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা একটি শো-কেসের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে গভীর সম্ভ্রমের সঙ্গে তার উপর ঝুঁকে পড়লেন।
আপনার মতো বিশেষজ্ঞের পক্ষে এ জিনিসটা হয়তো তেমন বিস্ময়কর কিছু নয়, মর্টিমারকে উদ্দেশ করে বললেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস, কিন্তু আপনার বন্ধু মিঃ জ্যাকসনের পক্ষে হওয়া উচিত।
এবার আমিও কাঁচের আবরণের উপর ঝুঁকে পড়ে দেখলাম, কেসের ভিতর রাখা রয়েছে হাতের তেলোর মতো বড় সূক্ষ্ম কারুকার্য করা একটি চতুষ্কোণ সোনার পাত, যার উপর তিন সারিতে চারটি-চারটি করে পাথর বসানো। পাতটির একদিকে দুই কোণে দুটি সোনার আংটা। সমান আয়তনের পাথরগুলো প্রত্যেকটি আলাদা জাতের এবং রঙের। রঙের বাক্সে পাশাপাশি খোপে খোপে যেমন বিভিন্ন রঙ সাজানো থাকে, এ যেন কতকটা সেইরকম। এও দেখলাম যে, প্রত্যেকটি পাথরের উপর একটি করে বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন খোদাই করা আছে।
মিঃ জ্যাকসন, আপনি কি উরিম ও থুমিমের কথা জানেন?
নামগুলো আমার চেনা, কিন্তু তাদের মানে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।
প্রোফেসর বললেন, ইহুদিদের প্রধান পুরোহিতের বুকে যে কবচটা ঝুলত, তাকেই বলা হত উরিম ও থুমিম। ইহুদিরা এই কবচের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করত, যেমন রোমানরা করত ক্যাপিটলে রাখা সিবিলাইন পুঁথিগুলির প্রতি। সাংকেতিক চিহ্ন-আঁকা বারোটি মহামূল্য রত্ন দেখতে পাচ্ছেন। উপরে বাঁ দিক থেকে শুরু করে পাথরগুলি হল কার্নেলিয়ান, পেরিডট, এমারেল্ড, রুবি, ল্যাপিস ল্যাজুলি, অনিক্স, অ্যাগেট, অ্যামেথিস্ট, টোপ্যাজ, বেরিল আর জ্যাসপার।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম মণিমুক্তোখচিত মহামূল্য কবচটার দিকে। শেষে প্রশ্ন করলাম, এই কবচের সঙ্গে কি কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িত আছে?
জিনিসটা যে অতি প্রাচীন এবং অতি মূল্যবান, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বললেন, প্রোফেসর। অ্যান্ড্রিয়াস। অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও আমরা নানা কারণে বিশ্বাস করি যে, এটা সেই সলোমনের মন্দিরের আদি ও অকৃত্রিম উরিম ও থুমিম। এ জিনিস ইউরোপের কোনও মিউজিয়মে নেই। আমার তরুণ বন্ধু ক্যাপ্টেন উইলসন মণিমুক্তো সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। উনিই বলবেন এই পাথরগুলো কত খাঁটি।
তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্যাপ্টেন উইলসন দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর ভাবী পত্নীর পাশেই। অল্প কথায় তিনি তাঁর মনের ভাব ব্যক্ত করলেন।
সত্যি কথা। আমি এর চেয়ে ভাল পাথর আর দেখিনি।
স্বর্ণকারের কাজও দেখার মতো, বললেন অ্যান্ড্রিয়াস। অতীতে স্বর্ণকারেরা–
প্রোফেসরের কথার উপর কথা চাপিয়ে উইলসন বললেন, ওর চেয়ে ভাল সোনার কাজের নিদর্শন দেখা যাবে এই মোমবাতিদানে। তাঁর দৃষ্টি এখন অন্য একটি টেবিলের দিকে। আমরা সকলেই শাখা-প্রশাখা-বিশিষ্ট সোনার বাতিদানটার আশ্চর্য কারুকার্যের প্রশংসায় উইলসনের সঙ্গে গলা মেলালাম।
অ্যান্ড্রিয়াসের মতো বিশেষজ্ঞের চোখ দিয়ে এইসব আশ্চর্য জিনিস দেখা পরম সৌভাগ্যের কথা। সত্যি বলতে কি, সবকিছু দেখা শেষ হলে পর প্রোফেসর যখন আমার বন্ধুকে জানালেন যে, এখন থেকে এ সবই তার জিম্মায় চলে যাচ্ছে, তখন ভদ্রলোকের জন্য বেশ কষ্টই হচ্ছিল, আর সেইসঙ্গে আমার বন্ধুর সৌভাগ্যকে খানিকটা ঈষার চোখে না দেখে পারছিলাম না। এক সপ্তাহের মধ্যেই ওয়র্ড মর্টিমার বেলমোর স্ট্রিট মিউজিয়মের অধিকর্তা হিসাবে তার নতুন বাসস্থানে উঠে গেল।
এর দিন পনেরো পর মর্টিমার তার জনা-ছয়েক অকৃতদার বন্ধুদের সঙ্গে তার নতুন বাড়িতে একটা ভোজের আয়োজন করল। শেষে যখন সবাই যাবার জন্য উঠে পড়েছে, তখন মর্টিমার আমার কোটের আস্তিন ধরে একটা ছোট্ট টান দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, সে চায় আমি আর একটুক্ষণ থাকি।
তোমার বাড়ি তো এখান থেকে দশ-পা, বলল মর্টিমার (আমি তখন অ্যালব্যানিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি)–তুমি একটু থেকে যাও। চুরুট সহযোগে দুজনে নিরিবিলি কথা হবে। একটা ব্যাপারে তোমার পরামর্শের দরকার।
অগত্যা আমি একটি আরাম কেদারায় বসে মর্টিমারের একটি উৎকৃষ্ট ম্যাট্রোনাস চুরুট ধরালাম। সবাই চলে যাবার পরে সে পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে আমার সামনে বসল।
এই নামবিহীন চিঠিটা আজই সকালে এসেছে, বলল মর্টিমার। আমি পড়ে শোনাচ্ছি, তারপর তুমি বলো এ ব্যাপারে আমার কী কর্তব্য।
বেশ তো আমার সাধ্যমতো পরামর্শ দিতে আমি প্রস্তুত।
চিঠিটা হচ্ছে এই–মহাশয়, আপনার জিম্মায় যে সমস্ত মহামূল্য সম্পদ রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে আপনাকে বিশেষ সাবধান হতে বলি। বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী একটিমাত্র পাহারাদারে কাজ হবে বলে আমি মনে করি না। আপনি এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন না করলে অপূরণীয় ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে।
এই কি পুরো চিঠি?
হ্যাঁ।
অন্তত এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, তোমাদের ওখানে রাত্রে যে একটিমাত্র পাহারাদার থাকে, সে-খবরটা মুষ্টিমেয় যে কজন জানে, তাদেরই একজন লিখেছে এ চিঠি।
মর্টিমার এবার একটা রহস্যজনক হাসি হেসে চিঠিটা আমার হাতে দিল।
হস্তলিপি ব্যাপারটা নিয়ে তুমি কোনও চর্চা করেছ? প্রশ্নটা করে মর্টিমার আর-একটা চিঠি আমার সামনে রেখে বলল, এটার কনগ্রাচুলেটে সি-এর সঙ্গে ওটার কমিটেড-এর সি মিলিয়ে দেখো। ক্যাপিটাল আই-টাও লক্ষ করো, আর ফুলস্টপের জায়গায় ড্যাশ-চিহ্ন ব্যবহার করাটা। আমি বললাম, দুটো চিঠি নিঃসন্দেহে একই লোকের লেখা, যদিও প্রথমটায় হাতের লেখা গোপন করার একটা প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় চিঠিটা হচ্ছে আমার এই নতুন চাকরিটা পাবার খবর পেয়ে প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াসের অভিনন্দন পত্র।
আমি অবাক হয়ে চাইলাম মর্টিমারের দিকে, তারপর দ্বিতীয় চিঠিটা ওলটাতেই মার্টিন অ্যান্ড্রিয়াস সইটা চোখে পড়ল। যে তোক হাতের লেখা নিয়ে সামান্যতম চচাও করেছে, তার মনে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না যে, প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসই মিউজিয়মের সদ্য-ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ককে চুরির ব্যাপারে সাবধান হতে বলে এই নামহীন চিঠিটা লিখেছেন। ঘটনাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।
কিন্তু ভদ্রলোক এমন চিঠি লিখবেন কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।
ঠিক এই প্রশ্নই আমি করতে চাই তোমাকে। তাঁর মনে যদি এ ধরনের আশঙ্কা থেকেই থাকে, তা হলে তো তিনি নিজে এসে আমাকে বলতে পারতেন।
তুমি কি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাও?
সেখানেও তো গণ্ডগোল। উনি তো সোজাসুজি অস্বীকার করতে পারেন যে, চিঠিটা উনি লেখেননি।
যাই হোক–এ চিঠির উদ্দেশ্য যে সৎ, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। উনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটা মানতে কোনও বাধা আছে কি? এখন যে ব্যবস্থা চালু আছে, সেটা কি সতর্কতার দিক দিয়ে যথেষ্ট?
আমার তো তাই বিশ্বাস। দর্শকদের জন্য মিউজিয়ম খোলা থাকে দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত। সেই সময়টা পাশাপাশি দুটো ঘরের জন্য একটি করে গার্ড মোতায়েন থাকে। দুটো ঘরের মাঝখানে যে দরজা–সেখানে দাঁড়ায় গার্ড, ফলে একসঙ্গে দুটো ঘরেই সে চোখ রাখতে পারে।
কিন্তু রাত্রে?
পাঁচটার পর লোহার গেটগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে গেট খোলার সাধ্যি কোনও চোরের নেই। যে পাহারা দেয়, সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক। সে তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সারা মিউজিয়মটা টহল দেয়। প্রত্যেকটি ঘরে একটি করে বিজলিবাতি সারারাত জ্বলে।
তা হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে গার্ডগুলিকে রাত্রেও রেখে দেওয়া।
সেটা খরচে পোষাবে না।
অন্তত পুলিশে খবর দিয়ে বললো যে, বেলমোর স্ট্রিটে তারা যেন একটি বিশেষ কনস্টেবলের ব্যবস্থা করে। এই চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি যদি তাঁর পরিচয় গোপন করতে চান, তা হলে কিছু বলার নেই। কেন তিনি এটা চাইছেন, সেটা আশা করি এর পর কী ঘটে তার থেকেই বোঝা যাবে।
এর পর অবিশ্যি এ বিষয়ে আলোচনা করার আর কিছু রইল না। আমি বাড়ি ফেরার পর সারারাত মাথা ঘামিয়েও প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের চিঠির পিছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী, সেটা বুঝতে পারলাম না। এ চিঠি যে তাঁরই লেখা সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। মিউজিয়মে যে চোরের উপদ্রব হতে পারে, সেটা তিনি আঁচ করেছিলেন; সেই কারণেই কি তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন? কিন্তু তাই যদি হয়, তা হলে সরাসরি মর্টিমারকে সতর্ক করলেন না কেন? আমি অনেক ভেবেও রহস্যের কিনারা করতে না পেরে শেষরাত্রে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, ফলে আমার উঠতেও দেরি হয়ে গেল।
ঘুমটা ভাঙলও আশ্চর্যভাবে। নটা নাগাদ মর্টিমার হন্তদন্ত হয়ে এসে আমার দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকল। তার চাহনিতে গভীর উদ্বেগ। এমনিতে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে মর্টিমার খুব পরিপাটি। কিন্তু আজ দেখি তার শার্টের কলার প্রায় খুলে এসেছে, গলার টাই আর মাথার টুপিরও প্রায় সেই দশা। তার সন্ত্রস্ত দৃষ্টি থেকে মোটামুটি বোঝা যায় কী ঘটেছে।
আমি তৎক্ষণাৎ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বললাম, মিউজিয়মে চোর এসেছিল বুঝি?
ঠিকই ধরেছ। সেই পাথরগুলো–উরিম আর থুমিমের সেই অমূল্য পাথরগুলো! দৌড়ে আসার ফলে মর্টিমার হাঁফাচ্ছে। আমি চললাম থানায়। তুমি যত শিগগির পায়রা চলে এসো জ্যাকসন–গুড বাই!
উদভ্রান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মর্টিমার, আর পরক্ষণেই শুনলাম তার দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নামার শব্দ।
আমি ওর কথামতো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিউজিয়মে পৌঁছে দেখি, মর্টিমার এর মধ্যেই একটি ইনস্পেক্টর ও আর একটি ভদ্রলোককে নিয়ে এসেছে। ভদ্রলোকটি হলেন মিঃ পার্ভিস–বিখ্যাত হীরক ব্যবসায়ী মবসন অ্যাণ্ড কোং-এর একজন অংশীদার। নামকরা জহুরি হিসাবে ইনি পাথর চুরির ব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত। ইহুদির কবচটা যে শো-কেসের মধ্যে ছিল, সেটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনজন। কবচটা এখন বাইরে বার করে কাঁচের আচ্ছাদনটার উপর রাখা হয়েছে, আর তিনজনে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেটাকে পরীক্ষা করছে।
কবচটার উপর যে মানুষের হাত পড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বলল মর্টিমার। আজ সকালে এটার দিকে চোখ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সন্দেহ হয়। কাল রাত্রেও আমি এটা দেখেছি, তখন ঠিকই ছিল। অর্থাৎ কুকীর্তিটা হয়েছে মাঝরাত্রে।
মর্টিমার ঠিকই বলেছে; কবচটা নিয়ে কেউ ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। প্রথম সারির চারটে পাথরকে ঘিরে সোনার উপর ক্ষতচিহ্ন। পাথরগুলো তাদের জায়গাতেই রয়েছে; ক্ষতি যা হয়েছে, সেটা সোনার সূক্ষ্ম কারুকার্যে–যার সৌন্দর্যের তারিফ আমরা এই কদিন আগেই করেছি।
ইনস্পেক্টর সাহেব বললেন, দেখে মনে হচ্ছে, কেউ যেন পাথরগুলোকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
মর্টিমার বলল, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, শুধু চেষ্টাই করেনি, কৃতকার্য হয়েছিল। আমার ধারণা, প্রথম সারির চারটে পাথরই নকল, যদিও চোখে দেখে ধরার উপায় নেই।
জহুরি মশাইয়েরও মনে হয়তো একই সন্দেহের উদয় হয়েছিল, কারণ তিনি এখন আতশ কাঁচের সাহায্যে অতি মনোযোগের সঙ্গে পাথরগুলো যাচাই করছেন। কাঁচের সাহায্য ছাড়াও নানাভাবে সেগুলোকে পরীক্ষা করে অবশেষে মর্টিমারের দিকে চেয়ে একগাল হেসে ভদ্রলোক বললেন, আপনার কপাল ভাল। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে, প্রথম সারির চারটে পাথরই খাঁটি। এত নিখুঁত পাথর সচরাচর দেখা যায় না।
আমার বন্ধুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাবটা চলে গেল। সে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক, বাবা! কিন্তু তা হলে চোরের উদ্দেশ্যটা ছিল কী?
হয়তো পাথরগুলো নেওয়ার মতলবেই এসেছিল, কিন্তু সেকাজে বাধা পড়ে।
কিন্তু নেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হবে, তা হলে তো একটা একটা করে খুলে নেওয়া উচিত। এখানে দেখছি চারটে পাথরকেই আলগা করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু একটাকেও নেওয়া হয়নি।
ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক, বললেন ইনস্পেক্টর সাহেব। ঠিক এরকম ঘটনা আর একটাও মনে পড়ছে না। চলুন, একবার পাহারাদারের সঙ্গে কথা বলা যাক।
প্রহরীকে ডেকে আনানো হল। মজবুত, মিলিটারি গড়ন, চেহারায় সততার ছাপ, গত রাত্রের ঘটনায় সে তার মনিবের মতোই বিচলিত।
না স্যার, আমি কোনও আওয়াজ পাইনি। ইনস্পেক্টরের প্রশ্নের উত্তরে সে বলল। আমি যেমন রোজ করি, তেমনই কাল রাত্রেও তিনবার টহল দিয়েছি, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। আমি গত দশ বছর এই কাজ করছি; এমন ঘটনা আমার আমলে এর আগে কখনও ঘটেনি।
কোনও জানলা দিয়ে চোর ঢুকতে পারে কি?
অসম্ভব স্যার!
তোমার ঘরের সামনে দিয়ে কেউ গিয়ে থাকতে পারে?
না স্যার। টহল দেবার সময়টুকু ছাড়া আমি সারাক্ষণ আমার ঘরের বাইরে বসে থাকি।
মিউজিয়মে ঢোকার আর কী পথ আছে?
মিঃ মর্টিমারের কোয়ার্টাসের একটা প্রাইভেট দরজা দিয়ে মিউজিয়মে ঢোকা যায়।
সে দরজা রাত্রে চাবি দিয়ে বন্ধ থাকে, বলল মর্টিমার। আর সেটায় পৌঁছতে হলে আগে মিউজিয়মের সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়।
আপনার চাকরবাকর?
তাদের থাকবার জায়গা একেবারে আলাদা।
ব্যাপারটা বেশ ঘোলাটে, তাতে সন্দেহ নেই–বললেন ইনস্পেক্টর। অবিশ্যি মিঃ পার্ভিসের মতে আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি।
আমি শপথ করে বলতে পারি, প্রথম সারির চারটে পাথর একেবারে খাঁটি, আবার বললেন মিঃ পার্ভিস।
তা হলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে যে, চোরের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কবচটাকে জখম করা, বললেন ইনস্পেক্টর সাহেব, তা সত্ত্বেও একবার দালানটা ঘুরে দেখায় কোনও ক্ষতি আছে বলে মনে করি না। হয়তো তার ফলে কে এই রহস্যময় চোর, তার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে।
সারা সকাল পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানেও কোনও ফল হল না। মিউজিয়মে ঢোকার যে আরও দুটো সম্ভাব্য পথ আছে, সেটা ইনস্পেক্টর সাহেব আমাদের দেখালেন। একটা হল মাটির নীচে সেলারের মাথায় একটা চোরা দরজা, আর দ্বিতীয় হল মাথার উপরে একটি অকেজো জিনিসপত্র রাখার ঘর বা লাম্বার রুমের স্কাইলাইট। এই ঘরের একটা বিশেষ স্কাইলাইট দিয়ে নীচে মিশরীয় ও ইহুদি জিনিসের ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। তবে এই দুটো প্রবেশপথের যে-কোনও একটা ব্যবহার করতে গেলেই চোরকে আগে ঢুকতে হবে দালানের মধ্যে। কিন্তু সে পথ যেহেতু বন্ধ, আর সেলার এবং লাম্বার রুম দুটোতেই যে পরিমাণ ধুলো জমে রয়েছে, এই দুটো প্রবেশপথের কথাই ওঠে না। শেষ পর্যন্ত কে, কখন, কেন কুকীর্তিটা করেছে সে রহস্যের কোনও কিনারা হল না।
আর একটিমাত্র পথ মর্টিমারের সামনে খোলা আছে, এবং শেষ পর্যন্ত সে সেটাই নিল। পুলিশদের তাদের কাজ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে আমাকে অনুরোধ করল সে দিনই বিকেলে তার সঙ্গে প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের ওখানে যেতে। যাবার সময় সে সঙ্গে চিঠি দুটো নিয়ে নিল, উদ্দেশ্য, প্রোফেসরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা তিনি কেন নামবিহীন চিঠিটা লিখেছিলেন এবং কী করে তিনি অনুমান করলেন যে, মিউজিয়ামে এইরকম একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। আপার নরউডে একটা ছোট বাড়িতে প্রোফেসর থাকেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে বাড়ির এক পরিচারিকার কাছ থেকে জানলাম যে, প্রোফেসর শহরে নেই। এই খবরে আমরা দুজনেই খুব হতাশ হয়েছি দেখে পরিচারিকা বললেন, আমরা যদি বৈঠকখানায় গিয়ে বসি, তা হলে তিনি প্রোফেসরের মেয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা করিয়ে দেবেন।
আগেই বলেছি যে, অ্যাড্রিয়াসের কন্যাটি সুন্দরী। দীর্ঘ ছিমছাম তার গড়ন, মাথার চুল সোনালি, গায়ের রঙ ও মসৃণতা গোলাপের পাপড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু সে যখন ঘরে ঢুকল, তখন এই দু-সপ্তাহে তার কত পরিবর্তন হয়েছে দেখে আমি প্রায় চমকে উঠলাম। তার চাহনিতে গভীর সংশয়ের ছাপ।
বাবা গেছেন স্কটল্যান্ডে, বললেন মহিলা। উনি বড় ক্লান্ত বোধ করছিলেন, তার উপর দুশ্চিন্তার কারণ ছিল। উনি কালই চলে গেছেন।
আপনাকেও যেন ক্লান্ত দেখছি, মিস অ্যাড্রিয়াস, বলল আমার বন্ধু।
সেটা হয়েছে বাবার সম্বন্ধে চিন্তা করেই।
ওঁর স্কটল্যান্ডের ঠিকানা আপনার কাছে আছে কি?
হ্যাঁ। উনি রয়েছেন ওঁর ভাই রেভারেন্ড ডেভিড অ্যাড্রিয়াসের বাড়িতে। ঠিকানা, এক নম্বর আরাম ভিলা, আরড্রোস্যান।
মর্টিমার ঠিকানাটা লিখে নেবার পর আমরা আমাদের আসার উদ্দেশ্যটা না জানিয়েই বিদায় নিলাম। সন্ধ্যায় আমরা দুজনে ঠিক সকালের মতোই আবার বেলমোর স্ট্রিটে মিলিত হলাম। প্রোফেসরের চিঠিই আমাদের একমাত্র কু। মর্টিমার স্থির করেছিল পরদিনই আরড্রোস্যানে গিয়ে প্রোফেসরকে চিঠিটা দেখিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করবে, এমন সময় একটা ঘটনার ফলে তার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেল।
পরদিন ভোরে আমার দরজায় টোকার শব্দে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দেখি, একটি লোকের হাতে মর্টিমারের একটা চিঠি। সে লিখছে, অবিলম্বে চলে এসো। রহস্য আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই মিউজিয়মে পৌঁছে দেখলাম মর্টিমার মাঝের ঘরটায় উদ্বিগ্নভাবে পায়চারি করছে, আর ঘরের একপাশে পল্টনের মতো দাঁড়িয়ে আছেন প্রহরীমশাই।
ওঃ জ্যাকসন! তোমায় আমার বিশেষ প্রয়োজন। এ রহস্যের কুলকিনারা করা আমার কম্ম নয়।
আবার কী হল?
মর্টিমার কাঁচের শো-কেসটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, যাও, নিজেই দেখো গিয়ে।
আমি যা দেখলাম, তাতে আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বেরিয়ে পড়ল। এবার মাঝের সারির পাথরগুলোর অবস্থাও হুবহু উপরের সারির মতো। বারোটার মধ্যে আটটা পাথরের উপর দুবৃত্তের হাত পড়েছে। শেষের সারির পাথরগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে।
পাথরগুলো কি বদলানো হয়েছে? আমি প্রশ্ন করলাম।
না। মাঝের চারটের মধ্যে এমারেন্ডের রঙে সামান্য একটু বৈষম্য ছিল। এখনও সেটা। রয়েছে। কাজেই ধরে নেওয়া যায় যে, উপরের সারির মতো এগুলোও বদলানো হয়নি। আচ্ছা সিম্পসন, তুমি তো বলছ সন্দেহজনক কোনও শব্দ পাওনি।
না স্যার, প্রহরী জবাব দিল, কিন্তু সকাল হলে পর আমি এই ঘরে এসে কবচটা দেখেই বুঝলাম যে, ওটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ আপনাকে খবর দিই। কিন্তু আমি যতক্ষণ পাহারা দিয়েছি ততক্ষণ কাউকে দেখিনি, কোনও শব্দও পাইনি।
মর্টিমার আমার দিকে ফিরে বলল, এসো আমার সঙ্গে, একটু ব্রেকফাস্ট করা যাক। তার ঘরে পৌঁছতেই সে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করল, এসব কী ঘটছে বলো তো জ্যাকসন?
সত্যি বলতে কি, এমন অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা আমার অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে। আমি বললাম, আমার মতে এ কোনও উন্মাদের কীর্তি।
এর মধ্যে কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছ না তুমি?
আমি একটু ভেবে বললাম, এই প্রাচীন কবচটা ইহুদিদের কাছে একটি অতি পবিত্র জিনিস। ধরো, যদি ইহুদি-বিরোধী কোনও দলের কেউ কবচটাকে নষ্ট
না, না, না! চেঁচিয়ে বলে উঠল মর্টিমার। ওটা কোনও কথাই হল না। এমন লোক হয়তো আছে যে কবচটাকে নষ্ট করতে চাইতে পারে, কিন্তু পাথরের চারধারে কুরে কুরে সেগুলোকে আলগা করার চেষ্টা করবে কেন? এর কারণ খুঁজতে হবে অন্য কোথাও। এখন বলো তো, টহলদার সিম্পসন সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা।
ওকে সন্দেহ করার কোনও কারণ আছে কি?
কারণ একমাত্র এই যে, রাত্রে এক সিম্পসন ছাড়া কেউ এ তল্লাটে থাকে না।
কিন্তু এমন অর্থহীন ধ্বংসের কাজ সে করবে কেন? কোনও জিনিস তো চুরি যায়নি।
ধরো যদি তার মাথা খারাপ হয়ে থাকে।
উঁহু। সিম্পসনের মাথায় কোনও গণ্ডগোল নেই, এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।
তুমি নিজে অন্য কাউকে সন্দেহ করো?
তুমিই তো রয়েছ! আমি হালকা হেসে বললাম। ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করার ব্যারাম-ট্যারাম আছে নাকি তোমার?
মোটেই না।
তা হলে এ রহস্য সমাধানের কাজে আমি ইস্তফা দিলাম।
কিন্তু আমি দিচ্ছি না। একটা পন্থা আছে, যার সাহায্যে আমরা এর কিনারা করতে পারব। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসের সঙ্গে দেখা করে?
না। স্কটল্যান্ড যাবার দরকার নেই। কী করব সেটা বলছি তোমাকে। ওপরের লাম্বার রুমের একটা স্কাইলাইট দিয়ে মাঝের হলঘরটা দেখা যায়, সেটা তো দেখলে। আমরা হলঘরে বাতি জ্বালিয়ে রেখে ওপরের স্কাইলাইটে চোখ লাগিয়ে বসে থাকব। তুমি আর আমি। দুজনে একজোটে রহস্যের সমাধান করব। যদি এই রহস্যময় ব্যক্তিটি এক-একদিনে চারটে করে পাথরের উপর কাজ করে, তা হলে সে নিশ্চয়ই আজ রাত্রে আবার এসে শেষ সারির চারটে পাথর নিয়ে পড়বে।
উত্তম প্রস্তাব।
আমরা ব্যাপারটা সম্পূর্ণ গোপন রাখব। পুলিশ বা সিম্পসন, কাউকেই কিছু বলব না। রাজি?
অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে রাজি।
.
২.
রাত দশটা নাগাদ আমি মর্টিমারের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। তাকে দেখেই বুঝলাম, সে একটা চাপা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছে। হাতে সময় আছে, তাই আমরা দুজনে মর্টিমারের ঘরে বসে ঘণ্টাখানেক ধরে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করলাম। অবশেষে একটা সময় এল, যখন রাস্তায় গাড়িঘোড়া পথচারী ইত্যাদির শব্দ কমে গিয়ে পাড়াটা নিস্তব্ধ হয়ে এল। প্রায় বারোটার সময় মর্টিমার আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল অকেজো জিনিসপত্র রাখার ঘরটাতে।
ইতিমধ্যে দিনের বেলায় একবার ঘরটাতে এসে মর্টিমার আমাদের বসার সুবিধার জন্য মেঝেতে চট বিছিয়ে রেখেছে। স্কাইলাইটের শার্সিগুলো স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি হলেও তার উপর ধুলো পড়ে এমন। দশা হয়েছে যে, আমরা নীচের ঘরটা মোটামুটি দেখতে পেলেও, নীচ থেকে কেউ আমাদের দেখতে পাবে না। কাঁচের উপর দুটো ছোট্ট অংশ থেকে ধুলো মুছে ফেলে সেইখানে আমাদের চোখ। লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। বিজলি বাতির উজ্জ্বল আলোতে হলঘরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এমনকী শো-কেসের ভিতরের জিনিসগুলো পর্যন্ত। ঘরে একপাশে দরজার ধারে দাঁড় করানো মিশরীয় মমি-কেস থেকে শুরু করে কাঁচের শো-কেসে রাখা ইহুদির কবচের প্রত্যেকটি ঝলমলে পাথর–সবকিছুই আমরা দেখছি সমান আগ্রহের সঙ্গে। ঘরে মণিমুক্তোর ছড়াছড়ি। কিন্তু কবচের উরিম ও ঘুমিমের বারোটা পাথরের জেল্লা অন্য সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। সিকারার সমাধি মন্দিরের ছবি, কাণাকের প্রাচীরচিত্র, মেমফিসের ভাস্কর্য, থিবিসের প্রস্তরলিপি–সবই তন্ময় হয়ে দেখার জিনিস; কিন্তু তা সত্ত্বেও চোখ বারবার চলে যায় কাঁচের নীচে কবচটার দিকে, আর মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওর রহস্য ভেদ করার জন্য। আমি এই রহস্যের কথাই ভাবছি, এমন সময় আমার বন্ধুটি হঠাৎ নিশ্বাস টেনে আমার কোটের আস্তিনটা সজোরে খামচে ধরল। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এর কারণ।
হলঘরের দরজার পাশে রাখা মমি-কেসটার কথা আগেই বলেছি। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, দাঁড় করানো মমি-কেসটার ডালাটা খুলতে শুরু করেছে। খোলার ফলে যে সরু কালো ফাঁকটার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অতি ধীরে ধীরে চওড়া হচ্ছে। এই ভোলার ব্যাপারটা এত সন্তর্পণে ঘটছে যে, ভাল করে না দেখলে চোখে ধরাই পড়ে না। একটু পরেই দেখলাম যে, ফাঁক দিয়ে একটা শীর্ণ হাত বেরিয়ে এসে নকশাদার ডালাটাকে ধরে সেটা আরও সামনে এগিয়ে দিল। তারপর বেরিয়ে এল অন্য হাতটা, আর তারপরেই একটা মুখ। এ-মুখ আমাদের দুজনেরই খুব চেনা। ইনি হলেন স্বয়ং প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। এবার তাঁর পুরো শরীরটা শবাধার থেকে বেরিয়ে এল, শেয়াল যেমন বেরিয়ে আসে তার গর্ত থেকে। ভদ্রলোকের দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, পা-দুটো একবার সামনে এগোচ্ছে, পরমুহূর্তেই থামছে, আবার দৃষ্টি ঘুরছে এদিক-ওদিক, আবার এগোচ্ছে পা। একবার রাস্তা থেকে আসা একটা অস্ফুট শব্দে তিনি থেমে গেলেন, কানখাড়া করে শুনতে লাগলেন, ভাবটা এই, যেন দরকার হলে তৎক্ষণাৎ আবার ফিরে যাবেন তাঁর লুকোনোর জায়গায়। কিন্তু সেটার প্রয়োজন। হল না। প্রোফেসর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে শো-কেসটার সামনে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে একটা চাবির গোছ বার করলেন। তারই একটা চাবি দিয়ে খোলা হল শো-কেসের ঢাকনা, বাইরে বেরিয়ে এল ইহুদির কবচ, আর সেটাকে ঢাকনার উপর রেখে একটা ছোট ধাতব যন্ত্র দিয়ে তার উপর কাজ শুরু করলেন প্রোফেসর। আমাদের একেবারে সরাসরি নীচে দাঁড়ানোর ফলে তাঁর ঝুঁকে-পড়া পিঠটা কবচটাকে ঢেকে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাত যেভাবে চলছিল তাতে বুঝতেই পারছিলাম, যে-নষ্টামির পরিচয় আমরা পেয়েছি, সেই একই কাজে তিনি মগ্ন!
আমার বন্ধুর দ্রুত নিশ্বাসের আর আমার হাতের উপর তার হাতের চাপ থেকেই বুঝতে পারছি। প্রোফেসরের এই কুকীর্তিতে তার মনে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অপকর্মের জন্য যে ইনিই দায়ী, সেটা। যে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। এই সেদিনই ইনি আমাদের কাছে ওই কবচের গুণগান করেছেন, আর আজ ইনিই সেই আশ্চর্য বস্তুটির সর্বনাশ করে চলেছেন! রাতদুপুরে এই কুকীর্তি যে কী অমানুষিক ভণ্ডামির পরিচয় বহন করে এবং তাঁর উত্তরাধিকারীর প্রতি কী পরিমাণ আক্রোশ যে এতে প্রকাশ পাচ্ছে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। কাজটা ভাবতেও যেমন, দেখতেও ঠিক তেমনই পীড়াদায়ক। আমি নিজে এ ব্যাপারে মোটেই বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু তাও এই আশ্চর্য কবচের এহেন দুর্গতি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। আমার সঙ্গীটি আমার হাতে একটা টান দিয়ে নিঃশব্দে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। নিজের ঘরে ফিরে আসার পর মর্টিমার মুখ খুলল।
লোকটা কতবড় শয়তান! এ জিনিস কি স্বপ্নেও ভাবা যায়?
ব্যাপারটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
হয় শয়তান, না হয় পাগল। এই দুটোর একটা হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা শিগগিরই জানা যাবে। এসো আমার সঙ্গে; এখনই একটা এপার ওপার করা দরকার।
একটা প্যাসেজের শেষ প্রান্তে একটা দরজা দিয়ে সোজা মিউজিয়মে ঢোকা যায়। এটা একমাত্র তত্ত্বাবধায়কের ব্যবহারের জন্যই তৈরি। মর্টিমারের দেখাদেখি আমিও আগে পায়ের জুতো-জোড়া খুলে ফেললাম। তারপর নিঃশব্দে চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে মিউজিয়মে ঢুকে ঘরের পর ঘর পেরিয়ে অবশেষে আসল ঘরে পৌঁছলাম। ভদ্রলোক এখনও তাঁর দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা নিঃশব্দে তাঁর দিকে অগ্রসর হলাম। কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ঘুরে একটা চাপা চিৎকার দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সিম্পসন! সিম্পসন। মর্টিমার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকগুলি দরজা পেরিয়ে শেষ দরজার মুখে বৃদ্ধ প্রহরী মশাইকে আবির্ভূত হতে দেখা গেল। প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াসও একই সঙ্গে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পরমুহূর্তেই তাঁর পিঠে দু দিক থেকে আমাদের দুজনের হাত পড়ল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ভদ্রলোক! আমি যাচ্ছি আপনাদের সঙ্গে। আপনার ঘরেই চলুন মিঃ মর্টিমার। জবাবদিহির ব্যাপারটা ওখানেই সারা যাবে।
মর্টিমার ক্রোধে এত অধীর যে, তার মুখ দিয়ে কথাই বেরোল না। প্রোফেসরকে মাঝখানে রেখে আমরা তিনজন প্রথমে হলঘরে ফিরে এলাম, সিম্পসন আমাদের পিছনে। শো-কেসের উপর ঝুঁকে পড়ে মর্টিমার কাচটা পরীক্ষা করে দেখল। নীচের সারির প্রথম পাথরটা এর মধ্যেই খানিকটা আলগা হয়ে এসেছে। কবচটা হাতে নিয়ে মর্টিমার প্রোফেসরের দিকে ফিরল–তার দৃষ্টি যেন অগ্নিবর্ষণ করছে।
কী করে পারলেন আপনি, কী করে পারলেন।
কাজটা অত্যন্ত ঘৃণ্য আমি জানি, বললেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। আপনার মনের ভাব আমি বুঝতে পারছি। আমি অনুরোধ করছি, আপনার ঘরে নিয়ে চলুন আমাকে।
কিন্তু এটাকে তো এভাবে ফেলে রাখা যায় না, বলল মর্টিমার। তারপর গভীর দরদের সঙ্গে সে কবচটাকে হাতে তুলে নিল। আমরা রওনা দিলাম। প্রোফেসরের পাশে আমি হাঁটছি, যেন পুলিশ চলেছে হাতেনাতে ধরা-পড়া চোরের পাশে। আমরা সোজা মর্টিমারের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। হতভম্ব সিম্পসন বাইরে রয়ে গেল তার নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঘটনাটা অনুধাবন করবার জন্য; প্রোফেসর একটা সোফায় বসলেন। তাঁর শোচনীয় অবস্থা দেখে রাগের পরিবর্তে আমরা দুজনেই তাঁর সম্বন্ধে সংশয়ান্বিত বোধ করছিলাম। ব্র্যান্ডি খাবার পর তিনি খানিকটা প্রকৃতিস্থ হলেন।
এখন অনেকটা সুস্থ বোধ করছি, বললেন ভদ্রলোক। গত কদিনের ধকল আমাকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে। আমি আর পেরে উঠছিলাম না। আমার পক্ষে এ এক চরম বিভীষিকা। একদিন যে-মিউজিয়ম আমারই জিম্মায় ছিল, সেই মিউজিয়মের ঘরেই আমাকে ধরা দিতে হল চোরের মতো! অথচ আপনাকেই বা দোষ দেব কী করে? আপনি আপনার কর্তব্য পালন করেছেন। আমি শুধু এটাই চেয়েছিলাম যে, কেউ টের পাবার আগে আমি যেন আমার কাজটা শেষ করতে পারি। সেটা আজ রাত্রেই হয়ে যেত, কিন্তু…।
আপনি ভিতরে ঢুকলেন কী করে? প্রশ্ন করল মর্টিমার।
আপনি যে দরজা ব্যবহার করেন, সেই দরজা দিয়ে, বললেন প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। কাজটা অত্যন্ত গর্হিত, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ সৎ। সেখানে কোনও দোষ ধরতে পারবে না কেউ। আসল ঘটনাটা জানলে আপনিও আমাকে আর গাল দেবেন না। আপনার বাসস্থানের দরজার একটা চাবি আর মিউজিয়মে ঢোকার একটা চাবি আমার কাছে ছিল। চাকরি ছাড়ার সময় সেগুলি ফেরত দিইনি। মিউজিয়ম থেকে দর্শকের দল বাইরে বেরোনো মাত্র আমি হলঘরে ঢুকে মমি-কেসটার ভিতর লুকিয়ে পড়তাম। তার পর নিরাপদ বুঝে বেরিয়ে এসে যা করার তা করতাম। যতবার সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেতাম, তত বারই আমাকে মমি-কেসের ভিতর আশ্রয় নিতে হত। তারপর কাজ শেষ হলে, যেভাবে ঢুকেছি সেই পথেই বেরিয়ে আসতাম।
তার মানে আপনি একটা মস্ত ঝুঁকি নিয়েছিলেন?
নিতেই হয়েছিল।
কিন্তু কেন? কোন উদ্দেশ্যে আপনাকে এরকম একটা জঘন্য কাজ করতে হল? পাশেই। টেবিলের উপর রাখা কবচটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল মর্টিমার।
এ ছাড়া কোনও রাস্তা ছিল না। অনেক ভেবেও আর কোনও উপায় খুঁজে পাইনি। এ না করলে লোকমুখে আমার বদনাম ছড়িয়ে পড়ত আর সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনেও আমাকে গভীর শোক ভোগ করতে হত। আমি যা করেছি তা মঙ্গলের জন্যই, যদিও আপনার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আমি চাই আমার কথা সত্য প্রমাণ করার সুযোগ আপনি দেবেন।
আপনার কী বলার আছে শোনার পর আমি আমার কর্তব্য স্থির করব, দৃঢ়স্বরে বলল মর্টিমার।
আমি কিছুই গোপন রাখব না, সব কথা অকপটে আপনাকে বলব। তারপর আপনি কী করেন, সেটা আপনার মর্জি।
আসল ব্যাপারটা তো আর আমাদের জানতে বাকি নেই।
আসল ব্যাপার আপনি কিছুই জানেন না। প্রথমে কয়েক সপ্তাহ আগের একটা ঘটনায় ফিরে যেতে দিন, তারপর আমি সব বুঝিয়ে বলব। এটুকু বিশ্বাস করুন যে, আমি যা বলছি তার মধ্যে একবর্ণ মিথ্যে নেই।
যে ব্যক্তি ক্যাপ্টেন উইলসন বলে নিজের পরিচয় দেন, তার সঙ্গে আপনাদের আলাপ হয়েছে। আমি এইভাবে বলছি, কারণ আমি এখন জানতে পেরেছি যে, এটা তার আসল পরিচয় নয়। ওর সঙ্গে আমার কী করে আলাপ হল, কী করে সে আমার বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠল, এবং কী করে সে আমার মেয়ের ভালবাসা আদায় করল, এসব বুঝিয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। সে এখানে আসার সময় বিদেশের অনেক জ্ঞানী-গুণীর কাছ থেকে প্রশংসাপত্র নিয়ে এসেছিল; তাই তাকে আমার আমল দিতে হয়। তা ছাড়া তার নিজেরও যে গুণ নেই, তা নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমি খুশি হয়েই তাকে নিয়মিত আমার বাড়িতে আসতে দিই। যখন জানলাম যে আমার মেয়ে এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট, তখন মনে হয়েছিল যে ঘটনাটা যেন একটু বেশি দ্রুত ঘটে গেল। কিন্তু আমি অবাক হইনি, কারণ উইলসনের স্বভাব আর কথাবার্তায় এমন একটা মাধুর্য ছিল যে, সমাজের উঁচু স্তরে নিজের জন্য একটা জায়গা করে নেওয়া তারপক্ষে ছিল সহজ ব্যাপার।
প্রাচ্যের প্রাচীন শিল্পবস্তু সম্পর্কে তার উৎসাহ ছিল, এবং এ বিষয়ে জ্ঞানও ছিল যথেষ্ট। অনেক সময় সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে সময় কাটাতে এসে সে আমার অনুমতি নিয়ে মিউজিয়মে গিয়ে একা ঘুরে ঘুরে সব দেখত। বুঝতেই পারছেন, এ ব্যাপারে আমি নিজে উৎসাহী হওয়াতে তার অনুরোধে খুশি হয়েই সম্মত হতাম, আর আমার বাড়িতে তার ঘন ঘন আগমনে কোনও বিস্ময় বোধ করতাম না। এলিজের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ পাকাঁপাকি হয়ে যাবার পর প্রায় প্রতি সন্ধ্যা ছেলেটি আমার বাড়িতে কাটাত, এবং তার মধ্যে ঘণ্টাখানেক কাটাত মিউজিয়মে। সেখানে সে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করত। এমনকী আমি যেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি থাকতাম না, সেদিনও সে এসে মিউজিয়মে কিছুটা সময় কাটিয়েছে। এই অবস্থার অবসান হয় তখনই, যখন আমি চাকরি ছেড়ে নরউডে চলে যাই, এবং নানা বিষয় নিয়ে বই লেখার তোড়জোড় শুরু করি।
চাকরি ছাড়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি যে লোককে নির্দ্বিধায় আপন করে নিয়েছিলাম, তার আসল চেহারাটা বুঝতে পারি। আমার বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া কয়েকটা চিঠি থেকে আমি জানতে পারি যে, যেসব পরিচয়পত্র উইলসন আমাকে দেখিয়েছিল, তার অধিকাংশই জাল। অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, এই ধাপ্পাবাজির পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সে যদি অর্থলোভী হয়ে থাকে তা হলে আমাকে দিয়ে তার কোনও কাজ হবে না, কারণ আমি ধনী নই। তা হলে সে এল কেন? তখন আমার খেয়াল হল যে, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান পাথরের বেশ কিছু রয়েছে আমার জিম্মায়, এবং নানান অজুহাতে একা মিউজিয়মে গিয়ে সেসব পাথরের কোষ্টা কোথায় আছে সেটা উইলসন দেখে এসেছে। অর্থাৎ সে হচ্ছে এক অতি ধূর্ত ব্যক্তি, যে আমার মিউজিয়মে চুরির সুযোগ খুঁজছে। এই অবস্থায়, তাকে অন্ধের মতো ভালবাসে আমার যে মেয়ে, তাকে কষ্ট না দিয়ে কী করে আমি উইলসনকে জব্দ করব? আমি অনেক ভেবে যে-পস্থা স্থির করলাম, সেটা বেয়াড়া তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কার্যকরী কোনও পস্থা আমার মাথায়। এল না। আমি যদি আপনাকে নিজের নামে চিঠি লিখতাম, তখন আপনি নিশ্চয়ই আমাকে নানা খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতেন–যার উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হত না। তাই আমি নাম ছাড়াই চিঠি লিখে আপনাকে সতর্ক করে দিই।
আমি বেলমোর স্ট্রিট থেকে নরউড চলে আসার পরেও এই যুবকের আমার বাড়িতে আসা একটুও কমেনি। হয়তো সে সত্যিই আমার মেয়েকে গভীরভাবে ভালবেসেছিল। আর আমার মেয়ের কথা যদি বলেন, তা হলে আমি এটুকু বলব যে, কোনও মেয়ে যে একজন পুরুষের দ্বারা এমনভাবে প্রভাবিত হতে পারে, এটা আমি কল্পনা করতে পারিনি। উইলসনের ব্যক্তিত্ব যেন এলিজকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছিল। এটা যে কতদূর সত্যি এবং ওদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা যে কত গভীর, সেটা আমি বুঝতে পারি এক সন্ধ্যায়, আর তখনই উইলসনের আসল রূপটা ধরা পড়ে। সেদিন আমি আগে থেকে হুকুম দিয়ে রেখেছিলাম যে, উইলসন এলে যেন সোজা আমার কাজের ঘরে চলে আসে বৈঠকখানায় যেন তাকে বসানো না হয়। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি সোজাসুজি বলে দিলাম যে, তার স্বরূপ জানতে আর আমার বাকি নেই, আর সেটা জেনেই তার দুরভিসন্ধির পথ আমি বন্ধ করেছি এবং আমি আর আমার মেয়ে তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখতে চাই না। সেইসঙ্গে এও বললাম যে, আমার পরম সৌভাগ্য সে মিউজিয়মের মহামূল্য জিনিসগুলোর কোনও ক্ষতি করার আগেই আমি তার আসল পরিচয়টা পেয়ে গেছি।
ছেলেটির বুকের পাটা যে অসামান্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমার কথা সে শেষ পর্যন্ত শুনে কোনও বিস্ময় বা বিরুদ্ধভাব প্রকাশ না করে ঘরের উলটোদিকে গিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে চাকরকে ডেকে পাঠাল। চাকর এলে পর তাকে বলল, মিস্ অ্যাড্রিয়াসকে গিয়ে বলো, তিনি যেন অনুগ্রহ করে এখানে আসেন।
আমার মেয়ে এল। উইলসন এগিয়ে গিয়ে তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, এলিজ, তোমার বাবা এইমাত্র আবিষ্কার করেছেন যে, আমি একটি দুশ্চরিত্র ব্যক্তি–যেটা তুমি আগেই জানতে।
এলিজ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
উনি বলছেন যে আমাদের পরস্পরকে ত্যাগ করতে হবে, চিরকালের জন্য।
এলিজ কিন্তু এখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।
তোমার উপর কি আমি ভরসা রাখতে পারি, না কি একমাত্র যে আমাকে সৎপথে চালাতে পারে, সেও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
জন! আমার মেয়ে গভীর আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, আমি কোনওদিন তোমাকে ছেড়ে যাব না। দুনিয়ার সব লোক যদি তোমার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তা হলেও না।
আমি আমার মেয়েকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও ফল হল না। সে যেন এই যুবকটির সঙ্গে তার জীবন অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলেছে। আমার মেয়ে আমার চোখের মণি; যখন দেখলাম যে তাকে সর্বনাশের হাত থেকে উদ্ধার করার কোনও উপায় নেই, তখন আমার যে কী অবস্থা হল তা বলতে পারি না। আমার অসহায় ভাব দেখে মনে হল উইলসনের কিছুটা দয়া হল। সে বলল, আপনি যতটা ভাবছেন, অবস্থা ততটা খারাপ নয়। এলিজের প্রতি আমার ভালবাসা এতই গভীর যে, হয়তো সেটাই আমাকে কলঙ্কের হাত থেকে উদ্ধার করবে। আমি কালই ওর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, জীবনে আর কখনও এমন কোনও কাজ করব না যাতে সে কষ্ট। পাবে। কথা দিয়ে কথা না রাখার লোক আমি নই।
উইলসনের কথায় মনে হল সে যা বলছে সেটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কথাটা বলে সে পকেট থেকে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স বার করে বলল, আমি যা বলছি তা যে সত্যি তার প্রমাণ আমি দিতে চাই। এলিজ, আমার উপর তোমার প্রভাব যে মঙ্গলকর সেটা এবার বুঝতে পারবে। প্রোফেসর অ্যান্ড্রিয়াস, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন যে আপনার সংগ্রহশালার অমূল্য সম্পদ আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল। যে কাজে লাভের সম্ভাবনার সঙ্গে বিপদের আশঙ্কা জড়িয়ে থাকে, সে কাজের প্রতি চিরকালই আমি একটা আকর্ষণ বোধ করি, তাই ইহুদির কবচের পাথরগুলোকে হাত করার জন্য আমি বদ্ধপরিকর হই।
সেটা আমি অনুমান করেছিলাম।
কিন্তু একটা ব্যাপার আপনি অনুমান করতে পারেন নি।
কী?
যে সেগুলো হাত করতে আমি সক্ষম হয়েছিলাম। এই বাক্সের মধ্যে রয়েছে সেই পাথরগুলো।
এই বলে সে বাক্সটা খুলে আমার ডেস্কের উপর উপুড় করে ধরল। দৃশ্য দেখে আমার হাত-পা হিম হয়ে এল। সংকেত চিহ্ন আঁকা বারোটা মহামূল্য পাথর বেরিয়ে পড়েছে আমার টেবিলের উপর। এগুলোই যে উরিম ও ঘুমিমের পাথর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সর্বনাশ! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। তুমি ধরা না পড়ে এ কুকীর্তি করলে কী করে?
আসলের জায়গায় নকল পাথর বসিয়ে, বলল উইলসন, নকলগুলো এতই নিখুঁত যে, দুইয়ের মধ্যে তফাত করা অসম্ভব।
এখন যে পাথরগুলো কবচে লাগানো রয়েছে, সেগুলো নকল?
হ্যাঁ, এবং বেশ কিছুকাল আগেই ঘটেছে এই ঘটনা।
আমরা তিনজন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মেয়ের মুখ বিবর্ণ হলেও সে তখনও তার হাত ছাড়িয়ে নেয়নি।
উইলসন এলিজের দিকে ফিরে বলল, আমার সাধ্যের মাত্রা কতদূর সেটা তো এবার বুঝলে?
এলিজ বলল, এটাও বুঝলাম যে দুষ্কর্ম করেছ, তার জন্য অনুতপ্ত হওয়াটাও তোমার অসাধ্য নয়।
সেটা তোমার প্রভাবের ফল বলল উইলসন, আমি পাথরগুলো আপনাকেই দিচ্ছি, প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস। আপনি এ ব্যাপারে যা করা উচিত মনে করবেন, তাই করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু করা মানেই আপনার মেয়ের ভবিষ্যৎ স্বামীর বিরুদ্ধে করা। এলিজ, কিছুদিন পরেই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব। এর পরে আর কোনওদিন আমার জন্য তোমাকে কষ্টভোগ করতে হবে না। এই বলে উইলসন প্রস্থান করল।
আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অমূল্য পাথরগুলো এখন আমার হাতে, কিন্তু ধরা না পড়ে কী করে সেগুলো যথাস্থানে ফেরত দিই? এটা বুঝতে পারছি যে, আমার মেয়ে যে রকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাকে উইলসন-এর হাত থেকে কোনওমতেই রক্ষা করতে পারব না। আর উইলসনের প্রভাব যদি তার উপর সত্যিই মঙ্গলকর হয়, তা হলে তাকে রক্ষা করার প্রশ্নই বা আসবে কেন? উইলসনের মুখখাশ খুলে দিলেই বা কী ফল হবে, বিশেষ করে সে যখন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে?
আমি অনেক ভেবে একটা রাস্তা বার করলাম, যেটা হয়তো আপনাদের কাছে খুব অবাচীন বলে মনে হবে, কিন্তু আমার মতে এ ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। আমি স্থির করলাম, কাউকে জানতে না দিয়ে আমি নিজেই গিয়ে পাথরগুলো যথাস্থানে বসিয়ে দেব। আমার চাবির সাহায্যে আমি যে কোনও সময় মিউজিয়মে ঢুকতে পারি, আর সিম্পসনের গতিবিধি যখন জানা আছে, তখন ধরা পড়ারও কোনও আশঙ্কা নেই। যা করতে যাচ্ছি সে সম্বন্ধে কাউকে কিছু বলব না–আমার মেয়েকেও না–এটাও স্থির করলাম। মেয়েকে বললাম, আমি স্কটল্যান্ডে আমার ভাইয়ের কাছে। যাচ্ছি। কটা রাত কারুর সন্দেহ উদ্রেক না করে আমি নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারি, এটাই ছিল আমার লক্ষ্য। সেই রাত্রেই হার্ডিং স্ট্রিটে একটা ঘর ভাড়া করলাম। বাড়িওয়ালাকে বললাম আমি খবরের কাগজে কাজ করি, আমাকে রাত্রেও কাজে বাইরে যেতে হতে পারে।
সেই রাত্রে মিউজিয়মে গিয়ে আমি প্রথম সারির চারটে নকল পাথর খুলে ফেলে আসল পাথর বসিয়ে দিলাম। কাজটা সহজ নয়, এবং সেটা করতে আমার সারারাত লেগে গেল। সিম্পসনের পায়ের শব্দ পেলেই আমি মমি-কেসের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম। স্বর্ণকারের কাজ সম্বন্ধে আমার কিছু জ্ঞান আছে, কিন্তু উইলসন ছিল আমার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ। সে যেভাবে মেকি পাথরগুলো বসিয়েছিল, তাতে সোনার কারুকার্য একটুও রদবদল হয়নি। কিন্তু আমার ছিল কাঁচা এবং বুড়ো হাতের কাজ। আমি চাইছিলাম যে যে-কদিন আমি কাজটা করব, সেকদিন যেন কেউ বেশি মনোযোগ দিয়ে কবচটাকে না দেখে। যাই হোক, একইভাবে দ্বিতীয় রাত্রে দ্বিতীয় সারির পাথরগুলো বসিয়ে ফেললাম। আজ কাজটা শেষ হয়ে যেত, কিন্তু অদৃষ্টের ফেরে সেটা হল না, এবং সেইসঙ্গে আমাকে এমন সব কথা বলে ফেলতে হল, যেগুলো একান্তই গোপনীয়। এখন আপনারা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে স্থির করুন, এখানেই ঘটনার পরিসমাপ্তি হবে, না এটাকে আরও কিছুদূর টেনে নেবেন। আমার নিজের শান্তি, আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ এবং তার ভাবী পতির সংস্কার–সবই নির্ভর করছে আপনাদের সিদ্ধান্তের উপর।
মর্টিমার বলল, সিদ্ধান্ত হল এই যে, যেহেতু সব ভাল যার শেষ ভাল, এই মুহূর্তে সমস্ত ঘটনাটির উপর চিরকালের মতো যবনিকা ফেলে দেওয়া হোক। কালই একজন পাকা স্বর্ণকারকে দিয়ে পাথরগুলো ঠিক করে বসিয়ে কবচটাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। এবারে আপনার হাতটা দিন, প্রোফেসর অ্যাড্রিয়াস, আর আশীবাদ করুন যেন এরকম অবস্থায় যদি কোনওদিন পড়তে হয় আমাকে, আমিও যেন আপনার মতো নিঃস্বার্থ আচরণ করতে পারি।
কাহিনী শেষ করার আগে একটা কথা বলা দরকার। এক মাসের মধ্যেই এলিজের বিয়ে হয়ে গেল তার সঙ্গে যার আসল নামটা বললে পাঠক বুঝতে পারতেন যে, তিনি এখন সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সত্যি কথাটা হল এই যে, সম্মান তার চেয়েও বেশি প্রাপ্য সেই শান্তস্বভাবা তরুণীর, যিনি তাঁর স্বামীকে পাপের পঙ্কিল পথ থেকে উদ্ধার করে ভদ্রসমাজে তার স্থান করে দিয়েছিলেন।
দি জু’স ব্রেস্টপ্লেট
সন্দেশ, অগ্রহায়ণ, পৌষ ১৩৯১
ঈশ্বরের ন লক্ষ কোটি নাম
আপনাদের অর্ডারটা একটু অস্বাভাবিক ধরনের, বিস্ময়ের মাত্রাটা যথাসম্ভব কমিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার–আমি যতদূর জানি, এর আগে কোনও তিব্বতি গুম্ফা থেকে অটোমেটিক সিকুয়েন্স কম্পিউটারের জন্য অর্ডার আসেনি। আপনাদের ঠিক এই ধরনের মেশিনের প্রয়োজন হতে পারে সেটা আমি ভাবিনি। আপনারা কী কাজের জন্য যন্ত্রটা চাইছেন, সেটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
নিশ্চয়ই, তাঁর সিল্কের আলখাল্লাটিকে সামলে নিয়ে, স্লাইড রুলের সাহায্যে ডলার ও তিব্বতি মুদ্রার পারস্পরিক সম্পর্কের হিসাবটা স্থগিত রেখে বললেন লামা। নিশ্চয়ই বলব। আপনাদের মার্ক-৪ কম্পিউটার সবরকম গণনারই কাজ করতে পারে, যদি না একসঙ্গে দশটার বেশি সংখ্যার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের কাজের জন্য আমরা সংখ্যার কথা ভাবছি না–আমরা ভাবছি অক্ষরের কথা। আপনারা যদি যন্ত্রের সার্কিটে কিছু অদল-বদল করে সেটাকে এমন একটা অবস্থায় এনে দিতে পারেন, যাতে তার সাহায্যে সংখ্যার বদলে অক্ষর ছাপা হবে, তা হলেই আমাদের কাজ হয়ে যায়।
ব্যাপারটা কিন্তু আমার কাছে এখনও ঠিক—
আমরা এই কাজটা বিনা যন্ত্রে গত তিনশো বছর ধরে করে আসছি। অর্থাৎ আমাদের গুম্ফা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে। হয়তো কাজটা আপনি এখনও ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না, কিন্তু যদি একটু মন দিয়ে শোনেন, তা হলেই পারবেন।
বেশ তো।
আসলে ব্যাপারটা খুবই সহজ। আমরা একটা তালিকা প্রস্তুত করছি, যাতে ঈশ্বরের যতরকম নাম হয়, তার সবগুলিই থাকবে।
মানে–?
লামা নিরুদ্বিগ্নভাবে বলে চললেন, আমাদের বিশ্বাস, ঈশ্বরের কোনও নাম লিখতেই নটির বেশি অক্ষরের প্রয়োজন হয় না। অবিশ্যি, নাম লিখতে যে বর্ণমালা ব্যবহার হবে, সেটা নতুন এবং আমাদেরই তৈরি।
এই কাজ আপনারা তিনশো বছর ধরে করছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা অনুমান করি, কাজটা সম্পূর্ণ হতে লাগত আরও পনেরো হাজার বছর।
ডাঃ ওয়াগনার এখনও খেই পাচ্ছেন না। তিনি বললেন, বুঝলাম। এখন বুঝতে পারছি, কেন আপনারা কম্পিউটার ব্যবহার করার কথা ভাবছেন। কিন্তু এই কাজের আসল উদ্দেশ্যটা কী?
লামার মধ্যে যেন কিঞ্চিৎ ইতস্তত ভাব। ডাঃ ওয়াগনারের আশঙ্কা হল, তিনি বুঝি অজান্তে অপমানসূচক কিছু বলে ফেলেছেন। কিন্তু লামার উত্তরে কোনও বিরক্তি প্রকাশ পেল না।
এই কাজটা আমাদের আচারানুষ্ঠানের একটা অঙ্গ। আমরা এটাকে একটা কর্তব্য বলে মনে করি। যতরকম নামে মানুষ ঈশ্বরকে জানে–গড়, জেহোভা, আল্লা, ইত্যাদি–এগুলো সবই মানুষের দেওয়া নাম। এখানে অবিশ্যি কতগুলো দার্শনিক প্রশ্ন এসে পড়ছে যেগুলো আমি আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু নটি অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখে যদি আমরা সেগুলিকে পারমিউটেশন কম্বিনেশনের সাহায্যে পাশাপাশি বসিয়ে চলি, তা হলে আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের সবকটি নামই লিখে ফেলতে পারব। সেই বিন্যাসের কাজটা আমরা এতদিন যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই করে আসছি।
বুঝেছি–আপনারা AAAAAAAA থেকে শুরু করে ZZZZZZZZZ পর্যন্ত যেতে চান।
ঠিক তাই। যদিও–যে কথাটা বললাম–এক্ষেত্রে অক্ষরগুলো আমরাই তৈরি করেছি। সংখ্যা থেকে অক্ষরে পরিবর্তন করার কাজটা আপনাদের পক্ষে কঠিন হওয়ার কথা নয়। তবে এমন সার্কিট করা দরকার, যাতে অক্ষরগুলো যুক্তিসম্মতভাবে পরপর সাজানো হয়। যেমন, কোনও শব্দে একই অক্ষর পরপর তিনবারের বেশি ব্যবহার করা চলবে না।
তিনবার? না দু বার?
তিনবার। কেন তিনবার সেটা বোঝাতে গেলে বৃথা সময় নষ্ট হবে।
ওঃ, বললেন ডাঃ ওয়াগনার। আর কিছু বলার আছে কি?
আমার বিশ্বাস, আপনাদের যন্ত্রটিকে আমাদের কাজের উপযুক্ত করে তৈরি করে দিতে বেশি সময় লাগবে না। তার পরেই সংখ্যার বদলে অক্ষর-বিন্যাসের কাজটা শুরু হয়ে যেতে পারবে। আমার ধারণা, যে কাজটা আমাদের লাগত পনেরো হাজার বছর, সেটা যন্ত্রের সাহায্যে হয়ে যাবে একশো দিনে।
ডাঃ ওয়াগনারের ঘরের খোলা জানলা দিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরের ট্রাফিকের মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সে শব্দ তাঁর কানে প্রবেশই করছে না। তাঁর মন এখন সম্পূর্ণ অন্য জগতে বিচরণ করছে। যেখানে গগনচুম্বী পাহাড়গুলি প্রকৃতির সৃষ্টি, মানুষের নয়। সেই পাহাড়ের চুড়োয় গুম্ফায় বসে এই তিব্বতি সাধকেরা যুগের পর যুগ ধরে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তাদের অর্থহীন তালিকা তৈরি করে যাচ্ছে! মানুষের পাগলামির কি কোনও সীমা নেই? যাই হোক, তাঁর মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করা চলবে না। কথাই তো আছেদ্য কাস্টমার ইজ নেভার রং।
ডাঃ ওয়াগনার বললেন, এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, আমাদের মার্ক-৫ কম্পিউটারকে আপনাদের কাজের উপযুক্ত করে তৈরি করে দিতে পারি আমরা। আমি এখন যে কথাটা ভেবে চিন্তিত হচ্ছি, সেটা হল–আপনাদের গুম্ফাতে যন্ত্রটিকে বসানো, চালানো এবং তার পরিচর্যা নিয়ে। ওটাকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়াটাও তো একটা দুরূহ কাজ।
সে ব্যবস্থা আমরা করব। আপনাদের কম্পিউটারের অংশগুলো তেমন কিছু বড় নয়–যে কারণে আপনাদের মডেলটা বাছাই করেছি। ওটাকে একবার ভারতবর্ষে পৌঁছে দিতে পারলে বাকি পথটুকুর ব্যবস্থা আমরাই করব।
আর আপনি বলছিলেন, আমাদের এখান থেকে দুজন লোক নেওয়ার কথা?
হ্যাঁ। তিন মাসের জন্য। তার বেশি সময় নিশ্চয়ই লাগবে না।
সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে, বিষয়টা প্যাডে নোট করে নিয়ে বললেন ডাঃ ওয়াগনার। অবিশ্যি আরও দুটো ব্যাপার–
কথা শেষ করার আগেই লামা তাঁর আলখাল্লার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওয়াগনারের হাতে দিয়ে বললেন, এটা হল এশিয়াটিক ব্যাঙ্কে আমার কত টাকা জমা আছে তার সার্টিফিকেট।
ধন্যবাদ। হ্যাঁ–তা, এতে যথেষ্ট হবে বলেই মনে হয়। দ্বিতীয় ব্যাপারটা এতই মামুলি যে, সেটা উল্লেখ করতেও আমার সঙ্কোচ হচ্ছে–অথচ না করলেও নয়। আপনাদের ইলেকট্রিসিটির কী ব্যবস্থা?
১১০ ভোল্টে ৫০ কিলোওয়াট উৎপাদনকারী ডিজেল জেনারেটর। বছর পাঁচেক হল এটা বসানো হয়েছে এবং কাজ দিচ্ছে ভালই। এটা আসার পর থেকে গুম্ফার জীবনযাত্রা অনেক সহজ হয়ে গেছে। অবিশ্যি ওটা আনার মূল উদ্দেশ্য ছিল বড় বড় জপ-যন্ত্রগুলোকে চালানো।
তা তো বটেই, বললেন ডাঃ ওয়াগনার। এটা আমার অনুমান করা উচিত ছিল।
.
গুম্ফার ছাতের বেঁটে পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে নীচের দিকে চাইলে প্রথমে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঠিকই, কিন্তু ক্রমে সবই অভ্যাস হয়ে যায়। এই তিন মাসেও দু হাজার ফুট নীচে খাদের দৃশ্য বা দূরে উপত্যকায় শস্যক্ষেত্রের নানারকম জ্যামিতিক নকশা জর্জ হ্যানলির মনকে নাড়া দিতে পারেনি। সে এখন ছাতের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দূরের পর্বতশৃঙ্গগুলোর দিকে চেয়ে আছে। সেগুলোর নাম জানার কোনও ঔৎসুক্য সে বোধ করেনি। এমন বেয়াড়া অবস্থায় তাকে কোনও দিন পড়তে হয়েছে কি? নিশ্চয়ই না। গত তিন মাস ধরে মার্ক-৫ কম্পিউটারে উদ্ভট অক্ষরের সমষ্টি ছাপা রোলের পর রোল কাগজ বেরিয়ে আসছে। অক্ষরগুলির যতরকম সম্ভাব্য বিন্যাস হতে পারে, যান্ত্রিক টাইপরাইটারে তার প্রত্যেকটি ছেপে চলেছে অক্লান্তভাবে। কাগজের রোল বেরোনোর সঙ্গে। সঙ্গে লামারা প্রত্যেকটি শব্দ কাঁচি দিয়ে কেটে সেগুলোকে বিরাট বিরাট খাতায় সযত্নে সেঁটে ফেলছে। আর এক সপ্তাহে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কোন্ হিসাবের ভিত্তিতে যে এরা কথাগুলোকে ন-অক্ষরে সীমাবদ্ধ রেখেছে, তার রহস্য জর্জ হ্যানলির অজানা। একটা আশঙ্কা মাঝে মাঝে হ্যানলির বুক কাঁপিয়ে দেয়, সেটা হল এই যে, লামারা হয়তো হঠাৎ একদিন স্থির করবে যে কাজটা ২০৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চালানো দরকার। এদের পক্ষে সবই সম্ভব।
একটা ভারী কাঠের দরজা খোলার শব্দের সঙ্গে চা ছাতে এসে জর্জের পাশে দাঁড়াল। চাকের মুখে চুরুট–যে চুরুট লামাদের ভারী প্রিয় হয়ে উঠেছে। ধর্মযাজক হলেও এরা অল্পবিস্তর ফুর্তির স্বাদ গ্রহণ করতে বিমুখ নয়। এরা ছিটগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু গোঁড়া নয়।
চাক্ এসেছে একটা জরুরি বক্তব্য নিয়ে। যা শুনছি জর্জ, তাতে কিন্তু ব্যাপার গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে।
কী শুনছ? যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে না? জর্জের মতে এর চেয়ে বেশি গোলমেলের আর কিছু হতে পারে না। যন্ত্রের গণ্ডগোল হলে তাদের যাওয়া পিছিয়ে যেতে পারে, আর সেটাই হবে চরম বিপর্যয়। ইদানীং টেলিভিশনের রদ্দিমাকা বিজ্ঞাপনের ছবিগুলোর কথা ভেবেও জর্জের মন কেমন করে, কারণ সেগুলোও তো দেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়!
না না, বলল চাক্, সে ধরনের গোলমাল নয়। চাক সাধারণত ছাতের পাঁচিলে বসে না, কারণ তাতে তার বুক ধড়ফড় করে, কিন্তু আজ ও সেখানেই বসে বলল, আমি আসল ব্যাপারটা জেনে ফেলেছি।
তার মানে? ব্যাপার তো সবই আমাদের জানা।
আমরা যেটা জানি সেটা হল লামারা কী করতে যাচ্ছে, কিন্তু কেন করতে যাচ্ছে, সেটা তো জানতাম না। এখন সেটা জেনেছি, এবং সে এক অভাবনীয় ব্যাপার!
তোমার ওসব বাজে কথা ছাড়া তো?
কিন্তু লামা যে আমায় নিজে বলেছেন! তুমি তো জানো, উনি রোজ এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কম্পিউটার থেকে টাইপ করা কাগজের রোল বেরিয়ে আসা দেখেন। আজও এসেছিলেন এবং আজ কেন যেন অন্যদিনের তুলনায় ওঁকে বেশি উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছিল। আমি যখন বললাম যে আমাদের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, উনি আমাকে তাঁর অদ্ভুত ইংরিজি উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কোনওদিন এই কাজটার পিছনে আসল উদ্দেশ্যটা সম্বন্ধে কিছু অনুমান করেছি কিনা। আমি বললাম–সেরকম উদ্দেশ্য কিছু আছে নাকি? তখন ভদ্রলোক ব্যাপারটা বললেন।
কী বললেন?
এঁরা বিশ্বাস করেন যে, যখন ঈশ্বরের নামের তালিকা তৈরি হয়ে যাবে–এঁদের মতে নামের সংখ্যা হচ্ছে ন লক্ষ কোটি–তখন ঈশ্বরের কাজও ফুরিয়ে যাবে। সেইসঙ্গে মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল যে কাজ করার জন্য, তাও শেষ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়–এর পরে মানুষের পক্ষে কিছু করতে যাওয়াটাই হবে ঈশ্বরবিরোধী কাজ।
তা হলে আমরা এখন করছিটা কী? আত্মহত্যা?
সেটার প্রয়োজন কোথায়? তালিকা শেষ হলে পর ঈশ্বর নিজেই যা করার করবেন। অর্থাৎ–খেল খতম!
বুঝলাম। আমাদের কাজ শেষ হওয়া মানে পৃথিবীর কাজও খতম!
চাক্ একটা শুকনো হাসি হেসে বলল, আমি ঠিক সেই কথাটাই বলেছিলাম লামাকে। কিন্তু তার ফল কী হল জানো? উনি আমার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বললেন–ব্যাপারটাকে অত হালকাভাবে নিও না।
জর্জ একটুক্ষণ চিন্তিতভাবে চুপ করে থেকে বলল, কিন্তু এ ব্যাপারে কী করা উচিত, সেটা তো বুঝতে পারছি না। অবিশ্যি সেভাবে দেখতে গেলে যাই করি না কেন তাতে কিছু এসে যায় না। এরা যে বদ্ধ পাগল, সে তো জানাই আছে।
কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখো জর্জ-তালিকা শেষ হওয়ার পর যদি কিছু না ঘটে, পৃথিবী যেমন আছে তেমনই থেকে যায়, তা হলে দোষটা আমাদের ঘাড়ে পড়বে না তো? আমাদেরই যন্ত্র তো কাজটা করছে! ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেই ভাল লাগছে না।
কথাটা খুব ভুল বলোনি, জর্জ গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল। কিন্তু এ ধরনের ব্যাপার তো আগেও ঘটেছে। লুইসিয়্যানায় আমাদের ছেলেবেলায় এক ছিটগ্রস্ত পাদরি হঠাৎ একদিন বলে বসলেন–আসছে রবিবার পৃথিবীর শেষ দিন। বহু লোক তাঁর কথা বিশ্বাস করল। এমনকী, সেই বিশ্বাসে তাদের ঘরবাড়ি সব বিক্রি করে দিল। শেষটায় যখন কিছুই হল না, তখন কিন্তু তারা এই নিয়ে কোনওরকম মাতামাতি করল না। তারা ধরে নিল, পাদরির হিসেবে কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। আসলে ঘটনাটা ঘটবে ঠিকই, কিন্তু পরে।
যাই হোক, এটা যে লুইসিয়্যানা নয়, সে খেয়াল আশা করি তোমার আছে। এখানে কেবল আমরা দুজন শ্বেতাঙ্গ, বাকি হল তিব্বতি সাধকদের বিরাট দল। এঁরা তোক ভালই এবং সত্যিই যদি। লামার ভবিষ্যদ্বাণী না ফলে, তা হলে আমার ওঁর জন্য একটু কষ্টই হবে। কিন্তু তাও বলছি, এ সময়টা এখানে না থেকে অন্য কোথাও থাকলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করতাম।
সে-কথাটা আমার কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা যে চুক্তি সই করেছি। আর আমাদের ফেরত যাবার প্লেন না আসা পর্যন্ত তো আমরা কিছুই করতে পারছি না।
চাক্ চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দিল। তারপর প্রায় আপনমনেই বলল, অবিশ্যি আমরা ব্যাপারটা ভণ্ডুল করে দিতে পারি।
খেছে? ওতে আরও বিপদ।
আমি যেভাবে ভাবছি, তাতে বিপদ নেই। শোনো-। মেশিন চলবে আর চারদিন–দিনে চব্বিশ ঘণ্টা করে। আমাদের প্লেন আসবে এক হপ্তা পরে। বেশ। এখন ধরো যদি এর মধ্যে যন্ত্রে কোনও গণ্ডগোল হয়, দুদিন কাজ বন্ধ থাকে। গণ্ডগোল আমরা শুধরিয়ে দেব ঠিকই; কিন্তু সেটা করব একেবারে শেষ মুহূর্তে। আমরাও প্লেনে উঠব, আর ঈশ্বরের শেষ নামটিও উঠবে তালিকায়। তখন আমরা লামাদের আওতার বাইবে।
ব্যাপারটা আমার মনঃপূত হচ্ছে না, মাথা নেড়ে বলল জর্জ। এ ধরনের কারচুপি আমার ধাতে নেই ভায়া। তা ছাড়া এতে ওদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। নাঃ, যেমন চলছে চলুক, তাতে যা হওয়ার হবে।
.
সাতদিন পরে খচ্চরের পিঠে চড়ে প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জর্জ বলল, আমার এখনও ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। এটা ভেবো না যে, আমি ভয় পেয়েছি বলে পালাচ্ছি। আমার এই বুড়ো লামাগুলোর জন্য মমতা হচ্ছে। তারা যখন দেখবে যে, তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ফলল না, তখন। তাদের অবস্থা কী হয়, সেটা আমি দেখতে চাই না। আর আমাদের হেড লামার যে কী প্রতিক্রিয়া হবে, কে জানে।
চাক্ বলল, আশ্চর্য। –ওঁকে যখন গুডবাই করলাম, তখন কেন যেন মনে হল যে, উনি আমাদের মনের কথা সব জানেন, কিন্তু তাই নিয়ে কোনও উদ্বেগ বোধ করছেন না, কারণ মেশিন আবার ঠিকমতো চলছে, আর কাজও অল্পক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর–অবিশ্যি ওঁর মতে তারপর বলে আর কিছু নেই।
জর্জ ঘোড়ার পিঠে উলটোমুখে ঘুরে পাহাড়ের দিকে চাইল। এর পরে মোড় ঘুরে আর গুফাটাকে দেখা যাবে না। সূর্যাস্ত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আকাশের শেষ রঙের সামনে বিরাটাকৃতি গুফাটাকে দেখা যাচ্ছে। কালো প্রাসাদের গায়ে এখন সেখানে জানলার ভিতরে আলো, যেমন দেখা যায় সমুদ্রগামী জাহাজের গায়ে পোর্টহোলের ভিতরে। ওগুলো সবই জেনারেটর চালিত বৈদ্যুতিক আলো, এবং একই জেনারেটরে চলছে কম্পিউটার। আর কতক্ষণ চলবে যন্ত্র? ভবিষ্যদ্বাণী না। ফললে লামারা কি তাদের আক্রোশ প্রকাশ করবে ওই যন্ত্রকে ধ্বংস করে? না কি তারা আবার নিরুদ্বেগে শুরু করবে তাদের হিসাব?
গুম্ফায় ঠিক এই মুহূর্তে কী হচ্ছে সেটা অবিশ্যি জর্জের জানতে বাকি নেই। লামাপ্রবর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে যন্ত্রটার কাছে বসে আছেন। অপেক্ষাকৃত কমবয়স্করা তাঁদের সামনে এনে হাজির করছে যন্ত্র থেকে নতুন বেরিয়ে-আসা নামের তালিকা। লামারা নামগুলোর উপর চোখ বোলাচ্ছেন, তারপর সেগুলো কেটে কেটে খাতায় সেঁটে ফেলছেন। কারও মুখে কোনও কথা নেই, একমাত্র শব্দ হচ্ছে যান্ত্রিক টাইপরাইটারের, কারণ মার্ক-৫ কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে হাজার হিসাবের কাজ করে সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। জর্জ ও চাক্ তিন মাস ধরে এই কাজ দেখেছে। তাদের যে মাথা খারাপ হয়ে যায়নি, এটা পরম ভাগ্যি।
ওই দেখো, বলে উঠল চা সামনের উপত্যকার দিকে হাত বাড়িয়ে। আহা, কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে বলো তো!
জর্জ মনে মনে ভাবল–সত্যিই সুন্দর। পুরনো ডি-সি-থ্রি বিমানটা রানওয়ের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি রুপালি ক্রুশের মতো। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ওদের দুজনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে সভ্য জগতে, যেখানে তারা পাবে মুক্তি। উৎকৃষ্ট সুরাপানে যে আনন্দ হয়, চিন্তাটা মাথায় আসতে জর্জ সেই আনন্দ অনুভব করল।
হিমালয়ের হঠাৎ-রাত্রি এখনই তাদের গ্রাস করবে। তবে সৌভাগ্যক্রমে রাস্তা ভাল, আর দৃজনের কাছেই রয়েছে টর্চ। একমাত্র যদি না শীত হঠাৎ বেড়ে গিয়ে অস্বস্তির কোনও কারণ ঘটায়, এ ছাড়া কোনও চিন্তা নেই। মাথার উপরে মেঘমুক্ত আকাশে অগণিত অতি পরিচিত নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। জর্জের একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল যে, প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য হয়তো প্লেন না উড়তে পারে; কিন্তু এখন সে দুশ্চিন্তাও দূর হয়েছে।
জর্জের গলা দিয়ে গান বেরিয়ে এল; তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। পর্বত পরিবেষ্টিত এই বিশাল প্রান্তরে গানটা যেন কিঞ্চিৎ বেমানান। সে রিস্টওয়াচের দিকে চাইল।
আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া উচিত, সে চেঁচিয়ে জানাল পিছনে চাক-এর উদ্দেশে। তারপর আরও কতগুলো কথা সে জুড়ে দিল। কম্পিউটারের কাজ শেষ হল কিনা কে জানে। এখনই তো হওয়ার কথা।
চাক-এর কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে জর্জ উলটোমুখে ঘুরল। সে দেখল ঘোড়ার পিঠে চাককে–তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।
ওপরে চেয়ে দেখো, বলল চাক্।
জর্জ চাইল –হয়তো শেষবারের মতো।
মাথার উপরে সন্ধ্যার আকাশ থেকে নির্বিবাদে একটি একটি করে তারা মুছে যাচ্ছে।
দি নাইন বিলিয়ন নেমস্ অফ গড
সন্দেশ, কার্তিক ১৩৯১
কনওয়েকাস্লের প্রেতাত্মা
তারিণীখুড়ো তাঁর এক্সপোর্ট কোয়ালিটি বিড়িতে দুটো টান দিয়ে বললেন, ভূতের গল্প অনেকে বলতে পারে, তবে পার্সোনাল এক্সপিরিয়েন্স থেকে বলা গল্পের জাতই আলাদা। সেটা আর কজন পারে বলো।
আপনি পারেন? প্রশ্ন করল ন্যাপলা।
হুঁঃ, বলে খুড়ো অন্য দিকে চাইলেন।
তারিণীখুড়োর এক্সপিরিয়েন্সের স্টক যে অফুরন্ত সেটা আমরা জানি। এই সেদিন অবধি সারা দেশময় টোটো করে বেড়িয়েছেন। ভারতবর্ষের তেত্রিশটা শহরে ছাপান্ন রকম কাজ করেছেন। উপার্জনের জন্য। তবে এক বছরের বেশি কোনও কাজে টিকে থাকেননি–সে ব্যবসাই তোক আর চাকরিই হোক। এখন চৌষট্টি বছর বয়সে চরকিবাজি থামিয়ে কলকাতায় এসে রয়েছেন বেনেটোলা লেনে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে। এখানে বলে রাখি, তারিণীখুড়ো সকলেরই খুড়ো। বাবাও খুড়ো বলেন, আমিও বলি। ন্যাপলা একবার ওঁকে দাদু বলেছিল, তাতে খুড়ো মহা ক্ষেপে বললেন, এখনও বাস পেলে অক্লেশে হেঁটে আসি বেনেটোলা টু বালিগঞ্জ–দাদু আবার কী? খুড়ো বলবি।
আমি আর পাড়ার পাঁচটা ছেলে মিলে আমাদের দল। আমাদের বাড়িতেই আসেন তারিণীখুড়ো; এলেই খবর চলে যায়, আর পাঁচজন তুরন্ত চলে আসে খুড়োর গল্পের লোভে। একটা গল্পে পুরো একটা সন্ধে কেটে যায়। খুড়ো বলেন আর্টের খাতিরে খানিকটা রং চড়ানো ছাড়া গল্পগুলো ষোলো আনা সত্যি।
আমি তখন থাকি পুনায়, বললেন তারিণীখুড়ো।
পুনে বলল ন্যাপলা।
একটা গল্পের গন্ধ পাচ্ছি, ন্যাপলা যাতে বারবার ইনটারাপ্ট না করে তাই তার কোমরে একটা চিমটি কেটে দিলাম।
ওই হল, বললেন তারিণীখুড়ো, পুনে-পুনা, মুম্বাই-বোম্বাই, তিরুচিরপল্লী-ত্রিচিনপলি–যে-কোনও একটা বললেই হল। আর আমি যখনকার কথা বলছি তখন সবে স্বাধীনতা এসেছে; পুনার পুনে হতে অনেক দেরি। পন্টু একটা চা বলো।
আমি লক্ষ্মণকে ডেকে চা অর্ডার দিলাম–দুধ-চিনি ছাড়া চা–আর খুড়ো তাঁর গল্প শুরু করলেন।
.
আমি রয়েছি আমার এক বন্ধু রাধানাথ চ্যাটুজ্যের বাড়ি। সে ফাগুসন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক। কোডামায় মাইকা মাইনসের কাজে ইস্তফা দিয়ে শিবাজীর দেশে এসেছি একটা হোটেলের ম্যানেজারি নিয়ে। আমার বয়স তখন চৌত্রিশ।
পৌঁছাবার দুদিনের মধ্যেই রাধানাথ নিয়ে গেল উকিল ঘনশ্যাম আপ্টের বাড়ি। সেখানে সন্ধ্যায় আড্ডা বসে, পাঁচ মেশালি আচ্ছা, যাকে বলে মিক্সড ক্রাউড। আমরা তিনজন ছাড়া আসে মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কের এজেন্ট মিঃ যোশী, ম্যাকডারমট কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী মিঃ হরিহরণ, পুলিশ ইনস্পেক্টর মিঃ আগাশে আর তরুণ সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি।
কুরেশির বয়স আমাদের মধ্যে সব চেয়ে কম, ত্রিশ পৌঁছায়নি। তুখোড় ছেলে, হ্যান্ডসাম চেহারা, চোখে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি। সে আসে হরিহরণের সঙ্গে দাবা খেলতে। তাঁরা ঘুটি এঘর ওঘর করেন, আর আমরা বাকি পাঁচজনে মারি আড্ডা। সবচেয়ে বেশি কথা বলেন বাড়ির কর্তা আপ্টে সাহেব নিজে। আমার বিশ্বাস তাঁর কথা বলার প্রয়োজনেই এই আড্ডার সৃষ্টি। কিছু লোক আছে যারা সাঙ্গোপাঙ্গ ছাড়া বাঁচতে পারে না। এই সাঙ্গোপাঙ্গ যদি তোষামুদে হয় তা হলে তো কথাই নেই। অবিশ্যি আড্ডার সকলে আপ্টেকে তোষামোদ করে বললে ভুল হবে, তবে ওঁর মতামতের প্রতিবাদ কেউ করে না।
আগাশের মতো খোশ মেজাজের দারোগা আমি আর দুটি দেখিনি। অবিশ্যি যখন প্রথম আলাপ তখন তিনি একটা ব্যাপারে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সম্প্রতি কিছু টাটকা জালনোট পাওয়া গেছে পুনাতে। জালিয়াত কারা এবং তাদের আস্তানাটা কোথায় তাই নিয়ে পুলিশ দপ্তরে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। আগাশেকে তাই মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে দেখা যায়।
দলের মধ্যে স্বল্পভাষী হলেন মিঃ যোশী; তবে শ্রোতা হিসেবে তিনি চমৎকার। সব কথাই উদগ্রীব হয়ে শোনেন। হসির কথায় ঘর কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করেন, দুঃখের কথায় তাঁর জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ শুনে আপ্টের পোষা ড্যালমেশিয়ন বারান্দা থেকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে যোশীর কাছে চলে এসেছে, এ ঘটনা বহুবার ঘটেছে।
আমার স্টকে হাজার গল্প, বাংলার বাইরে বছরের পর বছর কাটিয়ে ইংরিজিটাও বেশ রপ্ত, তাই। আমার একটা বেশ ভাল পোজিশন হয়ে গেল আপ্টের আড্ডায়।
কী প্রসঙ্গে মনে নেই, একদিন কথা উঠল অশরীরী আত্মার। দেখা গেল আপ্টে ছাড়া আর সকলেই ভূতে বিশ্বাস করে। আমি আপুটেকে বোঝালুম যে পুরাণ, শেক্সপিয়র, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথ, দেশবিদেশের উপকথা, সবেতেই ভুতের উল্লেখ আছে, কাজেই ভুতে বিশ্বাস না করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। আপ্টে তবু মাথা নাড়ে। সে বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিবাদী মন তার, খালি বলে ভূত জিনিসটা ভুয়ো।
হঠাৎ কেন জানি রোখ চেপে গেল, ধাঁ করে হাজার টাকা বাজি ধরে ফেললুম। বললুম দুমাসের মধ্যে ভূত দেখিয়ে দেব তোমায়। আটে হেসে উড়িয়ে দিলে। বললে–সাবধান। হাজার টাকা খোয়া যেতে চলেছে তোমার এটা তোমায় বলে দিলাম।
অবিশ্যি আমার দিক থেকে ব্যাপারটা অতিমাত্রায় রিস্কি হয়ে গিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। রাধানাথের কাছে ভর্ৎসনাও শুনতে হয়েছিল; কিন্তু বাজির ব্যাপারে দাবার মতোই চাল ফেরত নেওয়া যায় না। কাজেই ব্যাক-আউট করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
এরই দিন সাতেক বাদে আমাদের আড্ডায় এলেন প্রোফেসর অটো হেলমার। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের বাসিন্দা। ভদ্রলোক পক্ষিবিদ, ভারতবর্ষে এসেছেন ভারতীয় পাখির ডাক রেকর্ড করতে। টেপ রেকর্ডার জিনিসটা তখন সবে আবিষ্কার হয়েছে, সাহেবের কাছেই প্রথম দেখলুম সেই আশ্চর্য যন্ত্র। আমাদের নানারকম পাখির ডাক শুনিয়ে সাহেব বললেন পুনায় এক জায়গায় তিনি নাকি হুতোম প্যাঁচার ডাক শুনেছেন। সেইটে রেকর্ড করতে পারলেই নাকি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। প্যাঁচার ডাকের ভাল রেকর্ডিং তিনি এখনও পাননি।
কোথায় শুনলে ডাক? প্রশ্ন করলেন আপ্টে।
তাতে হেলমার সাহেব একটা বাড়ির বর্ণনা দিলেন–দুর্গ প্যাটার্নের প্রাচীন পরিত্যক্ত সাহেব বাড়ি। সেন্ট মেরি গিজার পুব পাশে। তারই কম্পাউন্ডে নাকি দুরাত আগে প্যাঁচাটা ডাকছিল। সাহেব ছিলেন গাড়িতে। সঙ্গে টেপরেকডার। চলন্ত অবস্থাতেই ডাকটা শুনে গাড়ি থামিয়ে নেমে কম্পাউন্ডের পাঁচিলের ধারে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কোনও ফল হয়নি। পাচা আর ডাকেনি।
বাড়ির বর্ণনা এবং অবস্থান শুনে আমাদের অনেকেই বললেন যে সেটা কনওয়ে কাল। এখানে বলা দরকার যে ব্রিটিশ আমলে পুনা ছিল সাহেবদের একটা বড় ঘাঁটি। মিলিটারি তো বটেই, সিভিলিয়ানও অনেক থাকতেন পুনা শহরে। তাঁরা অনেকেই রিটায়ার করার পর পুনাতে বাড়ি করে সারাজীবন সেখানেই কাটিয়ে দিতেন। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে ছিলেন এই রকম একজন সাহেব। তাঁরই তৈরি বাড়ি এই কনওয়ে কাল্প। কুরেশি বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানে, সেই বললে। বাড়িটা তৈরি হয় কুইন ভিক্টোরিয়া যে বছর ভারত-সম্রাজ্ঞী হন সেই বছর। অর্থাৎ ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে। কনওয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করার ছমাসের মধ্যে নাকি তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছেলে মারা যায়। ছেলেরা অবিশ্যি বাড়িতে মরেনি; তারা দুজনেই ছিল আর্মিতে, মরেছিল দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে। স্ত্রী মারা যায় যক্ষ্মারোগে। আর তার তিনমাসের মধ্যে কনওয়ে নিজেও মরে। কীভাবে মরে জানা যায়নি। তবে অনেকের ধারণা সে আত্মহত্যা করে।
মোট কথা সেই থেকে এই বাড়ি অভিশপ্ত বাড়ি বলে পরিচিত। কেউ আর সে বাড়িতে থাকেনি। সকলের পক্ষে সম্ভবও হত না, কারণ এত পেল্লায় বাড়ি মেনটেন করা মুখের কথা নয়। আসবাবপত্র যা ছিল সবই নাকি কনওয়ের এক আত্মীয় বিলেত থেকে এসে নিলামে বিক্রি করে দেয়।
রাধানাথ সব শুনে-টুনে বলল, কনওয়ে কাপ্ল সম্বন্ধে একটা ঘটনা শুনেছি সেটা স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
কোন স্বদেশি আন্দোলন? প্রশ্ন করলেন আপ্টে।
বালগঙ্গাধর তিলকের সময়কার, বললে রাধানাথ। উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে। মেজর লেথব্রিজ বলে এক সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল এক সন্ত্রাসবাদী দল। তারা নাকি ওই কাসূলে তাদের গুপ্ত ডেরা করেছিল। পরে আত্মসমর্পণ করে। তবে তাদের লিডার আচরেকারকে নাকি ধরা যায়নি। সে বেপাত্তা হয়ে যায়।
কনওয়ে কালে খোঁজ করা হয়েছিল কি? আপৃটে প্রশ্ন করলেন। আগাশে হো হো করে হেসে উঠলেন।
মিঃ আপ্টে–পুলিশও মানুষ। তাদেরও ভুতের ভয় আছে। ওই অভিশপ্ত বাড়ি রেড করতে গেলে রীতিমতো হিম্মৎ লাগে।
এদিকে আমার কৌতূহল চাগিয়ে উঠেছে। ছেলেবেলা থেকেই ডানপিটেমোর শখ। সেটা চৌত্রিশ বছরেও পুরোপুরি বজায় আছে। পর পর অতগুলো মৃত্যু যেখানে ঘটেছে, সেই বাড়ির ভেতরে দু-একটা প্রেতাত্মা বসবাস করবে না কি? বাজি জেতার পক্ষে এ যে একটা বড় সুযোগ।
এর কিছুদিন পরেই হেলমার সাহেব আবার এলেন আড্ডায় তাঁর টেলিফুংকেন টেপ রেকর্ডার নিয়ে। ভদ্রলোকের বাঁ কব্জিতে ব্যান্ডেজ। বললেন কাঁটা ঝোপে হাত কেটে গেছে। মুখের ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে না সুখবর না দুঃসংবাদ। তাঁকে বসতে দিয়ে সকলেই তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলুম। হুতোমের ডাক শোনা যাবে কি?
হেলমার কপালের ঘাম মুছে বললেন, ডাক তুলতে পেরেছি, তবে পারফেক্ট হল না। রাত বারোটার পর প্যাঁচাটা ডাকল, সঙ্গে সঙ্গে মেশিন চালু করলাম। তখন শহরের অন্য শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। নিয়মমতো নিখুঁত রেকর্ডিং হবার কথা, কিন্তু দেখ কী হয়েছে।
শুনলাম প্যাঁচার ডাক। ছেলেবেলা আমাদের বাদুড়বাগানের বাড়ির পাঁচিলের ওপারে পুকুরের ধারে শ্যাওড়া গাছে একটা হুতোম প্যাঁচা থাকত, তাই তার ডাক চেনা ছিল। ইনিও যে হুতোম তাতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ তাকে সত্যিই বড্ড ডিস্টার্ব করছে। সাহেবের এত মেহনত ষোলো আনা সার্থক হল না জেনে তাঁর প্রতি মমতা হল।
বাট হোয়াট ইজ দ্যাট আদার সাউন্ড? প্রশ্ন করল কুরেশি। সে দাবা ছেড়ে এগিয়ে এসেছে।
সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বললেন হেলমার। মেশিনেই গণ্ডগোল বলে মনে হচ্ছে। এর আগে তো এ রকম হয়নি কখনও।
শুনলে মনে হয় একটা যান্ত্রিক শব্দ। ঘটাং ঘটাং ঘটাং ঘটাং এই রকম। খুবই ক্ষীণ, কিন্তু জার্মান পক্ষিবিদ-এর মন যে তাতে খুঁত খুঁত করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
প্লে দ্যাট এগেন প্লিজ! হঠাৎ বলে উঠলেন ইনস্পেক্টর আগাশে। তাঁর শরীরটা টান, আর চোখে এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি–শিকারের গন্ধ পেলে যেমন হয় হিংস্র জানোয়ারের।
হেলমার টেপটা ব্যাক করে আবার চালালেন। আগাশে কোমর থেকে শরীরটা ভাঁজ করে কানটা নিয়ে গেছেন একেবারে স্পিকারের সামনে।
ততক্ষণে অবিশ্যি আমিও বুঝে গেছি আগাশে কী ভাবছেন।
শব্দটা শুনে প্রিন্টিং মেশিনের কথা মনে হয়। ছোট, পায়ে-চালানোর কল। যাকে বলে ট্রেল মেশিন।
এইরকম যন্ত্রই সাধারণত ব্যবহার হয়ে থাকে নোট জাল করার কাজে।
শব্দটা কাসলের ভিতর থেকেই আসছে না অন্য কোথাও থেকে আসছে সেটা অবিশ্যি বোঝার কোনও উপায় ছিল না। কিন্তু আগাশে স্থির করলেন যে কনওয়ে কাসূলে পুলিশের রেড হবে। আগাশের হুমকিতে নাকি কিছু কস্টেবল রাজি হয়েছে অভিশপ্ত দুর্গে প্রবেশ করতে। এমনি খোশমেজাজ হলে কী হবে, অফিসার হিসেবে নাকি ভদ্রলোক অত্যন্ত কড়া।
আমি কিঞ্চিৎ নিরাশ বোধ করছি। জালিয়াতরা যেখানে আস্ত। না গেড়েছে সেখানে ভূত থাকার কোনও সম্ভাবনা আছে কি? মনে তো হয় না।
পরদিনই রাত্তিরে রেড, আড্ডার সকলে ফলাফলের জন্য উদগ্রী, এমন সময় ইনস্পেক্টর সাহেব এসে হাজির।
সেকী, তোমাদের তো আজই রেড হবার কথা।
আমাদের হয়ে আপ্টেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
আগাশে একটা বোকা হাসি হেসে মাথা নেড়ে সোফায় বসে পড়লো।
ভাবতে পার? আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সে গ্যাং ধরা পড়েছে।
কোথায়? আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করে উঠলাম।
নাসিক, বললেন আগাশে।
তা হলে ওই শব্দটা…?
টেপরেকর্ডারেই কোনও গণ্ডগোল হবে। ওটা বাইরের কোনও শব্দ না। কাল মাঝ রাত্তিরে আমি কাসূলের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে কোনও শব্দ পাইনি।
আর কিছু বলবার নেই। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে একটা বেলুন চুপসানো ভাব, অথচ তার কোনও কারণ নেই। জালিয়াতের দল ধরা পড়েছে এ তো ভাল কথা; শুধু পুনার কনওয়ে কাসূলে ধরা না পড়ে পড়েছে অন্য শহরের অন্য জায়গায়। কিন্তু তাও বলতে হবে যা ঘটেছে তার মধ্যে যেন নাটকের অভাব।
অবিশ্যি পরমুহূর্তেই মনে হল–জালিয়াত যখন নেই, তখন ভূত থাকতে বাধা কী? কনওয়ে কাসূলে একবার হানা দিলে দোষ কী?
চা-টা শেষ করে আমিই কথাটা পেড়ে বসলাম, কে কে যেতে রাজি আছ বলো।
যোশী গোড়াতেই বললে তার ধুলোয় অ্যালার্জি, তাই ওই পোড়ো বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। হরিহরণ বললেন, আমি যাব, কিন্তু আপ্টে সাহেবেরও যাওয়া চাই। ভূত যদি থাকে তো সেটা ওঁর চাক্ষুষ দেখা উচিত। আমাদের কথা উনি মানতে নাও পারেন।
আপ্টে বললেন, ঠিক আছে, আমি যাব। এবং আমি সঙ্গে ক্যাশ হাজার টাকা নিয়ে যাব। আমার কন্ডিশন হল যে মিঃ ব্যানার্জিও যেন সঙ্গে টাকা রাখেন। বাজির টাকা ফেলে রাখা নিয়মবিরুদ্ধ।
আমি বললুম, তথাস্তু। তা হলে কালই হোক এক্সপিডিশন।
এইভেনে কুরেশি বললে তাকে নাকি দুদিনের জন্য কোলাপুর যেতে হবে একটা রিপোর্টিং-এর ব্যাপারে; ফিরে এসে সে যেতে প্রস্তুত আছে। আমরাও তাতে রাজি হয়ে গেলুম।
আগাশে এতক্ষণ চুপ করে আমাদের কথা শুনছিলেন; এবার তিনি মুখ খুললেন।
জেন্টলমেন, তোমাদের একটা প্রশ্ন করতে চাই। কালের সদর দরজা যদি তালা দিয়ে বন্ধ থাকে, তা হলে সেটা খোলার যন্ত্র, বা জানালা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম–এসব তোমাদের আছে কি? কাজটি কিন্তু সহজ নয়।
এ প্রশ্নের জবাব অবিশ্যি হ্যাঁ হতে পারে না। আমাদের যেটা আছে সেটা হল উৎসাহ আর উদ্যম। যন্ত্রপাতি থাকবে কোত্থেকে?
আমরা এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি দেখে আগাশে একটু হেসে বললেন, কাজেই বুঝতে পারছ, আমি ছাড়া তোমাদের গতি নেই।
ভালই হল। শুধু জানালা দরজা ভেঙে খোলার সরঞ্জাম নয়, একটি আগ্নেয়াস্ত্রও থাকবে সঙ্গে এটাও কম ভরসা নয়।
.
জুন মাস, দিনে বেজায় গরম, রাত্তিরের দিকটা তবু একটু ঝিরঝির হাওয়া দেয়। বন্দোবস্ত অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া সেরে ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় আমরা দুজন সেন্ট মেরি গিজার সামনে জমায়েত হলাম। পাড়াটা নির্জন, গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। আমরা দল বেঁধে এগোলাম কনওয়ে কাসূলের দিকে।
ফটক থেকে কাসূলের দরজা অবধি লম্বা রাস্তা। এককালে বাহার ছিল রাস্তাটার সেটা আঁচ করা যায়, এখন পথ বলতে প্রায় কিছুই নেই, টর্চের আলোয় কোনওরকমে আগাছা বাঁচিয়ে পা ফেলতে হয়। বাড়িটা আমাদের সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে এক বিশাল প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, কেউ যে কস্মিনকালেও সেখানে ছিল সেটা এখন আর বিশ্বাস হয় না। দলে আছি বলে রক্ষে, না হলে যতই ডানপিটে হই না কেন, আশি বছরের মধ্যে মানুষের পা পড়েনি এমন একটা থমথমে অন্ধকার অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে বুকের মধ্যে যে একটা ট্রেল মেশিন চলতে শুরু করেছে, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না।
আগাশে সদর দরজায় ঠেলা দিতেই সেটা একটা জান্তব আর্তনাদ করে ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর সেই সঙ্গে ইঁদুর বাদুড় পায়রা চামচিকে গিরগিটি ছুঁচো মেশানো একটা গন্ধর ধাক্কায় আমরা সকলেই বেশ কয়েক হাত পিছিয়ে গেলুম।
তারপর দুরু দুরু বক্ষে সবাই মিলে ঢুকলুম ভেতরে। এটা ল্যান্ডিং, বাঁ দিকে চওড়া কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। আগে একতলা সেরে তারপর দোতলায় যাব এটাই আমার ইচ্ছে ছিল, দেখলাম সকলেই তাতে সায় দিলে। আমরা সার বেঁধে গিয়ে ঢুকলুম একটা বিশাল ঘরে। সম্ভবত ডাইনিং রুম ছিল এটা। সারা ঘরে একটিও আসবাব নেই ঠিকই, কিন্তু দেয়ালে ধূলিমলিন ওয়ল পেপারের উপর বড় বড় ছবির ফ্রেমের দাগ রয়েছে, খান তিনেক দেয়ালবাতির মর্চে ধরা ব্র্যাকেট রয়েছে, আর সিলিং থেকে ঝুলে আছে ঝাড়লণ্ঠন আর টানাপাখার হুক। এটার কড়িকাঠেই বাদুড় ঝোলার কথা, তবে তারা বোধহয় রাত্তিরে খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে। এত বড় বাড়ির এতগুলো জানালার মধ্যে কয়েকটা কি আর ভোলা নেই? বাদুড় না থাকলেও, ছোটখাটো চতুষ্পদ প্রাণী যে কিছু রয়েছে সেটা মেঝের এদিক ওদিক থেকে সড়াৎ সড়াৎ শব্দেই বুঝতে পারছি।
এতক্ষণ সবাই একটা জমাট দল বেঁধে চলাফেরা করছিলুম, বড় ঘর পেয়ে সেটা কিছুটা আলগা হল। কুরেশি দেখলুম একাই একটা টর্চ নিয়ে হল ঘরের পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আপ্টেও খানিকটা এগিয়ে গেছে আমাদের ছেড়ে, তারও নিজস্ব একটি টর্চ আছে। ভূত এখনও চোখে পড়েনি ঠিকই, কিন্তু এর চেয়ে ভাল ভৌতিক পরিবেশ আর কী হতে পারে আমি জানি না।
হলঘরের একটা দরজা দিয়ে ডাইনে ঘুরে একটা প্যাসেজ পড়ল। সেটার ডাইনে বাঁয়ে দুদিকেই ঘরের সারি। আগাশে তার পাঁচ-সেলের টর্চ জ্বেলে এগিয়ে চলল প্যাসেজ ধরে। আমরা তার পিছনে। ঘর পড়লে দরজা দিয়ে আলো ফেলে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি।
এইভাবে পাঁচখানা ঘর দেখার পর একটা ঘটনা ঘটল যেটা ভাবতে এখনও গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
একটা গোঙানির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বাঁয়ের একটা দরজা থেকে পিছন ফিরে টলতে টলতে বেরিয়ে এল কুরেশি। তার মুখ দেখতে না পেলেও, আতঙ্কের ছাপ রয়েছে সর্বাঙ্গে সেটা বুঝতে পারছি। ঘাড় কুঁজো, হাত দুটো পিছনে এবং কনুই-এর কাছে ভাঙা, হাতের আঙুলগুলো ফাঁক।
আগাশের সঙ্গে আমরাও দৌড়ে গেলাম কুরেশির দিকে। আটেও এখন আমাদেরই সঙ্গে রয়েছে।
কী হল? কী ব্যাপার? আগাশে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করলে।
কুরেশি কাঁপা হাত দিয়ে খোলা দরজার দিকে দেখিয়ে দিলে।
ঘরের ভিতর আলকাতরা অন্ধকার। আগাশে তার টর্চটা ফেলতে প্রথমে বিপরীত দিকের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। তারপর টর্চটা একটু তুলতেই যা দেখলুম তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল।
সিলিং থেকে ঝুলছে দড়ি, আর সেই দড়ি ফাঁস দিয়ে বাঁধা একটি আস্ত নরকঙ্কালের গলায়।
ধন্যি ইন্সপেক্টর আগাশে। এই চরম আতঙ্কের মুহূর্তেও সে দিব্যি ঠাণ্ডা গলায় বললে, ইনিই সেই স্বদেশে গ্যাঙের লিডার আচরেকর বলে মনে হচ্ছে। এই কারণেই বেপাত্তা হয়ে গেছিলেন ভদ্রলোক।
বাট এ স্কেলিটন ইজ নট এ গোস্ট।
ঠিকই বলেছেন মিঃ আপ্টে। এবং তিনিও যেমন দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে বললেন কথাটা, তাতে তাঁর নার্ভের তারিফ না করে পারা যায় না।
সরি বললে কুরেশি, হঠাৎ সামনে কঙ্কালটা দেখে একটু বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম।
কিন্তু ওটা কী?
প্রশ্নটা করলেন আগাশে। তাঁর টর্চের আলো এখন সিলিং থেকে নীচের দিকে নেমেছে।
ঘরের কোণে ধুলো আর মাকড়সার জালে মুড়ি দেওয়া কীসের জানি একটা স্তূপ।
আলোটা ভাল করে ধরতে বুঝতে পারলুম জিনিসটা কী, আর পেরে একেবারে তাজ্জব বনে গেলুম।
এ যে দেখছি ট্রেডল মেশিন! এখানে ছাপার যন্ত্র কী করছে?
আগাশে ব্যাপারটার একটা খুব সহজ এক্সপ্ল্যানেশন দিয়ে দিলেন। বললেন, এটা যদি সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি হয়ে থাকে তা হলে ছাপার কল থাকা অস্বাভাবিক নয়। এক নম্বর—তাদের মুখপত্র লুকিয়ে ছাপবার জন্যে কলের দরকার হত; দুই সন্ত্রাসবাদীরা টাকার প্রয়োজনে নোট জাল করেছে এও অনেক শোনা গেছে।
রাধানাথ এ কথায় সায় দিল।
মাথার উপর ঝুলন্ত কঙ্কাল আর তার নীচে নির্জীব যন্ত্রটা অদ্ভুত ভাবে যেন এক অতীত যুগের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে কি? প্রশ্ন করলেন মিঃ আপ্টে।
আমরা সকলেই বললাম যে যখন এসেছি তখন সারা বাড়িটা না দেখে ফিরব না। আমিই অবিশ্যি কথাটায় সবচেয়ে বেশি জোর দিলাম। কঙ্কাল হল মৃতব্যক্তির দেহের পরিণাম। তার আত্মা কী অবস্থায় আছে তা কে বলতে পারে?
প্যাসেজ দিয়ে যখন উলটোমুখে অর্ধেক পথ এসেছি তখন শুনতে পেলাম সেন্ট মেরি চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। ঘণ্টার রেশ মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা শব্দ শুরু হল যেটা আমাদের হাঁটা বন্ধ করে দিল।
যে ঘর থেকে এলাম, সে ঘর থেকেই আসছে শব্দটা।
ট্রেডল মেশিন চলতে শুরু করেছে, আর তার শব্দে সারা কনওয়ে কাসল গম্ গম্ করছে। সেই সঙ্গে মাথার উপর ডানার ঝটপটানি শুরু হয়েছে, কারণ ঘুলঘুলির বাসিন্দা পায়রাগুলোর ঘুম ভেঙে গেছে প্রেসের শব্দে।
আমরা ছজনে রুদ্ধশ্বাসে শব্দটা শুনছি। দ্বিতীয়বার ওই ঘরের দিকে যাবার কোনও মানে নেই, কারণ জানি সে ঘরে যন্ত্র চালানোর মতো কোনও লোক নেই। হয়তো ওই আচরেকারই এককালে যন্ত্রটা চালিয়েছে। তারপর এক সময়ে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে লাঞ্ছনা এড়াবার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। আর সেই থেকে প্রতিদিন মাঝরাত্তিরে তার প্রেতাত্মা ওই ট্রেড়ল মেশিন চালিয়ে এসেছে। তার মানে হেলমারের রেকর্ডারে যে শব্দটা উঠেছিল সেটা এটারই শব্দ।
কনওয়ে কালের বাইরে বেরোবার পর বেশ কিছুক্ষণ কারুর মুখে কথা নেই। হরিহরণ অসুস্থ বোধ করছে, সে গিয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়ল। কথা ছিল আপ্টে তার গাড়িতে আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে। তার ডজ সিডানে ওঠার আগে সে আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল, টেন হানড্রেডরুপি নোট্রস-গুনে নাও।
আমার তখন রীতিমতো অসোয়াস্তি লাগছে। তবে এ তো আর এলেবেলে খেলা নয়–এ বেট ইজ এ বেট।
খাম থেকে নোটের গোছাটা বার করে রাস্তার আলোতে একবার দেখে নিলুম। দশখানাই আছে।
তিনদিন পরে এক শনিবারের সন্ধ্যায় নেপিয়ার হোটেলে ডিনার হল। আমিই খাওয়ালুম। তখনকার সস্তাগণ্ডার দিনে সাত জনের বিল হল একশো নব্বই টাকা। আজ হলে বড় হোটেলে সাত জনের ফাইভ-কোর্স ডিনার হাজার টাকায় হত কি না সন্দেহ।
গল্প শুনে ন্যাপলা বলল, তা হলে খুব দাঁও মারলেন বলুন।
খুড়ো উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন, কারণ সদ্য আনা তৃতীয় কাপ চায়ে গলা ভেজানো আছে, তারপর বিড়ি ধরানো আছে।
তা বটে, অবশেষে বললেন খুড়ো, তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
আরও আছে? আমরা সকলেই প্রশ্ন করলাম। এর পরে আর কী থাকতে পারে সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না।
তারিণীখুড়ো বলে চললেন—
.
ঘটনার কদিন পরে এক সকালে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল আমাদের আড্ডার সাংবাদিক আনওয়র কুরেশি। বললে, আমার গাড়ি আছে, তোমাদের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। বিশ মিনিট স্পেয়ার করতে পারবে?
কৌতূহল হল। রাধানাথ আর আমি গিয়ে উঠলুম তার গাড়িতে। কুরেশি নিজেই ড্রাইভ করে। কিছুদুর যেতেই বুঝলাম গাড়ি চলেছে আবার সেই কনওয়ে কাসূলের দিকে। কেন যাচ্ছে সে কথা বললে না ছোরা, খালি বললে এ কদিনে সে নাকি আরও তথ্য আবিষ্কার করেছে কনওয়ে সাহেব সম্বন্ধে।
একটি খবর নাকি বিলিতি কাগজে ছাপেনি, দিশি কাগজে পেয়েছে সেটা কুরেশি। ব্রিগেডিয়ার কনওয়ে তাঁর এক পাংখাবরদারকে বুট দিয়ে লাথিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। তাতে রাধানাথ বললে সেটা নাকি সে-যুগের একটা স্বাভাবিক ঘটনা। গরমকালে মাঝরাত্তিরে পাংখাবরদার পাখা টানতে টানতে ঘুমিয়ে পড়ত। মশার কামড়ে ঘুম ভেঙে যেত সাহেবের। আর তখন রাগে দিকবিদিকজ্ঞান হারিয়ে এমন প্রহার করত ভৃত্যকে যে সে বেচারা অনেক সময় মরেই যেত।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গাড়ি গিয়ে থামল কনওয়ে কাসূলের গেটের সামনে।
কুরেশির পিছন পিছন আমরা গিয়ে ঢুকলাম কাসূলের ভেতর। দিনের বেলাও রীতিমতো অন্ধকার, ঢুকলে গা ছমছম করে।
আমরা কি আবার সেই ঘরেই যাচ্ছি?
রাধানাথের এ প্রশ্নের কোনও জবাব দিলে না কুরেশি। তবে তার লক্ষ্য যে ওই একই ঘরের দিকে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কী দেখব কে জানে। শিরার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য অনুভব করছিলুম। কুরেশি ছোঁকরা নির্বিকার।
আর তা হবে নাই বা কেন। সে ঘর যে খালি! দড়ি কঙ্কাল, ছাপার যন্ত্র, সব হাওয়া!
আমাদের হতভম্ব ভাব দেখে কুরেশি হো হো করে হেসে উঠলে। তারপর এক অদ্ভুত প্রশ্ন করলে।
আপ্টের বাড়িতে চা ছাড়া কিছু খেয়েছ কখনও? প্র
শ্নটা অপ্রত্যাশিত হলেও বললুম, কই, না তো!
ওই তো! বললে কুরেশি। লোকটা হাড় কঞ্জুস। তা ছাড়া ওর আত্মম্ভরি ভাবটাও মাঝে মাঝে ইরিটেট করে আমাকে। তুমি বাজিটা ফেলে মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ করনি। তোমার নির্ঘাৎ হাজার টাকা খসত। তাই ভাবলাম কনওয়ে কালে যদি ভূতের ব্যবস্থা করতে পারি তা হলে তোমারও লাভ, উনিও জব্দ। তাই দুদিন সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। কঙ্কালটা আমার বন্ধু আর্টিস্ট কুলকার্নির বাড়ি থেকে আনা। ট্রেড়ল মেশিনটা শিবাজী জব প্রেসের। প্রোপ্রাইটার মধুকর ঢেঢ়ির ছেলে আমার সঙ্গে ইস্কুলে পড়ত। ওটার জন্যে কিছু দক্ষিণা লাগবে; আর ওদেরই আপিসের এক ছোঁকরা অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল; সে-ই কলটা চালায়। বেচারা অনেক মশার কামড় খেয়েছে। তাকে কিছু বকশিস দিয়েছি–
আমি আর কথা বলতে দিলুম না কুরেশিকে। এক হিসেবে পুরো টাকাটাই ওর প্রাপ্য, কিন্তু পাঁচশোর বেশি কিছুতেই নিতে রাজি হল না।
প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে যখন ল্যান্ডিং-এ এসেছি, তখন কুরেশি বললে, একবার দোতলায় যাবে নাকি? দেখবার জিনিস আছে কিন্তু। এলেই যখন…
কাঠের সিঁড়ি দিয়ে যুদ্ধের দামামার মতো শব্দ তুলে তিনজনে ওপরে হাজির হলুম। ল্যান্ডিং পেরিয়ে বৈঠকখানা। একটা শন্ শন্ মম্ মম্ শব্দ পাচ্ছিলুম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝতে পারছিলুম না।
বৈঠকখানায় ঢুকে প্রচণ্ড চমক।
এ ঘর যে একেবারে আসবাবে ঠাসা। ভিক্টোরীয় যুগের সোফা, টেবিল, আয়না, মার্বেলের মুর্তি, দেয়ালের বাতি, কার্পেট, ঝাড়লণ্ঠন–কোনওটাই বাদ নেই। মনে হয় ঠিক যেমন ছিল তেমনিই আছে, তবে সব কিছুরই উপর আশি বছরের ধুলো জমে সেগুলোর আসল চেহারা বেমালুম ঢেকে দিয়েছে।
কিন্তু মোক্ষম চমকটা ঘরের মেঝে বা দেয়ালে নয়, সেটা হল সিলিং-এ।
সিলিং-এ দুলছে একটি বিশাল শতচ্ছিন্ন টানা পাখা, যার হাওয়া এই জুন মাসের ঘাম ছুটোনো গরমে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু এই পাখা টানছে কে? আর টানছে কী ভাবে? কারণ পাখার কোনও দড়ি নেই।
অর্থাৎ সেটাকে টানার কোনও উপায় নেই।
ভূতের উৎপাত বলে এ ঘরে কেউ প্রবেশ করেনি, বলল কুরেশি। তাই জিনিসগুলোও নিলাম হয়নি। আমি ঘরটা আবিষ্কার করি ভুতের সব ব্যবস্থা করার পর। তারপর ভেবে মনে হল কঙ্কাল আর ট্রেল মেশিনে ব্যাপারটা আরও জমবে।
অবাক বিস্ময়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলুম অশরীরী পাংখাবারদারের অদৃশ্য হাতে টানা পাখার দিকে। ভূত বলেই তার ক্লান্তি নেই ঘুম নেই, সাহেবের লাথিতে মৃত্যু নেই।
আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছি তখনও বেশ কিছুক্ষণ ধরে শুনতে পেলুম ওই টানাপাখার শব্দ।
কঙ্কাল আর ছাপার কলের ব্যাপারটা কুরেশির কারসাজি জেনে মনে একটা খচখচে গিল্টি ভাব জেগে উঠেছিল; এখন বুঝতে পারলুম দিব্যি নিশ্চিন্ত লাগছে।
সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৮৯
কাগতাড়ুয়া
মৃগাঙ্কবাবুর সন্দেহটা যে অমূলক নয় সেটা প্রমাণ হল পানাগড়ের কাছাকাছি এসে। গাড়ির পেট্রল ফুরিয়ে গেল। পেট্রলের ইনডিকেটরটা কিছুকাল থেকেই গোলমাল করছে, সে কথা আজও বেরোবার মুখে ড্রাইভার সুধীরকে বলেছেন, কিন্তু সুধীর গা করেনি। আসলে কাঁটা যা বলছিল তার চেয়ে কম পেট্রল ছিল ট্যাঙ্কে।
এখন কী হবে? জিজ্ঞেস করলেন মৃগাঙ্কবাবু।
আমি পানাগড় চলে যাচ্ছি, বলল সুধীর, সেখান থেকে তেল নিয়ে আসব।
পানাগড় এখান থেকে কতদূর?
মাইল তিনেক হবে।
তার মানে তো দু-আড়াই ঘণ্টা। শুধু তোমার দোষেই এটা হল। এখন আমার অবস্থাটা কী হবে ভেবে দেখেছ?
মৃগাঙ্কবাবু ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, ভৃত্যস্থানীয়দের উপর বিশেষ চোটপাট করেন না, কিন্তু আড়াই ঘণ্টা খোলা মাঠের মধ্যে একা গাড়িতে বসে থাকতে হবে জেনে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল।
তা হলে আর দেরি কোরো না, বেরিয়ে পড়ো। আটটার মধ্যে কলকাতা ফিরতে পারবে তো? এখন সাড়ে তিনটে।
তা পারব বাবু।
এই নাও টাকা। আর ভবিষ্যতে এমন ভুলটি কোরো না কখনও। লং জার্নিতে এসব রিস্কের মধ্যে যাওয়া কখনওই উচিত নয়।
সুধীর টাকা নিয়ে চলে গেল পানাগড় অভিমুখে।
মৃগাঙ্কশেখর মুখোপাধ্যায় খ্যাতনামা জনপ্রিয় সাহিত্যিক। দুর্গাপুরে একটি ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁকে ডাকা হয়েছিল মানপত্র দেওয়া হবে বলে। ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি, তাই মোটরে যাত্রা। সকালে চা খেয়ে বেরিয়েছেন, আর ফেরার পথে এই দুর্যোগ। মৃগাঙ্কবাবু কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না, পাঁজিতে দিনক্ষণ দেখে যাত্রা করাটা তাঁর মতে কুসংস্কার, কিন্তু আজ পাঁজিতে যাত্রা নিষিদ্ধ বললে তিনি অবাক হবেন না। আপাতত গাড়ি থেকে নেমে আড় ভেঙে একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি তাঁর চারদিকটা ঘুরে দেখে নিলেন।
মাঘ মাস, খেত থেকে ধান কাটা হয়ে গেছে, চারদিক ধু-ধু করছে মাঠ, দুরে, বেশ দূরে, একটিমাত্র কুঁড়েঘর একটি তেঁতুলগাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এ ছাড়া বসতির কোনও চিহ্ন নেই। আরও দুরে রয়েছে একসারি তালগাছ, আর সবকিছুর পিছনে জমাট বাঁধা বন। এই হল রাস্তার এক দিক, অর্থাৎ পুব দিকের দৃশ্য।
পশ্চিমেও বিশেষ পার্থক্য নেই। রাস্তা থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত দূরে একটা পুকুর রয়েছে। তাতে জল বিশেষ নেই। গাছপালা যা আছে তা–দু-একটা বাবলা ছাড়া–সবই দূরে। এদিকেও দুটি কুঁড়েঘর রয়েছে, কিন্তু মানুষের কোনও চিহ্ন নেই। আকাশে উত্তরে মেঘ দেখা গেলেও এদিকে রোদ। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একটা কাগ্তাড়ুয়া।
শীতকাল হলেও রোদের তেজ আছে বেশ, তাই মৃগাঙ্কবাবু গাড়িতে ফিরে এলেন। তারপর ব্যাগ থেকে একটা গোয়েন্দা কাহিনী বার করে পড়তে আরম্ভ করলেন।
এর মধ্যে দুটো অ্যাম্বাসাডর আর একটা লরি গেছে তাঁর পাশ দিয়ে, তার মধ্যে একটা কলকাতার দিকে। কিন্তু কেউ তাঁর অবস্থা জিজ্ঞেস করার জন্য থামেনি। মৃগাঙ্কবাবু মনে মনে বললেন, বাঙালিরা এ ব্যাপারে বড় স্বার্থপর হয়। নিজের অসুবিধা করে পরের উপকার করাটা তাদের কুষ্ঠিতে লেখে না। তিনি নিজেও কি এদের মতোই ব্যবহার করতেন? হয়তো তাই। তিনিও তো বাঙালি। লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে তাঁর মজ্জাগত দোষগুলোর কোনও সংস্কার হয়নি।
উত্তরের মেঘটা অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত এগিয়ে এসে সূর্যটাকে ঢেকে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া। মৃগাঙ্কবাবু ব্যাগ থেকে পুলোভারটা বার করে পরে নিলেন। এদিকে সূর্যও দ্রুত নীচের দিকে নেমে এসেছে। পাঁচটার মধ্যেই অস্ত যাবে। তখন ঠাণ্ডা বাড়বে। কী মুশকিলে ফেলল তাঁকে সুধীর!
মৃগাঙ্কবাবু দেখলেন যে, বইয়ে মন দিতে পারছেন না। তার চেয়ে নতুন গল্পের প্লট ভাবলে কেমন হয়? ভারত পত্রিকা তাঁর কাছে একটা গল্প চেয়েছে, সেটা এখনও লেখা হয়নি। একটা প্লটের খানিকটা মাথায় এসেছে এই পথটুকু আসতেই। মৃগাঙ্কবাবু নোটবুক বার করে কয়েকটা পয়েন্ট লিখে ফেললেন।
নাঃ, গাড়িতে বসে আর ভাল লাগে না।
খাতা বন্ধ করে আবার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালেন মৃগাঙ্কবাবু। তারপর কয়েক পা সামনে এগিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখে তাঁর মনে হল বিশ্বচরাচরে তিনি একা। এমন একা তিনি কোনওদিন অনুভব করেননি।
না, ঠিক একা নয়। একটা নকল মানুষ আছে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে।
ওই কাগ্তাড়ুয়াটা।
মাঠের মধ্যে এক জায়গায় কী যেন একটা শীতের ফসল রয়েছে একটা খেতে, তারই মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কাগ্তাড়ুয়াটা। একটা খাড়া বাঁশ মাটিতে পোঁতা, তার সঙ্গে আড়াআড়ি ভাবে একটা বাঁশ ছড়ানো হাতের মতো দুদিকে বেরিয়ে আছে। এই হাত দুটো গলানো রয়েছে একটা ছেঁড়া জামার দুটো আস্তিনের মধ্যে দিয়ে। খাড়া বাঁশটার মাথায় রয়েছে একটা উপুড় করা মাটির হাঁড়ি। দূর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু মৃগাঙ্কবাবু অনুমান করলেন সেই হাঁড়ির রঙ কালো, আর তার উপর সাদা রং দিয়ে আঁকা রয়েছে ড্যাব ড্যাবা চোখ মুখ। আশ্চর্য–এই জিনিসটা পাখিরা আসল মানুষ ভেবে ভুল করে, আর তার ভয়ে খেতে এসে উৎপাত করে না। পাখিদের বুদ্ধি কি এতই কম? কুকুর তো এ ভুল করে না। তারা মানুষের গন্ধ পায়। কাক চড়ুই কি তা হলে সে গন্ধ পায় না?
মেঘের মধ্যে একটা ফাটল দিয়ে রোদ এসে পড়ল কাগ্তাড়ুয়াটার গায়ে। মৃগাঙ্কবাবু লক্ষ করলেন। যে, যে জামাটা কাগ্তাড়ুয়াটার গায়ে পরানো হয়েছে সেটা একটা ছিটের শার্ট। কার কথা মনে পড়ল ওই ছেঁড়া লাল কালো ছিটের শার্টটা দেখে? মৃগাঙ্কবাবু অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। তবে কোনও একজনকে তিনি ওরকম একটা শার্ট পরতে দেখেছেন–বেশ কিছুকাল আগে।
আশ্চর্য–ওই একটি নকল প্রাণী ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই। মৃগাঙ্কবাবু আর ওই কাগ্তাড়ুয়া। এই সময়টা খেতে কাজ হয় না বলে গ্রামের মাঠেঘাটে লোকজন কমই দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু এরকম নির্জনতা মৃগাঙ্কবাবুর অভিজ্ঞতায় এই প্রথম।
মৃগাঙ্কবাবু ঘড়ি দেখলেন। চারটে কুড়ি। সঙ্গে ফ্লাস্কে চা রয়েছে। সেইটের সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে।
গাড়িতে ফিরে এসে ফ্লাস্ক খুলে ঢাকায় চা ঢেলে খেলেন মৃগাঙ্কবাবু। শরীরটা একটু গরম হল।
কালো মেঘের মধ্যে ফাঁক দিয়ে সূর্যটাকে একবার দেখা গেল। কাগ্তাড়ুয়াটার গায়ে পড়েছে লালচে রোদ। সূর্য দুরের তালগাছটার মাথার কাছে এসেছে, আর মিনিট পাঁচেকেই অস্ত যাবে।
আরেকটা অ্যাম্বাসাডর মৃগাঙ্কবাবুর গাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মৃগাঙ্কবাবু আরেকটু চা ঢেলে খেয়ে আবার গাড়ি থেকে নামলেন। সুধীরের আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। কী করা যায়?
পশ্চিমের আকাশ এখন লাল। সেদিক থেকে মেঘ সরে এসেছে। চ্যাপটা লাল সূর্যটা দেখতে দেখতে দিগন্তের আড়ালে চলে গেল। এবার ঝপ করে অন্ধকার নামবে।
কাগ্তাড়ুয়া।
কেন জানি মৃগাঙ্কবাবু অনুভব করছে প্রতি মুহূর্তেই ওই নকল মানুষটা তাঁকে বেশি করে আকর্ষণ করছে।
সেটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে মৃগাঙ্কবাবু কতকগুলো জিনিস লক্ষ করে একটা হৃৎকম্প অনুভব করলেন।
ওটার চেহারায় সামান্য পরিবর্তন হয়েছে কি?
হাত দুটো কি নীচের দিকে নেমে এসেছে খানিকটা?
দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা কি আরেকটু জ্যান্ত মানুষের মতো?
খাড়াই বাঁশটার পাশে কি আরেকটা বাঁশ দেখা যাচ্ছে?
ও দুটো কি বাঁশ, না ঠ্যাঙ?
মাথার হাঁড়িটা একটু ছোট মনে হচ্ছে না?
মৃগাঙ্কবাবু বেশি সিগারেট খান না, কিন্তু এই অবস্থায় তাঁকে আরেকটা ধরাতে হল। তিনি এই তেপান্তরের মাঠে একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চোখে ভুল দেখছেন।
কাগ্তাড়ুয়া কখনও জ্যান্ত হয়ে ওঠে?
কখনওই না।
কিন্তু —
মৃগাঙ্কবাবুর দৃষ্টি আবার কাগাড়য়াটার দিকে গেল।
কোনও সন্দেহ নেই। সেটা জায়গা বদল করেছে।
সেটা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে এসেছে।
এসেছে না, আসছে।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা, কিন্তু দুপায়ে চলা। হাঁড়ির বদলে একটা মানুষের মাথা। গায়ে এখনও সেই ছিটের শার্ট; আর তার সঙ্গে মালকোঁচা দিয়ে পরা খাটো ময়লা ধুতি।
বাবু!
মৃগাঙ্কবাবুর সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা শিহরন খেলে গেল। কাগ্তাড়ুয়া মানুষের গলায় ডেকে উঠেছে, এবং এ গলা তাঁর চেনা।
এ হল তাঁদের এককালের চাকর অভিরামের গলা। এইদিকেই তো ছিল অভিরামের দেশ। একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মৃগাঙ্কবাবু। অভিরাম বলেছিল সে থাকে মানকড়ের পাশের গাঁয়ে। পানাগড়ের আগের স্টেশনই তো মানকড়।
মৃগাঙ্কবাবু চরম ভয়ে পিছোতে পিছোতে গাড়ির সঙ্গে সেঁটে দাঁড়ালেন। অভিরাম এগিয়ে এসেছে তাঁর দিকে। এখন সে মাত্র দশ গজ দূরে।
আমায় চিনতে পারছেন বাবু?
মনে যতটা সাহস আছে সবটুকু একত্র করে মৃগাঙ্কবাবু প্রশ্নটা করলেন।–
তুমি অভিরাম না?
অ্যাদ্দিন পরেও আপনি চিনেছেন বাবু?
মানুষেরই মতো দেখাচ্ছে অভিরামকে, তাই বোধহয় মৃগাঙ্কবাবু সাহস পেলেন। বললেন, তোমাকে চিনেছি তোমার জামা দেখে। এ জামা তো আমিই তোমাকে কিনে দিয়েছিলাম।
হ্যাঁ বাবু, আপনিই দিয়েছিলেন। আপনি আমার জন্য অনেক করেছেন, কিন্তু শেষে এমন হল কেন বাবু? আমি তো কোনও দোষ করিনি। আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না কেন?
মৃগাঙ্কবাবুর মনে পড়ল। তিন বছর আগের ঘটনা। অভিরাম ছিল মৃগাঙ্কবাবুদের বিশ বছরের পুরনো চাকর। শেষে একদিন অভিরামের ভীমরতি ধরে। সে মৃগাঙ্কবাবুর বিয়েতে পাওয়া সোনার ঘড়িটা চুরি করে বসে। সুযোগ সুবিধা দুইই ছিল অভিরামের। অভিরাম নিজে অবশ্য অস্বীকার করে। কিন্তু মৃগাঙ্কবাবুর বাবা ওঝা ডাকিয়ে কুলোতে চাল ছুঁড়ে মেরে প্রমাণ করিয়ে দেন যে, অভিরামই চোর। ফলে অভিরামকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।
অভিরাম বলল, আপনাদের ওখান থেকে চলে আসার পর আমার কী হল জানেন? আর আমি চাকরি করিনি কোথাও, কারণ আমার কঠিন ব্যারাম হয়। উদুরি। টাকা-পয়সা নাই। না ওষুধ, না পথ্যি। সেই ব্যারামই আমার শেষ ব্যারাম। আমার এই জামাটা ছেলে রেখে দেয়। সে নিজে কিছুদিন পরে। তারপর সেটা ছিঁড়ে যায়। তখন সেটা কাগতাড়ুয়ার পোশাক হয়। আমি হয়ে যাই সেই কাগতাড়য়া। কেন জানেন? আমি জানতাম একদিন না একদিন আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। আমার প্রাণটা ছটফট করছিল–হ্যাঁ, মৃত লোকেরও প্রাণ থাকে–আমি মরে গিয়ে যা জেনেছি সেটা আপনাকে বলতে চাইছিলাম।
সেটা কী অভিরাম?
বাড়ি ফিরে গিয়ে আপনার আলমারির নীচে পিছন দিকটায় খোঁজ করবেন। সেইখানেই আপনার ঘড়িটা পড়ে আছে এই তিন বছর ধরে। আপনার নতুন চাকর ভাল করে ঝাড়ু দেয় না তাই সে দেখতে পায়নি। এই ঘড়ি পেলে পরে আপনি জানবেন অভিরাম কোনও দোষ করেনি।
অভিরামকে আর ভাল করে দেখা যায় না–সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মৃগাঙ্কবাবু শুনলেন অভিরাম বলছে, এতকাল পরে নিশ্চিন্ত হলাম বাবু। আমি আসি। আমি আসি…
মৃগাঙ্কবাবুর চোখের সামনে থেকে অভিরাম অদৃশ্য হয়ে গেল।
তেল এনেছি বাবু।
সুধীরের গলায় মৃগাঙ্কবাবুর ঘুমটা ভেঙে গেল। গল্পের প্লট ফাঁদতে ফাঁদতে কলম হাতে গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ঘুম ভাঙতেই তাঁর দৃষ্টি চলে গেল পশ্চিমের মাঠের দিকে। কাগতাভুয়াটা যেমন ছিল তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
বাড়িতে এসে আলমারির তলায় খুঁজতেই ঘড়িটা বেরিয়ে পড়ল। মৃগাঙ্কবাবু স্থির করলেন ভবিষ্যতে আর কিছু গেলেও ওঝার সাহায্য আর কখনও নেবেন না।
সন্দেশ, পৌষ ১৩৯৩
কানাইয়ের কথা
নসু কবরেজ প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে বলরামের নাড়ি ধরে বসে রইলেন। শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে বলরামের সতেরো বছরের ছেলে কানাই কবরেজের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। আজ দশদিন হল তার বাপের অসুখ। কোনও কিছু খাবারে তার রুচি নেই; একটানা দশদিন না খেয়ে সে শুকিয়ে গেছে, তার চোখ কোটরে বসে গেছে, তার সর্বাঙ্গ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিন ক্রোশ পায়ে হেঁটে কানাই নসু কবরেজের কাছে গিয়ে তাঁর হাতে পায়ে ধরে তাঁকে নিয়ে এসেছে তার বাপের চিকিৎসার জন্য। এ রোগের নাম কী, তা কানাই জানে না। কবরেজ জানেন কি? তাঁর চোখের ভ্রুকুটি দেখে কেমন যেন সন্দেহ হয়। মোট কথা, এ যাত্রা তার বাপ না বাঁচলে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। আপন লোক বলতে তার আর কেউ নেই। নন্দীগ্রামে দু বিঘে জমি আর একজোড়া হাল বলদ নিয়ে থাকে বাপব্যাটায়। খেতে যা ফসল হয় তাতে মোটামুটি দুবেলা দু মুঠো খেয়ে চলে যায় দুজনের। কানাইয়ের মা বসন্ত রোগে মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে, আর এখন বাপের এই বিদঘুঁটে ব্যায়াম।
চাঁদনি, নাড়ি ছেড়ে মাথা নেড়ে বললেন কবরেজমশাই। নসু কবরেজের খ্যাতি অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তাঁর নাড়িজ্ঞান নাকি যেমন-তেমন নয়। তিনি জবাব দিয়ে গেলে রোগীকে বাঁচানো শিবের অসাধ্যি, আর তিনি ওষুধ বাতলে গেলে রোগী চাঙ্গা হয়ে উঠবেই। কিন্তু চাঁদনি আবার কী? আজ্ঞে? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল কানাই।
চাঁদনি পাতার রস খাওয়াতে হবে, তা হলেই রোগ সারবে। সংস্কৃত নাম চন্দ্রায়ণী। আর রোগের নাম হল শুনাই।
চাঁদনি একটা গাছের নাম বুঝি? ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল কানাই।
নসু কবরেজ ওপর-নীচে মাথা নাড়লেন দুবার। কিন্তু তাঁর চোখ থেকে ভ্রুকুটি গেল না।
কিন্তু চাঁদনি তো যেখানে-সেখানে পাবে না বাপু, শেষটায় বললেন তিনি।
তবে?
বাদড়ার জঙ্গলে যেতে হবে। একটা পোডড়া মন্দির আছে মহাকালের। তার উত্তরদিকে পঁচিশ পা গেলেই দেখবে চাঁদনি গাছ। কিন্তু সে তো প্রায় পাঁচ ক্রোশ পথ; পারবে যেতে?
নিশ্চয়ই পারব, বলল কানাই। হাঁটতে আমার কোনও কষ্ট হয় না।
কথাটা বলেই কানাইয়ের আরেকটা প্রশ্ন মাথায় এল।
কিন্তু গাছ চিনব কী করে কবরেজমশাই?
ছোট ছোট ছুঁচলো বেগনে পাতা, হলদে ফুল আর মন-মাতানো গন্ধ। বিশ হাত দূর থেকে সে গন্ধ পাওয়া যায়। স্বর্গের পারিজাতকে হার মানায় সে গন্ধ। তিন-চার হাতের বেশি উঁচু নয় গাছ। একটি পাতা বেটে রস খাওয়ালেই আর দেখতে হবে না। ব্যারাম বাপ বাপ বলে পালাবে, আর শরীর দুদিনেই তাজা হয়ে যাবে। তবে সময় আছে আর মাত্র দশদিন। দশদিনের মধ্যে না খাওয়ালে…
নসু কবরেজ আর কথাটা শেষ করলেন না।
আমি কাল সক্কাল-সক্কাল বেরিয়ে পড়ব, কবরেজমশাই, বলল কানাই। গণেশখুড়োকে বলব আমি যখন থাকব না তখন যেন বাবাকে এসে দেখে যায়। খাওয়ানো তো যাবে না বোধ হয় কিছুই?
নসু কবরেজ মাথা নাড়লেন। সে চেষ্টা বৃথা। এ ব্যারামের লক্ষণই এই। পেটে কিছুই সহ্য হয় না, আর দিনে দিনে শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে। তবে চাঁদনির রস এর অব্যর্থ ওষুধ। আর, ইয়ে, ব্যারাম সারবার পর বাকি কথা হবে…
পড়শি গণেশ সামন্তকে বাপের দিকে একটু নজর রাখার কথা বলে পরদিন ভোর থাকতে গুড়-চিড়ে গামছায় বেঁধে নিয়ে কানাই বেরিয়ে পড়ল বাদড়ার জঙ্গলের উদ্দেশে। পৌঁছতে পৌঁছতে সেই বিকেল হয়ে যাবে, কিন্তু কানাই পরোয়া করে না। বাপকে সে দেবতার মতো ভক্তি করে, আর বাপও ছেলেকে ভালবাসে প্রাণের চেয়েও বেশি। দিব্যি সুস্থ মানুষটার হঠাৎ যে কী হল!–দেখতে দেখতে শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেল।
পথ জানা নেই, তাই একে তাকে জিজ্ঞেস করে করে চলতে হচ্ছে। বনের নাম শুনে সকলেই জিজ্ঞেস করে, কেন, সেখানে আবার কী? শুনে কানাই বুঝতে পারে বনটা খুব নিরাপদ নয়, কিন্তু তা হলে কী হবে? বাপের জন্য চাঁদনি পাতা জোগাড় করতে সে প্রাণ দিতে প্রস্তুত।
সূর্যি যখন লম্বা ছায়া ফেলতে শুরু করছে তখন একটা ধানখেতের ওপারে কানাই দেখল একটা গভীর বন দেখা যাচ্ছে। খেত থেকে এক কৃষক কাঁধে লাঙল নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করে কানাই জানল ওটাই বাদড়ার বন। কানাই পা চালিয়ে এগিয়ে চলল।
শাল সেগুন শিমুলের সঙ্গে আর কত কী গাছ মেশানো ঘন বনে সুর্যের আলো ঢোকে না বললেই চলে। এই বিশাল বনে তিন-চার হাত উঁচু গাছ খুঁজে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? তবে কাছে মন্দির আছে, সেই একটা সুবিধে!
বিশ-পঁচিশ হাত ভিতরে ঢুকতেই একটা হরিণের পাল দেখতে পেল কানাই। তাকে দেখেই হরিণগুলো ছুটে পালালো। হরিণ তো ভাল, কিন্তু জাঁদরেল কোনও জানোয়ার যদি সামনে পড়ে? যাই হোক, সে ভেবে কোনও লাভ নেই। তার লক্ষ্য হবে এখন একটাই; প্রথমে মহাকালের মন্দির, তারপর চাঁদনি গাছ খুঁজে বার করা।
মন্দির দেখতে পাবার আগে কিন্তু গন্ধটা পেল কানাই। তত জোরালো নয়; মিহি একটা গন্ধ, কিন্তু তাতেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
এবার একটা মহুয়া গাছ পেরিয়ে পোডড়া মন্দিরটা চোখে পড়ল। দিন ফুরিয়ে এসেছে, তবে মন্দিরের চারপাশটায় গাছ একটু পাতলা বলে পড়ন্ত রোদ এখানে-ওখানে ছিটিয়ে পড়েছে।
তুই কে রে ব্যাটা?
প্রশ্নটা শুনে কানাই চমকে তিন হাত লাফিয়ে উঠেছিল। এখানে অন্য মানুষ থাকতে পারে এটা তার মাথাতেই আসেনি। এবার মুখ ঘুরিয়ে দেখল একটা গোলপাতার ছাউনির সামনে তিন হাত লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা একটা লোক ভুরু কুঁচকে চেয়ে আছে তার দিকে।
তুই যা খুঁজছিস তা এখানে পাবি না, এবার বলল বুড়ো কয়েক পা এগিয়ে এসে। সে কি মনের কথা বুঝতে পারে নাকি?
কী খুঁজছি তা তুমি জানো? জিজ্ঞেস করল কানাই।
দাঁড়া দাঁড়া, একটু মনে করে দেখি। তোকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু এখন আবার মন থেকে হঠাৎ ফসূকে গেল। একশো ছাপ্পান্ন বছর বয়সে স্মরণশক্তি কি আর জোয়ান বয়সের মতো কাজ করে?
বুড়ো মাথা হেঁট করে ডান হাত দিয়ে গাল চুলকে হঠাৎ আবার মাথা সিধে করে বলল, মনে পড়েছে। চাঁদনি। তোর বাপের অসুখ, তার জন্য চাঁদনি পাতা নিতে এসেছিস তুই। ওই মন্দিরের উত্তর দিকটায় ছিল আজ দুপুর অবধি। কিন্তু সে তোর আর নেই! গিয়ে দেখ–শেকড় অবধি তুলে নিয়ে গেছে।
কানাইয়ের বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে গেছে। এতটা পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে? সে মন্দির লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। উত্তর দিক। উত্তর দিক কোষ্টা? হ্যাঁ, এইটে। ওই যে গর্ত। ওইখানে ছিল গাছ–শেকড় অবধি তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু কে?
কানাইয়ের চোখে জল। সে বুড়োর কাছে ফিরে এল।
কে নিল সে গাছ? কে নিল?
রূপসার মন্ত্রী সেপাই-সান্ত্রী নিয়ে এসে গাছ তুলে নিয়ে গেছে। রূপসার প্রজাদের ব্যারাম হয়েছে–শুখনাই ব্যারাম–বিশদিনে না খেয়ে হাত পা শুকিয়ে মরে যায় তাতে। একমাত্র ওষুধ হল চাঁদনি পাতার রস।
কানাইয়ের আর কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। সে চোখে অন্ধকার দেখছিল। কিন্তু বুড়ো একটা অদ্ভুত কথা বলল।
চাঁদনি এখানে নেই বটে, কিন্তু আমি যে দেখছি তোর বাপ ভাল হয়ে উঠবে।
কানাই চমকে উঠল।
তাই দেখছেন? সত্যি তাই দেখেছেন? কিন্তু ওষুধ না পেলে কী করে ভাল হবে? এ গাছ আর কোথায় আছে সে আপনি জানেন?
বুড়ো মাথা নাড়ল। আর কোথাও নেই। এই একটিমাত্র জায়গায় ছিল, তাও এখন চলে গেছে রূপসার রাজ্যে।
সে কতদুর এখান থেকে?
দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি?
বুড়ো বোধহয় আবার ভুলে গেছে, তাই মনে করার চেষ্টায় মাথা হেঁট করে টাক চুলকোতে লাগল।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ত্রিশ ক্রোশ পথ। বিশাল রাজ্য।
এবার কানাইয়েরও মনে পড়েছে। বলল, রূপসা মানে যেখানের তাঁতের কাপড়ের খুব নামডাক?
ঠিক বলেছিস। রূপসার শাড়ি ধুতি চাদর দেশ-বিদেশে যায়। এমন বাহারের কাপড় আর কোথাও বোনা হয় না।
আপনি এত জানলেন কী করে? আপনি কে?
আমি ত্রিকালজ্ঞ। আমার নাম একটা আছে। তবে এখন মনে পড়ছে না। ভাল কথা, তোকে তো একবার রূপসা যেতে হচ্ছে। চাঁদনির খোঁজ তোকে তো করতেই হবে।
কিন্তু কবরেজ বলেছে দশদিনের মধ্যে বাপকে ওষুধ খাওয়াতে না পারলে বাপ আর বাঁচবে না। তার মধ্যে একদিন তো চলেই গেল।
তাতে কী হল। যা করতে হবে ঝটপট করে ফেল।
কী করে করব? ত্রিশ ক্রোশ পথ। সেখানে যাওয়া আছে, গাছ খুঁজে বার করা আছে, ফেরা। আছে…।
দাঁড়া, মনে পড়েছে।
বুড়ো এবার তার কুটিরের মধ্যে ঢুকে একটা থলি বার করে আনল। তারপর তার থেকে তিনটে গোল গোল জিনিস বার করল–একটা লাল, একটা নীল, একটা হলদে।
এই দ্যাখ, লালটা হাতে তুলে বলল বুড়ো। এটা একরকম ফল। এটা খেলে তুই হরিণের চেয়ে তিনগুণ জোরে ছুটতে পারবি। এক ক্রোশ পথ তোর যেতে লাগবে তিন মিনিট। তার মানে দেড় ঘণ্টায় তুই পৌঁছে যাবি রূপসা। এই তিনটেই ফল, আর তিনটেই তোকে দিলাম।
কিন্তু হলদে আর নীল ফল খেলে কী হয়? এই তো মুশকিলে ফেললি, বলে বুড়ো আবার মাথা হেঁট করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে বলল, উঁহু, মনে পড়ছে না। তবে কিছু একটা হয়, আর সেটা তোর উপকারেই লাগবে। যদি কখনও মনে পড়ে তবে তোকে জানাব।
কী করে জানাবে? আমি তো চলে যাব।
উপায় আছে।
বুড়ো আবার থলির ভিতর হাত ঢুকিয়ে এবার একটা ঝিনুক বার করল, সেটা প্রায় হাতের তেলোর সমান বড়। সত্যি বলতে কি, কানাই এতবড় ঝিনুক কখনও দেখেনি। ঝিনুকটা কানাইকে দিয়ে বুড়ো বলল, এটা সঙ্গে রাখবি। আমার কিছু বলার দরকার হলে আমি তোকে নাম ধরে ডাকব। তোর নাম কানাই তো?
হ্যাঁ।
সেই ডাক তুই এই ঝিনুকের মধ্যে শুনতে পাবি। ওটা তোর ট্যাঁকে থাকলেও শুনতে পাবি। তারপর ঝিনুকটাকে কানের উপর চেপে ধরলেই তুই পষ্ট আমার কথা শুনতে পাবি। আমার কথা যখন শেষ হবে তখন ঝিনুকে শোনা যাবে সমুদ্রের গর্জন। তখন আবার ঝিনুকটা ট্যাঁকে খুঁজে রাখবি।
কানাই ঝিনুকটা নিয়ে তার ট্যাঁকেই রাখল। বুড়ো এবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, আজ তো সন্ধে হয়ে গেল। তুই এখন রূপসা গিয়ে কিছু করতে পারবি না। আমি বলি আজ রাতটা আমার কুটিরেই থাক, কাল ভোরে রওনা হবি। তা হলে ওখানে সারা দিনটা পাবি, অনেক কাজ হবে। আমার ঘরে ফলমূল আছে, তাই খাবি এখন।
কানাই রাজি হয়ে গেল। তার ইচ্ছে করছিল তখনই লাল ফলটা খেয়ে রওনা দেয়; বুড়োর কথা ঠিক কিনা সেটা পরখ করে দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু সেটাকে সে দমন করল। সকালে রওনা দেওয়াই সবদিক দিয়ে ভাল হবে।
ভাল কথা, বলল বুড়ো, মনে পড়েছে। আমায় লোকে জগাইবাবা বলে ডাকে। তুইও বলিস।
.
০২.
পরদিন সকালে লাল ফলটা খেয়ে জগাইবাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা দিতেই কানাই বুঝল তার গায়ের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। তারপর হাঁটতে গিয়ে দেখল হাঁটলে চলবে না–দৌড়তে হবে। সে দৌড় যে কী বেদম দৌড় সে আর কী বলব! রাস্তার দুপাশে গাছপালা। ঘরবাড়ি মানুষজন গোরু ছাগল সব তীরবেগে বেরিয়ে যাচ্ছে উলটোদিকে, পায়ের তলা দিয়ে মাটি সরে যাচ্ছে শন শন করে, দুকানের পাশে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে কানে প্রায় তালা লাগে, দেখতে দেখতে দুদিকের দৃশ্য বদলে যাচ্ছে গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে মাঠ, মাঠ থেকে বন, বন থেকে আবার গ্রামে। পথে দুটো নদী পড়ল, মুহূর্তের মধ্যে সে নদী কানাইয়ের পায়ের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল, পায়ের গোঁড়ালিটুকুও ভিজবার সময় পেল না।
সূর্য মাথায় ওঠার আগেই কানাই বুঝতে পারল সামনে একটা বড় শহর দেখা যাচ্ছে। সে তখনই দৌড়নো বন্ধ করে হাঁটতে শুরু করল। বাকি পথটুকু এমনিভাবেই হেঁটে যাবে, নইলে অন্য পথচারীরা কী ভাববে? তাকে নিয়ে একটা হইচই পড়ে এটা কানাই মোটেই চায় না।
শহরে ঢোকবার মুখে একটা তোরণ, তার দুদিকে দুজন সশস্ত্র সেপাই। এটা আগে থেকে জানা ছিল না, তাই কানাইকে একটু মুশকিলেই পড়তে হয়েছিল। সেপাইরা কানাইকে দেখেই তার পথরোধ করতে গিয়েছিল, তাই নিরুপায় হয়ে কানাইকে সামান্য একটু দৌড় দিতে হয়েছিল। ফলে কানাই এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল, যেখান থেকে তোরণটা এত দূরে যে, সেটাকে প্রায় দেখাই যায় না।
আর কোনও ভাবনা নেই। কানাই এখন একটা বাজারের মধ্যে দিয়ে চলেছে। দুদিকে দোকানপাট, তাতে নানারকম জিনিসের মধ্যে কাপড়ই বেশি, আর সেই কাপড়ের বাহার দেখেই কানাই তো থ! দেশ-বিদেশের লোকেরা সে কাপড় দেখছে, দর করছে, কিনছে। কিন্তু একটা। জিনিস দেখে কানাইয়ের ভারী অদ্ভুত লাগল। যারা সে কাপড় বেচছে তাদের কারুর মুখে হাসি নেই। আর, আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, হাটের এখানে-সেখানে হাতে বল্লমওয়ালা সেপাইরা ঘোরাফেরা করছে।
কানাইয়ের ভারী কৌতূহল হল। সে একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, এই শহরের নাম কি রূপসা? লোকটা মুখে কিছু না বলে কেবল মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল। এবার কানাই বলল, তা তোমরা সবাই এত গম্ভীর কেন বলো তো? কেনা-বেচা তো বেশ ভালই হচ্ছে; তবু তোমাদের মুখে হাসি নেই কেন?
লোকটা এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে বলল, তুমি বুঝি ভিন দেশের লোক?
কানাই বলল, হ্যাঁ; আমি সবে এখানে এলাম।
তাই তুমি জানো না, বলল দোকানদার। এখানে মড়ক লেগেছে।
মড়ক?
শুখনাইয়ের মড়ক। এখন তাঁতিপাড়ায় লেগেছে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়তে আর কতদিন? তাঁতির! সব না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।
কিন্তু–
কানাই ওষুধের কথাটা বলতে গিয়ে বলল না। আশ্চর্য ব্যাপার!–-মন্ত্রী গিয়ে চাঁদনি গাছ নিয়ে এসেছে, তাও তাঁতিদের কেন অসুখ সারছে না? এই গাছের পাতায় কি তা হলে কাজ দেয় না? একটা আস্ত গাছে কত পাতা হয়? চার-পাঁচশো তো বটেই। তার একটা খেলেই একটা লোকের। অসুখ সারার কথা। কিন্তু সে গাছ তা হলে গেল কোথায়?
কানাই উঠে পড়ল। তার মনে পড়ে গেছে যে এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হল চাঁদনির পাতা জোগাড় করা। কিন্তু সেই গাছ তার নাগালে আসবে কী করে? মস্ক্রিমশাই সে গাছ কোথায় রেখেছেন সেটা সে জানবে কী করে?
কানাই হাঁটতে আরম্ভ করল। বাজার ছাড়িয়ে সে দেখল একটা পাড়ার মধ্যে এসে পড়েছে। এখানে চারিদিক থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। এটাই কি তাঁতিপাড়া?
রাস্তার ধারে একটা বুড়ো বসে আছে দেখে কানাই তার দিকে এগিয়ে গেল।
হ্যাঁ গো, এটা কি তাঁতিপাড়া? কানাই জিজ্ঞেস করল।
বুড়ো মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এটাই তাঁতিপাড়া। তবে তাঁতি আর এখানে বেশিদিন নেই। চারটে করে তাঁতি রোজ মরছে ব্যারামে। শশী গেল, নীলমণি গেল, লক্ষ্মণ গেল, বেচারাম গেল–আর কি! এ রোগের তো কোনও চিকিৎসা নেই। আমায় এখনও ধরেনি রোগে, তবে ধরতে আর কত দিন?
চিকিৎসা নেই বলছ কেন? একটা গাছের পাতার রস খেলেই তো এ ব্যারাম সারে। সে গাছ তো তোমাদের মস্ক্রিমশাই বাদড়ার জঙ্গলে গিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তাঁতিদের তাতে লাভটা কী? সে গাছ তো মন্ত্রিমশাই আমাদের দেবেন না।
কেন, দেবে না কেন?
আমাদের রাজা বড় সর্বনেশে। বুড়ো এদিক-ওদিক সন্দেহের দৃষ্টি দিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, এ রাজা পিশাচ। পেয়াদারা বল্লমের খোঁচা মেরে তাঁতিদের দিয়ে কাপড় বোনায়। যারা বোনে না তাদের শূলে চড়ায়। রূপসার কাপড় বিদেশ থেকে সদাগর এসে কিনে নিয়ে যায়। যা টাকা আসে তার চার ভাগের তিন ভাগ যায় রাজকোষে। তাঁতিরা সব একজোটে রাজাকে হটিয়ে তার ছেলেকে সিংহাসনে বসাবে ঠিক করেছিল। সেকথা কেউ গিয়ে তোলে রাজার কানে। আর সেই সময় লাগে এই মড়ক। রাজা চায় তাঁতিরা সব মরুক। তাই ওষুধ এনে সরিয়ে রেখেছে।
কানাইয়ের মনটা শক্ত হয়ে উঠল। এমন শয়তান রাজা এই রূপসার রাজ্যে? সে যে করে থোক। চাঁদনির পাতা এনে দেবে তাঁতিদের জন্য। যেকরে হোক!
বুড়ো বলে চলল, রাজা শয়তান, কিন্তু তার ছেলে রাজকুমার, সে সোনার চাঁদ ছেলে। তোমারই মতন বয়স তার। সে যদি রাজা হয় তা হলে দেশের সব দুঃখু দূর হবে।
এই রাজাকে সরাবার কোনও রাস্তা নেই বুঝি?
সে কি আর আমরা জানি? আমরা মুখ্য-সুখ মানুষ, আমরা শুধু দুঃখু পেতেই জানি।
আরও একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল বুড়োকে।
রাজবাড়িটা কোনদিকে বলতে পারো?
এই রাস্তা দিয়ে সোজা গেলে রাজপথ পড়বে। বাঁয়ে ঘুরে দেখবে দূরে রাজার কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে। তবে তোমায় সেখানে ঢুকতে দেবে না। পাহারা বড় কড়া।
কানাই বুড়োর কাছে বিদায় নিয়ে কিছুদূর গিয়েই রাজপথে পড়ল। বাঁ দিকে ঘুরে সত্যিই দেখল দূরে কেল্লার ফটক দেখা যাচ্ছে।
কানাই ইতিমধ্যেই মতলব এটে নিয়েছে। সে এমনি ভাবে হেঁটে গিয়ে যখন ফটক থেকে বিশ হাত দূরে, প্রহরী তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে, তখন সে দিল ফটক লক্ষ্য করে বেদম ছুট।
চোখের পলকে কানাই প্রথম ফটক দ্বিতীয় ফটক পেরিয়ে পৌঁছে গেল একটা বাগানে। এখানে আশেপাশে কোনও লোক নেই দেখে কানাই থামল। বাঁ দিকে বাগান, তাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছে শ্বেতপাথরের দালান।
কানাই কী করবে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল। বাগানে ফুলের ছড়াছড়ি, চারিদিক রঙে রঙ, কে বলবে এই দেশে শুখনাইয়ের মড়ক লেগেছে।
এই ফুলের মধ্যেই কি চাঁদনি গাছ রয়েছে? ছোট ছোট ছুঁচলো বেগুনি পাতা আর হলদে ফুল। যদি এর মধ্যেই থাকে তা হলে সে কাজ অনেক সহজে হয়ে যায়।
এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে কানাই এগোচ্ছিল, হঠাৎ তার পিঠে পড়ল একটা হাত, আর আরেকটা হাত তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে কোলপাঁজা করে তুলে নিল।
কানাই দেখলে সে এক অতিকায় প্রহরীর হাতে বন্দি।
.
০৩.
প্রহরী কানাইকে সোজা নিয়ে গেল রাজসভায়। কানাই দেখল রাজা সিংহাসনে বসে আছেন, আর তাঁকে ঘিরে রয়েছে সভাসদরা। রাজা যে শয়তান সেটা তাঁর কুতকুতে চোখ, ঘন ভুরু আর গালপাট্টা দেখলেই বোঝা যায়।
এটাকে কোত্থেকে পেলি? রাজা কানাইয়ের দিকে চোখ রেখে পেয়াদাকে জিজ্ঞেস করলেন।
মহারাজ, এ অন্দরমহলের বাগানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল।
এ ব্যাটা ফটক দিয়ে ঢুকল কী করে? দু-দুটো সশস্ত্র প্রহরী রয়েছে সেখানে!
তা জানি না মহারাজ!
হুঁ। বলবন্ত আর যশোবন্তকে শূলে চড়াও। ফটকে নতুন প্রহরী মোতায়েন করো। এ রাজ্যে কাজে ফাঁকির শাস্তি মৃত্যু।
মহারাজের পাশে দু-তিনজন কর্মচারী আদেশ পালন করার জন্য হাঁ হাঁ করে উঠল।
রাজা এবার কানাইয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেন।
তোর ব্যাপার কী শুনি। তোর নাম কী?
আজ্ঞে, আমার নাম কানাই।
কোত্থেকে আসছিস?
কানাই ঠিক করেছিল যে রাজার কাছে সে সব কথা সত্যি বলবে না। সে বলল, আজ্ঞে পাশের গাঁ থেকে।
কাগমারি?
আজ্ঞে হাঁ।
বাগানে কী খুঁজছিলি?
কই, কিছু খুঁজিনি তো। শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রাজা যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন, ঠিক আছে; এখন একে হাজতে পোরো। পরে এর বিচার হবে।
তিন মিনিটের মধ্যে কানাই দেখল যে সে কারাগারে বন্দি। গরাদওয়ালা দরজা খড়াং শব্দে বন্ধ। হতেই সে হতাশ হয়ে কারাগারের এককোণে বসে পড়ল। আর আটদিন বাকি আছে। তার মধ্যে চাঁদনির পাতা নিয়ে দেশে ফিরতে না পারলে তার বাপকে সে চিরতরে হারাবে।
এমন হতাশ কানাইয়ের কোনওদিনও লাগেনি। জগাইবাবার কথা মনে পড়ল তার। নীল আর। লাল ফল দুটো আর ঝিনুকটা এখনও তার ট্যাঁকে রয়েছে। কিন্তু কই, জগাইবাবা তো তাকে আর ডাকল না। ওগুলো দিয়ে কী কাজ হয় তাও জানা গেল না।
কয়েদখানার একটামাত্র খুপরি জানলা; সেটা পশ্চিম দিকে হওয়াতে তার ভিতর দিয়ে বিকেলের রোদ এসে পড়েছে। কমলা রঙের রোদ দেখে কানাই বুঝল যে, সূর্য অস্ত যাবার মুখে।
ক্রমে সেই আলোটুকুও চলে গিয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। ঘরের বাইরে একজন প্রহরী, সে সেখানে টহল ফিরছে। তার পায়ের একটানা খট খট শব্দে কানাইয়ের চোখে ঘুম এল, আর দশ মিনিটের মধ্যে কানাই ঘুমে ঢলে পড়ল।
এইভাবে জেগে ঘুমিয়ে, কয়েদখানার অখাদ্য খাওয়া খেয়ে, তিনদিন চলে গেল। সময় আর মাত্র পাঁচদিন। সন্ধ্যা হয়-হয়, কানাইয়ের চোখে ঘুমের আমেজ, মন থেকে আশা প্রায় মুছে এসেছে, এমন সময় সে হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠল। বাইরে প্রহরী এখন টহল দিচ্ছে, কে যেন এর মধ্যে বাইরে একটা মশাল জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, তার আলোয় ফটকের গরাদের লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে কারাগারের মেঝেতে।
কিন্তু কানাইয়ের ঘুমটা ভাঙল কেন?
কান পাততেই কানাই কারণটা বুঝল।
তার ট্যাঁকের ঝিনুক থেকে একটা শব্দ আসছে।
কানাই! কানাই! কানাই!
কানাই তাড়াতাড়ি ঝিনুকটা বার করে কানের উপর চেপে ধরল। তারপরেই সে পরিষ্কার শুনতে পেল জগাইবাবার কথা।
শোন, কানাই, মন দিয়ে শোন। আরও কিছু কথা মনে পড়েছে। তোর কাছে যে নীল ফলটা আছে সেটা খেলে তোর মধ্যে অদৃশ্য হবার শক্তি আসবে। কিন্তু অদৃশ্য হতে গেলে আগে একটা কথা বলে নিতে হবে। সেটা হল ফক্কা। সেটা বললেই তোকে আর কেউ দেখতে পাবে না। আবার যখন নিজের চেহারায় ফিরে আসতে চাইবি, তখন বলতে হবে টক্কা। বুঝলি?
হ্যাঁ, বুঝেছি, মনে মনে বলল কানাই।
আচ্ছা, এবার আরেকটা কথা বলি–সেটাও হঠাৎ মনে পড়ল। রূপসার রাজা তার ছেলেকে বন্দি করে রেখেছে প্রাসাদের ছাতের কোণে একটা ঘরে। বাবাকে হটিয়ে ছেলে সিংহাসনে না বসা অবধি রূপসার কোনও গতি নেই; শুখনাই অসুখে সারা দেশ ছারখার হয়ে যাবে। রাজাকে এক সদাগর এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে একটা পান্না বিক্রি করে আজ থেকে সাত বছর আগে। এই পান্না রাজার গলার হারে বসানো। এই পান্নায় জাদু আছে; এটাই যত নষ্টের গোড়া। বুঝছিস?
কানাই বুঝেছে ঠিকই, কিন্তু চাঁদনির পাতা কী করে পাওয়া যাবে সেই নিয়ে তো জগাইবাবা কিছুই বললেন না!
ঝিনুকের ভিতর আবার কথা শোনা গেল।
চাঁদনি উদ্ধার করায় বড় বিপদ। কিন্তু তারও রাস্তা আছে।
কী রাস্তা?
সেটা মনে পড়ছে না, বলল জগাইবাবা। পড়লে বলব।
ব্যস্, কথা শেষ। কানাই কানে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছে। সে ঝিনুকটাকে আবার ট্যাঁকে গুঁজে নিল।
প্রহরী এখনও টহল দিচ্ছে। লম্বা টহল, তার গোড়ায় আর শেষটায় প্রহরী কানাইয়ের দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। বাঁ দিকে একবার প্রহরী অদৃশ্য হতেই ট্যাঁক থেকে নীল ফলটা বার করে কানাই টপ করে মুখে পুরে দিল। তারপর প্রহরী ডান দিকে অদৃশ্য হতেই কানাই ধাঁ করে বলে দিল ফক্কা!
প্রহরী ফেরার পথে কয়েদখানার দিকে দেখেই চমকে উঠল। তার টহল থেমে গেল।
সে প্রথমে গরাদের ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখল-এ-কোণ, ও-কোণ, সে-কোণ।
তারপর মশালটা গরাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে আবার দেখল।
তারপর মশাল রেখে চাবি দিয়ে ফটক খুলে অতি সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকল। তার চোখে অবাক ভাবটা তখন দেখবার মতো!
কানাই এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করছিল। প্রহরীকে বেশ কিছুটা ভিতরে ঢুকতে দিয়ে টু করে পাশ কাটিয়ে খোলা ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল।
পা টিপে টিপে কোনও শব্দ না করে দুজন প্রহরীর নাকের সামনে দিয়ে কানাই বেরিয়ে এসে পৌঁছল একটা ঘোরানো সিঁড়ির মুখে।
সেই সিঁড়ি দিয়ে সে উঠতে লাগল উপরে। নিঘাত এ সিঁড়ি ছাতে গিয়ে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ, কানাইয়ের আন্দাজে ভুল নেই। সিঁড়ি উঠে গিয়ে একটা দরজার মুখে পৌঁছেছে, সেই দরজা পেরোতেই কানাই দেখল সে ছাতে এসে পড়েছে।
পেল্লায় ছাত, এককোণে একটা ঘর। তাতে একটা জানলা। সেই জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা টিমটিমে আলো। ঘরের দরজার বাইরে বসে আছে একটা প্রহরী, তার মাথা হেঁট।
অদৃশ্য কানাই এগিয়ে গেল প্রহরীর দিকে। যা আন্দাজ করেছিল তাই; প্রহরী মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে, তার নাক দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে।
ঘরের দরজায় একটা বড় তালা ঝুলছে। বোধহয় তারই চাবি রয়েছে প্রহরীর কোমরে গোঁজা।
কানাই খুব সাবধানে প্রহরীর ঘুম না ভাঙিয়ে চাবিটা বার করে নিল। তারপর সেটা তালায় ঢুকিয়ে একটা প্যাঁচ দিতেই খুট করে তালা খুলে গেল। কী ভাগ্যি এই শব্দেও প্রহরীর ঘুম। ভাঙেনি।
এবার দরজা খুলে অদৃশ্য কানাই ঘরের ভিতর ঢুকল। ঘরে একটা টেমি জ্বলছে, আর একটা খাটিয়ায় চোখে অবাক দৃষ্টি নিয়ে বসে আছে তারই বয়সি একটি ফুটফুটে ছেলে। ঘরের দরজা খুলল, অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না, তাতে রাজকুমারের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। এ কি ভেলকি নাকি?
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে কানাই এবার খাটের দিকে ঘুরে ফিসফিস্ করে বলল, টক্কা!–আর অমনই তার চেহারা দেখা যাওয়াতে রাজকুমার আরও চমকে উঠে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোনও জাদুকর নাকি?
ফিসফিসিয়েই কথা হল, যদিও প্রহরীর নাকডাকানি থেকে মনে হয় বাজ পড়লেও তার ঘুম ভাঙবে না।
কানাই রাজকুমারকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। রাজকুমার বলল, গাছের কথা তুমি বলছ বটে, কিন্তু সে গাছ তুমি পাবে কী করে? সে তত সহজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
কী করে পাব তা জানি না, বলল কানাই, কিন্তু গাছের পাতা আমার চাই-ই। শুধু আমার বাবার জন্য নয়; তোমাদের এখানে তাঁতিরা সব মরতে বসেছে। তাদের জন্য পাতা লাগবে। কম করে হাজার পাতা তো থাকবেই সে গাছে; তাতে হাজার লোকের প্রাণ বাঁচবে।
আমিও তো তাদের বাঁচাতে চাই, বলল রাজকুমার। বাবাকে আমি সে কথা বলেছিলাম। বাবা তাতেই আমাকে বন্দি করে রাখার হুকুম দিলেন। বাবা নিজের ছাড়া আর কারুর ভালও চান না। নিজের ভাল মানে যত বেশি টাকা আসে কোষাগারে ততই ভাল। ধর্মেকর্মে বাবার মতি নেই,
প্রজাদের মঙ্গলের চিন্তা নেই, আমি যে তাঁর নিজের ছেলে, তার জন্যও মায়া-মমতা কিচ্ছু নেই।
কানাই বলল, আচ্ছা, তোমার বাবার গলার হারে একটা জাদুপান্না আছে, তাই না? তা তো বটেই। সাত বচ্ছর আগে এক সদাগর বাবাকে সেটা বেচে। সেই থেকে বাবার একটা দিনের জন্যও কোনও অসুখ হয়নি, আর বাবার অত্যাচারও বেড়ে গেছে তিনগুণ। এখানকার তাঁতিরা তাঁকে সিংহাসন থেকে সরাবার ফন্দি করেছিল। হয়তো তারা সে কাজে সফল হত, কিন্তু সেইসময়ই লাগে শুনাইয়ের মড়ক।
কানাই একটু ভেবে বলল, আচ্ছা, একটা কথা বলো দেখি। রাজামশাইয়ের শোয়ার ঘরটা কোথায়? আমি তো ইচ্ছা করলে অদৃশ্য হতে পারি। আমি যদি তার গলা থেকে হারটা খুলে নিয়ে আসি?
রাজকুমার গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
বাবার শোয়ার ঘর রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে। কিন্তু তার দরজায় প্রহরী ছাড়াও একটা ভয়ানক হিংস্র কুকুর পাহারা দেয়। সে তোমাকে দেখতে না পেলেও তোমার গন্ধ পাবে, আর পেলেই চিৎকার শুরু করবে। না, ওভাবে হবে না। অন্য উপায় দেখতে হবে। যা করতে হবে দিনের বেলা।
কানাই একটুক্ষণ চুপ করে ভেবে বলল, তোমাকে তো এবার পালাতে হবে। আমি যখন এসেই পড়েছি, তখন আর তুমি বন্দি থাকবে কেন? রাজবাড়ি ছাড়া তোমার কোনও ঠাঁই আছে?
তা আছে, বলল রাজকুমার। তাঁতিদের মধ্যে আমার এক বন্ধু আছে, তার নাম গোপাল। তার এক বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। আমার নিজের মা-কে হারিয়েছি আমি তিন বছর বয়সে। গোপালের মা-কে আমি নিজের মায়ের মতো ভালবাসি। বাবা গোপালের সঙ্গে মিশতে দেন না আমাকে; কিন্তু আজ যদি তার কাছে যাই, সে আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।
তার বাড়িতে কি দুজনের জায়গা হবে?
হবে বইকী। তিনজনে এক ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে থাকব। আমার খুব অভ্যাস আছে।
তা হলে চলো, চাঁদের আলোয় বেরিয়ে পড়ি।
কিন্তু ফটকে প্রহরী আছে যে?
প্রহরী আমাদের কিছু করতে পারবে না। তোমাকে পিঠে করে নিয়ে আমি ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাব। কেউ আমাদের নাগাল পাবে না।
সত্যি বলছ?
সত্যি।
কিন্তু যে আমার এমন বন্ধুর কাজ করল, তার নামটা তো এখনও জানলাম না।
আমার নাম কানাই।
আর আমার নাম কিশোর।
তবে চলো যাই এবার। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে সোজা নেমে যাব।
বেশ। নীচে সিঁড়ির মুখে দরজা পেরোলেই বাগান।
সেইখান থেকেই দেব ছুট!
.
০৪.
গোপালদের বাড়ি তাঁতিপাড়ার এক প্রান্তে। সেখানে শুই রোগ এখনও পৌঁছয়নি, কিন্তু কবে এসে পৌঁছবে তার ঠিক কি? গোপালের মা সেই কথা ভেবে কানাই আর কিশোরকে বলেছিলেন, আমার এখানে থাকার বিপদটা কী তা জানো। সেটা ভেবেও কি তোমরা তিনজনে একসঙ্গে থাকতে চাও?
তিনজনেই মাথা নেড়ে বলেছিল হ্যাঁ, তারা তাই চায়। সেই সঙ্গে কানাই বলেছিল, আপনি ভাববেন না। শুখনাই রোগের ওষুধ আছে রাজবাড়িতে। সে ওষুধ আমি জোগাড় করবই যে করে হোক। তা হলে আর কারুর ব্যারাম থাকবে না।
কিন্তু মুখে বলা এক, আর কাজে আরেক।
তিনদিন কেটে গেল, তবু কাজ এগোলো না একটুও। আর মাত্র দুদিন আছে কানাইয়ের বাপ, তারপরেই তার আয়ু শেষ। এদিকে ঝিনুকেও আর কোনও কথা শোনা যায়নি। জগাইবাবা এমন চুপ কেন?
এর মধ্যে অবিশ্যি আরও অনেক কাণ্ড ঘটে গেছে। কানাই আর রাজকুমার দুজনেই কয়েদি অবস্থা থেকে পালিয়েছে দেখে রাজবাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেছে। এ জিনিস কেমন করে হয়? যে প্রহরী দুজন পাহারায় ছিল তাদের দুজনকেই শুলে চড়ানো হয়েছে। কানাই আর কিশোরকে ধরার জন্য শয়ে শয়ে সেপাই সারা রাজ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। গোপাল তাঁতির সঙ্গে যে রাজকুমারের ভাব ছিল সেটা রাজা জানতেন, তাই গোপালের বাড়িতেও পেয়াদা পাঠিয়েছিলেন। ঠিক সেই সময় কানাই বুদ্ধি করে ফক্কা বলে অদৃশ্য হয়ে পেয়াদার হাত থেকে বল্লম টেনে নিয়ে তাকে ল্যাঙ মেরে ফেলে দিয়েছে; পেয়াদা এই ভেলকিতে ভড়কে গিয়ে দিয়েছে চম্পট।
তারপর থেকে গোপালের বাড়িতে আর কেউ আসেনি।
আজ কানাই আর সবুর সইতে না পেরে কিশোরকে বলল, হ্যাঁ ভাই, সেই জাদুপান্না না সরাতে পারলে তো আর চলছে না। একবার একটু ভেবে বলল দেখি তোমার বাবা একা কখন থাকেন, তার কাছাকাছি যাবার সুযোগটা কখন পাওয়া যায়?
কিশোর বলল, জাদুপান্না নিলেই যে সব গোল মিটে যাবে তেমন ভেবো না। বরং উপকারের চেয়ে অপকার বেশি হতে পারে, বাবার রাগ সপ্তমে চড়ে যেতে পারে।
কানাই বলল, তাও চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তুমি একবার একটু ভেবে বলো।
কিছুক্ষণ চোখ বুজে ভেবে রাজকুমার বলল, একটা কথা মনে পড়েছে।
কী কথা?
বাবা রোজ ভোরে সূর্যোদয়ের সময় রাজবাড়ির অন্দরমহলের দিঘিতে স্নান করতে যান। সেই। সময় প্রহরী থাকে দূরে। বাবার কাছাকাছি কেউ থাকে না।
তবে আর কী! বলল কানাই, এই তো সুযোগ। কাল ভোরে আমি রাজবাড়ি যাব অদৃশ্য হয়ে। দেখি তোমার বাবার সঙ্গে দিঘিতে গিয়ে কিছু করা যায় কিনা।
পরদিন সূর্য ওঠার আগেই কানাই ফক্কা বলে অদৃশ্য হয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে রাজবাড়ি পৌঁছে দিঘির শ্বেতপাথরে বাঁধানো ঘাটের কাছেই একটা বকুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। পুব আকাশে পদ্মের রঙ ধরেছে কিন্তু সূর্য তখনও ওঠেনি।
কিছু পরে সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই কানাই খট খট শব্দ শুনে বুঝল রাজা খড়ম পায়ে ঘাটে আসছেন।
ওই যে রাজা! রাজার গা খালি। পরনে কেবল ধুতি আর কাঁধের উপর একটা রেশমের উত্তরীয়। উত্তরীয়টা ঘাটের পাশের বেদিতে রেখে রাজা খড়ম খুলে সিঁড়ির দিকে এগোলেন। গলার হারের পান্নাতে সূর্যের আলো পড়ে যেন তার থেকে আগুন বেরোচ্ছে।
এবার রাজা জলে নামলেন। কানাইও এগিয়ে গেল ঘাটের সিঁড়ির দিকে, তারপর ধীরে ধীরে সেও জলে নেমে রাজার সাত হাত দূরে গলা জলে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
রাজা যেই ডুব দিলেন, অমনই কানাইও ত্ব দিয়ে সাঁতরে এগিয়ে এসে পলকের মধ্যে রাজার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে আবার ডুব সাঁতার দিয়ে দিঘির উলটো পারে গিয়ে জল থেকে উঠল।
ততক্ষণে রাজা দিশেহারা হয়ে জলে তাঁর হার খুঁজছেন আর প্রহরী, প্রহরী বলে ডাকছেন।
প্রহরী ছুটে এল। কী হল মহারাজ?
এই সেই শয়তান রাঘব বোয়ালের কাজ। আমার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে গেল। খবর দিয়ে দে। দরকার হলে দিঘির জল সেঁচতে হবে। আর আমার ফেরত চাই।
ইতিমধ্যে অদৃশ্য কানাই হাতের মুঠোয় হার নিয়ে রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এক ছুটে মুহূর্তের মধ্যে চলে এল একেবারে গোপালের বাড়ি। তারপর টক্কা বলে আবার নিজের চেহারায় ফিরে এসে রাজকুমারকে দেখিয়ে দিল যে তার কাজ সে করে এসেছে।
কিন্তু এর ফলে রাজার মধ্যে কোনও পরিবর্তন এল কিনা সেটা কী করে বোঝা যাবে?
কানাইয়ের সে বুদ্ধিও মাথায় এসে গেছে। সে বলল, আমি কাল অদৃশ্য হয়ে রাজসভায় যাব। রাজার হাবভাব কীরকম সেটা দেখে আসব।
তাই ঠিক হল, আর কানাই পরদিন রাজসভায় গিয়ে হাজির হল।
সভাসদরা এসে গেছেন, কিন্তু রাজা তখনও আসেননি।
কানাই পিছনের দিকে এক কোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল।
সময় চলে যায়, কিন্তু রাজার দেখা নেই।
প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষার পর রাজামশাই এসে ঢুকলেন রাজসভায়।
কিন্তু কই, রাজার চেহারায় ভালর দিকে পরিবর্তনের তো কোনও লক্ষণ নেই। চোখে তো সেই একই শয়তানের দৃষ্টি, কেবল ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির বদলে আজ প্রচণ্ড রাগ।
রাজা সিংহাসনে বসে চারিদিকে একবার লাল চোখে দেখে নিয়ে বললেন, আমার রাজ্যে মহা শয়তান এক জাদুকরের আবির্ভাব হয়েছে। সে নিজে কয়েদখানা থেকে প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে, আমার ছেলেকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছে, আমার গলা থেকে আমার সাধের পান্নার হার খুলে নিয়েছে। গতকাল ভোরে দিঘিতে ডুব দেবার সময় এই ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম এ বোয়াল মাছের কাণ্ড, কিন্তু দিঘির জল সেঁচে সেই বোয়াল মাছকে ধরেও সে হার পাওয়া যায়নি। আজ থেকে শাসন হবে আরও দশগুণ কড়া। যতদিন সেই জাদুকর আর রাজকুমারকে খুঁজে না পাওয়া যায়, ততদিন হাটবাজার সব বন্ধ। লোকে না খেয়ে মরে মরুক!
এই ভীষণ কয়েকটা কথা বলে রাজা সিংহাসন ছেড়ে চলে গেলেন। কানাই একেবারে মুষড়ে। পড়ল। জাদুপান্না খুলে নিয়ে ফল আরও খারাপ হল। এখন কী উপায়?
কানাই গোপালের বাড়ি ফিরে এল।
তার কাছে সব শুনে-টুনে কিশোর আর গোপালের মুখও শুকিয়ে গেল। একে দেশে মড়ক, তার উপর রাজার এই মূর্তি! সারা দেশ তো ছারখার হয়ে যাবে।
কানাই তখন মনে মনে ভাবছে–আর একদিন মাত্র সময়। এই একদিনের মধ্যে চাঁদনির পাতা জোগাড় না হলে সে বাবাকে হারাবে।
দূর থেকে ঢ্যাঁড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আর সেইসঙ্গে ঘোষণা। আজ থেকে বাজারে কেনাবেচা বন্ধ। সেইসঙ্গে এও ঘোষণা হচ্ছে যে, রাজকুমার আর জাদুকরকে যে ধরে দিতে পারবে তাকে এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। ঢ্যাঁড়ার দুম দুম্ শব্দ ক্রমে এদিকে এগিয়ে আসছে। তাঁতিপাড়াতেও ঘোষণা হবে।
এই ডামাডোলের মধ্যে কানাই হঠাৎ চমকে উঠল।
তার নাম ধরে কে ডাকে ক্ষীণ স্বরে?
সে তৎক্ষণাৎ ট্যাঁক থেকে ঝিনুক বার করে কানে দিল। পরিষ্কার শোনা গেল জগাইবাবার কথা।
শোন কানাই, মন দিয়ে কাজের কথা শোন। কাল সকালে এক প্রহরে তুই যাবি রাজবাড়ির অন্দরমহলের বাগানের ঈশান কোণে। সেই কোণে জলে ঘেরা একটা ছোট্ট দ্বীপে চাঁদনি গাছ পোঁতা আছে। সেই গাছ তোকে উদ্ধার করতে হবে।
কী করে জগাইবাবা?
সেটা হবে তোর নিজের বুদ্ধি আর সাহসের জোরে। কাজটা সহজ নয়। বুঝলি?
বুঝলাম, কিন্তু—
কিন্তু কী?
হলদে ফলের গুণ কী সেটা তো বললেন না।
এখন মনে পড়েনি। পড়লে বলব। আগে তোর বাপকে বাঁচাবার ব্যবস্থা কর। তার প্রায় শেষ অবস্থা। তবে পাতার রস খেলেই সে চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আসি।
ঝিনুকের মধ্যে আবার সমুদ্রের গর্জন।
কানাই সব ঘটনা বলল কিশোর আর গোপালকে। কাল এক প্রহর, সব শেষে বলল কানাই। কালই এসপার, নয় ওসপার।
.
০৫.
জগাইবাবার নির্দেশমতো কানাই সকাল থেকেই অদৃশ্য হয়ে বাগানে হাজির হল। তারপর বাগানের ঈশান কোণে গিয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষুস্থির। একটা ছোট্ট দ্বীপে চাঁদনি গাছটা পোঁতা রয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই এক-মানুষ উঁচু গাছটার গোড়ায় পেঁচিয়ে আছে একটা শঙ্খচূড় সাপ, যার এক ছোবলেই একটা মানুষ পায় অক্কা। আর দ্বীপটাকে ঘিরে আছে একটা পাঁচ হাত চওড়া পরিখা, তাতে কিলবিল করছে পাঁচ-সাতটা কুমির। কানাই যখন পৌঁছল তখন সেই কুমিরগুলোর দিকে কোলা ব্যাঙ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে একটা লোক আর সেগুলো কপ কপ করে গিলে খাচ্ছে কুমিরগুলো। একটা ব্যাঙ সাপটার দিকেও ছুঁড়ে দেওয়া হল, আর সেটা তক্ষুনি সে মুখে পুরে গিলতে আরম্ভ করল।
খাওয়া শেষ হলে কানাই দুগ্না বলে কাজে লেগে গেল। আজই শেষ দিন, আজ তাকে যে করে হোক চাঁদনির পাতা জোগাড় করতেই হবে।
বাগানের একপাশে পাঁচিলের ধারে কিছু বাঁশ পড়ে আছে। অদৃশ্য কানাই তার থেকে দুটো বাঁশ নিয়ে সেগুলোকে পরিখার পাঁচিলে এমনভাবে শুইয়ে রাখল যে, বাঁশের অন্য দিক দ্বীপের উপর গিয়ে পড়ে। ফলে বেশ একটা সেতু তৈরি হয়ে গেল কুমির বাঁচিয়ে দ্বীপে যাবার জন্য।
কিন্তু সাপের কী হবে?
তার জন্য চাই অস্ত্র।
কানাই বাগানের ফটকে গিয়ে দেখল সেখানে হাতে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে একটা সেপাই দাঁড়িয়ে আছে। অদৃশ্য কানাই তার হাত থেকে একটানে তলোয়ারটা বার করে নিল। তারপর সেপাইকে হতভম্ব করে দিয়ে শুন্য দিয়ে সে তলোয়ার নিয়ে বাঁশের সেতুর উপর দিয়ে দ্বীপে পৌঁছে এক কোপে শঙ্খচূড়ের মাথা শরীর থেকে আলগা করে দিল। তারপর তলোয়ারটাকে পরিখার জলে ফেলে অদৃশ্য কানাই এক হ্যাঁচকায় শেকড়সুদ্ধ চাঁদনি গাছটাকে তুলে সেতু পেরিয়ে এসে ঝড়ের বেগে চলে এল গোপালের বাড়ি। তারপর টা বলে সে নিজের চেহারায় ফিরে এল।
গোপাল কানাইয়ের হাতে গাছ দেখে চেঁচিয়ে উঠল, চলো যাই ঘরে ঘরে পাতা বিলিয়ে আসি।
তাই যাও, বলল কানাই। তবে একটা পাতা আমি নিচ্ছি। আমি আবার ফিরে আসব বিকেল পড়তে না পড়তেই। আজই শেষ দিন; আজ আমার বাবাকে বাঁচাবার শেষ সুযোগ।
তীরের বেগে দেখতে দেখতে নন্দীগ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছে গেল কানাই। বাবা বিছানায় পড়ে আছে, তার শরীরের প্রত্যেকটি হাড় গোনা যায়।
কানাই এলি? ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করল বলরাম কৃষক।
কানাই তখন পাতার রস বার করতে শুরু করছে। বেগুনি পাতার বেগুনি রস।
এই নাও বাবা, খেয়ে নাও।
কোনওমতে ঘাড় উঁচু করে রস খেয়ে আঃ বলে একটা আরামের নিশ্বাস ফেলে আবার বালিশে মাথা দিল বলরাম। আর তার পরমুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখা দিল। অনেক আরাম বোধ করছি রে কানাই! তুই আমাকে বাঁচালি এ-যাত্রা।
কানাই বাবাকে বলল তার একবার রূপসা যেতে হবে, সেখানকার খবর নেওয়া দরকার। কাজ সেরেই সে আবার ফিরে আসবে।
তা যা, বলল বলরাম, তবে যাবার আগে কিছু ফল আর এক বাটি দুধ রেখে যাস খাটের পাশে। মনে হচ্ছে খিদে পাবে।
কানাই বাবার ফরমাশ পালন করে রূপসা গিয়ে হাজির হল।
শহরের চেহারাই বদলে গেছে। তাঁতিপাড়ায় ঘরে ঘরে হাসিমুখ দেখতে দেখতে কানাই পৌঁছল গোপালের বাড়ি। কিশোরও রয়েছে সেখানে, কিন্তু তার মুখ গম্ভীর।
কী ভাবছ কিশোর? জিজ্ঞেস করল কানাই।
ভাবছি বাবার কথা, বলল কিশোর। বাবারও ব্যারাম হয়েছে।
অ্যাঁ, সে কী? কী করে জানলে?
ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে গেল। বলল রাজার অসুখ; রাজা আমাকে দেখতে চায়। আমি যেখানেই থাকি যেন গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।
ব্যারাম মানে কী ব্যারাম? জিজ্ঞেস করল কানাই।
শুখ্নাই। তাঁতির যা অসুখ; তোমার বাপের যা অসুখ, বাবারও সেই অসুখ। আর তার একমাত্র ওষুধ এখন আমাদের কাছে।
তা বেশ তো, বলল কানাই, সে ওষুধ তাকে দাও, কিন্তু একটা শর্তে।
কী শর্ত?
তিনি যেন রোগ সারলেই রাজকার্য ছেড়ে তীর্থে যান। আর তাঁর জায়গায় তুমি বসো সিংহাসনে।
আমিও তাই ভাবছিলাম, বলল কিশোর। একটা কথা বলব? হঠাৎ বলে উঠল গোপাল তাঁতি।
কী কথা ভাই? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
তুমি রাজা হলে আমায় একটা নতুন তাঁত দেবে? যেটা আছে সেটা আমার ঠাকুরদাদার। তাতে ভাল বোনা যায় না।
নিশ্চয়ই দেব, বলল কিশোর। তুমি হবে তাঁতির সেরা তাঁতি। তোমার বোনা কাপড় পরে আমি সিংহাসনে বসব। তারপর কানাইয়ের দিকে ফিরে বলল, চলো যাই বাবার কাছে।
কানাইয়ের পিঠে চড়ে এক মুহূর্তে প্রাসাদের অন্দরমহলে পৌঁছে গেল কিশোর। রাজবাড়িতে শোকের ছায়া পড়েছে। রাজার অসুখের একমাত্র ওষুধ চাঁদনি পাতা ভেলকির বশে রাজার উদ্যান থেকে উধাও হয়ে গেছে। আর বিশ দিন মাত্র আয়ু তাঁর।
রাজার শোয়ার ঘরের বাইরে প্রহরী কিশোর আর কানাইকে দেখে চমকে উঠল, কিন্তু তাদের কোনও বাধা দিল না। কিশোর আর কানাই সোজা গিয়ে ঢুকল রাজার ঘরে।
রাজা শয্যা নিয়েছেন, পাশে রাজ কবিরাজ মাথায় হাত দিয়ে বসে রাজার প্রশ্নের উত্তরে বলছেন। আর কোনও জায়গায় চাঁদনি গাছ নেই, আর এ-রোগের আর কোনও চিকিৎসাও নেই।
ঠিক সেই সময় গিয়ে উপস্থিত হল কিশোর আর কানাই।
তুই এলি! ছেলেকে দেখে কাতর কণ্ঠে বলে উঠলেন রাজা। তবে তোর সঙ্গে এ কেন? এ যে পিশাচসিদ্ধ জাদুকর।
না বাবা, বলল কিশোর। এ হল রূপসার ভবিষ্যৎ মন্ত্রী।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ বাবা। আমি সঙ্গে করে তোমার ওষুধ এনেছি। এই ওষুধ তোমাকে দেব, যদি কথা দাও যে অসুখ সারলেই তীর্থে চলে যাবে চিরকালের মতো!
তা কেন দেব না কথা, বললেন রাজা, যত নষ্টের গোড়া ছিল ওই জাদুপান্না, যদিও রোগের হাত থেকে ওটাই আমাকে এতদিন রক্ষা করেছে। সেই পান্না যাবার পর থেকেই আমার দেহে আর মনে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমি বুঝেছি কত ভুল করেছি। আমি যাব তীর্থে, আর তুই বসবি আমার জায়গায় সিংহাসনে। রূপসার গৌরব ফিরিয়ে আনবি। লোকে ধন্য ধন্য করবে।
রাজকুমার এবার তার হাতের মুঠো খুলে ধরল বাপের সামনে। সেই মুঠোয় চাঁদনির বেগুনি পাতা, তার সৌরভে রাজার শয়নকক্ষ ভরপুর হয়ে গেল।
রাজা সেরে উঠলেন একদিনেই।
তিনদিন পরে যুবরাজের অভিষেক হল। রাজা নিজে তার হাত ধরে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন ছেলেকে, তার পরনে গোপালের তৈরি পোশাক। তারপর কিশোর কানাইকে বসিয়ে দিল মন্ত্রীর আসনে। ইতিমধ্যে কানাই নন্দীগ্রামে গিয়ে তার বাবাকে নিয়ে এসেছে, কিশোর বলরামকে থাকবার ঘর দিয়েছে, তার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
চারদিকে শাঁখ বাজছে, রোশনচৌকিতে সানাই বাজছে, তারই মধ্যে মন্ত্রীর আসনে বসে কানাই শুনতে পেল জগাইবাবার ডাক।
কানাই! কানাই! কানাই!
কানাই রাজসভার মধ্যেই ট্যাঁক থেকে ঝিনুক বার করে কানে দিল। খ্যান খ্যান করে শোনা গেল জগাইবাবার কথা।
তোর তো আস্পর্ধা কম না–তোর বিদ্যেবুদ্ধি নেই, তুই রূপসার মন্ত্রীর আসনে বসেছিস?
কী করব জগাইবাবা, মনে মনে বলল কানাই, আমি কি আর নিজে থেকে বসেছি?–এরা আমায় বসিয়েছে।
তবে শোন বলি, এল জগাইবাবার কথা। অ্যাদ্দিনে মনে পড়েছে। সেই হলদে ফলটা আছে তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে!
এইবার সেইটে খেয়ে নে। সেটা খেলে তোর বিদ্যেবুদ্ধি হাজার গুণ বেড়ে যাবে। মন্ত্রীগিরি কীভাবে করতে হয়, রাজাকে মন্ত্রণা কীভাবে দিতে হয়, দেশের মঙ্গল কীসে হয়, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন কাকে বলে–সব জানতে পারবি। তখন আর তোকে বেমানান লাগবে না, কেউ বলবে না তুই বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গেছিস। বুঝেছিস?
বুঝেছি জগাইবাবা, বুঝেছি।
তা হলে আসি।
ঝিনুকে আবার সমুদ্রের গর্জন।
কানাই ঝিনুকটা আবার ট্যাঁকে খুঁজে তার পাশ থেকে হলদে ফলটা বার করে মুখে পুরল।
সন্দেশ, ফান, চৈত্র ১৩৯২
কুটুম-কাটাম