আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অকারণে নরহত্যা করতে যার কিছুমাত্র দ্বিধা ছিল না, সেই চেরোকি বিল দুই চক্রান্তকারীর অসৎ উদ্দেশ্য জানতে পেরেও তাদের খুন করার চেষ্টা করেনি। বোধ হয় ষড়যন্ত্রকারীদের আশা-নিরাশার উদবেগপূর্ণ মুহূর্তগুলি সে উপভোগ করছিল; নিজের উপর তার আস্থা ছিল অপরিসীম।
বান্ধবীর সাবধানবাণী অগ্রাহ্য করে রজার্সের বাড়িতেই থেকে গেল বিল। সকালের পর দুপুর; আবহাওয়া থমথমে। প্রত্যেকেই নীরব। একটা আসন্ন দুর্ঘটনার ইঙ্গিত অনুভব করছিল সকলেই।
আইক রজার্স সশব্দে গলা পরিষ্কার করল, তারপর ভাইঝিকে ডেকে বলল, ম্যাগি, দোকানে গিয়ে ভালো দেখে কয়েকটা মুরগি নিয়ে এসো। বিল যখন এখানে আছে, ওকে ভালো করে খাওয়ানো দরকার। অতিথিকে আদর যত্ন করা আমাদের কর্তব্য।
একটু ইতস্তত করে পিতৃব্য রজার্সের হাত থেকে টাকা নিল ম্যাগি। একবার বিলের মুখে দিকে তাকাল সে, কিন্তু বিল নির্বিকার বান্ধবীর মুখের দিকে সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল না। অগত্যা একটা শাল টেনে মুরগি আনতে চলে গেল ম্যাগি।
স্কেলস খানিকটা তামাক ও সিগারেট পাকানোর কাগজ পকেট থেকে বার করল এবং নিপুণ হস্তে পাকিয়ে ফেলল একটি চমৎকার সিগারেট। তারপর সিগারেট তৈরির ওই মালমশলা সে তুলে দিল বিলের হাতে। বিল জানাল ওইভাবে সিগারেট বানাতে সে অভ্যস্ত নয়, তবে চেষ্টা করতে তার আপত্তি নেই। অনভ্যস্ত হাতে একটা বিশ্রী হোঁতকা সিগারেট বানাল বিল, তারপর সঙ্গীদের কাছে দেশলাই চাইল। দুই সঙ্গী জানিয়ে দিল তাদের কাছে দেশলাই নেই।
ওই তো আগুন, ওইখান থেকেই সিগারেট ধরাও, আঙুল তুলে অগ্নিকুণ্ড দেখিয়ে দিল রজার্স।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল বিল। নিত্যসঙ্গী রাইফেল তখনও তার হাতে। একহাতে রাইফেল ধরে অপর হাতে কাঠের স্তূপ থেকে একটা কাষ্ঠখণ্ড তুলে নিল সে। অগ্নিকুণ্ড থেকে কাঠের টুকরোটা জ্বালিয়ে সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে সচেষ্ট হয়েছিল বিল এবং সেইজন্যেই সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে সে ঝুঁকে পড়েছিল অগ্নিকুণ্ডের ওপর।
মুহূর্তের জন্য সে সঙ্গীদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল, মুহূর্তের জন্য তার দৃষ্টি সরে গিয়েছিল স্কেলস ও রজার্সের উপর থেকে।
ওই একটি মুহূর্তই যথেষ্ট রজার্সের কাছে বিড়ালের মত ক্ষিপ্রবেগে, বিড়ালের মতোই নিঃশব্দে কাঠের স্তূপ থেকে একটি কাঠ তুলে নিল রজার্স–পরক্ষণেই প্রচণ্ড বেগে সেই কাষ্ঠখণ্ড পড়ল বিলের মস্তকে।
অমন মোটা কাঠ দিয়ে অত জোরে বাড়ি মারলে যেকোনো জোয়ান মানুষের মাথা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেত, কিন্তু বিল ছিল অসাধারণ শক্তিশালী–আঘাতের বেগে সে হাঁটু দুমড়ে পড়ে গেল, তবে কাবু হল না।
বিলের রাইফেল হাত থেকে ছিটকে পড়েছিল কাষ্ঠপের উপর, সেটাকে পুনরায় হস্তগত করার সুযোগ সে পেল না–তার আগেই বিলের উপর একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল রজার্স ও স্কেলস।
এক ঝটকায় দুজনকে ছিটকে ফেলে দিয়ে বিল উঠে দাঁড়াল, তারপর সজোরে ঘুসি চালাতে লাগল আততায়ীদের লক্ষ করে।
মারামারির শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসেছিল মিসেস রজার্স। রাইফেলটাকে কাষ্ঠপের উপর পড়ে থাকতে দেখে মেয়েটি সেটাকে তুলে নিল, তারপর খেলা দরজা দিয়ে অস্ত্রটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশের ঘরে।
ওর রাইফেল এখন আমার কাছে! চেঁচিয়ে উঠল মিসেস রজার্স।
খেপা ষাঁড়ের মতো গর্জন করছিল বিল। বাইরের দরজা দিয়ে বিল একবার ছুটে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্কেলস আর রজার্স একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই তিনজন গড়িয়ে পড়ল মেঝের উপর। অন্তত বিশ মিনিট ধরে ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি আর ধস্তাধস্তি চলল তিনজনের মধ্যে। যুযুধানদের হস্তপদ ও দেহের আঘাতে চেয়ারগুলি হল টুকরো টুকরো। বিলের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনে ছুটে এল তার বান্ধবী ম্যাগি গ্ল্যাস, কিন্তু ওই অবস্থায় বিপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করার কোনো উপায়ই খুঁজে পেল না মেয়েটি।
অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে ম্যাগি দেখল, বিলের রক্তাক্ত দেহটাকে মেঝের উপর চেপে ধরেছে দুই স্যাঙাত। কড়াৎ করে একটা শব্দ হল, ম্যাগির ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনেই বিলের কবজিতে সশব্দে হাতকড়ি লাগিয়ে দিল রজার্স।
প্রহারক্লিষ্ট ক্ষতবিক্ষত দেহে মেঝের উপর পড়ে বিল কিছুক্ষণ ধরে সজোরে শ্বাস গ্রহণ করল, তারপর উঠে বসল। রজার্সের দিকে তাকিয়ে বিল বলল, আমি ভাবতেই পারিনি তুমি আমাকে ধরতে পারবে। আইক, তুমি অসাধ্য সাধন করেছ!
আইক বলল, জ্যান্ত অবস্থায় তোমাকে ধরতে পারব কি না সে-বিষয়ে আমারও সন্দেহ ছিল। একবার ভেবেছিলাম তোমাকে খুন করব।
বিল অনুনয় করে বলল, সেই ভালো। আইক, তুমি বরং আমাকে খুন করো। পুরস্কারের টাকা তো তুমি পাবেই সরকারের হাতে তুলে আমাকে ফাঁসিতে লটকে তোমার কী লাভ?
রজার্স জানাল বিচারক পার্কারের সামনে সে চেরোকি বিলকে হাজির করতে চায়।
কিন্তু বিচারে তো আমার ফাঁসির হুকুম হবে। তার চেয়ে তুমি আমাকে এখানেই মেরে ফেলছ না কেন?
উঁহু, রজার্স বলল, ওরা তোমার মৃতদেহ চায় না। তোমাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করতে পারলে আমরা মোটা টাকা পুরস্কার পাব। সেইরকম চুক্তি হয়েছে আমাদের সঙ্গে।
বিল বলল, তুমিও নিস্তার পাবে না আইক! মনে রেখো, আমার ভাই আছে! ক্লারেন্স তোমার উপর বদলা নেবে!