আমার তখন বুক ফেটে কান্না আসছে। বাপ বলল, কাদিস না নীলে। জন্মালে মরতেই হবে, দুঃখ করিস না। তবে সারাজীবন শুধু খুনখারাপি করে গেলাম এই কথাটাই মরণকালে মনে হচ্ছে। শোন বাবা, তোর গলায় সুর আছে, হাতের বাঁশিতে আছে জাদুর ছোঁয়া–এই খুনোখুনি আর রক্তারক্তির নেশায় তুই আর হাত লাল করিস না আর, আর আমাদের কত্তামশা রইলেন, ওঁকে আমার মতোই মানবি…।
বাপের শেষ কথা মেনে নিয়েছিলাম, তোদের টিটকারি, গালাগালি সব সহ্য করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্তামশাই আমার হাতে টাকার থলি ধরিয়ে দিলেন, হুকুম হল দেবী চৌধুরানির হাতে ওই টাকা তুলে দিতে হবে। তাই যাচ্ছি ঠ্যাঙাড়ের মাঠে লুঠেরার হাতে টাকা তুলে দিতে।
বলিস কী রে? বাঘার মস্ত গোঁফজোড়ার তলায় দাঁতগুলো একবার অন্ধকারেও ঝিকমিক করে উঠল, বদন সর্দার মারা গেছে, তা বলে ভুবনডাঙা গাঁয়ে কি আর মরদ নেই? নীলে, তুই বর্দন সর্দারের বেটা, আমি তার শাগরেদ চল, দুজনে একবার লাঠি ধরি, দেখি দেবী চৌধুরানির দলে কয়টা জোয়ান আছে?
না রে বাঘা। বাপের মরণকালে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কর্তামশাইকে কোনোদিন অমান্য করব না। সে-কথা আমায় রাখতেই হবে। তার হুকুমমতো টাকা তুলে দিতে হবে লুঠেরার হাতে। বাঘা রে, এমন না-মরদের কাজ করতে তোকে সঙ্গে নেব না, আমি একাই যাব।
টাকার থলিটা মাটি থেকে তুলে নিল নীলকণ্ঠ, তারপর দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলের দিকে… কিছুক্ষণের মধ্যেই তার দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে…
তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে বাঘা আপনমনেই বলল, বাপের কথায় রামচন্দ্র রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়েছিল বলে লোক তাকে বাহবা দেয়। সেটা এমন কী কঠিন কাজ? মরদের কাছে তার ইজ্জতের দাম রাজত্বের চাইতে অনেক বেশি। কথায় বলে জান দোব তো মান দোবনি। নীলু রে! সেই মান, সেই ইজ্জত তুই বিকিয়ে দিচ্ছিস বাপের কথায়, কিন্তু সেইজন্য কেউ তোকে বাহবা দেবে না। তবে আমিও সাচ্চা মরদ, তোর ব্যথা আমি বুঝি। আমি বুঝতে পারছি তোর বুকের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমারও তো কিছু করার নেই…
৪. প্রণামীর শত
চতুর্থ পরিচ্ছেদ — প্রণামীর শত
রাত বাড়ছে… আকাশে হানা দেয় পাচা… রাতের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে জেগে ওঠে জান্তব কোলাহল হুয়া-ক্কা-হুয়া–শেয়ালের পাল!
ঠ্যাঙাড়ের মাঠে বুড়ো বটগাছের তলায় লাঠি হাতে একটি দীর্ঘকায় মানুষ অস্থির চরণে পায়চারি করছে আর থেকে থেকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে পশ্চিমদিকের মেঠো পথটার দিকে। আকাশের পানে তাকিয়ে লোকটি অস্ফুটস্বরে স্বগতোক্তি করল, চাঁদ মাথার উপর উঠেছে। সময় হয়ে এল তবু কেউ তো টাকা নিয়ে আসছে না। ঠিক আছে, আরও ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করি। তারপর না হয় জমিদারবাড়িতে ভিক্ষে চাইতে যাব। সহজে রক্তারক্তি করতে চায় না, কিন্তু আজ বোধ হয় আমার লাঠি অনেকদিন বাদে রক্তের স্বাদ পাবে।
না গো কর্তা, তোমার লাঠি বোধ হয়, আজও উপোসি থাকবে, রক্তের স্বাদ সে আজও পাবে না।
কে রে! সবিস্ময়ে কণ্ঠস্বর লক্ষ করে ঘুরে দাঁড়াল লাঠিধারী ব্যক্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মনুষ্যমূর্তি! অন্ধকারে তার গায়ের সাদা চাদর কিছুটা দৃষ্টিগোচর হয়, চাদরের আড়ালে হাতে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে লাঠিধারী বলল, তুই তো কালীচরণের পাইক? ভুবনডাঙার পথ তো পশ্চিম দিকে। সেই দিকে তাকিয়ে চোখ যে ব্যথা হয়ে গেল তা তুই এলি কোন দিক থেকে?
আগন্তুক হাসল, যেদিক থেকেই আসি, আর যেখান দিয়েই আসি, সে-খোঁজে তোমার দরকার কী বাপু? টাকা আনার কথা, টাকা এনেছি। তিনি কোথায়?
কার কথা বলছিস?
দেবী ঠাকরুনের কথা বলছি।
মায়ের সঙ্গে তোর কী দরকার? টাকা আমার হাতেই দিয়ে যা।
আহাহা! আহ্বাদের কথা শুনে মরে যাই আর কি! চিঠি দিয়েছেন দেবী ঠাকরুন, টাকা দেব তার হাতে। তুমি কোথাকার উটকো লোক তোমার হাতে টাকা দেব কেন?
আগন্তুকের হাতে মস্ত থলিটাকে এইবার দেখতে পেল লাঠিয়াল, মায়ের কথাতেই এখানে এসেছি। রাতবিরেতে এমন জায়গায় কেউ শখ করে দাঁড়িয়ে থাকে? চিঠিতে তো। এই জায়গার কথাই লেখা আছে আর তুইও টাকা দিতেই এসেছিল, তবে আর কথা বাড়াচ্ছিস কেন?
আগন্তুক তরল কণ্ঠে বলল, তুমিই-বা কথা বাড়াচ্ছ কেন? মা-ঠাকরুনকে ডেকে দাও, টাকা তার হাতে তুলে দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই। ঝুটমুট তোমার সঙ্গে মাঝরাত্তিরে গল্প করতে তো আসিনি।
মা সকলের সাথে দেখা করেন না, লাঠিয়ালের কণ্ঠস্বর কর্কশ, টাকা আমার হাতেই দিতে হবে।
লাও কথা! দিতে হবে মানে?আগন্তুকের গলায় হাসির আভাস স্পষ্ট, আমি না-দিলে তুমি কেমন করে নেবে, শুনি? জোর করে?
হ্যাঁ, জোর করেই নেব। তুই বাধা দিতে পারিস?
পারি বই কী। আমি নিজে হাতে টাকা তুলে না-দিলে আমার হাত থেকে টাকা কেড়ে নিতে পারে এমন জোয়ান এখনও জন্মায়নি। বুঝলে কত্তা?
ওরে হতভাগা, তুই কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিস জানিস না। আমাদের মা সহজে কারুকে মারধর করতে চান না, তাই তুই এখনও আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা কইতে পারছিস। ভালো কথায় বলছি টাকা আমার হাতে দিয়ে চলে যা–নইলে, এই লাঠি দেখছিস?