ইংল্যান্ডের ওয়েস্টমিনিস্টার নামক স্থানে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের সামনে পূর্বোক্ত দ্বৈরথ সংঘটিত হয়। প্রচলিত রীতি অনুসারে বিপরীত দুই দিক থেকে সবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে এসে দুই যোদ্ধা শূল হাতে পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। কিন্তু প্রথম সংঘর্ষেই শূল দুটি গেল ভেঙে এবং যোদ্ধারাও আঘাতের বেগ সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লেন মাটির উপর। উভয় যোদ্ধারই দেহ ছিল লৌহবর্মে আবৃত, শূলের ফলক ওই বর্ম ভেদ করতে পারেনি; কিন্তু প্রচণ্ড আঘাতে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে পদাতিকে পরিণত করে দিয়েছিল। অশ্বারোহীর পদ থেকে পদাতিক যোদ্ধার অবনত স্থানে নেমে আসলেও যোদ্ধাদের উৎসাহ একটুও কমেনি, কোষ থেকে তরবারি টেনে নিয়ে দুই বীর আবার রণরঙ্গে মেতে উঠলেন। তলোয়ারের খেলায় দুই পক্ষই সিদ্ধহস্ত, সংঘাতে সংঘাতে তীব্র ঝংকার-ধ্বনি তুলে ঝকমক জ্বলতে লাগল দুটি ঘূর্ণমান তরবারি কিন্তু যুযুধানরা কেউ সুবিধা করতে পারলেন না। অবশেষে হঠাৎ প্রচণ্ড সংঘর্ষে দু-খানা তলোয়ারই ভেঙে গেল। তলোয়ার ভাঙল, কিন্তু যুদ্ধ থামল না। লৌহ-দস্তানায় আবৃত বজ্রমুষ্টি তুলে দুই যুযুধান পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। দুজনেরই সর্বাঙ্গ ছিল লৌহবর্মে ঢাকা, কিন্তু দূরদর্শী ফরাসি বীর যুদ্ধের বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন; তার ডান হাতের দস্তানার বহির্ভাগে বসিয়ে দিয়েছিলেন ধারালো লোহার কাটা। তীক্ষ্ণ কণ্টক-সজ্জিত সেই লৌহময় বজ্রমুষ্টির প্রহার যখন স্যার ভিকঁতের মুখের উপর বৃষ্টিধারার মতো পড়তে লাগল, তখন তিনি পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। মুখের লৌহ-আবরণ ভিকঁৎকে ওই ভয়াবহ দস্তানার বজ্রমুষ্টি থেকে বাঁচাতে পারল না। পরাজিত ভিকঁৎ হলেন ফরাসি বীর টমাসের বন্দি। এসব ক্ষেত্রে বিজয়ী যোদ্ধারা পরাজিত বন্দির কাছ থেকে মোটারকম মুক্তিপণ দাবি করতেন এবং ওই অর্থ না-পেলে বন্দিকে মুক্তি দিতেন না। কিন্তু স্যার দ্যা লা মার্চে কোনো মুক্তিপণ দাবি না-করেই উদারভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন।
স্যার ডেভিড লিন্ডসে ও জন ওয়েলস
১৯৩০ সালে এক ভোজসভায় স্কটল্যান্ডের নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসে এবং ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ক্রুদ্ধ বাদানুবাদ শুরু হয়। ইংরেজ ও স্কচদের মধ্যে কারা অধিকতর বীরত্ব ও সাহসের অধিকারী এই ছিল তাদের তর্কের বস্তু।
হাত থাকতে মুখ কেন? এই নীতি অবলম্বন করলেন ইংরেজ জন ওয়েলস; প্রতিপক্ষকে তিনি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন।
লন্ডন ব্রিজ নামে সেতুর ওপর রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সামনে দুই যোদ্ধা দ্বৈরথরণে ব্যাপৃত হলেন অশ্বপৃষ্ঠে।
কিছুক্ষণ লড়াই চলার পর ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস প্রতিদ্বন্দ্বীর শূলের আঘাতে আহত হয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়লেন মাটির উপর। স্কটল্যান্ডের নাইট তখন ঘোড়া থেকে নেমে পদব্রজে অগ্রসর হলেন ভূপতিত শত্রুর দিকে।
জনতা উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। এখনই প্রচণ্ড আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন জন ওয়েলস। কিন্তু না, চরম আঘাত পড়ল না। স্কচ নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসে শত্রুর শিরস্ত্রাণ খুলে শুশ্রূষা শুরু করলেন। অকুস্থলে চিকিৎসকের আগমন না হওয়া পর্যন্ত তিনি শত্রুর পরিচরর্যা থেকে বিরত হননি।
পূর্বোক্ত ঘটনার পরে ইংল্যান্ডের লর্ড জন ওয়েলস ও স্কচ নাইট স্যার ডেভিড লিন্ডসের মধ্যে দৃঢ় বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়। পরবর্তী জীবনে তারা কখনো ইংরেজ ও স্কচদের সাহস কিংবা বীরত্ব নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেননি।
হিউজ গ্লাস ও গ্রিজলি ভাল্লুক
ইতিহাসে যেসব দ্বন্দ্বযুদ্ধের ঘটনা পাওয়া যায়, সেইসব ঘটনার নায়করা যে সবসময় যুদ্ধের রীতি নীতি পালন করেছে এ-কথা বলা যায় না। কারণ মানুষের বিরুদ্ধে মানুষই যে সব সময় দ্বৈরথ রণে অবতীর্ণ হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। পশু ও মানুষের দ্বন্দ্বযুদ্ধও ইতিহাসে খ্যাতি লাভ করেছে একাধিকবার। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে হিউজ গ্লাস নামক এক বিখ্যাত সীমান্তরক্ষী ও অভিযাত্রী আমেরিকার রকি মাউন্টেন অঞ্চলে এক বিশালকায় গ্রিজলি ভাল্লুকের সম্মুখীন হয়েছিল। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বিরাট ওই ভাল্লুক ছিল নয় ফুট লম্বা। হিউজ তার বন্দুক ব্যবহার করার চেষ্টা করল। গুলি লাগতেই ভাল্লুকটা খেপে গিয়ে তেড়ে এল হিউজের দিকে। দ্বিতীয়বার গুলি চালানোর আগেই প্রকাণ্ড এক থাবার আঘাতে হিউজের বন্দুকটা দূরে ছিটকে পড়ল এবং ভাল্লুকের পরবর্তী চপেটাঘাত হিউজকে করল ধরাশায়ী। রক্তাক্ত ও অবসন্ন দেহ নিয়ে হিউজ টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। তারপর কোমর থেকে শানিত ছুরিকা কোষমুক্ত করে চতুম্পদ প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বার বার ছুরিকাঘাত করে হিউজ তার শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভাল্লুকটা তাকে এমন ভীষণভাবে জড়িয়ে ধরেছিল যে, হিউজের মনে হচ্ছিল তার শরীরের হাড়গুলি বুঝি এখনই ভেঙে যাবে।
দেহের শেষ শক্তি জড়ো করে প্রাণপণে ছুরি চালাতে লাগল হিউজ…
হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল ভাল্লুকের ভয়াবহ আলিঙ্গন, ধীরে ধীরে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল শ্বাপদের প্রাণহীন দেহ। হিউজ যুদ্ধে জয়ী হল বটে, কিন্তু ভাল্লুকের নখদন্ত তাকে প্রায় মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল। শরীরের মারাত্মক ক্ষতগুলি নিরাময় হতে বেশ সময় লেগেছিল; দীর্ঘ কয়েক মাস যন্ত্রণা ভোগ করার পর সুস্থ হয়ে উঠেছিল হিউজ গ্লাস।