পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা কাঠ কেটে আর শিকার করে জীবিকানির্বাহ করত। তারা পায়ে হেঁটে চলত, দুহাত দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে ধরতে তাদের অসুবিধা ছিল না। অধিকাংশ সময়েই দূর থেকে গুলি চালিয়ে তারা বন্য পশুকে বধ করত, তাই দূরপাল্লার শক্তিশালী রাইফেল ছিল তাদের প্রিয় অস্ত্র।
অপরপক্ষে পশ্চিমের সমভূমির মানুষ পশুপালনকেই জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং গৃহপালিত গোরুর পালের রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য তারা সর্বদাই ঘোড়ার পিঠে চেপে চলাচল করত। একহাতে লাগাম ধরে আর একহাত দিয়ে রাইফেল চালাতে অসুবিধা হয় বলেই পশ্চিম আমেরিকার মানুষ রাইফেলের চাইতে রিভলভারকেই প্রাধান্য দিয়েছিল।
শিকারের পক্ষে রাইফেল অবশ্য প্রয়োজনীয়। রিভলভার মানুষ খুনের অস্ত্র, খুনির আদর্শ আয়ুধ! পশ্চিম আমেরিকার অধিবাসীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে বুঝে নিল ঘোড়ার পিঠেই হোক আর মাটিতে দাঁড়িয়েই হোক, মানুষ মারার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার হচ্ছে রিভলভার। পশ্চিম আমেরিকার বাসিন্দাদের মধ্যে খুনোখুনি ছিল খুবই সাধারণ ব্যাপার। কলহরত যোদ্ধাদের মধ্যে দূরত্ব থাকত বারো থেকে চবিশ হাতের মধ্যে অত কাছ থেকে বন্দুকবাজ মানুষের পক্ষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া অসম্ভব, কাজেই যে-ব্যক্তি প্রতিপক্ষের আগেই খাপ থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে গুলি চালাতে পারত সে-ই হত জয়ী। অর্থাৎ আঙুল এবং কবজির ক্ষিপ্র সঞ্চালনের উপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করত অধিকাংশ সময়ে।
ক্রমাগত অভ্যাসের ফলে কয়েকটি মানুষ ওই ক্ষুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রে এমন সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিল যে, পলকের মধ্যে রিভলভার কোষমুক্ত করে তারা লক্ষ্য ভেদ করতে পারত অব্যর্থ সন্ধানে ক্রুদ্ধ কেউটের ছোবল মারার মতোই ছিল তাদের হাত চালানোর কায়দা; যেমন ক্ষিপ্র, প্রাণঘাতী নিশানায় তেমনই নির্ভুল নিষ্ঠুর।
সুতরাং গৃহযুদ্ধের পরে পশ্চিম আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে শুরু হল রিভলভারের জয়যাত্রা–ভোজনশালায়, খনি শ্রমিকের তাবুতে তাঁবুতে, পশুপালনের কেন্দ্রস্থলে এবং শহরে শহরে জাগল রিভলভারের কর্কশ গর্জনধ্বনি–দুর্ধর্ষ রেড ইন্ডিয়ানদের বার বার হটিয়ে দিয়ে সাদা মানুষের অধিকারভুক্ত সীমারেখা বাড়িয়ে দিল মৃত্যুবর্ষী রিভলভার, কিন্তু ওই ক্ষুদ্র অস্ত্রটির মহিমায় আইনশৃঙ্খলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল পশ্চিম আমেরিকার বুকে।
দাঙ্গাকারী ও আইন রক্ষকদের সেই সময়ে রিভলভারের আদর ছিল রাইফেলের চাইতে অনেক বেশি। রাইফেল দ্রুতবেগে অগ্নিবর্ষণে, অসমর্থ, মন্থর। রিভলভার ক্ষিপ্রগামী মৃত্যুর যন্ত্রদূত, হত্যাকারীর হাতে অমোঘ হাতিয়ার।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, পশ্চিম আমেরাির ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত আগ্নেয়াস্ত্রের লড়াইতে চার-চারটি রিভলভারের গর্জিত মহিমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল একটি মাত্র রাইফেল।
১৮৮৭ সালে, সেপ্টেম্বর মাসে ৪ তারিখে আরিজোনার হলব্রুক শহরে যে রক্তাক্ত যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তার বিবরণ দেওয়ার আগে পূর্বোক্ত হলব্রুক শহর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা দরকার।
চারদিকে বালি আর বালি, দক্ষিণে বালুকাসমুদ্রের বুকে সারিবদ্ধ পাহাড়। পাহাড়ের সারির মধ্যে অবস্থান করছে অ্যাপাচি নামক দুর্ধর্ষ রেড-ইন্ডিয়ান জাতি–ওই মরু ও পর্বতবেষ্টিত হলব্রুক এক ক্ষুদ্র শহর। কিন্তু আকারে ছোটো হলেও একটি কারণে হলব্রুক শহরের কিছু গুরুত্ব ছিল শহরের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছিল সান্টা ফি রেল এবং ওই রেলপথ ছিল ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বড়ো বড়ো র্যাঞ্চ বা গোশালা থেকে গোরুর পাল আসত হলব্রুক শহরে এবং সেখানেই বেচাকেনা চলত।
হলব্রুক আকারে ক্ষুদ্র, প্রকৃতিতে ভয়ংকর। শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোকদের পক্ষে ওই শহরটি মোটেই আদর্শ স্থান ছিল না। ওই শহরে যারা ঘেরাফেরা করত তাদের কোমরে চামড়ার খাপে ঝুলত গুলিভরা রিভলভার এবং দেয়ালের মতো নিরেট কোনো বস্তুতে পিঠ না-লাগিয়ে তারা কেউ বসত না। কারণ, অতর্কিতে পিছন থেকে গুলি খাওয়ার ভয়ানক সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা সকলেই ছিল বিলক্ষণ সচেতন। কিন্তু পূর্বোক্ত ভয়ানক ভদ্রলোকরাও একটি মানুষকে সভয়ে এড়িয়ে চলত মানুষটির নাম অ্যান্ডি কুপার।
লোকটির নাম অ্যান্ডি কুপার কি অ্যান্ড ব্লেভান্স সে-বিষয়ে কিছু মতবিরোধ ছিল। অনেকের মতে অ্যান্ডি হচ্ছে ব্লেভান্স গোষ্ঠীর মানুষ, তবে ব্লেভান্স ভাইদের সভাই। অনেকের মত আবার অন্যরকম। তবে এ-বিষয়ে যে-গল্পটা সবচেয়ে প্রচলিত, সেটি হচ্ছে অ্যান্ডি ব্লেভান্স নামক মানুষটিকে টেক্সাস অঞ্চলের এক দুর্দান্ত শেরিফ খুনের অপরাধে গ্রেপ্তার করতে সচেষ্ট হয়– পূর্বোক্ত শেরিফ নাকি লক্ষ্য ভেদে সিদ্ধহস্ত এবং অপরাধীর সাক্ষাৎ পেলেই সে প্রথমে গুলি চালায়, পরে প্রশ্ন করে। এহেন শেরিফের কবল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই টেক্সাস থেকে পলাতক অ্যান্ডি ব্লেভান্স নাকি নাম বদলে অ্যান্ডি কুপার হয়ে গেছে।
সে যাই হোক, অ্যান্ডি কুপার বা অ্যান্ডি ব্লেভান্স ছিল ভয়ানক ব্যক্তি। কুখ্যাত ব্লেভান্স পরিবারের সে ছিল নেতা। ওই পরিবারের সব মানুষই ছিল রিভলভার চালনায় সিদ্ধহস্ত। ভয়ংকর ঘটনার পর ঘটনার স্রোতে রচিত হয়েছিল ব্লেভান্স পরিবারের রক্তাক্ত ইতিহাস।