কুকুরটা তখনই মারা পড়ল। অন্যান্য কুকুরগুলো ভয়ে বাঘের সান্নিধ্য ত্যাগ করে সরে গেল। বাঘ তাদের দিকে ফিরেও তাকাল না, লাফ মেরে সে পাঁচিলের উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগল।
বাঘের লাফালাফিতে প্রথমে বিশেষ চিন্তিত হননি রাজামশাই, কারণ ইতিপূর্বেও অনেকগুলো বাঘ ওই প্রাঙ্গণের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রাচীরের উচ্চতা যে বাঘের নাগালের বাইরে, সেই সত্যও প্রমাণিত হয়ে গেছে অনেকবার।
কিন্তু বাঘের একটা থাবা যখন পাঁচিলের মাথায় পড়ে ফসকে গেল, তখন রাজামশাই ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝলেন এই সৃষ্টিছাড়া জন্তুটার সঙ্গে অন্যান্য বাঘের তুলনা চলে না–থাবায় নখ ছিল না বলেই সে উপরে উঠতে পারেনি, নখ থাকলে সেইবারই সে পাঁচিলের মাথায় নখ বসিয়ে উঠে পড়ত। বাঘের থাবা যে বার বার ফসকে যাবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই, অতএব রাজামশাই একজন ভৃত্যকে বন্দুক আনতে বললেন।
বাঘ বন্দুকের জন্য অপেক্ষা করল না, প্রচণ্ড এক লম্ফপ্রদান করে সে উঠে পড়ল পাঁচিলের উপর। সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল ভয়ার্ত চিৎকার।
বাঘ কোনোদিকে নজর দিল না, সোজা ছুটল সামনের দিকে। প্রাসাদের গায়েই রাজামশাইয়ের যে-বাগানটা ছিল সেই বাগানের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল বিদ্যুদবেগে
তখন ঘোর গ্রীষ্মকাল, প্রাসাদের ভিতর রাজার একমাত্র শিশুপুত্র গরমে ছটফট করছিল, তাই তাকে নিয়ে বেরিয়েছিল রাজবাড়ির দাসী উদ্যানের মুক্ত বায়ু সেবন করতে। একটা ছোটো ঠেলাগাড়ির ওপর শিশু রাজকুমারকে বসিয়ে দাসী বাগানের পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, আচম্বিতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেখানে হল রুদ্রমূর্তি ব্যাঘ্রের আবির্ভাব।
রাজপুত্রকে ফেলে দাসী দিল চো চো চম্পট, বাঘ তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করল না, ধেয়ে এল ঠেলাগাড়িতে উপবিষ্ট রাজপুত্রের দিকে।
ইতিমধ্যে এসে পড়েছে বন্দুক। অগ্নি-উদ্গার করে গর্জে উঠেছে মানুষের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়েছে বাঘ। কিন্তু মরার আগে সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে শমন-ভবনে।
একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে শোকে দুঃখে পাগলের মতো হয়ে গেছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর।
প্রাণ নিয়ে খেলা
এমন বিপজ্জনক পেশা ধরলেন কেন আপনি? দুনিয়াতে করে খাওয়ার জন্য আর কোনো পথ কি আপনার চোখে পড়ল না?
প্রশ্নটি করেছিলেন রাশিয়ার বিখ্যাত বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।
প্রশ্নের উত্তরে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বললেন, আপনার পেশাটি আরও বেশি বিপজ্জনক।
আজ্ঞে না মশাই, শোলোকভ হেসে উঠেছিলেন, আপনার সঙ্গে জায়গা বদল করতে আমি রাজি নই।
হ্যাঁ, বৈমানিকের পেশা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে, কিন্তু একদল সিংহের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খেলা দেখানোর কাজটা আরও বিপজ্জনক আর ভয়াবহ বলে মনে হয়েছিল সেইজন্যেই সার্কাসের ক্রীড়ামঞ্চে বরিস অ্যাডারের খেলা দেখে উপযুক্ত মন্তব্য করেছিলেন রুশ বৈমানিক ভ্যালেরি শোলোকভ।
বরিস অ্যাডার!
সোভিয়েট রাশিয়াতে সার্কাসের ইতিহাসে একটি নাম।
রুশ জাতি চিরকালই সার্কাসের খেলায় অত্যন্ত দক্ষ। ট্রাপিজ, রিং, বার এবং বিভিন্ন ধরনের জিমনাস্টিক্স প্রদর্শনীতে তারা অসামান্য কৃতিত্ব দেখিয়েছে, কিন্তু ১৯৩৫ সালের আগে সার্কাসের আসরে বন্য পশুর খেলায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি রাশিয়ার মানুষ। রাশিয়ার সার্কাসে হিংস্র জানোয়ার নিয়ে বরাবরই খেলা দেখিয়েছে জার্মান খেলোয়াড়। ১৯৩২ সালে রাশিয়ার ভরোনেজ শহরে জনৈক অসাধু জার্মান খেলোয়াড়ের লোভ আর অন্যান্য দাবির ফলে বন্য পশুর ক্রীড়ামঞ্চে একটি স্থানীয় মানুষের আবির্ভাব ঘটল, নাম তার বরিস অ্যাডার।
ঘটনার সূত্রপাত কী করে ঘটল, সে-কথাই বলছি।
সোভিয়েট রাশিয়ার সার্কাস বোর্ড জনৈক মালিকের কাছ থেকে একদল সিংহ কিনে নিয়েছিল। পূর্বোক্ত সিংহদের নিয়ে যে-লোকটি খেলা দেখাত, সেও ছিল জার্মান নাম কার্ল জেমেবাচ। কার্লের বদ্ধমূল ধারণা ছিল সে ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি ওই সিংহদের নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে না।
অতএব পারিশ্রমিক অর্থের জন্য তার দাবি বাড়তে লাগল অন্যায়ভাবে এবং দাবি পূরণ না-করলে সে যে দেশে ফিরে যেতে পারে সেই চমৎকার সম্ভাবনার কথাটিও বোর্ড-কে জানিয়ে দিতে ভুলল না।
কার্লের অন্যায় ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে বোর্ড স্থির করল সিংহের খেলা দেখানোর জন্য অন্য খেলোয়াড় নিযুক্ত করা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা সহজ নয়। রাশিয়ার খেলোয়াড় বিভিন্ন ধরনের সার্কাসের খেলায় দক্ষতা অর্জন করলেও বন্য পশু নিয়ে খেলা দেখাতে অভ্যস্ত নয়। সেই সময় বরিস অ্যাডার নামক জিমনাস্টিসের খেলোয়াড়টি ঠিক করলেন তিনি নিজেই সিংহের খেলা দেখাবেন।
বোর্ড প্রথমে আপত্তি তুলল–বুনো জানোয়ার নিয়ে খেলা দেখানো ভীষণ বিপজ্জনক, বিশেষ করে পশুরাজ সিংহকে নিয়ে হাতে খড়ি করতে গেলে অনভিজ্ঞ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
বরিস অ্যাডার একেবারে নাছোড়বান্দা
বিদেশিরা অন্যায়ভাবে জুলুম করে টাকা আদায় করবে আর আমরা তাদের অন্যায় ব্যবহার সহ্য করব? রাশিয়াতে কি মানুষ নেই?
অনেক তর্কবিতর্কের পর বোর্ড বরিস অ্যাডারকে সিংহের খেলা দেখাতে অনুমতি দিল। জিমনাস্টিকসের খেলায় ইস্তফা দিয়ে বরিস এলেন হিংস্র পশুদের নিয়ে খেলা দেখাতে। অ্যানিম্যাল ট্রেনার বা পশুশিক্ষক হিসাবে তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হল পশুরাজ সিংহের ভয়াবহ সাহচর্যে।… মস্কো থেকে খেলা দেখানোর অনুমতি পেয়েই অদূর ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষমাণ চতুম্পদ ছাত্রদের দর্শন করতে এলেন বরিস অ্যাডার। প্রথম দর্শনের অনুভূতি যে খুব উৎসাহজনক হয়নি সে-কথা স্বীকার করতে তাঁর দ্বিধা নেই–অ্যাডার সাহেব সোজাসুজি বলেছেন যে, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বিপুলবপু মরুচারী রাজন্যবর্গর দেহসৌষ্ঠব নিরীক্ষণ করতে করতে তার সর্বাঙ্গে জেগে উঠেছিল আতঙ্কের শীতল শিহরন মনে হয়েছিল, এই ভয়ংকর জানোয়ারগুলোকে তিনি কি বশ করতে পারবেন? এদের নিয়ে খেলা দেখানো কি সম্ভব হবে তার মতো অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে?