তবে বুনো জানোয়ারকে সবসময় বিশ্বাস করা চলে না। পাপা নামে একটি সিংহীকে শিশুকাল থেকেই পুষেছিলেন বরিস। পাপা সার্কাসের খাঁচায় থাকত না, থাকত বরিসের সঙ্গে একই বাড়িতে। কিন্তু পাপা যখন বড়ো হয়ে উঠল তখন বরিসের বাড়িওয়ালা বরিসকে জানিয়ে দিলেন তাঁর বাড়িটা তিনি বরিসকে ভাড়া দিয়েছেন বটে, কিন্তু একটা ধুমসো সিংহী নিয়ে সেখানে বসবাস করার অধিকার বরিসের নেই। অগত্যা বরিস পাপাকে সার্কাসের ভিতর একটা খাঁচায় রাখার ব্যবস্থা করলেন।
পাপার স্বভাবচরিত্র ছিল চমৎকার। লাফঝপ করে বেড়ালেও তার ব্যবহারে শ্বাপদসুলভ হিংস্র উগ্রতার চিহ্ন ছিল না একটুও। কিন্তু সার্কাসের খাঁচায় যাওয়ার পর থেকেই তার স্বভাবের পরিবর্তন ঘটল। যারা সার্কাসে জন্তুদের দেখাশুনা করে সেই পশুরক্ষকদের দেখলেই সে হিংস্র হয়ে উঠত, ক্রুদ্ধ গর্জনে বিরক্তি জানাত বারংবার বোধ হয় তার ধারণা হয়েছিল ওই লোকগুলোই তাকে বরিসের কাছ থেকে সরিয়ে এনে খাঁচায় আটকে রেখেছে। বরিস তার মনোভাব বুঝতেন, কিন্তু সার্কাসের খেলা নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, পাপার সঙ্গে যখনতখন দেখাসাক্ষাৎ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পাপার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটল, সে হয়ে উঠল ভয়ংকরী।
একদিন চরম বিপর্যয় ঘটল। বরিস এসেছেন অনেক দিন পরে, পাপাকে আদর করে বিদায় নেবার উদ্যোগ করছেন–অকস্মাৎ তাঁর কণ্ঠদেশ লক্ষ করে কামড় বসাল পাপা। তাড়াতাড়ি হাত তুলে বরিস গলা বাঁচালেন বটে, কিন্তু সিংহীর ধারালো দাঁতের আঘাতে তার হাতের অবস্থা হল শোচনীয়। কোনোরকমে আত্মরক্ষা করে বরিস পাপাকে তার খাঁচার ভিতর ঠেলে দিলেন। পাপা এক কোণে গিয়ে বসে রইল চুপ করে। রক্তাক্ত হাতটা তুলে ধরলেন বরিস পাপার দিকে, বললেন, দেখ কী করেছ! তোমার লজ্জা করে না? তোমাকে আমি এত ভালোবাসি, এই তার প্রতিদান?
মাথা নীচু করে পাপা এগিয়ে এল। ধীরে ধীরে মুখ তুলে রক্তাক্ত হাতটা চাটতে শুরু করল। স্পষ্টই বোঝা গেল তার ব্যবহারে সে লজ্জিত। হঠাৎ খেপে গিয়ে একটা বিশ্রী কাণ্ড সে করে ফেলেছে বটে, কিন্তু বরিসকে হত্যা করার ইচ্ছা তার ছিল না।
যাই হোক, বরিস বুঝলেন তাঁদের আগেকার সম্পর্ক আর ফিরে আসবে না; কারণ পাপা যেভাবে তার কাছ থেকে সেবা-যত্ন পেতে অভ্যস্ত, সেইভাবে তাকে দেখাশুনা করার সময় এখন বরিসের নেই। অতএব আবার দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সাবধান হওয়া ভালো পাপাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল চিড়িয়াখানায়।
বরিস অ্যাডার জীবনে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র পশুর বন্ধুত্ব লাভ করেছেন এবং তার আদরের চতুষ্পদ বন্ধুদের আক্রমণে তার প্রাণ বিপন্ন হয়েছে বারংবার–তবু সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে বরিসের আকর্ষণ কমেনি একটুও।
বরিস অ্যাডার বলেছেন, ওরা দু-একসময় ভীষণ দুষ্টুমি করে বটে, কিন্তু ছেলে-মেয়ে দুষ্ট হলে বাপ কি কখনো সন্তান ত্যাগ করে? আমি ওদের ভালোবাসি; হোক না দুষ্ট, ওরা আমার গর্বের বস্তু।
বেন স্টারডিভ্যান্ট ও জিম বোয়ি
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ। টেক্সাস অঞ্চলে একটি পানাগারের ভিতর বসে তাসের জুয়া খেলা খেলছে একটি অল্পবয়সি কিশোর ও জনৈক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। পূর্বোক্ত পুরুষটি ওই এলাকার একটি কুখ্যাত জুয়ারি ও দুর্ধর্ষ গুণ্ডা—নাম, বেন স্টারডিভ্যান্ট। কিশোরটির নাম—ল্যাটি মোর।
খেলা চলছে, ছেলেটি হেরে যাচ্ছে বার বার। তীব্র উত্তেজনায় তার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত; বার বার বাজি হারছে বটে কিন্তু খেলা ছেড়ে ওঠার নাম করছে না।
হঠাৎ পানাগারের দরজা ঠেলে একটি লোক ভিতরে প্রবেশ করল। খেলোয়াড়দের উপর একবার নজর বুলিয়ে নিয়ে আগন্তুকএকটু চমকে উঠল–কিশোরের পিতার সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। ছেলেটি তাকে চিনতে না-পারলেও নবাগত মানুষটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বন্ধুপুত্রকে শনাক্ত করতে পেরেছিল। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে আগন্তুক বুঝল ল্যাটি মোরকে অসভাবে ঠকিয়ে বাজির টাকা জিতে নিচ্ছে জুয়াড়ি বেন। অনভিজ্ঞ কিশোরের চোখে পাকা জুয়াড়ির জুয়াচুরি ধরা পড়ছে না, পরমানন্দে ল্যাটি মোরকে ঠকিয়ে তার টাকাগুলো পকেটস্থ করছে বেন স্টারডিভ্যান্ট।
নবাগত মানুষটি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে খেলা দেখল, তারপর ধীরপদে এগিয়ে এসে কিশোর ল্যাটি মোরের কাঁধে হাত রাখল :তুমি চিনতে পারবে না, কিন্তু তোমার বাবা পারবেন। আমি তোমার পিতৃবন্ধু। তোমার তাস নিয়ে আমাকে একটু খেলতে দাও।
ল্যাটি মোর সম্মত হয়ে জায়গা ছেড়ে দিল, তার স্থান গ্রহণ করল নবাগত মানুষ। কিছুক্ষণ খেলার পর দেখা গেল বেন জুয়াচুরি করে যে-টাকাগুলো ল্যাটি মোরের কাছ থেকে জিতে নিয়েছিল, সেই টাকা আবার নবাগত মানুষটি জিতে নিয়েছে। শুধু তাই নয়–সর্বসমক্ষে বেন স্টারডিভ্যান্টের অসাধু আচরণের কথা প্রকাশ করে দিল আগন্তুক। টাকাগুলো অবশ্য সে পকেটস্থ না-করে ল্যাটি মোরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেইসঙ্গে কিছু উপদেশ, সাবধান! ভবিষ্যতে কখনো জুয়া খেলবে না।
মুখের শিকার ছিনিয়ে নিলে বাঘ যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, বেন স্টারডিভ্যান্টের অবস্থাও হল সেইরকম। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে সে ছোরা বার করে আগন্তুককে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাল।
বেচারা স্টারডিভ্যান্ট! সে ভাবতেও পারেনি, যে-লোকটিকে ছোরার ডুয়েললড়তে চ্যালেঞ্জ করেছে সেই লোকটি হচ্ছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যোদ্ধা জিম বোয়ি! ছোরার লড়াইতে জিমের সমকক্ষ কোনো যোদ্ধা সে সময়ে ছিল না।