বাধা দিয়ে দেবী বলল, তোমার বাবাকে কে খুন করেছিল? কৈলাস?
খুনিকে কেউ দেখতে পায়নি, নীলকণ্ঠ বলল, আমি সেদিন গোঁসাইজির ঘরে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি, হঠাৎ খবর পেলাম ভিনগাঁয়ের পথে আমার বাবা জখম হয়ে পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম বাবার চোট সাংঘাতিক, বাঁচার আশা নেই। বাবার কাছে শুনলাম ঝোপের আড়াল থেকে কেউ সড়কি ছুঁড়ে মেরেছে। বাবা যখন ডুয়ে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তখন একটা লোক ঝোপ থেকে বেরিয়ে তাবিজটা বাবার গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাবা মরার আগে আমায় গান-বাজনা নিয়েই থাকতে বলেছিল–বলেছিল খুনোখুনি রক্তারক্তির পথ ছেড়ে দিতে। বাবার আদেশ মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আজ এই তাবিজটা দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেছে। মা ঠাকরুন, আপনি বিচার করুন–যে-লোক আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে মানুষ মারে তার কেমন সাজা হওয়া উচিত?
কৈলাসকে জিজ্ঞাসা করলে সত্যি কথা জানা যাবে না, দেবীর ললাটে জাগল কয়েকটা রেখা, কিন্তু শুধু তাবিজটা হাতানোর জন্য তোমার বাবাকে খুন করবে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
বাবার অনেক শত্রু ছিল। হয়ত কখনো কৈলাস বাপের হাতে মার খেয়েছে, অথবা অপমান হয়েছে। হয়তো কোনো শত্রু বাপকে খুন করার জন্য কৈলাসকে টাকা খাইয়েছে–আসল ব্যাপার তো জানার কোনো উপায় নেই। আরও অনেকের মতো কৈলাসও নিশ্চয় তাবিজের ক্ষমতার কথা শুনেছে। বাপকে ঘায়েল করার পর তাবিজ হাতানোর সুযোগটা সে ছেড়ে দেয়নি।
তোমার যুক্তি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, দেবী এবার কৈলাসের মুখের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, কৈলাস, এই তাবিজ তোমার হাতে এল কেমন করে?
ইয়ে-এই-মানে, হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল কৈলাস, এই তাবিজটা তো আমার। অনেকদিন হল পরছি। ছোঁড়াটা যদি এটা ওর বাবার জিনিস বলে দাবি করে, অমনি ওর কথাটা সত্যি হয়ে যাবে? মা, আপনি তো কখনো অবিচার করেন না–বলুন, এটা যে ওর বাবার জিনিস তেমন কোনো প্রমাণ আছে? একরকম দেখতে দুটো তাবিজ কি হয় না?
দেবীর ললাটে অনেকগুলো রেখার সৃষ্টি হল, কৈলাস, তুমি ভালো ফন্দি এঁটেছ। হ্যাঁ, একরকম দেখতে দুটো জিনিস হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস জিনিসটার আসল মালিক বদন সর্দার।
শুধু আপনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমায় সাজা দিলে কি সুবিচার হবে?
জনতা স্তব্ধ। দেবীর মুখে রুদ্ধ রোষের আভাস। শয়তান কৈলাস ভালো যুক্তি দেখিয়েছে সত্যিই তো, ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কারো দণ্ডবিধান করলে তাকে কিছুতেই সুবিচার বলা চলে না।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল নীলকণ্ঠ, এটা যে বাবার তাবিজ এই মুহূর্তে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কর্তামশাইয়ের কাছে গেলে হয়তো প্রমাণ হয়ে যেত তাবিজটার আসল মালিক কে ছিল। কিন্তু সেটাও তো অসম্ভব। তবে কৈলাস, তুমি যে একটু আগে হঠাৎ লাঠি চালিয়ে আমার মাথাটা ফাঁক করে দিচ্ছিলে, সেটা সবাই দেখেছে। মা-ঠাকরুন বল্লম তুলে রুখে না-দিলে আমি এতক্ষণে যমরাজার কাছে পৌঁছে যেতাম। কাউকে সতর্ক না-করে তার মাথায় হঠাৎ লাঠি চালানো কি অপরাধ নয়? মা-ঠাকরুন, অন্তত এই অপরাধের বিচার তো আপনি করতে পারেন?
দেবী কঠিন দৃষ্টিতে কৈলাসের দিকে চাইল, হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তি তো হতেই পারে।
আমি তৈরি ছিলাম না, ও আমায় লাঠি চালিয়ে খুন করতে গিয়েছিল, নীলকণ্ঠ বলল, একবার বলে-কয়ে আমার মাথায় লাঠি মারতে বলুন, দেখি ও কেমন মরদ!
রঙ্গলাল হঠাৎ বলে উঠল, এই কথাটা আমার মনে ধরছে। কৈলাস তো একটু আগেই বলছিল আমার মতো দুবলা মানুষ বলেই দুধের বাচ্চার হাতের মারে মাটি নিয়েছে, তেমন তেমন জোয়ান হলে নাকি ওই বাচ্চাটাকে মাটিতে শুইয়ে দিত। আমি একবার দেখতে চাই আমাদের কৈলাস কেমন জোয়ান। যার হাতের এক ঘায়ে রঙ্গলাল সর্দার মাটিতে ঠিকরে পড়ে, তার পাল্লায় পড়লে কৈলাসের কী হাল হয় সেটাই একবার দেখতে চাই আমি। অবশ্য মায়ের কথাই শেষ কথা। আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা জানিয়ে দিলাম।
সমবেত জনতা সাগ্রহে চিৎকার করে রঙ্গলালের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। এখন শুধু দেবীর অনুমতির অপেক্ষা।
হাত তুলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল দেবী, লাঠির মুখে বিচার আমি কখনো করিনি, তবে সবাই যখন চাইছে
হাতজোড় করে নীলকণ্ঠ বলল, মা ঠাকরুন, এই অনুমতিটা যদি দেন তাহলে আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।
তাই নাকি? দেবীর মুখে কৌতুকের হাসি দেখা দিল, এত সহজে একটা মানুষকে যদি কেনা যায়, তাহলে তো অনুমতি দিতেই হয়। বেশ, সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি যাব না–শুরু হোক লড়াই।
নীলকণ্ঠের হাতে তখনও রঙ্গলালের লাঠিটা ছিল, সেটা তুলে ধরে সে বলল, রঙ্গ সর্দার, তোমার লাঠিটা আমি কিছুক্ষণের জন্য ধার নিলাম। ওহে কৈলাস, মা যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তোমার লাঠিটা মাটি থেকে তুলে নাও, দেখি তুমি কেমন মরদ।
একবার ডান দিকে পাঁয়তারা করল তারপর লাঠিটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁক দিল, তৈরি হয়ে নে নীলু। আবার বলিস না তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ মেরেছে। এবার তোকে বলে-কয়েই মারছি–দেখ যদি সামলাতে পারিস।
এক ঝটকায় গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে প্রতিদ্বন্দীর দিকে ফিরে দাঁড়াল নীলকণ্ঠ, মশালের আলো ঝলমল করে উঠল পেশিবদ্ধ দেহের উপর চাদরের তলায় যে এমন একটি বর্ণচোরা আম লুকিয়ে ছিল সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি, হঠাৎ যেন খাপ থেকে বেরিয়ে এল একটা ধারালো তলোয়ার!