০১. আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে
আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাপ, ভাই-বোন। ভাতের লড়াইয়ে তারা হেরে গেল।
অনেক আশা, অনেক ভরসা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে তারা শহরের বুকে পা বাড়িয়েছিল। সেখানে মজুতদারের গুদামে চালের প্রাচুর্য, হোটেলে খাবারের সমারোহ দেখে দেখে তাদের জিভ শুকিয়ে যায়। ভিরমি খেয়ে গড়াগড়ি যায় নর্দমায়। এক মুঠো ভাতের জন্যে বড়লোকের বন্ধ দরজার ওপর মাথা ঠুকে ঠুকে পড়ে নেতিয়ে। রাস্তার কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়। দৌলতদারের দৌলতখানার জাঁকজমক, সৌখিন পথচারীর পোশাকের চমক ও তার চলার ঠমক দেখতে দেখতে কেউ চোখ বোজে। ঐশ্বর্যারোহীর গাড়ীর চাকায় নিষ্পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় কেউ বা।
যারা ফিরে আসে তারা বুকভরা আশা নিয়ে আসে বাঁচবার। অতীতের কান্না চেপে, চোখের জল মুছে তারা আসে, কিন্তু মানুষের চেহারা নিয়ে নয়। তাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ধনুকের মত বাকা দেহ শুষ্ক ও বিবর্ণ। তবুও তারা ভাঙা মেরুদণ্ড দিয়ে সমাজ ও সভ্যতার মেরুদণ্ড সোজা করে ধরবার চেষ্টা করে। ধুকধুকে প্রাণ নিয়ে দেশের মাটিতে প্রাণ সঞ্চার করে, শূন্য উদরে কাজ করে সকলের উদরের অন্ন যোগায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে হুঁচোট খাওয়া দেশ আবার টলতে টলতে দাঁড়ায় লাঠি ভর দিয়ে।
দুটি ছেলে-মেয়ের হাত ধরে জয়গুনও গ্রামে ফিরে আসে। বাইরের ছন্নছাড়া জীবন। এতদিন অসহ্য ঠেকেছে তার কাছে। কতদিন সে নিজের গ্রামে ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। ছায়া-সুনিবিড় একখানি বাড়ী ও একটি খড়োঘর তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে কতদিন! কিন্তু বৃথাই ডেকেছে। তার সে বাড়ী, সে ঘর আর তার নয় এখন। দুর্ভিক্ষের মহাগ্রাসে কোথায় গেল বাড়ী আর কোথায় গেল ঘর। বেচে নিঃশেষ করে দিল উদরের জ্বালা মেটাতে।
জয়গুন গ্রামে আসে একটি মাত্র আশা নিয়ে। ছাড়া ভিটে আছে একটা। সে তার আট আনা অংশের মালিক। বাকী আট আনার অংশীদার তার নাবালেগ ভাই-পো শফি। শফিকে নিয়ে শফির মা-ও আসে। তাদেরও মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। শেষে স্থির হয়—এই ছাড়া ভিটেটার ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে দু-ভিটিতে দুখানা ঘর তুলে আবার তারা সংসার পাতবে।
কিন্তু এটা যে সূর্য-দীঘল বাড়ী!
জয়গুন ও শফির মা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
পূর্ব ও পশ্চিম সূর্যের উদয়াস্তের দিক। পূর্ব-পশ্চিম প্রসার। বাড়ীর নাম তাই সুর্য-দীঘল বাড়ী। সূর্য-দীঘল বাড়ী গ্রামে কচিৎ দু’একটা দেখা যায়। কিন্তু তাতে কেউ বসবাস করে না। কারণ, গায়ের লোকের বিশ্বাস সূর্য-দীঘল বাড়ীতে মানুষ টিকতে পারে না। যে বাস করে তার বংশ ধবংস হয়। বংশে বাতি দেয়ার লোক থাকে না। গ্রামের সমস্ত বাড়ীই উত্তর-দক্ষিণ প্রসারী।
সূর্য দীঘল বাউরি ইতিহাস ভীতিজনক। সে ইতিহাস জয়গুন ও শফির মা-র অজানা নয়।
সে অনেক বছর আগের কথা। এ গ্রামে হাতেম ও খাদেম নামে দুই ভাই ছিল। ঝগড়া করে ভাই-ভাই ঠাঁই-ঠাঁই হয়ে যায়। খাদেম আসে সূর্য-দীঘল বাড়ীটায়। বাড়ীটা বহুদিন থেকেই খালি পড়ে ছিল।
এখানে এক সময়ে লোক বাস করত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা বংশ রক্ষা করতে পেরেছিল কিনা কেউ জানে না। তবুও লোকের ধারণা, সূর্য-দীঘল বাড়ীতে নিশ্চয়ই বংশ লোপ পেয়ে থাকবে। নচেৎ এরকম বিরান পড়ে থাকবে কেন?
যাই হোক, শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে খাদেম এসে সূর্য-দীঘল বাড়ীতে বসবাস আরম্ভ করে। কিন্তু একটি বছরও ঘুরল না। বর্ষার সময় তার একজোড়া ছেলে-মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেল। সবাই বুঝতে পারল—বংশ নির্বংশ হওয়ার পালা শুরু হল এবার। বুড়োরা উপদেশ দিলেন বাড়ীটা ছেড়ে দেয়ার জন্য। বন্ধু-বান্ধবরা গালাগালি শুরু করল—আল্লার দুইন্যায় আর বাড়ী নাই তোর লাইগ্যা। সূর্য-দীগল বাড়ীতে দ্যাখ কি দশা অয় এইবার।
খাদেমের মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছিল। সাতদিনের মধ্যে ঘর-দুয়ার ভেঙ্গে সে অন্যত্র উঠে যায়। জয়গুনের প্রপিতামহ খুব সস্তায়, উচিত-মূল্যের অর্ধেক দিয়ে তার কাছ থেকে বাড়ীটা কিনে নেয়। উত্তরাধিকারের সেই সূত্র ধরে জয়গুন ও শফি এখন এ বাড়ীর মালিক।
ঐ ঘটনার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। এতদিনের মধ্যে আর কোন লোক ভুলেও এ বাড়ীতে আসেনি। আকালের সময় জয়গুন ও শফির মা এ বাড়ীটাই বিক্রী করতে চেয়েছিল। কিন্তু সূর্য-দীঘল বাড়ী কেউ কিনতে এগোয়নি। তখন এ বাড়ীটা বিক্রী করতে পারলেও জয়গুনের স্বামীর ভিটেটুকু রক্ষা করা যেত; ছেলে-মেয়ের বাপ-দাদার কবরে আজ আবার বাতি জ্বলত।
বহুদিনের পরিত্যক্ত বাড়ী। সর্বত্র হাঁটুসমান ঘাস, কচুগাছ, মটকা ও ভাট-শেওড়া জন্মে অরণ্য হয়ে আছে। বাড়ীর চারপাশে গোটা কয়েক আমগাছ জড়াজড়ি করে আছে। বাড়ীর পশ্চিম পাশে দুটো বড়া বাশের ঝাড়। তা ছাড়া আছে, তেতুল, শিমুল ও গাবগাছ। গ্রামের লোকের বিশ্বাস—এই’গাছগুলোই ভূত-পেত্নীর আড্ডা।
অনেকদিন আগের কথা। সন্ধ্যার পর গদু প্রধান সোনাকান্দার হাট থেকে ফিরছিল। তার হাতে একজোড়া ইলিশ মাছ। সুর্য-দীঘল বাড়ীর পাশের হালট দিয়ে যেতে যেতে সে শুনতে পায়-অই পরধাইন্যা, মাছ দিয়া যা! না দিলে ভালা অইব না।