- বইয়ের নামঃ মৃত্যুপুরীর অতিথি
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. কাল্পনিক কাহিনি নয়
[কাল্পনিক কাহিনি নয়। সত্য ঘটনা]
মালিক! আমরা চললাম! তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রেড-ইন্ডিয়ানদের দলপতির দিকে তাকাল, তারপর সেই ছোটোখাটো লোকটির উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে দলেব বাকি ছয়জন মানুষকে ভালো করে নিরীক্ষণ করলে…
আচ্ছা, এবার আমাদের কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের সঙ্গে পাঠক-পাঠিকাদের পরিচয় করে দিচ্ছি
স্থান-ইকুয়েডরের বনভূমি।
কাল-১৯৫৫ সাল, ডিসেম্বরের কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত। পাত্রদের মধ্যে উপস্থিত আছে কাহিনির নায়ক ফ্রাঙ্ক নোভাক এবং সাতজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি। কুইচারা এখানে এসেছে নোভাকের সঙ্গে। তারা নোভাকের ভাড়াটে মাঝিও বটে, মোট বহনকারী কুলিও বটে। কিছু অর্থের বিনিময়ে তারা নদীপথে ও বনপথে মালিকের প্রয়োজন অনুযায়ী মাঝি ও কুলির কর্তব্য পালন করতে রাজি হয়েছে। পারিশ্রমিক হিসাবে যে অর্থ তারা দাবি করেছিল তার অঙ্কটা যদিও একটু বেশি তবু ফ্রাঙ্ক নোভাক আপত্তি জানায়নি, হাসি মুখেই কুইচাদের দাবি মেনে নিয়েছিল।
হঠাৎ আজ সকালে কুইচাদের দলপতি মালো বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, মালিক! আমরা চললাম। তোমার ইচ্ছা হলে তুমি আমাদের সঙ্গে আসতে পারো অথবা একলা এখানে থাকতে পারো কিন্তু আমরা আর এগোতে রাজি নই, আমরা ফিরে যাব।
একটু থেমে মালো আবার বললে, জিভারোরা আমাদের ফিরে যেতে বলেছে।
ফ্রাঙ্ক নোভাক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল, তারপর পকেট থেক সিগারেট বার করলে। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে সে প্যাকেটটা সকলের সামনে এগিয়ে ধরলে।
কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ কথা কইল না, নিঃশব্দে উড়তে লাগল সিগারেটের ধোঁয়া।
নোভাক ধুমপান করছিল আর চিন্তা করছিল, কি উপায়ে লোকগুলোকে এখন সামলানো যায়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে তল্পিতল্পা নিয়ে পথ চলা সত্যিই অত্যন্ত কঠিন কাজ।
একটু পরে নোভাক মুখ খুলল, তাহলে জিভারোরা তোমাদের ফিরে যেতে বলেছে?
দলপতি মালো বললে, হ্যাঁ মালিক। যে মানুষের মাথায় ঘিলুর বদলে শুকনো কাঠ আছে, সে ছাড়া আর কেউ জিভারোদের আদেশ অমান্য করতে সাহস পাবে না। কমো সে ডাইস? মালিক, তুমি কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?
জিভারোদের আদেশ তুমি কি করে শুনলে, মালো? তারা বোধহয় স্বপ্নে তোমার সঙ্গে দেখা করে আদেশ জানিয়ে গেছে? অথবা একটা ছোটো বাঁদর কিচমিচ করে গাছের উপর থেকে জানিয়ে দিয়েছে জিভারোদের নির্দেশ? এ পর্যন্ত কোনো জিভারোকে আমরা দেখতে পাইনি, তাই তাদের আদেশটা কি করে তোমার কানে পৌঁছে গেল সেটা আমি জানতে চাই।
মানলা একেবারে অশিক্ষিত নয়।
রেড-ইন্ডিয়ানদের কুসংস্কারকে কটাক্ষ করে তার উপর যে বিদ্রূপ বর্ষিত হল সেটা সে তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলে।
তার ভ্রু কুঞ্চিত হল, কপালে জাগল সারি সারি কুঞ্চনরেখা।
গম্ভীর স্বরে সে বললে, না, স্বপ্ন কিংবা বাঁদরের চিৎকারের মতো বাজে প্রমাণের উপর নির্ভর করে আমি ফিরে যেতে চাই না। আমার প্রমাণের ভিত্তি খুব মজবুত।
তাই নাকি? তা তোমার মজবুত প্রমাণটা কি? একবার শুনি।
যেসব গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি, সেইসব জায়গায় আমাদের চোখে পড়েছে বহু মানুষের মুণ্ডহীন দেহ আর সেই মৃতদেহগুলির কাছে বসে চিৎকার করে কাঁদছিল মেয়েরা। নদীর ধারে বালির উপর বিধেছিল মৃত যোদ্ধাদের বর্শাগুলি। এই সব চিহ্ন দেখেই আমরা বুঝতে পারছি জিভারোরা বেরিয়েছে নরমুণ্ডের সন্ধানে। মালিক, আমাদের মুণ্ডগুলো আমরা ঘাড়ের উপর রাখতে চাই– আমরা ফিরে যাব।
অসহিষ্ণু স্বরে নোভাকে বললে, কি মুশকিল। আমরা এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি। আমাদের উপর জিভারোদের রাগের কোনো কারণ থাকতে পারে না। মালো! সত্যি কথাটা বলো তো? চাপ দিয়ে আরও টাকা আদায় করতে চাও এই তো?
-না মালিক! আমরা টাকা চাই না, বাঁচতে চাই
মালো, ক্রুদ্ধস্বরে নোভাক বললে, এতগুলো জোয়ান মরদের দলপতি হয়ে তুমি একটা বুড়ি মেয়েমানুষের মতো কথা কইছ? তোমার দেখাদেখি দলের লোকগুলোও মেয়েমানুষের মতো ভয় পাচ্ছে।
মালোর মুখ কালো হয়ে উঠল, মালিক, তোমার কথাটা ঠিক হল না। আগের দিন তোমার সঙ্গে লড়াইতে আমি হেরে গেছি বটে কিন্তু ভয় পেয়ে আমি পরাজয় স্বীকার করেনি তুমি আমার চাইতে অনেক ভালো যোদ্ধা তাই তুমি জয়লাভ করেছ।
তাই নাকি? তাহলে জেনে রাখো আমার কথা না শুনলে আবার আমি তোমার সঙ্গে লড়তে বাধ্য হব।
নোভাকের চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে উঠল। কুইচাদের গায়ে হাত দিতে তার ভালো লাগে না। এই লোকগুলিকে সে সত্যিই পছন্দ করে আর তারাও ভালোবাসে তাদের মালিককে। কিন্তু এখন নোভাক কি করবে? এতদূর এগিয়ে সে ফিরে যেতে রাজি নয়।
সে মালোর দিকে তাকাল।
নিজের দুই কাঁধে ঝকানি দিয়ে মালো বুঝিয়ে দিলে লড়াই করতে তার আপত্তি নেই সে প্রস্তুত।
নোভাক মালোর মাথার দিকে হাত বাড়ালে, চুল ধরে মাথাটাকে নীচের দিকে টেনে নিয়ে সজোরে মুখের উপর হাঁটু তুলে দিতে পারলেই লড়াই ফতে
কিন্তু তার উদ্দেশ্য সফল হল না।
মালো সাঁৎ করে একপাশে সরে গেল আর সঙ্গেসঙ্গে একটা কঠিন বস্তু সবেগে আঘাত করলে নোভাকের ঘাড়ে।
নোভাক দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না, হাঁটু পেতে বসে পড়ল হুমড়ি খেয়ে—
একজন কুইচা ম্যাচেটের উলটো দিক দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করেছে।
ম্যাচেট এক ধরনের বড়ো ছোরা।
ছোরা না বলে এই অস্ত্রকে তরবারি বললেই ভালো হয়।
লোকটা ইচ্ছে করলে ম্যাচেটের এককোপে নোভাকের মাথাটা ঘাড় থেকে নামিয়ে দিতে পারত, কিন্তু খুন করার উদ্দেশ্য তার ছিল না– মালিককে সে বাধা দিতে চেয়েছিল।
দারুণ ক্রোধে নোভাকের কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল।
সে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল মালোর উপর।
আবার দুলে উঠল একটা ম্যাচেট, অস্ত্রের ভোতা দিকটা ঠকাস করে এসে লাগল নোভাকের মাথায়।
আঘাতের বেগ সামলাতে না পেরে সে একটা গাছের শিকড়ের উপর পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে হোঁচট খেয়ে তার দীর্ঘদেহ লম্বমান হল ভূমিশয্যায়। দারুণ যাতনায় তার সর্বাঙ্গ হয়ে এল অবশ, কেবল তীব্র ইচ্ছাশক্তির জোরে নোভাক তার চৈতন্যকে জাগ্রত করে রাখল।
নোভাকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা দুঃখিত। তোমার উপর আমাদের একটুও রাগ নেই, তোমাকে আমরা মারতেও চাইনি। কিন্তু কি করব? তুমি আমাদের সবাইকে মৃত্যুর মুখে টেনে নিতে চাও তাই তোমাকে বাধা দিলুম। সামান্য কিছু খাদ্য আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আর সব খাবার, মালপত্র, সাজসরঞ্জাম সবই তোমার জন্য রেখে দিচ্ছি। মনে রেখো মালিক- কুইচারা চোর নয়।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
মালিক! এখনো বলছি তুমি আমাদের সঙ্গে এসো। জিভারোরা নরমুণ্ড-শিকারে বেরিয়েছে, এখানে থাকলে তুমি মারা পড়বে।
নোভাক বললে, চুলোয় যাও।
বেশ। যে লোক মরতে চায় তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। আমরা তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু চাই না কারণ তোমার সঙ্গে যে চুক্তি ছিল তা আমরা রাখতে পারিনি, কাজেই তোমার কাছে আমরা কোনো পারিশ্রমিক দাবি করতে পারি না। তোমার জন্য একটা ক্যানো আমরা রেখে যাচ্ছি।
নোভাক আবার বললে, চুলোয় যাও।
কুইচারা চলে গেল।
একটা ক্যানো নৌকো এবং প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ-বিষুধের বাক্স পড়ে রইল সেখানে। যেটুকু–নিলে নয় শুধু সেই টুকু খাবার দাবার নিয়ে কুইচারা জলপথে অন্তর্ধান করলে।
নোভাক মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে কুইচারা সত্যিই ভালো লোক। মার খেয়ে নোভাক একটুও অসন্তুষ্ট হয়নি, ওদের চলে যাওয়াটাই তার ভীষণ খারাপ লাগছিল। জিভারো সম্বন্ধে মালোর উক্তি সে আদৌ বিশ্বাস করেনি।
নোভাক চিন্তা করে দেখল যে এবার তাকে একাই এগিয়ে যেতে হবে। সেটা একেবারে অসম্ভব না হলেও সে বুঝল ব্যাপারটা অতিশয় কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। এক ঘণ্টার পথ চলতে এখন তার সময় লাগবে তিন ঘণ্টা। যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি- সে ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
হোঁচট খেয়ে পড়ে নোভাকের পা মচকে গিয়েছিল কিন্তু পায়ের আঘাত যে কতখানি গুরুতর সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। উঠে দাঁড়াতেই পায়ের গোড়ালি থেকে উরু অবধি অসহ্য যন্ত্রণায় টনটন করে উঠল–
অগত্যা নোভাক আবার মাটির উপর বসে পড়ল ধপাস করে। বুট জুতো খুলে সে দেখল। পায়ের গোড়ালিটা খুব ফুলে উঠেছে আর চামড়ার তলা থেক ঠেলে উঠেছে অনেকগুলি নীল শিরা– পায়ের অবস্থা শোচনীয়!
কুয়াশা সরে যাচ্ছে। ঘন সন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও সারিবদ্ধ গাছের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছে প্রভাত-সূর্যের আলোকধারা।
নোভাক দেখল উঁচু জমিটা মোটেই সঁতসেঁতে নয়, বেশ শুকনো। একটু দূরেই কলকল শব্দে গান গাইতে গাইতে ছুটে চলেছে নদীর জলধারা। কুইচারা রেখে গেছে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, একটু দূরে বাক্সবন্দি অবস্থায় সেগুলো ছড়িয়ে আছে।
নোভাক নিশ্চিন্ত হল- তাবু খাঁটিয়ে বিশ্রাম নেবার পক্ষে এটি হচ্ছে আদর্শ স্থান…
নোভাকের বঁড়শিতে ধরা পড়ল কয়েকটা নদীর মাছ।
ঘাসপাতা, শুকনো গাছের ডাল প্রভৃতির সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে নোভাক মাছ রান্না করলে। আহার-পর্ব শেষ করে নোভাক বসে রইল নদীর জলে গা ডুবিয়ে কারণ জঙ্গলের মধ্যে পোকার বড়ো উপদ্রব।
ঠান্ডা জলের স্পর্শে ঘাড় এবং পায়ের ব্যথা অনেক কমে গেল। রাত্রিবেলা নৈশভোজন শেষ করে সে তার বাঁশীটাকে বার করে ফুঁ দিলে। যাত্রাপথে নোভাক একটা গান শিখেছিল আর এই গানটাকেই নানারকম করে সে বাজাতে লাগল।
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডর পাশে বসে ভরা পেটে বাঁশি বাজাতে বাজাতে এক সময় তার চোখ ঘুমে ভারি হয়ে উঠল। বাঁশি রেখে সে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার একবার মনে হল হতভাগা মালো যদি এখানে থাকত তাহলে বুঝতে পারত তার আশঙ্কা কতখানি অমূলক..
.
পরের দিন সকালে নোভাক বুঝল মালো মোটেই ভুল করেনি।
সকালবেলা। একটা গাছের গুঁড়িতে, ঠেস দিয়ে ঢুলছে নোভাক। পায়ের ব্যথা কমে গেলেই সে যাত্রা শুরু করবে এই হচ্ছে তার মনের ইচ্ছা।
হঠাৎ তার তন্দ্রাচ্ছন্ন শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল এক অদ্ভুত শব্দ-তরঙ্গ- ঠিক তার মাথার উপরে গাছের গুঁড়িতে আওয়াজ উঠল ফট। ফট ফট!
নোভাক সচমকে শব্দ লক্ষ্য করে দৃষ্টি সঞ্চালিত করলে
পরক্ষণেই পায়ের যন্ত্রণা ভুলে সে মাটির উপর ঝাঁপ খেল এবং কখনো গড়িয়ে কখনো ছুটে উধ্বশ্বাসে এগিয়ে চলল তাঁবুর দিকে বন্দুকের উদ্দেশ্যে।
–গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একঝাক তির!
নোভাকের অভিজ্ঞ চক্ষু একনজরেই বুঝল যে তিরগুলো সাধারণ ধনুকের সাহায্যে নিক্ষেপ করা হয়নি। এগুলো ছোঁড়া হয়েছে ব্লো-গান নামক মারাত্মক যন্ত্র থেকে।
ব্লো-গান বা ব্লো-পাইপ এক ধরনের ফাপা নল। এই নলের মধ্যে তির বসিয়ে সজোরে ঠু দিয়ে রেড-ইন্ডিয়ানরা তিরকে লক্ষ্যপথে চালনা করে। এতক্ষণে নোভাকের জ্ঞান-চক্ষু উন্মীলিত হল
কুইচা দলপতি মালো তাকে মিথ্যা কথা বলে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেনি! তিরগুলো যে জিভারো-যোদ্ধাদের ব্লো-গান থেকে উড়ে এসেছে এ বিষয়ে নোভাকের একটুও সন্দেহ রইল না।
তবে জিভারো হোক আর যাই হোক বিনাযুদ্ধে মৃত্যুবরণ করার মানুষ ফ্রাঙ্ক নোভাক নয়
তাবুর ভিতর থেকে বন্দুকটাকে হস্তগত করে সে প্রস্তুত হল।
শু-শু-শুট ট!
আবার ছুটে এল একঝাক তির তাবুর ক্যানভাস ভেদ করে! একটা তির তত আর-একটু হলে তার হাতে লাগত
তিরের চকচকে ফলাটা নোভাকের আঙুল ঘেঁসে মাটিতে কামড় বসাল!
নাঃ! এখানে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য! বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে নীচু হয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল নদীর দিকে, আর একটু পরেই জঙ্গল আর নদীর মাঝখানে একটা মস্ত পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করলে…
অনেকক্ষণ কেটে গেল। নোভাক অপেক্ষা করছে…।
কোথায় কি? জঙ্গলের আড়াল থেকে কোনো সশস্ত্র জিভারো তার দিকে তেড়ে এল না, এমনকী তিরের ছুটোছুটিও হঠাৎ হয়ে গেল বন্ধ।
কিন্তু নোভাক জানত শত্রুপক্ষ আশেপাশে ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেইতির ছুঁড়ে তারা শিকারের প্রাণবধ করবে। শক্ত মুঠিতে বন্দুক বাগিয়ে ধরে সে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রইল…
অনেকক্ষণ পরে খুব সাবধানে একটুখানি মুখ বাড়িয়ে সে একবার চারদিকে দৃষ্টিপাত করার চেষ্টা করেছিল তৎক্ষণাৎ মারাত্মক অভ্যর্থনা জানিয়ে তার দিকে ছুটে এল একঝাক তির!
নোভাক চট করে মাথাটাকে আবার পাথরের আড়ালে টেনে নিলে। এতক্ষণ পরে তার মনে হল মালোর কথা শুনে তার সঙ্গে ফিরে গেলে ভালোই হত; কিন্তু এখন আর অনুতাপ করে লাভ নেই…
সময় এগিয়ে চলেছে।
সকালের সোনালি আলোর পরিবর্তে আকাশে জ্বলছে মধ্যাহ্নসূর্যের রুদ্র দীপ্তি।
ঝলসে যাচ্ছে নোভাকের সর্বাঙ্গ অসহ্য উত্তাপে। কিন্তু স্থান ত্যাগ করে জঙ্গলের ছায়ায় আশ্রয় নেবার উপায় নেই, চতুর্দিকে শরীরী মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে বসে আছে জিভাবো-যোদ্ধার দল। সূর্যদেবের জ্বলন্ত আশীবাদ থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য নোভাক তার শার্ট খুলে মাথাটা ঢেকে ফেলল। সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল নতুন উপদ্রব!
ঝাঁকে ঝাঁকে পোকা এসে তার দেহের উপর বসল এবং অনাবৃত ঊ-অঙ্গের নানা জায়গায় হুল ফুটিয়ে রক্তপান করতে লাগল মনের আনন্দে।
অসহ্য যাতনায় সে বালির উপর গড়াগড়ি দিতে শুরু করলে…
পতঙ্গকুলের দংশনে ইতিমধ্যেই নোভাকের দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে- ক্ষতস্থানগুলি তপ্ত বালুকার স্পর্শে জ্বালা করতে লাগল ভীষণভাবে। তবে একটা উপকার হল। ঘামে-ভেজা দেহের সঙ্গে বালি জড়িয়ে সর্বশরীরে পড়ল বালুকণার নিবিড় প্রলেপ। অজস্র বালুকণার ঘন আবরণ ভেদ করে কীটপতঙ্গরা আর নোভাকের দেহে কামড় বসাতে পারলে না…।
অপেক্ষা করছে নোভাক জিভারোদের জন্য আর জিভাষোরা অপেক্ষা করছে নোভাকের জন্য। দু-পক্ষই জানে যার ধৈর্য বেশি সেই জিতবে।
কিছুক্ষণ পরেই নোভাকের অবস্থা হল শোচনীয়। সে শুয়ে আছে উন্মুক্ত আকাশের নীচে, তার মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে ইকুয়েডরের মধ্যাহ্ন-সূর্য, কিন্তু জিভাবোরা দাঁড়িয়ে আছে। বনের শীতল ছায়ায়।
একটু পরেই নোভাক পিপাসা বোধ করলে।
ক্রমে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠল তৃষ্ণার যন্ত্রণা।
জলের জন্য তার প্রাণ ছটফট করতে লাগল।
একটু দূরেই নদীর জল, কিন্তু সেখানে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণের উপায় নেই- অরণ্যের অন্তরালে সুযোগের অপেক্ষায় ব্লো-গান বাগিয়ে বসে আছে জিভারো যোদ্ধার দল…
মাটির উপর গাছের ছায়া হল দীর্ঘতর।
আকাশের জ্বলন্ত নীলিমার উপর পড়ল ধূসর অন্ধকারের শীতল প্রলেপ এল সন্ধ্যা।
নোভাকের রৌদ্রদগ্ধ অঙ্গ জুড়িয়ে গেল, কিন্তু সে খুশি হতে পারলে না। জিভারোদের উদ্দেশ্য বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। রাতের অপেক্ষায় বসে আছে জিভারো-যোদ্ধারা। নিবিড় অন্ধকার যখন দৃষ্টিকে করে দেবে অন্ধ, তখনই তারা করবে আক্রমণ।
সব বুঝেও কিছু করার উপায় ছিল না।
সতর্ক ভঙ্গিতে বন্দুকটা চেপে ধরে অর্ধ-শায়িত অবস্থায় সে পাহারা দিতে লাগল…
রৌদ্রদগ্ধ দেহের উপর লাগছে নৈশ-সমীরের স্নিগ্ধ স্পর্শ, গভীর অবসাদে বুজে বুজে আসছে নোভাকের চোখের পাতা। হঠাৎ ডান দিক থেকে ভেসে এল একটা অস্ফুট শব্দ আর সঙ্গেসঙ্গে তার চোখ থেকে পালিয়ে গেল তন্দ্রার আমেজ–
আঙুলের রূঢ় স্পর্শে শব্দ লক্ষ্য করে সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করলে নোভাকের বন্দুক! আগুনের চকিত ঝলকে এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে ধরা পড়ল একটা চতুষ্পদ মূর্তি- শূকর!
জন্তুটা নদীর জলে তৃষ্ণা নিবারণ করতে এসেছিল, তার জলপানের চকচক শব্দেই ঝিমুনি ভেঙে জেগে উঠেছিল নোভাক।
আবার শব্দ হল। এবার বাঁ-দিক থেকে।
নোভাক তাড়াতাড়ি সেদিকে ঘুরল আর হঠাৎ উঁচু পাথরের আড়াল থেকে একটা অদৃশ্য হাত তার বন্দুকের নলটাকে ধরে ফেললে
পরক্ষণেই প্রচণ্ড আকর্ষণে নোভাকের হাতের বন্দুক অন্ধকারের গর্ভে মিলিয়ে গেল।
এতক্ষণ পরে নোভাক হল নিরস্ত্র।
ক্ষোভে, ক্রোধে সে চিৎকার করে উঠল।
অন্ধকারে আন্দাজ করে একমুঠো বালি নিয়ে নোভাক শত্রুর উদ্দেশ্যে ছুড়ল। তার আশা ছিল চোখে বালি লেগে হয়তো আততায়ীর দৃষ্টি অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সে রকম কিছু ঘটল না।
পাথরের বিপরীত দিকে থেকে অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে নোভাকের চোখের সামনে আবির্ভূত হল এক মনুষ্য-মূর্তি- জিভারো!
বিদ্যুৎবেগে লোকটার উদর লক্ষ্য করে নোভাক লাথি ছুড়ল।
আর্তধ্বনি তুলে জিভারো ধরাশায়ী হল আর লম্বমান দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নোভাক। মাটির উপর গড়াগড়ি খেয়ে দুই শত্ৰু পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল দারুণ আক্রোশে।
অকস্মাৎ ভূমিপৃষ্ঠে জাগল ঘন ঘন পদশব্দ।
সচমকে নোভাক দেখল অন্ধকারের মধ্যে আরও-অন্ধকার অনেকগুলি ছায়ামূর্তি তাদের দিকে ছুটে আসছে।
একটা মুগুর শূন্যে দুলে উঠল- নোভাক চেষ্টা করেও আত্মরক্ষা করতে পারলে না, ঠকাস করে মুগুরটা এসে পড়ল তার দেহের উপর। পরমুহূর্তেই অনেকগুলো লোক একসঙ্গে তাকে আক্রমণ করলে।
বৃষ্টির মতো নোভাকের সর্বাঙ্গে পড়তে লাগল ঘুসি এবং লাথি। এমনি দারুণ মার খেলে অধিকাংশ লোকই জ্ঞান হারিয়ে ফেলত, কিন্তু নোভাক পোড়-খাওয়া মানুষ– সমস্ত শরীরটাকে গোল করে পাকিয়ে সে মাটির উপর শুয়ে পড়ল এবং নিঃশব্দে সহ্য করতে লাগল সেই অমানুষিক প্রহার…
নোভাকের দুই হাত বেঁধে ফেলা হল।
দুজন জিভারো-যোদ্ধা শুকনো ডালপালা এনে তাতে অগ্নিসংযোগ করলে। অন্ধকারের গর্ভে যাদের দেহগুলি এতক্ষণ প্রায়-অদৃশ্য ছিল, আগুনের আভায় এবার তারা নোভাকের দৃষ্টিপথে ধরা দিলে।
চারপাশের মানুষগুলোর উপর নোভাক দৃষ্টিনিক্ষেপ করলে
অনেকগুলো অর্ধনগ্ন বলিষ্ঠ মানুষ, কারও হাতে ব্লো-গান আবার কেউ বা বল্লমধারী। অস্পষ্ট আলোতেও বোঝা গেল তাদের চুল কুচকুচে কালো এবং সকলেই দস্তুরমতো সুপুরুষ।
শুধু পুরুষ নয়–জিভারো যোদ্ধাদের সঙ্গে রয়েছে নারীবাহিনী। পুরুষদের মতো মেয়েদের পোশাক-পরিচ্ছদও খুব স্বল্প। অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্তাভ আলোকধারা ছড়িয়ে পড়ছে মেয়েদের শরীরের উপর।
আলোছায়ার খেলায় নেচে নেচে উঠছে কয়েকটা ভুতুড়ে ছায়া তাদের সুগঠিত দেহের অঙ্গে অঙ্গে..
নোভাক লক্ষ করলে নারীবাহিনীর প্রত্যেকটি মেয়ে তাকিয়ে আছে তারই দিকে! পুরুষ-যোদ্ধারা তখন নোভাকের মালপত্র নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে। যোদ্ধাদের ভিতর থেকে হঠাৎ একটি লোক নোভাকের দিকে এগিয়ে এল। লোকটিকে দেখে নোভাক বুঝল সে একজন ছোটোখাটো সর্দার।
নোভাকের বন্দুকটা তখন সেই সর্দারের পিঠে ঝুলছে। তার চলাফেরার ধরন দেখে মনে হয় বন্দুকের অধিকারী হয়ে সে বিশেষ গর্ববোধ করছে। আরও একটা বৈশিষ্ট্য নোভাকের চোখে পড়েছিল সর্দারের হাত থেকে ঝুলছে দড়িতে বাঁধা একটা তরমুজ।
লোকটা হঠাৎ আগুনের খুব কাছে এসে দাঁড়াল।
সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল নোভাক, তার কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অস্ফুট আর্তধ্বনি!
লোকটির হাতে দড়ি বাঁধা ওটা তরমুজ নয়
অগ্নিকুণ্ডের রক্তিম আলোকে স্পষ্টই হয়ে উঠেছে একটা ছিন্ন নরমুণ্ড! মুণ্ডটার দুই কান ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে গলিয়ে দেওয়া হয়েছে একটা সরু চামড়ার ফালি এবং সেই চর্মরঙ্কুর বন্ধনে আবদ্ধ নরমুণ্ডটা সর্দারের হাতে দুলে দুলে উঠছে!
নোভাক অনুমান করলে কুইচাদের সঙ্গে আসার পথে গ্রামের ভিতর যে-সব মুণ্ডহীন দেহ তারা দেখেছে, এই মুণ্ডটা নিশ্চয় তাদের মধ্যেই কোনো হতভাগ্যের শরীর থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।
নোভাকের সর্বাঙ্গে একটা অসুস্থ অনুভূতি পাক দিয়ে উঠল, তিক্তস্বাদে কটু হয়ে উঠল তার কণ্ঠনালী– পরক্ষণেই সে বমি করে ফেললে!
নারী পুরুষের সম্মিলিত জনতা বন্দিকে লক্ষ করে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ত সানটা! ত সানটা!
নোভাক আবার শিউরে উঠল।
রেড-ইন্ডিয়ানদের ভাষা সে কিছু কিছু বোঝে।
ত, সানটা মানে হল শুষ্ক নরমুণ্ড!
জিভারোরা বাক্সের ভিতর থেকে জিনিসপত্র নামিয়ে এনেছিল, সেগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকরকম করে পরীক্ষা করলে, তারপর আবার মালপত্রগুলিকে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখতে লাগল।
নোভাক বুঝল, জিভারোদের স্বভাব-চরিত্র হিংস্র হলেও তারা বেশ শৃঙ্খলা-প্রিয় জাতি।
হঠাৎ একটি মেয়ে এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
কিছুক্ষণ তার চোখে চোখ রেখে সে ফিরে গেল অগ্নিকুণ্ডের কাছে এবং একখানা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আবার নোভাকের সামনে এসে দাঁড়াল।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে নোভাকের মনে হল, মেয়েটি দেখতে অপূর্ব সুন্দরী হলেও কিন্তু তার উদ্দেশ্য খুব সুন্দর নয়।
নোভাকের সন্দেহ সম্পূর্ণ সত্য মেয়েটা হঠাৎ জ্বলন্ত কাঠ দিয়েই তার বুকে মারলে এক খোঁচা!
নোভাকের হাত-পা বাঁধা। সেই অবস্থাতেই সে কোনোরকমে পশ্চাদদেশে ভর দিয়ে পিছিয়ে গেল এবং রজ্জবদ্ধ হাত তুলে জ্বলন্ত কাঠটাকে ছিটকে ফেলে দেবার চেষ্টা করলে।
তার চেষ্টা সফল হল না মেয়েটি হেসে উঠল, জ্বলন্ত কাঠটা আবার এসে পড়ল নোভাকের বুকে।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল নোভাক।
জিভারো রমণীদের মুখ দেখে মনে হল তারা বেশ আনন্দ উপভোগ করছে। কিন্তু জিভারো দলপতি এই নিষ্ঠুর খেলা পছন্দ করলে না।
নোভাকের চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে যোদ্ধারা ছুটে এল।
জিভারোদের সর্দার নোভাকের নির্যাতনকারিণীর মুখের উপর করলে এক দারুণ চপেটাঘাত। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেল, তার হাত থেকে খসে পড়ল জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড। সর্দার কাঠটা তুলে নিয়ে মেয়েটির দেহে আঘাত করতে উদ্যত হল।
বাঘিনী পরিণত হল হরিণীতে উধ্বশ্বাসে ছুটল সেই নারী এবং তাকে লক্ষ্য করে সর্দারের হাত থেকে ছুটে এল অগ্নিময় কাষ্ঠখণ্ড।
জ্বলন্ত কাঠের টুকরোটা এসে পড়ল রমণীর পায়ের উপর।
মেয়েটি মাটিতে বসে পড়ল, যাতনা-বিকৃত মুখে আহত পায়ের শুশ্রূষায় মন দিলে। মাঝে মাঝে তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছিল অস্ফুট আর্তস্বর- নিজের দেহের জ্বলন্ত কাঠের কাষ্ঠ-রসিকতা তার একটুও ভালো লাগেনি…
সকাল হল। জেগে উঠল জিভারোরা।
নোভাক জেগে উঠল না, কারণ সে জেগেই ছিল।
সারারাত তার একটুও ঘুম হয়নি।
যোদ্ধারা সকলেই কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল, তাই মশারা তাদের উপর বিশেষ উৎপাত করতে পারেনি। কিন্তু নোভাককে কেউ কম্বল দেয়নি, ফলে উপবাসী মশককুলের আক্রমণে তার অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। তার উপর হঠাৎ এসেছে বৃষ্টি। প্রহার-জর্জরিত শরীরের উপর অসংখ্য মশকের দংশন এবং ডিসেম্বরের বৃষ্টিসিক্ত রাত্রির হিমশীতল স্পর্শ গ্রহণ করে কোনো মানুষই ঘুমোতে পারে না- নোভাকও পারেনি। নিদ্রাহীন চক্ষু মেলে সারা রাত সে অপেক্ষা করেছে। প্রভাতের আলোর…
জিভাবরা যোদ্ধারা নদী থেকে কয়েকটা মাছ ধরলে। সেই মাছ এবং বনের ফল দিয়ে জিভায়রারা সকাল বেলা উপবাস ভঙ্গ করলে।
নোভাকের ভাগ্যে কিছু জুটল না।
একজন শুধু তৃষ্ণা-নিবারণের জন্য তাকে একপাত্র জল এগিয়ে দিলে।
আহারাদির পর্ব শেষ করে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত বাহিনী বন্দির সামনে এসে দাঁড়াল সারিবদ্ধ হয়ে।
নোভাক দেখল তাদের স্থিরদৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। সে ভয় পেল এবং অসুস্থ বোধ করলে—
গত কাল রাত্রিবেলা নোভাক দেখেছিল মাত্র একটা ছিন্নমুণ্ড, আজ সকালে তার ভীত চক্ষু আবিষ্কার করলে আরও তিন-তিনটে নরমুণ্ড!
একটা লোকর হাতে ঝুলছে চামড়ার বন্ধনী।
মুণ্ডগুলোর কান ফুটো করে যে ধরনের ফিতা দিয়ে সেগুলিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এই চর্মবন্ধনীটাও ঠিক সেই রকম।
তবে এটার সঙ্গে কোনো নরমুণ্ড ঝুলছে না।
নোভাক মনে মনে ভাবলে ওই চর্মরঙ্গুর ফাঁসটা বোধ হয় তার জন্যেই আনা হয়েছে। খুব সম্ভব একটু পরেই তার ছিন্নমুণ্ডটা ধরা পড়বে ওই চর্মরঙ্কুর আলিঙ্গনে!
সে মনে মনে ঈশ্বরের নাম নিলে এবার তার পালা।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল দলের সর্দার। যে মেয়েটি আগের রাতে বন্দিকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের আপ্যায়ন জানিয়েছিল, সে এবার এগিয়ে এসে নোভাকের চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে ধরলে।
সেই অবস্থায় চোখের দৃষ্টিকে নাক বরাবর চার্লিয়ে নোভাক দেখল দলপতির ডান হাতখানা স্যাৎ করে কোমরের দিকে সরে এল–
পরক্ষণেই তার দক্ষিণ হস্তে আবির্ভূত হল একখানা ঝকঝকে ম্যাচেট!
মেয়েটির হাতের সবল আকর্ষণ নোভাকের মাথাটাকে পিছনে ঠেলে রেখেছে– নোভাক বুঝল তার গলদেশকে শাণিত অস্ত্রের সম্মুখে উন্মুক্ত রাখার জন্যই মেয়েটি তার চুল ধরে টানছে।
জীবনে সর্বপ্রথম সে বুঝতে শিখল যে রমণীর করস্পর্শ সব সময় খুব রমণীয় হয় না।
দারুণ আতঙ্কে এক ঝটকা মেরে নোভাক মাথাটাকে মুক্ত করে নিলে। আবার মেয়েটি চেপে ধরলে নোভাকের চুল, আবার ঝাঁকুনি দিলে নোভাক এবং প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও নোভাকের মুণ্ড রমণীর কবলমুক্ত হয়ে ঘাড়ের উপর সোজা হয়েই থাকল।
মেয়েটি এবার অন্য উপায় অবলম্বন করলে। বন্দির দুই কাঁধের মাঝখানে হাঁটু লাগিয়ে সে দুহাত দিয়ে বাগিয়ে ধরলে চুলের মুঠি– পরক্ষণেই একটানে সে নোভাকের মাথাটাকে পিছন দিকে টেনে আনলে।
প্রাণপণ শক্তিতে টানাটানি করেও নোভাক এবার তার মাথাটাকে মেয়েটির কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারলে না!
অসহায় ভাবে সে সর্দারের দিকে তাকাল।
শাণিত ম্যাচেটটা তখন সর্দারের হাতে বন বন করে ঘুরছে।
হঠাৎ বন্ধ হল ম্যাচেটের ঘন ঘন আন্দোলন- শূন্যে একবার পাক খেয়ে শাণিত অস্ত্র বেগে নেমে এল নোভাকের গলার দিকে।
নোভাক চোখ বুজল। অস্ত্রাঘাতের প্রতীক্ষায় কেটে গেল কয়েকটা নীরব মুহূর্ত… ঠান্ডা বাতাসের আভাস এসে লাগল তার গালে। নেভাক চোখ খুলল না।
চোখ বুজেই মনে মনে ভাবলে মুণ্ডুটা বোধ হয় এতক্ষণ স্কন্ধচ্যুত হয়েছে- আকস্মিক আঘাতে সে যাতনাবোধের সময় পায়নি।
আরও কিছুক্ষণ কাটল, নোভাক কোনো যন্ত্রণা অনুভব করলে না।
ভয়ে ভয়ে সে চোখ খুলে ফেললে।
সর্দার হাসছে। হাসছে জিভারো-যোদ্ধারা। হাসছে মেয়েরা।
নোভাক বুঝল এটা হচ্ছে ঠাট্টা। প্রাণরক্ষার আনন্দে সেও হেসে ফেললে বোকার মতো।
একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হল– তার মুণ্ডটা অন্তত আজকের মতো দেহের উপরেই। অবস্থান করবে।
একটু পরে জিভারোরা ক্যানোতে উঠল।
দুখানা ক্যানো নৌকো। একখানায় শুধু পুরুষ, আর একটিতে রয়েছে মেয়েরা। নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেখল পুরুষদের ক্যানোতেই তার স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে। পূর্বরাত্রের অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পেরেছিল জিভারো-রমণীরা সুন্দরী বটে কিন্তু স্বভাবে তারা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। জিভারো পুরুষ নরহত্যা করলেও অকারণ নিষ্ঠুরতা পছন্দ করে না।
নদীর বাঁক ধরে বৈঠার আঘাতে দুখানা ক্যানো এগিয়ে চলল…
২. জিভারোদের গ্রাম
প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পরে নোভাকের চোখে পড়ল একখানা গ্রাম। এই প্রথম সে জিভারোদের গ্রাম দেখতে পেল
ঘরবাড়িগুলি কাঠের তৈরি, মাথার উপর শুষ্ক লতাপাতার আচ্ছাদন। কুটিরগুলোর চারপাশে বড়ো বড়ো কাঠের খুঁটি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। বেড়ার খুঁটিগুলোর মধ্যে একটু বৈশিষ্ট্য আছে– খুঁটিগুলো মাথার দিকে বর্শার মতো চোখা। দূর থেকে মনে হয় অনেকগুলি অতিস্থূল কাষ্ঠনির্মিত বল্লম কুটিরগুলিকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে।
গ্রামবাসীরা ক্যানো দুটিকে দেখতে পেল। নদীর তীরে দলে দলে ছুটে এল পুরুষ, নারী, শিশু এবং কুকুর। নোভাক মেয়েদের দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝল দীর্ঘদেহের অধিকারিণী না হলেও এই কৃষ্ণকেশী অর্ধসভ্য জিভারো নারী শ্বেতাঙ্গ সুন্দরীদের চাইতে একটুও কম সুন্দর নয়— নাক-চোখ এবং অধর-ওষ্ঠের এমন নিখুঁত গড়ন ইতিপূর্বে নোভাকের চোখে পড়েনি।
ক্যানো থেকে একটা মোটা দড়ি তীরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। কয়েকটি মেয়ে বুক জলে নেমে সেই দড়ি শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে। নোভাক দেখলে জিভারো নারী শুধু সুন্দরী নয়, তাদের দেহের শক্তিও অসাধারণ। অবলা হস্তের সবল আকর্ষণে দুটি নৌকাই তীরে এসে ভিড়ল।
নোভাকের মালপত্রগুলি ক্যানো থেকে নামিয়ে ফেলা হল।
দলের সর্দার নোভাকের চুলের মুঠি ধরে টেনে তাকে নৌকো থেকে নামিয়ে আনলে। মেয়েরা তৎক্ষণাৎ ঘিরে ধরলে বন্দিকে লাল চুল তারা কখনো দেখেনি, বন্দি নোভাকের রক্তবর্ণ কেশ তাদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। বন্দি অনুমান করলে জিভারো মেয়েরা বোধ হয় মানুষের চুলে কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ দেখেনি।
বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হল একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে।
ঘরটা প্রায় অন্ধকার, কোনো জানালা নেই শুধু যাতায়াত করার জন্যে আছে একটি চোটো দরজা। সেই দরজা দিয়ে নোভাককে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে জিভারোরা প্রস্থান করলে।
ঘরের চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নোভাক দেখল ঘরের মেঝেটা অতিশয় অপরিষ্কার এবং এখানে সেখানে ছড়িয়েই আছে অনেকগুলি শুষ্ক অস্থি পঞ্জর। তার নাকেও এসে ধাক্কা মারলে একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ। অন্য সময় হলে এমন নোংরা পরিবেশের মধ্যে সে হয়তো বমি করে ফেলত কিন্তু এখন সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। এমনকী হাড়গুলো মানুষের কি জন্তুর তাও সে পরীক্ষা করলে না কোনোমতে মেঝের খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সে শুয়ে পড়ল এবং একটু পরেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমগ্ৰ চেতনা…
এইভাবে শুরু হল ফ্রাঙ্ক নোভাকের জীবন জিভারোদের মধ্যে…
.
তৈলখনির সন্ধানে গিয়ে ইকুয়েডরের জঙ্গলে জিভারোদের হাতে নোভাক যখন বন্দি হল তখন তার বয়স ৩৫ বৎসর। বন্দি হওয়ার আগে তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে তৈল ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে! নোভাকের জন্ম হয়েছিল ওকলাহামা প্রদেশের সাপলা শহরে। তার বাবা পাভেল নোভাক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তৈলবিশেষজ্ঞ। তেলের খনিতে কিভাবে ডিনামাইট ব্যবহার করতে হয়, হঠাৎ আগুন ধরে গেলে কি করেই সেই আগুনকে নিভিয়ে ফেলা যায়– এই সব খুঁটিনাটি ব্যাপারে প্যাভেল নোভাকের জ্ঞান ছিল অসীম। মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে বাপের কাছে তালিম পেয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক বাপকা বেটা হয়ে উঠল। সেই অল্প বয়সেই সে তৈলখনির ভয়ংকর আগুনকে এত সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারত যে সেই অঞ্চলের তৈলবিশারদ দক্ষ মানুষগুলিও তার কৃতিত্বে অবাক হয়ে যেত। শুধু তৈলবিদ্যা আয়ত্ত করেই নোভাক খুশি হয় নি। দ্যপও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে ভূবিদ্যা শিখল ভালোভাবে। চার বছর ধরে সৈন্য-বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সে সমস্ত ইউরোপ ঘুরল। বিভিন্ন অয়েল কোম্পানি বা তৈল-প্রতিষ্ঠানগুলি নোভাককে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে। মাটির নীচে কোথায় তৈল লুকিয়ে আছে সে খুব সহজেই তা বলে দিতে পারত– এ বিষয়ে তার যষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিল অতিশয় জাগ্রত।
ভেনিজুয়েলায় একবার তৈল-অভিযানে গিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক স্থির করলে সে আর চাকরি করবে না। তেল সম্বন্ধে যাদের খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে, সেই সব লোক চাকরি না করেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই সব তৈল-বিশেষজ্ঞরা মাস মাস বেতন না নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিবদ্ধ তৈল-বিশেষজ্ঞরা যখন নতুন তৈলখনির সন্ধান পায়, তারা সেই খনির ভার দেয় কোনো তৈল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। উক্ত প্রতিষ্ঠান হয় তেলের খনির মালিক কিন্তু এই আবিষ্কারের বিনিময়ে তৈল-বিশেষজ্ঞ পায় এককালীন প্রচুর টাকা এবং বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেবার জন্য কোম্পানি আবিষ্কারকর্তাকে প্রতি বৎসর লভ্যাংশের কিছু অংশ দিয়ে থাকে। এই অর্থের পরিমাণ সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য। ফ্রাঙ্ক নোভাক সাধারণ মানুষ নয় নিজের সম্বন্ধে তার বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত গভীর। নোভাক ঠিক করলে যে সে আর চাকরি করবে না বরং স্বাধীনভাবে বিভিন্ন স্থানে তৈল-খনির গহ্বরে একবার নিজের ভাগ্যকে যাচাই করে দেখবে।
কারাকাস অঞ্চলে নোভাকের সঙ্গে একটা ছোটো তৈল-প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ হল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট জানালেন যদি সে তেলের খনির সন্ধানে ইকুয়েডর অঞ্চলে সম্পূর্ণ এককভাবে যেতে সম্মত হয় তাহলে উক্ত প্রতিষ্ঠান তাকে ২৫,০০০ ডলার দিতে রাজি আছে। টাকার অঙ্কটা অবশ্য খুবই বেশি, কিন্তু একটা বিরাট দল নিয়ে অভিযানে চালাতে গেলে আরও দশগুণ টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা, তার উপর যদি অভিযান ব্যর্থ হয় তাহলে তো সমস্ত টাকাটাই জলে গেল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ভাবলেন অত টাকার ঝুঁকি না নিয়ে ২৫,০০০ ডলার দিয়ে নোভাকের মতো অভিজ্ঞ লোককে নিযুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্থির হল নোভাক যদি সত্যিই কোনো তৈলখনির সন্ধান পায় তাহলে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক ছাড়া ওই তেলের খনি থেকে যে টাকা লাভ হবে, তার একটা অংশ সে চিরজীবন ভোগ করতে পারবে।
প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু ইকুয়েডরের বনভূমি অতিশয় বিপদজনক। ফ্রাঙ্ক নোভাক দুঃসাহসী মানুষ, স্বর্ণপ্রসূ তৈলখনির জন্য কোনো বিপদের সম্ভাবনাকে সে গ্রাহ্য করলে না– সে রাজি হয়ে গেল।
প্রেসিডেন্ট বললেন, এটা ডিসেম্বর মাস। সামনেই বড়দিনের উৎসব। উৎসবের দিনগুলো দেশে কাটিয়ে ইচ্ছে করলে তারপরেও তুমি ইকুয়েডর-অভিযান শুরু করতে পারো।
নোভাক জানিয়ে দিলে বড়োদিনের উৎসব নিয়ে সে সময় নষ্ট করতে রাজি নয়, এখনই সে যথাস্থানে যাত্রা করবে শুভস্য শীঘ্রং!
দুদিন পরেই নোভাক আকাশপথে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর উদ্দেশে যাত্রা করলে। অকাশপথে উড়ে যেতে যেতে উড়োজাহাজে বসে এবং কুইটোর একটা হোটেলের মধ্যে সে ইকুয়েডর অঞ্চলের বিভিন্ন রেড-ইন্ডিয়ান জাতি সম্পর্কে লিখিত অনেকগুলি বই পড়ে ফেললে। তাছাড়া ইকুয়েডরের ভৌগোলিক বৃত্তান্ত এবং তৈলখনি সম্বন্ধেও সে কয়েকটা বই থেকে নানা রকম জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করলে। তারপর কুইটো থেকে একটা জিপগাড়ি নিয়ে পূর্ব-আন্দির গড়ানো পার্বত্যভূমির উপর দিয়ে সে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে। জিপগাড়ির মধ্যে নানা রকম প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে অবশ্য সে ভুল করেনি- এই সব দরকারি জিনিসের মধ্যে ছিল অ্যাট্রোপিন, পেনিসিলিন, শুকনো জমাট খাবার, জরিপের যন্ত্র, তেল দেখবার গিয়ার, ডিনামাইট, তাবুর সাজ-সরঞ্জাম এবং একটা আর্মির বন্দুক ও তিনশ টোটা।
পার্বত্যভূমির নীচে একটা গ্রামে পৌঁছে একজন স্থানীয় পাদরির সাহায্যে সে ছজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি জোগাড় করে ফেললে। বেশ মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুইচারা ফ্রাঙ্ক নোভাকের মালপত্র বহন করতে এবং প্রয়োজন হলে জলপথে নৌকা চালাতে রাজি হল। ১৯৫৫ সালে ডিসেম্বরের তিন তারিখে কুইচাদের নিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক তার অভিযান শুরু করলে।
প্রথম প্রথম ধারাল ম্যাচেটের আঘাতে লতাপাতা কেটে এগিয়ে যেতে ভালোই লাগছিল। নোভাক অবাক হয়ে ভাবছিল জঙ্গল কেটে অভিযান চালাতে অভিযানকারীরা এত অনিচ্ছুক হয় কেন? একটু পরেই তার ভুল ভাঙল। ঘন ঘন ম্যাচেট চার্লিয়ে তার হাত হয়ে গেল অবশ, কিন্তু তার সামনে তখনো দুলছে অসংখ্য লতাপাতার সবুজ যবনিকা!–~
নোভাক ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার সঙ্গী কুইচারা সম্পূর্ণ নির্বিকার। তারা খুব সহজেই জঙ্গল কাটতে কাটতে পথ করে এগিয়ে চলেছে।
শুধু কি লতাপাতার বাধা? অসংখ্য মশা আর উড়ন্ত কীট এসে আক্রমণ করলে তাদের। অস্থির হয়ে উঠল নোভাক; তার হাত মুখ প্রভৃতি যে সব জায়গা পরিচ্ছদের আড়ালে ঢাকা পড়ে নি, সেই সব অনাবৃত স্থান পতঙ্গের দংশনে ফুলে উঠে ভীষণভাবে জ্বালা করতে লাগল। কুইচাদের মুখের ভাব নির্বিকার মশককুলের আক্রমণ অথবা কীট-পতঙ্গের দংশন তারা আমলেই আনলে না।
নোভাক সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে এই খর্বকায় লোকগুলির দিকে তাকাল। কুইচারা মোটেই দীর্ঘ দেহের অধিকারী নয়, কিন্তু তাদের নাতিবৃহৎ পেশিবহুল শরীর যেন লোহা দিয়ে তৈরি। বিশেষ করে তাদের সর্দার মালোর চেহারাটা সত্যিই দেখবার মতত। সঙ্গীদের মত সে-ও খর্বকায়, তবে তার দৈর্ঘ্যের অভাব পূরণ করে দিয়েছে একজোড়া পেশীবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তার। নোভাক দেখল মালোর ঘর্মসিক্ত শার্টের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পৃষ্ঠদেশের সর্পিল মাংসপেশী এবং ঘন সারিবদ্ধ বৃক্ষ ও লতাবঝাপের বন্ধনকে ম্যাচেটের আঘাতে কাটতে কাটতে সে এমন সহজভাবে এগিয়ে চলেছে যে মনে হয় লোকটি এতটুকু ক্লান্তিবোধ করছে না। কিন্তু কুইচারা ক্লান্ত না হলেও নোভাকের শরীর এক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ হয়ে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে সে চেঁচিয়ে উঠল, আর
বাবা, আর নয়। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। মালপত্র নামিয়ে সবাই বসে পড়ল। নোভাক প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরালে তারপর প্যাকেটটাকে এগিয়ে দিলে কুইচাদের দিকে। কুইচারা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, নিঃশব্দে পথ চলেছে। এবার তাদের ভাবলেশহীন মুখে ফুটল হাসির রেখা– তারা হঠাৎ হৈ হৈ করে কথা বলতে শুরু করলে। তাদের কাছেই নোভাক শিখল কেমন করে বনের পথে মালপত্র ঘাড়ে করে হাঁটতে হয়। কুইচারা ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারে খুব সহজেই নোভাক তাদের কথা বুঝতে পারলে।
নোভাক এবার প্রশ্ন করলে, তোমরা এতক্ষণ একটাও কথা বলনি কেন? গ্রামের মধ্যেও তোমাদের মুখে একটাও কথা শুনতে পাইনি!
মালো দন্তবিকশিত করে বললে, মালিক, তোমাকে আগে ঠিক বুঝতে পারিনি। সাদা চামড়ার অনেক লোক আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, তাদের কাছ আমরা শুধু ভারবহনকারী জানোয়ার মাত্র। তাই তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলি না, কেবল চুক্তিমতো কাজ করে যাই। তুমি আমাদের দু-পেয়ে জন্তু মনে করোনি, তাই তোমার সঙ্গে আমরা গল্প করছি, সহজভাবে মন খুলে কথা বলছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্প বেশ জমে উঠল। প্রভুভৃত্যের নীরস সম্পর্কের বদলে উভয়পক্ষে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের মিষ্ট বন্ধন।
মালো বললে, মালিক! কাঁধের মালটাকে বেশি ঝুলিয়ে না দিয়ে খুব উঁচু করে রাখো আর মেয়েমানুষের কাপড় কাঁচার মতো ধপাস ধপাস করে ম্যাচেট না চার্লিয়ে চলবার সময়ে যখন তোমার বাঁ পা মাটিতে পড়বে, ঠিক তখনই লক্ষ্যবস্তুর উপর কোপ হাঁকড়াবে।
মালোর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে নোভাক দেখল সত্যিই তাতে পরিশ্রম অনেক কম হয়।
সেদিন অর্থাৎ ডিসেম্বরের তিন তারিখে তারা এসে পৌঁছল পাটাজা নামক স্থানে।
মালো বললে, আজ রাতে এখানেই তাবু ফেলা যাক। কাল সকালে আমরা জলপথে ক্যানো ভাসিয়ে যাত্রা শুরু করব।
নোভাক সম্মতি দিলে। কুইচারা তাবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিনে জমানো শুকনো খাবার কুইচারা বাধ্য হয়ে খায়, কিন্তু ওই শুষ্ক খাদ্য তারা পছন্দ করে না- এ কথাটা নোভাকের জানা ছিল। সে মাথার উপর দৃষ্টির নিক্ষেপ করলে গাছে গাছে বসে আছে অথবা দোল খাচ্ছে অনেকগুলো বাঁদর। নোভাক শুনেছিল এইসব বাঁদরের মাংস নাকি অতিশয় উপাদেয় খাদ্য। অতএব গর্জে উঠল তার হাতের বন্দুক, বৃক্ষশাখা থেকে সশব্দে মাটির উপর আছড়ে পড়ল কয়েকটা বাঁদরের মৃতদেহ।
এমন টাটকা মাংস পেয়ে কুইচারা খুব খুশি। বাঁদরের মাংস খাওয়ার প্রবৃত্তি নোভাকের হল না, সে শুকনো টিনের খাবারেই ক্ষুধা নিবৃত্ত করলে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারা শুকনো লতাপাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাবুর ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালবেলায় অগ্নিকুণ্ডর আশেপাশে দেখা গেল জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল জাতীয় হিংস্র জন্তুর পায়ের চিহ্ন।
রাত্রিতে সবাই যখন নিশ্চিন্ত ঘুমে অচৈতন্য ছিল তাঁবুর ভিতরে, অরণ্য-প্রাচীরের অন্তরালে তখনও তাদের লক্ষ্য করেছে ক্ষুধিত, শাপদের জ্বলন্ত চক্ষু!…
কুইচারা কাজের লোক। চটপট নদী থেকে দুটো মস্ত মস্ত মাছ তারা ধরে ফেললে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ। তারপর নদীর জলে ভাসল ক্যানো- শুরু হল জলযাত্রা।
নোভাকের কাছে জলযাত্রা খুব আরামদায়ক লাগল। নদীর উপর সর্বদাই ছুটছে বাতাস; তাতে গরমের কষ্টও কম আর দুরন্ত বাতাসের মাতামাতি দূর করে দিলে উড়ন্ত পতঙ্গদের- কুইচাদের সঙ্গে যোগ নিয়ে নোভাকও দাঁড় বাইতে শুরু করলে।
সেদিন বিকালবেলা যখন তারা নদীর ধারে বিশ্রাম নেবার জন্য থামল, তখন নোভাক অনুভব করলে অরণ্য এখানে অগভীর এবং গরমও খুব বেশি। তারা তখন বনের মধ্যে প্রায় ২৫ মাইল চলে এসেছে। নোভাক সে রাত্রে তার বই খুলে স্থানীয় অধিবাসীদের কথা পড়তে লাগল। রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কয়েকটা জাতি এই অঞ্চলে বাস করে, তাদের নাম- কুইচা, জিভারো, কোকোমা, মুরাট, অকা প্রভৃতি। শুধু বই পড়ে নোভাক ক্ষান্ত হল না, সে এইসব জাতি সম্বন্ধে মালোকে প্রশ্ন করতে শুরু করলে।
মালোর কাছ থেকে যে ধরনের উত্তর এল, তাতে নোভাক খুব সন্তুষ্ট হতে পারলে না। সে বুঝল রেড-ইন্ডিয়ানদের সমস্ত জাতির শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মালোর বিশেষ পরিচয় নেই।
অবশেষে নোভাক প্রশ্ন করলে, এরা কি হিংস্র?
মালো বললে, কে জানে! রেড-ইন্ডিয়ানদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে জোর করে কিছু বলা যায় না। আজ হয়তো তারা শান্ত আবার কাল হয়তো দেখবে সবাই খুনের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে জিভারোদের সবাই ভয় করে। এখন অবশ্য জিভারোরা শান্ত হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে অকা জাতি।
-অকা? তারা অবার কারা?
মালিক, অকা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক জাতি। তারা সুযোগ পেলেই নরহত্যা করে। যে জিভারোরা সমস্ত অরণ্যবাসীর আতঙ্ক, তারাও অকাদের যমের মতো ভয় করে। জানো মালিক, কোনো অকা কখনো নরকে যায় না!
–কেন?
–কারণ নরকের রাজা শয়তানও অকাদের ভয় করে।
নোভাক হেসে উঠল।
মালো গম্ভীরভাবে বললে, হেসো না মালিক। কোনো অকার সঙ্গে যদি কখনো তোমার দৃষ্টি বিনিময় ঘটে, তবে সেই মুহূর্তে ধরে নিতে পারো যে তুমি আর বেঁচে নেই। অকা বড়ো ভয়ংকর জাতি।
অকাদের সম্বন্ধে আরও যেসব কাহিনি মালোর মুখ থেকে নোভাকের কর্ণগোচর হল সেগুলো সত্যিই ভয়ানক।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো নোভাক শুনতে লাগল সেই রক্তপিপাসু জাতির ভয়াবহ কাহিনি…
অভিযানের চতুর্থ দিনে ক্যানো দুটো উপস্থিত হল একটি গ্রামের কাছে। কিন্তু এ কি দৃশ্য!
নদীর ধারে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলি দগ্ধ পর্ণকুটিরের ভগ্নাবশেষ, নদীতীরে বালুকাভূমির উপর অবস্থান করছে একাধিক পুরুষের মুণ্ডহীন দেহ এবং ছিন্নস্কন্ধ। মৃতদেহগুলির ক্ষতস্থানে বন বন করে ঘুরছে শবভোজী মক্ষিকার দল- ভয়াবহ দৃশ্য!
কয়েকটি রেড-ইন্ডিয়ান মেয়ে ছুটে এল ক্যানো দুটির কাছে। একজন নোভাকের কাঁধে-ঝোলানো বন্দুকটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ক্রন্দন-জড়িত স্বরে চিৎকার করে উঠল। অন্য মেয়েগুলিও কাঁদতে লাগল এবং কথা কইতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। তাদের কথার অর্থ নোভাক বুঝল না, কিন্তু মালোর উদবিগ্ন মুখভঙ্গি দেখে তার ধারণা হল ব্যাপারটা বেশ গুরুতর।
মেয়েটির কথা শেষ হতেই মালো নোভাককে বললে, জিভারো! জিভারোরা হানা দিয়েছে এই গ্রামে তাই ওদের এই দুর্দশা! মেয়েরা বন্দুকটা দেখে খুশি হয়েছে, তারা আশা করছে তুমি জিভারোদের পিছনে তাড়া করবে এবং তাদের শাস্তি দেবে।
–হুম। এটা যদি জিভারোদের কীর্তি হয় তাহলে তাদের শাস্তি হওয়াই উচিত। তুমি কি বল, মালো?
না মালিক, তুমি যেও না। জঙ্গলের মধ্যে তুমি জিভারোদের দেখার আগেই তারা তোমায় দেখতে পাবে। ওই লোকগুলির যা অবস্থা হয়েছে- মালো মুণ্ডহীন দেহগুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে তারপর নোভাকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, তোমারও ঠিক ওই অবস্থা হবে।
সেই রাতটা নোভাক আর তার সঙ্গীরা সেই গ্রামেই থাকল। গাঁয়ের পুরুষরা মৃতদেহগুলির অগ্নি-সৎকার, মেয়েরা দগ্ধ কুটিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে আবার নতুন ঘর তৈরি করার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
সকালে উঠেই নোভাক দেখলে গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক। নারীপুরুষ সকলের মুখেই হাসি দেখা দিয়েছে, প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা তাদের দেখলে মনেই হয় না যে গতরাত্রে এই গ্রামের মধ্যে খুনোখুনি রক্তারক্তি হয়ে গেছে। নোভাক বুঝল গ্রামবাসীরা দার্শনিক।
তারা বিশ্বাস করে মৃত মানুষ জীবিতের সঙ্গী হতে পারে না তাই মৃতের জন্য শোক না করে খুব সহজভাবেই তারা জীবনযাত্রার সহজ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
মালো এবং তার সঙ্গীদের জীবন-দর্শন এত সরল নয়। গ্রামবাসীদের মতো সহজভাবে তারা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারলে না।
সেদিন সকালবেলা মালো দলের মুখপাত্র হয়ে নোভাককে বললে, জিভারোরা খেপে গেছে। আমাদের মাথাগুলো আর নিরাপদ নয়। মালিক, আমরা ফিরে যেতে চাই।
নোভাক তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলে, জিভারোদের সঙ্গে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ নেই। তারা আমাদের কেন আক্রমণ করবে? হয়তো এই গ্রামবাসীরা জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিল তাই এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে। যাই হোক আমি এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, এখন ফিরে যেতে পারব না।
মালো বললে, মালিক তাহলে তুমি থাকো, আমরা চললুম।
নোভাক দেখলে বেগতিক!–ইকুয়েডরের বনপথে একা একা পথ চলা দুঃসাধ্য ব্যাপার, যে। ভাবেই হোক কুইচাদের মত বদল করাতেই হবে। সে এবার অন্য কায়দা ধরলে, তিক্তকণ্ঠে বিদ্রূপ করে বললে, মালো তুমি একটা পুরুষ মানুষ নও! তোমার বুকে মানুষের হৃৎপিণ্ড নেই, আছে একটা মুরগির কলজে! তুমি এদের দলপতি হয়েছে কেন? এখানকার একটা মেয়েমানুষও তোমার চাইতে ভালো সর্দার হতে পারে।
মালোর মুখ চোখের চেহারা ভয়ানক হয়ে উঠল।
সে পিছন ফিরে চলে যাওয়ার উপক্রম করলে, পরক্ষণেই এক পায়ের উপর ভর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে পাক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মালিকের উপর তার দুহাতের দশটা আঙুল বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরলে নোভাকের কণ্ঠনালী!
এমন অতর্কিত আক্রমণের মুখে নোভাক সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলে না, কোনো রকমে মালোর পেটে হাঁটুর গুতো মেরে সে নিজকে ছাড়িয়ে নিল।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে ছেড়ে সরে গেল, দুজনেই দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগল। অন্য কুইচারা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো- দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না।
আবার আক্রমণ করল মালো। নোভাক শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে ঘুসি ছুড়ল কিন্তু মালো ক্ষিপ্রপদে সরে গিয়ে ঘুসিটাকে ব্যর্থ করে দিলে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিজের গতির বেগে নোভাক ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। তৎক্ষণাৎ এক লাফে নোভাকের পাশে এসে দাঁড়াল মালো, হাঁটু দিয়ে ধূর্ত রেড-ইন্ডিয়ান সজোরে আঘাত করলে নোভাকের কিডনিতে। নোভাক ছিটকে পড়ল মাটিতে! মালো ভূপতিত শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে লাথি ছুড়ল। নোভাক চট করে প্রতিদ্বন্দ্বীর পা ধরে ফেললে, তারপর দুহাতে গোড়ালি ধরে এক ঝটকায় পা মুচড়ে ভেঙে দেবার চেষ্টা করলে।
কিন্তু মালো মারামারিতে ওস্তাদ, সে সার্কাসের পাকা খেলোয়াড়ের মতো শূন্যপথেই নিজের দেহটাকে ঘুরিয়ে নিলে। মালোর পা ভাঙল না বটে কিন্তু তার দেহটা সশব্দে আছাড় খেল কঠিন মাটিতে আর সমস্ত শরীরের ওজনটা এসে পড়ল পেটের উপর তার দম ফুরিয়ে গেল।
নোভাক মালোকে টেনে তুলল, পর পর চারটি নিষ্ঠুর ঘুসির আঘাতে শেষ হয়ে গেল লড়াই।
নোভাকের প্রথম দুটি ঘুসি পড়ল মালোর পেটে, তৃতীয়টি পড়ল মুখে আর আঘাতের যন্ত্রণায় মালো যখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখন চতুর্থ ঘুসিটি তার ঘাড়ের উপর- মালো ভূমিশয্যা গ্রহণ করলে।
আবার তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে নোভাক, হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলে মানো, তোমার উপর আমার রাগ নেই। কিন্তু আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে। শোনো, আমরা এগিয়ে যাব– ঠিক?
মালো মাথা নাড়লে, ঠিক।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার সবাই ক্যানোতে উঠল–শুরু হল জলযাত্রা। প্রথম দু ঘণ্টা কেউ কথাবার্তা বললে না। নদীর চাইতে নদীর তীরের দিকেই কুইচাদের দৃষ্টি বেশি সজাগ দেখা গেল। তারা জানত জিভারোরা যদি নরমুণ্ড শিকার করতে চায়, তাহলে নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যেই তারা গা-ঢাকা দিয়ে সুযোগের প্রতীক্ষা করবে। নোভাক নীরবতা ভঙ্গ করার চেষ্টা করলে না, গুলিভরা বন্দুক কোলের উপর রেখে সে স্থির হয়ে বসে রইল চলন্ত নৌকার উপর শুধু তার প্রখর চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি ঘুরতে লাগল নদীর তীরে তীরে বনভূমির বুকে।
সন্ধ্যা হল, চারদিকে ঘনিয়ে এল অস্পষ্ট অন্ধকার।
হঠাৎ একজন কুইচা মাঝি চেঁচিয়ে উঠে নদীর তীরে একদিকে আঙুল দেখাল। তার নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই সকলের চোখে পড়ল বালির উপর বিঁধে আছে একটা বল্লম।
খুব তাড়াতাড়ি বৈঠা চার্লিয়ে তারা জায়গাটা পেরিয়ে গেল এবং রাত্রির অন্ধকার যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টিকে একেবারে আচ্ছন্ন না করে ফেলল, ততক্ষণ পর্যন্ত নৌকা বেয়ে চলল প্রাণপণে।
সেই রাত্রিতে তারা আগুন না জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই তাবু খাটাল। ঠান্ডা শুকনো টিনের খাবার চিবিয়ে তার ক্ষুধা শান্ত করলে এবং অন্ধকার তাবুর গর্ভে শয্যাগ্রহণ করে শুয়ে পড়ল। নোভাকের ঘুম এল না। তার চারপাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে যে লোকগুলো শুয়েছিল, তাদের অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনে নোভাক বুঝল যে আজ রাত্রে তাঁবুর মধ্যে কোনো লোকই নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে রাজি নয়– তীব্র শঙ্কা ও উদ্বেগ সকলের চোখ থেকে ঘুমকে তাড়িয়ে দিয়েছে…
কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত।
তীব্র কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল কয়েকটা কাকাতুয়া!
নোভাক উঠে বসল, দেখল সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ কুইচারা!
সকলের মুখপাত্র হয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা ফিরে যাচ্ছি।
নোভাক বললে, কালও তুমি ওই কথাই বলেছিলে।
নোভাক উঠে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল লড়াই।
কিন্তু এবার আর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হল না, অন্যান্য কুইচারা একসঙ্গে নোভাককে আক্রমণ করলে। তারপর কেমন করে আহত নোভাককে ফেলে রেখে কুইচারা সরে পড়ল, কেমন করে হল জিভারোদের আক্রমণ এবং কেমন করে জিভারোদের হাতে বন্দি হয়ে নোভাক এল জিভাবোদের গ্রামে সেই কথা কাহিনির পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা আছে, আবার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।
৩. কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত
আচ্ছা, এবার জিভারোদের গ্রামে একটা কুঁড়েঘরের ভিতর নিদ্রিত ফ্রাঙ্ক নোভাককে নিয়ে আবার কাহিনি শুরু করছি।
নোভাকের ঘুম ভাঙল অত্যন্ত রূঢ়ভাবে।
অচম্বিতে তার পাঁজরের উপর এসে পড়ল একটা লাথি আর শ্রবণেন্দ্রিয়ে আঘাত করলে অনেকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা পেয়ে নোভাকের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভাবল, এবার নিশ্চয়ই তার মুণ্ডুটাকে ঘচাং করে কেটে জিভারোদের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ত-সানটা করা হবে।
নোভাক ভালো করে চারদিকে তাকাল।
কুঁড়েঘরের ভিতর এসে দাঁড়িয়েছে অনেকগুলি লোক।
যে সর্দার আগের রাতে নোভাকের বন্দুকটা অধিকার করেছিল সেই লোকটিও ভিড়ের মধ্যে আছে, তবে আজ তার হাতে বন্দুকের পরিবর্তে শোভা পাচ্ছে একটা মস্ত ধনুক।
নোভাকের ঘুম ভেঙে যেতেই ধনুকধারী সর্দার কুটিরের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বললে, চিচা ম্যনিয়ক!
নোভাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
চিচা হচ্ছে এক ধরনের উত্তেজক পানীয় আর ম্যনিয়ক একজাতীয় গাছের মূল, রেড-ইন্ডিয়ানদের প্রিয় খাদ্য।
নোভাক বুঝলে জিভারোরা এখনো তাকে হত্যা করার সঙ্কল্প করেনি। সেই ধরনের ইচ্ছা থাকলে অন্তত তাকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে তারা আপ্যায়ন জানাবে না।
আহার্য এবং পানীয় নিয়ে এল একটি অর্ধবয়স্ক জিভারো রমণী। ক্ষুধার জ্বালায় বাঘ ঘাস খায় কিনা জানি না কিন্তু যে অপরূপ খাদ্য ও পানীয় কোনো শ্বেতাঙ্গ মানুষের গলা দিয়েই নামত না, সুসভ্য আমেরিকার অধিবাসী হয়েও ফ্রাঙ্ক নোভাক সেই বস্তু অম্লানবদনে গিলে ফেলল।
তবে স্বাদ যতই খারাপ তোক, শরীরের পক্ষে ওই খাদ্য ও পানীয় নিশ্চয়ই খারাপ নয়। কারণ, পানাহারের পরেই নোভাকের অবসাদ কেটে গেল, সে দস্তুরমতো সুস্থবোধ করলে।
এবার তাকে নিয়ে যাওয়া হল আর একটা কুটিরের দরজায়। গ্রামের মধ্যে যে কটা কুঁড়েঘর নোভাকের চোখে পড়েছিল এটা তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো।
যে সর্দার নোভাকের সঙ্গে এসেছিল সে নোভাককে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে। কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করতেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল একটি বলিষ্ঠ দেহ মানুষের উপর।
লোকটির মুখ দেখে তার বয়স অনুমান করা যায় না, তবে সে যে একেবারে তরুণ নয়, এ কথাটা নোভাক সহজেই বুঝতে পারলে। লোকটির মুখের রেখায় রেখায় বহু অভিজ্ঞতার ছাপ, কিন্তু তার পেশীবহুল দেহের উপর বয়স স্বাক্ষর এঁকে দিতে পারেনি।
ঘরের ভিতর একটা কাঠের আসনের উপর বসে আছে সেই অপরূপ মনুষ্য-মূর্তি এবং তার পাশেই একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে ঝুলছে তিনটি শুষ্ক নরমুণ্ড ও নোভাকের বন্দুক। নোভাক সবিস্ময়ে দেখলে মুণ্ড তিনটির গঠন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের মতো হলেও একটি সাধারণ মানুষের মাথার তুলনায় মুণ্ডগুলি প্রায় চারগুণ ছোটো।
একেই বলে ত-সানটা, সঙ্কুচিত নরমুণ্ড!
উপবিষ্ট মানুষটির দিকে একনজর তাকিয়ে নোভাক বুঝল পূর্ববর্তী সর্দার একটি ছোটোখাটো দলের নায়ক মাত্র- এই হচ্ছে জিভারোদের প্রধান দলপতি!
দলপতি একা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে দুজন স্ত্রীলোক।
একজন প্রৌঢ়া, অপরজন তরুণী।
প্রৌঢ়াকে দেখে নোভাক অনুমান করলে দলপতির স্ত্রী।
তরুণীর দিকে একবার তাকিয়ে সে চমকে উঠল।
জিভারো মেয়েদের সৌন্দর্য ইতিপূর্বেই নোভাকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু এই মেয়েটির সঙ্গে অন্য কোনো মেয়ের তুলনাই হয় না। দুর্ভেদ্য অরণ্যের অন্তরালে হিংস্র নৃমুণ্ড শিকারির অন্তঃপুরে এমন রূপসীর অস্তিত্ব কল্পনার অতীত- এক মুহূর্ত নোভাকের দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে রইল মেয়েটির মুখের দিকে, পরক্ষণেই সে চোখ ফিরিয়ে নিলে।
মেয়ে দুটি ছাড়া তাঁবুর মধ্যে অন্য মানুষও ছিল।
দলপতির পিছনে মাটিতে বিছানা পাতা রয়েছে এবং সেই শয্যা আশ্রয় করে শুয়ে আছে একটি কিশোর। অনেকগুলি চাদর ও কম্বল দিয়ে টাকা দেওয়া হয়েছে সেই ছেলেটিকে। কুটিরের মধ্যে খুব গরম— এই দারুণ গরমে ছেলেটিকে এতগুলো কাপড় কম্বল দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে দেখে নোভাক আশ্চর্য হল। সে লক্ষ করলে ছেলেটি টেনে টেনে অতিকষ্টে শ্বাসগ্রহণ করছে এবং তার উন্মুক্ত অধরোষ্ঠের আশেপাশে জমে উঠেছে নীলাভ ফেনা ও লালা নোভাক অনুমান করলে ছেলেটি অসুস্থ।
একটু পরেই ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় দলপতি কথা কইতে শুরু করলে। স্প্যানিশ ভাষা নোভাকের ভালোভাবেই জানা ছিল, দলপতির কথা বুঝতে তার অসুবিধা হল না।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা চার্লিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে নোভাক জানতে পারলে দলপতির নাম হচ্ছে পনি। রোগশয্যায় শায়িত কিশোরটি পনির পুত্র তার নাম পটো। জিভারোদের ওঝা বলেছে বনের মধ্যে কোনো শয়তানের কু-নজর লেগেই পনির ছেলে পটো হয়েছে অসুস্থ। সেই শয়তানের মুণ্ড কেটে আনতে পারলেই নাকি পটো আরোগ্যলাভ করবে। সেই জন্যই জিভারো যোদ্ধারা চতুর্দিকে নরমুণ্ড শিকার করতে শুরু করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আসল শয়তানের মুণ্ডটা কেউ আনতে পারেনি।
হায় হায়, নোভাক ভাবলে, এই তুচ্ছ কারণে এতগুলো মানুষকে হত্যা করা হল!
কিন্তু জিভাবোদের নিবৃত্ত করবে কে? এই ওঝারা হচ্ছে রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সর্বশক্তিমান তাদের কথা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে একেবারে অকাট্য, অভ্রান্ত।
তারপর পনি যা বললে তা শুনে নোভাকের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। পনি বললে তাদের ওঝা বলেছে নোভাকই হচ্ছে সেই শয়তান। অতএব তার মুণ্ডটাকে স্কন্ধচ্যুত করতে পারলেই পটো করবে আরোগ্যলাভ।
নোভাকের মাথা গরম হয়ে উঠল। নির্বোধ, মুখ, বলে সে সবাইকে গালাগালি দিতে লাগল।
হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল একজন জিভারো, তার কাঁধে ও হাতে রয়েছে নোভাকের চিকিৎসার সরঞ্জাম এবং আরও দুটো মস্ত মস্ত বাক্স।
পনি বললে, এই হচ্ছে তোমার ওষুধপত্র। আমি দেখেছি এইসব ওষুধ দিয়ে খ্রিস্টান পাদরিরা অসুস্থ লোকদের সারিয়ে দেয়। তুমি যদি খারাপ লোক না হও, তাহলে এক্ষুনি আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও।
একটু থেমে সে আবার বললে, তুমি বলছো তুমি খারাপ লোক নও। বেশ, তাহলে আমার ছেলেকে সারিয়ে দাও। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করতে চাই না, আমার ছেলে যদি সুস্থ হয়ে বেঁচে ওঠে তুমিও বাঁচবে! সে যদি মরে, তুমিও মরবে।
কি মুশকিল! নোভাক প্রতিবাদ করলে, ওর অসুখটা কি তাই তো আমি জানি না!
ওকে বাঁচাও!
ওষুধ হয়তো কাজ না করতে পারে।
পনি তার পাশে যে ব্লো-গানটা ছিল সেটাকে তুলে নিলে, তারপর অঙ্গুলি নির্দেশ করলে খুঁটিতে দোদুল্যমান নরমুণ্ডগুলির দিকে ইঙ্গিত অতি স্পষ্ট।
নিরুপায় নোভাক শেষ পর্যন্ত বাক্স থেকে পেনিসিলিন ও ইনজেকশনের সরঞ্জাম বার করলে। যা থাকে বরাতে, একবার পেনিসিলিন দিয়ে দেখা যাক–কাপড় সরিয়ে নোভাক ছেলেটির নিতম্বে অ্যালকোহল লাগিয়ে দিলে। ঘরের মধ্যে সমবেত জিভারো পুরুষ ও নারী সকলেই খুব আগ্রহের সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ দেখতে লাগল।
হঠাৎ ঘটনাস্থলে প্রবেশ করলে একটি জিভারো।
লোকটি নেহাৎ সাধারণ মানুষ নয়– কুটিরের দরজায় দণ্ডায়মান দুই প্রহরীকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে সে এসে দাঁড়াল দলপতি পনির সম্মুখে!
কয়েকজন ফিসফিস করে বলে উঠল, উইশিন! উইশিন!
নোভাক বুঝল এই হচ্ছে জিভারোদের ওঝা!
লোকটার সর্বাঙ্গে ও মুখে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা আঁকা হয়েছে, কালো চুলে বাহার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি লাল আর কালো রঙের পাখির পালক, হাতে রয়েছে একটা কাষ্ঠদণ্ড এবং সেই দণ্ডের অঙ্গসজ্জা করা হয়েছে শুষ্ক অস্থিচূর্ণ, পাখির পালক ও লাল-নীল কাপড়ের সাহায্যে।
এই অপরূপ দণ্ডটি হচ্ছে তার যাদুদণ্ড।
লোকটির নাম ফ্যাচুয়ে।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। হঠাৎ লোকটি উগ্রকণ্ঠে চিৎকার করে পনির উদ্দেশ্যে কিছু বললে। প্রত্যুত্তরে পনিও চিৎকার করে উঠল। তারপর উভয়পক্ষে উচ্চৈঃস্বরে কথা কাটাকাটি চলল। নোভাক তাদের কথা খুব ভালো বুঝতে পারলে না, তবে এইটুকু সে বুঝল যে পটোকে ইনজেকশন দেওয়াতে ফ্যাচুরের আপত্তি আছে।
পনি অবশ্য সাদা চামড়ার মানুষের ওষুধে খুব বিশ্বাস করে, কিন্তু ফ্যাচুয়ের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ উপেক্ষা করতে সে ভরসা পাচ্ছে না।
ওঝাদের ক্ষমতা রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে অতিশয় প্রবল। রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি বিষয়ে পরাক্রান্ত দলপতিও ওঝাদের কথার উপর কথা বলতে সাহস পায় না, আর এটা তোত একেবারেই চিকিৎসার ব্যাপার।
চিৎকার-চেঁচামেচি চলল, উভয়পক্ষই উচ্চৈঃস্বরে নিজের নিজের মত প্রকাশ করতে ব্যস্ত।
নোভাক কিন্তু এই চেঁচামেচিতে কান দিলে না, সে ছেলেটির দেহে ইনজেকশন করে দিলে!
ছুঁচ ফুটতেই ছেলেটি আর্তনাদ করে উঠল।
ফ্যাচুয়ে ও পনি দুজনেই চমকে উঠে তর্ক বন্ধ করে ফেললে।
নোভাক তখন তার কাজ শেষ করে ছুঁচটাকে বার করে আনছে। তর্কের অবকাশে কারও কোনো মতামতের অপেক্ষা না করে নোভাক যে ঔষুধ প্রয়োগ করতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা দুজনের কারও মাথাতেই আসেনি।
ওঝা রাগে জ্বলে উঠল।
পনি কিন্তু তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, সমস্ত ঘটনার দায়িত্ব যে এখন তার কাঁধ থেকে নোভাকের কাঁধে চেপেছে তাতেই সে খুশি।
ওঝা ফ্যাচুয়ে তখনও ক্রোধ প্রকাশ করছে উগ্রকণ্ঠে।
নোভাক হঠাৎ এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, এই! শোনো!
ফ্যাচুয়ে চমকে উঠল। নোভাক ক্ষিপ্রহস্তে ফ্যাচুয়ের একটা হাত ধরে ফেললে তারপর ইনজেকশনের যন্ত্রপাতি জোর করে তার হাতে গুঁজে দিলে। হতভম্ব ফ্যাচুয়ে কিছু বলার আগেই নোভাক চিৎকার করে বললে, ঠিক আছে পটো সেরে যাবে।
তারপরই ধীর পদক্ষেপে সে কুটিরের বাইরে বেরিয়ে গেল। সশস্ত্র রক্ষীরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ তাকে বাধা দিলে না।
কিছুক্ষণ পরে নোভাক ফিরে এল, আরও দুটো পেনিসিলিন ইনজেকশন দিলে রোগীর দেহে। তার বরাত ভালো ওষুধটা কাজে লেগে গেল। দুদিন পরেই অসুস্থ ছেলেটি ম্যনিয়ক সিদ্ধ আর কাকাতুয়ার মাংসের গ্রিল গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে! আরও দিন সাতেক বাদে দেখা গেল রোগী অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে মিলে নদী থেকে মাছ ধরছে এবং গ্রামের পথে পথে ছুটোছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে।
নোভাক বুঝল ফ্যাচুয়ে যতই রাগ করুক, এ যাত্রা তার মুণ্ড যথাস্থানেই বজায় থাকবে। পনি তাকে কথা দিয়েছিল তার ছেলে যদি বাঁচে তাহলে নোভাককে হত্যা করা হবে না। নোভাক জানত রেড-ইন্ডিয়ানরা কখনো কথার খেলাপ করে না, অতএব বর্তমানে সে সম্পূর্ণ নিরাপদ।
জিভারোরা নোভাককে খুব আদর-যত্ন করলে একথা বললে ভুল হবে, তবে পনি তাকে যথেষ্ট স্বাধীনতা দিলে। নোভাকের বন্দুক তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল এবং গ্রামের ভিতর যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ালেও তাকে কেউ বাধা দিত না, কিন্তু গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতা তার ছিল না। অর্থাৎ জিভাবোরা তার সঙ্গে বেশ ভালো ব্যবহার করলেও তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে তারা রাজি হয়নি।
বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন পনির কুটিরে নোভাকের তলব পড়ল।
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই নোভাককে ডেকে পনি বললে, তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিলুম! তুমি ম্যাকানিকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও- আজ থেকে তোমরা স্বামী-স্ত্রী।
কথাটা বলেই পনি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
নোভাক দেখলে ঘরের ভিতর সে আর পনির মেয়ে ম্যাকানি ছাড়া আর কেউ নেই। খানিকক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে থেকে সে মেয়েটির হাত ধরে পনির ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করলে।
পনির ঘরে প্রথম যে সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে নোভাক মুগ্ধ হয়েছিল এই হচ্ছে সেই মেয়ে ম্যাকানি! নোভাকের জিভারো বউ।
ব্যস, শুরু হল তাদের বিবাহিত জীবন।
জিভারোদের জীবনযাত্রায় কোনো জটিলতা নেই। পিতার সম্মতি পেলেই যে কোনো লোক কন্যার পাণিগ্রহণ করতে পারে। এজন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের দরকার হয় না।
নতুন বউ পেয়ে নোভাক খুবই খুশি হল। মেয়েটি দেখতেও যেমন সুন্দর, তার স্বভাব-চরিত্র তেমনই নম্ব। একটা বিষয়ে নোভাক বড়ো অসুবিধা বোধ করতে লাগল- ম্যাকানি স্প্যানিশ কিংবা ইংরাজি জানে না, শুধুমাত্র আকার ইঙ্গিতেই পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময় করতে হত-~ কথা বলার কোনো উপায় ছিল না।
কিছুদিন পরে এই অসুবিধাও নোভাক আর অনুভব করলে না। ম্যাকানি বড়ো মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে এবং বুদ্ধিমতীও বটে। নোভাকের ইশারা সে সহজেই বুঝতে পারত আর খুব বেশি কথা কইবার জন্যেও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, নোভাকের সঙ্গে থাকতে পারলেই সে খুশি থাকত। ম্যাকানিকে নোভাকের খুবই পছন্দ হল- এমন অনুগত স্ত্রী সুসভ্য ইউরোপীয় বা মার্কিনদের মধ্যেও বড়ো একটা দেখা যায় না।
একঘেয়ে ভাবে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। নোভাকের মনে আর বিপদের আশঙ্কা ছিল না, তবে সে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল- বুনো মানুষদের মধ্যে সংসার করে দিন কাটাতে সে আসেনি, সে এখানে এসেছে অন্য উদ্দেশ্যে। নোভাক বুঝল তেলের সন্ধান এখন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে গেলে জিভারোদের মনে নানা রকম সন্দেহ দেখা দিতে পারে, এমনকী হঠাৎ পাওয়া স্বাধীনতাটুকুও হয়তো আবার কেড়ে নেওয়া হবে। মনে মনে অস্থির হয়ে পড়লেও সে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগল সুযোগের প্রতীক্ষায়…
জিভারোদের শান্ত জীবনযাত্রায় একদিন ঝড় উঠল।
যে লোকটিকে নিয়ে গোলমালের সুত্রপাত তার নাম নানিও।
এই নানিও একদিন ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল পনির কাছে তার মুখ ও শরীর ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত!
নানিও যা বললে তার মর্ম হচ্ছে এই–
নদীর ধারে সে মাছ রান্না করছিল। এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হল একদল রেড-ইন্ডিয়ান। এই মানুষগুলিকে নানিও জানে তারা জিভারোদের গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে বাস করে। নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে, এই নবাগত মানুষগুলোর গ্রামও সেইদিকে।
লোকগুলো এসেই হাতের লাঠি দিয়ে নানিওকে দারুণ প্রহার করলে! আহত নানিও যখন মাটিতে পড়ে ছটফট করছে, তখন লোকগুলি আবার অরণ্যের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল। নানিরও ধারণা আক্রমণকারীরা দূরে কোথাও ক্যানো লুকিয়ে রেখেছিল, কার্য শেষ করে তারা আবার ক্যানো চার্লিয়ে জলপথে অদৃশ্য হয়েছে। খুব সম্ভব তারা এদিকে এসেছিল শিকার করতে, হঠাৎ নানিওকে একা পেয়ে তার উপর খানিকটা অত্যাচার করে গেল- জিভারোদের সঙ্গে এই উপজাতির মোটেই সদ্ভাব ছিল না, তাই বেচারা নানিওর কপালে এই লাঞ্ছনা।
নানিও আরও বললে যে লোকগুলির সঙ্গে বর্শা, ব্লো-গান প্রভৃতি অস্ত্র তো ছিলই, তার উপর তাদের মধ্যে একজন বন্দুকধারী। নানিওর সৌভাগ্যবশত তাকে কেউ অস্ত্রাঘাত করেনি, যদিও বন্দুকধারী লোকটি মাঝে মাঝে তাকে বন্দুক তুলে ভয় দেখিয়েছে।
নানিওর কাহানি শুনে জিভারোরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল- তারা এখনই যুদ্ধযাত্রা করতে চায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এক সশস্ত্র জিভারো জনতা ক্যানো ভাসাবার জন্য প্রস্তুত হল। পুরুষ-যোদ্ধাদের সঙ্গে সেজেগুজে তৈরি হল জিভারো-মেয়েরা।
পনির বক্তব্য হচ্ছে মেয়েদের দেখলে শত্রুপক্ষ হয়ত অসাবধান হতে পারে। তাদের অসাবধানতার সুযোগে যদি আক্রমণ চালানো যায়, তাহলে নিশ্চয়ই খুব তাড়াতাড়ি জয়লাভ করা যাবে।
সাধারণত মারাত্মক যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্যে মেয়েরা অংশগ্রহণ করে না কিন্তু দলপতির ইচ্ছাতেই মেয়েরা এই অভিযানে যোগ দিলে।
সশস্ত্র যোদ্ধারা এবং মেয়েরা যখন নৌকার দিকে ছুটে চলল তখন পনি নোভাকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল, ক্রুদ্ধ উত্তেজিত কণ্ঠে বললে, দাও! তোমার বন্দুকটা আমায় দাও! ওদের সঙ্গে একটা বন্দুক আছে, আমাদেরও একটা থাকা দরকার। তাড়াতাড়ি।
নোভাক বললে, না, আমি বন্দুক দেব না। তবে আমি তোমাদের সঙ্গে যেতে রাজি আছি! আমার বন্দুক আমার সঙ্গেই থাকবে, যদি দরকার হয় আমি নিজেই গুলি ছুড়ব- অন্য লোকের হাতে আমি বন্দুক দেব না।
পনি অসন্তুষ্ট হল, কিন্তু নোভাককে যেতে বারণ করলে না।
যোদ্ধাদের সঙ্গে নৌকায় চড়ে নোভাক যুদ্ধ যাত্রা করলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জিভারোদের ক্যানো নৌকাগুলি শত্রুপক্ষের গ্রামের কাছে নদীর তীরে ভিড়ল। শক্ত কাঠের গুঁড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে গ্রামের কুটিরগুলিকে। সেই বেড়ার আড়ালে আত্মগোপন করে শত্রুরা ওত পেতে আছে জিভারোদের অপেক্ষায়। কাঠের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে শত্রুর অস্ত্র সজ্জা ব্লো-গান, তীরধনুক, বর্শা, ম্যাচেট, মুগুর প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রগুলি নোভাকের চোখে পড়ল। নানিও যে বন্দুকধারীর উল্লেখ করেছিল তাকেও নোভাক দেখতে পেল। সেটা বন্দুক নয় রাইফেল- কিন্তু তেলের অভাবে অস্ত্রটার অবস্থা অতিশয় শোচনীয়। নোভাক বুঝল রাইফেলের অধিকারী অস্ত্রটাতে কখনো তেল দেয় না, খুব সম্ভব তেল দেওয়ার পদ্ধিত সম্বন্ধে তার কোনো জ্ঞান নেই– ফলে বহুদিন ধরে মরচে পড়ে রাইফেলটার অবস্থা এমন হয়েছে যে গুলি চালালে অস্ত্রটা হয়তো অস্ত্রধারীর হাতেই ফেটে যেতে পারে।
নৌকাগুলি নদীতীরে থেমে যেতেই পনি ডাঙায় নামল। তার সঙ্গে নামল মেয়েরা আর কয়েকটি পুরুষ যোদ্ধা।
শত্রুরা বেড়ার গাত্র-সংলগ্ন দরজাটা খুলে দিলে। মেয়েদের দেখে তাদের ধারণা হয়েছিল যে পনি এসেছে বন্ধুভাবে মিটমাট করতে, খারাপ উদ্দেশ্য তার নেই। ঠিক এই ব্যবহারই পনি আশা করেছিল, ভিতরে ঢুকেই সে চেঁচিয়ে উঠল, নান কি সুশায়ে! (এই নাও আমার বর্শা!)
পরক্ষণেই তার হাতের তীক্ষ্ণ বল্লম একজন শত্রুর কণ্ঠভেদ করলে।
ব্যস বারুদের গাদায় কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিলে।
অরণ্যের শান্ত নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল বহু কণ্ঠের হিংস্র গর্জন, শনশন শব্দে ছুটে এল অসংখ্য তির জিভারোদের দিকে!
নোভাক তাড়াতাড়ি ম্যাকানিকে টেনে নিয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ল- তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল একঝাক উড়ন্ত মৃত্যুদূত। পনির তিরন্দাজরা এবার তির ছুঁড়ল।
উভয় পক্ষেই কয়েকজন হতাহত হয়ে ধরাশয্যায় লম্বমান হয়ে পড়ল।
নোভাক দেখলে একজন জিভারো-যোদ্ধার গলার মধ্য দিয়ে ঢুকে একটা তির পিছনের কাঠের গুঁড়িতে বিধে গেল। লোকটি যথাসাধ্য টানাটানি করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারলে না– সেই অবস্থায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুখৃস্টের মতো প্রাণ বিসর্জন দিলে।
এবার শুরু হল হাতাহাতি লড়াই। দুজন শত্রু পানিকে ঘিরে ফেলল। নোভাক এবার স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করলে জিভারো দলপতির বীরত্ব পনি একাই বর্শা চার্লিয়ে দুজন শত্রুকে হত্যা করলে।
নোভাকের সামনে, পিছনে, এপাশে, ওপাশে চলছে হাতাহাতি লড়াই। ঝকঝক করে উঠছে শাণিত ম্যাচেট, ধারাল বর্শার আঘাতে ফুটো হয়ে যাচ্ছে যোদ্ধাদের দেহ, মুগুরের আঘাতে চুরমার হয়ে যাচ্ছে মানুষের মাথা এক বীভৎস রক্তাক্ত কাণ্ড!
হঠাৎ একটা লোক মুগুর হাতে এগিয়ে এসে ম্যাকানির হাত ধরে টানলে।
এক ঝটকায় নোভাক ম্যাকানিকে ছাড়িয়ে নিলে। শত্রু এবার মুগুর তুলল নোভাকের মঞ্চ লক্ষ্য করে–
নোভাক গুলি ছুড়ল না, বন্দুকের নল দিয়ে সজোরে গুঁতো মারল তার মুখে! দাঁত ভেঙে বন্দুকের নলটা প্রায় তিন ইঞ্চি ভিতরে ঢুকে গেল– লোকটা মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল, তার মুখ দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এল রক্তের ধারা এবং অনেকগুলো ভাঙা দাঁতের টুকরো।
ইতিমধ্যে যে লোকটার হাতে রাইফেল ছিল সে নোভাককে লক্ষ্য করে রাইফেল উঁচিয়ে ধরলে।
নোভাক তার বন্দুকের ট্রিগার টিপল।
একই সঙ্গে গর্জে উঠল দুটি আগ্নেয়াস্ত্র।
নোভাকের গুলি ফসকে গেল, কিন্তু রাইফেলধারীর নিজের অস্ত্রই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে। মরচে পড়া রাইফেল সশব্দে ফেটে পড়ল- হ্যাঁমার, স্প্রিং প্রভৃতি যান্ত্রিক অংশগুলি রাইফেলধারীর মুখে চোখে যেখানে-সেখানে বিঁধে গেল। লোকটি আর্তনাদ করে রাইফেল ফেলে দিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। খুব সম্ভব সে একেবারেই অন্ধ হয়ে গেছে!
অল্প সময়ের মধ্যেই লড়াই শেষ হয়ে গেল। বিজয়ী জিভারোরা ধরাশায়ী শত্রু যোদ্ধাদের দেহ থেকে মাথাগুলোকে কচাকচ কেটে ফেললে; তারপর সেই রক্তাক্ত নরমুণ্ড গুলিকে হাতে নিয়ে বিজয়গর্বে ক্যানোতে উঠে বসল। পনি চিৎকার করে হুকুম দিলে, নৌকা চালাও।
জিভারো যোদ্ধারা তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল করলে। কারণ, যে কোনো সময়ে বিজেতারা আবার দল বল নিয়ে বিজয়ীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে- অতএব চটপট সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
ছিন্ন নরমুণ্ডগুলি দেখে প্রথমে নোভাকের মনে জিভারোদের সম্বন্ধে ঘৃণার উদ্রেক হয়েছিল কিন্তু একটু পরেই তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বিগত মহাযুদ্ধের ছবি।
সেই যুদ্ধে নোভাকও সৈন্য হয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছিল। সভ্য মানুষ যে কত অসভ্য হতে পারে সে কথা নোভাক জানে- মহাযুদ্ধের সে একজন ভুক্তভোগী সৈনিক।
যুদ্ধের সময়ে সুসভ্য ইউরোপের মানুষ যে নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল তার কোনো তুলনা নেই, নরমুণ্ড শিকারি জিভারো-যোদ্ধা মানুষের ইতিহাসকে এতখানি কলঙ্কিত করতে পারেনি।
নোভাক বুঝল জিভারোদের ঘৃণা করা তার উচিত নয়…।
শুধু জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে জিভাষোরা শত্রুর মুণ্ডচ্ছেদ করেনি। একটু পরেই নোভাকের বোধগম্য হল যে ছিন্ন মুণ্ডগুলো সঙ্গে আনার বিশেষ কারণ আছে। গ্রামে এসেই একটা গাছের বড়ো বড়ো পাতা দিয়ে মুণ্ডগুলোকে ঢেকে দেওয়া হল। পনি নোভাককে বুঝিয়ে দিলে মুগুগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়া দ্বারা শোধন করে নেওয়া হবে। ওই ভাবে শোধন করে নিলে মুণ্ডগুলো আকারে ছোটো হয়ে ত-সানটায় পরিণত হবে এবং যে সব মানুষ মস্তক বিহীন অবস্থায় প্রেতদেহ ধারণ করে প্রতিহিংসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের প্রেতাত্মাগুলিও প্রক্রিয়ার ফলে শুন্যে লীন হয়ে যাবে। যতক্ষণ ওই প্রেতাত্মা বেঁচে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত জিভাবোরা নিরাপদ নয়। একমাত্র সানটা হলে অর্থাৎ মুণ্ডগুলোকে প্রক্রিয়া অনুযায়ী সঙ্কুচিত করতে পারলেই হত্যাকারীরা প্রেতের আক্রোশ থেকে মুক্তিলাভ করবে অদ্ভুত কুসংস্কার!
শোধন প্রক্রিয়ার সমস্ত কার্যকলাপ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল না, কারণ জিভারোদের কাছে এখনও সে বিজাতীয় মানুষ তাকে কখনই সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করা চলে না। প্রক্রিয়ার কিছু কিছু অংশ নোভাককে দেখতে দেওয়া হল বটে কিন্তু ওই বীভৎস কার্যকলাপের বর্ণনা দেবার ইচ্ছা আমার নেই আমার ধারণা ওই সব বর্ণনা পাঠক-পাঠিকাদের বিশেষ ভালো। লাগবে না।
যাইহোক, কাজ শেষ হয়ে গেলে পনি নোভাককে ডেকে পাঠাল। বিস্মিত নোভাক দেখলে সেই মুণ্ডগুলির মুখের আকৃতি একটুও পরিবর্তিত হয়নি বটে কিন্তু দৈর্ঘ্য প্রস্থে তাদের আকার হয়ে গেছে অতিশয় ক্ষুদ্র- সেই সঙ্কুচিত মুণ্ডগুলি এখন স্বাভাবিক নরমুণ্ডের তুলনায় অন্তত চারগুণ ছোটো! ত-সানটা!
সেই শুষ্ক সঙ্কুচিত নরমুণ্ডগুলিকে বর্শাফলকে বিদ্ধ করে জিভারোরা উৎসব শুরু করলে নৃত্য, গীত, পান ও আহার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলল সেই উন্মত্ত উৎসব…
আর এই উন্মত্ত উৎসবের ফাঁকে এতদিন পরে নোভাক যা চাইছিল তাই হল। পনি তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলে। এখন থেকে সে গ্রামের ভিতর অথবা গ্রামের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে যেখানে-সেখানে বিনা-অনুমতিতে ঘুরে বেড়াতে পারবে-যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করার জন্যই এই পুরস্কার।
নোভাক ঠিক করলে এইবার চারপাশের জঙ্গলে সে তেলের খোঁজ করবে। যে-সব জায়গায় তেলের অস্তিত্ব আছে বলে সন্ধানকারীর সন্দেহ হয় সেই সব জায়গায় সে ডিনামাইটের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অনুসন্ধান করে। বিস্ফোরণের ফলে ভূমির কম্পন এবং প্রতিধ্বনির শব্দ থেকেই অভিজ্ঞ তৈল-বিশারদরা তেলের সন্ধান বুঝতে পারে!
নোভাকের সঙ্গে যে সাজ-সরঞ্জাম ছিল তার মধ্যে কয়েকটা ডিনামাইটের স্টিক সে নিয়ে আসতে ভোলেনি। এইবার সব কিছু গুছিয়ে তার অভিযান শুরু করার আগে সে পনিকে বললে, ম্যাকানিকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। সে আমায় সাহায্য করবে।
পনি একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে নোভাকের দিকে, তার গলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ঘৎকার জাতীয় অসন্তোষের ধ্বনি- কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বাধা দিলে না।
ম্যাকানি প্রথমে নোভাকের প্রস্তুতি দেখে ভয় পেয়েছিল, তার ধারণা ছিল তার স্বামী বুঝি তাকে ফেলে প্রস্থান করতে চায়। অবশেষে যখন সে বুঝল যে নোভাক তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে তখন তার মুখের ভাব হয়ে উঠল অতিশয় হাসি-খুশি!
মালপত্র নিয়ে ম্যাকানির কাঁধে একটা প্যাকেট ঝুলিয়ে নোভাক যাত্রার উদ্যোগ করছে এমন সময়ে বিপত্তি- রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ ভুতুড়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের আবির্ভাব।
ফ্যাচুয়ে পনিকে উদ্দেশ করে কি বললে নোভাক তা বুঝল না কিন্তু আচম্বিতে একদল অস্ত্রধারী যোদ্ধা পনির আদেশে নোভাকের পথরোধ করে দাঁড়াল।
নোভাক রুষ্টকণ্ঠে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর মানে কী?
পনি বললে, যাওয়া হবে না!
–যাওয়া হবে না! যাওয়া হবে না মানে? তুমি কথা দিয়েছিলে যে আমাকে কোথাও যেতে বাধা দেওয়া হবে না, এখন তুমি কথার খেলাপ করতে চাও? তোমার কথার কোনো দাম নেই? বাঁদরের কিচির-মিচির শব্দের মতো তোমার কথাও দেখছি নিতান্ত মূল্যহীন!
পনির মুখ লাল হয়ে উঠল, সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওঝা ফ্যাচুয়ের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
ফ্যাচুয়ে দন্তবিকাশ করে হাসল, তারপর তার গলায় ঝোলানো চামড়ার থলি থেকে একটা কোনো বস্তু বার করলে ইনজেকশন সিরিঞ্জ।
নোভাকের মনে পড়ল প্রথম যেদিন সে পটোকে ইনজেকশন দেয় তখন খালি সিরিঞ্জিটাকে সে ওঝার হাতেই গুঁজে দিয়েছিল– এটা সেই সিরিঞ্জ!
ফ্যাচুয়ে সিরিঞ্জটাকে মট করে ভেঙে ফেলল তারপর পনির দিকে তাকিয়ে এমন ভাবে হাসতে লাগল যেন সে একটা মস্ত কাজ করে ফেলেছে।
রাগে নোভাকের সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল কিন্তু সে তার মনোভাব প্রকাশ করলে না, শান্তভাবে পনিকে প্রশ্ন করলে, এর অর্থ কি?
পনি বললে, ওঝা বলছে তুমি আমার মেয়েকে জঙ্গলের ভিতর নিয়ে যাবে কিন্তু আর ফিরবে না। তুমি ওর দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো খেয়ে ফেলবে আর এমন সব গুণ-তুক করবে যে গ্রামের লোকের ভীষণ অকল্যাণ হবে।
কী! নেভাক চিৎকার করে উঠল, আমি আমার বউকে হত্যা করে তার মাংস খাব? শয়তান! বর!… পনি, তোমার ছেলেকে আমি বাঁচিয়েছি সেকথা কী এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
ফ্যাচুয়ে বলছে আমার ছেলেকে সে বাঁচিয়েছে, তুমি নও। এইমাত্র তোমার ওষুধটা সে ভেঙে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ফ্যাচুয়ে ঠিকই বলছে। তোমার ওষুধের মোটেই জোর নেই তাই সে তোমার ওষুধে ভালো হয়নি, তাকে বাঁচিয়েছে ফ্যাচুয়ে।
–হুঁ। ফ্যাচুয়ে আর কি বলছে?
-সে বলছে তুমি অত্যন্ত খারাপ লোক। তোমার মাথা দিয়ে ত-সানটা করতে পারলে গ্রামের লোকের কল্যাণ হবে।
নোভাক বন্দুকটাকে আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাইল। ম্যাকানি তার পাশ থেকে তখন সরে গেছে- স্বামী তোক আর যাইহোক নোভাক হচ্ছে বিদেশি, কলহের সময় জিভারো রমণীর স্থান স্বজাতির পাশে, বিধর্মীর পাশে নয়!
হু নোভাক মনে মনে বললে, আমার মাথা ত-সানটা করার আগে অন্তত কয়েকটা মাথা আমি ফুটো করে দেব। মরবার আগে কয়েকজনকে আমি মেরে মরব…।
হঠাৎ নোভাকের রাগ ঠান্ডা হয়ে এল। সে বুঝল জিভারোদের সঙ্গে তার ঝগড়ার কোনো কারণ নেই, ওই শয়তান ফ্যাচুয়েটাকে জব্দ করতে পারলেই তার পথ হবে নিষ্কণ্টক।
নোভাক পনির মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললে, আমি একবার প্রমাণ করেছি যে ফ্যাচুয়ের যাদুবিদ্যার চাইতে আমার ওষুধের শক্তি বেশি। এবার আমি প্রমাণ করে দেব যে মানুষ হিসাবে আমি তার চেয়ে অনেক বড়ো, পুরুষ হিসাবেও তার চেয়ে আমি অনেক শক্তিশালী পুরুষ। পনি, আমাকে চারখানা মাদুর আর একটা চাকভর্তি ভীমরুল আনিয়ে দাও।
পনির আদেশে কয়েকজন জিভারো মিনিট কুড়ি বাদে একটা ভীমরুলের চাক এবং চারখানা মাদুর হাতে নিয়ে ফিরে এল। চাকের প্রবেশ পথ কাঠের ছিপি দিয়ে বন্ধ করা আছে।
সমস্ত ব্যাপারটা ফ্যাচুয়ের পছন্দ হল না। কিন্তু এখন আর পিছিয়ে আসার উপায় নেই— পরীক্ষার সম্মুখীন না হলে জিভায়রারা তাদের ওঝাকে আর সম্মান করতে রাজি হবে না। ফ্যাচুয়ে অস্বস্তির সঙ্গে নোভাকের কার্যকলাপ লক্ষ করতে লাগল।
নোভাক কাঠের ছিপি খুলে ভীমরুলের চাকটাকে আগুনের উপর ধরলে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধুমরাশি প্রবেশ করলে চাকের মধ্যে, ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল ভীমরুলের গুঞ্জনধ্বনি– অবশেষে যখন নোভাক বুঝল ভীমরুগুলি চাকের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে গেছে তখন সে দুখানা মাদুর বিছিয়ে চাকটাকে ওই মাদুর দুটির উপর ঝাঁকাতে লাগল। প্রায় অচেতন অবস্থায় ভীমরুলগুলি এসে পড়ল মাদুরের উপর। কয়েকটা তখনও খুব দুর্বল ভাবে নড়াচড়া করছিল বটে কিন্তু তাদের অবস্থা খুব ভালো নয়। নোভাক গুনে দেখল এক একটা মাদুরে রয়েছে প্রায় চব্বিশটা ভীমরুল। সে এবার অন্য দুটো মাদুর দিয়ে আগের মাদুর দুটিকে চাপা দিলে।
ভীমরুলগুলিকে দুজোড়া মাদুরের মাঝখানে বন্দি করে চাকটাকে নোভাক ছুঁড়ে ফেললে অগ্নিকুণ্ডর মধ্যে…।
কিছুক্ষণ পরেই ধোঁয়ার প্রভাব কেটে গেল। মুক্ত বায়ুর সংস্পর্শে চঞ্চল হয়ে উঠল মাদুরের বন্ধনে বন্দি ভীমরুলগুলি- ক্রুদ্ধ গুঞ্জনধ্বনি তুলে তারা জানিয়ে দিলে বর্তমান অবস্থাটা তারা মোটেই পছন্দ করছে না।
নোভাক তার গায়ের শার্ট খুলে ফেললে, তারপর পনির দিকে ফিরে বললে, আমরা দুজন এবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ব, তোমরা ভীমরুল সুদ্ধ এক-একখানা মাদুর আমার আর ফ্যাচুয়ের বুকের উপর চাপিয়ে দাও। আমি শক্তিশালী পুরুষ, ভীমরুলের কামড় সহ্য করতে পারব কিন্তু তোমাদের ওঝা ওই বুজরুক ফ্যাচুয়েটা হচ্ছে মেয়েমানুষের অধম ও এখনই উঠে দৌড় মারবে।
নোভাক এবং ফ্যাচুয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জিভাবোরা খুব সাবধানে দুপাশ থেকে ধরাধরি করে মাদুর দুটাকে দুজনের বুকের উপর চাপিয়ে দিলে। মাদুরের বুনোটের ফাঁক দিয়ে ক্রুদ্ধ ভীমরুলগুলি তাদের ভীষণভাবে দংশন করতে শুরু করলে…
অসহ্য যাতনায় নোভাকের কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছিল একটা আর্তচিৎকার- দাঁতে দাঁত দিয়ে সে আর্তনাদ রোধ করলে। আর কতক্ষণ? তার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সমস্ত পৃথিবী তার চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসছে- দুহাতের আঙুল দিয়ে নোভাক প্রাণপণে মাটি আঁকড়ে ধরলে…
ফ্যাচুয়ে আর সহ্য করতে পারলে না। মাদুরটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে উঠে পড়ল এবং দুহাতে বুকের মাংস চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল।
নোভাক এবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। অস্থির পদক্ষেপে সে প্রবেশ করলে নিজের কুটিরে, তারপর কীট-পতঙ্গের দংশনের প্রতিবোধ যে ওষুধ ছিল তার সঙ্গে ডিসটিলড ওয়াটার (পরিশ্রুত জল) মিশিয়ে স্বহস্তে বাহুতে ইনজেকশন করলে। এতক্ষণ পরে নোভাক তার রুদ্ধ আবেগকে মুক্ত করে দিলে বাঁশের খাঁটিয়ার উপর শুয়ে সে ফোঁপাতে লাগল…।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে সে উঠে পড়ল এবং সোজা প্রবেশ করলে ফ্যাচুয়ের কুটিরের মধ্যে। যাতনাকাতর ফ্যাচুয়েকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সে আবার বাইরে বেরিয়ে এল।
…এর পর আর কোনো দিন ফ্যাচুয়ে তার পিছনে লাগতে চেষ্টা করেনি..
নোভাক এবার নতুন উদ্যমে তৈলখনির সন্ধানে অভিযান শুরু করলে। জঙ্গলের মশা, জোঁক প্রভৃতির অত্যাচারে সে অস্থির হয়ে উঠল, বু ভাগ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না।
একজন রেড ইন্ডিয়ানকে সে ডিনামাইটের ব্যবহার শিখিয়ে দিয়েছিল। ডিনামাইটের সাহায্যে অরণ্যের বুকে ধ্বংসের তাণ্ডব সৃষ্টি করে সেই লোকটি অবশ্য খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল কিন্তু নোভাকের মনে এতটুকুও আনন্দ ছিল না কোথাও সে তেলের সন্ধান পায়নি।
এত পরিশ্রম আর আশাভঙ্গের দুঃখে নোভাক হয়তো ভেঙে পড়ত, তবে অনেক কষ্টের মধ্যেও তার একটি আনন্দের কারণ ছিল- সে হচ্ছে ম্যাকানি, তার জিভাবেউ!
মেয়েটি স্প্যানিশ কিংবা ইংরেজি ভাষা বলতে পারে না। তাই ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যে সে কোনোমতে নোভাককে তার মনের ভাব বোঝাবার চেষ্টা করত।
স্বামীর সঙ্গে বাক্যালাপ করার উপায় তার ছিল না। কিন্তু কথা বলতে না পারলেও নোভাকের সুখ-সুবিধার জন্য তার দৃষ্টি থাকত সর্বদাই জাগ্রত। ছায়ার মতো সে অনুসরণ করত স্বামীকে সারাদিনের ক্লান্তি ও পথশ্রমে আচ্ছন্ন হয়ে যখন নোভাক বিছানায় লুটিয়ে পড়ত তখন ম্যাকানি নিঃশব্দে এসে দাঁড়াত তার পাশে, নিপুণ হাতের সযত্ন সেবায় নোভাকের চোখে নেমে আসত সর্বসস্তাপহারিণী নিদ্রার আবেশ….
নোভাক কখনো ভাবতে পারেনি যে ম্যাকানির সঙ্গে তার বিচ্ছেদ হতে পারে…
বিচ্ছেদ এল। নোভাক আর ম্যাকানির মধ্যে হঠাৎ নেমে এল দুস্তর ব্যবধানের যবনিকা। আচম্বিতে বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো হিংসা আর আক্রোশের বন্যা আঘাত হানলে জিভায়রা-পল্লীর বুকে…
১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সাল।
পনি সদলবলে বেরিয়ে গেছে মাছ ধরতে ও শিকার করতে। প্রায় ফাঁকা, অধিকাংশ লোক আছে পনির সঙ্গে। মাত্র দুজন জিভারো বসে বসে তিরের মুখে শান দিচ্ছে আর ব্লো-গান তৈরি করছে। নোভাক প্রস্তুত হচ্ছে তার দৈনন্দিন অভিযানের জন্য, অ্যানি নামে যে রেড-ইন্ডিয়ানটিকে নোভাক ডিনামাইট ফাটাতে শিক্ষা দিয়েছিল সেও তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে নোভাকের হুকুম পেলেই সে বেরিয়ে পড়বে।
নোভাক বললে, অ্যানি, এবার চলো, বেরিয়ে পড়ি!
অ্যানি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল তারপর হঠাৎ দরজার দুদিকে হাত দিয়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অসহিষ্ণু কণ্ঠে নোভাক বললে, কী হল? থামলে কেন? চলো, চলো।
নোভাক এগিয়ে এসে অ্যানির পিঠে হাত দিয়ে আস্তে ধাক্কা দিলে, সঙ্গেসঙ্গে অ্যানির দেহ গড়িয়ে পড়ল মাটির উপর!
নোভাক এবং অপর দুজন জিভারো দেখলে অ্যানির বুকে বিঁধে আছে একটা তির!
জিভারো দুজন ঊধ্বশ্বাসে ছুটল পনির উদ্দেশে।
নোভাক চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি সঞ্চালন করলে কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে কোনো মনুষ্য-মূর্তি তার নজরে পড়ল না।
একটু পরেই ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলে পনি এবং অন্যান্য গ্রামবাসীরা। পনি চিৎকার করে বলছে, অকা! অকা!
কিন্তু তার গলার স্বর অত্যন্ত ক্ষীণ ও দুর্বল। স্পষ্ট বোঝা গেল অনেকটা পথ দ্রুত ছুটে এসে সে হাঁপিয়ে পড়েছে।
গ্রামের ভিতরে ঢুকেই জিভারোরা বেড়ার গাত্ৰ-সংলগ্ন প্রধান ফটকটা বন্ধ করে দিলে। কাঠের গুঁড়ির তৈরি বেড়ার ফাঁক দিয়ে তারা চারদিক লক্ষ্য করতে লাগল- হাতে তাদের ব্লো-গান, বর্শা, ম্যাচেট প্রভৃতি অস্ত্র।
জিভারোদের ভাবভঙ্গি দেখে নোভাক বুঝতে পারল তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে। এই ভীত সঙ্কুচিত মানুষগুলিকে দেখলে মনেই হয় না যে মাত্র কয়েকদিন আগেও তারা গর্বিত পদক্ষেপে যুদ্ধ যাত্রা করেছিল।
নোভাক পনিকে ডেকে প্রশ্ন করলে, ব্যাপারটা কি?
পনি বললে, অকা! অকারা আমাদের আক্রমণ করেছে।
তা এত ভয় পাচ্ছ কেন? অকারা তো তোমাদের মতোই মানুষ।
–অকাদের সবাই ভয় করে।
জিভারোদের মতো ভীষণ যোদ্ধারা যাদের ভয়ে এমন বিচলিত হয়ে উঠেছে তাদের স্বভাব-চরিত্র অনুমান করতে নোভাকের একটুও অসুবিধা হল না। তবে সে ঠিক করলে এবারের লড়াইতে সে নিরপেক্ষ থাকবে। সবসময় রেড-ইন্ডিয়ানদের ঘরোয়া ঝগড়া-বিবাদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না।
অবশ্য আক্রান্ত হলে তাকে বাধ্য হয়ে বন্দুক ধরতে হবে- নোভাক তার কুটিরে প্রবেশ করলে। ঘরের মধ্যে ঢুকেই সে দেখলে একটা কাঠের আসনের উপর বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তার বউ ম্যাকানি!…
ঠিক দুপুরবেলায় অকা-যোদ্ধারা জিভারোদের পল্লী আক্রমণ করলে। জঙ্গলের মধ্যে টুইটি টিট শব্দে পাখির শিস শোনা গেল হঠাৎ শুনলে মনে হবে সত্যিকার পাখির ডাক– কিন্তু আসলে সেটা আক্রমণোদ্যত অকাদের সঙ্কেত ধ্বনি।
কাঠের বেড়ার চারদিকে জঙ্গলের ভিতর থেকে ঘন ঘন ভেসে এল সেই নকল পক্ষী কণ্ঠের কলরব জিভারো-যোদ্ধারা ব্লো-গানে তির লাগিয়ে প্রস্তুত হল। একটু পরেই ছুটে এল একঝাক তির জঙ্গলের ভিতর থেকে। জিভায়রারা চুপ করে থাকল না, তাদের স্লোগান থেকে ঝাঁকে ঝকে তির নিক্ষিপ্ত হল জঙ্গলের দিকে শন শন শব্দে বাতাসে আলোড়ন তুলে উড়ে গেল এক ঝাঁক মৃত্যুদূত শত্রুর উদ্দেশে। অকাদের মধ্যে কেউ হতাহত হল কিনা বোঝা গেল না কারণ ঘন পত্র-পল্লবের আড়ালে কোথায় তারা গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছে তা অনুমান করা অসম্ভব। কিন্তু দুজন জিভারো যোদ্ধা শত্রুর তিরে আহত হয়ে মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে লাগল। নোভাক আশ্চর্য হয়ে দেখলে যে তির যদিও সাংঘাতিক ভাবে তাদের দেহ ভেদ করেছে তবুও দুটি যোদ্ধার মধ্যে একজনও চিৎকার করছে না!
একজন যোদ্ধা শরীরের ভিতর থেকে তিরটা নিজের হাতেই টেনে বার করে ফেললে তিরের পশ্চাৎভাগে কাঁটা তার জড়ানো থাকায় লোকটির পাকস্থলী ক্ষতপথে বাইরে বেরিয়ে এল! তবুও আহত যোদ্ধা একটুও আর্তনাদ করলে না– আশ্চর্য সহ্য শক্তি!…
মেয়েরা তখন চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। ঝাঁকে ঝাকে ছুটে আসছে তির– সেই অসংখ্য মৃত্যুদূতের উড়ন্ত দংশন উপেক্ষা করে জিভায়রা-যোদ্ধারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না– কাঠের গুঁড়ির পিছন থেকে সরে এসে তারা যে যার ঘরের মধ্যে গা-ঢাকা দিলে।
অকারা এবার বনের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করলে। কাঠের গুঁড়ির বেড়া ডিঙিয়ে তারা ভিতরে ঢুকলে এবং বেড়ার বড়ো দরজাটা খুলে ফেললে; জঙ্গলের ভিতর থেকে আরও অনেক অকা-যোদ্ধা ছুটে এসে খোলা দরজা দিয়ে জিভারো পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করলে।
ঘরের মধ্যে যেসব জিভারো যোদ্ধা লুকিয়েছিল এবার তারা বাইরে এসে শত্রুকে আক্রমণ করলে। শুরু হল হাতাহাতি লড়াই।
নোভাক তার কুটিরের ভিতরে সরে এল। তার পিছনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল তার জিভায়রা-বউ ম্যাকানি।
দরজার কাছে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে যথাসম্ভব আত্মগোপন করে নোভাক যোদ্ধাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে
জিভারো পল্লীর মাঝখানে তখন ভীষণ লড়াই শুরু হয়েছে।
নোভাকের চোখের সামনেই একটা বর্শা একজন জিভারো-যোদ্ধার মস্তক ভেদ করলে… একটি জিভারো হাতের ধারাল ম্যাচেট চার্লিয়ে একজন অকা-যোদ্ধাকে মাটির উপর পড়ে ফেললে আর সঙ্গেসঙ্গে বিজয়ীর পৃষ্ঠদেশে বিদ্ধ হল তিন-তিনটে শাণিত তির…
অকাদের পুরুষ বাহিনীর পিছন পিছন ছুটে এল মেয়েরা!
নোভাক সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলে অকা-নারী পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও হিংস্র!
চারদিক তখন ধুলায় ধুলায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে, এখানে সেখানে জিভারো কুটিরে অগ্নিসংযোগ করছে অকা-সৈন্য… জ্বলন্ত গৃহত্যাগ করে বাইরে এসে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করছে জিভারো মেয়েরা আর তাদের উপর হিংস্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ছে শত্রুপক্ষের নারী বাহিনী… নোভাকের চোখের সামনেই তিন চারটি অকা রমণী একটি জিভারো মেয়েকে জ্বলন্ত কাষ্ঠের সাহায্যে প্রহার করতে লাগল…
হঠাৎ চারজন অকা-যোদ্ধার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল নোভাকের কুটিরের দিকে। তারা একসঙ্গে এগিয়ে এল ঘরটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণের জন্য নোভাক বুঝল জিভারোদের লড়াই তার লড়াই, যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার উপায় নেই!
উন্মুক্ত দ্বারপথে একজন বন্দুকধারীর আকস্মিক আবির্ভাবে অকারা চমকে গেল, চারজন যোদ্ধাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
নোভাক তাদের দিকে এগিয়ে এল, কাছে, কাছে আরও কাছে…
হঠাৎ মুখ বাড়িয়ে সে চিৎকার করে উঠল, চুলোয় যাও তোমরা! চারজন যোদ্ধা একসঙ্গে লক্ষত্যাগ করলে সচমকে!
অকারা দেখেছে তাদের সামনে দাঁড়ালেই যে কোনো শত্রু ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় এমন অপ্রত্যাশিত অভ্যর্থনা তারা কোনো আশা করেনি!
অকা চারজন কি করত বুলা যায় না, হয়তো তারা ধীরে ধীরে সরে পড়ত– কিন্তু অকস্মাৎ রঙ্গস্থলে আত্মপ্রকাশ করলে নোভাকের বউ ম্যাকানি।
নোভাকের পিছন থেকে হঠাৎ ভেসে এল অস্পষ্ট ক্রন্দন ধ্বনি। সচমকে পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করতেই নোভাক দেখতে পেল ম্যাকানিকে। সে বুঝল শূন্যঘরে একা থাকার সাহস তার হয়নি, তাই সে স্বামীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্ত্রীর উপরে নোভাকের দারুণ রাগ হল! এতক্ষণ শুধু তাকে আত্মরক্ষার কথাই ভাবতে হচ্ছিল কিন্তু এখন ম্যাকানির ভারও তার উপরেই এসে পড়ল। যতই রাগ হোক, এই সঙ্গীন মুহূর্তে স্ত্রীর প্রতি ক্রোধ প্রকাশ করা সম্ভব নয়! ম্যাকানিকে আড়াল করে সে ধীরে ধীরে কুটিরের দিকে পিছিয়ে চলল। তাদের দুজনকে ঘিরে এগিয়ে আসতে লাগল চারজন অকা-যোদ্ধা।
ম্যাচেট হাতে একজন বলিষ্ঠ অকা সামনে এগিয়ে এল।
তার ওষ্ঠাধরে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসির রেখা।
নোভাক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার একটু পিছনেই কুটিরের দেয়াল আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
ম্যাচেটধারীর মুখের হাসি মুছে গেল, বাঘের মতো গুঁড়ি মেরে সে নোভাকের দিকে এগিয়ে এল আক্রমণের পূর্বাভাস..
গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক, লোকটি ছিটকে পড়ল মাটির উপর তার মস্তক ভেদ করে ছুটে গেছে বুলেট!
বাকি তিনজন শত্রুর চোখে চোখ রেখে পিছিয়ে গেল। একজন হাতের বর্শা তুলে নোভাকের দিকে ছুড়বার উপক্রম করলে। আবার অগ্নিবৃষ্টি করলে বন্দুক- লোকটি দুপাক ঘুরে সশব্দে মাটিতে বসে পড়ল, তার কাঁধে গুলি বিঁধেছে…
বন্দুকের গর্জনধ্বনিতেই শেষ হয়ে গেল যুদ্ধ।
উভয় পক্ষই মুহূর্তের জন্য নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল- অকাদের মধ্যে অনেকেই বন্দুকের শব্দ কখনো শোনেনি।
পাখির কণ্ঠ অনুকরণ করে চেঁচিয়ে উঠল অকা-যোদ্ধার দল। দুএকজন অকা বন্দুকধারী নোভাক এবং গুলিবিদ্ধ আহত সঙ্গীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে, স্পষ্টই বোঝা গেল আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার ইচ্ছা তাদের নেই। আবার জাগল নকল পক্ষীকণ্ঠের কলধ্বনি– অকাদের পলায়ন সঙ্কেত!
অতিদ্রুত অথচ সুশৃঙ্খল ভাবে অকা যোদ্ধারা পিছিয়ে গেল প্রধান দরজার দিকে। নোভাক তাদের অনুসরণ করলে…
হঠাৎ তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তীব্র উৎকণ্ঠা আর আশঙ্কায় সে নিজেকে হারিয়ে ফেললে চিৎকার করে উঠল নোভাক, উচ্চৈঃস্বরে অভিশাপ বর্ষণ করতে লাগল অকাদের উদ্দেশে।
নিজের উপর আর নোভাকের কর্তৃত্ব রইল না, বিকল স্নায়ু এবার বিদ্রোহ ঘোষণা করলে অজ্ঞাতসারে তার ডান হাতের অবাধ্য আঙুল বারংবার বন্দুকের ঘোড়া টিপে ধরলে, যান্ত্রিক কণ্ঠের হুঙ্কারে অরণ্যের বুকে প্রতিধ্বনি তুলে লক্ষ্যহীন অনির্দিষ্ট পথে ছুটল গুলির পর গুলি…
অকাদের মধ্যেও এবার ভীতির সঞ্চার হল। এতক্ষণ তারা সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতো পিছিয়ে অসছিল, এবার সব নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙে তারা ছড়িয়ে পড়ল- এলোমেলো ভাবে যে যেদিকে পারে ঊর্বশ্বাসে ছুটল।
পলায়নের সময়েও অকারা ক্ষতি করতে ছাড়ল না।
জিভারোদের যে কখানা ক্যানো নদীর ধারে ছিল সেগুলোকে অকা-যোদ্ধার দল লুঠ করে জলপথে পলায়ন করলে…
নোভাক ভেবেছিল এবার নিশ্চয়ই জিভাবোরা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু কোথায় কি? তারা সমস্ত ব্যাপারটাকে খুব সহজ ভাবেই গ্রহণ করলে। যোদ্ধারা দুএকবার নোভাকের দিকে দৃষ্টিপাত করে অন্য কাজকর্মে ব্যস্ত হয় পড়ল। মেয়েরা কোনো দিকে চাইল না, হতাহত পুরুষদের জন্যে করুণ কণ্ঠে তারা শোকপ্রকাশ করতে লাগল।
যে অকা-যোদ্ধাটি প্রথমেই বন্দুকের গুলি খেয়ে মারা পড়েছিল নোভাক তার মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়াল। হঠাৎ তার চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল অত্যন্ত প্রখর-মৃতের গলায় চামড়ার ফাঁসের সঙ্গে ওটা কি ঝুলছে? সে নীচু হয়ে নিহত অকার গলা থেকে সেই বস্তুটি খুলে নিয়ে দেখল জিনিসটা আর কিছু নয়– একটা পাথর।
পাথরটার উপর ভালো করে নজর বুলিয়ে সে চমকে উঠল– এটা সাধারণ পাথর নয়, বালিপাথর!
এই বালিপাথরের নীচেই থাকে তেলের ভাণ্ডার!
নোভাক নাসারন্ধ্র সঙ্কুচিত করলে; তার নাকে এসে ধাক্কা মেরেছে একটা পরিচিত তীব্র গন্ধ আর সেই গন্ধ আসছে অকা-যোদ্ধার মৃতদেহ থেকে–
নোভাক মৃতদেহের উপর ঝুঁকে পড়ল।
তেল! তেল! তেল! অকা-যোদ্ধার দেহ থেকে ভেসে আসছে তেলের গন্ধ!
খনিজ তৈলের মূল্যবান খনি আবিষ্কার করেছে এই বর্বর অকা, যুদ্ধে যাত্রা করার আগে সেই তেলে রং মিশিয়ে নকশা এঁকেছে নিজের সর্বাঙ্গে!
ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠল নোভাক।
অকারা যে অঞ্চলে বাস করে সেদিকে অনুসন্ধান চালালে হয়তো তেলের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। একমাত্র পনি ছাড়া এ বিষয়ে অন্য কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলে লাভ নেই। কিন্তু জিভাবো দলপতি এখন আহতদের শুশ্রূষা এবং মৃতদেহগুলি সকার নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত নোভাক বুঝল এই মুহূর্তে তাকে কৌতূহল সংবরণ করতেই হবে।
সে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তবু সকাল পর্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করলে। পরের দিন সকালে সে পনিকে সেই পাথরটা দেখিয়ে অকাদের আস্তানা কোথায় জানতে চাইল।
পনি বললে আক্রমণকারী অকা-যোদ্ধাদের গলায় এই ধরনের বালিপাথর ইতিপূর্বে সে বহুবার দেখছে কিন্তু ওই পাথর বা তেল তারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে তা সে বলতে পারে না।
পনির ধারণা অকাদের বাসস্থানের কাছেই আছে সেই তৈলভাণ্ডার। নোভাক ঠিক করলে এবার সে একাই তেলের সন্ধানে যাত্রা করবে।
পনিকে তার উদ্দেশ্য জানাতেই সে নোভাককে বারণ করলে। তার বক্তব্য হচ্ছে অকারা এমনই হিংস্র, আর এখন তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে। অতএব এখন অকাদের আস্তানায় গেলে বিদেশির মৃত্যু অবধারিত।
নোভাক স্থির হয়ে জিভারো দলপতির বক্তব্য শুনল কিন্তু নিজের সঙ্কল্প ত্যাগ করলে না। একদিন সকালে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে তৈল অভিযানে যাত্রা করলে। যাওয়ার আগে সে জিভারোদের কাছ থেকে আর একটা ধাক্কা খেল। গ্রাম ছেড়ে সে যখন চলে গেল কোনো জিভারো-যাদ্ধাই তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে এল না, এমনকী তার বউ ম্যাকানি পর্যন্ত একবার তার সামনে এসে দাঁড়াল না।
আগের দিন নোভাক ম্যাকানিকে বুঝিয়ে বলেছিল যে সে চলে যাচ্ছে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
ম্যাকানি নোভাকের ভাষা বুঝতে না পারলেও স্বামীর বক্তব্য ভালো ভাবেই বুঝেছিল।
এতদিনের মধ্যে নোভাক কখনও ম্যাকানির মুখে ইংরেজি ভাষা শোনেনি, যাওয়ার আগের দিন সে স্ত্রীর মুখে ইংরেজি শুনল- সেই প্রথম সেই শেষ!
শুধু দুটি কথা, নোভাক গোয়িং! (নোভাক যাচ্ছে)।
নোভাক আশা করেছিল যাওয়ার সময়ে নিশ্চয়ই ম্যাকানি তার সামনে এসে দাঁড়াবে কিন্তু তার আশা পূর্ণ হল না। সে গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে প্রবেশ করলে,
ম্যাকানি একবারও তার চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করলে না!…
৪. নোভাকের অরণ্যযাত্রা
আবার শুরু হল নোভাকের অরণ্যযাত্রা।
অন্যান্য বারের মতো এবারও তার খুব কষ্ট হতে লাগল।
আসন্ন বর্ষার ইঙ্গিত বহন করে ছুটে আসে কালো মেঘে, যখন তখন প্রবল বর্ষণে নোভাকের সর্বাঙ্গ হয়ে যায় জলসিক্ত।
জুতোর চামড়ায় জল শুষে শুষে চামড়া হয়ে উঠল শক্ত, তার পায়ে পড়ল বড়ো বড়ো ফোঁসকা। ফোঁসকাগুলোতে ধুলো লেগে নোভাকের অবস্থা হয়ে উঠল অতিশয় শোচনীয়।
একদিন জলে ভিজে অসুস্থ নোভাক বিশ্রাম নিতে বাধ্য হল। নদীর জলে ভালো করে পা ধুয়ে তাতে ওষুধ লাগিয়ে শুয়ে পড়ল। পা দুটোকে উঁচু করে সে পায়ের উপর গ্রহণ করলে সুর্যরশ্মির উত্তাপ এবং পর পর দুদিন একটুও হাঁটাহাঁটি করলে না। দুদিন বিশ্রাম নেবার পর তার পা ভালো হয়ে গেল। নতুন উদ্যমে শুরু হল তার অভিযান…
২৩ জানুয়ারি।
যাত্রা আরম্ভ করার এক সপ্তাহ পরে সে এসে দাঁড়াল একটা মস্ত নদীর ধারে- ম্যাপ দেখে সে বুঝল এটা কুরারে নদী।
কুরারে নদী চলে গেছে অকাদের আস্তানার ভিতর দিয়ে নোভাক মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠল, তার চেষ্টা অন্তত আংশিক ভাবে সফল হয়েছে।
সে এবার নতুন কায়দায় অনুসন্ধান-পর্ব শুরু করলে।
নদীর ধার দিয়ে বনের ভিতর পর্যন্ত আঁকাবাঁকা ভাবে সে প্রার্থিত বস্তুর সন্ধান করতে লাগল। তার সঙ্গে কম্পাস ছিল, কাজেই দিগভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না।
দিন দুই পরে হঠাৎ সে ইন্ডিয়ানদের দেখতে পেল।
তেলের সন্ধানে টহল দিতে সে যখন অরণ্যের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখনই তার দৃষ্টি পথে ধরা দিলে একটি ক্যানো এবং দুজন আরোহী। দুটি লোকই বর্গার সাহায্যে নদী থেকে মাছ ধরছিল। নোভাক ঘাস-জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে পড়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করলে, ক্ষিপ্রহস্তে বন্দুকে টোটা ভরে সে প্রস্তুত হল যুদ্ধের জন্য।
নৌকাটা নদীর বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল– সম্ভবত আরোহীদের দৃষ্টি ঘাস জঙ্গলের মধ্যে ভূমি শয্যায় লম্বমান নোভাককে আবিষ্কার করতে পারেনি।
ক্যানোর আরোহীদের দেহের গঠন ও চুল কাটার ধরন দেখে তাদের অকা বলেই মনে হল তবু অতদূর থেকে নোভাক খুব নিশ্চিত ভাবে রেড-ইন্ডিয়ান দুটির জাতি নির্ণয় করতে পারলে না।
সাবধানের মার নেই- অতএব নোভাক হাতের বন্দুক বাগিয়ে মাটির উপরে শুয়ে রইল। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষা করার পরেও যখন নদীর জলে কোনো ক্যানো দেখা গেল না তখন সে আবার তেলের সন্ধানে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলে।
সেদিন বিকাল বেলা নোভাক যখন আবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আর একটা নতুন পথ ধরে নদীর দিকে এগিয়ে আসছে তখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটা ভাঙা এরোপ্লেন বা বিমান-পোত!
বিমানটি নদীর অপর তীরে অকেজো অবস্থায় পড়ে ছিল।
নদী পার হয়ে নোভাক বিমানপোতের পাশে এসে দেখলে যন্ত্রটির অবস্থা নিতান্ত শোচনীয় তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দারুণ আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে অর্থাৎ এককথায় সেটি হচ্ছে একটি বিমানপোতের ভগ্নাবশেষ।
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে নোভাক বুঝলে যে ভারি অস্ত্র দিয়ে বারংবার আঘাত করে যন্ত্রটিকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
নোভাক হঠাৎ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল– ব্যাপারটা কি?
বিমানটি কি হঠাৎ অচল হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছে?
বিমান চালকেরই বা পাত্তা নেই কেন?
বিমানের যান্ত্রিক-দেহটাকে কারা এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে? জড় পদার্থের উপর আক্রমণকারীদের এমন আক্রোশের কারণই বা কি হতে পারে?….
বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা অশুভ চিন্তা তার মাথায় পাক দিয়ে উঠল, মনে মনে নিজেকেই বার বার অভিশাপ দিতে লাগল নোভাক নদীর ধারে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ানো তার উচিত হয়নি। অকাদের আক্রমণের কথা তার হঠাৎ মনে পড়ল- জিভারো যোদ্ধাদের উপর ছুটে এসেছিল অকাদের তিরগুলি অরণ্যের আড়াল থেকে, আর সেই অকা-যোদ্ধাদের ডেরার মধ্যেই সে দাঁড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়!
নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই সে মনে মনে গালাগালি দিলে।
কাঁধের বন্দুকটা হাতে নামিয়ে নোভাক ভাঙা বিমানের নীচে আশ্রয় গ্রহণ করলে এবং সেইখানে গুঁড়ি মেরে বসে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারদিকের ঝোঁপ-জঙ্গল।
একটা গাছের উপর ধাতু নির্মিত একটা ছোটো ঘর তার চোখে পড়ল। আর এক জায়গায় সে দেখলে অগ্নিকুণ্ডের ভস্মাবশেষ এছাড়া মানুষের বসবাসের কোনো চিহ্ন তার নজরে ধরা দিলে না।
কিন্তু…হঠাৎ তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেই গাছটির নীচে যার উপর ধাতু নির্মিত ঘরটি অবস্থান করছে–
একটা ঢিপি!
হ্যাঁ, একটা টিপি– কিন্তু ঢিপিটাকে দেখলে একটা কবর বলেই সন্দেহ হয়।
নোভাক এগিয়ে এসে টিপিটাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে। তার সন্দেহ সত্য ঢিপিটা আর কিছু নয়, একটা খুব সাধারণ কবর। নোভাকের মনে নানারকম প্রশ্ন জমা হল– কবরটা কাদের? কয়জন মানুষের প্রাণহীন দেহ শুয়ে আছে এই কবরের মৃত্তিকা-শয্যায়? লোকগুলির সঙ্গে এই বিধ্বস্ত বিমানপোতটির কি কোনো সম্পর্ক আছে?
কবরের আশেপাশে মানুষের পায়ের চিহ্ন দেখা গেল না। ঝড়বৃষ্টি ও সূর্যরশ্মি সব চিহ্নকে করে দিয়েছে লুপ্ত। তবু বারবার নোভাকের মনে হল অকাদের কথা কিছুতেই সে অশুভ চিন্তাটাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারলে না!
বিমানটির দুখানা ডানার মধ্যে মাত্র একখানা বর্তমান, সেই একটি মাত্র ডানার ছায়ায় বসে নোভাক চিন্তা করতে লাগল। তার ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, কিন্তু হাতের বন্দুক রইল তৈরি আর চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল প্রখর ও তীব্র…।
নোভাক ভাবছে, ভাবছে আর ভাবছে। সে যেন ছুটে চলেছে এক মরীচিৎকার পিছনে এই তৃষ্ণার্ত যাত্রার বুঝি আর শেষ নেই।
অরণ্যের এই অঞ্চলে হানা দিয়ে ফিরছে হিংস্র শ্বাপদ এবং হিংস্রতর মানুষ আর সেই মৃত্যুপুরীর মাঝখানে পদে পদে প্রাণ বিপন্ন করে ঘুরছে নোভাক– কিন্তু কেন?
একটা বন্য মানুষের তৈল-লিপ্ত দেহ এবং গলায় ঝোলানো একখানা বালিপাথরকে নিশানা করে সে এতদূর ছুটে এসেছে আশায় আশায়। আজ দুমাস হল সে তৈলখনির কোনো সন্ধানই পায়নি। ভবিষ্যতে যে পাবে তারই বা নিশ্চয়তা কী?
আর সে তেলের সন্ধান পাওয়ার আগেই যদি রক্ত-পিপাসু অকা-যোদ্ধারা তার সন্ধান পায় তাহলে ঘাড়ের উপর মাথাটাকে সে কি বজায় রাখতে পারবে?
নোভাক ঠিক করলে আর নয় যথেষ্ট হয়েছে, এবার সে সভ্য জগতে ফিরে যাবে মরীচিকা-লুব্ধ পথিকের মতো সে আত্মহত্যা করতে রাজি নয়।
গুঁড়ি মেরে নীচু হয়ে সে বিমানপোতের তলা থেকে বেরিয়ে এল, তার পর সেই অবস্থায় নদীর ধারে ধারে ঘন অরণ্যের ছায়ায় ছায়ায় যথাসম্ভব আত্মগোপন করে সে ছুটে চলল। দারুণ গরমে তার দেহ অবশ হয়ে এল, চোখে নামল ঘুমের আবেশ- কিন্তু নোভাক বিশ্রাম নিতে একটুও থামল না।
এখানে ঘুমিয়ে পড়লে যে কোনো মুহূর্তে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হতে পারে। খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলল নোভাক…
যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়!
নদীটা হঠাৎ যেখানে পাক খেয়ে ঘুরে গেছে ঠিক সেই জায়গায় নোভাক এসে পড়ল তাদেরই কাছে যাদের কবল থেকে পালাবার জন্যে সে এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে!
চারজন অকা নদীর ধারে তির-ধনুক দিয়ে মাছ শিকার করছিল। (রেড-ইন্ডিয়ানরা ধনুর্বিদ্যায় সিদ্ধহস্ত- জলের মাছকে তারা অনায়াসেই তির দিয়ে বিঁধে ফেলতে পারে) অকাদের ক্যানোটা নদীর ধারে বাঁক ঘুরে ছুটে আসতেই নোভাকের সঙ্গে তাদের চোখাচোখি হয়ে গেল। একজন অকা ধনুকের ছিলা টেনে নদীর জলে শর সন্ধান করছিল– মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাবে সে মাছের উপর থেকে নোভাকের উপর নিশানা সরিয়ে নিলে পরক্ষণে শন শন শব্দে ছুটে এসে তিরটা নোভাকের মাথার কাছে একটা গাছের গুঁড়িতে বিধে গেল।
নোভাক পরবর্তী তিরের জন্য অপেক্ষা করলে না, সে চটপট জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দুটো তির তৎক্ষণাৎ তাকে অনুসরণ করলে কিন্তু পলায়মান শিকারের দেহস্পর্শ করতে পারলে না। একটা গাছের আড়াল থেকে নোভাক দেখলে চারজনের মধ্যে তিনজন অকা পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে মেরে অরণ্যে প্রবেশ করলে আর একজন রইল ক্যানোর কাছে।
গাছের আড়াল ছেড়ে নোভাক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল।
তার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিল অনেকগুলি লতার বেড়াজাল। সেই ঘন সন্নিবিষ্ট লতার বন্ধন ভেদ করে নোভাক ছুটবার চেষ্টা করলে এবং পরক্ষণেই তার ধীর্ঘ দেহ সশব্দে আছড়ে পড়ল একটা কর্দমাক্ত জলাশয়ের মধ্যে!
কোমর পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নোভাক নিজের অবস্থা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে চারদিকে কর্দমাক্ত জল, আর সেই ঘোলাটে জলের ভিতর এখানে-ওখানে শিকড়বাকড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলি গাছ। বন্দুকটাকে বুক অবধি তুলে ধরলে নোভাক অস্ত্রটা জলে ভিজে অকেজো হয়ে গেলেই সর্বনাশ!…
কাঁধের বোঝাটা তার মাংসপেশীতে কেটে কেটে বসছে।
জলের মধ্যে তার দেহকে আক্রমণ করেছে রক্তপিপাসু জোঁকের দল, আর বোঁ বোঁ শব্দে রণ-সঙ্গীত গাইতে গাইতে তার মাথার উপর উড়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে মশা নোভাকের সর্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল জোঁক ও মশকের মিলিত আক্রমণে!
এইভাবে পদে পদে মৃত্যু-যাতনা সহ্য করার চাইতে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া অনেক ভালো- দাঁতে দাঁত দিয়ে নোভাক শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল…
তারা এল।
নোভাক শুনতে পেল লতার বন্ধন-জাল ভেদ করে তারা সশব্দে আসছে।
ডোবার মধ্যে একটা মরা গাছের গুঁড়ি পড়েছিল।
নোভাক সেই গাছটার উপর আশ্রয় নিলে…
একটু পরেই রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হল তিনজন অকা-যোদ্ধা। হাতের তিরধনুক বাগিয়ে তারা জলে নেমে পড়ল। বদ্ধ জলাশয়ের বুকে সশব্দ আলোড়ন তুলে তিনটি হিংস্র মানব-মূর্তি এগিয়ে এল নোভাকের দিকে।
আক্রমণকারীরা যখন প্রায় দশ গজ দূরে আছে তখন গর্জে উঠল নোভাকের বন্দুক। একজন অকা তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল কিন্তু ফলাফল দেখার জন্য নোভাক একটুও অপেক্ষা করলে না, চট করে ঝাঁপ দিলে জলের বুকে গাছের গুঁড়িটার গায়ে আরও অসংখ্য শিকড়বাকড়ের আড়ালে যথাসম্ভব গা-ঢাকা দিয়ে সে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে।
একটু আগে নোভাক যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাটায় গাছের গুঁড়িটাকে বিদ্ধ করে কেঁপে কেঁপে উঠছে একজোড়া তির!
সঙ্গীর মৃত্যুতে যোদ্ধা দুজন একটুও ভয় পায়নি, তারা আবার ধনুকের ছিলায় তির বসিয়ে নিলে।
আবার গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র পর পর দুবার। ধনুকধারী দুই অকা-যযাদ্ধার প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল জলার মধ্যে। একজনের ধনুক থেকে জ্যা-মুক্ত তিরে ছুটে গেল উপর দিকে, অদৃশ্য হয় গেল অসংখ্য বৃক্ষশাখা ও পত্রপল্লবের অন্তরালে…।
নোভাক বৃক্ষ কাণ্ডের আশ্রয় ত্যাগ করলে না– তার তিন শত্ৰু নিহত কিন্তু এখনও সে নিরাপদ নয়।
ক্যানোর কাছে নদীর ধারে আর একজন অকা-যোদ্ধার কথা সে ভোলেনি।
একটু পরে বদ্ধ জলাশয়ের এক প্রান্তে অনেকগুলো লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে একখানা মুখ দেখা দিলে চার নম্বর শত্রু।
নোভাক গুলি ছুড়ল– উপরি-উপরি দুবার অগ্নি-উদগার করলে তার বন্দুক।
অকা-যোদ্ধার গুলিবিদ্ধ শরীরটা ঝুঁকে পড়ল জলের উপর কিন্তু অজস্র লতার কঠিন আলিঙ্গন ভেদ করে মৃতদেহটা জলাশয়ের বক্ষ স্পর্শ করতে পারলে না উদ্ভিদের নাগপাশ তার প্রাণহীন শরীরকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখল।
নোভাক গাছের গুঁড়িটার উপর মাথা রেখে চোখ বুজে ফেললে। জলসিক্ত দেহে মশা আর জোঁকের আক্রমণের মুখেই সে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে তীব্র উত্তেজনায় তার স্নায়ুগুলি অবশ হয়ে পড়েছিল…
সশব্দে জল ভেঙে নোভাক ডাঙায় উঠল এবং অকাদের বেওয়ারিশ ক্যানোটাতে কাঁধের মালপত্র চাপিয়ে উঠে বসল। আশেপাশে যদি কোনো অকা যোদ্ধা লুকিয়ে থাকে তবে ফাঁকা নদীর বুকে তার শরীটা যে চমৎকার তিরের নিশানায় পরিণত হবে একথা বুঝতে নোভাকের মোটেই অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ক্লান্তিতে আর উত্তেজনায় তার শরীর তখন ভেঙে পড়ছে, অকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার ধৈর্য তার ছিল না বন্দুকটাকে তৈরি রেখে আন্দি পাহাড়ের নীচে অবস্থিত পার্বত্যভূমির দিকে সে দ্রুত নৌকা চালনা করলে…
কয়েকঘণ্টা ধরে একটুও না থেমে সে ক্যানো চার্লিয়ে গেল। মাঝে মাঝে দারুণ ক্লান্তি আর অবসাদে তার দুই চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছে তবু সে ঘুমায়নি– অবিরাম অবিরত নৌকা চার্লিয়েছে, এই অরণ্য-আবৃত সবুজ মৃত্যুপুরী থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে পড়া যায় ততই মঙ্গল। সারা রাত্রি ধরে সকাল পর্যন্ত সে প্রাণপণে বৈঠা চালাল তারপর আর পারলে না– বিকালবেলার দিকে সে ক্যানোটাকে নদীর তিরে ভিড়িয়ে দিলে।
অমানুষিক পরিশ্রমে তার হাত দুখানা তখন থর থর করে কাঁপছে।
নদীর ধারে ঘাস জমির উপর ক্যানোটাকে তুলে রেখে সে তার মালপত্রের বোঝা সমেত বন্দুকটাকে নিয়ে ধরাশয্যায় শুয়ে পড়ল এবং সেই অবস্থায় গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল…
কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে সে যখন জেগে উঠল তখন আঁটার জল সরে গিয়ে আবার নদীতে জোয়ার এসেছে। চারদিকে ব্যগ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও নোভাক ক্যানোটাকে দেখতে পেল না– সে বুঝল জোয়ারের জল তার একমাত্র অবলম্বন নৌকাখানাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে…
এবার আর জলপথে এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
অসহ্য কষ্টকর অরণ্যপথেই তাকে অগ্রসর হতে হবে।
নোভাকের চোখ ফেটে জল এসে পড়ল।
ম্যাপ দেখে তার ধারণা হল নদীর স্রোত যেদিকে চলে গেছে সেদিকে কয়েক মাইল হাঁটলেই নদীতীর থেকে ভিতরের দিকে ২০ মাইল দূরে আমেরিকানদের যে উপনিবেশ ও বিমানবন্দর আছে সেখানে সে উপস্থিত হতে পারবে। কোনো রকমে এই পথটা অতিক্রম করতে পারলেই সে নিরাপদ। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আর পথ চলার উপায় ছিল না কারণ তার ম্যাচেটা হারিয়ে গেছে। দুর্ভেদ্য লতার বেড়াজাল ম্যাচেট দিয়ে না কেটে পথ চলা অসম্ভব- নোভাক নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে শুরু করল…
অসহ্য গরম আর অবসাদে তার চোখের পাতা ফুলে উঠল, বার বার বুজে এল তার দুই চোখ তবু নোভাক একবারও বিশ্রাম নেবার জন্যে থামল না। দুবার তার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটল, দুদুবার তার চোখের সামনে ভেসে উঠল মরীচিকা!
প্রথমবার সে দেখলে শিশুক্রোড়ে একটি নারী এগিয়ে চলেছে।
নোভাক চিৎকার করে তাকে আহ্বান জানালে আর সঙ্গেসঙ্গে নারীমূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল!
দ্বিতীয় বার সে দেখলে হলুদ চামড়ার পোশাকে সজ্জিত হয়ে একটি লোক হাঁটছে, তার পিঠে বাঁধা আছে একটা মস্ত বড়ো কড মাছ!
এবার আর নোভাক মরীচিৎকার মায়ায় বিভ্রান্ত হল না, মাথা নীচু করে সে লোকটির পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল– এমনকী একবার পিছন ফিরে সে মৎস্যের অধিকারীকে দেখার চেষ্টাও করলে না।
…সন্ধ্যার ধূসর অরণ্যকে লুপ্ত করে নেমে এল কৃষ্ণা রজনীর যবনিকা… পথের উপর বসে পড়ল নোভাক, তার শুষ্ক কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে এল অবরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি– দূরে উপনিবেশের কুটিরগুলিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতারের পাহারা, বাতায়ন পথে ছড়িয়ে পড়েছে আলোর উজ্জ্বল ইশারা— অন্ধকার রাত্রির বুকে!
মুক্তির আনন্দে অনেকক্ষণ ধরে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল, তারপর কাঁধের বোঝাটাকে ছুঁড়ে ফেলে সে ছুটে গেল কাঁটাতারের বেড়ার দিকে, সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, এই! এই! এদিকে এস।
চটপট নিভে গেল সবগুলি আলো, অন্ধকার কুটিরের দ্বারে দ্বারে আবির্ভূত হল কয়েকটা চলন্ত ছায়ামূর্তি!
এই! এই! এদিকে! আবার চেঁচিয়ে উঠল নোভাক। সঙ্গেসঙ্গে অন্ধকারের গর্ভে এখানে-সেখানে জ্বলে উঠল কয়েকটা চকিত অগ্নিশিখা– ডান দিকের কাঁধে একটা অসহ্য যন্ত্রণা বোধ করলে নোভাক, ছিটকে মাটিতে পড়ে যেতে সে শুনতে পেল যান্ত্রিক কণ্ঠের কর্কশ গর্জন!
আঃ! সে রুদ্ধস্বরে আর্তনাদ করে উঠল, ওরা আমায় গুলি করল!
নোভাক বুঝতে পারলে ধীরে ধীরে তার জ্ঞান লুপ্ত হয়ে আসছে, ভগ্নকণ্ঠে সে একবার বললে, আমাকে গুলি করছ কেন?
তারপরই তার মাথাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
কাঁটা তারের বেড়ার ভিতর দিয়ে খুব সাবধানে কয়েকজন বন্দুকধারী বাইরে বেরিয়ে এল। বন্দুকের নল দিয়ে খোঁচা মেরে মেরে তারা নোভাকের শরীরটাকে পরীক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ একজন চিৎকার করে বললে, আরে! আরে! এ যে সাদা চামড়ার মানুষ!
তৎক্ষণাৎ অনেকগুলি মনুষ্যমুর্তি তার উপর ঝুঁকে পড়ল।
রক্তাক্ত শার্টটা খুলে নিয়ে কয়েকটা হাত সেই জামাটা দিয়েই তার রক্ত মুছিয়ে দিতে শুরু করলে।
মাফ করো, একটা কণ্ঠস্বর নোভাকের কানে এল, আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি। আমরা তোমাকে অন্ধকারে অকা-যোদ্ধা বলে ভুল করেছিলুম। অকাদের ভয়ে আমাদের মাথার ঠিক নেই।
হ্যাঁ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আগে নোভাক শুধু একটা কথাই বলতে পেরেছিল, আমি জানি। অকাদের আমি জানি।
ওই কথাটা বলেই নোভাক অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল…
উপনিবেশের মানুষগুলির সেবা-যত্নে কিছুদিনের মধ্যেই নোভাক সুস্থ হয়ে উঠল। যে উড়োজাহাজটাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় সে দেখেছিল তার ইতিহাসও সে জানতে পারলে। কয়েকজন পাদরি ওই বিমানে চড়ে অকাদের দেশে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেও অকাদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেন।
অকারা প্রথম কয়েকদিন কিছু বলেনি কিন্তু পরে তারা সবাইকে হত্যা করে। বিমানটিকেও তারা ধ্বংস করে দেয়। পরে একদল সৈন্য বিমানপথে ঘটনাস্থলে যায় এবং হতভাগ্য ধর্মপ্রচারকদের মৃতদেহগুলিকে কবরস্থ করে। পাছে তাদের উপর শ্বেতাঙ্গরা আক্রমণ চালায় সেই ভয়ে অকারা গ্রাম ছেড়ে আরও দক্ষিণ দিকে সরে যায়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা হানা দিতে শুরু করলে উপনিবেশের উপর সন্ত্রান্ত নাগরিকরা তাই সর্বদা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিতে লাগল। এই সঙ্গীন মুহূর্তেই নোভাক এসে পড়েছিল উপনিবেশে আর তাই তার এই দুর্দশা…
কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে নোভাক আকাশ পথে উড়ল। উপনিবেশের বিমানবন্দর থেকে একখানা বিমান তাকে পৌঁছে দিলে সেই কুইটো শহরে– যেখান থেকে সে প্রথম যাত্রা শুরু করেছিল।
সভ্য জগতের সংস্পর্শে এসে নোভাক নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল।
বিগত কয়েকটা মাস যেন কেটে গেছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো। তবু অনেক দুঃখের মধ্যেও একটু সুখ, অনেক গরলের সঙ্গে একটু অমৃতের স্বাদও ছিল–
রক্তারক্তি, হানাহানি, ছিন্ন নরমুণ্ডের বীভৎস উৎসব আর তৈল অভিযানের ব্যর্থতা ছাপিয়েও একটুখানি আনন্দের স্মৃতি নোভাকের মনে দাগ কেটেছিল, একটি অস্পষ্ট নারীমূর্তি বারংবার এসে দাঁড়িয়েছিল তার স্মৃতির মণিকোঠায় ম্যাকানি, তার জিভারো বউ!