- বইয়ের নামঃ কোথাও কেউ নেই
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল
গেটের কাছে এসে মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল। ডায়ালটা এত ছোট কিছুই দেখা গেল না। আলোতেই দেখা যায় না, আর এখন তো অন্ধকার। রিকশা থেকে নেমেই একবার ঘড়ি দেখেছিল সাড়ে সাত। গলির মোড় থেকে এ পর্যন্ত আসতে খুব বেশি হলে চার মিনিট লেগেছে। কাজেই এখন বাজে সাতটা পঁয়ত্ৰিশ। এমন কিছু রাত হয়নি। তবু মুনার অস্বস্তি লাগছে। কালও ফিরতে রাত হয়েছে। তার মামা শওকত সাহেব একটি কথাও বলেননি। এমন ভাব করেছেন যেন মুনাকে দেখতেই পাননি। আজও সে রকম করবেন।
মুনা গেট খুলে খুব সাবধানে ভেতরে ঢুকল। জায়গাটা প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে আছে। সকালে বাবুকে দুবার বলেছিল ইট বিছিয়ে দিতে। সে দেয়নি। বারান্দায় বাতিও জুলায়নি। পা পিছলে। উল্টে পড়লে শাড়ি নষ্ট হবে। নতুন জামদানী শাড়ি। আজই প্রথম পরা হয়েছে। একবার কাদা লেগে গেলে আর তোলা যাবে না। মুনা পা টিপে টিপে সাবধানে এগুতে লাগল।
মামার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বকুলকে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। সকাল বেলা রাখাল বালক বাঁশি বাজাইতেছিল, বল ইংরেজি কী হবে? বকুল ফোপাচ্ছে। চড়টির খেয়েছে হয়ত। ইদানীং মামার মেজাজ বেশ খারাপ যাচ্ছে। মুনা মনে মনে ট্রানস্লেশনটা করতে চেষ্টা করল। রাখাল বালকের ইংরেজি কী হবে? ফারমার বয়? না অন্য কিছু? অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সে দরজার কড়া নাড়ল–একবার, দুবার, তিনবার। দরজা খুলতে কেউ এগিয়ে আসছে না। মুনা নিচু স্বরে ডাকল বকুল, এই বকুল।
বকুল ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। শওকত সাহেব ধমকে উঠলেন একটা ট্রানস্লেশন করতে একদিন লাগে? বাঁশি বাজাইতেছিল এই ইংরেজি কী বল? বকুল ভয়ে ভয়ে বলল বাবা, মুনা আপা এসেছে। শওকত সাহেব কড়া গলায় বললেন, তোর পড়া তুই পড়। দরজা খোলার লোক আছে। মন থাকে বাইরে, পড়াটা হবে কিভাবে? মাথাতে তো গোবর ছাড়া কিছু নেই। বকুল মাথা নিচু করে ফেলল। তার চোখে পানি আসছে। বাবা দেখে ফেললে আরো রেগে যাবেন। আজেবাজে কথা বলবেন। তিনি একবার রেগে গেলে এমন সব কথা বলেন যে মরে যেতে ইচ্ছা! করে। পরশু বলছিলেন পাতিলের তলার মত মুখ তবু সাজগোজের তো কোনো কমতি দেখি না। একশ টাকার লাগে শুধু পাউডার।
মুনা আবার কড়া নাড়ল। শওকত সাহেব উঁচু গলায় ডাকলেন বাবু, বাবু। বাবু ফ্যাকাশে মুখে ঘরে ঢুকল। সে পড়ে ক্লাস সেভেনে। রোজ সন্ধ্যায়। তার মাথা ধরে বলেই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। শওকত সাহেব বাবুকে দেখেই রেগে উঠলেন। কানে শুনতে পাস না? বাবু ভয়ে ভয়ে তাকাল বকুলের দিকে। শওকত সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন দরজা খুলতে পারিস না গরু কোথাকার।
বাবু দরজা খুলল। শওকত সাহেব মুনার দিকে ফিরেও তাকালেন না। কোনো রকম কারণ ছাড়াই বকুলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসালেন। ব্যাপারটা ঘটল আচমকা। বকুলের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল এক মুহূর্তে। মাথা অনেকখানি ঝাঁকিয়ে সে তার খাতায় কী সব লিখতে চেষ্টা করল। লেখাগুলি সব ঝাপসা। চোখ থেকে পানি উপচে পড়ছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শওকত সাহেব কর্কশ স্বরে বললেন–মাথা তোল, ঢং করিস না। বকুল মাথা তুলল না। তার ছোট্ট হালকা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। মুনা শান্ত স্বরে বলল মামা, এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক না। শওকত সাহেব কিছু বললেন না।
মুনা আরো কিছু বলবে ভেবেছিল, বলল না। নিজেকে সামলে নিয়ে তার শোবার ঘরে ঢুকল। এ বাড়িতে দু’টি মাত্র শোবার ঘর। একটিতে মামা এবং মামি থাকেন, অন্যটিতে থাকে মুনা, বকুল এবং বাবু। মুনার রুমটি অসম্ভব ছোট। তবু সেখানে দু’টি চৌকি ঢোকানো হয়েছে। এক কোণায় একটা আলনা। আলনার পাশে বকুলের পড়ার টেবিল। টেবিলের উল্টোদিকের ফাঁকা জায়গাটা একটা বিশাল কালো রঙের ট্রাঙ্ক। তার উপরে প্যাকিং বক্সের ভেতর শীতের লেপ-কাঁথা। এখানে ঢুকলেই দাম আটকে আসে। পুব দিকের একটা বড় জানালায় আলো-হাওয়া খেলত। শওকত সাহেব পেরেক মেরে সেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছেন। তার ধারণা খোলা জানালায় গুণ্ডা ছেলেরা এসিড-ফ্যাসিড ছুড়বে। অসহ্য গরমের দিনেও সে জানালা আজ আর খোলার উপায় নেই।
মুনা শোবার ঘরে বাতি জ্বালাল। বাবু বাতির দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মুনা বলল, আজও মাথাব্যথা?
হুঁ।
বেশি?
বাবু জবাব দিল না। মুনা বলল, বাবু তুই একটু বাইরে দাঁড়া তো, আমি কাপড় ছাড়ব। বাবু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এক চিলতে বারান্দা। সেখানে একটা ক্যাম্পখাট পাতা আছে। গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এলে এখানে ঘুমুতে দেয়া হয়। বাবু নিঃশব্দে বসিল ক্যাম্পখাটে। মাথাব্যথাটা এখন একটু কমের দিকে। বমি বমি ভাবাটাও কেটে যেতে শুরু করেছে। বাবু লক্ষ্য করেছে মুনা আপা বাসায় এলেই তার মাথাব্যথা কমতে শুরু করে।
মুনা কাপড় বদলে বারান্দায় এসে হাতে-মুখে পানি ঢালল। বাবু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলবে। তবে নিজ থেকে সে কখনো কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করতে হয়। মুনা বলল, বাবু কিছু বলবি?
হুঁ।
বলে ফেল।
বাকের ভাই আজ দুপুরে জিজ্ঞেস করছিল।
কী জিজ্ঞেস করছিল?
তোমার কথা।
পরিষ্কার করে বল। অর্ধেক কথা পেটে রেখে দিলে বুঝব কিভাবে?
বাবু ইতস্তত করতে লাগল। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, বল কী বলল?
বলল, কী রে তোর আপামণি নাকি বিয়ে করছে?
তুই কী বললি?
আমি কিছু বলিনি।
কিছুই বলিসনি?
বাবু ইতস্তত করে বলল, বলেছি, আমি কিছুই জানি না। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, মিথ্যা বললি কেন? সত্যি কথাটা বলতে অসুবিধা কী? সত্যি কথা বললে সে কী তোকে মারত? আবার যদি কোনোদিন জিজ্ঞেস করে, তুই বলবি, হ্যাঁ বিয়ে করবে। বাবু মুখ ফিরিয়ে নিল, যেন সত্যি কথাটা সে স্বীকার করতে চায় না। এই ব্যাপারটার জন্যে সে যেন লজিত। মুনা কড়া গলায় বলল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছিস কেন? তাক আমার দিকে। বাবু তাকাল। মুনা হালকা স্বরে বলল, তোরা সবাই এ রকম ভাব করিাস যেন আমি মস্ত একটা অন্যায় করে ফেলেছি। একটা মেয়ে যদি একটা ছেলেকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করে তাহলে তার মধ্যে লজ্জার কিছুই নেই; তুই যখন বড় হবি তখন তুইও এ রকম পছন্দ করে একটা মেয়েকে বিয়ে করবি।
যাও।
তুই দেখি লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছিস।
মুনা। আপা ভাল হবে না কিন্তু।
তুই মুনা আপা মুনা আপা করিস কেন? শুধু আপা ডাকবি। কিংবা বড় আপা। সঙ্গে আবার মুনা কী জন্যে?
আচ্ছা। আপা, তোমাদের বিয়ে কবে?
সামনের মাসে।
বাবু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে মনে হল বেশ লজ্জা পাচ্ছে। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোরা কেউ আমাকে সহ্য করতে পারিস না। বাবু লজ্জিত স্বরে বলল, কী যে তুমি বল।
ঠিকই বলি। ইট বিছিয়ে রাখতে বলেছিলাম, বিছিয়েছিস? সন্ধ্যার পর বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে বলেছিলাম তাও তো রাখিসনি।
বাবু কী যেন বলতে চাইল, মুনা তা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না। মামা-মামির শোবার ঘরে ঢুকল। এই ঘরটিতে কিছু জায়গা আছে। একটা আলমারি, ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল; তার পাশে বিয়েতে পাওয়া পুরনো আমলের ভারী খাট, একটা কালো রঙের আলনা। তবুও কিছু ফাঁকা জায়গা আছে।
মুনা ঘরে ঢুকতেই তার মামি লতিফা হাত ইশারা করে তাকে কাছে ডাকলেন। তার হাত ইশারা করে ডাকার ভঙ্গি ও তাকানোর ধরন-ধারণ দেখেই টের পাওয়া যায় কিছু একটা ঘটেছে। মুনা বিছানার পাশেই বসল।
মামি শরীর কেমন?
ভালোই।
জ্বর আসেনি তো?
উঁহু।
মুখে উঁহু বললেও বোঝা যাচ্ছে গায়ে জ্বর আছে। চোখ লালচে। কপালের চামড়া শুকিয়ে খড়খড় করছে। চারদিকে অসুস্থ অসুস্থ গন্ধ। লতিফা তার রোগা হাতে মুনার হাত চেপে ধরলেন। গলার স্বর অনেক খানি নিচে নামিয়ে বললেন, তোর মামা যায় নাই।
কেন, যায়নি কেন?
আমি কী করে বলব?
আংটি দেখিয়েছিলো?
হুঁ! আংটি দেখে আরো রাগ করেছে। বাবু সামনে পড়ে গেল তখন। রাগের চোটে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলেছে খাটে। জিব কেটে গেছে বোধ হয়। রক্ত পড়ছিল।
বল কী?
হুঁ।
লতিফা কান্নার মত শব্দ করতে লাগলেন। মুনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করল। আজ দুপুরে লতিফার বড় ভাই মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের ছোট মেয়ের আকিকা। সেই উপলক্ষে এ বাড়ির সবার দাওয়াত ছিল। শওকত সাহেব যেতে রাজি হলেন না। দাওয়াত প্রসঙ্গে অত্যন্ত তেতো ধরনের কিছু কথা বললেন, ফকির খাওয়ানোর বদলে আমাদের খাইয়ে দিচ্ছে। তু বলে ডাকলেই যাব নাকি? পেয়েছি কী আমাকে? আমি ভিখিৱি নাকি? আমি তো যাই না। এ বাড়ির কেউ যদি যায় ঠ্যাং ভেঙে দেব।
লতিফা এই জাতীয় কথায় বিশেষ কান দেননি। তাঁর বড় ভাই তাকে করুণার চোখে দেখে বলেই হয়ত গোপন সঞ্চয় ভেঙে মুনাকে দিয়ে একটা আংটি কিনিয়ে এনেছিলেন। তার আশা ছিল রাগটোগ ভাঙিয়ে দুপুরের দিকে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু পারেননি।
মুনা উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি খাওয়া-দাওয়া কিছু করেছ? লতিফা জবাব দিলেন না। মুনা বলল, কাল অফিসে যাবার সময় আংটি দিয়ে আসব আর বলব তোমার অসুখের জন্যে কেউ আসতে পারেনি। কথাটা তো মিথ্যাও না। লতিফা কী যেন বললেন। মুনা শোনার অপেক্ষা না করে রান্নাঘরে চলে গেল। ভাত চড়াতে হবে। কাজের ছেলেটি চলে যাওয়ায় খুব ঝামেলা হচ্ছে। সারাদিন অফিস করে চুলার পাশে এসে বসতে ইচ্ছা করে না। বড় খারাপ লাগে।
মুনা আপা, বাবা ডাকে।
মুনা দেখল বাবুর মুখ রক্তশূন্য। যেন বড় রকমের কোনো বিপদ আশংকা করছে সে। মুনা স্বাভাবিক ভাবেই বলল, এখন যেতে পারব না। ভাত চড়াচিছে, দেরি হবে।
না, তুমি এখন চল।
কী ব্যাপার?
বাবু কিছু বলল না। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য চেহারা। সে বেশ ভয় পেয়েছে।
শওকত সাহেব চেয়ারে পা তুলে শক্ত হয়ে বসে আছেন। ছোটখাটো মানুষ। মাস তিনেক আগেও স্বাস্থ্য ভাল ছিল। এখন অসম্ভব রোগা হয়ে গেছেন। গালটাল ভেঙে একাকার। চুল উঠতে শুরু করেছে। মাথা ভর্তি চকচকে টাকের আভাস। মেজাজও হয়েছে খারাপ। কথায় কথায় রেগে ওঠেন। গতকাল প্ৰায় বিনা কারণে কাজের ছেলেটিকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।
শওকত সাহেবের চোখে চশমা। এটি একটি বিশেষ ঘটনা। কারণ চশমা তিনি পরেন না। তাঁর ধারণা চশমা পরলেই চোখ খারাপ হতে থাকবে এবং বুড়ো বয়সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যেতে হবে। আজ হঠাৎ চশমা চোখে দেয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। খুব সম্ভব পরিবেশ বদলাতে চাচ্ছেন।
মুনা ঢোকা মাত্র তিনি ইশারায় তাকে বসতে বললেন। মুনা বসল না। শওকত সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, তুই আমার ছেলেমেয়েগুলিকে নষ্ট করছিস।
কীভাবে?
তোর কাছ থেকে সাহস পেয়ে এরা এ রকম করে। সামান্য একটা চড় দিয়েছি, এতেই মেয়ে উঠে গিয়ে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এত বড় সাহস।
সাহস না মামা, লজ্জা।
লজ্জা? লজ্জার কী আছে। এর মধ্যে?
তুমি বুঝবে না মামা।
বুঝবে না কেন?
মুনা চেয়ার টেনে মামার মুখোমুখি বসল। শওকত সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। মুনাকে কেন জানি তিনি একটু ভয় করেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, এতবড় মেয়ের গাযে হাত তোলা ঠিক না। মামা।
এত বড় মেয়ে কোথায় দেখলি তুই?
মেট্রিক দিচ্ছে তিন মাস পর। সে ছোট মেয়ে নাকি?
নিজের মেয়েকে শাসনও করতে পারব না?
না।
না মানে?
না মানে না। আর কিছু বলবে?
তুই এ বাড়ি থেকে যাবি কবে?
বিয়ে হোক তারপর তো যাব। বিয়ের আগে যাই কী করে? নাকি তুমি চাও এখনই চলে যাই?
শওকত সাহেব সিগারেট ধরালেন। মুনা সহজ স্বরে বলল মামা, তুমি আমার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করছ কেন?
কী রকম ব্যবহার করছি?
কথাটথা বল না। যেন আমাকে চিনতেই পার না।
রোজ রাতদুপুরে বাসায় ফিরবি আর আমি তোকে কোলে নিয়ে নাচব? এটা ভদ্রলোকের বাসা না? পাড়ার লোকের কাছে আমার ইজ্জত নেই?
কয়েকটা দিন মামা। তারপর তুমি তোমার ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারবে।
মুনা উঠে দাঁড়াল।
শওকত সাহেব চুপ করে গেলেন। মুনা বলল, তুমি আর কিছু বলবে? তিনি জবাব দিলেন না। মুনা চলে এল রান্নাঘরে। বাথরুমের দরজা খুলে বকুল বের হয়েছে। তার চোখ-মুখ ভেজা। আচার-আচরণ বেশ স্বাভাবিক। সে আবার তার বাবার কাছে পড়তে গেল। যেন কিছুই হয়নি। শওকত সাহেব শুকনো মুখে মেয়েকে ইংরেজি গ্রামার পড়াতে লাগলেন। বকুল এবার ইংরেজিতে তেইশ পেয়েছে। হেড মিসট্রেস প্রগ্রেস রিপোটো লিখে দিয়েছেন ইংরেজের একজন টিচার রাখার জন্যে।
ভাত চড়াবার আগে মুনা দুকাপ চা বানোল। বাবুকে দিয়ে এক কাপ পাঠাল মামার কাছে। অন্য কাপটি রাখল নিজের জন্যে। বড় ক্লান্ত লাগছে। রান্নার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না।
খাওয়া-দাওয়া সারিতে রাত হল। ভাদ্র মাস। বিশ্ৰী গরম। গা ঘামে চটচট করছে। মুনা বকুলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের বারান্দায় মোড়া পেতে বসেছে। কিছু বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শোবার ঘর নরক হয়ে আছে। আজ রাতে ঘুমানো যাবে বলে মনে হয় না। বকুল বলল, আপা তোমরা বাসা পেয়েছে?
না। মালিবাগে একটা ফ্ল্যাট দেখলাম। বেশ ভাল, চার তলায়।. খুব হাওয়া, পনেরশ টাকা চায়।
নিয়ে নাও।
নিয়ে নিলে খাব কী? ও বেতনই পায় পনেরশ।
তুমিও তো পাও।
আমি পাই নয়শ পঁচাত্তর। নয়শ পঁচাত্তরে দুজনের চলবে?
বকুল কিছু বলল না। মুনা হালকা স্বরে বলল, মনে হয় বৃষ্টি হবে। বিজলি চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামলে আজ ভিজব।
তোমার টনসিালের দোষ। টনসিল ফুলে যাবে।
যা ইচ্ছা হোক, আজ ভিজব। সারা রাত যদি বৃষ্টি হয়। সারা রােতই ভিজব। দেখিস তুই।
বকুল অস্পষ্ট স্বরে হাসল। মুনা আপার অনেক পাগলামি আছে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলেই সে ভিজে অসুখ বাধায়। যেন অসুখ বাধাবার জন্যেই ভিজে। বকুল নিচু গলায় বলল, বাকের ভাই তোমার ব্যাপারে খোজখবর করছিল জানো?
জানি।
খুব নাকি হাম্বিতম্বি করছিল?
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, হাম্বিতম্বি মানে? সে হস্তিম্বি করার কে? তার অনুমতি নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে?
বাবুকে নাকি কী সব আজেবাজে কথা বলেছে।
কই বাবু তো আমাকে কিছুই বলেনি। আয় তো যাই জিজ্ঞেস করি।
বকুল উঠল না। তার বসে থাকতে ভালই লাগছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হয়ত সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামবে। এই বাড়ির ছাদে টিনের হওয়ায় বৃষ্টির শব্দ চমৎকার পাওয়া যায়। মুনা বিরক্ত স্বরে ডাকল এই চল, জিজ্ঞেস করে আসি বাবুকে।
বাবু তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আরেকটু বাস। তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলব।
বকুল মজার ঘটনা বলতে শুরু করার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ভদ্র মাসের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। মুনা বকুলকে নিয়ে ভেতরের উঠোনে ভিজতে নামল। বকুল খানিকটা সংকোচ বোধ করছিল কারণ শওকত সাহেব ভেতরের বারান্দায় চশমা পরে বসে আছেন। বকুলের ধারণা তিনি বাজে ধরনের একটা ধমক দেবেন। কিন্তু শওকত সাহেব তেমন কিছুই করলেন না। তার নিজেরও কেন জানি পানিতে নেমে যেতে ইচ্ছা করছিল। এবং এর রকম একটা ইচ্ছার জন্যে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মুনা উঁচু গলায় বাবুকে ডাকল, এই বাবু নেমে আয়। বাবু নামল না। ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল এত ঢং করছিস কেন? আয়।
শওকত সাহেব বাবুকে সুযোগ দেবার জন্যেই হয়ত শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাবু বসেছে উঠোনে। বকুল একবার বলল আপা, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল লাগুক।
তোমার টনসিল।
আমার টনসিালের ভাবনা আমি ভাবব। তোর ভিজতে ইচ্ছা না করলে উঠে যা।
তুমি যতক্ষণ থাকবে আমিও ততক্ষণ থাকব।
আমি থাকব। সারারাত।
আমিও।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। বুপকূপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এক সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। বাবু শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল আমি উঠলাম। আপা! উঠতে গিয়ে সে আবার পিছলে পড়ল। খিলখিল করে হেসে উঠল মুনা। অন্ধকার বৃষ্টির রাতে সেই হাসি এমন চমৎকার শোনাল।
মুনার দেখা নেই
দশটা থেকে এগারটা এই এক ঘণ্টা মামুন মুনার অফিসে বসে রইল। মুনার দেখা নেই। অপরিচিত লোকজনদের মাঝে বসে থাকা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার। সবাই যে অপরিচিত তা নয়, পাল বাবু তাকে চিনতে পেরেছেন এবং বাকি সবার সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিয়েছেন এই যে ইনি মামুন সাহেব। আমাদের মুনা ম্যাডামের সঙ্গে এনার সামনের মাসে বিয়ে হচ্ছে। কেউ কোনো উৎসাহ দেখায়নি। সম্ভবত মুনার সঙ্গে এদের সম্পর্ক ভাল নয়। পাল বাবু চা এনে দিয়েছেন এক কাপ। চায়ে ঘন সর। তার মধ্যে একটা বেশ তাজা কালো রঙের পিঁপড়া ভাসছে। মামুন আঙুল ডুবিয়ে পিঁপড়া সরাল। চায়ে চুমুক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু সময় কাটানোর জন্যে একটা কিছু করা দরকার। মামুন পিঁপড়াটার দিকে তাকিয়ে চায়ে চুমুক দিল। চায়ে অন্য কোনো পোকা-মাকড় ডুবে থাকলে কেউ সে চা খায় না। কিন্তু পিঁপড়া ডুবে থাকলে কেউ আপত্তি করে না। এর কারণ কী? মামুন সিগারেট ধরাল। এক ঘণ্টার মধ্যে এটা হচ্ছে চতুর্থ সিগারেট। বা পাশের ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে তাকাচ্ছে। তিনি হয়ত সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারেন না। মামুন লক্ষ্য করেছে যে কবারই সে সিগারেট ধরিয়েছে এই লোকটি ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। একে নিৰ্ভয়ে সিগারেট অফার করে ভদ্রতা দেখানো যায়। সিগাটে নেবে না, ভদ্রতাও বজায় থাকবে। মামুন হাসিমুখে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়াল। মামুনকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক সিগারেট নিলেন এবং আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এই অফিসে কাজকর্ম একটু বেশি হয় নাকি? সবাই ব্যস্ত। কোণার দিকে একটি মেয়ে একবারও মাথা না তুলে ক্রমাগত টাইপ করে যাচ্ছে। মুনা বলছিল এই অফিসের বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে মেয়েটির কী নাকি একটা বাজে ঝামেলা হয়েছে। বাজে ঝামেলাটা কী সেটা পরিষ্কার করে বলেনি। আগে মেয়েটি বিশ্বাস সাহেবের সঙ্গে বসন্ত, এখন অফিসের সবার সঙ্গে বসে। মামুন আড়াচোখে মেয়েটিকে কয়েকবার দেখল। বাজে ঝামেলাটা কোন পর্যায়ের হতে পারে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল। তেমন কোনো আকর্ষণীয় চেহারা নয়। মোটা ঠোঁট, চাপা নাক।
মামুন সাহেব!
মামুন তাকিয়ে দেখল পাল বাবু এক কপি দৈনিক বাংলা নিয়ে ঢুকেছেন।
বড় সাহেবের ঘর থেকে নিয়ে এলাম। বসে বসে পড়ুন। চা খাবেন নাকি আর এক কাপ?
জি না। ও বোধ হয় আজ আর আসবে না।
আসবে। আসবে। মেয়েরা ইন জেনারেল অফিস কামাই করে না। দেরি করে আসে। সাজতেগুজতে দেরি হয়।
পাল বাবু মামুনের পাশের চেয়ারটায় বসলেন। পানের কৌটা বের করলেন। হাসিমুখে বললেন পান খাবেন?
জি না।
খান একটা, ভাল জর্দা আছে।
মামুন পান নিল। বসে থাকার চেয়ে পান চিবানো ভাল। জর্দাটা কড়া। চট করে মাথায় ধরেছে। মুখ ভর্তি হয়ে গেছে পানের পিকে। ফেলার জায়গা নেই, গিলে ফেলতেও সাহস হচ্ছে না। পাল বাবু। তরল গলায় বললেন বাড়ি না, অফিসই মেয়েরা বেশি পছন্দ করে। বাড়িতে শতেক রকমের কাজ। ওই রান্না করবে, এই এক গ্লাস পানি দাওরে, এই চা বানাওরে। অফিসে এসব ঝামেলা নেই। মামুন কিছু বলল না, জর্দার রস ভর্তি পিক গিলে ফেলায় তার সত্যি সত্যি বমি বমি লাগছে। সে বলল, এগারটা বিশ বাজে। আজ আর বোধ হয় আসবে না।
যদি আসে কিছু বলতে হবে?
বলবেন ছুটির পর আমার মেসে যেতে। খুব দরকার।
বলব।
পাল বাবু তাকে অফিসের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এই লোকটি সম্ভবত ফাঁকিবাজ, শুধু সময় নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এখন আবার এক আমসত্তওয়ালার সঙ্গে দীরদাম করা শুরু করেছে। দর দামের নমুনা দেখেই মনে হচ্ছে কিনবে না। সময় কাটানোর একটা ব্যাপার।
মামুন হাঁটছে ধীরপায়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চারদিকে। তার মনে ক্ষীণ আশা, হঠাৎ দেখবে মুনা নামছে রিকশা থেকে। কিংবা মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে আসছে অফিসের দিকে। সে সিগারেট কেনার অজুহাতে পান বিড়ির দোকানটির সামনে মিনিট দশেক দাঁড়াল। মুনার দেখা পাওয়া গেল না।
আজকের দিনটাই মাটি হয়েছে। তিনদিনের ক্যাজুয়েল লিভের আজ হচ্ছে প্রথম দিন। কথা ছিল মুনা অফিসে এসে কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে সাড়ে এগারটার দিকে বেরুবে। তারপর দুজনে মিলে বাড়ি দেখতে যাবে কল্যাণপুরে। সেখানে নাকি নশ টাকায় চমৎকার একটা দুরুমের ফ্ল্যাট আছে। কথা দেয়া আছে একটার সময় বাড়িওয়ালা চাবি নিয়ে থাকবেন। হাতে এখনো সময় আছে। নিউ পল্টন থেকে মুনাকে উঠিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু মুনার কঠিন নিষেধ যেন কোনোদিন তার মামার বাড়িতে মামুন না যায়। নিষেধ সব সময় মানতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু সে রেগে যাবে। একবার রেগে গেলে তার রাগ ভাঙান মুশকিল। দিনের পর দিন কথা না বলে থাকবে। দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা কথার জবাব দেবে। তাও এক অক্ষরের জবাব। হ্যাঁ কিংবা না।
মামুন গুলিস্তান থেকে মীরপুরের বাসে উঠল। জর্দা দিয়ে পান খাবার জন্যেই তার মাথাটা হালকা লাগছে। বমি বমি ভােব কাটেনি। কিন্তু সেই সঙ্গে বেশ ক্ষিধেও লেগেছে। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ব্যাপার এক সঙ্গে কিভাবে ঘটছে কে জানে। মামুন একটা সিনেমার কাগজ কিনে ফেলল। প্রথম পাতা জুড়ে তিন রঙা বিশালবীক্ষা মেয়ের ছবি। ভালই লাগে দেখতে।
বলা হয়েছিল মেইন রোডের পাশেই দোতলা বাড়ি। আসলে তা নয়, বেশ খানিকটা ভেতরে যেতে হল। বাড়ি দেখে যে কোনো আশাবাদী মানুষেরই আশাভঙ্গ হবে, মামুনেরও হল। অর্ধসমাপ্ত একটি বাড়ি। সামনে চুনসুড়কির পাহাড়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি এমন যে দু’জন মানুষও পাশাপাশি উঠতে পারে না। বাড়িওয়ালা হাজী সাহেবকেও খুব সুবিধার লোক মনে হল না। যেন বাড়ি দেখানোর তার কোনো গরজ নেই। দুপুর একটায় আসতে হওয়ায় তার যে কত বড় ক্ষতি হল সেই কথা তিনি চার-পাঁচ বার বললেন। সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, স্ত্রীকে নিয়ে আসবেন। বলেছিলেন, আনলেন না কেন?
একটা কাজে আটকা পড়ে গেছে। পরে আসবে।
বাববার তো বাড়ি দেখানো যাবে না। নিতে যদি চান আজই বলবেন। নিতে না চাইলেও আজ বলবেন।
দোতলার বারান্দায় উঠেই মামুন বলল, বাড়ি পছন্দ হয়েছে, আমি নেব।
না দেখেই পছন্দ, ভাল করে দেখেন।
মামুন হৃষ্টচিত্তে ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখল। চমৎকার বাড়ি। দু’টি বিশাল ঘর। দু’টি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচিড বাথরুম। রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা স্টোর রুম। চমৎকার একটা বারান্দা। উথালিপাথাল হাওযা খেলছে। হাজী সাহেব বললেন, আপনি আসবেন কবে?
সামনের মাসেব দশ-পনের তারিখেই আসব। কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে যাই আপনাকে?
অ্যাডভান্স দেয়ার দরকার নেই। আর আপনি যদি সামনের মাসের আগেই উঠতে চান বা জিনিসপত্র ব্যাখতে চান রাখবেন। তার জন্যে কোনো বাড়তি ভাড়া দিতে হবে না।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ধন্যবাদের দরকার নেই। বাড়িটার যত্ন করবেন, সাত তারিখের মধ্যে ভাড়া দিবেন ব্যস। দেশ কোথায় আপনার?
ময়মনসিংহ।
ময়মনসিংহের লোক খুব পাজি হয়। আমার বাড়িও ময়মনসিংহ। তবে আপনি প্রফেসর মানুষ। এটাই ভরসার কথা।
মেসে ফিরতে ফিরতে চারটা বেজে গেল। ঘরে ঢুকে দেখে মুনা তার চৌকির ওপর একা একা বসে আছে। তার গলায় নীল রঙের একটা মাফলার। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি করেছে। দেখেই বোঝা যায় গায়ে জুব। মুনা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, সেই কখন থেকে বসে আছি, কোথায় ছিলে? মামুন আজ সারাদিন ভেবেছে মুনার সঙ্গে দেখা হলেই খুব কথা শোনাবে। খুব রাগ করবে। কিন্তু রাগ করা গেল না। মুনার ওপর রাগ করা মুশকিল। মামুন গম্ভীর গলায় বলল, একটার সময় আমাদের এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল না?
যাব কিভাবে? অফিসেই গিয়েছি। দেড়টার সময। আমার জ্বর, গলা ব্যথা। টনসিল!
আবার টনসিল, বল কী?
বৃষ্টিতে ভিজালাম। আমি ভিজালাম, বকুল ভিজল, বাবু ভিজল। ওদের কারো কিছু হয়নি। আমার অবস্থাই কাহিল।
মুনা অসহায়ের মত মুখ করল। মামুন এগিয়ে এসে হাত রাখল। তার গলায়। মতলব ভাল নয়। মুনা বলল, কী অসভ্যতা করছ, হাত সরাও।
না সরাব না।
মামুনের ঘরের দরজা হাট করে খোলা। কখন কে এসে পড়বে। বারান্দায় লোকজন চলাচল করছে। মামুন তার হাত সরিয়ে নিল না। তার হাসি হাসি মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রকম কোনো ইচ্ছাও তার নেই। মামুন নরম স্বরে বলল, কাল তোমার কী প্ল্যান?
কোনো প্ল্যান নেই, কেন?
চল কাল তোমাকে কল্যাণপুরের বাড়িটা দেখিয়ে নিয়ে আসি।
মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। মামুন বলল–দু’একটা ফার্নিচারও কিনব। তুমি সঙ্গে থাকলে ভাল হয়।
কী ফার্নিচার?
বড় দেখে একটা খাট!
এমন অসভ্যের মত কথা বলা কেন?
মামুন শব্দ করে হাসল। চোখ ছোট করে বলল, খাট কেনার মধ্যে অসভ্যতার কী দেখলে তুমি?
ভদ্র হয়ে বাস।
ঠিক আছে বসছি। ভদ্র হয়ে। কাল কখন আসবে বল।
কাল আসতে পারব না, অনেক কাজ আছে। ঘরে কাজের লোক নেই। মামির অসুখ।
কোনো কথা শুনব না। কাল আসতেই হবে। প্লিজ। মুনা। দুপুরে কোনো রেস্টটুরেন্টে বসে খাব। ফাইন হবে।
রেস্টুরেন্টে বসে খাবার মধ্যে ফাইন কী আছে?
আছে, তুমি বুঝবে না। মুনা, আসবে তো?
দেখি।
দেখাদেখি না। আসতেই হবে। সকাল নটার মধ্যে চলে আসবে, পজিটিভলি।
মুনা হ্যাঁ-না কিছু বলল না। এখান থেকে সে যাবে মামির ভাইয়ের বাড়ি। আংটি দিয়ে আসবে। মামুন বলল … কী আশ্চর্য, এখনি উঠছ কেন?
কাজ আছে আমার।
এত কাজের মেয়ে হয়ে উঠলে কবে থেকে?
মুনা কিছু বলবার আগেই মামুন চট করে তার ঠোঁটে চুমু খেল। মুনা সরে গেল মুহূর্তেই। বিরক্ত স্বরে বলল, কেন সব সময় বিরক্ত কর? দরজা খোলা। লোকজন যাওয়া-আসা করছে।
মামুন হাসিমুখে বলল, ঠিক আছে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।
থাক। দরজা বন্ধ করতে হবে না।
তুমি আসছ তো?
দেখি।
কাল নটায়। পজিটিভলি।
মামির ভাই বাসায় ছিলেন না। তার স্ত্রী ছিলেন। ভদ্রমহিলা মুনাকে দেখেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন কাল তোমরা কেউ আসলে না যে, ব্যাপারটা কী?
মামির শরীরটা ভাল না।
তোমাদের শরীর তো ঠিক ছিল, না তোমাদের সবার একসঙ্গে শরীর খারাপ হল?
মুনা কিছু বলল না।
শদেড়েক লোক খেয়েছে। অথচ নিজের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। বাস তুমি। চা-টা কিছু খাবে?
জি না।
এক বাটি গোসাত তুলে রেখেছিলাম তোমাদের জন্যে, যাওয়ার সময় নিয়ে যেয়ো।
মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, গোসতের বাটি নিয়ে যাব কিভাবে?
বাটি নিয়ে যাবে কেন? টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে দেব।
মুনাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হল। এ বাড়িতে অনেক লোকজন থাকে। এদের কাউকেই সে ভাল করে চেনে না। সে যে অনেকক্ষণ ধরে একা একা বাস আছে। এটা কেউ তেমন লক্ষ্যই করছে। না। পাশের কামরায় বেশ কিছু ছেলেমেয়ে ভি সি আর দেখছে। একটি মেয়ে এসে এক ফাঁকে বলে গেল–অমিতাভের ছবি হচ্ছে, দেখবেন? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ছুটে চলে গেছে।
মুনা টিফিন বক্সের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। কাজের ছেলেটি তার সামনে একটা পেপসির বোতল রেখে গেছে। বাড়ির কত্রী টেলিফোন ধরতে গিয়ে আর ফিরছেন না। মুনা ঘড়ি দেখল, সাড়ে ছটা বাজে। আজও বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে
মুনার মনে হল তার জ্বর আসছে।
মুখ তেতো, মাথায় ভোঁতা। একটা যন্ত্রণা। সকালে নাশতা খেতে গিয়ে টের পেল গলাব্যথা আরো বেড়েছে। গলা দিয়ে কিছুই নামছে না। মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল–বকুল, একটু গরম পানি করে দে, গোসল করব। বকুল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।
নাশতা শেষ করে যা। বলা মাত্রই দৌড়াতে হবে নাকি?
আমার নাশতা খাওয়া হয়ে গেছে।
বকুল রান্নাঘরে ঢুকে গেল। মুনা বলল, মামা কোথায় রে বাবু?
সকালবেলা কোথায় যেন গেছেন।
নাস্তা খেয়ে গেছেন?
না। বকুল বলেছিল চা খেয়ে যেতে।
মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, বকুল বকুল করছিস কেন? কতবার বলেছি আপা বলতে।
আপাই তো বলি।
আবার মিথ্যা কথা? চড় খাবি।
গার্গল করেও লাভ হল না। পানি বেশি গরম ছিল, মাঝখান থেকে জিব পুড়ে গেল; বকুল বলল, তোমার চোখ লাল হয়ে আছে। শুয়ে থাক গিয়ে। মুনা কিছু বলল না। বকুল ইতস্তত করে বলল, ফজলু ভাইদের বাসায় একটু যার আপা? মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কেন?
যেতে বলেছিল আমাকে। খুব নাকি দরকার।
কী দরকার?
জানি নাকি, শুধু বলেছেন খুব জরুরি। বোধ হয় ভাবীর সঙ্গে আবার ঝগড়া-টগড়া হয়েছে।
সেটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, তুই কেন যাবি?
বকুল আর কিছু বলল না। ফজলুর রহমান সাহেব গলির ওপাশেই থাকেন। মাস ছয়েক হল এসেছেন। খুব সামাজিক ধরনের মানুষ। এসেই আশপাশের সব বাড়িতে গেছেন। বিয়ের সময় নিজে এসে দাওয়াত করে গেছেন। মুনার নিজের ধারণা লোকটি গায়ে-পড়া ধরনের। প্রথম আলাপেই খালা, খালু, আপামণি ডাকাডাকি তার ভাল লাগেনি। বকুলের সঙ্গে ভদ্রলোকের স্ত্রীর খুব খাতির। এটাও মুনার ভাল লাগেনি। অবিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে একজন বিবাহিত মহিলার এত ভাব থাকা ঠিক না। বকুল আবার বলল, আপা যাব?
মুনা জবাব দিল না। ব্যাপারটা সে এড়িয়ে যেতে চায়। কিন্তু বকুলের চোখে-মুখে আগ্রহ ঝলমল করছে। মুনা বলল, কী নিয়ে তোদের এত গল্প?
বকুল মাথা নিচু করে হাসতে লাগল। তার গালে লাল আভা। নিশ্চয়ই নিষিদ্ধ গল্পগুজব হয়। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েরা সুযোগ পেলেই অন্য মেয়েদের সঙ্গে বাতের অন্তরঙ্গতার গল্প করতে চায়। মুনা এ ধরনের অনেক গল্প শুনেছে। শুনতে ভালই লেগেছে। বকুলেরও নিশ্চয়ই লাগে।
আপা যাব?
না, রান্নাবান্না করতে হবে না? আজ আমি বাইরে যাব; ফিরতে সন্ধ্যা হবে।
জ্বর নিয়ে কোথায় যাবে?
মুনা জবাব দিল না। বকুল বলল–বেশিক্ষণ থাকব না আপা। যাব আর আসব। যাই?
ঠিক আছে যা।
লতিফা বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দশটার দিকে। আজ তাঁর শরীর বেশ ভাল; দশ-বারো দিনের মধ্যে আজ এই প্রথম ঘর ছেড়ে বের হলেন। বাবু ছুটে গিয়ে মাকে বসার জন্যে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। তিনি অবশ্যি বসলেন না। দেয়াল ধরে ধরে বসার ঘরে চলে এলেন। বাবু বলল, বেশি হাঁটাহঁটি করবে না মা। লতিফা বললেন, তোর বাবা কোথায়?
জানি না।
বকুল, বকুল কোথায় গেল?
ফজলু ভাইদের বাসায় গেছে। ডেকে নিয়ে আসব?
না ডাকতে হবে না।
তিনি একটি বেতের চেয়ারে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন।
মুনাকে বল তো আমাকে এক কাপ আদা চা দিতে।
মুনা আপার জ্বর, শুয়ে আছে। আমি বানিয়ে দেই?
না থাক। হাতটাত পুড়বি।
না হাত পুড়ব না।
বাবু খুব উৎসাহ নিয়ে চা বানাতে গেল। লতিফা এলেন তার পেছনে পেছনে। বিরক্ত স্বরে বললেন, ইস কী অবস্থা রান্নাঘরের।
তোমাকে একটা চেয়ার এনে দেব মা? বসবে?
না চেয়ার লাগবে না।
লতিফা নোংরা মেঝেতেই পা ছড়িয়ে বসলেন। বাবু বলল, মা দেখ তো লিকার কড়া হয়ে গেছে?
না ঠিকই আছে। মুনার জ্বর কী খুব বেশি?
হুঁ। ঐ দিন বৃষ্টিতে সবাই ভিজলাম তো। কারো কিছু হল না, মুনা আপার টনসিল ফুলে গেল।
চায়ে চুমুক দিয়েই লতিফার বমি বমি ভাব হল। শরীরটা গেছে। তিনি সাবধানে উঠে দাঁড়ালেন। তার পা কাঁপছে।
চা খাবে না?
উঁহু তুই খেয়ে ফেল। শরীরটা খারাপ লাগছে। শুয়ে থাকব। মুনাকে বল তো একটু আসতে।
তিনি নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। তার মনে হল আর কোনোদিন এ ঘর থেকে বেরুতে পারবেন না। বাকি জীবনটা এ ঘরেই কাটাতে হবে। আজকাল প্রায়ই তার এ রকম মনে হয়। মুনা এসে দেখল। লতিফা কাঁদছেন। সে না দেখার ভান করে সহজ ভাবেই বলল ডেকেছিলে মামি?
তুই একটু বোস আমার পাশে।
মুনা বসল। লতিফা কী বলবেন মনে করতে পারলেন না। কি একটা যেন বলতে চেয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরে এ রকম হচ্ছে। কিছুই মনে থাকছে না।
কি জন্যে ডেকেছিলে মামি?
এমনি এমনি ডাকলাম! শরীরটা বড় খারাপ।
তোমার নিজের জন্যেই তোমার শরীর ঠিক হচ্ছে না মামি। দুপুর একটার আগে কিছু মুখে দাও না। রুগীদের আরো বেশি করে খেতে হয়।
ইচ্ছা করে না, বমি আসে।
আসলে আসুক।
লতিফা ক্লান্ত স্বরে বললেন, বকুলের একটা বিয়ের ব্যবস্থা কর। তোর মামাকে বল। মুনা অবাক হয়ে বলল, কেন? ওর কী বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? কী যে তুমি বল।
বয়স খুব কমও তো না। নভেম্বর মাসে পনেরো হবে।
পনেরো বছর বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে হয় নাকি?
বিয়ে দিলেই বিয়ে হয়। আমার বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে।
তুমি বলছি তেত্ৰিশ বছর আগের কথা।
লতিফা ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমার শরীর ভাল না। তুইও চলে যাচ্ছিস। আমার সাহস হয় না। তোর মামাকে বল ঐ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। তুই বললে শুনবে।
কোন ছেলেটার সঙ্গে?
বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল যে। গ্রিন রোডে ফার্মেসি আছে ছেলেটার। মামা মিডফোর্ডের ডাক্তার।
বাঁটু বাবাজীর কথা বলছি? তিন ফুট বামুন?
লতিফা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, বকুলের বিয়ে প্রসঙ্গে আমি কারো সঙ্গে কোনো কথাটথা বলতে পারব না। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে খুব কম আছে। ওর বিয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
লতিফা মৃদু স্বরে বললেন, আমি বেশি দিন বাঁচব না।
মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, না বাঁচলে, তাই বলে বাচ্চা মেয়েকে ধরে বিয়ে দিতে হবে? এই সব কী?
তুই চলে গেলে ঝামেলা হবে।
কী কামেলা হবে?
ছেলেরা চিঠিফিটি লেখে।
চিঠি তো লিখবেই। সুন্দরী মেয়েদের এইসব সহ্য করতে হয়। এসব কিছু না।
মুনা উঠে চলে এল। বকুল গিয়েছে দেড় ঘণ্টা আগে, এখনো ফেরার নাম নেই। কখন রান্না হবে কে জানে। মামা বাজার নিয়ে ফিরবেন। কিনা তাও বোঝা যাচ্ছে না। মুনা একবার ভাবল ভাতটা চড়িয়ে দেয়। কিন্তু আগুনের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর চেপে আসছে।
বাবু গম্ভীর হয়ে বসার ঘরে বসে আছে। মুনাকে ঢুকতে দেখে সে কী মনে করে হাসল। মুনা বলল, ছুটির দিনে ঘরে বসে আছিস কেন? বাইরে খেলাধুলা করগে।
বাবু আবার মুখ টিপে হাসল।
হাসছিস কেন?
এমনি।
আমার জ্বর কী-না দেখ তো।
হুঁ তোমার জ্বর।
গায়ে হাত না দিয়েই টের পেয়ে গেলি?
বাবু লজ্জিত মুখে কাছে এগিয়ে এল। তার হাত বেশ ঠাণ্ডা; তার মানে বেশ জ্বর গায়ে। বাসায় কোনো থার্মোমিটার নেই। জ্বর কত বোঝার উপায় নেই।
মুনা। আপা তুমি শুয়ে থাক, আমি মাথার চুল টেনে দেব।
চুল টানতে হবে না, তুই বকুলকে ডেকে নিয়ে আয়। এক্ষুণি যা। এতক্ষণ কেউ অন্যের বাড়িতে থাকে?
বাবু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। মুনা। আপার কাজ করতে তার এত ভাল লাগে। সারাক্ষণই ইচ্ছা! করে কিছু একটা করে মুনা আপনাকে খুশি করতে।
বকুলই রান্না করল। ভাত ডাল এবং ইলিশ মাছের ঝোল। শওকত সাহেব ভর দুপুরে বাজার নিয়ে এসেছেন। রান্না করতে তাই দুটো বেজে গেল। শওকত সাহেব দুবার এসে খোঁজখবর নিলেন তরকারি নেমেছে কিনা। বকুল তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে সব কিছুই কেমন এলোমেলো করে ফেলতে লাগল।
খেতে বসে শওকত সাহেব কঠিন কঠিন কিছু কথা বললেন। এত বড় মেয়ে সামান্য একটা তরকারি রাধতে পারে না কেন এই নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। গলা টেনে টেনে বললেন, লবণ কী সস্তা হয়েছে? আধাসের লবণ দিয়ে দিয়েছিস তরকারিতে। সবটা তুই একা খেয়ে শেষ করবি।
বকুলের লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করল। শওকত সাহেব প্লেট ঠেলে দিয়ে হাত ধুতে গেলেন। বকুল বাবুকে ফিসফিস করে বলল, লবণ খুব বেশি হয়ে গেছে?
শুধু মাছটা খা। ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খা।
তুমি খাবে না?
না।
বকুল সত্যি সত্যি কিছু মুখে দিল না। নিজের জন্যে তার খুব কষ্টও হল না। এটা তার অভ্যেস আছে। প্রায়ই সে রাগ করে না খেয়ে থাকে।
মুনা দু’টা প্যারাসিটামল খেয়েছে। মাথা ধরা। তবু কমেনি। আরো যেন বেড়েই যাচ্ছে। আজ কোথাও বেরুনোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। মামুন অপেক্ষা করে করে মহা বিরক্ত হবে। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মামুনের সঙ্গে যে কবার কোথাও যাবার প্রোগ্রাম করা হয়েছে সে কবারই এ রকম ঝামেলা।
মুনা আপা।
কী।
কিছু খাবে না?
না। মামিকে খেতে দিয়েছিস?
মা ভাত খাবে না। রুটি বানিয়ে দিতে বলছে।
বানিয়ে দে। আটাটা গরম পানিতে সেদ্ধ করে নিবি। নয় তো রুটি নরম হবে না।
ঘরে আটা নেই।
বাবুকে দোকানে যেতে বল।
বাবু যেন কোথায় গেছে। আমি গিয়ে নিয়ে আসব?
না, তুই কি যাবি। মামাকে গিয়ে বল।
আমি বলতে পারব না। তুমি বল।
ঠিক আছে, আমিই বলব।
শওকত সাহেব কোনো রকম বিরক্তি প্রকাশ না করেই আটা আনতে গেলেন। বকুল বলল আপা, টিনা ভাবীর বাচ্চা হবে। মুনা বলল, এখনই বাচ্চা হবে কি, সেদিনই না বিয়ে হল।
সেদিন না। ছয় মাস এগার দিন হয়েছে।
তোর দেখি একেবারে দিন-তারিখ মুখস্থ। এত খাতির কেন তোর সাথে?
খাতির কোথায় দেখলে? আর খাতির হওয়াট ও কি খারাপ?
বেশি হওয়াটা খারাপ। বেশি কোনোটাই ভাল না।
কেন?
মুনা প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। সে লক্ষ্য করল বকুল আজকাল বেশ কঠিন ভঙ্গিতে কথা বলছে। এটা ভাল লক্ষণ। মেয়েদের এত পুতুপুতু থাকলে চলে না।
বকুল বলল মুনা। আপা, ওরা শুক্রবারে কাবলিওয়ালা দেখতে যাবে। ইন্ডিয়ান অ্যাম্বেসিব অডিটোরিয়ামে। আমাকেও সাথে যেতে বলছে। আমার জন্যেও টিকিট এনেছে।
ওরা স্বামী-স্ত্রী দেখতে যাবে, তাদের মধ্যে তুই যাবি কেন?
আমি তো যেতে চাই না। ওরা জোর করছে। আপা যাব?
শুক্রবার আগে আসুক তারপর দেখা যাবে।
তুমি আগে থেকে বাবাকে বলে রাখবে, নয়ত শেষে রাজি হবে না। তুমি আজ আর কোথাও যাবে না?
না।
বকুল মৃদু হেসে বলল, মামুন ভাই অপেক্ষা করে থাকবে। মুনা কিছু বলল না। বকুল তরল গলায় বলল, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তিনি তোমাকে দেখার জন্যে আজ এখানে চলে আসবেন।
বকুল লক্ষ্য করল। মুনা এই প্রসঙ্গটি পছন্দ করছে না। সে কিছুটা বিব্রত বোধ করল। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তোমার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। শুয়ে থাক না।
সন্ধ্যার দিকে মুনার জ্বর খুবই বাড়ল। শওকত সাহেব একটা থার্মোমিটার কিনে আনলেন। জ্বর একশ তিনের কাছাকাছি। তিনি থমথমে স্বরে বললেন, বৃষ্টির মধ্যে ঝাপঝাঁপি, জ্বর তো হবেই। শরীর বেশি খারাপ লাগছে? মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল, কনের কাছে বকবক করলে খারাপ লাগে। তুমি যাও তো ঘর থেকে। শওকত সাহেব নড়লেন না। পাশেই বসে রইলেন।
বাতি নিভিয়ে দাও মামা, চোখে লাগছে।
বাবু বাতি নিভিযে বারান্দায় একা একা বসে রইল। বকুল রাতের রান্না চড়িয়েছে। একা একা রান্নাঘরে তার একটু ভয় লাগছে। সে বেশ কয়েকবার বাবুকে ডেকেছে। বাবু আসেনি। লতিফার পানির তৃষ্ণা হয়েছিল। ক্ষীণ কণ্ঠে কয়েকবার পানির কথা বললেন, কেউ শুনল না। তিনি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেন না। চোখ জড়িয়ে আসে।
মুনা বলল, মামা তুমি আমার পাশে এ রকম বসে থাকবে না তো! অন্য ঘরে যাও।
তোর কোনো অসুবিধা করছি নাকি?
করছি। ভোস-ভোস করে সিগারেট টানছ। গন্ধে থাকতে পারছি না।
শওকত সাহেব আধাখাওয়া সিগারেটটা ফেলে দিলেন। মৃদু স্বরে বললেন, গ্রিন ফার্মেসিতে বলে এসেছি, ডাক্তার এলেই পাঠিয়ে দেবে।
মুনা পাশ ফিরল।
গায়ের ওপর কথাটা দিয়ে রাখ না। ফেলে দিচ্ছিস কেন?
গরম লাগছে তাই ফেলে দিচ্ছি। ঠাণ্ডা লাগলে আবার দেব। তুমি ও-ঘরে গিয়ে বস না মামা।
শওকত সাহেব উঠলেন না। গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বললেন, তোর বাবা তোর বিয়ের জন্যে আলাদা করে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। নয়। হাজার টাকা। সেই আমলে নয়। হাজার টাকা অনেক টাকা। বুঝলি মুনা, টাকাটা সংসারে খরচ হয়ে গেছে।
খরচ হয়েছে ভাল হয়েছে। এখন চুপ কর।
আমি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ছয় হাজার টাকা তুলে রেখেছি। তুই নিয়ে নিস। বাকিটা পরে দেবী! ভাগে ভাগে দেব।
মামা আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয়ার দরকার নেই! তোমরা না দেখলে আমার যাওয়ার জায়গা ছিল? তুমি আমাকে যে আদর কর তার দশ ভাগের এক ভাগ নিজের ছেলেমেদের কোনোদিন করেছ? আর আজ তুমি টাকার কথা তুললে? ছিঃ ছিঃ!
না মানে…।
মাঝে মাঝে তুমি এমন সব আচরণ করা যে মেজাজ ঠিক থাকে না।
কী করলাম?
এই যে দুপুরে খেতে বসে চেঁচামেচিটা করলে। বেচারী বকুল কেঁদে কেটে অস্থির। ভাত খায়নি দুপুরে।
ননীর পুতুল একেকজন। ধমক দিলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে হয় এদের।
তুমি যাও তো মামা, ওকে দু’একটা মিষ্টি কথা বল। আমার কানের কাছে বসে ঘ্যান ঘ্যান করবে না;
শওকত সাহেব উঠে পড়লেন। বারান্দায় গিয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন বাবুকে বই নিয়ে বসার কথাটা বলে দিতে হবে?
বাবু শুকনো মুখে বই আনতে গেল।
অংক বই খাতা নিয়ে আয়। গায়ে তো কারো বাতাস লাগে না? শক্ত মার দিলে হুঁশি হবে। তার আগে হুঁশি হবে না। শয়তানের ঝাড়। দুপুরবেলা হুঁট করে কোথায় গিয়েছিলি?
বাবু কোনো জবাব দিল না। অংক খাতা ও বই নিয়ে বসল। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। বাবাকে সে খুব ভয় পায়। শওকত সাহেব রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। বকুল বাবাকে দেখে জড়সড় হয়ে গেল।
রান্নাঘরটাকে একেবারে দেখি পায়খানা বানিয়ে রেখেছিস; গুছিয়ে-টুছিয়ে নিতে পারিস না। কোনোটাই তো দেখি হয় না। পড়াশুনা না কাজকর্মও না। কারবিটা কি? কারো বাড়িতে ঝিগিরিও তো পাবি না। এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যা।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, দুধ চা?
একটা হলেই হল। তোর মা কিছু খেয়েছিল দুপুরে?
রুটি খেয়েছিল।
মুনার জন্যে হালকা করে বার্লি বানা। লেবুর রস দিয়ে লবণ দিয়ে ভাল করে বানা। বার্লি আছে না ঘরে?
আছে।
শওকত সাহেব চলে গেলেন। তখন বকুলের মনে পড়ল ঘরে বার্লি নেই। এই কথাটা এখন বাবাকে বলবে কে? রাগে নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে। সে বাবার জন্যে চায়ের পানি চড়াল। ঘরটা একটু গোছাতে চেষ্টা করল। তার আবারও কেন জানি ভয় ভয় করছে। রান্নাঘরে একা থাকলেই একটা ভয়ের গল্প মনে হয়। ঐ যে রান্নাঘরে একটি বউ একা একা মাছ ভাজছিল। হঠাৎ জানালা দিয়ে একটা রোগাকালো হাত বেরিয়ে এল। নাকি সুরে একজন কে বলল, মাছ ভাজা দে। তাছাড়া আজ দুপুরেও ভাবী পাঁচ-ছটা ভূতের গল্প বলেছে। তার কোন খালার নাকি জ্বীনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই জ্বীন সুন্দর সুন্দর সব জিনিসপত্র এনে দিত। একবার নাকি একটা ফুলের মালা এনে দিয়েছিল যার সবগুলি ফুল কুচকুচে কালো রঙের। দিনের বেলা গল্পগুলি শুনে হাসি এসেছে কিন্তু এখন আবার কেমন ভয় ভয় লাগছে। সবগুলি গল্পই মনে হচ্ছে সত্যি। ভাবী বলছিল–তুমি যা সুন্দর, সাবধানে থাকবে ভাই। ভর দুপুরে আর সন্ধ্যায় এলোচুলে থাকবে না। বকুল অবাক হয়ে বলেছিল, এলোচুলে থাকলে কি হয়?
খারাপ বাতাস লাগে।
খারাপ বাতাস লাগে মানে?
জীন-ভূতের আছর হয়। সুন্দরী মেয়েদের ওপর জ্বীনের আছর হওয়া খুব খারাপ। সারা রাত এরা ঘুমুতে দেয় না। বিরক্ত করে।
কিভাবে বিরক্ত করে?
এখন বুঝবে না। বিয়ে হওয়ার পর বুঝবে।
এই বলে ভাবী মুখ টিপে টিপে হাসল। রহস্যময় হাসি।
কি বকুল শুনতে চাও কিভাবে বিরক্ত করে?
না শুনতে চাই না।
অবশ্যি অনেকে সেটা পছন্দও করে। আমার ঐ খালার কথা বলছিলাম না সেই খালা জ্বীন না এলে কেমন অস্থির হয়ে যেত কাপড়-টাপড় খুলে ফেলে বিশ্ৰী কাণ্ড করত।
এখন তিনি কোথায় থাকেন?
চাঁদপুরে। এখন আর এইসব নেই। খুব ভাল মানুষ। এক ওভারশিয়ারের সাথে বিয়ে হয়েছে। তিন ছেলেমেয়ে। জ্বীন-ভূতের কথা আর কিছুই মনে নেই।
ডাক্তার এল সাড়ে নটার সময়। তার সঙ্গে এল বাকের। বাকেরের গায়ে চকচকে লাল রঙের একটা শার্ট। শার্টের পকেটে ফাইভ ফাইভের প্যাকেট উঁচু হয়ে আছে। তার মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। যেন অসুখের ব্যাপারে দারুণ চিন্তিত। বাকেরকে দেখে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। তাকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে–এ বাড়িতে যেন কোনোদিন না আসে। তবু কেমন নির্লিজের মত এসেছে। আর বাবুর কাণ্ড, একেবারে শোবার ঘরে নিয়ে আসতে হবে। সে তো অব ডাক্তার না। মুনা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের বলল, খুব ফুঁ হচ্ছে চারদিকে। কাহিল অবস্থা। জ্বর বেশি। নাকি তোমার?
মুনা জবাব দিল না। তাকাল ডাক্তারের দিকে। এই ডাক্তার এ পাড়ায় নতুন এসেছে। দেখে মনে হয় নাইন-টেনে পড়ে। স্টেথিসকোপ হাতে নিয়ে এমন ভাবে চারদিক দেখেছে যেন যন্ত্রটি নিয়ে সে কি করবে। মনস্থির করতে পারছে না। কিংবা হয়ত স্টেথিসকোপ বুকে বসাতে সাহস করছে না। মুনা বলল, আমার গলাটা দেখুন। ঢোঁক গিলতে পারি না।
ডাক্তার সাহেব গলায় ছোট্ট একটা টর্চের আলো ফেললেন। বাকের বলল, দেখি আমি টর্চ ধরছি, আপনি দেখুন ভাল করে। ডাক্তারের কিছু বলার আগেই সে টর্চ নিয়ে নিল। মুনা বলল, আপনি বসার ঘর গিয়ে বসুন না। ওঁকে দেখতে দিন।
উনিই তো দেখছেন। আমি দেখছি নাকি? আমি কি ডাক্তার? হা হা হা।
ডাক্তার সাহেব বললেন, কানে ব্যথা আছে?
জি না।
আপনার কি আগেও টনসিালের প্রবলেম ছিল?
জি।
বাকের একগাল হেসে বলল, একেবারে ছেলেবেলা থেকে মুনার এই প্রবলেম। বৃষ্টির একটা ফোঁটা পড়ল, ওমনি তার গলা ফুলে গেল। পিকিউলিয়ার।
ডাক্তার সাহেব নিচু স্বরে বললেন, একটা থ্রোট কালচার করা দরকার।
বাকের বলল, দরকার হলে করবেন। একবার কেন দশবার করবেন। হা হা হা।
মুনা, বলল, আপনারা বসার ঘরে গিয়ে বসুন। আমি চা দিতে বলি।
বাকের বলল, চা-টা কিছু লাগবে না। রোগীর বাসায় কোনো খাওয়া-দাওয়া করা ঠিক না। কি বলেন ডাক্তার সাহেব? ডাক্তার কিছু বললেন না। বকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে একটু পানি দেবেন? হাত ধোব।
এই প্রথম বোধ হয় বয়স্ক একজন কেউ বকুলকে আপনি বলল। বকুলের গাল টকটকে লাল হয়ে গেল মুহুর্তেই। সে অনেকখানি মাথা নিচু করে ফেলল। বাকের বলল, সাবান আর পানি নিয়ে আস বকুল। পরিষ্কার দেখে একটা টাওয়ালও আনবে।
মুনু বলল, বাকের ভাই, আপনি বসার ঘরে চলে যান। মামার সঙ্গে কথা বলুন। এই ঘরটা গরম।
ফ্যানটা ছাড় না।
ফ্যান নষ্ট। কয়েল নষ্ট হয়ে গেছে।
তাই নাকি! আচ্ছা সকাল বেলা লোক পাঠিয়ে দেব খুলে নিয়ে যাবে। মদীনাকে বললেই এক ঘণ্টার মধ্যে ঠিক করে দেবে।
ঝামেলা করতে হবে না।
কোনো ঝামেলা না। মদীনা শালাকে একটা ধমক দিলেই হবে।
বাকের বেশ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করল। চকচকে লাইটার বের করে অনেক সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল।
ডাক্তার সাহেব বারান্দায় হাত ধুতে গিয়ে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম আপনার? উত্তর দিতে বকুলের খুব লজ্জা লাগতে লাগল। তার মনে হল যেন এর উত্তর দেয়াটা ঠিক না। সে অস্পষ্ট স্বরে বলল, বকুল। আমাকে তুমি করে বলবেন। আমি স্কুলে পড়ি।
তাই নাকি! কোন স্কুলে?
মডেল গার্লস স্কুলে?
মেট্রিক দেবে এবার?
জি।
সায়েন্স?
জি না।
সায়েন্স পড়লে ভাল করতে। ডাক্তার হতে পারতে। ডাক্তারের খুব দরকার আমাদের। মেয়ে ডাক্তারের দরকার আরো বেশি।
বকুল কিছু বলল না। জগে করে পানি ঢেলে দিতে লাগল। ডাক্তার সাহেবের হাত পরিষ্কার করতে অনেক সময় লাগল। যাবার সময় তিনি ভিজিট ও নিলেন না। কেন ভিজিট নিচ্ছেন না সেই কারণটিও স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। হড়বড় করে যা বললেন তার মানে হল–সবার কাছ থেকে তিনি ভিজিট নেন না। ডাক্তারি তো কোনো ব্যবসা না। ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটাকে দেখা ঠিক না…ইত্যাদি।
তারা বেশ কিছু সময় বসার ঘরে বসে রইল। ডাক্তার সাহেব বললেন তিনি চা খান না, তবুও শেষ পর্যন্ত চা খেলেন। বাকের বলল ঘরে কাজের লোক নেই এটা তাকে বললেই একটা ব্যবস্থা করতে পারত। বাবুকে সে ছোটখাটো একটা ধমকও দিল, রোজ দেখা হয়, আমাকে বললেই পারতি।
পরদিন সকালে মদন মিস্ত্রীর লোকজন এসে ফ্যান খুলে নিয়ে গেল। বলে গেল বিকেলের মধ্যে দিয়ে যাবে। তার কিছুক্ষণ পর এলেন ডাক্তার সাহেব। তিনি নাকি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রুগী কেমন আছে দেখে যেতে এসেছেন। বকুল তাকে চা বানিয়ে খাওয়াল। চাটা তার কাছে খুব চমৎকার লাগল। কোন দোকান থেকে চায়ের পাতা কেনা হয়েছে তা জানতে চাইলেন। বকুল চোখ-মুখ লাল করে তার সামনে বসে রইল। ডাক্তার সাহেব যাবার আগে বললেন, বকুল যাই। বকুলের কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু সে বলতে পারল না।
পাল বাবু অবাক হয়ে বললেন
পাল বাবু অবাক হয়ে বললেন, এ কি অবস্থা ম্যাডাম!
মুনা বলল, ক’দিন খুব ভুগলাম। টনসিলাইটিস। আপনার ভাল তো?
ভালই। তিন দিনের জ্বরে কারো এমন অবস্থা হয় জানতাম না। আপনার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। গেছো পেত্নীর মত লাগছে। রাগ করলেন নাকি?
মুনা রাগ করল না, তবে বিরক্ত হল। পাল বাবু বড় বিরক্ত করতে পারেন। মেয়েদের টেবিল বেছে বেছে বসবেন, সামান্য জিনিস নিয়ে বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেবেন।
আপনার ভাবী স্বামী এসেছিলেন। তারও দেখলাম মুখ শুকনো। সিক লিভের দরখাস্ত করেছেন শুনে মুখ আরো শুকিয়ে গেল। উনি গিয়েছিলেন নাকি আপনাদের ওখানে?
না যায়নি।
সেটাই ভাল, ঘন ঘন শ্বশুর বাড়ি যাওয়া ভাল না। এই আমাকে দেখেন, প্রতি বৃহস্পতিবার শ্বশুরবাড়ি যাই–শুক্র, শনি দু’দিন থাকি। এতে লাভটা কী হয়েছে জানেন? শ্বশুরবাড়িতে প্রেস্টিজ আমার কিছুই নেই।
মুনা শুকনো গলায় বলল, তাই নাকি?
হ্যাঁ। গত সপ্তাহে শ্বশুরমশাই আমাকে বললেন, বাবা রেশনটা একটু তুলে দিতে পারবে? চিন্তা করেন অবস্থা, জামাইকে বলছে রেশন তুলতে।
মুনা সবচেয়ে উপরের ফাইলটা খুলল। দশটা এখনো বাজেনি। অফিস ফাঁকা। ইলিয়াস সাহেব আর আখতারুজ্জামান সাহেব এসেছেন। ওদের টেবিল ঘরের শেষ প্রান্তে। মুনার সঙ্গে তাদের তেমন আলাপ নেই। তবু আখতারুজ্জামান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন–শরীর ঠিক হয়েছে? খুব কাহিল হয়েছে দেখি। মুনা বলল, আপনার ভাল ছিলেন সবাই? বলেই মনে হল কথাটা খুব মেয়েলি হয়ে গেল। তিন দিন পর এসেই আপনার ভাল ছিলেন সবাই জিজ্ঞেস করাটা আদিখ্যেতার মত।
কী হয়েছিল। আপনার, ফু?
মুনা জবাব দেবার আগেই পাল বাবু বললেন ম্যাডামের হয়েছে টনসিলের ব্যারাম, হা হা হা।
কিছু কিছু লোক থাকেন এমন বিশ্ৰী স্বভাবের। পাল বাবুর মত আরেকজন আছে সিদ্দিক সাহেব। সব সময় গলা নিচু করে এমন ভাবে কথা বলবেন যেন মনে হয় ষড়যন্ত্র করছেন। ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাবেন এবং কাঠিগুলো টেবিলের ওপর ফেলে রেখে যাবেন। অসহ্য।
বড় সাহেবের বেয়ারা মুনির এসে বলল, আপনারে স্যার ডাকে। পাল বাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, অফিস তো এখন শুরু হয় নাই, এখনই কিসের ডাকাডাকি? যাও, বল দশ মিনিট পরে আসবে। না না ম্যাডাম, ডাকা মাত্রই ছুটে যাওয়া ঠিক না। বসেন চা খান, তারপর যান। চায়ের কথা বলে এসেছি।
চা তো আমি বেশি খাই না।
আরে খান না। খাওয়ার পর একটা পান খান, মাইল্ড একটা জর্দা আছে। মুর্শিদাবাদ থেকে আমার এক মামা-শ্বশুর পাঠিয়েছেন।
মুনাদের অফিসের বড় সাহেব লোকটি ছোটখাটো। বালক বালক চেহারা কিন্তু লোকটি কাজ জানে এবং কাজ করতেও পারে। কাজ জানা সমস্ত মানুষদের মত সেও অফিসের খুব অপ্রিয়। তার নামে নানান রকম গুজব ও আছে। টিফিন টাইমে সে নাকি মেয়েদের ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। এবং কাজের প্রশংসা করবার ছলে পিঠ চাপরায় কিংবা হাত ধরে। একবার নাকি ডিসপ্যাস সেশনের নিনু খানের ব্লাউজ খুলে ফেলেছিল। বিরাট কেলেংকারি। মুনির সেই সময় চা নিয়ে ঢুকেছিল বলে তার চাকরি যায় যায় অবস্থা।
মুনার সঙ্গে এরকম কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি। তবু যতবারই সে বড় সাহেবের ঘরে ঢোকে ততবারই দারুণ অস্বস্তি ভোগ করে। আজও সে ঢুকাল ভয়ে ভয়ে। ইসরাইল সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, খুব কাহিল হয়েছে তো?
জি স্যার। টনসিল ফুলে গিয়েছিল।
ভালমত চিকিৎসা করান। কেটে ফেলে দিন। নয়ত রেগুলার অফিস কামাই হবে। গত তিন মাসে আপনি নয় দিন ছিলেন সিক লিভে। ফাইলটা সেদিন দেখলাম।
মুনা কিছু বলল না। ইসরাইল সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, বসুন দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মুনা আড়ষ্ট হয়ে সামনের একটি চেয়ারে বসল। ইসরাইল সাহেব থেমে থেমে বললেন, না দেখে চিঠিতে সই করেন কেন? টাইপিস্টরা ভুল করেই। কাজেই এদের টাইপ করা প্রতিটি শব্দ চেক করতে হয়। বিশেষ করে ফিগারগুলো
মুনা ঠিক বুঝতে পারল না ঝামেলাটা কি। বড় রকমের কিছু হওয়ার কথা না। সে চিঠিপত্র দেখেই সই করে।
এনকো কর্পোরেশনের কাছে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে এগার হাজার নয়শ ছত্ৰিশ। একচুয়েল ফিগার হবে এগার হাজার ছয়শ ছত্রিশ। কমন মিসটেক, ছয় হয়েছে নয়। আমি জাস্ট আউট অব কিউরিওসিটি ফাইলটা আনিয়ে দেখি এই ব্যাপার।
মুনা সাবধানে একটি নিঃশ্বাস ফেলল। ইসরাইল সাহেব বললেন, এর জন্যেই ডেকেছিলাম, যান।
স্নামালিকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম সালাম। শুনুন, আপনার শরীর বেশি খারাপ মনে হচ্ছে। আজ দিনটা বরং রেস্ট দিন। ঘণ্টা খানিক থেকে ফাইলপত্র অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান।
মুনা থ্যাংক ইউ বলতে গিয়েও বলতে পারল না। এই লোকটির সামনে সে ঠিক সহজ হতে পারে না। মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার যাই।
ঠিক আছে যান। তারেক সাহেব থাকলে একটু পাঠিয়ে দেবেন।
জি আচ্ছা স্যার।
ঘণ্টা খানিক থেকে চলে যেতে বললেও মুনা লাঞ্চ ব্রেক পর্যন্ত থাকল। জমে থাকা কাজগুলি নিখুঁতভাবে করতে চেষ্টা করল। মাথা হালকা হয়ে আছে। খুব মন দিয়ে কিছু পড়তে গেলেই আপনাতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়। তারেক একবার বলেই ফেলল, ঘুমাচ্ছেন নাকি আপা?
নারে ভাই। মাথা ঘুরছে।
বড় সাহেব যেতে বলেছে চলে যান না। জরুরি কাজ যা আছে দিয়ে যান আমার টেবিলে, অবসর পেলে করে দেব।
কাজ তেমন নেই কিছু।
তাহলে শুধু শুধু বসে আছেন কেন? মুনিরকে বলেন একটা রিকশা ডেকে দেবে।
মুনা মুনিরকে ডাকল। অফিসের আশপাশে রিকশা পাওয়া যায় না। মোড় থেকে ডেকে আনতে হয়। এ রকম এক অন্ধগলিতে এত বড় অফিস কোম্পানি কেন বানাল কে জানে। অফিস থাকবে মতিঝিলে।
তারেক, যাই ভাই।
ঠিক আছে আপা যান। কাল কথা হবে। বাসার দিকেই তো যাবেন?
হুঁ।
মুনা অফিসের এই একটিমাত্র ছেলেকে নাম ধরে ডাকে এবং তুমি বলে। যদিও সে নিশ্চিত তারেক বয়সে বড়ই হবে। তুমি ডাকার ব্যাপারটিও কিভাবে শুরু হয়েছে মুনা নিজেও জানে না। প্রায় অবাক হয়েই এক’দিন সে লক্ষ্য করেছে তারেক আপনি বললেও সে নিজে বলছে তুমি। মামুনের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা এত পাকাপাকি না থাকলে অফিসে এই নিয়ে একটা আলোচনা হত। পাল বাবু সস্তা ধরনের কিছু রসিকতা করারও চেষ্টা করতেন।
রিকশায় উঠেই মুনার মনে হল বাসায় এই সময় ফিরে কোনো লাভ নেই। দুপুরে ঘুমুলেই সারাটা বিকাল এবং সারাটা সন্ধ্যা তার খুব খারাপ কাটে। রাতের বেলা ঘুম আসে না। রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। মুনা রিকশাওয়ালাকে বলল মগবাজারের দিকে যেতে। এ সময় মামুনের মেসে থাকার কথা নয়। তাকে পাওয়া যাবে না এটা প্রায় একশ ভাগ সত্যি। তবু একবার দেখে গেলে ক্ষতি নেই কোনো। না পাওয়া গেলে কলেজে গিয়ে খোঁজ নেয়া যাবে। কোন বইতে যেন পড়েছিল পুরুষরা সবচে খুশি হয় যখন তারা মেয়েদের কাছ থেকে সিগারেট উপহার পায়। মামুনকে সে আগেও কয়েকবার সিগারেট দিয়েছে, কোনোলারই মনে হয়নি সে খুব খুশি হয়েছে। এমন ভাবে প্যাকেট খুলেছে যেন এটা তার প্রাপ্য। আজও তাই করবে।
মামুন মেসে ছিল না। তার পাশের রুমের আলম সাহেব বললেন, উনি তো টেলিগ্রাম পেয়ে দেশে গেছেন। তার এক বোন মারা গেছে, আপনি কিছু জানেন না?
না।
অনেক দিন ধরে অসুস্থ ছিল। উনার সবচে ছোট বোন।
মুনা একটু বিব্রত বোধ করতে লাগল। এত বড় একটা ব্যাপার মামুন তাকে কোনোদিন বলেনি। তার একটি ছোট বোন আছে তা সে জানত কিন্তু এই বোনের এমন একটা অসুখ তা মামুন কোনোদিন বলেনি।
বসবেন আপনি?
জি না, বসব না। ও দেশে গেছে কবে?
পরশু সকালে। টেলিগ্রাম এসেছে তার আগের রাত্রে। ট্রেন ছিল না, যেতে পারেনি।
কবে আসবে কিছু বলে গেছে?
জি না কিছু বলেনি। আজ-কালের মধ্যে এসে পড়বে। মরবার পর তো আর কিছু করার থাকে না, শুধু শুধু ঘরে বসে থেকে হয়টা কি?
মুনা ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে রিকশায় উঠল। কড়া রোদ এসেছে। চকচক করছে চারদিক। তাকালেই মাথা ধরে যায়। মুনা হ্যান্ড ব্যাগ খুলে সানগ্লাস বের করল। রোদটা খুব চোখে লাগছে।
সানগ্নাস ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। চোখে পরিবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক কেমন মেঘলা হয়ে যায়। একটু যেন মন খারাপ ও লাগে। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হতে লাগল–মামুন কখনো তার নিজের ভাই-বোন-মা-বাবার কথা নিয়ে তার সঙ্গে গল্প করেনি। এমন একজন অসুস্থ বোন ছিল তার এটাও পর্যন্ত বলেনি। না বলার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। মুনার খুব জানতে ইচ্ছে হল এই বোনটি কি ওর খুব আদরের ছিল? নামই বা কি তার? নাম মামুন বলেছিল, খুবই কমন একটা নাম বলে এখন মনে পড়ছে না। রোকেয়া বা সাবিহা জাতীয়।
মুনার মনে হল একটা চিঠি লিখে রেখে এলে ভাল হত। অল্প কয়েক কথার সুন্দর একটা চিঠি–
হঠাৎ করে তোমার বোনের মৃত্যু সংবাদ শুনলাম।
সে যে অসুস্থ তা তো তুমি কখনো বলনি।…
চিঠিটা ঠিক হচ্ছে না। অভিযোগের ভঙ্গি এসে পড়েছে। কেন অসুস্থতার খবর আগে বলা হয়নি। সেই নিয়ে অভিযোগ। পুরোপুরি মেয়েলি অভিযান। মৃত্যুর মত এত বড় একটা ব্যাপারের পাশে মেয়েলি অভিযোগ একেবারেই মিশ খায় না।
মুনা মনে মনে চিঠিটা অন্যভাবে লিখতে চেষ্টা করল। এবং এক সময় খুবই অবাক হয়ে লক্ষ্য করল। তার চোখ ভিজে উঠেছে। কেন মামুন তাকে আগে বলল না?
বকুলদের স্কুলে কোনোদিনই পুরোপুরি ক্লাস হয় না। প্রায় দিনই সেভেনথ পিরিয়ডে ছুটি হয়ে যায়। আজ সেভেনথ পিরিয়ডে রেহানা। আপার ক্লাস। এই ক্লাসটা হবে না ধরেই নেয়া যায়। কারণ রেহানা আপার অনেক রকম যোগাযোগ আছে। সে সব নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। মেয়েদের টিফিন এবং কোঅপারেটিভদের দোকান তিনিই চালান। গার্লস গাইড এবং সবুজ সেবিকার ব্যাপারগুলিও তাকে দেখতে হয়। নিয়মিত ক্লাস নেবার সময় কোথায় তার! কিন্তু আজ তাকে ক্লাসে আসতে দেখা গেল। তাঁর মুখ গম্ভীর, হাতে প্রকাণ্ড একটা গ্লোব। তিনি ক্লাসে ঢুকেই ব্ল্যাকবোর্ডে বড় বড় করে লিখলেন, জলবায়ু। জলবায়ু তিনি গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে পড়িয়েছেন, কেউ অবশ্যি তাকে সেটা বলল না।
ফরিদা তুই বল জলবায়ু মানে কি?
ফরিদা ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ছাত্রীদের মোট সংখ্যা গুণতে লাগলেন। সব মিলিয়ে আটত্রিশ জন ছাত্রী উপস্থিত। তিনি মুখ অন্ধকার করে বললেন, আটত্রিশ জন প্রেজেন্ট, কিন্তু টিফিন এনেছিস একচল্লিশটা, কেন?
ক্লাস ক্যাপ্টেন অনিমার মুখ শুকিয়ে গেল।
বল একচল্লিশটা টিফিন কেন?
অনিমা আমতা আমতা করতে লাগল।
চুরি শিখে গেছিস এই বয়সে, বাবা কি করে?
অনিমার মুখে কথা জড়িয়ে গেল। রেহানা আপা আরো গম্ভীর হয়ে বললেন, জলবায়ু কাকে বলে বল দেখি? এটি একটি কাঁচা কাজ হয়ে গেল। কারণ অনিমা খুবই ভাল ছাত্রী। জলবায়ু কি এটি সে তার চেয়েও অনেক গুছিয়ে বলল।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু কী বল?
আপা এটা এখনো পড়ানো হয়নি?
সব কিছু পড়িয়ে দিতে হবে? নিজে নিজে পড়া যায় না? তুই আজ ক্লাস শেষে আমার সঙ্গে দেখা করবি। বসছিস কি জন্যে? বসতে বলেছি? দাঁড়িয়ে থােক। ফরিদা তুইও দাঁড়িয়ে থাক।
তিনি প্ৰায় দশ মিনিট ধরে মেয়েদের মিথ্যা বলার অভ্যাস এবং চুরি করার অভ্যাসের ওপর বক্তৃতা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। ক্লাসে টু শব্দও হল না। তিনি কপালের ঘাম মুছে ক্লান্ত স্বরে বললেন, বকুল ক্লাসে এসেছে?
সবচে পেছনের বেঞ্চ থেকে বকুল ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল।
তোকে গতকাল টিফিন পিরিয়ডে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম, করেছিলি?
আপা, আমি গিয়েছিলাম, আপনি হেড আপার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
কথা কি আমি সারা জীবন ধরে বলেছিলাম? পাঁচ মিনিট দাঁড়ানো গেল না?
বকুল প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু সে কিছু বলল না।
আজ ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে আসবি। বাংলাদেশের জলবায়ু কি রকম বল?
বকুল ঘামতে লাগল।
বইয়ের সঙ্গে কারো কোনো সম্পর্ক নেই? মৌসুমী বায়ু কাকে বলে? কেউ জানো না? কে জানে? হাত তোল।
শুধু অনিতা হাত তুলল। তিনি অনিমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। বিমর্ষ মুখে বাংলাদেশের জলবায়ুর কথা বলতে লাগলেন। গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহেও একই কথা বলেছিলেন। তার মনে নেই। ক্লাসের মেয়েরা ঘণ্টা পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। ঘণ্টা আর পড়ছে না। তাদের মনে হল তারা অনন্তকাল ধরে ক্লাসে বসে আছে।
বকুল টিচার্স কমন রুমে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল। রেহানা আপা হাত নেড়ে নেড়ে অংক আপার সঙ্গে কথা বলছে। তিনি ইশারায় বকুলকে অপেক্ষা করতে বললেন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। অন্য ছাত্রীরা সব চলে যাচ্ছে। স্কুল ঘর দ্রুত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আজ তার একা একা যেতে হবে। বকুল কিছুক্ষণ পর পর্দা ফাঁকা করে আবার উঁকি দিল। রেহানা আপা এবং অংক আপা দুজনেই খুব হাসছে। অংক আপা কখনো হাসেন না। তার হাসি দেখে বকুল খুবই অবাক হল। ংক আপা বকুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। রেহানা আপার মুখ অবশ্যি এখনো হাসি হাসি। তিনি চটের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
বকুল তুই আয়, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দেব। তারপর রিকশা নিয়ে চলে যাবি। কাল যখন স্কুলে আসবি তখন মনে করে তোর একটা ছবি নিয়ে আসবি।
বকুল অবাক হয়ে তাকাল। রেহানা আপা বললেন, শাড়ি পরা ভাল ছবি আছে?
জি না আপা।
তাহলে এক কাজ কর, আজ বিকেলেই একটা তুলিয়ে ফেল। চুলগুলি সামনে ছড়িয়ে দিবি। যাতে কত লম্বা সেটা টের পাওয়া যায়।
বকুল ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, জি আচ্ছা।
খুব দরকার, ভুলে যাবি না যেন আবার।
বকুল কথা বলল না। রেহানা। আপা বললেন, তুই তো সবার বড়, তাই না?
জি আপা।
ক ভাই-বোন তোরা?
এক ভাই এক বোন।
বাহ ছোট ফ্যামিলি তো। এক’দিন যাব তোদের বাসায়। তোর মাকে বলিস।
জি আচ্ছা।
পড়াশুনা করছিস তো ঠিকমত?
করছি।
লাস্ট বেঞ্চে বসিস কেন সব সময়? ফাস্ট, বেঞ্চে বসবি। মনে থাকবে?
থাকবে।
রেহানা। আপা রাস্তার মোড়ে বকুলের জন্যে একটা রিকশা ঠিক করে, রিকশাওয়ালার হাতে দুটাকা ভাড়া দিয়ে দিলেন।
বকুল হুঁড় তুলে দে। হুঁড না তুলে মেয়েদের রিকশা করে যাওয়া আমার পছন্দ না।
বকুল সারা পথ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মেয়েদের কাছে রেহানা। আপার ছবি চাওয়া কোনো নতুন ব্যাপার না। তিনি উপরের ক্লাসের সুন্দরী মেয়েদের কাছে (বেছে বেছে, সবার কাছে না) ছবি চান এবং তার দিন দশেকের মধ্যে সেই সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। আজেবাজে বিয়ে নয়, ভাল বিয়ে।
রেহানা। আপার ধারণা ক্লাস টেনে পড়া মেয়েরা হচ্ছে বিয়েব পাত্রী হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ। এই সময়টা মেয়েরা ছেলেদের সম্পর্কে প্রথম কৌতূহলী হয় এবং প্রেম করবার জন্যে ছোক ছোক করে। বিয়ের পর হাতের কাছে স্বামীকে পায় বলেই প্রথম প্ৰেম হয়। স্বামীর সঙ্গে। সে প্ৰেম দীর্ঘস্থায়ী হয়। ক্লাস টেনে পড়া মেয়েদের সম্পর্কে তার নানা রকম থিওরি আছে। এই সব থিওরি তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন।
শওকত সাহেব বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বকুলকে রিকশা থেকে নামতে দেখে অবাক হলেন। তাকে রিকশা ভাড়া দেয়া হয় না। স্কুল এত দূরে নয় যে, রিকশা করে যাওয়া-আসা করতে হবে। সংসারে কোনো কাঁচা পয়সা নেই। বকুল বোধ হয় মুনার কাছ থেকে নিচ্ছে। মুনা এই সংসারে নানান ভাবে টাকা খরচ করে। এটা তার পছন্দ নয়। কোন বইতে যেন পড়েছিলেন, যে সংসারে মেয়েদের রোজগারের টাকা খরচ হয় সেই সংসারের কোনো আয়উন্নতি হয় না।
বকুল ঘরে ঢুকলা খুব ভয়ে ভয়ে। তার ধারণা ছিল বাবা অকারণেই তাকে একটা ধমক দেবে। দেরি হল কেন? রিকশা করে এসেছিস কেন? কিন্তু শওকত সাহেব তেমন কিছুই করলেন না। মেয়ের দিকে ভালমত তাকালেনও না।
চারদিক ফাঁকা ফাঁকা। মুনা আপা বা বাবু কেউ নেই। সে মার ঘরে উঁকি দিল। লতিফা হাত ইশারায় তাকে আসতে বললেন। তার চোখ জুলজুল করছে, যেন বড় একটা কিছু ঘটেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, তোর বাবার কি হয়েছে?
কেন? হবে। আবার কি?
মিষ্টি কিনে এনেছে।
কোথায় মিষ্টি?
ঐ দেখা ড্রেসিং টেবিলের উপর।
বকুল অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি এক প্যাকেট মিষ্টি। সে বলল, তুমি জিজ্ঞেস করণি কিছু?
না, তুই জিজ্ঞেস করে আয়।
মুনা। আপা আসুক, সে জিজ্ঞেস করবে।
লতিফা নিজের মনে বললেন, আজ তোর বাবা চেঁচামেচি রাগারগি কিছু করেনি। অফিস থেকে এসেছেও সকাল সকাল।
বকুল বলল, আজ তোমার শরীর কেমন?
ভালই। যা তোর বাবাকে চা বানিয়ে দে। ঘরে মুড়ি আছে। পেয়াজ-মরিচ দিয়ে মেখে দে।
বকুল বারান্দায় গেল। বাবা আগের মতই হাঁটাহাঁটি করছেন। কারো জন্যে অপেক্ষা করছেন বোধ হয়। বকুল ক্ষীণ স্বরে ডাকল বাবা।
কি?
চা আনি?
আন।
চায়ের সঙ্গে কিছু খাবে? ঘরে মুড়ি আছে। মেখে দেই।
দে। বেশি করে ঝাল দিবি। আর শোন, মিষ্টি এনেছি। তোর মাকে দে। তুইও খা।
বকুল ভয়ে ভয়ে বলল, মিষ্টি কি জন্যে?
এমনি আনলাম।
শওকত সাহেব সিগারেট ধরিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে কাশতে লাগলেন। মিষ্টি এনে তিনি যেন একটা অপরাধ করে ফেলেছেন।
বকুল ছবির কথা তুলাল রাতের খাবার সময়। অন্য সবার খাওয়া হয়ে গেছে। মুনা এবং সে বসেছে। শেষে। এ-কথা সে-কথার পর বকুল খুব স্বাভাবিক ভাবে রেহানা আপার ছবি-চাওয়ার কথা বলল। মুনা খাওয়া বন্ধ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কেন, ছবি দিয়ে কি হবে?
আমি কি করে জানব। আপা?
তুই কিছু জিজ্ঞেস করিাসনি?
না।
ঠিক কি কি কথা হয়েছে তোর সাথে?
বকুল কথাগুলো গুছিয়ে বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিকমত বলতে পারল না।
মুনা বলল, শাড়ি পরা ছবি চেয়েছে?
হ্যাঁ।
তোকে বিয়ে দিতে চায় নাকি?
বকুল কোনো জবাব দিল না।
কি, কথা বলছিস না কেন?
বোধ হয়। আপা এ রকম মেয়েদের কাছে ছবি চায়। তারপর ওদের বিয়ে হয়ে যায়। শায়লার এ রকম বিয়ে হল। ডাল নাও আপা। ডাল নিয়ে খাও।
খেতে ইচ্ছা করছে না।
মুনা প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়াল।
তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ। আপা?
তোর ওপর বাগ করব কেন? তুই আয়, তোব সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
বাবু বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। পড়ার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে গল্পের বই। কিন্তু গল্পের বই না। বাবা যে কোনো সময় ঘরে ঢুকতে পারেন রাত দশটার আগে হাতে গল্পের বই দেখলে সৰ্ব্বনাশ হয়ে যাবে।
মুনা ঘরে ঢুকতেই বাবু হাসিমুখে বলল, ফ্যান দেখেছি আপা? নতুন ফ্যান। বাকের ভাই বলে গেছেন। পুরানটা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত এটা থাকবে। মুনা বিরক্ত চোখে ফ্যান দেখল। কিছু বলল না। বাবু বলল, আরাম করে ঘুমানো যাবে, ঠিক না। আপা?
হুঁ। তোর মাথাব্যথা হয়নি?
না!
বিকেলে খেলতে গিয়েছিলি?
হুঁ।
এখন থেকে রোজ যাবি। নিয়মিত খেলাধুলা করলে মাথাব্যথা থাকবে না। ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, যাবি।
আচ্ছা যাব।
যা তো আমার জন্যে একটা পান নিয়ে আয়। কেমন যেন বমি বমি আসছে।
বাবু পান আনতে গিয়ে আর ফিরল না। শওকত সাহেব তাকে আটকে ফেললেন। ইংরেজি বানান ধরতে লাগলেন। মসকুইটো, এমব্রয়ডারি, ইনকুইজিটিভনেস এই জাতীয় বানান। বাবু তালগোল পাকিয়ে ফেলতে লাগল। যেটাতেই সে আটকাচ্ছে সেটাই ডিকশনারি খুঁজে বের করতে হচ্ছে। এবং বিশবার করে সশব্দে বানান করতে হচ্ছে।
রান্নাঘর গুছিয়ে বকুল যখন শোবার ঘরে উঁকি দিল তখন রাত দশটা বাজে। মুনা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। বকুল মৃদু স্বরে ডাকল, আপা।
কি?
ঘুমোচ্ছ নাকি?
না।
কি যেন বলবে বলেছিলে আমাকে?
মুনা একটা লম্বা বক্তৃতা তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু বক্তৃতাটা দেয়া গেল না। সে শুধু বলল, তুই রেহানা আপাকে বলিস, আমার বাবা ছবি দিতে রাজি হলেন না। বকুল বলল, এটা কেমন করে বলব?
অন্য কথাগুলি যেমন করে বলিস ঠিক তেমনি বলবি।
আপা দারুণ রাগ করবে।
রাগ করলে করবে। রাগ কমানোর জন্যে বাচ্চা একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে? তুই কী বুঝিাস বিয়ের?
আপা আস্তে। বাবা শুনবে।
মাস্টারদের দায়িত্ব হচ্ছে পড়ানো। বিয়ে দেয়া না। যখন সময় হবে তখন আপনাতেই বিয়ে হবে। এই নিয়ে তোর এত চিন্তা কিসের?
আমি আবার কখন চিন্তা করলাম?
ছবি দেয়ার ব্যাপারে তোর এত আগ্রহ কেন?
তুমি বুঝতে পারছি না। আপা খুব রাগ করবে।
রাগ করলে করবে। যা আমার জন্যে একটা পান বানিয়ে আন। বাবুকে পাঠিয়েছিলাম, সে আর ফিরবে না। আটকে গেছে।
আপা নতুন ফ্যান দেখেছ?
দেখলাম।
বাকের ভাই নাকি এসে অনেকক্ষণ ছিল। অনেক গল্পটল্প করল।
কার সঙ্গে করল?
বাবার সঙ্গে। বাবা আজ সকাল ফিরেছিলেন। বাকের ভাই এসেই গল্প জুড়ে দিল। কালপরশুর মধ্যে একটা কাজের লোকও এনে দেবে বলেছে।
এনে দিলে তো ভালই। তুই যা, পানটা নিয়ে আয়।
আমার সাহসে কুলাচ্ছে না। বাবার সামনে দিয়ে যেতে হবে। তুমি নিজেই যাও না আপা।
মুনা উঠে বসল। বকুল বলল, মিষ্টি কি জন্যে আনলেন এটাও একটু জিজ্ঞেস করবে। জানতে ইচ্ছা করছে।
জানতে ইচ্ছে হলে তুই নিজেই জিজ্ঞেস কর।
আমার এত সাহস নেই।
বসার ঘর থেকে শওকত সাহেব ডাকলেন, বকুল বকুল। বকুল মুখ অন্ধকার করে উঠে গেল।
শওকত সাহেবের সামনে বাবু কানে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ লাল। বকুল এসে ঢুকতেই শওকত সাহেব বললেন, পাটিগণিত নিয়ে আয়।
টেলিগ্রামে লেখা ছিল
টেলিগ্রামে লেখা ছিল–ফরিদা সিরিয়াস, কাম ইমমিডিয়েটলি। মামুন ধরেই নিয়েছিল। সে মারা গেছে। আলম সাহেবকে যাবার বেলায় বলেও গেল, বোনটা মারা গেছে বোধহয়। মৃত্যুর খবরে লোকজন সব সময়ই হকচাকিয়ে যায়, আলম সাহেবও হকচাকিয়ে গেলেন।
কীভাবে মারা গেছে? সে সব কিছু লেখেনি অসুস্থ ছিল। ওর মৃত্যুটা আমাদের সবার জন্যেই রিলিফ। বড় কষ্টে छ्लि।
তাই নাকি? জি। বাড়িতে গেলে ঘুমাতে পারতাম না। চিৎকার করত। সারা রাত। চোখে দেখা যায় না। এমন কষ্ট।
হয়েছে কি? স্নায়ুর মধ্যে কি যেন হয়েছে। চিকিৎসা নেই কোনো। ব্যথা কমানোর ইনজেকশন দিয়েও কিছু হয় না। বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কথা খুবই সত্যি। মামুন গত এক বছরে একবার মাত্র গিয়েছিল এক’দিন থেকে পালিয়ে এসেছে। সারারাত উঠোনে মোড়া পেতে কাটিয়েছে। ভয়ংকর একটা রাত। এখন বাড়িতে গেলে সে রকম কোন ঝামেলা হবে না। ঘুমানো যাবে না।
তাদের গ্রামের বাড়িটি সুন্দর। পাকা দালান। পেছনের পুকুরটি বুজে গেছে। এটা ঠিকঠাক করতে হবে। মুনাকে নিয়ে গ্রামে আসতে হবে। সে কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। গ্রাম সম্পর্কে তার ধারণা খুবই খারাপ। ধারণা পাল্টে যাবে।
মামুন বাড়ি পৌঁছল সন্ধ্যার পর। চারদিকে কেমন অস্বাভাবিক নীরবতা। বসার ঘরের বারান্দায় হারিকেন জ্বলিয়ে কয়েকজন মুরব্বি বসে আছেন। মামুনকে দেখে তাঁরা এগিয়ে এলেন। মৃদু স্বরে কি সব যেন বলতে লাগলেন। কিছুই বোঝা গেল না। মামুনের বড় চাচা বললেন, তোমার লাগি অপেক্ষা। তুমি না। আওনে দম বাইর হইতাছে না। যাও ভিতরের বাড়িতে যাও। ভইনের সাথে কথা কও;
ফরিদা বড় খাটটায় পড়ে আছে। ঘরে দুটো হারিকেন। একটা কুপী। অনেক মেয়েদের ভিড়। মামুন ঘরে ঢুকতেই ফরিদার গোঙানি থেমে গেল। সে পরিষ্কার গলায় ডাকল, ভাইজান!
মামুন অসাহায়ের মত তাকাল চারদিকে।
ভাইজান বড় কষ্ট।
হারিকেনেব আলোয় চকচক করছে ফরিদার চোখ। চোখগুলো এখনো এত সুন্দর?
ফরিদার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। মামুনের কি উচিত কাছে গিয়ে বসা? হাতে হাত রাখা। কিন্তু জন্তুর মত শব্দ যে করছে সে কি ফরিদা? একজন কে হারিকেন উঁচু করে ধরলেন। ভালমত দেখাতে চান বোধ হয়। কী আছে দেখানোর?
ফরিদা শ্বাস টানার ফাঁকে ফাঁকে বলল, গত বছর আপনি আসছিলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনো কথা বললেন না। আমার মনে কষ্ট হয়েছে।
এমন কোনো মনের কষ্ট আছে যা এই তীব্র শারীরিক যন্ত্রণাকে স্পর্শ করতে পারে? মামুন ঘোলাটে চোখে তাকাতে লাগল চারদিকে।
একজন বুড়ো মহিলা বললেন, পশ্চিম দিকে মুখ কইরা দেন। কলমা তৈয়াব পড়েন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসুলাল্লাহ।
শ্বাসকষ্ট সন্ধ্যা রাত্ৰিতে শুরু হলেও ফরিদা মারা গেল পরদিন সকাল নটায়। একেকবার কষ্টটা কমে যায়, সে চোখ বড় বড় করে তাকায় সবার দিকে। সেই তাকানো দেখেই মনে হয়। সে বুঝতে পারছে সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং তার জন্যে সে খুশি। সে অপেক্ষা করছে আগ্রহ নিয়ে।
মামুন বাড়ি যাবার সময় ঠিক করে রেখেছিল দু’দিন থাকবে। কলেজ থেকে ছুটি নেয়া হয়নি। কাউকে কিছু বলে যাওয়া হয়নি। দুদিনের বেশি থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সে থাকল এগারো দিন। বারো দিনের মাথায় ঢাকায় ফিরে এল। তার মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অনিদ্রাজনিত কারণে চোখ লাল। আলম সাহেব তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। মামুন শুকনো হাসি হেসে বলল, সব ভাল তো?
ভাল, সবই ভাল। আপনি কেমন?
ভালই। চিঠিপত্র আছে কিছু?
জিনা, চিঠিপত্র নেই।
মুনা খোঁজ করেছিল?
জি, এসেছিল এক’দিন।
মামুন আর কিছুই জিজ্ঞেস করল না। সারাদিন কাটাল ঘুমিয়ে। সন্ধ্যাবেলা একা একা একটা সিনেমা দেখতে গেল–দি বিস্ট। একজন মানুষ পূর্ণিমা রাতে কেমন করে নেকড়ে হয়ে যায় তার গল্প। প্রথমদিকে গল্পটি কিছুই ধরা যাচ্ছিল না। শেষ দিকে দারুণ জমে গেল। মামুন অবাক হয়ে লক্ষ্য করল সে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। শেষ দৃশ্যে সুন্দরী একটি তরুণী মেয়ের কৌশলের কাছে জন্তুটির পরাজিত হবার ঘটনাটি তাকে অভিভূত করে ফেলল। চারদিকে হাততালি পড়ছে। সে বহু কষ্টে হাততালি দেবার লোভ সামলাল। প্রথম থেকে ছবিটি মন দিয়ে না দেখার জন্যে তার আফসোসের সীমা রইল না।
মেসে রাতে খাবার ব্যবস্থা আছে। তবুও সে হেঁটে হেঁটে নবাবপুরের এক দোকানে বিরিয়ানী খেতে গেল। ছাত্র থাকাকালীন দল বেঁধে এখানে আসত। অনেক দিন পর আবার আসা। সব কিছু আগের মত আছে। একশ বছর পরেও বোধ হয় দোকানটা এ রকমই থাকবে। তবে বিরিয়ানী আগের মত লাগল না, চাল পুরোপুরি সেদ্ধ হয়নি। লবণও কম হয়েছে। আগে তেঁতুলের টক দিত। এখন বোধ হয় দিচ্ছে না। কাঁচা মরিচে কোনো ঝাল নেই। মিষ্টি মিষ্টি লাগছে খেতে। মামুন প্লেট শেষ না করেই উঠে পড়ল। ঘুম ঘুম লাগছে কিন্তু মেসে ফিরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোরও কোনো অর্থ হয় না।
মামুন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে চলে গেল। অনেককাল আগে দল বেঁধে সবাই আসত। এখানে। একবার নৌকা ভাড়া করেছিল আধা ঘণ্টার জন্যে। বশিরের জন্যে নৌকা ডোবার উপক্রম হয়েছিল। মামুন একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। লঞ্চ টার্মিনাল আগের মত নেই। অনেক দিন আসা হয় না। এদিকে। সব বদলে যাচ্ছে।
আলম সাহেব জেগে বসে ছিলেন। মামুনকে আসতে দেখে উঠে এলেন কোথায় ছিলেন এত রাত পর্যন্ত? মামুন অস্পষ্ট ভাবে হাসল। আপনি যাওয়ার পরপরই আপনার বান্ধবী এসেছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিলেন। মামুন কোনো উৎসাহ দেখাল না।
আপনাকে কাল সকালে তাদের বাসায় যেতে বলেছেন।
কাল যাব কিভাবে, কাল কলেজ আছে।
কাল শুক্রবার না। কাল তো ছুটি।
ও হ্যাঁ।
চিঠিও লিখে গেছেন একটা। আপনার টেবিলে রেখে দিয়েছি। আর ভাত-তরকারিও ঢাকা দিয়ে রেখেছি। আপনার শরীর ভাল তো মামুন সাহেব?
জি ভাল।
চোখ লাল হয়ে আছে।
সারাদিন ঘুমিয়েছি তো তাই।
সন্ধ্যাবেলা কোথায় গিয়েছিলেন?
একটা ছবি দেখলাম। নাজ সিনেমায়। দি বিসিট। ভাল ছবি।
আলম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন?
জি। মনটা ভাল ছিল না। তাই ভাবলাম যাই দেখে আসি।
ভালই করেছেন।
ছাত্র জীবনে খুব ছবি দেখতাম। রোমান হলিডে ছবিটা মোট এগারো বার দেখেছিলাম। ঐ মেয়েটার প্ৰেমে পড়ে গিয়েছিলাম।
মামুন চিঠিটা পড়ল। দুলাইনের চিঠি। আগামীকাল আমাদের বাসায় দুপুরে ভাত খাধে। সকালে চলে আসবে। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। ওদের এখানে যাওয়ার ব্যাপারে মুনার খুবই আপত্তি। মামা পছন্দ করেন না। একবার গিয়ে তো বেইজাতী অবস্থা। ভদ্রলোক একটা কথাও বললেন না! সালামের জবাব পর্যন্ত দিলেন না। রাগ দেখাবার জন্যে তার সামনেই কাজের মেয়েটাকে বিনা কারণে এমন একটা চড় দিলেন যে মেয়েটা উল্টে চেয়ারের ওপর পড়ে গেল। বিশ্ৰী অবস্থা।
মামুন সাহেব।
জি।
ভাত খান।
না ভাত খাব না। ভাত খেয়ে এসেছি।
চা খাবেন? চলেন মোড়ের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।
মামুন কোনো রকম আপত্তি করল না। চা খেতে গেল। আলম সাহেব হালকা স্বরে বললেন, দুঃখ-কষ্ট সংসারে থাকেই। দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বাঁচতে হয়। জন্ম নিলেই মৃত্যু লেখা হয়ে যায়। কি বলেন?
তা তো বটেই।
আপনি এই সব নিয়ে ভাববেন না।
না আমি ভাবি না।
চা খেতে খেতে আলম সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, দাড়ি-টাড়িগুলি কেটে ফেলেন। ভাল লাগছে
জি কাটব। কালই কাটব।
মুনা সকাল থেকেই মামুনের জন্যে অপেক্ষা করছিল। এগারোটার দিকে তার কেন যেন মনে হল মামুন আসবে না। এ রকম মনে হবার কারণ নেই। কিন্তু মনে যখন হচ্ছে তখন মুনার মনে হয় মামুনের সঙ্গে দেখা হবে না, তখন হয় না।
শওকত সাহেব ফর্সা একটা পাঞ্জাবি পরে অপেক্ষা করছিল। মুনা গিয়ে বলল, মামা, তোমার কোথাও যাবার থাকলে যাও, ও আসবে না।
আসবে না কেন?
তা আমি কি করে বলি। হয়ত খবর পায়নি।
শওকত সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। রাগী গলায় বললেন, আসতে বললে আসবে না। এর মানে কি? যখন আসতে বলা হয় না। তখন তো দশবার আসে।
এটা তো মামা ঠিক বললেন না। সে এ বাসায় একবারই এসেছিল। তুমি একটি কথাও বলনি। উল্টো এমন ব্যবহার করেছ লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। তোমার বোধ হয় মনে নেই।
শওকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, বাবুকে ঠিকানা দিয়ে পাঠা, ও গিয়ে নিয়ে আসুক।
তুমি হঠাৎ এত ব্যস্ত কেন?
বিয়েটা কবে হবে কি, এইটা ফয়সালা করতে চাই। লোকজন কথা বলাবলি শুরু করেছে।
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কে আবার কী কথা বলল?
নওয়াব সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ভাগীর বিয়ে দিচ্ছেন। কবে? তিনি তোদের দেখেছেন এক রিকশায় যেতে। আমি লজ্জায় বাচি না। বিয়ের আগে কোনো মেয়ে ছেলের সঙ্গে এক রিকশায় যেতে পারে? দেশটা তো বিলাত-আমেরিকা এখনো হয়নি।
মুনা কিছু বলল না। শওকত সাহেব সিগারেট ধরলেন। দামী সিগারেট। আজকের এই বিশেষ উপলক্ষে তিনি পাঁচটি ফাইভ ফাইভ কিনেছেন।
মুনা, যা বাবুকে ঠিকানা দিয়ে পাঠা।
না, ওর যেতে হবে না।
মুনা রান্নাঘরে ঢুকল। বকুল সারা সকাল চুলোর পাশে বসে। তার ফর্সা গাল লাল টুকটুক করছে। মুনাকে ঢুকতে দেখে সে হাসিমুখে বলল, পোলাওটা খুব ভাল হয়েছে আপা।
পোল ও কেন? পোলা ও কে করতে বলেছে?
বাধা।
আমি না বললাম সিম্পল ব্যবস্থা করতে … আমরা যা খাই।
বকুল কিছু বলল না, মুখ টিপে হাসল। মুনা বিরক্ত মুখে বলল, হাসছিস কেন?
তুমি আসলে আপা খুশিই হয়েছ, কিন্তু মুখে বলছ এই কথা, এ জন্যেই হাসছি।
কি সব পাকা পাকা কথা বলছিস। গা জ্বালান কথা। এই বয়সে এত পাকা কথা বলা লাগে না।
বকুল বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, রাগছ কেন আপা? ঠাট্টা করছিলাম।
এ রকম ঠাট্টা আমার ভাল লাগে না।
গোসতের লবণ একটু দেখবে আপা।
আমি দেখতে পারব না, তুই দেখ! চুলা খালি থাকলে আমাকে একটু চা করে দে। মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে থাকব।
মামুন ভাই এত দেরি করছে কেন আপা? তুমি কখন আসতে বলেছ?
মুনা তার কথার জবাব না দিয়েই চলে গেল। বকুল ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। গত কয়েক দিন থেকেই মুনা আপা তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। কেন করছে কে জানে। রেহানা আপা ছবি চাইলে সে কী করতে পারে? সে তো বলতে পারে না না। আপনি ছবি চাইতে পারবেন না। কেন ছবি চাইবেন?
বকুল চায়ের কাঁপে চা ঢালল। আর তখনই বাবু এসে গম্ভীর স্বরে বলল–ডাক্তার সাহেব এসেছে। বকুলের হাত কেঁপে গেল। বাবুর মুখ রাগী রাগী। যেন ডাক্তারের আসা একটা অপরাধ। এবং এর জন্যে বকুল দায়ী। বকুল বলল, ডাক্তার এসেছে তো আমি কি করব? বাবু বলল, কথা বলছে বাবার সঙ্গে।
বলছে বলুক, যা তুই মুনা। আপাকে চা দিয়ে আয়।
বাবু আগের চেয়েও গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে কেন?
বকুল চমকে উঠল। ক্ষীণ স্বরে বলল, কে বলল?
আমি দেখলাম।
ডেকেছিল তাই গিয়েছিলাম।–কী হয়েছে তাতে?
আমি মুনা। আপাকে বলে দেব।
দিস। যা এখন চা নিয়ে যা।
বাবু চা নিয়ে চলে গেল। সে অবশ্যি মুনা আপাকে কিছুই বলবে না। তার স্বভাবের মধ্যে এটা নেই। একজনের কথা অন্যজনকে কখনো বলবে না। তবু বকুলের হাত-পা কাঁপতে লাগল।
ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা এমন কিছু নয়। সে স্কুল থেকে ফিরছিল চিশতি মেডিকেল কর্নারের কাছে আসতেই দেখে ডাক্তার সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখেই ডাকলেন, এই যে বকুল, এই! এস দেখি। বকুল নিশ্চয়ই না-শোনার ভান করে চলে যেতে পারে না। সে গিয়েছে। ডাক্তার সাহেব বলেছেন, ইস ঘেমে-টেমে কি অবস্থা। ভেতরে এসে ফ্যানটার নিচে দাঁড়াও তো। ঠাণ্ডা কিছু খাবে? বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, জি না। তিনি শুনলেন না। একটা ছেলেকে পাঠালেন খুব ঠাণ্ডা দেখে এক বোতল পেপসি কিংবা কোক নিয়ে আসতে। বকুল বলতে গেলে কোনো কথাই বলেনি। পেপসি অর্ধেক শেষ করে চলে এসেছে। ভয়ে তার সমস্ত শরীর কঁপিছিল। কেউ যদি দেখে ফেলে। তার ধারণা ছিল কেউ দেখেনি। কিন্তু ধারণা সত্যি নয়। বাবু দেখেছে। বকুলের কান্না পেতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল এক্ষুণি কেউ এসে বলবে, ডাক্তার সাহেব তোমাকে ডাকে। কিন্তু কেউ সে রকম কিছু বলল না। বকুল নিজের মনে রান্না সারতে লাগল। সে ভেবে পেল না। তাকে নিয়ে কেন এত ঝামেলা হচ্ছে।
বাবু এসে বলল, ডাক্তার সাহেবকে এক কাপ চা দাও। বকুল নিঃশব্দে চা বানাতে লাগল। বাবু বলল, ডাক্তার সাহেব মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। তার এক বোনের মেয়ে হয়েছে এই জন্যে। বকুল কিছুই বলল না।
কড়া নাড়ার শব্দে মামুনের ঘুম ভাঙল। সে দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়েছিল। চারদিক অন্ধকার। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে নাকি? মামুন ক্লান্ত স্বরে বলল, কে?
আমি। আমি মুনা।
মামুন তেমন কোনো আবেগ অনুভব করল না। আজ দুপুরে ওদের ওখানে খেতে যাবার কথা। যাওয়া হয়নি। তার জন্যে তেমন অনুশোচনাও হল না।
মুনা বলল, কি হয়েছে তোমার?
কিছু হয়নি।
যাওনি কেন?
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শরীরটা ভাল না;
মামুন হাই তুলল। টেনে টেনে বলল, এস ভেতরে এসে বস।
মুনা একবার ভাবল বলবে না বসব না। এবং গভীর মুখ করে চলে যাবে। কিন্তু যেতে পারল না। মুখ ভর্তি দাড়িতে এমন অদ্ভুত লাগছে মামুনকে। মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। মুখ কেমন রোগা রোগা। সারাদিন ঘুমানোর জন্যে চোখ লাল। মুনা ভেতরে ঢুকাল।
বস, চেয়ারটায় বস। চা খাবে?
হুঁ।
কাউকে পেলে হয়। ছুটির দিন তো। লোকজন থাকে না। এই বলেই মামুন বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল, যেন খুব-একটা হাসির কথা। মুনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখতে লাগল।
তুমি বসে থাক। আমি হাত-মুখটা ধুয়ে আসি। একা একা বসে থাকতে ভয় লাগবে না তো?
ভয় লাগবে কেন?
মামুন আবার হেসে উঠল। সুস্থ মানুষের হাসি না। ছাড়া ছাড়া হাসি; হাসার সময় কেমন অদ্ভুত ভাবে গা দোলাচ্ছে। r
হাত-মুখ ধুতে মামুনের অনেক সময় লাগল। তার মনেই রইল না ঘরে একজন অপেক্ষা করছে। কাজের ছেলেটি দুকাপ চা দিয়ে গেছে। সেই চা পিরিচ ঢেকে রাখা সত্ত্বেও জুড়িয়ে জল হয়েছে।
মামুন বিস্বাদ ঠাণ্ডা চাতেও চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা বলল, চা ভাল লাগছে?
হ্যাঁ ভালই তো।
ঠাণ্ডা না?
একটু অবশ্যি ঠাণ্ডা।
আগে তো ঠাণ্ডা চা মুখেই দিতে পারতে না।
মামুন চুপ করে রইল। মুনা বলল, দুপুরে কিছু খেয়েছে?
না!
কেন, খাওনি কেন?
ঘুমিয়ে পড়লাম। দশটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্ষিধেও হয়নি।
এখন হয়েছে?
হুঁ।
চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
আমাদের বাসায়। রাতে খাবে।
ঠিক আছে চল।
কাপড় বদলাতে বদলাতে মামুন বলল, তোমার শরীর ভাল মুনা?
হ্যাঁ ভাল।
টনসিালের ঐটা কমেছে, তাই না?
হ্যাঁ। তুমি দাড়ি রেখেছ কেন?
দাড়ি রাখব কেন? কয়েক’দিন কাটা হয়নি সেই জন্যে।
তোমাদের বাড়ির খবর কি বল।
বাড়ির কোনো খবর নেই। ছোট বোনটা মারা গেছে।
ওর কথা তো তুমি আমাকে কখনো কিছু বলনি।
মামুন চুপ করে রইল।
মুনা বলল, তুমি নিজের কথা কখনো কাউকে কিছু বল না। এটা ঠিক না। এতে মনের ওপর চাপ পড়ে।
হুঁ।
তোমার ভাই-বোনদের কথা আমি কিছুই জানি না।
মামুন চাপা স্বরে বলল, ঐ একটি বোন আমার। মরবার সময় খুব কষ্ট পেয়েছে। খুব কষ্টের মৃত্যু।
সব মৃত্যুই কষ্টের, সুখের মৃত্যু তো কিছু নেই।
তাও ঠিক।
মামুন হাসতে চেষ্টা করল। সিগারেট ধরিয়ে খুব উৎসাহের সঙ্গে টানতে শুরু করল। মুনা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কষ্টের ব্যাপারগুলি নিয়ে বেশি চিন্তা করা ঠিক না।
না চিন্তা করি না তো। ঐ সব নিয়ে আমি ভাবি না। চল যাই।
মুনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, দাড়িটা কেটে ফেল। খুব খারাপ দেখাচ্ছে।
খুব খারাপ লাগছে, না?
হুঁ।
কোনো একটা সেলুনে গিয়ে কাটাতে হবে। দাড়ি বেশি বড় হয়ে গেছে, নিজে নিজে কাটা যাবে না। মেসের সামনেই একটা আছে সেখানে কাটাব।
একটি ছেলে শেভ করাচ্ছে। তার পাশেই একটি রূপসী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে–দৃশ্যটি অদ্ভুত। লোকজন কৌতূহলী হয়ে দেখছে। মামুন খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। বিব্রত স্বরে বলল–তুমি বাইরে যাও না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার কি? মুনা কিছু বলল না, বাইরেও গেল না। তার কেন জানি পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভাল লাগছে।
দাড়ি কাটার পর মামুনকে আরো রোগা এবং ফর্সা দেখাচ্ছে। তারা একটা রিকশা নিল। রিকশায় উঠলেই মামুন এক হাতে মুনাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। আজ সে রকম কিছু করল না। লাজুক প্রেমিকের মত সংকুচিত ভাবে বসে রইল। মুনা বলল, তোমরা কভাই-বোন? মামুন জবাব দিল না। মুনার মনে হল এই প্রশ্নটি সে আগেও করেছে–মামুন। এড়িয়ে গেছে। মনের ভুলও হতে পারে। হয়ত জবাব দিয়েছে, মুনার মনে নেই। নাকি এই প্রশ্ন সে কোনোদিন করেনি?
মুনা আবার জিজ্ঞেস করল, কভাই-বোন তোমার?
দু’ভাই এক বোন।
অন্য ভাইটি কি করে?
ছোটবেলায় মারা গেছে। পানিতে ডুবে মারা গেছে।
মুনা কিছু বলল না। মামুন বলতে লাগল–আমরা দুভাই পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিলাম। আমি সাঁতার জানি না ও জানে। একটা পেতলের কলসী উল্টে তার কানায় ধরে সাঁতার কাটছি, হঠাৎ,…। মুনা বলল থাক বলার দরকার নেই। শুনতে চাই না।
শুনতে চাইবে না কেন? শোন। কলসী হাতছাড়া হয়ে গেল। হঠাৎ। ডুবে যেতে ধরেছি, বড় ভাই সাঁতরে এসে আমাকে ধরল। মরিয়া হয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম এবং ডুবে গেলাম দুজনেই।
মুনা প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল হুঁডটা তুলে দাও না।
মামুন হুঁড তুলল না। গাঢ় স্বরে গল্প শেষ করতে লাগল তারপর কি হয়েছে শোন, দু’জনকে আধমরা অবস্থায় উদ্ধার করা হল। একজন বাঁচল, একজন বাঁচল না।
মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মামুন বলল–আমরা ছিলাম তিনজন। এখন আমি একজন। এবং আমার কি মনে হয় জানো? আমার মনে হয়। আমিও থাকব না।
সে তো কেই থাকবে না।
না তুমি বুঝতে পারছি না। আমি নিজেও বেশিদিন বাঁচব না।
রিকশা থামিয়ে মামুন সিগারেট কিনল। জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে রিকশায় উঠে এল। মুনা অবাক হয়ে বলল–পান খাবে নাকি?
হুঁ। কেমন যেন বমি বমি আসছে। আমার শরীরটা বেশি ভাল না। মুনা।
মুনা তার হাত ধরল। তাদের পরিচয় প্রায় তিন বছরের। এই দীর্ঘদিনে আজই প্রথমবারের মত মুনা নিজ থেকে তার হাত বাড়াল এবং এর জন্যে তার কোনো লজ্জা লাগল না। মুনা নরম স্বরে বলল–তোমার গা গরম। মনে হয় জ্বর আছে।
থাকতে পারে। মাথা ধরে আছে।
এই মাথা ধরা নিয়ে সিগারেট টানছ?
অভ্যাস। অভ্যাসের বসে টানছি। টানতে ভাল লাগছে না। তবু টানছি।
ফেলে দাও।
মামুন সিগারেট ফেলে দিয়ে হালকা স্বরে বলল, এখন কেমন জানি একা এক লাগে। এই মাসের মধ্যে একটা বিয়ের তারিখ হলে তোমার আপত্তি আছে? কল্যাণপুরের বাসাটাও তোমাকে দেখিয়ে আনব। কাল সময় হবে?
অফিস ছুটির পর হবে।
আজ তোমার মামার সঙ্গে কথা বলে একটা ডেট করে ফেলি। কি বল?
এত বড় একটা দুঃসংবাদের পর হুঁট করে বিয়ের তারিখ ফেলা কি ঠিক হবে? যাক কয়েকটা দিন।
না। আমার ভাল লাগছে না। আজই সব ঠিকঠাক করব।
বাকি রাস্তা কাটল চুপচাপ। দুজনের কেউই কথা বলল না।
বাকের ভাই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছেন
এই বাবু, যাস কোথায়? শুনে যা এদিকে।
বাবু এগিয়ে গেল। বাকের ভাই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার মুখ অস্বাভাবিক গভীর। বাবু ভয়ে ভয়ে বলল, কি?
বাসায়?
কেউ না। লম্বা করে, ফর্সা মত একটা ছেলে ঢুকল, মুনা ছিল সাথে। কে সে? চোখে চশমা।
বাবু তৎক্ষণাৎ কোনো জবাব দিতে পারল না। অসহায় ভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না।
এই ছেলের সাথেই মুনার বিয়ে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এটা বলতে এতক্ষণ লাগল কেন? টান দিয়ে বাঁ কান ছিঁড়ে ফেলব। আমার সাথে ফাজলামি। বিয়েটা কবে?
সামনের মাসের তিন তারিখে।
বাকের সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে হঠাৎ উদাস হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল যা ভাগ। বাবু তবুও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। লজ্জায় তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। বহু কষ্টে সে পানি সামলানোর চেষ্টা করছে। বাকের সব সময় তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সে যখন ক্লাস ফাইভে। পড়ত তখন বাকের একবার একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল বাবু বহু চেষ্টা করেও বের করতে পারেনি। সে ফিরছিল স্কুল থেকে। হঠাৎ বাকেরের সঙ্গে দেখা, সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছে। বাবুকে দেখে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ল। কড়া গলায় ডাকল এই এদিকে আয়! বাবু এগিয়ে যেতেই কথা নেই বার্তা নেই প্রচণ্ড এক চড়। বাবু কিছু বুঝে উঠবার আগেই বাকের সাইকেলে উঠে চলে গেল। যেন কিছুই হয়নি।
আজকের রাগের কারণটা অবশ্যি স্পষ্ট। বাবু সে কারণ ভালই বুঝতে পারে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, এককালে মুনা আপার সঙ্গে বাকের ভাইয়ের কিছুটা ভাব ছিল। কে জানে বিয়ের দিন এসিড-ট্যাসিড ছুড়ে মারবে হয়ত। দারুণ মন খারাপ করে বাবু ঘরে ফিরল। সে বড় ভয় পেয়েছে।
মুনা বাইরে বেরুবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। মামুনের সঙ্গে কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কেনার কথা। সংসার তৈরি হবার আগেই সংসারের জন্যে জিনিসপত্র কেনার কথা ভাবতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। আবার ভালও লাগে। আজ তারা কিনবে চায়ের কাপ পিরিচ। রান্নার জন্যে বাসন কোসন। গত রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর মুনা একটা লিস্ট করেছে। তার সারাক্ষণই ভয় এই বুঝি বকুল জেগে উঠে চোখ কচলে জিজ্ঞেস করবে, কি করছ আপা? বকুলের ঘুম খুব পাতলা। একটু নড়াচড়া হলেই জেগে উঠে বলে, কি হয়েছে আপা? কি হয়েছে?
মুনা ঘর থেকে বেকবার আগে বলে গেল ফিরতে দেরি হবে। বকুলকে বলল ভাত চড়িযে দিতে। বকুল চাপা হেসে বলল, ভাত কজনের জন্যে রান্না হবে? ঠিক করে বলে যাও।
কজনের জন্যে রান্না হবে মানে?
মামুন ভাইও কি এখানে খাবেন?
মুনা ধমক দিতে গিয়েও দিতে পারল না। মামুন ইদানীং বেশ কয়েকবার এখানে ভাত খেয়েছে। বকুল বলল, মামুন ভাই আজ এখানে খেলে মুশকিল হবে। খাবার কিছু নেই, ডিমও নেই।
মুনা কোনো উত্তর না দিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়ল। মামুনের রাতের এখানে খাওয়ার ব্যাপারটা তার নিজেরও পছন্দের নয়। কিন্তু সে আজকাল রাত আটটার দিকে হঠাৎ এসে পড়ে এবং বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। মামা তার সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। তাতে সে কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করে না। বকুল যখন গিয়ে বলে মামুন ভাই, আপনি কী এখানে খাবেন? সে সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ। দাও ভাত দাও।
ঘরে খাবার কিন্তু খুব খারাপ।
অসুবিধা নেই।
আসুন তাহলে। ভাত বাড়ছি।
মামুন সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে। যেন ভাতের জন্যেই এতিক্ষণ বসে ছিল। এমন লজ্জা লাগে। মুন্নার। মামুন কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই কোনো উৎসাহ নেই।
বকুল বলল–মুনা আপা, এই শাড়িতে কিন্তু তোমাকে ভাল লাগছে না। বদলে যাও। সবুজ শাড়িটা পর। মুনা গম্ভীর গলায় বলল, শাড়ি-টাড়ি নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। যা পরেছি সেটাই যথেষ্ট। তোর এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।
রাগ করছ, কেন?;
পাকামো কথা শুনে রাগ করছি।
বকুল আহত স্বরে বলল, পাকা কথা কি বললাম? শাড়িটাতে তোমাকে মানাচ্ছে না। এর মধ্যে পাকামির কি আছে?
মুনা লক্ষ্য করল বকুল বেশ শীতল স্বরে তর্ক করছে। এই স্বভাব তার আগে ছিল না। আগে সে কোনো কথার জবাব দিত না। আজকাল দিচ্ছে। প্রেমে পড়লে মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র পাল্টায়। বকুল কারো প্ৰেমে-ট্রেমে পড়িনি তো? মুনা বলল, চায়ের পাতা শেষ হয়েছে বোধ হয়। বাবুকে দিয়ে আনিয়ে রাখা।
টাকা? টাকা দেবে কে? দোকানে এখন বাকি বন্ধ।
মুনা নিঃশব্দে একটা দশ টাকার নোট বের করল। শওকত সাহেব ঘরে না থাকলে টুকিটাকি কেনা এখন মুশকিল। শওকত সাহেব আগে সংসার খরচের কিছু টাকা লতিফাকে দিতেন। ইদানীং দেন না। আধা সের লবণ কেনার টাকাও এখন তার কাছে চাইতে হয়।
বকুল বলল, তুমি ফিরবে। কখন আপা?
সন্ধ্যার আগেই ফিরব। কেন?
না এমনি জিজ্ঞেস করলাম। শাড়িটা বদলে যাও আপা। প্লিজ। আর যাবার আগে মার সঙ্গে দেখা করে যাও। আজ বেশ কয়েকবার তোমাকে খোঁজ করেছেন। খুব নাকি জরুরি।
কই আগে তো বলিসনি?
আগে মনে ছিল না। এখন মনে পড়ল।
মুনা শাড়ি বদলাল না। বকুলের কথায় শাড়ি বদলানোর কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া এটা এমন কোনো খারাপ না। গত সপ্তাহেই বকুল বলেছিল সুন্দর মানিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে যে শাড়িতে মানায় এক সপ্তাহ পরে তাতে মানায় না, এ কেমন কথা?
লতিফা আজ বেশ সুস্থ। গত রাতে ভাল ঘুম হয়েছে। সকালে নাশতা খেয়েছেন। দুপুরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছেন। সারাদিন একবারও জ্বর আসেনি। অনেক দিন পর প্রথমবারের মত র্তার মনে হয়েছে হয়ত শরীর আবার আগের মত হবে। সংসার ফিরে পাওয়া যাবে। তাকে কেউ আর এড়িয়ে চলবে না।
মুনা বলল, তুমি ডেকেছিলে নাকি মামি?
লতিফা উজ্জ্বল চোখে বললেন, বোস তুই। অনেক কথা আছে। আমার পাশে বোস।
তোমার শরীর আজ মনে হয় ভাল?
হুঁ। জ্বর নেই। দেখা গায়ে হাত দিয়ে দেখ।
মুনা তাঁর কপালে হাত লাগাল। গা ঠাণ্ডা। জ্বর সত্যি সত্যি আসেনি। লতিফা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–কি, জ্বর আছে?
না। এখন বল কি বলবে। আমার হাতে সময় নেই। এক জায়গায় যাব।
দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে আয়।
এমন কি কথা দরজা বন্ধ করতে হবে?
আহ বন্ধ করতে বলছি কর না।
মুনা অবাক হয়েই দরজা বন্ধ করল। লতিফা বিছানায় উঠে বসলেন। গতকাল বকুলের স্কুলের একজন মিসট্রেস বাসায় এসেছিলেন। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কে? রেহানা আপা?
হুঁ। বকুলের জন্যে একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। খুবই ভাল ছেলে। ভাল বংশ। উনার দূর-সম্পর্কের আত্মীয়।
মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, এই সব আমি শুনতে চাই না। বাদ দাও তো।
সবটা না শুনেই এ রকম করিস কেন? সবটা আগে শোন। বাবা-মার একমাত্র ছেলে। জাপানে গেছে গত বছর। কম্পিউটার না কিসে যেন ডিগ্রি করেছে। বকুলকে সে দেখেছে। খুব পছন্দ হয়েছে।
দেখল কোথায়?
ছেলে এই মিস্ট্রেসের কাছে গিয়েছিল। তারপর উনি বকুলকে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে যান। বকুল অবশ্যি কিছু বুঝতে পারেনি।
মুনা বলল বুড়ো ছেলে, বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, ওর মাথা-টাথা কি খারাপ নাকি? এইসব চিন্তা বাদ দাও তো মামি। লতিফা অবাক হয়ে বললেন–এরকম ছেলে পরে তুই পাবি কোথায়? ছেলের ছবি আছে। ছবি দেখ তুই। ছবি দেখার পর…।
আমার ছবি-টবি দেখতে হবে না।
আগেই রাগ করছিস কেন? বকুলের একটা ভাল বিয়ে হোক এটা তুই চাস না?
চাইব না কেন, চাই। কিন্তু ওর বিয়ের বয়স হতে হবে তো? কেন এত ব্যস্ত হয়েছ? মেট্রিকটা অন্তত পাস করতে দাও। ছেলে অপেক্ষা করুক।
না, ছেলে অপেক্ষা করতে পারবে না। তিন মাসের ছুটিতে এসেছে, বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে। তুই অমত করিস না। তোর মামার সঙ্গে কথা বলছিলাম, সে রাজি আছে।
আমাদের রাজি আর অরাজিতে কিছু আসে যায় না। বকুল কিছুতেই রাজি হবে না। কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। কেন বুঝতে পারছি না?
লতিফা গম্ভীর স্বরে বললেন, না ও কাঁদবে না।
বুঝলে কি করে কাঁদবে না?
বকুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওর মত আছে। বলেছে আমাকে।
বল কি তুমি!
লতিফা টেনে টেনে বললেন, রাজি কেন হবে না বল? মেয়ে তো বোকা না। যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। কোনটাতে ভাল হবে সেটা সে জানে।
জানলে তো ভালই। বিয়ে দিয়ে দাও। আর কি?
মুনা মুখ কালো করে উঠে দাঁড়াল।
যাচ্ছিস কোথায়? কথা শেষ হয়নি আমার।
কথা শোনার আমার তেমন কোনো ইচ্ছা নেই। তোমরা নিজেরা নিজেরাই শোন।
বকুল ভাত চাপিয়েছে। তার মুখ একটু বিষন্ন। মুনা আপা অকারণে তার ওপর এতটা রাগ করবে। সে ধারণাও করেনি। সবাই তার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করে কেন? বকুল দেখল মুনা দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল, তুমি এখনো যাওনি?
না।
কী করছিলো? এতক্ষণ মার সঙ্গে এমন কি আলাপ?
মুনা কড়া গলায় বলল, গতকাল তোর টিচার এসেছিল। এই কথা তুই আমাকে বললি না কেন?
তুমি রাগ করবে। এজন্যে বলিনি।
শুনলাম জাপানের ঐ ছেলের সঙ্গে বিয়েতে তোর মত আছে। মামিকে নাকি তুই বলেছিস?
বকুল জবাব দিল না। মুনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কথার জবাব দে। চুপ করে আছিস কেন?
বকুল থেমে থেমে বলল মা আমাকে খুব আগ্রহ করে বলছিল। তার মুখের ওপর না বলতে খারাপ লাগল। মা বেশিদিন বাঁচবে না। তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছিল না।
মুনা তাকিয়ে রইল বকুলের দিকে। বকুল সহজ স্বরে বলল তোমার মা যদি এ রকম অসুস্থ হত আর সে যদি তোমার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের কথা বলত তাহলে তুমিও রাজি হতে। হতে না?
এ রকম বাজে তর্ক কার কাছে শিখেছিস?
বকুল জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। আজ সে একটা ছাপা শাড়ি পরেছে। এত সুন্দর লাগছে তাকে দেখতে। মুনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আরো কড়া কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। প্রতিমার মত একটি কিশোরীকে কোনো কড়া কথা বলা যায় না। মুনা কোমল স্বরে বলল, কাঁদছিস কেন তুই? বকুল চোখ মুছে বলল, তোমরা সবাই আমার সঙ্গে এ রকম করবে। আর আমি কাঁদতে পারব না?
সেকেন্ড পিরিয়ডে রীতা আপার ক্লাস। ইংলিস সেকেন্ড পেপার। রীতা। আপাকে ছাত্রীরা আড়ালে ডাকে রয়েল বেঙ্গল। ভয়ানক রাণী। এবং তিনি বেছে বেছে এমন সব ছাত্রীদের পড়া জিজ্ঞেস করেন যারা সেদিন শিখে আসেনি। সবার ধারণা কপালের মাঝখানে তার একটা তিন নম্বর চোখ আছে, যেই চোখ দিয়ে তিনি দেখে ফেলেন কে পড়া করেছে কে করেনি।
বকুল বসে বসে ঘামছিল। রীতা। আপা ক্লাসে ঢুকে প্রথম প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করবেন তাকে। প্রথম দাঁড়াতে বললেন। তারপর শীতল চোখে তাকবেন। ক্লাসের সমস্ত সাড়াশব্দ যখন থেমে যাবে তখন প্রশ্ন করবেন। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করবেন আলাদা আলাদা ভাবে। এবং এমন প্রশ্ন করবেন যার উত্তর ক্লাসের কেউই জানে না।
আজও তাই হল। রীতা। আপা ক্লাসে ঢুকেই বললেন বকুল দাঁড়া। বকুল দাঁড়াল। আপা তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, কমন রুমে চলে যা। রেহানা। আপা তোকে ডাকছেন। বই-খাতা নিয়ে যা।
রেহানা আপা দারুণ ব্যস্ত। হাতে একগাদা কাগজপত্র কিন্তু মুখ হাসি হাসি। বকুল তার পাশে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, বকুল তুই বাড়ি চলে যা। আজ বিকেল পাঁচটার সময় তোকে দেখতে আসবে, মাকে বলবি। সাজগোজ বেশি দরকার নেই। ছেলের মা আর এক ফুফু আসবে। খবর না দিয়ে হঠাৎ গিয়ে দেখার কথা। সেজেগুজে থাকলে বুঝে ফেলবে। বুঝেছিস?
বকুল মাথা নাড়ল। সে বুঝেছে।
যা একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যা। শাড়ি পাবে থাকবি! কামিজটামিজ না। আর শোন, দুপুরে কাঁচা হলুদ গায়ে দিয়ে গোসল করবি, রঙ খুলবে। আবশ্যি তোর রঙ খারাপ না। চাপা রঙ। এটাই ভাল।
বকুল সরাসরি বাড়ি এল না। গেল টিনা ভাবীদের বাড়ি। অনেক দিন পর আসা। টিনা ভাবী ঘুমুচ্ছিল। সে ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দিল।
কেমন আছ ভাবী?
আর কেমন আছি। আমাদের খোজখবর কে করে? তোর ফজলু ভাই দারুণ রেগে আছে, তোকে মজা দেখাবে। কাবলিওয়ালা দেখতে এলি না কেন?
বাসা থেকে আসতে দেয়নি। মুনা। আপা নট বলে দিয়েছিল।
এরকম দারোগা আপা জোগাড় করলি কোথেকে?
বকুল মৃদু হাসল।
তোর এই আপাকে আমার একেবারেই সহ্যই হয় না। কি রকম পুরুষ পুরুষ মেয়ে।
বকুল অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। মুনা। আপার নামে কেউ কিছু বললে তার খারাপ লাগে। টিনা ভাবী বললেও লাগে। যদিও তার প্রায়ই মনে হয় টিনা ভাবীকেই সে সবচে বেশি ভালবাসে।
তোর বিয়ে হচ্ছে। এ রকম একটা গুজব শোনা যাচ্ছে, এটা কি সত্যি?
বলেছে কে তোমাকে?
যেই বলুক, সত্যি কি না বল?
না। সত্যি না।
টিনা ঘাড় কাত করে হাসতে লাগল।
বকুল বলল, হাসছ কেন?
এমনি।
এই কদিনের মথ্যে তোমার পেট অনেকখানি বড় হয়ে গেছে ভাবী।
তা হয়েছে। আমার মনে হয় যমজ। দু’জন আছে। এখানে।
যমজ হলে ভালই হয়।
তোর হোক তখন বুঝবি–ভাল কি মন্দ। রাতে ঘুমুতে পারি না। সবচে অসুবিধা হয় তোর
ভাইয়ের; বেচারা ক’দিন ধরে দারুণ মনোকষ্টে আছে।
কেন? তা বলা যাবে না।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বকুল লজ্জা পেয়ে গেল। টিনা বলল, তুই এমন টমেটোর মত লাল হয়ে গেলি কেন? বুঝতে পেরেছিস নাকি কি জন্যে মনোকষ্টে আছে?
না।
আবার মিথ্যা কথা। ঠিকই বুঝেছিস। আজ তুই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবি। তোর ফজলু ভাই আসুক, তারপর যাবি। সে অনেক’দিন তোকে না দেখে মন খারাপ করে আছে।
আজ থাকতে পারব না ভাবী, আমার কাজ আছে।
কি কাজ? এত কাজের লোক হলি কবে থেকে? বাস গল্প করব। বিছানায় পা উঠিয়ে বস না।
বকুল বসল। টিনা এসে বসল। তার পাশে। একটা হাত রাখল বকুলের কোলে। মৃদু স্বরে বলল, তুই দিন দিন যা সুন্দর হচ্ছিস। আমারই লোভ, লাগে।
কি যে বল তুমি।
যে তোকে বিয়ে করবে। সে প্রথম তিন মাস এক ফোটাও ঘুমুতে দেবে না। সারা রাত জাগিয়ে রাখবে। যদি না রাখে আমার নাম বদলে ফেলব।
থাক তোমার নাম বদলানোর দরকার নেই।
টিনা মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল আমার চেহারা-ছবি তো দেখছিস। এই আমাকেই তোর ভাই এক মাস রাতে ঘুমুতে দেয়নি। সারা রাত জেগে থাকি দিনের বেলায় ফ্যাক পেলেই ঘুমাই। শ্বশুর বাড়িতে সবাই হাসাহাসি করে।
বকুল কিছু বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, এখন আর তোমাকে জাগায় না?
না। আগের মত না।
বকুল তিনটা পর্যন্ত থাকল সেখানে। টিনা ভাবীর সঙ্গে কথা বলা একটা নেশার মত। কিছুতেই আসতে ইচ্ছা করে না। পুরুষদের নিয়ে এমন সব মজার মজার গল্প সে জানে শুধু শুনতে ইচ্ছা! করে। আজ সে একটা গল্প বলেছে যে শুনলেই গা বিমঝিম করে।
টিনা ভাবীর এক খালার বিয়ে হয়েছে রাজশাহীতে। টিনা ভাবী তখন মাত্র মেট্ৰিক দিয়েছে। সেও গিয়েছে বিয়েতে। সমবয়সী মেয়েরা শাড়ি পরে ছুটোছুটি করছে। সেও করছে। রাত নটার সময় বর এল। সবাই ছুটে গেল গেট ধরতে। সে গেল ছাদে। সেখান থেকে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে দেখা যাবে। তখন হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। ছাদে পাঞ্জাবি পরা একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, খুকী ভয় লাগছে? তারপর…।
গল্প শেষ হবার পর বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, তুমি ফজলু ভাইকে বলেছ। এই ঘটনা?
পাগল হয়েছিস? সবাইকে সব কথা বলা যায়! মেয়েদের অনেক কথা পুরোপুরি গিলে ফেলতে হয়।
ঐ লোকটির সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল?
না। আর হলেই কি? তুই দেখি গল্প শুনে ঘামতে শুরু করেছিস। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক কষ্ট রে বকুল।
এ সময় বাড়িতে মা ছাড়া অন্য কারো থাকার কথা নয়। কিন্তু বকুল অবাক হয়ে দেখল বাবা খালি পায়ে বারান্দায় ক্যাম্পখাটে বসে আছেন। তারও কি অফিস ছুটি? নাকি তিনি খবর পেয়েছেন রেহানা আপা আসবেন ছেলের মাকে নিয়ে?
শওকত সাহেবের মুখ অত্যন্ত বিমর্ষ। খালি গায়ে থাকার জন্যেই হয়ত তাকে দেখাচ্ছে বুড়ো মানুষের মত। তিনি বকুলের দিকে না তাকিয়েই বলল আজি ক্লাস হয়নি? কি অবস্থা, তিন মাস পর মেট্রিক পরীক্ষা।
বকুল কিছু বলল না। মেট্রিক পরীক্ষার এখনো অনেক দেরি। সেদিন মাত্র ক্লাস টেইনে হাফ ইয়ার্লি হল। কিন্তু বাবার মাথায় কি করে যেন তিন মাস ঢুকে গেছে।
স্কুলে পড়ায় না?
পড়ায়।
আর পড়া। পড়াশোনা কি দেশে আছে? ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দে।
বকুল পানি নিয়ে এল। শওকত সাহেব তৃষ্ণার্তের মত পানি পান করলেন। তৃষ্ণ মিটাল না।
আয়েক গ্ৰাস পানি দে।
সরবত বানিয়ে দেব? ঘরে কাগজি লেবু আছে।
দে! তোর মার শরীর আজ কেমন?
ভাল।
ভাল? এর নাম ভাল। বিছানা থেকে নামতে পারে না। আর শরীর ভাল। খাওয়া-দাওয়া করেছে?
আমি তো জানি না। সকালে স্কুলে চলে গেলাম।
যা আগে খোঁজ নিয়ে আয়। মা-বাপের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস। এটা আবার বলে দিতে হয়। কেন?
লতিফা জেগেই ছিলেন। বকুলকে ঢুকতে দেখে মাথা উঁচু করে বললেন–তোর বাবা এসেছে নাকি? কথা শোনা যাচ্ছে।
দরজা খুলল। কিভাবে?
দরজা খোলা ছিল বোধ হয়।
না। আমি নিজের হাতে বন্ধ করলাম। তুই জিজ্ঞেস করে আয় দরজা খুলল। কিভাবে?
জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমি পারব না।
জিজ্ঞেস করতে অসুবিধা কি? তোকে তো খেয়ে ফেলবে না।
বকুল বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকাল। অসুস্থ হবার পর লতিফাব এমন হয়েছে। সামান্য ব্যাপারে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
বকুল, তোর বাবা রোজ এমন সকাল সকাল বাড়ি আসছে কেন?
রোজ আসছে নাকি?
কালও তো একটার সময় চলে এসেছে। এর আগের দিন এসেছে দুটার সময।
অফিসে কাজ-টাজ বোধ হয় বেশি নেই।
কাজ থাকবে না কেন? কি যে বলিস! যা তো জিজ্ঞেস করে আন্য রোজ এত সকাল সকাল আসে। কেন?
আমি জিজ্ঞেস করতে পারব না। মা।
তাহলে ডেকে দে, আমি জিজ্ঞেস করছি।
ঠিক আছে দিচ্ছি। তুমি কিছু খেয়েছিলে মা?
দুধ-মুড়ি খেয়েছি। যা তোর বাবাকে আসতে বল।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে সরবত খেলেন। গ্রাস শেষ করে বিবক্ত স্বরে বললেন, ছেকে দিতে পারলি না, লেবুর ছোবরায় গ্লাস ভর্তি। কোনো একটা কাজ ঠিকমত করতে পাবিস না, না?
বকুল চুপ করে রইল। শওকত সাহেব বললেন, তোব মা কিছু খেয়েছে?
হ্যাঁ। দুধ-মুড়ি।
রোজ দুধ-মুড়ি। মুড়ির মধ্যে আছেটা কি? এর চাইতে এক বাটি ডাল খেলে পুষ্টি বেশি হয়। যত বেকুবের মত কাজ।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, মা তোমাকে ডাকে।
এখন তার ভ্যাজর ভ্যাজার শুনতে পাবিব না। আমার পাঞ্জাবি এনে দে বাইরে যাব।
কখন ফিরবে?
শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। ছেলে-মেয়েদেব সব কথার তিনি জবাব দেন না।
রেহানা। আপা আসাব কথা বিকাল পাঁচটায, তিনি চারটিাব মধ্যেই চলে এলেন। তার সঙ্গে অসম্ভব বেঁটে অতিরিক্ত মোটা এক মহিলা। ইনিই সম্ভবত ছেলেবে মা। আবেকজন তার মত বেটে কিন্তু দারুণ রোগা ছেলের ফুফু হবেন। বেহানা আপা বকুলকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল শাড়ি পরতে বলেছিলাম না? এখনো স্কুলেব ড্রেসই পরে আছিস? মাথায় বুদ্ধি-শুদ্ধি কিছু আছে না সবটাই গোবব?
আপনি বলেছিলেন পাঁচটার সময় আসবেন।
পাঁচটার সময় আসব বলেছি বলেই তুই পাঁচটা বাজার দুমিনিট আগে কাপড় বদলাবি? আব তুই পা ছুয়ে সালাম করলি না কেন?
এখন করব?
এখন কববি কোন অজুহাতে? যাবার সময় করিস। আব্বা মুখ এমন আমসি কবে আছিস কেন? হাসিমুখে থােক। তাই বলে কথায্য কথায় হাসার দবকার নেই।
ছেলের মাকে বকুলের পছন্দ হল। খুব রসিক মহিলা। ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মজার মজার রসিকতা করতে লাগলেন। এবং এক ফাঁকে বকুলকে বললেন আমাকে দেখে অনেকেই মনে করে আমার ছেলেমেয়েগুলি বোধ হয়। আমার সাইজের। আসলে তা না, ওরা সবাই ওদেব বাবাব মত লম্বা। তবে আমি নিশ্চিত আমার নাতিগুলি হবে আমার সাইজের। এই বলে তিনি খুব হাসতে লাগলেন। হাসি এমন আন্তরিক যে সবাই তাতে যোগ দিল। বকুলের সঙ্গে তার কথাবার্তা হল খুবই কম। একবার শুধু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ভাল নাম কি মা? তার উত্তর শোনার জন্যেও অপেক্ষা করলেন না, অন্য প্রশ্ন করলেন। বেশ মহিলা।
যাবার সময় বকুল পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। অনেক’দিন বকুলকে এমন ভাবে কেউ আদর করেনি।
মামুন বলল কি কেমন দেখছ
মামুন বলল কি কেমন দেখছ? বাসা পছন্দ হয়? মুনা এতটা আশা করেনি। সে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল, খুবই সুন্দর। তুমি মোটামুটি বলেছিলে কেন? মামুন হাসতে শুরু করল।
এস পেছনের বারান্দাটা দেখি।
পেছনেও বারান্দা আছে নাকি?
থাকবে না। মানে। এখন বল বাসা কেমন?
চমৎকার! সত্যি চমৎকার।
একটু দূর হয়ে গেল। তাই না?
হোক দূর।
বসবার কোনো ব্যবস্থাই নেই। মামুন পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসল–জিনিসপত্র কিনে ঘরদুয়ার গোছাও এখন। চল আজ ফেরার পথে বড় দেখে একটা খাট কিনে ফেলি।
তোমার মাথায় শুধু খাট ঘুরছে।
তা ঘুরছে। ফোমের একটা গদি কিনিব বুঝলে মুনা। সাড়ে নশ টাকা দাম।
বাজে খরচ করার পয়সা আমাদের নেই।
ঐটা আমি কিনবাই, তুমি যাই বল না কেন। দাঁড়িয়ে আছ কেন বাস।
মামুন হাত ধরে মুনাকে টেনে পাশে বসোল। কেমন নির্জন চারদিক। একটু যেন গা ছমছম করে। মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল হাত সরাও প্লিজ।
এ রকম করছ কেন তুমি? আমার ওপর বিশ্বাস নেই তোমার?
মুনা জবাব দিল না। মামুন তাকে কাছে টানল। গাঢ় স্বরে বলল এমন শক্ত হয়ে আছ কেন? কেউ তো দেখছে না।
চল আজ যাই, সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হোক সন্ধ্যা, তুমি বস তো।
তুমি এ রকম কর, বসতে ভাল লাগে না।
কিচ্ছু করব না তুমি সহজ হয়ে বস।
ওয়ার্ড অব অনার?
হ্যাঁ, ওয়ার্ড অব অনার। শুধু আমার হাত থাকবে তোমার হাতে। নাকি তাতেও আপত্তি?
না তাতে আপত্তি নেই।
মামুন গাঢ় স্বরে বলল চল তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলি। আর ভাল্লাগছে না। আগে যে রকম কথা ছিল সে রকমই করি। কাজীর অফিসে গিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দি।
মামা রাজি হবে না। ছোট করে হলেও একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। মুনার কথা শেষ হবার আগেই মামুন তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। মুনা কোন বাধা দিল না। তা্রা সন্ধ্যা না মিলানো পর্যন্ত থাকল সেখানে।
রহস্যময় কিছু সময় কাটল তাদের।
মুনা রোজ ভাবে সকাল সকাল ঘুমুতে যাবে কিন্তু রোজই দেরি হয়। আজও দেরি হল। বারোটার সময় বাতি নেভাতে যেতেই বকুল বলল, একটু পরে আপা। আমার পাঁচ পৃষ্ঠা বাকি আছে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল–মশারির ভেতরে বসে গল্পের বই পড়িস। কেন? চোখ নষ্ট হবে। আর প্রতিদিন একটা করে বই জোগাড় করিস কোথেকে?
ফজলু ভাই এনে দেয়।
আমি বারান্দায় বসছি। বই শেষ হলে ডেকে দিস।
আজ গরম নেই। আশ্বিনের শেষাশেষি। শেষ রাতের দিকে ভাল ঠাণ্ডা পড়ে। মুনা ক্যাম্পখাটে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচ পৃষ্ঠা বাকি কথাটা মিথ্যা। অনেকখানিই বাকি। মুনাকে ডাকতে কেউ আসে না।
শওকত সাহেবকে বারান্দার দিকে আসতে দেখা গেল। তিনি মুনাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, অন্ধকারে বসে আছিস কেন? সাড়ে বারোটা বাজে।
এমনি বসে আছি। তুমি নিজেও তো অন্ধকারে হাঁটাহাঁটি করছ। কিছু খুঁজছি নাকি?
দড়ি আছে?
দড়ি দিয়ে কি করবে?
মশারি খাটাব।
মশারি তো খাটানোই আছে। আবার নতুন করে খাটাবে কি?
শওকত সাহেব থেমে থেমে বললেন বসার ঘরে বিছানা করেছি। আজ থেকে আলাদা শোব।
কেন?
প্রত্যেক দিন রুগীর সাথে শুয়ে শুয়ে শরীরটাই আমার খারাপ হয়ে গেছে।
শওকত সাহেব বিরক্তির ভঙ্গি করে বসার ঘরের দিকে গেলেন। সেখানে সত্যি সত্যি একটা বিছানা করা হয়েছে। নোংরা একটা মশারি খাটানোর চেষ্টাও হচ্ছে। মশারির তিন কোণ শিথিলভাবে ঝুলছে। দড়ির অভাবে চার নম্বর কোণাটির গতি হচ্ছে না। মুনা বলল দুপুর রাতে দড়ি পাওয়া যাবে না। তুমি একটা কয়েল জ্বালিয়ে শুয়ে থাক।
কয়েল আছে?
আছে, এনে দিচ্ছি। আচ্ছা মামা, সত্যি করে বল তো তোমার কি হয়েছে?
কি আবার হবে? রুগীর সাথে ঘুমাতে চাই না। এর মধ্যে হওয়া-হওযির কি আছে?
এই কথা না। তুমি নাকি প্রতিদিন দুপুরে অফিস-টফিস বাদ দিয়ে ঘরে এসে বসে থাক?
কে বলেছে, লতিফা?
হ্যাঁ। ব্যাপার কি?
ব্যাপার কিছু না। অফিসে একটা ঝামেলা যাচ্ছে।
ঝামেলা গেলে তো সেখানেই বেশিক্ষণ থাকা উচি৩। কি ঝামেলা বল?
শওকত সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ভ্যাজব ভ্যাজব করিস না। কয়েল জুলিখে দি যে যা। আর দেখা হাতপাখা পাওয়া যায় কি না। বিশ্ৰী গরম।
গরম কোথায়? বেশ তো ঠাণ্ডা।
শওকত সাহেব গুম হয়ে বসে রইল। এখন তিনি আর কথা-টথা বলবেন না। মুনা কযেল। আনতে গেল। মামির ঘবের ড্রয়ারে এক প্যাকেট কযেল আছে।
লতিফা জেগে ছিলেন। মুনা ড্রয়ার খুলতেই তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, তোর মামা আলাদা ঘুমাচ্ছে কেন রে?
এই ঘরে গরম লাগে। বাতাস-টাতাস নেই।
ফ্যান আছে তো।
ফ্যানের বাতাসে তার ঘুম হয় না। একেক জনের একেক স্বভাব।
লতিফা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, এতদিন তো ঘুম হয়েছে। আজ হবে না কেন? বলতে বলতেই তার গলা ভারী হয়ে এল। মুনা এসে বসল বিছানার পাশে। লতিফা বললেন, এক সময় তোেব মামা আমাকে বিয়ে করার জন্যে কত কাণ্ড করেছে।
এই গল্প মুনার জানা। মামির কাছ থেকে অসংখ্যাবার শুনেছে। আজ রাতে আরেকবার হয়ত শুনতে হবে।
মুনা, কি সব পাগলামি কাণ্ড যে সে করেছে। একবার শুনলাম সে বিষ খাবে। এক বোতল র্যাটম না কি যেন জোগাড় করেছে। আমি ভয়ে বাঁচি না। কি কেলেঙ্কারি। কাণ্ড! বাড়িতে সবাই দোয্য দিচ্ছে আমাকে। আমি কি জানি বল? আমার সঙ্গে কোনোদিন তার একটা কথাও হয়নি।
বলতে বলতে শাড়ির আঁচলে লতিফ চোখ মুছলেন। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে মুনা বলল, বকুলের হবু শাশুড়ী নাকি লম্বায় দেড় ফুট? বিয়ের ডেট-ফেট ফেলে দিয়েছ নাকি মামি?
না ডেট হয়নি। বিয়ে নিয়ে কোনো কথাবার্তাই হয়নি।
দুই বেয়ানে কি নিয়ে গল্প করলে?
লতিফা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন। সম্ভবত মনে করতে চেষ্টা করছেন। কিছুই মনে করতে পারলেন না। মুনা বলল, শুয়ে থাক মামি। বাতি নিভিয় দেই। লতিফা চাপা স্বরে বললেন, আমি বেশিদিন বাঁচব না রে।
বুঝলে কিভাবে?
কয়েক’দিন আগে স্বপ্নে দেখলাম আমি আর তোর মা দুজনে ভাত খাচ্ছি। স্বপ্নে মরা মানুষদের সঙ্গে খেতে বসা খুব খারাপ। যে দেখে সে আর বাঁচে না।
কি দিয়ে ভাত খাচ্ছিলে?
লতিফা জবাব দিলেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলেন। মুনা বাতি নিভিয়ে বের হয়ে এল। বকুলের পাঁচ পৃষ্ঠা এখনো শেষ হয়নি। মুনা কোনো কথা না বলে বাতি নিভিয়ে দিল। বকুল বলল, আর একটা পাতা। আপা, প্লিজ।
কোনো কথা না, ঘুমো।
এই পাতাটা শেষ না করলে আমার ঘুম আসবে না।
ঘুম না এলে জেগে থাক। কথা বলিস না। কি বই এটা?
উপন্যাস।
কার লেখা?
সতীনাথ ভাদুড়ির অচিন রাগিনী। ফজলু ভাই এনে দিয়েছে লাইব্রেরি থেকে।
ভাল নাকি খুব?
মোটামুটি।
মোটামুটি? তুই যেভাবে পড়ছিস তাতে তো মনে হয় রসগোল্লা ধরনের উপন্যাস।
বকুল খিলখিল করে হেসে উঠে জড়িয়ে ধরল। মুনাকে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, হাত উঠিয়ে নে। গরম লাগছে। বকুল হাত সরাল না। আরো কাছে ঘেঁষে এসে বলল, তুমি এত ভাল কেন মুনা আপা?
জানি না কেন। বিরক্ত করিস না।
ধাকুল মৃদু স্বরে বলল, একটা গল্প বল না আপা।
কি মুশকিল, রাত দেড়টার সময় গল্প কিসের?
একটা বল আপা। তোমার পায়ে পড়ি? ভূতের গল্প। সত্যি সত্যি তোমার পায়ে ধরছি কিন্তু।
আহ কেন সুড়সুড়ি দিচ্ছিস?
আপা প্লিজ, প্লিজ।
মুনাকে গল্প শুরু করতে হল। ওপাশের বিছানা থেকে বাবু ক্ষীণ স্বরে বলল, একটু জোরে বল আপা, আমিও শুনছি। মুনা অবাক হয়ে বলল, এখনো জেগে আছিস?
ই। ঘুম আসছে না, কি করব?
বাবু অস্পষ্ট ভাবে কি যেন বলল। পরিষ্কার বোঝা গেল না। মুনা উঁচু গলায় বলল–কি বলছিস ভাল করে বল। বোবা ধরেছিল?
হ্যাঁ।
কাল সকালে মনে করিাস তোকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
ঠিক আছে।
গল্প শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেল। বকুল বলল, বাথরুমে যেতে হবে তুমি একটু দাঁড়াও। বাবুর ও বাথরুম পেয়ে গেল। বাবু বলল, আজ না ঘুমিয়ে সারারাত গল্প করলে কেমন হয় আপা? মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, ফাজলামি করিস না, বাথরুম শেষ করে ঘুমুতে যা। আর একটি কথাও না।
তারা তিনজন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই দেখল। শওকত সাহেব উবু হয়ে বারান্দায় বসে আছেন। অন্ধকার বারান্দা। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট শুধু উঠানামা করছে। মুনা ডাকল মামা! তিনি ফিরে তাকালেন। কোনো উত্তর দিলেন না।
একা একা কি করছ মামা?
কিছু করছি না।
শওকত সাহেব নিঃশব্দে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। বকুল চাপা স্বরে বলল, বাবার কি হয়েছে মুনা আপা? মুনা বলল, কিছুই হয়নি। ঘুম আসছে না। তাই বসে ছিল বারান্দায়। কেন জানি বকুলের মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাবার বসে থাকার ভঙ্গিটা কেমন দুঃখী দুঃখী। তার মনে হল বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছিল। মানুষের কত রকম গোপন দুঃখ থাকে। তার নিজেরও আছে। প্রায়ই সে এ রকম একা একা কাঁদে। তার মত দুঃখ তো বাবা-মাদেরও থাকতে পারে। ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। অল্পতেই তার কান্না পায়।
জলিল মিয়ার চায়ের দোকানে
সকাল ন’টার মত বাজে।
বাকের জলিল মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কড়া রোদ বাইরে। বাকেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জলিল মিয়া ডাকল–বাকের ভাই, আসেন চা খান। বাকের জবাব দিল না। সব কথার জবাব দেয়া ঠিক না। এতে মানুষের কাছে পাতলা হয়ে যেতে হয়। সে এগিয়ে গিয়ে পান-বিড়ির দোকানটার সামনে দাঁড়াল। বেশ কয়েকজন কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, দোকানদার সবাইকে বাদ দিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, কি দিব বাকের ভাই?
সিগ্রেট দে।
ফাইভ ফাইভ?
বাকের এমন ভাবে তাকাল যেন সে দারুণ বিরক্ত হয়েছে। তাকে ক্ষমা করে দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, অন্য কোনো সিগ্রেট খাই? দোকানদার জিবে কামড় দিয়ে একটা সিগ্রেট বের করল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, এক প্যাকেট দে। সে একটা চকচকে একশ টাকার নোট ছুড়ে ফেলল।
আজ তার মন নানান কারণে খারাপ হয়ে আছে। গত রাতে খবর পাওয়া গেছে। ইয়াদ চাকরি পেয়েছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা ইয়াদের সঙ্গে ওঠাবসা অথচ এই খবরটা ইয়াদ তাকে দেয়নি। অন্যের কাছে জানতে হল। খবরটা যাচাই করবার জনে সে সাত সকালে গিয়েছিল। ইয়াদের বাড়ি। ইয়াদ হাই তুলে বলল, আর কতদিন এমনি এমনি ঘুরব? আর চাকরিটাও খারাপ না। ঘোরাঘুরি আছে। টি এ ডি এ পাওয়া যায়।
কবে থেকে চাকরি?
সামনের মাসের এক তারিখ থেকে। দেরি আছে। চল যাই চা খেয়ে আসি। নাশতা করেছিস?
চা খেতে খেতেই বাকের একবার বলল, আমবা চারজন মিলে যে স্পেয়ার পার্টস-এর দোকান দেব বলেছিলাম তার কি?
আরে দূর এইসব কি আর হয় নাকি? দুইজন তো ভোগেই গেল, বিয়ে-শাদী করে একেবারে গেরস্ত।
তুই আর আমি দুইজনে মিলে করতে পারতাম।
পয়সা কই?
ইয়াদ খানিকক্ষণ পরই গলা নিচু করে বলতে লাগল, বড় ভাই এদিকে আবার ফ্যাচাং বঁধিয়ে ফেলেছে। আই.এ. পাস এক মেয়ের সাথে সম্বন্ধ করে ফেলেছে। মেয়ে কালো কিন্তু সুইট দেখতে। একটু অবশ্যি রোগা।
বাকের একটি কথাও বলল না। গম্ভীর হয়ে রইল। ইয়াদ নিজের মনেই কথা বলে যেতে লাগল–আমি নিজে তো মেট্রিকটা পাস করতে পারলাম না। এদিকে বউ হল গিয়ে এই–এ। শালা কেলেঙ্কারি অবস্থা। এখন বউ যদি বি.এ. পড়তে চায় তাহলে গেছি। বড় ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে গেলাম। ইয়াদের মুখ দেখে মনে হল না ঝঞাটের জন্যে সে বিরক্ত। বরং মনে হল সে সমস্ত ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে।
বাকের চা শেষ না করেই উঠে এল। এটা ঠিক যে পাড়ার সবাই তাকে খাতির করে। কিন্তু দল ভেঙে যাচ্ছে। এ সব লাইনে দল ভেঙে গেলে খাতির থাকে না। দেখতে দেখতে চ্যাংড়ারা উঠে আসবে। গত সপ্তাহেই তার চোখের সামনে মজনু সিগারেট টানতে টানতে রিকশায় উঠল। একটা চড় দিলে দুটো চড়ের জায়গা নেই যার তার এত বড় সাহস।
বাকের জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে ঢুকল। জলিল মিয়া নিজেই গলা উঁচিয়ে ডাকল গফফর, গরম পানি দিয়া ভাল কইরা বাকের ভাইরে চা দে। কাপ ধুইয়া দিস। বাকের বসে রইল। উদাস ভঙ্গিতে। এখানে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ নেই। স্কুলের সময় হয়ে গেছে, পাড়ার মেয়েরা স্কুলে রওনা হয়েছে দল বেঁধে। দেখতে এত ভাল লাগে। বাকের লক্ষ্য করতে লাগল কোনো ছোকরা শিসটিস দেয়। কিনা। টেনে জিব ছিঁড়ে ফেলবে সে। তার পাড়ায় মেয়েছেলের অসম্মান হতে দেবে না।
মুনা ঘর থেকে বেরুল দশটার দিকে। অফিস পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চয়ই এগারোটা বেজে যাবে। রোজ দেরি হয়। কালও সে ঘর থেকে বের হয়েছে এগারোটায়। বাকের চায়ের সন্টল ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।
এই যে মুনা অফিসে যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ। সকালবেলা আর কোথায় যাব?
মামাকে বলবে কাজের মেয়ে একটা জোগাড় করেছি।
ঠিক আছে বলব।
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করল। মুনা কিছু বলল না। বাকের হালকা স্বরে বলল, তোমাদের অফিসে যাব এক’দিন। মেয়েছেলেরা কাজ করছে দেখলে ভাল লাগে।
আপনারী কিছু করবেন না, গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াবেন। মেয়েরাও যদি তাই করে তাহলে হবে কিভাবে?
তোমাদের জন্যেই তো কিছু করতে পারি না। মেয়েরা সব কাজকর্ম নিয়ে নেয়। বাংলাদেশ একেবারে নারীমহল হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন অন্দরে ঢুকে রান্নাবান্না করব। হা হা হা।
বাকের রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। নিজের কথা তার নিজেরই খুব মনে ধরেছে। সে বড় রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেল। এ সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল, কিন্তু সে ছুটোছুটি করে রিকশা নিয়ে এল। রিকশাওয়ালাকে গম্ভীর গলায় বলল, আপামণিকে তুরন্ত নিয়ে যাবি। মুনার ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু-একটা বলা উচিত। কিন্তু সে কিছু বলল না। বাকের বলল মুনা, ভাড়া দিতে হবে না।
কেন? দিতে হবে না কেন?
দিয়ে দিয়েছি।
বাকের উদাস ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল। তার এখন কিছু করার নেই। মোটর পার্টস-এর দোকানে আগে এই সময়টায় আড্ডা দিতে বসন্ত সে আড্ডাটা এখন আর নেই। লোকজন আসে। না। একা একা কতক্ষণ বসে থাকা যায়? সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ করছে না। রাস্তার পাশে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে প্যাসেঞ্জারের ঝগড়া বেঁধে গেছে। অন্য সময় হলে প্যাসেঞ্জারের পক্ষ নিয়ে রিকশাওয়ালার গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিত। আজ সে ইচ্ছাও হল না। মুনার সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখার হবার পর তার এ রকম হয়। বেশি কিছু সময় কিছুই ভাল লাগে না।
বাকের গ্রিন ফার্মেসিতে উঁকি দিল। ডাক্তার ছেলেটি এখনো আসেনি। সে এলে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসা যেত। বাকের গম্ভীর গলায় বলল ডাক্তার কখন আসবে?
দুপুরের পরে।
দেখি টেলিফোনটা দেখি।
ফার্মেসির নীল শার্ট পরা লোক বিরক্ত স্বরে বলল–ফোন তালা দেয়া। চাবি নেই। এই লোকটি নতুন এসেছে, তাকে বোধ হয় ঠিক চেনে না। বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, চাবি না থাকলে তালা ভাঙার ব্যবস্থা কর। লোকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। বাকের থমথমে গলায় বলল, ফাজলামি কথাবার্তা আমার সাথে বলবে না। চড় দিয়ে চাপার দাঁত ফেলে দেব। টেলিফোন তালা দেওয়া! তোমার বাবার টেলিফোন?
লোকটি টেলিফোন বের করল। সত্যি বোধ হয় চাবি নেই। সেফটিপিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তালা খুলল।
কাকে ফোন করা যায়? মুনাকে করলে কেমন হয়? মাঝে মাঝে সে মুনার সঙ্গে কথা বলে। মুনা ভীষণ বিরক্ত হয়। তবু করে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে টেলিফোনটি বড় সাহেবের ঘরে। মুনাকে ডেকে আনতে হয়। আজও তাই হল। বড় সাহেব তাকে লাইনে থাকতে মুনাকে আনতে খবর পাঠালেন।
হ্যালো, আমি বাকের।
কি ব্যাপার?
রিকশা ভাড়া দাওনি তো? আমি অলরেডি দিয়ে দিয়েছিলাম।
সে তো আপনি আমাকে বলেছিলেন। আবার টেলিফোন কেন? তোমার কাছ থেকে আবার সেকেন্ড টাইম ভাড়া নিল কি না সেটা জানার জন্যে। রিকশাওয়ালারা या হাब्राभि श्श। হা হা হা।
আর কিছু বলবেন?
না। তোমাদের বিয়ের ডেট হয়েছে নাকি?
না। এখনো হয়নি।
হ্যালো মুনা, আমার কানেকশন আছে, আমি হাফ প্রাইসে একটা কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া করে দেব। জাস্ট দশ দিন আগে আমাকে বলতে হবে।
ঠিক আছে বলব। এখন টেলিফোন রাখি?
হ্যালো শোন–তোমাদের ঐ ফ্যানটার কিছু করা গেল না। অসুবিধা নেই, যেটা আছে সেটা ইউজ কর। নো প্রবলেম।
ঠিক আছে, এখন রাখছি। আমার কাজ আছে।
মুনা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। বাকের অলস ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, একটা খুব ঠাণ্ডা দেখে পেপসি নিয়ে আস তো। বলবে, বাকের ভাই চায়।
নীল শার্ট পরা লোকটি পেপসি আনতে গেল! বাকের রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
শওকত সাহেব অফিসে এলেন লাঞ্চের পর। সবাই তখনো লাঞ্চ সেরে ফেরেনি–অফিস ফাঁকা ফাঁকা। শওকত সাহেবের মনে হল সবাই তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। ডিসপ্যান সেকশনের মল্লিক বাবু তাকে দেখেই যেন হঠাৎ করে ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শওকত সাহেব বললেন, ভাল আছেন মল্লিক। বাবু? মল্লিক। বাবু অতিরিক্ত ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন, জি ভাল। আপনি ভাল তো?
বড় সাহেব আছেন?
আছেন, অফিসেই আছেন। যান না, দেখা করুন গিয়ে।
শওকত সাহেব বড় সাহেবের কাছে গেলেন না। যাবার সাহস সঞ্চয় করতে তার কিছু সময় লাগবে। ছোকড়া মত একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে ক্যাশ সেকশনে। নতুন অ্যাপয়েন্টেমেন্ট হয়েছে নাকি? মল্লিক। বাবু বললেন, চা খাবেন?
জি না।
ক্যাশ সেকশনের নতুন ছেলেটি আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে। তার খবর শুনেছে বোধ হয়।
জসিম সাহেব ঢুকলেন। খুব ফুর্তিবাজ লোক। রসিকতা না করে এক সেকেন্ডও থাকতে পারেন। না। শওকত সাহেবকে দেখে তিনিও কেমন জানি হকচাকিয়ে গেলেন। শুকনো হাসি হেসে বললেন, কি ভাল?
জি ভালই।
দেখা হয়েছে বড় সাহেবের সঙ্গে?
জি না। দেখা করতে বলেছেন?
না কিছু বলেননি। তবে আমার মনে হয় দেখা করা উচিত। ইনকোয়ারি কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে।
শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কি রিপোর্ট?
জসিম সাহেব উত্তর না দিয়ে ড্রয়ার খুলে কি নিয়ে যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
বড় সাহেবের কাছে কি এখনই যাব?
যান। এখুনি যান। দি আরলিয়ার দি বেটার।
শওকত সাহেব ভীত স্বরে বললেন, কিছু শুনেছেন রিপোর্ট সম্বন্ধে?
জি না ভাই। কিছু শুনিনি।
তিনি কথাটা মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। তার মানে এটা মিথ্যা। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে হয় অন্যদিকে তাকিয়ে।
বড় সাহেব মানুষটি ছোটখাটো। হাশিখুশি ধরনের। সহজে রাগ করেন না। কড়া ধরনের কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনিও গভীর। শওকত সাহেবকে দেখে মুখ অন্ধকার করে বললেন, ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্ট ভাল না। শুনেছেন বোধ হয়?
শওকত সাহেব মূর্তির মত বসে রইলেন।
ইনকোয়ারি কমিটির সুপারিশ হচ্ছে, যে টাকার গরমিল দেখা যাচ্ছে সেটা আপনি দশ দিনের ভেতর যদি ফেরত দেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে কোনো পুলিশ অ্যাকশন নেয়া হবে না। আর তা না হলে কেইস পুলিশ হ্যান্ডওভার করা হবে, বুঝতেই পারছেন একটা কেলেংকারি ব্যাপার হবে। আপনি টাকাটা ফেরত দিয়ে দেন।
টাকা আমি কোথায় পাব স্যার?
বড় সাহেব সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমি স্যার কিছুই জানি না।
এটা তো শওকত সাহেব ঠিক বললেন না। আপনি না জানা মতে এটা হওয়া সম্ভব না। কাজটা করেছেন কাঁচা। আমি নিজেও ইনকোয়ারি কমিটির একজন মেম্বার এটা ভুলে যাচ্ছেন কেন? থানা-পুলিশ হলে একটা বেইজ্জতী ব্যাপার হবে, তার হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা করুন। শুধু শুধু এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট করবেন না। হেড ক্লার্কের কাছে ইনকোয়ারি কমিটির রিপোর্টের কপি আছে। সেটা নিয়ে যান। ভাল করে পড়ুন।
বকুলের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে
বকুলের বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে এই খবরটি বকুল কাউকে বলেনি। টিন ভাবীকে পর্যন্ত না। অথচ বকুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল ক্লাসের সবাই এটা জানে। সেকেন্ড পিরিয়ডে ইংরেজি। আপা আসেননি। সবাই খুব হৈচৈ করছে। অনিমা গিয়ে এক ফাঁকে বোর্ডে লিখল আজ বকুলের গায়ে হলুদ, কাল বকুলের বিয়ে। দারুণ হাসোহাসি শুরু হল। হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ছে। বকুল বেঞ্চে মাথা রেখে কেঁদে ভাসাতে লাগল।
ফোর্থ পিরিয়ডে ছুটি নিয়ে চলে গেল টিনা ভাবীদের বাসায়। ভেবেছিল পাঁচটা পর্যন্ত থাকবে–কিন্তু টিনা ভাবীর দেশের বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। বাসা ভর্তি মানুষ। কিছু কিছু দিন এমন খারাপ ভাবে শুরু হয়। বাসায় ফেরার পথে ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এই যে বকুল না? এ রকম মাথা নিচু হরে হাঁট কেন? গাড়ির নিচে পড়বে।
বকুল কি বলবে ভেবে পেল না।
এস পেপসি খেয়ে যাও।
জি না, লাগবে না।
লাগবে না কেন। লাগবে। আস তো! চল ফার্মেসিতে বসি, যা গরম।
গরম কোথায়? আজি তো ঠাণ্ড।
এই তো কথা ফুটছে। আমার তো ধারণা ছিল তুমি কথা বলতেই জানো না।
জানব না কেন?
বকুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সে বেশ কথার পিঠে কথা বলছে।
কয়েক’দিন আগে কি তুমি শাড়ি পরে কোথাও গিয়েছিলো? নীল শাড়ি?
টিনা ভাবীর বাসায় গিয়েছিলাম।
আমি চিনতে পারিনি। সারাক্ষণ ভাবছিলাম চেনা চেনা লাগছে। অথচ চিনাছি না কেন? আচ্ছা! বকুল বল তো, কাদের পথে দেখলে চেনা চেনা মনে হয়, কিন্তু আসলে ওরা চেনা নয়।
বকুল অনেকক্ষণ ভেবেও কিছু বলতে পারছে না। ডাক্তার ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল, টিভি বা সিনেমায় যারা অভিনয় করে ওদের রাস্তায় দেখলে চেনা চেনা মনে হয় ঠিক না?
আমি ওদের কাউকে কখনো রাস্তায় দেখিনি।
আমি অনেক দেখেছি।
সুবৰ্ণাকে দেখেছেন কখনো?
না তাকে দেখিনি।
আমি দেখেছি। আমি আর অনিমা এক’দিন নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম। তখন তাকে দেখলাম কাগজ কিনছে। প্রিন্টের সাদা শাড়ি পরা ছিল।
বকুল প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত ফার্মেসিতে একটি টুলের ওপর বসে বসে গল্প করল। এতটা সময় গিয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারেনি।
বাসায় ফিরতে ভয় ভয় লাগছিল। তার মনে হল বাবু নিশ্চয়ই আজও দেখেছে এবং হয়ত বলে দেবে মুনা আপাকে। কিংবা কে জানে বাবা নিজেই হয়ত দেখেছেন। তিনি পাঁচটার দিকে মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফেরেন। বেছে বেছে হয়ত আজই ফিরেছেন। বকুল ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
বাড়িতে কেউ নেই। বাবা, মুনা আপা, বাবু কেউই ফেরেনি। দশ-এগারো বছরের একটা কাজের মেয়েকে দেখা গেল, তার নাম সখী। এ রকম অদ্ভুত নাম থাকে নাকি মানুষের? যতবার তার নাম ধরে ডাকা হয় ততবারই এমন হাসি লাগে। লতিফা এক সময় বিরক্ত হয়ে বললেন, ওকে সখিনা ডাকবি। সখী ডাকছিস কি?
যে নাম ওর বাবা-মা রেখেছে সেটা ডাকবে না?
না ঐ নামে ডাকতে হবে না। সখিনা ডাকবি।
মেয়েটা খুব কাজের। অল্প সময়ের মধ্যেই ঘর-দুয়ার গুছিয়ে ঝকঝকে করে ফেলেছে। বকুলকে জিজ্ঞেস করল, চা খাবে কি না। লতিফা চিন্তিত মুখে বললেন এই মেয়ে বেশিদিন থাকবে না। যারা কাজ জানে তারা এ বাড়িতে বেশিদিন টেকে না।
লতিফার শরীর আজ বেশ ভাল। অনেক দিন পর তিনি আজ রান্নাঘরে ঢুকে হালুয়া বানালেন। সবাই চায়ের সঙ্গে খাবে। গরম পানি দিয়ে ভালমত গোসল করলেন। তার শরীর বেশ ঝরঝরে। লাগছে। বকুল বলল–তুমি গোসল-টোসল সেরে এমন সেজোগুজে বসে আছ কেন?
সাজগোজের কি দেখলি? পরিষ্কার একটা শাড়ি পারলাম শুধু।
তোমাকে বেশ ফ্রেশ লাগছে মা।
লতিফা মনে মনে খুশি হলেন। শরীর যদি সত্যি সত্যি সেরে গিয়ে থাকে তাহলে শক্ত হাতে এবার সংসারের হাল ধরতে হবে। সব জলে ভেসে যাচ্ছে।
বকুল!
কি?
তোর রেহানা। আপা আর আসে না ক্লাসে?
আসবে না কেন, রোজই আসে।
তোর বিয়ের কথা কিছু বলে না?
না।
তুই নিজে কিছু জিজ্ঞেস করিস না?
কি যে তুমি বল মা। আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করব। আমার বিয়ের কি করলেন আপা?
লতিফা হেসে ফেললেন। মনে মনে ভাবলেন বড় কথা শিখেছে তো এই মেয়ে। মেয়েরা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়। কয়েক’দিন আগেও খালি গায়ে ফ্রক পরে ঘুরে বেড়াত, আজ বিয়ের কথা হচ্ছে। হয়ত সত্যি সত্যি বিয়েও হয়ে যাবে। জাপানে না কোথায় চলে যাবে এইটুকু মেয়ে। এক’দিন তারও ছেলেমেয়ে হবে। ওদেরও বিয়ের বয়স হবে। লতিফার চোখ ভিজে ওঠার উপক্রম হল। বকুল বলল, তুমি শুয়ে থাক তো মা! আবার জ্বর এসে যাবে।
আসবে না। আয় বারান্দায় একটু বসি।
তারা দু’জন বারান্দায় মোড়া পেতে বসল।
তোমার শরীর সতি সত্যি সেরে গেছে নাকি মা?
বোধ হয় সেরেছে। বাবুর স্কুল ছুটি হয়। কখন?
এখন ছুটি হয়ে গেছে। ও খেলতে যায়, সন্ধ্যা হয় আসতে আসতে।
আর মুনা? ও কখন আসে?
একেক দিন একেক সময় আসে।
বলতে বলতেই শওকত সাহেবকে লম্বা পা ফেলে আসতে দেখা গেল। লতিফা বললেন তোর বাবার শরীরটা খুব খারাপ হয়েছে তো।
হুঁ।
যত্ন করার কেউ নেই। কখন খায় কি করে কে জানে।
বকুল বলল, চল ভেতরে যাই মা। বাবা এখানে আমাদের বসে থাকতে দেখলে রাগ করবেন।
শওকত সাহেব কিন্তু রাগ করলেন না। সন্ধ্যাবেলা বই নিয়ে বসবার জন্যেও কাউকে বললেন না। নতুন কাজের মেয়েটা তার চোখের সামনে একটা গ্লাস ভেঙে ফেলল, তিনি শুধু মৃদু স্বরে বললেন–কাজকর্ম সাবধানে করবি। অন্য সময় হলে এর জন্যে চড়-চাপড় মারতেন। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতেন। রাতের খাবারও খেলেন নিঃশব্দে। মুনা একবার বলল, তোমার শরীর ভাল তো মামা।
হুঁ ভাল।
অফিসে ঝামেলা মিটেছে?
হুঁ মিটেছে।
লতিফা বসেছেন ওদের সঙ্গে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এখনো তাঁর জ্বর আসেনি। মাথা একটু হালকা লাগছে। এ ছাড়া শারীরিক আর কোনো অসুবিধা নেই। তিনি নিজেও ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না। বকুল বসেছে তার পাশে। তিনি একবার বললেন–দেখ তো আমার গা গরম কি না। বকুল বলল না। অসুখটা বোধ হয়। সেরেই গেল। তার চোখ চকমক করতে লাগল। শওকত সাহেব খাওয়া শেষ করে উঠবার সময় বললেন–মুনা, তুই একটু শুনে যা।
অফিসের ঝামেলার ব্যাপারটা মুনা শুনল। শান্ত স্বরে বলল এটা কতদিন আগের ব্যাপার?
এক মাস।
এতদিন তুমি এটা হজম করে রেখেছিলে?
শওকত সাহেব জবাব না দিয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন।
এখন ওরা পুলিশ কেইস করবে?
ই। টাকাটা রিকভার না হলে করবে।
তোমাকে তো তাহলে ধরে নিয়ে যাবে হাজতে।
হুঁ।
টাকার ব্যাপারে তুমি কিছু জানো?
না। কিছুই জানি না।
মুনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি জানো না ঠিক না মামা! তুমি জানো। তবে তুমি একা এটা করনি তা ঠিক। এত সাহস তোমার নেই। সঙ্গে অন্য লোক ছিল। তুমি খানিকটা শেয়ার পেয়েছে? কত পেয়েছে?
শওকত সাহেব চুপ করে রইলেন। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, কত পেয়েছ?
দশ হাজার।
আমাকে যে ছ’হাজার দিতে চেয়েছিলে সেটা ওখান থেকেই?
হ্যাঁ।
বাকি চার হাজার কোথায়?
ধার-টার ছিল। শোধ দিয়েছি।
ঐ দিন যে মিষ্টি আনলে সেটা কি এই টাকা থেকে?
শওকত সাহেব জবাব দিলেন না। দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে খুক খুক করে কাশতে লাগলেন। মুনা বলল–মামা, তুমি কাল সকালেই অফিসে গিয়ে বলবে, আমি টাকাটা ফেরত দেব, তবে আমাকে দুমাস সময় দিতে হবে।
দু’মাসের মধ্যে কোথায় পাব এত টাকা?
পাবে না। তবে এর মধ্যে আমরা বকুলের বিয়ে দিয়ে দেব। তোমাকে জেলে নিয়ে ঢোকালে ঐ মেয়ের কি আর বিয়ে হবে, না পড়াশোনা হবে? যত সুন্দরীই হোক চোরের মেয়েদের আমাদের সমাজে জায়গা নেই। বুঝলে মামা? তুমি কালই অফিসে যাবে এবং দু’মাস সময় নেবে।
ঠিক আছে নেব।
মুনা উঠে পড়ল। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না তার। সে বুঝতে পারল বকুলও জেগে আছে, কিন্তু সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। সে কি কিছু আঁচ করতে পারছে?
বকুল?
কি?
জেগে আছিস তো কথা বলছিস না কেন?
বাবা এতক্ষণ ধরে কি বললেন?
তেমন কিছু না। তোর বিয়ে নিয়ে কথা হল। বুঝলি বকুল, আমি অনেক ভেবে-টেবে দেখলাম অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া খারাপ না। এর কিছু কিছু ভাল দিকও আছে।
বকুল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
এই সময়ে মেয়েদের মনে প্রচুর ভালবাসা থাকে। ভালবাসাটা খুবই জরুরি। সব কিছু অভাবই সহ্য করা যায়, কিন্তু ভালবাসার অভাব সহ্য করা যায় না।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, তোমাকে একটা কথা বলব মুনা আপা?
বল।
তুমি রাগ করবে না তো?
রাগ করবার মতো কথা না হলে রাগ করব কেন? বল কি বলবি?
বকুল মুনার কাছে সরে এসে আলতো করে একটা হাত রাখল তার গায়ে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ক্লাস টেনের একটা মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে তাহলে সেটা কি খারাপ আপা?
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, ছেলেটা কে?
বকুল জবাব না দিয়ে দুহাতে মুনাকে জড়িয়ে ধরল। মুনা লক্ষ্য করল বকুল থারথার করে কাঁপছে।
ভোরবেলা সূর্য ভালভাবে ওঠার আগেই বাড়িতে পুলিশের ওসি এবং তিনজন কনস্টেবল এল। তাদের সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তারা টাকা খুঁজল।
লতিফা রক্তশূন্য মুখে দরজা ধরে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। মাঝে মাঝে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করলেন। কেউ তা বুঝতে পারল না। শওকত সাহেব বসে রইলেন বেতের চেয়ারে। তিনি খুব ঘামতে লাগলেন। তার ঠিক সামনেই বসেছেন ওসি সাহেব। এ জাতীয় দৃশ্য তিনি তাঁর জীবনে অনেক দেখেছেন। কাজেই এ দৃশ্য তার মনে কিছুমাত্র রেখাপাত করল না। তবু তিনি একবার লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয়ের কিছু নেই, আপনি শান্ত হয়ে বসুন।
এই ভোরবেলাতেও বাড়ির সামনে এবং তার লাগোয়া রাস্তায় প্রচুর লোক জমে গেল। এ বাড়িতে একটি মেয়ে খুন হয়েছে। এ রকম একটা গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। রোদ বাড়তে লাগল কিন্তু কৌতূহলী মানুষের ভিড় কমল না।
সার্চ শেষ হতে হতে আটটা বেজে গেল। ওসি সাহেব বললেন, শওকত সাহেব আপনার নামে একটা ওয়ারেন্ট আছে, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। ভয়ের কিছু নেই, জামিনের ব্যবস্থা হবে। মুনা বলল, আমি কি যেতে পারি আপনার সঙ্গে?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই পারেন। একজন পুরুষ মানুষ হলে ভাল হত। উকিল-টুকিলের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক ছোটাছুটির ব্যাপার আছে।
মুনা বাবুকে পাঠাল পরিচিত। যদি কাউকে পাওয়া যায়। আশপাশের বাসার অনেকের সঙ্গেই এদের চেনা-জানা। তবু কেউ আসতে রাজি হল না। সাবধানী মানুষ, ইচ্ছা করে কোনো বাজে ঝামেলায় জড়াতে চায় না।
বাকেরকে শুধু পাওয়া গেল। সে ঘুমুচ্ছিল। খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। সিগারেট ধরিয়ে দায়িত্বশীল মানুষের মত সে মুনাকে বলল, নো প্রবলেম, এক ঘণ্টার মধ্যে জামিনে ছাড়িয়ে আনব। ছেলেখেলা নাকি। তোমরা সব দরজা বন্ধ করে বসে থাক। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কোনো উত্তর দেবে না। ঘরে টাকা-পয়সা আছে তো?
বকুল তার ঘরে একা একা বসে ছিল। শওকত সাহেবকে বের করে নিয়ে যাবার সময় সে শুধু বেরিয়ে এল। অত্যন্ত কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার বাবাকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ওসি সাহেব সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। শওকত সাহেব অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মত চারদিকে তাকাতে লাগলেন। উপদেশ দেবার মত ভঙ্গিতে বললেন, ঠিকমত পড়াশোনা করিস মা। দু’দিন পর মেট্রিক পরীক্ষা।
বাসার সামনে অসম্ভব ভিড়, সেই ভিড় ঠেলে তারা এগুতে লাগল। শওকত সাহেব শিশুদের মত শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। বাকের তাঁর একটা হাত ধরে আছে। সে মৃদু স্বরে বলল, মামা কাঁদবেন না। কিছু হবে না, এক ঘণ্টার মধ্যে জামিন হবে। আমার চেনা লোকজন আছে।
বাসার সামনে লোকের ভিড় বাড়তেই লাগল।
উকিল ভদ্রলোক দেখতে পান-বিড়ির দোকানদারের মত।
রোগা দড়ি পাকানো চেহারা। কথাও ঠিকমত বলতে পারেন না–জড়িয়ে যায়। কিন্তু তিনি নাকি ফৌজদারী মামলায় একজন মহা ওস্তাদ আদমি। তার হাতে মামলা গেলে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো যায়।
কিন্তু মুনা বিশেষ ভরসা পাচ্ছে না। তাকে সামনে বসিয়ে উকিল সাহেব গভীর যত্নে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে প্রতিটি দাতের গোড়ায় গোসত আটকে আছে এবং এই মুহূর্তেই সেগুলো বের করা দরকার।
মুনার পাশের চেয়ারে বসে আছে বাকের। তার ভাবভঙ্গি খুব বিনীত। বাকেরই তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। বাকেরের ধারণা এই লোক এক নম্বর আসল জিনিস, খাঁটি বাঘের বাচ্চা।
বাঘের বাচ্চারা এত দীর্ঘ সময় নিয়ে দাঁতের পরিচর্যা করে তা মুনার জানা ছিল না। সে অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। উকিল সাহেব মাঝে মাঝে দাঁত খোঁচানো বন্ধ রেখে এক দৃষ্টিতে মুনার দিকে তাকাচ্ছেন। তাঁর দৃষ্টি মুনার বুকের কাছে এসে থমকে যাচ্ছে। এমন নির্লজ্জ মানুষও আছে নাকি?
আসামি আপনার কে হয়?
আমার মামা।
আপন মামা? মায়ের ভাই?
জি।
মুনা ভেবে পেল না। আপন মামা না পর মামা, তার সঙ্গে এই মামলার সম্পর্ক কী? নাকি উকিল-মোক্তারদের স্বভাবই হচ্ছে খামোক প্রশ্ন করা।
ভয়ের কিছু নেই, ক্রিমিন্যাল মিস এপ্ৰোপ্রিয়েশন; চারশ তিন ধারা। ম্যাক্সিমাম পেনাল্টি হচ্ছে দুবছরের জেলা। এত নার্ভাস হবার তো কিছু দেখি না। ডোন্ট গেট নাভার্স।
মুনা নড়েচড়ে বসে রুমাল দিয়ে নাক ঘষল। বড় ঘাম হচ্ছে। এ জন্যেই বোধ হয় তাকে নাৰ্ভাস দেখাচ্ছে।
আপনার নাম কী?
মুনা।
মিস নাকি মিসেস?
এই সব কী ধরনের প্রশ্ন? মুনা মৃদু স্বরে বলল, মিস।
মিস মুনা, এখন আপনি বলুন আপনার মামা কী চুরি সত্যি সত্যিই করেছেন?
মুনা কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। তাকাল বাকেরের দিকে। বাকের দাঁত বের করে হাসছে। কেন হাসছে কে বলবে। এটা একটা লজ্জায় ফেলার প্রশ্ন, এতে হাসির কিছু নেই।
উকিল সাহেব অ্যাসট্রেতে একগাদা থুথু ফেলে সেদিকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন। যেন এই মুহূর্তে থুথুটায় বিরাট একটা কিছু ঘটবে। সেই ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করতে চান। এক সময় তার দেখা শেষ হল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–চুরি যদি না করে থাকেন। তাহলে খালাস করে আনা মুশকিল। আর যদি সত্যি চুরি করে থাকেন। সহজেই খালাস হয়ে যাবে।
মুনা অবাক হয়ে বলল, তার মানে?
অপরাধীদের খালাস করা অতি সহজ। এরা যখন অপরাধ করে কিছুটা সাবধান হয়েই করে। কোর্টে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়। আর যারা অপরাধী না, ভাল মানুষ–তারা পড়ে যায় প্যাঁচকলে। হা হা হা।
মুনা অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে রইল। ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, অপরাধীদের খালাস করে আনার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। আইনের পশ্চাৎদেশে লাথি বসানোর আনন্দ। আমি এটা খুব এনজয় করি।
বাকের শব্দ করে হাসতে লাগল। সে মুগ্ধ। মুনা কিছু বলল না। উকিল সাহেব জড়ানো স্বরে বললেন। এই জাতীয় ছোটখাটো মামলা আমি নিই না। তবে আপনারটা নেব।
মুনা একবার ভাবল বলে আমারটা কেন নেবেন? কিন্তু সে কিছু বলল না। উকিল সাহেবের চোখ তার বুকের ওপর স্থির হয়ে আছে। শাড়ির আঁচল টেনে দেয়া উচিত। সেটা অভদ্রতা হবে। এতটা অভদ্র হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনা বলল, আমরা কী তাহলে উঠব?
হ্যাঁ উঠবেন। যাবতীয় কাগজপত্র এবং আসামিকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। কবে আসবেন সেটা আমার মুহুরির কাছ থেকে জেনে যান।
মুহুরি কোথায়?
পাশের ঘরে। আর শুনুন–আমার ফিস কিন্তু বেশি। এবং ফিসের টাকার সবটা আমি অ্যাডভান্স নেই। আজ এক টাকা কাল আট আনা–এই ভাবে নেই না।
আপনার ফিস কত?
সেটা বলব কাগজপত্র দেখে।
বাকের দাঁত বের করে বলল, একটু সার কনসেশন করতে হবে। গরিব মানুষ সার ভেরি নিডি।
কনসেশন কিছু নেই। অনোর বেলায় যা আপনাদের বেলাতেও তা। মাছের বাজার তো না।
মুনা বেরিয়ে এসেই বিরক্ত স্বরে বলল ভেরি নিডি, গরিব মানুষ, এসব বলার দরকার কী?
দরাদাম করতে হবে না? বল কী তুমি? বাড়িতে তো তোমার টাকার গাছ নেই।
লোকটাকেও আমার পছন্দ হয়নি। আস্ত ছোটলোক।
ছোটলোক কী বড়লোক এটা দিয়ে আমাদের দরকার কী? আমরা দেখব। কাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার হয়। এই শালাকে দিয়ে হবে। এ হচ্ছে নাম্বার ওয়ান ধনুকর।
ধনুকর মানে?
ধনুকর মানে হচ্ছে যে, ধুনে দেয়। এই শালা ধুনে দেবে। এক ধাক্কায় মামাকে খালাস করে নিয়ে আসবে। এখন যে জিনিসটা লাগবে সেটা হচ্ছে টাকা। মানি। এখন শুরু হবে টাকার খেলা। টাকা-পয়সা কেমন আছে তোমাদের?
মুনা জবাব দিল না। টাকা-পয়সা তেমন কিছু নেই। মামার কাছে ছহাজার টাকা ছিল। তার থেকে এখন কত আছে কে জানে। তার নিজের একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকার মত আছে। বেতনের টাকা থেকে জমানো। মামির কিছু গোপন সঞ্চয় আছে। তাঁর ভাই তাকে ঈদ উপলক্ষে টাকা-পয়সা যা দেন তার সবটাই মামি জমিয়ে রাখেন। একটা পাই পয়সাও খরচ করেন না।
বাকের বলল, কোল্ড ড্রিংক-ট্রিংক কিছু খাবে? ফান্টা, পেপসি?
মুনা বিরক্ত স্বরে বলল–ঠাণ্ডার মধ্যে ফান্টা-পেপসি খাব কী জন্যে?
তাহলে গরম কিছু খাও। চা খাবে?
আমি এখন কিছু খাব না। আপনি চলে যান, আমার অন্য কাজ আছে।
কী কাজ?
এক জায়গায় যাব।
চল আমি দিয়ে আসি। আমার এখন কোনো কাজ নেই, ফ্রি আছি।
আপনি তো সব সময়ই ফ্রি।
বাকের শুকনো মুখে বলল, মামুন সাহেবের কাছে যাচ্ছ? তিনি তো আমার মত ফ্রি না। কলেজ-টলেজ আছে। তাকে কী এখন পাবে?
মামুন সত্যি সত্যি ছিল না। গতকাল রাতের ট্রেনে দেশের বাড়িতে চলে গেছে। কেন গিয়েছে তা মেসের কেউ বলতে পারে না। কাউকে জানিয়ে যায়নি। মুনা বড়ই অবাক হল। এমন হুঁট করে চলে যাবে? কিছু বলেও যাবে না। কবে ফিরে আসবে তাও কেউ বলতে পারল না।
বেলা সাড়ে এগারোটা। মুনা বাসায় ফিরে যাবার জন্যে রিকশা নিল, কিন্তু মাঝপথে ঠিক করল। অফিসে যাবে। পর পর দু’দিন কামাই হয়েছে। আজ নিয়ে তিন দিন হবে। এটা ঠিক না। কিন্তু অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিছুতেই মন বসছে না।
আকাশে মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে বোধ হয়। রিকশাওয়ালা প্রচণ্ড গতিতে রিকশা টানছে। একটা অ্যাকসিডেন্ট-ট্যাকসিডেন্ট বাধাবে। মুনা একবার ভাবল বলবে আস্তে চালাও ভাই। কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কেন যেন শুধু কান্না পাচ্ছে। দুঃসময়ে কাউকে কাছে থাকতে হয়।
শওকত সাহেব
শওকত সাহেব সারাদিন কোথায় কোথায় যেন ঘুরে বেড়ান। বাসার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই হয়। নাশতা খেয়েই বেরিয়ে পড়েন, ফেরেন সন্ধ্যা মেলাবার পর। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় ক্যাম্পখাটে শুয়ে থাকেন। বকুল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে–চা দেব?
তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না। তবে চা এনে দিলে নিঃশব্দে খান। আগের মত চিনি কম হয়েছে, লিকার পাতলা হয়েছে বলে চেঁচামেটি করেন না। বকুল যদি বলে চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবে? মুড়ি মেখে দেব? তিনি মৃদু স্বরে বলেন না লাগবে না।
রাত বাড়তে থাকে। তিনি বারান্দার বাতি জ্বালান না। অস্পষ্ট আলোতে পত্রিকার একটা পাতা চোখের সামনে ধরে রাখেন। বকুলের বড় মন খারাপ লাগে। খুব ইচ্ছা করে বাবার পাশে এসে বসতে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না।
আজও তিনি অন্য দিনের মত ক্যাম্পাখাটে বসে আছেন। খালি গা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। এবার শীত পড়ে গেছে আগেভাগে। শীতে একেকবার তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন, বকুল একটা পাঞ্জাবি তাকে এনে দিল। তিনি যন্ত্রের মত পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। বকুল ভয়ে ভয়ে বলল বাবা তোমার কী শরীর খারাপ? তিনি কিছুক্ষণ থেমে বললেন শরীর ঠিক আছে রে মা; বকুলের চোখ ভিজে গৈল। গলা ব্যথা ব্যথা করতে লাগল। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সে হয়ত কেঁদেই ফেলবে। সে মাথা নিচু করে তার মার ঘরে ঢুকে পড়ল।
লতিফা বললেন তোর বাবা কী করছে?
বসে আছেন।
মুন? মুনা এখনো আসেনি?
এসেছে। শুয়ে আছে। মাথা ধরেছে।
ওকে একটু ডেকে আন।
বললাম না মাথা ধরেছে। এখন ডাকলে যোগ করবে।
লতিফা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর অসুখ খুবই বেড়েছে। নতুন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। শ্বাস কষ্ট। এত বাতাস চারদিকে অথচ প্রাযই নিঃশ্বাস নেবার মত বাতাসের টান পড়ছে তার। সারারাত এ ঘরের সব ক’টি জানালা খোলা থাকে, ফ্যান চলে ফুল স্পিডে। তবু তিনি বাতাস পান না।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে শ্বাস কষ্ট শুরু হলেই শওকত সাহেব তাঁর পাশে এসে বসেন। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু তিনি একটা হাতপাখা নিয়ে বাতাস করেন। লতিফার লজ্জা লাগে। আবার ভালও লাগে।
শওকত সাহেব অনেক’দিন পর এ ঘরে ঘুমুতে এলেন; মিনামিন করে একটা অজুহাত ও দিলেন বিছানায় পিঁপড়া উঠেছে। লাজুক ভঙ্গি। বিয়ের প্রথম ক’দিন এ রকম হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর যেন বিয়ের প্রথম দিকের রাত ফিরে এল। পৃথিবীতে কিছুই বোধ হয় শেষ হয় না। পুরনো ঘটনা আবার ঘুরেফিরে আসে। অর্থহীন কথাবার্তাও তাদের মধ্যে হল। লতিফা বললেন, বকুলের বিয়ে সত্যি সত্যি হলে মন্দ হয় না, কী বল? তিনি বললেন, ভালই হয়।
এ রকম ছেলে পাওয়া ভাগ্যের কথা ঠিক না?
হুঁ।
তবে বড় বেশি বড়লোক। এত বড়লোকের সঙ্গে সম্পর্ক করতে ভয় ভয় লাগে।
ভয়ের কী?
শওকত সাহেব অন্ধকারে একটা সিগারেট ধরান; বড় মায়া লগে লতিফার। ইচ্ছা করে একটা হাত গায়ের ওপর উঠিয়ে দিতে কিন্তু লজ্জার জন্যে পারেন না।
যৌবনের কথা অস্পষ্ট ভাবে তার মনে পড়ে; কত রহস্যময় বাত গিয়েছে। গল্প করতে করতেই কতবার ভোর হল। পাখ-পাখালি ডাকতে লাগল। কতবার আফসোস করেছেন রাতগুলি এত ছোট কেন?
মানুষের সব কিছুই ছোট ছোট। জীবন ছোট। ভালবাসাবাসির দিন ছোট শুধু দুঃখের কাল দীর্ঘ। ভাবতে ভাবতেই নিজের অজান্তে ফুঁপিয়ে ওঠেন। শওকত সাহেব ব্যস্ত হয়ে বলেন কী হয়েছে?
কিছু হয়নি।
শ্বাসের কষ্ট?
হুঁ।
পানি খাবে? পানি এনে দেই?
না, কিছু আনতে হবে না। তুমি ঘুমোও।
লতিফা তার রোগজীৰ্ণ শ্ৰীহীন হাত বাড়িয়ে দেন। গত রাতটা তারা দু’জন জেগেই কাটিয়েছেন। আজও কী সে রকম হবে?
বকুল কেমন রাগী রাগী মুখ করে বসে আছে বিছানার পাশে। এমন বিরক্ত তার মুখের ভাব যে কিছু বলতেই ভরসা হয় না। তবু লতিফা ক্ষীণ স্বরে বললেন তোর বাবা কী করছে?
একবার তো বলেছি মা; কিছু করছেন। ক্যাম্পখাটে বসে আছে।
ডেকে নিয়ে আয় না।
কী জন্যে?
এমনি। তোকে ডাকতে বলছি ডাক।
বকুল চলে যায়। লতিফা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন। কেউ আসে না। এই ঘরে। বকুল নিশ্চয়ই বলেনি কিছু। বাবার সঙ্গে ছেলেমেয়েদেব যোগাযোগ খুব কম! সবাই কেন তাকে এত ভয় পায়? ভয় পাওয়ার মত কী আছে এই মানুষটার?
রাত নটার দিকে ঝমঝম কবে বৃষ্টি পড়তে লাগল। মুনা ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েও তার মাথাধরা সারেনি। কেমন যেন বমি বমি ভাব হচ্ছে এখন। হাত ধড়িয়ে সে বৃষ্টির ফোঁটা ধরতে চেষ্টা করল। তার কিছুই ভাল লাগছে না। তবু সে ফুর্তির আগলা একটা ভাব এনে উঁচু গলায় বলল। এই বাবু, বৃষ্টিতে ভিজবি? বাবু কিছুই বলল না। বকুল ও রাজি হল না।
এক একই উঠোনে নামল মুনা। বৃষ্টিা ফোঁটাগুলি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা! গা কোপে কেঁপে উঠছে। তবুও ভালই লাগছে। বাবু বাবান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। মুন! আবার ডাকল এই বাবু আয় না। বারু কোনো জবাব দিল না। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়তে লাগল।
স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে
স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে বেহানা আপার বাড়ি সে রকম নয়। বাড়ি দেখেই মনে হয়। স্কুল মাস্টারি তিনি সখের জন্যে করেন! মুনা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে লাগল; ভালী ভারী সোফা। লাল কাঁপেট ঝকমক করছে। দেয়ালে কামরুল হাসানের ছবি। তিনটি মেয়ে নদীতে নাইতে নেমেছে। রেহানা আপা বললেন অরিজিনাল পেইনটিং; মুনা বলল। চমৎকার তো।
উনি আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হন। বাসায় প্রায়ই আসেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুমি চা-টা কিছু খাও।
জি না। আমার শবীর ভাল না। গলাব্যথা। রেহানা। আপা সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী হলেন।
টনসিল নাকি?
জি।
এক গ্রাস গরম পানির মধ্যে কয়েক দানা লবণ আর পেয়াজের রস দিয়ে গার্গল কর, দেখবে সেরে যাবে।
জি আচ্ছা করব।
এখানেই করা, আমি এনে দিচ্ছি।
মুনা না বলবার সময় পেল না। রেহানা। আপা ভেতরে চলে গেলেন। মুনা বসে রইল একা একা। এ বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু কেউ বসবার ঘরে উঁকি দিচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকবারই টের পাওয়া গেল পর্দার ওপাশে কৌতূহলী মেয়েরা উঁকি দিচ্ছে! কৌতূহলের কারণটি স্পষ্ট হচ্ছে না! তারা কী জেনেছে সে বকুলের বোন; যার সঙ্গে এ বাড়ির কোনো একটি ছেলের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি! সে কথাও জানার কথা নয়। মুনা শুধু রেহানা। আপাকেই বলেছে আমি বকুলের বোন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তিনি নিশ্চয়ই সে কথা বাড়ির ভেতরে সবাইকে বলেননি। তাকে সে রকম মনে হয় না।
মুনাকে গার্গল করতে হল। অপরিচিত কোনো বাড়িতে বেড়াতে এসে শব্দ করে গার্গল করা খুব অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় নেই, রেহানা। আপা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, এখন একটু আরাম লাগছে না?
জি লাগছে।
এস, আমরা বসার ঘরে না বসে অন্য কোথাও বসি।
চলুন।
রেহানা আপা তাকে দোতলার বায়ন্দায় নিয়ে এলেন। চমৎকার বারান্দা। ছবির মত সাজানো। ধবধবে সাদা বেতের চেয়ার। ছোট্ট একটা লেতের টেবিল। এই সাত সকালে ও টেবিলের ফুলদানিতে টাটক৷ ফুল রাখা হয়েছে। রোজই কী এ রকম রাখা হয়? রেহানা। আপা বললেন বল কী বলবে? মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কীভাবে কথাটা শুরু করা যায় বুঝতে পারল না।
কোনো রকম সংকোচ বা লজ্জা করবে না। বল।
বকুলের ঐ বিয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আমার মামা-মমিব খুধ আগ্রহ।
আমাদেরও আগ্রহ। তোমার বোন মেয়েটি ভাল। একটু বোধ হয় বোকা। সেটাও ভাল। বোকা মেয়েরা বৌ হিসেবে ভাল হয়।
মুনা তাকিয়ে রইল। এই নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আপনারা একবার বলেছিলেন, পনেরো দিনের মধ্যে কাবিনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চান।
হ্যাঁ তা চাই।
আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা যখন বলবেন তখনই আমরা রাজি আছি।
রেহনা আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন একটা বড় রকমের প্রবলেম হয়েছে। তোমার সঙ্গে খোলাখুলি বলি; বকুলের বাবা শুনলাম অ্যারেস্ট হয়েছে। কথাটা বোধ হয় সত্যি। সত্যি না?
জি। ওঁকে একটা মিথা মামলায় জড়িয়েছে।
সেটা তুমি জানো এবং আমরা জানি। কিন্তু অন্যরা তো জানে না। তারা নিজেদের মত করে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করবে! করবে না?
জি করবে।
ব্যাপারটা কী রকম সেনসেটিভ বুঝতে পারছ। পারছ না?
পারছি!
ধর, তোমার নিজের একটি ছেলের তুমি বিয়ে দিচ্ছি। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ দেখলে মেয়ের বাবাকে পুলিশ চুরির দায়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেমন লাগবে তোমার?
আপ ওটা একটা মিথ্যা মামলা। বিশ্বাস ককোনা!
বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস করছি। চা খাও, দাঁড়াও চা দিতে বলি।
মুনা না বলবার আগেই রেহানা আপা চা আনতে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে! চা বোধ হয় তৈরিই ছিল। শুধু চা নয় সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার।
বেহানা আপা অন্তিরিক স্বরে বললেন, খাও কিছু খাও। আমার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না! মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল বিয়েটা তাহলে হবে না?
না। তারা অন্য মেয়ে দেখেছে। কথা ও মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে।
ও।
দিনাজপুরের মেয়ে। হোম ইকনমিক্সের ছাত্রী। বাবা রিটায়ার্ড সেশন জজ।
মুনা কিছু বলল না। রেহানা আপা বললেন বকুলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবে না। ওর বিয়ে আমি দিয়ে দেব। এই ছেলের চেয়েও অনেক ভাল ছেলে জোগাড় করব।
কী ভাবে করবেন? ওরাও নিশ্চয়ই বাবা সম্পকে জানতে চাইবে।
তা চাইবে। কিন্তু এ সব কথা লোকজন বেশি দিন মনে রাখে না। প্রথম কিছু দিন খুব হৈচৈ হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়।
মুনা বলল আমি উঠি।
একটু বস।
আমার অফিসে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
না দেরি হবে না। আমার এক ননদ গাড়ি নিয়ে এসেছে, তাকে বলেছি সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।
মুনা বসে রইল। রেহানা আপা বললেন কেইস শুরু হবে কবে?
খুব শিগগিরই শুরু হবার কথা।
ভাল উকিল দিয়েছ তো?
দিয়েছি।
আমার নিজের জানাশোনা কিছু উকিল আছে। আমি বললে ওরা বিনা ফিতে মামলা দেখে দেবে। বলব?
তার দরকার নেই।
বকুল স্কুলে আসে না অনেক দিন থেকে। ওকে স্কুলে আসতে বলবে। পরীক্ষাব ডেট দিয়ে দিয়েছে।
মুনা বিস্মিত হল। বকুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার জানা ছিল না। রেহানা আপা বললেন, বাবা কী করেছে না করেছে তার জন্যে মেয়ে কেন লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকবে? তুমি খুব কড়া করে ধমক দিয়ে তাকে স্কুলে পাঠাবে।
জি আচ্ছা!
মুনাকে দিয়ে আবার তিনি গার্গল করালেন; এবং সত্যি সত্যি তার গলাব্যথা অনেকখানি কমে গেল!
সে অফিসে ঢুকল ভয়ে ভয়ে; গত দু’দিন নানান ছোটাছুটিতে অফিসে আসা হয়নি। ঘন ঘন কামাই হচ্ছে। বড় সাহেবের কানে উঠেছে নিশ্চয়ই। নিজের জায়গায় বসে মুনার ধারণা আরো দৃঢ় হল। সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে। পাল বাবু এসে বললেন বড় সাহেব খোঁজ করেছিলেন। আপনাকে।
কবে?
পরশু খোঁজ করলেন। কাল খোঁজ করলেন। আমরা বলেছি অসুস্থ!
কি জন্যে খোঁজ করেছেন জানেন?
না! যান জেনে আসুন! স্যার আছেন।
মুনা ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামতে লাগল।
বড় সাহেব শুকনো গলায় বললেন বসুন, দাড়িয়ে কেন?
মুনা বসল। এই ঘরটায় ঢুকলেই তার এমন অস্বস্তি লাগে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব সময় মনে হয় এক্ষুণি এই ছোটখাটো লোকটি চেঁচিয়ে উঠবে। যদিও কোনো সমযই তিনি তা করেন না।
শরীর খারাপ ছিল?
জি না স্যার, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। খুব ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।
ঝামেলাটা কী বলুন? অবশ্যি যদি আপত্তি না থাকে। আপনার ঝামেলার জন্যে অফিসের কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই আপনার সমস্যা জানার রাইট আমার আছে।
মুনা রুমাল দিয়ে কপালেব ঘাম মুছল এবং ক্ষীণ স্বরে তার মামার কথা বলল। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু শুনছেন না কিন্তু মুনা জানে তিনি খুব মন দিয়েই শুনছেন।
আপনিই সব দেখাশোনা করছেন?
জি।
বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই? আছে স্যার; আমার ছোট ভাই। খুব ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ে।
মামলাটা শেষ হতে কতদিন লাগবে?
উকিল সাহেব বলেছেন এক মাসের মত লাগবে।
বড় সাহেব সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে রাখলেন। গম্ভীর গলায়, আপনি মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করুন; আমি ব্যবস্থা করে দেব। নিজের সমস্যা ভালমত মেটান।
মুন্না ক্ষীণ স্বরে বলল, থ্যাংকয়্যু স্যার।
বড় সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমরা বাবা মারা যান যখন আমরা সবাই খুব ছোট। সেই সময় আমার বড় বোন শুধু এম.এ. পড়তেন। তিনি একটা চাকরি নেন! নানান রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করতে থাকেন। তিনি কোনোদিন ঠিকমত অফিসে যেতে পারতেন না। প্রাযই অফিস কামাই হত। তার বস প্রতি সপ্তাহেই বলতেন, তোমার চাকরি শেষ। আগামীকাল থেকে আর আসবে না।
মুনা চুপ করে রইল। বড় সাহেব দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে হাসি মুখে বললেন, কিন্তু ওটা ছিল মুখের কথা। ঐ বড় সাহেব একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করলেন এই অজুহাতে যেন আমার আপা ভালমত অফিসের কাজে মন দিতে পারেন। সবাই বলে মানুষের খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। মানুষকে পাশে পাওয়া যায় দুঃসময়ে। আচ্ছা আপনি যান।
স্যার স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। যদি কখনো মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু করানো সম্ভব, জানাবেন। আমি করব।
অফিসের বাইরে এসে মুনা চোখ মুছল। বড় সাহেবের এই সামান্য কথা তাকে অভিভূত করেছে। মাঝে মাঝে আমরা অতি অল্পেই অভিভূত হই। নিজের টেবিলে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক এসে উপস্থিত। তার মুখ হাসি হাসি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। তারেক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা খবর দেয়া হয়নি, আমি বিয়ে করেছি।
সে কি! কবে?
হুট করে হয়ে গেল। গত পরশু। মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম, গিয়ে এই কাণ্ড। তারেক লজ্জিত ভঙ্গিতে মানি ব্যাগ থেকে ছবি বের করল। লম্বা রোগা একটি মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। তারেক মৃদু স্বরে বলল, অফিসে আপনিই প্রথম জানলেন, আর কাউকে বলিনি। মুনা অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুব সুন্দর বউ হয়েছে।
ছবিতে যত সুন্দর দেখা যাচ্ছে, তত সুন্দর সে না। ফটো জিনিক ফেস আর কী। নাম হচ্ছে তনিমা।
সুন্দর নাম।
ডাকনামটাই সুন্দর। ভাল নাম শুনলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠবেন। হা হা হা।
তারেক বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। একজন সুখী মানুষের হাসি। দেখতে ভাল লাগে।
তুমি মনে হয় খুব খুশি?
তা বলতে পারেন। আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে আপা?
বুঝতে পারছি না।
শুধু শুধু বঝুলিয়ে রাখবেন না। দি আরলিয়ার দি বেটার।
বিয়ে করার পর এ রকম মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ তা হচ্ছে।
বিয়ের ব্যাপারটা তাহলে খুব খারাপ না?
তারেক মৃদু হাসল। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হল মামুন কী তার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? কী করছে সে এখন গ্রামে? একটা চিঠি লিখবে নাকি? চিঠি লেখার ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রচুর কাজ জমে আছে।
উকিল খুব ব্যস্ত
শওকত সাহেব সকাল থেকে বসে আছেন। উকিল খুব ব্যস্ত, সময় দিতে পারছেন না। বাকের শওকত সাহেবের পাশেই বসে আছে। মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট টেনে আসছে। একবার মুহুরি বলে এল আমাদের একটা কাজ আছে ভাই, কাইন্ডলি একটু দেখেন না। মুহুরি তাকে পাত্তাই দিল না। বাকের একবার ভাবল গরম দেখাবে। কিন্তু জায়গা খারাপ, গরম দেখানো ঠিক হবে না। ডাক্তার এবং উকিল। এই দুজায়গায় গরম দেখানো যায় না।
মামা, চা খাবেন?
শওকত সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।
চলুন গলাটা ভিজিয়ে আসি, দেরি হবে মনে হয়। মারাত্মক উকিল। ভিড়টা কেমন দেখলেন। বিকালের আগে চান্স পাওয়া যাবে না।
শওকত সাহেব চা খেতে গেলেন না। একা একা বসে রইলেন। তার খুব-একটা খারাপ ও লাগছে না। এমনিতেও তো বসেই থাকতেন। অফিস-টফিসের ঝামেলা তো আর নেই। অবশ্যি গতকাল অফিসে গিয়েছিলেন। কোনো কাজের যাওয়া না, এমনি হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হওয়া একুশ বছরের অভ্যাস চট করে ছাড়া মুশকিল। তাকে দেখে সাধারণ ভাবে একটা মৃদু উত্তেজনা হল। শমসের আলি হঠাৎ খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন আরে শওকত ভাই যে, আসেন আসেন। চেঁচানোটা এত উঁচু স্বরে হল যে অফিসের সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
কোনো কাজে এসেছেন নাকি?
নাহ। ‘কাজ থাকলে বলেন। এতদিনের সম্পর্ক এক কথাম শেষ কবে দিলেন। এটা একটা কথা হল? শমসের আলি জোর করে তাকে কান্টিনে নিয়ে গেলেন। হঠাৎ করে এই লোকটির এরকম দরদী হয়ে ওঠার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হল না।
তারপর বলেন মামলার তদ্বির কেমন চালাচ্ছেন?
চালাচ্ছি।
ঢিল দেবেন না। একটু ও ঢিল দেবেন না। নেন সিগারেট নেন।
শওকত সাহেব সিগারেট নিলেন। শমসের অ্যালি গলা অনেকখানি নিচু করে বললেন ভেতরের খবর, দেই একটা, সাদেক সাহেবের বিবরুদ্ধে মামলা উইথড্র করা হচ্ছে। আগে তে{ দুজনের বিরুদ্ধে চার্জ ছিল। এখন শুধু আপনার বিবরুদ্ধে।
তাই নাকি?
গুজবটা এ রকমই; গত মঙ্গলবারে সাদেক সাহেব অফিসে এসেছিলেন খুব হাসি হাসি মুখ। বিপদ আসে গবিবোর উপরে, বড় ই-কাতলা পার পেয়ে যায়।
শওকত সাহেব কিছু বললেন না। শমসের আলি নিচু গলায় কথা চালিয়ে যেতে লাগলেন। একজনকে উইথড্র করা মানে কেইস দুর্বল করা। চোখ বন্ধ করে ঘুমান, খালাস পেয়ে যাবেন। শুধু খালাস না। চাকরি ও ফেরত পাবেন। নাইন্টি নাইন পারসেন্ট গেরান্টি।
শওকত সাহেব প্রায় তিন ঘণ্টার মত সমযঃ বিন! কারণে অফিসে বসে ক{ট1লেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন সবাই খুব অস্বস্তি বোধ করছে, তবু তার চলে যেতে ইচেছু করছিল না;
তাঁর চেয়ারে নতুন একটি ছেলে এসেছে। প্রথম চাকরিতে ঢুকেছে বোধ হয়। কিছুই জানে না। বার বার চেয়ার ছেড়ে উঠে অন্যদের জিজ্ঞেস করছে। এইসব অল্প বয়সী ছোকড়া দিয়ে কাজ হয়? ফাইলিং শিখতেই এক বছর লাগবে।
উকিল সাহেবের কাছে তাদের ডাক পড়ল একটার দিকে। উকিল সাহেব টিফিন-ক্যারিয়ার খুলে আলু ভাজা এবং পরোটা খাচ্ছেন। এত নামী ডাকি একজন মানুষ আলুভাজা এবং পরোটা দিয়ে লাঞ্চ খায় শওকত সাহেবের ধারণা ছিল না। উকিল সাহেব দরজা গলায় বললেন বসেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বাকের হাত কচলে বলল, স্যার ভাল আছেন?
ভালই আছি।
আমাদের কেউসটা দেখেছেন?
হ্যাঁ দেখলাম। কনভিকসন হবে না। নিশ্চিন্ত থাকেন। এই কেইসে যদি আমার ক্লায়েন্টের কনভিকসন হয় তাহলে তো আমাকে ওকালতি ছেড়ে কাঠমিস্ত্রি হতে হবে। হা হা হা।
উকিল সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাকেরও হাসল। সে মুগ্ধ। শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বলল, চাকরি ফিরে পাব?
কনভিকসন না হলে নিশ্চয়ই ফিরে পাবেন। কনভিকসন না হওয়ার মানে হল আপনি অপরাধী নন। যে অপরাধী না তার চাকরি থাকবে না কেন? তবে ওলা যদি কোর্টে না এসে ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন নিত, তাহলে চাকরি থাকত না। ওরা সেটা নেয়নি। কোর্টে এসেছে। আপনার জন্যে শাপে বর হয়েছে। কোনো রকম দুঃশ্চিন্তা করবেন না। ভরসা রাখেন আমার ওপর।
বাকের দাঁত বের করে বলল, আপনার ওপরই স্যার ভরসা। নব্বই পারসেন্ট ভরসা আপনার ওপর। আর দশ পারসেন্ট আল্লার ওপর।
উকিল সাহেব বাকেরের কথা পছন্দ করলেন বলেই মনে হয়। তিনি তার পান খাওয়া কালো কালো দাঁত বের করে হো হো করে হাসতে লাগলেন। যেন খুব-একটা মজার কথা।
বকুল অনেকদিন পর টিনা ভাবীর বাসায় এসেছে। আড়াইটা বাজে। বেড়াতে আসার মত সময় নয়। কিন্তু টিনা ভাবীর বাসায় তার অসময়ে আসতেই ভাল লাগে। বকুল কড়া নেড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। দরজা খুলল এক অপরিচিত মেয়ে। টিনা ভাবীর বোন হবে। তার মত দেখতে।
টিনা ভাবী আছে?
আছে। ঘুমাচ্ছে।
বকুল সরাসরি শোবার ঘরে ঢুকে গেল। টিনা ঘুমাচ্ছিল না। শেষ পর্যায়ে এসে সে খুব কাহিল। হয়ে পড়েছে। চিৎ হয়ে ছাড়া ঘুমুতে পারে না। কাত হয়ে শুলেই মনে হয় পেট শরীর থেকে খসে আসবো। সে বিরক্ত স্বরে বলল, বকুল তুই কী মনে করে?
কেমন আছ ভাবী?
জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগে না? এত দিন পর তুই কী মনে করে এলি?
আসতে ইচ্ছা করছিল না ভাবী। কোথাও যাই না। আমি স্কুলেও যাই না।
তোব বাবা দোষ করেছে, তুই তো করিসনি?
বাবা কিছু করেনি।
তোদের আচার-আচরণে তো এরকম মনে হয় না। ঐ দিন বাবু যাচ্ছিল বাসার সামনে দিয়ে। আমি এত ডাকলাম, সে ফিরে ও তাকাল না। এ রকম ভাব করল যেন শুনতে পায়নি।
বকুল প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, তোমার পেট তো ভাবী হিমালয় পর্বতের মত হয়ে গেছে।
তা হয়েছে। আগে ভেবেছিলাম যমজ এখন মনে হচ্ছে। যমজ না, তিনজন বাস করছে। তিন বাচ্চাকে কী বলে ত্রিমজ?
বকুল খিলখিল কবে হেসে ফেলল। বহুদিন এমন প্ৰাণ খুলে সে হাসেনি। সে সন্ধ্যা পর্যন্ত টিনা ভাবীর সঙ্গে থাকল। বাচ্চাদের জন্যে কাঁথা বানানো হল খানিকক্ষণ। খানিকক্ষণ ছাদে বসে গল্প হল। তেঁতুল এবং কাঁচা কলার ভর্তা বানিয়ে মহানন্দে খাওয়া হল। এ বড় সুখের সময়।
টিনা একসময় বলল, তুই একবার আমার সঙ্গে সারাবাত থাকবি। রাত জেগে গল্প করব।
কী গল্প?
কিছু কিছু গল্প রাতেই করতে হয়; সেই সব গল্প।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বাড়ি ফেরার আগে বকুল হঠাৎ নিচু স্বাবে বলল। আচ্ছা ভাবী, যদি কোনো মেয়ের কোনো ছেলেকে ভাল লাগে তাহলে তার কী করা উচিত? ধর ছেলেটাব মেয়েটাকে ভাল লাগছে না। শুধু মেয়েটারই লাগছে।
টিনা বেশ কিছু সময। চুপ চাপ থেকে বলল মেয়েটা যদি তোর মত সুন্দরী হয় তাহলে তার উচিত এক’দিন ভাল লাগার ব্যাপারটি ছেলেটিকে বলা;
আর যদি আসুন্দধ হয়?
টিনা জবাব দিল না। সহজ ভাবেই অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এল।
তোর বিয়ের কী হল?
কিছু হয়নি। এর জন্যে কী তোর মন খারাপ?
নাহ।
বকুল বাড়ি ফিরল মন খারাপ কবে। যদিও মন খারাপ করার মত কিছুই ঘটেনি সেখানে।
বাবু আজি স্কুলে যায়নি।
অথচ সকাল বেলা বই-খাতা নিয়ে বের হয়েছে। স্কুলের গোট পর্যন্ত গিয়ে নান্টুকে বলল আমার মাথা ধরেছে, আজ যাব না। অথচ তার মাথা ধরেনি।
সে অন্যমনস্কভাবে এদিক-ওদিক খানিকক্ষণ ঘুরল। স্কুলের লাগোয়া মিউনিসিপ্যালিটির একটি শিশু পার্ক আছে। সেখানে বসে রইল একা একা। এখান থেকে স্কুলের ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হবার ঘণ্টা শুনে সে পার্ক থেকে বেরুল।
রাস্তার পাশে একজন বুড়ো মানুষ ম্যাজিক দেখিয়ে নিম টুথ পাউডার বিক্রি করছিল। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখল। পুরনো ধরনের ম্যাজিক। চারটা হরতনের বিবি চারটা টেক্কা হয়ে যায়। দড়ি মাঝখানে কেটে রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখার পর সেই দড়ি জোড়া লেগে যায়। এই সব হাবিজাবি। বুড়োটা যখন বলল বাচ্চা লোগ তালি লাগাও। তখন সে চলে এল। ছেলে-বুড়ো সবাই মহানন্দে তালি দিচ্ছে, তার তালি দিতে ইচ্ছা করছে না।
হঠাৎ করে তার মন খারাপ লাগছে। বাবুর ইচ্ছা করল হেঁটে হেঁটে অনেক দূরে কোথাও চলে যায়। দূরের সেই অচেনা দেশে থাকবে শুধু অপরিচিত মানুষ। কেউ তাকে চিনবে না। সেও চিনবে না। কাউকে। কেউ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্ত্রীর মত জিজ্ঞেস করবে না তোমাদের সংসার এখন কে চালাচ্ছে বাবু? কিংবা আলমের বাবার মত কেউ বলবে না তোমরা নাকি এই বাসা বদলি করছ? সত্যি নাকি?
বাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল বলে, আমরা এ বাড়ি ছাড়লে আপনার কী? কিন্তু সে কিছু বলেনি। সে মুনা আপার মত না। কারো মুখের ওপর সে কথা বলতে পারে না। শুধু চাপা একটা রাগ হয়। রাগের জন্যে মাথা ধরে যায়। প্রথম দিকে অল্প অল্প ধরে, তারপর যন্ত্রণাটা বাড়তে থাকে। ধ্বক ধ্বক শব্দ হয়ে মাথায়। পুলের উপর ট্রেন গেলে যে রকম শব্দ হয় সে রকম শব্দ।
ভাল লাগে না, কিছু ভাল লাগে না। সেদিন ক্লাসের ইরাজুদিন স্যার হঠাৎ বললেন এই তোর বাবা নাকি জেল হাজতে, সত্যি নাকি? বাবুর কান্না এসে যাচ্ছিল, সে বহু কষ্টে কান্না সামলাল। স্যার আবার বললেন সত্যি নাকি রে? বাবু চাপা স্বরে বলল, সত্যি না স্যার। বাবুদের ক্লাস ক্যাপ্টেন বলল, মামলা চলছে স্যার। রায় হয় নাই। পড়া বাদ দিয়ে ইরাজুদ্দিন স্যার মামলার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠলেন এবং সবশেষে অন্য সবার মত বললেন, সংসার চলছে কী ভাবে?
বাবু মনে মনে বলেছিল, আমাদের সংসার যে ভাবেই চলুক তাতে আপনার কী স্যার? আপনি কেন সবার সামনে এইসব কথা বলবেন? কেন আপনি অন্য রকম ভাবে তাকাবেন? কেন আমার বাবার নামে আজেবাজে কথা বলবেন?
কেউ অবশ্যি তার মনের কথা শুনতে পেল না। ভাগ্যিস কেউ মনের কথা টের পায় না। এক সময় ইরাজুদিন স্যার সমাজ পাঠ পড়াতে শুরু করলেন। সে পড়া বাবুর কানে ঢুকল না। তার মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। এবং এত দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে যে বাবুর মনে হচ্ছে এই ক্লাস শেষ হবার আগেই মারা যাবে।
সেটা খুব-একটা খারাপ হবে না বোধ হয়। মরার কথা মনে হলেই আগে তাঁর ভয় লগত। এখন সে রকম লাগে না।
কড়া রোদ উঠেছে। কিন্তু বাতাস ঠাণ্ডা। বাবু উদ্দেশ্যহীন ভাবে এগোতে লাগল। আজ প্রথম যে সে এ রকম করেছে তা না। আগেও কয়েকবার সে স্কুল ফাকি দিয়ে হেটে হেটে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছে। একবার তো লালবাগ কেল্লার কাছে এসে পথ; হারিয়ে ফেলল। যা ভয় লেগেছিল। ছেলে ধরার মত দেখতে একটা লোক তার পিছু পিছু আসছিল। আজ অবশ্যি পিছু পিছু কেউ আসছে না। সকালবেলা সবাই নিজের কার্জ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিকাল বেলার দিকে এবং কম একা একা হাঁটলে কম হলেও দুতিনজন লোক জিজ্ঞেস করবে, কী খোকা কোথায্য যাচ্ছি? আজ এখনো কেউ সে রকম কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
শাহবাগের কাছে এসে বাবু দেখল। বড় মামা হকারের কাছ থেকে পত্রিকা। কিনছেন। সে প্রত উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। তাকে দেখলেই বড় মামা এক লক্ষ প্রশ্ন করবেন। শুধু প্রশ্ন না, এমন কথা বলবেন যা শোনা মাত্রই মাথা ধরে যাবে।
বড় মামাকে সে কোনোদিনই পছন্দ করেনি। মুনা আপার সঙ্গে গণ্ডগোলটার পর সে ঠিক করে রেখেছে, কোনোদিন বড় মামার সঙ্গে সে কথা বলবে না। মাঝে গেলেও না।
বড় মামার সঙ্গে মুনা আপার গণ্ডগোলটার প্রথম অংশ বাবু দেখতে পায়নি। সে গিয়েছিল বিসকিট, চানাচুর কিনতে মামা এসেছেন, তাকে শুধু চা তো দেয়া যায় না। মামা অবশ্যি এসব কিছুই মুখে দেবেন না। চায়ের কাঁপে তিন চারটা চুমুক দিয়ে উঠে পড়বেন, তবু তাকে শুধু চা দেয়া যাবে না।
বাবু বিসকিটের ঠোঙা নিয়ে ঘরে ঢুকেই শোনে বড় মামা চিবিয়ে চিবিয়ে বলছেন, উকিলটুকিল সব তুমিই ঠিক করেছ? মুনা আপা বলল হ্যাঁ।
স্ত্রী-বুদ্ধিতে সংসার চলছে এখন?
কী করবে। মামা, পুরুষ-বুদ্ধির কাউকে তো পাওয়া গেল না। কেউ তো সাড়া শব্দ করল না।
সাড়া শব্দ করবে। কী ভাবে? কেউ কী কখনো এসেছে আমার কাছে?
আপনার কাছে যেত হবে কেন মামা? আপনার তো নিজেরই আসা উচিত—
উচিত-অনুচিত আমার শিখতে হবে তোমার কাছ থেকে?
শিখতেই যে হবে এমন কোনো কথা নেই, আপনার শিখতে ইচ্ছে না হলে শিখবেন না।
মুখ সামলে কথা বল।
আমার সঙ্গে এমন চিৎকার করে কথা বলবেন না। আশপাশে লোকজন আছে, ওরা কী মনে করবে?
মামা রেগে অস্থির হয়ে এমন সব কথা বলতে লাগলেন যে, বাবুর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ধরে গেল। বকুল কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল বড় মামা, ছিঃ ছিঃ আপনি মুনা আপাকে এসব কী বলছেন? বড় মামা কাঁপতে কাঁপিতে বললেন ঠিকই বলেছি। একটা কথাও ভুল বলিনি। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্শক রাখি না। এই সব কারণে।
সেই রাতটা যে কী খারাপ কেটেছে বাবুর। মুনা আপার জন্যে এমন কষ্ট হয়েছে। মনে হয়েছে। মুনা আপনাকে জড়িয়ে ধরে সে খানিকক্ষণ কাব্দে। মুনা আপ অবশ্যি খুব শক্ত মেয়ে। মা যখন বললেন কিছু মনে করিস না মুনা, রাগের সময় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। তখন মুনা। আপা বেশ সহজ ভাবেই বলেছে এসব আমি পাত্তা দেই না। যার যা ইচ্ছা বলুক।
মুনা আপা যে এসব জিনিস একেবারেই পাত্তা দেয় না, তাও ঠিক না। গভীর রাতে বাবু বাথরুমে যাবার জন্যে জেগে উঠে দেখে–মুনা আপা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে। অন্ধকারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবু বাবু পরিষ্কার বুঝল তার গাল ভেজা।
মুনা আপা তাকে দেখে বলল কী, বাথরুম?
হু।
এক রাতে তিনবার চারবার বাথরুমে যাস, তোর ডায়াবেটিস নাকি?
বলতে বলতেই মুনা আপা শব্দ করে হাসল। কী সহজ স্বাভাবিক আচরণ। যেন তার কিছুই হয়নি। এমনি এমনি বারান্দায় বসে আছে। বাবু ভয়ে বলল, তোমার মন খারাপ আপা?
না। মন খারাপ হলে বারান্দায় বসে থাকব। কেন? মন ভাল করার জন্যে বারান্দায় কিছু আছে নাকি? ঘুম আসছে না। তাই বসে আছি।
ঘুম আসছে না কেন?
কী মুশকিল, ঘুম আসছে না কেন সেটা আমি কী করে বলব? আমি কী ডাক্তার?
দুপুর বারোটার দিকে বারু মগবাজার চৌরাস্তায় উপস্থিত হল। আর হাঁটতে ভাল লাগছে না। এখন আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া যেতে পারে। যে পথে এসেছে সেই পথেই যাবে না। অন্য কোনো পথ ধরবে এটা ঠিক করতে বাবুর কিছু সময় কাটল। চেনা পথ ধরে ফেরাই ভাল। কিন্তু নান্টু সব সময় বলে যে পথে আসা হয়েছে সে পথে ফিরে যেতে নেই। সে পথে ফিরলে বিপদ হয়। বাবু কী করবে বুঝতে পারছে না। ঠিক তখন সে একটি অবিশ্বাসা দৃশ্য দেখল। তার বাবা আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম কিনছেন। নিজের জন্যেই কিনছেন নাকি? বাবুর উচিত পালিয়ে যাওয়া, কিন্তু সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রইল। বাবা একবার তাকালেন তার দিকে। তার চোখে-মুখে চিনতে পারার কোনো লক্ষণ ফুটে উঠল না। তিনি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মত লাল রঙের আইসক্রিমটি কামড়ে কামড়ে খেতে লাগলেন। তার বগলে একটি ছাতা। প্রচণ্ড রোদেও ছাতা না খুলে নিশ্চয়ই প্রচুর হাঁটাহাঁটি করেছেন। ঘামে ভেজা মুখ হয়েছে আয়নার মত চকচকে। তিনি আইসক্রিম হাতে রাস্তা পার হলেন। রাস্তা পার হওয়াও শিশুদের মত। কোনো দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ ছুটলেন। একজন বয়স্ক মানুষ শিশুদের মত এতগুলো কাণ্ড একসঙ্গে কিভাবে করে?
বাবু নিজের অজান্তেই ডাকল, বাবা।
শওকত সাহেব থমকে দাঁড়ালেন। সামনেই দাঁড়িয়ে, তবু তিনি যেন তাকে চিনতে পারছেন R
তুই এখানে!
বাবু জবাব দিল না। শওকত সাহেব জবাবের জন্য অপেক্ষাও করলেন না। সহজ ভাবে বললেন, আইসক্রিম খাবি?
না।
হঠাৎ তৃষ্ণা লেগে গেল।
যেন তিনি ছেলের কাছে কৈফিয়ত দিচ্ছেন।
খা একটা আইসক্রিম। এ্যাই, এ্যাই আইসক্রিমওয়ালা।
বাবুকে আইসক্রিম নিতে হল।
আমাদের সময় লালগুলি দুপয়সা দাম ছিল, দুধ মালাই একটা ছিল এক আনা করে। চল বাসায় যাই। হেঁটে যেতে পারবি, না রিকশা নেব?
হাঁটতে পারব।
রিকশার চেয়ে হাঁটাটাই আরাম। রিকশায় অ্যাকসিডেন্টের ভয়। পেছন থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিলে অবস্থা কাহিল।
বাবু সারাক্ষণই ভাবছিল এই বুঝি বাবা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন, এইখানে কী করছিলি? স্কুলে যাসনি কেন? কিন্তু শওকত সাহেব কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বরং তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল ছেলেকে হঠাৎ রাস্তায় পেয়ে তিনি বেশ খুশি।
রোদ লাগছে নাকি বাবু?
না!
রোদ লাগলে বলিস, সঙ্গে ছাতা আছে। তবে শরীরে রোদ লোগা ভাল। ভিটামিন ডি আছে। এতে শরীরের হাডিডর খুব পুষ্টি হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এই যে ভিখারিগুলো দেখছিস? সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখ অসুখ-বিসুখ হয় না।
বাবু অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকাল, এমন অদ্ভুত ভাবে কথাবার্তা বলছেন কেন?
আমি সকালবেলা ঘর থেকে বের হয়েই হাঁটা শুরু করি। দুপুর পর্যন্ত হাঁটি আর শরীরে রোদ লাগাই। খুব উপকারী।
বাবু কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। শওকত সাহেব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, জেলে কত দিনের জন্যে নিয়ে রাখে কোনো ঠিক আছে? তখন রোদও পাওয়া যাবে না, হাঁটাহাঁটিও করা যাবে না।
শওকত সাহেব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বাবুর হঠাৎ মনে হল বাবা শুধু কথাবার্তাতেই না দেখতেও কেমন যেন অচেনা মানুষের মত হয়ে গেছেন। হাঁটছেন কেমন কঁজো হয়ে। অস্বাভাবিক লম্বা লম্বা পা ফেলছেন।
শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল ইয়াদ
অনেক দিন পর জলিল মিয়ার চায়ের দোকানে বাকের এসে ঢুকল। আগে রোজ সন্ধ্যায় তাদের একটা আড্ডা বসত। তিন-চার বছর ধরে ভাঙন ধরেছে। একজন একজন করে খসে পড়তে শুরু করেছে। আশফাকের মত ছেলেও বিয়ে করে মদন বলে এক জায়গায় পড়ে আছে। শ্বশুরের সঙ্গে নাকি কাঠের বিজনেস করে। এক বছরের ওপর হয়েছে তার কোনো খোঁজ নেই। নিৰ্ঘাৎ বাচ্চা বাধিয়ে ফেলেছে বাই দিস টাইম।
শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল ইয়াদ। তারও দিন শেষ। সকাল-বিকাল চাকরি করছে। ব্রিফকেস নিয়ে টু্যরে যাচ্ছে। শালা। পুরোপুরি ভেডুয়া হয়ে গেছে। দেখা হলেই আই.এ. পাস মেয়ের কথা শুরু হয়। নানান ধরনের গল্প। পরশুদিন একটি শুনল এ রকম, ইয়াদ নিউ মাকেটে গিয়ে দেখে তার সেই আই.এ. পাস একজন বান্ধবীকে নিয়ে শাড়ির দোকানে ঘুরছে। তারা যাতে ইয়াদকে চিনতে না পারে সে জন্যে সে চট করে সানগ্লাস পরে ফেলল। কিন্তু মেয়েটি ঠিকই চিনল। কী সব বলল তার বান্ধবীকে। সেই বান্ধবী তার দিকে চোখ ড্যাবি করে তাকাতে লাগল।
অসহ্য। গল্প শুনলেই ইচ্ছা করে একটা চড় বসিয়ে দিতে। ড্যাবি ড্যাবি করে তাকাচ্ছিল। ড্যাব ড্যাবি করে তাকানোর মাল হচ্ছে তুমি। শালা। ফকিরামির জায়গা পায় না।
জলিল মিয়ার চায়ের সন্টলে ইয়াদ বসে ছিল। তার গায়ে কালো কোট। গলায় লাল রঙের টাই। ক্লিন শেভড। মুখে ক্রিম ঘষেছে বোধ হয়। ভুরতুর করে গন্ধ বেরুছে। বাকেরকে দেখে সে হকচাকিয়ে গেল। বাকের অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, তুই এখানে।
আসলাম। দেখা-সাক্ষাৎ হয় না।
সাজ-পোশাক তো মাশাআল্লাহ ভালই চড়িয়েছিস।
আর বলিস কেন। ওদের বাড়ি থেকে আমাকে দেখতে আসবে। ওর এক দূর সম্পর্কের চাচারও আসার কথা। এক্স মিনিস্টার এল রহমান।
দেখতে আসবে তো তুই এখানে কেন? চায়ের দোকানে দেখতে আসবে নাকি?
বাসায় তো আর সেজোগুজে বসে থাকা যায় না। মনে করবে। ইচ্ছে করে সেজে বসে আছি। ওরা এলে রঞ্জু এসে এখান থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। ভাবটা এ রকম যেন বাইরে ছিলাম, বাসায় এসেছি।
বাকের চায়ের অর্ডার দিল। ইয়াদের কোনোদিকে দৃষ্টি নেই। সে ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। পাঁচ মিনিটের মাথায় তিনবার বলল, এত দেরি হওয়ার তো কথা না। এসে গেছে নাকি? বলে এসেছি জলিলের চায়ের দোকানে খোঁজ করতে। কোথায় না কোথায় খুঁজছে কে জানে। রঞ্জু হারামজাদা মহা বেকুব।
উত্তেজনায় ইয়াদ একটা ফাইভ ফাইভ সিগারেট উল্টোদিকে ধরিয়ে ফেলল। বাকের দেখেও কিছু বলল না। ফিল্টারের ধোঁয়া খেয়ে কেশে মরুক। বাকের উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। জলিল মিয়া বলল, বাকের ভাইকে নতুন পাত্তি দিয়া আর এক কাপ চা দেই?
না চা লাগবে না।
খান বাকের ভাই। চা এক কাপ যা দশ কাপ ও তা।
বাকের কিছু বলল না। জলিল মিয়া টেনে টেনে বলল, তারপর দেশের খবরাখবর কিছু বলেন।
বাকের বিরক্তমুখে তাকাল। জলিল মিয়ার স্টলে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ। দুই-তিন জায়গায় এই কথাগুলো ফ্রেম করে বাধানো, কিন্তু রাজনীতিতে জলিল মিয়ার নিজের খুব উৎসাহ। সে মনেপ্ৰাণে বিশ্বাস করে মাশলি ল ছাড়া এই দেশের কোনো উপায় নেই। কিন্তু এই কথাটা নিজে বলতে পারে না, অন্যের মুখে শুনতে চায়।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হইছে দেখছেন বাকের ভাই। সিভিল গভৰ্মেন্টের ক্ষমতা নাই ঠিক করার। সে পরিস্থিতি ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করা ছাড়া উপায় নাই।
বাকের তিক্ত স্বরে বলল, উপায় না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিলেই হয়! পায়ে ধরে কেউ সাধছে?
জলিল মিয়া খুব অপ্রস্তুত হয়। বাকেরের বিরক্তির কারণ ঠিক বুঝতে পারে না। সে কাউকে বিরক্ত করতে চায় না। বাকেরের কাউকে তো নয়ই।
ইয়াদ বলল, কটা বাজে দেখ তো বাকের। শালা এত দেরি করছে কেন? বাকের কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে বলল, যাই। ইয়াদ বলল, এত সকাল সকাল যাচ্ছিস কোথায়? বাস না। শালা এ তো দারুণ টেনশনের মধ্যে পড়লাম।
কাজে আছে।
তোর আবার কী কাজ?
খুব-একটা খারাপ কথা বাকেরের মুখে এসে গিয়েছিল। সে সেটা বলল না। ইয়াদ হারামজাদাটার সঙ্গে মুখ খারাপ করে কোনো ফয়াদা নেই।
রাস্তা অন্ধকার। সব কটি লাইটপোস্টের বাতি আবার চুরি হয়েছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে দুইবার বাতি চুরি গেল। চোরের উপদ্রবটা বড় বেশি হচ্ছে। বাকেরের ধারণা কাজটা করে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা। মই ফিট করে কোন চোর যাবে বালু চুরি করতে? ধরতে হবে একবার শালদের। মামদোবাজি বের করে দিতে হবে।
বাকের দেয়াশলাই বের করে ঘড়ি দেখল, ঘড়ি ঠিকই চলছে। আটটা পঁয়ত্ৰিশ। এত সকাল সকাল বাড়ি গিয়ে হবেটা কী? লাভের মধ্যে লাভ হবে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। এবং লাটসাহেব বড় ভাই মুখটাকে এমন করবে যেন ভূত দেখছে। বড় অফিসার এদের মেজাজ-মর্জিই অন্য রকম।
রাত এগারটার পর বাড়িতে যাওয়ার অনেক সুবিধা। কারো সঙ্গেই দেখা হয় না। খাবার ঢাকা দেয়া থাকে। খেয়েদেয়ে লম্বা হয়ে পড়লেই সব সমস্যার সমাধান।
সকাল দশটার দিকে ঘর থেকে বেরুলে বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা না করে দিন পার করে দেয়া যায়। অবশ্যি ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়। সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি, সেই কারণেই ভাবীর মেজাজ থাকে আকাশে। তিনি সহজ ভাবে বাকেরের সঙ্গে কোনো কথাই বলতে পারেন না। যাও বলেন এমন সব ভাষা ব্যবহার করেন যে বাকেরের প্রতিদিনই একবার বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছা! করে। সেই ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ বাকের মেয়েমানুষের কথার কখনোই তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। মেয়ে মানুষের কাজই হচ্ছে বেশি কথা বলা এবং ফালতু কথা বলা। ফালতু কথাকে এমন গুরুত্ব দিলে চলে?
বাকের সিগারেট ধরাল। প্যাকেটে আর তিনটা সিগারেট আছে, রাত কাটবে না। ঘুম ভাঙলেই তার সিগারেটের তৃষ্ণা হয়। কিন্তু এখন আবার হেঁটে হেঁটে মোড় পর্যন্ত যেতে ইচ্ছা করছে না।
ফজলু সাহেবের বাসার সামনে একটা ছোটখাটো ভিড়। বাকের এগিয়ে গেল। বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েলি গলায় কান্নার শব্দ।
কী হয়েছে?
কী হয়েছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ফজলু সাহেবের পোয়াতী স্ত্রী নাকি খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। ফজলু সাহেব গিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স আনতে। বাকেরের বিরক্তির সীমা রইল না। ধামসী এক মহিলা খাট থেকে পড়ে যাবে কেন? কচি খুকু তো না। অ্যাম্বুলেন্স আনতে গেছে মানে? আনতে গেলেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসে নাকি? চলে এলে তো কাজই হত। হাসপাতালে সত্যি সত্যি নিতে হলে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাতে করেই নিতে হবে।
বাকের ছুটিল বেবিটেক্সি ধরে আনতে। এই বেবিটেক্সিতেই টিনার যমজ ছেলে হল।
বাকের দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, বেকুব মেয়েছেলেদের নিয়ে মুসিবত।
বাচ্চা কার মত হয়েছে বকুল? আমার মত না তো ভাইয়ের মত?
কারো মতই না।
বকুল উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে রইল টিনার দিকে। টিনা ভাবী কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে। কী চমৎকার মায়া মায়া চেহারা হয়েছে টিনা ভাবীর।
দু’জনকে সামলাবে কী ভাবে?
টিনা হাসতে হাসতে বলল, একটাকে তুই নিয়ে যা। অরুণকে নিয়ে যা। অরুণ বড্ড জ্বালায়।
অরুণ কোনটি?
বাঁ পাশেরটি।
দু’জনই তো এক রকম।
দূর-দূর এক রকম হবে কেন? চেহারা দুরকম, কাঁদে দুরকম করে। ওদের গায়ের গন্ধও দুরকম।
কী যে তুমি বল ভাবী।
ঠিকই বলি। নে তুই অরুণকে নিয়ে যা।
সত্যি সত্যি। কিন্তু নিয়ে যাব।
নিয়ে যাবার জন্যেই তো বললাম। তুই কী ভাবছিস ঠাট্টা করছি?
বকুল খুব সাবধানে একজনকে কোলে তুলল! কী চমৎকার একটা ঘ্রাণ আসছে গা থেকে। বাসি শিউলী ফুলের ঘ্রাণ এত মায়া লাগে কেন? বকুলের চোখে পানি আসার উপক্রম হল।
তোর ভাই যমজ বাচ্চা হওয়া উপলক্ষে আমাকে যমজ শাড়ি দিয়েছে। বাচ্চা-কাচ্চা হলে বউকে শাড়ি দিতে হয় জানিস তো?
না। জানি না।
দিতে হয়। কষ্ট করে বাচ্চা আনে। সেই জন্যে দেয়া। দেখ তো শাড়ি দুটো কেমন।
দু’টি একই রকম শাড়ি। নীল জমিনের ওপর সাদা ফুল।
খুব সুন্দর ভাবী, তোমাকে দারুণ মানাবে।
একটা শাড়ি তুই নিবি?
বকুল বিব্রত স্বরে বলল, আমি নেব কেন? কষ্ট করবে তুমি, শাড়ি নেব আমি?
দুটাই তো আর নিচ্ছিস না। একটা নিচ্ছিস।
না ভাবী প্লিজ।
না নিলে আমি খুব রাগ করব, ক’দিন কথা বলব না তোর সাথে। তোকে দেবার জন্যেই তোর ভাইকে বলে আমি দু’টি শাড়ি আনিয়েছি। শুধু শাড়ি না, ব্লাউজ-পেটিকোট সবই আছে। যা, কাপড় বদলে আয়।
বকুলকে শাড়ি পরে আসতে হল। টিনা দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে বলল, এখন যা ঐ ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে পেপসি খেয়ে আয়।
বকুলের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। টিনা বিরক্ত স্বরে বলল তুই কী ভাবছিস কেউ কিছু টের পায় না। সবাই সব কিছু টের পায়। তোর ভাইয়ের কাছে শুনলাম। সে দেখেছে তুই ঐ ডাক্তার ছোকরার সঙ্গে বসে কোক না পেপসি কি যেন খাচ্ছিস, আর খুব হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করছিস।
বকুলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। এসব কি বলছে ভাবী। কিন্তু টিনা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চার নাভিতে বরিক পাউডার দিতে দিতে বলল, কিছু মানুষই আছে যারা শুধু অল্প বয়সী মেয়েদের সঙ্গে ছোক ছোক করতে চায়। প্রথমে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, তারপর গায়ে-টায়ে হাত দেয়।
কি যে তুমি বল ভাবী।
ঠিকই বলি। ঘাস খেয়ে তো বড় হইনি।
তুমি যা ভাবিছ সে সব কিছু না।
প্রথম প্রথম এ রকম মনে হবে। তারপর দেখবি এক’দিন হঠাৎ হাতের সঙ্গে হাত লেগে যাবে। যেন একটা অ্যাকসিডেন্ট। তারপর এক’দিন আশপাশে লোকজন না থাকলে জড়িয়ে ধরবে। চুমু খাবে।
কি যা তা বলছ?
ঠিকই বলছি। না জেনে বলছি?
ওনার সম্পকে এরকম বলাটা ঠিক না। সব মানুষ তো এক রকম নয়।
সব মানুষই এক রকম। সবারই দুটো করে চোখ, দুটো কান, একটা নাক। খবরদার আর কোনুন। এখানে যাবি না। দরকার হয় সে আসবে, তুই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরারি।
ছিঃ।
এত ছিঃ করতে হবে না। যা বলছি মনে রাখিস।
খুব মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল বকুল। নতুন শাড়ি পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসতে কেন জানি তার লজ্জা করছিল। ফার্মেসির পাশ দিয়ে আসবার সময় খুব ইচ্ছা হল একবার তাকিয়ে দেখে ডাক্তার আছেন কি না। কিন্তু কিছুতেই তাকাতে পারল না। তার কেন জানি মনে হল ডাক্তার সাহেব আছেন এবং তিনি তাকে দেখছেন অবাক হয়ে। এক্ষুণি বেরিয়ে এসে ডাকবেন–এই বকুল, এইভাবে পালিয়ে যাচ্ছ কেন?
কিন্তু কেউ ডাকল না। কেউ ডাকেনি শুধুমাত্র এই কষ্টেই তার চোখ ভিজে উঠছিল। কেন তার এ রকম হচ্ছে? এটা কি কোন অসুখী? না অন্য কিছু?
শওকত সাহেব সুন্দর শাড়ি পরা এই মেয়েটিকে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি তারই মেয়ে এটা বুঝতে সময় লাগল।
বকুল মা, কাঁদছিস কেন?
কাঁদছি না। কাদর কেন শুধু শুধু।
বকুল তাকে পেছনে ফেলে তার তার করে এগিয়ে গেল। শওকত সাহেব অনেকক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলেন একই জায়গায়। তার মেয়েটি এত বড় হয়ে গেছে। এটি কেন এতদিনেও তার চোখে পড়েনি?
কাঁদছিস কেন? পাড়ার ছেলেরা কিছু বলেছে? মেয়েটির জন্যে তার নিজের মন কেমন করতে লাগল। এদেরকে অসহায় ফেলে রেখে দীর্ঘ দিনের জন্যে তাকে জেলে ঢুকে পড়তে হবে। উকিল সাহেব যদিও বলছেন কিছুই হবে না, কিন্তু তিনি জানেন ব্যাটা মিথ্যা কথা বলছে। উকিলরা সত্যি কথা বলতে পারে না।
শওকত সাহেব মাথা নিচু করে বুড়ো মানুষের মত হাঁটতে লাগলেন।
মামলার আবার একটি ডেট পড়েছে। এ রকম কি অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকবে? উকিল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, একেকটা মামলা চার-পাঁচ বছর ধরে ঝোলে। ঝোলাটাই ভাল। যত ঝোলে, মামলা তত দুর্বল হতে থাকে। সামনের মাসে আসেন দেখা যাবে।
শওকত সাহেবকে বেশ খুশি খুশি মনে হয়। তিনি যেন সমস্ত ব্যাপারটাকেই এড়াতে চাইছেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, চল রে মুনা বাড়ি যাই।
আমি যাব না, তুমি যাও। বাকের ভাইকে নিয়ে যাও।
তুই এখন কি করবি?
অফিসে যাব।
তিনটার সময় অফিসে গিয়ে কি কারবি?
আমার কাজ আছে।
কি কাজ?
আছে একটা কাজ। রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে পারব না।
মুনা রিকশায় উঠে বসল। অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল। লোকজন বেশির ভাগই বাড়ি চলে গেছে। যারা যায়নি তারা টেবিলপত্র গুছিয়ে ফেলছে। পাল বাবু ছিলেন। তিনি হাসি মুখে বললেন, আপনার কাজ হয়েছে। লোন স্যাংশন হয়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে এলে চেক পেয়ে যেতেন। অবশ্যি আজ পাওয়া আর কাল পাওয়া সোম। এখন তো আর ভাঙাতে পারছেন না।
এটা একটা ভাল খবর। টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু মুনা খুশি হতে পারছে না। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। সামলানো যাচ্ছে না। রিকশা ভাড়াতেই অনেকগুলি টাকা চলে যাচ্ছে। সামনে কি অবস্থা হবে কে জানে। পাল বাবু বললেন, বিয়ে উপলক্ষে লোন নিলেন নাকি?
না।
না কেন? ঐ ঝামেলাটা চুকিয়ে ফেলুন।
দেখি।
উঠছেন নাকি? কোন দিকে যাবেন? আসুন। এগিয়ে দেই! এই টাইমে রিকশা পাওয়া মুশকিল।
কোথায় যাবে মুনা মনস্থির করতে পারল না। বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। মামুনের খোঁজে যাওয়াও অর্থহীন। সে নিশ্চয়ই ফেরেনি। আর ফিরলেই কি। যে লোক দীর্ঘ দেড় মাস কোনো রকম খবর না দিয়ে ডুব দিয়ে থাকতে পারে তার কাছে বার বার যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি? তারেকের বাসার ঠিকানা জানলে সেখানে যাওয়া যেত। দেখা যেত কেমন মেয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু ওর ঠিকানা জানা নেই। কাঁচা বাজারের দিকে গেলে কেমন হয়, বেশ কিছুদিন ধরে বাজার হচ্ছে না। ডাল ভাত আর ডিম খেতে খেমে অরুচি ধরে গেছে। মুনা ব্যাগ খুলে টাকা গুণল। বাজার করার মত টাকা নেই। তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে তার কোথাও যাবার জায়গা নেই। মুনা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।
দরজায় খুটাখুটি শব্দ হচ্ছে। মামুন অবেলায় ঘুমিয়ে ছিল। শীত্বের শুরুতে বিকেল বেলার ঘুম অন্য রকম একটা আলস্য এনে দেয় শরীরে। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না।
কে?
আমি–আমি মুনা।
মামুন দরজা খুলে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাল। মুনার চোখ-মুখ কঠিন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে রোগে আছে।
এস, ভেতরে এস। কেমন আছ বল?
মুনা শুকনো গলায় বলল, এসেছ কবে?
গতকাল। আজ ঠিক করে রেখেছিলাম যাব তোমার ওখানে। ভালই হয়েছে। দেখা হল। রোগা হয়ে গেছ মুনা।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন বলল, বুঝতে পারছি খুব রেগে আছ।
রাগব কেন?
এই যে ডুব দিলাম দেড় মাস। এদিকে তোমার এমন দুঃসময়।
আমার দুঃসময়ের সাথে তোমার কি সম্পার্ক? আমি কি তোমাকে বলেছি আমার দুঃসময়ে আমার হাত ধরে বসে থাকতে?
জাস্ট এ মিনিট। আমি মুখ ধুয়ে চায়ের কথাটা বলে আসি। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মুনা লক্ষ্য করল মামুন বেশ সহজ স্বাভাবিক। দীর্ঘ দিন যে ডুব মেরে ছিল তার জন্যে তার বিন্দুমাত্র লজ্জা বোধ নেই। যেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া তার স্বাস্থ্যও ভাল হয়েছে। দেখেই মনে হয় সে সুখেই ছিল। সুখী সুখী চেহারা।
শুধু চা নয়। চায়ের সঙ্গে পিয়াজু এবং বেগুনী। মামুন খুব উৎসাহের সঙ্গে খেতে শুরু করল। মুনা বলল, এত দিন যে ডুব দিয়েছিলে চাকরির অসুবিধা হয়নি?র
আরে দূর চাকরি। মাস্টারি করে কিছু হয় নাকি? চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।
ছেড়ে দিয়েছি মানে?
ছেড়ে দিয়েছি মানে ছেড়ে দিয়েছি। চাকরি করব না। ব্যবসা করব। গ্রামের বাড়িতে একটা অয়েল মিল দিচ্ছি। লোনের জন্যে অ্যাপ্লাই করব। সরিষা ভেঙে তেল করা হবে। ধান, গম, মসলা, সব ভাঙানো যাবে।
এই সব নিয়েই ব্যস্ত ছিলে?
রাইট। লোনও পেয়ে যাব।
থাকতে পারবে গ্রামের বাড়িতে?
পারব না কেন? ফাইন বাড়ি আমাদের। তুমি দেখলে মুগ্ধ হবে।
মুনা লক্ষ্য করল মামুন একবারও জিজ্ঞেস করছে না, তোমাদের খবর কি? তোমাদের মামলার কি অবস্থা? মুনা উঠে দাঁড়াল, আমি যাই। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
মামুন হাত ধরে তাকে টেনে বসাল। অবাক হয়ে বলল, সন্ধ্যা হয়েছে তো কি হয়েছে, আমি আছি কি জন্যে? বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসব। এবং রাতে খাব তোমাদের ওখানে। বুঝতে পারছি তুমি রাগ করে আছে আমার ওপর। রাগ ভাঙানোর সুযোগ দাও। না তাও দেবে না।
চুপ করে ছিলে কেন?
নতুন এই আইডিয়া নিয়ে খুব জড়িয়ে পড়লাম। এবং ইচ্ছা করেই তোমাকে কোনো খবর দিলাম না। কারণটা হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম কোনো খবরাখবর না পেয়ে তুমি অস্থির হয়ে বাড়িতে এসে উপস্থিত হবে এবং সব কিছু দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তখন আমি বলব, না। আর ফিরে যেতে পারবে না। তোমাদের ঝামেলার কথা আমার তেমন করে মনে হয়নি। আই অ্যাম সরি। রাগ করেছ মুনা?
বলেছি তো আমি রাগ করিনি। আমি সহজে রাগ কবি না।
এই বার আমি তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। একদিনের জন্যে হলেও নিয়ে যাব। তোমার খারাপ লাগবে না, ভালই লাগবে। বাড়ি দেখেও তুমি মুগ্ধ হবে। বাড়ির সামনে বাগান করেছি। ওনলি ফর ইউ মাই ইয়ং লেড়ি। চল ওঠা যাক। বাইরে কোথাও খাব।
না।
চল না, প্লিজ। ফ্রায়েড স্পিং চিকেন। চিলি বিফ। এন্ড সুইট এন্ড সাওয়ার প্রন।
মামুন কাপড় পরতে শুরু করল। সে ধরেই নিয়েছে মুনা যাবে তার সঙ্গে। মুনা তার উল্লাসের কারণটা ঠিক ধরতে পারছে না।
তোমাদের মামলার কি অবস্থা?
ভালই।
ভালই মানে কি? উকিল ভাল দিয়েছ তো?
মুনা জবাব দিল না।
উকিল ভাল হলে খালাস করে নিয়ে আসবে, গায়ে আঁচড়ও লাগবে না। সিরিয়াস সিরিয়াস সব খুনিদের বের করে নিয়ে আসছে। এই দেশে অপরাধীদের সাজা হয় না।
মুনা শীতল স্বরে বলল, আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।
কেন?
ইচ্ছা করছে না? আমার অনেক রকম সমস্যা আছে, এখন আমি তোমার সঙ্গে বসে। ফ্রায়েড চিকেন খেতে পারব না।
ফ্রায়েড চিকেন না খেলে অন্য কিছু খাওয়া যাবে।
আমি বাসায় যাব, মাথা ধরেছে।
রিকশায় দুজনের কোনো কথা হল না। মামুন দু’একবার কথা শুরু করতে চেষ্টা করল, লাভ হল না কিছু।
মাথা খুব বেশি ধরেছে নাকি?
হুঁ।
আমার সঙ্গে গ্রামে গিয়ে থাকতে তোমার অসুবিধা হবে না তো? মুনা জবাব দিল না।
প্রথম কিছুদিন ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কি, কিছু বলছ না কেন?
বললাম তো মাথা ধরেছে। মুনা গলির মাথায় নেমে পড়ল। সহজ ভাবেই বলল, থাক তোমাকে আসতে হবে না। আমি নিজে নিজেই যেতে পারব। রাস্তার আলো আছে।
আমি সঙ্গে এলে অসুবিধা আছে?
আছে। তুমি এলেই তোমার সঙ্গে বসতে হবে, কথা বলতে হবে। রাতে খাবার দিতে হবে। আমার এখন এসব করতে ইচ্ছা করছে না। মাথা ধরেছে খুব।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক পরামর্শ আছে মুনা।
পরামর্শ পরে করা যাবে। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
মুনা লম্বা লম্বা পা ফেলে এগুতে লাগল। মামুন তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।
লতিফা ছটফট করছিলেন
লতিফা ছটফট করছিলেন সন্ধ্যা থেকেই–মুনা এসেছে? মুনা এসেছে? বকুল বিরক্ত হয়ে বলেছে এলে তো তোমাকে বলতাম মা। একশো বার এক কথা বলছ কেন?
আজ সমস্ত দিন লতিফার শরীর খারাপ গেছে। দুপুরে একবার বিছানা থেকে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে উঠল। শরীরটা একেবারেই গেছে। দুপুরে কিছুই খেতে পারেননি। বমি করে উগড়ে ফেলেছেন। সন্ধ্যাবেলা তার বুক কাঁপতে লাগল। পুরনো শ্বাস কষ্ট নয়, অন্য এক ধরনের কষ্ট। তাঁর ভয় করতে লাগল। তিনি চাপা স্বরে কয়েকবার বাবুকে ডাকলেন। কেউ এল না। হয়ত শুনতে পায়নি। কিংবা শুনেও আসছে না। আজকাল সহজে তার কাছে কেউ আসে না।
এক সময় সখিনা এসে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করল। কি অলক্ষুণে ব্যাপার। সন্ধ্যাবেলা কেউ গৃহস্থ বাড়িতে বাট দেয়? তিনি অনেকক্ষণ উঁচু গলায় বকাঝকা করলেন। তার বুকের ধরফরানি আরো বেড়ে গেল। এক সময় মনে হল ঘরের আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। চোখে বিধছে। অনেক রাতের দিকে মাঝে মাঝে এ রকম হয়। আলো হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য বেড়ে যায়। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন মুনার জন্যে। মিনিটে একবার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, দেখ তো মুনা এসেছে নাকি?
মুনা এসে তার অবস্থা দেখে বড়ই অবাক হল। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। ব্যাপার কী? মুনা উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, মামা ফেরেননি?
বাবু বলল–ফিরেছিলেন, আবার কোথায় যেন গেছেন।
মামি কি রকম করছে তোরা দেখছিস না? যা দৌড়ে ডাক্তার নিয়ে আয়।
লতিফা হাঁপাতে শুরু করলেন। ঘরের আলো এত উজ্জ্বল যে চোখ মেলে রাখা যাচ্ছে না।
মামি খুব খারাপ লাগছে?
হুঁ। তুই আমার হাত ধরে বসে থাক।
মুন্না হাত ধরে পাশে বসল। বকুল অবাক হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, লতিফা তাকালেন বকুলের দিকে। কি সুন্দর একটি মেয়ে, কে বলবে তার মত অতি সাধারণ একটি মায়ের কোলে এত সুন্দর একটি শিশু আসবে।
মুনা বলল, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে এনে কপাল মুছিয়ে দে। বকুল ছুটে গেল রান্নাঘরে। লতিফা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারিস বকুলের বিয়ে দিয়ে দিবি। এত সুন্দর মেয়ে ঘরে বেশিদিন রাখবি না। অনেক সমস্যা হবে।
ঠিক আছে দেব।
পড়াশোনা কপালে থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। তুই ওর বিয়ে দিয়ে দিবি। যত তাড়াতাড়ি পারিস।
বিয়ে দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয় নাকি মামি?
লতিফা কিছু বললেন না। বকুল মাথায় ভেজা ন্যাকড়া বুলোতে লাগল। তিনি কাঁপা গলায় বললেন–আহ ঠাণ্ডা লাগে।
ডাক্তার এল সাড়ে সাতটায়। তারও ঘণ্টা তিনেক পরে দীর্ঘ ছবছরের রোগ যন্ত্রণার অবসান হল। ডাক্তার ছেলেটি বড় অবাক হল। সে এমন ভাবে সবার দিকে তাকাতে লাগল যেন ঘটনাটি সে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হাতে এটিই কি প্রথম মৃত্যু?
কিছু কিছু ঘটনা মানুষ দ্রুত ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেই চেষ্টা সচেতন ভাবেই করা হয় এবং সে কারণেই সে লজ্জিতও বোধ করে। মৃত্যু এমন একটি ঘটনা। অতি প্রিয়জনের মনে হয় না সেই প্রিয়জন কোনো কালে আমাদের মধ্যে ছিল। কেন এ রকম করা হয়? আমাদের নিজেদেব ব্যবহারে নিজেরাই অবশ্য লজ্জিত হই, যার জন্যে প্ৰিয়জনটির একটি বড় ছবি যত্ন করে দেয়ালে টাঙানো হয়। এবং এক’দিন কেউ খুব রাগারগি করে ফ্রেমে মাকড়শার জাল, কেউ দেখছে না, ধ্যাপারটা কি?
লতিফার মৃত্যুর পর তার কোনো ছবি দেয়ালে টাঙানো হল না। তবে তার বিয়ের একটি ছবি মুনা বের করে খুব কাদাল। সেই ছবিতে তাকে দেখাচ্ছিল একটি দুষ্ট বালিকার মত। শওকত সাহেবের চোখে চশমা। কেমন ভয় পাওয়া চেহারা। ছবিটি স্টুডিওতে তোলা। সন্ট্রডিওতে তোলা সব ছবিই কেমন মূর্তি মূর্তি হয়। এই ছবিটি সে রকম নয়। প্রাণের একটা ব্যাপার আছে কোথাও। কিংবা এও হতে পারে মানুষের মৃত্যুর পর তাদের সব ছবিতে কিছু প্ৰাণ সঞ্চার হয়।
লতিফার ঘর আগের মতই আছে। মৃত মানুষদে বা ঘর দীর্ঘদিন একই রকম থাকে। সহজে সে ঘরের কোনো কিছুতে কেউ হাত দিতে চায় না। তবু ঘবটা কেমন যেন আগেবা মত থাকে না! সূক্ষ্ম। একটা পরিবর্তন হয় কোথাও। সে পরিবর্তন সূক্ষ্মণ হলেও যে-কেউ ধরতে পারে।
প্রথম রাত এই ঘরে ঘুমুতে এসে শওকত সাহেবের ভয় ভাগ করতে লাগল। লতিফার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যেই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করলেন পুবনো দিনের কথা মনে করতে। সমস্তই মনে আছে কিন্তু সে সব নিয়ে ভাবতে ভাল লাগছে না; বরং শওকত সাহেবের মনে হতে লাগল। এই ঘবে কে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুব সাবধানে পা ফেলছে। নিঃশব্দ পদচারণা! এইবার যেন বসল পাশের চেয়ারটায়। ভয় কাটাবার জন্যে তিনি শব্দ করে কাশলেন। সেই কাশির শব্দে তার নিজেরই ভয় বেড়ে গেল। তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করলেন। তখনি মনে হল মাথার উপরের ফ্যান ঘুরতে শুরু করেছে। লতিফা শীতের ব্যাতে ও ফ্যান না ছেড়ে ঘুমুতে পালিত না। সেই জন্যেই কি? ঘর অন্ধকার, তবুও সব কিছু আবছা আবছা দেখা যায়। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফানটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হা ফ্যান ঘুরছে। শওকত সাহেবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। তিনি চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন এবং স্পষ্ট শুনলেন মশারিব ওপাশে কেউ যেন মিষ্টি করে হাসল; প্রথম যৌবনে লতিফা যেমন হাসত। শওকত সাহেব ভাঙা গলায় ডাকলেন, মুনা মুনা।
মুনা সম্ভবত বারান্দায় বসে ছিল সে এসে দরজায ধাক্কা দিল, কি হয়েছে মামা? শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, কিছু না তুই যা।
মামা দরজা খোলো।
শওকত সাহেব দরজা খুলে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলেন।
কি হয়েছে?
তিনি জবাব দিলেন না। মুনা বলল, ভয় পাচ্ছ?
হুঁ।
কেন, ভয় পাঁচ্ছ কেন?
ফ্যানটা ঘুরছে শুধু শুধু।
কোথায় ঘুরছে?
না এখন আর ঘুবছে না। শওকত সাহেব ক্লান্ত স্বরে বললেন, যা খুমুতে যা। মুনা বলল, তুমি বরং আমাদের ঘরে ঘুমাও। বাবুর সঙ্গে শুয়ে পড়ে। আমি এখানে ঘুমাব।
শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা বলল যাও মামা আমার কথা শোন। তাছাড়া আজ রাতটা এমনিতেই তোমার উচিত ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমানো।
শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, তোর মামির ওপর বড় অবিচার কবেছি রে মুনা।
তা করেছ।
বড় খারাপ লাগছে।
অল্প কয়েক দিন লাগবে, তারপর আর লাপবে না। মানুষ বড় অদ্ভুত প্ৰাণী মামা।
শওকত সাহেব কোনো কথা বললেন না। মুনা চাপা স্বরে বলল, ধর কিছু দিন পর আবার যদি তুমি বিয়ে কর তাহলে প্রথম কিছু দিন ঐ মেয়েটিকে খুব ভালবাসবে, তারপর আবার আগের মত নানান অবিচার শুরু করবে। এবং এক সময় বিছানা-বালিশ নিয়ে আলাদা ঘুমুতে চাইবে। চাইবে না?
শওকত সাহেব একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মুনা বলল, যাও ওদের ঘরে গিয়ে শোও। ওরা জেগেই আছে, ওদের সঙ্গে দু’একটা কথা-টথা বল।
কি কথা বলব?
যা মনে আসে বল। ওদের সাহস দাও।
বাবু তার বাবাকে পাশে শুতে দেখে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। বকুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মশারির ভেতর থেকে। শওকত সাহেব ডাকলেন, বাবু। বাবু জবাব দিল না।
ঘুমাচ্ছিস নাকি বাবু?
না!
বকুল ঘুমাচ্ছিস?
না।
শওকত সাহেব তাদের কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার তেমন যোগাযোগ নেই। চিরদিন দূরে দূরে থেকেছেন। একটা আড়াল তৈরি হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ করে ওদের কাছে আসা যায় না। ওরা কাঁদছেও না। কাঁদলে বলা যেত কাঁদিস না রে। শওকত সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন গরম লাগছে, তাই না? বকুল বা বাবু কেউই কিছু বলল না।
মুনার অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এল না। পায়ের কাছে জানালাটা খোলা। খোলা জানালায় শীতল হাওয়া আসছে। সেই হাওয়ায় সিলিং ফ্যানটি অল্প অল্প ঘুরছে। ঘরে অন্য রকম একটা গন্ধ। রোগের গন্ধ, শোকের গন্ধ, মৃত্যুর গন্ধ। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে ডাকল, মামি। কেউ জবাব দিল না। মৃত্যুর ওপারে অন্য কোনো ভুবন আছে কী? না থাকাটা খুব কষ্টের হবে।
মুনার পানির তৃষ্ণা হচ্ছিল কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার ইচ্ছা হচ্ছিল না। সে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। কত অসংলগ্ন কথাই না তার মনে এল। যার সঙ্গে মামির কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। খুব ছোটবেলায় নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানে লাল রঙের একটা প্রকাণ্ড কাকড়া তার দিকে হঠাৎ ছুটে আসতে শুরু করল। অনেক দিন পর সেই দৃশ্যটি পরিষ্কার মনে এল। কেন এল?
শীত করছে। এবার কি আগে ভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? কাঁথায শীত মানবে না। লেপ বের করতে হবে শিগগির। লেপগুলির কি অবস্থা কে জানে। তেলাপোকায় কেটেকুটে সর্বনাশ করে। রেখেছে হয়ত। অনেক দিন রোদে দেয়া হয় না।
মুনা বিছানা ছেড়ে উঠল। পানির পিপাসা অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। দরজা খুলে বের হয়ে সে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মামা তাঁর ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিয়ে ক্যাম্পখাটে বসে আছেন। দুহাতে জড়িয়ে ধরে আছেন দু’জনকে। মামা ধরা গলায় ডাকলেন মুনা, আয় মা এদিকে।
মুনা গেল না। নিশিরাত্রির এই মুহূর্তটি ওদের। সেখানে তার স্থান কোথায়? সে রান্নাঘর থেকে পানি খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল। আজ সারাদিন বড় পরিশ্রম গিয়েছে। বড় ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ঘুম আসছে না। মুনা চেষ্টা করল তার বাবার ছবিটি মনে আনতে। কিছুতেই মনে এল না। শুধু মনে পড়ল প্রচণ্ড একটা শীতের রাতে ছোট খালা তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। বাবার ঘরে। চারদিকে অনেক লোকজন, অনেক আলো। ছোট খালা বলছেন চল মা, বাবাকে একটা চুমু দিয়ে আসবে। লক্ষ্মী মেয়ের মত বাবাকে একটা চুমু দেবে।
বাবার ঘর ভর্তি মানুষ। সবাই কেমন অন্য রকম। বাবা তাকে দেখে কাঠির মত রোগা একটি হাত উঁচু করলেন। মুনা তার খালার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠল। সে কিছুতেই যাবে না। বাবার কাছে। বাবা দুর্বল স্বরে বললেন, ও ভয় পেয়েছে, ওকে নিয়ে যাও। ছোট খালা ঘর থেকে বের করে এনে প্রচণ্ড একটা চড় দিয়ে বলেছিলেন, বোকা মেয়ে।
মুনা কথাটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে মৃদু স্বরে বলল বাবা ঐ ভয়ংকর রাতে তোমাকে চুমু খেতে পারিনি। কিন্তু তোমাকে আমি লক্ষ লক্ষ চুমু খেয়েছি। কোনোদিন তুমি তা জানতে পারবে না। এই দুঃখ আমি সারা জীবন বুকের মধ্যে পুষে হাসি মুখে ঘুরে বেড়াব। কত রকম সুখের ঘটনা ঘটবে আমার জীবনে। ঘর-সংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে। ওরা বড় হবে ওদের বিয়ে হবে, কিন্তু সেই দুঃখ থাকবেই।
মৃত্যুর পর কি কোনো জগৎ সত্যিই নেই? এই একটিই জীবন আমাদের? কোনোদিন বাবার কাছে দু’হাত বাড়িয়ে যাওয়া যাবে না? শৈশবের দিনগুলি কি ভয়াবহই না ছিল। কিছু দিন এর বাড়ি, কিছু দিন ওর বাড়ি। সাত বছর বয়সেই বুঝতে পারল সে একটা উপদ্রবের মত। কেউ তাকে দীর্ঘদিন রাখতে চায় না। তার যখন নবছর বয়স তখন এক’দিন মামা এসে বললেন মুনা, তুই চলে আয় আমার সাথে। আমার সাথে থাকবি। ছোট খালা বিরক্ত হয়ে বললেন, তোর সাথে থাকবে মানে! তুই একা মানুষ মেসে পড়ে আছিস।
একটা ঘর ভাড়া নেব। এখানে ওর কষ্ট হচ্ছে।
মামা সত্যি সত্যি ঘর ভাড়া করে তাকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। দু’জন মাত্র মানুষ তারা, কত রকম সমস্যা। রাত নটা-দশটা পর্যন্ত মুনাকে মাঝে মাঝে একা থাকতে হত। কি যে ভয় লগত একেক দিন। কিন্তু সে সুখে ছিল। মামা তাকে ভালবাসায় ডুবিয়ে রেখেছিলেন। যার যতটুকু ভালবাসার প্রয়োজন সে বোধহয় তা কোনো না কোনো ভাবে পেয়েই যায়। মুনার অস্পষ্ট ভাবে মনে হল সে সুখী হবে। ভালবাসার অভাব তার জীবনে হবে না।
শেষ রাতের দিকে মুনা সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল। রিকশা করে সে আর মামুন যাচ্ছে। রিকশা যাচ্ছে কোনো একটা পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে। অপূর্ব সব দৃশ্য চারদিকে। খুব বাতাস দিচ্ছে। সেই বাতাস অগ্রাহ্য করে মামুন সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। একটার পর একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি নষ্ট হচ্ছে। মামুন বড় বিরক্ত হচ্ছে। সে যতই বিরক্ত হচ্ছে মুনার ততই মজা লাগছে।
কত রকম অদ্ভুত স্বপ্নই না মানুষ দেখে।
মামুন ভেবেছিল ঢাকায় খুব বেশি হলে সাতদিন থাকবে।
বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। রাজমিস্ত্রী ঠিক করা আছে, ওরা বসে থাকবে। মেশিন রাখার বেস পাকা হবে। একটা হাফ বিল্ডিং হবে, প্রচুর কাজ। কিন্তু ঢাকা থেকে বের হবার সে পথ পাচ্ছে না। মুনার সঙ্গে সরাসরি কথা হওয়া দরকার। সমস্ত পরিকল্পনাটি তাকে ভালমত বোঝানো দরকার। তাও সম্ভব হচ্ছে না, একটির পর একটি ঝামেলা লাগছে। ছোটখাটো ঝামেলাও নয়, বিরাট সব ঝামেলা। এর মধ্যে ইন্ডাসট্ৰি-ফিন্ডাসটির কথা বলা যায় না।
তাছাড়া ঢাকায় এসে কেন জানি মনে হচ্ছে মুনা ঠিক আগের মত নেই। তাকে তেমন পছন্দ করছে না, এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। সেদিন ওর অফিসে গিয়েছিল। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, কোনো কাজে এসেছ না। এমনি?
জরুরি কথা ছিল কিছু।
এখন তো খুব ব্যস্ত। তুমি চলে যাও, আমি যাব তোমার কাছে।
মামুন রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। মুনার পাত্তা নেই। এমন কখনো হয় না। এই মেয়েটির কথার নড়াচড় হয় না। মামুন সে রাতেই মুনাদের বাসায় গিয়েছে। মুনা সহজ ভাবেই বলেছে মাথা ধরেছে কাজেই তোমার ওখানে যাইনি। তাছাড়া মন-টনও ভাল না, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। তুমি বস, চা খাও। আমি একটু শুয়ে থাকব।
মামুন রাত প্ৰায় এগারোটা পর্যন্ত বসে রইল। মুনা একবার এসে শুধু চা দিয়ে গেল। শওকত সাহেব এই দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে গল্প করলেন। সাপের গল্প। কবে বারহাট্টায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যাবেলা বাইরে বেরুবেন। শার্ট গায়ে দিতেই মনে হল ঠাণ্ডা একটা কি যেন গা বেয়ে যাচ্ছে। হারিকেন আনতেই দেখা গেল কালো কুচকুচে একটা সাপ। আরেকবার চাদপুরে ঘুমিয়ে আছেন। মশারি-টশারি সব ফেলা। বাতি নিভিযে চাদর গায়ে দিতেই মনে হল ঠাণ্ডা একটা কি যেন পায়ের উপর দিয়ে যাচ্ছে…।
মামুনের মনে হল স্ত্রীর মৃত্যুর কারণেই হোক অথবা অন্য যে কারণেই হোক এই লোকটির মধ্যে বড় রকমের একটা পরিবর্তন হয়েছে। সাপের মত একটা বিষয় নিয়ে কেউ দুঘণ্টা একনাগাড়ে কথা বলতে পারে না। বিশেষত সেই লোক, যে কপালে বিরক্তির ভাজ না ফেলে। আগে একটি কথাও বলত না। অথচ এখন একে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না। এর কোনো সমস্যা আছে। একবার হাল ছেড়ে দিলে যেমন একটা নিশ্চিন্ত আলস্যের ভাব চলে আসে মানুষের মধ্যে ওনারও কী তাই হয়েছে? মামুন একবার মামলার প্রসঙ্গ তুলতে চেষ্টা করল, নেক্সট ডেট কবে পড়েছে মামা?
জানি না কবে। মুনা বলতে পারবে। তারপর শ্ৰীপুরের গল্পটা শোন। ভাদ্র মাস, নৌকা করে যাচ্ছি। শ্ৰীপুর…।
শ্ৰীপুরের গল্প শেষ হতে পনের মিনিট লাগল। মুনা এসে বলল, যেতে দাও মামা। রিকশা পাবে না। শওকত সাহেব বললেন, রাত বেশি হয়ে গেছে। থেকে যাক না।
না না থাকবে কি?
মামুন উঠে পড়ল। মুনা কি সত্যি সত্যি তাকে অপছন্দ করছে? অপছন্দ করবার মত বাস্তব কোনো কারণ কি আছে। ওর একটা দুঃসময় যাচ্ছে এবং তখন মামুন তাকে কোনো রকম সাহায্য করেনি। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসে ছিল। ঝামেলা এড়াবার জন্য যে সে এটা করছে তা তো না।
ফরিদা মারা যাবার পর বাবা-মা একলা হয়ে পড়েছেন। নানান রকম কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। ফরিদাকে নাকি হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পান। অসুস্থ ফরিদকে নয়। স্বাস্থ্য সৌন্দর্যে ঝলমলে ফরিদাকে; কখনো তাকে দেখা যায় বসে আছে লাল চাদর গায়ে দিয়ে; কখনো বা হেঁটে যায় পাশ দিয়ে। মানসিক ভাবে বাবা-মা দুজনেই বিপর্যন্ত। এমন অবস্থায় তার নিশ্চয়ই অধিকার আছে বাড়িতে থেকে যাওয়ার।
তাছাড়া বাড়ির সঙ্গে তার দীর্ঘদিন সম্পর্শক ছিল না। ফরিদার কারণেই ছিল না। বলতে গেলে সে পালিয়ে বেড়িয়েছে। এই নিয়ে তার অপরাধবোধ আছে। সেটা কাটানোর জন্যেও গ্রামে থাকা দরকার। গ্রাম তো সেই পুরনো গ্রাম নেই। পিলার বসছে, ইলেকট্রিসিটি মাস খানিকের ভেতর চলে যাবে। রেডিও-টেলিভিশন সবই চলবে। তেলের কল ঠিকমত কাজ করলে ভাল টাকা-পয়সা আসার কথা। ঢাকায় কলেজের মাস্টারির পুরো বেতনটাই তো চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। সেখানে বাড়ি ভাড়া দিতে হচ্ছে না। চমৎকার বাড়ি আছে নিজেদের। দোতলার দক্ষিণের ঘরটিতে একটা অ্যাটাচিড বাথরুমের ব্যবস্থা করলেই পুরোপুরি শহরের বাড়ি হয়ে যাবে।
কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এসব কথা বুঝিয়ে বলার মত সুযোগই তৈরি হচ্ছে না। মামুনের ধারণা মুনা তাকে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করছে। টেলিফোনের কথাবার্তা থেকে সেটা কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়েই মুনা বলেছে আমার হাতে অনেক কাজ, তুমি কি পরে একবার রিং করবে। দুটোর পর। দুটোর পর টেলিফোন করা হল। সে অফিসে নেই এর মানে কি? স্পষ্ট কথা হওয়া উচিত। মামুন এখন আর তার বিয়ের ব্যাপারটি ঝুলিয়ে রাখতে চায় না। এই নিয়েও কথা বলতে চায়।
মুনার আশংকা সে বুঝতে পারছে। মামার জেল-টেল হয়ে গেলে এরা যাবে কোথায়?
সে যদি উপন্যাসের আদর্শ নায়িকাব মত ভাবে পরিবারের বাকি সবার জন্যে জীবন উৎসর্গ করবে, বাকি জীবন চিরকুমারী থাকবে তাহলে সে ভুল করবে।
সবার আলাদা আলাদা জীবন আছে। এইসব মহৎ আদর্শ উপন্যাসে এবং সিনেমায় ভাল লাগে। জীবন উপন্যাসেও না সিনেমাও না। আর এমন তো না মুনা ছাড়া ওদের অন্য কোনো গতি নেই। অবশ্যই আছে। আত্মীয়-স্বজনরা আছে। বকুলের এক মামা আছেন যথেষ্ট ক্ষমতাবান মানুষ।
মুনার এখন যে দুঃসময় তার চেয়েও ভয়াবহ দুঃসময় মানুষের আসে এবং তখন তারা নিজেদেব এ রকম করে গুটিয়ে নেয় না। মামুন মনে মনে মুনার সঙ্গে কথাবার্তাগুলি ঝালাই করতে লাগল।
তুমি এখন আর আমার সঙ্গে দেখা করতে আস না কেন?
ভাল লাগে না সেই জন্যে আসি না।
ভাল লাগে না মানে?
মানে-টানে কিছু নেই।
তার মানে আমাকে বিয়ে করবে না?
তোমাকে বিয়ে করব কেন? কি আছে তোমার?
মনে মনে কথাবার্তা বেশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া যায় না। তর্কে মুনা জিতে যায়। এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। বাস্তবেও তর্কে মুনা জেতে, কল্পনার তর্কে ও সে-ই জেতে। অন্তত কল্পনাতে তো মামুনের জেতা উচিত।
অথচ প্রথম পরিচয়ের সময় মুনার এই তার্কিক স্বভাব তার চোখেই পড়েনি। বরঞ্চ মনে হয়েছিল বড় ঠাণ্ডা একটি মেয়ে। ঠাণ্ডা এবং লাজুক! মামুন তার বন্ধুর একটি কাজ নিয়ে গিয়েছিল অফিসে। লাজুক ধরনের মেয়েটি দ্রুত কাজটা করে দিল। মামুন বলল–মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে জানতাম না তো। সে হেসে বলল–মেয়েদের এত অক্ষম ভাববেন না।
এখন থেকে আর ভাবব না।
মেয়েটি তাকে এক কাপ চা খাওয়াল।
সেই কাজটি নিয়ে মামুনকে পরদিন আবার যেতে হল। মেয়েদের যতটা সক্ষম ভাবা গিয়েছিল কার্যক্ষেত্রে সে রকম দেখা যায়নি। কাগজপত্র ঠিকমত তৈরি হয়নি। মেয়েটি দারুণ লজ্জিত হল। ছোটাছুটি করে আবার নতুন কাগজ তৈরি করে দিল। তাতেও ভুল বের হল। আবার আসতে হল মামুনকে এবং সে হেসে বলল–
আপনার এখানে এসে এসে এমন অভ্যাস হয়েছে যে, কাগজপত্র পুরোপুরি ঠিক হলে মন খারাপ লাগবে। মেয়েটি লাল হয়ে বলল, আপনাকে আব আসতে হবে না। এবার ঠিকঠাক না হলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব।
কিন্তু সপ্তাহখানেক পর মামুন আবার এল। লাজুক ভঙ্গিতে বলল আজ কোনো কাজে আসিনি। আপনাকে থ্যাংকস জানাতে এসেছি। থ্যাংকস জানাতে এসে প্রায় দুঘণ্টা বসে রইল। এই দুঘণ্টায় সে এক প্যাকেট সিগারেট এবং চার কাপ বিশ্বাদ চা খেয়ে ফেলল। কি সব আনন্দের দিনই না গিয়েছে।
বাইরে হাঁটাহাঁটির পরিমাণ
শওকত সাহেবের বাইরে হাঁটাহাঁটির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের মত দুপুরে খেতে আসেন না। কোনো একটা সস্তা হোটেলে ঢুকে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া সেরে চেয়ারে বসেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেন। এই নিয়ে হোটেলওয়ালাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মৃদু বাচসা হয়। সেদিন একেবারে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। নীলক্ষেতের এক হোটেলওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল এই যে ঘুমান কেন? ভাত খাইছেন এখন যান। অন্য কাস্টমাররা বসুক।
শওকত সাহেব লজ্জিত হয়েই উঠে পড়লেন। ক্ষেপে গেল অন্য কাস্টমাররা একজন বুড়ো মানুষ খাওয়ার পর বিশ্রাম করছে, আর তুমি যে জোর করে তুলে দিলে। পয়সাটাই শুধু দেখ।
দেখতে দেখতে ওদের সঙ্গে হোটেলওয়ালার তুমুল লেগে গেল। প্রায় হাততাতির উপক্রম। এ সব ক্ষেত্রে যা হয় হোটেলওয়ালার পরাজয় হল। এবং সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, যান ভাই ঘুমান, ঐ বুড়া মিয়ারে একটা বালিশ আইন্যা দে।
শওকত সাহেব দ্বিতীয় দফায় ঘুমুতে গেলেন না। বিল মিটিয়ে চলে এলেন। লোকজন ইদানীং তাকে বুড়ো মিয়া ডাকছে। হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন নাকি? পান। কিনতে গিয়ে খুব নজর করে আয়নায় নিজেকে দেখলেন। চেহারা তো আগেই মতই আছে। শুধু কপালের কাছের কিছু চুল ইন্দিরা গান্ধীর মত পেকে গেছে। তবু সবাই কেন বুড়ো ভাবতে শুরু করল।
অবশ্যি বুড়ো হবার অনেক সুবিধাও আছে। বাসে উঠলে সহজেই সিট পাওয়া যাচ্ছে। গতকালই গুলিস্তান যাচ্ছিলেন। লেডিস সিটে বসা অল্পবয়সী একটা মেয়ে বলল জায়গা আছে বসুন না। মেয়েটি সরে কিছু জায়গা করে দিল।
কোথায় যাওয়া যায়? বাইরে বেশ রোদ। রোদ না কমলে হাঁটাহাঁটি করে আরাম পাওয়া যায় না। কোনো পার্ক-টার্কে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে কেমন হয়? শওকত সাহেব চলে গেলেন সোহরাওয়াদী উদ্যানে। এই দুপুরের রোদেও জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে দেখা গেল। প্রেমের সুবিধা দেয়ার জন্যেই কি সরকার এই পার্ক বানিয়েছেন? এই ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে শওকত সাহেব একটা ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজে বের করলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুলেন। বেশ লাগল তাঁর।
আজও তিনি সে রকম করবেন ভাবলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদলে চলে গেলেন নিজের অফিসে। মল্লিক। বাবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা পাওনা আছে ম্যাদি পাওয়া যায়। আজ মাসের এক তারিখ, হাতে টাকা থাকার কথা। তার নিজের হাত দ্রুত খালি হয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ত মুনার কাছে হাতখরচ চাইতে হবে।
আরে আরে শওকত সাহেব যে, কোথায় ডুব দিয়েছিলেন?
শওকত সাহেব হকচকিয়ে গলেন। অফিসের কোথাও যেন সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন হয়েছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। তার পোস্টে যে নতুন ছেলেটির অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে সে উঠে দাঁড়িয়ে স্নামালিকুম দিল। জসীম সাহেব হাসি মুখে বললেন, এসেছেন ভাল হয়েছে, অনেক কথা আছে। শরীর কেমন আপনার বলেন?
শরীর ভালই।
ভাল কোথায়? আপনি তো ভাই বুড়ো হয়ে গেছেন। এ কি অবস্থা!
সংসারে অনেক ঝামেলা গেল। আমার স্ত্রী মারা গেছেন।
তাই নাকি? আহা বলেন কি? বড় আফসোসের কথা। কোনোই খবর রাখি না। ঐদিন অবশ্যি মল্লিক বাবু বলছিলেন চলেন যাই খোঁজ নিয়ে আসি। ঝামেলার জন্য যেতে পারলাম না। অডিট হচ্ছে। কোনো কোনো দিন আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকতে হয়। চলেন ক্যান্টিনে চলেন। চাটা কিছু খাই।
চা খাব না। এই মাত্র ভাত খেয়ে এসেছি।
চা না খাবেন অন্য কিছু খাবেন। পেপসি খান। ফান্টা খান? আপনার সাথে কথা আছে।
অফিসের ক্যান্টিনাটিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাঠের চেয়ার সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। টেবিলের উপর পরিষ্কার টেবিল ক্লথ। জসীম সাহেব বললেন, ক্যান্টিনের ভোল পাল্টে গেছে, বুঝলেন তো?
জি।
ক্যান্টিন এখন ইউনিয়নের হাতে। ইউনিয়ন ক্যান্টিন চালাচ্ছে। এখন ইউনিয়ন খুব সন্ট্রং। এই জন্যেই আপনাকে খুঁজছিলাম।
কেন আমাকে কেন?
শওকত সাহেব বড়ই অবাক হলেন। ইউনিয়ন তাকে কেন খুঁজছে, সেটা জেনে তার বিস্ময়ের পরিমাণ আরো বাড়ল।
আপনাদের মামলাটার ব্যাপারেই খোঁজ হচ্ছে। আমরা সিরিযাস চাপ দিয়েছি। আমরা বলেছি, আসল যে আসামি দিব্যি চাকরি করছে বেতন নিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কেইস তোমরা তুলে নিয়েছ। আর যে নিরপরাধ তাকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমরা এটা হতে দেব না।
আমি নিরপরাধ না।
আপনি তো এটা বললে হবে না। আমরা ব্যাপারটি জানি। আপনাকে সিগনেচার করতে বলা হয়েছে। আপনি দুর্বল মানুষ, ভয়ের চোটে সিগনেচার করেছেন। আপনার মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু টাকা আপনার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, ব্যস।
শওকত সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন।
ইউনিয়নের চাপে ওদের অবস্থা এখন কাহিল। সাপের ব্যাঙ খাওয়ার মত অবস্থা। ফেলতেও পারছে না গিলতেও পারছে না। হা হা হা। বারবার যে আপনার মামলার তারিখ পড়ছে, কি জন্যে পড়ছে? এই জন্যেই পড়ছে। ওরা সময় নিচ্ছে। আপনি এসেছেন যখন এক কাজ করুন। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন।
দেখা করব?
হ্যাঁ। জাস্ট দেখা করবেন। অন্য কিছু বলার দরকার নেই। বড় সাহেব কিছু বললে শুনবেন।
সাহস হয় না।
সাহসের এখানে কি আছে, যান তো। ব্যাটার রি-অ্যাকশনটা কি দেখেন।
বড় সাহেব তাকে প্রথম চিনতেই পারলেন না। শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, স্যার আমি শওকত। ক্যাশ সেকশনের।
ও আচ্ছা। একি অবস্থা হয়েছে। আপনার?
অনেক রকম বিপদ-আপদ যাচ্ছে স্যার; জানেনই তো। তার ওপর স্ত্রী মারা গেলেন।
তাই নাকি? কবে?
গত মাসের চব্বিশ তারিখ?
আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম ভেরি সরি। বসুন বসুন চা খান!
জি না স্যার চা খাব না।
খাবেন না কেন–খান। সাড়ে তিনটা বাজে, এখন অলমোস্ট টি টাইম।
শওকত সাহেব সংকুচিত ভঙ্গিতে বসলেন। বড় সাহেব বললেন, আপনার নিজের শরীর কেমন?
শরীর ভালই। মামলাটা নিয়ে ঘোরাঘুরি বেশি হয়। বারবার ডেট পড়ে। জেল-টেল যা হবার একবারে হয়ে গেলে ভাল ছিল।
জেলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছেন?
জি স্যার।
বাসায় কে আছে? আমার একটা মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে, একটা ছেলে আছে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আর আমার ভাগ্নী আছে একটি।
বড় সাহেব হঠাৎ বললেন, ধরুন আপনাকে যদি জেলে যেতে হয় তাহলে ওদের দেখাশোনা কে করবে?
আমার ভাগীই করবে স্যার। আমি সেটা নিয়ে চিন্তা করি না। ও খুব তেজী মেয়ে। বড় সাহেবের ঘরের চা শওকত সাহেবের খুব পছন্দ হল। এই চা ক্যান্টিন থেকে আসে না। আলাদা তৈরি হয়। হালকা লিকার, মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ। আসল চায়ের গন্ধ বোধ হয় এ রকমই।
স্যার যাই।
ঠিক আছে যান। আর শোনেন, বেশি চিন্তা করবেন না। স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখবেন। ঐ মামলাটা নিয়ে কোম্পানি চিন্তা-ভাবনা করছে। হয়ত শেষ পর্যন্ত তুলে নেবে। যদিও আমি ঠিক সিওর না।
শওকত সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আপনি দিন সাতেক পর খোঁজ নেবেন।
শওকত সাহেবের কি করা উচিত? ছুটে গিয়ে বড় সাহেবকে জড়িয়ে ধরা? কেঁদে ফেলা? এর কোনোটাই তিনি করতে পারলেন না। বেকুবের মত চারদিকে তাকাতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হেঁচকি উঠে গেল।
মল্লিক বাবু ধারের পঞ্চাশ টাকা ফিরিয়ে দিলেন। গলার স্বর নিচু করে বললেন, এই টাকায় ভাল দেখে দৈ-মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। আমোদ-ফুর্তি করেন।
শওকত সাহেব সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকারই সন্দেশ কিনে ফেললেন। চল্লিশ টাকার কিনলে ভাল হত, রিকশা করে বাসায় ফিরতে পারতেন। এখন যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। কিন্তু বেশ লাগছে। হাঁটতে। কিসের যেন একটা মিছিল বের হয়েছে। তিনি মিষ্টির প্যাকেট হাতে ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন। মিছিলের সঙ্গে হাঁটা বেশ মজার ব্যাপার। নিজেকে তখন আর ক্ষুদ্র মনে হয় না। শওকত সাহেব কোনো কিছু না বুঝেই দলের সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হুংকার দিতে লাগলেন–দিতে হবে দিতে হবে।
তিনি বাসায় পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা! বাসায় তখন ছোটখাটো একটা উত্তেজনার ব্যাপার চলছে। পুরনো ফ্যানটি নিয়ে আসা হয়েছে। বাকের-এর তত্ত্বাবধানে সেই ফ্যান ফিট করা হয়েছে। সুইচ টিপতেই ফ্যানে এক ধরনের কক্ষপন দেখা গেল। মেঘ ডাকার মত একটা শব্দ হয়ে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাকের বলল শালা মদনা। হারামজাদার সবগুলি দাঁত আমি খুলে ফেলব। বকুল খিলখিল করে হেসে ফেলল।
হাসির কি হল? এর মধ্যে হাসির কি হল? কেউ একটা মোমবাতি আনো না। আরো ব্যাপার কি?
হ্যারিকেন, মোমবাতি, কুপী কিছুই পাওয়া গেল না। এ রকম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় শওকত সাহেব মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ওরা জিজ্ঞেস করবে মিষ্টি কি জানো? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
মুনা এক টুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল বাসি সন্দেশ। কোথেকে আনলে মামা?
শওকত সাহেব রাত আটটায় সন্দোশের দোকানে রওনা হলেন ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা নিয়ে আসতে। বয়স হয়েছে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুনার কাছ থেকে চেয়ে রিকশা ভাড়াটা নিয়ে এলে হত।
ঠাণ্ডাও লাগছে। এবার কি আগেভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? গরম চাদরটা সঙ্গে আনলে হত।
টিনা বিরক্ত হয়ে বলল
টিনা বিরক্ত হয়ে বলল দুঘণ্টা আগে আসবার জন্যে খবর পাঠালাম না?
কাজ ছিল ভাবী।
টিনা রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, অল্পের জন্যে মিস কবলি, তোর ডাক্তার এসেছিল। বকুল বড় লজ্জা পেল। ইদানীং টিনা ভাবী কথায় কথায় বলছে তোর ডাক্তার। কি লজ্জার ব্যাপার, কারো কানে গেলে কি হবে কে জানে।
বাচ্চাদের গা গরম, ডাক্তার ডাকতে হয়। কোন ডাক্তারকে আর ডাকি, তোর ভাইকে বললাম বকুলের ডাক্তারকেই ডাক।
বকুল লাল হয়ে বলল কি যে তুমি কর ভাবী।
টিনা বকুলের কোলে একটা বাচ্চা তুলে দিল। গা সত্যি গরম, মুখে লাল লাল কি দেখা যাচ্ছে।
ওর কি হয়েছে ভাবী?
কিছু না, মাসি-পিসি। সব বাচ্চাদের হয়। তোকে একটা বিশেষ কাজে ডেকেছি। বকুল। একটা না দু’টা বিশেষ কাজ। প্রথমটা হচ্ছে নাম ঠিক করেছিস?
উঁহু।
আজকেই নাম চাই। খুব জরুরি।
কেন এত জরুরি কেন?
টিনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলিল বাচ্চাদের দাদা চিঠি দিয়েছে। নাতীদের নাম যেন ফজলুর সঙ্গে মিল রেখে বজলু আর মজনু রাখা হয়। তোর ভাই বলছে, বাবা যা চান তাই রাখ। আমি মরে গেলেও ছেলেদের নাম বজলু মজনু রাখব না। এখন ছেলেদে বা কত সুন্দর সুন্দর নাম হয়, আর আমার দুটোর নাম হবে বজলু আর মজনু?
বকুল হেসে ফেলল।
টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, হাসির কি হল? সুন্দর সুন্দর নাম দশ মিনিটের ভেতর বের কবি;
ঠিক আছে করব, এখন দ্বিতীয় জরুরি কথাটি বল?
তোর ডাক্তারকে আজ বললাম তোর কথ।
তার মানে।
খোলাখুলি বললাম। প্রথমে চা-টা খাইয়ে ভাই সম্পর্ক পাতালাম, তাপ প<ং পল পাম তুমি বয়সে আমার ছোট হবারই কথা, কাজেই তুমি বলছি।
বকুল বলল, থাক ভাবী আমি আর শুনতে চাই না।
শুনতে না চাইলে উঠে চলে যা, আমার যেটা বলার সেটা বলে যাচ্ছি। তারপর আমি বললাম তুমি কি ভাই বকুল নামের কোনো মেয়েকে চোন? সে দেখি লজ্জায টমেটোর মত হয়ে গেল। আমি বললাম। ওকে আমি ছোটবেলা থেকে চিলি। এ রকম মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম জন্মায়। তুমি যদি চাও এই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়েব ব্যবস্থা করি।
বকুল ভেবেছিল সে কোনো জবাব দেবে না, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে বলল, উনি কি বললেন?
কি বললেন সেটা শোনাল দরকার নেই। শুনলে পায়া ভাবী হয়ে যাবে। তোর মুনা। আপা বাসায়। আছে? তার সঙ্গে আমার কথা আছে। আছে বাসায়?
না।
কোথায় গেছে?
জানি না। মামুন ভাইয়ের কাছে বোধ হয়।
কখন আসবে?
সন্ধ্যার পর চলে আসবে।
ঠিক আছে সন্ধ্যার পর আমি যাব তোদের বাসায়।
বকুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। তার চোখে পানি চলে এসেছে। সে টিনা ভাবীর কাছে তা গোপন করতে চায়।
টিনা হেসে বলল, কেঁদে গাল ভাসাচ্ছিস কেন বোকা মেয়ে? যা, বাসায় চলে যা। তোর আপাকে বলিস মনে করে আমি আসব। জরুরি কথা আছে তার সাথে।
টিনা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। বকুল দীর্ঘ সময় বসে বসে কাঁদল। দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না।
মামুন তাকিয়ে আছে। রাগী চোখে।
এমন রাগী চোখে তাকিয়ে থাকার মত তো কিছু হয়নি। মুনার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছিল। সে বলল–চল যাই, কথা তো শেষ হল।
না শেষ হয়নি, আরো কথা আছে।
মামুন একটা সিগারেট ধরাল। মুনা ঘড়ি দেখল আটটা প্রায় বাজে বাজে। কল্যাণপুরের হাজি সাহেবের বাসায় আসতে অনেকখানি সময় লেগেছে। এখানে না এলেও চলত। এমন কোনো জরুরি কথা মামুনের ছিল না। যা শোনার জন্যে তাকে কল্যাণপুরের এই বাসায় আসতে হবে।
মুনার নিজের হাতের কেনা জিনিসপত্র চারদিকে ছড়ান। থালা বাটি চায়ের কাপ। কাটা চামচ। বসার মোড়া। দেখতে এমন মায়া লাগে। মুনা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস গোপন করল। দিনের অবস্থা ভাল না। আকাশে মেঘ করেছে। বাড়ি ফেরা দরকার। মামুন হাতে সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল। তুমি তাহলে আমাকে বিয়ে করবে না?
করব না এমন কথা তো বলিনি। বলেছি এখন না।
একই কথা। এখন না মানে কখনো না।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন ধমকে উঠল–কথা বলছ না কেন?
কি বলব?
তোমার মনে কি আছে সেটা বল?
তোমাকে বলার মত তেমন কিছু আমার নেই। তুমি একজন স্বার্থপর মানুষ। আমার ভাল লাগে না।
মুনা ক্লান্ত স্বরে বলল আমার মাথা ধরেছে। বাসায় যাব। মামুন হঠাৎ উঠে দরজার ছিটিকিনি তুলে দিল। মুনা বলল কি করছ?
তেমন কিছু না।
মামুন বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাতি নিভিয়ে জড়িয়ে ধরল। মুনাকে। মুনা একবার ভাবল আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে। কিন্তু সে চিৎকার করল না; অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সত্যি সত্যি কি তার জীবনে এটা ঘটছে?
শওকত সাহেব বললেন, তোর কি হয়েছে মুনা? মুনা বলল, আমার কিছুই হয়নি মামা। আমি বেশ ভাল আছি।
এ রকম লাগছে কেন তোকে?
মাথা ধরেছে।
একা এসেছিস? মামুন আসেনি?
না। একাই এসেছি।
শওকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, একটা খবর আছে মুনা। আজ অফিসে গিয়েছিলাম। বড় সাহেব যেতে বলেছিলেন। অফিসে গিয়ে শুনলাম ওরা কেইস উইথড্র করেছে। চাকরিও ফেরত পাওয়া যাবে।
ভাল।
তোর কি হয়েছে মুনা?
কিছু হয়নি মামা। আমি ভাল আছি।
মুনা ঘর অন্ধকাব করে একা একা তার নিজের বিছানায় বসে রইল। পাশের বিছানায় বাবু শুয়ে আছে। বোধ হয় তার মাথা ধরেছে। শওকত সাহেব একবার এসে বিরক্ত স্বরে বললেন পড়াশোনা কিছু হচ্ছে না। সন্ধ্যা না হতেই ঘুম! মুনা তুই তো কিছু দেখিস না, ডেকে তোল।
মুনা কিছু বলল না। শওকত সাহেব বললেন বকুল দেখি শাড়ি পরে সেজেণ্ডজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মুনা সে কথারও জবাব দিল না।
তুই ভাল আছিস তো মা?
ভালই আছি মামা।
রাত দশটার দিকে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। শীতকালের বৃষ্টি। নামলেই ঠাণ্ডা লাগবে। তবু বকুল ফিসফিস করে বলল, বৃষ্টিতে একটু ভিজবে আপ?
বকুলের পরনে একটা নীল রঙের শাড়ি। আবার কপালে নীল টিপও দিয়েছে। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বৃষ্টিতে নামার। সে আবারও বলল, আপা এস না। পায়ে পড়ি তোমার।
আহ কি সুন্দর লাগছে বকুলকে!
পরপর তিন কাপ চা
পরপর তিন কাপ চা খেয়ে ফেলল বাকের।
সে বসেছে জলিল মিয়ার স্টলে। দৃষ্টি এগার নম্বরের বাড়িটির দিকে। কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়ি। এক মাস হল ভাড়া দেয়া হয়েছে। সন্দেহজনক ভাড়াটে। নজর রাখতে হচ্ছে সে জন্যেই। তার একটা দায়িত্ব আছে। চোখের সামনে বেচাল কিছু হতে দেয়া যায় না। এটা ভদ্রলোকের পাড়া। সবাই ফ্যামিলি ম্যান। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাস করে। এলেবেলে কেউ না।
বাকের হাতের ইশারায় জলিল মিয়াকে ডাকল। জলিল মিয়া ক্যাশ সামলাচ্ছিল। সকাল বেলাটা বিজনেসের আসল সময়। ক্যাশ ফেলে হুঁট করে উঠে আসা যায় না। কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কি? বাকের ভাই ডাকছেন। জলিল মিয়া বহু কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। বিনীত একটা ভঙ্গি করে বলল, কি বাকের ভাই?
কাছে আসতে বললাম। এক মাইল দূরে থেকে কি বাকের ভাই? তাড়াতাড়ি আসেন। প্রাইভেট কথা আছে।
জলিল মিয়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে উঠে এল। বাকের গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলল।
এগার নম্বর বাড়িটার ব্যাপার কি?
জানি না তো বাকের ভাই।
ভাল করে দেখলে কি মনে হয়।
জলিল মিয়া তাকাল এগার নম্বর বাড়ির দিকে। কিছুই বুঝতে পারল না। আর দশটা বাড়ির মতই। আলাদা কিছু না। নতুন রঙ করা হয়েছে এই যা।
বোঝা যায় কিছু?
জি না।
একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে না, বাড়ির সামনে? কালো রঙের।
হুঁ, তা আছে।
বোঝা যায় কিছু?
জি না।
চোখ-কান বন্ধ করে দোকান করেন, বোঝা যাবে কি? চোখ দু’টি খুলে পকেটে রেখে দিলেই হয়। সেইটাই ভাল। ব্যবহার যখন হয় না।
জলিল মিয়া এটাকে রসিকতা মনে করে হাসতে চেষ্টা করল। বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে না কি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় তার নেই। একদল চোর নিয়ে দোকান চালাতে হচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকাবার সময় কি আছে? চায়ের সন্টল করতে গেলে ম্যানেজারের দশটা চোখ থাকতে হয়। তাকিয়ে থাকতে হয় দশ দিকে। তার দু’টা মাত্র চোখ।
বাকের ভাই আমি যাই। ক্যাশ খালি।
বাকের সে কথার জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কালো গাড়িটার মালিক বের হয়ে আসছে। লোকটার ওপর চোখ রাখা দরকার। লোকটা মুশকো জোয়ান। চকচকে একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছে। তাকে বিদেয় দিতে আঠার-উনিশ বছরের একটা মেয়ে গেটের বাইরে এসেছে; খুব হাত নাড়ছে। লোকটা গম্ভীর।
বাকের এগিয়ে গেল। তার হাতে সিগারেট। মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখা দরকার। দুই বোন এবং এদের মা থাকে এ বাড়িতে। মেয়েদের বাবা থাকে ইরান অথবা ইরাকে। বাড়িওয়ালা তাই বলল। পয়সাওয়ালা ফ্যামিলি। এক বছরের ভাড়া অ্যাডভান্স দিয়েছে। এতেই বাড়িওয়ালা খুশি। এদের নজর শুধু টাকার দিকে। টাকা ঠিকমত পেলেই হল। অন্য কিছু দেখবে না।
বাকের গেটের কাছে পৌঁছবার আগেই মেয়েটি ভেতরে ঢুকে গেল। চিমশে ধরনের এক বুড়ো এসে গেটে তালা লাগিয়ে দিল। এটাও সন্দেহজনক। সব সময় গেটে তালা থাকবে কেন? তাছাড়া বুড়োর ধরন-ধারণাও কেমন কেমন। মাটির দিকে তাকিয়ে হাটে। কারো চোখের দিকে তাকায় না। মনে পাপ আছে নিশ্চয়ই। বাকেরের সঙ্গে এক’দিন অল্প কিছু কথা হয়েছে।
বুড়ো বাজার করে ফিরছিল। দুহাতে দুটো ব্যাগ। ব্যাগের ভারে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। রীতিমত ঘামছে। বাকের এগিয়ে গিয়ে বলল, কেমন আছেন ভাই?
বুড়ো দারুণ চমকে উঠল। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে যাবার মত অবস্থা। ব্যাগ নামিয়ে কপালের ঘাম মুছল।
গোটা বাজারটাই কিনে এনেছেন দেখি। এত কি কিনলেন?
আমাকে বলছেন?
আপনাকে ছাড়া আর কাকে বলব? আর কেউ কি আছে। আশপাশে? এত বাজার যে–ব্যাপার কি? পার্টি-ফার্টি নাকি?
সপ্তাহের বাজার।
চলে যাচ্ছেন কেন? দাঁড়ান দুটো কথা বলি। এই পাড়ায় নতুন এসেছেন আলাপ-পরিচয় হয় নাই। আমার নাম বাকের। নেন সিগারেট নেন।
আমি সিগারেট খাই না। অন্যদিন আপনার সঙ্গে কথা বলব। আজ আমার একটু তাড়া अজি।
নামটা বলে যান।
জোবেদ আলী।
মেয়ে দু’টির কে হন। আপনি?
চাচা। দূর সম্পর্কের চাচা।
জোবেদ আলী হাঁটা ধরল। এবং দুবার পেছন ফিরে তাকাল। চোখের দৃষ্টি মাছের মত। খুবই সন্দেহজনক।
তালাবদ্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাকের দ্বিতীয় সিগারেটটি ধরাল। সাড়ে দশটা বাজে। চড়াচড় করে রোদ বাড়ছে। রোদের মধ্যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। সানগ্নাস সঙ্গে নেই। মাথা ধরে যাবে। বাকের গেটের ভেতর উঁকি দিল। বাড়িটা ভাল সাজিয়েছে। ফুলের টব দিয়ে ছয়লাব করে ফেলেছে। একটা কুকুরও আছে। এ পাড়ায় কুকুরওয়ালা বাড়ি তাহলে দু’টা হল। বদরুদ্দীন সাহেবের বাড়িতেও কুকুর আছে। সেই কুকুরটা অবশ্যি দেশী। এদেরটার মত না। এই বাড়ির কুকুরটা উলের বলের মত, দেখলেই লাথি দিতে ইচ্ছা করে। এক’দিন নিৰ্ঘাৎ লাথি বসাবে। এখনই পা নিশপিশ করছে।
বাকের দেখল মুনা হনহন করে যাচ্ছে। আজও সে দেরি করল অফিসে যেতে। রিকশা পেতে আরো আধঘণ্টা লাগবে। অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারটা বেজে যাবে। কেউ অবশ্যি কিছু বলবে না। মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক অসুবিধা আছে।
মুনা। এই মুনা।
মুনা থমকে দাঁড়াল।
অফিসে যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
চল, রিকশা ঠিক করে দেই।
রিকশা আমি নিজেই ঠিক করতে পারব।
চল না, আমার চেনা রিকশাওয়ালা আছে। হাফ ভাড়ায় নিয়ে যাবে।
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মুনা কিছু বলল না। বলে লাভ নেই। সে আসবেই। সারা পথ বকবক করতে করতে মাথা ধরিয়ে দেবে।
এগার নম্বর বাড়ির ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছ?
কি ব্যাপার?
দু’টি মেয়ে মাকে নিয়ে একা থাকে।
তাতে অসুবিধা কি?
না কোনো অসুবিধা নাই। মেয়েগুলি স্কুল-কলেজ কোথাও যায় না বাড়িতেই থাকে। গাড়ি করে নানান কিসিমের লোকজন আসে প্রায়ই। আজ সকালেই একজনকে দেখলাম।
পরের ব্যাপার নিয়ে এত মাথা ঘামান কেন, বাকের ভাই?
বেচাল কিছু কিনা তাই ভাবছি। পাড়ার একটা ইজতের ব্যাপার আছে না? ভেসে যেতে দেয়া যায় না।
পাড়ার ইজ্জতের দায়িত্বটা আপনাকে দিল কে?
না, তা না। দায়িত্ব কিছু না।
বাকের খানিকটা বিষগ্ন হয়ে পড়ল। মুনার সঙ্গে দেখা হলেই তার এ রকম হয়। মন কেমন খারাপ হয়ে যায়। বাকের ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে রিকশার খোঁজে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। এই সময় রিকশা পাওয়া মুশকিল। বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতে হবে।
মুনা অফিসে ঢুকতেই পাল বাবু বললেন, আজ এত দেরি করলেন যে? বড় সাহেব তিনবার আপনাকে খোঁজ করেছেন। যান। তাড়াতাড়ি যান। ভাল একটা এক্সকিউজতৈরি করুন। বলবেন রিকশা এক্সিডেন্ট হয়েছে। মুনা হাসল। বড় সাহেব কাউকে ডাকলেই পাল বাবু অস্থির হয়ে পড়েন। কত রকম অদ্ভুত সাইকোলজি থাকে মানুষের। বেশির ভাগ মানুষই কি অন্যের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায়? পাল বাবু উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, যান। অপেক্ষা করছেন কেন?
যাচ্ছি।
যাচ্ছি বলেও মুনা তার চেয়ারে বসল। টেবিল ভর্তি ফাইল। একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম টেবিল বোধ হয় তার কখনো হবে না। রোক একগাদা ফাইল জমা হয়ে থাকবে। বড় বড় ফিগার ভর্তি ফাইল। প্রতি পাতায় দশটা করে ভুল থাকবে। ক্যালকুলেটর টিপে টিপে ফিগার চেক করতে করতে মাথা ধরে যাবে এবং বমি বমি ভাব আসবে। কুৎসিত ব্যাপার। পাল বাবু বললেন, আবার বসে পড়লেন কেন?
শরীরটা বিশেষ ভাল না পাল বাবু। ফাইল দেখে মাথা ঘুরাচ্ছে। বমি আসছে। মনে হচ্ছে বমি করে দেব।
মুনা মুখ বিকৃত করল।
স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসেন। তারপর রেস্ট নেন। এক গ্লাস লেবুর সরবত খান। শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। ভিটামিন সি আছে। খুব এফেকটিভ। যান যান দেরি করবেন না, স্যারের সঙ্গে ঝামেলাটা সেরে আসুন। আমি সরবতের ব্যবস্থা করছি।
ঝামেলা করতে হবে না। আমি অফিসে বেশিক্ষণ থাকব না। এক্ষুণি চলে যাব।
কেন?
বলেছি তো আপনাকে, আমার শরীরটা ভাল না। মাথা ঘুরছে।
বড় সাহেব কাকে যেন টেলিফোন করছিলেন। হাত ইশারা করে মুনাকে বসতে বললেন। টেলিফোন নিশ্চয়ই খুব ব্যক্তিগত। তিনি নিচু গলায় কথা বলছেন এবং মনে হচ্ছে মুনার উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছেন। মুনার একবার ইচ্ছে হল বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বড় সাহেব হাত ইশারা করে বসতে বলেছেন। মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কথাবার্তা শুনতে ইচ্ছে করছে না, তবু শুনতে হচ্ছে। অফিসের এত বড় একজন মানুষ কেমন অসহায় গলায় কার যেন রাগ ভাঙবার চেষ্টা করছেন। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর।
বসুন। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
মুনা বসল। এই লোকটির অফিসে অনেক বদনাম আছে। কিন্তু মুনা কোনোটিই বিশ্বাস করে না। তার ধারণা ছোটখাটো এই মানুষটি নিতান্তই ভাল মানুষ। শুধু ভাল না, বেশ ভাল।
মিস মুনা!
জি।
ব্যাপার কি বলুন তো? তিন মাসের ছুটি চেয়েছেন।
আমার স্যার ছুটি পাওনা আছে।
সে তো সবারই আছে। আমারও হিসেব করলে এক বছরের ছুটি পাওনা হবে। তাই বলে কি আমি এক বছরের ছুটি নেব? বলুন?
মুনা জবাব দিল না। তার ধারণা ছিল ছুটি দিতে তিনি আপত্তি করবেন না।
মিস মুনা আপনার কি শরীর খারাপ?
জি না স্যার। শরীর ভালই।–
তাহলে এত লম্বা ছুটি দিয়ে কি করবেন? আপনার মামার চাকরি সংক্রান্ত যে ঝামেলা ছিল তাও তো মিটে গেছে বলে আমার ধারণা। মেটেনি?
জি মিটেছে।
বড় সাহেব সিগারেট প্যাকেট নাড়াতে নাড়াতে বললেন, মেটারনিটি লিভ ছাড়া এত লম্বা ছুটি কখনো দেয়া হয় না। বুঝতে পারছেন? তবে বিয়ে-টিয়ের কোনো ব্যাপার হলে মাস খানেক ছুটি নিন।
বিয়ে-টিয়ের কোনো ব্যাপার নয় স্যার।
ও আচ্ছা।
স্যার আমি তাহলে উঠি?
ঠিক আছে যান। অফিসে কি রকম কাজের চাপ বুঝতেই পারছেন। ইয়ার এন্ডিং। নিশ্চয়ই আপনার টেবিলে দশ-পনেরটা ফাইল পড়ে আছে। আছে না?
জি আছে।
বড় সাহেব ফাইলপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মুনা খুব মন খারাপ করে তার টেবিলে ফিরল। সে ধরেই নিয়েছিল আজ তার ছুটি হবে। এতটা আশা উচিত হয়নি। কেন সে করল কে জানে।
টেবিলে কি ফাইলের সংখ্যা আরো বেড়েছে? মুনা শুকনো মুখ করে তার চেয়ারে বসতেই পাল বাবু বিশাল এক গ্লাস লেবুর সরবত নিয়ে এলেন। সেটা দেখা মাত্র গা গুলাতে শুরু করল।
নিন এক চুমুকে খেয়ে ফেলুন। হেভি ট্রাবল হয়েছে জোগাড় করতে। লেবু কিনে এনে বানানো। ক্যান্টিনওয়ালাকে এক টাকা দিয়েছি চিনির জন্য। তাও ব্যাটা দিতে চায় না। যত ছোটলোক এসে জড় হয়েছে। নিন খান। চুমুক দিন।
রেখে দিন আপনি। আমি ধীরে-সুস্থে খাব। এখন ইচ্ছে করছে না।
মুনা দুপুর পর্যন্ত একনাগাড়ে কাজ করল। একটা থেকে লাঞ্চ ব্ৰেক। লাঞ্চ ব্রেকের কিছু সময় আগেই সেকশনাল ইনচার্জ মতিন সাহেব এসে বিরস মুখে বললেন, আপনি কি ছুটির দরখাস্ত করেছিলেন? মুনা মাথা নাড়ল। মতিন সাহেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল নয়। কথাবার্তা তেমন হয়। না।
ছুটির দরখাস্ত তো আমার মাধ্যমে যাওয়ার কথা, আপনি সরাসরি করেছেন কেন? ব্যাপার কি?
আপনি ঐ দিন ছিলেন না–তাই।
ঐদিন ছিলাম না, পরে এসেছি তো। নিখোজ তো হয়ে যাইনি। অফিসের একটা ডেকোরাম আছে। আইন-কানুন আছে। সে সব মানা উচিত। নাকি আপনি মনে করেন উচিত না?
মুনা কিছু বলল না। আশপাশের সবাই তাকাচ্ছে। টাইপিস্ট দু’জন টাইপ বন্ধ করে কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছে। মতিন সাহেবের কথা শোনার জন্য টাইপ বন্ধ করার প্রয়োজন ছিল না। তিনি বেশ উঁচু গলাতেই কথা বলছেন। ইচ্ছে করেই বলছেন। সবাইকে শোনাতে চান।
মিস মুনা।
জি স্যার।
বড় সাহেবের সাথে আপনার ব্যক্তিগত পরিচয় থাকতে পারে। শুধু আপনার কেন অনেকেরই থাকতে পারে তার মানে এই না যে, সামান্য ব্যাপারেও তার কাছে যেতে হবে। ভবিষ্যতে এটা দয়া করে মনে রাখবেন। প্লিজ।
মুনার চোখ ভিজে উঠল। সে কি বলবে ভেবে পেল না। সরি বলবে না চুপ করে থাকবে? মতিন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। একটা টাইপ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন তার দিকে। থমথমে গলায় বললেন, এই নিন। অর্ডার। বড় সাহেব আপনাকে দুমাসের ছুটি মঞ্জর করেছেন। যান বাড়ি গিয়ে ঘুমান। কাজের সময়টাতে যদি আপনাদের ছুটির দরকার হয় তাহলে অফিস খোলা রাখার মানে কি? সব বন্ধ করে দিলেই হয়।
মতিন সাহেব কি বলছেন না বলছেন তা মুনার কানে ঢুকছে না। সে টাইপ করা অর্ডারটি দ্বিতীয়বারের মত পড়ছে–স্বাস্থ্যগত কারণে আপনাকে দুমাসের ছুটি মঞ্জর করা হল। আপনি ছুটিতে যাবার আগে আপনার দায়িত্ব ডিলিং সেকশনের জুনিয়র এসিসটেন্ট জনাব রকিবউদ্দিন ভুইয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবেন।…
অফিস থেকে বেরুতে পাঁচটা বেজে গেল। পাল বাবু সঙ্গে এলেন রিকশা খুঁজে দেবার জন্যে। আসল কারণ অবশ্যি দুমাস ছুটি নেবার রহস্যটা জানা। এত কৌতূহল মানুষদের? মানুষের কৌতূহল যদি কিছু কম থাকত তাহলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হত। কিংবা কে জানে হয়ত কৌতূহল আছে বলেই হয়ত পৃথিবী সুন্দর।
হঠাৎ ছুটি নিলেন ব্যাপার কি?
এমনি নিলাম।
আমরা আরো ভাবলাম বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার।
না। ঐ ব্যাপার হলে আপনারা জানতেন। জানতেন না?
অবশ্যি ঠিক। ওদের সেই কথাই বলেছিলাম।
কাদের?
কলিগদের। সবাই জিজ্ঞেস করছিল।
মুনা রিকশায় উঠে পড়ল। ঝকঝকে সুন্দর আকাশ। অপরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাটে লোকজন গিজগিজ করছে কিন্তু আকাশটা কি নির্জন কি পরিষ্কার। মুনার বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। একা একা ঘুরতে ইচ্ছা করছে। কালও অফিস থেকে ফিরে একা একা বেশ খানিকক্ষণ ঘুরেছে। শাহবাগের একটা দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেস্ট্রি কোক খেয়েছে। আজও কি সে রকম করবে? নাকি যাবে মামুনের কাছে? এক’দিন না এক’দিন তো যেতেই হবে। আজই সে দিন হতে অসুবিধা কি? এখন অবশ্যি তাকে পাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিংবা কে জানে হয়ত পাওয়া যাবে। না পাওয়া গেলেও কোনো ক্ষতি নেই।
মামুন অবাক হয়ে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি এসেছি। আমার ধারণা ছিল তুমি কোনোদিনই আসবে না। তোমাকে শান্ত করবার জন্যে আমাকেই যেতে হবে। রাগ ভাঙাতে হবে। তোমার নেচার তো জানি। আজই যাব ভেবেছিলাম।
যাওনি তো।
না। যাইনি। সাহস হয়নি। তোমাকে কি বলর, কিভাবে ক্ষমা চাইব। তাই ভাবছিলাম ক’দিন ধরে। মারাত্মক মেন্টাল প্রেসার গেছে। এই ক’দিন ধরে। ইউ কেননট ইমাজিন।
এখন কি প্রেসারটা কমেছে?
হ্যাঁ কমেছে। যখন তুমি বলবে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ তখন পুরোপুরি কমে যাবে। এক মিনিট ব্যস, আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছে?
চা-টা দিতে বলি। যাব। আর আসব। রিল্যাক্স কর।
মামুন চটি ফটফট করতে করতে খুব ব্যস্ত ভাবে নিচে নেমে গেল। নেমে যাওয়ার ভঙ্গি কত সহজ কত স্বাভাবিক। মুনা নিজের মনেই খানিকক্ষণ হাসল। একটি দশ-এগার বছরের ছেলে কৌতূহলী হয়ে উঁকি দিচ্ছে। নতুন কাজের ছেলে বোধহয়। এই মেসে দু’দিন পরপরই নতুন কাজের ছেলে আসে। কিছুদিন থাকে তারপর কোনো-এক বোর্ডারের জিনিসপত্র চুরি করে চলে যায়। একবার মামুনের জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে গেল। ঐ ছেলেটার নাম ছিল রাখাল। মুনার সঙ্গে ভালই খাতির ছিল। তাকে আসতে দেখলেই ছুটে মামুনকে খবর দিত। মামুন যখন থাকত না সে ঘর খুলে দিত। মেঝেতে বসে গল্প করত।
রাখাল কি কারো নাম হয়? তুই তো আর গরু, চড়াস না যে নাম থাকতে হবে রাখাল?
আপা কি করমুকন। বাপ-মায় রাখছে।
হিন্দুদের রাখাল না থাকে। কিন্তু মুসলমান। নামটা বদলানো দরকার বুঝলি? সুন্দর রেখে একটা নাম দেব তোর। ঠিক আছে?
জি আইচ্ছা!
মুনা ভেবে রেখেছিল তারা যখন নতুন বাসা করবে তখন রাখালকে মেস থেকে নিয়ে নেবে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে সেখানে একটি চটপটে কাজের ছেলে দরকার। বাজার করবে, রান্না করবে, বাড়ি পাহারা দেবে।
চেহারা দেখে মানুষকে বোঝা বোধ হয় খুব মুশকিল। এই রাখাল যে এই কাণ্ড করবে। কে জানত।
মামুন একগাদা খাবার-দাবার এনেছে। ডালপুরি, পেঁয়াজু। ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা।
মুনা চা খাও। নিজে ঢেলে নাও। বেশ লাগছে খেতে। মামুন তার বিছানায় পা তুলে বসেছে। মাঝে মাঝে পা নাড়াচ্ছে। পা নাচান দেখতে ভাল লাগে না। আগে অনেকবার মামুনকে সে পা নাচাবার জন্যে বকা দিয়েছে। আজ কিছুই বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মুনা!
বল।
তুমি আসায় আমি যে কি পরিমাণ খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝানো মুশকিল। যা দুশ্চিন্তা করছিলাম। ঐ দিনের ব্যাপারটার জন্যে আমি খুব দুঃখিত।
দুঃখিত?
হ্যাঁ। দুঃখিত। লজ্জিত। অনুতপ্ত। ব্যথিত।
এত কিছু একসঙ্গে?
মামুন লক্ষ্য করল, মুনা চা খাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার মুখ ভাবলেশহীন। যেন সে তার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে দূরে কোথাও।
মুনা।
মুনা তাকাল তার দিকে, জবাব দিল না। মামুন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ঐ দিনটার ঘটনা আমি জাস্টিফাই করতে অনেক চেষ্টা করেছি। দেখ মুনা, আমাদের বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে আছে। আমবা দুজনে মিলে একটা বাড়ি ভাড়া করেছি। ঘর সাজাবার জিনিসপত্র কিনেছি। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। কিন্তু ধরতে গেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী। ঠিক না? বল তুমি, অ্যাম আই রাইট?
মুনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। মামুন তা লক্ষ্য করল না। যেন সে ক্লাসে বক্তৃতা করছে এমন ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলতে লাগল, দেখ মুনা, ঐদিন আশপাশে কেউ ছিল না। তুমি এবং আমি। হঠাৎ আমার বুদ্ধিাশুদ্ধি গুলিয়ে গেল। তুমি ব্যাপারটা কি ভাবে নেবে কিছুই ভাবলাম না। মানে…।
থাক আমি শুনতে চাই না।
শুনতে না চাওয়াই ভাল। আমিও বলতে চাই না। তার চেয়ে ভাবা যাক এ জাতীয় কিছু কখনো আমাদের মধ্যে হয়নি, ওটা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন।
মুনা তীক্ষু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মামুনের কেন জানি মনে হল চোখ দু’টিতে কোনো প্ৰাণ নেই। পশুর চোখের মত চোখ। যেখানে আবেগের ছায়া পড়ে না।
মুনা! তুমি কি আমাকে ক্ষমা করেছ?
ক্ষমা চাও তুমি?
হ্যাঁ চাই। ক্ষমা চাব না মানে? কি ভাব তুমি আমাকে, পশু?
না পশু ভাবি না। মানুষই ভাবি।
তাহলে বল তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ।
ঠিক আছে করলাম। এখন আমি উঠব।
পাগল, এখনি উঠবে মানে? রাত আটটা পর্যন্ত থাকবে। তারপর আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব এবং তোমাদের বাসায় রাতে খাব। তোমার মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের ডেট ফাইনাল করব। বিয়েটা এক সপ্তাহের ভেতর সেরে ফেলতে হবে। এমনিতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে।
মামুন অবাক হয়ে দেখল মুনা উঠে দাঁড়াচ্ছে। সে কি সত্যি চলে যাবে? মামুন হাত ধরে তাকে টেনে বসাতে গেল। মুনা কঠিন স্বরে বলল, হাত ছাড়। মামুন হাত ছেড়ে দিল। মুনা নিচু গলায় প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বলল, আমি এখানে এসেছিলাম একটা কথা বলবার জন্যে। কথাটা হচ্ছে তোমাকে আমি বিয়ে করব না।
কি বলছি পাগলের মত?
যা বলছি ভেবেচিন্তেই বলছি। আমি এক সপ্তাহ ধরেই ভাবছি। আজ তোমাকে বললাম।
সামান্য একটা অ্যাকসিডেন্টকে তুমি এত বড় করে দেখছি কেন? ভিক্টোরিয়ান যুগের কোন মহিলা তো তুমি না। এ কালের মেয়ে এ যুগের মেয়ে।
আমি কোন যুগের মহিলা জানি না। যে কথাটা বলতে এসেছিলাম বলে গেলাম।
শোন মুনা, শোন আমার কথা শোন। ছেলেমানুষির একটা সীমা থাকা দরকার। আমার কথাটা শোন। শান্ত হয়ে বাস।
মুনা কঠিন স্বরে বলল, আমার হাত ছাড় নয়ত আমি চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করব। মামুন হাত ছেড়ে দিল। মুনা ঘর থেকে নিঃশব্দে বের হয়ে এল। একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না।
সন্ধ্যা হয় হয় করছে। সন্ধ্যার আগে আগে সব কিছু কেমন অন্য রকম লাগে। পরিচিত। ঘরবাড়ি এমনকি পরিচিত মানুষকেও অপরিচিত মনে হয়। মুনা রিকশা করে বাড়ি ফিরছে। তার বারবার মনে হচ্ছে নিতান্তই অচেনা একটি শহরের অজানা একটি রাস্তায় তার রিকশা যাচ্ছে। এই বোধহয় ভাল। চেনা মানুষের চেয়ে অচেনা মানুষ ভাল।
মুনা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা পার করে। রিকশা থেকে নেমেই দেখল, বাকের ঠিক আগের জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে বাকেরকে লাগছে ভূতের মত। সে মুনাকে দেখেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। ভারী গলায় বলল, সন্ধ্যার পর মেয়েদের এমন একা একা ঘোরাফেরা করা ঠিক না। রোজ চেষ্টা করবে সন্ধ্যার আগে ফিরতে।
আপনি কি সারাদিন এই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন?
আরে না। কি যে বল; আমার কাজ আছে না?
বাকের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগল। মুনা বিরক্ত গলায় বলল, আপনি আমার পেছনে পেছনে আসছেন কেন? বাকের থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, তোমার কি হয়েছে?
কিছুই হয়নি। হবে। আবার কি?
কাঁদছ কেন?
কি আশ্চৰ্য। আমি কাঁদছি কেন সেই কৈফিযতও আপনাকে দিতে হবে?
না তা না। তোমাকে কাঁদতে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কেউ কিছু বলেছে?
কেউ কিছু বলেনি। আর বললেও আপনার কিছু যায় আসে না। প্লিজ, আমাকে বিরক্ত করবেন না।
না না বিরক্ত করব কেন? যাও বাসায় যাও।
মুনা ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল। বাকের তাকিয়ে রইল। মুনাকে সে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। তাকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি। কত রকম দুঃখ থাকে মানুষের। মানুষ হয়ে জন্মানোটাই একটা বাজে ব্যাপার।
বাকের এগিয়ে গেল। সাতটার ওপর বাজে। বয়েজ ক্লাবে নাটকের রিহার্সেল শুরু হবে। ছেলে-ছোকরাদের কারবার। বয়স্ক কারো থাকা দরকার। নাটকের জন্যে টাকা তুলে দিতে হবে। চার-পাঁচ হাজার টাকার কমে নাটক নামানো যায় না। এরা হুঁট করে একটা ডিসিসান নেয় ক্যামেলা সামলাতে হয় তাকে।
রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে!
এত রাতে রান্নাঘরে কে? মুনা ঘড়ি দেখল। রাত দুটো। চোর নাকি? বাসন-কোসন নড়াচড়া হচ্ছে। চোররা এত শব্দ করে কিছু করবে না। তাছাড়া সে জেগে আছে। টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। চোর আসার কথা নয়। একবার দেখে এলে হয়। কিন্তু কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। আগে কখনো এ রকম হত না। কিন্তু এখন কোথেকে একটা ভয় ঢুকে গেছে মনে। সন্ধ্যার পর পর একা একা রিকশায় চড়তে ভয় করে। দুপুর রাতে ঘুম ভাঙলে ভয় করে।
মুনা নিচু স্বরে ডাকল, বকুল, বকুল! বকুল নড়ল না। তার ঘুম পাথরের মত। টেনে বিছানা থেকে নামালেও ঘুম ভাঙবে না। বিয়ে হলে এই মেয়ের খুব ঝামেলা হবে। স্বামী বেচারা খুব বিরক্ত হবে। পৃথিবীর সব স্বামীরাই বোধ হয় চায় রাতে গায়ে হাত দেয়া মাত্র স্ত্রী জেগে উঠে আদুরে গলায় বলবে কি চাও? মুনা এসব আজেবাজে কথা ভাবছে কেন? তার নিজের ওপর রাগ লাগল। সে বকুলের শাড়ি ঠিক করে দিল। এত বড় মেয়ে কিন্তু কি বিশ্রী ঘুমুবার ভঙ্গি।
বকুল, বকুল।
বকুল পাশ ফিরল। কিন্তু কোনো শব্দ করল না। তার মুখ হাসি হাসি। সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে বোধ হয়। ওর বয়সে সে শুধু ভয়ের স্বপ্ন দেখত। একটা স্বপ্ন ছিল সাপের। স্বপ্নটা এত স্পষ্ট যে সব সময় মনে হত সত্যি। সে পুকুরে গোসল করতে গিয়েছে। পানিতে পা ছোঁয়াবার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে ভাসতে ভাসতে একটা সাপ আসতে থাকে তার দিকে। সে দৌড়াতে শুরু করে। সাপট তার পিছু ছাড়ে না। সে পাগলের মত কত অলিতে গলিতে ঢোকে৷ কিন্তু সাপটা থাকেই। পেছনে ফিরলেই সে দেখে লাল পুতির মত দু’টি চোখ। চেরা জিব। কি কুৎসিত স্বপ্ন! এমনিতেই কত ভয়াবহ সমস্যা মানুষের থাকে। ঘুমের মধ্যেও সেসব সমস্যা উঠে আসতে হবে? স্বপ্নটা কেন সব সময় আনন্দের হয় না?
বকুল, বকুল!
কি।
উঠ তো একটু। রান্নাঘরটা দেখে আসি। কে যেন খুঁটখাট করছে।
বকুল উঠে বসিল, বিছানা থেকে নামল। তার ঘুম কাটেনি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সে হেলে পড়ে যাচ্ছে। চোখ আধিবোজা। এখন মুনার মায়া লাগছে। ঘুম না ভাঙালেই হত।
স্বপ্ন দেখছিলি নাকি, এই বকুল।
না। কটা বাজে আপ?
দু’টা পাঁচ।
তারা দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দাটা বেশ ঠাণ্ডা। কার্তিক মাসের মাঝামাঝি ঠাণ্ডা হবারই কথা। কিন্তু ঘরে গুমটি গরম। এখনো ফ্যান ছেড়ে ঘুমুতে হয়। যখন পুরোপুরি শীত পড়বে তখন এই ঘরটি হয়ে যাবে হিমশীতল। কি অদ্ভুত যে বাড়ি।
রান্নাঘরে কিছুই নেই। জানালা বন্ধ। শিকল তোলা। বকুল বলল, ইঁদুর শব্দ করছে আপা। খুব ইঁদুর হয়েছে। এত মোটা একটা ধাড়ি ইঁদুর দেখেছি। মুনা কিছু বলল না। বকুল হাই তুলছে। ঘুম ভাড়িয়ে ওকে তুলে আনাটা খুব অন্যায় হয়েছে।
কে? কথা বলছে কে?
শওকত সাহেবের মোটা গলা শোনা গেল। মুনা বলল, মামা আমি। শওকত সাহেব। আর কিছু বললেন না। মুনা ভেবেছিল মামা জিজ্ঞেস করবেন, এত রাতে কি করছিস? তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে আসবেন। কিন্তু তিনি তা করছেন না। মামা কি বদলে যাচ্ছেন? হঠাৎ একা হয়ে পড়লে মানুষ দ্রুত বদলে যেতে শুরু করে। মুনা নিজেও কি বদলাচ্ছে না?
বকুল শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। হয়ত প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন দেখতে শুরু করছে। বিড়বিড় করে কি সব যেন বলছে। কেমন গভীর শোনাচ্ছে তার গলা। ঘুমের মধ্যে মানুষের গলার স্বর বদলে যায় নাকি? মুনা বাতি নিভিয়ে দিল। ঘুম আসবে না। বাকি রাতটা কাটাতে হবে জেগে। ইদানীং তার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। সন্ধ্যায় খুব ঘুম পায়। চোখের পাতা খুলে রাখা যায় না। এমন ঘুম। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কেটে যায়।
একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। ফ্যানটা বন্ধ করে দিলে হয়। উঠতে ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে উঠত কিন্তু তার ধারণা হল ফ্যান বন্ধ করলেই আবার গরম লাগতে শুরু করবে। আবার বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে হবে ফ্যান ছাড়বার জন্যে। রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হচ্ছে। ইদুর। ইদুরের উপদ্রব আগে ছিল না। হঠাৎ হয়েছে। শুধু নয়। সেই সঙ্গে প্রচুর তেলাপোকা। এত তেলাপোকাও আগে ছিল না। ঐদিন বাবু বলছিল, মা মারা যাবার পর বাড়িটা অন্য রকম হয়ে গেছে। বলেই সে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। এটা একটা সাধারণ সহজ কথা। এর মধ্যে লজ্জা পাওয়ার মত কিছু নেই। মামির মৃত্যুর পর বাড়িটা সত্যি সত্যি কিছু বদলেছে। মনে হয় বাড়িটা আগের মত নেই। পরিবর্তন কোথায় হয়েছে তা অবশ্যি ধরা যাচ্ছে না।
ভেতরের দিকে দরজা খোলার শব্দ হচ্ছে। মামা জেগেছেন। বারান্দার ইজিচেয়ারে তিনি এখন বসে থাকেন। রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে তিনি জেগে ওঠেন। তারপর তার ঘুম হয় না। বুড়ো বয়সের কত রকম সমস্যা। কিংবা কে জানে এটা হয়ত তেমন কোনো সমস্যা নয়; বুড়োদের হয়ত জেগে থাকতেই ভাল লাগে। মামা আজ ইজিচেয়ারে শুয়ে নেই। হাঁটাহাঁটি করছেন। সাড়ে তিনটা কি বেজে গেছে? মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল। আগের ঘড়িটায় অন্ধকারে সময় দেখা যেত। এটাতে দেখা যায় না। রেডিয়াম ডায়াল নেই। বাতি জ্বালাতে হবে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকার চেয়ে বাতি জ্বালিয়ে ঘড়িটা দেখা যেতে পারে। কিছুক্ষণ গল্প করা যেতে পারে মামার সঙ্গে।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তুই এখনো জেগে? মুনা মাথা নাড়ল।
প্রায়ই জেগে থাকিস নাকি? বাতি জ্বালা দেখি।
হুঁ থাকি।
শরীর ঠিক আছে তো?
হুঁ আছে।
একটা চেয়ার এনে আমার কাছে বাস তো দেখি।
না মামা, আমি এখন শুয়ে পড়ব। ঘুম আসছে।
পাঁচ-দশ মিনিট বাস।
মুনা চেয়ার নিয়ে এল। শওকত সাহেব মুনার পিঠে হাত রেখে কোমল স্বরে বললেন, শুনলাম অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিস। কি হয়েছে?
কিছু হয়নি। হবে কি? শরীরটা খারাপ তাই ছুটি নিলাম।
মামুনকে তো আর এ বাড়িতে আসতে দেখি না।
আমি আসতে নিষেধ করেছি। তাই আসে না। মামা, তোমাকে তো একবার বলেছি। ওকে আমি এখন পছন্দ করি না। ঐ প্রসঙ্গ থাক।
একটা মানুষকে এত দিন ধরে পছন্দ করে আসছিস। বিয়ে ঠিকঠাক। এখন হঠাৎ করে…।
মামা, ঐ প্রসঙ্গ বাদ দাও।
বাদ দেব কেন? জানতেও পারব না?
না পারবে না? এত জেনে কি করবে? বেশি জানা ভাল না। মুনা হাসতে চেষ্টা করল। তার ইচ্ছে করছে উঠে চলে যেতে। কিন্তু যেতে পারছে না। কারণ মামা তার পিঠে হাত দিয়ে রেখেছেন। পিঠ থেকে হাত নামিয়ে উঠে চলে যাওয়া যায় না।
মামুনকে একবার আসতে বলিস। ওর সঙ্গে কথা বলব।
মামা, পিঠ থেকে হাত নামাও আমি এখন ঘুমুতে যাব।
এখন আর ঘুমিয়ে কি কারবি। ভোর তো হয়ে গেল। তোর তো অফিসও নেই। আয় গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দেই।
কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। চোখ জ্বালা করছে।
শওকত সাহেব হাত নামিয়ে নিলেন। তার নিজেরও কেমন ঝিমুনী এসে যাচ্ছে। বয়স হয়ে যাচ্ছে। একটা বয়সের পর সবাই খুব ঝিমুতে পছন্দ করে। ঝিমুনোর মত বয়স কি তার হয়েছে? রিটায়ারমেন্টের এখনো তিন বছর বাকি। বরুণ বাবুরও তিন বছর বাকি রিটায়ারমেন্টের। কিন্তু এখনো তাকে জোয়ান বলে মনে হয়। জুলপির কাছে কিছু চুল পাকা ছাড়া মাথার সব চুল কালো। ঝিমুতে ঝিমুতে শওকত সাহেব একসময় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়লেন।
তাকে ডেকে তুলল। বকুল। তিনি দেখলেন রোদে চারদিক ঝলমল করছে। এত বেলা হয়ে গেছে। তিনি কল্পনাও করেননি।
ক’টা বাজে রে?
দশটা।
কি সর্বনাশ! আগে ডাকিসনি কেন?
মুনা আপা নিষেধ করে গিয়েছে।
নিষেধ করলেই হল? আমার কি অফিস-টফিস নেই?
শওকত সাহেব অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যে ভাবেই হোক এগারটার আগে অফিসে পৌঁছতে হবে। বড় সাহেব এগারটার সময় আসেন। এসেই একবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে যান। কে কে এখনো আসেনি সেটা মনে মনে নোট করেন।
বকুল!
জি।
মুনাকে ডেকে আন।
আপা তো বের হয়ে গেছে।
কোথায় গেছে? অফিস থেকে তো ছুটি নিয়েছে শুনলাম।
কোথায় গেছে জানি না বাবা। কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
জিজ্ঞেস করিাসনি কেন?
কাল জিজ্ঞেস করেছিলাম তাতে খুব রেগে গেল।
রাগলে রাগবে। রোজ জিজ্ঞেস করবি। ওর ব্যাপারটা কি?
জানি না বাবা।
জানি না বললে তো হবে না। জানতে হবে।
মুনা কাঁধে কালো ব্যাগ ঝুঁলিয়ে হাঁটছে। ক’দিন ধরেই সে এ রকম করছে। উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটা। কোনো একটি দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ানো তারপর আবার হাঁটা।
আকাশে গানগনে সূৰ্য। ঘামে মুনার মুখ চটচট করছে কিন্তু ভাল লাগছে হাঁটতে। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো বন্ধন নেই। অফিসের তাড়া নেই। ঘর ফেরার আকর্ষণ নেই। শুধু হেঁটে বেড়ানো।
মুনা এগারটার সময় রিকশা নিয়ে নিল। যাবে যাত্রাবাড়ি। যাত্রাবাড়িতে তার এক চাচা থাকেন–মনিব চাচা। তার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ নেই। হঠাৎ করেই তার কথা মনে পড়ল। মুনার দুঃসময়ে তিনি কোনো রকম দায়িত্ব নেননি। মুখ শুকনো করে বলেছিলেন, নিজের ছেলেমেয়েই মানুষ করতে পারি না। আর অন্যের মেয়ে মানুষ করব কি ভাবে? অসম্ভব। মেয়ের মামারা আছে তারা দেখুক। আমি গরিব মানুষ। নিজের চলে না।
মনিব সাহেব বাড়িতেই ছিলেন। তিনি মুনাকে দেখে খুবই অবাক হলেন। ভারী গলায় বললেন, কি রে তুই কি মনে করে? ভাল আছিস?
ভালই আছি। আপনি কেমন আছেন?
আর আমার থাকা। ব্লাড প্রেসার, নড়তে-চড়তে পারি না।
আপনি একা নাকি? আর কেউ নেই?
আছে সবাই আছে যা ভেতরে যা।
সবাই যথেষ্ট খাতির-যত্ন করল। চাচি মুনাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনেক দুঃখের কথা বললেন। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বেঁটা মিচকা শয়তান। এর কথা তাকে লাগাচ্ছে তার কথা ওকে লাগাচ্ছে। বড় মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি। কিন্তু ছোটটা বিয়ে করে ফেলেছে। তার একটা বাচ্চাও আছে। জামাইয়ের কোনো চাকরি-বাকরি নাই। শ্বশুর বাড়িতে থাকে। মুরুব্বিদের সামনে সিগারেট খায়। হায়া-শরম কিছুই নাই। আদব-কায়দা তো নাই-ই।
মুনা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল কেউ তার কথা বিশেষ জানতে চাচ্ছে না। সবাই নিজেদের সমস্যা বলতে ব্যস্ত। অন্যের ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই। মুনা থাকতে থাকতেই ছোট মেয়ে তার স্বামীর সঙ্গে একটা কুৎসিত ঝগড়া করে ফেলল। তুই-তুকারি গালিগালাজ বিশ্ৰী কাণ্ড। বাইরের একজন মানুষ আছে। এ নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। অন্যদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে।
বাড়ির মানুষজনের মধ্যে নতুন বৌটিকেই বরং ভাল লাগল। তাকে মোটেই মিচকা শয়তান বলে মনে হল না। কথাবার্তা চমৎকার। বেশ বুদ্ধিাশুদ্ধি আছে। মুনাকে তার ঘরে নিয়ে চা বানিয়ে খাওয়ালো। এই ছোট একটুখানি ঘরে চায়ের সরঞ্জাম এবং কেরোসিন কুকার।
বুঝলেন আপা, এই সংসারে কিছুদিন থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আলাদা যে বাসা করব সে উপায়ও নেই। ও যা টাকা-পয়সা পায় তাতে সকলের নাশতার খরচটাই ওঠে না।
করে কি সে?
সিনেমায় ছোটখাটো পার্ট করে।
বল কি?
হুঁ। বেশির ভাগ গুণ্ডার পার্ট পায়। মাথা কামিয়ে অভিনয় করতে হয়।
মুনা বড়ই অবাক হল। তার ধারণা ছিল না। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ সিনেমায় অভিনয় করে।
সংসার চলে কিভাবে?
চলে কোথায়? চলে না। দেশ থেকে চাল-ডাল আসে। বাবা টুকটাক কিছু ব্যবসা করেন। এখন অসুখে পড়ে সেই ব্যবসার খুব খারাপ অবস্থা। কি যে হবে ভাবতেও পারি না।
মুনাকে দুপুর বেলা খেয়ে তারপর আসতে হল। খাবার আয়োজন বেশ ভাল। মাছ, গোসত ভাজাভুজি। অনেক কয়টা পদ। বুঝাই যাচ্ছে এটা বিশেষ করে তার জন্যেই করা।
খাওয়া শেষ হবার পর মবিন চাচা নিজেই তাকে রিকশায় উঠিয়ে দিতে এলেন, তোর খোঁজখবর নেই মা! নেবার মত অবস্থা আমার না। নরকে বাস করি বুঝলি। ছেলে বিয়ে দিয়ে ডাইনি। ঘরে এমেছি। সব ছারখার করে দিচ্ছে। এমনি তো খুব মিষ্টি কথাবার্তা। কিন্তু আসলে বিষকন্যা। আসিস মাঝে-মধ্যে। তোর কথা মনে হয় প্রায়ই। ঐদিনও তোর চাচিকে বলছিলাম।
রিকশা ছুটে চলেছে। মুনার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। বেশ কষ্ট করে তাকে জেগে থাকতে হচ্ছে। আগামীকাল কোথায় যাওয়া যায়। তাই ভাবতে ভাবতে মুনার ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করতে লাগল।
মামুনের মন খারাপ হয়ে গেল
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মামুনের মন খারাপ হয়ে গেল।
শার্টের পকেটের কাছে এক পয়সার সাইজের একটা ফুটো তেলাপোকার কাণ্ড। এই শার্ট গায়ে দিয়ে বেরুনো যাবে না। সবাই তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু বদলে অন্য কিছু পরতেও ইচ্ছা করছে। না। এটা মুনার পছন্দ করে কিনে দেয়া শার্ট। মামুন ভেবে রেখেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলেই এটাই পরবে। তাতে মুনার উপর এক ধরনে মানসিক চাপ তৈরি হবে। লাল স্ট্রাইপের এই শার্ট নিঃশব্দে সারাক্ষণ বলবে।–মুনা, তোমাকে ভালবাসি। তোমাকে ভালবাসি। মেয়েদের মনস্তত্ত্বে ছেলেমানুষী একটা ব্যাপার আছে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়েরাও এ ধরনের হালকা জিনিস পছন্দ করে।
কিন্তু এটা পরে কী খাওয়া যাবে? ফুটোটা বেশ বড়। সাদা গেঞ্জি দেখা যায়। মামুন আয়নার সামনে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে মন ঠিক করল। থাকুক ফুটো। এতে একটা সুবিধা পাওয়া যাবে। মুনা এক সময় নিশ্চিত বলবে ১ পকেটের ওখানে কি? সে তখন মুখ কালো করে বলবে হৃদয়ের কাছাকাছি ফুটো হয়ে আছে। খুবই হালকা ধরনের কথা। তবে হালকা ধরনের কথাবার্তাও মাঝে মাঝে শুনতে ভাল লাগে।
মামুন মুনার অফিসে ঢুকে আকাশ থেকে পড়ল। মুনা নেই। সে নাকি দুমাসের ছুটি নিয়েছে। আজ নিয়ে পাঁচ দিন হল। কিন্তু অদ্ভুত কথা! পাল বাবু চোখ কপালে তুলে বলবেন, সে কী আপনি জানেন না?
জি না, জানি না।
বলেন কি? কেন জানেন না?
মামুন বিরক্ত হয়ে বলল, আমাকে বলেনি। তাই জানি না।
কিন্তু আপনাকে বলবে না কেন? হোয়াই? ঝগড়া চলছে নাকি?
না কিছু চলছে না।
বিরক্তিতে মামুনের চোখ সরু হয়ে গেল। পাল বাবু তার বিরক্তিকে মোটেও আমল দিলেন না। জোর করে তাকে ক্যান্টিনে নিয়ে আলুর চাপ এবং চায়ের অর্ডার দিয়ে বসলেন। মামুন শুকনো গলায় বলল, খামোকা এসব আনছেন। আমি কিছুই খাব না।
না খেলে না খাবেন। আমার সঙ্গে দুমিনিট বসতে তো অসুবিধা নেই। আরাম করে বসুন এবং ধীরে-সুস্থে বলুন ব্যাপারটা কি? ঝগড়াটা কি নিয়ে করলেন?
ঝগড়া হয়েছে আপনাকে কে বলল?
এসব বলার দরকার হয় না। আপনার চোখে-মুখে পরিষ্কার লেখা আছে। মান-অভিমানপর্ব বোঝা যায়। হা হা হা।
মামুন কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। আগে এই লোকটিকে ভালই লাগত। আজ কেমন গ্ৰাম্য লাগছে। কথার ফাঁকে থুথুর কণা ছিটকে আসছে। কিছু কিছু নিশ্চয়ই পড়েছে চায়ের কাঁপে এবং আলুর চাপে। কুৎসিত দৃশ্য। সহ্য করা মুশকিল। মামুন সাহেব।
বলুন।
রাগ ভাঙবার বুদ্ধি আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি। সোজা বুদ্ধি। জটিল সমস্যা গুলি সলভ করতে হয় সহজ বুদ্ধি দিয়ে। কঠিন বুদ্ধি খরচ করলে সমস্যটা আরো জট পাকিয়ে যাবে। চা খাচ্ছেন না। তো। ঠাণ্ডা হচ্ছে।
হোক ঠাণ্ডা। দুপুরে আমি চা খাই না।
তাহলে ঠাণ্ডা কিছু খান–লাচ্ছি আছে। এই ইনাকে ভাল করে লাচ্ছি দাও।
আপনি শুধু শুধু ব্যস্ত হচ্ছেন আমি কিছুই খাব না।
আরে ভাই খান। খেতে খেতে আমার বুদ্ধিটা শুনুন। কিছু না যাবেন, সোজাসুজি পায়ে ধরে ফেলবেন এবং কান্না কান্না গলায় বলবেন ক্ষমা চাই।
রাগে মামুনের গা জ্বলে গেল। কি রকম ইডিওটিক কথাবার্তা। এ ধরনের কথাবার্তা একজন শিক্ষিত মানুষ বলে কি করে?
বুঝলেন মামুন সাহেব, এপ্রোচটা নাটকীয় কিন্তু এর নাম হচ্ছে কোরামিন ইনজেকশান। এটাতেই রোগের আরাম হবে। আর যদি কাজ না হয় তাহলে আপনি অফিসে এসে আমার ডান গালে একটা চড় দিয়ে যাবেন। হা হা হা।
এখানে বসে সময় নষ্ট করার আর কোনো মানে হয় না। যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই এর বকবকানি শুনতে হবে।
উঠলেন নাকি?
জি উঠলাম।
লাচ্ছি। তো মুখেই দিলেন না।
বলছি তো আপনাকে, কিছুই খাব না।
আপনি মিস মুনার বাসায় চলে যান। যা বললাম সেটা করেন। শ্ৰীকৃষ্ণের মত দেবতা যদি রাধার পা ধরতে পারে তাহলে আপনার ধরতে বাধা কী?
বকুল আজ স্কুলে যায়নি। স্কুল খোলা আছে, টেস্ট পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্যে ক্লাস হচ্ছে না। একা একা বাসায় তার ভয় ভয় লাগছিল। কাজের মেয়েটি তার এক খালার বাড়িতে গেছে এখনো আসেনি। বাবুর স্কুল ছুটি তিনটায়। এতক্ষণ একা একা থাকতে হবে। সে ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠে নিচু গলায় বলছিল কে? একা ঘরে থাকলেই যত ভূতের গল্পগুলি মনে পড়ে যায়। টিনা ভাবীর কাছে শোনা একটা গল্প তখন থেকেই মনে হচ্ছে কাটা হাতের গল্প। কবজি পর্যন্ত কাটা একটা হাত মানুষের ঘরে এসে ঢোকে। নানান কাণ্ডকারখানা করে। বকুলের দুপুর থেকে মনে হচ্ছে হাতটা তাদের ঘরে এসেছে। রান্নাঘরে খুটখাট করছে। সে একা একা বসে আছে রান্নাঘরে। তার দুপুরের খাওয়া হয়নি। বাবু না আসা পর্যন্ত হবেও না। একা একা রান্নাঘরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
দুটোর সময় দরজার কড়া নড়ল। বকুলের আনন্দের সীমা রইল না। যাক কেউ-একজন এসেছে। সে দরজা খুলে দেখল মামুন ভাই। হেঁটে হেঁটে এসেছেন বোধ হয়। ঘেমে লাল হয়ে আছেন।
কেমন আছ বকুল?
জি ভাল আছি।
মুনা বাসায় নেই?
জি না। আপা নেই।
কোথায় গেছে?
জানি না। কোথায় যেন ঘুরে বেড়ায়।
বল কি।
ভেতরে আসুন মামুন ভাই। আপনি আসায় যা ভাল লাগছে। একা একা খুব ভয় লাগছিল।
একা তুমি?
জি একা।
মামুন ভেতরে ঢুকল। কথাবার্তা কী বলবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ অবশ্যি অপেক্ষা করা যায়। মামুন বলল, সে সাধারণত কখন ফিরে?
কোনো ঠিক নেই। অনেক সময় সন্ধ্যার পর ফিরে।
বল কি?
আপনাদের ঝগড়া হয়েছে তাই না মামুন ভাই?
মামুন ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ হয়েছে। তোমাকে সে কি কিছু বলেছে?
না, মুনা। আপা মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবে না। আপনাকে একটু চা করে দেই?
উঁহু! ভাত খাইনি এখনো।
আমাদের এখানে খান। আমিও খাইনি।
না ভাত খাব না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাব। তুমি আমাকে ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দাও।
মামুন মুখ কালো করে বসে রইল। বকুল ঠাণ্ডা পানি বদলে ভাত বেড়ে বলল, খেতে আসুন মামুন ভাই। মামুন নিঃশব্দে খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। বড় মায়া লাগল বকুলের। কেমন আগ্রহ করে খাচ্ছেন। নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
বকুল!
জি।
আমার ব্যাপারে তোমার আপা তোমাকে সত্যি কিছু বলেনি?
জি না।
আমি একটা অন্যায় করেছিলাম বুঝলে বকুল। তার জন্যে আমার লজ্জার সীমা নেই। আমি তো মহাপুরুষ না। সাধারণ মানুষ। মহাপুরুষেরাও ভুল করে। অন্যায় করে। করে না?
বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মামুন ভাই ক্লাসে বক্তৃতা দেবার মতো ভঙ্গিতে কথা বলছেন। ওদের ভেতর কি সমস্যা হয়েছে কে জানে? বড় জানতে ইচ্ছা করছে।
মামুন খাওয়া শেষ হওয়া মাত্র চলে গেল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে চলে যাওয়া। যেন সে হঠাৎ সবার উপরে বিরক্ত হয়ে উঠেছে। মনস্থির করছে কিছু-একটা করবে। কেমন থমথমে মুখ।
বাবু এল সাড়ে তিনটার দিকে। শীতের দিন। সাড়ে তিনটায় কেমন বিকেল বিকেল হয়ে যায়। বাবুকে ভাত বেড়ে দিয়ে বুকল বলল, তুই কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবি বাবু? আমি ভাবীদের বাসায় পাঁচ মিনিটের জন্যে যাব। বাবু গম্ভীর গলায় বলল, একবার গেলে এক ঘণ্টার আগে আসবে না।
যাব আর আসব। উনার ছেলেদের জ্বর। দেখে আসা দরকার। যাই বাবু? লক্ষ্মী ময়না।
আচ্ছা যাও।
একা এক ভয় লাগবে না তো?
আমার এত ভয় নেই।
ইস কি আমার সাহসী। রাতে তো একা একা বাথরুমে যেতে পারিস না।
বাবু কিছু বলল না। কথাটা সত্যি। দিনের বেলা তার কোনো ভয় লাগে না। কিন্তু রাত হলেই দারুণ ভয় লাগে।
টিনা ভাবী ঠোঁট উল্টে বললেন, তারপর কি মনে করে? তার মনে ভাবী রেগে আছেন। রাগাই স্বাভাবিক। দু’দিন খবর পাঠাচ্ছেন্ন আসবার জন্যে। আসা হচ্ছে না।
বাচ্চারা কেমন আছে ভাবী?
তা জেনে তোর কী হবে? ওরা জ্বরে বেইশ হয়ে পড়ে থাকলেই বা কি আর ভাল থাকলেই বা কি?
বকুল বেশ লজ্জা পেল। দু’টি বাচ্চার প্রচণ্ড জ্বর। হাত-পা এলিয়ে ঘুমাচ্ছে। জ্বরের আঁচে গা কেমন লালাভ হয়ে আছে।
ডাক্তার দেখিয়েছ ভাবী?
হুঁ দেখিয়েছি। তোর ডাক্তারকেই আনিয়েছিলাম। ও ডাক্তারি কিছু জানে না বলে মনে হয়, কি ওষুধপত্র দিয়েছে তাতে জ্বর আরো বেড়ে গেছে।
অন্য ডাক্তার দেখাও। দেশে কি আর ডাক্তার নেই? কত বড় বড় ডাক্তার আছে।
অন্য ডাক্তার দেখাব। চক্ষুলজার জন্যে পারছি না। বেচারা রোজ দুতিনবার এসে খোঁজ নেয়। এখন যদি দেখে অন্য ডাক্তায় এনেছি…। মহা যন্ত্রণায় পড়লাম বুঝলি।
তুমি আজই অন্য ডাক্তার খবর দাও।
তাই দিতে হবে। তোর ভাই চোঁচামেচি করছে। আমি আজ দিনটা সময় নিয়েছি। আজ দিনের মধ্যে না কমলে অন্য ডাক্তারের কাছে যাব।
ভাবী দেখ, গা ঘামছে। জ্বর বোধ হয় নেমে যাচ্ছে। ঠোঁট চাটছে। ওদের একটু পানি খাওয়াই। খাওয়া। বোতলে গুকোজ সরবত আছে দেখ। আমি একটু গা ধুয়ে আসি।
পাঁচ মিনিটের জন্যে এসে এক ঘণ্টার ওপর কাটিয়ে দিল। তার উঠে আসতে ইচ্ছে করছে না। টিনা ভাবী দুই বাচ্চাকে দুই পাশে নিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প করছে। এত ভাল লাগছে দৃশ্যটি দেখতে। একই রকম দেখতে দু’টি বাচ্চাকে দুপাশে নিয়ে শোবার মতো আনন্দ বোধ হয়। আর কিছু নেই। বকুলের মনে হল–ইস। তার যদি এ রকম দু’টি বাচ্চা হত। এটা মনে হতেই সে লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল। তার মনে হল টিনা ভাবী তার মনের কথাটা টের পেয়ে ফেলেছে।
বকুল!
কী ভাবী?
তো বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে হয়। কার সঙ্গে কথা বলব? তোর আসল গার্জেন তো বোধ হয় তোর বোন।
বকুল মাথা নিচু করে বসে রইল। উত্তর দিল না। টিনা হালকা গলায় বলল, তুই কিছু মনে করিস না বকুল–তোর এই বোনটাকে আমার পছন্দ হয় না। কেমন পুরুষ পুরুষ ভাব।
মুনা আপা খুব ভাল মেয়ে।
ভাল মেয়ে তো বটেই। তোদের ঝামেলার যেভাবে ঝড় সামাল দিয়েছে। এ রকম কাঁটা পুরুষ পারবে? তবে ব্যাপার কি জানিস বকুল.. তোর আপা হচ্ছে কঠিন ধরনের মেয়ে। মেয়েরা কঠিন হলে ভাল লাগে না। মেয়েরা হবে নরম ধরনের। আহাদী। কথায় কথায় কেঁদে ফেলবে… যেমন তুই?
আমি বুঝি আহাদী?
না আহাদী না। তুই হচ্ছিস মায়াবতী।
মুনা আপা বুঝি মায়াবতী না?
না।
বকুলের মন খারাপ হয়ে গেল। মুনা আপা সম্পর্কে কেউ কিছু বললে তার ভাল লাগে না। রাগ লাগে।
বকুল, এমন মুখ কালো করে ফেলেছিস কেন?
ভাবী, আমি উঠি?
এখন উঠবি কি? আরেকটু বস। তোর ডাক্তার আসবে কিছুক্ষণ মধ্যে। তার সঙ্গে দুই-একটা কথাটথা বল।
কি যে তুমি বল ভাবী।
বিয়ের আগে কথাটথা বলা হাতের সঙ্গে হাত লেগে যাওয়া এইসব খুব ভাল লাগে। অন্য রকম একটা আনন্দ হয়। বিয়ের পর দেখবি এইসব খুব পানসে লাগছে। শরীরের সঙ্গে শরীরের পরিচয়ের আগের যে প্রেম সেটার মত ভাল আর কিছু নেই।
টিনা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল। মনে মনে বকুলও একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার কেমন ভয় ভয় করে। এত রহস্য পৃথিবীতে। এইসব রহস্যের মধ্যে বড় হওয়া বেশ কষ্টে।
বকুল। একটু চা করতে পারবি। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছি না।
ঘুমাও।
উঁহু। তোর ভাই আসবে। ঘুমিয়ে আছি দেখলে মুখ ভারী হয়ে যাবে। পুরুষ মানুষদের তুই তো চিনিস না। অদ্ভুত জিনিস।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই।
বাচ্চা দু’টি এমন ওদের যন্ত্রণাতেই রাতে ঘুমুতে পারছি না–শেষ রাতে একটু তন্দ্ৰামত এসেছে তখন তোর ভাই ডেকে তুলল। তার নাকি ভীষণ মাথাব্যথা চুল টেনে দিতে হবে। উঠে গেলাম চুল টেনে দিবার জন্যে–ও আল্লা দেখি মাথা ব্যথা কিছু না তার অন্য কিছু চাই।
বকুল মুখ লাল করে বসে রইল।
পুরুষের মত স্বার্থপর জাত আর তৈরি হয়নি। নিজের বাচ্চারা এমন অসুস্থ এর মধ্যে কেউ কি পারে…
বকুল কথার মাঝেই উঠে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে বলল, ভাবী আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসি।
লজ্জায় তুই দেখি একেবারে লাল হয়ে গেছিস। এসব খুব সাধারণ ব্যাপার। বিয়ের দু’দিন পর দেখবি ডাল-ভাত হয়ে গেছে।
বকুল চা বানিয়ে এসে দেখে টিনা ভাবী ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম থেকে জাগানোর কোনো মানে হয় না। সে নিজেই চাটা খেল। বাচ্চা দু’টির জ্বর আসলেই অনেকখানি কমেছে। এরা ঘুমের মধ্যে হাসছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার দু’জন একই সঙ্গে হাসছে। একটি স্বপ্নই বোধ হয় দেখছে দু’জন। বকুল নিচু হয়ে ওদের কপালে চুমু খেল। কেমন দুধ দুধ গন্ধ। একবার চুমু খেলে মুখ উঠিয়ে নিত ইচ্ছা করে না। বুকের মধ্যে কেমন অদ্ভুত ভাবে শিরশির করে। কেন করে? কোনোদিন বোধ হয় তা জানা যাবে না।
বকুল বেরুল চারটার একটু আগে। বেরুনো মাত্র দেখা হল ডাক্তার ছেলেটির সঙ্গে। বকুলের বুক ধ্বক করে উঠল। এক পলকের জন্যে দুলে উঠল সব কিছু।
বকুল ভাল আছ?
রুগী দেখতে গিয়েছিলো?
হুঁ।
আছে কেমন ওরা?
ভাল।
তোমার তো আর দেখাই পাওয়া যায় না। স্কুলে যাও না?
এখন আমাদের ক্লাস হচ্ছে না।
ক্লাস হচ্ছে না কেন?
টেস্টের প্রিপারেশনের জন্য।
কেমন হচ্ছে প্রিপারেশন?
ভাল। আমি এখন যাই?
এই সপ্তাহের মধ্যেই আমার মা যাবেন তোমাদের বাসায়।
বকুল কিছু বলল না। জহির হাসিমুখে বলল, মাকে তোমার ছবি দেখিয়েছি; মা কি বললেন জান? মা বললেন–মেয়েটার নাকটা এত মোটা কেন? জহির বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। এত লজ্জা লাগছে বকুলের। একই সঙ্গে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা শুনতেও ইচ্ছা করছে। সম্পূর্ণ দুরকম জিনিস একসঙ্গে মানুষের মনে আসে কিভাবে কে জানে।
বকুল!
জি।
তুমি দেখি ঘেমে-টেমে একটা কাণ্ড করছি। এত অস্বস্তি বোধ করছ কেন? এ কালের মেয়েরা কত স্মার্ট থাকে।
আমি যাই এখন।
বকুলের পা পাথরের মত ভারী। বড্ড কষ্ট হচ্ছে পা টেনে টেনে যেতে। কান্না পেয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আসছে। যখন এই ছেলেটির সঙ্গে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করবে। উঠে চলে যাবার কোনো তাড়া থাকবে না। কে দেখে ফেলবে এই নিয়ে চাপা আতংক থাকবে না। কি প্রচণ্ড সুখের সময়ই না হবে সেটা। ঝুম বৃষ্টি নামলে তারা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজবে। হাত ধরাধরি করে ভিজবে। ভাবতে বকুলের চোখ জলে ভর্তি হয়ে গেল। সুখের কথা ভাবতেও যে কষ্ট হয় কেন কে জানে। এত বিচিত্র কেন পৃথিবীটা। কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। কাকে সে জিজ্ঞেস করবে?
মামুন এসেছিল
মামুন এসেছিল। দুপুরে ভাত খেয়েছে।
এই খবরে মুনা বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাল না। সে আজ একগাদা জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যা পার করে। তিনটা বড় বড় প্যাকেট তার হাতে। উৎসাহ নিয়ে কি কি সে কিনল। তাই দেখাচ্ছে। জিনিসপত্রগুলি বিচিত্র। একটা গ্লোব। ব্যাটারি লাগান। সুইজ টিপলেই পৃথিবী ঘুরতে থাকে। একটা নব ঘুরিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণনের বেগ কমানো বা বাড়ানো যায়। মুনা উজ্জ্বল মুখে বলল, জিনিসটা সুন্দর না? বাবু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ সুন্দর। এটা কি জন্যে কিনেছ?
পছন্দ হয়েছে তাই কিনেছি। আসল জিনিসটা দেখলে মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে।
কি সেটা?
রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর দেখবি। শাড়ি কিনলাম দুটা। দেখ তো বকুল কেমন।
শাড়ি দেখে বকুল অবাক। কি চড়া রঙ চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব দামী শাড়ি।
শাড়িগুলি কেমন কিছু বলছিস না কেন?
গায়ে কটকট করবে।
করুক কটকট। আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি যে সাদা শাড়ি পড়তে হবে?
রাতের খাবার-দাবার শেষ হয়ে যাবার পর আসল জিনিসটা বেরুল। একটি ক্যাসেট প্লেয়ার। ছোটখাটো চমৎকার একটা জিনিস। বাবু অবাক হয়ে বলল, কত দাম আপা?
তেইশশ টাকা। জিনিসটা কেমন?
সুন্দর খুব সুন্দর। এত টাকা কোথায় পেলে তুমি?
ব্যাংকে যা ছিল খরচ করে ফেললাম। কি হবে টাকা জমিয়ে? পাঁচটা ক্যাসেট কিনেছি কোনটা দিব বল। রবীন্দ্র সঙ্গীত না হিন্দি। হিন্দি ক্যাসেট আছে তিনটা। একটা আছে পুরনো দিনের গান। কোনটা দেব বল?
বকুল বা বাবু কেউ কিছু বলল না। মুনা মহাউৎসাহে নিজেই একটি ক্যাসেট চালু করল। শওকত সাহেব তাস খেলে রাত নটার দিকে বাড়ি ফিরে শুনলেন–গান হচ্ছে–মাটি মে পৌরণ, মাটি মে শ্রাবণ, মাটি মে তনবিন জায়গা যব মাটি মে সব মিল যায়গা।
শওকত সাহেব বড়ই অবাক হলেন।
বাকের ঠিক করল। আজ বিকেলে যাবে ও-বাড়িতে। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা দরকার। দু’টি মেয়ে ছিল। ক’দিন ধরে দেখা যাচ্ছে তিনটে মেয়ে। তিন নম্বরটি বেঁটে ধরনের। মোটাসোটা। তবে এ অন্য দুজনের চেয়েও সুন্দর, গায়ের রঙ সোনার মত। মাথা ভর্তি চুল। এর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়েছে এক’দিন মুন্দির দোকানে এসেছে কিসমিস কিনতে। কালো একটা চশমায় মুখ ঢাকা। শীতের দিনের বিকেলে যখন চারদিক এমনিতেই অন্ধকার তখন এ রকম একটা কালো চশমার মানে কি মুখ ঢেকে রাখা না?
জোবেদ আলীকে জিজ্ঞেস করেছিল মেয়েটির কথা। জোবেদ আলী গম্ভীর মুখে বলেছে। ওদের চাচাত বোন। চিটাগাং-এ থাকে। বেড়াতে এসেছে।
কি পড়ে?
বিএ ফাস্ট ইয়ার।
এখানের দু’জন ওরা কি পড়ে?
এরা আইএ পড়ে।
কলেজে-টলেজে তো দেখি না।
ভর্তি হয়নি এখনো। ট্রান্সফার নিয়ে এসেছে।
ও আচ্ছা।
ভর্তি নাও হতে পারে। বাবার কাছে চলে যেতে পারে।
ইরানে?
না ইরাকে।
এই ইরান-ইরাক ব্যাপারটাও সন্দেহজনক। পোস্টম্যানকে বাকের জিজ্ঞেস করেছিল–বিদেশী চিঠিপত্র এদের কেমন আসে? পোস্টম্যান বলেছে…. এই ঠিকানায় এখনো চিঠিপত্র আসা শুরু করে নাই। এর মানে কি? দুমাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে চিঠিপত্র দিয়ে কেউ খোঁজ করবে না?
সবচে যা সন্দেহজনক, মেয়ে তিনটি পাড়ার কোনো বাড়িতে এখন পর্যন্ত যায়নি। এই বয়সের মেয়েরা দিনরাত ঘরে বসে থাকবে কেন? তাছাড়া এরা প্রচুর গয়না পরে। অবিবাহিত মেয়েরা সাজগোজ করে ঠিকই এত গয়না পরে না। ব্যাপারটা নিয়ে ইয়াদের সঙ্গে আলাপ করলে ভাল হত। কিন্তু ইয়াদ হারামজাদাটা বিয়ের পর ভেড়ুয়া নাম্বার ওয়ান হয়ে গেছে। সেই তেজ সেই সাহসের কিছুই নেই। মাথার মধ্যে তার শুধু সংসার ঘুরছে। সেদিন গিয়ে দেখে গামছা পরে কমোড় পরিষ্কার করছে। বেরিয়ে এসে বলল, কি করব বল বৌয়ের পরিষ্কার বাতিক। চাকর-বাকরের হাতে দিলে কিছুই হয় না। তুই নিজের চোখে দেখ কেমন ঝকঝকে করে ফেলেছি।
তোর বৌ কোথায়?
বাপের বাড়ি গেছে। আজ থাকবে সেখানে। আমাকে যেতে হবে। নয় তো তোর সঙ্গে জাম্পেশ আড্ডা দিতাম। শালা আড্ডা দেওয়াই ভুলে গেলাম।
না গেলেই হয় শ্বশুর বাড়িতে। থেকে যা আড্ডা দেই। পাড়ায় একটা ব্যাপার হচ্ছে এটা বলি।
ইয়াদ আঁতকে উঠল। হতাশ মুখ করে বলল, কোন উপায় নেই রে ভাই। আমি না গেলে ভূমিকম্প হয়ে যাবে। ওর আবার আমি পাশে না থাকলে ঘুম হয় না। ভূতের ভয়। অল্প বয়সের মেয়ে বিয়ে করে যারা ভুল করেছি রে ভাই।
রাগে গা জ্বলে যাবার মত কথা। ইয়া ধামড়ি মেয়ে বলে কী-না অল্প বয়সের মেয়ে।
পাড়ার সমস্যা কি বল শুনি। অনেক’দিন যাওয়া হয় না। সবাই আছে কেমন?
ভালই।
নাটক হচ্ছে নাকি? বদরুলের সঙ্গে দেখা হল? বই কোনটা নামাচ্ছিস?
জানি না এখনো।
তারপর বল কি ব্যাপার?
বাকের বলতে শুরু করতেই ইয়াদ তাকে থামিয়ে দিল। মুখ কাচুমাচু করে বলল, মেঝেতে ছাই ফেলিস না রে দোস্ত। বউ রাগ করে। দাঁড়া এসট্রে দিচ্ছি। কার্পেটে ছাই ফেললে তোলা মুশকিল। আঠার মত লেগে যায়।
বাকেরের মুখ তেতো হয়ে গেল। কি ছিল আর কি হয়েছে। বিয়ে তো আরো মানুষে করে কিন্তু এ রকম কেউ হয়? হারামজাদার পাছায় লাথি দিয়ে মুখে দুধের বোতল ধরিয়ে দিতে হয়।
ইয়াদ বাহারি একটা এসস্ট্রে এনে রাখল।
কেমন অদ্ভুত এসট্রে দেখলি। কচ্ছপের মত। সুন্দর না?
হুঁ।
দাম কত বল দেখি?
জানি না কত। আমি উঠলাম।
এখনি উঠবি? কি যেন বলবি বলছিলি।
আরেক দিন বলব।
আচ্ছা আসিস আরেক দিন।
বাকেরের আফসোসের সীমা রইল না। এত পয়সা খরচ করে এখানে আসাটা ভুল। শালা ভেভুয়া। পাড়ার একটা ব্যাপার। কিন্তু কোনো উৎসাহ নেই। এ কি অবস্থা। অথচ এক কালে এরই আশা-ভরসা ছিল।
সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বাকের গেটে টোকা দিল। এরা একটা দারোয়ানও দেখি রেখেছে। দারোয়ানটার মধ্যে ড্যাম কেয়ার ভাব। দারোয়ান খসখসে গলায় বলল, কারে চান?
গেট খোল।
কারে চান বলেন?
আরে তুই তো মহা মাতবর দেখছি। চড় দিয়ে চাপার দীত ফেলে দিব। বাড়ি কোথায় তোর?
চুপ, মুখ সামলাইয়া কথা কন।
হারামজাদা বলে কি?
মেয়ে দু’টির মা বের হয়ে এলেন। সাদা সিন্ধের শাড়ি। পরনে চোখে রিমালেস চশমা। সিনেমার বড়লোক ছেলের মার মত চেহারা। ভদ্রমহিলা চিকন স্বরে বললেন, কি হয়েছে খসরু?
আম্মা ঝামেলা করতাছে।
গেট খুলে দে।
ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে মধুর গলায় বললেন, এস বাবা। এস। নতুন লোক, কার সঙ্গে কি ব্যবহার করতে হয় জানে না। বাকের খাতির-যত্বের বহরে হকচকিয়ে গেল।
বসার ঘরটি সুন্দর করে সাজানো। দেয়ালে তিনটা জলরঙ ছবি। ঝুলন্ত হ্যাংগারের অর্কিড। নিচু নিচু সোফা। তরমুজ আকৃতির ছটা বাতি রুপালি শিকলে ঝুলছে।
বাবা, তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।
আমার নাম বাকের।
ও আচ্ছা। জোবেদ আলী বলেছে তোমার কথা।
নতুন এসেছেন। খোঁজ-খবর নিতে আসলাম।
ভাল করেছি। খুব ভাল করেছ। মেয়েগুলিকে নিয়ে একা একা থাকি। বস বাবা কি খাবে?
কিছু খাব না।
তা কি হয়? প্রথম এসেছি।
তিনি নিজেই উঠে গিয়ে মিষ্টি নিয়ে এলেন। রুপোর গ্রাসে পানি। কিন্তু মেয়েগুলি আসছে না, উকি-কুঁকিও দিচ্ছে না।
তুমি করে বলছি। রাগ হচ্ছে না তো।
জি না।
জোদেব আলী বলছিল, তোমরা নাকি নাটক করছ?
জি একটা হচ্ছে।
কি নাম নাটকের?
নাম ঠিক হয় নাই।
নাটক তো খুব খরচান্ত ব্যাপার। টাকা-পয়সা জোগাড় হচ্ছে কীভাবে?
চাঁদা তুলে। সবাই দিচ্ছে।
কই আমার কাছে তো তোমরা কেউ আসনি?
বাকের অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে সন্দেহে ভেঙে মুখে দিল। সুন্দর একটা গন্ধ সন্দেশে। বাকের কান খাড়া করে রাখল। যদি ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায়। কোনো রকম সাড়াশব্দ নেই।
বাকের উঠে আসার সময় ভদ্রমহিলা তাকে এক হাজার টাকা দিলেন নাটকের খরচের জন্য। বাকেরের মুখ শক্ত হয়ে গেল। রহস্য পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
আবার এস বাবা।
জি আসব।
নাটকে আমার খুব সখ্য ছিল। এখন কিছুই নেই।
বেরুবার সময় দারোয়ান সালাম দিয়ে গেট খুলে দিল। বাকের এই প্রথম দেখল মেয়ে তিনটি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে তাকে। তার দিকে চোখ পড়তেই দু’টি মেয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বেটেটা শুধু দাঁড়িয়ে রইল। এদের কারো নাম জানা হল না। জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
দারোয়ান গেটে তালা লাগাচ্ছে। বাকের ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, মেয়েগুলির নাম কী জান? দারোয়ান এমন ভাবে তাকিয়ে রইল যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারছে না।
নাম জান না ওদের?
জি না।
কী ডাক?
বড় আফা, ছোট আফা, মাইঝা আফা।
ও আচ্ছা।
বেঁটে মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। বাকের গেটের কাছে দাঁড়িয়েই সিগারেট ধরাল। এই সিগারেটটা সে এখানে দাঁড়িয়েই শেষ করবে। দেখবে মেয়েটা কি করে। মেয়েটি ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু দারোয়ান গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।
আমার নাম ফজলু
শওকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।
আমার নাম ফজলু। ফজলুর রহমান।
আমি আপনাদের পাশেই থাকি। ঐ যে লাল দালানটা। লোহার গেট। গেটের পেছনে কামিনি ফুলের গাছ আছে। আমি আগেও কয়েকবার এসেছি আপনার বাসায়।
শওকত সাহেব খুব লজ্জা পেলেন। একই পাড়ায় পাশাপাশি থেকে চিনতে না পারাটা লজ্জার ব্যাপার। এক সময় সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এখন একেবারেই নেই। অফিসে যান। অফিস থেকে ফিরে এসে বারান্দায় বসে থাকেন। এ রকম হয়ে যাচ্ছেন্ন কেন?
আমার স্ত্রীর সঙ্গে বকুলের খুব ভাব। ওরা প্রায়ই গল্পগুজব করে। আমার স্ত্রীর নাম হচ্ছে টিনা।
ও আচ্ছা। বসুন্ন ভাই বসুন। বয়স হয়ে গেছে কিছু মনে থাকে না।
আমাকে নাম ধরে ডাকবেন। বকুল আমার স্ত্রীকে টিনা ভাবী ডাকে। আমি বলতে গেলে আপনার ছেলের মত। বকুলের সঙ্গে আমার ভাই সম্পর্ক।
তাই নাকি?
জি। কাজেই আপনিও যদি ভাই ডাকেন তাহলে ঝামেলা হয়ে যাবে। সম্পর্কটা ঠিক থাকা দরকার।
ফজলু উঁচু গলায় হাসতে লাগল। শওকত সাহেব অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। কি কথাবার্তা চালাবেন? কথা বলতে ইচ্ছাও হচ্ছে না। ক্লান্তি লাগছে। শরীর ভাল না, শুয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে। তার আবার মনে হল বয়স হয়ে গেছে। তিনি দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন।
আপনি বসুন আমি বকুলকে ডেকে দিচ্ছি।
ওকে ডাকার দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে এসেছি। দরকারে এসেছি।
একটা দরকারি কথা বলব।
বলুন।
তার আগে এক কাপ চা খাব। বাসা থেকে চা না খেয়ে বেরিয়েছি। টিনা বলল, তুমি চাচার সঙ্গে কথাটা সেরে এসেই চা খাও। আমি ভাবলাম মন্দ কি!
শওকত সাহেব চিন্তিত মুখে চায়ের কথা বলে এলেন। তার সাথে এমন কি কথা থাকতে পারে? পাড়ার কোনো ব্যাপার কি? হতে পারে। মাঝে মাঝে হঠাৎ দু’একজন মানুষ এসে পাড়া দরদী হয়ে যায়। ক্লাবট্রিাব করে। একবার কি একটা পরিচ্ছন্ন কমিটি হল। তিনি হলেন সেই কমিটির মেম্বার। সপ্তাহখানিক এর-ওর বাড়িতে চা খাওয়া ছাড়া সেই কমিটি কিছু করেনি। একদিনের জন্যে একজন মেথর ভাড়া করে এনেছিল সে ঘণ্টা তিনেক কোদাল দিয়ে নর্দমা নাড়াচাড়া করে কুড়ি টাকা নিয়ে ভোগে গেল। পরিচ্ছন্ন কমিটিরও সমাপ্তি।
আমি বকুলের বিয়ের একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
শওকত সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। ইতস্তত করে বললেন, বকুলের বিয়ে? আমি তো ঠিক…
আগে সবটা শুনে নিন। তারপর আপনার যা বলার বলবেন। আমি এবং আমার স্ত্রী দু’জনই বকুলকে খুব পছন্দ করি। আমি ওকে দেখি নিজের বোনের মত। ওর যাতে ভাল হয় তাই আমরা দেখব–এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
ফজলু থামল। কারণ রকুল চা নিয়ে ঢুকেছে। অবাক হয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। বকুলের চোখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ।
বকুল, কেমন আছ?
জি ভাল।
তোমার ভাবী জলপাইয়ের একটা আচার বানিয়েছে, একবার গিয়ে চোখে আসবে। নিজ দায়িত্বে রাখবে। হাহা হা।
বকুল হাসিতে যোগ দিল না। কাপ নামিয়ে চলে এল। তার বুক ঢ়িপঢ়িপ করছে। আজই কি সেই দিন? হয়ত বা। টিনা ভাবী বলেছিল। সে নিজেই আজকালের মধ্যে প্রস্তাব নিয়ে আসবে। তা না করে কী ফজলু ভাইকে পাঠিয়েছে? ফজলু ভাই কি গুছিয়ে কিছু বলতে পারবে? সে নিশ্চয়ই সব এলেবেলে করে দেবে। কি বলতে কী বলবে। তাছাড়া আগেই বাবার সঙ্গে কথা বলছে কেন? আগে মুনা আপার সঙ্গে কথা বলা দরকার–মুনা আপা যদি প্রথমেই বলে না। তাহলে তো এ নিয়ে আগানোই যাবে না। যদি কোন কারণে হ্যাঁ বলে ফেলে তবেই শুধু বাবার সঙ্গে কথা বলা উচিত। তার আগে নয়।
বকুল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। কথাবার্তা তেমন কিছু শোনা যাচ্ছে না। ফজলু ভাইয়ের কথা দু’একটা শোনা গেলেও বাবার কথা কিছুই কানে যাচ্ছে না। বাবু তার ঘর থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ছে। এমন চেঁচিয়ে পড়লে কিছু শোনা যায়? বকুলের ইচ্ছে করছে বাবুকে গিয়ে বলে–এত চেঁচিয়ে পড়ছিস কেন? মনে মনে পড়তে পাড়িস না। কিন্তু বাবুকে এসব কিছুই বলা যাবে না। সে একশটিা কথা বলবে, চেঁচিয়ে পড়লে কি হয়? তোমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। হয়ত একটা ঝগড়াই বাঁধিয়ে বসবে। বাবু এখন কথায় কথায় তার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাচ্ছে।
বকুল!
বকুল চমকে উঠল। মুনা আপা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। সরু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সর্বনাশ।
কি করছিস এখানে?
কিছু না আপা।
বকুল এগিয়ে এল ভয়ে ভয়ে। তার মুখ শুকিয়ে গেছে। বুক ধ্বক ধ্বক করছে। মুনা। আপা নিৰ্যাৎ জেরা করতে শুরু করবে।
বসার ঘরে কে কথা বলছে?
ফজলু ভাই।
ফজলু ভাইটা কে?
টিনা ভাবীর হাসবেন্ড।
তুই কি আড়ি পেতে কথাবার্তা শুনবার চেষ্টা করছিলি?
না আপা।
না। আপা মানে? আমি তো বেশ খানিকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস। কি করছিলি?
চা দিতে গিয়েছিলাম আপা।
চোখ-মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? ব্যাপারটা কি?
কিছু না আপা।
তোর বিয়েটিয়ে নিয়ে কোনো কথা?
আমি জানি না।
বকুল এই শীতেও ঘামতে লাগল। বড় লজ্জার ব্যাপার হয়ে গেল। তার ইচ্ছে করছে মুনা আপার সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু পা দু’টি হয়ে আছে পাথরের মত। বকুল খুব সহজ ভাবে হাসতে চেষ্টা করল পারল না। মুনা আপা এখনো তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার মুখ থমথম করছে। কেন যে দরজার পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিল।
ছেলে ডাক্তার। ছেলের বাবা নেত্রকোনা শহরের নামকরা উকিল ছিলেন–আবদুস সোবহান সাহেব। রাজাকাররা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মেরে ফেলেছে। নেত্রকোনা শহরে ওদের বিরাট বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে ছেলের মা এবং ছোট ভাই ছাড়া আর কেউ থাকে না। ঢাকাতে মোহাম্মদপুরে ওদের একটা দোতলা বাড়ি আছে। তিন হাজার টাকা ভাড়া আসে বাড়ি থেকে।
ছেলে দেখতে কেমন?
আমার কাছে তো ভালই মনে হয়। আপনি নিজেও তো দেখেছেন। এই বাড়িতে তো সে আসে। মানে অসুখ-বিসুখ হলে তাকে আনা হয়। ডাক্তার জহির।
শওকত সাহেব অবাকই হলেন। ছেলেটিকে তার পছন্দ। ভদ্র ছেলে। বয়সও কমই মনে হয়। ফজলু হাসিমুখে বলল, ছেলে কেমন কি তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, আপনার মেয়ের ছেলেকে খুব পছন্দ।
কি বলছেন এসব?
ঠিকই বলছি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বকুলের কথা হয়েছে। আপনি বকুলকে ডেকে জিজ্ঞেসও করতে পারেন।
আরে না। আমি এসব জিজ্ঞেস করব কেন?
জিজ্ঞেস করে নেয়াটা ভাল। তাছাড়া আজকালকার যুগে ছেলেমেয়ের নিজেদের পছন্দে বিয়ে হওয়াটাই ভাল। তাতে সমস্যা কমে যায়।
বকুল বাচ্চা মেয়ে সে আবার…।
বাচ্চা মেয়েদের তো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। পারে না?
শওকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, আমি মুনার সঙ্গে আলাপ করে দেখি। মুনা রাজি হবে না।
দেখুন কথা বলে। আমার স্ত্রীও উনার সঙ্গে কথা বলবেন। আমারও মনে হয় বিয়েটা বকুলের জন্য ভালই হবে। আমি উঠি এখন।
আরে না বসুন। আরেক কাপ চা খান। বকুল, বকুল।
ফজলু উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, এখন আর চা খাব না। বাসায় গিয়ে গোসল করব। আমি আবার অফিস থেকে ফিরেই গোসল করি। অনেক দিনের অভ্যাস।
দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফজলু আবার ফিরে এল।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ছেলের মা এখন ঢাকায় আছেন। কয়েক দিন ঢাকায় থাকবেন। সম্ভব হলে এর মধ্যে বকুলকে দেখিয়ে দিন।
শওকত সাহেব মুখ কালো করে বললেন, মুনা কিছুতেই রাজি হবে না। ওর ইচ্ছা বকুলের পড়াশোনা আগে শেষ হোক।
রাজি না হলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে। দিনকাল খারাপ। মেয়ে বিয়ে দেয়া এখন মহাসমস্যা। ছেলে পাওয়া যায় না। বিয়ের যুগ্যি ছেলেদের কোন চাকরি-বাকরি নেই। বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তা ঠিক।
এই আমাকেই দেখুন না, সামান্য চাকরি তবু ডিসট্রিক্ট জজের মেয়ের প্রস্তাবও এসেছিল।
ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ছেলেদের তো গায়েই হাত দেয়া যায় না। ঠিক বলছি না?
জি ঠিকই বলছেন।
মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিন।
দেখি মুনার সঙ্গে কথা বলে।
শওকত সাহেব রাত দশটার সময় মুনাকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলতে লাগলেন। শীত খুব বেশি পড়েছে। তার অফিসের কে যেন বলছিল শ্ৰীমঙ্গলে বরফ পড়েছে। আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে। এ রকম শীত কখনও পড়ত না। বুড়ো মরা শীত একেই বলে। ইত্যাদি।
মুনা বেশ খানিকক্ষণ মন দিয়ে মামার কথা শুনল। তারপর হাসতে হাসতে বলল, এই ভদ্রলোক তোমাকে কি বললেন সেটা বল, শুনে চলে যাই। কেন শুধু শুধু দেরি করছ? শওকত সাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।
উনি কি বকুলের বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন?
বুঝলি কি করে?
আন্দাজ করলাম। ডাক্তার ছেলে?
হুঁ।
তুমি কি বললে?
আমি না-ই করে দিয়েছি। বলেছি মেয়ের বয়স খুবই কম। পড়াশোনা করছে। এখন তুই ভেবে দেখ। তুই যা বলবি তাই। আসল গার্জেন হলি তুই।
মুনা হাই তুলে বলল, বিয়ে দিয়ে দাও।
শওকত সাহেব বুঝতে পারলেন না এটা কি সে ঠাট্টা করে বলছে না। সত্যি সত্যি বলছে। তিনি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।
বিয়ে হয়ে যাওয়াটাই ভাল।
কেন? ভাল কেন?
বকুল হচ্ছে বউ টাইপ মেয়ে। বিয়ের জন্যে মনে মনে সে তৈরি হয়েছে।
কি বলছিস তুই!
ঠিকই বলছি। ছেলেটাও ভাল। দেখি তো প্রায়ই।
তুই ভালমত চিন্তা করে তারপর বল। ফন্ট করে হ্যাঁ বলার দরকার কি? এমন কোন তাড়া তো নেই।
চিন্তা করেই বলছি। ওরা নিজেরা আগ্রহ করে আসছে সেটা দেখা দরকার। এ রকম আগ্রহ নিয়ে বকুলের জন্যে খুব বেশি ছেলে আসবে না।
আসবে না বেন? বকুল কী দেখতে খারাপ?
খারাপ হবে কেন? বকুলের মতো রূপসী মেয়ে কমই আছে। কিন্তু বিয়ে-টিয়ের ব্যাপার শুধু মেয়েটাকে কেউ দেখে না। সব কিছু মিলিয়ে দেখে। বিয়ে কোন আলাপ হলেই সবাই জানাবে তুমি চুরির দায়ে এক সময় জেলে গিয়েছিলে। চোরের মেয়েদের ভাল বিয়ে হয় না।
শওকত সাহেব মুখ কালো করে ফেললেন। এ রকম কঠিন একটা কথা মুনা এমন স্বাভাবিক ভাবে বলল? মুখে এতটুকু আটকাল না।
বিয়ে দিয়ে দাও মামা; বকুলের ঐ ছেলেকে খুবই পছন্দ।
ওর পছন্দের কথাটা আসছে কেন?
আসবে না কেন? নিশ্চয়ই আসবে। বিয়েটা তো সেই করছে।
পছন্দ করবার জন্যে ছেলেকে সে পেল কোথায়?
পেয়েছে যে ভাবেই হোক। সেটা আমাদের দেখার ব্যাপার না। মামা, আমি উঠলাম।
বোস, আরেকটু বোস।
না মামা, আমার শরীরটা ভাল লাগছে না।
বকুল আড়চোখে মুনার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের বইপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেন পৃথিবীর কোনো দিকে তার দৃষ্টি নেই। বাবু বসেছে তার উল্টো দিকে। সে পড়ছে চেঁচিয়ে। মুনা শুয়ে পড়ল। বাবু বলল, আপা আমরা বসার ঘরে গিয়ে পড়ব? বাতি নিভিয়ে দেব এ ঘরের?
এত সকাল সকাল শুয়ে পড়লে যে আপা?
এমনি, ভাল লাগছে না।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?
না লাগবে না।
বকুল এবং বাবু বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে চলে গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার এ ঘরে চলে এল। ঘর অন্ধকার। বারান্দা থেকে আলো এসে তেরছা ভাবে মুনার গায়ে পড়েছে। সেই আলোর জন্যেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণেই হোক মুনাকে খুব অসহায় লাগছে। বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, আপা ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
বসি একটু তোমার পাশে?
বোস।
বকুল মাথার কাছে বসল। বেশ কিছু সময় দুজনের কেউ কোনো সাড়াশব্দ করল না। এক সময় বাবু এসে উঁকি দিল।
আপা তোমরা এমন চুপচাপ বসে আছ কেন?
মুনা হালকা গলায় বলল, ইচ্ছে করলে তুইও এসে বোস। বাবু এল না। চলে গেল এবং আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান পড়তে লাগল। মুনা বলল–হঠাৎ এমন চেঁচিয়ে পড়া ধরেছে কেন বল তো? এ রকম মাইক লাগিয়ে কেউ পড়ে? বুকল হেসে ফেলল। মুনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ওদের কোন স্যার নাকি চেঁচিয়ে পড়তে বলেছেন। এতে নাকি পড়া তাড়াতাড়ি মুখস্থ হয়।
তোর পড়া কেমন হচ্ছে রে বকুল?
হচ্ছে।
ভালমত পড়। বিয়ে যদি হয় তারপরও পড়াশোনা চালিয়ে যাবি।
বিয়ের কথা উঠল। কেন?
ভাল করেই জানিস কেন উঠল। তুই তো আড়ি পেতে শুনছিলি।
বকুল চুপ করে গেল। মুনা হালকা গলায় বলল, অল্প বয়সে বিয়েটা খারাপ না। মন কোমল থাকে। সংসারের খারাপ দিকগুলি চোখে পড়ে না।
তুমি হঠাৎ এমন কথা বলছ কেন আপা? আগে তো এ রকম বলতে না।
মানুষ তো সব সময় এক রকম থাকে না।
তুমি বদলে যাচ্ছ আপা।
হ্যাঁ বদলে যাচ্ছি। বয়স হচ্ছে। খুঁজে দেখলে দু’একটা পাকা চুলও বোধ হয় পাবি।
বকুল নিচু গলায় বলল, আপা তুমি কাঁদছ?
কি বলছিস পাগলের মত? কাঁদব কেন শুধু শুধু?
তোমার গলাটা অন্য রকম শুনাল।
অন্য রকম মানে?
কেমন যেন ভারী ভারী। কান্না চেপে রাখলে যেমন লাগে।
মনে হচ্ছে খুব কান্না বিশারদ হয়ে গেছিস।
মুনা নিচু গলায় হাসল। বকুলও হেসে ফেলল।
বকুল এক কাপ চা বানিয়ে আন তো। মাথা ধরেছে। আদা থাকলে আদা দিস। না থাকলে লিকার চা। আর দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যা। আলো চোখে লাগছে।
বকুল চা বানিয়ে ফিরে এসে, একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মুনা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। কান্নার দমকে সে বারবার কেঁপে উঠছে। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে সে কান্না চেপে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বকুল হতভম্ব হয়ে দরজার পাশেই দাঁড়িয়েই রইল। একবার শুধু বলল, চা এনেছি আপা। মুনা কিছুই বলল না। বকুল নিজেও তার চোখ মুছতে লাগল। কাউকে কাঁদতে দেখলেই তার কান্না পায়। সে ভাঙা গলায় ডাকল, আপা।
কি?
তোমার কি হয়েছে আমাকে বলবে? কিছুই হয়নি। তুই এ ঘর থেকে যা। চায়ের কাপ টেবিলের উপরে রেখে চলে যা।
বাকের একটা মোটর সাইকেল জোগাড় করেছে
বাকের একটা মোটর সাইকেল জোগাড় করেছে।
মটর সাইকেলটা মজিদের। তাকে বলেছে–দশ মিনিটের জন্যে দে তো গুলিস্তান যাব। আর আসব। মজিদ কিছুক্ষণ গাইগুই করলেও শেষটায় বিরসমুখে চাবি দিয়েছে। সেটা মঙ্গলবারের কথা। আজ হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে মজিদ। দশবারের মত বাকেরের বাসায় এসেছে। নোট লিখে গেছে। জলিলের চায়ের দোকানে খবর দিয়েছে কোন লাভ হয়নি। বাকেরের কোন হদিস নেই।
মোটর সাইকেল জিনিসটা বাকেরের বেশ পছন্দ। কেনা সম্ভব নয়। এক সঙ্গে এতটা টাকা তার হাতে আসে না। ভাগ্যক্রমে মজিদেয় জিনিসটা যখন সঙ্গে আছে যত দূর সম্ভব ব্যবহার করা যাক। এর মধ্যে পেছনের একটা ল্যাম্প ভেঙে চুরমার। এটা ঠিক না করে মজিদের জিনিস তার কাছে ফেরত দেয়াও এক ঝামেলা। সে ল্যাম্প সারাতে দুশ টাকার মত লাগে। এও আরেক যন্ত্রণা। দুশ টাকা তার সাথে নেই। ইয়াদের কাছে চাওয়া যায়। কিন্তু ঐ শালা খচ্চরের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে না।
বাকের অবশ্যি শেষ পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক করল। ইয়াদকে ধরতে হবে তার অফিসে। মিতিঝিল পাড়ায় অফিস। একবার এসেছিল, এখন কী খুঁজে বের করতে পারবে? জায়গা-টায়গা তার মনে থাকে না। দৈনিক বাংলার মোড়ে এসে সে একটা মজার দৃশ্য দেখল। হকার স্ট্যান্ডের সামনে মুনা দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে ম্যাগাজিন দেখছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনের পাতা উল্টায় পুরুষেরা। একজন মেয়েও যেন এ রকম করতে পারে তা সে ভাবেনি। বাকের তার মািটর সাইকল রেখে এগিয়ে এল।
মুনা, কি করছ?
দেখতেই পারছেন কি করছি। পত্রিকা পড়ছি।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছি মানে?
বসে বসে পড়ার কোন উপায় নেই। চেয়ার-টেবিল দেয়নি দেখছেন না।
মুনার এই জিনিসটা বাকেরের ভাল লাগে। চটাচিটা জবাব দিবে। এক সেকেন্ডও ভাববে না। যেন জবাবটা তৈরিই ছিল! বাকের এ রকম গুছিয়ে কিছু বলতে পারে না;
মুনা, একটু এদিকে আসি তো জরুরি কথা আছে।
মুনা এগিয়ে এল।
বলুন কি ব্যাপার?
আইসক্রিম খাবে?
আইসক্রিম খাব কেন শুধু শুধু।
না মানে কড়া রোদ তো।
কড়া রোদ উঠলেই লোকজন আইসক্রিম খায়?
বাকের কি বলবে ভেবে পেল না। মুনা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এটা কি আপনার জরুরি কথা?
না। ইয়ে শুনলাম। বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে — সত্যি নাকি?
হুঁ।
ডাক্তারের সাথে?
হ্যাঁ, ডাক্তারের সাথে। জহির উদ্দিন।
ভেরি গুড। ছোকরা খারাপ না ভালই। কমু্যনিটি সেন্টার ভাড়া নিয়েছ? না নিয়ে থাকলে নিও না। হাফ খরচে বাড়ির সামনে প্যান্ডেল খাটিয়ে ব্যবস্থা করে দেব। নো প্রবলেম।
মুনা হেসে ফেলল। বাকের অবাক হয়ে বলল, হাসছ কেন?
বেকার যুবকরা সামান্য একটা কাজ পেলে কেমন লাফিয়ে ওঠে তাই দেখে হাসছি।
বাকের মিইয়ে গেল। মুনা বলল, আইসক্রিম খাব না। তবে চা খেতে পারি। আশপাশে ভাল চায়ের দোকান আছে?
আশপাশে না থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে মোটর সাইকেল আছে।
কি আছে?
মোটর সাইকেল। ভটভটি।
মোটর সাইকেলে আপনার পিছনে বসে চা খেতে যাব? পাগল হয়েছেন নাকি? আশপাশে কোথাও চায়ের স্টল থাকলে চলুন যাই।
তোমার অফিস নেই?
না ছুটি নিয়েছি।
কি জন্যে?
ঘুরে বেড়াবার জন্যে।
বাকের কিছুই বুঝতে পারল না। খুঁজে পেতে চায়ের স্টল একটা বের করল। মেয়েদের জেনা কেবিন আছে। মুনা ঠোট উল্টিয়ে বলল, কোন নরকে নিয়ে এসেছেন। আপনি?
কি করব, ভাল কিছু নেই এদিকে। উঠে পড়বে?
এসেছি। যখন চা খেয়েই যাই।
আমি একটা সিগারেট ধরালে তোমার অসুবিধা হবে মুনা?
না অসুবিধা হবে না।
বাকের খুব কায়দা করে সিগারেট ধরাল এবং এই সঙ্গে খুব সাবধানে মানিব্যাগটা ঠিক আছে কিনা দেখল। চা খাবার পর যদি দেখা যায় মানিব্যাগ আনা হয়নি। কিংবা পকেট মারা গেছে তাহলে সর্বনাশ। মেয়েমানুষের কাছে হাত পাততে হবে। বেইজ্জাতি ব্যাপার হবে।
চাটা ভালই বানিয়েছে কি বল মুনা?
ভাল কি দেখলেন এর মধ্যে আপনি? বমি আসছে।
কফি খাবে? কফি পাওয়া যায়। এক্সপ্রেসো কফি।
না। যথেষ্ট হয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি শেষ করুন।
বাকের কোনো রকম তাড়া দেখাল না। তার ইচ্ছা করছে অনন্তকাল এই ঘুপসি ঘরটাতে বসে থাকতে।
মুনা।
বলুন।
মামুন সাহেবের সঙ্গে তোমার ঝগড়া হয়েছে নাকি?
ঝগড়া হবে কেন?
এমনি জিজ্ঞেস করছি। আগে তো প্রায়ই আসতেন তোমাদের বাসায় এখন আসতে দেখি না।
আপনি কী দিনরাত মানুষের বাসার দিকেই তাকিয়ে থাকেন? কে আসছে কে যাচ্ছে তাই দেখেন?
না তা না। তোমাদের বিয়ে কবে?
হবে শিগগিরই। হলে খবর পাবেন। সস্তায় কোথায় ডেকোরেটর পাওয়া যায়। এইসব খোঁজ তো আপনাকেই করতে হবে।
মুনা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। বাকের বলল, এখন কি বাসায় যাবে?
হুঁ।
চল একটা রিকশা করে দি।
রিকশা আমি নিজে নিয়ে নেব। আপনার যেখানে যাবার যান;
আমার তেমন কোন কাজ নেই। একটা অবশ্যি আছে সেখানে পরে গেলেও কোন ক্ষতি হ না। বকুলের বিয়ের তারিখ হয়েছে নাকি?
মোটামুটি ভাবে হয়েছে, তেসরা জ্বিলকদ।
জিলকদটা আবার কি?
আরবি মাসের নাম। মোহররমের আগের মাস হচ্ছে জিলকদ। বিয়েশাদিতে আরবি মাস ব্যবহার করা হয় জানেন না?
না জানি না তো।
রিকশায় উঠে মুনার বিরক্তির সীমা রইল না। বাকের মোটর সাইকেলে করে তার পেছনে আছে। ভাবটা এর রকম যেন পাহারা দিতে দিতে যাচ্ছে। একবার ইচ্ছা হল কড়া করে ধমক দেয়। কিন্তু ধমক দিতে মায়া লাগছে। চোখে চশমা পরে কেমন মহাকাপ্তান ভঙ্গি নিয়ে এসেছে চেহারায়। ঠোঁটে আবাবু একটা সিগারেট কামড়ে ধরা আছে। রিকশাওয়ালা একবার একটু বেশি স্পিড দিয়ে ফেলায় সে বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছে–থাবরা দিয়ে মুখ ভোতা করে দেব। একসিডেন্ট করে প্যাসেনজার মারতে চাস নাকি? অত্যন্ত বিরক্তিকর অবস্থা। মাঝে মাঝে আবার দু’হাত ছেড়ে মোটর সাইকেল চালাবার চেষ্টা করছে। এটা বোধ হয় নতুন কোন কায়দা। মুনা ভেবে পেল না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ কী করে মাঝে মাঝে এমন বির্বোধের মতো আচরণ করে? নাকি সে ঠিক বুদ্ধিমান নয়? বুদ্ধিমান মানুষ স্বার্থপর হয়। এটাই নিয়ম। টিকে থাকবার জন্যেই তাকে স্বার্থপর হতে হয়। বাকেরকে কী স্বার্থপর বলা যাবে? না বোধ হয়।
বকুলকে আজ তার শাশুড়ি দেখতে আসবেন
বকুলকে আজ তার শাশুড়ি দেখতে আসবেন।
এর মানে কি বোঝা যাচ্ছে না। জহিরের আত্মীয়-স্বজন এর আগে কয়েক দফায় তাকে দেখে গেছে। আংটি পরিয়ে দিয়েছে। বিয়ের তারিখ ঠিক করেছে। এরপর আবার মা আসছেন কেন? টিনা এসে বকুলকে খানিকটা ভয়ও পাইয়ে দিয়েছে। গম্ভীর হয়ে বলেছে, খুব ক্যাটক্যাটে মহিলা। স্কুল মাস্টারি করেছে। কিছুদিন তাই মেজাজ। এ রকম হয়েছে। কথাবার্তা সাবধানে বলবি। বেশি। কথা বলার দরকার নেই।
বকুল বলল, উনি কী বিয়েটা পছন্দ করছেন না?
না।
বুঝলে কি করে, তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে?
না, জহির আমাকে কথায় কথায় বলল; তোর একটা ছবি দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ছবির দিকে না তাকিয়েই বললেন, মেয়ের নাক মোটা।
আমার নাক কি মোটা?
নাক ঠিকই আছে। বুদ্ধি মোটা।
বকুলের মন খারাপ হয়ে গেল। তার বুদ্ধি কম এটা সে নিজেও জানে। যাদের বুদ্ধি বেশি তারা পাটিগণিত ভাল জানে। সে একেবারেই জানে না। মেট্রিকে সে যদি ফেল করে পাটিগণিতের জন্যেই করবে।
ভদ্রমহিলার সন্ধ্যাবেলা আসার কথা। তিনি বিকেলে একা একা চলে এলেন। চল্লিশ-পয়তাল্লিাশ বছর বয়সী একজন মহিলা। লম্বা, ফর্সা, রোগা মাথা ভর্তি ঘন কালো চুল। পান খাবাব। কারণে ঠোট টকটকে লাল। সাদা সিন্ধের শাড়ি পরেছেন। শাড়ির ওপর নীলের ওপর সাদা কাজ করা একটা চাদর। তাকে দেখে মনেই হয় না তার এত বড় একটা ছেলে আছে। তিনি রিকশা থেকে নেমেই বললেন, খুব ফার্স ফর্সা শুনেছি, তুমি কিন্তু মা একটু কালো।
মুনা হেসে ফেলল।
আপনি ভুল মেয়েকে দেখেছেন। ফার্স মেয়ে ঘরে আছে। আমার নাম মুনা। আমি বকুলের মামাতো বোন।
ভদ্রমহিলা মোটেই অপ্রস্তুত হলেন না। আরো শক্ত করে মুনার হাত চেপে ধরলেন। মুনার মনে হল ইনি ইচ্ছে করেই ভুলটা করছেন। তিনি ভালই জানেন এই মেয়ে তার ছেলের পছন্দের মেয়ে নয়। ছবি দেখেছেন অন্যদের কাছে শুনেছেন।
মুন্না, তোমার নাম?
জি।
তোমার কথা আমি জহিরের কাছে শুনেছি।
কি শুনেছেন?
তুমি নাকি খুব শক্ত মেয়ে।
আপনার কাছে কি সে রকম মনে হচ্ছে? я
হ্যাঁ হচ্ছে। আমি নিজেও বেশ শক্ত মেয়ে। জহিরের চার বছর বয়সে তার বাবা মারা গেলেন। তারপর আমিই এদের এত দূর টেনে তুললাম। শক্ত মেয়ে না হলে কি এটা সম্ভব তুমিই বল।
বকুলকে দেখে তিনি তেমন কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। গল্প করতে লাগলেন শওকত সাহেবের সঙ্গে। ঘর-বাড়ির গল্প, জমিজমার গল্প। পঞ্চাশ বিঘা জমি আছে তার। জমির বিলিব্যবস্থা নিয়ে যে সব সমস্যা হচ্ছে তার গল্প। ঘুরে ঘুরে প্রতিটি ঘর দেখলেন।
কে কোথায় ঘুমায় আগ্রহ করে জানতে চাইলেন। শওকত সাহেবের স্ত্রীর বাধানো ছবি দেখে বললেন, বেয়ান সাহেব তো খুব সুন্দর ছিলেন। ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর মতো হয়নি।
মুনা এক ফাঁকে বলল, বকুলকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?
তিনি শীতল গলায় বললেন, আমার পছন্দ-অপছন্দের তো কোনো ব্যাপার না। জহির পছন্দ করেছে, বিয়ে হচ্ছে ওর পছন্দে।
তার মানে আপনার পছন্দ হয়নি?
না মা হয়নি। আমার দরকার ছিল তোমার মত একটা মেয়ে। শক্ত, তেজী। বকুল সে রকম না। কোনো একটা ঝামেলা হলেই এ মেয়ে ভেঙে পড়বে। আমার সংসার হচ্ছে মা ঝামেলার সংসার।
কিসের এত ঝামেলা আপনার?
আছে অনেক। বলব সবই।
বকুলের ভদ্রমহিলাকে ভাল লাগছে না। ইনি এত কথা বলছেন কেন? একজন বয়স্ক মানুষ বয়স্ক মানুষের মত থাকবেন। হড়বড় করে এত কথা বলবেন কেন? তাছাড়া উনার জমিজমার সমস্যা। সে সব পৃথিবী সুদ্ধ মানুষকে জানানোর দরকার কী? বকুল রান্নাঘরে চলে এল। মুনা খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করছে। সবই বাইরের খাবার। ঘরের বলতে পায়েস। সেটা এত মিষ্টি হয়েছে যে মুখে দেয়া যাচ্ছে না।
আপা!
বল।
ভদ্রমহিলাকে তোমার কেমন লাগছে?
ভালই।
এত সাজগোজ করেছেন কেন বল তো?
সাজগোজ কোথায় দেখলি?
আমার ভাল লাগছে না আপা। তার এই সমস্যা সেই সমস্যা। এ সব শুনতে কি কারো ভাল লাগে।
যা চা দিয়ে আয়।
আমি পারব না।
বাজে কথা বলবি না। নে ট্ৰে’টা ধর।
বকুল ট্রে নিয়ে মুখ কালো করে বের হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবু এসে বলল, আপা, মামুন ভাই এসেছে। বসার ঘরে বসেছে। মুনা সহজ স্বরে বলল, গিয়ে বল ঘরে অনেক মেহমান অন্যদিন যেন আসে।
বাবু নিচু স্বরে বলল, এটা আমি বলতে পারব না আপা। বলতে হলে তুমি বলবে।
মামুন জড়সড় হয়ে বসে ছিল। তার হাতে এক হাঁড়ি দৈ। আসার পথে কি মনে করে সে এক হাঁড়ি দৈ কিনে ফেলেছে। এর জন্যে নিজেই সে খানিকটা বিব্রত বোধ করছে। মিষ্টি, দৈ এসব কিনে কারো বাড়ি যাওয়াটাই অস্বস্তিকর। নিজেকে কেমন জামাই জামাই মনে হয়। মুনা এসে ঢুকল। মামুন হাসতে চেষ্টা করল। হাসিটা ঠিক ফুটিল না। কোথায় যেন আটকে গেল।
তোমাদের বাড়িতে কি হচ্ছে? কেউ এসেছে নাকি?
ই। বকুলের বিয়ে হচ্ছে। ওর শ্বশুর বাড়ি থেকে এসেছে।
বকুলের বিয়ে হচ্ছে নাকি?
হুঁ।
এত তাড়াতাড়ি যে?
ডাল ছেলে পাওয়া গেছে বিয়ে দিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এটা খারাপ না। একদিক দিয়ে ভালোই। আমি তাহলে বরং অন্যদিন আসি। কথা ছিল তোমার সঙ্গে।
কথা থাকলে এখনি বল। আবার আসার দরকার কি?
আর আসার দরকার নেই, কি বল তুমি?
একবার তো বলেছি তোমাকে।
শোন মুনা, ঠাণ্ডা মাথায় একটা কথা শোন। ঠাণ্ডা মাথায় কথা বল।
আমি যা বলছি ঠাণ্ডা মাথায় বলছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, একটা কথা রাখ, তুমি বরং আরো মাসখানেক নিজের মতো থাক। মাসখানেক আমি তোমাকে বিরক্ত করব না।
ভাল।
গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। মাসখানেক ওখানে থাকব। চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি।
মুনা চুপ করে রইল। মামুন সিগারেট ধরাল একটা। নিচু গলায় বলল, বাসা যেটা নিয়েছিলাম সেটা থাকবে। ভাড়া দিয়ে যাব। তোমার রাগ ভাঙলে বিয়ে করে ঐ বাড়িতে গিয়ে উঠব। উঠি এখন?
এসেছ। যখন বসি। চা খেয়ে যাও।
আচ্ছা খেয়েই যাই। তোমাদের জন্যে দৈ এনেছিলাম। দৈটা নাও।
মুনা দৈ হাতে রান্নাঘরে চলে গেল। বাবুকে দিয়ে চা এবং পায়েস পাঠিয়ে দিল। মামুন চা খেয়ে বেশ খানেক সময় একা একা বসে রইল। একসময় বাবু ঢুকল। মামুন নড়েচড়ে বসল।
বাবু কেমন আছ?
ভাল আছি।
তোমার যে মাথাব্যথা হত। সেটা সেরে গেছে, না এখনো মাঝে মাঝে হয়?
হয় মাঝে মাঝে।
তুমি যেন কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস সেভেন।
বাহ ভাল তো। সাঁতার জানো তুমি?
না।
আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিরাট পুকুর আছে। নিয়ে যাব তোমাকে। সাঁতার শিখিয়ে দেব, দুদিনে শিখিয়ে দেব।
বাবু কিছু বলল না। বকুলের শ্বশুর বাড়ির আরো কিছু লোকজন এল এ সময়। সবই মেয়ে মানুষ। এরা সরাসরি ভেতরে চলে গেলেন। বাবুও উঠে ভেতরে চলে গেল। মামুন থাকল। আরো খানিকক্ষণ। একটা টিকটিকি উঁকি দিচ্ছে।-কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। বিশাল তার সাইজ। সম্ভবত এটা তক্ষক।
বিদেয় নেবার আগে মুনাকে বলে যাওয়া দরকার কিন্তু মুনা আসছে না। হয়ত আর আসবে না। মেহমানদের নিয়ে ব্যস্ত। মামুনের মনে হল মুনার রাগ কিছুটা কমেছে। আজকের ব্যবহার তো খুব সহজ ও স্বাভাবিক। নিজ থেকেই চা খেয়ে যেতে বলল। রাগ কমে যাবে। নিশ্চয়ই কমবে। এক মাস দীর্ঘ সময়। আদর্শন কোন না কোন ভাবে মন দ্রবীভূত করায় একটা ভূমিকা নেবে।
মামুন বসেই রইল। কাউকে না বলে চলে যাওয়াটা ভাল দেখায় না। টিকটিকিটা এখনো তাকে দেখছে।
বাকেরের বড় ভাই হাসান সাহেব
বাকেরের বড় ভাই হাসান সাহেব ফাইন্যান্সের জয়েন্ট সেক্রেটারি লোকটি শান্ত প্রকৃতির।
কখনো কোনো ব্যাপারে সামান্যতম উত্তেজনাও তার আচার-ব্যবহারে প্রকাশ পায় না। অফিস শেষে সরাসরি বাসায় ফেরেন। দোতলা থেকে পারতপক্ষে নিচে নামেন না। মাঝে মাঝে বারান্দায় গম্ভীর মুখে বসে থাকেন।
আজও তেমনি বসে ছিলেন। আজ তার মুখ শুধু গভীর নয় কিছুটা বিষগ্নও। বারান্দায় বসে থাকলে সাধারণত তার হাতে খবরের কাগজ কিংবা কোনো ম্যাগাজিন থাকে। আজ তাও নেই। তার ফর্সা গাল কিঞ্চিৎ লাল হয়ে আছে। আজ তাদের একটি নাটক দেখতে যাবার কথা। তিনি কিছুক্ষণ আগে সেলিনাকে জানিয়ে এসেছেন, তিনি যাবেন না। সেলিনা ব্লাউজ ইন্ত্রি করছিলেন। নাটকে যেতে হবে এই উপলক্ষেই শাড়ির রঙ মিলিয়ে ব্লাউজটি আজই কেনা হয়েছে। রঙ মিলছিল না। বহু ঝামেলা করে পাওয়া গেছে। তিনি কিছুক্ষণ আগেই ব্লাউজ ধুয়েছেন। ভেজা কাপড়টি এখন ইন্ত্রি করে করে শুকান হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে নাটকেই যাওয়া হবে না। তার স্বভাব-চরিত্র হাসান সাহেবের মত নয়। তিনি অল্পতেই রাগেন। আজও রাগলেন। রাগ প্রকাশ না করে বললেন, কেন যাবে না? হাসান সাহেব বিরস মুখে বললেন, যেতে ইচ্ছা করছে না।
কেন ইচ্ছা করছে না। সকালেও তো বললে যাবে। আমি ইয়াসিনকে পাঠিয়ে টিকিট আনালাম। দুপুরে টেলিফোন জিজ্ঞেসও করলাম। তখনো বললে যাবে।
শরীরটা ভাল লাগছে না।
আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। আমার কাছে তো তোমার শরীর ভালই মনে হচ্ছে।
হাসান সাহেব কথা না বাড়িয়ে বারান্দায় চলে গেলেন। কাজের মেয়েটি চা নিয়ে এল। অন্য সময় সেলিনা চা নিয়ে আসতেন। তিনি চায়ে বেশি চিনি খান। কাজের মেয়েটির সেই আন্দাজ নেই। চায়ে চুমুক দিয়ে তাঁর মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না।
আজ অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছে। সামান্য ঝামেলা নয় বড় রকমের ঝামেলা। এক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। সামরিকান্স সরকারের মন্ত্রী, এদের মেজাজ উঁচু তারে বাধা থাকে, সারাক্ষণই মনে করে তাদের যোগ্য সম্মান দেয়া হচ্ছে না। এই মন্ত্রীটি পান খেতে খেতে হাসান সাহেবের ঘরে ঢুকেই বললেন, এগারটার সময় আপনাকে দেখা করতে বলেছিলাম।
হাসান সাহেব বিনীত ভাবে বললেন, আমি স্যার গিয়েছিলাম। আপনি ব্যস্ত ছিলেন। কাদের সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন।
ব্যস্ত তো থাকবই। এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে বসে ঠাণ্ডা বাতাস খাবার জন্যে তো মন্ত্রী হই নাই। অপেক্ষা করতে পারলেন না?
আধঘণ্টা অপেক্ষা করেছি।
আধঘণ্টা অপেক্ষা করেই আপনার মাথায় ব্যথা হয়ে গেল। নিজের ঘরে তো বসেই থাকেন। কাজকর্ম তো কিছু করেন না।
হাসান সাহেব শীতল গলায় বললেন, কাজকর্ম প্রসঙ্গে আপনি যা বলছেন তার জনো প্রয়োজনীয় তথ্য কি স্যার আপনার আছে?
তথ্য? আপনি তথ্য কপচাচ্ছেন আমার সাথে। একজন মন্ত্রীকে আপনি কি মনে করেন?
মন্ত্রীকে মন্ত্রীই মনে করি এর বেশি কিছু মনে করি না।
আপনারা সিএসপি রা মিলে দেশটাকে নষ্ট করেছেন। এটা জানেন?
না। স্যার আমার জানা ছিল না।
দেশের কমন মানুষ আপনাদের ধারে কাছে যেতে পারে না। নিজেদেরকে আপনার একজন লাট-বেলাটি ভাবেন।
আপনি এসব কি বলছেন?
একজন মন্ত্রী আপনাকে কল দিয়েছে আপনি দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারেন না? আপনি কি জানেন চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর আমি আপনার চাকরি খেতে পারি?
স্যার এটা আমার জানা ছিল না।
মন্ত্রী কোনো কথা না বলে ঘর ছেড়ে চলে গেল। ডেপুটি সেক্রেটারি। আমিনুল ইসলাম বললেন, আপনি স্যার চলে যান, ক্ষমা চেয়ে আসুন। ক্ষমা চাইলেই এরা পানি হয়ে যায়।
হাসান সাহেব বিরক্ত স্বরে বললেন, ক্ষমা চাওয়ার মত কিছু হয়নি।
সময় খারাপ স্যার।
তা খারাপ।
ঝামেলা টামেলা হতে পারে।
আগে হোক। তারপর দেখা যাবে।
বাকি সময়টায় অফিসের কোনো কাজে তার মন বসেনি। এখনো বসছে না। বারান্দায় বসে থেকে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সেলিনার সঙ্গে গল্পটল্প করলে ভাল লাগত। সেলিনার মেয়েলি গল্প শুনতে তার খারাপ লাগে না। সেলিনা আসবে না। তাকে রাগিয়ে দিয়েছেন। হাসান সাহেবের মনে হল নাটক দেখতে না যাওয়াটা অন্যায় হচ্ছে। আগে থেকে প্রোগ্রাম করা। প্রোগ্রাম ঠিক রাখা উচিত। জীবনযাত্ৰা ওলট-পালট করে ফেলবার মত কিছু হয়নি।
তিনি সেলিনার ঘরে ঢুকলেন। হালকা গলায় বললেন, চল নাটক দেখে আসি। এখনো নিশ্চয়ই সময় আছে।
তোমার শরীর সেরে গেল?
হুঁ সেরেছে। এখন ভালই লাগছে। সাতটার সময় শুরু হবার কথা না? সাড়ে ছটা বাজে। আধঘণ্টা আছে এখনো। চট করে তৈরি হয়ে নাও। পারবে না?
সেলিনা হাসিমুখে বললেন, পারব। তুমি কি ভাব দুতিন ঘণ্টা লাগিয়ে আমি সাজগোজ করি? সেলিনার মুখে রাগের চিহ্নও নেই। তার এই গুণটি হাসান সাহাবের খুব পছন্দ। রাগ করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। হাসান সাহেবের মনে হল তাদের দু’একটা ছেলেমেয়ে থাকলে মোটামুটি একটি সুখের সংসার হত। সেটা কখনো সম্ভব হবে না।
বাকের জলিল মিয়ার চায্যের স্টলের বাইরে টুল পেতে বসে ছিল। ভাই এবং ভাবীকে আসতে দেখে সে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। যাতে চোখে না পড়ে। চোখে চোখ পড়লেই দেড় টাকা দামের সিগারেটটা ফেলে দিতে হবে। ভাইয়া হয়ত হাত ইশারা করে ডাকবে। কাছে গেলেই গম্ভীর মুখে বাণী-টানী দিবে। এরচে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকাই ভাল।
সেলিনা বললেন, তোমার মাস্তান ভাইকে দেখেছ?
হুঁ।
সেও আমাদের দেখেছে, এখন এ রকম ভান করছে যেন দেখতে পায়নি।
এটাই স্বাভাবিক। বাবার সঙ্গে আমার যখন দেখা হত। আমিও এ রকমই করতাম না। না। দেখার ভান করতাম।
তোমার ভাই তোমার মতই হয়েছে, তাই বলতে চাও?
হাসান সাহেব কোন কথা বললেন না। রাস্তার মোড়ে রিকশার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কোথাও যাবার তাড়া থাকলে কখনো রিকশা পাওয়া যায় না। সেলিনা বললেন, তোমার গাড়ি কেনার কী হল?
টাকা কোথায়?
প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নেবে বলেছিলে? ব্যাংকেও তো কিছু আছে।
দেখি।
দেখাদেখি না। রোজ এমন রিকশা করে ঘোরাঘুরি করতে ভাল লাগে না।
হাসান সাহেব চুপ করে রইলেন। একটা খালি রিকশা দ্রুতগতিতে আসছে। এর তাড়া দেখে মনে হয় না। এ থামবে। কিন্তু হাসান সাহেবকে অবাক করে দিয়ে রিকশা থামল। রিকশাওয়ালা গম্ভীর গলায় বলয়, উঠেন।
আমরা বেলি রোডে যাব। যাবে তুমি?
যেখানে কন হেইখানে যামু। আমারে পাঠাইছে বাকের ভাই। উঠেন।
সারাপথ দু’জন কোনো কথা বললেন না। রিকশাওয়ালা অনবরত কথা বলে গেল।
দশ টাকা সের চাইল কেমনে চলুম কন দেহি। ছয়জন খানেওয়ালা। বড় মাইয়ার বিয়া দেওন দরকার। ক্যামনে দিমুকন? রিকশার জমা হইছে আফনের চল্লিশ টাকা। টায়ার ফাটলে হেই খরচ আমার, শিক ভাঙলেও আমার। আহন কন দেহি ভাইজান ক্যামনে চলি? আপনে বিচার-বিবেচনা কইরা কন।
হাসান সাহেব বিচার-বিবেচনা করে কিছুই বললেন না। পরিষ্কার বুঝতে পারছেন যা ভাড়া তার ওপর গোটা পাঁচেক টাকা দিতে হবে বকশিস। লম্বা দুঃখের পাঁচালী শুনবার এটা হবে খেসারত।
কিন্তু রিকশাওয়ালা কোন পয়সাই নিল না। চোখ কপালে তুলে বলল, না না ভাড়া দেওনের দরকার নাই। বাকের ভাই পাঠাইছে।
সেলিনা তিক্ত গলায় বললেন, আর সাধাসাধি করতে হবে না। তোমার বিখ্যাত ভাই পাঠিয়েছে পয়সা সে নেবে কেন? দেরি হচ্ছে চলে আস। ঘণ্টা দিয়ে দিয়েছে। শুরুটা মিস করতে চাই না।
বাকের সন্ধ্যা পর্যন্ত জলিল মিয়ার দোকানে বসে রইল। তার সঙ্গে আছে মাখন এবং কুদ্দুস। দু’জনই গাঁজা টেনে এসেছে। বিকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। মাখন কিছু-একটা নিয়ে চিস্তিত। সে কিছু বলছে না। কিন্তু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বলবে। সে দেরি করছে। কারণ তার বক্তব্য বাকেরের পছন্দ হবে না বলেই মনে হচ্ছে। গাজা টেনে আসার কারণে কুন্দুসের গলা শুকিয়ে আছে। সে কিছুক্ষণ পর পর খুথু ফেলবার চেষ্টা করছে। থুথু আসছে না। জলিল মিয়া দোকানের কাজকর্মের ফাঁকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। এই টেবিলে। দিন দশেক আগে কোন রকম কারণ ছাড়াই কুদ্দুস এবং মাখনের মধ্যে এই চায়ের দোকানেই ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছিল। চারটা কাপ এবং দু’টা গ্লাস ভেঙেছে। একটা চেয়ারের পায়া ভেঙেছে। আজও লেগে যেতে পারে। তবে ভরসার কথা হচ্ছে বাকের ভাই আছে। তার সামনে এরা কিছু করতে সাহস পাবে না। জলিল মিয়া দাঁত বের করে বলল, বাকের ভাই, চা দিতে কাই? বাকের কিছু বলল না। মাখন বলল, সিগারেট আনান জলিল মিয়া।
জলিল বিরসমুখে পাঁচটা টাকা বের করে সিগারেট আনতে পাঠাল। মাখন বলল, বাকের ভাই একটা কথা ছিল।
কি কথা?
প্রাইভেট কথা।
বলে ফোল।
মাখন গলা নিচু করে ফেলল। কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে বলল, ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। সিদ্দিক সাহেবের রিকোয়েস্ট।
ব্যাপারটা কি?
ভাড়াটে উঠে না। ধানাই-পানাই করছে। এখন বলছে, উঠব না মামলা করে উঠাও। শালা, মামলার ভয় দেখায়। সিদ্দিক ভাই খুব রেগেছেন। আমাকে বললেন, তোমরা থাকতে এই অপমান!
বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, এর মধ্যে অপমানের কী আছে? মামলা করতে বলছে মামলা করুক।
বাকের ভাই, ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। আমরা থাকতে মামলা-মকদ্দমা কি? শালাকে একটু কড়াকে দিলে কালই বাসা ছেড়ে দিবে।
সিদ্দিক সাহেবের কাছ থেকে কত নিয়েছিস?
টাকা-পয়সার কোন ব্যাপার না। খাতিরে কাজটা করে দিচ্ছি। আর কি।
খুব পিতলা খাতির জন্মাচ্ছিস ব্যাপারটা কি?
ব্যাপার কিছু না। ব্যাপার আবার কি? উঠিয়ে দেই শালাকে। কি বলেন বাকের ভাই?
বাকের কিছু বলল না। মনে মনে খুশিই হল। একটা কাজ করবার আগে এরা তাকে জিজ্ঞেস করছে। মান্যগণ্য করছে। তবে সিদ্দিক সাহেবের ব্যাপারটার বোঝা যাচ্ছে না। তাকে বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে যাচ্ছে। কয়েক’দিন আগে রাস্তায় দেখা হল এমন ভাব করল যে চিনতে পারছে না।
কুদ্দুস বহু কষ্টে একদলা থুথু ফেলে বলল, পাঁচটা টাকা দেন বাকের ভাই। পকেট খালি।
বাকের দশ টাকার নোট দিয়ে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। এখন বাজছে আটটা। সাধারণত আটটার দিকে কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িতে লোকজন আসে। আজও আসবে হয়ত। কারা আসছে লক্ষ্য রাখা দরকার।
গেটের কাছে জোবেদ আলি দাঁড়িয়ে আছে। বাকেরকে দেখে সে আড়ালে সরে গোল
বাকের উঁচু গলায় ডাকল, এই যে ভাই আছেন কেমন?
ভাল।
ঘর অন্ধকার কেন? লোকজন নাই?
দাওয়াতে গেছে।
দাওয়াত কোথায়?
জানি না কোথায়? এত সব জিজ্ঞেস করেন কেন?
এক পাড়ায় থাকি। খুঁজে-খবর নিতে হয়। নেন সিগারেট নেন।
বাকের সিগারেটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে এল। জোবেদ আলি বলল–আমি সিগারেট খাই না। কথাটা সত্যি নয়। উটের মত মুখের এই লোকটিকে দেখেছি খেতে। ভাম কোথাকার!
মাঝে-মধ্যে সিগারেট টানতে দেখি।
জোবেদ আলি গম্ভীর হয়ে গেল। বাকের তার গভীর মুখ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বলল, মেয়েরা ভর্তি হয়েছে কলেজে?
কি বললেন?
মেয়েরা কলেজে ভর্তি হয়নি? আপনি বলছিলেন ভর্তি হবে।
জানি না কিছু।
বোধ হয় হয়নি। কোথাও তো যেতে-টোতে দেখি না। আচ্ছা ভাই যাই, বিরক্ত করলাম। খাবেন একটা সিগারেট?
না।
বাকের চলে গেল রিহার্সেল দেখতে। নাটকের নাম রাতের পাখিরা। নাম শুনেই মনে হচ্ছে বাজে মাল। টিপু সুলতানটা নামালে হয়, তা না। সামাজিক নাটক। টিপু সুলতানে অনেক শেখার জিনিস ছিল। দেখলে মনটা অন্য রকম হয়। তা না রুন্দিামাল রাতের পাখি।
বাকেরকে দেখে একটা সাড়া পড়ে গেল। বাকের ভাইকে বসতে দে। চায়ের কথা বলে আয়। নাটকটির পরিচালকের নাম বদরুল আলম। বয়স চল্লিশেরর মতো। এই পাড়ায় যে কটি নাটক হয়েছে তার প্রতিটিতে সে পাগল কিংবা পাগলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে। এই একটি অভিনয় সে নিখুঁত করে। রাতের পাখিরা সে একটা চরিত্র আছে যে শুধু অমাবস্যার রাতে পাগল হয়ে যায়। পাগল হলেই পাগলামির ফাঁকে ফাঁকে সে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে। উচ্চমার্গের ফিলসফি।
বদরুল আলম নাটক বন্ধ রেখে বাকেরের কাছে এসে দাঁড়াল। গলা নামিয়ে বলল, আপনার সাথে একটা কথা ছিল। একটু বাইরে আসুন বাকের ভাই।
কি ব্যাপার?
জামান সাহেব আমাকে বলেছেন নাটক-ফাটক বাদ দিতে।
কেন?
তার দোকানের বিকিকিনির নাকি অসুবিধা হয়।
অসুবিধা কি? আপনি ছাড়াও তো আরেকজন কর্মচারী আছে।
এটাই একটু বলে দেবেন।
দেব বলে দেব। নাটক হচ্ছে কেমন?
ভাল। এক নম্বর; ফাসিক্লাস জিনিস হবে বাকের ভাই।
বদরুল আলমের চোখ চকচক করতে লাগল। নাটকের ব্যাপারে তার উৎসাহ সীমাহীন।
আসুন বাকের ভাই, রিহার্সেল দেখুন। থার্ড সিনটা দেখাই আপনাকে। মারাত্মক সিন।
না চলে যাই।
চলে গেলে হবে না। থার্ড সিনটা দেখতেই হবে।
থার্ড সিনে দরিদ্র স্কুল মাস্টার বাড়ি ফিরে দেখে তার ছোট মেয়ে মারা যাচ্ছে। সে ছুটে যায় ডাক্তারের খোঁজে। ডাক্তার একজনকে পাওযা যায়। কিন্তু সে ভিজিটের টাকা না নিয়ে যেতে রাজি না। মাস্টার বহু কাকুতি-মিনতি করল কোন লাভ হল না। সে আবার ফিরে গেল। ঘরে। চিৎকার করে বলল, কোথায় আমার নয়নের মণি। কেউ জবাব দিল না। কারণ নয়নের মণি মারা গেছে। মাস্টার চেঁচিয়ে বলতে লাগল? হায় টাকা, হায় রে টাকা।
বাকের মুগ্ধ হয়ে গেল। তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। গলা ভার ভার হয়ে গেল। দুঃখের সিন দেখলেই তার এ রকম হয়। চোখে পানি এসে যায়। নাটক দেখতে দেখতে তার ইচ্ছা! করছিল থাবড়া দিয়ে ডাক্তার হারামজাদাটার দাঁত ফেলে দিতো। শুয়োরের বাচ্চা। মানুষ মারা যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নাই। টাকা আর টাকা। দেশটার হচ্ছে কি?
সে আবার কম্পাউন্ড ওয়ালা বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াল। বাড়ি অন্ধকার। শুধু সিঁড়ির বাতি জ্বলছে। এরা কখন ফেরে লক্ষ্য রাখা দরকার। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। মাথা ধরেছে।
বাকের ভাই!
বাকের চমকে তাকাল। ইউনুস মিয়া। সিগারেটের টাকা পায় বোধ হয়। নানান দিকে বাকি পরে গেছে।
কি খবর ইউনুস মিয়া?
সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে একজন ভাড়াটে যে থাকে তার জিনিসপত্র সব টেনে তুলে বাইরে ফেলে দিচ্ছে।
আমি কি করব? সিদ্দিক সাহেব। আর তার ভাড়াটে মামলার।
তা তো ঠিকই। বাচ্চারা কান্নাটি করছে দেখে মনটা খারাপ হল।
কথা কথায় মন খারাপ হলে সংসার চলে না। এই জিনিসটা মনে রাখবেন। আর শোনেন,
আপনি টাকা-পয়সা কিছু পান নাকি?
জি।
সামনের মাসে দিব। এখন একটু অসুবিধা আছে।
জি আচ্ছা ঐটা কোন ব্যাপার না। যখন ইচ্ছা দিবেন।
বাকের ঘরের দিকে রওনা হল। রাত নটার মতো বাজে। খেয়ে-দোয়ে শুয়ে পড়তে হবে। শরীরটা জুত লাগছে না। আরেকটু দেরি কবে গেলে ভাল হত ভাই-ভাবীরা খেয়ে শুয়ে পড়ত। কারো মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকত না। এখন যাওয়া মানেই ভাবীর সামনে পড়ে যাওয়া। যদি তাদের খাওয়া না হয়ে থাকে তাহলে এক সঙ্গে খেতে হবে; ভাইয়া বসবে ঠিক তার সামনের চেয়ারটায়। একটি কথাও বলবে না। একবার তাকাবেও না। নিজেকে মনে হবে চোরের মত। গলা দিয়ে ভাত নামতে চাইবে না। বারবার পানি খেতে হবে।
বাকেরদের বাড়ির সামনের বারান্দায় একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। বাকেরকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। বাকের তাকে চিনতে পারল না। ত্রিশ-পযত্ৰিশ বছরের রোগা কিছু মেয়েরা আসে প্রাযাই। যাদের মুখ দেখলেই মনে হয় এরা বাড়িতে প্রচুর ঝগড়া করে কর্কশ গলায় ছেলে।পুলেদের ধমকায। এবং এদের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে।
আপনি বাকের সাহেব?
জি।
আমি আপনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।
কি ব্যাপার?
আপনার ছেলেরা আমার ঘর থেকে জিনিসপত্র টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। আমার বড় মেয়েটার একশ তিন জ্বর। এদের বাবা বাসায্য নেই দেশের বাড়িতে গেছে।
আপনি সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে থাকেন?
জি। দুমাসের ভাড়া বাকি পড়েছে। ওব বাবা টাকার জন্যেই দেশের বাড়িতে গেছে। এর মধ্যে এই অবস্থা।
চলুন যাই। দেখি কি ব্যাপার। আসুন আমার সাথে; কাঁদবেন না। কাঁদার কিছু নেই। আমি মাখন হারামজাদার দাঁত ভেঙে ফেলব।
ভদ্রমহিলা এবার শব্দ করেই কাঁদতে লাগলেন। বাকের লক্ষ্য করল এঁর পায়ে স্যান্ডেল নেই। ঝামেলা শুরু হওয়া মাত্র ছুটে এসেছেন। বাকেরের মন অসম্ভব খারাপ হয়ে গেল।
সিদ্দিক সাহেবের বাসার সামনে বেশ কিছু লোকজন। ঘরের জিনিসপত্র সব বাইরে এন রাখা হয়েছে। অসুস্থ মেয়েটা একটা চেয়ারে চোখ বড় বড় করে বসে আছে। তার ছোট ভাইটা বসে আছে একটা ট্রাঙ্কের ওপর। ছোট ভাইটা নিঃশব্দে কাঁদছে।
বাকের উঠোনে দাঁড়িয়ে শীতল গলায় ডাকল মাখনা। মাখন ভেতরে ছিল। অবাক হয়ে বের হয়ে এল। বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, মেয়েটা অসুস্থ। ঘরে কোনো পুরুষ মানুষ নেই। এর মধ্যে তুই নিজিসপত্র বের করে ফেললি?
মাখন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিক সাহেব তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি নিচে নেমে এলেন। হড়বড় করে বললেন, দুই মাসের ভাড়া বাকি। আমি বলেছি দিতে হবে না। শুধু বাড়িটা ছেড়ে দাও। তাও চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। জিনিসপত্র তো রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে না। বারান্দায় থাকবে। পাহারা থাকবে। ঘরটা শুধু তালা দিয়ে দিব। এদের পৌঁছে দিব এদের আত্মীয় বাড়ি; গাড়ি করে পৌঁছে দিব। আমি নিজের মুখে বলেছি। এই কথা। বাকের তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ।
বাকের থমথমে গলায় বলল, মাখনা জিনিসপত্র ভেতরে নিয়ে যা।
সিদ্দিক সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, জিনিসপুত্র ভেতরে নিবে মানে; মাগের মুলুক নাকি?
সিদ্দিক সাহেব, সাবধানে কথা বলুন।
সাবধানে কথা বলব মানে?
ভূঁড়ি নামিয়ে ফেলব। একটা কিছু বেতাল হয় যদি লাশ পড়ে যাবে। আমার নাম বাকের। মাখনা, জিনিসপত্র ঢোকা।
অতি দ্রুত জিনিসপত্র ভেতরে ঢুকে গেল। যারা দাঁড়িয়ে ছিল সবাই হাত লাগাল। মাখন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিল। বাকের এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা চড় বসাল। এই জাতীয় কাজকর্ম সে ছেড়েই দিয়েছিল। আবার শুরু করতে হল। কিছু কিছু জিনিস আছে যা একবার ধরলে কখনো ছাড়া যায় না। আঠার মত গায়ে লেগে থাকে।
সিদ্দিক সাহেব হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাখন নিজেও তাকিয়ে আছে। শুধু কুদ্দুসকে দেখা যাচ্ছে ছোটোছুটি করে আলনা-টালনা ভেতরে নিয়ে যেতে।
সিদ্দিক সাহেব মৃদু গলায় বললেন, বাকের আমার সঙ্গে ভেতরে আসা। কথা আছে।
বাকের ফিরেও তাকাল না। অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরাল। তারপর হাঁটতে শুরু করল। যেন কিছুই হয়নি।
হাসান সাহেবদের ফিরতে বেশ রাত হল। দুজনে মিলে বাইরে খেয়ে নিলেন। অনেক’দিন পর তারা বাইরে খেতে এসেছেন। ইদানীং দুজনে একসঙ্গে তেমন কোথাও যান না। সূক্ষ্ম একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। সেলিনার ধারণা এটা হয়েছে তার জন্যে। সংসারে শিশু না থাকলে সবাই দূরে দূরে চলে যায়। এটাই নিয়ম। সংসারে শিশু না আসার দায়িত্ব সেলিনার একার। বিয়ের পর পর টিউমারের কারণে তার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হাসান সাহেব এখন পর্যন্ত বলেননি, একটা বাচ্চাকাচ্চা থাকলে ভাল হত। সেলিনার ধারণা এক’দিন না এক’দিন সে এই প্রসঙ্গ তুলবেই। কে জানে হয়ত আজই তুলবে। সেলিনা বললেন, কথা বলছি না কেন? কি ভািবছ? হাসান সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, চাকরি ছেড়ে দিলে কেমন হয় সেলিনা? সেলিনা অবাক হয়ে তাকালেন।
জাকরি ছাড়ার কথা বলছ কেন?
হাসান সাহেব কিছু বললেন না। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তোকানোর এই ভঙ্গিটি সেলিনার চেনা। এর মানে হচ্ছে তিনি আর কিছুই বলবেন না। এই প্রসঙ্গে তো নয়ই। সেলিনা প্রসঙ্গ বদলালেন, নাটক কেমন লাগল?
ভাল।
কার অভিনয় সবচে ভাল লেগেছে?
সবাই ভাল।
তবু স্পেসিফিক্যালি দু’একজনের নাম বল।
হাসান সাহেব। আবার ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তার মানে নাটকের কিছুই তার মাথায় ঢোকেনি। অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে ভেবেছেন. ব্যাপারটা কি? সেলিনার উদ্বেগের সীমা রইল না।
বাড়ি পৌঁছেই তোমাকে চিঠি দেব
মুনা,
ভেবেছিলাম বাড়ি পৌঁছেই তোমাকে চিঠি দেব। তা সম্ভব হয়নি। কেন সম্ভব হয়নি। শুনে তুমি হাসবে। কলমের অভাব। ভুলে কলম ফেলে গেছি। বাড়ির কাছে যে কয়েকটি দোকান আছে তাদের কাছে বল পয়েন্ট ছাড়া কিছু নেই। কলমের জন্যে যেতে হবে সিদ্ধিরগঞ্জ বাজারে। সেটা এখান থেকে তিন মাইল। সমস্যার সমাধান হল আজ। দেখতেই পােচ্ছ চিঠি কালির কলমে লেখা। বাড়ি এসে অনেকগুলি সমস্যার মধ্যে পড়েছি। চারদিকে কোমর উঁচু ঘাস হয়েছে। সেই ঘাসের বনে অনায়াসে মাঝারি সাইজের একটা বাঘ লুকিয়ে থাকতে পারে। তালা দিয়ে গিয়েছিলাম। তালা ভেঙে জিনিসপত্র চুরি গেছে। শুধু যে ছোটখাটো জিনিস গেছে তাই না। আমাদের একটা বিশাল খাটিও উধাও। আর ময়লা যে কি পরিমাণ হয়েছে কী বলব। লোক লাগিয়ে সাতদিন ধরে পরিষ্কার করছি এখনো সিকিভাগ কাজও হয়নি। সারাদিন এইসব নিয়ে থাকি। সন্ধ্যাবেলা করার কিছু থাকে না। তুমি শুনলে হাসবে তখন কেন জানি একটু ভয় ভয়ও করে।
কাজের যে মেয়েটি আছে সে আরো বেশি ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। সে নাকি কবে দেখেছে রান্নাঘরে ঘোমটা মাথায় একটা বৌ মশলা পিষছে। সে কে কে বলে চিৎকার করতেই বৌ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। দিনের বেলায় ঘটনাটা খুব হাস্যকর মনে হয়। কিন্তু সন্ধ্যা মিলাবার পর ভয় ভয় করে। সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখি।
আসলে আমাদের এই বাড়ির এখন মৃত্যু হয়েছে। জড় পদার্থেরও প্রাণ আছে। এরাও মাঝে মাঝে মারা যায়। যেমন এই বাড়ি। যে বাড়িতে নিয়মিত জন্মমৃত্যু হয় সেই বাড়িটির প্রাণ আছে। আমাদের এই বাড়িটিতে শুধু মৃত্যুই হচ্ছে। দীর্ঘদিন কেউ জন্মায়নি। কাজেই বাড়িটির মৃত্যু হয়েছে। আমি ঠিক করেছি এটাকে বাঁচিয়ে তুলব। সব সময় লোকজনে বাড়ি গমগম করবে। নতুন শিশুরা জন্মাবে। আমার অনেক পরিকল্পনা আছে। সেই সব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলা হয়নি। কারণ বাড়ির ব্যাপারটা তোমার পছন্দ নয়। না দেখই তুমি অপছন্দ করে বসে আছ। আগে একবার এসে দেখ। দীঘির ঘাটে গিয়ে বস। কিংবা ছাদে পাটি পেতে দূরের বিলের দিকে তাকাও তাহলে দেখবে এটা চমৎকার জায়গা।
গ্রামে, শহরের সব রকম সুযোগ ব্যবস্থাও হচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি চলে আসছে। গ্রামীণ ব্যাংক হয়েছে। কৃষি অফিসও হবে। মেয়েদের যে মাইনর স্কুল ছিল এ বছরই নাইন-টেন চালু হবে। ইচ্ছা! করলে এই স্কুলে তুমি মাস্টারিও করতে পার। স্কুলের জন্যে আমি ছবিঘা জমি দিয়েছি। আগ্রহ শুই দিয়েছি। আমি জায়গাটাকে বদলে ফেলতে চাই। শহর থেকে কেউ এসে যেন হাঁপিয়ে না ওঠে।
মুনা, তুমি বকুল এবং বাবুকে নিয়ে এখানে এসে কয়েক’দিন থেকে যাও। আমার ওপর রেগে আছ, ঠিক আছে থাক। রাগ কমাতে বলছি না। রাগ নিয়েই আস। তোমার ভাল লাগবে। তোমরা কবে আসতে পারবে জানালে লোক পাঠাব। আমি নিজে আসতে পারছি না। কারণ অনেক রকম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। এলেই দেখবে। আজ এই পর্যন্ত থাকুক। দয়া করে চিঠির উত্তর দিও।
মামুন
নিতান্ত অপ্রিয় চিঠিও মানুষ দুবার পড়ে। কিন্তু এই চিঠিটি দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছা করছে না। আবার ফেলে দিতেও মন চাইছে না। মুনা ড্রয়ারে রেখে দিল। যদি কখনো ইচ্ছা হয় আবার পড়া যাবে। ইচ্ছা না করলে পড়ে থাকবে এবং এক সময় ড্রয়ার গুছাতে গিয়ে বকুল এসব জঞ্জাল ফেলে দেবে।
বাবু এসে বলল, আপা তোমাকে বাবা ডাকে।
যাচ্ছি। তুই আজ স্কুলে যাসনি?
তুই প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিস তাই না?
কে বলল তোমাকে?
আমার মনে হচ্ছে।
মুনা উঠে দাঁড়াল। বাবু দাড়িয় রইল শুকনো মুখে।
শওকত সাহেবের হঠাৎ করে জ্বর এসে গেছে। শেষ রাতের দিকে গা কেঁপে জ্বর এসেছে। এখনো থামেনি। আজ অফিস কামাই হয়ে গেল। বড় সাহেব রাগারগি করবে নিৰ্ঘাৎ। কাউকে দিয়ে একটা খবর পাঠানো দরকার। খবরটা দেবে কে?
মামা, ডেকেছি কেন?
শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে। জ্বর।
সে তো সকালেই শুনলাম। জ্বর কি আরো বেড়েছে?
হুঁ। অফিসে যেতে পারব না।
যেতে বলেছে কে তোমাকে, শুয়ে থাক। আর যদি বেশি খারাপ লাগে তোমার ভাবী জামাই তো আছেই খবর দিয়ে দেই।
তুই রেগে আছিস কেন রে?
রোগে থাকব কেন? মেজাজ খারাপ হয়ে আছে।
একটু বোস। কথা আছে।
মুনা বসল। শওকত সাহেব বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। বলার মতো কিছু তাঁর ছিল না।
বল মামা কি বলবে?
বকুলের বিয়ের কি হল তাই বল। নতুন করে কি আর হবে? তারিখ মত বিয়ে হবে। চিন্তার কিছু নেই। কেনাকাটা?
সামনের মাসে হবে। তুমি টাকা দিলে তারপর তো কেনাকাটা।
দাওয়াতের কার্ড-টার্ড তো ছাপানো দরকার।
হবে সবই হবে। যথাসময়ে হবে।
বিয়ে বাড়িটা ঠিক জমছে না। মানে ইয়ে…
মুনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শওকত সাহেব নিচু গলায় বললেন, হৈচৈ ছাড়া কি বিয়ে বাড়ি হয়? কোন হৈচৈ নেই। কিছু নেই।
ঐদিন তুমি বললে কোন হৈচৈ না, আর আজ উৎসব-উৎসব করছি আশ্চর্য। মামা উঠি।
যাবি নাকি কোথাও?
হুঁ। একটা শাড়ি কিনব!
আবার শাড়ি? ঐদিন না কিনলি?
আরো কিনিব। আমার জমানো সব টাকা খরচ করব। দুটো সোনার চুড়ি বানাব।
শওকত সাহেব চুপ করে গেলেন। মুনার কোন-একটা সমস্যা হয়েছে যা তিনি ধরতে পারছেন না। লতিফা থাকলে ঠিকই ধরত।
মুনা বকুলকে সঙ্গে নিল। বকুলকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাওয়া একটা সমস্যা। ইদানীং বকুলের খুব বকবকানি স্বভাব হয়েছে। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দেয। এখনো তাই করছে। রিকশায় উঠেই কথা বলা শুরু করেছে।
বাকের ভাইয়ের কাণ্ডকারখানা কিছু শুনেছ। আপা? মারামাবি করেছে। মাখন বলে একটা ছেলে আছে না, মুখটা চ্যাপ্টা, তাকে এমন চড় দিয়েছে যে চাপার একটা দান্ত নড়ে গেছে। তারপর সিদ্দিক সাহেব আছে না? ঐ যে কুজো হয়ে হাঁটেন তাকে গিয়ে বলেছে, আমি আপনাকে খুন করে ডেডবিডি নর্দমায় ফেলে দিব। সিদ্দিক সাহেব এখন ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না। আপা, তুমি শুনিছ কী বলছি?
শুনছি।
সিদ্দিক সাহেবের একটা গাড়ি আছে না। ঐটার দুটো টায়ার কে যেন ফাসিযে দিয়ে গেছে। নিৰ্ঘাৎ বাকের ভাইয়ের কাণ্ড। আরো কি যে করবে। কে জানে।
মুনা বিরক্ত হয়ে ধমক দিল, চুপ করত।
বকুল কয়েক সেকেন্ডের জনো চুপ করে আবার কথা শুরু করল, মাঝখানে বাকের ভাই বেশ ভদ্র হয়ে গিয়েছিল তাই না। আপা? এখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। পা ফাক করে দাঁড়িয়ে থাকে। আর এমন ভাবে তাকায় যেন কাঁচা খেয়ে ফেলবে। অবশ্যি আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। গতকাল স্কুলে যাবার সময় দেখা, বাকৃের ভাই গম্ভীর হয়ে বলল, কই যাচ্ছ? স্কুলে? আমি বললাম, হ্যাঁ। বাকের ভাই বলল, হেঁটে হেঁটে যাচ্ছ কেন? রিকশা নাও, দু’দিন পর বিয়ে এখন রোদে হাঁটাহাঁটি করা ঠিক না। ঘর থেকে ধের হওয়াই ঠিক না। ঘরে বসে থাকবে। আমি বললাম..
চুপ কর তো বকুল।
তোমার শরীর খারাপ নাকি আপা?
হুঁ। আর শোন, তুই কি গায়ে সেন্ট দিয়েছিস? বকুল মৃদু স্বরে বলল, হ্যাঁ।
একগাদা সেন্ট দেয়ার মানেটা কি? গন্ধে বমি আসছে। বিয়ে ঠিক হলেই গায়ে বালতি বালতি সেন্ট ঢালতে হবে?
বকুল লজ্জা পেয়ে গেল। মুনা শীতল গলায় বলল, বিয়েটা এমন কোন ব্যাপার না। বিয়ে হচ্ছে বলেই জীবন-যাপনের পদ্ধতি পাল্টাতে হবে না। আগে যেমন ছিলি পরে ও তেমনি থাকবি।
আচ্ছা থাকব। তুমি এমন কথায় কথায় ধমক দি ও না তো আপা।
কথায় কথায়, ধমক দেই?
হ্যাঁ দাও। আগে বাবা দিত এখন দাও তুমি। কি যে খারাপ লাগে তুমি সেটা কোনদিন বুঝবে না। যদি বুঝতে তাহলে এ রকম করতে না। তোমার সঙ্গে আসাই ভুল হয়েছে।
ভুল হলে চলে যা। রিকশা নিয়ে চলে যা। তোকে সাধাসাধি করে সাথে নিয়ে যেতে হবে? বকুল কাটা কাটা গলায় বলল, মামুন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার একটা কিছু হয়েছে। সেই রাগটা তুমি ঢালছ আমাদের সবার ওপর। রিকশা থামাতে বল। আমি নেমে যাব।
মুনা রিকশা থামাতে বলল। বকুল সত্যি সত্যি নেমে গেল। বিয়ে কী বিশেষ একটা কিছু যা সত্যি মানুষকে বদলে দেয়? মুনা নিজেও তার কিছুক্ষণের ভেতরেই ঘরে ফিরে এল। বকুলকে কোথাও পাওয়া গেল না; সে ফেরেনি। তার সেই বিখ্যাত টিমা ভাবার কাছেও যায়নি। কোথায় যেতে পারে? জহিরের কাছে? বসে বসে পেপসি খাচ্ছে?
রাগ করতে গিয়েও মুনা রাগ করতে পারল না। তার কেন জানি হাসি পেতে লাগল। বাবু বলল, হাসছ কেন?
হাসি আসছে তাই হাসছি।
বকুল আপাকে না করে দিও। রোজ ওখানে যায় আমার ভাল লাগে না।
রোজ যায় নাকি?
হুঁ রোজই যায়।
করে কী? বসে বসে পেপসি খায়?
হুঁ। তুমি হাসছ কেন?
আমি হাসলে তোর অসুবিধা কী?
বাবু গম্ভীর মুখে বের হয়ে গেল। অল্প বয়সে কেমন একটা ভারিক্কি ভাব এসে গেছে বাবুর মধ্যে। দেখতে মজা লাগে। মাথা নিচু করে হাঁটার ভঙ্গিটিও কেমন বুড়োটে যেন সংসারের জটিলতায় ক্লান্ত একজন মানুষ।
শওকত সাহেবেবী জ্বর আরো বেড়েছে। বুড়ে বয়সে জুরািজুরি খুব কাবু করে মানুষকে, তাকে যেমন করেছে। তার মনে হচ্ছে। এ যাত্ৰা তিনি বাঁচবেন না। তিনি সারা দুপুর জ্বর গায়ে বারান্দায় বসে রইলেন। তার প্রাণ ই ই করতে লাগল। সংসার মোটামুটি গুছিয়ে এনেছেন এ সময় মরে যাওয়াটা অন্যায়। কিন্তু সংসারে অন্যায়গুলিই সব সময় হয়। যখন একজন সব গুছিয়ে-টুছিয়ে বসে তখনই দুম করে একটা হাট অ্যাটাক। চোখ উল্টে বিছানায় ভিডুমি খেয়ে পড়া। কোনো মানে হয় না।
রাতের বেলা জ্বর হাঁস করে নেমে গেল। ঘাম দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা। শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। ক্ষিধে হচ্ছে। শওকত সাহেবের মনে হল এসবও ভাল লক্ষণ নয়। এ রকম চট করে জ্বর নেমে যাবে কেন? তিনি ক্ষীণ স্বরে ডাকলেন, মুনা, মুনা।
মুনা রান্না চাপিয়েছে। সে বিরক্ত মুখ করে উঠে এল।
কি হয়েছে মামা? মিনিটে মিনিটে ডাকছ কেন?
শরীরটা ভাল লাগছে না।
জ্বরটর সেরে তুমি তো দিব্যি ভালমানুষ। এত ডাকাডাকি কেন?
বাঁচব না রে মুনা?
বুঝলে কি করে? স্বপ্লটিপ্ল দেখছ? মামি কি এসে বলেছে নিয়ে যেতে এলাম?
হাসছিস কেন? এটা কী হাসির কোনো কথা?
মুনা খানিকটা বিব্রত বোধ করল। হেসে ফেলা উচিত হয়নি। সে রান্নাঘরে ফিরে গেল! বারু উনোনের পাশে মুখ লম্বা করে বসে আছে। অন্যদিন এই সময়টার বকুল থাকে। নিজের মনে কথা বলে যায়। আজ রাগারগির কারণে সে নিশ্চয় মুখ অন্ধকার করে নিজের ঘরে বসে আছে। বারু মুন আপাকে দেখে একটু হাসল। মুনা ঝাঁঝাল গলায় বলল, তুই এখানে কেন? পড়াশোনা নেই?
মাথা ধরেছে।
মুনা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বাবু সত্যি কথা বলছে না। তার মুখ হাসি হাসি। মাথা ধরা মানুষের মুখ নয়।
কিছু বলবি নাকি?
হুঁ।
কি? বলে ফেল। কথা পেটে নিয়ে বসে আছিস কেন?
শোবার সময় বলব।
একবার যখন বলেছে শোবার সময় বলর তখন সে শোবার সময়ই বলবে। এর আগে মারে গেলেও সে মুখ খুলবে না।
বাবু।
কি?
একটা কাজ করত একজন ডাক্তার নিয়ে আয়। মামাকে দেখাই। মামার মনে হয় ধারণা হয়েছে তার অসুখ-বিসুখকে আমরা তেমন পাত্তা দিচ্ছি না।
এখন আনব?
হুঁ। এখনি নিয়ে আয়। জহিরকে আনবি।
বাবু মুখ কালো করে বলল, ওকে কেন?
ওকে আনানই তো ভাল। ভিজিট দেয়ার ঝামেলা থাকবে না। আর জামাই মানুষ শ্বশুরকে দেখবে দরদ দিয়ে।
মুনা মুখ নিচু করে হাসতে লাগল। তার কেন জানি খুব মজা লাগছে। সে ঠিক করে রাখল জহির এলে বকুলকে দিয়ে চা পাঠাবে। আগে থেকে এ রকম ছেলেমানুষি একটি চিন্তা তার মাথায় কেন ঢুকল এই নিয়েও মুনা খানিকক্ষণ ভাবল। তার মাথাটা কী খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি?
মেয়েদের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া খুব বাজে ব্যাপার। সে যখন তার চাচাদের সঙ্গে থাকত তখন ময়নার মাকে দেখেছে। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের সুন্দরী মেয়ে। মাথা খারাপ হবার পর এমন সব কুৎসিত কথা চেঁচিয়ে বলত যে শোনা মাত্র ইচ্ছা করত ছুটে পালিয়ে যেতে।
মুনা রান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দেখল। ইজিচেয়ারে বকুল বসে আছে। তার চোখে-মুখে রাগের কোন চিহ্ন নেই। সে বোধ হয় শুনেছে বাবু গিয়েছে জহিরকে আনতে।
বকুল?
কি আপা?
তোকে আমি খুব একটা জরুরি কথা বলব, বকুল, মন দিয়ে শোন।
বকুল উঠে দাঁড়াল। মুনা চাপা স্বরে বলল, আমি যদি কোন কারণে পাগল-টাগল হয়ে যাই তাহলে তুই বিষ খাইয়ে আমাকে মেরে ফেলবি। চিকিৎসা করার দরকার নেই।
এসব কথা বলছ কেন তুমি?
মুনা তার জবাব না দিয়ে হাত-মুখ ধোবার জন্যে বাথরুমে ঢুকল। বকুল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারল না। আপার কি হয়েছে।
হাসান সাহেব শুনলেন
হাসান সাহেব শুনলেন কে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। বসে আছে ড্রইং রুমে। সকাল ন’টা বাজে। অফিস যাবার তাড়া। এ সমযে কেউ আসে? হাসান সাহেব কাপড় পরতে পারতে ভাবলেন দু’ধরনের লোক এ সমযে তার কাছে আসতে পারে নির্বোধ ধরনের লোক কিংবা বড় ধরনের বিপদে পড়ে লোক। প্রথমটিই হওয়ার কথা। কারণ পৃথিবীতে বড় ধবনের বিপদে পড়া মানুষের চেয়ে নির্বোধের সংখ্যা বেশি।
ড্রইং রুমে সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বসে ছিলেন। গায়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি! পান চিবাচ্ছেন। ঠোঁট বেয়ে এক ফোঁটা পানের রস পড়েছে সাদা পাঞ্জাবিতে। তার দিকে তাকালে পাঞ্জাবিতে সদা হওয়া পানের পিকের দাগই সবার প্রথম চোখে পড়বে। হাসান সাহেবেরও পড়ল। তিনি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।
স্নামালিকুম স্যার। আমার নাম সিদ্দিকুর রহমান। আমি থাকি আপনার…
আমি চিনি আপনাকে। কি ব্যাপার বলুন! আমার অফিসের তাড়া আছে।
বলতে একটু সময় লাগবে।
সময় লাগলে অন্য সময় আসতে হবে। এই মুহুর্তে আমার হাতে সময় নেই।
ঘটনাটা আপনার ভাই প্রসঙ্গে। বাকেরের বিষয়ে।
সেটা বাকেবের সঙ্গেই বলা উচিত। আমার সঙ্গে নয়।
ওর সঙ্গে কয়েক’দিন আগে আমায় একটা ঝামেলা হয়েছিল। তার পর থেকে একটার পর একটা ক্ষতি হচ্ছে আমার!
কি রকম ক্ষতি?
আমার গাড়ির উইন্ডশিল্ডটা চুরি গেল। একটা দোকান আছে আমার। স্টেশনারি শপ। তার কাচ-টাচ ভেঙে একাকার। তারপর একদিন…
আপনার ধারণা এসব বাকেরের কাজ?
পুলিশে কেইস করুন। আপনার সন্দেহের কথা বলুন।
এক পাড়ায় থাকি পুলিশে কেইস …?
এক পাড়ায় থাকলে পুলিশে কেইস করা যাবে না। এমন কোনো কথা নেই।
হাসান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তার গাড়ি এসে গেছে। আর বসে থাকা অর্থহীন। তিনি সব সময় অফিসে যাবার আগে সেলিনাকে বলে যান। আজ সেটা করতে ভুলে গেলেন। গাড়িতে উঠলেন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। সারা পথে কোন কথা বললেন না।
অফিসে তার জন্যে একটি বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাকে ওএসডি করা হয়েছে। অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি! মন্ত্রী সাহেব ব্যাপারটা তাহলে ভুলেননি। তার ক্ষমতা দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত। হাসান সাহেবের এই মন্ত্রীর প্রতি খানিকটা সমীহ বোধ হল। এর ক্ষমতা তাহলে আছে। অধিকাংশেরই থাকে না। মাঠে বক্তৃতা দিয়েই যাবতীয় ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।
সেক্রেটারি। আমিরুল ইসলাম সাহেবের নিঃশ্বাস ফেলার সময় ছিল না। তবু তিনি হাসান সাহেবকে ডেকে পাঠালেন। শান্ত গলায় বললেন, কেমন আছেন?
স্যার, ভালই আছি।
নিন চা খান। চা খাবার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি।
থ্যাংক য়্যু।
খুব মন খারাপ করেছেন নাকি?
তা করেছি।
মন খারাপ করবার কিছুই নেই। ব্যাপারটা খুবই সাময়িক। আমি এটা ছেড়ে দেব এ রকম মনে করার কোনোই কারণ নেই। মন্ত্রী সাহেবের যে যোগাযোগ আছে আমার যোগাযোগ তারচে কম না।
হাসান সাহেব কিছু বললেন না। আমিরুল ইসলাম সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ক্ষমতার মধ্যে একটা চালাচালির ব্যাপার আছে। একজন একটা চাল দেবে, অন্যজন তারচে বড় একটা চাল দেবে। এটা চলতেই থাকবে।
স্যার, আমি চাকরি ছেড়ে দেবার কথা ভাবছি।
হোয়াই? বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী। মহাভারত পড়েননি নাকি?
আমিরুল ইসলাম ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। মুহূর্তের মধ্যে হাসি থামিয়ে শক্ত মুখে বললেন, কয়েকটা দিন বিশ্রাম করুন। আমি কেমন প্যাচ লাগাচ্ছি। দেখুন।
প্যাঁচ লাগানোর কোনো দরকার দেখছি না। স্যার।
দরকার থাকবে না মানে? অফকোর্স আছে। এদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের খুব কাছাকাছি আসতে নেই। একটু দূরে থাকতে হয়। পুলিশে ছুঁয়ে দিলে হয় আঠার ঘা। সিএসপি কলম দিয়ে কিছু লিখলে হয় বিয়াল্লিশ ঘা। এবং সেই ঘার কোনো এন্টিডোেজ নেই। যান এখন বাড়ি যান। আজ আর অফিসে থাকার দরকার নেই।
হাসান সাহেব অসময়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরে তার ভালই লাগল। অনেক’দিন পর ফুলের টবগুলির পেছনে কিছু সময় দিলেন। চার-পাঁচটা বিশাল বনি প্রিন্স ফুটেছে। এদের দিকে তাকালেই মন ভাল হয়ে যায়। তিনি কাচি দিয়ে খুব যত্নে গোলাপ চারার মরা পাতাগুলি কাটলেন। মাটি খুঁড়ে দিলেন। বনি প্রিন্সের জন্যে চায়ের পাতার সার নাকি খুব ভাল। তিনি ভেবে রাখলেন, সেলিনাকে জিজ্ঞেস করবেন, চায়ের পাতা দেয়া হচ্ছে কিনা।
সেলিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আজ তার বিশেষ রান্না করতে ইচ্ছা হচ্ছে। হাসান সাহেবের অসময়ে ফিরে আসার ব্যাপারটা তার খুব ভাল লাগছে। কেন জানি বিয়ের প্রথমদিককার কথা মনে হচ্ছে। বিয়ের প্রথমদিকে এ রকম হত। অসময়ে সে এসে উপস্থিত। তার নাকি জুরািজ্বর লাগছে তাই চলে এসেছে। খুব মনে হয় ঐসব দিনের কথা। সুখের সময়গুলি বারবার কেন ফিরে আসে না। এই ভেবে সেলিনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
বাকের দুপুরে খেতে এসে আকাশ থেকে পড়ল। খাবার টেবিলে ভাইয়া বসে আছে। এমন অবস্থা যে উঠে চলে আসা যায় না। আবার বসাও যায় না। অসময়ে ভাইয়া কেন?
সেলিনা বললেন দাঁড়িয়ে আছ কেন, বস।
বাকের বসল। যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করল। তার লবণ নেবার দরকার ছিল কিন্তু লবণদানীটা অনেকখানি দূরে। ভাইয়ার কাছে। তাকে নিশ্চয়ই বলা সম্ভব না–ভাইয়া লবণটা দাও।
হাসান সাহেব খাবার টেবিলে কথাবার্তা একেবারেই বলেন না। আজ নিচু গলায় সেলিনার সঙ্গে দু’একটা কথা বলছেন। যেমন, বনি প্রিন্সগুলি তো চমৎকার হয়েছে। টবে কী তুমি চায়ের পাতা দিচ্ছ। এই জাতীয় কথাবার্তা। বাকেরের মনে হল ভাইয়া কোন একটা ঝামেলা নিয়ে চিন্তিত। নিজের চিন্তা ঢাকার জন্যেই আজেবাজে ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে।
বাকের!
জি ভাইয়া।
বাকেরের মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভাইয়া তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ব্যাপার কি?
বিছু বলবে আমাকে ভাইয়া?
হুঁ। তুই কি কারো গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেঙে দিয়েছিস?
বাকেরের গলায় ভাত আটকে গেল। সে হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারল না। হাসান স্বাভাবিক স্বরে বললেন, কারো গাড়ির উইন্ডশিন্ড তোমার যদি ভাঙতে ইচ্ছা করে তুমি ভাঙবে। এটা তোমার ব্যাপার। তোমার কি করা উচিত বা উচিত নয় সেটা তোমাকে বলা আমি অর্থহীন মনে করি। উপদেশ শোনার বয়স তুমি অনেক আগেই পার হয়েছ।
হাসান সাহেব দম নেবার জন্যে একটু থামতেই সেলিনা বললেন, খাবার টেবিলে এই আলোচনা না করলেও হবে। খেতে এসেছ খাও।
অন্য সময় তো বাকেরকে পাওয়া মুশকিল, নানান কাজে সে ব্যস্ত থাকে। খাবার টেবিলটাই কথা বলার জন্যে ভাল। বাকের!
জি।
তুই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা কর।
জি আচ্ছা।
তুই আমার কথাটা বুঝতে পারছিস না। না বুঝেই বলছিস জি আচ্ছা।
বাকের অবাক হয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসান সাহেব বললেন, তুই অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা কর। যাতে তোর বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেইন নিয়ে কেউ আমার কাছে না। আসে। তাছাড়া…
হাসান সাহেব একটু থামলেন। তাকালেন সেলিনার দিকে। সেলিনা চোখ বড় বড় করে বসে আছেন। খাবার টেবিলের এই নাটকের জন্যে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না; হাসান সাহেব পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন, গুণ্ডা পোষার কাজটি আমি আর করতে রাজি নই।
সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল। সেলিনা ভাবলেন বাকের হয়ত খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যাবে। কিন্তু সে উঠল না। সেলিনা বললেন, বাকের আচারের বোতলাটা দাও তো! বাকের আচারের বোতল এগিয়ে দিল।
সন্ধ্যাবেলা বাকের তার জিনিসপত্র নিয়ে মহিউদ্দিন সাহেবের দোকানে গিয়ে উঠল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার এখানে কয়েকটা দিন থাকব। মহিউদ্দিন সাহেব পান-খাওয়া হলুদ দাঁত বের করে প্রচুর হাসতে লাগলেন। ভাবলেন এটা একটা রসিকতা।
হাসছেন কেন?
মহিউদ্দিন সাহেবের হাসি বন্ধ হয়ে গেল।
আমি আপনার দোকানে কিছু দিন থাকলে আপনার অসুবিধা হবে?
জি না অসুবিধা কিসের?
তাহলে একটা বোতলের ব্যবস্থা করেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাব। বিদেশী জিনিস আনবেন। অনেক দিন খাওয়া হয় না।
মহিউদ্দিন সাহেবের মুখ শুকিয়ে গেল। একি যন্ত্রণায় পড়লেন।
বাকের বন্ধুদের খোঁজে বেরুল। নতুন জীবনযাত্রার শুরুটা তার খারাপ লাগছে না। ভালই লাগছে।
বিয়ের কার্ড শেষ পর্যন্ত ছাপা হল। চারশ কার্ড। দাওয়াতের এত মানুষ নেই। যেহেতু কার্ডের সংখ্যা বেশি কাজেই যাদের পাওয়ার কথা নয় তারাও দাওয়াত পেতে লাগল। বাবু চল্লিশটা কার্ড নিয়ে তার ক্লাসের সব ছাত্রকে একটি করে দিয়ে এল। শওকত সাহেব তার অফিসের চার-পাঁচজনকে বলবেন ভেবেছিলেন শেষ পর্যন্ত দেখা গেল। তিনি দাওয়াত করেছেন একুশজনকে। তাতেও শেষ নয়। তার মনে হল শুধু একুশজনকে বলাটা ঠিক হল না। অন্যরা কি দোষ করল। দ্বিতীয় দিনে তিনি আরো একগাদা কার্ড নিয়ে গেলেন। যাবার পথে মুনাকে বললেন, খরচপাতি কিছু হচ্ছে হোক একটাই তো বিয়ে ফ্যামিলিতে।
মুনা গম্ভীর গলায় বলল, একটাই বিয়ে মানে? আমি কি বিয়ে করব না নাকি?
শওকত সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। মুনা বলল, কি চুপ করে আছ কেন? তোমার কি ধারণা আমি সন্ন্যাসী হয়ে যাব?
কি যে বলিস তুই।
শওকত সাহেব হাসতে চেষ্টা করলেন। মুনার আজকাল কি হয়েছে উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলে। মুনা তুই মামুনকে কার্ড পাঠিয়েছিস?
মামুনকে কার্ড পাঠাব কেন?
বিয়েতে যাতে আসে সে জন্যে। সে এলে তোদের বিয়েরও একটা ডেট ফেলে দেব। শরীরের অবস্থা ভাল না। কাজকর্ম সব শেষ করে রাখতে চাই। কী বলিস?
শরীরের অবস্থা খারাপ মনে করলে তাই করা উচিত। বাবুরও বিয়ে দিয়ে দাও।
কি বললি?
বললাম, বাবুরও বিয়ে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ে এমন একটা মেয়ে খুঁজে বের কর। একটা বাল্যবিবাহও হয়ে যাক।
শওকত সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। মুনা বলল, কি রাজি আছ?
তোর কি মাথাটা খারাপ হয়েছে নাকি রে মুনা?
একটা প্র্যাকটিক্যাল কথা বললাম, এর মধ্যে মাথা খারাপের কি দেখলে?
মুনা তার মামাকে গভীর সমুদ্রে ফেলে চলে এল বাবুর কাছে। বাবু স্কুলে যায়নি। দুহাতে মাথা চেপে বসে আছে। তার চোখ লাল। দেখেই মনে হচ্ছে তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
কি রে বাবু মাথা ধরেছে?
হুঁ।
তোর বিয়ের ঠিকঠাক করে এলাম। বালিকা বধূ চলে আসবে ঘরে। মাথা ধরলে মাথা টিপে দেবে? কি খুশি?
বাবু তাকিয়ে রইল। মুনা হাসতে লাগল। বাবু বলল, একটু মাথা টিপে দেবে আপা? মরে যাচ্ছি।
মাথা টেপার সময় নেই রে, এখন যেতে হবে অফিসে। বকুলের বিয়ের কার্ড ডিসট্রিবিউট করব। সবার বন্ধুবান্ধব আসবে, আমার কেউ আসবে না। এটা খারাপ না? তুই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। মাথা ধরা সেরে যাবে।
মুনা নতুন শাড়ি পরল। অনেক সময় নিয়ে চুল বাঁধল। কড়া করে লিপিসিন্টক লাগল ঠোঁটে। বকুলকে বলল, কেমন লাগছে রে আমাকে? পেত্নীর মত লাগছে নাকি?
ভালই লাগছে। পেত্নীর মত লাগবে কেন?
আমার তো মনে হচ্ছে ড্রাকুলার মত লাগছে। ঠোঁট দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র কারোর রক্ত খেয়ে এসেছি ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে।
কি যে তুমি বল আপা। যাচ্ছ কোথায়?
অফিসে। সবাইকে তোর বিয়ের কার্ড দেব। এই কারণেই এত সাজগোজ করলাম। এলেবেলে ভাবে গেলে সবাই মনে করবে। ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে আমার হচ্ছে না। এই দুঃখে আমি…
মুনা কথা শেষ করল না। একগাদা কার্ড নিয়ে রওনা হল। বাকেরের সঙ্গে দেখা হল পথে। মুনা হাসিমুখে বলল, বাকের ভাই আপনাকে নাকি বাড়ি থেকে গেট আউট করে দিয়েছে? বাকের চুপ করে রইল। তার মুখ শুকনো। সে ঘন ঘন থুথু ফেলছে।
কি বাকের ভাই কথা বলছেন না কেন? যা শুনছি তা কি মিথ্যা?
মিথ্যা না। সত্যি।
হাতখরচ পাচ্ছেন, না তাও বন্ধ?
হাতখরচের দরকার কি?
দিন চলছে কিভাবে? ধারের ওপর?
বাকের তার জবাব না দিয়ে বলল, তোমার কি শরীর খারাপ নাকি?
মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, এত সেজোগুজে বের হয়েছি তারপরও বলছেন শরীর খারাপ। দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে।
অফিসেও সবাই এই কথা বলল। পাল বাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, হয়েছে কি আপনার?
কি আবার হবে কিছু হয়নি।
গালটাল ভেঙে একাকার। অসুখটা কি?
কোন অসুখ নেই।
মুনা ভেবেছিল কার্ডগুলি দিয়েই চলে আসবে। কিন্তু সে অফিস ছুটি না হওয়া পর্যন্ত থাকল। সবার টেবিলে খানিকক্ষণ করে বসে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করল। সে ভেবেছিল অনেকেই তাকে জিজ্ঞেস করবে নিজের বিয়ের কার্ড নেই ছোট বোনের বিয়ের কার্ড। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ সে প্রসঙ্গ তুলল না। এখনো পনের দিনের মত ছুটি আছে তার হাতে তবু সে ঠিক করে ফেলল আগামী কালই সে জয়েন করে ফেলবে। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকার কোন মানে হয় না।
তার জন্যে একটা বিস্ময়ও অপেক্ষা করছিল। অফিস ছুটির পর দেখা গোল কর্মচারীদের জন্যে ঝকঝকে নতুন বাস। পাল বাবু বললেন, ইউনিয়ন ঘাড় ধরে বাস কিনিয়েছে। এখন থেকে পায়ের উপর পা তুলে অফিসে যাবেন অফিস থেকে আসবেন। হা হা হা মুনাও উঁচু গলায় হাসতে লাগল। তার বড় ভাল লাগছে। অফিস-টফিস বাদ দিয়ে বাড়িতে বসে থাকাটা খুব বোকামি হয়েছে।
শুধু বাস নয় বুঝলেন মিস মুনা, আরো আছে।
আর কি?
আন্দাজ করেন দেখি।
মুনা আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলার আগেই পাল বাবু নিচু গলায় বললেন, কর্মচারীদের জন্যে ফ্ল্যাট হচ্ছে।
বলেন কি?
বোর্ড মিটিং-এ পাস হয়েছে। ছমাসের মধ্যে তিনটা চারতলা ফ্ল্যাট। দু’টা বেডরুম ড্রইং কাম ডাইনিং রুম। বারান্দা।
বাহ চমৎকার তো।
এর নাম ইউনিয়নের চাপ। রাম চাপ।
চাপ তো আগেও ছিল তখন তো কাজ হয়নি।
তখন হবে না বলে এখনো হবে না? দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে না? আগের দিন কি আছে নাকি?
যাদের নাম ক দিয়ে শুরু হয়
মামুন লক্ষ্য করেছে যাদের নাম ক দিয়ে শুরু হয় তারা বেশ প্যাচানো স্বভাবের মানুষ হয়ে থাকে। সে ক নামের কজনকে চেনে সবার পেটে স্কুর প্যাচ। কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজারের কথাই ধরা যাক। তার নাম কাশেম আলী, হাড় বজাত। লোনের ব্যাপারটা নিয়ে ক্রমাগত ঘুরাচ্ছে। কলেটরেল হিসেবে জমিজমার দলিলের নকল চেয়েছিল সেগুলি দেয়া হয়েছে যথাসময়ে। এখন সে বলছে, দলিলের নকলগুলি আবার দিন। আগেরগুলি মিস প্লেসড হয়েছে। মনে হচ্ছে কাশেম আলী সাহেব পান খাওয়ার জন্যে কিছু চান মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। নিজ থেকে না চাইলে পান খাওয়ার টাকা দেয়াও তো মুশকিল। মামুন নিশ্চয়ই বলতে পারবে না। ভাই আপনাকে আমি ঘুষ দিতে চাই। কত টাকা দেব বলুন? আপনার রেট কত? আর একটা বলতে পারবে না। বলেই প্রতি সপ্তাহে তাকে দুতিনবার এসে ঘণ্টা খানিক বসে থাকতে হবে। আজও তাই হবে। কাশেম আলী সাহেব ভীষণ ব্যস্ততার ভান করে বললেন, আপনি কাইন্ডলি আগামী সপ্তাহে আসুন। আমাদের এজিএম সাহেব আসছেন। নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই এখন।
মামুনের ভাগ্য ভাল। আজ সে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের কথা শুনল। কাশেম আলী সাহেব সরু গলায় বললেন, আপনার কাগজপত্র গুছানো হয়ে গেছে। ফাইল জাহানারার কাছে। সে আপনাকে বলবে এখন কি করতে হবে। মামুন অবাক হয়ে বলল, জাহানারা কে?
আমাদের নতুন সেকেন্ড অফিসার। পরশু জয়েন করেছেন। আপনি অপেক্ষা করুন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।
মহিলা অফিসারদেরও এত দূর পাঠানো হচ্ছে?
হবে না কেন? দিনকাল পাল্টে গেছে। মেয়েদেরও এখন সমানে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ইনটেরিয়রে। মেয়েরাও তেমন আপত্তি করছে না। ইয়াং ইয়াং সব মেয়েরা কাজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছে।
ভালই তো।
হুঁ ভালই। মেয়েরা হচ্ছে আপনার অফিসারের শোভা। সেজোগুজে বসে থাকে। সেজোগুজে বসে থাকে, দেখতে ভালই লাগে, হা হা হা।
মামুন লক্ষ্য করল, কাশেম আলী সাহেবকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। সুন্ট-টুট পরেছেন। গ্রামের কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজাররা এমন স্যুট পরে না।
জাহানারার বয়স তেইশ-চব্বিশ। রোগা পাতলা মেয়ে। চশমার ফ্রেমটি মুখের তুলনায় একটু বড় বলেই বোধ হয় তাকে অনেক বেশি রোগা লাগছে। গলার স্বর খুব নরম। শুনতে ভাল লাগে। টেবিল ভর্তি কাগজপত্র নিয়ে সে এমন ভাবে বসে আছে যেন মনে হচ্ছে গভীর সমুদ্রে পড়েছে। মেয়েটির নাকে একটা ফুটো, সেখানে সুতো বাধা এটা একেবারেই মানাচ্ছে না।
কাশেম আলী সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। মামুনের ফাইল বের করে কি সব করতে বললেন। মামুন তার কিছুই বুঝতে পারল না। এবং তার মনে হয় মেয়েটিও বুঝতে পারছে না। পরীক্ষার কঠিন প্রশ্নের দিকে মেয়েরা যে ভাবে তাকায় সেই ভাবে তাকাচ্ছে। মামুন হাসিমুখে বলল, এ রকম পাড়া গাঁয়ে এলেন কেন?
কি করব বলুন? অন্য কোথাও ভেকেন্সি ছিল না। তবে বেশিদিন থাকতে হবে না। এজিএম বলেছেন মাস দুয়েকের ভেতর ঢাকায় ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করবেন।
ঐ সব মুখের কথা একেবারেই বিশ্বাস করবেন না। একবার যখন এনে ফেলে দিয়েছে। আর নড়াবে না।
মেয়েটি চোখ-মুখ অন্ধকার করে বসে রইল। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মামুনের বড় মায়া লাগল। মেয়েটিকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সে বাবা-মা, ভাই-বোন ফেলে এসেছে। আসতে হয়েছে অর্থনৈতিক কারণে। সংসার চলছে হয়ত বাবার পেনশন এবং মেয়ের চাকরির টাকায়।
এখানে থাকেন কোথায়?
ম্যানেজার সাহেবের বাসায়। উনি ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। একটা কামরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন।
অসুবিধা হচ্ছে না তো?
জি না।
অসুবিধা হলে বলবেন। আমি এখানকারই ছেলে।
মেয়েটি অল্প হেসে কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়ল। যেন সে কথাবার্তা আর চালিযে যেতে আগ্রহী নয়। মামুনের হঠাৎ করে মনে হল এই মেয়েটির সঙ্গে মুনার কোথায় যেন একটা মিল আছে। সেই মিলটি কোথায় সে তার ধরতে পারছে না। অমিলগুলি ধরা পড়ছে সহজেই। মুনার মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে এই মেয়েটির মধ্যে সে জিনিসটা একেবারেই নেই। চেহারাও দুজনের দুরকম। মুনার মুখ লম্বাটে, এ মেয়েটির মুখটি গোলাকার। তালে মিলের একটা ব্যাপার মনে আসছে কেন? মুনার সঙ্গে যে পরিস্থিতিতে আলাপ হয়েছিল। এই মেয়েটির সঙ্গে ঠিক সেই ভাবেই আলাপ হচ্ছে। এটিই কি কারণ? একটা কাজের ব্যাপারে সে মুনাদের অফিসে গিয়েছিল। কাজটি তেমন জটিল কিছু ছিল না। কিন্তু মুনা সেই সামান্য কাজ নিয়েই হাবুডুবু খাচ্ছিল। আজ যেমন এই মেয়েটি খাচ্ছে। কিছু কিছু ঘটনা কি আমাদের জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে?
জাহানারা বলল, আপনি খানিক্ষণ বসুন। মামুন হাসিমুখে বলল, বসেই তো আছি। প্রায়ই আসি এবং বসে থাকি।
মামুন ভেবেছিল মেয়েটি কথার পিঠে কোন কথা বলবে। ইন্টেলিজেন্ট কিছু বলতে চেষ্টা করলে কিন্তু তা ঠিক ইন্টেলিজেন্ট হবে না। কিন্তু জাহানারা কিছুই বলল না। গভীর মনোযোগে ফাইল উল্টাতে লাগল। একটি মেয়ের সামনে চুপচাপ বসে থাকা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু একা একা বকবক করাও মুশকিল।
আমাদের জায়গাটা কেমন লাগছে?
ভালই।
আগে কখনো গ্রামে কাটিয়েছেন?
না।
শহরেই মানুষ?
ঠিক শহরে না মফস্বল শহর।
কোন মফস্বল শহর?
জাহানারা তার জবাব না দিয়ে শান্ত গলায় বলল, আপনাকে আর আমাদের এখানে আসতে হবে না। কাগজপত্র সব ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। লোন স্যাংশন হলেই আপনাকে খবর দেয়া হবে।
ংশন হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে। হবে না কেন।
ঘরে বসে থাকলেই হবে, না ধরাধরির ব্যাপার আছে?
আপনাতেই হবে।
এ দেশে আপনাতেই কিছু হয় না।
জাহানারা এ কথারও কোনো জবাব দিল না। অন্য কি সব কাগজপত্র দেখতে লাগল। মামুনের এখন উঠে পড়া উচিত। কিন্তু উঠতে চেষ্টা করছে না। এক ধরনের আলস্য লাগছে।
উঠি আজ? আবার দেখা হবে।
মেয়েটি সামান্য হাসল। মুনার হাসির সঙ্গে এই মেয়েটির হাসির কি কোন মিল আছে। আছে হয়ত। প্রতিটি মানুষ হাসে নিজের মত করে। একজনের হাসির সঙ্গে অন্যজনের হাসির কোন মিল নেই। অবশ্যি সবাই কাঁদে একইভাবে। নাকি একেকজন মানুষের কান্নাও একেক রকম।
ডাকে একটি রেজিস্ট্রি চিঠি এসেছে। মামুন মনে করতে পারল না রেজিস্ট্রি চিঠিতে সে কখনো কোনো জরুরি কিছু পেয়েছে কি না। না পায়নি। বরং আজেবাজে জিনিসপত্রই লোকে তাকে রেজিস্ট্রি করে পাঠিয়েছে। একবার সে চিঠি পেল যে কোনো এক লোক মদিনা শরিফে কি একটা স্বপ্ন দেখছে সেই স্বপ্নের কথা সাতজনকে লিখে জানাতে হবে। যদি না জানানো হয় তাহলে বিরাট ক্ষতি হবে। জানালে লটারিতে টাকা। কত অদ্ভুত ধরনের মানুষই না আছে পৃথিবীতে।
মামুন চিঠিটা খুলল না। সন্ধ্যার পর ধীবে-সুস্থে খোলা যাবে। সন্ধ্যার পর তার কিছু করার থাকে না তখন চিঠিপত্র পড়াটা ভালই লাগবে। এমনও তো হতে পারে এটা মুনার চিঠি। আবেগটাবেগে দিয়ে একগাদা কথা লিখেছে। যার মূল বক্তব্য হচ্ছে–যা হবার হয়েছে এখন তুমি এস। এই জাতীয় চিঠি পেলে তার তৎক্ষণাৎ ছুটে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং উল্টোটা করতে হবে। চিঠির জবাব না দিয়ে গ্যাট হয়ে বসে থাকতে হবে। তারপর আসবে দ্বিতীয় চিঠি। দ্বিতীয় চিঠির পর তৃতীয় চিঠি। তৃতীয় চিঠির জবাবও যখন আসবে না। তখন হয়ত সে নিজেই চলে আসবে। চমৎকার হবে সেটা।
মামুন সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারল না। বিকেলে চিঠি খুলে ফেলল। বকুলের বিয়ের কার্ড। সঙ্গে চিঠিপত্র কিছুই নেই। একটা লাইন পর্যন্ত না। এর মানে কি? খামের ঠিকানাও কি মুনার লেখা নয়?
ম্যানেজারের বাসায় থাকাটা জাহানারার সহ্য হচ্ছে না। ভদ্রলোক রোজ তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করছেন। বেগুন দিয়ে ডিমের তরকারি রান্না করার বদলে ম্যানেজার সাহেবের স্ত্রী আলু দিয়ে তরকারি রোধেছেন। এতেই ভূমিকম্প হয়ে যাচ্ছে।
পেয়েছ তুমি কি? যা ইচ্ছা তাই করবে? এমন তো না ঘরে বেগুন ছিল না। ছিল। আমি নিজে কিনে দিয়েছি। ঘরে থেকে জিনিস পচবে আর তুমি লোক পাঠিয়ে আলু কিনে আনবে। না। এই তরকারি। আমি খাব না। ফেলে দিয়ে আস। এক্ষুণি ফেলে দিয়ে আস। ·
অসহ্য। ভদ্রলোক কখনো বোধ হয় ভাবেন না যে এ বাড়িতে বাইরের একজন আছে। তার সামনে অন্তত কিছুটা সংযত আচরণ করা উচিত। স্ত্রীকে পশুর মত কেউ কি দেখে এই সময়ে? আর মেয়েটি এমন বোকা একটি কথাও বলবে না। নিঃশব্দে গাল হজম করবে। মাঝে মাঝে জাহানারারই বলতে ইচ্ছা করে, এসব কি শুরু করেছেন?
কিন্তু তা বলা সম্ভব নয়। অনেক কিছুই আমরা বলতে চাই কিন্তু বলতে পারি না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়। অবশ্যি জাহানারা একটা ঘর নেবার চেষ্টা করছে। যদিও সে জানে একা এক একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঢাকা থেকে মা এবং ভাই-বোনদের নিয়ে আসার প্রশ্নই উঠে না। বোন দু’টির স্কুল আছে। ছোট ভাই অনার্স পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবার শরীরও ভাল হবে না। তবু জাহানারা যাকে পাচ্ছে তাকেই বলছে, আমার জন্যে একটা বাসা-টাসা দেখবেন। কেউ তার কথার তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। গুরুত্ব দেবার কথাও নয়। এ রকম পাড়াগা জায়গায় লোকজন ভাড়া দেবার জন্যে গণ্ডায় গণ্ডায় বাড়ি রাখে না। ম্যানেজার সাহেব এক’দিন বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, শুনছি চারদিকে আপনি বাড়ি খুঁজছেন? জাহানারা কিছু বলল না।
আমার এখানে আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?
জি না স্যার।
অল্প কিছুদিন থাকবেন বাড়ি-টাড়ি খোজার ঝামেলা করবেন না। একা একা থাকবেন কিভাবে?
জাহানারা চুপ করে রইল। ম্যানেজার সাহেব শুকনো গলায় বললেন, তাছাড়া এই যে আপনি বাড়ি খোঁজাখুঁজি করছেন তার একটা বাজে দিক আছে।
বাজে দিক মানে?
লোকজন নানান কথা বলবে।
জাহানারা অবাক হয়ে বলল, স্যার আপনার কথা বুঝতে পারছি না।
আপনি এতদিন ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এখন চলে যেতে চাচ্ছেন। অথচ একা মেয়ে মানুষ লোকজন আমাকে নিয়ে নানান কথা ভাববে।
জাহানারা হকচকিয়ে গেল। তার দারুণ মন খারাপ হল। এটা এমন জায়গা যে মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। কোথাও যাবার নেই। ঢাকায় থাকলে কত কি করা যেত। একটা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় বসে থাকা যেত। বই মুখের ওপর ধরে কাদা যেত। কেউ দেখে ফেললে অসুবিধা নেই। ভাববে পড়ে কাঁদছে।
কিন্তু এখানে কিছুই করার নেই। তবু সে মন খারাপ হলে একা একা হাঁটে। লোকজন প্রথম দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাত, এখন তাকায় না। কাঁচা রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে সে কুসুমখালি নদী পর্যন্ত যায়। মরা নদী। তবে বর্ষার সময় নদী নাকি খুব ফুলে-ফেপে ওঠে। ম্যানেজার সাহেবের কাছে শুনেছে সেটা নাকি একটা দেখার মত ব্যাপার। জাহানারা নিশ্চিত জানে সে বর্ষা পর্যন্ত থাকবে না। কিন্তু কোনো-এক বিচিত্র কারণে মাঝে মাঝে তার মনে হয়। বর্ষা পর্যন্ত থেকে গেলে ভালই হবে।
নদীর যে দিকটায় জাহানারা যায়। সেখানে শ্মশান ঘাট। ভাঙা হাঁড়ি-কুড়ি আছে। শ্মশান যাত্রীদের বিশ্রামের জন্যে একটা শ্যাওলা ধরা পাকা ঘর আছে। তার দেয়ালে কাঠ কয়লা দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথাবার্তা লেখা। এক’দিন অফিসের পিওনাকে সঙ্গে নিয়ে সে লেখা পড়তে এসেছিল। রোজ রোজ তো তাকে সঙ্গে নিয়ে আসা যায় না।
শ্মশান ঘাটেই এক’দিন তার মামুনের সঙ্গে দেখা। মামুন চোখ কপালে তুলে বলল, এখানে কি করছেন?
জাহানারা বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, কিছু করছি না। বেড়াচ্ছি।
বেড়াচ্ছেন্ন মানে? এটা কি বেড়াবার জায়গা?
কেন ভূত আছে নাকি?
ভূত আছে কি না জানি না। তবে এখানে সেভেন্টিওয়ানের যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে গুলি করে মেরেছে। আমরা কেউ একদিকটায় আসি না।
এই তো আপনি এসেছেন।
আমি আপনার জন্যেই এসেছি। দূর থেকে দেখলাম শাড়ি পরা একটা মেয়ে ঘুরছে। তাও শহরের মেয়ে। আপনার ব্যাপারটা কি বলুন তো?
ব্যাপার কিছু না। বেড়াচ্ছিলাম। বেড়াবার তো জায়গা নেই।
বেড়াবার জায়গা থাকবে না কেন? বিরাট একটা দেয়াল আছে। সারদেয়াল নাম। কারা তৈরি করেছে। কেউ জানে না। বিশাল ব্যাপার। দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।
জাহানারা কিছু বলল না। লোকটির তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবার এই বাড়াবাড়ি আগ্রহ ভাল লাগছে না।
কি যাবেন। সারদেয়াল দেখতে?
জি না।
এখান থেকে মাইল দুয়েক দূরে বড় গঞ্জ আছে। একটা সিনেমা হলও হয়েছে। গিয়েছেন সেখানে?
জি না।
যাবেন। যেতে চাইলে আমি নিয়ে যেতে পারি।
থ্যাংকস। আমি কোথায় যাব না।
জাহানারা হাঁটতে শুরু করল। মামুন আসছে তার পাশাপাশি। এরকম সরু রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটার দরকার কি। একবার গায়ে গা লেগে গেল জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, আপনি আগে আগে যান। আমি আসছি আপনার পেছনে।
পাশাপাশি না হাঁটলে গল্প করা যাবে না তো। গল্প করার সময় মাঝে মাঝে মুখের দিকে তাকাতে হয়। অন্যের মুখের ভাবের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।
আপনিও কি লক্ষ্য রাখছেন?
হ্যাঁ রাখছি। এবং বুঝতে পারছি আপনি আমার ওপর অসম্ভব বিরক্ত হচ্ছেন।
তা হচ্ছি।
বিরক্ত হবার কিন্তু কোনো কারণ নেই। আপনি যদি মনে করে থাকেন–আপনার সঙ্গে খাতির জমানোর জন্যে বেড়াতে-টেড়াতে নিতে যাচ্ছি তাহলে ভুল করবেন। ঐ জাতীয় কোন উদেশ্য আমার নেই। আপনাকে কেমন লোনলি লাগছিল তাই বলছিলাম। আচ্ছা, যাই তাহলে।
মামুন লম্বা লম্বা পা ফেলে ডানদিকে রওনা হল। জাহানারার অস্বস্তির সীমা রইল না।
বকুলের গায়ে হলুদ
আগামীকাল বকুলের গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ জাতীয় অনুষ্ঠানের আগের দিনটি যেমন জমজমাট হওয়া উচিত তেমন লাগছে না। বকুলের মনে হল সবাই কেমন যেন গা ছেড়ে দিয়েছে। মুনা। আপা যথারীতি অফিসে চলে গিয়েছে। আজ অফিসে না গেলে কি হত? বাবুও রান্নাঘরে ভাত নিয়ে বসেছে। সেও বোধ হয়। স্কুলে যাবে। কি আশ্চর্য এত বড় উৎসবের ঠিক আগের দিনটিতে সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। যেন গায়ে হলুদ খুব সাধারণ ব্যাপার। এ বাড়িতে রোজই এ রকম একটা উৎসব হচ্ছে। বকুল বেশ মন খারাপ করে রান্নাঘরে গেল। ইতস্তত করে বলল স্কুলে যাচ্ছিস, বাবু?
হুঁ।
তোরা সবাই যদি যে যার ধান্ধায় বেরিয়ে যাস তাহলে কাজগুলি কে করবে?
ঘরের কি কাজ?
বকুলের কান্না পেয়ে গেল। কাল তার গায়ে হলুদ আর আজ বাবু বলছে ঘরের কি কাজ? কত কিছু করে লোকজন। ঘর সাজায়। কলাগাছ পুঁতে। কি কি রান্না হবে তার লিস্ট করে। তার বেলায় কিছুই হচ্ছে না। প্রথম দিকে বাবা খানিক উৎসাহ দেখিয়েছেন। বকুলের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু একটি কথাও বললেন না। এর মানে কি এই যে বকুলের বিয়েটা কেউ পছন্দ করছে না?
বাবু হাত ধুতে ধুতে বলল, কি কাজ বললে না? বকুল মুখ কালো করে বলল, কোন কাজ নেই। কাজ আবার কি?
কিছু আনতে হলে বল।
আনতে হবে না কিছু।
বকুল তার ঘরে চলে গেল। সে আজ সারাদিন শুয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়বে। তিনটা গল্পের বই হাতে আছে। একটা বইয়ে নাম এক বৃন্তে দু’টি ফুল। খুব নাকি ভাল বই। টিনা ভাবীর মতে, . অসাধারণ বই। টিনা ভাবীর কথার তেমন গুরুত্ব অবশ্যি নেই। সে অতি অখাদ্য বইকেও মাঝে মাঝে বলে অসাধারণ।
দশ পাতা পড়বার পর বকুলের মনে হল সে কি পড়ছে তা নিজেই বুঝতে পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মন বসছে না।
বাড়িতে কোন লোকজন নেই। যে কাজের মেয়েটি ছিল সে পরশু দিন মুনা আপার দু’টি শাড়ি চুরি করে পালিয়েছে। কেমন নির্জন চারদিক। বকুলের গা ছমছম করতে লাগল। তার শ্বশুর বাড়ি নিশ্চয়ই এমন নির্জন হবে না। চারপাশে লোকজন থাকবে। সেটা হবে একটা হৈচৈয়ের বাড়ি। আনন্দের বাড়ি। অদেখা সুখ ও আনন্দের কথা ভাবতে ভাবতে বকুলের চোখ ভিজে উঠতে লাগল। দরজার কড়া নড়ছে। বকুলের উঠে গিয়ে দরজা খুলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোন ভিখিরি নিশ্চয়ই। আজকাল ভিখিরিরা খুব গম্ভীর ভঙ্গিতে দরজায় কড়া নাড়ে, কলিং বেল টিপে ভিক্ষা চায়।
কড়া নেড়েই যাচ্ছে। এ ভিখিরি নয়। বকুল চোখ মুছে দরজা খুলল। টিনা ভাবী বিরাট একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঘুমুচ্ছিল নাকি? এক ঘণ্টা ধরে দরজা ধাক্কাচ্ছি। চোখ লাল কেন?
বকুল জবাব দিল না। টিনা বিরক্ত হয়ে বলল, বাড়িঘরের এই অবস্থা কেন? এটাকে তো বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন তোদের কোনো আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে। যা ময়দার লেই তৈরি কর।
কেন?
কেন কি? ঘর সাজাব। জানি তোরা কেউ কিছু করবি না। কাগজ নিয়ে এসেছি। কাচি আছে ঘরে?
জি আছে।
বের কর। বাবু কোথায়?
স্কুলে।
আজকের দিনটায় স্কুলে না গেলে হত না। কি সব অদ্ভুত ভাইবোন তোর।
নিজের বিয়েব জন্যে রঙিন কাগজের মালা বানাবো খুবই অস্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু উপায় নেই। টিনা ভাবী ছাড়বে না।
মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন রে বকুল?
কিছু ভাল লাগছে না ভাবী।
বিয়ের ঠিক আগে এ রকম হয়। হঠাৎ করে মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে যায়। ভয়টা কেটে যায় বিয়ের রাতেই।
এই বলে টিনা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
বকুল।
কি?
তোকে কিছু কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেব, বুঝলি?
কি কায়দা-কানুন?
বলব বলব। এত ব্যস্ত কিসের?
বকুল উঠে দাঁড়াল। টিনা বলল, যাচ্ছিস কোথায়?
চা নিয়ে আসি। তুমি তো আবার মিনিটে মিনিটে চা খাও।
চায়ে চুমুক দিয়ে টিনা প্রথম যে কথাটি বল সেটা হচ্ছে–বিয়ের রাতে তোর বর যখন প্রথম তোর গাযে হাত দেবে তখন ইলেক্ট্রিক শক খাবার মত লাফিয়ে উঠবি না। বুঝলি?
বকুল অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে তার অস্বস্তি লাগে আবার সেই সঙ্গে ভালও লাগে। সে এ রকম কেন? সে কি খারাপ মেয়ে? বকুলের বুক হু-হু করতে লাগল।
মুনা ভেবে রেখেছিল। সে আজ লাঞ্চ টাইম পর্যন্ত কাজ করবে। তারপর ঘরে ফিরে আসবে। সেটা সম্ভব হল না। সিদ্দিক সাহেব তাকে ডেকে একগাদা কাজ দিয়ে দিলেন এবং শান্ত গলায় বললেন, যে ভাবেই হোক আজ পাঁচটায় শেষ করে দেবেন। পারবেন না?
জি পারব।
গুড। ভেরি গুড। আপনি ছাড়া অন্য কেউ হলে বলত–একদিনে সম্ভব না।
মুনা কিছু বলল না। সিদ্দিক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, মেয়েদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে এরা সহজে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। তবে শেষ পর্যন্ত কন্টিনিউ করতে পারে না।
আমি স্যার পাঁচটার মধ্যেই শেষ করে দেব।
গুড। পাঁচটার সময় আমি অফিস থেকে বেকবি। তখন ফাইলগুলি নিয়ে যাব।
যেদিন খুব মন দিয়ে কাজ করবার থাকে সেদিনই যন্ত ঝামেলা দেখা দেয়; যেমন আজ একাউন্টের নতুন মেয়েটি এসে গলা নিচু করে তার এক গাদ সমস্যার কথা বলতে লাগল। সেই সমস্যাও ভয়াবহ সমস্যা। তার স্বামীর ছোট ভাই তাকে একটি প্ৰেমপত্র লিখে বসে আছে। এই ব্যাপারটি সে তার স্বামীকে জানাবে, না জানাবে না। এই হচ্ছে সমস্যা। মেয়েটির সঙ্গে মুনার তেমন কোন আলাপ নেই। আজ হঠাৎ করে এ রকম একটি জটিল সমস্যার কথা তাকে বলতে এল মুনা? মুনা একবার ভাবলী বলবে. পরে তোমার কথা শুনব ভাই। আজ একটু ব্যস্ত আছি। কিন্তু এটা বলা সম্ভর নয়।
মেয়েটি যাবার পরপর এলেন পাল বাবু। তিনি কোন এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর খোঁজ পেয়েছেন। যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ সবই বলতে পারে। পাল বাবুর ইচ্ছা মুনাকে নিয়ে একবার তার কাছে যাওয়া। বহু কষ্টে মুনা পাল বাবুকে বিদেয় করল তখন এসে উপস্থিত হলেন শওকত সাহেব। মুনা বিরক্ত হয়ে বলল, ব্যাপার কি মামা?
তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।
জরুরি কথা বাসায় গিয়ে শুনব। এখন কাজ আছে তুমি যাও।
না এখনই বলতে হবে।
বল তাহলে। এক মিনিটের মধ্যে শেষ করতে হবে।
এখানে বলা যাবে না। বাইরে আয়।
বাইরে কোথায় যাব?
চল তোদের ক্যান্টিনে যাই। জায়গাটা নিরিবিলি।
ক্যান্টিনে যেতে পারব না। যা বলার এখানেই বল। আমি টেবিল ছেড়ে উঠব না।
শওকত সাহেব বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলেন। মুনা তাকিয়ে রইল। বড় ঝামেলায় পড়া গেল।
মামা বল।
বলছি।
বলছি বলেও তিনি মুখ বন্ধ করে বসে রইলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল।
মুনা।
বল শুনছি।
বকুলের বিয়েটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। ওদের খবর পাঠিয়ে দে বিয়ে হবে না।
কেন?
কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখলাম। খারাপ স্বপ্ন! ভোর রাতে স্বপ্নটা দেখলাম।
তুমি স্বপ্ন দেখছ এই জন্যে বিয়ে হবে না?
স্বপ্নটা শুনলে তুই বুঝবি?
কিছু শুনতে হবে না। তুমি বাড়িতে গিয়ে ঘুমাও।
আমার কথাটা পুরোপুরি শোন–স্বপ্নে দেখলাম তোর মামি এসে আমাকে বলছে, জহির ছেলেটা ভাল না। ও আমার মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। তারপর দেখলাম। বকুল শুয়ে আছে আর জহির একটা বটি হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকছে এই সময় ঘুমটা ভেঙে গেল।
মুনা বলল, চা খাবে মামা? শওকত সাহেব কিছু বললেন না।
চা এনে দিচ্ছি। খাও। তারপর বাড়িতে চলে যাও।
আর কিছু বলবি না?
না। খবরের কাগজে। আজকাল প্রায়ই খবর উঠছে যৌতুকের জন্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন এইসব খবর পড়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছি।
শওকত সাহেব রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, বাড়িতে গিয়ে কোনো খোঁজ নিয়ে দেখ, যে রাতে তুমি স্বপ্ন দেখেছি আগের দিনের পেপারে এ রকম কোন খবর আছে।
কথা সত্যি। এ জাতীয় একটি খবর সত্যি সত্যি আছে। শওকত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
চলে যাচ্ছ মামা?
হুঁ।
চা খাবে না?
না।
বিকেল পাঁচটায় সিদ্দিক সাহেব এসে দাঁড়ালেন টেবিলের সামনে। নিচু গলায় বললেন, কাজটা শেষ করতে পারেননি। তাই না? মুনা বিব্রত স্বরে বলল জি না স্যার।
বকুলের বিয়ে হয়ে গেল
বকুলের বিয়ে হয়ে গেল।
শওকত সাহেব বিয়ের অনুষ্ঠানে খুব মনমরা হয়ে রইলেন। বকুলকে নিয়ে যাবার সময়ও তেমন কোন উচ্ছ্বাস দেখালেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন না। কেমন যেন শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। বকুল খুব কাঁদল। সে সারাদিনই কাঁদছিল। কনে বিদেয়ের সময় হতেই তার হেঁচকি উঠতে লাগল। মুনা তাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে বলল, এ রকম করছিস কেন? মরা কান্না কাঁদছিস। বিশ্ৰী লাগছে শুনতে। কান্না থামা।
বকুল ধরা গলায় বলল, বাবার কি হয়েছে? বাবা এ রকম করছে কেন?
কি রকম করছে?
দেখ না কেমন করে তাকাচ্ছে।
কোন রকম করে তাকাচ্ছে না। মামা ভালই আছে। তুই কোন রকম হৈচৈ না করে তোর বরের বাড়ি যা।
বকুলের কান্না থামল না। জহিরকে দেখা গেল ফিসফিস করে কয়েকজনকে কি সব বলছে। নিশ্চয়ই কোন হাসির কথা। কারণ সেই ফিসফিসানি শুনে সবাই হাসছে। মুনার মন খারাপ হয়ে গেল। যার স্ত্রী এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে সে হাসির কথা বলবে কেন? কেন সে এই কিশোরী মেয়েটির দুঃখ বুঝবে না?
মুনা জহিরকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেল। আলাদা করে কিছু বলার উপায় নেই। বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে। বর ভেতরে এসেছে কাজেই অল্পবয়সী মেয়েগুলি চেষ্টা করছে গা ঘেঁষে দাঁড়াতে। মুনা অনেক চেষ্টা করে ওদের সরাল। জহির বলল, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাবী, তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। মুনা তার ভাবী নয়। কিন্তু সে ভাবী ডাকছে। বিচার-বুদ্ধি কমে এসেছে। সেও নিশ্চয়ই একটা ঘোরের মধ্যে আছে।
ভাবী ডাকছ কেন জহির? আমি তোমার আপা।
সরি আপা। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
হ্যাঁ বলব। বকুল খুব বাচ্চা মেয়ে একটু খেয়াল রাখবে। বিয়ে হয়ে গেছে বলেই কিন্তু সে বড় হয়ে যায়নি। বকুলের স্বভাব-চরিত্র অনেক’দিন পর্যন্ত কিশোরীদের মত থাকবে।
এইসব আপনি আমাকে কেন বলছেন?
যাতে তুমি বুঝতে পার সেই জন্যেই বলছি।
বুঝতে পারব না কেন? আমার যথেষ্ট বুদ্ধিবিবেচনা আছে বলেই আমার ধারণা।
জহিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। গলার স্বর হল কঠিন। মুনা ভেবে পেল না তার কথায় এই ছেলেটি রাগ করছে কেন। এই ছেলেটিকে সে এখন রাগাতে চায় না।
আপা আমাদের তো এখন যেতে হয়। নটা বেজে গেছে।
চল দেখি যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কিনা।
যাবার ব্যবস্থা খুব সহজেই হল। বকুলকে আরো খানিক্ষণ এ বাড়িতে ধরে রাখার কেউ নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে। উৎসব শেষ হলেই যেন সবাই বাঁচে। নিজের নিজের বাড়িতে ঘুমুতে যেতে পারে। রাত দশটার মধ্যে বাড়ি খালি হয়ে গেল! একেবারেই ফাঁকা। বকুলের মামির বোধ হয় থাকার ইচ্ছা ছিল। মুনা কোনো রকম আগ্রহ দেখাল না। মুখ ফুটে বলে ফেলল, বাড়িতে বিছানা নেই মামি আপনার কষ্ট হবে। মুনার ইচ্ছা নয়। কেউ থাকুক। একা হয়ে যেতে মন চাইছে।
ডেকোরেটরের ঘর থেকে দুইজন ছোকরা এসেছে। অল্প বয়সের কিন্তু ভারি ছটফটে। রাত এগারটার মধ্যে সব ঐটে থালাবাসন ধুলে ফেলল। ঠেলাগাড়ি এনে চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ফেলল। বাসি খাবারের গন্ধ ছাড়া বিয়ে বাড়ির আর কোন চিহ্ন রইল না। সে অনায়াসে চলে যেতে পারে কিন্তু গেল না। তার এই বাড়িতে আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করছে। বিয়ের সমস্ত ঝামেলা সে একা কি করে সামাল দিয়েছে সে বিষয়ে মুনার কাছ থেকে কিছু শোনার ইচ্ছা করছে। মুনা কিছুই বলেনি। এখন হয়ত বলবে।
বাকের নিতান্ত আপনজনের ভঙ্গিতে রান্নাঘরে উঁকি দিল। মুনা উনোনে চায়ের পানি বসিয়েছে। বিজবিজ শব্দ হচ্ছে। সে বসে আছে মাথা নিচু করে। কাঁদছে নাকি? অস্বাভাবিক নয়। বোন চলে গিয়েছে, কাঁদাই উচিত।
মুনা অবশ্যি কাঁদছিল না। বাকেরকে দেখে বলল, কিছু বলবেন?
না কিছু বলব না। খাওয়া-দাওয়া কেমন হয়েছে?
ভালই তো। খারাপ কেউ বলেনি।
বাচু বাবুর্চিকে ধরে এনেছি। খারাপ বলবে মানে। মারাত্মক বাবুর্চি।
তাই নাকি?
এক নাম্বারা যাকে বলে। হাই ডিমান্ড। এক মাস আগে থেকে বলে না রাখলে পাওয়া যায় না। আমাকে না করে দিয়েছিল। শেষে পা চেপে ধরলাম।
মুনা হেসে ফেলল। বাকের অপ্রসন্ন মুখে বলল, হাসছ কেন?
বাবুর্চির পা ধরতে হল। তাই হাসছি। চা খাবেন? চা হচ্ছে।
দাও এক কাপ চা খাই।
বাকের মুনার সামনে উবু হয়ে বসে পড়ল। তার মুখ হাসি হাসি।
আপনার খুব কষ্ট হল বাকের ভাই।
আরে না। কষ্ট কিসের? বকুল হচ্ছে আমার বোনের মত। তার বিয়েতে কষ্ট না করলে কার বিয়েতে কষ্ট করব?
এই পাড়ার সব মেয়ের বিয়েতেই তো আপনি কষ্ট করেন। খাটাখাটি করেন। করেন না?
তাই নাকি?
আমার বিয়েতেও কি করবেন?
বাকের জবাব দিল না। আড়চোখে তাকাল মুনার দিকে। মুনা কাঁপে চা ঢালছে। আগুনে আঁচে তার মুখ লাল হয়ে আছে। কি সুন্দর লাগছে দেখতে।
কি জবাব দিচ্ছেন না যে? করবেন আমার বিয়েতে খাটাখাটনি?
কেন করব না? নিশ্চয়ই করব।
এত মারা গলায় বলছেন কেন? শক্ত করে বলুন।
বাকের চায়ের কাঁপে চুমুক দিল। এই কি যে অদ্ভুত কথাবার্তা!
বাকের ভাই।
বল।
একটা কথা বোধ হয়। আমি আপনাকে কোনোদিন বলিনি, কথাটা হচ্ছে। আমি আপনাকে খুব পছন্দ করি। আপনি আবার এটাকে প্রেম বলে ধরে নেবেন না। প্রেম অন্য জিনিস।
বাকের একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে–প্ৰেম কি জিনিস? সে জিজ্ঞেস করল না। গম্ভীর মুখে চায়ে চুমুক দিতে লাগল। গুছিয়ে কিছু-একটা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কোনো কথা মনে আসছে না। সে নিজের অজান্তেই বলে বসল।–রোসটটা বেশ নরম হয়েছিল। তাই না?
মুনা অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ রোস্টের কথা বলছেন কেন?
না মানে…
অনেক খাবার বেঁচে গেছে। আপনি খাবেন?
দাও খাই।
বাকেরের খিদে বিন্দুমাত্র ছিল না। বিয়ে বাড়ির খাবার দ্বিতীয়বার খাওয়া যায় না। কিন্তু মুনা খাবার বেড়ে দেবে বসে থাকবে সামনে এর জন্যেও দ্বিতীয়বার খাওয়া যায়।
আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন আমি খাবার গরম করছি।
এখানে বসে খাব?
না। এখানে কেন? খাবার টেবিলে যান।
বাকের উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, এগার নাম্বার বাড়িতে ঐ মেয়ে তিনটি আসলে কি জিনিস জানো?
না জানি না। জানার ইচ্ছাও নেই।
ওরা হচ্ছে বাজারের মেয়ে।
বাজারের মেয়ে মানে?
খারাপ মেয়ে।
কি সব আজেবাজে কথা যে আপনি বলেন বাকের ভাই। অসহ্য। যান হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসুন। আপনাকে খাইয়ে আমি শুয়ে থাকব। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
প্যারাসিটামল খাও।
প্যারাসিটামল আমি এখন পাব কোথায়?
এনে দিচ্ছি। নো প্রবলেম। ময়না মিয়া রাত এগারটার আগে দোকান বন্ধ করে না। মুনাকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই সে রাস্তায় নেমে পড়ল।
আজ সন্ধ্যায় রাতের পাখিরার অভিনয় হবে। বাকের তার কিছুই জানে না। কেউ তাকে বলেনি। এর মানে কি? তাকে কেউ কিছু বলবে না কেন? সারা বিকাল ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তা করল। পরিষ্কার কোন কারণ সে ভেবে পেল না। একটা হতে পারে তাকে খবর দেয়ার কথা মনে নেই। থিয়েটার মানেই অসম্ভব ঝামেলা। ঝামেলাতে কথা এলোমেলো হয়ে যায় সব কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু এই সহজ যুক্তিটি বাকেরের মনে ধরছে না। কারণ জসীমের সঙ্গে তার কয়েকবার দেখা হয়েছে। জসীম তাকে এড়িয়ে গেছে। স্পষ্ট মনে আছে একবার সে জিজ্ঞেস করল বই কবে নামোচ্ছ? জসীম তার উত্তর দেয়নি। ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হোসেছে। ফন্ট করে তো আর ঠিক করা হয়নি। আজি সন্ধ্যায় অভিনয় হবে। নিশ্চয়ই অনেক আগে থেকে ঠিকঠাক করা।
জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে সে উপস্থিত হল সন্ধ্যার আগে। তোলা-উনুনে পেয়াজু ভাজা হচ্ছে। জলিল, মিয়া এই ব্যাপারটি নতুন শুরু করেছে। সন্ধ্যা হতেই পেঁয়াজু, ডালপুরি ভাজা। ভাল বিক্রি হচ্ছে। ভাজাবুজির জন্যে নতুন লোক রাখা হয়েছে। জলিল মিয়া ভালই দেখাচ্ছে। বাকের বারান্দায় চেয়ার টেনে বসল। জলিল মিয়া উঁচু গলায় বলল, বাকের ভাইরে পেয়াজু দে। চা দে।
বাকের ইশারায় নিষেধ করল। জলিল মিয়া বলল, বই শুরু হতে দেরি আছে বাকের ভাই। আটটা বাজাবে। মিনিসটার আসতাছে।
কে আসছে?
মিনিস্টার।
মিনিস্টার মানে? কি মিনিস্টার?
মিনিস্টারের কি আর দেশে অভাব আছে ভাইজান?
কথা খুবই ঠিক। দেশে প্রচুর মিনিস্টার আছে কিন্তু এরা নিশ্চয়ই পাড়ার নাটকে উপস্থিত হয়। না। এদের অন্য কাজ আছে।
মিনিস্টারের কথা। আপনি কিছু জানেন না বাকের ভাই?
না!
হুলস্থূল হয়ে যাচ্ছে। সিদ্দিক সাহেব ব্যবস্থা করলেন। কার্ড-টার্ড ছাপিয়েছে।
তাই নাকি?
আপনি কিছুই জানেন না?
বাকের গম্ভীর মুখে বসে রইল। তাকে কিছু না বলার রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে। সিদ্দিক সাহেবেব চাল। মিনিস্টার-ফিনিস্টাের আনছেন। ভবিষ্যতে কোন পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই।
বাকের ভাই!
বল।
চা খান এক কাপ। স্পেশাল পাত্তি আছে। কাস্টমারদের দেই না। দিতে বলি?
বল।
জলিল চায়ের কথা বলল। তার বেশ মজা লাগছে। সে বুঝতে পারছে সিদ্দিক সাহেবের সঙ্গে বাকেরের একটা ঝামেলা শুরু হয়েছে। বাকের একা পড়ে গেছে। এই সময়ে থাকা মানেই ডুবে যাওয়া। সামনে দিনগুলিতে বাকেরকে আর ডেকে ডেকে চা-পিয়াজু খাওয়াতে হবে না। স্পেশাল পাত্তির চা বানাতে হবে না। কিন্তু তাতে তার কোন লাভ নেই। নতুন দল আসবে। স্পেশাল পাত্তি তাদের জন্যে রাখতে হবে।
বাকের ভাই।
উঁ।
মিনিস্টার সাহেব নাকি যুব সমিতিতে অনেক টাকা-পয়সা দিচ্ছেন। ঘর দিচ্ছেন।
ভালই তো।
যুব সমিতির পাঠাগার হবে। বিশ ইঞ্চি টিভি দিবে। পাঠাগারে।
ভাল।
এরশাদ সাহেবের দলটা খারাপ না কি বলেন? খরচপাতি করছে। জিয়া সাহেবের সময় এত খরচপাতি করে নাই। খালি খাল কাটা হয়েছে। কি বলেন বাকের ভাই?
বাকের জবাব দিল না। জলিল মিয়া হৃষ্টচিত্তে বলতে লাগল, মিলিটারি ছাড়া এই দেশ ঠিক রাখা যাবে না। এরশাদ সাব মিলিটারি মানুষ। দুই মেয়ে পলিটিশিয়ানদের কেমন চরকি বাজি দেখিয়ে দিল। ঠিক বললাম। কিনা বলেন বাকের ভাই?
ঠিকই বলেছেন।
মেয়ে মানুষের কাজ হইল বাচ্চা দেওয়া। এই কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ মেয়ে মানুষ দিয়ে হয় না। ঠিক বললাম না বাকের ভাই?
বাকের উত্তর না দিয়ে উঠে এল। জলিল মিয়ার দোকানে এখন কাস্টমার নেই। সে অনবরত বকর বকর করতে থাকবে। পলিটিক্স তার প্ৰিয় বিষয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময় সে ছিল জিয়া ভক্ত। এখন এরশাদ প্রেমিক। এরশাদ সাহেবের একটা বাঁধানো ছবি দোকানে ঝুলিছিল। লোকজন হৈচৈ করাতে ছবি সরিয়ে ফেলেছে। এই দেশের মানুষগুলি অদ্ভুত যে ক্ষমতায় থাকে তাকে কেউ সহ্য করতে পারে না। সবাই তার বিরুদ্ধে চলে যায়। কেন যায়?
বাকের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা পৰ্যন্ত কয়েকবার হাটল। রাস্তার মোড়ে টর্চ হাতে দু’জন ট্রাফিক পুলিশ। এই রকম জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ? নিৰ্ঘাৎ মিনিস্টার সাহেব আসছেন সেই উপলক্ষে। একবার গিয়ে দেখে আসবে নাকি কেমন জমেছে। সব কিছু? বাকের মনস্থির করতে পারল না। মুনাদের বাসায় গেলে কেমন হয়? না, তাদেরও পাওয়া যাবে না। সেজেগুজে দল বেঁধে হয়তো গিয়েছে থিয়েটার দেখতে। বাকের রওয়ানা হল কম্পাউন্ডওয়ালা বাড়িটির দিকে। এই বাড়ির কেউ থিয়েটারে যাবে না। এরা ঘরে থাকবে। সে যদি গিয়ে বলে, চলুন থিয়েটার দেখে আসি তাহলে কেমন হয়? চশমা পরা বুড়ি তার উত্তরে কি বলবে? মেয়ে তিনটিই বা কি করবো? এদের সঙ্গে এখনো কথাবার্তা হয়নি? নাম পৰ্যন্ত জানা নেই। এদের নিশ্চয়ই খুব বাহারি নাম। ফুলেশ্বরী, রত্নেশ্বরী এ রকম। এর নিশ্চয়ই কণা, বীণু এ রকম নাম রাখবে না; রাখলেও বদলে ফেলবে।
গেট তালাবন্ধ। গেটের ভেতরে একটি কালো রঙের গাড়ি। জোবেদ আলিকে দেখা গোল গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে সেহে হেসে কি বলছে। জোবেদ আলির হাতে সিগারেট। অথচ কয়েক’দিন আগেই সে বলেছে সিগারেট খায় না। বাকের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকল, এই যে জোবেদ আলি সাহেব। একটু শুনে যান।
জোবেদ আলি গম্ভীর মুখে এগিয়ে এল।
কেমন আছেন ভাই?
ভাল। কি চান?
কিছু চাই না। গল্পগুজব করতে আসলাম।
জোবেদ আলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। বাকের হাসিমুখে বলল, থিয়েটারে যান নাই? রাতের পাখিরা হচ্ছে।
জি না। থিয়েটার দেখি না।
মেয়েরাও যায় নাই?
না।
যান নাই কেন? কাস্টমার এসেছে নাকি?
কি বললেন?
বললাম কাস্টমার এসেছে নাকি? মেয়ে তিনটা তো ব্যবসা করে তাই না?
জোবেদ আলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। বাকের গম্ভীর গলায় বলল, ভদ্রপাড়ায় বেশ্যাবাড়ি খুলে ফেললেন?
জোবেদ আলি থমথমে গলায় বলল, পাগলের মত কি বলছেন? বাকের ঠাণ্ডা গলায় বলল, ঠিক বলছি। একটা কথাও ভুল বলি নাই। গেট খুলেন। বুড়ির সঙ্গে কথা বলব।
আপনি সকাল বেলায় আসেন। যা বলার সকালে বলবেন।
বাকের সিগারেট ধরিয়ে উদাস স্বরে বলল, বেশ্যার দালালি কতদিন ধরে করছেন?
আমাকে বলছেন?
হ্যাঁ আপনাকেই। আপনি ছাড়া আর কে আছে। নেন সিগারেট নেন।
আমি সিগারেট খাই না।
একটু আগেই তো দেখলাম সিগারেট টানছেন।
জোবেদ আলি নিচু গলায় বলল–বাকের ভাই, আপনি সকালে আসেন। এখন হৈচৈ করবেন না।
হৈচৈ? হৈচৈ কোথায় করলাম?
ভাই আপনি এখন যান।
সাদা শাড়ি পরা ফর্সা মহিলা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। সে রিনারিনে গলায় বলল, কে কথা বলে রে?
জোবেদ আলি বলল, কেউ না আম্মা।
জোবেদ আলি এই মহিলাকে আম্মা ডাকে নাকি? এটা জানা ছিল না। বাকের সিগারেট টানতে টানতে রাস্তার দিকে রওনা হল। এখন তার বেশ একটা ফুর্তির ভাব হচ্ছে। কালো গাড়িতে করে যে ভদ্রলোক তিন কন্যার কাছে এসেছেন তার শার্টের কলার চেপে ধরলে কেমন হয়? বাকের নিজের মনে খানিক্ষণ হাসল। দলবল জুটিয়ে বাড়ি ঘেরাও করলে হয়। কিন্তু সবাই গেছে রাতের পাখিরা দেখতে। সেখান থেকে হাতী নিয়ে টেনেও কাউকে আনা যাবে না। বাকের মুনাদের ঘরের দিকে রওনা হল। কাউকে ঘটনাটা বলতে না পারলে রাতে ঘুম হবে না।
অনেক্ষণ কড়া নাড়ার পর দরজা খুলল। বাকের হাসিমুখে বলল, খবর কি মুনা? মুনা বিরসমুখে বলল, কোনো কাজে এসেছেন?
না কোনো কাজ নেই। যাচ্ছিলাম। এদিক গিয়ে ভাবলাম…।
আমার শরীরটা ভাল না। এখন চলে যান।
বাসায় কেউ নেই?
না। মামা কোথায় যেন গেছেন। বাবু গেছে বকুলের শ্বশুর বাড়ি।
ও আচচ্ছা। একা এক ভয় লাগছে না?
আমার এত ভয়টয় নেই।
একটা মজার খবর আছে মুনা। রহস্যভেদ হয়েছে। ভূতের কাছে মামদোবাজি। ফটাস করে হাড়ি ভেঙে ফেলেছি। অপেন মার্কেট পট ব্ৰেকিং হয়ে গেছে।
কি বকবক করছেন?
শুনলে লাফ দিয়ে উঠবে।
লাফ দিয়ে উঠার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এখন যান তো।
বেশিক্ষণ না এক মিনিট বসব।
বাকের ঘরে ঢুকে পড়ল। সহজ গলায় বলল, চা কর এক কাপ। চা খেয়ে জুত হয়ে বসে গল্পটা করি।
আপনি বড্ড বিরক্ত করেন বাকের ভাই।
বিরক্ত করব না। এক মিনিটের মামলা। তুমি নাটক দেখতে যাওনি।
যাইনি। সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। শুধু শুধু কথা বলা আপনার একটা বদ অভ্যাস।
তা ঠিক। নাটকে মিনিসটার সাহেব আসছেন জানো নাকি?
না জানি না। আসুক যার ইচ্ছা।
সিদ্দিক সাহেবের চাল। ব্যাটা ইলেকশন করবে। ফিল্ড করছে। বুঝলে মুনা? লোকজনদের খেলাচ্ছে।
খেলাক। আপনি চুপ করে বসুন। চা এনে দিচ্ছি খেয়ে বিদেয় হোন।
নাটক যদি দেখতে চাও নিয়ে যেতে পারি। ঘরে তালা দিয়ে চলে যাব। নো প্রবলেম।
কিচ্ছু দেখতে চাই না।
মুনা ভেতরে চলে গেল। বাকের সিগারেট বের করল। পকেটে দেয়াশলাই আছে। তবু সে রান্নাঘরে উঁকি দিল ম্যাচ আছে? সিগারেট ধরাতে পারছি না। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে দেয়াশলাই এগিয়ে দিল।
কাজের একটা মেয়ে ছিল না? সেও নেই?
না। দেশের বাড়ি গেছে। আপনি এখানে বসছেন কেন? বসার ঘরে গিয়ে বসুন।
তুমি একা একা আছ!
।বাকের ভাই, বসার ঘরে গিয়ে বসুন তো।
বাকের উঠে গেল।
মিনিস্টার সাহেব চলে এসেছেন। অনেক মাইকী-টাইক লাগানো হয়েছে। এখান থেকেও পরিষ্কার শুনা যাচ্ছে। সব মিনিস্টাররা এক ধরনের ভাষায় বক্তৃতা দেন। গলা উঠানামা করে এক ভঙ্গিতে। এক এক সরকারের মন্ত্রীদের এক এক ধরনের বক্তৃতা। শেখ মুজিবের মন্ত্রীরা আঙুল দেখিয়ে বক্তৃতা করতেন। রেসকোর্স ময়দানে মুজিবের ভাষণের নকল করতেন। এরশাদ সাহেবের মন্ত্রীরা সবাই খুব আল্লাহ ভক্ত। সবাই কোরান শরীফ থেকে উদ্ধৃতি দেন। তাদের বক্তৃতায় ইহকালের চেয়ে পরকালের কথা বেশি থাকে। বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ওয়াজ করছেন।
বাকের শুনল মিনিস্টার সাহেব বলছেন–যুবকদের সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে। যুবকদের অনুসরণ করতে হবে রসুলুল্লাহর নির্দেশিত পথ। কারণ সেই পথেই ইহকাল ও পরকালের জন্যে
মুনা চা এনে সামনে রেখে ক্লান্ত গলায় বলল, বাকের ভাই, আমার শরীরটা ভাল না। চা খেয়ে আপনি চলে যান।
হয়েছে কি?
কি জানি কি! বমি বমি লাগছে।
নো প্রবলেম দু’টি এভোমিন ট্যাবলেট নিয়ে আসছি।
আপনাকে কিছু আনতে হবে না, প্লিজ।
বাকের চায়ে চুমুক দিল। মুনা তার সামনেই বসে আছে। চোখ ঈষৎ রক্তাভ। সন্ধ্যা বেলাতেই ঘন ঘন হাই তুলছে। কেমন কঠিন একটা ভঙ্গি তার চারদিকে। মেয়েরা এমন কঠিন হলে ভাল লাগে না।
রাত সাড়ে এগারটার দিকে শেষবারের মত চা খাবার জনো বাকের বের হল। ভাইয়ের বাসায় থাকার সময় তাকে এই কষ্টটা করতে হত না। শোবাব আগে এক কাপ চা খাওয়া যেত। এখন বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হয়। অস্বস্তিকর ব্যাপার। বিছানায় বসে চা খাওয়া আর দোকানের চেয়ারে বসে চা খাওয়া একটা বড় রকমের পার্থক্য আছে।
জলিল মিয়া তার সন্টল বন্ধ করে দিয়েছে। সাধারণত বারোটার দিকে বন্ধ হয়। আজ সকাল সকাল বন্ধ হল। বাকের এগিয়ে গেল মেইন রোডের দিকে। সেখানে হোটেল আকবরিয়া সারারাত খোলা থাকে।
বাকের ভাই। বাকের ভাই।
বাকের থমকে দাঁড়াল। জসীম লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। তার মধ্যে ব্যস্ত একটা ভঙ্গি। মনে হচ্ছে বেশ ফুর্তিতে আছে।
কি খবর জসীম?
জি খবর ভাল।
তোমাদের নাটক কেমন?
জসীম খানিকটা চুপসে গেল। নিচু গলায় বলল, ভাল হয়েছে।
ভাল হলেই ভাল। মিনিসটার এসেছিল নাকি?
হুঁ।
গুড, ভেরি গুড।
আমি আপনাকে খুঁজছিলাম বাকের ভাই। দু’বার আপনার ঘরে গিয়ে খুঁজে এসেছি
কি জন্যে?
জসীম ইতস্তত করতে লাগল। যেন কোন একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ তুলতে চায়। কিন্তু সাহসে কুলুচ্ছে না। সে অকারণে কাশতে লাগল।
বলে ফেল কি ব্যাপার।
আপনি জোবেদ আলিকে কি বলেছেন?
বাকেরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল।
আজ সন্ধ্যার কথা বলছ?
হুঁ।
তা দিয়ে তোমার কি? জোবেদ আলির সঙ্গে তোমার কি? জোবেদ আলি বেশ্যার দালাল। তুমি করা দোকানদারি। তাকে কি বললাম না বললাম তাতে তোমার গায়ে লাগছে কেন বুঝলাম না।
না। আমার কিছু না। সিদ্দিক সাহেবের কাছে ওরা গিয়েছিল। সিদ্দিক সাহেব আমাকে খবর দিয়ে আনলেন। আমাকে আর মাখনা ভাইকে। বললেন…
জসীম থেমে গেল। বাকের গভীর স্বরে বলল, কি বললেন?
বললেন আপনাকে সাবধান করে দিতে। ঝামেলা করলে অসুবিধা হবে।
কি অসুবিধা হবে?
জসীম চুপ করে রইল। বাকের কড়া গলায় বলল, তোমরা সিদিকের সঙ্গে গিয়ে জুটেছ?
তা না। উনি পাড়ার একটা মাথা।
কবে থেকে পাড়ার মাথা হল? কি, কথা বলছি না যে? গিয়ে বলবে তোমার পাড়ার মাথাকে, আমি তার মুখে পেচ্ছাব করে দেই।
জসীম রুমাল দিয়ে তার ঘাম মুছতে লাগল। বাকের বলল, কি বলতে পারবে না?
এটা কেমন করে বলি বাকের ভাই?
অসুবিধা কি? আমি যেমন বললাম। সে রকম বলবে। তোমাদের কাজই তো হচ্ছে একজনের কথা অন্যজনকে বলা।
আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
চা খেতে যাই। হোটেল আকবরিয়ায়। খাবে নাকি?
জি না।
না খেলে চলে যাও। সিদ্দিক সাহেবকে খবরটা দাও। মুখে পেচ্ছাবের কথাটা গুছিয়ে বলবে। ওটা বাদ দি ও না।
জসীম শুকনো মুখে চলে গেল। হোটেল আকবরিয়ার মালিক দিলদার মিয়া খুবই যত্ন করল। নিজে উঠে গিয়ে চা নিয়ে এল। বসল মুখোমুখি। দিলদার মিয়ার মুখে বসন্তের দাগ। চিবুকের কাছে এক গোছা কুৎসিত দাড়ি। তবু বাকেরের দিলদার মিয়ার সঙ্গে গল্প করতে বেশ লাগল। সে ঘরে ফিরল রাত একটায়। রাত দুটায় পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেল। অভিযোগ গুরুতর। বেআইনি অস্ত্র রাখা। জনগণের ওপর জোরজবরদস্তি। সে ধরা পড়ল। গুণ্ডা আইনে। তার কাছে অস্ত্রশস্ত্র কিছুই ছিল না। কিন্তু পরদিনের পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হল। তার সঙ্গে যে সব অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গেছে তার ছবিও উঠল। একটি পিস্তল, দু’টি ন’ইঞ্চি ড্যাগার এবং তিনটি তাজা হাতবোমা।
এক সপ্তাহ অনেক লম্বা সময় নয়
বকুলের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এক সপ্তাহ অনেক লম্বা সময় নয়। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে সে বৌ সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘুমুতে যাচ্ছে একজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে। মানুষটিও যেন তার সঙ্গে অনন্তকাল ধরেই ঘুমুচ্ছে! গায়ে ঘামের গন্ধ। সে বলে উঁচু গলায়। রেগে ওঠে। অল্পতে। বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই সে বলল, পিঠটা একটু চুলকে দাও তো বকুল। কী অদ্ভুত কথা! ঘর ভর্তি মানুষজন। সে বসে আছে টানা বারান্দায়। লোকজন আসা-যাওয়া করছে এর মধ্যে পিঠ চুলকে দেবে কী? কিন্তু জহির শার্ট তুলে খালি গায়ে বসে আছে। অসহিষ্ণু গলায় বলল, আহ দেই করছ কেন?
নতুন বৌকে কেউ এমন কড়া গলায় কিছু বলে। বকুলের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। সে বহু কষ্টে পানি সামলাল এবং হাত রাখল। জহিরের পিঠে। জহির বিরক্তমুখে বলল, এ রকম শান্তিনিকেতনি কায়দায় সুড়সুড়ি দিচ্ছি কেন? ভালমত চুলকাও।
কি বিশ্ৰী কথা বলার ভিঙ্গি। বিয়ের পর মানুষটিকে বকুলের মোটেও ভাল লাগছে না। দুপুরের পর থেকেই তার শুধু মনে হতে থাকে সন্ধ্যা এসে পড়ছে। এক সময় সন্ধ্যা মিলাবে এবং জহির সবার সামনেই দরজা বন্ধ করে ঝাপটা-ঝাপটি করতে করতে বলবে তুমি এমন মাছের মতো পড়ে থাক কেন? তোমার অসুবিধাটা কি? বকুল শুধু মনে মনে বলবে, আহ আজকের রাতটা পার হোক। এক সময় সেই রাত পার হয়। কিন্তু আবার নতুন একটি রাত আসতে শুরু করে। একটি বিবাহিত মেয়ের জীবন মানেই কী একের পর এক গ্লানিময় ক্লান্তির দীর্ঘ রজনী?
কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কাকে করবে? টিনা ভাবী নেই। তাকে চিঠি লেখা যায়। কিন্তু চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে না। ইদানীং তার বারবার মনে হয় সবাই ইচ্ছা করে তাকে জলে ফেলে দিয়েছে। সবাই জানত তার এই অবস্থা হবে কিন্তু কেউ তাকে বলেনি।
বিশাল এই বাড়িতে তার শুধু হাঁফ ধরে। প্রায়ই মনে হয় নিঃশ্বাস নেবার মতো বাতাস নেই কোথাও। অথচ কি খোলামেলা বাড়ি। তাদের শোবার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দিলে বাতাসে বিছানার চাদর সব উড়িয়ে নিয়ে যায়। টানা বারান্দা এত প্রশস্ত যে নেট টানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা যায়।
একতলার বেশির ভাগ ঘরই তালাবদ্ধ। থাকার লোক নেই ব্যবহার হয় না। তার শাশুড়ি প্রথম দিনেই সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। সারাক্ষণই কথা বললেন–
এই যে দেখ মা। পাশাপাশি দুই ঘরা। তোমার শ্বশুর বলতেন অতিথি ঘর। অতিথি এলে থাকবে। কত বড় ঘর দেখলে? ইচ্ছা করলে বাইজী নাচানো যায়। তোমার শ্বশুর সাহেবের মাথাটা ছিল খারাপ। টাকা-পয়সা যা ছিল সব ঢেলেছ এই বাড়িতে। তা না করে যদি জমিজমা করত তাহলে আজ তোমরা পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারত। বুঝলে মা এই বংশই হচ্ছে পাগলের। আমার ছেলেও পাগল। এখন বুঝতে পারছি না, কয়েক’দিন যাক বুঝবে। এই যে দেখ এটা দেখ। লাইব্রেরি ঘর। রাজ্যের বই আছে। এখানে। পোকায় কেটে সব শেষ করেছে। একটা বই আস্ত নেই। বই পড়ার অভ্যাস আছে? থাকলে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে যেও। তবে মা রাতের বেলা একা একা। এ ঘরে আসবে না। সবাই বলে কী সব নাকি দেখে। আমি নিজে কোনোদিন দেখি নাই। তোমার শ্বশুর সাহেবকে নাকি দেখে ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়ছে। যত বানানো কথা। শুনলে রাগে গা জ্বলে যায়।
জহির নিজেও বাড়ি প্রসঙ্গে অনেক কথাটথা বলল। বকুলকে খানিক ঘুরিয়ে দেখাল, ছাদে নিয়ে গেল। হৃষ্টচিত্তে বলল, বাড়ি কেমন দেখলে?
ভাল।
একুশটা ঘর আছে। অথচ দু’টা মাত্র বাথরুম, তাও একতলায়। বাবার একটা নেশাই ছিল ঘর বানানো। কি করে রুমের সংখ্যা বাড়ানো যায়। অথচ মানুষ মাত্র তিনজন।
এ রকম অদ্ভুত সখা হল কেন? কে জানে কেন। গৌরীপুরের মহারাজার বাড়ি দেখে বোধ হয় এই নেশা চেপেছিল। লোকজনের বাড়ির সামনে পেছনে খোলা জায়গা-টায়গা থাকে, বাগান-টাগান করে। এইসব কিছু নেই। সবটা জায়গা জুড়ে বাড়ি। কিছুদিন পর এটা হবে ভূতের বাড়ি। কেউ থাকবে না।
বকুল ক্ষীণ স্বরে বলল, মা আমাকে লাইব্রেরি ঘরে একা একা যেতে নিষেধ করেছেন। জহির বিরক্তমুখ বলল, যত ফালতু ব্যাপার। যেখানে যেতে ইচ্ছা হয় যাবে। ভূত-প্রেতি গল্পের বই ছাড়া অন্য কোথাও নেই। তুমি আবার ভূত বিশ্বাস কর না তো?
অল্প অল্প করি।
এখন থেকে আর করবে না। তবে শোন, রাতের বেলা বাথরুমে যেতে হলে আমাকে ডেকে তুলবে। একা একা যাবার দরকার নেই। আমি দোতলায় বাথরুমের ব্যবস্থা করছি। কালই রাজমিস্ত্রী লাগাব!
সত্যি সত্যি ভোর হতেই রাজমিস্ত্রী চলে এল। বকুলের শাশুড়ি মুখ কালো করে ফেললেন। এত টাকা খরচ করে বাথরুম বানানোর তার কোনো ইচ্ছা নেই। দিন তো চলে যাচ্ছে। ওদের দোতলায় অসুবিধা হলে একতলায় চলে এলেই পারে। ঘর তো সব খালিই পড়ে থাকে।
মা এবং পুত্রের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা লড়াই হয়ে গেল। এ জাতীয় লড়াই বকুল আগে দেখেনি। সে কী করবে। বুঝতে পারল না। শাশুড়ি তার ঘরে শুয়ে কাঁদছেন। জহির চায়ের কাপ হাতে রাজমিস্ত্রীদের কাজের তদারক করছে হাসিমুখে। বকুল শুকনো মুখে একবার যাচ্ছে শাশুড়ির কাছে একবার আসছে জহিরের কাছে।
বাড়িতে আর লোকজন বলতে দু’টি কাজের মেয়ে এবং শমসের নামের একজন গোমস্তা ধরনের মানুষ। যার একমাত্র কাজ হচ্ছে বাজার করে এনে রোদে পিঠ মেলে বসে থাকা। বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন যা এসেছিল তারা এক’দিন পরই বিদেয় হয়েছে। বকুলের শাশুড়ির তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়ার কারণ হচ্ছে বিয়েতে দেয়া উপহার।
তিনি বকুলের চাচি শাশুড়িকে সবার সামনেই বললেন, দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছেলে আমার। তার বৌয়ের জন্যে যে শাড়ি আনলেন সেই শাড়ি তো আমার কাজের মেয়েও পরে না। আমার একটা ইজ্জত নেই। ছেলের বৌয়ের কাছে আমার মুখ ছোট হল না? আপনি দুমেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের বিয়েতে আমি সোনা দিয়েছি। দেইনি? আমার ছেলে কী নদীর পানিতে ভেসে এসেছে?
কঠিন কঠিন কথা খুব সহজ মুখে বলে যাচ্ছেন। রোগা ফর্সা ও সুন্দর মহিলাটি কাঁদতে লাগলেন। কী অস্বস্তিকর অবস্থা।
পাঁচ দিনের মাথায় বাবু এসে উপস্থিত। একা একা চলে এসেছে। হাতে নতুন কেনা সুটকেস। বকুলের বিস্ময়ের সীমা রইল না। বিস্ময় এবং আনন্দ। তার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে বাবুকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ খুব কাঁদে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। শাশুড়ি বাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। জহির দোতলা থেকে নেমে এসেছে।
বাবুর শোবার জায়গা হল একতলায়। বকুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল বাবুর ঘর গোছগাছ করে দেবার জন্যে জহির নিজেই উদ্যোগী হয়েছে। বকুল এটা ঠিক আশা করেনি। তার কেন জানি মনে হচ্ছিল জহিরের এখন আর তার বা তার পরিবারের কারোর প্রতি কোন আগ্রহ নেই। রাতের বেলা বকুলকে খানিকক্ষণ কাছে পেলেই তার হবে। সমস্ত ভালবাসাবাসি রাতের খানিকক্ষণ সময়ের জন্যে। সে ভেবে পাচ্ছে না। এই ব্যাপারটি শুধু কী তার ক্ষেত্রেই সত্যি না পৃথিবীর সব মেয়েদের বেলাতেও সত্যি।
বকুলের আনন্দের সীমা রইল না। যখন জহির বলল, তুমি বরং আজ তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমাও। বকুল তাকিয়ে রইল। জহির বলল, বেচারা একা একা ভয়টয় পেতে পারে। তাছাড়া তোমার নিজেরও ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে নিশ্চয়ই। রাত জেগে গল্প কর।
আনন্দে বকুলের চোখে পানি এসে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এমন কিছু বলতে যাতে জহির খুব খুশি হয়। কিন্তু তেমন কোনো কথা তার মনে আসছে না। সে শুধু বলল, তোমার অসুবিধা হবে না তো?
অসুবিধা? অসুবিধা হবে কেন?
ঠিকই তো তার অসুবিধা হবে কেন। বকুল কথাটা বলেছে খুব বোকার মতো। জহির বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়? বাবুকে এখানে রেখে দেয়া যায় না?
এখানে রেখে দেব?
হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে থাকবে। পড়াশোনা করবে। বিরাট বাড়ি খালি পড়ে আছে। তাছাড়া ও থাকলে তোমার একজন সঙ্গী হবে।
সত্যি বলছ?
সত্যি বলছ মানে?
না মানে তুমি চাও ও এখানে থাকুক?
না চাইলে শুধু শুধু বলব কেন? চাই বলেই তো বলছি। তাছাড়া আমি যখন এখানে থাকব না তুমি তখন খুবই লোনলি হয়ে পড়বে।
বকুল অবাক হয়ে বলল, তুমি এখানে থাকবে না। মানে? মা যে বলল, তুমি এখানেই থাকবে।
আমি কি এই মফস্বলে পড়ে থাকব নাকি? কি যে তুমি বল। ঢাকা ছাড়া আমি থাকতে পারি না।
তুমি ঢাকা থাকলে আমিও ঢাকা থাকব।
জহির নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল, পাগল হয়েছ। মা যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন তোমার এখানেই থাকতে হবে।
কেন?
এই শর্তেই মা তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে মত দিয়েছেন।
বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জহির হৃসতে হাসতে বলল, মা বড় কঠিন জিনিস। যত দিন যাবে ততই বুঝবে। তুমি শোবার আগে এক জগ পানি এবং একটা গ্লাস দিয়ে যাবে। জহির ঘুমুবার আয়োজন করল।
রাতে বাবুর সঙ্গে তেমন কোন কথাবার্তা হল না। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তাছাড়া এমনিতেও তার বোধ হয় কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। সে ঘাড় বাকিয়ে বলল, এই ঘরে ঘুমাতে হবে না।
বকুল বলল, ঘুমালে কি অসুবিধা?
বাবু তার জবাবে মুখ অন্ধকার করে বসে রইল।
বাসার খবর কি?
একবার তো বললাম। বাসার খবর।
মুনা আপা কোন চিঠি দেয়নি?
না দেয়নি। দিলে তো তোমার কাছেই দিতাম। লুকিয়ে রাখতাম নাকি?
চিঠি দিল না কেন?
আমি কী জানি কেন দেয়নি।
বকুল ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথা বোধ হয় সবাই ভুলেটুলে গেছে। বাবু চুপ করে রইল। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে বকুলের এই কথা সমর্থন করছে। বকুল বলল, তোর মাথাব্যথা এখনো হয়?
হয়।
এখন হচ্ছে?
না।
হলে বলিস। তোর দুলাভাইয়ের কাছ থেকে ওষুধ এনে দেব।
আমার কোন অষুধ-টুষুদ লাগবে না।
বাবু চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলল। বকুল নরম গলায় বলল, তুই আমার সঙ্গে কথা বল বাবু। এর রকম করছিস কেন? তুই এসেছিস আমার এত ভাল লাগছে।
বাবু মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে ফেলল। বকুল হঠাৎ বলে ফেলল, আমি এখানে খুব কষ্টে আছি রে বাবু। আমার কিছু ভাল লাগে না; মরে যেতে ইচ্ছা করে।
কেন?
তাও জানি না।
বিয়ে করার জন্যে তুমি তো পাগল হয়েছিলে।
বকুল চুপ করে রইল। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘুম এল না। একবার ইচ্ছে করল জহিরের কাছে ফিরে যেতে। এই ইচেছটা কেন হল তাও সে ঠিক ধরতে পারল না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন সব চিন্তা-ভাবনা আসছে মাথায়। বাইরে কাক ডাকছে। কাকের ডাকের সঙ্গে নানান রকম পাখ-পাখালির ডাকও কানে আসছে। ভোর হয়ে যাচ্ছে বোধ হয়। ঘুমহীন রাত একটি কেটে গেল। তার কেন যেন মনে হল এ রকম নিদ্রাহীন রজনী আরো অনেক আসবে তার জীবনে। সে খানিকক্ষণ কাঁদল। এই কান্নাও কেমন অন্য রকম। আগে কাঁদলে মন হালকা হয়ে যেত। ভাল লাগত। এখন লাগছে না। মন ভারী হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে কি মানুষকে এমন ভাবে বদলে দেয়?
টিনা ভাবী বিয়ে নিয়ে কত গল্প করেছে। এ রকমও যে হয় তা তো কখনো বলেনি। এটি সে লুকিয়ে রাখল কেন? নাকি সবার জীবনে এ রকম হয় না? বেছে বেছে বকুলদের মতো মেয়েদের বেলাতেই এ রকম হয়? বকুলের ধারণা হল সে নিশ্চয়ই খুব খারাপ মেয়ে। খারাপ মেয়েদের এ রকম শাস্তি হয়। হওয়াই উচিত।
ভোরবেলা এক কাণ্ড হল। জহির এসে বলল, এই বাবু ঘোড়ায় চড়বে?
বাবু অবাক হয়ে বলল, ঘোড়া পাবেন কোথায়?
কোথায় পাব সেটা আমি দেখব। তুমি চড়বে কি না বল?
না নড়ব না।
দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। আমরা ছোটবেলায় চড়তাম। একটা বেতো ঘোড়া আছে। নড়েচড়ে না।
বাবু হাসিমুখে বলল, আপনার ছোটবেলার ঘোড়া সেটা কি আর এখনো আছে? মরে ভূত হয়ে গেছে।
তাও তো কথা। দাঁড়াও খোঁজ নিয়ে দেখি। এসব জায়গায় ঘোড়া পাওয়া যায়। শীতের সময় ঘোড়ার পিঠে করে ভাটী অঞ্চলে মাল যায়। আধমরা ঘোড়া। চড়তে খুব আরাম। লাফ-বাপ নেই।
বকুল অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি দুপুর নাগাদ এক ঘোড়া উপস্থিত। দাড়িওয়ালা এক বুড়ো ঘোড়ার দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাবু ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। মুখ ভর্তি হাসি। বাবুর মুখে এমন হাসি বকুল আগে দেখেনি। বকুলের মনে হল, জহির বাবুকে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করছে। মাকড়সার সূক্ষ্ম জালের মতো জাল। চোখে দেখা যায় না। কিন্তু আটকা পড়ে যেতে হয়। একবার আটকা পড়ে গেলে বেরুবার পথ থাকে না।
পুলিশের হাঙ্গামায় বাকের
পুলিশের হাঙ্গামায় বাকের এর আগেও দুবার পড়েছে। প্রথমবার ভয় ভয় করছিল। জিপে করে থানায় যাবার সময় তার বুক কঁপিছিল এবং প্রচণ্ড রকম পিপাসা বোধ হচ্ছিল। থানায় পৌঁছে অবশ্যি ভয়টা কেটে গেল। ওসি সাহেব চমৎকার ব্যবহার করলেন। এমন ভাবে কথাবার্তা বলতে লাগলেন যেন বাকের তার দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ। চা-সিগারেট খাওয়ালেন। ঘণ্টা দু’এক পর বললেন, আচ্ছা ভাই যান।
কেনই বা তাকে এনেছিল কেনই বা ছেড়ে দিয়েছিল তা বাকের জানতে পারেনি। জানার চেষ্টাও করেনি। ইয়াদ অবিশ্য খুব ছোটাছুটি করেছে। নানান জায়গায় টেলিফোন করেছে। সেই সব টেলিফোনের একটি ভূমিকাও হয়ত আছে। থানার সেকেন্ড অফিসার বাকেরকে নামিয়ে দিতে জিপ নিয়ে এলেন। লোকটির বয়স অল্প। বয়সের তুলনায় চেহারা বেশ কঠিন। কথা বলে খ্যাসখ্যাসে গলায়। কিন্তু লোকটিকে বাকেরের পছন্দ হয়েছিল। সে জিপে আসতে আসতে বলল, সব সময় মাস্তানরা কি করে জানেন? ক্ষমতায় যে দল থাকে তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তাদের টিকে থাকার স্বার্থেই তারা তা করে। ক্ষমতাসীন দলের ওদের দরকার। ওদেরও সরকারি সাপোর্ট দরকার। মাঝখান থেকে আমরা বসে বসে কলা চুষি।
বাকের বলল, সরকারি দলের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
সেকেন্ড অফিসার সেই কথার তেমন কোন গুরুত্ব দিল না।
বিরসমুখে সিগারেট টানতে লাগল। সস্তা সিগারেট। গন্ধে মাথা ধরে গেল বাকেরের। পুলিশের অফিসারও যে সস্তা সিগারেট খায় তা বাকেরের জানা ছিল না। সে সেপাইদের হাতেও ফাইভ ফাইভের প্যাকেট দেখেছে।
দ্বিতীয়বার পুলিশ হাঙ্গামা হল মইনুদ্দীন বেপারী নামের এক লোকের জন্যে। সে বাকের এবং ইয়াদের নামে কেইস করে দিল। দোকানের ক্ষতিসাধন ও লুণ্ঠন। অভিযোগও গুরুতর। মইনুদ্দীনের কোমরে জোর ছিল। তার এক খালাতো ভাই প্রতিমন্ত্রী। কাজেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল বাকের এবং ইয়াদকে। সেবার পাঁচ ঘণ্টার মতো থাকতে হল থানায়। এই পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কে বা কারা যেন মইনুদ্দীন বেপারীর দোকানে আগুন লাগিয়ে দিল। পাঁচ ছ লাখ টাকার জিনিস নিমিষে উধাও। দিনদুপুরে তিনটা বোমা ফাটল মইনুদ্দীন সাহেবের বাড়ির সামনে।
বাকের ছাড়া পেয়ে আসামাত্র মইনুদ্দীন সাহেব কাঁদো কাঁদো মুখে দেখা করতে এলেন। জড়িত গলায় বললেন–একটা মিস আন্ডারস্টেনডিং হয়ে গেছে। অন্যের পরামর্শে পড়ে এই ব্যাপার। এখন আপনি যদি জিনিসটা ক্ষমার চোখে না দেখেন তাহলে তো মুশকিল। আপনি আমার ছোট ভাইয়ের মতো। বড় ভাই যদি না বুঝে একটা কাজ করে…
জিপে করে পুলিশের কাছে যাওয়াটাই এক সময় একটি আনন্দের ব্যাপার ছিল। লোকজন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। নেতা নেতা একটি ভাব হচ্ছে মনে।
কিন্তু আজ সে রকম মনে হচ্ছে না। বাকেরের মনে হল এবারের ব্যাপারটা অন্যরকম। কারণ থানার ওসি এক পর্যায়ে তাকে বলল, এইবার আপনার তেল কমাব।
একটা থানার ওসি তার সঙ্গে এই ভাবে কথা বলবে কেন? রহস্যটা কোথায়? এই লোকই তো আগের দুবার তাকে ভাই বলেছে। চা এবং গরম ডালপুরী এনে খাইয়েছে। ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশের জিপে।
আজ সে তিন ঘণ্টা যাবত কাঠের একটা বেঞ্চিতে বসে আছে। ওসির ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে তাকে চিনতেই পারছে না। একটা লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। এ নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। ওসি সাহেব বিয়ে বাড়ির এক লম্বা-চওড়া গল্প ফেদেছেন। সবাই আগ্রহ করে গল্প শুনছে। সেতাবগঞ্জে বরযাত্রী যাবে ভুলে গিয়ে উঠেছে নবীগঞ্জে। সেখানেও এক মেয়ের বিয়ে। সাজানো বাড়ি দেখে সবাই গিয়ে বর নিয়ে উঠল। মাইকে গান-টান বাজছে। কনে পরীয়রে মধ্যে কানাঘুষা হচ্ছে। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। অচেনা বর, অচেনা লোকজন। দীর্ঘ গল্প। শেষই হতে চায় না। যারা শুনছে তারা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। উৎসাহ পেয়ে ওসি সাহেব রসাল জায়গাগুলি দ্বিতীয়বার করে বলতে লাগলেন। বাকেরের মনে হল এই গল্প শেষ হবা মাত্র দ্বিতীয় একটি গল্প শুরু হবে। সে শুকনো মুখে বলল, এক গ্লাস পানি খাব।
ওসি সাহেব বললেন, পানি খেলেই পেচ্ছাব পেয়ে যাবে। চুপচাপ বসে থাকেন। ঠাণ্ডার দিনের এত কিসের পানি খাওয়া-খাওয়ি?
এতেই হাসির স্রোত বয়ে গেল! বাকেরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। দুপুর একটা পর্যন্ত বাকের একই জায়গায় বসে রইল। একটা সময। ওসি সাহেব বললেন, ওকে হাজতে ঢুকিয়ে দিন।
বাকের বলল, কী ব্যাপার আমাকে বলুন?
ওসি সাহেব বললেন, সময় হলে সবই শুনবেন। সময় হয় নাই। এখনো বাকি আছে।
এই কথাতেও একটি হাসির স্রোত বইল! এ থানার ওসি সাহেব যে একজন রসিক ব্যক্তি সে পচিয় বাকের এর আগে পায়নি। বিভিন্ন পরিবেশে মানুষের বিভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়।
হাজতে ছোট্ট ঘরটায় নজন হাজতি। এর মধ্যে একজন অসুস্থ। সে বিকট শব্দে বমি করছে। বমির চাপে চোখ উল্টে আসছে। কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সবার চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের উদাস ভাব।
দরজার পাশে সেন্ট্রি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে-মুখে রাজ্যের নির্লিপ্ততা! বমি করার ব্যাপারটি সে দেখছে কিন্তু সে দৃশ্য তার মনে কোনো ছাপ ফেলছে না। বাকের বলল, ভাই এসব পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করুন। লোকটাকে একটা ডাক্তার দেখান!
পুলিশটি কোনো শব্দ করল না। বাকের দ্বিতীয়বার বলল, কি ব্যাপার ভাই? কিছু করুন।
সন্ধ্যাবেলা জমাদার আসবে তখন পরিষ্কার হবে।
লোকটাকে এক গ্রাস পানি এনে দিন।
পুলিশটি বড় একটি টিনের মাগে এক মগ পানি এনে দিল।
বাকেরের ধারণা ছিল সন্ধ্যার আগেই অনেকে আসবে তার কাছে।
তার ভাই হয়ত আসবে না। কিন্তু লোক পাঠাবো। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হবে কষ্ট করে।
ঘরে বমির কুৎসিত গন্ধ। সবাই নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। টাক মাথার গোঁফ ওয়ালা একটি লোক বলল, বড় ভাই আপনার কাছে সিগারেট আছে?
বাকের বলল, না।
টাকা তো আছে। সেন্ট্রিকে দেন সিগারেট এনে দিবে। ওকে পাঁচটা টাকা দিতে হবে। আমার কাছে দেন ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বাকের একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দিল। টাক মাথার লোকটি বলল, আরো পাঁচটা টাকা দেন তাহলে ভাল কম্বল পাবেন। নয়, এমন কম্বল দিবে ঘুমাতে পারবেন না।
আপনি কতদিন ধরে আছেন এখানে?
তের মাস।
তের মাস? বলেন কি?
এতদিন খাজতে রাখার কোনো নিয়ম নিযাই। কোর্টে নিতে হয়। জামিন দিতে হয়, জামিন না। হলে জোলখানায় হাজত আছে। কিন্তু–
কিন্তু কি?
না কিছু না।
দুইটা খুন করেছি। টাকা খেয়ে করেছি। যাদের টাকা খেয়ে করেছি। তারাই ধরিয়ে দিয়েছে। বড় ভাই, গোটা দশেক টাকা ধার দিতে পারেন? আমার ছেলে টাকা নিয়ে এলেই পেয়ে যাবেন।
আপনার নাম কি?
আমার নাম কবীর উদ্দিন। বাড়ি হচ্ছে গিয়ে মুন্সিগঞ্জ। মুন্সিগঞ্জ গিয়েছেন কখনো?
না।
ভালই করেছেন না গিয়ে। যাওয়ার মতো জায়গা না। আমি নিজেই যাই না।
বাকের মানিব্যাগ খুলে দশটি টাকা দিল। ব্যাগে আরো ত্ৰিশ টাকার মত আছে। তার জন্য যথেষ্ট। সন্ধ্যার আগেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
সন্ধ্যার আগে কোন ব্যবস্থা হল না। কেউ এল না বাকেরের কাছে। অসুস্থ লোকটি বিকট শব্দে বমি করতে লাগল। মাঝরাতে। বাকের ভেবেছিল এখানেই মরে পড়ে থাকবে। তা অবশ্যি হল না। ওসি সাহেব এসে তাকে হাসপাতালে পাঠালেন। হাজতঘরে কোনো বাতি নেই। বাতির দরকারও নেই। বারান্দার আলো এসে পড়ছে। এতেই দেখা যাচ্ছে। তবু ওসি সাহেব কি মনে করে যেন পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট সবার মুখের ওপর কিছুক্ষণ করে ধরতে লাগলেন। বাকেরের মুখের ওপর তাও অনেকক্ষণ ধরা রইল।
এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে হাসান সাহেব বাকেরের গ্রেফতার হবার খবর পেলেন দেড় দিন পর। তাও পত্রিকার মাধ্যমে। ছবি ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। কোন খবরই তিনি দুবার পড়েন না। এটিও পড়লেন না। যদিও তার মন বলতে লাগল এ খবরটা আবার পড়া উচিত। এবং কিছু করলেন না। এগারটা বাজার আগেই বাসায় চলে এলেন। অফিসে তার কিছুই করার ছিল না।
সেলিনা অসময়ে তাকে ফিরতে দেখে মোটেই অবাক হলেন না। যেন তিনি জানতেন হাসান সাহেব অসময়ে ফিরবেন। এবং এ জন্যেই যেন সেজোগুজে অপেক্ষা করছিলেন। সেলিনা বললেন, তুমি কি আট ঘণ্টার নোটিসে চিটাগাং যেতে পারবে?
কেন?
পারবে কিনা আগে বল।
না পারার তো কোনো কারণ দেখি না।
তানিয়ার বিয়ে। এখন আবার বলে বোস না যে তুমি তানিয়াকে চেন নয়। চেন তো?
হ্যাঁ চিনি। তোমার খালাতো বোন।
না হয়নি। আমার ফুফাতো বোন। হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমাকে টেলিফোনে বলল। আমি বলে দিয়েছি যে ভাবেই হোক তোমাকে নিয়ে আমি কাল সকালে চিটাগাং উপস্থিত হব।
হাসান সাহেব কিছু বললেন না। সেলিনা বললেন, কথা বলছি না কেন?
কি বলব?
যেতে পারবে কিনা? বিয়েটা সেরে সেই রাতেই না হয় ফিরে আসব। রাত দশটায় ট্রেন আছে। আমি টিকিট কাটতে পাঠিয়েছি। অনেক দিন ট্রেনে চড়া হয় না? তোমার ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করে না?
করে।
তুমি যে প্রায়টা একটা করিতা বলতে কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম। রজনী নিঝুম।
হা বলতাম।
রাতের ট্রেনে জাস্ট আমরা দু’জন। ইন্টারেস্টিং হবে না? আমার তো মনে হয় খুব ফান হবে।
হবে হয় তো।
আমি তোমার সুটকেস গুছিয়ে রেখেছি।
কাজ তো তাহলে অনেক দূর এগিয়ে রেখেছ।
হ্যাঁ তা রেখেছি।
ট্রেন ছাড়ল রাত দশটায়। হাসান সাহেবের বেশ ভালই লাগছে। কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম রজনী নিঝুম। কবিতাটি বাববার মাথায় ঘুরছে। দু’জন মাত্র প্রাণী এ কামরায়। তাদের কেউ ঘুমুচ্ছে না। তবু এই কবিতার চরণটিই মাথায় আটকে গেল কেন? সেলিনা কি সব যেন বলছে। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু শুনতে ভাল লাগছে। সেলিনার গলার স্বর চমৎকার।
এ্যাই তুমি কথা বলছি না কেন?
শুনছি। দুজনে কথা বললে কে শুনবে?
বাকেরের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করেছ?
হাসান সাহেব বললেন, তুমি জানতে?
জানব না কেন?
কবে জানলে?
যেদিন ধরে নিয়ে গেল সেদিনই। তুমি অফিসে চলে গেলে। একটা ছেলে এসে আমাকে বলল।
আমাকে তো কিছু বলছিন। আমি জানলাম খবরের কাগজ পড়ে।
সেলিনা চুপ করে রইলেন। হাসান সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, আমাকে জানানো উচিত ছিল।
আমার জানাতে ইচ্ছা করেনি।
হাসান সাহেব। আবার চুপ করে গেলেন। ট্রেন চলছে দ্রুতগতিতে। ঝিকঝিক শব্দ হচ্ছে। ছোটবেলায় এই শব্দে কত রকম গান মিশে যেত। এখন যাচ্ছে না। শুধু রজনী নিঝুম কথাটা এসে মিশেছে।
সেলিনা বললেন, ঘুমিয়ে পড়েছ?
না।
বাকেরকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওর বন্ধু-বন্ধাবরা ওকে ছাড়িয়ে আনবে।
আমি বাকেরকে নিয়ে ভাবছি না।
কি ভাবিছ তাহলে?
নিজের কথা ভাবছি।
কোর্টে বাকেরের জামিন হল না। তার বিরুদ্ধে চারশত আটচল্লিশ এবং উনিশ অবলিকের এফ ধারায় দু’টি অতিযোগ। এই দু’টি অভিযোগই জামিনযোগ্য নয়। কোর্টে থেকে পুলিশ রিমান্ডে উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা। তার সহয়োগী অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্যাদি নেয়া। কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে সে রকম কিছু হল না। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারার পুলিশের কোন রকম আগ্রহ দেখা গোল না। এরমধ্যে ইয়াদ এল তাকে দেখতে। সুন্ট-টুট পরা ভদ্রলোক। চুলের স্টাইল বদলে ফেলেছে কিংবা কিছু একটা করেছে। তাকে চেনা যাচ্ছে না। সে চোখ কপালে তুলে বলল, অবস্থা কি?
অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস।
হেভি পিটন দিয়েছে মনে হয়। মুখ ফোলা।
মারধর করেনি। মশার কামড়ে মুখ ফুলেছে।
মশারি দেয় না।
বাকের উত্তর দিল না তার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে গারদের ফ্যাক দিয়ে হাত বের করে প্রচণ্ড একটি চড় কষিয়ে দিতে। সে দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলল, হারামজাদা।
আমি খবর পেয়েছি। পরশু বুঝলি। খবর শুনে আমার মাথায় থান্ডার এসে পড়ল। বিনামেঘে বজাঘাত। আমি ভাবলাম ব্যাপারটা কি! কোন ঝামেলায় জড়ালি। নে সিগারেট নে।
বাকের সিগারেট নিল। টাক মাথার কবীর উদ্দিন বলল, স্যার আমারে একটা দেন। আমি বাকের সাহেবের খোঁজখবর করছি।
ইয়াদ সিগারেটের প্যাকেট বাকেরের দিকে এগিয়ে দিল। রাজা মহারাজাদের মতো ভঙ্গি করে বলল, রেখে দে তোর কাছে। আর শোন কোনরকম চিন্তা করবি না। আমি আমার শ্বশুর। সাহেবকে বলছি। সে কানেকশনওয়ালা আদমি। দুই তিনটা টেলিফোন করলেই দেখষি জামিন হয়ে গেছে। তোর ভাই কিছু করছে?
জানি না। বোধ হয় কিছু করছে না। শুনলাম তার চাকরি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। কি সমস্যা?
তা জানি না। বাংলাদেশে কি সমস্যার শেষ আছে নাকি? হা হা হা।
বাকের পেট কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। এর মধ্যে তার একটা নাদুস নুদুস ভুড়িও হয়েছে। দেখলেই হাত বুলাতে ইচ্ছা করে।
বাকের।
বল।
আমার একটা নিউজ আছে। শ্ৰীলংকা যাচ্ছি।
তাই নাকি?
হুঁ, আমার এক মামাশ্বশুর ম্যানেজ করে দিলেন। ব্যবসার ব্যাপার। ওখান থেকে নারকেল তেল আনব।
ভাল।
আমার বউও সঙ্গে যেতে চাচ্ছে বুঝলি। দিনরাত ঘ্যান ঘ্যান করছে।
নিয়ে যা।
মেয়েছেলে কোথাও সঙ্গে নিতে আছে? ঐ যে কি যেন বলে–পথে নারী বিবর্জিতা। আমিও চেষ্টা করছি। কিছু লাভ হবে না। এঁটেল মাটির মতো লেগে গেছে।
বাকের চুপ করে রইল। ইয়াদ তার সিগারেট শেষ করে উঠে থু করে একদলা থুথু ফেলল। চোখ মুখ কুঁচকে বলল, বড় গাধা জায়গা, বমি এসে যাচ্ছে। তুই কোন চিন্তা করিস না। চিকোবশ ঘণ্টার মধ্যে ছুটিয়ে নিয়ে যাব। কাউকে কোন খবর টাবর দিতে হবে?
না। তুই যাচ্ছিস?
হুঁ।
কবীর উদ্দীন বলল, স্যার আপনি বাকের সাহেবকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে যান। উনার হাতে একটা পয়সা নাই।
ইয়াদ আশ্চর্য হয়ে মানিব্যাগ বের করল। দুইটি একশ টাকার নেট এবং কিছু খুচরা ছিল। একশ টাকার দু’টি নোটিই এগিয়ে দিল। বাকের টাকা নেবার ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখাল না। হাত বাড়াল কবীর উদ্দীন। মুখ তৰ্তি হাসি দিয়ে বলল, যাবার আগে ওসি সাহেবকে একটু স্যার বলবেন আমাদের দেখাশোনার জন্যে। একটা এক্সট্রা কম্বল পেলে স্যার খুব ভাল হয়।
সাত দিনের পুলিশ রিমান্ডের সময়সীমা শেষ। কিন্তু পুলিশ আরো সাত দিনের সময় চাইল। কোর্ট সময় মঞ্জর করল। বাকের পুরনো হাজতঘরে ফিরে এল। কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে এল না। প্রথম সাতদিন পার করতে যতটা খারাপ লাগছিল। দ্বিতীয় সাতদিনে ততটা খারাপ লাগল না। কারণ কবীর উদ্দীন কী ভাবে যেন গাজার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। গাজাটা বেশ ভাল জিনিস। টানার জন্যে কলকে লাগে না। সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে তার ভেতর গাজা ভরে চমৎকার টানা যায়। ভালই লাগে।
প্রথম খানিকক্ষণ মন খুব কোমল হয়ে যায়। কাঁদতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে খুব ভাল ভাল কাজ করতে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিতে। সেই কোমল ভাবটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। খানিকক্ষণের মধ্যেই জগৎ-সংসার সম্পর্কে একটি বৈরাগ্য এসে পড়ে। এই বৈরাগ্যের ভাব সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। সবচে বড় কথা রাতের ঘুমটা ভাল হয়। এক ঘুমে রাত কাভার। ঢং ঢেং করে এরা যে ঘণ্টা পিটে সেই শব্দও কানো যায় না।
অন্যান্য হাজতিদের সম্পর্কে প্রথমদিকে তাক খানিকটা বিতৃষ্ণার ভাব ছিল। এখন সেটা নেই। সবার সঙ্গেই তার এখন ভাল সম্পর্ক। মতিলাল নামে একজন হাজতি ছাড়া পেয়ে চলে যাবার দিন বাকেরের বুক হুঁ-হু করতে লাগল। আর মতিলাল হারামজাদাও এমন গরু, ছাড়া পেয়েছিস বগল বাজাতে বাজাতে চলে যা, তা না। সবাইকে জড়িয়ে ধরে আকাশ-পাতাল কান্না। এই ভাবে কাঁদলে অন্যদের চোখে পানি আসবেই। বাকেরের গাল ভার হয়ে গেল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। বহু চেষ্টায় গলার স্বর কর্কশ করে সে বলল, কী এত দেরি করছেন? বাড়ি চলে যান। আর এত কাঁদছেন কেন? মেয়েছেলে নাকি? চোখ মুছেন রে ভাই!
জাহানারা অবাক হয়ে বলল
জাহানারা অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?
মামুন হাসিমুখে বলল, কোন ব্যাপার না। এমনি এসেছি। এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, ভাবলাম এসেছি। যখন দেখে যাই কেমন আছেন।
ভালই আছি।
করছেন কি?
দেখতেই পাচ্ছেন ফাইল নিয়ে বসে আছে।
জাহানারার ঠোঁট বিরক্তিতে বেঁকে গেল। মামুন অবাক হয়ে মুনার সঙ্গে জাহানারার অদ্ভুত একটা মিল খুঁজে পেল। মুনাও মাঝে মাঝে বিরক্তিতে ঠোঁট বাকাত। ঠিক এই ভঙ্গিতে বাকাত। মামুন বলল, লোন স্যাংশন হয়ে গেছে সেই খবরটাও দিতে এলাম।
পুরনো খবর আগেই একবার দিয়েছেন।
ও আচ্ছা।
মামুন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তার উঠে যাওয়া উচিত। কিন্তু উঠতে ইচ্ছা করছে না। বসে থাকতে ভাল লাগছে।
আপনি বাড়ি খুঁজে পেয়েছেন?
না।
এখনো খুঁজছেন? না খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছেন?
খুঁজছি। আপনি কী চা খাবেন?
জি খাব।
জাহানারা নিজে উঠে গিয়ে চায়ের কথা বলে এল। মামুন লক্ষ্য করল শুধু চা নয়, চায়ের সঙ্গে বিসকিট দেবার কথাও বলছে। এবং ফিরে এসে বসেছে হাসিমুখে। আগের বিরক্তির লেশমাত্র নেই।
আপনি কি এখনো শশানে বেড়াতে যান?
না। যাই না। আপনার কথার পর ভয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
বিকালে কি করেন-ঘরেই বসে থাকেন?
হুঁ। বসে থাকা ছাড়া আর কি করব। গল্পের বই পড়ি। আপনার কাছে গল্পের বই আছে?
আছে। কাল নিয়ে আসব। অনেক আছে।
বলেই মামুন একটু চমকাল। কারণ গল্পের বই তার কাছে নেই। খুঁজলে-টুজলে এক-আধটা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অনেক বই আছে এটা পুরো মিথ্যা। এত বড় একটা মিথ্যা কথা সে কেন বলল। এই মেয়েটার আচার-আচরণ অনেকটা মুনার মতো সেই কারণেই কী?
জাহানারা বলল, কালই আপনাকে বই নিয়ে আসতে হবে না। পরের বার যখন এদিকে আসবেন নিয়ে আসবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনার কাজকর্ম কেমন এগুচ্ছে?
কোন কাজকর্মের কথা বলছেন?
ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছেন যে কাজকর্মের জন্যে। আমাদের তো রিপোর্ট করতে হবে।
কাজ চলছে পুরোদমে। জিনিসপত্র আনতে ঢাকা যাব।
জাহানারা কৌতূহলী হয়ে তাকাল।
কবে যাবেন?
এখনও ঠিক করিনি শিগগিরই যাব। আপনার কোন খবর থাকলে দিবেন। আমি পৌঁছে দেব।
কাকে পৌঁছে দেবেন?
আপনার মাকে। তারা তো ঢাকাতেই থাকেন। তাই না?
আমার কোন খবর নেই।
কোন জিনিসপত্র দিতে চাইলে দিতে পারেন। কোন রকম সংকোচ করবেন না। এখানে মোক্তার পাটি বলে এক রকম পাটি পাওয়া যায়। মোক্তা গাছের ছাল দিয়ে তৈরি ভাল জিনিস। আমি যোগাড় করে দেব।
আপনাকে কিছু জোগাড় করতে হবে না। আমি কোন কিছু পাঠাতে চাই না।
আপনার বদলির কী হয়েছে?
হয়নি কিছু।
হেড অফিসে দরখাস্ত করেছিলেন যে তার কী হল?
জানি না। কিছু হয়নি নিশ্চয়ই। হলে কি আর এখানে পড়ে থাকতাম? নিন। চা খান।
চা খাবার পরও মামুন ঘণ্টা খানিক বসে রইল। সে বুঝতে পারছিল জাহানারা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। জাহানারা একবার বলেই ফেলল, চলে যান কেন শুধু শুধু বসে আছেন? এই যাচ্ছি বলেও মামুন বসে রইল। জাহানারা চশমা পরে মাথা নিচু করে কাজ করছে। চশমা নাকের ডগার দিকে অনেকটা নেমে এসেছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। এই মেয়েটির চোখ দু’টি সুন্দর। কিন্তু চশমার জন্যে সুন্দর চোখ আড়ালে পড়ে থাকে। যে ভদ্রলোক এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে। সে হয়ত বুঝতেও পারবে না তার স্ত্রীর চোখ কত সুন্দর।
আজ তাহলে ফাই?
আরেক কাপ চা খেতে চাইলে খেতে পারেন।
মামুন উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। ইতস্তত করে বলল, আরেক কাপ চা অবশ্যি খাওয়া যায়। জাহানারা হেসে ফেলল।
হাসছেন কেন?
এমনি হাসছি। আপনি আরাম করে বসুন। আমি চায়ের কথা বলে আসি।
মামুন ঠিক আরাম করে বসতে পারল না। ম্যানেজার তার ঘর থেকে আড়াচোখে বারবার তাকাচ্ছে। তার চোখে-মুখে এই বিরক্তির কারণটি কী? একজন মহিলা কর্মচারীর সামনে বসে কাজের ক্ষতি করছে এইটিই কী বিরক্তির কারণ?
গল্পের বই খুঁজতে গিয়ে মামুন বাড়ি চষে ফেলল, কিছুই নেই। পুরনো কিছু মাসিক পত্রিকা পাওয়া গেল নাম-সোনার দেশ, উইপোকা সে সব ঝাঝড়া করে ফেলেছে। মার ঘরে পাওযা গেল। হয়রত আলীর জীবনী এবং তপসী রাবেয়া। হয়রত আলীকে ইউপোকা কাবু করতে পারেনি। কিন্তু তাপসী রাবেয়াকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। মামুন নিশ্চয়ই হয়রত আলীর জীবনী নিয়ে জাহানারার কাছে যেতে পারে না। অথচ সে বলে এসেছে অনেক বই আছে। এখন যদি গিয়ে বলে কোনো বই নেই তাহলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে। বানিয়ে কিছু-একটা বললে কেমন হয়?
চোখ কপালে তুলে বলতে পারে, আর বলবেন না। সব বই উধাও। কয়েক দিন ছিলাম না। এখানে বাড়ি সাফ করে দিয়েছে। ধর্মের কয়েকটা বই ছাড়া কিছু নেই। কিন্তু কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য হবে? এই অজ জায়গায় লোকজনদের এতটা সাহিত্য প্রীতি থাকার কথা নয়। কিছু বই আনিয়ে নিলে কেমন হয়?
মুনাদের বাড়ি ভর্তি বই। বকুলের বই পড়ার সখ। মুনাকে কতবার দেখেছে বই কিনছে। সেই সব বই বকুল নিশ্চয়ই শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যায়নি।
মামুন রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চিঠি লিখতে বসল। অনেক দিন পর মুনাকে লিখছে। কেমন যেন সংকোচ লাগছে লিখতে। আগে কত সহজে লিখিত–প্ৰিয় মুনা। কিন্তু এখন প্রিয় শব্দটি পর মনে হল শব্দটা মানাচ্ছে না। কিন্তু শুধু মুনা দিয়ে চিঠি শুরু করতে ইচ্ছা করছে না। দু’এক লাইনে চিঠি শেষ করবে ঠিক করেও দীর্ঘ চিঠি লিখে ফেলল।
প্রিয় মুনা,
একটি বিশেষ প্রয়োজনে লিখছি। চিঠি পাওয়া মাত্র তুমি আমাকে গোটা দশেক ভাল গল্পউপন্যাস ভিপি করে পাঠিয়ে দিবে। তোমার অফিসের কোন বেয়ারাকে বললেই সে ভিপি করে দেবে। আমার অত্যন্ত প্রয়োজন। একা থাকি তো কিছুই করার নেই। সন্ধ্যার পর মনে হয়। ভূতের বাড়িতে বাস করছি। রাত দশটা পর্যন্ত জেগে থেকে ঘুমুতে যাই। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলে বাচিতাম। তা আসে না। কোনো কোনো দিন বারোটা পর্যন্ত বেজে যায়। গ্রাম দেশে রাত বারোটা ভয়াবহ ব্যাপার। মনে হয় অন্য কোন ভুবনে বাস করছি। গল্পের বই থাকলে সময়টা কাটবে।
মুনা একটু আগে যে কথাটা লিখেছি সেটা ঠিক না। বইগুলি আমার জন্যে নয়। জাহানারা নামের এক মেয়ের জন্য। তোমাকে আমি এক সময় বলেছিলাম যে আমি কোনো দিন তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। তবু শুরুতে বলে ফেলেছি। কেন বললাম? কারণ আমার মনের মধ্যে একটা ভয় ছিল তুমি কি না কি মনে কর। যদিও আমি জানি তোমার মধ্যে এইসব ক্ষুদ্র ঈর্ষার কোন ব্যাপার নেই।
এইবার জাহানারার কথা বলি। কৃষি ব্যাংকের সেকেন্ড অফিসার। এখানে একা একা থাকে। তোমার সাথে মিল আছে। তার মধ্যে কঠিন একটা ভাব আছে। যখন বিরক্ত হয় তোমার মতো ঠোঁট বাকিয়ে দেয়। তুমি নিশ্চয়ই ভাবিছ মেয়েটিকে নিয়ে এত কথা লিখছি কেন? লিখছি কারণ লেখার কিছু নেই। অথচ আমার ইচ্ছা করছে বিরাট একটা চিঠি লিখতে।
মুনা আমি খুব একা হয়ে পড়েছি। রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার সময় খুব মন খারাপ হয়। তুমি ঐ ব্যাপারটা নিজের মনে গেথে রেখে নিজে কষ্ট পাচ্ছি, আমাকে ও কষ্ট দিচ্ছি। আমি কতবার তোমাকে বলব আমি ফেরেশতা নই। আর তাছাড়া ফেরেশতারাও মাঝে-মধ্যে ভুল করে। করে না? তুমি কি বলতে পারবে যে এ জীবনে তুমি কোনো ভুল করনি। না তুমি বলতে পারবে না।
আচ্ছা মুনা…
এ পর্যন্ত লিখে মামুন চিঠিটা গোড়া থেকে পড়ল এবং মনে হল চিঠিটা খুব বাজেভাবে লেখা হয়েছে। এই চিঠি পাঠানোর কোনো মানে হয় না। সে চিঠি টুকরো টুকরো করে ফেলল।
জাহানারা অফিসে নেই। ম্যানেজার সাহেব বললেন, উনি আসেননি। আপনার কিছু বলার থাকলে আমাকে বলুন। মামুন বলল, উনার জন্যে একটা বই এনেছিলাম।
আমার কাছে দিয়ে যান পৌঁছে দেব।
উনি আসেননি কেন?
শরীর ভাল নেই। গাল ফুলেছে। বোধ হয় মামস।
বলেন কি? তাহলে তো দেখতে যেতে হয়।
ম্যানেজার বিরক্ত চোখে তাকিয়ে রইল। মামুন বলল, বেচারী বিদেশে অসুখে পড়েছে স্থানীয় মানুষ হিসেবে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে, কী বলেন?
ম্যানেজার সাহেব কিছুই বললেন না।
ডাক্তার দেখছে তো?
হ্যাঁ দেখছে।
মামসের একটা ভাল কবিরাজি চিকিৎসা আছে। ধুধুল পাতার রস, বটগাছের শিকড় এবং মধু এই তিনটা একত্রে মিশিয়ে পুলটিস করে দিতে হয়। আমার একবার মামস হয়েছিল। দেওয়া মাত্র আরাম হয়েছে।
তাহলে যান। আপনার ওষুধ দিয়ে আসুন। আমার বাসা তো চেনেন। চেনেন না?
হ্যাঁ চিনি।
জাহানারা মামুনকে দেখে মোটেই অবাক হল না! যেন সে জানত সে আসবে। মামুন বলল, আপনাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে দুগালে দু’টি কমলা লেবু ঢুকিয়ে বসে আছেন। তাকানো যাচ্ছে না।
কই আপনি তো দিব্যি তাকিয়ে আছেন।
বই এনেছি আপনার জন্যে।
কি বই?
হযরত আলীর জীবনী।
জাহানারা তাকিয়ে রইল। মামুন হাসিমুখে বলল, ঐ দিন আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছিলাম। বাড়িতে কোনো বই নেই। আমি ঢাকা থেকে নিয়ে আসব।
আপনি বসুন।
মামুন বসল। ছোট্ট একটা ঘর। সুন্দর করে সাজানো। বুক শেলফ ভর্তি বই। জাহানারার হাতেও একটা বই। সে বইয়ের পাতা মুড়তে মুড়তে বলল, বেশিক্ষণ থাকবেন না। আপনারও হবে।
হলে হবে। নো প্রবলেম। খাওয়া-দাওয়া কী করছেন?
বার্লি খাচ্ছি। সলিড কিছু গিলতে পারি না। আপনি কী চা খাবেন?
চা দেবে কে?
কে দেবে সেটা আমি দেখব। আপনি খাবেন কি না বলুন।
খাব।
জাহানারা উঠে ভেতরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল চা নিয়ে।
এত তাড়াতাড়ি কিভাবে করলেন?
আমি করিনি। ভাবী করে দিয়েছেন। আপনি চা খেতে খেতে একটি সত্যি কথা বলবেন?
বলুন কি জানতে চান?
আপনি কেন আসেন আমার কাছে?
মামুন কিছু বলতে পারল না। চায়ে চুমুক দিতে লাগল। জাহানীরা শাড়ি দিয়ে ফোলা গাল ঢেকে চুপচাপ বসে আছে। তার বসার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে সে প্রশ্নের জবাব চায়।
বলুন কেন আসেন?
আমি আজ উঠি?
উঠবেন তো বটেই। সারাদিন আমার ঘরে বসে থাকার জন্যে আপনি নিশ্চয়ই আসেননি? কেন আপনি আমার কাছে বারবার আসেন একটা বলে চলে যান।
মুনার সঙ্গে আপনার চেহারার খুব মিল আছে। আচার-আচরণও দুজনের এক রকম। দুজনের প্রকৃতিই খুব কঠিন। আপনার সাথে যখন কথা বলি তখন মনে হয় মুনার সঙ্গেই কথা বলছি। এই জন্যেই আসি।
মুনা কে?
ওর সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা।
বিয়েটা কবে?
ওসব চুকে-বুকে গেছে। বিয়ে হচ্ছে না।
কেন, উনার কী অন্য কোথাও বিয়ে হয়েছে?
না তা হয়নি। ও সে রকম মেয়ে নয়।
এর পরের বার আমি যখন ঢাকা যাব তখন আমাকে উনার ঠিকানা দেবেন। আমি উনাকে বুঝিয়ে বলব।
আপনার ওকালতির কোনো দরকার নেই। আচ্ছা আমি উঠি।
মামুন উঠে দাঁড়াল। জাহানারা বলল, প্লিজ আপনি-একটু বসুন। আমার কথায় রাগ করে এ ভাবে চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
মামুন বসল। দীর্ঘ সময় দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না।
শওকত সাহেব চোখ মেললেন
শওকত সাহেবের মনে হল কে যেন এসে তার বুকে বসেছে। যে বসেছে সে মানুষ নয়। বিশাল কোন একটি জন্তু যার গায়ে বোটকা গন্ধ। জন্তুটি শুধু বসেই নেই, প্রকাণ্ড থাবা বাড়িয়ে তাঁর গলা চেপে ধরতে চাইছে। তিনি বুঝতে পারছেন গলা চেপে ধরা মানেই মৃত্যু। কাজেই তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন যাতে জন্তুটি তার গলা চেপে ধরতে না পারে। শওকত সাহেবের মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল। তিনি গোঙানির মত শব্দ করতে লাগলেন। ঠিক তখন মুনা ডাকল, মামা দরজা খোল কি হয়েছে? চিৎকার করছে কেন?
শওকত সাহেব চোখ মেললেন। জম্ভটি নেই। স্বপ্নই দেখছিলেন। কিন্তু ঠিক স্বপ্নও বোধ হয় নয়। সমস্ত ঘরাময় বোটিকা গন্ধ কোথেকে এল?
মামা দরজা খোল। কী হয়েছে তোমার?
তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। ঘড়ি দেখলেন দু’টা দশ। অনেকখানি রাত সামনে পড়ে আছে। জেগে বসে কাটাতে হবে। বাকি রাতটা এক ফোঁটা ঘুম আসবে না। তিনি ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
স্বপ্ন দেখছিলে নাকি মামা?
হুঁ।
নাও পানি খাও।
শওকত সাহেব পানি খেয়ে বিড়বিড় করে বললেন, তুই কি এই ঘরে কোন বোটিকা গন্ধ পাচ্ছিস?
না তো।
আমি পাচ্ছি। ইঁদুর মরে পড়ে থাকেল যে রকম গন্ধ হয় সে রকম গন্ধ।
বলেই শওকত সাহেবের মনে হল এই গন্ধের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর আগে এই জাতীয় গন্ধ ছিল এই ঘরে। এত তীব্র ছিল না। কিন্তু ছিল।
মুনা, কোনো রকম গন্ধ পাচ্ছিস না?
উঁহু। তুমি কী বারান্দায় ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে বসবে?
শওকত সাহেব হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না। বারান্দায় ইজিচেয়ারে এসে বসলেন। উঠোনে জ্যোৎস্না হয়েছে। দিনের মতো আলো। ফাকফািক করছে চারদিক।
মামা, এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসি দুধ খাও। ঘুম আসবে।
কিছু আনতে হবে না। তুই আমার পাশে বসে থাক।
মুনা তার পাশে বসতেই তিনি নরম গলায় বললেন, বেশিদিন বাঁচব না। ডাক এসে গেছে।
মুনা তরল গলায় বলল, এটা তো তুমি গত পাঁচ বছর ধরে বলছি।
আজ নিশ্চিত হয়েছি।
তাহলে তো ভালই হল। কবে মারা যাচ্ছে জেনে গেলে। আমরা যারা জানি না তাদের হচ্ছে অসুবিধা। সব সময় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হয়।
শওকত সাহেব মৃদু গলায় বললেন, সব সময় ঠাট্টা করিস না মা। তিনি মুনার হাত ধরলেন। মুনা লক্ষ্য করল, মামার হাত অস্বাভাবিক শীতল। তিনি অল্প অল্প কাঁপছেন।
কি স্বপ্ন দেখেছি বল তো শুনি।
একটা জন্তু বুকের ওপর বসেছিল।
এই থেকেই তোমার ধারণা হয়ে গেল তুমি আর বাঁচবে না?
তিনি কিছুই বললেন না! মুনা সহজ ভঙ্গিতে বলল, ধর তুমি যদি মরেই যাও তাতে খুব আফসোস থাকার কথা নয়। বড় সমস্যার সমাধান করেছ। মেয়ের ভাল বিয়ে দিয়েছ। কারো কাছে তোমার কোন ধার-দেনা নেই। তাছাড়া–
শওকত সাহেব মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তুই একটা বিয়ে করলে আমি খুব সহজে মরতে পারব।
বলতে চাচ্ছি। আমি তোমাকে মরতে দিচ্ছি না?
তিনি কিছু বললেন না। মুনা বলল, আমাকে নিয়ে কোনো রকম চিন্তা করবে না মামা। আমি বেশ আছি। তুমি মরে গেলেও আমার কোনো অসুবিধা হবে না।
শওকত সাহেব থেমে থেমে বললেন, আমি মামুনকে একটা চিঠি লিখেছি। ওকে আসতে লিখেছি।
এই কাণ্ড আবার কবে করবে?
পরশু দিন। ও এলে আমি তোর কোনো কথা শুনব না।
মুনা মাথা নিচু করে বসে রইল। শওকত সাহেব বললেন–ঝগড়াঝাটি ঝামেলা এইসব হয়। এটাকে এত বড় করে দেখলে পৃথিবী চলে? চলে না। কমপ্রমাইজ করতে হয়।
তুমি ব্যাপারটা জান না বলে এসব বলছ। জানলে এ রকম করতে না। শোন তোমাকে আমি বলি। এর পরও যদি তুমি ওকে বিয়ে করতে বল আমি করব। মন দিয়ে আমার কথাটা শোন মামা।
আমি মামুনকে নিয়ে বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম কল্যাণপুরে। একটা বাড়ি পছন্দ হল আমাদের। ও বাড়ি ভাড়া করল। এক’দিন বিকেলে ঐ বাড়িতে গিয়েছি। জিনিসপত্র সাজাচ্ছি। ও হঠাৎ দরজা বন্ধ করে ফেলল। বাকিটা তোমাকে তো আর বলতে হবে না মামা। খুবই সহজ গল্প। এ ধরনের একটা ঘটনা আমার ছেলবেলাতেও ঘটেছিল। তখন আমার বয়স তের। তোমাদের কাউকে কিছু বলিনি। আমার মনটা অসাড় হয়ে গেছে মামা। ঘেন্না ধরে গেছে।
মুনার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। শওকত সাহেব কোন কথা বললেন না। উঠোনের জ্যোৎস্নার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। মুনা নিজেকে চট করে সামলে নিল। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলল, একটা কাজ করা যাক মামা। আমি বরং বকুলকে লিখে দেই এখানে আসবার জন্যে। হঠাৎ ঘর খালি হয়ে গেছে তো তাই তোমার এ রকম লাগছে। ওরা এলে ভাল লাগবে। এখন আর তোমার মনে হবে না কোনো জন্তু তোমার বুকে বসে আছে।
মুনা খিলখিল করে হেসে ফেলল। পরমুহুর্তেই হাসি বন্ধ করে গম্ভীর মুখে বলল, বকুল বোধ হয়
এ কথা কেন বলছিস?
বিয়ের পর আমাকে একটি চিঠিও দেয়নি।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কোনো চিঠি লিখেনি?
না। কেউ আমাকে পছন্দ করে না মামা। আমার মধ্যে কিছু একটা বোধ হয় আছে যা মানুষকে
আজেবাজে কথা বলিস না।
আজেবাজে কথা না মামা, খুব সত্যি কথা।
মুনা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। হালকা গলায় বলল, যখন ছোট ছিলাম। তখন খারাপ লাগত এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। মামা, যাও শুয়ে পড়।
আমি আর শোক না।
সারারাত বসে থাকবে এখানে?
হ্যাঁ।
বেশ থাক। আমি ঘুমুতে গেলাম। সকালে অফিস।
বিছানায় গিয়েও ঘুম এল না। মুনা এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। মর্নিং অফিস হয়েছে। সাতটার আগে ঘর থেকে বেরুতে হয়। কাল নিৰ্ঘাৎ অফিস কামাই হবে।
সত্যি সত্যি তাই হল, ঘুম ভাঙল নটায়। তার বিরক্তির সীমা রইল না। শওকত সাহেব এখনো বারান্দায় চেয়ারে।
মামা, আমাকে ডাকলে না কেন?
আরাম করে ঘুমুচ্ছিলি তাই ডাকিনি? তোর কাছে একটা ছেলে এসেছে।
কে এসেছে?
চিনি না, গিয়ে দেখ। বসার ঘরে আছে।
মুনাও ছেলেটিকে চিনল না। লুঙ্গী পরা খালি পায়ের একটি ছেলে জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসে ছিল মুনাকে দেখে লাফিয়ে উঠল। তোর-চৌদ্দ বছর বয়স। সবে গোঁফ উঠতে শুরু করছে।
কে তুমি?
আপা আমার নাম গোবিন্দ। জলিল মিয়ার চায়ের স্টলে কাম করি।
আমার কাছে কী?
বাকের ভাই আপনারে যাইতে কইছে।
বাকের ভাই আমাকে যেতে বলেছে মানে? সে তো জেলখানায়।
জি না থানা হাজতে।
থানা হাজতে আমাকে যেতে বলেছে?
জি।
সখ তো কম না দেখি। থানা হাজতে আমি কি জন্যে যাব? খবরটা তোমাকে দিয়ে পাঠিয়েছে?
জি। আমি গেছিলাম। বাকের ভাই কষ্টের মধ্যে আছেন।
কষ্টের মধ্যে তো থাকবেই, থানা হাজতে কে আর তাকে কোলে করে বসে থাকবে?
বিরক্তিতে মুনা ভ্রূ কুঁচকাল। গোবিন্দ বলল, আমি যাই আপা?
আচ্ছা যাও।
মুনা স্বপ্নেও ভাবেনি সে বাকেরকে দেখতে যাবে। অসুখ-বিসুখ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকলে দেখতে যাওয়া যায়। কিন্তু চোর-ডাকাতের সঙ্গে বাস করছে এমন একজনের কাছে যাওয়া যায় না। বাবু এখানে থাকলে একটা কথা হত। তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যেত। বাবু নেই। গেলে তাকে একা যেতে হয়। থানার লোকজনদের গিয়ে বলা আমি একজন আসামীকে দেখতে এসেছি।-সেও একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার। তারা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে–আসামি আপনার কে? তখন যদি সে বলে–কেউ না তাহলেও ঝামেলা। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করবে। নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কথা বলার চেষ্টা করবে। জঘন্য। মুনা ঠিক করল যাবে না। কিন্তু তবুও বিকেলে চলে গেল। ওসি সাহেবকে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি বাকের সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনাদের হাজতে আছেন। দেখা করা কী সম্ভব হবে?
বাকের ভাই কেমন আছেন?
ভাল।
দাড়ি রেখেছেন কেন?
রোজ রোজ শেভ করা মুশকিল। তুমি ভাল আছ?
আমি খারাপ থাকব কেন? আমি তো আপনার মতো গুণ্ডামিও করিনি, বন্দুক–বোমা নিয়ে লাফ-ঝাঁপও দেইনি।
তা ঠিক।
আমি তো দেখেছি। ধরা পড়লেই ছাড়া পেয়ে যান। এবার পাচ্ছেন না কেন?
কেউ ছাড়াবার চেষ্টা করছে না। তুমি কি একটু দেখবে?
আমি দেখব?
কেউ কিছু করছে না। মুনা। আমার ভয় ধরে গেছে।
বাকেরের গলা কেঁপে গেল। মুনা বলল, মামা যখন ঝামেলায় পড়ল তখন আপনি অনেক কিছু করেছিলেন। আমার পাশে আপনি ছাড়া কেউ ছিল না। কাজেই এবার তো সেই উপকারের শোধ দিতেই হবে।
সে সব কিছু না মুনা।
কিছু না হবে কেন? এটা আপনার প্রাপ্য। আপনি এ রকম রোগা হয়ে গেছেন কেন? অসুখ-বিসুখ?
না অসুখ-বিসুখ না। এখানে খাওয়া খুব খারাপ। হোটেলের খাওয়া তো সহ্য হয় না।
আপনার ভাই আপনার কোন খোঁজখবর করছে না?
বাকের জবাব দিল না। মুনা বলল, আজ উঠি, আমি কাল আবার আসব।
বাকের বলল, তোমার সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সা থাকলে দিয়ে যাও, খুব কষ্টে আছি। টাকার অভাবে সিগারেট খেতে পারি না।
মুনা দীর্ঘ সময় বাকেরের দিকে তাকিয়ে রইল। ছোট সেল ঘরে বাকের ছাড়াও আরো চারজন মানুষ। এদের একজনের জন্যে টিফিন কেরিয়ারে করে খাবার এসেছে। ভাত গোসত। এই সন্ধ্যাবেলায় সে গপগপ করে খাচ্ছে। ঝোলে তার হাত-মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে। সেদিকে তার ভ্রক্ষেপ নেই। একজন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে সঙ্গীর খাওয়া দেখছে। অন্য সবাই তাকিয়ে আছে মুনার দিকে।
মুনা তার হাত ব্যাগ খুলল। টাকা-পয়সা কিছু নিয়ে আসেনি। ফিরে যাবার রিকশা ভাড়াটা শুধু আছে। মুনার অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল। সে লক্ষ্য করল তার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। কেন এ রকম হবে? সে চাপা গলায় বলল, কাল আমি আপনার জন্যে টাকা নিয়ে আসব।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ উঠেছে
সকাল নটার মতো বাজে।
ঝাঁ ঝাঁ রোদ উঠেছে। মামুন দোতলার বারান্দায় বসে দাড়িতে সাবান লাগাচ্ছে। আজ তাকে অনেকগুলি কাজ করতে হবে। রাজমিস্ত্রীকে খবর দিতে হবে। সেতাবগঞ্জে যেতে হবে সিমেন্টের জন্যে। চাইনিজ সিমেন্টের বস্তা পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি ব্যাগে বিশ-ত্রিশ টাকা কম পড়বে। আকিল মিয়ার রড দিয়ে যাবার কথা। সে আসেনি। তার খোঁজেও যেতে হবে। আজ দিনের মধ্যে কি কি করতে হবে একটা কাগজে লিখে ফেললে হয়। মামুন ঠিক করল দাড়ি শোভ করার পরই পয়েন্ট বাই পয়েন্ট সব লিখে ফেলবে। সামনে প্রচুর কাজ। ভালই লাগছে। কাজ ছাড়া মানুষ থাকতে পারে?
আয়নাটা ভাল না। মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে চোয়াল ভাঙা অচেনা একটি লোক বসে আছে। স্বাস্থ্য বোধ হয় খারাপ হয়েছে। মামুন গালে ব্লেড ছোঁয়াতেই অনেকখানি কেটে গেল। টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল। আরো কি কাণ্ড? নতন ব্লেড। গাল কাটার কথা না। সে কি দাড়ি শেভ করাও ভুলে গেছে? মামুন তোয়ালে দিয়ে গাল চেপে উঠে দাঁড়ানো মাত্র অদ্ভুত একটি দৃশ্য দেখল। মুনা আসছে। কাধে পাটের একটি ব্যাগ। এই ঝাঁ ঝাঁ রোদেও গায়ে একটা চাদর। বিস্মিত চোখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে এগুচ্ছে। দ্বিধার ভঙ্গিটি স্পষ্ট। মামুন উঁচু গলায় চোঁচাল। এ্যাই এ্যাই। মুনা তাকাল চোখ তুলে। হাসল। মামুন ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা নয়, জাহানারা। এত বড় ভুলও হয় মানুষের। মুনা কেন এখানে আসবে? তার এত কী দায় পড়েছে?
কী ব্যাপার এ্যাই এ্যাই করে চেঁচাচ্ছিলেন কেন?
মামুন হাসল। জাহানারা বলল, এত বড় অসুখ দেখে এলেন তারপর তো এক’দিনও এলেন না। নানান রকম ঝামেলায়…।
কোন ঝামেলা ছিল না। আপনি ইচ্ছে করেই যাননি। মামুন কী বলবে বুঝতে পারল না। আপনার গাল দিয়ে তো টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। তুলা দিয়ে গাল চেপে রাখুন। ঘরে তুলা নেই?
না এটা কি ডাক্তারখানা। তুলা, জগ ওষুধপত্র এইসব থাকবে। আসুন ভেতরে আসুন।
না। আমি বসব না। হয়রত আলীকে ফেরত দিতে এসেছি।
পড়েছেন নাকি?
আপনি এত কষ্ট করে নিয়ে গিয়েছেন আর আমি পড়ব না। মেয়েদের আপনারা কি ভাবেন, পাষাণ?
মামুন বলল, আপনি একটু বসুন। দেখি আমি চায়ের ব্যবস্থা করি। এই পাঁচ মিনিট।
জাহানারা বসে রইল। মামুন প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল। চা তাকেই বানাতে হবে। কাজের যে মেয়েটি আছে সে ভাত-তরকারি ছাড়া অন্য কিছু রাঁধতে পারে না।
জাহানারা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আমার খুব একটা ভাল খবর আছে।
কী খবর?
দেখি আন্দাজ করুন তো?
মেয়েটি হাসছে মিটমিটি। তার চরিত্রের সঙ্গে এই হাসিটি ঠিক মিশ খাচ্ছে না। মামুন ধাঁধায় পড়ে গেল।
বলতে পারলেন না? আমার ট্রান্সফার অর্ডার হয়েছে।
বলেন কি?
আমি শনিবারে ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
আমিও ঢাকায় যাচ্ছি। আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। কোনো চিন্তা করবেন না। গল্প করতে করতে যাব। ফাইন হবে।
জাহানারা হাসল। মামুন অবাক হয়ে বলল, হাসছেন কেন?
আপনার মধ্যে একটা ছেলেমানুষি আছে তাই দেখে হাসছি।
জাহানারা আবার হাসতে লাগল। কিশোরীদের হাসি; যা শুধু শুনতে ইচ্ছে করে।
আপনি খুব খুশি হয়েছেন?
খুশি হব না। মানে! কী বলছেন। আপনি?
এই জায়গাটা কী এতই খারাপ?
হ্যাঁ খারাপ। আর কিছুদিন থাকলে আমি মরে যেতাম।
মানুষ খুব কঠিন জিনিস। মানুষ এত সহজে মরে না।
আমি মরি। আপনার গাল দিয়ে কিন্তু এখনো রক্ত পড়ছে। ঘরে ওষুধপত্র কিছুই নেই?
না।
গাঁদা ফুলের পাতা কচলে গালে দিন না।
গাঁদা ফুলের পাতা আমি পাব কোথায়?
জাহানারা আবার হাসতে শুরু করল। তার আজ এত আনন্দ হচ্ছে। সে বেশিক্ষণ থাকবে না। বলে এসেছিল। কিন্তু সে বিকাল পর্যন্ত রইল। অনবরত কথা বলল। যাবার সময় কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল। হালকা স্বরে বলল, আপনি যতবার ঢাকা যাবেন ততবার আমাদের বাসায় আসবেন। আসবেন তো?
হ্যাঁ আসব।
আমি আপনাকে সঙ্গে নিয়ে এক’দিন উনাকে দেখতে যাব।
কাকে দেখতে যাবেন?
ঐ যে মেয়েটি যে আমার মত দেখতে।
ও মুনাকে?
হ্যাঁ। উনি আমাকে দেখে আবার রেগে যাবেন না তো?
না রাগবে না; ও অন্য ধরনের মেয়ে।
জাহানারা নিঃশ্বাস ফেলল।
ভদ্রলোক সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন
মুনা বলল, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
ভদ্রলোক সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। যেন প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না। মুনা বলল, আমি অন্য একটা কেইসের ব্যাপারে। আপনার কাছে এসেছিলাম। আমার মামা একটা ঝামেলায় পড়েছিলেন…
ভদ্রলোক মুনাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মনে আছে। ক্রিমিনাল মিস এপ্রোপ্রিয়েশনের মামলা। চারশ তিন ধারা। আপনার মামার নাম শওকত হোসেন কিংবা শওকত আলি।
মুনা যথেষ্ট অবাক হল। এই উকিল ভদ্রলোক অসম্ভব ব্যস্ত। চেম্বারে লোকজন গিজগিজ করছে। তার পক্ষে এতদিন আগের একটা মামলার কথা মনে থাকার কথা নয়। এর রকম স্মৃতিশক্তি মানুষের থাকে?
আপনার নামও মনে আছে। মিস মুনা। এখনো কি মিস আছেন না মিসেস হয়েছেন?
হইনি এখানে।
কেন অসুবিধা কি?
ভদ্রলোক গভীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলেন। যেন সত্যি সত্যি জানতে চান। কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষই না থাকে পৃথিবীতে।
অসুবিধাটা কি বলুন।
ব্যক্তিগত অসুবিধা। সেটা এই জায়গায় বলতে চাই না।
আরে এই জায়গা কি দোষ করল? উকিলের চেম্বারে সব কথা বলা যায়। এ টু জেড।
আমি যে সমস্যা নিয়ে এসেছি তার সঙ্গে আমার মিস বা মিসেসের কোনো সম্পর্ক নেই।
ও আচ্ছা।
আমি কি সমস্যাটার কথা বলব?
আজ শুনতে পারব না। আজ ব্যস্ত। আগামী সপ্তাহে আসুন। সোমবার। এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে যান। কাগজপত্র কী আছে?
কিছু কিছু আছে।
সেই সব রেখে যান। আমার এসিসটেন্ট আছে। জুনিয়র দুই উকিল। বুদ্ধিশুদ্ধি মিলিটারিদের মত। মাথার খুলির ভেতরে সাবানের ফেনা ছাড়া আর কিছু নেই। নো ব্রেইন। কিন্তু উপায় কি বলুন? এই শমসের চা দে। ইনারে চা দে।
মুনা বলল, আমি চা খাব না।
কেন খাবেন না?
কারণ কিছুই না। খেতে ইচ্ছে করছে না।
আপনি বললেন। কারণ নেই আবার খেতে ইচ্ছে করছে না। দুরকম কথা বলেন কেন? খেতে ইচ্ছে করছে না। এটাই হচ্ছে কারণ। কথাবার্তা চিন্তা-ভাবনা করে বলা উচিত।
উকিল ভদ্রলোক থু করে একদলা থুথু ফেললেন এ্যাসট্রেতে। চারদিকে এ্যাসট্রের ছাই ছড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক বিরক্ত হবার বদলে মনে হয় আরো খুশি হলেন। ছাই কি করে উড়ে সেটা পরীক্ষা করবার জন্যে আরেক দফা থুথু ফেললেন।
মিস মুনা।
জি।
ছাই ফেলবার জন্যে সব টেবিলে এ্যাসট্রে থাকে। কিন্তু থুথু ফেলবার জন্যে কিছু থাকে না। কিছু থাকা উচিত। পিকদানি টাইপ কি বলেন?
মুনা কিছু বলল না। উকিল সাহেব হাই তুলে বললেন চলে যান, বসে আছেন কেন? সোমবারে আসবেন। দেখে দেব। আমার ফিস কিন্তু আরো বেড়েছে। জেনে যাবেন। শেষে আমড়াগাছি করবেন। সেটা হবে না। উকিলের চেম্বার কোনো মাছের বাজার না। মুহুরির কাছে সব জেনে-টেনে যান।
জি আচ্ছা।
সোমবারে ফিসের টাকার গোটাটাই নিয়ে আসবেন। খালি হাতে আসবেন না। মুনা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনার কাছে যারা আসেন তাদের সবারই নামধাম কি আপনার মনে থাকে?
হুঁ থাকে। নাম মনে থাকে আর কোনো ধারার কেইস ঐটা মনে থাকে। করে খাচ্ছি। তো এই কারণেই। হা হা হা।
মুনা বের হয়ে গেল। অফিসের সময় হয়ে আসছে। এখান থেকে একটা রিকশা নিলে ঠিক সময় পৌঁছান যাবে। মুনা খানিকক্ষণ ভেবে ঠিক করল। আজ অফিস