১৮৯৫ সালের ২৪ অগাস্ট চেরোকি বিলকে আবার আদালতে হাজির করা হল।
.
পরিশিষ্ট
বিচারক পার্কারের রায় অনুসারে ১৮৯৬ সালের ১৭ মার্চ ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করল ক্রফোর্ড গোল্ডসবি ওরফে চেরোকি বিল।
মরার আগে বিশ্বাসঘাতক রজার্সের মৃত্যুসংবাদ শুনে গিয়েছিল বিল। সম্মুখযুদ্ধে গুলি করে রজার্সকে হত্যা করেছিল এক ব্যক্তি।
ওই ব্যক্তির নাম ক্লারেন্স গোল্ডসবি–চেরোকি বিলের ভাই সে।
প্রতিশোধ
ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি করদ-রাজ্যে একদা সংঘটিত এক ঘটনার ভয়াবহ বিবরণী শুনলে মনে হয় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী প্রকৃতি দেবী কখনো কখনো তাঁর বন্য সন্তানের ওপর মানুষের অত্যাচার দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তখনই তার প্রতিশোধপরায়ণ ন্যায়দণ্ড নেমে আসে হতভাগ্য অপরাধীর মাথার উপর অদৃশ্য অমোঘ বজ্রের মতো!
ঘটনাটি নীচে দেওয়া হল…
বহু বৎসর আগে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের একটি অরণ্যসংকুল করদ রাজ্যে পদার্পণ করেছিলেন জনৈক ইউরোপের অধিবাসী; ভদ্রলোকের নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক। নিছক দেশভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার জন্য ফ্রাঙ্ক বাক সাহেব ভারতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন অর্থ উপার্জনের আশায়। ফ্র্যাঙ্ক বাকের পেশা ছিল অতিশয় অভিনব, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জীবন্ত বন্য পশু ধরে দেশবিদেশের সার্কাস ও চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষের কাছে জন্তুগুলোকে সরবরাহ করতেন তিনি, বিনিময়ে গ্রহণ করতেন প্রচুর অর্থ।
ভারতবর্ষে তিনি এসেছিলেন কয়েকটা বাঘের জন্য। ইউরোপের একটি বিখ্যাত চিড়িয়াখানার কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি ভারতীয় ব্যাঘ্র সংগ্রহ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং ওইসব জীবন্ত ও বিপজ্জনক পণ্যের জন্য উক্ত প্রতিষ্ঠান যে পরিমাণ অর্থ দিতে সম্মত ছিলেন সেই টাকার অঙ্কটা মোটেই তুচ্ছ মনে করতে পারেননি ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেব।
অতএব সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে ভদ্রলোক পদার্পণ করলেন ভারতের মাটিতে।
যে করদ রাজ্যে ফ্র্যাঙ্কবাক উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই রাজ্যে সরকারি চাকরি করতেন তারই এক বন্ধু। উক্ত বন্ধুবর ছিলেন ইউরোপের মানুষ। তার সঠিক নাম ফ্র্যাঙ্ক বাক আমাদের বলেননি, অতএব আমরা তাঁকে মি. এক্স নামেই অভিহিত করব। করদ রাজ্যটির নাম জানাতেও বাক সাহেব রাজি নন, তাই পূর্বোক্ত রাজ্যটির নামও আমরা দিতে পারলাম না।
যাই হোক, নামধাম জানতে না-পারলেও কাহিনির রসগ্রহণ করতে বোধ হয় আমাদের বিশেষ অসুবিধা হবে না ।
যথাস্থানে পৌঁছে ফ্র্যাঙ্ক বাক খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন ওই রাজ্যের বনে-জঙ্গলে বাঘের অভাব নেই। ফ্র্যাঙ্কের বন্ধু পূর্বোক্ত মি. এক্স জানালেন সেইদিনই একটা মস্ত বাঘ মহারাজের ফঁদে ধরা পড়েছে। বাঘটি এখন রাজার সম্পত্তি। তবে বাক সাহেব যদি জন্তুটাকে দেখতে চান তাহলে মি. এক্স তাকে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। বলাই বাহুল্য ফ্র্যাঙ্ক বাক জন্তুটাকে দেখতে চাইলেন এবং বন্ধুবর মি. এক্সের সঙ্গে যাত্রা করলেন নির্দিষ্ট স্থানের উদ্যেশে। একটু পরেই ধৃত পশুটিকে দেখতে পেলেন বাক সাহেব। এমন প্রকাণ্ড বাঘ ইতিপূর্বে কখনো তার চোখে পড়েনি। কিন্তু সেইসঙ্গে এমন আর একটি দৃশ্য তার দৃষ্টিগোচর হল, যা দেখার জন্য তিনি আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না।
একটা সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে পূর্বোক্ত ব্যাঘ্র এবং খাঁচার গরাদের ফাঁকে লোহার সাঁড়াশি দিয়ে জনৈক ব্যক্তি চেপে ধরেছে বাঘের থাবা; আর একজন লোক অতিশয় মনোযোগ সহকারে থাবার নখগুলোকে উৎপাটিত করছে লৌহনির্মিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে। অতি সংকীর্ণ খাঁচার মধ্যে বাঘের নড়াচড়া করারও উপায় নেই, তাই ক্রোধে ও যাতনায় বার বার গর্জন করে বাঘ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে কিন্তুআত্মরক্ষার কোনো চেষ্টাই করতে পারছে না।
ফ্র্যাঙ্ক বাক তাঁর বন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন, এমন নিষ্ঠুরভাবে জন্তুটাকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে কেন? উত্তরে বন্ধুবর জানালেন, বাঘের থাবাগুলো থেকে এক-এক করে সবকয়টি নখই তুলে ফেলা হবে, কারণ এই কাজ করার আদেশ দিয়েছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর স্বয়ং!
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফ্র্যাঙ্ক বাক স্থানত্যাগ করলেন।
পরের দিন সকালে বাক সাহেবের আস্তানায় উপস্থিত হলেন মি. এক্স। বন্ধুর মুখে ফ্র্যাঙ্ক জানলেন বাঘটির সঙ্গে ছয়টি কুকুরের লড়াই হবে–রাজামশাই জানিয়েছেন মি. ফ্র্যাঙ্ক বাক যদি বাঘ আর কুকুরের লড়াই দেখতে চান, তবে যেন মি. এক্স-র সঙ্গে সেইদিনই সন্ধ্যার পর যথাস্থানে গমন করেন। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে বাক সাহেব জানালেন বাঘের থাবা থেকে নখ তুলে ফেলা হয়েছে মাত্র বারো ঘণ্টা আগে, তার পায়ের ক্ষত থেকে এখনও নিশ্চয় রক্ত ঝরে পড়ছে। এই অবস্থায় ছয়টি হিংস্র কুকুরের বিরুদ্ধে বাঘকে যদি লড়াই করতে বাধ্য করা হয়, তবে সেটা লড়াই হবে না, হবে হত্যাকাণ্ড! এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড দেখার প্রবৃত্তি যে তার নেই, সেই কথাই জানিয়ে দিলেন ফ্র্যাঙ্ক বাক।
মি. এক্স জানালেন, বাঘের থাবা থেকে নখগুলোকে উৎপাটিত করেই রাজামশাই ক্ষান্ত হননি, তার নির্দেশে বাঘের মুখটাকেও চামড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছে–সুতরাং বাঘ শুধু তার নখ থেকেই বঞ্চিত হয়নি, তার মুখের ধারালো দাঁতগুলিও এখন সম্পূর্ণ অকেজো। মি. এক্স আরও জানালেন, যে কুকুরগুলোকে বাঘের উপর লেলিয়ে দেওয়া হবে, সেগুলোর জন্ম হয়েছে অতি-বৃহৎ হাউন্ড-জাতীয় কুকুর ও বন্য নেকড়ের সংমিশ্রণে! ওই বর্ণসংকর নেকড়ে-কুকুরের আকৃতি-প্রকৃতি নেকড়ের চাইতেও ভয়ংকর। অতি ভয়াবহ ছয়-ছয়টি এমন রক্তলোলুপ জানোয়ারের আক্রমণে নখদন্তহীন অসহায় ব্যাঘ্রের শোচনীয় মৃত্যু দেখে আনন্দ পাবেন রাজামশাই আর সেই রাজকীয় পুলকের অংশগ্রহণ করার জন্যই ফ্র্যাঙ্ক বাক সাহেবকে সাদরে আহ্বান জানাচ্ছেন করদ-রাজ্যের অধীশ্বর; মহারাজের তরফ থেকেই উক্ত নিমন্ত্রণবার্তা বহন করে এনেছেন মি. এক্স।