ঝোপজঙ্গলের বাধা ঠেলে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল রে-র ঘোড়া, সঙ্গেসঙ্গে ২৫ গজ দূরে আত্মপ্রকাশ করল পলাতক গ্রিজলি।
প্রকাণ্ড ভাল্লুকটাকে দেখে ঘাবড়ে গেল রে-র ঘোড়া, সে হঠাৎ পিছনের দুটি পায়ে খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল। রাইফেল বাগিয়ে ধরার চেষ্টা করছিল রে, কিন্তু তার চতুষ্পদ বাহন আচম্বিতে দ্বিপদ জীবে পরিণত হওয়ার ফলে ভারসাম্য হারিয়ে রে লম্বমান হল মাটির উপর এবং উইনচেস্টার রাইফেলটাও ছিটকে পড়ল হস্তচ্যুত হয়ে।
মাটিতে শুয়েই সে ভাল্লুকটাকে দেখতে পেল। তার সামনে প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে রক্তাক্ত শ্বাপদ জন্তুটার পাঁজরের ওপর হাঁ করে রয়েছে একটা মস্ত ক্ষতচিহ্ন, আর সেখান থেকে ঝরঝর ঝরছে লাল রক্তের ধারা। রে বুঝল আজ তার রক্ষা নেই, ছিটকে পড়া রাইফেলটাকে উদ্ধার করার সময় আর পাওয়া যাবে না।
তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুর জীবন্ত পরোয়ানা!
মুহূর্তের জন্য রে-র মানসপটে ভেসে উঠল জেসুসিতার মুখ, তারপরেই বুকের উপর গুরুভার বস্তুর প্রচণ্ড চাপে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার যাতনাদায়ক অনুভূতি, পরক্ষণেই তার চেতনাকে লুপ্ত করে নামল মূৰ্ছার অন্ধকার…
জ্ঞান ফিরে পেয়ে রে দেখল তার ভূপতিত দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কালো আর ফ্রেড এবং তার বাঁ-হাত জড়িয়ে অবস্থান করছে ছেঁড়া কাপড়ের একটা রক্তাক্ত আবরণ। অনাবৃত ঊর্ধ্ব-অঙ্গের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল তার শার্ট ছিঁড়ে ক্ষতবিক্ষত, বাঁ-হাতটাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে তার দুই সঙ্গী।
তোমার হাতটা ভীষণ জখম হয়েছে, ফ্রেড বলল, তবে শরীরের অন্য কোথাও আঘাত লাগেনি।
তোমরা ঠিক সময়েই এসে পড়েছ, রে-র কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার আভাস।
সঙ্গীদের সাহায্যে ধরাশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াল রে। এবার ভূপতিত গ্রিজলির মৃতদেহটা তার দৃষ্টিগোচর হল। রে দেখল ভাল্লুকের ঘাড়টা মুচড়ে প্রকাণ্ড মাথাটা বেঁকে গেছে একদিকে এবং তার কণ্ঠদেশ বিদীর্ণ করে জেগে উঠছে একটা সুদীর্ঘ ক্ষতচিহ্ন। রে অবাক হয়ে ভাবতে লাগল এমন অদ্ভুত ক্ষতরেখার উৎপত্তি হল কেমন করে–রাইফেলের বুলেট তো এমন অদ্ভুতভাবে গলা কেটে ফেলতে পারে না!
রে প্রশ্ন করল, জেসুসিতা কোথায়?
শোন সিনর, গভীর বিষণ্ণ কণ্ঠে কালো বলল, আমি আর জেসুসিতা একইসঙ্গে বেরিয়েছিলাম বটে, কিন্তু একটু পরেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে মেয়েটি তোমাকে অনুসরণ করেছিল। শিকারির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বোধ হয় আসন্ন বিপদের আভাস পেয়েছিল মেয়েটি আমার সঙ্গে যাত্রা করলেও একটু পরে আমাকে ছেড়ে সে তোমার পিছু নিয়েছিল। ভাল্লুক যখন তোমাকে আক্রমণ করে, সেই সময় সে বন্দুক ব্যবহার করতে সাহস পায়নি। কারণ তোমরা এত কাছাকাছি ছিলে যে গুলি চালালে তোমার প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল। বন্দুক ফেলে ছুরি হাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাল্লুকের ওপর।
এইবার কার্লোর পাশে মাটির ওপর শায়িত প্রাণহীন দেহটাকে দেখতে পেল রে–ঘোড়ার জিন থেকে একটা কম্বল নিয়ে মৃতদেহের ওপর আবরণ টেনে দেওয়া হয়েছে, মরণঘুমে ঘুমিয়ে আছে মেক্সিকো-সুন্দরী সিনোরিতা জেসুসিতা লোপেজ।
সেট বাটলার ও মি. পিটার বারোজ
১৮০০ সালে কিলকেনি ফ্রেল্যান্ড নামক স্থানের নিকটবর্তী এক উন্মুক্ত প্রান্তরে পিস্তল নিয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলেন দুটি ভদ্রলোক। ওই ভদ্রলোক দুটির নাম অনারেবল সমারসেট বাটলার ও মি. পিটার বারোজ। শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন ব্যারিস্টার। তবে বাটলার সাহেবের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে তিনি আদালতের আশ্রয় না-নিয়ে পিস্তলের সাহায্য গ্রহণ করেছিলেন–অতএব দ্বন্দ্বযুদ্ধ। মধ্যস্থের নির্দেশ পাওয়ামাত্রই যোদ্ধাদের পিস্তল গর্জে উঠল। বারোজ সাহেব ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী বাটলার অক্ষত দেহ নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন অতি দ্রুত বেগে।
একজন চিকিৎসক তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ধরাশায়ী বারোজকে পরীক্ষা করে বললেন আহত ব্যক্তির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বহির্গত হবে প্রাণবায়ু। কয়েক মিনিট তো দূরের কথা, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আহত বারোজ আর্তনাদ করলেন, তবু অনিবার্য মৃত্যুর কোনো লক্ষণই তার দেহে দেখা দিল না। বিস্মিত চিকিৎসক আবার ভালো করে পরীক্ষা শুরু করলেন এবং মরণোন্মুখ বারোজ সাহেবের ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একগাদা বাদামের সঙ্গে মারাত্মক গুলিটাকেও বার করে ফেললেন। চিকিৎসক বুঝলেন পকেটস্থ গাদা গাদা বাদাম আর একটি রৌপ্যমুদ্রার সংঘর্ষে পিস্তলের গুলির শক্তি কমে গিয়েছিল–বুলেট সজোরে আঘাত করে বারোজকে ফেলে দিয়েছিল বটে, কিন্তু বাদাম আর রৌপ্যমুদ্রার কাঠিন্য ভেদ করে বারোজকে জখম করতে পারেনি। বারোজ যখন চিকিৎসকের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত শুনলেন এবং জানলেন এখন আর তিনি মরছেন না, তখন ভারি আশ্চর্য হয়ে তিনি আর্তনাদ থামিয়ে ফেললেন এবং এক লাফে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গেসঙ্গে তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল নিকটবর্তী চিকিৎসক ও মধ্যস্থের প্রবল অট্টহাসি। মি. পিটার বারোজের কর্ণমূল হল রক্তবর্ণ, চটপট পা চালিয়ে তিনি অকুস্থল ছেড়ে প্রস্থান করলেন দ্রুত বেগে।
স্যার টমাস দ্য লা মার্চে ও স্যার জন দ্য ভিকঁৎ
১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে স্যার টমাস দ্য লা মার্চে নামক একজন ফরাসি নাইট স্যার জন দ্য ভিকঁৎ নামে জনৈক সম্ভ্রান্ত সাইপ্রিয়টের অধিবাসীকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। একদল খ্রিস্টান সৈন্য তুর্কিদের হাতে বিপন্ন হয়েছিল এবং স্যার টমাসের মতে ওই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী স্যার জন দ্য ভিকৎ। অভিযোগ শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ভিকঁৎ তার হাতের লৌহ-দস্তানা খুলে টমাসের সামনে ফেলে দিলেন। তখনকার দিনে ওইভাবেই একজন আর একজনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করত–অতএব টমাস ও জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়ে পড়ল অবধারিত।