অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক জানালেন এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুর দৃশ্য দেখতে তিনি ইচ্ছুক নন, আর মি. এক্স-এর মধ্যে যদি কিছুমাত্র মনুষ্যত্ব বোধ থাকে তবে তিনিও নিশ্চয়ই অকুস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন।
মুখ নীচু করে অস্পষ্ট স্বরে মি. এক্স জানালেন ওইরকম অনুষ্ঠানে যোগ দেবার আগ্রহ তার নেই, কিন্তু যথাস্থানে না-গেলে তার চাকরি থাকবে না বলেই নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তাকে রাজ-আদেশ পালন করতে হবে।
ক্রুদ্ধ ফ্র্যাঙ্ক বাক অতঃপর যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা বন্ধুবরের পক্ষে আদৌ সম্মানজনক নয়। মি. এক্স চুপ করে বন্ধুর কটু উক্তি শুনলেন, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন একটি কথাও না-বলে…
সেদিনটা খুব ঘোরাঘুরি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, তাই সন্ধ্যার একটু পরেই আহারাদির পালা শেষ করে নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মনোনিবেশ করলেন। ঘুমটা বেশ জমে এসেছিল, অকস্মাৎ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল বহু মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত কোলাহল-ধ্বনি। কান পেতে শব্দটা শুনতে শুনতে সাহেব অনুভব করলেন, প্রাসাদের দিক থেকে, অর্থাৎ যেখানে বাঘ আর কুকুরের লড়াই হওয়ার কথা সেই দিক থেকেই ভেসে আসছে জনতার কোলাহল।
একটু পরেই একটা যান্ত্রিক শব্দ শোনা গেল, মনে হল বন্দুকের শব্দ। তারপরেই আবার বহু মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
ফ্র্যাঙ্ক বাক শব্দতত্ত্ব নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামালেন না, শ্রান্ত শরীরকে আবার সমর্পণ করলেন নিদ্রার ক্রোড়ে।
পরের দিন প্রভাতেই আবার বাক সাহেবের আস্তানায় আবির্ভূত হলেন মি. এক্স। বন্ধুকে সম্বোধন করে তিনি বললেন, ওহে ফ্র্যাঙ্ক! কাল রাতে কী হয়েছিল জান?
নীরস স্বরে ফ্র্যাঙ্ক বাক বললেন, জানাজানির কী আছে? বাঘের মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। তাই হয়েছে নিশ্চয়ই?
হ্যাঁ বাঘটা মারা পড়েছে বটে; তবে ওইসঙ্গে মারা গেছে একটি কুকুর, আর
আর?
আর মহারাজের শিশুপুত্র!
বল কী? আশ্চর্য হয়ে গেলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক, এমন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল কী করে?
অতঃপর মি. এক্স-এর মুখ থেকে যে আশ্চর্য ঘটনার বিবরণ শুনেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক তা হচ্ছে। এই :
একটা বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণের মাঝখানে ধৃত বাঘটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রাঙ্গণের চারপাশ ঘিরে দণ্ডায়মান সুউচ্চ প্রাচীরের ওপর থেকে প্রাচীরবেষ্টিত আঙিনার দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা ছিল। বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখার জন্য পূর্বোক্ত স্থানে আসন গ্রহণ করেছিলেন রাজামশাই। মজা দেখার জন্য রাজ্যের বহু মানুষও সেখানে সমবেত হয়েছিল। নিরাপদে বসে পশুদের হানাহানি দেখার জন্যই রাজামশাই প্রাচীরবেষ্টিত ওই গোলাকৃতি প্রাঙ্গণটি তৈরি করেছিলেন। একটু পরেই প্রাচীরের গাত্র-সংলগ্ন দ্বারপথে ছয়টা নেকড়ে-কুকুর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল। কুকুরগুলো প্রথমে বাঘের কাছে আসতে চায়নি, দূরে দাঁড়িয়ে তারা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ডোরাদার জন্তুটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। কিন্তু বাঘকে নিশ্চেষ্ট ও নীরব দেখে তাদের সাহস হল, এগিয়ে এসে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোধ হয় তারা বাঘের অসহায় অবস্থা বুঝতে পারল–সঙ্গেসঙ্গে শুরু হল আক্রমণ। থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে, মুখও রয়েছে বাঁধা তবু বাঘের শরীরের মর্মস্থানে কুকুরের দংশন মারাত্মক হয়ে চেপে বসতে পারল না–অদ্ভুত কৌশলে মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে বাঘ আত্মরক্ষা করতে লাগল। মাঝে মাঝে দু-একটা কুকুর কামড় বসাতে পারছিল বটে, কিন্তু সেই কামড় মারাত্মক দংশনে পরিণত হওয়ার আগেই বাঘ তার বিশাল গুরুভার দেহ দিয়ে এত জোরে প্রাচীরের দেয়ালের সঙ্গে আততায়ীদের চেপে ধরছিল যে; চাপের যাতনায় আর্তনাদ করে কুকুরগুলো কামড় ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছিল। এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা লড়াই চলার পরেও দেখা গেল বাঘের দেহ প্রায় অক্ষত, কুকুরের দাঁত বাঘের শরীরে কোথাও রক্ত ঝরাতে পারেনি। হঠাৎ একটা কুকুর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঘের গলায় দাঁত বসিয়ে দিল। কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে না-পেরে বাঘ এইবার তার থাবা ব্যবহার করল এক থাপ্পড়ে সে কুকুরটাকে তার গলার ওপর থেকে সরিয়ে দিল। বাঘের থাবা থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল, চড় মারার সময়ে তার চোখে-মুখে যে যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল সেটাও দর্শকদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। আচমকা মার খেয়ে কুকুরটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। দারুণ আক্রোশে সে আবার লাফ দিল বাঘের কণ্ঠদেশ লক্ষ করে। কুকুরের দুর্ভাগ্য তার কামড় বাঘের গলার উপর পড়ল না, দাঁত বসল মুখ-বাঁধা চামড়ার ফঁসের উপর। অন্ধ আক্রোশে কুকুরটা সেই চামড়ার বাঁধনটাকেই কামড়ে ধরল প্রাণপণে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধারালো দাঁতের পেষণে কেটে গেল চামড়া কিন্তু বাঘের মুখ তখনও সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হল না। এমন শক্ত করে চোয়ালের দু-পাশ দিয়ে মোটা চামড়ার বন্ধনী দেওয়া হয়েছিল যে, এক পাশের চামড়া কুকুরের কামড়ে ছিঁড়ে গেলেও অন্যদিকের চামড়ার বাঁধন বাঘকে পুরোপুরি হাঁ করতে দিল না শুধু মুখের একদিক ফাঁক হয়ে বেরিয়ে এল একটিমাত্র দাঁত। তৎক্ষণাৎ সেই একটিমাত্র দাঁতের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল বাঘ, থাবা দিয়ে কুকুরটাকে চেপে ধরে বেরিয়ে-আসা দাঁতটাকে সে সজোরে বসিয়ে দিল শত্রুর দেহে। আমরা যেভাবে শুকনো খাদ্যের টিন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলি, ঠিক সেইভাবেই কুকুরের শরীরটাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলল বাঘ একটিমাত্র দাঁতের আঘাতে।