নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল দেবীর কৌতুকজড়িত কণ্ঠ, কী দেখছ?
মনে হয়, মনে হয়
কী মনে হয়?
না, মানে ইয়ে,আগন্তুক মাথা নীচু করে, আপনাকে দেখে ডাকাত বলে মনে হয় না, তাই : ইয়ে অর্থাৎ
দেবী হাসল, ডাকাত তো আমি নই।
আগন্তুক এবার মুখ তুলে দেবীর দিকে চাইল, কিন্তু আপনি তো ডাকাতি করেন। কর্তামশাইয়ের কাছেও
হ্যাঁ, টাকা চেয়েছি। কিন্তু কেন? তোমার কর্তামশাই আর তারই মতো কিছু জমিদার আর সুদখোর মহাজন গরিব মানুষের দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে, ওই গরিবদের শ্রমের ফলভোগ করে নির্লজ্জের মতো আমি ওই রক্তচোষা জমিদার আর সুদখোরদের যম। গরিবের লুঠ-করা টাকা আমি গরিবদের মধ্যেই বিলিয়ে দিই, বুঝলে? এটাকে যদি ডাকাতি মনে করো তবে আমি ডাকাত।
এসব কথা আমি জানতুম না। কিন্তু মা-ঠাকরুন, আপনি ভুল করছেন। আমাদের কর্তামশাই আর সকলের মতো নন।
দেবী হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, ভূষণ এদিকে এসো!
দস্যুদলের ভিতর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল, কী বলছ মা?
বলো, জমিদার কালীচরণ তোমার কী অবস্থা করেছে।
পাইক দিয়ে আমার জমি থেকে আমায় উঠিয়ে দিয়েছে। যেতে রাজি হইনি বলে আমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তুমি আশ্রয় না-দিলে বউ-ছেলে নিয়ে আমায় পথে দাঁড়াতে হত।
আগন্তুক ভূষণের চোখে দিকে চাইল, কর্তামশাই তোমার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে কেন?
জমিদারের জমিতে বেগার খাটতে রাজি হইনি, তাই। কিছু খাজনাও বাকি ছিল, কিন্তু
কর্তামশাই তোমায় বেগার খাটতে বলেছিল?
না। নায়েবমশাই বলেছিল।
পাইক কে ছিল? বাঘা, করিম, এমতাজ?
না, ওরা নয়। নারদ সর্দারের দল।
তুমি কর্তামশাইয়ের কাছে যাওনি, কেন?
নায়েবমশাই বলেছিল কত্তার হুকুমেই সব হচ্ছে। আরও বলেছিল তাকে বিরক্ত করলে মুণ্ডুটা ধড়ে থাকবে না।
আগন্তুক এবার দেবীর দিকে চাইল, আপনি ঠিক বিচার করেননি মা। নায়েবই এসব করেছে। কর্তামশাই কিছু জানেন না। নায়েব অঘোর বসু খুব খারাপ লোক। ও-ই নারদ সর্দারের দলকে ওই জুটিয়েছে। পুরানো লাঠিয়ালরা কর্তার হুকুম ছাড়া কারো ভিটেয় হাত দেবে না।
হতে পারে কালীচরণ ভালো মানুষ, এসবের কিছু জানেন না, দেবীর জ্ব কুঞ্চিত, কিন্তু তার জমিদারিতে প্রজার উপর হামলা হলে তাকেই সবাই দোষ দেবে।
তা ঠিক, আগন্তুক সায় দিল, গিন্নিমা মারা যাওয়ার পর কর্তা যেন কেমন হয়ে গেছেন। কোনো কিছুই দেখেন না।
তোমরা তার প্রজা, তোমাদের তো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। একটা ভূষণ তোমায় দেখালুম, কিন্তু এর মতো আরও অনেক মানুষকেই বিনা অপরাধে ভিটে থেকে উৎখাত করা হয়েছে। তোমরা গাঁয়ের জোয়ান ছেলে–তোমরা থাকতে নায়েব এমন অন্যায় অত্যাচার চালিয়ে যাবে? তোমরা তবে আছ কী করতে?
আগন্তুক জবাব দেওয়ার আগেই ভূষণ বলল, ওকে ওসব কথা বলে লাভ নেই মা! আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত তাহলে কার সাধ্যি আমায় ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে?
আগন্তুকের নতদৃষ্টি ভূষণের মুখের উপর পড়ল, বাপ বেঁচে থাকলে টাকা আদায় করা অত সহজ হত না রে ভূষণ।
ভূষণ বলল, টাকা চাইবার কারণটাও যে ঘটত না, সে-কথা ভুলিস না নীলে।
দেবী একটু অবাক হয়ে বলল, এর নাম বুঝি নীলে? ওর বাবা বুঝি খুব ওস্তাদ লাঠিয়াল ছিল?
এবার শুধু ভূষণ নয়, দলের মধ্যে অনেকগুলো কণ্ঠ সোচ্চার হয়ে উঠল, ওর নাম নীলে নয়, নীলকণ্ঠ। ওর বাপ বদন সর্দার ছিল দারুণ লেঠেল। লাঠি নিয়ে দাঁড়ালে এক-শো জোয়ানের মহড়া নিতে পারত।
ভূষণ বলল, নীলু কিন্তু বাপের মতো হয়নি মা। নায়েবের অত্যাচার ও রুখবে কেমন করে? বাঁশি বাজিয়ে আর গান গেয়ে তো অঘোর বসুর মতো পাজি নায়েবকে শায়েস্তা করা যায় না মা।
ওর নাম নীলকণ্ঠ?… ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! ও আবার বাঁশি বাজায়, গান গায়?… ভাবা যায় না।
একজন দস্যু প্রশ্ন করল, কেন ভাবা যায় না?
বদন সর্দারের ছেলের নাম নীলকণ্ঠ! দেবী হাসল, তোমার নাম কে রেখেছিল নীলু?
আজ্ঞে গ্রামের ব্রাহ্মণ শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর। উনি আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমি একেবারে মুখ নই।
তোমার কথা শুনে তা বোঝা যায়। গান, অভিনয় এগুলো খুবই ভালো জিনিস, কিন্তু দরকারে লাঠিও ধরতে হয়। তোমাদের গ্রামে একটা নায়েব প্রজাদের উপর জুলুম করবে আর তোমরা সেটা সহ্য করবে?
আমি কিছুই জানতাম না।
কথাটা ঠিক, ভূষণ বলল, কিন্তু জানলেই-বা কী করবে ও? নীলেটা বাপের নাম ডোবাল, অমন জোয়ানের বেটা এমন ভেড়া হয় ভাবতে পারি না।
যাই বল ভূষণ, দেবী হাসল, ও যদি ভেড়া হয়, তাহলে ওর শিং-এর গুঁতোটা যে খুবই সাংঘাতিক এ-কথা আমাদের রঙ্গলাল অন্তত স্বীকার করবে। কী বলো রঙ্গলাল?
লাঠি হাতে যে-লোকটি প্রথমেই ঘাড়ের উপর আগন্তুকের রদ্দা খেয়ে মাটি নিয়েছিল, তার মুখটা শক্ত হয়ে উঠল। মনের ভাব গোপন করার জন্য সে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
দলের ভিতর থেকে একটি লম্বা-চওড়া জোয়ান সামনে এগিয়ে এল, মাঠান যদি অনুমতি করেন তো একটা কথা বলি।
দেবীর ভ্রু কুঞ্চিত হল, তুমি তো নতুন এসেছ কৈলাস? বোধ হয় মাস দুই হবে, তাই না? তোমার সম্পর্কে কিছু কিছু নালিশ আমার কানে এসেছে। শুনেছি তুমি ভারি ওস্তাদ লাঠিয়াল, কিন্তু এখানকার ব্যাপার আলাদা। নালিশগুলো সম্পর্কে আমি খোঁজখবর করছি। যা শুনেছি তার সবটুকু না হোক, যদি কিছুটাও সত্যি হয়, তাহলে তোমার কাঁধের উপর মাথাটা নাও থাকতে পারে বুঝেছ?