গাঁয়ের মেয়েরা তাকে ভালোবাসে; বাড়িতে ডেকে গান শুনতে চায়। জোয়ান ছেলেরা সামনাসামনি টিটকারি দেয়, বলে, এ যেন বাঘের ঘরে ভেড়ার ছানা। বদন-সর্দারের নাম ডোবাল ছেলেটা।
নীলকণ্ঠ প্রতিবাদ করে না, মৃদু হেসে পাশ কাটিয়ে সরে যায়…
এই হল নীলকণ্ঠ নামে মানুষটির পরিচয়। চৈত্রমাসের সেই আগুন ঝরা দুপুরে বনের মধ্যে একটা গাছের ছায়ায় বিভোর হয়ে গান গাইছে ঘোর শাক্ত বংশের ছেলে নীলকণ্ঠ, কে যায়, বৃন্দাবনের কুঞ্জপথে কে যায় গো, কনক বরণী কে অভি–
আচম্বিতে সংগীত সাধনায় বাধা দিয়ে একটা তীব্র শিসের শব্দ বেজে উঠল কর্কশ ঝংকারে, রিক-রিক-চুঁঈঈ!
ভীষণ চমকে দুই হাতে কান চেপে ধরে নীলকণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, উঃ! কে রে? জঙ্গল ঠেলে নীলকণ্ঠের সামনে যে-লোকটি লাঠি হাতে আত্মপ্রকাশ করল, তার চেহারা দেখে আর বলে দিতে হয় না সে কেমন মানুষ। চোখের দৃষ্টি উগ্র রক্তিম, দক্ষিণ জ্বর উপর থেকে কপালের মাঝ বরাবর চলে গেছে একটা শুষ্ক ও গভীর ক্ষতচিহ্নের রেখা, ঠোঁটের দু-পাশে কামড় দিয়ে একজোড়া মস্ত গোঁফ সরু হয়ে উঠে গেছে গালের দিকে আর মাথার উপর থেকে ঘাড়ের উপর বাবরি হয়ে নেমে এসেছে লম্বা চুলের রাশি। আড়ে-বহরে মানুষটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু তার কঠিন স্থূল মাংসপেশিগুলির মধ্যে যে জান্তব শক্তি লুকিয়ে আছে এক নজরেই তা ধরা পড়ে যায়।
লোকটির নাম বাঘা মৃত বদন সর্দারের এক প্রিয় অনুচর, জমিদার কালীচরণের বেতনভোগী লাঠিয়াল।
হা হা শব্দে হেসে উঠে বাঘা বলল, কীরে নীলে, কান দুটো ফেটে গেল নাকি?
কুঞ্চিত মুখে নীলকণ্ঠ বলল, ঝামেলা থেকে বাঁচতে জঙ্গলে পালিয়ে এলাম, এখানেও জ্বালাতে এসেছিস?
তা আমি কী করব? বাঘা বলল, কত্তামশাই বললেন–যেখান থেকে পারিস নীলেকে এখনই নিয়ে আয়।
কেন রে?
সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করিস। আমি কী করে জানব?
তা বটে। আচ্ছা চল।
নীচু হয়ে মাটি থেকে কী যেন তুলে নিল নীলকণ্ঠ। ওটা কী রে? বাঘার গলায় স্পষ্ট বিদ্রূপ, বাঁশি নাকি?… সত্যি নীলে, তুই একেবারে না-মরদ হয়ে গেছিস।
নীলকণ্ঠের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার হেসে ওঠে বাঘা, কী হয়ে গেছিস তুই যাত্রা করিস, বাঁশি বাজাস, গান করিস ইনিয়েবিনিয়ে, গায়ে অষ্টপ্রহর জামা চড়িয়ে রাখিস ছি, ছি, ছি, কে বলবে তুই বদন লাঠিয়ালের বেটা।
হেসে নীলকণ্ঠ মাঠের দিকে পা বাড়ায়। পেছন থেকে ভেসে আসে বাঘার তিক্ত কণ্ঠস্বর, বো বামুনই তোর মাথাটা খেল নীলু।
একটা কালো ছায়া পড়ে নীলকণ্ঠের মুখে? কয়েকটা কঠিন রেখা কি ফুটে ওঠে কপালে, চোখের তলায়, আড়ষ্ট চোয়ালের ভাঁজে ভাঁজে?..
পিছন থেকে ওই পরিবর্তন বাঘার চোখে পড়েনি, পড়লে সে সাবধান হত। ঘুরে দাঁড়িয়ে বাঘার মুখোমুখি যখন কথা বলে নীলকণ্ঠ, তখন তার মুখ স্বাভাবিক, ঠোঁটের তরল হাসিটিও আবার ফিরে এসেছে যথাস্থানে, তোর বড়ো ভুললামন বাঘা, ঠাকুরের পুরো নামটা মনে রাখতে পারিস না। ঠাকুরের নাম বেন্দা নয়, শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্র ঠাকুর।
লে, লে, চল, ওই হল, অপরিসীম অবজ্ঞায় হাতটা একবার শূন্যে ঘুরিয়ে আনল বাঘা, তোকে আর যাত্রার বক্তিমে করতে হবে না।
স্থির চোখে কিছুক্ষণ বাঘার দিকে তাকিয়ে থাকে নীলকণ্ঠ, তারপর ঠান্ডা গলায় বলে, মাইরি বলছি বাঘা, মাঝে মাঝে আমার রাগ হয়ে যায়। যাক, আজ চলি–শুনে আসি কর্তামশাই কেন ডাকছেন।
তার চলার পথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাটির উপরে সশব্দে থুথু ফেলে বাঘা লাঠিয়াল, রাগ হয়ে যায় রাগ হলে তুই কী করবি রে? এক চড় মারলে আর এক চড় মারার জায়গা থাকে না, তোর রাগের ভয়ে আমি ইঁদুরের গর্তে নুকুব?… নেহাত বদন সর্দারের বেটা, তাই কিছু বলি না।
২. বাঘের বাচ্চা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ — বাঘের বাচ্চা
জমিদার কালীচরণ পায়চারি করছিলেন ঘরের মধ্যে। জানালাগুলো একেবারে হাট করে খোলা নেই–আবছা আলো-আঁধারির মধ্যেও বোঝা যায় প্রৌঢ় মানুষটি বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
বাইরে থেকে একটা গলা খাকরানির আওয়াজ এল। ঘুরে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে কালীচরণ হাঁকলেন, কে?
আজ্ঞে আমি।
কে? নায়েব মশাই?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আসুন, ভিতরে আসুন।
ঈষৎ শীর্ণ বিরলকেশ নায়েব অঘোর বসু ঘরে ঢুকলেন, কিছু বলতে গেলেন, কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে আর একটা গলা সাড়া দিল, আজ্ঞে কর্তা, আমিও এসেছি।
এসেছেন? তা, বেশ করেছেন, কালীচরণের মুখে হাসির রেখা ফুটল, অনুগ্রহ করে গৃহে পদার্পণ করুন।
হেঁ, হেঁ, একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল নীলকণ্ঠ, অমন করে বলবেন না কর্তামশাই, আমার অপরাধ হয়। তা, এমন অসময়ে তলব কেন?
হ্যাঁ, হুজুর, নায়েবমশাই বললেন, আমাকেও বাঘা বাড়িতে খবর দিয়েছে। ব্যাপারটা কী?
ব্যাপার? একটু হাসলেন কালীচরণ, একটা চিঠি এসেছে।
আজ্ঞে, চিঠিপত্তর রাজা লোকের ঘরে তো আসবেই, তাই জন্যে এই আঁ আঁ রোদ্দুরে তলব?… ওঃ, গা যেন জ্বলে গেছে।
কালীচরণ চটে উঠলেন, কথা শুনুন নায়েবমশাই। বদন সর্দারের বেটা তার গায়ে রোদ লাগলে ননীর শরীর গলে যায়। আজ যদি ওর বাপ বেঁচে থাকত, তাহলে কি এমন সর্বনাশ হয়?
কী গেরো! নীলকণ্ঠ বেশ বিব্রত, কথায় কথায় ধান ভানতে শিবের গীত কেন? রাজা-গজার বাড়িতে চিঠি আসতেই পারে, তাতে বাবার কথা ওঠে কী করে? আর এতে সর্বনাশই-বা হবে কেন?