• আমাদের সম্পর্কে
  • যোগাযোগ
  • গোপনীয়তা নীতি
শুক্রবার, মার্চ 31, 2023
  • Login
BnBoi
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ
No Result
View All Result
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ
No Result
View All Result
BnBoi
No Result
View All Result
  • বইয়ের নামঃ দেবী দর্শন
  • লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
  • বিভাগসমূহঃ গল্পের বই

১. সুর এবং অসুর

দেবী দর্শন

প্রথম পরিচ্ছেদ – সুর এবং অসুর

আজ থেকে দু-শো বছর আগেকার কথা। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে অবাধে চলছে ডাকাতি, চলছে লুঠতরাজ। ইংরেজের পুলিশ ও সেনাবিভাগ মাঝে মাঝে দস্যুদের পাকড়াও করার চেষ্টা করছে, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারছে না। সেযুগের লোক পুলিশি ব্যবস্থার উপর খুব  বেশি আস্থা রাখতে শেখেনি, তার চেয়ে বেশি ভরসা করত তারা জোয়ানের হাতের লাঠির উপর। তারা জানত বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় শক্তিই একমাত্র যুক্তি…।

চৈত্রমাস। ভুবনডাঙা গ্রামটা শেষ হয়ে যে মস্ত মাঠটা চোখে পড়ে, রোদের তেজে সেদিকে আর তাকানো যায় না। মাথার উপর আগুন ছড়িয়ে হাসছে চৈত্রের প্রখর সূর্য–জ্বলছে আকাশ, জ্বলছে বাতাস আর সেই জ্বলন্ত নরকে যোগ দিতে মাঝে মাঝে ছুটে আসছে পাগলা হাওয়ার ঘূর্ণি ঝড়, সঙ্গে উড়িয়ে আনছে যত রাজ্যের আবর্জনা, শুকনো পাতা আর ধুলোবালি…

মাঠের শেষে যে-জঙ্গলটা শুরু হয়েছে, সেখানে প্রবেশ করলে অবশ্য আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু মাঠের বুকে, খাঁজে খাঁজে ও গর্তের মধ্যে যে বুকে-হাঁটা জীবগুলো বাস করে, তারা সবাই এসে এখন আশ্রয় নিয়েছে ঠান্ডা জঙ্গলের মধ্যে; তাদের কথা মনে পড়লেই ক্লান্ত পথিকের বিশ্রাম নেওয়ার ইচ্ছা আর থাকে না–কারণ, যদিও দিনের বেলা এত গরমে তাদের বাইরে আসার নিয়ম নেই, তবু দু-একটি অবাধ্য নাগসন্তান যদি হঠাৎ কোনো বেআইনি কাজ করে ফেলে তবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ফুরসত হবে না–

ওর নাম সাপ, ঠেকালেই সোনা!

শুধু তাই নয়; এই ছোটো জঙ্গলের মধ্যে অতিকায় বিড়ালগুলি দিনমানেও বেড়াতে আসে–যাদের গাঢ় কমলা-হলুদ চামড়ার উপর কালো কালো গোল ছাপগুলি গাছের ছায়ায় ছায়ায় ঝোপঝাড়ের মধ্যে মিশে যায়, যাদের মখমল-কোমল পায়ের গদিতে লুকিয়ে থাকে ছুরির চেয়েও ধারালো বাঁকা বাঁকা নখ–হঠাৎ মানুষের সামনাসামনি পড়ে গেলে তারা গেরস্ত বাড়ির মিনি কিংবা পুষির মতো চুপচাপ সরে পড়বে এমন কথা বলা যায় না

চিতাবাঘ বড়ো হিংস্র জানোয়ার।

তবু এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লোক চলাচল করে, করতে বাধ্য হয়। কিন্তু শখ করে কোনো মানুষ ওই জ্বলন্ত নরক পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে সংগীতচর্চা করতে আসবে এমন উৎকট কথা চিন্তা করা যায় না।

হ্যাঁ, শখটা উৎকট হলেও নীলকণ্ঠের গলাটা উৎকট নয়, মধুর মতো মিষ্টি।

এইখানে নীলকণ্ঠ নামে মানুষটির একটু পরিচয় দরকার। তার বাপ ছিল মস্ত জোয়ান। হাতে লাঠি নিয়ে হাঁক ছাড়লে এক-শো মরদের বুক চমকে উঠত। তার ভয়ে ভুবনডাঙার জমিদারবাড়িতে কখনো ডাকাতি হয়নি।

লাঠিয়ালের-বংশ; বাঘের বাচ্চা বাঘ। মা-মরা ছেলে নীলকণ্ঠ বাপের কাছে তালিম নিয়ে বড়ো হল। বারো বছরের ছেলের হাতে শিস দিয়ে ঘুরত লাঠি, ছুরির ফলায় চমকে উঠত বিদ্যুৎ পাকা জোয়ান চোখে সরষের ফুল দেখত, আচ্ছা-আচ্ছা মরদ পিছিয়ে আসত ভয়ে।

ভয় শুধু তার অস্ত্রকে নয়, হাতিয়ার হাতে নিলেই ছেলেটার চোখ-মুখ কেমন বদলে যেত–সে যেন সবার পরিচিত নীলে নয়, এ আর এক নীলকণ্ঠ! তখন তার শরীরটা কুঁকড়ে যেত, উজ্জ্বল চোখ দুটো হয়ে পড়ত ম্লান, নিষ্প্রভ।

মাঝে মাঝে খেলা থামিয়ে বাপ হুংকার দিয়ে উঠত, এই বেটা নীলে, হতভাগা খুনে– ফেলে দে লাঠি, ফেল বলছি।

বাপের চোখের দিকে তাকিয়ে হাতিয়ার ফেলে দিত নীলকণ্ঠ আর তার সমস্ত শরীর কাপত থর থর করে মনে হত একটা দুরন্ত ঝড় অধীর আগ্রহে মুক্তি চাইছে তার দেহের ভিতর থেকে, ব্যর্থ আক্রোশে দাপাদাপি করছে তার বুকের মধ্যে!

সর্দারের অন্য শাগরেদরা বলাবলি করত, এই ছেলে বড়ো হয়ে বাপকেও ছাড়িয়ে যাবে।

সেই কথা শুনে বদন লাঠিয়ালের বুক গর্বে ফুলে ওঠার কথা কিন্তু উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্দার শুধু অন্যমনস্ক হয়ে যেত, দাড়িতে হাত বুলিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলত, হু।

নীলকণ্ঠ নামটারও একটা ইতিহাস আছে। বদন সর্দারের ছেলের নাম মদন হওয়াই স্বাভাবিক, বড়জোর অর্জুন হতে পারে–নীলকণ্ঠ হয় না। ওই নাম রেখেছিলেন বৃন্দাবন ঠাকুর গ্রামের পুরোহিত, শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ। তিনি বলেছিলেন, ওরে ও যখন গান গায়, তখন ওর চোখ দুটো দেখেছিস?… ওই চোখ লাঠিয়ালের চোখ নয়, খুনির চোখ নয়–ওই চোখ উদাস বাউলের। বিষ পান করে মহাদেব নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন, আমি ওর নাম রাখলুম নীলকণ্ঠ।

তাই পাঁচ বছরের অর্জুন নাম বদলে একদিন নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। কিন্তু দেবতার নামে নাম রাখলেই মানুষ দেবতা হয়ে যায় না। যুগ যুগ ধরে যে হিংস্র বিষাক্ত রক্ত আশ্রয় নিয়েছে নীলকণ্ঠের দেহে, সাধ্য কী সেই বিষ সে হজম করে? হাতিয়ার হাতে পড়লেই ছেলেটা বদলে যেত, ভাববিভোর বাউলের কণ্ঠে গর্জে উঠত বনের বাঘ–জিগির দিয়ে বারো বছরের ছেলে যখন খেলার মাঠে লাঠি হাতে লাফিয়ে পড়ত, তখন বদন সর্দারের সেরা শাগরেদ করিমের বুকটাও একবার চমকে উঠত।

সেই নীলকণ্ঠ বদলে গেল। বাপের মৃত্যুর পর হঠাৎ বদলে গেল নীলকণ্ঠ। মানুষ বদলায়, কিন্তু এমন আকস্মিক পরিবর্তন ভাবা যায় না। যাত্রার দলে কেষ্ট সেজে গান গেয়ে বেড়ায়। নীলকণ্ঠ, হাঁটুর কাপড় নেমে আসে গোড়ালির দিকে, গায়ে ওঠে ফিনফিনে ফতুয়া, বেনিয়ান, অথবা চাদর–আর পায়ে জুতো। আঠারো বছরের নীলকণ্ঠকে কেউ খালি গায়ে দেখেনি, তার নাকি লজ্জা করে।

গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ভালোবাসে; বাড়িতে ডেকে গান শুনতে চায়। জোয়ান ছেলেরা সামনাসামনি টিটকারি দেয়, বলে, এ যেন বাঘের ঘরে ভেড়ার ছানা। বদন-সর্দারের নাম ডোবাল ছেলেটা।

নীলকণ্ঠ প্রতিবাদ করে না, মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে সরে যায়…

এই হল নীলকণ্ঠ নামে মানুষটির পরিচয়। চৈত্রমাসের সেই আগুন ঝরা দুপুরে বনের মধ্যে একটা গাছের ছায়ায় বিভোর হয়ে গান গাইছে ঘোর শাক্ত বংশের ছেলে নীলকণ্ঠ, কে যায়, বৃন্দাবনের কুঞ্জপথে কে যায় গো, কনক বরণী কে অভি–

আচম্বিতে সংগীত সাধনায় বাধা দিয়ে একটা তীব্র শিসের শব্দ বেজে উঠল কর্কশ ঝংকারে, রিক-রিক-চুঁঈঈ!

ভীষণ চমকে দুই হাতে কান চেপে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, উঃ! কে রে? জঙ্গল ঠেলে নীলকণ্ঠের সামনে যে-লোকটি লাঠি হাতে আত্মপ্রকাশ করল, তার চেহারা দেখে আর বলে দিতে হয় না সে কেমন মানুষ। চোখের দৃষ্টি উগ্র রক্তিম, দক্ষিণ জ্বর উপর থেকে কপালের মাঝ বরাবর চলে গেছে একটা শুষ্ক ও গভীর ক্ষতচিহ্নের রেখা, ঠোঁটের দু-পাশে কামড় দিয়ে একজোড়া মস্ত গোঁফ সরু হয়ে উঠে গেছে গালের দিকে আর মাথার উপর থেকে ঘাড়ের উপর বাবরি হয়ে নেমে এসেছে লম্বা চুলের রাশি। আড়ে-বহরে মানুষটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু তার কঠিন স্থূল মাংসপেশিগুলির মধ্যে যে জান্তব শক্তি লুকিয়ে আছে এক নজরেই তা ধরা পড়ে যায়।

লোকটির নাম বাঘা মৃত বদন সর্দারের এক প্রিয় অনুচর, জমিদার কালীচরণের বেতনভোগী লাঠিয়াল।

হা হা শব্দে হেসে উঠে বাঘা বলল, কীরে নীলে, কান দুটো ফেটে গেল নাকি?

কুঞ্চিত মুখে নীলকণ্ঠ বলল, ঝামেলা থেকে বাঁচতে জঙ্গলে পালিয়ে এলাম, এখানেও জ্বালাতে এসেছিস?

তা আমি কী করব? বাঘা বলল, কত্তামশাই বললেন–যেখান থেকে পারিস নীলেকে এখনই নিয়ে আয়।

কেন রে?

সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করিস। আমি কী করে জানব?

তা বটে। আচ্ছা চল।

নীচু হয়ে মাটি থেকে কী যেন তুলে নিল নীলকণ্ঠ। ওটা কী রে? বাঘার গলায় স্পষ্ট বিদ্রূপ, বাঁশি নাকি?… সত্যি নীলে, তুই একেবারে না-মরদ হয়ে গেছিস।

নীলকণ্ঠের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার হেসে ওঠে বাঘা, কী হয়ে গেছিস তুই যাত্রা করিস, বাঁশি বাজাস, গান করিস ইনিয়েবিনিয়ে, গায়ে অষ্টপ্রহর জামা চড়িয়ে রাখিস ছি, ছি, ছি, কে বলবে তুই বদন লাঠিয়ালের বেটা।

হেসে নীলকণ্ঠ মাঠের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে ভেসে আসে বাঘার তিক্ত কণ্ঠস্বর, বো বামুনই তোর মাথাটা খেল নীলু।

একটা কালো ছায়া পড়ে নীলকণ্ঠের মুখে? কয়েকটা কঠিন রেখা কি ফুটে ওঠে কপালে, চোখের তলায়, আড়ষ্ট চোয়ালের ভাঁজে ভাঁজে?..

পিছন থেকে ওই পরিবর্তন বাঘার চোখে পড়েনি, পড়লে সে সাবধান হত। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘার মুখোমুখি যখন কথা বলে নীলকণ্ঠ, তখন তার মুখ স্বাভাবিক, ঠোঁটের তরল হাসিটিও আবার ফিরে এসেছে যথাস্থানে, তোর বড়ো ভুললামন বাঘা, ঠাকুরের পুরো নামটা মনে রাখতে পারিস না। ঠাকুরের নাম বেন্দা নয়, শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর।

লে, লে, চল, ওই হল, অপরিসীম অবজ্ঞায় হাতটা একবার শূন্যে ঘুরিয়ে আনল বাঘা, তোকে আর যাত্রার বক্তিমে করতে হবে না।

স্থির চোখে কিছুক্ষণ বাঘার দিকে তাকিয়ে থাকে নীলকণ্ঠ, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, মাইরি বলছি বাঘা, মাঝে মাঝে আমার রাগ হয়ে যায়। যাক, আজ চলি–শুনে আসি কর্তামশাই কেন ডাকছেন।

তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাটির উপরে সশব্দে থুথু ফেলে বাঘা লাঠিয়াল, রাগ হয়ে যায় রাগ হলে তুই কী করবি রে? এক চড় মারলে আর এক চড় মারার জায়গা থাকে না, তোর রাগের ভয়ে আমি ইঁদুরের গর্তে নুকুব?… নেহাত বদন সর্দারের বেটা, তাই কিছু বলি না।

 ২. বাঘের বাচ্চা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — বাঘের বাচ্চা

জমিদার কালীচরণ পায়চারি করছিলেন ঘরের মধ্যে। জানালাগুলো একেবারে হাট করে খোলা নেই–আবছা আলো-আঁধারির মধ্যেও বোঝা যায় প্রৌঢ় মানুষটি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।

বাইরে থেকে একটা গলা খাকরানির আওয়াজ এল। ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে কালীচরণ হাঁকলেন, কে?

আজ্ঞে আমি।

কে? নায়েব মশাই?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আসুন, ভিতরে আসুন।

ঈষৎ শীর্ণ বিরলকেশ নায়েব অঘোর বসু ঘরে ঢুকলেন, কিছু বলতে গেলেন, কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে আর একটা গলা সাড়া দিল, আজ্ঞে কর্তা, আমিও এসেছি।

এসেছেন? তা, বেশ করেছেন, কালীচরণের মুখে হাসির রেখা ফুটল, অনুগ্রহ করে গৃহে পদার্পণ করুন।

হেঁ, হেঁ, একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল নীলকণ্ঠ, অমন করে বলবেন না কর্তামশাই, আমার অপরাধ হয়। তা, এমন অসময়ে তলব কেন?

হ্যাঁ, হুজুর, নায়েবমশাই বললেন, আমাকেও বাঘা বাড়িতে খবর দিয়েছে। ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার? একটু হাসলেন কালীচরণ, একটা চিঠি এসেছে।

আজ্ঞে, চিঠিপত্তর রাজা লোকের ঘরে তো আসবেই, তাই জন্যে এই আঁ আঁ রোদ্দুরে তলব?… ওঃ, গা যেন জ্বলে গেছে।

কালীচরণ চটে উঠলেন, কথা শুনুন নায়েবমশাই। বদন সর্দারের বেটা তার গায়ে রোদ লাগলে ননীর শরীর গলে যায়। আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কি এমন সর্বনাশ হয়?

কী গেরো! নীলকণ্ঠ বেশ বিব্রত, কথায় কথায় ধান ভানতে শিবের গীত কেন? রাজা-গজার বাড়িতে চিঠি আসতেই পারে, তাতে বাবার কথা ওঠে কী করে? আর এতে সর্বনাশই-বা হবে কেন?

কালীচরণের হাত দুটো বরাবর পিছনদিকেই ছিল–খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন নীলকণ্ঠের দিকে, তারপর হঠাৎ ডান হাতটা ঘুরিয়ে আনলেন সামনে।

একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল নায়েব অঘোর বসুর গলা থেকে, সর্বনাশ!

কালীচরণের ডান হাতে রয়েছে একটা তির, তিরের সঙ্গে কালো সুতোয় বাঁধা একটা পাকানো চিঠি।

হাতটা সামনে বাড়িয়ে কালীচরণ বললেন, নীলে, তুই তো বৃন্দাবন ঠাকুরের কাছে লেখাপড়া শিখেছিস, পড়ে দেখ।

আজ্ঞে ওতে আর পড়ে দেখার কী আছে, খুব ঠান্ডা গলায় বলল নীলকণ্ঠ, তিরের নিশানা দেখেই বুঝেছি দেবী চৌধুরানির পত্র এসেছে। তা কত টাকা চেয়েছেন মা-ঠাকরুন?

তার কথার জবাব না-দিয়ে কালীচরণ বললেন, নায়েবমশাই চিঠিটা আপনি পড়ুন।

নায়েব অঘোর বসু চিঠিটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় পড়তে লাগলেন—

শ্ৰীশ্ৰীকালীচরণ চৌধুরী সমীপেষু
মহাশয়, দরিদ্র নারায়ণের সেবার জন্য আমি আপনার নিকট সামান্য কিছু অর্থ ভিক্ষা করিতেছি। বর্তমানে মাত্র হাজার দশেক হইলেই চলিবে। এই সামান্য অর্থ আপনার ন্যায় মহাশয় ব্যক্তির নিকট কিছুই নহে। যদি অদ্য নিশীথে রাত্রি বারো ঘটিকায় ঠ্যাঙাড়ের মাঠ নামক স্থানে অবস্থিত প্রাচীন বটবৃক্ষের তলায় পূর্বোক্ত অর্থ আপনি বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে প্রেরণ করেন, তাহা হইলে অতিশয় বাধিত হইব। উক্ত ব্যবস্থায় যদি আপনার বিশেষ অসুবিধা থাকে, তবে আমি স্বয়ং মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎপূর্বক ভিক্ষা লইয়া আসিব। অধিক কী লিখিব? আপনি আমার অভিবাদন গ্রহণ করিবেন।
ইতি– দেবী চৌধুরানি

চিঠি পড়া হলে মাছের মতো বোরাচোখে তাকিয়ে রইলেন নায়েবমশাই। স্তব্ধতা ভঙ্গ করল নীলকণ্ঠ, চিঠিটা আপনার হাতে এল কেমন করে কর্তামশাই?

একটু আগে বাড়ির একটা চাকর চিঠিটা দিয়ে গেল। দাওয়ার উপর সে কাপড় শুকোতে দিচ্ছিল, কোথা থেকে উড়ে এসে তিরটা তার সামনে মাটিতে বিধে গেল। ওই তির দেখেই লোকটার প্রাণ উড়ে গেছে। তিরের মুখে চিঠি যে দেবী চৌধুরানির নিশানা সে-কথা আজ দেশসুদ্ধ লোক সবাই জানে। চাকরটা কাঁপতে কাঁপতে এসে চিঠিটা আমায় দিয়ে গেছে।

যাই হোক, নায়েবমশাই বললেন, টাকাটা তো এখন দিতেই হবে। কি বলেন হুজুর?

কালীচরণ কিছু বলার আগেই নীলকণ্ঠ বলে উঠল, লাও কথা! টাকা কি খোলামকুচি? চাইলেই দিতে হবে?

কুঞ্চিত চক্ষে কালীচরণ বললেন, না-দিয়ে উপায় কী?

এটা আপনি কী কইছেন কর্তা? নীলকণ্ঠ বলল, দেবী আসছেন আপনার গৃহে, তুচ্ছ টাকা দিয়ে কি আমরা তাকে অপমান করতে পারি? আমরা বরং ফুল-চন্দন সাজিয়ে তাকে বরণ করব, বলব–মাগো, তুচ্ছ টাকা দিয়ে তোমায় আমরা অপমান করতে পারি না। আজ ভক্তের পুজো নিয়ে যাও। ভক্তির ধাক্কা যদি সামলাতে পারো, তাহলেই প্রণামীর দশ হাজার টাকা তোমার চরণে সমর্পণ করব।

কালীচরণ কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রইলেন, তারপর হো হো শব্দে হেসে উঠলেন, হতভাগা যাত্রার দলে ঢুকে উচ্ছন্নে গেছিস। সব ব্যাপারেই ঠাট্টা, লঘুগুরু জ্ঞান নেই?… না, না, নীলকণ্ঠ তোর বাপ বেঁচে থাকলেও কথা ছিল–টাকা আমি দেব, গোলমালে কাজ নেই।

নায়েবমশাই আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু হুজুর, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

হুজুর মুখ খোলার আগেই নীলকণ্ঠ বলে উঠল, এত সহজ কথাটা বুঝলেন না নায়েবমশাই? দেবী চৌধুরানিকে আজ সারাদেশের লোক ভক্তি করে। যাকে বলে ভয়ে ভক্তি। আমরা যদি তাঁকে ঠিকমতো আপ্যায়িত করতে না-পারি, তাহলে লোকে বলবে জমিদার কালীচরণ মানীর মান রাখতে জানে না। এখন দেবীকে তো শুধু-মুখে প্রণামীর টাকা ধরে দেওয়া যায় না, কর্তামশাই তাকে পুজো দেবেন লাঠি, তলোয়ার আর সড়কির ফলায় আমরা তবে আছি কী করতে?

আছি কী করতে! ভেংচে উঠলেন নায়েবমশাই, এমতাজ, করিম আর বাঘা ছাড়া লাঠি ধরতে কে জানে এখানে? এ কি প্রজা ঠেঙানো? এর নাম দেবী চৌধুরানি। তার সঙ্গে আসবে খুনে ডাকাতের দল–বুঝলি? গান গেয়ে আর বাঁশি বাজিয়ে তাদের ঠেকানো যাবে না।

ওই তো ভুল করলেন নায়েবমশাই। নীলকণ্ঠ কি খালি বাঁশি বাজাতে জানে? হাত দুটো চিতিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, দরকার হলে সে কেমন বাঁশও হাঁকরাতে পারে একবার দেখুন।

কালীচরণ এতক্ষণ কোনো কথা বলেননি, চুপ করে ছিলেন। এখনও তিনি কিছু বললেন না। শুধু তার দুই চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠল।

নায়েবমশাই কী বলতে গেলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে নীলকণ্ঠ কর্কশ স্বরে বলল, আপনি থামুন নায়েবমশাই। যা বলার কর্তামশাই বলুন।

নায়েবমশাই ভীষণ চটে কী যেন বলতে গেলেন, কিন্তু আবার বাধা পড়ল–কালীচরণ এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে, নীলে, তোর সাহস আছে বুঝলাম। কিন্তু কাজিয়া-দাঙ্গায় কাজ নেই বাবা

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, তোর বাপের আর ছেলেপুলে নেই, তোর কিছু হলে আমার বুকে শেল বাজবে।

নীলকণ্ঠ ক্ষুণ্ণ হয়ে বলল, তবে আর আমায় ডাকলেন কেন?

টাকাটা তোকেই দিয়ে আসতে হবে। বাঘা, করিম ওদের বিশ্বাস নেই। বেটাদের খুন তো গরম হয়েই আছে, হয়তো দাঙ্গা বাধিয়ে দেবে।

কর্তামশাই, নিজের হাতে ডাকাতের হাতে টাকা তুলে দেবে?রুদ্ধ আক্রোশে নীলকণ্ঠের গলার স্বর আটকে যায়, আপনি কী বলছেন কর্তা?

আরে সেইজন্যই তো তোকে ডাকা হল, নায়েব অঘোর বসুর বিদ্রূপ অতিশয় স্পষ্ট, যার যা কাজ।

নায়েবমশাই, ঘুরে দাঁড়াল নীলকণ্ঠ, আপনি মরদের মন বোঝেন না। কর্তামশায়ের হুকুম নিজের হাতে লুঠেরার হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। তাই দেব। আমরা তো হুকুমের চাকর তাই দেব। কিন্তু আপনি আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে এস না নায়েবমশাই। মন-মেজাজ ভালো নেই, কী হতে কী হয়ে যাবে।

নীলকণ্ঠের মুখের দিকে তাকিয়ে নায়েবের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল–এই নীলকণ্ঠ পরিচিত নীলে নয়, এই মানুষ অন্য মানুষ, একে চোখ রাঙানো চলে না, ধমক দেওয়া চলে না–নায়েব মশাই-এর মনে হল তার চোখের সামনে ফণা তুলে একটা গোখরো সাপ হিংস্র আক্রোশে দুলছে আর দুলছে!

সত্যিই নীলকণ্ঠ টলছিল। কালীচরণের দিকে না-তাকিয়েই সে রুদ্ধস্বরে বলল, কর্তামশাই, আমি রাত্রে আসব। টাকা তৈরি রাখবেন।

তারপরই সে দ্রুতপদে বেরিয়ে গেল খোলা দরজা দিয়ে। কালীচরণ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, নায়েবমশাই, নীলেকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম.. বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, ছাগল হয় না।

৩. নির্মোকমুক্ত নিশাচর

তৃতীয় পরিচ্ছেদ — নির্মোকমুক্ত নিশাচর

অন্ধকার মেঠো পথে লম্বা লম্বা পা ফেলে যে-মানুষটা এগিয়ে চলেছে, তার মুখ দেখতে না-পেলেও চেনা মানুষের ভুল হওয়ার কথা নয়–

পথিকের পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র কণ্ঠস্বর। নীলে-এ এ, এই নীলে-এ-এ-এ!

আঃ, কী ঝামেলা, পথিক থমকে দাঁড়াল, এত চেঁচাচ্ছিস কেন বাঘা?

অন্ধকার পথের উপর এগিয়ে এল একটি ছায়ামূর্তি অর্থাৎ বাঘা

কর্তামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিস?

করেছি।

বেশ, বেশ। তা চাদর মুড়ি দিয়ে চলেছিস কোথায়?… আরে! তোর হাতে একটা থলে রয়েছে না! দেখি তো কীসের থলে?

বাঘা, নিজের চরকায় তেল দে। এদিকে হাত বাড়াবি না।

কী এত বড়ো কথা! বাঘা এগিয়ে এসে নীলকণ্ঠের থলি সমেত ডান হাত সজোরে চেপে ধরল, দেখি, তোর থলেতে কী আছে?

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল নীলকণ্ঠ। তার বাঁ-হাত তলোয়ারের মতো কোপ মারল বাঘার ঘাড়ে। অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ল বাঘা। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে সে বসেই রইল, তারপর সন্তর্পণে ঘাড়টা মালিশ করতে লাগল…

থলিটা মাটিতে নামিয়ে কঠিন স্বরে নীলকণ্ঠ বলল, উঠে আয় বাঘা। আজ দেখব তুই কেমন মায়ের দুধ খেয়েছিস।

বাঘা ওঠার চেষ্টা করল না, শুধু মাথা নাড়ল, ক্ষ্যামা দে নীলে। উরে বাপ–আমার মাথা ঘুরছে, চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

খুব লেগেছে? নীলকণ্ঠের গলায় ক্রোধের আভাস ছিল না, মালিশ করে দিচ্ছি, এখনই ঠিক হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ মালিশ করার পর বাঘা বলল, ছেড়ে দে নীলে। এখন ভালো লাগছে। আর মালিশের দরকার নেই।

বড় জোরে লেগে গেছে। রাগ একবার উঠলে আমার জ্ঞান থাকে না বাঘা। কিছু মনে করিস না রে।

আরে দুৎ, মরদের ইজ্জত মরদেই বোঝে। আজ বুঝলাম তুই বাপের বেটা। তাই তো বলি বদন সর্দারের বেটা এমন মেয়েমানুযের অধম হয় কেমন করে!

ওরে বাঘা গান গাইলে, বাঁশি বাজালে মানুষ না-মরদ হয় না; এ-কথাটা তোরা বুঝবি না, কিন্তু তোদের চেয়ে অনেক বড়ো মরদ আমার বাপ বুঝেছিল, একটু থেমে নীলকণ্ঠ আবার বলল, আজ থেকে দশ বছর আগেকার কথা হয়তো তোর মনে আছে

বাধা দিয়ে বাঘা বলল, মনে আছে, তোর বাপ বদন সর্দার নিজে দাঁড়িয়ে তোকে তালিম দিত। তবে মাঝে মাঝে

হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমার মাথায় খুন চড়ে যেত। একদিন বাবা ভীষণ চটে গেল। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, ছোরা খেলতে খেলতে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম খেলুড়ের পেটের দিকে অস্ত্রটাকে চালিয়ে দিলাম। সেটা লাগলে বেচারা গণেশের সেইদিনই জান নিয়ে টানাটানি পড়ত–কিন্তু বাবা হঠাৎ লাফিয়ে এসে আমার হাতে মারল এক দারুণ রদ্দা। ছোরাটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল না বটে, কিন্তু আমার হাত হয়ে গেল অসাড়। এক ধমক দিয়ে বাপ বলল, নীলে, এটা কি কাজিয়া হচ্ছে? তুই কি মানুষ খুন করতে চাস? এর আগে চারটে জোয়ান তোর হাতে চোট হয়েছে। এবার থেকে তুই আমার সাথে খেলবি। তারপর থেকে সবার চোখের আড়ালে বাব আমায় তালিম দিতে লাগল–কখনো ছোরাছুরি, কখনো লাঠি-সড়কি, কখনো-বা হাতাহাতি। লড়াই।

বাধা দিয়ে বাঘা বলল, তোকে তালিম দিয়েছিল বটে বদন সর্দার। আমার ঘাড়টা এখনও টনটন করছে। যাকগে–তারপর?

নীলকণ্ঠ আবার বলতে শুরু। করল, লাঠি ছোরা চালালেও আমার গান-বাজনার দিকে দারুণ ঝোঁক ছিল। বাপের ভয়ে লুকিয়ে গান গাইতাম। যাত্রা শুনতে গিয়ে গানগুলো মনে মনে তুলে নিতাম।  তার পর আড়ালে-আবডালে সেগুলোর সুর ভঁজতাম। একদিন নির্জন বনের ধারে গান ধরেছি আর কোথা থেকে হঠাৎ সামনে এসে পড়েছে বাবা! আমি তো চমকে গান থামিয়ে দিয়েছি আর ভাবছি এই বুঝি পড়ল এক থাপ্পড় আমার গালে–কিন্তু না, বাপ কিছুই বলল না, চুপ করে চলে গেল সেখান থেকে। আর একদিন সন্ধের সময় বনের ধারে বাঁশি বাজাচ্ছি, এমন সময় সেদিনও হঠাৎ গাছের ফাঁকে ফাঁকে লম্বা পা, ফেলে বাপ এসে দাঁড়াল আমার সামনে। আগের দিন বলেনি দেখে আমার ভয় ভেঙে গিয়েছিল, বললাম, আমি ইয়ে-মানে-এখনই যাচ্ছি বাবা। বাবা কোনো কথা না-বলে পিছন ফিরে হাঁটা দিল, চলতে চলতেই বলল, তোকে আজ লাঠি নিয়ে রেয়াজ করতে হবে না, তুই যা করছিস তা-ইকর।এবার আমার সাহস বেড়ে গেল, সবার চোখের সামনেই গোঁসাইজির কাছে গান-বাজনা শিখতে শুরু করলাম। একদিন দুপুরে গোঁসাইজির ঘরে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি, হঠাৎ গোয়ালাদের গোবিন্দ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ওরে নীলে, তুই এখানে বাঁশি বাজাচ্ছিস? আমি সারাপাড়া তোকে গোরু-খোঁজা খুঁজছি–শেষে বামুনদিদিবললে তুই এখানে আছিস, তাই ছুট্টে এনু। ছেলেটা তখনও হাঁপাচ্ছিল। গোসাইজি বললেন, কী হয়েছে গোবিন্দ? গোবিন্দ বলল, সর্বনাশ হয়েছে। নীলের বাপ বদন সর্দারকে কে যেন চোট করেছে। সর্দারকে দেখে এলাম ভিন-গাঁয়ের পথে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে রয়েছে। আমায় দেখে বলল, ছুট্টে যা গোবিন, নীলুকে খবর দে। আমি আর । বাঁচব না, ছেলেটাকে একবার দেখে যেতে চাই। চ নীলু, পা চালিয়ে চল। প্রথমে ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝতে পারিনি, মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল–তারপর লাফিয়ে উঠে প্রাণপণে ছুটলাম গোবিন্দর সঙ্গে। ভিন-গাঁয়ের পথে একটা ঝোপের ধারে পেলাম বাবাকে; রক্তে মাখামাখি অবস্থা। আমায় দেখে বাবা বলল, কে যেন ঝোপের ভিতর থেকে সড়কি ছুঁড়েছে। কোনোমতে সেটাকে পাঁজর থেকে টানাটানি করে বার করলাম বটে, কিন্তু তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেলাম! জ্ঞান ফিরে আসতে ওঠার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। চোখের সামনে সব কিছু তখন অন্ধকার হয়ে আসছে, বুঝলাম বাঁচব না…হঠাৎ দেখলাম গোবিন্দকে পাশের পুকুর থেকেই বোধ হয় জল এনে আমার মুখে মাথায় ঝাঁপটা দিচ্ছে আর ডাকাডাকি করছে। বললাম, ছুটে যা, নীলেকে খবর দে, মরার আগে তাকে একবার দেখতে চাই।

আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। বাপ বলল, কাদিস না নীলে। জন্মালে মরতেই হবে, দুঃখ করিস না। তবে সারাজীবন শুধু খুনখারাপি করে গেলাম এই কথাটাই মরণকালে মনে হচ্ছে। শোন বাবা, তোর গলায় সুর আছে, হাতের বাঁশিতে আছে জাদুর ছোঁয়া–এই খুনোখুনি আর রক্তারক্তির নেশায় তুই আর হাত লাল করিস না আর, আর আমাদের কত্তামশা রইলেন, ওঁকে আমার মতোই মানবি…।

বাপের শেষ কথা মেনে নিয়েছিলাম, তোদের টিটকারি, গালাগালি সব সহ্য করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্তামশাই আমার হাতে টাকার থলি ধরিয়ে দিলেন, হুকুম হল দেবী চৌধুরানির হাতে ওই টাকা তুলে দিতে হবে। তাই যাচ্ছি ঠ্যাঙাড়ের মাঠে লুঠেরার হাতে টাকা তুলে দিতে।

বলিস কী রে? বাঘার মস্ত গোঁফজোড়ার তলায় দাঁতগুলো একবার অন্ধকারেও ঝিকমিক করে উঠল, বদন সর্দার মারা গেছে, তা বলে ভুবনডাঙা গাঁয়ে কি আর মরদ নেই? নীলে, তুই বর্দন সর্দারের বেটা, আমি তার শাগরেদ চল, দুজনে একবার লাঠি ধরি, দেখি দেবী চৌধুরানির দলে কয়টা জোয়ান আছে?

না রে বাঘা। বাপের মরণকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কর্তামশাইকে কোনোদিন অমান্য করব না। সে-কথা আমায় রাখতেই হবে। তার হুকুমমতো টাকা তুলে দিতে হবে লুঠেরার হাতে। বাঘা রে, এমন না-মরদের কাজ করতে তোকে সঙ্গে নেব না, আমি একাই যাব।

টাকার থলিটা মাটি থেকে তুলে নিল নীলকণ্ঠ, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে… কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে…

তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে বাঘা আপনমনেই বলল, বাপের কথায় রামচন্দ্র রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়েছিল বলে লোক তাকে বাহবা দেয়। সেটা এমন কী কঠিন কাজ? মরদের কাছে তার ইজ্জতের দাম রাজত্বের চাইতে অনেক বেশি। কথায় বলে জান দোব তো মান দোবনি। নীলু রে! সেই মান, সেই ইজ্জত তুই বিকিয়ে দিচ্ছিস বাপের কথায়, কিন্তু সেইজন্য কেউ তোকে বাহবা দেবে না। তবে আমিও সাচ্চা মরদ, তোর ব্যথা আমি বুঝি। আমি বুঝতে পারছি তোর বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমারও তো কিছু করার নেই…

৪. প্রণামীর শত

চতুর্থ পরিচ্ছেদ — প্রণামীর শত

রাত বাড়ছে… আকাশে হানা দেয় পাচা… রাতের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জেগে ওঠে জান্তব কোলাহল হুয়া-ক্কা-হুয়া–শেয়ালের পাল!

ঠ্যাঙাড়ের মাঠে বুড়ো বটগাছের তলায় লাঠি হাতে একটি দীর্ঘকায় মানুষ অস্থির চরণে পায়চারি করছে আর থেকে থেকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে পশ্চিমদিকের মেঠো পথটার দিকে। আকাশের পানে তাকিয়ে লোকটি অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করল, চাঁদ মাথার উপর উঠেছে। সময় হয়ে এল তবু কেউ তো টাকা নিয়ে আসছে না। ঠিক আছে, আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি। তারপর না হয় জমিদারবাড়িতে ভিক্ষে চাইতে যাব। সহজে রক্তারক্তি করতে চায় না, কিন্তু আজ বোধ হয় আমার লাঠি অনেকদিন বাদে রক্তের স্বাদ পাবে।

না গো কর্তা, তোমার লাঠি বোধ হয়, আজও উপোসি থাকবে, রক্তের স্বাদ সে আজও পাবে না।

কে রে! সবিস্ময়ে কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল লাঠিধারী ব্যক্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মনুষ্যমূর্তি! অন্ধকারে তার গায়ের সাদা চাদর কিছুটা দৃষ্টিগোচর হয়, চাদরের আড়ালে হাতে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে লাঠিধারী বলল, তুই তো কালীচরণের পাইক? ভুবনডাঙার পথ তো পশ্চিম দিকে। সেই দিকে তাকিয়ে চোখ যে ব্যথা হয়ে গেল তা তুই এলি কোন দিক থেকে?

আগন্তুক হাসল, যেদিক থেকেই আসি, আর যেখান দিয়েই আসি, সে-খোঁজে তোমার দরকার কী বাপু? টাকা আনার কথা, টাকা এনেছি। তিনি কোথায়?

কার কথা বলছিস?

দেবী ঠাকরুনের কথা বলছি।

মায়ের সঙ্গে তোর কী দরকার? টাকা আমার হাতেই দিয়ে যা।

আহাহা! আহ্বাদের কথা শুনে মরে যাই আর কি! চিঠি দিয়েছেন দেবী ঠাকরুন, টাকা দেব তার হাতে। তুমি কোথাকার উটকো লোক তোমার হাতে টাকা দেব কেন?

আগন্তুকের হাতে মস্ত থলিটাকে এইবার দেখতে পেল লাঠিয়াল, মায়ের কথাতেই এখানে এসেছি। রাতবিরেতে এমন জায়গায় কেউ শখ করে দাঁড়িয়ে থাকে? চিঠিতে তো। এই জায়গার কথাই লেখা আছে আর তুইও টাকা দিতেই এসেছিল, তবে আর কথা বাড়াচ্ছিস কেন?

আগন্তুক তরল কণ্ঠে বলল, তুমিই-বা কথা বাড়াচ্ছ কেন? মা-ঠাকরুনকে ডেকে দাও, টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। ঝুটমুট তোমার সঙ্গে মাঝরাত্তিরে গল্প করতে তো আসিনি।

মা সকলের সাথে দেখা করেন না, লাঠিয়ালের কণ্ঠস্বর কর্কশ, টাকা আমার হাতেই দিতে হবে।

লাও কথা! দিতে হবে মানে?আগন্তুকের গলায় হাসির আভাস স্পষ্ট, আমি না-দিলে তুমি কেমন করে নেবে, শুনি? জোর করে?

হ্যাঁ, জোর করেই নেব। তুই বাধা দিতে পারিস?

পারি বই কী। আমি নিজে হাতে টাকা তুলে না-দিলে আমার হাত থেকে টাকা কেড়ে নিতে পারে এমন জোয়ান এখনও জন্মায়নি। বুঝলে কত্তা?

ওরে হতভাগা, তুই কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিস জানিস না। আমাদের মা সহজে কারুকে মারধর করতে চান না, তাই তুই এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা কইতে পারছিস। ভালো কথায় বলছি টাকা আমার হাতে দিয়ে চলে যা–নইলে, এই লাঠি দেখছিস?

অমন লাঠি অনেক দেখেছি। আমার হাতে লাঠি নেই, তাই লাঠি দেখাচ্ছ?

তোকে মারতে লাঠি লাগে না, লাঠিয়াল সামনে এগিয়ে এসে আগন্তুকের থলিসমেত হাত সজোরে চেপে ধরল, দে, টাকা।

আগন্তুকের হাত থেকে টাকার থলিটা সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল। হো হো শব্দে হেসে উঠে লাঠিয়াল বলল, তুই কেমন মরদ? একটা হাতের চাপ সহ্য করতে পারিস না, আবার মুখে লম্বা লম্বা কথা?

নীচু হয়ে টাকার থলিটা তুলে নেওয়ার উদযোগ করল সে। সঙ্গেসঙ্গে আগন্তুকের একটা হাত লোহার ডান্ডার মতো এসে পড়ল লাঠিয়ালের ঘাড়ে… কয়েক মুহূর্তের জন্য মানুষটার চৈতন্য লোপ পেয়েছিল… সম্বিৎ ফিরে আসতে সে দেখল টাকার থলি যেখানে পড়ে ছিল সেখানেই আছে, কিন্তু তার হাতের লাঠিটা এখন বিরাজ করছে নবাগত মানুষটির হাতে!

লাঠি হাতে আগন্তুক হেসে উঠল, তুমি তো তুমি, ওধারে মাটির উপর যে জোয়ানগুলো শুয়ে আছে, ওরা সবাই মিলে চেষ্টা করলেও এই থলিটাকে নিতে পারবে না। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, ওদের ডেকে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো।

স্তম্ভিত বিস্ময়ে লাঠিয়াল বলল, মাঠের উপর লোক আছে তুই জানিস?

জানি বই কী।

আশ্চর্য ব্যাপার! কী করে জানলি?

ভুবনডাঙার দিক থেকে যে-পথটা এসেছে, সেটার উপর দিয়ে অর্থাৎ পশ্চিমদিক থেকেই আমি আসছিলাম। ওখানে কত লোক আছে আঁধারে মালুম হবে না জানতাম। তাই মাঠের উপর শুয়ে বুকে হেঁটে এগিয়ে গেলাম। তুমি নিশ্চয়ই জান অন্ধকারে মাঠের উপর কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে দাঁড়ানো-মানুষ দেখতে পায় না, কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়লে আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ শুয়ে-থাকা মানুষের চোখে পড়বে। তাই মাটিতে শুয়ে পড়েও আমি যখন কারুকে দেখতে পেলাম না, তখন বুঝলাম স্যাঙাতরা সব মাটিতে শুয়ে আছে। মানে, জমিদার মশাই টাকা না-পাঠিয়ে একদল পাইকও তো পাঠাতে পারেন–তাই বোধ হয় মা-ঠাকরুনের এই সতর্কতা। আমিও তখন তোমাদের ওষুধ তোমাদেরই খাওয়ালাম–অর্থাৎ মাঠের পথ ছেড়ে উলটোদিকে বনের পথ ধরলাম, তারপর ওই পথ দিয়ে মাঠ ধরে বুকে হেঁটে এই গাছের তলায় আসতেই তোমার সাথে মোলাকাত হয়ে গেল। সোজা পথে বুকে হেঁটে এগোলে হয়তো তোমাদের দলের মধ্যে গিয়ে পড়তাম। সেই বখেড়াটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই এতটা পরিশ্রম করতে হল।

লাঠিয়াল গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তুই তো দেখছি বহুত পোড়-খাওয়া লোক। তবে এখানে কত লোক আছে তা তো তুই জানিস না। একা তুই কয়জনকে সামলাতে পারবি?

অন্ধকারেও আগন্তুকের দাঁতগুলো একবার চকচক করে উঠল, অন্তত শ-খানেক জোয়ানকে তো সামলাতে পারব। তার বেশি হলে কী হবে বলা যায় না।

উরিব্বাস, লাঠিয়াল বলে উঠল, তুই তো খুব ভারি মরদ। তোর মুখটা তো একবার দেখতে হয়।

দু-হাতের আঙুল মুখে ঢুকিয়ে সে কুঈ দিল–পরক্ষণেই মাঠের উপর থেকে ভেসে আসতে লাগল তীব্র সংকেত ধ্বনি–রিক-রিক-চুঁ-ঈঈঈ!

একটু পরেই জ্বলে উঠল মশাল; প্রথমে একটা দুটো, তারপর অনেকগুলো…

জ্বলন্ত মশাল নিয়ে লোকগুলো এগিয়ে এল কাছে। একজন হাঁক দিয়ে বলল, সর্দার! কী খবর? টাকা এসেছে?

এসেছে, সর্দার অর্থাৎ আমাদের পূর্ব-পরিচিত লাঠিয়াল বলল, কিন্তু এ বলছে মায়ের হাতে টাকা দেবে, আর কারো হাতে দেবে না।

একটা অস্ফুট গুঞ্জন উঠল। একজন চড়া গলায় বলল, তোর মতো লোক মায়ের সাক্ষাৎ পায় না। ভালো কথায় টাকা দিয়ে দে।

সর্দার এবার আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে হাসল, কী মনে হয়? এতগুলো জোয়ানকে সামলাতে পারবি?

আগন্তুকও হাসল, ওসব চেষ্টা না-করাই ভালো! জোর করে টাকা নিতে গেলে কয়েকটা ভালো মানুষের লাশ পড়বে এখানে–সেটা কি ভালো হবে সর্দার?

সর্দারের চোয়াল শক্ত হল, এই তোর শেষ কথা?

হ্যাঁ, এই আমার শেষ কথা, আগন্তুকের কণ্ঠে আর হাসির রেশ নেই, দেবীদর্শন না হলে প্রণামী দেব না।

কথাটা সকলেই শুনতে পেল। কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে এল, সর্দার, হুকুম দাও বেটাকে এখানেই শুইয়ে দি।

সর্দার কিছু বলার আগেই আগন্তুকের পিছন থেকে ভেসে এল নারীকণ্ঠের ধ্বনি, আমাকে দেখলেই যদি টাকা দিতে রাজি থাকে, তবে খুনোখুনির দরকার কী? আমি তো পর্দানশিন নই।

সচমকে পিছন ফিরে আগন্তুক দেখল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক রমণী! একটু দূরে হাতে হাতে যে-মশালগুলো জ্বলছিল তার অস্পষ্ট আভায় রমণীর মুখ ভালোভাবে দেখা না-গেলেও তার হাতের বল্লম ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি আগন্তুকের মনে বিস্ময় ও সম্ভ্রমবোধ জাগিয়ে তুলল। সে কিছু বলার আগেই রমণী আবার বলল, ওরে, তোদের মধ্যে একজন একটা মশাল এদিকে নিয়ে আয়। আমাকে দর্শন না-করলে প্রণামী দিতে চায় না আমার এমন ভক্তের মুখটা তো একবার ভালো করে দেখতে হয়।

মশাল হাতে দু-তিনজন সামনে এগিয়ে এল। রমণীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠল আগন্তুক–এই কি দস্যুনেত্রী দেবী চৌধুরানি! এরই জন্য ঘুম নেই কুঠিয়ালদের চোখে? এরই জন্য সন্ত্রস্ত পরাক্রান্ত ইংরেজ সরকার! একেই গ্রেপ্তার করার জন্য হন্যে হয়ে ফিরছে ইংরেজের সেনাবাহিনী!…

৫. দেবীদর্শন

পঞ্চম পরিচ্ছেদ — দেবীদর্শন

স্তব্ধ বিস্ময়ে আগন্তুক তাকিয়ে রইল রমণীর মুখের দিকে সেই মুখ সুন্দর কি অসুন্দর সেই প্রশ্ন মনে আসে না, আয়ত দুই নয়নের দৃষ্টি স্নেহ ও কৌতুকে স্নিগ্ধ, মৃদু হাসিতে বাঁকা ওষ্ঠাধরে অগাধ প্রশ্রয়ের আভাস–দুরন্ত শিশুর কাণ্ড দেখে মায়ের মুখে বুঝি এমন হাসিই ফুটে ওঠে– অনির্বচনীয় সেই মুখের বুঝি তুলনা নেই!

নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল দেবীর কৌতুকজড়িত কণ্ঠ, কী দেখছ?

মনে হয়, মনে হয়

কী মনে হয়?

না, মানে ইয়ে,আগন্তুক মাথা নীচু করে, আপনাকে দেখে ডাকাত বলে মনে হয় না, তাই : ইয়ে অর্থাৎ

দেবী হাসল, ডাকাত তো আমি নই।

আগন্তুক এবার মুখ তুলে দেবীর দিকে চাইল, কিন্তু আপনি তো ডাকাতি করেন। কর্তামশাইয়ের কাছেও

হ্যাঁ, টাকা চেয়েছি। কিন্তু কেন? তোমার কর্তামশাই আর তারই মতো কিছু জমিদার আর সুদখোর মহাজন গরিব মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে, ওই গরিবদের শ্রমের ফলভোগ করে নির্লজ্জের মতো আমি ওই রক্তচোষা জমিদার আর সুদখোরদের যম। গরিবের লুঠ-করা টাকা আমি গরিবদের মধ্যেই বিলিয়ে দিই, বুঝলে? এটাকে যদি ডাকাতি মনে করো তবে আমি ডাকাত।

এসব কথা আমি জানতুম না। কিন্তু মা-ঠাকরুন, আপনি ভুল করছেন। আমাদের কর্তামশাই আর সকলের মতো নন।

দেবী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, ভূষণ এদিকে এসো!

দস্যুদলের ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল, কী বলছ মা?

বলো, জমিদার কালীচরণ তোমার কী অবস্থা করেছে।

পাইক দিয়ে আমার জমি থেকে আমায় উঠিয়ে দিয়েছে। যেতে রাজি হইনি বলে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তুমি আশ্রয় না-দিলে বউ-ছেলে নিয়ে আমায় পথে দাঁড়াতে হত।

আগন্তুক ভূষণের চোখে দিকে চাইল, কর্তামশাই তোমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে কেন?

জমিদারের জমিতে বেগার খাটতে রাজি হইনি, তাই। কিছু খাজনাও বাকি ছিল, কিন্তু

কর্তামশাই তোমায় বেগার খাটতে বলেছিল?

না। নায়েবমশাই বলেছিল।

পাইক কে ছিল? বাঘা, করিম, এমতাজ?

না, ওরা নয়। নারদ সর্দারের দল।

তুমি কর্তামশাইয়ের কাছে যাওনি, কেন?

নায়েবমশাই বলেছিল কত্তার হুকুমেই সব হচ্ছে। আরও বলেছিল তাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডুটা ধড়ে থাকবে না।

আগন্তুক এবার দেবীর দিকে চাইল, আপনি ঠিক বিচার করেননি মা। নায়েবই এসব করেছে। কর্তামশাই কিছু জানেন না। নায়েব অঘোর বসু খুব খারাপ লোক। ও-ই নারদ সর্দারের দলকে ওই জুটিয়েছে। পুরানো লাঠিয়ালরা কর্তার হুকুম ছাড়া কারো ভিটেয় হাত দেবে না।

হতে পারে কালীচরণ ভালো মানুষ, এসবের কিছু জানেন না, দেবীর জ্ব কুঞ্চিত, কিন্তু তার জমিদারিতে প্রজার উপর হামলা হলে তাকেই সবাই দোষ দেবে।

তা ঠিক, আগন্তুক সায় দিল, গিন্নিমা মারা যাওয়ার পর কর্তা যেন কেমন হয়ে গেছেন। কোনো কিছুই দেখেন না।

তোমরা তার প্রজা, তোমাদের তো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। একটা ভূষণ তোমায় দেখালুম, কিন্তু এর মতো আরও অনেক মানুষকেই বিনা অপরাধে ভিটে থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তোমরা গাঁয়ের জোয়ান ছেলে–তোমরা থাকতে নায়েব এমন অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে যাবে? তোমরা তবে আছ কী করতে?

আগন্তুক জবাব দেওয়ার আগেই ভূষণ বলল, ওকে ওসব কথা বলে লাভ নেই মা! আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত তাহলে কার সাধ্যি আমায় ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে?

আগন্তুকের নতদৃষ্টি ভূষণের মুখের উপর পড়ল, বাপ বেঁচে থাকলে টাকা আদায় করা অত সহজ হত না রে ভূষণ।

ভূষণ বলল, টাকা চাইবার কারণটাও যে ঘটত না, সে-কথা ভুলিস না নীলে।

দেবী একটু অবাক হয়ে বলল, এর নাম বুঝি নীলে? ওর বাবা বুঝি খুব ওস্তাদ লাঠিয়াল ছিল?

এবার শুধু ভূষণ নয়, দলের মধ্যে অনেকগুলো কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠল, ওর নাম নীলে নয়, নীলকণ্ঠ। ওর বাপ বদন সর্দার ছিল দারুণ লেঠেল। লাঠি নিয়ে দাঁড়ালে এক-শো জোয়ানের মহড়া নিতে পারত।

ভূষণ বলল, নীলু কিন্তু বাপের মতো হয়নি মা। নায়েবের অত্যাচার ও রুখবে কেমন করে? বাঁশি বাজিয়ে আর গান গেয়ে তো অঘোর বসুর মতো পাজি নায়েবকে শায়েস্তা করা যায় না মা।

ওর নাম নীলকণ্ঠ?… ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! ও আবার বাঁশি বাজায়, গান গায়?… ভাবা যায় না।

একজন দস্যু প্রশ্ন করল, কেন ভাবা যায় না?

বদন সর্দারের ছেলের নাম নীলকণ্ঠ! দেবী হাসল, তোমার নাম কে রেখেছিল নীলু?

আজ্ঞে গ্রামের ব্রাহ্মণ শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর। উনি আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি একেবারে মুখ নই।

তোমার কথা শুনে তা বোঝা যায়। গান, অভিনয় এগুলো খুবই ভালো জিনিস, কিন্তু দরকারে লাঠিও ধরতে হয়। তোমাদের গ্রামে একটা নায়েব প্রজাদের উপর জুলুম করবে আর তোমরা সেটা সহ্য করবে?

আমি কিছুই জানতাম না।

কথাটা ঠিক, ভূষণ বলল, কিন্তু জানলেই-বা কী করবে ও? নীলেটা বাপের নাম ডোবাল, অমন জোয়ানের বেটা এমন ভেড়া হয় ভাবতে পারি না।

যাই বল ভূষণ, দেবী হাসল, ও যদি ভেড়া হয়, তাহলে ওর শিং-এর গুঁতোটা যে খুবই সাংঘাতিক এ-কথা আমাদের রঙ্গলাল অন্তত স্বীকার করবে। কী বলো রঙ্গলাল?

লাঠি হাতে যে-লোকটি প্রথমেই ঘাড়ের উপর আগন্তুকের রদ্দা খেয়ে মাটি নিয়েছিল, তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল। মনের ভাব গোপন করার জন্য সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

দলের ভিতর থেকে একটি লম্বা-চওড়া জোয়ান সামনে এগিয়ে এল, মাঠান যদি অনুমতি করেন তো একটা কথা বলি।

দেবীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, তুমি তো নতুন এসেছ কৈলাস? বোধ হয় মাস দুই হবে, তাই না? তোমার সম্পর্কে কিছু কিছু নালিশ আমার কানে এসেছে। শুনেছি তুমি ভারি ওস্তাদ লাঠিয়াল, কিন্তু এখানকার ব্যাপার আলাদা। নালিশগুলো সম্পর্কে আমি খোঁজখবর করছি। যা শুনেছি তার সবটুকু না হোক, যদি কিছুটাও সত্যি হয়, তাহলে তোমার কাঁধের উপর মাথাটা নাও থাকতে পারে বুঝেছ?

কৈলাসের মুখ-চোখ বিবর্ণ হয়ে গেল, আমার নামে যদি কেউ মিথ্যে করে লাগায়, তাহলেও আমায় শাস্তি পেতে হবে? এই কি আপনার বিচার?

মিথ্যে হলে শাস্তি পাবে না। সত্যমিথ্যা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তোমায় দেখে কথাটা মনে পড়ে গেল, তাই সাবধান করে দিলাম। যাই হোক–কী যেন বলছিলে তুমি?

সর্দার ওই ছোঁড়াটার হাতের মারে মাটি নিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন তেমন জোয়ানের পাল্লায় পড়লে ওই দুধের বাচ্চাটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না, অনেক আগেই মাটিতে শুয়ে পড়ত।

তেমন তেমন জোয়ানটা কি তুমি নাকি? দেবী কঠিন স্বরে বলল, রঙ্গলালকে আমি তোমার চেয়ে ভালো করে চিনি। আমি যখন থাকব না, সেই সময় একবার রঙ্গলালকে ঘাঁটিয়ে দেখ।

মা এই লোকটা নতুন এসেছে, কিন্তু ওর চালচলন দেখলে মনে হয় ও-ই যেন দলের সর্দার।

রঙ্গলাল বলল, কী বলব মা, তোমার সামনে তো গরম দেখাতে পারি না, যদি অনুমতি দাও তাহলে এই বেআদব লোকটাকে কিছু আদব শেখাতে পারি।

দেবী উত্তর দেওয়ার আগেই নীলকণ্ঠ কৈলাস নামে লোকটার সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, দেখি! দেখি! ওটা একবার দেখি!

পরক্ষণেই তার ডান হাত কৈলাসের গলায় আছড়ে পড়েই ফিরে এল একটা শব্দ হল : ফট! ছিন্নহারের সঙ্গে সংলগ্ন তাবিজটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, এই তাবিজ তুমি কোথায় পেলে?

উত্তর এল লাঠির মুখে। সজোরে নীলকণ্ঠের মাথায় আঘাত হানল কৈলাস। সেই লাঠি মাথায় পড়লে নীলকণ্ঠ তখনই মারা পড়ত, কিন্তু চকিতে বর্শা তুলে আঘাত রুখে দিল দেবী চোখের পলক ফেলার আগেই আবার ঘুরল বর্শা, মুহূর্তের মধ্যে ধারালো ফলা কৈলাসের কণ্ঠনালি স্পর্শ। করল, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কণ্ঠের আদেশ, কৈলাস। লাঠি ফেলে দাও, নইলে

নইলে কী ঘটবে সেটা আর বলতে হল না, কৈলাসের হাতের লাঠি খসে পড়ল মাটির উপর। শুধু কৈলাস নয়, নীলকণ্ঠের বুকের ভিতরেও আতঙ্কের বিদ্যুৎ-শিহরন তুলে দিল সেই আদেশবাণী। জীবনে সর্বপ্রথম নীলকণ্ঠ বুঝল রমণীর কণ্ঠস্বর সবসময় খুব রমণীয় হয় না!

কঠিন স্বরে দেবী বলল, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। আমার সামনে তুমি একটা মানুষের মাথায় লাঠি চালিয়ে দিলে!

সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। দেবী আবার বলল, তুমি কি জানো না অনর্থক রক্তপাত আমি পছন্দ করি না? আমার দলে বিনা প্রয়োজনে কেউ খুনোখুনি করলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।

কিন্তু মা-ঠাকরুন, নীলকণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠল, আত্মরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে।

অবাক হয়ে দেবী বলল, তা আছে। কিন্তু তুমি তো কৈলাসকে আক্রমণ করনি, আত্মরক্ষার প্রশ্ন আসে কী করে?

আসে মা ঠাকরুন, আসে, নীলকণ্ঠের মুখে অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল, এই তাবিজটা ও কোথায় পেল সে-কথা বলতে হলেই আরও অনেক পুরোনো কথা উঠবে। আমি আপনাকে প্রথম দেখলাম–তবু এইটুকু সময়ের মধ্যে আপনাকে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হয় এই তাবিজের ঘটনা জানার পর আপনার দলে ওর স্থান তো হবেই না, উপরন্তু কিছু বাড়তি দুর্ভোগও ওর বরাতে জুটতে পারে। তাই আমার মুখ চটপট বন্ধ করার জন্যই কৈলাস ফট করে লাঠি চালিয়ে দিয়েছে, দারুণ ভয়ে আগুপিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওর ছিল না।

বটে? বর্শার ফলা সরে গেল কৈলাসের গলা থেকে, তাহলে তো এই তাবিজের ব্যাপারটা আমাকে জানতেই হয়। এটা যদি কৈলাসের সম্পত্তি না হয়, তাহলে এর আসল মালিক কে?

তাবিজের আসল মালিক বেঁচে নেই, মা-ঠাকরুন।

তুমি তাকে জানতে?

জানতুম।

কে সে?

বদন সর্দার। আমার বাবা।

মাঠের মধ্যে তখন বোধ হয় ছুঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যায়… হঠাৎ নীরবতা ভেঙে দেবী বলল, তাবিজটা আমার হাতে দাও।

কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দেবী বলল, তাবিজটা যদি তোমার বাবার হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি ওটা পাবে। কিন্তু এটা তো পিতলের তৈরি খুব সাধারণ জিনিস, কৈলাস এটা চুরি করবে কেন?

কৈলাস কিছু বলতে যেতেই দেবী উগ্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, চুপ করো। সময় যখন আসবে তখন তোমার কথাও আমি শুনব। এখন কোনো কথা কইবে না।

ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল কৈলাস। নীলকণ্ঠ বলল, জিনিসটা খুব সাধারণ নয়। কৈলাস ওটা চুরি করেনি, বাবাকে খুন করে গলা থেকে খুলে নিয়েছিল।

এই সামান্য জিনিসের জন্য মানুষ খুন করেছে কৈলাস?–না, না, এ-কথা বিশ্বাস করা যায় না।

মা ঠাকরুন, এটা সামান্য জিনিস নয়, নীলকণ্ঠ বলল, সব কথা শুনলেই আপনি বুঝবেন। এই তাবিজটা কর্তামশাইয়ের ঠাকুরদার ঠাকুরদা পেয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী নাকি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন এই তাবিজ যার কাছে থাকবে সে কখনো কোনো লড়াইতে হারবে না।

জনতার ভিতর থেকে একাধিক কণ্ঠ সাড়া দিল, হ্যাঁ, হা এ-কথা আমরাও শুনেছি। কালীচরণ চৌধুরির ওই তাবিজের কথা অনেকেই জানে। চৌধুরি কত্তাদের সকলেই খুব বেপরোয়া মানুষ ছিলেন, জমির দখল নিয়ে তারা অনেক লাঠালাঠি খুনোখুনি করেছেন কিন্তু কখনো কোনো দাঙ্গা-কাজিয়ায় তারা হারেননি, সবসময়ই জিতেছেন। লোকে বলে ওই তাবিজ যতদিন কাছে থাকবে, ততদিন চৌধুরি বংশের কেউ লড়াইতে হারবে না। তবে তাবিজটা যে বদন সর্দারের কাছে গেছে এমন খবর আমাদের জানা নেই।

বামাচরণ! শিবু কাকা!… তোমাদের তো আমি চিনি, নীলকণ্ঠ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তোমরাও মা-ঠাকরুনের দলে যোগ দিয়েছ!… যাক গে, যে-কথা বলছিলাম–হ্যাঁ, তাবিজটা যে বাবাকে কর্তামশাই দিয়েছিলেন সে-কথা অনেকেই জানে না। জানার কথাও নয়। তাবিজটা কী করে কর্তামশাইয়ের গলা থেকে বাবার গলায় এল সেই ঘটনা এখন বলছি, শোনো। একদিন শিকারে গিয়ে কর্তামশাই একটা বুনো শুয়োরকে গুলি করেন। শুয়োর মরল না, জখম হল। চোট খেয়ে পালানোর চেষ্টা না-করে সে তেড়ে এল কর্তামশাইয়ের দিকে। কর্তামশাই আবার গুলি করলেন। গুলি গেল ফসকে। শুয়োর সেদিন কর্তামশাইকে মেরেই ফেলত, কিন্তু আমার বাবা লাঠি চালিয়ে শুয়োরের দুটো ঠ্যাং ভেঙে দেয় বলে কর্তামশাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপর নতুন করে বন্দুকে গুলি ভরে শুয়োরটাকে মারলেন কর্তামশাই আর তাবিজটা নিজের হাতে খুলে বাবার গলায় পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে ওই তাবিজটা সর্বদা বাবার গলায় থাকত, কিন্তু বাবাকে যখন খুন করা হয়

বাধা দিয়ে দেবী বলল, তোমার বাবাকে কে খুন করেছিল? কৈলাস?

খুনিকে কেউ দেখতে পায়নি, নীলকণ্ঠ বলল, আমি সেদিন গোঁসাইজির ঘরে বসে বাঁশি বাজাচ্ছি, হঠাৎ খবর পেলাম ভিনগাঁয়ের পথে আমার বাবা জখম হয়ে পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখলাম বাবার চোট সাংঘাতিক, বাঁচার আশা নেই। বাবার কাছে শুনলাম ঝোপের আড়াল থেকে কেউ সড়কি ছুঁড়ে মেরেছে। বাবা যখন ডুয়ে পড়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তখন একটা লোক ঝোপ থেকে বেরিয়ে তাবিজটা বাবার গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে। বাবা মরার আগে আমায় গান-বাজনা নিয়েই থাকতে বলেছিল–বলেছিল খুনোখুনি রক্তারক্তির পথ ছেড়ে দিতে। বাবার আদেশ মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু আজ এই তাবিজটা দেখে আমার মাথায় খুন চড়ে গেছে। মা ঠাকরুন, আপনি বিচার করুন–যে-লোক আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে মানুষ মারে তার কেমন সাজা হওয়া উচিত?

কৈলাসকে জিজ্ঞাসা করলে সত্যি কথা জানা যাবে না, দেবীর ললাটে জাগল কয়েকটা রেখা, কিন্তু শুধু তাবিজটা হাতানোর জন্য তোমার বাবাকে খুন করবে এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

বাবার অনেক শত্রু ছিল। হয়ত কখনো কৈলাস বাপের হাতে মার খেয়েছে, অথবা অপমান হয়েছে। হয়তো কোনো শত্রু বাপকে খুন করার জন্য কৈলাসকে টাকা খাইয়েছে–আসল ব্যাপার তো জানার কোনো উপায় নেই। আরও অনেকের মতো কৈলাসও নিশ্চয় তাবিজের ক্ষমতার কথা শুনেছে। বাপকে ঘায়েল করার পর তাবিজ হাতানোর সুযোগটা সে ছেড়ে দেয়নি।

তোমার যুক্তি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, দেবী এবার কৈলাসের মুখের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করল, কৈলাস, এই তাবিজ তোমার হাতে এল কেমন করে?

ইয়ে-এই-মানে, হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল কৈলাস, এই তাবিজটা তো আমার। অনেকদিন হল পরছি। ছোঁড়াটা যদি এটা ওর বাবার জিনিস বলে দাবি করে, অমনি ওর কথাটা সত্যি হয়ে যাবে? মা, আপনি তো কখনো অবিচার করেন না–বলুন, এটা যে ওর বাবার জিনিস তেমন কোনো প্রমাণ আছে? একরকম দেখতে দুটো তাবিজ কি হয় না?

দেবীর ললাটে অনেকগুলো রেখার সৃষ্টি হল, কৈলাস, তুমি ভালো ফন্দি এঁটেছ। হ্যাঁ, একরকম দেখতে দুটো জিনিস হতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস জিনিসটার আসল মালিক বদন সর্দার।

শুধু আপনার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে আমায় সাজা দিলে কি সুবিচার হবে?

জনতা স্তব্ধ। দেবীর মুখে রুদ্ধ রোষের আভাস। শয়তান কৈলাস ভালো যুক্তি দেখিয়েছে সত্যিই তো, ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়া কারো দণ্ডবিধান করলে তাকে কিছুতেই সুবিচার বলা চলে না।

স্তব্ধতা ভঙ্গ করল নীলকণ্ঠ, এটা যে বাবার তাবিজ এই মুহূর্তে সেটা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কর্তামশাইয়ের কাছে গেলে হয়তো প্রমাণ হয়ে যেত তাবিজটার আসল মালিক কে ছিল। কিন্তু সেটাও তো অসম্ভব। তবে কৈলাস, তুমি যে একটু আগে হঠাৎ লাঠি চালিয়ে আমার মাথাটা ফাঁক করে দিচ্ছিলে, সেটা সবাই দেখেছে। মা-ঠাকরুন বল্লম তুলে রুখে না-দিলে আমি এতক্ষণে যমরাজার কাছে পৌঁছে যেতাম। কাউকে সতর্ক না-করে তার মাথায় হঠাৎ লাঠি চালানো কি অপরাধ নয়? মা-ঠাকরুন, অন্তত এই অপরাধের বিচার তো আপনি করতে পারেন?

দেবী কঠিন দৃষ্টিতে কৈলাসের দিকে চাইল, হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তি তো হতেই পারে।

আমি তৈরি ছিলাম না, ও আমায় লাঠি চালিয়ে খুন করতে গিয়েছিল, নীলকণ্ঠ বলল, একবার বলে-কয়ে আমার মাথায় লাঠি মারতে বলুন, দেখি ও কেমন মরদ!

রঙ্গলাল হঠাৎ বলে উঠল, এই কথাটা আমার মনে ধরছে। কৈলাস তো একটু আগেই বলছিল আমার মতো দুবলা মানুষ বলেই দুধের বাচ্চার হাতের মারে মাটি নিয়েছে, তেমন তেমন জোয়ান হলে নাকি ওই বাচ্চাটাকে মাটিতে শুইয়ে দিত। আমি একবার দেখতে চাই আমাদের কৈলাস কেমন জোয়ান। যার হাতের এক ঘায়ে রঙ্গলাল সর্দার মাটিতে ঠিকরে পড়ে, তার পাল্লায় পড়লে কৈলাসের কী হাল হয় সেটাই একবার দেখতে চাই আমি। অবশ্য মায়ের কথাই শেষ কথা। আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা জানিয়ে দিলাম।

সমবেত জনতা সাগ্রহে চিৎকার করে রঙ্গলালের প্রস্তাবে সম্মতি জানাল। এখন শুধু দেবীর অনুমতির অপেক্ষা।

হাত তুলে সবাইকে চুপ করিয়ে দিল দেবী, লাঠির মুখে বিচার আমি কখনো করিনি, তবে সবাই যখন চাইছে

হাতজোড় করে নীলকণ্ঠ বলল, মা ঠাকরুন, এই অনুমতিটা যদি দেন তাহলে আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।

তাই নাকি? দেবীর মুখে কৌতুকের হাসি দেখা দিল, এত সহজে একটা মানুষকে যদি কেনা যায়, তাহলে তো অনুমতি দিতেই হয়। বেশ, সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি যাব না–শুরু হোক লড়াই।

নীলকণ্ঠের হাতে তখনও রঙ্গলালের লাঠিটা ছিল, সেটা তুলে ধরে সে বলল, রঙ্গ সর্দার, তোমার লাঠিটা আমি কিছুক্ষণের জন্য ধার নিলাম। ওহে কৈলাস, মা যখন অনুমতি দিয়েছেন তখন তোমার লাঠিটা মাটি থেকে তুলে নাও, দেখি তুমি কেমন মরদ।

একবার ডান দিকে পাঁয়তারা করল তারপর লাঠিটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁক দিল, তৈরি হয়ে নে নীলু। আবার বলিস না তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ মেরেছে। এবার তোকে বলে-কয়েই মারছি–দেখ যদি সামলাতে পারিস।

এক ঝটকায় গায়ের চাদর ফেলে দিয়ে প্রতিদ্বন্দীর দিকে ফিরে দাঁড়াল নীলকণ্ঠ, মশালের আলো ঝলমল করে উঠল পেশিবদ্ধ দেহের উপর চাদরের তলায় যে এমন একটি বর্ণচোরা আম লুকিয়ে ছিল সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি, হঠাৎ যেন খাপ থেকে বেরিয়ে এল একটা ধারালো তলোয়ার!

জনতার ভিতর থেকে ভেসে এল অস্ফুট প্রশংসার ধ্বনি। রঙ্গলাল সোৎসাহে বলে উঠল, এ যে রেয়াজি জোয়ান!… দুধের বাচ্চার চেহারাটা ভালো করে দেখে নে কৈলাস। তোর বরাত আজ খুবই খারাপ রে কৈলাস, খুবই খারাপ।

অল্পবয়সি ছেলেটাকে দেখে কৈলাস ভেবেছিল লাঠির এক ঘায়েই লড়াই ফতে করবে। ছেলেটার হাতের মারে রঙ্গলালকে পড়ে যেতে দেখে সে বিশেষ ঘাবড়ায়নি–দলের পুরোনো লোকদের মতো রঙ্গলালের ক্ষমতা সম্বন্ধে সে সচেতন ছিল না, ভেবেছিল যোগ্যতার জন্য নয়, দেবীর অনুগত পুরানো লোক বলেই বুঝি সর্দারি করছে রঙ্গলাল। কিন্তু নীলকণ্ঠের আবরণ-মুক্ত শরীরটা দেখেই সে বুঝতে পারল নিয়মিত রেওয়াজ বা চর্চা না-করলে এমন শরীর হয় না ছেলেটাকে দুধের বাচ্চা বলে অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি।

তবে শরীরে যতই শক্তি থাক, এত অল্প বয়সে পাকা লাঠিয়ালের সঙ্গে লড়াই দেওয়ার ক্ষমতা বড়ো একটা হয় না। বেশিক্ষণ লড়াই চললে দমের লড়াইতেই ছেলেটা জিতে যেতে পারে, সেই সুযোগ দিতে রাজি নয় কৈলাস–

বাঁ-দিকে পাঁয়তারা করে এগিয়ে গেল সে, পলকে দিক পরিবর্তন করে বিকট হাঁক দিয়ে সে ডান দিকে ঘুরে গিয়ে সজোরে লাঠি হাঁকাল।

আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজের লাঠি তুলে সেই আঘাত রুখে দিল নীলকণ্ঠ, পরক্ষণেই প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে–

ঠক, ঠক, ঠকাস…সংঘাতে সংঘাতে কর্কশ শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল দুটি লাঠি। লাঠিয়ালদের স্পষ্ট করে দেখা যায় না, শুধু দুটি ঘূর্ণিত চক্র যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেষ্টন করে ঘুরতে থাকে নিষ্ঠুর আক্রোশে…

হঠাৎ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল কৈলাস। নীলকণ্ঠের লাঠি আবার উঠল, আবার নামল… আবার আর্ত চিৎকার… মাটির উপর পড়ে ছটফট করতে লাগল কৈলাস! জনতা নিরাশ হল, যে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে কে জানত!

লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে নীলকণ্ঠ বলল, কৈলাস, আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে তুমি মানুষ মারতে পারো, আচমকা লোকের মাথায় লাঠি মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারো কিন্তু জোয়ান মরদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়ার ক্ষমতা তোমার নেই। ইচ্ছে করলে এখনই তোমায় সাবাড় করতে পারতাম, করলাম না দয়া করে ছেড়ে দিলাম। তবে তোমার মতো লোক বহু মানুষের দুঃখের কারণ হতে পারে, তাই তোমার ডান হাত আর বাঁ-দিকের ঠ্যাংটাকে আমি বরবাদ করে দিলাম–বুঝেছ?

কৈলাসের কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না, দারুণ যন্ত্রণায় তার চৈতন্য তখন প্রায় অবলুপ্ত…

হাতের লাঠি নীরবে রঙ্গলালের হাতে তুলে দিল নীলকণ্ঠ, তারপর ফিরে দাঁড়াল দেবীর দিকে, মা, এবার আমি যাই?

যাবে? দেবী যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল, নীলকণ্ঠের গলার আওয়াজে তার সংবিৎ ফিরে এল, হ্যাঁ, এবার তোমার যাওয়ার সময় হয়েছে। তবে যাওয়ার আগে টাকার থলিটা তুলে নাও।

হ্যাঁ, মা, নীচু হয়ে নীলকণ্ঠ থলিটা তুলে নিল, এটা আপনার হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই, কিন্তু খুনিটার গলায় বাবার তাবিজ দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল, সব ভুলে গেলাম।

নীলকণ্ঠ থলিসমেত হাত বাড়িয়ে দিল দেবীর দিকে। দেবীর দুই চোখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল তার মুখের উপর, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, থলিটা তুমি নিয়ে যাও, নীলকণ্ঠ। জমিদার কালীচরণ চৌধুরিকে বলবে টাকা আমি ফেরত দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে তার জমিদারিতে কোনো প্রজার উপর যদি অত্যাচার হয়, তাহলে তাকেই আমি দায়ী করব, আর সেদিন আমার রোষ থেকে তোমার লাঠিও তাঁকে বাঁচাতে পারবে না।

কী বলছেন মা! নীলকণ্ঠ চমকে উঠল, আপনার বিরুদ্ধে আমি লাঠি ধরব এমন কথা ভাবতে পারলেন? আপনি বল্লম তুলে বাধা না-দিলে কৈলাসের লাঠি আমার মাথাটা চুরমার করে দিত, সে-কথা আমি কোনোদিন ভুলব?

একটু থেমে সে আবার বলল, কিন্তু আপনার কাছে আমি অপরাধী। না-জেনে আপনাকে অসম্মান করেছি মা, আমায় ক্ষমা করুন।

দেবী বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠল, সে কী নীলকণ্ঠ, তুমি কখন আমায় অসম্মান করলে?

করেছি বই কী, নীলকণ্ঠের গলার স্বর দারুণ আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল, ঠাট্টা করে বলেছিলাম–দেবীদর্শন না হলে প্রণামী দেব না। তবু আমার কী ভাগ্য–ঠ্যাঙাড়ের মাঠে সত্যিই দেবীদর্শন করলাম। মা, প্রণামী তো নিলে না, সন্তানের প্রণামটা তো নেবে?

দেবী কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু তার মুখের মৃদু হাসিতেই মৌন সম্মতি বুঝে নিল নীলকণ্ঠ। নতজানু হয়ে সে হাত বাড়াল দেবীর পায়ের দিকে…

আকাশের দিকে তাকিয়ে রঙ্গলাল বলল, মা, চাঁদ যে ঢলে পড়ল। এবার বোধ হয় যাওয়ার সময় হয়েছে।

মাঠের উপর আবছা অন্ধকারে ভুবনডাঙা গ্রামের দিকে একটা চলমান ছায়ামূর্তি তখনও দেখা যাচ্ছে–সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দেবী বলল, হ্যাঁ, রঙ্গলাল, এবার আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। ভোরের আগেই বজরা ধরতে হবে।

Previous Post

ডুয়েল – ময়ূখ চৌধুরী

Next Post

কোথাও কেউ নেই – হুমায়ূন আহমেদ

মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

No Result
View All Result
  • আত্মজীবনী
  • ইতিহাস
  • উপন্যাস
  • কবিতা
  • কাব্যগ্রন্থ
  • গল্পের বই
  • গোয়েন্দা কাহিনী
  • ছোট গল্প
  • জীবনী
  • দর্শন
  • ধর্মীয় বই
  • নাটকের বই
  • প্রবন্ধ
  • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
  • বৈজ্ঞানিক বই
  • ভূতের গল্প
  • রহস্যময় গল্পের বই
  • রোমাঞ্চকর গল্প
  • রোম্যান্টিক গল্পের বই
  • শিক্ষামূলক বই
Next Post
কোথাও কেউ নেই - হুমায়ূন আহমেদ

কোথাও কেউ নেই - হুমায়ূন আহমেদ

  • আমাদের সম্পর্কে
  • যোগাযোগ
  • গোপনীয়তা নীতি

© 2022 BnBoi - All Right Reserved

No Result
View All Result
  • বাংলাদেশী লেখক
    • অতুলচন্দ্র গুপ্ত
    • অভিজিৎ রায়
    • আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
    • আনিসুল হক
    • আবু ইসহাক
    • আবু রুশদ
    • আবুল আসাদ
    • আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
    • আবুল বাশার
    • আরজ আলী মাতুব্বর
    • আল মাহমুদ
    • আসাদ চৌধুরী
    • আহমদ ছফা
    • আহমদ শরীফ
    • ইমদাদুল হক মিলন
    • উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
    • কাসেম বিন আবুবাকার
    • জসীম উদ্দীন
    • তসলিমা নাসরিন
    • দাউদ হায়দার
    • দীনেশচন্দ্র সেন
    • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
    • নিমাই ভট্টাচার্য
    • প্রফুল্ল রায়
    • প্রমথ চৌধুরী
    • ময়ূখ চৌধুরী
    • মহাদেব সাহা
    • মাহমুদুল হক
    • মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    • হুমায়ূন আহমেদ
  • ইন্ডিয়ান লেখক
    • অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
    • অতুল সুর
    • অদ্রীশ বর্ধন
    • অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • অনীশ দেব
    • অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • অমিয়ভূষণ মজুমদার
    • আশাপূর্ণা দেবী
    • আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    • ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
    • কাজী নজরুল ইসলাম
    • ক্ষিতিমোহন সেন
    • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
    • তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
    • দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
    • নারায়ণ সান্যাল
    • নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    • নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    • পাঁচকড়ি দে
    • পূর্ণেন্দু পত্রী
    • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    • বিমল মিত্র
    • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
    • হেমেন্দ্রকুমার রায়
  • বিভাগসমূহ
    • আত্মজীবনী
    • ইতিহাস
    • উপন্যাস
    • কবিতা
    • কল্পকাহিনী
    • কাব্যগ্রন্থ
    • খেলাধুলার বই
    • গল্পের বই
    • গোয়েন্দা কাহিনী
    • ছোট গল্প
    • জীবনী
    • দর্শন
    • ধর্মীয় বই
    • নাটকের বই
    • প্রবন্ধ
    • বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
    • বৈজ্ঞানিক বই
    • ভূতের গল্প
    • মুক্তিযুদ্ধের-বই
    • রহস্যময় গল্পের বই
    • রোমাঞ্চকর গল্প
    • রোম্যান্টিক গল্পের বই
    • শিক্ষামূলক বই
    • সমগ্র
  • সিরিজ বই
    • মিসির আলী সমগ্র
    • হিমু সিরিজ

© 2022 BnBoi - All Right Reserved

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In