- বইয়ের নামঃ ডুয়েল
- লেখকের নামঃ ময়ূখ চৌধুরী
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আফ্রিকার অভিশাপ
১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে সিয়েরা লিওন নামক স্থানে উপস্থিত হলেন: একজন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোকের নাম হ্যারি উইগিনস।
যে সময়ের কথা বলছি সেই সময় সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ। পূর্বোক্ত অঞ্চলের সৈন্যবাহিনীর জন্য পানীয় জল সরবরাহের বিভিন্ন পরিকল্পনা করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার। ওই পরিকল্পনাগুলিকে কার্যকরী করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার হ্যারি উইগিনস সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আফ্রিকার মাটিতে পদার্পণ করলেন।
বেশ কিছুদিন কাজ করার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সরকারের পক্ষ থেকে হ্যারিকে পাঠানো হল রিজেন্ট নামক একটি নিগ্রো পল্লিতে। জায়গাটার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলেন হ্যারি। কিন্তু জলের রিজার্ভয়ার বসাতে গিয়ে তিনি দেখলেন, পরিকল্পনা কার্যকরী করার প্রধান বাধা হচ্ছে ঘনসন্নিবিষ্ট লতাগুল্ম ও ঝোপজঙ্গলের নিবিড় সমাবেশ। জলের পাইপ বসাতে গেলে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করা দরকার, অতএব একদল স্থানীয় মজুরকে জঙ্গল সাফ করার কার্যে নিযুক্ত করা হল।
কয়েকদিন ভালোভাবেই কাজ চলল। তারপরই হল গোলমালের সূত্রপাত। একদিন সকাল বেলা কার্যস্থলের কাছাকাছি এসে হ্যারি অনুভব করলেন, চারিদিকে বিরাজ করছে এক অস্বাভাবিক নীরবতা। মজুরদের কোলাহল অথবা জঙ্গলের ওপর ম্যাচেট নামক ধারালো অস্ত্রের আঘাতজনিত শব্দ একেবারেই শোনা যাচ্ছে না। সব চুপচাপ।
এই অস্বাভাবিক নীরবতার কারণ অনুসন্ধান করতে অকুস্থলের দিকে সবেগে পদচালনা করলেন হ্যারি। যথাস্থানে গিয়ে হ্যারি দেখলেন, মজুরেরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের সামনে মাটি থেকে প্রায় চার ফুট উপরে ঝুলছে এক অদ্ভুত দোলনা।
দোলনাটাকে টাঙানো হয়েছে একটা ময়লা কাপড়ের সাহায্যে। নানারকম আজেবাজে জিনিস রয়েছে দোলনার ভিতরে। ওইসব জিনিসের মধ্যে যে-বস্তুটি হ্যারির দৃষ্টি আকৃষ্ট করল সেটি হচ্ছে সবুজ রং-এর একটি বোতল।
বোতলটা শূন্যগর্ভ নয়, তার মধ্যে রয়েছে খানিকটা তরল পদার্থ। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হ্যারি বুঝলেন, উক্ত তরল পদার্থটি ময়লা জল ছাড়া আর কিছুই নয়।
একটা বিশ্রী দোলনার সামনে এতগুলো কাজের লোক কাজ না-করে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে হ্যারি খেপে গেলেন। মজুরদের সর্দারের কাছে কৈফিয়ত চাইতেই সে জানাল, ওটা ভূতের ওঝার জাদু; ওই বিপজ্জনক জাদুর দোলনাটা সরিয়ে নিলেই তারা মন দিয়ে কাজ করতে পারে।
এই কথা শুনে হ্যারি দৃঢ়পদে দোলনার দিকে অগ্রসর হলেন! সঙ্গেসঙ্গে সমবেত জনতা হাঁ হাঁ করে উঠল–মজুররা সভয়ে জানাল মাসা যেন ওই দোলনা স্পর্শ না-করেন; কারণ যে-ওঝা ওখানে জাদু খাঁটিয়েছে, একমাত্র সেই ব্যক্তি ছাড়া অপর কেউ ওই দোলনা স্পর্শ করলে তার মৃত্যু অবধারিত।
আফ্রিকাতে উইচ-ডক্টর বা ভূতের ওঝার প্রতাপ সাংঘাতিক। স্থানীয় মানুষ ওঝাদের যমের মতো ভয় করে। কিন্তু হ্যারি উইগিনস ইংরেজ; তিনি যখন শুনলেন, যে-ওঝা এই কাণ্ড করেছে তাকে ডেকে আনতে হলে পুরো একটা দিন বসে থাকতে হবে, তখন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।
লাথি মেরে দোলনাটাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন ঘন জঙ্গলের গর্ভে!
দারুণ আতঙ্কে নিগ্রো মজুরের দল মাটিতে শুয়ে পড়ল। একটু পরে মুখ তুলে তারা দেখল তাদের মাসা মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং তার দেহের উপর মৃত্যুর কোনো লক্ষণ নেই।
নিগ্রো মজুররা আশ্চর্য হয়ে গেল।
তারা ভেবেছিল দোলনাতে লাথি মারার সঙ্গে সঙ্গে মাসার মৃত্যু হবে, কিন্তু হ্যারিকে জীবিত দেখে তাদের ধারণা হল ভূতের ওঝার চাইতে মাসা অনেক বড়ো জাদুকর।
এমন ক্ষমতাশালী জাদুকর সহায় থাকলে আর ভয় কীসের? অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়ে মজুরের দল কাজে লেগে গেল।
তারপরেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা।
দোলনাতে লাথি মারার এক সপ্তাহের মধ্যেই হ্যারি দেখলেন, তার ডান হাতের মধ্যম আঙুলটি ভীষণ ফুলে উঠেছে, সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে দারুণ যন্ত্রণা।
হ্যারি নিকটবর্তী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। ওই চিকিৎসকটি শ্বেতাঙ্গ নন, চিকিৎসাশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এক স্থানীয় অধিবাসী। দোলনাঘটিত ব্যাপারটি ইতিমধ্যেই উক্ত নিগ্রো চিকিৎসকের কানে এসেছিল, আঙুলের চিকিৎসা না-করে তিনি হ্যারিকে ওঝার সঙ্গে মিটমাট করার পরামর্শ দিলেন।
বিজ্ঞানসম্মত ইউরোপীয় পদ্ধতিতে সুপণ্ডিত এক নিগ্রো চিকিৎসকের কাছে হ্যারি এমন ব্যবহার আশা করেননি। হ্যারি চিকিৎসা করার জন্যই চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন, উপদেশ চাইতে আসেননি। চটে-মটে তিনি স্থানত্যাগ করলেন। স্থানীয় নিগ্রো বন্ধুরাও হ্যারিকে বার বার ওঝার সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু হ্যারি কারুর কথায় কান দিলেন না। তার আঙুলের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হতে লাগল।
ওই সময়ে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে আবির্ভূত হল এক দারুণ সংক্রামক জ্বরব্যাধি। সংক্রামক জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নিগ্রো পল্লি ছেড়ে হ্যারি ফ্রি-টাউন শহরে উপস্থিত হলেন এবং সেখানকার মিলিটারি হাসপাতালের শরণাপন্ন হলেন।
হ্যারিরও জ্বর হয়েছিল। প্রায় চার মাস পরে সুস্থ হয়ে তিনি কার্যস্থলে ফিরে গেলেন। তার আঙুলটা কিন্তু মিলিটারি হাসপাতালের নিপুণ চিকিৎসাকেও পরাজিত করল, আঙুলের ক্ষত কিছুতেই আরোগ্য লাভ করল না। হ্যারি ডান হাতটাকে একটা কাপড়ে বেঁধে গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতেন।
হ্যারির বন্ধুবান্ধব এবং তার অধীন নিগ্রো মজুররা বার বার তাকে ওঝার সঙ্গে দেখা করে মিটমাট করতে উপদেশ দিল। কিন্তু হ্যারি তার সংকল্পে অটল, কিছুতেই তিনি ওঝার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন না।
হঠাৎ একদিন সকালে ওঝা নিজেই এল হ্যারির সঙ্গে দেখা করতে। ওঝার পোশাক পরিচ্ছদে অবশ্য যদি সেটাকে পরিচ্ছদ বলা যায় সত্যিই কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল। তার অধমাঙ্গের কিছু অংশ আবৃত করে ঝুলছে বাঁদরের চামড়া এবং উক্ত বানরচর্মের সঙ্গে সংলগ্ন হয়েছে মানুষের হাতের হাড়, কঙ্কাল-করোটি, শুষ্ক গিরগিটি প্রভৃতি বিচিত্র ও বীভৎস জন্তু।
পরস্পরের ভাষা বুঝতে যদি অসুবিধা হয়, সেজন্য হ্যারি তার নিগ্রো ভৃত্যকে ওঝার সামনে হাজির করলেন। ভৃত্যটি ওঝার সান্নিধ্য পছন্দ করেনি, কিন্তু প্রভুর আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হল।
অবশ্য কথাবার্তা বলতে বা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না। আফ্রিকায় প্রচলিত পিজিন ইংলিশ নামে অশুদ্ধ ইংরেজিতে কথোপকথন চলছিল।
হ্যারির জিজ্ঞাস্য হল, ওঝার জাদুবিদ্যা তাকে আফ্রিকার মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারেনি কেন?
ওঝা জানাল, সে আশ্চর্য হয়েছে এবং সেইজন্যই সে মাসার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ওঝা আরও জানাল যে হ্যারির আঙুলের ক্ষত সে ভালো করে দিতে পারে, অবশ্য মাসা যদি তার সঙ্গে মিটমাট করতে সম্মত হয়।
হ্যারি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, তুমি জাদুবিদ্যার সাহায্যে আমাকে মারতে পারবে না। এমনকী অস্ত্রের সাহায্যেও তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না।
নিজের গুলিভরা রিভলভার তিনি ওঝার হাতে দিয়ে বললেন, যদি সাহস থাকে আমাকে গুলি করে মারো।
ওঝা রিভলভারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, তারপর অস্ত্রটাকে হ্যারির হাতে ফেরত দিয়ে জানাল, এত ছোটো বন্দুক ছুঁড়তে সে অভ্যস্ত নয়।
হ্যারি তৎক্ষণাৎ ভৃত্যকে তার রাইফেল নিয়ে আসতে আদেশ করলেন।
রাইফেল এল। ওঝা বলল, বন্দুক ছুঁড়তে তার ভালো লাগে না, সে তরবারি চালনা করতেই অভ্যস্ত।
নাছোড়বান্দা হ্যারি ভৃত্য পাঠিয়ে নিকটবর্তী এক সৈনিক বন্ধুর কাছ থেকে একটা আর্মি সোর্ড আনালেন এবং সেই তলোয়ারটা তুলে দিলেন ওঝার হাতে।
ওঝা অস্ত্রটার ধার পরীক্ষা করে শূন্যে দুই একবার তরবারি আস্ফালন করল, তারপর বলল, শ্বেতাঙ্গদের অস্ত্র সে ব্যবহার করতে পারবে না–অতএব এই তলোয়ার দিয়ে কোনো মানুষকে হত্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
আফ্রিকার স্মারক-চিহ্ন হিসাবে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা তরবারি ক্রয় করেছিলেন হ্যারি, এইবার সেই অস্ত্রটাকে তিনি ওঝার হাতে তুলে দিলেন।
তলোয়ারটা সে হ্যারির হাতে ফিরিয়ে দিল।
হ্যারি কিন্তু তাকে ছাড়লেন না। এক ধাক্কায় ওঝাকে মাটিতে ফেলে তিনি তলোয়ারের ফলা তার কণ্ঠদেশে স্থাপন করলেন, তারপর বললেন, তুমি আমাকে মারতে পারবে না। কিন্তু আমি তোমাকে হত্যা করব। এখনই হত্যা করব।
বলাই বাহুল্য, লোকটিকে হত্যা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হ্যারির ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তাকে বে-ইজ্জত করার জন্যই হ্যারি এত কাণ্ড করছিলেন। দারুণ হাসির আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, অবরুদ্ধ হাস্যকে দমন করার চেষ্টায় তিনি প্রাণপণে ক্রোধের অভিনয় করছিলেন।
নিগ্রো ভৃত্যটি তার কম্পিত কণ্ঠস্বরে অবরুদ্ধ হাস্যের পরিবর্তে নিদারুণ ক্রোধের আভাস অনুমান করে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল।
ওঝা কিন্তু বিশেষ ভয় পায়নি। হ্যারির হাতের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল, মাসা! ওই ওষুধটাই তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
হ্যারি সচমকে নিজের হাতের দিকে তাকালেন। দুই হাতের কবজির ওপর একসময় তিনি শখ করে উলকি আঁকিয়েছিলেন। ওঝা জানাল ওই উলকির চিহ্নই নাকি তাঁকে রক্ষা করেছে।
ওঝা অসন্তুষ্ট হয়নি। সে হ্যারিকে আফ্রিকা ত্যাগ করতে বলল। সে আরও বলল, মাসা যদি আফ্রিকা না-ছাড়েন তবে তার আঙুলের ঘা কিছুতেই সারবে না।
ওঝার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। হ্যারি যতদিন আফ্রিকাতে ছিলেন ততদিন তার আঙুলের ক্ষত তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে। আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে উপস্থিত হওয়ার পর তার আঙুলের ঘা শুকিয়ে যায় এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে আরোগ্যলাভ করেন।
উপরে বর্নিত কাহিনিটি মনগড়া গল্প নয়, বাস্তব সত্য। কাহিনির স্থান, কাল, পাত্রের নামও যথাযথভাবে দেওয়া হয়েছে, কোনো কিছুর পরিবর্তন করা হয়নি।
ইয়েলো হ্যান্ড ও বাফেলো বিল কোডি
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৭ জুলাই আমেরিকার পশ্চিম অংশে যে বিখ্যাত দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেই যুদ্ধের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম ইয়েলো হ্যান্ড ও বাফেলো বিল কোডি। রেড ইন্ডিয়ানদের এক দলপতির নাম ইয়েলো হ্যান্ড। বাফেলো বিল কোডি ছিল আমেরিকার তদানীন্তন সেনাবাহিনীর জনৈক অশ্বারোহী সৈনিক।
যুদ্ধটা কী করে ঘটেছিল এইবার সেই কথাই বলছি। পূর্বোক্ত অশ্বারোহী বাহিনীর একটি দল একদিন হঠাৎ আকস্মিকভাবে শেনি জাতীয় রেড ইন্ডিয়ানদের একদল যোদ্ধার সামনে পড়ে গেল। রেড ইন্ডিয়ানদের ওই দলটা শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিল, কিন্তু তারা আমেরিকার অশ্বারোহী সৈন্যদের আক্রমণের চেষ্টা করল না। কারণ, সর্দার ইয়েলো হ্যান্ড ইতিমধ্যেই কোডিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে দল ছেড়ে এগিয়ে এসেছে। হঠাৎ এতগুলো লোকের ভিতর থেকে কোডিকে সর্দার কেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বেছে নিয়েছিল এই প্রশ্নটা হয়তো কারো মনে জাগতে পারে তাই পাঠকদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, সেই যুগে বাফেলো বিল কোডি নামটি ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের ক্রোধ আর ঘৃণার বস্তু। কারণ রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যুদ্ধে বিল কোডি অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল। কোডিকে চিনতে পেরেছিল বলেই সর্দার ইয়েলো হ্যান্ড তাকে দ্বৈরথ রণে আহ্বান করেছিল। সর্দারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এল কোডি। সর্দারও অগ্রসর হল–দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে লক্ষ করে তিরবেগে এগিয়ে আসতে লাগল, হাতে তাদের গুলিভরা রাইফেল। ধাবমান ঘোড়ার পায়ে পায়ে মধ্যবর্তী দূরত্ব যখন খুব কমে এসেছে, তখন হঠাৎ নিজের উইনচেস্টার রাইফেল তুলে গুলি ছুড়ল কোডি। ইয়েলো হ্যান্ড গুলি চালানোর সময় পেল না, তার আহত ঘোড়া মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল। পরক্ষণেই কোডি নিজের ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে ধরাশয্যা অবলম্বন করল। দুজনেই একসঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর পরস্পরকে লক্ষ করে গুলি চালাতে লাগল উন্মাদের মতো। যোদ্ধাদের মধ্যে কেউ লক্ষ্য ভেদ করতে পারল না। অবশেষে যখন তাদের গুলি ফুরিয়ে গেল তখন অকেজো রাইফেল ফেলে দিয়ে তারা কটিবন্ধের খাপ থেকে টেনে নিল শানিত ছুরিকা। সতর্ক দৃষ্টিতে পরস্পরকে নিরীক্ষণ করতে করতে গোল হয়ে ঘুরতে লাগল দুই যোদ্ধা, দুজনেই প্রতিদ্বন্দ্বীর পাঁয়তাড়ার মধ্যে ফঁক খুঁজতে খুঁজতে ব্যস্ত… আচম্বিতে যেন এক অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু-আলিঙ্গনে আবদ্ধ হল। সঙ্গেসঙ্গে ছুরির ফলকে ফলকে জাগল বিদ্যুতের চমক…
কিছুক্ষণের মধ্যেই জয় পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়ে গেল, ছুরিকাঘাতে ছিন্নভিন্ন ইয়েলো হ্যান্ড রক্তাক্ত দেহে মৃত্যুবরণ করল—মৃত্যুপণ দ্বৈরথে জয়লাভ করল বাফেলো বিল কোডি। শেনি-রেড-ইন্ডিয়ানরা তাদের সর্দারের মৃত্যুতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। একটি কথাও না-বলে তারা নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করল।
উইনস্টন চার্চিল ও পাঠান দলপতি
লেখাপড়ায় কোনোদিনই ভালো ছিলেন না স্যার উইনস্টন চার্চিল, কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তার তলোয়ারের হাত ছিল পাকা। ছাত্রজীবনেই তলোয়ারের দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি শ্রেষ্ঠ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিদ্যালয়গুলির মধ্যে তার সমকক্ষ কোনো অসিযোদ্ধা ছিল না। স্যান্ডহার্স্ট অঞ্চলে রয়েল মিলিটারি কলেজ-এ সৈনিকের শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন চার্চিল এবং সসম্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর চতুর্থ হাসার নামক সেনাবিভাগের অন্যতম অধিনায়ক হয়েছিলেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের এক পর্বতসংকুল স্থানে তিনি যখন অধীন সেনাদের নিয়ে টহল দিচ্ছিলেন, সেই সময়ে তাদের আক্রমণ করল একদল বিদ্রোহী পাঠান।
ইংরেজ সেনাদলে সৈন্যসংখ্যা ছিল খুবই কম, তাই তারা পিছু হঠে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। নিরাপদ স্থান থেকে চার্চিল দেখলেন তাঁর এক আহত সঙ্গী পাঠান দলপতির উদ্যত তরবারির নীচে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ উচ্চকণ্ঠে পাঠান সর্দারকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন।
পাঠান দলপতি সেই রণ-আহ্বান উপেক্ষা করল না। আহত সৈনিককে ছেড়ে সে এগিয়ে গেল চার্চিলের দিকে। উদ্যত তরবারি হাতে মৃত্যুপণ দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হল দুই যোদ্ধা। পাঠান বিদ্রোহীরা সরে গিয়ে যোদ্ধাদের জায়গা করে দিল। উদবিগ্ন নেত্রে শত্রুর গতিবিধি নিরীক্ষণ করতে করতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাঁয়তাড়া করল বেশ কিছুক্ষণ, তারপর অকস্মাৎ তীব্র ঝনৎকারে পরস্পরকে আলিঙ্গন করল দু-খানা শানিত তরবারি। পাঁচ মিনিট ধরে লড়াই চলার পর তরবারির এক দ্রুত সঞ্চালনে চার্চিল লড়াই শেষ করে দিলেন। রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ধরাশায়ী হল পাঠান-সর্দার। প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এল বিদ্রোহী পাঠান-বাহিনী; কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হল না। ইংরেজ সেনাদের রাইফেলগুলো ঘন ঘন অগ্নিবর্ষণ করে পাঠানদের ঠেকিয়ে রাখল এবং সেই ফাঁকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিলেন উইনস্টন চার্চিল।
উইলিয়াম অসবোর্ন ও কর্নেল ম্যাগরুডার
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার লজ এঞ্জেলস নামক স্থানে গণমান্য ব্যক্তিদের একটি ভোজসভা বসেছিল। ভোজসভা শেষে বাধল গণ্ডগোল। উইলয়াম অসবোর্ন নামে একটি লোক বলে বসল আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে মহান ব্যক্তি হচ্ছেন তার বাবা এবং তার কথার সত্যতা সম্বন্ধে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে সে ওই ব্যক্তিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করতে প্রস্তুত।
প্রতিবাদকারী ভদ্রলোকটির নাম হচ্ছে কর্নেল ম্যাগরুডার। ডুয়েল-এর নিয়ম অনুসারে যাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করা হয়, সেই ব্যক্তিরই যুদ্ধের অস্ত্র ও স্থান নির্বাচন করার অধিকার থাকে। কর্নেল ম্যাগরুডার বললেন, আমি ডিলিঞ্জার পিস্তল নিয়ে লড়ব। লড়াই হবে এখনই, এই টেবিলের দু-পাশ থেকে।
দুটি ছোটো অথচ মারাত্মক পিস্তল তখনই এসে গেল। পিস্তল দুটিতে গুলি ভরে দেওয়া হল এবং টেবিলের দু-ধারে বসে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে লক্ষ করে উঁচিয়ে ধরল হাতের অস্ত্র। অসবোর্ন তখন ভয়ে কাঁপছে; কর্নেল শান্ত নির্বিকার। দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়ম অনুসারে মধ্যস্থ নির্দেশ দিলে প্রতিদ্বন্দ্বীরা গুলি চালায়, কিন্তু কাপুরুষ অসবোর্ন নির্দেশ আসার আগেই পিস্তলের ঘোড়া টিপে দিল। ভীত বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে অসবোর্ন নিরীক্ষণ করল তার প্রতিদ্বন্দ্বী অবিচলিত ও অকম্পিত হস্তে তার দিকে পিস্তলের লক্ষ্য স্থির করছে–নিক্ষিপ্ত গুলি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। দারুণ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে অসবোর্ন কর্নেলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল। কর্নেল পিস্তল না-চালিয়ে চালালেন পা–প্রচণ্ড পদাঘাতে তিনি অসবোর্নকে ছিটকে ফেলে দিলেন। বেচারা অসবোর্ন! সে জানত না যে, দুটি পিস্তলের মধ্যেই বুলেটের পরিবর্তে ভরে দেওয়া হয়েছিল বোতলের ছিপি!
[১৯৭০]
একটি রাইফেল ও চারটি রিভলভার
গৃহযুদ্ধের আগে আমেরিকা মহাদেশের সীমানা বিস্তৃত হয়েছিল মিসিসিপি ছাড়িয়ে দূরদূরান্তরে এবং সেই সীমান্ত বিস্তারে সাহায্য করেছিল যে-অস্ত্রটি, তার নাম রাইফেল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের পরবর্তীকালে পশ্চিম আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চল ও সমভূমিতে সীমানা বিস্তারের কার্যে রাইফেলের স্থান অধিকার করল ক্ষুদ্রাকৃতি আগ্নেয়াস্ত্র রিভলভার।
আমেরিকার পূর্বাঞ্চলের মানুষ অবশ্য রাইফেলকেই প্রাধান্য দিয়েছিল, কিন্তু পশ্চিম আমেরিকার অধিবাসীরা রাইফেলের পরিবর্তে রিভলভারকে জানাল সাদর অভ্যর্থনা।
পূর্বাঞ্চলের অরণ্যচারী পদাতিকের মতো পশ্চিম আমেরিকার অশ্বারোহী অধিবাসীরাও ছিল যাযাবর। প্রতি মুহূর্তে বিপদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত ছিল দুই অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু পরিবেশ ভিন্ন হওয়ার জন্যে পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ছিল একেবারেই আলাদা, তাই অস্ত্র হিসাবে একদল গ্রহণ করল দূরপাল্লার রাইফেল–আর একদল বেছে নিল কাছের থেকে বার বার আঘাত হানার মারাত্মক অস্ত্র, রিভলভার।
পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা কাঠ কেটে আর শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত। তারা পায়ে হেঁটে চলত, দুহাত দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে ধরতে তাদের অসুবিধা ছিল না। অধিকাংশ সময়েই দূর থেকে গুলি চালিয়ে তারা বন্য পশুকে বধ করত, তাই দূরপাল্লার শক্তিশালী রাইফেল ছিল তাদের প্রিয় অস্ত্র।
অপরপক্ষে পশ্চিমের সমভূমির মানুষ পশুপালনকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং গৃহপালিত গোরুর পালের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য তারা সর্বদাই ঘোড়ার পিঠে চেপে চলাচল করত। একহাতে লাগাম ধরে আর একহাত দিয়ে রাইফেল চালাতে অসুবিধা হয় বলেই পশ্চিম আমেরিকার মানুষ রাইফেলের চাইতে রিভলভারকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
শিকারের পক্ষে রাইফেল অবশ্য প্রয়োজনীয়। রিভলভার মানুষ খুনের অস্ত্র, খুনির আদর্শ আয়ুধ! পশ্চিম আমেরিকার অধিবাসীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে বুঝে নিল ঘোড়ার পিঠেই হোক আর মাটিতে দাঁড়িয়েই হোক, মানুষ মারার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার হচ্ছে রিভলভার। পশ্চিম আমেরিকার বাসিন্দাদের মধ্যে খুনোখুনি ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। কলহরত যোদ্ধাদের মধ্যে দূরত্ব থাকত বারো থেকে চবিশ হাতের মধ্যে অত কাছ থেকে বন্দুকবাজ মানুষের পক্ষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া অসম্ভব, কাজেই যে-ব্যক্তি প্রতিপক্ষের আগেই খাপ থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে গুলি চালাতে পারত সে-ই হত জয়ী। অর্থাৎ আঙুল এবং কবজির ক্ষিপ্র সঞ্চালনের উপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করত অধিকাংশ সময়ে।
ক্রমাগত অভ্যাসের ফলে কয়েকটি মানুষ ওই ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রে এমন সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল যে, পলকের মধ্যে রিভলভার কোষমুক্ত করে তারা লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে ক্রুদ্ধ কেউটের ছোবল মারার মতোই ছিল তাদের হাত চালানোর কায়দা; যেমন ক্ষিপ্র, প্রাণঘাতী নিশানায় তেমনই নির্ভুল নিষ্ঠুর।
সুতরাং গৃহযুদ্ধের পরে পশ্চিম আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে শুরু হল রিভলভারের জয়যাত্রা–ভোজনশালায়, খনি শ্রমিকের তাবুতে তাঁবুতে, পশুপালনের কেন্দ্রস্থলে এবং শহরে শহরে জাগল রিভলভারের কর্কশ গর্জনধ্বনি–দুর্ধর্ষ রেড ইন্ডিয়ানদের বার বার হটিয়ে দিয়ে সাদা মানুষের অধিকারভুক্ত সীমারেখা বাড়িয়ে দিল মৃত্যুবর্ষী রিভলভার, কিন্তু ওই ক্ষুদ্র অস্ত্রটির মহিমায় আইনশৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পশ্চিম আমেরিকার বুকে।
দাঙ্গাকারী ও আইন রক্ষকদের সেই সময়ে রিভলভারের আদর ছিল রাইফেলের চাইতে অনেক বেশি। রাইফেল দ্রুতবেগে অগ্নিবর্ষণে, অসমর্থ, মন্থর। রিভলভার ক্ষিপ্রগামী মৃত্যুর যন্ত্রদূত, হত্যাকারীর হাতে অমোঘ হাতিয়ার।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, পশ্চিম আমেরাির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্রের লড়াইতে চার-চারটি রিভলভারের গর্জিত মহিমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল একটি মাত্র রাইফেল।
১৮৮৭ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে ৪ তারিখে আরিজোনার হলব্রুক শহরে যে রক্তাক্ত যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তার বিবরণ দেওয়ার আগে পূর্বোক্ত হলব্রুক শহর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
চারদিকে বালি আর বালি, দক্ষিণে বালুকাসমুদ্রের বুকে সারিবদ্ধ পাহাড়। পাহাড়ের সারির মধ্যে অবস্থান করছে অ্যাপাচি নামক দুর্ধর্ষ রেড-ইন্ডিয়ান জাতি–ওই মরু ও পর্বতবেষ্টিত হলব্রুক এক ক্ষুদ্র শহর। কিন্তু আকারে ছোটো হলেও একটি কারণে হলব্রুক শহরের কিছু গুরুত্ব ছিল শহরের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিল সান্টা ফি রেল এবং ওই রেলপথ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বড়ো বড়ো র্যাঞ্চ বা গোশালা থেকে গোরুর পাল আসত হলব্রুক শহরে এবং সেখানেই বেচাকেনা চলত।
হলব্রুক আকারে ক্ষুদ্র, প্রকৃতিতে ভয়ংকর। শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের পক্ষে ওই শহরটি মোটেই আদর্শ স্থান ছিল না। ওই শহরে যারা ঘেরাফেরা করত তাদের কোমরে চামড়ার খাপে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার এবং দেয়ালের মতো নিরেট কোনো বস্তুতে পিঠ না-লাগিয়ে তারা কেউ বসত না। কারণ, অতর্কিতে পিছন থেকে গুলি খাওয়ার ভয়ানক সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা সকলেই ছিল বিলক্ষণ সচেতন। কিন্তু পূর্বোক্ত ভয়ানক ভদ্রলোকরাও একটি মানুষকে সভয়ে এড়িয়ে চলত মানুষটির নাম অ্যান্ডি কুপার।
লোকটির নাম অ্যান্ডি কুপার কি অ্যান্ড ব্লেভান্স সে-বিষয়ে কিছু মতবিরোধ ছিল। অনেকের মতে অ্যান্ডি হচ্ছে ব্লেভান্স গোষ্ঠীর মানুষ, তবে ব্লেভান্স ভাইদের সভাই। অনেকের মত আবার অন্যরকম। তবে এ-বিষয়ে যে-গল্পটা সবচেয়ে প্রচলিত, সেটি হচ্ছে অ্যান্ডি ব্লেভান্স নামক মানুষটিকে টেক্সাস অঞ্চলের এক দুর্দান্ত শেরিফ খুনের অপরাধে গ্রেপ্তার করতে সচেষ্ট হয়– পূর্বোক্ত শেরিফ নাকি লক্ষ্য ভেদে সিদ্ধহস্ত এবং অপরাধীর সাক্ষাৎ পেলেই সে প্রথমে গুলি চালায়, পরে প্রশ্ন করে। এহেন শেরিফের কবল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই টেক্সাস থেকে পলাতক অ্যান্ডি ব্লেভান্স নাকি নাম বদলে অ্যান্ডি কুপার হয়ে গেছে।
সে যাই হোক, অ্যান্ডি কুপার বা অ্যান্ডি ব্লেভান্স ছিল ভয়ানক ব্যক্তি। কুখ্যাত ব্লেভান্স পরিবারের সে ছিল নেতা। ওই পরিবারের সব মানুষই ছিল রিভলভার চালনায় সিদ্ধহস্ত। ভয়ংকর ঘটনার পর ঘটনার স্রোতে রচিত হয়েছিল ব্লেভান্স পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাস।
মার্ক ব্লেভান্স ছিল বাপ, তার পাঁচটি পুত্র সন্তান–অ্যান্ডি, হ্যাঁম্পটন, চার্লস, জন এবং স্যাম। স্যামের বয়স ছিল মাত্র ষোলো, কিন্তু ওই বয়সেই সে রিভলভার ছুড়ত পাকা বন্দুকবাজের মতো।
ম্যাগেল্লান পর্বতমালার বিস্তৃত তৃণ-আচ্ছাদিত উপত্যকা ছিল পশুচারণের পক্ষে চমৎকার জায়গা। প্রথমে ওখানে গোরুর পাল নিয়ে এল রাখালের দল, তারপরই হল সেখানে মেষপালকের আবির্ভাব। ফলে প্রচণ্ড কলহ। গোপালকদের সঙ্গে মেষপালকদের যুদ্ধ বাধল।
গোপালকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল গ্রাহাম পরিবার, বিরোধী মেষপালকদের নেতা ছিল টিউকসবেরি নামক আর একটি গোষ্ঠী। ওই যুদ্ধকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়–প্লেজেন্ট ভ্যালি ওয়ার, গ্রাহাম-টিউকসবেরি দাঙ্গা, ম্যাগেল্লান যুদ্ধ প্রভৃতি। আরিজোনা প্রদেশে সংঘটিত যাবতীয় দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল পূর্বোক্ত যুদ্ধ।
ওই লড়াইতে অন্তত বিশ জন লোক মারা গিয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবার ছিল গোপালকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী। ১৮৮৭ সালে জুলাই মাসে পরিবারের কর্তা মার্ক ব্লেভান্স হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সেই সময় তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। সাত বছর পরে একটি ফাঁপা গাছের গুঁড়ির মধ্যে এক অস্থিময় নরমুণ্ডের সঙ্গে যে-রাইফেলটা পাওয়া গিয়েছিল, সেই রাইফেলটিকে মার্ক ব্লেভান্সের নিজস্ব অস্ত্র বলে শনাক্ত করা হয়েছিল। মুণ্ডহীন দেহটিকে উদ্ধার করা যায়নি, মার্কের হত্যাকারীরও সন্ধান করতে পারেনি কেউ।
জুলাই মাসে মার্ক ব্লেভান্স মারা গেল, অগাস্টে দাঙ্গার বলি হল ব্লেভান্স পরিবারের দ্বিতীয় ব্যক্তি—মার্কের মেজো ছেলে হ্যাম্পটন ব্লেভান্স অতর্কিতে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করল।
টিউকসবেরি দলের লোকরাই নিশ্চয় গুলি করে মেরেছিল হ্যাঁম্পটনকে। বাপ এবং পাঁচ ছেলের মধ্যে দুজন মারা পড়ল, রইল বাকি চার। মার্কের চারটি ছেলেই ছিল রিভলভার চালাতে ওস্তাদ। ষোলো বছরের কিশোর স্যামও লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে। ওই চারটি ছেলেই প্রতিশোধ গ্রহণে কৃতসংকল্প, তারা টিউকসবেরির দলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুযোগের প্রতীক্ষা করছিল সাগ্রহে।
সুযোগ এল। টিউকসবেরিদের গোশালার কাছেই গুলির আঘাতে মারা পড়ল জন টিউকসবেরি এবং তার অংশীদার বিল জ্যাকব। দুজনকেই পিছন থেকে গুলি করা হয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি যে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে-বিষয়ে শহরবাসীর সন্দেহ ছিল না একটুও কিন্তু, প্রমাণ কোথায়?
অ্যান্ডি কুপারের একটি দোষ ছিল। খুনখারাপি করে সে চুপচাপ থাকতে পারত না, নিজের বীরত্বের কাহিনি সে বলে বেড়াত বুক ফুলিয়ে। জোড়া খুনের ব্যাপারটাও সে চেপে রাখতে পারল না বা চাইল না–সগর্বে সে জানিয়ে দিল জন টিউকসবেরি ও বিল জ্যাকবকে সে নিজের হাতে গুলি করে মেরেছে।
হলব্রুক শহরের মার্শাল লোকমুখে ব্যাপারটা জানতে পারলেন। মার্শাল মহাশয় জানতেন অ্যান্ডিকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে সুবোধ বালকের মতো ধরা দিতে রাজি হবে না এবং তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসবে উদ্যত রিভলভার নিয়ে ব্লেন্স পরিবারের চার ভাই–গরম গরম গুলির ঝড়ে প্রাণ বিপন্ন করে আইনরক্ষার আগ্রহ দেখালেন না মার্শাল, সব জেনেশুনেও তিনি চুপ করে রইলেন।
সকলেই ভাবল ব্যাপারটা এখানেই চুকে গেল। কিন্তু তা হল না, আইন রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে শহরে প্রবেশ করল অশ্বারোহী নূতন শেরিফ–কমোডোর ওয়েন্স।
নবাগত শেরিফের কয়েকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তার কোমরের বাঁ-দিকে খাপে-আটকানো রিভলভারের বাঁট ছিল সামনের দিকে ফেরানো অর্থাৎ অস্ত্রটা হস্তগত করতে হলে তাকে নিজের শরীরের ওপর দিয়ে হাত চালাতে হবে। ওইভাবে খাপের রিভলভার বার করতে গেলে যথেষ্ট দেরি হয়, সকলেই জানে সঙিন মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে রিভলভার হস্তগত করে গুলি চালাতে না-পারলে প্রতিপক্ষের গুলিতে রিভলভারধারীর মৃত্যু অনিবার্য অতএব, বন্দুকবাজ মানুষ মাত্রেই কোমরের ডান দিকে রিভলভার রাখে এবং অস্ত্রের বাঁট থাকে পিছনদিকে ফেরানো, কারণ, ওই অবস্থায় রিভলভারটাকে চটপট টেনে খাপ থেকে বার করা যায়।
সুতরাং কোমরের বাঁ দিকে সামনের-দিকে-ফেরানো রিভলভারের বাঁট নিয়ে কমোেডোর ওয়েন্স নামে নূতন শেরিফ যখন গুন্ডার রাজত্ব হলব্রুক শহরে প্রবেশ করল, তখন তাকে দেখে শহরবাসীর মুখে মুখে ফুটল বিদ্রুপের হাসি।
ওয়েন্সের চেহারাও আদর্শ আইনরক্ষকের মতো ছিল না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত পাকা বন্দুকবাজ মানুষের মুখে-চোখে যে রুক্ষ কাঠিন্যের আভাস থাকে, গোঁফ-দাড়ি-কামানো ওয়েন্সের পরিচ্ছন্ন মুখে সেই ধরনের অভিব্যক্তি অনুপস্থিত। উপরন্তু মস্ত বড়ো টুপির তলা থেকে লম্বা লম্বা সোনালি চুল ঘাড় অবধি নেমে এসে তার চেহারাটাকে করে তুলেছে শৌখিন ভদ্রলোকের মতো।
তবে হ্যাঁ, তার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল লোকটি পাকা ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার পিঠে জিনের সঙ্গে ওয়েন্সের পায়ের ফাঁকে ঝুলছিল একটি উইনচেস্টার রাইফেল।
হঠাৎ হলব্রুক শহরে শেরিফ হয়ে এই মানুষটি কেন প্রবেশ করল সে-কথা জানতে হলে কমোডোর ওয়েন্স সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। কমোডোর ওয়েন্স এসেছিল টেক্সাস অঞ্চলে একপাল গোরুর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। একটি র্যাঞ্চ বা গোশালার বেতনভোগী পরিচালক ছিল সে। সেই সময় তার বয়স ছিল ৩৫, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ওয়েন্স ছিল সম্মানিত ব্যক্তি।
একদিন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার টাকা লুঠ করার চেষ্টা করল তিনটি চোর। তাদের চেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি, কিন্তু চোরদের তো গ্রেপ্তার করা দরকার?–তবে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধে কে? প্রত্যেকটি অপরাধী যেখানে খুন করতে অভ্যস্ত, সেখানে চোরের পিছনে তাড়া করা আর আত্মহত্যার চেষ্টা করায় তফাত কিছু নেই–অতএব শেরিফের দায়িত্ব নিয়ে শান্তিরক্ষার কর্তব্যপালন করার আগ্রহ কেউ দেখাল না।
কিন্তু কমোডার ওয়েন্সকে যখন আত্মহত্যার সহজ পথ দেখানো হলো, অর্থাৎ শেরিফের পদে নিয়োগ করার প্রস্তাব দেওয়া হল, সে রাজি হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। বিভিন্ন অঞ্চলের অপরাধীদের পাকড়াও করে সেন্ট জন নামক ছোটো শহরের বিচারালয়ে উপস্থিত করার দায়িত্ব নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে হলব্রুক শহরে এসে পৌঁছোল কমোডোর ওয়েন্স।
তাবৎ হলব্রুক শহর ওয়েন্সকে দেখে হাসাহাসি করতে লাগল–লম্বা সোনালি চুল আর উলটোদিকে ফেরানো রিভলভার নিয়ে এই মেয়েমুখো শেরিফটা যে অতি শীঘ্রই গুলি খেয়ে মরবে, সে-বিষয়ে শহরবাসীর সন্দেহ ছিল না কিছুমাত্র।
নূতন শেরিফ শান্তভাবে তার বাহিনীকে দাঁড় করাল ব্রাউন অ্যান্ড কাইন্ডার নামে ভাড়াটে আস্তাবলের কাছে, তারপর ঘোড়াটাকে যথাস্থানে রেখে অফিসের ভিতর প্রবেশ করল।
একটি ছোকরা এতক্ষণ অফিসে বসে ভাঙা বেহালা মেরামত করছিল। সে ওয়েন্সকে দেখে উঠে দাঁড়াল, তারপর বাইরে বেরিয়ে গেল ধীর পদক্ষেপে।
ওই ছোকরা হচ্ছে জন ভোন্স, ব্রেভান্স ভাইদের চতুর্থ ভ্রাতা। সে আগে কখনো ওয়েন্সকে দেখেনি, কিন্তু লোকের মুখে মুখে লম্বা চুলওয়ালা নূতন শেরিফের বর্ণনা তার শ্রুতিগোচর হয়েছিল। এখন ওয়েন্সকে দেখেই সে তার পরিচয় আন্দাজ করে নিল এবং ওইসঙ্গে এ-কথাও ভেবে নিল যে, নূতন শেরিফের হঠাৎ উপস্থিতির সঙ্গে তার বড়ো ভাই অ্যান্ডি কুপারের একটা অশুভ যোগসূত্রের কার্যকারণ সম্বন্ধ থাকা বিচিত্র নয়–হয়তো অ্যান্ডিকে গ্রেপ্তার করার জন্যই আবির্ভূত হয়েছে শেরিফ ওয়েন্স। অতএব কনিষ্ঠের কর্তব্য হিসাবে সে চটপট যাত্রা করল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অ্যান্ডির সন্ধানে, তাকে এখনই সাবধান করে দিতে হবে যে!
সত্যি কথা বলতে কী, ওয়েন্সের কাছে অ্যান্ডি কুপারের নামে একটা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু পরোয়ানায় তাকে খুনি বলে অভিযুক্ত করা হয়নি, সেটা ছিল ঘোড়া চুরির অভিযোগ। ওয়েন্স আর অ্যান্ডি ছিল পূর্বপরিচিত। ওই ঘোড়া চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আগেও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল। এর মধ্যে চুরির অভিযোগ আদালতে উঠেছে, আর অভিযুক্ত অ্যান্ডি কুপারকে গ্রেপ্তার করার ভার নিয়ে হলব্রুক শহরে উপস্থিত হয়েছে কমোডোর ওয়েন্স। কিন্তু আসল ব্যাপারটা ছিল সকলের কাছেই অজ্ঞাত। তাই জন ব্লেভান্স যখন ভ্রাতৃবর অ্যান্ডিকে শেরিফের আগমন-সংবাদ পরিবেশন করতে ছুটল, সেও ভেবে নিল যে, সদ্য-সংঘটিত জোড়া খুনের তদন্ত করার জন্যই এই অঞ্চলে শেরিফ ওয়েন্সের শুভাগমন–অতএব অ্যান্ডি কুপারের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন।
হলব্রুক পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে খোশমেজাজে আড্ডা দিচ্ছিল অ্যান্ডি কুপার। অকস্মাৎ হন্তদন্ত হয়ে সেখানে জন ব্লেন্সের আবির্ভাব!
ওহে অ্যান্ডি, শহরে ওয়েন্স এসেছে।
জানি। অ্যান্ডি বলল।
অ্যান্ডি আগেই অশ্বারোহী ওয়েন্সকে দেখতে পেয়েছিল। তখন সে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু এখন ভাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে হঠাৎ অনুভব করল, আবহাওয়া মোটেই সুবিধের নয়।
অ্যান্ডি কুপার ছিল চোর এবং খুনি। অনেকবারই সে গোরু ঘোড়া চুরি করেছে। বহু চৌর্যবৃত্তির মধ্যে যেকোনো একটি চুরির অভিযোগ তার নামে থাকতে পারে, তার চেয়েও মারাত্মক ব্যাপার হচ্ছে সদ্য সদ্য দুটি মানুষ খুন করে সে শহরময় তার কীর্তির কথা প্রচার করেছে নিজমুখে এখন সেই খুনের অভিযোগে যদি ওয়েন্স তাকে গ্রেপ্তার করতে এসে থাকে তাহলে তো সময় থাকতে সাবধান হওয়া দরকার।
মুহূর্তের মধ্যে সংকল্প স্থির করল অ্যান্ডি কুপার।
আমি র্যঞ্চে যাচ্ছি, জনকে উদ্দেশ করে বলল অ্যান্ডি।
ক্যানিয়ন ক্রিক নামক স্থানে ব্লেভান্স পরিবারের একটি গোশালা ছিল। কয়েকটা গোরু ওখানে থাকত। অনেকে বলে, গোরু ঘোড়া চুরি করে পাচার করার জন্য লোকের চোখে ধুলো দিতে ওই গোশালাটি রেখেছে ব্লেন্স পরিবার। ওই জায়গাটিরই উল্লেখ করেছিল অ্যান্ডি বন্ধুদের সামনে।
ভাইকে তার পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিয়ে অ্যান্ডি তার ঘোড়াটাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলল। যে-বাড়িতে ব্লেভান্সরা থাকত, সেই বাড়িটা ছিল পূর্বে উল্লিখিত ব্রাউন অ্যান্ড কাইন্ডার নামে আস্তাবলটির কাছে। বন্ধুদের শুনিয়ে সে বলল বটে র্যাঞ্চই হচ্ছে তার গন্তব্যস্থল, কিন্তু ভাইকে আস্তাবল থেকে ঘোড়াটাকে নিয়ে যেতে বলে সে রওনা দিল বাড়ির দিকে কমোডোর ওয়েন্সকে সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল।
আগেই বলেছি অ্যান্ডি এবং ওয়েন্স পরস্পরের পরিচিত ছিল। কাজেই হলব্রুক শহরের লোক ওয়েন্সের চেহারা ও হাবভাব দেখে যতই হাসাহাসি করুক, অ্যান্ডি ভালো করেই জানত কমোডোর ওয়েন্স কোন ধরনের মানুষ অতএব তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মোটেই ইচ্ছুক ছিল না অ্যান্ডি।
এদিকে ওয়েন্স তার ঘোড়াটাকে আস্তাবলে রেখে দাঙ্গাবাজিতে অভ্যস্ত বন্দুকবাজ মানুষ যা করে তাই করছিল, অর্থাৎ রাইফেল ও রিভলভারের কলকবজা পরীক্ষা করে দেখছিল। রাইফেল সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে সে যখন রিভলভার পরিষ্কার করছে, সেই সময় হঠাৎ দুই ব্যক্তির আবির্ভাব স্যাম ব্রাউন ও ডি. জি. হার্ভে। দুজনেই ছিল ওয়েন্সের বন্ধু। তাদের দেখামাত্রই ওয়েন্স প্রশ্ন করল, অ্যান্ডি কুপারকে দেখেছ?
উত্তর এল, হ্যাঁ, সে এখন এই শহরেই আছে।
ঠিক তখনই প্রবেশ করল জন ব্লেভান্স, তারপর অ্যাণ্ডির ঘোড়াটাকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
তিনটি মানুষ নীরবে জনের কার্যকলাপ দেখল, তারপর মৌনভঙ্গ করল স্যাম ব্রাউন, ওই ছোকরা হচ্ছে ব্লেভান্স ভাইদের এক ভাই। আর ওটা হচ্ছে অ্যান্ডি কুপারের ঘোড়া। অ্যান্ডি এখন শহর থেকে সরে পড়তে চাইছে।
কনোডোর ওয়েন্স একটিও কথা বলল না। হাতের রিভলভার উলট করে বাঁ দিকের খাপে ঢুকিয়ে দিল, তারপর উইনচেস্টার রাইফেলটা হস্তগত করে আস্তাবলের বাইরে পদার্পণ করল। আস্তাবলের কাছেই একটু দূরে রাস্তার উপরে অবস্থান করছিল ব্লেভান্স পরিবারের বাড়ি আঙুল তুলে ওয়েন্সের বন্ধুরা তাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিল।
বাড়িটা ছিল কাঠের তৈরি, একতলা। রাস্তা থেকে ১৫ ফুট দূরে অবস্থিত ওই বাড়ির সামনের দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, তারপরই সমান্তরালভাবে চলে গেছে সান্টা ফি রেললাইন। পূর্বে উল্লিখিত আস্তাবলের পুব দিকেই ছিল ব্লেভান্স পরিবারের বাড়ি। ব্লেভান্সদের বাড়ির কাছাকাছি আরও কয়েকটা ছোটো ছোটো বাড়ি ছিল। ব্লেভান্সদের বাড়ির ঠিক আগেই যে কামারশালাটা ছিল, সেখানে এসে দাঁড়াল কমোডোর ওয়েন্স হাতে তার গুলি ভরা রাইফেল।
বাড়ির সামনের দিকে দুটো জানালা, ভিতরে সম্ভবত দুটো ঘর। ওয়েন্সের বাঁ-দিকে খানিকটা ঢাকা জায়গা, বোধ হয় সেখানেও একটা ঘর রয়েছে এবং ওই জায়গাটার সংলগ্ন বারান্দাটা ঘুরে বাড়ির সামনের অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দুটি দরজার একটি রয়েছে ঢাকা জায়গাটার দিকে, আর একটি দরজা অবস্থান করছে বাড়ির প্রধান অংশের সম্মুখে।
বাড়ির ভিতরের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিল না ওয়েন্স। তার অজ্ঞাতে বাড়ির মধ্যে জমায়েত হয়েছিল কয়েকটি নারী ও পুরুষ।
পুরুষদের মধ্যে ছিল স্বয়ং অ্যান্ডি কুপার, জন ব্লেভান্স, পরিবারের অন্যতম বন্ধু ও ওই বাড়ির অধিবাসী মোস রবার্টস এবং স্যাম হোস্টন ব্লেভান্স।
মেয়েরা ছিল সংখ্যায় তিনজন–ব্লেভান্স ভাইদের বিধবা মাতা মিসেস মেরি ব্লেভান্স, ইভা ব্লেভান্স নামে একটি ভাই-বউ, এবং মিসেস অ্যামান্ডা গ্ল্যাডেন নামে পরিবারের এক বান্ধবী।
শেরিফ ওয়েন্স যখন বাড়ির সামনে উঠানের উপর এসে দাঁড়াল, দরজাগুলি তখন বন্ধ ছিল। ওয়েন্স উঠান থেকে বারান্দায় উঠে এল, সঙ্গেসঙ্গে বাড়ির সংলগ্ন ঢাকা জায়গাটার মধ্যে চারটি মনুষ্যমূর্তি তার চোখে পড়ল।
ওয়েন্স চিৎকার করে উঠল, অ্যান্ডি কুপার, বাইরে এসো।
ছোটো ঘরের ভিতর থেকে বড়ো ঘরে প্রবেশ করল অ্যান্ডি, পরক্ষণেই দরজা খুলে গেল ওয়েন্স দেখল তার সামনে দণ্ডায়মান অ্যান্ডি কুপার, হাতে খোলা রিভলভার।
প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ঢাকা জায়গাটার সংলগ্ন দরজায় শব্দ উঠল, অর্ধমুক্ত দ্বারপথে ওয়েন্সের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একটি পরিচিত মানুষকে আবিষ্কার করল–উদ্যত রিভলভার হাতে জন ব্লেভান্স।
কমোডোর ওয়েন্স তখন দুই ভাইয়ের মাঝখানে, তার অবস্থা রীতিমতো সংকটজনক। কিন্তু ওয়েন্সের চোখে-মুখে ভীতি বা উত্তেজনার চিহ্ন দেখা গেল না, রাইফেলটা যেমন কোমরের কাছে ধরা ছিল তেমনই রইল–শুধু তার দুই চোখের প্রখর দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে রইল অ্যান্ডির ওপর, পিছনে জন ব্লেভান্সের গতিবিধি লক্ষ করার সুযোগ বা সময় ছিল না।
শান্তস্বরে ওয়েন্স বলল, কুপার, আমি তোমাকে চাই।
গর্জে উঠল খুনি, কেন? আমাকে কী দরকার?
তোমার নামে পরোয়ানা আছে।
কীসের পরোয়ানা?
অনর্থক কথাবার্তা বলে কালক্ষেপ করতে চাইছিল অ্যান্ডি কুপার। ওই সময়ের মধ্যে বাড়ির ভিতর রিভলভারধারী তিন ব্যক্তি পছন্দমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ওয়েন্সের উপর নিশানা স্থির করার সুযোগ পাবে বলেই অ্যান্ডি সময় নষ্ট করছিল। ওয়েন্স হয়তো অ্যান্ডির উদ্দেশ্যে বুঝেছিল, কিন্তু কর্তব্য অনুসারে সে পরোয়ানার অভিযোগ ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট হল।
ঘোড়া চুরির যে ব্যাপারটা আগে তোমাকে বলেছিলাম, সেই অভিযোগই রয়েছে এই পরোয়ানাতে।
অপেক্ষা করো, এ-বিষয়ে আমি পরে ভেবে দেখব।
আমি অপেক্ষা করতে পারব না। এই মুহূর্তে তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।
অকস্মাৎ চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল অ্যান্ডি কুপার, আমি যাব না।
প্রায় একইসঙ্গে গর্জে উঠল রিভলভার ও রাইফেল।
ওয়েন্স তার রাইফেল তুলে ধরার সময় পায়নি, কোমরের কাছে ধরা অবস্থাতেই সে ট্রিগার টিপেছিল। ওয়েন্স অনুভব করল তার দেহের পাশ দিয়ে ছুটে গেল লক্ষ্যভ্রষ্ট রিভলভারের তপ্ত বুলেট, কিন্তু অ্যান্ডি কুপার প্রতিদ্বন্দ্বীর রাইফেলকে ফাঁকি দিতে পারল না–অসহ্য যাতনায় অ্যান্ডির শরীর দুমড়ে গেল দু-ভাজ হয়ে, উইনচেস্টার রাইফেলের ভারী গুলির আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল তার পাকস্থলী।
সমস্ত ঘটনাটা ঘটল মুহূর্তের মধ্যে। দু-দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই প্রায় প্রতিধ্বনির মতো আর একটি গুলির আওয়াজ শোনা গেল। খিড়কির দরজা থেকে গুলি চালিয়েছে জন ব্লেভান্স।
অত কাছ থেকে জনের মতো পাকা বন্দুকবাজ কী করে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বলা মুশকিল, খুব সম্ভব ওয়েন্স চটপট সরে গিয়েছিল–তবে গুলিটা যে ফসকে গিয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। একটু দূরেই বাঁধা ছিল অ্যান্ডির ঘোড়া–ওয়েন্সের উদ্দেশে নিক্ষিপ্ত বুলেট এসে লাগল তার গায়ে। জন্তুটা মারা পড়ল তৎক্ষণাৎ।
ওয়েন্সের রাইফেল তখনও কোমরের কাছেই নীচু করে ধরা ছিল। অস্ত্রটাকে না-তুলে সেই অবস্থাতেই সে সাঁৎ করে জনের দিকে ঘুরে গেল এবং পরক্ষণেই অভ্যস্ত আঙুলের চাপে রাইফেল করল অগ্নি-উদগিরণ।
পিছন দিকে ঘুরে পড়ে গেল জন ব্লেভান্স। গুলির আঘাতে তার একদিকের কাঁধ চূর্ণবিচূর্ণ।
একলাফে বারান্দা থেকে নেমে রাস্তার উপর এসে দাঁড়াল ওয়েন্স, এর মধ্যেই সে রাইফেলের লিভার টেনে শূন্য গুলির খোল ফেলে নূতন টোটা ভরে ফেলেছে। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দু-দিকের দরজার উপরই সে নজর রাখতে পারছিল। পলকের জন্য খোলা জানালা দিয়ে অ্যান্ডির দেহ তার চোখে পড়ল টলতে টলতে ঘরের ভিতর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আহত খুনি। আবার গর্জে উঠল উইনচেস্টার রাইফেল, কিন্তু এবার ওয়েন্সের লক্ষ্য ব্যর্থ হল।
ঠিক সময়েই সরে গিয়েছিল ওয়েন্স, কারণ সে রাস্তায় নেমে পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই বাড়ির পুবদিকে ঘুরে সামনে এসে দাঁড়াল মোস রবার্টস, পরক্ষণেই সশব্দে অগ্নিবৃষ্টি করল তার হাতের রিভলভার।
এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম ওয়েন্স গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করল। বাড়ির সামনে একটা ওয়াগন দাঁড়িয়ে ছিল, সেই গাড়িটার পিছনে সরে এসে ওয়েন্স রাইফেল চালাল।
প্রচণ্ড আঘাতে এক পাক ঘুরে পিছিয়ে গেল রবার্টস, তারপর টলতে টলতে আত্মগোপন করল বাড়ির পিছন দিকে।
কিন্তু লড়াই তখনও শেষ হয়নি। অ্যান্ডির পরিত্যক্ত রিভলভারটা তুলে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল প্রতিশোধ গ্রহণে কৃতসংকল্প কিশোর স্যাম হোস্টন ব্লেভান্স। সে রিভলভার তুলে ওয়েন্সের দিকে লক্ষ্য স্থির করতে লাগল। কিন্তু স্যামের রিভলভার অগ্নিবর্ষণ করার সুযোগ পেল না, তার আগেই ওয়েন্সের রাইফেলের গুলি অব্যর্থ সন্ধানে প্রতিবন্দ্বীর বক্ষ ভেদ করল। স্যামের মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ। তার প্রাণহীন দেহ দরজা দিয়ে এসে পড়ল মায়ের প্রসারিত বাহুবন্ধনের মধ্যে।
কয়েক মিনিট পরে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল শেরিফ কমোডার ওয়েন্স। তার সঙ্গে এল আশেপাশে দণ্ডায়মান দর্শকের দল। মেয়েরা তখন চিৎকার করে কাঁদছে আর সাহায্য ভিক্ষা করছে।
বাড়ির ভিতরের অবস্থা তখন বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রের মতো। দেয়াল, মেঝে, আসবাবপত্র রক্তে রক্তময়। বিছানার উপর পড়ে আছে রবার্টসের দেহ, ওইখানেই এসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। সে। দরজার কাছে স্যামের প্রাণহীন শরীর মেঝের উপর লম্ববান; আর একটু দূরেই মায়ের ঘরে মেঝের উপর পড়ে অসহ্য যাতনায় ছটফট করছে অ্যান্ডি কুপার, তার উদর বিদীর্ণ করে দিয়েছে রাইফেলের বুলেট।.আর্তস্বরে অ্যান্ডি বার বার অনুরোধ করছে তাকে যেন এই মুহূর্তে গুলি করে মেরে ফেলা হয়, এই যন্ত্রণা সে আর সহ্য করতে পারছে না।
অ্যান্ডির মৃত্যু হল পরের দিন। চারজনের মধ্যে প্রাণে বেঁচেছিল শুধু জন ব্লেভান্স। অর্ধমূৰ্ছিত অবস্থায় সে বসেছিল একটা চেয়ারের উপর, তার সর্বাঙ্গ রক্তসিক্ত। সে আরোগ্যলাভ করেছিল। পরবর্তীকালে বিচারে তার কারাদণ্ডের আদেশ হয়।
কিন্তু ওই ভয়ংকর রক্তাক্ত যুদ্ধে কমোডোর ওয়েন্স ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত। সে রাইফেল ছুঁড়েছিল পাঁচবার তার মধ্যে একবারই সে ব্যর্থ হয়েছিল, বাকি চারটি গুলি লক্ষ্য ভেদ করেছিল অব্যর্থ সন্ধানে।
কাহিনি রক্তসিক্ত
১৮৬৩ সাল, গ্রীষ্মের শেষ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অধিকৃত মেক্সিকোর অন্তর্গত কলোর্যাডো টেরিটরি নামক রাজ্যে স্থানীয় শাসনকর্তা গভর্নর জন ইভান্সের কাছে চিঠি পাঠাল একজন মেক্সিকোর অধিবাসী।
তার নাম, ফিলিপ নিরিও এসপিনোসা।
ফিলিপের চিঠিতে যা লেখা ছিল তার সারমর্ম হচ্ছে, যদিও সরকার তাকে ছাব্বিশটি আমেরিকান কুকুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন, তবু পত্ৰলেখকের মতে এ-বিষয়ে স্থানীয় অধিবাসী ও সৈন্যদের মতামত গ্রহণ করা উচিত, কারণ শেষোক্ত ব্যক্তিদের মতে পত্রলেখক কর্তৃক নিহত মানুষের সংখ্যা কম করেও চল্লিশ। তবে এ-বিষয়ে জোর করে কিছু বলা যায় না, লোকে হয়তো পত্ৰলেখককে একটু বেশি সম্মান দিয়ে থাকে। যাই হোক, এই খুনখারাপির ব্যাপারটা পত্ৰলেখকের কাছে অত্যন্ত ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে, তাই সে এখন শান্তি চায়। শান্তির মূল্য হিসাবে তার কিছু চাহিদা আছে–সদয় সরকার যদি সেই যৎসামান্য দাবি পূরণ করেন, তাহলে পত্ৰলেখক ফিলিপ তার অস্ত্র নামিয়ে দলের লোকদের খুনোখুনি থেকে নিরস্ত করতে রাজি। নিম্নলিখিত শর্তগুলি পত্রে উল্লিখিত যৎসামান্য দাবি
১) ফিলিপ এবং তার দলবল সম্পর্কে যেসব হত্যা, লুণ্ঠন ও চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগগুলিকে প্রত্যাহার করে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষমা করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া চলবে না।
(২) এসপিনোসা পরিবারভুক্ত যাবতীয় ব্যক্তির অধিকৃত পশুগুলিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মেনে নিতে হবে (ওই পশুগুলি লুঠের মাল বলে সন্দেহ হলেও সে-বিষয়ে অনুসন্ধান করা চলবে না) এবং কয়েক হাজার একর জমি পূর্বোক্ত ব্যক্তিদের দান করতে বাধ্য থাকবেন আমেরিকান সরকার। শুধু তাই নয়, ওইসব জমির কাছাকাছি গো-চারণের উপযুক্ত তৃণভূমিও জমির মালিকদের দান করবেন সদাশয় সরকার। (সব মিলিয়ে পত্রে লিখিত জমির পরিমাণ সমগ্র কলোরাডো রাজ্যের এক দশমাংশ তো বটেই)।
(৩) ফিলিপ, তার ভ্রাতুস্পুত্র এবং আরও দুজন এসপিনোসা পরিবারের যোগ্য ব্যক্তি কলোরাডো ভলান্টিয়ার কোম্পানি নামক সেনাদলে ভরতি হতে চায়–অবশ্য সাধারণ সৈনিক হিসাবে নয়, ক্যাপ্টেন বা সেনানায়কের মর্যাদা দিয়েই উক্ত বাহিনীতে তাদের নিয়োগ করতে হয়। যোগ্যতার প্রমাণ হিসাবে পত্রলেখক জানিয়েছে, অত্যন্ত অসুবিধাজনক পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই করে তারা সরকারের ছাব্বিশটি প্রজাকে হত্যা করেছে, কিন্তু তাদের তরফে মারা গেছে মাত্র একজন এসপিনোসা–এটাই কি তাদের যোগ্যতার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
স্থানীয় শাসনকর্তা গভর্নর জন ইভান্স ফিলিপের চিঠি পেয়ে খুশি হলেন। দেশজোড়া অজস্র খুনখারাপির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীটিকে গ্রেপ্তার করার কাজটা সহজ হয়ে গেল। রাজধানী ওয়াশিংটনে ইভান্স সাহায্য চেয়ে পাঠালেন। উত্তর এল, গৃহযুদ্ধ নিয়ে সরকার এখন অত্যন্ত বিব্রত, অতএব নিজস্ব ক্ষমতায় গভর্নর যেন বর্তমান সমস্যার সমাধান করেন।
গভর্নর ইভান্স ওয়াশিংটনের ভরসা না-করে এইবার নিজের ক্ষমতায় সমস্যার সমাধান করতে সচেষ্ট হলেন। চিঠিতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সরকারকে সময় দেওয়া হয়েছিল। ওই পত্রে ফিলিপ জানিয়েছিল তার যুক্তিসংগত ন্যায্য শর্তগুলি সরকার যদি মেনে নিতে রাজি না থাকেন, তাহলে আবার সে যুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং তার ফলে আরও ৫৭৪ জন আমেরিকানের প্রাণহানি যে অবশ্যম্ভাবী এ-কথাটা যেন গভর্নর মনে রাখেন।
গভর্নর ইভান্স ঘোষণা করলেন, জীবিত বা মৃত ফিলিপ এসপিনোসাকে সরকারের কাছে যে হাজির করতে পারবে, সেই ব্যক্তিকে ২৫০০ ডলার পুরস্কার দেবেন সরকার।
এইবার পাঠকদের কাছে ফিলিপ এসপিনোসা নামক ভয়ানক মানুষটির পরিচয় দেওয়া দরকার। মেক্সিকো থেকে নিউ মেক্সিকোর কাঁচেটি অঞ্চলে পদার্পণ করেছিল ফিলিপ, কিন্তু ঠিক কোন সময়ে তার আবির্ভাব ঘটেছিল সে-কথা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। এসপিনোসা বংশ একটি বিরাট গোষ্ঠী–ভাই, ভাইপো, ভাগনে প্রভৃতি বিভিন্ন সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন নিয়ে বিরাট দল পরিচালনা করত পূর্বোক্ত ফিলিপ এসপিনোসা। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে সমগ্র স্প্যানিশ মেক্সিকোর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ ছিল এসপিনোসা বংশের অন্তর্গত।
স্যান লুই উপত্যকা থেকে কোর্যাডো রাজ্যের স্যান রাফাল নামক পর্বতবেষ্টিত শহরে এসে প্রথম হানা দেয় ফিলিপ এবং তার দলবল–তারপর শুধু হত্যা ও লুণ্ঠনলীলার বীভৎস ইতিহাস।
প্রথম প্রথম তারা ঘোড়া চুরি করত। একটা ঘোড়া বিক্রি করলে কম করেও পাঁচশো ডলারের প্রাপ্তিযোগ–অতএব বেশ কিছুদিন ওই লাভজনক ব্যাবসা চালিয়ে গেল ফিলিপের দল। দস্যুবৃত্তি করলেও তাদের মধ্যে রসবোধ ছিল বিলক্ষণ, তবে রসিকতার ধরনটা হয়তো সকলের কাছে উপভোগ্য ছিল না।
দস্যুদের রসিকতার একটি উদাহরণ পাঠকদের সামনে উপস্থিত করছি :
সান্টা ফি থেকে গ্যালিসটিওর পথে একটা গাড়ি লুঠ করে দস্যুদল শকটচালকের পা দুটি এমনভাবে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল যে, বেচারার শরীরটা মাটির ওপর পড়ে রইল অসহায় অবস্থায়। লোকটিকে ওইভাবে ঝুলিয়ে রেখে গাড়ির ঘোড়া দুটিকে চাবুক মেরে দস্যুরা ছুটিয়ে দিল। শকটচালককে তারা খুন করেনি, কারণ উক্ত গাড়োয়ান ছিল মেক্সিকোর অধিবাসী। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও গাড়োয়ান বেচারার অবস্থা হয়েছিল অতিশয় শোচনীয়, পথের ওপর ঠোক্কর খেতে খেতে তার সর্বাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। বলা বাহুল্য, দস্যুদের রসিকতা ওই গাড়োয়ানটির কাছে খুব উপভোগ্য মনে হয়নি।
ঘোড়া চুরির ছোটো কাজে নিজেকে খুব বেশিদিন আবদ্ধ রাখল না ফিলিপ, বসন্তকাল শুরু হতে-না-হতেই দলবল নিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠনকার্যে মনোনিবেশ করল সে। আরাকানসাস নদীতীরে এবং সাউথ পার্ক অঞ্চলে ফিলিপের হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণয় করাও সম্ভব হয়নি। স মিল গালচ নামক স্থানটি দুবৃত্তদের হত্যালীলার ফলে নাম বদলে হয়ে গেল ডেড ম্যানস ক্যানিয়ন অর্থাৎ মৃত মানুষের খাদ। পূর্বোক্ত স্থানে একটি কারখানার মধ্যে বাস করত ওই কারখানারই মালিক বৃদ্ধ হেনরি হার্কেন। হেনরির সহকারী ও অংশীদাররা কাজকর্মের শেষে স্থানত্যাগ করতেই অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল ফিলিপ ও তার খুনে চ্যালাচামুণ্ডার দল। ওরা এতক্ষণ আড়াল থেকে নজর রাখছিল, এইবার বৃদ্ধকে একা পেয়ে আক্রমণ করল। কুঠারের প্রচণ্ড আঘাতে বৃদ্ধের মস্তক হল বিদীর্ণ, তারপর ঘরবাড়ি দরজার উপর চলল দুবৃত্তদের ধ্বংসলীলা। ঘরবাড়ির ভগ্নদশা দেখে প্রথমে রেড ইন্ডিয়ানদের সন্দেহ করা হয়েছিল, কারণ, ওই অরণ্যচারী জাতি কাউকে হত্যা করলে নিহত ব্যক্তির ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়ে যায়। তারপর আবার সন্দেহ পড়ল বৃদ্ধের দুই অংশীদারের উপর তাদের নাম মি. ফার্সন ও মি. ব্যাসেট। পরে অবশ্য আসল ঘটনা জানা যায় এবং নিরাপরাধ ভদ্রলোক দুটিও মুক্তি পান।
পরবর্তী ঘটনাগুলি হচ্ছে বীভৎস রক্তারক্তির ধারাবাহিক ইতিহাস। খুনের পর খুন করতে করতে সদলবলে ফিলিপ এগিয়ে চলল ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক খনি-এলাকায়। জর্জ ব্রুস নামে একজন আমেরিকান ভদ্রলোককে তারা ওই অঞ্চলে খুন করেছিল। খুনের ধরনটা ছিল পূর্বে উল্লিখিত বৃদ্ধ হেনরির হত্যাকাণ্ডের অনুরূপ। স্থানীয় শেরিফ ও তার বাহিনী খুনিদের অনুসরণ করতে গিয়ে পথের মধ্যে আরও কয়েকটা রক্তাক্ত মৃতদেহ আবিষ্কার করেছিল, কিন্তু খুনিদের সে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
হত্যার তাণ্ডব চলল দীর্ঘদিন ধরে। প্রথম প্রথম খুনির স্বরূপ নির্ণয় করতে পারেনি সরকার কে দায়ী এই হত্যাকাণ্ডগুলির জন্য? রেড ইন্ডিয়ান? সন্ত্রাসবাদী বিদ্রোহী? কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্ত, বিমূঢ়। অনেক সময় দেখা গেছে নিহত মানুষের ধনসম্পত্তি তার সঙ্গেই অবস্থান করছে, অর্থাৎ নিছক রক্তপিপাসাকে তৃপ্ত করার জন্যই খুন করেছে খুনি। স্থানীয় দস্যুরা এভাবে অনর্থক নরহত্যা করে না। মৃতদেহের মাথার চামড়া অক্ষত দেখে বোঝা যায় রেড ইন্ডিয়ানরাও ওইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী নয়, কারণ, রেড ইন্ডিয়ানদের প্রথা অনুসারে কাউকে হত্যা করলে নিহত ব্যক্তির চুলসুদ্ধ মাথার চামড়া তারা ছুরি দিয়ে কেটে নিয়ে যায়। মৃতদেহের অঙ্গে উজ্জ্বল পোশাকপরিচ্ছদ থাকলে সেগুলি অবশ্য খুনি লুঠ করত, আরও লুঠ করত ঘড়ি, আংটি, ছুরি প্রভৃতি বস্তু। মৃতদেহগুলো দেখলেই বোঝা যেত অন্ধ আক্রোশে হত্যাকারী তাদের উপর অস্ত্র চালনা করেছে। শুধু গুলি চালিয়ে নরহত্যা করে খুশি হত না খুনি, বারংবার ছুরিকাঘাত করে নিহত মানুষগুলোকে সে টুকরো টুকরো করে ফেলত। তবে খুনি যে খ্রিস্টধর্মের প্রতি অত্যন্ত অনুগত সে-বিষয়ে সন্দেহ ছিল না–নিহত মানুষের বুকের ওপর ছুরি দিয়ে আঁকা থাকত রক্তাক্ত ক্রসচিহ্ন অথবা দুটো গাছের ডাল কেটে আড়াআড়িভাবে ক্রস বেঁধে খুনি সেটাকে মৃতদেহের বুক ভেদ করে মাটির ওপর বসিয়ে দিত।
যে-লোকগুলো খুন হয়েছিল, তারা প্রায় সকলেই ছিল খুনির অপরিচিত। নিহত ব্যক্তিদের একমাত্র অপরাধ, তারা ছিল আমেরিকান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধদের হত্যা করা হত। মনে হয়, ১৮৪৬ থেকে ১৮৪৮ সালের মধ্যে মেক্সিকো এবং আমেরিকার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের সময়ে ওই বৃদ্ধরা আমেরিকা-সরকারের সঙ্গে জড়িত ছিল সন্দেহ করেই খুনি তাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। মেক্সিকান ফিলিপ ছিল ঘোর সাম্প্রদায়িক আমেরিকানদের উপর সে ছিল বেজায় খাপ্পা। তার ক্রোধের আগুনে প্রাণ বিসর্জন দিতে লাগল বহু আমেরিকান। কলোরাডো রাজ্যে এমন হত্যাপাগল হন্তারক আগে কখনো আত্মপ্রকাশ করেনি।
ফিলিপ এসপিনোসাকে স্বচক্ষে দেখেও জীবিত আছে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। তবু সেই অল্পসংখ্যক মানুষের বর্ণনা থেকে জানা যায় পূর্বোক্ত নরঘাতক দুবৃত্ত নাকি যেমন লম্বা তেমনই চওড়া–দুই কালো চোখে তীব্র প্রখর দৃষ্টি, চেপটা নাক, চোয়াল ঘিরে ঘন দাড়ির জঙ্গল এবং মাথার ওপর সুদীর্ঘ কালো কেশের নিবিড় সমাবেশ।
ফিলিপের নিত্যসঙ্গী ছিল ভিভিয়েন নামে একটি যুবক। ফিলিপের মতো বিপুল দেহ, প্রচণ্ড শক্তি ও দুরন্ত সাহসের অধিকারী না হলেও ভিভিয়েন ছিল পাকা খুনি–নরহত্যায় তার কুণ্ঠা ছিল না কিছুমাত্র। হিংস্র ও নির্মম ভিভিয়েন ছিল ফিলিপ এসপিনোসার যোগ্য সহচর।
ফিলিপকে যে-মানুষটি প্রথম স্বচক্ষে দর্শন করেছিল, সে এক ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান–নাম, এড মেটকাফ।ফেয়ার প্লে থেকে এলমা শহরে যাচ্ছিল এড, আচম্বিতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক বীভৎস দৃশ্য–পথের উপর একটি নিশ্চল নরদেহের উপর পরমানন্দে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে দুটি মানুষ। বলাই বাহুল্য যে, লোক দুটি হচ্ছে ফিলিপ আর ভিভিয়েন। ধাবমান শকটের পথ ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি সরে গেল দুই খুনি, কিন্তু কাজে বাধা পড়ায় তাদের মেজাজ গরম হয়ে উঠল। শকটচালক এডকে লক্ষ করে গুলি ছুড়ল ফিলিপ, অব্যর্থ লক্ষ্যে বুলেট এসে পড়ল এডের বুকে। এড লুটিয়ে পড়ল গাড়ির মধ্যে অবস্থিত কাঠের স্তূপের উপর। কিন্তু লক্ষ্যভেদ করতে পারলেও এডকে খুন করতে পারেনি ফিলিপ এডের বুকপকেটে ছিল একটা ছোটো বই, গুলিটা বইয়ের উপর পড়েছিল বলেই সে বেঁচে গেল। আঘাতের বেগ তাকে উলটে ফেলেছিল বটে, কিন্তু গুলি সেই বইটাকে ভেদ করে তার দেহ স্পর্শ করতে পারেনি।
শকটচালক এড মেটকাফ হত্যাকারীদের বর্ণনা দিয়ে বলেছিল, লোক দুটোর গায়ের রং ফর্সা নয়, সম্ভবত তারা রেড ইন্ডিয়ান। দুজনের মধ্যে যে-লোকটির বয়স বেশি তার মুখখানা থালার মতো, মাথায় লম্বা চুল; আড়েবহরে প্রকাণ্ড ওই খুনির কদাকার চেহারার দিকে তাকালে আতঙ্কে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়, মনে হয় একটা হিংস্র জন্তুর সামনে এসে পড়েছি। খুব চড়া রং-এর জমকালো পোশাক পরেছিল দুই খুনি, আর তাদের সর্বাঙ্গ ঘিরে ঝুলছিল মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রাইফেল, পিস্তল, ছোরা।
ফিলিপের হত্যালীলা চলল অবিরাম। ওইসব হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা অত্যন্ত একঘেয়ে আর বৈচিত্র্যহীন। কলোরাডো রাজ্যের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের ভীত ও সন্ত্রস্ত করে চলল ফিলিপ এসপিনোসার রক্তসিক্ত বিজয়-অভিযান।
অবশেষে একদিন মৌচাকে ঢিল পড়ল। লেফটেন্যান্ট জর্জ এল শুপ নামক সেনাবিভাগের একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কনিষ্ঠ ভ্রাতা মারা পড়ল ফিলিপের হাতে। মৃত ব্যক্তি ছিল সৈনিক, তার মৃত্যুতে হইচই পড়ে গেল চারদিকে। সৈন্যরা যদি এমনভাবে খুন হয়, তবে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়? এমন ভয়ানকভাবে ওই সৈন্যটিকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল যে, তার মৃতদেহ দেখে তাকে শনাক্ত করা যায়নি–সৈনিকের ছিন্নভিন্ন পরিচ্ছদ বা ইউনিফর্ম থেকেই মৃত ব্যক্তির স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছিল।
ক্রোধ, ঘৃণা ও আতঙ্কে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কলোরাডোর মানুষ। জন ম্যাকক্যানন নামে জনৈক প্রতিপত্তিশালী খনি-মালিক নিজে উদ্যোগী হয়ে একটি বেসরকারি বাহিনী গড়ে তুলল। বনপথে বিচরণ করতে অভ্যস্ত কুড়িটি স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত ওই বেসরকারি বাহিনীর প্রত্যেকটি লোক ছিল লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, প্রাণ-দেওয়া-নেওয়ার রক্তাক্ত খেলা খেলতে তাদের আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। বন্দুক-পিস্তলে দক্ষ ভয়ংকর ওই মানুষগুলোর উপযুক্ত নেতা ছিল জন ম্যাকক্যানন। ম্যাকক্যাননের মুখে ছিল মস্ত দাড়ি, দেহ ছিল প্রকাণ্ড। দলবল নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে সে বেরিয়ে পড়ল হত্যাকারী ফিলিপের সন্ধানে।
বনপথে ঘোরাফেরা করে জীবিকা নির্বাহ করতে যারা অভ্যস্ত, তাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া খুব কঠিন–সেইজন্যই বেছে বেছে ওই ধরনের মানুষ নিয়ে দল গঠন করেছিল ম্যাকক্যানন। কয়েকদিন অক্লান্তভাবে অনুসরণ করার পর ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী জঙ্গলের মধ্যে একদিন খুনিদের আবিষ্কার করতে সমর্থ হল।
অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে বসেছিল দুই দুবৃত্ত, সঙ্গে ছিল তিনটি ঘোড়া। ম্যাকক্যাননের বাহিনী থেকে জো ল্যাম্ব নামে একটি লোক প্রথমে গুলি চালিয়েছিল। গুলি লাগল ভিভিয়েনের পায়ে, সে তৎক্ষণাৎ মাটির উপর ঝাঁপ খেয়ে শুয়ে পড়ল। আহত সঙ্গীর সাহায্যে ছুটে এল ফিলিপ এবং হিংস্রকণ্ঠে চিৎকার করতে করতে দু-হাতে পিস্তল ছুঁড়তে শুরু করল। অপরপক্ষও চুপ করে রইল না, অগ্নি-উদগিরণ করে গর্জে উঠল অনেকগুলো রাইফেল।
একটা ঘোড়া আর্তনাদ করে ধরাশায়ী হল। তার দেহের আড়ালে দুবৃত্ত দুজন গা-ঢাকা দিয়ে গুলি চালাতে লাগল। সেই ম্যাকক্যাননের সঙ্গে ছিল আটজন স্বেচ্ছাসেবক, বাকি লোকজন সেখানে ছিল না। ওই আটজন লোক নিয়ে খুনি দুটোকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল ম্যাকক্যানন। তার চেষ্টা সফল হল না, দুটি ঘোড়াকে একসঙ্গে ছুটিয়ে দিল ফিলিপ–একটার পিঠে সে বসেছিল, অপর ঘোড়াটার লাগাম ধরে জন্তুটাকে সে ব্যবহার করছিল জীবন্ত ও চলন্ত ঢালের মতো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একটা ঘন ঝোপের মধ্যে প্রবেশ করল ঘোড়া দুটি; একটা ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে অপরটির পিঠে সওয়ার হয়ে ঝড়ের মতো পার্বত্য পথ অতিক্রম করে অদৃশ্য হল ফিলিপ, পিছনে পড়ে রইল তার তরুণ অনুচরের মৃতদেহ। চার্লি কার্টার নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক গুলি চালিয়ে ভিভিয়েনের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছিল।
ম্যাকক্যানন ও তার বাহিনী এবার অকুস্থল থেকে কয়েকটি থলি কুড়িয়ে পেল। অশ্বারোহীরা ওই ধরনের থলি ঘোড়ার জিনের সঙ্গে বহন করে। বলাই বাহুল্য, থলিগুলো ছিল দুবৃত্তদের সম্পত্তি। এবার খানাতল্লাশি–থলিগুলোর ভেতর থেকে পাওয়া গেল কাপড়চোপড়, রিভলভার, ছোরা, ঘড়ি প্রভৃতি। ওই জিনিসগুলো ছিল দস্যুহস্তে নিহত একাধিক মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ওইসঙ্গে একটা ডায়েরিও পাওয়া গিয়েছিল। ডায়েরিতে তারিখ দিয়ে বহু নরহত্যার সংবাদ লেখা রয়েছে–কেমন করে ওই আমেরিকানদের খুন করা হয়েছে সে-কথাও লেখা আছে সবিস্তারে। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা ওই ডায়েরির পাতা থেকে জানা গেল ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা করার সংকল্প নিয়েছে ফিলিপ এসপিনোসা।
আর একটা কাগজের স্তূপ থেকে এমন ভয়ানক প্রতিজ্ঞার কারণটা বোধগম্য হল। আমেরিকার সেনাবাহিনী বিগত যুদ্ধে মেক্সিকোর ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, তার ফলে শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একটি এসপিনোসা বংশ। ওই বংশেরই ছেলে ফিলিপকে প্রতিশোধ নিতে উৎসাহিত করছিল তার বাপ। ছেলেও বাপের মান রেখেছে, অনেকগুলো আমেরিকানকে সে পরলোকে পাঠিয়েছে–সবসুদ্ধ ৬০০ আমেরিকানকে হত্যা না-করে সে ক্ষান্ত হবে না। সংখ্যাটা বিশেষ করে ছ-শো কেন হল সে-বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
পূর্বোক্ত ডায়েরি ও জিনিসগুলো নিয়ে দলবলের সঙ্গে ফিরে এল ম্যাকক্যানন। ভিভিয়েনের মৃতদেহ অবশ্য তারা অকুস্থলেই ফেলে এসেছিল। ক্যালিফোর্নিয়া গালচ নামক স্থানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে অভিনন্দন জানাল উল্লসিত জনসাধারণ।
ম্যাকক্যানন ভেবেছিল স্বেচ্ছাসেবক চার্লির গুলিতে নিহত তরুণ ভিভিয়েনই দলের সর্দার, অতএব তার মৃত্যুতে এখন আপদের শান্তি। কর্তৃপক্ষ কিন্তু ম্যাকক্যাননের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। কিছুদিন পরেই জানা গেল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা অমূলক নয়–প্রচণ্ড বিক্রমে আবার আত্মপ্রকাশ করেছে ফিলিপ।
ভিভিয়েনের মৃত্যুর পর এক সপ্তাহ যেতে-না-যেতেই ফিলিপের হাতের কাজ দেখা গেল বিল স্মিথ নামে জনৈক নাগরিক প্রথমে খুন হল, পরবর্তী শিকার হল এক অখ্যাত সৈনিক।
খবর নিয়ে জানা গেল ফিলিপ একটি নূতন সঙ্গী সংগ্রহ করেছে। নূতন সহচরটিও এসপিনোসা বংশের ছেলে, বয়স তার খুবই কম–নাম, জুলিয়েন। বয়সে কৈশোর অতিক্রম না-করলেও খুনোখুনিতে ওস্তাদ ছিল জুলিয়েন, মানুষ মারতে তার হাত কাঁপত না একটুও। ফিলিপ ও জুলিয়েনের কবলে প্রাণ হারাল আরও কয়েকজন অভাগা আমেরিকান।
হত্যা-হাহাকারে পরিপূর্ণ বর্তমান নাটকের রক্তাক্ত রঙ্গমঞ্চে এইবার প্রবেশ করল এক দুর্ধর্ষ ব্যক্তি–টম টবিন।
যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় দুর্গম অরণ্যপথে রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণে বহু আমেরিকানের প্রাণহানি ঘটেছে। ওই ভয়ংকর রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করে জীবিকা নির্বাহ করত একদল আমেরিকার মানুষ–ইতিহাসে তাদের নামকরণ হয়েছে স্কাউট।
পূর্বোক্ত স্কাউটরা ছিল নির্ভীক চরিত্রের মানুষ, বন্দুক পিস্তলে তাদের নিশানা অব্যর্থ। বনপথে অনুসরণ-কার্যে দুঃসাহসী স্কাউটের অসাধারণ দক্ষতা আজও জনশ্রুতি ও ইতিহাসের গল্পকথা হয়ে আছে। পূর্বে উল্লিখিত টম টরিন ছিল ওইরকম এক স্কাউট।
সেনাবাহিনী যখন অসহায় বলে প্রমাণিত হত, তখনই স্কাউটের সাহায্য গ্রহণ করতেন সেনাধ্যক্ষ। কিছুতেই ফিলিপকে জব্দ করতে না-পেরে কর্নেল ট্যাপ্পান চিরাচরিত পন্থা অবলম্বন করলেন ফোর্ট গারল্যান্ড দুর্গ থেকে কর্নেলের তলব পেয়ে তার সামনে উপস্থিত হল স্কাউট টম টবিন। সেনাবাহিনী থেকে দুরূহ কাজের ভার নিলে দস্তুরমতো পারিশ্রমিক পেত ভারপ্রাপ্ত স্কাউট, অতএব টম টবিনও যে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশা নিয়ে এসেছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কর্নেলের বক্তব্য শুনে টম টবিন জানাল একটিমাত্র যোগ্য সহকারী পেলেই সে ফিলিপ এসপিনোসার পশ্চাদ্ধাবন করতে রাজি, কিন্তু কর্নেল ট্যাপ্লান বললেন, ফিলিপের মতো ভয়ানক দস্যুর মোকাবেলা করতে হলে যথেষ্ট লোকবল প্রয়োজন–অতএব, তার আদেশে পনেরোজন সশস্ত্র সৈনিক এগিয়ে এল টবিনকে সাহায্য করতে। ওই সেনাদল ছাড়া আরও একটি মেক্সিকান বালক ছিল টবিনের সঙ্গী। বালকটিকে নির্বাচন করেছিল টবিন স্বয়ং। ১৮৬৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ফোর্ট গারল্যান্ড নামক দুর্গ থেকে টম টবিন যাত্রা করল হন্তারক ফিলিপ এসপিনোসার সন্ধানে।
তিন দিন তিন রাত্রি ধরে চলল অবিরাম অনুসরণ-পর্ব, তারপর এক জায়গায় এসে কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখে থামল মানুষ-শিকারির দল।
উটা জাতীয় রেড ইন্ডিয়ানদের পায়ে পায়েই ওই চিহ্নগুলির সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সেই পদচিহ্নগুলিকে মেক্সিকান খুনিদের পায়ের ছাপ মনে করে বিভ্রান্ত হল ছ-জন সৈন্য এবং টবিনের নির্দেশ অমান্য করে পূর্বোক্ত পদচিহ্নের অনুসরণ করতে সচেষ্ট হল। ফলে টবিনের লোকবল বেশ কিছু কমে গেল।
পরের দিন সকাল ন-টা কি দশটার সময়ে টবিনের দল বনপথে দুটি ষাঁড়ের পদচিহ্ন আবিষ্কার করল। টবিন পায়ের ছাপ পরীক্ষা করে বুঝতে পারল, জন্তু দুটিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্ত ফিলিপ এবং তার কিশোর সঙ্গী জুলিয়েন। নির্ভুলভাবে তাদের অনুসরণ করতে লাগল টবিন। কিছুক্ষণ করে দেখা গেল একটি ষাঁড়কে দস্যুরা ছেড়ে দিয়েছে। টবিন বুঝল, মেক্সিকান দস্যু দুটি মাংস খাওয়ার জন্য অপর ষাঁড়টিকে হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের তাঁবুর দিকে।
আবার শুরু হল অনুসন্ধান। ঘন জঙ্গল আর ঘাসঝোপের ভিতর দিয়ে অপরাধীদের পদচিহ্ন পাওয়া দুষ্কর, কিন্তু অভিজ্ঞ স্কাউট টবিনের শ্যেনচক্ষু একবারও ভুল করল না, স্থির লক্ষ্যে সে এগিয়ে চলল সৈন্যদের নিয়ে।
এক জায়গায় গোল হয়ে উড়ছিল কয়েকটা কাক। টম টবিন অনুমান করল ওইখানেই ষাঁড়টাকে হত্যা করা হয়েছে। সে আবার অগ্রসর হল। প্রায় এক-শো গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পর অনেকগুলো ম্যাগপাই পাখি (এক ধরনের মাংসাশী পাখি) তার চোখে পড়ল। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দুবৃত্তদের তাবুটাকে আবিষ্কার করল টবিন। সৈন্যদের ডেকে টবিন তাদের কথা কইতে নিষেধ করল। সে আরও বলল, হাত তুলে সংকেত জানালেই সকলে যেন রাইফেল বাগিয়ে বসে পড়ে, কিন্তু নির্দেশ না-পেলে কিছুতেই যেন গুলি না-চালায়।
সঙ্গীদের সাবধান করে দিয়ে আরও কয়েক পা এগিয়ে একটি খুনিকে দেখতে পেল টবিন। ঠিক সেই সময় তার পায়ের তলায় একটা শুকনো গাছের ডাল মট করে ভেঙে গেল। শব্দটা শুনতে পেয়েছিল খুনি, শব্দ লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াতেই টবিনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়।
সচমকে এক লক্ষ ত্যাগ করে দস্যু রিভলভারে হাত দিল, কিন্তু সে গুলি চালানোর আগেই টবিনের রাইফেল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি অব্যর্থ সন্ধানে তার দেহ বিদ্ধ করল।
আহত দুবৃত্ত চিৎকার করে উঠল, হে যিশু, আমাকে দয়া করো! তারপরই সে সঙ্গীর উদ্দেশে হাঁক দিল, পালাও, পালাও! আমি মারা গেলাম!
রাইফেল গুলি ভরতে ভরতে টবিন দেখল নিকটবর্তী খাদের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক ধাবমান মূর্তি এবং তিরবেগে এগিয়ে চলল একটা ঘন ঘাসঝোপের দিকে–
দুই নম্বর খুনি।
টবিন চেঁচিয়ে উঠল, ওহে ছোকরার দল, গুলি চালাও।
তিনটি সৈনিক একসঙ্গে গুলি ছুড়ল। কিন্তু তাদের লক্ষ্য ব্যর্থ হল।
ততক্ষণে টবিন তার রাইফেলে গুলি ভরে ফেলেছে।
অভ্যস্ত আঙুলের স্পর্শে চকিত অগ্নিশিখার গর্জিত আবির্ভাব, পরক্ষণেই ধাবমান দস্যুর দেহ ধরাশয্যায় লম্বমান।
এক গুলিতেই ফিলিপের কোমর ভেঙে দিয়েছে টবিন।
ভাঙা কোমর নিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারল না ফিলিপ, তবু সে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হল না–একটা গাছ মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে গাছটার দিকে এগিয়ে গেল ফিলিপ, তারপর সেই ধরাশায়ী বৃক্ষে পৃষ্ঠ স্থাপন করে বাগিয়ে ধরল রিভলভার। একটি সৈন্য টবিনের নির্দেশ অমান্য করে বীরবিক্রমে এগিয়ে গেল দস্যুর দিকে কিন্তু ফিলিপের গুলি তার টুপি উড়িয়ে দিতেই বীরবরের চৈতন্য হল, চটপট পিছিয়ে এসে বনের আড়ালে সে আত্মগোপন করল।
অবশেষে শিথিল হয়ে এল ফিলিপের হাত, অবশ মুষ্টি থেকে খসে পড়ল রিভলভার। টবিন চিৎকার করে শত্রুকে ডাকল, উত্তরে দুর্বল কণ্ঠে একটা শপথ উচ্চারণ করল ফিলিপ। এইবার এগিয়ে গেল টবিন, ফিলিপের চুলের মুঠি ধরে তার ঘাড়টাকে স্থাপন করল গাছের গুঁড়ির উপর, তারপর কটিবন্ধ থেকে খুলে নিল ছোরা কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ না নিয়ে গেলে পুরস্কার মিলবে না।
মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও এতটুকু কাতর হয়নি দুর্দান্ত মেক্সিকান। শত্রুর দিকে তাকিয়ে ফিলিপ বলেছিল, সিনর টবিন, কাজটা একটু তাড়াতাড়ি সারো। তোমার ছুরিতে তেমন ধার নেই!
এসপিনোসা বংশের দুই খুনি ফিলিপ আর জুলিয়েনের ছিন্ন মুণ্ড নিয়ে গারল্যান্ড দুর্গে উপস্থিত হল টবিন। একটা থলির ভিতর থেকে মুণ্ড দুটি বের করে গভর্নরের ডেস্কের উপর টবিন সাজিয়ে দিয়েছিল বলে শোনা যায়। সেই সময় সরকারি কোষাগারে টাকা ছিল না, তাই। তৎক্ষণাৎ টবিনকে পুরস্কার দেওয়া সম্ভব হয়নি কিন্তু গভর্নর ইভান্স তার পকেট থেকে নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে একটি চমৎকার হরিণ-চর্মের পরিচ্ছদ এবং ভালো একটি রাইফেল টবিনকে উপহার দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে পুরস্কার হিসেবে যে-অর্থ টবিন পেয়েছিল, তার অঙ্কটা কম নয়—
১৫০০ ডলার!
ক্যাপ্টেন বয়েড ও মেজর ক্যাম্পবেল
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি বিভাগে ক্যাপ্টেন বয়েড ও মেজর ক্যাম্পবেল নামক দুই সেনাধ্যক্ষের মধ্যে হঠাৎ বাদানুবাদ শুরু হল সেনানিবাসের মধ্যে। মেজর ক্যাম্পবেল অধীন সৈন্যদের উপর যে আদেশ জারি করেছিলেন, সেই আদেশ ক্যাপ্টেন বয়েডের পছন্দ হয়নি এবং তার ফলে উত্তপ্ত বিতর্কের অবতারণা। বয়েডের মতে মেজর সাহেবের পক্ষে ওই আদেশ জারি অনুচিত কার্য। মেজরের বক্তব্য, উচিত কাজই করেছেন তিনি। দুজনেই নিজস্ব ধারণায় অটল। তীব্রস্বরে বাদানুবাদ চলল কিছুক্ষণ, তারপর দেখা গেল ক্রুদ্ধ পদক্ষেপে স্থানত্যাগ করছেন ক্যাম্পবেল এবং তাকে অনুসরণ করছেন বয়েড। পরবর্তী ঘটনার সঠিক বিবরণ কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি; তবে এটুকু জানা যায় যে, দুজনের মধ্যে পিস্তল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ ঘটেছিল।
একটা ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে ডুয়েল হয়েছিল, অকুস্থলে কোনো মধ্যস্থ উপস্থিত ছিলেন না। আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ শুনে অকুস্থলে ছুটে এলেন কয়েকজন অফিসার। তাদের সামনে অতিশয় উদবিগ্ন স্বরে ক্যাম্পবেল তার মরণাহত প্রতিদ্বন্দ্বীকে উদ্দেশ করে বললেন, বয়েড, সাক্ষীদের সামনে স্বীকার করো যে লড়াইটা ন্যায়সঙ্গতভাবেই হয়েছিল।
স্খলিতস্বরে বয়ে যা বললেন, সেই বক্তব্য হল ক্যাম্পবেলের পক্ষে মারাত্মক।না, লড়াই ন্যায়সংগত হয়েছিল এ-কথা বলা যায় না। তুমি আমাকে প্রস্তুত হওয়ার সময় দাওনি। তুমি খুব খারাপ লোক, ক্যাম্পবেল। ওইকথা বলার পরেই বয়েডের মৃত্যু হয়।
ক্যাম্পবেলের বিচার হল। বয়েডের মৃত্যুকালীন উক্তি ক্যাম্পবেলকে ঠেলে দিল মৃত্যুর মুখে। বিচারে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিলেন মেজর ক্যাম্পবেল।
গিলস বোথাম ও টম ব্রাস
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ঠিক ক্রিসমাসের আগে লন্ডনের একটি ক্লাবে গিলস বোথাম ও টম ব্রাস নামক দুই ভদ্রলোকের মধ্যে ভীষণ তর্ক শুরু হল। তর্কের বিষয়বস্তু খুবই তুচ্ছ, কিন্তু শ্লেষসিক্ত কণ্ঠের বাদানুবাদের ফল হল অতিশয় মারাত্মক। বোথামের ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চ্যালেঞ্জ তর্কযুদ্ধকে টেনে আনল পিস্তল-ডুয়েল নামক ভয়াবহ দ্বৈরথের প্রাণঘাতী সম্ভাবনার মধ্যে। সাধারণত দিনের আলোতেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু উত্তেজিত ভদ্রলোক দুটি আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারকে উপেক্ষা করেই তৎক্ষণাৎ ফয়সালা করার জন্য উগ্রীব হয়ে উঠলেন। ক্লাবের মধ্যে ডুয়েল লড়া সম্ভব নয়, অতএব নিকটস্থ একটি মাঠের দিকে দুজনে রওনা হলেন। মধ্যস্থ হিসাবে দুটি সঙ্গী জোগাড় করতেও তাদের দেরি হয়নি। তখন তুষারপাত হচ্ছে। পিস্তলের নিশানা অস্পষ্ট করে তুলেছে সন্ধ্যার ছায়া–দুই প্রতিযোগী অন্ধকারকে অগ্রাহ্য করে পিস্তল তুললেন। মধ্যস্থের নির্দেশ পাওয়ামাত্র গুলি ছুড়লেন বোথাম। তাঁর লক্ষ্য ব্যর্থ হল। এবার পিস্তল তুললেন টম ব্রাস এবং ধীরে ধীরে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর নিশানা স্থির করতে লাগলেন। মধ্যস্থ দুজন ও বোথাম বুঝলেন আজ আর রক্ষা নেই। কারণ, টম ব্রাস হলেন ক্র্যাক-শট–তাঁর হাতের গুলি কখনো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন বোথাম। পিস্তলের লক্ষ্য স্থির করে গুলি চালাতে উদ্যত হলেন টম ব্রাস আর ঠিক সেই মুহূর্তে নীরবতা ভঙ্গ করে সন্ধ্যার বাতাসে ভেসে এল ক্রিসমাসের সংগীত-ধ্বনি। টম শুনলেন সুরের জাল বুনতে বুনতে গায়করা সমগ্র মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি প্রীতি ও স্নেহপরায়ণ হতে অনুরোধ করছে অদ্ভুতভাবে সেই সংগীত টমের হৃদয়কে পরিবর্তিত করল। উদ্যত পিস্তল নামিয়ে নিলেন টম ব্রাস…
যে ক্লাবঘরের ভিতর পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, আবার সেইখানে দুই যুযুধানকে দেখা গেল, অবশ্যই তাদের হাতে পিস্তল ছিল না ছিল কাঁচের পানপাত্র। তারা হাসিমুখে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করছেন এবং তাঁদের পানপাত্রে স্থান পেয়েছে দুটি বিভিন্ন জাতের সুরা যাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রথমে বাগযুদ্ধ ও পরে দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ও চার্লস ডিকেনসন
জেনারেল অ্যান্ড্রু জ্যাকসন ছিলেন যেমন শক্তসমর্থ, তেমনি তার কথাবার্তাও ছিল চোখা চোখা। রেখে-ঢেকে কথা বলতে তিনি জানতেন না, প্রয়োজনে উচিত কথা শুনিয়ে দিতে তিনি ইতস্তত করতেন না কখনোই, এবং তার ফলে যেকোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে তাঁর আপত্তি ছিল না কিছুমাত্র। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ডিকেনসন নামে একটি কুখ্যাত জুয়াড়ির সঙ্গে তার ঝগড়া বেধে গেল। আগেই বলেছি জেনারেল ছিলেন স্পষ্টবক্তা। তার শানিত বাক্যবাণে বিপর্যস্ত জুয়াড়ি খেপে গিয়ে তাকে পিস্তলের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাল।
জুয়াড়ি ডিকেনসন ছিল পাকা পিস্তলবাজ। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পনেরো বার পা ফেলে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে, সেই দূরত্ব থেকে পিস্তলের গুলি চালিয়ে একটা দোদুল্যমান সুতোকে ছিঁড়ে ফেলতে পারত ডিকেনসন। জুয়াড়ি চার্লস ডিকেনসনের লক্ষ্য ভেদ করার সাংঘাতিক ক্ষমতা সম্বন্ধে সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ ছিল অতিশয় অবহিত। জেনারেল অ্যান্ড্রও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্ভুল নিশানার কথা জানতেন, কিন্তু তবুও এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বিলম্ব হয়নি এক মুহূর্তও। দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য তার নির্বাচিত স্থানটির নাম টেনেসি।
পিস্তলধারী দুই যোদ্ধার মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল মাত্র আট পা। পরস্পরকে লক্ষ করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পিস্তল উদ্যত করলেন। প্রথমেই গুলি ছুড়ল ডিকেনসন। মধ্যস্থরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন অটল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল। প্রতিদ্বন্দ্বীর গুলি নিশ্চয়ই ব্যর্থ হয়েছে? পরক্ষণেই অগ্নি উদগিরণ করে গর্জে উঠল জেনারেল জ্যাকসনের পিস্তল এবং ডিকেনসনের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল মাটির ওপর। বিবর্ণ রক্তহীন মুখে জেনারেল তার জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেন স্খলিত চরণে। জেনারেলের অবস্থা দেখে জনৈক মধ্যস্থ সন্দেহ করলেন ডিকেনসনের লক্ষ্য বোধ হয় ব্যর্থ হয়নি। সন্দেহ সত্য। জেনারেলের পাঁজরে বিদ্ধ হয়েছিল প্রতিদ্বন্দ্বীর গুলি। দাঁতে দাঁত চেপে সেই আঘাত সহ্য করে জেনারেল যখন তার নিশানা স্থির করছিলেন, তখনও শত্রুর নিক্ষিপ্ত বুলেট তার দেহের ভিতরেই ছিল! আহত জেনারেল পরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি হয়েছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
জেফারি হাডসন ও অফিসার ক্রফটস
জেফারি হাডসন ছিল ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের অত্যন্ত স্নেহের পাত্র। অতি ক্ষুদ্রকায় বামন হলেও জেফারি ছিল অতিশয় সাহসী মানুষ। একবার রাজার বাগানে কয়েকটি ক্রীড়ারত শিশুকে যখন একটি অতিকায় টার্কি পাখি আক্রমণ করেছিল, সেইসময় তরবারি হাতে পাখিটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জেফারি হাডসন। ওই টার্কি পাখির দৈহিক আয়তন জেফারির চাইতে বড়ো ছিল, কিন্তু নিপুণ হাতে তরবারি চালিয়ে পাখিটাকে হত্যা করে হাডসন সেদিন শানিত নখচঞ্চুর আক্রমণ থেকে বিপন্ন শিশুদের রক্ষা করেছিল।
সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মতোই মর্যাদাবোধ সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল জেফারি হাডসন। একদিন ক্রফটস নামক জনৈক অফিসার হাডসনকে নিয়ে একটু মজা করার চেষ্টা করল। হাডসন খেপে গেল, সে ক্রফটসকে আহ্বান করল দ্বন্দ্বযুদ্ধে।
এতটুকু একটা পুঁচকে মানুষ রাজার খাবারের বাটির মধ্যে যে আত্মগোপন করে বসে থাকতে পারে তার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ? ক্রফটস তো হেসেই আকুল। হাসতে হাসতেই সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। দ্বন্দ্বযুদ্ধে নির্দিষ্ট স্থানে যোগ দিতে এল জেফারি হাডসন। ক্রফটসও এসেছিল, তবে তার সঙ্গে তলোয়ার কিংবা পিস্তল ছিল না–অস্ত্র হিসাবে সে বাগিয়ে ধরেছিল একটা জল দেবার পিচকারি।
দ্বিতীয়বার অপমানে হাডসন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। তার সঙ্গে ছিল একজোড়া পিস্তল–একটা পিস্তল সে ক্রফটসের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তাকে অস্ত্র ব্যবহার করতে অনুরোধ করল।
এবার আর পায়ে হেঁটে নয়। অশ্বপৃষ্ঠে পিস্তল হাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের সম্মুখীন হল।
বামন জেফারি হাডসনের পিস্তল থেকে নিক্ষিপ্ত গুলি যখন ক্রফটসের বক্ষ ভেদ করল, তখনও তার মুখ থেকে হাসির রেখা মিলিয়ে যায়নি।
হাসতে হাসতেই মৃত্যুবরণ করল অফিসার ক্রফটস।
দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম
প্রথম পরিচ্ছেদ : হন্তারক
কথায় কথায় ঝগড়া। তারপরই মুষ্টিবদ্ধ হস্তের মুষ্টিযোগ।
পশ্চিম আমেরিকায় অবস্থিত ঊনবিংশ শতাব্দীর শহর ফোর্ট গিবসন-এর একটি নৃত্যশালায় দুটি ক্রুদ্ধ যুবকের মধ্যে যে-লড়াইটা শুরু হয়েছিল, সেই মুষ্টিযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিট পরেই কিন্তু পরবর্তীকালে ওই দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিণাম সমগ্র দেশের বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাস ও বিভীষিকার করাল ছায়া।
ফোর্ট গিবসন শহর। ওই শহরের একটি নৃত্যশালায় রাতের আসর জমজমাট। পুরুষদের সঙ্গে মেয়েরাও যোগ দিয়েছে মহা আনন্দে; চলছে নাচগান, হইহুল্লোড়। হঠাৎ সামান্য কারণে ঝগড়া বাধল দুটি যুবকের মধ্যে। যুবকদের নাম ক্রফোর্ড গোল্ডসবি এবং জেক লিউইস।
ক্রফোর্ডের বয়স লিউইসের চাইতে অনেক কম, তার শরীরটাও বেশ দশাসই জোয়ানের মতো। বিপুলবপু দীর্ঘদেহী ক্রফোর্ডের সামনে জেককে নিতান্তই নগণ্য মনে হয়। কিন্তু লিউইস মারামারিতে পোক্ত–বহুদিনের অভিজ্ঞতার ফলে সে মার খেতে যেমন অভ্যস্ত, মার ফিরিয়ে দিতেও তেমনই ওস্তাদ। অতএব ক্রফোর্ড যখন তার ঘুসি হজম করে পালটা ঘুসিতে তাকে মেঝের উপর শুইয়ে দিল, তখনই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি হল না সে।
হঠাৎ বাধা দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, ওহে ছোকরারা, তোমরা বাইরে গিয়ে ফয়সালা করো। এটা মারামারির জায়গা নয়। এখানে মহিলারা আছেন।
বেশ, জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ক্রফোর্ডের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল লিউইস, আমি বাইরে যাচ্ছি।
খুব ভালো কথা। আমিও যাচ্ছি, সদম্ভে উত্তর দিল ক্রফোর্ড।
নাচঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল দুই যুযুধান।
মে মাসের রাত্রি, আলো-আঁধার-মাখা রাজপথের উপর শুরু হল মারামারি। সজোরে ঘুসি চালাল ক্রফোর্ড। ছিটকে পড়ল জেক। পরক্ষণেই বিড়ালের মতো লঘু চরণে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে লিউইস ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণ হয়ে গেল শক্তির চাইতে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক বেশি। হাত ঝেড়ে লিউইস ঢুকল নাচঘরের ভিতর, বাইরে মাটিতে পড়ে রইল প্রহার-জর্জরিত ক্রফোর্ডের প্রায়-অচেতন অবসন্ন দেহ।
কয়েকটি দর্শক ধরাধরি করে আহত ক্রফোর্ডকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল।
ছেড়ে দাও! ক্রোধরুদ্ধ হিংস্র কণ্ঠে গর্জে উঠল ক্রফোর্ড, আমাকে একা থাকতে দাও।
টলতে টলতে কয়েক পা এগিয়ে এসে একবার দাঁড়াল সে। তার দুই চোখ ঘুসির আঘাতে প্রায় বুজে এসেছে সেই আধবোজা চোখের ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দরজার উপর নিবদ্ধ; ওই দরজা দিয়েই নাচঘরের ভিতর ঢুকেছে জেক লিউইস।
আসরের মুক্ত দ্বারপথে ভেসে আসছে নৃত্যগীত ও বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনি, কিন্তু সেই শব্দের তরঙ্গ ক্রফোর্ডের কানে প্রবেশের পথ পায়নি। তার অন্তরের অন্তস্থল ভেদ করে জেগে উঠেছে এক হত্যাপাগল হন্তারক, প্রতিশোধের হিংস্র আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ না-করে তার তৃপ্তি নেই।
দুই হাতে মুঠো পাকিয়ে একবার মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটিকে সে নিরীক্ষণ করল। মুঠির হাড়গুলো ঘুসোঘুসির ফলে ক্ষতবিক্ষত। হাত দুটো নামিয়ে নিল ক্রফোর্ড, তারপর অস্পষ্ট ভগ্ন স্বরে বলে উঠল, এই শেষ। হাতাহাতি মারামারির মধ্যে আমি আর নেই।
কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা পিছিয়ে গেল সভয়ে। কণ্ঠস্বরে খুনির উদগ্র আগ্রহ বুঝে নিতে তাদের একটু দেরি হয়নি।
ক্রফোর্ড যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই জায়গাটার উপর আলো এসে পড়েছিল নাচঘরের ভিতর থেকে। ক্রফোর্ড গোল্ডসবি আলোকিত স্থান ত্যাগ করে ছায়াচ্ছন্ন অন্ধকারের ভিতর পদচালনা করল। তার দীর্ঘ দেহ রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নাচঘরের দরজা ঠেলে বাইরে ছুটে এল ক্রফোর্ডের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। সে চিৎকার করে ডাকল, ক্রফোর্ড! ক্রফোর্ড!
উত্তর এল না। আবার চিৎকার করে ডাক দিল তরুণী। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এইবার ভেসে এল ক্রফোর্ডের কণ্ঠস্বর, এখানে এসো না। এখন আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। পরে সাক্ষাৎ হবে। সম্ভবত নোয়াটা শহরে তোমার সঙ্গে আমি দেখা করতে পারব।
যেখানে তার ঘোড়াটা বাঁধা ছিল, সেইখানে এগিয়ে গেল ক্রফোর্ড–তারপর একলাফে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাহনকে চালনা করল তিরবেগে। সারারাত ধরে ছুটল ঘোড়া। ভোরের দিকে সে এসে পৌঁছোল বাড়িতে। ক্রফোর্ড তার ঘুমন্ত মা আর ভাইকে জাগাল না, নিঃশব্দে বাড়ির ভিতর ঢুকে সে অস্ত্র গ্রহণ করল এবং পথশ্রান্ত বাহনটিকে রেখে আর-একটি তাজা ঘোড়া বেছে নিল আস্তাবল থেকে।
পরের দিন। বেশ বেলা হয়েছে। ধক ধক জ্বলছে সূর্যের আলো। ওল্ড টাউন শহরের জি. এল. বাউডেন নামক ভদ্রলোকটির গোলাবাড়ির দিকে হেঁটে চলেছে লিউইস। ওইখানেই সে কাজ করে।
উঠোন পার হয়ে গোলাবাড়ির এলাকার মধ্যে লিউইস পদার্পণ করল। মাথা নীচু করে সে পদচারণা করছিল অন্যমনস্কভাবে, হঠাৎ তার কানে এল তীব্র কণ্ঠস্বর, এই যে লিউইস! ঠিক সময়েই তুমি এসে পড়েছ!
সচমকে মুখ তুলে লিউইস দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে আছে গোেল্ডসবি ক্রফোর্ড!
ক্রফোর্ডের মুখের ওপর বিগত রাত্রের প্রহার-চিহ্ন দিবালোকে সুস্পষ্ট, ক্ষতবিক্ষত সেই মুখে করাল ক্রোধের হিংস্র অভিব্যক্তি লিউইস সভয়ে নিরীক্ষণ করল, ক্রফোর্ডের ডান হাতে রয়েছে একটা ভারী রিভলভার।
মুহূর্তের মধ্যে লিউইস বুঝে নিল তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মূর্তিমান মৃত্যুদূত; মহা আতঙ্কে পিছন ফিরে সে ছুটল। সঙ্গেসঙ্গে ছুটল রিভলভারের গুলি। লিউইস ছিটকে পড়ল মাটির উপর। তার মরণাহত দেহ একবার ছটফট করে উঠল। তৎক্ষণাৎ আবার গর্জে উঠল ক্রফোর্ডের রিভলভার। দ্বিতীয় বারের নিক্ষিপ্ত বুলেট লিউইসের শরীর থেকে জীবনের শেষ চিহ্ন মুছে দিল। মৃতদেহ পড়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো, রক্তে ভিজে গেল গোলাবাড়ির প্রাঙ্গণ।
শান্তভাবে চারদিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ক্রফোর্ড। কিন্তু তার চোখ দুটো জ্বলছিল জ্বলন্ত কয়লার মতো।
ক্রফোর্ড দেখতে পেল গোলাবাড়ির দরজা খুলে তার দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন বাউডেন। অত্যন্ত নির্বিকারভাবে হাত তুলে তাকে অভিনন্দন জানাল খুনি, গুড মর্নিং, মি. বাউডেন।
প্রতি-অভিবাদনের জন্য না-দাঁড়িয়ে গোলাবাড়ি প্রদক্ষিণ করে সে এগিয়ে গেল তার ঘোড়ার দিকে। জন্তুটাকে একটা খুঁটির সঙ্গে সে বেঁধে রেখেছিল গোলাবাড়ির কাছেই। এইবার বাঁধন খুলে সে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হল। একটুও তাড়াহুড়ো না-করে সে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : তিন স্যাঙাতের ত্র্যহস্পর্শ যোগ
বাড়ির পথে যায়নি ক্রফোর্ড। সে জানত তার মাথার ওপর ঝুলছে ফাঁসির দড়ি; স্বচক্ষে তাকে খুন করতে দেখেছে বাউডেন। তার মুখ থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরবাসী জেনে যাবে জেক লিউইসকে খুন করেছে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি। অশ্বারোহণে সে এগিয়ে চলল দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ক্রিক নেশান নামক প্রদেশ অভিমুখে।
১৮৯৪ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে উইটাম্পকা শহরে এসে পৌঁছোল ক্রফোর্ড। পথশ্রমে সে তখন অবসন্ন, ক্ষুধার্ত। সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু নেই, সম্বলের মধ্যে একটি শ্রান্ত ক্লান্ত অশ্ব, একটি উইনচেস্টার ৩০ রাইফেল এবং কোল্ট, ৪৪ রিভলভার। এক নজরে দেখলেই বোঝা যায় মানুষটা অত্যন্ত বেপরোয়া এক পলাতক আসামি।
একটি দোকানের সামনে বসে ছিল দুই ব্যক্তি। রূঢ় দৃষ্টি মেলে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিল তারা। দুজনের মধ্যে যে লোকটি বয়সে বড়ো, সে হঠাৎ হাত তুলে বন্ধুর মতো হাঁক দিল, ওহে ছোকরা! পিছন দিকের আস্তাবলে তোমার ঘোড়াটাকে নিয়ে যাও। আর জনকে বলো ঘোড়াটাকে দলাইমলাই করে কিছু দানাপানির ব্যবস্থা যেন করে দেয়। আমরা হচ্ছি জিম কুক আর বিল কুক। তুমি হয়তো আসার পথে আমাদের নাম শুনে থাকবে।
হয়তো শুনেছি, গোল্ডসবি সতর্কভাবে উত্তর দিল, অবশ্য আমি যাদের কথা ভাবছি, তোমরা যদি সেই লোক হও।
আমরাই সেই লোক, জানাল জিম কুক।
অল্পবয়সি খুনিটি অনেকদিন পরে পেট ভরে খেতে পেল। নতুন বন্ধুদের ব্যবহারে সে কৃতজ্ঞ বোধ করল। সে আরও লক্ষ করল উইটাম্পকা শহরের মানুষ তার বন্ধুদের সঙ্গে তাকেও যথেষ্ট সমীহ করছে। শহরবাসীর সমীহ করার কারণ ভয়ে ভক্তি–জিম আর বিল তদানীন্তন কালের দুর্ধর্ষ দস্যু। ক্রফোর্ড গোল্ডসবিকে পূর্বোক্ত দুই দস্যুর গৃহে অতিথি হতে দেখে শহরবাসী ভেবে নিয়েছিল নবাগত মানুষটিও নিশ্চয়ই ভয়ানক চরিত্রের এক দুবৃত্ত না হলে সে দস্যুদের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করবে কেন?
কয়েকটা দিন কাটল। ক্রফোর্ড তখন বেশ সুস্থ। তার ঘোড়াটিও পরিচর্যার ফলে বেশ তাজা হয়ে উঠেছে। কুক ভাইরা বুঝল এইবার ক্রফোর্ডকে কাজে লাগানো যায়। তাদের দলে এখন নতুন মানুষ দরকার। রতনে রতন চেনে ক্রফোর্ডকে দেখেই কুক ভাইরা বুঝে নিয়েছিল এই ছোকরা বেশ কাজের হবে।
জিম কুক টোপ ফেলল, স্কেলস বুড়োর দোকানে বেশ ভালো টাকাকড়ি পাওয়া যেতে পারে।
মাছ টোপ খেল; ক্রফোর্ড বলল, লুঠেরা মানুষ কাজের জায়গার কাছাকাছি বন্ধুবান্ধব রাখে। এই শহরের লোক আমাদের যথেষ্ট ইজ্জত দেয়। সুতরাং বন্ধু পাওয়া খুব কঠিন হবে না।
জিম বলল, লুঠেরা মানুষ বন্ধুর পরোয়া করে না। লুঠেরার বন্ধু নেই, থাকতে পারে না। লুঠেরা যদি মনে করে তার বন্ধু আছে, আর সেই বন্ধুর ভরসা যদি সে করে তার দফা শেষ খুব বেশিদিন তাকে দুনিয়ার আলো দেখতে হবে না।
ক্রফোর্ড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, ঠিক আছে। তোমরা যা ভালো বুঝবে, তাই হবে।
এইসব কথা যেদিন হল, ঠিক তার পরের দিনই স্কেলস মার্কেন্টাইল স্টোর্স নামে দোকানটার ওপর রিভলভার হাতে হানা দিল তিন দুবৃত্ত–জিম কুক, বিল কুক ও গোল্ডসবি ক্রফোর্ড।
তারা মুখোশ অথবা রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে আত্মপরিচয় গোপন করার চেষ্টা করল না। বুক ফুলিয়ে ডাকাতি করে টাকা নিয়ে সরে পড়ল তিন স্যাঙাত। শহর থেকে অনেক দূরে একটা বনের মধ্যে টাকাকড়ির ভাগবাটোয়ারা হল।
গোল্ডসবি ক্রফোর্ড মনে মনে গর্ববোধ করতে লাগল–সে এখন সাধারণ খুনি নয়, স্বনামধন্য কুক দস্যুদের যোগ্য সহকর্মী এক লুঠেরা সে!
কুক ভাইরা কিন্তু হতাশ হয়েছিল। জিম কুক তার লুঠের বখরা পকেটস্থ করে বলল, ধৎ! কিচ্ছু হল না। আরও অনেক বেশি টাকা পাওয়া উচিত ছিল।
আরও অনেক জায়গা আছে যেখানে মালকড়ি পাওয়া যায়, ক্রফোর্ড বলল, শুধু সঠিক জায়গা চিনে হানা দেওয়া দরকার।
জিম বলল, এই ক্রিক নেশান এলাকায় মালকড়ি বিশেষ নেই।
ক্রফোর্ড বলল, চেরোকি এলাকাতে ভালো রেস্ত পাওয়া যায়।
জিম মন্তব্য করল, তা যায়। তবে ওই জায়গার হাওয়া বড়োই ফাঁকা, আর ওই ফাঁকা হাওয়ার উপর ঠ্যাং ছুঁড়তে ছুঁড়তে শূন্যে ঝুলতে মোটেই ভালো লাগে না, বুঝেছ দোস্ত?
বিল এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, আরে! ফাঁসিতে ঝোলাতে হলে লুঠেরাকে আগে ধরতে হবে তো! আমরা সেই সুযোগ দেব কেন? আমার মনে হয় বব আর এফির সাহায্যে আমরা গা-ঢাকা দিতে পারব।
জিম সায় দিল, তা বটে।
কুক ভাইরা যার কথা বলল সেই বব হার্ডিন হচ্ছে কুক ভাইদের শ্যালক। শালাবাবু কাজ করত এফি ক্রিটেনডেন নামে এক মহিলার সরাইখানাতে। সরাইখানাটির নাম হাফওয়ে হাউস। ওই হাফওয়ে হাউস ছিল ফোর্ট গিবসন ও টেলাকুয়া প্রদেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত একমাত্র বিশ্রামাগার। পূর্বোক্ত দুটি প্রদেশের মধ্যে যাতায়াতকারী পথিকদের বিশ্রাম ও খাদ্যগ্রহণের জন্য হাফওয়ে হাউস ছাড়া অন্য কোনো সরাইখানা সেই অঞ্চলে ছিল না।
বিল কুক বলল, সে যাই হোক, ওই সরাইখানায় ববের কাছেই আমাদের যেতে হবে। স্কেলস বুড়োর দোকান লুঠ করার পর এখন আর এই এলাকার মানুষ আমাদের সুনজরে দেখবে না। অতএব চলো ববের কাছে।
পর্বতসংকুল পথের উপর দিয়ে ঘোড়ায় চেপে তিন স্যাঙাত চলল বব হার্ডিনের সঙ্গে মোলাকাত করতে। অধিকাংশ সময়েই রাতের দিকে তারা ভ্রমণ করত অশ্বপৃষ্ঠে। ওইভাবে ঘোড়া চালিয়ে কয়েকটা পাহাড় পার হয়ে তারা এসে পৌঁছোল তাদের লক্ষ্যস্থল হাফওয়ে হাউস নামক পূর্বে উল্লিখিত সারাইখানাতে।
বব এবং কত্রীঠাকুরানি এফি মহানন্দে তাদের অভ্যর্থনা জানাল। তবে কয়েকটা দিন সেখানে কাটিয়েই তারা অধৈর্য হয়ে পড়ল। তা ছাড়া ব্যাপারটা ব্যয়সাপেক্ষ। এফি ঠাকুরানি ব্যাবসা করছে, বিনা পয়সায় দস্যুদের আশ্রয় ও আহার সে দেবে কেন?
নাঃ, এভাবে পকেটের টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। অতএব পরামর্শ-সভা বসল তিন বন্ধুর মধ্যে। টেলাকুয়া শহরে অর্থ উপার্জনের উপায় আছে। উপায়টা অবশ্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
গোয়িং স্নেক ও টেলাকুয়া পরগনার রাজধানী হচ্ছে টেলাকুয়া। রাজধানীতে আইনরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা–ফোর্ট স্মিথ থেকে যুক্তরাজ্যের এক দঙ্গল মার্শাল জমায়েত হয়েছে ওই শহরে। রাজধানী টেলাকুয়া তাই মার্শালদের সবচেয়ে বড়ো ডেরা, অর্থাৎ হেড কোয়ার্টার। ওখানে ডাকাতির চেষ্টা করা মানেই ভিমরুলের চাকে ঘা দেওয়া। কিন্তু তিন স্যাঙাত বদ্ধপরিকর। ওই শহরে মানুষজনের টাকা আছে, বিপদের ঝুঁকি না-নিলে লাভের আশা কোথায়?
মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার–এই হচ্ছে তিন বন্ধুর প্রাণের কথা।
অতএব জিম কুক পাঠিয়ে দিল শ্রীমতী এফিকে খবরাখবর সংগ্রহ করতে। বলাই বাহুল্য, লুঠের একটা অংশ এফির হস্তগত হবে এই ধরনের আশ্বাস তাকে দেওয়া হয়েছিল।
দিন দুই পরে ফিরে এসে এফি জানাল অবস্থা অনুকূল, মার্শালরা এখন টেলাকুয়া শহরে অনুপস্থিত।
জিম বলল, তাহলে তুমি বলছ এখন নিরাপদে কাজ হাসিল করা যাবে?
এফি সহাস্যে বলল, আলবত! ভয়ের কোনো কারণ নেই।
তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জিম কুক একবার এফির দিকে তাকাল। তার মনে হল এফি যেন জোর করে সহজ হতে চাইছে। সে যেন একটু বেশিরকম হাসিখুশি, বড়ো বেশি সপ্রতিভ।
জিম তার সঙ্গীদের একান্তে ডেকে চুপি চুপি বলল, হাওয়া সুবিধের নয়। মনে হচ্ছে এফি শয়তানি করে কর্তাদের কাছে আমাদের খবর পাঠিয়েছে।
বিল বলল, কিন্তু ও তো শহরে গিয়েছিল। খবর দিতে হলে শহরের ভিতর না-গেলেও চলত। এখান থেকেও খবর পাঠানো যায়।
জিম ঘাড় নাড়ল, তা বটে। কিন্তু এফির হাবভাব আমার মোটেই ভালো লাগছে না।
তিন বন্ধু সতর্ক হয়ে গেল। দিনের আলোতে যে তাদের কেউ ধরতে আসবে না, এ-বিষয়ে তারা নিঃসন্দেহ। হঠাৎ যদি পলায়নের প্রয়োজন হয়, তাই ঘোড়াগুলিকে জিন লাগাম চড়িয়ে তারা তৈরি রাখল। তারপর চটপট শেষ করে নিল নৈশভোজন।
ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। তিন স্যাঙাতের চোখে ঘুম নেই। অনাগত বিপদের আশঙ্কায় তারা জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরায়।
অন্ধকারের ভিতর হঠাৎ লাগাম টানার শব্দ। ঘোড়ার জিনে চামড়ার মচ মচ আওয়াজ। কারা যেন আসছে!
ছায়াচ্ছন্ন রাতের আঁধারে আত্মগোপন করে অগ্রসর হল তিন পলাতক আসামি, হাতে তাদের উদ্যত রাইফেল।
কয়েক মিনিট পরেই চেরোকি নেশান অঞ্চলের শেরিফ এলিস র্যাটলিং গোর্ড ঘোড়ায় চেপে সরাইখানার সম্মুখবর্তী ফাঁকা জায়গাটার উপর এসে দাঁড়াল; সঙ্গে তার একদল সশস্ত্র রক্ষী।
রক্ষীদের নাম সিকুয়া হোস্টন, বিল নিকেল, আইজ্যাক গ্রিস, ব্র্যাকেট, হিকস, ডিক ক্রিটেনডেন ও জেক ক্রিটেনডেন। পূর্বোক্ত ডিক ক্রিটেনডেন হচ্ছে শ্রীমতী এফির পূর্বতন স্বামী (বর্তমানে বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে বিচ্ছিন্ন) আর জেক হচ্ছে তার ভাই, অর্থাৎ এফির দেবর।
দস্যুদের সন্দেহ সত্য। এফি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এবার ওদের একটু ওষুধ দেওয়া দরকার, শান্তস্বরে বলল ক্রফোর্ড; তারপরই গুলি ছুড়ল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল না, ঘোড়ার উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল সিকুয়া হোস্টনের মৃতদেহ।
পরক্ষণেই অগ্নি-উগার করে গর্জে উঠল কুক ভাইদের জোড়া রাইফেল। লড়াই শুরু হল।
রক্ষীবাহিনী পাগলের মতো ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তারপর এদিক-ওদিক ছুটে আড়াল খুঁজে গুলি থেকে প্রাণ বাঁচাতে সচেষ্ট হল। আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো তীব্র হ্রেষাধ্বনি তুলে ছোটাছুটি শুরু করল। অন্ধকারের ভিতর থেকে শোনা গেল একাধিক যাতনাকাতর কণ্ঠে ক্রুদ্ধ শপথবাক্য ও অভিশাপ।
তারপরই কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে এক বেটা!
তৎক্ষণাৎ জাগল অনেকগুলো আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন-ধ্বনি, ছুটে এল তপ্ত বুলেটের ঝটিকা–জিম কুকের দেহ বিদ্ধ করল সাত-সাতটা গুলি।
গুলির আওয়াজ থামাল কিছুক্ষণ পরে। আশেপাশের ঝোপঝাড়ে শব্দ উঠল; আগেকার আশ্রয়স্থল ছেড়ে আরও ভালো জায়গায় আড়াল খুঁজে সরে যেতে চাইছে বন্দুকধারী মানুষ। আবার জাগল নূতন শব্দের তরঙ্গ। অশ্বখুর-ধ্বনি। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে শেরিফ বুঝল শিকার পলাতক খুনিরা পালিয়েছে আধ ঘণ্টা আগেই।
আহত জিম কুককে মাঝখানে নিয়ে অদ্ভুত কৌশলে ঘোড়া ছুটিয়ে বিল আর ক্রফোর্ড এসে পৌঁছোল কুক ভাইদের এক বোনের বাড়ি। বিল এবং ক্রফোর্ডের হাতে হাত মিলিয়ে আহত জিমকে ঘরের ভিতর দিয়ে আসতে সাহায্য করল ভগ্নী লু, তারপর ক্ষতগুলো ধুয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
তোমরা এবার ওকে চটপট সরিয়ে নিয়ে যাও,লু বলল, শেরিফ র্যাটলিং গোর্ড এখনই এখানে এসে পড়বে।
বিল বলল, শেরিফ যদি বেঁচে থাকে তাহলে সে এখানে আসতে পারে বটে, কিন্তু জিমকে বাইরে নিয়ে গেলে সে নির্ঘাত মারা পড়বে।
লু উত্তর দিল, তোমরা যদি ওকে এখনই বাইরে না-নিয়ে যাও, তাহলে কি ও বাঁচবে? এখানে থাকলে ও মরবে ফাঁসিতে ঝুলে।
তা বটে। লু-র যুক্তি অস্বীকার করতে পারল না দুই দস্যু। আহত সঙ্গীকে নিয়ে তারা বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আঁধার রাতের গর্ভ ভেদ করে তাদের কানে ভেসে এল ধাবমান অশ্বের পদশব্দ। তারপরই সব চুপচাপ। একবার মার খেয়ে শেরিফ বুঝেছে পলাতক তিন আসামি অতি ভয়ংকর চরিত্রের মানুষ–ওরা অন্ধকারেও নির্ভুল লক্ষ্যে গুলি চালাতে পারে এবং নরহত্যা করতে তাদের দ্বিধা নেই বিন্দুমাত্র। দ্বিতীয়বার ভুল করল না শেরিফ র্যাটলিং গোর্ড, সদলবলে : বাড়িটাকে ঘিরে ফেলল নিঃশব্দে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেরিফ বুঝল শিকার পলাতক, সে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল।
একটি গামলার ভিতর রক্তাক্ত জল দেখতে পেল শেরিফ। অভিজ্ঞ আইনরক্ষক বুঝল দস্যুরা একটু আগেও এখানে ছিল। লুর উদ্দেশে প্রশ্ন নিক্ষেপ করল শেরিফ, তোমার ভাইদের সঙ্গে যে-লোকটি এখানে এসেছিল, সে কে? আমার মনে হয় ওই লোকটি হচ্ছে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি।
লু মাথা নাড়ল, না ক্রফোর্ড নয়। লোকটির বেশ বয়স হয়েছে। ভাইরা বলছিল ওর নাম চেরোকি বিল।
শেরিফের কবল থেকে ক্রফোর্ডকে বাঁচানোর জন্য যে মিথ্যা নামটি আবিষ্কার করেছিল কুক ভগ্নী লু, সেই নামটিই স্থায়ী হয়ে গেল ক্রফোর্ডের জীবনে–ক্রফোর্ড গোল্ডসবির পরিবর্তে জন্মগ্রহণ করল দস্যু চেরোকি বিল। পশ্চিম আমেরিকার কুখ্যাত নরহন্তা দস্যুদের ইতিহাসে চেরোকি বিল নামটি অতিশয় পরিচিত।
১৮৯৪ সালে ৮ জুলাই রাত্রে শেরিফ র্যাটলিং গোর্ডকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল বিল। তারপর থেকে বিল অধিকাংশ সময়েই নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছে; লুঠতরাজ করেছে বিভিন্ন স্থানে, নরহত্যা করেছে একটার পর একটা। সেই বছরেরই শেষের দিকে যেসব অপরাধ সে করেছিল, সেই দুষ্কর্মগুলির তালিকা আছে ফোর্ট স্মিথ আর্ক নামক স্থানে। ওই তালিকার দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায় নোয়াটা অঞ্চলে ট্রেন-ডাকাতিতে অভ্যস্ত আর এক দস্যুকে সে হত্যা করেছে, তারপর তার হাতে খুন হয়েছে পূর্বোক্ত দস্যুর শ্যালক জন ব্রাউন–অতঃপর বিল কর্তৃক লুণ্ঠিত হয়েছে রেড ফর্ক অঞ্চলের ট্রেন, ওকমালজিতে পার্কিনের দোকান, শ্যাটো এক্সপ্রেস অফিস, করেটার একটা ট্রেন এবং লেনাপা পোস্ট অফিস। মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে বারোটি নরহত্যা করেছিল বিল। নিহত বারো জনের মধ্যে শেষ ব্যক্তির নাম আর্নেস্ট মেলটন।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : শেষ সংঘাত
১৮৯৪ সালে নভেম্বর মাসের ৮ তারিখে লেনাপার রাজপথের উপর দিয়ে সবেগে ও সশব্দে ঘোড়া ছুটিয়ে চেরোকি বিল এসে থামল শাফেল্ট-এর দোকানের সামনে।
সঙ্গে তার এক সহযোগী দস্যু, নাম ভার্ডিগ্রিস কিড।
কিডের রাইফেল সগর্জনে কয়েকবার অগ্নিবর্ষণ করল, সঙ্গেসঙ্গে রাজপথ কঁকা। চেরোকি বিল দোকানে ঢুকল, হাতে তার উইনচেস্টার রাইফেল।
তরুণ দোকানি শাফেল্টকে উদ্দেশ করে বিল বলল, যা আছে সব নিয়ে যাব।
ঠিক আছে বিল, সব কিছুই তোমার, বলল শাফেল্ট, তারপর সিন্দুক খুলে দিল।
শাফেল্টের দোকানের পাশেই একটা রেস্তোরাঁ বা ভোজনালয়। ওই রেস্তোরাঁ এবং শাফেন্টের দোকানের মাঝখানে অবস্থান করছিল খানিকটা ফাঁকা জায়গা। রেস্তোরাঁর একটি জানালা দিয়ে আর্নস্ট মেলটন সাগ্রহে ডাকাতির ব্যাপারটা দেখছিল। হঠাৎ বিলের দৃষ্টি পড়ল মেলটনের দিকে। বীরত্বের সাক্ষী হিসাবে দর্শক পেলে খুশি হত বিল, কিন্তু কী কারণে জানি না সেদিন মেলটনকে দেখেই তার মেজাজ ছিল বিগড়ে–ধাঁ করে রাইফেল তুলে সে গুলি চালিয়ে দিল। জানালার কাঁচ ভেঙে মেলটনের মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ হল। তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল আর্নেস্ট মেলটন।
এমন অকারণ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ না-করে থাকতে পারল না তরুণ শাফেল্ট :লোকটাকে শুধু শুধু মারলে? কাজটা মোটেই ভালো হল না।
তুমিও বুঝি ওইভাবে মরতে চাও?
না। বিল, তুমি আমার সোনাগুলি নিয়েছ। ওতেই খুশি থেকো, আমার প্রাণ নিয়ে তোমার কিছু লাভ নেই।
ঠিক আছে।
হত্যাকারী দোকানের বাইরে এসে ঘোড়ায় চাপল। ভার্ডিগ্রিস কিড এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সঙ্গীর জন্য। দোকানের সামনে কয়েকবার গুলি ছুঁড়ে শহরবাসীকে বিদায় সংবর্ধনা জানাল দুই দস্যু, তারপর সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শহর ত্যাগ করল।
প্রায় দুই মাইল পথ অশ্বারোহণে অতিক্রম করার পর বিল তার সঙ্গীকে বলল, এবার মালের বখরা নিয়ে তুমি সরে পড়ো। পরের সপ্তাহে টালসি শহরে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব। এখন আমি যাচ্ছি ম্যাগি গ্লাসের সঙ্গে দেখা করতে। ম্যাগি আছে নোয়াটাতে তার আত্মীয়স্বজনের কাছে।
কিড বলল, ওহে বিল, তোমার বান্ধবী ম্যাগির কাছে তুমি যেয়ো না। সবাই জানে তুমি ওখানে যাও। মার্শাল তোমাকে ওইখান থেকেই গ্রেপ্তার করবে। ভালো চাও তো ওইখানে যাওয়া ছেড়ে দাও।
রূঢ়স্বরে বিল বলল, আমার ব্যাপার আমি ভালোই বুঝি। তুমি কি আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে চাও?
ভার্ডিগ্রিস কিড ব্যস্ত হয়ে জানিয়ে দিল সেরকম উদ্দেশ্য তার নেই।
অতঃপর লুঠের মাল ভাগ হল। দুই দস্যু চলে গেল দুই দিকে। সেই রাতেই নোয়াটা শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে আইজ্যাক রজার্সের বাড়ির দরজায় এসে ধাক্কা দিল বিল। দরজা খুলে বিলকে দেখে ভারি খুশি রজার্স : আরে দোস্ত যে! তাড়াতাড়ি ঘোড়া রেখে ভিতরে এসো।
আইজ্যাক, তুমি কেমন আছ? বিল বলল, তুমি একবার নোয়াটাতে গিয়ে ম্যাগিকে নিয়ে এসো।
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
পথে কারো সঙ্গে আজেবাজে কথা কইবে না। বুঝেছ আইক?
আমাকে তুমি জান না, বিল? আমি কাউকে তোমার কথা বলব না।
আমার কথা অন্য লোককে বললে তোমাকে বেশিক্ষণ বাঁচতে হবে না, আইক।
ওভাবে কথা বলছ কেন? আমি কি তোমাকে বিপদে ফেলতে পারি? বিল, তুমি মিছিমিছি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ।
কিছুক্ষণ পরে ভাইঝি ম্যাগিকে নিয়ে ফিরে এল রজার্স। বিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যে জায়গা থেকে ভাইঝিকে আনতে রওনা হয়েছিল রজার্স, ঠিক সেই জায়গাতেই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিল হাতে তার নিত্যসঙ্গী রাইফেল, চোখের দৃষ্টি কঠোর এবং বিশ্লেষণে তীক্ষ্ণ।
আইজ্যাক সরে যেতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল ম্যাগি : তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি ক্রফোর্ড। আইজ্যাক তোমাকে ধরিয়ে দিতে চায়। আগেও তোমাকে সাবধান করে দিয়েছি আমি। কেন তুমি এখানে এলে?
অনেকেই ও-কথা বলছে বটে, কিন্তু আমি জানি আইজ্যাক আমাকে ধরিয়ে দেবে না।
বিল স্মিথ এখানে অন্তত বার-ছয়েক এসে আইজ্যাকের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।
স্মিথ ছাড়া আরও অনেক মার্শাল আমার পিছু নিয়েছে। সদম্ভে ঘোষণা করল বিল, আমি ওদের পরোয়া করি না।
পুরো দুটো দিন রজার্সের সঙ্গে কাটালেও রাইফেলটাকে বিল একবারও হাতছাড়া করেনি।
সে সবসময়েই হাসিখুশি, কিন্তু তার সতর্ক দৃষ্টি সর্বদাই রজার্সের উপর। তৃতীয় দিন সকালে রজার্সের বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে গেল। তারপর অশ্বপৃষ্ঠে টালসিতে গিয়ে ভার্ডিগ্রিস কিড এবং কুক ভাইদের সঙ্গে মিলিত হল বিল। কিন্তু কয়েকদিন পরেই রক্ষীবাহিনীর তাড়া খেয়ে আবার তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।
১৮৯৫ সালের জানুয়ারি ২৯ তারিখে আবার আইজ্যাক রজার্সের গৃহে উপস্থিত হল অশ্বারোহী বিল :ওহে রজার্স, তুমি চটপট নোয়াটাতে গিয়ে ম্যাগিকে নিয়ে এসো। আমি বেশ কিছুদিন এখানে বিশ্রাম নেব। চারদিকে হাওয়া বড়ো গরম, গতিক সুবিধের নয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি বিশ্রাম করো বিল, রজার্স বলল, রাইফেল রেখে দিয়ে একটু আরাম করো।
ওই কথাটি বলবে না আইজ্যাক। আমি রাইফেলের উপর নজর রাখি, তাই রাইফেলও আমার উপর নজর রাখে।
ক্রফোর্ড গোল্ডসবি বহু নরহত্যা করেছিল। তার ভগ্নীপতিকে সামান্য কারণে সে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। অনেক মানুষকে সে খুন করেছে সম্পূর্ণ অকারণে। কিন্তু রজার্স যে তাকে ধরিয়ে দিতে চায় সে-কথা জেনেও কেন যে ওই লোকটিকে বিল খুন করেনি তা বলা মুশকিল। খুব সম্ভব রজার্সের সঙ্গে একটা বিপজ্জনক খেলায় নেমে সে মনে মনে আনন্দ আর উত্তেজনার চমক উপভোগ করেছিল। রজার্স যে এক সময়ে যুক্তরাজ্যের অন্যতম মার্শাল ছিল এবং বর্তমান ডেপুটি মার্শাল উইলিয়াম স্মিথের সঙ্গে চক্রান্ত করে সে যে বিলকে ধরতে চাইছে, সেইসব তথ্যও বিলের অজ্ঞাত ছিল না। রজার্সের আর এক প্রতিবেশী ক্লিং স্কেলসও বিলকে ধরিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিল। শুধু পুরস্কারের লোভেই যে সে এই কাজ করছিল তা নয়। উইটাম্পকিন শহরে যে স্কেলসদের দোকানে বন্ধুদের নিয়ে বিল ডাকাতি করেছিল, সেই স্কেলসদের এক আত্মীয় ছিল ক্লিং স্কেলস।
ম্যাগি গ্ল্যাস আবার সতর্ক করে দিল তার বন্ধুকে, কিন্তু চেরোকি বিল তার কথায় কান দিল না।
রজার্স অবশ্য খুবই যত্ন করছিল তার অতিথিকে। আদর করে এক গ্যালন হুইস্কি নিয়ে এল সে বিলের জন্য। দুঃখের বিষয়, বিল সেই হুইস্কির স্বাদ গ্রহণ করতে রাজি হল না। রজার্স তার প্রতিবেশী ক্লিংকে নিয়ে এসেছিল তাস খেলার অন্যতম সঙ্গী হিসেবে। অতিথিকে সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন সুস্বাদু পদ রান্না করেছিল রজার্সের বউ। অবশ্য ওইসব রান্নার উপকরণ সংগৃহীত হয়েছিল চেরোকি বিলের টাকা থেকেই।
টেবিলের উপর সাজানো আহার্য নিয়ে নৈশভোজনে বসেছিল বিল। চেয়ারে উপবিষ্ট বিলের পিঠ ছিল দেয়ালে, মুখ ছিল দরজার দিকে ফেরানো এবং কোলের উপর ছিল উইনচেস্টার রাইফেল।
সারা দুনিয়া জানে তোমার বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসে, ক্ষুণ্ণকণ্ঠে অভিযোগ জানাল রজার্স, কিন্তু তুমি বন্ধুদের বিশ্বাস করো না। সত্যি, এটা খুবই অপমানের বিষয়।
বিলের ওষ্ঠাধরে ফুটল হিংস্র হাস্য; নির্বিকার স্বরে সে বলল, আইক, ওই মাংসের পাত্রটা এগিয়ে দাও তো।
খাওয়া শেষ হলে তারা তাস খেলতে বসল। খেলা চলল ভোর চারটে পর্যন্ত; এর মধ্যে একবারও কোলের উপর থেকে রাইফেল নামায়নি বিল। তিন খেলোয়াড়ই অনুভব করছিল হাওয়া খারাপ, পরিবেশ সুবিধের নয়। অবশেষে চারটের সময় তিনজনেই শুয়ে পড়ল।
একই খাটে একই বিছানায় শয্যা নিয়েছিল তিনজন। কিছুক্ষণ পরে অতি সন্তর্পণে খাট থেকে নিঃশব্দে নামল রজার্স, তৎক্ষণাৎ বিলের পা পড়ল মেঝের উপর এবং মুহূর্তপূর্বে শায়িত বিল হল রাইফেল হাতে দণ্ডায়মান!
মধুর হেসে বিল জানতে চাইল, কোনো শব্দ-টব্দ শুনে উঠে পড়েছ বুঝি, আইক?
আইক আবার শয্যা গ্রহণ করল। বিলও শুয়ে পড়ল তার নিজস্ব জায়গায়।
একটু পরে আবার যেই আইক উঠেছে, সঙ্গেসঙ্গে বিলও উঠে দাঁড়িয়েছে রাইফেল নিয়ে এবং নিরীহ কণ্ঠে আইকের নিদ্রাভঙ্গের কারণ জানতে চেয়েছে। বার বার একই ঘটনার যখন পুনরাবৃত্তি ঘটল, তখন হতাশ হয়ে নিদ্রার ক্রোড়ে আত্মসমর্পণ করল আইক।
ঘুম ভাঙতে আইক দেখল সে একাই শুয়ে আছে; চারদিকে ঝলমল করছে সূর্যালোক। সে বুঝল বেশ বেলা হয়েছে। শয্যাত্যাগ করে জামাকাপড় চড়িয়ে আইক রান্নাঘরে এসে দেখল ওই ঘরে খাওয়ার টেবিলের সামনে চেয়ার পেতে বসে আছে বিল–কোলে নিত্যসঙ্গী রাইফেল, মুখে বিদ্রপের মৃদু হাসি।
স্কেলসও ছিল সেখানে, মিসেস রজার্স ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ পরিবেশন করছিল। খাওয়া শেষ হলে তিনজনই চেয়ার পেতে উপবিষ্ট হল অগ্নিকুণ্ডের সামনে। শীতের দেশ, সকালের কনকনে ঠান্ডায় অগ্নিকুণ্ডের উত্তপ্ত সান্নিধ্য বেশ আরামদায়ক।
হঠাৎ ঘরের ভিতর ঢুকল বিলের বান্ধবী ম্যাগি গ্লাস। চঞ্চল-চরণে সে ঘরের এক দরজা দিয়ে ঢুকে অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাতায়াত করার সময়ে তার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি ঘুরছিল উপবিষ্ট তিন ব্যক্তির মুখের উপর। কয়েকবার ওইভাবে ঘোরাঘুরি করার পর হঠাৎ বিলের পাশে এসে দাঁড়াল ম্যাগি এবং পুরোনো নাম ধরে সম্বোধন করে বলল, ক্রফোর্ড! তুমি এখানে রয়েছ কেন? তাড়াতাড়ি চলে যাও এখান থেকে। তুমি কি জানো না, ওরা দুজনে তোমাকে ধরিয়ে দিতে চায়?
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অকারণে নরহত্যা করতে যার কিছুমাত্র দ্বিধা ছিল না, সেই চেরোকি বিল দুই চক্রান্তকারীর অসৎ উদ্দেশ্য জানতে পেরেও তাদের খুন করার চেষ্টা করেনি। বোধ হয় ষড়যন্ত্রকারীদের আশা-নিরাশার উদবেগপূর্ণ মুহূর্তগুলি সে উপভোগ করছিল; নিজের উপর তার আস্থা ছিল অপরিসীম।
বান্ধবীর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে রজার্সের বাড়িতেই থেকে গেল বিল। সকালের পর দুপুর; আবহাওয়া থমথমে। প্রত্যেকেই নীরব। একটা আসন্ন দুর্ঘটনার ইঙ্গিত অনুভব করছিল সকলেই।
আইক রজার্স সশব্দে গলা পরিষ্কার করল, তারপর ভাইঝিকে ডেকে বলল, ম্যাগি, দোকানে গিয়ে ভালো দেখে কয়েকটা মুরগি নিয়ে এসো। বিল যখন এখানে আছে, ওকে ভালো করে খাওয়ানো দরকার। অতিথিকে আদর যত্ন করা আমাদের কর্তব্য।
একটু ইতস্তত করে পিতৃব্য রজার্সের হাত থেকে টাকা নিল ম্যাগি। একবার বিলের মুখে দিকে তাকাল সে, কিন্তু বিল নির্বিকার বান্ধবীর মুখের দিকে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল না। অগত্যা একটা শাল টেনে মুরগি আনতে চলে গেল ম্যাগি।
স্কেলস খানিকটা তামাক ও সিগারেট পাকানোর কাগজ পকেট থেকে বার করল এবং নিপুণ হস্তে পাকিয়ে ফেলল একটি চমৎকার সিগারেট। তারপর সিগারেট তৈরির ওই মালমশলা সে তুলে দিল বিলের হাতে। বিল জানাল ওইভাবে সিগারেট বানাতে সে অভ্যস্ত নয়, তবে চেষ্টা করতে তার আপত্তি নেই। অনভ্যস্ত হাতে একটা বিশ্রী হোঁতকা সিগারেট বানাল বিল, তারপর সঙ্গীদের কাছে দেশলাই চাইল। দুই সঙ্গী জানিয়ে দিল তাদের কাছে দেশলাই নেই।
ওই তো আগুন, ওইখান থেকেই সিগারেট ধরাও, আঙুল তুলে অগ্নিকুণ্ড দেখিয়ে দিল রজার্স।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিল। নিত্যসঙ্গী রাইফেল তখনও তার হাতে। একহাতে রাইফেল ধরে অপর হাতে কাঠের স্তূপ থেকে একটা কাষ্ঠখণ্ড তুলে নিল সে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কাঠের টুকরোটা জ্বালিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে সচেষ্ট হয়েছিল বিল এবং সেইজন্যেই সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে সে ঝুঁকে পড়েছিল অগ্নিকুণ্ডের ওপর।
মুহূর্তের জন্য সে সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি সরে গিয়েছিল স্কেলস ও রজার্সের উপর থেকে।
ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট রজার্সের কাছে বিড়ালের মত ক্ষিপ্রবেগে, বিড়ালের মতোই নিঃশব্দে কাঠের স্তূপ থেকে একটি কাঠ তুলে নিল রজার্স–পরক্ষণেই প্রচণ্ড বেগে সেই কাষ্ঠখণ্ড পড়ল বিলের মস্তকে।
অমন মোটা কাঠ দিয়ে অত জোরে বাড়ি মারলে যেকোনো জোয়ান মানুষের মাথা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেত, কিন্তু বিল ছিল অসাধারণ শক্তিশালী–আঘাতের বেগে সে হাঁটু দুমড়ে পড়ে গেল, তবে কাবু হল না।
বিলের রাইফেল হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল কাষ্ঠপের উপর, সেটাকে পুনরায় হস্তগত করার সুযোগ সে পেল না–তার আগেই বিলের উপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল রজার্স ও স্কেলস।
এক ঝটকায় দুজনকে ছিটকে ফেলে দিয়ে বিল উঠে দাঁড়াল, তারপর সজোরে ঘুসি চালাতে লাগল আততায়ীদের লক্ষ করে।
মারামারির শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছিল মিসেস রজার্স। রাইফেলটাকে কাষ্ঠপের উপর পড়ে থাকতে দেখে মেয়েটি সেটাকে তুলে নিল, তারপর খেলা দরজা দিয়ে অস্ত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের ঘরে।
ওর রাইফেল এখন আমার কাছে! চেঁচিয়ে উঠল মিসেস রজার্স।
খেপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করছিল বিল। বাইরের দরজা দিয়ে বিল একবার ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্কেলস আর রজার্স একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই তিনজন গড়িয়ে পড়ল মেঝের উপর। অন্তত বিশ মিনিট ধরে ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি আর ধস্তাধস্তি চলল তিনজনের মধ্যে। যুযুধানদের হস্তপদ ও দেহের আঘাতে চেয়ারগুলি হল টুকরো টুকরো। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে ছুটে এল তার বান্ধবী ম্যাগি গ্ল্যাস, কিন্তু ওই অবস্থায় বিপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করার কোনো উপায়ই খুঁজে পেল না মেয়েটি।
অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে ম্যাগি দেখল, বিলের রক্তাক্ত দেহটাকে মেঝের উপর চেপে ধরেছে দুই স্যাঙাত। কড়াৎ করে একটা শব্দ হল, ম্যাগির ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনেই বিলের কবজিতে সশব্দে হাতকড়ি লাগিয়ে দিল রজার্স।
প্রহারক্লিষ্ট ক্ষতবিক্ষত দেহে মেঝের উপর পড়ে বিল কিছুক্ষণ ধরে সজোরে শ্বাস গ্রহণ করল, তারপর উঠে বসল। রজার্সের দিকে তাকিয়ে বিল বলল, আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আমাকে ধরতে পারবে। আইক, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ!
আইক বলল, জ্যান্ত অবস্থায় তোমাকে ধরতে পারব কি না সে-বিষয়ে আমারও সন্দেহ ছিল। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে খুন করব।
বিল অনুনয় করে বলল, সেই ভালো। আইক, তুমি বরং আমাকে খুন করো। পুরস্কারের টাকা তো তুমি পাবেই সরকারের হাতে তুলে আমাকে ফাঁসিতে লটকে তোমার কী লাভ?
রজার্স জানাল বিচারক পার্কারের সামনে সে চেরোকি বিলকে হাজির করতে চায়।
কিন্তু বিচারে তো আমার ফাঁসির হুকুম হবে। তার চেয়ে তুমি আমাকে এখানেই মেরে ফেলছ না কেন?
উঁহু, রজার্স বলল, ওরা তোমার মৃতদেহ চায় না। তোমাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করতে পারলে আমরা মোটা টাকা পুরস্কার পাব। সেইরকম চুক্তি হয়েছে আমাদের সঙ্গে।
বিল বলল, তুমিও নিস্তার পাবে না আইক! মনে রেখো, আমার ভাই আছে! ক্লারেন্স তোমার উপর বদলা নেবে!
রজার্স তাচ্ছিল্য জানিয়ে বলল, ছাই করবে! তোমার ভাই ক্লারেন্স আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
নোয়াটা শহরে এসে রজার্স বিলকে তুলে দিল বিল স্মিথ নামক ডেপুটির হাতে। সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিলকে নিয়ে যাত্রা করল ডেপুটি বিল স্মিথ এবং তিনদিন ভ্রমণ করে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে আরকানসাস নদী পেরিয়ে উপস্থিত হল ফোর্ট স্মিথ বিচারশালায়। পূর্বোক্ত বিচারশালাটি ছিল ওই অঞ্চলের একমাত্র আদালত।
বিচারক আইজ্যাক পার্কার কর্তৃক মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত উনষাট জন অপরাধী যে-কারাগারে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল, সেইখানেই বিচারের আগে বন্দি হয়ে রইল ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিল।
১৮৯৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিলকে উপস্থিত করা হল আদালতে বিচারের জন্য। বিচারক পার্কারের এজলাসে বিলের ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, কিন্তু জে. ওয়ারেন রিড নামে জনৈক অ্যাটর্নির চেষ্টায় সাময়িকভাবে মুত্যুদণ্ড স্থগিত রইল।
বিলকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল কারাগারে। সেইদিনই কারাগারের লৌহকপাটের ভিতর থেকে তরুণ হন্তারক আঘাত হানল।
লরেন্স কিটিং ও ইয়ফ নামে দুজন কারারক্ষী খুনিদের তত্ত্বাবধান করছিল। সারিবদ্ধ লৌহপিঞ্জরের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে তালা লাগাচ্ছিল ইয়ফ। কোমরে রিভলভার ঝুলিয়ে বাইরে পায়চারি করছিল লরেন্স কিটিং।
চেরোকি বিল যে লৌহপিঞ্জরে আবদ্ধ ছিল, ঠিক তার পার্শ্ববর্তী খাঁচাটা ছিল ডেনিস ডেভিন্স নামে জনৈক অপরাধীর বাসস্থান।
উক্ত ডেনিসের খাঁচার তালা লাগাতে গিয়ে ইয়ফ দেখল চাবি লাগছে না, কারণ, তালার গায়ে চাবি লাগানোর ফুটোটাকে কাগজ ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ব্যাপারটা সন্দেহজনক! খাঁচার রেলিং-এর ভিতর দিয়ে বাইরে রিভলভারধারী সঙ্গীর দিকে তাকাল ইয়ফ, ওহে ল্যারি, এখানে একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ব্যাপার সুবিধের মনে হচ্ছে না।
আচম্বিতে বিলের খাঁচার দরজাটা খুলে গেল। লৌহকপাট ইয়ফের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করল, সজোরে। সঙ্গেসঙ্গে পার্শ্ববর্তী কারাকক্ষ থেকে ইয়ফের লৌহপিঞ্জরে প্রবেশ করল চেরোকি বিল, হাতে তার প্রকাণ্ড রিভলভার।
(ভগবান জানেন রিভলভারটা সে কোথা থেকে জোগাড় করেছিল!)
–খাঁচার দরজার ভিতর দিয়ে রিভলভারটা কিটিং-এর দিকে উঁচিয়ে ধরল বিল, উন্মুক্ত দন্তের ফকে বেরিয়ে এল রোষরুদ্ধ অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর :কিটিং! তোমার হাতের রিভলভার আমাকে দাও। তারপর হাত দুটো উপরে তোলো! চটপট করো!
কিটিং হাত উপরে তুলল না, চটপট নামিয়ে আনল নীচে কোমরবন্ধে আবদ্ধ রিভলভারের বাঁটের উপর। কিন্তু অস্ত্রটাকে টেনে বার করার আগেই গর্জে উঠল বিলের রিভলভার। গুলি লাগল, কিটিং তবুও ধরাশায়ী হল না। আবার গুলি ছুড়ল বিল। এবার পড়ে গেল কিটিং। অপর রক্ষী ইয়ফ তখন খাঁচার ভিতরের দিকে লম্বা গলিপথ ধরে ছুট দিয়েছে। পর পর দু-বার তাকে লক্ষ করে বিল গুলি ছুড়ল।
চারজন প্রহরী গুলির আওয়াজ শুনে অকুস্থলে ছুটে এল। টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল কিটিং, এগিয়ে গেল সহকর্মীদের দিকে। চেরোকি বিল পালাতে চেষ্টা করছে, কিটিং বলল, ও আমাকে খুন করেছে!
কথাগুলো বলেই মাটিতে পড়ে গেল কিটিং। তার মৃত্যু হল তৎক্ষণাৎ।
লরেন্স কিটিং-এর রিভলভারটা মাটিতে পড়ে ছিল। অস্ত্রটাকে কুড়িয়ে নিয়ে বিলের দিকে গুলি চালাল প্রহরী ম্যাককনেল। সঙ্গেসঙ্গে তাকে লক্ষ করে গর্জে উঠল বিলের রিভলভার। দুজনের নিশানাই ব্যর্থ হল, খাঁচার গরাদে প্রতিহত হয়ে সশব্দে ছিটকে গেল বুলেট।
প্রহরীরা এক জায়গায় জড়ো হল। তারা বুঝেছিল চেরোকি বিল আর পালাতে পারবে না। কিন্তু তার কাছে গিয়ে তাকে বন্দি করবে কে? বিলের হাতে রিভলভার আছে, সুতরাং তার খাঁচার কাছাকাছি গেলেই যে গুলি খেয়ে মরতে হবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিলকে নিরস্ত্র করার কোনো উপায় প্রহরীদের মাথায় এল না।
সমস্যার সমাধান করল বন্দি দস্যু হেনরি স্টার। সে তার কারাকক্ষ থেকে হাঁক দিয়ে বলল, আমাকে যদি তোমরা বিলের কাছে যেতে দাও, তাহলে রিভলভারটা আমি নিয়ে আসতে পারি।
হেনরিকে অনুমতি দেওয়া হল। ডেপুটি মার্শাল ব্রুনার সাবধানবাণী শুনিয়ে বলল, ঠিক আছে হেনরি, তুমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো। কিন্তু খবরদার, শয়তানির চেষ্টা করতে যেয়ে না!
কোন মন্ত্রে ক্ষিপ্ত বিলকে ঠান্ডা করেছিল হেনরি সে-কথা কারো জানা নেই, তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল তাও কেউ বলতে পারে না–তবে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিলের কারাকক্ষ থেকে রিভলভারটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল হেনরি স্টার। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে অস্ত্রটাকে সে সমর্পণ করল ব্রুনারের হাতে।
কারাগারের ভিতর থেকে খুনের খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়ল, লরেন্সের মৃত্যুসংবাদ শুনে খেপে গেল শহরের মানুষ। এক ক্ষিপ্ত জনতা কারাগার ঘেরাও করে দাবি জানাল হত্যাকারী বিলকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতেই তারা খুনির দণ্ড বিধান করতে চায়।
বলা বাহুল্য, মার্শাল জনতার দাবি মানল না। দৃঢ়ভাবে সে জানিয়ে দিল, বিচারক পার্কার যথাসময়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা করবেন–নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার
অধিকার জনসাধারণের নেই।
১৮৯৫ সালের ২৪ অগাস্ট চেরোকি বিলকে আবার আদালতে হাজির করা হল।
.
পরিশিষ্ট
বিচারক পার্কারের রায় অনুসারে ১৮৯৬ সালের ১৭ মার্চ ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করল ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিল।
মরার আগে বিশ্বাসঘাতক রজার্সের মৃত্যুসংবাদ শুনে গিয়েছিল বিল। সম্মুখযুদ্ধে গুলি করে রজার্সকে হত্যা করেছিল এক ব্যক্তি।
ওই ব্যক্তির নাম ক্লারেন্স গোল্ডসবি–চেরোকি বিলের ভাই সে।
প্রতিশোধ
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি করদ-রাজ্যে একদা সংঘটিত এক ঘটনার ভয়াবহ বিবরণী শুনলে মনে হয় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী প্রকৃতি দেবী কখনো কখনো তাঁর বন্য সন্তানের ওপর মানুষের অত্যাচার দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তখনই তার প্রতিশোধপরায়ণ ন্যায়দণ্ড নেমে আসে হতভাগ্য অপরাধীর মাথার উপর অদৃশ্য অমোঘ বজ্রের মতো!
ঘটনাটি নীচে দেওয়া হল…
বহু বৎসর আগে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি অরণ্যসংকুল করদ রাজ্যে পদার্পণ করেছিলেন জনৈক ইউরোপের অধিবাসী; ভদ্রলোকের নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক। নিছক দেশভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার জন্য ফ্রাঙ্ক বাক সাহেব ভারতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন অর্থ উপার্জনের আশায়। ফ্র্যাঙ্ক বাকের পেশা ছিল অতিশয় অভিনব, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জীবন্ত বন্য পশু ধরে দেশবিদেশের সার্কাস ও চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের কাছে জন্তুগুলোকে সরবরাহ করতেন তিনি, বিনিময়ে গ্রহণ করতেন প্রচুর অর্থ।
ভারতবর্ষে তিনি এসেছিলেন কয়েকটা বাঘের জন্য। ইউরোপের একটি বিখ্যাত চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি ভারতীয় ব্যাঘ্র সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং ওইসব জীবন্ত ও বিপজ্জনক পণ্যের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অর্থ দিতে সম্মত ছিলেন সেই টাকার অঙ্কটা মোটেই তুচ্ছ মনে করতে পারেননি ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেব।
অতএব সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে ভদ্রলোক পদার্পণ করলেন ভারতের মাটিতে।
যে করদ রাজ্যে ফ্র্যাঙ্কবাক উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই রাজ্যে সরকারি চাকরি করতেন তারই এক বন্ধু। উক্ত বন্ধুবর ছিলেন ইউরোপের মানুষ। তার সঠিক নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক আমাদের বলেননি, অতএব আমরা তাঁকে মি. এক্স নামেই অভিহিত করব। করদ রাজ্যটির নাম জানাতেও বাক সাহেব রাজি নন, তাই পূর্বোক্ত রাজ্যটির নামও আমরা দিতে পারলাম না।
যাই হোক, নামধাম জানতে না-পারলেও কাহিনির রসগ্রহণ করতে বোধ হয় আমাদের বিশেষ অসুবিধা হবে না ।
যথাস্থানে পৌঁছে ফ্র্যাঙ্ক বাক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ওই রাজ্যের বনে-জঙ্গলে বাঘের অভাব নেই। ফ্র্যাঙ্কের বন্ধু পূর্বোক্ত মি. এক্স জানালেন সেইদিনই একটা মস্ত বাঘ মহারাজের ফঁদে ধরা পড়েছে। বাঘটি এখন রাজার সম্পত্তি। তবে বাক সাহেব যদি জন্তুটাকে দেখতে চান তাহলে মি. এক্স তাকে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। বলাই বাহুল্য ফ্র্যাঙ্ক বাক জন্তুটাকে দেখতে চাইলেন এবং বন্ধুবর মি. এক্সের সঙ্গে যাত্রা করলেন নির্দিষ্ট স্থানের উদ্যেশে। একটু পরেই ধৃত পশুটিকে দেখতে পেলেন বাক সাহেব। এমন প্রকাণ্ড বাঘ ইতিপূর্বে কখনো তার চোখে পড়েনি। কিন্তু সেইসঙ্গে এমন আর একটি দৃশ্য তার দৃষ্টিগোচর হল, যা দেখার জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না।
একটা সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত ব্যাঘ্র এবং খাঁচার গরাদের ফাঁকে লোহার সাঁড়াশি দিয়ে জনৈক ব্যক্তি চেপে ধরেছে বাঘের থাবা; আর একজন লোক অতিশয় মনোযোগ সহকারে থাবার নখগুলোকে উৎপাটিত করছে লৌহনির্মিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে। অতি সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে বাঘের নড়াচড়া করারও উপায় নেই, তাই ক্রোধে ও যাতনায় বার বার গর্জন করে বাঘ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কিন্তুআত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই করতে পারছে না।
ফ্র্যাঙ্ক বাক তাঁর বন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, এমন নিষ্ঠুরভাবে জন্তুটাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তরে বন্ধুবর জানালেন, বাঘের থাবাগুলো থেকে এক-এক করে সবকয়টি নখই তুলে ফেলা হবে, কারণ এই কাজ করার আদেশ দিয়েছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর স্বয়ং!
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক স্থানত্যাগ করলেন।
পরের দিন সকালে বাক সাহেবের আস্তানায় উপস্থিত হলেন মি. এক্স। বন্ধুর মুখে ফ্র্যাঙ্ক জানলেন বাঘটির সঙ্গে ছয়টি কুকুরের লড়াই হবে–রাজামশাই জানিয়েছেন মি. ফ্র্যাঙ্ক বাক যদি বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখতে চান, তবে যেন মি. এক্স-র সঙ্গে সেইদিনই সন্ধ্যার পর যথাস্থানে গমন করেন। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে বাক সাহেব জানালেন বাঘের থাবা থেকে নখ তুলে ফেলা হয়েছে মাত্র বারো ঘণ্টা আগে, তার পায়ের ক্ষত থেকে এখনও নিশ্চয় রক্ত ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় ছয়টি হিংস্র কুকুরের বিরুদ্ধে বাঘকে যদি লড়াই করতে বাধ্য করা হয়, তবে সেটা লড়াই হবে না, হবে হত্যাকাণ্ড! এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দেখার প্রবৃত্তি যে তার নেই, সেই কথাই জানিয়ে দিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক।
মি. এক্স জানালেন, বাঘের থাবা থেকে নখগুলোকে উৎপাটিত করেই রাজামশাই ক্ষান্ত হননি, তার নির্দেশে বাঘের মুখটাকেও চামড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে–সুতরাং বাঘ শুধু তার নখ থেকেই বঞ্চিত হয়নি, তার মুখের ধারালো দাঁতগুলিও এখন সম্পূর্ণ অকেজো। মি. এক্স আরও জানালেন, যে কুকুরগুলোকে বাঘের উপর লেলিয়ে দেওয়া হবে, সেগুলোর জন্ম হয়েছে অতি-বৃহৎ হাউন্ড-জাতীয় কুকুর ও বন্য নেকড়ের সংমিশ্রণে! ওই বর্ণসংকর নেকড়ে-কুকুরের আকৃতি-প্রকৃতি নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর। অতি ভয়াবহ ছয়-ছয়টি এমন রক্তলোলুপ জানোয়ারের আক্রমণে নখদন্তহীন অসহায় ব্যাঘ্রের শোচনীয় মৃত্যু দেখে আনন্দ পাবেন রাজামশাই আর সেই রাজকীয় পুলকের অংশগ্রহণ করার জন্যই ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেবকে সাদরে আহ্বান জানাচ্ছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর; মহারাজের তরফ থেকেই উক্ত নিমন্ত্রণবার্তা বহন করে এনেছেন মি. এক্স।
অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক জানালেন এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখতে তিনি ইচ্ছুক নন, আর মি. এক্স-এর মধ্যে যদি কিছুমাত্র মনুষ্যত্ব বোধ থাকে তবে তিনিও নিশ্চয়ই অকুস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন।
মুখ নীচু করে অস্পষ্ট স্বরে মি. এক্স জানালেন ওইরকম অনুষ্ঠানে যোগ দেবার আগ্রহ তার নেই, কিন্তু যথাস্থানে না-গেলে তার চাকরি থাকবে না বলেই নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তাকে রাজ-আদেশ পালন করতে হবে।
ক্রুদ্ধ ফ্র্যাঙ্ক বাক অতঃপর যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা বন্ধুবরের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক নয়। মি. এক্স চুপ করে বন্ধুর কটু উক্তি শুনলেন, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন একটি কথাও না-বলে…
সেদিনটা খুব ঘোরাঘুরি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, তাই সন্ধ্যার একটু পরেই আহারাদির পালা শেষ করে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করলেন। ঘুমটা বেশ জমে এসেছিল, অকস্মাৎ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল বহু মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত কোলাহল-ধ্বনি। কান পেতে শব্দটা শুনতে শুনতে সাহেব অনুভব করলেন, প্রাসাদের দিক থেকে, অর্থাৎ যেখানে বাঘ আর কুকুরের লড়াই হওয়ার কথা সেই দিক থেকেই ভেসে আসছে জনতার কোলাহল।
একটু পরেই একটা যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল, মনে হল বন্দুকের শব্দ। তারপরেই আবার বহু মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
ফ্র্যাঙ্ক বাক শব্দতত্ত্ব নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামালেন না, শ্রান্ত শরীরকে আবার সমর্পণ করলেন নিদ্রার ক্রোড়ে।
পরের দিন প্রভাতেই আবার বাক সাহেবের আস্তানায় আবির্ভূত হলেন মি. এক্স। বন্ধুকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ওহে ফ্র্যাঙ্ক! কাল রাতে কী হয়েছিল জান?
নীরস স্বরে ফ্র্যাঙ্ক বাক বললেন, জানাজানির কী আছে? বাঘের মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই হয়েছে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ বাঘটা মারা পড়েছে বটে; তবে ওইসঙ্গে মারা গেছে একটি কুকুর, আর
আর?
আর মহারাজের শিশুপুত্র!
বল কী? আশ্চর্য হয়ে গেলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কী করে?
অতঃপর মি. এক্স-এর মুখ থেকে যে আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ শুনেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক তা হচ্ছে। এই :
একটা বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের মাঝখানে ধৃত বাঘটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রাঙ্গণের চারপাশ ঘিরে দণ্ডায়মান সুউচ্চ প্রাচীরের ওপর থেকে প্রাচীরবেষ্টিত আঙিনার দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা ছিল। বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখার জন্য পূর্বোক্ত স্থানে আসন গ্রহণ করেছিলেন রাজামশাই। মজা দেখার জন্য রাজ্যের বহু মানুষও সেখানে সমবেত হয়েছিল। নিরাপদে বসে পশুদের হানাহানি দেখার জন্যই রাজামশাই প্রাচীরবেষ্টিত ওই গোলাকৃতি প্রাঙ্গণটি তৈরি করেছিলেন। একটু পরেই প্রাচীরের গাত্র-সংলগ্ন দ্বারপথে ছয়টা নেকড়ে-কুকুর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল। কুকুরগুলো প্রথমে বাঘের কাছে আসতে চায়নি, দূরে দাঁড়িয়ে তারা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ডোরাদার জন্তুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু বাঘকে নিশ্চেষ্ট ও নীরব দেখে তাদের সাহস হল, এগিয়ে এসে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোধ হয় তারা বাঘের অসহায় অবস্থা বুঝতে পারল–সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল আক্রমণ। থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে, মুখও রয়েছে বাঁধা তবু বাঘের শরীরের মর্মস্থানে কুকুরের দংশন মারাত্মক হয়ে চেপে বসতে পারল না–অদ্ভুত কৌশলে মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে বাঘ আত্মরক্ষা করতে লাগল। মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর কামড় বসাতে পারছিল বটে, কিন্তু সেই কামড় মারাত্মক দংশনে পরিণত হওয়ার আগেই বাঘ তার বিশাল গুরুভার দেহ দিয়ে এত জোরে প্রাচীরের দেয়ালের সঙ্গে আততায়ীদের চেপে ধরছিল যে; চাপের যাতনায় আর্তনাদ করে কুকুরগুলো কামড় ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিল। এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা লড়াই চলার পরেও দেখা গেল বাঘের দেহ প্রায় অক্ষত, কুকুরের দাঁত বাঘের শরীরে কোথাও রক্ত ঝরাতে পারেনি। হঠাৎ একটা কুকুর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের গলায় দাঁত বসিয়ে দিল। কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে না-পেরে বাঘ এইবার তার থাবা ব্যবহার করল এক থাপ্পড়ে সে কুকুরটাকে তার গলার ওপর থেকে সরিয়ে দিল। বাঘের থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল, চড় মারার সময়ে তার চোখে-মুখে যে যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল সেটাও দর্শকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। আচমকা মার খেয়ে কুকুরটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। দারুণ আক্রোশে সে আবার লাফ দিল বাঘের কণ্ঠদেশ লক্ষ করে। কুকুরের দুর্ভাগ্য তার কামড় বাঘের গলার উপর পড়ল না, দাঁত বসল মুখ-বাঁধা চামড়ার ফঁসের উপর। অন্ধ আক্রোশে কুকুরটা সেই চামড়ার বাঁধনটাকেই কামড়ে ধরল প্রাণপণে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো দাঁতের পেষণে কেটে গেল চামড়া কিন্তু বাঘের মুখ তখনও সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হল না। এমন শক্ত করে চোয়ালের দু-পাশ দিয়ে মোটা চামড়ার বন্ধনী দেওয়া হয়েছিল যে, এক পাশের চামড়া কুকুরের কামড়ে ছিঁড়ে গেলেও অন্যদিকের চামড়ার বাঁধন বাঘকে পুরোপুরি হাঁ করতে দিল না শুধু মুখের একদিক ফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল একটিমাত্র দাঁত। তৎক্ষণাৎ সেই একটিমাত্র দাঁতের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল বাঘ, থাবা দিয়ে কুকুরটাকে চেপে ধরে বেরিয়ে-আসা দাঁতটাকে সে সজোরে বসিয়ে দিল শত্রুর দেহে। আমরা যেভাবে শুকনো খাদ্যের টিন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলি, ঠিক সেইভাবেই কুকুরের শরীরটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলল বাঘ একটিমাত্র দাঁতের আঘাতে।
কুকুরটা তখনই মারা পড়ল। অন্যান্য কুকুরগুলো ভয়ে বাঘের সান্নিধ্য ত্যাগ করে সরে গেল। বাঘ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না, লাফ মেরে সে পাঁচিলের উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগল।
বাঘের লাফালাফিতে প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি রাজামশাই, কারণ ইতিপূর্বেও অনেকগুলো বাঘ ওই প্রাঙ্গণের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রাচীরের উচ্চতা যে বাঘের নাগালের বাইরে, সেই সত্যও প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেকবার।
কিন্তু বাঘের একটা থাবা যখন পাঁচিলের মাথায় পড়ে ফসকে গেল, তখন রাজামশাই ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন এই সৃষ্টিছাড়া জন্তুটার সঙ্গে অন্যান্য বাঘের তুলনা চলে না–থাবায় নখ ছিল না বলেই সে উপরে উঠতে পারেনি, নখ থাকলে সেইবারই সে পাঁচিলের মাথায় নখ বসিয়ে উঠে পড়ত। বাঘের থাবা যে বার বার ফসকে যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই, অতএব রাজামশাই একজন ভৃত্যকে বন্দুক আনতে বললেন।
বাঘ বন্দুকের জন্য অপেক্ষা করল না, প্রচণ্ড এক লম্ফপ্রদান করে সে উঠে পড়ল পাঁচিলের উপর। সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার।
বাঘ কোনোদিকে নজর দিল না, সোজা ছুটল সামনের দিকে। প্রাসাদের গায়েই রাজামশাইয়ের যে-বাগানটা ছিল সেই বাগানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল বিদ্যুদবেগে
তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল, প্রাসাদের ভিতর রাজার একমাত্র শিশুপুত্র গরমে ছটফট করছিল, তাই তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল রাজবাড়ির দাসী উদ্যানের মুক্ত বায়ু সেবন করতে। একটা ছোটো ঠেলাগাড়ির ওপর শিশু রাজকুমারকে বসিয়ে দাসী বাগানের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, আচম্বিতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেখানে হল রুদ্রমূর্তি ব্যাঘ্রের আবির্ভাব।
রাজপুত্রকে ফেলে দাসী দিল চো চো চম্পট, বাঘ তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল না, ধেয়ে এল ঠেলাগাড়িতে উপবিষ্ট রাজপুত্রের দিকে।
ইতিমধ্যে এসে পড়েছে বন্দুক। অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠেছে মানুষের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়েছে বাঘ। কিন্তু মরার আগে সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে শমন-ভবনে।
একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর।
প্রাণ নিয়ে খেলা
এমন বিপজ্জনক পেশা ধরলেন কেন আপনি? দুনিয়াতে করে খাওয়ার জন্য আর কোনো পথ কি আপনার চোখে পড়ল না?
প্রশ্নটি করেছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।
প্রশ্নের উত্তরে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বললেন, আপনার পেশাটি আরও বেশি বিপজ্জনক।
আজ্ঞে না মশাই, শোলোকভ হেসে উঠেছিলেন, আপনার সঙ্গে জায়গা বদল করতে আমি রাজি নই।
হ্যাঁ, বৈমানিকের পেশা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে, কিন্তু একদল সিংহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখানোর কাজটা আরও বিপজ্জনক আর ভয়াবহ বলে মনে হয়েছিল সেইজন্যেই সার্কাসের ক্রীড়ামঞ্চে বরিস অ্যাডারের খেলা দেখে উপযুক্ত মন্তব্য করেছিলেন রুশ বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।
বরিস অ্যাডার!
সোভিয়েট রাশিয়াতে সার্কাসের ইতিহাসে একটি নাম।
রুশ জাতি চিরকালই সার্কাসের খেলায় অত্যন্ত দক্ষ। ট্রাপিজ, রিং, বার এবং বিভিন্ন ধরনের জিমনাস্টিক্স প্রদর্শনীতে তারা অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে, কিন্তু ১৯৩৫ সালের আগে সার্কাসের আসরে বন্য পশুর খেলায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি রাশিয়ার মানুষ। রাশিয়ার সার্কাসে হিংস্র জানোয়ার নিয়ে বরাবরই খেলা দেখিয়েছে জার্মান খেলোয়াড়। ১৯৩২ সালে রাশিয়ার ভরোনেজ শহরে জনৈক অসাধু জার্মান খেলোয়াড়ের লোভ আর অন্যান্য দাবির ফলে বন্য পশুর ক্রীড়ামঞ্চে একটি স্থানীয় মানুষের আবির্ভাব ঘটল, নাম তার বরিস অ্যাডার।
ঘটনার সূত্রপাত কী করে ঘটল, সে-কথাই বলছি।
সোভিয়েট রাশিয়ার সার্কাস বোর্ড জনৈক মালিকের কাছ থেকে একদল সিংহ কিনে নিয়েছিল। পূর্বোক্ত সিংহদের নিয়ে যে-লোকটি খেলা দেখাত, সেও ছিল জার্মান নাম কার্ল জেমেবাচ। কার্লের বদ্ধমূল ধারণা ছিল সে ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি ওই সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে না।
অতএব পারিশ্রমিক অর্থের জন্য তার দাবি বাড়তে লাগল অন্যায়ভাবে এবং দাবি পূরণ না-করলে সে যে দেশে ফিরে যেতে পারে সেই চমৎকার সম্ভাবনার কথাটিও বোর্ড-কে জানিয়ে দিতে ভুলল না।
কার্লের অন্যায় ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বোর্ড স্থির করল সিংহের খেলা দেখানোর জন্য অন্য খেলোয়াড় নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ নয়। রাশিয়ার খেলোয়াড় বিভিন্ন ধরনের সার্কাসের খেলায় দক্ষতা অর্জন করলেও বন্য পশু নিয়ে খেলা দেখাতে অভ্যস্ত নয়। সেই সময় বরিস অ্যাডার নামক জিমনাস্টিসের খেলোয়াড়টি ঠিক করলেন তিনি নিজেই সিংহের খেলা দেখাবেন।
বোর্ড প্রথমে আপত্তি তুলল–বুনো জানোয়ার নিয়ে খেলা দেখানো ভীষণ বিপজ্জনক, বিশেষ করে পশুরাজ সিংহকে নিয়ে হাতে খড়ি করতে গেলে অনভিজ্ঞ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
বরিস অ্যাডার একেবারে নাছোড়বান্দা
বিদেশিরা অন্যায়ভাবে জুলুম করে টাকা আদায় করবে আর আমরা তাদের অন্যায় ব্যবহার সহ্য করব? রাশিয়াতে কি মানুষ নেই?
অনেক তর্কবিতর্কের পর বোর্ড বরিস অ্যাডারকে সিংহের খেলা দেখাতে অনুমতি দিল। জিমনাস্টিকসের খেলায় ইস্তফা দিয়ে বরিস এলেন হিংস্র পশুদের নিয়ে খেলা দেখাতে। অ্যানিম্যাল ট্রেনার বা পশুশিক্ষক হিসাবে তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হল পশুরাজ সিংহের ভয়াবহ সাহচর্যে।… মস্কো থেকে খেলা দেখানোর অনুমতি পেয়েই অদূর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমাণ চতুম্পদ ছাত্রদের দর্শন করতে এলেন বরিস অ্যাডার। প্রথম দর্শনের অনুভূতি যে খুব উৎসাহজনক হয়নি সে-কথা স্বীকার করতে তাঁর দ্বিধা নেই–অ্যাডার সাহেব সোজাসুজি বলেছেন যে, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বিপুলবপু মরুচারী রাজন্যবর্গর দেহসৌষ্ঠব নিরীক্ষণ করতে করতে তার সর্বাঙ্গে জেগে উঠেছিল আতঙ্কের শীতল শিহরন মনে হয়েছিল, এই ভয়ংকর জানোয়ারগুলোকে তিনি কি বশ করতে পারবেন? এদের নিয়ে খেলা দেখানো কি সম্ভব হবে তার মতো অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে?
প্রথম যেদিন সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন বরিস অ্যাডার, সেইদিনই জন্তুগুলোর ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় পেলেন তিনি। খাঁচায় ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই তিন-তিনটি সিংহ তাকে লক্ষ করে তেড়ে এল। আক্রমণোদ্যত সিংহের রুদ্র মূর্তির সামনে বরিস সাহেবের অনভ্যস্ত স্নায়ু বিদ্রোহ ঘোষণা করল–দ্রুতবেগে পিছিয়ে এসে তিনি তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিলেন, ক্রুদ্ধ সিংহের মুখোমুখি মোকাবেলা করার সাহস সেদিন তাঁর হয়নি।
কার্ল জেমবাচ তখন একগাল হেসেছিল বটে, কিন্তু পরের দিন যখন বরিস আবার সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন এবং দু-দুটো ক্রব্ধ সিঙ্ঘের আক্রমণ এড়িয়ে তাদের নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করলেন, তখন তার মুখের হাসি মুখেই রয়ে গেল।
কয়েকদিনের মধ্যেই সিংহদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অ্যাডার সাহেব সচেতন হয়ে উঠলেন। সব মানুষের স্বভাব একরকম হয় না, সিংহদের সম্পর্কেও একই নিয়ম প্রযোজ্য মানুষের মতো তাদের চরিত্রেও বিভিন্ন দোষগুণের পরিচয় পাওয়া যায়। সার্কাসের দলে প্রাইমাস, রিফি এবং মুরাদ নামে তিনটি সিংহ ছিল অতিশয় ভয়ংকর ও কোপনস্বভাব, বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত খেলোয়াড়ের ওপর আবার আলি নামে সিংহটি ছিল খুবই শান্ত ও ভদ্র। ওই আলির সঙ্গে বরিস অ্যাডারের বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল। আলি ছাড়া ক্রিম নামক আর একটি সিংহও অ্যাডার সাহেবকে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছিল। একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে পশুরাজ সিংহও মানুষের ভালোবাসার দাম দিতে জানে।
একদিন বরিস যখন সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন সেইসময় অতর্কিতে দুটি সিংহ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটির ওপর পেড়ে ফেলল; কিন্তু নখদন্তের প্রহারে মানবদেহটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আগেই আততায়ীদের ওপর বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই অবতীর্ণ হল বন্ধুবর ক্রিম। ক্রিমের আক্রমণে আততায়ীরা বরিস সাহেবের দেহের উপর থেকে সরে যেতে বাধ্য হল এবং তিনিও সেই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে চটপট খাঁচার বাইরে এসে আত্মরক্ষা করলেন। বরিস অ্যাডার বুঝলেন, অরণ্যচারী সিংহও বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে।
সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে বরিস অ্যাডারের জীবন বিপন্ন হয়েছে বারংবার। প্রাইমাস আর রিফি নামের সিংহ দুটি বার বার অ্যাডার সাহেবকে আক্রমণ করেছে। তারা ছিল দুই সহোদর। বরিস অ্যাডার তাদের নামকরণ করেছিলেন দুই দস্যু ভাই।
সহোদর ভাইদের মতোই দুই দস্যুর মধ্যে ছিল নিবিড় একতা ও বন্ধুত্বের বন্ধন। ওদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বরিস অ্যাডারের লড়াই শুরু হলেই অপরজন তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে এসে উপস্থিত হত। ভাইকে সাহায্য করার জন্য। ফলে একটির পরিবর্তে দুটি সিংহকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন বরিস অ্যাডার।
একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
সার্কাসে খেলা দেখানোর পর লোহার গরাদে ঘেরা সরু পথ দিয়ে খাঁচায় ঢোকার সময়ে হঠাৎ রিফি বরিস অ্যাডারকে আক্রমণ করল। ফাঁকা রিভলভার দিয়ে আওয়াজ করে তিনি জন্তুটাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু রিভলভারটা ঠান্ডায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল, শব্দ হল না রিফি তৎক্ষণাৎ বরিসের রিভলভারসুদ্ধ ডান হাতটা কামড়ে ধরল। পরক্ষণেই অকুস্থলে রিফির ভাই প্রাইমাস-এর আবির্ভাব; এক মুহূর্ত বিলম্ব না-করে প্রাইমাস কামড় বসাল বরিস সাহেবের বাঁ-হাতের উপর–তারপর দুই ভাই মিলে টানাটানি করে শিকারকে খাঁচার ভিতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
সিংহ-চরিত্রে অভিজ্ঞ অ্যাডার বুঝলেন তারা যদি তাকে একবার গরাদে ঘেরা গলিপথের ভিতর থেকে নিজস্ব খাঁচার ভিতর নিয়ে যেতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই–দুই ভাই মিলে তার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। বরিস চটপট তার দুই পা লোহার গরাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ের সাহায্যে গরাদ আঁকড়ে ধরলেন, শুরু হল টাগ-অব-ওয়ার। আশেপাশে যারা ছিল তারা ভয়ে হতবুদ্ধি, দু-দুটি সিংহের কবল থেকে মানুষটাকে ছাড়িয়ে আনার সাহস বা ক্ষমতা কারুর নেই। হঠাৎ গরাদের সামনে এগিয়ে এল সার্কাসের এক খেলোয়াড়। সামনেই ছিল এক বালতি জল খেলোয়াড়টি বালতি তুলে গরাদের ফাঁক দিয়ে জল ঢেল দিল সিংহদের গায়ে। মরুভূমির সিংহ রাশিয়ার তীব্র শীতল আবহাওয়াতে অভ্যস্ত নয়–হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা জলের আক্রমণ বিখ্যাত সিংহ-বিক্রমকে কাবু করে দিল–ঘেঁয়াওৎ শব্দে প্রতিবাদ জানিয়ে সিংহ দুটি শিকার ছেড়ে ছিটকে সরে গেল দূরে।
বরিস এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেন না, এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে লৌহবেষ্টনীর বাইরে এসে চটপট লোহার দরজা বন্ধ করে দিলেন। সিংহেরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ সগর্জনে ছুটে এসেছিল, কিন্তু বরিস তখন নাগালের বাইরে।
সার্কাসের এক অখ্যাত খেলোয়াড়ের উপস্থিত বুদ্ধির জন্যই সেবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেলেন বরিস অ্যাডার।
বরিসের ঘটনাবহুল জীবনে তিনি বহুবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু সিংহ নয়–বাঘ, লেপার্ড, ভাল্লুক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের হিংস্র জানোয়ার নিয়ে তিনি খেলা দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে যে সুন্দরী মহিলাটির তিনি পাণিগ্রহণ করেছিলেন সেই মহিলাটিও সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে এবং স্বামীর মতোই অগণিত দর্শকের প্রশংসা অর্জন করেছেন মিসেস টামারা অ্যাডার।
বরিস অ্যাডারের কথা বলতে গিয়ে তার জীবনসঙ্গিনী সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আগেই বলেছি স্বামীর মতোই ওই মহিলাটিও বিভিন্ন হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে খেলা দেখাতে গিয়ে একটি অতিশয় হিংস্র জীবের সঙ্গে টামারার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
পূর্বোক্ত জীবটির নাম ছিল হ্যারি। উসুরি অঞ্চলের একটি বাঘ ও আফ্রিকার এক সিংহীর সংমিশ্রণে জাত হ্যারি নামের টাইগ্রন ছিল যেমন বিশাল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তার স্বভাবও ছিল তেমনই ভয়ংকর। ওই অতিকায় অতি-ভয়ংকর টাইগ্রন ভীষণ ভয় করত সার্কাসের একটি ছোটোখাটো বাঘকে। ছোটোখাটো বাঘটির নাম ছিল রাজা। রাজা সুন্দরবনের জানোয়ার, বাঘের দলে সে ছিল সবচেয়ে ছোটো। রাজার স্বভাবচরিত্র বেশ ভালোই, কিন্তু হ্যারিকে দেখলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা নখদন্ত বিস্তার করে সে হ্যারিকে তাড়া করত আর ক্ষুদ্রকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায় শশব্যস্ত হয়ে পড়ত বিপুলবপু হ্যারি। বাঘদের নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে রাজা আর হ্যারিকে নিয়ে এমন বিব্রত হয়ে পড়তেন বরিস যে, ভালো করে খেলার দিকে মন দেবার সুযোগ তার হত না। অতএব বরিসের নির্দেশে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন টামারা, তার হাতে থাকত সুদীর্ঘ পিচফর্ক (লম্বা লাঠির মুখে সাঁড়াশির মতো দুটি শানিত ফলক বসানো। পিচফক খড় তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সার্কাসের খেলোয়াড়ের হাতে ওই বস্তুটি মারাত্মক অস্ত্র)।
হ্যারিকে রাজা আক্রমণ করলেই খাঁচার ফাঁক দিয়ে পিচফর্কের সাহায্যে রাজাকে খোঁচা মারতেন টামারা এবং হ্যারিকে ছেড়ে নিজের জায়গায় গিয়ে খেলা দেখাতে বাধ্য হত রাজা। বারকয়েক খোঁচা খেয়েই রাজা বুঝল হ্যারিকে আক্রমণ করলেই টামারার পিচফর্ক তার দেহ বিদ্ধ করবে, অতএব সে শান্তভাবে হ্যারির সঙ্গে সহাবস্থান মেনে নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করল।
একদিন বাঘগুলোকে তাদের নিজস্ব খাঁচার ভিতর থেকে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর মধ্যে এনে বরিস যখন খেলা দেখানোর উদ্যোগ করছেন, সেই সময়ে দৈবক্রমে টামারা আছেন কি নেই তা খেয়াল করেননি বরিস, কিন্তু টামারার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করল রাজা তৎক্ষণাৎ সগর্জনে সে তেড়ে গেল হ্যারির দিকে। হাঁকডাক! গর্জন! মহাকায় হ্যারি ছুটছে লৌহবেষ্টনীর ভিতর, পিছনে তার ক্ষুদ্রকায় রাজা।
গোলমাল শুনে টামারা তাড়াতাড়ি এসে পড়লেন অকুস্থলে, হাতে তাঁর পিচফর্ক। হ্যারি চটপট লোহার গরাদের ধারে টামারার কাছে এসে দাঁড়াল, আর রাজাও হ্যারিকে ছেড়ে ফিরে গিয়ে বরিসের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সুবোধ বালকের মতো টামারাকে দেখেই রাজার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে, পিচফর্কের ধারালো অভ্যর্থনা তার ভালো লাগে না একটুও।
গোলমাল মিটে যেতে হ্যারিও শান্তভাবে তার নিজের জায়গায় এসে বসল খেলা দেখাতে। কিন্তু খেলা শুরু করার আগে সে হঠাৎ টামারার দিকে ফিরে এক প্রচণ্ড হুংকার ছাড়ল—বোধ হয় বাঘের ভাষায় বলল, ছিলে কোথায় কতক্ষণ? আর একটু হলেই গুণ্ডাটা যে আমায় শেষ করে দিত!
খাঁচার ফাঁক দিয়ে হ্যারির ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন টামারা এবং হ্যারিও সেই আদর উপভোগ করত শান্তভাবে। কিন্তু টামারাকে ভালোবাসলেও বরিস সম্পর্কে হ্যারির মনোভাব ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর সুযোগ পেলেই সে সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নখদন্তের আলিঙ্গনে বরিসকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করত। সার্কাসে খেলা দেখানোর আগে বন্য পশুকে নিয়ে খেলোয়াড় রিহার্সাল বা তালিম দিয়ে থাকেন। প্রথম প্রথম ওই রিহার্সালের সময় এমন উগ্রমূর্তি ধারণ করত হ্যারি যে, খেলা দেখানো তো দূরের কথা নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অস্থির হয়ে পড়তেন বরিস সাহেব।
জানোয়ার যদি সবসময়েই খেলোয়াড়কে আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তাকে দিয়ে খেলা দেখানো অসম্ভব। অতএব হ্যারিকে জব্দ করার একটা উপায় স্থির করলেন। কয়েকটা সোডার বোতল ভরতি বাক্স নিয়ে একদিন তিনি ঢুকলেন হ্যারির খাঁচায়। হ্যারি তাকে লক্ষ করে তেড়ে আসতেই একটা বাক্স তিনি ছুঁড়ে দিলেন জন্তুটার দিকে। শূন্যপথেই দাঁতে নখে লুফে নিয়ে বাক্সটাকে ভেঙে ফেলল হ্যারি, সঙ্গেসঙ্গে–ফটাস! প্রচণ্ড শব্দে সোডার বোতলের বিস্ফোরণ। হ্যারির পিলে গেল চমকে, এক লাফে সে পিছিয়ে গেল। কয়েকটি মিনিট সে হতভম্ব হয়ে ছিল, তারপর আবার নূতন উদ্যমে সে বরিসকে আক্রমণ করল। বরিস তৈরি ছিলেন, সোডার বোতল ভরতি দ্বিতীয় বাক্স তার হাত থেকে ছুটে গেল হ্যারির দিকে এবং প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বাক্সটিও হ্যারির নখদন্তের আপ্যায়নে বিদীর্ণ হল প্রচণ্ড শব্দে। হ্যারি এবার কাবু হল, ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের গর্জিত কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল বাক্সের গর্জন! আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে হ্যারি খেলোয়াড়ের নির্দেশ মানতে সচেষ্ট হল।
হ্যারি ছাড়া আর একটি প্রাণী বরিসকে বিব্রত করে তুলেছিল। যে বাঘের দলটাকে নিয়ে বরিস খেলা দেখাতেন, সেই দলে জ্যাক নামে একটি মানুষখেকো বাঘ ছিল। নরখাদক শ্বাপদ নিয়ে কোনো খেলোয়াড় সচরাচর খেলা দেখায় না, কিন্তু বরিস ওই ভয়ংকর জন্তুটাকে নিয়েও খেলা দেখিয়েছেন। জ্যাকের আক্রমণে বরিসের জীবন বিপন্ন হয়েছে একাধিকবার কিন্তু সদয় ব্যবহার, অসীম ধৈর্য ও অনুশীলনের ফলে মানুষখেকো বাঘও শেষ পর্যন্ত মানুষের বশীভূত হয়েছিল। বরিস বলেন, সদয় ব্যবহার দিয়েই তিনি জ্যাকের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিংস্র শ্বাপদও তাহলে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে!
তবে বুনো জানোয়ারকে সবসময় বিশ্বাস করা চলে না। পাপা নামে একটি সিংহীকে শিশুকাল থেকেই পুষেছিলেন বরিস। পাপা সার্কাসের খাঁচায় থাকত না, থাকত বরিসের সঙ্গে একই বাড়িতে। কিন্তু পাপা যখন বড়ো হয়ে উঠল তখন বরিসের বাড়িওয়ালা বরিসকে জানিয়ে দিলেন তাঁর বাড়িটা তিনি বরিসকে ভাড়া দিয়েছেন বটে, কিন্তু একটা ধুমসো সিংহী নিয়ে সেখানে বসবাস করার অধিকার বরিসের নেই। অগত্যা বরিস পাপাকে সার্কাসের ভিতর একটা খাঁচায় রাখার ব্যবস্থা করলেন।
পাপার স্বভাবচরিত্র ছিল চমৎকার। লাফঝপ করে বেড়ালেও তার ব্যবহারে শ্বাপদসুলভ হিংস্র উগ্রতার চিহ্ন ছিল না একটুও। কিন্তু সার্কাসের খাঁচায় যাওয়ার পর থেকেই তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটল। যারা সার্কাসে জন্তুদের দেখাশুনা করে সেই পশুরক্ষকদের দেখলেই সে হিংস্র হয়ে উঠত, ক্রুদ্ধ গর্জনে বিরক্তি জানাত বারংবার বোধ হয় তার ধারণা হয়েছিল ওই লোকগুলোই তাকে বরিসের কাছ থেকে সরিয়ে এনে খাঁচায় আটকে রেখেছে। বরিস তার মনোভাব বুঝতেন, কিন্তু সার্কাসের খেলা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, পাপার সঙ্গে যখনতখন দেখাসাক্ষাৎ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পাপার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটল, সে হয়ে উঠল ভয়ংকরী।
একদিন চরম বিপর্যয় ঘটল। বরিস এসেছেন অনেক দিন পরে, পাপাকে আদর করে বিদায় নেবার উদ্যোগ করছেন–অকস্মাৎ তাঁর কণ্ঠদেশ লক্ষ করে কামড় বসাল পাপা। তাড়াতাড়ি হাত তুলে বরিস গলা বাঁচালেন বটে, কিন্তু সিংহীর ধারালো দাঁতের আঘাতে তার হাতের অবস্থা হল শোচনীয়। কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে বরিস পাপাকে তার খাঁচার ভিতর ঠেলে দিলেন। পাপা এক কোণে গিয়ে বসে রইল চুপ করে। রক্তাক্ত হাতটা তুলে ধরলেন বরিস পাপার দিকে, বললেন, দেখ কী করেছ! তোমার লজ্জা করে না? তোমাকে আমি এত ভালোবাসি, এই তার প্রতিদান?
মাথা নীচু করে পাপা এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে মুখ তুলে রক্তাক্ত হাতটা চাটতে শুরু করল। স্পষ্টই বোঝা গেল তার ব্যবহারে সে লজ্জিত। হঠাৎ খেপে গিয়ে একটা বিশ্রী কাণ্ড সে করে ফেলেছে বটে, কিন্তু বরিসকে হত্যা করার ইচ্ছা তার ছিল না।
যাই হোক, বরিস বুঝলেন তাঁদের আগেকার সম্পর্ক আর ফিরে আসবে না; কারণ পাপা যেভাবে তার কাছ থেকে সেবা-যত্ন পেতে অভ্যস্ত, সেইভাবে তাকে দেখাশুনা করার সময় এখন বরিসের নেই। অতএব আবার দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সাবধান হওয়া ভালো পাপাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল চিড়িয়াখানায়।
বরিস অ্যাডার জীবনে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র পশুর বন্ধুত্ব লাভ করেছেন এবং তার আদরের চতুষ্পদ বন্ধুদের আক্রমণে তার প্রাণ বিপন্ন হয়েছে বারংবার–তবু সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে বরিসের আকর্ষণ কমেনি একটুও।
বরিস অ্যাডার বলেছেন, ওরা দু-একসময় ভীষণ দুষ্টুমি করে বটে, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুষ্ট হলে বাপ কি কখনো সন্তান ত্যাগ করে? আমি ওদের ভালোবাসি; হোক না দুষ্ট, ওরা আমার গর্বের বস্তু।
বেন স্টারডিভ্যান্ট ও জিম বোয়ি
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ। টেক্সাস অঞ্চলে একটি পানাগারের ভিতর বসে তাসের জুয়া খেলা খেলছে একটি অল্পবয়সি কিশোর ও জনৈক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। পূর্বোক্ত পুরুষটি ওই এলাকার একটি কুখ্যাত জুয়ারি ও দুর্ধর্ষ গুণ্ডা—নাম, বেন স্টারডিভ্যান্ট। কিশোরটির নাম—ল্যাটি মোর।
খেলা চলছে, ছেলেটি হেরে যাচ্ছে বার বার। তীব্র উত্তেজনায় তার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত; বার বার বাজি হারছে বটে কিন্তু খেলা ছেড়ে ওঠার নাম করছে না।
হঠাৎ পানাগারের দরজা ঠেলে একটি লোক ভিতরে প্রবেশ করল। খেলোয়াড়দের উপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে আগন্তুকএকটু চমকে উঠল–কিশোরের পিতার সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। ছেলেটি তাকে চিনতে না-পারলেও নবাগত মানুষটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বন্ধুপুত্রকে শনাক্ত করতে পেরেছিল। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আগন্তুক বুঝল ল্যাটি মোরকে অসভাবে ঠকিয়ে বাজির টাকা জিতে নিচ্ছে জুয়াড়ি বেন। অনভিজ্ঞ কিশোরের চোখে পাকা জুয়াড়ির জুয়াচুরি ধরা পড়ছে না, পরমানন্দে ল্যাটি মোরকে ঠকিয়ে তার টাকাগুলো পকেটস্থ করছে বেন স্টারডিভ্যান্ট।
নবাগত মানুষটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে খেলা দেখল, তারপর ধীরপদে এগিয়ে এসে কিশোর ল্যাটি মোরের কাঁধে হাত রাখল :তুমি চিনতে পারবে না, কিন্তু তোমার বাবা পারবেন। আমি তোমার পিতৃবন্ধু। তোমার তাস নিয়ে আমাকে একটু খেলতে দাও।
ল্যাটি মোর সম্মত হয়ে জায়গা ছেড়ে দিল, তার স্থান গ্রহণ করল নবাগত মানুষ। কিছুক্ষণ খেলার পর দেখা গেল বেন জুয়াচুরি করে যে-টাকাগুলো ল্যাটি মোরের কাছ থেকে জিতে নিয়েছিল, সেই টাকা আবার নবাগত মানুষটি জিতে নিয়েছে। শুধু তাই নয়–সর্বসমক্ষে বেন স্টারডিভ্যান্টের অসাধু আচরণের কথা প্রকাশ করে দিল আগন্তুক। টাকাগুলো অবশ্য সে পকেটস্থ না-করে ল্যাটি মোরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেইসঙ্গে কিছু উপদেশ, সাবধান! ভবিষ্যতে কখনো জুয়া খেলবে না।
মুখের শিকার ছিনিয়ে নিলে বাঘ যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, বেন স্টারডিভ্যান্টের অবস্থাও হল সেইরকম। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে সে ছোরা বার করে আগন্তুককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাল।
বেচারা স্টারডিভ্যান্ট! সে ভাবতেও পারেনি, যে-লোকটিকে ছোরার ডুয়েললড়তে চ্যালেঞ্জ করেছে সেই লোকটি হচ্ছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা জিম বোয়ি! ছোরার লড়াইতে জিমের সমকক্ষ কোনো যোদ্ধা সে সময়ে ছিল না।
জিম আত্মপরিচয় দিল না। ছোরা নিয়ে সে দ্বন্দ্বযুদ্ধের উদযোগ করল। লড়াই শুরু হল মেক্সিকান ডুয়েল নামক রীতি অনুসারে। তখনকার দিনে ছোরা হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধ লড়ার যেসব পদ্ধতি ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর মেক্সিকান ডুয়েল। আগে যোদ্ধাদের বাঁ-হাত দুটি শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় এবং লড়াই শুরু করার নির্দেশ পাওয়ামাত্র খোলা ডান হাতে ছোরা নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে আঘাত করতে থাকে নির্মমভাবে।
পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে লড়াই চলল কিছুক্ষণ ধরে। কয়েকবার নিজের ছোরা দিয়ে প্রতিপক্ষের আঘাত প্রতিহত করল জিম, তারপর হঠাৎ বিদ্যুদবেগে আঘাত হানল শত্রুর ডান হাতের উপর। শানিত ছুরিকা মুহূর্তের মধ্যে বেন স্টারডিভ্যান্টের দক্ষিণ হস্তে বিদ্ধ হল, দারুণ যাতনায় ছুরি খসে পড়ল স্টারডিভ্যান্টের হাত থেকে। জিমের হাতের ছোরা আবার ঝলসে উঠল, কিন্তু না প্রতিদ্বন্দ্বীর দেহে নয়–দুই যোদ্ধার বাঁ-হাত আটকে যে দড়ির বাঁধনটা শক্ত হয়ে বসেছিল সেই দড়িটাকেই দংশন করল জিমের অস্ত্র।
অসহায় বেনকে অনায়াসে হত্যা করতে পারত জিম, কিন্তু তা না-করে সে উদারভাবে শত্রুর হাতের দড়ি কেটে তাকে মুক্তি দিল।
জিমের সঙ্গে যারা ছোরা হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র বেন ছাড়া কোনো মানুষই পৃথিবীর আলো দেখার জন্য জীবিত ছিল না।
বেন স্টারডিভ্যান্ট ছিল ভাগ্যবান পুরুষ।
বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড ও রবার্ট মেনার্ড
সাত সাগরের বুকে জাহাজ ভাসিয়ে যেসব জলদস্যু ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তাক্ত করে তুলেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, হিংস্র ও ভয়ংকর মানুষ হচ্ছে বোম্বেটে-সর্দার এডওয়ার্ড টিচ ওরফে এডওয়ার্ড ব্ল্যাক বিয়ার্ড। সাধারণ মানুষের কথা তো ছেড়েই দিলাম, দুর্ধর্ষ জলদস্যুরাও তাদের দলপতি ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে যমের মতোই ভয় করত। ব্ল্যাক বিয়ার্ড তার দলকে পরিচালনা করত কঠোর হস্তে। ক্রুদ্ধ হলে তার হাতে শত্ৰুমিত্র কারুরই রক্ষা ছিল না। উক্ত বোম্বেটে-দলপতির দৈহিক শক্তি ছিল অসাধারণ। একটা জোয়ান মানুষকে সে মাথার ওপর তুলে ফেলতে পারত অনায়াসে। বছরের পর বছর ধরে সমুদ্রের ওপর সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছিল বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড। তার অধীনে জলদস্যুরা বহু জাহাজ লুঠ করেছিল এবং ওইসব জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল ব্ল্যাক বিয়ার্ডের আদেশ অনুসারে। কোনো
একদিন রাজকীয় নৌবহরের দুটি জাহাজ বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ডের জাহাজকে আক্রমণ করল। উক্ত জাহাজ দুটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেনার্ড। প্রচণ্ড হট্টগোল ও মারামারির মধ্যেও মেনার্ডের সন্ধানী দৃষ্টি ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হল। তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বোম্বেটে দলপতিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন অসিধারী মেনার্ড। বলাই বাহুল্য সেই আহ্বানে সাড়া দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড। শুরু হল যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্ল্যাক বিয়ার্ড বুঝল এ-শত্রু সহজ নয়–সে আজ শক্ত পাল্লায় পড়েছে। একবার এগিয়ে, একবার পিছিয়ে এবং চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে লড়াই চলল। দুই যোদ্ধারই সর্বাঙ্গ হল ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। অবশেষে সমুদ্রের দিকে সংঘটিত যাবতীয় দ্বন্দ্বযুদ্ধের জাহাজের রক্তরঞ্জিত পাটাতনের ওপর লুটিয়ে পড়ল মরণাহত ব্ল্যাক বিয়ার্ডের ঘৃণিত শরীর।
তখনকার দিনে প্রচলিত সূক্ষ্মাগ্র সোর্ড বা সোজা তলোয়ার নিয়ে লড়াইটা হয়নি–দ্বন্দ্বযুদ্ধটা হয়েছিল কাটলাস (cutlass) নামক বাঁকা তলোয়ার নিয়ে।
মসিয় দ্য গ্র্যান্ড প্রি ও মসিয় লে পিক
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর আকাশে এক আশ্চর্য দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে যোগদানকারী দুই যোদ্ধার নাম হচ্ছে যথাক্রমে মসিয় দ্য গ্র্যান্ড প্রি ও মসিহঁ লে পিক। কোনো কারণে পূর্বোক্ত দুই ভদ্রলোকের মধ্যে মতান্তর ঘটেছিল, যার ফলে তারা স্থির করলেন বেলুনে উঠে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে তাদের কলহের মীমাংসা করবেন। খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো। যখনকার কথা বলছি সেই সময় ইউরোপের মানুষ, বিশেষ করে ফরাসিরা, কথায় কথায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমে পড়তেন। কাজেই পূর্বোক্ত দুই ভদ্রলোকের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ব্যাপারটা এমন কিছু অভিনব ছিল না। কিন্তু আকাশে বেলুন উড়িয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিকল্পনা ইতিপূর্বে কারো মাথায় আসেনি। অতএব নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে সেই চমকপ্রদ ও অভূতপূর্ব দ্বৈরথের ফলাফল দর্শন করার জন্য ভিড় করল এক বিপুল জনতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যোদ্ধাদের নিয়ে আকাশে উড়ল দুটি বেলুন। প্রত্যেক বেলুনের মধ্যে যুযুধানদের সঙ্গে ছিলেন একজন করে মধ্যস্থ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অট্টালিকাগুলোর মাথা ছাড়িয়ে দুটি বেলুন বেশ উপরে উঠে গেল। মাটি ছাড়িয়ে প্রায় আধ মাইল উপরে যখন বেলুনরা উড়ছে, সেই সময়ে মসিয় লে পিক তার ব্লান্ডারব্যাস (এক ধরনের বন্দুক) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ করে অগ্নিবর্ষণ করলেন। তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। এইবার গুলি ছুড়লেন মসিহঁ গ্র্যান্ড প্রি। তার নিক্ষিপ্ত গুলি মসি! লে পিকের শরীর স্পর্শ করল না বটে, কিন্তু বেলুনের দেহ বিদ্ধ করে বেলুনটাকে ফাটিয়ে দিল। হতভাগ্য লে পিক ও তাঁর সঙ্গী মধ্যস্থকে নিয়ে বেলুনটা সবেগে আছড়ে পড়ল একটা বাড়ির ছাদের উপর এবং সেই আঘাতের বেগ সামলাতে না-পেরে দুটি মানুষই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর ক্রোড়ে।
মেজর জেমস জ্যাকসন ও রবার্ট ওয়াটকিন্স
অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যেসব দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেইসব যুদ্ধে সূক্ষ্ম রুচিবোধ ও উদারতার অভাব থাকলেও ভীষণতার কোনো অভাব ছিল না–পাশবিক হিংসার প্রাণঘাতী উগ্রতায় তৎকালীন দ্বৈরথের ইতিহাস অতিশয় ভয়াবহ।
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আমেরিকার দুজন রাজনৈতিক নেতা পিস্তল হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। উক্ত দুই ভদ্রলোকের নাম ছিল মেজর জেমস জ্যাকসন ও রবার্ট ওয়াটকিন্স। দুই যোদ্ধাই গুলি ছুড়লেন, দুজনের লক্ষ্যই হল ব্যর্থ। আবার পিস্তলে গুলি ভরার চেষ্টা না-করে দুজনেই তিরবেগে ছুটে পরস্পরের নিকটবর্তী হয়ে পিস্তলের নীচে লাগানো ছোটো সঙিনের সাহায্যে শত্রু নিপাতের চেষ্টা করতে লাগলেন। ধারালো সঙিনের খোঁচায় দুজনেরই পোশাক-পরিচ্ছদ হল ছিন্নভিন্ন, দেহ হল রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত এবং একসময়ে দেখা গেল শ্রান্ত ক্লান্ত যোদ্ধাদের শিথিল মুষ্টি থেকে অস্ত্র দুটি পড়ে গেছে মাটির উপর। লড়াই তখনও শেষ হল না। জ্যাকসন আর ওয়াটসন এবার প্রয়োগ করলেন মুষ্টিযুদ্ধ হস্তে মুষ্টিযোগ শুরু হল দারুণ ঘুসোঘুসি। প্রায় ঘণ্টাখানেক মারামারি করার পর দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই জ্ঞান হারিয়ে ধরাশায়ী হলেন।
এমন সাংঘাতিক লড়াইয়ের পরেও জয় পরাজয়ের নিষ্পত্তি হল না। ওই দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার বেশ কয়েক বৎসর পরেও যোদ্ধাদের কে বড়ো এই নিয়ে ভীষণ তর্কের সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই বাগযুদ্ধ কখনো কখনো রূপান্তরিত হয়েছে প্রচণ্ড মুষ্টিযুদ্ধে।
রব রয় ম্যাকগ্রেগর ও স্টুয়ার্ট যোদ্ধা
ডিউক অবমন্টরোজ স্কটল্যান্ডের রব রয় ম্যাকগ্রেগরকে তার নিজস্ব জমি থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। উক্ত ডিউক ছিলেন অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী ও অসাধু প্রকৃতির এক ইংরেজ। রব রয়ের জমি থেকে চালাকি করে তাকে উৎখাত করার পর জায়গাটা নিজেই দখল করে নিয়েছিলেন ডিউক অব মন্টরোজ। ফলে স্কটল্যান্ডের মাটিতে জন্ম নিল এক ইংরেজ-বিদ্বেষী দস্যু–রব রয় ম্যাকগ্রেগর।
১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে ম্যাকগ্রেগর গোষ্ঠী তার প্রতিবেশী স্টুয়ার্ট বংশের সঙ্গে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়ল। স্টুয়ার্টদের দলপতি জানাল উভয়পক্ষ থেকে একজন করে নির্বাচিত যোদ্ধা যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে অসিহস্তে অবতীর্ণ হয়, তাহলে বহু মানুষের হতাহত হওয়ার সাংঘাতিক সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়, কারণ দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলাফল থেকেই সমস্ত বিবাদের নিষ্পত্তি হতে পারে অনায়াসে। ধূর্ত স্টুয়ার্ট দলপতি জানত তার দলের নির্বাচিত যোদ্ধার সমকক্ষ কেউ নেই ম্যাকগ্রেগরদের মধ্যে। রব রয়কে সে গণ্য করেনি। সে ভেবেছিল বৃদ্ধ বয়সে রব রয় আর তলোয়ার ধরতে এগিয়ে আসবে না।
স্টুয়ার্ট দলপতির ধারণা ভুল; স্টুয়ার্টদের নির্বাচিত যোদ্ধার সম্মুখীন হল অসিহস্তে স্বয়ং রব রয় ম্যাকগ্রেগর। বয়স তার যুদ্ধের উদ্যমকে থামিয়ে দিতে পারেনি। ষাট বৎসর বয়সেও রব রয় ছিল ম্যাকগ্রেগর গোষ্ঠীর শ্রেষ্ঠ অসিযোদ্ধা।
শুরু হল লড়াই। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ঢাল আর তলোয়ার নিয়ে পরস্পরকে আক্রমণ করল। এক ঘণ্টার উপর লড়াই চলল–অভিজ্ঞতা ও নৈপুণ্যের বিরুদ্ধে যৌবন-উদ্ধত শক্তির লড়াই। অবশেষে একসময়ে রব ক্লান্ত হয়ে পড়ল; তার বলিষ্ঠ বাহুকে আক্রমণ করল বয়সের ক্লান্তি অনিবার্যভাবে, ঘূর্ণিত অসির চমক হয়ে পড়ল মন্থর। সুযোগ বুঝে আঘাত হানল স্টুয়ার্ট যোদ্ধা বিদ্যুদবেগে তার হাতের শানিত তরবারি প্রতিদ্বন্দ্বীর অসিধারী দক্ষিণ বাহুর মাংস ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কেটে বসে গেল। রক্তসিক্ত বিদীর্ণ হস্তে আর অসিধারণ করতে পারল না রব, তার শিথিল মুষ্টি থেকে তলোয়ার খসে পড়ল। অবিচলিত প্রস্তরমূর্তির মতো স্থির হয়ে রব রয় অপেক্ষা করতে লাগল চরম আঘাতের জন্য। কিন্তু আঘাত পড়ল না। বৃদ্ধ রব রয়ের বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল স্টুয়ার্ট যোদ্ধা। নিজের হাতে কাপড় ছিঁড়ে সে প্রবীণ যোদ্ধার ক্ষতস্থান বেঁধে দিল।
ওই যুদ্ধই রব রয়ের জীবনের শেষ যুদ্ধ। পূর্বোক্ত দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর মাত্র তিন বৎসর বেঁচে ছিল। তারপর তার মৃত্যু হয়।
সিনোরিতার শেষ শিকার
ছিপছিপে লম্বা, নিখুঁত মুখ-চোখ, কাকের পাখার মতো কালো কুচকুচে একমাথা চুল–এক কথায় যাকে বলে অপূর্ব সুন্দরী, একবার তাকালে চট করে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
কিন্তু রে বেনেট নামে যে-মানুষটি উত্তর আমেরিকার একটি পানাগারের মধ্যে গেলাসের তরল পদার্থে চুমুক দিচ্ছিল, সে মেয়েটির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিল না–কারণ, সেই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর চাইতেও একজন শক্তসমর্থ অভিজ্ঞ গাইড বা পথপ্রদর্শকের সাহায্য ছিল তার কাছে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়।
রে বেনেটের সঙ্গে একই টেবিলে বসেছিল তার বন্ধু ফ্রেড ও মেক্সিকান অনুচর কালো। পূর্বোক্ত মেয়েটি পানাগারের দরজা খুলে একবার রে-র দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর এগিয়ে গেল কার্লোর দিকে।
চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল কার্লো : সিনর! আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সিনোরিতা জেসুসিতা লোপেজ!
সুন্দরী হাসল। অতঃপর উভয়পক্ষের করমর্দন, পরিচয়ের পালা শেষ। মেয়েটি এবার চেয়ারে বসে কার্লোর সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করল। কয়েক মিনিট পরেই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল রে কার্লো এবং জেসুসিতা যে-ভাষায় কথা বলছিল সেই স্প্যানিশ ভাষা ছিল দুই বন্ধুর কাছে দুর্বোধ্য। অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে রে বলে উঠল, ওহে কার্লো, এবার কাজের কথা বলো। যে গাইডটির এখানে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল, তার কী হল?
কার্লো একটি মৃদু আদরের থাপ্পড় বসাল মেয়েটির কাঁধে : তার সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছে, সিনর। এই অঞ্চলের সেরা গাইড হচ্ছে জেসুসিতা। পায়ের ছাপ ধরে যারা ভাল্লুকের সন্ধান বলে দিতে পারে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ওস্তাদ হল এই মেয়েটি।
কার্লোর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ফ্রেড এবং রে। দুজনেই বোকার মতো তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। জেসুসিতা এবার হেসে উঠল, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে সকলের কাছে নিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
দুই চোখে আগুন জ্বালিয়ে কার্লোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রে : কালো! তুমি কি ইয়ার্কি মারছ আমাদের সঙ্গে?
না সিনর, না, দ্রুতবেগে হাত নাড়তে নাড়তে কার্লো জবাব দিল, আমি সত্যি কথাই বলছি। ওই মেয়েটির বাবা ছিল মস্ত বড়ো শিকারি। আপনারা ভাল্লুক চাইছেন। ও ভাল্লুকের সন্ধান দিতে পারবে।
দেখ কার্লো, অনেক তোড়জোড় করে আমরা গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করতে এসেছি, রে তার মেক্সিকান অনুচরকে সাবধান করে দিল :যদি তুমি আমাদের সঙ্গে রসিকতার চেষ্টা কর, তাহলে
কার্লো জানাল সিনরদের সে ঠাট্টার পাত্র মনে করে না। মেয়ে বলে সিনররা হয়তো জেসুসিতাকে অবজ্ঞা করছেন, কিন্তু এই অঞ্চলের অধিবাসীরা জানে মেয়ে হলেও ভাল্লুক শিকারের পক্ষে জেসুসিতা হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত গাইড। বাপ ছিল মস্ত শিকারি। বাপের কাছেই শিকারের তালিম নিয়েছে মেয়ে।
জাগুয়ারের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে জেসুসিতার বাপ। বাবার মৃত্যুর পর শিকার এবং পথপ্রদর্শকের পেশা গ্রহণ করেছে জেসুসিতা। উপযুক্ত তথ্য পরিবেশন করে কালো জানাল ওই মেয়েটিকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করা চলে, কোনোরকম গোলমাল বা ঝঞ্ঝাটের আশঙ্কা এক্ষেত্রে অমূলক। অনেক তর্কবিতর্কের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই বন্ধু কালোর উপদেশ গ্রহণ করল, স্থির হল মেয়েটিকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে।
পরের দিন শহর থেকে একটু দূরে একটা গোলাবাড়ির কাছ থেকে জেসুসিতাকে তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে সকলে যাত্রা করল গ্রিজলি ভাল্লুকের সন্ধানে। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল টেমেচিক প্রদেশের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পাপাগচিক নদীর সন্নিহিত অঞ্চল।
দিনটা ভারি সুন্দর, সিনর, ইংরেজিতে বলল জেসুসিতা।
তার মুখে স্পষ্ট ইংরেজি শুনে দুই বন্ধু চমকে গেল। জেসুসিতা সবসময়েই কথা বলেছে। স্প্যানিশ ভাষায়, এই প্রথম তার মুখে ইংরেজি শুনল দুই বন্ধু। জেসুসিতার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিও দেখার মতো। চলন্ত ঘোড়ার পিঠের ওপর এমন সহজভাবে সে বসে রয়েছে যে, মনে হয় তার দেহ অশ্বপৃষ্ঠে সংলগ্ন জিনেরই একটা অংশ মাত্র। জিনের সঙ্গে লাগানো আছে একটা কারবাইন (এক ধরনের বন্দুক), কটিবন্ধে ঝুলছে ছোরা; পরনে পুরুষের মতো শার্ট আর প্যান্ট, মুখের হাসিতে বেপরোয়া ঔদ্ধত্যের আভাস–দুই বন্ধু মনে মনে স্বীকার করল, হা একটা মেয়ের মতো মেয়ে বটে!
গল্প করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। জেসুসিতার কথায় জানা গেল বারো বছর বয়স থেকেই সে বাপের শিকার-সঙ্গিনী, এবং ওই সময়েই সে প্রথম জাগুয়ার শিকার করে। বাপই তাকে শিখিয়েছে পুমা, জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় পশু এবং ভাল্লুকের পদচিহ্ন ধরে কেমন করে অনুসরণ করতে হয়। গাছের গায়ে নখের আঁচড় দেখে নখীর স্বরূপ নির্ণয় করার শিক্ষাও। সে গ্রহণ করেছে বাপের কাছেই। তারপর হঠাৎ একদিন জাগুয়ারের কবলে প্রাণ দিল জেসুসিতার বাবা।
রে তার আফ্রিকার অরণ্যে অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল। হাতি, গণ্ডার, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তু শিকারের রোমাঞ্চকর কাহিনি সাগ্রহে শুনতে লাগল জেসুসিতা। একটি আহত সিংহকে অনুসরণ করার ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল রে; গল্পটা যখন খুব জমে উঠেছে, ঠিক তখনই হল ছন্দপতন ধাঁ করে জিনের গায়ে লাগানো বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিল জেসুসিতা।
পেকারি, চেঁচিয়ে উঠল ফ্রেড।
না, সিনর, সাধারণ বুনো শুয়োর, সংশোধন করে দিল জেসুসিতা।
মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন জানাল কার্লো।
একটু জোরে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত জন্তুটাকে কার্লো নিয়ে এল। মালবহনকারী ঘোড়াগুলির ভিতর একটির পিঠে শূকরের মৃতদেহ বেঁধে নিয়ে আবার এগিয়ে চলল শিকারির দল।
বন্দুকের শূন্য ঘরে একটা নতুন টোটা ভরে হাসল মেয়েটি, এবার বেশ মজা করে শুয়োরের মাংস খাওয়া যাবে, কি বলো?
রে অবাক হয়ে গিয়েছিল, বিস্মিত কণ্ঠে সে বললে, তোমার হাতের টিপ খুব ভালো।
না, টিপভালো নয়, তবে খুব তাড়াতাড়ি আমি গুলি চালাতে পারি, জেসুসিতাবলল, কোনো জানোয়ার কাছাকাছি থাকলে আমি বুঝতে পারি… আচ্ছা, এবার সেই সিংহের ব্যাপারটা বলো।
অসমাপ্ত কাহিনিটা এবার শেষ করার জন্য তাগাদা দিল সুন্দরী।
গল্পটা শেষ হতেই কার্লো জানাল মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে।
…বিকালের দিকে পরস্পরের শিকারের অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। মাঝে মাঝে গল্প থামিয়ে কার্লোকে পথের নির্দেশ দিচ্ছিল জেসুসিতা কোন পথে গেলে ভাল্লুকের সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানিয়ে দেওয়াই তো তার আসল কাজ, ওইজন্যই তাকে নিযুক্ত করেছে রে বেনেট। দূরবর্তী পর্বতমালার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে তার বক্তব্য জানাচ্ছিল তরুণী গাইড।
সন্ধ্যার সময়ে একটা পাহাড়ের তলা দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ রে-র চোখ পড়ল ওপরের দিকে, মনে হল পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একটা চলন্ত ছায়ামূর্তির যেন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কাঁধের রাইফেল হাতে নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, পাথরের আড়াল থেকে আবার দেখা দিল ছায়ামূর্তি, সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল রে-র হাতের রাইফেল। দূরত্ব ছিল প্রায় আড়াইশো গজের মতো, তবু লক্ষ্য ব্যর্থ হল না–ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল একটা পুমার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ।
গুলিটা চমৎকার চালিয়েছে, মন্তব্য করল জেসুসিতা।
সঙ্গিনীর সামনে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরে মনে মনে খুশি হয়ে উঠল রে। সঙ্গে সঙ্গে তার এ-কথাও মনে হল যে, লক্ষ্য ব্যর্থ হলে লজ্জার সীমা থাকত না।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে শিকারির দল তাবু ফেলল। পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু। রাত্রের দিকে একটা পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল সবাই। কার্লো জানাল এই জায়গাটা স্থায়ীভাবে তাঁবু খাটানোর পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত। অতএব, সেখানেই তাঁবু পড়ল।
পরের দিন সকাল থেকেই শিকার অভিযান শুরু হল। শিকারের সঙ্গী হিসাবে ফ্রেড পছন্দ করল কার্লোর সান্নিধ্য, আর একদিকের জুটি হল মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতা লোপেজ এবং রে বেনেট। পর পর তিনদিন ধরে চলল শিকার-পর্ব। জেসুসিতা আর রে-র গুলিতে প্রাণ হারাল অনেকগুলি হরিণ আর পুমা, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুকের দেখা পাওয়া গেল না। আরও দুটো দিন কাটল। ভাল্লুকদের মধ্যে কেউ শিকারিদের সঙ্গে দেখা করতে এল না। ফলে রে-র মেজাজ হয়ে উঠল উত্তপ্ত। মেজাজের দোষ নেই, গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করার জন্যই উত্তর আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিল রে বেনেট। আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহ শিকার করেও তৃপ্ত হয়নি সে, মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব গ্রিজলি ভাল্লুকের সঙ্গে রাইফেল হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে চেয়েছিল শিকারি রে বেনেট। পর পর পাঁচদিন ঘুরেও ভাল্লুকের সাক্ষাৎ না-পেয়ে সে বিরক্ত হয়ে উঠল, মনে হল জেসুসিতা লোপেজ নামে মেয়েটিকে ভাল্লুক শিকারের গাইড হিসাবে নিযুক্ত করে সে ভুল করেছে। সে ভাবতে লাগল, সুন্দরীর বন্দুকের টিপ ভালো বটে, কিন্তু ভাল্লুকের সন্ধান বলে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা তার নেই। কার্লোর কথায় মেয়েটির ওপর এতটা নির্ভর করা উচিত হয়নি।
জেসুসিতার মেজাজও ভালো ছিল না, কথায় কথায় হঠাৎ দুজনের মধ্যে তর্ক বাধল। ফলে তপ্ত বাক্যস্রোত ছুটল এবং পরের দিন যখন শিকারির অভিযান শুরু হল তখন দেখা গেল জুটি বদল হয়েছে কালোর সঙ্গে জুটেছে জেসুসিতা, ফ্রেডের সঙ্গী হয়েছে রে বেনেট।
এখানে গল্প বলা থামিয়ে গ্রিজলি ভাল্লুক সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলছি। ওই জন্তুটির স্বভাব-চরিত্র এবং দৈহিক-শক্তির বিষয়ে যেসব পাঠক অবহিত নন, তাদের পক্ষে পরবর্তী ঘটনার ভয়াবহতা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়–সেইজন্যই গল্প থামিয়ে বর্তমান প্রসঙ্গের অবতারণা।
গ্রিজলি ভাল্লুকের দেহের ওজন বাঘ অথবা সিংহের চাইতে অনেক বেশি। বাঘ-সিংহের মতো চটপটে না হলেও ক্ষিপ্রতার অভাব গ্রিজলি পুষিয়ে নিয়েছে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে। ভারতীয় বাঘ এবং আফ্রিকার সিংহ কখনো দলবদ্ধ বন্য মহিষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস করে না, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুক বাইসনের পালে হানা দিয়ে শিকার সংগ্রহ করেছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। জীবতত্ত্ববিদের মতে গ্রিজলি ভাল্লুক হচ্ছে মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে শক্তিশালী জীব। ভারতীয় ভাল্লুক কখনো কখনো মৃত পশুর মাংস ভক্ষণ করে বটে, কিন্তু জীবিত প্রাণী শিকার করে উদর পূরণের চেষ্টা সে করে না–ফলমূল, মধু প্রভৃতি নিরামিষ খাদ্যেই সে জীবনধারণ করতে অভ্যস্ত। নিরামিষে গ্রিজলির আপত্তি নেই, তবে শিকারের তপ্ত রক্তমাংসই তার প্রধান খাদ্য। পূর্বোক্ত ভয়ংকর জীবটিকে শিকার করার জন্যই ওই অঞ্চলে পদার্পণ করেছে রে আর ফ্রেড, বর্তমান কাহিনির জন্মও সেই কারণে।
হ্যাঁ, ফেলে-আসা গল্পটাকে এবার আমরা আবার শুরু করতে পারি। আগেই বলেছি মন-কষাকষির ফলে রে আর জেসুসিতার জুটি বদল হয়েছে শিকার অভিযানের ষষ্ঠ দিনে রে-র সঙ্গী ফ্রেড, মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতার সঙ্গ নিল কার্লো। সকলেই যাত্রা করেছিল অশ্বপৃষ্ঠে।
একটা পাহাড়ের ওপর নাটকীয় সাক্ষাৎকার! তলা থেকে পাহাড় বেয়ে উঠছে দুই বন্ধু, এমন সময়ে আচম্বিতে কোথা থেকে তাদের সামনে আবির্ভূত হল বিপুলবপু এক গ্রিজলি ভাল্লুক। মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, পরক্ষণেই পাহাড়ের গায়ে সারি সারি গাছের ফাঁকে শ্বাপদের দ্রুত অন্তর্ধান।
বন্ধুকে তলা দিয়ে ঘোড়া চালাতে বলে পাহাড়ের উপরদিকে অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হল রে। এক মাইলের প্রায় এক চতুর্থাংশ যখন পার হয়ে এসেছে রে-র ঘোড়া, সেই সময় হঠাৎ রে শুনতে পেল রাইফেলের আওয়াজ।
আওয়াজটা এসেছে তলা থেকে, অতএব শব্দের উৎসস্থল যে বন্ধুবর ফ্রেডের রাইফেল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘোড়ার লাগাম টেনে স্থির হয়ে দাঁড়াল রে, তারপর কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল নূতন শব্দতরঙ্গের জন্য
শব্দ এল, রাইফেলের যান্ত্রিক কণ্ঠ নয়–মনুষ্যকণ্ঠে চিৎকার। ফ্রেডের কণ্ঠস্বর বুঝতে পারল রে, কিন্তু দূর থেকে বন্ধুর বক্তব্য বুঝতে পারল না সে। আহত ভাল্লুক যদি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে, তবে নিশ্চয়ই আর একবার রাইফেলের আওয়াজ শোনা যাবে আর শ্বাপদ যদি নিহত হয়, তবে পর পর তিনবার শোনা যাবে রাইফেলের শব্দ, এই ব্যবস্থাই ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে। এখন একবারের বেশি রাইফেলের আওয়াজ শোনা গেল না, তাই রে বুঝল গ্রিজলি ফ্রেডকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। রাইফেলের শব্দটা এসেছে বাঁ-দিক থেকে, অতএব সেই দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল রে।
ঝোপজঙ্গলের বাধা ঠেলে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল রে-র ঘোড়া, সঙ্গেসঙ্গে ২৫ গজ দূরে আত্মপ্রকাশ করল পলাতক গ্রিজলি।
প্রকাণ্ড ভাল্লুকটাকে দেখে ঘাবড়ে গেল রে-র ঘোড়া, সে হঠাৎ পিছনের দুটি পায়ে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল বাগিয়ে ধরার চেষ্টা করছিল রে, কিন্তু তার চতুষ্পদ বাহন আচম্বিতে দ্বিপদ জীবে পরিণত হওয়ার ফলে ভারসাম্য হারিয়ে রে লম্বমান হল মাটির উপর এবং উইনচেস্টার রাইফেলটাও ছিটকে পড়ল হস্তচ্যুত হয়ে।
মাটিতে শুয়েই সে ভাল্লুকটাকে দেখতে পেল। তার সামনে প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে রক্তাক্ত শ্বাপদ জন্তুটার পাঁজরের ওপর হাঁ করে রয়েছে একটা মস্ত ক্ষতচিহ্ন, আর সেখান থেকে ঝরঝর ঝরছে লাল রক্তের ধারা। রে বুঝল আজ তার রক্ষা নেই, ছিটকে পড়া রাইফেলটাকে উদ্ধার করার সময় আর পাওয়া যাবে না।
তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর জীবন্ত পরোয়ানা!
মুহূর্তের জন্য রে-র মানসপটে ভেসে উঠল জেসুসিতার মুখ, তারপরেই বুকের উপর গুরুভার বস্তুর প্রচণ্ড চাপে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যাতনাদায়ক অনুভূতি, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…
জ্ঞান ফিরে পেয়ে রে দেখল তার ভূপতিত দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কালো আর ফ্রেড এবং তার বাঁ-হাত জড়িয়ে অবস্থান করছে ছেঁড়া কাপড়ের একটা রক্তাক্ত আবরণ। অনাবৃত ঊর্ধ্ব-অঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল তার শার্ট ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত, বাঁ-হাতটাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে তার দুই সঙ্গী।
তোমার হাতটা ভীষণ জখম হয়েছে, ফ্রেড বলল, তবে শরীরের অন্য কোথাও আঘাত লাগেনি।
তোমরা ঠিক সময়েই এসে পড়েছ, রে-র কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার আভাস।
সঙ্গীদের সাহায্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল রে। এবার ভূপতিত গ্রিজলির মৃতদেহটা তার দৃষ্টিগোচর হল। রে দেখল ভাল্লুকের ঘাড়টা মুচড়ে প্রকাণ্ড মাথাটা বেঁকে গেছে একদিকে এবং তার কণ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে জেগে উঠছে একটা সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন। রে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল এমন অদ্ভুত ক্ষতরেখার উৎপত্তি হল কেমন করে–রাইফেলের বুলেট তো এমন অদ্ভুতভাবে গলা কেটে ফেলতে পারে না!
রে প্রশ্ন করল, জেসুসিতা কোথায়?
শোন সিনর, গভীর বিষণ্ণ কণ্ঠে কালো বলল, আমি আর জেসুসিতা একইসঙ্গে বেরিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একটু পরেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি তোমাকে অনুসরণ করেছিল। শিকারির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বোধ হয় আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছিল মেয়েটি আমার সঙ্গে যাত্রা করলেও একটু পরে আমাকে ছেড়ে সে তোমার পিছু নিয়েছিল। ভাল্লুক যখন তোমাকে আক্রমণ করে, সেই সময় সে বন্দুক ব্যবহার করতে সাহস পায়নি। কারণ তোমরা এত কাছাকাছি ছিলে যে গুলি চালালে তোমার প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল। বন্দুক ফেলে ছুরি হাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাল্লুকের ওপর।
এইবার কার্লোর পাশে মাটির ওপর শায়িত প্রাণহীন দেহটাকে দেখতে পেল রে–ঘোড়ার জিন থেকে একটা কম্বল নিয়ে মৃতদেহের ওপর আবরণ টেনে দেওয়া হয়েছে, মরণঘুমে ঘুমিয়ে আছে মেক্সিকো-সুন্দরী সিনোরিতা জেসুসিতা লোপেজ।
সেট বাটলার ও মি. পিটার বারোজ
১৮০০ সালে কিলকেনি ফ্রেল্যান্ড নামক স্থানের নিকটবর্তী এক উন্মুক্ত প্রান্তরে পিস্তল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলেন দুটি ভদ্রলোক। ওই ভদ্রলোক দুটির নাম অনারেবল সমারসেট বাটলার ও মি. পিটার বারোজ। শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন ব্যারিস্টার। তবে বাটলার সাহেবের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে তিনি আদালতের আশ্রয় না-নিয়ে পিস্তলের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন–অতএব দ্বন্দ্বযুদ্ধ। মধ্যস্থের নির্দেশ পাওয়ামাত্রই যোদ্ধাদের পিস্তল গর্জে উঠল। বারোজ সাহেব ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাটলার অক্ষত দেহ নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন অতি দ্রুত বেগে।
একজন চিকিৎসক তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ধরাশায়ী বারোজকে পরীক্ষা করে বললেন আহত ব্যক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বহির্গত হবে প্রাণবায়ু। কয়েক মিনিট তো দূরের কথা, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আহত বারোজ আর্তনাদ করলেন, তবু অনিবার্য মৃত্যুর কোনো লক্ষণই তার দেহে দেখা দিল না। বিস্মিত চিকিৎসক আবার ভালো করে পরীক্ষা শুরু করলেন এবং মরণোন্মুখ বারোজ সাহেবের ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একগাদা বাদামের সঙ্গে মারাত্মক গুলিটাকেও বার করে ফেললেন। চিকিৎসক বুঝলেন পকেটস্থ গাদা গাদা বাদাম আর একটি রৌপ্যমুদ্রার সংঘর্ষে পিস্তলের গুলির শক্তি কমে গিয়েছিল–বুলেট সজোরে আঘাত করে বারোজকে ফেলে দিয়েছিল বটে, কিন্তু বাদাম আর রৌপ্যমুদ্রার কাঠিন্য ভেদ করে বারোজকে জখম করতে পারেনি। বারোজ যখন চিকিৎসকের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনলেন এবং জানলেন এখন আর তিনি মরছেন না, তখন ভারি আশ্চর্য হয়ে তিনি আর্তনাদ থামিয়ে ফেললেন এবং এক লাফে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গেসঙ্গে তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল নিকটবর্তী চিকিৎসক ও মধ্যস্থের প্রবল অট্টহাসি। মি. পিটার বারোজের কর্ণমূল হল রক্তবর্ণ, চটপট পা চালিয়ে তিনি অকুস্থল ছেড়ে প্রস্থান করলেন দ্রুত বেগে।
স্যার টমাস দ্য লা মার্চে ও স্যার জন দ্য ভিকঁৎ
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস দ্য লা মার্চে নামক একজন ফরাসি নাইট স্যার জন দ্য ভিকঁৎ নামে জনৈক সম্ভ্রান্ত সাইপ্রিয়টের অধিবাসীকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। একদল খ্রিস্টান সৈন্য তুর্কিদের হাতে বিপন্ন হয়েছিল এবং স্যার টমাসের মতে ওই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী স্যার জন দ্য ভিকৎ। অভিযোগ শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভিকঁৎ তার হাতের লৌহ-দস্তানা খুলে টমাসের সামনে ফেলে দিলেন। তখনকার দিনে ওইভাবেই একজন আর একজনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করত–অতএব টমাস ও জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়ে পড়ল অবধারিত।
ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনিস্টার নামক স্থানে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের সামনে পূর্বোক্ত দ্বৈরথ সংঘটিত হয়। প্রচলিত রীতি অনুসারে বিপরীত দুই দিক থেকে সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দুই যোদ্ধা শূল হাতে পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু প্রথম সংঘর্ষেই শূল দুটি গেল ভেঙে এবং যোদ্ধারাও আঘাতের বেগ সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লেন মাটির উপর। উভয় যোদ্ধারই দেহ ছিল লৌহবর্মে আবৃত, শূলের ফলক ওই বর্ম ভেদ করতে পারেনি; কিন্তু প্রচণ্ড আঘাতে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে পদাতিকে পরিণত করে দিয়েছিল। অশ্বারোহীর পদ থেকে পদাতিক যোদ্ধার অবনত স্থানে নেমে আসলেও যোদ্ধাদের উৎসাহ একটুও কমেনি, কোষ থেকে তরবারি টেনে নিয়ে দুই বীর আবার রণরঙ্গে মেতে উঠলেন। তলোয়ারের খেলায় দুই পক্ষই সিদ্ধহস্ত, সংঘাতে সংঘাতে তীব্র ঝংকার-ধ্বনি তুলে ঝকমক জ্বলতে লাগল দুটি ঘূর্ণমান তরবারি কিন্তু যুযুধানরা কেউ সুবিধা করতে পারলেন না। অবশেষে হঠাৎ প্রচণ্ড সংঘর্ষে দু-খানা তলোয়ারই ভেঙে গেল। তলোয়ার ভাঙল, কিন্তু যুদ্ধ থামল না। লৌহ-দস্তানায় আবৃত বজ্রমুষ্টি তুলে দুই যুযুধান পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। দুজনেরই সর্বাঙ্গ ছিল লৌহবর্মে ঢাকা, কিন্তু দূরদর্শী ফরাসি বীর যুদ্ধের বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন; তার ডান হাতের দস্তানার বহির্ভাগে বসিয়ে দিয়েছিলেন ধারালো লোহার কাটা। তীক্ষ্ণ কণ্টক-সজ্জিত সেই লৌহময় বজ্রমুষ্টির প্রহার যখন স্যার ভিকঁতের মুখের উপর বৃষ্টিধারার মতো পড়তে লাগল, তখন তিনি পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। মুখের লৌহ-আবরণ ভিকঁৎকে ওই ভয়াবহ দস্তানার বজ্রমুষ্টি থেকে বাঁচাতে পারল না। পরাজিত ভিকঁৎ হলেন ফরাসি বীর টমাসের বন্দি। এসব ক্ষেত্রে বিজয়ী যোদ্ধারা পরাজিত বন্দির কাছ থেকে মোটারকম মুক্তিপণ দাবি করতেন এবং ওই অর্থ না-পেলে বন্দিকে মুক্তি দিতেন না। কিন্তু স্যার দ্যা লা মার্চে কোনো মুক্তিপণ দাবি না-করেই উদারভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
স্যার ডেভিড লিন্ডসে ও জন ওয়েলস
১৯৩০ সালে এক ভোজসভায় স্কটল্যান্ডের নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসে এবং ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ক্রুদ্ধ বাদানুবাদ শুরু হয়। ইংরেজ ও স্কচদের মধ্যে কারা অধিকতর বীরত্ব ও সাহসের অধিকারী এই ছিল তাদের তর্কের বস্তু।
হাত থাকতে মুখ কেন? এই নীতি অবলম্বন করলেন ইংরেজ জন ওয়েলস; প্রতিপক্ষকে তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন।
লন্ডন ব্রিজ নামে সেতুর ওপর রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সামনে দুই যোদ্ধা দ্বৈরথরণে ব্যাপৃত হলেন অশ্বপৃষ্ঠে।
কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস প্রতিদ্বন্দ্বীর শূলের আঘাতে আহত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লেন মাটির উপর। স্কটল্যান্ডের নাইট তখন ঘোড়া থেকে নেমে পদব্রজে অগ্রসর হলেন ভূপতিত শত্রুর দিকে।
জনতা উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। এখনই প্রচণ্ড আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন জন ওয়েলস। কিন্তু না, চরম আঘাত পড়ল না। স্কচ নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসে শত্রুর শিরস্ত্রাণ খুলে শুশ্রূষা শুরু করলেন। অকুস্থলে চিকিৎসকের আগমন না হওয়া পর্যন্ত তিনি শত্রুর পরিচরর্যা থেকে বিরত হননি।
পূর্বোক্ত ঘটনার পরে ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস ও স্কচ নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়। পরবর্তী জীবনে তারা কখনো ইংরেজ ও স্কচদের সাহস কিংবা বীরত্ব নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেননি।
হিউজ গ্লাস ও গ্রিজলি ভাল্লুক
ইতিহাসে যেসব দ্বন্দ্বযুদ্ধের ঘটনা পাওয়া যায়, সেইসব ঘটনার নায়করা যে সবসময় যুদ্ধের রীতি নীতি পালন করেছে এ-কথা বলা যায় না। কারণ মানুষের বিরুদ্ধে মানুষই যে সব সময় দ্বৈরথ রণে অবতীর্ণ হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। পশু ও মানুষের দ্বন্দ্বযুদ্ধও ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করেছে একাধিকবার। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হিউজ গ্লাস নামক এক বিখ্যাত সীমান্তরক্ষী ও অভিযাত্রী আমেরিকার রকি মাউন্টেন অঞ্চলে এক বিশালকায় গ্রিজলি ভাল্লুকের সম্মুখীন হয়েছিল। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিরাট ওই ভাল্লুক ছিল নয় ফুট লম্বা। হিউজ তার বন্দুক ব্যবহার করার চেষ্টা করল। গুলি লাগতেই ভাল্লুকটা খেপে গিয়ে তেড়ে এল হিউজের দিকে। দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর আগেই প্রকাণ্ড এক থাবার আঘাতে হিউজের বন্দুকটা দূরে ছিটকে পড়ল এবং ভাল্লুকের পরবর্তী চপেটাঘাত হিউজকে করল ধরাশায়ী। রক্তাক্ত ও অবসন্ন দেহ নিয়ে হিউজ টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোমর থেকে শানিত ছুরিকা কোষমুক্ত করে চতুম্পদ প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বার বার ছুরিকাঘাত করে হিউজ তার শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভাল্লুকটা তাকে এমন ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে, হিউজের মনে হচ্ছিল তার শরীরের হাড়গুলি বুঝি এখনই ভেঙে যাবে।
দেহের শেষ শক্তি জড়ো করে প্রাণপণে ছুরি চালাতে লাগল হিউজ…
হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল ভাল্লুকের ভয়াবহ আলিঙ্গন, ধীরে ধীরে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল শ্বাপদের প্রাণহীন দেহ। হিউজ যুদ্ধে জয়ী হল বটে, কিন্তু ভাল্লুকের নখদন্ত তাকে প্রায় মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। শরীরের মারাত্মক ক্ষতগুলি নিরাময় হতে বেশ সময় লেগেছিল; দীর্ঘ কয়েক মাস যন্ত্রণা ভোগ করার পর সুস্থ হয়ে উঠেছিল হিউজ গ্লাস।