জনতার ভিতর থেকে ভেসে এল অস্ফুট প্রশংসার ধ্বনি। রঙ্গলাল সোৎসাহে বলে উঠল, এ যে রেয়াজি জোয়ান!… দুধের বাচ্চার চেহারাটা ভালো করে দেখে নে কৈলাস। তোর বরাত আজ খুবই খারাপ রে কৈলাস, খুবই খারাপ।
অল্পবয়সি ছেলেটাকে দেখে কৈলাস ভেবেছিল লাঠির এক ঘায়েই লড়াই ফতে করবে। ছেলেটার হাতের মারে রঙ্গলালকে পড়ে যেতে দেখে সে বিশেষ ঘাবড়ায়নি–দলের পুরোনো লোকদের মতো রঙ্গলালের ক্ষমতা সম্বন্ধে সে সচেতন ছিল না, ভেবেছিল যোগ্যতার জন্য নয়, দেবীর অনুগত পুরানো লোক বলেই বুঝি সর্দারি করছে রঙ্গলাল। কিন্তু নীলকণ্ঠের আবরণ-মুক্ত শরীরটা দেখেই সে বুঝতে পারল নিয়মিত রেওয়াজ বা চর্চা না-করলে এমন শরীর হয় না ছেলেটাকে দুধের বাচ্চা বলে অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি।
তবে শরীরে যতই শক্তি থাক, এত অল্প বয়সে পাকা লাঠিয়ালের সঙ্গে লড়াই দেওয়ার ক্ষমতা বড়ো একটা হয় না। বেশিক্ষণ লড়াই চললে দমের লড়াইতেই ছেলেটা জিতে যেতে পারে, সেই সুযোগ দিতে রাজি নয় কৈলাস–
বাঁ-দিকে পাঁয়তারা করে এগিয়ে গেল সে, পলকে দিক পরিবর্তন করে বিকট হাঁক দিয়ে সে ডান দিকে ঘুরে গিয়ে সজোরে লাঠি হাঁকাল।
আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজের লাঠি তুলে সেই আঘাত রুখে দিল নীলকণ্ঠ, পরক্ষণেই প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে–
ঠক, ঠক, ঠকাস…সংঘাতে সংঘাতে কর্কশ শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল দুটি লাঠি। লাঠিয়ালদের স্পষ্ট করে দেখা যায় না, শুধু দুটি ঘূর্ণিত চক্র যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে বেষ্টন করে ঘুরতে থাকে নিষ্ঠুর আক্রোশে…
হঠাৎ আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল কৈলাস। নীলকণ্ঠের লাঠি আবার উঠল, আবার নামল… আবার আর্ত চিৎকার… মাটির উপর পড়ে ছটফট করতে লাগল কৈলাস! জনতা নিরাশ হল, যে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে কে জানত!
লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে নীলকণ্ঠ বলল, কৈলাস, আড়াল থেকে সড়কি ছুঁড়ে তুমি মানুষ মারতে পারো, আচমকা লোকের মাথায় লাঠি মেরে তার মাথা ফাটিয়ে দিতে পারো কিন্তু জোয়ান মরদের সঙ্গে সামনাসামনি লড়ার ক্ষমতা তোমার নেই। ইচ্ছে করলে এখনই তোমায় সাবাড় করতে পারতাম, করলাম না দয়া করে ছেড়ে দিলাম। তবে তোমার মতো লোক বহু মানুষের দুঃখের কারণ হতে পারে, তাই তোমার ডান হাত আর বাঁ-দিকের ঠ্যাংটাকে আমি বরবাদ করে দিলাম–বুঝেছ?
কৈলাসের কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না, দারুণ যন্ত্রণায় তার চৈতন্য তখন প্রায় অবলুপ্ত…
হাতের লাঠি নীরবে রঙ্গলালের হাতে তুলে দিল নীলকণ্ঠ, তারপর ফিরে দাঁড়াল দেবীর দিকে, মা, এবার আমি যাই?
যাবে? দেবী যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল, নীলকণ্ঠের গলার আওয়াজে তার সংবিৎ ফিরে এল, হ্যাঁ, এবার তোমার যাওয়ার সময় হয়েছে। তবে যাওয়ার আগে টাকার থলিটা তুলে নাও।
হ্যাঁ, মা, নীচু হয়ে নীলকণ্ঠ থলিটা তুলে নিল, এটা আপনার হাতে তুলে দেওয়া উচিত ছিল অনেক আগেই, কিন্তু খুনিটার গলায় বাবার তাবিজ দেখে মাথায় রক্ত উঠে গেল, সব ভুলে গেলাম।
নীলকণ্ঠ থলিসমেত হাত বাড়িয়ে দিল দেবীর দিকে। দেবীর দুই চোখের দৃষ্টি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল তার মুখের উপর, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, থলিটা তুমি নিয়ে যাও, নীলকণ্ঠ। জমিদার কালীচরণ চৌধুরিকে বলবে টাকা আমি ফেরত দিলাম। কিন্তু ভবিষ্যতে তার জমিদারিতে কোনো প্রজার উপর যদি অত্যাচার হয়, তাহলে তাকেই আমি দায়ী করব, আর সেদিন আমার রোষ থেকে তোমার লাঠিও তাঁকে বাঁচাতে পারবে না।
কী বলছেন মা! নীলকণ্ঠ চমকে উঠল, আপনার বিরুদ্ধে আমি লাঠি ধরব এমন কথা ভাবতে পারলেন? আপনি বল্লম তুলে বাধা না-দিলে কৈলাসের লাঠি আমার মাথাটা চুরমার করে দিত, সে-কথা আমি কোনোদিন ভুলব?
একটু থেমে সে আবার বলল, কিন্তু আপনার কাছে আমি অপরাধী। না-জেনে আপনাকে অসম্মান করেছি মা, আমায় ক্ষমা করুন।
দেবী বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠল, সে কী নীলকণ্ঠ, তুমি কখন আমায় অসম্মান করলে?
করেছি বই কী, নীলকণ্ঠের গলার স্বর দারুণ আবেগে প্রায় রুদ্ধ হয়ে এল, ঠাট্টা করে বলেছিলাম–দেবীদর্শন না হলে প্রণামী দেব না। তবু আমার কী ভাগ্য–ঠ্যাঙাড়ের মাঠে সত্যিই দেবীদর্শন করলাম। মা, প্রণামী তো নিলে না, সন্তানের প্রণামটা তো নেবে?
দেবী কোনো উত্তর দিল না, কিন্তু তার মুখের মৃদু হাসিতেই মৌন সম্মতি বুঝে নিল নীলকণ্ঠ। নতজানু হয়ে সে হাত বাড়াল দেবীর পায়ের দিকে…
আকাশের দিকে তাকিয়ে রঙ্গলাল বলল, মা, চাঁদ যে ঢলে পড়ল। এবার বোধ হয় যাওয়ার সময় হয়েছে।
মাঠের উপর আবছা অন্ধকারে ভুবনডাঙা গ্রামের দিকে একটা চলমান ছায়ামূর্তি তখনও দেখা যাচ্ছে–সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দেবী বলল, হ্যাঁ, রঙ্গলাল, এবার আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। ভোরের আগেই বজরা ধরতে হবে।