বরিস অ্যাডারের কথা বলতে গিয়ে তার জীবনসঙ্গিনী সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
আগেই বলেছি স্বামীর মতোই ওই মহিলাটিও বিভিন্ন হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে খেলা দেখাতে গিয়ে একটি অতিশয় হিংস্র জীবের সঙ্গে টামারার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
পূর্বোক্ত জীবটির নাম ছিল হ্যারি। উসুরি অঞ্চলের একটি বাঘ ও আফ্রিকার এক সিংহীর সংমিশ্রণে জাত হ্যারি নামের টাইগ্রন ছিল যেমন বিশাল দেহ ও প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী, তার স্বভাবও ছিল তেমনই ভয়ংকর। ওই অতিকায় অতি-ভয়ংকর টাইগ্রন ভীষণ ভয় করত সার্কাসের একটি ছোটোখাটো বাঘকে। ছোটোখাটো বাঘটির নাম ছিল রাজা। রাজা সুন্দরবনের জানোয়ার, বাঘের দলে সে ছিল সবচেয়ে ছোটো। রাজার স্বভাবচরিত্র বেশ ভালোই, কিন্তু হ্যারিকে দেখলেই তার মেজাজ হত খাপ্পা নখদন্ত বিস্তার করে সে হ্যারিকে তাড়া করত আর ক্ষুদ্রকায় শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টায় শশব্যস্ত হয়ে পড়ত বিপুলবপু হ্যারি। বাঘদের নিয়ে খেলা দেখাতে গিয়ে রাজা আর হ্যারিকে নিয়ে এমন বিব্রত হয়ে পড়তেন বরিস যে, ভালো করে খেলার দিকে মন দেবার সুযোগ তার হত না। অতএব বরিসের নির্দেশে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন টামারা, তার হাতে থাকত সুদীর্ঘ পিচফর্ক (লম্বা লাঠির মুখে সাঁড়াশির মতো দুটি শানিত ফলক বসানো। পিচফক খড় তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সার্কাসের খেলোয়াড়ের হাতে ওই বস্তুটি মারাত্মক অস্ত্র)।
হ্যারিকে রাজা আক্রমণ করলেই খাঁচার ফাঁক দিয়ে পিচফর্কের সাহায্যে রাজাকে খোঁচা মারতেন টামারা এবং হ্যারিকে ছেড়ে নিজের জায়গায় গিয়ে খেলা দেখাতে বাধ্য হত রাজা। বারকয়েক খোঁচা খেয়েই রাজা বুঝল হ্যারিকে আক্রমণ করলেই টামারার পিচফর্ক তার দেহ বিদ্ধ করবে, অতএব সে শান্তভাবে হ্যারির সঙ্গে সহাবস্থান মেনে নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করল।
একদিন বাঘগুলোকে তাদের নিজস্ব খাঁচার ভিতর থেকে রঙ্গমঞ্চের লৌহবেষ্টনীর মধ্যে এনে বরিস যখন খেলা দেখানোর উদ্যোগ করছেন, সেই সময়ে দৈবক্রমে টামারা আছেন কি নেই তা খেয়াল করেননি বরিস, কিন্তু টামারার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করল রাজা তৎক্ষণাৎ সগর্জনে সে তেড়ে গেল হ্যারির দিকে। হাঁকডাক! গর্জন! মহাকায় হ্যারি ছুটছে লৌহবেষ্টনীর ভিতর, পিছনে তার ক্ষুদ্রকায় রাজা।
গোলমাল শুনে টামারা তাড়াতাড়ি এসে পড়লেন অকুস্থলে, হাতে তাঁর পিচফর্ক। হ্যারি চটপট লোহার গরাদের ধারে টামারার কাছে এসে দাঁড়াল, আর রাজাও হ্যারিকে ছেড়ে ফিরে গিয়ে বরিসের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সুবোধ বালকের মতো টামারাকে দেখেই রাজার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে, পিচফর্কের ধারালো অভ্যর্থনা তার ভালো লাগে না একটুও।
গোলমাল মিটে যেতে হ্যারিও শান্তভাবে তার নিজের জায়গায় এসে বসল খেলা দেখাতে। কিন্তু খেলা শুরু করার আগে সে হঠাৎ টামারার দিকে ফিরে এক প্রচণ্ড হুংকার ছাড়ল—বোধ হয় বাঘের ভাষায় বলল, ছিলে কোথায় কতক্ষণ? আর একটু হলেই গুণ্ডাটা যে আমায় শেষ করে দিত!
খাঁচার ফাঁক দিয়ে হ্যারির ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন টামারা এবং হ্যারিও সেই আদর উপভোগ করত শান্তভাবে। কিন্তু টামারাকে ভালোবাসলেও বরিস সম্পর্কে হ্যারির মনোভাব ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর সুযোগ পেলেই সে সগর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নখদন্তের আলিঙ্গনে বরিসকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করত। সার্কাসে খেলা দেখানোর আগে বন্য পশুকে নিয়ে খেলোয়াড় রিহার্সাল বা তালিম দিয়ে থাকেন। প্রথম প্রথম ওই রিহার্সালের সময় এমন উগ্রমূর্তি ধারণ করত হ্যারি যে, খেলা দেখানো তো দূরের কথা নিজের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টায় অস্থির হয়ে পড়তেন বরিস সাহেব।
জানোয়ার যদি সবসময়েই খেলোয়াড়কে আক্রমণ করার চেষ্টা করে, তাকে দিয়ে খেলা দেখানো অসম্ভব। অতএব হ্যারিকে জব্দ করার একটা উপায় স্থির করলেন। কয়েকটা সোডার বোতল ভরতি বাক্স নিয়ে একদিন তিনি ঢুকলেন হ্যারির খাঁচায়। হ্যারি তাকে লক্ষ করে তেড়ে আসতেই একটা বাক্স তিনি ছুঁড়ে দিলেন জন্তুটার দিকে। শূন্যপথেই দাঁতে নখে লুফে নিয়ে বাক্সটাকে ভেঙে ফেলল হ্যারি, সঙ্গেসঙ্গে–ফটাস! প্রচণ্ড শব্দে সোডার বোতলের বিস্ফোরণ। হ্যারির পিলে গেল চমকে, এক লাফে সে পিছিয়ে গেল। কয়েকটি মিনিট সে হতভম্ব হয়ে ছিল, তারপর আবার নূতন উদ্যমে সে বরিসকে আক্রমণ করল। বরিস তৈরি ছিলেন, সোডার বোতল ভরতি দ্বিতীয় বাক্স তার হাত থেকে ছুটে গেল হ্যারির দিকে এবং প্রথমটির মতো দ্বিতীয় বাক্সটিও হ্যারির নখদন্তের আপ্যায়নে বিদীর্ণ হল প্রচণ্ড শব্দে। হ্যারি এবার কাবু হল, ক্রুদ্ধ ব্যাঘ্রের গর্জিত কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিল বাক্সের গর্জন! আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে হ্যারি খেলোয়াড়ের নির্দেশ মানতে সচেষ্ট হল।
হ্যারি ছাড়া আর একটি প্রাণী বরিসকে বিব্রত করে তুলেছিল। যে বাঘের দলটাকে নিয়ে বরিস খেলা দেখাতেন, সেই দলে জ্যাক নামে একটি মানুষখেকো বাঘ ছিল। নরখাদক শ্বাপদ নিয়ে কোনো খেলোয়াড় সচরাচর খেলা দেখায় না, কিন্তু বরিস ওই ভয়ংকর জন্তুটাকে নিয়েও খেলা দেখিয়েছেন। জ্যাকের আক্রমণে বরিসের জীবন বিপন্ন হয়েছে একাধিকবার কিন্তু সদয় ব্যবহার, অসীম ধৈর্য ও অনুশীলনের ফলে মানুষখেকো বাঘও শেষ পর্যন্ত মানুষের বশীভূত হয়েছিল। বরিস বলেন, সদয় ব্যবহার দিয়েই তিনি জ্যাকের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন। হিংস্র শ্বাপদও তাহলে ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে!