মার্ক ব্লেভান্স ছিল বাপ, তার পাঁচটি পুত্র সন্তান–অ্যান্ডি, হ্যাঁম্পটন, চার্লস, জন এবং স্যাম। স্যামের বয়স ছিল মাত্র ষোলো, কিন্তু ওই বয়সেই সে রিভলভার ছুড়ত পাকা বন্দুকবাজের মতো।
ম্যাগেল্লান পর্বতমালার বিস্তৃত তৃণ-আচ্ছাদিত উপত্যকা ছিল পশুচারণের পক্ষে চমৎকার জায়গা। প্রথমে ওখানে গোরুর পাল নিয়ে এল রাখালের দল, তারপরই হল সেখানে মেষপালকের আবির্ভাব। ফলে প্রচণ্ড কলহ। গোপালকদের সঙ্গে মেষপালকদের যুদ্ধ বাধল।
গোপালকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল গ্রাহাম পরিবার, বিরোধী মেষপালকদের নেতা ছিল টিউকসবেরি নামক আর একটি গোষ্ঠী। ওই যুদ্ধকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়–প্লেজেন্ট ভ্যালি ওয়ার, গ্রাহাম-টিউকসবেরি দাঙ্গা, ম্যাগেল্লান যুদ্ধ প্রভৃতি। আরিজোনা প্রদেশে সংঘটিত যাবতীয় দাঙ্গাহাঙ্গামার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল পূর্বোক্ত যুদ্ধ।
ওই লড়াইতে অন্তত বিশ জন লোক মারা গিয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবার ছিল গোপালকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গোষ্ঠী। ১৮৮৭ সালে জুলাই মাসে পরিবারের কর্তা মার্ক ব্লেভান্স হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সেই সময় তার পাত্তা পাওয়া যায়নি। সাত বছর পরে একটি ফাঁপা গাছের গুঁড়ির মধ্যে এক অস্থিময় নরমুণ্ডের সঙ্গে যে-রাইফেলটা পাওয়া গিয়েছিল, সেই রাইফেলটিকে মার্ক ব্লেভান্সের নিজস্ব অস্ত্র বলে শনাক্ত করা হয়েছিল। মুণ্ডহীন দেহটিকে উদ্ধার করা যায়নি, মার্কের হত্যাকারীরও সন্ধান করতে পারেনি কেউ।
জুলাই মাসে মার্ক ব্লেভান্স মারা গেল, অগাস্টে দাঙ্গার বলি হল ব্লেভান্স পরিবারের দ্বিতীয় ব্যক্তি—মার্কের মেজো ছেলে হ্যাম্পটন ব্লেভান্স অতর্কিতে গুলি খেয়ে মৃত্যুবরণ করল।
টিউকসবেরি দলের লোকরাই নিশ্চয় গুলি করে মেরেছিল হ্যাঁম্পটনকে। বাপ এবং পাঁচ ছেলের মধ্যে দুজন মারা পড়ল, রইল বাকি চার। মার্কের চারটি ছেলেই ছিল রিভলভার চালাতে ওস্তাদ। ষোলো বছরের কিশোর স্যামও লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে। ওই চারটি ছেলেই প্রতিশোধ গ্রহণে কৃতসংকল্প, তারা টিউকসবেরির দলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুযোগের প্রতীক্ষা করছিল সাগ্রহে।
সুযোগ এল। টিউকসবেরিদের গোশালার কাছেই গুলির আঘাতে মারা পড়ল জন টিউকসবেরি এবং তার অংশীদার বিল জ্যাকব। দুজনকেই পিছন থেকে গুলি করা হয়েছিল। ব্লেভান্স পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তি যে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সে-বিষয়ে শহরবাসীর সন্দেহ ছিল না একটুও কিন্তু, প্রমাণ কোথায়?
অ্যান্ডি কুপারের একটি দোষ ছিল। খুনখারাপি করে সে চুপচাপ থাকতে পারত না, নিজের বীরত্বের কাহিনি সে বলে বেড়াত বুক ফুলিয়ে। জোড়া খুনের ব্যাপারটাও সে চেপে রাখতে পারল না বা চাইল না–সগর্বে সে জানিয়ে দিল জন টিউকসবেরি ও বিল জ্যাকবকে সে নিজের হাতে গুলি করে মেরেছে।
হলব্রুক শহরের মার্শাল লোকমুখে ব্যাপারটা জানতে পারলেন। মার্শাল মহাশয় জানতেন অ্যান্ডিকে গ্রেপ্তার করতে গেলে সে সুবোধ বালকের মতো ধরা দিতে রাজি হবে না এবং তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসবে উদ্যত রিভলভার নিয়ে ব্লেন্স পরিবারের চার ভাই–গরম গরম গুলির ঝড়ে প্রাণ বিপন্ন করে আইনরক্ষার আগ্রহ দেখালেন না মার্শাল, সব জেনেশুনেও তিনি চুপ করে রইলেন।
সকলেই ভাবল ব্যাপারটা এখানেই চুকে গেল। কিন্তু তা হল না, আইন রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে শহরে প্রবেশ করল অশ্বারোহী নূতন শেরিফ–কমোডোর ওয়েন্স।
নবাগত শেরিফের কয়েকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ছিল। তার কোমরের বাঁ-দিকে খাপে-আটকানো রিভলভারের বাঁট ছিল সামনের দিকে ফেরানো অর্থাৎ অস্ত্রটা হস্তগত করতে হলে তাকে নিজের শরীরের ওপর দিয়ে হাত চালাতে হবে। ওইভাবে খাপের রিভলভার বার করতে গেলে যথেষ্ট দেরি হয়, সকলেই জানে সঙিন মুহূর্তে বিদ্যুৎবেগে রিভলভার হস্তগত করে গুলি চালাতে না-পারলে প্রতিপক্ষের গুলিতে রিভলভারধারীর মৃত্যু অনিবার্য অতএব, বন্দুকবাজ মানুষ মাত্রেই কোমরের ডান দিকে রিভলভার রাখে এবং অস্ত্রের বাঁট থাকে পিছনদিকে ফেরানো, কারণ, ওই অবস্থায় রিভলভারটাকে চটপট টেনে খাপ থেকে বার করা যায়।
সুতরাং কোমরের বাঁ দিকে সামনের-দিকে-ফেরানো রিভলভারের বাঁট নিয়ে কমোেডোর ওয়েন্স নামে নূতন শেরিফ যখন গুন্ডার রাজত্ব হলব্রুক শহরে প্রবেশ করল, তখন তাকে দেখে শহরবাসীর মুখে মুখে ফুটল বিদ্রুপের হাসি।
ওয়েন্সের চেহারাও আদর্শ আইনরক্ষকের মতো ছিল না। দাঙ্গাহাঙ্গামায় অভ্যস্ত পাকা বন্দুকবাজ মানুষের মুখে-চোখে যে রুক্ষ কাঠিন্যের আভাস থাকে, গোঁফ-দাড়ি-কামানো ওয়েন্সের পরিচ্ছন্ন মুখে সেই ধরনের অভিব্যক্তি অনুপস্থিত। উপরন্তু মস্ত বড়ো টুপির তলা থেকে লম্বা লম্বা সোনালি চুল ঘাড় অবধি নেমে এসে তার চেহারাটাকে করে তুলেছে শৌখিন ভদ্রলোকের মতো।
তবে হ্যাঁ, তার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল লোকটি পাকা ঘোড়সওয়ার। ঘোড়ার পিঠে জিনের সঙ্গে ওয়েন্সের পায়ের ফাঁকে ঝুলছিল একটি উইনচেস্টার রাইফেল।
হঠাৎ হলব্রুক শহরে শেরিফ হয়ে এই মানুষটি কেন প্রবেশ করল সে-কথা জানতে হলে কমোডোর ওয়েন্স সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা দরকার। কমোডোর ওয়েন্স এসেছিল টেক্সাস অঞ্চলে একপাল গোরুর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য। একটি র্যাঞ্চ বা গোশালার বেতনভোগী পরিচালক ছিল সে। সেই সময় তার বয়স ছিল ৩৫, নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ওয়েন্স ছিল সম্মানিত ব্যক্তি।