কার্লো একটি মৃদু আদরের থাপ্পড় বসাল মেয়েটির কাঁধে : তার সঙ্গে আপনাদের দেখা হয়েছে, সিনর। এই অঞ্চলের সেরা গাইড হচ্ছে জেসুসিতা। পায়ের ছাপ ধরে যারা ভাল্লুকের সন্ধান বলে দিতে পারে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ওস্তাদ হল এই মেয়েটি।
কার্লোর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল ফ্রেড এবং রে। দুজনেই বোকার মতো তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। জেসুসিতা এবার হেসে উঠল, তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে সকলের কাছে নিয়ে স্থান ত্যাগ করল।
দুই চোখে আগুন জ্বালিয়ে কার্লোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রে : কালো! তুমি কি ইয়ার্কি মারছ আমাদের সঙ্গে?
না সিনর, না, দ্রুতবেগে হাত নাড়তে নাড়তে কার্লো জবাব দিল, আমি সত্যি কথাই বলছি। ওই মেয়েটির বাবা ছিল মস্ত বড়ো শিকারি। আপনারা ভাল্লুক চাইছেন। ও ভাল্লুকের সন্ধান দিতে পারবে।
দেখ কার্লো, অনেক তোড়জোড় করে আমরা গ্রিজলি ভাল্লুক শিকার করতে এসেছি, রে তার মেক্সিকান অনুচরকে সাবধান করে দিল :যদি তুমি আমাদের সঙ্গে রসিকতার চেষ্টা কর, তাহলে
কার্লো জানাল সিনরদের সে ঠাট্টার পাত্র মনে করে না। মেয়ে বলে সিনররা হয়তো জেসুসিতাকে অবজ্ঞা করছেন, কিন্তু এই অঞ্চলের অধিবাসীরা জানে মেয়ে হলেও ভাল্লুক শিকারের পক্ষে জেসুসিতা হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত গাইড। বাপ ছিল মস্ত শিকারি। বাপের কাছেই শিকারের তালিম নিয়েছে মেয়ে।
জাগুয়ারের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে জেসুসিতার বাপ। বাবার মৃত্যুর পর শিকার এবং পথপ্রদর্শকের পেশা গ্রহণ করেছে জেসুসিতা। উপযুক্ত তথ্য পরিবেশন করে কালো জানাল ওই মেয়েটিকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করা চলে, কোনোরকম গোলমাল বা ঝঞ্ঝাটের আশঙ্কা এক্ষেত্রে অমূলক। অনেক তর্কবিতর্কের পর অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই বন্ধু কালোর উপদেশ গ্রহণ করল, স্থির হল মেয়েটিকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখা যেতে পারে।
পরের দিন শহর থেকে একটু দূরে একটা গোলাবাড়ির কাছ থেকে জেসুসিতাকে তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে সকলে যাত্রা করল গ্রিজলি ভাল্লুকের সন্ধানে। তাদের গন্তব্যস্থল ছিল টেমেচিক প্রদেশের পশ্চিম দিকে অবস্থিত পাপাগচিক নদীর সন্নিহিত অঞ্চল।
দিনটা ভারি সুন্দর, সিনর, ইংরেজিতে বলল জেসুসিতা।
তার মুখে স্পষ্ট ইংরেজি শুনে দুই বন্ধু চমকে গেল। জেসুসিতা সবসময়েই কথা বলেছে। স্প্যানিশ ভাষায়, এই প্রথম তার মুখে ইংরেজি শুনল দুই বন্ধু। জেসুসিতার ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিও দেখার মতো। চলন্ত ঘোড়ার পিঠের ওপর এমন সহজভাবে সে বসে রয়েছে যে, মনে হয় তার দেহ অশ্বপৃষ্ঠে সংলগ্ন জিনেরই একটা অংশ মাত্র। জিনের সঙ্গে লাগানো আছে একটা কারবাইন (এক ধরনের বন্দুক), কটিবন্ধে ঝুলছে ছোরা; পরনে পুরুষের মতো শার্ট আর প্যান্ট, মুখের হাসিতে বেপরোয়া ঔদ্ধত্যের আভাস–দুই বন্ধু মনে মনে স্বীকার করল, হা একটা মেয়ের মতো মেয়ে বটে!
গল্প করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। জেসুসিতার কথায় জানা গেল বারো বছর বয়স থেকেই সে বাপের শিকার-সঙ্গিনী, এবং ওই সময়েই সে প্রথম জাগুয়ার শিকার করে। বাপই তাকে শিখিয়েছে পুমা, জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল-জাতীয় পশু এবং ভাল্লুকের পদচিহ্ন ধরে কেমন করে অনুসরণ করতে হয়। গাছের গায়ে নখের আঁচড় দেখে নখীর স্বরূপ নির্ণয় করার শিক্ষাও। সে গ্রহণ করেছে বাপের কাছেই। তারপর হঠাৎ একদিন জাগুয়ারের কবলে প্রাণ দিল জেসুসিতার বাবা।
রে তার আফ্রিকার অরণ্যে অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করল। হাতি, গণ্ডার, সিংহ প্রভৃতি হিংস্র জন্তু শিকারের রোমাঞ্চকর কাহিনি সাগ্রহে শুনতে লাগল জেসুসিতা। একটি আহত সিংহকে অনুসরণ করার ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিল রে; গল্পটা যখন খুব জমে উঠেছে, ঠিক তখনই হল ছন্দপতন ধাঁ করে জিনের গায়ে লাগানো বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিল জেসুসিতা।
পেকারি, চেঁচিয়ে উঠল ফ্রেড।
না, সিনর, সাধারণ বুনো শুয়োর, সংশোধন করে দিল জেসুসিতা।
মাথা নেড়ে তাকে সমর্থন জানাল কার্লো।
একটু জোরে ঘোড়া চালিয়ে এগিয়ে গিয়ে মৃত জন্তুটাকে কার্লো নিয়ে এল। মালবহনকারী ঘোড়াগুলির ভিতর একটির পিঠে শূকরের মৃতদেহ বেঁধে নিয়ে আবার এগিয়ে চলল শিকারির দল।
বন্দুকের শূন্য ঘরে একটা নতুন টোটা ভরে হাসল মেয়েটি, এবার বেশ মজা করে শুয়োরের মাংস খাওয়া যাবে, কি বলো?
রে অবাক হয়ে গিয়েছিল, বিস্মিত কণ্ঠে সে বললে, তোমার হাতের টিপ খুব ভালো।
না, টিপভালো নয়, তবে খুব তাড়াতাড়ি আমি গুলি চালাতে পারি, জেসুসিতাবলল, কোনো জানোয়ার কাছাকাছি থাকলে আমি বুঝতে পারি… আচ্ছা, এবার সেই সিংহের ব্যাপারটা বলো।
অসমাপ্ত কাহিনিটা এবার শেষ করার জন্য তাগাদা দিল সুন্দরী।
গল্পটা শেষ হতেই কার্লো জানাল মধ্যাহ্নভোজনের সময় হয়েছে।
…বিকালের দিকে পরস্পরের শিকারের অভিজ্ঞতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে তারা এগিয়ে চলল। মাঝে মাঝে গল্প থামিয়ে কার্লোকে পথের নির্দেশ দিচ্ছিল জেসুসিতা কোন পথে গেলে ভাল্লুকের সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানিয়ে দেওয়াই তো তার আসল কাজ, ওইজন্যই তাকে নিযুক্ত করেছে রে বেনেট। দূরবর্তী পর্বতমালার দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে তার বক্তব্য জানাচ্ছিল তরুণী গাইড।
সন্ধ্যার সময়ে একটা পাহাড়ের তলা দিয়ে ঘুরে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ রে-র চোখ পড়ল ওপরের দিকে, মনে হল পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একটা চলন্ত ছায়ামূর্তির যেন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কাঁধের রাইফেল হাতে নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, পাথরের আড়াল থেকে আবার দেখা দিল ছায়ামূর্তি, সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল রে-র হাতের রাইফেল। দূরত্ব ছিল প্রায় আড়াইশো গজের মতো, তবু লক্ষ্য ব্যর্থ হল না–ওপর থেকে গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের নীচে এসে পড়ল একটা পুমার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ।