জিম আত্মপরিচয় দিল না। ছোরা নিয়ে সে দ্বন্দ্বযুদ্ধের উদযোগ করল। লড়াই শুরু হল মেক্সিকান ডুয়েল নামক রীতি অনুসারে। তখনকার দিনে ছোরা হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধ লড়ার যেসব পদ্ধতি ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর মেক্সিকান ডুয়েল। আগে যোদ্ধাদের বাঁ-হাত দুটি শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয় এবং লড়াই শুরু করার নির্দেশ পাওয়ামাত্র খোলা ডান হাতে ছোরা নিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে আঘাত করতে থাকে নির্মমভাবে।
পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে লড়াই চলল কিছুক্ষণ ধরে। কয়েকবার নিজের ছোরা দিয়ে প্রতিপক্ষের আঘাত প্রতিহত করল জিম, তারপর হঠাৎ বিদ্যুদবেগে আঘাত হানল শত্রুর ডান হাতের উপর। শানিত ছুরিকা মুহূর্তের মধ্যে বেন স্টারডিভ্যান্টের দক্ষিণ হস্তে বিদ্ধ হল, দারুণ যাতনায় ছুরি খসে পড়ল স্টারডিভ্যান্টের হাত থেকে। জিমের হাতের ছোরা আবার ঝলসে উঠল, কিন্তু না প্রতিদ্বন্দ্বীর দেহে নয়–দুই যোদ্ধার বাঁ-হাত আটকে যে দড়ির বাঁধনটা শক্ত হয়ে বসেছিল সেই দড়িটাকেই দংশন করল জিমের অস্ত্র।
অসহায় বেনকে অনায়াসে হত্যা করতে পারত জিম, কিন্তু তা না-করে সে উদারভাবে শত্রুর হাতের দড়ি কেটে তাকে মুক্তি দিল।
জিমের সঙ্গে যারা ছোরা হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র বেন ছাড়া কোনো মানুষই পৃথিবীর আলো দেখার জন্য জীবিত ছিল না।
বেন স্টারডিভ্যান্ট ছিল ভাগ্যবান পুরুষ।
বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড ও রবার্ট মেনার্ড
সাত সাগরের বুকে জাহাজ ভাসিয়ে যেসব জলদস্যু ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তাক্ত করে তুলেছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর, হিংস্র ও ভয়ংকর মানুষ হচ্ছে বোম্বেটে-সর্দার এডওয়ার্ড টিচ ওরফে এডওয়ার্ড ব্ল্যাক বিয়ার্ড। সাধারণ মানুষের কথা তো ছেড়েই দিলাম, দুর্ধর্ষ জলদস্যুরাও তাদের দলপতি ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে যমের মতোই ভয় করত। ব্ল্যাক বিয়ার্ড তার দলকে পরিচালনা করত কঠোর হস্তে। ক্রুদ্ধ হলে তার হাতে শত্ৰুমিত্র কারুরই রক্ষা ছিল না। উক্ত বোম্বেটে-দলপতির দৈহিক শক্তি ছিল অসাধারণ। একটা জোয়ান মানুষকে সে মাথার ওপর তুলে ফেলতে পারত অনায়াসে। বছরের পর বছর ধরে সমুদ্রের ওপর সন্ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছিল বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড। তার অধীনে জলদস্যুরা বহু জাহাজ লুঠ করেছিল এবং ওইসব জাহাজের নাবিক ও যাত্রীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল ব্ল্যাক বিয়ার্ডের আদেশ অনুসারে। কোনো
একদিন রাজকীয় নৌবহরের দুটি জাহাজ বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ডের জাহাজকে আক্রমণ করল। উক্ত জাহাজ দুটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেনার্ড। প্রচণ্ড হট্টগোল ও মারামারির মধ্যেও মেনার্ডের সন্ধানী দৃষ্টি ব্ল্যাক বিয়ার্ডকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হল। তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে বোম্বেটে দলপতিকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানালেন অসিধারী মেনার্ড। বলাই বাহুল্য সেই আহ্বানে সাড়া দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনি বোম্বেটে ব্ল্যাক বিয়ার্ড। শুরু হল যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্ল্যাক বিয়ার্ড বুঝল এ-শত্রু সহজ নয়–সে আজ শক্ত পাল্লায় পড়েছে। একবার এগিয়ে, একবার পিছিয়ে এবং চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে লড়াই চলল। দুই যোদ্ধারই সর্বাঙ্গ হল ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত। অবশেষে সমুদ্রের দিকে সংঘটিত যাবতীয় দ্বন্দ্বযুদ্ধের জাহাজের রক্তরঞ্জিত পাটাতনের ওপর লুটিয়ে পড়ল মরণাহত ব্ল্যাক বিয়ার্ডের ঘৃণিত শরীর।
তখনকার দিনে প্রচলিত সূক্ষ্মাগ্র সোর্ড বা সোজা তলোয়ার নিয়ে লড়াইটা হয়নি–দ্বন্দ্বযুদ্ধটা হয়েছিল কাটলাস (cutlass) নামক বাঁকা তলোয়ার নিয়ে।
মসিয় দ্য গ্র্যান্ড প্রি ও মসিয় লে পিক
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিস নগরীর আকাশে এক আশ্চর্য দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে যোগদানকারী দুই যোদ্ধার নাম হচ্ছে যথাক্রমে মসিয় দ্য গ্র্যান্ড প্রি ও মসিহঁ লে পিক। কোনো কারণে পূর্বোক্ত দুই ভদ্রলোকের মধ্যে মতান্তর ঘটেছিল, যার ফলে তারা স্থির করলেন বেলুনে উঠে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে তাদের কলহের মীমাংসা করবেন। খবরটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো। যখনকার কথা বলছি সেই সময় ইউরোপের মানুষ, বিশেষ করে ফরাসিরা, কথায় কথায় দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমে পড়তেন। কাজেই পূর্বোক্ত দুই ভদ্রলোকের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের ব্যাপারটা এমন কিছু অভিনব ছিল না। কিন্তু আকাশে বেলুন উড়িয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের পরিকল্পনা ইতিপূর্বে কারো মাথায় আসেনি। অতএব নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট স্থানে সেই চমকপ্রদ ও অভূতপূর্ব দ্বৈরথের ফলাফল দর্শন করার জন্য ভিড় করল এক বিপুল জনতা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যোদ্ধাদের নিয়ে আকাশে উড়ল দুটি বেলুন। প্রত্যেক বেলুনের মধ্যে যুযুধানদের সঙ্গে ছিলেন একজন করে মধ্যস্থ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অট্টালিকাগুলোর মাথা ছাড়িয়ে দুটি বেলুন বেশ উপরে উঠে গেল। মাটি ছাড়িয়ে প্রায় আধ মাইল উপরে যখন বেলুনরা উড়ছে, সেই সময়ে মসিয় লে পিক তার ব্লান্ডারব্যাস (এক ধরনের বন্দুক) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে লক্ষ করে অগ্নিবর্ষণ করলেন। তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল। এইবার গুলি ছুড়লেন মসিহঁ গ্র্যান্ড প্রি। তার নিক্ষিপ্ত গুলি মসি! লে পিকের শরীর স্পর্শ করল না বটে, কিন্তু বেলুনের দেহ বিদ্ধ করে বেলুনটাকে ফাটিয়ে দিল। হতভাগ্য লে পিক ও তাঁর সঙ্গী মধ্যস্থকে নিয়ে বেলুনটা সবেগে আছড়ে পড়ল একটা বাড়ির ছাদের উপর এবং সেই আঘাতের বেগ সামলাতে না-পেরে দুটি মানুষই ঢলে পড়লেন মৃত্যুর ক্রোড়ে।
মেজর জেমস জ্যাকসন ও রবার্ট ওয়াটকিন্স
অষ্টাদশ শতাব্দী ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যেসব দ্বন্দ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়, সেইসব যুদ্ধে সূক্ষ্ম রুচিবোধ ও উদারতার অভাব থাকলেও ভীষণতার কোনো অভাব ছিল না–পাশবিক হিংসার প্রাণঘাতী উগ্রতায় তৎকালীন দ্বৈরথের ইতিহাস অতিশয় ভয়াবহ।