- বইয়ের নামঃ আয়না (ব্যঙ্গরচনা)
- লেখকের নামঃআবুল মনসুর আহমেদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
গো-দেওতা কা দেশ
দিনটাও ছিল বেজায় গরম, মেজাজটাও ছিল নিতান্ত চড়া। রাত না পোহাতেই বিবির সাথে ঝগড়া হওয়ায় প্রতিজ্ঞা করিলাম : আজ বাসায় থাকিব না; সারাদিন বাহিরে থাকিয়া বিবিকে একটু শাস্তি দিব।
কিন্তু যাই-ই বা কোথায় ছাই! জামা-কাপড় লইয়া আড়চোখে বিবির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া লইলাম। বিবি ভ্রুক্ষেপও করিল না। রাগ আমার আরও বাড়িয়া গেল। জোরে জোরে পা ফেলিয়া রাস্তায় নামিয়া পড়িলাম।
বন্ধু রশিদের বাসায় আসিয়া দেখিলাম ও প্রচণ্ড আড্ডা, বিষম কোলাহল। আমাকে দেখিয়া সবাই একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিল : চল, নৌকা ভ্রমণে যাওয়া যাক।
বাড়ির বাহিরে সারাদিন, চাই কি সারা সপ্তাহে, কাটাইয়া দিবার যে কোন সুযোগে আমার আনন্দিত হইবার কথা। কিন্তু নৌকা ভ্রমণের কথা শুনিয়া আমি শিহরিয়া উঠিলাম।
ছেলে বেলা এক বেটা গণক বলিয়াছিল যে, আমার মৃত্যু পানিতে ডুবিয়া! সেই হইতে আমি নদী তো চুলায় যাক, পুকুরে গোসল করিতাম না।
তারপর কলিকাতায় আসিয়া পুকুরের বদলে পানির কলের সুবন্দোবস্ত দেখিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিলাম।
নিতান্ত দায়ে ঠেকিয়া একবার বর্ষাকালে পল্লীগ্রামের বাড়িতে যাইতে হইয়াছিল; প্রায় পনর হাত প্রশস্ত এক নদীর খেয়া পার হইতে গিয়া অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া খোদার নাম লইয়া নৌকায় উঠিলাম। পাঁচ ছয় জন আরোহীর ঠিক মাঝখানে দাঁড়াইয়া আল্লাহর নাম যপ করিতে লাগিলাম। কিন্তু নৌকা যেই মাঝ নদীতে গিয়া পড়িল, অমনি হাঁটু দু’টি ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে লাগিল। আমি মূৰ্ছিত হইয়া পড়িলাম।
নৌকা ভ্রমণের কথা শুনিয়া আমার সে কথা মনে পড়িয়া গা কাঁটা দিয়া উঠিল। মনটা নিতান্ত দমিয়া গেল।
কি করিব ভাবিতে লাগিলাম।
কিন্তু আমার জি হইয়াছিল বিবিকে শাস্তি দিতেই হইবে! কেন সে আসিবার সময় আমাকে বাধা দিল না? তাকে শাস্তি দিবার জন্য আমি আত্মহত্যা করিতেও প্রস্তুত আছি। কাজেই নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়াও আমি বন্ধুদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলিলাম : নৌকা-ভ্রমণে যাইব।
এই বেফাঁস কথাটা বলিয়া ফেলিয়া মনটাই খারাপ হইয়া গেল। বন্ধুরা নৌকা-যাত্রার বিধি-ব্যবস্থার কথা আলোচনা করিতে লাগিল। আমার কিছুই ভাল লাগিল না।
বিকালে প্রস্তুত থাকিতে উপদিষ্ট হইয়া আমি মাতালের মতো টলিতে টলিতে বিদায় হইলাম।
বাসায় ফিরিয়া বিবিকে শুনাইয়া চিৎকার করিয়া আমার এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা চাকরকে জ্ঞাপন করিলাম। বিবির উদ্দেশ্যে রান্না-ঘরের দরজার দিকে দুই একটা কটাক্ষও করিলাম।
কিন্তু সে রান্নাঘর হইতে বাহির হইল না।
রান্নাঘরের সম্মুখ দিয়া বার সাতেক হাঁটাহাঁটি করিলাম, তথাপি সে একবার চাহিয়া দেখিল না। ছুরি হারাইয়া যাওয়ার ভান করিয়া বঁটিতে পেন্সিল কাটিবার জন্য রান্নাঘরে গেলাম এবং বঁটি খুঁজিয়া না পাওয়াতে বিবির কাছে জিজ্ঞাসা করিলাম। তথাপি সে কথা বলিল না, কেবল ইঙ্গিতে পার্শ্ববর্তী বঁটিটা দেখাইয়া দিল।
পেন্সিল কাটিবার কোনও দরকার ছিল না, ছুরিও সশরীরে টেবিলের উপর বিরাজ করিতেছিল। সুতরাং রান্নাঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িলাম!
এইবার ঘরে আসিয়া পেন্সিলটা দূরে নিক্ষেপ করিয়া প্রায় কাঁদিয়া ফেলিলাম। বিছানায় চিৎ হইয়া শুইয়া-শুইয়া ভাবিতে লাগিলাম। চোখের পানিতে বালিশ ভিজিতে লাগিল।
আমি নৌকা-ভ্রমণে গিয়া পানিতে ডুবিয়া মরিলে বিবি কাঁদিবে কিনা, আবার বিবাহ করিবে কি না, করিলে কতদিন পরে করিবে, এবং কাকে করিবে, এই লইয়া মনে বিষম তোলপাড় আরম্ভ হইল।
চোখ বুজিয়া আকাশ-পাতাল ভাবিতে লাগিলাম।
.
দুই
বন্ধু আসিয়া বাহির হইতে হাঁকাহাকি আরম্ভ করিল।
নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাহির হইলাম। চল, বলিয়া বন্ধুরা রওয়ানা হইল।
আমার তখনও নাওয়া হয় নাই। ক্ষুধা তৃষ্ণায় বুক ফাটিয়া যাইতেছিল।
তথাপি তাদের পিছু লইলাম; অনাহারের কথা তাদের জানাইলাম না। অল্পক্ষণ পরেই যে পানিতে ডুবিয়া মরিবে, তার আর আহার অনাহার কি?
অফিস আর বাসা, বাসা আর অফিস- ইহাই আমার যাতায়াতের স্থান। সুতরাং বর্ষায় গঙ্গা যে সাগর হইয়া বসিয়া আছে, সে খবর আমার জানা ছিল না।
মাথা হইতে পা পর্যন্ত ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল।
বন্ধুরা বিরাট হল্লা করিয়া নৌকায় উঠিল।
আমি নিতান্ত অন্যমনস্ক হইয়া তখনও তীরেই দাঁড়াইয়াছিলাম। ডাকাডাকিতে চমক ভাঙিল।
আমি উদ্দেশ্যে স্ত্রীকে শেষ চুম্বন দিয়া আল্লাহর নাম করিতে করিতে, ফাঁসির আসামী যেমন করিয়া মঞ্চে আরোহণ করে ঠিক তেমনি করিয়া নৌকায় আরোহণ করিলাম।
নৌকা চলিতে লাগিল।
বন্ধুরা গান করিতে লাগিল, কি কোলাহল করিতে লাগিল আমার ঠিক মনে নাই। বোধ হয় গানই হইবে। কারণ গানের আয়োজন করা হইয়াছিল।
আমার সেদিকে লক্ষ্য ছিল না। আমি আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম।
দেখিলাম : পশ্চিমাকাশে মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘের মধ্যে আমি আজরাইল ফেরেশতার মুখ দেখিতে পাইলাম, তিনি আমার দিকে অঙ্গুলি সংকেত করিয়া তার চরদিগকে কি বলিতেছেন।
ব্যাপার কি বুঝিতে আমার বাকি রহিল না।
বন্ধুদের কোলাহলে আমার ধ্যানভঙ্গ হইল।
দেখিলাম : তারা সবাই চিৎকার করিতেছে। সবারই মুখে আতংক ফুটিয়া উঠিয়াছে। নৌকা বিষম দুলিতেছে।