০১. আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে
আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাপ, ভাই-বোন। ভাতের লড়াইয়ে তারা হেরে গেল।
অনেক আশা, অনেক ভরসা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে তারা শহরের বুকে পা বাড়িয়েছিল। সেখানে মজুতদারের গুদামে চালের প্রাচুর্য, হোটেলে খাবারের সমারোহ দেখে দেখে তাদের জিভ শুকিয়ে যায়। ভিরমি খেয়ে গড়াগড়ি যায় নর্দমায়। এক মুঠো ভাতের জন্যে বড়লোকের বন্ধ দরজার ওপর মাথা ঠুকে ঠুকে পড়ে নেতিয়ে। রাস্তার কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়। দৌলতদারের দৌলতখানার জাঁকজমক, সৌখিন পথচারীর পোশাকের চমক ও তার চলার ঠমক দেখতে দেখতে কেউ চোখ বোজে। ঐশ্বর্যারোহীর গাড়ীর চাকায় নিষ্পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় কেউ বা।
যারা ফিরে আসে তারা বুকভরা আশা নিয়ে আসে বাঁচবার। অতীতের কান্না চেপে, চোখের জল মুছে তারা আসে, কিন্তু মানুষের চেহারা নিয়ে নয়। তাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ধনুকের মত বাকা দেহ শুষ্ক ও বিবর্ণ। তবুও তারা ভাঙা মেরুদণ্ড দিয়ে সমাজ ও সভ্যতার মেরুদণ্ড সোজা করে ধরবার চেষ্টা করে। ধুকধুকে প্রাণ নিয়ে দেশের মাটিতে প্রাণ সঞ্চার করে, শূন্য উদরে কাজ করে সকলের উদরের অন্ন যোগায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে হুঁচোট খাওয়া দেশ আবার টলতে টলতে দাঁড়ায় লাঠি ভর দিয়ে।
দুটি ছেলে-মেয়ের হাত ধরে জয়গুনও গ্রামে ফিরে আসে। বাইরের ছন্নছাড়া জীবন। এতদিন অসহ্য ঠেকেছে তার কাছে। কতদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। ছায়া-সুনিবিড় একখানি বাড়ী ও একটি খড়োঘর তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে কতদিন! কিন্তু বৃথাই ডেকেছে। তার সে বাড়ী, সে ঘর আর তার নয় এখন। দুর্ভিক্ষের মহাগ্রাসে কোথায় গেল বাড়ী আর কোথায় গেল ঘর। বেচে নিঃশেষ করে দিল উদরের জ্বালা মেটাতে।
জয়গুন গ্রামে আসে একটি মাত্র আশা নিয়ে। ছাড়া ভিটে আছে একটা। সে তার আট আনা অংশের মালিক। বাকী আট আনার অংশীদার তার নাবালেগ ভাই-পো শফি। শফিকে নিয়ে শফির মা-ও আসে। তাদেরও মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। শেষে স্থির হয়—এই ছাড়া ভিটেটার ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে দু-ভিটিতে দুখানা ঘর তুলে আবার তারা সংসার পাতবে।
কিন্তু এটা যে সূর্য-দীঘল বাড়ী!
জয়গুন ও শফির মা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
পূর্ব ও পশ্চিম সূর্যের উদয়াস্তের দিক। পূর্ব-পশ্চিম প্রসার। বাড়ীর নাম তাই সুর্য-দীঘল বাড়ী। সূর্য-দীঘল বাড়ী গ্রামে কচিৎ দু’একটা দেখা যায়। কিন্তু তাতে কেউ বসবাস করে না। কারণ, গায়ের লোকের বিশ্বাস সূর্য-দীঘল বাড়ীতে মানুষ টিকতে পারে না। যে বাস করে তার বংশ ধবংস হয়। বংশে বাতি দেয়ার লোক থাকে না। গ্রামের সমস্ত বাড়ীই উত্তর-দক্ষিণ প্রসারী।
সূর্য দীঘল বাউরি ইতিহাস ভীতিজনক। সে ইতিহাস জয়গুন ও শফির মা-র অজানা নয়।
সে অনেক বছর আগের কথা। এ গ্রামে হাতেম ও খাদেম নামে দুই ভাই ছিল। ঝগড়া করে ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই হয়ে যায়। খাদেম আসে সূর্য-দীঘল বাড়ীটায়। বাড়ীটা বহুদিন থেকেই খালি পড়ে ছিল।
এখানে এক সময়ে লোক বাস করত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা বংশ রক্ষা করতে পেরেছিল কিনা কেউ জানে না। তবুও লোকের ধারণা, সূর্য-দীঘল বাড়ীতে নিশ্চয়ই বংশ লোপ পেয়ে থাকবে। নচেৎ এরকম বিরান পড়ে থাকবে কেন?
যাই হোক, শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে খাদেম এসে সূর্য-দীঘল বাড়ীতে বসবাস আরম্ভ করে। কিন্তু একটি বছরও ঘুরল না। বর্ষার সময় তার একজোড়া ছেলে-মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেল। সবাই বুঝতে পারল—বংশ নির্বংশ হওয়ার পালা শুরু হল এবার। বুড়োরা উপদেশ দিলেন বাড়ীটা ছেড়ে দেয়ার জন্য। বন্ধু-বান্ধবরা গালাগালি শুরু করল—আল্লার দুইন্যায় আর বাড়ী নাই তোর লাইগ্যা। সূর্য-দীগল বাড়ীতে দ্যাখ কি দশা অয় এইবার।
খাদেমের মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছিল। সাতদিনের মধ্যে ঘর-দুয়ার ভেঙ্গে সে অন্যত্র উঠে যায়। জয়গুনের প্রপিতামহ খুব সস্তায়, উচিত-মূল্যের অর্ধেক দিয়ে তার কাছ থেকে বাড়ীটা কিনে নেয়। উত্তরাধিকারের সেই সূত্র ধরে জয়গুন ও শফি এখন এ বাড়ীর মালিক।
ঐ ঘটনার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। এতদিনের মধ্যে আর কোন লোক ভুলেও এ বাড়ীতে আসেনি। আকালের সময় জয়গুন ও শফির মা এ বাড়ীটাই বিক্রী করতে চেয়েছিল। কিন্তু সূর্য-দীঘল বাড়ী কেউ কিনতে এগোয়নি। তখন এ বাড়ীটা বিক্রী করতে পারলেও জয়গুনের স্বামীর ভিটেটুকু রক্ষা করা যেত; ছেলে-মেয়ের বাপ-দাদার কবরে আজ আবার বাতি জ্বলত।
বহুদিনের পরিত্যক্ত বাড়ী। সর্বত্র হাঁটুসমান ঘাস, কচুগাছ, মটকা ও ভাট-শেওড়া জন্মে অরণ্য হয়ে আছে। বাড়ীর চারপাশে গোটা কয়েক আমগাছ জড়াজড়ি করে আছে। বাড়ীর পশ্চিম পাশে দুটো বড়া বাশের ঝাড়। তা ছাড়া আছে, তেতুল, শিমুল ও গাবগাছ। গ্রামের লোকের বিশ্বাস—এই’গাছগুলোই ভূত-পেত্নীর আড্ডা।
অনেকদিন আগের কথা। সন্ধ্যার পর গদু প্রধান সোনাকান্দার হাট থেকে ফিরছিল। তার হাতে একজোড়া ইলিশ মাছ। সুর্য-দীঘল বাড়ীর পাশের হালট দিয়ে যেতে যেতে সে শুনতে পায়-অই পরধাইন্যা, মাছ দিয়া যা! না দিলে ভালা অইব না।
প্রথমে গদু প্রধান ভ্রূক্ষেপ করেনি। পরে যখন পায়ের কাছে ঢিল পড়তে শুরু করে, তখন তার হাত থেকে মাছ দুটো খসে পড়ে যায়। সে ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়তে পড়তে কোনো রকমে বাড়ী এসেই অজ্ঞান।
রহমত কাজী রাত দুপুরের পর তাহাজ্জদের নামাজ পড়বার জন্যে ওজু করতে বেরিয়ে ফুটফুটে জোছনায় একদিন দেখেছে সূর্য-দীঘল বাড়ীর গাবগাছের টিকিতে চুল ছেড়ে দিয়ে একটি বউ দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে দেখছিল। চোখের পলক ফেলে দেখে আর সেখানে বউ নেই। একটা ঝড়ো বাতাস উত্তর-পশ্চিম কোণাকুণি করম আলী তার বাড়ীর ওপর দিয়ে চলে গেল। পরের দিনই করম আলী হাজীর ‘পুতের বউ’ কলেরায় মারা যায়। দু’দিন পরে তার হালের তিনটা তরতাজা গরু কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে খতম।
আরও অনেকের সাথেই নাকি অনেক বেশে ভূতের দেখা হয়েছে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর ভুতের গল্পের অন্ত নেই। তাই দিন-দুপুরেও পারতপক্ষে এ বাড়ীর পাশ দিয়ে কেউ হাঁটে না।
বাড়ীটার বড় আকর্ষণ একটা তালগাছ। এত উঁচু তালগাছ এ গায়ের লোক আর কোথাও দেখেনি। কত শিশুর পরিচয় হল তালগাছটির সঙ্গে। তারা বুড়ো হল, জীবন-লীলা সাঙ্গ করল। তাদের কত উত্তরপুরুষও গেল পার হয়ে। কিন্তু তালগাছটি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে প্রহরীর মত। কালের সাক্ষী হয়ে শত ঝড়-ঝাপটা উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাথা উঁচু করে।
তালগাছটি এ-এলাকার গর্বের বস্তু। চর-অঞ্চলে বিশেষ করে বক্তবলীর চরে গেলে কথায় কথায় যখন কুল-কৌলীন্যের তক ওঠে, তখন এখানকার লোক এ তালগাছটির নজির দেখায়। কেউ কেউ নিজেদের বনেদীপনা জাহির করে। তারা এরকম করে বলে—আমরা অইলাম গিয়া সাবেক মাড়ির ভর্নলোক, বুঝলানি মিয়া? আমাগো ঘর বহুত পুরানা। ঐ আসমাইন্যা তালগাছটা সাক্ষী। দেহাও দেহি, অত বুড়া আর ডাগর গাছ একটা তোমাগ মুল্লুকে? ও হো, ঠন ঠন। তোমাগ এইদিগের বড় তালগাছ আমাগ গেরামের খাজুর গাছের হমান। আমাগড়া সেই মইযখালির হাটের তনে দেহা যায়। তোমাগড়া অত বড় অইব ক্যামনে? এইত হেদিনের চর এইডা। এইহানে আগে আছিল গাঙ। তোমরা অইলা চরুয়া ভূত—বাইল্যা মাডির তরমুজ, ইত্যাদি।
অপর পক্ষ রাগ করে না। তারা সব সময় এ সাবেক মাটির বাসিন্দাদের কৌলীন্য স্বীকার করে। বহু টাকা খরচ করেও এদের ছেলে-মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করে। এখানকার বহু কালো কুৎসিত মেয়ে চরের সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরে বিকিয়ে যায় এ কারণেই।
জয়গুন ও শফির মা সাত-পাঁচ ভেবে এ বাড়ীতে বাস করার আশা ছেড়েই দিয়েছিল। ছেলেমেয়ের অমঙ্গল আশকা করেই নিরস্ত হয়েছিল বিশেষ করে। কিন্তু একদিন এক নামকরা ফকির—জোবেদ আলী এ সঙ্কট থেকে তাদের উদ্ধার করে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর চারকোণে চারটা তাবিজ পুঁতে এসে সে জানিয়ে দেয়—এই বার চউখ বুইজ্যা গিয়া ওড বাড়ীতে। আর কোন ডর নাই। ধুলাপড়া দিয়া ভূত-পেত্নীর আচ্ছা ভাইঙ্গা দিছি। চাইর কোণায় চাইড্যা আলীশান আলীশান পাহারাদারও রাইখ্যা আইছি। সব আপদ-বিপদ ওরাই ঠেকাইব। বাড়ীর সীমানার মইদ্যে ভূত-পেত্নী; জিন-পরী, ব্যারাম-আজার—কিছু আইতে পারব না।
জয়গুন ও শফির মা খুশী হয় ফকিরের ওপর। শফির মা তার ভিক্ষার ঝুলি খালি করে সোয়া সের চাল দেয় তাকে। জয়গুন দেয় সোয়া পাঁচ আনা পয়সা। কিন্তু ফকিরের মন ওঠে না। শফির মা অনুনয় করে—আমরা গরীব-কাঙ্গাল মানু। এই এর বেশী আর কি দিতে পারি?
—বাড়ীতে যখন ঠিকঠাক অইবা তখন একটা পিতলের কলসী দিও। আর হোন, তোমাগ বাঁশ ঝাড়ে বড়্ড়া বাঁশ দ্যাখলাম। এক জোড়া বাঁশ দিও আমারে অরে দিলে আখেরে কাম দিব।
জয়গুন ও শফির মা আপত্তি করে না।
ফকির আবার বলে—হোন, আর এক কথা। বচ্ছর বচ্ছর কিন্তু পাহারা বদলাইতে অইব। যেই চাইরজন এইবার রাইখ্যা গেলাম, হেইগুলা কমজোর অইয়া যাইব সামনের বচ্ছর। বোঝতেই পার, দিনরাইত ভূত-পত্নীর লগে যুদ্ধ করা কি সোজা কাণ্ড!
সূর্য-দীঘল বাড়ী মানুষের হাত লেগে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। জয়গুন ও শফির মা আজেবাজে গাছ-গাছড়া বিক্রি করে টাকার আমদানী করে। তাতে অন্ধকার বাড়ীটায় আলোর আমদানীও হয় বেশ। নিজেদের ঝড়ের বাঁশ কেটে খুঁটি হয়। খড়ের চালা ও পাটখড়ির বেড়া নিয়ে দু’ভিটেয় দু’খানা ঘর ওঠে। ঘর নয় ঠিক—ঝুপড়ি। রোদ-বৃষ্টি ঠেকানোর আদিম ব্যবস্থা।
বছর বছর পাহারাদার বদলিয়ে তিনটি বছর কেটে গেল সূর্য-দীঘল বাড়ীতে। কোনো বিপদ-আপদ আজ পর্যন্ত আসেনি। ম্যালেরিয়া জ্বর ছাড়া অসুখ-বিসুখও হয়নি ছেলেমেয়েদের। এ জন্যে ফকিরের দোষ দেয়া যায় না। ম্যালেরিয়া জ্বর কোন বাড়ীতে
এবার আবার পাহারাদার বদলাবার সময় হয়েছে। একদিন জয়গুনের ঘরে বসে শফির মা বলে—ফকিরের যে আর দ্যাহা মিলে না আইজকাইল। হেইযে কবে আইয়া গেছে। আর একবার হাত-হপনেও দাহা দিয়া গেল না, আমরা বাঁইচ্যা আছি না মইরা গেছি। কেমনতরো মানু। এদিকে বছর যে ঘুইরা গেল। কলসীডা না দেওনে বেজার অইছে বুঝিন্।
ফকিরকে তাদের প্রতিশ্রুত পেতলের কলসী দেয়া হয়নি এ পর্যন্ত। সাত-স্বপনেও তার দেখা না পাওয়ার কারণ এটা নয়। কারণ অন্য একটা। জয়গুন ছাড়া আর কেউ তা জানে না।
কলসীর তাগাদা দিতে ফকির মাঝে মাঝে আসত। জয়গুন ও শফির মা নিজেদের উপস্থিত অক্ষমতা জানিয়ে কিছুদিন সবুর করবার অনুরোধ জানাত। শফির মা বাড়ী থাকলে কখনো লাউ-কুমড়ো, কখনো শসা-বেগুন—যখনকার যা নিয়ে সে খুশী মনে ফিরে যেত। শফির মা বাড়ী না থাকলে সেদিন জয়গুনের ঘরের দোরগোড়ায় যেন শিকড় গেড়ে বসত সে। উঠবার নামও করত না। কোনোদিন সে বলত—এক খিলি পান দ্যাও বেয়ান।
জয়গুনকে ‘বেয়ান’ আর হাসুকে ‘জামাই’ বলতে শুরু করেছিল সে। প্রথম থেকেই লোকটার কথাবার্তা, ভাবগতিক জয়গুনের কাছে সুবিধের মনে হয়নি। সামান্য একটা পেতলের কলসীর জন্যে এত ঘন ঘন কেন সে আসে? ‘বেয়ান’ বলে এত ঘনিষ্ঠতাই বা করতে চায় কেন? কি মতলব?
জয়গুনের মনে সন্দেহ। কিন্তু কিছু বলার উপায় ছিল না। যে লোকটা এত উপকার করল, তাকে কটু কথা বলতেও বাধে।
জয়গুন একটা আস্ত পানে সুপারী, চুন ও খয়ের দিয়ে এগিয়ে দিত। ফকির বলত, বেয়াইরে খিলি বানাইয়া দিলে বুঝিন জাইত যায়, না? কত দিন খোশামুদ কইর্যাও তোমার আতের এক খিলি পান খাইতে পারলাম না। মইরা গেলেও হায়-আফসোস থাকব।
জয়গুন কোন উত্তর দিত না।
পান খেতে খেতে ফকির নানা রকমের কথা বলতে শুরু করত। কখনো কোনো প্রশ্ন করে উত্তরের জন্য হা করে থাকত। উত্তর না পেয়ে আবার শুরু করত। মাঝে মাঝে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠত লাগামছাড়া হাসি। জয়গুন এ অস্বস্তিকর হাসি-ঠাট্টায় জ্বলে উঠত মনে মনে। পিছ-দুয়ার দিয়ে এক সময়ে সরে পড়ত।
একদিন রাত্রে বৃষ্টি মাথায় করে কোথা হতে ফকির এসে হাজির। জয়গান পান খেতে বসেছিল। ফকিরের আগমনে সে একটু সচকিত হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়ে দুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। শফির মা-ও বাড়ী নেই আজ।
ফকির দরজার ওপর বসে পান চিবোতে চিবোতে এক সময়ে বলে—বেয়ানের আতের পান খাইতে কি মুলাম! এক্কেরে মুখের সাথে মিশা যায়। যেই আতের পান এত মুলাম, হেই আতখানও না জানি কেমুন। শরীলখানও বুঝিন তুলতুল করে তুলার মতন।
ফকির হাসে। জয়গুনের সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। শক্ত একটা কিছু বলতে চায়। কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।
—দেহি না, বেয়ান! বলতে বলতে সে এগোয়—দেহি না তোমার নরম আতহানে কি লেহা আছে।
জয়গুন পিছিয়ে যায়। বেড়ার সাথে গিয়ে ঠেকে।
—দেহি না আতহান। নওল মুরগীর মতন পলাও ক্যান! ছিঃ ছিঃ!
ফকির হাত বাড়াতেই জয়গুন হাতের কাছের চুনের ঘট্টা ছুঁড়ে দেয় ফকিরের মুখের ওপর। চেঁচিয়ে ওঠে—কুত্তার পয়দা! বাইর অ, বাইর অ ঘরতন।
এ ব্যাপারের পর জোবেদ আলী ফকির আর তার চুন-কালির মুখ সূর্য-দীঘল বাড়ীতে দেখায়নি।….
জয়গুন শফির মার কথার উত্তর দেয়—বেজার অইলে অউক গিয়া। দিমু না কলসী, কাম নাই আর পাহারাদারের।
শফির মা জয়গুনের ভাবান্তরের কারণ খুঁজে পায় না। জয়গুন এমন অকৃতজ্ঞ হল কেমন করে? আর পাহারাদার ছাড়া সূর্য-দীঘল বাড়ীতে থাকবার সাহসই বা তার কোত্থেকে হল?
০২. পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন
পাশাপাশি পিঁড়ে বিছিয়ে বসে দুটি ভাইবোন—হাসু ও মায়মুন। জয়গুন পান্তা বেড়ে ছেলে ও মেয়ের সামনে দুটো থালা এগিয়ে দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে বসে। মায়মুন আড়চোখে হাসুর থালার দিকে চায়। রোজ সে এমনি চেয়ে দেখে। রোজই হাসুকে বেশী করে খেতে দেয় মা। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস তার হয় না। জয়গুন বুঝতে পেরে নিজের পাতের একমুঠো ভাত দিয়ে বলে—বিছমিল্লা বুইল্যা মোখে দে। দেখবি এই দুগগায়ই প্যাট ভইরা যাইব।
—বিছমিল্লা।
হাসুও বলে—বিছমিল্লা।
প্যাচপেচে পান্তাভাত পোড়া মরিচ মেখে কালো করে নেয়। খেতে খেতে জয়গুন সারাদিনের কাজের ফরমাস করে যায় মায়মুনকে। ঘর ঝাট দেয়া, থালাবাসন মাজা, পানি আনা ইত্যাদি।
—ভাত আছে আর, মা? হাসু বলে।
ভাতের হাঁড়িটা হাসুর থালার ওপর উপুড় করে ঢেলে জয়গুন বলে—খাইয়া নে, পরাণ ঠাণ্ডা অইব।
শুধু পানিতে থালা ভরে যায়। মায়মুনের পাতে তার আবাটা ঢেলে দিয়ে লবণ দিয়ে। ঘেঁটে চুমুক দেয় হাসু।
খাওয়ার পরে জয়গুন পানের ডিবা নিয়ে বসে। পেট ভরে দুটি ভাত খেতে না পেলেও পানটা একটু মুখে দিলে তবু ভালো লাগে।
হাসু কোষার পানি সেচে ডাকে—মা, শিগগির। গাড়ী কইলাম আইয়া পড়ল বইল্যা।
জয়গুন বাশের চোঙা থেকে পঁচটা টাকা বের করে নেয়। এই টাকা কটিই তার মুলধন। ময়মনসিং থেকে সন্তায় চাল এনে সে গায়ে বিক্রি করে। এই করে টাকা প্রতি এক সের সোয়া সের মুনাফা হয় প্রতি খেপে। আচঁলে সব ক’টি টাকা বেঁধে চটের দুটো ঝুলি হাতে বেরিয়ে পড়ে সে তারপর।
দশ বছরের মেয়ে মায়মুন। কিন্তু সাত বছরের বেশী বলে মনে হয় না। হাঁটতে গেলে পাক খেয়ে পড়ে যাবে মনে হয়। একা একা কাজ করতে ভালো লাগে না ওর। কিন্তু কাজের কোনোটা বাকী রাখলে চুল এক গাছও মাথায় থাকবে না, সে জানে। শীর্ণ শরীরটাকে টেনেটুনে কোনো রকমে মাজা-ঘসা করে, বদনা ভরে ভরে সাত আটবারে পানির কলসীটা ভরে সে।
আজ হাঁস দুটো ছাড়তে গিয়ে খাঁচার নিচে ডিম দেখে মায়মুনের আনন্দ আর ধরে না। তাদের হাঁস ডিম দিয়েছে আজ নতুন। কি সাদা আর বড় বড়! দুহাতে দুটো ডিম নিয়ে সে নাচতে আরম্ভ করে। লাফাতে লাফাতে সে বাইরে আসে। দৌড়ে যায় শফির মা-র ঘরে। ডাকে—মামানি গো, অ-মামানি, দাহ কি সোন্দর আণ্ডা। আমাগ আঁসে পাড়ছে। উল্লাস যেন সে ধরে রাখতে পারে না।
—দেহি দেহি বলে মামী হাত পেতে ডিম দুটো নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তারপর হেসে বলে—ভালো আণ্ডা অইত। পয়লা বারের অইলেও ডাঙর-ডোঙর অইছে! আষ্ট পয়সা কইর্যা বেচতে পারবি এক একটা।
—না গো মামানি, এই আণ্ডা বেচ্তাম না।
—খাবি?
—ওহোঁ। বাচ্চা ফুডাইমু।
—বেইশ, বেইশ! মামী উৎসাহ দিয়ে বলে।
ডিম দুটো তুষের হাঁড়ির মধ্যে রেখে মায়মুন বাড়ীর এদিক ওদিক খুঁজে গাছের শুকনো ডাল ভাঙে। আজ তার কাজ করতে খারাপ লাগে না। আর দিনের চেয়ে অনেক বেশী লাকড়ি যোগাড় করে ফেলল সে।
বিকেলবেলা মায়মুন বড়শী নিয়ে তেঁতুলতলা গিয়ে বসে। যাবার আগে আণ্ডা দুটো আর একবার দেখে যায় দুই চোখে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ও বসে থাকে বড়শী নিয়ে। পিঠালী সব শেষ। হয়ে যায়। কিন্তু মাছ ওঠে মাত্র একটা টেংরা, তিনটে পুঁটি আর কয়েকটা ডানকানা। মাছগুলো যেন ওর চেয়েও চালাক হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঘরে সঁঝবাতি দেখিয়ে আবার নিবিয়ে দেয় মায়মুন। আবছা অন্ধকারে বসে মাছ কয়টা কুটে লবণ দিয়ে রাখে।
রাত ন’টা দশটা পর্যন্ত অন্ধকারে ওকে একা বসে থাকতে হয় প্রায়ই। মায়মুনের বড় ভূতের ভয়। কোনো কোনো দিন সে শফির মার ঘরে গিয়ে কেচ্ছা শোনে। তার পান ছেঁচে দেয়। কিন্তু আজ সে দুপুর বেলা বেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। ভিক্ষে করে খায় সে। মাঝে মাঝে বাড়ীও আসে না। মায়মুন দোরের ঝাপ বন্ধ করে দিয়ে চুপ-চাপ পড়ে থাকে।
রাত গোটা নয়ের সময় হাসু আর হাসুর মা আসে। শব্দ পেয়ে মায়মুন মাথার ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে।
মায়মুন এবার লাফ দিয়ে ওঠে। খুশীতে আটখান হয়ে সে বলে—মা, মা, আমাগ আঁসে আণ্ডা পাড়ছে। বলতে বলতে সে বের করে আনে ডিম দুটো। হাসু খুশী হয়ে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে, কী সুন্দর সাদা আর বড়।
হাসু বলে—কাইল অই আণ্ডা বিরান খাইম মা,পান্তা ভাত দিয়া।
—ই–স! বাচ্চা ফুডাইমু আমি। প্রতিবাদ করে বলে মামুন।
জয়গুন বলে—ওহোঁ। পয়লা দিনের আণ্ডা। আণ্ডা দুইডা জুম্মার ঘরে দিয়া আবি নামাজের দিন।
ভাই-বোন দুজনেরই মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।
জয়গুন তাড়াতাড়ি চুলো ধরায়। রাতের জন্য মুঠ মেপে ছয়মুঠো ও ভোরের জন্য আরো ছয়মুঠো চাল নিয়ে সে হাঁড়ি বসায় চুলোর ওপর। ছেলেকে হুকুম দেয় কয়েকটা কুমড়ো পাতা তুলে আনতে। নিজে সে যায় না। বাচ্চা-কাচ্চার মা, রাত-বিরাতে গাছের ফল-পাতা ছিঁড়তে নেই।
ভাত ফুটিয়ে মায়মুনের ধরা মাছ কয়টা রাঁধতে দেরী হয় না।
তিনটি বাসনে ভাত বাড়ে জয়গুন, আর আন্দাজ করে—হাঁড়িতে কতটা আছে। ফেনটাও ভাগাভাগি করে নেয়। খেতে খেতে হাসু বলে—ফেনডাত খুব ঘন মা, মিডা মিডা লাগে।
—নয়া আউশ যে। এর লাইগ্যাইত আউশ চাউল আনলাম। দরেও হস্তা। ফেনডাও অয় ভালা। কিন্তু ভাতে বাড়ে না এক্কেরেই। অ্যাঁরে হাসু, নারাণগঞ্জে চাউল কি দর দেখলিরে আইজ?
—ট্যাহায় দেড় সের, মা।
—কি পোড়ার দ্যাশ দ্যাখ দেহি! উত্তুরে এডুক হস্তা না অইলে হুকাইয়া তেজপাতা অইয়া যাইতাম না? আইজ আড়াই সের ভাও আনলাম। আমন চাউল দুইসের কইরা।
–আমি একদিন তোমার লগে উত্তুরে যাইমু মা।
—ওহোঁ কাম কামাই দিয়া তোমার উত্তুরে যাওনের দরকার নাই বাজান।
খাওয়া শেষ হলে জয়গুন হাঁড়ির ভাতগুলোতে পানি ঢেলে রাখে। ছেলেমেয়ের জন্যে তেলচিটে একটা লম্বা বালিশ নামিয়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন শুয়ে পড়ে। জয়গুন পানের ডিবাটা নিয়ে বসে এবার। আজ আর পানের ডিবা নেয়ার কথা মনে ছিল না তার। গাড়ীর মধ্যে ছমুর মা-র কাছ থেকে চেয়ে একবার মুখে দিয়েছে একটু। আর সারা দিনের মধ্যে সে পান খায়নি। তবু হাসু অনুযোগ দেয়—পান খাওয়া ছাইড়্যা দ্যাও, মা। পান আর আনতাম না আমি। চাইর পয়সা কি কম?
পান খাওয়া সে অনেক কমিয়েছে। চার পয়সার পানে দু’দিন যায় আজকাল। পান চিবোতে চিবোতে সে সারাদিনের দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতে চেষ্টা করে।
রাত অনেক হয়েছে। কুপিটা নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ে।
০৩. আজকের ডিম দুটো মায়মুনের
আজকের ডিম দুটো মায়মুনের। সে বাচ্চা ফুটাবে। মা রাজী হয়েছে। সারা রাত তার ভাল ঘুম হয়নি। তার ছোট মনে কত কল্পনা জেগেছে। হাঁসের বাচ্চা হবে, সেগুলো বড় হবে, ডিম দেবে—ফকফকে সাদা ডিম। সেই ডিমের থেকে আবার বাচ্চা হবে। নানা রঙের হাসে তাদের খাঁচা ভরে যাবে। স্বপ্নেও সে দেখে রঙ-বেরঙুের হাসের সারি চলেছে ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে। ডিম কুড়িয়ে কুড়িয়ে সে একটা হাঁড়ি ভরে ফেলেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে হাঁস দুটো ছাড়তে যায়। ঠিক ঠিক দুটো ডিমই পেড়েছে আজো। ডিম দুটো তুলে সে তুষের হাঁড়ির মাঝে রেখে দেয় আলাদা করে। সেখানে আগের দু’দিনের আরো চারটে রাখা হয়েছে। এক দুই করে গুণে দেখে মায়মুন একবার। তারপর হাঁস দুটো ছেড়ে দিয়ে সে চেয়ে থাকে। দু’তিনবার ডানা ঝাপটা মেরে হাঁস দুটো ভেসে যায় ধানক্ষেতের দিকে। মায়মুনের চোখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে। হাত-মুখ ধুয়ে মায়মুন ঘরে আসে। ডিম দুটো সে বুকের সাথে চেপে ধরে খুশীতে। জয়গুন বলে—অই রহম কইরা ধইরা রাখলে অই বাচ্চা অইব? বেবাকগুলা আণ্ডা লইয়া আয় আমার কাছে। বাছাই কইরা দেই। যেই আণ্ডাডা লম্ফা, হেইডায় অইব আঁসা, আর যেইডা গোল হেইডায় অইব অসী, গোল দেখে দুটো ডিম বেছে মায়মুনের হাতে দিয়ে সে আবার বলে—অই পাড়ায়। গিয়া দ্যাখ, কেউর মুরগীর উমে দিতে পারস যদি। হাসুও যা ওর লগে। তোর আর এই বেলা কামে যাওন লাগত না।
এ কথায় রীতিমত খুশী হয়ে ওঠে হাসু।
জয়গুন আরো বলে—দুফরে যাবি জুম্মার ঘরে। আণ্ডা চাইড্যা দিয়া আবি।
—চাইডা অই! হাসু আশ্চার্য হয়ে যায়—তুমি না হেদিন কইলা, পয়লা দিনের কেবল?
—দুইড্যা আণ্ডা জুম্মার ঘরে কেমন কইর্যা দেই, পাগল? এক আলির কমে—
–আমরা খাইমু না বুকিন একটাও?
—তুই আছস তোর প্যাট লইয়া।
খেয়ে দেয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে।
বর্ষার সময় বাড়ীর চারদিকে থাকে পানি। বিলের মাঝে একটা দ্বীপের মতো যেন। এ সময়ে নৌকা ছাড়া চলবার উপায় থাকে না। তারা সকলে তাদের কোষায় চড়ে ওপাড়ায় যায়। জয়গুন নামে মোড়ল বাড়ীর ঘাটে। সেখানে সে মাঝে মাঝে মোড়লদের ধান ভানে, চিড়া কোটে, ঘর লেপে দেয়।
হাসু ও মায়মুন পাড়াময় ঘুরে শেষে দিয়ে এল ডিম দুটো।
সাতদিন পরে বসবে সোনা চাচীর মুরগী। তার ফুটবে চৌদ্দটা ডিম। তবু সে বলেছিল—দুটো বাচ্চা হলে তাকে একটা দিতে হবে। অনেক কাকুতি-মিনতি করায় শেষ পর্যন্ত সে রাজী হয়েছে।
গ্রামের মসজিদ। জুম্মার নামাজ হচ্ছে। হাসু বাইরে দাঁড়িয়ে দেখে। সব লোক এক সঙ্গে উঠছে, বসছে, সেজদা দিচ্ছে। হাসুর কেমন ভয় হয়। তারও নামাজের বয়স হয়েছে। সে ভাবে- বারো বছরের হলেই তো নামাজ পড়তে হয়।
নামাজ শেষ হলে হাসু গামছায় বাধা ডিম কয়টা নিয়ে এগোয়। একজন নামাজী শিরনি বিলিয়ে দিচ্ছিল সকলের মধ্যে। গামছা খুলে হাসু তার হাতে দিয়ে দেয় ডিম কয়টা।
ইমাম সায়েবের চোখে এড়ায় না। তিনি ডেকে বলেন—নিয়া আস আণ্ডা কয়ডা এদিকে।
কাছে যেতে আবার বলেন-যাও, দিয়া আস গিয়া আমার এখানে। কে দিল হে?
—ঐযে ঐ ছ্যাঁড়া। আঙুল দিয়ে দেখায় সে।
একজন বলে—সূর্য-দীগল বাড়ীর।
আর একজন বলে চিনেন না হুজুর? জব্বর মুন্সীর পোলা।
ইমাম সায়েব চমকে ওঠেন—ও-ওই! তওবা! তওবা! হারাম! হারাম!
তিনি ডিম কয়টার দিকে জনীর নির্দেশ দিয়ে বলেন—নিয়া যাও জলদি আমার কাছ থ্যাইকা। মসজিদের মধ্যে কে আনল এই আণ্ডা?ফিরাইয়া দ্যাও অহুনি। বেপর্দা আওরতের চীজ। ছি! ছি! ছি!—তার চোখে মুখে ঘৃণার তীব্রতা ফুটে ওঠে।
একজন ইজিগাত করে—একলা একলা সে ময়মনসিংহ যায় টেরেনে কইর্যা। কী হিম্মত!
ইমাম সাহেব বলেন—দেখলা মিয়ারা, ইমানদারকে খোদাওদ করিম হারাম থ্যাইকা কি ভাবে হেফাজত করেন।
আর একজন বলে—জব্বর মুন্সী কত পরহেজগার আছিল। খোদার এমন পিয়ারা আছিল। আর তার পরিবার
হাসু রেগে ওঠে মনে মনে। একবার ইচ্ছে হয়—দেয় ছুঁড়ে ডিম কয়টা ইমামের মুখের ওপর। কিন্তু সাহস হয় না। ডিম ক’টা নিয়ে সে বেরিয়ে আসে।
কোষাটাকে সে জোরে বেয়ে নিয়ে যায়। আজ অনেকগুলো ট্রেন ও স্টীমার ফাঁক গেল। দুটোর জাহাজ ধরা চাইই চাই। দুটো মোট পেলেও ছানার কাজ হবে।
দুটোর জাহাজ, আর বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে সে আসে বাজারে। ডিম চারটে সে বিক্রি করেই ফেলবে। কেন দেবে সে মসজিদে? মা জিজ্ঞেস করলে বলে দেবে, জুম্মার। ঘরে দেয়া হয়েছে।
ডিম ক’টা সাত আনায় বেচে সে পাঁচ আনায় চারগাছা কাচের চুড়ি কেনে মায়মুনের জন্যে, আর নিজের কোমরে পয়সা বেধে রাখবার জালি কেনে একটা। বাকি দু’আনার এক আনায় কোনে একটা চরকি ও এক আনায় চারটে তিলের কদমা।
সন্ধ্যার দিকে সে কোষ ভিড়ায় একটা বাড়ীর ঘাটে। চারদিকে চেয়ে সে চুপিচুপি ডাকে–কাসু, অ-কাসু!
বছর সাতেকের একটি ছোট্ট ছেলে লাফিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। হাসু ওকে কোলে তুলে নেয়। তারপর ওর মুখে একটা কদমা দিয়ে বলে—দ্যাখ, কেমুন মিষ্ট। এই চরকিডাও তোর লাইগ্যা আনছি। দ্যাখ, কেমুন সোন্দর ঘোরে।
কাসু খুশী হয় খুব। হাসু বলে—যাবি তুই আমার লগে? মা তোর লাইগ্যা কত কান্দে দিন-রাইত!
–ক্যার মা?
—তোর মা। আমার মা।
—হুঁ, মিছা কথা।
—না বলদ, সত্যই।
মা-র কথা শুনে কাসু যেন কেমন হয়ে যায়। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তার চোখ টলটল করে। কাসু কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে জানে, তার মা মরে গেছে। বাপ তো। সেই কথাই বলে সব সময়।
—যাইমু তোমার মা-র কাছে—কাসু বলে।
—আমার মা যে তোর মা অয়, বলদ।
—কে? কেডারে অইহানে? কাসর বাপ করিম বক্শ চিৎকার করে ওঠে। তেড়ে আসে লাঠি হাতে-খাড়া হারামির পয়দা, কানকথা দিতে আইছস আমার পোলারে!
কাসুকে কোল থেকে নামিয়ে বাকী কদমা তিনটে ওর হাতে দিয়ে প্রাণভয়ে দৌড় দেয় হাস। কোটা ঠেলে দিয়ে চড়ে বসে। প্রাণপণে বেয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কাসুর বাপ করিম বক্শ পানির কিনারা পর্যন্ত এসে বাধা পায়। চেঁচিয়ে বলে—আবার এই মাহি পাও বাড়াইলে আড্ডি গুড়া কইর্যা ফ্যালাইমু। মানুষ চিন না বজ্জাতের বাচ্চা!
তারপর এদিক ওদিক চেয়ে কয়েকটা মাটির ডেলা নিয়ে ছুঁড়তে থাকে ওর দিকে। একটা ডেল। এসে হাসুর পিঠের ওপর পড়তেই সে লাফ দিয়ে পানিতে পড়ে যায়। কোষার আবডালে থেকে আত্মরক্ষা করতে থাকে। করিমবক চলে যেতেই কোমায় চড়ে জোরে লগির খোচ দেয়।
কাসুদের বাড়ী থেকে শব্দ শোনা যায়, সাথে সাথে গর্জনও হারামজাদা, কদমা দিয়া ভুলাইতে আইছস। আবার আইলে বাপের মরণ দেহাইয়া ছাইড়্যা দিমু।
আবার শোনা যায়—চরকি! দ্যাখ অহন চরকিবাজি কেমুন লাগে।
হাসুর চোখে পানি আসে। পিঠের ব্যথার কথা ভুলে যায় সে। কাসু যে তারই ভাই, এক মা-র পেটের ভাই। হোক না বাপ ভিন্ন। কিন্তু মা-তো একজনই। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে আর ঐ মুখো হবে না। তার জন্যেই কাসু আজ মার খাচ্ছে।
মোট বয়ে আজ ছ’আন পেয়েছে হাসু। বাড়ী এসেই মা-কে দেয় তিনটে দু’আনি।
মা বলে—এই পাইলি আইজ?
—গেলাম তো দুফরের পর, আরঅ? বলেই হাসু বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। মায়মুনকে ডাকে—দেইকা যা মায়মুন, কি আনছি।
নতুন কিছু দেখবার জন্যে মামুনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসু চুড়ি চারগাছা ওর হাতে পরিয়ে দেয়। মায়মুনের মুখ আনন্দে ভরে যায়।
জয়গুন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়ে বলে—চুড়ি কিনলি, পয়সা পাইলি কই?
—আইজ পথে যাওনের কালে একটা পোকা পাইয়া গেলাম। আমতা আমতা করে হাসু।
—চুড়ি তোমারে কে কিনতে কইছে? রাগতস্বরে বলে জয়গুন। হাসু কোন উত্তর দেয় না। তার এই চুপ করে থাকাটা জয়গুনকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। দাঁত কিড়মিড় করে বলে—খাইতে নাই হইতে রাঙ্গা পাডি। আইজ রাইতে ভাত নাই তোর কপালে।
মায়মুন মুখ কালো করে দূরে সরে যায়। হাসু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েই থাকে।
জয়গুন আবার বলে—আণ্ডা কই?
—জুম্মার ঘরে দিয়া দিছি। বলেই হাসু শিউরে ওঠে।
–জুম্মার ঘরে! তুমি বুঝছ, আমি কিছুই জানমু না? মোড়ল বাড়ীর তন বেবাক হুইন্যা আইছি। হুজুর ফিরাইয়া দিছেন আণ্ডা।
হাসুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। চাপে পড়ে সত্য কথাটাই বলে সে-–বেইচ্যা ফ্যালাইছি।
–পয়সা দে।
–চুড়ি কিনছি, পয়সা রাহনের জালি আর—
জয়গুন এবার বেরিয়ে আসে বাঘিনীর মত।
—আর কাসুর লাইগ্যা চরকি আর কদ্মা।
বাঘিনীর তেজ মিলিয়ে যায় শুধু একটা নামে। কি মধুর নাম! কাসু! রাগের মাঝে বাৎসল্যের হঠাৎ আবির্ভাব সে সহ্য করতে পারে না। সরে যায় সেখান থেকে।
খাওয়ার সময় আবার তাদের কথা হয়। মা বলে-কাসু কতহানি ডাঙর অইছে রে?
—মায়মুনের মত অত বড় অইছে।
একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। হাসু ও মায়মুন চকিত হয়ে মার দিকে চায়। হাসু এবার অন্য কথা পাড়ে-তুমি আর বাইরে যাইও না, মা। মাইনষে কত কতা কয়, বেপর্দা–
ছেলের পাকামি দেখে জয়গুন ধমক দেয়—বাইরে যাইমু না! ঘরে আইন্যা কে মোখের উপর তুইল্যা দিব?
—আমি যা পাই। না পাইলে না খাইয়া মইরা যাইমু। হেই অ ভালা, ত মাইনষের কত আর সয় না।
হাসু সারাদিনে দশ বারো আনা পায় মোট বয়ে। এ দিয়ে তিনটি প্রাণীর এক বেলাও চলে না। জয়গুন বাধ্য হয়েই ঘরের বার হয়েছে আজ অনেক দিন। সে বাড়ী বাড়ী ঘর লেপে, ধান ভানে, চিড়া কোটে। সস্তায় চাল কিনতে যায় উত্তরে। গাড়ীতে করে যায়, ভাড়া লাগে না। গায়ের লোকের কথায় তার গা জ্বালা করে। তাদের নিষেধ মেনে চললে না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে, সে জানে।
জয়গুন এবার বলে—খাইট্যা খাইমু। কেওরড়া চুরি কইর্যাও খাই না, খ’রাত কইরাও খাই না। কউক না, যার মনে যা’—
কঠিন তার কণ্ঠস্বর।
কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়—সে খোদার কাছে পাপ করছে। বাড়ীর বার হয়ে খোলা রাস্তায় সে পুরুষদের মাঝ দিয়ে হেঁটে বেড়ায়। গাড়ীতে কত বেগানা মানুষের মাঝে বসে সে চলে। বেপর্দা মেয়েলোকের কি আজাব হয়, সে জানে। তার প্রথম স্বামী-হাসুর বাপ মুনশী ছিল। পুঁথি পড়ে শোনাত দোজখের শাস্তির বিবরণ। পুঁথির কয়েকটা লাইন তার আজো মনে পড়ে–
মুখের ছুরত যার পুরুষে দেখিবে,
বিছা, বিচ্ছু, জোঁকে তারে বেড়িয়া ধরিবে।
যে চুল দেখিবে তার পুরুষ অচিন,
সাপ হইয়া দংশিবে হাশরের দিন।
যে নারী দেখিবে পর-পুরুষের মুখ,
শকুনি গিরধিনী খাবে ঠোকরাইয়া চোখ।
জয়গুন শিউরে ওঠে। সাপ, বিছা, জোঁক …! তার প্রথম স্বামীর মুখখানাও মনে পড়ে যায়। কী সুন্দর চাপদাড়ি-শোভিত মুখখানা জব্বর মুনশীর। বেহেস্ত-দোজখের কত কথাই সে বলত! বেহেস্তে কত সুখ! আর দোজখ! দোজখের নামে আর একবার আঁতকে ওঠে সে। তার বিশ্বাস, হাশরের দিন জব্বর মুনশী কিছুতেই তাকে তার বেপর্দার জন্য নিজের স্ত্রী বলে স্বীকার করবে না।
তারপর তার মনে পড়ে করিম বশের কথা। জব্বর মুনশীর মৃত্যুর পর জয়গুন তার মান-ইজ্জতের ভার দিয়েছিল তার ওপর। কিন্তু সে তা রাখতে পারেনি। দুর্ভিক্ষের বছর বিনা দোষে সে জয়গুনকে তালাক দেয়।
পুত্র সে হাতের লাঠি বংশের চেরাগ।
কন্যা সে মাথার বোঝা কুলে দেয় দাগ।
সমাজের এই নীতি-নির্দেশে তিন বছরের ছেলে কাসু রয়ে গেল করিম বকশের কাছে। আর মায়মুন ও কোলের মেয়েটির পরিত্যক্তা মায়ের কোল ছাড়া আর কোথাও আশ্রয় রইলো না।
কোলের মেয়েটি দুর্ভিক্ষের বছর মারা যায়।
হাসু ও মায়মুনকে নিয়ে ভেসেই চলছিল জয়গুন। কিন্তু নিজের চেষ্টায় অকুল পাথারে কূল সে পায়। লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাজে। তাকে বাঁচতে হবে, ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে হবে—এই সঙ্কল্প নিয়ে আকালের সাথে পাঁচ বছর সে লড়াই করে আসছে।
আরো অনেক কিছু ভাবছিল জয়গুন। ছেলের ডাকে তার ধ্যান ভেঙে যায়।
—তুমি খাও না, মা?
ছেলেমেয়ের মুখের দিকে চেয়ে মমতায় তার বুক ভরে ওঠে।
দুটি কচি মুখ। এদের বাঁচাতেই হবে। ধর্মের অনুশাসন সে ভুলে যায় এক মুহূর্তে। জীবনধারণের কাছে ধর্মের বারণ তুচ্ছ হয়ে যায়, মিথ্যে হয়ে যায় তার কাছে।
০৪. রেল-রাস্তার ধারে
রেল-রাস্তার ধারে মা-কে নামিয়ে দিয়ে হাসু কোষা ডুবিয়ে রাখে। কেউ নিয়ে যেতে পারে। এই ভয়ে সে তার ওপর কচুরি ঢাকা দিয়ে রাখে। এ ব্যাপারে খুবই হুঁশিয়ার সে। কারণ, বর্ষার দিনে কোষাটা তাদের চলাফেরার একমাত্র সম্বল।
হাসু গাড়ীর দেরী বুঝে রেল-রাস্তা ধরে দক্ষিণমুখি পথ নেয় নারায়ণগঞ্জের দিকে। রেল ও স্টীমারের বড় স্টেশন সেখানে। আজ তিন মাইল রাস্তা হেঁটেই যেতে হবে। আর সব দিন গাড়ীর পা-দানের ওপর দাঁড়িয়ে হাতল ধরে দিব্যি এতটা রাস্তা সে পার হয়ে যায়।
জয়গুন ফতুল্লা স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। ট্রেন আসার অনেক দেরী। সে এদিক ওদিক খুঁজে দুজন সাথী যোগাড় করে নেয়।
নয়টার ট্রেন আসে দশটারও পরে। এখানে এক মিনিটের বেশী দাঁড়ায় না গাড়ী। ভিড়ের মাঝে সঙ্গিনীদের সাহায্যে জয়গুন কোনো রকমে উঠে পড়ে। মেঝেতে একটু জায়গা নিয়ে থলে বিছিয়ে বসে। জয়গুনের সাথী দুটি—গেদির মা, লালুর মা-ও বসে নিচে। গেদির মা-র সাথে পাঁচ বছরের গেদি। লালুর মা বিরক্ত হয়, বলে—মাইয়াহান বাড়ীতে রাইক্যা আইতে পার না, গেদির মা?
—বাড়ীতে কার কাছে রাহি বইন?
—ভিড়ের মইদ্যে নিজেরই চলন দায়, তুমি আবার–
—তুমি কি ফ্যালাইয়া দিতে কও মাইয়াডারে! গেদির মা রুষ্ট হয়ে বলে।
—না, না, হেইডা কইমু ক্যাঁ? কইছিলাম তোর কষ্ট দেইক্যা।
—কষ্ট অইলে আর কি করমু বইন? অদিষ্টে কষ্ট থাকলে খণ্ডাইব কে?
—এক কাম কর না? মাইয়াডার বিয়া দিয়া দে!
—মোডে পাঁচ বচ্ছর বয়স। এত শিগগিরেই!
—এই আর কি এমুন? মাইয়াডাও খাইতে লইতে পারব, তুইও নিভাবনায় থাকবি।
জয়গুন রাস্তাঘাটে সংকুচিত হয়ে থাকে। সে কথা বড় কয় না। এখনও লজ্জাকে সে জয় করে উঠতে পারে নি। তার কান অন্য দিকে। ওপাশে আলোচনা হচ্ছে—দেশ স্বাধীন হবে, চাল সস্তা হবে, এই সব।
চার-পাঁচজন যাত্রীর মধ্যে তখন আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। জনকয়েক একটা বাংলা খবরের কাগজের দিকে ঝুঁকে আছে। বাকী সবাই শুনছে ওপাশের আলোচনা।
একজন বলে—এই বচ্ছর আহালের নমুনা দেহা যায়। চাউলের দর একই চোডে আটতিরিশ অইছে।
আর একজন সায় দিয়ে বলে—আহাল অইব না আবার! মানুষ কি আর মানুষ আছে? পাপের ডুইবা গেছে দ্যাশ। দেইক্যে মিয়ার আধা মানুষ মইরা যাইব এই বার। পাপ, পাপে বাপেরেও ছাড়ে না।
অন্য একজন বলে—পঞ্চাশ সনের চাইয়া বড় আহাল অইব এই বার।
একজন প্রতিবাদ করেনা মিয়া, দ্যাশ স্বাদীন অইব। আর দুখু থাকব না কারুর, হুনছি আমি। স্বাদীন আইলে চাউলও হস্তা অইব। আগের মত ট্যাকায় দশ সের।
—ও মশাই আপনের খবরিয়া কাগজে কি লেখছে? জোরে জোরে পড়েন না, হুনি।
যে লোকটি খবরের কাগজ পড়ছিল, সে জোরে পড়তে আরম্ভ করে, ১৫ই আগস্টের মধ্যে ভারতবাসীর হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হইবে–
—ও মশাই, ওড়া কার ছবি? একজন জিজ্ঞেস করে।
—জিন্নাহ সাবের। খবরের কাগজের পাঠক বলে।
আবার তর্ক। একজন বলে, জিন্না সাবই রাজা অইব। খুব বড় মাথা লোকটার।
অন্য দিক থেকে আর একজন বলে—গান্ধী অইব এই দেশের রাজা।
এ নিয়ে কিছুক্ষণ তর্ক চলে। মাঝ থেকে একজন বলে—সুভাষ বসু থাকলে সে-অই রাজা অইতেন।
—আইচ্ছা মামু, স্বাদীন অইলে খাজনা দিতে অইবনি?
-না, না, খাজনা দিলে আবার স্বাদীন অইল কি?
অপর একজন বলেনা মিয়া, রাজার খাজনা মাপ নাই, দিতেই অইব।
জয়গুন মন দিয়ে শোনে সব কথা। একটি কথাই তার ভালো লাগে, আশা জাগে মনে-চাল সস্তা হবে, কারো কোন কষ্ট থাকবে না।
—হাসুর মা!
জয়গুন তাকায়। লালুর মা বলে—মোখ বুইজ্যা বইয়া আছ যে, এই দিকে কত কি অইয়া গেল।
–কি? উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে জয়গুন।
—আমার লালুর বিয়া ঠিক কইর্যা ফেললাম। এই দ্যাহো বউ।
লালুর মা গেদিকে আরো কাছে টেনে নেয়।
জয়গুন একটু হাসে শুধু। লালুর মা বলে—বউ কেমন অইব দ্যাখ দেহি।
—ভালা। জয়গুনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
লালুর মা খুশী হয়। সে গদির মা-কে বলে—-গয়নার লাইগ্যা অমন কইর্য না গো। আমি কইছি—কানে কানফুল, নাকে নাকফুল আর বালি, আতে বয়লা, পায়ে ব্যাকখাড়ু দিমু। তয় রূপার দিতে পারতাম না, বইন।
-ওহো, হেইডা অইব না। তুমি বেবাক কেমিকল আর বেলী দিয়া চালাইতে চাও। না বইন, রূপার একপদ জিনিস দিতেই অইব। আর গলার অড়কল আর কোমরের নাবীসঙগ। আমার গাদা মাইয়া। নাবীসঙ্গ না অইলে কেমুন দাহা যাইব।
ঢাকা স্টেশন। লোক নামে, লোক ওঠে। ভিখারীও ওঠে নানা রকমের কানা, খোড়া, বোবা। একজন অন্ধ করুণ সুরে বলে যায়–
যে জন করিবে দান অন্ধ মিসকিনে
বকশিশ পাইবে সেই হাশরের দিনে।।
এক পয়সা যেই দিবে খুশী খোশালিতে।
সত্তুর পয়সা পাইবে আল্লার রহমতে।।
বরকত হইবে তার রুজি-রোজগারে।
বাল-বাচ্চা জিন্দা রবে সুখের সংসারে।।
আ—ল্লা–হ!
অন্ধ হাত পাতে—দ্যান বাবা একটা পয়সা।
একজন যাত্রী বলে—এক পয়সা কি আর আছে বাপু?
মসজিদের চাদার জন্য আসে লোক। রীতিমত বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করে–জয়নগর মসজিদের জন্য দান করুন। এর ফল পাবেন কেয়ামতের দিন, পুলসেরাতের দিন। এই টাকায় বেহেস্তে ফুল-বাগিচা হবে, দালান-বালাখানা হবে।
দুএক পয়সা কেউ দেয়, অনেকেই দেয় না। কেউ বলে—এদের এই একটা পেশা।
গাড়ী চলতে আরম্ভ করলে লালুর মা আবার মুখর হয়ে ওঠে—নাবীসঙ্গ দিতে পারতাম না। বিয়াইন, গলার অড়কলও না। তয় খাড়ু না দিয়া পায়ের বুনঝুনি দিমু বউরে, ছোড বউ আমার আঁটব ঝুনঝুন কইর্যা!
জয়গুন ভাবছিল অনেক কিছু। সে নিজের ছেলের বিয়ে দেবে—বউ আসবে ঘরে। মেয়ের বিয়ে দেবে—পরের বাড়ী যাবে সে। লালুর মার শেষ কথায় সে একটু হাসে।
—হে অইলে শাওন মাসের পয়লা দিয়া-অই বিয়া অইব। কি কও বিয়াইন?
গেদির মা একটু চিন্তা করে বলে—ওহো, শাওন মাস আমার মাইয়ার জর্মমাস।
—হে অইলে পরের মাসে?
—পরের মাসে? না না। ভাদ্র মাসে বিলাই পার করে না ঘরতন। আর আমি বুঝিন। মাইয়া পার করুম? কী যে তোমার আক্কল!
—সত্য অইত। আমার মনেই আছিল না ভাদ্র মাস। হে অইলে পরের মাসেই অইব, কেমুন গো?
গেদির মা রাজী হয়।
একটা ছেলে সুর করে বলে যাচ্ছে–
খেয়ে যান মজার নাশতা,
নিয়ে যান সস্তা সস্তা,
এক আনায় দুই বস্তা।
ছেলেটার ছড়া বলার ভঙ্গী আর বস্তার বিরাটত্ব দেখে যাত্রীরা সব হো-হো করে হেসে ওঠে। কেউ কেউ দু’একটা প্যাকেট কিনে চানাচুরের মজাটাও পরখ করে। লালুর মা দুই পয়সা দিয়ে একটা প্যাকেট কিনে ভাবী বউকে দেয়। গেদি খুশী হয়।
একটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। গাড়ী একটা স্টেশনে থামতেই জয়গুন, লালুর মা ও গেদির মা নেমে পড়ে। ময়লা কাপড়ে ভিখারী ভেবে টিকেট কালেক্টর দেখেও দেখে না। এখান থেকে বাজার কিছু দূরে, প্রায় এক মাইল। লালুর মা তার বউকে কোলে করে নিয়ে বেয়ানকে সাহায্য করে।
বাজারে এসে তিনজনে তিন রকমের চাল কেনে তারা। কিন্তু একই দরের—টাকায়। আড়াই সের করে।
তারপর বাজার থেকে বেরিয়ে তারা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম করে। ফিরে যাওয়ার গাভী আবার বিকেল চারটায়।
গাড়ীর সময় আন্দাজ করে তারা ওঠে। রওয়ানা দেয়ার আগে তিনটা বুলির চাল মিশিয়ে ছয়টা ঝুলির মধ্যে ভরে। ঝুলিতে এক রকমের অনেক চাল দেখলে রেল-বাবুরা সন্দেহ করে, টিকেট চায়। এ রকম করে মিশিয়ে ভিক্ষার চাল বলে চালিয়ে দেয় তারা। টিকেটও লাগে না।
গেদিকে স্টেশনের বাইরে তিনটা বালির পাহারায় রেখে তারা তিনজন তিনটা ঝুলি হাতে স্টেশনে আসে। কিন্তু সদর দরজা দিয়ে নয়, রেলের লাইন ধরে ধরে। টিকেট কালেক্টরকে এড়িয়েই যেতে চায় সব সময়। কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও বাকী তিনটে ঝুলি নিয়ে আসার সময় প্ল্যাটফরমে রেল পুলিশ তাদের আটকায়। বলে—দেখি, দেখি।
সকলের মুখ শুকিয়ে যায়। লালুর মা বলে—ভিক্কার চাউল।
সেপাই চাল দেখে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে ভিক্ক্যার চাওয়াল, এতনা! হামি কুছু বোঝে না! চল্ থানামে। জানতি নেহি এক জিল্লাকা চাওয়াল দুসরা জিন্নামে যানে হুকম নেহি আছে?
লালুর মা সাহসী। বলে—ছাইড়া দাও, সিপাইজী।
সেপাই বলে—তব্ আয় হামার ছঙ্গে।
প্ল্যাটফরম থেকে দূরে গিয়ে সেপাই প্যান্টের বিরাট পকেট খুলে ধরে। বলে—দে হামার পাকিট ভরদে। রেশন মে চাওয়াল মিলতে আছে না, খালি খুদ।
লালুর মা তিনটা ঝুলির থেকে মুঠ ভরে আধ সের খানেক চাল সেপাইর দুই পকেটে ঢেলে দেয়। সেপাই এবার ছেড়ে দেয়।
জয়গুন পরিশ্রান্ত, ট্রেনের দুলানিতে ঝিমুনি আসে। কাঠের সাথে মাথা ঠেকিয়ে সে ঘুমিয়েই পড়ে। গাড়ী গেন্ডারিয়া স্টেশন ছাড়লে গেদির মার ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙে।
তাড়াতাড়ি তারা ঝুলিগুলোর মুখ দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধে। ট্রেনের হুইসল বাজে। ফতুল্লা স্টেশন এসে যাবে এক্ষুণি। তারা ঝুলি হাতে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়! হাসু কোষাটা পানি থেকে তুলে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ধারিত স্থানে কুল গাছটার কাছে গাড়ী আসতেই তারা সবক’টি ঝুলি জানালা দিয়ে দুপদাপ বাইরে ফেলে দেয়।
ফতুল্লা স্টেশনে নেমে তারা কুলগাছতলায় আসে। হাসু ঝুলিগুলো কুড়িয়ে জড়ো করেছে। এক জায়াগায়। মা-কে দেখে বলে—আইজ গাড়ী বড় দেরী করল, মা? বেইল ঘরে যায় যায়, এমুন সময় আমি আইছি।
-কই আর এমুন দেরী?
জয়গুন ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে সময়ের টের পায়নি। আটটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ।
–কি দর আনলা মা চাউল?
—আড়াই সের ভাও। কিন্তুক দর যেন চড়া চড়া ঠেলরে। তুই কত পালি, বাজান?
—বার আনা। আমি কিন্তু দুই পয়সার চিনাবাদাম খাইছি, মা। এই কয়ড়া আলছি মায়মুনের লাইগা।
জগনের মন প্রসন্ন হয় ছেলের ওপর। সে বলে—জলদি কইর্যা চল, যাই।
০৫. বয়সের সাথে সাথে মানুষের মেজাজ
বয়সের সাথে সাথে মানুষের মেজাজ পরিবর্তন হয়। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে করিম বকশের মেজাজ ঠাণ্ডা না হলেও কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে বৈকি। তা না হলে তার শড়কির হাতল ঘুণে ধরতে পায়? চার বছর বোধ হয় লাঠিটায়ও তেল মাজা হয়নি। তেলের দামও বেড়েছে, আর লাঠির দরকারটাও কমেছে অনেক। মাটির ওপর পুরানো লাঠিটা ঠুকতে ঠুকতে তার নিজের ও লাঠির বিগত শৌর্যের কথা মনে পড়ে। পেতলে মুঠি-বাধা এই লাঠিটা যৌবন-কাল থেকেই তার পথচলার সাথী। কারণ, মেজাজের জন্যে শত্রু কম ছিল না তার। তাই বুড়োর মত লাঠি হাতে সে চলত। এমন কি ঘুমোবার সময় পাশেই থাকত লাঠিটা। লাঠিটা হাতে নিলেই তার একদিনের কথা মনে পড়ে।
দুপুর রাত্রে যাত্রাগান শুনে এসেছিল সে। মেহেরনের দরজা খুলে দিতে দেরী হয়েছিল। তাকে হাতের এই লাঠিটা দিয়েই সে মেরেছিল। গর্ভবতী মেহেরন সে আঘাত সহ্য করতে পারেনি। তারপর গলায় রশি বেঁধে গাবগাছে লটকিয়ে সে রেহাই পেয়েছিল। হাজারখানেক টাকা অবশ্য খরচ করতে হয়েছিল এ-ব্যাপারে।
তার আরো মনে হয় আজকাল, লাঠিটা হয়তো হাশরের দিন তার বিরুদ্ধেই সাক্ষী দেবে খোদার কাছে।
মেহেরন করিম বকশের প্রথম স্ত্রী।
তারপর সে জয়গুনকে বিয়ে করে। তার ওপরও তার বাহুবলের কসরত চলে ছয় বছর। তার শরীরের কোনো অঙ্গ বোধ হয় তার প্রহারের কাছে রেহাই পায়নি।
জয়গুনের শাশুড়ী সান্ত্বনা দিত—ওয়াতে কি অইছে বউ! মরদগুনে যেই পিডে মারব, হেই পিড বিস্তে যাইব। যেই আতে, যেই পায় মারব, বেবাক বিস্তে যাইব। তুই বুঝিন কাডুরিয়ার বউর কিচ্ছা হোনস নাই? তয় হোন : রসুল-করিম একদিন বিবি ফাতেমারে কইল-”অমুক জাগায় এক কাডুরিয়া থাকে। তার বউ আট বিস্তের বড় বিস্তে যাইব।” বিবি ফাতেমা জিগাইল—”ক্যান যাইব?” রসুল করিম কইল—”যাও, গিয়া দেইখ্যা আহ একদিন।” বিবি ফাতেমা কাডুরিয়ার বাড়ী গিয়া দ্যাহে কি, ওমা! ঘরের দুয়ারে হাজাইয়া থুইছে দাও, লাডি, ঠ্যাঙ্গা, দড়ি। বিবি ফাতেমা কাডুরিয়ার বউরে জিগাইল—”অত লাঠি ঠ্যাঙ্গা এমুন কইর্যা রাখছে কে?” সে জ’ব দিল—”আমি।” জিগাইল, “ক্যাঁ?” সে জব দিল—”যদি সোয়ামীর খেডমতে তিরুডি অয়, তয় এই লাঠি দিয়া আমারে পিডাইব। কামের সময় কোতায় লাডি বিচরাইব? এই এর লাইগ্যা আতের কাছে আইন্যা রাখছি। জিগাইল, “দাও রাখছ ক্যাঁ?” জব দিল—”যদি মনে লয় কাটব।”
—দ্যাখ, কেমুন জননা আছিল। জয়গুনের শাশড়ী মাথা নাড়ত।
জয়গুন এ কেচ্ছা বহু আগেই শুনেছে। মুসলমান ঘরের বউ এ কেচ্ছা শোনেনি, তা অস্বাভাবিক।
জয়গুন হয়তো সহ্য করত। কিন্তু করিম বক্শ তাকে সে সুযোগ দেয়নি।
বছর দুই আগে করিম বক্শ আবার বিয়ে করেছে। তবে আঞ্জুমনের কপাল ভালো। আগের সে মেজাজ আর নেই। বিশেষ করে পয়লা ঘরের ছেলে রহিম বক্শ বাপের অত্যাচারে শ্বশুর বাড়ী উঠে যাওয়ার পর, তার মেজাজ অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে।
কিন্তু বাহুবল যত কমেছে, বাক্যবল তত নয়। ঝগড়া আর প্যানপ্যানিটাই আজকাল আছে। প্রতিপক্ষ ঝগড়ায় পিছপাও নয় বলে, খেতে বসতে ঝগড়া হয়। দিন বড় বাদ যায় না। যে দিন বাদ যায়, সেদিন পাড়ার সবাই সচকিত হয়। একজন আরেক জনকে জিজ্ঞেস করে—করিম বক্শ বুঝি বাড়ীতে নাই আইজ?
সেদিন আঞ্জুমন এক বেদেনীর কাছ থেকে মেয়ের অসুখের জন্য কিসের তাবিজ রাখছিল! করিম বক্শ হাট থেকে এসে দেখেই আগুন। জিজ্ঞেস করে—কিয়ের তাবিজ, আঁ? আমারে টোনা করবি নি?
তার এই এক অকারণ সন্দেহ।
আঞ্জুমন রেগে যায়, বলে–হ, টোনা করমু। ভেড়া বানাইয়া রাখমু তোমারে।
—হারামী! বৈতাল মাগি! বলে সে উঁচু করে পুরানো লাঠিটা।
—আত উডাইও না কইতে আছি। খইয়া পড়ব আত। কুড়-কুষ্ঠ অইব।
করিম বক্শ লাঠিটা নামায়। তারপর বলে—জয়গুন তো তোর মতন আছিল না। মাইর্যা চাবড়া কইরা ফেলাইলেও উই করত না। আর তোর গায়ে ফুলের টোহা না দিতেই–
জয়গুনকে ছেড়ে দেয়ার পর কাসুকে নিয়ে করিম বক্শ বিব্রত হয়েছিল। একদিন করিম বকশের এক নিঃসন্তান বোন এসে কাসুকে নিয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিন্ত হয়।
কাসু ফুপুর বাড়ীতে এক রকম ভালোই ছিল।
কিছুদিন আগে ফুপু মারা যাওয়ার পর করিম বক্শ তাকে নিজের বাড়ী নিয়ে এসেছে। কিন্তু এ বাড়ীর ঝগড়াটে আবহাওয়ায় এসে কয়েক দিনেই সে মনমরা হয়ে গেছে। এখানে আদর করে কেউ কোলে নেয় না তাকে। ডাকেও না কেউ। এখানে কারো মুখেই হাসি নেই। তাই ওর নিজের হাসিও কোথায় মিলিয়ে গেছে। কারো মুখের দিকে চেয়েই সে ভরসা পায় না। শুধু একজনকেই তার পছন্দ হয়েছে। সে হাসু। তার এখানে আসবার পর সে তিনদিন এসেছে। কিছুদিন ধরে তারও দেখা নেই।
হাসুর দেওয়া কদমা করিম বক্শ পানিতে ফেলে দিয়েছিল। চরকিটা ভেঙে দিয়েছিল পায়ের তলায় ফেলে। কাসুকেও থাপ্পড় মেরেছিল পিঠের ওপর। ঐ দিন থেকেই কাসু আরো মুষড়ে পড়ে। করিম বক্শ সেদিন তাকে একটা মাটির ঘোড়া কিনে দিয়েছিল! কাসু তা ছোঁয়নি।
হাসু আর আসবে না, তার ছোট মনেই সে অনুমান করেছিল সেদিন। হাসুর আসার পথের দিকে চেয়ে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
করিম বক্শ ঐ দিন থেকেই হুঁশিয়ার হয়েছে। হাসুকে তার সন্দেহ হয়। ছোঁড়াটা ভারী ফেরেববাজ। ফুসলি দিয়ে কাসুকে নিয়ে যেতে পারে এই তার ভয়। তাই সে যেখানে যায়, প্রায় সাথে সাথেই রাখে কাসুকে। বড় ছেলেটা শ্বশুর বাড়ী পালিয়েছে। কাসুই এখন একমাত্র ভরসা।
খেত-পাথারে জোয়ারের পানি আসার সাথে সাথে করিম বক্শের মনে আসে এক জোয়ার। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সে কোঁচ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মাঠে মাঠে! তার ঐ এক ঝোঁক। তার যৌবনের হিংস্র স্বভাবের অবশিষ্ট এই মাছ শিকার। কয়েকদিনের চেষ্টাও অনেক সময় বিফলে যায়। তবু তার ধৈর্যের অভাব নেই। রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে সে ধান খেতের ভেতর মাছের সন্ধান করে বেড়ায়।
এ বছর তার সুবিধা হয়েছে আরো। আউশ ধান পেয়েছে মণ সাতেক। এ ধানে প্রায় আমন ধর ধর হবে। কারণ ছেলে ও ছেলেবৌ চলে যাওয়ায় খাবার লোক কমেছে। গাই দুই সের দুধ দেয়। আট আনা করে রোজ একটাকা পাওয়া যায়। সুতরাং তার আর ভাবনা নেই। সারাদিনে সে শুধু বাজারে গিয়ে দুধ বেচে! কাজ আরো আছে বটে। কিন্তু মাছ ধরার নেশায় সে সব কাজের খেয়ালই হয় না। ছেলে থাকতে সব কাজ সে-ই করত।
তিনদিন অবিরাম বৃষ্টিপাতের পর আজ দুপুরের দিকে রোদ উঠেছে। ভাত খাওয়ার পর করিম বক্শ ডাকে—ফুলির মা, এক ছিলিম তামাক দাও দেহি জলদি। বাতাসের রাগ নাই আইজ। মাছ দ্যাখতে সুবিধা অইব।
আঞ্জুমন কয়ে আগুন দিয়ে ফু দিতে দিতে আসে। করিম বকশের হাতের কোটায় কঙ্কেটা বসিয়ে দিয়ে বলে—আর তো কাম নাই তোমার। পাডের জাগডা দ্যাখছ?
—হুঁ, দেখমু হনে আইজ। নিরাগ বাতাসে আইজ চকে যা মাছ দ্যাহা যাইব! —
বাটনা বাইট্টা রাহুম হে-অইলে, কি কও?
করিম বক্শ খোঁচাটা নীরবে সহ্য করে। মাছ সে চার-পাঁচ দিনেও একটা পায় না। তাই এ টিটকারী।
কোঁচ-যুতি হাতে সে নৌকায় ওঠে। পাশের বাড়ীর হারুনকে ডেকে নেয় নৌকা বাইতে। কাসুকেও রেখে যায় না বাড়ীতে।
এদিকের পানি কালো, তাই স্বচ্ছ। মাছ মারতে অসুবিধা। শিকারী মাছ দেখবার আগেই, মাছ শিকারীকে দেখতে পেয়ে পালায়।
দাড়া-পথ বেয়ে তারা খালের ধারের একটা ধান খেতে ওঠে। নদীর পানি খাল দিয়ে। এসে এখানকার পানি ঘোলা করে রাখে।
করিম বক্শ নিশ্চুপ ওঁত পেতে থাকে। চারিদিকে চোখ বুলায় একটা ধান গাছ নড়ে কিনা। কখনও কোঁচ নিয়ে, কখনও যুতি হাতে নিয়ে সে তাক করে।
মাছের কোন লক্ষণ না পেয়ে হাতের ইশারায় সে আর এক খেতের দিকে নৌকা চলাবার নির্দেশ দেয়।
এক জায়গায় কয়েকটা ধান গাছ নড়ে ওঠে। আর যায় কোথা! ঝররর ঝপ! কোঁচ দিয়ে কোপ দেয় করিম বক্শ।
আরো অনেক লোক জমা হয়েছিল মাছ মারতে। একজন বলে আইজ আর মিয়াবাই খালি আতে যাইব না, বোঝতে পারছি।
করিম বক্শ কোঁচটা তুলে নিরাশ হয়। বলে—দুশশালা! আইজ যাত্রাডাই খারাপ। আর কেওর কোঁচের নিচে পড়তে পারলি না? আমারডার নিচেই–
—কি মিয়া, কাছিম নাহি? একজন জিজ্ঞেস করে।
—আর কইও না মিয়া। আইজ যাত্রাড়াই খারাপ।
—যাত্রা খারাপ! ক্যাঁ? বউর মোখ দেইক্যা যাত্রা কর নাই মিয়া?
হারুন ও কাসু দু’জনেই উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল। হারুন নিজের মাথা থেকে মাথলাটা। কাসুকে দিয়ে বলে—ঘাম দিছেরে, ইস! মাথলাডা মাথায় দে, রউদ লাগব না।
আরো কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে যখন আর মাছের সাড়া পাওয়া যায় না, তখন করিম বক্শ বলে—কি জানি এইরম আইতাছে ক্যান। তোরা কাপড় উড়া কইর্যা পিন্দা নে, দেহি কি অয়।
করিম বক্শ নিজেও গামছা পরে লুঙ্গি ছাড়ে। লুঙ্গির দিক পালটিয়ে নিয়ে আবার পরে।
এবার করিম বক্শ এক চাক গজার মাছের পোনার পেছনে লাগে। কিন্তু গজারটা খুবই চালাক। পোনার কাছাকাছিও ঘেঁষে না। মাছটা বড়ই হবে খুব, করিম বক্শ অনুমান করতে। পারে। পোনাগুলিও বড় হয়েছে। অনেকক্ষণ পরে পরে এক সঙ্গে ভেসে ওঠে। এক জায়গায় থাকলেও কথা ছিল। এই এখানে দেখা যায়, তারপর আর নেই। কোথায় গেল? কোথায় গেল? করিম বক্শ এদিক-ওদিক তাকায়। কিছুক্ষণ পরে ভুস করে ভেসে ওঠে। করিম বক্শ মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। হারুন আস্তে আস্তে অনুসরণ করে।
পোনাগুলি খেতের পর খেত পার হয়ে চলেছে। ঘোলাপানি ছেড়ে আসে কালো পানিতে। করিম বক্শ তবুও হাল ছাড়ে না।
এবার একটা জলা খেত পার হয়ে পোনাগুলি ধানখেতে ঢোকে। করিম বক্শ কেঁচটা রেখে যুতি হাতে নিয়ে আবার মনোযোগ দেয়। পেছনে হাত দেখিয়ে নৌকার গতি মন্থর করার নির্দেশ দেয়। নিজেও সে নুয়ে এক হাতে ধানগাছের গোছা ধরে নৌকার গতিরোধ করে।
কাসু!
হাসুর ডাক। করিম বক্শ চমকে ওঠে। চেয়ে দেখে সে জয়গুনের বাড়ীর কাছাকাছি এসে পড়েছে।
জয়গুন, মায়মুন ও হাসু দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে, এদিকে জয়গুন এখন গাছের আড়ালে চলে গেছে।
কাসু ডাক শুনে দাঁড়িয়েছিল। করিম বক্শ বলে—ব’ হারামজাদা। বইয়া পড়! পইড়া যাবি।
তারপর হারুনের কাছ থেকে লগি নিয়ে জোর ঠেলায় সে নৌকা ছুটায় বাড়ীর দিকে।
জয়গুন চেয়ে থাকে যতক্ষণ নৌকাটা দেখা যায়। কাসুকে তিন বছরের রেখে সে এসেছিল। এখন সে বড় হয়েছে। কথা বলতে শিখেছে। কিন্তু দূর থেকে মুখখানা আদৌ দেখা গেল না। এখন বড় হয়ে সে মুখখানা কেমন হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও মনে মনে তা গড়তে পারে না জয়গুন।
০৬. হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি
১৫ই আগষ্ট শুক্রবার, ১৯৪৭ সাল।
হাসু মা-কে মোড়ল পাড়ায় নামিয়ে দিয়ে রেল-রাস্তার পাশে আসে। রোজ সেখানে কোষা ডুবিয়ে রেখে সে কাজে যায়।
রাস্তায় উঠেই সে চমকে ওঠে। চারদিক থেকে চিৎকারের ধ্বনি শোনা যায়। হিন্দু-মুসলমানে কাটাকাটি শুরু হল না ত!
রেল-রাস্তা ধরে সে ভয়ে ভয়ে পা ফেলে। মারামারি বাধলে কোন কাজই হবে না আজ। গত বছর এমন দিনে মারামারি বেধেছিল। পনেরো দিন সে ঘরের বার হতে পারেনি। তিনদিন না খেয়ে কাটাতে হয়েছে।
একটা গাড়ী আসছে নারায়ণগঞ্জ থেকে। ইঞ্জিনের সামনে একটা নিশান পতপত করছে। বাতাসে। সবুজ রঙের বড় নিশান। মাঝে চাঁদ ও তারা।
গাড়ীর মাঝেও চিৎকার। চারদিকের চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠেছে। গাড়ীটা কাছাকাছি আসতে স্পষ্ট বোঝা যায়—
আজাদ পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!
কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!
হাসুর গা রোমাঞ্চিত হয় আনন্দে। সে চেয়ে থাকে। গাড়ীর প্রত্যেকটি লোক আনন্দ-চঞ্চল। অনেকের হাতেই নিশান। বাইরে মুখ বাড়িয়ে নিশান নেড়ে তারা চিক্কার করছে। প্রত্যেক কামরায় ঐ একই আওয়াজ।
হাসু হাত উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে আওয়াজ তোলে ঐ সাথে।
মানুষের বিরাট মিছিল চলছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হিন্দু-মুসলমান ছেলে বুড়ো—সবাই আছে মিছিলে।
হাসু দাঁড়িয়ে দেখছিল। মিছিল সে বহু দেখেছে। কিন্তু এরকম আর দেখেনি। একজন কাগজের একটা নিশান ওর হাতে দিয়ে দাড় করিয়ে দেয় লাইনে। হাসু মিছিলের সাথে মিশে যায়। কাজের কথা তার মনেই হয় না।
মিছিল শহরের সমস্ত রাস্তা ঘোরে। চিৎকার করে জানায় স্বাধীনতার বার্তা।
মিছিল ভাঙে দেড়টায়। হাসু তাড়াতাড়ি স্টেশনে আসে। মেল স্টীমার এখনও আসেনি। হাসুর ভাগ্য ভালো। আর দিন আসে একটার মধ্যেই।
তিনটার সময় মেল আসে। জাহাজের সামনে ঠিক ছাদের ওপর উড়ছে সবুজ নিশান। জাহাজের ডেকে লোক ঠাসাঠাসি হয়ে আছে। ছাদেও উঠেছে অনেক লোক, সেখান থেকে আওয়াজ ওঠে–
পাকিস্তান জিন্দাবাদ!
কায়েদে আজম—জিন্দাবাদ!
পাড়ের থেকে একদল তাদের ধ্বনির প্রতিধ্বনি করে। জাহাজখানা যেন কেঁপে ওঠে। সমস্ত মিলে একটা নতুন অনুভূতির সঞ্চার হয় হাসুর মনে।
দুটো মোট বয়ে আজ দশ আনা পায় হাসু। অন্য দিন দর কষাকষি হয়। তিন আনা বড় জোর চার আনার বেশী মোট পিছু দিতে চায় না। কিন্তু আজ আর পয়সার দিকে যেন খেয়াল নেই কারো।
আজ আর কাজ করবে না হাসু।
পথে আসতে আসতে সে দেখে, শহরের প্রত্যেক বাড়ীতে নিশান উড়ছে বড় বড়। সে তার হাতের কাগজের নিশানটার দিকে চায়, আবার চায় দুই পাশে। ডানে হিন্দু পাড়া, বাঁয়ে মুসলমান পাড়া। সব বাড়ীতেই আজ সবুজ নিশান।
হাসু বাড়ী আসে। চিৎকার করে সে গলা ভেঙেছে আজ। ভাঙা গলায় সে সমস্ত দিনের কথা বলে যায় মা-র কাছে। জয়গুন হাসুর হাত থেকে নিশানটা নিয়ে দেখে আর শুনে যায়। হাসুর কথা এক মনে।
হাসু বলে—আর আমাগ কষ্ট অইব না, কেমুন গো, মা? মাইনষে কওয়াকওয়ি করতে আছে ঘাডে পথে। দ্যাশ স্বাদীন অইল। এইবার চাউল হস্তা আইব। মানুষের আর দুখ থাকব না।
—হুঁ। জয়গুন সায় দেয়। সে-ও সেদিন গাড়ীতে শুনেছে, দেশ স্বাধীন হবে। ভাত-কাপড় সস্তা হবে। কেউ না খেয়ে মরবে না।
জয়গুনের সুখের স্বপ্ন আজ সফল হলো। সত্যি সত্যি স্বাধীনতা এল আজ।
হাসু বলে—টাউনে আইজ বেবাক বাড়ীতে নিশান ওড়তে আছে, মা। কি সোন্দর বড় বড় নিশান! তুমি একটা বানাইয়া দ্যাও, মা।
জয়গুন হাতের নিশানটা দেখিয়ে বলে—এই যে আছে একটা। আর দিয়া কি অইব?
—এইড়া যে এক্কেরেই ছোড়। গাছের ডাইলে বাইন্দা উপরে তুলতাম, মা। গেরামের বেবাক মাইনষে দ্যাখতে পাইব। টাউনে কত বড় বড় নিশান ওড়তে আছে আইজ!
জয়গুন ঘরে যায়। একটা গাঁটরি নামায় মাচার ওপর থেকে। লাল কাপড়ের একটা টুকরো বের করে হাসুকে দেখায়।
উহুঁ, রাঙ্গায় অইব না, মা। এই রহম কচুয়া অওয়ন চাই। হাতের নিশানটা দেখিয়ে প্রতিবাদ করে হাসু।
—ক্যাঁ? রাঙ্গায় দোষ কি? কী সোন্দর খুনী রঙ! মীরপুরের শাহ সাবের দরগায় দেইক্যা আইলাম লাল নিশান।
—টাউনের এক বাড়ীতেও রাঙ্গা নিশান দ্যাখলাম না। বেবাক এই রহম কচুয়া।
আসমানী রঙ্গে অইব?
—উহুঁ, কইলাম যে এই রঙ। তোর লাইগ্যা এই রঙ বানাইলে পারি অহনে। জয়গুন রাগ করে। সে আর একটা গাঁটরির জন্যে উঠতেই হাসু খুশী হয়।
গাঁটরি খোলে জয়গুন। পুরাতন কাপড়ের গাঁটরি। কালিঝুলি মেখে বিশ্রী হয়ে গেছে টরিটা। খুলতে খুলতে তার হাত অবশ হয়ে আসে। বুকের ভেতর স্পন্দন বেড়ে যায় অসম্ভব রকম। জীর্ণ পুরাতন কাপড় ভাজ করে করে সাজান। জয়গুনের বিগত জীবনের অনেক কাহিনী কাপড়গুলোর মধ্যে পুঞ্জীভূত। ভাঁজ খুলতে খুলতে তার স্মৃতির ভাঁজও খুলে যায়। এই টুপিটা তার প্রথম স্বামীর—হাসুর বাপের। ঢোলা পাঞ্জাবীটাও তার। জয়গুনের চোখে ভাসে, কিশতি টুপি মাথায় পাঞ্জাবী গায়ে জবর মুনশীর চেহারাখানা।…এই বোম্বাই শাড়ীটা তার প্রথম বিয়ের। ঘোমটা-টানা বধু জীবনের সুমধুর স্মৃতি এখন শুধু ব্যথাই দেয়।…এই ছোট্ট জামাটা কাসুর। এই জামা আর কানটুপিটা ছোট খুকীর।
জয়গুনের চোখ আর বাধ মানে না। চোখের পানিতে গঁাটরির কাপড়গুলো ভিজে ওঠে।
ছোট খুকী!
তখন দুর্ভিক্ষ সবে দেখা দিয়েছে। দুর্নামের ভয়ে স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন তখনও ঘরের বার হয়নি। খেতে না পাওয়ায় তার বুকে দুধ ছিল না। দুধের শিশু দুধ না পেয়ে শুকনো পাটখড়ির মত হয়েছিল। শেষে ধুকতে ধুকতে একদিন মারা গেল। তাকে কবর দিতে কাফনের কাপড় জোটেনি। এই বোম্বাই শাড়ীটার অর্ধেক দিয়ে কাফন পরিয়ে যখন কবরে নামান হয় তখন জয়গুন বিলাপ করতে করতে বলেছিল—”আইজ তোরে বউ সাজাইয়া দিলাম।”
জয়গুন আর ভাবতে পারে না। একমাত্র সবুজ বোম্বাই শাড়ীটার অবশিষ্ট পাটটা হাসুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে কাপড়গুলোর মধ্যে মুখ লুকায়।
হাসু ও মায়মুন অবাক হয়ে চেয়েছিল মা-র দিকে। তারা কিছু বুঝতে না পেরে শাড়ীর পাটটা নিয়ে বেরিয়ে যায়।
মায়মুন সুঁই নিয়ে আসে। সাদা কাপড়ের চাঁদ ও তারা কেটে নিশানের মাঝে জুড়ে দেয়।
বেশ সুন্দর নিশান হয়েছে। ঠিক সায়েব বাড়ীর নিশানটার মত। মায়মুন উৎফুল্ল হয়। হাসুর চোখে-মুখে হাসি ফোটে।
জয়গুন যখন বাইরে আসে, তখন হাসু আম গাছে উঠে নিশানটা বেঁধে দিয়েছে। মায়মুন ও শফি চেয়ে আছে ওপর দিকে। গাছের থেকে হাসু ডাকে—মায়মুন! শফি! আমি যা কই আমার লগে লগে আওয়াজ করবি, কেমন?
শফি বলে—কি কইমু?
—পাকিস্তান—জিন্দাবাদ!
হাসুর সাথে গলা মিলিয়ে শফি ও মায়মুন আওয়াজ তোলে। জয়গানের মনে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে কথাগুলো।
জয়গুন নিশানটার দিকে তাকায়। সবুজ নিশান নতুন জীবনের আভাস দিয়ে যায়। মনে জাগে বাঁচবার আশা।
০৭. চারদিকে আনন্দকোলাহল
চারদিকে আনন্দকোলাহল। মায়মুন ডাকে—মা, চান ওঠছে বুঝিন, ঈদের চান।
মায়মন দৌড়ে যায় বাড়ীর পশ্চিম দিকে। শফি এসে দাঁড়ায় এর পাশে। পশ্চিম দিগন্তের রঙিন মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ওরা তন্ন তন্ন করে খোঁজে চাদ। জয়ন এসে যোগ দেয়।
মায়মুন বলে—কই মা?
—অই সাঁকুয়া তারাডার কাছ দিয়া দ্যাখ। ওডার নিচে দিয়াই দ্যাহা যায় হগল বচ্ছর।
—অই, ঐ যে দ্যাহা গেছে, ঐ ঐ ঐ! শহি লাফিয়ে ওঠে আনন্দে, মায়মনকে টেনে আঙুল দিয়ে দেখায়—ঐ যে তারাডার একটু নিচে। কালা মেঘড়ার পাশে।
মায়মুন দেখতে পেয়ে আনন্দে হাত তালি দেয়। জয়গুন এখনও দেখতে পায়নি। সে বলে—আমাগ কি হেই দিন আছে! তোগ নতুন চউখ। তোর দ্যাখতে পাবি।
—তুমি অহনও দ্যাহ নাই মা! মায়মুন এবার মাকে দেখাতে চেষ্টা করে। জয়গুন দেখতে পায় অনেক পরে। ভক্তিতে সে মাথা নোয়ায়, দু’হাত তুলে মোনাজাত পড়ে।
—এক্কেরে কাচির মতন চিকন এইবারের চান। সিদা অইয়া ওঠছে। আর হগল বচ্ছরের মতন কাইত অইয়া ওড়ে নাই। মোনাজাত সেরে বলে জয়গুন।
চাঁদটা মেঘের আড়ালে চলে গেলে জয়গুন আবার বলে—চুল, ইফতার খুলি গিয়া।
শফির মার ঘরের কাছে যেতে সে ডাকে—চান দেখলিনি, হাসুর মা?
—হ বইন। দ্যাখলাম। বড় ছোড এইবারের চান।
তোরাই দ্যাখ বইন, তোগ চইখ দিছে খোদায়। আমার একটা চউখ, হেইডাও বুঝিন বুইজ্যা গেল।
শফির মা নিশ্বাস ছাড়ে। এমনিতেই সে লবেজান। তার ওপর রোজা রেখে সে বিকালের দিকে খুবই কাহিল হয়ে যায়। সে আবার বলে—চাইর-পাঁচদিন পরে ছাড়া আমি দ্যাকতে পারমু না। চান্ডা সিয়ানা অউক। আ-গো হাসুর মা,—এইবার কোন মুহি কাইত অইয়া ওঠছে গো চান? দহিণমুহি?
—এইবারে সোজাসুজিই ওঠছে বইন। ব্যাকা-ত্যাড়া ওড়ে নাই। লক্ষণ ভালা, না?
-হ বইন, আর আহাল অইব না এইবার দেহিস। যা কইলাম যদি না ফলে তহন। কইস, কানা বুড়ী কি কইছিল।
শফির মা’র কুঁচকে যাওয়া শুকনো কালো মুখখানা খুশীতে ভরে ওঠে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে সে মুখখানা দেখে জয়গুনেরও ভরসা হয়। ভবিষ্যদ্বাণীর মতই বিশ্বাস করে শফির মা’র কথাগুলো।
শফির মা বলে—হেই আকালের বচ্ছর পঞ্চাশ সনে দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া ঈদের চান উঠছিল। আমি নিজে দেকছি। চউখ তুহা তাজা আছিল। আমি দেইক্যা কইছিলাম তহন—এইবার না জানি কি আছে কপালে।
—দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া ওঠলে অকাল অইবই। বুড়া-বুড়ীর কাছে হুনছি, দক্ষিণ মুহি কাইত অইয়া চান যদি সমুদ্রের ওপরে নজর দেয়, তয় বান ডাইক্যা দ্যাশ—দুইন্নাই তলাইয়া যায়। দেখলি না অই বাচ্ছর কেমুন–
—কত বচ্ছর পর এইবার সিদা ওঠছে চান। খোদা বাঁচানেওয়ালা।
এফতারের সময় উৎরে গেছে। জয়গুন ঘরের দিকে পা দেয়। মায়মুন বলে—উত্তর মহি কাইত অইয়া ওঠলে কি অয় মা?
—মড়ক লাগে। কলেরা-বসন্ত অয়। মানুষ মইর্যা সাফ অইয়া যায়।
মায়মুন শিউরে ওঠে।
ওজু করে জয়গুন ঘরে যায়। শেষ রোজার ইফতারের জন্য আজ একটু আলাদা আয়োজন—চার ফালি শশা ও এক খোরা গুড়ের শরবত। আর সব দিন এক মগ সাদা পানি সামনে কারে সে বসে থাকত বেলা ডুবে যাওয়া পর্যন্ত! এমন করে খাবার সামনে নিয়ে ইফতারের জন্য বসে থাকা অনেক পুণ্যের কাজ, সে জানে। মসজিদের আজান ইফতারের সংকেত জানালে সে এক ঢোক পানি খেয়ে রোজা ভাঙত।
জয়গুন একচুমুক শরবত খেয়ে মায়মুনের সামনে ঠেলে দেয় বাটিটা। মায়মুন বাটিটা নিয়ে চুমুক দিতেই জয়গুন বলে—মজা পাইয়া বেবাকহানি খাইয়া ফেলাইস না আবার। তোর মিয়াভাইর লাইগ্যা থুইয়া দিস।
শশার এক ফালি মায়মুনের হাতে দিয়ে জয়গুন এক ফালি তুলে নেয়। বাকী দুই ফালি রেখে দেয় হাসুর জন্যে।
শশা চিবোতে চিবোতে সে গত কয়েক বছরের কথা মনে করে। পঞ্চাশ সনের পর থেকে সে এ রকম পুরো তিরিশ রোজা রাখতে পারেনি। চার বছর পর এবার তিরিশ রোজা পুরিয়ে তার মনে শান্তির অবধি নেই। কিন্তু গত বছরগুলির চিন্তাও তাকে পেয়ে বসে। পঞ্চাশ সনে একটা রোজাও রাখা হয়নি। তার পরের বছর ছয়টা, তার পরে পাচটা এবং গত বছর সাতটা রোজা ভাঙা হয়েছে—সে মনে করে রেখেছে! জয়গুন হিসেব করে দেখে, এ কয় বছরে সে দু’ কুড়ি আটটা রোজা ভেঙেছে। নামাজ-রোজা সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি তার জানা। প্রথম স্বামী জরূর মুনশীর দৌলতেই তা সম্ভব হয়েছে। সে জানে, রমজানের একটা রোজা ভাঙলে তার বদলে তিনকুড়ি রোজা রাখতে হয় তবেই গোনা মাফ হয়।
জয়গুন হিসেব করতে চেষ্টা করে। আগেও সে করেছে কয়েকবার। একটা রোজার জন্যে ষাটটা হ’লে দুকুড়ি আটটার জন্য কতদিন রোজা রাখতে হয়। সে হিসেব করতে গিয়ে মাথা গুলিয়ে ফেলে। একশো পর্যন্ত সে ভালোমত গুনতে পারে না। এককুড়ি’ ‘দুই কুড়ি ‘ করে সে হিসেব করে। সুতরাং সে ক্ষান্ত হয়। কিন্তু তবুও সে আন্দাজ করে নিয়েছে অনেক বছর, হয়ত বা বাকী জীবনভর রোজা রেখেও সে আটচল্লিশ দিনের রোজা শোধ করতে পারবে না। সে আরো জানে, একটা রোজার জন্যে আশী হোক দোজখের আগুনে পুড়তে হবে। এক একটা হোক ইহকালের আশী বছরের সমান।
জয়গুনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে নামাজ সেরে তসবীহ নিয়ে বসে। তসবীহ জুপা এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়। তার আবার মনে হয়, কেন? সে-ত জীবনভর রোজা রেখেই চলেছে। রোজা ছাড়া আর কি? বারো মাসের একদিনও সে পেট ভরে খেতে পায় না। ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত আধপেটা খেয়ে থাকে। পেট ভরে কবে সে শুধু দু’টো ভাত খেয়েছে তার মনে পড়ে না। পঞ্চাশ সনের কথা মনে হয়। একটা রোজাও রাখা হয়নি। রোজা রাখার কথা মনেও হয়নি। এক বাটি ফেনের জন্যে ছেলেমেয়ে নিয়ে কত জায়গায়, কত বাড়ীতে বাড়ীতে তাকে ঘুরতে হয়েছে। এক বাটি খিচুড়ির জন্যে শারখানায় লাইন ধরতে হয়েছে। কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা আধ-হাঁটু কাদার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়েছে। মাথার ওপর বৃষ্টি পড়েছে, রোদ জ্বলেছে। তার বেশী জ্বলেছে পেটের মধ্যে। যখন যেখানে যতটুকু পেয়েছে, খেয়েছে। পেট ভরেনি। পানি খেয়ে খেয়ে পেট ভরেছে। তার পরের বছরগুলিও চলেছে অতি কষ্টে। ছেলেমেয়েকে খাইয়ে কতদিন উপোস করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে সারারাত সারাদিন কেটেছে একটা দানাও পড়েনি পেটে। রমজান মাসের রোজার চেয়েও যে ভয়কর এ রোজা। রমজানের একমাস দিনের বেলা শুধু উপোস। কিন্তু তার বারোমেসে রোজার যে অন্ত নেই।
কিন্তু তবুও জয়গুনের শান্তি নেই, সাত্বনা সে পায় না। তার অন্যায়ের জন্য সে খোদার। কাছে প্রার্থনা করে।
হাসু আসে রাত আটটায়। মোট বয়ে বারো আনা পেয়ে সে চার আনা দিয়ে একটা নারকেল নিয়ে আসে। জয়গুন দেখে রাগ করে—তোর আর আৰুল অইব কোনদিন! অত পয়সার নাইকল কিনতে গেলি ক্যান?
—ঈদের দিন এট্টু শিন্নিও খাই না?
—নাইকল বেগর আর শিন্নি অয় না! নোয়াবের পো নোয়াব! নাইকল বেগরই – পাকাইমু আমি। অইড়া বেইচ্যা ফালাবি কাইল।
হাসু ক্ষুণ্ণ হয়। বলে—থাউক আর শিন্নি রানতে অইব না, পান্তা ভাত আর মরিচ-পোড়া – খাওয়া কপাল। বচ্ছরের একটা দিন আর শিন্নি খাইয়া কি অইব!
জয়গুন চুপ করে। খানিক পরে আবার বলে—পরাণে খাইতে চায়, খাও। পয়সা কামাই করবা, খাইবা, আমার কি? দুই দিন বাদে যহন হকাইয়া তেজপাতা হইয়া যাইবা, তহন বোঝবা শিন্নির মজা!
খাওয়ার পর জয়গুন বাশের চোঙাটা নামায়। পয়সা রাখবার একমাত্র আঁধার এ চোঙাটা। মাটির ওপর ঢালে সমস্ত পয়সা। আনি, দুয়ানি, সিকি আলাদা আলাদা সাজিয়ে হিসেব করে। হাসুর আজকের আট আনাসহ মোট তিন টাকা দশ আনা। চাল কিনতে হবে। তেল, মরিচ, আরো অনেক কিছুই নেই। অনেক কিছুর মধ্যে লবণটা না কিনলেই চলে না। লবণ একটু বেশীই লাগে তার সংসারে। পান্তা ভাত খেতেই বেশী খরচ হয় লবণ।
হাসু বলে—একটা টুপি কিনার পয়সা দিবা, মা? কাইল ঈদের ময়দানে কি মাথায় দিয়া যাইমু?
—তোর টুপি কিনন লাগত না। টুপি একটা দিমু তোরে, তয় কাসুর লাইগ্যা একটা
হাসু সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে—ওর একটা টুপি কিনতে আর কত লাগব? এই বড় জোর পাঁচ আনা, ছয় আনা।
মায়মুন একটু এগিয়ে মার দিকে চেয়ে ডাকে—মা।
—কি? থাইম্যা গেলি ক্যান? ক’।
পরিহিত কাপড়ের একটা ছেঁড়া জায়গা দেখিয়ে মায়মুন বলে—দ্যাহ মা, কেমুন ছিঁড়্যা গ্যাছে। ঈদের দিনে বেড়াইতে যাইমু না?
মেয়ের আবদার বুঝে রাগ হয় জয়গুনের। সে বলে—কি? কাপোড়?
—হ!
—হ! কাপোড়! কাপোড় দিয়া কবর দিমু তোরে শয়তান। ধাক্কা দিয়ে মায়মুনকে সরিয়ে ভেঙচিয়ে ওঠে জয়গুন।
হাসু মায়মুনের দিকে তাকায়। ব্যথায় তার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
মায়মুন তাড়া খেয়ে শুয়ে পড়েছে। জয়গুন ডাকে—হাসুর গামছাটা পিন্দা কাপোড় খুইল্যা দে মায়মুন, সিলাইয়া দেই। কাইল রাইত গোয়াইলে সোডা দিয়া ধুইয়া দিমুহনে।
জয়গুন সুঁই-সুতা নিয়ে বসে। নিজের ও মায়মুনের কাপড়ে জোড়াতালি লাগায়। হাসু ও মায়মুন ঘুমিয়ে পড়েছে। মশার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে। জয়গুন ওদের দিকে হাত বাড়িয়ে মশা তাড়ায়।
সেলাই সারতে অনেক রাত হয়। রাত্রির নীরবতা ভেঙে হঠাৎ ডাহুক ‘কোয়াক—কোয়াক’ করে ওঠে। চারদিকে পশুপাখীর ঘুম-কাতর সারা পাওয়া যায়। ঘরের হাঁস দু’টোও প্যাঁক প্যাঁক করে আবার ঠোঁট লুকায় পালকের মধ্যে। জয়গুন ভাবে—পইখ-পাখলার এক ঘুম হয়ে গেল।
জয়গুন কুপিটা নিবিয়ে মায়মুনের পাশ দিয়ে শুয়ে তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। অভ্যাসবশ মায়মুনও মা-র গলার ওপর একখানা হাত লতিয়ে দেয় ঘুমের ঘোষ। জয়গুনের বুক স্নেহে ভিজে ওঠে। সে ভাবে এ মেয়েটি কোন দিন তার কাছে আদর পায় না। আবদার করলে কিলথাপ্পড় খায়। কাপড় তার একখানা। তাও তালি দিয়ে দিয়ে এতদিন চলেছে। কিন্তু কাল ঈদ—বছরের সেরা দিন। এ কাপড়ে লজ্জা নিবারণ করা চলে, কিন্তু কুটুম্ব-বাড়ী যাওয়া চলে না। আর কুটুম্ব আছেই বা কে?
হাসুর চাচা আছে দু’জন। কিন্তু তারা হাসুর মৃত্যুই কামনা করে। জব্বর মুনশীর মৃত্যুর পর তার ভাগের তিন বিঘা জমি আর ঘরখানা পর্যন্ত হাসুর চাচা দু’জন জোর করে ভোগ-দখল করছে। এগুলোর আশা জয়গুন ছেড়েই দিয়েছে। হাসু বড় হয়ে যদি কোনদিন আদায় করতে পারে।
জয়গুন আবার ভাবে—হাসু ও মায়মুনের কপালে কুটুম্ব-বাড়ীর এক মুঠো ভাত লেখা নেই।
জয়গুন মায়মুনের চুলের মাঝে হাত দেয়। আঙুলের সাথে জড়িয়ে আসে এক গোছা চুল।
মায়মুন কোন কিছুর আবদার করলে বা কোন অন্যায় করলে সে চুল ধরে টান মারত। টানতে টানতে সে-ই আলগা করে দিয়েছে চুলগুলো। চুলগুলোর জন্যে তার মায়া হয়। চুলের মুঠি ধরে টানাটানি না করলে তার চুল এতদিন হয়ত কোমর অবধি লম্বা হত।
জয়গুন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, মায়মুনকে আর সে মারধর করবে না। অন্ততঃ তার চুল ধরে আর সে টানাটানি করবে না। মেয়ে বলে মায়মুনকে এতদিন সে অনাদর করেই আসছে। কিন্তু আর না। হাসু কোলের আর মায়মুন পিঠের—তাতো নয়! দু’জনকেই সে পেটে ধরেছে। আর মেয়ে হলেও মায়মুন লক্ষ্মী। সে বাইরে গেলে মায়মুনই সব কাজ করে। গায়ে এতটুকু জোর না থাকলেও কোন কাজ সে বড় ফেলে রাখে না।
মায়মুনের জন্যে আর কোন দিন জয়গুন এমন করে ভাবেনি। আজ হাসু ও মায়মুন তার চোখে সমান হয়ে গেছে।
অল্প কয়েকটা মাত্র চুল মায়মুনের মাথায়। বাদরের লোমের মত লালচে। যত্ন ও তেলের অভাবে জট পাকিয়ে গেছে। জয়গুন অন্ধকারে মাথা হাতড়ে উকুন মারে। উকুনে গিজগিজ করছে মাথা। রাত্রে রাত্রে এমনি করে মেরে সে কমিয়ে রেখেছে। নয় তো উকুনের আণ্ডা-বাচ্চায় এতদিন মাথা ছেয়ে যেত। তার নিজের মাথায় উকুন টিকতে পারে না। নানা চিন্তা-ভাবনায় মাথা গরম থাকে বলেই বোধ হয়।
অনেক রাত হয়েছে। উকুন বাছতে বাছতে মায়মুনের মাথায় হাত রেখেই জয়গুন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
০৮. ফুড কমিটির সেক্রেটারী
খুরশীদ মোল্লা গ্রামের ফুড কমিটির সেক্রেটারী। ঈদের দিন ভোর হওয়ার সাথে সাথে তার বৈঠকখানার বাইরে জড় হয় অনেক লোক। কেউ কেউ ভেতরেও আসে।
খুরশীদ মোল্লা একটু দেরীতেই ঘুম ভেঙ্গে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে চৌকির উপর এসে বসে। তার মুখে বিরক্তির স্পষ্ট আভাস সবার চোখেই ধরা পড়ে। গ্রামের মোড়ল কাজী খলিল বক্শ ও গদু প্রধান চৌকির ওপর সেক্রেটারীর পাশে বসে পড়ে।
খুরশীদ বলে—দেখুন তো কি ঝঞঝাট। ভোর না হতেই বাড়ী মাথায় করে তুলেছে। সব। ঈদের দিন এই উৎপাত কার ভাল লাগে? চিনি এসেছে মাত্র কমণ, আর গ্রামে লোক হচ্ছে দু’হাজার! এক তোলা করেও পড়বে না মাথা পিছু।
কাজী খলিল বক্শ উপস্থিত একজনকে উদ্দেশ করে বলে—কিরে লেদু, চিনি দিয়া কি করবি? তারপর নিজে নিজেই বলে—ভাত জোটে না, চিনি খায়। বাহার ব্যাটা! হেই-যে মাইনষে কইছিল—ঘর নাই, দুয়ার দিয়া হোয়।
লেদু মিয়া টিপ্পনী কাটতে পটু। ভেতরে ভেতরে গরম হয়ে বলে—আমাগ মতন গরীব মাইনষের আবার ঈদ কি? ঈদ অইল আপনে লাইগ্যা, বড়মিয়া সাব। হ্যা-হ্যা-হ্যা।
কাজী মোড়ল প্রাকুটি করে। আস্তে আস্তে সে সেক্রেটারীকে বলে—এ হারামজাদাকে এক কণা চিনিও দিতে পারব না, কইয়া রাখলাম।
গদু প্রধান এতক্ষণে কথা বলে—কি মোল্লার পো, চা অইব নি? তারপর নিজেই হাঁক দেয়—ওরে নসুয়া, চা দিয়া যা দুই কাপ।
রোজ ভোরে খুরশীদ মোল্লার বাড়ীতে তাগাদা দিয়ে চা খাওয়ার অভ্যাস তার। ভুলেও তার একদিন বাদ যায় না। রোজার মাসে মুখ বন্ধ ছিল বলে এক মাস মোল্লা গদু প্রধানের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিল। মুখ খোলার সাথে সাথেই তার আগমনে খুরশীদ মোল্লা বিরক্ত হয়। সে খলিল বকশের দিকে চেয়ে বলে—আপনি খাবেন না, কাজীর পো?
—হ, খাইমু। খাইমু না ক্যান? তুমি ত বাজান চিনির রাজা।
খুরশীদ হাঁক দেয়—তিন কাপ—তিন কাপ কারো চা।
খলিল বক্শ বলে—আর যা কর কর—আমার ছয় সের চাই-অই। এইডুক না অইলেই অইব না। তুমি জ্ঞাত আছ, এক পাল পৈষ্যের সংসার আমার।
গদু প্রধান বলে–আমার পাঁচ সের আগে রাইক্যা, তারপর ভাগ কর। পাঁচ সের না পাইলে ফাডাফাডি আছে তোমার লগে।
—কাকে রেখে কাকে দেই? আচ্ছা, দেখা যাবে। এ পাঁয়তারা আর কদ্দিন ভালো লাগে, বলুন! বিনে পয়সার চাকরি! ইচ্ছে হয় ছেড়ে দিই এই মুহূর্তে।
-না না, ছাড়বা ক্যাঁ? তুমি না অইলে–
-ব্যাপার দেখুন না। এই খাটছি, তবু নাম নাই। সবাই বলে চোর।
—কোন শালা কয়? দেইক্যা নেই তার গর্দানে কয়ডা মাথা।
চা আসে। তিনজন তিনটা বাটি নিয়ে চুমুক দেয়। জমিদারের পাইক এসে এক টুকরো কাগজ সামনে ধরে। খুরশীদ মোল্লা পড়ে একটু ব্যস্ত হয়ে বলে—ভবানীবাবু বাড়ী এসেছেন নাকি? আর কে কে এসেছেন?
—না, তিনি একলাই আইছেন! দিন চাইরে থাকবেন। চা খাওনের লাইগ্যা তাই
—আচ্ছা,আচ্ছা, তোমাকে বলতে হবে না আর। মাত্র পাঁচ সের ত? তুমি যাও। আমি নিজেই দিয়ে আসব খন। এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি আসব।
চা শেষ করে খুরশীদ মোল্লা দোয়াত কলম নিয়ে উবু হয়ে বসে। দুই টুকরো কাগজে দু’টো পারমিট লিখে খলিল বক্শ ও গদু প্রধানের হাতে দিয়ে বলে—চার সের করে লিখে দিলাম আপনাদের। ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বারদের দিতে হবে আবার।
বাইরের লোক এতক্ষণে উতলা হয়ে গেছে। কেউ কেউ চলেও গেছে এর মধ্যে।
এবার খুরশীদ মোল্লা উঠে তাদের উদ্দেশ করে বলে আমি কি করতে পারি, বল তোমরা। গভরমেন্ট মোটে সাপলাই দেয় না, তার আর হ্যা শোন অল্প কিছু চিনি আছে হাতে। মাথা পিছু এক তোলা করেও পড়বে না। তার চেয়ে বরং এক কাজ করলে হয়, আবার যখন চিনি আসবে, তার সাথে মিলিয়ে ভাগ করে দেওয়া যাবে।
একজন আর একজনকে বলে—চল যাইগা। এই সব না দেওয়ার ছল-চক্কর। এইহানে হতৃতা ধইরা থাকলে জামাত পাওয়া যাইব না।
সব লোক সরতে আরম্ভ করে। খুরশীদ মোল্লা আবার বলে—কি করবে আর। গুড় কিনে নাও গে।
একজন বলে—গুড়ের সের দ্যাড় টাকা। আমরা কি অত পয়সার গুড় কিন্যা খাইতে পারি মিয়া সাব? রেশনের চিনি অইলে তয়—
কথা শেষ না হতেই আর একজন বলে—আপনেরাই ঈদ করেন। আপনে দিন দিছে। খোদায়—ঈদ করতে দিছে।
কথাগুলি কোন রকমে হজম করে খুরশীদ মোল্লা অন্দরে যায়। এক্ষুণি জমিদার বাড়ী যাওয়া তার দরকার।
হাসু এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল। সে এবার বাজারের পথ ধরে।
বাজারের একটা জায়গায় সারি সারি গুড়ের হাড় ও জ্বালা সাজিয়ে দোকানদাররা বসেছে। আজ এদিকে খুব ভিড়। মাছি মৌমাছিও ভিড় করেছে গুড়ের ওপর। কয়েকটা ভিখারী ছেলে গুড় কেনার নামে এ-মাথা থেকে ও-শাথা পর্যন্ত সমস্ত হাড়ার গুড় চেখে বেড়াচ্ছে। এক দোকানীর তাড়া খেয়ে একটি আধ-পাগলা ভিখারি ছেলে বলছে—এমন কর ক্যান? ঈদের দিন এটটু মিড়া মুখ করি, মিয়া ভাই। হি-হি-হি।
দোকানীরা খরিদ্দারের সাথে দর কষাকষি করে, গুড় মেপে দেয় আবার মাঝে মাঝে গামছা নেড়ে মাছি তাড়ায়।
হাসু একটা হাঁড়ি থেকে আঙুল দিয়ে একটু গুড় নিয়ে বলে—একটু কড়া জ্বলের। দ্যাট্টাকা কইরা দিবানি? হে অইলে দ্যাও এক পোয়া।
—উহুঁ। এক টাকা বারো আনার এক আধলাও কম না।
পেছন থেকে একজন হাসুকে টান দেয়। সে হাসুদের প্রতিবেশী কেরামত। সে বলে—মিডাই না কিন্যা চিনি লইয়া যা। এই দ্যাখ আমিও কিনলাম। দুই টাকা কইরা চিনি। মিডাইর তন ভালা বরকত দিব।
—কোন ঠাঁয়?
—লতিফ মোল্লার দোকানে। খুরশীদ মোল্লার ভাই লতিফ মোল্লা। পিছ-দুয়ার দিয়া যা চুপচাপ।
হাসু বলে—ওঃ ড় কুমুডির চিনির এই দশা! হেইত আমরা কই, চিনিগুলা কই যায়?
—আর কইস না। ব্যালাক চালাইয়া ব্যাডা ফুইল্যা গেল।
হাসু একটু চিন্তা করে বলে—থাউকগা, মিডাই কিন্যা লইয়া যাই।
হাসু বাজার নিয়ে বাড়ী আসে।
খেতে বসে হাসু ও মায়মুন। খাওয়ার সময় সুড়ুত সুড়ুত শব্দ হয় ওদের মুখে।
হাসু বলে—শিন্নি পানসা অইয়া গেছে মা, মিডা হয় নাই এক্কেরেই।
জয়গুন বলে—যেমন গুড় তেমন মিড়া। তিন পোয়া চাউল এক পোয়া গুড়। মিডা অইব কেমনে?
—নাইকল দেওনে তবু একটু সোয়াদ আইছে, না মা?
—হ। আলা চাউল অইলে দেখতি কেমুন মজা অইত! সিদ্ধ চাউলে আর কি অইব?
—আরেট্টু দ্যাও, মা।
—উহুঁ, অহন আর না। ঈদগার তন আইয়া খাবি।
—ঈদের দিনও এটটু মনাচ্ছি মতন খাইমু না?
—তোগই পেট আছে, অ্যাঁ?
আর কেঅর নাই? শফিডারে এটটু দিয়া আইতে অইব। ও ঘরে যে কিছুই পাক অয় নাই।
হাসু এবার চুপ করে। মায়মুনের পাতেরটা শেষ হয়ে গেছে। সে আঙুল দিয়ে তখনও চাটছে থালাটা।
জয়গুন বলে—অহন আত ধো। তুই দ্যাখতে আছি বাসন ভাইঙ্গা খাইতে চাস।
মায়মুন লজ্জিত হয়। থালায় পানি ঢেলে সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।
জয়গুন হাসুকে বলে—মাচার উপরতন কালা কাপড়ের গাট্টি নে। ওড়ার ভিতরে একটা টুপি আছে। ওড়া তুই নে, আর নতুন কাসুরে দিয়া আয়।
—আমি পারতাম না মা। হাসু বলে।
–ক্যাঁ।
ঐ দিনের চরকি দিতে যাওয়ার বিপদের কথা হাসু মা-কে বলেনি।
সে বলে—আমি ঈদগায় যাইমু, মা। নামাজের ওকত অইয়া গেছে। তুমি আর কেই বে দিয়া
—আর কারে পাডাই? তুই-ই যাওনের কালে এটটু ঘুইর্যা ওইহান অইয়া দিয়া আয়।
হাসু আর গোপন রাখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলে সেদিনের সব কথা।
জয়গুন অসহায়ের মত তাকায় ছেলের মুখের দিকে। শেষে বলে—আগে কস নাই ক্যাঁ? এত পয়সার টুপিড়া ফ্যালাইয়া দিমু? তোর মাতায়ও লাগব না।
—কানা মামানীরে দিয়া পাড়াইয়া দ্যাও।
কথাটা জয়গুনের পছন্দ হয়। শফির মা বুড়ো মানুষ। সে নিয়ে গেলে করিম বক্শ লজ্জায় কিছু বলবে না হয়তো। রাখতে পারে। তা ছাড়া ঈদের দিন। খুশীর দিনে সে হয়ত রাগ করবে না।
হাসু গাঁটরি খোলে। বাপের কিশতি টুপিটা বের করে মাথায় দেয়। টুপিটা অনেক বড় হয়েছে। কান পর্যন্ত ডুবে যায় টুপির মধ্যে।
জয়গুন হাসুর দিকে এক নজর চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে আর তাকাতে পারে না।
হাসু গামছাটা কাঁধে ফেলে কোষায় চড়ে। শফির মা এবং শফিও ওঠে কোষায়। হাসকে ঈদগার রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে শফির মা শফিকে নিয়ে করিম বকশের বাড়ীতে যাবে। এখন যাওয়াই ভালো। করিম বক্শ এখন বাড়ীতে নেই। নামাজ পড়তে গিয়েছে নিশ্চয়ই।
শফির মা টুপিটা দিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসে।
জয়গুন খুটে খুটে জিজ্ঞেস করে কাসুর কথা।
—টুপিডা ঠিক অইল নি মাতায়?
—হ, টুপিডা মাথায় দেওনে এমন সেদর দেহাইল কাসুরে! কি কইমু তোমারে—যেন একটা পরীর বাচ্চা!
শফির মা আবার বলে—সময় বুইঝা গেছিলাম গো। করিম বকশা বাড়ীতে আছিল না। নামাজ পড়তে গেছিল। ওর বউরে তালিম দিয়া আইছি। টুপি যে তুমি দিছ, তা হে কইব না। হে কইব, হে-ই কিন্যা দিছে।
জয়গুন নিশ্চিন্ত হয়। তার ভয় ছিল করিম বক্শ হয়তো ছেলেটাকে মারতে শুরু করবে।
শফির মা বলে—করিম বকশের বউ মানুষ ভালা, খুব হাসিখুশী। আমারে পিঁড়ি দিল বসবার। নিজেই এই এত বড় একটা আস্ত ধলডোগ পান ঘেঁইচ্যা দিল।
জয়গুন বলে—কাসু কিছু কইল?
—উহুঁ। ও আমার মোখের দিগে চাইয়া আছিল! এক্কেরে এতিমের মতন—যেন বাপ-মা নাই।
–তুমি কোলে নিলা না?
—নিলাম। আমার কোলের তন আর কি নামতে চায়! এক্কেরে বুকের লগে মিশ্যা, আছিল। তারপর কত কোস্তাকুস্তি কইর্যা কান্দাইয়া নামাইয়া থুইয়া আইলাম। কি জানি, করিম বক্শ আইলে আবার কি কাণ্ড কইরা ফালায়।
জয়গুন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করবার চেষ্টা করে।
০৯. জয়গুন ও হাসু
জয়গুন ও হাসু আজ সকাল সকালই বেরিয়ে গেছে।
মায়মুন হাঁস দুটো খাঁচা থেকে বের করে পানিতে ছেড়ে আসে।
এবার সে হাঁসের বাচ্চা দুটো বের করে ঘরের মেঝের ওপর ছেড়ে দেয়। নিজেও হাত দুটো মাটিতে রেখে উপুড় হয়ে চেয়ে থাকে। হলুদ রঙের বাচ্চা দুটো কেমন সুন্দর হাঁটে আর চিপচিপ করে। মায়মুনের আনন্দ হয়।
কাল,মায়মুন বাচ্চা দুটো নিয়ে এসেছে। সোনাচাচী বলে দিয়েছে—আমারে এক আলি আণ্ডা দিবি। আমারে না খাওয়াইলে পাতিহিয়ালে ধইর্যা লইয়া যাইব তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন স্বীকার করে এসেছে। সোনা চাচীকে প্রথম দুই দিনের ডিম সে দেবে। তাকে আগে না খাইয়ে নিজেরা ছোবেও না ডিম।
কাল বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসার পর থেকে মায়মুন এগুলোকে নিয়েই কাটিয়ে দেয়। কখনও মাটির ওপর ছেড়ে দেয়, আবার কখনো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। রাতে শুতে যাওয়ার সময়ও সে বাচ্চা দুটো কাছ ছাড়া করতে চায় না।
জয়গুন ধমক দিয়ে বলে—সুখে থাকতে ভূতে কিলায়? খাঁচার নিচে রাইখ্যা আয় জলদি। না’ লে চুল ছিঁড়া ফ্যালাইমু ট্রাইন্যা।
মায়ের ধমকের কাছে মায়মুন এতটুকু হয়ে যায়।
বাচ্চাদুটো খাঁচার নিচে রেখেই সে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত সজাগ থেকে সে শুনতে পায় বাচ্চা দুটোর ডাক। মাঝে মাঝে চিপচিপ করে ওঠে ওগুলো। শিশুর কান্নায় অসহায় মায়ের মত অবস্থা হয় মায়মুনের।
মা চলে যাওয়ার পর মায়মুনের পূর্ণ স্বাধীনতা। এবার তাকে বলবার কেউ নেই। বাচ্চা দুটোকে খাঁচার মধ্যে রেখে সে উঠানের দক্ষিণ পাশে লাউ মাচার নিচে একটা জায়গা বেছে নেয়। কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ে চৌকা একটা গর্ত করে। পানি ঢেলে সেটাকে ভরে। তারপর বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দেয় তার মধ্যে।
হাঁসের বাচ্চা দুটোর নতুন অভিজ্ঞতা। জন্মাবার পর এই প্রথম তারা পানির পরশ পায়। সেজন্যে পানিতে ছেড়ে দিতেই ভয় পেয়ে ওপরে উঠে আসে। মায়মুন ভাবে—দু’দিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বড় হাঁসের মতই সঁতরাবে তখন।
মায়মুন গতটার চারদিকে কতগুলো লম্বা পাটখড়ি পুঁতে দেয়। এমনি ভাবে লাউ মাচার। সমান উঁচু করে সে একটা বেড়া বানিয়ে ফেলে। চিল বা বাজ ছো মেরে নিয়ে যেতে না পারে, সে জন্যে এ সতর্কতা।
মায়মুন বাড়ীর চারপাশ ঘুরে ছোট বড় নানা রকমের শামুক কুড়িয়ে আনে। দা দিয়ে সেগুলোর খোসা ছাড়ায়। তারপর কুচি কুচি করে কাটতে কাটতে গান গায়–
শামুক খাজারে, আমার বাড়ী আয়,
কুচি কুচি শামুক দিমু হলদি দিমু গায়,
ওরে শামুক খাজারে।
তোর বাড়ী অনেক দূরে, সাত পাক ঘুইরে ঘুইরে
আমার বাড়ী আয়।
শফি এসে পাশে দাঁড়ালে মায়মুনের গান বন্ধ হয়ে যায়।
শফি বলে—এগুলা দিয়া কি করবি?
মায়মুন কিছু না বলে হাঁসের বাচ্চা দুটো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
—দে আমি কাইট্যা দেই।
—উহু আমিই পারি কত কাটতে।
মায়মুন একটা পাতায় করে কুচি কুচি করে কাটা শামুক নিয়ে বাচ্চা দুটোর সামনে ধরে। বাচ্চা দুটো কয়েকবার ঠোঁট দিয়ে নেড়ে খেতে শুরু করে।
শফি বলে—বাহ খাইতে শিখছে রে! কেমন ক্যাং ক্যাৎ কইরা খায়! দ্যাখ চাইয়া।
—দেখছি।
মায়মুন বসে বসে দেখে।
শফি বলে—আমারে একটা বাচ্চা দিবি?
—ইশ!
—পয়সা দিমু আষ্ট খান।
—উহু এক ট্যাহা দিলেও না।
—ফুলঝুরি দিমু। আর চুলের কিলিপ।
মায়মুন বলে—উহু সাত রাজার ধন মাণিক্য দিলেও না।
—না দিলে চুরি কইর্যা লইয়া যাইমু তোর আঁস, কইয়া রাখলাম।
মায়মুন এবার চেঁচিয়ে ওঠে—মামানি, ও মামানি, দ্যাখ তোমার পোলা কেমুন লাগাইছে। তারপর হাঁসের বাচ্চা রাখবার গর্ত থেকে পানি ছিঁটিয়ে দেয় শফির চোখেমুখে।
শফির মা-ও শফিকে ডাক দেয়—অ্যাঁরে শফি, কি শুরু করলি? আমি আইলে ঠ্যাঙ ভাঙুম কিন্তু।
-না মা, ফাঁকিজুকি দিলাম আমি।
কলাগাছের ভেলায় চড়ে শফি ও মায়মুন মোড়লদের ছাড়া ভিটয় যায় লাকড়ি কুড়াতে। শফি জঙ্গলের ভেতর দিকে নিয়ে যায় মায়মুনকে। শফি গাছে উঠে শুকনো ডাল ভেঙে নিচে ফেলে। মায়মুন কুড়িয়ে জড়ো করে এক জায়গায়।
শফি গাছে চড়তে বেশ ওস্তাদ। এক গাছের ডাল বেয়ে সে আর এক গাছে চলে চায়। মায়মুন বলে—আর ওই মুহি যাইও না শফি ভাই, ওই গাবগাছে—
—কি ঐ গাবগাছে?
—আলেক মোড়লের বউ গলায় দড়ি দিছিল ঐ গাবগাছে, তুমি বুঝিন জান না?
—হেতে কি অইছে?
—উঁহু, আমার ডর করে। তুমি নাইম্যা আহ হবিরে। শফি গাছ থেকে নেমে বলে—মায়মুন চাইয়া দ্যাখ দেহি, ঐ দিক ঐ গাবগাছে কালা একটা কি দ্যাহা যায়।
মায়মুন ঐ দিকে না চেয়েই ওগো মাগো বলে শফিকে জড়িয়ে ধরে। শফি জোরে হেসে ওঠে। বলে—আরে কিছু না, ফাঁটকি একদম ফাঁটকি। দিনে-দুপরে কিয়ের ডর? চাইয়া দ্যাখ। দ্যাখ না ছেড়ি। কিছুই না, চউখ মেল এইবার।
মায়মুন তবু চোখ খোলে না।
শফি ওকে কোলে তুলে ভেলার কাছে নামিয়ে দেয়। মায়মুন এতক্ষণে চোখ মেলে। সে বলে তুমি কি ফাজিল। খামাখা ডর দেহাইলা।
শফি হাসে হিঁ-হিঁ করে।
মায়মুন বলে—তুমি গিয়া লাকড়ি লইয়া আহ। আমি আর যাইতে পারতাম না।
শফি বাগানে যায়। শুকনো ডালগুলো একটা লতা দিয়ে বেঁধে মাথায় করে নিয়ে আসে। তারপর বাড়ী এসে দুটো ভাগ করে। নিজের ভাগের থেকে কয়েকটা ডাল মায়মুনকে দিয়ে। বলে—তোরা মানুষ বেশী। এই কয়ডা বেশী নে তোরা।
বিকেল বেলায় মায়মুন তেঁতুল তলায় বড়শী নিয়ে বসে। তার কোলের কাছে হাঁসের বাচ্চা লুটো। আবার শফি এসে জোটে সেখানে। একটা ছিল ওর বড়শীর কাছে ছুঁড়ে শফি তেঁতুল গাছের আবডালে পালায়।
মায়মুন কিছু দেখতে না পেয়ে দাঁড়াতেই হেসে ওঠে শফি— হিঁ-হিঁ-হিঁ!
মায়মুন বলে—তুমি বড় শয়তান। চাইঙ্গা মারলা ক্যান?
-কই চাইঙ্গা! মাছে ডাফ দিল ছেঁড়ি। জবর মাছ অইবরে! বোয়াল মাছ।
মায়মুন মাথা নেড়ে বলে—হুঁ, বোয়াল মাছ।
—হ রে হ। কি মাছ পাইছস?
—কিচ্ছুই না। একটা তিঁত পুডিও না।
—কিছুই না?
–উঁহু।
শফি আশ্চর্য হয়। তারপর গম্ভীরভাবে বলে—তোর বড়শীতে কার জানি মোখ লাগছে রে! কেও নষ্ট না করলে এমুন অয়? আমার মনে অয়, কেও ডিঙ্গাইয়া গেছে তোর ছিপ। হেই-এর লাইগ্যা মাছ ওঠতে আছে না।
মায়মন শফির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
শফি বলে—পোড়াইয়া নে আগুনে। ঠিক অইয়া যাইব।
শফি ও মায়মুন মাটির হাতায় আগুন নিয়ে বড়শীটা পোড়া দেয়।
তারপর একসঙ্গে সুর করে বলে—
বড়শী পুড়ি, বড়শী পুড়ি,
ট্যারা পড়শীর মোখ পুড়ি,
মাছ ধরমু দুই কুড়ি।।
লোয়ার বড়শী সুতার ডোর
পুঁডি পাবদা, শিং মাগুর।।
বড়শী আমার প্যাদা
ধইরা আনব ভ্যাদা–
ভ্যাদা মাছে ক্যাদা খায়,
পুডি মাছে পান চাবায়।
অ-হো-হো হি-হি-হি-হি!
শফি ও মায়মুন দুজনে হেসে লুটোপুটি। শফি মাটি খুঁড়ে কেঁচো তুলে দেয়। মাছ কেঁচোর টোপ খায় ভাল।
মায়মুন আবার বড়শী নিয়ে বসে।
সন্ধ্যার পর সে শফির মা’র ঘরে যায়।
শফির মা বলে—আমার পানডা ছেইচ্যা দে তো, ময়ম। তুই ভালা ছেঁচতে পারস। শফি পারে না। ও দিলে কোনদিন খর বেশী অয়, আবার কোনদিন চুনা বেশী পড়ে।
প্রশংসায় মায়মুন খুশী হয়। কলাপাতায় জড়ানো পান খুলতে খুলতে মায়মুন বলে—কতটুকু নিমুগো, মামানি?
—আধ খান নে। তয় অডুকে গাল ভরে না। গাল না ভরলে কি পান খাইয়া সুখ আছে? কিন্তু কি করমু আর। গাছের পাতা, হেই-এর যে দাম! হোনলে মাথা ঘোরে। দুইডা পান
একটা পয়সা। আগে এক পয়সায় এক বিড়া পাওয়া যাইত।
মায়মুন ঠনর ঠনর করে পান ছেচতে আরম্ভ করে।
শফির মা আবার বলে—আইজকাইল বেবাক জিনিসই আক্রা। আগে এক টাকায় আধামণ চাউল মিলত। আমার বয়সেই দেখছি। আর অহন বেবাক জিনিসের উপর তন খোদার রহমত উইট্টা গেছে। আগে এক টাকার বাজার কিনলে এক মরদের এক পোঝা অইত আর অহন এক টাকার বাজার আতের তালুতে লইয়া বোম্বাই শহর যাওয়ন যায়।
শফির মা বলেই চলে—তোর মামু একটা ইলশা মাছ আনছিল দুই পয়সা দিয়া কিন্যা। তহন শফি অয় নাই। মফি আমার পেড়ে। এই এত বড় মাছটা। হেইডার একজোড়া আণ্ডা যা অইছিল—এই এক বিঘৎ লমফা। তখন আমার বুক জুইড়্যা ওর ভাই বইনে চাইর জন। কত খুশী অইছিল হেই আণ্ডা দেইখ্যা!
শফির মা আর পুরাতন স্মৃতি ঘাটতে সাহস পায় না। সে সব সময় ভুলে থাকতেই চেষ্টা করে। কিন্তু কথায় কথায় বা একা বসে থাকলে যখন সে স্মৃতি এসেই পড়ে, তখন সে আর সহ্য করতে পারে না। বিনিয়ে বিনিয়ে বিলাপ করতে শুরু করে। তার এই পঞ্চাশ বছর বয়সে সে নয় সন্তানের জননী। কিন্তু একমাত্র শফিই বেঁচে আছে—বাকী আটটির চারটি আঁতুড়েই শেষ হয়। এটি কলেরায় আর একটি বসন্তে মারা যায়। আর একটি—তার নাম মফি, শফির দুই বছরের বড় ছিল—দুর্ভিক্ষের বছর সে কোথায় হারিয়ে গেল! শফির মা আজও এ ছেলেটির আশা ছাড়ে নি। তার ধারণা মফি এখনও বেঁচে আছে।
মাঝে মাঝে শফির মা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলে—আমার ওরা বাঁইচ্যা থাকলে এই দশা আমার? আইজ আমি খরাত কইর্যা খাই! ওরা বাঁইচ্যা থাকলে আমার বাদশাই কপাল আছিল। ওরা কামাই করত। ও বউ আইত ঘরে। ওরা রাইন্দা-বাইড়া সামনে ধরত। সোনার খাটে বইস্যা, রূপার খাটে পাও রাইখ্যা আমি সব দ্যাখতাম আর হুকুম করতাম। নাতি-নাতকুড় ঘিরা বইত চাইর পাশে। ক্যাচম্যাচ করত কিচ্ছা হোননের লেইগ্যা।
শফির মা-র চোখ দিয়ে দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ে। মায়মুন দেখে আশ্চর্য হয় না। কারণ, এ আজ নতুন নয়। কখন সে কাঁদবে আর কখন কাঁদবে না—কেউ বলতে পারে। না। মায়মুন ছেচনীর থেকে ছেচা পান তুলে ধরে। শফির মা মুখে দেয়।
মায়মুন এবার বলে—একখান কিচ্ছা কও না, মামানি?
—না লো। আইজ আর পরাণড় ভালা ঠেকে না।
মায়মুন আর অনুরোধ করে না। শফির মা বলে—তুই একটু দেইখ্যা আয় তো শফি কি দিয়া কি রানদে। কয়ডা কলমীর শাক রানব আর ভাত। কাইল ভাত ফুটছিল কম। চাউল চাউল ভাত গিল্যা গিল্যা খাইছি। দাঁতদন্ত না থাকা আর এক জ্বালা।
মায়মুন রান্না ঘরে যায়। চুলোর ওপর বসানো ভাতের হাঁড়ি থেকে কয়েকটা ভাত। তুলতে তুলতে শফিকে বলে—একটা শোলক ভাঙ্গাও দেহি শফি ভাই–
মাছ করে ঝক ঝক ছোট্ট এক ঝিলে
একটা মাছে টিপ দিলে বেবাকগুলা মিলে।
ইশ, জবর শোলক ত। এইডা শিখা রাখছি কুট্টিকালে—ঝিল অইল আঁড়ি আর মাছ অইল ভাত! কেমুন? অইছে? এই বার একটা মাছে টিপ দিয়া দ্যাখ দেখি ফোটলনি?
মায়মুন একটা ভাতে টিপ দিয়ে বলে—অইয়্যা গেছে। দ্যাখত কেমুন মজা! একটা ভাতে টিপ দিলে বুঝা যায় ফোটলনি না ফোটল না।
—আর একটু ফোটতে দে। মা আবার শক্ত ভাত খাইতে পারে না।
—কাইল তুমি শক্ত শক্ত চাউল চাউল ভাত রানছিলা, মামানি কইছে। ভাত রানতেও জান না?
—আমি জানি না, কে জানে রে? টিক্কাদার সাবের বাসায় এতকাল পাক করলাম আমি। আইজ তুই আমারে হিগাইতে আইছস?
রান্না সেরে শফি ও মায়মুন ঘরে এলে শফির মা বলে—তোর মা অহনো আইল না, ময়মন? রাইত যে অনেক অইল!
বাইরে চ্যাবর চার পায়ের শব্দ শোনা যায়। উঠানে কাদার মধ্যে দিয়ে কে যেন আসছে।
শফির মা ডাকে—হাসুর মা?
—হ ভাজ, আমি অই।
—আহো আমার ঘরে।
জয়গুন এসে দরজায় দাঁড়ায়। শফির মা বলে—তোর হায়াত আছে। অনেক দিন বাছবি তুই। এই এটটু আগেই তোর নাম নিছিলাম।
—অহন যাই বইন। আখা ধরাইতে অইব আবার।
-আইচ্ছা যাও। আখা ধরাইয়া এটটু এদিকে আইও, তোমার লগে কতা আছে।
—কি কতা?
—পরে কইমু। অহন যাও চাউল কি দর আনলাগে?
—দুই সের, বইন। দর চইড়া গেছে। আর যা মছিবত আইজ কাইল। টারেনে যা মানুষের ভিড়। জেরের এই দুই কিস্তি ধইর্যাই এই রহম। আগে এমন ভিড় আছিল না।
জয়গুন পাক চড়িয়ে শফির মার ঘরে আসে। শফির মা বলে—কয়দিন ধইরা একটা কথা কইমু কইমু করতে আছি। কিন্তু সময় মত এটটু একখানে বইতে পারি না। তুমি থাকলে আমি থাকি না, আমি থাকলে আবার তোমার দাহাই মিলে না।
—কি কতা?
—কই, সবর কর। পান খাইলে একটু খা, ঐ দ্যাখ তোর পিছে পাতার মধ্যে।
জয়গুন পান খেতে খেতে বলে–কি কতা এই বার কও দেখি ভাজ।
—রাখ না, কই। আমার এই কাপড়ভা একটু তালি দিয়া দিবি। আমি আবার সুঁইয়ে সূতা গাঁথতে পারি না। ছাই, চউখটা এক্কেবারে গেছে।
—আইচ্ছা।
—ছিঁড়া কাপড় পিন্দা বাইরে যাইতে লজ্জা করে। তুই একটু সিলাইয়া দিলে তবু বেড় দিয়া পিনতে পারমু। তোর আতে সিলাইডা অয় ভালা।
–শফিরে দিয়া পাড়াইয়া দিও। এই এর লাইগ্যা বোলাইছিলা? জয়গুন উঠতে উদ্যত হয়।
—না, আরো কত আছে, ব’।
-কও কি কতা।
–ফকিরের লগে তোর দেহা অয় না, আঁ? তোরা ত কত দূরে দূরে যাস। একদিনও চউখে পড়ে না?
–উঁহু।
—দ্যাখ দেখি কেমুন বে-য়াক্কেইল্যা! কতদিন গুজারিয়া গেল, বাড়ীর পাহারা আর বদলাইয়া দিয়া গেল না। আমার ত রাইতে ঘুমই আহে না ডরে। তুইও আমল দিবি না।
—উহুঁ, পাহারা বদলাইতে অইব না আর। পাহারা না ছাই। ফুক্কা দিয়া টাকা নেওনের ছল—চক্কর।
—ছল-চক্কর! তুই যে কী কস্! আইচ্ছা সূর্যু-দীগল বাড়ীতে থাকতে তোর কি পরাণে ডর-ভয় লাগে না?
জয়গুন আবার উঠতে উদ্যত হয়।
শফির মা বাধা দেয়—ব’। আদত কথা তো অহনো কই নাই।
—কী আদত কতা, কও।
—তোরে আগেও কয়বার আমি কইছিলাম। তুই আমার কতা ঠেইল্যা দিলি।
—ঠেলমু না কি করুম?
—এইডা কি ঠেলুনের মত কতা!
–তয় কি?
—তোর ভাই বাইচ্ছা থাকলে তার কতা ঠেলতে পারতি? ধইরা বাইন্ধা কবে তোর নিকা দিয়া দিত।
—তুমি মোখ বোজ দেহি। তোমার ঐ এক বুলি আমার আর কানে সয় না।
—হেইয়া সইব ক্যাঁ? আমি তোর ভালার লেইগ্যা কই কি না। বয়স ত অহনো তিরিশ অয় নাই। অহনো গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা-কাচ্চা পেড়ে ধরনের বয়স আছে।
জয়গুন শ্রান্ত। সে মুখ নিচু করে বসে থাকে।
শফির মা বলে—দু পরধান মানুষ ভালা। তার পাঁচটা বলদ, তিনডা গাই। দশ মরাই ধান পায় বচ্ছর। জাগা-জমিনের ইসাব-কিতাব নাই। কাম আছে মানি। তয় আমি কই, যেইখানে কাম আছে হেইখানে ভাতও আছে। আর তোর ত একলা কাম করতে অইব না। আগের তিন জননা আছে পরধানের। চাইড্যা পোলার বৌ আছে। এক্কেরে সোনার বাগিচা হাজাইয়া রাখছে। ওরাই বেবাক কাম করব! তুই হুকুম দিয়া খাডাবি।
জয়গুনের মুখ ছাই-এর মত ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সে কিছু বলতে পারে না।
শফির মা আবার বলে—পরধান কাইলও আমারে ধরছিল। আমি কইলাম, পোলা আর মাইয়াড়ার লেইগ্যাই যত মুস্কিল। হে কইল, তা পোলা আর মাইয়াডারে আমার বাড়ীতে লইয়া আইলেই ত অয়। কত মানুষ খাইয়া বাচে আমারডা। দুইডায় আর কি অইব! এইবার বিবেচনা কইরা তুই মোখ ফুইটা একটু হুঁ করলেই অইয়া যায়। সুখে থাকবি, কইয়া দিলাম।
খড়ের আগুনের মত দপ করে জ্বলে ওঠে জয়গুন—হুঁহ, আমারে তাড়াইতে পারলে লুইট্যা-লাপইট্যা ফলার কইর্যা খাইতে পারবা। তা মনেও জাগা দিও না, কইয়া দিলাম।
—তোবা! তোবা! তোর চীজ ছুঁইলে যেন আত খইয়া পড়ে, তোগ গাছের একটা পাতা ছিঁড়লে যেন রাইত না পোয়ায় আমাগ।
জয়গুন যেমন জ্বলে উঠেছিল, শফির মা-র কথায় আবার নিবে যায়। সে তার স্বাভাবিক কণ্ঠে এবার বলে—না বইন, বিয়া ত দুই খানেই অইল। অনেক দ্যাখলাম, অনেক শিখলাম, আর না। পোলা মাইয়ার মোখ চাইয়া আর পারুম না, মাপ করো। পোলা আর মাইয়াডার বিয়া দেইখ্যা যেন চউখ বুজতে পারি, দোয়া কইরো।
শফির মা নিরাশ হয়ে বলে—তোর ময়মনের বিয়া দে এইবার। একটা সম্বন্ধ আছে আতে।
—না, এত শিগগির কি অইল! যাউক আর দুই বচ্ছর।
—না, না। মাইয়া তোর বিয়ার লায়েক অইছে। আর ঘরে রাখন ঠিক না।
জয়গুন একটু চিন্তা করে বলে—কোথায় সম্বন্ধ আছে?
—সদাগর খাঁরে তুই ত চিনসই। তার নাতি-সোলেমানের ব্যাডা, নামড়া যেন কি! ভুইল্যা গেলাম বুঝিন, অহো মনে পড়ছে, ওসমান। ওসমান।
-ওঃ, ওসমান। ওসমান ত বিয়া করছে!
করছিল। বউ মইরা গেছে চৈত মাসে ভেদের ব্যারামে।
—কিন্তু পোলার বয়স যে অনেকখানি।
—তোর মাইয়াড়ার বয়সই কম কি।
—কম না? আমার মাইয়ার বয়স মোড়ে দশ, ধরতে গেলে দুধের মাইয়া আমার।
—দুধের মাইয়া! কি যে কস তোরা ছাই-মুণ্ডু। মাইয়ারা এই বয়সে বাচ্চা বিয়ায়। আমার মা-র এগারো বছরের কালে আমার জর্ম অয়।
শফির মার সাথে কথায় পেরে ওঠে না জয়গুন। সে বলে—আইচ্ছা ভাইব্যা চিন্তা দেহি। পরে কইমু। নছিবে যদি ঐখানে ভাত লেইখ্যা থাকে, তয় অইব। কার কোনখানে দানাপানি লেহা আছে, খোদা জানে। অহন যাই। ওদিকে আবার ভাতের আঁড়ি না ভাইঙ্গা চালায়।
বাইরে নামতেই চোখে পড়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সে চারদিকে চেয়ে বলে—উত্তরে আর পুবে যে মেঘা করছে, ভাজ! আইজ বুঝিন আসমান শুদ্ধ ভাইঙ্গা পড়ব। আইজ আর উপায় নাই। এই বষাকালডা ভিজতে ভিজতে গেল। তোমার ঘরের চাল ত ভালা আছে। আমার চালে ছনই নাই।
—আমার চালে আর কই আছে? হেই কবে, গেল বচ্ছরের আগে ঠিক করছিলাম। তব বিষ্টি পড়ে ছয় সাত জায়গায়।
—কি করমু আর! কপালে আছে ভিজতে অইব, ভিজমুই। পাচটা ট্যাকাও একখানে করতে পারলাম না। ঘরের চাল ছাওয়াই কি দিয়া। উদর লইয়া আর পারলাম না। উদরেই যায় বেবাক টাকা।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। জয়গুন ধরে যায়। মায়মুন রান্না শেষ করেছে।
—চালাক কইর্যা ভাত খা তোরা। আসমানের দিগে চাইছিলি? কাউয়ার আণ্ডার মতন কালা অইছে আসমান। আইজ আবার ঘরের মধ্যে সোত ছুটব। খাইয়া লইয়া উত্তরমুখি বিছানা সরা।
অসংখ্য ছিদ্রপথে বৃষ্টির পানি ঝরতে থাকে ঘরের ভেতরে। তা ছাড়া দক্ষিণে বাতাসের জন্য বৃষ্টির ঝাপটা দক্ষিণ দিকটায় লাগে বেশী। তাড়াতাড়ি খেয়ে তারা বিছানা সরায় উত্তর দিকে।
জয়গুন বলে—একটা কাঁথাও পাইড়্যা নেগ্যা। তারপর কুঁকড়ি মুকড়ি অইয়া শুইয়া থাক ভাই-বইনে।
বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে জোরে। সত্যি সত্যি আকাশটাই ভেঙে পড়ছে যেন। এশার নামাজ পড়ে ছেলেমেয়ের শিয়রের কাছে তসবী হাতে বসে জয়গুন। সে তসবীর দানা গুণছে কি সময় গুণছে বোঝা যায় না। অনেকক্ষণ পরে বৃষ্টির বেগ কমে। কিন্তু বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয় না একেবারে। এখন যে রকম অলস বর্ষণ শুরু হয়েছে, তাতে সারা রাতেও বৃষ্টি থামবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। জয়গুন কাঁথার ওপর হাত দিয়ে দেখে, কথাটা ভিজে গেছে। সে এক পাশে শুয়ে পড়ে।
হাসু হঠাৎ জেগে উঠে বলে—পায়ের কাছটা একদম ভিজ্যা গেছে, মা।
—তুই অহনো ঘুমাস নাই?
–উহুঁ।
–আত-পা কাঁকড়ার মত গুডিসুডি মাইরা পইড়া থাক।
১০. সূর্যের মুখ দেখা যায় না
এমন দিন পড়েছে, এক মুহূর্তের জন্যেও সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সারাদিন টিপিরটিপির বৃষ্টি পড়ে। হাসু ঘরের বার হয় না। শরীরটাও ভালো নেই। শরীরের সমস্ত গিঁঠে গিঁঠে বিশেষ করে ঘাড়ে টনটনে ব্যথা হয়েছে।
হাসু মা-কে বলে—গর্দানডায় বেদনা করেগো, মা। শীত শীত লাগে।
হাসুর গায়ে হাত দিয়ে জয়গুন শঙ্কিত হয়। ছেলেটা জ্বরে পড়লে উপায় নেই আর। বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে ছেলেটাকে যে ভাবে সে কাজে পাঠায় তাতে এই ছোট শরীরটার ওপর জুলুমই করা হয়। কচি ঘাড়টার ওপরেই জুলুমটা হয় বেশী। অথচ এই ঘাড়টা তাদের জীবন-মরণের কল-কাঠি। তিনটি প্রাণীর জীবনের বোঝা মাথায় নিয়ে হাসুর এই কাঁচা ঘাড়টা মাঝে মাঝে ব্যথাকাতর হয়ে পড়ে।
জয়গুন নিষেধ করে থাউক, আইজ আর কামে যাওন লাগব না। কথা গায়ে দিয়া হুইয়া থাক। তোরে পইপই কইর্যা নিযুধ করি ভারী পোঝা মাতায় নিস না। তা হুনবি না।
বেশী লোভ করার জন্য মাঝে মাঝে নিজেকে ধিক্কার দেয় জয়গুন। তের বছরের এতটুকু ছেলে কামাই করে খাওয়ায় এই ত বেশি।
রোজগার করে সব পয়সা তার হাতে এনে দেয়। একটা পয়সাও এদিক-ওদিক করে না। এমন কি এক পয়সার চিনেবাদাম খেলেও তার হিসেব দেয় তার কাছে।
জয়গুন সর্ষের তেলের শিশি থেকে একটু তেল নিয়ে হাসুর ঘাড়ে মালিশ করতে করতে বলে—পায়ে তুঁইত্যার পানি দিছিলি কাইল?
–উহুঁ।
—হেইয়া দিবি ক্যান। দেহি কেমুন অইছে?
জয়গুন পায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে বলে— দ্যাখ, ক্যাদায় চামড়া খাইয়া ঝাঁজরা কইরা দিছে।
একটা নারকেলের মালায় তুঁতে গোলা নিয়ে আসে জয়গুন। হাঁসের পালক ভিজিয়ে হাসুর পায়ের তলায়, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে এঁতের পানির পো দেয়।
হাস উ-হু-হুঁ করে ওঠে। বলে—আর দিও না, মা। বড় পোড়ায়।
—না দিলে চামড়া পইচা যাইব এক্কেরে। আঁটতে পারবি না। রাস্তা-ঘাটে যেই ক্যাদা।
জয়গুন নিজের পায়েও পুঁতে গোলা দিয়ে প্রলেপ লাগায়। মায়মুনের পায়েও লাগিয়ে দেয়। বাড়ীর উঠানে পর্যন্ত কাদা হয়েছে। পায়ের পাতা অবধি ডুবে যায় কাদায়। তুঁতের প্রলেপ দিলে পায়ের তলা অত হেজে যেতে পারে না।
পরের দিন চমৎকার রোদ ওঠে। জয়গুন হাসুর কপালে ও বুকে হাত দিয়ে দেখে। তার মুখের ওপর থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যায়। প্রভাতী রোদের মত তার মুখ আনন্দে চিকচিক করে। হাসুকে ডেকে সে বলে—ওঠ, দ্যাখ আইজ কেমুন রউদ ওঠছে!
হাসু উঠে বসে।
জয়গুন বলে—আমার ত ডরেই ধরছিলো। কাইল যেই রহম গরম আছিল শরীল। জ্বর ওডে নাই কপালের ভাগ্যি। কেমুন লাগছে রে শরীল?
—ভালা। আইজ কামে যাইমু, মা?
—আত-মুখ ধুইয়া আয়। খাইয়া তারপর চল যাই। আমিও যাইমু। চাউল ফুরাইছে। আহজ চাউল না আনলে ওই বেলা চুলা জ্বলব না।
হাসু, হাসুর মা কাজে বের হয়। হাসুর মা বার বার হাসুকে নিষেধ করে দেয়, খবরদার, ভারী পোঝা মাতায় নিবি না কিন্তুক। গর্দান ভাইগা যাইব।
কিন্তু হাসু দু’দিনের কাজ একদিনে করার সঙ্কল্প নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়েছে। কাল কাজ হয়নি। আজ বেশী কাজ করে অন্তত কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া তার চাই-ই।
হাসু নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে আসে।
আজকাল যাত্রীর সংখ্যা খুবই বেড়েছে। বাইরের থেকে যেমন বহুলোক আসছে, আবার বাইরেও যাচ্ছে তেমনি। বিশ্রামঘরে গাদাগাদি হয়ে আছে লোক। জাহাজে গাড়ীতে জায়গা হয় না। অনেক যাত্রীকেই দু-তিন দিন স্টেশনে পড়ে থাকতে হয়। ছেলেমেয়ে মা-বউ নিয়ে আবার অনেক বিদেশী আশ্রয় নিয়েছে স্টেশনের চালা ঘরে।
হাসু মোটের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘোরে আর এদের দিকে চায়। তার অদ্ভুত লাগে এদের পোশাক। এদের কথাও বোঝা যায় না—হাসু কাছে দাঁড়িয়ে শুনেছে! এক জায়গায় একটি স্ত্রীলোক রুটি সেঁকতে শুরু করেছে। দুটি ছেলেমেয়ের লোলুপ দৃষ্টি তার ওপর। রেল লাইনের পাশেও এক জায়গায় সে এরকম আরো অনেক লোক দেখেছে আজ। হাসুর মনে পড়ে দুর্ভিক্ষের বছরের কথা। এরকম ভাবে মায়ের সাথে সাথে গাছ তলায় কত রাত কেটেছে। বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় নিতে গিয়ে কত লোকের তাড়া খেয়েছে। হাসু অনুমান করে, নিশ্চয় ওদের দেশে আকাল এসেছে।
যাত্রীর সংখ্যা বাড়লেও হাসু সুবিধা করতে পারে না। নম্বরী কুলিদের জন্যে মোট ধরবার যো নেই। যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় বরং অসুবিধা হয়েছে। ভিড়ের জন্যে ঘাটে জাহাজ। ধরবার আগেই জেটির গেট বন্ধ হয়ে যায়। নশ্বরী কুলি ছাড়া অন্য কুলিরা ঢুকতে পারে। না। সে পানি সাঁতরে স্টীমারে ওঠে। কিন্তু নম্বরী কুলিরা দেখতে পেলে মাথার ওপর গাট্টা মারে। হাসু এই কুলিদের খুবই ভয় করে।
ট্রেন ও স্টীমারের সময় হাসুর মুখস্থ হয়ে গেছে। একটা ট্রেন আসবে দশটায়। দশটা বাজবার এখনো দেরী। হাস রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে যায়। এগারোটার জাহাজে যারা যাবার তারা সাধারণত এখানেই নামে রিক্সা থেকে।
এক ভদ্রলোকের মালপত্র নিয়ে দু’জন নশ্বরী কুলির মধ্যে বচসা শুরু হয়েছে। হাসু দুরে দাঁড়িয়ে দেখে।
একটা কুলি বলেছোড়দে। আপনি কিসকো লিবেন, বাবুজি?
আর একটা রিক্সা এসে থামে। চড়নদার ভদ্রলোকের সাথে ছোট একটা স্যুটকেস ও বিছানা। বোঝাটা বেশী ভারী হবে না। হাসুর মাথার পক্ষে উপযুক্ত বোঝাই। হাসু এগিয়ে যায়। সুটকেস ধরে জিজ্ঞাসা করে—কলি লাগব নি, বাবু?
ঝগড়ায় রত কুলিদের একজন তার প্রতিদ্বন্দ্বী কুলিকে বোঝাটা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে আসে। হাসুকে হাত দিয়ে সরিয়ে বলে—ভাগ ব্যাটা।
হাসু নিঃশব্দে সরে যায়। একটা লাইটপোস্টে পিঠ ঠেকিয়ে সে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে। রিক্সায় কোন যাত্রী এলে সে আগেই আন্দাজ করে, ঘাডে কুলাবে কিনা। তার উপযোগী মোট না হলে সে এক পা নড়ে না, লাইট পোস্টের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে সে দাঁড়িয়েই থাকে। অনেকক্ষণ পরে যদি বা মোট পাওয়া যায়, তাও নম্বরী কুলিদের ফাঁকি দিয়ে লওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।
দুরে হুইসিল শোনা যায়। একটা ট্রেন আসছে। হাসু স্টেশনে ঢোকে। ট্রেনেই যা কিছু সুবিধা করা যায়। এখানে নশ্বরী কুলিদের ফাঁকি দেওয়া যায়। পেছনের দিকের গাড়ীগুলোর থেকে মোট নিয়ে সরে পড়লে তারা দেখতে পায় না। কিন্তু এখান থেকে মোট বয়ে রিক্সায় তুলে মোট পিছু দু’আনার বেশী পাওয়া যায় না। পথ কম বলে দু’আনার বেশী আশাও করা যায় না। জাহাজের মোটে পয়সা বেশী। মোট পিছ চার আনা। এখানকার দুই মোটের সমান। কিন্তু খাটুনিও ডবল।
ট্রেন থামতেই হাসু চটপট উঠে পড়ে পেছনের একটা গাড়ীতে। একটা মোট দু’আনায় ঠিক করে। যাদের মালপত্র কম তারা এ রকম ছোট কুলিই খোঁজে। এদের দু’আনা দিলেই খুশী হয়। বড় কুলিরা চার আনার কমে রাজী হয় না।
হাসু গাড়ী থেকে নেমে দেখ-না-দেখ সরে পড়ে।
বারোটার মেল ও একটার স্পেশাল জাহাজ ধরে হাসু রোদে এসে দাঁড়ায়। তার সমান আকারের আরো পাচ-ছ’টি কুলিও গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে আসে। ওভারব্রিজের রেলিং-এ সকলে সারি সারি গামছা রোদে দেয়।
গামছা পরে সাঁতার দিয়ে স্টীমারে উঠতে হয় তাদের। নশ্বরী কুলি ছাড়া জেটির দরজা দিয়ে অন্য কুলিরা ঢুকবার সুযোগ পায় না। তারা সাঁতার দিয়েই অনেক সময় স্টীমারে ওঠে।
হাসু ও অন্যান্য খুদে কুলিরা বসে বসে গল্প করে। একজন একটা বিড়ি ধরায়, কয়েকজন তার দিকে হাত বাড়িয়ে চেয়ে থাকে, কে কার আগে নিয়ে টানবে। একজন বলে—শীত লাগছেরে। দে দেহি বিড়িডা, একটা টান দিয়া লই।
আর একজন বলে-ওয়াক থু ওর মুখের বিড়ি টানিস না। ছি! ও মেথরের পোলা।
—মেথর বুঝি মানুষ না? রমজান বলে।—পয়সা পাইলে মেথর-গিরিও করতে পারি চাই পয়সা। রমজান হাতে তুড়ি দিয়ে দেখায়।
জনপ্রতি দুটো করে টান দেয়ার পর ফেলে দেয়া হয়েছিল বিড়িটা। যে ছেলেটা মেথর বলে থুক ফেলেছিল, সে এবার বিড়িটা তুলে টানতে আরম্ভ করে।
একটা ছেলে গলা ছেড়ে সিনেমার গানে টান দেয়–মালতী লতা দোলে—
রমজান হাসুকে ডাকে—ও দোস্ত খুব ভালা একটা সিনেমা আইছে। যাইবেন নি আইজ?
হাসু বলেনা দোস্ত মা রাগ করব।
—চলেন না আইজ। তিন আনার পয়সা মোডে। আমার গাঁটের পয়সায়ই না অয় দেখবেন।
–উহুঁ।
রমজান আর পীড়াপীড়ি করে না।
রমজান হাসুর বন্ধু ও খুদে কুলিদের সরদার। রমজানকে সবাই ভয় করে। তার কথামত সবাইকে চলতে হয়। তবে হাসুকে খুবই খাতির করে সে।
রমজান বলে—তরশুর তন তোরা আমার লগে এক জায়গায় কামে লাগবি।
হাসু জিজ্ঞাসা করে—কোনখানে দোস্ত?
—হোসেন দালালের নাম হোনছেন? নতুন ধনী হোসেন দালাল?
একজন বলে—হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনছি। পাডের দালালি কইর্যা বস্তাবস্তা ট্যাকা করছে ব্যাডা।
রমজান বলে–হ্যাঁ, হেই হোসেন দালাল! খানপুরে তেতলা দালান খিঁচব এইবার। হেই জায়গায় কাম আছে।
—ইট ভাঙ্গবি, ইট টানবি, পানি তুলবি। এক ট্যাকা কইর্যা রোজ।
সবাই রাজী হয়।
রমজান আবার বলে—আমারে মাথা পিছু সরদারি দিবি এক আনা কইর্যা। দ্যাখ, যদি মনে খাডে লাইগ্যা যা তোরা সবাই।
এখানে সারাদিনে দশ বারো আনার বেশী পাওয়া যায় না। কোনোদিন তার চেয়েও কম পাওয়া যায়। সুতরাং কেউ অমত করে না।
ছয়টার ট্রেন ধরে হাসু পয়সার হিসাব করে। মাত্র তেরো আনা হয়েছে। একটা টাকার কাজও হল না। কোমরে বাঁধা জালির মধ্যে পয়সাগুলো খুঁজে সে এক জায়গায় বসে। হাসুর সাথীরা সব চলে গেছে। রোজ এমন সময় সেও বাড়ীর দিকে পথ নেয়। কিন্তু আজ সাতটার স্টীমারটা দেখেই যাবে সে। মা হয়তো বসে থাকবে তার জন্যে। দেরী হলে রাগ করতে পারে। কিন্তু একটা টাকা পুরিয়ে নিলে রাগ না করে সে হয়তো খুশীই হবে।
ছড়ি হাতে এক ভদ্রলোক হাসুর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হাত থেকে সিগারেটের শেষাংশ ছুঁড়ে ফেলতেই হাসু মাটি থেকে তা কুড়িয়ে নিয়ে টানতে আরম্ভ করে। দোস্তের পাল্লায় পড়ে কয় দিন হয় সে বিড়ি টানতে শিখেছে। ঠাণ্ডার মধ্যে বিড়ি টানতে মন্দ লাগে না হাসুর।
সাড়ে সাতটার পরে স্টীমার আসতে দেখা যায়। হাসু তিন নম্বর জেটির দিকে দৌড়ায়। গেট বন্ধ হয়ে গেছে। হাসু ফিরে এসে গামছা পরে লুঙ্গিটা বেঁধে নেয় মাথায়।
স্টীমারটা ঘাটে ধরতেই সে তার দেয়। আজ একা একা তার ভয় করে। অন্য সময় ছয় সাত জন মিলে নদীর পানি তোলপাড় করতে করতে তারা জাহাজে ওঠে।
যে ফ্লাটের গায়ে স্টীমারটা ধরেছে তার একটা কাছি বেয়ে বেয়ে সে আগে ফ্লাটের ওপর ওঠে। লুঙ্গি পরে গামছার পানি নিঙরে সে শরীরটা মুছে নেয়। তারপর ফ্লাটের কিনারার সরু পথ ধরে ধরে স্টীমারে উঠবার সিঁড়িতে যায়। ভিড় গলিয়ে এবং নম্বরী কুলিদের চোখ এড়িয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে।
এক মোটা ভদ্রলোক কুলির সাথে দরাদরি করছেন—চার আনায় যাবে? অল্প মাল আমার, সব শুদ্ধ দশ সেরও হবে না।
—ছয় আনা রেট আছে সাব। কমে অইব না।
—না, যাও। চার আনার বেশী দেব না আমি। কুলিটা চলে যেতেই হাসু এগোয়—কুলি লাগব নি, বাবু।
লাগবে ত। কত নিবি? —আপনে খুশী অইয়া যা দ্যান।
—তবে মাথায় নে। চল জলদি।
মোট মাথায় নিয়ে হাসু অনুমান করে—কোথায় দশ সের? স্যুটকেসটার ওজনই বিশ সেরের কাছাকাছি হবে। যেন সীসা ভরা আছে স্যুটকেসটায়। তার ওপর বিছানা। হাসুর মাথায় ভারী লাগে বোঝাটা। ভদ্রলোক এবার ওপর থেকে খবরের কাগজ ও একটা হাতব্যাগ নিয়ে হাসুর হাতে চাপিয়ে দেন।
জেটি পার হবার সময় একজন ডাকেন—আরে রশীদ, তোর জন্যে সাড়ে ছ’টা থেকে অপেক্ষা করছি। তোর বাড়ীতে খবর নিয়ে জানলাম তুই আজ আসছিস।
দু’জনের করমর্দন ও কুশলবার্তার পরে আলম সাহেব বলেন—তোর জন্যে অপেক্ষা করছি কেন জানিস?
—আরে হ্যাঁ—হ্যাঁ। কোথায় বল দেখি?
প্যারাডাইসে, হজ্জতুল্লা আর নির্মল বসে আছে। তুই না হলে যে জমেই না।
রশীদ সাহেব বলেন—যে রকম দেখছি তাতে পাকিস্তানে সোমরস পান বুঝি আর সম্ভব হবে নারে।
সব বে-রসিক।
আলম সাহেবের সাথে রশীদ প্যারাডাইস ক্যাফেতে গিয়ে ওঠেন।
হাসুকে বলে যান—তুই বোস এখানে বাইরে।
হাসু মোট নামিয়ে বসে থাকে। ক্যাফের ঘড়িতে ন’টা বাজে। কিন্তু সাহেবের বের হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বসে থাকতে থাকতে হাসুর বিরক্তি ধরে যায়। একবার মনে হয়—স্যুটকেসটা নিয়ে ভেগে গেলে কেমন হয়? কিন্তু তারপরই সে নিজেকে শুধরে নেয়।
রশীদ সাহেব বাইরে এসে চলতে আরম্ভ করেন। হাসু অনুসরণ করে। ওভারব্রিজের কাছে আসতে হাসুর পা আর চলতে চায় না। বোঝা মাথায় সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা খুবই কষ্টকর। ক্ষুধায় হাসুর শরীর দুর্বল। তার ওপর এমন ভারী বোঝা।
হাসু বলে—একটু ধরেন, জিরাইয়া লই।
—চলে আয়। এতটুকুর জন্যে জিরিয়ে কাজ নেই, বাবা। বেশী দূরে নয়, কাছেই আমার বাড়ী-রশীদ সাহেবের মুখ দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে বের হয় কথাগুলো।
রশীদ সাহেব না থেমে ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে এগিয়ে যান। হাসু এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি করে উঠতে থাকে। তার পা কাঁপে। ঘাড়টা চাপ খেয়ে মচকে যাবার মত হয়।
রশীদ সাহেবের আগমনে তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। তাদের আনন্দ কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে বাড়ীখানা। ছোট ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে অন্য দুটির হাত ধরে তিনি অন্দরে ঢোকেন। একটি চাকরাণী এসে হাসুর মাথার মোট নামিয়ে নেয়। হাসু দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে!
রাত হয়ে যাচ্ছে অনেক। কিন্তু তাকে পয়সা দেয়ার কথা বোধ হয় মনে নেই কারো।
অনেকক্ষণ পরে হাসু সাহস করে বলে—আমারে বিদায় করেন সা’ব।
রশীদ সাহেবের ছেলে মজিদ হাসুকে ডেকে নিয়ে যায় ভেতরে।
রশীদ সাহেব তখন বিরাট বপু বিস্তার করে শুয়েছেন। মজিদকে বলেন, পকেট থেকে তিন আনা বের করে দিতে।
হাসু আপত্তি করে—তিন আনা কম অইয়া যায় সা’ব।
—কম! বলিস কী, অ্যাঁ!
—জাহাজের তন রিকসায় উড়াইয়া দিলেই ত চাইর আনা দেয়। আর এইডা ত অনেকখানি দূর। আবার দেরী অইল কত!
—নে তোল পয়সা।
—না সাব, পাঁচ আনার কম নিমু না।
মজিদ বলে—বাপরে! এখান থেকে এখানে পাঁচ আনা! এক মিনিটের পথ না, এত পেলে ত রাজা হয়ে যাবি।
হাসু নাছোড়বান্দা।
রশীদ সাহেব এবার ডাকেন—এই ছোঁড়া, আয় পাঁচ আনাই দেব। তবে হাত-পাগুলো টিপে দে ত আমার। ভালো করে তেল মালিশ করে দে।
–না সাব আমি পারতাম না। আমার দেরী অইয়া গেছে।
–অ্যাঁ, পারবিনে? গর্জে ওঠেন রশীদ সাহেব। বিছানার ওপর মেদবহুল শরীরখানা দুলিয়ে তিনি বলেন—এমনি এমনি তোমাকে পাঁচ পাঁচ গণ্ডার পয়সা দেব? আমি কন্ট্রাক্টর। কড়ায় গণ্ডায় কাজ আদায় করে পয়সা দিই। হ্যাঁ—হ্যাঁ—হ্যাঁ।
ইসু রশীদ সাহেবের পায়ের কাছে বসে তার পায়ে তেল মালিশ করতে শুরু করে।
তেল-মালিশ নেওয়া রশীদ সাহেবের অনেক দিনের অভ্যাস। শোবার আগে রোজ হাত পা টিপিয়ে না নিলে তাঁর ঘুম হয় না। কালকাতা থাকতে এ ব্যাপারে সুবিধে ছিল অনেক। চার আনা দিলে অব ঘটা বেশ হাত-পা বানিয়ে নেয়া যেত। রাত ন’টার সময় বাসার দরজায় এসে রোজ চীৎকার করে উঠত-মালিশ, তেল মালিশ। বাড়ীতে সে সুবিধে না। থাকায় কি-চাকর দিয়েই চলে সে কাজ।
দশটা বাজে। পা টিপতে টিপতে হাস অন্যমনস্ক হয়ে যায়। মা-র কথা মনে পড়ে। রেল-রাস্তার ধারে মা তার পথ চেয়ে আছে। এতক্ষণ এ লোকটার ব্যবহারে তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। তাই ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা তার মনেই ছিল না। কিন্তু এখন ক্ষুধায় তার হাত-ল অবশ হয়ে আসে। পেটটা ব্যথা করতে আরম্ভ করে।
মা-র কথা ভাবতে ভাবতে পাটেপা এক সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।
রশীদ সাহেব বলেন—কিরে, থামলি কেন? কি টেপা টিপিস? গায়ে কী জোর নেই বাপ? খোট্টারা এ কাজে ভারী ওস্তাদ। কলকাতায় ভুলুয়া বলে একটা খোট্টা রোজ আসত আমার বাসায়। চমৎকার টিপতে পারত সে। আর তুই টিপিস, আমার গায়েই লাগে না। মনে হয় পিপড়ে হাঁটছে শরীর বেয়ে।
কতক্ষণ পরে আবার বলে—এবার হাতের দিকে আয়।
রশীদ-গৃহিণী চা হাতে থমকে দাঁড়ান। তিনি রুক্ষস্বরে বলেন—ওঃ সব কাজেই ঠিকাদারী! আচ্ছা কি আক্কেল তোমার! কার ছেলেকে তুমি এ রকম করে আটকে রেখেছো?
রশীদ সাহেব বলেন—আমার নাম রশীদ কন্ট্রাক্টর। কড়াক্ৰান্তি পর্যন্ত আদায় করা চাই আমার। এই ছোড়া, এবার হাতগুলো টিপে তারপর যাবি।
চায়ের কাপটা রেখে রশীদ-গহিণী বলেন—থাক আর হাত টেপাতে হবে না। কেন তুমি পরের ছেলেকে কষ্ট দেবে?
হাসুর দিকে ফিরে আবার বলেন—আয় ত বাবা। আহা! কার ছেলে গো! তোর কি মা-বাপ নেই?
সহানুভূতির কথায় এবার হাসুর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরে।
রশীদ—গৃহিণী হাসুর মুখ দেখে বিস্মিত হন। নিজের আঁচলে চোখ মুছিয়ে তিনি বলেন—দুপুরে খাসনি কিছু? আহা! মুখখানা শুকিয়ে কেমন হয়েছে।
মায়ের মন ক্ষুধাতুর সন্তানের জন্যে ব্যথিত হয়। তার চোখও শুকনো থাকে না।
তিনি হাসুকে খাবার ঘরে নিয়ে যান। একটা থালায় ভাত ও দুটো পেয়ালায় তরকারী দিয়ে হাসুর সামনে দেন।
ভাতের দিকে চেয়ে হাসর চোখে ভাসে—মা তার আশায় সন্ধ্যা থেকে বসে আছে। মায়মুন বাড়ীতে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। বাড়ী গেলে রান্না হবে। তারপর খাওয়া হবে সকলের। হাসুর চোখ দিয়ে এবার বেশী করে পানি ঝরতে থাকে।
রশীদ-গৃহিণী বলে চলেন—খেয়ে নে বাছা আমার। কাঁদিস নে আর।
হাসু জোর করে এক মুঠো ভাত মুখে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ক্ষুধার তাগিদ চাপা পড়ে গেছে।
সে হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। বলে—আমি যাই।
—কিছুই তো খেলিনে। শান্ত হয়ে খেয়ে এখানেই থেকে যা আজ।
—উহুঁ, আমি যাই।
–বাড়িতে কে আছে তোর?
হাসু কোন উত্তর দিতে পারে না।
রশীদ-গৃহিণী একটা টাকা এনে হাসুর হাতে দেন। অনেক দ্বিধার সঙ্গে টাকাটা নিয়ে সে বেরিয়ে যায়। রশীদ-গৃহিণী চেয়ে থাকেন ছেলেটার মুখের দিকে। তার মেজ ছেলের কিছুটা ছাট আসে ওর মুখে। তখন কলকাতায় দাঙ্গা। ছেলেটি একদিন তার সাথে রাগ করে সামনের ভাত ফেলে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। আর ফিরল না…
হাসু সিঁড়ির গোড়ায় নেমে একবার ফিরে তাকায়। রশীদ—গৃহিণীর চোখ থেকে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
ঢং-ঢং, ঢং-ঢং–এগারোটার ঘণ্টা। পথে আসতে আসতে হাসু শোনে।
যেখানটায় রোজ কোষা রাখা হয়, সেখানে এসে দেখে, মা বসে নেই। কোষাটাও নেই।
মা তার উপর রাগ করেই চলে গেছে, সে বুঝতে পারে।
হাসু অন্ধকারের মধ্যে হাত কচলাতে শুরু করে। রাতটা কোথায় কাটান যায়? দোস্তের বাড়ী অনেক দূরে, তাও আবার নদীর ওপারে। এত রাতে খেয়া পাওয়া যাবে না।
নিরুপায় হয়ে হাসু কয়েক পা হেঁটে ছোট রেলস্টেশনটার চালা ঘরে গিয়ে ওঠে। রাতটা এখানে কাটান যাবে। কিন্তু ক্ষুধা পেয়েছে খুব। এত রাত্রে খাবার কিছু পাবার যো নেই। দু’মাইল হেঁটে চাষাড়া পর্যন্ত গেলে কিছু কিনে খাওয়া যেত। কিন্তু তার এক পা হাটতেও আর ভালো লাগে না।
হাসু বসে পড়ে। যখন বসতেও খারাপ লাগে তখন এক সময়ে গামছা বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে সে বাড়ীর কথা মনে করে।
মায়মুনকে খাইয়ে মা নিজে না খেয়ে শুয়ে শুয়ে তার কথাই ভাবছে। তাকে না খাইয়ে সে কোনদিন একমুঠো ভাত মুখে দেয়নি, আজও দিতে পারে না। মায়ের কথা ভাবতেই আরো একজনের কথা তার মনে পড়ে। মায়ের মুখের পাশে, মায়ের মর্যাদা নিয়ে যে একখানা মুখ। তার চোখের সামনে ভাসে, সে মুখখানা রশীদ-গৃহিণীর।
রাত বারোটার পরে আর কোনো ট্রেন নেই। ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর স্টেশনে লোক দেখা যায় না।
সব নিস্তর। মাঝে মাঝে দুর থেকে সমবেত চিৎকার ভেসে আসে—আল্লা আল্লা বল ভাইরে মোমিন
কোথাও কলেরা-বসন্ত লেগেছে। তার জন্যেই খোদাই শিরণী হচ্ছে, হাসু বুঝতে পারে। চিৎকার শুনে তার শরীরের লোম কাটা দিয়ে ওঠে।
জয়গুন সন্ধ্যার পরেই এসেছিল। পথ চেয়ে চেয়ে তার মেজাজ গরম হয়ে ওঠে ছেলের ওপর। ন’টার সময় সে নিজেই কোষাটা বেয়ে বাড়ী চলে যায়। কিন্তু বাড়ীতে পা দিয়েই তার ধারণা পাল্টে যায়। হাসু তার সে ছেলে নয়! তার কাছে না বলে কোথাও সে যায় না। দোস্তের বাড়ী গেলে তার কাছে বলেই যেত।
জয়গুনের মাথার মধ্যে নানা রকমের দুশ্চিন্তা তাল পাকাতে আরম্ভ করে।
কাল শরীর গরম ছিল, আজ হয়তো জ্বর হয়ে কোন গাছতলায় পড়ে আছে। পানি সাঁতরে স্টীমারে উঠতে হয়। তবে কি স্রোতে ভেসে গেল? নদীতে কুমীর থাকে। কুমীরেও টেনে নিয়ে যেতে পারে। কিছুই অসম্ভব নয়।
জয়গুন কুপি জ্বালে। মায়মুন ভূতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে আছে।
জয়গুন কাঁথা সরিয়ে দেখে মায়মুন ঘুমিয়ে আছে। সে আর মায়মুনকে ডাক দেয় না। এখন ওকে তুললেই ভাতের জন্যে কাঁদবে। ঘুমিয়ে থাক, সেই ভালো। আজ জয়গুনের চুলো ধরাবার শক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেছে। খাঁচার নিচে বড় ইসি দুটোও দেখা যায় না। বর্ষার দিনে পাতিশিয়ালে নেওয়ার কথাও নয়। বোধ হয়, কেউ ধরে রেখেছে কিম্বা জবাই করে খেয়েছে।
জয়গুনের কাছে সমস্ত দুনিয়াটা এলোমেলো মনে হয়।
মায়মুনের পাশ দিয়ে সে শুয়ে পড়ে। এবার দুশ্চিন্তার দুর্বার স্রোত মাথায় ঢুকবার সুযোগ। পায়। জয়গুন ভাবে—তবে কি গাড়ী চাপা পড়ল? হয়তো কিছু চুরি করায় পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
এমনি আরো অনেক চিন্তা তার মনে আসে। একটা কিছুক্ষণ ভাবার পর সেটাকে সরিয়ে আর একটা নতুন দুশ্চিন্তা এসে আঁকিয়ে বসে মনে।
১১. মোরগের ডাক শুনে
কুউ—কুরু—ত—কু—উ–
মোরগের ডাক শুনে জয়গুন আর বিছানায় পড়ে থাকে না। তাড়াতাড়ি উঠে আগে ফজরের নামাজ পড়ে, তারপর মায়মুনকে ডাকে—গা তোল, মায়মুন। আত-মোখ ধুইয়া জলদি কইর্যা চুলা জ্বাল।
—মিয়াভাই আহে নাই, মা?
–উহুঁ।
জয়গুন আর কিছু না বলে কোষায় ওঠে। অনভ্যস্ত হাতে লগি বেয়ে সে রেল-রাস্তার পাশে আসে।
বিলের শেষ প্রান্তে গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য উকি দিচ্ছে।
আবছা আলোয় দুর থেকে জয়গান দেখতে পায় স্টেশনের চালাঘরে হাসু চোলি হয়ে শুয়ে আছে। কাছে গিয়ে হাত রাখতেই হাসু ধড়ফড়িয়ে ওঠে। মা-কে সামনে পেয়ে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।
জয়গুন দেখে, হাসুর সারা মুখে মশার কামড়ের দাগ। চোখ দুটোও লাল। মুখে ভয়ের সুস্পষ্ট ছায়া! সে বলে—ডরে ধরছিল, অ্যাঁ?
হাসু মাথা নেড়ে স্বীকার করে।
—ডরে ধরছিল! কিছু দেখছিলি নি?
—হ। কি দুড়দুইডা আন্ধার গো মা! একটা মাইনষের আলয় নাই। এইহানে ওইহানে। এটটু পরে পরে কিয়ের জানি খচখচানি। বিলের মধ্যে কিয়ের যেন বাত্তি—এই জ্বলে, এই আবার নিবে। আবার কিয়ের বিলাপ হুনলাম। মাইনষের মন কান্দে। ডরে আমি এক্কেরে মাডির লগে মিশ্যা আছিলাম। এই আলোগুলা আলৈয়া, না মা?
—যাউক, অই হগল কওয়ন ভাল না। তোর অহনও ডর করে অ্যাঁ?
হাসু হাঁ-সুচক মাথা নাড়ে।
—না—না, ওগুলা কিচ্ছু না।
পথে আসতে আসতে হাসু কালকের সমস্ত ঘটনা মা-র কাছে বলে। রশীদ—গৃহিণীর দেয়া টাকাটা মা-র হাতে তুলে দেয়।
বাড়ীর ঘাটে কোষ ভিড়ার শব্দ পেয়ে মায়মুন দৌড়ে আসে। শফি, শফির মা-ও আসে।
শফির মা জিজ্ঞেস করে—কোনখানে পাইলি গো?
—ইস্টিশনে হুইয়া আছিল।
—ইস্টিশনে আছিল! একলা! তুই বড় নিডুর গো! মা অইয়া কেমুন কইর্যা পেডের বাচ্চারে ফ্যালাইয়া চইলা আইছিলি!
শফি বলে—দ্যাহ মা, মোখটা কেমুন দরমা-দরমা অইয়া গেছে।
—দরমা দরমা অইয়া গেছে!
হাসু বলে—মশার কামড়। সারা রাইত—
বাধা দিয়ে শফির মা বলে—মশার কামড়, না আর কিছু! তোরা দ্যাখ দেহি ভাল কইরা চউখ লাগাইয়া। আমি আবার চউখে দেহি না।
জয়গুন ভালো করে দেখে বলে—মশার কামড়ই।
—নালো, আমার কিন্তুক ভালা ঠেকে না। দিনকাল খারাপ। শেখপাড়ায় এক ঘরও বাদ নাই। মোল্লাপাড়ায়ও দয়া অইছে। আমি এই ডরেই আর খরাত করতে ঠ্যাং বাড়াই না ওই মুখি। হোনলাম ছয়জন পাড়ি দিছে।
হাসু শিউরে ওঠে ভয়ে। সে নিজের কানেও শুনেছে খোদাই শিরনি দেয়ার চিৎকার।
জয়গুন চিন্তিত হয়। বলে রাইতে ডরেও ধরছিল, ভাজ। আমারও চিন্তা লাগে।
—ডরে ধরছিল!
শফির মা চমকে ওঠে। সে আবার বলে—তোরা কি কথা কস! আমার এক্কেরেই ভালা ঠেকে না।
—অহন কি উপায় করি, বইন?
—এক কাম কর। গোসল না করাইয়া ওরে ঘরে নিস না। সোনা-রূপার পানি দিয়া গোসল করাইয়া তারপর ঘরে লইয়া যা।
হাসুর মা হাসুকে বলে—তুই অহন বাইরে থাক। গোসল কইর্যা তারপর ঘরে গিয়া ভাত খাবি। এতক্ষণই যহন থাকতে পারলি, এডুকে আর কি অইব? তারপর শফির মা-কে উদ্দেশ করে বলে—তোমার ঘরে রূপা আছে নি ভাজ? সোনা ত নাই জানি।
—নালো, বইন। রূপাও নাই। কবে বেইচ্যা খাইছি। আকালে কি আর কিছু রাইখ্যা গেছে? বেবাক ছারখার কইরা লইয়া গেছে, খালি শফিরে রাইখা গেছে। শফিই আমার সোনা, শফিই আমার রূপা, ও-ই সব। এখন খোদায় মোখ চাইলে অয়।
—খাড়ুজোড়া, হেইও খাইছ? আহা কেমুন সোন্দর জল-তরঙ্গের খাড়ু আছিল তোমার। আমার এতডি বয়স অইল, ওই রহম খাড় আর চউখে দ্যাখলাম না।
—কত আশা আছিল দিলে। শফিরে বিয়া করাইলে ওর বউরে দিমু খাড় জোড়া। কিন্তু উদরের টানে তাও দিলাম বেইচ্যা। সোয়ামীর চিহ্ন একটা ভাতের কাড়িও রইল না আর।
শফির মা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে।
জয়গুন বলে—অখন কোথায় পাই সোনা-রূপার পানি। মোড়ল বাড়ীর বউ-ঝিগ গায়ে রূপার গয়না আছে। কিন্তু সোনার গয়না ধারেকাছে কার ঘরে আছে আমার ত চউখেই পড়ে না।
—ক্যান, যার আছে হের আছেই। আমাগ মতন পোড়াকপাল কি আর বেবাকের! খোরশেদ মোল্লার বাটীতে আছে। কিন্তুক হেই বাড়ীর লাগা পরের বাড়ীতেই গুডির ব্যারাম। হ, এক কাম কর। গদু পরধানের বাড়ীতে গেলেই পাবি। গদু পরধানের বউগ শরীল গয়নায় ঝিল্লিক মারে। তুই আমার কথা হুনলে তোর শরীলও আইজ সোনা-দানায় ভরা থাকত। আইজগা আর বিচরান লাগত না।
জয়গুন বিরক্ত হয় শফির মা-র ওপর। সে বলে—চান্দের মইদ্যে ফান্দের কথা ক্যান আনো? কেরামতের বউর একজোড়া সোনার কানফুল দেখছিলাম।
—ইস! সোনা না আরো কিছু! ক্যামিকল, হুনছি আমি! হেই যে আমার দাদী কইত কথা—দড়ি যদি হাপ অইত আর অজা যদি রাজা অইত! হ, সোনার এক জোড়া মুড়কি আছিল জালালের বউর। হেদিন গিয়া দেহি বউর কান খালি। জিগাইলাম, তোর কান যে খালি বউ? হে কইল-মুড়কি বেইচ্যা কাপড় কিনছি। কাপড় আগে না গয়না আগে? হাচা কথাই ত। কাপড় না থাকলে কি গয়না ধুইয়া পানি খাইব মাইনষে?
জয়গুন বলে—গদু পরধানের বাড়ীত আমি যাইতে পারতাম না। তোমার শফিরে পাড়াইয়া দ্যাও। মায়মুনও যাইব লগে।
শফির মা বলে—যা শফি চিল-সত্বর চইল্যা আবি। কোনখানে দেরী করিস না কিন্তুক।
একটা মেটে ঘটের মধ্যে সোনা ও রূপার গয়না-ধোয়া পানি নিয়ে কয়েক পা এসেই মায়মুন বিস্ময়ের স্বরে বলে—দ্যাখলা শফি ভাই? এমুন মোট্টা মোট্টা রূপার গয়না বেডিগো গায়ে! আবার সোনার গয়নাও আছে!
—তোরে এই বাড়ীতে বিয়া দিমু। এই রহম মোট্টা মোট্টা গয়না পরতে পাবি। কেমুন?
মায়মুন দাঁত বের করে ভেঙচি কাটে, জবাব দেয়—তোমার বউ নিমু এই বাড়ীততন। ঐযে হেঁড়ি কোদালের মতন দাঁত–
মায়মুন হাঁসের ডাক শুনে পাশের দিকে চেয়ে দেখে খাঁচায় বাঁধা দুটো হাঁস তাদের দিকে চেয়ে প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকছে। মায়মুন চিনতে পারে—তাদেরই হাঁস যে! হাঁস দুটোও মায়মুনকে চিনতে পেরে খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মায়মুন আস্তে শফিকে বলে—শফি ভাই, দ্যাখছো? আমাগো আঁস দুইডা বাইন্দা থুইছে।
শফি চোখ দুটো বড় বড় করে বলে—আঁ, সত্যই নি!
—কাইল রাইতে ওইগুলা বাড়ীত যায় নাই।
–বাড়ীত যায় নাই! তুই পানির ঘটটা লইয়া কোষায় গিয়া ব’। আমি ফাঁক বুইঝ্যা ছাইড়া দিয়া পলাইমু।
শফি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সুযোগের সন্ধানে! গদু প্রধানের শেষ পক্ষের স্ত্রী ওকে দেখতে পেয়ে বলে কি চাসরে ছেঁড়া ঐহানে?
—কিছু না। সোনা-রূপার পানি নিতে আইছিলাম।
সে চোখের আড়াল হতেই শফি এক টানে খাঁচাটা উল্টে দিয়ে পালায়। হাঁস দুটো দৌড়ে গিয়ে পানিতে নামে।
শফি কোষাটাকে জোরে বেয়ে নিয়ে যায়। চকের মাঝে গিয়ে কোষা থামিয়ে মায়মুন ডাকে—চঁই-চঁই-চঁই।
পরিচিত কণ্ঠের ডাক অনুসরণ করে হাঁস দুটোকে ধানখেতের আল দিয়ে আসতে দেখা যায়। মায়মুনের ডাক শুনে গদু প্রধানের বাড়ীতে হাঁস দুটোর খোঁজ পড়েছে। সেই বাড়ীর কুড়ি খানেক ছেলেমেয়ে বাড়ীর নিচে পানির কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। একটি ছোট মেয়ে চেঁচিয়ে বলে-কতগুলা ধান খাইছে আমাগ! আবার ধরতে পারলে গলা কাইটা খাইমু।
শফি লগি উঁচু করে চীৎকার করে–তোগ গলা কাটমু।
মায়মুন বলে—হেই ছেঁড়ি। ঐ যে কোদালের মতন দাঁত। তোমার বউ।
মায়মুনের কথায় কান না দিয়ে শফি বলে—আইজ ব্যাডাগুলা বাড়ীতে নাই, থাকলে আমাগ গলাই কাইট্যা ফেলাইত রে!
কাছে এলে হাঁস দুটোকে কোষায় তুলে নিয়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে মায়মুন।
শফি কোষ বেয়ে বাড়ী যায়।
নিছক মশার কামড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না হাসুর মুখে! দুদিন বাদেই রমজানের ব্যবস্থা মত সে কাজে লেগে যায়।
বিরাট জায়গা নিয়ে দালান উঠছে। হাসুর আনন্দ হয়। কারণ, অনেকদিন এখানে কাজ করা যাবে। এখানে কাজ বেশী। ইট ভেঙে সুরকি করা, ইটের বোঝা টানা, পানি তোলা—এইসব কাজ করতে হয়। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত খাটতে হয়। এক মুহূর্তও বসে কাটাবার উপায় নেই। কিন্তু তবুও হাসুর খারাপ লাগে না। স্টেশনে টো-টো করে ঘোরার চেয়ে এ কাজ অনেক ভালো। এখানে ইচ্ছে মতো বোঝা নেওয়া যায়। কেউ ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় না। কিন্তু স্টেশনের যাত্রী বাবু-সাহেবরা মাঝে মাঝে এত ভারী বোঝা মাথায় চাপিয়ে দেয় যে ঘাড় ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হয়। স্টেশনে কাজেরও কোন ঠিকানা নেই, পয়সারও কোন ঠিক নেই।
বারো আনা পয়সা প্রায় দিনই হয়ে ওঠে না। কিন্তু এখানে একদিন কাজ করলেই বাধা। এক টাকা। এক পয়সাও কম না। বন্ধুত্বের খাতিরে এক আনা করে সরদারি দিতে হয় না। রমজানকে! স্টেশনের কাজে আরও কত ঝকমারি। বাবুদের সাথে দরাদরি, ভিড় ঠেলে পথ চলা, সাঁতার কেটে স্টীমারে ওঠা, এইসব। এগুলো সহ্য হলেও নম্বরী কুলিদের অত্যাচার একেবারেই অসহ্য।
হাসুদের দলের সব ছেলেই এখানে কাজে যোগ দিয়েছে। হাস শফিকে এনে এখানে কাজে ভর্তি করে দেয়।
শফি একদিন মা-কে বলে—মা, তুমি আর খরাত কইর্য না। মাইনষে মন্দ ক০০
ছেলের মুখের কথা লুফে নিয়ে মাথা নেড়ে শফির মা বলে—মাইনষে কয় খরাতনীর পুত? হেইয়াতে কি গায়ে ঠোয়া পড়ে? দশ-দুয়ার মাইগ্যা আইন্যা তোরে এতখানি ডাঙ্গর করছি।
জয়গুন বলে—পোলা তোমার উচিত কতাই কয় গো। ও অহন যাইডের বড় অইছে। রোজগারও করছে। ওর শরম লাগনের কতাই।
—ও রুজি-রোজগার করলে আর আমার ভাবনা কি! আমি খরাত করি কি আমার আমোদে? ঠ্যাঙ্গের জোরও গেছে। শরীলেও তাকত নাই। অহন সারাদিন এক ও’কত খাইয়া আর বইস্যা খোদার শুকুর ভেজতে পারলে বাঁচি।
১২. গন্ধভাদাল পাতা
বিকেল বেলা ঘুরে ঘুরে জয়গুন অনেক গন্ধভাদাল পাতা যোগাড় করে আনে। শহরের গিন্নিরা এ জংলী শাকের বড়া খেতে ভালবাসে। পাতাগুলো শুকিয়ে ওঠে বলে রাত্রিবেলা ওগুলো সাজিয়ে ঘরের চালার ওপরে রেখে দেয়া হয়।
রাত্রির শিশির-ভেজা হয়ে ভোর বেলায় পাতাগুলো সতেজ ও সজীব হয়ে ওঠে। রোদ উঠবার আগে জয়গুন চালার ওপর থেকে চাঙারিটা নামিয়ে নেয়। তারপর বসে বসে চার পয়সায় কতটা, তা আলাদা করে সে চাঙারির ভেতর সাজিয়ে নেয়।
খাওয়া সেরে জয়গুন তুষের হাঁড়ির থেকে আটটা ডিম নিয়ে গন্ধভাদাল পাতার মাকে বসিয়ে দেয়। তারপর চাঙ্গারিটা কাঁধে নিয়ে হাসু ও শফির সাথে কোষায় এসে বসে।
সবুজ মাঠের মাঝ দিয়ে কোষা চলে। ধান খেতের দিকে চেয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়। নতুন শীয় মাথা বের করেছে। শীষের ভাবে ঈষৎ নুয়ে পড়েছে ধানগাছগুলো। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বাতাস এসে সবুজ খেতে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যায়।
জয়গুন বলে—-এই বচ্ছর খোদায় দিলে পান অইব খুব। আর না খাইয়া মরতাম না। এই সময় বিষ্টি রইয়া-সইয়া আইলে অয়। শীষমোখে বিষ্টি পাইলে বরবাদ অইয়া। যাইব।
হাসু বলে—কেমন মোটা মোট্টা ছড়া বাইর অইছে, দ্যাহ মা। বেবাক জায়গায় এইবার ভালা ধান অইব। উজান দেশেও হুনছি খুব বরাদ্দ দ্যাহা যায়।
—অউক। বরাদ্দ অইলেই খাইয়া বাঁচতে পারমু। এইবার পরা ফসল না অইলেও, বারো আনা ফসল অইব, অহন যেই রহম ভাওবরাদ্দ দাহা যায়। গেল বছর আধা ফসলও অয় নাই।
শফির হাতে লগি। সে একটা ধানখেতের ভেতর কোষা চালাতেই জয়গুন বাধা দেয়—এই কি করস, শফি? এমন ভরা খেতের মইদ্যে দিয়া নাও বাইতে আছে?
—ক্যান? এইডা তো আর আমাগ খেত না।
-অলক্ষ্মী ছেঁড়ার কথা হোন। আমাগ খেত নাই বুইল্যা তুই অমন ফুলে ভরা ধানের উপর দিয়া কোষা চালাবি? যা খাইয়া মানুষ বাঁচে, হেইয়া লইয়া খেলা! খেতের আইল। দিয়া যা।
——আইল দিয়া গেলে, কিন্তুক দেরী অইব।
—অউক দেরী। ধানের ছড়া বাইর অইছে। খেতের মাঝ দিয়া আর যাওন যাইব না। এট্ট টোক্কা লাগলেই কাইত অইয়া পড়ব, আর মাথা খাড়া করতে পারবো না।
শফি খেতের আল ধরে কোষা চালায়।
যে খেতে পাট ছিল সেগুলো কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। চার পাশের ধানখেতগুলোরও অনেকটা জায়গা গ্রাস করেছে কচুরীপানায়। কচুরির ঝাড়ে বিচিত্র ফুলের মেলা।
দু’একজন নিরলস কৃষক খেতের চারপাশে বাঁশের বেড়া দিয়ে কচুরিপানার আক্রমণ ঠেকিয়েছে।
দু’একটা জলা-খেতে যেখানে কচুরিপানার উৎপাত নেই, সেখানে আধবোজা শাপলার ল। রোদের তেজ বাড়লে বুজে যাবে।
যেতে যেতে জয়গুন বলে কয়েকটা শাপলা তুইল্যা লইয়া যাই। উকিল বাবুর বউ। হেদিন কইয়া দিছিল।
শাপলা তুলে গোটা কয়েক তাড়া বেঁধে নেয় জয়গুন।
একটা ট্রেন সবেমাত্র যাচ্ছে স্টেশন থেকে। হাসু ও শফি দৌড়ে গিয়ে চলতি গাড়ীর হাতল ধরে লাফিয়ে ওঠে পাদানের ওপর। হাসু চেঁচিয়ে বলে—তুমি ধীরে-হস্তে আহ মা। আমরা গেলাম।
জয়গুন শাপলার তাড়া কয়টা কুনইর সাথে ঝুলিয়ে, চাঙারি কাঁধে নারায়ণগঞ্জের দিকে যায়।
মসজিদের মৌলবী সাহেব আসছেন। তার মুখোমুখি হওয়ায় সঙ্কুচিত হয় জয়গুন। তার হাত দু’খানাই আটকা থাকায় সে মাথার কাপড়টাও টেনে দিতে পারে না। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে যায় সে। আড়চোখে চেয়ে মৌলবী সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বলে ওঠেন—তওবা তওবা!
জয়গুনের প্রথম স্বামী জব্বর মুন্সী এই মৌলবী সাহেবের খুবই প্রিয়পাত্র ছিল। তার স্ত্রী সদর রাস্তায় হাঁটে তা তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। কতবার লোক পাঠিয়ে তিনি জয়গুনকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু জয়ন তা শোনেনি।
ডিম ও গন্ধ ভাদাল পাতা বেচতে বেশী সময় লাগে না। উকিলপাড়ায়ই আজ সমস্ত কাবার হয়ে যায়। ঝাকা নামান মাত্র চিলিবিলি করে নিয়ে যায় সব।
জয়গুন বাজারে গিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় লবণ, মরিচ, গরীবের বিলাসদ্রব্য পান-সুপারি এবং আরো কয়েকটা প্রয়োজনীয় সওদা কেনে। রাস্তার এক জায়গায় আখ বিক্রি হচ্ছে। গাছের সাথে বাঁশ বেঁধে উচ্চতা ও দামের ক্রমানুসারে সারি সারি আখ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মায়মুন কতদিন মাকে বোম্বাই আখ নিতে বলেছে। কিন্তু সে ইচ্ছে করেই এতদিন নেয় নি, অযথা পয়সা খরচ হবে বলে। মায়মুনকে ফাঁকি দিয়ে সে বলেছে—উখের কি খায়? অহনো মিড়া অয় নাই। পানসে উখ খাওয়ন আর ঘাস খাওয়ন সমান কথা।
কিন্তু আজ সারি সারি আখ দেখে তার মনে ব্যথা লাগে। সে ভাবে-মওসুমের একটা জিনিস কার না মুখে দিতে ইচ্ছে হয়? আর মায়মুন ত নেহায়েত কচি মেয়ে।
জয়গুন তিন আনা দিয়ে একটা আখ কেনে।
রাস্তায় রাজার মা-র সাথে দেখা হয়। রাজার মা জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী। সে জিজ্ঞেস করে—কত দিয়া কিনলাগে! উখখান?
—বা-রো পয়সা।
রাজার মা মাথায় হাত দেয়। সে আবার বলে—তিন আঙুল উখ না, দাম তিন আনা! উহতু না—অষুধ। আস্তা পয়সা চাবাইয়া খাওয়ান।
-এই রহমই বইন। আমাগ ঘরের জিনিসের দর নাই। আমরা যা বেচতে যাই-হস্তা। এক্কেরে পানির দাম। বাজারে একটা আদনা চিজ কিনতে গিয়া দ্যাহ, গহটের পয়সায় কুল পাইবা না। একটু থেমে আবার বলে—এই চাঙারির এক চাঙারি শাক, এক্কেরে তরতাজা বেচলাম চাইব আনা। আর দ্যাহ, আষ্ট আনার বেহাতি কোন নিচে পইড়্যা আছে।
—দেখছি বইন। এই দশা। এহন যাই গো। দেহি চাউলেরনি যোগাড় করতে পারি। আইজ গাড়ীতে ওঠতে পারলাম না। যা ভিড়। মাগগো মা!
—পুরুষ মাইনষেই ওঠতে পারে না গাড়ীতে। আমরা ত মাইয়া মানুষ। কাইল পরশু আবার যাইবা নি গো? গেলে লইয়া যাইও আমারে। দ্যাশের চাউলে প্যাট ভরে না। চাউলের দাম যেন রোজ রোজ ওঠতেই আছে।
রাজার মা এতক্ষণে কয়েক পা এগিয়ে গেছে। জয়গুন হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, আর বুঝি উত্তরে যাওয়া হয় না। লোকের ভিড়ে গাড়ীতে ওঠবার যো নেই। কত লোক হাতল ধরে পা-দানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ীর ছাতে বসে যায় কত লোক। সেদিন তার চোখের সামনে একটা লোক গাড়ীর পা-দানের ওপর থেকে পড়ে গেল।
টিকেটর জন্যেও আবার খুব কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিনা টিকেটে লুকিয়ে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে আর কত দিন যাওয়া যায়? জয়গুনদের গ্রামের জহিরুদ্দিন বিনা টিকেটে গাড়ী চড়ায় তিনদিন ফাটক খেঠে এসেছে।
পথে আসতে একটা উদলা নৌকার ওপর জয়গুনের দৃষ্টি পড়ে। রেল-রাস্তার পাশে গাছের সাথে বাধা ছোট নৌকাটি। একটি ছোট ছেলে বসে আছে নৌকার ওপর। যে কোন ছোট ছেলে হাতের কাছে পেলেই সে কোলে তুলে নেয়। তার মুখে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে। কাসুর নাক, কাসুর চোখ, তার কপাল, যুগল গায়ের রঙ কেমন ছিল আজও জয়গুনের চোখের সামনে ভাসে। কারও ছোট ছেলে কোলে নিয়ে তার মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে মন্তব্য করে—ওর নাকটা আমার কাসুর নাকের মতন। আমার কাসুরও এই রহম জোড়-ভুরু। জোড়-ভুরু ভাইগ্যমানের লক্ষণ। কিন্তু অইলে কি অইব? যে দশ মাস দশ দিন উদরে রাখল, তার বুক খালি।
একটা নিশ্বাস ছেড়ে সে আবার বলে—থাক আমি শাপ দিমু না কাউরে। আমার কাসু। “জান-ছালামতে বাঁইচ্যা থাউক-খোদার কাছে দিন-রাইত চবিবশ ঘটা এইডাই আরজ করি।
নৌকায় বসা ছেলেটার দিকে চেয়ে দ্রুয়গনের মনে হয়, তার কাসুও এতদিনে হয়তো এতটা বড় হয়েছে।
নৌকাটার দিকে আর একবার চেয়ে দেখে জয়গুন। এ রকম একটা নৌকা করিম বকশেরও ছিল। নৌকার মাঝে একটা কোঁচও দেখা যায় ঠিক করিম বকশের কোঁচটার মতই। সে ভালো করে দেখে। তাইত! করিম বকশের কোঁচটাই। কোন ভুল নেই।
জয়গুন থমকে দাঁড়ায়। তার মনে আনন্দ ও আবেগের মিলনসংঘাত আবর্তের সৃষ্টি করে। সে ভুলে যায়, আসমানে না জমিনে, স্বপ্নে না জাগরণে কোথায় কোন অবস্থায় সে আছে।
মুহূর্ত পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কাখের ঝাকাটা রাস্তার ওপর ফেলে সে নৌকার দিকে ছুটে যায়।
নৌকায় পা দিতেই ছেলেটি বলে—উইট্য না আমাগ নায়।
জয়গুন উত্তর না দিয়ে নৌকায় ওঠে। ছে
লেটি বলে—ক্যাদা মাইখ্যা দিল যে! বাজান আমারে মারব।
জয়গুনের খেয়াল নেই। সে কাদা পায়েই উঠে পড়েছে।
জয়গুন ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে। তার চিবুক ধরে বলে—তোমার নাম কি?
ছেলেটি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তার দিকে। মুখ না নামিয়ে আস্তে বলে—কাসু।
–কাসু! কাসু! আমার কাস! জয়গুন পাগল হয়ে গেল বুঝি। সে দুই হাতে কাসুকে জড়িয়ে ধরতে যায়। কাসু সে হাত সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
জয়গুন ভাবে—আজ সে পেটের সন্তানের কাছে পর হয়ে গেছে।
জয়গুন কাসুকে কোলে নেয়। কিন্তু কাসু কোস্তাকুস্তি করে কোল থেকে নেমে যায়।
জয়গুন আখ খেতে দেয় কাসুকে। নিজের দাঁত দিয়ে চোকলা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে তার মুখে দেয়। কাসু চিবোয়। জয়গুন অশেষ তৃপ্তির সাথে তার দিকে চেয়ে দেখে।
এক সময়ে জয়গুন বলে—তোমার বাজান কই?
—দুধ বেচতে গেছে।
—তোমার মুখখানা হুকনা যে? তোমার মায় তোমারে খাইতে দেয় নাই?
—আমার মা নাই, মইরা গ্যাছে।
জয়গুন সহ্য করতে পারে না। সে তাকে কোলে তুলে নেয়। আখ খেতে দেয়ায় কাসু বশ হয়েছে। এবার সে কোলে উঠতে আপত্তি করে না। জয়গুন পরম স্নেহে তার কপালে চুম্বন করতে থাকে। তার চোখের পানি কাসুর মুখখানা সিক্ত করে দেয়।
কাসুকে কোলে নিয়ে জয়গুনের অনেক সময় কাটে। করিম বক্শ দুধের হাঁড়ি মাথায় নৌকার কাছে এসে কখন দাঁড়িয়ে আছে জয়গুনের হুঁশ নেই। করিম বকশের ডাকে তার আবেশ ভেঙে যায়। মুখ তুলে দেখে—করিম বক্শ। তার চোখ দুটো রাঙা–জ্বলছে।
জয়গুন মাথার কাপড় আরো টেনে দিয়ে দাঁড়ায়। নৌকা থেকে নেমে শিথিল বিবশ পা দুটোয় স্বাভাবিক শক্তি ফিরিয়ে আনবার আগেই করিম বকশের গম্ভীর গলা শোনা যায়—খাড়, কথা আছে।
জয়গুন দাঁড়ায়। করিম বক্শ বলে—আমারে আর সুখে-শান্তিতে থাকতে দিবি না, দেখতে আছি। মায়ে-পুতে জোট কইর্যা আমারে পাগল বানাইয়া ছাড়বি তোরা। হাসুয়া হারামজাদা কদ্দিন জালাইছে, আবার তুইও–
জয়গুন নীরব।
—আমার সুখ তোগ চউখে সয় না? সাত সাতটা বচ্ছর দুধ ভাত খাওয়াইয়া ওরে অত ডার করছি। এহন চাও তৈয়ার আণ্ডায় উম দিতে।
জয়গুনের ইচ্ছে হয় বলে—আণ্ডা তুমি পাড় নাই। আমার আণ্ডায় আমি উম দিলে তোমার এত পোড়ানি কিয়ের লেইগ্যা? ওরে দশ মাস দশ দিন পেডে রাখছি, তিন বচ্ছর বুকের দুধ খাওয়াইছি। তুমিই তৈয়ার আণ্ডায়–
কিন্তু মুখ ফুটে একটি কথাও সে বলতে পারে না।
করিম বক্শ আবার বলে—তোগ ডরে ওরে বাড়ীতে রাইখ্যা আহি না। লেজুড়ে লেজুড়ে বাইন্দা রাখি সব সময়। নাওডা চোরে লইয়া যায় এই ডরে ওরে না বহাইয়া বাজারে যাই। এদিগেও তোগ উৎপাত শুরু অইছে! আমি এহন কোথায় যাই? তোগ যন্তন্নায় মুল্লুক ছাইড়্যা বনবাসে গেলে পারি অহন।—করিম বক্শ গুমরে ওঠে।
জয়গুন চলতে আরম্ভ করে।
করিম বক্শ বলেই চলে—দোহাই খোদার। ওরে ফুসলি দিস না আর। আমার পোলারে ফুসলি দিলে আল্লার কাছে ঠেকা থাকবি। রোজ কেয়ামত তক দাবী থাকবো তোর উপরে।
জয়গুন বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে।
করিম বক্শ জোরে বলে—আবার যদি ফেউ-এর মতন আমার পিছু লাগস, আখেরি কথা হনাইয়া দিলাম, তয় তোরই একদিন কি আমারই একদিন।
জয়গুন কোনো দিন কাসুকে ফুসলি দেয়নি, আর দিবেও না—সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা।
১৩. মেয়ে লোকটি কে
মেয়ে লোকটি কে?
কাসুর মনে বারবার এই প্রশ্নটাই আনাগোনা করতে থাকে। তাকে কোলে নিয়ে কত আদর করলো! আখ খেতে দিলো। দরদর করে পানি পড়ছিল তার চোখ বেয়ে! কে সে?
একবার তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়েছিল। কিন্তু করিম বকশের মুখ-চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্নটা চাপা পড়ে যায়।
করিম বকশের রাগ তখনও থামেনি। জয়গুন সে রাগ থেকে কোন রকমে বেঁচে গিয়েছিল। একত্র ঘর-সংসার করার পুরাতন স্মৃতি করিম বকশের মেজাজকে চরমে উঠতে দেয়নি। কিন্তু তারপর লগির উপর দিয়ে তার রাগের জের চলে সমানভাবে। লগির জোর গুঁতোয় ধানখেতের মাঝ দিয়ে যেন তীরের মত ছুটছিল তার ডিঙি। ডিগির গলুইয়ে পানি উঠছিল ছলাৎ ছলাৎ! কিন্তু বাড়ীর কাছাকাছি এসে লগিটা মটাৎ করে ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায়। করিম বকশের রাগ কিন্তু এতক্ষণে থামে। লগি ভাঙার আফসোসে নয়, তার রাগের জয়লাভ। তার রাগ জয়ী হয়েছে লগিটা ভেঙে দিয়ে। এমনি কোনো মাশুল না পেলে তার রাগের কোনো মতেই শান্তি আসে না। লগিটা না ভাঙলে বাড়ী পর্যন্ত পৌছে আঞ্জুমনের সাথে খুব এক চোট ঝগড়া হওয়ার সম্ভাবনা হয়ত ছিল।
বাপের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে কাসুর কথা বলার সাহস হয় না। চুপ করে সে বসেই থাকে আর ভাবে—মেয়েলোকটি কে হতে পারে?
প্রশ্নটার মীমাংসায় সেদিন থেকে সে অনেকটা সময় নিয়োজিত করেছে। কিন্তু তার কাঁচা মাথা কোন সন্তোষজনক হদিস খুঁজে বার করতে পারেনি।
হদিস শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়।
আঞ্জুমন একদিন হাশরের ময়দানের কিচ্ছা বলছিল। শুনে কাসু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে—হাশরের ময়দানে এত মাইনষের মধ্যে মারে চিনতে পারা যাইব? আমি ত মা-রে দেহি নাই। তুমি মা-রে চিনাইয়া দিবা?
আঞ্জুমন কাসুর অভিলাষ বুঝতে পেরে ব্যথিত হয়। কাসুর প্রশ্নটা তাকে খুব পীড়া দিতে আরম্ভ করে আজ। সে ভাবে কাসুকে এমন করে মিথ্যার জালে জড়িয়ে রাখার কোন অর্থ হয় না। অন্তত তার তো কোনই লাভ নেই লোকসান ছাড়া। কাসু ওর মা-র কাছে চলে গেলেই ভালো হয় যেন। করিম বকশা ফুলিকে মোটেই আদর করে না। এমন কি বাজান বাজান বলে কেঁদে খুন হয়ে গেলেও কোলে তুলে নেয় না। আরো গলাগাল দেয়—মেকুরের বাচ্চাড়া কান্দে ক্যাঁ? এইডারে ছালা ভইরা জঙ্গলে ফ্যালাইয়া দিয়া আয়। কাসুই করিম বকশের কাছে সব। ফুলি যেন তার কেউ নয়।
ভাবতে ভাবতে তার মন বিরক্তিতে ভরে ওঠে। সে স্থির করে—আজ কাসুক ওর মা-র কথা বলে দেবে। জয়গুনের বাড়ী দেখিয়ে দেবে কাসুকে। করিম বকশের ইঙ্গিতে সে এতদিন কাসুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রেখেছিল। মা-র কথা জিজ্ঞেস করলে তাকে সাজিয়ে বলতে হত অনেক কথা। কাসু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, তার মা-র কবরের কথা। আঞ্জুমন কোন দ্বিধা না করে মেহেরনের কবরটাই দেখিয়ে বলেছিল—এই যে এইডা তোর মা-র কবর।
কাসু বিশ্বাস করেছিল, নিশ্বাস ফেলেছিল আর চেয়েছিল একদৃষ্টে কবরটার দিকে।
মা-র কথা শুনতে শুনতে সে তন্ময় হয়ে যেত। আর ভাবত আহা—মা থাকা কত সুখের! সঙ্গে সঙ্গে তার মনে জাগত সমবয়সীদের কথা। হামিদের মা হামিদকে কত স্নেহ করে। সেলিমের মা কত আদর করে সেলিমকে। কিন্তু তাকে আদর করবার কেউ নেই।
তারপর থেকে সে প্রায়ই কবরটাকে দেখতে আসতো। মাঝে মাঝে করিম বকশের কাছ থেকে পয়সা চেয়ে মোমবাতি কিনে কবরে দিত।
আঞ্জুমন এবার বলে—আমি একটা কথা কইতে পারি। কেওর কাছে না কইতে পারস? কাসু মাথা নাড়ে।
—খবরদার, তোর বাজান হোনলে আমারে কাইট্যা দুই খণ্ড কইর্যা ফ্যালাইব। তয় হোন। অই কবরডা তোর সতাই মা-র! আমি যেমুন সতাই মা, তেমন।
—কে আমার মা? কাসু উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তুমিই ত কইছিলা ঐডা আমার মা-র কবর।
—ওহোঁ, মিছা কথা। তোর মা অহনো বাঁইচ্যা আছে।
কাসু বিশ্বাস করতে পারে না। সে বলে ফাঁটকি দ্যাও তুমি।
—ফাঁটকি দিমু ক্যাঁ? বিশ্বাস না করলে আর কইমু না। থাউক। আঞ্জুমন চুপ করে।
কিন্তু কাসুর শোনার আগ্রহ এবার বেড়ে যায়। সে বলে, আইচ্ছা, এইবার বিশ্বাস করমু,
–কইলে কি দিবি আমারে?
—তুমি যা চাও হেইয়া দিমু।
–আমি চাই :
আসমানী বিরিক্ষর ফল,
তল নাই দীঘির জল,
যা খাইলে হয় অসুরের বল। পারবি দিতে?
কাসু বিপদে পড়ে। কোথায় পাবে সে এসব? আসমানে গাছ হয়, সেই গাছে ফল হয়। কি তার নাম? সে বুঝতেই পারে না কিছু। আর তল নাই দীঘি—সেটাই বা কেমন? হতাশায় কাসুর মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। তার ধারণা, এগুলো দিতে না পারলে তার সৎসা তাকে তার মা-র কথা বলবেই না।
আঞ্জুমন খলখলিয়ে হেসে ওঠে। কাসুর পিঠ চাপড়ায়। কাসু এবার ভরসা পায়।
অঞ্জুমন আরম্ভ করে—তোর বয়স তহন তিন বচ্ছর। তোর বাপ তোর মারে ছাইড়া দেয়। তোরে তোর ফুফুর কাছে, পাড়াইয়া দায়। তোর একটা বইন আছে, মায়মুন তার নাম।
কাসুর সন্দেহ দূর হয় না। কিন্তু সে মনোযোগ দিয়ে শোনে সব কথা।
আঞ্জুমন আবার বলে—ঈদে টুপিখান দিছিল কে? তোর মা দিছিল না? অই যে কানা বুড়ি দিয়া গেল, ঐ কানা বুড়ি তোর মামানি।
কাসুর সমস্ত সন্দেহের অবসান হয় এবার। সৎমায়ের আচরণে কাসু কোন দিনই সদিচ্ছার পরিচয় পায়নি। তার হাব-ভাব দেখলে তার ভয়ই হত। আজ সৎমায়ের মমতায় সে বিস্মিত হয়। তাকে খুব ভালো লাগে। আঁচল ধরে আবদার করতেও এখন বাধে না কাসুর।
সে বলে—যাইমু মা-র কাছে। আমারে লইয়া যাও না মা-র কাছে।
—আমি লইয়া যাইমু কোতায়? সর্বনাশ! তোর বাজান জানতে পারলে আমারে মাইরা কাহটা গাঙে ফ্যালাইয়া দিব। খবরদার। জানতে যেন না পারে।
কাসু মাথা নাড়ে।
আঞ্জুমন বলে—চল, তোরে দেহাইয়া দেই। বাড়ীর উত্তর ধারে গেলে দ্যাহা যায় বাড়ীখান।
কাসুকে নিয়ে আঞ্জুমন বাড়ীর উত্তর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সে বলে—ঐ যে দুইখান বাড়ীর ফাঁক দিয়া দ্যাহা যায় একটা বড় তালগাছ। ঐ বাড়ী, অই হানেই থাকে তোর মা।
কাস পলকহীন দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার মন এই মুহূর্তে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু নিচে মাঠের দিকে চেয়ে নিরুপায় বলে মনে হয় নিজেকে। আশ্বিনের শেষাশেষি, পানি শুকিয়ে আসছে। জমির উঁচু আল দেখা যায়। সমস্ত মাঠ কাদায় দৈ-দৈ হয়ে আছে। পায়ের পথও নয়, নায়ের পথও নয়।
করিম বখ্শ যখন বাড়ী থাকে না, তখন কাসু প্রায়ই বাড়ীর উত্তর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নৌকার মাঝে দেখা মা-র মুখখানা চিন্তা করে।
এখান থেকে তালগাছটা স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু মাঠের কাদা আর পানি কাসুর সাথে আড়ি ধরেছে যেন। রোজ এখানে এসে এসে তার রাগ ধরে পানির ওপর। কেন পানি শুকাতে দেরী করছে এত?
দু’একটা লোককে কাদা ভেজা পথ চলতে দেখে তার মনে হয়, সে যদি একটু বড় হত, তবে সে-ও যেতে পারত অনায়াসে। মাঝে মাঝে কারো কাঁধে চড়ে যাওয়ার ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু কে এমন দরদী যে তাকে কাঁধে করে নেবে?
তালগাছটার দিকে দু’একটা পাখীকে উড়ে যেতে দেখে তারও উড়বার স্পৃহা জাগে। ঐ শাখীগুলোর মত দুটো পাখা যদি তার থাকত!
মাঠের কাদা যতই শুকিয়ে আসতে থাকে, কাসুর মনও ততই উড়-উড় করতে থাকে। কার্তিক মাসের শেষে মাঠের মাঝে পথ পড়ে। এমনি সময়ে একদিন শফির মা আসে এ বাড়ীতে। কাসুর আনন্দ আর ধরে না। এ রকমই একটা সুযোগের অপেক্ষা করছিল সে।
এক প্রহর বেলা। করিম বক্শ গোয়াল থেকে গাইটা বের করে উঠানে কাঠাল গাছের সাথে বাধে। আঞ্জুমন ঝিনুকে করে সর্ষের তেল এগিয়ে দেয়।
করিম বক্শ হুকুম করে—হাম্বাডা লইয়া আয়। বাজারের বেইল অইয়া গেছে।
—আমার ঘিন করে। তুমিই যাও।
করিম বক্শ গোয়ালের এক পাশে ঝুলানো হাম্বাটা নিয়ে আসে।
গাইটার বাছুর মরেছে অনেক দিন। দুধ-চোর গাই বাছুর না দেখলে দুধ ছাড়ে না। কোথায় লুকিয়ে রাখে। বাছুর না দেখলে বাটে হাত দেওয়াও মুস্কিল। ঠ্যাং দিয়ে লাথি মারে। এসব অসুবিধার জন্যে এই অদ্ভুত ব্যবস্থা। মরা বাছুরটার চামড়ার খোলসে খড়-বিচালি ভরে নকল বাছুর তৈরী করা হয়েছে।
করিম বক্শ হাতে সর্ষের তেল নিয়ে বাঁটে মাখিয়ে দেয়। তারপর নকল বাছুরটার মুখ বাটের কাছে নিয়ে বাছুরের অনুকরণে গুঁতো মারে। এ রকম করলে যখন বাটে দুধ নেমে আসে, তখন দুই হাঁটুর মাঝে হাঁড়ি রেখে করিম বক্শ দুইতে আরম্ভ করে।
-বাছুর কবে মরল ভাই?
করিম বক্শ চেয়ে দেখে—শফির মা। নিতান্ত অনিচ্ছার সাথেই সে উত্তর দেয়—মাস তিনেক অইল।
—অনেক দিন ত অইল। কেমুন কইর্যা মরল? দুধে পানি মিশাও বুঝিন? দুধে পানি মিশাইলে বাছুর মইরা যায়। এইডা হাচা কতা। শফির মা ঠাট্টার সুরে বলে।
জয়গুন করিম বকশের সংসারে থাকতে এ রকম ঠাট্টা-মশকরা প্রায়ই মূলত তাদের মধ্যে। বহুদিন বহু ঘটনার তিক্ততার পরেও আজ কেমন করে যে এ ঠাট্টাটুক জিভ থেকে পিছলে বেরুল, শফির মা নিজেই বুঝতে পারে না। কথাটা বলেই সে লজ্জিত হয়। করিম বক্শ আপন মনে এ-বাঁট থেকে ও-বাঁটে হাত চালিয়ে দুধ নামাতে থাকে। তার মুখেও ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়।
গাইটা নিষ্প্রাণ নিষ্পন্দ নকল বাছুরটার গা চাটতে থাকে শুধু শুধু।
আঞ্জুমন পিঁড়ে এনে বসতে দেয় শফির মাকে। শফির মা-র কথার উত্তর সে-ই দেয় এবার—পানি মিশাইব কোন দুখে? পানি মিশান বোধ করি ভাল আছিল। বাছুররে দুধ খাইতে না দিলে বাঁচব কেমন কইর্যা, কও? ঘাস না চিনতেই দুধের বাছুরের সামনে দিয়া রাখত ঘাস। আর সমস্ত দিন ভ্যা-ভ্যা করত বাছুর। বাছুরেরে দুধ খাইতে দিলে যে আঁড়ি উনা থাকে, বোঝলা নি বইন?
করিম বক্শ খেকিয়ে ওঠে-থাম মাগি বেজাত। কুড়ুমের কাছে বিত্তান্ত শুরু করছে। বেশী বকরবকর করলে দুধের আঁড়িডা তোর মাথার ‘পর ভাওমু, কইয়া রাখলাম।
শফির মা বলে—থাউক, বিহান বেলা কাইজ্যা কইর্য না গো তোমরা। হাশ্বাড়া কিন্তু খুব কসই অইছে। আমি তো ভাবছিলাম জিত বাছুরই। কে বানাইছে? মায়মুনের বাপ, তুমি?
অনেকদিন পরে ‘মায়মুনের বাপ’ ডাকটা শুনে চমকে ওঠে করিম বক্শ। শফির মা এই বলেই তাকে ডাকত। এ পাড়ার সবাই ডাকে ‘রহির বাপ’ বলে। আঞ্জুমনের বাপের বাড়ীতে ডাকে ‘ফুলির বাপ’। শেষের দুটোই চলছে আজকাল। আগের নামটা ঘুমিয়ে গেছে তার মনে। করিম বক্শ মাথা নাড়ে।
—হ। কারিগরিতে, তোমার মত ওস্তাদ আর নাই এই আশে-পাশে।
করিম বকশের দুধ দোহন শেষ হয়েছে। শফির মা-কে কথা বলবার অবসর না দিয়ে সে দুধের হাঁড়ি হাতে উঠে পড়ে।
শফির মা বলে—আদত কথাডা হোন এইবার। তোমার কাছে আইছি একটা কথা লইয়া।
করিম বক্শ দাঁড়ায়। বলে—কি কতা?
—মায়মুনের সম্বন্ধ ঠিক অইছে। আমি কত চেষ্টা-তদবির কইর্যা তয় ঠিক করলাম। অইলে এমুন সম্বন্ধ কপাল কুটলেও জুটত না।
—কোথায় সম্বন্ধ!
—সোলেমানের পোলা, সদাগর খার নাতি ওসমানের লগে।
–কবে বিয়া?
—এই মাসের এই কয়দিন পর। অগ্রাণ মাসের নয় তারিখ। তোমার কিন্তু যাইতে অইব।
—আমি যাইতে পারতাম না।
—এ তুমি কেমুন কথা কও! তোমার মাইয়া, তুমি না গেলে চলব কেমনে?
তোমার মাইয়া!
করিম বকশের মনের দুয়ারে ধাক্কা খেয়ে বারবার প্রতিধ্বনি করে কথা দুটি। কিন্তু উমর মনে বারিপাতের চেষ্টা বৃথা। কাসুকে ফুসলি দেয়ার ষড়যন্ত্রের কথা মনের ভেতর টেনে এনে সে নিজেকে কঠিনতর করে তোলে। এবার স্বরটা কঠিন করেই সে বলে—যেদিন থেইকা ও বিদায় দিছি, হেদিন থেইকা ওরা আমার কেউ না।
-তুমি কি কও ভাই! তোমার মাইয়া, তুমি না গেলে কেমুন দ্যাহা যায়? কাসুও যাইব তোমার লগে।
–কাসু যাইব!
—ক্যাঁ, দোষ কি? আবার তোমার লগেই লইয়া আইবা।
–বাহার কথা কইছ! কেও যাইব না। কাসু যাইব না, বাড়ীর একটা পোনাও যাইব না। কাসু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। আঞ্জুমনের ইশারায় এবার সে চুপি চুপি সরে যায়।
—কেউ না? কফির মা আবার বলে।
–হ, হ, কেউ না। বিয়া দিয়া দ্যাও, চাই কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দ্যাও, হেতে আমার কি? আমি হুঁ-হাঁ কিচ্ছু কইমু না।
শফির মা আর কথা বাড়াবাড়ি করতে সাহস করে না। সে আগেই জানত, মায়মুনের বিয়েতে করিম বক্শকে পাওয়া যাবে না। তবু সে এসেছিল যাতে পরে দূষতে না পারে।
পাশ থেকে কঞ্চির লাঠিটা হাতে নিয়ে শফির মা ওঠে।
আঞ্জুমন বলে—পান খাইলা না বইন?
—নালো বইন। আমি আবার বিনে ছেঁচা মোখে দিতে পারি না। ছেঁচতে দেরী অইয়া যাইব।
শফির মা পথ নেয়। খেতের আলের ওপর কাসু দাঁড়িয়ে আছে। শফির মা যেতেই তার একখানা হাত ধরে সে বলে—আমি যাইমু, মামানি।
—আমি তোর মামানি, কে কইছে?
—আমি হুনছি।
কাসু আবার বলে—আমি যাইমু, তোমার লগে।
—কই যাবি?
কাসু কোন উত্তর দেয় না।
শফির মা বলে—নারে বাজান। তোরে নিলে আমি দোষের ভাগী অইমু। শিগগির বাড়ীতে যা। তোর বাপ মাইরা খুন কইর্যা ফ্যালাইব।
—উহুঁ, জানতে পারব না। বাজান দুধ বেচতে যাইব।
—ফুলির মা কইয়া দিব তোর বাজানের কাছে।
—ওহোঁ, কইব না। হে-ই ত আমারে চিনাইয়া দিছে ঐ তালগাইছ্যা বাড়ীডা।
শফির মা একটু চিন্তা করে বলে—আইচ্ছা চল। আবার তাড়াতাড়ি ফিরা আইতে অইব। তোর বাপ জানতে পারলে কিল এট্টাও জমিনে পড়ব না।
কাসু বলে—বাজার তন ফিরতে দেরী অইব। তার আগেই ফিরা আইমু আমি।
শফির মা-কে পেছনে ফেলে কাস এগিয়ে যায়। শফির মাও জোরে পা ফেলে। কিন্তু। কাসুর সাথে সে হেটে পারে না। সে কতদূর এগোয়, আবার পেছনে ফিরে তাকায়।
করিম বকশের বাড়ী ছাড়িয়ে অনেক দূর এসে পড়েছে তারা। এবার পেছন দিকে তাকাতেই শফির মা দেখতে পায়-করিম বক্শ উর্বশ্বাসে ছুটে আসছে এদিকে। কোণাকুণি ধানখেত মই দিয়ে যেন আসছে সে। কাসু শফির মা-কে ছাড়িয়ে নল খানেক এগিয়ে গিয়েছিল।
শফির মা ডাকে কাসু। ভয়ে তার গলা দিয়ে আর কথা বেরোয় না।
কাসু পেছন দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায়।
শফির মা বলে—ভালা চাসত বাড়ীমুখি পথ দে। নইলে আড্ডি গুড়া কইর্যা ফ্যালাইব।
কাসু এসে শফির মা-কে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে। তারা দু’জনেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। শফির মা-র কাঁপুনি অনুভব করতে পেরে তার ভয় আরো বেড়ে যায়।
করিম বক্শ এসে পড়েছে। দুই হাতে কাসুকে ধরতেই সে আত-চীৎকার করে ওঠে। সে। শফির মা-র আঁচল জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু করিম বক্শ তার রাক্ষুসে থাবায় ছাড়িয়ে নেয় কাসুকে। শফির মা-কে ধাক্কা মেরে বলে—তুই মাইয়ালোক। নইলে আইজ–
রাগের অতিশয্যে করিম বকশের মুখ দিয়ে কথার শেষটা বের হয় না। এবার সে কাসকে বাম কাঁধে ফেলে ডান হাত দিয়ে এক একটা থাপ্পড় মারে আর বলে—আর এই মুখি পাও ফেলবি? দ্যাখ, কেমুন মজা।
কাসু কাঁধের ওপর থেকেই হাত পা ছুঁড়ে চিৎকার করতে থাকে।
করিম বকশের ধাক্কা খেয়ে শফির মা বসে পড়েছিল মাটির ওপর। সে অবস্থায়ই সে জিরিয়ে নেয় আর চেয়ে দেখে করিম বকশের কাণ্ড।
কিছু দূর যাওয়ার পর আর করিম বকশকে দেখা যায় না। পানি খেতের আড়ালে পড়ে গেছে সে এখন। সোজা হয়ে দাঁড়ালে করিম বক্শের কীর্তি দেখা যেত। কিন্তু শফির মা তখনও বসে হাঁপাচ্ছে।
১৪. আজ মায়মুনের বিয়ে
৯ই অগ্রহায়ণ। আজ মায়মুনের বিয়ে। লতিফ মিয়ার বাড়ী গিয়ে এই শুভ দিনটি জেনে এসেছিল শফির মা।
লতিফ মিয়া তার পকেট পঞ্জিকা বের করে। একটা পাতার ওপর নজর দিয়ে সে আপন মনেই বলে—চন্দ্র রাজ্জা বুধ মন্ত্রী। তারপর শুভকার্যের নির্ঘণ্ট দেখে বলে দেয়—অগ্রাণ মাসের ১ তারিখে একটা শুভদিন আছে। আর একটা আছে শেষাশেষি-২৭ তারিখ। এছাড়া অগ্রাণ মাসে আর দিন নেই।
লতিফ মিয়া তার পঞ্জিকা বন্ধ করে। পঞ্জিকার ওপরের রাশিচক্র অঙ্কিত মলাটের দিকে তাকিয়ে লতিফ মিয়ার গণনায় শফির মার মনে একটু সন্দেহ জাগে না। সে ভাবে—এমন বই-এর গণনা কখনও ভুল হতে পারে না। লতিফ মিয়াকে দাওয়াত করে শফির মা বিদায় হয়। পথে আসতে আসতে সে শুভদিনটি মনে মনে ইয়াদ করে।
গণনা নির্ভুল সন্দেহ নেই। কারণ, এই তারিখে আশেপাশে আরো অনেক বাড়ীতে বিয়ের ধুম লেগেছে। গায়ের জমিদার বাড়াতেও আজ বিয়ে। বাজারে দুধ কিনতে গিয়ে তা টের পাওয়া যায়। দুধের সর ছয় আনা থেকে বেড়ে এক টাকা হয়। মাছের দর চড়ে হয় দ্বিগুণ। বাজারের অর্ধেক দুধ, ঝাকায় ঝাকায় বাছা-বাছা রুই কাতলা মাছ যায় জমিদার বাড়ী।
হাসু ও শফি আসে বিয়ের বাজার করতে। চার সের দুধ, দুটো শোল মাছ, দুটো লাউ আর চাল-ডাল এবং আরো কিছু সওদা নিয়ে তারা বাড়ী আসে।
বাজার-ফেরত তিন টাকা ও কয়েক আনা হাসু মা-র কাছে ফেরত দেয়।
জয়গুন বলে বারো টাকা যে খতম করলি, আরো ত অনেক খরচ আছে।
শফির মা বলে—থুইয়া দ্যাও। অতহত দরকার নাই। পনেরো টাকা দিছে মোট্টে। ওয়াগ ট্যাকা দিয়া ওয়াগ খাওয়াই। আমরা খরচ করতে যাইমু কোন্ দুক্খে?
—গোশত অইলে ভালা অইত।
থুইয়া দে, আবার গোশত। আরো পাঁচখান ট্যাকা দিবার কইছিলাম, হেইয়া দিল না, কিরপিন।
—দিছে পনেরো টাকা। আইব ত ভেড়ার পালের একপাল।
—আহনের কত দশ জনের। কয়জন আহে, আল্লা মালুম।
-তাইত আমি আগেই কইছিলাম, মায়মুনের বিয়াতে টাকা নিমু না। পান-শরবত খাওয়াইয়া বিদায় করমু।
—হেইডা ভালা আছিল।
—কিন্তু কেও হোনলা না আমার কথা। অহন ট্যাকা নিয়া বদনামের ভাগী অই।
—তুমি কিছু চিন্তা কইর না, হাসুর মা। শইল মাছ আর কদু দিয়া একটা ঘণ্ড, ডাইল। আর দুধ-বাতাসা, ব্যস! আবার কি! এ খাইয়া তোর বেয়াই সোলেমান খাঁ তার বউর কাছে, গল্প ছাড়বো! তারিফ করবো তোর রান্দার।
জয়গুলোর হাসি পায়।
নওশা আসবে সন্ধ্যার পরে। বিকেল বেলায় হাসু ও শফি পাড়ার থেকে হোগলা যোগাড় করে এনে পেতে দেয় অতিথিদের বসবার জন্যে। উঠানের এক পাশে পা ধোয়ার জন্যে পানি ভরা কলসী ও বদনা রেখে দেয়। তার পাশে রাখে জলচৌকি ও খড়ম।
সময়টা ভালো। বৃষ্টি-বাদলের ভয় নেই।
সন্ধ্যার পর বরযাত্রীরা আসে। দুলাও আর সকলের মত পায়ে হেঁটেই আসে। গরীবের বিয়েতে পাল্কীর কথা কেউ কল্পনা করতেও পারে না। পাল্কীর ভাড়ায় একটা পুরোদস্তুর বিয়ে স্বচ্ছন্দে হয়ে যেতে পারে।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে জয়গুন জামাই দেখে নেয়। গোলাপী মাদ্রাজী লুঙ্গি পরনে, গায়ে বেগুনী রঙের পাঞ্জাবী আর মাথায় লাল টুপি। তার মুখের বসন্তের কালো কালো দাগ আর ছাগলে দাড়ি কয়গাছা জয়গুনের কাছে বিশ্রী ঠেকে। বয়স পঁচিশের ওপরে হবে, জয়গুন অনুমান করে। মেয়েকে নদীতেই ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। তা ছাড়া আর কি!
দুলা এবং আর যে দু’এক জনের পায়ে জুতো আছে, তারা উঠে গিয়ে বিছানায় বসে। বাকী সবাই এক এক করে জলচৌকির ওপর বসে পা ধোয়। তারপর বিছানার পাশে আর একজনকে খড়ম ছেড়ে দিয়ে মজলিশে এসে বসে।
সকলের শেষে জুতো পায়ে থপথপ শব্দ করতে করতে আসে গদু প্রধান। বেঢপ চটি জোড়া বিছানার পাশে রাখতে ভরসা হয় না তার। শফিকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করে—এই হানে রাখলে থাকবো ত? না চুরি যাইব?
মজলিশের মাঝ থেকে একজন বলে—গেলই বা চুরি। পুরান গেলে নতুন আনবেন।
—তোমরা এহনও নাবালক। জানো, পুরান জোতা আর পুরান চাদরের মর্ম? পুরান জোতা আর পুরান চাদরের সর্মান বেশী।
জুতো জোড়া হাতে করে যেতে যেতে আবার বলে—নতুন জোত পায়ে দিয়ে মজলিশে গেলে মাইনষে কি মনে করে, জানো? মনে করে, নতুন হিখছে জোতা পায় দিতে।
মৃদু হাসির গুঞ্জন শোনা যায়।
গদু প্রধান মসজিদের মৌলবী সাহেবের পাশে জায়গা বেছে নেয়। বসবার আগে জুতো জোড়া পেছনে হোগলার নিচে রেখে দেয়।
গদু প্রধান এসে জুতো চুরির যে প্রসঙ্গ তুলে দেয়, তা আর থামতে চায় না। কার বিয়েতে কার জুতো চুরি গিয়েছিল, কার চামড়ার জুতো কার রবারের জুতোর সঙ্গে বদল হয়েছিল—এসব গল্প।
সবাই যখন গল্পে মেতে আছে, তখন হাসু এক ফাঁকে লোক গুণে যায়। জয়গুনকে গিয়ে বলে বেবাকে তেইশ জন, মা।
জয়গুন মাথায় হাত দেয়। সব শুদ্ধ পনেরো জনের আয়োজন করা হয়েছে। এখন কি উপায় করা যায় সে ভেবে উঠতে পারে না।
শফির মা-কে ডেকে বলে—তুমি সামলাও। আমি আর পারি না, বইন।
—কোন চিন্তা নাই। এক কাম কর। চাইর সের চাউলের ভাত চাপাইয়া দে। আমি ডাইলে দুই বদনা আর দুধে এক বদনা পানি মিশাইয়া দেই। যেমুন মাছ, তেমুন বড়ি না অইলে কি দুইন্যাই চলে? পালবরাদ্দে আইছে যেমুন, খাইব তেমুন ঝড়া পানি।
জুতো চুরির চাপ ছেড়ে কার জমিতে কি রকম ধান হবে, কোন বিলের ধানে পোকা। ধরেছে, কার বছরের খোরাকি হবে, কার হবে না—এ সব আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে।
একজন বলে—পরধানের চিন্তা নাই। কম কইরাও পাচ-ছয় হাজার টাকার ধান বেচতে পারব।
গদু প্রধান চুপ করে থাকে। মজলিসের মধ্যে তার টাকার তারিফ করলে সে খুশীই হয়।
এবার দুলার বাপ সোলেমান খাঁ অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে পড়ে। সে বলে, স্বাদীন যে অইল হের কোন নমুনাই যে পাইলাম না আইজও। দিন দিন যে খারাপের দিগেই চুলল। মওসুমের সময়ই চাউলের দর এত, শেষে না জানি কি অয়!
শেষে যদি কিছু হয়, তবে গদু প্রধানের পোয়াবারো। চালের দর চড়ক—মনে মনে সে তাই কামনা করে।
একজন বলে—দ্যাখছ, কাপড় পাওয়া যায় না বাজারে। খালি জোলইরা কাপড়। তাও কুড়ি-বাইশ টাকা জোড়া। একি কিনতে পারে?
গদু প্রধান বলে—আর কিছু দিন পর এও পাইবা না। বউ-ঝিরা ঘরের বাইর অইতে পারব না।
দুলার চাচা লোকমান বলে—কত আশা-ভসসা আছিল। স্বাদীন অইলে ভাত কাপড় সাইয্য অইব। খাজনা মকুব অইব। কিন্তু কই? বেবাক ফাঁটকি, বেবাক ফাঁকি। আবার রেল গাড়ীর ভাড়াও বাইড়া গেল।
—আরো কত দ্যাখা মিয়া, মাত্র বিছমিল্লা।—মৌলবী সাহেব বলেন। তারপর গদু প্রধানের কানে কানে কি বলেন।
গদু প্রধান বলেন—দশটার মইদ্যে বিয়া পড়াইতে অইব। কই সোলেমান? শোন এদিগ। সোলেমান খাঁ এলে আস্তে আস্তে গদু প্রধান বলে—তোমার বেয়ানরে আগে তোবা করাইতে অইব।
—ক্যাঁ?
—ক্যাঁ আবার! হায়ানের মত যেইখানে হেইখানে ঘুইরা বেড়ায়, দ্যাখতে পাও না? ভাল মাইনষের মাইয়া। বিয়াও অইছিল ভালা ঘরে। ভালা জাতের মাইয়া এই রকম বেজাত বেপর্দা অইলে আমাগই বদনাম। তোবা করাইয়া দিতে অইব। পরচাতে আর যেন বাড়ীর বাইর না অয়।
—হেইডা ত ভালা কথাই।
—তুমি কথাডা মজলিশে উড়াও। জোরে কইও যেন ঘরের তন তোমার বেয়ান হোন্তে। পায়। আমি আছি তোমার পিছে।
—না, আপনেই উড়ান। আমার শরম করে।
গদু প্রধান বলে বেশ জোরের সাথেই–বিয়ার আগে বৌর মারে তোবা করাইতে অইব। তোবা না করাইলে মৌলবী সাব কলমা পড়াইব না। আর হে ছাড়া কে কলমা পড়ায় আমি দেইক্যা লইমু।
মৌলবী সাহেবের মুখের ওপর মজলিশের সমস্ত চোখ একযোগে এসে পড়ে। মৌলবী সাহেব এবার একজন বেপর্দা স্ত্রীলোক ও তার স্বামীর কেচ্ছা শুরু করেন।
জয়গুন মায়মুনের চুলের জট ছাড়াতে শুরু করেছিল। গদু প্রধানের কথা তার কানে। আসতেই সে লাফ দিয়ে ওঠে। শফির মা-র কাছে গিয়ে বলে—হোনলা নি শফির মা?
—হ, হোনলাম। তার কি করতে চাও?
—কি করতে চাই? তোবা আমি করতাম না। আমি কোন গোনা করি নাই। মৌলবী সা’ব বিয়া না পড়াইলে না পড়াউক। আমার মায়মুনের বিয়া দিমু না।
—এইডা কি কথার মতোন কতা। ট্যাকা দিছে তারা।
—ট্যাকা দিছে, পেড় ভইরা খাইয়া ট্যাকা ওসুল কইরা যাউক। আমি ত আর টাকা সিন্দুকে ভইরা থুই নাই।
—না, না। ওই হগল কথা রাখ। এমুন ঘর আর পাবি না। আর আইজ এই রহম কইর্যা ফিরাইয়া দিলে বদনামী অইব কত! তোর বাড়ীতে আর কেও থুক ফেলতেও আইব না। আবার গদু পরধান আছে এর পিছে। ওকি যেমুন তেমুন গোঁয়ার! ও যদি মনে করে, উর মাডি চুর করে।
জয়গুন চিন্তিত হয়। তার মুখে কালো ছায়া। সে ভাবে—তওবা করলে ঘরে বদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। ঘরে বন্ধ হয়ে থাকার অর্থ না খেয়ে তিলে তিলে শুকিয়ে মরা। জয়গুনের চোখ ঘৃণায় কুঞ্চিত হয়। সে তীব্র কণ্ঠে বলে—না, আমি তোবা করতাম না।
মজলিশে মৌলবী সাহেবের গলা শোনা যায়। তিনি গল্প বলছেন—ঐ লোকটা তার বেপর্দা স্ত্রীকে কিছুতেই তালাক দিল না। তখন একজনের ওপর হুকুম অইল—ওরে কতল কর। লোকটাকে কাইট্যা ফেলা অইল। আর তার লহু থেইকা পয়দা অইল কি? না, একটা হারাম জানোয়ার–খিঞ্জির—শুয়োর। এইবার আপনারা দ্যাখেন, পর্দা কি চীজ। পর্দা না মানলে চল্লিশ বছরের এবাদত কবুল হয় না খোদার দরগায়। সব বরবাদ অইয়া যায়। বেপর্দা স্ত্রীলোক আর রাস্তার কুত্তী সমান।
জয়গুন চমকে ওঠে।
শফির মা কেরামত ও জহিরুদ্দিন মোড়লকে ডেকে আনে।
জহিরুদ্দিন বলে—মৌলবী সা’ব ঠিক কথাই কইছে হাসুর মা। তোবা কইরা ফ্যাল।
কেরামত সায় দিয়ে বলে—হ চাচি, তোবা কর।
জয়গুন জ্বলে ওঠে—তোবা কইরা ঘরে বইস্যা থাকলে আমারে খাওয়াইতে পারবি?
শান্ত হয়ে আবার বলে—তোমরা ইনসাফ কইর্যা কও, তোবা করলে কে আমারে ঘরে আইন্যা খাওয়াইব? হাসু যা রোজগার করে ও দিয়া দুই পেট চলে না। মায়মুনেরে আইজ বিদায় দিলেও ওরে নাইয়র আনত অইব। ও অহনতরি শিশু। মাসের মইদ্যে দশদিন ও আমার বাড়ীতেই থাকব। এতগুলা পেট কেমন কইর্যা চালাই, তোমরাই কও।
জহিরুদ্দিন বলে—খোদায় খাওয়াইব। মোখ দিছে যে, আহার দিব সে।
জয়গুন হাসে শ্লেষের হাসি।
কেরামত বলে—আইজকার দিনডার লেইগ্যা তোবা কইর্যা নেও। তারপর–
—তোবা তো’বা-ই। একবার করলে তা আর ভাঙতে পারতাম না।
বাইরে দু প্রধানের গলা শোনা যায়—অনেক রাইত অইল। কই কেরামত? চালাক কর।
—করতাছি মিয়া সাব।
কেরামত মজলিশে যায়। মৌলবী সাহেব দোর গোড়ায় এসে তার মাথার লম্বা পাগড়িটা খুলে তার এক প্রান্ত কেরামতের হাতে তুলে দিয়ে অন্য প্রান্ত নিজের কাছে রাখেন।
কেরামত ঘরের ভেতর গিয়ে বলে—ধইর্যা থাক, চাচি। হুজুর যা যা কইবেন, খেয়াল কইর্য। দিলের মইদ্যে গাইথ্যা রাইখ্য সব।
দ্বিধার সাথে জয়গুন পাগড়ির মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে। তার মনের মধ্যে তখনও দ্বন্দ্ব চলছে।
মৌলবী সাহেব টানা সুরে থেমে থেমে কি বলে যান তার একটা কথাও তার কানে ঢোকে না। কেরামত যখন আবার তার হাত থেকে পাগড়ির প্রান্তটা নিতে আসে, তখন তার সম্বিত ফিরে আসে।
এবার খাওয়ার পালা।
জয়গুন তওবা করায় আজ মৌলবী সাহেবেরও খেতে আপত্তি নেই। একদিন তিনি জয়গুনের দেয়া হাঁসের ডিম ফেরত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেইদিনের সেই জয়গুন আর এখনকার জয়গুনে তফাত অনেক। একটু আগেও সে মৌলবী সাহেবের কাছে ছিল রাস্তার কুকুরের সামিল।
গদু প্রধান সামনের সারির একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে—কিরে আদেল, ভাত সামনে কইর্যা বইস্যা আছস ক্যান? খাইতে পারস না বুঝি?
—পারমু না ক্যাঁ? দুধ দিয়া মাইর্যা দিমু।
সাদত আলী বলে—আইজ কাইলকার ছেঁড়ারা পোয়া চাউলের ভাত খাইতে পারে না। এই বয়সে আমরা লোয়া খাইয়া লোয়া অজম করছি। খাইতে খাইতে মাজার কাপড় যে। কয়বার ঢিলা করতে অইত তার শুমার নাই।
গদু প্রধান বলে—জোয়ান বয়সের কালে এক সের চাউলের ভাত অজম করছি আমি।
সাদত আলী বলে—পরধানের মনে আছে? হেই মধু আলইকরের দোকানে তুমি আর আমি বাজী রাইখ্যা রসোগোল্লা খাইছিলাম। তুমি আমার তন ছয়খান বেশী খাইছিল। আমি খাইছিলাম একচল্লিশটা, আর তুমি–
—আর আমি সাতচল্লিশটা। সাদত আলীর কথা শেষ না হতেই গদু প্রধান বলে।
লেদু পাশ থেকে বলে রাইখ্যা দ্যাও ওই হগল কিচ্ছা। আইজ কাইলকার ডোরা খাইতে পারে না? খাইতে পারে, মিয়াভাই কিন্তু খাওয়ায় কেডা? খাইতে না পারলে ভালই আছিল। খোদা খোরাক কমাইয়া দিলে ত খুশী অইতাম। শুকুর ভেজতাম খোদার দরবারে। মসজিদে শিন্নি দিতাম!
লেদুর মাথায় ছিট আছে। কিন্তু তার স্পষ্টবাদিতার জন্য অনেকে তাকে পছন্দ করে। গদু প্রধান কিছু বুঝতে না পেরে বলে—কি রহম?
—বোঝলা না, মিয়াভাই? তোমার গোলাভরা ধান আছে। এক সেরের বদলে দুই সের খাইলেও তোমার গোলা ঠিক থাকব। কিন্তু আমি সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলাইয়া রুজি করি পাঁচ সিকা। এই টাকা পেড়ে দিমু, কাপোড় পিল্ম, না এর তন রাজার খাজনা দিমু? ঘরে পরিবার আছে। তিনডা বাচ্চা আছে। আমার পেড যদি তোমার মতন এক সের খাইতে চায়, তয় উপায়খান অইব কি? সারাদিন খাইট্যা সোয়া সের চাউল গামছায় বাইন্দা ঘরে ফিরি। সাধে কি আর আইজকাইলকার ছেঁড়ারা খাইতে পারে না। খাইতে পারে না, না, খাইতে পায় না, কও। মাইনষের পেড ছোড অইয়া যাউক খোদার কাছে আরজ করি। বেবাকের পেড়ে মাজায় লাইগ্যা এক অউক। এক ছড়াকের বেশী যেন খাইতে না অয়। এইডা অইলে আর আকাল অইব না দ্যাশে।
অনেকক্ষণ ধরে থাকা গ্রাসটা এবার মুখে দেয় লেদু।
তার কথা সবারই ভালো লাগে। শুধু দাদু প্রধানের কাছে ভালো লাগে না। সে এবার। হক দেয়–আরে, এই খানে ভাতের গামলা লও। ডাইল লও। কেমুন খাদেম, অ্যাঁ! খানেওয়ালা চিন না?
থালার ওপর ঝুঁকে পড়া নিব্জদেহ বৃদ্ধ নাজিমুদ্দিন মাথা উঠিয়ে বলে—লেদুরে আমরা। পাগল কই আর ছাগল কই, ওর কথা কাডায় কাডায় সত্য। মাইনষের পেডটা না থাকলে আমি খুশী অইতাম। পেডের জ্বালাই বড় জ্বালা মাইনষের। নানা জনের নানা কথার মধ্য দিয়ে খাওয়া শেষ হয়। সোলেমান খাঁ মজলিশের মধ্যে একটা জায়গায় নিজের কাঁধের গামছাটা বিছিয়ে দেয়। তার চারপাশে কন্যাপক্ষের কেরামত ও জহিরুদ্দিন এবং বরপক্ষের প্রায় সমস্ত লোক কাঁধে কাঁধে মেশামেশি হয়ে বসে। প্রথম সারির পেছনে অল্প বয়সী ছেলেরা হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে তাকায় উৎসুক হয়ে।
সোলেমান খাঁ একটা টিনের পুরাতন সুটকেস খুলে গয়নাগুলো গামছার ওপর আলাদা করে জোড়ায় জোড়ায় সাজিয়ে রাখে। গয়নার মধ্যে বয়লা, গোলখাড়, নাকফুল, নোলক। এগুলো হাত দিয়ে নেড়ে প্রথমেই আপত্তি করে কেরামত—আপনের গয়নার জোখা নেন নাই? এত বড় গয়না কে পরব?
—বড় অওয়ন ভালা। বউ আমাগ অহন ডেগা অইলে কি অইব? এক বচ্ছর পর যহন। সিয়ানা অইব তহন ঠিক কাপাকাপা অইব। ভাঙা-গড়া করলে রূপা আর রূপা থাকে না। ফুক্কা আইয়া যায়।
আসলে গয়নাগুলো ছিল ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর। সে মারা যাওয়ার পর চোখা রূপার এই গয়নাগুলোকে মেজে ধুয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
জহিরুদ্দিন গয়না হাতে নিয়ে ভালো করে পরখ করে। নাকের নোলক ও নাকফুল ছাড়া আর কোনটাই তার কাছে রূপার বলে মনে হয় না। সে কেমিক্যালের কানফুল জোড়া এক দিকে সরিয়ে হাত দিয়ে আর গুলো চোখের কাছে নিয়ে দেখে। কিন্তু বরপক্ষের এত লোকের সামনে কথা বলতে তার সাহস হয় না। সত্যিই যদি রাপার জিনিস হয়ে থাকে তবে মজলিশের এত লোকের সামনে লজ্জায় কান কাটা যাবে। কেউ হয়ত বলেও বসতে পারে—বাপের বয়সে রূপা দ্যাহ নাই কোন দিন?
ওসমানের প্রথমা স্ত্রীর পাটের শাড়ী, একখানা লাল পেড়ে শাড়ী ও গয়নাগুলো ঘরে নিয়ে যায় কেরামত। হাতের বয়লা ও পায়ের গোলখাড় সুতো দিয়ে বেঁধে পরিয়ে দেওয়া হয় মায়মুনকে। পাটের দশ হাত শাড়ীটা এমন পেঁচিয়ে সামলান হয় যে, দূর থেকে মায়মুনকে দেখে বোঝা যায় না। মনে হয় একটা কাপড়ের পুটলি।
মায়মুন আবদারের সাথে তার মা-কে বলে—মা, তুমি যাইবা না আমার লগে?
—আমি যাইমু কি করতে মা?
—আমি তোমারে ছাইড়্যা কেমনে থাকতাম?
—ক্যাঁ? হাসু যাইব, শফি যাইব।
মায়মুন নিশ্চিন্ত হয়।
জয়গুণ আবার বলে—তোর চিন্তা নাই। দুই দিনের বেশী রাখতাম না তোরে পরের বাড়ী। পরশু লইয়া আইমু আবার। এই বার আঁইট্যা যা দেহি দুয়ার তক, দেহি কেমুন দাহা যায়।
মায়মুন উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এত বড় শাড়ীটা সামলান তার পক্ষে কষ্টকর। শাড়ীটা বারবার পায়ের নিচে পড়ে তার হাঁটায় বাধার সৃষ্টি করে।
মায়মুনকে দেখে জয়গুনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এ চোখের পানি সুখের না দুঃখের বলা শক্ত।
সাক্ষী ও উকিল যখন ঘরে আসে, তখন মায়মুন বসে বসে ঝিমুচ্ছে। জয়গুন মাথার কাপড়টা একটু টেনে মায়মুনকে হাত দিয়ে আকষর্ণ করে—একি মায়মুন! ওঠ দ্যাখ কারা আইছে!
উকিল তখন বলতে শুরু করে—তোমারে সোলেমানের ব্যাটা ওসমানের লগে পঞ্চাশ টাকা দেন মোহরে নিকাহ দিলাম। তুমি রাজী আছ?
জয়গুন মায়মুনকে বুকে চেপে ধরে। বলে—কও মায়মুন, হ রাজী আছি।
একথা বোঝার বা বলার মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই মায়মুনের কাছে। কথা কয়টা তার অনুভূতিকে একটুও নাড়া দেয় না। তোতা পাখীকে শিখিয়ে দিলে সে যেমন বলে, মায়মনও তেমনি মা-র কথা অনুসরণ করে।
—রাজী আছি।
সাক্ষী ও উকিল পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসে। জয়গুন একগ্লাস শরবত মায়মুনের হাতে দিয়ে বলে—নে লক্ষী, এক চুমক খাইয়া গেলাসটা দিয়া দে।
উকিল সরবতের গ্লাস নিয়ে সাক্ষীর সাথে বিয়ের মজলিশে চলে যায়।
এক সঙ্গে অনেকগুলো বিয়ে হচ্ছে বলে একটা ভুলিও পাওয়া যায়নি। বিয়ের পর তাই সোলেমান বা তার ছেলে-বৌকে কোলে তুলে নিয়ে সকলের সাথে বাড়ীর দিকে পথ নেয়। মায়মুনের ছোট ও পাতলা শরীরের ওজনে সোলেমান খ বিস্মিত হয়। একটা তুলো ভরা বালিশের মত মনে হচ্ছে তার কাছে। সে মনে মনে চিন্তিত হয়। জোয়ান ছেলের জন্যে এতটুকু মেয়ে নেয়া ঠিক হল না বুঝি। আরো তিন তিনটি বছর পুষতে হবে ভাত-কাপড় দিয়ে, তবে ছেলের উপযুক্ত হবে বউ। কিন্তু এ তিন বছর–
সোলেমান খাঁ জোর করে চিন্তাটাকে সরিয়ে দেয়। ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে সে আজকের বিয়ের আনন্দটা মাটি করে দিতে চায় না।
ভোর রাত্রের দিকে বেশ শীত পড়ে। জয়গুন বাইরে চুলোর পাশে গিয়ে বসে। চুলোর মধ্যে বিয়ের রান্নার আগুন তখনও নিবে যায়নি। জয়গুন ঠাণ্ডা হাত দুটো চুলোর ওপর মেলে ধরে। মাথাটাও ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে। তার চোখ-ঝরা পানি চুলোর আগুনে পুড়ে অস্পষ্ট ছ্যাং-ছ্যাৎ শব্দ করে আর সাথে সাথে বাষ্প হয়ে মিশে যায় বাতাসে।
১৫. কাসুকে কড়া নজরে পাহারা
আজকাল করিম বক্শ কাসুকে কড়া নজরে পাহারা দেয়। যত দিন মাঠ-ভরা পানি ছিল ততদিন কালাপানির বন্দীর মত ছিল কাসু। কিন্তু মাঠে পথ পড়ার সাথে সাথে করিম বক্শ চিন্তিত হয়। তার মনে আশকা জাগে—কাসু হয়তো একদিন ফুড়ুত করে ওর মা-র কাছে চলে যাবে। সেদিন আর একটু আগে দুধ বেচতে বেরিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়েছিল আর কি!
করিম বক্শ আঞ্জুমনকে সতর্ক করে দেয়—কানা বুড়ী আমার বাড়ীতে পাও বাড়াইলে ঠাগা মাইর খোড়া কইরা দিবা। আমার তিরিসীমানায় দ্যাখতে পাইলে, ওর আর এট্টা চোখ কানা কইর্যা ছাইড়া দিমু। আমার তুমড়ীবাজি অহনও দ্যাহে নাই বুড়ী!
আঞ্জুমন করিম বকশের হৃদয় জয় করার মতলব নিয়ে বলে—বুড়ীরে দ্যাখলে ভাল। মানুষ বুইল্যা মনে হয়। কতাও কয় যেন মিছরির শরবত। দিলের মধ্যে এত কালি কে জানে!
কানা বুড়ীর দোষকীর্তন করায় আমনের ওপর করিম বক্শ মনে মনে খুশী হয়। কিন্তু সে তাকে বিশ্বাস করে না। সন্দেহ হয়—কাসুর মাথাটা হয়ত ইতিমধ্যেই আঞ্জুম বিগড়ে দিয়েছে। ঘরে-বাইরে এ রকম ষড়যন্ত্র অসহ্য। কোন রকমে মনের গোস্বা মনে চাপা দিয়ে সে কাসুকে পাহারা দেয়। বাইরে গেলেও সে কাসুকে সাথে করে নিয়ে যায়। যেদিন সাথে নেয়া সম্ভব হয় না, সেদিন গরুর দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে কাসুকে।
কয়েকদিন ধরে ধান কাটার ধুম পড়েছে। করিম বকা তার নারকেলের কোটা কাসুর হতে দেয়, আর আগুনের মালসাটা নিজের হাতের তালুতে বসিয়ে অপর হাতে দুটো কাস্তে নিয়ে মাঠে রওয়ানা হয়।
কাসুর হাতে একটা কাস্তে দিয়ে বলে—আমার লগে থাইক্যা ধান কাটতে হিগ। বড় অইলে এই কইর্যা খাইতে অইব।
কাসু তার ডান হাতের ছোট্ট মুঠোর মধ্যে কাস্তের মোটা হাতল ভালো করে সামাল দিতে পারে না। কোন রকমে হাতলটা চেপে ধরে সে দু’একটা করে ধানের ছড়া কাটতে আরম্ভ করে।
মাঠে আরো অনেক জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। দুরের একটা জমি থেকে কৃষাণদের সমবেত গান ভেসে আসে–
কচ-কচ কচ কচ-কচা-কচ
ধানরে কাটি,
মুঠা মুঠা ধান লইয়া বান্দি আঁটি-রে।
(ও ভাই) ঝিঙ্গাশাইলের হুড়ুম ভালা
বাঁশফুলেরই ভাত,
লাহি ধানের খইরে ভালা,
দইয়ে তেলেসমাত—রে।
কস্তুরগন্ধী চাউলরে আলা,
সেই চাউলেরি পিঠা ভালা,
সেই না পিঠায় সাজিয়ে থালা
দাও কুটুমের হাত—রে।
আল্লাদি বউ কোটে চিড়া
মাজায় রাইখ্যা হাত,
সেই না চিড়ায় কামড় দিয়া
বুইড়ার ভাঙে দাঁত—রে।
মিয়া বাড়ী ঘটক আসে
কন্যা-বিয়ার কথার আশে,
বোরো ধানের ভাত খাওয়ানে
মিয়ার গোল জাত—রে।
পাশের একটা জমিতে আলোচনা হচ্ছে। একজন বলে—আমরা হেদিন বৈঢকে ঠিক করলাম, সাতভাগা অইলে কেও ধান কাটতাম না। কিন্তুক দ্যাখ, ছমিরদ্দির দল সাতভাগায় গদু পরধানের ধান কাটতে শুরু করছে।
আর একজন বলে—আবার গানও লাগাইছে ফূর্তির ঠেলায়।
—হেইয়া করব না! বেয়াক্কেলরা এড়কও বোঝে না, এই বারের যেই প্রান, তা সাত ভাগের এক ভাগ নিয়া কি ওগ বাপ-মার ফত্তা করব?
—এই বচ্ছর যে ধানের অবস্থা, এই রহম অইব কে কইছিল? জুইতের ধান অইলে না অয় সাত ভাগায় কিছু অইত। কিন্তু একটা ধানের ছড়ার মধ্যে চাইর আনাই মিছা।
বর্ষার সময় ধানগাছের রকম দেখে অনেকেই অনেক আশা করেছিল। কিন্তু সবুজ ধান যখন সোনালী রঙ ধরতে শুরু করে, তখন চাষীরা ধানের ছড়া দেখে মাথায় হাত দেয়। এক একটা ছড়ার মধ্যে চার আনা ধানই অপুষ্ট—চালশূন্য চিটে। এখানে সেখানে ধানগাছ মরে যাওয়ায় জমিগুলো টাক পড়া মাথার মত হয়ে আছে।
করিম বক্শ কয়েক ‘ঘোপ কেটে আলের ওপর এসে পা ছড়িয়ে বসে। পাশের জমি থেকে ধানকাটা রেখে লেদু মিয়া আলের দিকে আসতে আসতে বলে—ভালা কইর্যা তামুক সাজ, চাচা। একটা দম দিয়া যাই।
করিম বক্শ বাশের ডিবা হতে তামাক নিয়ে সাজতে থাকে। অদূরে বসে কাসু ধানগাছের ডগা দিয়ে বাশী তৈরী করার চেষ্টা করছে। সুর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা বেশী দুরে নয় এখান থেকে। গাছটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে।
লেদু বলে—কাসুরে এই মাথা-ফাড়া রউদের মইদ্যে লইয়া আইছ কাঁ, চাচা? ওরে বাড়ীতে রাইখ্যা আইলেই পার।
—এহন এন্টু আধটু রউদ মাথায় না নিলে অইব ক্যাঁ? নোয়াব সাইজ্যা বইয়া থাকলে ত কাম অইত না। আর এই শীতের মিডাম রউদে তেজ নাই।
—তেজ নাই। তয় বড় হুকনা রউদ। দ্যাই না, চউখ-মোখ টানতে শুরু করছে। কাসুর হাত থেকে ধানগাছের নলটা নিয়ে লেদু বলে—দে, বানাইয়া দেই। বাশী তৈরী করতে করতে লেদু বলে—মাইয়ার বিয়াতে গেলা না যে চাচা? তোমার পরাণ কি দিয়া বানাইছে খোদায়? পাথর না পোড়া মাড়ি দিয়া কও দেহি? মায়া-দয়া কি এক্কেরেই নাই তোমার পরাণে? কাসুর মা–
করিম বশের ভ্রূকুটি ক্ষণেকের জন্য লেদুর মুখ বন্ধ করে রাখে। সে কাসুর দিকে বাঁশীটা ছুঁড়ে দিয়ে আবার শুরু করে—তুমি অমুন কর ক্যাঁ, চাচা? কাসু বড় অইয়্যা ওর মা-রে বিচরাইয়া–
করিম বক্শ সাজানো কল্কেটা হুঁকোর মাথায় না বসিয়ে ছুড়ে মারে লেদুর দিকে, চচিয়ে ওঠে—চুপ কর শয়তানের বাচ্চা! মশকারির জাগা পাস না? মানুষ চিনস না তুই?
লেদু ঘাড় নিচু করে আত্মরক্ষা করে। তার মাথার ওপর দিয়ে শো করে কল্কেটা ধানগাছের ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়ে।
আশেপাশের জমি থেকে কুষাণরা ছুটে আসে—কি অইল? কি অইল?
লেদুই বলে–কিছুই না। যাও তোমরা।
লেদু কল্কেটা তুলে গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে—রাগ করলা নি, চাচা? আর কোনোদিন কিছু কইমু না। এই কান ডলা খাইলাম দশবার।
করিম বক্শ তখনও রাগে গর গর করছে।
লেদু নিজেই এবার তামাক সেজে হুঁকোটা করিম বকশের হাতে দেয়। তারপর বলে—তোমার জমিনে এইবার ধানে বরাদ্দ নাই। আমাগ লগে ধান কাটতে যাইবা? খুরশীদ মোল্লার বটতলার ক্ষেতে ধান মন্দ অয় নাই। দিবও ছয় ভাগা।
করিম বকশের রাগ থামে। তার বদমেজাজের জন্য কেউ তাকে দলে নিতে চায় না। লেদুর এ প্রস্তাবে সে খুশী হয়। বলে—কবে যাইবা তোমরা?
—এই জমিনের ধান কাডা অইলে। তুমিও তোমার জমিনের ধান কাইট্যা কাবার কর।
–কাবার আমার কাইল অইব। পাতলা পাতলা ধান কাটতে দেরী লাগে না। এইবার তিন মাসের খোরাকীও অইব না। গেল বছর ছয় মাসের ধান পাইছিলাম। এহন তোমরা যদি দলে নেও, তয়ই না বাঁচতে পারমু।
—তোমারে দলে নিতে ত আপত্তি নাই! আপত্তি কিয়ের লেইগ্যা জানো? তোমার মেজাজের লেইগ্যা দলের কেউ রাজী হয় না। যাউকগ্যা, আমি বেবাকেরে বুঝাইয়া ঠিক কইর্যা নিমু। তুমি তোমার মেজাজ খান ঠাণ্ডা কর। আর একটু অইলে আইজ আমার। মাথাডা ফাড়াইয়া দিছিলা আর কি!
করিম বকশের নিজের জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। খুরশীদ মোল্লার বটতলার খেতে ধান কাটতে যাবে সে। কিন্তু কাসুকে আর পেছনে টানতে ভাল লাগে না। বটতলার খেত অনেক দূরে। রোদের মধ্যে এত দূরে নিয়ে ছেলেটাকে বসিয়ে কষ্ট দেয়া তার ইচ্ছে নয়। এ কয় দিনে ছেলেটা শুকিয়ে গেছে। তার চোখ-মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। আর যে ভয়ে সে কাসুকে সাথে সাথে নিয়ে বেড়ায়, সে ভয় সব জায়গায়ই দেখা দিয়েছে। কাসূকে ওর ফুফুর বাড়ী থেকে নিয়ে আসার পর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তাতে কাসু হয়তো অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছে। তবুও সে সাধ্যমত চেষ্টা করে। বাজার থেকে বিস্কুট, জিলিপি, কদমা, এনে কাসুকে খেতে দেয়। নিত্য-নতুন খেলনা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কোনো লোককে ওর কাছে ঘেঁষতে দেয় না, পাছে কেউ ওর মা-র কথা বলে দেয়।
কাল পান্তা ভাত খেয়েই করিম বক্শ ধান কাটতে যাবে। কিন্তু কাসকে বাড়ীতে রেখে যেতে তার মন সরে না। আবার তাকে সাথে নিয়ে গিয়েও কোন লাভ নেই। সেখানে উস্কানি দেয়ার লোক আছে যথেষ্ট। জয়গুনের বাড়ীর কাছের কেরামত আছে লেদুর দলে। কে কখন কোন তাল দিয়ে বসে বলা যায় না। সে ভাবে–তাল দিতে পারে সব্বাই,মিডাই দিতে পারে না কেউ।
মহাসমস্যা করিম বকশের সামনে। চিন্তা করে সে কোন সমাধান খুঁজে পায় না। আমন তামাক দিয়ে যায়। তামাক টানতে টানতে সে চিন্তা করে। তার চিন্তা তামাকের ধোয়ার সাথে কুণ্ডলি পাকাতে আরম্ভ করে।
এক সময়ে হুঁকোয় টান দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায় করিম বক্শ। তারপরই তার চোখে-মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
হুঁকোটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে সে এক লাফে বেরিয়ে পড়ে। পাশের বাড়ীর হারুনকে ডেকে চুপি চুপি যুক্তি করে দু’জনে।
হারুন বলে—সাদা চুল পাইমু কই?
—আমি যোগাড় কইরা দিমু। তুই এট্টা সাদা কাপড় যোগাড় করিস। আর খবরদার, কেও যেন না জানে। তুই আর আমি, বুঝালি কথা? তিন কান অইলেই সর্বনাশ।
একটু থেমে আবার বলে—আমার কাম যদি ফতে অয়, তয় তোরে একখান গামছা কিন্যা দিমু!
করিম বক্শ সন্ধ্যার সময় কাসুর কোমরের দড়ির বন্ধন খুলে দেয়। কড়া পাক-দেওয়া গরুর দড়িটার দাগ বসে গেছে কোমরে। করিম বক্শ আদর করে ডাকে—কাসু অ-কাশেম! চল্ বাজান, তোরে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা ধইরা দিমু। ওই তেঁতুল গাছে টিয়ার বাসা আছে।
কাসু উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।
—চল আমার লগে।
করিম বক্শ কাসুর হাত ধরে তেঁতুল গাছের দিকে নিয়ে যায়। পথে যেতে যেতে করিম বক্শ বলে—আমারে বাজান কইয়া ডাক দে।
দীর্ঘ চার বছর কাসু ফুফুর বাড়ীতে কাটিয়েছে। কেউ তাকে ঐ নামে ডাকতে শেখায়নি! অনভ্যস্ত বলে এখন বাজান ডাকতে কাসুর লজ্জা হয়। বাপের কাছে এসে সে আদর-স্নেহ যা পেয়েছে, তার চেয়ে মারধর খেয়েছে ঢের বেশী। করিম বক্শ ছেলের কাছে পিতার উপযোগী কোন ভক্তি-শ্রদ্ধাই অর্জন করতে পারেনি। সে যা অর্জন করেছে তা ভয়। কিছুটা ভয় আর বেশীর ভাগই লজ্জায় কাসু বাজান বলে ডাকতে পারে না। এ জন্য কতদিন মারও খেয়েছে। মার খেয়ে অনিচ্ছায় উচ্চারণ করেছে কয়েক বার। কিন্তু মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে শব্দটি কোনদিন বের হয়নি।
করিম বক্শ আবার বলে…কিরে, ক। না কইলে টিয়াপক্ষীর বাচ্চা দিম না।
এত লোভ দেখানো সত্ত্বেও কাসু মুখ বুজে থাকে। কোন কথাই বের হয় না মুখ দিয়ে। করিম বক্শ আর পীড়াপীড়ি করে না।।
তেঁতুল গাছের কাছাকাছি যেতেই কি রকম এক গোঙানির শব্দ শুনে কাসু থমকে দাঁড়ায়।
করিম বক্শ বলে—কিরে, কি অইল?
—অইডা কি দোহা যায়? তেতুল গাছের টিকিতে বইয়া রইছে! করিম বক্শ কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলে—সত্যই ত! পাকনা চুল ছাইড়া বইয়া রইছে! আবার গোঙায়!
করিম বক্শ চোখ দুটো বড় করে বলে-খাড়া, দেইখ্যা লই।
কাসু এবার করিম বকশের হাত ধরে তার গায়ের সাথে মিশে দাঁড়ায়। করিম বক্শ কাসুকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে।
—কাসু, শিগগির আমার কোলে ওঠ। বাপরে বাপ! এইডা ত আর কিছু না! এইডা যে। গোঙাবুড়ি! গলা টিপ্যা ধরব! আল্লা! আল্লা, বাঁচাও! আল্লা, আল্লা! কাসু, আল্লার নাম কর। আল্লা, আল্লা।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে মুখ লুকায়। ভয়ে চোখ বন্ধ করে। কাঁপে থরথর করে। করিম বক্শ কাসুকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয়। বাড়ী এসেও কাসু চোখ খোলে না।
রাত্রে শুয়ে শুয়ে করিম বক্শ বলে—কাসু, আমারে বাজান কইয়া ডাক দে। বা’জান না ডাকলে গোঙাবুড়ী বোলাইমু।
অন্ধকারের মধ্যে শিউরে ওঠে কাসু। করিম বক্শকে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। তার চোখের সামনে তখনও যেন সে দেখছে গোঙাবুড়ীর বিকট মূর্তি।
করিম বক্শ কাসুকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ভান করে বলে—সইর্যা যা আমার কাছতন। আমারে বাজান না কইলে এহনি গোঙাবুড়ী ডাক দিমু।
কাসুর ভীত-কম্পিত কণ্ঠ অস্ফুট শব্দ করে–বাজান।
করিম বক্শ সাড়া দেয়। তারপর বলে—কাসু, বাড়ীর বাইরে যাইস না কিন্তুক, খবরদার! ঐ গোঙাবুড়ী গলা টিপা ধরব! তেঁতুল গাছে আরো একটা পিচাশ আছে! হেইডার নাম ছালাবুড়ী। ছালার মইদ্যে ভইরা তোর মতন ডেগা পোলা পাইলে লইয়া যায়। তারপর তেঁতুল গাছে বইস্যা রক্ত খায়।
কাসু করিম বকশের বুকের মধ্যে শিউরে ওঠে। তার কাঁপুনি করিম বক্শও অনুভব করতে পারে।
সে আবার বলে—খরদার! কানাবুড়ীর সুরত ধইর্যা ছালাবুড়ী ধইরা লইয়া যাইব।
করিম বক্শ তার অদ্ভুত ফন্দির সফলতায় মনে মনে খুশী হয়। কাসুকে বাড়ীতে রেখে এখন নিশ্চিন্তে কাজ করা যাবে। কাসু ভুলেও জয়গুনের বাড়ীর দিকে পা বাড়াবে না। কারণ পথের ওপরেই তেঁতুল গাছ। আবার ছালাবুড়ীর চেহারা নিয়ে কানা বুড়ীও এসে আর সুবিধে করতে পারবে না।
করিম বকশের মতলব হাসিল হয়েছে। কাসু এখন আর বাড়ী থেকে বের হয় না। আগে বাড়ীর উত্তর পাশটায় গিয়ে দাঁড়াত সে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটার দিকে চেয়ে চেয়ে সে
অনেক সময় কাটিয়ে দিত। রোজ ঐ তালগাছটা দেখে দেখে সে তার মা-র চিন্তাটাকে তাজা করে নিত মনের মধ্যে। মা-র অভাব তাতে অসহনীয় হয়ে উঠত। তেতুল গাছে গোঙাবুড়ী দেখার পর সে আর কোনো দিকে পা বাড়ায় না।
সে কখনও ফুলির বিছানার পাশে, কখনও উঠানে, কখনও বা রান্না ঘরে তার সৎমার পাশে বসে কাটিয়ে দেয়। এমন কি গোয়াল ঘরের পাশে যেতেও এখন তার সাহস হয় না।
মা-র মধুর চিন্তা তার মনে বার বার যে ছাপ রেখে গেছে, তা কখনও মুছবার নয়। সে স্থায়ী ছাপকে এখন ভুতের বীভৎস মূর্তি যেন রাহুর মত গ্রাস করছে। গোঙাবুড়ীর গোঙানি, ছালাবুড়ীর ছালা, তাদের নখর ও দাতের এলোমেলো কল্পনা কাসুকে সব সময়ে সন্ত্রস্ত করে রাখে। কোনো ঠুংঠাং শব্দ শুনলেই সে ভয়ে অস্থির হয়। রাত্রে ঘুমের ঘোরে সে চিৎকার করে ওঠে। করিম বক্শ সে চিৎকারে সজাগ পেয়ে কাসুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে–কিরে কাসু, অমুন করস ক্যান?
কাসু কোন উত্তর দেয় না। করিম বকশের বুকের মধ্যে গিয়েও সে কাঁপে থরথর করে।
হঠাৎ একদিন কাসুর জ্বর হয়। প্রথম দিন-দুই করিম বক্শ মোটেই গা করে না। তিন দিনের দিন বেশ তোড়জোড়ের সাথে জ্বর ওঠে। বিছানায় পড়ে পড়ে কাসু প্রলাপ বকে।
করিম বক্শ দাওয়ায় বসে মাটির ওপর আঁচড় কেটে বাকী খাজনার হিসেব করছিল। সে ঘরের মাঝে উঠে এসে বলে-কাসু, অ কাসু! কি অ্যাঁ? অমন করস ক্যাঁ?
—ছালাবুড়ী আইল! উঃ-উঃ-উঃ! না—না, বাজান কইতাম না।
করিম বক্শ কাসুর মাথায় কপালে হাত দিয়ে দেখে। হাত রাখা যায় না। মনে হয়, পুড়ে যাবে হাত।
—মা, মা, মাগো মা।
করিম বক্শ বলে—ম্যাও ম্যাও করস ক্যাঁ? আল্লা আল্লা কর। আল্লায় রহম করব।
কাসুর হুঁশ নেই। সে কখনও বিড় বিড় করে, কখনও বা টানিয়ে টানিয়ে প্রলাপ বকতে থাকে।
করিম বক্শ উদ্বিগ্ন হয়। সে তাড়াতাড়ি করে ফকির বাড়ী যায়। গ্রামের সেরা ফকির দিদার বক্শ এসে হাতের লাঠিটা বেড়ার সাথে ঠেকিয়ে রেখে কাসুর বিছানার পাশে বসে।
কাসু প্রলাপ বকছে—ওইডা কি? তেঁতুল গাছ!
কিছুক্ষণ বসে থেকে দিদার বক্শ চোখ বুজে ওপরের দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটে চাপ দিয়ে বিজ্ঞের মত কয়েকবার মাথা নাড়ে। তারপর গাম্ভীর্যের সাথে বলে—আর দ্যাখতে অইব না। মোখ দেইখ্যা আগেই আমি বোঝতে পারছি।
করিম বক্শ উদ্বেগভরা কণ্ঠে বলে-কি, পাগল ভাই?
দিদার বক্শকে সবাই পাগলা দিদার বলে।
সে বলে—আবার কি! কথা হুইন্যাও মালুম করতে পার না? দ্যাহ না কেন বিলকি-ছিলকি কয়?
—আমিও আগেই মালুম করছি কিছু। সব সময় খালি কয় গোঙাবুড়ী আইল। গলা টিপ্পা ধরল। আল্লা খোদার নাম নাই মোখে। আর কেবল ম্যাও ম্যাও করে। আমার দাদার মোখে হুনছি, ভূতে পাওয়া মানু আল্লার নাম ভুইল্যা যায়। এহন কি করা যায়, পাগল—ভাই?
—কিছু চিন্তা নাই! হোন, একখান ন্যাকড়া লইয়া আহ। আর এক চামুচ কডুতেল।
ফকিরের নির্দেশ মত করিম বক্শ ন্যাকড়া ও সর্ষের তেল নিয়ে আসে। ন্যাকড়া দিয়ে। দড়ি পাকিয়ে ফকির তার এক প্রান্ত ডুবিয়ে ধরে তেল-ভরা ঝিনুকের মধ্যে। তারপর বাতির শিখার ওপর দড়ির তেল-মাখন মাথাটা পোড়া দেয়। দড়ির প্রান্ত থেকে যখন ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে, তখন ফকির কুণ্ডলায়িত ধোঁয়াসহ গরম প্রান্তটা কাসুর নাকের মধ্যে বারবার প্রবেশ করিয়ে দেয়। কাসু যন্ত্রণায় উঃ করে ওঠে প্রত্যেক বার। তার কোমরটা বিছানা ছেড়ে উঁচু হয়ে ওঠে। শক্তি নিঃশেষ করে হাঁচি দেয় কয়েক বার।
মুখে হাসি টেনে ফকির বলে—আঁচি দিছে, আর চিন্তা নাই। এই অ্যাঁচির ঠেলায় আলাই-বালাই পলাইব। যদি একে না-ই পলায়, তয় মাগরিবের ওক্তে একবার খবর দিও। আইজ রাতেই বৈডক দিমু। হেইখানে বোলাইয়া ওর চৌদ্দ-গোষ্ঠির ছেরাদ্দ করুম। ভালয় ভালয় যদি না যায় তো ওস্তাদ শেখ ফরিদের নাম লইয়া এমুন মন্তর ঝাড়, যার তেজে সুড় সুড় কইর্যা আমার বোতলের মইদ্যে ঢুকব। আমি তহন চট কইর্যা বোতলের মোখ বন্ধ কইরা দিমু। তারপর আমার শিথানের নিচে মাড়িতে গর্ত কইর্যা বোতলডা উপড় কইর্যা বহাইয়া মাড়ি দিয়া ঢাইক্যা দিমু। আমার শিথানের নিচে কি একটা দুইডা! এই রহম কত ভূত-পেত্নী, দানা-পিচাশ জিন-আত কবর দিয়া থুইছি, লেখাজোখা নাই। কিন্তুক জাহিলগুলার মউয়ত নাই। রাইতে যহন বালিশে মাথা রাখি, তহন কত কান্দা-কাড়ি! কয়—আর কোন দিন আদমজাতের ক্ষেতি করতাম না। একবার ছাইড়্যা। দ্যাও। তোমার গোলাম অইয়া থাক। তোমারে পাকিস্তান জয় কইরা দিমু, পাকিস্তানের রাজা বানাইমু। আমিও কই—আমি রাজা অইতে চাই না। তোরা রোজকিয়ামত পর্যন্ত বোতলের মইদ্যে থাকবি। গোলমাল করলে উফায় নাই।
করিম বক্শ শোনে মনোযোগ দিয়ে। ফকিরের গল্প শুনে সে বিস্ময়ে হতবাক। একটা কুলোয় করে সে সোয়া সের চাল আর সোয়া পাঁচ আনা পয়সা এনে ফকিরের পায়ের কাছে রেখে দেয়।
রাত বারোটার পর বৈঠক। মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালিয়ে লোকজন ও শাগরেদসহ দিদার বক্শ ফকির ‘ভারানে’ বসে!
আগেই সে জিজ্ঞেস করে—কার উপরে চালান দিমু, করিম বক্শ? তোমার উপরে?
—আমার উপরে! না—না—না খবরদার ভাই, খবরদার! আমার ডর করে।
—ভর করলে চলব ক্যাঁ? তোমার উপরে ত আর চিরজনম ভর অইয়া থাকব না। আমার কাম অইয়া গেলে আবার নামাইয়া দিমু।
—না! আর কেওরে কইয়া দ্যাহেন।
—কে আছে আর? রুস্তম, তুমি? সাদেক? হারুন? কিছু ভর নাই। এক্কেরে পান্তাভাত।
সবাই মাথা নেড়ে অস্বীকার করে! শেষে ফকির তার এক শাগরেদকে ঠিক করে। তার ওপরেই ভর করবে ভূত।
দিদার বক্শ মোমবাতি নিবিয়ে দিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেয়— খবরদার, কেও চউখ উপর দিক কইর্য না! ভূতের চউখে চউখ পড়লে তোমাগ চউখ গইল্যা পানি অইয়া
ফকির এবার বাবরি চুল নাচিয়ে গলার মধ্যে কেমন ফাস ফাস শব্দ করে ‘জিকির’ আরম্ভ করে।
এক সময়ে ঘরের চালার ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে।
ফকির বলে—চাইশা মারস ক্যাঁ? পিড়পিড়াইয়া ঘরে আয়। ঘরে আইতে অইবই।
কিছুক্ষণ পরে ঘরের চালাটা কড়কড় করে ওঠে। সাথে সাথে ফকিরের চেলাটিও দুলতে আরম্ভ করে আর গলার ভেতর অদ্ভুত ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ করে—হ্যাঁরে—হাঁই—হুম।
সবাই বুঝতে পারে, ওর ওপরে ভূত ভর করেছে। দিদার বক্শ এবার টানা সুরে বলতে আরম্ভ করে–
আমার নাম দিদার বক্শ শুইন্য মন দিয়া
আমার নামে ভূত-পত্নী সবাইর কাঁপে হিয়া!
শেখ ফরিদের নাম লইয়া যদি মন্তর ঝাড়ি,
হাজার গণ্ডা ভূত-পেত্নী ভেন্টাইবার পারি।
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
তোমার লেইগ্যা বইস্যা আছি, কও তোমার নাম।
কিবা জাত, কিবা গোত, কোন খানেতে ধাম?
হ্যাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
শাগরেদের ওপর চালান-দেওয়া ভূত বলে—
আমার নাম ল্যাজফটকা থাকি ডালে ডালে,
কাচ্চা-বাচ্চা পাই যদি ভরি দুই গালে।
সিয়ানা অইলে তার কান্ধে চইড়্যা বসি,
লহু মাংস শুষে খাই সারা দেহ চষি।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
রুস্তম অন্ধকারের মধ্যে বাম হাত চালিয়ে পাশের সাদেকের পিঠে চাপ দেয়। উদ্দেশ্য, সাদেকের মনে এ ব্যাপারে আরো বেশী বিস্ময় জাগিয়ে তোলা। সাদেক কাঁপছে থরথর করে। তার রক্তও বুঝি হিম হয়ে যায়।
পাশের ঘরে কাসু থেকে থেকে প্রলাপ বকছে। ফকির আবার বলে—
শোনরে ভাই ল্যাজফটকা, রাখ বাজে কথা,
বাঁচতে চাইলে উড়াল দে যথা ইচ্ছা তথা।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
এই বাড়ী ছাইড়া যদি না যাস চলে,
লোয়া পুইড়্যা লাল কইর্যা ছেঁকা দিমু গালে।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
ভূত বলে—
তোর মতন ফকিরের রাখি কিরে ডর?
কত ফকির ভাইগ্যা গেল খাইয়া থাপ্পর।
হাঁরে—হাঁই-হুম-হাঁই-হুম-হাঁই।
বিছানার ওপর দুই হাতের থাপ্পড় মেরে ফকির বিকট চিৎকার করে–
তয়রে হারামজাদা বইস্যা থাক সোজা,
পাগলা দিদার মন্তর ঝাড়ব বুঝবি এহন মজা।
কই গেলিরে ল্যাৰা ভূত, কই গেলিরে ট্যাবা,
কই গেলি কাইল্যা ঠ্যাড়া, কই গেলিরে খ্যাবা,
সমদ্দুরের ফেনা আইন্যা–
ভূত এবার ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। দুই হাতে ফকিরের পা জড়িয়ে ধরে বলে—না, না, না। আমি এহনি চইল্যা যাই। সব্বনাশ কইর্য না আমার। বাপ্পুস রে!
—হ, অহনি চইল্যা যা। দেরেং করলে বোতলের মইদ্যে আটকাইয়া ফ্যালাইমু, কইয়া। দিলাম হেই কতা।
—তুমি আমার মনিব। আমি তোমার নফর। যাওনের আগে একটা ভোগ দ্যাও।
–কিয়ের ভোগ?
—আড়াই গণ্ডা শবরীকেলা, মিহিন চাউলের ভাত
সেরেক পাঁচেক মাইপ্যা দিও কাইট্যা কেলার পাত।
ঝাল-ছাড়া নুন-ছাড়া পোড়া গজার মাছ,
রাইখ্যা দিও এইগুলা যেথায় তেঁতুল গাছ।
ফকির বলে—আইচ্ছা, আইচ্ছা, দিমু। তুই অহন পলা।
অন্ধকারের মধ্যে ঘরের চালাটা আবার কড়কড় করে ওঠে।
বাতি জ্বালাতেই দেখা যায়, ফকিরের শাগরেদ বিছানার ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। ফকির ও তার অন্যান্য শাগরেদ ছাড়া আর সবার মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে।
ফকির এবার পানিতে হাত ভিজিয়ে শাগরেদের গায়ের ওপর ছিঁটিয়ে দেয়। শাগরেদ লাফ দিয়ে ওঠে।
ফকির আড়ামোড়া ভেঙে শাগরেদকে জিজ্ঞেস করে—কিরে, কই আছিলি এতক্ষুণ?
—ঘুমাইয়া পড়ছিলাম।
ফকির মাথা নাড়ে আর গোঁফের তলা দিয়ে হাসে।
করিম বক্শ বলে—ঘুমাইছিলা! আর তোমার উপরে এত তফরখানা গেল!
ফকির অভিভাবকের মত বলে—থাউক, থাউক, ওয়া নিয়া আর মাথা ঘামাইয়া কাম নাই। হোন করিম বক্শ, কামডা খুব সহজে অইয়া গেল। ওরে ওই হগল খাইতে দিলেই ও চইল্যা যাইব। কাইলই বাজার তন গজার মাছ, কেলা আর চিনিগুড়া চাউল আইন্যা আমার কাছে দিও। তেতুল গাছের গোড়ায় আমিই রাইখ্যা আসমু ঠিক রাইত দুপুরের সুময়। তোমাগ যেই ডর! তোমার উপরে এই কাম ছাইড্যা দিতে ভস্সা পাই না।
একটু থেমে আবার সে বলে—ভুত ছাইড়া গেলে কাসুরে গোসল করাইয়া পাক-সাফ করতে অইব।
—গোসল! এই জ্বরের মইদ্যে?
–-হ, হ। জ্বর কুথায় দ্যাখছ তুমি? এইডাও জান না, ওরা আগুনের তৈয়ারী? আমাগ মতন মাডির তৈয়ারী না। ঘেড়ির উপরে চাইপ্যা থাকলে শরীল গরম না অইয়া যায়? পরশু বিহানে মোরগের বাকের আগে কাসুরে রাস্তার তেমাথায় নিয়া গোসল করাইতে অইব। তুমি সাত পুকুরের পানির যোগাড় রাইখ্য। সাত ঘাডের না কিন্তুক। এক পুকুরেরও সাতখান ঘাড থাকতে পারে। সাত পুকুরের পানি অওয়ন চাই।
১৬. মায়মুন শ্বশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে
মায়মুন শ্বশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে। জয়গুন রাগে ফেটে পড়ে। কঠিন স্বরে জেরা করতে আরম্ভ করে—না কইয়া পলাইয়া আলি ক্যাঁ? এহন মাইনষে হুনলে ঝাটা মারব মোখে।
—পলাইয়া আহি নাই মা। খেদাইয়া দিছে।
—খেদাইয়া দিছে!
—হ, দ্যাহ না আমার নাক-কান খালি। গয়নাগুলা খুইল্যা নিছে। পিন্দনের কাপড় রাইখ্যা এই ছিঁড়া কাপড় দিছে।
কৈফিয়তে জয়গুনের রাগ নামে। ব্যাপারটার কিছু কিছু সে হাসুর কাছে শুনেছিল সেদিন। কিন্তু তার শাশুড়ীর এরূপ আচরণের কোন কারণ হাসু বলতে পারেনি। সেও ভেবে পায় না। জয়গুন আবার জেরা করে–কি দোষ করছিলি? ক’ শীগগীর।
—কিচ্ছু দোষ করি নাই, মা। মায়মুনকে শ্বশুর বাড়ীর কেউ পছন্দ করেনি। সোলেমান খাঁও না। কিন্তু অপছন্দের কথা সে কখনও মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কারণ সে নিজেই দেখেশুনে ছেলের জন্যে বউ পছন্দ করেছিল।
মায়মুন যেদিন প্রথম শ্বশুর বাড়ী আসে, সেদিনই তার শ্বশুর-শাশুড়ীর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
শাশুড়ী বলে—তুমি কি চউখের মাথা খাইয়া বউ দেখছিলা? এই রহম জালি বউ দেইখ্যা-হুইন্যা আনে কেও? এহন ভাত কাপড় দিয়া পালতে অইব।
—জালি কোহানে দ্যাখছ তুমি? এক্কেরে ঝুনা নাইকল।
—হ, ঝুনা না আরও কিছু। ও না পারব ওসমানের ঘর করতে, না পারব এক কলসী পানি আনতে। দুই ঠ্যাং লইয়া টেকির উপরে ওঠলেও কথা হোন না ঢেঁকি! দুই সের চাউলের ভাতের আঁড়ি উডাইতে গেলে ফেলাইয়া দিব। তহন ভাতও যাইব, আঁড়িও যাইব।
সোলেমান খাঁ কথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারে। কিন্তু নিজের কৃতকর্মের জন্যে স্ত্রীর কাছে সে হার মানতে রাজী নয়। সে স্ত্রীকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে—তুমি কিছু চিন্তা কইর না। হবায় বিয়ার পানি পাইছে। দুই মাসের মইদ্যেই দ্যাখবা বউ আমাগ লায়েক অইছে।
কিন্তু দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। মায়মুন তার শ্বশুর-শাশুড়ীর চোখের সামনে তাদের ইচ্ছেমত বড়সড় হয়ে উঠল না। যেমন ছিল, তেমনটি রয়ে গেল। শাশুড়ীর রাগ ধরে—কেন সে ভোমরায় আল দেওয়া কদুর মত ঝিম ধরে থাকল, কেন হাতে-পায়ে বড় হয়ে উঠল না।
সোলেমান খাঁর এজলাসে প্রায়ই এ ব্যাপারে শুনানি হতে থাকে। একদিন সোলেমান খাঁর স্ত্রী বলে—ভাত খাইতে ত কম খায় না। আমাগ দুনা ভাত খায়। যদি জিগাই আর নিবি বউ? তয় কোন দিন ‘না’ করব না। আঁসের মতন গলা–সমান খাইয়া টাববুস অইয়া তারপর উঠব। এত খাওয়া ত’ বড় অয়নের নাম নাই। আর অইবই বা কেমনে। সুর্য-দীগল বাড়ীর মাইয়া। পরাণ লইয়া বাঁইচ্যা আছে, এই কালের ভাইগ্য। তোমারে হেইসুম কত কইর্যা যে কইলাম, সূর্য-দীগল বাড়ীর মাইয়া আননের কাম নাই। হেইয়া হোনলা না। মাইয়ার উপরে পেত্নীর দিষ্টি না আছে ত কি কইলাম।
সোলেমান খাঁ মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর বলে মানুষ ত তিন আঙুল। এত ভাত রাখে কই?
কে জানে কই রাখে? আমার মনে অয় গলার তন পাও পর্যন্ত বেবাকখানি ওর প্যাট। এমুন হাবাইত্যা ঘরের মাইয়া বেশী দিন ভাত-কাপোড় দিয়া রাখলে তোমারে আর বিচরাইয়া পাওয়া যাইব না—তালুক-মুলুক বেচতে অইব।
সোলেমান খাঁ নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরে। গালে হাত দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলে—আমার মনে লয়, তোমার কথাই খাডি। পেত্নীর দিষ্টি আছে। পেত্নী ওর লগে খায় বুইল্যাই না এত ভাত লাগে।
সোলেমান খাঁ-র স্ত্রী আবার বলে—হোন কই, এই রাকস রাহনের কাম নাই। হেদিন ওসমানের ঘরে দিছিলাম। শরমেরও কত। রাইতে হেই কি চিক্কইর! আর এট্ট অইলে চৌদ্দ বাড়ীর মানু একখানে কইরা লইত? ছিঃ ছিঃ! অ-ঘিন, অ-ঘিন। বোঝলাম, এইডা জুয়ান অইতে অইতে আমার ওসমান ঠণ্ডা অইয়া যাইব। আর এদ্দিন তক্ত বহাইয়া। খাওয়াইলে ফউত অইয়া যাইবা, কইয়া রাখলাম। কমসে কম তিন খান বচ্ছর ত লাগব লায়েক অইতে।
-কি করতে চাও ত?
–আমি কই, ওরে ওর মা-র কাছে পাইয়া দ্যাও। মা-রড খাইয়া বড় অউক। জেরে দাহা যাইব।
সোলেমান খাঁ সব শুনে এবার রায় দেয়——ওরে ওর মার কাছেই পাড়াইয়া দ্যাও। আমি আবার ওসমানের শাদী দিমু।
—গয়নাগুলা?
—খুইল্যা রাখবা। ওসমানের বিয়া দিতে লাগব তো। আবার জোড়ায় জোড়ায় গয়না বানাইমু, ট্যাকা কই? টাকা কি গাছের গোড়া যে, ঝুল দিলেই পড়ে? খালি গয়না কী, কাপোড় দুইডাও রাইখ্যা দিবা। কয়মাস আগে কিনছি। অহনও দুই ধোপ পড়ে নাই। এই কাপোড় আর গয়না দিয়া হাজাইয়া নতুন বউ ঘরে আনমু।
তারপর একদিন হাসু ও শফি আসে মায়মুনকে দেখতে। মায়মুনের শাশুড়ী, দুটি ননদ ও ছোট্ট একটি দেবর একটা চাঙারির চারপাশে চক্রাকারে বসে কাঁচা মটরশুটি ছাড়াচ্ছিল। মানুষ আসার শব্দ পেয়ে মায়মুনের শাশুড়ী একবার তাকায়। তারপর মাথায় আঁচল টেনে আবার মটরের দানা বাছতে শুরু করে।
হাসু ও শফি পরস্পর মুখের দিকে তাকায়। এ রকম অবজ্ঞা ও অবহেলার কি কারণ থাকতে পারে, তারা ভেবে পায় না। হাসু জিজ্ঞেস করে–কেমুন আছেন মাঐ সা’ব? মায়মন কই?
উত্তর দেয় মায়মুনের ছোট ননদ, গাঙ্গের ঘাডে পানি আনতে গেছে। তার মুখের কথা। শেষ না হতেই মায়মুন আসে। কাঁখের কলসীটা ছোট। তবুও তার ভারে মায়মুন সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। কোমর বেঁকিয়ে খোড়ার মত পা ফেলতে ফেলতে সে আসে। হাঁসু ও শফিকে দেখতে পেয়ে খুশীতে ভরে ওঠে। সে পানির কলসীটা রান্না ঘরে রেখে ছুটে আসে। হাসুর একটা হাত ধরে বলে—মিয়াভাই গো, কোনসুম আইলা?
–এইত আইলাম।
–আমি যাইতাম তোমার লগে।
জরিনা বিবি অথাৎ মায়মুনের শাশুড়ী এবার ফোঁস করে ওঠে—হ, যাও ভাইর লগে অহনই চইলা যাও। হ হাশেম মিয়া, তোমায় আললাদি বইনগারে আইজই লইয়া যাও। আমরা আর রাখতে চাই না।
–কি অইছে মাত্র? কোন দোষ করছে মায়মুন?
—না বাপু, অমুন ঝিরকুইট্যা বউ দিয়া আমাগ চলব না। কই গেলি ওসমান? কি কইছিলাম?
জরিনা বিবি ঘরে যায় ওসমানের কাছে। আস্তে আস্তে বলে—গয়না গুলা খুইল্যা রাখ। পিন্দনের কপোড়ডা রাইখ্যা এট্টা ছিঁড়া কাপোড় দিয়া দে! ওড়া পিন্দা কোন রহমে শরম বাঁচাইয়া আতে পায়ে যাউকগা ভাইর লগে।
ওসমানের চোখে-মুখে অক্ষমতা ফুটে ওঠে। হাসু ও শফির উপস্থিতিতে এ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে বলে—তুমি দ্যাও গিয়া। আমার শরম করে।
—আহা, আমার নতুন বউ রে! অত যদি শরম, তয় ঘোমডা দিয়া ঘরে বইয়া থাক। তোরা মরদ অইছিলি কোন দুকখে? আমি মাইয়া মানুষ। পারি কিনা-পারি দ্যাখ চউখ মেইল্যা!
জরিনা বিবি দুই গোত্তা দিয়ে দু’পা এগুতেই ওসমান বাধা দেয়—মা, মা, হোন। ওরা আইজ যাউকগা। পরশু তরশু আইয়া যেন লইয়া যায়।
জরিনা বিবি দরজার ওপর দাঁড়িয়ে যায়। ওসমানের দিকে ফিরে বলে—আইচ্ছা, কইয়া দেই।
তারপর ঘর থেকে নিচে নেমে হাসু ও শফির দিকে চেয়ে বলে—হোন বাপু। কাইল পরশু আইয়া তোমাগ বইনেরে লইয়া যাইও।
হাসু বলে—বিষয় কি? কি অইছে মাঐ?
—কিচ্ছুই অয় নাই মিয়া। যা কই মনে থাকে যেন।
শফি হাসুর দিকে চেয়ে বলে—আইজই মায়মুনেরে লইয়া যাই।
—না, আইজ থাউক। মা-র কাছে জিগাইয়া দেহি, যদি নিতে কয়, তয় লইয়া যাইমু। হাসুর কথা শুনতে পেয়ে জরিনা বিবি বলে—মা-র কাছে আর হোনতে অইব না বাপু। তোমার মা মানা করত না। কাইল আইয়া লইয়া যাইও।
-আইচ্ছা।
এই ‘আইচ্ছা’ বলে যে হাসু চলে গেল আর হাসুর দেখা নেই। জরিনা বিবি নিজেই মায়মুনের গায়ের গয়না খুলে একটা ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে তাকে তৈরী করে রেখেছে। তিন দিনের দিনও যখন কেউ এসে নিয়ে গেল না, তখন তার পরের দিন ভোরবেলা জরিনা বিবি নিজেই মায়মুনের হাত ধরে বাড়ীর নিচের মটর খেতের পাশে এনে ছেড়ে দেয়।
তাদের পেছনে মায়মুনের দুটি ননদও এসে দাঁড়ায়।
দূরে সুর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছটা দেখিয়ে জরিনা বিবি বলে—ঐ তালগাছটা বরাবর চইল্যা যাও। খোদায় যদি তোমার কপালে এই বাড়ীর ভাত লেইখ্যা থাকে তো আবার আইও, অহন মা-র বুকের দুধ খাইয়া মোটা তাজা অও গিয়া।
—আমি একলা যাইমু? মায়মুন জরিনা বিবির মুখের দিকে তাকায়।
—একলা যাইবা না তো দোকলা পাইবা কই? যাও। তোমার রূপ বাইয়া বাইয়া পড়ে না সোনা। পথের মাইনষে ধইর্যা লইয়া যাইব না।
মায়মুন যেন কারাগার থেকে খালাস পেয়ে এল। তার আনন্দই হয়। আর সে আনন্দ বেড়ে যায় প্রত্যেক পদক্ষেপে। পেছনে তাকাতেও তার ভয় হয়।
কিন্তু বাড়ীতে পা দিয়ে মা-র কর্কশ জেরার মধ্যে পড়ে তার বুক দুরু দুরু করতে থাকে।
জয়গুন আবার জিজ্ঞেস করে–কি দোষ করছিলি?
—কিচ্ছু দোষ করি নাই মা।
—দোষ-ঘাইট না করলে অম্বায়ই খোদাইয়া দিল? হাসুকে দিয়া অহনই আবার পাড়াইয়া দিমু।
শফির মা আসে। কথার আগা-গোড়া না শুনেই শুরু করে—পুরুষের ঘরতন পলাইয়া আহে কেও? পুরুষের ঘরই মাইয়ালোকের হাপন ঘর। হেইখানে জিন্দিগী কাড়াইতে অইব। হউর-হাউরীর খেদমত করতে অইব। মরলেও হেই মাড়ি বুকের উপুর লইয়া থাকতে অইব। হেই মাড়ি ছাড়তে আছে? হেই মাড়ি কামড় দিয়া পইড়্যা থাকতে অয়।
মায়মুনের মুখের দিকে চেয়ে দেখে জয়গুন। আসহায় চোখ দুটো টলটল করছে, করুণা ভিক্ষা করছে তার কাছে।
এবার মায়মনের ওপরের সমস্ত রাগ জয়গুন শফির মা-র ওপর ঢালে। সে বলে—থাউক, থাউক। আর বকরবকর কইর্য না। তুমি বুড়া অইছ বাতাসে। তোমার কথায় মাডি খাইছি আমি। অমন বুইড়া জামাইর কাছে মাইয়া না দিয়া কুচি কুচি কইর্যা কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দেওয়ন ভাল আছিল। আমার বাড়ী থাকতে ও এমুন আছিল? প্যাট ভইরা ভাত খাইতে না পারলেও, এই রকম হকনা কাষ্ট আছিল না।
শফির মা মায়মুনকে জিজ্ঞেস করে—তোর হাউরী প্যাট ভইর্যা তোরে খাইতে দেয় নাই, মায়মুন?
—এই দুই মুঠ ভাত দিয়া কইত—নে, খাইয়া ওঠ বউ। দিনকাল ভালা না। প্যাট উনা থাকলে কোন ব্যারাম-আজার আইতে পারে না।
—অ্যাঁহ-হ্যাঁ-হ্যাঁ। কাসুর মা বাড়ীতে আছ?
গলা খাঁকারি দিয়ে সাদেক মিয়া সকলের সামনে এসে দাঁড়ায়।
জয়গুন মাথায় কাপড়ের আঁচল টেনে দেয়। শফির মা জিজ্ঞেস করে—কি খবর সাদেক মিয়া?
—খবর বেশী ভালা না। কাসুর খুব অসুখ। যহন-তহন অবস্থা।
জয়গুন চমকে ওঠে। তার পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। দুনিয়াটা অন্ধকার ঠেকছে চোখে। ঘোমটার নিচে অস্ফুট প্রতিধ্বনি হয়-কাসুর অসুখ! যহন-তহন অবস্থা।
—বেহাল অবস্থা। করিম ভাই আমারে পাড়াইয়া দিছে, তোমারে নিতে। দেরী অইলে–
সাদেক মিয়ার মুখ দিয়ে কথার শেষটা বের হয় না।
কাসুর শয্যা-পার্শ্বে দু’জন মৌলবী অনর্গল দোয়া-কালাম পড়ে চলেছেন। মাঝে মাঝে করিম বকশের কথার নিচে তাদের স্বর চাপা পড়ে যায়। তার আকুল আবেদন কান্নার মত বেরিয়ে আসে—আল্লা, তুমি আমার কাসুরে বাঁচাও। তুমি জান-মালের মালিক। ওর জানের বদলে দুইডা জান সদকা দিমু। তুমি ওরে বাঁচাও ওর জানের বদলে দুইডা খাসি সদকা দিমু। আল্লা, আল্লা, তুমি রহমান, তুমি রহিম। তুমি বাঁচানেওলা। তুমি–
লম্বা ঘোমটা টেনে জয়গুন দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার পিছনে হাসু ও শফির মা-কে দেখে করিম বক্শ বুঝতে পারে, জয়গুন এসেছে। করিম বক্শ মৌলবী দু’জনকে ইশারায় সরে যেতে বলে নিজেও বেরিয়ে যায়।
জয়গুন কাসুর বিছানার পাশে বসে ডাকে—কাসু, কাসু আমার সোনামণি।
শফির মা, শফি, হাসু ও মায়মুন বিছানার দুই পাশে বসে। আঞ্জুমনও আসে। তাদের সকলের মাথা ঝুঁকে থাকে কাসুর মুখের ওপর।
শফির মা বলে—চাইয়া দ্যাখ কাসু। তোর মা আইছে।
কাসু কোন সাড়া দেয় না। চোখ দুটো আধবোজা। মাথাটা কখনও সোজা হয়, কখনও এ-পাশে ও-পাশে হেলে পড়ে। তার নিশ্চল হাত পা ছড়িয়ে আছে লম্বা হয়ে। অনিয়মিত নিশ্বাস-প্রশ্বাসে বুকের ওপরের কথাটা দুলে ওঠে। বুকের ওপর কান পেতে কফের ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ শোনা যায়।
জয়গুন আবার ডাকে—কাসু, বাজান একবার চউখ মেইল্যা দ্যাখ।
করিম বক্শ ডেকে বলে–কাসু, চাইয়া দ্যাখ তোর মা আইছে।
কাসুর মাথাটা বাম কাত থেকে ডান কাত হয় শুধু। কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
আঞ্জুমন বলে—দুই দিন আগেও টাস টাস কতা কইছে। দুই দিন ধইরা জব বন্ধ। কত ফকির-কবিরাজ, কত কত পানি পড়া, তাবিজ-তুমার! কিছুতেই কিছু অইল না। যে যা কইছে কোন তিরুডি অয় নাই। অহন আল্লার আতে সপর্দ। অউয়ত-মউয়ত আল্লার আত। আল্লায় যদি মোখের দিকে চায়। – করিম বক্শ দোর গোড়া থেকে বলে—আল্লা যদি কাসুরে দুইন্যায় রাইখ্যা যায়, তয় আমি জমিনের উপরে খাড়াইয়া মানতি করলাম, কাসুর একটা জানের বদলে দুইডা খাসি জবাই কইর্যা তার গোশত গরীব মিসকিনরে বিলাইয়া দিমু। কাসুরে আজমীরশরীফ খাজা বাবার দরগায় লইয়া যাইমু।
জয়গুনের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে অবিরল ধারায়। হৃদয়ভেদী কান্নার বেগ চেপে রাখতে গিয়ে তার স্বর ভেঙে যায়। ভাঙা গলায় সে আমিনকে বলে—দুইডা দিন আগেও যদি আমারে খবর দিত। ওর মোখের কথা হুইন্যা মনেরে বুঝ দিতে পারতাম। ওর ‘মা-মা’ ডাক হুইন্যা পরাণ শীতল করতাম।
একটু থেমে আবার বলে—তোমরা ডাকতর দেহাইছিলা?
—ডাকতর কি করব? কত ফকির হট খাইয়া গেল!
অন্ধকারের মধ্যে জয়গান আলো খুঁজে বেড়ায়। নিরাশার মধ্যেও আশা চেপে ধরে বুকে। ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও সে হাল ছেড়ে দেয় না।
হাসুকে সে নির্দেশ দেয়—হাসু, যা। জগদীশ ডাকতর না অয় আর কোনো ডাকতর জলদি কইর্যা লইয়া আয়। পথে দেরী করিস না। বলেই সে মনে মনে চিন্তা করে, ডাক্তার এলে টাকা দিতে হবে। কিন্তু কোথায় টাকা?
জয়গুন এবার শফিকে বলে—তুই বাড়ীত যা। বড় আঁস দুইডা বাজারে লইয়া যা। বেইচ্যা টাকা লইয়া চালাক কইরা আবি। কিন্তু দুইডা আসে কত পাওয়া যাইব! বড় জোর দুই টাকা।
মায়মুন বলে—আমার আঁস দুইডাও লইয়া যাইও, শফি ভাই। আমাগ কাসু বাঁচলে কত আঁস পাওয়া যাইব আবার।
জয়গুন বলে—হ, চাইড্যা আঁসই লইয়া যায়।
শফির মা শফিকে সাবধান করে দেয়—জলদি কইর্যা যা। তোর কিন্তুক আবার শামুকের চলতি। দেরী করলে উফায় রাখতাম না।
নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ তাই সব সময়ে পাওয়া যায় না।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সারাদিনের কর্মফল বড় সামান্য। পরোপকার প্রায়ই বিফলে যায়। সে কর্মে যদিও ফল ফলে, তা তিতো, বিষাক্ত।
এটা অনিয়ম বৈকি।
গ্রামের বুড়ো ডাক্তার রমেশ চক্রবর্তীর বেলায়ও এ অনিয়মটা নিয়মিত ভাবে বিদ্যমান। বিশ বছর রোগী দেখে, ওষুধ ঢেলে-গলে তিনি হাত পাকিয়েছেন। কিন্তু এই পর্যন্তই। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেও অর্থ সঞ্চয় করেননি কিছুই। অসহায় রোগীর চিকিৎসার বোঝাই ঘাড়ে নিয়েছেন শুধু। টাকার সিন্দুক বোঝাই হল না কোনদিন।
সাধারণভাবে গ্রামের লোকের আস্থা নেই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওপর। তাদের ধারণা—অ্যালোপ্যাথিকের তেজালো ওষুধ পেটে গেলে রোগী যা–ও দুঘণ্টা বাঁচত, তাও শেষ হয়ে যায় দুঘণ্টা আগেই। গ্রামে তাই ফকির-কবরেজদের পসার বেশী। ওষুধ মেশানো পানির চেয়ে বেশী কদর মন্ত্রপূত পানির। সোয়া সের চাল আর সোয়া পাঁচ আনা পয়সা দিয়ে যেখানে ফকির বিদায় করা যায়, সেখানে টাকা খরচ করে ডাক্তার বড় কেউ ডাকে না।
ধরাবাধা কয়েক ঘর লোক আছে রমেশ ডাক্তারের। ঘুরে ফিরে তারাই আসে। দু’টাকা দেয়, মাসখানেক ধরে চিকিৎসা করিয়ে নেয়। ওষুধ খেয়ে খেয়ে টাকার দাম তোলে। চিকিৎসায় টাকা খরচ করবার মত বড়লোক যারা, তারা এখানে আসে না। তারা যায় বড় ডাক্তার জগদীশবাবুর কাছে। দিনমজুরের কাছ থেকে দিন-মজুরী নিয়ে রমেশ ডাক্তারের দিন চলে টেনেটুনে।
রমেশ ডাক্তারের বাইরের ঘরটা একাধারে ডাক্তারখানা ও বৈঠকখানা দুই-ই। ঘরের এক পাশে দুটো আলমারী। তার মধ্যে নানা আকারের শিশি-বোতল সাজানো। ওগুলোর অধিকাংশই খালি। সুদিনে যখন ওষুধ পাওয়া যেত অপর্যাপ্ত, তখনও ওগুলো পুরোপুরি ভরা ছিল না।
আলমারীর একটা তাকে ভারী ভারী কয়েকখানা ডাক্তারী বই। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। তার এক পাশে ডাক্তারের বসবার জন্যে একখানা কাঠের চেয়ার, অন্য তিন পাশে টিনের চেয়ার তিনখানা। এক পাশে একটা লম্বা টুল। দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে আরাম করে বসবার জন্যে টুলটাকে দেয়ালের কাছ ঘেঁষে রাখা হয়েছে। অপর পাশে দেয়ালের সাথে ঠেকানো একটা কাঠের চেয়ার। তার পেছনের একটা পায়া ভাঙা। আসন গ্রহণে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের হুশিয়ার করার জন্যে পায়া-ভাঙা চেয়ারটায় কে একজন একটা কাগজ এঁটে দিয়েছে। তাতে লেখা—খোঁড়া।
এত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও নিরক্ষর গদু প্রধান একদিন চেয়ারটা নিয়ে পড়ে গিয়েছিল।
ডাক্তারের চোখের সামনে একটা দেয়াল ঘড়ি। বহু দিন ধরে অমেরামত পড়ে আছে। কোন রসিক লোক ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে ঘড়িটার কাচের উপর একটা কাগজ এঁটে দিয়েছে। কাগজটিতে লেখা ‘কলেরা রোগী।‘
লেখাটা দেখে রমেশ ডাক্তার হেসে ফেলে বলেছিলেন-কলেরা নয়, কলেরা নয়। হৃদ-বন্ধ। কলেরা হলে এমন ওষুধ খাইয়ে দিতাম–
—কলেরার আবার চিকিৎসা আছে নি? ডাক্তারের কথা শেষ না হতেই জাফর মিয়া বলে।
—নেই কেন? নিশ্চয় আছে। জীবনে কত কলেরা রোগী ভাল করলাম এই হাতে।
—তয় হেইডা আসল কলেরা না। পেডের অসুখ। আসল কলেরা বসন্তু অইলে আবার মানুষ বাঁচে?
—বাঁচে না মানে? একশোবার বাচে। এবারও কত রোগী বেঁচে গেল আমার হাতে।
নিত্যানন্দ বলে—তুমি আবার মানুষ বাঁচাতে পার নাকি, ডাক্তার?
–নিশ্চয়ই পারি।
ডাক্তারের কথায় সবাই হেসে ওঠে। অনেকে মনে করে ডাক্তারের ক্ষ্যাপামিটা আজ আবার বেড়ে গেল।
—এ কি! তোরা হাসছিস? মানুষ যদি বাঁচাতে না পারি, তবে তোরা আসিস কেন? আমার ওষুধ খাস কেন? ডাক্তার টেবিলের ওপর চাপড় মারেন।
কালিপদ বলে তোমার কাছে আসি মনের শান্তির জন্যে, মনেরে বুঝ দিতে। তা ছাড়া কি! তুমি বাঁচাতেও পার না, মারতেও পার না। মরা-বাঁচা ঈশ্বরের হাত।
কালিপদ ওপর দিকে আঙুল দেখিয়ে ঈশ্বরের অবস্থান নির্দেশ করে।
মুখ বিকৃত করে রমেশ ডাক্তার বলেন—মরা বাঁচা ঈশ্বরের হাত! তবে দেব এক ফোটা পটাশিয়াম সায়নাইড? দেখি কে বাঁচায়?
নিত্যানন্দ বলে—তোমার ঐ বাজে কথা রাখ ডাক্তার। মাথাটা তোমার আজ আবার গরম হয়েছে, বুঝলাম। জগদীশ সেন এত বড় ডাক্তার, সেও এত বড় কথা বলতে সাহস করে না। ঈশ্বরের ওপর ভরসা করে সে। সেদিন অজিত চৌধুরীর ছেলে মারা গেল। জগদীশ ডাক্তার চৌধুরীকে বল—আমরা ওষুধ দিতে পারি, জীবন তো আর দিতে পারি না।
—ও সব ফাঁকা কথা বুঝলে? অজ্ঞতা ঢাকবার পথ ওটা। লোককে সান্ত্বনা দেওয়ার বুলি। আসলে ও কথার কোন অর্থ হয় না। এমন অনেক রোগী আছে, যার বাবার ভরসা ছিল না, আমাদের ওষুধ খেয়ে সে হয়তো বেঁচে যায়। যখন বেঁচে ওঠে তখন নাম হয় উপরওয়ালার। তার গুণকীর্তন হয়। মসজিদে শিরনি দেওয়া হয়। হরিলুট দেওয়া হয় মন্দিরে। আমাদের নামও নেয় না মুখে। জালাল শেখের টাইফয়েড হয়েছিল, জানো তোমরা। দুই মাইল পথ হেঁটে রোজ সকালে বিকালে হাজিরা দিয়েছি, ওষুধ দিয়েছি। আমার কাছে ক্লোরোমাইসিটিন ছিল না। জগদীশের কাছ থেকে নিজের টাকায় কিনে দিয়েছি। যখন বেঁচে গেল, তখন একদিন দেখাও করলে না এসে। আমাকে দিয়েছিল কত জানো? তিন টাকা। শুনেছি, আজমীরের দরগায় জালাল পাঁচ টাকা মানত পাঠিয়েছে।
একটু দম নিয়ে আবার তিনি আরম্ভ করেন—আমাদের হাতে সব লোকই যে বাঁচবে তা তো বলছি না। এর কারণ অনেক। একটা কারণ হচ্ছে–চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমাদের অজ্ঞতা। আমার হাতে যে রোগী মারা গেল, আর একজন ভালো ডাক্তারের কাছে সে হয়তো মরত না। তা ছাড়া রোগ নির্ণয়ে, ওষুধ-নির্বাচনে ভুল-ভ্রান্তি, ওষুধের অভাব, যন্ত্রপাতির অভাব—নানা কারণ আছে। এ ছাড়াও আছে রোগীর গাফিলতি। সময় থাকতে আসবে না। আসবে তখন যখন টলমল অবস্থা। ঐ অবস্থায় ডাক্তার ডেকে কোন কাজ হয় না। ডুবন্ত নৌকা উদ্ধার করা সোজা ব্যাপার নয়। কথায় বলে—মরণকালে লক্ষ্মীবিলাসের বড়ি কোন কাজ দেয় না। মানুষ মরবে, এতে সত্য কথা। তবে অকালমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে তো। বাতির তেল ফুরালে তেল দিতে হবে। ঝড়ে নিবে না যায়। তার জন্য ঢাকনা লাগাতে হবে। বাতিটা যে-দিন ফুটো ঝাঁজরা হয়ে ভেঙে যাবে, সে দিনের কথা আলাদা। অবশ্য সমস্ত লোককে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবার মত চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি হচ্ছে দিন দিন।
সবাই বিরক্ত হয় ডাক্তারের ওপর। তারা মনে করে—আজ মাথাটা একটু বেশীই খারাপ হয়েছে ডাক্তারের।
কালীপদ বলে রাখ তোমার বক্তিমা। এইবারে বিদায় কর। ডাক্তার বলেন—একটু সবুর কর। ওদের আগে বিদায় করি। ওরা দূরের লোক। এসো দেখি দিল মহম্মদ। ক’দিন থেকে জ্বর?
—আইজ চাইর দিন।
ডাক্তার নাড়ী দেখেন। বুক পরীক্ষা করেন। তারপর বলেন—দেখি জিভ। হা করো, আ—এমন করে।
দিল মহম্মদ হা করে। তার নিশ্বাসের সাথে এক ঝলক দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা মারে ডাক্তারের নাকে। তিনি মুখটা একপাশে সরিয়ে বলেন—কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি।
একটা কাগজে ‘ব্যবস্থা’ লিখে ডাক্তার বলেন—কোন ভয় নাই। এ কাগজটা কম্পাউডারকে দাও। ওষুধটা দিনে তিনবার খাবে। ঠাণ্ডা লাগিও না। শিশি এনেছো?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা যাও। পরশু এসো আবার। আলাউদ্দিন, তুমি এসো। কি তোমার?
—প্যাটটা ফুইল্যা রইছে দুই দিন ধইর্যা। একবার খাইলে আর খাইতে ইচ্ছা করে না।
ভাত দেখলে বমি আহে। খোয়াবে খাইলে হুনছি এই রহম অয়।
—অ্যাঁ, কি বল্লি?
–মা কইছে, খোয়াবে যারা খায়, তাগ প্যাট ভার অইয়া থাকে এই রহম। অজম অয় না।
বুড়ো ন’কড়ি বলে—ডাক্তারের কাছে এগুলা কইস না। এই সব ভূতের ব্যামোর কিছু ডাক্তার বুঝবও না, বিশ্বাসও করব না। আমিও কত দিন স্বপ্নে খাইছি—রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাফি, কচুরী, পানতুয়া—ন’কড়ি মিষ্টির নামের শিকলি ছাড়তে শুরু করে।
মুচকি হেসে ডাক্তার বলেন—খেতে কেমন লাগে?
—কেমন লাগবে আবার! ভালা। ঠিক হালুইকরের মিষ্টির মতন। কিন্তুক অজম অইতে চায় না। অজম অইলে কি আর কথা আছিল?
ডাক্তার রহস্য করে বলেন—সত্যি, হজম হলে আর কোন কথা ছিল না। বাজারে যখন রসগোল্লা সন্দেশ পাওয়া যায় না আজকাল, তখন স্বপ্নে বিনে পয়সায়—
—বেশ মজা কাইরা খাওয়ন যাইত। ডাক্তারের মুখের কথা লুফে নিয়ে ন’কড়ি বলে।
ডাক্তার এবার গর্জন করে ওঠেন—হুঁহ্, যত সব আহম্মক নিয়ে কারবার। যা এখন থেকে। স্বপ্নে রসগোল্লা খা গে। ওষুধ খেতে হবে না।
আলাউদ্দিন দাঁড়িয়ে থাকে। ডাক্তার হাত বাড়িয়ে তাকে একটু কাছে টেনে নেন। জামাটা তুলে রাগের সাথে জোরে জোরে তার পেট টিপতে শুরু করেন।
বাধা-ধরা একঘেয়ে জীবন ডাক্তারের এমনি করেই চলে। চলে ঘড়ির কাঁটার মত একই পথে। কিন্তু তার কাছে বৈচিত্র্যহীন একঘেয়ে বলে মনে হয়নি কোনদিন। মুর্খ লোকের কার্য-কারণহীন আজগুবি কথাবার্তা শুনে তিনি যত বিরক্ত হন, তাদের অজ্ঞতার জন্যে তার চেয়েও বেশী সহানুভূতি জাগে তার মনে। এ সমস্ত লোকের নাড়ী দেখে দেখে তাদের ওপর কেমন একটা নাড়ীর টান জন্মে গেছে ডাক্তারের। ভোর বেলা এদের মুখ দেখলে তবেই তার ভালো লাগে। তাজা হয়ে ওঠে দেহ-মন।
কিন্তু কিছুদিন ধরে ডাক্তারের দিনগুলো আর চলতে চায় না। যেন হুঁচোট খেয়ে চলছে দিনগুলো। স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাস্তুত্যাগের হিড়িক পড়েছে দেশে। ভারত ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের চোখে লেগেছে আলোর ধাঁধা। ডাক্তারের স্ত্রীর চোখেও তাই লেগেছে। পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার জন্যে তিনি অধীর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু ডাক্তারের পাকা চোখে দূরের সে আলো নেশা জাগাতে পারে না। পারে না মায়ার সৃষ্টি করতে। স্বামী-স্ত্রীর এই বিরুদ্ধ মনোভাব সংসারের সমস্ত শান্তি নষ্ট করেছে। এই একই প্রসঙ্গ নিয়ে কথার প্যাচাল শুরু হয় দু’জনের মধ্যে। সহজে তা থামতে চায় না। স্ত্রী নানারকম যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন, বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে স্বামীকে প্ররোচিত করেন। কিন্তু আদম তার সংকল্পে হল। সে জানে, নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার অর্থ স্ব-ভ্রষ্ট হওয়া। ঈভ তাই নিষিদ্ধ ফলের সাজি নিয়ে ব্যর্থ হয় বারবার।
আজও ডাক্তার রোগী দেখা শেষ করে সবে আঙিনায় উঠেছেন অমনি গিন্নী আরম্ভ করেন—ওগো শুনছো? আর তোমাকে বলেই বা কি হবে?
অন্যমনস্কভাবে ডাক্তার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গলা চড়িয়ে গিন্নি বলেন—জগদীশ ডাক্তার আজ যাচ্ছে, শুনেছো?
—তাতে হয়েছে কি?
—হবে আবার কি? সবাই একে একে চলে যাচ্ছে। আর আমরা এখানে জপমালা নিয়ে বসে থাকি আর কি!
–হ্যাঁ, মালা জপতেই শুরু কর। তাই ভালো। দেখো ঈশ্বর যদি কিছু ব্যবস্থা করেন। চাও তো পুষ্পক রথও পাঠিয়ে দিতে পারেন তোমার জন্যে।
বিরক্তির মধ্যেও নিজের রসিকতায় হেসে ওঠেন ডাক্তার। তার হাসি গিন্নীর অন্তরে ঘা দেয়। তিনি বলেন—তা তুমি যেয়ে।
—আমি যাব! উহুঁ! এখান থেকে আমি একচুলও নড়ছিনে। এমন সাজানো বাগিচা ছেড়ে নরকে যেতে পারবো না।
কথায় সুবিধা করতে না পেরে গিন্নী বলেন—তা বেশ। এখানে থেকে মুসলমানের হাতে যদি কচুকাটা না হও তো কি বল্লাম।
—ওসব বাজে কথা রাখ। এখানে কে তোমাকে মারছে শুনি? কতগুলো পশুর প্ররোচনায় যা হয়েছিল, তা আর হবে না দেখে নিও। ভাইয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়
—সবাই বুঝতে পেরেছে। ভাইয়ের বুকের রক্তে যে করুণ অভিজ্ঞতা হল, হিন্দুমুসলমানের মন থেকে তা সহজে মুছে যাবে না। আর যদি একান্ত মুছেই যায়, তবে বুঝব তার পেছনে কাজ করেছে স্বাথান্ধ হিংস্রতা। শুধু এখানেই নয়। সব জায়গায় এ হিংসতা দেখা দিতে পারে। যেমন আসামে ‘বঙ্গাল খেদা’ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ধুতিবালাদের বিরুদ্ধে মুখারা কুকরি শান দিচ্ছে। বিহারে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে বাঙালীকে। এখন এক গণ্ডগোলের ভয়ে পালিয়ে আর এক গণ্ডগোলের মুখে গিয়ে পড়তে হবে। এখানে আমাদের কিসের অভাব? কোন দুঃখে যাব আমরা ঘর-বাড়ী ছেড়ে? জানো না, এখানে আমরা মার কোলে আছি।
হাসু এসে ডাক্তারের উঠানে দাঁড়ায়।
ডাক্তারের খোঁজে সে এ-গাও ও-গাও ঘুরেছে। জগদীশ ডাক্তারকে পাওয়া গেল না। তিনি পাততাড়ি গুটিয়েছেন। আজই চলে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে। হরেন ডাক্তারও নেই। তিনি অনেক দিন আগেই চলে গেছেন। তার শূন্য ভিটা তচনচ হয়ে আছে ঘাস-লতা-পাতায়।
রমেশ ডাক্তার তখনও বকে চলেছেন—এখন হুজুগে মেতে অনেকেই বাড়ী-দরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাদের টাকা নেই তারাও যাচ্ছে। অনেকে বাড়ী-ঘর বিক্রি করে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি না কিসের নেশায় যাচ্ছে এরা। কিন্তু দেখবে, আবার এরা ফিরে আসবে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ক্ষুধা ও রোগে আধমরা হয়ে আবার এরা ফিরবে। কিন্তু তখন আর মাথা খুঁজবার ঠাঁই মিলবে না। আমাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু-মুসলমান আপনজনের মত কত যুগ ধরে কাটিয়েছে এ মাটিতে। একের ওপর নির্ভর করে বেঁচে উঠেছে আর একজন। একজন যুগিয়েছে ক্ষুধার অন্ন, আর একজন দেখিয়েছে আলো।
ডাক্তার পাশের দিকে দেখেন–গিন্নী নেই। কখন তিনি বেরিয়ে গেছেন। উঠানে হাসু দাঁড়িয়ে। দেখতে পেয়ে ডাক্তার বলেন—কিরে বাপু, কি চাই।
—আমার ভাইয়ের খুব অসুখ।
স্ত্রীর ওপর এতক্ষণ বক্তৃতা ঝেড়ে রমেশ ডাক্তারের মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। তিনি বলেন—আমি যেতে পারব না।
কথাটা বলে তখনি ভাবেন—আর তো কেউ নেই। হরেন অনেক দিন আগেই চলে গেছে। জগদীশও আজ যাচ্ছে। এ তল্লাটে এ তিন হন ছাড়া আর কে আছে? ডাক্তার যাবার মনস্থ করেন। বাড়ীতে থাকলে আবার স্ত্রীর কথায় কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং রোগী দেখতে যাওয়া ভালো।
জামা গায়ে চড়িয়ে স্টেথসকোপ ও ‘এমারজেন্সী ব্যাগ’ নিয়ে ডাক্তার বের হন। পেছন থেকে স্ত্রী বাধা দেন—এই দুপুরে রোদ মাথায় করে কোথায় চল্লে আবার?
উত্তর না দিয়ে ডাক্তার এগিয়ে যান।
—চান করে খাও-দাও। বিকেলে যেও। স্ত্রী তাগাদা দেন।
স্ত্রীর কথাগুলোকে শ্লেষের আঘাত করে ডাক্তার বলেন—চান করব আবার খাব। এদিকে মানুষ মরে যাচ্ছে।
পেছন ফিরে ডাক্তার আবার বলেন—এখন দেখো, আমরা চলে গেলে এদের কি উপায় হবে। এতগুলো গ্রামের মধ্যে আমরা তিনটে ডাক্তার ছিলাম। দু’জন তো চলেই গেল।
আমিও যদি চলে যাই, তবে এরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
ডাক্তারের ব্যাগটা হাসু হাতে করে নেয়।
ডাক্তার রোগী দেখে চিন্তিত মুখে বলেন—ডবল নিমোনিয়া। এত দিন ছিলে কোথায়?
করিম বক্শ বলে—ফকির দেখছিল এতদিন।
—নাকের ওর ঘা হয়েছে কেমন করে?
–দড়ি-পড়া দিছিল ফকির।
ডাক্তার দাতে দাঁত চেপে বলেন—ফকির! দড়ি পড়া! দেশের শাসন ক্ষমতা আমার হাতে থাকলে ব্যাটাদের কুরবাজি দেখিয়ে ছাড়তাম। ফাঁসি দিতাম ব্যাটাদের। এ নরহত্যা ছাড়া কিছু নয়।
ডাক্তার আসায় জয়গুন বড় করে মাথায় কাপড় টেনে পেছন ফিরে বসেছিল। তার বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটছে অবিশ্রান্ত। সে এবার ঘুরে ডাক্তারের পা ধরে করুণ মিনতি জানায়—ডাক্তার বাবু, আমার কাসুকে বাঁচাইয়া দ্যান। আপনে আমার ধর্মের ব্যাপ।
১৭. জয়গুন আহার-নিদ্রা ভুলে
জয়গুন আহার-নিদ্রা ভুলে দিনের পর দিন ছেলের শয্যা-পার্শ্বে কাটিয়ে দেয়। মায়মুনও থাকে মা-র কাছে। প্রত্যেক দিন খাবার সময়ে করিম বক্শের ইঙ্গিতে আঞ্জুমন জয়গুনের হাত ধরে টানাটানি করে খাওয়ার জন্যে। বলে—এই রহম পেডে পাথর বাইন্দা থাইক্য না। দুইডা দানাপানি মোখে দ্যাও বুজান, নালে শরীল তোমার ভাইঙ্গা যাইব।
জয়গুন খেতে যায় না। সে ভাবে, এ বাড়ীর ভাত তার কপাল থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে।
হাসু রোজ খাবার নিয়ে আসে। রেখে যাওয়া সে খাবার সে মায়মুনকে দেয়। নিজেও খাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার খাওয়া আসে না। দু’এক মুঠো জোর করে গিলে এক মগ পানি খেয়ে একদিন কাটিয়ে দেয়।
দিনের বেলা যেমন তেমন কেটে যায়। কিন্তু রাত্রি বেলা জয়গুনের আর দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে রাত্রির জন্যে প্রস্তুত হয়। বাতির তেল না থাকলে মায়মুনকে পাঠিয়ে পাশের বাড়ী থেকে কুপি মেপে তেল ধার আনে। একটা মালসাতে তুষ সাজিয়ে আগুন দিয়ে রাখে।
রাত্রে জয়গুনের কাছে থাকার জন্যে শফির মা আসে। সে ‘বুড়া মানু’ তাই তার ঘুম কম। রাত্রের যে কোন সময়ে ডাক দিলে তার সাড়া পাওয়া যায়। সে কাছে থাকলে মনে বল পাওয়া যায়। হাসুও দুই রাত্রি ছিল। কিন্তু ও ছেলে মানুষ। সন্ধ্যার পরেই ঘুমিয়ে পড়ে। সারা রাত্রির জন্যে আর তাকে সজাগ পাওয়া যায় না। শফির মা-র জন্যে জয়গুন। সন্ধ্যার আগেই বেশী করে পান ঘেঁচে রাখে, যাতে কাসুর কানের কাছে ঠনর ঠনর করতে না হয়।
শফির মা অনেকক্ষণ বসে থাকে জয়গুনের পাশে। তারা মুখোমুখি বসে। আগুনের মালসার ওপর হাতগুলোকে গরম করে। মাঝে মাঝে কান মুখ ও অন্যান্য অঙ্গে গরম হাত বুলিয়ে শীত তাড়াবার চেষ্টা করে। শফির মা কখনও পান চিবোতে চিবোতে পিচ ফেলে মালসার মধ্যে। তুষের আগুন থেকে ধোঁয়া বের হয়। নানা কথায় সে জয়গুনকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তার নিরাশ মনে আশা জাগিয়ে তোলে। থানার ঘন্টা যখন জোড়ায় জোড়ায় বাজে, তখন সে গুণতে আরম্ভ করে সাথে সাথে। বলে—বারোখান বাজল। এইবার এট্ট কাইত অই। আত দিয়া দ্যাখ, কাপড় ভিজা প্যাচপেইচ্যা অইয়া গেছে।
শফির মা কাঁথা উঠিয়ে মায়মুনের পাশ দিয়ে শুয়ে পড়ে। তার শীতল শরীরের ছোয়া লেগে মায়মুন একবার নড়াচড়া করে ওঠে। শফির মা বলে—চুপ কইর্যা থাক বেডি, অহনি উম অইয়া যাইব।
শফির মা গরম হাত দুটো মায়মুনের গায়ে বুলিয়ে এবার ক্ষতি পূরণের চেষ্টা করে। জয়গুনকে বলে—আমারিক্ত ঠাণ্ডা অইয়া গেছে। খাড়াকাড়ি গরম অয় না। ওগ রক্ত গরম। আমার শফিরে বুকে লইয়া হইলে মুহতুকের মইদ্যে উম অয়। তা না অইলে পৌষ মাইস্যা শীতে ঠকঠক করতে করতে জান কবচ অওনের জোগাড়। মাইনষে কইতেই কয়—
পৌষের হিমে ভীম দমন,
মাঘের শীতে বাঘের মরণ।
শফির মা শুয়ে শুয়ে গল্প আরম্ভ করে—ভীম একদিন তার মা-রে জিগায় ‘মা, আমার তন বড় জোয়ান কে? তার মা কয়—‘আছে একজন। গাঙ্গের পাড় দিয়া আঁটলেই তার দ্যাহা পাইবা। তহন পৌষ-মাইস্যা রাইত। ভীম কতক্ষুণ পর শীতে ঠকঠক করতে করতে বাড়ীতে আহে। মায় জিগায়—দ্যাহা পালি বাজান? ভীম কয় ‘হ গো মা।’
জয়গুন কাঠি দিয়ে তুষের আগুন ঘেঁটে তাতিয়ে নেয়। আগুনে হাত-পাগুলোকে গরম করে।
ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উত্তুরে হিমশীতল বাতাস ঢোকে। জয়গুনের শরীরের রক্ত জমে ওঠে যেন!
বাতাসে নিবুনিবু করে কুপিটা। জয়গুন উঠে সলতে উস্কিয়ে দেয়। এক প্রস্ত কাঁথা এনে আগুনে গরম করে গায়ের ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে কাঁথাগুলো পালটিয়ে দেয়।
করিম বক্শ এক সময়ে ডাকে—কাসু কি ঘুমাইছে?
বার দুই ডেকে করিম বক্শ ক্ষান্ত হয়। শফির মা ঘুমিয়ে পড়েছে। জয়গুন ডান হাত বাড়িয়ে তাকে ধাক্কা দেয়। শফির মা ধড়ফড় করে ওঠে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে—আল্লা-রছুল! কি কাসুর মা? সারা রাইত এম্বায় বইস্যা থাকবি? তুই আয়, আমার বালিশে মাথা রাইখ্যা এটু ক্যাইত অইয়া থাক। ও এহন চুপ মাইর্যা আছে।
করিম বক্শ আবার ডাকে—ও কি ঘুমাইছে?
—হ ভাই, এহন ঘুমেই আছে।
নিঝুম রাত। কোন দিকে সাড়া-শব্দ নেই। অনেকক্ষণ পরে পরে পাখীর কলবল এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তারপর আবার নিস্তব্ধ। এমন নিস্তব্ধতার মধ্যে ঘরে শোয়া করিম বক্শের নিশ্বাস পতন পর্যন্ত গণনা করা যায়। কানের কাছে কাসুর বুকে কফের ঘ্যাড়-ঘ্যাড় শব্দ এবং তার অনিয়মিত হ্রস্ব দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস জয়গুনের আশঙ্কাঘন মনে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। ঘন কালো অন্ধকার যেন চারদিক থেকে গিলে ধরবার জন্যে হা করে আছে।
শেষ রাতে ভয়ঙ্কর শীত নেমে আসে। জয়গুন আর একবার কাঁথা বালিশ গরম করে কাসুর বিছানা বদলে দেয়। নিজের হাত-পা শরীর তুষের আগুনের তাপে গরম করে। তারপর কাসুর কাঁথার নিচে শুয়ে তাকে নিজের বুকের তাপ দিয়ে গরম করবার চেষ্টা
সপ্তাহ খানেক পরে একদিন ডাক্তার বলেন—আর চিন্তা করো না, মা। ভয় কেটে গেছে। তোমার ছেলে এবার ভালো হয়ে উঠবে!
জয়গুনের মুখের ওপর থেকে নৈরাশ্যের মেঘ কেটে যায়। আশার আলোয় মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। ডাক্তারের ওপর কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে বুক। কিন্তু তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা তার জানা নেই। সে বলে–বাবা—তুমিই আমার কাসুরে বাঁচাইল। মরণঘর তন তুমিই ওরে ফিরাইয়া আনছ।
ডাক্তার আশ্চর্য হন। তার সমস্ত জীবনে এমন সহজ সোজা কথা কোন নিরক্ষরের মুখে তিনি কখনও শোনেন নি। ডাক্তার মানুষ বাঁচাতে পারে, এ-কথা বিশ্বাস করে না কেউ।
ডাক্তার বলেন—আমার চিকিৎসা ছাড়াও তোমার শুশ্রূষা অনেক সাহায্য করেছে। তুমি কাছে না থাকলে, সময় মত ওষুধ-পথ্য না দিলে এ রোগী বাঁচান এত সহজ ছিল না।
কাসু ভালো হয়ে ওঠার সাথে সাথে জয়গুনের কর্তব্যও যেন ফুরিয়ে যায়। একদিন ভোর রাত্রে কাসুকে ঘুমে রেখে সে মায়মুনকে নিয়ে হাসর সাথে বাড়ী চলে আসে।
জয়গুনের এমনি করে চলে আসার কারণও ‘ঘটেছিল।
শফির মা সেদিন আসে নি। জ্বর হয়েছিল তার। রাত্রে মা-র কাছে থাকবার জন্যে হাসু এসেছিল।
গভীর রাত্রি। হাসু ও মায়মুন ঘুমে অচেতন। কাসুও কতক্ষণ ছুটফট করে কিছু আগে। মুমিয়ে পড়েছে। তার শিয়রে আগুনের মালসার ওপর হাত রেখে জয়গুন ঝিমোচ্ছে।
করিম বক্শ অন্ধকারে বালিশ থেকে মাথা উঁচিয়ে ঘর ও বারান্দার মাঝের বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকায়। কয়েকদিন ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে তার কেমন নেশা ধরে গেছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে জয়গুনের মুখখানা বড়ই সুন্দর লাগে তার চোখে। চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু, কখনও বুজে আসে। সারা মুখে বেদনার ছাপ যেন সুন্দরতর করেছে তার মুখখানা।
করিম বক্শ আস্তে আস্তে বারান্দায় নেমে আসে। আওয়াজ পেয়ে জয়গুন গা ঝাড়া দিয়ে বসে। তাড়াতাড়ি মাথার কাপড় লম্বা করে টেনে দেয়।
করিম বক্শ এসে কাসুর মাথায় হাত দিয়ে শরীরের তাপ দেখে। জয়গুন বুঝতে পারে, কথা বলার ভূমিকা ছাড়া এ আর কিছু নয়। সে একটু দূরে সরে বসে হাসু ও মায়মুন যেখানে শুয়ে আছে।
করিম বক্শ বলে—আমারে দেইখ্যা তুমি ঘুমডা দ্যাও ক্যাঁ?
বার তিনেক হল এই একই অভিযোগ।
জয়গুন উত্তর দেয় না।
—আমারে আবার শরম কিয়ের? এত বচ্ছর আমার ঘর করলা, আর এহন আমারেই শরম! মাথার কাপড় উডাও, লক্ষ্মী। হোন আমার কথা।
জয়গুনের বুকের ভেতর টিপটিপ করতে শুরু করে।
করিম বক্শ বলে—আমার কথা যদি রাখ, তয় একটা প্রস্তাব করতে চাই।
জয়গুন নিরুত্তর।
-আইচ্ছা, আমি যদি আবার—
জয়গুন শক্ত একটা কিছু বলার জন্যে মনে মনে মুসাবিদা করে কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বের হয় না।
—তোমারে আবার আমি ঘরে আনতে চাই।
কম্পিত কণ্ঠে জয়গুন বলে–না।
-ক্যাঁ? আমি শরা-শরিয়ত মতই করতাম।
শরিয়ত মত আগে একজনের লগে সাঙ্গা বইয়া হেইখান তন তালাক লইয়া তারপর? ওহোঁ।
—ওয়াতে দোষ কি? লক্ষ্মী, তুমি রাজী অও। তহন কি আম্মুকি করছি ঘরের লক্ষ্মী ছাইড়্যা দিয়া। শরিয়তে আইন আছে এই রহম নিকার।
—শরিয়তে থাকলেও আমি পারতাম না।
—ক্যাঁ? সতীনের ঘর বুইল্যা? যদি একবার মোখ ফুইট্যা কও ‘সতীনের ঘর করতাম না’ তয় ফুলির মা-রে রাইত পোয়াইলেই খেদাইয়া দিতে পারি। তুমি একবার একটু–
—ওহোঁ।
—ক্যাঁ? ঘরের লক্ষী তুমি। করিম বক্শ জয়গুনের একটা হাত ধরে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। জয়গুন ঝাড়া দিয়ে সে হাত ছাড়িয়ে নেয়। পাশে হাসুকে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয়—হাসু হাসু ওঠ।
করিম বক্শ চোরের মতো সরে যায়।
বাকী রাতটা জয়গুন বসে কাটিয়ে দেয়। প্রথম মোরগের বাকের সময়, সে হাসু ও মায়মুনকে ডেকে তোলে। কাসু ঘুমিয়ে আছে। তার রোগ-শীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে চেয়ে জয়গুন চোখের পানি রাখতে পারে না। কাসুর গালে একটা চুমো দিয়ে তার গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে রাখে কিছুক্ষণ।
সে আঞ্জুমনকে ডেকে কাসুর কাছে রেখে যায়। আঞ্জুমন কিছু বুঝতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করে—আইজ যাইবা ক্যাঁ?
—যাইমু না কি করমু আর? এহন ও ভাল অইয়া উডব। তুমি এটু নজর রাইখ্য বইন। তোমার ত পোলা নাই। মনে কইর্য এইড়া তোমার প্যাডের।
জয়গুন বাড়ী এসে প্রথমেই শফির মার বিছানার পাশে গিয়ে বসে।
শফির মা বলে—চইল্যা আলি ক্যাঁ? তোরে দ্যাখতে না পাইলে যদি ও চিল্লায়?
—চিল্লাইলে কি করতাম, বইন? যার পোলা হে-ই রাখব। আমার কি! সখেদে বলে জয়গুন।
—আমার ত মনে অয় না করিম বক্শ ওরে রাখতে পারব। ঘুমের তন উইঠ্যাই যখন তোরে দ্যাখব না, তহন করিম বকশের দিল-কইলজাডা খুইল্যা খাইয়া ফ্যালাইব না!
—তার আমি কি করতাম! হেদিন কইছিলাম—ওরে আমার কাছে আইন্যা কিছু দিন রাহি। তারপর ভালা অইয়া গেলে যার পোলা হে-ই লইয়া যাইত। ব্যারাম তন ওঠলে এট্টু আবদার করব। হেইয়া সইজ্য আইলে তয় ত! কিন্তু তুমি মত করলা না।
–কেমন কইর্যা করি? আমাগ সূর্য-দীগল বাড়ী। এই বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না। আবার এক বছর ধইর্যা পাহারা নাই। এমন সোনার চান মানিকরে এইখানে আনলে যদি এটটু উনিশ-বিশ অয়, তয় বদনাম অইব তোর।
—ক্যাঁ। আমরা তো কতদিন ধইরা আছি। আমাগ কি অইছে?
আমাগ কতা আলাদা। আমাগ সইয়া আইছে। আর এতদিন বাড়ীর পাহারা আছিল। পাহারা যেই দিন তন নাই, হেই দিন তন আমার জ্বর যেন ঘন ঘন ওঠতে আছে! আবার মায়মুনেরও পরের বাড়ীর ভাত ওঠল। এইগুলা কি কম চোট?
সূর্য-দীঘল বাড়ীর অমঙ্গল আশঙ্কা করে জয়নুন সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করে। তবুও তার মন মানে না। তার অন্তর কেঁদে ওঠে। রোগশীর্ণ কাসুর কান্না শুনতে পায় সে তার অন্তরে। স্পষ্ট দেখতে পায়, ঘুম থেকে জেগে কাসু মা-মা বলে কাঁদছে।
অসুখ ভালো হয়ে আসার পর প্রথম চোখ মেলেই সে মা-কে চিনতে পেরেছিল। তারপর যতক্ষণ সে জেগে থাকত, কখনও জয়গুনের বুকে মাথা রেখে, কখনও হাত আকড়ে ধরে থাকত। তার বিছানা ছেড়ে জয়গুনের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। সে কোথাও গেলে কাসু কান্না জুড়ে দিত। দুর্বল হাত-পা দিয়ে কাঁথা বালিশ ছুঁড়তে আরম্ভ করত। আজও জয়গুন তার মনের চোখে দেখতে পায়—কাসু পায়ের লাথি মেরে গায়ের কাঁথা ফেলে দিচ্ছে। করিম বক্শ বা আমন কেউ তাকে শান্ত করতে পারছে না।
আসলেও তাই ঘটেছিল। করিম বক্শ নানা রকম লোভ দেখিয়েও কাসুর কান্না থামাতে পারে নি।
রমেশ ডাক্তার জয়গুনকে আনবার জন্যে লোক পাঠাতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি করিম বক্শের কাছে জানতে পারেন, জয়গুন আর আসবে না।
ডাক্তার তার সুন্দর থার্মোমিটারটা কাসুর হাতে দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেটা সে মাটির ওপর ছুঁড়ে ভেঙে দেয়।
ডাক্তার করিম বক্শকে ভৎর্সনা করেন—শিগগির ওকে ওর মা-র কাছে পাঠিয়ে দাও। এভাবে একে রাখতে পারবে না। এখনও শরীর দুর্বল। এক্ষুণি নিয়ে যাও। দেরী করো না। আমি ওখানে গিয়ে দেখে আসব। ঐ তালগেছো বাড়াটা তো? হ্যাঁ, চিনেছি। ওর মা-র কাছে ভালো থাকবে।
করিম বক্শ কাচুমাচু করে। ডাক্তারের আদেশ লঙ্ঘন করার সাহস তার হয় না। সে যখন কাসুকে কোলে করে নিয়ে যায়, তখন রোদের তেজ বেড়েছে। মাঠের আধা-পাকা মশুর, কলাই ও সর্ষের গাছে শিশির তখনও ঝলমল করছে।
করিম বক্শ কাসুকে এনে জয়গুনের ঘরের দরজার ওপর ছেড়ে দেয়। হাসু ও মায়মুন এসে কাসুর হাত ধরে ঘরে নিয়ে যায়। জয়গুন বসে আছে নিশ্চল। চোখের পানি শুকিয়ে তার দুই গালে দুটি রেখা স্পষ্ট হয়ে আছে। জয়গুন কাসুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় না, বলেও না কিছু মুখে। কাসু দু’হাত দিয়ে তাকে ধরতেই জয়গুন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। হাসু ও মায়মুন পাশে বসে কাসুর পিঠে ও মাথায় হাত বুলায়।
উঠানে করিম বক্শ দাঁড়িয়ে আছে। মায়মুনকে উঠানে একখানা পিঁড়ে দিয়ে আসতে বলে জয়গুন।
মায়মুন সসঙ্কোচে পিঁড়ে হাতে বাপের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। করিম বক্শের মমতাহীন লাল চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। হাত বাড়িয়ে মায়মুনকে ধরতে যায়। কিন্তু তার হাত কাঁপছে কেন? মেহেরনকে হত্যা করার সময় যে হাত কাঁপেনি, মায়মুনসহ জয়গুনকে মেরে তাড়িয়ে দেয়ার সময় যে হাত তার বিচলিত হয় নি, আজ সেই হাত কাঁপছে কেন? সেই হাতের শক্তি কোথায়? নিজের মেয়েকে স্পর্শ করার শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। মায়মুনকে স্পর্শ করার অধিকার যেন হারিয়েছে সে।
করিম বকশের হাতটা আপনার থেকেই নেমে আসে। মাথা নিচু করে সে বাড়ীর দিকে পথ নেয়।
শফির মা জ্বরের শরীর নিয়ে লাঠি ভর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসে। বলে—আহা, হুকাইয়া এক্কেরে কাষ্ট অইছে মানিক। খালি আড়গুলা আছে।
—আড় বাঁইচ্যা থাকলে মাংস একদিন অইবই। কাসুর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জয়গুন বলে।
—হ, আল্লায় বাঁচাইয়া রাখুক। আমার যত গাছ চুল আছে, তত বচ্ছর আয়ু যেন খোদায় ওরে দ্যায়।
করিম বক্শ এখন রোজ আসে কাসুকে দেখতে। কোনদিন মাঠের মাঝ দিয়ে তাকে আসতে দেখে কাসু আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঝোপের আড়ালে বসে থাকে যতক্ষণ না করিম বক্শ চলে যায়। তার ভয়—করিম বক্শ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আসে। তার এ বিশ্বাসে ইন্ধন যোগায় মায়মুন। রোজ ভোরে সে পথের দিকে চেয়ে থাকে। করিম বক্শকে দেখতে পেলেই সে হুশিয়ারী সঙ্কেত দেয়। করিম বক্শ ব্যর্থ হয়ে শফির মা-র ঘরে গিয়ে কথাবার্তা বলে। তার ছেঁচা পানে ভাগ বসায়।
–কি করলা, ভাজ? পরস্তাবডা করছিলা? করিম বক্শ জিজ্ঞেস করে।
—করছিলাম। কিন্তুক রাজী অয় না। বহুত দিন ধইর্যা আমিও চেষ্টা করতে আছি। চক-চেহারায় তো কম না। মাইনষে দ্যাখলে এহনও এক নজর চাইয়া দ্যাহে। ষাইডের বান্দে ছান্দেও ঠিক আছে। এহনও নিকা দিলে গণ্ডায় গণ্ডায় বাচ্চা-কাচ্চা অয়। আমি এত কইর্যা বুঝাই, আমার কথা কানেই নেয় না। গদু পরধান কত ঘুরাঘুরি করে! দুই কানি জমিন আর একখান ঘর লেইখ্যা দিতে চাইছিল।
—আমি ভালার লেইগ্যা কইছিলাম। আমার সংসারও চলত, আর আমার পোলা মাইয়াও সুখে থাকত। আমার তিন কানি জমিন ওর নামে দলিল রেজেষ্টি কইর্যা লেইখ্যা দিতাম। তুমি আর একবার কইয়া দেইখ্য না। যদি সতীনের ঘর করতে রাজী না অয়, তয় আঞ্জুমনরেও তালাক দিয়া দিতে পারি। এর বেশী আর কি চায়?
—কিন্তুক ও যে কিছুই চায় না। আমার মোখের উপরে কইয়া দিছে,—’যেই থুক একবার মাডিতে ফ্যালাইছি, তা মোখ দিয়া চাটতে পারতাম না।’
করিম বক্শ এবার ফতুয়ার পকেট থেকে একটা পান বের করে শফির মা-র হাতে দিয়ে বলে-খবরদার কেও যেন না জানে। তোমার ঘরে ডাক দিয়া এই পানডা খাওয়াইয়া দিও। নাগর বাইদ্যার আতে পায়ে ধইর্যা এইডা যোগাড় করছি। বান্দরের নউখের কলম আর মানিকজোড়ের রক্ত দিয়া এই পানের উপরে লেইখ্যা দিছে আর কইয়া দিছে,—’সাত রোজের মইদ্যে যদি ও তোমার লেইগ্যা পাগল না অয় তো আমার নামে কুত্তারে ভাত দিও।’
১৮. টিয়া-ঠুঁইট্যা আমগাছ
–কারা ওইখানে? কেডা, কেডারে? শফির মা চেঁচিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।–খবরদার, ফলগাছে কোপ দিলে আজগাই ঠাডা পড়ব মাতায়, কইয়া রাখলাম।
কে একজন বলে—আমরা কিনছি এই গাছ। জিগাও গিয়া হাসুর মা-রে।
শফির মা রাগে গরগর করতে করতে আসে—অ্যাই হাসুর মা, টিয়া-ঠুঁইট্যা আমগাছটাও বেচ্ছস?
—হ, গফুর শেখ নিছে ওডা, দশ টাকায় লাকড়ির লেইগ্যা।
—ওহুঁ, যেই নেউক, ওই গাছ আমি কাটতে দিতাম না।
—ক্যাঁ? ওই গাছ তো আমার ভাগের।
—ওই গাছ তোর তা মুল্লুকের মাইনষে জানে। কী সোন্দর আম অইছে গাছটায়। জষ্টি মাসে পাকব। তুই এই গাছ বেচ্লি কোন আক্কেলে? বাচ্চা-কাচ্চারা কি মোখে দিব?
এক সঙ্গে অনেকগুলো কথা চেঁচিয়ে বলে শফির মা হাঁপিয়ে ওঠে।
–-কি মোখে দিব আবার? আগে ভাত খাইয়া বাঁচলে তারপর তো আম-জাম।
শফির মা ভেঙচিয়ে ওঠে—তারপর ও আম-জাম! আমের দিনে বেবাকে আম খাইব, আর ওরা মাইনষের মোখের দিক চাইয়া থাকব। কর যা তোর মনে লয়। তুই গলায় দড়ি দিলেও আর আমি না করতাম না।
দুইদিন বাদে গলায় দড়িই দিতে অইব। কি করতাম আর! তোমরাই হে-সুম ধইরা-বাইন্দা তোবা করাইলা। ঠ্যাং ভাইগা কতদিন ধইরা বইস্যা আছি। একটা না, দুইডা না, চাইরখান প্যাডের ভাত আহে কই তন?
শফির মা ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। বাড়ীর দক্ষিণ পাশ থেকে গাছ কাটার শব্দ আসে। জয়গুনের বুকের ভেতরেও যেন কুঠারের আঘাত পড়ছে বারবার।
টিয়াঠুঁটে আম গাছটায় আম ধরেছিল এবার খুব। আমও জাতের আম। দুধে মেশালে দুধ নষ্ট হয় না, এত মিষ্টি আমের তলার দিকটা টিয়ার ঠোঁটের মত বাকা। আর পাকলে ঐ ঠোঁটটাই শুধু লাল হয়।
হাসু ও মায়মুন গাছে বোল দেখে কত খুশী হয়েছিল! আর একটা মাস রয়ে সয়ে বেচলে ওরা খেতে পারত। কিন্তু এদিকে পেট তো আর ক্ষুধার জ্বালায় ‘র’ মানবে না।
করিম বক্শ দুধের হাঁড়ি মাথায় উঠানে এসে ডাকে–কাসু!
কাসু ততক্ষণে পিছ-দুয়ার দিয়ে পালিয়েছে।
আরো দু-তিন ডাক দিয়েও যখন কাসুর সাড়া পাওয়া যায় না, তখন সে মায়মুনকে ডাকে—একটা ঘড়ি লইয়া আয় মায়মুন।
জয়গুনের একবার বলতে ইচ্ছে হয়—আমরা দুধ খাই না। লইয়া যান দুধ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই বলা হয় না।
মায়মুন ঘটি নিয়ে আসে।
করিম বক্শ এক সের দুধ টিতে ঢেলে দিয়ে বলে—রোজ এমুন সুম আমি দুধ দিয়া যাইমু। আমাগ ধলা গাইড বিয়াইছে। কাসুর ভাগ্যে একটা দামড়ি বাছুর অইছে। বাছুর ঘাস ধরলে কাসুরে দিয়া যাইমু। কাসু কই গেছে রে?
মায়মুন উত্তর দেয়—পালাইছে।
করিম বক্শ আর দাঁড়ায় না। যেতে যেতে একবার পেছনে তাকায়। জয়গুনের চোখে চোখ পড়তে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
জয়গুন ধমক দেয় মায়মুনকে—দুধ রাখলি, খাইব কে?
—ক্যাঁ? আমরা।
—হ, তোরা-ই খা। আমি ইতাম না ওই দুধ।
সকলকে চমকে দিয়ে টিয়া-ঠুঁটে আম গাছটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। দু’একটা পাখীর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে পাশের ঝোপ থেকে।
নাবিক সিন্দাবাদের ঘাড়ের ওপর এক দৈত্য চেপে বসেছিল। বাঙলা তেরোশ’ পঞ্চাশ সালের ঘাড়েও তেমনি চেপে বসেছিল দুর্ভিক্ষ। হাত-পা শেকলে বাঁধা পরাধীন সে বুভুক্ষু তেরো’শ পঞ্চাশের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে, তার পরের আরো চারটি উত্তরাধিকারীর। কিন্তু দুর্ভিক্ষ আর ঘাড় থেকে নামেনি। ঘাড় বদল করেই চলেছে একভাবে। হাত-পায়ের। বন্ধনমুক্ত স্বাধীন তেরোশ’ পঞ্চান্নে এসেও সে আকাল-দৈত্য তার নির্মম খেলা খেলছে। তাকে আর ঘাড় থেকে নামান যায় না।
দেশে চালের দর কড়ি টাকার নিচে নামে না বছরের কোন সময়েই। ফালগুন মাস থেকে সে দর আরো চড়ে যায়। চড়ে যায় লাফিয়ে লাফিয়ে। চল্লিশ টাকায় গিয়ে ঠেকে। আউশ ধান ওঠার আগে এই দর আর নামে না। ফলে যারা টেনেটুনে দু’বেলা খেত, তারা এক বেলার চালে দু’বেলা চালায়। ফেনটাও বাদ দেয় না, ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দুধ-ভাতের মত করে খায়। যারা দুবেলা আধপেটা খেয়ে থাকত, এ সময়ে তারা শাক-পাতার সাথে অপি চাল দিয়ে জাউ রেধে খায়। মুধিতের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যায়। পেটের জ্বালায় ভিক্ষার ঝলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেকে। আশা—দশ দুয়ারে মেগে এক দুয়ারে বসে খাবে। কিন্তু দশের দশা শোচনীয়। সমস্ত দেশ দিশেহারা। দুর্ভিক্ষে কে দেয় ভিক্ষে?
এ পৌনঃপুনিক দুর্ভিক্ষ শুধু কি ভাতের? কাপড়েরও। শত কপাল কুটলেও সরকার-নিয়ন্ত্রিত মূলের দ্বিগুণ দিয়েও একখানা কাপড় পাওয়া যায় না। অনেকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে দেয় একই কাপড়ে। তালি খেয়ে খেয়ে ময়লা জমে জমে ভারী হয়ে ওঠে সে কাপড়। বৃষ্টি ও ঘামে ভিজে বিদঘুটে বোটকা গন্ধ ছড়ায়।
জয়গুন অনেক ভেবেছে ভাল কাপড়ের ভাবনা। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে বসে এ ভাবনার অর্থ নেই, সে হাড়ে হাড়ে বুঝেছে। মায়মুনের বিয়ের সময়, ছমাস আগে তওবা করে সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আজ পর্যন্ত সেই তওবারর অমর্যাদা সে করেনি।
—কিন্তু এমনি করেই কি আর দিন চলবে? এমনি করেই কি পেটের জ্বালা জুড়োবে? কাপড় জুটবে পরনের? জয়গুন প্রশ্ন করে নিজেকে।
পেটের জ্বালা এদিকে বেড়েই চলছে দিন দিন। দুই দিন এক রকম কিছুই খাওয়া হয়নি।
কাল রাত্রে খাওয়ার সময় কাসু জিজ্ঞেস করেছিল—তুমি খাইবা না, মা?
—আমি রোজা আছি। তোরা খাইয়া ওঠ। তোর ব্যারামের সময় মানতি করছিলাম তিনড়া রোজা রাখতাম বুইল্যা।
—রাইতেও খাইবা না তুমি? মায়মুন বলে।
—এই রোজায় দিন-রাইত না খাইয়া থাকতে অয়।
কাসু বিশ্বাস করলেও হাসু ও মায়মুন বিশ্বাস করে নি সে কথা। নিজের পাতের কয়েক মুঠো ভাত হাঁড়িতে তুলে রেখে হাসু উঠে গিয়ে বলেছিল—আইজ ভুখ নাই মা।
হাসুর দেখাদেখি মায়মুনও থালার ভাত রেখে বলে–আমারও ভুখ্ নাই। দু’দিনের মধ্যে সে ভাত ক’টাই পেটে দিয়ে আছে জয়গান।
বাড়ীর আমগাছ, তেঁতুলগাছ, কাডের বাঁশ কেটে ছাপ্পোনছাড়া’ করে দেয়া হয়েছে। চারটে ‘আণ্ডালু’ হাস বিক্রি করে দিয়েছে। বিক্রি করবার মত আর কিছুই নেই।
বিকেল হলেই কাসু খেলা ছেড়ে মা-র আঁচল ধরে তার পিছু পিছু ঘুরতে থাকে, তাগিদ দেয়—ভাত রানবা না, মা? আমার ভুখ লাগছে। এই দ্যাই না প্যাটটা কেমুন ছোড অইয়া গেছে।
কাসু হাত দিয়ে পেটটা দেখায়। জয়গুন দেখে, সত্যি পেটটা নেমেই গেছে। সে ফাঁকি দিয়ে বলে—তার মিয়াভাই মাছ আনলে তারপর পাক করমু। নিত্যি নিত্যি শাক পাতা ভাললাগে না।
—কি মাছ, মা? ইলশা মাছ?
—হ, ইলশা মাছ।
কাসু খুশী হয়।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। হাসু এখনও এলো না। জয়গুন কাসুকে ভুলিয়ে রাখবার জন্যে মায়মনকে বলে—মায়মন, ওরে লইয়া যা। ঝিঁঝিঁ ধইর্যা দে গিয়া। ঐ দ্যাখ, হেন কেমুন ডাকে।
দুটো নারকেলের আঁইচা যোগাড় করে কাসুকে নিয়ে মায়মুন শফিদের ঘরের ছাঁচতলায় যায়। দু’হাতে আঁইচা দুটো নিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে—ঠর্র্ ঠর্র্।
এ রকম শব্দে ঝিঁঝিঁ পোকা আকৃষ্ট হয়! জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শব্দকে কেন্দ্র করে উড়তে থাকে। যখন হাতের কাছের কোন কিছুর উপরে বসে, তখন ধরতে বেগ পেতে হয় না।
নিজের অসামর্থ্যের জন্য অবুঝ ছেলের কাছেও লজ্জিত হয় জয়গুন। পেটের ছেলে, তবুও নিজেদের দৈন্য ঢেকে রাখবার চেষ্টা করে সে সব সময়। হাসু ও মায়মুনকে কম করে খেতে দিলেও কাসুকে খেতে দিতে হয় পুরো। যেন সে অভাবের কথা জানতে না পারে।
কাসু হাঁড়ির খবর জানে না। জাবার বয়সও তার নয়। তা ছাড়া জানবার মত কোন কারণও জয়গুন ঘটতে দেয়নি আজ পর্যন্ত।
জয়গুন শুনতে পায় নারকেলের আঁইচা বাজিয়ে মায়মুন ও কাসু ঝিঁঝি ধরার ছড়া গাইতে শুরু করেছে?
ঝিঁঝি লো, মাছি লো,
বাঁশতলা তোর বাড়ী,
সোনার টুপি মাথায় দিয়া
রূপার ঝুমুর পায়ে দিয়া
আয়-লো তাড়াতাড়ি।
ঝিঁঝি ঝিঁঝি করে মায়,
ঝিঁঝি গেছে সায়বের নায়,
সাতটা কাউয়ায় দাঁড় বায়,
ঝিঝিলো তুই বাড়ীত আয়।
ঝিঝির বাপ মরছে
কুলা দিয়া ঢাকছে,
ঝিঁঝির মা কানছে,
আয়-লো ঝিঁঝি */বাড়ীত আয়।
কিন্তু এ রকম ফাঁকি দিয়ে আর কত দিন? কাল রাত পোহালেই যখন এক মুঠো ভাত দিতে পারবে না ছেলের মুখে, তখন কি এ অভাবের কথা গোপন থাকবে ছেলের কাছে? ক্ষুধায় অস্থির হয়ে যখন সে ‘ভাত ভাত করে চিৎকার করবে, তখন মা হয়ে কি জবাব দেবে সে? জবাব না পেয়ে সে কি তখন বুঝবে না যে, তার মা অপদার্থ, খেতে দিতে পারে না। জয়গুন ভাবে এসব কথা। এ ভেবে আরো ব্যথিত হয় যে পেট ভরে খেতে দিতে না পারলে কাসুর কাছে তার বুকভরা স্নেহের কোন দামই আর থাকবে না। ছেলের আস্থা থাকবে না মা-র ওপর। মা-র স্নেহের ছায়ায় আসার জন্য একদিন সে অস্থির হয়ে উঠেছিল। এবার ক্ষুধার তাড়নায় করিম বুকশের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে সে অস্থির হয়ে উঠবে আবার।
সন্ধ্যার পর তিনপো চাল গামছায় বেঁধে হাসু বাড়ী আসে।
জয়গুন চোখ টিপে হাসুকে জিজ্ঞেস করে—মাছ কই হাসু? তোরে না কইছিলাম, ইলশা মাছ আনতে?
হাসু কথার ধরন বুঝতে পেরে বলে—ইলশা কাতলা কোন মাছই পাইলাম না বাজারে। মাছ মোডে নাই।
দু’দিনের না-খাওয়া জয়গুনের বুকের ভেতর ধড়ফড় করে। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, যেন নাড়ি-ভুড়িগুলোও হজম হয়ে যাচ্ছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গামছায় বা ধা চাল দেখে তার ক্ষুধা আরো বেড়ে যায়।
জয় গুন সমস্তটা চাল নিয়ে হাঁড়ি বসায় আজ। ভোরের জন্যে রেখে দেয় না কিছুই। এই বেলা খেয়ে কিছু যদি বাঁচে তবে ছেলে-মেয়েরা পান্তা ভাত খেতে পাবে ভোরে। কিন্তু সে আশা কম। তার মনে হয়, একাই সে তিনপো চালের ভাত খেতে পারবে এখন।
কচুর লতির চচ্চড়ি ও ডাটা শাক দিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ভাত খায় সকলে। অনাহারে শুকনো বুকে ভাত ঠেকে জয়গুনের। বাবার পানি খেয়ে সে বুক ভিজিয়ে নেয়।
জয়গুন বলে হাসুকে-কি চাউল রে! ফেনা যে ঘাডের পানি মতন। আবার চুকা। দেইখ্যা আনতে পারস না?
—চাউল পাওয়া যায় না বাজারে, তার আবার দেইখ্যা আনুমু। কত কষ্টে এই চাউল যোগাড় করলাম। বারো ছটাক বারে অনা। কাইল বাজারে ঢোল দিছিল ম্যাজিস্টর সাব—নয় আনার বেশী এক সেরের দাম নিলে জরিমানা অইব। এই-এর লেইগ্যা বাজারে চাউল নাই। মহাজনরা গোলায় গুঁজাইয়া থুইছে চাউল।
খাওয়া শেষে হাঁড়িতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
ছেলে-মেয়েরা মুমিয়ে পড়েছে সকাল সকাল। দু’দিনের অনাহারের পর ভাত খেয়ে জয়গুন আরো শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। আজ তার শরীর ঝিমঝিম করে। চোখ দিয়ে পানি ঝরে
জয়গুন বসে বসেই এশার নামাজ শেষ করে। প্রতিদিনের মত তসবীহ নিয়ে জপতে আরম্ভ করে। কিন্তু সকাল কাজের মধ্যে ঐ এক চিন্তা–কাল রাত পোহালে ছেলে-মেয়েরা মুখে কী দেবে? হাসু কী খেয়ে কাজে যাবে? কার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার কিছু নেই।
জয়গুনের উত্তরে চাল কিনতে যাওয়ার সাথী লালুর মা দু’দিন এসেছিল। অনেক সাধাসাধি করেছিল ফতুল্লার ধান কলে কাজ করার জন্যে। কিন্তু জয়গুন তওবার কথা ভেলে নি। হাতে পায়ে যে শিকল সে পরেছিল সেদিন, তা খুলবার সাহস তার নেই। শক্তি পায় না। নিতান্ত অসহায়ভাবে সে লালুর মা-র প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ লালুর মা-র বলা কয়েকটি কথা বারবার তার মনে আসে। সে বলছিল-না খাইয়া জানেরে কষ্টে দিলে খোদা ব্যাজার সয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পা ও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া টাকা রুজি করনের লেইগ্যা।
লালুর মা কথায় কথায় গ্রাম্য গীতের কয়েকটা লাইনও গেয়ে উঠেছিল সেদিনঃ
আত আছিল, পাও আছিল,
আছিল গায়ের জোর,
আবাগী মরল ওরে
বন্দ কইর্যা দোর।
কথাগুলো আজ তার নতুন অর্থ, নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে জনের চিন্তাকে নাড়া দেয়। লালুর মা-র প্রস্তাবকে সে বারবার বিবেচনা করে দেখে। ধান কলের কাজ এমন কিছু নয়। ধান ঘাটা, ধান রোদে দেয়া, চাল ঝাড়া—এই সব কাজ। রোজ পাচসিকা করে পাওয়া যায়। তা ছাড়া খুদ-কুড়াও পাওয়া যায় চেয়ে-চিন্তে।
মনের দুই বিরোধী চিন্তার সংঘর্ষের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
মশার কামড় খেয়ে মায়মুন হাত-পা নাড়ছে। জয়গুন তাকায় ঐ দিকে। হাসু বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। সারাদিন খেটে তার আর হুঁশ নেই। মশার কামড়েও তার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না। কাসু তার মিয়াভাইর গলা ধরে তার গায়ের ওপর একখানা পা চড়িয়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। কুপির অস্পষ্ট আলোকে ছেলেমেয়েদের দিকে সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাদের কচি মুখ জয়গুনকে তার পথের সন্ধান বাতলে দেয়, তওবার কথা সে ভুলে যায়। লালুর মা-র। প্রস্তাব মাথায় নিয়ে কাল যাবে সে ধান কলে কাজ করতে। হাতে পায়ে তাকত থাকতে কেন সে না খেয়ে মরবে? ক্ষুধার অন্ন যার নেই, তার আবার কিসের পর্দা, কিসের কি? সে বুঝেছে, জীবন রক্ষা করাই ধর্মের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মূলমন্ত্র। জীবন রক্ষা করতে ধর্মের যে কোন অপ-আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সে প্রস্তুত। উদরের আগুন নিবাতে দোজখের আগুনে ঝাপ দিতেও তার ভয় নেই।
জয়গুন সুঁই-সুতো নিয়ে কাপড় সেলাই করতে বসে। কাপড়টা অনেক জায়গায় ছিড়ে গেছে। এ কাপড় নিয়ে বেরোবার উপায় নেই। হাসুর গামছা বুকে জড়িয়ে গায়ের আঁচলটা আগে সেলাই করে। সেটা শেষ হলে বাকী আঁচলটা সেলাই করে তারপর।
ভোর হয়। ঘুম থেকে জয়গুন ওঠে নতুন প্রাণ, নতুন উদ্যম নিয়ে।
শফির মা-র কাছ থেকে চাল ধার করে রান্না হয়। ছেলেমেয়েকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে জয়গুন বেরিয়ে পড়ে।
ধানখেতের আল ধরে পথ চলে জয়গুন। হাঁটু-সমান উঁচু ধান গাছে ভরা মাঠ। যেন সবুজ দরিয়া। ঝিরঝিরে বাতাস ঢেউ-এর নাচন তোলে। ছড়িয়ে দেয় মাঠের এক প্রান্ত হতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত। দূরপ্রসারী মাঠের দিকে তাকিয়ে জয়গুনের চোখ জুড়ায়।
খেতের কাজে ব্যস্ত চাষীরা তাকায় জয়গুনের দিকে। কিন্তু তার ভ্রূক্ষেপ নেই। গদু প্রধান তার খেত তদারক করছিল। সকলের অলক্ষ্যে সে মাথা নাড়ে আর বলে—তোরে শাসন করতে পারতাম না! আমার নাম গদু পরধান। এটু সবুর কর।
১৯. সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত ক্ষেপেছে
সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত ক্ষেপেছে।
রাতে জয়গুনের ঘরের বেড়া ও চালের ওপর ঢিল পড়তে শুরু করে। হাসু, কাসু ও মায়মুন চিৎকার করে ওঠে, শেষে গলা দিয়ে চিৎকারও বের হয় না। ভয়ে তারা মা-কে জড়িয়ে ধরে।
ওদিকে শফির মা-র চিৎকার শোনা যায়।
পরের দিন ভোরে সে বলে–হেসুম কইছিলাম পাহারা বদলাইতে। অখন দ্যাখ কি দশা অয়! গাছগুলা কাটতে মানা করছিলাম। কোন্ গাছে কি আছিল, কে জানে? ওগ বাসা ভাইঙ্গা দেওনে রাগ অইছে।
পরের রাত্রেও এমনি ঢিল পড়ে। গ্রামে এই নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর কাছ দিয়ে আর কেউ হাঁটে না।
গ্রামের বুড়ো সোনাই কাজী বলে—সূর্য-দীগল বাড়ীর ভূত ক্ষেপছে, আর উফায় নাই। সূর্য-দীগল বাড়ীতে মানুষ উজাইতে পারে না, বুড়া-বুড়ীর কাছে হুনছি। সূর্য-দীগল হাটেরও উন্নতি অয় না। আমার চাউথেই দ্যাখলাম, জলধর কুণ্ডু, কুণ্ডেরচরে হাট মিলানোর লেইগ্য কত টাকা খরচ করল। কত হরিলুট দিল। ব্যাপারীগ মিডাই খাওয়াইল, নট্ট কোম্পানীর যাত্রা গানেও দুই এক আজার টাকা খরচ করছিল। কিন্তু কই? হাট আর মিলাইতে পারল না।
থুথুরে বুড়ী হনুফা বিবি বলে আমার মামু একবার সূর্যুদীগল মৌপোকের বাসা ভাঙছিল। আমার মনে আছে। গাছের তন নামতে না নামতে আঁড়ির তলা ভাইঙ্গা মধু পইড়া গেল। কী তেজ! বাপ্পুসরে!
জয়গুন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে রাত্রে শফির মা-র ঘরে আশ্রয় নেয়। ছেলে-মেয়েদের বুকে নিয়ে সারারাত ‘আল্লা আল্লা’ করে।
অমাবস্যার রাত। করিম বক্শ গালে হাত দিয়ে কুপির সামনে বসে ভাবছে। তার মরে চোখে ভাসে—জয়গুনের ঘরে ঢিল পড়ছে দাডুম-দুড়ুম। তার বুকে কাসু ও মায়মুন ভয়ে মিইয়ে গেছে। হাসু পাশে বসে বসে কাঁপছে চোখ বন্ধ করে। জয়গুন আর একা এদের সামলাতে পারছে না। করিম বশের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। তার চোখের অব্যক্ত ভাষায় সে যেন সাহায্য চাইছে তার কাছে।
করিম বক্শ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তাকের ওপর থেকে চারটে গজাল নিয়ে গামছায় বাঁধে। জোবেদ আলী ফকিরের নির্দেশমত আজ এই অমাবস্যার দুপুর রাতে সূর্য-দীঘল বাড়ীর চার কোণে মন্ত্রসিদ্ধ গজাল ক’টা পুঁতে আসতে হবে তাকে।
সূর্য-দীঘল বাড়ী ঠিক-ঠাক কারে জোবেদ আলী ফকির সেই যে একটি পেতলের কলসী দাবী করেছিল, আজ পর্যন্ত তাকে দেয়া হয় নি সে কলসী। বছর বছর পাহারা বদলাবার কথাও সে বলেছিল। তাতেও কান দেয়নি জয়গুন ও শফির মা। এ জন্যে গোস্বা হয়ে সে করিম বক্শকে জানিয়েছিল—এইবার দেখুক মজাখান। সাত দিনের মধ্যে বেবাক মিস্মার অইয়া যাইব। করিম বক্শ একটা পেতলের কলসী কিনে দিয়ে এবং অনেক হাতে-পায়ে ধরে জোবেদ আলী ফকিরের রাগ মাটি করেছে।
ফকির গজাল কয়টায় ফুঁ-ফাঁ দিয়ে তুকতাক করে করিম বকশের হাতে দিয়ে বলে-পরশু অমাবইস্যা। রাইত দুফরের পর–। চাইর কোণে চাইড্ডা—
–আমার ডর করে যে! একলা যাইতে সাবাসে কুলায় না। করিম বক্শ বলে।
—ডর করে! কও কি?
একটু চিন্তা করে ফকির বলে—আইচ্ছা, হেই দাওয়াইও আছে। করিম বকশের কাঁধে দুই হাত রেখে ফকির টানা সুরে মন্ত্র পড়ে–
খাটো কাপড় উলট বেশে
বাণ মারলাম হেসে হেসে।
সেই বাণে মেদিনী কাঁপে,
জল কাঁপে, থল কাঁপে,
চান কাঁপে, তারা কাঁপে,
পাতালের বাসুকী কাঁপে,
আগে ভাগে ভূত-পেরেতে,
জিন ভাগে শেষে।
কালা বাণে ভূত মারলাম,
পেত্নী বানলাম কেশে।
মন্ত্র পড়ে করিম বক্শের বুকে ও চোখে সাতবার ফুঁ দিয়ে ফকির এবার বলে-ডরের মাজা ভাইঙ্গা দিছি। যাও এইবার, আর ডর নাই। পরশু রাইত দুফরের পর, মনে থাকে যেন। চাইর কোণায় চাইড্ডা–
চারটি গজাল—বাড়ীর চার পাহারাদার। ঠিক-ঠাকে বসিয়ে আসতে পারলে ভূত-পেত্নীর দৌরাত্ম আর থাকবে না।
কুপি নিবিয়ে করিম বক্শ লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরোয়। সে পা ফেলে জোরে, আরো জোরে। কালো রাত্রির জমাট অন্ধকার যেন ভয় পেয়ে তার চলার পথ ছেড়ে দেয়।
ঈশান ও বায়ু কোণে দুটি গজাল পুঁতে সে পশ্চিম দিকে চলে আসে। ঘন অন্ধকার। তার মাঝেও দৃষ্টি চলে করিম বক্শের।- তিনটা ছায়ামূর্তি! ভয়ে তার গায়ের রোম কাটা দিয়ে ওঠে। সূর্য-দীঘল বাড়ীর তাল গাছের তলায় সে থমকে দাঁড়ায়। কাঁপতে কাঁপতে বসে পরে মাটিতে।
ছায়ামূর্তিগুলো ঢিল ছুঁড়ছে আর তারই দিকে সরে সরে আসছে। করিম বক্শ একটা শব্দহীন চিৎকার করে ওঠে। বার কয়েক টিপটিপ করে যন্ত্রটা যেন বন্ধ হয়ে যায়। একটা মূর্তি আরো কাছে সরে আসে তার। করিম বক্শের গায়ে ধাক্কা লাগে লাগে। এবার করিম বক্শ চিনতে ভুল করে না। হৃদযন্ত্রটা আবার বার দুই ঢিপঢিপ করে চালু হয়ে যায়। হঠাৎ ঘাম দিয়ে তার ভয়ও কেটে যায়। সে দাঁড়ায়। পাশ থেকে খপ করে ছায়ামূর্তির একটা হাত চেপে ধরে- গদু পরধান! তোমার এই কাম!!…!!!
সূর্য-দীঘল বাড়ীর তালগাছের তলায় করিম বক্শের মৃতদেহ টান হয়ে পড়ে আছে। আশ-পাশ গ্রামের লোক ছুটে আসে দেখ্তে। মৃতের শরীরে কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। সকলেই একমত— সূর্য-দীঘল বাড়ীর ভূত তার গলাটিপে মেরেছে।
যে হিম্মত বুকে বেধে জয়গুন এত দিন সূর্য-দীঘল বাড়ীতে ছিল, তা আজ খান্ খান্ হয়ে যায় এ ঘটনার পরে।
আজ বারবার করিম বকশের কথাই মনে পরে জয়গুনের। বেদনায় বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দরদর ধারায় পানি ঝরে গাল বেয়ে। আহা বেচারা! জীবনে কাউকে ভালোবাসেনি। কারো ভালোবাসা পায়ও নি সে।
শফির মা আগে আগে গাইরি-বোচকা বাঁধে। জয়গুন জিজ্ঞেস করে—বাড়ী ছাইড়া কই যাইবা?
—আগেত সোনার মানিকগো লইয়া বাইর অ। খোদার এত বড় দুইন্যায় কি আর এট্টু জা’গা পাইতাম না আমরা?
ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে জয়গুন ও শফির মা বেরিয়ে পড়ে। মনে তাদের ভরসা খোদার বিশাল দুনিয়ায় মাথা গুঁজবার একটু ঠাঁই তারা পাবেই।
চলতে চলতে আবার জয়গুন পেছন ফিরে তাকায়। সূর্য-দীঘল বাড়ী! মানুষ বাস করতে পারে না এ বাড়িতে। দু’খানা ঝুপড়ি। রোদ বৃষ্টি ও অন্ধকারে মাথা গুঁজবার নীড়। দিনের শেষে, কাজের শেষে মানুষ পশু-পক্ষী এই নীড়ে ফিরবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
ঐ উঁচু তালগাছ অনেক কালের অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষী এটা। তারা এগিয়ে চলে।
বহুদূর হেঁটে শ্রান্ত পা-গুলোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তারা গাছতলায় বসে। উঁচু তালগাছটা এত দূর থেকেও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আবার তারা এগিয়ে চলে…….