গুলিটা চমৎকার চালিয়েছে, মন্তব্য করল জেসুসিতা।
সঙ্গিনীর সামনে নিজের দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরে মনে মনে খুশি হয়ে উঠল রে। সঙ্গে সঙ্গে তার এ-কথাও মনে হল যে, লক্ষ্য ব্যর্থ হলে লজ্জার সীমা থাকত না।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে শিকারির দল তাবু ফেলল। পরের দিন সকালে আবার যাত্রা শুরু। রাত্রের দিকে একটা পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল সবাই। কার্লো জানাল এই জায়গাটা স্থায়ীভাবে তাঁবু খাটানোর পক্ষে অত্যন্ত উপযুক্ত। অতএব, সেখানেই তাঁবু পড়ল।
পরের দিন সকাল থেকেই শিকার অভিযান শুরু হল। শিকারের সঙ্গী হিসাবে ফ্রেড পছন্দ করল কার্লোর সান্নিধ্য, আর একদিকের জুটি হল মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতা লোপেজ এবং রে বেনেট। পর পর তিনদিন ধরে চলল শিকার-পর্ব। জেসুসিতা আর রে-র গুলিতে প্রাণ হারাল অনেকগুলি হরিণ আর পুমা, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুকের দেখা পাওয়া গেল না। আরও দুটো দিন কাটল। ভাল্লুকদের মধ্যে কেউ শিকারিদের সঙ্গে দেখা করতে এল না। ফলে রে-র মেজাজ হয়ে উঠল উত্তপ্ত। মেজাজের দোষ নেই, গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করার জন্যই উত্তর আমেরিকার পার্বত্য অঞ্চলে হানা দিয়েছিল রে বেনেট। আফ্রিকার জঙ্গলে সিংহ শিকার করেও তৃপ্ত হয়নি সে, মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর জীব গ্রিজলি ভাল্লুকের সঙ্গে রাইফেল হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে চেয়েছিল শিকারি রে বেনেট। পর পর পাঁচদিন ঘুরেও ভাল্লুকের সাক্ষাৎ না-পেয়ে সে বিরক্ত হয়ে উঠল, মনে হল জেসুসিতা লোপেজ নামে মেয়েটিকে ভাল্লুক শিকারের গাইড হিসাবে নিযুক্ত করে সে ভুল করেছে। সে ভাবতে লাগল, সুন্দরীর বন্দুকের টিপ ভালো বটে, কিন্তু ভাল্লুকের সন্ধান বলে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা তার নেই। কার্লোর কথায় মেয়েটির ওপর এতটা নির্ভর করা উচিত হয়নি।
জেসুসিতার মেজাজও ভালো ছিল না, কথায় কথায় হঠাৎ দুজনের মধ্যে তর্ক বাধল। ফলে তপ্ত বাক্যস্রোত ছুটল এবং পরের দিন যখন শিকারির অভিযান শুরু হল তখন দেখা গেল জুটি বদল হয়েছে কালোর সঙ্গে জুটেছে জেসুসিতা, ফ্রেডের সঙ্গী হয়েছে রে বেনেট।
এখানে গল্প বলা থামিয়ে গ্রিজলি ভাল্লুক সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলছি। ওই জন্তুটির স্বভাব-চরিত্র এবং দৈহিক-শক্তির বিষয়ে যেসব পাঠক অবহিত নন, তাদের পক্ষে পরবর্তী ঘটনার ভয়াবহতা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়–সেইজন্যই গল্প থামিয়ে বর্তমান প্রসঙ্গের অবতারণা।
গ্রিজলি ভাল্লুকের দেহের ওজন বাঘ অথবা সিংহের চাইতে অনেক বেশি। বাঘ-সিংহের মতো চটপটে না হলেও ক্ষিপ্রতার অভাব গ্রিজলি পুষিয়ে নিয়েছে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে। ভারতীয় বাঘ এবং আফ্রিকার সিংহ কখনো দলবদ্ধ বন্য মহিষের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস করে না, কিন্তু গ্রিজলি ভাল্লুক বাইসনের পালে হানা দিয়ে শিকার সংগ্রহ করেছে এমন ঘটনা খুব বিরল নয়। জীবতত্ত্ববিদের মতে গ্রিজলি ভাল্লুক হচ্ছে মাংসাশী পশুদের মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র, সবচেয়ে শক্তিশালী জীব। ভারতীয় ভাল্লুক কখনো কখনো মৃত পশুর মাংস ভক্ষণ করে বটে, কিন্তু জীবিত প্রাণী শিকার করে উদর পূরণের চেষ্টা সে করে না–ফলমূল, মধু প্রভৃতি নিরামিষ খাদ্যেই সে জীবনধারণ করতে অভ্যস্ত। নিরামিষে গ্রিজলির আপত্তি নেই, তবে শিকারের তপ্ত রক্তমাংসই তার প্রধান খাদ্য। পূর্বোক্ত ভয়ংকর জীবটিকে শিকার করার জন্যই ওই অঞ্চলে পদার্পণ করেছে রে আর ফ্রেড, বর্তমান কাহিনির জন্মও সেই কারণে।
হ্যাঁ, ফেলে-আসা গল্পটাকে এবার আমরা আবার শুরু করতে পারি। আগেই বলেছি মন-কষাকষির ফলে রে আর জেসুসিতার জুটি বদল হয়েছে শিকার অভিযানের ষষ্ঠ দিনে রে-র সঙ্গী ফ্রেড, মেক্সিকো-সুন্দরী জেসুসিতার সঙ্গ নিল কার্লো। সকলেই যাত্রা করেছিল অশ্বপৃষ্ঠে।
একটা পাহাড়ের ওপর নাটকীয় সাক্ষাৎকার! তলা থেকে পাহাড় বেয়ে উঠছে দুই বন্ধু, এমন সময়ে আচম্বিতে কোথা থেকে তাদের সামনে আবির্ভূত হল বিপুলবপু এক গ্রিজলি ভাল্লুক। মুহূর্তের দৃষ্টি বিনিময়, পরক্ষণেই পাহাড়ের গায়ে সারি সারি গাছের ফাঁকে শ্বাপদের দ্রুত অন্তর্ধান।
বন্ধুকে তলা দিয়ে ঘোড়া চালাতে বলে পাহাড়ের উপরদিকে অশ্বপৃষ্ঠে অগ্রসর হল রে। এক মাইলের প্রায় এক চতুর্থাংশ যখন পার হয়ে এসেছে রে-র ঘোড়া, সেই সময় হঠাৎ রে শুনতে পেল রাইফেলের আওয়াজ।
আওয়াজটা এসেছে তলা থেকে, অতএব শব্দের উৎসস্থল যে বন্ধুবর ফ্রেডের রাইফেল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। ঘোড়ার লাগাম টেনে স্থির হয়ে দাঁড়াল রে, তারপর কান পেতে অপেক্ষা করতে লাগল নূতন শব্দতরঙ্গের জন্য
শব্দ এল, রাইফেলের যান্ত্রিক কণ্ঠ নয়–মনুষ্যকণ্ঠে চিৎকার। ফ্রেডের কণ্ঠস্বর বুঝতে পারল রে, কিন্তু দূর থেকে বন্ধুর বক্তব্য বুঝতে পারল না সে। আহত ভাল্লুক যদি চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে, তবে নিশ্চয়ই আর একবার রাইফেলের আওয়াজ শোনা যাবে আর শ্বাপদ যদি নিহত হয়, তবে পর পর তিনবার শোনা যাবে রাইফেলের শব্দ, এই ব্যবস্থাই ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে। এখন একবারের বেশি রাইফেলের আওয়াজ শোনা গেল না, তাই রে বুঝল গ্রিজলি ফ্রেডকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। রাইফেলের শব্দটা এসেছে বাঁ-দিক থেকে, অতএব সেই দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল রে।