প্রথম যেদিন সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন বরিস অ্যাডার, সেইদিনই জন্তুগুলোর ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় পেলেন তিনি। খাঁচায় ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই তিন-তিনটি সিংহ তাকে লক্ষ করে তেড়ে এল। আক্রমণোদ্যত সিংহের রুদ্র মূর্তির সামনে বরিস সাহেবের অনভ্যস্ত স্নায়ু বিদ্রোহ ঘোষণা করল–দ্রুতবেগে পিছিয়ে এসে তিনি তাড়াতাড়ি খাঁচার দরজা বন্ধ করে দিলেন, ক্রুদ্ধ সিংহের মুখোমুখি মোকাবেলা করার সাহস সেদিন তাঁর হয়নি।
কার্ল জেমবাচ তখন একগাল হেসেছিল বটে, কিন্তু পরের দিন যখন বরিস আবার সিংহের খাঁচায় প্রবেশ করলেন এবং দু-দুটো ক্রব্ধ সিঙ্ঘের আক্রমণ এড়িয়ে তাদের নিয়ে খেলা দেখাতে শুরু করলেন, তখন তার মুখের হাসি মুখেই রয়ে গেল।
কয়েকদিনের মধ্যেই সিংহদের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে অ্যাডার সাহেব সচেতন হয়ে উঠলেন। সব মানুষের স্বভাব একরকম হয় না, সিংহদের সম্পর্কেও একই নিয়ম প্রযোজ্য মানুষের মতো তাদের চরিত্রেও বিভিন্ন দোষগুণের পরিচয় পাওয়া যায়। সার্কাসের দলে প্রাইমাস, রিফি এবং মুরাদ নামে তিনটি সিংহ ছিল অতিশয় ভয়ংকর ও কোপনস্বভাব, বিন্দুমাত্র সুযোগ পেলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত খেলোয়াড়ের ওপর আবার আলি নামে সিংহটি ছিল খুবই শান্ত ও ভদ্র। ওই আলির সঙ্গে বরিস অ্যাডারের বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে উঠেছিল। আলি ছাড়া ক্রিম নামক আর একটি সিংহও অ্যাডার সাহেবকে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছিল। একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে পশুরাজ সিংহও মানুষের ভালোবাসার দাম দিতে জানে।
একদিন বরিস যখন সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন সেইসময় অতর্কিতে দুটি সিংহ তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মাটির ওপর পেড়ে ফেলল; কিন্তু নখদন্তের প্রহারে মানবদেহটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার আগেই আততায়ীদের ওপর বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই অবতীর্ণ হল বন্ধুবর ক্রিম। ক্রিমের আক্রমণে আততায়ীরা বরিস সাহেবের দেহের উপর থেকে সরে যেতে বাধ্য হল এবং তিনিও সেই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে চটপট খাঁচার বাইরে এসে আত্মরক্ষা করলেন। বরিস অ্যাডার বুঝলেন, অরণ্যচারী সিংহও বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে জানে।
সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে বরিস অ্যাডারের জীবন বিপন্ন হয়েছে বারংবার। প্রাইমাস আর রিফি নামের সিংহ দুটি বার বার অ্যাডার সাহেবকে আক্রমণ করেছে। তারা ছিল দুই সহোদর। বরিস অ্যাডার তাদের নামকরণ করেছিলেন দুই দস্যু ভাই।
সহোদর ভাইদের মতোই দুই দস্যুর মধ্যে ছিল নিবিড় একতা ও বন্ধুত্বের বন্ধন। ওদের মধ্যে একজনের সঙ্গে বরিস অ্যাডারের লড়াই শুরু হলেই অপরজন তৎক্ষণাৎ অকুস্থলে এসে উপস্থিত হত। ভাইকে সাহায্য করার জন্য। ফলে একটির পরিবর্তে দুটি সিংহকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন বরিস অ্যাডার।
একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।
সার্কাসে খেলা দেখানোর পর লোহার গরাদে ঘেরা সরু পথ দিয়ে খাঁচায় ঢোকার সময়ে হঠাৎ রিফি বরিস অ্যাডারকে আক্রমণ করল। ফাঁকা রিভলভার দিয়ে আওয়াজ করে তিনি জন্তুটাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু রিভলভারটা ঠান্ডায় অকেজো হয়ে গিয়েছিল, শব্দ হল না রিফি তৎক্ষণাৎ বরিসের রিভলভারসুদ্ধ ডান হাতটা কামড়ে ধরল। পরক্ষণেই অকুস্থলে রিফির ভাই প্রাইমাস-এর আবির্ভাব; এক মুহূর্ত বিলম্ব না-করে প্রাইমাস কামড় বসাল বরিস সাহেবের বাঁ-হাতের উপর–তারপর দুই ভাই মিলে টানাটানি করে শিকারকে খাঁচার ভিতর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
সিংহ-চরিত্রে অভিজ্ঞ অ্যাডার বুঝলেন তারা যদি তাকে একবার গরাদে ঘেরা গলিপথের ভিতর থেকে নিজস্ব খাঁচার ভিতর নিয়ে যেতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই–দুই ভাই মিলে তার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়বে। বরিস চটপট তার দুই পা লোহার গরাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ের সাহায্যে গরাদ আঁকড়ে ধরলেন, শুরু হল টাগ-অব-ওয়ার। আশেপাশে যারা ছিল তারা ভয়ে হতবুদ্ধি, দু-দুটি সিংহের কবল থেকে মানুষটাকে ছাড়িয়ে আনার সাহস বা ক্ষমতা কারুর নেই। হঠাৎ গরাদের সামনে এগিয়ে এল সার্কাসের এক খেলোয়াড়। সামনেই ছিল এক বালতি জল খেলোয়াড়টি বালতি তুলে গরাদের ফাঁক দিয়ে জল ঢেল দিল সিংহদের গায়ে। মরুভূমির সিংহ রাশিয়ার তীব্র শীতল আবহাওয়াতে অভ্যস্ত নয়–হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে কনকনে ঠান্ডা জলের আক্রমণ বিখ্যাত সিংহ-বিক্রমকে কাবু করে দিল–ঘেঁয়াওৎ শব্দে প্রতিবাদ জানিয়ে সিংহ দুটি শিকার ছেড়ে ছিটকে সরে গেল দূরে।
বরিস এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেন না, এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে লৌহবেষ্টনীর বাইরে এসে চটপট লোহার দরজা বন্ধ করে দিলেন। সিংহেরা অবশ্য তৎক্ষণাৎ সগর্জনে ছুটে এসেছিল, কিন্তু বরিস তখন নাগালের বাইরে।
সার্কাসের এক অখ্যাত খেলোয়াড়ের উপস্থিত বুদ্ধির জন্যই সেবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে গেলেন বরিস অ্যাডার।
বরিসের ঘটনাবহুল জীবনে তিনি বহুবার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। শুধু সিংহ নয়–বাঘ, লেপার্ড, ভাল্লুক প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের হিংস্র জানোয়ার নিয়ে তিনি খেলা দেখিয়েছেন। পরবর্তীকালে যে সুন্দরী মহিলাটির তিনি পাণিগ্রহণ করেছিলেন সেই মহিলাটিও সার্কাসের রঙ্গমঞ্চে হিংস্র পশুর খেলা দেখিয়েছেন সাফল্যের সঙ্গে এবং স্বামীর মতোই অগণিত দর্শকের প্রশংসা অর্জন করেছেন মিসেস টামারা অ্যাডার।