- বইয়ের নামঃ ৫০টি প্রেমের গল্প
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আলো-অন্ধকার
এক-একটা দিন ভোলা যায় না। জীবনে সেই সব দিন যেন নোঙর করা নৌকোর মতো স্মৃতির ভারে দুলতে থাকে। একটু দেরি হল অফিসে পৌঁছোতে। আজকাল আর সময়কে কোনও কিছুতেই মাপা যায় না। সময়ের হিসেবে স্থানের দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। একই যানবাহনে এই একই জায়গা থেকে আগে যে সময়ে ডালহৌসি পৌঁছোতুম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। এর একাধিক কারণ। আমরা যে অঞ্চলে রয়েছি সেখান থেকে অনিবার্য কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধেই ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে। একটা বড় বা প্রধান বাসরুট উঠে গেছে। অন্যান্য বাসের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। দুধ পাওয়া যায় না। পোস্টঅফিস নেই। বাজারের অবস্থাও খারাপ। জিনিসপত্রের চালান নেই। স্কুল, কলেজ অনিয়মিত। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে, সকলেই গৃহের গণ্ডিতে অন্তরিন। আজকাল দেরিতে অফিস পৌঁছেলে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ সব কিছুই অনিশ্চিত! সকলেরই এক অবস্থা। বলতে গেলে—ফাদার উই আর অন দি সেম বোট।
অফিসে পৌঁছে আজকাল আর প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায় না। ঢুকেই কাজ নিয়ে বসতে হয়। কোনও কোনওদিন এক ঘর ভিজিটার নানা সমস্যা নিয়ে মুখিয়ে বসে থাকে। পোর্টফোলিও এক কোণে ফেলেই কাজের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। এর মাঝে একমাত্র রিলিফ— মলয় এক কাপ চা যখন দিয়ে যায়। চুমুকে চুমুকে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকানো—পনেরো-কুড়ি মিনিটের জন্যে অন্য জগতে, কল্পনার জগতে মুক্তি। টেলিফোন বেজে উঠল। চায়ের সময় ফোন বড় বিরক্তিকর। তবুও রিসিভার তুলতে হল। ও প্রান্তে কাবেরী। কী হল! এই তো মাত্র দু-ঘণ্টা আগে তাকে ছেড়ে এলাম। কী হল কাবেরী? একটু তাড়াতাড়ি চলে আসব! আচ্ছা, তুমি যদি এইরকম করো, কাজকর্ম কী করে করব! লোকে আমাকে স্ত্রৈণ বলবে যে। আচ্ছা আজকের দিনটা। বেশ তাই হবে। কিন্তু নট বিফোর ফোর।
একটা জরুরি ডেসপ্যাঁচ ছিল। তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললুম। দুটো নোট পাঠিয়ে দিলুম বড়কর্তার ঘরে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়স বেশিনয়। এমন করুণ চেহারা যে দেখলেই মায়া হয়। ভদ্রলোক বছরখানেক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বিপর্যয়। এখন মেয়েকে কোনও হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে চান। মনে যে ঝড় বইছে তা তো আর কমানো যাবে না, এখন দেহটাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু আন্তরিক ব্যবস্থাপত্র দিলেও, কাজ কী হবে বলা শক্ত। কিন্তু বৃদ্ধ খুশি হয়ে চলে গেলেন। আশা এমন জিনিস, কিছু একটা হতে পারে এই চিন্তায় তিনি হয়তো কয়েক দিন স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দেবেন।
কাবেরীকে কথা দিয়েছি—একটু আগে বেরোব। সুতরাং, কাজ সারতে হবে চটপট। এর পর সামান্য কিছু কেনাকাটাও আছে। আমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের আকর্ষণ প্রকৃতই অসাধারণ। সাজানো-গোছানো, ছিমছাম। কাবেরীর শিল্পীমনের ছাপ সর্বত্র। পরদা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, টেবলক্লথ, সোফাসেটের ঢাকা এক রঙের। পালিশ করা অল্পসল্প ফার্নিচার। জাপানি। কায়দায় ফুল সাজানো। দেওয়ালে কয়েকটি নির্বাচিত জায়গায় কাবেরীর নিজের আঁকা, জল এবং তেল রঙের বিভিন্ন স্টাডি। আমার নিজের সংগ্রহশালার কিছু কিছু ছবি। শিল্পসমালোচক হিসেবে আমার নিজের সংগ্রহও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এই ছবি দিয়েই আমাদের পরিচয়ের শুরু। অ্যাকাডেমিতে কাবেরীর একক চিত্রপ্রদর্শনীতে আমাদের প্রথম আলাপ। শেষ আমার ফ্ল্যাটে। নিঝঞ্চাট, নির্বিবাদী মানুষ না হলেও শিল্পসত্তা একটা আছে, স্ত্রী একজন রুচিসম্পন্না প্রকৃতই যশস্বী শিল্পী। যোগাযোগ অদ্ভুত। ভাগ্য দেখে হিংসে করলে কিছু করার নেই। সবই ভবিতব্য। তবে আমি এইটুকুই জেনেছি, জীবন থেকে এই পাঠই নিতে পেরেছি সুখ আর দুঃখ চাকায় বাঁধা, জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে। উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। একটা মুক্ত অনাসক্ত মন নিয়ে চলতে হবে।
সাড়ে তিনটে। এবার বেরোতে হবে। দিনের কাজ শেষ। কয়েকদিন দেখছি কাবেরী সঙ্গ চাইছে। ভীষণ মুডি মেয়ে। যখন ছবি নিয়ে থাকে তখন তার সেই জগতে আমার প্রবেশ নেই। আমায়। হঠাৎ হয়তো ডেকে নেবে। দেখো তো কেমন হচ্ছে সমালোচক মশাই! ইজেলের ধারে দাঁড়ানো তার দীর্ঘ শরীর, হাতে তুলি, রঙিন শাড়ি, তেলহীন অবিন্যস্ত চুলের ঢল পিঠে ভেঙে পড়েছে সে তখন নিজেই একটা ছবি। কাকে দেখব? ক্যানভাসের ছবি না জীবন্ত ছবি! তখন স্বভাবতই একটু অন্যরকম আবেগ মনের মধ্যে টগবগ করে ওঠে। দুজনের নিভৃত সংসারে স্থান, কাল, পাত্রের তো কোনও বাধা নেই। কাবেরী হয়তো একটু মৃদু আপত্তি জানায়। সে আর কিছু নয়, ব্যাপারটাকে আরও একটু আকর্ষণীয়, উদ্বেল করে তোলা। আমি তখন বলতে চাই—দিস ইস। লাইফ মাই ডিয়ার লেডি! তখন সেই অফিস অথবা জীবনসংগ্রাম কিংবা শহরজীবনের কাটাকাটি, হানাহানি, অথবা রাজনীতি ইত্যাদি অনেক দূরে। যেমন সমুদ্রের গর্জন। কানে আসছে কিন্তু যেহেতু জলে নামিনি সেইহেতু যেন একটা অন্য স্বাদ। সব মিলিয়ে জীবন।
আজকাল ট্যাক্সি কিংবা অফিসের গাড়ি পাড়ায় ঢুকতে চায় না। মানুষের নিরাপত্তা ক্রমশই কমছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন জঙ্গল এখন শহরের চেয়ে অনেক নিরাপদ। বাঘ অথবা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের গতিবিধি অথবা আচার-আচরণের একটা বাঁধা নিয়ম আছে, কিন্তু মানুষের চালচলনের নাকি আজকাল কোনও ঠিক নেই। সেই গল্পের সিংহ, যে উপকারীর উপকার মনে রেখেছিল। এরেনার সমস্ত মানুষ রুদ্ধনিশ্বাস। বন্দি আর ক্ষুধার্ত সিংহ মুখোমুখি। সিংহ বন্দির পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। কারণ একদা এই বন্দিই তার পা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ! বিদ্যাসাগরমশাই বলেছিলেন—অমুকে আমার সম্বন্ধে যা-তা বলছে কেন, কই আমি তো তার কোনও উপকার করেছি বলে মনে পড়ছে না। যুগ তো পালটায়নি। মানুষের স্বভাব সেই একই আছে।
নিউ মার্কেট থেকেই পরদার কাপড় কিছু কিনে নিই। একটা বাথ টাওয়েল। আর একটা বিলিতি সেন্ট। কাবেরীকে একটু সারপ্রাইজ দিয়ে দেব। কেনাকাটা সাধারণত বিনা দর-দস্তুরে হয় না। ভারতবর্ষে একটা জিনিসের ঠিক কী দাম, বোঝবার উপায় নেই। মুনাফার পরিমাণ কত কেউ বলতে পারবে না। বিক্রেতাদের মেজাজ অত্যন্ত চড়া পরদায় বাঁধা। বেশি কথা বলারও উপায় নেই।
কেনাকাটা শেষে একবার ট্যাক্সির চেষ্টা করে দেখতে ইচ্ছে হল যদি পেয়ে যাই। দুটো ট্যাক্সি। ফ্ল্যাগ ডাউন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল। আমার মতো যাত্রীর আবেদন অথবা অনুরোধ শোনার কোনও ইচ্ছেই দেখা গেল না। একজন থামলেন, কিন্তু তিনি আমি যেদিকে যেতে চাই তার। উলটোদিকে ছাড়া যাবেন না। আর একজন বললেন তিনি খাওয়া-দাওয়া না করে এক পা-ও নড়বেন না এবং সেই আহারপর্ব কখন কোথায় শেষ হবে তিনি জানেন না। এর পর ট্যাক্সি করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হল। যদিও সেই সপ্তাহ ছিল ট্যাক্সিচালকদের সৌজন্য সপ্তাহ।
চৌরঙ্গির মোড়ে তখন জমজমাট অবস্থা। চারদিক থেকে পতাকাধারী মানুষের মিছিল একের পর এক আসছে। কোনও যানবাহনই চলার রাস্তা পাচ্ছে না। এই শতকের মানুষ প্রায়শই। সমস্যাগুলোকে দার্শনিকের চোখে দেখে থাকেন। কোনও কিছুই আর তেমন করে মনে দাগ কাটে না। মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে না। অন্য সময় হলে আমিও এতটা ছটফট করতুম না বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কাবেরী এখন এই সময়টা আমার সঙ্গ চায়। আমার অভিজ্ঞতা কম কিন্তু শুনেছি মেয়েদের এই সময়টায় নানারকম মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। বলতে পারে না মুখ ফুটে। শরীর অপটু হয়, মনের মধ্যে সাগরের ঢেউ আছড়া-আছড়ি করে। বাড়িতে মা, অথবা বর্ষীয়ান কোনও মহিলা থাকলে এইসময়, ঠিক এই সময়ে হয়তো অনেক সাহায্যে আসতেন। অন্য সময় হলে এই ভীষণ বিভ্রান্তিকর অবস্থা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতুম। কোনও একটা সিনেমার যে কোনও মূল্যের একটা টিকিট কেটে ঢুকে বসে থাকতুম। ইতিমধ্যে মিছিলের মানুষ, জমে থাকা অসংখ্য যানবাহন, ঘরমুখো মানুষ, সময়ের ভেলায় চেপে এই কেন্দ্রস্থরঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যে যার দিকে চলে যেত। হয়তো বাস, ট্রাম অথবা অন্যান্য যানবাহন বন্ধ হয়ে যেত। বেশি রাতে হয় হেঁটে না হয় ভাগের ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে যেতুম।
হঠাৎ একটা প্রায়-খালি আমার রুটের গাড়ি মোড় ঘুরছে দেখে অনেকটা জীবনের মায়া ছেড়েই লাফিয়ে উঠে পড়লাম এবং একটা বসার জায়গাও পাওয়া গেল। এই সব ছোটখাটো ঝুঁকি। অনিচ্ছা সত্বেও নিতে হয় অথচ এর থেকে যে কোনও মুহূর্তে বড় রকমের বিপদ ঘটতে পারে। অবশ্য জীবন মানেই ঝুঁকি। এর পর গাড়ি চলবে শম্বুকগতিতে। জ্যামে আটকাবে। কয়েকবার রাস্তা পালটাবে। আকণ্ঠ মানুষ বোঝাই করবে। যেখানে খুশি থামবে। টিকিটের পয়সা নিয়ে। ঝগড়া হবে। যাত্রীদের মধ্যে ফাটাফাটি হবে। এ এক চলমান রঙ্গমঞ্চ। এরই মধ্যে চোখ বুজিয়ে বসে থাকা। ঝিমুনি আসতে পারে। কখনও বিরক্ত হয়ে নেমে যাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। অবশেষে নিজের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি। কিন্তু আজ আর গন্তব্যে পৌঁছোনো গেল না। তার আগেই যাত্রা শেষ। বাস যাবে না। নেমে যান। কে একজন ভয়ে ভয়ে ফিশফিশ। করে বলল—সামনেই মার্ডার হয়েছে, ভারী লিডার ছিল। অনেক আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠের প্রশ্ন—কে, কে? কী নাম? হেঁটে যাওয়া যাবে তো ভাই সামনে? এসব প্রশ্নের তো কোনও উত্তর নেই। সকলেই পালাতে চাইছে।
প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে নেমে পড়তে হল। এসব ঘটনা এই শহরজীবনে বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি তো মরিনি, এখনও বেঁচে আছি, অতএব ভাববার কী আছে। জীবনটাকে একটা মোড়কের মতো করে সাবধানে বাড়ি অবধি নিয়ে যেতে হবে। হয়তো কোনও সময় ফসকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেই হারাবার মুহূর্তে সাময়িক একটা আপশোশ, খুব অল্প সময়ের জন্যে। কেউ কেউ অবশ্য হারাতে হারাতেও ফিরে পেয়ে যেতে পারেন। সে এক ভীষণ অভিজ্ঞতা!
কিন্তু যতই এগোচ্ছি রাস্তা নির্জন, থমথমে, সমস্ত দোকান বন্ধ। এখনও দিনের আলো নেভেনি। দিন আর রাত্রির সন্ধিক্ষণ। ঘটনার কেন্দ্রস্থল থেকে সকলেই যেন দূরে চলে যেতে চাইছে। ভীত পশুর মতো। জানি, জিগ্যেস করলে কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। সামনে হয়তো কিছু দূরে। মানুষের কোনও প্রতিনিধি ধুলোয়, রক্তে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও শোক নেই, কোনও করুণা নেই। কারণ আমরা এখন প্রকৃতই দার্শনিক। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করাও উচিত নয়। প্রশ্ন—আমার নিরাপত্তা আছে কি না। আমি ওই পথ দিয়ে সোজা, অক্ষত আমার সাজানো সুন্দর ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে পারব কি না, যেখানে আমার জীবনের অনেক নরম মুহূর্ত আমার অপেক্ষায় রয়েছে।
একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিয়ে, কাঁপা কাঁপা, দুরুদুরু বুকে যতটা সম্ভব দ্রুত স্থানত্যাগ। একটা টাটকা মৃত্যু। দুশ্যটা অসহনীয়। মাত্র পনেরো-কুড়ি মিনিট আগের ঘটনা। জনশূন্য স্থান। সকলেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই স্থান ত্যাগ করেছে। আমিও করছি। এ ছাড়া কী করার আছে! পশু হলে হয়তো মৃতদেহের পাশে এসে শুকে দেখতুম, বিলাপ করতুম। চকাচকি পাখির গল্প শুনেছি। কাকের মৃত্যুও দেখেছি। মানুষ আজকাল পথে-ঘাটে নিঃসঙ্গে মরে। মৃত্যুর আর যেন সেই গ্ল্যামার নেই।
সেই নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কিছু চরিত্রের আবির্ভাব হল। চার-পাঁচটি ছেলে, প্রত্যেকেরই দু-হাতে গোলাকার পদার্থ। মৃতদেহের কাছাকাছি এসে, একটা গলির মধ্যে, সেই বিস্ফোরক দু-একটা ছুড়ে দিল। আমি একটু ভয় পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম আমার শবদেহের ওপর দিয়েই চলে যেতে চাইবে। কিন্তু আমাকে তারা উপেক্ষা করল। আমার শরীর একটু ঘর্মাক্ত হল। আমার গতি দ্রুত হল। আমার কণ্ঠতালু শুষ্ক হল। এখন কি কোনও রিকশা পাওয়া যাবে? আমার পথের সঙ্গী? কোথায় কী! পথ জনশূন্য। যতদূর দৃষ্টি চলে, সরীসৃপ রাস্তা প্রসারিত। সেই প্রসারিত রাস্তায়, মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমি যেন কত যুগ ধরে চলেছি। অবশেষে পৌঁছেছি আমার সেই কোমল, কমনীয় গৃহের গণ্ডিতে।
কাবরী উৎকণ্ঠিত। তুমি আসছ না কেন? আমি ভাবছি। চারটে বলেছিলে। তারপর কী গোলমাল এইদিকে। তুমি এসেছ! কাবেরী আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও কীসব করে ফেলল আবেগের মুহূর্তে। একবার মনে হল সেই পথের চার মোহনায় যে পড়ে আছে, তারও জন্যে হয়তো এমনই কেউ জানলার গরাদে মাথা রেখে অপেক্ষা করছে। আমার অক্ষত ফিরে আসার পুরস্কার এই আদর, এই চুম্বন। অবশেষে গরম কফি, কিছু সুস্বাদু ভাজা। জীবনের ছোট ছোট অথচ গভীর সুখ।
রান্নাঘর থেকে প্রেসার কুকারের স্টিম মাংসের সুগন্ধ নিয়ে আসছে। ভাগ্যিস ওইসব গোলমাল শুরু হওয়ার আগেই কিনে এনেছিলাম। কাবেরী যেন বিজয়ীর হাসি হাসল। মানুষ কত অল্পে কত তৃপ্ত। মাংস কেনা আর রাজ্য জয় করা যেন দুটো সমান ওজনদার জিনিস। মাংস না পেলেই বাকী অসুবিধে হত! কিছুই না, ডিম ছিল। কাবেরী একটু ছড়িয়ে বসল। শরীর বেশ ভারী। হয়েছে। এই সময়টা মেয়েদের কেমন যেন ক্লান্ত অথচ পূর্ণ দেখায়। কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছে। কিছু অপ্রাসঙ্গিক। চারদিক নিস্তব্ধ। রাস্তা অন্ধকার, জনশূন্য। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও বাড়িতে একটা রেডিও বাজছে না। একটা থমথমে আবহাওয়া। কখন কী ঘটে যায়! একটু আগে জীবনকে মেডেলের মতো গলায় ঝুলিয়ে ওই পথে যে এসেছি এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আশে-পাশে এখনও অনেকে ফিরতে পারেনি। কিন্তু তাতে আমাদের কফি খাওয়া অথবা ছোট ছোট গল্পের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ আমি তো ফিরে এসেছি, যারা। আসেনি তারা আসবে, হয়তো আসবে না। কী করা যাবে। আজকাল আর কিছু করা যায় না। ঘটনার স্রোতকে প্রতিরাধ করা যায় না। চারদিক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। তা না হলে হয়তো গান গাওয়া যেত কিংবা রেডিওগ্রামে কিছু রেকর্ড বাজানো যেত। কিন্তু ইস্পাতের পাতের মতো এই দুর্ভেদ্য নিস্তব্ধতাকে শব্দ দিয়ে ভেদ করতে ইচ্ছে করছে না।
তোমাকে আজ সকাল সকাল আসতে বলেছিলুম, তা না হলে, কী হত বলো তো! যত রাত বাড়ত ততই গোলমাল বাড়ত। পথঘাট বিপজ্জনক হত। আর আমি একলা এই শরীরে কেবল ঘরবার করতুম। তা ঠিক। তবে কী জানো, তুমি কোনওদিন ফুটবাথ নিয়েছ? প্রথমে গরম জলে পায়ের তলা ছ্যাঁক করে ওঠে। পা তুলে নিতে হয়, তারপর সইয়ে সইয়ে আস্তে আস্তে আধখানা পা সহজেই চলে যায় জলের তলায়। এখন যদি ওই অন্ধকার ঘন রাতে, ঘাতকদের মধ্যে দিয়ে আমাকে আসতে হত, উপায় নিশ্চয়ই একটা বের করে নিতুম। ছায়ায় ছায়ায় মিশে মিশে, বিপদকে ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে রেখে, দেখতে ঠিকই এসে উঠেছি তোমার এই ঘরে। দেখবে আমার পরেও এমনিভাবে অনেকে এসেছে।
এর পর আমাদের সেই শান্ত গৃহকোণে বাইরের জগতের নানা খবর ভেসে আসতে লাগল। অনেক ঘুরে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, হাত মাথার ওপর তুলে অনেকে ফিরে এলেন। দোকান পুড়ছে। বাড়ি জ্বলছে। অসংখ্য ক্ষিপ্ত মানুষ অনেক মৃত্যু দিয়ে একটি মৃত্যুর ক্ষোভ ভুলতে চাইছে। কে যাবে, কে থাকবে বলা শক্ত। অনেকে এমন কথাও বললেন, আমরা নাকি কেউই। নিরাপদ নই। কাবেরী যেন আমার খুব কাছাকাছি এসে একটু নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। সে যেন এই মুহূর্তে জানালা, ঘরের কোণে কোণে, এমনকী শিলিং-এ পর্যন্ত অসংখ্য কালো কালো মুখ দেখছে।
রান্না বেশ ভালো হয়েছে। আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই। সাজানো খাবার টেবল, পরিষ্কার টেবল-ঢাকা, দুগ্ধশুভ্র চিনেমাটির পাত্রে ভোজ্যসামগ্রী। ফিকে ধোঁয়ায় মৃদু গন্ধ ভাসছে। এই হল গার্হস্থ্য সুখ। পরিবেশ, বিপ্লব কিংবা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ অথবা অনেক কৃচ্ছসাধনের কথা। ভুলিয়ে দেয়। জৈবিক আর আধ্যাত্মিকের অপূর্ণ সমন্বয়। যৌবনবতী নারী উষ্ণ, কমনীয়। সুস্বাদু ভোজ্যসামগ্রী। একটা সৌন্দর্যঘেরা পরিবেশ। কিছু সৃজনী প্রতিভা, দুটো বিচারশীল মন।
কিছু মানুষ হয়তো এখনও বাইরে, মর্গে, কিংবা হাসপাতালের এমারজেন্সি বিভাগে অথবা অপারেশন টেবিলে কিংবা ক্রিমেটোরিয়ামে—এমন সমস্ত পরিবেশে যেখানে দৈহিক সুখ নেই, মানসিক স্থৈর্য নেই; কিন্তু আমরা এখন দুজনে পরম নিশ্চিন্তে একটি সুকোমল শয্যায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। এর পর ঘুম আসবে দু-চোখ জুড়ে নিঃশব্দে, একরাশ পাখির মতো, ডানা নেড়ে নেড়ে।
কাবেরী প্রথমে একটু উশখুশ করছিল। যেন ঠিক আরাম পাচ্ছে না। একটু অস্বাচ্ছন্দ্য। একবার জিগ্যেস করল কটা বাজল। এগারোটা বেজে দশ মিনিট। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কাবেরী মাথার বালিশ জড়িয়ে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কী হল। তোমার? অসহ্য ব্যথা, অসহ্য যন্ত্রণা। তুমি যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করো। আমি আর পারছি না।
কী সর্বনাশ! এখন এই ভীষণ সময়ে আমি কোথায় পাব ডাক্তার, কোথায় পাব গাড়ি! রাস্তায় বেরোবে কী করে? এ তোমার মনের আতঙ্ক। এখন ব্যথা কী? তোমার তো এখন সময় নয়। পুরো দু-মাস বাকি। এ তোমার ফলস ব্যথা। চাপ খাওয়া হয়েছে, গ্যাস হয়েছে পেটে। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা অ্যান্টাসিড দিচ্ছি। আমার স্টকে আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কাবেরী বললে—কিচ্ছু হবে না। আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। এ সেই ব্যথা। তুমি যা হয় একটা কিছু করো।
হা ঈশ্বর, এ কী দুর্দিন! এখন তো সুখশয্যা ছাড়তে হয়। বলা যায় না প্রথম সন্তানের জন্ম ভীষণ বিপজ্জনক। কী হতে কী হয়ে যায়। মৃত্যু? নানা কাবেরীকে হারাতে চাই না। ঘরে মৃত্যুর ছায়া, বাইরে মৃত্যুর ছায়া। উঠতে হল। ঘরের সবুজ আলোকে জোর করতে হল। কাবেরীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলুম। এখন কী করি! এই সমস্যাকে কীভাবে আক্রমণ করব! কাছাকাছি। কোনও বাড়ি থেকে ডাক্তারকে ফোন করব। অথবা নার্সিংহোমে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলব। কিন্তু সমস্ত কল অফিসই তো বন্ধ। কোন বাড়িতে ফোন আছে তাও জানা নেই। প্রথমে থানায় জানাই, পুলিশের সাহায্য চেয়ে দেখি, কিন্তু কাবেরী কি একলা থাকবে? তাই বা কী করে হয়?
রাস্তা কী ভীষণ অন্ধকার! পাশের বাড়ির সাহায্য নিতেই হবে। এখন আর ভাববার সময় নেই, সমস্ত কাজ অত্যন্ত দ্রুত সারতে হবে। কলিংবেলে চাপ দিলুম, একবার, দুবার, তিনবার, চারবার—কোনও সাড়া নেই। কোনও ঘরে আলো জ্বলল না। শুধু মনে হল কারা যেন ফিশফিশ করে বললে, ওই এসে গেছে। সাড়া দিও না, কজন আছে, কে জানে। ওরা এখন হন্যে হয়ে আততায়ীকে খুঁজছে।
আমাকে ঘাতক ভেবেছে। কী সর্বনাশ, বলা যায় না কোনও অলক্ষ্য স্থান থেকে কিছু ছুঁড়ে মারতে পারে। আবার আমিও দাঁড়িয়ে আছি একেবারে উন্মুক্ত রাস্তায়। আমি চিৎকার করে বললুম।—দরজা খুলুন। কোনও ভয় নেই। আপনাদের প্রতিবেশী। আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। আপনাদের একটু সাহায্য চাই—না কেউ দরজা খুলল না। সেই ফিশফিশ গলা—খুলো না, ওসব চালাকি। যেই দরজা খুলবে…
আমার সময় খুবই কম। ওই তো আমার জানালায় আলো জ্বলছে। কাবেরী প্রসব বেদনায় ছটফট করছে। আমি তখন ছুটছি। থানা, থানাতেই হয়তো সাহায্য পাওয়া যাবে। এই নির্জন রাস্তায় আমি একলা ছুটন্ত পথিক। আমাকে পেছন থেকে অথবা সামনে থেকে কিংবা চারপাশ থেকে আক্রমণ করতে পারে। দূর থেকে দেখলে আমাকে পলাতক মনে হবে।
অফিসার ইনচার্জ ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। ইতিমধ্যে তার এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। মৃতদেহ আসছে একে একে, ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত। কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আমাদের গাড়ি নেই, সব টহল দিতে বেরিয়ে গেছে। তবে ফোনটা ব্যবহার করতে পারেন। ফোন, শুধু ফোনে কী হবে? একটা গাড়ি না হলে রোগীকে নার্সিংহোমে অথবা হাসপাতালে নেব কী করে?
কী যে করেন মশাই, আপনারা এই দুর্দিনে, একটু সংযম অভ্যেস করতে পারেন না। এই কি সন্তান আনবার সময় না পরিস্থিতি! দেখছেন দেশ জুড়ে লণ্ডভণ্ড চলছে। দিন থাকতে থাকতে গোলমালের আগে হাসপাতালে দেননি কেন? সেই দুঃসময়েও গল্পের ডুবে যাওয়া সেই। ছেলেটির কথা আমার মনে পড়ল। ডুবছে সে, সাহায্য চাইছে, তীর থেকে তাকে উপদেশ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, সাঁতার না জেনে জলে নেমেছিলে কেন?
অবশেষে ফোন। গৃহ চিকিৎসক। আমি কী করব মশাই, এ তো আমার কেস নয়, কোনও গাইনোকোলজিস্টকে যোগাযোগ করুন। তাছাড়া আমার জীবন এমনিতেই বিপন্ন, আজ তো। কোনও কথাই চলে না। হাসপাতাল। একের পর এক। রোগী নিয়ে আসুন। অ্যাম্বুলেন্স নেই, কোথায় পাবো অ্যাম্বুলেন্স! প্রথমত হাউস স্টাফরা আগের মতো কাজ করে না। এছাড়া আজকের প্রেসারটা বুঝতে পারছেন না! আপনিও তো আচ্ছা ক্যালাস, এসব কেস বাড়িতে ফেলে রাখে!
বলছেন কী? রুগি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? যাবে। কী করা যাবে! ওসব সেন্টিমেন্টাল কথা বলবেন না। এতে আর চিঁড়ে ভেজে না।
—কী করি বলুন তো। প্লিজ আপনি একটু সাহায্য করুন। আমার স্ত্রী..আমি আর বলতে পারলুম না। অফিসার ইনচার্জ সিগারেট খেতে খেতে একটি মাত্রই জবাব দিলেন—শেষ জবাব—কাঁধে করে নিয়ে যান।
আমি প্রায় উড়তে উড়তে ফিরে এলুম আমার ফ্ল্যাটে। সমস্ত বিছানার চাদর হাত দিয়ে খামচাতে খামচাতে কাবেরী যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে প্রায় ধনুকের মতো হয়ে গেছে। সমস্ত মুখে তার। আতঙ্কের ছায়া। না অসহ্য, এ দেখা যায় না। জীবন দিয়েও আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি আমি। ইতিমধ্যে ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি ঘোলাটে হয়ে গেছে।
দরজার কড়া নড়ে উঠল। ভারি উত্তেজিত গলার আওয়াজ। আলো নেভান। এই একটা কথায় আমি যেন আলো দেখতে পেলুম। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালুম। হাতে ধারালো অস্ত্র চারজন যুবক। আমি দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে, সরাসরি আত্মসমর্পণ করলুম—ভাই, তোমরা আমাকে বাঁচাও। আপনাকে মারতে আসিনি আমরা। আলো নেভান। আমাদের কাজের অসুবিধে হচ্ছে। না, সে কথা নয়। আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। এই মুহূর্তে সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি কোনওভাবেই তাকে হাসপাতালে নিতে পারছি না। তোমরাই আমার ভরসা। তোমরা বাঁচালে বাঁচবে, তোমরা মারলে মরবে।
—পন্টু, দাদা কী বলছে রে! কী করতে হবে আমাদের?
—একটা গাড়ি ভাই। কোনও রকমে আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তোমরা ছাড়া।
—ঠিক আছে, বিশু তুই ঝট করে একটা রিকশা ধরে নিয়ে আয়। শালারা এমনি আসতে চাইবে। জোর করে ধরে আনবি। কাছাকাছি যে ডাক্তাররা আছে তাদেরও তো পাবি না, সব লকার এ বসে আছে। শালা প্রাণের কী মায়া! একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে?
—ওই তো, ওই তো আমার স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
—শালা ঠিক মার্ডার করলে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি হচ্ছে।
—পন্টু, তোর কোনও বুদ্ধি নেই, একে বলে প্রসববেদনা। আমাদের মায়েদেরও এমনই হয়েছিল, বুঝেছিস!
বিশু নামক ছেলেটি একটা রিকশা ধরে নিয়ে এল। ঘুম জড়ানো চোখ অথবা নেশার ঘোরে রিকশাওয়ালা জিগ্যেস করল কোথায় যেতে হবে? হাসপাতালে। দাদা, সময় আমাদের কম, বউদিকে নামান, গোটা কতক বালিশ আনবেন, বেশ করে সাজিয়ে বউদিকে আরামে বসান, কিংবা কোলে নিন। একলা নামাতে পারবেন?
দেখি চেষ্টা করে।
ওরা পাঁচজন নীচে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলুম। কাবেরীর তখন অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রণা যে কত ভয়ানক! একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসতে চাইছে, সে যে কী অসহ্য দৃশ্য, জন্ম যে এত বেদনাদায়ক, আমার জানা ছিল না।
কাবেরীকে কোনওরকমে পাঁজাকোলা করে তুলে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছি প্রচণ্ড শব্দে একটা বোমা ফাটল, কাবেরী চমকে উঠল, যন্ত্রণা যেন সাময়িকভাবে অপসৃত হল, অন্যরকম একটা আতঙ্কে। বারুদের গন্ধ এল নাকে, একটা আগুনের ঝিলিক, কিছু শক্ত কঠিন জিনিস দেওয়ালে, কাচে লাগল। সিঁড়ির শেষ ধাপে দরজার সামনে তখন ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
কিন্তু এ কী! দরজার সামনে বিশু পড়ে আছে রক্তাক্ত। ক্ষতবিক্ষত, জীবন আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাওয়ালা নেই, নেই আর চারটি ছেলে। কাবেরীর যন্ত্রণা আবার ফিরে এল। আমার জামাটা খামচাতে লাগল, দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করল শাড়ির আঁচল। ভাবছি এখন কী করব! তারা কোথায়? হঠাৎ অন্ধকার থেকে পন্টু বেরিয়ে এল—ভাববেন না কিছু বউদিকে বসান রিকশায়।
—কিন্তু বিশু, বিশুকে তো আগে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। ও কি বাঁচবে? দৃশ্য দেখে কাবেরী তখন মূৰ্ছিত।
—আপনি কিছু ভাববেন না দাদা, আমরা মরতেই জন্মেছি, ওকে আমরা কাঁধে করেই নিয়ে যাব। আর সময় নেই, আপনি উঠে বসুন, ব্যাটা রিকশাওয়ালা ভয়ে ভেগেছে, আশেপাশেই আছে ধরে আনছি।
ইতিমধ্যে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আর তিনটে ছেলে ফিরে এল।
—শালা, ওরা তিনজন ছিল। দুটো পালিয়েছে, একটাকে খতম করেছি। শালা, কী রক্ত মাইরি, যেন পিচকারি। মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে! দেখ, জামা-প্যান্টের কী অবস্থা।
—তুই আর এগোসনি, বউদি ভয় পেয়ে যাবে। তোরা একজন রিকশাওয়ালাকে ধরে নিয়ে আয়, তারপর চল, বিশুটাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাই। যদি বাঁচে।
রাত তখন কটা! হাসপাতাল যেন ক্লান্ত; মৃদু আলোকিত করিডর, সারি সারি নিদ্রিত রোগী। কোথাও কোনও রোগী আধবসা, ঘুম তার আসছে না, কেউ কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ওয়ার্ড খালি, কোথায় নার্স, কোথায় হাউস সার্জেন। কিন্তু এতদূরে যখন আসতে পেরেছি তখন বাকিটারও ব্যবস্থা করতে হবে।
কে যেন বলল—রাত তখন তিনটে। উনিশনম্বর মারা গেছে। একটু জল, নার্স আমাকে একটু জল।
আপনি কি ডাক্তার ভাই! আমার স্ত্রী, একেবারে শেষ অবস্থা। কী কেস? ডেলিভারি কেস। এখানে কী? তবে? চলুন চলুন, ডেলিভারি ওয়ার্ডে। সার্জেন–কী হয়েছে সিস্টার? এমারজেন্সি ওয়ার্ডে আর একটা এসেছে। কিছু নেই, একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, বম্ব ইনজুরি। এখনও প্রাণ আছে। তাপসকে বলুন, অ্যাটেন্ড করতে এখুনি, স্যলাইন রেডি করুন। আমার হাতে ডেলিভারি কেস।
ডেটল, ইথার, ইউরিন্যাল, সব মিলিত, মিশ্রিত গন্ধ। বড় বড় চওড়া করিডর, খোলা-গরাদহীন জানালা, উঁচু উঁচু ছাদ, সারি সারি লোহার খাট, সরু সরু লম্বারডে পাখা ঝুলছে, ঘুরছে, হাইহিল জুতোর খটখট, চকচকে, বড় বড় বেঞ্চি, কাবেরী এখন ওই ডেলিভারি লেখা দরজার ওপাশে। কী হচ্ছে সিস্টার, এত দেরি কেন? সিস্টার, ওই যে ছেলেটি এল বললেন, সব ঝাঁঝরা, ওর নাম কি বিশু? সিস্টার তাপসবাবু কি ওকে অ্যাটেন্ড করেছে?
খবর আছে? কী হল কাবেরীর? সিস্টার—শিইজ অল রাইট। ভালো আছে সে, আপনার একটা ছেলে হয়েছে, সাড়ে ছপাউন্ড ওজন। ঠিক চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে জন্মেছে। না, এখন দেখতে পারবেন না। সকাল আটটায় আসবেন।
সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামছি। পুবের আকাশে আলোর ছোঁয়া লেগেছে। ছেলে হয়েছে! প্রথম সন্তান! কার মতো দেখতে হয়েছে কে জানে। কী নাম রাখব। সময়টা নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কেমন হবে! নিশ্চয়ই খুব বড় হবে। হাউস স্টাফদের মিষ্টি খাওয়াব, আর ওই ছেলেদের! ওরা না থাকলে কী করতুম!
—দাদা, একটা সিগারেট দেবেন?
—কে পিন্টু তুমি?
—হ্যাঁ দাদা, কী হল আপনার, বউদি ভালো আছেন তো?
—হ্যাঁ ভাই, ছেলে হয়েছে; কিন্তু বিশু? সে কেমন আছে?
পিন্টু ধোঁয়া ছেড়ে প্রচণ্ড একটা দার্শনিকের মতো বলল—নাঃ বাঁচল না, একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গেছে, চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে সব শেষ হয়ে গেল। শালা বোমাটা বেশ জবরদস্ত ছিল। ওর মাটার বড় কষ্ট হবে; ওই একটাই তো ছেলে। যাকগে, অতসব ভাবলে চলে না।
মনটা ভারাক্রান্ত হল। পুত্রলাভের আনন্দের অনেকটাই পুত্রশোকের ব্যথায় যেন মিলিয়ে গেল।
—আমার জন্যেই হল ভাই।
—দুর দাদা, কী যে বলেন, ও তো হবেই। আমরা এই আছি এই নেই। আপনি কিছু ভাববেন না। এখন শালা ডেডবডি বার করাই মহা হ্যাপা, পোস্টমর্টেম হবে, মর্গে যাবে। সেই বডি পচে ফুলে উঠবে, তবে শালারা ছাড়বে।
—তোমরা একদিন এস ভাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবে।
—কী যে বলেন দাদা। আমাদের চেনেন না তাই। পাড়ার খবর তো রাখেন না। আমাদের সঙ্গে বেশি দোস্তি মানেই জানেন তো—এই। পিন্টু গলার কাছে হাতের চেটো নেড়ে একটা ভঙ্গি করল যার মানে—জবাই। পিন্টু সিগারেট খেতে খেতে করিডরের আলোছায়ায় মিলিয়ে গেল।
চরিত্র
ট্রেন ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। অপরেশ জানালার ধারে গুছিয়ে বসলেন। স্টেশনে যাঁরা বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাঁদের হাসিজড়ানো সসম্রম মুখের দিকে অপরেশ শেষবারের মতো তাকালেন। জোড়া জোড়া হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে এখনও বুকের সামনে ঝুলছে। অপরেশ তাঁর মুচকি হাসি, ছড়ানো প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে:নিলেন। সবই তাঁর মাপা। সময়ের ফিতে তাঁর পকেটে ঘোরে। তাঁর সাহিত্যও ওই একই গুণে সমৃদ্ধ।
অপরেশ পকেট থেকে একটা দামি লম্বা সিগারেট বের করে ধরালেন। দুটো দিন অনেক সভা সমিতি করলেন। সাহিত্যের আলোচিত-অনালোচিত বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক সারগর্ভ কথা এই শহরের মানুষকে শুনিয়ে গেলেন। কজন বুঝেছে সন্দেহ। এই সব শিল্পশহরের যান্ত্রিক মানুষ সাহিত্যের কিছু বোঝে বলে মনে হয় না। খায়দায়, বংশবৃদ্ধি করে আর প্রসাধনের মতো মাঝে মাঝে সাহিত্য শিল্প ধর্ম আদর্শকে পাউডারের মতো ঘাড়ের কাছে লেপটে ঘুরে বেড়ায়। মহান। সাহিত্য, মহৎ শিল্পকর্ম, দর্শনের গাম্ভীর্য বোঝার ক্ষমতা হাজারে একজনের হয়তো থাকে, তাঁরা কেউ এই ধরনের সভায় আসেন না। তবু এই সব সভায় আসতে হয়, তা না হলে জনপ্রিয়তা থাকে না। জনপ্রিয়তা না থাকলে বই বিক্রি হয় না। জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে রেখে অপরেশ এই সব ভাবছিলেন। তাঁর আশে-পাশে কারা বসে আছেন ভ্রক্ষেপ করার প্রয়োজনও বোধ। করেননি। মানুষ সম্পর্কে চিরকালই তাঁর একটা উপেক্ষার ভাব আছে।
সন্ধে হয়ে এল। বাইরেটা ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। প্রথম শ্রেণির কামরা। আদৌ ভিড় নেই। বসার সময় অপরেশ একপলকে যেটুকু দেখেছিলেন, সারা কামরায় জনা ছয় যাত্রী বসে আছেন। তিনজন অবাঙালি, মনে হয় ব্যবসায়ী। দুজন বাঙালি। হয়তো উচ্চপদে চাকরি করেন। আর একজন মহলা। বাঙালিও হতে পারেন, অবাঙালিও হতে পারেন। আধুনিকাদের জাত বোঝা
অপরেশ ভেবেছিলেন অবাঙালি তিনজন না হলেও বাঙালি দুজন এতক্ষণে যেচে তাঁর সঙ্গে আলাপ করবেন। ট্রেন ছাড়ার প্রাক্কালে সকলেই তাঁর বিদায়পর্ব লক্ষ করেছেন। অপরেশ যে অবশ্যই একজন মানী-গুণী মানুষ তা-ও বুঝেছেন। অপরেশনিজে আলাপ করেননি; করবেনও না; কিন্তু সহযাত্রীদের করা উচিত ছিল। অবাঙালি তিনজন ব্যবসার কথা বলে চলেছেন। বাঙালি দুজন অফিসের কথা। ভদ্রমহিলা ট্রেন ছাড়ার আগেই হ্যাডলি চেজ খুলে বসেছেন। কোনও দিকেই তাঁর দৃকপাত নেই।
অপরেশ ভদ্রমহিলার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। সামনে আয়না নেই। তবু মনে হল তাঁর দৃষ্টিতে হয়তো একটু লোভ, কিংবা কোনও আকাক্ষা চুইয়ে পড়তে চাইছে। যে দৃষ্টি শিশুর চোখের মতো উদাস নয়, অর্থহীন নয়, তেমন দৃষ্টি দিয়ে কোনও সুন্দরী মহিলাকে দেখা অপরাধ। অপরেশ চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। একটা সুডৌল, সুগৌর হাতের ওপর তাঁর চোখ দুটো আটকে রইল।
কী নাম হতে পারে মহিলার! অপরেশ একটা নাম রাখলেন—শিলাবতী। তাঁর পরবর্তী কোনও উপন্যাসের চরিত্রে শিলাবতীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আপত্তি কী! বয়স পঁচিশ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। ইংরেজিতে এম.এ। কলকাতার বাইরে কোনও কলেজের অধ্যাপিকা। অবিবাহিতা। এর পর কী হবে! ছক বাঁধা রাস্তায় কোনও সহকর্মী প্রেম নিবেদন করবেন। প্রত্যাখান। আত্মহত্যা। অপরেশ নিজের কল্পনার দীনতায় মনে মনে একটু হাসলেন। জীবন থেকে কাহিনি কত দূরে সরে যেতে চায়! অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মহিলা পাশে রাখা একটা ফ্লাস্কের দিকে হাত বাড়ালেন।
অপরেশ যখন আবার তাকালেন মহিলা তখন ছোট ছোট চুমুকে চা খাচ্ছেন। অপরেশের মনে হল তিনি একটা সুখের ছবি দেখছেন। চলন্ত ট্রেনে বই পড়া। চা খাওয়া। ঈষৎ আয়েশ করে বসা। যে জীবনে সুখ আছে, যে জীবনে ভ্রমণ আছে, রহস্য উপন্যাস আছে, ফ্লাস্কের চা আছে, সে জীবন। প্রেমের ফাঁদে পড়বে না। প্রেমে সুখ নেই। প্রেম আষ্টেপৃষ্টে দুঃখের ফাঁদে বাঁধা। শিলাবতীর জীবন শুরু করবেন বিবাহের পর থেকে। ডাক্তারের স্ত্রী শিলাবতী। কলকাতায় চলেছে মার্কেটিং-এ। শিলাবতীর প্রাক-বিবাহিত জীবনের ছবি আঁকার ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা—কোনওটাই নেই অপরেশের।
অপরেশ চায়ের একটা ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলেন। প্রথম শ্রেণিতে বসে প্ল্যাটফর্মের ভাঁড়ের চা খাওয়া চলে না। অপরেশ চায়ের আশা ছেড়ে দিলেন। চা জুটবে আবার কাল সকালে। ভোরবেলা বিছানার কাছে টিপয়ের ওপর রমলা এক কাপ চা রেখে যাবে। আজ বিশ বছর ধরে এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। কী শীত কী গ্রীষ্ম। রমলা অপরেশের নিতান্ত সাদামাঠা স্ত্রী। তিন সন্তানের জননী। অপরেশ খ্যাতিমান সাহিত্যিক না হয়ে কোনও কারখানার শ্রমিক হলেও রমলার কিছু এসে যেত না। নিতান্তই সাংসারিক স্ত্রী। সংসারধর্ম ছাড়া তার বাড়তি কোনও আকাঙ্ক্ষাও নেই। মোটাসোটা শ্যামবর্ণ নিতান্তই এক মহিলা। ইদানীং একটু সন্দেহপ্রবণও বটে। রং এবং শরীরের জন্যে একটু হীনমন্যতাও বোধহয় দেখা দিয়েছে। কোনও পাঠিকা প্রশংসা করে চিঠি লিখলে রমলা আজকাল কেমন যেন কঠোর হয়ে ওঠে। কোনও সুন্দরী পাঠিকা হঠাৎ অপরেশের সঙ্গে দেখা করতে এলে রমলা প্রথমে কিছু বলে না, পরে গভীর রাতে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এ এক ভালো জ্বালা হয়েছে!
অপরেশের মনে আজকাল একটা ক্ষীণ আপোশ ধূপের ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে ওঠে। জীবন কোনও প্রতিশ্রুতির সীমানা চিহ্ন থেকে শুরু হয়নি। সাধারণ শিক্ষার সাধারণ কেরানি। অল্পসল্প লেখার বাতিক ছিল। খ্যাতি এল অতি ধীর পায়ে। জীবনের মধ্য সীমানা। রমলাকে যখন বিয়ে করলেন তখন জীবনে রমলাকে বেমানান মনে হয়নি, মেনে নিতে কোনও অসুবিধে হয়নি। এখন কিন্তু একটু অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় সংসারে কাজের লোক পেয়েছেন, সন্তানের জননী পেয়েছেন, সেবার মানুষ পেয়েছেন, কিন্তু মনের কোনও সঙ্গী পাননি। শিলাবতীকে রমলার। আসনে বসালে কেমন হয়? ট্রেনের কামরার ওপ্রান্তে নয়, একেবারে অপরেশের পাশে, কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে। পরিপাটি পরিচয্যায় ফুরফুর তৈলবিহীন চুল হাওয়ায় উড়ে মাঝে মাঝে মুখে এসে লাগছে। সিল্কের শাড়ির আঁচল উড়ে উড়ে আসছে। গাঢ় নীল ব্লাউজের আবরণ পেরিয়ে শরীরের চিকন শুভ্র অংশে অপরেশের চোখ পড়ছে। অবাঙালি তিনজন কী এক রসের কথায় হইহই করে হেসে উঠলেন। বাঙালি ভদ্রলোক দুজনের একজন ব্রিফকেস খুললেন, ফটফট করে শব্দ হল, বন্দুকের গুলির মতো! ভদ্রমহিলা বই থেকে চোখ তুললেন। চোখাচোখি হল অপরেশের সঙ্গে। অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হলেন।
বাইরেটা আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার নদীপ্রান্তর দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আলোর বিন্দু আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। অপরেশ চোখ বুজলেন। শিলাবতী কি রমলার আসনে বসতে পারবে! ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় ভালোই মানাবে। কিন্তু কলকাতার বাড়িতে? কাকডাকা ভোরে স্নান সেরে শিলাবতী কি বেড-টি দিতে পারবে? পারবে তার পঙ্গু মা-র সেবা করতে? পারবে অপরেশের পাঞ্জাবি কেচে পরিপাটি করে ইস্ত্রি করে দিতে?
শিলাবতীকে জননীর আসনে, গৃহকত্রীর আসনে বসাতে অপরেশের কষ্ট হল। শিলাবতী কমরেড, শিলাবতী স্ত্রী, শিলাবতী জননী নয়। অসম্ভব! প্রকৃতির নিয়মে শিলাবতী হয়তো গর্ভবতী হবে, জননী হবে না। হতে পারে না। শিলাবতীর স্থান তাহলে কোথায়! সাহিত্যিক অপরেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। শিলাবতীকে নিয়ে তিনি কী করবেন! কলকাতার কোনও নামজাদা। হোটেলে উঠবেন। কিংবা আলিপুরের কোনও বাড়িতে! নিজের জীবনধারায় শিলাবতীকে স্থান। দিতে পারলেন না অপরেশ। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানকে শিলাবতীর গলা জড়িয়ে ধরতে দিয়ে অপরেশ মনের চোখে দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করলেন, ভালো লাগল না। শিলাবতী পোষা কুকুরের উপদ্রব সহ্য করবে কিন্তু নিজের সন্তানের গ্রাম্য আদরে অতিষ্ট হয়ে উঠবে। ঝকঝকে গাড়ির পেছনের আসনে কুকুর রেখে শিলাবতী পশু চিকিৎসালয়ে যেতে পারে, কিন্তু তোয়ালে মুড়ে নিজের সন্তানকে কোলে ফেলে রিকশা চেপে রাজপথ দিয়ে কোনও হাসপাতালের আউটডোরে যেতে পারে না যাওয়া উচিতও নয়। অপরেশ অবশেষে হাল ছেড়ে দিতে চাইলেন। রমলাকে সামনে রেখে তিনি চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন, কল্পনাকে প্রসারিত করতে পারেন; শিলাবতীকে নিয়ে। নয়। শিলাবতীর জীবন পরিকল্পনার কোনও খবরই তাঁর জানা নেই। অপরেশ আবার চোখ বুজলেন। একটু তন্দ্রার মতো আসছে। অনেক ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন।
ইয়ার্ডে ট্রেন ঢুকছে। অজস্র আলোর লাল চোখ সাঙ্কেতিক ভাষায় ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে। অদৃশ্য কলকজার চাপে এক লাইন থেকে আর এক লাইনে ট্রেন পাশে হেঁটে হেঁটে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে চলেছে। রাত প্রায় দশটা। দূরপাল্লার অধিকাংশ ট্রেন বেরিয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মে তেমন ভিড় নেই। শিলাবতী আগে আগে চলেছেন। কাঁধে ফ্লাস্ক, হাতে দামি সুটকেস। অপরেশ পিছনে। শিলাবতীর চালচলন, ব্যক্তিত্বের ছাপ মনে ধরে রাখতে চাইছেন। দৃশ্যটা চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে। হঠাৎ দেখা, আবার মিলিয়ে যাওয়া।
স্টেশনের বাইরে একটা মেরুন রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ঝকঝকে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ঋজু বনেদি চেহারা। হাতে ওয়ালনাটের ছড়ি। পায়ে ভেলভেটের চটি। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। কোলে একটি ফুটফুটে দুরন্ত শিশু। মুখের ভাবে শিলাবতীর আদল আসে। শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্যে অপরেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
শিলাবতী দ্রুত বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলেন। বুদ্ধের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে শিলাবতী মহিলাকে। চুম্বন করার ভঙ্গি করলেন, শিশুটিকে ছিনিয়ে নিলেন নিজের কোলে। শিশুটি একহাতে শিলাবতীর চুল খামচে ধরল। কষ্টে কেশ মুক্ত করে শিশুটিকে আদরে আদরে অস্থির করলেন। শিশুটি কেঁদে ওঠায় সকলে সমস্বরে হেসে উঠলেন। মিলন পর্ব শেষ হল। গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ হল। বৃদ্ধই গাড়ি চালাবেন।
অনেকক্ষণ হল গাড়িটা চলে গেছে। পেছনের লাল আলো অপস্রিয়মাণ স্মৃতির মতো পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। নির্জন রাস্তায় অপরেশদাঁড়িয়ে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। একটা খালি ট্যাক্সির প্রয়োজন কিন্তু শিলাবতীদের চিন্তায় এতই আচ্ছন্ন যে দৌড়ঝাঁপ করার শক্তিটাই যেন চলে গেছে। কাপড়ের কোঁচা লুটোচ্ছে পায়ের কাছে।
ধূপের ধোঁয়ার মতো ক্ষীণ আক্ষেপ যেন হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। শিলাবতীকে সহজেই রমলার আসনে বসানো যায়। বসন্তকালের মতো হাওয়া দিচ্ছে। অপরেশের মনে হল সে যেন কতকালের বিরহী। দুঃসহ একটা বেদনার বোঝা নিয়ে রাজপথে মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় কেউ যদি তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় ভালো হয়। শিলাবতীকে নিয়ে সে উপন্যাস লিখবে। তার পরবর্তী কাহিনির নায়ক হবে অপরেশ, নায়িকা শিলাবতী। কী নাম রাখবে? সারাটা পথ একটা নামের সন্ধানে কখন ফুরিয়ে গেল অপরেশ টের পেলেন না। মনে হল সময় ইদানীং বড় সংক্ষিপ্ত।
জলছবি
আমরা তখন সকলে সবিস্ময়ে সেই উঁচু ঢিবির দিকে তাকিয়ে রইলুম। দিগন্তে তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। সারা আকাশ তামাটে লাল। সেই সূর্য্যাস্তের দিকে মুখ করে ওরা দুজনে বসে আছে। মেয়েটির মাথা রয়েছে ছেলেটির কাঁধে। ছেলেটির হাত মেয়েটির কোমর জড়িয়ে রয়েছে। আমরা যারা ছুটি কাটাবার জন্যে সেই প্রান্তরে সমবেত হয়েছিলাম, কাঁধে জলের ফ্লাস্ক, হাতে খাবারের বাস্কেট নিয়ে, তারা এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যথেষ্ট রোমান্টিক অথচ একেবারে নির্লজ্জ সেই দৃশ্য দেখে মুখে ছিঃ ছিঃ করলেও মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আমরা অনেকেই সে মুহূর্তে কল্পনায়, ছেলেটিকে মেয়েটির পাশ থেকে সরিয়ে নিজেদের পাশে বসাবার চেষ্টা করছিলাম।
আমরা যারা সেই প্রান্তরে শুধুমাত্র সূর্য্যাস্ত দেখবার জন্যে সমবেত হয়েছিলাম তারা সকলেই প্রথামতো সূর্য্যাস্তর দিকে চোখ রাখলেও বস্তুত সেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ের ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ জড়াজড়ি ইত্যাদি দেখছিলাম। এমনও হতে পারে তখন সেই শেষবেলায় আমরা সারাদিনের ক্লান্তির লাভ খতিয়ান নিতে নিতে শুধুমাত্র সূর্য্যাস্তই, শুধুমাত্র আকাশে চাপা আগুন অথবা রঙের ছড়াছড়িই যখন যথেষ্ট নয় ভাবতে শুরু করেছিলাম তখন ওই অদূরে একটি রোমাঞ্চকর দৃশ্যকে আজকের লাভের খতিয়ানে ধরে একটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলাম। পলিথিনের পাতলা জাজিমে আমরা পাশাপাশি কয়েকজন। হাতে প্লাস্টিকের কাপে প্রায় ঠান্ডা সর-পড়া কফি, ফ্লাস্কের শেষ তলানি, দাঁতের আগায় দিনশেষের স্যান্ডউইচ। এইরকম সব ছোট-বড়-মাঝারি জটলা সেই সবুজ প্রান্তরের এখানে-সেখানে। দূরে দূরে নানা রঙের অচল মোটরগাড়ি আর একটু পরেই আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের চেনা পরিবেশে।
তারপর সেই নির্জন অথবা প্রায় নির্জন প্রান্তরে কাগজের কাপ, ডোরাকাটা স্ন্যাক্সের প্যাকেট, হয়তো একটি-দুটি চুলের কাঁটা অথবা দলিত গোলাপ কিংবা দলা-পাকানো সুগন্ধি রুমাল, এখানে-ওখানে পড়ে থাকবে রাতের আকাশের তলায়। তারপর ফোঁটা ফোঁটা শিশির নেমে আসবে ঘাসের ডগায়।
কিন্তু যাই বলুন মশাই, এটা একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না কি?
এগজ্যাক্টলি, আরও তো অনেকেই এসেছেন জোড়ায় জোড়ায়, কিন্তু কই এমন ঢঙে বসে বেলেল্লাপনা তো আর কেউ করছে না। কীরকম একটা বেপরোয়া ভাব দেখেছেন, ডোন্ট কেয়ার! গাঢ় লাল আকাশের পটভূমিকায় দুটি সিলয়েট আমরা বেশ দেখতে পাচ্ছি। দুটি মুখ কত কাছাকাছি, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকে যাচ্ছে নাকি?
বুঝলেন আসলে ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়। কিছুতেই নয়। এসব ঘটনা প্রকৃতপক্ষে শোবার ঘরে চাপা আলোতে অলক্ষেই হওয়া উচিত।
আর একটা কি, মানে সত্যি কথা বলতে কি, আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রীতে কোনও মিল থাকে না। আমার পেটে মশাই কোনও কথা থাকে না, আমি এসব ব্যাপারে ভীষণ ফ্র্যাঙ্ক। জানেন আমরা দুজনে আজ দশ বছর ধরে আলাদা শুচ্ছি। ঠোঁট কোথায় পাই বলুন যে চুম্বন ইত্যাদি ইচ্ছে হলেই করব।
মশাই ওসব পারিবারিক ব্যাপার আর না-ই বা তুললেন অন্তত আজকের দিনে এই জায়গায়।
সে আপনি যাই বলুন মশাই, কিন্তু কেন, পারিবারিক বলছেন কেন? এসব ঘটনা তো আমার পরিবারেই শুধু নয়, সব পরিবারেই প্রায় ছড়িয়ে গেছে। ব্যাপারটাকে এখন একটা যাকে বলে ইউনিভার্সাল ব্যাপার বলা যায়।
আমার অবশ্য কথার মাঝে কথা বলা উচিত নয়, তবে ফ্র্যাঙ্কলি বলুন তো আমরা কজন সস্ত্রীক এসেছি?
আমি আসতাম, আমার স্ত্রী প্রায় সাজগোজ করেই ফেলেছিলেন, এমন সময় না, সেই কোলের মেয়েটা যেটা এই সবে বছরখানেক হয়েছে ককিয়ে কেঁদে উঠল।
ইশ, কোলে মেয়ে! কোলে মেয়ে থাকলে স্ত্রীদের গ্ল্যামার নষ্ট হয়ে যায়। সেসব স্ত্রী নিয়ে আর বেড়াননা চলে না।
বেশ বললেন যা হোক। যাঁরা সস্ত্রীক এসেছেন তাঁদের স্ত্রীরা কি সব বাঁজা?
যাক গে, যাক গে। ওদিকে দেখুন। অবস্থা একেবারে ঘনীভূত। আমার কিন্তু জানেন, ব্যক্তিগতভাবে বলছি, এই দৃশ্য দেখে মনটা ভীষণ সন্তুষ্ট হচ্ছে। আমি, জানেন এই কফির কাপ ছুঁয়ে দিব্যি করছি—আজ থেকে আমার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসব। খাটের পাশে আজ রাতে দুজনে ঠিক এমনি করে বসব। মিথ্যে বলব না, বাইরে খোলা জায়গায় সকলের চোখের সামনে পারব না, কেমন যেন লজ্জা করবে। আমার শোবার ঘরে আমার স্ত্রীকে আমি অমনিভাবে বেষ্টন করে থাকব।
কেন মিথ্যে বলছেন? নিজের স্ত্রী-র সঙ্গে ওইসব ঢং করতে গেলে, সোজা তার কাছ থেকে জুতোই খাবেন, স্ত্রীদের মুখ যখন ছোটে না তাদের দিগবিদিক জ্ঞান থাকে না।
তাহলে ওসব পরস্ত্রীর জন্যেই তোলা থাক বলছেন?
ও মেয়েটা মশাই বেশ্যা। দেখছেন না কীরকম আম্রপালীর মতো চেহারা?
কারেক্ট, স্ত্রীদের চেহারায় মশাই এত শ্রী থাকে না। সংসার-রূপ কটাহে পড়ে, আমাদের স্নেহের অত্যাচারে, তারপর কি না ওইসব পারিবারিক উৎপাতে একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে যায়।
মানে বলতে চাইছেন, কাছে এলে, চোখ বুজিয়ে আগে ভেবে নিতে হয় যেন কোনও পরস্ত্রী এসেছে। তবেই একটু উৎসাহ পাওয়া যায়।
দেখবেন ওরা যা আরম্ভ করেছে একটু পরেই না একটা পুলিশ এসে ওদের অ্যারেস্ট করবে, পেনালাইজ করে দেবে, পাবলিক প্লেসে এইসব নুইসেন্স, অ্যাঁ।
পুলিশ! হাঃ হাঃ। মশাই ঝট করে এতখানি একটা নোট ছেড়ে দেবে ব্যস সব অন্যায় ন্যায় হয়ে যাবে। টাকায় কী না হয় মশাই, গাড়ি হয়, বাড়ি হয়, ভালোবাসা হয়, নাম হয়, যশ হয়, গরুও মানুষ হয়।
কেবল একটা জিনিস হয় না—আধ্যাত্মিক উন্মেষ।
আধ্যাত্মিক! কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন। শোবার ঘর থেকে মন্দিরে।
দেখোনা হে বাস্কেটে আর স্যান্ডউইচ আছে কি না?
এখানে সব ছোট ছোট ছেলেরা দৌড়োদৌড়ি করছে, তাদের চোখের সামনে এইসব নারকীয় দৃশ্য! দেশটা কী হয়ে গেল বলুন তো?
ওরা মশাই ওসব বোঝে না। আপনার চোখ তো ওখানেই আটকে আছে কারণ আপনি ওই রসের রসিক।
কী বলছেন কী? আজকালকার ছেলেরা সব বিচ্ছু। আমার বড় ছেলেটা হার্ডলি দশ বছর। কী বলেছে জানেন একদিন তার মাকে তোমাদের—খাটে একটু তেল দিয়ো, রাত্তিরে আওয়াজে আমার ঘুমের অসুবিধে হয়।
হ্যা হ্যা হ্যা শালাকী কাণ্ড!
তবে কী জানেন এ ভালো হচ্ছে, ভালোই, সেক্স সম্বন্ধে আগেভাগেই জ্ঞান হয়ে গেলে অনেক ঝামেলা কমে যায়।
কী জানি মশাই! আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত প্রজনন সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই ছিল না। আমি মনে করতুম, ছি ছি, এখন এই দু-ছেলের বাপ হয়ে বলতে লজ্জাই করে—মুখ দিয়ে কিছু খেলে তবেই বোধ হয়?
থাক থাক আর বলতে হবে না। পশ্চিম আকাশের রং বদলাচ্ছে, কটা বাজল বলুন তো?
আর কী? হয়ে গেল। এইবার ফেরার পালা। এইবার আমরা সব চলে যাব।
আচ্ছা কী ব্যাপার বলুন তো? ওই ভদ্রলোক তখন থেকে ক্রমান্বয়ে ওদের ছবি তুলে যাচ্ছেন নানা দিক থেকে!
কী করে বলব বলুন। আমিও তো আপনার মতোই এখানে আউটিং-এ এসেছি।
দিস ইজ ভেরি অবজেকশানেবল—কী বলেন? ওরা না হয় মশগুল হয়ে আছে, কিন্তু টের পেলে ক্যামেরা-ফ্যামেরা ভেঙে বারোটা বাজিয়ে দেবে। কেসও করতে পারে।
ওই দেখুন ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে। আরেব্বাস—এবার একেবারে ম্যাক্সিমাম। ওই দেখুন, ওই দেখুন মেয়েটা কেমন বর্ষার উন্মুক্ত ফুলের মতো মুখ তুলেছে আর ছেলেটা যেন বৃষ্টির জলের। মতো ওর মুখের দিকে ঠোঁট নামিয়ে আনছে।
ইশ, দৃশ্যটা যা হয়েছে যেন ছবি! মশাই জীবনে যে এমন ঘটনা ঘটে, কারওর জীবনে ঘটে এ ধারণা আমার ছিল না।
এইবার দেখছেন, ক্যামেরা ভদ্রলোক যেন খেপে গেছেন। ওরা যেমন জড়িয়ে জড়াজড়ি করছে ইনিও তেমনি জমিয়ে ছবি তুলছেন।
দাঁড়ান, ভদ্রলোককে একটু চেক করে দিই।
কী মশাই—এত ছবি তোলার কী আছে অ্যাঁ?
এইসব ব্যাপার কি এনকারেজ করার জিনিস! বয়স থাকলে মশাই ওই দুটোকে পিটিয়ে ঢিবি ছাড়া করতুম। মশাই ছেলেমেয়ে নিয়ে এলুম একটা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখব বলে। মশাই তাকানো যায় না।
ইয়ে ইয়েস, আর একটু…একটু ফাইন স্ন্যাপ। যা এল না, মারভালাস! আরে থামুন মশাই, কানের কাছে বকবক করবেন না। এইবার বাআআস কমপ্লিট। হ্যাঁ বলুন কী বলছিলেন?
বলছিলাম, ছবি তুলছিলেন, মানে ছবি তুলছিলেন কেন?
সে কী মশাই! হাঃ হাঃ সিগারেট চলবে? সারাদিন যা পরিশ্রম গেল, বাপস! এইটা হল লাস্ট শট —ফাইন এসেছে মশাই। পেছনে ব্রোঞ্জ রঙের আকাশ, আর সামনে সিলুয়েট হিরো-হিরোইন। এমনি করে দাঁড়িয়ে, টেরিফিক! যেমন ডিরেকশন, তেমনি ক্যামেরা। ইস্টম্যান কালার।
মানে এটা নিয়ে কী বলে সিনেমা হবে?
তবে কী? জলছবি, ছায়াছবি, জলছবি, ছায়াছবি, হুহু। প্যাক আপ কল্যাণ। স্ট্রেট টু হোটেল। একটু সরে দাঁড়ান স্যার—অ্যা অ্যাদ্যাটস ফাইন।
আরে মশাই দেখেছেন! জীবন সার্থক। অতবড় হিরো-হিরোইনকে চোখের সামনে এতক্ষণ দেখলুম। ছি ছি, আমরা এতক্ষণ কী যা তা বলছিলুম অ্যাঁ!
আমি আগেই বলেছিলাম—এসব সাধারণ লোক নয়। আরে ভাই দেশ এখনও অত অনাচারী হয়ে ওঠেনি। কী জেনুইন অভিনয়, তাই না, যেন রিয়েল লাইফ ড্রামা!
আমার স্ত্রী ওদিকে ছিলেন তা না হলে দেখতেন, ও ভীষণ ফ্যান, একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। সত্যি কথা বলতে কী আমার একটু জেলাসিই আছে। আমি ওই নায়কের বই সাধারণত দেখতে চাই না।
আমার ছেলে মশাই বাচ্চা, খুব বড় নয়। একদিন দেখি কী মশাই ওর জামার পকেট থেকে বেরোল একটা ছবি, সে ছবি মশাই ওই হিরোইনের।
ওই দেখুন সাদা বিরাট বড় গাড়িতে ওরা চলে গেল। যেন একটা সাদা হাঁস। কী জীবন তাই না!
কিন্তু দেখছেন জীবনটা ভীষণ হলো। এই অভিনয় করছে, হাসছে, কাঁদছে, কিন্তু কোনওটাই রিয়েল নয়, যেন আলুনি তরকারি।
মানে অনেকটা এই যখন আমরা সব একে একে চলে যাব তখন যেমন এই বিশাল প্রান্তর শূন্য পড়ে থাকবে, তেমনি ওদের মন—একেবারে ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই।
তাহলে আমরা এবার উঠতে পারি। এই পলিথিন-মলিথিন সব গুটিয়ে ফেলা যাক। আবার কোনওদিন আসব আমরা এইখানে সূর্য্যাস্ত দেখতে।
একটি-দুটি করে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে গেল। কাঁধে ক্যামেরা, বাইনোকুলার অথবা ফ্লাস্ক কিংবা সাইডব্যাগ ঝোলানো কিছু মেয়ে-পুরুষ সেই ঝাপসা অন্ধকারে অস্পষ্ট গুঞ্জন তুলে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দিন চলে যায়
আমি যে হারানোর কথা বলছি তার জন্যে কেউ কখনও সংবাদপত্রের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ স্তম্ভে বিজ্ঞাপন দেবেন না। এই হারানো আমাদের জীবনে এতই অনিবার্য যার জন্যে আমাদের স্থায়ী কোনও ক্ষোভ নেই। সময় সময় এমনই উদাসীন, কী হারাল বুঝেও বুঝি না, ভেবেও ভাবি না। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্ত হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে দিনে। গাছের পাতা যেমন ঝড়ে যায় তেমনি আবার নব কিশলয়ে নবীন হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন থেকে যে মুহূর্ত প্রতিনিয়ত সময়ের স্রোতে অনন্তের দিকে ভেসে চলেছে, তারা কোথায় গিয়ে কোন সাগরের মোহনায় পাললিক ব-দ্বীপ তৈরি করছে, জীবন জানে না। জীবনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হারিয়ে যাওয়াই হল এর ধর্ম।
যে-কোনও মানুষই জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। এর কিছুটা আপেক্ষিকভাবে স্থিতিশীল, কিছুনশ্বর। যেমন, যে বাড়িতে জন্মেছিলাম, সেই বাড়িটা এখনও আছে, আরও শখানেক বছর হয়তো থাকবে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে কিছু প্রাচীন হয়েছে, যৌবনের চেকনাই হয়তো নেই, তবু পুরোনো বাড়িটা তার অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। উত্তরের দিকের দৌড়-বারান্দা, যে বারান্দায় আমি শৈশবে ট্রাইসাইকেল চালাতাম, সেই বারান্দাটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু শৈশবে ঠিক বেলা তিনটের সময় মুখে পান দোক্তার খিলি পুরে যে দুর্গার মা বারান্দা মুছত সে আর নেই। ট্রাইসাইকেলটাও নেই। আমি কিন্তু আছি। এখন বলাইয়ের মা বারান্দা মোছে। তখন যেন ক্ষণিকের জন্যে অতীত উঁকি দিয়ে যায়। অস্পষ্ট, ঝাপসা শৈশব, জল উড়ে যাওয়া আয়নায় হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে আবার ঝাপসা হয়ে যায়। বলাইয়ের মাকে দুর্গার মা বলে ভাবতে ইচ্ছে করে।
বারান্দায় পুবের বাঁকে যেখানে সকালের রোদ থইথই করে, সেখানে ছেলেবেলায় মা আমাকে রোজ স্নান করাতেন। কাঠের পিঁড়ে পেতে লোহার বালতি থেকে রোদের তাতে ঠান্ডা কমে যাওয়া জল ঘটি করে মাথায় ঢেলে দিতেন। জল ঢালতে ঢালতে একটা জলাশয় মতো হত, আমি তখন। সাঁতার কাটার চেষ্টা করতুম। মা তখন পিঠে ফুলো চড় মেরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। মা-র হাতের চুড়ি কিনকিন করে উঠত। সেই বারান্দার বাঁকে এখনও সকালের রোদ জমা হয়। মা কিন্তু বহুদিন চলে গেলেন। এখন হাজার চেষ্টা করলেও শৈশব আর ফিরবে না, মা-ও আর ফিরে আসবে না। বারান্দার ও জায়গাটায় এখন নীল প্লাস্টিকের বালতিতে জল থাকে। রোদ খেলা করে জল থেকে ছিটকে ওঠে উলটো দিকের দেওয়ালে। ছেলেবেলায় জলটাকে দুলিয়ে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে রোদের প্রতিফলনকে নৃত্যচঞ্চল করে ভোলা একটা মজার খেলা ছিল। এখন আর সে বয়স নেই। অথচ জলও আছে, রোদও আছে। কোনওভাবে তিরিশটা বছর পেছোতে পারলে আবার সেই মুহূর্তগুলো ফিরে পেতাম। সময় বড় একমুখী। নদীতে তবু জোয়ার-ভাটা আছে, জল যায় আবার ফিরে আসে, সময়ের নদীতে কেবলই ভাটার টান।
আমাদের ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে একটা মা লক্ষ্মীর পট আছে। চল্লিশ বছর আগে এক শীতের সকালে মা, জ্যাঠাইমা, পিসিমারা কালীঘাটে গিয়ে ওই পটটা কিনেছিলেন। মা লক্ষ্মী এখনও সেই কুলুঙ্গিতে আছেন। তলার দিকটা এক ধরনের পোকা তিল তিল করে খেয়ে চলেছে, তবু মুখের হাসি অম্লান। সেই পুরোনো পেতলের প্রদীপ সন্ধ্যায় কেঁপে কেঁপে জ্বলে। সারা ঘরে সেই একই ভাবে ছায়া কাঁপে। আজও কেউ না কেউ গলায় আঁচল দিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করে; তবে সে আমার মা-ও নয়, জ্যাঠাইমাও নয়। অথচ এই একই ঘরে তিরিশ বছর আগে আমার শৈশব বসে থাকত বাবু হয়ে, একপাশে মা, একপাশে জ্যাঠাইমা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। প্রদীপ কাঁপত ছায়া নিয়ে দেওয়ালের গায়ে। উপাসনার বই খুলে জ্যাঠাইমা সুর করে পড়তেন, মাতঃ সরস্বতী, ভগবতী ভারতী। আমরাও সেই সুরে সুর মিলিয়ে সন্ধ্যাকে রাতের দিকে নিয়ে যেতুম। রাতের পর রাত পেরিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে সন্ধ্যা আছে, প্রদীপ আছে, পট আছে, এমনকী পাতা খোলা বিবর্ণ কীটদষ্ট উপাসনার বইটাও আছে, নেই কেবল শৈশব। অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় শৈশবটা হারায়নি, কোথাও না কোথাও ফুলের দাগের মতো, সিঁদুরের টিপের মতো লেগে আছে। মাতৃজঠরের জ্বণের মতো প্রৌঢ় আমি-র সঙ্গে তার নাড়ির যোগ রয়েছে, জঠরের শিশুর মতো মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে, কেবল ভূমিষ্ঠ হতে পারছে না। যেন বহুকাল আগে নদীর জলে হারিয়ে যাওয়া একটি মুদ্রা। স্তরে স্তরে পলি জমেছে তার ওপর। স্রোত খেলা করে চলেছে। অদৃশ্য হলেও আছে। শৈশবের কাঠিমেই পরতে পরতে জড়িয়েছে সময়ের সুতো। দৌড়োতে পারিনি বলেই সময় আমাকে ছেড়ে ক্রমশ দূর থেকে দূরেই চলে যাচ্ছে।
আমাদের বাগানে একটা নিমগাছ আছে। আমাদের দুজনের বয়েসই প্রায় এক। আমার শৈশব এই গাছের তলায় এক সময় খেলা করত। হাত বাড়িয়ে নিমপাতা পাড়তুম। সেই গাছ এখন। বিশাল মহীরুহ। তার সমস্ত ডালপালা এখন আমার নাগালের বাইরে। ধুলোখেলার বয়স যখন ছিল তখন গাছটার কাণ্ডে একটা পেতলের ড্রপিং পিন মেরে দিয়েছিলুম। সেই পেতলের টিপ এখন চব্বিশ ফুট উঁচুতে। ছুটির দুপুরে গাছটার রোদ ছিটোনো পাতার দিকে তাকিয়ে মনটা যখন হু-হু করে ওঠে তখন গাছের সঙ্গে কথা বলি,—তুমি আছ কিন্তু অনেকেই নেই। তুমি আমার সহজ অঙ্ক। জীবনের বছরের হিসেবে সময়কে আমি তোমার জন্যেই ফুটে মাপতে পারছি। ওই যে পেতলের টিপ, ঊর্ধ্বে মাত্র চব্বিশ ফুট এগিয়েছে। চব্বিশ ফুটেই আমি রিক্ত, নিঃস্ব, পোড়োবাড়ির প্রৌঢ় পুরোহিত। সময় আর কয়েক ফুট এগোলেই আমার খেলা শেষ।
দক্ষিণের ঘরে একটা ইজিচেয়ার পাতা আছে। বহুকাল আগে জ্যাঠামশাই এই চেয়ারটায় বসতেন। শীতকালে গায়ে জড়ানো থাকত বাদামি রঙের কাশ্মীরী শাল। একটা হাঁটুর ওপর আমি চেপে বসতুম। সমানে চলত নানা আবদার।
ইজিচেয়ারটা এখনও পাতা আছে। হাতলে এখনও হয়তো জ্যাঠামশাইয়ের চায়ের কাপের তলা থেকে লেগে যাওয়া চায়ের শুকনো দাগ খুঁজলে পাওয়া যাবে। আমি মাঝে মাঝে নাট্যকারের মতো পুরোনো দৃশ্য সাজাবার চেষ্টা করেছি জ্যাঠামশাইকে ফিরিয়ে এনেছি, জ্যাঠাইমাকে বসিয়েছি ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল বাঁধতে। মাকে একই সময় বসিয়েছি খাটের পাশে, আমাকে রেখেছি ঘরের মেঝেতে জ্যাঠামশাইয়ের কালো চটি জোড়ার পাশে, হাতে দিয়েছিদম দেওয়া খেলনা—একটা জাপানি ট্যাঙ্ক। শূন্য ঘরে সময়কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি, পরমুহূর্তে শূন্যতা আরও বেড়েছে, হঠাৎ আলোর পর অন্ধকার আরও গভীর হয়েছে। আয়না আমারই বিষণ্ণ মুখ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, চেয়ার বলতে চেয়েছে—তুমিই এখন বোসো, এরপর অন্য কেউ বসবে। খাট বলেছে আমার স্মৃতি নেই, তাই আমি কাষ্ঠকঠিন।
বাদামি শালটার ওপর দিয়ে সময়ের স্রোত বয়ে গেলেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। শালটার গায়ে অস্পষ্ট একটু কালির দাগ লেগে আছে। এটা মঙ্গলার কাজ। মঙ্গলা আমার ছেলেবেলার। বেড়াল। মশারির চাল বেয়ে খড়খড় করে ওপরে উঠে গিয়ে দুষ্টু দুষ্টু মুখে নীচের দিকে তাকাত, তাল খুঁজত ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার। সেই মঙ্গলা কালির দোয়াত উলটে দিয়েছিল শালের ওপর। শালের মালিক এখন আর নেই। মঙ্গলাকে প্রচণ্ড প্রহার করা হয়েছিল। পরের দিন মঙ্গলা মারা। গেল। তার সঙ্গে আমার জীবনের যোগ রয়ে গেল এই কালির দাগে। অস্পষ্ট দাগটা যেন আমার কোলের কাছে শুয়ে থাকা গুটিশুটি মঙ্গলা। একদিন সে ছিল, এই দাগটা তার প্রমাণ।
মা মারা যাওয়ার পর একদিন বাক্স খুলে মা-র ফুল হাতা নীল সোয়েটারটা উলটে-পালটে দেখেছিলুম। যে অঙ্গে একদিন এই সোয়েটারটা উষ্ণতা দিত সে অঙ্গ বহুদিন আগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘ্রাণ নিয়ে দেখলুম, মা-র গন্ধ লেগে আছে কি না। না, একটা পুরোনো ধুলো-ধুলো গন্ধ ছাড়া আর কিছু নিশ্বাসে পেলুম না। হঠাৎ আবিষ্কার করলুম পিঠের দিকে একটা লম্বা চুল জড়িয়ে আছে। সোঁয়া-সোঁয়া উলের সঙ্গে আটকে আছে। নিশ্চয়ই মা-র চুল। শেষ যে দিন সোয়েটার খুলে রেখেছিলেন, সেই দিন হয়তো আটকে গিয়েছিল। একগাছা চুল পড়ে আছে, মানুষটি কিন্তু বহুদিন চলে গেছেন। হঠাৎ যেন সময়ের উজান বেয়ে শৈশবকে ধরে ফেললুম। চলে গেলুম জামতাড়ার এক খোলা মাঠে। শীতের সকাল। দূরে একটা ঝাপসা পাহাড়। তিনটি চরিত্র সামনে এসে দাঁড়াল। বাবার যৌবন, আমার শৈশব, মা-র মৃত্যুর আগের বছর। মা আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে শিশিরভেজা কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। ক্লান্ত চলার ভঙ্গি। মাথায় সিল্কের স্কার্ফ। পেছন থেকে বাবা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন,—সাপ, সাপ। মা আমার হাত ধরে ছিটকে সরে এলেন। কুচকুচে কালো রঙের একটা সাপ এঁকেবেঁকে চলেছে। মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিতে চাইছেন, বুকের কাছে। অসুস্থ শরীর। শক্তি নেই। পেরেও পারছেন না। বাবার হাতে একটা পাথর। বলছেন ভয় নেই, ভয় নেই। সোয়েটার গায়ে ফেলে বত্রিশ বছর আগের মা-র স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আমার প্রৌঢ় শরীর আকুল হয়ে উঠল। সময় হেসে বললে, অনেক দূরে চলে গেছি। তোমার জীবনের কোমল মুহূর্তটি তুমি চিরকালের গর্ভে ফেলে দিয়েছ, আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই।
ফিরে পাব না ছাত্রজীবনের সঙ্গীদের শিক্ষকদের। জীবনে বিকেল ঘুরে ঘুরে আসে কিন্তু সব বিকেলই এক নয়। গঙ্গার ধারে একদিন যাদের সঙ্গে বসে পালতোলা নৌকো দেখতুম, যে ছেলেটি চকখড়ি দিয়ে ঘাটের বাঁধানো পৈঠেতে ডেভিড কপারফিল্ডের, মিঃ ক্রিকলের ছবি আঁকত সুন্দর কার্টুনের ঢঙে, কিংবা যে ছেলেটি অপূর্ব সুরেলা গলায় বৈজু বাওরার গান গাইত, বচপনকে মহব্বতকো দিল সে না জুদা করনা, সেই শচীন, সেই নীতু আর কোনওদিনও ওই ঘাটের সেই জায়গাটায় এসে বসবে না। বহু গান, বহু হাসি, বহু আলোচনা ভেসে চলে গেছে। কে কোথায় ছিটকে গেছি জানি না।
বর্ষা গেছে, শীত এসেছে, গঙ্গা বয়ে চলেছে আজও; ঘাটের পৈঠেতে শ্যাওলা আরও পুরু হয়েছে। যেখানেই থাকুক নীতুর চুলে পাক ধরেছে, শচীন আছে কি নেই বলা শক্ত। পুরোনো রেকর্ডে বৈজু বাওরার গানটা যখনই কানে আসে, তখনই আমার ছাত্রজীবন সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের সামনে নীতুকে দেখতে পাই। বিষণ্ণ মুখ। ডেনরি-অন-শোন-এর ছেলে কলকাতায় এসেছিল পড়তে। থাকত মামার বাড়িতে, বড় কষ্ট করে। এখন কোথায় আছে? কোন নগরে, কোন বন্দরে! এখনও গান গায়, কে শোনে?
গঙ্গার পাতায় আজও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা ভাঙা নৌকো। নৌকোটা ছিল রজনী মাঝির। ঘাটে বাঁধা থাকত। ঢেউয়ের দোলায় দুলত। পরীক্ষার পর পড়ার চাপ যখন কম থাকত তখন। জ্যোৎস্না রাতে আমরা নৌকোটায় বসে জলের আওয়াজ শুনতুম, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করতুম। এক সময় লণ্ঠন হাতে রজনী পাড়ে এসে দাঁড়াত। হেঁকে বলত—জোয়ার আসছে নৌকো খোলো। রজনী মারা গেছে বহুকাল। তার ঘরের চাল উড়ে গেছে, দেওয়াল পড়ে গেছে। তার ঘরের সব গোপন অংশ বাইরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। চালের বাতায় রজনীর হুঁকোটা এখনও বাঁধা আছে। দাওয়ার পাশে পাতা উনুনের একপাশ ধসে পড়েছে। দীর্ঘকালের। রান্নার স্মৃতি দেওয়ালের গায়ে কালো হয়ে আছে। মাছ ধরার জালটা মাকড়সার জালের মতো একপাশে ঝুলছে। কখনও কখনও শৈশব খুঁজতে গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার অন্ধকারে গেলে রজনীর নৌকোটাকে মনে মনে তুলে আবার জলে ভাসাই। সঙ্গীসাথীদের ডেকে ডেকে জড়ো করি। কান খাড়া করে থাকি কখন রজনীর ডাক শুনব—মাঝি নৌকো ভাসাও জোয়ার আসছে।
দেয়ালের হুকে একটা তম্বুরা ঝুলছে। ছুটির দিনের দুপুরে আমাকে চুপিচুপি কাছে ডাকে। সময়ের জলাশয় থেকে কুড়ি বছর আগের কয়েকটা মুহূর্ত বড়শি গেঁথে তুলে আনি। দক্ষিণের। বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে আছে একটি যুবক রাস্তার দিকে। আমারই যৌবন। দূরে রাস্তার মোড়ে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ এক বৃদ্ধ হনহন করে এগিয়ে আসছেন, বগলে তম্বুরা। আমার দাদু। কানাইবাবুর দোকান থেকে পুরোনো তম্বুরা কিনে আনছেন দাদু। হাঁটুগেড়ে বসে সুর বাঁধছেন। চোখ বুজিয়ে সুর ছাড়তে ছাড়তে বলছেন আহা, যেন কাঁসর-ঘণ্টা বাজছে, ওঁকার ধ্বনি উঠছে। দাদু গাইছেন আমার দিন যে আগত দেখি জগৎ জননী। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।
টাটায় গিয়ে দাদু মারা গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, রোজ একটু করে ধুলো ঝেড়ো পান্তুরানি। আমাকে আদর করে ওই নামেই ডাকতেন। আমি ভালো হয়ে এসে আবার গান। শোনাব, ওঠো মা করুণাময়ী খোল গোকুটির দ্বার। দাদু আর ফিরলেন না, মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে পুত্রবধূকে বললেন—তুলে বসিয়ে দাও, পান্তুরানিকে বলো তানপুরাটা দিতে, গানটা গাই। ইউরেমিয়ার যে কণ্ঠ প্রায় বুজে এসেছিল হঠাৎ ছেড়ে গেল। দাদু গাইতে গাইতে চলে গেলেন—ওঠো মা করুণাময়ী খোল গো কুটির দ্বার, আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁদে অনিবার।
মাঝেমধ্যে এমনই এক-একটা ছাড়পত্র নিয়ে আমি অতীতে বেড়াতে যাই। পুরোনো জিনিসপত্র রাখার ঘরে একদিন হঠাৎ জ্যাঠামশাইয়ের মাছ ধরার ছিপ আর ভাঙা হুইলটা পেয়ে গেলুম। ওইটাই আমার ছাড়পত্র। অতীতের সুড়ঙ্গ বেয়ে সোজা শৈশবে। কোনও এক সকাল। পুকুরধারে বসে আছেন জ্যাঠামশাই ফাতনার দিকে চেয়ে। পাশে গোটাকতক সিগারেটের টিন—কোনওটায় চার, কোনওটায় টোপ। কালো জলে থিরথির করে হাওয়া খেলছে। মাঝে মাঝে ঘাই মেরে উঠছে বড় মাছ। দিনের শেষে নির্জন পথে পেল্লায় মাছ হাতে আমরা ফিরছি। দরজার চৌকাঠে মা দাঁড়িয়ে আছেন মৎস্যশিকারিদের সংবর্ধনা জানাতে। মা-র কাঁধে হাত দিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে জ্যাঠাইমা। ভাঙা হুইলটাই যেন কড়কড় শব্দ করে উঠল, মাছের টানে ছিপের মাথাটা বেঁকে। গেল। বদ্ধ ঘরেই পুকুরের ভিজে হাওয়া উঠল, ঝাঁঝি, শ্যাওলা, কচুরিপানার গন্ধ এল।
ওই ঘরেই পেলুম তারের খাঁচা। পাখিটা উড়ে গেছে বহুদিন। কোথায় গেছে? কোথায় কার সঙ্গে পেতেছে সংসার! ছেলেবেলার লাটাইয়ের দুটো চাকা পেলুম। আমার এগারো বছরের বয়েসটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে সামনে দিয়ে ছুটে দুপুরের ন্যাড়া ছাদে গিয়ে উঠল। তামার মতো আকাশে চিল উড়ছে, উড়ছে আমার ময়ূরপঙ্খি।
পুরোনো বইয়ের মধ্যে থেকে পুরোনো চিঠি বেরিয়ে আসে। যিনি লিখেছেন, তিনি আর লিখবেন না। কাকার চিঠি। অমুক তারিখে আমি আসছি। কাকা আসছেন, সঙ্গে আসছে কয়েকটা আনন্দের দিন। হই-হুল্লোড়, হাত দেখা, জ্যোতিষচর্চা, হিপনোটিজম। বিশাল ছাদে চাঁদের আলোয় মাদুর পেতে আশ্চর্য সব গল্প। শেষ যেদিন এলেন সেদিন গায়ে পাঞ্জাবির বদলে টেনিস শার্ট। জামাটা হ্যাঙারে না রেখে মেঝেতে ফেলে রাখলেন। তুলে রাখছি বলতে বললেন, অত যত্ন। করে কী হবে? ইঙ্গিতটা বুঝিনি। চায়ের সঙ্গে ভালো বিস্কুট দেওয়া হল, বললেন, দিচ্ছিস দে, খেয়ে যাই। গলাটা কেমন উদাস। অনেক রাতে বললুম, কাল সকালে কোষ্ঠীটা একবার। দেখবেন। বললেন, সকালে আর সময় হবে না রে, এখুনি দে। রসিকতা ভেবে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলুম, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দুজনে বসব। বললেন, তখন তো আমি থাকব না রে! বিশ্বাস করিনি। দুটোর সময় উদ্বিগ্ন মুখে বাবা অফিসে এলেন, শিগগির চল। তখনকার কলকাতার সবচেয়ে উঁচু বাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে কাকা আত্মহত্যা করেছেন। চিঠিটা হাতে নিলেই সেই ভয়ংকর ঝড়ের রাত ফিরে আসে! আকাশ ভেঙে পড়েছে মর্গ। পোস্টমর্টেমের টেবিলে শুয়ে আছেন সদা হাস্যময় কাকা। গায়ে রক্তেভেজা টেনিস শার্ট। একটা পাদুমড়েমুচড়ে গেছে।
মামার চিঠি। আমাকে সাবধানে থাকতে বলে, শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা বলে বসন্তের এক সন্ধ্যায় নিজেই চলে গেছেন।
সময় শুধু নেয় না, কিছু মানুষকে দেউলে করে ঝুলিয়ে রাখে। সময়ের সবচেয়ে বড় রসিকতা। সময় ধার করে বেঁচে থাকা। শূন্য পাত্র হাতে নিয়ে একপাশে বসে দিন গোনা। শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে মৃত্যুর পরোয়ানা। চোখে সাদা পরদা, কোঁচকানো দেহত্বক বৃদ্ধ পিতাকে দেখলে মনে হয় সময়ে ফকির। ভাঁটার নদী। তারছেড়া তানপুরা। সময়ের ভীমরুল সব শুষে নিয়েছে। অ্যালবামে বিভিন্ন সময়ের ছবিতে এই দেউলে মানুষটির বহতা জীবনের ছবি আছে। পুরীর সমুদ্রতীরে, মুসৌরীর গানহিলে, সাহেবগঞ্জের পাহাড়ে। চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন আমার যুবক বাবা। বাবার জীবনে আমার জীবনের মিলন যেন প্রবাহ পথে দুটো নদীর। মিলন। দুটো নদীই এক হয়ে চলেছে মোহনার দিকে। একজন পথের শেষে, সামনে মহাশূন্য হা হা করছে। পশ্চিম আকাশে আগুন ঢেলে সূর্য ডুবছে। আর একজন আসছে পেছনে পেছনে। দূর থেকে দেখলে লাল আকাশের পটে টিলার ওপর একটি রিক্ত মানুষের অপেক্ষার ভঙ্গিতে বসে থাকা সিয়েট। হঠাৎ দেখবে নেই। তখন সে পৌঁছে যাবে পথের শেষে।
দক্ষিণের ঘরের মেঝেতে শুয়ে হঠাৎ একদিন আটটা পেরেকের মাথা আবিষ্কার করেছি। সবকটা মেঝেতে পোঁতা। এক-একটি পেরেক এক-একটি মৃত্যুর হিসেব। ষাটটা বছর স্থির হয়ে আছে আটটা পেরেকের মাথা। দক্ষিণের এই ঘরটা হল মৃত্যুর ঘর। সিঁড়ির কাছাকাছি। দেউলে। মানুষদের বিছানা পড়ে এই ঘরে। বাঁ-দিকের দরজাটা খুলে দিলেই একটু চাতাল মতো জায়গা, সিঁড়ি নেমে গেছে ঘুরে ঘুরে। ওই তো যাওয়ার পথ। মাথার কাছে খাটের পাশে সাইড-টেবিল। ফিডিংকাপ থাকবে, দু-একটা লেবু থাকবে। ওষুধের শিশি থাকবে। স্টোর থেকে বেরোবে বেডপ্যান। থাকবে একটা চেয়ার। রাতের দিকে গম্ভীর মুখে ডাক্তার এসে বসবেন। গলায় স্টেথিসকোপ। সময়ের হিসেব নেবেন। প্রেসক্রিপশান লিখবেন। তিরিশ বছর আগে আসতেন জয়ন্ত ডাক্তার। এখন হয়তো আসবেন ডাক্তার কুশারী। ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাবে তিনি নেমে যাচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে। গায়ে উদাসীনতার সাদা কোট। নেমে যাচ্ছে আশা। সন্ধেবেলা ঘরে কেউ ধুনো দিয়ে যাবে। অনেকদিনের অসুখ-অসুখ গন্ধ যদি একটু কাটে। দেয়ালে ঝুলছে আগে আগে যাঁরা গেছেন তাঁদের ভরা-দিনের ছবি।
হঠাৎ একদিন দরজার বাইরে ফিশফিশ কথা শোনা যাবে। লোকটির সময় শেষ হয়েছে। একটা রাত কাটে কি না সন্দেহ। মাথার কাছের জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাতের উদার আকাশ। টিপটিপ করে জ্বলছে সময়ের রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে যারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে, আরও লক্ষ লক্ষ বছর থাকবে। তন্দ্রার ঘোরে সারাজীবন একবার ঘুরে যাবে। ওই তো সেই শিশু, মা-র কোলে, সন্ধ্যার শাঁখ বাজছে। ওই তো সেই কিশোর, বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। ওই তো সেই যুবক, কলেজে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে একটি মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে—প্রথম প্রেম। ওই তো বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। গলায় রজনীগন্ধার মালা। ফুলশয্যার বিছানা। চলে যাওয়া জীবন, চলে যাওয়া মুহূর্তের স্রোত উলটো বইছে।
রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে রাতের কথার খই ফুটছে। ডিম ফোঁটাবার শব্দ আসছে। কে যেন বলছে ওমলেটটা একটু নরম থাকে যেন কার্তিক। ওমলেট আমিও ভালোবাসি। নরম ওমলেট খাবার আর সময় নেই। আবার খাওয়া যাবে অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। মালাটা ছিঁড়ে গেছে। সমস্ত পুঁতি ছড়িয়ে পড়েছে। একটা একটা করে কুড়োতে পারি কি না দেখি! না বড় শক্ত কাজ।
দক্ষিণের ঘরের আটটা পেরেক নটা হবে। এটা নতুন, মাথাটা অন্যগুলোর চেয়ে চকচকে। চশমাটা কেউ খাপে ভরে রাখবে। কলমের মাথাটা বন্ধ করে রাখবে। বিয়ের গরদের পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেবে। নতুন ধুতিগুলো ছাপিয়ে শাড়ি করে নেবে। নতুন চটিজোড়া রাকে তুলে রাখবে। আমি তখন খাট থেকে ফুটতিনেক উঁচুতে ছবি হয়ে ঝুলব! সব মুহূর্ত খরচ করে আমি তখন চলে গেছি সময়ের ভাণ্ডারে আমার রিক্ত ঝুলি নতুন করে ভরে নিতে। আমার দু-পাটি বাঁধানো দাঁত আলমারির কাঁচের ওপাশ থেকে অবয়বহীন হাসি ছড়াবে ইন্টারন্যাল লাফ-এ গ্রিন উইদাউট এ ফেস।
পরিশিষ্ট
Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained in time past.
If all time is eternally present
All time is unredeemable.
[T. S. Eliot.]
পেয়ালা পিরিচ
আমার একটা সোয়েটার ছিল। কারওর স্নেহের হাতের বোনা নয়। নীরস দোকান থেকে কেনা। সেই সোয়েটার আমার ছাত্রজীবনের শেষভাগ থেকে চাকুরে জীবনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত শীতে আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর স্ত্রীযোগে সোয়েটার বিয়োগ হল। প্রথম দিকে স্ত্রী-রা দু-এক বছর বড় মধুর ব্যবহার করে থাকেন। অঙ্গে বউভাতের রাতে পাওয়া কখনও নীল শাড়ি, কখনও লাল শাড়ি। এলোচুলে ফুলশয্যা আর গায়েহলুদের তত্বে পাওয়া গন্ধতেলের সুবাস। কপালে আঁকা যত্নের গোল টিপ। মুখে মৃদু ‘শুনচ, শুনচ’ সম্বোধন। স্বামীরাও তখন পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। পোষা বেড়ালের মতো। ডাকের কী বাহার! সোহাগে জরজর, ‘হ্যাঁ গা।’ স্ত্রী আমার সেই পাটকেল রঙের সোয়েটারটিকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করল। এ আবার মানুষে গায়ে দেয়! যেন এতকাল আমি জানোয়ার ছিলুম। বিবাহের পর মনুষ্য পদবাচ্য হয়েছি বছর চারেক পরে অবশ্য আবার আমি জানোয়ার হয়ে গেছি। এখন উঠতে উঠতে শুনি, জানোয়ারের হাতে পড়ে জীবনটা গেল। তার মানে স্বামী পুরোনো হলেই জানোয়ার হয়ে যায়। যেমন চামড়া পাকা হলে জুতো হয়।)।
প্রথমে আলমারির এক কোণে, তারপর আলমারির পেছনে, সব শেষে সেই সায়েটার এসে পড়ল কয়লার গাদায়। অবশেষে সেটির মালিক হল আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার স্বামী। আর আমার স্ত্রী নস্যি রঙের উলের জমিতে হলুদ রঙের সাপ খেলিয়ে বেশ আহামরি গোছের। একটি বুকখোলা সোয়েটার বুনে দিলে। মেডেন সং-এর মতো মেডেন সোয়েটার। সেই প্রথম আর সেই শেষ। অমন পাপকর্ম সে আর দ্বিতীয়বার করেনি (পুরোনো স্বামীর মতো পাপী ব্যক্তি পুলিশের খাতাতেই নেই। ছুপা রুস্তম।)।
বছর ঘুরতেই খোকা। আবার বছর ঘুরতেই খুকি। স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে গেল। জননীর অনেক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার অংশীদার হয়েই জীবন কাটাতে হবে। সুখের সীমানা বড় সংকীর্ণ। সেই স্ত্রী এখনও সোয়েটার বোনে। তবে আমার নয়, ছেলেমেয়ের। ইতিমধ্যে তার নিজস্ব জগৎও বেশ। বড় হয়েছে। হাঁকডাক বেড়েছে। ঠাকুরপো-টাকুরপো গোটাকতক জুটেছে। তাদের জন্যেও মাঝে মাঝে সোয়েটার বোনার সময় করে নিতে পেরেছে। আমি তো ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। আমার স্বাদ কমে গেছে। আমার বাহবার তেমন দাম নেই। আমি খুশি হলেই বা কী। অখুশি হলেই বা কী। (স্বামীরা আসলে ক্লীব লিঙ্গ। সামান্য আশকারায় নিজেদের পুংলিঙ্গ ভেবে আস্ফালন প্রকাশ করে যথাস্থানে যথোচিত ঠোক্কর খেয়ে একপাশে চিত হয়ে পড়ে। অনেকটা বিরাট আকৃতির। গুবরে পোকার মতো। ঘরে ঢুকে জেট-প্লেনের মতো সগর্জনে খুব উড়ছে। ভীতু ভাবছে না জানি কী মাল। যার আয়তন আর আওয়াজ এত সাংঘাতিক তার কামড় নিশ্চয়ই মারাত্মক হবে। কিন্তু যে জানে সে জানে। উড়তে উড়তে এক সময় দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়বে আর একবার চিত হলেই ভোলা মহেশ্বর। পড়ে পড়ে সারারাত শুড় নাড়বে। সকালে চিত থেকে সোজা করে। দাও গোঁ-গোঁ করে উড়ে বাইরে চলে যাবে। বিবাহিত মানুষের সঙ্গে অসাধারণ মিল। বাড়ি ঢুকল। গোঁ-গোঁ করতে করতে। স্ত্রী ছাড়া সকলেই তটস্থ। ঠ্যাকাস করে পয়লা ধাক্কাতেই ফ্ল্যাট। বাবু চিত হয়ে রইলেন। সকালে ঝাঁটা দিয়ে উপুড় করে দাও। সামনে এককাপ চা ধরো। তারপর দেখো। বাজার, দোকান সব ঠিকঠাক। ন’টার সময় উড়তে উড়তে কর্মস্থলে। অত বড় ক্ষমতাশালী মহাদেব। তাঁকে চিত করে সেই যে একবার মা কালী বুকে উঠে দাঁড়ালেন আজও তিনি সেইভাবে পড়ে আছেন আর উঠতে হল না।)
মানুষের জ্ঞানোদয় হলে তার আর কোনও দুঃখ থাকে না। আমারও নেই। প্রত্যাশাইদুঃখের মূল কারণ। আমি মূলোচ্ছেদ করে দিব্যি আছি। আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে আর কিছুই আশা করি না। আমি জানি সকালের কুয়াশার মতোই স্ত্রীর প্রেম ক্ষণস্থায়ী। (শুনেছি জাপানে এক ধরনের। মারাত্মক বিষাক্ত মাছ পাওয়া যায়। সেই বিষ বের করে যারা রাঁধতে পারেন তাঁরা জানেন এর চেয়ে সুস্বাদু মাছ আর দ্বিতীয় নেই। স্ত্রীও অনেকটাই সেই রকম। বিষ বের করে যাঁরা নাড়াচাড়া করার কৌশল জানেন তাঁরা বলেন, ধনধনা ধন ধনা, এ ধন যার ঘরে নেই তার কীসের ধিনতাধিনা। সংসারে থাকবে ভারবাহী বলদের মতো। সৃষ্টিরক্ষার জন্যে ঈশ্বর তোমাকে ফাঁদে ফেলবেনই। তোমার নিজেরও কিছু মুখুমি থাকবে। সব মিলিয়ে ল্যাজে-গোবরে হয়ে জীবন কাটাতে হবে।
সবই যখন জানি তখন একটা সোয়েটার নিয়ে এত ধানাইপানাই কেন? মানুষের ভ্রম হয়, মতিভ্রম হয়। আমার মতিভ্রম হয়েছিল। হাঁড়ির একটা চাল তুলে টিপে দেখে সব চালের অবস্থা বুঝেও বুঝিনি। একটু স্নেহটেহ, প্রেমট্রেম খুঁজতে আবার ছিপ ফেলেছিলুম। আমার মনে হয়েছিল জীবনটা অনেকটা কম্বিনেশন তালার মতো। ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় নম্বরে নম্বর মিলে গেলেই খুলে যাবে। এই মহিলাটির সঙ্গে মিল হয়নি, কুছ পরোয়া নেই। কম্বিনেশন মেলাতে পারিনি, তাই সংসারের ফটকে টাম্বলার তালার মতো গোমড়া মুখে ঝুলতেই থাকবে সারা জীবন। থাকুক। কত কিছুই তো খোলে না জীবনে। সংসারের কত শিশি থাকে যার ঢাকনা খোলা যায় না। আড়পাঁচ হয়ে পড়ে থাকে। গরম জলে চুবিয়ে, আগুনের ছেকা দিয়েও খোলা যায় না। বিজ্ঞানীরা বলে, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড। ভুল হতে হতে এক সময় মিলে যাবে। স্ত্রী-রা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলের মাশুল। মুষল বিশেষ। সংসারের মোহ-মুদগর। বিবাহের পরই বোঝা যায় এ-তালার চাবি আমার হাতে নেই। আমি হলাম অন্য তালার চাবি।
সেই তালাটি যে অফিসে আমার চেয়ারের তিনটি চেয়ার পরে এতকাল বসে বসে ফাইল নাড়তেন। তা কি আমি জানতুম; (বিবাহ না করিলে মানুষের দৃষ্টি খোলে না)! পৃথিবীতে স্ত্রী-নিগৃহীত স্বামী। যেমন আছে তেমনি স্বামী-নিগৃহীত স্ত্রীও আছেন। বিধাতার কৌতুকে সবলে দুর্বলেই জোড় বাঁধে। কদাচিৎ সবলে সবলে মোলাকাত যে হয় না তা নয়। পাড়ার এই রকমের দম্পতি দু-একটি দেখা যায়, শোনাও যায়। শোনা যাবে না কেন, তাঁরা এতই সরব এবং রোষযুক্ত যে তাদের সৌরভ যোজন বিস্তৃত। যাই হোক, এরকম হাম ভি মিলিটারি তোম ভি মিলিটারি গোছের মিলন বিধাতার হাত ফসকেই বেরিয়ে যায়। (আমি মাঝনদীতে একবার একটা নৌকো দেখেছিলুম। হাল, দাঁড়। ফেলে দুই মাঝিতে পাটাতনে দাঁড়িয়ে মল্লযুদ্ধ করছে। নৌকো ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। জীবনও তো তাই। হাল ধরি আর না ধরি ভাসতে ভাসতে ঠিক চলে যায় মৃত্যু মোহনায়।)
তা সেই শান্ত চেহারার, মিষ্ট স্বভাবের মহিলাটির সঙ্গে সামান্য উশখুশেই একটা হৃদ্যতা জন্মে। গেল। জন্মাতেই পারে। এক পালকের পাখি এক জায়গায় জড়ো হয়। আমার তো কোনও দোষ ছিল না। আমার স্ত্রী-র উপেক্ষাতেই আমার বিপথে গমন। এ তো জানা কথাই, ছেলেমেয়েরা স্নেহ ভালোবাসা না পেলেই কুসঙ্গে চলে যায়। আমি স্বামী হলেও ছেলে তো, আর যার সঙ্গে আমার ভাব-ভালোবাসা সে অন্যের স্ত্রী হলেও মেয়ে তো। এ যুক্তি জজেও মানবে। আর দুজনেই ঘা। খাওয়া প্রাণী। তা ছাড়া ‘ঘৃতশাস্ত্রে’ বলেছে—অগ্নি সমীপে ঘতের অবস্থানে অগ্নি উদ্দীপিত হয়। পুরুষ আর নারী সেই অগ্নি ও ঘৃত। কে অগ্নি, কে ঘৃত তা জানি না। শাস্ত্রবাক্যে সাবধান না হয়ে কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ দহনশীল ও দাহ্য বস্তু দুটিকে এত পাশাপাশি রাখলেন কেন? দোষ আমার নয়। দোষ যখন আমার নয় বিবেক তখন মুক্ত। বেশ করেছি ভালো করেছি। (কার বাপের কী? বললে, শ্বশুরমশাইকে বোঝায়। নিগৃহীত স্বামী হলেও আমি অভদ্র নই) নিজের স্ত্রী-র যখন সময় নেই, মেজাজ নেই, তখন অন্যের বাতিল স্ত্রীর সঙ্গে ভাব বিনিময়ে দোষের কিছু নেই। (সমাজ এখন অনেক লিবার্যাল) কথা বলতে গেলেই সংসারের কথা। হরেক উপদেশ। পিতার কর্তব্য কী? কন্যার বিবাহ। অমুকের তমুক। গুষ্টির পিণ্ডি। মুখ খুলেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চুলোচুলি, খুনোখুনি, দক্ষযজ্ঞ। (স্ত্রীরা কত আপনজন ল্যাজে পা পড়লেই বোঝা যায়। স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কোন ব্যাটা বলেছে বিবাহবন্ধন জন্মের বন্ধন, সাতপাকে বাঁধা। কিস্যুই তিনি। জানতেন না। এলো সুতোয় একতে ঘুড়ি ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে। পান থেকে চুন খসলেই শ্বশুরমহাশয়ের কন্যার অন্য রূপ। কে ওই বামা এলোচুলে! বড় পলকা বন্ধন। ঘাঁটাঘাঁটি না করলে বেশ আছে। ঘাঁটালেই ভিমরুলের চাকে খোঁচা। স্ত্রীর পিরিত চাকের মধু। চাকেই থাক।) অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য চেহারা। হাসিহাসি মুখ। উজ্জ্বল চোখ। ডগমগ অবস্থা। (রামকৃষ্ণ বলতেন, অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে লড়ে যাবে। লড়ে যাবে বলেননি, সংসার করতে বলেছিলেন। তার মানে স্বামীকে আঁচলে বেঁধে দাপটে সংসার। আর প্রবাদ আছে, যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙে দাঁতের গোড়া।) আমি পিতা হতে পারি, বাজার সরকার হতে পারি, মুদ্দোফরাশ হতে পারি, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো হতে পারি, পারি না কেবল স্নেহভাজন স্বামী হতে। শাস্ত্রে আছে যেমন কুকুর তেমন মুগুর, আছে বাঘা ওল বুনো তেঁতুল। সুতরাং এই জাতীয় একস্ট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স-এ আমার অধিকার আছে। আমার বিবেকের সমর্থন আছে। তা ছাড়া পার্শ্ববর্তিনী মহিলাটির সঙ্গে এমন কিছু করছি না যা অসামাজিক।
দুজনে অবসর সময়ে সুখ-দুঃখের আলোচনা করি। কে ক-ঘা খেলুম। কে কেমন আঁচড়ালে। অন্যমনস্ক চিনেবাদাম দাঁতে কাটতে কাটতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা। একই চাতালে দাঁড়িয়ে ক্ষত অনুসন্ধান আর লেহন। অনেকটা কুকুরের মতো। কামড়াকামড়ি, ঝটাপটির পর একপাশে বসে বসে কেমন তারিয়ে তারিয়ে চাটে। এইভাবে মনের দুঃখ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এক। ধরনের সান্নিধ্য গড়ে উঠল। দুজনেরই মনে হতে লাগল এ জীবনে যা হওয়ার নয় তাই হলে একটা সুখের সংসার গড়ে উঠত। একটা খুব ভালো প্লট কাঁচা লেখকের হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। সমবেদনায় বেদনামাখা দুটো মন এক হয়ে গেল। আমরা অফিস ছেড়ে ছুটির পর মাঝেমধ্যে পার্কে গিয়ে পাশাপাশি বসতে শুরু করলুম। একে বলে সংযত প্রেম। যৌবনের ফোঁসফোঁসানি নেই, আবেগ নেই। টুকটাক কথা, ভাঁড়ে চা, মাঝেমধ্যে একটু দর্শন আলোচনা আর আশেপাশে জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতিদের দেখে তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে আঁতকে ওঠা। একটা-দুটো সিনেমাও হত। সেকেন্ড হ্যান্ড প্রেমের একটা আলাদা মাধুর্য। কোনও দাবি নেই, বন্ধন নেই। তিক্ততা নেই, এক সময় যে যার চুল্লিতে ফিরে যাও। পরের দিন মিলিয়ে দেখো কে কতটা ঝলসালে।
চলতে চলতে মানুষ কত কী আবিষ্কার করে। হঠাৎ মনে হতে লাগল আমার স্ত্রী-র নাকটা ভীষণ ফ্ল্যাট। মুখের অনেকটা জায়গা জুড়ে আনাড়ির হাতে তৈরি শিঙাড়ার খোলের মতো পড়ে আছে। চোখে কোনও বুদ্ধির দীপ্তি নেই। প্যাঁচার মতো গোলগোল। চুলে তেমন চেকনাই নেই। ঘোড়ার বালামচির মতো সোঁটা সোঁটা। হাতের রান্না তেমন ভালো নয়। সব কাজেই অপটু। শরীরে তেমন লাবণ্য নেই। কপালটা আবার উঁচু। (কী করে তখন যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতুম ঈশ্বরই জানেন। তখন বোধহয় অন্ধ ছিলুম। বেড়ালের চোখ ফোটে দেরিতে।)।
রাতে পাশাপাশিবিছানায় শুয়ে আছি। যে-কোনও কথারই ছাড়া কোনও উত্তর নেই। এক অক্ষরের আলাপন। শরীরে হাত ঠেকলেই খ্যাঁক করে ওঠে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি স্বামীর পাশে শুয়ে আছে না ভাসুরের পাশে। শোওয়ার সময় ভগবানের নাম নিতে হয়। হে করুণাময়! আমাকে সুনিদ্রার তটে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে নিয়ে চলো। সে সব নেই। হঠাৎ অন্ধকারে বলে উঠল, চিনি ফুরোল, কাল সকালের চায়ের মতো পড়ে আছে। চা আনতে হবে। এবারের চায়ে তেমন লিকার ছিল না। তার মানে খরচ বেশি হয়েছে। পরশু তপুর ছেলের অন্নপ্রাশন। কিছু দিতে হবে! কী দেবে? সামনের শনিবার বিকাশের বিয়ে। কী দেবে? অবিরাম দেহি দেহি। যেন। ট্যাঁকশালের পাশে এসে শুয়েছে। সবসময় স্বার্থ। বিছানাটা আলাদা করে নিতে হবে। কী দরকার বাবা! ভুলে কোথাও হাতটাত পড়ে গেলে বড় অপমানিত হতে হয়। কপালে! ভীষণ মাথা ধরেছে। কাঁধে? সংসারের ভার। পেটে বোধহয় টিউমার। পায়ে গুঁপো। এ জিনিস বিছানায় কেন? ডাক্তারের টেবিলে শোয়া উচিত ছিল।
সোয়েটার থেকে অনেক দূরে এসেছি। না সরে আসতে পারিনি। শীত ফিরে ফিরে আসে। এক। মাঘে শীত যায় না। প্রথম শীতেই আমার সেই অফিসার মহিলা সুন্দর একটি সোয়েটার উপহার দিলেন। আমরা দুজনে একটা ইংরেজি ছবি দেখলাম। সিনেমা হলে সেই সোয়েটারটা তাঁর কোলে থেকে গরম হয়ে উঠল। নস্যি রঙের উলে নকশার বিনুনি হাত ধরাধরি করে চলেছে। হাতে নিলেই বোঝা যায় দামি উল। হালকা, নরম। ছবি দেখতে দেখতে মন খুশিতে নেচে উঠেছিল জয়ের আনন্দে। (মন জয় করার যে গর্ব। রাজত্ব জয় কোথায় লাগে!) নতুন এক মহাদেশে নৌকো নোঙর ফেলেছে। এক-একটি মন অজানা এক-একটি মহাদেশ। ইংরেজি বই চলার মাঝে মাঝেই মনে বাংলা গান গুমরে গুমরে উঠছে, আমার কী হবে তারিণী, ত্রিগুণধারিণী!
তারিণী জানতেন, ব্যাটাচ্ছেলে তোর কী হবে। প্যাকেট বগলে বাস-এর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। বলদাত্রী, সোয়েটারদাত্রী চলে গেছেন। পরে আছি স্ত্রীর হাতে বোনা প্রেমের তাজমহল। সম্পর্কের শুরু ও শেষের উল-ফলক (মর্মর ফলকের মতোই, হেথায় চিরশায়িত সেই মানুষটির প্রেম। আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, ঘাড়ে ধরে পিতা গছিয়েছেন। ভুল করে বোনা সোয়েটার ভুলে অঙ্গে চেপে বসেছে। গায়ের সোয়েটার যেন বগলের সোয়েটারকে প্রশ্ন করছে, কোথায় চললে? কেন, তোমার সঙ্গে! তুমি যে ইললিগ্যাল মানিক। ঝাঁটা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি। তুমি কোন উৎস হইতে উঠিয়া কোথায় চলিয়াছ? বাঘের ঘরে কি ঘোগ বাসা বাঁধিতে চলিয়াছে? তুমি তো আমার সতীন হে। একটু ভয় ভয় ভাব যে হচ্ছে না তা নয়। অফিস থেকে সিনেমা, সোয়েটার উপহার, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি বসে থাকা, রেস্তোরাঁ, খানা— এতক্ষণে বেশ ঘোরে ছিলুম। এইবার একা একা বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনটা যেন ক্রমশই এলিয়ে পড়ছে। সে শক্তি আর নেই। চোখের আড়ালে আত্মিক অনুসন্ধানে বিপদের ঝুঁকি কম। বামাল বাড়ি ঢুকলে চুলোচুলি তো হবেই। সোয়েটার তো আর আশমান থেকে পড়ে, ছেলেরাও বোনে না। কোন মহিলার এই কীর্তিকীসের এত খাতির (যার ওপর দুর্ব্যবহার করা হয় তাকে সব সময় চোখে রাখতে হয়। মার খেতে খেতে পালিয়ে না যায়। অন্য কোথাও ছিটকে গিয়ে আদরে না থাকে। আমার পাঁঠা। ন্যাজে কাটব, মুড়োয় কাটব।) হঠাৎ তোমাকে কেন সোয়েটার বুনে দেওয়া। সোহাগ না থাক সজাগ দৃষ্টি ঠিক আছে। (কুস্তিগির খেটেখুটে, তেল ঢেলে জমি তৈরি করে, তার ওপর নিত্য দাপাদাপি করার জন্যে। এর নাম আখড়া। স্বামীরা হল। স্ত্রীদের আখড়া। যে যার আখড়ায় কুস্তি করবে। অন্যের প্রবেশ নিষেধ।) এমন জিনিস রাস্তায় তো আর ফেলে দিতে পারি না। তা ছাড়া এর প্রতিটি বুনোনে ভালো লাগা, ভালোবাসা। যা হয় হোক সতীন বগলেই বাড়ি ঢুকব। ঠান্ডা লড়াই একদিন গরম লড়াই হবেই। যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যায় স্নায়ুর পক্ষে ততই ভালো। ধিকিধিকি তুষের আগুনের মতোনা জ্বলে দাউদাউ করে জ্বলে উঠুক। (অশান্তিটাও এক সময় বিলাস হয়ে দাঁড়াল। উট যেমন কাঁটা চিবিয়ে রক্তাক্ত হতে ভালোবাসে।)
সোয়েটার বগলে বাড়ি ঢোকার দিনটিতে তেমন কিছু হল না। কারণ আমার আসা, আমার যাওয়া তেমনভাবে আর কারওর নজরে পড়ে না। সে ছিল প্রথম দিকে। ফিরতে একটু দেরি হলে দূর থেকেই দেখতে পেতুম জানালায় একটি মুখ। আমি পথ চেয়ে রব। বেরোনোর সময় ফিশফিশে অনুরোধ, তাড়াতাড়ি ফিরো। বেশি রাত কোরো না। (আমাদের সেই মঙ্গলা গরুটার মতো। দেশের বাড়িতে দেখেছি। সকালে চরতে বেরোল। জানা আছে বিকেলে ঠিক ফিরে আসবে। যেখানেই থাকুক। কোনও চিন্তা নেই। মাঝে কেউ একবার গোয়ালে উঁকি মেরে আসত। মঙ্গলা শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। মঙ্গলা দুধ দিত আমি টাকা দিই এই যা তফাত।) সুতরাং নিঃশব্দে। বাড়ি ঢুকে প্যাকেটটা আলমারিতে গুঁজে রাখলাম। শীত আসুক তখন সাদা প্যান্টের সঙ্গে পরা। যাবে। আর তখনই হবে ধুমধারাক্কা। ততদিন সম্পর্কটা আরও বিষিয়ে উঠবে। ফোঁড়া থেকে কার্বঙ্কল।
শীত এল। যেমন আসে। মৃদু আমেজ। প্রথম কয়েকদিন আমার সেই পেটেন্ট সোয়েটার দিয়েই উদ্বোধন করা গেল। ঝলঝলে মাল। রং জ্বলে গেছে। যৌবন ঝরে গিয়ে বার্ধক্যের দশা। কাপ্তেনি করার বয়েস চলে গেছে বলে মানিয়ে যায়; বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি শীত চলে গেলেই ওটাকে আবার খুলে বোনা হবে। যেমন শোনা যায় রামরাজত্ব আবার আসবে। যাই হোক নতুন। সোয়েটারের তখনও তেমন প্রয়োজন হল না। চলছে চলুক। এরই মধ্যে একদিন বৃষ্টি হয়ে। শীতটা জাঁকিয়ে পড়ল। অফিসের সেই মহিলা বললেন, সোয়েটারটা এবার একদিন পরুন। তুলে রেখে রেখে পোকায় যে কেটে দেবে। গিন্নির ভয়ে পরছেন না বুঝি! (পৃথিবীতে কত রকমের ভয়! আরশোলার ভয়, সাপের ভয়, ছোঁয়াচে রোগের ভয়, মাসের শেষে কারওর বিয়ের ভয়, বড়কত্তার ভয়—সব সেরা গিন্নির ভয়।)।
উপলক্ষ্য একটা জুটে গেল। আজ অফিসের এক সহকর্মীর বউভাত। সদলে যেতে হবে। সামান্য মাঞ্জা দিলে ক্ষতি কী? সাদা প্যান্টের ওপর নতুন সোয়েটার। যথাস্থানে হাত চলে গেল। হাত ফিরে এল। প্যাকেট স্থানচ্যুত, আলমারি তোলপাড়। শীতল একটা গলা শোনা গেল, ‘কী খোঁজা হচ্ছে? সব যে বারোটা বেজে গেল। কী চাই আমাকে বললেই তো হয়। হাঁটকে পাঁটকে একশা!’
‘একটা প্যাকেট ছিল।’
‘কীসের?’
‘সোয়েটারের।’
‘ও সোয়েটার! নস্যি নস্যি রং। কার সোয়েটার?’
‘আমার, আবার কার?
‘কে বুনে দিলে?’
‘বউদি।’
‘তোমার আবার বউদি কোথা থেকে এল?’
‘তোমার একগাদা ঠাকুরপো থাকতে পারে আমার একজন বউদি থাকতে পারে না!’
‘রসের বউদি! তলে তলে আজকাল এইসব হচ্ছে। বুড়ো বয়েসে লজ্জা করে না! ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। মুখ দেখাবে কী করে?’
‘তুমি যদি দেখাতে পারো আমিও পারব।’
‘তার মানে?’
‘বুঝে নাও।’ আবার আমি আলমারি হাঁটকাতে শুরু করলাম।
‘তার মানে আমিও তোমার মতো চরিত্রহীন!’
‘যে যেমন অর্থ করে।’
‘আচ্ছা-আ।’
‘আচ্ছা’ শব্দটা ধারালো ছুরির মতো হাওয়া কেটে গেল। আলমারির সব কিছু ঠিকঠাক রেখে সোয়েটার খোঁজার ধৈর্য আর নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুমদাম করে সব ফেলতে লাগলুম। রাগে সর্বশরীর জ্বলছে।
‘সোয়েটার ওখানে নেই।’
‘কোন চুলোয় আছে।’
‘ভবানীপুরে।’
‘ভবানীপুরে?’
‘হ্যাঁ, ভবানীপুরে। তোমার ছোটশালা পরে চলে গেছে।’
‘বাঃ, বারে শ্বশুরবাড়ি। যেখানে যা পাবে হাতিয়ে নিয়ে চলে যাবে। দেওয়ার মুরোদ নেই, নেওয়ার বেলায় শত হস্ত।’
‘কী নিয়েছে শুনি? কী-ই বা তুমি দিয়েছ?
‘কী নেয় না শুনি! দেওয়া? দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? তোমার ওই বাহারের ছোটভাইটি যেখানে যা পাবে ঝেড়ে নিয়ে চলে যাবে। যেন কর্পোরেশনের মাল রে! এই তো সেদিন একটা জামা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। কী? না জামার রংটা ভীষণ ভালো। ভীষণ অ্যাপিলিং ইংরেজি শিখেছে, ইংরেজি। আমার আর ভালো কিছু পরে দরকার নেই, ছেঁড়া পরে ঘুরে বেড়াই। আর তুমি একটি গোমুখ্য। বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে সারাটা জীবন হেদিয়ে মলে।’
‘তাই তো বলবে! হ্যাদানোর কী দেখলে? আর তুমি যখন আমার শাড়ি ধরে টানাটানি করো?
‘তোমার শাড়ি? তোমার ত্রিসীমানায় যেতে আমার ঘেন্না করে। আমি জানি, আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বন ভালো।’
‘তা ঠিক। পর তো ভালো হবেই। বাইরে বাইরে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ফস্টিনস্টি। তাদের তো আর অন্য কোনও দায়দায়িত্ব নিতে হবে না। ঘরেরটাকে জিইয়ে রেখে বাইরের এক একটাকে ধরে একটু খেলু খেলু। বাবুর খেলা হচ্ছে। খেলা। হাজারবার তাগাদার পর একটা শাড়ি এল। না পরে তুলে রাখলাম। তারপর যেই একটা বিয়ে এল বাবুর অমনি নাকে কান্না, মাসের। শেষ, বড় টানাটানি, কী করা যায়, তোমার ওই শাড়িটা দিয়েই এ যাত্রা ম্যানেজ করি। তোমাকে। আরও ভালো শাড়ি কিনে দেব। ব্যস হয়ে গেল। ফুর্তিতে টাকা ওড়ালে সংসারের এই হালই হয়। তোমার রকমসকম দেখে আমারও ঘেন্না ধরে গেছে। তোমার ত্রিসীমানায়, তোমার কোনও কিছুতে থাকতে ইচ্ছে করে না।’
‘থাকার দরকার নেই। এসেছি একলা যাবও একলা। তোমার ভাইকে এই সোয়েটারটা, এই শালটা, এই জামাটা, এই প্যান্টটা, এই কলারওলা গেঞ্জিটা দয়া করে নিয়ে যেতে বোলো। আমি সন্ন্যাসী হয়েই দিন কাটাব।’
সব টেনে টেনে, ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দিলুম। ভেতরটা বেশ খোলসা হল। কোষ্ঠকাঠিন্যের পরের আনন্দ। অফিসে বেরোবার তাড়া না থাকলে বেশ ভালোভাবে লড়া যেত। যাক, তবু কিছুটা লণ্ডভণ্ড করা গেছে। ক্রোধে শরীরের রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। কল্পনার স্বপ্নজগৎ থেকে বাস্তবে বেশ কিছুদিনের জন্যে ফিরে আসা সম্ভব। গণ্ডারের মতো গোঁ গোঁ করে গোঁত্তা মারার জায়গার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। মুহ্যমান ভাব কেটে যায়। কাজে-কর্মে গতি আসে।)
অফিসে আমার সেই বান্ধবী বললেন, ‘কী হল? কাল নতুন সোয়েটার পরার কথা বলায় একেবারে উদোম হয়ে চলে এলেন যে?’
বাহুল্য বর্জন। বলতে পারলুম না যে, আপনার সযত্নে বোনা সোয়েটার ভবানীপুরের এক মাল পরে আশুতোষ কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে শিকার করছে।
‘ঠান্ডা লেগে যাবে যে? আজ ফিরতে অনেক রাত হবে তো!’
‘বিকল্প ব্যবস্থা আছে।’
‘সেটা কী?
‘ছিলিম। বিকেলে বেরিয়ে বটতলার বাবাজির কাছে উবু হয়ে বসে টান মেরে যাব।’
ঠান্ডা লাগার কথা আমার বউও বলেছিল তবে বাঁকা করে। ‘ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া হলে সেবা করতে পারব না কিন্তু।’ সেবার নমুনা তোমার দেখা আছে। ছেলেবেলায় আমাদের পড়তে বসার মতো। এদিক তাকাচ্ছি, ওদিক তাকাচ্ছি, কাগজের গোল্লা তৈরি করছি, পেনসিল চিবোচ্ছি। শেষে হাওয়ায় বইয়ের পাতা উড়ছে, পড়ুয়া মাঠে দৌড়োচ্ছে। তোমার সেবাও তো তাই। আমার কপাল রইল কপালে। তোমার হাত রইল হাতে। মুখে বারকতক বললে, কপালে হাত বুলিয়ে দোব? কপালে?
বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল। দশটা-টশটা হবে। শোওয়ার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলুম। এতদিনের জোড়া খাট সিঙ্গল হয়ে গেছে। ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছে। শব্দ করলে। প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ছেলে আর মেয়ে দুজনেই ঘরে ছিল। বড়সড় হয়েছে। বুঝতে-সুঝতে শিখেছে। মেয়ে বলল, ‘কী গো তোমার রাগ কমেছে?’
ছেলে বলল, ‘কক ফাইটের ভয়ে রাত করে ফিরলে?
আরে তাই তো, বেরোবার সময় বলে যেতে ভুলেই গেছি, আমার নিমন্ত্রণ ছিল। অবাক হয়ে আমাকে ঘরের এপাশে-ওপাশে ঘুরতে দেখে ছেলে বললে, ‘আর ফাইট করতে পারবে না। মাতাঠাকুরানি আলাদা হয়ে গেছে।’
মেয়ে বললে, ‘ফিমেল খাটটা মেল খাটকে ডাইভোর্স করেছে।’
আজকাল ছেলেমেয়েরা কী সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে! ভালো ভালো। যত তাড়াতাড়ি বুঝতে টুঝতে শেখে ততই ভালো। আগে যাত্রা শুরু করলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। জামা খুলতে খুলতে জিগ্যেস করলুম, ‘কী ব্যাপার, তোমরা দুটিতে এখনও বসে?
মেয়ে বললে, ‘তোমাদের একটু হেল্প করার জন্যে বসে আছি।’
‘হেল্প মানে?’
‘এখন তো দিনকতক তোমাদের কথা বন্ধ থাকবে তাই আমরা দূতের কাজ করব।’
ছেলে বললে, ‘একবার দেখে নাও হাতের কাছে ঠিক আছে কি না। আমরা তো জানি না তোমার কী লাগে না লাগে।’
মেয়ে বলল, ‘যতটা জানি সব গুছিয়ে রেখেছি। মাকে তোমার এখন কিছু বলার আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। বলে দাও, বাবা কিছু খাবে না।’
ছেলে বললে। ‘জানতাম, তুমি আজ খাবে না।’
ফিশফিশ করে জিগ্যেস করলে, ‘বাইরে ভালো করে খেয়ে এসেছ তো? তুমি লড়ে যাও। আমরা তোমাদের পেছনে আছি।’
মেয়ে বললে, ‘মায়ের সকাল থেকে উপোস চলেছে। আমাদের মাছের ভাগ বেড়ে গেছে।’
ছেলে বললে, ‘তা হলে তুমি এক গেলাস জল খেয়ে এবার শুয়ে পড়া। বেশ শীত পড়েছে। ওষুধ-টষুধ কিছু খাবে? এ সময় আবার জ্বরে পড়ে হেরে যেয়ো না যেন। প্রত্যেকবার তুমিই হারো। এবার কিন্তু জিতবে হবে।’
‘না, ওষুধটষুধ লাগবে না। এ ঠান্ডায় জ্বর হবে না।’
‘তুমি সোয়েটারটা পরলে না কেন? একটু বোকা আছ। ছোটমামা তোমার কী নেবে? নিয়ে পার পাবে? আমরা আছিনা! মামার বাড়ি যাই আর আসার সময় ভালো প্যান্টটা, জামাটা, যা পাই বাগিয়ে আনি। তুমিও যেমন! এই তো ও মাসির দুখানা শাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।’
মেয়ে বললে, ‘আর তিনখানা আনতে পারলেই সমানে সমান হয়ে যাবে রে দাদা।’
‘ও মায়ের বুঝি পাঁচখানা নিয়ে গেছে? চল তা হলে আর একবার যাই!
মেয়ে এক গেলাস জল এনে চাপা দিয়ে রেখে গেল। মশারি-টশারি বেশ পরিপাটি করে খাটানো। ছেলে মাকে বলছে শুনলাম, ‘তোমার কিছু বলার আছে মা?’
‘আছে। খাবে না যখন আগে বলতে কী হয়েছে? পয়সা কি সস্তা?’
ছেলে ও ঘর থেকে হেঁকে বললে, ‘পয়সা কি সস্তা? মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়ার খরচ। পয়সা কি সস্তা?’ তারপর মাকে বলছে শুনলুম, ‘কী কী খেতে হবে বলো, আমরা দুজনে সাবাড় করে দিয়ে যাই। নষ্ট হওয়াটা ঠিক নয় মা। যা বাজার, কী বলো? ভাগ্যিস আমরা ছিলুম?’
আমাদের কথাই ওদের দিক থেকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। জীবনের অংশীদার বেড়ে গেছে। একা একা আর কিছু করা যাবে না। সব স্বাধীনতা চলে গেছে এমনকী মান-অভিমানের স্বাধীনতাও। যাক, যা হওয়ার তা হয়েছে। পা পিছলে গেলে পড়ে যেতে হয়। জীবন পিছলে গেলে সংসার স্রোতে এইভাবেই ভেসে যেতে পারে। সাঁতার জানলেও কোনও লাভ হয় না।
বিছানায় শুয়ে পড়েছি। ছেলেমেয়ে বাইরে থেকে সমস্বরে বলে উঠল, ‘গুড নাইট।’
‘গুড নাইট।’
মেয়ে বললে, ‘তোমার আবার একা শুতে ভয় করবে না তো?’
‘ভয়ের কী আছে? ভয় করবে কেন?’
ছেলে বললে, ‘যদি ভয় করে তা হলে তুমি যেন আবার মায়ের বিছানায় এসে ঢুকো না। আমাদের ঘরে চলে আসবে? কেমন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়েছে। অনেক উপদেশ ঝেড়েছিস, এবার শুয়ে পড়।’
অন্যদিন আলো জ্বেলে বেশি রাত পর্যন্ত পড়ার উপায় থাকে না। আর একজনের চোখে আলো লাগে। সারাদিন কী ভীষণ খাটুনি! ঘুমের ব্যাঘাত হয়। আমাদের সারাদিন তো কোনও পরিশ্রম হয় না। অফিসে আমরা আড্ডা মারতেই যাই। ফুর্তি করতে যাই। আজ আলো জ্বেলে ইচ্ছে করলে সারা রাত পড়া যায়। জীবন ছোট হয়ে আসছে। বরফের টুকরোর মতো ক্রমশই গলে যাচ্ছে। কত কী পড়ার আছে, জানার আছে। কত দেশ আছে। কত রকমের জীবন আছে। পিঁপড়ের পিঠে খাওয়ার মতো এক কোণে ধরে একটা ফুটোফাটা করে সরে পড়া। সেই এক
মহিলা, এক কণ্ঠস্বর, এক বাড়ি, এক ঘর, এক রাস্তা, এক অফিস। একই জগতে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে, থাকা আর না-থাকার তফাতটাই ভুলে গেছি।
হ্যাঁ, অনেক জ্ঞান লাভ হয়েছে। আজ শুয়েই পড়া যাক। বিছানা ছোট হয়ে গিয়ে ঘরটা বড় হয়ে গেছে। কতকটা নতুন জায়গা বেরিয়েছে। আলমারিটা যেন দূরে সরে গেছে। টেবিল আর চেয়ারটা যেন ছোট দেখাচ্ছে। যে দিকে খুশি ইচ্ছেমতো পা ছুড়ছি, কারওর গায়ে লাগছেনা। অন্ধকারে কোনও প্রতিবাদ ভেসে আসছে না। বিছানাটাও কেমন যেন বেশি শীতল মনে হচ্ছে। এতদিনের অভ্যাস, পাশে একটা প্রতিরোধ নিয়ে ঘুমোনো! (মেছুনিকে রাজবাড়ির শয্যায় শুতে দেওয়া হয়েছিল। কিছুতেই ঘুম আসে না। শেষে মাঝরাতে আঁশের ঝুড়িটাকে জল ছিটিয়ে মাথার পাশে রেখে তবেই ঘুমোতে পারল।)
ঘুম আর কিছুতেই আসতে চায় না। সারাদিন না খেয়ে আছে। এ দিকে আমি একপেট ভালোমন্দ খেয়ে শুয়ে আছি। না, আমি খোশামোদ করে খাওয়াতে পারব না। অসম্ভব। আমার বান্ধবী এখন কী করছে? নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। কার পাশে শুয়েছে? সেই শয়তান লোকটার পাশে? তিনি নাকি অন্য এক মহিলাতে আসক্ত। সে শয়তান, আমি শয়তান, স্ত্রী শয়তান; দেবতারা কোথায় গেল কে জানে? না, পরস্ত্রী-র কথা চিন্তা করা উচিত নয়। নির্জন, অন্ধকার ঘরে, একা শয্যায় অন্য নারীর চিন্তা আক্ষেপ বাড়িয়ে তোলে। জীবনকে আরও অসহনীয় করে তোলে। অনেক বয়েস হয়েছে। আমার এক বন্ধু বলেছিল, পুণ্য করার জন্যে সাহসের দরকার হয় না। পাপ করতে গেলে সাহস চাই। জেনুইন লম্পট হওয়া খুব শক্ত। সন্ন্যাসীকে যেমন সব ছাড়তে হয়, লম্পটকে তেমনি সব। ছাড়তে হয়। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়। আমার বউটাকে ঈশ্বর যদি একটু বুদ্ধি দিতেন। বেশ হত। সবসময় যেন কাঁকড়াবিছের মতো খরখর করে বেড়াচ্ছে।
একটু ঘুম বোধহয় এসেছিল। কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার পক্ষের রাত। বাইরে পাগল হাওয়া উঠেছে। মাঝরাতে পৃথিবীটা কেমন অচেনা হয়ে যায়। নিজের পরিচিত ঘরটাও তখন বিশালে হারিয়ে যেতে চায়। মহাকাশে ড্যাব ড্যাবা তারা। সমুদ্র থেকে মেঘ উঠছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। মাঝে-মধ্যে কুকুরের আর্তনাদ। পাশেরই কোনও বাড়িতে রোগের যন্ত্রণায় কেউ ওঁ ওঁ শব্দ করছে। নিঃশব্দে আকাশ গুটিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে। এত অন্ধকার, যেন জানলার বাইরে হাত বাড়ালে হাতে কালো রং লেগে যাবে।
ছেলেবেলা থেকেই আমার একটু ভূতের ভয় আছে। একা একা শুতে পারি না। একবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে তিন রাত ঠায় বিছানায় জেগে বসে কাটিয়েছি। এই যে ঘুম ভেঙে গেল আর আসবে না। এইবার একে একে তারা আসবে। হারু গলায় দড়ি দিয়েছিল। সেই হারু আসবে। এখুনি। নিত্যর মা পুড়ে মরেছিল। সেই কালো, পোড়া কাঠের মতো নিত্যর মা আসবে। বসন্ত খুন হয়েছিল। সে আসবে স্কন্ধকাটা হয়ে। সেই ছেলেটি জলে ভেসে উঠবে। গঙ্গায় যে ভাসছিল প্যান্ট-জামা পরে উপুড় হয়ে। সবাই আসবে একে একে। শেষে এমন অবস্থা হবে ইচ্ছে হলেও বাথরুমে যাওয়ার সাহস থাকবে না। এতখানি বয়েস হল তবু ভূতের ভয় আর গেল না। ইদানীং আবার চোরের ভয় ঢুকেছে। বাইরে সামান্য শব্দ হলেই মনে হচ্ছে কেউ পা টিপে টিপে হাঁটছে।
তবু বেশ কিছুক্ষণ মন শক্ত করে বিছানায় পড়ে রইলুম। চোখ বন্ধ। তবে বেশ জানি ঘরে আমি আর একা নই। অনেকে এসে গেছে। মন আর কোনও যুক্তি মানতে চাইছে না। রাত যে অচেনা! সত্য, মিথ্যা, লৌকিক, অলৌকিক সব ঢেকে দিয়েছে। বউয়ের সঙ্গে লড়াই আমি চালাতে পারব না। রাতে আমি বড় অসহায়। নরওয়ে হলে পারতুম, সেখানে ছ-মাস দিন, ছমাস রাত। দিনের ছ-মাস অন্তত ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি। সাবিত্রী সত্যবানকে আগলে রেখেছিল বলে যমেও। ছুঁতে পারেনি। স্ত্রী পাশে থাকলে ভূতে কী করবে গো। হাজার চেষ্টা করলেও আমার গলা দিয়ে এখন শব্দ বেরোল না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ও ঘরেও কি যেতে পারব? খাটের নীচে কী। আছে কে জানে। পা নামালেই যদি টেনে ধরে। ভয়! কীসের ভয় তা জানি না। ভূত আছে কি নেই স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে পারবে কি? যার কাছে আছে তার কাছে আছে।
এইবার মনে হচ্ছে খাটের তলায় কে যেন ধীরে ধীরে তালে তালে টোকা মারছে। দূরে একটা কুকুর মড়াকান্না কাঁদছে। আর নয়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ও সব বান্ধবী-টান্ধবী কেউ কিছু নয়। বউই সব। প্রকৃতির বেগে, ভূতের তাড়ায় মানুষ সব পারে। গ্রাম্য কথাতেই আছে হাগার নেই বাঘার ভয়। পাশের ঘরে কোনও মতে গিয়ে মশারির দড়িমড়ি ছিঁড়ে হুড়মাড় হুড়মাড় করে সেই রাগিণীদেবীর ঘাড়ে গিয়ে পড়লুম।
শীতের চেয়ে, ভূতের চেয়েও ঠান্ডা গলা ভেসে এল, ‘এলে তা হলে? পারলে না শেষ পর্যন্ত?’
‘না, পারলুম না!’
‘ঘেন্না করছে না?’
‘না, ও ছিল কথার কথা। অন্তরের কথা নয়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ মনে হল মাঝরাতে সিনেমার রামকৃষ্ণ কথা বলে উঠলেন।
‘এঘরে ভীষণ ঠান্ডা। উত্তরের ঘর ড্যাম্প, ওঘরে চলো। রাতের যেটুকু বাকি আছে সেইটুকু অন্তত ঘুমিয়ে নাও।’
এত স্নেহ কোথায় ছিল চকমকি? ঘষা না লাগলে বুঝি আগুন বেরোয় না!
সকালে একেবারে সোনার পাতের রোদ উঠেছে। কোথায় কী? ভূতটুত এখন সব ভাগলবা। গরম গরম চা চলছে। মন আর মেঘলা নেই। বর্ষার পরেই তো শরৎ আসে। বাঁ পাশে বসে আসে। ছেলে। সে খুব দুঃখের গলায় বলল, ‘এ বারেও হেরে গেলে?’
ডানপাশে বসে মেয়ে। সে খুব ভারিক্কি চালে, লেডি ডাক্তারের গলায় বললে, ‘এবারেও ভূতের ভয়?’
ছেলে বললে, ‘তা ছাড়া আবার কী?’
মেয়ে বললে, ‘তোমাকে পাঁচু ঠাকুরের কাছ থেকে একটা মাদুলি এনে পরিয়ে দিতে হবে।’
ছেলে জিগ্যেস করলে, ‘তোমরা এবারে ক’দিন ঠান্ডা থাকবে?
এর উত্তর আপাতত আমার জানা নেই। তোমাদের যখন বিয়ে হবে তোমরাও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। তবে জীবনের সার কথা মনে হল এতদিনে বুঝতে পেরেছি। ভাগ্যের চুল্লি থেকে নিশিদিন জোড়ায় জোড়ায় পেয়ালা পিরিচ বেরিয়ে আসছে ডিজাইনে মিলিয়ে। একটি গেলে আর একটি খোঁড়া। যার সঙ্গে যা। যেমনটি মিলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ঠুংঠাং করতে করতে একদিন একটা ভাঙবেই। তখন অন্যটা পড়ে থাকবে সংসারের এক কোণে অবহেলায়। যতক্ষণ জোড়ে আছে দাপটে আছে। হাতে হাতে ঘুরছে। জীবনের নির্যাসে ভরা সেই পেয়ালা পিরিচ থেকে জীবনের সুগন্ধ বেরোচ্ছে। কখনও অসাবধানে ছলকে পড়ে গেলেও পিরিচেই জমা। থাকছে। একদিন একটা ভাঙবেই। তবে কোনদিন কোনটা—আমিই জানি না তা তোমাদের বলব কী?
প্রেম আর ভূত
অনেক শুকনো পাতা পড়ে আছে পার্কের বেঞ্চে। বছরের এই সময়টায় গাছ পাতা ঝরায়, নতুন সাজে সাজবে বলে। জলের ধারে ধারে কচি কচি ঘাস গজিয়েছে। লেকের জলেও কিছু শুকনো পাতা আনমনে ভাসছে। দিব্যেন্দু বেঞ্চে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার ওপরেই বসে পড়ল। দুপুরের রোদ হলুদ নেশার মতো ঝিমঝিম করছে চারপাশে। লেক এখন ফাঁকা। বাতাসে শীত শেষের গরম হলকা। আজ তো আর ছুটির দিন নয়। কারা আর আসবে এখন এই লেকে বেড়াতে! দূরে একটা গাছের তলায় একটা ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে গায়ে গা লাগিয়ে। নতুন প্রেম। দেখলেই বোঝা যায়। যা কথা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। হাতে হাত রেখে। দুজনে বসে আছে। বড় ক্লান্ত, বড় শ্রান্ত।
দিব্যেন্দু চোখ সরিয়ে নিল। ভাবতে লাগল, একটা বছর কোথা দিয়ে কীভাবে চলে গেল! এই। সেই বেঞ্চ। দিব্যেন্দুচিড় ধরা কাঠের দিকে তাকাল। কত দিন, কত কত দিন, সে আর স্মিতা এই আসনে পাশাপাশি বসে গেছে! আজ সে একা আর কিছু ঝরা পাতা। দিব্যেন্দু আজ এসেছে, পুরোনো দিনের স্মৃতিতে ফিরে যেতে। মাঝে মাঝেই আসে, হিসেব করে, যখন তেমন কেউ থাকে না। কেউ বুঝতেও পারে না কেন সে এসেছে! মানুষকে মানুষ দ্যাখে, তার মন তো কেউ পড়তে পারে না। একটা লোক বসে আছে, এই মাত্র। হয় বেকার! না হয় কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, সময়টা কাটিয়ে যাচ্ছে।
গতকালই দিব্যেন্দু উত্তরবঙ্গ থেকে এসেছে কলকাতায় কয়েক দিনের ছুটি কাটাতে। সেখানে দিব্যেন্দু একটা ব্যাঙ্কে কাজ করে। এই চাকরিটা সে যদি আর কিছু দিন আগে পেত; তাহলে তার জীবনটা অন্যরকম হয়ে যেত! সে ভীরু, না স্মিতা ভীরু! বহুবার চেষ্টা করেছে এই প্রশ্নের উত্তর। পেতে। খুঁজে পায়নি সমাধান। মেয়েরা প্রেম চায়, না নিরাপত্তা! একটা ভালো চাকরি, একটা ফ্ল্যাট, নিটোল একটা সংসার!
‘ঝাল-মুড়ি আর চিনেবাদাম খেয়ে তো আর সারাজীবন কাটানো যায় না!
এই বাঁ-পাশটিতে বসে ঠিক এই কথাই বলেছিল স্মিতা। সেই ছিল ওদের শেষ বসা। ‘তুমি এই কথা বলছ কেন স্মিতা? চাকরি আমি একটা পাবই।
‘তিন বছরেও পেলে না। তোমার সে ক্যালিবার নেই। মুখচোরা, লাজুকরা এ বাজারে চাকরি পায় না।’
‘তুমি আর ছ’টা মাস আমার জন্যে অপেক্ষা করো।’
‘আমি রাজি হলেও আমার বাড়ি রাজি হবে না।’
‘তুমি রাজি করাবে।’
‘আমি তিন বছর ঠেকিয়ে রেখেছি। আর কত রাখব! আর কতকাল খোলা আকাশের নীচে হাত ধরে বসে থাকব!’
‘আমরা দুজনেই যদি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে একটা কিছু করি!’
দিব্যেন্দু, বিয়ে করতে সময় লাগে মাত্র পনেরো মিনিট; তারপর? কোথায় গিয়ে উঠবে! হাওড়া স্টেশানের ওয়েটিং রুমে! খাবে কী! খাওয়াবে কী!’
‘কোথাও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করব।’
‘ছশো টাকার কমে ভদ্রলোকের থাকার মতো আস্তানা হয় না। কোথায় পাবে অত টাকা!’ দিব্যেন্দু আপনমনে হেসে উঠল। সে যেন চোখের সামনে দেখতে পেল স্মিতা তার পাশ থেকে উঠে চলে যাচ্ছে। নীল শিফন শাড়ি-মোড়া অনিন্দ্য একটা শরীর। রেশমি চুলের আলগা খোঁপা নিটোল। ঘাড়ের কাছে অল্প অল্প দুলছে। তীক্ষ্ণ নাক। টানা টানা চোখ, ধনুকের মতো ভুরু। শালুকের ডাঁটির মতো লতানে দুটি বাহু। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়েছে চুলে। আগুনের সুতোর মতো ঝিলমিল করছে। দিব্যেন্দুস্মিতাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেনি। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল স্মিতার দূর থেকে দূরে চলে যাওয়া। তার হৃদয় থেকে একটা নরম পাখি যেন উড়ে চলে গেল। স্মিতার বাবা ডাক্তার। স্মিতার ঠাকুরদা ছিলেন হাইকোর্টের জজ সাহেব। বিলেতটিলেত ঘুরে বেড়াতেন। সাহেবি কেতার মানুষ ছিলেন। এই ধরনের নীল রক্ত যার শরীরে তার মনে বাঁধন ছেঁড়া বেদুইন-প্রেম থাকে কী করে, কী করে! দিব্যেন্দু হাত বাড়িয়ে ছিল কার দিকে! আজ দিব্যেন্দু যেভাবে বসে আছে একা, সেদিনও এইভাবেই বসেছিল স্থির সমাধি ফলকের মতো। শেষ শীতের বাতাসে ঠান্ডার কামড়। সন্ধে হয়ে গেল। ঝাপসা একটা চাঁদ ঠেলে উঠল পুব আকাশে। কুয়াশার অশরীরী আঁচল নেমে এল লেকের জলে।
স্কুল শিক্ষকের ছেলে দিব্যেন্দু স্কটিশচার্চের মেধাবী ছাত্র। ভেবেছিল, লেখাপড়ায় ভালো হলেই বুঝি ভালো একটা চাকরি হেঁটে এসে হাত ধরবে। পৃথিবীর সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের ঘষাঘষিতে দিব্যেন্দুবুঝে গেল দুটো জগৎ পাশাপাশি ঘুরছে, কল্পনার জগৎ আর বাস্তব জগৎ। বাস্তব জগতের চাঁদে কবিতা নেই। আছে অজস্র, অতল অন্ধকার গহুর। সূর্য আলোনা দেখালে চাঁদ পৃথিবীতে রাতের রুপালি আলো ঢালতে পারে না। সূর্য হল সোনার চাকতি। চাঁদির চাকতি ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ এক অচল পশু।
স্মিতা ছিল তার সহপাঠী। দিব্যেন্দুস্মিতাকে কবিতা লিখে শোনাত। কলেজ সোশ্যালে কাঁপা কাঁপা গলায় আবৃত্তি করত। অত শ্রোতার মধ্যে একমাত্র স্মিতাকেই সে শোনাত। পড়াশোনায় নড়বড়ে স্মিতাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লজিক আর ফিলোজফি পড়াত। আর মনে মনে ভাবত, স্মিতাকে বউ করবে। ছোট্ট নিখুঁত একটা সংসার। দোতলার বারান্দায় অর্কিড দোল খাবে। ছাদের টবে গোলাপ হাসবে। জানলা দিয়ে ধপধপে চাঁদের আলো এসে পড়বে সাদা বিছানায়। আকাশে চাঁদ, স্মিতার ছোট্ট কপালে রুপালি টিপ। ভিজে ভিজে গোলাপি ঠোঁট। শরীরে সমুদ্রের ঢেউ। দিব্যেন্দু একদিন স্মিতার কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল! সেইদিনই বুঝেছিল স্মিতা কত। সাবধানী। দিব্যেন্দুকে দু-হাতে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ছিঃ, অমন করতে নেই।’ দিব্যেন্দু সেদিন ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিল। মনে হয়েছিল, সে এক কাঙাল। পরে ভেবেছিল স্মিতা ঠিকই করেছে। প্রবল আকর্ষণে মানুষ বোধবুদ্ধি হারায়। তৃতীয় একটা প্রাণ এসে গেলে কে সামলাত!
স্মিতা চলে গেলেও পদচিহ্ন রেখে গেছে। মানুষের মন তো আর সমুদ্রের বেলাভূমি নয় যে ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যাবে। মন হল কাঁচা সিমেন্টের মেঝে। দাগটা ছাঁচের মতো থেকেই যায়। যতই পালিশ করো অস্পষ্ট ফুটেই থাকে। আলোর বিপরীতে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। দিব্যেন্দুর মন সেই দাগ ধরা মেঝে।
স্মিতার খবর সে আর রাখার চেষ্টা করেনি; তবু খবর তো উড়ে উড়ে আসবেই। খবর আর তুলোর ফুলে বিশেষ তফাত নেই। শিমুল যখন ফাটে বাতাসে পাখনা মেলে দেয় অজস্র বীজ। স্মিতা এক পাঞ্জাবি ধনকুবেরের ছেলেকে পাকড়েছে। কলকাতা, দিল্লি, বম্বে তিনটে শহরে তাদের বড় বড় তিনটে হোটেল। মানালিতে বিশাল আপেল-বাগান। তাদের পরিবারের প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি আছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা বাড়ি। এক উর্দু-কবি বলেছিলেন, ‘প্রেমিকা যদি সুখে থাকে প্রকৃত প্রেমিকের তো তাইতেই আনন্দ। বিবাহ প্রেমের কবর রচনা করে।’ দিব্যেন্দু অতটা ওপরে উঠতে পারেনি। কবি বলেছিলেন, ‘প্রেমিকাকে বউ হিসেবে কাছে পাওয়ার চেয়ে তার স্মৃতি নিয়ে সারা জীবন অবিবাহিত থাকাই স্বর্গীয়।’ দিব্যেন্দু ভেবেছিল বিমলের মতো আত্মহত্যা করবে। বিমল তারই কলেজে সিনিয়ার ছিল। নামকরা ছাত্র, আবার ডিবেট চ্যাম্পিয়ান। বিমল ভালোবাসত মাধুরীকে। মাধুরী ভালোবাসত পার্থকে। মাধুরীর প্রেমের পাল্লা হঠাৎ পার্থর দিকে বেশি ঝুঁকে গেল। একদিন খুব ভোরে দেখা গেল, হেদুয়ার রেলিং-এ মাথা রেখে বিমল অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সে ঘুম আর ভাঙল না। পকেট থেকে বেরুল সামান্য এক চিরকুট। একটি মাত্র লাইন—’আমি হেরে গেছি।’ ডক্টর চ্যাটার্জির সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র ছিল বিমল। তিনি খবর পেয়ে বলেছিলেন—’প্রেম এক ধরনের পাগলামি। মরে বেঁচেছে।’ এই শেষ উক্তিটিই দিব্যেন্দুকে বেঁচে থাকার শক্তি জুগিয়েছে। দিব্যেন্দু তখন উর্দু কবির নির্দেশে স্মৃতি নিয়ে অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্ত আত্মস্থ করে ফেলেছে। উত্তরবঙ্গের ছবির মতো শহরে, ছবির মতো এক কাঠের বাড়িতে দিব্যেন্দুর বসবাস। মাইনেও পাচ্ছে ভালো। সম্মানের চাকরি। তবু চিউইং গামের মতো স্মিতা আটকে আছে স্মৃতির চুলে। রাতে বড় একা লাগে। উত্তরবঙ্গে গিয়ে দিব্যেন্দু আবিষ্কার করেছে তার ভূতের ভয় আছে। রাতে কোথাও একটু খুট করে আওয়াজ হলে, তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তারস্বরে রামনাম জপতে থাকে! এমনকী ছেলেবেলার ছড়াটাও ‘ভূত আমার পুত, শাকচুন্নি আমার ঝি, বুকে আছে রাম-লক্ষ্মণ ভয়টা আমার কী?’ এই ভূতের জন্যেই তাকে না বিয়ে করতে হয়!
দিব্যেন্দু ঘড়ি দেখল। নার্সিংহোমে বিকেলের ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হয়ে গেছে। দিব্যেন্দু উঠে পড়ল। গাছের তলায় তলায় ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল পথের দিকে। বেশ লোক চলাচল করছে। শহরের পথে বিকালের টান ধরেছে। দিব্যেন্দু হাঁটতে হাঁটতে চলে এল নার্সিংহোমের সামনে। সম্প্রতি চশমা নিয়েছে। মুখটা বেশ ভারী দেখাচ্ছে। উত্তরবঙ্গের পরিষ্কার জলবাতাসে স্বাস্থ্যটাও বেশ ফিরে গেছে। স্মিতার স্মৃতি মনকে কাবু করলেও শরীরকে কাবু করতে পারেনি। শরীর শরীরের কাজ ঠিকই করে চলেছে। নার্সিংহোমের বাগান মতো জায়গাটা পেরিয়ে দিব্যেন্দু দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে থমকে দাঁড়াল। তেমন গলগলে ভিড় নেই। বেশ নির্জন নির্জন একটা ভাব। এই হোমে সাধারণত বড় বড় অফিসের কর্মীরা কোম্পানির টাকায় চিকিৎসা করাতে আসেন।
দিব্যেন্দুতিনতলায় উঠে ঘরের নম্বর মিলিয়ে এগিয়ে গেল। চওড়া বারান্দা। ডানপাশে সব ঘর। পেতলের অক্ষরে নম্বর মারা। বারান্দায় শেষবেলার আলো প্রবীণ মানুষের মতো পায়চারি করছে। হাহা, খোলা আকাশে গাছের পাতার ঝালর বাতাসে দোল খাচ্ছে। দিব্যেন্দু আপনমনে চওড়া প্রশস্ত বারান্দায় এ-পাশ থেকে ও-পাশ একবার ঘুরে এল। তারপর এগিয়ে গেল মোলো নম্বর ঘরের দিকে। ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল। ওপাশেই বড় জানলা। দুপাশে সরানো নেটের পর্দা। সেই আলোয় পাতা একটি খাট। ট্র্যাকশানে সটান শুয়ে আছে একটি মেয়ে। তার মাথার লম্বা চুল খাটের মাথার দিকে ঝুলছে। দিব্যেন্দু ভেবেছিল ঘরে কেউ না কেউ থাকবে। কেউই নেই। নেটের পর্দা মৃদু বাতাসে দুলছে। বসন্ত এসেছে শহরে।
দিব্যেন্দু সামান্য ইতস্তত করে ডাকল, ‘মৃণাল।’ মেয়েটি দরজার দিকে ঘাড় ফেরাল। তার দুটো পা-ই সামান্য উঁচুতে ভারী ওজন ঝুলিয়ে টান করে রাখা।
দিব্যেন্দু ঘরে ঢুকতেই স্প্রিং লাগানো দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। দিব্যেন্দু ঘরের মাঝখানে। বিব্রত ভাবটা কাটাবার জন্যে আবার বললে, ‘মৃণাল, আমি দিব্যেন্দু।’ বহু দূর থেকে যেন। মৃণালের গলা ভেসে এল, ‘আসুন। আপনি কী করে এলেন? চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসুন।’ দিব্যেন্দু চেয়ারটা টেনে এনে বসতে বসতে বললে, ‘আমি তিন দিন হল এসেছি! মাসিমার কাছে শুনলুম তোমাকে গাড়ি ধাক্কা মেরেছে। তাই দেখতে এলুম। কেমন আছ তুমি?’
মৃণাল দিব্যেন্দুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, ‘সারা জীবনের মতোই বোধহয় পঙ্গু হয়ে গেলুম। হাঁটবার আশা আর নেই। তবু চেষ্টা করে দেখা! আপনি আসবেন আমি ভাবতেই পারিনি।’
মৃণাল একবার বাঁ-হাত, একবার ডান হাত দিয়ে মাথার পাতলা বালিশের তলায় কী একটা খুঁজতে লাগল। দিব্যেন্দু বললে, ‘কী খুঁজছ?’ উঠে গেল বিছানার কাছে। মৃণালের দু-চোখের পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে। সে ফিশফিশ করে বললে, ‘রুমালটা যে কোথায় গেল!’ বালিশের তলা থেকে পাতলা একটা রুমাল বের করে দিব্যেন্দু সাবধানে মৃণালের চোখ মুছতে গেল। যত মোছে ততই জল বেরোয়! মৃণালের চোখদুটো ভারি সুন্দর। দীর্ঘ আঁখি-পল্লব! মূণালকে দিব্যেন্দু যখন পড়াত, তখন তার এই চোখ দুটো তাকে ভীষণ আকর্ষণ করত। সমুদ্রের মতো নীল আর গভীর। দীঘির মতো প্রশান্ত। দিব্যেন্দু বললে, ‘তুমি কাঁদছ কেন মৃণাল?’
‘আমি কাঁদিনি তো।। আমার চোখে ঠান্ডা লেগেছে।’
দিব্যেন্দু রুমালটা মৃণালের হাতে দিয়ে চেয়ারে এসে বসল। মৃণাল কেন কাঁদছে তার মাথায় এল না। দুঃখ না আনন্দে! দিব্যেন্দু জানে মৃণাল তাকে ভালোবাসত। পড়াতে পড়াতে সে বুঝতে। পারত, সম্পর্কটা শিক্ষক আর ছাত্রীর মতো থাকতে চাইছে না, অন্যদিকে বাঁক নিচ্ছে। দিব্যেন্দু সেই সময় স্মিতা ছাড়া আর কারওর কথাই ভাবতে রাজি নয়। মৃণাল কিন্তু স্মিতার চেয়েও দেখতে সুন্দরী। মুখটা ঠিক মা দুর্গার মতো। একটাই তফাত—দুজনের ব্যক্তিতৃ দুরকমের। মৃণাল শীতল, স্মিতা উত্তপ্ত। মৃণাল গিরি। স্মিতা আগ্নেয়গিরি। মৃণাল গভীর, স্মিতা চটুল।
দিব্যেন্দু চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মৃণালের ছোট্ট কপালে হাত রাখল। কপালের কিনারায় মসৃণ চুলের সীমানা। মেয়েটাকে কেউ একটা টিপও পরিয়ে দেয়নি! কে দেবে! মৃণালের মা। আরথ্রাইটিসে প্রায় পঙ্গু। আত্মীয়স্বজনও বিশেষ কেউ নেই। দিব্যেন্দুর দিকে মৃণাল তাকিয়ে আছে এক নজরে। দু-চোখে টলটলে জল।
দিব্যেন্দু জিগ্যেস করলে, ‘তোমার টিপ কোথায় গেল মৃণাল? টিপ পরলে তোমাকে ভারি সুন্দর দেখায়।’
মৃণাল বললে, ‘টিপ? টিপ হারিয়ে গেছে দিবুদা।’
মৃণাল দুহাত দিয়ে দিব্যেন্দুর হাতটা চেপে ধরল।
দিব্যেন্দু বললে, ‘তুমি ভেঙে পড়ছ কেন? আমি তো আছি!’
দিব্যেন্দুর হাতে মৃণালের হাতের চাপ বাড়ল।
দিব্যেন্দু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ঘরের দরজা খুলে এক ঝলক দমকা বাতাসের মতো ঘরে এল একটি যুবক। সুন্দর চেহারা। দেখলেই মনে হয় খেলাধুলো করে। ছেলেটি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হয় ছুটতে ছুটতে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে বললে, ‘মৃণাল, আসতে। আঠারো মিনিট দেরি হয়ে গেল। বিলিভ মি, এই জ্যামের জন্যে কলকাতা ছাড়তে হবে। জানো তো, ফুটপাথে স্কুটার উঠিয়েছিলুম বলে পুলিশ আমার কান মলে দিয়েছে। তোমার জন্যে আমি ব্যাটাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
ছেলেটি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নেবার জন্যে থামতেই দিব্যেন্দুর দিকে চোখ পড়ল। এতক্ষণ সে মৃণাল ছাড়া আর কারোকে দেখেনি। পাগলের মতো সাত মাইল স্কুটার চালিয়ে। এসেছে। পড়ি কি মরি করে। দিব্যেন্দুকে দেখে সামান্য থতমত খেয়ে গেল ছেলেটি। আরও কিছু বলতে গিয়েও বলা হল না।
মৃণাল বিছানার পাশে একটা হাত ঝুলিয়ে দিয়ে বললে, ‘ভিক্টর! দিব্যেন্দুদা আমার মাস্টারমশাই ছিলেন।’ ভিক্টর হাতজোড় করে নমস্কার করলেও, দিব্যেন্দুর মাস্টারমশাই পরিচয়টা তেমন। ভালো লাগল না। মনে মনে সে নিজেকে যতখানি তুলেছিল ঠিক তেমনিই নেমে এল নীচে। মাস্টারমশাই বলে মৃণাল তার প্রেমিক আমির পেটে ভোজালি মেরে দিয়েছে। মৃণালের শীতল কপালে হাত রেখে, তার পদ্ম-ভাসা, জল টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে দিব্যেন্দু তার জীবনের চরম কথাটি বলতে যাচ্ছিল—’মৃণাল, তুমি পঙ্গু হয়ে গেলেও আমি তোমাকে বিয়ে করব। আর। প্রেম নয়, এবার সেবা। সারাজীবন তোমাকে সেবা করার অধিকার আমাকে দাও মৃণাল।’ ভেবেছিল খুব আবেগ দিয়ে, নাটক যে ভাবে করে, সেইভাবে বলবে। তার আবেগের বেলুন ফুটো করে দিয়েছে মৃণাল। মাস্টারমশাই! মাস্টারমশাই তো ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমালাপের অধিকারী হতে। পারে না। সে তো খুব নিন্দনীয় ব্যাপার। মৃণাল ততক্ষণে ভিক্টরের পরিচয় দিতে শুরু করেছে। সে পরিচয় দিব্যেন্দুর কানে গেল কি গেল না। ভিক্টর আচারিয়া মৃণালের সহকর্মী। দুজনেই কম্পিউটার বিজ্ঞানী। দুজনেরই ভীষণ ভালো মাইনে। ভিক্টর প্রাণোচ্ছল, মৃণালের বন্ধু। সবচেয়ে বড় কথা, ভিক্টর মাস্টারমশাই নয়।
দিব্যেন্দু আর একটু হলেই মৃণালের কপালে ঠোঁট নামিয়ে ছোট্ট একটি চুমু খাবার আবেগ প্রকাশ করতে চলেছিল। সেই অবস্থায় ভিক্টর দেখে ফেললে লজ্জার একশেষ হত। সেই অপমান থেকে বেঁচে গেছে, সেইটাই তার পরম সৌভাগ্য। মৃণাল যখন তাকে শিক্ষক থেকে প্রেমিক করতে চেয়েছিল, তখন দিব্যেন্দু পাত্তা দেয়নি। প্রেম কি কারওর জন্যে অপেক্ষা করে থাকে! প্রেম আর ট্রেন প্রায় এক জিনিস। আসামাত্রই উঠে পড়তে হয়। ট্রেন যেমন কোনও স্টেশানে এক মিনিট কোথাও দু-মিনিট থামে। থেমেই চলে যায়। ট্রেনের গুমটি যেমন ইয়ার্ড, প্রেমের গুমটি হল। বিবাহ। দিব্যেন্দুর আর এক মিনিটও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না। এই প্রথম সে অনুভব করল ঈর্ষা। ভিক্টর এখানে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রেম আর চাকরি প্রায় একই ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। দিব্যেন্দু যেখানেই ইন্টারভিউ দিতে গেছে, সেখানেই দেখেছে বিশ-বাইশজন, পরস্পর পরস্পরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। কে? কে? তুমি? তুমি?
দিব্যেন্দু নীরস গলায় বললে, ‘মৃণাল, আমি তাহলে আজকে যাই।’
মৃণাল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললে, ‘আসুন। সময় পেলে আবার আসবেন।’
দিব্যেন্দু নেমে এল পথে। খুব ইচ্ছে করছিল তার, তখনই একটা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। গোলমালটা কোথায়? চেহারায়? বোকা বোকা মুখ! মরামরা চোখ! না কি, মেয়েদের সে খেলাতে জানে না! মেয়ে আর মাছ কি এক জিনিস? প্রেমের চারে, কথার টোপে গাঁথতে হবে, তারপর। হুইল থেকে লোভের সুতো ছেড়ে ছেড়ে, জীবনের জলে খেলিয়ে খেলিয়ে তুলতে হবে। দিব্যেন্দু একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসল। কিছুদূর যাবার পর খেয়াল হল হাতের মুঠোয় কী একটা ধরা রয়েছে। মৃণালের রুমাল। ভুলে হাতের মুঠোয় রুমালটা নিয়ে চলে এসেছে। নরম, ফুলফুল, ছোট্ট একটা রুমাল।
পরের দিনই দিব্যেন্দু ফিরে গেল উত্তরবঙ্গে। বসন্ত ফেটে পড়েছে শহরতলির বনস্থলীতে। দূর আকাশের পাহাড়ে অভ্ররেখা। সারাদিন কাজে কর্মে বেশ তবু কেটে যায়। রাতে, আটটার মধ্যে শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। তখন! তখনই দিব্যেন্দু তার নিরালা ঘরে বসে ভাবতে থাকে। দুটো প্রশ্ন —প্রেম আছে? না প্রেম নেই? পরক্ষণেই হু-হু পাহাড়ি বাতাসে দুলে ওঠে জানলার পরদা, সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে দ্বিতীয় প্রশ্ন—ভূত আছে? না নেই? কেউ বলে আছে, কেউ বলে নেই। মৃণালের ছোট্ট লেডিজ রুমাল দিয়ে চশমার কাচ মুছে, দিব্যেন্দু কারওকে একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করে। কাকে লিখবে?
ফল্গু
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় আড় হয়ে কী একটা বই নাড়াচাড়া করছি। আজকাল এইরকমই হয়েছে। কী খাচ্ছি, কী পড়ছি, কিছুই আর তেমন খেয়াল থাকে না। খেয়াল করিও না। কিছুটা অভ্যাস, কিছুটা সংস্কার এইভাবেই জীবন চলছে। অভ্যাসে বাজার যাই। অফিসে ছুটি। সংস্কারে বই টেনে নিই। পাতা ওলটাই। বয়েস বেড়ে গেছে। চোখের তেজ কমেছে। তেমন দেখতে পাচ্ছি না। উঠে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসব, সে শক্তিও যেন নেই। রোজই ওইরকম হয়। দু-চার পাতা নাড়াচাড়া করতে না করতেই শরীর খ্যাস করে নেতিয়ে পড়ে। রোজই এই সময়টায় আমার এক সমস্যা হয়—কে মশারি খাটাবে! আমি না আমার বউ? এদিকে সাংঘাতিক মশার উপদ্রব। মশারি ছাড়া এক মুহূর্ত শোবার উপায় নেই। আর রোজ রাতেই এই মশারি-পলিটিক্স হয়। বউ বলবে—’চারটে কোণ খাঁটিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো। আমার সৃষ্টি-কাজ পড়ে আছে, আমার অপেক্ষায় থেকো না। গতরটা একটু নাড়াতে শেখো। এই গতর শব্দটা শুনলেই আমার মাথায় খুন চেপে যায়। মেয়েদের জগতের বিশ্রী একটা শব্দ। অশ্লীল তো বটেই। আজ আমি অপেক্ষায় আছি। কাল, পরশু, তার আগের দিন পর পর তিনদিন আমি মশারি খাঁটিয়েছি। আজ আর আমি নেই। মরে গেলেও নেই। বইটার পাতা ওলটাচ্ছি আর মনে মনে বলছি—এ লড়াই জিততে হবে। আজ আর আমি নেই। আর ঠিক সেই সময় রান্নাঘর থেকে চিৎকার ‘এলিয়ে না থেকে মশারিটা ফেলে চারপাশ ভালো করে গোঁজো। জীবনে একটা কাজ অন্তত ভালো করে করতে শেখো।’
‘পর পর তিনদিন আমি মশারি ফেলেছি, আজ আমি মরে গেলেও ফেলব না।’
‘তাহলে মরো, মশার কামড় খেয়েই মরো। যখন ম্যালেরিয়া হবে তখন বুঝবে ঠেলা।’
‘হলে তোমার আমার একসঙ্গেই হবে, এক যাত্রার তো আর পৃথক ফল হয় না।’
‘ওই আনন্দেই থাকো, মেয়েদের ম্যালেরিয়া হয় না। হলে অম্বল হয় বাত হয়, পিত্তপাথুরী হয়। স্বামীদের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়।’
‘আচ্ছা।’ আমি সুর টানলুম।‘
হাওয়া বইছে এলোমেলো। রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটার সময় আমি আর ফাটা কাঁসি নিয়ে তরজা শুরু করতে চাই না। এ পাড়ায় আমার একটা সম্মান আছে। অনেকেই প্রণাম-ট্রণাম করে। বাড়ির লোক ঝাঁটা মারলে কী হবে বাইরে আমার অল্প-বিস্তর খাতির। একসময় ভালো ফুটবল খেলতুম, ফরোয়ার্ড লাইনে। সেকালে ফুটবলের তেমন কদর ছিল না, একালের ছেলেরা তো। বল-পাগল। সেই কারণেই অতীতের গোলন্দাজ হিসেবে একালে আমার খাতির। আমার পায়ে বল মানেই গোল। এই তো গত দুর্গাপূজায় পাড়ার ক্লাব আমাকে সংবর্ধনা জানালে। একটা টিনের ট্রে, তার ওপর ছোট সাইজের একটা নারকেল, ছোট বাক্সে চারটে সন্দেশ। সে যাই হোক, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনও মূল্য হয় না। গলায় একটা রজনীগন্ধার শুকনো শুকনো মালা পরিয়ে দিল টুলটুলে একটা মেয়ে। মালাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলুম। একেই বলে মহানুভবতা। লোককে দেখানো, আমি কতটা নির্লোভ, নিরহঙ্কারী। সবার আগে একটু বড় একটা মেয়ে প্রদীপ দিয়ে আমাকে বরণ করেছিল। মেয়েটি মনে হয় আমার ব্যক্তিত্বে ভয় পেয়ে। গিয়েছিল, তা না হলে আমার গোঁফে ছ্যাঁকা দিয়ে দেবে কেন? আমার এক গোছা ঝোলা ঝোলা গোঁফ পড়পড় করে পুড়ে গেল। সে যাক, দোষটা আমারই। একালে কেউ অত বড় গোঁফ রাখে। না। সেই যে আমি গোঁফ কামালুম, এখন আমার ঠোঁট সাফ। বয়সটাও যেন অনেক কমে গেছে। আগে অচেনা লোকমাত্রই কিছু জিগ্যেস করার হলে কথা শুরু করত হিন্দিতে। এখন বাংলাতেই করে। সভার সভাপতি মহাশয় গলায় একটা পাট করা মাদ্রাজি চাদর পরিয়ে দিলেন। আমাকে। আবার দু-চার কথা বলতে হল। আমি বলেছিলুম—ফুটবলই আমাদের জীবন। দুটো পা যেন স্বামী-স্ত্রী জুটি; আর বল হল গোল, মানে বিশ্ব। এই বিশ্ব হল স্বামী-স্ত্রীর খেলা। ঠিক বোঝাবুঝি, মেলামেশা হল তো, খেলা হয়ে গেল কবিতা। দুটো পায়ের আন্ডারস্ট্যান্ডিংই হল খেলোয়াড়ের সাফল্যের মূল কথা। উঃ, সে কী হাততালি! তিন মিনিটে হিরো! অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে শ’খানেক তরুণ তেড়ে এল। যার খাতা নেই সে এগিয়ে ধরল ঠোঙা। মনে হয় বাদামটাদাম খাচ্ছিল। সই করতে করতে আমার জান কয়লা। ফড়াক ফড়াক ছবি তুললেন ফটোগ্রাফার। এক নেতা এসে বললেন—নেক্সট ইলেকশানে আমরা আপনাকে পার্টির টিকিট দেব। যদি জিততে পারেন, যদি আমরা মিনিস্ট্রি ফর্ম করতে পারি, জেনে রাখুন আপনি হবেন ক্রীড়া-মন্ত্রী। আমি। সেই গ্যাস খেয়ে বাড়িতে এসে একটা উলটো-পালটা করে ফেললুম। মন্ত্রীদের মতো মেজাজ। দেখাতে গিয়েছিলুম। সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়। আমার একমাত্র স্ত্রীর সঙ্গে একমাস বাক্যালাপ বন্ধ ছিল। টিনের ট্রে-টা দেখে বলেছিল, আজকাল এক প্যাকেট বড় সার্ফ কিনলে ওইরকম ট্রে ফ্রি পাওয়া যায়। চাদরটা দেখে বলেছিল, ব্যান্ডেজ হিসেবে ভালোই। নারকেলটা হাতে নিয়ে বলেছিল, একটা মোচা নিয়ে এলে ছোলা দিয়ে ঘন্ট করা যাবে। সংবর্ধনার নারকেলে কি ঘণ্ট করা উচিত? এই সংশয় আমার ছিল। এ তো ভাবের নারকেল। ভালোবাসার উপহার। ভালোবাসার ঘণ্ট হবে! মোচার দাম কম নয়। এর পর সংবর্ধনায় যাঁরা নারকেল দেবেন, তাঁরা যদি একটা করে মোচাও দেন তো বেশ হয়। আমার বউ আবার হিসেব করে ছেলেকে বুঝিয়ে দিলে বুড়ো বয়সে তার বাপের কীরকম ভীমরতি ধরেছে। একশো এক টাকা চাঁদা কানমলে নিয়ে গিয়ে কুড়ি টাকার মাল ঠেকিয়েছে, পরের বছরের জন্যে গলায় পরিয়ে দিয়েছে ব্যান্ডেজ। গামছার সিম্বল। ওরে আমার বড় পেলোয়াররে! সারা রাত বাতের যন্ত্রণায় কোঁ-কোঁ করে। তিন পা হেঁটে সাতবার হাপরের। মতো হাঁপায়।
যাক, যারা আমার গৌরবোজ্জ্বল অতীত দেখতে পায় না, দেখলেও দেখতে চায় না, তাদের আমার কিছু বলার নেই। বাঙালি ইতিহাসবিমুখ জাতি, আমরা সবাই জানি। এরা ইতিহাস বলতে বোঝে আকবর বাদশার ইতিহাস। সিনেমার ‘ফ্লাশব্যাক’ দেখবে, একটা জ্যান্ত মানুষের ফ্লাশব্যাক শুনবেও না, বিশ্বাস করবে না। আমাদের যেন অতীত থাকতে নেই। আমরা সব বর্তমানের সরীসৃপ। আবার বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলুম। এবার মলাটে চোখ পড়ল। র্যাক থেকে ভালো বই টেনেছি—গীতা মাহাত্ম। এই বয়েসে যে বইয়ের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, সংসার সবের ছিরি তো দেখছি। কতদিন ভাবি সন্ন্যাসী হয়ে কেটে পড়ব, পারি। অন্য কিছুর জন্যে নয়, শুধু মাত্র বাথরুমের ভয়ে। গৃহত্যাগের সময় নিজের বাথরুমটাকে তো আর নিয়ে যেতে পারব না। যত্রতত্র আমার পোষায় না। ঘেন্না করে।
দরজার কাছ থেকে আমার রাখওয়ালের একটু চড়া গলা শোনা গেল—’কী হল, মশারির চারটে কোণ আর দয়া করে খাটাতে পারছনা, গতরটা একটু নাড়াও! না পরের গতরে যতটা হয়ে যায়!’
আবার সেই অশ্লীল শব্দটা। উঠে বসলুম। গতর বললেই, লুঙ্গি পরা, বিশাল ভূঁড়ি আর পাছাওলা একটা নির্বোধ ভোগীর চেহারা ভেসে ওঠে। বিছানায় শুয়ে যারা মিঠি মিঠি গলায় গুন গুন করে ডাকে, ‘কই গো, কই গো, তোমার হল।’ বউ তেলানো পাটি। আমি সব অর্থে তার বিপরীত। জীবনে বউকে হ্যাঁ গা, কই গা, শুনছ বলিনি। সেন্টার ফরোয়ার্ডের স্ট্রেটকাট কথা। পায়ে বল নাও, ছ’বার ড্রিবল করে ঢুকিয়ে দাও নেটে। আর তাকাতাকি নেই, ফিরে এসো মাঝ-মাঠে। আমার গুরু আমাকে জপের মন্ত্র দিয়েছিলেন, ‘অ্যাটাক, অ্যাটাক’। আমি ঝাঁঝেই বললুম:
দ্যাখো গতর গতর বলবে না। গতর হয় মেয়েদের। আমার মতো খেলোয়াড়দের হয় ফিগার। আমার একেবারে কঞ্চির মতো শরীর। মশারি আজ আমি খাটাব না, খাটাব না, খাটাব না। দিস ইজ নট মাই জব।’
‘খাটিয়ো না, খাটিয়ো না।’
গলা তো নয় গোলা। একেবারে সংলগ্ন বাড়ির প্রতিবেশী মশারি ফেলা অন্ধকার ঘর থেকে দাবড়ে উঠলেন, ‘আয় চোপ।’ ভদ্রলোক সূর্য ডোবার পর থেকেই চড়াতে থাকেন। এখন তিনি পুরো চড়ে আছেন। আমি কিছু মনে করলুম না। জানি সকালেই তিনি বিনীত গলায় বলবেন—’কী দাদা, বাজারে চললেন?’ আমরা জানি, মাতালে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।
আমার ছেলে। ওই একটি মাত্রই ছেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললে—’আশ্চর্য, দিন দিন। তোমাদের বয়েস বাড়ছে না কমছে?’ বলেই সরে পড়ল। সবে প্রেম করে বিয়ে করেছে। মৌতাতে আছে। নতুন বউমা বিয়ের পর দিনসাতেক মশারি খাঁটিয়ে পরিপাটি বিছানা করে শ্বশুর, শাশুড়ির সেবা করেছিল। তারপর শোনা গেল স্পন্ডিলোসিস হয়েছে। হাতের খিল জ্যাম হয়ে গেছে। ওপর দিকে আর উঠছে না। যা পারছে তলার দিক থেকে সব হাতড়ে নিচ্ছে। মানুষের কপাল মন্দ হলে যা হয়। কে কাকে সেবা করে! এখন বধূ আর পুত্রবধূ দুজনের সেবা করে প্রারব্ধ ক্ষয় করি। ছেলে তো বিয়ে করেই দায় সেরেছে। একালের ছেলেদের তো কোনও কর্তব্যবোধ নেই। প্রেম করার সময় খিদমত খাটত তা আমি জানি। তখন মাছ খেলছিল, এখন মাছ জালে। আর তো কোনও ভয় নেই। এখন খাও দাও আর বগল বাজাও। নিধিকেষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াও।
পাখার স্পিড বাড়িয়ে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। প্রথমত রেগে আছি, অভিমানে একেবারে টসটসে। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের হুল যে সহ্য করতে পারে, মশা তার কী করবে। সেই আছে না, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়! নিদ্ৰাতেই মানুষের সব দুঃখের অবসান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লুম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাত কত তা জানি না। ঘরে গুমোট গরম। পাখা বন্ধ। কানের কাছে ঝাঁক ঝাঁক মশার কালোয়াতি। রাস্তার আলো শোওয়ার আগে জ্বলছে দেখেই শুয়েছি। এখন চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মানে লোডশেডিং। মেঝেতে। আপাদমস্তক সাদা চাদর ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে। আমার পঁচিশ বছরের প্রাচীন অভিমানী বউ। যত বয়েস বাড়ছে, তত মেদ বাড়ছে। তত বাড়ছে রাগ আর অভিমান। এইটুকু বুঝলুম ইলেকট্রিক সাপ্লাই চলে বউদের নির্দেশে। তানা হলে ঠিক এইসময়ে লোডশেডিং হবে কেন? আমাকে অন্যায় রণে হারিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। যেমন কুরুক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা বসে গেল।
যাই হোক, সামান্য একটু যা ঘুমিয়েছি তাইতেই আমার রাগ জল হয়ে গেছে। আমি খাটে, বউটা আমার মেঝেতে। মনটা গুমরে উঠল, আহা পরের মেয়ে! বাপ নেই, মা নেই। মেরেছ কলসির। কানা, তা বলে কি প্রেম দোব না। খাট থেকে অন্ধকারে ঠাহর করে করে নামলুম। তারপর খুঁজে খুঁজে গোল গোল হাত দুটো ধরে তোলার চেষ্টা করলুম। ও বাবা, এ যেন এক পেল্লায় বোয়াল। মাছ, পিছলে যায়। একবার এ-পাশ একবার ও-পাশ। আবার আমার রাগ চড়ছে। কী উঠবে না? মার টান। হেঁইয়ো, মারি হেঁইয়ো, আউর থোড়া হেঁইয়ো, বয়লট ফাটে হেঁইয়ো, ঘাস বিচুলি। হেঁইয়ো। হাতখানেক তুলি তো, থ্যাস করে শুয়ে পড়ে। আমার বউ যে এত ভারী জানা ছিল না। যেন জগদ্দল পাথর। বোম্বে ছবির নায়িকা হলে হিরোর ভাত মারা যেত, কারণ একটা-দুটো সিন এইরকম থাকতই যেখানে নায়ক নায়িকাকে দু-হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে বনের ধারে পাগলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে আর গাইছে—মেরা পেয়ার ঝুলতা রহে, ঝুমঝুম। বোম্বে ছবির নায়করা তো সব প্রেমে আধপাগলা মতো হয়ে যায়। তা এই নায়িকাকে কে তুলবে? এক গব্বর সিং পারতে পারে। যাই হোক, আমার রোক চেপে গেল—কী? স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খাটে তুলতে পারব না! কত ছোবড়ার ওজনদার গদি আমি তুলেছি একা। অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ান ওয়েট লিফটারদের স্মরণ করে, মারলুম আর এক টান। চাগাবার চেষ্টা করলুম। আর তখনই বুকের ডানপাশে যেন ওয়ার্ল্ড হেভি ওয়েট চ্যাম্পিয়ানের এক ঘুসি পড়ল। নিথর নিস্পন্দ হয়ে এল শরীর। পরাজিত মুষ্টিযোদ্ধা যেভাবে স্লো-মোশানে রিং-এর মধ্যে পড়ে যায় আমিও সেইভাবে। পড়ে যেতে যেতে বললুম—’যাঃ সুধা, তুমি বিধবা হলে। হার্ট-অ্যাটাক।’ আর কোনও বড় কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই। উঃ, হৃদয় আটকে গেলে, মানুষের কী যে হয়! কোথায় রেল রোকো, বাংলা বনধ। হৃদয় বন্ধের মতো কিছু নেই।
চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে আমি। শরীর অবশ। দম পড়ছে, আবার বন্ধ হচ্ছে। একটু বাতাসের জন্য মানুষের কী ছটফটানি। আমার বউ এতক্ষণ জেগে জেগে মশকরা করছিল। বিধবা শব্দটায় চাঁদমারি হল। আচ্ছন্ন চেতনা নিয়েই বুঝতে পারছি, অন্ধকারে উঠে বসেছে। প্রথম প্রথম বিধবা হতে সকলেরই ভয় লাগে। ওই অবস্থাতেও নিজেকে হিরো মনে হচ্ছে। ফেলেছি তুরুপের তাস। খেলো, নন্দিনী, খেলো। আমি রামায়ণের রাম। আবার এ-ও মনে হচ্ছে—চলে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে। আবার একটা গানের লাইনও মনে পড়ছে সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী। মরে যাবার সময় মানুষের কত কী মনে পড়ে। মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ ভালোবাসা পায় মনে।
আমার বউ আমার বুকে ভর রেখে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। যেন বারান্দার রেলিং-এ হাতের ভর রেখে রাস্তার লোক দেখছে। বেশ মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করলে—’কোথায় রেখেছ?’
এই সময় এই প্রশ্নের একটাই অর্থ, পাশবই, চেকবই, সেভিংস এইসব রেখেছ কোথায়? তুমি তো চললে। সেখানে গিয়ে তো আর তুড়ুম ঠুকতে পারব না। তখনও আমার একেবারে বাক্যরোধ হয়ে যায়নি। অস্পষ্ট হলেও স্মৃতি আর চেতনা দুটোই কাজ করছে। আমি। কোনওরকমে বললুম ‘ভেবো না তুমিই নমিনি, কাগজপত্র, চেকবই, পাসবই সবই আলমারির লকারে আছে। চাবিটা আছে মাটির যে গোপালমূর্তি, তার ভেতরে। রুমালে জড়ানো।’ এর পর আর আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরুল না, গোঁ করে উঠলাম। আমার বউ বললে—’যাও, তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলব না, মানুষকে কেবল তোমার কামড়ানো স্বভাব।’ আমি মনে মনে বললুম—’হায় রে। এখনও তুমি বুঝলে না, আর হয়তো পনেরো মিনিট পরেই তোমাকে প্রথামতো ডুকরে কেঁদে উঠতে হবে। তুমি ভাবছ আমি বোধ হয় অভিনয় করছি, তা কিন্তু নয়, একেই বলে হার্ট অ্যাটাক! অব্যর্থ পরোয়ানা।’ ভাবলুম, কিন্তু বলতে পারলুম না কিছু। কোঁক, কোঁক শব্দ হল কয়েকবার। তখন আমার বউ সরে এসে বললে, ‘তোমার সেই অম্বলের ওষুধটা কোথায়? অফিসে আজ কী গিলে মরেছিলে? হার্ট অ্যাটাক না হাতি! একে বলে গ্যাস।’
আমি বলতে চাইলুম—’পাগলি, সবাই গ্যাসই ভাবে। মরলে তবেই বোঝা যায় গ্যাস না। করোনারি।’ প্যাঁক করে একটা শব্দ বেরোল মাত্র। আমার বউ তখন উঠে আলো জ্বালাল। আমার দিকে তাকিয়েই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। স্বপ্নের ঘোরে যেন দেখছি সব। ছেলেকে ডাকছে। ভদ্রমহিলার হইহই করা স্বভাব। এমনভাবে ডাকছে বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে। আমার ছেলের ঘুম সহজে ভাঙে! তার ওপর সবে বিয়ে করেছে। এক সময় ছেলের গলা পাওয়া গেল। ঘুম জড়ানো, বিরক্তি মেশানো গলায় বলছে—’এত রাতে ডাক্তার, তোমার মাথা খারাপ। হয়েছে নার্সিংহোম? গাড়ি পাবে কোথায়! কোনওরকমে ভোর পর্যন্ত ম্যানেজ করো, তারপর যা হয় করা যাবে। বাবাকে তো চেনো! তিলকে তাল করা স্বভাব। এর আগেও তো দেখেছ!’
মনে মনে বললুম, ‘তাই না কি সোনা! বাবারা বুঝি তোমাদের সেবার জন্যে অমর হবে। খালি ফুয়েল ঢেলে যাবে সোনা, আর তোমরা শুধু কপচে যাবে! পাখি সব করে রব।’
তিন জোড়া পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশে বাবুরা এসে গেছেন। আমার ছেলে আবার জাত আমেরিকান। জিনস পরেই ঘুমোয়। উবু হয়ে বসতে পারছে না। এখুনি পেছন ফেঁড়ে যাবে। পুত্রবধূ আমার বুকের উপর হাত রেখে বারে বারে ডেকেই যাচ্ছে, ‘বাবা, বাবা, ও বাবা!’ যেন হার্ট অ্যাটাকের এইটাই চিকিৎসা, বাবা, বাবা করলেই হৃদয় খুলে যাবে।
আমার বউ বলছে, নিশ্চয় আজ ঘুগনি খেয়েছে। ঘুগনি দেখলে তো আর লোভ সামলাতে পারে না। আজ তো সোমবার। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। আজ ওদের অফিস ক্যান্টিনে ঘুগনির ডেট।
আমি সব শুনছি, আর মনে মনে হাসছি। এত যন্ত্রণাতেও হাসি। কেন হাসব না! ছেলেবেলায় কত আবৃত্তি করেছি—জীবন-মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য।
ছেলে বলছে—’এই অবস্থা কতক্ষণ হয়েছে?’
‘তা প্রায় আধঘণ্টা।’
ছেলে আমার হেসে উঠল। ‘আধঘণ্টা! তাহলে জেনে রাখো ব্যাপারটা হার্টের নয়, পেটের। হার্ট হলে কী হত জানো, পাকা আমটির মতো, টুপ করে খসে যেত। এ তোমার ঘুগনি কেস। তলপেটে নারকেল তেল, সাবান আর জল মিশিয়ে ডলতে থাকো। পায়ের তলায় নখ দিয়ে কুডু কুডু করে দ্যাখো তো!’
আমার বউ বললে, ‘মাগো, সাতজন্ম পায়ে সাবান দেয় না, ওই পায়ের তলায় আমি মরে গেলেও হাত দোব না।’
মনে মনে বললুম—’পিটপিটে বামনী, এখুনি মরলে ওই পায়েই তো আলতা মাখিয়ে ছাপ তুলবে।’
ছেলে বললে, ‘তোমার আবার বেশি বেশি। আমি যে প্যান্টের জন্যে নীচু হতে পারছি না।’
বউমা বললে, ‘আমি দেখছি।’
আঙুলে বড় বড় নখ। সেই নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। আমি ঝড়াক করে পা টেনে নিলুম।
ছেলে বললে, ‘বুঝেছি, এ তোমার মাকে টাইট দেবার চেষ্টা। থ্রম্বোসিস হলে পায়ে কোনও সাড় থাকত না। চলে এসো সুমিতা। ও স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, নিজেরাই ফয়সালা করে নিক।’
মনে মনে বললুম, ‘ও হে ছোকরা, তোমার বউয়ের আঙুলে যে ফ্যাশানের নখ, অ্যালসেশিয়ানকেও হার মানায়। ওই আঁচড়ে মরা মানুষও ঠ্যাং সরাবে বাপ। পায়ে সাড় থাকলে কী হবে, শ্বাস যে এদিকে বন্ধ হয়ে এল। পালসটা দ্যাখো, বিট মিস করছে কি না!’
আমি তিনবার ব্যাঙের মতো কোঁক কোঁক করলুম। ল্যাভেন্ডার পাউডারের গন্ধ উড়িয়ে নবদম্পতি বিদায় নিল। পড়ে রইলুম আমি আর আমার বোকা বউ। পঁচিশ বছরের পোড় খাওয়া একটি জীব। কোথা থেকে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে তলপেটে চেপে ধরল। ফ্যাঁস ফাঁস করে একটু কাঁদল। বউটার ধৈর্য একটু কম। কোনও কাজ একটানা বেশিক্ষণ করতে পারে না। এমনি মানুষটা বেশ ভালো, তবে অবুঝ। বয়েস হলে কী হবে, বালিকার স্বভাব। আমি চলে গেলে বুড়িটার কী হবে! ছেলের সংসারে আয়াগিরি করতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমার চোখেই জল এসে গেল। আমার বউ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘তুমি চলে গেলে আমি আত্মহত্যা করব, মাইরি বলছি, আমি আত্মহত্যা করব, আমার কে আছে বলো!’
তিন-চার ফোঁটা চোখের জল টপাটপ আমার গালে কপালে পড়ল।
আমি আমার অবশ হাত দুটো তোলার চেষ্টা করলুম। প্রথমে পারছিলাম না। পরে পারলুম। পারলুম মনের আবেগে। মন তো আর হৃদয়ে থাকে না। মেয়েটাকে আস্তে আস্তে পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরলুম। রাতের ধরিত্রীর মতো ঠান্ডা শীতল একটি শরীর। ধীরে ধীরে আমার হাতে চাপ বাড়ছে। কাছে টানছি, কাছে, আরও কাছে। আমার অর্ধ অঙ্গকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি, যেন হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করছি। হাপুস কাঁদছে আমার বউ। আমি কথা বলার চেষ্টা করলুম। পারলুম। আমার বাক্য ফিরে এসেছে। বললুম, ‘মাইরি বলছি, আমার একটা মাইলড স্ট্রোকই হয়ে গেল। আমি আজ ঘুগনি খাইনি, কিছুই খাইনি। স্রেফ তোমার জন্যেই আমার হৃদয়ের বাধা খুলে গেল।’
আমার বুকের ওপর বউয়ের মাথা। চুলের আর সে শোভা নেই। দেহে আর সে উত্তাপ নেই, কিন্তু চোখে অনেক জল এসেছে। ভেতরে একটা সমুদ্র তৈরি হয়েছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?
আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার চির বালিকাবউ ধরা ধরা গলায় বললে, ‘বুঝতে পারো না বোকা!’ আমার চোখের সামনে খেলে গেল অতীতের দৃশ্য, একটা গাছ, এক টুকরো জমি, সবুজ ঘাস, এক তরুণ আর তরুণী, কাঁধে মাথা হাতে হাত। অদৃশ্য এক স্টার্টার বাঁশি বাজিয়ে দিলেন, শুরু হল চলা। আজও চলছি। কোথায় সেই লাল ফিতে! কত দূরে। মনে মনে আমার ছেলেকে বললুম —’কী প্রেম করিস তোরা? দেখে যা প্রেম কাকে বলে? চোখের জল ছাড়া প্রেম হয়!’ একটা হৃদয় হলে আজ যবনিকা পড়ে যেত। দুটো হৃদয় মিলেছিল বলেই রয়ে গেলুম। থাকি না আর কিছুকাল।
বিকাশের বিয়ে
বিকাশ আমার বন্ধু। বিকাশ বিয়ে করবে। না করে উপায় নেই। ব্যাংকে ভালো চাকরি পেয়েছে। পরিবারের একটি মাত্র ছেলে। নিজেদের বাড়ি আছে। বাবা মারা গেছেন। মায়ের বয়েস হয়েছে। বিকাশের বিয়ে অবশ্যম্ভাবী। আত্মরক্ষার জন্যেও বিয়ের প্রয়োজন। এদেশে অবিবাহিতা মেয়ের অভাব নেই। সকলেই যে প্রেম করবেন তা-ই বা আশা করা যায় কী করে! মেয়ের বাপ-মাকেই ভালো পাত্র ধরার জন্যে উদ্যোগী হতে হয়। বিকাশের হয়েছে মহা বিপদ। বিকাশ যেন তাজা ফুলকপি। বিকাশ যেন গঙ্গা থেকে সদ্য তোলা একটি ইলিশ মাছ। যাঁরা তাকে চেনেন, জানেন সকলেই তাঁকে ওই দৃষ্টিতে দেখেন। ঝোলাতে হবে, মেয়ের হাতের ইলিশ করে।
দু-চার কথার পরেই তাঁদের প্রশ্ন ইলিশের তেলের খোঁজে চলে যায়। কড়ায় ছাড়লে বিকাশ কতটা তেল ছাড়বে! ব্যাংকের চাকরি? বাঃ বাঃ। কোন ব্যাংক? ন্যাশন্যালাইজড? এখন পাচ্ছ। কত? পাকা চাকরি? বেড়ে বেড়ে কোথায় উঠবে? প্রোমোশান আছে? বাঃ বাঃ। তা ছুটিছাটার দিন। এসো না একদিন। একটু ফ্রায়েডরাইস, চিকেন। রবীন্দ্রসংগীত নিশ্চয় ভালোবাসো। উমা আজকাল ভীষণ ভালো গাইছে। পল্লব সেনের প্রিয় ছাত্রী। তুমি ছবি ভালোবাসো না, ছবি? মেয়েটার আঁকার হাত দুর্দান্ত। নিজের মেয়ের প্রশংসা করা উচিত নয়। তবু না বলে পারছি না।
বিবাহযোগ্যা বাঙালি মেয়ের মা-বাবার, বিশেষ করে মায়েদের যে কী উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের দিন কাটাতে হয় তা আমি জানি। কারণ আমার একটি বোন আছে। আমার মায়ের ঘুম চলে গেছে। এই বুঝি মেয়ে প্রেম করে বসল! এই বুঝি কোনও পাড়াতুতো মাস্তান মেয়ের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আমার মায়ের যত রকমের উদ্ভট চিন্তা! আমার বাবার জীবন অতিষ্ঠ। বাবা অফিস। থেকে ফেরামাত্রই প্রথম প্রশ্ন, কী খোঁজ নিয়েছিলে?
সারাদিন অজস্র কাজের চাপে বাবার কিছু মনেই নেই, ফলে মিথ্যে বলে কি অভিনয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না। পালটা প্রশ্ন, কী খোঁজ বলো তো?
ব্যস লেগে গেল ধুমধাড়াক্কা। ওই মেয়ে যখন তোমার মুখে চুনকালি মাখাবে তখন বুঝবে। সেইদিন তুমি বুঝবে। সেইদিন তোমার শিক্ষা হবে। কেউ বলবে না তখন আমার মেয়ে। সবাই তোমার নাম করে বলবে, ওমুকের মেয়ে।
বাবার আর জামাকাপড় ছাড়া হল না, বিশ্রাম হল না, চা খাওয়া হল না। রেগে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, আজ আমি যাকে পাব তাকেই ধরে আনব।
খামোখা মাইলতিনেক অকারণ হেঁটে ধুকতে ধুকতে ফিরে এলেন রাত দশটায়। এই ভ্রমণের নাম প্রাতভ্রমণ নয়, পাত্রভ্রমণ। এ তো হল গিয়ে রাগের পাত্রভ্রমণ। ঠান্ডা মাথায় পাত্রভ্রমণ অহরহই চলছে। ভালো চাকুরে, অবিবাহিত ছেলেরা ঠিক ধরতে পারে। ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা মাছ ধরতে বেরিয়েছেন। বগলে অদৃশ্য ছিপ। ছিপের সুতোয় ঝুলছে টোপ-গাঁথা বঁড়শি। মেয়ের গুণের টোপ, বংশপরিচয়ের টোপ, ভালোমন্দ দেয়াটেয়ার টোপ। অনেকে আবার একটু বেশি দুঃসাহসী। চোখ দিয়ে দেহ জরিপ করেন, বুকের ছাতি, গলার মাপ। কেউ কেউ আবার কায়দা করে হাতের গুলি মেপে নেন। এই তো চাই, ফাইন ইয়াং ম্যান। এই তো চাই। সাহস, কারেজ, হেলথ। ওপর বাহুটা কথা বলতে বলতে ধরে, তাগার মতো মেপে নিলেন। দেখে নিলেন কতটা তাগড়া। বিয়ের ধাক্কা, সংসারের ধাক্কা সামলাতে পারবে কি না। ক্ষইতে কতটা সময় নেবে বাবাজীবন। পরে হয়তো একটু উপদেশ যোগ করলেন—ব্যায়ামট্যায়াম করো, একটু ভালোমন্দ সময়মতো খাও, শরীরম আদ্যম। শরীরটাই সব।
বাজারের মাছ আর ব্যাগের মাছের যা পার্থক্য। কোনওক্রমে একটা ব্যাগে ঢুকে গেলে, আর দরদস্তুর নেই। কানকো তুলে তুলে দেখা নেই। বিকাশ সেই কারণেই ব্যাগে ঢুকে পড়তে চায়। ছেলে ভালো। তেমন লোভী নয়। শ্বশুর মেরে হন্ডা চাপতে চায় না। সেরকম বন্ধুও আমার আছে। সোমেন। সে তো প্রায় দফতর খুলে বসেছিল, রাজনৈতিক নেতাদের মতো। পার্টি-অফিস। ঠিক সে খোলেনি। খুলেছিলেন তার পিতা। ছেলের পেছনে ভদ্রলোকের যথেষ্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল। অভাব সত্বেও ছেলেকে সাংঘাতিকভাবে মানুষ করেছিলেন। ছেলেও সরেস ছিল। শেষে। আইএএস হয়ে পাড়া-প্রতিবেশীকে তাক লাগিয়ে দিলে। এম.এ-তে ফার্স্টক্লাস পাবার পরই আমাদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়তে লাগল। আইএএস হবার পর আমাদের কোনওরকমে একটু চিনতে পারত। ভালো পোস্টিং হয়ে যাবার পর পথেঘাটে দেখা হলে, চোখে চোখে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিত। টর্চলাইট ফেলার মতো। সোমেনের বাবা বলতেন, ছেলে হল হিরে। কত খুঁজে তোলা হল। তারপর অভিজ্ঞ হাতে কাটাই-ছাঁটাই। কম খরচ! তারপর নিলাম। একলাখ বিশ! দেড় লাখ! তিন লাখ! কে হাঁকবে দর? মেয়ের বাবারা।
সোমেন নামক হীরকখণ্ডটি প্রায় তিন লাখে বিকিয়ে গেল। জাহাজ থেকে মাল খালাসের বিজনেস ছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বেহালায় বিশাল বাগানবাড়ি। সেই বাগানে আবার ফোয়ারা। মার্বেল। পাথরের উলঙ্গ নারীমূর্তি। সোমেনের বাবার সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। বড়লোকের কন্যাটি অসুন্দরী ছিল না; তবে যাদের ঘরে ছ-ছটা গরু থাকে তাদের ছেলেমেয়েরা একটু গায়েগতরে হবেই। আর বড়লোকেরা একটু মোটাসোটা না হলে মানায় না। মেদ হল অর্থের বিজ্ঞাপন। ঘেঁকুরে বড়লোক হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কাগজে বিজ্ঞাপন লাগাতে হবে। বড়লোকের নানা শরীর-লক্ষণ থাকা উচিত। কর্তার পঞ্চাশের পর রক্তে চিনি। চায়ের কাপে আয়েশ করে। স্যাকারিনের পুঁচকি ট্যাবলেট ফেলতে ফেলতে বলবেন, একটু বেড়েছে, একশো আশি। অর্থাৎ ওদিকে ব্যাংকে যত বাড়ছে, সেই অনুপাতে এদিকেও বাড়বে। মানি হল হানি। টাকা হল সুগার কিউব। রক্ত তো বটেই। তা না হলে রক্তের চাপ বাড়ে কেন? চল্লিশের পরেই গৃহিণীর বাত। বাতের জন্যেই রাজহংসীর মতো চলন। মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু মোটা। সোমেনের বাবা। কোনওরকমে একতলা একটা বাড়ি করেছিলেন। প্লাস্টার আর রং ছিল না। বেয়াইমশাই। মেয়েকে পাঠাবার আগে একদল কন্ট্রাকটার পাঠালেন। তাঁরা এক মাসে আড়াইতলার একটা ছবি খাড়া করে দিলে। কটক থেকে মালি এসে চারপাশের খোলা জায়গায় ফুল ফুটিয়ে দিলে। দু তিন লরি ফার্নিচার ঢুকে পড়ল হইহই করে। তারপর বাজল সানাই। সে কী সুর কালোয়াতি! পাড়া-প্রতিবেশীর বুকের চাপাকান্না যেন বাতাসে কাঁপছে। প্রতিবেশীরা কাঁদবেই তো। সোমেনের বাবা ছিলেন সামান্য মানুষ। অবস্থা তেমন ভালো না। জীবনের প্রথম দিকটায় খুচখাচ ব্যবসা করতেন। শেষটায় করতেন ঘটকালি। সেই মানুষ কীভাবে একটা একতলা বাড়ি করলেন! আধা গেঁচড়া হলেও মাথার ওপর ছাদ তো! সেইটাই তো প্রতিবেশীর কাছে বিশাল এক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তো, নিজেদের প্রশ্ন, আমরা কেন পারলুম না! যেই মনে হল, আমরা কেন পারলুম না, অমনি ভেতরে শুরু হল শৃগালের কান্না। যাক, সোমেনদের বাড়ি হওয়ার ক্ষত শুকোতে না শুকোতে, সোমেনের এমএ-তে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হওয়া। সে যেন পুরোনো ক্ষতে। নুনের ছিটে। একটা ছেলে চোখের সামনে তরতর করে সৌভাগ্য আর প্রতিপত্তির দিকে এগিয়ে যাবে—এ তো সহজে সহ্য করা যায় না। এর পরের মস্ত আঘাত হল সোমেনের আইএএস হওয়া। যাঃ সর্বনাশ! এ ছেলেকে তো শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনায় সাধারণের স্তরে
আটকে রাখা গেল না। এ তো অফিসার হবেই। গাড়ি, কোয়ার্টার, মোটা মাইনে, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সবই তার হাতের মুঠোয়। চিন্তায় চিন্তায় একপাড়া লোক রোগা হয়ে গেল। আমরা তখন সোমেনকে বয়কট করলুম। যে ছেলে অসামাজিক হয়ে যাবে, তার সঙ্গে খাতির রেখে আর লাভ কী? শেষ আঘাত সোমেনের বিয়ে। আমরা নিমন্ত্রিত হওয়া সত্বেও, না গেলুম বরযাত্রী, না গেলুম বউভাতে। যে ছেলে বিয়েতে শ্বশুরকে দোহন করে পণ নেয়, উপহার নেয়, সে একটা নির্লজ্জ লোভী। তার অনুষ্ঠানে যাওয়াটাও পাপ। বড়লোকের আবার না চাইতেই কিছু তাঁবেদার জুটে যায়। সোমেনের পক্ষে অনেকে বলতে লাগলেন, শ্বশুরের আছে তাই দিয়েছে, সে তত আর চায়নি। চেয়েছে কি চায়নি বুঝল কী করে?
বিকাশ বললে, সোমেনের মতো আমি চামার নই। একটা পয়সাও আমি নেব না। তবে হ্যাঁ, আমার একটা শর্ত আছে মেয়েটি সুন্দর হওয়া চাই। বউ নিয়ে বুক ফুলিয়ে যেন রাস্তায় হাঁটতে পারি। বিকাশের মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, ছেলেকে আমি নিলামে চড়াব না। তবে মেয়ে পক্ষ যদি মেয়েকে ঘর সাজিয়ে দিতে চান, তাহলে আমি রোজগেরে ছেলের অহংকারে অপমান করতে পারব না। লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা। অহংকার একেবারে সহ্য করতে পারেন না।
শনিবার-রবিবার বিকাশের কাজই হল আমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে বেরোনো। একটা ব্যাপার লক্ষও করছি, ছেলেরা যখন বেকার থাকে তখন সে প্রেমিক। প্রেম করে বেড়ায়। যেই সে ভালো চাকরি পেল, অমনি তার প্রেম ঘুচে গেল। তখন তার আটঘাঠ বেঁধে, ঠিকুজি-কোষ্ঠী মিলিয়ে বউ আনার তাল। বিকাশের একজন প্রেমিকা ছিল, তাকে আর পাত্তাই দেয় না। আমি জিগ্যেস করেছিলুম, ব্যাপারটা কী। প্রথমে বলতেই চায় না, শেষে বললে, আমি একটু ভালো মেয়ে চাই। আর এখন আমার চাইবার অধিকারও এসেছে। প্রেমের আবেগে বোকামি করলে আমাকেই পস্তাতে হবে। সারা জীবনের ব্যাপার। সারা জীবন প্রেমের চশমা পরে একটা মেয়ের দিকে তাকানো সম্ভব নয়। বাস্তব হল অঙ্কের মতো।
তোর প্রেমিকাটি তো ভালোই দেখতে।
ভালো দেখতে হলে কী হবে, ভীষণ ঘামে আর সর্দির ধাত।
আমি হাঁ করে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। পৃথিবীতে কত রকমের মাল আছে ভগবান!
জিগ্যেস করলুম, একটা মেয়েকে বাইরের দেখায় তুই রূপটা দেখলি, অন্তরঙ্গ খবর পাবি কী করে! ঘামে কি না, সর্দি হয় কি না! তোকে তাহলে অবজেকটিভ টেস্টের মতো প্রশ্নপত্র বিলি করতে হবে রে! তুই কী চাস বল তো!
অনেক মেয়ে আছে খাওয়াদাওয়ার পর ঢেউ করে গ্যাসের রুগির মতো সেঁকুর তোলে।
তারপর?
সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খোঁটে। হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মোছে। চিৎকার করে কথা বলে। দুমদুম করে সিঁড়ি ভাঙে। কথা বলার সময় গায়ে ধাক্কা মারে। দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে না, পা নাচায়। খাওয়ার সময় চ্যাকোর চ্যাকোর শব্দ করে। ঠুকে জিনিস রাখে। চিরুনিতে চুল ওঠে। মাথায় খুসকি হয়। পেটে হুড়হুড় গুড়গুড় শব্দ হয়। জ্বর হলে উ আঁ করে। ধনুকের মতো বেঁকে। শোয়। হাঁউ হাঁউ করে হাই তোলে। নির্জনে নাক খোঁটে। খেতে বসে আঙুল চোষে। দাঁত দিয়ে নখ কাটে।
অসম্ভব! তোর বিয়ে হওয়া অসম্ভব। হলেও ডিভোর্স হয়ে যাবে। এই সব ডিফেকট একটা মেয়ের খুব কাছে না এলে ধরা যায় না।
ধরার চেষ্টা করতে হবে। বউ করব বাজিয়ে। এ তো প্রেম করা নয়, যে মেনে নিতে হবে প্রেমের প্রলেপ দিয়ে। আমি সব শুনে রাখলুম। মনে মনে হাসলুম। এমন মেয়ে মানুষের বাড়িতে মেলা অসম্ভব। কুমোরটুলিতে অর্ডার দিতে হবে। স্বয়ং মা দুর্গাও হয়তো অসুর মারার সময় ঘেমেছিলেন।
রবিবারের এক বিকেলে আমরা রামরাজাতলায় মেয়ে দেখতে গেলুম। বেশ বড় সাবেক আমলের বাড়ি। গ্যারেজ আছে। বিকাশ ঢুকতে ঢুকতে বললে, আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িই আমার শ্বশুরবাড়ি।
হলেই ভালো। তবে তোমার যা চাহিদা!
বৈঠকখানায় আমরা বসলুম। বসতে না বসতেই মেয়ের বাবা সবিনয়ে এসে হাজির। মোটাসোটা এক ভদ্রলোক। ঢোলা পাঞ্জাবি পরিধানে। ভুঁড়িটা সামনে ফুটবলের মতো উঁচু হয়ে আছে। ভদ্রলোক সোফায় বসামাত্র বিকাশ উঠে দাঁড়াল।
ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হল আপনার?
আমার পছন্দ হল না। বিকাশের সরাসরি উত্তর।
কী করে! আপনি তো আমার বোনকে এখনও দেখেননি।
বিকাশ একটু থতমতো খেয়ে গেল। আমরা দুজনেই ভদ্রলোককে পিতা ভেবেছিলুম। মেয়ের দাদা বললেন, আমার বোনকে আগে দেখুন, তারপর তো পছন্দ-অপছন্দ!
বিকাশ বললে, শুধু শুধু আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আপনাকে দেখেই আমার ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে আপনার মতোই হবে। আপনারই স্ত্রী-সংস্করণ।
ভদ্রলোক বেশ আহত হয়ে বললেন, ছিঃ চেহারা তুলে কথা বলবেন না। এটা এক ধরনের অসভ্যতা।
আমি বললুম, আমার বন্ধুর কোনও দাবি-দাওয়াও নেই, পছন্দ হলেই পত্রপাঠ কাজ সারবে। তবে ওর একটাই শখ, বউ যেন সুন্দরী হয়।
ভদ্রলোক বললেন, আমাকে দেখে আমার বোন সম্পর্কে কোনও ধারণা করলে ভুল করবেন। সে কিন্তু প্রকৃতই সুন্দরী।
বিকাশ বললে, ও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলে না। আমি শুধু সুন্দরী মেয়েই চাই না, আমি চাই সুন্দরের বংশ। আপনি আমার শ্যালক হলে পরিচয় দিতে পারব না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, গেট আউট। আভি নিকালোহিয়াসে।
আমরা এক দৌড়ে রামরাজাতলার রাস্তায়। ভদ্রলোক এই ভদ্রতাটুকু অন্তত করলেন, যে রাস্তা পর্যন্ত তেড়ে এলেন না। এলে পাবলিক আমাদের পিটিয়ে লাশ করে দিত। বেশকিছু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে, চা খেতে খেতে বিকাশকে বললুম, তাহলে আরও কিছু নতুন শর্ত যোগ হল?
হলই তো। একটা পয়সাও যখন নেব না, তখন বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বিয়ে করব। অনেকে কী করে জানিস তো, মেয়ের এক একটা ডিফেক্টের জন্যে টাকা দাবি করে। একটু খাটো মাপের, দু-হাজার। নাক থেবড়া, পাঁচ হাজার। চাপা রং তিন হাজার। সামনের দাঁত উঁচু, সাত হাজার। পৃথিবীটা লোভী মানুষে ছেয়ে গেছে। অনেকে দেখবি ওই কারণে ওই রকম মেয়েই খোঁজে। বিয়ে নয়, ব্যবসা।
তুই মেয়েটিকে না দেখে ওইরকম একটা অভদ্র কাণ্ড করলি কেন?
শোন লুঙ্গি পরা শ্বশুর, ভুড়িঅলা শালা, দাঁত বড় শাশুড়ি—এই সব আমার চলবে না। আমি যে বাড়ির জামাই হব সে বাড়িতে যেন চাঁদের হাটবাজার হয়।
বাড়িতে লুঙ্গি পরা চলবে না?
না, লুঙ্গি অতি অশ্লীল জিনিস। আমার শ্বশুরকে ড্রেসিং-গাউন পরতে হবে।
বেশ ভাই, যা ভালো বোঝো তাই করো।
সব সময় একটু দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকাবি। ধর বিয়ের পর আমাদের একটা গ্রুপফোটো তোলা হল। আমার পাশে হিড়িম্বা, আমার ওপাশে সূর্পনখা, পেছনে ঘটোৎকচ, তার পাশে হিরণ্যকশিপু। কেমন লাগবে?
বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পর শুকচরে আবার একটি মেয়ে দেখতে যাওয়া হল। সেও বেশ সাবেককালের বাড়ি বনেদি বাড়ি। লোকজন নেই বললেই চলে। বাড়ির আকার-আকৃতি দেখলে মনে হয়, শতাব্দীর শুরুতে এই গুহ ছিল শতকণ্ঠে মুখর। উঠোনের পাশে ভেঙে পড়া একটি বাড়ির কাঠামো দেখে মনে হল, এখানে একসময় একটি আস্তাবল ছিল। আমার অনুমান সত্য প্রমাণ করার জন্যে পড়ে আছে কেরাফি গাড়ির দুটি ভাঙা চাকা। বিকাশের কী মনে হচ্ছিল জানি। না, আমার মনে ভিড় করে আসছিল অজস্র মুখস্মৃতি। মনে হচ্ছিল আমি যেন ইতিহাসে ঢুকে পড়েছি। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সামনেই চণ্ডীমণ্ডপ। ভেঙে এলেও, অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে টাটকা স্বস্তিকা চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলুম এখনও পূজাপাঠ হয়। উঠানের একপাশে ফুটে আছে একঝাঁক কৃষ্ণকলি আর নয়নতারা। ভীষণ ঘরোয়া ফুল। দেখলেই মনে হয় দুঃখের মধ্যে সুখ ফুটে আছে। যে সব পরিবার, বড় পরিবার ভেঙে গিয়েও নতুন করে বেঁচে আছে, নতুন ভাবে, তাঁদের সেই অতীত বর্তমানের জমিতে ফুটে থাকে কৃষ্ণকলি হয়ে। বিশাল দরজা, ততোধিক বিশাল উঠান পেরিয়ে আমরা চলেছি। তখনও মানুষজন চোখে পড়েনি। ভেতরের বাড়িতে সবাই আছেন। দূরে কোথাও একটা গরু পরিতৃপ্ত গলায় ডেকে উঠল। এই ডাক আমার চেনা—এ হল গরবিনী গাভীমাতার ডাক। আমি জাতিস্মর নই, তবু মনে হত লাগল এই বাড়ি আমার অনেককালের চেনা।
ভেতর বাড়িতে পা রাখামাত্রই শীর্ণ চেহারার এক ভদ্রলোক ছুটে এলেন। শীর্ণ কিন্তু সুশ্রী। ভদ্রলোকের পরিধানে পাজামা ও পাঞ্জাবি। মুখে ভারি সুন্দর হাসি। এক মাথা ঘন কালো চুল। ভেতরের বাড়িটা যাকে বলে চকমেলানো বাড়ি, হয়তো সেই বাড়িই ছিল এক সময়। দেখেই মনে হল বাড়িটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আমাদের নীচের তলার ঘরে নিয়ে এলেন। বিশাল বড় ঘর। শ্বেতপাথরের মেঝে। ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই। কাপের্ট ঢাকা একটা চৌকি পাতা। ভদ্রলোক আমাদের বসিয়ে দ্রুতপায়ে ভেতরে চলে গেলেন।
বিকাশকে জিগ্যেস করলুম, কী মনে হচ্ছে? তোমার ষষ্ঠ অনুভূতি কী বলছে?
পড়তি!
আর পড়বে না, এখন একটা জায়গায় এসে আটকেছে। আর তোমার তো দাবিদাওয়া নেই।
দাবি না থাক, এই ভাঙা গোয়ালে কে বাসর পাতবে। সাপে কামড়ালে কে বাঁচাবে ভাই! লক্ষীন্দরের বাসর হয়ে যাবে। আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িতে কম সেকম এক হাজার জাতসাপ আছে।
বিকাশের কথায় গা জ্বলে গেল। আমাদের সঙ্গে রকে বসে আড্ডা মারত। চা, চপ খেত। হঠাৎ ভালো একটা চাকরি পেয়ে মাথা বিগড়ে গেছে। ধরাকে সরা জ্ঞান। মনে মনে বললুম—যা ব্যাটা মরগে যা। বিকাশের ওপর আমার একটা ঘৃণা আসছে।
ভদ্রলোক নিজেই একটা ট্রে দু-হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার ওপর সাধারণ দুটো কাচের গেলাস। গেলাসে ডাবের জল। ট্রেটা সামনে রেখে সাবধানে গেলাস দুটো আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বিকাশ ডাঁট মারতে শুরু করেছে। গেলাসটা এমন ভাবে নিল, যেন দয়া করছে। কার্পেটের একপাশে রেখে ভারিক্কি গলায় বললে, এই সব ফর্মালিটি ছেড়ে, কাজের কাজ সারুন! আমার অনেক কাজ আছে।
ভদ্রলোক সবিনয়ে বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়! তবে দূর থেকে আসছেন, গরমকাল, এখনও কিছু পিতার আমলের নারকেল গাছ আছে। খেয়ে দেখুন, খুব মিষ্টি জল!
ও জলটল পরে হবে, দেখাদেখিটা সেরে নিন।
ভদ্রলোক বিষণ্ণ, বিব্রত মুখে ভেতরে চলে গেলেন। আমি বিকাশকে বললুম, তোর সঙ্গে আর আমি যাব না কোথাও। এবার তুই ছোটলোকমি শুরু করেছিস।
ছোটলোকমির কী আছে! আমার এই রোগা রোগা চেহারার পড়তি বড়লোকদের বিশ্রী লাগে। বিনয়ের আদিখ্যেতা। স্পষ্ট উচ্চারণে নীচু গলার কথা।
তা হলে এলি কেন, খামোখা একটা মানুষকে অপমান করার জন্যে?
জানব কী করে?
একটা চেয়ার নিয়ে ভদ্রলোককে আসতে দেখে এগিয়ে গেলুম। ভারী চেয়ার। একা সামলাতে পারছেন না।
সরুন আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বইছেন কেন! আর কেউ নেই?
না, আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। আমার চেহারা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন না।
আমি খুব খাটতে পারি।
চেয়ারটাকে জানালার পাশে আমাদের দিকে মুখ করে রাখা হল। কিছু পরেই তিনি পাত্রীকে নিয়ে এলেন। সাজগোজের কোনও ঘটা নেই! ফিকে নীল শাড়ি। হাতাওয়ালা সাদা ব্লাউজ। চুলে একটা এলো খোঁপা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিপ।
মেয়েটি নমস্কার করে চেয়ারে বসল। পুরো ব্যাপারটাই অস্বস্তিকর! বোকা বোকা হৃদয়হীন নির্দয় একটা ব্যাপার। দু-জোড়া চোখ প্রায় অসহায় একটি মেয়েকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! আমি সেভাবে না দেখলেও বিকাশ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখছে। মাপজোক করছে। সুন্দরী বউ চাই। ডানাকাটা পরি চাই। লেখাপড়ায়, চাকরিতে বাল্যবন্ধু সোমেন মেরে বেরিয়ে গেছে। হেরে আছে একটা জায়গায় বিয়েতে। পেয়েছে খুব, কিন্তু বউ নিখুঁত সুন্দরী নয়! বিকাশ বউ দিয়ে মেরে বেরিয়ে যাবে।
মেয়েটি মুখ নীচু করে বসে আছে। ভদ্রলোকের মুখের আদলের সঙ্গে মেয়েটির মুখ মেলে— ধারালো অভিজাত মুখ। চাঁপা ফুলের মতো গাত্রবর্ণ। লম্বা ছিপছিপে বেতসলতার মতো চেহারা। ভারি সুন্দর। বেশ একটা মহিমা আছে। অন্তত আমার চোখে। মেয়েটি খুব নম্র। ভীরু মনে হল। বসে আছে অসহায় অপরাধীর মতো।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ছেলেবেলায় দিদি আর জামাইবাবু মারা যাবার পর আমার এই ভাগনি আমার কাছেই মানুষ। তখন আমাদের সাংঘাতিক দুরবস্থা। তবু আমি আমার কর্তব্য করে গেছি। পড়িয়েছি। গান শিখিয়েছি। সভ্যতা, ভদ্রতা, সংসারের যাবতীয় কাজ শিখিয়েছি। একটাই আমি পারিনি। তা হল ভালো করে খাওয়াতে পারিনি। তার জন্যে দায়ী আমাদের অভাব। আমার রোজগার করার অক্ষমতা। তবে এই গ্যারান্টি আমি দিতে পারি, এমন মেয়ে সহজে পাবেন না। দুঃখের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড় হয়েছে। ওদিকে বড় ঘরের সংস্কারও কাজ করেছে। মেয়েটিকে আপনারা গ্রহণ করুন। আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে আসছে।
বিকাশ ফট করে উঠে পড়ল। একেবারে আচমকা।
ভদ্রলোক অপদস্থ হয়ে বললেন, কী হল! আমি কি কোনও অন্যায় করে ফেললুম!
বিকাশ একেবারে গুলি ছোড়ার মতো করে বললে, যে মাল বিজ্ঞাপনের জোরে বিকোতে হয় সে মাল ভালো হয় না।
মেয়েটি শিউরে উঠল।
ভদ্রলোক বললেন, এ কী বলছেন আপনি!
ঠিকই বলছি। আপনার ভাগনির স্ত্রী-রোগ আছে।
আমার পক্ষে সহ্য করা আর সম্ভব হল না। সমস্ত শক্তি এক করে বিকাশের ফোলা ফোলা গালে ঠাস করে এক চড় মারলুম। আর একটা চড় তুলেছিলুম। ভদ্রলোক ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। উত্তেজনায় কাঁপছেন। বিকাশের নিতম্বে কষে একটা লাথি মারার বাসনা হচ্ছিল।
বিকাশমুখে অহংকারী, শরীরে দুর্বল। হন হন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
আমি ফিরে তাকালুম! ভীরু মেয়েটির ঠোঁট ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। বড় বড় পাতাঘেরা চোখে জল টলটলে! সেই মুহূর্তে ভেতরের বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল। পুজো হচ্ছে গৃহদেবতার। ঘণ্টা বাজছে টিং টিং করে। আমি পিছোতে পিছোতে চৌকিটার ওপরে গিয়ে বসলুম। আমার ভীষণ একটা তৃপ্তি হয়েছে। একটা অসভ্য একটা ইতরকে আমি আঘাত করতে পেরেছি। অসীম সুখে আমার মন ভরে গেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন শাঁখ আর ঘণ্টা বাজছে পুজোর ঘরে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। ভদ্রলোককে বললুম আপনি দিন দেখুন, আমি বিয়ে করব। আমি বড় চাকরি করি না, তবে মানুষ। বিয়ে এখন বড়লোকের ব্যবসা, তবু আমি এই ঝুঁকি নেব। আমর পিতা এলে পাকা কথা বলে যাবেন। হ্যাঁ তার আগে আপনার ভাগনিকে জিগ্যেস করুন আমাকে পছন্দ কি না?
ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রাখলেন; তখনও হাত কাঁপছে।
মেয়েটি অস্ফুট বললে, আপনাকে আমি চিনি।
কী করে!
আমি বইয়ে পড়েছি এমন চরিত্রের কথা।
আমি বাস্তব নই!
কাল বোঝা যাবে।
মেয়েটি পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ; তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
ভদ্রলোক আবেগের গলায় বললেন, তুমি বাস্তব হবে তো!
সরষে
সরষে
আমি অনশন করব, আমৃত্যু অনশন।
সকালে চায়ের কাপ হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে জানালার দিকে মুখ বাড়িয়ে বসলেন প্রকাশবাবু। ঘটনাস্থল কলকাতার উপকণ্ঠে মধ্যবিত্ত পাড়ার সদ্যনির্মিত একটি বাড়ির দোতলার ঘর। পশ্চিম খোলা। জানলার ওপাশে আকাশ, পরিমিত গাছপালা। দু-একটি বাড়ি। গোটাকতক পায়রা। চরিত্র দুটি প্রাণী। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত, ডাকসাইটে শিক্ষক প্রকাশ মুখোপাধ্যায় আর তাঁর স্ত্রী মহামায়া মুখোপাধ্যায়। বিবাহের আগে ছিলেন চট্টোপাধ্যায়।
কাপ থেকে চা চলকে ডিশে পড়ল। আর একটু জোরে ঠেললে মহামায়ার হাতে তৈরি, নীলের ওপর সাদার কাজ করা টেবিলক্লথে পড়ত। সেই সম্ভাবনায় মহামায়ার ভুরু কুঁচকে ছিল। মনে মনে প্রস্তুতও ছিলেন, একটু পড়ুক, তারপর কী করতে হয়, আমিও দেখাব। সাতদিন হয়ে গেল বাতের ব্যথায় উঠতে পারছিনা। ডাক্তারের কথা, ওষুধের কথা বলে বলে মুখে ফেকো পড়ে গেল। একদিন নিয়ে এলেন ঢ্যাঁপা ঢ্যাঁপা একগাদা রসুন। এককোষি রসুন রোজ সকালে একটা করে জল দিয়ে কোঁত করে গিয়ে ফেলো মায়া, সাতদিনে তোমার বাত বাপ বাপ করে পালাবে। আর একদিন নিয়ে এলেন ইয়া মোটা এক স্টিলের পাঞ্জাবি বালা। এটি মায়ের নাম করে ধারণ করে ফেলো মহামায়া, বাত তো ভালোই হবে, দেখবে যৌবনও ফিরে আসছে আবার। শেষে। নিয়ে এলেন হাততিনেক ইলেকট্রিক তার। কোমরে আড়াই প্যাঁচ মেরে বসে থাকো মায়া, প্রথম বর্ষার প্রথম বিদ্যুতেই অ্যাকশান পেয়ে যাবে। শরীরে কয়েক ওয়াট কারেন্ট ঢুকলেই তোমার। হাত-পায়ের গাঁট খুলে যাবে, যৌবনকালের মতো সারা বাড়ি ধুমধুম করে আবার দাপিয়ে বেড়াবে। কেপপন অনেক দেখেছি বাবা, এই মানুষটার মতো এমন হাড়-কেপপন দেখিনি!
মহামায়া ভারিক্কি গলায় বললেন, চা-টা চলকে টেবিলক্লথে পড়ে গেলে কী হত? আকাশের দিকে ফেরানো মুখ তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, যেত, যেত।
সাতসকালে বাবারে মারে করতে করতে চা করে নিয়ে এলুম, উলটে ফেলে দেওয়ার জন্যে! যত বয়েস বাড়ছে, তত তোমার রাগ বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে, বউমা এই নিয়ে হাসাহাসি করে, তোমার প্রেসটিজে লাগে না?
না, লাগে না। ওরা হাসার জন্যে, ব্যঙ্গ করার জন্যে জন্মেছে, আমি জন্মেছি সেই উপহাস আর ব্যঙ্গ কুড়োবার জন্যে। যুগটাই তো পড়েছে, বাপ-জ্যাঠার কাছা খোলার যুগ। অপমান আমার। নয়, অপমান ওইসব চপল বালক-বালিকার। যাদের জীবনটাই হল অনন্ত, অখণ্ড, অপার, অপরিমেয়, অনিয়ন্ত্রিত, অলস তামাসার। পরপর একগাদা অকারান্ত শুনে মহামায়া বললেন, বাপস। রাগের চোটে মুখ দিয়ে অমরকোষের স্রোত বইছে। নাও খুব হয়েছে, চা খেয়ে নাও। ছেলেমানুষের মতো কথায় কথায় অত ক্ষেপে যাও কেন?
প্রকাশ এবার জ্বলন্ত মুখ ঘোরালেন, নো মোর সুগার কোটেড ওয়ার্ডস ম্যাডাম, মিষ্টি কথায় আর চিঁড়ে ভিজবে না, জল চাই, জল। বোকারাও ধাক্কা খেতে খেতে একদিন বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে, তখন আর তাকে বোকা বানানো যায় না। তখন নিজেকেই বোকা বনে যেতে হয়। কথা যত কম হয় ততই ভালো। তোমাদের সবকটাকে আমি চিনে নিয়েছি। সব শেয়ালের এক রা।
আমরা কী করলুম যে শেয়াল-টেয়াল বলছ?
এই সংসারে আমি এখন উপেক্ষিত। এ নেগলেক্টেড ওল্ড ফুল। আমার কোনও স্ট্যাটাস নেই। আমি গৃহপালিত দিশি কুত্তার মতো।
আঃ, কী যা-তা বলছ?
ঠিকই বলছি, ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট। তোমরা যেই দেখলে, বুড়ো ব্যাটার লাস্ট ফার্দিংবাড়ি তৈরিতে খরচ হয়ে গেছে, রেস্তো চুঁচুঁ, ব্যাংক-ব্যালেন্স নিল, মরলে একজোড়া চশমা, আর ছেড়া একজোড়া চপ্পল ছাড়া আর কিছুই ব্যাটা রেখে যাবে না; তখনই তোমরা সব নিজমূর্তি ধরলে। ক্যাপসুল খুলে গেল। ঠিকই করেছ। জগতের নিয়মেই চলছ। প্রত্যাশা থেকেই মানুষের হতাশা আসে। মনের আর দেহের জোর থাকলে বানপ্রস্থে চলে যেতুম। এতকাল ধরে বোকাটাকে কুরে কুরে খেয়েছ। জ্ঞান যখন হল তখন দেখলে বোকার ছোবড়াটা পড়ে আছে। নড়বার-চড়বার ক্ষমতা নেই। চোখে চালসে, হাত-পা কাঁপছে। পড়ে পড়ে মার খাও। বাঁধা মার। সাংখ্য কী বলেছেন জানো—জীব তিন ধরনের দুঃখ পায়, আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আধিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখের কারণ আমাদের ইন্দ্রিয়, আর…।
তোমাদের সাংখ্যে গুলি মারো। সারাদিন ওই ছাইপাঁশ পড়ে পড়ে মাথাটি একেবারে গেছে। একদিন আগুন লাগিয়ে দেব, আপদ চুকে যাবে।
বাঃ চমৎকার মাস্তানি ভাষা শিখেছ তো। একজন অবসরপ্রাপ্ত, সম্মানিত, জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত প্রধানশিক্ষকের স্ত্রী-র ল্যাংগোয়েজ দেখো! আমাকে জুতো মারা উচিত। আমার গলায় যাঁরা পদক ঝুলিয়েছেন, তাঁদের বললো, এবার এসে জুতোর মালা ঝুলিয়ে দিয়ে যাক। যে নিজের বাড়িকে। শিক্ষিত করতে পারল না, সে সারাটা জীবন উৎসর্গ করে গেল দেশের শিক্ষায়। অপদার্থ পাঁঠা! আমি অত কথা শুনতে চাই না, তুমি চা খাবে কিনা?
না, খাব না। আমি খ্যাচাখ্যাচি করতে চাই না, নাকে কাঁদতে চাই না, আমি সাবেকপন্থী শান্তিপ্রিয় মানুষ, আমরণ অনশনের আমার সিদ্ধান্ত। তুমি এখন যেতে পারো। যাওয়ার সময় তোমাদের এই হতচ্ছেদ্যার পিঁপড়ে ভাসা, সর ভাসা, কেলে গামছা নিঙড়োনো গরম জলটা নিয়ে যাও।
মহামায়া চেয়ার ছেড়ে উঠে চায়ের কাপের সামনে ঝুঁকে পড়লেন, তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর! দেখাও তো! আর বর্ণ? এমন সোনার বর্ণ চা। তোমাকে গ্র্যান্ড হোটেলও দিতে পারবে না। না দেখেই ধেই ধেই নাচ। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙিয়ে…।
প্রকাশ স্ত্রীকে কথা শেষ করতে দিলেন না, নিজেই টেনে নিলেন গাধা হয়ে গেছি, গাধা। ধোপার গাধা হলে তবু পরিত্রাণের পথ ছিল, স্ত্রী-র গাধা হয়ে মরেছি। ইহকাল, পরকাল দুটোই গেল।
আমি তোমাকে গাধা বলেছি?
ওই কথার পর অবধারিত ওই কথাটাই আসে। আমার বয়স হয়েছে, ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।
দ্যাখো, সকালবেলা শুধু শুধু ঝগড়া কোরো না। কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর। তুমি দেখাও।
প্রকাশ চশমা পরে চায়ের কাপ সামনে টেনে নিয়ে প্যাথোলজিস্টের মতো চা পরীক্ষা করতে লাগলেন। মহামায়া বিজয়িনীর মতো হাসছেন, পাবে না, পাবে না, ব্যর্থ চেষ্টা।
প্রকাশ বললে, ছিল, থাকতে থাকতে গলে গেছে।
গলে গেছে? মহামায়া ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
হেসো না, হেসো না। ডোন্ট লাফ। আজ হয়তো নেই ভাগ্যক্রমে অথবা ছিল, অন্যদিন গোটাকতক পিঁপড়ের লাশ, বাসি দুধের সর থাকবে। বুডোর ব্রেকফাস্ট।
অন্যদিনের কথা আমি জানি না। বউমা কী করে আমি বলতে পারব না।
অ, তোমার বউমা তাহলে যা খুশি তাই করতে পারে! সাত খুন মাফ।
আঃ, কেন পরের মেয়েকে মিথ্যে মিথ্যে দোষী করছ?
অ, আমি হলুম মিথ্যেবাদী, তুমি হলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। এ সংসারে তোমরা দলে ভারী বলে দিনকে রাত করবে?
বউমা তোমার যথেষ্ট সেবা করে। শ্রদ্ধা করে। ভয়ও করে। কেন পরের মেয়ের নামে মিথ্যে বলো সব!
আমি অন্যের সেবা নেব কেন? তুমি আমার জন্যে কী করো? এই বেওয়ারিশ বুড়োর জন্যে!
আমি কিছু না করলে এতদিনে ভেসে যেতে।
তার মানে তোমার আদরের বউমা কিছু করে না!
উঃ আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেল তো। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছলেও নিবংশের ব্যাটা। তুমি কি আগুন জ্বালাতে চাচ্ছ, শুধু শুধু অকারণে?
আগুনটাগুন নয়, আমার পথ শান্তির পথ। আমরণ অনশন। ধীরে ধীরে নিবে যাওয়া। অনেকদিন এসেছি মহামায়া। পুরোনো হয়ে গেছি। গরুর দুধ চলে গেলে গোয়ালা কসাইখানায় দিয়ে আসে। তখনও তার দু-পয়সা কামাই হয়। দুর্ভাগ্য তোমার, আমি গরু নই।
হোল ফ্যামিলি তোমার জন্যে তটস্থ তবু তোমার মন পায় না।
এরপর আমাদের আর কিছু বলার নেই।
অই, অই সেই শব্দ। আমাদের, তার মানে তোমরা একটা দল, অনেকটা একালের মাস্তান পার্টির মতো। আর আমি হলুম গিয়ে একা মাইনরিটি। শাসনের নামে দুঃশাসন চলেছে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। লাশ পড়ে যাবে। মেজরিটি যা করবে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। নইলে তুমি খিটখিটে বুড়ো, একলাষেড়ে, বাহাত্তরে ধরেছে, চিরকালের স্বার্থপর। দে বেটাকে একঘরে করে। ধোপা-নাপিত সব।
মহামায়া হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, মাস্টার না হয়ে তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। নাম করতে পারতে, দুটো পয়সার মুখও দেখা সম্ভব হত। আমরা মানে, আমরা যারা তোমার সেবা করছি।
প্রকাশবাবু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, সেবা? তোমরা আমার সেবা করছ! গোপাল সেবা? সিংহাসনে একবার করে ওঠাচ্ছ আর শোয়াচ্ছ। শালগ্রামের শোয়াও যা বসাও তাই। বোঝার উপায় নেই, বসে আছি না শুয়ে আছি। যুগ যুগ জিও।
এটা কী ভাষা?
যুগের ভাষা।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বুঝলে? সব নাটবল্ট ঢিলে হয়ে গেছে। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙালে হয়।
কী হয়—গাধা?
সে কথা বলেছি?
সব কথা কি আর বলতে হয়? বলার আগেই বুঝে নিতে হয়।
এ বুড়োটা তো মহা ঝগড়াটে!
অ, আমি এখন বুড়ো, আর নিজে ভারি যুবতী? যৌবনে শরীর একেবারে মাখামাখি।
মহামায়া রাগে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন, চা খেতে হয় খাও, না খেতে হয় ফেলে দাও। সাতসকালে এই হুলো বেড়ালের মতো ঝগড়া আমার ভালো লাগে না। বয়েস বাড়ছে না কমছে?
বাতের ব্যথা ভুলে মহামায়া দুম দুম করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। নাতিটা দালানের একপাশে পুতুল নিয়ে খেলছিল। দিদাকে দেখে বললে একটু চুন-হলুদ করে দেবে দিদা, আমার এই গুন্ডা ছেলেটা পা মচকে ফেলেছে।
অন্যদিন হলে কোলে তুলে নিতেন, আজ মেজাজ ভালো নেই, বললেন, তোমার মামিকে বলো।
নাতি আপনমনেই বললে, বাবা মেজাজ একেবারে টপ।
ছেলে দাড়ি কামাচ্ছিল, মহামায়া বললেন, তোর বাবা সকাল থেকেই অনশন শুরু করলেন, আমৃত্যু।
বাবা! গান্ধী রিলিজ হতে না হতেই সত্যাগ্রহ? কীসের দাবিতে অনশন?
ওঁকে নাকি আমরা সবাই উপেক্ষা করছি। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও অধম জ্ঞান করছি।
বৃদ্ধরা একটু অভিমানী হয় মা। কী করেছিলে?
কী আবার করব?
কোনও খোঁচাখুঁচি করোনি তো?
না রে বাবা, দুর্বাসা মুনিকে খোঁচাতে হয় না, পান থেকে চুন খসলেই তেলে-বেগুনে।
ঠিক আছে। তুমি আর নাড়াচাড়া করতে যেও না, আমি যাচ্ছি। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নিয়েই হয়েছে সমস্যা।
বাড়ির যা অবস্থা, ওটাকে এখন নামিয়ে দেনা বাবা।
তোমার মায়ের তিলকে তাল করা অভ্যাস। বৃদ্ধদের হ্যান্ডেল করার আলাদা কায়দা আছে। অনেকটা ট্রানজিস্টার রেডিওর মতো, শুধু টিউনিং নব ঘোরালেই হয় না। ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে হয়।
যাও তাহলে। এখন দক্ষিণমুখো বসে আছেন, পুব কি পশ্চিমমুখো করে দ্যাখো।
বলেছ ভালো। এবারে পুজোয় পশ্চিমে নিয়ে যাব, সেই কথাটাই বলি। হয়তো চিত্ত প্রফুল্ল হবে।
প্রকাশবাবুর বড় ছেলের নাম প্রশান্ত। বড় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজিকিউটিভ। দু-এক মাসের মধ্যে রাশিয়া যাওয়ার কথা আছে। তাই চিবুকের তলায় দাড়ির চাষ করছে, সযত্ন সম্পাদনায়। দাড়ির একটা আলাদা অ্যারিস্টোক্র্যাসি আছে। সেকালের জারেদের দাড়ি ছিল, একালের পলিটিশিয়ানদের থাকে। টলস্টয়ের দেশেদাড়ি ছাড়া যাওয়া যায়! প্রশান্তর সবে বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী-র নাম ঊর্মিলা। মিষ্টি স্বভাবের সুন্দরী মেয়ে। প্রকাশবাবুরই নির্বাচন। পুত্রবধূ পাশে পাশে, কাঁধে কাঁধে থাকবে, মিহি মিহি হাসবে, বাবা বাবা করবে—প্রকাশবাবুর মনে এইরকম একটা বাসনা ছিল। তা সংসার বধূটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। সারাদিনে বারকয়েক দেখা হয়। জমবার আগেই মহামায়া নামক শত্ৰুটি ডেকে সরিয়ে নেয়। সম্প্রতি হোমিওপ্যাথির চর্চা শুরু করেছেন। রুগি তেমন আসে না। খুঁজে খুঁজে বের করেন। স্ত্রী মহামায়ার হোমিও ধরবে না। পান দোক্তা খেয়ে খেয়ে সিস্টেমটাকে চড়িয়ে ফেলেছে। হোমিওপ্যাথির জন্যে নরম, সাত্বিক জমি। চাই। যুধিষ্ঠির জীবিত থাকলে আদর্শ রুগি হতে পারতেন। এক পুরিয়া ওষুধে পাশা খেলার নেশা ছুটে যেত। অতবড় কুরুক্ষেত্র আর হত না। মহাভারত লেখা হত অন্যভাবে। ভীমকে আর একটু রোগা করে দিতেন। অর্জুনের নার্ভাস ব্রেকডাউন সেরে যেত বায়োকেমিকে। কৃষ্ণ বড় টকেটিভ ছিলেন, মনে হয় ডিপ্রেশনে ভুগতেন, তারও ওষুধ ছিল। দুর্যোধন, দুঃশাসন ছিলেন। ওভারসেক্সড। এক ডোজ মাদার টিংচার ছাড়লে দ্রৌপদী বেচারির ওই অবস্থা হত না। গান্ধারীকে দিতেন ব্যার্থ কনট্রোলের দাওয়াই। হ্যানিম্যান সায়েব যে বড় দেরিতে জন্মালেন। ভেবেছিলেন পুত্রবধূটিকে মনের মতো রুগি তৈরি করবেন, তা আর না। আজ পর্যন্ত একবারও ফ্যাঁচ করে হাঁচল না। বিয়ের জল পড়ে বরং…না থাক, ওসব কথা না ভাবাই ভালো। কন্যাসমা।
এখন একমাত্র সম্ভবনাপূর্ণ রুগি মেয়ের ছেলে ওইনাতিটি। একমাত্র রোগ পেটের গোলমাল। এন্তার খাচ্ছে আর হজমের একমাত্র রোগ পেটের গোলমালে সব এলোমেলো করে ফেলছে। এ রুগিও বেশিদিনের নয়। গরমের ছুটি শেষ হলেই মিরাটে পালাবে।
প্রকাশবাবু হাঁক মারলেন, বুড়ো।
বুড়ো এই ডাকটির অপেক্ষাতেই ছিল। ছেলে এই বয়সেই অনেক কথা শিখেছে। দু-পক্ষ জোরে জোরে কথা বলে খিচাইন হচ্ছে। দাদু আর দিদা এতক্ষণ জোরে জোরে কথা বলছিল বলে ঘরে ঢোকেনি। এখন পুতুলটিকে বুকে চেপে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল,
কী বলছ দাদা?
এদিকে এসো।
তুমি কি খুব রেগে আছ?
তা একটু আছি।
তাহলে পরে আসব।
কেন?
এখন তো তুমি কিছু দেবে না।
অ, পৃথিবীতে কেবল দাও আর দাও, তাই না বুড়ো? শুধু দাও, কেবল দিয়ে যাও। আচ্ছা, তোমাকে আর কোনওদিন আসতে হবে না। মায়া, মায়া, সব মায়া!
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশবাবু তিনবার টুসকি মারলেন। এক সময় অল্পস্বল্প সংগীতচর্চা করতেন। গুনগুন করে গান ধরলেন, ভিখারি বাসনা করি হইতে চায় লক্ষপতি, লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি। আরও দু-চার লাইন এগোতে ছেলে প্রশান্ত ঢুকে ভাব চটকে দিল। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা প্রকাশবাবুর অসহ্য লাগে। রাখতে হয় পুরো রাখো ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো, নয়তো মেরে সাফ করে দাও। এ কী ধরনের ক্ষৌরী!
যাক, মুখ নীচু করে থাকাই ভালো। সংসরের কোনও কিছুর দিকে আর তাকাবেন না। প্রতিজ্ঞা। গীতা বলছেন, উদাসীন বাচরেত। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তবাবু দাঁড়িয়ে। রইলেন। গানের পরের লাইনটা মনে ভাসছে, কোটিপতি হলেও সে ইন্দ্রত্ব লভিতে চায়।
প্রশান্ত একগাল হেসে বললে, কী, মর্নিংওয়াকে যাচ্ছেন?
কানের পাশে সাবান শুকিয়ে আছে। নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা-দুটো খুসকি উড়ে যাচ্ছে। দাড়ির যত বাড়বাড়ন্ত চুলের ততটা নয়। সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। শ্যাম্পু করে ফুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রশান্তর দেহগত ত্রুটি আজ পিতার চোখে ধরা পড়ছে। স্বার্থপরের মতো নেওয়াপাতি একটি ভুঁড়ি নামছে। আলোচাল খাওয়া বিধবাদের মতো চোখমুখ ফুলো ফুলো। ভোগীর চেহারা। এ চেহারা ত্যাগীর নয়।
প্রকাশবাবু কাটা কাটা গলায় বললেন, কেন বলো তো? বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তোমাদের সুবিধে হয়?
প্রশান্ত হকচকিয়ে গেল। স্নিগ্ধ প্রাতঃকাল। পাখি ডাকছে। দিবসের এই সময়টিতে কারওর মেজাজ এমন উত্তপ্ত হয়ে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। আমতা আমতা করে বললে:
আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন।
তোমার ধারণা বুঝি সেইরকম। নিজেকে ঠিকমতো চেনো কি? কখনও অ্যাসেস করে দেখেছ? দেখার চেষ্টা করেছ কোনওদিন! পার্সেন্টেজ অফ স্বার্থপরতা কত, উদাসীনতার পার্সেন্টেজ কত, লোভ কত, লালসা কত, ভণ্ডামি কত! সময় পেলে একবার খতিয়ে দেখো।
কথা শুনে প্রশান্তর পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। আশ্চর্য! ভদ্রলোক অকারণে খোঁচা মারছেন। খেতে একটু ভালোবাসি। সে আসক্তি তো ওঁরও ছিল। এখনও আছে লালসা? সে বস্তুটা কী? মানেটা ঠিক জানা নেই। অভিধান দেখতে হবে। স্বার্থপরতা? স্বার্থপরতার কী দেখলেন? দক্ষিণের ঘরটা তো নিজেই ছেড়ে দিলেন। পশ্চিমের ঘরে সব তুলে নিয়ে এলেন। কারওর কথা শুনলেন না। এখন সারা দুপুর রোদের তাপে কষ্ট পান। শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, লোডশেডিং অর নো লোডশেডিং আমার সেই এক অবস্থা। পাখার বাতাস যেন ব্লাস্টফার্নেসের ঝাপটা। ভণ্ডামি? ভণ্ডামি মানে? তিলক সেবা করে কীর্তনও করি না, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা বব-ববম হুঙ্কার ছাড়ি না।
প্রশান্ত রাগ রাগ গলায় বললে, আপনি অকারণে আমাকে তিরস্কার করছেন। আমাকে যতটা ঘৃণিত ভাবছেন, আমি ততটা ঘৃণিত নই।
না না, ঘৃণিত হবে কেন? তুমি যথেষ্ট সম্মানিত, বড় চাকরি করো, মোটা টাকা মাইনে পাও। তুমি আধুনিক যুগের একজন সম্মানিত, অতিসম্মানিত সফল মানুষ। আরও উঠবে, আরও ওপরে উঠবে। তোমার গাড়ি হবে, তোমার বাড়ি হবে। হয় তো পদ্মভূষণ খেতাবও পেয়ে যাবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী অহংকারে মটমট করবে। তবে একটা কথা কি জানো, কেউ কেউ তোমাকে স্বার্থপর সঙ্কীর্ণ উদাসীন ভাববে।
সে কেউয়ের মধ্যে অবশ্যই আপনি একজন।
আমার ভাবায় কী এসে-যায় প্রশান্ত? আমার সব দুধ সংসার দুয়ে নিয়েছে। শুকনো গরু গোয়ালে পড়ে আছি। দু-বেলা দুটি জাবনা পাই। চারপেয়ে গরু হলে কসাইখানায় দিয়ে আসতে। তা যখন পারলে না, তখন অবহেলা, অশ্রদ্ধা, উপেক্ষা, অবমাননা দিয়ে, এক এক দিনে একশো দিনের পথ এগিয়ে দিচ্ছ। সেই মহাকসাইখানার দিকে হু-হু করে ছুটে চলেছি।
এসব কথা আপনি বলতে পারছেন?
অবশ্যই পারছি।
উপেক্ষা? আপনাকে আমরা উপেক্ষা করি? অপমান করি?
মজাটা কী জানো প্রশান্ত, তোমরা এতই উদাসীন, কী করো তা বোঝবার মতো তোমাদের বোধশক্তিও নেই। একটা উদাহরণ দেব?
নিশ্চয়ই দেবেন
আজ থেকে সাতদিন আগে তোমাকে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আনতে বলেছিলুম। মনে পড়ছে? তুমি সে ওষুধ এনেছিলে?
প্রশান্ত করুণ মুখে বলল, আজ্ঞে সাত কাজে ভুলে গেছি।
অবশ্যই ভুলে যাবে। ভুলতে তোমাকে হবেই! তুমি যে আমার পুত্র। তোমাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি। কিন্তু তোমার বউ যদি কিছু আনতে বলত, তুমি ভুলতে না, ভুলতে পারতে না। সারাদিন জপ করতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে।
আপনার এই ধারণা ঠিক নয়। আমার ভুলো মন। একটা কাজ সাতদিনের চেষ্টায় করি। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।
রাইট ইউ আর। আমি জানতুম তুমি ওই ফাঁক দিয়েই গলতে চাইবে। মহাঅস্ত্র তোমার হাতেটু আর ইজ হিউম্যান টু ফরগিভ ডিভাইন। তা হলে তোমার দু-নম্বর ক্যালাসনেসটা শোনো, মনে আছে, তোমাকে একদিন বলেছিলুম, কানে আমি একটু কম শুনছি, মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে। সঙ্গে সঙ্গে তুমি খুব বোলচাল ছাড়লে। পটপট কয়েকজন স্পেশ্যালিস্টের নাম বললে। বললে কালই আমি ব্যবস্থা করছি। দু-মাস হয়ে গেল। কাল সমুদ্রে চলে গেল। প্রশান্ত সামান্য বিব্রত হয়ে বললে, আপনি একটু সুস্থ আছেন দেখে আমি একটু সময় নিচ্ছিলুম।
সুস্থ আছি! এ খবর তোমাকে কে দিলে?
মা।
ও, তুমি আজকাল ঘোড়ার মুখে ঘাস খাও বুঝি! তোমার সঙ্গে কি আমার ভাসুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক! আমাকে একবার জিগ্যেস করতে কী হয়েছিল? কে আর ঝককি-ঝামেলা নেয়, কী বলো? বুড়ো তো বেশ আছে! ঘুরছে-ফিরছে, বসে বসে জাবর কাটছে। আমি তো তোমার শ্যালিকা নই। চিংড়ির মালাইকারি খেয়ে ঠোঁট চুলকে উঠল বলে সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশটাকা ফিয়ের ডাক্তার এসে গেল।
কী বলছেন আপনি?
ট্র, ব্ল্যাটান্ট টুথ। নির্ভেজাল সত্য। স্বার্থ ছাড়া এ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। ওই ছোট ছেলেটা, যার এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হয়নি, সেও স্বার্থ বুঝেছে। স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও নড়ে না।অন্দর থেকে মহামায়ার তর্জনের গলা শোনা গেল, খোকা চলে আয়, কথায় কথা বাড়ে, টাকায় বাড়ে সুদ। চলে আয়।
প্রকাশবাবু ভুরু কুঁচকে ছেলেকে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সরে পড়ো। বার্ধক্য বড় ছোঁয়াচে ব্যাধি, স্মল পক্সের মতো। মশারি ফেলে দিন গুণতে হয়। হ্যাঁ, যাওয়ার আগে আমার অভ্যন্তর ভাগটি অবলোকন করে যাও।
প্রকাশবাবু জামা তুলে গেঞ্জিটি দেখালেন, কী বুঝলে?
আজ্ঞে একটু লালচে হয়ে আছে।
লালচে নয় কালচে। তোমার শাসনব্যবস্থায় সাবানের বড়ই অভাব ঔরঙ্গজেব। আর তোমার গর্ভধারিণী! তাঁর কথা না বলাই ভালো। আর তোমার অর্ধাঙ্গিনী! তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আধুনিক, কমরেড।
মহামায়া আবার বললেন, চলে আয় খোকা। ঘাঁটাসনি।
প্রকাশবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে যাও। বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাজ্য। যত ঢিল মারবে, তত গন্ধ বেরোবে। যাওয়ার আগে আর একটা জিনিস দেখে যাও। এইদিকে এসো।
প্রশান্ত পিতার সঙ্গে ঘরের কোণে তাকের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। প্রকাশবাবু একটা মুখ ফাঁদালো শিশি দেখিয়ে বললেন, এটা কী জানো?
আজ্ঞে না, কড়াই-টড়াই হবে।
রাইট ইউ আর। একে বলে কুলখ কড়াই। সামান্য জিনিস অথচ এর ওপর আমার জীবন অনেকখানি নির্ভর করছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আজ্ঞে হ্যাঁ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এই তো চাই, হ্যাঁ আর না, এই দিয়েই জীবনটা চালিয়ে যাও।
হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ।
আমার কিডনি দুটো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে জানো কি?
আজ্ঞে সেই রকমই শুনেছি।
তার জন্যে তোমার কোনও দুশ্চিন্তা আছে?
আজ্ঞে অবশ্যই আছে?
যাক শুনে সুখী হলুম। তোমার মায়ের কোনও দুশ্চিন্তা আছে, না বিধবা হবার জন্যে নাচছে?
ছিঃ ছিঃ, এ আপনি কী বলছেন?
তর্কশাস্ত্র কি বলছে জানো, কার্য দেখে কারণ অনুমান করা যায়।
আজ্ঞে, ও শাস্ত্রটা আমার তেমন পড়া নেই। আপনি যখন বলছেন, তখন তাই হয়তো হবে।
এইবার এদিকে এসো।
প্রকাশবাবু ছেলেকে নিয়ে দেওয়াল ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়ালেন।
এটা কী মাস?
আগস্ট।
কত তারিখ?
সাতাশ।
কটা লাল ঢ্যারা দেখছ?
আজ্ঞে পয়লা তারিখে একটা ঢ্যারা, আর পনেরোতে একটা ঢ্যারা।
মাত্র দু-দিন। তোমার মাকে খেচকে খেচকে, অনেক জল ঘোলা করে, মাত্র দু-দিনের কুলখ কড়াই ভেজানো জল পেয়েছি। প্রতিদিন খাবার কথা। বুঝলে কিছু?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কাজের চাপে মা ভুলে গেছে।
মাই সন, কাজের চাপ নয়, শিয়ার নেগলেকট। আমার মরা-বাঁচায় তার কিছু এসে-যায় না। বুঝলে? এই হল সংসার। ছিলুম দুধেল গরু। এখন আমি গোবরে গরু। একেবারেই ওয়ার্থলেস। যাক, তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলুম। এবার তুমি যেতে পারো।
২.
মহামায়া ডাকলেন, বউমা!
দিশাহারা বউমা গুটিগুটি শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, বলুন মা।
আমার চাল নিয়েছ নাকি?
ভাত এখনও বসাইনি।
সে কী, খোকা তা হলে কী খেলে গেল?
এক গেলাস জল।
বাঃ, তোমার হাতে ছেলেটাকে তুলে দিয়ে ভালোই হয়েছে দেখছি।
আমার কী দোষ বলুন! কিছুতেই খেতে চাইলে না। বললে অশান্তির অন্নের চেয়ে উপবাসই ভালো।
ভালোই করেছে। আমিও কিছু খাব না। অনশনের প্রতিবাদে অনশন।
কী যে আপনারা করছেন মা!
বুড়োকে আমিও টাইট দিতে জানি। ভেবেছে সবাই ছাত্র।
বুড়ো বলবেন না মা। বিশ্রী শোনায়।
বুড়োকে বুড়ো বলব না তো কি ছোকরা বলব! সারাটা জীবন একা পেয়ে শুধু ধামসে গেল। আমি যেন সাঁওতালদের ধামসা রে। শরীরে দয়া, মায়া, মমতা বলে কিছুই নেই। শুধু রাগ, আর অভিমান। বাপের এক ছেলে যে, একলাফেঁড়ে তো হবেই। তোমার বয়েস হয়েছে। কচি খোকাটিও নও। কোথায় পাঁচজনকে নিয়ে হেসে-খেলে থাকবে, তা নয়, নিত্য নতুন ফ্যাঁকড়া বের করে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ধিকিয়ে ধিকিয়ে জ্বলার চেয়ে এবারে একেবারে জ্বলেপুড়ে যাক।
মা, আপনার শরীর কিন্তু ভালো নয়, লো প্রেশার। খাওয়া বন্ধ করে দিলে শরীর আরও খারাপ হবে।
সে কথাটা আমাকে না বলে তোমার দুর্বাসা শ্বশুরকে বলো।
আমার সে সাহস নেই।
তাহলে যা করছ তাই করো গে যাও। কেবল বাচ্ছাটাকে উপোস করিয়ে রেখো না।
মাগুর মাছের ঝোলভাত করে ওকে খাইয়ে দিই?
আর তুমি?
অনশন।
এই সময়টায় তোমার ভালো খাওয়াদাওয়া করা উচিত। নিজে মরো ক্ষতি নেই। পেটেরটা মেরো না। বুড়োর সঙ্গে আমার লড়াই! তোমরা এর মধ্যে জড়িয়ে পোড়োনা।
সংসারে আগুন লাগলে সকলকেই পুড়ে মরতে হবে। কী আর করা যাবে মা!
বেশ, তবে তাই হোক। ওই ওরা বলে, চলছে চলবে, আমরা বলি জ্বলছে জ্বলবে। কত্তাকে শুধু বলে দিও, আমিও আমৃত্যু অনশন চালিয়ে যাব। দেখি কার কত হিম্মত।
মহামায়া গোটাতিনেক গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার আর রুমাল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। আজ শুধু ধুয়ে যাব সারাদিন। দেখি লালকে সাদা করা যায় কি না?
প্রকাশবাবু এদিকে দাবার ছকে খুঁটি সাজিয়ে বই দেখে চাল রপ্ত করছেন। মনটাকে ঘোরাতে না পারলে মনটা ভীষণ খাই খাই করছে। মানুষের জীবনে খাওয়া বিশ্রী একটা বদভ্যাস। সারা। জীবন তো এত খেলি প্রকাশ, আর কত খাবি!
নিজেকেই নিজে শাসন করলেন। নাতিটি এসে পাশে বসেছে। আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল। খরগোশের মতো ঝকঝকে দুটি চোখ। নাতি বললে, তুমি তাহলে কী খাবে দাদু?
হরিমটর।
এই যে তুমি বললে কিছু খাবে না। মটর কী করে চিবোবে দাদু, তোমার যে দাঁত নেই!
হরিমটর চিবোতে হয় না। গিলেই খাওয়া যায়।
দিদাও হরিমটর খাবে?
দিদা কোন দুঃখে খাবে! দ্যাখো গে যাও, এতক্ষণে একগাদা চচ্চড়ি নিয়ে বসে গেছে চিবোতে।
এ রাম, তুমি কিছুই জানোনা। দিদাও তোমার মতো অনশন করেছে। আজ তো রান্নাই হয়নি।
অ্যাঁ, সে কী রে? তুই কী খেলি?
আমি ঝোল-ভাত খেয়েছি।
আর ওরা?
নাতি বুড়ো আঙুলটি দাদুর সামনে নাচাতে নাচাতে বললে, কাঁচকলা, কাঁচকলা।
অ্যাঁ, বলিস কী? বুড়ির যে আবার লো প্রেশার? শেষে বুড়ি মেরে খুনের দায়ে পড়ব নাকি?
দাদু, তুমি একটা লজেন্স খাবে?
নো-ও
বাব্বা কী রাগ!
হ্যাঁ, রাগ। রাগই হল পুরুষের ভূষণ, বুঝলি বুড়ো।
যাই, দিদাকে একটা লজেন্স খাইয়ে আসি।
তোমার দিদা এখন কোথায়?
ও-ঘরে শুয়ে আছে।
কী বলছে?
পাকা পাকা কথা বলছে। বলছে, এবার আমার যেতে পারলেই ভালো। সারাজীবন একটা লোকের অত্যাচার আর কত সহ্য করা যায়! লোকটা কে দাদা?
আমি জানি। নাতি বিজ্ঞের মতো বললে, সে লোকটা হলে তুমি।
বুড়ো ছুটে পালাল। প্রকাশবাবু দাবার ছকে খুঁটি নাড়াতে নাড়াতে অনুভব করলেন, রাগ ক্রমশ পড়ে যাচ্ছে। আর রাগ যতই কমে আসছে ততই কিছু একটা খাবার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। চারটে প্রায় বাজল। চায়ের সময়। মনটা ফসফস করছে। কিছু নেশা জীবনটাকে একেবারে নষ্ট করে। দিয়েছে। চা-সিগারেট। মহাত্মা গান্ধীর এসব নেশা ছিল না। তাই অনশন অত সাকসেসফুল হত। ফুলকো ফুলকো চিঁড়েভাজা খেতে ইচ্ছে করছে। নাঃ, রাগটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। রেগে না গেলে মানুষের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। রাগে দুর্বল মানুষও অনায়াসে জানালার শিক বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। কী নিয়ে রাগা যায়! কার ওপর রাগা যায়! কেউ যে ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইছে না। প্রকাশবাবু ঢক ঢক করে আবার খানিকটা জল খেলেন।
জল খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে উঠল। ভালোই হচ্ছে, ওয়াটার থেরাপি। জলই তো জীবন। এই সময় কেউ খাওয়ার অনুরোধ করতে এলে আবার একবার রেগে ওঠা যায়। কেউ যে আসছেই না।
ছটার সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। বেয়াইমশাই এলেন। বড় অমায়িক, আলাপী মানুষ। আজ না এলেই পারতেন। এ তো রাজনৈতিক অনশন নয় যে, নেতারা আসবেন লেবুর জল খাওয়াতে। এ হল পারিবারিক অনশন।
প্রকাশবাবু বেশ গোছগাছ করে, গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসলেন। পাশের টেবিল থেকে একটি ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। যে-সে ম্যাগাজিন নয়, বেদান্তকেশী। এক ঢোঁক জল খেয়ে শুকনো। ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মুখে একটি লবঙ্গ ফেলে রাখলেন। কুটুম মানুষ। পারিবারিক কেচ্ছা জেনে ফেললে বড় লজ্জার হবে। মহামায়াকেই ভয়। হাঁউ হাঁউ করে সব বলে না ফেলে। এমনভাবে বলবে, সব দোষ যেন আমার। যত বুড়ো হচ্ছি ততই নাকি ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছি। স্বার্থপর সংসারের বিরুদ্ধে এ আমার একক সংগ্রাম! করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। কিন্তু আমি কী করতে চাইছি, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।
সংশয়ে প্রকাশবাবুর সংগ্রামের শক্তি যেন দুর্বল হয়ে পড়ল।
বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। বেয়াইমশাই আসছেন। খুব মজলিশী মানুষ। গল্পে-গানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারেন। চতুর্দিকে ফলাও ব্যবসা। প্রচুর অর্থ। মধুপুর, শিমুলতলায় বাড়ি। খানদুয়েক গাড়ি। দক্ষিণ কলকাতায় হাল ফ্যাশানের বাড়ি।
সত্যেনবাবু দরজার বাইরে চটি ছেড়ে হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢুকলেন। দুই বেয়াই প্রায় সমবয়সি। ইনি একটু হৃষ্টপুষ্ট, উনি শীর্ণ। ইনি আনন্দপ্রধান, উনি রাগপ্রধান।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে সত্যেনবাবু বললেন, কেমন আছেন বেয়াইমশাই?
ওই চলছে একরকম। চলে যাচ্ছে কোনওরকমে।
আপনি কি কোনওদিন ভালো বলবেন না?
যে টেকনিকে ভালো বলা যায়, সেই সিলভার টনিক আমার আয়ত্তের বাইরে। আমার পৃথিবী হল অ্যানিমিক পৃথিবী। দিনগত পাপক্ষয় করে চলে যাওয়া।
সব সময় অমন বেসুরো বাজেন কেন বেয়াইমশাই! একটু সুরে বেজে দেখুন না, বেশ ভালো। লাগবে। সব সহজ হয়ে যাবে। এখানে কাঁদতে এসেছি, না হাসতে এসেছি?
মশাই, আপনার চোখে এক রকম চশমা, আমার চোখে আর এক রকম চশমা। দুজনের দেখা কি সমান হতে পারে?
আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কথায় আমি পারব না। দয়া করে গাত্রোখান করুন। ধুতি পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে নিন।
কেন বলুন তো! আজ আর আমি আপনার কোনও অনুরোধ রাখতে পারব বলে মনে হয় না। একটু বেএক্তার হয়ে আছি।
সেই জন্যেই ঈশ্বর মনে হয় আমাকে পাঠালেন। উঠুন উঠুন। আপনার কোথায় কী আছে বলুন, হাতের কাছে এনে দিই।
না, না, সে কী কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো?
জীবনে আপনি এমন সুন্দর কীর্তন কখনও শোনেননি। মম্মমহাপ্রভু জগৎসুন্দর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে চৈতন্যআশ্রমে একটি মাত্র অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। রাত আটটায় শুরু। জন্মাষ্টমীর প্রাককালে একটি রজনী। চলুন, চলুন, মনটাকে একটু ভিজিয়ে আসি। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…
সত্যেনবাবু আপন মনে গান ধরলেন। গলা শুনলেই বোঝা যায় একসময় সংগীতচর্চা করতেন। দু-লাইন গেয়ে গান থামিয়ে সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ানের কী হল! আজ নীরব কেন কবি, ফুলের জলসায়!
উদাত্ত কণ্ঠে বেয়ান, বেয়ান করতে করতে সত্যেনবাবু অন্দরের দিকে এগোলেন। বাবার গলা শুনে শর্মিলা এগিয়ে এল, তুমি কখন এলে?
তা মিনিট পনেরো হবে। কত্তার সঙ্গে কথা বলে এলুম। আমার বেয়ান কোথায়?
মা শুয়ে আছেন।
অ্যাঁ, সে কী রে! ভর সন্ধেবেলা শুয়ে থাকার মানুষ তো তিনি নন। হ্যাঁ রে, শরীর ঠিক আছে তো!
শর্মিলা কী আর বলবে। আমতা আমতা করে বলল, এই উপোসটুপোস চলছে তো!
উপোস? অম্বুবাচি তো হয়ে গেছে?
আঃ বাবা, কী বলছ তুমি? অম্বুবাচি বিধবারা করেন।
আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম অফুলি সরি।
ওদিকে প্রকাশবাবু ঝট করে একটুকরো কাগজে লিখলেন, দয়া করে বাইরের কুটুমের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলোনা। লজ্জায় তা হলে মাথা কাটা যাবে। ফিশফিশ করে বুড়োকে বললেন, যা চুপিচুপি তোর দিদার হাতে গুঁজে দিয়ে আয়।
মহামায়া চিরকুটটা পড়ে হু: করে একটি শব্দ ছাড়লেন। শর্মিলা ঘরে ঢুকে বললে, বাবা এসেছেন।
শুনেছি।
মহামায়া মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরের বাইরে এলেন।
সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ান, ঝট করে রেডি হয়ে নিন। কত্তাকে খাড়া করেছি কোনও রকমে।
মহামায়া মৃদু গলায় বললেন, শরীরটা আজ তেমন জুতের নেই।
শরীর? সত্যেনবাবু হইহই করে হেসে উঠলেন, শরীর ঠিকই আছে বেয়ান। মনটা গোলমাল করছে। সেই মনের দাওয়াই মিলবে এখুনি। আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
উপাদেয় কীর্তন। জীবনে হয়তো আর শোনার সৌভাগ্য হবে না। নিন, নিন, গেট রেডি।
মহামায়া ধরা ধরা গলায় বললেন, বউমা, একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।
সত্যেনবাবু বেয়াইয়ের কাছে এসে বসলেন। প্রকাশবাবু জামা-কাপড় পরে ফেলেছেন। পেট জ্বলছে। গলা শুকনো। ঠোঁট খসখসে। ছাত্রজীবনে শিবরাত্রির উপবাস করেছিলেন একবার। সেই স্মৃতি মনে পড়ল। রাতের দিকে কাহিল অবস্থা। নির্জলা উপবাস। পুজোয় বসে আচমনের নামে কোষাকুষি থেকে ঢোঁকে ঢোঁকে গঙ্গাজল গিলতে লাগলেন। আজ যেন সেই শিবরাত্রির উপবাস।
সত্যেনবাবু বললেন, চলুন, এবার পুজোয় সকলে মিলে, মধুপর কি শিমুলতলা ঘুরে আসি।
মনে মনে ভাবলেন, ততদিনে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আজ ঘুরছি। কাল শয্যা নেব। পরশু খাবি খাব। পরের দিন পরপারে।
শর্মিলা বাবার জন্যে চা আর জলখাবার নিয়ে এল।
বেয়াইমশাই আপনার?
আজ্ঞে, আজ আমার উপবাস, আপনি গ্রহণ করুন।
ও, স্বামী স্ত্রী দুজনেরই উপবাস। আজ কী বার? শনিবার। ভালো, খুব ভালো। আমারও খুব ইচ্ছে করে একটা কিছু পালন করি। করি করি করে করা আর হয় না।
এটা ঠিক ধর্মীয় নয়। বলতে পারেন স্বাস্থ্যের জন্য। উপবাসে শরীর আর মন দুটোই খুব শুদ্ধ হয়। লাগাতার উপবাসে নির্বাণ লাভ হয়।
এ আপনার কার কথা, বুদ্ধদেবের?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সত্যেনবাবু ঢ্যাঁপা ঢ্যাঁপা খাস্তা কচুরি খাচ্ছেন। বড় প্রিয় জিনিস তাঁর। প্রকাশবাবুরও প্রিয়। কে যে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন? তাঁর নামে একটি মঠ দেওয়া উচিত।
সত্যেনবাবু কচুরির তারিফ করে বললেন, আপনার সামনে বসে খাচ্ছি, আর নিজেকে কেবলই মনে হচ্ছে বিধর্মী।
ও সব ভাববেন না। আহারের সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই।
কথায় কথায় আহারাদি শেষ হল। মহামায়া একটি লালপাড় শাড়ি পরেছেন। কপালে সিঁদুরের গোল টিপ। মুখটা খুব শুকনো লাগছিল বলে ছোট্ট একটা খিলি পান পুরেছেন। চুলে সামান্য পাক ধরেছে। ফরসা টকটকে রং। টিকানো নাক। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে বাগবাজারের মা জগদ্ধাত্রীর কথা মনে পড়ে।
প্রকাশবাবু স্ত্রীকে দেখে মনে মনে তারিফ করেই, মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন। স্বার্থপর! এর নাম অনশন! মুখে পানের খিলি! দুপুরে শরবত-টরবতও চলেছে বোধহয়। হেঁশেল যার হাতে, তার আর ভাবনা কী। রাগ থিতোলে অভিমান হয়। প্রকাশবাবুর ভেতরে অভিমানের বান। ডেকে গেল। দুপুরে আর একবার খোশামোদ করলেই অনশন ভঙ্গ হয়ে যেত। এতবড় অহংকারী মেয়েমানুষ গোঁ ধরে বসে রইল। অঃ, রোজগেরে ছেলের অহংকারে দেমাকে মাটিতে যেন পা পড়ছে না! বুড়ো ব্যাটা মরলেও ছেলে সিংহাসনে বসিয়ে তো দেবে।
মহামায়া সত্যেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। প্রকাশবাবু পেছন পেছনে চলেছেন। গুমরোতে গুমরোতে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, সদাহাস্যময় ভোজনবিলাসী ওই বণিকটি কার টানে প্রায়ই ছুটে আসেন! নীচ ভাবনা হলেও ভাবতে হচ্ছে।
গাঢ় নীল রঙের ঝকঝকে গাড়ি, গুমোরে যেন গুম মেরে আছে। সাদা উর্দিপরা চালক। পেছনের দরজা খুলে সত্যেনবাবু মহামায়াকে বললেন, উঠুন বেয়ান।
প্রকাশবাবুর ভেতরটা রাগে কষকষ করছে। বেয়ানের খাতির দেখো! বেয়াইটা যেন ফেউ! বানের জলে ভেসে এসেছে।
সত্যেনবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, বেয়াইমশাই আসুন, আসুন।
প্রকাশবাবু বেশ কঠিন গলায় বললেন, আমি সামনে বসব।
আপনারা দুজনে আরাম করে পেছনে বসুন।
না, না, হর-পার্বতীকে পেছনে রেখে আমি চলব সামনে। আসুন, আসুন।
প্রকাশবাবু আরও কঠিন গলায় বললেন, পেছনে বসায় আমার একটু অসুবিধে আছে। বেয়াইমশাই। আপনারা দুজনে বসুন, আমি সামনে যাচ্ছি। আর তাতেও যদি অসুবিধে হয়, আমি ফিরে যাই।
সত্যেনবাবু গাড়ির খোলা দরজায় হাত রেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহামায়া ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। এগিয়ে গেলেন বাড়ির দরজার দিকে। সিঁড়ির কাছাকাছি এসে আর পারলেন না। সিঁড়ির হাতলে মাথা রেখে কান্নায় ফুলতে লাগলেন। এই চওড়া লালপাড় শাড়ি, গহনা, জাপান, পালঙ্ক—সবই একটা মানুষের মর্জি। যখন খুশ মেজাজে তখন তুমি আমার সোহাগের স্ত্রী। মেজাজ বিগড়ালেই মানসিক নির্য্যাতন! ঠিক ওই কথাটাই মনে এল মহামায়ার— স্ত্রী হল প্রয়োজনের পিকদান।
সত্যেনবাবু তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলেন, কী হল বেয়ান! নেমে এলেন কেন? কাঁদছেন কেন?
মহামায়া কোনওক্রমে বললেন, আমি যাব না।
প্রকাশবাবু দু-পাদূরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যেনবাবু সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েদের মনে দুঃখ দেন কেন? আপনি পণ্ডিতমানুষ এইটুকু বোঝেন না, যেসংসারে মেয়েরা হাসতে পারে না, সে সংসারের কখনও উন্নতি হয় না। মরুভূমি হয়ে যায়।
মহামায়া ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলেন। পেছন পেছন এলেন সত্যেন আর প্রকাশ। প্রকাশের মনে খুব লেগেছে। বড় নীচ হয়ে গেছেন তিনি। অপমানিত মহামায়ার করুণ মুখ বড় দাগ কেটেছে মনে। সারাজীবন অনেক টর্চার করেছেন। নির্য্যাতন করে এক ধরনের আনন্দ পেয়েছেন। আমি এক ঘৃণ্য স্যাডিস্ট।
ধীরে ধীরে পা থেকে চটি খুললেন। ডান হাতে তুলে নিলেন একপাটি চটি। সত্যেনবাবু অবাক হয়ে মানুষটিকে দেখছেন। লম্বা বারান্দা ধরে মহামায়া এগিয়ে চলেছেন পায়ে পায়ে।
প্রকাশবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।
সত্যেনবাবু আতঙ্কের গলায় বললেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সে কী কথা!
জুতো, জুতোই তোমার দাওয়াই।
নিজের গালে পটাপট জুতো মারতে লাগলেন।
এ কী, এ কী করছেন আপনি? সত্যেনবাবু হাত চেপে ধরেও সামলাতে পারছেন না। শরীরে অসুরের শক্তি এসে গেছে।
জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দাও। এই নিন আর একপাটি। পটাপট মারুন।
মহামায়া দ্রুতপায়ে ঘুরে এলেন, এ কী করছ তুমি? এ কী পাগলামি!
ক্ষিপ্ত প্রকাশবাবু নেচে উঠলেন, মারো, মারো, পটাপট মারো। ডাকো প্রশান্তকে, ডাকো বউমাকে। সবাই মিলে পেটাও। এই অত্যাচারী বুড়োটাকে জুতোও, জুতোও। জুতিয়ে সিধে করো। মহামায়া স্বামীকে জাপটে ধরলেন। হু-হু করে কাঁদছেন আর বলছেন, তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেলে? মহামায়ার শীতল আলিঙ্গনে প্রকাশবাবুর শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে এল। শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠেছে। ঘোর লেগে গেছে। মহামায়াকে আর মহামায়া বলে মনে হচ্ছেনা। বহুকাল আগের এক অনুভূতি ফিরে আসছে। উনিশশো চুয়াল্লিশ সাল। টাইফয়েড হয়েছে। দাওয়ায় বসিয়ে মাথায় জল ঢেলে, মা বুকে জড়িয়ে ধরে, ধীরে ধীরে ঘরের দিকে নিয়ে চলেছেন।
মহামায়া ধীরে ধীরে স্বামীকে খাটে শুইয়ে দিলেন। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন, ইস ডান গালটার কী অবস্থা করেছে!
প্রকাশবাবু বললেন, আমি একটু জল খাব।
শর্মিলা দরজার কাছে। মহামায়া বললেন, বউমা এক গেলাস ঠান্ডা জল দাও। ফুল স্পিডে। পাখা ঘুরছে। সত্যেনবাবু একপাশে বসে স্বামী-স্ত্রী-র অপূর্ব লীলা দেখছেন। শর্মিলা ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করে ভাবতে লাগল, শুধু জলে তো অনশন ভঙ্গ হয় না। ফলের রস দিতে হয়। এক বোতল আঙুরের রস আছে। গোটা চারেক মুসুম্বি আছে। প্রশান্ত একটা ক্রাশার কাম মিক্সার কিনে এনেছে কাল। আজই তার উদ্বোধন হোক। মিক্সার চলছে ঘির ঘির করে। মুসুম্বির নরম শরীর ঘেঁতো হচ্ছে। দলা পাকাচ্ছে। রস বেরোচ্ছে। শর্মিলার হঠাৎ মনে হল—এরই নাম সংসার। যত চটকাবে তত রস বেরোবে। সব যেন ঘানির সরষে। পেষাই না হলে তেল বেরোয় না।
হাইওয়ে
আমরা তখন হাঁটতে হাঁটতে সেই দোকানে গিয়ে বাঁশের বেঞ্চির ওপরে তিনজন বসলুম। বেশ ক্লান্ত। আমাদের তিনজনেরই কপালে ঘাম জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। বলতে গেলে সূর্য ওঠার আগে। প্রথমে আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল। চারিদিকে গাছগাছালি। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে। শহরের সীমানার শেষে এই গ্রাম্য পরিবেশ। একটা-দুটো পুকুর। একটা-দুটো পাতিহাঁস। একদিক দিয়ে চওড়া সড়ক বেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর পথের যাত্রীবাহী বাস হু-হু করে ছুটে চলে যাচ্ছে। মালবাহী লরি। কোনও কোনও ড্রাইভার স্ফুর্তিতে গান গাইতে গাইতে চলেছে।
প্রথম প্রথম আমরা পরস্পর অল্প অল্প কথা বলছিলুম। তারপর যত রোদ চড়েছে, পায়ের ডিম চলার ক্লান্তিতে শক্ত হয়েছে, কথাও ফুরিয়েছে। কী দরকার ছিল এত হাঁটার। সোজা বাসে করে এলেই চলত।
পথের পাশের দোকান—তার একটা আলাদা আকর্ষণ। বাঁশের বেঞ্চির তলায় দূর্বাঘাসের জাজিম বিছানো। দোকানির উনুনে চায়ের জল ফুটছে কালো কেটলিতে। দূরে একটা বাচ্চা মেয়ে গাছের ভাঙা ডাল কুড়োচ্ছে। খড় বোঝাই গরুর গাড়ি মন্থর গতিতে চলেছে। চাকায় তেল শুকিয়েছে, ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ উঠছে। দোকানের দিকে পেছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা তিনজন বসেছি। দূরে সবুজ মাঠ আকাশের কোলে গিয়ে মিশেছে। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছি। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।
দোকানির দিকে না ফিরেই সুব্রত বললে—
তিনটে চা দাও, বিস্কুট-টিস্কুট কিছু আছে?
এজ্ঞে সে যা আছে তা কি আপনাদের চলবে?
আরে চালালেই চলবে, দুখানা করে দিয়ে দাও।
বুঝলি নৃপেন—দূর মাঠের দিকে চোখ রেখে সুব্রত বললে—এসব দেশি বিস্কুটের একটা আলাদা টেস্ট।
সে তো বুঝলুম,—পরেশ একটু খুঁতখুঁতে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তো কথাই নেই। সাজ পোশাক সব কিছুতেই ভীষণ পিটপিটে। এই রাস্তার ধারের চা, ধুলোভর্তি বিস্কুট সে খাবে হয়তো পাল্লায় পড়ে কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তার ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব চলবে। পরেশ তার আপত্তিটা একটু ঘুরিয়ে প্রকাশ করল—আমি একবার একটা ছোট বেকারি দেখেছিলুম বুঝলি—সে একবারে। নরক। হেলথ অ্যান্ড হাইজিনের কোনও বালাই নেই। শালা পা দিয়ে ময়দা ঠাসছে। বুঝলি ময়দা আর ভেলিগুড়ের বস্তা পাশাপাশি। বর্ষায় রাস্তার নোগ্রা জল ঢুকে একাকার।
আরে রাখ তোর একাকার। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পাবি পেটে পুরবি। আজ আর তোর নিস্তার নেই। পড়েছ মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।
দোকানির মেয়ে চা আর সাদা সাদা বিস্কুট রেখে গেল আমাদের পাশে। ছোট ছোট গ্লাসে কালচে কালচে চা।
চায়েরই কত রকম রূপ দেখ। গ্র্যান্ডের প্রিনসেসের চা, ময়দানের টি-বোর্ডের গাড়ির চা, তোমার বাড়ির মাসিমার সেই গঙ্গাজলের চা, স্টেশনের চা…
তুই একটু থামবি পরেশ। তোর চা-তত্ব, ওটা টি-বোর্ডে গিয়ে শোনাস, চায়ের শতনাম।
সুব্রত একটা চুমুক দিয়ে বলল,—অসাধারণ। শালা কী সুপারফাইন টেস্ট। বিস্কুটটা যেন নিরেট এক টুকরো শুকতলা।
এখানে কীসের চাষ বেশি হয়?
এজ্ঞে আলু। আলুই তো এ অঞ্চলের সেরা ফসল।
পয়সা থাকলে একটা কোল্ড স্টোরেজ করতুম। ভীষণ লাভ বুঝলি। মনে আছে সেই আমাদের সঙ্গে কলেজে একটা ছেলে পড়ত। বাবার কোল্ড স্টোরেজ ছিল। ছেলে দু-হাতে পয়সা ওড়াত। কম কাঁঠাল ভেঙেছি আমরা তার মাথায়, মনে আছে তোর?
তুই কোল্ড স্টোরেজ করলে আমরা সব কিছু ছেড়ে আলুর চাষে নেমে পড়ব। তোর কোল্ড স্টোরেজ আমাদের আলু। অসাধারণ ব্যাপার, কী বলিস?
তুই শহরে বাড়ি করবি হাল ফ্যাশানের, সুইমিং পুলে তোর ওই ভুড়িদাস চেহারা কস্টিউম পরে ভাসবে। গ্যারেজে ঝকঝকে গাড়ি, কলকাতার মেয়েমানুষ, মদের বোতল। শালা আইডিয়াল শিল্পপতি। আর আমরা কাদামাখা চাষা আলুর চাষ করে মরব।
আর আমি ক্রেতা, তোরা দুজনে বাজারে আলুর দাম বাড়াবি-কমাবি, তোদের কেরামতিতে অসাধারণ আনন্দে থাকব।
কোথায় শুরু করেছিলুম কোথায় চলে এলি। একে বলে ডে ড্রিমিং—একটা মনস্তাত্বিক বিকার। মেয়েটা দেখ। যেন টাটকা পালংশাক। দেখেছিস সুব্রত কী ন্যাচারাল বিউটি!
তুই দেখ। আমি দেখব না! আমার স্ত্রী শুনলে রাগ করবে।
খুব সাধু হয়েছিস। বলব তোমার কথা? ভাঙব হাটে হাঁড়ি? তুমি কী বলেছিলে একদিন। কোথায় গিয়েছিলে!
পুরোনো কথা। আমরা সবাই গিয়েছিলুম। তোকে প্রাইভেটলি বলছি—শিখা আর সেই বাজারের মেয়েদের কোনও তফাত খুঁজে পাই না ইদানীং। সেই একই ছলাকলা। সেই অনাবৃত ফালি কোমর, কাপড় কীভাবে রেখেছে সেই জানে। ব্লাউজের হাতা দুটো কেটে বাদ দিয়েছে। ব্রা-র ফিতে কাঁধের পাশে উঁকি দিচ্ছে। সেই খোঁপার বাহার। তফাত কোথায়! কিছু আদায় করার দরকার হলেই সেক্স ছুড়ে মারবে। সেই এক ধরন, সেই এক মোডাস অপারেন্ডি।
চা-টা বেশ গরম ছিল! চা গরম হলেই হল। ফ্লেভার-টেলভার আর কোথায় পাবি? চল্লিশটাকা পাউন্ডের চা হলে তবে হয়তো কিছু গন্ধ পাওয়া যাবে।
মাটির গন্ধের কাছে আর কিছু লাগে না। কেমন ভিজে ভিজে সোঁদা সোঁদা গন্ধ। অসাধারণ!
রেবেকার কথা মনে পড়ে? কী একটা বিলিতি সেন্ট মাখত। খুব ফিকে অথচ কেমন একটা গুমোট গন্ধ। গন্ধ আর রেবেকা, রেবেকা আর গন্ধ যেন অনেকটা, ওই কী যেন বললি—মাটি আর গন্ধের মতো।
রেবেকার কথা এখনও ভুলতে পারছিস না?
চাষা কি মাটির কথা ভুলতে পারে–না ভুলে থাকতে পারে।
কোথায় চাষা, কোথায় মাটি আর কোথায় রেবেকা! পাগল হয়ে গেছিস।
মেয়েরা মাটির মতো উর্বর আর শ্যামল। মনে পড়ে সেই নিরঞ্জনের কথা। ভোরবেলা আমরা তাকে খুঁজে পেলুম। হাত-পা ছড়িয়ে কেমন নিশ্চিন্তে শিশির ভেজা মাটির ওপর ঘাড় গুঁজে পড়েছিল। রেবেকার বুকে মুখ গুঁজে আমার মাটির কথা, মাটির গন্ধের কথা মনে হত। মনে হত গুড়ো গুড়ো হয়ে রেবেকার শরীরে মিশে যাই।
আরও তিনটে চা দাও হে। বেশ যেন গরম থাকে।
কী অসাধারণ শরীর দেখ মেয়েটার। পোড়া পোড়া রং। রোদে ঝলসানো। রিয়েল সানট্যান। কী মনে হচ্ছে জানিস—যেন মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট।
শিখার কথা মনে আছে। ঠোঁটে সাদা সাদা দগদগে ঘায়ের মতো লিপস্টিক, পাছা ল্যাপটানো। শাড়ি, ঘাড়ের ওপর টেনে তোলা খোঁপা, ভিজে টয়লেটের মতো একটা ঘিনঘিনে ভাব হত ওকে দেখলে।
কটা বাজল?
কী হবে সময় দেখে? এখনও অনেক সময় আছে।
কী নাম বললে তোমার?
এজ্ঞে সুকুমার।
আর একটু চিনি আন তো খুকি।
হাসছে দেখ ফিকফিক করে। মেয়েদের খুকি বললেই হাসে। আসলে ও খুকি নয় কিশোরী। দেহের পাপড়ি খুলছে, মন উড়ছে তার চারপাশে ভ্রমরের মতো।
কী নাম বললে তোমার? সুকুমার? কোথায় দেশ ছিল?
ওপার বাঙলায়।
ঠিক ধরেছি শরণার্থী, না হয় উদ্বাস্তু। যা হয় একটা কিছু হবে। আমাদের মতোই এ অঞ্চলে প্রক্ষিপ্ত। না ঘরকা না ঘাটকা। তা বেশ করেছ, বসে না থেকে লড়ে যাও।
এজ্ঞে লড়াই খুব হয়েছে। খান সেনাদের সঙ্গে খুব লড়েছি আমরা। আমার বড় ছেলে এজ্ঞে মুক্তিফৌজ।
কী শয়তান দেখ। প্রথম ধাক্কাতেই হয়তো হুড়মুড় করে পালিয়ে এসেছে। এখন ওই মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে হিরো হতে চাইছে। গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে।
তুই ভয়ানক সিনিক। লোকটা সাফার করেছে। আরে লড়াই একটা সামগ্রিক ব্যাপার সকলকেই তা কোনও না কোনওভাবে স্পর্শ করে যায়।
তা অবশ্য ঠিক। চা-টা ভীষণ কম দিয়েছে। দু-চুমুকেই শেষ। কীরকম প্রফিটিয়ারিং টেনডেনসি, দেখেছিস। শেখাতে হয় না, শিখে যায়। ওই ব্যাপারে কি গ্রামের মানুষ, কি শহরের মানুষ ফাদার দে আর অন দি সেম বোট-হাঃ হাঃ হাঃ।
অত জোরে হাসলি কী রে? ফুসফুসে যদি কোনও ডিফেক্ট থাকে শালা পাংচার হয়ে পটল তুলবি। তারপর ক্লেম কবি হাম ভি শহিদ।
দেখবি সেক্সের ব্যাপারেও সবাই সমান। গ্রেট ইকুয়ালাইসার। দেখলি না ওদেশেকী হল? মরতে-মরতে মারতে-মারতে মেয়েগুলোকে নিয়ে কী কাণ্ড করলে? দেখবি শক্তি আর ব্যভিচার যেন জড়িয়ে মুড়িয়ে আছে।
তা বলতে পারিস। শিখাকে ওই একটা সময়েই যেন ভালো লাগে, অন্য সময় যেন মনে হয় একটা ডার্টি টাওয়েল।
কতক্ষণ বসে আছি আমরা?
কপয়সা হল তোমার সুকুমারবাবু?
এখন আমাদের কিছু সুবিধে হবে—কী বলিস? ভালো ভালো মাছ আসবে—যশোরের কই, সিরাগঞ্জের রুই। বাজারে মাছের দাম হু-হু করে কমবে।
শুধু মাছ কেন রে, চাল, নারকেল, তরি-তরকারি। অসাধারণ ব্যাপার হবে, কী বলিস?
রেপ অফ বাংলাদেশ তোরাই সম্পূর্ণ করবি। তোমরা সব আস্তিন গুটিয়ে পঙ্গপালের মতো গিয়ে পড়বে। মনের আনন্দে সব বাগিয়ে-টাগিয়ে, খেয়ে-দেয়ে, গায়ে-গতরে হয়ে সাফারিং হিউম্যানিটির জন্যে গলা ছেড়ে কাঁদবে। সুবিধাবাদী শয়তানের দল!
মূর্খ, দুটো দেশের মধ্যে একটা ট্রেড ডেভলাপ করবে না? ইডিয়ট। মাটির ফসল, জলের মাছ, মানুষের শ্রমের উৎপাদন কি জমিতে পড়ে পচবে?
আমরাও কি কম সাফার করেছি? ওই শরণার্থীদের চাপ, এইট্যাক্সেশান, এই যুদ্ধ, সেই পার্টিশান, এই বেকারি, ওই রাজনৈতিক খুনোখুনি কী সব অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে এই দেহতরি দুলে দুলে চলেছে।
অনেক দিন দেহতত্বের কোনও গান শোনা হয়নি। এদিকে খুব ভোরে এলে হয়তো কোনও বাউল-টাউলের গান শোনা যেত।
ওরা এখন সব আমেরিকায় চলে গেছে। কলকাতায় আসর মারছে—কোথায় পাবি তারে তোর মনের মানুষ যেরে।
দেহতত্ব বড় শক্ত জিনিস রে! মনে আছে নিখিল কতবার অ্যানাটমিতে ফেল করেছিল? কী সব শক্ত নাম দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সোলার প্লেকসাস, মেডুলা অবলঙ্গেটা, দাঁত ভেঙে যায়।
দুর, দেহতত্ব ব্যাপারটা অন্যরকম। বুঝেছিস—সেটা খুব কোমল, অনেকটা নরম একটা কাবুলি বেড়ালের গায়ে হাত বোলাবার মতো অনুভূতি।
শিখার কাছে আমি অনেক দেহতত্ব শিখেছি। সে একটা দেহতত্বের স্কুল খুলেছে ইদানীং বেশ ভালো রোজগার, জমজমাট ব্যবসা।
ঘুরে ফিরে সেই এক কথা। শিখা, শিখা, শিখা।
ও শালা পাগল হয়ে যাবে, ডেফিনিট, কোনও সন্দেহ নেই।
সুকুমারের দোকানের একটা বৈশিষ্ট্য দেখলি বেশ নিঝঞ্চাট। কোনও খদ্দেরপত্তর নেই। ডেলি কপয়সা হয় তোমার?
এজ্ঞে আমাদের বিক্রি-টিক্রি সব রাতের বেলা। এদিকের এই স্টাইলের দোকানের এই রীতি।
বাবা, বলে কী রে? এ যেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সূর্য ডুবলেই ভিড় বাড়ে। ভেলপুরী উড়ছে, ফুচকা ফুটো হচ্ছে, আইসক্রিম জিভে গলছে, এলাহি ব্যাপার!
এদিকে রাতেই খদ্দের বাড়ে, কেন জানিস? যত দূরপাল্লার পাড়ির পথ বিশ্রাম, পান্থশালা।
সেই জিনিস পাওয়া যায় নাকি রে—সেই সর্বসুখপ্রদ ক্লান্তি হরণকারী, অতি মনোহর।
যায় যায়, ওইটাই তো আসল রোজগার।
সুকুমারবাবু একটু আসল মাল ছাড়বে?
কী যে বলেন বাবু এজ্ঞে।
সুকুমার, কেন বাবা টালবাহানা করছ। খদ্দের লক্ষ্মী, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে আছে ম্যান?
দেখবি আমাদের কাছে কিছুতেই ভাঙবে না। সাধু সেজে যাবে। যেন কিছুই জানে না।
আসলে ও সব জানে। ব্যাটা মেয়েছেলেও সাপ্লাই করে, হয় পয়সা না হয় জোর এই দুটোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে শিখেছে।
আমাদের কোনওটাই নেই, কী বল? আমরা চুকচুক করে ছোটছেলের মতো চা খাব কী বল? আমরা ওর এলেবেলে খদ্দের।
সুকুমার, ভালো কথায় বলছি ভণ্ডামি না করে তিন পাত্তর মাল ছাড়ো।
কী যে বলেন বাবু। বেশ তো বসে বসে চা খাচ্ছিলেন আর গল্প করছিলেন কী যে মাথায় ভূত চাপল।
ও বোধহয় আমাদের পুলিশের লোক ভেবেছে।
আরে দুর, এসব লাইনে পুলিশকে ওরা ভয় পায় না। আসলে জেদ। প্রচণ্ড জেদ। আমরাও ছাড়ব না, ও-ও দেবে না। কম শয়তান! ও একটা সার্কেলে ঘোরে। এসব হচ্ছে চক্রের ব্যাপার।
ভৈরব চক্র তাই না?
করাপ্ট শালা। পরগাছা প্যারাসাইট। দেখছিস না পথের ধারে গ্রাম ঘেঁষে বসে আছে। গ্রামের সুবিধে নিচ্ছে আর শহরের পাপগুলো এখানে আমদানি করছে। প্রু আউট দ্য হাইওয়ে তুই এদের দেখবি।
ঠিক বলেছিস। মাঠের মানুষ ঘন ঘন চা খায় না। তারা আঁজলা ভরে বিশুদ্ধ জল খায় তেষ্টার সময়। এসব হল মর্ডান ভাইসেস। বেটা শয়তানের দোসর।
ব্লাডারে চোলাই মাল আসে, আর ওই নিরীহ সরল লোকগুলো এর ফাঁদে পা দিচ্ছে।
আবার মুখে কত বড় বড় বুলি। লড়াই, মুক্তি সংগ্রাম।
আসলে লোভের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম। অসাধারণ সংগ্রাম।
সুকুমার, সুকুমারই তো বললে, নাকি? সুকুমার, বেশি সাধুগিরি ফলিও না। ঝট করে তিন পাত্তর ঢেলে ফেলো বাবা, কেমন।
এজ্ঞে সেই যে আপনাদের এক গোঁ। তিনটে চা দেব বাবু, বেশ মোটা করে দুধ দিয়ে।
শালা ন্যাকা সেজে পার পাবে! নিকালো আভি নিকালো মাল।
এই সুব্রত, সুব্রত ছেড়ে দে, মরে যাবে বেটা।
ছেড়ে দেব, আগে বের করুক মাল। শালা আগেই কবুল করুক যে ও নরকের পথে ব্যবসা করছে।
সুব্রত দাঁড়া, দাঁড়া, অন্য রাস্তায় এর স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে।
কী যে করিস সামান্য ব্যাপারে। ওই দেখ মেয়েটার মুখ কীরকম কাঁদো-কাঁদো করুণ হয়ে গেছে।
ও-ও তো ওই শয়তানের দোসর। দেখছিস না ওর চোখে-মুখে পাপের ছায়া। মোটেইইনোসেন্ট নয়, রাতের বেলায় ওর চেহারাই অন্যরকম দাঁড়ায়।
এইবার দেখ কোনওরকম বলপ্রয়োগ নয়, কীরকম সুর-সুর করে সব বলে দেবে। এটি বাছাধন খেলনা পিস্তল নয় আসল কোল্ট।
একটা লক্ষ্যভেদ করে শালার পিলে চমকে দে না।
বেশ ওই ছবিটা টার্গেট, কী বলিস। মা কালীর ছবি ঝুলিয়ে যত অনাচার তাই না? ওয়ান টু থ্রি… বিউটিফুল! কাঁচগুলো ভেঙে দুধের ডেকচিতে পড়ল।
বাবা সুকুমার এবার কবুল করো।
এজ্ঞে কিছু মাল তো রাখতেই হয়। নানারকম খদ্দের তো আসেই। এই যেমন আপনারা।
চোপ শালা, টিটকিরি! খুলি উড়িয়ে দেব।
কোথায় আছে?
এজ্ঞে ওই জালার ভেতরে।
সুব্রত দেখে আয় তো।
ওরি ফাদার! আগুন বোতল—সব মাকালী মার্কা।
সুকুমার, আর কিছু? রাতে আর কী কী হয়? তোমার মেয়ে?
এজ্ঞে ওকে তো দোকানেই থাকতে হয়। কে আর আমাকে সাহায্যে করবে? একলা লোক। কত রকমের খদ্দের।
কী শয়তান! ওই ফুলের মতো মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা!
দে না বেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে। তারপর চল মেয়েটাকে নিয়ে যাই। ওকে বাঁচতে দে। ওকে ওর মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে।
কার জন্যে ভাবছিস? ওই দেখ শয়তানের বাচ্চা শয়তানই হয়। ওই দেখ লোহার রড তুলেছে। সাবধান সুব্রত। ফায়ার!
কী হল খুকি? এদিকে এসো। এসো এদিকে। ফেলে দাও রড! এই তো লক্ষ্মী মেয়ে!
এজ্ঞে বাবু দোকানের পেছনে একটা ঘর আছে। একে একে ওকে নিয়ে যেতে পারেন বা সকলে একসঙ্গেও যেতে পারেন।
এই তো বাবা সুকুমার কবুল করেছ। একেই বলে জীবনসংগ্রাম—কী বল! মুক্তি সংগ্রাম নাকি! বিবেকের হাত থেকে মুক্তি—শাবাশ।
কী নাম তোমার?
শেফালি।–অসাধারণ। যাও ওখানে চুপটি করে বোসো। তোমাকে আমরা এই লজ্জার জীবন থেকে মুক্তি দেব।
তা সুকুমার রোজগারপাতি কেমন হয়?
এজ্ঞে খুবই সামান্য, গরিব লোক বাবু।
আবার মিথ্যে কথা? তুমি তো বাবা মাটির মানুষ নও। তুমি তো বাবা নিজের শ্রমে রোজগার করো না। তুমিও তো সোনার হরিণ খুঁজছ বাছাধন।
সুব্রত টাইম ইজ আপ। সময় দেখো। ঠিক চারটে বেজে কুড়ি মিনিট তাইনা?
দেন গেট রেডি। মনে আছে চকোলেট রঙের গাড়ি WBG…
শেফালি, তোমার একটা ছোট্ট কাজ আছে। তারপর তোমার আমার, আমাদের সকলের মুক্তি। বিরাট ঐশ্বর্য! শালা গরিবি হাটাও।
কথায় কথায় উচ্ছ্বাস। আসল কথাটা বল না।
একটু পরে ওই হাইওয়ে দিয়ে একটা চকোলেট রঙের অ্যামবাসাডার আসবে। কেমন ফাইন। গাড়িটা হু-হু করে আসবে আর তুমি প্রাণের মায়া ছেড়ে গাড়িটার সামনে লাফিয়ে পড়ে হাত তুলে থামাবে। তারপর, তারপর…সুকুমার, চিন্তা করতে পারো রাশি রাশি টাকা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, লক্ষ্মী মেয়ে শেফালি। ইস! তোমার চুলে কী আঠা! শ্যাম্পু করতে পারো না!
শোনো সুকুমার, তোমার মেয়ে যদি কাজটা ঠিকমতো করতে পারে ব্যস! কোথায় তোমার
উঞ্ছবৃত্তি! তুমি, আমি, আমরা টাকার গদিতে শুয়ে থাকব।
কিন্তু খবরদার প্ল্যানমাফিক কাজ না হলে—দুম।
সুব্রত চারটে আঠাশ। ওই দেখ দূরে।
সুকুমার, রাজি?
এজ্ঞে আপনারাই আমার মা-বাপ।
অসাধারণ! শেফালি রেডি।
ওই আসছে আসছে। সুব্রত রেডি! রেডি! সবাই রেডি!
আসছে টপ স্পিডে। ভয় নেই। শেফালি, থামতে ওকে হবেই।
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…
ইস। কী অসাধারণ। শালা চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইস কী তাজা শরীর ছিল মেয়েটার। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলুম—সুকুমার।
ইডিয়েট!—কী রক্ত, কী রক্ত!
সুকুমার, তোমার লাকটাই খারাপ। তোমার অভাব ঘোচাতে পারলুম না!
তোর অস্ত্র ফেলে দে। তোর একটা এম নেই। তুই তিন-তিনটে গুলি ছুঁড়লি অথচ টায়ারে একটাও লাগাতে পারলি না।
অসাধারণ। সুকুমারের চায়ের দামটা দিয়ে দে। ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। আহা নিজের মেয়ে, তায় রোজগেরে মেয়ে, কিছু বেশি দিয়ে দিস।
কার মেয়ে ছিল কে জানে!
সুব্রত, ভেবে দেখেছিস কী সাংঘাতিক! ওরা কি ফিরে আসতে পারে? এই স্পট ওদের চিনতে অসুবিধে হবে না। শেফালির ডেডবডি হবে ওদের নিশানা।
তাহলে?
কী অসাধারণ ব্যাপার! তাহলে চল শেফালিকে আমরা লোপাট করে দিই।
কিন্তু ওই চাপ চাপ রক্ত। ষোলো বছরের মেয়ের ওই তাজা রক্ত!
অসাধারণ। আমার মাথাটা দেখেছিস? বিপদেও কী ক্লিয়ার! সুকুমার বালতি বালতি জল দিয়ে পরিষ্কার করবে।
ইউ সুকুমার, একটা সাদা কাপড় আছে? নেই। তবে তোমারটাই খোলো। কুইক। কটা বাজল? চারটে পঞ্চান্ন। সামনের চেক পোস্ট থেকে ওরা ফিরবে, আর মাত্র কয়েক মিনিট সময়।
খোল খোল খুলে নে ওর কাপড়। বিপদের সময় আবার লজ্জা।
কী আশ্চর্য! বিপদের সময় আর সেই সমস্ত চরম আনন্দের সময় আমরা কেবল নিঃসঙ্কোচে উলঙ্গ হতে পারি।
নে জড়িয়ে নে। গায়ে রক্ত লাগাসনি। তুলে নে। সুকুমার জল ঢালো। উঁহু দেখছ হাতে কী? নিষ্কৃতি নেই। ঢালো এক-দুই..ফাইন? দেখছিস পিচে রক্ত লাগে না।
মেয়েটা এখন হালকা হয়ে গেছে। কী ঠান্ডা। যদি বেঁচে থাকত কী অসাধারণ হত!
সামনে এগিয়ে চল। আর হাইওয়ে নয়। মাঠের রাস্তা ধর।
ওকে শুইয়ে দে এই সাঁকোর তলায়। অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। বেচারা। মুক্তির সংগ্রামে মুক্তি পেয়ে গেল!
কী টাটকা শরীর ছিল এই একটু আগে। এখন মাটির কত কাছাকাছি। আমি ওকে একটা চুমু খেতে পারি!
হাইওয়ের ওপর দিয়ে আলোর সারি ছুটে চলেছে উত্তরে দক্ষিণে। যত রাত বাড়ছে তত আলো বাড়ছে, যত রাত বাড়ছে তত আলো বাড়ছে।