মাস্টার হাসিয়া বলিলেন : আমরা এসলামের ইজ্জত রক্ষার জন্যই তুর্কী টুপি পোড়াচ্ছি। অন্য টুপি আমরা পোড়াতে যাব কেন?
–তুর্কী টুপি কি অপরাধ করেছে? এ টুপি ত রোমের বাদশার হুকুমে তৈরি হচ্ছে।
মাস্টার সাহেব হাসিয়া বলিলেন : এটা আপনাদের ভুল ধারণা। তুর্কী টুপি নামেই তুর্কী। আসলে এ তৈয়ার হয় খ্রিস্টানদের দেশে। সেই দেশের নাম ইটালি। এই ইটালি দেশ আজকাল রোমের সুলতান আমাদের খলিফার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেইজন্য সে দেশের তৈরি টুপি আমরা বয়কট করেছি।
কথোপকথনে মৌলবী সাহেবের খাওয়া শেষ হইয়াছিল, সুতরাং রাগও কমিয়া আসিয়াছিল। তিনি এইবার খেয়াল করিতে-করিতে অবিশ্বাসের উচ্চ হাসি হাসিয়া বলিলেন : রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইটওয়ালি না কে, এই কেস্সায় আপনারা এতবার করছেন? কে বলেছে এই কথাকে এনেছে এই খবর? কে গিয়েছিল রোমে?
–বলিয়া বিজয়গর্বদীপ্ত মুখে তিনি উপস্থিত প্রত্যেকের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং হাসিতে-হাসিতে সম্মুখস্থ পানদান হইতে একটা পান গালে পুড়িয়া আঙ্গুলের ডগায় চুন লইয়া নিপুণতার সহিত শাদাপাতা ছিড়িতে লাগিলেন।
মাস্টার যুবক মানুষ। মৌলবী সাহেবের এই অমার্জনীয় অজ্ঞতায় তাঁহার রাগ হইল। তিনি কিঞ্চিৎ রাগতস্বরে বলিলেন : আপনি তা হলে লড়াইর কথাটাই অবিশ্বাস করেন?
মৌলবী সাহেব ফিক্ করিয়া ঘরের বেড়ায় একগাল পিক ফেলিয়া দিয়া নিশ্চিন্ত জয়ের গাম্ভীর্যের সহিত বলিলেন : অবিশ্বাস করব না? রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে যে ইটওয়ালি না কে লড়াই করছে, আপনি বলতে পারেন, তার সোলতানৎ কত বড়? তার কয় লাখ সিপাই আছে?
মাস্টার বলিলেন তা, তার রাজ্য খুব বড় নয় বটে, কিন্তু ইংরাজ তাকে সাহায্য করছে।
মৌলবী সাহেব মাস্টারের অজ্ঞতায় এবার রাগিয়া গেলেন। বলিলেন : ইংরাজ রোমের সুলতানের দুশমনকে সাহায্য করছে, এও আপনার বিশ্বাস করেছেন? ইংরাজি পড়ে আপনাদের ঈমান-আমান সব গেছে, যাক, আক্কেলের মাথাও কি আপনারা খেয়েছেন? প্রজা হয়ে মনিবের বিরুদ্ধে লড়াই করবে ইংরাজ?
মাস্টার অবাক হইয়া বলিলেন : কে কার প্রজা? কে কার মনিব?
মৌলবী সাহেব বলিলেন : বাহ্। কেন, ইংরাজ রোমের সুলতানের প্রজা নয়? এটাও জানেন না? কি লেখাপড়া শিখেছেন তবে?
মাস্টার এবারে হাসিয়া ফেলিলেন। বলিলেন : ইংরাজ রোমের সুলতানের প্রজা নয়, সুলতানের চেয়ে ঢের বড় বাদশাহ।
মৌলবী সাহেব কানে আঙ্গুল দিয়া “আসতা ফেরুল্লাহ পড়িতে লাগিলেন। অবশেষে বলিলেন : আপনি হাদিস-কোরআনের খেলাফ কথা বলতে শুরু করেছেন। আপনার সঙ্গে বাহাস করে আমি গোনাহগার হতে চাই না।
বলিয়া তিনি সমবেত লোকজনের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : হাদিস শরীফে এসেছে : তামাম জাহানের মধ্যে রোমের সোলতানৎ সকলের চেয়ে বড় মুকুল। কোরআন-পাকেও খোদাতালা রোমের সুলতানের বয়ান করেছেন। আর আজ কিনা ইংরাজি-পড়া লোকের কাছে শুনতে পাই ইংরাজদের বাদশাহি রোমের বাদশাহির চেয়েও বড়। হাদিস শরীফে রোমের সুলতানকে শারেজাহানের বাদশাহ বলা হয়েছে। ইংরাজরা কি জাহানের বাইরে বাস করে? কোরআনের কথা কি ঝুট হয়ে গেল? নাউযুবিল্লাহে-মিন যালেক।
মাস্টার দেখিলেন : ইহার সঙ্গে তর্ক করিয়া জিতিবার কোন সম্ভাবনা নাই। তাই তিনি আর কোন কথা না বলিয়া বাড়িওয়ালা মাতব্বর সাহেবের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : এ গ্রাম থেকে যে চাদার ওয়াদা করেছিলেন, তা আদায় করতেই আমরা এসেছি।
মাতব্বর সাহেব কোন কথা বলিবার আগেই মৌলবী সাহেব যেন কিছুই জানেন না এইভাবে জিজ্ঞেস করিলেন : কিসের চাঁদা?
মাস্টার কোন জবাব দিলেন না। মাতব্বর বলিলেন : সেই যে রোমের সুলতানের যুদ্ধের সাহায্য।
মৌলবী সাহেব আবার চিৎকার করিলেন? কোথায় যুদ্ধ যে তার সাহায্য? কার ঘাড়ে দশটা মাথা যে রোমের সুলতানের বিরুদ্ধে লড়াই করবে? আর লড়াই বাধলেই যে সুলতান হিন্দুস্থানের সাহায্য চাইবেন, একথা কি বিশ্বাসযোগ্য? যে রোমের সুলতানের মাল-মাত্তার কথা কোরআন-হাদীসে বয়ান করা হয়েছে, হিরা, ইয়াকুৎ, লাল, জওয়াহের যার খাযাঞ্চিখানা বোঝাই, তিনি কিনা যুদ্ধের জন্য ভিক্ষা চাইতে এসেছেন এই হিন্দুস্থানে–এই দারুল হরবে! যত সব মতলববাজ লোক টাকা রোজগারের এ-একটা ফন্দি বের করেছে। নইলে রোমের বাদশাহ-সাত মুলুকের যিনি বাদশাহ–তিনি এলেন ভিক্ষা করতে, এটাও কি একটা কথা হল? যান যান, সাব এ গ্রামের সকলেই উম্মি লোক নয়। এখানে ও-সব ঠকামি চলবে না।
মাস্টারের রক্ত গরম হইয়া উঠিল। তিনি মৌলবী সাহেবের দিকে চোখ গরম করিয়া বলিলেন : হয়েছে, আপনার আর বক্তৃতা করতে হবে না।
মাতব্বরের দিকে ফিরিয়া বলিলেন : কই মিয়াসাব চাঁদাটা দিয়ে দিন।
মাতব্বর আমতা আমতা করিয়া বলিলেন : দিব বই কি! তবে কিনা লড়াই-উরাইর কথাই যদি মিথ্যা হয়, তবে আর চাঁদা দিয়ে কি হবে?
মৌলবী সাহেব মাতব্বরের কথার মাঝখানে বলিলেন : মিথ্যা মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা। সব জোয়াচুরি!
মাস্টার আরও উষ্ণ হইয়া বলিলেন : আপনারা যে ওয়াদা করেছিলেন?
মাতব্বর সাহেব কি বলিতে যাইতেছিলেন। মৌলবী সাহেব বাধা দিয়া বলিলেন : লড়াইর কথা যে ডাহা মিথ্যা, তখন ত এরা সে কথা জানত না। এ-রকম ওয়াদা খেলাফে দোষ নাই।