কৈলাসের মুখ-চোখ বিবর্ণ হয়ে গেল, আমার নামে যদি কেউ মিথ্যে করে লাগায়, তাহলেও আমায় শাস্তি পেতে হবে? এই কি আপনার বিচার?
মিথ্যে হলে শাস্তি পাবে না। সত্যমিথ্যা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তোমায় দেখে কথাটা মনে পড়ে গেল, তাই সাবধান করে দিলাম। যাই হোক–কী যেন বলছিলে তুমি?
সর্দার ওই ছোঁড়াটার হাতের মারে মাটি নিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন তেমন জোয়ানের পাল্লায় পড়লে ওই দুধের বাচ্চাটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না, অনেক আগেই মাটিতে শুয়ে পড়ত।
তেমন তেমন জোয়ানটা কি তুমি নাকি? দেবী কঠিন স্বরে বলল, রঙ্গলালকে আমি তোমার চেয়ে ভালো করে চিনি। আমি যখন থাকব না, সেই সময় একবার রঙ্গলালকে ঘাঁটিয়ে দেখ।
মা এই লোকটা নতুন এসেছে, কিন্তু ওর চালচলন দেখলে মনে হয় ও-ই যেন দলের সর্দার।
রঙ্গলাল বলল, কী বলব মা, তোমার সামনে তো গরম দেখাতে পারি না, যদি অনুমতি দাও তাহলে এই বেআদব লোকটাকে কিছু আদব শেখাতে পারি।
দেবী উত্তর দেওয়ার আগেই নীলকণ্ঠ কৈলাস নামে লোকটার সামনে এগিয়ে এসে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, দেখি! দেখি! ওটা একবার দেখি!
পরক্ষণেই তার ডান হাত কৈলাসের গলায় আছড়ে পড়েই ফিরে এল একটা শব্দ হল : ফট! ছিন্নহারের সঙ্গে সংলগ্ন তাবিজটাকে চোখের সামনে তুলে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, এই তাবিজ তুমি কোথায় পেলে?
উত্তর এল লাঠির মুখে। সজোরে নীলকণ্ঠের মাথায় আঘাত হানল কৈলাস। সেই লাঠি মাথায় পড়লে নীলকণ্ঠ তখনই মারা পড়ত, কিন্তু চকিতে বর্শা তুলে আঘাত রুখে দিল দেবী চোখের পলক ফেলার আগেই আবার ঘুরল বর্শা, মুহূর্তের মধ্যে ধারালো ফলা কৈলাসের কণ্ঠনালি স্পর্শ। করল, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র কণ্ঠের আদেশ, কৈলাস। লাঠি ফেলে দাও, নইলে
নইলে কী ঘটবে সেটা আর বলতে হল না, কৈলাসের হাতের লাঠি খসে পড়ল মাটির উপর। শুধু কৈলাস নয়, নীলকণ্ঠের বুকের ভিতরেও আতঙ্কের বিদ্যুৎ-শিহরন তুলে দিল সেই আদেশবাণী। জীবনে সর্বপ্রথম নীলকণ্ঠ বুঝল রমণীর কণ্ঠস্বর সবসময় খুব রমণীয় হয় না!
কঠিন স্বরে দেবী বলল, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। আমার সামনে তুমি একটা মানুষের মাথায় লাঠি চালিয়ে দিলে!
সকলেই স্তব্ধ, নির্বাক। দেবী আবার বলল, তুমি কি জানো না অনর্থক রক্তপাত আমি পছন্দ করি না? আমার দলে বিনা প্রয়োজনে কেউ খুনোখুনি করলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়।
কিন্তু মা-ঠাকরুন, নীলকণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠল, আত্মরক্ষার অধিকার তো সকলেরই আছে।
অবাক হয়ে দেবী বলল, তা আছে। কিন্তু তুমি তো কৈলাসকে আক্রমণ করনি, আত্মরক্ষার প্রশ্ন আসে কী করে?
আসে মা ঠাকরুন, আসে, নীলকণ্ঠের মুখে অদ্ভুত হাসির রেখা ফুটল, এই তাবিজটা ও কোথায় পেল সে-কথা বলতে হলেই আরও অনেক পুরোনো কথা উঠবে। আমি আপনাকে প্রথম দেখলাম–তবু এইটুকু সময়ের মধ্যে আপনাকে যতটুকু বুঝেছি, তাতে মনে হয় এই তাবিজের ঘটনা জানার পর আপনার দলে ওর স্থান তো হবেই না, উপরন্তু কিছু বাড়তি দুর্ভোগও ওর বরাতে জুটতে পারে। তাই আমার মুখ চটপট বন্ধ করার জন্যই কৈলাস ফট করে লাঠি চালিয়ে দিয়েছে, দারুণ ভয়ে আগুপিছু চিন্তা করার ক্ষমতা ওর ছিল না।
বটে? বর্শার ফলা সরে গেল কৈলাসের গলা থেকে, তাহলে তো এই তাবিজের ব্যাপারটা আমাকে জানতেই হয়। এটা যদি কৈলাসের সম্পত্তি না হয়, তাহলে এর আসল মালিক কে?
তাবিজের আসল মালিক বেঁচে নেই, মা-ঠাকরুন।
তুমি তাকে জানতে?
জানতুম।
কে সে?
বদন সর্দার। আমার বাবা।
মাঠের মধ্যে তখন বোধ হয় ছুঁচ পড়লেও শব্দ শোনা যায়… হঠাৎ নীরবতা ভেঙে দেবী বলল, তাবিজটা আমার হাতে দাও।
কিছুক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে দেবী বলল, তাবিজটা যদি তোমার বাবার হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তুমি ওটা পাবে। কিন্তু এটা তো পিতলের তৈরি খুব সাধারণ জিনিস, কৈলাস এটা চুরি করবে কেন?
কৈলাস কিছু বলতে যেতেই দেবী উগ্রদৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল, চুপ করো। সময় যখন আসবে তখন তোমার কথাও আমি শুনব। এখন কোনো কথা কইবে না।
ঢোক গিলে চুপ হয়ে গেল কৈলাস। নীলকণ্ঠ বলল, জিনিসটা খুব সাধারণ নয়। কৈলাস ওটা চুরি করেনি, বাবাকে খুন করে গলা থেকে খুলে নিয়েছিল।
এই সামান্য জিনিসের জন্য মানুষ খুন করেছে কৈলাস?–না, না, এ-কথা বিশ্বাস করা যায় না।
মা ঠাকরুন, এটা সামান্য জিনিস নয়, নীলকণ্ঠ বলল, সব কথা শুনলেই আপনি বুঝবেন। এই তাবিজটা কর্তামশাইয়ের ঠাকুরদার ঠাকুরদা পেয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে। সন্ন্যাসী নাকি সিদ্ধপুরুষ ছিলেন, তিনি বলেছিলেন এই তাবিজ যার কাছে থাকবে সে কখনো কোনো লড়াইতে হারবে না।
জনতার ভিতর থেকে একাধিক কণ্ঠ সাড়া দিল, হ্যাঁ, হা এ-কথা আমরাও শুনেছি। কালীচরণ চৌধুরির ওই তাবিজের কথা অনেকেই জানে। চৌধুরি কত্তাদের সকলেই খুব বেপরোয়া মানুষ ছিলেন, জমির দখল নিয়ে তারা অনেক লাঠালাঠি খুনোখুনি করেছেন কিন্তু কখনো কোনো দাঙ্গা-কাজিয়ায় তারা হারেননি, সবসময়ই জিতেছেন। লোকে বলে ওই তাবিজ যতদিন কাছে থাকবে, ততদিন চৌধুরি বংশের কেউ লড়াইতে হারবে না। তবে তাবিজটা যে বদন সর্দারের কাছে গেছে এমন খবর আমাদের জানা নেই।
বামাচরণ! শিবু কাকা!… তোমাদের তো আমি চিনি, নীলকণ্ঠ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তোমরাও মা-ঠাকরুনের দলে যোগ দিয়েছ!… যাক গে, যে-কথা বলছিলাম–হ্যাঁ, তাবিজটা যে বাবাকে কর্তামশাই দিয়েছিলেন সে-কথা অনেকেই জানে না। জানার কথাও নয়। তাবিজটা কী করে কর্তামশাইয়ের গলা থেকে বাবার গলায় এল সেই ঘটনা এখন বলছি, শোনো। একদিন শিকারে গিয়ে কর্তামশাই একটা বুনো শুয়োরকে গুলি করেন। শুয়োর মরল না, জখম হল। চোট খেয়ে পালানোর চেষ্টা না-করে সে তেড়ে এল কর্তামশাইয়ের দিকে। কর্তামশাই আবার গুলি করলেন। গুলি গেল ফসকে। শুয়োর সেদিন কর্তামশাইকে মেরেই ফেলত, কিন্তু আমার বাবা লাঠি চালিয়ে শুয়োরের দুটো ঠ্যাং ভেঙে দেয় বলে কর্তামশাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তারপর নতুন করে বন্দুকে গুলি ভরে শুয়োরটাকে মারলেন কর্তামশাই আর তাবিজটা নিজের হাতে খুলে বাবার গলায় পরিয়ে দিলেন। সেই থেকে ওই তাবিজটা সর্বদা বাবার গলায় থাকত, কিন্তু বাবাকে যখন খুন করা হয়