দিব্যেন্দু চোখ সরিয়ে নিল। ভাবতে লাগল, একটা বছর কোথা দিয়ে কীভাবে চলে গেল! এই। সেই বেঞ্চ। দিব্যেন্দুচিড় ধরা কাঠের দিকে তাকাল। কত দিন, কত কত দিন, সে আর স্মিতা এই আসনে পাশাপাশি বসে গেছে! আজ সে একা আর কিছু ঝরা পাতা। দিব্যেন্দু আজ এসেছে, পুরোনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যেতে। মাঝে মাঝেই আসে, হিসেব করে, যখন তেমন কেউ থাকে না। কেউ বুঝতেও পারে না কেন সে এসেছে! মানুষকে মানুষ দ্যাখে, তার মন তো কেউ পড়তে পারে না। একটা লোক বসে আছে, এই মাত্র। হয় বেকার! না হয় কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, সময়টা কাটিয়ে যাচ্ছে।
গতকালই দিব্যেন্দু উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছে কলকাতায় কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে। সেখানে দিব্যেন্দু একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে। এই চাকরিটা সে যদি আর কিছু দিন আগে পেত; তাহলে তার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত! সে ভীরু, না স্মিতা ভীরু! বহুবার চেষ্টা করেছে এই প্রশ্নের উত্তর। পেতে। খুঁজে পায়নি সমাধান। মেয়েরা প্রেম চায়, না নিরাপত্তা! একটা ভালো চাকরি, একটা ফ্ল্যাট, নিটোল একটা সংসার!
‘ঝাল-মুড়ি আর চিনেবাদাম খেয়ে তো আর সারাজীবন কাটানো যায় না!
এই বাঁ-পাশটিতে বসে ঠিক এই কথাই বলেছিল স্মিতা। সেই ছিল ওদের শেষ বসা। ‘তুমি এই কথা বলছ কেন স্মিতা? চাকরি আমি একটা পাবই।
‘তিন বছরেও পেলে না। তোমার সে ক্যালিবার নেই। মুখচোরা, লাজুকরা এ বাজারে চাকরি পায় না।’
‘তুমি আর ছ’টা মাস আমার জন্যে অপেক্ষা করো।’
‘আমি রাজি হলেও আমার বাড়ি রাজি হবে না।’
‘তুমি রাজি করাবে।’
‘আমি তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছি। আর কত রাখব! আর কতকাল খোলা আকাশের নীচে হাত ধরে বসে থাকব!’
‘আমরা দুজনেই যদি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে একটা কিছু করি!’
দিব্যেন্দু, বিয়ে করতে সময় লাগে মাত্র পনেরো মিনিট; তারপর? কোথায় গিয়ে উঠবে! হাওড়া স্টেশানের ওয়েটিং রুমে! খাবে কী! খাওয়াবে কী!’
‘কোথাও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব।’
‘ছশো টাকার কমে ভদ্রলোকের থাকার মতো আস্তানা হয় না। কোথায় পাবে অত টাকা!’ দিব্যেন্দু আপনমনে হেসে উঠল। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল স্মিতা তার পাশ থেকে উঠে চলে যাচ্ছে। নীল শিফন শাড়ি-মোড়া অনিন্দ্য একটা শরীর। রেশমি চুলের আলগা খোঁপা নিটোল। ঘাড়ের কাছে অল্প অল্প দুলছে। তীক্ষ্ণ নাক। টানা টানা চোখ, ধনুকের মতো ভুরু। শালুকের ডাঁটির মতো লতানে দুটি বাহু। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে চুলে। আগুনের সুতোর মতো ঝিলমিল করছে। দিব্যেন্দুস্মিতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল স্মিতার দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া। তার হৃদয় থেকে একটা নরম পাখি যেন উড়ে চলে গেল। স্মিতার বাবা ডাক্তার। স্মিতার ঠাকুরদা ছিলেন হাইকোর্টের জজ সাহেব। বিলেতটিলেত ঘুরে বেড়াতেন। সাহেবি কেতার মানুষ ছিলেন। এই ধরনের নীল রক্ত যার শরীরে তার মনে বাঁধন ছেঁড়া বেদুইন-প্রেম থাকে কী করে, কী করে! দিব্যেন্দু হাত বাড়িয়ে ছিল কার দিকে! আজ দিব্যেন্দু যেভাবে বসে আছে একা, সেদিনও এইভাবেই বসেছিল স্থির সমাধি ফলকের মতো। শেষ শীতের বাতাসে ঠান্ডার কামড়। সন্ধে হয়ে গেল। ঝাপসা একটা চাঁদ ঠেলে উঠল পুব আকাশে। কুয়াশার অশরীরী আঁচল নেমে এল লেকের জলে।
স্কুল শিক্ষকের ছেলে দিব্যেন্দু স্কটিশচার্চের মেধাবী ছাত্র। ভেবেছিল, লেখাপড়ায় ভালো হলেই বুঝি ভালো একটা চাকরি হেঁটে এসে হাত ধরবে। পৃথিবীর সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের ঘষাঘষিতে দিব্যেন্দুবুঝে গেল দুটো জগৎ পাশাপাশি ঘুরছে, কল্পনার জগৎ আর বাস্তব জগৎ। বাস্তব জগতের চাঁদে কবিতা নেই। আছে অজস্র, অতল অন্ধকার গহুর। সূর্য আলোনা দেখালে চাঁদ পৃথিবীতে রাতের রুপালি আলো ঢালতে পারে না। সূর্য হল সোনার চাকতি। চাঁদির চাকতি ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ এক অচল পশু।
স্মিতা ছিল তার সহপাঠী। দিব্যেন্দুস্মিতাকে কবিতা লিখে শোনাত। কলেজ সোশ্যালে কাঁপা কাঁপা গলায় আবৃত্তি করত। অত শ্রোতার মধ্যে একমাত্র স্মিতাকেই সে শোনাত। পড়াশোনায় নড়বড়ে স্মিতাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লজিক আর ফিলোজফি পড়াত। আর মনে মনে ভাবত, স্মিতাকে বউ করবে। ছোট্ট নিখুঁত একটা সংসার। দোতলার বারান্দায় অর্কিড দোল খাবে। ছাদের টবে গোলাপ হাসবে। জানলা দিয়ে ধপধপে চাঁদের আলো এসে পড়বে সাদা বিছানায়। আকাশে চাঁদ, স্মিতার ছোট্ট কপালে রুপালি টিপ। ভিজে ভিজে গোলাপি ঠোঁট। শরীরে সমুদ্রের ঢেউ। দিব্যেন্দু একদিন স্মিতার কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল! সেইদিনই বুঝেছিল স্মিতা কত। সাবধানী। দিব্যেন্দুকে দু-হাতে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ছিঃ, অমন করতে নেই।’ দিব্যেন্দু সেদিন ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিল। মনে হয়েছিল, সে এক কাঙাল। পরে ভেবেছিল স্মিতা ঠিকই করেছে। প্রবল আকর্ষণে মানুষ বোধবুদ্ধি হারায়। তৃতীয় একটা প্রাণ এসে গেলে কে সামলাত!
স্মিতা চলে গেলেও পদচিহ্ন রেখে গেছে। মানুষের মন তো আর সমুদ্রের বেলাভূমি নয় যে ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যাবে। মন হল কাঁচা সিমেন্টের মেঝে। দাগটা ছাঁচের মতো থেকেই যায়। যতই পালিশ করো অস্পষ্ট ফুটেই থাকে। আলোর বিপরীতে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। দিব্যেন্দুর মন সেই দাগ ধরা মেঝে।