ইসমাইল সাহেব হাজি সাহেবের সম্মুখে নত হইয়া তাঁর কদমবুসি করিলেন; তাঁর বাম হাতটি নিজের মাথায় লইয়া বিনীতভাবে বলিলেন : আপনি বরাবর আপনার এই অযোগ্য সন্তানের বুদ্ধিবৃত্তির উপর নির্ভর করে আসছেন। আশা করি, সে-বিশ্বাস আপনার এখনো টলে নাই। আপনি পিতৃতুল্য, আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নাই। আহলে-হাদিস মত প্রচার করতে গিয়ে আমি বাজারের মামুলি পন্থা অবলম্বন করতে চাই নে। আপনি জানেন, আমি খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচার প্রণালী বহুদিন ধরে অধ্যয়ন করে আসছি। এ বিষয়ে আমি তাদের নীতিই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। উদারতার ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচারেই সাফল্যের আশা অধিক।
হাজি সাহেবের সন্দেহ অনেকটা দূর হইল। তিনি নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন : আচ্ছা বাবা, যা হয় কর। আমি আর কি বলব? আমাদের উদ্দেশ্য যেন ভুলে যেয়ো না।
ইসমাইল সাহেব দৃঢ়তার হাসি হাসিয়া আবার মাথা ঝুকাইয়া বলিলেন : আপনি দোয়া করুন।
হাজি সাহেব খুশি হইলেন।
ইসমাইল সাহেব বিদায় হইলেন।
.
চার
‘গুর্যের’ পাঠক-পাঠিকার প্রাণ বহুদিন প্রতীক্ষার সূতায় লটকাইয়া রাখিবার পর ইসমাইল সাহেবের এতেকাফের ফল বাহির হইল।
একদিন সম্পাদকীয় স্তম্ভে এইরূপ লেখা হইল : অধঃপতিত বঙ্গ-মুসলিমের দুরবস্থা দর্শনে যে মহাপুরুষের প্রাণ কাঁদিয়া উঠিয়াছিল, যিনি সংগোপন লোক-লোচনের অন্তরালে সমাজের কল্যাণ কঠোর সাধনায় শিবরাত্রির শলিতার মতো নিজকে তিল তিল করিয়া বিসর্জন দিতেছিলেন, খোদার দরবারে হাজার শোকর, আমাদের সেই পূজনীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেব তদীয় সাধনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। তিনি দীর্ঘ একমাস এতেকাফে বসিয়া খোদার দরবার হইতে এল-হামের অনুপ্রেরণা পাইয়াছেন। সমস্ত মুসলিম বঙ্গ আজ সমস্বরে বল ও আল্লাহু আকবর।
এহতেকাফে বসিয়া হযরত মওলানা সাহেব কি এহলাম পাইয়াছেন, সমাজের কল্যাণের কি অনুপ্রেরণা তিনি লাভ করিয়াছেন, প্রবন্ধের বাকি অংশে সে-সমস্ত কথা বর্ণনা করা হইল। তার সারমর্ম এই মুসলিম বঙ্গের অদ্বিতীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেব শিবরাত্রির শলিতার মতো তিলে তিলে আত্মবিসর্জন দিয়া আল্লাহ রাব্দুল-আলামিনের নিকট হইতে যে এহলাম পাইয়াছেন তা এই : ইসলামের রজ্জুকে শক্ত করিয়া না ধরার অপরাধেই মুসলিম বঙ্গ এই শাস্তি ভোগ করিতেছে। মুসলিম বঙ্গের উন্নতি করিতে হইলে বাংলায় ইসলামকে পুনর্জীবিত করিতে হইবে; খ্রিস্টান পাদ্রিদের ধোকায় পড়িয়া লক্ষ লক্ষ মুসলিম আজ মুরতে হইয়া যাইতেছে, ইহাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে; ভিন্ন। ধর্মাবলম্বীদিগকে ইসলামের সুশীতল ক্রোড়ে স্থান দিতে হইবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইভাবে সমাজের দুরবস্থা ও তার প্রতিকারের উপায় বর্ণনা করিয়া উপসংহারে হযরত মওলানা সাহেবের এলহাম-প্রাপ্ত তরকিবের কথা বলা হইল। তা এই : এতদুদ্দেশ্যে হযরত মওলানা সাহেব আঞ্জুমনে-তবলিগুল ইসলাম নামক একটি আঞ্জুমন কায়েম করিয়াছেন। আপাততঃ কলিকাতার কতিপয় উৎসাহী ও দেশ বিখ্যাত আলেমকে সদস্য করিয়াই এই আঞ্জুমন গঠিত হইয়াছে। সদস্যগণের সনির্বন্ধ ও সর্বসম্মত অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হযরত মওলানা সাহেব উক্ত আঞ্জুমনের সভাপতি সম্পাদক কোষাধ্যক্ষের বিরাট দায়িত্ব বহন করিতে রেযামন্দি ফরমাইয়াছেন। দীর্ঘকাল সমাজের খেদমতে রাতদিন অবিশ্রান্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে হযরত মওলানা সাহেবের স্বাস্থ্যভঙ্গ হইবার উপক্রম হইয়াছে সেজন্য অন্য কোনও নবীন কর্মীর স্কন্ধে এই বিরাট দায়িত্ব অর্পিত হইলে আমরা সুখী হইতাম। কিন্তু সত্যের খাতিরে একথা আমরা স্বীকার করিতে বাধ্য যে, হযরত মওলানা সাহেব ব্যতীত এত বড় বিরাট দায়িত্ব বহন করার লোকও দেশে সুলভ নয়। কাজেই হযরত মওলানা সাহেবের সাস্থ্য সম্বন্ধে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমরা এই নির্বাচনে আঞ্জুমনের সদস্যগণের দূরদৃষ্টির প্রশংসা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না।
অতঃপর কি প্রণালীতে বিভিন্ন জিলায় এই আঞ্জুমনের শাখা প্রতিষ্ঠিত হইবে, প্রবন্ধের বাকি অংশে তাহা বর্ণনা করা হইল।
কমিশন, রাস্তা খরচ ও ভাতা বাদে প্রচারকের ত্রিশ টাকা করিয়া বেতন ধার্য করিয়া আপাততঃ কমপক্ষে প্রচারক পাঠাইত্তে কিভাবে অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকার দরকার, প্রবন্ধে তারও নির্ভুল হিসাব প্রদর্শিত হইল। তিন কোটি মুসলমান-অধ্যুষিত বাংলায় ইসলামের খেদমতের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা যে কিছু নয়, খুব উদ্দীপনাময়ী ভাষায় তা বলিয়া প্রবন্ধে উপসংহার করা হইল এবং বারান্তরে এ বিষয়ে আরও বলা হইবে বলিয়া পাঠকগণকে আশ্বাস দেওয়া হইল।
দেশময় হৈ চৈ পড়িয়া গেল।
কমিশন, রাস্তা খরচ ও ভাতা বাদে ত্রিশ টাকা মাহিয়ানার সম্ভাবনায় দেশের মাদ্রাসা পাশ মৌলবী সাহেবদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য পড়িয়া গেল।
বেকার গ্র্যাজুয়েটরা মৌলবী না হওয়ার জন্য অদৃষ্টকে ধিক্কার দিল এবং প্রচারকের যোগ্যতা অর্জনের উদ্দেশ্যে ইসলামের সৌন্দর্যে ওয়াকিফহাল হইবার জন্য আহমদিয়াদের প্রকাশিত ইংরাজী গ্রন্থাবলী সংগ্রহ করিয়া গভীর মনোযোগে অধ্যয়ন করিতে লাগিল। ‘গুর্য আফিসে চাঁদার মনিঅর্ডার এবং প্রচারক পদপ্রার্থীদের দরখাস্তের বন্যা প্রবাহিত হইল।