- বইয়ের নামঃ হর-পার্বতী সংবাদ
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. বুঝলে পার্বতী
বুঝলে পার্বতী।
আবার, আবার তুমি ওই রেফযুক্ত নামে আমাকে সম্বোধন করছ। বলছি না পারু বলে ডাকবে। তোমার মুখে বড় মিষ্টি শোনায় গো। তা ছাড়া এই সেদিন তোমার দাঁত বাঁধানো হয়েছে। মুখে ধরে রাখার কায়দাটা এখনও রপ্ত করতে পারনি। রেফ্, রফলা, যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে গেলেই খুলে-খুলে যাচ্ছে। পেনসানের টাকায় একবারই দাঁত বাঁধানো যায়। বারে বারে কে তোমার দাঁত বাঁধিয়ে দেবে। বয়েস হচ্ছে, বুদ্ধি কিন্তু তেমন খোলতাই হচ্ছে না। এবার থেকে পারু বলবে।
দাঁত বের করে অমন চ্যাংড়া ছোঁড়াদের মতো হাসছ কেন? নতুন দাঁত দুপাটির আনন্দে।
না পারু। দাঁতের আনন্দে সেই একবারই হেসেছিলুম। মায়ের কোলে বসে। ছবছর বয়েসে। তারপর শুধু কেঁদেছি। মিষ্টি আমার দাঁত খেয়েছে। ওই তোমাদের র্যাশানের চালের কঁকরে চাকলা উঠে বেরিয়ে গেছে। শেষে দাঁত আমার বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আমি হাসছি অন্য কারণে। ভাগ্যিস বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার কমিটি তোমার নাম থেকে একটা ব খুলে নিয়েছিল, তা না হলে ববিএ রেফের ঠেলায় আমার দন্তপঙতির কী হত!
এক ধামা কাগজ নিয়ে সাত সকালেই পেছন উলটে বসে আছ কেন? অন্য কাজ নেই?
গিন্নি, ভুলে গেলে? গবাক্ষপথে একবার অবলোকন করো, ওই দেখো এসেছে শরৎ হিমের পরশ। ধামা ধামা ডাক আসছে ভক্তদের। অবশ্য হিন্দিতেই ডাকছে, আযা, আ যা, মেরা জান, দিল পহছান। তৈরি হও। বোধন এসে গেল। এবার ল্যান্ড করতে হবে।
পুজো এবার হবে?
কেন পারু? পুজো কেন হবে না?
গদিতে যাঁরা গর্দানসীন, আমার সেই সব সোনার চাঁদেরা ধম্মকম্ম মানে না রে বাপু। তারা বলে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। বুড়ো এবার মনে হয় পুজো হবে না। বন্যা।
তোমার মাথা। প্রতি বছরই বন্যা হয়। বন্যা না হলে কী হয়, চার ছেলেমেয়ের মাকে আমি কী করে বোঝাব? রাজনীতির হালচাল উনি আজও শিখলেন না। কচি খুকি! বন্যা চাই, খরা চাই, খরা চাই, বন্যা চাই।
রেগে যাও কেন? রেগে যাও কেন? কথায়-কথায় অত রাগ ভালো নয়। একে তোমার হাইপ্রেসার, তার ওপর সুগার, তার ওপর এসকেমিক হার্ট।
পারু যেখানে যাচ্ছ, সেখানে ইংলিশ মিডিয়ামের জন্যে সব খেপে আছে। টাকে ছেলে নিয়ে বড়-বড় স্কুলের গেটে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে। তোমার মতো দিদিমণিরা সব চুল বব করে, ঠোঁটে লিপস্টিক চড়িয়ে, লম্বা সিগারেট গুঁজে পিড়িং-পিড়িং ইংরিজি ছাড়ছে। ওই যে ইংরিজিটা বললে, ওটা এসকিমোদের দেশে চলতে পারে। বলো, ইসকিমিক হার্ট।
কত্তা আমাদের ভাষা তো দেবভাষা। কোনও ভয় নেই। ওই পূজারী ব্রাহ্মণ অনুস্বার, বিসর্গ লাগিয়ে যা বলবে তাই মন্ত্র হয়ে যাবে। আর ষষ্ঠীর দিন না সপ্তমীর ভোর রাতে রেডিওতে চণ্ডীপাঠ। আমারই বন্দনা। তোমাকে আর কে চায় বলো?
তাই তো। তাই তো। সারা শ্রাবণমাস বাঁক কাঁধে কাতারে কাতারে আমার ভক্তরা যায় কোথায়? আজকাল আবার দু-হাত অন্তর চটি হয়। হিন্দিগানে দিনরাত বাতাস কাঁপতে থাকে। এই ভোলেবাবা পার না করলে গুরুদের কী দশা হত! ভেবে দেখেছ একবার? আমার পয়লা ভক্ত অমিতাভ বচ্চন কী ফ্যানটাসটিক গেয়েছে, জয় জয় শিবশঙ্কর/কাটা লাগে না টঙ্কর…
ফিল্মের কিছু বোঝো না যখন বলতে যাও কেন? অমিতাভ বাবা গায়নি। সে শুধু নেচেছে আর লিপ দিয়েছে। গান গেয়েছে গানের আর্টিস্ট। যাক কজায়গা থেকে নিমন্ত্রণ এল? বেড়েছে না কমেছে?
কমবে? কমবে কেন? বেড়েছে। শোনো সার্বজনীন অনেকটা টিউমারের মতো, আবের মতো। বেড়েই চলে। বেড়েই চলে। বাঙালির জীবনে আর কী আছে বলো? চাকরি নেই, বাকরি নেই, জল নেই, আলো নেই, খাদ্য নেই, বাসস্থান নেই, সুখ নেই, নিরাপত্তা নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই। থাকার মধ্যে এই পুজোটুকু আছে।
আমার ভক্তদের এ হাল কেন?
ওই যে কেন্দ্র। মহিষাসুর। এবারে আসার সময় একটু দাবড়ে দিয়ে এসো তো?
কেন্দ্রটা কোথায়?
ওই যে গো, আগে যে জায়গাটাকে আমরা ইন্দ্রপ্রস্থ বলতুম।
সিংহাসনে কে?
গিন্নি, তোমার জ্ঞান কমছে। ওখানে আর সিংহাসন নেই। রিপাবলিক বুঝলে, গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ পাঠশালা। জনগণমন অধিনায়কেরা সুজলাং সুফলাং নৃত্য করছে। বেগোড়বাঁই কিছু দেখলেই মিছিল নিয়ে পথে নেমে পড়ছে, চলবে না, চলবে না। কী চলবে সেটা এখনও ঠিক হয়নি বলে মোটামুটি সবই অচল হয়ে আছে।
সে কী গো, তাহলে বারোয়ারি হবে তো?
বারোয়ারি ঠিকই হবে। পাবলিকের টাকায় বারো ইয়ারে ঠিক জমিয়ে দেবে। তোমার আর আমার তেমন শত্রু নেই। রাইটার্সে ভেরি পপুলার। মন্ত্রীরাও বলে ফেলেন, ভোলেবাবা পার করে গা। সিনেমার নায়িকা কেঁদে-কেঁদে বলে, ত্রিশূলধারী শক্তি যোগাও। আর তুমি তো ক্যাপিটাল গো, মূলধন। তোমাকে পেছনে রেখে, পুজো, পুজো কমিটি। বাইশের পল্লী, তেইশের পল্লী। বিল বই, চঁদা। প্রিপূজা সেল, পূজা সেল, একজিবিসান, ফাংশান। পটুয়াপাড়ায় তুমি হাফ-ফিনিশ হয়ে এসেছ। দোমেটের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। তোমার ছাঁচে ঢালা মুণ্ডু সার-সার তাকে তোলা আছে। ঠ্যাঙে বায়নার টিকিট ঝুলছে। গেরস্থরা মার্কেটিং-এ নেমে পড়েছে। শ্যামবাজার থেকে গড়িয়া গুতোগুতি শুরু হয়ে গেছে।
বুঝলে, গতবার ভীষণ মশা কামড়েছে। এক-একটার সাইজ কী, যেন টুনটুনির বাচ্চা। কামড়ে কামড়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়েছে।
কার নাম? শ্বশুরমশাইয়ের? বেশ করেছে। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার চির অবনিবনা। হিংসে বুঝলে হিংসে। আমার পপুলারিটি ভদ্রলোক সহ্য করতে পারেন না। এবারে প্যাণ্ডেলে সিংহের পিঠে উঠে পোজ দেওয়ার আগে বড়বাজার থেকে বেশ বড় সাইজের একটা নাইলনের মশারি কিনে নিও। ম্যালিরিয়া ফ্লু আর ডেঙ্গু একসঙ্গে ধরলে ধন্বন্তরির বাবার ক্ষমতা নেই সারায়।
কী হবে গো?
আবার কী হল?
গতবারে পুলিশ নাকি খুব বেঁকে বসেছিল। যেখানে-সেখানে প্যাণ্ডেল বাঁধতে দেবে না। চাদা নিয়ে জুলুম করলে চ্যাংদোলা করে তুলে আনবে।
তাতে তোমার পুজোর কোনও অসুবিধে হয়েছিল? প্যান্ডেলের চেকনাই কি কিছু কম ছিল?
তা ছিল না অবশ্য।।
তবে এবারেও ঠিক তাই হবে। পুলিশ যেমন শাসায় তেমনি শাসাবে। চাদা যা ওঠে তার চেয়ে বেশিই উঠবে। ভুলে যেও না গিন্নি দেশের নাম পশ্চিমবাংলা। তাই তো কবি গাহিয়াছেন;
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ/তবু রঙ্গে ভরা।
সব হবে। সব এক মঞ্চে পাশাপাশি হবে। পাতালরেল, চক্ররেল, বাহাত্তর ইঞ্চি পাইপ, দাবি মিছিল, ধর্ম মিছিল, বিয়ের মিছিল, ফুটবল, বাস্কেটবল, হকি, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, যাত্রা-উৎসব, বাংলা বন্ধ, বোম, ছোরাছুরি, ভোট, ব্যালে নাচ, ম্যাজিক, সার্কাস, বন্যা, খরা, বনমহোৎসব, বননিধন, সব পাশাপাশি চলবে। বাপের শ্রাদ্ধ। ছেলের বিয়ে। তুমি কিস্যু ভেবো না।
সরস্বতীটা একটু বেঁকে বসেছে। বলছে রাজ্যপাল রাজভবন থেকে না নড়লে ও যাবে না।
সেরেছে। ও আবার রাজনীতিতে নাক গলিয়েছে! মাথায় ঘোল ঢেলে ছেড়ে দেবে। ওকে বলো এ পুজোয় ওর তো বীণা হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কোনও ভূমিকা নেই। এ তো তোমার পুজো। সেই মাঘে ওকে যখন একা যেতে হবে তখন যেন নিজের মত খাটায়। বিশ্বকর্মাকে দেখে শিখতে বলো। কল নেই, কারখানা নেই। শিল্পের সমাধিতে কেমন হাতি চেপে ঘুরে এল। চলছে-চলবে-র দেশ। ওখানে সবই তো খেলা গো!
পুজোও খেলা?
আলবাত। পুতুল খেলা। মা-মা করে চেল্লায়, তুমি ভাবো খুব ভক্তি! গিন্নি, তুমি হলে বেওসা। মা আসছেন, মা আসছেন, ঘোড়ার ডিম, আসলে পুজোর বাজার আসছে। বাবুদের বোনাস আসছে। যাদের ভাড়ে মা ভবানী তাদের আতঙ্ক আসছে। দোকানে ঝুলছে শাড়ি। সিল্ক, জর্জেট, পলিয়েস্টার, পিওর সিল্ক, অরগ্যাঞ্জা। ঝুলেছে পোশাক। টপলেস, বটমলেস।
সে আবার কী?
দেবী হয়ে বসে আছ, চিরকাল চেয়ে রইলে পায়ের তলায় হামাগুড়ি অসুরটির দিকে। ক্যাপ্টেন কার্তিককে শুধিয়ো, সে-ছোঁড়া সব জানে। পোশাকের চেয়ে স্টাইল বড়। সিথু, কী বস্তু জানো গিন্নি? বলতে শরম লাগে। তোমার বয়েস না হলে পরাতুম। শাড়ি পরেছ কী পরনি। তোমার কাঠামোটি পুরো দেখা যাবে। যেন একসরের চোখে তোমাকে জগদবাসী জুলজুল করে দেখছে। তোমার ডায়গ্রাম নয় স্কায়াগ্রাম।
মরণ আর কী! ফ্যাশানের মুখে ঝাড়ু মারো। আর বটমলেস, টপলেস কী জানো? বাক্স আছে, মাল নেই। খুলে পরো। কী পরো? মায়া কাঁচুলি। সব খোলা। উদোম। সি সি সিটি। সাধে আমি একটি পাথরের লিঙ্গ হয়ে মন্দিরে-মন্দিরে বসে আছি! চোখ, নাক, কান, মুখ, হাত, পা, দেহ কিছুই নেই।
হ্যাঁ গো, এবার কী রঙের শাড়ি পরে যাব? টকটকে লাল? না ফিকে লাল? নির্বাচনের ফলাফল তো ফিকের দিকে!
গিন্নি, তোমার মাথাটিও গেছে। শাড়ির সঙ্গে রাজনীতি জুড়ছ। চিরকাল তুমি তো খড়ের পোশাক পরেই যাও, তারপর যে বারোয়ারি তোমাকে যেমন সাজায়।
দেব, রাজনীতি ছাড়া ওদেশে আর কী আছে! আর, পুজোর প্রাক্কালে ঘরে-ঘরে গৃহিণীদের শাড়ি পলিটিক্স। মনের মতো দিতে পারলে ভোলেবাবা জিন্দাবাদ। নইলে মুর্দাবাদ। কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
০২. এই যে ঠাকুর সাতশোবার ডায়াল করলুম
এই যে ঠাকুর সাতশোবার ডায়াল করলুম কানেকশন পেলুম না। কেন চিন্তা করছেন? মা ঠাকরুণ ভালোই আছেন। ভালোই থাকবেন। বারোয়ারীবাবুরা আর যাই করুন, যত্নের ত্রুটি করেন না। প্যান্ডেলটি ভালোই বাঁধেন। আজকাল আবার ফ্যান ফিট করেন। খুব বাহারও দেন। কোনওটা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের মতো। কোনওটা লাট ভবনের মতো। কোনওটা যাদুঘরের মতো। কেন আপনি দুশ্চিন্তা করে মৌতাত নষ্ট করছেন? মা আমাদের ভালোই আছেন।
কেন ফ্যাচর-ফ্যাচর করছ। বাঙালিবাবুদের হাওয়া গায়ে লেগেছে? তেনাদের স্লোগান হয়েছে, আসি যাই মাইনে পাই, কাজের জন্য ওভারটাইম। সাতশোবার করেছ, আরও সাতশোবার করো। মায়ের কি আর যৌবন আছে? বেচারার বয়সও হয়েছে, তার ওপর ভক্তদের টানা হ্যাঁচড়া। যে দেশে গেছে সে দেশের খবর কিছু রাখো? রাস্তায় বড়-বড় গর্ত। ম্যানহোলের মুখ খোলা। রাস্তার দুপাশে ড্রেনের পাঁক তোলা। তার ওপর পৌর ধর্মঘটে টন টন আবর্জনা জমে আছে। তার ওপর শহর পাতালে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে এক সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তোমার কোনও ধারণা নেই। ওখানে আমার চ্যালারা লড়ে যেতে পারে। ছিলিমের জোরে আমি পার লাগাতে পারি। আমার বউ কি তা পারবে। বছরের পর বছর এক ঠ্যাঙে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে পায়ে ভেরিকোস ভেন হয়ে গেছে। আমার স্ত্রীকে কি তুমি ট্রাফিক পুলিশ ভেবেছ? যাও আবার ডায়াল করো।
সাতশো কেন, সাত হাজার বার আমি ডায়াল করব। ঠাকুর ওদেশে শুধু গণতন্ত্র নয় সবই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফোন আছে কিন্তু ঘড়ঘড় নেই।
ডায়াল ওয়ান নাইন নাইন।
প্রভু সে রাস্তাও আমি ধরেছিলুম। কেঁকো করছে। এনগেজড। ওটা এনগেজডই থাকে প্রভু।
তাহলে আমাকেই নামতে হচ্ছে। আমার বাহনটাকে ধরে আনো। ওই যে ছাইগাদায় শিং ঘষছে।
ঠাকুর এই টাইমে ষাঁড় তো শহরে ঢুকতে দেবে না।
কে বলেছে ঢুকতে দেবে না। খোদ অফিস টাইমে, সকাল নটার সময় পাল-পাল মোষ পাশ করছে টালার ব্রিজের ওপর দিয়ে। এই সেদিন আমি দেখে এলুম। আমি ভি আই পি রোড দিয়ে ঢুকব।
ঠাকুর ওটা মন্ত্রীদের রাস্তা। ভি আই পি-দের রাস্তা। ভোলেবাবাকে যেতে দেবে না। ধরে মেরে দেবে। তখন বুঝবেন মজা। এই বুড়ো বয়েসে কচুরি ধোলাই খেলে প্রাণবায়ু খাঁচা ছেড়ে পালাবে। পানা-পুকুর থেকে লাশ উদ্ধার হবে। বলবে ছত্রিশটা অপরাধের দাগি আসামি। খাতায় নাম ছিল। দলেরই কেউ কুপিয়ে দিয়েছে।
কী বলছিস রে হারামজাদা। আমি ভি আই পি নই?
না প্রভু। আপনার এয়ার কন্ডিশনড গাড়ি নেই। সাইরেন নেই। দল নেই। দলে এম এল এ নেই। আপনি প্রভু মেয়েলি দেবতা। সেকালের মেয়েরা শিব গড়ে জল ঢালত আর মনের মতো বর পেত। একালের মেয়েরা থোড়াই আপনাকে কেয়ার করতে চায়। ফ্রি-মিকসিং-এর যুগ। মোড়ে মোড়ে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস। হাত ধরে ঢুকছে। মিস্টার-মিসেস হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। না পোষালে দুজনে দু-রাস্তায় আদালতে গিয়ে ঢুকছে। মিসেস মিস হয়ে মিস্টারের খোঁজে বেরোচ্ছে। জীবন খুব সহজ করে নিয়েছে ঠাকুর। আপনার শোভা এখন ক্যালেন্ডারে। আর গঞ্জিকার আখড়ায়।
বলিস কী?
ঠিকই বলছি প্রভু!
দ্যাখো, দ্যাখো। ঘণ্টা বেজেছে। আপনিই বেজে উঠেছে। এ মনে হয় সেই ফোনটা, যেটার সেদিনে শ্রাদ্ধ হল চেম্বার অফ কমার্সের বাইরে।
হ্যালো! কে, মা বলছেন? আচ্ছা, আচ্ছা। ধরুন বাবা কথা বলবেন। হ্যাঁ বড় উতলা হয়েছেন।
কে পারু? ভালোভাবে পৌঁচ্ছে?
ভালোভাবে মানে? জানো আমার কী হয়েছে? একটা হাত খুলে পড়ে গেছে।
তা যাক গে। তোমার তো দশটা হাত গো। একটা গেলে কী হয়েছে। তুমি তো আর রেজেস্ট্রি অফিসের কেরানি নও যে দশ হাতে ঘুষ নেবে?
তা তো বলবেই।
কী করে ভাঙলে? টেম্পো গর্তে পড়ে গেল। বুঝলে কত্তা নাকটা ভোতা হয়ে গেছে।
সে কী! আহা অমন নাক। ওই জন্যই বলেছিলুম ও দেশের ব্যাপারে নাক গলাতে যেও না। বুড়োর কথা শুনলে না! এখন কী হবে?
একটা পাহাড়ের খাঁজে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কে একজন বিলিতি আঠার খোঁজে বেরিয়েছে। বলছে, সে-আঠায় কাটা মুণ্ডু জুড়ে যায়। হাত তো সামান্য জিনিস!
আর নাক?
বলছে, ওটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই। হাতটা গুণতিতে আসে। দশভুজের এক ভুজ গেলে পাবলিক ধরে ফেলবে। নাকটা মেকআপেই ম্যানেজ হয়ে যাবে। আজকাল নাকি মেকআপের যুগ।
ভুরু আছে না কামিয়ে দিয়েছে?
নেই। প্লাক করে তুলি দিয়ে টেনেছে। ভুরুর বাহার দেখলে এই বয়সেও তুমিও ভড়কে যাবে।
তাই নাকি? সুইট ডারলিং। কী পরিয়েছে?
জিনস আর কুর্তা পরাতে চেয়েছিল। পারেনি। আমার পোজ আর দশটা হাতের জন্য। শেষে স্যাররা রারা রারা রারা পরিয়েছে।
সে আবার কী?
বোম্বেতে খুব চলছে গো।
সে যাই পরাক, তাতে তোমার লজ্জা নিবারণ হয়েছে তো?
মোটামুটি।
উঠেছ কোথায়?
আমাদের পেছনেই মনে হয় ধাপা। খোঁটায় বেঁধে রেখেছে তাই, নইলে সপরিবারে কৈলাসের দিকে দৌড় লাগাতুম। সরস্বতীটা বেঁচেছে। ডাস্ট অ্যালার্জিতে সর্দি হয়েছে। লক্ষ্মী কাল থেকে ফোঁস ফোঁস করছে আর বলছে বোম্বে পালাব।
আরে বাংলার লক্ষ্মী তো বোম্বেতেই পালিয়েছে, আর নতুন করে কী পালাবে?
কীরকম জমেছে?
মোটামুটি। সব কীরকম ভ্যাবলা মেরে গেছে।
চাঁদা নিয়ে লাশটাশ পড়েছে?
এখনও রিপোর্ট পাইনি।
গান চলছে গান?
মিউমিউ করে। লোডশেডিং হচ্ছে খুব।
শোনো গিন্নি একটা কথা বলি, কোনও ব্যাপারে নাক গলিও না। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কারুর কোনও প্রার্থনা থাকলে, তুমি শুনো না। স্রেফ বলে দিও ওটা অসুরের ব্যাপার। আমি ওর মধ্যে নেই বাবা। যাক তুমি তাহলে ভালোই আছ। হা শোনো, বারোয়ারির হিসেবে লেখা থাকে পাঁচ পয়সার সিদ্ধি। আসার সময় পুরিয়াটা নিয়ে এসো। গণশা কী করছে?
আহা, বাছা আমার ঘুমিয়ে পড়েছে গো। নাক ডাকছে।
শোনো দুম করে না জেনে অসুর টসুর মেরে বোসো না। কে কোন দলের জানা না থাকলে ক্ষুর চালিয়ে দেবে।
পাগল হয়েছ কত্তা। আমি কি সেই মেয়ে? এতকাল অসুর মারব-মারব করেছি। সত্যিই কি মেরেছি। অসুর না থাকলে আমার পুজোই তো বন্ধ হয়ে যাবে।
গিন্নি তুমি থানার বড় দারোগা কেন হলে না গো?
০৩. গণতন্ত্র জিনিসটা কী বস্
আচ্ছা মহেশ্বর, তুমি বলতে পারো গণতন্ত্র জিনিসটা কী বস্তু! আমি জগৎ সৃষ্টি করলুম, প্রজা সৃষ্টি করলুম। পৃথিবীকে ঘুরিয়ে দিলুম লাটুর মতো। বলে দিলুম, রাজার কর্তব্য কী, প্রজাপালন কীভাবে করতে হয়! সমাজ কীভাবে গড়ে উঠবে। সামাজিক রীতিনীতি কী হবে। মোটামুটি সবই তো বলে দিয়েছিলুম। তারপর কী হল বলো তো মহেশ্বর?
সব তালগোল পাকিয়ে গেল প্রভু। খোদার ওপর খোদকারি। আপনার মানুষের মতো বেয়াড়া জীব আর দুটি নেই। আপনার সৃষ্টির কলঙ্ক। আপনার মুখে চুনকালি লেপে দিয়েছে। টাকা আর ক্ষমতা। ক্ষমতা আর টাকা, এই হয়েছে ধ্যান-জ্ঞান। কামিনী আর কাঞ্চন, অমৃতের পুত্ররা এই নিয়েই মেতে আছে প্রভু। এ ওকে গুঁতোচ্ছে, ও একে। সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের বাঁদরামি এত বেড়েছে আপনার আসল বাঁদরেরা হাঁ হয়ে গেছে।
বাঁদর থেকে ধাপে-ধাপে আমি মানুষ সৃষ্টি করেছিলুম, ধাপে-ধাপে আবার বাঁদর হয়ে যাচ্ছে তো মহেশ্বর?
কী জানি প্রভু। আমার তো সেই রকমই মনে হচ্ছে।
চলো না একবার দেখে আসি। আহা ওরা তো আমারই সন্তান।
প্রথমে কোন দেশে নামবেন?
কেন, ভারতে? ভারত হল পুণ্যভূমি। গঙ্গা, সিন্ধু, যমুনা যে দেশে প্রবাহিত। যার উত্তরে দেবতাদের আবাসস্থল, হিমালয়। যুগ-যুগ ধরে সংসারত্যাগী সন্ন্যাসীরা সেই গিরি করে বসে দিবা নিশি আমার নাম করে চলেছে। যে দেশের দক্ষিণ তটভাগে সমুদ্রের অবিরত চুম্বন। সেই তীর্থভূমি ভারতেই চলো আমরা অবতরণ করি। স্বাধীনতা সেখানে প্রবীণ হতে চলেছে। বয়েস হল সাঁইত্রিশ। চলো-চলো মহেশ্বর, গণতন্ত্রের সেই পীঠস্থানে চলো।
মহেশ্বর এই সেই হিমালয়?
হ্যাঁ প্রভু এই সেই গিরিরাজ।।
কিন্তু এ কী! সেই পুণ্যভূমির এ অবস্থা নে? এখানে, ওখানে, সেখানে ডাণ্ডা পোঁতা ঝাণ্ডা, হুহু বাতাসে উড়ছে। কারণটা কী মহেশ্বর?
প্রভু এক্সিপিডিশান। এদেশ, ওদেশ, সে-দেশ সারা বছরই, কোনও না কোনও সময়ে পর্বত অভিযানে আসছে। এদল এপাশ দিয়ে ওঠে তো ওদল ওপাশ দিয়ে। দেশে-দেশে প্রতিযোগিতা। মাউন্টেনিয়ারিং এখন একটা ফ্যাশান। মনে নেই প্রভু, এভারেস্টের মাথায় হিলারি আগে উঠেছিল, না তেনজিং আগে, এই নিয়ে কী ঝামেলা।
বেশ সে না হয় হল। ছেলেমানুষরা অমন করেই থাকে। আমরাও যখন ছোট ছিলুম তখন ঢিবি দেখলেই চড়ে বসতুম। কিন্তু এত আবর্জনা কেন চারপাশে! এ তোমার কলকাতা না করাচি!
ওই যে প্রভু, দলে-দলে যারা এক্সপিডিশানে আসে তারা ফিরে যাওয়ার সময় টন-টন মাল, কাগজ, কৌটো হ্যাঁনা-ত্যানা ফেলে রেখে যায়। কে আর পরিষ্কার করে প্রভু! ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সবই।
মহেশ্বর, ভারতীয়রা দেবতাত্মা হিমালয়ের এইভাবে, এঁটো-কাঁটা ফেলে মাহাত্ম্য নষ্ট করছে? বেদ-বেদান্তের দেশের মানুষ কি শেষে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী হয়ে গেল!
ঈশ্বর! কিছু মনে করবেন না প্রভু! আপনাকে, আপনার সন্তানরা কবর দিয়ে দিয়েছে। বেদ আছে বেদান্ত আছে। গীতা আছে। কয়েকশো ব্যাখ্যা আছে। মন্দির আছে, মসজিদ আছে, গীর্জা আছে, গুরু আছে, চ্যালা আছে, মেলা আছে, প্রণামী আছে, সব আছে, কেবল আপনিই অনুপস্থিত।
মহেশ্বর আমার এ দশা হল কেন?
মানুষকে অত পাওয়ার দিলে এইরকমই হবে প্রভু। পিতা হয়ে পিতার কর্তব্য করেননি। শাসনের অভাব। আদরে সব বাঁদর হয়ে গেছে। পায়ের জিনিস এখন মাথায় উঠে নাচছে। ধর্ম কর্ম সব গেছে। থাকার মধ্যে আছে রাজনীতি। আপনাকে ভজে-ভজে মানুষের খুব আক্কেল হয়ে গেছে। পায় তো ঘোড়ার ডিম! কেউ তারকেশ্বর, কেউ কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজের অন্ন না জুটলেও আপনার সেবা ঠিকই চড়ায়। পাণ্ডা আর সেবাইতদের পেট মোটা হয়। ঐশ্বর্য বাড়ে। নিজেরা পায় কঁচকলা। ছেলের চাকরি জোটে না। স্বামীর ক্যান্সার ভালো হয় না। কেউ দুর্ঘটনায় মরছে। কেউ ছুরি খাচ্ছে। সোনার সংসার এক কথায় ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আপনার ওপর মানুষের আর আগের মতো বিশ্বাস নেই।
কেন মহেশ্বর, আমি তো বলেই দিয়েছি, কর্মফলেই এইসব হয়।
ওই পুরোনো যুক্তি মানুষ আর মানতে চাইছে না। সায়েবদের হাওয়া গায়ে লেগেছে। নিৎসে কী বলেছে জানেন, দি গড ইজ ডেড। আপনি মারা গেছেন।
সে আবার কে?
সে এক পাগল দার্শনিক। হিটলারের গুরু।
হিটলার? ও সেই পাগলাটা, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়েছিল। ওর দোষ নেই মহেশ্বর। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় সব আমারই খেলা। মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্য এসব আমারই ব্যবস্থা। নাও চলল, এই বরফের টঙে চড়ে আমার আর ভালো লাগছে না। শীত-শীত করছে। আমার স্বর্গে তো চির বসন্ত।
প্রভু এই হল আমাদের কাশ্মীর। যাকে ভূস্বর্গ বলে মানুষ নাচানাচি করে। সারা বছর ক্যামেরা কাঁধে ট্যুরিস্টরা এসে গুলমার্গ, সোনা মার্গে বরফের ওপর কাঠের জুতো পায়ে হড়কে-হড়কে বেড়ায়।
তাই না কী, এই তোমার সেই কাশ্মীর! এইখানেই তোমার সেই জাফরানের খেত। আহা কী শোভা!
আর এগোবেন না প্রভু। গুলি করে দেবে। শ্রীনগরে কার্ফু।
কার্ফু? সে আবার কী?
ও হল মানুষের জগতের নিয়ম। রাস্তায় বেরিয়েছ কী মরেছ।
তার মানে? ভূস্বর্গে লোকে বেড়াতে আসবে না?
এর নাম রাজনীতি মালিক। এটা তো বর্ডার স্টেট। সেই স্বাধীনতার পর থেকেই একটা -একটা ঝামেলা লেগেই আছে। ওপাশে পাকিস্তান, এপাশে হিন্দুস্তান। হাত ধরে টানাটানি। মা আমার ধর্ষিতা। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।
আমার কৃষ্ণ কোথায়। সুদর্শন চক্র কি আর ঘোরে না।
প্রভু এক কুরুক্ষেত্রেই কৃষ্ণ কাত। গীতায় কিছু বাণী রেখে তিনি সরে পড়েছেন। চক্র এখন ছবি হয়ে আটকে আছে ভারতের তেরঙা জাতীয় পতাকায়।
তাহলে আমি আর একজন কৃষ্ণ তৈরি করি।
সে কৃষ্ণ শুধু বাঁশিই বাজাবে প্রভু। আর রাধার সঙ্গে প্রেম করবে। গণতন্ত্রে ভোট যুদ্ধই একমাত্র যুদ্ধ।
ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো মহেশ্বর। পলিটিক্যাল সায়েন্সে আমার কোনও ডিগ্রি নেই।
ডিগ্রি, ডিপ্লোমার ব্যাপার এদেশ থেকেও ঘুচে গেছে প্রভু। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই এখন পেটো-পটকার খেলা। দু-দলে কাজিয়া। ভিসিরা ঘেরাও হয়ে বসে থাকে মল মূত্র চেপে।
ভিসি মানে?
ভাইস চ্যান্সেলার মালিক। কে ভাইস চ্যান্সেলার হবে সেই ফঁপরে পড়ে পশ্চিমবাংলার রাজ্যপালকে রাজভবন ছেড়ে পালাতে হয়েছে। ওরা এখন বলছে, রাজ্যপালের পদটাই তুলে দাও।
ওরা মানে?
ওই যারা বাম আর কী?
মানুষের আবার বাঁ-ডান আছে না কি। আমি তো ওদের দুটো হাত দিয়েছিলুম। একটা ডান আর একটা বাঁ। তা শুনেছি সরকারি অফিসে বাঁ-হাতের কারবার হয়।
ঠিকই শুনেছেন। তবে রাজনীতিরও বাঁ-ডান হয়েছে। আমেরিকা যাদের টিকি ধরে আছে তারা হল ডান। আর রাশিয়া যাদের কান ধরে আছে তারা বাঁ। তারা কেবল বলছে; বিপ্লব, বিপ্লব। আগে বিপ্লব তারপর জীবন। বলছে লড়ে যাও।
কার সঙ্গে লড়বে?
নিজেদের সঙ্গেই। রামের সঙ্গে শ্যাম, শ্যামের সঙ্গে যদু। এই তো সেদিন পশ্চিমবঙ্গে এক রাউন্ড হয়ে গেল। পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর।
মন্ত্রীতে-মন্ত্রীতে লড়াই! কী নিয়ে হল?
প্রভু, পৃথিবীর সব লড়াইয়ের মূলে তিনটি জিনিস–জমি, মেয়েমানুষ আর টাকা। টাকা নিয়েই হল। এ বলে, রুপেয়া লে আও, ও বলে কঁহা রুপেয়া। শ্রেণী সংগ্রাম প্রভু। যার আছে সে দেবে না। যার নেই সে ছাড়বে না।
এই বললে বামে-ডানে লড়াই। এখন বলছ বামে-বামে লড়াই।
প্রভু কত রকমের বাম আছে জানেন? মাথা খারাপ হয়ে যাবে। ও আপনার না জানাই ভালো। ভোট যুদ্ধের কথা শুনুন।
কিছু বুঝব না তো।
খুব সহজ। লোহার ফুটো বাক্সে লোকে ছাপামারা কাগজ ফেলবে। কিছু লোক নিজে নিজে ফেলবে। কিছু লোকের হয়ে অন্যে ফেলবে। তাকে ইংরিজিতে আগে বলত প্ৰসি এখন বলে রিগিং। সেই ভোটে একগাদা এম. এল. এ. হয়। এম. এল. এ. থেকে মন্ত্রী। মন্ত্রী থেকে একজন মুখ্যমন্ত্রী। ওদিকে কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী। তারপর দাবার খেল। দান ফেলল আর দান তোলো। মন্ত্রিসভা ফেলো। এম. এল. এ. কেনো। আর এক মুখ্যমন্ত্রী বসাও। গোলাগুলি, কার্ফু। আবার তাকে ফেলো, ফেলে আর একজনকে বসাও। ফেলা আর তোলা এই হল দাদা তোমার খেলা।
সারা দেশ জুড়ে এই ইয়ারকিই চলছে বুঝি! তা প্রজাপালনের কী হচ্ছে?
কঁচকলা হচ্ছে মালিক। রাজা-মহারাজাদের আমলে প্রজাপালন হত। এক রাজা আর তার চেলারা কত খাবে প্রভু। দেশের মানুষ তখন খেতে পেত। রাস্তাঘাট হত। পুকুর কাটানো হত। জলের ব্যবস্থা হত। মন্দির প্রতিষ্ঠা হত। উৎসব হত। গণতন্ত্রে প্রজা নেই, আছে ভোট। আর আছে শয়ে শয়ে এম পি, এম এল এ, মন্ত্রী। প্রভু তারা ভালো থাকলেই হল। খাচ্ছে-দাচ্ছে ভুড়ি বাগাচ্ছে। আর একবার এ-দল, একবার ও-দল করছে। প্রজাপালন সেকেলে ব্যাপার মহারাজ। তাদের জন্যে একটা সংবিধান আছে। তাও সাতশোবার জোড়াতালি মারা হয়েছে।
এ তুমি আমাকে কোথায় আনলে মহেশ্বর।
আপাতত আপনার পায়ের তলায় ভূস্বর্গ কাশ্মীর। শেখ আবদুল্লার জমিদারি ছিল। ফারুক আবদুল্লা দখলদারি নিয়েছিল। কেন্দ্র ল্যাং মেরে দিয়েছে।
তখন থেকে কেন্দ্র-কেন্দ্র করছ। কেন্দ্রটা কী।
আজ্ঞে দিল্লি। ইন্দিরার রাজধানী।
অ, সেই জওহরলালের মেয়ে!
আজ্ঞে মায়ে পোয়ে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক ছেলে বিমান ভেঙে খসে গেছে তার বউ আবার একটা দল করে শাশুড়িকে ল্যাং মারার তাল খুঁজছে। বড় পোলা সিংহাসনে বসার জন্যে মায়ের পেছন-পেছন বিলিতি বউ নিয়ে ঘুরছে। আবার মোটরগাড়ির কারখানা খুলেছে। আর ওই দেখুন প্রভু ডাল লেকে সারি-সারি হাউসবোট। জনপ্রাণী নেই। কেউ আর বেড়াতে আসে না। গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ট্যুরিস্ট এলে তবেই না তাদের গলা কেটে সারা বছর চলবে। পানি আছে, দানা নেই। দানার মধ্যে আছে বুলেট। একটা খেলেই এ রাজত্ব থেকে আপনার রাজত্বে।
মহেশ্বর গোলগুলির আওয়াজ পাচ্ছ?
পাচ্ছি প্রভু? একটু দূরে। অমৃতসরে লড়াই হচ্ছে।
কে আক্রমণ করলে?
কেউ না। নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। দেশটাকে শত-টুকরোর চেষ্টা চলেছে। পাঞ্জাব দু-টুকরো হয়েছে। আরও এক টুকরো করার তালে কিছু লড়াকু লোক বিদেশি মদত নিয়ে স্বর্ণমন্দিরে ঢুকে বসে আছে। কেন্দ্রের সেনাবাহিনী কামান দাগছে।
হায় ঈশ্বর!
আপনি নিজেই তো ঈশ্বর প্রভু। আপনার সন্তানদের খেল দেখুন।
শুনেছিলুম স্রষ্টা সৃষ্টি থেকে মহান। মহেশ্বর এ যে দেখি সৃষ্টিই মহান। আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে? কোথায় আমার গুরু নানক। গুরু গোবিন্দ। তাদের একবার ডাকো।
কোনও লাভ নেই প্রভু। হয় আমেরিকা না হয় রাশিয়াকে ডাকুন।
চলো তা হলে ইন্দিরার কাছে যাই।
প্রভু দেখা হবে না। তিনি এখন অন্ত্র নিয়ে ন্যাজে-গোবরে।
অন্ধ্রে আবার কী বাঁধালে?
আমি বাঁধাব কেন? নিজেরাই লাগিয়ে বসে আছে। ফিল্মসের এক কৃষ্ণ নাম তার রাম রাও চৈতন্য রঙ্গমে চেপে একেবারে রমরম করে রাজ্য-সিংহাসনে বসেছিল। বেশ চলছিল। প্রায় একবারে সাধু হয়ে গিয়েছিল। শেষে বিকল হৃদয় সারাতে গিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে এসে দেখে শ্যালক সিংহাসনে চেপে বসে আছে। কেন্দ্র খুব তো দড়ি টানাটানি করছিল। রামবাবু আবার অ্যায়সা চাল দিলেন শ্যালক চিৎপাত। মাঝখান থেকে হায়দরাবাদে কমুনাল রায়াটে সব চৌপাট হয়ে গেল।
এসবের কী মানে মহেশ্বর?
প্রভু এর নাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজ্যশাসন। যেখানে দেশের চেয়ে গদি বড়। প্রজার চেয়ে চামচা বড়। আইনের চেয়ে ক্রাইম বড়।
ধরো।
কাকে ধরব পরমেশ্বর?
ইন্দুকে ফোনে ধরো।
হ্যালো। হ্যালো।
হ্যালো প্রাইমমিনিস্টারস সেক্রেটারিয়েট।
ইন্দু আছে?
কে ইন্দু?
তোমাদের প্রধানমন্ত্রী গো! বলো পরমেশ্বর কথা বলবেন।
পরমেশ্বর। সে আবার কে? কোন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী?
বলো, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যিনি প্রধান তিনি কথা বলবেন।
পি এম পাগলদের সঙ্গে কথা বলেন না।
অ, তাই নাকি? আচ্ছা সে কথা আমি খোদ মালিককে জানাচ্ছি। প্রভু পি এম আপনাকে পাগল ভেবেছেন। তার পি-এ বলছে, প্রধানমন্ত্রী পাগলদের সঙ্গে কথা বলে না।
আচ্ছা, তাই নাকি! তাহলে বাতাস-তরঙ্গে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়।
কোনও প্রয়োজন নেই। প্রভু আমি বরং একটু মজা করি। আবার একবার ফোন করি।
হ্যালো।
প্রাইম মিনিস্টারস…
মহেশ্বর বলছি।
কে মহেশ্বর প্রসাদ সিং?
না শুধু মহেশ্বর। ভক্তরা বলে ভোলা মহেশ্বর। তোমার মালকানকে বলো খোদ পরমেশ্বর কথা বলতে চেয়েছিলেন, তুমি যাকে পাগল বলে উড়িয়ে দিলে। মা-মণিকে শুধু স্মরণ করিয়ে দিও, নির্বাচন তো এসে গেল।
মহেশ্বর ফোন ছেড়ে দিলেন। কী মনে হল পি এম-কে একবার জানালেন, কে এক মহেশ্বর ফোন করেছিল, বলেছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক পরমেশ্বর আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। পাগল ভেবে লাইন দিইনি। আবার ফোন করে বললে, বলে দিও নির্বাচন আসছে। তারপর লাইন ছেড়ে দিলে।
পি এম লাফিয়ে উঠলেন, মূর্খ? আমার সব সাধনা ব্যর্থ করে দিলে। আমি কখনও বেলুড়, কখনও তিরুচেরুপল্লী, কখনও আকালতখতে গিয়ে রাতের-পর-রাত সাধনা করে যাঁকে নামিয়ে আনলুম তাকে পাগল বলে ভাগিয়ে দিলি গাধা! সামনের নির্বাচনে আমার ফিউচার তোরা ভাবলি না। এখুনি যোগাযোগ কর ফোনে।
মাতাজি ভগবানের ফোন নম্বর যে পৃথিবীর ডাইরেক্টারিতে নেই!
তুমি মরে ভূত হয়ে জেনে এসো।
দেশের প্রায় সবাই তো মরে এসেছে দিদি! আর তাড়াহুড়োর কী দরকার। আপনি আর পরমশ্বের ছাড়া এরপর আর তো কেউ থাকবে না।
সব কটা স্যাটেলাইট একসঙ্গে চেষ্টা করতে লাগল– হ্যালো পরমেশ্বর, হ্যালো। কলকাতার সব ফোন বিকল? কারণ, সব ফোনই পরমেশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। হ্যালো পরমেশ্বর।
৪. হিমালয়েই তো তোমার সামার হাউস
মহেশ্বর?
প্রভু!
এই হিমালয়েই তো তোমার সামার হাউস তাই না।
আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশির ভাগ সময়েই তো আমাকে ঘুরে-ঘুরে বেড়াতে হয়! তারকেশ্বর, দ্বারকেশ্বর, কল্যাণেশ্বর। পারুকে একা থাকতে হয় তো প্রভু। মানব, দানব, দেবতা কারুর চরিত্রই তেমন সুবিধের নয় মহারাজ। কী স্বর্গে, কী মর্তে। কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির তো শেষ নেই। তাই পাহাড় দিয়ে, হিমবাহ দিয়ে, গুহা দিয়ে, গহ্বর দিয়ে পারুকে নিরাপদে রাখা!
তখন থেকে পারু-পারু করছ কাকে?
প্রভু পার্বতাঁকে আমি আদর করে পারু বলে ডাকি। শরৎবাবু বলে এক লেখক ছিলেন। তার দেবদাস এক সাংঘাতিক প্রেমের বই। সেই বইয়ের প্রেমিক দেবদাস তার নায়িকাকে পারু পারু বলে ডাকত। কী সুন্দর?
সিনেমাটা আমি দেখেছি।
সে তো মর্তের ব্যাপার প্রভু।
গবেট। স্বর্গ যার মতও তার। আর তুমি, তুমি জানোই না, যেখানেই সৃষ্টি সেখানেই আমি। যেখানে মৃত্যু সেইখানেই যম। শরৎ অমন একটা যুবক-যুবতী-চিত্ত কঁপানো সাহিত্য সৃষ্টি করলে কী করে!
কলমের জোর ছিল প্রভু। দেখার চোখ ছিল। লিখে ফেললে গড়গড় করে।
তোমার মাথা। শরৎ কেন লিখবে! সে তো উপলক্ষ্য মাত্র। লিখেছি তো আমি। শরৎকে মিডিয়াম করে। আমার অনুপ্রেরণা ছাড়া তার সাধ্য ছিল লেখার!
শুনে খুব খারাপ লাগছে প্রভু। যিনি লেখেন তিনি নিজের আদলে নায়ক চরিত্র সৃষ্টি করেন। প্রভু, দেবদাস তাহলে আপনি? ছিঃ ছিঃ। কী কেচ্ছাই না করলেন। মদ খেয়ে মেয়েছেলের বাড়ি গিয়ে। টিবি ধরিয়ে। কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত তুলে ফেঁসে গেলেন। এটা কেমন ধারা সৎ দৃষ্টান্ত হল পরমপ্রভু। বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ, গীতা, বাইবেল, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, ঠিক আছে। কিছু কিছু এদিক সেদিক থাকলেও দেবভাবে ভরপুর। কিন্তু দেবদাস! ওই কি দেবতার দাস হল প্রভু। রমণী-আসক্ত, মদ্যাসক্ত। পারুটাকে ছিপ দিয়ে কী পেটানো না পেটালেন একদিন! লোক তো খুব সুবিধের নন আপনি!
মহেশ্বর, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল। আমাকে লোক বলছ? আমি যে ত্রিলোকেশ্বর, পরমেশ্বর। আমার পাপ নেই, পুণ্য নেই।
আপনি তাহলে পলিটিসিয়ান।
কথায় কথায় তুমি এত ম্লেচ্ছ ভাষা ব্যবহার করছ কেন মহেশ্বর? শিখলে কোথা থেকে।
প্রভু পৃথিবীতে যে আমার আনাগোনা আছে। ভক্তরা যখন দলে-দলে আমার পীঠস্থান তারকেশ্বরে ছোটে তখন পথের দু-পাশে শুধু হিন্দি-ফিল্মি গান। বেদ-মন্ত্র ভুলে গেছি প্রভু। দেবভাষা আমার মুখে আটকে যায়। চালচলনও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে আজকাল। মাথায় চুলের বাহার দেখছেন। নেচে-নেচে হাঁটি।
পলিটিসিয়ান মানেটা কী? রাজনীতিক?
ধরেছেন ঠিক। তাদের পাপও নেই, পুণ্যও নেই। কথার কোনও দাম নেই। প্রভু আপনারও সেই এক হাল। সারা জীবন শুধু ডেকেই গেল, পেল না কিছুই।
আবার তুমি গবেটের মতো কথা বলছ। পেয়ে কী হবে। মানুষের পেয়ে কী হবে! কোটিপতিও চিতায় চড়বে, কানাকড়ি-পতিও চিতায় চড়বে। মানুষকে দিয়ে কী লাভ হবে ঘোড়ার ডিমের! রাখতে পারবে! থাকতে-থাকতেই ফুকে দেবে। রেস খেলবে, বোতল ধরবে, মেয়েছেলের পেছনে ছুটবে। ডাকাতে মেরে দেবে। ট্যাকসে দেউলে করবে।
প্রভু এ সবই তো আপনার ইচ্ছায় হয়েছে! মানুষকে একটু সুখ দিলে কী এমন ক্ষতি হত আপনার!
খুব ক্ষতি হত। মানুষ আমাকে ভুলে মেরে দিত।
এখনই বা কী এমন মনে রেখেছে! খাচ্ছেদাচ্ছে আর বংশবৃদ্ধি করে পৃথিবীর অ্যায়সা হাল করেছে, একপাশে কাত হয়ে ঘুরছে। টলটলায়মান।
এত মন্দির, মসজিদ, চার্চ, কাবা, সকাল-বিকেল আরতি, ঘণ্টাধ্বনি, আজান, আহ্বান, কেন মহেশ্বর! আমাকে মনে না রাখলে এসব হত কি?
আমার কিছু বলার নেই প্রভু। কে যে কীসের ধান্দায় ঘুরছে আমার চেয়ে আপনি ভালোই জানেন।
তা অবশ্য জানি। কেবল দেহি, দেহি করছে। গাড়ি দাও, বাড়ি দাও, চাকরি দাও, বেহিসেবি টাকা দাও, যশ দাও, খ্যাতি দাও, মৃত্যুর পরে স্ট্যাচু দাও। এত দাও-দাও–বিরক্ত হয়ে আমি আর কিছু দিই না। সৃষ্টি সেই একবারই করেছিলুম। যা বাবা, এবার তোরা লুটেপুটে খা।
প্রভু পাঁচজনে খাচ্ছে আর পঁচানব্বইজন টেরিয়ে-টেরিয়ে দেখছে।
মরুক গে। যা পারে করুক। তোমার আমার কাঁচকলা। তা যাই বলো বাপু, এবার একটু শীত-শীত করছে।
শীত করছে প্রভু! চলুন তাহলে। পারুর হাতে এক কাপ করে গরমাগরম চা খাওয়া যাক।
আবার ওই মর্তের নেশাটা ধরাবে!
আপনাকে আর কে ধরাবে মালিক! আপনিই তো নেশা, কারুর কারুর আপনিই তো নেশা। নিন উঠুন। চলুন। খুব ঝাল চানাচুর দিয়ে চা খাওয়া যাক। হিমালয়ের শীত। হাড় কাঁপয়ে দিলে।
মহেশ্বরের ডেরায় এসে পরমেশ্বরের চোখ কপালে উঠে গেল। প্রশ্ন করলেন, ভোলা মহেশ্বর, এ কী করে ফেলেছ! তোমার ভক্তরা গায়, বাবা শ্মশানে থাকে ছাই ভষ্ম মাখে, তোমার এই ঐশ্বর্য দেখলে তারা কী বলবে? ভাগ্যিস এখানে ইনকামট্যাক্স নেই। থাকলে তোমার এই দুনম্বরি কারবার ধরে ফেলত। কোথা থেকে আমদানি করলে!
মহেশ্বর লাজুক লাজুক মুখে হাসলেন। ত্রিশূল দিয়ে জটা চুলকোতে-চুলকোতে বললেন, প্রভু, ঐশ্বর্য আর আব একই জিনিস। একবার বাড়তে শুরু করলে আর থামানো যায় না। ওই ফিল্ম স্টার হয়ে যাওয়ার পর থেকে মর্তে আমার পপুলারিটি এত বেড়ে গেছে! কী করব প্রভু! এসব পাপের পাষাণ। ওদিকে হেরেরেরে করে পাপ বাড়ছে, এদিকে আমার জেল্লা বাড়ছে। বিশ্বনাথে রোজ মন-মন দুধ ঢালছে আমার মাথায়, চতুর্দিকে পুজো চড়াচ্ছে। মিষ্টির দোকানে আজকাল খুব লাভ। রমরমা কারবার। দুধ ধরে ক্ষীর, ক্ষীর চটকে পাড়া। পারুরও সময়টা ভালো যাচ্ছে। এক কলকাতাতেই ছহাজার বারোয়ারি। বরাত খুলে গেছে প্রভু। শ্মশানে আমার আসন কেড়ে নিয়েছে কলকেবিহারি দেশি-বিদেশি হিপির দল। মারছে টান আর ব্যোম ভোলে বলে চোখ উলটে চিৎপাত। কারবার ভালোই চলেছে।
আমি জানি, হিংসে হচ্ছে প্রভু। হিংসে, এই-ই হয়। জমিদার ফুটে যায়, নায়েব নবাবি করে। এই স্বর্গে উর্বশী একটু নাচ দেখাবে। দু-চার পাত্র সোমরস চলবে। দেবাসুরে মাঝে-মাঝে লড়াই হবে। সবই একঘেঁয়ে প্রভু। আপনার জীবনও জীবন। মানুষের জীবনও জীবন। মানুষের জীবনে যে কী মজা! এই দেখুন প্রভু, একে বলে টিভি। এর নাম ভিডিও। একে বলে স্টিরিও।
রাখো-রাখো, ওসব তোমার ছেলেমানুষি খেলনা। ও দিয়ে তুমি তোমার পারুর মন ভোলাও। আমি পরমেশ্বর। ইংরেজরা আমাকে লর্ড বলে। জানো কি তা! আমি অলমাইটি।
প্রভু জীবন যদি খেলা হয়, তাহলে মানুষ কিন্তু জীবন নিয়ে আজকাল খুব ভালোই খেলতে শিখেছে। আকাশে উড়ছে। মাটিতে ছুটছে। চাঁদে এসে মাটি কোপাচ্ছে। আপনার বড়-বড় গ্রহের পাশ দিয়ে রকেট ছোটাচ্ছে। কেলোর কীর্তি করে ফেলছে। দিনকতক পরে আপনাকেই গদি থেকে ফেলে দেবে!
মামার বাড়ি আর কী! আমার রাজত্বে আমারই সৃষ্টি আমাকে ফেলে দেবে! কছিলিম চড়িয়েছ আজ মহেশ্বর? তোমার পারু কি তোমাকে একেবারেই ছাড়া-গরু করে দিয়েছে। কলকাতার বড়বাজারের বেওয়ারিশ ষাঁড়ের মতো।
আজ বিনা ছিলিমেই চলছে প্রভু। যা বলেছি তা আমার জগৎঘোরা অভিজ্ঞতার কথা। পৃথিবীতে গিয়ে বেশি না দিনকতক থাকলেই আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলে যাবে।
আমার আবার জ্ঞানচক্ষু কী হে। আমি নিজেই তো জ্ঞান।
সে হল পরমজ্ঞান। ও আপনার কেতাবে থাকে। সেই জ্ঞানে জগৎ-সংসার চলে না। পৃথিবীতে গেলে দেখবেন, পিতাদের কী অবস্থা? ভারত-পিতা গান্ধীমহারাজ যিনি আপনার নীতি অনুসরণ করেছিলেন–ন্যায়, সত্য, অহিংসা, সদাচার, জাতি-বর্ণের বিভেদ দূর। কী হল তাঁর? আপনি কিছু করতে পারলেন? একটা বুলেট? হায় রাম। সব শেষ।
আমি ওর শেষটা ওই ভাবেই করতে চেয়েছিলুম।
কী কারণে প্রভু?
চিরকাল মানুষ মনে রাখবে বলে। সত্য আর অহিংসার বাণী রক্তের অক্ষরে জাতির জীবনে দগদগ করবে।
হায় মূর্খ।
কাকে মূর্খ বলছ হে। আমাকে, না আমার আশীর্বাদ ধন্য গান্ধীমহারাজকে।
আপনাকে প্রভু। সারাজীবন যিনি শুধুই জ্ঞানের ভাণ্ডারা দিয়ে গেলেন।
তোমার সাহস দিন-দিন বাড়ছে। বেড়েই চলেছে অ্যাঁ।
বাড়বেই যে প্রভু। দেবতারা প্রথমত অমর। তা ছাড়া স্বর্গে পুলিশ নেই যে ধরে রুলের গুতো মারবে। আদালত নেই যে মানহানির মামলা ঠুকে দেবে!
তা বলে তুমি আমাকে জগৎ-পিতা, পরম-পিতাকে মূর্খ বলবে?
কেন বলব না প্রভু! সত্য আর অহিংসার বাণী রক্ত দিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন। বাণী মুছে গেছে, রক্তটাই দগদগ করছে। জাতির সর্বাঙ্গ দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ভারত-পিতার গোটাকতক কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি এখানে ওখানে খাড়া করা আছে। বছরে একদিন জাতীয় ছুটি। মূর্তির গলায় গোটাকতক মালা। সারা বছর কাক-পক্ষীর পেছনের ব্যবস্থাপনায় চুণকাম। তার বাণী ভেসে চলে গেছে। তার জীবন লোকে ভুলে মেরে দিয়েছে। ছোরাছুরি ছাড়া আদান-প্রদান নেই। বোমা ছাড়া শব্দ নেই। সব সময় মারমার, কাটকাট চলেছে। গদি ছাড়া লক্ষ্য নেই। ভোট দাও ছাড়া বাণী নেই।
পৃথিবীটাকে এবার আমি একদিন ধরে উলটে দেব।।
পারবেন না। এমন প্রাকৃতিক, গাণিতিক নিয়মে ফেলে দিয়েছেন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা, পরস্পরের টানে কক্ষপথে ঘুরতেই থাকবে, ঘুরতেই থাকবে।
সব মানুষ আমি মেরে ফেলব।
ইমপসিবল প্রভু, ইমপসিবল। পিলপিল করে মানুষ জন্মাচ্ছে ছারপোকার মতো। ওষুধ বের করে ফেলেছে নানারকম। যত না মরছে, জন্মাচ্ছে তার বেশি। সব রক্ত-বীজের ঝাড়।
তাহলে কী হবে মহেশ্বর?
এক কাজ করুন। শয়তানের সঙ্গে আপনি একবার আলোচনায় বসুন। পৃথিবীটা উইল করে তাকেই দান করে দিন। শয়তান ছাড়া মানুষকে কেউ শায়েস্তা করতে পারবে না। অমৃতস্য পুত্ৰা বলে সেই দ্বাপর ত্রেতা থেকেই যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে। ও যেন দয়ালু জমিদারের অত্যাচারী মোসায়েবের ফল। প্রথম থেকে শাসন করেননি পিতা, পুত্রেরা সব বিগড়ে বসে আছে।
কই হে তোমার চা কি হল?
মহেশ্বর, পারু-পারু বলে ডাকতে লাগলেন, কোথায় গেলে বুড়ি?
পরমেশ্বর বললেন, পার্বতী কি বুড়ি হয়ে গেছে?
না প্রভু, এ হল আদরের বুড়ি? এই কসমেটিকস আর হরমোনের যুগে কেউ কি আর বুড়ো, বুড়ি হবে। মনের বয়েস বেড়ে যাবে। দেহের বয়েস বাড়বে না।
সে আবার কী? জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, কিছুই থাকবে না।
হ্যাঁ জন্ম অবশ্যই থাকবে তবে প্ল্যান্ড। এক ইয়া দো, তিন কভি নেহি।
পরমেশ্বর মাথা চুলকোলেন। চোখ বড়-বড় হয়ে গেল।
মহেশ্বর মুচকি হেসে বললেন, দেবতারাই শুধু চির-যৌবন আর অমৃতের কলসি কাকে নিয়ে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না প্রভু। হিরোসিমায় সেই অ্যাটম-বোমা ফেলেছিল মনে আছে?
খুব আছে। বোমার ধোঁয়া ছাতার মতো পেখম মেলেছিল।
তুমি আমাকে দেখিয়ে বললে, শরতের তুলো মেঘ। দেখতে গিয়ে ধোঁয়া লেগে আমার মাথার সব চুল ভুসভুস করে উঠে গেল। সরোবরের জলে কুলকুচো করতে গিয়ে মুখের সব দাঁত খুলে পড়ে গেল। নাগার্জুন আর চরক এসে পরীক্ষা করে বললে, আণবিক প্রতিক্রিয়া। মনে নেই আবার! সেই দাঁত তো এখন গজমতির মালা হয়ে নারায়ণীর গলায় ঝুলছে। গায়ে ফোঁসকা বেরিয়ে গেল। সাতদিন কামধেনুর দুধে গা চুবিয়ে বসে রইলুম, মাথায় চাপিয়ে রাখলুম কামধেনুর গোবর। মনে নেই আবার!
আপনার তো তবু সব বেরোল। আর আমার! আমার গোঁফ-জোড়া সেই যে খুলে পড়ে গেল, শত চেষ্টাতেও আর বেরোল না।
ভালো হয়েছে মহেশ, শাপে বর হয়েছে। মুখটা ছিল তোমার, গোঁফটা ছিল মহিষাসুরের। যা তোমাকে মানায় না, তা যাওয়াই মঙ্গল। বাঘের মুখে বেড়ালের, বেড়ালের মুখে বাঘের গোঁফ মানায় না। দ্যাখো তো, এখন মুখটায় কেমন সুন্দর একটা দেব-ভাব এসেছে।
যাক ও গোঁফ-দাড়ি-চুল নিয়ে আর মাথাব্যথা নেই। অমর হলেও বয়েস হয়েছে অনেক। যে কথা বলছিলাম প্রভু, ওই বোমার বাতাস ঠেলে আর একটু ওপরে উঠলেই, আমাদের হাড় পর্যন্ত খুলে পড়ে যাবে। তখন এই স্বর্গরাজ্যে এসে আপনার ওই মানবকুল পরম-পিতার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজবে। তখন কী হবে? ভেবে দেখেছেন একবার পরমপিতা!
কী হবে মহেশ্বর! একটা রাস্তা বের করো। এ সংগ্রাম তো দেখছি, সৃষ্টির সঙ্গে স্রষ্টার।
তাই তো হয় প্রভু। ওরা সেই ফ্রাঙ্কেস্টাইন সৃষ্টি করেছিল। তারপর! জানেন তো! সবই তো আপনি জানেন! কেবল মাঝে-মাঝে আপনি ভুলে যান।
চা বোলাও!
হিন্দি বলছেন যে প্রভু!
উত্তেজনার মুহূর্তে কি মানুষ কি দেবতা, সকলেরই ভাষা পালটে যায়। এরই নাম প্রাকৃতিক নিয়ম।
মহেশ্বর হাসলেন। তারপর কী একটা টিপতেই দূরে ঘণ্টা বেজে উঠল।
এ আবার তোমার কী কেরামতি মহেশ্বর!
প্রভু ইসকো বোলতা হায়, কলিং বেল। পারুকে আর কত ডাকব গলা ছেড়ে!
এবার কলকাতার বারোয়ারি সেরে ফেরার সময় চিনে বাজার থেকে তুলে এনেছে। বড় মজার জিনিস প্রভু।
কোঁক-কোঁক করে অদ্ভুত একটা শব্দ হতে লাগল। পরমেশ্বর প্রশ্ন করলেন, কী হে, শয়তান এল না কি! অমন সাপের ব্যাঙ ধরার মতো শব্দ হচ্ছে!
না প্রভু। ও আর এক বড়িয়া যন্তর। ওরে কয় ইন্টারকম।
ঘন-ঘন তোমার ভাষা পালটাচ্ছে কেন মহেশ্বর! দেবতার গাম্ভীর্য তোমার গেছে। তুমি চ্যাংড়া হয়ে গেছ।
মহেশ্বর হাসতে-হাসতে ইন্টারকম তুললেন, হ্যালো! কে পারু! কী করছ তুমি সুইট! হানি। মানি গুনছ। এদিকে আউটার গুহায় আমি খোদ মালিককে নিয়ে বসে আছি। ওঃ সনি। খোদ মালিক কে? আমাদের গ্রেট পরমেশ্বর। চা চা করে মাথা খারাপ করে দিলেন। আমরা যাব! আ মাই ডারলিং। কী করছ তুমি! ভিডিও দেখছ। হাও সুইট! আমরা আসছি। দিলওয়ারা। মেরা জান।
পরমেশ্বর মহেশ্বরের কথা শুনে কেমন যেন হয়ে গেলেন।
গম্ভীর জগৎ-স্রষ্টা যেন আরও গম্ভীর। মেঘ-ভারাক্রান্ত আকাশের মতো থমথমে মুখ। ইন্টারকম ছেড়ে দিয়ে মহেশ্বর বললেন, কী হল প্রভু! ভড়কে গেছেন মনে হচ্ছে!
তুমি একেবারেই বকে গেলে মহেশ। তুমি বদসঙ্গে পড়েছ। আজ বুঝলেন প্রভু! আমি তো কবেই বখে গেছি। আমি এক বখা ছেলে।
ছেলে নয় মহেশ্বর। তুমি দেবতা। বখাটে দেবতা।
তাই তো বলে সবাই। গাঁজা ভাঙ খাই। ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াই। সংসারে মন নেই।
পার্বতীর মতো বউ পেয়েছিলে বলে তরে গেলে!
তা ঠিক। তবে মজাটা কোথায় জানেন প্রভু? সব আইবুড়ো মেয়েই আমাকে পুজো করে, নইলে মনের মতো পতি পায় না। কী কেলো!
পরমেশ্বর ধমকে উঠলেন, তোমার ওই রকের ভাষা ছাড়বে না আমি ফিরে যাব ব্রহ্মলোকে।
মহেশ্বর হাসলেন, আর ফেরা! জীবনে আর ফিরতে পারেন কি না দেখুন। পারু ডাকছে। ভেতরের গুহায়। সেখানে ভিডিও চলছে। একবার নেশায় ধরে গেলে আর ফিরতে হচ্ছে না। হিন্দি ছবির নেশা সাংঘাতিক নেশা। আপনার সৃষ্টির মতো। কিছুই নেই অথচ সবই আছে। মায়ার মায়া। কায়ার ছায়া। ভ্রান্তি অথচ ছেড়ে যেতে মহা অশান্তি। চলুন প্রভু। গাত্রোৎপাটন করুন।
পরমেশ্বর উঠে দাঁড়ালেন। আড়ামোড়া ভেঙে বললেন, তুমি দেখছি আমাকেও বখিয়ে ছাড়বে।
আপনাকে বখাবার ক্ষমতা আমার নেই। আর প্রভু, আপনিই তো সব। চোর, জোচ্চর, ভালো, মন্দ, সৎ, অসৎ, সাধু, অসাধু, সবই তো আপনি। গীতায় আপনিই বলেছেন, আমা হইতে সব উথিত হইয়া, আমাতেই লয় প্রাপ্ত হয়। যেমন, জলের বিম্ব, জলেতেই মিলায়।
খুব হয়েছে। চলো। পথ দেখাও।
মহেশ্বর আগে-আগে চলছেন। পেছনে আসছেন পরমেশ্বর। গুহাপথের দেয়ালে নানা বর্ণের পোস্টার সাঁটা। পরমেশ্বর কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন, কৈলাসে কি ছাপাখানা হয়েছে?
কেন প্রভু?
এ সব কী সাঁটিয়েছ!
সিনেমার পোস্টার। বোম্বাই, বাংলা আর তামিলনাড়ু থেকে এসেছে। ফিল্মে আমি যে খুব পপুলার জগদীশ্বর। কতরকম আমার ভূমিকা একবার অবলোকন করুন।
খুবই নিম্ন রুচির পরিচয় মহেশ্বর! তুমি ক্রমশই, ক্রমশই একটি নিকৃষ্ট দেবতা হয়ে যাচ্ছ।
আমার ভক্তরাই এর জন্য দায়ী প্রভু। আমার কিছু করার নেই! বিশ্বনাথে আমার টাকে কলসি কলসি জল আর দুধ ঢালে ধনী ব্যাবসায়ীরা। কী প্রার্থনা শুনবেন? আরও টাকা আরও কালো টাকা চাই। ভোগ চাই। ব্যাভিচার চাই। তুমি একটা বোকা হাঁদা। নিশ্চয়ই তথাস্তু বলো।
কী করব প্রভু! ভক্তের মনোবাঞ্ছা আমাকে পূর্ণ করতেই হয়। সেই রত্নাকরকে দিয়েই শুরু। আমি তো ভোগ করি না। ভোগ করে সেবায়েতরা।
চালিয়ে যাও। চালিয়ে যাও।
পার্বতী ডিভানে শুয়ে ভিডিওতে শোলে দেখছেন। মহেশ্বর আর পরমেশ্বর ঢুকতেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন। গব্বর সিং-এর ডায়লগ চলেছে। পরমেশ্বর আসন নিলেন। গম্ভীর মুখ। ম্লান জ্যোতি। মানুষের চেয়ে দেবতার অধঃপতন কী আরও বেশি হল। পার্বতীর বেশ-ভূষার এ কী ছিরি হয়েছে। এ যে বাইজিমার্কা পোশাক। হায় মহেশ্বর। শাসনের অভাবে সংসার যে ভেসে যায় রে বাপ। অবশ্য সংসার তোমার কোনও কালে ছিল না।
পার্বতী নতজানু হয়ে বললেন, প্রভু কেন হেরি বিরস বদন এমন? শরীর স্বাস্থ্য কুশল তো প্রভু! উদরে কোনও গোলমাল উপস্থিত হয়নি তো? জিয়াডিয়াসিস, অ্যামিবায়োসিস ইত্যাদি কোনও পার্থিব ব্যামোর আক্রমণ হয়নি তো প্রভু!
পরমেশ্বর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমার দিকে তাকাতে পারছি না। তোমার পোশাক বড় অশালীন। অশ্লীল তোমার অঙ্গভঙ্গি। উপরন্তু তুমি অতিশয় ফাজিল ও বাচাল হয়েছে। তিলতিল করে তোমাকে আমরা সৃষ্টি করেছিলুম। শক্তির বলয়। শক্তি-পুঞ্জও বলা চলে।
জাতি পুঞ্জ বা যুক্তফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্রের মতো।
চুপ করো দেবলোকের ব্যাপারে পৃথিবীর উপমা টেনে এনো না। তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
প্রভু বারে বারে আমাকে অসুর দমনে আপনার আজ্ঞাবাহী হয়ে পৃথিবীতে যেতে হয়।
বেশ তো। দেব কার্যে পৃথিবীতে যাওয়া মানে স্বৈরিনী হয়ে ফিরে আসা? বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছ?
প্রভু, আমার আরাধনা যারা করে, সেই ভক্তকূল আমাকে যেভাবে সাজায়, যেভাবে যেরূপে ভজনা করে, আমি দিনে-দিনে ঠিক সেই রকম হয়ে উঠছি। আমার তো কোনও দোষ নেই। দোষ আপনার।
আমার দোষ? তুমি কী বলতে চাইছ রমণী?
প্রভু রমণী নয়। দেবী।
তোমাকে আর দেবী বলতে পারছি না। তুমি এখন লাস্যময়ী রমণী। বলো কোথায় আমার দোষ! যত দোষ, নন্দ ঘোষ।
আপনি আজকাল বড় ভুলে যান। অবশ্য দোষ নেই আপনার। হাজার, হাজার-হাজার বছরের সুদীর্ঘ জীবনের খুঁটিনাটি মনে রাখা সহজ নয়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো বুদ্ধিমান হলে একটা কম্পিউটার বসিয়ে নিতেন। নিজের স্মৃতি আর প্রয়োজন হত না। কম্পিউটারের স্মৃতিতে সব জমা থাকত। মনে আছে প্রভু, সখা কৃষ্ণ হয়ে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পার্থকে বলেছিলেন! মানুষকে গীতা পড়তে বলেন। রোজ সকালে শুদ্ধ বস্ত্রে অন্তত একটি অধ্যায়। অথচ নিজের গীতা নিজে একবার উলটে দেখেন না?
কী বলেছিলুম?
বলেছিলেন যে, যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। প্রভু, মনে পড়ে? বলেছিলেন, আমার শরণ যারা যে-ভাবেতে লয়, সে ভাবেই পায় মোরে আমি সর্বাশয়।। প্রভু, আপনার বাক্য তো মিথ্যা হতে পারে না। আমি কখনও হেমা, কখনও জয়া, কখনও জীনাত, কখনও রেখা, কখনও লেখা। যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।
যাদের নাম করলে তারা আবার কোথাকার দেবী? ওই যে প্রভু! সেলুলয়েডের দেবী।
মহেশ্বর একমনে শোলে দেখছিলেন। দুজনের দিকে ফিরে বললেন, কী তখন থেকে শুরু করেছেন? আপনার জগৎ ভুলে যান। দেখুন সেলুলয়েড ওয়াল্ডের বড়িয়া খেল। সব ভুলিয়ে দেয়। জগৎ মায়া। এ আবার মায়ার মায়া। বড় মিষ্টি মোয়া। একেবারে জয়নগর।
পার্বতী উঠে দাঁড়ালেন। মহেশ্বর বললেন, প্রভু কী সেবনের ইচ্ছা? সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। রাত্রি আসন্ন। এক চুমুক অ্যাপেটাইজার হয়ে যাক।
সে আবার কী?
প্রভু সভ্য মানুষেরা সোমরসকে অ্যাপেটাইজার বলে। আমি কলকাতায় গিয়ে এই শব্দটি শিখে এসেছি। সেবনে চনমনে খিদে হয়। মেজাজ শরিফ হয়। পার্বতীর ভাণ্ডারে কয়েক বোতল বিলাইতি আছে।।
সে আবার কী? আমাদের আবার দিশি-বিলিতি কী?
আছে প্রভু আছে। বিলেতে আপনি গড। দেশে আপনি ঈশ্বর। তা সেই গডের দেশের চোলাইটি বড় মধুর। সেবনে মনে হবে, জিভ ফুড়ে একটি ধারাল তলোয়ার চলে গেল পেটে। হয়ে যাক প্রভু। তারপর একটু চিকেন চাওমিন। চিলিচিকেন। মাটন আফগানি।
এসব বিজাতীয় বস্তু, এসব বিদঘুঁটে, বিকট বস্তু তুমি পাচ্ছ কোথা থেকে?
সবই আমার সুগৃহিণীর কল্যাণে। বারোয়ারি সেরে আসার সময়, কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে কয়েক বোতল স্মাল করে এনেছে। আর এনেছে খানদুই রান্নার বই। ফাটাফাটি ব্যাপার। মানস সরোবরে হংস মেরে, সে যা বস্তু হচ্ছে। জিভে পড়া মাত্রই সমাধি।
পরমেশ্বর চমকে উঠলেন, সে কী হে! তোমরা মানস-সরোবরের হংস মেরে হাওচাও করে। পেটায় নমঃ করছ? ও যে পরমহংস।।
প্রভু হাওচাও নয়, চাওমিন। আমরা যে এখন মহাচিনের এলাকায় চলে গেছি। তারা আবার কমুনিস্ট। ধর্ম-টর্ম মানে না প্রভু। ওদের কাছে আপনার অস্তিত্ব নেই।
তাতে কী হয়েছে। তার মানে ওরা বৈদান্তিক। আমার প্রিয় পুত্র শঙ্করের অনুগামী।
না প্রভু। সোহহংবাদী নয়। পুরোপুরি মানুষ। অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ আত্মপুরুষের ধার ধারে না। তিনটি যন্ত্রের কারবারি। রাষ্ট্র যন্ত্র, উৎপাদন যন্ত্র এবং শ্রমিক। খাটো খাও বয়েস হলে ফুটে যাও।
অসহ্য তোমার ভাষা। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।
প্রভু, মানুষের কবি লিখেছিলেন, জিভ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। তিনি মানে আপনি। আমি বলছি, বাড়ি দিলেন যিনি, রক বানালেন তিনি। প্রভু সেই রকের ভাষার আর রক কালচারের জয় জয়কার সর্বত্র। রক থেকে রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতির রূপ-রেখা শিক্ষা-দীক্ষা সবই উঠছে। রক যেন বিষ্ণুর নাভীপদ্ম। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় চলেছে রক-এন-রোল। সে কী ভীষণ সোরগোল। পার্বতী, তোমার ভিডিওতে সেইটা চাপাও না গো, রক, রক, রক।
পার্বতী রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার করলেন। শোলের জায়গায় শুরু হল প্রথমে ওসিবিসা। পরমেশ্বরের পিলে চমকে গেল। কৈলাসের গা বেয়ে হিমবাহ নেমে গেল, গুড়গুড় করে। বিদ্যুৎ চমকে উঠল খিলিখিলি করে। পরমেশ্বর চিৎপাত হয়ে পড়ে গেলেন বাঘছাল বিছানো শয্যার ওপর।
মহেশ্বর ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন, দেখো-দেখো। প্রভুর থ্রম্বোসিস হল না তো?
পার্বতী বললেন, তোমার যে কবে বুদ্ধি পাকবে কত্তা! কত বেল পেকে গেল! সারা জীবন বেলতলায় বসে রইলে, তোমার বুদ্ধি কিন্তু পাকল না। মাথায় অত জটাজুট থাকলে বুদ্ধি কি আর পাকে! টাক তো আর পড়বে না? মাথাটা কামিয়ে ফেলো। যদি কিছু হয়?
আমি আবার কী করলুম?
বৃদ্ধ দেবতাকে কি এসব শোনাতে আছে! প্রভুর থ্রম্বোসিস হলে কী হবে?
তোমার যেমন বুদ্ধি গিন্নি! প্রভুর থ্রম্বোসিস হবে কী? ও তো হয়েই আছে। আমি বাঙাল হলে বলতুম।
কী বলতে?
যাক সে আর তোমার শুনে কাজ নেই। তুমি বরং মুখে একটু বিলিতি ব্র্যান্ডি ঢেলে দাও।
পার্বতী পরমেশ্বরের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। পরমেশ্বর মৃদু স্বরে বিড়বিড় করে বলছেন, জুজু, ওরে বাবা জুজু।
পার্বতী তাড়াতাড়ি ভিডিও বন্ধ করে দিলেন। কান ফাটানো শব্দ বন্ধ হয়ে সুন্দর এক নীরবতা নেমে এল। পরমেশ্বরের কপালে হাত বুলোতে-বুলোতে পার্বতী বলতে লাগলেন, প্রভু, ও জুজু নয়, ওর নাম ডাক পোট্যাটো। খুব ভালো ড্রাম বাজায়।
পরমেশ্বর চোখ খুললেন। ভীত কণ্ঠে জিগ্যেস করলেন, আমি কোথায়?
প্রভু আপনি কৈলাসে।
তুমি কে? তোমার ঠোঁট অত লাল কেন? তোমার চোখের পাতা অমন সোনালি কেন?
প্রভু, আমি পার্বতী। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছি। চোখের পাতায় আইল্যাশ রং। পৃথিবীর সেরা সুন্দরীরা এর চেয়ে কত সাজে। তাও তো আমি ভুরু প্লাক করিনি। চুল বয়-কাট করিনি। জিন্স পরিনি, গেঞ্জি চাপাইনি। বিশ্বসুন্দরীর পোশাকে দেখলে আপনি কী কলতেন প্রভু?
নির্ঘাত মরে যেতুম জননী।
আপনার যে মৃত্যু নেই প্রভু। অবুদ অবুদ অবুদ বছর আপনি শুধুই জীবিত থাকবেন। ছারপোকার মতো অসংখ্য মানুষ সৃষ্টি করে যাবেন আপন খেয়ালে। যে পিতার অসংখ্য সন্তান, সে পিতা কোনও সন্তানকেই মনে রাখে না। সন্তানও পিতাকে মনে রাখে না। নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি খুনোখুনি হতে থাকে। বিষয় সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে যায়। পাঁচিলের পর পাঁচিল ওঠে। বৃদ্ধ পিতা ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ান। আর ওরাই বলে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না।
ওরা কারা?
আপনার সন্তানেরা। সেই অমৃতের পুত্ররা।
পরমেশ্বর বড়-বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর চিৎকার করে বললেন, ওয়েটার হুইস্কি বোলাও।
মহেশ্বর বললেন, এ কী প্রভু! এ আপনি কী বলছেন? বাংলা ছবির নায়ক এই ডায়ালগ ছাড়ে।
মূর্খ মহেশ্বর, সে কে? সে তো আমিই।
এই তো। এই তো পথে আসুন প্রভু। এতক্ষণ তাহলে অভিনয় করছিলেন!
ধূর্ত মহেশ্বর, ধরেছ ঠিক। এই যে তুমি সংসারী হয়েও সংসার করো না, এও কি আধুনিক মানুষের লক্ষণ নয়!
হ্যাঁ প্রভু! আপনিও ঠিক ধরেছেন। একেই ওরা বলে, রতনে রতন চেনে, ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু।
সবই তো আমার। আমিই তো সব। আমি সাধু, আমি শয়তান। আমি রাজ্য, আমিই প্রজা। আমি গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র, আমি মিত্র, আমি অরীত্র, আমি সৎ, আমি অসৎ, আমি যুদ্ধ, আমি শান্তি।
প্রভু, আপনি বাঁধাকপি, আপনিই ফুলকপি। আপনি আলু, আপনিই রাঙালু।
তুমি আবার কোথা থেকে, কোথায় চলে গেলে?
প্রভু, আমি শম্প জগতে ঢুকে গেলুম। মানে আপনাকে ঢুকিয়ে দিলুম।
তুমি আবার নতুন করে ঢোকাবে কী! আমি তো ঢুকেই আছি। আমি মহেশ্বর, আমিই পার্বতী।
অসম্ভব। অসম্ভব প্রভু। তা হতে পারে না। আমরা দুজন ছাড়া আপনি সব।
পাগলা, তা কি কখনও হয়! আমার প্রিয় পুত্র শ্রীরামকৃষ্ণ একেই বলেছিল, মতুয়ার বুদ্ধি। আমার ঋষিদের মুখ দিয়ে হাজার-হাজার বছর আগে যে বেদ-বেদান্ত রচনা করিয়ে গেছি, সময় করে সে সব একটু পড়ো না! সত্য জানতে পারবে।
পার্বতী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সারাদিন ট্যাঙোস-ট্যাঙোস করে না ঘুরে, একটু লেখা-পড়া করো। আজকাল বি-এ, এমএ পাশ কিছুই নয়। ঘরে-ঘরে। রিসার্চ করো, ডক্টরেট হও। রাজনীতিতে নেমো না বাপু। এই তো একটু আগে দুম করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মেরে দিলে।
মহেশ্বর বললেন, অ্যাঁ, সে কী গো, কে মারলে? তুমি কীভাবে খবর পেলে?
আমার যন্ত্রে। আমার টিভি যন্ত্রে।
পরমেশ্বর বললেন, তোমরা বেদজ্ঞ হলে এমন উতলা হতে না। আমি শ্রীকৃষ্ণ রূপে তোমাদের কী বলেছিলুম।
ন জায়তে বা স্রিয়তে কদাচিদ
ভূত্বা ন বায়ং ভবিতা ন ভূয়ঃ।
নিত্যঃ পুরাণোহয়মজোহব্যয়োহসৌ
ন হন্যমানে নিহতঃ শরীরে।।
জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, পুনর্জন্ম নাই,
দেহের নাশেও দেহী থাকে সর্বদাই।
অজ্ঞাত, শাশ্বত, নিত্য, চির-পুরাতন।।
প্রভু, আপনার ওইসব হেঁয়ালি মানুষ বোঝে না বলেই, পৃথিবীতে ভণ্ডামি এত বেড়ে গেছে। মা মরছে, বাবা মরছে। ভাই ভাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। স্বামী সংসার ভাসিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। সন্তান মায়ের কোল খালি করে সরে পড়ছে। শ্মশানে চড়চড় করে মৃতদেহ পুড়ছে। আর আপনি বলে আসছেন, জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, পুনর্জন্ম নাই। দেহের নাশেও দেহী থাকে সর্বদাই!
অ্যাটমের যুগে এসব চলে না মালিক। চিরকাল মানুষ আপনার ছায়াটাই দেখে এল। কায়াটা একবার দেখান।
পাগল হলে মহেশ্বর। সশরীরে পৃথিবীতে হাজির হলে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
জ্যোতির্ময় শরীর ধারণ করে পৃথিবীর আকাশে ভেসে বেড়ান।
ভূত ভেবে সব ভিরমি যাবে।
তাহলে এই চলবে! কল্প কল্পান্তর ধরে?
বোকা, সেই কারণেই তো আমি অবতার পাঠাই। কিছু শক্তি দিয়ে, কিছু বিভূতি দিয়ে।
বহু বছর তো কোনও অবতারও পাঠাননি।
সময় হয়নি এখনও। আমি তো বলেই রেখেছি, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি।
গ্লানির আর কী বাকি আছে প্রভু। রক্ষক ভক্ষক হয়ে প্রাইম মিনিস্টারকে শেষ করে দিলে।
তুমি কেবল ভারতের কথাই ভাবছ। পক্ষপাতদুষ্ট ভাবনা। গোটা পৃথিবীর কথা ভাবো।
সারা পৃথিবী জুড়েই কেলোর কীর্তি হচ্ছে। ইরাক-ইরানে যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। অ্যায়সা বায়োবোম ছেড়েছে, মানুষের কী দুর্গতি! গায়ে চাকা-চাকা ফোঁসকা। দগদগে ঘা। অন্ধ। চামড়া ফেটে রক্ত ঝরছে। আফগানিস্থানের ঘাড়ে রাশিয়া চড়ে বসে আছে। ইয়লো রেন কাকে বলে জানেন প্রভু?
বিষাক্ত গ্যাস।
কাম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ফকল্যান্ড, আর্জেনটিনা। জার্মানি ফেঁড়ে দু-ভাগ। ভারত সীমান্তে পাকিস্তানের ঠুসঠাস। চিন আবার মাকর্সকে বাতিল করে দিলে। আমেরিকায় সঙ্গে দোস্তি। আপনার সাধের ইংরেজ, যাদের কিংডামে সূর্য অস্ত যেত না, সেখানে কী অবস্থা! থ্যাচারকে তো প্রায় শেষ করেই দিয়েছিল। মাইনাররা ধর্মঘট করে বসে আছে। আয়াল্যান্ড তেড়ে-তেড়ে আসছে। ডিকটেটাররা মানুষ ধরছে আর কোতল করে দিচ্ছে। আর আপনার প্রিয় আফ্রিকা।
আমার প্রিয়?
প্রভু, প্রথম মানুষকে তো আপনি আফ্রিকাতেই ফেলেছিলেন। মানুষের জন্মভূমি।
তা অবশ্য ঠিক। দুর্গম স্থানেই আমি বীজ বপন করেছিলুম। ইচ্ছে করেই। ধীরে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, মরতে মরতে। মারতে মারতে, মানুষ অসভ্যতা থেকে সভ্যতার আলোতে আসুক। এই ছিল আমার প্ল্যান।
তা আফ্রিকার কী হয়েছে!
প্রভু, আপনার টেলিস্কোপে একবার ফোকাস করুন না, দেখুন না ইথিওপিয়ায় কী হচ্ছে।
জানি। জানি। জানি রে বাপু। বৃষ্টি নেই, দুর্ভিক্ষ, অনাহার, কঙ্কালসার মানুষ, ধুকছে, মরছে। মানুষের উদাসীনতায় মানুষ মরছে। জানি। আমি জানি সব।
পরমেশ্বর পায়চারি শুরু করলেন। হাত দুটো পেছন দিকে মোড়া। মাথায় একমাথা রূপালি চুল। গায়ের রং উত্তপ্ত তামার মতো। চোখের বর্ণ নীল। স্বর্ণ বর্ণ দন্তসারি। কী ভীষণ রূপ!
মহেশ্বর বললেন, কেন এমন করেন প্রভু? পৃথিবী তো কারুর বাপের সম্পত্তি নয়। কিছু মানুষ ভোগ করবে। আর কিছু মানুষ ভোগ্য হবে। কেন! কেন এই অবিচার?
পরমেশ্বর পায়চারি থামালেন। ঘন নীল দৃষ্টি মেলে মহেশ্বরের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন বলো তো! কেন এমন করি?
কী জানি প্রভু! মানুষ তো বলে, আপনি নাকি কবে কখন তাদের বলে এসেছেন, যে করে আমার আশ, আমি করি তার সর্বনাশ।
সে তো ওদের কথা। আসল রহস্যটা কী?
যদি বলি আমিই শয়তান। তোমরা এতকাল যাকে পরমেশ্বর ভেবে এসেছ, আসলে সে ছদ্মবেশী শয়তান। জীবিতের রাজত্বের মালিক হল শয়তান। মৃত্যুর রাজা ঈশ্বর। যোজন-যোজন ব্যাপী শূন্যতা। গ্রহ নেই, তারা নেই, অসীম অন্ধকার। সেখানে বসে আছেন তোমাদের ঈশ্বর। জীবন মানে কি মহেশ্বর? জন্ম আর মৃত্যু। ভোগ অথবা দুর্ভোগ। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি। জীবন মানে সংঘর্ষ। জীবন মানে বেঁচে থাকার শয়তানি কৌশল। আমার এই নীল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখো। বিষাক্ত নীল। আমার বুকে হাত রেখে দেখো, হৃদয় নেই। আমার কোনও অনুভূতি নেই। মহেশ্বর, তোমাদের ঈশ্বর পরাভূত। তিনি শুধু কোলে তুলে নেন। কোল থেকে যেখানে নামান সে হল আমার এলাকা।
মহেশ্বর, পার্বতী দুজনেই স্তব্ধ। এ কী পরমেশ্বরের হেঁয়ালি, না সত্য? সত্য কোথায়? সৃষ্টি আর লয় দুটোই তো রহস্য! জানা, অজানা হয়ে যেতে কতক্ষণ।
আমি এবার বিদায় নেব।
মহেশ্বর বললেন, প্রভু, আপনি যদি শয়তানই হন, আমরা কিন্তু এতকাল আপনাকে পরমেশ্বর বলেই জেনে এসেছি। সে ভুল আর না-ই বা ভেঙে দিলেন।
গুহামুখ থেকে পরমেশ্বর অথবা শয়তান, যিনিই হোন না কেন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, সে তোমাদের ব্যাপার! কী সত্য আর কী মিথ্যা, এ বিচারের ভার আমি তোমাদেরই দিয়ে গেলুম। আমার কাছে সত্যও নেই, মিথ্যাও নেই। মানুষকে আমি নিজে কোনওদিনই বলতে যাইনি, তোমরা ভগবানকে মানো, কি শয়তানের থেকে সাবধান হও। বিশ্বাস আপনিই জাগে। সন্দেহ আপনিই আসে।
মহেশ্বর আর পার্বতী গুহামুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কেউ নেই। রাত নেমেছে কৈলাসে। তুষারধবল রাত। হুহু বাতাস বইছে। হিমবাহ নামার শব্দ। বরফে-বরফে ঘর্ষণে হিলহিলে বিদ্যুৎ খেলছে চারপাশে।
.
মহেশ্বর বললেন, পারু এতক্ষণ কি আমরা কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম?
হতে পারে? ভদ্রলোক আবোল-তাবোল কী সব বকে গেলেন!
অতটা অশ্রদ্ধা প্রকাশ কোরো না।
দেবতা কখনও ভদ্রলোক হয় না। অমন কথা বলতে নেই, ছিঃ! তোমার বয়েস কয়েক কোটি আলোকবর্ষ হলেও, তোমার এখনও ভীমরতি হয়নি?
দেবতারা তাহলে কি ছোটলোক!
দেবতা-দেবতা। লোক কেন হতে যাবেন! লোক তো পোক!
সে আবার কী?
কেন? শোনোনি? অবতার পুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তোক না পোক। পোক মানে পোকা। উনি তো সৃষ্টির আদি থেকেই উলটোপালটা কথা বলার জন্য বিখ্যাত। কী আর করা যাবে। অমন বলেন বলেই পৃথিবীতে একদল মানুষ করে কর্মে খাচ্ছে গো!
কথা বেচে? কথা সারা জীবন ওলোটপালোট করে!
যারা রাজনীতি করে, তারা ওইরকম কথা বলে। কারুর সঙ্গে কারুর মিল নেই। এখন একরকম পরমুহূর্তেই আর একরকম। আর একদল হল দার্শনিক পণ্ডিত। পিপে-পিপে নস্যি আর ঘাড় দুলিয়ে তর্ক, তৈলাধার পাত্র, না পাত্ৰাধার তৈল। বীজ আগে না গাছ আগে! ডিম আগে না ছানা আগে!
যাই, বৃদ্ধ মানুষটিকে ফিরিয়ে আনি। তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছে।
আবার মানুষ বলছ? ঈশ্বর বলল।
তাইতো বলতুম। এই যে বলে গেলেন, আমি ঈশ্বর নই, শয়তান।
আরে বোকা ঈশ্বর আর শয়তান আলাদা নাকি? একই টাকায় এ-পিঠ ওপিঠ। এই যে আমি বারে বারে পৃথিবীতে যাই, কী দেখে আসি! মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর, মানুষের মধ্যেই শয়তান। বাইরেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। একদিকে প্যাণ্ডেলে ধুনুচি-নৃত্য হচ্ছে, আর একদিকে পেট্রল বোমা চলেছে। বন্ধু বন্ধুর বুকে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। তোমার মাথায় তো সারাদিন ঘড়া-ঘড়া দুধ ঢালছে। কেন ঢালছে? কী চায় তারা! ধর্ম? আত্মার উন্নতি?
না পারু। শুধু স্বার্থ। টাকা চাই টাকা। মুনাফা। মানি মানি মানি, সুইটার দ্যান হানি।
তবে? কে ঈশ্বর! আর কে শয়তান, তুমি বুঝবে কী করে!
বেশ আমি তাহলে শয়তানের সন্ধানে চলুম। যদি পাই, ধরে এনে পরমেশ্বরের পাশে দাঁড় করিয়ে দোব। তখনই ধরা পড়ে যাবে, এই জগৎ-সংসার দুইয়ের খেলা, না একের খেলা। গাছের ডালে দুটি পাখি, সু আর কু! না একটি পাখি সুকু। কী বলো গিন্নি!
তোমার তো ট্যাঙোস-ট্যাঙোস করে ঘুরে বেড়ানোই কাজ। সেই ছুতোয় বেরিয়ে পড়ো। ব্রহ্মাণ্ডটা একবার চক্কর মেরে এসো।
.
মহেশ্বর বার-গুহায় এসে হাঁফ পাড়লেন, নন্দে। এই ব্যাটা নন্দে।
নন্দী আপাদমস্তক চামরি-গাইয়ের লোমের কম্বল ঢাকা দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। ধড়মড় করে উঠে বসল। ঘুমজড়ানো গলায় বললে, জি হাঁ। ছিলাম প্রস্তুত।
ধ্যার ব্যাটা ছিলাম। মাথাটা গুইলে দিয়ে গেল।
গুইলে নয় প্রভু গুলিয়ে। যাঃ বাবা, নিজেরই গুইলে যাচ্ছে।
অ্যাঁ সে কী রে! শব্দটা তাহলে কী? গুলিয়ে। নে ধরে থাক।
কী ধরব প্রভু?
হস্যইটাকে আগে আসতে দিবি না।
ঠিক আছে মহারাজ। চেপে ধরলুম। আগে আসতে দেব না।
কী হয়েছে বলুন তো, সব যেন কেমন এমোলেলো হয়ে যাচ্ছে।
কতটা টেনেছিস? এমোলেলো না এলোমেলো! ওঠ। ওঠ। উঠে দাঁড়া।
নন্দী উঠে দাঁড়াল। প্রভু আমার মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন ধীরে ঘুরছে। ইসপিড কমে গেছে।
স্পিডোমিটারটা দ্যাখ। আস্তে ঘুরছে কী রে! তাহলে তো দিন রাত্রির মাপ ছোট-বড় হয়ে যাবে। ঋতু পালটে যাবে। বছর লম্বা হয়ে যাবে।
নন্দী স্পিডোমিটার দেখে বললে, হ্যাঁ প্রভু, ইসপিড কে কমিয়ে দিয়েছে।
সেরেছে।
তাতে আমাদের কী? আমাদের কাঁলকচা।
কাঁলকচা কী রে! বল কাঁচকলা। শুধু আমার-আমার করে মরছিস কেন? মানুষের কথা ভাব। সারা বছর চাল, কলা, মূলো কম দিচ্ছে! দুধ খাওয়াচ্ছে ঘড়া-ঘড়া।
আর বলবেন না। বোগড়া চাল, পচা কলা, জোলো দুধ।
তা আর কী হবে বল! রেশানের চাল জাঁকের কলা, ফুঁকো দেওয়া দুধ। বিজ্ঞানেই বারোটা বাজালে।
ক্যাঁচ করে ভীষণ একটা শব্দ হল। নন্দী আর মহেশ্বর দুজনেই দুম করে মাটিতে পড়ে গেলেন।
মহেশ্বর বললেন, নন্দে, এটা তোর কী কায়দা!
আমার কায়দা নয় প্রভু। ব্রেক কষেছে। পৃথিবী থেমে গেছে! আর ঘুরছে না।
কে কষলে?
মালুম শয়তানে। অনেক দিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছিল।
শয়তানের ঠিকানা জানিস? ফোন নম্বর?
সে যে পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে চেনা।
তোকে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত করতে বলিনি। চল, আমি শয়তানকে ধরতে যাচ্ছি।
সে কি প্রভু! লোকে মাছ ধরতে যায়, আপনি শয়তান ধরতে যাবেন।
কথা বাড়াসনি, চল।
মহেশ্বর বললেন, নন্দে, পৃথিবীর আকাশে এই হাহাকার কীসের?
বেশ বড় কিছু ঘটছে।
আর কী ঘটবে! ভারতের আকাশে আর কী ঘটতে পারে। স্বর্ণমন্দিরে লড়াই। কর্ণাটকে মন্ত্রিসভার–না কর্ণাটক নয়, অন্ধ্র। অন্ধ্রে মন্ত্রিসভার পতন ও উত্থান। প্রধানমন্ত্রীর তিরোধান। আর কী হবে!
কিছু একটা হয়েছে। এত দূর থেকে বলি কী করে? চলুন নীচে নেমে দেখা যাক। আপনারাই তো বলেছেন, ধূম দেখলেই বুঝবে বহ্নি আছে।
চল তা হলে।
মহেশ্বর আর চিরকালের বিখ্যাত সঙ্গী নন্দী ভূপালে এসে নামলেন। নামার সময় শুধু একবার মাত্র বলতে পেরেছিলেন, কী বিশ্রী কুয়াশার রাত।
তারপর শ্রীমুখে আর কথা সরল না। ডানাকাটা জটায়ুর মতো দুম করে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়লেন। মুখ হাঁ হয়ে গেল। তিনবার কোনওক্রমে বললেন, নন্দে, একটু জল। সেই ঘোরের মধ্যেই দেখলেন, শহর ছেড়ে মানুষ পালাচ্ছে। রাজা ছুটছে, প্রজা ছুটছে। মরা পাখির মতো, টুপটাপ মানুষ ঝরছে। তারপর আর জ্ঞান রইল না। অসীম শ্বাসকষ্টে জ্ঞান হারাবার আগে একবার শুধু ভাবতে পারলেন, এতদিনে পার্বতী আমার বিধবা হল। কোথায় গেল আমার সেই ক্ষমতা। একদিন এই কণ্ঠে সমুদ্রমন্থনের সব হলাহল ধারণ করেছিলুম!
মহেশ্বর মরলেন না। দেবতার মৃত্যু হয় না। অমর। জ্ঞান হল। নির্জন বনানীর ধারে, নদীর পারে। কার কোলে মাথা? পার্বতীর!
তুমি কে?
আমি পরমেশ্বর। তুমি ওখানে মরতে গিয়েছিলে কেন?
জানো না, তোমার আর সে ক্ষমতা নেই। সঙ্গদোষে সব গেছে।
প্রভু, তা ঠিক। আমরা এসেছিলুম হাহাকার শুনে। ভেবেছিলুম, শয়তান আবার নতুন চাল চেলেছে। ব্যাটাকে ধরতে হবে।
পরমেশ্বর বললেন, আরে আমিও তো সেই খোঁজেই এসেছিলুম। ভেবেছিলুম জালার ভেতর থেকে সেই মহা-প্রতাপশালী ধোঁয়ার কায়া নিয়ে বেরোচ্ছে আলাদিনের দৈত্যের মতো। ভুল হয়েছিল। এ যে আমেরিকান গ্যাস। নাম মিক। সব ছারখার করে দিয়েছে।
এ তারই খেলা।
না-না, এ হল মানুষের বিজ্ঞানের খেলা।
তা হলে বিজ্ঞানই শয়তান।
হতে পারে। তবে আকাশে আমি তার অট্টহাসি আর কণ্ঠস্বর শুনেছি।
কী শুনলেন?
বললে, মুখ ভগবান, তোমার সৃষ্টির ভেতর আমি নিজেকে পাউডারের মতো ছড়িয়ে দিয়েছি। এখন আমার আর নির্দিষ্ট শরীর নেই। আমি এখন বহু হয়ে গেছি। কোটি-কোটি মনের কোথায় আমি তিলতিল হয়ে আছি, খুঁজে বের করতে তোমার চুল পেকে যাবে।
প্রভু, এই কলস্বনা নদীটির নাম?
বৈতরনী।
তাহলে চলুন প্রভু, ভাসাই ভেলা। পারুর জন্য মন কেমন করছে।